০৩৪. নীতিকথনচ্ছলে সুধন্ববিরোচনসংবাদ

৩৪তম অধ্যায়

নীতিকথনচ্ছলে সুধন্ববিরোচনসংবাদ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে মতিমন! তুমি ধর্ম্মার্থসঙ্গত বাক্যসকল বারংবার কীর্ত্তন করিতেছি, তথাপি আমার তৃপ্তিলাভ হইতেছে না; তুমি যাহা কহিলে, উহা সাতিশয় আশ্চৰ্য্য বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে; অতএব পুনরায় ধর্ম্মযুক্ত বাক্যসকল কীর্ত্তন কর।” বিদুর কহিলেন, “মহারাজ! সকল তীর্থে স্নান ও সর্ব্বভূতে সরল ব্যবহার উভয়ই তুল্য অথবা তাহার মধ্যে সরলতাই অপেক্ষাকৃত উৎকৃষ্ট। অতএব আপনি পাণ্ডবগণের সহিত সরল ব্যবহার করুন, তাহা হইলে ইহকালে মহীয়সী কীর্ত্তি লাভ করিয়া পরলোকে স্বৰ্গভোগ করিবেন। পৃথিবীতে যতকাল মনুষ্যের কীর্ত্তিপতাকা উড্ডীন হইতে থাকে, তাবৎকাল সে স্বর্গে পূজিত হয়। এক্ষণে সুধন্ববিরোচনসংবাদ নামক যে এক প্রাচীন ইতিহাস আছে, তাহা কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন।

ব্ৰাহ্মণ-দানব-শ্রেষ্ঠত্ববিষয়ক বিরোচনকেশনীর প্রশ্নোত্তর

“দিতিনন্দন বিরোচন কেশিনীলাভবাসনায় তাঁহার নিকট গমন করিলেন, কেশিনী জিজ্ঞাসা কিরলেন, “হে বিরোচন! ব্রাহ্মণেরা শ্রেষ্ঠ কি দানবেরা শ্রেষ্ঠ, আর সুধন্বা কি নিমিত্তই বা পৰ্য্যাঙ্কে [উত্তম আসনে-খাটে] আরোহণ করিবেন না?” বিরোচন কহিলেন, “হে কেশিনি! আমরাই শ্রেষ্ঠ, এই লোকসকল আমাদেরই অধিকৃত; সুতরাং দেবতা ও ব্রাহ্মণ আমাদিগের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হইতে পারেন না।” কেশিনী কহিলেন, “হে দৈত্যেন্দ্র। আমরা এই স্থলেই পরীক্ষা করিব; সুধন্বা কল্য প্ৰাতঃকালে আমার উপাসনা করিবার নিমিত্ত আগমন করিবেন, তাহা হইলে তোমাদের উভয়কেই সমবেত দেখিব।” বিরোচন কহিলেন, “হে ভদ্রে! তুমি যাহা কহিতেছ, আমি তাহার অনুষ্ঠান করিব, কল্য প্রাতে সুধন্বা ও আমাকে একত্ৰ সমাগত দেখিবে।”

সুধন্বা দ্বিজের স্বপক্ষসমর্থন-কৌশল

“অনন্তর রজনী প্রভাত হইলে, যে স্থানে বিরোচন ও কেশিনী অবস্থান করিতেছেন, সুধন্বা তথায় উপস্থিত হইলেন। কেশিনী ব্রাহ্মণকে সমাগত দেখিয়া প্রত্যুদগমনপূর্ব্বক পাদ্য, অর্ঘ ও আসন প্রদান করিলেন। সুধন্বা কহিলেন, “হে দৈত্যেন্দ্ৰ! আমি তোমার এই হিরন্ময় আসন স্পর্শ করিলাম, কিন্তু যদি তোমার সমান হই, তাহা হইলে এখনই প্রতি গমন করিব; তোমার সহিত কদাচ একাসনে উপবেশন করিব না।” বিরোচন কহিলেন, ‘সুধন্বন! কাষ্ঠপীঠ, কুশাসন বা কুশমুষ্টি তোমার উপবেশন করিবার সম্পূর্ণ উপযুক্ত; তুমি কোনক্রমে আমার সহিত একাসনে উপবেশন করিবার উপযুক্ত নও।” সুধন্বা কহিলেন, “হে বিরোচন! ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্ৰ—ইঁহারা পিতাপুত্রে একাসনে উপবেশন করিতে সমর্থ হয়েন, কিন্তু ঐ চারিবর্ণের পরস্পর একাসনে উপবেশন করা নিতান্ত নিষিদ্ধ। আমি উপবিষ্ট হইলে তোমার পিতা আমার আসনের অধঃপ্রদেশে উপবেশন করিয়া উপাসনা করিতেন; তুমি বালক, গৃহমধ্যে বিবিধ সুখসেব্য দ্রব্যসামগ্ৰী উপভোগ করিতেছ; এখনও তোমার বিষয়বুদ্ধি পরিপক্ক হয় নাই।”

পণরক্ষণে বিরোচন-সুধন্বার বিতর্ক

“বিরোচন কহিলেন, “হে সুধন্বন! আমরা হিরণ্য, গো, অশ্ব প্রভৃতি অসুরগণের সঞ্চিত বিত্তসমুদয় পণ রাখিয়া বিদ্বান ব্যক্তিদিগকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিব।” সুধন্বা কহিলেন, “হে দৈত্যরাজ! হিরণ্য, গো, অশ্ব প্রভৃতি পণ রাখিবার কোনো প্রয়োজন নাই, আইস, আমরা পরস্পর প্রাণ পণ রাখিয়া বিজ্ঞব্যক্তিদিগকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি।” বিরোচন কহিলেন, ‘হে ব্ৰহ্মন! আমরা প্রিয়তম প্রাণকে পণ রাখিয়া এক্ষণে কোথায় গমন করিব, আমার ত’ দেবতা বা মনুষ্যে কিছুমাত্র আস্থা নাই।” সুধন্বা কহিলেন, দৈত্যবর! আমরা এক্ষণে তোমার পিতা প্ৰহ্লাদের নিকট গমন করিব; বোধহয়, তিনি পুত্রের নিমিত্ত কদাচ মিথ্যা কহিবেন না।”

“উভয়ে এইরূপ বচনবদ্ধ ও নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া প্ৰহ্লাদসন্নিধানে গমন করিলেন। তিনি তাঁহাদিগকে সন্দর্শন করিয়া মনে করিলেন, “যাহারা কদাচ পরস্পর সংস্রব রাখেন না, তাহারা আজ কি নিমিত্ত কুপিত ভুজঙ্গের ন্যায় একপথে আগমন করিতেছেন?” অনন্তর তিনি বিরোচনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বৎস! পূর্ব্বে তোমরা কখনই একত্ৰ সঞ্চরণ করিতে না, এক্ষণে বল, সুধন্বার সহিত তোমার কিরূপে সৌহার্দ্য জন্মিয়াছে?” বিরোচন কহিলেন, ‘তাত! সুধন্বার সহিত আমার সৌহার্দ্য জন্মে নাই, আমরা প্ৰাণ পণ রাখিয়া আপনার নিকট একটি তত্ত্ব জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি; বোধকরি, আপনি কদাচ তাহার বৃথা সিদ্ধান্ত করিবেন না।”

প্ৰহ্লাদকর্ত্তৃক উত্তরপ্রদান

“অনস্তর প্রহ্লাদ সুধন্বাকে কহিলেন, “হে সুধন্বন! আপনি পূজনীয়; অতএব আপনার নিমিত্ত উদক, মধুপর্ক ও স্থূলকায় শ্বেতবর্ণ ধেনু আহরণ করুক।” সুধন্বা কহিলেন, “হে প্ৰহ্লাদ! আমি উদক ও মধুপৰ্ক পথিমধ্যে প্রাপ্ত হইয়াছি, এক্ষণে ব্রাহ্মণেরা শ্রেষ্ঠ কি দৈত্যেরা শ্রেষ্ঠ, এই প্রশ্নের প্রকৃত প্ৰত্যুত্তর শ্রবণ করিবার মানসে আসিয়াছি, আপনি যথার্থ উত্তর প্রদান করুন।” প্ৰহ্লাদ কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! আমার একমাত্র পুত্ৰ, তুমিও স্বয়ং আমার সন্নিধানে অবস্থান করিতেছ, অতএব আমি কি প্রকারে সেই বিবাদের সিদ্ধান্ত করিতে পারি?” সুধন্বা কহিলেন, “হে দৈত্যরাজ! যদি ঔরসপুত্রের প্রীতিসম্পাদন আপনার অভিপ্রেত হয়, তবে তাহাকে ধেনু ও অন্যান্য প্রিয়তর সম্পত্তি প্ৰদান করুন, কিন্তু বিবাদীদিগের বিবাদভঙ্গ করা আপনার অবশ্য কর্ত্তব্য, অতএব এক্ষণে আমাদিগের বিবাদের যথার্থ সিদ্ধান্ত করুন।”

“প্ৰহ্লাদ কহিলেন, “হে সুধন্বন! এক্ষণে জিজ্ঞাসা করি, যে ব্যক্তি সত্য না বলিয়া মিথ্যা সিদ্ধান্ত করে, সেই অন্যায়বক্তা কিরূপ দুঃখ প্রাপ্ত হইয়া থাকে?” সুধন্বা কহিলেন, “হে দৈত্যরাজ! অধিবিন্না [সপত্নী-সতীন] স্ত্রী, দূতপরাজিত ও সুর্ব্বহাভারাক্রান্ত ব্যক্তি যেরূপ যামিনীযোগে দুঃখভোগ করে, অন্যায়বক্তা সেইরূপ দুঃখ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। আর যে ব্যক্তি মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করে, সে নগরমধ্যে প্রতিরুদ্ধ, বুভুক্ষিত ও বহিৰ্দ্ধারে শত্ৰুগণপরিবেষ্টিত ব্যক্তির ন্যায় দুঃখভোগ করিতে থাকে। পশুর নিমিত্ত মিথ্যা কহিলে পঞ্চপুরুষ, গোর নিমিত্ত মিথ্যা কহিলে দশপুরুষ, অশ্বের নিমিত্ত মিথ্যা কহিলে শতপুরুষ ও মানুষ্যের নিমিত্ত মিথ্যা কহিলে সহস্রপুরুষ স্বর্গভ্ৰষ্ট হইয়া থাকে। সুবর্ণের নিমিত্ত মিথ্যা কহিলে জাত [এখন যাহারা বর্ত্তমান আছে] ও অজাত [যাহারা পরে জন্মিবে] উভয়বিধ পুরুষই পতিত হয়; আর ভূমির নিমিত্ত মিথ্যা কহিলে সমুদয় বিনাশপ্ৰাপ্ত হইয়া থাকে।”

“প্ৰহ্লাদ কহিলেন, “হে বিরোচন! মহর্ষি অঙ্গিরা আমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, সুধন্বা তোমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, আর সুধন্বজননী তোমার জননী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; অতএব তুমি অদ্য দুধন্বাকর্ত্তৃক পরাজিত হইলে; সুতরাং এক্ষণে সুধন্বা তোমার প্রাণেরও ঈশ্বর হইলেন।” অনন্তর সুধন্বাকে কহিলেন, “হে সুধন্বন! তুমি এক্ষণে আমার পুত্রকে পুনরায় প্রদান [প্ৰাণপণ-প্রত্যাহারে বিরোচনের প্রাণরক্ষা] কর।” সুধন্বা কহিলেন, ‘প্ৰহ্লাদ! আমি তোমার ধর্ম্মপরায়ণতা ও সত্যবাদিতার নিমিত্ত তোমার পুত্ৰ বিরোচনকে পুনরায় প্রদান করিলাম; বিরোচন আমার সমক্ষেই কুমারী কেশিনীর পাণিগ্রহণ করুক।’ ”

পুত্ৰপক্ষপাতিত্বত্যাগে বিদুরের উপদেশ

বিদুর কহিলেন, “হে মহারাজ! অতএব আপনি ভূমির নিমিত্ত কদাচ মিথ্যা কহিবেন না; যদি ভূমির নিমিত্ত মিথ্যা বলেন, তাহা হইলে পুত্র ও অমাত্যবর্গের সহিত বিনাশপ্ৰাপ্ত হইবেন, সন্দেহ নাই। দেবগণ সামান্য পশুপালকের ন্যায় দণ্ড গ্রহণ করিয়া রক্ষা করেন না; কিন্তু যাহাকে রক্ষা করিবার অভিলাষ করেন, তাহাকে বুদ্ধিদ্বারা রক্ষা করিয়া থাকেন। পুরুষ যেরূপ কল্যাণকর কাৰ্য্যে মনোনিবেশ করিবে তাহার অর্থসকল সেইরূপে সিদ্ধ হইবে, তাহার সন্দেহ নাই। বেদসকল মায়াবী ব্যক্তিকে পাপ হইতে উদ্ধার করে না, প্রত্যুত যেমন শকুন্তশাবক [পাখীর ছানা] পক্ষ উদ্ভিন্ন [জাত-উদ্গত] হইলে নীড় [কুলায়-পাখীর বাসা] পরিত্যাগ করে, তদ্রূপ বেদসকল অল্পকালমধ্যেই তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া থাকে। মদ্যপান, কলহ, দম্পতিবিচ্ছেদ, দম্পতিকলহ, সাধারণ বৈর, জ্ঞাতিভেদ, রাজবিদ্বেষ-এই সমস্ত পরিত্যাগ করবে। সামুদ্রিক-বেত্তা [হস্তরেখাদিদৃষ্টে অদৃষ্টগণনায় অভিজ্ঞ], চৌরপূর্ব্ব বণিক [পূর্ব্বে চৌৰ্য্যব্যবসায়ী, পরে বণিকবৃত্তিকারী; অথবা কম ওজনে বা কৃত্রিম দ্রব্যের বিক্রেতা], শলাকধূর্ত্ত [শলকাপাশদ্বারা পাখী ধরিয়া দিবার অঙ্গীকারে অর্থগ্রহণপূর্ব্বক পরবচনাকারী পাখী ধরিতেও পারে না—পাখী দেয় না], চিকিৎসক, অরি, মিত্র ও কুশীলব [কুচরিত্র অথবা নটীর চাকর বা লম্পট ও উন্মাদ]-এই সাত জনকে সাক্ষী করিবে না। মানাগ্নিহোত্র, মানমৌন, মানাধ্যয়ন ও মানযজ্ঞ এই চারিটি ভয়াবহ নহে; কিন্তু অযথারূপে অনুষ্ঠিত হইলেই নিতান্ত ভয়ানক হইয়া উঠে। গৃহদাহক, বিষপ্রযোক্তা, কুণ্ডাশী [স্বামী বাঁচিয়া থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীর ব্যভিচার-জাত পুত্ৰ কুণ্ড; সেই কুণ্ডের জনক], সোমবিক্রয়ী, শরকর্ত্তা [প্ৰাণীবধাৰ্থ বাণাদি আয়ুথনির্ম্মাতা], খল, মিত্রদ্রোহী, পারদারিক, ভ্রূণঘাতী, গুরুতল্পগামী, মদ্যপায়ী ব্রাহ্মণ, দুঃখিত ব্যক্তির দুঃখবিবৰ্দ্ধক, উগ্ৰস্বভাবসম্পন্ন, বেদদ্বেষী, গ্রামপুরোহিত [গ্রামযাজী-বহুলোকের যাজনকারী], নাস্তিক, পতিতসাবিত্ৰীক [যথাকালে অনুপনীত; ১৫ বৎসর তিন মাসের মধ্যে যাহার পৈতা না হয়], কর্ষক এবং যে ব্যক্তি বলসম্পন্ন হইয়াও অন্যের আশ্রয় গ্রহণপূর্ব্বক হিংসা করে-ইহারা ব্ৰহ্মঘাতীর তুল্য বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে।

“তৃণাগ্নি [তৃণাদির মৃদু অগ্নি] দ্বারা সুবর্ণ, চরিত্রদ্বারা ভদ্র ও ব্যবহারদ্বারা সাধুকে অবগত হওয়া যায় এবং ভয় উপস্থিত হইলে শূর, অর্থকৃচ্ছ্র উপস্থিত হইলে ধীর ও আপৎকালে সুহৃৎ ও শত্রুর পরীক্ষা হইয়া থাকে। জরা সৌন্দৰ্য্যনাশ, বলবতী আশা ধৈয্যনাশ, মৃত্যু প্ৰাণনাশ, অসূয়া ধৰ্মচর্য্যনাশ, ক্ৰোধ সম্পত্তিনাশ, অনাৰ্য্যসেবা শীলনাশ, কাম লজ্জানাশ ও অভিমান সমুদয় নাশ করিয়া থাকে। সম্পত্তি মঙ্গল হইতে প্রাদুর্ভূত, প্ৰগলভতাদ্বারা পরিবর্দ্ধিত ও ক্ষিপ্রকারিতাদ্বারা বদ্ধমূল হইয়া সংযমদ্বারা চিরস্থায়ী হয়। প্রজ্ঞা, সৎকুল, দম, শস্ত্ৰজ্ঞান, পরাক্রম, মিতভাষিতা, যথাশক্তি দান ও কৃতজ্ঞতা—এই আটটি গুণ পুরুষকে প্রতিভাসম্পন্ন করে। আর একটি গুণ ঐ সমস্ত গুণকে সহসা আশ্রয় করিয়া থাকে; যদি রাজা কোন পুরুষকে আশ্রয় প্রদান করেন, তাহা হইলে ঐ সকল গুণ তাঁহারই অনুসরণ করে।

“হে মহারাজ! ঐ আটটি গুণ স্বৰ্গপ্ৰাপ্তির উপায়স্বরূপ, কিন্তু সৎপুরুষেরা নিত্যানুষ্ঠেয় যজ্ঞ, দান, অধ্যয়ন ও তপস্যা-এই চারিটির অনুসরণ করিয়া থাকেন। আর দম, সত্য, আর্জ্জব ও অনৃশংসতা—এই চারিটি অতি যত্নপূর্ব্বক উপার্জ্জন করিতে হয়। যজ্ঞ, অধ্যয়ন, দান, নীতি, সত্য, ক্ষমা, ঘৃণা ও লোভ-এই আটটি ধর্মের পথ। লোক দম্ভের নিমিত্ত পূর্ব্ব চারিটির সেবা করিয়া থাকে, আর অন্য চারিটি অনাৰ্য্য ব্যক্তিকে কখনই আশ্রয় করে না। যে সভায় বৃদ্ধের সমাগম নাই, তাহা সভাই নয়; যে বৃদ্ধেরা ধর্মের উপদেশ প্রদান না করেন, তাহারা বৃদ্ধই নন, যে ধর্মে সত্য নাই, তাহা ধৰ্মই নয়, আর যে সত্য কপটতাদ্বারা নিতান্ত কুটিলভাব ধারণ করে, তাহা সত্যই নয়। রূপ, সত্য, শাস্ত্র, দেবোপাসনা, সৎকুল, শীল, বল, ধন, শৌৰ্য্য ও যুক্তিসঙ্গত বাক্য-এই দশটি স্বৰ্গ হইতে প্রাদুর্ভূত হইয়া থাকে।

“পাপাত্মা পাপানুষ্ঠান করিয়া পাপেরই ফলভোগ করে, কিন্তু পুণ্যাত্মা পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠান করিয়া পুণ্যেরই ফলভোগ করিয়া থাকেন। আর প্রজ্ঞাহীন মনুষ্য প্রতিনিয়তই পাপানুষ্ঠান করিয়া থাকে; অতএব কদাচ পাপাচরণ করিবে না। কারণ, বারংবার পাপানুষ্ঠান করিলে বুদ্ধিভ্রংশ হইয়া নিরন্তর পাপকর্মেই প্রবৃত্তি জন্মে। পুণ্য বারংবার আচরিত হইলে বুদ্ধি পরিবর্দ্ধিত হইয়া উঠে, তাহা হইলে নিরন্তর পুণ্যসঞ্চয়েই পুরুষের অভিলাষ জন্মিয়া থাকে এবং পরিণামে পুণ্যস্থান লাভ হয়; অতএব মনুষ্য সুসমাহিত হইয়া পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠানেই যত্নবান হইবে।

“অসূয়াপরবশ, নিষ্ঠুর, মর্ম্মচ্ছেদী, শঠ ও বৈকারী ব্যক্তিরা পাপাচরণের অনতিকালবিলম্বেই সাতিশয় ক্লেশভোগ করিয়া থাকে। আর অসূয়াশূন্য প্রজ্ঞাবান শুভাচারসম্পন্ন মনুষ্য নিরন্তর সুখসম্ভোগ করেন ও সকলেরই প্রতিভাজন হয়েন। যিনি প্রজ্ঞাসম্পন্ন মনুষ্য হইতে জ্ঞানোপার্জ্জন করিতে পারেন, তিনিই পণ্ডিত। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ধর্ম্মাৰ্থলাভ করিয়া সুখী হইয়া থাকেন।

“দিবাভাগে এইরূপ কর্ম্ম করিবে, যাহাতে রাত্রিকাল সুখে অতিবাহিত হইতে পারে; আট মাস এরূপ কর্ম্ম করিবে, যাহাতে বর্ষাকাল সুখে অতিবাহিত হইতে পারে: প্রথম-বয়সে এরূপ কর্ম্ম করিবে যাহাতে চরমকাল পরমসুখে অতিবাহিত হইতে পারে; যাবজ্জীবন এরূপ কর্ম্ম করিবে যাহাতে পরকাল সুখে অতিবাহিত হইতে পারে। পণ্ডিতেরা জীৰ্ণ অন্ন, গতিযৌবন ভাৰ্য্যা, সমরবিজয়ী বীর ও পারদর্শী তপস্বীর সবিশেষ প্ৰশংসা করিয়া থাকেন।

“অধর্ম্মলব্ধধনদ্বারা এক ছিদ্র সংবৃত করিতে হইলে তাহা সংবৃত না হইয়া প্রত্যুত তাহা হইতে অন্য ছিদ্র প্রকাশিত হইয়া উঠে। গুরু কৃতাত্মা দিগের ও রাজা দুরাত্মাদিগের শাস্তা আর যাহারা প্রচ্ছন্নভাবে পাপানুষ্ঠান করিয়া থাকে, অন্তক তাহাদিগকে শাসন করেন। ঋষি, নদী, মহাত্মাগণের কুল ও স্ত্রীলোকের দুশ্চরিত্রতার কারণ অবগত হওয়া নিতান্ত দুরূহ। যে ক্ষত্ৰিয় ব্ৰাহ্মণ-সেবানিরত, দাতা, সুশীল ও জ্ঞাতিগণের প্রতি সরল ব্যবহার করেন, তিনিই চিরকাল পৃথিবী পালন করিতে সমর্থ হয়েন। আর শূর, কৃতবিদ্য ও সেবানিরত-এই তিনপ্রকার পুরুষ পৃথিবী অধিকার করিতে পারেন। বুদ্ধিসাধ্য কৰ্মসকল প্রশস্ত, বাহুবলসাধ্য কর্ম্মসকল মধ্যম, কপটসাধ্য কর্ম্ম নীচ ও যে-সকল কর্মের ভার স্বীয় মস্তকে বহন [বিবেকবান ব্যক্তি অন্যের অপেক্ষা না করিয়া সমস্ত কাৰ্যের ভারগ্রহণ ও বহন করিতে পারে, তাদৃশ ব্যক্তিকেই স্বাবলম্বী বলা হয়। বিবেকহীনের ভারবহন সর্ব্বথা অসম্ভব; অতএব নিন্দিত।] করিতে হয় তাহা নীচতর বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। হে মহারাজ! আপনি দুৰ্য্যোধন, শকুনি, দুঃশাসন ও কর্ণের হস্তে সমস্ত ঐশ্বৰ্য্য সমর্পণ করিয়া কিরূপে কুশল অভিলাষ করিতেছেন? পাণ্ডবগণ সর্ব্বগুণালঙ্কত এবং আপনাকেও পিতার ন্যায় সম্মান করিয়া থাকেন, অতএব আপনি র্ত্তাহাদিগকে সূতনির্ব্বিশেষে স্নেহ করুন।”