১২৯. কৃষ্ণকে বন্দী করার জন্য দুর্য্যোধনের দুরাগ্রহ

১২৯তম অধ্যায়

কৃষ্ণকে বন্দী করার জন্য দুর্য্যোধনের দুরাগ্রহ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! দুৰ্য্যোধন সদর্থসম্পন্ন মাতৃবাক্যশ্রবণে জাতক্ৰোধ হইয়া সভা পরিত্যাগপূর্ব্বক পুনরায় দুরাত্মাদিগের সমীপে গমন করিয়া দ্যূতপ্রিয় শকুনির সহিত মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন। অনন্তর দুৰ্য্যোধন, কৰ্ণ, শকুনি ও দুঃশাসন – ইঁহারা এইরূপ চেষ্টা এবং পরামর্শ করিতে লাগিলেন যে, ক্ষিপ্রকারী জনাৰ্দন ধৃতরাষ্ট্র ও ভীষ্মের সহিত মিলিত হইয়া প্রথমে আমাদিগের নিগ্ৰহ করিয়াছেন; এক্ষণে আমরাও তাঁহাকে ইন্দ্ৰকর্ত্তৃক নিগৃহীত বৈরোচনির [বলিরাজ] ন্যায় বলপূর্ব্বক নিগৃহীত করিব। বাসুদেব বদ্ধ হইয়াছে শ্রবণ করিলেই পাণ্ডবগণ ভগ্নদন্ত ভুজঙ্গের ন্যায় হতচেতন ও নিরুৎসাহ হইবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। এই মহাবাহুই পাণ্ডবগণের সুখ ও ধর্ম্মস্বরূপ; ইঁহাকে বন্ধন করিলে অবশ্যই পাণ্ডব ও সোমকগণের উদ্যম ভঙ্গ হইবে। অতএব রাজা ধৃতরাষ্ট্ৰ আক্রোশ করিলেও আমরা এই স্থানেই ক্ষিপ্রকারী কেশবকে বন্ধন করিয়া শক্রগণের সহিত সংগ্রাম করিব।

ইঙ্গিতজ্ঞ ও সর্ব্বজ্ঞ সত্যকি পাপাত্মাদিগের পাপ অভিসন্ধি অবগত হইয়া অতি শীঘ্ৰ হার্দ্দিক্যের সহিত বিনিষ্ক্রান্ত হইলেন এবং কৃতবর্ম্মাকে কহিলেন, “কৃতবর্ম্মা! আমি যতক্ষণ অক্লিষ্টকর্ম্মা [অবিশ্রান্ত কাৰ্য্যকারী-কোন কাজেই যাহার ক্লেশ না হয়] কৃষ্ণকে এই বৃত্তান্ত অবগত না করি, তাবৎ তুমি শীঘ্র সৈন্য যোজনা করিয়া কবচধারণপূর্ব্বক সভাদ্বারে উপস্থিত থাক।”

সাত্যকির সতর্কতা

সাত্যকি কৃতবর্ম্মকে এই কথা বলিয়া সিংহের গিরিগুহাপ্রবেশের ন্যায় সভামণ্ডপে প্রবেশপূর্ব্বক মহাত্মা বাসুদেবকে সেই অভিপ্ৰায় অবগত করাইলেন।

পরে সহাস্যবদনে ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুরের নিকট দুৰ্য্যোধনাদির সেই অসৎ অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়া কহিলেন, “হে ধৃতরাষ্ট্র! হে বিদুর! পাপাত্ম্যাগণ, অর্থ ও কাম-লোভের নিমিত্ত সাধুবিগৰ্হিত কর্ম্ম করিতে ইচ্ছা করে; কিন্তু কোনপ্রকারে তাহা সম্পাদন করিতে সমর্থ হয় না। যেমন জড় ও বালকগণ বস্ত্রদ্বারা প্রজ্বলিত অগ্নি নির্ব্বাণ করিতে বাসনা করে, সেইরূপ ঐসকল পাপাত্মা একত্ৰ মিলিত এবং কাম, ক্রোধ ও লোভের বশবর্ত্তী হইয়া এই বাসুদেবকে বন্ধন করিতে অভিলাষী হইয়াছে।”

দীর্ঘদর্শী বিদুর সাত্যকির বাক্যশ্রবণে সভামধ্যেই মহাবাহু ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! আপনার পুত্ৰগণ কালপ্রেরিত হইয়া অসাধ্য ও অযশস্কর কাৰ্য্য করিতে সমুদ্যত হইয়াছে; এই পুরুষশ্রেষ্ঠ অনভিভাবনীয় ভগবান বাসুদেবকে বলপূর্ব্বক অভিভব করিয়া নিগ্ৰহ করিতে অভিলাষ করিতেছে। যেমন পতঙ্গগণ পাবকে পতিত হইয়া বিনষ্ট হয়, ইহাদিগের দশাও কি সেইরূপ হইবে না? সিংহ যেমন ক্রুদ্ধ হইয়া হস্তিগণকে বিনষ্ট করে, সেইরূপ জনাৰ্দন ইচ্ছা করিলে যুদ্ধকালে তাহাদিগের সকলকেই শমনসদনে প্রেরণ করিবেন। কিন্তু পুরুষোত্তম বাসুদেব কদাপি নিন্দিত কর্ম্ম করবেন না ও ধর্ম্ম হইতে পরিভ্রষ্ট হইবেন না।”

বিদুরের বাক্যাবসানে মাহাত্মা বাসুদেব সুহৃদগণের সমক্ষে ধৃতরাষ্ট্রকে নিরীক্ষণ করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে রাজন! শুনিতেছি, দুৰ্য্যোধনপ্রভৃতি সকলে ক্রুদ্ধ হইয়া আমাকে বলপূর্ব্বক নিগৃহীত করবেন। কিন্তু আপনি অনুমতি করিয়া দেখুন, আমি ইহাদিগকে আক্রমণ করি, অথবা ইহারাই আমাকে আক্রমণ করেন। আমার এরূপ সামর্থ্য আছে যে, আমি একাকী ইহাদিগের সকলকে নিগৃহীত করিতে পারি। কিন্তু আমি কোনপ্রকারেই পাপজনক নিন্দিত কর্ম্ম করিব না; আপনার পুত্রেরাই পাণ্ডবগণের অর্থে লোলুপ হইয়া স্বাৰ্থভ্রষ্ট হইবেন। বস্তুতঃ ইহারা আমাকে নিগৃহীত করিতে ইচ্ছা করিয়া যুধিষ্ঠিরকেই কৃতকাৰ্য্য করিতেছেন। আমি অদ্যই ইহাদিগকে ও ইহাদের অনুচরগণকে নিগ্ৰহণ করিয়া পাণ্ডবগণকে প্ৰদান করিতে পারি; তাহাতে আমাকে পাপভাগী হইতেও হয় না; কিন্তু আপনার সন্নিধানে ঈদৃশ ক্রোধ ও পাপবুদ্ধিজনিত গর্হিতকাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইব না। আমি অনুজ্ঞা করিতেছি যে, দুর্নীতিপরায়ণগণ দুৰ্য্যোধনের ইচ্ছানুসারে কাৰ্য্য করুক।”

রাজা ধৃতরাষ্ট্র কৃষ্ণের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে বিদুর! অমাত্য, মিত্র, সহোদর, সহচর ও অনুচরগণসমবেত রাজ্যলুব্ধ দুৰ্য্যোধনকে শীঘ্ৰ আনয়ন কর; যদি তাহাকে সৎপথাবলম্বী করিতে পারি, একবার চেষ্টা করিয়া দেখি।”

কৃষ্ণের বলবীর্য্যবর্ণনে দুয্যোধনের নিবৃত্তিচেষ্টা

বিদুর তাঁহার আজ্ঞানুসারে ভ্রাতা ও ভূপতিগণে পরিবৃত দুৰ্য্যোধনকে সভামধ্যে প্রবেশিত করিলে রাজা ধৃতরাষ্ট্র তাঁহাকে কহিতে আরম্ভ করিলেন, “দুৰ্য্যোধন! তুমি অতি নৃশংস, পাপাত্মা ও নীচসহায় [নীচাশয় লোকের সাহায্যগ্রহণকারী]; এই নিমিত্তই অসাধ্য অযশস্কর সাধুগৰ্হিত পাপাচরণে সমুৎসুক হইয়াছ। কুলপাংশুল [কুলকলঙ্ক-কুলাঙ্গার] মূঢ়ের ন্যায় দুরাত্মাদিগের সহিত মিলিত হইয়া নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ জনার্দনকে নিগ্রহ করিতে ইচ্ছা করিতেছ। বালক চন্দ্ৰমাকে গ্ৰহণ করিতে উৎসুক হয়, তুমি ও সেইরূপ ইন্দ্ৰাদি দেবগণের দুরাক্রম্য [আক্রমণের অযোগ্য] কেশবকে গ্রহণ করিবার বাসনা করিতেছ। দেব, মনুষ্য, গন্ধৰ্ব, অসুর ও উরগগণ [সর্প] যাহার সংগ্রাম সহ্য করিতে সমর্থ হন না, তুমি কি সেই কেশবের পরিচয় প্রাপ্ত হও নাই? বৎস! হস্তদ্বারা কখন বায়ু গ্ৰহণ করা যায় না; পাণিতলদ্বারা কখনও পাবক [অগ্নি] স্পর্শ করা যায় না; মস্তকদ্বারা কখনও মেদিনী ধারণ করা যায় না এবং বলদ্বারা কখন কেশবকে গ্রহণ করা যায় না।”

ধৃতরাষ্ট্রের বাক্যাবসানে মহামতি বিদুর দুৰ্য্যোধনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “দুৰ্য্যোধন! এক্ষণে আমার বাক্য শ্রবণ কর। সৌভনগরদ্বারে দ্বিবিদনামা বানররাজ যাহাকে গ্রহণ করিবার নিমিত্ত সর্ব্বপ্রযত্নে প্রভূত শিলাবর্ষণপূর্ব্বক আচ্ছাদিত করিয়াও গ্ৰহণ করিতে সমর্থ হয় নাই, তুমি সেই পুরুষোত্তম নারায়ণকে বলপূর্ব্বক গ্রহণ করিবার বাসনা করিতেছ। নির্মোচিননগরে ষট্সহস্ৰ মহাসুর যাঁহাকে গ্রহণ করিতে অসমর্থ হইয়া পরিশেষে আপনারাই পাশবদ্ধ হইয়াছিল, তুমি সেই পুরুষোত্তম নারায়ণকে বলপূর্ব্বক গ্রহণ করিবার বাসনা করিতেছ। প্ৰাগজ্যোতিষনগরে নরকাসুর দানবগণের সহিত মিলিত হইয়া যাঁহাকে গ্ৰহণ করিতে সমর্থ হয় নাই, তুমি সেই পুরুষোত্তম নারায়ণকে বলপূর্ব্বক গ্ৰহণ করিবার বাসনা করিতেছ।

“ইনি বাল্যকালে পূতনা এবং শকুনিকে নিহত করিয়াছিলেন। ইনি গোকুলরক্ষার্থ গোবৰ্দ্ধনপর্ব্বত ধারণ করিয়াছিলেন। ইনি অরিষ্ট, ধেনুক, মহাবল চাণুর, অশ্বরাজ, কংস, জরাসন্ধ, দন্তবক্র, শিশুপাল, বাণ ও অন্যান্য রাজাদিগকে সমরে সংহার করিয়াছেন। ইনি তেজোদ্বারা বরুণ, অগ্নি এবং পারিজাতহরণকালে দেবরাজকে পরাজিত করিয়াছিলেন। ইনি সকলের কর্ত্তা; কিন্তু ইহার কেহ কর্ত্তা নাই; ইনি সকল পৌরুষের কারণ। ইনি যাহা ইচ্ছা করেন, তৎসমুদয় সংসাধন করিতে ইঁহার যত্নের আবশ্যকতা নাই; উহা আপনিই সিদ্ধ হইয়া উঠে। ইনি মহাপ্ৰলয়জলে শয়নকালে মধুকৈটভকে বিনষ্ট করিয়াছিলেন। পরে ইনি জন্মান্তর পরিগ্রহ করিয়া হয়গ্রীবকে কালকবলে নিক্ষেপও করিয়াছিলেন। তুমি এই মহাবলপরাক্রান্ত অক্লিষ্টকর্ম্ম কৃষ্ণকে অবগত হইতে সমর্থ হও নাই। অতএব পতঙ্গ যেমন পাবকে পতিত হইয়া ভস্মাবশেষ হয়, তুমিও সেইরূপ এই কুপিত ভুজঙ্গসদৃশ অতি তেজস্বী মহাবাহু বাসুদেবকে আক্রমণ করিয়া বিনাশপ্ৰাপ্ত হইবে।”

অরাতিবিমর্দন জনার্দন বিদুরের বাক্যানুবসানে দুর্য্যোধনকে কহিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন! তুমি যে আমাকে একাকী মনে করিয়া পরাভূত ও রুদ্ধ করিবার অভিলাষ করিতেছ, তাহা তোমার ভ্ৰান্তি। পাণ্ডব, অন্ধক, বৃষ্ণি, আদিত্য, রুদ্র, বসু ও ঋষিগণ এই স্থানে বিদ্যমান আছে।” তিনি এই কহিয়া উচ্চৈঃস্বরে হাস্য করিতে লাগিলেন।

কৃষ্ণের বিশ্বরূপপ্রকাশ

তখন শৌরির শরীর হইতে বিদ্যুতের ন্যায় রূপবান, অগ্নির ন্যায় তেজস্বী, অঙ্গুষ্ঠপরিমিত দেবগণ আবির্ভূত হইতে লাগিলেন;-তাহার ললাট হইতে ব্ৰহ্মা, বক্ষঃ হইতে রুদ্র, হস্ত হইতে লোকপালগণ, মুখমণ্ডল হইতে অনল, আদিত্য, সাধ্য, বসু ও বায়ুগণ, অশ্বিনীদ্বয়, ইন্দ্র ও ত্রয়োদশ বিশ্বদেব সমুৎপন্ন হইলেন। এইরূপ দক্ষিণবাহু হইতে ধনুৰ্দ্ধর ধনঞ্জয়, বামবাহু হইতে হলধর বলরাম এবং পৃষ্ঠ হইতে যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব, প্ৰদ্যুম্ন প্রভৃতি অন্ধক ও বৃষ্ণিগণ উদ্যতায়ুধ হইয়া আবির্ভূত হইলেন। শঙ্খ, চক্ৰ, গদা, শক্তি, শার্ঙ্গ, লাঙ্গল ও নন্দক এইসকল মহাস্ত্ৰ সমুদ্যত হইয়া তাঁহার নেত্র, নাসিকা ও শ্রোত্র হইতে ধূমসম্বলিত অতি ভীষণ হুতাশনশিখা আবির্ভূত হইল এবং লোমকূপ হইতে সূৰ্য্যকিরণের ন্যায় কিরণসকল নিঃসৃত হইতে লাগিল ।

দ্ৰোণাদির দিব্যচক্ষে বিশ্বরূপনিরীক্ষণ

ভগবান বাসুদেব দ্রোণ, ভীষ্ম, বিদুর, সঞ্জয় ও ঋষিগণকে দিব্যচক্ষু প্ৰদান করিয়াছিলেন; তাঁহারা ভিন্ন তত্রস্থ সমস্ত ভূপাল মহাত্মা কেশবের সেই ভীষণ মূর্ত্তি নিরীক্ষণ করিয়া ভয়াকুলিতচিত্তে নেত্রদ্বয় নিমীলিত করিলেন। সভাতলে বাসুদেবের এই সর্ব্বলোকাতীত অতি আশ্চৰ্য্য ব্যাপার অবলোকন করিয়া দেবদুন্দুভিসকল নিনাদিত ও পুষ্পবৃষ্টি নিপতিত হইতে লাগিল।

দিব্যচক্ষে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের বিশ্বরূপদর্শন

তখন রাজা ধৃতরাষ্ট্র কৃষ্ণকে কহিলেন, “হে পুণ্ডরীকক্ষ! হে যাদবশ্রেষ্ঠ! তুমি সকল জগতের হিতকারী; অতএব প্রসন্ন হইয়া আমাকে চক্ষু প্ৰদান কর; আমি তদ্বারা কেবল তোমাকে দর্শন করিবার অভিলাষ করি; অন্যকে দেখিবার প্রবৃত্তি নাই, তোমাকে দর্শন করা হইলে তাহা যেন পুনরায় তিরোহিত হয়।”

মহাবাহু কৃষ্ণ কহিলেন, “হে কুরুনন্দন! আপনি অন্যকর্ত্তৃক অদৃশ্যমান নেত্রদ্বয় লাভ করুন।”

রাজা ধৃতরাষ্ট্র বিশ্বরূপসন্দর্শনের অভিলাষে বাসুদেব হইতে নয়নদ্বয় প্রাপ্ত হইলেন। রাজা ও ঋষিগণ তাঁহাকে লব্ধ নয়ন নিরীক্ষণ করিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন এবং মধুসূদনের স্তব করিতে লাগিলেন। পৃথিবী বিচলিত ও সাগর সংক্ষোভিত হইয়া উঠিল। এবং ভূপতিগণ সাতিশয় বিস্ময়ান্বিত হইলেন।

অনন্তর বাসুদেব সেই স্বীয় মূর্ত্তি ও সেই অদ্ভুত বিচিত্র সমৃদ্ধি উপসংহার এবং ঋষিগণের নিকট অনুজ্ঞা লাভ করিয়া সাত্যকি হার্দ্দিক্যের পাণিধারণপূর্ব্বক সভামণ্ডপ হইতে প্রস্থান করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। নারদাদি মহর্ষিগণ অন্তর্হিত হইয়া সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। তখন এক অদ্ভুত কোলাহল উপস্থিত হইল।

কৃষ্ণের সভাত্যাগ

কৌরবগণ পুরুষোত্তমকে প্রস্থান করিতে দেখিয়া ভূপতিগণ-সমভিব্যাহারে দেবরাজের অনুগামী দেবগণের ন্যায় তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। আমেয়াত্মা বাসুদেব তাঁহাদিগকে গণনা না করিয়া সাধূম হুতাশনের ন্যায় বিনিষ্ক্রান্ত হইয়া শৈব্যসুগ্ৰীব [তল্লামক প্ৰসিদ্ধ অশ্বদ্ধয়]-যুক্ত অতি বৃহৎ শ্বেতবর্ণ রথসমেত সারথি দারুক, মহারথ কৃতবর্ম্মা ও বৃষ্ণিগণের প্রিয়তম হার্দ্দিক্যকে নয়নগোচর করিলেন।

অনন্তর তিনি রথারোহণপূর্ব্বক গমন করিতে আরম্ভ করিলে রাজা ধৃতরাষ্ট্র তাঁহাকে কহিলেন, “হে কেশব! আমার পুত্ৰগণের বল তোমার অগোচর নাই; সমুদয়ই প্রত্যক্ষ করিয়াছ; আমার যেরূপ অবস্থা এবং আমি কৌরবগণের শান্তির নিমিত্ত যে প্রকার যত্ন করিতেছি, সেই সকল অবগত হইয়া শঙ্কা করা তোমার উচিত নয়। পাণ্ডবগণের প্রতি আমার পাপাভিসন্ধি নাই; আমি দুৰ্য্যোধনকে যাহা কহিয়াছি, তুমি তাহা অবগত হইয়াছ। আমি সন্ধিসংস্থাপনের নিমিত্ত যে কি প্রকার যত্ন করিতেছি, সমুদয় কৌরব ও পার্থিবগণ উহা বিলক্ষণ অবগত আছেন।”

তখন বাসুদেব রাজা ধৃতরাষ্ট্র, দ্রোণ, ভীষ্ম, বিদুর, বাহ্লীক ও কৃপাচাৰ্য্যকে কহিলেন, “হে মহানুভবগণ! আজি কৌরবসভায় যে ঘটনা হইয়াছে, দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন রোষবশতঃ যে প্রকার অশিষ্টের ন্যায় সমুত্থিত হইয়াছিল এবং রাজা ধৃতরাষ্ট্র আপনার [নিজের] কর্ত্তৃত্ব নাই বলিয়া যে প্রকার পরিচয় প্রদান করিতেছেন, আপনারা তৎসমুদয়ই প্রত্যক্ষগোচর করিলেন। এক্ষণে সকলকে আমন্ত্রণ [সকলের নিকট বিদায় লইয়া] করিয়া যুধিষ্ঠিরের নিকট গমন করি।”

বাসুদেব এইরূপে তাঁহাদিগকে আমন্ত্রণ করিয়া প্রস্থান করিলে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র, বাহ্লীক, অশ্বত্থামা, বিকৰ্ণ, যুযুৎসুপ্রভৃতি মহাধনুৰ্দ্ধর কুরুবীরগণ তাঁহার অনুগমন করিলেন। অনন্তর বাসুদেব পিতৃষ্বসা কুন্তীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত গমন করিলেন। তখন অন্যান্য কৌরবগণ তথায় দণ্ডায়মান হইয়া দর্শন করিতে লাগিলেন।