০৩৫. সাধ্য-আত্ৰেয়সংবাদ

৩৫তম অধ্যায়

সাধ্য-আত্ৰেয়সংবাদ

বিদুর কহিলেন, “মহারাজ! এই স্থলে সাধ্যাত্ৰেয়সংবাদনামক এক প্রাচীন ইতিহাস কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। পূর্ব্বে একদা মহর্ষি আত্ৰেয় পরিব্রাজকরূপে ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতেছেন, এই অবসরে সাধ্যগণ তথায় সমুপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে তপোধন! আমরা সাধ্যগণ, আপনাকে নিরীক্ষণ করিয়া, কিছুই অনুমান করিতে পারিলাম না। কিন্তু বোধ হইতেছে, আপনি বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও ধীর; অতএব এক্ষণে সাতিশয় উদার ও রমণীয় কথাসকল কীর্ত্তন করুন।”

“পরিব্রাজক কহিলেন, “হে সাধ্যগণ! আমি উপদেশকালে গুরুমুখে শ্রবণ করিয়াছি যে, ধৈৰ্য্য, ইন্দ্ৰিয়জয় ও সত্যধর্ম্মানুবৃত্তি দ্বারা হৃদয়ের গ্রন্থি ছেদন করিয়া সুখ-দুঃখ সমান বোধ করিবে। কেহ শাপ প্ৰদান করিলে তাহার উপর কদাচ প্ৰতিশাপ প্ৰদান করিবেন না, বরং ক্ৰোধ সংবরণ করিবে; তাহা হইলে অভিশপ্তাকে দগ্ধ করিয়া তাহার সমস্ত সুকৃত অপহরণ করিয়া থাকে। অন্যের অবমাননা, মিত্রদ্রোহ ও নীচ লোকের উপাসনা কদাচ কর্ত্তব্য নহে। অভিমানপরতন্ত্র ও নীচবৃত্তিপরায়ণ হওয়া একান্ত অবিধেয়। অতি কঠোরবাক্য পুরুষের মর্ম্ম, অস্থি, হৃদয় ও প্রাণ পৰ্য্যন্ত দগ্ধ করিয়া থাকে; অতএব ধর্ম্মপরায়ণ ব্যক্তি কদাচ অতি কৰ্কশ ও মর্ম্মচ্ছেদী বাক্য ব্যবহার করিবেন না। যে মর্মোপঘাতী অতি পরুষ-বাক্যস্বরূপ কণ্টকদ্বারা অন্যের হৃদয় বিদ্ধ করে সেই লক্ষ্মীহীন মানবের মুখমণ্ডলে সকল লোকের অমঙ্গল বা মৃত্যু নিরন্তর বাস করিয়া থাকে। যদি কোন ব্যক্তি তাহাকে অনলসদৃশ সুতীক্ষ্ন বাক্যবাণে দৃঢ়তর বিদ্ধ করেন, তাহা হইলে বিজ্ঞ ব্যক্তির বিবেচনা করা উচিত যে, ইনি তাহার উপকার করিতেছেন। যেমন বস্তু নীলাদি বর্ণদ্বারা রঞ্জিত করিলে সেই সকল বর্ণের সাদৃশ্য প্রাপ্ত হইয়া থাকে, তদ্রুপ সাধু বা অসাধু, তপস্বী বা তস্করের সেবা করিলে তাহাদিগেরই সাদৃশ্য প্রাপ্ত হয়।

“কেহ কটূক্তি করিলে স্বয়ং বা অন্যদ্বারা তাহার প্রত্যুত্তর প্রদান করিবে না; আহত হইলে স্বয়ং বা অন্যদ্বারা আঘাত করিবে না। যিনি হন্তাকে সংহার করিবার অভিলাষ না করেন, তিনি দেবগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। প্রথমতঃ অসম্বন্ধ প্ৰলাপ অপেক্ষা মৌনাবলম্বন, দ্বিতীয়তঃ সত্যবাক্য, তৃতীয়তঃ প্রিয়বাক্য, চতুর্থতঃ ধর্ম্মানুগত বাক্য শ্রেয়স্কর বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হয়। পুরুষ যাদৃশ লোকের সহিত সহবাস ও যাদৃশ লোকের সেবা এবং যেরূপ স্বভাবসম্পন্ন হইতে অভিলাষ করে, সে সেইরূপ স্বভাবশালী হইয়া থাকে। মানব যেসকল বিষয় হইতে নিবৃত্ত হয়, সে তজ্জনিত দুঃখসকল – হইতেও বিমুক্ত হইয়া থাকে। এইরূপে সকল বস্তু হইতে নিবৃত্ত হইলে তাহাকে অণুমাত্রও দুঃখভোগ করিতে হয় না। অন্যকর্ত্তৃক বিজিত বা জিগীষাপরবশ হইবে না, কাহারও প্ৰতি বৈরাচরণ বা বৈরানিৰ্য্যাতন করিবে না; নিন্দা ও প্রশংসা উভয়ে সমভাব প্রদর্শন করিবে; তাহা হইলে শোক বা হর্ষ কিছুই থাকে না। যিনি সকলের মঙ্গল প্রার্থনা করেন, কদাচ যিনি অন্যের অশুভ আশংকা করেন। না, যিনি সত্যবাদী, মৃদু ও দানশীল, তিনিই উত্তম। যিনি অন্যকে বৃথা সান্ত্বনা করেন না এবং অঙ্গীকার করিয়া দান ও পররন্ধ্রের অনুসন্ধান করেন, তিনি মধ্যম। আর যে ব্যক্তি মঙ্গলময় পদার্থে শ্রদ্ধা ও গুরুজনদিগকে বিশ্বাস করে না এবং মিত্ৰগণকে নির্যাকরণ করিয়া থাকে, যাহাকে শাসন করা নিতান্ত কঠিন, যে ব্যক্তি আহত ও শস্ত্রে বিদীর্ণ হইলেও ক্রোধা বেগবশতঃ কখনই সরলভাবে ধারণ করে না, আর সকলের সহিত মৈত্রীভাব সংস্থাপন করিতে একান্ত পরাঙ্মুখ হইয়া থাকে ও যে ব্যক্তি কৃতঘ্ন, সেই অধম। মঙ্গলাভিলাষী ব্যক্তি উত্তম পুরুষের সেবা করিবেন, সময়ানুসারে মধ্যম পুরুষেরও সেবা করিতে পারেন, কিন্তু অধম পুরুষের সেবা সর্ব্বতোভাবে অনুচিত। পুরুষ স্বীয় বল, বীৰ্য্য, অভ্যুদয়, প্রজ্ঞা ও পুরুষকার সহকারে ঐশ্বৰ্য্যশালী হইতে পারে; কিন্তু মহৎকুলসম্ভূত ব্যক্তিদিগের চরিত্র ও কীর্ত্তি লাভ করিতে কদাচ সমর্থ হয় না।” ”

সদ্বংশের লক্ষণ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে বিদুর! ধর্ম্মার্থনিরত বহুশাস্ত্রজ্ঞ শীলাসম্পন্ন দেবগণ সতত মহাকুলের অভিলাষ করিয়া থাকেন, অতএব জিজ্ঞাসা করি, কিরূপ কুলকে মহাকুল বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে?” বিদুর কহিলেন, “মহারাজ! যে কুলে তপস্যা, ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ, বেদাধ্যয়ন, ধন, যজ্ঞানুষ্ঠান, পুণ্যবিবাহ ও সতত অন্নদান, এই সাতটি পরিদৃশ্যমান হইয়া থাকে, তাহাই মহাকুল। পিত্ৰাদি যাঁহাদিগের চরিত্রদর্শনে ব্যথিত না হয়েন, যাহারা এককালে মিথ্যা ব্যবহার পরিত্যাগ করিয়া প্ৰসন্নমনে ধর্ম্মানুষ্ঠান করিয়া থাকেন এবং স্বীয়বংশমধ্যে মহীয়সী। কীৰ্তিসংস্থাপনের অভিলাষ করেন, তাহারাই মহাকুলপ্রসূত। যত্নের অননুষ্ঠান, বিধিবিরুদ্ধ বিবাহ, বেদের উৎসাদ, সনাতন ধর্মের অতিক্রম, দেবীন্দ্রব্যের অপলাপ, ব্ৰহ্মস্বের অপহরণ ও ব্ৰাহ্মণাতিক্রমদ্বারা কুলসকল দুষ্কুলত্বপ্রাপ্ত হইয়া থাকে। যে সমস্ত কুল, বিদ্যা, অর্থ ও সৎপুরুষদ্বারা অলঙ্কৃত হইয়াও ধর্ম্ম হইতে পরিভ্রষ্ট হয়, সেইসমুদয় কুল কখনই কুলমধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না; আর যে সমস্ত কুল ধৰ্মদ্বারা বিভূষিত হইয়াছে, সেই সকল কুল অল্পধনসম্পন্ন হইলেও যশোলাভ করিয়া কুলমধ্যে পরিগণিত হইয়া থাকে। অতএব হে রাজন! পরমযত্নসহকারে ধনরক্ষা করাই বিধেয়। ধনের আগমন ও ক্ষয় নিরন্তরই হইয়া থাকে; অতএব ধর্ম্মপরায়ণ ব্যক্তি ক্ষীণধন হইলে তাঁহাকে ক্ষীণ বলা যায় না, কিন্তু যাহার ধর্ম্ম ক্ষীণ হইয়াছে, সেই যথার্থ ক্ষীণ। যে কুলে ধর্ম্ম নাই, তাহা বিদ্যা, পশু, অশ্ব, কৃষি ও সমৃদ্ধি দ্বারা কখনই সমুজ্জ্বল হইতে পারে না।

“আমাদিগের বংশে বৈরকারী, পরস্বাপহারী, রাজ্যমাত্য, মিত্রদ্রোহী, কপটাচারপরায়ণ, অনৃতবাদী এবং পিতৃলোক, দেবতা ও অতিথিদিগের পূর্ব্বভোজী [অতিথিগণের ভোজনের পূর্ব্বে আহারকারী] ব্যক্তি যেন জন্মপরিগ্রহ না করে। যে ব্যক্তি ব্রাহ্মণগণকে দ্বেষ বা বিনাশ করে এবং কৃষিকাৰ্য্য নির্ব্বাহ করে না, কদাচ তাহার সভায় গমন করিবে না। পুণ্যকর্ম্মকারী সাধুলোকের নিকেতনে তৃণ, ভূমি, উদক ও সুনৃতা বাক্য—এই চারিটি কদাচ উচ্ছিন্ন হয় না। তাঁহারা তৃণাদিসকল পরমশ্রদ্ধাসহকারে অন্যের সৎকারার্থ আনয়ন করিয়া থাকেন। যেমন স্যন্দনবৃক্ষ সূক্ষ্ম হইলেও ভার বহন করিতে পারে, কিন্তু অন্য মহীরুহসকল তদ্বিষয়ে কখনই সমর্থ হয় না, তদ্রূপ মহাকুলীনেরা একান্ত ভারসহ হইয়া থাকেন, কিন্তু সামান্যকুলপ্রসূত ব্যক্তিরা কদাচ তাঁহাদিগের অনুকরণ করিতে পারে না। যাঁহার ক্ৰোধে ভীত হইতে হয়, যাঁহাকে শঙ্কিতমনে সেবা করিতে হয়, তিনি কদাচ মিত্ৰ বলিয়া পরিগণিত হইতে পারেন না; ফলতঃ পিতার ন্যায় বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিই যথার্থ মিত্র, কিন্তু অন্যের সহিত মিত্ৰতা কেবল সম্বন্ধত্র মাত্র। যদি কোন ব্যক্তি অসম্বন্ধ [সম্পর্কহীন] হইয়াও মিত্রভাব অবলম্বন করেন, তাহা হইলেই তিনি প্রকৃত মিত্র, তিনিই একমাত্র গতি ও প্রধান আশ্রয়।

“চঞ্চলচিত্ত, স্থূলবুদ্ধি ও বৃদ্ধোপদেশপরাঙ্মুখ ব্যক্তির সহিত মিত্রভাব সংঘটন হয় না। যেমন হংসমণ্ডলী শুষ্ক সরোবর পরিহার করিয়া থাকে, তদ্রূপ অর্থসকল অব্যবস্থিতচিত্ত ইন্দ্ৰিয়বশবর্ত্তী ব্যক্তিকে পরিত্যাগ করে। অসাধু লোকের স্বভাব চপল জলদের ন্যায় অবস্থিত; তাহারা সহসা ক্রোধাপরবশ ও অকারণ প্ৰসন্ন হইয়া উঠে। যে ব্যক্তি মিত্ৰগণকর্ত্তৃক সৎকৃত ও কৃতকাৰ্য্য হইয়াও তাঁহাদিগের উপকার করে না, অন্যের কথা দূরে থাকুক, সেই কৃতঘ্ন কলেবর পরিত্যাগ করিলে ক্ৰব্যাদেরা [শবমাংসভোজী] তাহার মৃতদেহ স্পর্শ করে না। ধনী হউন, বা নিৰ্দ্ধনই হউন, মিত্ৰকে অর্চ্চনা করা নিতান্ত কর্ত্তব্য। প্রার্থনা না করিলে তাহাদিগের সারবত্তার পরীক্ষা হইতে পারে না। সন্তাপ হইতে রূপ নষ্ট হয়, সন্তাপ হইতে বল নষ্ট হয়, সন্তাপ হইতে জ্ঞান নষ্ট হয় ও সন্তাপ হইতে ব্যাধি উৎপন্ন হয়। শোক উপস্থিত হইলে অভিলষিত বস্তু-লাভ হয় না, শোকে শরীর পরিতপ্ত হয় এবং শোক হইলে শত্ৰুগণ নিতান্ত সন্তুষ্ট হইয়া থাকে; অতএব আপনি কদাচ শোক করিবেন না। মনুষ্যগণ বারংবার মৃত্যুমুখে নিপতিত হয়, বারংবার জন্মপরিগ্রহ করে, বারংবার ক্ষয় হয়, বারংবার পরিবর্দ্ধিত হয়, বারংবার অন্যের নিকট প্রার্থনা করে, অন্য ব্যক্তিও বারংবার তাহার নিকট যাচ্ঞা করে, আর বারংবার শোক করে এবং অন্যেও তাহার নিমিত্ত শোক করিয়া থাকে। সুখ, দুঃখ, জন্ম, মরণ, লাভ ও ক্ষতি- এই সকল পৰ্য্যায়ক্রমে ভোগ করিতে হয়; অতএব ধীর পুরুষ কদাচ হর্ষ ও শোকের বশীভূত হইবেন না। চক্ষুরাদি ছয় ইন্দ্ৰিয় নিতান্ত চঞ্চল। ইহারা যে যে বিষয়ে প্রবল বা অনুরক্ত হইয়া উঠে, বুদ্ধি সেই সকল বিষয় হইতে ভ্ৰংশ হয়।”

শান্তিসুখলাভের উপায়

যুধিষ্ঠিরের সহিত অনেক কপট ব্যবহার করিয়াছি, এ নিমিত্ত তিনি আমার মন্দমতি পুত্ৰগণকে রণস্থলে সংহার করিবেন, সন্দেহ নাই। সমস্ত বিষয়ই উদ্বেগের কারণ, এ নিমিত্ত মন নিতান্ত উদ্বিগ্ন হইতেছে, অতএব যাহাতে শান্তিলাভ হয়, এরূপ উপদেশ প্রদান কর।” বিদুর কহিলেন, “মহারাজ! বিদ্যা, তপস্যা, ইন্দ্ৰিয়সংযম ও লোভপরিত্যাগ ব্যতিরেকে আপনার শান্তিলাভ হওয়া নিতান্ত অসম্ভব। আত্মজ্ঞানদ্বারা সংসারভয় নিবারণ হয়; তপস্যাদ্বারা ব্ৰহ্মা, গুরুশুশ্রূষাদ্বারা জ্ঞান ও যোগবলে শান্তিলাভ হইয়া থাকে। মোক্ষার্থীরা দান ও বেদজ্ঞানজনিত পুণ্যে অনাস্থা প্রদর্শন করিয়া রাগদ্বেষ পরিত্যাগপূর্ব্বক এই পৃথিবীতে সঞ্চরণ করিয়া থাকেন। অধ্যয়ন, ধর্ম্মযুদ্ধ, পুণ্যকর্ম্ম ও তপস্যায় পরিণামে সুখলাভ হয়। যাহারা আত্মাকে ঈশ্বর হইতে ভিন্ন বোধ করেন, তাহারা বিস্তীর্ণ শয়নে [শয্যা-বিছানা] শয়ান হইয়া কদাচ নিদ্রাসুখ অনুভব করিতে পারেন না; কি স্ত্রী, কি মাগধগণের স্তুতিবাদ, কিছুতেই তাঁহাদের প্রীতিলাভ হয় না; তাঁহারা ধর্ম্মাচরণে নিতান্ত পরাঙ্মুখ হইয়া থাকেন। তৎকালে তাঁহাদের আর গৌরব থাকে না, তাঁহারা শান্তিলাভ ও প্রীতিসম্পাদনা করিতে সমর্থ হয়েন না; তাঁহাদের পক্ষে হিতোপদেশ নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর হইয়া থাকে এবং অলব্ধ অর্থের লাভ ও লব্ধ অর্থের রক্ষা উভয়ই একান্ত অসম্ভবপর হইয়া উঠে। বিনাশ ব্যতিরেকে তাঁহাদিগের অন্য কোন আশ্রয় দৃষ্টিগোচর হয়।

“ধেনু হইতে দুগ্ধ উৎপন্ন হয়, ব্রাহ্মণই তপানুষ্ঠান করিয়া থাকেন, মহিলাগণেই চাপল্য জন্মে ও জ্ঞাতি হইতেই ভয় উৎপন্ন হয়, কখনই ইহার অন্যথা হইতে পারে না। আপনি বাল্যাবস্থায় পাণ্ডবগণকে লালন-পালন করিয়াছেন, পরে তাঁহারা বহুসংখ্যক বন্ধু ও ঋষিগণসমভিব্যাহারে অনেক বৎসর অরণ্যে অশেষ ক্লেশভোগ করিয়াছেন, এ নিমিত্ত তাঁহারা সাধুলোকের নিদর্শনস্থান হইয়াছেন। হে মহারাজ! যেমন অঙ্গারসকল পৃথক পৃথক হইলে ধূমায়িত হয় ও একত্র মিলিত হইলে প্রজ্বলিত হইয়া উঠে, আপনার জ্ঞাতিবর্গও তদ্রূপ। ব্রাহ্মণ, স্ত্রী, গো ও জ্ঞাতিমধ্যে যে সমস্ত বীর জন্মগ্রহণ করে, তাহারাও সুপক্ক ফলের ন্যায় নিপতিত হয়। দৃঢ়বদ্ধমূল অতিমহৎ একমাত্র মহীরুহ সমীরণভরে অনায়াসে মদিত ও পতিত হইয়া থাকে, কিন্তু বহু বৃক্ষ একত্ৰ মিলিত ও বদ্ধমূল হইলে অক্লেশে প্রবল বায়ুবেগ সহ্য করিতে পারে; এইরূপ গুণসমন্বিত ব্যক্তিও একাকী হইলে শত্রুগণ তাহাকে পরাজয় করা অনায়াসসাধ্য মনে করিয়া থাকে। যেমন সরোবরমধ্যে উৎপলদলসকল পরিবর্দ্ধিত হয়, তদ্রূপ জাতিবর্গ পরস্পরকে আশ্রয় করিয়া পরিবর্দ্ধিত হইয়া থাকে। ব্রাহ্মণ, গো, শিশু ও স্ত্রীলোকসকল অবধ্য, আর যাহাদিগের অন্ন ভোজন করিতে হয়, যাহারা শরণাপন্ন হইয়া থাকে, তাহারাও অবধ্য বলিয়া পরিগণিত। ধনী না হইলে মনুষ্যের গুণ থাকে না। রোগী ব্যক্তি মৃতকল্প হইয়া অবস্থান করে, অতএব আপনি আরোগী হউন। হে মহারাজ! অব্যাধিজ [তীব্র বেদনাদায়ক] কটু [ব্যাধি-ব্যতিরেকে-জাত], শিরোরোগের কারণ, পাপের প্রসূতি, সন্তাপজনক, সাধুগণের সংবরণীয় [সহনীয়] ও অসাধুগণের অপরিহার্য্য ক্ৰোধ সংবরণ করিয়া শান্তিলাভ করুন। পীড়িত ব্যক্তিরা ফলমূলের আদর করে না, কোন বিষয়ে যথার্থ লাভ করিতে সমর্থ হয় না এবং ধনভোগজনিত সুখস্বচ্ছন্দতাও অনুভব করিতে পারে না।

সন্ধিস্থাপনে বিদুরের অনুরোধ

“হে মহারাজ! পণ্ডিতেরা দ্যূতানুরাগ পরিত্যাগ করিয়া থাকেন; এ নিমিত্ত আমি দ্যূতে দ্রৌপদীকে পরাজিতা দেখিয়া আপনাকে দুৰ্য্যোধনকে নিবারণ করিতে কহিয়াছিলাম; কিন্তু আপনি তৎকালে তাহার অনুষ্ঠান করেন নাই। যে বল দুর্ব্বলকর্ত্তৃক প্রতিহত হইয়া থাকে, সে বল, বল বলিয়া পরিগণিত হয় না। যাহাতে অতি অল্প ধর্ম্মলাভ হইতে পারে, আগ্রহাতিশয়-সহকারে তাহারও অনুষ্ঠান করিবে। লক্ষ্মী ক্রূরের হস্তগত হইলে তাঁহারই বিনাশের হেতু হইয়া উঠেন; কিন্তু শান্তব্যক্তিকর্ত্তৃক সমাশ্ৰিত হইলে তাহার পুত্রপৌত্ৰাদি বংশপরম্পরায় অনুগামিনী হয়েন।

“ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ পাণ্ডবদিগকে ও পাণ্ডবেরা আপনার পুত্রদিগকে প্রতিপালন করুন; তাঁহারা একধর্ম্ম ও সমৃদ্ধিসম্পন্ন হইয়া পরমসুখে জীবনযাপন করুন; তাঁহাদের অন্যতরের শত্রু ও মিত্র তাহাঁদের উভয়ের শত্রু ও মিত্ৰ হউক। আপনি কৌরবগণের স্বেচ্ছাচারিনিরোধক; কুরুকুল আপনারই অধীন; অতএব আপনি বসবাসসন্তপ্ত অল্পবয়স্ক পাণ্ডবগণকে রক্ষা করিয়া আপনার যশোরক্ষা করুন। আপনি পাণ্ডবগণের সহিত কৌরবদিগের সন্ধিসংস্থাপন করুন; শত্রুগণ কদাচ যেন আপনাদিগের পরস্পর ভেদ দর্শন না করে; পাণ্ডবেরা একমাত্ৰ সত্যে নির্ভর করিয়া রহিয়াছেন; অতএব এক্ষণে দুৰ্য্যোধনকেও যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত করুন।’