০৪১. মৃত্যুর অলীকতা কীর্ত্তন

৪১তম অধ্যায়

মৃত্যুর অলীকতা কীর্ত্তন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর রাজা ধৃতরাষ্ট্র বিদুরবাক্যে সমাদর-প্রদর্শন করিয়া পরম জ্ঞানপ্রাপ্তির নিমিত্ত নির্জ্জনে মহর্ষি সনৎসুজাতকে কহিলেন, “ভগবন! আপনি কহিয়া থাকেন, মৃত্যু নাই, কিন্তু দেব ও অসুরগণ মৃত্যুভয়ে সতত ব্ৰহ্মচৰ্য্য অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন, অতএব ইহার মধ্যে কোন পক্ষ সত্য, আপনি তাহা সবিশেষ নির্দ্দেশ করিয়া আমার সংশয় অপনোদন করুন।

সনৎসুজাত কহিলেন, “মহারাজ! মৃত্যু নাই ও মৃত্যু আছে, এই উভয় পক্ষের পরস্পর বিরোধাশঙ্কা করিবেন না। একমাত্র পুরুষেরই অবস্থাভেদে উভয় পক্ষ সত্য হইয়া থাকে। আমার মতে প্রমাদ মৃত্যু ও অপ্ৰমাদ অমৃত্যু। অতএব বিদ্বান ব্যক্তিরা কহিয়া থাকেন, মোহবশতঃ মৃত্যু হয়। আর মোহহীন হইলেই অমর হয়। অসুরগণ প্রমদাবশতঃ মৃত্যুলাভ ও অপ্রমাদ্যবশতঃ অমৃতলাভ করে। মৃত্যু ব্যাঘ্রের ন্যায় জন্তুগণকে ভক্ষণ করে না এবং মৃত্যুর স্বরূপ নিরূপণ করা নিতান্ত সুকঠিন। কেহ কেহ অন্তককে মৃত্যু ও আত্মনিহিত তত্ত্বজ্ঞানকেই অমৃত কহিয়া থাকেন। সেই অন্তক পিতৃলোকে রাজ্যশাসন করিতেছেন, তিনি মঙ্গলের মঙ্গল ও অমঙ্গলের অমঙ্গল। তাহার আদেশানুসারে ক্ৰোধ, প্ৰমাদ ও লোভস্বরূপ মৃত্যু সমুদ্ভূত হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি অহঙ্কারপরতন্ত্র হইয়া কুপথে পদার্পণ করে, সে আত্মস্বরূপ প্রাপ্ত হয় না, সে ক্ৰোধাদিরূপ মৃত্যুর বশীভূত ও ইহলোক হইতে অন্তরিত হইয়া বারংবার নরকে নিপতিত হয় এবং ইন্দ্ৰিয়গণও তাহার অনুসরণ করে। এই নিমিত্ত মৃত্যু মরণনামে নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। ভোগপ্রদ কর্মের ফলোদয় হইলে তদনুরাগসম্পন্ন মনুষ্যেরা স্বর্গে গমন করিয়া থাকে, সুতরাং দেহনাশ হইতে উত্তীর্ণ হয় না। ব্ৰহ্মপ্রাপ্তির উপায়ভূত যোগের অনবগম [অপ্রাপ্তিহেতু] প্রযুক্ত দেহী বিষয়বাসনার বশীভূত হয়, সেই পুরুষের স্বাভাবিক অনিত্য বিষয়ে অনুরাগ ও প্রবৃত্তি ইন্দ্ৰিয়গণকে মহামোহে বিমোহিত করে এবং সেই পুরুষ অলীক বিষয়সংসর্গে প্রতারিত হইয়া বিষয়ম্মরণই বিষয়ের সেবা বলিয়া বোধ করে। অজিতচিত্ত ব্যক্তিরা প্রথমতঃ বিষয়-চিন্তা, পরে বিষয়প্রাপ্তির অভিলাষ এবং তৎপরে কোন কারণজনিত ক্ৰোধে আক্রান্ত হইয়া ক্রমে ক্রমে মৃত্যুমুখে নিপতিত হয়, কিন্তু পকৃত ধীর ব্যক্তিরা ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক মৃত্যুহস্ত হইতে বিমুক্ত হইয়া থাকেন। যিনি আত্মচিন্তানিরত ও বিষয়বাসনায় সতত অনাদর প্রদর্শন করেন, তিনি কামসকল বিনষ্ট করিতে পারেন এবং মৃত্যু তাঁহাকে গ্ৰাস করিতে সমর্থ হয় না।

“বিষয়ানুরাগী মনুষ্য বিষয়নাশের পর বিনষ্ট হইয়া থাকে, কিন্তু বিষয়োপভোগ পরিত্যাগ করিলে দুঃখসমুদয় বিনষ্ট হয়। বিবেকালোকশূন্য বিষয়ানুরাগ মনুষ্যদিগের তমঃস্বরূপ ও নরকের ন্যায় দুঃখপ্রদ। যেমন সুরাপানবিমোহিত ব্যক্তিগণ গর্ত্তমধ্যে নিপতিত হয়, তদ্রূপ বিষয়ানুরাগীরা সুখপ্রদ বিষয়ে নিমগ্ন হইয়া থাকে। যাঁহার চিত্তবৃত্তি বিষয়ানুরাগে অভিভূত হয় নাই, তাঁহার পক্ষে মৃত্যু তৃণময় ব্যাঘের ন্যায় নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। অতএব বিষয়ানুরাগ বিনষ্ট করিবার নিমিত্ত অন্য কোন কাম্য বিষয় কদাচ স্মরণ করিবে না। তোমার শরীরমধ্যে যে অন্তরাত্মা আছেন, তিনিই ক্ৰোধ, লোভ ও মৃত্যুস্বরূপ। জ্ঞানবান ব্যক্তি মৃত্যুকে জন্মশীল জানিয়া কদাচ ভয় করে না। দেহ যেমন যমের হস্তগত হইয়া বিনষ্ট হয়, মৃত্যুও জ্ঞানগোচর হইয়া তদ্রূপ বিনাশপ্রাপ্ত হইয়া থাকে।”

জীবাত্মা-পরমাত্মার ঐক্যকথন

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সনৎসুজাত! বেদে একমাত্ৰ যজ্ঞদ্বারা পুণ্যতম সনাতন সত্যলোকসকল প্রাপ্ত হওয়া যায় এবং তাহাদিগেরই মোক্ষপ্রাপকতা প্ৰতিপন্ন হইতেছে, অতএব মনুষ্য ইহা সবিশেষ জ্ঞাত হইয়া কি নিমিত্ত কর্মের অনুষ্ঠান না করিবে?” সনৎসুজাত কহিলেন, “মহারাজ! আপনার মতে অবিদ্বান ব্যক্তিরা উক্তপ্রকারে মোক্ষপদ প্রাপ্ত হইয়া থাকে, আর বেদ বহুতর উদ্দেশ্যসংসাধনের উপদেশ প্ৰদান করিতেছে। কিন্তু জীবাত্মা নিষ্কাম হইলেই পরমাত্মার অভিমুখীন হয় এবং প্রকৃত পথ প্রাপ্ত হইয়া অন্যান্য পথ পরিত্যাগপূর্ব্বক মুক্তিলাভ করে।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে ভগবান! যিনি এই সচরাচর বিশ্ব ক্রমে সৃষ্টি করিতেছেন, সেই জন্মমৃত্যুবিহীন পুরাণ আত্মাকে কে নিয়োগ করিয়া থাকে? তিনি কিরূপে কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান ও কি প্রকার সুখভোগ করেন? আপনি ইহা সবিশেষ কীর্ত্তন করুন।” সনৎসুজাত কহিলেন, “মহারাজ! যদি জীবাত্মা ও পরমাত্মা পরস্পর ভিন্ন হয়েন, তাহা হইলে অভেদে একতা সম্পাদন করা অসম্ভব; তাহাতে মহদোষের উৎপত্তি হইয়া থাকে। পরমাত্মা জলচন্দ্রের [জলে প্ৰতিবিম্বিত চন্দ্ৰ-আকাশে একটি ও জলে একটি, এই দ্বিচন্দ্ৰভ্ৰম] ন্যায় কেবল অজ্ঞান-প্রভাবে স্থূল ও সূক্ষ্ম শরীরদ্বয় সংযোগে জীব বলিয়া খ্যাত হয়েন, ঔপাধিক ভেদদ্বারা তাঁহার মহত্ত্বের কিছুমাত্ৰ হানি হয় না। সেই অবিকারী ভগবান পরমাত্মা মায়াযোগে এই বিশ্ব সৃষ্টি করিতেছেন, এই স্বপ্লবৎ বিশ্ব যে যথার্থ বলিয়া প্রতীয়মান হইয়া তঅকে, ইহা কেবল সেই পরমাত্মারই শক্তি, বেদবাক্যেও ইহা সপ্রমাণ হইতেছে।”

পাপ-পুণ্যের ভোগ্যতা নিৰ্দ্ধারণ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “ভগবান! এই পৃথিবীতে কেহ বা ধর্ম্মানুষ্ঠান পরাঙ্মুখ, কেহ বা ধর্ম্মাচরণপরায়ণ; অতএব এক্ষণে জিজ্ঞাসা করি, পাপদ্বারা ধর্ম্ম বিনষ্ট হয় কি ধর্ম্মদ্বারা পাপ বিনষ্ট হয়?” সনৎসুজাত কহিলেন, “মহারাজ! পাপ ও পুণ্য উভয়েরই ফলভোগ করিতে হয়। সন্ন্যাস ও উপাসনাপূর্ব্বক কর্ম্মানুষ্ঠান উভয়ই মোক্ষপ্রাপ্তির অবিচলিত কারণ, কিন্তু সন্ন্যাসসহকৃত জ্ঞানদ্বারা ব্ৰহ্মত্ব ও উপাসনাপূর্ব্বক কৰ্মদ্বারা দেবত্বলাভ হইয়া থাকে। দেবত্বলাভ হইলে যেমন তাহা হইতে ব্ৰহ্মত্বলাভ হইতে পারে, সেইরূপ পুনরায় নরলোকে আবর্ত্তিত হইবারও সম্ভাবনা আছে; অতএব সন্ন্যাস-সহকৃত জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ। এইরূপ ধর্ম্ম ও অধর্ম্ম উভয়েরই ফলভোগ করিতে হয়; কিন্তু উভয় ফলই অনিত্য; তন্নিমিত্ত ধর্ম্ম ও অধৰ্মজনিত ফলভোগের অবসানে পুনরায় কর্ম্মক্ষেত্রে জন্ম হইয়া থাকে, তন্মধ্যে যিনি ধর্মের অনুষ্ঠান করেন, তিনি পাপকে দূরীভূত করিতে পারেন এবং তদ্বারা কালক্রমে মোক্ষলাভ হইবারও সম্ভাবনা আছে, অতএব ধর্ম্মই শ্রেষ্ঠ।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “ভগবন! পুণাত্মা ব্রাহ্মণগণ স্বধৰ্মবলে যে সমস্ত সনাতন লোক লাভ করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগের তারতম্য ও অন্যান্য বিষয়সকল কীর্ত্তন করুন। আমি স্বধর্ম্মানুযায়ী কর্ম্ম ভিন্ন অন্য কোন কর্ম্ম শ্রবণ করিতে অভিলাষ করি না।” সনৎসুজাত কহিলেন, “মহারাজ! যেমন বীরপুরুষ স্বীয় বল ও বীৰ্য্যের স্পৰ্দ্ধা করিয়া থাকে, তদ্রূপ যাঁহারা ব্রতসাধনবিষয়ে স্পৰ্দ্ধা করেন, সেই ব্ৰাহ্মণগণ কলেবর পরিত্যাগ করিয়া ব্ৰহ্মালোকে গমন করিয়া থাকেন। যাঁহাদিগের যজ্ঞাদি অনুষ্ঠানে একান্ত আগ্রহ আছে, তাঁহাদিগের যজ্ঞাদিই জ্ঞানের সাধন, তাঁহারা সংসারপাশ হইতে বিমুক্ত হইয়া স্বর্গে গমন করেন। বৈদিক অভিমানিগণ ধর্মের অনুষ্ঠানকেই শ্রেষ্ঠ বলিয়া জ্ঞাত আছেন, এই নিমিত্ত সেই নিষ্কাম ও সকাম কর্মের অনুষ্ঠাতারা কিঞ্চিৎ সম্মানভাজন হয়েন।

সন্ন্যাসীর আচারব্যবহার

“যে গৃহ তৃণাদিপরিপূর্ণ বর্ষাকালীন ক্ষেত্রের ন্যায় অন্নপানে পরিপূর্ণ, সন্ন্যাসীব্রাহ্মণ তথায় বাস করিবেন, কিন্তু ক্ষীণবৃত্তি গৃহস্থকে কদাচ উৎপীড়িত করিবেন না। যে স্থানে আপনার মাহাত্ম্য প্রকাশ না করিলে অমঙ্গলজনক ভয় প্রাপ্ত হওয়া যায়, সে স্থানেও যে ব্যক্তি স্বীয় উৎকর্ষ প্ৰকাশ না করেন, তিনিই সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। যিনি অন্যের উৎকর্ষ দর্শন করিয়া ঈর্ষাপরবশ না হয়েন এবং ব্রহ্মস্ব-গ্রহণে নিতান্ত পরাঙ্মুখ, সাধুলোকে তাঁহার অন্ন ভক্ষণ করিয়া থাকেন। কুকুরগণের স্বীয় উদগীরিত দ্রব্য ভক্ষণ করা ও সন্ন্যাসীদিগের পাণ্ডিত্য প্রকটনপূর্ব্বক জীবিকা নির্ব্বাহ করা উভয়ই তুল্য। যে ব্রাহ্মণ জ্ঞাতিগণমধ্যে বাস করিয়াও মনে করেন যে, জ্ঞাতিবর্গ আমার আচার-ব্যবহারাদি কিছুই অবগত না হউন, তিনিই ব্রাহ্মণ। পূর্বোক্ত আচার না করিয়া কোন ব্রাহ্মণ উপাধিশুন্য, বুদ্ধির অগম্য, সর্ব্বব্যাপী, নির্লেপ ও অদ্বিতীয় আত্মাকে বিদিত হইতে পারেন? কিন্তু তিনি পূর্বোক্ত আচারপরায়ণ ক্ষত্ৰিয়ের হৃদয়েও আবির্ভূত হয়েন। তখন সেই ক্ষত্ৰিয়ও তাঁহাকে প্রত্যক্ষ করিতে পারে।

“যে ব্যক্তি স্বয়ং একরূপ হইয়া অন্যরূপ প্রকাশ করিয়া থাকে, সেই আত্মাপহারী চৌরকর্ত্তৃক কোন পাপ অনুষ্ঠিত না হয়? ব্ৰহ্মপরায়ণ ব্রাহ্মণ অশ্রান্ত, প্রতিগ্রহশূন্য, সাধুসম্মত ও নিরুপদ্রব্য হইবেন এবং শিষ্ট হইয়াও কদাচ শিষ্টাচার [সামাজিক ব্যবহারে নির্লিপ্ত থাকিবেন] প্রদর্শন করিবেন না। যাহারা সামান্য মনুষ্যলব্ধ অর্থে দরিদ্র, কিন্তু পারলৌকিক ধর্ম্মাদি ও যজ্ঞপ্রিভৃতি ক্রিয়াকলাপের অধীশ্বর, একান্ত দুৰ্দ্ধৰ্ষ ও অচলচিত্ত, তাঁহাদিগকেই প্রকৃত ব্ৰাহ্মণ বলিয়া জ্ঞাত হইবেন। যে দেবগণ যজ্ঞে প্রীত হইয়া যজমানের নিমিত্ত দিব্যস্ত্রী, অন্ন ও পান প্রস্তুত করেন, সেই দেবগণকে যিনি জ্ঞাত হয়েন, তিনি ব্রাহ্মণের সদৃশ নহেন, যেহেতু তিনি সেই দিব্যস্ত্রী, অন্ন ও পানের অভিলাষ করিয়া থাকেন। দেবগণ যে সন্ন্যাসী ব্যক্তিকে সম্মান করেন, তিনিই সম্মানিত; এতএব স্বয়ং আত্মাকে কদাচ সম্মাননা বা অবমাননা করিবে না। লোকসকল স্বভাবতঃ মনে করিয়া থাকে যে, আমাকে সকলেই সম্মান করে; কিন্তু উহা নিতান্ত অনুচিত। ফলতঃ বিদ্বানেরা যাঁহাকে সম্মান করেন, তিনিই প্রকৃত মানী। মায়াবিশারদ অধৰ্মপরায়ণ মূর্খেরা মান্য ব্যক্তিদিগের সম্মান করে না, প্রত্যুত অবমাননা করিয়া থাকে। পণ্ডিতেরা কহিয়া থাকেন, মান ও মৌন কদাচ একত্র বাস করে না। কিন্তু ইহলোক সম্মানলাভের নিমিত্ত এবং পরলোক মৌনের নিমিত্ত নির্দ্দিষ্ট আছে। হে মহারাজ! ইহলোকে সম্পদই মান ও সুখের স্থান, কিন্তু উহা পরলোকবিনাশক ও সাতিশয় অনিষ্টকর। প্রজ্ঞাহীন ব্যক্তিরা কদাচি ব্রাহ্মণের শ্ৰীলাভ করিতে সমর্থ হয় না। সাধুলোকেরা নিরূপণ করিয়াছেন, সত্য, আৰ্জব, হী, দম, শৌচ ও বিদ্যা ব্ৰহ্মানন্দের দ্বারা; মোহ কদাচ তাহা রোধ করিতে পারে না।”