০৯২. কৃষ্ণের স্বীয় কর্ত্তব্য জ্ঞাপন

৯২তম অধ্যায়

কৃষ্ণের স্বীয় কর্ত্তব্য জ্ঞাপন

কৃষ্ণ কহিলেন, “হে বিদুর! মহাপ্ৰজ্ঞ ব্যক্তিরা যেরূপ বাক্য প্রয়োগ করিয়া থাকেন, বিচক্ষণেরা যেরূপ কহিয়া থাকেন এবং মৎসদৃশ সুহৃদের প্রতি ভবাদৃশ [আপনার মত] ব্যক্তির যেরূপ ধর্ম্মর্থযুক্ত সুহৃদের প্রয়োগ করা উচিত, আপনি তদনুরূপ কথা কহিয়াছেন। আপনি আমাকে যাহা যাহা কহিয়াছেন, তৎসমুদয়ই যথার্থ; কিন্তু আমি যে অভিপ্ৰায়ে এ স্থানে আগমন করিয়াছি, অবহিতচিত্তে তাহা শ্রবণ করুন। আমি দুৰ্য্যোধনের দৌরাত্ম্য ও ক্ষত্ৰিয়গণের শত্রুতা অবগত হইয়াই এখানে আগমন করিয়াছি। হে বিদুর! যিনি অশ্বকুঞ্জররথসমবেত [অশ্ব-গজ-রথসমন্বিত] বিপৰ্য্যস্ত সমুদয় পৃথিবী মৃত্যুপাশ হইতে বিযুক্ত করিতে সমর্থ হয়েন, তাঁহার উৎকৃষ্ট ধর্ম্মলাভ হয়। আমি স্থিরসিদ্ধান্ত করিয়াছি যে, মনুষ্য যথাসাধ্য ধর্ম্মকর্ম্মসাধনে সচেষ্ট হইয়া যদি তাহা সম্পাদন করিতে না পারে তথাপি তাহার সেই কাৰ্য্যসাধনানুরূপ ফলপ্রাপ্তি হয়। কিন্তু কেবল মনে মনে পাপকর্ম্মনুষ্ঠানের বাসনা করিয়া যদি তাহার অনুষ্ঠানে কৃতকাৰ্য্য না হয়, তাহা হইলে সেই পাপানুষ্ঠানের ফলভোগ করিতে হয় না। দেখুন, কর্ণ ও দুৰ্য্যোধনের অপরাধে কুরুকুলে ঘোরতর আপদ সমুপস্থিত হইয়াছে; এক্ষণে যাহাতে সংগ্রামে বিনাশোন্মুখ [মরণে উদ্যত] কৌরব ও সৃঞ্জয়গণের শান্তি হয়, তৎসম্পাদনে আমি যথাসাধ্য যত্ন করিব।

“হে বিদুর! যে ব্যক্তি ব্যসনগ্ৰস্ত বান্ধবকে মুক্ত করিবার নিমিত্ত যথাসাধ্য যত্নবান না হয়, পণ্ডিতগণ তাহাকে নৃশংস বলিয়া কীর্ত্তন করেন। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি মিত্রের কেশ পর্য্যন্ত ধারণ করিয়া তাহাকে অকার্য্য হইতে নিবৃত্ত করিবার চেষ্টা পাইবেন; যদি সে তাহাতে নিবৃত্ত না হয়, তাহা হইলে ঐ ব্যক্তি কখনই লোকসমাজে নিন্দনীয় হইবেন না। আমি ধার্ত্তরাষ্ট্র, পাণ্ডব ও অন্যান্য ক্ষত্ৰিয়গণের হিতার্থ যেসমুদয় কথা কহিব, তৎসমুদয় গ্ৰহণ করা দুৰ্য্যোধনের অবশ্য কর্ত্তব্য, যদি তিনি আমার হিতকর বাক্য শ্রবণ করিয়াও আমার প্রতি শঙ্কা [সংশয়] করেন, তাহাতে আমার কিছুমাত্র ক্ষতি নাই; প্রত্যুত আত্মীয়াকে সদুপদেশপ্ৰদান নিবন্ধন পরম সন্তোষ ও আনৃণ্যলাভ [কর্ত্তব্য-উপদেশে স্বীয় দায়িত্বভার লাঘব] হইবে। যে ব্যক্তি জ্ঞাতিভেদ [অনৈক্যবশতঃ বিবাদ] সময়ে মিত্ৰকে সৎপরামর্শ প্রদান না করে, সে ব্যক্তি তখন আত্মীয় নহে। হে বিদুর! আমি কুরুপাণ্ডবগণের শান্তির নিমিত্ত যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়া কৃতকাৰ্য্য না হইলেও অধাৰ্মিক মূঢ়গণ বা আত্মীয়গণ কখনই বলিতে পরিবে না যে, কৃষ্ণ সমর্থ হইয়াও ক্রোধবিমূঢ় [ক্রোধান্ধ] কুরুপাণ্ডবকে নিবারণ করিল না। আমি উভয় পক্ষের অর্থসাধন করিবার নিমিত্ত এ স্থানে আগমন করিয়াছি; অতএব উভয় পক্ষের অর্থসাধনে প্ৰাণপণে যত্ন করিয়া জনসমাজে অনিন্দনীয় হইব। যদি দুৰ্য্যোধন বালস্বভাবপ্রযুক্ত আমার ধর্ম্মার্থক্ত হিতকর বাক্য গ্ৰহণ না করেন, তবে তাঁহার অদৃষ্ট যাহা আছে, তাহাই হইবে।

“হে মহাত্মন! আমি যদি পাণ্ডবগণের অর্থের অবিঘাতে [যাহাতে স্বার্থহানি না হয় এইরূপভাবে] কৌরবগণের সহিত তাঁহাদের সন্ধিসংস্থাপন করিতে পারি, তাহা হইলে আমার পুণ্যলাভ ও কৌরবগণের মৃত্যুপাশ হইতে মুক্তি হয়। ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ কি আমার ধর্ম্মর্থযুক্ত নির্দোষ বাক্য শ্রবণ করিবে; আমি কুরুসভায় গমন করিলে কৌরবগণ কি আমার সম্মান করিবে? যাহা হউক, সিংহ যেমন অন্যান্য পশুগণকে অনায়াসে বিনাশ করিতে পারে, তদ্রূপ আমি সমুদয় কৌরবপক্ষীয় ভূপতিদিগকে অবলীলাক্রমে সংহার করিতে পারি।” যদুকুলপ্ৰদীপ বাসুদেব এইসকল কথা বলিয়া সুখস্পর্শশয্যাতলে শয়ন করিলেন।