০৩৭. গাৰ্হস্থ্য-নীতি

৩৭তম অধ্যায়

গাৰ্হস্থ্য-নীতি

বিদুর কহিলেন, “মহারাজ! স্থবির ব্যক্তি যুবকের নিকট গমন করিলে যুবকের প্রাণ ঊৰ্দ্ধে উৎপতিত [বৃদ্ধ ব্যক্তি গৃহে আসিলে তাঁহার সমুচিত সৎকারের জন্য যে প্রাণের ব্যাকুলতা, তাহাই প্রাণের ঊৰ্দ্ধে উৎপতন] হয়; পরে যুবা ব্যক্তি স্থবিরকে প্রত্যুত্থান ও অভিবাদন করিলে পুনর্ব্বার তাহা প্রাপ্ত হয়। সাধুগণ পীঠদান ও পানীয় আনয়ন করিয়া অভ্যাগত ব্যক্তির পাদপ্রক্ষালন করিয়া কুশলপ্রশ্নপূর্ব্বক আত্মসংস্থান [নিজের অবস্থা–শুভাশুভ ইত্যাদি], নিবেদন, পরে অবহিত হইয়া অন্নদান করিবে। মন্ত্রবিৎ ব্যক্তি লোভ, ভয় ও কার্পণ্য দেখিয়া যাহার গৃহে জল, মধুপর্ক বা গো গ্ৰহণ না করেন, আৰ্য্যগণ তাহার জীবন নিরর্থক বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। চিকিৎসক, শরকর্ত্তী, নষ্টব্রহ্মচৰ্য্য, চৌর, মদ্যপায়ী, ভ্রূণহত্যা [গৰ্ভস্থ সন্তানের নাশকারী], সেনাজীবী [যুদ্ধকাৰ্য্যে জীবিকাকারী] ও শ্রুতিবিক্রেতা [বেদবিক্রয়কারী] ব্ৰাহ্মণ উদকার্হ [যাহার জল আচরণীয় নহে] না হইলে যদি অতিথিরূপে আগত হয়, তবে তাহাকে অর্চ্চনা করিবে। লবণ, পক্ক, অন্ন, দধি, ক্ষীর, মধু, তৈল, ঘৃত, তিল, মাংস, ফল, মূল, শাক, রক্তবস্ত্ৰ, গন্ধদ্রব্যসকল ও গুড় বিক্রয় করিবে না। যাহার ক্ৰোধ নাই, লোষ্ট্র, প্রস্তর ও কাঞ্চনে সমজ্ঞান, শোক নাই, সন্ধি ও বিগ্ৰহ নাই, যিনি নিন্দা ও প্রশংসায় উপেক্ষা প্রদর্শন করেন, যিনি উদাসীনের ন্যায় প্রিয় ও অপ্রিয় বিষয় পরিত্যাগ করেন, তিনিই ভিক্ষুক। নীবার [তৃণধান্য-ধান ঝাড়া হইয়া গেলে যে তৃণের গায়ে দুই একটা ধান থাকে; অথবা বপনাদি যত্ন ব্যতিরেকে যে ধানের গাছ হয়], মূল, ইঙ্গুদী-ফল ও শাক যাঁহার জীবিকা, যিনি সংযতাত্মা, অগ্নিকাৰ্য্যে অবহিত, বনবাসা, সতত অতিথিসৎকারে অনুরক্ত, ধুরন্ধর ও পুণ্যকর্ম্ম, তিনিই তাপস। বুদ্ধিমানের অপকার করিয়া দূরস্থ হইয়াও বিশ্বস্ত [নিশ্চিন্ত] থাকিবে না, বুদ্ধিমানের বাহুদ্বয় অতি দীর্ঘ [বুদ্ধিমান ব্যক্তির জ্ঞানই বাহুস্বরূপ-তদ্বারা দূরস্থ বস্তু আয়ত্ত করিতে পারে] তিনি হিংসিত হইলে তদ্বারা হিংসা করিয়া থাকেন। অবিশ্বস্ত ব্যক্তিকে কদাচ বিশ্বাস করিবে: না; বিশ্বস্ত ব্যক্তিকেও অতি বিশ্বাস করা কর্ত্তব্য নহে, বিশ্বাস হইতে ভয় উৎপন্ন হইলে সে ভয় মূল পৰ্য্যন্ত উচ্ছিন্ন করে। ঈর্ষাশুন্য, স্ত্রীরক্ষক, সংবিভক্তা [নিরপেক্ষ বিভাগকর্ত্তা-বিভাগ বিষয়ে পক্ষপাতশূন্য], প্রিয়বাদী, স্নেহবান, মধুরভাষী ব্যক্তি স্ত্রীলোকের বশীভুত হইবে না। পূজনীয় সচ্চরিত্র ভাগ্যবতী। রমণীসকল গৃহের শ্ৰী ও দীপ্তিস্বরূপ, অতএব তাহাদিগকে সাতিশয় যত্নসহকারে রক্ষা করিবে। পিতার হস্তে অন্তঃপুর, মাতার হস্তে মহানস [পাকশালা] ও আত্মসম ব্যক্তির হস্তে গোসমূহের রক্ষণাবেক্ষণের ভার অর্পণ এবং স্বয়ং কৃষিকাৰ্য্যের তত্ত্বাবধারণ করিবে। বণিকদিগকে ভৃত্যদ্বারা ও দ্বিজগণকে পুত্রদ্বারা সেবা করিবে। জল হইতে অগ্নি, ব্রাহ্মণ হইতে ক্ষত্র ও প্রস্তর হইতে লৌহ উৎপন্ন হইয়া থাকে এবং তাহাদিগের সর্ব্বত্রগামী তেজ স্ব স্ব উৎপত্তিস্থানেই শান্তভাব প্রাপ্ত হয়। সাতিশয় তেজস্বী কুলীন সৎপুরুষেরা কাষ্ঠাভ্যন্তরবিলীন নিরাকার অগ্নির ন্যায় ক্ষমা অবলম্বন করিয়া অবস্থান করেন।

রাজনীতি

“হে মহারাজ! কি বহিঃশত্রু কি অন্তঃশত্রু কেহই যাহার মন্ত্রণা অবগত হইতে না পারে, সেই চতুরস্র [চারিদিকে সমানদৃষ্টি] রাজাই দীর্ঘকাল ঐশ্বৰ্য্যভোগ করেন। ধর্ম্মকাৰ্য্য, কামকাৰ্য্য ও অর্থকাৰ্য্য অগ্ৰে প্ৰকাশ না করিয়া অনুষ্ঠিত হইলে পর প্রকাশ করিবে। মন্ত্রণা কদাচ প্রকাশ করিবে না। গিরিপৃষ্ঠ, প্রাসাদ, তৃণাদিশূন্য অরণ্যপ্রভৃতি নির্জ্জন স্থানে মন্ত্রণা করা বিধেয়। সুহৃৎ না হইলে রহস্য [মুপ্ত মন্ত্রণা]-মন্ত্রণা জানিবার যোগ্য হইতে পারেন না। সুহৃৎ বা পণ্ডিত হইলেই যে সচিবপদের যোগ্য হইলে, এমন নয়, সুহৃৎ মূর্খ হইতে পারেন, এবং পণ্ডিতও চপলবাক হইতে পারেন, অতএব পরীক্ষা না করিয়া কাহাকেও আপন সচিবপদ প্রদান করিবে না। আমাত্যের অর্থলিপ্সা ও মন্ত্রণারক্ষণ [যন্ত্রণাকার্পণ্য-হাতে রাখিয়া যন্ত্রণা দেওয়া] উভয়ই থাকিবার সম্ভাবনা।

“যে রাজার অনুষ্ঠিত কাৰ্য্যজাত কেবল পরিষদেরাই অবগত হইতে পারেন, সেই রাজাই ধর্ম্মার্থক্যামবিষয়ে প্রধান। সেই গূঢ়মতি নৃপতি অবশ্যই সিদ্ধিলাভ করেন, যে মোহবশতঃ অপ্রশস্ত কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করে, সে ব্যক্তি সেই কাৰ্য্য ভ্রংশনিবন্ধন বিনাশপ্ৰাপ্ত হয়। প্রশস্ত কর্মের অনুষ্ঠান সুখের নিদান ও তাহার অননুষ্ঠান অনুতাপের কারণ। যেমন ব্রাহ্মণ বেদপাঠ না করিলে শ্রাদ্ধের অধিকারী হয় না, সেইরূপ যে ব্যক্তি সন্ধি, বিগ্রহ, যান, আসন, দ্বৈধীভাব ও সমাশ্রয়ণ-রূপ ষাড়গুণ্য [ছয়গুণ সম্বন্ধে] বিষয়ে অনভিজ্ঞ, সে মন্ত্রণাশ্রবণের যোগ্য হইতে পারে না। যিনি স্থান, বৃদ্ধি, ক্ষয় ও ষাড়গুণ্যবিষয়ে অভিজ্ঞ, যাহার চরিত্র জনসমাজে সমাদৃত, যাহার ক্রোধ ও হর্ষ অব্যর্থ, যিনি স্বয়ং কাৰ্য্যজাত পৰ্য্যবেক্ষণ ও কোষ সকলের তত্ত্বাবধারণ করেন, পৃথিবী তাহার নিকট স্বাধীন হয়। মহীপতি ছত্র [রাজচ্ছত্র-রাজ্যাধিকার] ও নাম লাভ করিয়াই পরিতুষ্ট হইবেন, ভৃত্যগণকে অর্থদান করিবেন ও একাকী সর্ব্বগ্রাহী হইবেন না। ব্ৰাহ্মণ ব্ৰাহ্মণকে, ভর্ত্তা স্ত্রীকে এবং নৃপতি অমাত্য ও অমাত্য নৃপতিকে অবগত আছেন। বধ্য শত্রু বশীভুত হইলেও পরিত্যাগ করিবে না; স্বয়ং হীনবল হইলেও শত্রুর উপাসনা করিবে: বলবান হইলে তাহাকে বধ করিবে। বধ্য ব্যক্তিকে বধ না করিলে অচিরাৎ তাহা হইতে ভয় উৎপন্ন হয়। বৃদ্ধ, বালক ও আতুরের প্রতি ক্ৰোধ হইলে তাহা সংবরণ করিবে। যে প্ৰজ্ঞ ব্যক্তি অনর্থক কলহ পরিত্যাগ করেন, তিনি লোকে কীর্ত্তিলাভ করেন ও তাঁহার অনৰ্থপাত হয় না। যাহার প্রসাদ নিস্ফল ও ক্ৰোধ নিরর্থক, এরূপ প্ৰভু কাহারও অভিলষণীয় হয়েন না; কোন স্ত্রী নপুংসকের পত্নী হইতে অভিলাষ করে? বুদ্ধি থাকিলেই যে ধনলাভ হয়, এমন নয়, আর জাড্য[জড়তা-অকৰ্মণ্যতা] দোষ থাকিলেই যে দরিদ্র হয়, এমন নয়। প্রাজ্ঞ ব্যক্তিই লোকদ্বয়ের ক্রমবৃত্তান্ত অবগত আছেন, ইতর ব্যক্তি তাহা অবগত নয় ।

“মূঢ় ব্যক্তি বিদ্যা, শীল, বয়স, বুদ্ধি, ধন বা আভিজাত্যে শ্রেষ্ঠ লোককে প্রতিনিয়ত অবজ্ঞা করিয়া থাকে। অসচ্চরিত্র, অপ্ৰজ্ঞ, অসূয়ক, অধার্মিক, দুষ্টবাক ও কোপনস্বভাব ব্যক্তি শীঘ্ৰ বিপদগ্ৰস্ত হয়। প্রতারণা-পরিত্যাগ, দান, মৰ্য্যাদার অনুবর্ত্তন ও সম্যক উচ্চারিত বাক্য প্রাণীগণকে বশীভূত করে। অপ্রতারক, কাৰ্য্যদক্ষ, কৃতজ্ঞ, বুদ্ধিমান ও সরল স্বভাব ব্যক্তি রিক্তকোষ [অর্ধশূন্য-নির্ধন] হইলেও মিত্ৰাদি পরিবারগণকে লাভ করিয়া থাকেন। ধৃতি, শম, দম, শৌচ, কারুণ্য, মৃদুবাক্য ও মিত্ৰগণের আদ্রোহ-এই সাতটি লক্ষ্মীরূপ অনলের ইন্ধনস্বরূপ। অসংবিভাগ্য, দুষ্টাত্মা, কৃতঘ্ন নির্লজ্জ ব্যক্তিকে পরিত্যাগ করিবে; যে ব্যক্তি স্বয়ং দোষী হইয়া নির্দোষ অন্তরঙ্গ লোককে প্রকোপিত করে, তাহাকে সসৰ্প গৃহশায়ী ব্যক্তির ন্যায় অতিকষ্টে যামিনীযাপন করিতে হয়। যেসকল ব্যক্তি স্বয়ং দোষী হইলে যোগক্ষমের [স্ব স্ব আশ্রমোচিত ক্রিয়া নির্ব্বাহের আনুকূল্য] ব্যাঘাত জন্মে, দেবতাদিগের ন্যায় তাহাদিগকে সতত প্ৰসন্ন করিবে। যে সমস্ত অর্থসম্পত্তি স্ত্রী, প্ৰমাদী, পতিত ও অনাৰ্য্য লোকের হস্তে নিহিত হয়, তাহা পুনরায় লাভ করা অনায়াসসাধ্য নহে। যেমন প্রস্তরময় ভেলা নদীতে নিমগ্ন হয়, তদ্রূপ স্ত্রী, ধূর্ত্ত বা বালক যে স্থানের শাসনকর্ত্তা, তত্ৰত্য লোকেও উৎসন্ন হইয়া যায়। যে ভূত্যেরা নিরন্তর প্রয়োজনে সংসাত্ত হয়, কিন্তু অতিরিক্ত কাৰ্য্যে হস্তার্পণ করে না, তাহারাই বিজ্ঞ। ধূর্ত্ত, চর, অধরা বারবনিতা যাহাকে প্রশংসা করে, তাহার জীবনরক্ষা হওয়া সুকঠিন। আপনি তাদৃশ মহাধনুৰ্দ্ধর অমিততেজঃ পাণ্ডবগণকে পরিত্যাগ করিয়া দুর্য্যোধনের হস্তে সমস্ত ঐশ্বর্য্য ন্যস্ত করিয়াছেন, কিন্তু যেমন বলি লোকত্ৰয় হইতে ভ্ৰষ্ট হইয়াছে, তদ্রূপ এই ঐশ্বৰ্য্যমদমুগ্ধ দুৰ্য্যোধনকে অবিলম্বে রাজ্যভ্রষ্ট অবলোকন করিবেন।”