০৮৭. দুর্য্যোধনের কৃষ্ণকে বন্দী করার বাসনা

৮৭তম অধ্যায়

দুর্য্যোধনের কৃষ্ণকে বন্দী করার বাসনা

দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “মহারাজ! বিদুর কৃষ্ণের বিষয় যাহা কহিলেন, তৎসমুদয়ই সত্য। তিনি পাণ্ডবগণের প্রতি নিতান্ত অনুরক্ত, কখনই তাঁহাকে বশীভুত করিতে পরিবেন না। আপনি সৎকারার্থ তাঁহাকে যেসমুদয় ধন-সম্পত্তি প্ৰদান করিতে বাসনা করিয়াছেন, তৎসমুদয় কখনই প্রদেয় নহে। কেশব আমাদের অবশ্য পূজনীয়; কিন্তু এ সময়ে ঐ সকল সামগ্ৰীদ্বারা তাঁহাকে পূজা করিলে তিনি মনে করিবেন, ইঁহারা ভীত হইয়া আমার অর্চ্চনা করিতেছে। অতএব যে কর্ম্ম করিলে স্বয়ং অবমানিত হইতে হয়, ক্ষত্ৰিয়ের পক্ষে তাহা কদাপি কর্ত্তব্য নহে। বিশাললোচন কৃষ্ণ যে ত্ৰিভুবনের পূজ্য, তাহা আমার অবিদিত নাই; কিন্তু যখন তাঁহাকে অর্চ্চনা করিলে উপস্থিত যুদ্ধ শান্ত হইবে, তখন তাঁহাকে পূজা করা আমার মতে রীতিবহির্ভূত কাৰ্য্য।”

অনন্তর কুরুকুলপিতামহ ভীষ্ম দুৰ্য্যোধনের বাক্য শ্রবণ করিয়া ধৃতরাষ্ট্রকে কহিলেন, “হে মহাবাহো! কৃষ্ণকে সৎকারই কর অথবা অসৎকারই কর, তিনি কদাচ ক্রুদ্ধ হয়েন না; তথাপি তাঁহার অবজ্ঞা করা কর্ত্তব্য নহে, তিনি অবজ্ঞার পাত্র নহেন; তিনি যাহা কর্ত্তব্য বলিয়া নিৰ্দ্ধারিত করেন, সহস্ৰ উপায় উদ্ভাবন করিলেও কেহ তাহা অন্যথা করিতে সমর্থ হইবে না। সেই মহাবাহু মধুসূদন যাহা কহিবেন, অসন্দিগ্ধচিত্তে তাহা সম্পাদন করা কর্ত্তব্য। সেই মহাত্মাকে অবলম্বন করিয়া অবিলম্বে পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধিসংস্থাপন কর। ধর্ম্মাত্মা জনাৰ্দন নিশ্চয়ই ধর্ম্মার্থসংযুক্ত বাক্য বলিবেন; অতএব আপনারও বন্ধুগণসমভিব্যাহারে তাঁহার নিকট প্রিয় বাক্য প্রয়োগ করা কর্ত্তব্য।”

দুৰ্য্যোধনের দুষ্টচেষ্টায় ক্রুদ্ধ ভীষ্মের সভাত্যাগ

তখন দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে পিতামহ! আমি পাণ্ডবগণকে আপনার বশীভুত করিয়া যে স্বয়ং সমুদয় রাজ্য ভোগ করিতে পারিব, এমন কোন উপায় দেখিতেছি না। কিন্তু মনে মনে একটি উপায় স্থির করিয়াছি, শ্রবণ করুন। পাণ্ডবগণের একমাত্র অবলম্বন ভগবান যদুনন্দন কল্য প্ৰাতঃকালে যখন এখানে আগমন করিবেন, আমি তাঁহাকে তখন বদ্ধ করিয়া রাখিব; তাহা হইলে বৃষ্ণিগণ, পাণ্ডবগণ ও সমুদয় পৃথিবী আমার বশীভূত হইবে। অতএব যাহাতে জনাৰ্দন আমার এই অভিসন্ধি বুঝিতে না পারেন এবং যাহাতে আমার কোন অপকার না হয়, আপনি এক্ষণে আমাকে এমন কোন উপায় বলুন।”

মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র অমাত্যসমভিব্যাহারে দুৰ্য্যোধনের এই সকল নিষ্ঠুর বাক্য-শ্রবণে সাতিশয় ব্যথিত হইয়া কহিলেন, “বৎস! ওরূপ কথা আর কদাচ কহিও না; উহা ধৰ্মসঙ্গত নহে। দেখ, হৃষীকেশ দূত হইয়া আসিতেছেন। বিশেষতঃ তিনি আমাদের আত্মীয় ও প্রিয়, তিনি কদাচ কুরুকুলের অনিষ্টাচরণ করেন নাই; অতএব তাঁহাকে বদ্ধ করা কদাপি বিধেয় নহে।”

তখন ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৃতরাষ্ট্র! তোমার এই সন্তান সাতিশয় দুবুর্দ্ধি; এ সততই অনর্থচিন্তা করিয়া থাকে, সুহৃজ্জনের অনুরোধেও অর্থচিন্তায় প্রবৃত্ত হয় না। তুমিও বান্ধবগণের বাক্য পরিত্যাগপূর্ব্বক এই কুপথগামী পাপাত্মার অনুবর্ত্তন কর। এই দুরাত্মা অক্লিষ্টকর্ম্মা কৃষ্ণের ক্ৰোধে অমাত্যগণসমভিব্যাহারে শমনসদনে গমন করিবে। আমি আর এই ত্যক্তবর্ম্মা পাপাত্মা দুৰ্মতির অনৰ্থজনক বাক্য শ্রবণ করিতে বাসনা করি না।”

সত্যপরাক্রম ভরতবংশাবতংস ভীষ্ম এই বলিয়া ক্রোধাভরে গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।