১৩৪. বিদুলার পুনঃ পুনঃ সঞ্জয়প্ৰবোধন

১৩৪তম অধ্যায়

বিদুলার পুনঃ পুনঃ সঞ্জয়প্ৰবোধন

“ ‘হে বৎস! কোন প্রকার আপদেই রাজার ভীত হওয়া উচিত নহে। ভূপতি যদিও কখন মনে মনে ভীত হয়েন, তথাপি কদাচ ভীতের ন্যায় ব্যবহার করিবেন না। রাজাকে ভীত দেখিলে রাজ্য, বল, অমাত্যপ্রভৃতি সকলে ভীত হইয়া সমুদয় প্ৰজাগণকে ভেদ [একতাবন্ধনহীন] করিবার চেষ্টা করে; কেহ কেহ শত্রুর শরণাপন্ন হয়, কেহ কেহ। শক্ৰকে পরিত্যাগ করে; আর যাহারা পূর্ব্বে অবমানিত হইয়াছিল, তাহারা শত্রুকে প্রহার করিতে ইচ্ছা করে। লোকে অত্যন্ত সৌহার্দ্য [মিত্ৰতা] নিবন্ধন অন্যের উপাসনা করিয়া থাকে অথবা বদ্ধবৎসা ধেনুর ন্যায় শক্তিহীনতাপ্রযুক্ত অন্যের কল্যাণকামনা করে এবং অন্যকে শোকাকুল দেখিলে শোক করিয়া থাকে। তোমার পূর্ব্বপূজিত সুহৃদগণ বর্ত্তমান আছে, উহারা তোমার রাজ্য স্বীয় রাজ্য বলিয়া জ্ঞান ও তোমাকে ব্যসন হইতে উদ্ধার করিতে নিতান্ত বাসনা করে। তুমি সেই সুহৃদগণের ভেদোৎপাদন করিও না ও সুহৃদ্বর্গ যেন তোমাকে ভীত দেখিয়া পরিত্যাগ করিতে বাসনা না করে।

“ ‘হে পুত্র! আমি তোমার পুরুষকার ও বুদ্ধির পরীক্ষা, তেজোবৃদ্ধি এবং ধৈৰ্য্যবিধান করিবার নিমিত্তই এইসকল কথা কহিলাম; যদি আমার কথা তোমার হৃদগত ও যথার্থ বলিয়া বোধ হইয়া থাকে, তাহা হইলে তুমি স্থিরচিত্ত হইয়া জয়ার্থ সমুত্থিত হও। তোমার অবিদিত আমাদের কোষসমূহ আছে, আমি ভিন্ন আর কেহই উহা জানে না; আমি উহা তোমাকে প্ৰদান করিব। তোমার বহুসংখ্যক সুখদুঃখসহ হৃদয়ানুবর্ত্তী বান্ধবও বর্ত্তমান আছে। উক্তবিধ সুহৃদগণ ইষ্টসাধনতৎপর ঐশ্বৰ্য্যাভিশালী ব্যক্তির সহায় ও সচিবস্বরূপ।”

“বিদুলার পুত্র স্বভাবতঃ অল্পবুদ্ধি ছিলেন। তথাপি মাতার উক্তবিধ বিচিতাৰ্থপরিপূর্ণ [মনোহর চাতুৰ্য্যপূর্ণ] বাক্যশ্রবণে তাঁহার অজ্ঞান দূর হইল। তখন তিনি মাতাকে কহিলেন, “জননী! আপনি আমাকে নিয়ত শ্রেয়স্কর পথে প্রবর্ত্তিত করিয়া থাকেন; অতএব আমি সলিলমগ্ন মেদিনীর ন্যায় পৈতৃক রাজ্যের প্রত্যুদ্ধার, না হয় সংগ্রামে প্রাণ পরিত্যাগ করিব। আমি আপনার নিকট উক্ত বাক্যসমুদয় শ্রবণ করিবার বাসনায় আপনার বাক্যের প্রতিকূলে কিঞ্চিৎ উত্তরপ্রদান করিয়া তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়াছিলাম। আপনার অমৃতোপম বচন শ্রবণে আমার আনন্দের পরিসীমা রহিল না; আমি এক্ষণে শক্ৰগণকে নিগ্রহ ও পরাজয় করিবার নিমিত্ত উৎসাহিত হইতেছি।’ ”

যুধিষ্ঠিরসমীপে বিদুলা-সঞ্জয় সংবাদদানে অনুরোধ

কুন্তী কহিলেন, “বৎস! বিদুলানন্দন সঞ্জয় জননীর বাক্যে উত্তেজিত হইয়া সুশিক্ষিত অশ্বের ন্যায় তাঁহার বাসনানুরূপ সমুদয়কাৰ্য্য সম্পাদন করিলেন। হে কেশব! মন্ত্রী শক্ৰপীড়িত অবসন্ন ভূপতিকে এই তেজোবৰ্দ্ধন অত্যুৎকৃষ্ট উপাখ্যান শ্রবণ করাইবেন। বিজিগীষ ব্যক্তির এই জয়াখ্য ইতিহাস শ্রবণ করা কর্ত্তব্য; ইহা শ্রবণ করিলে অচিরাৎ পৃথিবী পরাজয় ও শক্রমর্দন করিতে পারেন। গর্ভবতী রমণী এই পুত্রপ্রসবকর বীরজনন উপাখ্যান শ্রবণ করিলে অবশ্যই বীরপুত্র প্রসব করে আর ক্ষত্ৰিয়া এই ইতিহাস শ্রবণ করিলে নিশ্চয়ই বিদ্যাবান, তপঃপরায়ণ, দাতা, ব্রাহ্মীশ্ৰীসম্পন্ন [জ্ঞানশালী] সাধুবাদোচিত মহাবলপরাক্রান্ত মহারথ, ধৈর্য্যশালী, অজেয়, জেতা, অসাধুনিয়ন্তা, সজ্জনপরিপালক, সত্যপরাক্রম বীরপুত্র প্রসব করে।”