০৪৩. ব্ৰহ্মচৰ্য্য-বিধাননির্ণয়

৪৩তম অধ্যায়

ব্ৰহ্মচৰ্য্য-বিধাননির্ণয়

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সনৎসুজাত আপনি অত্যুৎকৃষ্ট ব্ৰহ্মপ্রাপক ও বিশ্বপ্রকাশক কথা কীর্ত্তন করিতেছেন, এক্ষণে ১। শাখার উল্লেখে। যেমন বৃক্ষ বুঝাইতে হয়, কলার কথায় যেমন চন্দ্রের পরিচয় হয়-তদ্রূপ সমগ্ৰ বেদের বিষয় বলিতে উপনিষদের বিবরণ বিষয়সম্পর্কশূন্য সুদুর্লভ বাক্য কীর্ত্তন করুন।” সনৎসুজাত কহিলেন, “মহারাজ! আপনি প্রফুল্লমনে আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিতেছেন, সত্বর সেই ব্ৰহ্মলাভ করা নিতান্ত সুকঠিন। আমি ব্ৰহ্ম’ এই নিশ্চয়াত্মিক বুদ্ধিতে মন বিলীন হইলে পর

হইয়া থাকে।” ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “ভগবন! আপনি সামান্য কাৰ্য্যের অসদৃশ ব্রহ্মচৰ্য্যব্রতসিদ্ধ যে সনাতন ব্রহ্মবিদ্যার কথা উল্লেখ করিলেন, তাহা কাৰ্য্যকালে আত্মাতেই অবস্থান করে, অতএব ব্রাহ্মণের যোগ্যমুক্তি কি প্রকারে লাভ হইতে পারে?”

সনৎসুজাত কহিলেন, “মহারাজ! ব্রহ্মচৰ্য্যসিদ্ধ পুরাতন ব্রহ্মবিদ্যা বুদ্ধিদ্বারা কীর্ত্তন করিব; সেই বিদ্যা বৃদ্ধ গুরুদিগকে নিত্য আশ্রয় করিয়া রহিয়াছে এবং তাহা লাভ করিলে মনুষ্য মর্ত্যলোক পরিত্যাগ করে।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “ভগবন! ব্রহ্মবিদ্যা ব্ৰহ্মচৰ্য্যদ্বারা প্রকৃতরূপে জ্ঞাত হওয়া যায়; অতএব এক্ষণে ব্ৰহ্মচৰ্য্য কিরূপ, আপনি তাহা কীর্ত্তন করুন।” সনৎসুজাত কহিলেন, “মহারাজ! যিনি আচার্য্যের নিকট গমনপূর্ব্বক নিষ্কপটসেবাদ্বারা তাঁহার ব্ৰহ্মত্বপ্রাপ্ত হয়েন এবং কলেবরপরিত্যাগ করিয়াও পরহ্মেরর সহিত একীভূত হইয়া থাকেন। যে সমস্ত সত্ত্বগুণসম্পন্ন ব্যক্তিরা ইহলোকে জিতকাম হইয়া থাকেন। যে সমস্ত সত্ত্বগুণসম্পন্ন ব্যক্তিরা ইহলোকে জিতকাম হইয়া মুক্তিলাভ করিবার নিমিত্ত তিতিক্ষা করিয়া আছেন, যেমন মুঞ্জ [শরমূজা তৃণ] হইতে ঈষীকা [শরমূজা তৃণের ডাঁটা] পৃথককৃত হয়, তদ্রূপ তাঁহারা দেহ হইতে আত্মাকে পৃথক করিয়া থাকেন। মনুষ্যেরা পিতামাতা হইতে জন্মপরিগ্ৰহ করিয়া থাকে; পরে তাঁহারা গুণোপদেশপ্ৰাপ্ত হইলে পবিত্র, অজর ও অমর হয়। আচাৰ্য্য সত্যদ্বারা বাহ্যন্তুর আবৃত এবং বাক্যদ্বারা ব্ৰহ্ম আবিষ্কৃত ও মোক্ষ প্ৰদান করিয়া থাকেন; অতএব তাঁহাকেই পিতামাতাস্বরূপ বিবেচনা করিবে এবং তৎকৃত উপকার স্মরণ করিয়া কদাচ তাঁহার অপকারে প্রবৃত্ত হইবে না। শিষ্য প্রতিনিয়ত গুরুকে অভিবাদন এবং শুচি ও অপ্ৰমত্ত হইয়া অধ্যয়ন করিবে। মান ও রোষ বিসর্জ্জন করা তাঁহার অবশ্য কর্ত্তব্য। ইহা ব্ৰহ্মচর্য্যের প্রথম পাদ। প্ৰাণ, ধন, কর্ম্ম, মন ও বাক্যদ্বারা আচাৰ্য্যের শুভানুধ্যাননিরত হইবে। এবং গুরুপত্নী ও গুরুপুত্রের প্রতি গুরুর ন্যায় ব্যবহার করিবে। ইহা ব্ৰহ্মচর্য্যের দ্বিতীয় পাদ। আচাৰ্য্যের অনুগ্রহে দুঃখনিবৃত্তি, আনন্দবৃদ্ধি ও উন্নত অবস্থাপ্ৰাপ্তি হইয়াছে, এই কয়েকটি উপকার স্মরণ করিয়া তাঁহার প্রতি প্রতিনিয়ত সন্তুষ্ট থাকিবে। ইহা ব্ৰহ্মচর্য্যের তৃতীয় পাদ। গুরুদক্ষিণা প্ৰদান না। করিয়া কদাচ আশ্রমান্তর প্রবেশ করিবে না ও ‘আমি গুরুকে অর্থ প্রদান করিতেছি, ইহাও কখন মনে করিবে না বা বলিবে না। ইহা ব্ৰহ্মচর্য্যের চতুর্থ পাদ। শিষ্য বুদ্ধিপরিপাকদ্বারা এক পদে, গুরুলাভে দ্বিতীয় পাদ, বৃদ্ধিবৈভবদ্বারা তৃতীয় পাদ ও সহাধ্যায়ীদিগের সহিত বিচারদ্বারা চতুর্থ পাদ—এই চারিপাদ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। ধর্ম্মাদি দ্বাদশটি ব্ৰহ্মচর্য্যের স্বরূপ ও আসনপ্রাণায়ামাদি ধর্ম্মাঙ্গসকল তাহার বল; এই ব্ৰহ্মচৰ্য্য আচাৰ্য্যের সাহায্য বেদার্থপ্রতিপত্তিদ্বারা ফলিত হইয়া থাকে। এইরূপ গুরুপ্রয়োজনে প্রবৃত্ত শিষ্য যে কিছু অর্থ উপার্জ্জন করিতে সমর্থ হইবে, তাহা আচাৰ্য্যকে দান করিবে; গুরু এই বৃত্তি বহুগুণসম্পন্ন বলিয়া স্বীকার করেন এবং একপ্রকার বৃত্তি গুরুপুত্রের প্রতিও অভিহিত হইয়া থাকে। ব্ৰহ্মচর্য্যের প্রভাব

ব্রহ্মচর্য্যের প্রভাব

“যিনি এইরূপ ব্ৰহ্মচর্য্যের অনুষ্ঠান করেন, তিনি সর্ব্বপ্রকারে পরিবর্দ্ধিত হইয়া বহু পুত্র ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়া থাকেন; নানাদিগদেশস্থ ব্যক্তি তাঁহাকে অর্থদান করে ও অনেকে তাঁহার দৃষ্টান্তানুসারে ব্রহ্মচৰ্য্য অবলম্বন করিয়া থাকে। ব্ৰহ্মচৰ্য্যপ্রভাবে দেবগণ দেবত্ব ও মনীষী মহর্ষিগণ ব্ৰহ্মলোক লাভ করিয়াছেন। অপ্সরা ও গন্ধর্ব্বগণ ব্ৰহ্মচৰ্য্যপ্রভাবে সৌন্দৰ্য্যপ্রাপ্ত হইয়াছেন এবং সূৰ্য্যদেব ব্ৰহ্মচৰ্য্যপ্রভাবেই প্রতিনিয়ত উদিত হইতেছেন। যেমন লোকে চিন্তিতবস্তুপ্ৰদ চিন্তামণি লাভ করিয়া অভিলষিত অর্থ প্রদান করিতে পারে, তদ্রূপ দেবাদি ব্ৰহ্মচৰ্য্য লাভ করিয়া অভিলষিত বস্তু প্ৰদান করিতে সমর্থ হইয়াছেন। যিনি তপানুষ্ঠানপরায়ণ হইয়া ব্রহ্মচর্য্য আশ্রয় করিয়াছেন, তাঁহার শরীর পবিত্র। তিনি রাগদ্বেষ পরিত্যাগ করিতে সমর্থ এবং অন্তকালে মৃত্যু জয় করিয়া থাকেন। তিনি দেহপরিত্যাগ করিয়া কর্ম্মপ্রভাবে অভিলষিত লোক সমুদয় জয় করেন; কিন্তু বিদ্বান ব্যক্তি জ্ঞানপ্রভাবে ব্ৰহ্মলাভ করিয়া থাকেন। হে মহারাজ! জ্ঞান ব্যতিরেকে মুক্তিলাভের আর উপায় নাই।”

হৃদয়স্থ ব্রহ্মের স্বরূপ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “ভগবন! বিদ্বান ব্যক্তি হৃদয়মধ্যে ব্ৰহ্মকে শুক্লবৰ্ণ কি কৃষ্ণবর্ণ, কি লোহিতবর্ণ কি পিঙ্গলবৰ্ণ অথবা আয়সবর্ণ [লৌহকান্তি-লোহর ন্যায় বর্ণ] সন্দর্শন করেন? আপনি এক্ষণে সেই অবিনাশী সর্ব্বব্যাপীর রূপ কি প্রকার তাহা কীর্ত্তন করুন।” সনৎসুজাত কহিলেন, “মহারাজ! ব্রহ্মের রূপ শুক্ল, লোহিত, আয়স এবং সূৰ্য্যের ন্যায় শোভা পাইতে থাকে। সেই রূপ ভূলোকে নাই, দ্যুলোকে নাই, সাগরে নাই, সলিলে নাই, তারকাসমূহে নাই, সৌদামিনীমালায় নাই, জলদজালে নাই, বায়ুতে নাই, দেবনিবহে নাই, নিশাকরে নাই এবং সূৰ্য্যমণ্ডলেও নাই। ঋক্, যজুঃ, অথর্ব্ব, সাম, রথন্তর [সামের অংশ], বাহদ্রথ [সামের অংশ] এবং মহাযজ্ঞেও তাহা নয়নগোচর হয় না। সেই ব্ৰহ্ম অনতিক্রমণীয় [দুর্বোধ্য] ও অজ্ঞানরূপ অন্ধকারের অতীত, প্ৰলয়কালে অস্তকও তাঁহাতে বিলীন হইয়া থাকে; তিনি ক্ষুরধারের ন্যায় নিতান্ত দুর্লক্ষ এবং পর্ব্বত অপেক্ষাও বৃহত্তর; তিনি প্রতিষ্ঠা, তিনি মুক্তি, তিনি সমুদয় লোক, তিনি যশঃ ও তিনিই ব্ৰহ্ম। তাঁহা হইতে প্রাণীগণ উৎপন্ন হইয়াছে এবং তাঁহাতেই লীন হইতেছে। তিনি অনাময়, মহৎ ও উদিত যশঃস্বরূপ। কবিগণ তাঁহাকে বিকারস্বরূপ বলিয়া কীর্ত্তন করেন; কিন্তু তিনি বিকৃত নহেন; তাঁহাতে এই সমস্ত জগৎ প্রতিষ্ঠিত আছে। যেসকল মাহাত্মারা তাঁহাকে বিদিত হয়েন, তাঁহারা মুক্তিলাভ করেন।”