১০৪. ইন্দ্রের প্রতি গরুড়ের রোষ

১০৪তম অধ্যায়

ইন্দ্রের প্রতি গরুড়ের রোষ

“অনন্তর পন্নগরাজ গরুড় সুররাজ নাগকে আয়ু প্রদান করিয়াছেন শ্রবণ করিয়া ক্ৰোধকম্পিত্যকলেবরে পক্ষপবনে [পাখীর পাখার বাতাস] ত্ৰিভুবন আকুলিত করিয়া বাসবের প্রতি ধাবমান হইলেন; তথায় সমুপস্থিত হইয়া পুরন্দরকে কহিলেন, ‘সুররাজ তুমি কি নিমিত্ত অবজ্ঞা করিয়া আমার বৃত্তিলোপ করিলে? তুমি পূর্ব্বে স্বেচ্ছানুসারে বর প্রদান করিয়া এক্ষণে কি নিমিত্ত বিচলিত হইতেছ? সর্ব্বভূতেশ্বর বিধাতা সর্পকে আমার আহার নিরূপণ করিয়াছেন, তুমি কি নিমিত্ত তাহার অন্যথা করিলে? আমি মহানাগের নিকট প্রার্থনা করিয়া তাহার সহিত নিয়ম সংস্থাপনপূর্ব্বক [কাহাকে কোন দিন ভক্ষণ করিব এইরূপ পালা নির্দ্দেশ] পরিবার ভরণপোষণ করিতেছি। অন্য কাহারও হিংসা করিতে পারিব না। কিন্তু তোমার কোন নিয়ম এক্ষণে পরিজন ও ভৃত্যবর্গের সহিত প্ৰাণ পরিত্যাগ করিব, তুমি সুখে কালব্যাপন কর। যখন আমি ত্ৰিলোকের ঈশ্বর হইয়াও পরের ভূত্য হইয়াছি, তখন আমার পক্ষে মৃত্যুই শ্রেয়স্কর। হে সুরেশ্বর! তুমি অনন্তকাল রাজ্যভোগ করিবে; তুমি বর্ত্তমান থাকিতে বিষ্ণুও আমার প্রভু নহেন।

“ ‘হে বাসব! আমিও দক্ষসূতা বিনতার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছি, আমার সমুদয় লোক বহন করিবার ক্ষমতা আছে; আমার বল সর্ব্বভূতের অসহ্য। দানবগণের সহিত সংগ্রামসময়ে আমিও মহৎকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছি। শ্রুতশ্ৰী, শ্রুতসেন, বিবস্বান, রোচনামুখ, প্রস্তুত ও কালকক্ষপ্ৰভৃতি দানবগণ আমারই হস্তে নিহত হইয়াছে। বোধহয়, আমি তোমার অনুজকে [কনিষ্ঠ উপেন্দ্ৰ-বিষ্ণুকে] বহন ও তাঁহার ধ্বজাগ্রে উপবেশন করি বলিয়া তুমি আমাকে অবজ্ঞা কর। কিন্তু বিবেচনা করিয়া দেখ, আমা অপেক্ষা বলবান ও ভারসহ আর কে আছে? আমি শ্রেষ্ঠ হইয়াও কৃষ্ণকে সবান্ধবে বহন করিয়া থাকি; আর তুমি অবজ্ঞাপূর্ব্বক আমার আহারের ব্যাঘাত করিলে; অতএব তোমাদিগের উভয় হইতে আমার গৌরব নষ্ট হইল। হে পুরন্দর! অদিতির গর্ভে যেসমুদয় বলবিক্রমশালী পুরুষেরা জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তুমি তাহাদের সকলের অপেক্ষা বলবান। কিন্তু আমি স্বীয় পক্ষের একদেশে তোমাকে বহন করিতে পারি; অতএব বিবেচনা কর, আমা অপেক্ষা বলবান আর কে আছে?’ ”

গরুড়ের দর্পচূৰ্ণ

কণ্ব কহিলেন, “ভগবান চক্ৰপাণি অক্ষুব্ধ [অক্ষোভণীয়-প্রায় কখনও যাহার ধৈর্য্যচ্যুতি হয় না, এইরূপ] গরুড়ের গর্ব্বিত বাক্যশ্রবণে ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে ক্ষোভিত করিয়া কহিলেন, ‘হে বলহীন অণ্ডজ! তুমি মনে মনে আপনাকে বলবান বলিয়া স্থির করিয়াছ; কিন্তু আমাদের সমক্ষে আত্মশ্লাঘা [আত্মপ্রশংসা-নিজের গুণকীর্ত্তন] করা তোমার নিতান্ত অনুচিত। ত্রিভুবনও আমার দেহ ধারণ করিতে পারে না; আমি আপনিই আপনাকে ও তোমাকে ধারণ করিতেছি। যদি তুমি আমার এই দক্ষিণবাহুর ভার সহ্য করিতে পার, তাহা হইলে তোমার আত্মশ্লাঘা সার্থক।” ভগবান নারায়ণ এই বলিয়া গরুড়ের স্কন্ধে দক্ষিণবাহু অর্পণ করিবামাত্ৰ পক্ষিরাজ নিতান্ত বিকল হইয়া বিনষ্টচৈতন্যের [সংজ্ঞাহীনের-অচৈতন্যেরা] ন্যায় ধরাতলে নিপতিত হইলেন। সপর্ব্বত সকানন মেদিনীমণ্ডলের ভার যে প্রকার গুরুতর, পতগেন্দ্ৰ বিষ্ণুর এক বাহুতে তদনুরূপ ভার অনুভব করিলেন।

“ফলতঃ, ভগবান অচ্যুত স্বীয় বলদ্বারা গরুড়কে নিতান্ত নিপীড়িত করেন নাই বলিয়াই তাঁহার জীবনরক্ষা হইল। তিনি তখন গুরুতর বিষ্ণুবাহুভরে বিহ্বল, শিথিলকায় [অবশদেহ] ও বিচেতন্যপ্রায় হইয়া বমন এবং পক্ষবিস্তারপূর্ব্বক তাহার চরণে প্ৰণিপাতপূর্ব্বক দীনবচনে কহিতে লাগিলেন, “ভগবন! আপনার গুরুভারযুক্ত দক্ষিণবাহু আমার উপর একবার নিক্ষিপ্ত হওয়াতে আমি নিস্পিষ্ট হইয়াছি; অতএব অনুগ্রহ করিয়া এই অল্পচেতাঃ [ক্ষুদ্রমতি] বলদৰ্পহীন ধ্বজবাসী পক্ষীর অপরাধ মার্জ্জন করুন। আমি আপনার বলবিক্রম অবগত ছিলাম না বলিয়াই আপনাকে [নিজেকে] সর্ব্বাপেক্ষা বলবান স্থির করিয়াছিলাম।”

“অনন্তর ভগবান নারায়ণ গরুড়ের স্তব-শ্রবণে তাঁহার প্রতি প্রসন্ন হইয়া স্নেহসহকারে কহিলেন, ‘বিহগরাজ! কদাচ আর এমন কর্ম্ম করিও না।” এই বলিয়া সুমুখকে আনয়নপূর্ব্বক পদাঙ্গুষ্ঠদ্বারা গরুড়ের বক্ষস্থলে নিক্ষেপ করিলেন। তদবধি গরুড় সৰ্পের সহিত একত্র বাস করিতে লাগিলেন।

কণ্বের বাক্যে দুর্য্যোধনের অবজ্ঞা

“হে গান্ধারীনন্দন! মহাবল পরাক্রান্ত বিনতাতনয় এইরূপে বিষ্ণুর নিকট বিনষ্টদৰ্প হইয়াছিল। আপনিও যে পৰ্য্যন্ত সমরে পাণ্ডবগণের সহিত সাক্ষাৎ না করিবেন, সেই পৰ্য্যন্ত জীবিত থাকিবেন। মহাবলপরাক্রান্ত পবননন্দন ভীমসেন ও ইন্দ্রতনয় ধনঞ্জয় সমরে কাহাকে সংহার করিতে সমর্থ না হয়েন? হে দুৰ্য্যোধন! আপনি কিরূপে বিষ্ণু, বায়ু, ইন্দ্র, ধর্ম্ম ও অশ্বিনীতনয়দ্বয়কে সংগ্রামে পরাভব করিবেন? অতএব আপনি সমরবাসনা পরিহারপূর্ব্বক বাসুদেবের দ্বারা পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধিসংস্থাপন করিয়া কুল রক্ষা করুন। এই সেই বিষ্ণুর মাহাত্ম্যদর্শী মহাতপাঃ দেবর্ষি নারদ এবং এই সেই চক্ৰগদাপাণি। ভগবান নারায়ণ উপস্থিত রহিয়াছেন।”

দুৰ্মতি দুৰ্য্যোধন মহর্ষি কণ্বের বাক্য-শ্রবণে ভ্রূকুটিকুটিল মুখে কর্ণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া হাস্য করিতে লাগিলেন এবং মহর্ষির বাক্যে অশ্রদ্ধা প্রদর্শনপূর্ব্বক উরুদ্দেশে চপেটাঘাত করিয়া কহিলেন, “হে তপোধন। পরমেশ্বর আমাকে সৃষ্টি করিয়া যেরূপ বুদ্ধি প্রদান করিয়াছেন, আমি তদনুরূপ কাৰ্য্যই করিতেছি; আমার অদৃষ্ট যাহা আছে, তাহাই ঘটিবে। আপনি কেন বৃথা প্ৰলাপ [অসম্বন্ধ বাক্য-বৃথা কথা] করেন?”