০৭৪. ভীমমুখে সান্তবাদে কৃষ্ণের বিস্ময়

৭৪তম অধ্যায়

ভীমমুখে সান্তবাদে কৃষ্ণের বিস্ময়

বৈশম্পায়ন কহিরেন, মহারাজ! মহাবাহু শার্ঙ্গপাণি কেশব গিরির লঘুত্বের ন্যায়, পাবকের শীতলত্বের ন্যায়, ভীমসেনের মুখে অভূতপূর্ব্ব বাক্য শ্রবণপূর্ব্বক তাঁহাকে উত্তেজিত করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে ভীমসেন! আপনি অন্যান্য সময়ে বাধাকাঙক্ষী ক্রুরকর্ম্মা কৌরবগণকে সংহার করিবার মানসে যুদ্ধেরই প্রশংসা করিয়া থাকেন, একবারও নিদ্রিত হয়েন না, ন্যুব্জভাবে [কুব্জভাবে-উপুড় হইয়া] শয়ন করিয়া জাগরিতাবস্থাতেই রজনী অতিবাহিত করেন, সতত দারুণ ও প্রশান্ত ক্রোধজ্ঞাপক বাক্য প্রয়োগ করিয়া থাকেন। আপনি যখন স্বীয় ক্ৰোধাগ্নিতে সন্তপ্ত হইয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করেন, তৎকালে আপনাকে সধুম হুতাশনের ন্যায় বোধ হয়। যখন ভয়ার্ত্তা দুর্ব্বল ব্যক্তির ন্যায় একাস্তে শয়ন করিয়া নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে থাকেন, তখন আপনার আন্তরিক ভাবানভিজ্ঞ [অবস্থায় অনভিজ্ঞ] ব্যক্তিগণ আপনাকে উন্মত্ত জ্ঞান করে। হে বৃকোদর! আপনি সততই মদস্রাবী মাতঙ্গের ন্যায় বৃক্ষসমুদয় সমূলে নির্ম্মূল করিয়া ক্ষিতিতলে পাতিত ও পদাঘাতপূর্ব্বক নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে করিতে মহাবেগে ধাবমান হন, এই সমুদয় ব্রাহ্মণগণের সহবাসে আনন্দিত হন না, নির্জ্জনে কালব্যাপন করেন এবং কি দিবা, কি বিভাবরী, কোন সময়েই যুদ্ধচিন্তা ব্যতীত আর কিছুতেই মনোনিবেশ করেন না। আপনি অকস্মাৎ হাস্য ও রোদন করিয়া নির্জ্জনে জানুদ্বয়ের মধ্যে মস্তক সংস্থাপনপূর্ব্বক নিমীলিতনেত্ৰে উপবেশন করেন [চিন্তাবিষ্টের লক্ষণ-যাহারা নিবিষ্টভাবে চিন্তা করে, তাহারা ঐরূপ করিয়া থাকে]। পুনরায় ভ্রূকুটীবন্ধন ও ওষ্ঠদংশনপূর্ব্বক ক্রোধ প্রকাশ করিয়া থাকেন। দেখুন, যেমন দিবাকর প্রত্যহ পূর্ব্বদিগবিভাগে উদিত হইয়া স্বীয় কিরণজাল বিস্তরপূর্ব্বক অস্তাচলে গমন করিয়া পুনঃ পুনঃ মেরু প্ৰদক্ষিণ করেন, কদাপি ইহার ব্যতিক্রম হয় না, তদ্রূপ আপনিও ‘গদাঘাতে দুৰ্য্যোধনকে সংহার করিব, কদাচ অন্যথা হইবে না’, ভ্রাতৃগণের মধ্যে এই বলিয়া গদাস্পৰ্শ পূর্ব্বক সত্য করিতেন। কি আশ্চৰ্য্য! এক্ষণে আপনার মতি শান্তিপথানুবর্ত্তী হইয়াছে। আজি আপনার মনে ভয়ের উদয় হইয়াছে। এক্ষণে নিশ্চয় করিলাম, যুদ্ধকাল সমুপস্থিত হইলে যুদ্ধাভিলাষী ব্যক্তির চিত্তবৃত্তির বৈপরীত্য জন্মে।

“হে ভীমসেন! আপনি নিদ্রিত ও জাগরিতাবস্থায় দুর্নিমিত্তসমুদয় সন্দর্শন করিয়া থাকেন; তন্নিমিত্তই শান্তিপথাবলম্বনে কৃতযত্ন হইয়াছেন। কি আশ্চৰ্য্য! আপনি ক্লীবের ন্যায় আপনাকে পুরুষত্ববিহীন অনুভব করিতেছেন। আপনি মোহে একান্ত অভিভূত হইয়াছেন; তন্নিমিত্তই আপনার মন বিকৃত হইয়া উঠিয়াছে। আপনার হৃদয় কম্পিত হইতেছে, মন বিষন্ন হইয়াছে এবং আপনি ঊরুস্তম্ভে [সঙ্কল্পমাত্রেই কাৰ্য্যসম্পাদনে সদ্য উদ্যমীর জঙ্ঘাবল বিশেষ দরকার। উরুস্তম্ভে সেই জঙ্ঘাবলের অভাব সূচিত হয়] অভিভূত হইয়াছেন, তন্নিমিত্তই শাস্তিসংস্থাপনে যত্ন করিতেছেন। মনুষ্যের চিত্ত বাতিবেগপ্রচলিত শাল্মলিবীজের ন্যায় নিতান্ত চঞ্চল। যেমন গোমুখে মানুষের বাক্য অশ্রদ্ধেয়, তদ্রূপ আপনার এই বুদ্ধি নিতান্তই অশ্রদ্ধেয় হইয়াছে। আপনার বাক্যশ্রবণে পাণ্ডবগণের মন একেবারে উৎসাহশূন্য হইয়াছে।

“হে ভীমসেন! আপনার এইরূপ অসদৃশ বাক্য শ্রবণ করিয়া আমার বোধ হইতেছে যে, পর্ব্বতও প্রচলিত হইতে পারে। যাহা হউক, এক্ষণে আপনি আপনার কর্ম্ম ও ক্ষত্ৰিয়কুলে জন্ম বিবেচনা করিয়া যুদ্ধে মনোনিবেশ করুন, বিষাদ করিবেন না, স্থির হউন। হে অরতিনিপাতন! প্লানি আপনার পক্ষে সাতিশয় বিরুদ্ধ; স্বীয় তেজঃপ্রভাবে যাহা লাভ না হয়, ক্ষত্ৰিয়গণ তাহা কদাচ ভোগ করেন না।”