০৫৯. সঞ্জয়বাক্যে ধৃতরাষ্ট্রের জয়াশাপরিত্যাগ

৫৯তম অধ্যায়

সঞ্জয়বাক্যে ধৃতরাষ্ট্রের জয়াশাপরিত্যাগ

বৈশস্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! প্রজ্ঞাচক্ষু [জ্ঞাননেত্র-অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন] রাজা ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের বাক্য শ্রবণ করিয়া পুত্ৰগণের জয়কামনায় যথাবুদ্ধি সূক্ষ্মরূপে সেই বাক্যের গুণদোষ বিচার করিতে লাগিলেন। অনন্তর যথার্থরূপে বলাবল নিশ্চয় করিয়া উভয়পক্ষের শক্তিবিচারে প্রবৃত্ত হইলেন; পরে পাণ্ডবগণকে দৈব ও মানুষ উভয় প্রকার তেজ ও শক্তিসম্পন্ন এবং কৌরবগণকে অপেক্ষাকৃত অল্পতর শক্তিশালী বিবেচনা করিয়া দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, “বৎস! আমি যে নিমিত্ত প্রতিনিয়ত চিন্তাকুল হইতেছি, তাহা কেবল অনুমানসিদ্ধ নহে, প্রত্যক্ষের ন্যায় সত্য বলিয়া বোধ হইতেছে। সকল জীবই আত্মাজের প্রতি স্নেহপ্ৰদৰ্শন, তাহাদিগের প্রিয়াচরণ ও হিতানুষ্ঠান করিয়া থাকে এবং ইহাও দেখিতেছি যে, উপকৃত সাধুগণ প্রায়ই উপকারীর প্রত্যুপকার করিতে পরাঙ্মুখ হয়েন না; অতএব পাণ্ডবগণের জন্মদাতা যমরাজপ্রভৃতি দেবগণ আহূত হইলেই তাহাদিগের সাহায্য করিবেন; হুতাশন খাণ্ডবারণ্যে অর্জ্জুনকৃত উপকার স্মরণ করিয়া এই ভয়ঙ্কর কুরুপাণ্ডযুদ্ধে তাঁহার সহকারী হইবেন সন্দেহ নাই। বোধহয়, এইসকল দেবতা পাণ্ডবগণকে ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপাদির ভয় হইতে রক্ষা করিবার নিমিত্ত অধিকতর ক্রোধাবিষ্টও হইবেন। পাণ্ডবগণ একে বীৰ্য্যবান ও অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী, তাহাতে আবার দেবগণ তাহাদিগের সাহায্য করিলে কোন ব্যক্তিই তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ হইবে না। যাঁহার দিব্যগাণ্ডীবধনু অতিভয়ঙ্কর, বরুণদত্ত তৃণীরদ্বয় সততই অক্ষয় ও পরিপূর্ণ, যাঁহার দিব্যরথের গতি ধূমের ন্যায় নির্লিপ্ত [অবাধ-সর্ব্বত্র গমনশীল], যাঁহার দিব্যধ্বজ বানরে অঙ্কিত, যিনি সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে অদ্বিতীয়, যাঁহার সিংহনাদ জলদগর্জ্জনের ন্যায়-বজ্রনির্ঘোষের ন্যায় শক্রগণের হৃৎকম্প উপস্থিত করে, সমুদয় লোক যাঁহাকে অলৌকিক বীৰ্য্যবান ও সমুদয় ভূপতি যাঁহাকে দেবগণেরও জেতা বলিয়া অবগত আছেন, যিনি একনিমেষের মধ্যে পঞ্চশত বাণ গ্রহণ, পরিত্যাগ ও অতি দূরে নিক্ষেপ করিয়া থাকেন, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, মদ্ররাজ শল্য ও অন্যান্য মধ্যস্থ মানবগণ যাঁহাকে অলৌকিকপরাক্রমশালী, পার্থিবগণেরও অপরাজেয় ও কর্ত্তবীৰ্য্যের ন্যায় ভুজবীৰ্য্যসম্পন্ন বলিয়া নির্দ্দেশ করেন, আমি এই মহাযুদ্ধে সেই মহাধনুৰ্দ্ধর মহেন্দ্র ও উপেন্দ্রসদৃশ পরাক্রমশালী ধনঞ্জয়কে যেন সংহারে প্রবৃত্ত বোধ করিতেছি। হে পুত্র! আমি অহোরাত্র এইরূপ চিন্তায় বিহ্বল হইয়া নিদ্রা ও সুখে বঞ্চিত হইয়াছি। এই কলহে কুরুগণের বিনাশকালে উপস্থিত হইয়াছে, সন্ধি ব্যতিরেকে ইহার অবসান হইবার সম্ভাবনা নাই। এই নিমিত্ত পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধি করিতেই সমুৎসুক হইতেছি। পাণ্ডবগণ কৌরব অপেক্ষা সমধিক বলবান; অতএব তাঁহাদের সহিত যুদ্ধ করা কোনক্রমেই আমার অভিপ্রেত নয়।”