০৫৭. ধৃতরাষ্ট্র সন্ধিপ্রস্তাবে দুৰ্য্যোধনের উপেক্ষা

৫৭তম অধ্যায়

ধৃতরাষ্ট্র সন্ধিপ্রস্তাবে দুৰ্য্যোধনের উপেক্ষা

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমি বিলাপ করিতেছি, তথাপি আমার মন্দমতি পুত্ৰগণ ক্ষত্ৰতেজঃসম্পন্ন ও কুমারব্রহ্মচারী যুধিষ্ঠিরের সহিত যুদ্ধাভিলাষী হইয়াছে। হে বৎস দুৰ্য্যোধন! যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হও; কোনপ্রকার যুদ্ধই প্রশংসনীয় নয়। অৰ্দ্ধ-পৃথিবীতে তোমার প্রয়োজন কি? আপনার ও অমাত্যগণের জীবনরক্ষার নিমিত্ত পাণ্ডবগণকে যথোচিত অংশ প্রদান কর। তুমি যে মহাত্মা পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধি কর, কুরুগণ সকলেই ইহা ধর্ম্মানুগত বলিয়া বিবেচনা করিতেছেন। হে পুত্র! আপনার সেনাগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করা; ইহারা তোমার মৃত্যুস্বরূপ হইয়া উৎপন্ন হইয়াছে; তুমি মোহবশতঃ তাহা অবগত হইতেছ না। যুদ্ধ করা আমার অভিপ্রেত নহে। আমিই যে কেবল যুদ্ধ করিতে নিবারণ করিতেছি, এমন নহে; বাহ্লীক, ভীষ্ম, দ্ৰোণ, অশ্বত্থামা, সঞ্জয়, সোমদত্ত, শল্য, কৃপ, সত্যব্রত, পুরুমিত্র, জয় ও ভূরিশ্রবাপ্রভৃতি যেসকল বীর পরপীড়িত কৌরবগণের একমাত্র আশ্রয়, তাঁহারা কেহই যুদ্ধকাৰ্য্যে অভিলাষ বা অভিনন্দন করিতেছেন না; অতএব তুমিও তাঁহাদের মতের অনুবর্ত্তী হও। তুমি আপনি ইচ্ছায় যুদ্ধ করিতে প্ৰবৃত্ত হইতেছ না; কিন্তু কৰ্ণ, দুঃশাসন ও পাপাত্মা শকুনি তোমাকে তদ্বিষয়ে প্রবর্ত্তিত করিতেছে।”

দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে তাত! আমি দ্রোণ, অশ্বত্থামা, ভীষ্ম, কাম্বোজ, কৃপ, বাহ্লীক, সত্যব্রত, পুরুমিত্র কিংবা ভূরিশ্রবা অথবা আপনার অন্য কোন বীরের উপর নির্ভর করিতেছি না। আমি ও কৰ্ণ এই উভয় বীর দীক্ষিত হইয়া রণযজ্ঞ বিস্তার করিব। যুধিষ্ঠির তাহার পশু, রথ, বেদী, খড়গ, স্রুব, গদা, স্রুক, কবচ, যজ্ঞভূমি, ঘোটকচতুষ্টয় হোতা, শরীসকল, দর্ভ ও যশ তাহার ঘৃতস্বরূপ হইবে। আমরা দুইজন যমরাজের উদ্দেশে এইরূপ রণযজ্ঞ সমাপন করিয়া জয়লাভ করিব, আরাতিগণকে সংহার করিব এবং পরিশেষে রাজলক্ষ্মীর আলিঙ্গনপাশে বদ্ধ হইয়া প্রত্যাগমন করিব। হে তাত! আমি, কর্ণ ও আমার ভ্রাতা দুঃশাসন, আমরা এই তিনজন পাণ্ডবকে নিপাতিত করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই।

“মহারাজ! হয় আমি পাণ্ডবগণকে বিনাশ করিয়া এই ভূমণ্ডলের আধিপত্য করিব; না হয় তাহারা আমাকে বিনষ্ট করিয়া এই পৃথিবী সম্ভোগ করবে। যদি জীবন, রাজ্য ও সমস্ত ঐশ্বৰ্য্য পরিত্যাগ করিতে হয়, তাহাও করিব; তথাপি পাণ্ডবগণের সহিত একত্র অবস্থান করিব না। ভূমি যে পরিমাণে তীক্ষ্ন সূচীর অগ্রভাগে সংলগ্ন হইয়া থাকে, পাণ্ডবগণকে তৎপরিমিত ভূমিও প্রদান করিব না।”

ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রপরিত্যাগে সঙ্কল্প

ধৃতরাষ্ট্ৰ কহিলেন, “হে ভূপতিগণ! আমি দুৰ্য্যোধনকে পরিত্যাগ করিলাম; এক্ষণে কেবল ইহার নিমিত্ত পরিতাপ করিতেছি না; ইনি শমনসদনে গমন করিলে যাহারা ইহার অনুগমন করিবে, তাহাদিগের জন্যই শোকাকুল হইতেছি। ব্যাঘ্রে যেমন মৃগযূথ বিনষ্ট করে, সেইরূপ পাণ্ডবগণ প্রধান প্রধান যোদ্ধৃগণকে সংহার করিবে। আমি যেন দেখিতেছি, দীৰ্ঘবাহু যুযুধান ভারতী সেনা আক্রমণপূর্ব্বক বিমন্দিত ও ব্যস্তসমস্ত করিয়াছে। বাসুদেব ধনঞ্জয়ের বিনষ্ট বল পরিপূর্ণ করিবেন; সাত্যকি বীজ বপনের ন্যায় শরজাল বর্ষণ করিয়া সমরে দণ্ডায়মান হইবেন। উচ্চতর প্রাকার [প্রাচীর-দেওয়াল] সদৃশ ভীমসেন সেনাগণের সহিত অগ্রসর হইলে তাহারা সকলেই তাহার আশ্রয় গ্রহণ করিবে।

“যখন দেখিবে, ভীমসেন পর্ব্বতপ্রতিম কুঞ্জরগণকে নিপাতিত করিয়াছে, তাহাদিগের দন্তসমুদয় বিশীর্ণ এবং কুম্ভ [হস্তীর ব্ৰহ্মরন্ধ্র—মস্তকের আধার] সকল বিদীর্ণ ও শোণিতাক্ত হইয়াছে, তাহারা বিশীর্ণ পর্ব্বতের ন্যায় রণক্ষেত্রে শয়ান রহিয়াছে, তখন ভীমসেনের আক্রমনভয়ে ভীত হইয়া আমার বাক্য স্মরণ করিতে হইবে। যখন ভীমরূপ হুতাশনে হস্তী, রথ ও সৈন্যগণ দগ্ধ হইয়াছে অবলোকন করিবে, তখন আমার বাক্য স্মরণ করিতে হইবে। পাণ্ডবগণ হইতে যে অনিষ্ট উপস্থিত হইবে, ইহা আমার অভিপ্রেত নহে; কেননা, তাহা হইলে তোমাদিগকে ভীমসেনের গদাঘাতে নিঃশেষিত হইতে হইবে। যখন কৌরবাবল উন্মুলিত মহাবনের ন্যায় ভীমহস্তে নিপাতিত হইয়াছে অবলোকন করিবে, তখন আমার বাক্য স্মরণ করিতে হইবে।” রাজা ধৃতরাষ্ট্র সমুদয় ভূপতিগণকে এইরূপ কহিয়া পুনর্ব্বার সঞ্জয়কে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন।