০৮২. সন্ধির জন্য কৃষ্ণের হস্তিনাগমনোদ্যোগ

৮২তম অধ্যায়

সন্ধির জন্য কৃষ্ণের হস্তিনাগমনোদ্যোগ

অর্জ্জুন কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! তুমি আমাদের উভয় পক্ষেরই সম্বন্ধী [কুটুম্ব] ও স্নেহভাজন; অতএব যাহাতে আমাদের ও ধৃতরাষ্ট্রতনয়দিগের মঙ্গল হয়, এরূপ কাৰ্য্য কর। তুমি মনে করিলে অনায়াসেই শাস্তিস্থাপন করিতে পার। হে পুণ্ডরীকাক্ষ! তুমি এখান হইতে কুরুসভায় গমন করিয়া অতিক্ৰোধন দুৰ্য্যোধনের নিকট সন্ধিস্থাপনের কথা উল্লেখ করিবে। যদি ঐ অল্পবুদ্ধি তোমার ধর্ম্মার্থযুক্ত মঙ্গলজনক বাক্যে সম্মত না হয়, তবে তাহার অদৃষ্ট যাহা আছে, তাহাই হইবে।”

কৃষ্ণ কহিলেন, “হে ধনঞ্জয়! কৌরবগণের মঙ্গল করা আমার পক্ষে হিতকর ও ধর্ম্মজনক। অতএব আমি উহা সম্পাদনা করিবার নিমিত্ত অবিলম্বেই ধৃতরাষ্ট্রসমীপে গমন করিব।”

এইরূপে কথোপকথন করিতে করিতে রজনী প্ৰভাত হইল। বিনির্ম্মল প্রভাবশালী ভগবান মরীচিমালী মৃদুভাব স্বীয় কিরণজাল বিস্তার করিতে লাগিলেন। যদুবংশাবতংস বাসুদেব ঐ রেবতীনক্ষত্ৰযুক্ত কার্ত্তিকমাসীয় দিনে মৈত্রমুহূর্তে [জ্যোতিষশাস্ত্ৰ মতে মিত্ৰতাকারক ক্ষণ] কৌরবসভায় গমন করিবার বাসনায় সুবিশ্বস্ত ব্ৰাহ্মণগণের মাঙ্গল্য পুণ্যনির্ঘোষ [বেদধ্বনি মঙ্গলাবহ শব্দযুক্ত শাস্ত্ৰবাক্য] শ্রবণ ও প্রাতঃকৃত্য সমাপনপূর্ব্বক স্নান ও বসনভূষণ পরিধান করিয়া সূৰ্য্য ও বহ্নির উপাসনা করিলেন এবং বৃষলাঙ্গুল স্পৰ্শন, ব্ৰাহ্মণগণকে অভিবাদন, অগ্নিপ্রদক্ষিণ ও কল্যাণকর দ্রব্যসকল সন্দর্শনপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরের বাক্য স্মরণ করিয়া সমীপে আসীন শিনির নপ্তা [পৌত্র]। সত্যকিকে কহিলেন, “ভদ্র! আমার রথের উপর শঙ্খ, চক্ৰ, গদা, তূণীর, শক্তি ও অন্যান্য আয়ুধসকল সংস্থাপন কর। দুৰ্য্যোধন, কৰ্ণ, শকুনি নিতান্ত দুষ্টাত্মা, বলবান ব্যক্তির অতি দুর্ব্বল শত্রুকেও অবজ্ঞা করা কর্ত্তব্য নহে।”

কৃষ্ণের রথসজ্জা-হস্তিনাযাত্রা

তখন কৃষ্ণের অগ্ৰগামিগণ [আদেশ পালনার্থ অগ্ৰে অগ্ৰে গমনকারী] তাঁহার অভিপ্ৰায় অবগত হইয়া রথযোজনে প্রবৃত্ত হইলেন। ঐ রথ ক্ষিপ্ৰগতি গগনচারী প্ৰদীপ্ত কালগ্নির ন্যায় সমুজ্জ্বল, চন্দ্রসূর্য্যসদৃশ চক্রদ্বয়ে বিভূষিত, কৃত্রিমচন্দ্ৰ, অৰ্দ্ধচন্দ্র, মৎস্য, মৃগ ও পক্ষিসমূদয়ে শোভিত এবং বিবিধ পুষ্প, মণি, রত্ন ও সুবৰ্ণে অলঙ্কৃত, ধ্বজপতাকামণ্ডিত, ব্যাঘ্রচর্মে আবৃত, শত্ৰুগণের যশোনাশক ও যাদবগণের আনন্দবৰ্দ্ধন। অগ্ৰগামিগণ মুহূর্ত্তমধ্যে শৈব্য, সুগ্ৰীব প্রভৃতি অশ্বগণ রথে যোজিত করিল। ধ্বজের অগ্রভাগে পতগেন্দ্র গরুড় সন্নিবেশিত হইল; দেখিলে বোধ হয় যেন, শ্ৰীকৃষ্ণের মহিমা কীর্ত্তন করিতেছে।

যদুকুলপ্ৰদীপ শ্ৰীকৃষ্ণ সেই কামগবিনাশসদৃশ, মেরুশিখরতুল্য মেঘগম্ভীরনিস্বন স্যন্দনে আরোহণ করিলেন। পরে সাত্যকিকে তথায় আরোপিত করিয়া রথনির্ঘোষে পৃথিবী ও অন্তরীক্ষ প্ৰতিধ্বনিত করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। ক্ষণকালমধ্যে আকাশমণ্ডল বিগতভ্র [মেঘহীন] হইয়া উঠিল, বায়ু অনুকূল হইয়া প্রবাহিত হইতে লাগিল, পার্থিব ধূলিপটল একবারে প্রশান্ত হইল, মাঙ্গল্য মৃগ ও পক্ষিগণ তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিল এবং সারস, শতপত্র, হংস প্রভৃতি পক্ষিগণ সুমধুর শব্দ করিয়া মধুসূদনের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইল। মন্ত্রাহুত হুতাশনে নিধুম হইয়া প্রজ্জ্বলিত হইতে লাগিল; তাহার শিখাসমুদয় দক্ষিণাবর্ত্ত হইয়া উঠিল। বশিষ্ঠ, বামদেব, ভূরিদ্যুম্ন গায়, ক্ৰথ, শুক্র, নারদ, বাহ্লীক, মরুত, কুশিক, ভৃণ্ড প্রভৃতি মহর্ষিগণ এবং দেবগণ ও ব্রহ্মর্ষিগণ কৃষ্ণকে প্ৰদক্ষিণ করিতে লাগিলেন।

ভগবান মধুসূদন এইরূপে সেই সমুদয় মহাভাগগণকর্ত্তৃক পূজিত হইয়া কৌরবসভায় গমন করিবার নিমিত্ত যাত্রা করিলেন। যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চভ্রাতা, মহাবলপরাক্রান্ত চেকিতান, ধৃষ্টকেতু, দ্রুপদ, কাশীরাজ, শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন, সপুত্র বিরাট, কেকয়গণ ও অন্যান্য ক্ষত্রিয়সমুদয় তাঁহার সমভিব্যাহারে গমন করিতে উদ্যত হইলেন।

যুধিষ্ঠিরাদির মাতৃপ্ৰণামজ্ঞাপন

যিনি কাম, ক্ৰোধ, ভয় বা অর্থের বশীভূত হইয়া কদাচ অন্যায়াচরণ করেন নাই, যিনি সর্ব্বভূতের অধীশ্বর এবং সর্ব্বাপেক্ষা ধৰ্মজ্ঞ, স্থিরবুদ্ধি, ধৃতিমান ও প্রাজ্ঞ, সেই মহারাজ যুধিষ্ঠির তখন ভূপতিগণসমক্ষে সেই সর্ব্বগুণসম্পন্ন, শ্ৰীবৎসলক্ষণ [দক্ষিণাবৰ্ত্ত লোমাবলীদ্বারা শোভিত বক্ষ] সনাতন দেবগণকে আলিঙ্গন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে মাধব! যিনি আমাদিগকে বাল্যকাল হইতে প্রতিপালন করিয়াছেন, যিনি উপবাস, তপস্যা, স্বস্ত্যয়ন, দেবতা ও অতিথির পূজা এবং গুরুশুশ্রূষায় একান্ত নিরত ও নিতান্ত পুত্ৰবৎসল, যিনি দুৰ্য্যোধনের ভয় হইতে আমাদিগকে পরিত্রাণ করিয়াছেন, যিনি আমাদের নিমিত্ত সতত দুঃখাৰ্ণবে নিমগ্ন রহিয়াছেন, তুমি কৌরবীভবনে গমন করিয়া আমাদের সেই দুঃখিনী জননীর অনাময়জিজ্ঞাসা করিবে এবং তাঁহাকে অভিবাদনপূর্ব্বক আমাদের কুশল প্ৰদান করিবে। সেই পুত্ৰবৎসলা বিবাহের পর হইতেই শ্বশুরকুলের দুঃখ ও অবমাননা দর্শনে নিতান্ত দুঃখভোগ করিতেছেন। হে অরতিনিপাতন! আমার কি এমন সময় উপস্থিত হইবে যে, আমি সেই চিরদুঃখিনী জননীর দুঃখ মোচন করিতে পারিব? হায়! আমরা যখন বনে গমন করি, তৎকালে তিনি রোদন করিতে করিতে দ্রুতবেগে আমাদের নিকট আসিয়াছিলেন; কিন্তু আমরা তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছি। বোধ হইতেছে, তিনি পরলোক প্রাপ্ত হয়েন নাই; পুত্রবিরহাদুঃখে একান্ত অভিভূত হইয়া জীবিত আছেন। তুমি তাঁহাকে এবং মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, অশ্বত্থামা ও মহারাজ বাহ্লীক এবং সোমদত্ত প্রভৃতি ক্ষত্রিয়গণকে অভিবাদন করিয়া কুরুকুলের প্রধানমন্ত্রী, অগাধবুদ্ধি, ধর্ম্মপরায়ণ মহাপ্রাজ্ঞ বিদুরকে আলিঙ্গন করিবে।” ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভূপতিগণমধ্যে কৃষ্ণকে এই কথা বলিয়া প্ৰদক্ষিণ করিয়া তাঁহার অনুমতিগ্রহণপূর্ব্বক প্রতিনিবৃত্ত হইলেন।

অনন্তর মহানুভব অর্জ্জুন স্বীয় সখা শক্রবলনিসূদন মধুসূদনকে কহিতে লাগিলেন, “হে গোবিন্দ! আমরা মন্ত্রবিনিশ্চয় [সন্ধি-বিগ্ৰহাদিবিষয়ক নীতি-রাজনৈতিক মন্ত্রণা] সময়ে যে রাজ্যার্দ্ধ গ্রহণপূর্ব্বক সন্ধিসংস্থাপনে কৃতনিশ্চয় হইয়াছি, তাহা ভূপতিগণ বিদিত হইয়াছেন। কৌরবগণ যদি আমাদিগকে সৎকারপুরঃসর উহা প্ৰদান করেন, তাহা হইলে তাঁহাদের কোন শঙ্কা থাকিবে না; নচেৎ আমি নিশ্চয় সমুদয় ক্ষত্রিয়কে সংহার করি।” ধনঞ্জয় এই কথা কহিবামাত্র মহাবীর বৃকোদার সাতিশয় হৃষ্ট হইলেন এবং ক্ৰোধকম্পিত্যকলেবরে ভয়ানক স্বরে চীৎকার করিতে লাগিলেন। ভীমসেনের ভয়ঙ্কর চীৎকারধ্বনি শ্রবণে ধনুৰ্দ্ধরগণ কম্পিত হইতে লাগিল। অর্জ্জুন কৃষ্ণকে ঐ কথা বলিয়া তাহার অনুমতি গ্রহণ ও তাঁহাকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক প্রতিনিবৃত্ত হইলেন।

ধৃতরাষ্ট্রসমীপে গমনেচ্ছু ঋষিগণের সাক্ষাৎকার

অনন্তর সমুদয় ক্ষত্ৰিয়গণ প্রতিনিবৃত্ত হইলে জনাৰ্দন সত্বরে কৌরবনগরাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন; অশ্বগণ দারুককর্ত্তৃক পরিচালিত হইয়া বায়ুবেগে গমন করিতে লাগিল; দেখিলে বোধ হয়, যেন তাহারা পথ ও আকাশমণ্ডল গ্রাস করিতেছে। মহাবাহু কেশব এইরূপে কিয়দ্দূর গমন করিয়া পথের উভয়পার্শ্বে ব্ৰহ্মতেজে জাজ্বল্যমান কতিপয় মহর্ষিকে সন্দর্শন করিলেন। তিনি তাঁহাদিগকে দেখিবামাত্র অতিমাত্র ব্যগ্রতাসহকারে রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া অভিবাদনপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে মহর্ষিগণ! সমুদয় লোকের কুশল? ধর্ম্ম উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত হইতেছে? ক্ষত্রিয়াদি বর্ণত্রয় ব্ৰাহ্মণগণের শাসনে অবস্থান করিতেছে? আপনারা কোথায় সিদ্ধ হইয়াছেন? কোথায় যাইতে বাসনা করিতেছেন? আপনাদের প্রয়োজন কি? আমাকে আপনাদের কোন কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিতে হইবে এবং আপনারা কি নিমিত্ত ধারণীতে অবতীর্ণ হইয়াছেন?”

তখন মহাভাগ জমদগ্ন্য [জমদগ্নির পুত্র-পরশুরাম] কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করিয়া কহিলেন, “হে মধুসূদন! আমাদের মধ্যে কেহ কেহ দেবর্ষি, কেহ কেহ বহুশ্রুত ব্ৰাহ্মণ, কেহ কেহ রাজর্ষি এবং কেহ কেহ তপস্বী। আমরা অনেকবার দেবাসুরের সমাগম দেখিয়াছি; এক্ষণে সমুদয় ক্ষত্রিয়, সভাসদ, ভূপতি ও আপনাকে অবলোকন করিবার বাসনায় গমন করিতেছি। আমরা কৌরব সভামধ্যে আপনার মুখবিনির্গত ধর্ম্মর্থযুক্ত বাক্য শ্রবণ করিতে অভিলাষী হইয়াছি। হে যাদবশ্রেষ্ঠ! ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর প্রভৃতি মহাত্মাগণ এবং আপনি যে সত্য ও হিতকর বাক্য কহিবেন, আমরা সেই সকল বাক্যশ্রবণবাসনায় নিতান্ত কৌতুহলাক্রান্ত হইয়াছি। এক্ষণে আপনি সত্বর কুরুরাজ্যে গমন করুন; আমরা তথায় আপনাকে সভামণ্ডপে দিব্য-আসনে আসীন ও তেজঃপ্রদীপ্ত দেখিয়া পুনরায় আপনার সহিত কথোপকথন করিব।”