০২৬. সঞ্জয়ের সময়োচিত উপদেশ

২৬তম অধ্যায়

সঞ্জয়ের সময়োচিত উপদেশ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে ধৰ্মরাজ! আপনার সমস্ত কাৰ্য্য ধর্ম্মানুগত বলিয়া লোকমধ্যে বিশ্রুত ও দৃষ্ট হইয়া থাকে। অতএব আপনি আপনার মহতী কীর্ত্তি ও জীবন অনিত্য বিবেচনা করিয়া ক্ৰোধাভরে ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগের সংহারে প্রবৃত্ত হইবেন না। হে অজাতশত্ৰো! কৌরবগণ বিনা যুদ্ধে কখনই আপনাকে রাজ্য প্রদান করিবেন না। কিন্তু আমার মতে যুদ্ধে রাজ্যলাভ করা অপেক্ষা অন্ধক ও বৃষ্ণিরাজ্যে ভিক্ষাবৃত্তিদ্বারা উদরপূর্ত্তি করাও শ্ৰেয়স্কর। বিবেচনা করিয়া দেখুন, মনুষ্যের জীবন ক্ষণভঙ্গুর ও দুঃখময়। বিশেষতঃ, আপনি যেরূপ যশস্বী, কুরুকুলের হিংসা করা কদাপি আপনার বিধেয় নহে; অতএব আপনি এই পাপানুষ্ঠানে নিরত হউন। হে নরেন্দ্র! ধর্ম্মবিনাশিনী বিষয়বাসনা সকল মনুষ্যকে আক্রমণ করে; কিন্তু বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাহার পরতন্ত্র [অধীন] না হইয়া লোকে মহতী কীর্ত্তি লাভ করিয়া থাকে। অর্থতৃষ্ণা অতি বলবতী, তাহাতে অভিভূত হইলে অবশ্যই ধর্ম্মনাশ হয়। অতএব যে ব্যক্তি ধর্মে একান্ত অনুরক্ত, তিনিই যথাৰ্থ বুদ্ধিমান। কামপরতন্ত্র হইলে অর্থনুরোধে হীনপ্রবৃত্তি জন্মে। লোকে ধর্ম্মানুযায়ী কর্ম্ম করিলে সূর্য্যের ন্যায় প্রতাপশালী হইয়া উঠে; কিন্তু ধর্ম্মবিহীন হইলে সমুদয় ভূমণ্ডলের অধীশ্বর হইয়াও সতত বিষাদে কালব্যাপন করিতে হয়। আপনি বেদাধ্যয়ন, ব্ৰহ্মচৰ্য্যানুষ্ঠান, যজ্ঞে ব্রাহ্মণগণকে ধনপ্রদান ও পরলৌকিক সুখের নিমিত্ত বহুদিবস আত্মসমর্পণ [আত্মনিয়োগ-সর্ব্বপ্ৰাণে ধর্ম্মানুষ্ঠান] করিয়াছেন, এইক্ষণে আপনার ন্যায় ধাৰ্মিক ও বুদ্ধিমান আর কে আছে? যে ব্যক্তি কেবল ভোগসুখে নিমগ্ন থাকিয়া যোগাভ্যাসে বিমুখ হয়, সে ধনক্ষয়ে দুঃখিত, সুখভোগে বঞ্চিত ও বাসনায় একান্ত অভিভূত হইয়া নিরন্তর দুঃখভোগ করিতে থাকে। আর যে ব্যক্তি পরলোকে অশ্রদ্ধা প্ৰকাশ করিয়া ব্ৰহ্মচৰ্য্য ও অন্যান্য ধর্ম্ম পরিত্যাগপূর্ব্বক অধর্ম্মাচরণ করে, তাহাকে দেহত্যাগানন্তর পরকালে অশেষ প্রকার অনুতাপ করিতে হয়।

“পরলোকে পুণ্য বা পাপের ক্ষয় হয় না, মনুষ্যকে জন্মান্তরে পূর্ব্বকৃত স্বকীয় কর্মের ফলভোগ করিতে হয়। হে মহারাজ! আপনি যে বহুদক্ষিণ যজ্ঞে ব্রাহ্মণগণকে ন্যায়ানুসারে শ্রদ্ধাপূর্ব্বক সুগন্ধরস সম্পন্ন অন্ন প্ৰদান এবং সজনগণসমভিব্যাহারে অতি প্রশস্ত অন্যান্য পারলৌকিক কার্য্যকলাপ সম্পাদন করিয়াছেন, তাহা এই ভূমণ্ডলে সর্ব্বত্র প্রচারিত হইয়াছে। হে রাজন! মনুষ্যগণ ইহলোকেই ধর্ম্মানুষ্ঠান করিয়া থাকে। পরলোক কৰ্মভূমি নহে, তথায় জরা, মৃত্যু, ভয়, ক্ষুধা, পিপাসা, অপ্রীতি প্রভৃতি কিছুই নাই এবং ইন্দ্ৰিয়প্রীতিসাধন ব্যতীত অন্য কোনো কর্ম্মও করিতে হয় না। যাহা হউক, আপনি কি ঐহিক, কি পারিত্রিক, কোনো সুখলাভবাসনায় কাৰ্য্যানুষ্ঠান করিবেন না; এরূপ কর্ম্ম করুন, যাহাতে স্বৰ্গ বা নরক-এ। উভয়ের কোনো স্থানেই গমন করিতে না হয়। হে মহারাজ! এক্ষণে আপনারই জ্ঞানপ্রভাবে কর্ম্মসমুদয় বিনষ্ট হইবার সময় উপস্থিত হইয়াছে; অতএব এমন সময়ে সত্য, দম [বাহ্য ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ], আৰ্জব [সরলতা] ও অনুশংসতা [অক্ররতা—অরুক্ষ ব্যবহার] পরিত্যাগ করিবেন না, বরং কালব্যাপনের নিমিত্ত রাজসূয় ও অশ্বমেধ প্রভৃতি পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠান করুন, কিন্তু পাপকর্ম্মানুষ্ঠানে কদাপি প্রবৃত্ত হইবেন না।

“হে পাণ্ডব! যদি আপনি পরিশেষে এই জ্ঞাতিবধরূপ পাপানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইবেন, তবে কি নিমিত্ত এতাবৎকাল দারুণ বনবাসক্লেশ সহ্য করিলেন? এই সমুদয় সৈন্য তখনও আপনার অধীন ছিল। মহাবীর জনাৰ্দন ও সাত্যকি এবং সচিবগণ চিরকালই আপনার বশীভূত আছেন। মহারাজ মৎস্যরাজ ও তাঁহার মহাবলপরাক্রান্ত পুত্ৰগণ এবং আপনাদের পূর্ব্বনির্জিতভূপতিসমুদয় অবশ্যই আপনাদের পক্ষ হইতেন, তাহা হইলে আপনি মহাসহায়সম্পন্ন হইয়া বাসুদেব ও অর্জ্জুনের সাহায্যে অনায়াসে শত্রুপক্ষীয় মহারথগণকে সংহারপূর্ব্বক দুৰ্য্যোধনের দর্প চূৰ্ণ করিতে পারিতেন; কিন্তু তখন তাহা না করিয়া বহু বৎসর বনে বাসপূর্ব্বক শক্রবর্গের বলবৰ্দ্ধন ও স্বীয় সহায়গণের বলহ্রাস করিয়া এখন কি নিমিত্ত এই অনুপযুক্ত সময়ে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইতেছেন? অপ্রাজ্ঞ ও ধর্ম্মজ্ঞ এই উভয়ই সমরে শত্ৰুগণকে পরাজয় করিয়া ঐশ্বৰ্য্য লাভ করিতে পারে, প্ৰাজ্ঞ ব্যক্তিরাও দৈববশতঃ কখন কখন যুদ্ধে পরাজিত হইয়া ঐশ্বৰ্য্যভ্ৰষ্ট হয়েন।

“হে যুধিষ্ঠির! আপনি ত’ কখনই ক্রোধের বশীভূত হইয়া পাপচিন্তা বা পাপাচরণ করেন নাই, তবে কি নিমিত্ত এক্ষণে এই প্রজ্ঞাবিরুদ্ধ দুষ্ককর্ম্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইতেছেন? যাহা হউক, এক্ষণে এই যশোনাশক পাপফলপ্ৰদ অসত্যের দুস্ত্যাজ্য [যাহা সহজে পরিত্যাগ করা যায় না] ক্ৰোধ পরিত্যাগ করিয়া শান্ত হউন। আমার মতে, আপনার পক্ষে রাগ অপেক্ষা ক্ষমাই শ্ৰেয়ঃ। দেখুন, যুদ্ধ করিয়া রাজ্যলাভ করিতে হইলে শান্তনুনন্দন ভীষ্ম, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কৃপ, শল্য, সৌমদত্তি, বিকৰ্ণ, বিবিংশতি, কর্ণ ও দুৰ্য্যোধনকে বিনাশ করিতে হইবে। তাহা হইলে আপনার কি সুখলাভের সম্ভাবনা? আর দেখুন, আপনি সমুদয় পৃথিবীর অধীশ্বর হইলেও জরা, মৃত্যু এবং প্রিয়, অপ্রিয় ও সুখদুঃখ-ইহার কিছুই অতিক্রম করিতে পরিবেন না; অতএব যুদ্ধাভিলাষ পরিত্যাগ করুন। আর যদি অমাত্যগণের ইচ্ছানুসারে এই কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন, তবে তাঁহাদের উপর সমুদয় ভার সমর্পণ করিয়া স্বয়ং ঔদাসীন্য অবলম্বন করুন। হে ধৰ্মরাজ! আপনি জ্ঞাতিদ্রোহরূপ পাপপঙ্কে নিমগ্ন হইয়া কদাচ সজ্জনানুগত পথ পরিত্যাগ করিবেন না।”