০৩৩. কুরুপাণ্ডববিষয়ে শ্রেয়ষ্কর প্রশ্ন

৩৩তম অধ্যায়

কুরুপাণ্ডববিষয়ে শ্রেয়ষ্কর প্রশ্ন

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “বৎস বিদুর! তুমি ধর্ম্ম ও অর্থবিষয়ে সুনিপুণ; অতএব যে ব্যক্তি জাগরিত হইলে যন্ত্রণানলে দগ্ধ হয়, তাহার কর্ত্তব্য কি, বল। আমাকে প্রজ্ঞাপূর্ব্বক যথাশাস্ত্ৰ উপদেশ প্রদান কর, যাহা যুধিষ্ঠিরের হিতসাধন ও কৌরবগণের শ্রেয়স্কর তাহাই বর্ণন কর। ভাবী অনিষ্টপাতশঙ্কা ও অনুষ্ঠিত পাপাচরণ মনে করিয়া আমার আত্মা নিতান্ত ব্যাকুল হইয়াছে, এই নিমিত্ত জিজ্ঞাসা করিতেছি, হে সর্ব্বজ্ঞ! হে অদীনসত্ত্ব [যাহার হৃদয়ে দৈন্য নাই]! তুমি যুধিষ্ঠিরের সমুদয় সঙ্কল্প যথার্থকরিয়া বল।”

বিদুরের উপদেশে লোভপরিত্যাগ

বিদুর কহিলেন, “হে রাজন! যাহার জয় ও শুভ অভিলাষ করিতে হয়, তিনি জিজ্ঞাসা না করিলে শুভ হউক বা অশুভ হউক, প্রিয় হউক বা অপ্রিয় হউক, সমুদয় তাহার সমক্ষে বর্ণন করা কর্ত্তব্য; অতএব আমি কল্যাণকামনায় কুরুগণের শ্রেয়স্কর ও ধর্ম্মানুগত বাক্য কহিব; শ্রবণ করুন। যেসকল কর্ম্ম অসত্যদোষে দূষিত, যাহা সম্পাদন করিতে হইলে অসদুপায় অবলম্বন করিতে হয়, তাহা মনেও করিবেন না। যদি উপায়বিহিত কর্ম্ম সিদ্ধ না হয়, তাহা হইলে মনকে গ্লানিমুক্ত করা বুদ্ধিমান ব্যক্তির একাত্ত অকর্ত্তব্য। বিনা প্রয়োজনে কোন কর্ম্ম করিবে না, অগ্ৰে তাহার নিশ্চয় করিয়া পশ্চাৎ অনুষ্ঠান করিবে, অধীরতাসহকারে কোনো কর্ম্ম করিবে না। কর্মের পরিণাম ও প্রয়োজন এবং আপনার উদ্যোগ বিবেচনা করিয়া ধীর ব্যক্তি তদনুষ্ঠানে অগ্রসর বা পরাঙ্মুখ হইবেন। যিনি দুর্গপ্রভৃতি স্থান, বৃদ্ধি, ক্ষয়, কোষ, জনপদ ও দণ্ডের প্রমাণজ্ঞ নহেন, তিনি রাজ্যলাভ করিতে পারেন না। যিনি উক্ত প্রমাণসকল ও ধর্ম্মার্থবিষয়ে অভিজ্ঞ, তিনি রাজ্যলাভ করিতে সমর্থ হয়েনি। রাজ্যলাভ হয় নাই মনে করিয়া অযোগ্যরূপে জীবনযাত্ৰানির্ব্বাহ করিবে না। জরা যেমন রমণীয় রূপ বিনষ্ট করে, অবিনয় হইতে সেইরূপ শ্ৰী বিনষ্ট হয়। লোভপরতন্ত্র মৎস্য পরিণামে বন্ধন আলোচনা না করিয়া ভোজ্যসামগ্ৰীসমাবৃত লৌহময় বড়িশ গ্ৰাস করে। যাহা ভোজন করিবার উপযুক্ত, যাহা ভোজন করিলে পরিপাক হইতে পারে এবং যাহা পরিপাকাবস্থায় হিতকর হয়, সম্পত্তিলিপ্সু ব্যক্তি তাহাই ভোজন করিবে।

“যিনি বনস্পতির অপরিপক্ক ফল চয়ন করেন, তিনি তাহা হইতে রস প্রাপ্ত হয়েন না; প্রত্যুত তাহার বীজ পৰ্য্যন্ত শুষ্ক হইয়া যায়; কিন্তু যিনি যথাকলে পরিণত ফল গ্রহণ করেন, তিনি ফল হইতে রস লাভ করেন এবং তাহার বীজ হইতেও পুনরায় ফল উৎপন্ন হইয়া থাকে।

“হে মহারাজ! যেমন মধুকর কুসুমনিকর রক্ষা করিয়া তাহা হইতে রস গ্রহণ করে, সেইরূপ হিংসা না করিয়া মনুষ্যগণের নিকট অর্থ গ্রহণ করিবে। মালাকার উপবন হইতে নানাবিধ পুষ্প চয়ন করে, কিন্তু মূলাচ্ছেদ করে না; অতএব মালাকারের অনুকরণ করিবে, কদাচ অঙ্গারকারের অনুকরণ করিবে না। ইহার অনুষ্ঠান করিলে কি হয়, না করিলেই বা কি হইতে পারে, এইরূপ বিবেচনা করিয়া কর্ম্ম করিবে অথবা তাহা হইতে বিরত হইবে। যিনি প্রয়োজন অপেক্ষা করেন না, যাঁহার পুরুষকার ফলহীন, যিনি অর্থগমশূন্য, যাঁহার প্রসাদ নিস্ফল ও ক্ৰোধ নিরর্থক, কেহই তাঁহাকে প্ৰভু বলিয়া স্বীকার করিতে ইচ্ছা করে না; দেখুন, কোন স্ত্রী ক্লীবকে স্বামী বলিয়া গ্ৰহণ করিতে অভিলাষ করে? প্রাজ্ঞ ব্যক্তি অল্পায়াসসাধ্য প্রচুর ফলপ্ৰদ কর্মের অনুষ্ঠানেই প্রবৃত্ত হয়েন। যিনি সরলস্বভাব হইয়া প্রীতিনয়নে সকলকে অবলোকন করেন, তিনি মৌনভাব অবলম্বন করিয়া অবস্থান করিলেও প্ৰজাগণ তাঁহার প্রতি অনুরক্ত হয়।

“সূপুষ্পিত হইয়াও ফলিত হইবে না, ফলিত হইয়াও দুরারোহ হইবে ও অপক্ক হইয়াও আপনাকে পক্কবৎ প্রদর্শন করিবে, তাহা হইলে কোনোকালেই বিশীর্ণ হইবে না। যে ব্যক্তি, চক্ষু, মন, বাক্য ও কর্ম্মদ্বারা সকলকে প্রসন্ন করেন, লোকে তাঁহার প্রতি প্ৰসন্ন হইয়া থাকে। যেমন মৃগগণ ব্যাধ হইতে ভীত হয়, সেইরূপ প্রাণীগণ যাহা হইতে ভয়প্রাপ্ত হয়, তিনি সসাগরা ধরা লাভ করিয়াও রক্ষা করিতে পারেন না। বায়ু যেমন জলধারকে বিচ্ছিন্ন করে, সেইরূপ দুর্নীতিপর ব্যক্তি স্বতেজোলব্ধ পৈতৃক রাজ্য ভ্রংশিত করিয়া থাকে। যিনি প্রথমাবধি সাধুসমাচরিত ধর্ম্ম অনুষ্ঠান করেন, বসুধা সেই ভূপতির নিকট বাসুপূর্ণ ও সম্পত্তিবৰ্দ্ধিনী হইয়া বৃদ্ধি পাইতে থাকেন। যেমন চর্ম্মপত্র অগ্নির নিকট সন্ধুচিত হয়, সেইরূপ এই পৃথিবীও ধর্ম্মত্যাগী ও অধৰ্মচারী নরপতির নিকট সঙ্কুচিত হইয়া অল্পফলশালিনী হইয়া থাকে। পররাজ্যবিমৰ্দন যেরূপ যত্ন করিতে হয়, স্বরাজ্যসংরক্ষণেও সেই প্রকার যত্ন করা কর্ত্তব্য। ধর্ম্মানুসারে রাজ্যলাভ ও ধর্ম্মানুসারে রাজ্যপালন করিবে। ধর্ম্মানুগত রাজলক্ষ্মী প্ৰাপ্ত হইয়া অপ্ৰমত্তচিত্তে রক্ষা করিলে তিনি কখন হীন বা ক্ষীণ হয়েন না। যেমন প্রস্তর হইতে কাঞ্চনসকল সঙ্কলিত হয়, সেইরূপ উন্মত্তদিগের প্রলাপ ও বালকদিগের জল্পনা হইতে সার গ্রহণ করিবে। ধীর ব্যক্তি উঞ্ছাহারীদিগের উঞ্ছ-অন্বেষণের ন্যায় সর্ব্বত্র অন্বেষণ করিয়া সকল লোক হইতেই সদ্বাক্য ও সদাচার সঙ্কলন করিবেন। গোসকল গন্ধদ্বারা, ব্রাহ্মণেরা বেদদ্বারা, রাজারা চরদ্বারা এবং ইতর ব্যক্তিরা চক্ষুদ্বারা দর্শন করেন।

“যে ধেনু অনায়াসে দোহন করিতে না দেয়, লোকে তাহাকে অধিক ক্লেশ প্রদান করিয়া থাকে, আর সুখদোহা গোকে কেহই যন্ত্রণা প্ৰদান করে না। যে কাষ্ঠ পরিতপ্ত না হইলে নত হয় অথবা স্বতঃই নত হইয়া থাকে, কেহ তাহা উত্তাপিত করে না; এই দৃষ্টান্তদ্বারা স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে যে, ধীর ব্যক্তি বলবানকে প্ৰণাম করিবেন। কারণ, বলবানকে প্ৰণাম করিলে সুরপতিকে প্ৰণাম করা হয়। পশুগণের বন্ধু পর্জ্জন্য [মেঘ], রাজার বন্ধু মন্ত্রী, স্ত্রী বন্ধু স্বামী, ব্রাহ্মণের বন্ধু বেদ। ধর্ম্ম সত্যদ্বারা, বিদ্যা অভ্যাসদ্বারা, রূপ অঙ্গমার্জ্জন দ্বারা, কুল ধনদ্বারা, ধান্য পরিমাণদ্বারা, অশ্ব ব্যায়ামশিক্ষাদিদ্বারা, ধেনু তত্ত্বাবধানদ্বারা এবং স্ত্রীলোক কুৎসিতবস্ত্ৰদ্বারা [বিলাস বর্জ্জনদ্বারা] রক্ষণীয় হয়।

“আমাদের মতে আচারভ্রষ্টদিগের কুল কদাচ কোনো কার্য্যে প্রমাণ বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে না; একমাত্ৰ সদাচার অন্ত্যজ ব্যক্তিগণকর্ত্তৃক অনুষ্ঠিত হইলেও প্রধান প্রমাণ বলিয়া গ্রাহ্য হইতে পারে। অন্যের ধন, রূপ, বীরত্ব, কুল, সুখ, সৌভাগ্য ও সৎকারে যে ব্যক্তির ঈর্ষা হয়, তাহার ব্যাধি অনন্ত। যিনি অকর্ত্তব্য কর্মের অনুষ্ঠান, কর্ত্তব্যকর্ম্ম পরিত্যাগ ও আকালিক [যাহা কালোচিত নহে] মন্ত্রভেদে ভীত হয়েন, তিনি মাদকদ্রব্যসেবা পরিত্যাগ করিবেন। বিদ্যা, ধন, ও আভিজাত্য অসাধুগণের মদ এবং সাধুগণের দমগুণের কারণ। যদি সাধুগণ বিখ্যাত অসাধু ব্যক্তিকে কখন কোনো কাৰ্য্যে আহ্বান করেন, তাহা হইলে সে ব্যক্তি সেই কাৰ্য্যের অত্যঙ্গমাত্র সুসম্পন্ন না করিয়া আপনাকে সাধু বলিয়া বিবেচনা করে। সাধুগণ মহাত্মা সাধু ও অসাধুদিগের গতি; কিন্তু অসাধুগণ সাধুগণের গতি নহে। পরিচ্ছদসম্পন্ন ব্যক্তি সভা জয় করেন, গোধনসম্পন্ন ব্যক্তি মিষ্টভোজনাভিলাষ জয় করেন, যানসম্পন্ন ব্যক্তি পথ জয় করেন এবং শীলাসম্পন্ন ব্যক্তি সকলকেই জয় করেন। শীলই পুরুষের প্রধান গুণ; ইহলোকে যে ব্যক্তির উহা নষ্ট হইয়াছে, তাহার জীবন, ধন বা বন্ধুতে প্রয়োজন কি? আঢ্যগণের ভোজন মাংসপ্রধান, মধ্যবিত্তগণের ভোজন গব্যরসপ্রধান ও দরিদ্রগণের ভোজন তৈল প্ৰধান। দরিদ্রেরাই সুস্বাদু অন্ন ভোজন করে; কেন না, যে ক্ষুধা খাদ্যবস্তুর স্বাদুতা সম্পাদন করে, তাহা উহাদিগেরই আছে, আঢ্যব্যক্তিদিগের উহা অতি দুর্লভ। সম্পন্ন ব্যক্তিদিগের ভোজনশক্তি প্রায় থাকে না, কিন্তু দরিদ্রেরা কাষ্ঠ পৰ্য্যন্ত জীর্ণ করিতে পারে। অধম ব্যক্তিরা জীবিকা না থাকিলেই ভীত হয়, মধ্যম লোকেরা মৃত্যু হইতে ভীত হয়েন এবং উত্তম পুরুষেরা অপমান হইতে যৎপরোনাস্তি ভীত হইয়া থাকেন। ঐশ্বৰ্য্যমদ পানমদ অপেক্ষাও অধিকতর নিন্দনীয়; কারণ ঐশ্বৰ্য্যমদমত্ত ব্যক্তির পতন না হইলে চৈতন্যের উদয় হয় না। যেমন গ্ৰহগণ নক্ষত্ৰসকলকে তাপপ্রদান করে, সেইরূপ অবশীভূত ইন্দ্ৰিয়গণ স্ব স্ব বিষয়ে আসক্ত হইলে ভূলোককে পরিতাপিত করিয়া থাকে। যে ব্যক্তি বিষয়লালসা প্রবর্ত্তক সহজাত শ্রোত্ৰাদি পঞ্চেন্দ্ৰিয়ের বশীভূত হয়, তাহার আপদ। শুক্লপক্ষশশীর ন্যায় পরিবর্দ্ধিত হইতে থাকে।

“যিনি মনকে জয় না করিয়া অমাত্যকে অথবা অমাত্যকে জয় না করিয়া অমিত্ৰকে জয় করিতে ইচ্ছা করেন, সেই ব্যক্তি অবশ হইয়া অত্যন্ত হীন-অবস্থাপ্রাপ্ত হয়েন। যিনি প্রথমে অমিত্ররূপে মনকে পরাজয় করেন, পরে অমাত্য ও অমিত্রগণের প্রতি তাঁহার জিগীষা [জয়ের ইচ্ছে] কদাচ বিফল হয় না। যিনি ইন্দ্ৰিয়গণ ও মনকে পরাজয়, অন্যায়কারীর প্রতি দণ্ডবিধান ও পরীক্ষা করিয়া সমুদয় কাৰ্য্য সম্পাদন করেন, রাজলক্ষ্মী সেই বীরপুরুষকে নিরন্তর সেবা করিয়া থাকেন। শরীর রথ, আত্মা সারথি ও ইন্দ্ৰিয়গণ অশ্ব। ধীর ব্যক্তি অপ্ৰমত্ত হইয়া ঐ সমস্ত বশীভূত অশ্বদ্বারা রথীর ন্যায় কুশলে ও পরমসুখে গমন করেন। যেমন অবশীভূত অশ্বগণ পথিমধ্যে কুসারথির প্রাণ নাশ করে, সেইরূপ ইন্দ্ৰিয়গণ নিগৃহীত না হইলে পুরুষের প্রাণবিনাশের দৃঢ়তর কারণ হইয়া উঠে। বালকগণ অনর্থকে অর্থ, অর্থকে অনর্থ ও অপরাজিত ইন্দ্ৰিয়জনিত দূরপনেয় দুঃখকেও সুখবোধ করে। যে ব্যক্তি ধর্ম্ম ও অর্থ পরিত্যাগ করিয়া ইন্দ্ৰিয়গণের বশীভূত হয়, সে ব্যক্তি অবিলম্বে বিনষ্ট, শ্ৰীভ্রষ্ট, গতসর্ব্বস্ব ও বনিতাকর্ত্তৃক পরিতপ্ত হইয়া থাকে। যিনি অর্থরাশির অধীশ্বর হইয়াও ইন্দ্ৰিয়গণের অনীশ্বর [অধীন] হইয়া থাকেন, তিনি অবশ্যই ঐশ্বৰ্য্য হইতে পরিচ্যুত হয়েন। আত্মা, মন, বুদ্ধি ও নিগৃহীত ইন্দ্ৰিয়গণদ্বারা আত্মাকে অন্বেষণ করিবে, কারণ, আত্মাই আমার শত্রু এবং আত্মাই আত্মার বন্ধু। যে আত্মা আত্মাকে বশীভূত করিয়াছে, সেই আত্মাই আত্মার নিয়ত বন্ধু ও অবশীভূত আত্মাই নিয়ত রিপু। যেমন ক্ষুদ্র ছিদ্রজাল বৃহৎ মৎস্যদ্বয়কে আবৃত করে, সেইরূপ প্রজ্ঞান কাম ও ক্ৰোধ উভয়কেই বিলুপ্ত করে।

“যে ব্যক্তি ধর্ম্ম ও অর্থের অনুরোধে জয়সামগ্ৰী [জয়াবহ বস্তুসমূহ] সকল আহরণ করে, সেই সম্ভৃতাসম্ভার [দ্রব্যের আয়োজনকারী] ব্যক্তি নিরন্তর সুখলাভ করিয়া থাকে। যে ব্যক্তি মনোময় শ্রবণাদি পঞ্চ-ইন্দ্ৰিয়াকে পরাজিত না করিয়া অন্য শক্রকে পরাজয় করিতে অভিলাষী হয়, শত্ৰুগণ তাহাকেই পরাজয় করে। দেখুন, অনেক দুরাত্মা রাজা ঐশ্বর্য্যবিলাসের নিমিত্ত ইন্দ্ৰিয়গণকে বশীভূত করিতে অসমর্থ হইয়া নিহত হইয়াছে। যেমন আর্দ্রকাষ্ঠ শুষ্ককাষ্ঠের সহিত মিলিত হইয়া দগ্ধ হয়, সেইরূপ পাপপরায়ণ ব্যক্তিদিগের সহিত পুণ্যবানকেও সমান দুঃখভোগ করিতে হয়; অতএব সর্ব্বপ্রকার পাপ ও পাপপরায়ণ মানবের সহিত সংস্রব পরিত্যাগ করিবে। যে ব্যক্তি মোহবশতঃ উন্মাৰ্গপ্রস্থিত স্ব স্ব বিষয়াসক্ত পঞ্চশত্রুকে [চক্ষু, কৰ্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক] নিগৃহীত না করে, আপদ তাহাকে গ্রাস করে। অনসূয়া, আৰ্জব, শৌচ, সন্তোষ, প্ৰিয়বাদিতা, দম, সত্য, অনায়াস-এই কয়েকটি গুণ দুরাত্মাদিগের নাই। আত্মজ্ঞান, অনায়াস, তিতিক্ষা, ধর্ম্মনিত্যতা, গুপ্তবাক্য ও দান-এই সকল গুণ অধম ব্যক্তিকে আশ্রয় করে না। যে অজ্ঞ ব্যক্তি কটুবাক্য ও পরীবাদদ্বারা জ্ঞানবানের হিংসা করে, সেই পাপভাগী হয়; কিন্তু যিনি ক্ষমা করেন, তিনি পাপ হইতে মুক্ত হয়েন। হিংসা অসাধুগণের বল, দণ্ডবিধান রাজার বল, শুশ্রুষা স্ত্রীর বল এবং ক্ষমা গুণবানের বল। বাকসংযম অতি দুষ্কর কর্ম্ম, অর্থযুক্ত বিচিত্র বহুবাক্যপ্রয়োগও ক্ষমতার অতীত। সুভাষিত বাক্য বিবিধ কল্যাণের আকর; কিন্তু উহাই আবার দুর্ভাষিত [দুরুক্ত] হইলে অনর্থরাশি উৎপাদন করে। সায়কবিদ্ধ বা পরশুচ্ছিন্ন অরণ্য পুনরায় প্রাদুর্ভূত হইয়া থাকে; কিন্তু দুর্ব্বাক্যসায়কে বিক্ষত ব্যক্তি কিছুতেই আরোগ্যলাভ করিতে পারেন না। কর্ণী [অস্ত্রের নাম], নালীক [অস্ত্রের নাম] ও নারাচ [অস্ত্রের নাম] শরীর হইতে উৎখাত হইয়া থাকে, কিন্তু হৃদিপ্রবিষ্ট বাকশল্য কোনক্রমেই উদ্ধৃত করা যায় না। যে বাকসায়ক [বাক্যবাণ] বদন হইতে বিনিৰ্গত হয়, যদ্বারা লোকসকল আহত হইলে দিবারাত্ৰ শোক করিয়া থাকে, যাহা মানবের মর্ম্ম ভিন্ন অন্য স্থান স্পর্শ করে না, পণ্ডিতগণ অন্যের প্রতি কদাচ তাহা নিক্ষেপ করেন না। দেবতারা যে পুরুষকে পরাভব করেন, তাহার বুদ্ধি অপকৃষ্ট হয় এবং সে ব্যক্তি অর্ব্বাচীন [মহাজনগণের অনুমোদিত] কর্মেরই অনুসরণ করে। মৃত্যু আসন্ন ও বুদ্ধি কলুষিত হইলে নীতিবৎ প্রতীয়মান দুর্নীতিসকল কখনো হৃদয় হইতে অপসারিত হয় না। হে ভরতশ্রেষ্ঠ! পাণ্ডবদিগের সহিত বিরোধনিবন্ধন আপনার পুত্রদিগের বুদ্ধি সেই প্রকার কলুষিত হইয়াছে; এক্ষণে আনুধাবন করিতেছেন না। অতএব আপনার শিষ্য ত্ৰৈলোক্যরাজসমুচিত লক্ষণসম্পন্ন যুধিষ্ঠির শাসনকর্ত্তা হউন; সকল পুত্রকে অতিক্রম করিয়া তাঁহাকে ভাগধেয় [ন্যায্যপ্ৰাপ্য অংশ] প্ৰদান করুন। তেজ ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন, ধৰ্ম্মার্থতত্ত্ববিৎ, ধাৰ্ম্মিকবর যুধিষ্ঠির কেবল অনুগ্রহ, দয়া ও আপনার গৌরবরক্ষার নিমিত্ত বহুবিধ ক্লেশ সহ্য করিয়া আছেন।”