০৮১. দ্ৰৌপদীর যুদ্ধে উত্তেজনা

৮১তম অধ্যায়

দ্ৰৌপদীর যুদ্ধে উত্তেজনা

অনন্তর দ্রুপদনন্দিনী ধর্ম্মরাজের ধর্ম্মার্থযুক্ত বাক্য শ্রবণে ও ভীমসেনের প্রশান্তভাব অবলোকনে শোকে একান্ত অভিভূত হইয়া সহদেব ও সাত্যকিকে পূজাপূর্ব্বক অশ্রুপূৰ্ণলোচনে কৃষ্ণকে কহিতে লাগিলেন, “হে মধুসূদন! ধৃতরাষ্ট্রতনয় যেরূপ শঠতাসহকারে পাণ্ডবগণকে সুখচ্যুত করিয়াছে এবং মহারাজ যুধিষ্ঠির গোপনে সঞ্জয়ের সহিত যেরূপ মন্ত্রণা করিয়াছেন, তাহা তোমার অবিদিত নাই। মহারাজ যুধিষ্ঠির সন্ধি করিবার মানসে তোমার সমক্ষেই সঞ্জয়কে কহিয়াছিলেন, “হে সঞ্জয়! তুমি দুৰ্য্যোধনকে কহিবে যে, সে আমাকে অবিস্থল, বৃকস্থল, মাকন্দী, বারণাবত ও অন্য কোন জনপদ-এই পঞ্চগ্ৰাম যেন প্ৰদান করে।” সঞ্জয় তাঁহার আদেশানুসারে দুর্য্যোধনকে কহিয়াছিল, কিন্তু ঐ দুরাত্মা তাহাতে সম্মত হয় নাই।

কৃষ্ণপ্ৰতি বিগ্রহাভিলাষিণী কৃষ্ণার অনুযোগ

“যাহা হউক, তুমি কৌরবসভায় গমন করিলে দুৰ্য্যোধন যদি তোমার নিকট রাজ্য প্ৰদান না করিয়া সন্ধিস্থাপনের বাসনা প্ৰকাশ করে, তাহাতে কদাচ সম্মত হইবে না। পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ একত্র মিলিত হইলে অনায়াসেই দুৰ্য্যোধনের সৈন্যসামন্তগণকে পরাভব করিতে পারেন। সাম বা দানদ্বারা কৌরবগণের নিকট হইতে কাৰ্য্যসিদ্ধি করা কাহারও সাধ্য নহে; অতএব তাহাদের প্রতি দয়া প্রকাশ করা কদাপি তোমার কর্ত্তব্য নহে। যে শত্ৰুগণ সাম বা দানদ্বারা প্রশান্ত না হয়, স্বীয় জীবনরক্ষার্থে তাহাদের প্রতি অবশ্যই দণ্ডবিধান করিতে হয়। অতএব কৌরবগণের উপর মহাদণ্ড নিক্ষেপ করা তোমার এবং পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণের পক্ষে নিতান্ত বিধেয়। এই কর্ম্ম পাণ্ডবগণের অবশ্য কর্ত্তব্য, তোমার যশস্কর ও ক্ষত্ৰিয়ের সুখাবহ। স্বধৰ্মনিরত ক্ষত্ৰিয়গণের লুব্ধ ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্যান্য জাতিগণকে সংহার করা কর্ত্তব্য কর্ম্ম। ব্রাহ্মণ সর্ব্ববর্ণের গুরু ও পূজা; অতএব তিনি সর্ব্বপ্রকার পাপে লিপ্ত হইলেও কদাপি কাহারও বধ্য নহেন।

“হে জনাৰ্দন। ধর্ম্মসিং পণ্ডিতগণ কহিয়াছেন যে, অবধ্য ব্যক্তিকে বধ করিলে যে পাপ হয়, বধ্যকে বধ না করিলেও সেই পাপ হইয়া থাকে। অতএব তুমি যাহাতে পাণ্ডব, সৃঞ্জয় ও সৈনিক পুরুষগণসমভিব্যাহারে উক্ত পাপে লিপ্ত না হও, এরূপ কাৰ্য্য করিবে।

“হে মাধব! এই ভূমণ্ডলমধ্যে আমার তুল্য কামিনী আর কে আছে? আমি দ্রুপদরাজের অযোনিসম্ভূতা কন্যা, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী, তোমার প্রিয়সখী, আজমীঢ়কুলসম্ভূত পাণ্ডুরাজের স্নুষা ও ইন্দ্ৰসম তেজস্বী পঞ্চপাণ্ডবের পত্নী। ঐ পঞ্চভ্রাতার ঔরসে আমার গর্ভে পঞ্চ মহারথ সমুৎপন্ন হইয়াছে; তোমার পক্ষে অভিমন্যু যেরূপ, উহারাও তদ্রূপ। আমি এতাদৃশ সৌভাগ্যশালিনী হইয়াও তুমি এবং পাঞ্চল ও বৃষ্ণিগণ জীবিত থাকিতেই পাণ্ডুনন্দনগণের সমক্ষে সভামধ্যে কেষাকর্ষণক্লেশ অনুভব করিয়াছি। ঐ সময়ে আমি সেই পাপপরায়ণ ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের দাসী হইয়াছিলাম। যখন দেখিলাম, পাণ্ডবগণ অমর্ষশূন্য হইয়া নিশ্চেষ্টভাবে পরস্পর মুখাবলোকন করিতেছেন, তখন আমি ‘হে গোবিন্দ! আমাকে রক্ষা কর’ বলিয়া মনে মনে তোমাকে স্মরণ করিয়াছিলাম। তার ফলেই আমার শ্বশুর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র আমাকে বর প্রার্থনা করিতে কহিলেন। আমি তাঁহার আজ্ঞানুসারে ‘পাণ্ডবগণ স্ব স্ব রথ ও আয়ুধ প্রাপ্ত হউন এবং উহাদের দাসত্বমোচন হউক’ বলিয়া বর গ্রহণ করিতে, তাঁহারা বনবাস হইতে মুক্ত হইলেন।

“হে জনাৰ্দন! তুমি আমার সেই সমুদয় দুঃখ বিলক্ষণ পরিজ্ঞাত আছ; অতএব এক্ষণে আমাকে এবং আমার ভতাঁ, জ্ঞাতি ও পাণ্ডবগণকে পরিত্রাণ করা। দেখ, আমি ধৰ্মতঃ ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্রের স্নুষা, আমাকেও শত্ৰুগণের পরাক্রমপ্রভাবে দাসী হইতে হইল। কি আশ্চৰ্য্য! দুৰ্য্যোধন এখনও জীবিত আছে, পার্থের শরাসন ও ভীমসেনের বলে ধিক্! হে কৃষ্ণ! যদি আমার প্রতি তোমার অনুগ্রহ ও কৃপা থাকে, তাহা হইলে অচিরাৎ ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণের উপর ক্রোধাগ্নি নিক্ষেপ কর।”

অসিতাপাঙ্গী [যে নারীর চক্ষুর তারা কৃষ্ণাভ, প্রান্তদ্বয় রক্তাভ] দ্রুপদনন্দিনী এই কথা বলিয়া কুটিলাগ্ৰ [যাহার প্রান্তভাগ কুঞ্চিত], পরমরমণীয়, সর্ব্বগন্ধাধিবাসিত [সৌগন্ধচর্চিত-সুবাসিত] সর্ব্বলক্ষণসম্পন্ন, মহাভুজগসদৃশ কেশকলাপ ধারণ করিয়া অশ্রুপূৰ্ণলোচনে দীনবচনে পুনরায় কৃষ্ণকে কহিতে লাগিলেন, “হে জনাৰ্দন! দুরাত্মা দুঃশাসন আমার কেশ আকর্ষণ করিয়াছিল। শত্রুগণ সন্ধিস্থাপনের মত প্ৰকাশ করিলে তুমি এই কেশকলাপ স্মরণ করিবে। ভীমার্জ্জুন দীনের ন্যায় সন্ধিস্থাপনে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছেন, তাহাতে আমার কিছুমাত্র ক্ষতি নাই; আমার বৃদ্ধ পিতা মহারথ পুত্ৰগণসমভিব্যাহারে শক্ৰগণের সহিত সংগ্ৰাম করিবেন। আমার মহাবলপরাক্রান্ত পঞ্চপুত্র অভিমন্যুকে পুরস্কৃত করিয়া কৌরবগণকে সংহার করিবে। দুরাত্মা দুঃশাসনের শ্যামল বাহু ছিন্ন, ধরাতলে নিপতিত ও পাংশুগুন্ঠিত [ধূলি-ধূসরিত] না দেখিলে আমার শান্তিলাভের সম্ভাবনা কোথায়? আমি হৃদয়ক্ষেত্রে প্রদীপ্ত পাবকের ন্যায় ক্ৰোধসংস্থাপনপূর্ব্বক ত্ৰয়োদশ বৎসর প্রতীক্ষা করিয়া আছি। এক্ষণে সেই ত্ৰয়োদশ বৎসর অতিক্রান্ত হইয়াছে; তথাপি তাহা উপশমিত হইবার কিছুমাত্র উপায় দেখিতেছি না; আজি আবার ধর্ম্মপথাবলম্বী বৃকোদরের বাক্যশল্যে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে।”

রোরুদ্যমানা দ্ৰৌপদীর প্রতি কৃষ্ণের সান্ত্বনা

নিবিড়নিতস্বিনী আয়তলোচনা কৃষ্ণা এই কথা কহিয়া বাষ্পগদগদম্বরে কম্পিত্যকলেবরে ক্ৰন্দন করিতে লাগিলেন। দ্রবীভূত হুতাশনের ন্যায় অত্যুষ্ণ নেত্ৰজলে তাঁহার স্তনযুগল অভিষিক্ত হইতে লাগিল। তখন মহাবাহু বাসুদেব তাঁহাকে সাস্তুনা করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে কৃষ্ণে! তুমি অতি অল্পদিনের মধ্যেই কৌরবমহিলাগণকে রোদন করিতে দেখিবে। তুমি যেমন ক্ৰন্দন করিতেছ, কুরুকুলকামিনীরাও তাঁহাদের জ্ঞাতিবান্ধবগণ নিহত হইলে এইরূপ রোদন করিবে। আমি যুধিষ্ঠিরের নিয়োগানুসারে ভীমার্জ্জুন, নকুল ও সহদেব-সমভিব্যাহারে কৌরবগণের বন্ধসাধনে প্রবৃত্ত হইব। ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ কালপ্রেরিতের ন্যায় আমার বাক্যে অনাদর প্রকাশ করিলে অচিরাৎ নিহত ও শৃগালকুকুরের ভক্ষ্য হইয়া ধরাতালে শয়ন করিবে। যদি হিমবান প্রচলিত, মেদিনী উৎক্ষিপ্ত ও আকাশমণ্ডল নক্ষত্ৰসমূহের সহিত নিপতিত হয়, তথাপি আমার বাক্য মিথ্যা হইবে না। হে কৃষ্ণে! বাস্পসংবরণ কর; আমি তোমাকে যথার্থ কহিতেছি, তুমি অচিরকালমধ্যেই স্বীয় পতিগণকে শক্রসংহার করিয়া রাজ্যলাভ করিতে দেখিবে।”