• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০২. মন খারাপ হল না ডাক্তারের

লাইব্রেরি » তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় » আরোগ্য-নিকেতন (১৯৫৩) » ০২. মন খারাপ হল না ডাক্তারের

মন খারাপ হল না ডাক্তারের। মতির মায়ের বয়স হয়েছে, বয়সের অনুপাতে দেহ অনেক বেশি। ভেঙেছে। বাত-জ্বর, পেটের গোলমাল–নানানখানা রোগ তো আছেই। তার উপর এই আঘাতে পায়ের হাড়ে আঘাত লেগেছে। ভেঙেছে। হয়তবা শেষ পর্যন্ত আঘাতের স্থানটা পাকবে। একমাত্র ছেলে, বউ, কয়েকটিই নাতি-পুতি, তা যাক না বুড়ি; এ তো সুখের যাওয়া। বুড়ির যেতে ইচ্ছে নাই। ডাক্তার এক নজরেই বুঝতে পারেন। মৃত্যুর কথা শুনলে চমকে ওঠে না—এমন লোক বোধহয় সংসারে খুব কম। তবু বলেন এই কারণে যে, মানুষের এগিয়ে যাওয়ারও তো সীমা নেই।

বেচারি মতির মা পিছনে পড়ে আছে অন্ধকারের মধ্যে। তাকে দোষ দিতে পারবেন না। ছেলে, বউ, নাতি, নাতনী, ঘর-সংসার–বড় জড়িয়ে পড়েছে বুড়ি।

অন্যহনি ভূতানি গচ্ছতি যমমন্দিরং
শেষাঃ স্থিরত্বমিচ্ছন্তি কিমাশ্চর্যমতঃপরম্।

বুড়ি সেই সনাতন আশ্চর্য হয়ে উঠেছে আজ। কিন্তু যেতে হবে বুড়িকে। আর যাওয়াটাই ওর পক্ষে মঙ্গল। হ্যাঁ মঙ্গল। নইলে দুর্ভোগের আর অন্ত থাকবে না।

জীবন ডাক্তারের দেহখানা খুব ভারী। পা দুটো মাটির উপরে দেহের ওজনে জোরে জোরেই পড়ে। ডাক্তার পথ দিয়েই চলেন-পাশের বাড়ির লোকেরা জানতে পারে ডাক্তার চলেছেন। এই শ্রাবণ মাসের ফিনফিনে বৃষ্টিতে পিছল এবং নরম মেটে রাস্তার উপর সন্তৰ্পণে পা ফেলে চলতে হবে। চোখ রাখতে হবে মাটির উপর। দুটোই ডাক্তারের পক্ষে বিরক্তিজনক। কিন্তু উপায় নাই—পিছল পথে পা ফসকালে অঙ্গ আর থাকবে না। পৃথিবীকে মানুষ বলে মা, সবুজ ঘাসে আর ফসলে ঢাকা দেখে বলে—কোমলাঙ্গী; একবার পড়লেই ভুল ভেঙে যায়। আপন মনেই ডাক্তার হাসেন।

আরে–আরে–আরে! ডাক্তার থেমে গিয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেন। পথের ধারের একটা ডোবার মুখে এই অনাবৃষ্টির বর্ষায় সামান্য পরিমাণে খানিকটা জল জমেছে—দুটো ছেলেতে পরমোৎসাহে তাই হেঁচতে শুরু করেছে। কাদাগগালা জল ছিটিয়ে রাস্তার ওইখানটা। কর্দমাক্ত করে তুলেছে।

ছেলে দুটো থেমে গেল। জীবন মশায় এখানে সর্বজনমান্য।

–কী করছি? হচ্ছে কী?

–মাছ গো। এই এতু বড়ি একটা ল্যাঠা মাছ।

–তুই তো মদন ঘোষের ব্যাটা?

–হি গো, মদনার ব্যাটা বদনা আমি।

ডাক্তার হেসে ফেললেন, বললেন–শুধু মদনার ব্যাটা বদনা? তুই মদনার ব্যাটা—বদনা ঠাটা! পাজির পা-ঝাড়া! উল্লুক!

–ক্যানে? কী করলাম আমি?

–কী করলি? এবার কণ্ঠস্বর স্নিগ্ধ করে ডাক্তার বললেন, এমনি করে বাবার নাম, নিজের নাম বলতে হয়? ছিঃ ছিঃ ছি! বলতে হয়—আজ্ঞে হ্যাঁ, শ্রীমদনলাল ঘোষের ছেলে আমি, আমার নাম শ্ৰীবদনলাল ঘোষ। বুঝলি?

বদন ঘাড় কাত করে মাথাটা কাঁধের উপর ফেলে দিলে। খুব খুশি হয়েছে বদন। ডাক্তার বললেন– আর এটি? এটি কে?

ছেলেটি বেশ সুশ্ৰী। সুন্দর চেহারা। এ গ্রামের বলে মনে হচ্ছে না। ডাক্তারের কথার উত্তরও দিলে না। বদন বললেও আমাদের গায়ে এসেছে। সরকারদের বাড়ি। মামার বাড়ি এসেছে।

–আচ্ছা! অহীন্দ্র সরকারের মেয়ে অতসীর ছেলে?

ছেলেটি ঘাড় নেড়ে দিলে দুবার–হ্যাঁ।

ডাক্তার বললেন––জলে ভিজো না, বাড়ি যাও। সর্দি হবে। জ্বর হবে। মাথা ধরবে।

বদন বললে—আপুনি ভিজছে ক্যানে?

ডাক্তার কৌতুকে সশব্দেই হেসে উঠলেন। বললেন–আমি ডাক্তার রে দুষ্টু। অসুখ আমাকে ভয় করে। যা–বাড়ি যা। চল, আমার সঙ্গে চল।

ছেলে দুটোকে সঙ্গে নিয়েই তিনি ফিরলেন। সেতাব না এসে থাকলে এদের নিয়েই একটু আমোদ করবেন। চলতে চলতে বললেন––-জানিস, আমড়া খেলে অম্বল হয়, অম্বল হলে জ্বর হয়। কিন্তু ডাক্তারেরা খায়। লোককে বলি আমড়া খাই আমরা, লোককে বলি খেয়ো না আমড়া।

আরোগ্য-নিকেতনের বারান্দায় ইতিমধ্যেই সেতাব মুখুজ্জে কখন এসে বসে আছেন। ডাক্তারকে দেখে তিনি বললেন, গিয়েছিলি কোথা? আমি এসে ভাবি গেল কোথায়! নন্দ কি ইন্দির দুজনের একজন পর্যন্ত নাই।

ছেলে দুটোকে ছেড়ে দিয়ে ডাক্তার বললেন, যা—বাড়ি যা তোরা। সেতাবকে বললেন, গিয়েছিলাম মতি কর্মকারের বাড়ি। মতির মায়ের হুকুম এসেছে। বোস, চায়ের জন্য বাড়িতে বলে আসি। কঙ্কের টিকেটা ধরিয়ে দে তুই, ইন্দির বাইরে গিয়েছে।

একেবারে সাত-আটটা কল্কেতে তামাক সাজা আছে। এ ছাড়াও তামাক-টিকে আছে। খাওয়াদাওয়ার পরই নন্দ সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছে। তারপর প্রয়োজনের সময় ইন্দির থাকলে ইন্দির, না থাকলে ডাক্তার বা সেতাব নিজেরাই কেউ দরকারমত কল্কেতে আগুন দিয়ে নেন। এখন দুজনে বসবেন দাবাতে। কতক্ষণ চলবে কে জানে! বাড়িতে ভাত ঢাকা থাকবে। তবু তো আগেকার কালের শক্তি নাই—উৎসাহও নাই।

চায়ের বরাত করে তামাকের টিকে ধরিয়ে নিয়ে দাবায় বসলেন দুজনে। খেলাটা হঠাৎ যেন। জমে উঠল। সেতাবের মন্ত্রীটা ধাঁ করে মেরে বসলেন মশায়। ওদিকে আকাশে মেঘও বেশ জমেছে, বৃষ্টিও বেশ সুর ধরেছে; ঝিপঝিপ করে বৃষ্টি নেমেছে, বৃষ্টি খানিকটা হবে বলে মনে হচ্ছে। নীরবেই খেলা চলছিল, সেতাব মুখুজ্জে বললেন–ভিতরে চল জীবন—গা শিরশির করছে।

–শিরশির করছে? কেন রে? আমার তো বেশ আরাম বোধ হচ্ছে।

–তোমার কথা আলাদা। এত চর্বিতে শীত লাগে কখনো? আমার শরীরটাও ভাল নাই।

–জ্বর হয় নি তো? দেখি হাত?

–না, হাত দেখতে হবে না। ওই তোর বাতিক। আমি নিজেও জানি হাত দেখতে। দেখেছি নাড়ি গরম একটু হয়েছে। ও কিছু নয়; চল ভেতরে চল। সেতাব সরিয়ে নিলেন। হাতখানা।

ডাক্তার কিন্তু ছাড়লেন না, হাত বাড়িয়ে একরকম জোর করে সেতাবের হাতখানা টেনে নিলেন। হ্যাঁ, বেশ উত্তাপ হাতে! কিন্তু নাড়ি অনুভব করার সুযোগ পেলেন না। সেতাব মুখুজ্জে হাতখানাকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছেন।

—ছাড়, হাত ছাড়, জীবন। হাত ছাড়।

–পাগলামি করিস নে সেতাব। নাড়ি দেখতে দে।

–না। চিৎকার করে উঠলেন সেতাব।

–আরে, হল কী তোর? আরে! বিস্মিত হয়ে গেলেন জীবন ডাক্তার।

–না–না–না। ছেড়ে দে আমার হাত। ছেড়ে দে। ঝটকা মেরে ডাক্তারের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সেতাব উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর নিজের লণ্ঠনটা একপাশে নামানো ছিল। সেটা জ্বালাবার অবকাশও ছিল না; নেভানো লণ্ঠনটা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়লেন দাওয়া থেকে।

—সেতাব, ছাতা, তোর ছাতা।

এবার সেতাব ফিরলেন। ছাতাটি নিয়ে লণ্ঠনটি জ্বালাতে জ্বালাতে বললেন– নিজের নাড়ি দেখ তুই। তুই এইবার যাবি আমি বললাম। লোকের নাড়ি দেখে নিদান হেঁকে বেড়াচ্ছি, নিজের নিদান হাঁক।

সেতাব চলে গেলেন সেই বৃষ্টির মধ্যে।

ডাক্তার চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। সেতার মধ্যে মধ্যে এমনি অকারণে রেগে ওঠেন। অকারণ ঠিক নয়, নিজের চাল ভুল হলে মনে মনে রাগেন নিজের উপরেই, তারপর একটা যে-কোনো ছুতোতে ঝগড়া করে বসেন। উঠেও চলে যান। ফেরানো তাকে যায় না, পরের দিন ডাক্তার যান তার বাড়ি। গেলেই সেতাব বলেন-আয়-আয় বোস। এই যাব বলে উঠেছিলাম আর তুইও এলি।

ডাক্তার একটু হেসে বাড়ির ভিতরে যাবার জন্যে ঘুরলেন; ডাক্তারখানার দরজা বন্ধ করতে গিয়ে কিন্তু থমকে দাঁড়ালেন। আজ সেতাবের রাগটা প্রচ্ছন্ন বিকার নয় তো? উত্তাপে অল্প জ্বর মনে হল। কিন্তু নাড়ি দেখতে তো দিলেন না সেতাব। ঐ দুটি কুঞ্চিত করে তিনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। ভাবছিলেন যাবেন এখুনি সেতাবের বাড়ি।

ফল নেই। তাই যদি হয় তবে সেতাব কিছুতেই তাকে হাত দেখতে দেবেন না, বরং আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠবেন।

আর এই বৃষ্টিতে ভিজে অনিষ্ট? সে যা হবার হয়েছে।

মৃত্যু-রোগের একটা যোগাযোগও আছে, যা বিচিত্র এবং বিস্ময়জনক।

পরের দিন।

সাধারণত ডাক্তার বেশ একটু দেরিতে ওঠেন। আজ কিন্তু উঠলেন সকালেই। সমস্ত রাত্রি ভাল ঘুম হয় নি। সেতাব সম্পর্কেই দুশ্চিন্তা একটা বাতিকের মত তাকে চঞ্চল করে রেখেছিল। কত উদ্ভট চিন্তা। তাঁর অভিজ্ঞতায় যত বিচিত্র রোগলক্ষণ উপসর্গ তার চোখে পড়েছে, তিনি যেন। উপলব্ধি করেছেন সেইসব উপসর্গের লক্ষণ তিনি সেতাবের আচরণের সঙ্গে মিলিয়ে পেয়েছেন। সেদিন। যত দেখেছেন ততই যেন মিলেছে। মনে মনে অনুতাপ হয়েছে, সেতাবকে তিনি জাপটে ধরে জোর করে ঘরে বন্ধ করে রাখলেন না কেন? ওই বৰ্ষণের মধ্যে যেতে দিলেন কেন? প্রচ্ছন্ন বিকার নিয়ে জ্বরই খুব খারাপ, তার উপর এই বর্ষায় ভিজে যদি সর্দিটা প্রবল হয় তবে

যে অসাধ্য হয়ে উঠবে।

বয়স সেতাবের হয়েছে, জীবনে বন্ধনও নাই। বন্ধন বলতে স্ত্রী—কিন্তু সে স্ত্রী এমনই সক্ষম ও আত্মপরায়ণা যে, সেতাবের অভাবে তার বিশেষ অসুবিধা ঘটবে না। সেতাবের অভাব অনুভব করবেন তিনি নিজে। সেতাব না হলে তার দিন কাটে না। তিনি থাকবেন কাকে নিয়ে?

সকালে উঠেই তিনি সেতাবের বাড়ি যাবার জন্যে প্রস্তুত হলেন। ডাক্তার-গ্নিনিও সকালেই ওঠেন। এবং তাঁর বিচিত্র স্বভাবের বিচিত্রতম অংশটুকু এই প্রথম প্রভাতেই আত্মপ্রকাশ করে থাকে। নাম তার দুর্গা। দুৰ্গা প্রভাতে ওঠেন যুদ্ধোদ্যতা দশপ্ৰহরণ ধারিণীর মত। মেজাজ সপ্তমে উঠেই থাকে; সেই মেজাজে বকেঝকে বাড়িটাকে সন্ত্রস্ত করে দিয়ে কিছুক্ষণ পর আশ্চর্যভাবে ধীরস্থির হয়ে আসেন। ডাক্তার দেরিতে ওঠেন যেসব কারণে ওটা তার মধ্যে একটা প্রধান কারণ। গিন্নি স্থির হলে নিশ্চিন্ত হয়ে গাত্রোত্থান করেন তিনি।

ডাক্তার-গিন্নি অনেক আগেই উঠে বাসনমাজা-ঝিকে তিরস্কার করছিলেন, বালি এবং করকরে ছাই দিয়ে বাসন মাজার জন্য। ওতে বাসনের পরমায়ু কতদিন? সংসারে যারা সিদ্ধপুরুষ, মৃত্যু যাদের ইচ্ছাধীন, তাদের মাথায় ডাণ্ডা মারলে তারাও মরতে বাধ্য হন। ও তো নির্জীব কাসার গেলাস। বালি দিয়ে দুবেলা ঘষলে ও আর কতদিন। কাসার দাম যে কত দুমূল্য হয়েছে সেও তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। ডাক্তার উঠে আসবার সময় কেশে গলা পরিষ্কার করে সাড়া দিয়ে নামলেন। তারপর গম্ভীরভাবে বললেন– আমি বেরুচ্ছি একবার মাঠে। সকালবেলা উঠেই প্রথম কথাটি তাঁকে মিথ্যে বলতে হল। নইলে গিনির দৃষ্টি এবং হুঙ্কার ভস্মলোচন ভস্মকারিণীর মত প্রখর এবং ভীষণ হয়ে উঠবে।

ছাতাটি নিয়ে বেরিয়ে সোজা এসে উঠলেন ওই বড়বাজারের গ্রামখানিতে। সদর রাস্তা থেকে ছোট পথ ধরে সেতাবের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং ডাকলেন।

–সেতাব!

সেতাবও তখন উঠেছেন। ঘরের ভিতর তক্তপোশের উপর বসে তামাক খাচ্ছেন। বাইরে ডাক্তারকে দেখে হেসে বললেন–এসেছিস?

ডাক্তার ঘরে ঢুকে তক্তপোশের উপর বসে বললেন–যাক। জ্বরটর নাই তো? মুখ দেখে মনে হচ্ছে ছেড়ে গিয়েছে।

–সেতাব হাতখানি বাড়িয়ে দিলেন–দেখ।

–দেখব? হাসলেন ডাক্তার।

–দেখ। নিদান একটা হাঁক দেখি। আর তো পারছি না। জীবনে ঘেন্না ধরে গেল।

ডাক্তার হেসে বললেন–তা কাল রাত্রে বুঝেছি। যে রাগ তোর আমার উপর।

সেতাব ওদিক দিয়েই গেলেন না, বললেন, কাল রাত্রে বুড়ি আমাকে যা বলে, সে তোকে কী বলব? এক মুঠো মুড়ি পর্যন্ত খেতে দিলে না রে। বললাম সর্দিতে গা গরম হয়েছে, জীবন আমাকে দুধ-মুড়ি খেতে বলেছে। ঘি-ময়দা থাকলে চারখানা গরম লুচি সব থেকে উত্তম। ঘরে ঘি-ময়দা আছে, বুঝলিজেনেই আমি বলেছিলাম। বাজারে ময়দা মেলে না—আমার জমিতে মন দুই গম হয়েছিল, সে পিষিয়ে ময়দা করিয়ে রেখেছি। বাড়ির দুধ হয়-না হয়-না করেও সের দেড়েক হয়। তার সব সরটুকু জমিয়ে বুড়ি ঘি করে। একদিন সরের মুখ দেখতে পাই না। কালই বিকেলে সর গালিয়েছে রে! তা তোকে কী বলব, আমাকে ন ভূতো ন ভবিষ্যতি, তোর পর্যন্ত বাপান্ত করে ছাড়লে। এই সকালে খিদেতে পেট জ্বলছে খাণ্ডব দাহনের মত।–কী করব–বসে বসে তামাক টানছি। এর চেয়ে যাওয়াই ভাল। কী হবে বেঁচে!

ডাক্তার হাতখানা এবার টেনে নিলেন–স্পর্শমাত্রেই বুঝলেন জ্বর ছেড়ে আসছে। বললেন––জ্বর ছেড়ে আসছে। কাল রাত্রে গিনি খেতে না দিয়ে ভালই করেছে। কয়েক মুহূর্ত নাড়ি পরীক্ষা করে বললেন– আজ সকাল সকাল ঝোল-ভাত খা। এখন বরং চায়ের সঙ্গে কিছু খা। আর জ্বর হবে বলে মনে হচ্ছে না।

–কিছু খা! সেতাব রুস্বরে বলে উঠলেন-–কিছু খা! ঠাকুরসেবা নাই? সে কে করবে?

–কাউকে বল না, করে দেবে।

—দেবে? একালের কোন ব্যাটা এসব জানে, না এতে মতি আছে। আছে এক মুখ্য ভাঙ ওই ঠ্যাঙবাকা চাটুজ্জেদের ছেলে। তা এখন তার কাছে যায় কে? যদি ব্যাটা বুঝতে পারে যে আমি খেয়েছি তবে এক বেলাতেই আট আনা চেয়ে বসবে।

—তাই দিবি। শরীর আগে না পয়সা আগে! খিদেয় তোর পেট জ্বলছে–আমি বুঝতে পারছি, তুই খা। আমি বরং ব্যবস্থা করছি। আমাদের গ্রামের মিশ্রদের কাউকে পাঠিয়ে দোব, বুঝলি? খা তুই, পেট ভরে খা। চায়ের সঙ্গে মুড়ি ফেলে নাশতা কর।

সেতাব এবার চুপিচুপি বললেন–তুই বল না, একটু হালুয়া করে দিক। ময়দা চাললেই সুজি বেরুবে। চিনি অবিশ্যি নাই, তা ভাল গুড় আছে। খেজুরগুড়ের পাটালিও আছে ওর ভাঁড়ারে। বুঝলি, রোজ রাত্রে দুধের সঙ্গে ভাত খায় আর ওই পাটালি বার করে। ভাবে আমি ঘুমিয়ে গিয়েছি। আমি সাড়া দিই না, কিন্তু গন্ধ পাই। বল না ওকে।

ডাক্তার হেসে ফেললেন।

খাওয়ার বিলাসে সেতাব চিরকাল বিলাসী, একটু ভালমন্দ খেতে ভালবাসেন বলে ওঁর স্ত্রী নাম দিয়েছে বালকদাসী। বলে, উনি আমার বালকদাসীভালমন্দ খেতে ভালবাসি। রাম রাম রামজিভখানা কেটে ফেলো গিয়ে না খেলে মানুষ বাঁচে না, খিদে পেলে পৃথিবী অন্ধকার, তাই খাওয়া। তা বলে এটি খাব, ওটি খাব, সেটি খাব-এ কী আবদার! রামচন্দ্র।

ভালমন্দ খাওয়ার রুচি ওঁদের স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই। বার্ধক্যের সঙ্গে সে রুচি আরও বেড়েছে। এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বাধে। ডাক্তারকে মধ্যে মধ্যে মধ্যস্থতা করতে হয়। সেতাবের কথা শুনে ডাক্তার তাই হাসলেন।

সেতাব ভ্রূ কুঞ্চিত করে বললেন–হাসলি যে!

ডাক্তার বললেন–নিদান হাঁকতে বলছিলি না?

মুহূর্তে সেতাবের মুখ শুকিয়ে গেল। ডাক্তার সেটুকু লক্ষ্য করলেন–এবং সমাদরের সঙ্গে অভয় দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন–না-না, তা বলি নি, ভয় পাস নে, এখনও অনেক দেখবি রে তুই। দেরি আছে। রুচি এখনও সমানে আছে। কিন্তু আজ আর হালুয়াটা খাস্ নে। জ্বরটা একেবারে ছেড়ে যাক। বরং একবেলা আজ ঝোল-ভাত খাস। ওবেলা যদি আর জ্বর না আসে–কই দেখি দে, নাড়িটা দেখি। গায়ে হাত দিয়ে জ্বর ছাড়ছে বুঝে আর নাড়ি দেখি নি। জ্বর আসবে কি না দেখি। নাড়ি ধরে ডাক্তার হাসলেন, বললেন–না। জ্বর আর আসবে না মনে হচ্ছে। হালুয়া কাল তেকে আমি খাওয়াব। আজ না। কিন্তু হঠাৎ হালুয়াতে এমন রুচি হল কেন বল তো?

–চা-মুড়ির নাম শুনে বমি আসছে। বুঝেছি না? কী রকম অরুচি হয়ে গিয়েছে। তা তুই এক কাজ কর, দোকান থেকে চারখানা বিস্কুট আনিয়ে দিতে বল। তাই বলে যা। চায়ের সঙ্গে ভিজিয়ে সে ভাল লাগবে।

বিস্কুট নিজে পাঠিয়ে দেবেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডাক্তার উঠলেন। সেতাব-গৃহিণী এখনই তর্ক তুলবেন, রোগীর এই অবস্থায় মুড়ি বেশি উপযোগী অথবা বিস্কুট বেশি উপযোগী? একেবারে সমকক্ষ চিকিৎসকের মতই তর্ক তুলবেন। এবং প্রশ্ন করবেন—দেশে যে আগেকার কালে বিস্কুট ছিল না তখন রোগীরা খেত কী? এবং বিস্কুট খেত না বলে তারা কি মনুষ্যপদবাচ্য ছিল না, না তাদের রোগ সারত না? সেতাব-গৃহিণী নারী না হয়ে যদি পুরুষ হতেন তবে বড় উকিল হতে পারতেন। রাগ করে চেঁচামেচি করবেন না, নিজের খুঁটে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে কূটতর্ক করবেন; কার সাধ্য তাকে এক পা হটায়। এ-যুগে জন্মালেও জন্ম সার্থক হতে পারত। এখন তো মেয়েরাও উকিল জজ ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছেন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

ডাক্তারের মনের মধ্যেই কথাগুলি খেলে গেল। প্রকাশ্যে সেতাবকে বললেন– গিন্নিকে বলে। কাজ নাই। আমি বরং ফিরবার পথে বাজার থেকে দেখেশুনে কারুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুই যেন বাইরে থাকিস। বুঝলি!

নিজের পথ্য সম্পর্কে আশ্বস্ত হয়ে সেতাব এবার হাত ধরে বললেন–বোস বোস, একটু চা খেয়ে যা।

ডাক্তার হেসেই বললেন–চা খাব তো তোর বিস্কুট কিনে পাঠাবে কে? তা ছাড়া কৰ্মফল ভোগ, সেই বা কে করবে? দু-চার জন হাত দেখাতে আসবে তো! বসে থাকবে তারা। আমি উঠি।

বলেই তিনি উঠলেন।

সেতাব সম্পর্কে দুশ্চিন্তা কেটে গেছে তার। পরমানন্দ মাধব, পরমানন্দ মাধব! মৃদুস্বরে নাম জপ করতে করতে ভারী পা ফেলে তিনি অগ্রসর হলেন।

মাথার ছাতাটা একটু নামিয়ে মাথার উপর ধরলেন। সাধারণ লোকে—যাদের ঘরে রোগী আছে—তারা দেখতে পেলে তাকে ছাড়বে না।—ডাক্তারবাবু একটু দাঁড়ান। ছেলেটার হাত দেখে যান। কি—একবার আমার বাড়ি চলুন। আজ দশ দিন পড়ে আছে আমার বাবা–একবার ধাতটা দেখুন।

তারপর অনর্গল প্রশংসা। যার নাম নিছক তোষামোদ। বিনা পয়সায় একবার ডাক্তার দেখানো। ওতে অবশ্য জীবন মশায়ের খুব একটা আপত্তি বা দুঃখ নেই, কারণ বাপের আমল থেকে তার আমল পর্যন্ত বিনা ফিতেই গরিবগুনা মধ্যবিত্তদের ঘরে চিকিৎসা করে এসেছেন। কিন্তু এখন এই বয়সে আর না। তা ছাড়া এই বাদলা দিনের ঠাণ্ডা সকালবেলাতেও তাঁর কান ঝ ঝ করে উঠল। লোকে তাকে আর চায় না। হ্যাঁ, চায় না। বলে—সে আমলের ডাক্তার, তাও পাসকরা নয়। আসলে হাতুড়ে। এখনকার চিকিৎসায় কত উন্নতি হয়েছে। সেসবের কিছু জানে না।

কেউ কেউ বলে, গোবদ্যি।
হনহন করে হাঁটলেন ডাক্তার।

পথের পাশেই হাসপাতাল; পাশেই তৈরি হচ্ছে নতুন হেলথ সেন্টার। ওদিকে একবার না তাকিয়ে পারলেন না। যাবার সময়ও তাকিয়েছিলেন, তখন সব নিঝুম স্তব্ধ ছিল। এখন জেগেছে সব। হাসপাতালটার বারান্দায় কজন রোগী বইরে এসে বসেছে। ঝাড়ুদারেরা ঘুরছে স্বামী স্ত্রীতে। ওই নার্সদের ঘর থেকে দুজন নার্স বেরিয়ে চলেছে হাসপাতালের দিকে। এদিকে চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির বারান্দায় এর মধ্যেই কজন রোগী এসে গেছে। আরও আসছে। ওই ওদিকে হেলথ সেন্টারের নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। প্রকাণ্ড বড় বাড়ি। অনেক আয়োজন, অনেক বেড, অনেক বিভাগ, শিশুমঙ্গল, মাতৃমঙ্গল, সংক্রামক ব্যাধির বিভাগ, সাধারণ বিভাগ। সার্জারি বিভাগটা বড় হবে, তাতে রক্ত থেকে যাবতীয় পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। তা ভালই হচ্ছে। রোগে যে রকম দেশ ছেয়ে ফেলছে তাতে এমনি বিরাট ব্যবস্থা না হলে প্রতিবিধান হবে না। ডাক্তারের মনে পড়ল-প্রথমে হয়েছিল ওই চ্যারিটেবল ডিসপেনসারিটি। সে হল উনিশ শো দুই বা তিন সালে।

তার আগে–।

—প্ৰণাম ডাক্তারবাবু! কোথায় গিয়েছিলেন? ডাকে?

ডাক্তার চকিত হয়ে মুখ ফেরালেন। দেখলেন এখানকার চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির কম্পাউন্ডার হরিহর পাল তার পিছনেই সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ি থেকে ডিসপেনসারিতে আসছে, তাকে চিনেই বোধহয় বেল না দিয়ে রথ থেকে নেমে পদাতিক হয়ে তাঁকে সম্মান দেখিয়েছে। সস্নেহে ডাক্তার বললেন–ভাল আছ হরিহর?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

–তারপর খবর ভাল তো? কী রকম চলছে তোমার?

–ওই কোনো রকমে চলে যায় আর কি।

ডাক্তার বুঝলেন হরিহরের প্র্যাকটিস ভালই চলছে আজকাল। ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। বললেন–

পেনিসিলিন চালাচ্ছ খুব! এ তো পেনিসিলিনের যুগ!

–আজ্ঞে তা বটে। সবেই পেনিসিলিন। ওষুধটা খাটেও ভাল। বলতে বলতেই সামনের দিকে অর্থাৎ মশায়ের পিছনের দিকে তাকিয়ে হরিহর একটু চঞ্চল হয়ে বললে—ডাক্তারবাবু আসছেন আমাদের। আপনাদের গ্রাম থেকেই আসছেন দেখছি। ওঃ, বোধহয় মতি কর্মকারের মাকে দেখতে গিয়েছিলেন। কাল রাত্রে মতি এসেছিল, কল দিয়ে গিয়েছিল।

মনের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ-তরঙ্গ বয়ে গেল মশায়ের। তাকে অবিশ্বাস করেই তা হলে মতি কল দিয়ে গিয়েছে তার মাকে দেখতে? মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ালেন মশায়। ওদিকে হাসপাতালের নূতন ডাক্তারটির বাইসিক্ল দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে। জীবন মশায় নমস্কার করলেন—নমস্কার!

হাসপাতালের ডাক্তার নামলেন বাইসিক্ল থেকে। তরুণ বয়স, পরনে প্যান্ট, বুশ-শার্টের উপরে ওয়াটারফ, মাথায় অয়েলস্কিনের ঢাকনি-মোড়া শোলার হ্যাট। চোখে শেলের চশমা; কলকাতার অধিবাসী—নাম প্রদ্যোত বোস। প্রতিনমস্কার করে প্রদ্যোত ডাক্তার বললেন– ভাল আছেন?

–ভাল? তা রোগ তো নেই। সংসারে তো একেই ভাল থাকা বলে। তারপর মতির মাকে দেখে এলেন?

–হ্যাঁ। কাল রাত্রে মতি এসে বলে রাত্রেই যেতে হবে। তার মা নাকি যন্ত্রণায় অধীর অস্থির হয়ে পড়েছে। সে কিছুতেই ছাড়বে না। সেটা তো জানা। প্রথম যখন পড়ে যায় তখন কিছুদিন হাসপাতালে ছিল। কমেও গিয়েছিল বেদনা। তারপর বেদনা বেড়েছে আবার, বোধহয় ওই অবস্থাতেই ঘোরাফেরা কাজকর্ম করেছে। আমার ধারণা, আবারও ধাক্কাটাক্কা লাগিয়েছিল। আপনি তো দেখেছেন কাল বিকেলে। সবই তো জানেন।

–হ্যাঁ দেখেছি। তাই তো জিজ্ঞাসা করছি, কেমন দেখলেন?

–একটু পাকিয়ে গেছে, এক্স-রে না করলে ঠিক ব্যবস্থা তো হবে না। ভিতরে কোথাও হাড়ের আঘাত গুরুতর হয়েছে, ফেটে থাকতে পারে, যদি ফ্র্যাকচার হয়ে হাড়ের কুচিটুচি থাকে তো অপারেশন করতে হবে। ব্যবস্থা হলেই সেরে যাবে। মারাত্মক কিছু নয়। ঠোঁট দুটিতে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি ফুটিয়ে তুললেন তিনি।

মশায় একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, কুচিটুচি নেই। ফ্র্যাকচার নয়। ব্যথাটা সরে নড়ে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ফুলোটাও। আমার অবিশ্যি সার্জারিতে বিদেবুদ্যি নাই। ভাল বুঝি না। বুঝি নাড়ি। আমার যা মনে হল—তাতে ওটা উপলক্ষ। যাকে বলে হেতু। আসলে–কথাটা অর্ধসমাপ্ত রেখে একটু হেসে ইঙ্গিতের মধ্যে বক্তব্য শেষ করলেন।

প্রদ্যোত ডাক্তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে একটু কড়া সুরেই বললেন–হ্যাঁ—আপনি তো জ্ঞানগঙ্গার ব্যবস্থা দিয়ে এসেছেন। হাসলেন প্রদ্যোত ডাক্তার। এবার রসিকতা করেই বললেন–আমি গিয়ে দেখি ভয়ে বুড়ির এমন প্যালপিটেশন হচ্ছে যে, জ্ঞানগঙ্গাও আর পৌঁছুতে হবে না। স্টেশনে যাবার জন্য গাড়িতে তুলতে তুলতেই হার্টফেল করবে।

আরও একটু হেসে নিলেন প্রদ্যোত ডাক্তার। তারপর বললেন–নাঃ, বেঁচে যাবে বুড়ি! মতি কিছু খরচ করতে প্রস্তুত আছে, বাকিটা হাসপাতাল থেকে ব্যবস্থা করে ওকে আমি খাড়া করে দেব। ওকে মরতে আমি দেব না।

শেষের কথাটিতে প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্যের ব্যঙ্গ রনরন করে বেজে উঠল। মনে হল ডাক্তার তীর ছুঁড়লে—তীরটা তার মাথায় খাটো-করে-ছাঁটা চুলগুলি স্পর্শ করে বেরিয়ে চলে গেল; তীরটার দাহ–তীরটা তার কপালে কি ব্ৰহ্মতালুতে বিদ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা থেকেও শতগুণে মর্মান্তিক।

ঘাড় নেড়ে মশায় বললেন–আমাকে মারতে হবে না ডাক্তারবাবু, বুড়ি নিজেই মরবে। তিন মাস কি ছ মাস-এর মধ্যেই ও যাবে। ওর অনেক ব্যাধি পোষা আছে। এই আঘাতের তাড়সে সেগুলি–

প্রদ্যোতবাবু চকিতে ঘাড় তুললেন—তারপর বাধা দিয়ে বললেন–পেনিসিলিন, স্ক্রেপ্টোমাইসিন—এক্স-রে–এসবের যুগে ওভাবে নিদান হাকবেন না। এগুলো ঠিক নয়। জড়ি বুটি সর্দি পিত্তি এসবের কাল থেকে অনেক দূর এগিয়ে এসেছি আমরা। তা ছাড়া এসব হল ইনহিউম্যান—অমানুষিক।

এরপর জীবন মশায়কে আর কথা বলার অবকাশ না দিয়েই প্রদ্যোত ডাক্তার বললেন– আচ্ছা নমস্কার, চলি। দেরি হয়ে যাচ্ছে হাসপাতালের সঙ্গে সঙ্গে বাইসিক্লে উঠে ভিতরের দিকে চালিয়ে দিলেন দ্বিচক্রযানখানিকে। কটু কথা বলে মানুষের কাছে চক্ষুলজ্জা এড়াবার জন্য মানুষ এমনি নাটকীয়ভাবেই হঠাৎ পিছন ফিরে চলে যায়।

খানিকটা গিয়ে আবার নেমে বললে—আসবেন একদিন, আমাদের ব্যবস্থা দেখলেই বুঝতে পারবেন সব। নতুন নতুন কেসের সব অদ্ভুত ট্রিটমেন্টের হিস্ট্রি পড়ে শোনাব–মেডিক্যাল জার্নাল থেকে। হাতুড়ে চিকিৎসা ছাড়া এককালে যখন চিকিৎসা ছিল না তখন যা করেছেন করেছেন। কিন্তু একালে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা যখন হয়েছে, লোকে পাচ্ছে—তখন ওই হাতুড়ে চিকিৎসা ফলানো মারাত্মক অপরাধ। অন্য দেশ হলে শাস্তি হত আপনার।

কঠিন হয়ে উঠেছে তরুণ ডাক্তারটির মুখ।

জীবন মশায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি অপরাধী? অন্য দেশ হলে তার শাস্তি হত?

এত বড় কথা বলে গেল ওই ছোকরা ডাক্তার? জীবন ডাক্তার স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েই রইলেন; কয়েকটি রোগী হাসপাতালে ঢুকবার সময় তাকে দেখে থমকে দাঁড়াল, সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। জীবন মশায় লক্ষ্য করলেন না। তিনি আত্মসংবরণ করছিলেন। এ তো তার পক্ষে নতুন নয়। দীর্ঘ জীবনে পাস-করা ডাক্তার এখানে অনেক এল-অনেক গেল। জেলা থেকে বড় ডাক্তারও এসেছেন। কলকাতা থেকেও এসেছিলেন। মতভেদ হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনি অবজ্ঞাও তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে জীবন মশায়ই অভ্রান্ত। না, জীবন মশায় নয়—তিনি নয়, নাড়িজ্ঞান-যোগ অভ্রান্ত।

মনে পড়ছে। সব ঘটনাগুলি মনে পড়ছে।

পিতামহ দীনবন্ধু দত্ত এই জ্ঞানযোগ পেয়েছিলেন এখানকার বৈদ্যকুলতিলক কৃষ্ণদাস সেন কবিরাজ মহাশয়ের কাছে।

আবার তিনি চলতে শুরু করলেন।

Category: আরোগ্য-নিকেতন (১৯৫৩)
পূর্ববর্তী:
« ০১. উনিশশো পঞ্চাশ সাল–বাংলা তেরশো ছাপ্পান্ন
পরবর্তী:
০৩. জীর্ণ আরোগ্য-নিকেতনের দাওয়ায় »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑