০৭১. ভগবদ্যানপর্ব্বাধ্যায়

৭১তম অধ্যায়

ভগবদ্যানপর্ব্বাধ্যায়

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নরনাথ! সঞ্জয় প্রতিনিবৃত্ত হইলে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সর্ব্বযাদবশ্রেষ্ঠ বাসুদেবকে কহিতে লাগিলেন, “হে মিত্রবৎসল! এক্ষণে তোমার মিত্ৰগণের সেই সময় সমুপস্থিত হইয়াছে; এ সময় তোমা ভিন্ন তাহাদিগকে আপদ হইতে উদ্ধার করে, এমন আর কাহাকেও দেখিতেছি না। হে মাধব! আমরা কেবল তোমার উপর নির্ভর করিয়া নিৰ্ভয়চিত্তে বৃথা গর্ব্বিত দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনকে অমাত্যসমভিব্যাহারে পরাজয়পূর্ব্বক আপনাদের রাজ্যাংশ গ্রহণ করিতে বাসনা করিতেছি। হে অরতিনিপাতন! তুমি আপৎকাল উপস্থিত হইলে বৃষ্ণিদিগকে যেমন রক্ষা করিয়া থাক, পাণ্ডবগণকেও সেইরূপ রক্ষা করা কর্ত্তব্য; অতএব আমাদিগকে এই মহাভয় হইতে পরিত্ৰাণ কর।”

কৃষ্ণ কহিলেন, “হে মহাবাহো! এই আমি উপস্থিত রহিয়াছি; বলুন, এক্ষণে কি করিতে হইবে, আপনি যাহা কহিবেন, আমি তদ্বিষয় সম্পাদনে সম্মত আছি।”

কৃষ্ণসমীপে যুধিষ্ঠিরের কর্ত্তব্য জিজ্ঞাসা

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! তুমি সপুত্র ধৃতরাষ্ট্রের অভিপ্ৰায় শ্রবণ করিয়াছ। সঞ্জয় আমার নিকট যাহা কহিয়াছে, উহাই ধৃতরাষ্ট্রের মত। সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের আত্মার স্বরূপ হইয়া তাঁহার সমুদয় মনোগত ভাব প্রকাশ করিয়া কহিয়াছি। রাজার বাক্য যথার্থরূপে কীর্ত্তন করা দূতের অবশ্য কর্ত্তব্য। যে দূত তাহার অন্যথাচরণ করে, সে বধ্য। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র লোভাবশতঃ আমাদিগকে রাজ্যাংশ প্রদান না করিয়াই আমাদের সহিত সন্ধি সংস্থাপন করিতে বাসনা করিতেছেন। আমরা কেবল ধৃতরাষ্ট্রের আজ্ঞানুসারেই দ্বাদশ বৎসর বনবাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করিয়াছি; মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র চতুর্দশ বর্ষে আমাদিগকে রাজ্য প্রদান করিবেন, এই বিবেচনা করিয়া আমরা প্ৰতিজ্ঞাভঙ্গ করি নাই; ব্ৰাহ্মণগণ ইহা বিশেষরূপে অবগত আছেন। তিনি এক্ষণে দুষ্ট পুত্রের একান্ত বশীভুত হইয়া স্বধৰ্মচিন্তায় বিরত ও তাঁহারই শাসনের অনুবর্ত্তী হইয়াছেন। তিনি কেবল দুৰ্য্যোধনের মতানুসারে আমাদের সহিত মিথ্যাচরণ করিতেছেন। হে জনাৰ্দন! আমি স্বীয় মাতা ও বান্ধবগণের দুঃখ নিবারণ করিতে পারিতেছি না, ইহা অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি হইতে পারে? হে মধুসূদন! আমি কাশী, চেদি, পাঞ্চাল ও মৎস্যদেশীয় ভূপতিগণ এবং তোমার দ্বারা তাহাঁর নিকট অবিস্থল, বৃকস্থল, মাকান্দী, বারণাবত ও অন্য কোন গ্রাম, এই পাঁচখানি গ্রাম অথবা পাঁচটি নগর যাজ্ঞা করিয়াছিলাম। আমার মানস ছিল যে, আমরা পঞ্চভ্রাতা একত্ৰ হইয়া কৌরবগণের সহিত বিবাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক ঐ সমুদয় স্থানে আধিপত্য করি; কিন্তু দুৰ্মতি ধৃতরাষ্ট্র আপনার আধিপত্য বিবেচনা করিয়া তাহাতে সম্মত হইলেন না, ইহা অপেক্ষা অধিক দুঃখজনক আর কি আছে?

“মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র সৎকুলে সম্ভূত, এক্ষণে বৃদ্ধও হইয়াছেন; কিন্তু পরাধনাপহরণে তাঁহার লোভ জন্মিয়াছে। হে ভগবান! লোভ প্রজ্ঞা বিনষ্ট করে; প্রজ্ঞা বিনষ্ট হইলো লজ্জানাশ হয়; লজানাশ হইলে ধর্ম্মনিষ্ট হয়; ধর্ম্মনিষ্ট হইলে শ্ৰীর হানি হয়; শ্ৰী হত হইলেই পুরুষের নাশ হয়। ধনাভাবই পুরুষের মৃত্যুস্বরূপ; যেমন পক্ষিগণ ফলপুষ্পবিহীন বৃক্ষ পরিত্যাগ করে, তদ্রূপ জ্ঞাতি, সুহৃৎ ও দ্বিজগণ অধম ব্যক্তিকে পরিত্যাগ করিয়া থাকেন। হে মহাত্মন! যেমন মৃত ব্যক্তির দেহ হইতে প্ৰাণ বহির্গত হয় এবং লোকে যেমন পতিত ব্যক্তিকে পরিত্যাগ করিয়া থাকে, তদ্রূপ জ্ঞাতিগণ আমাকে পরিত্যাগ করিতেছেন, ইহা আমার পক্ষে মৃত্যুস্বরূপ। সম্বর কহিয়াছেন যে, প্রাতির্ভোজন-সম্পাদনের ধন না থাকা অপেক্ষা ক্লেশকর অবস্থা আর কিছুই নাই।

দরিদ্রের দুর্দশা-প্রদর্শন

“ধনই পরম ধর্ম্ম, ধনদ্বারা সকল কাৰ্য্যই সম্পাদিত হইয়া থাকে। ধন্যবান ব্যক্তিরাই জীবিত; নিৰ্দ্ধন ব্যক্তির জীবন মরণের তুল্য। যাহারা স্বীয় বাহুবলপ্রভাবে অন্য ব্যক্তিকে ধনভ্রষ্ট করে, তাহারা ধর্ম্ম, অর্থ ও কাম এবং সেই ব্যক্তিকে এককালে বিনষ্ট করে। নিৰ্দ্ধনতানিবন্ধন অনেকে প্ৰাণ পরিত্যাগ করিয়াছে; অনেক নাগরিক পুরুষ গ্রামে ও অনেক গ্রামবাসী ব্যক্তি অরণ্যে বাস করিতেছে; কেহ বা প্ৰাণবিনাশের অভিলাষে দেশান্তরে গমন করিয়াছে; কত শত লোক উন্মাদগ্ৰস্ত হইয়াছে; কেহ কেহ। অরাতিকুলের বশীভূত হইতেছে এবং অনেকে পরের দাসত্ব স্বীকার করিতেছে। ধর্ম্মকামের হেতুভূত সম্পত্তিবিনাশ আপদ। পুরুষের পক্ষে মরণ অপেক্ষাও গুরুতর; কিন্তু স্বভাবসিদ্ধ মৃত্যু কেহ অতিক্রম করিতে পারে না।

“হে মধুসূদন! যে ব্যক্তি অগ্রে প্রভূত ধনের অধীশ্বর হইয়া পশ্চাৎ সম্পত্তিবিহীন হয়, তাহার পক্ষে নিৰ্দ্ধনতা যাদৃশ ক্লেশকর আজন্ম ধনহীন ব্যক্তির পক্ষে তাদৃশ কষ্টজনক হয় না। ধন্যবান ব্যক্তি আপনার দোষেই ব্যসনাপন্ন হইয়া ইন্দ্ৰাদি দেবগণ ও আত্মার নিন্দা করিয়া থাকে। ব্যসন শাস্ত্ৰপ্ৰভাবে বিনষ্ট হইবার নহে; ব্যসনী ব্যক্তি সতত ভৃত্যদিগের উপর ক্রোধ ও সুহৃজ্জনের প্রতি অসূয়া করে; সতত ক্ৰোধপরায়ণতাপ্রযুক্ত মুগ্ধ ও মোহবশতঃ পাপকর্ম্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়। অনবরত পাপ করাতে পাপসঙ্কর [নানাপ্রকার মিশ্র পাপ] সমুপস্থিত হইয়া উঠে; উহা নরকের নিদান ও পাপের পরাকাষ্ঠা। মনুষ্য জ্ঞানশূন্য হইয়া কাৰ্য্য করিলে এইরূপে ক্রমে ক্ৰমে মহানরকে নিমগ্ন হয়, কিন্তু প্রতিবুদ্ধ হইলে প্রজ্ঞাচক্ষু উন্মীলিত হইয়া তাহাকে পাপপঙ্ক হইতে উত্তীর্ণ করে। প্রজ্ঞাচক্ষুদ্বারা শাস্ত্রে দৃষ্টি হইলে মানবগণ ধর্ম্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়, ধর্মের প্রধান অঙ্গ লজা। লজ্জাশীল ব্যক্তি পাপের দ্বেষ করিয়া থাকে; তন্নিবন্ধন তাহার শ্ৰীবৃদ্ধি হয়। যে পুরুষ শ্ৰীমান, সেই যথার্থ পুরুষ।

‘ধর্ম্মনিষ্ঠ, প্রশান্তাত্মা, কাৰ্য্যকুশল ব্যক্তি কদাপি অধৰ্মচিন্তা বা অধর্ম্মাচরণ করে না। নির্লজ্জ অথবা মূঢ় ব্যক্তি স্ত্রী ও পুরুষ এই উভয়ের মধ্যেই পরিগণিত নহে; শূদ্রের ন্যায় তাহার বেদে অধিকার নাই; হ্রীমানই [লজ্জাশীল-অধৰ্মবিমুখ] ব্যক্তি দেবগণ, পিতৃগণ ও আত্মার নিকট সতত প্ৰণত থাকেন এবং তান্নিবন্ধন মুক্তিলাভ করেন; মুক্তিলাভই পুণ্যের পরাকাষ্ঠা।

যুধিষ্ঠিরের অহিংস অর্থনীতিনিষ্ঠা

“হে মধুসূদন! তুমি ত’ স্বচক্ষে আমার লজ্জাশীলতা প্রত্যক্ষ করিয়াছ। আমি রাজ্যপরিভ্রষ্ট হইয়া প্ৰতিজ্ঞা পালনার্থ দ্বাদশ বৎসর বনবাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করিয়াছি। ন্যায়ানুসারে আমরা কখনই সম্পত্তির অনধিকারী নহি; অতএব রাজ্যলাভের নিমিত্ত যদি আমাদিগকে প্ৰাণ পৰ্য্যন্ত পরিত্যাগ করিতে হয়, তাহাও শ্ৰেয়ঃ। রাজ্যলাভবিষয়ে আমাদের প্রথম কল্প [পরিকল্পনা-নিৰ্দ্ধারণ] এই যে, আমরা ও তাহারা সকলেই পরস্পর যুদ্ধচেষ্টা পরিত্যাগপূর্ব্বক প্ৰশান্তচিত্তে স্ব স্ব রাজ্যাংশ লাভ করি। আমরা কৌরবগণের সংহার করিয়া রাজ্যলাভ করিলে রৌদ্র [বীভৎস-ভীষণ] কর্মের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা হয়। জ্ঞাতিবর্গের কথা দূরে থাকুক, যাহারা বান্ধব নহে, অথচ সতত অভদ্রতা ও শক্ৰতা করে, তাহাদিগকেও বিনাশ করা কর্ত্তব্য নহে। কুরুবংশীয়েরা আমাদিগের জ্ঞাতি ও সহায়; তাঁহাদের মধ্যে অনেকে আমাদিগের গুরুলোক আছেন; অতএব যুদ্ধ করিয়া কৌরবদিগকে বধ করা নিতান্ত পাপকর। ক্ষত্ৰিয় ধর্ম্ম পাপজনক; অতএব ধর্ম্মই হউক বা অধৰ্মই হউক, আমাদিগকে ক্ষাত্রধর্ম্মই অবলম্বন করিতে হইবে, অন্যবৃত্তি আমাদের পক্ষে একান্ত বিগৰ্হিত।

“শূদ্ৰ শুশ্রূষা, বৈশ্য বাণিজ্য, ক্ষত্রিয় লোকবিনাশ ও ব্রাহ্মণ ভিক্ষা করিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করে। ক্ষত্ৰিয় ক্ষত্ৰিয়গণকে সংহার করে, মৎস্য মৎস্যভক্ষণপূর্ব্বক প্রাণধারণ করিয়া থাকে, কুকুর কুকুরকে বিনাশ করে। এইরূপ যাহার যে ধর্ম্ম, সে তদনুসারেই কাৰ্য্য করিয়া থাকে। কলি [কহল] নিয়তই যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করে; যুদ্ধে প্ৰাণনাশ হয়; যুদ্ধ সর্ব্বতোভাবে পাপজনক। বল ও নীতির তারতম্য অনুসারেই যুদ্ধে জয় ও পরাজয় হইয়া থাকে। জীবিত বা মরণ লোকের স্বেচ্ছানুসারে হয় না। কেহই অকালে সুখ বা দুঃখ ভোগ করে না। একাকী অনেককে সংহার করে; কখন কখন অনেকে সমবেত হইয়াও একজনকে বধ করিয়া থাকে। অনেক সময়ে কাপুরুষ শূরকে ও অযশস্বী যশস্বীকে বিনাশ করে। এককালে উভয়েরই জয় বা পরাজয় কখনই হয় না। পরাজয়ভয়ে পলায়ন করিলে দীনতাপ্রকাশ হয় এবং সম্পত্তিনাশ ও মৃত্যু হইবারও বিলক্ষণ সম্ভাবনা আছে। সমরে অন্যকে আঘাত করিলে প্রায়ই তৎকর্ত্তৃক আহত হইতে হয়। মৃত ব্যক্তির জয় ও পরাজয় উভয়ই সমান। আমার মতে পরাজয় মৃত্যু হইতে বিশেষ নহে।

“যুদ্ধে জয়লাভও পরাজয়ের তুল্য; কেন না, উহাতে অন্য কর্ত্তৃক অনেক দায়িত [প্রিয়] ব্যক্তির প্রাণসংহার হইয়া থাকে। এইরূপে বিজয়ী ব্যক্তির মান, জাতি, বল এবং পুত্র ও ভ্রাতৃগণের বিনাশনিবন্ধন মহান নির্ব্বেদ সমুপস্থিত হয়। নিতান্ত ধীর, লজ্জাশীল, সজ্জন ও কারুণ্যরস সম্পন্ন ব্যক্তিরা যুদ্ধে নিহত হয়; কিন্তু নিকৃষ্ট লোকেরা প্রায়ই পরিত্ৰাণ পায়। সংগ্রামে অনাত্মীয় ব্যক্তিগণকে সংহার করিলেও অতিশয় অনুতাপ উপস্থিত হইয়া থাকে। বিশেষতঃ শত্রুপক্ষীয় হতাবিশিষ্ট ব্যক্তিরা ক্ৰমে ক্ৰমে সৈন্য সংগ্ৰহ করিয়া বিজয়ী ব্যক্তির বল সংহার করিতে আরম্ভ করে এবং বৈরানিৰ্য্যাতন করিবার মানসে একবারে তাহাকে সমূলে উন্মুলনা করিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে।

“জিত ব্যক্তির মনে বৈরানিল চিরকাল প্রজ্বলিত থাকে। আর পরাজিত ব্যক্তি নিরন্তর দুঃখ ভোগ করে; কিন্তু জয় ও পরাজয় পরিত্যাগপূর্ব্বক শান্তিমাৰ্গ অবলম্বন করিলে স্বচ্ছন্দে নিদ্রাসুখ অনুভূত হইয়া থাকে। জাতবৈর পুরুষ সর্পধিষ্ঠিত [সৰ্পকর্ত্তৃক আধ্যুষিত-যেখানে সৰ্প বাস করে] গৃহমধ্যস্থ ব্যক্তির ন্যায় অতিকষ্টে নিদ্রিত হয়। যে ব্যক্তি সকলকে উৎসাদিত করে, সে চিরকাল অযশ ও অকীর্ত্তিভাজন হয়। বহুকাল গত হইলেও বৈর উপশমিত হয় না; শত্ৰুকুলে এক ব্যক্তি জীবিত থাকিলেই পুরাতন বৈরের উল্লেখ হইতে থাকে। বৈর কদাচ বৈরিদ্বারা প্রশমিত হইবার নহে, প্রত্যুত ঘৃতাহুত বহ্নির ন্যায় পুনঃ পুনঃ পরিবর্দ্ধিত হইয়া উঠে। শত্ৰুগণকে বিনাশ না করিলে পরিত্রাণের উপায়ান্তর নাই। এই বিবেচনা করিয়া যাহারা অরাতিকুলের ছিদ্রান্বেষণে যত্নবান হয়, তাহারা স্বতঃই বিনষ্ট হইয়া থাকে। পুরুষকার হৃদয়ব্যথার প্রধান কারণ; অতএব পুরুষাভিমান পরিত্যাগ বা প্রাণত্যাগ ব্যতীত শান্তিলাভ করিবার সম্ভাবনা নাই। শত্ৰুগণকে সমূলে উন্মুলিত করিতে পারিলে শান্তিলাভ হয় বটে, কিন্তু উহা নিতান্ত নৃশংসতার কাৰ্য্য। রাজ্য পরিত্যাগপূর্ব্বক শান্তিলাভ করা মৃত্যুর সদৃশ, কারণ, তাহা হইলে শক্ৰগণ আমাদিগের ছিদ্র পাইয়া আমাদিগকে প্রহার বা উপেক্ষা করিবে, এই সংশয়ে এবং আত্মবিনাশসম্ভাবনায় নিরন্তর কালব্যাপন করিতে হয়। অতএব আমরা রাজ্য পরিত্যাগ বা কুলক্ষয়-এই উভয় কাৰ্য্যেই পরাজুখি হইতেছি। এ স্থলে সন্ধিস্থাপনপূর্ব্বক আমাদের উভয় পক্ষেরই সমুচিত স্বস্ব অংশ প্রাপ্ত হইয়া শান্তিলাভ করাই শ্ৰেয়ঃ।

“আমরা প্রথমে যুদ্ধচেষ্টা-পরাঙ্মুখ হইয়া অন্যান্য উপায়দ্বারা রাজ্যলাভ করিতে চেষ্টা করিব; যদি কোন প্রকারেই কৃতকার্য্য হইতে না পারি, পরিশেষে অগত্যা আমাদিগকে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইতে হইবে; শান্তির চেষ্টা বিফল হইলে সুতরাং যুদ্ধ করিতে হয়। পণ্ডিতগণ যুদ্ধকারীদিগকে কুকুরগণের তুল্য বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। কুকুরগণ কোন আমিষের জন্য প্রথমে পরস্পর লাঙ্গুলচালন, চীৎকার, বিবর্ত্তন, দন্তপ্রদর্শন ও পুনরায় চীৎকার করিয়া যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হয়; পরিশেষে বলবান দুর্ব্বলকে পরাজয় করিয়া সেই আমিষ ভক্ষণ করে; মনুষ্যেরাও তদ্রূপ সংগ্রাম করিয়া স্বীয় অভিলষিত দ্রব্য লাভ করিয়া থাকে। বলবান ব্যক্তিরা দুর্ব্বলের প্রতি সতত অনাদরপ্রদর্শন ও তাহার সহিত বিরোধ করে এবং দুর্ব্বল ব্যক্তিরা বলবানের নিকট সতত নত হয়।

“হে জনাৰ্দন! পিতা, রাজা ও বৃদ্ধ সর্ব্বতোভাবে মাননীয়; অতএব ধৃতরাষ্ট্র আমাদের পরম পূজনীয় ও মান্য। কিন্তু তাঁহার পুত্রস্নেহ অতিশয় বলবান, তিনি পুত্রের বশীভূত হইয়া আমাদের প্ৰণিপাত অগ্রাহ্য করিয়া রাজ্য প্রদানে পরাঙ্মুখ হইবেন। তাহা হইলে আমাদের কি করা কর্ত্তব্য? আর কিরূপেই বা আমাদের ধর্ম্ম ও অর্থ উভয়ের রক্ষণ হইবে? হে মধুসূদন! এক্ষণে এই নিতান্ত দুরবগাহ বিষয়ে তোমা ব্যতীত আর তাহাকে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করি? তুমি আমাদের নিতান্ত প্রিয় ও হিতৈষী, তুমি সর্ব্বকাৰ্য্যজ্ঞ, আমাদের মধ্যে তোমার ন্যায় সমুদয় বিষয়ের নিশ্চয় তত্ত্ববেত্তা আর কে আছে?”

কৃষ্ণের দৌত্যগ্ৰহণসঙ্কল্প

মহাত্মা জনাৰ্দন যুধিষ্ঠিরকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কহিতে লাগিলেন, “হে ধৰ্মরাজ! আমি আপনাদের উভয় পক্ষের হিতার্থ কৌরবসভায় গমন করিব। যদি তথায় আপনাদের স্বার্থের অব্যাঘাতে শান্তিসংস্থাপন করিতে পারি, তাহা হইলে কৌরব, সৃঞ্জয়, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডব ও অন্যান্য ব্যক্তিগণ মৃত্যুপাশ হইতে মুক্তিলাভ করিতে পরিবেন; তিন্নিবন্ধন আমারও মহাফলপ্ৰদ পুণ্যলাভ হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! আমার মতে কৌরবগণের নিকট তোমার গমন করা অকর্ত্তব্য; তুমি কুরুসভায় গমন করিয়া অতি হিতকর বাক্য প্রয়োগ করিলেও দুৰ্য্যোধন তদনুসারে কাৰ্য্য করিবে না। আর যে সমুদয় ভূপতিগণ তথায় আছেন, তাঁহারা সকলেই দুৰ্য্যোধনের বশবর্ত্তী; অতএব তাঁহাদের নিকট তোমার গমন করা অভিপ্রেত নহে। হে মাধব! তোমার অনিষ্টঘটনাদ্বারা পার্থিব ঐশ্বৰ্য্য ও সুখের কথা দূরে থাকুক, যদি দেবত্ব বা সমুদয় দেবগণের ঐশ্বৰ্য্যও লাভ হয়, তাহাতেও আমাদের সন্তোষ হয় না।

কৃষ্ণ কহিলেন, “হে ধৰ্মরাজ! আমি দুৰ্য্যোধনের পাপভিনিবেশ-বিষয় বিলক্ষণ অবগত আছি; কিন্তু অগ্ৰে তথায় উপস্থিত হইয়া সন্ধিবিষয়ক প্রস্তাব করিলে লোকমধ্যে আমরা অনিন্দনয়ি হইব, এই বিবেচনায় কুরুসভায় গমন করিতে বাসনা করিতেছি। যেমন ক্রোধান্বিত সিংহ অনায়াসে অন্যান্য পশুদিগকে সংহার করে, তদ্রূপ আমি ক্রুদ্ধ হইলে অনায়াসেই সমুদয় পার্থিবগণকে মুহূর্ত্তমধ্যে বিনাশ করিতে পারি। যদি কৌরবগণ আমার উপর কোন অত্যাচার করে, তাহা হইলে আমি এককালে তাহাদিগকে সংহার করিব। হে মহারাজ! কৌরবগণ-সমীপে আমার গমন করা কদাপি ব্যর্থ হইবে না, হয় তোমাদের স্বার্থের অব্যাঘাতে সন্ধি স্থাপিত হইবে, না হয় লোকমধ্যে তোমরা অনিন্দনীয় হইবে।”

তদ্বিষয়ে আমার কোন আপত্তি নাই। তুমি স্বচ্ছন্দে কৌরবগণসমীপে গমন কর। যেন তোমাকে কৃতাৰ্থ হইয়া নির্ব্বিঘ্নে পুনরায় এখানে আগমন করিতে দেখি। হে মধুসূদন! তুমি কুরুকুলে গমন করিয়া এরূপ শাস্তিস্থাপন করিবে যে, আমরা যেন সকলে প্ৰশান্তচিত্তে একত্র মিলিত হইয়া পরস্পর আমোদ-প্রমোদে কালব্যাপন করি। তুমি আমাদের ভ্রাতা, বিশেষতঃ অর্জ্জুনও তোমার প্রিয়সখা; পরম সৌহার্দপ্ৰযুক্ত তোমার প্রতি কখন আমাদের কোন আশঙ্কা হয় না; তোমার মঙ্গল হউক, মঙ্গলসম্পাদনের নিমিত্ত কৌরবসভায় গমন কর। হে কৃষ্ণ! তুমি আমাদিগকে ও আমাদের শত্রুদিগকে বিশেষরূপ অবগত আছ, অর্থতত্ত্বজ্ঞতা ও বাগ্নিতার পারদর্শিতা লাভ করিয়াছ অতএব যাহাতে আমাদিগের হিত হয়, দুৰ্য্যোধনকে তদনুরূপ উপদেশ প্ৰদান করিবে। হে কেশব! যে বাক্য ধর্ম্মনিপেত [ধর্মের অধিকারী-নীতিসম্মত] ও আমাদের হিতজনক, কৌরবসভায় তাহা কহিবে; ইহাতে সন্ধিসংস্থাপন হয় উত্তম, না হয় পরিশেষে যুদ্ধ করিব।”