১৩৩. শিথিলোদ্যম সঞ্জয়ের উৎসাহদান

১৩৩তম অধ্যায়

শিথিলোদ্যম সঞ্জয়ের উৎসাহদান

“তখন সঞ্জয় কহিলেন, “হে অকরুণে [দয়াহীনে] বীর্যাভিমানিনি জননি! নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, বিধাতা লৌহদ্বারা আপনার হৃদয়নির্ম্মাণ করিয়াছেন। ক্ষত্ৰিয়দিগের আচার-ব্যবহার কি আশ্চৰ্য্যজনক! আপনি জননী হইয়া পরমাতার ন্যায় আমাকে যুদ্ধে নিয়োগ করিতেছেন। আমি আপনার একমাত্র পুত্র; তথাপি আপনি আমাকে ঈদৃশ ভীষণ কাৰ্য্যে নিযুক্ত করিতে অণুমাত্র ব্যথিত হইতেছেন না; কিন্তু বিবেচনা করিয়া দেখুন, আপনার এই প্রিয় পুত্ৰ নেত্রপথ হইতে অন্তহিত হইলে সমুদয় পৃথিবী ভোগ, আভরণ ও জীবনে আপনার প্রয়োজন কি?”

“বিদুলা কহিলেন, “বৎস! মনুষ্যের সকল অবস্থাতেই ধর্ম্ম ও অর্থচিন্তা করা কর্ত্তব্য। আমি এই দুই বিষয়ের নিমিত্তই তোমাকে যুদ্ধে নিয়োগ করিতেছি। তুমি অসামান্য পরাক্রমসম্পন্ন, আর কালক্রমে শক্রকে আক্রমণ করিবার উপযুক্ত সময়ও সমুপস্থিত হইয়াছে। যদি এ সময় তুমি কর্ত্তব্যকাৰ্য্যে উপেক্ষা কর, তাহা হইলে তোমার নিতান্ত নৃশংসের [কাপুরুষের—আমাদের দুঃখ দেখা দিলে তোমার নৃশংসতার পরিচয় হইবে] ন্যায় ব্যবহার করা হইবে। হে বৎস! যদি আমি তোমাকে অযশস্বী দেখিয়াও কিছু না বলি, তাহা হইলে গর্দভীর ন্যায় অকারণ ফলবিহীন বাৎসল্য প্রদর্শন করা হইবে। হে পুত্ৰ! প্রায় সমুদয় লোকই মহতী অবিদ্যার প্রভাবে অজ্ঞানপ্রায় হইয়া আছে, অতএব তুমি যেন সজ্জনবিগৰ্হিত মুখনিষেবিত পথ অবলম্বন করিও না। তুমি সদ্যবৃত্তসম্পন্ন হইলেই আমার প্রিয়পাত্ৰ হইবে।

“ ‘হে বৎস! যে ব্যক্তি ধর্ম্ম, অর্থ ও গুণসম্পন্ন সজ্জনাচরিতপথাবলম্বী, দৈব ও পুরুষকারযুক্ত পুত্রপৌত্র প্রাপ্ত হইয়া সুখস্বচ্ছন্দে কালাতিপাত করে, তাহার জন্ম সার্থক। কিন্তু যে ব্যক্তি উদ্যোগশূন্য, অবিনীত, দুবুদ্ধি পুত্রকে প্রাপ্ত হইয়া আনন্দিত হয়, তাহার জন্ম বৃথা। যে পুরুষাধমগণ সৎকর্মেবিরত ও নিন্দিত কর্মেনিরত থাকে, তাহাদের কি ইহকাল, কি পরকাল কোন কালেই সুখ হয় না। যুদ্ধ ও জয়লাভ করিবার নিমিত্ত ক্ষত্ৰিয়ের সৃষ্টি হইয়াছে, অতএব ক্ষত্রিয় রণক্ষেত্রে জয়লাভ বা প্ৰাণত্যাগ করিলে অবশ্যই ইন্দ্ৰলোকপ্ৰাপ্তি হয়। ক্ষত্ৰিয় শত্ৰুগণকে বশীভূত করিতে পারিলে ইহলোকে যেরূপ সুখসম্ভোগ করে, শত্ৰুভয়ে ভীত হইলে স্বর্গেও সেইরূপ সুখভোগ করিতে পারে না। যশস্বী ব্যক্তি শত্ৰুগণকে পরাজয় করিবার আশায় ক্রোধাগ্নিতে দগ্ধ হইয়া যায়, শত্রুগণকে সংহার, না হয় জীবন পরিত্যাগ করিয়া সুখী হয়, ফলতঃ উক্ত উভয়বিধ কাৰ্য্যব্যতীত মনস্বী[উন্নতচেতা]র শান্তিলাভের উপায়ান্তর নাই। প্ৰজ্ঞ ব্যক্তি স্বল্পবিভব অপ্রিয় জ্ঞান করিয়া থাকেন, কিন্তু যে মানব স্বল্প ঐশ্বৰ্য্য প্রিয় বোধ করে, তাহার পক্ষে উহা অচিরাৎ অনর্থকরা হইয়া উঠে। সুতরাং প্রিয়বস্তুবিরহে সে কদাপি মঙ্গলভাজন হয় না; প্রত্যুত সাগরগামিনী গঙ্গার ন্যায় অচিরকালমধ্যেই বিলীন হইয়া যায়।”

“সঞ্জয় কহিলেন, ‘জননি! পুত্রকে এরূপ কথা বলা কদাপি আপনার কর্ত্তব্য নহে। আপনি জড় [অকৰ্মণ্য] মূকের[বোবা]র ন্যায় হইয়া আমার প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করুন।”

“বিদুলা কহিলেন, “বৎস! তুমি যে আমাকে দয়া করিতে কহিলে, উহা শুনিয়া আমি সাতিশয় আহ্লাদিত হইলাম, তুমি আমাকে মাতার মত কর্ত্তব্যকর্মে নিয়োগ করিতেছি, আমিও তন্নিমিত্ত তোমাকে তোমার কর্ত্তব্যকর্ম্ম করিতে অনুরোধ করিতেছি। হে পুত্র! সমুদয় সৈন্ধবকে [সিন্ধুদেশবাসীকে] নিহত করিয়া যখন তোমাকে সম্পূর্ণ জয়লাভ করিতে দেখিব, তখন তোমাকে সম্মান করিব।”

“সঞ্জয় কহিলেন, ‘জননি! আমি ধনহীন ও সহায়বিহীন হইয়া কিরূপে জয়লাভ করিব, এই মনে করিয়া রাজ্যপ্ৰত্যাশা পরিত্যাগ করিয়াছি। যদি আপনি এক্ষণে আমার জয়লাভের কোন সদুপায় উদ্ভাবন করিয়া থাকেন, তবে বলুন, আমি আপনার আজ্ঞাপ্রতিপালনে একান্ত সম্মত আছি।”

“বিদুলা কহিলেন, “বৎস! পূর্ব্বতন সমৃদ্ধির অভাবপ্রযুক্ত ক্ষুব্ধ হইও না; অর্থ না থাকিলে উহার সঞ্চয় করা যায় এবং সঞ্চিত অর্থও বিনষ্ট হইয়া থাকে। অতি মূখ ব্যক্তিরাও ক্ৰোধপরায়ণ হইয়া কাৰ্য্য আরম্ভ করে না। সকল কর্মেরই ফল অনিত্য, পণ্ডিতেরা কর্ম্মফল অনিত্য বলিয়া জানেন; তথাপি কর্ম্মানুষ্ঠানে বিরত হয়েন না; এই নিমিত্ত তাঁহারা কখন কর্ম্মফলপ্রাপ্ত, কখন বা উহাতে বঞ্চিত হয়েন। আর যাঁহারা কর্ম্মানুষ্ঠানে নিতান্ত পরাঙ্মুখ হইয়া নিশ্চেষ্টভাবে কালাতিপাত করে, তাহাদের কখনই ফললাভ হয় না, নিশ্চেষ্টতার ফল একমাত্ৰ অভাব। চেষ্টার ফল দুই প্রকার;—প্ৰাপ্তি ও অপ্রাপ্তি। যে ব্যক্তি পূর্ব্বে কর্ম্মফলের অনিত্যতা অবগত হইয়াছে, সেও আপনার ক্লেশ ও শত্রুর সমৃদ্ধি দূর করিয়া থাকে। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি “কাৰ্য্যসিদ্ধি অবশ্যই হইবে মনে মনে এই নিশ্চয় করিয়া অব্যথিতচিত্তে ব্ৰাহ্মণ ও দেবগণকে অগ্ৰে করিয়া মঙ্গলদর্শনপূর্ব্বক সতত মুখত্থিত, জাগরিত শ্রেয়স্কর কর্মে নিযুক্ত হইয়া থাকেন। যে ভূপতি উক্তরূপ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করেন, তাঁহার অচিরাৎ বৃদ্ধি হয়; যেমন দিবাকর কখনো পূর্ব্বদিক পরিত্যাগ করেন না, তদ্রূপ লক্ষ্মী তাঁহাকে কদাপি পরিত্যাগ করেন না, তিনি সকলের দৃষ্টান্তস্থল এবং বহুবিধ উপায় ও উৎসাহ তাহার অনুগামী হয়। তুমি শোকবৃত্তান্ত অবগত হইয়াছ; এক্ষণে পুরুষকার প্রদর্শনপূর্ব্বক অভিপ্ৰেত পুরুষাৰ্থ উপার্জ্জনে যত্নবান হও। হে বৎস! তুমি অগ্রে ক্রুদ্ধ, লুব্ধ, ক্ষীণ, গর্ব্বিত, অবমাননাকারী, স্পৰ্দ্ধাশীল ব্যক্তিগণকে বশীভুত কর; তাহা হইলে যেমন সমীরণ বলাহক[মেঘ]সমূহকে বিভিন্ন করে, তদ্রূপ তুমি শক্ৰগণকে ভেদ করিতে পরিবে। তুমি অগ্রে ক্রুদ্ধ ও লুব্ধ ব্যক্তিগণকে অর্থ প্ৰদান কর, উহাদের হিতচেষ্টা কর এবং উহাদের প্রতি প্ৰিয়বাক্য প্রয়োগ কর, তাহা হইলে তাহারা অবশ্যই তোমার প্রিয়কাৰ্য্য করিবে ও অগ্রসর হইবে।

“হে পুত্র! সংগ্রামে জীবিতনিরপেক্ষই [প্রাণে মমতাহীন] শত্ৰু গৃহস্থিত সপের ন্যায় উদ্বেগজনক। পরাক্রান্ত শক্রকে যদি বশীভূত করিতে না পার, তাহা হইলে দূতদ্বারা তাহার নিকট সন্ধি বা দানের কথা উত্থাপন করিবে; ফলতঃ তাহাতেই তাহাকে বশীভূত করা হয়। এইরূপে দূতদ্বারা শক্রকে বশীভূত করিয়া লব্ধপ্রসর [অগ্রগমনে সমর্থ] হইলে অচিরকালমধ্যে ধন্যবৃদ্ধি হইয়া থাকে। মিত্ৰগণ ধনবানের আশ্রয় গ্রহণ ও ধনহীনকে পরিত্যাগ করিয়া থাকে। তাহারা ধনহীনের নিকট কদাচ আশ্বস্ত হয় না এবং সতত তাহার নিন্দা করে। যে ব্যক্তি শত্রুকে সহায় করিয়া তাহাকে বিশ্বাস করে, তাহার রাজ্যপ্ৰাপ্তির বিলক্ষণ সম্ভাবনা।’ ”