১৩৮. একরথস্থ কৃষ্ণকর্ণ-কথোপকথন প্রকাশ

১৩৮তম অধ্যায়

একরথস্থ কৃষ্ণকর্ণ-কথোপকথন প্রকাশ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়। মহাত্মা বাসুদেব রাজপুত্র ও অমাত্যগণপরিবৃত হইয়া কৰ্ণকে আপনার রথে আরোহণ করাইয়া যখন নগর হইতে নিৰ্গত হইয়াছিলেন, তখন তিনি অতি গভীরস্বরে কর্ণকে যেসকল মৃদু বা তীক্ষ্ন সাত্ত্বনাবাক্য কহিয়াছিলেন, তুমি তৎসমুদয় আমাকে বল।”

সঞ্জয় কহিলেন, “হে ভারতশ্রেষ্ঠ! মহানুভব মধুসূদন কর্ণকে যেসকল তীক্ষ্ন, মৃদু, প্রিয়, ধর্ম্মযুক্ত, সত্য, হিতকর ও হৃদয়গ্রাহী বাক্য কহিয়াছিলেন, তাহা আনুপূর্ব্বিক কহিতেছি, শ্রবণ করুন। হে মহারাজ! বাসুদেব কর্ণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে রাধেয়! তুমি বেদপারগ ব্ৰাহ্মণগণের সেবা এবং নিয়ত অসূয়াশূন্য হইয়া তত্ত্বাৰ্থ জিজ্ঞাসা করিয়াছ। তুমি সনাতন বেদবাক্য অবগত হইয়াছ এবং অতিসূক্ষ্ম ধর্ম্মশাস্ত্ৰেও তোমার নিষ্ঠা জন্মিয়াছে। শাস্ত্রজ্ঞেরা কাহেন, যিনি যে কন্যার পাণিগ্রহণ করেন, তিনিই সেই কন্যার কানীন [কন্যাকালজাত] ও সহোঢ় [বিবাহের পূর্ব্বে পরজাত] পুত্রের পিতা। হে কর্ণ! তুমিও তোমার জননীর কন্যাকাবস্থায় সমুৎপন্ন হইয়াছ; তন্নিমিত্ত তুমি ধর্ম্মতঃ পাণ্ডুর পুত্র; অতএব চল, ধৰ্মশাস্ত্রের বিরুদ্ধেও [ধর্ম্মশাস্ত্রসম্মত না হইলেও] তুমি রাজ্যেশ্বর হইবে।

পাণ্ডবগণ তোমার পিতৃকুলজাত ও বৃষ্ণিগণ তোমার মাতৃকুলজাত; তুমি এই উভয়কুল অবগত হইয়া আজি আমার সহিত আগমন কর; পাণ্ডবগণও তোমাকে কৌন্তেয় ও যুধিষ্ঠিরের অগ্রজ বলিয়া পরিজ্ঞাত হউন। তোমার ভ্রাতা পঞ্চপাণ্ডব, দ্রৌপদীর পঞ্চকুমার, জয়শীল অভিমন্যু এবং সমাগত রাজা, রাজপুত্র ও অন্ধকবৃষ্ণিগণ তোমার পদ গ্রহণ করিবে। রাজা ও রাজকন্যাগণ হিরন্ময় [সুবৰ্ণময়], রজতময় ও মৃন্ময় কুম্ভ [মাটীর-কলস], ওষধি, সর্ব্বপ্রকার বীজ, সমুদয় রত্ন ও লতাপ্রভৃতি অভিষেকসামগ্ৰীসকল আনয়ন করুন। দ্রৌপদী দিবসের ষষ্ঠভাগে তোমার সমীপে আগমন করিবেন। আত্মতত্ত্বজ্ঞ দ্বিজোত্তম ধৌম্য অগ্নিতে আহুতি প্ৰদান করুন। চতুৰ্বেদী ব্রাহ্মণেরা তোমাকে অভিষিক্ত করুন। পাণ্ডব, দ্ৰৌপদেয়, পাঞ্চাল ও চেদিগণ, বৈদিক কর্ম্মপরায়ণ পুরোহিত ধৌম্য ও আমি—আমরা সকলেই তোমার অভিষেকক্রিয়া সম্পাদন করিব। ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির তোমার যুবরাজ হইয়া শ্বেতব্যজন গ্রহণপূর্ব্বক তোমার অনুপদে [অনুগামী] রথে আরোহণ করুন। তুমি অভিষিক্ত হইলে মহাবল ভীমসেন তোমার মস্তকে বিশাল শ্বেতচ্ছত্র ধারণ করবেন; ধনঞ্জয় তোমার কিঙ্কিণীশতনিনাদিত [মাল্যাকারে গ্রথিত বহু ক্ষুদ্র ঘণ্টার শব্দে শাব্দিত] ব্যাঘ্রচর্ম্মসংছাদিত [বাঘছালে আচ্ছাদিত] শ্বেতবাহনসংবাহিত [শ্বেত অশ্ব পরিচালিত] রথ সঞ্চালন করিবেন; অভিমন্যু প্রতিনিয়ত তোমার সমীপবর্ত্তী থাকিবেন; নকুলসহদেব, দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র, পাঞ্চালগণ, মহারথ শিখণ্ডী ও আমি-আমরা সকলে তোমার অনুবর্ত্তী হইব এবং দাশার্হ ও দাশার্ণগণ তোমার পরিবার হইবে।

“অতএব, হে মহাবাহো! জপ, হোম ও পৃথক পৃথক মঙ্গলকার্মে ব্যাপৃত হইয়া পাণ্ডবগণের সহিত রাজ্যভোগ কর। দ্রাবিড়, কুস্তল, অন্ধক, তালচর, চুচুপ ও বেণুপগণ তোমার পুরোবতী হউক; বন্দিগণ বিবিধ স্তুতিদ্বারা তোমার স্তব করুক এবং পাণ্ডবগণ তোমার জয় ঘোষণা করুন।

“ ‘হে বসুসেন! তুমি নক্ষত্রগণপরিবৃত চন্দ্ৰমার ন্যায় পাণ্ডবগণে পরিবেষ্টিত হইয়া রাজ্যশাসন ও কুন্তীর আনন্দবৰ্দ্ধন কর। আজি মিত্ৰগণ আনন্দিত, শত্রুগণ ব্যথিত এবং পাণ্ডবগণের সহিত তোমার সৌভ্রাত্র সমুৎপন্ন হউক।’”