• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

১৩. রঙলাল ডাক্তার

লাইব্রেরি » তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় » আরোগ্য-নিকেতন (১৯৫৩) » ১৩. রঙলাল ডাক্তার

অদ্ভুত মানুষ ছিলেন রঙলাল ডাক্তার।

সাধারণ মানুষের সমাজ তাকে মহাদাম্ভিক অর্থপিপাসু হৃদয়হীন বলেই মনে করত। ঠিক তাঁর বাবার প্রকৃতির বিপরীত।

ভাষা ছিল রূঢ়, আপ্যায়নহীন অসামাজিক মানুষ।

জীবন ডাক্তারের সঙ্গেও প্রথম পরিচয়ে এমনই ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন তিনি।

জগৎ মশায়ের মৃত্যুর পর। মনে তখন গভীর অশান্তি। সুপ্ত অতৃপ্তি যেন প্ৰচণ্ড তৃষ্ণায় জেগে উঠেছে জগৎ মশায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে, তার গুরুগম্ভীর অস্তিত্বের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে। তাঁর স্নেহ যেমন প্রসন্ন এবং গাঢ় ছিল, তার নির্দেশ এবং পরোক্ষ শাসনও ছিল তেমনি গুরুগম্ভীর, অলঙ্নীয়। জীবনের যে অসন্তোষ ছিল চাপা সে যেন চূড়া-ভেঙে-পড়া পাহাড়ের বুকের আগুনের মত বেরিয়ে পড়ল।

ওঃ–প্রথম দিনের অগ্ন্যুদ্গারের কথা মনে পড়ছে।

আতর-বউ সেদিন প্রথম মাথা কুটেছিলেন। আতর-বউও চিরকালের অসন্তোষের আগুন বুকে বয়ে নিয়ে চলেছেন। বিবাহের পর সেই ফুলশয্যার রাত্রি থেকেই জীবন ডাক্তার সে আগুনের উত্তাপ সহ্য করে আসছেন।

বাল্যকালে পিতৃমাতৃহীনা মেয়েটি মামার বাড়িতে মানুষ। চিরদিনের মুখরা। চিরদিনের–। কী বলবেন? প্রচণ্ডা ছাড়া বোধ করি বিশেষণ নাই। চিরদিনের প্রচণ্ডা। অদ্ভুত জীবনীশক্তি। সেই বাল্যকাল থেকেই মাথা কুটে বিদ্রোহ করতেন। শাসন যত কঠিন হয়েছে তত মাথা কুটেছেন। তত চিৎকার করে কেঁদেছেন। তারপর কৈশোরে দিনের পর দিন উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছেন মামা-মামির ঘরে, দিনেকের জন্য বিশ্রাম নেন নি। তার সঙ্গে উপবাস। মাসের মধ্যে সাতটাআটটা দিন উপবাস করতেন; অন্যপক্ষ শাসনের নামে নির্যাতন করে ক্লান্ত হয়ে হার মানলে তবে অন্ন গ্রহণ করতেন।

বিবাহের ফুলশয্যাতেই এমন মেয়ের বুক থেকে অগ্নিজ্বালা না হক অগ্নিতাপ বিকীর্ণ হবে তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে। কিন্তু নতুন বউ হিসেবে সংসারে সে সুনাম কিনেছিল। দিনের বেলা দূর থেকে জীবনমশায় আতর-বউকে দেখতেন প্রসন্ন, প্রশান্ত, হাস্যময়ী; অবশ্য শাশুড়ির সমাদর তার একটা বড় কারণ। মা বউকে বড় সমাদর করতেন। মায়ের ধারণা ছিল আতরবউয়ের মত পয়মন্ত মেয়ে আর হয় না। বিয়ের পর বাপের কাছে আয়ুর্বেদ শিক্ষায় জীবনের মনপ্ৰাণ সমৰ্পণ করা দেখে এই ধারণা হয়েছিল তার। তিনি বলতেন—আমার বউয়ের পয়েই এমনটা হল। নইলে সেই জীবনে, যে মাথাটা নিচু করে টু মেরে বড় বড় জোয়ানকে ঘায়েল করেছে, বোশেখ মাসের দিনে সকালে বেরিয়ে বেলা দুপুর পার করে তা খেয়ে ফিরেছে, মোলকিনী পুকুর বিশবার এপার-ওপার করে পাক তুলে কাদা করে তবে উঠেছে, তার এই মতিগতি হয়। স্কুলে গিয়ে মারামারি করেছে। বই তো না। এ যেন সে মানুষই নয়। বউমার পয় ছাড়া আর কী বলব? বউমা বাড়িতে পা দেওয়ার পর এই হল!

এ কথা শুনে সেকালে আতর-বউয়ের মুখ স্মিতহাস্যে ভরে উঠত।

এই সময়টাই জগৎ মশায়ের জীবনের প্রবীণতম কাল, প্রবীণতার সঙ্গে সঙ্গে বিচক্ষণতা এবং বহুদৰ্শিতার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন জগৎমশায় নিজে আর সাধারণ রোগী দেখতে বের হতেন না, জীবন ছিলেন সেজন্য। রোগ কঠিন হলে তবে নিজে যেতেন। নইলে বলতেন, আমার যাবার দরকার নাই বাবা, আমার জীবন যাচ্ছে। ও আমারই যাওয়া। সঙ্গে সঙ্গে মৃদু হাসতেন।

কথাটার ভিতরের অর্থ যে না বুঝত, তাকে তিনি ওর অর্থ বোঝাতে চেষ্টা করতেন না, রসিকতা যে বোঝে না তার সঙ্গে রসিকতা তিনি করতেন না, সাদা কথায় বলতেন, জীবন দেখে এসে আমাকে বলবে, তাতেই হবে। জীবনকেই আমি বলে দেব যা করতে হবে, যে ওষুধ দিতে হবে, তার জন্যে ভেবো না।

যেতেন, জীবন যখন বলত তখন। আর যেতেন অন্য চিকিৎসকের হাতের রোগী দেখবার জন্য ডাক এলে তখন। আর যেতেন যে ক্ষেত্রে নিদান হাকতে হবে সেই ক্ষেত্রে।

একটা ঘটনা মনে পড়ছে। এই ঘটনায় জগৎ মশায়ের খ্যাতি পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। নবগ্রামের বরদাপ্রসাদবাবুর কঠিন অসুখ। বরদাবাবুরা নবগ্রামের প্রাচীনতম জমিদার বংশ; এক পুরুষকাল আগে এই বংশেরই বড়তরফের কর্তার বাড়িতে জগৎ মশায়ের বাবা দীনবন্ধু মশায় খাতা লিখতেন এবং ছেলেদের পড়াতেন। এই বাড়ির ছেলের রোগের সেবা করে দীনবন্ধু মশায় প্রথম চিকিৎসাবিদ্যার আস্বাদ পেয়েছিলেন এবং কর্তার ছেলের আরোগ্যের পর বিখ্যাত কবিরাজ কৃষ্ণদাস সেনগুপ্ত নিজে ডেকে তাকে আয়ুর্বেদে দীক্ষা দিয়েছিলেন। এই কৃতজ্ঞতায় দীর্ঘকাল, জগৎ মশায়ের চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত, এই বংশের যে-কোনো বাড়িতে ডাকলে সসম্ভ্ৰমে বিনা দক্ষিণায় চিকিৎসা করেছেন। কিন্তু এরা তাঁর সমকে বজায় রাখত না, উপরন্তু পদে পদে অসম করত, এমনকি ওষুধের দামও দিত না; বলত খাজনায় কাটছিট করে দেব। এই কারণেই জগৎমশায় স্বগ্রামের কয়েক পয়সা জমিদারি কিনে অসম্ভমের হাত থেকে রক্ষা পেতে চেয়েছিলেন। এবং রক্ষাও পেয়েছিলেন। নবগ্রামের রায়চৌধুরী বংশ তাকে আর ডাকতেন না। তারা হরিহরপুরের কবিরাজ হীরালাল পাঠককে গৃহ-চিকিৎসক করেছিলেন। রোগ কঠিন হলে ডাকতেন রাঘবপুরের গুপ্ত কবিরাজদের। বরদাবাবুর অসুখে বাধ্য হয়ে তার ছেলে জগৎ মশায়কে ডেকেছিলেন। বরদাবাবুর ছেলে কলকাতায় ব্যবসায় করতেন। বাপের অসুখের সংবাদ শুনে গ্রামে এসেই ডাকলেন রাঘবপুরের গুপ্তকে। গুপ্ত এসে বললেন– তিন দিন, এক সপ্তাহ বা নবম দিনে মৃত্যু অনিবার্য।

ছেলে বললেন–আমি কলকাতায় নিয়ে যাব।

গুপ্ত বললেন–তাতে পথে মৃত্যু হবে। তিন দিন পরমায়ুও তাতে ক্ষয়িত হবে।

ছেলে এরপর রঙলাল ডাক্তারকে ডাকলেন, কবিরাজ হাত দেখে বললেন। রূঢ়ভাষী রঙলাল ডাক্তার বাধা দিয়ে বললেন–ও বিদ্যেটা আমি বুঝি না, বিশ্বাস করি না।

ছেলে বললেন– মানে উনি বলেছেন তিন দিন, এক সপ্তাহ বা নবম দিনে মৃত্যু অনিবার্য।

রঙলাল বললেন–সেও আমি বলতে পারব না। তবে ওর কাছে লিখে নিতে পারেন। মৃত্যু না হলে নালিশ করতে পারবেন। আমাকে লিখে দিলে আমি নালিশ করব।

ছেলে বললেন–এখন আমি চিকিৎসার জন্যে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাই।

—তবে আমাকে কেন ডেকেছেন? নিয়েই যান।

–কবিরাজ বলেছেন—তাতে তিন দিনও বাঁচবেন না, পথেই ত্ৰিশূন্যে অর্থাৎ গাড়িতেই মারা যাবেন।

—তা পারেন। আবার নাও পারেন। আমি ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি। রোগ কঠিন। মরবেন কি বাঁচবেন সে আমি জানি না।

রঙলাল ডাক্তার চলে গেলে অগত্যা তাঁরা জগৎ মশায়কে ডাকলেন।

জগৎমশায় নাড়ি দেখে বলেছিলেন–সুচিকিৎসার জন্যে কলকাতা নিয়ে যাবেন, বাধা দেব না; নিয়ে যান। চিন্তার কোনো কারণ নাই আমি দায়ী রইলাম।

ছেলে বলেছিলেন—দেখুন, ভাল করে বুঝুন।

—না বুঝে কি এতবড় কথা বলতে পারি রায়চৌধুরীমশায়? নিয়ে যান। আমার কথার অন্যথা হলে আমি দশের সম্মুখে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, চিকিৎসা আমি ছেড়ে দেব। আর–।

হেসে বলেছিলেন–আর এ যাত্রায় কর্তার রোগভোগ আছে, দেহরক্ষা নাই। অচিকিৎসা কুচিকিৎসা হলে তার কথা আলাদা। চিকিৎসা হলে বাঁচবেন। আপনি কলকাতায় নিয়ে যান।

তার কথাই সত্য হয়েছিল। বরদাবাবুকে কলকাতা নিয়ে পৌঁছুতে কোনো বিঘ্ন ঘটে নাই এবং তিনি সেবার রোগমুক্ত হয়ে দেওঘরে শরীর সেরে বাড়ি ফিরেছিলেন।

বরদাবাবুর বাড়িতে তিনি কোনো দক্ষিণা গ্রহণ করেন নাই। বরদাবাবু বাড়ি ফিরে তাকে উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। দেওঘরের পেঁড়া, একটি ভাল গড়গড়া ও নল, কিছু ভাল তামাক আর একখানি বালাপোশ।

এই ঘটনার পরই জীবন তাঁকে বলেছিল—এবার ফিজ বাড়াতে হবে আপনাকে। চার টাকা ফিজ করুন।

জগৎমশায় তাতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু জীবন ছাড়ে নাই। বলেছিল–গরিব যারা তাদের বাড়ি আপনি বিনা ফিজে যাবেন। কিন্তু যে যা দেবে—এ করলে আপনার মর্যাদা থাকবে না।

এই সময়টিই দত্তমশায়দের বাড়ির সর্বোত্তম সুসময়।

জীবনের মা বলতেন, এসব আমার বউয়ের পয়।

আতর-বউ নিজেও তাই ভাবতেন।

সেকালে জীবন ডাক্তার রোগী দেখতে বের হবার সময় নিয়মিতভাবে আতর-বউ সামনে এসে দাঁড়াতেন। তার মুখ দেখে যাত্রায় শুভ ফল অবশ্যম্ভাবী।

***

জগৎ মশায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দত্তমশায়দের খ্যাতিতে প্রতিষ্ঠার ভাটা পড়ল স্বাভাবিকভাবে।

অনেক বাঁধা ঘর–চার-পাঁচখানা গ্রাম তাঁকে ছেড়ে কামদেবপুরের মুখুজ্জে কবিরাজের এবং হরিহরপুরের পাঠক কবিরাজের কাছে গিয়ে পড়ল। ওদিকে নবগ্রামের বাবুরা নিয়ে এলেন। একজন ডাক্তার। দুর্গাদাস কুণ্ডু। জীবনমশায় তখন শুধু জীবন দত্ত। মহাশয় তো সহজে লোকে বলে না। ওদিকে ডাক্তারির একটা সুবিধে আছে। বয়স যেমনই হোক, অভিজ্ঞতা থাক আর না থাক ডিগ্রি আছে; ডিগ্রির জোরেই ডাক্তার খেতাব তাদের প্রতিষ্ঠিত।

জীবন দত্তের সুপ্ত কামনা এই দুঃসময়ের ঝড়ে ছাই-উড়ে-যাওয়া আগুনের মত গগনে হয়ে উঠল। তিনি ডাক্তার হবেন। সম্মুখে রঙলাল ডাক্তারের দৃষ্টান্ত। ওদিকে নবগ্রামে আরও একজন নতুন ডাক্তার এল। তারই বন্ধু কৃষ্ণদাসবাবু, ওই কিশোর ছেলেটার বাপ, নতুন ডাক্তারকে আশ্রয় দিলেন। আরও শোনা গেল, নবগ্রামের নবীন ধনী ব্রজলালবাবু এখানে চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি অ্যালোপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করছেন। তিনি গোপনে গোপনে আরম্ভ করে দিলেন। অনেক সন্ধান করে দুখানি বই আনালেন—ডাক্তারি শিক্ষা ও বাঙলা মেটিরিয়া মেডিকা। ইচ্ছা সত্ত্বেও রূঢ়ভাষী রঙলাল ডাক্তারের কাছে যেতে সাহস হল না।

মাতিনেক পর হঠাৎ রঙলাল ডাক্তারের সঙ্গে তাঁর দেখা হল, তার সঙ্গে জীবনের যোগসূত্র রচিত হবার প্রথম গ্রন্থি পড়ল।

ওই কিশোর ছেলেটিকে তিনি এইজন্যই এত ভালবাসেন। এই গ্রন্থিটি পড়েছিল তাকে উপলক্ষ করেই।

হঠাৎ একদিন শুনলেন, নবগ্রামের কৃষ্ণদাসবাবুর ছেলে কিশোরের বড় অসুখ। আজ দশ দিন একজ্বরী। দেখছিল ওই নবাগত হরিশ ডাক্তার, আজ মাসখানেক সে নবগ্রামে এসেছে। কৃষ্ণদাসবাবুই তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। পাসকরা ডাক্তার-পাটনা স্কুল থেকে পাস করে এসেছে। পোর না হওয়া পর্যন্ত কৃষ্ণদাসবাবুই তার সকল ভার বহন করবেন বলেছেন। সে ই দেখছিল—আজ রঙলাল ডাক্তার দেখতে আসবেন।

জীবন দত্ত বিস্মিত হলেন, শঙ্কিতও হলেন। নিজেকে একটা ধিক্কারও দিলেন। খবর রাখা উচিত ছিল। কৃষ্ণদাসবাবু তার চেয়ে বয়সে বড় হলেও বন্ধু। এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেপালের পরমাত্মীয়-সম্বন্ধী। তা ছাড়া এই কিশোর ছেলেটিকে তিনি বড় ভালবাসেন। এই নতুন ডাক্তারটি কৃষ্ণদাসবাবুর বাড়িতে আসবার আগে পর্যন্ত অর্থাৎ চার মাস আগে পর্যন্তও তারাই পুরুষানুক্রমে এঁদের বাড়িতে চিকিৎসা করতে আসছিলেন। তার তো একবার যাওয়া উচিত ছিল। চিকিৎসক হিসেবে না-ডাকতে যাওয়ায় মর্যাদায় বাধে, কিন্তু তার উপরেও যে একটা অন্তরঙ্গতার সম্পর্ক আছে। কৃষ্ণদাসবাবুর সঙ্গে আছে, ওই কিশোর ছেলেটির সঙ্গেও আছে। ও পাড়ায় গেলেই তিনি কিশোরের খোঁজ করে দু-চারটি কথা বলে আসেন। ছ-সাত বছরের এই শ্যামবৰ্ণ ছেলেটি আশ্চর্য রকমের দীপ্তিমান। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং রসবোধে সরস বুদ্ধি।

এই তো সেদিন।

নেপালের বাড়ি থেকে তিনি নেপালকে সঙ্গে নিয়েই বের হচ্ছিলেন। পথে যাচ্ছিল কিশোর। দুপুরবেলা শ্যালক-পুত্রকে একা দেখে পাগলা নেপালের কর্তব্যবোধ জেগে উঠল। কিশোরের গতিপথ দেখে যে-কেউ বুঝতে পারত যে, সে নিজেদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছে; পাগলা নেপাল সেই হিসেবে অকারণেই প্রশ্ন করলে—কোথায় যাবি? আমাদের বাড়ি?

–না।

–তবে? দুপুরবেলা যাবি কোথায়?

কিশোর উত্তর দিয়েছিল–যাব তোমার শ্বশুরবাড়ি।

নেপাল বুঝতে পারে নাই রসিকতাটুকু। জীবন হা-হা করে হেসেছিলেন।

 

জীবন ডাক্তার নিজেও অপ্রতিভ হয়েছেন তার কাছে। এই তো মাসকয়েক আগে। তখনও চিকিৎসা করতেন ওদের বাড়িতে। কিশোরেরই জ্বর হয়েছিল। নাড়িতে দেখলেন অশ্লদোষ। কৃষ্ণদাসবাবুর ভগ্নী বললেন–এই জ্বর অবস্থাতেও কাল খোয়া-ক্ষীর চুরি করে খেয়েছে। অশ্লদোষের আর দোষ কী?

জীবন ডাক্তার বলেছিলেন-অ্যাঁ? তুমি চুরি করে খেয়েছ?

কিশোর অপ্রস্তুত হয় নি। বলেছিল–হ্যাঁ।

—জান, চুরি করে খেলে পাপ হয়?

কিশোর ঘাড় নেড়ে বলেছিল—হয়। কিন্তু খোয়া-ক্ষীর খেলে হয় না।

জীবন ডাক্তার অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন,-কে বলেছে তোমাকে?

কিশোর বলেছিল—ভাগবতে শুনেছি। কৃষ্ণ নিজে খোয়া-ক্ষীর, ননি, মাখন চুরি করে খেতেন। তবে কেন পাপ হবে?

জীবন ডাক্তারকে হার মানতে হয়েছিল। অতঃপর চিকিৎসাশাস্ত্ৰতত্ত্ব বোঝাতে হয়েছিল। ছেলেটি মন দিয়ে শুনেছিল এবং শেষে বলেছিল—আচ্ছা আর বেশি খাব না। কম করে খাব।

এরপর জীবন ডাক্তার কিশোরকে দেখলেই পুরাণ-সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন। কিশোর প্রায়ই উত্তর দিয়েছে এবং বিচিত্র ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছে। রাবণের কটা মাথা কটা হাত জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল দশটা মাথা কুড়িটা হাত। জানেন, রাবণ কখনও ঘুমোত না।

—কেন?

–শুয়ে পাশ ফিরবে কী করে?

এইভাবে ছেলেটির সঙ্গে একটি নিবিড় অন্তরঙ্গতা জমে উঠেছিল। তার অসুখবেশি অসুখ, রঙলালবাবুর মত ডাক্তার আসছেন–জীবন ডাক্তার আর থাকতে পারলেন না। তিনি নিজেই এলেন কৃষ্ণদাসবাবুর বাড়ি। কৃষ্ণদাস অপ্রস্তুত হলেন কিন্তু জীবন স্মিতহাস্যে বললেন– কিছু না কৃষ্ণদাস দাদা, আপনারা ব্রাহ্মণ, আমি কায়স্থ হলেও তো আমি আপনার ভাই। খুড়া হিসেবে দেখতে এসেছি। চলুন, কিশোরকে একবার দেখব।

কিশোর প্রায় বেশ হয়ে পড়ে ছিল। গলায় মৃদু সর্দির শব্দ উঠছে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে। দুচারটি ভুলও বকছে। ভাদ্র মাসে গরম কাপড় দিয়ে তাকে প্রায় মুড়ে রাখা হয়েছে। নতুন ডাক্তার বললেন–বুকে সর্দির দোষ রয়েছে; জ্বর উঠেছে এক শো তিন। নিউমোনিয়া এতদিন পূর্ণমাত্রায় দেখা দিত, কিন্তু আমি গোড়া থেকেই বেঁধেছি। তবু যে কেন জ্বর কমছে না বুঝছি না।

জীবন ডাক্তার দুটি হাতের নাড়ি দীর্ঘক্ষণ ধরে মনঃসংযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করলেন। জিভ চোখ দেখলেন, পেট টিপে পরীক্ষা করলেন। তারপর উঠে হাত ধুয়ে কৃষ্ণদাসবাবুর কাছে বসে বললেন–একুশ দিন বা চব্বিশ দিনে জ্বরত্যাগ হবে কৃষ্ণদাস দাদা। ভয়ের কোনো কারণ নাই, তবে জ্বরটা একটু বাঁকা। আগন্তুক জ্বর, সানিপাতিক দোষযুক্ত, তবে প্রবল নয়; মারাত্মকও নয়। শ্লেষ্মা দোষ—ডাক্তারবাবু যেটা বলছেন–

হরিশ ডাক্তারের দিকে চেয়ে বললেন–এটা আনুষঙ্গিক, আসল ব্যাধি ওটা নয়।

হরিশ ডাক্তার প্রায় তার সমবয়সী; জীবন দত্তের থেকে বছর চার-পাঁচের ছোট। কর্মজীবনে এটা খুব পার্থক্যের বয়স নয়। প্রীতির সঙ্গেই বলেছিলেন। কিন্তু পাস-করা হরিশ ডাক্তার বলেছিল না। আমি স্টেথোসকোপ দিয়ে দেখেছি। সর্দির দোষটাই মূল দোষ। আর সান্নিপাতিক মানে টাইফয়েডের কথা যা বলছেন—ওটা আমার মতে ঠিক নয়।

জীবন দত্ত ধ্যানস্থের মত নাড়ি ধরে অনুভব করেছেন, যা বুঝেছেন তা ভুল হতে পারে না। তিনি মৃদু হাসির সঙ্গে ঘাড় নেড়েছিলেন। ঠিক এই সময়েই বাইরে পালকির বেহারাদের হক শোনা গিয়েছিল।

হরিশ ডাক্তার ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল—ওই, উনি এসে গিয়েছেন।

জীবন দত্তও বাইরে যাবার জন্য উদ্যত হলেন, হঠাৎ নজরে পড়ল কিশোরের শিয়রে বসে অবগুণ্ঠনবতী তার মা। জীবন দত্ত গভীর বিশ্বাসে আশ্বাস দিয়ে আবার বলেছিলেন কোনো ভয় নাই। যে যা বলবে বলুক মা, একুশ দিন বা চব্বিশ দিনে জ্বর ছেড়ে যাবে, ছেলে সেরে উঠবে।

রঙলাল ডাক্তারের সঙ্গেও সংঘর্ষ বাঁধল—এই একুশ দিন, চব্বিশ দিন নিয়ে।

রঙলাল ডাক্তার রোগী দেখলেন।

প্রথমেই বললেন– বাজে লোক—বেশি লোক ঘরে থাকা আমি পছন্দ করি না। যে ডাক্তার দেখছে আর রোগীর যে সেবা করছে, আর এক-আধজন।

জীবন দত্তও বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণদাসবাবু বললেন–তুমি থাক জীবন।

উনি তার হাত ধরলেন। জীবন মশায়ের মনে আছে-ভীত কৃষ্ণদাসবাবুর হাত ঘামছিল; জীবন দত্ত মৃদুস্বরে সাহস দিয়ে বলেছিলেন—ভয় কী?

রোগী দেখে রঙলাল ডাক্তার কিছু বললেন– না। প্রেসক্রিপশন চাইলেন। পড়ে দেখলেন। সেগুলি ফিরিয়ে দিয়ে নিজে প্রেসক্রিপশন লিখে হরিশ ডাক্তারের হাতে দিলেন, বললেন–এসব পালটে এই দিলাম। পথ্য—বার্লি, ছানার জল, বেদানার রস চলতে পারে। কোনো শক্ত জিনিস নয়। ছেলের টাইফয়েড হয়েছে।

হরিশ ডাক্তারের মুখ ম্লান হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে জীবন দত্তের দিকে সকলের দৃষ্টি পড়েছিল—এ জীবন মশায়ের মনে আছে। জীবন দত্ত কিন্তু হরিশ ডাক্তারের মুখের দিকে তাকান নি। ছিঃ! অপ্রস্তুত হবেন উনি।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রঙলাল ডাক্তার হরিশকে ভাল করে সব বুঝিয়ে দিলেন।

জীবন দত্তের কবিরাজি পদ্ধতির সঙ্গে তাতে কয়েকটিতে গরমিল ছিল। কিন্তু তিনি চুপ করে রইলেন। তার অধিকার কী? তারপর রঙলাল ডাক্তার ওষুধ তৈরি করতে বসলেন।

ওইটি ছিল তাঁর একটি বিশেষত্ব। নিজের কলবাক্স থেকে ওষুধ তৈরি করে দিতেন। অন্য কোনো ডাক্তারের কি ডাক্তারখানায় তৈরি ওষুধ তিনি রোগীকে খেতে দিতেন না। এমনকি হঠাৎ যে বিপদ বা পরিবর্তন আসতে পারে, তাও ওষুধ তৈরি করে দিয়ে বলতেন—এই রকম হলে এই দেবে। এই রকম হলে এটা। এক-একদিন পর অবস্থা লিখে লোক পাঠাবে আমার কাছে। তবে যে ডাক্তার দেখছে, তার কাছে গোপন রাখতেন না কিছু। বিশ্বাসের পাত্র হলে তারপর তাকে দিতেন প্রেসক্রিপশন—সে ওষুধ তৈরি করে দিত। বলতেন—বিষ মিশিয়ে রোগীর অনিষ্ট করবে না, সে আমি জানি; বিষের দাম আছে। আমার ই-করা প্রেসক্রিপশন আছে—আমাকে দায়ী করতে পারবে না। কিন্তু জোলো দেশে জলের দাম লাগে না, ওষুধের বদলে জল দিলে কী করব? ছটা ওষুধের তিনটে না দিলে কী করব? পচা পুরনো দিলে কী করব? আমার বদনাম হবে।

ঠিক এই সময়। ওষুধের শিশি দুটি ঝাঁকি দিয়ে একবার নিজে ভাল করে তার রঙ এবং চেহারাটা দেখে হরিশ ডাক্তারের হাতে দিলেন—দু রকম ওষুধ থাকল। এইটাই এখন চলবে। যদি ভুল বকে বা জ্বর বাড়ে—জ্বর বাড়লেই ভুল বকবে, ভুল বকলেই জানবে জ্বর বেড়েছে, তখন এইটে দেবে। বুঝেছ? আর ওই লেপকথাগুলো খুলে দাও। অত চাপা দিয়েই তো বাচ্চাটাকে খতম করবে। এমন করে জানালা-দরজা বন্ধ কোরো না। আলো-বাতাস আসতে দাও। বুঝেছ?

উঠলেন তিনি।

কৃষ্ণদাসবাবু এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলেন—রোগ কি টাইফয়েড?

–হ্যাঁ, কঠিন রোগ।

–আজ্ঞে হ্যাঁ, সে-ই জিজ্ঞাসা করছি।

–বাঁচা-মরা ঈশ্বরের হাত, সে আমি বলতে পারি না।

কৃষ্ণদাসও সাহসী লোক ছিলেন তিনি মুখে মুখে জবাব দিতে পটু ছিলেন। বলেছিলেন, সে কথা আপনি কেন, আমরাও বলতে পারতাম। আপনার দেখে কেমন মনে হল? টাইফয়েড সানিপাতিক হলেই তো অসাধ্য হয় না। রোগেরও প্রকারভেদ আছে। মৃদু, মধ্যম-কঠিন।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মুখের দিকে তাকিয়ে রঙলাল বলেছিলেন-আপনিই তো কৃষ্ণদাস বাবু? ছেলের বাবা?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

–রোগ মধ্যম রকমের বলশালী। তবে কঠিন হতে কতক্ষণ। উপযুক্ত সেবা, নিয়মিত ওষুধএ না হলে রোগ বাড়তে পারে। এ রোগে সেবাটাই বড়।

–তার জন্যে দায়ী আমরা। এ রোগ সারতে কতদিন লাগবে?

–সে কী করে বলব আমি? সে আমি জানি না।

জীবন কবিরাজের এতটা অসহ্য মনে হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, কৃষ্ণদাস দাদা, বাইশ থেকে চব্বিশ দিনের মধ্যে আপনার ছেলের জ্বর ত্যাগ হবে, আপনি উতলা হবেন না।

হেঁট হয়ে কলবাক্সে ওষুধ গুছিয়ে রাখছিলেন রঙলাল ডাক্তার তিনি খোঁচা খাওয়া প্রবীণ গোক্ষুর সাপের মত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফিরে ডাকলেন।

–আপনি কে? গণক?

–না। উনি আমাদের এখানকার কবিরাজ। জগদ্বন্ধু মশায়ের নাম বোধহয় জানেন।

–নিশ্চয় জানি। বিচক্ষণ কবিরাজ ছিলেন তিনি। রোগনির্ণয়ে আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল। এখানকার বরদাবাবুর কথা মনে আছে আমার।

—উনি তাঁরই ছেলে। জীবন দত্ত।

রঙলাল আবার একবার তাকালেন জীবন দত্তের দিকে, বললেন, বাইশ থেকে চব্বিশ দিন কী থেকে বুঝলে? নাড়ি দেখে?

—হ্যাঁ, নাড়ি দেখে তাই আমার অনুমান হয়। জ্বর চব্বিশ দিনে ছাড়বার কথা। তিন অষ্টাহ। তবে প্রায়ই আমাদের দেশে এ রোগে প্রথম একটা দুটো দিন গা ছ্যাঁকছ্যাঁকের শামিল হয়ে ছুট হয়ে যায়। সেই কারণেই বলেছি-বাইশ থেকে চব্বিশ দিন।

—তোমার সাহস আছে। অল্প বয়সতাজা রক্ত। হেসেছিলেন রঙলাল ডাক্তার। তোমাদের বংশের নাড়িজ্ঞানের প্রশংসা শুনেছি, বরদাবাবুর বেলা দেখেছিও। কিন্তু ওটা তো আমাদের শাস্ত্রের বাইরে।

ঠিক চব্বিশ দিনেই কিশোরের জ্বর ছেড়েছিল।

কৃষ্ণদাসবাবু জীবন দত্তকে ডেকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। রঙলাল ডাক্তারের কাছে লোক পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে লিখেছিলেনআজ চব্বিশ দিনেই জ্বর ত্যাগ হইয়াছে। ইহার পর ঔষধ এবং নির্দেশ দিলে সুখী হইব। আসিবার প্রয়োজন বোধ করিলে কখন আসিবেন জানাইবেন।

রঙলাল ডাক্তার আর আসেন নি। শুধু নির্দেশ এবং ওষুধ পাঠিয়েছিলেন। তার সঙ্গে লিখেছিলেন, জগদ্বন্ধু মশায়ের ছেলেটিকে আমার আশীর্বাদ দিবেন।

জীবন দত্ত উৎসাহিত হয়ে চার মাইল পথ হেঁটে তাঁকে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন।

বহ্নিগর্ভ দুটি শমীবৃক্ষ পরস্পরের সান্নিধ্যে আসবামাত্র দুজনের ভিতরের বহ্নিই উৎসুক হয়ে উঠল।

***

সেই রঙলাল ডাক্তার তাঁর পিঠে সেদিন হাত বুলিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। সে হাতের স্পর্শের মধ্যে জীবন দত্ত স্নেহ অনুভব করেছিলেন। সে এক বিস্ময়। তান্ত্রিক শবসাধকের মত মানুষ রঙলাল ডাক্তার। বামাচারীর মত কোনো আচার-নিয়ম মানেন না, কঠিন রূঢ় প্রকৃতি, নিষ্ঠুর ভাষা, ময়ূরাক্ষীর জলে ভেসে-যাওয়া মড়া টেনে নিয়ে ফালি ফালি করে চিরে দেখেন। কবর থেকে মড়া টেনে তোলেন, মায়ের কোলে সন্তানকে মরতে দেখেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না, পৃথিবীর কারও কাছে মাথা হেঁট করেন না। এই মানুষটিকে এই তন্ত্রপ্রধান অঞ্চলের লোকে বলত, আসলে রঙলাল ডাক্তার হলেন প্রচ্ছন্ন তান্ত্রিক। বামাচারী।

কেউ কেউ বলত, নাস্তিক্যবাদী পাথর।

রঙলাল ডাক্তার তাকে প্রথম কথাই বলেছিলেন—তুমি যদি ডাক্তারি পড়তে হে! বড় ভাল করতে। তোমার মধ্যে একজন জাত চিকিৎসক রয়েছে। কবিরাজি শাস্ত্রে কিছু নেই এ কথা আমি বলছি না। কিন্তু আমাদের জাতের মত শাস্ত্রটিও কালের সঙ্গে আর এগোয় নি। যে কালে এ শাস্ত্রের সৃষ্টি চরম উন্নতি—সে কালে কেমিস্ত্রির এত উন্নতি ছিল না। তা ছাড়া আরও অনেক কিছু আবিষ্কার হয় নি। তারপর ধর, কত দেশ থেকে কত মানুষ আমাদের দেশে এসেছে। তাদের সঙ্গে তাদের দেশের রোগ এ দেশে এসেছে—জল বাতাস মাটির পার্থক্যে বিচিত্র চেহারা নিয়েছে। তা ছাড়া আয়ুৰ্বেদ আগন্তুজ ব্যাধি বলে যেখানে থেমেছে, ইউরোপের চিকিৎসাবিদ্যা মাইক্রোসকোপের কল্যাণে জীবাণু আবিষ্কার করে অনুমান ও উপসর্গের সীমানা ছাড়িয়ে চলে এসেছে বহুদূরে এগিয়ে।

আধুনিক কালের রোগ-চিকিৎসা নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। জীবন দত্ত তন্ময় হয়ে শুনেছিলেন। বার বার মনে পড়েছিল নিজের বাপ এবং মহাগুরু জগৎ মশায়কে। পার্থক্যের মধ্যে জগৎমশায় শিক্ষার মধ্যে বার বার উল্লেখ করতেন অদৃষ্টের, নিয়তির, ভগবানের; এবং সমস্ত বক্তব্যই যেন রোগবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা ছাড়াও অন্য একটি ভাব-ব্যাখ্যা-জড়িত বলে মনে হত, যেন কথার অর্থ ছাড়াও একটি ভাব থাকত; রঙলাল ডাক্তারের বক্তব্যের মধ্যে ঈশ্বর ছিল না, অদৃষ্ট ছিল না এবং সমস্ত বক্তব্য ছিল শুষ্ক, কেবলমাত্র বুদ্ধিগ্ৰাহ্য, কথার মানে ছাড়া কোনো ভাববাষ্পের অস্তিত্ব ছিল না। রঙলাল ডাক্তার বলতেন-মানুষ মরে গেলে আমরা আর কোনো দিকে তাকাই না। বুঝেছ, ওই দেহপিঞ্জর করি ভঙ্গ প্রাণ-বিহঙ্গ কেমন করে ফুড়ত করে উড়লেন—সে দেখতে আমরা চেষ্টা করি না। মধ্যে মধ্যে হেসে বলতেন—আরে, প্রাণ যদি বিহঙ্গ হয় তবে নিশ্চয় বন্দুকধারী শিকারিও আছে, তারা নিশ্চয় পক্ষিমাংস ভক্ষণ তা হলেই তো পুনর্জন্ম খতম।

সেই দিনই জীবন সুযোগ বুঝে বলেছিলেন, আমার একটি প্রার্থনা আছে। আমাকে যদি দয়া করে ডাক্তারি শেখান!

—তুমি ডাক্তারি শিখবে! তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন রঙলাল বাবু। অন্তর্ভেদী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কপালে সারি সারি কুঞ্চনরেখা। বিস্ময়, প্রশ্ন অনেক কিছু তার মধ্যে ছিল। তারপর প্রশ্ন করেছিলেন, কবিরাজি ভাল চলছে না?

হেসে জীবন দত্ত বলেছিলেন, লেখাপড়াজানা বাবুদের সমাজে কবিরাজির চলন কম হয়েছে। বটে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে ভাল চলে।

—তবে?

–আমার ছেলেবেলা থেকেই ডাক্তারি পড়বার ইচ্ছা ছিল কিন্তু–। জীবন দত্ত একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছিলেন।

—তবে পড় নি কেন? তোমার বাবার তো অবস্থা ভাল ছিল।

জীবন দত্ত ম্লান হেসে বলেছিলেন—আমরা ভাগ্য মানি, তাই বলছি আমার ভাগ্য। আর কী বলব? নইলে বাল্যকাল থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল আমি ডাক্তারি পড়ব। কিন্তু–

—তোমার বাবা দেন নি পড়তে?

–আজ্ঞে না। অপরাধ আমার।

মঞ্জরীর কথাটা বাদ রেখে ভূপী বোসের সঙ্গে মারামারির কথা বলে বললেন– গ্রামে ফিরলাম-বাবা বললেন, আর না। আর তোমাকে বিদেশে পাঠিয়ে আমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারব না। কৌলিক বিদ্যায় তুমি দীক্ষা গ্রহণ কর।

কথাটা শুনে ন্যাড়া পাহাড়ের মত মানুষ রঙলাল ডাক্তার অকস্মাৎ হা-হা-হা শব্দে অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন কৌতুকে; যেন তৃণপাদপহীন কালো পাথরে গড়া পাহাড়টা এই কাহিনী শুনে কৌতুকে ফেটে গেল এবং ভিতর থেকে ঝরঝর শব্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বের হল ঝরনার ফোয়ারা। এমনভাবে রঙলাল ডাক্তারকে হাসতে বড় কেউ একটা দেখে নি।

বেশ খানিকক্ষণ হেসে বললেন– সেই ভূপী বোস ছেলেটার সুডৌল নাকটা এমন করে তুমিই ভেঙে দিয়েছ? আরে, তাকে যে আমি দেখেছি। চিকিৎসা করেছি। তার শ্বশুর নিজের বাড়িতে এনেছিল চিকিৎসা করাতে, সংশোধন করতে। অপরিমিত মদ্যপান করে লিভারের অসুখ। আমাকে ডেকেছিল। ছোকরার মাকাল ফলের মত টুকটুকে চেহারায় পোকাধরার কালো দাগের মত নাকে ওই খুঁত।

হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন রঙলালবাবু, বললেন–আমি কিন্তু সন্দেহ করেছিলাম, ওটা হয়েছে সিফিলিস থেকে। বড়লোকের ছেলেদুর্দান্ত মাতাল! সন্দেহ হওয়ারই কথা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম। কিছুতেই স্বীকার করে না। তারপর স্বীকার করলে। যা এ দেশের লোকের স্বভাব! উত্তেজিত হয়ে উঠলেন রঙলাল ডাক্তার হাতের চুরুটটা মুখ থেকে নামিয়ে বললেন– অদ্ভুত, এ দেশটাই অদ্ভুত! লজ্জায় রোগ লুকিয়ে রাখবে, বংশাবলীকে রোগগ্রস্ত করে যাবে! নিজে ভুগবে। কিছুতেই বুঝবে না তুই দেবতা নোস। তুই রক্তমাংসের মানুষ। ক্ষুধার দাস, ললাভের দাস, কামের দাস!

উঠে দাঁড়ালেন রঙলাল ডাক্তার, বললেন–সেই শুয়ারটা কী বলেছিল জান? বলেছিল, কী করে হল তা জানি না। আমার স্ত্রী ছাড়া আর কারও সংস্রবে তো আমি কখনও আসি নি। আমি আর থাকতে পারি নি। প্রচণ্ড এক চড় তুলে বলেছিলাম-মারব এক চড় উল্লুক

কিছুক্ষণ পায়চারি করে শান্ত হয়ে রঙলাল ডাক্তার এসে বসেছিলেন তার আসনে। চুরুট ধরিয়ে দুটো টান দিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ওটা তা হলে তোমার ওই মুরসদৃশ হস্তের মুষ্ট্যাঘাতের চিহ্ন? তুমি তো ভয়ানক লোক। তবে ভূপী বোসের বন্ধুর কাজ করেছ। ওই চিহ্ন থেকে ওর ওই পাপ রোগটাকে ধরার সুযোগ করে দিয়েছ।

তারপর রঙলাল ডাক্তার বলেছিলেন-হ্যাঁ, তোমাকে আমি শেখাব, যতটা পার নিয়ে নাও তুমি আমার কাছ থেকে। কী? কী ভাবছ তুমি?

সেদিন তখন জীবন দত্ত ভাবছিলেন—ভূপী বোসের কথা, মঞ্জরীর কথা। যতক্ষণ রঙলাল ভূপী বোসের কথা বলছিলেন জীবন দত্ত অবশ্য চিন্তাশক্তিহীন মানুষের মত তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। রঙলালবাবু তাকে ডাক্তারিবিদ্যা শিক্ষা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কথা শেষ করলেন, জীবন দত্ত তার উত্তরে কিন্তু প্রশ্ন করলেন—ভূপীর লিভারের দোষ হয়েছে? সেরেছে?

রঙলাল ডাক্তার তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভূপীর জন্যে যেন তোমার মমতা রয়েছে জীবন?

জীবন এবার সচেতন হয়ে উঠলেন; লজ্জিত হলেন।

রঙলাল বললেন– তোমরা তো বৈষ্ণব?

–হ্যাঁ।

—তাই। তারপর বললেন–ভূপীর অসুখ আপাতত সেরেছে। আবার হবে। ওটা বাঁচবে না বেশিদিন। ওতেই মরবে। যোগাযোগ যে ভারি বিচিত্র। ছোকরার স্ত্রী, এক ধরনের মা আছে দেখেছ, রোগা ছেলেকে খেতে দেয় লুকিয়ে, ঠিক সেই রকম! ডাক্তার বারণ করেছে, ভূপী মদের জন্য ছটফট করছে, স্ত্রী গোপনে লোককে বকশিশ দিয়ে মদ আনিয়ে স্বামীকে দিচ্ছে, বলে বেশি খেয়ো না, একটু খাও। আশ্চর্যের কথা হে, নিজের গহনা বিক্রি করে করছে। অদ্ভুত। পুরাণে আছে সতী স্ত্রী মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বামীকে বাঁচায়। আর এ মেয়েটা ভালবাসায় তো তাদের চেয়ে খাটো নয়, কিন্তু এ মৃত্যুকে ডেকে এনে স্বামীকে তার হাতে তুলে দেয়। অদ্ভুত।

এরপর স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন জীবন ডাক্তার। স্থান, কাল, পাত্র সব তিনি ভুলে গেলেন, মুছে গেল চোখের সম্মুখ থেকে। অর্থহীন একাকার হলে গেল। রঙলাল ডাক্তার সচেতন করে তুললেন জীবন দত্তকে। বললেন–ছেড়ে দাও ওই পচা ধনীর ছেলেটার কথা। ওসব হল মানুষের নিজের পাপের সৃষ্টির অপব্যয়। এখন শোন যা বলছি। শিখবে তুমি ডাক্তারি? আমার মত কঠিন নয় তোমার পক্ষে। তুমি চিকিৎসা জান—রোগ চেন। তোমার পক্ষে অনেক সহজ হবে। আমি এ দেশের জন্যে অনুবাদ করেছি ওদের চিকিৎসাশাস্ত্র। পড়ে ফেললেই তুমি পারবে। আমি তোমাকে সাহায্য করব। শেখাব। পড়াব।

এবার জীবন দত্তের কান এড়াল না। মুহূর্তে তাঁর সব উদাস অবসন্নতা দূর হয়ে গেল। আগুন জ্বলে উঠল জীবনে।

মঞ্জরী আর ভূপী বোস একদিন মেঘ আর বাতাসের মত মিলে তার জীবনের সদ্য প্ৰজ্বলিত। বহির উপর দুর্যোগের বর্ষণ ঢেলে নিভিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বনস্পতির কাণ্ড থেকে শাখাগ্র পর্যন্ত প্রসুপ্ত বহ্নির ধারা নেভে নি। সে জ্বলল। ভুলে গেলেন মঞ্জরীকে ভূপীকে। আতর-বউকেও মনে রইল না সে মুহূর্তে। সেদিন সামনে ছিলেন রঙলাল ডাক্তার। হাতে ছিল—মোটা বাঁধানো খাতা-চোখের সামনে ছিল ভবিষ্যৎ। উজ্জ্বল দীপ্ত।

Category: আরোগ্য-নিকেতন (১৯৫৩)
পূর্ববর্তী:
« ১২. সেদিন আশ্চর্য মনে হয়েছিল
পরবর্তী:
১৪. উদয়লগ্ন »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑