০০৮. সশচী-ইন্দ্ৰদুঃখশ্রবণে যুধিষ্ঠিরের ইচ্ছা

৮ম অধ্যায়

সশচী-ইন্দ্ৰদুঃখশ্রবণে যুধিষ্ঠিরের ইচ্ছা

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে রাজন! দেবরাজ ইন্দ্র ভাৰ্য্যাসমভিব্যাহারে কিরূপে দুঃসহ দুঃখভোগ করিয়াছেন, শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে।”

শল্য কহিলেন, “হে ধৰ্মরাজ! সুররাজ ইন্দ্র যেরূপে ভাৰ্য্যাসমভিব্যাহারে দারুণ দুঃখভোগ করিয়াছিলেন, সেই পুরাণবৃত্তান্ত কহিতেছি, শ্রবণ করুন। পূর্ব্বকালে দেবশ্রেষ্ঠ মহাতপঃ তুষ্টা নামে এক প্রজাপতি ছিলেন। তিনি ইন্দ্রের অনিষ্টসাধনের নিমিত্ত এক ত্রিশিরা পুত্র উৎপাদন করেন। ত্রিশিরা একবদনে বেদাধ্যয়ন ও অন্যবদনে সুরাপান করিতেন। তাঁহার আর একটি বদন অবলোকন করিলে বোধ হইত যেন, তিনি ঐ বদনে সমুদয় দিগবিদিক গ্ৰাস করিবার নিমিত্ত ইতস্ততঃ নিরীক্ষণ করিতেছেন। মহামতি ত্রিশিরা ইন্দ্ৰপদগ্রহণমানসে নিতান্ত শান্ত ও অতিশয় দান্ত হইয়া কঠোর তপস্যা আরম্ভ করিলেন।

“সুররাজ শতক্ৰতু তুষ্টৃতনয়ের ধর্ম্মপরতা, তপোনিষ্ঠা ও সত্যানুষ্ঠানসন্দর্শনে স্বীয় ইন্দ্ৰত্বপদের লোপাশঙ্কায় যৎপরোনাস্তি বিষন্ন হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন, “এক্ষণে কিরূপে ত্ৰিশিরাকে তপানুষ্ঠান হইতে বিরত করিয়া ভোগে আসক্ত করিব? ঐ ব্যক্তি ক্ৰমে ক্রমে তপঃপ্রভাবে অনায়াসে সমুদয় ভুবন গ্ৰাস করিতে সমর্থ হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”

ইন্দ্ৰকর্ত্তৃক ত্বষ্টৃপুত্ৰী ত্রিশিরার তপোভঙ্গ প্রয়াস

“ধীমান্য পুরন্দর মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া পরিশেষে অপ্সরাদিগকে আহ্বানপূর্ব্বক কহিলেন, “হে বারাঙ্গনাগণ! তোমরা সত্বর শৃঙ্গারবেশ ধারণপূর্ব্বক ত্বষ্টৃনন্দনের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া হাবভাব ও লাবণ্যদ্বারা তাহাকে প্রলোভিত করিয়া ভোগে আসক্ত কর। আমি তাহার তপঃপ্রভাবে নিতান্ত ভীত হইয়াছি; আমার অন্তরাত্মা সাতিশয় ব্যাকুল হইতেছে। তোমরা সত্বর আমার এই মহদভয় বিনাশ কর।”

“অপ্সরাগণ কহিল, “হে সুররাজ! আমরা যথাযোগ্য যত্নসহকারে তাঁহাকে প্রলোভিত করিয়া আপনার ভয় বিনাশ করিতে চেষ্টা করিব। ঐ তপোধন যুবা, স্বীয় নয়নদ্বারা সমুদয় জগৎ দগ্ধপ্ৰায় করিতেছেন; আমরা সকলে একত্ৰ হইয়া অচিরাৎ তাঁহার সমীপে গমনপূর্ব্বক প্রলোভনদ্বারা তাঁহাকে বশীভূত করিয়া আপনার ভয় নিবারণ করিব।”

“অনন্তর অপ্সরাগণ ইন্দ্রের আদেশানুসারে ত্রিশিরার নিকট গমনপূর্ব্বক প্রত্যহ হাবভাব ও অঙ্গসৌষ্ঠব প্রদর্শন করিয়া তাঁহাকে প্রলোভিত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু মহানুভব তুষ্টনন্দন ইন্দ্ৰিয়সংযমপূর্ব্বক পূর্ণসাগরের ন্যায় গভীরভাবে অবস্থান করিতেছিলেন; সেই সমুদয় সুরবারাঙ্গনাকে [স্বৰ্গবেত্যা] অবলোকন করিয়াও অণুমাত্ৰ প্ৰহৃষ্ট বা বিচলিত হইলেন না। অপ্সরাগণ যখন যথাসাধ্য যত্নসহকারেও তাঁহাকে প্রলোভিত করিতে সমর্থ হইল। না, তখন পুনরায় শত্রুসন্নিধানে গমনপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে কহিল, ‘সুররাজ! সেই তপোধন যুবাকে ধৈৰ্য্যচ্যুত করা দুঃসাধ্য। আমরা অশেষ প্রকার কৌশলেও তাঁহাকে বিচলিত করিতে পারিলাম না; এক্ষণে আপনি উপায়ান্তর অবলম্বন করুন।”

ত্ৰিশিরার বধাৰ্থ নিক্ষিপ্ত বজ্রের বিফলতা

“সুররাজ অপ্সরাদিগের বাক্যশ্রবণানন্তর যথোচিত সম্মানপূর্ব্বক বিদায় করিয়া ত্রিশিরার বধোপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ স্থিরচিত্তে অনুধাবন করিয়া স্থির করিলেন যে, “উহার উপরে বজ্র প্রহার করাই কর্ত্তব্য; তাহা হইলে অবশ্যই বিনষ্ট হইবে বলবান ব্যক্তিও দুর্ব্বল শক্রকে কদাচ উপেক্ষা করিবেন না।” দেবরাজ এইরূপ কৃতনিশ্চয় হইয়া ত্রিশিরার উপর অগ্নিসদৃশ ঘোরতর বজ্রপ্রহার করিলেন। তুষ্টনন্দন বজ্রাঘাতে নিহত হইয়া ভগ্নপর্ব্বতশিখরের ন্যায় ধরাতলে নিপতিত হইলেন; কিন্তু তাঁহার তেজের কিছুমাত্র হ্রাস হইল না। অশনিপ্ৰহারে নিহত হইলেও তাঁহাকে জীবিত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। তাঁহার মুখমণ্ডলসকল কিছুমাত্র মলিন হইল না। সুররাজ পুরন্দর তাঁহার তেজঃপ্রভাবসন্দর্শনে নিতান্ত ভীত ও অস্বস্থ হইয়া মনে মনে ইতিকর্ত্তব্যতা অবধারণ করিতেছেন, এমন সময়ে একজন সূত্রধর পরশু স্কন্ধে করিয়া সেই বনে সমুপস্থিত হইল। সুররাজ তাহাকে দেখিবামাত্র অঙ্গুলিদ্বারা ত্রিশিরাকে প্রদর্শন করাইয়া কহিলেন, “সূত্রধর! সত্বর ইহার মস্তকচ্ছেদন কর।”

“সূত্রধর কহিল, “এই ব্যক্তির স্কন্ধাদেশ সাতিশয় বিপুল; আমার পরশুদ্বারা উহা ছেদন করা দুঃসাধ্য; বিশেষতঃ আমি এই সাধুবিগৰ্হিত কর্মে হস্তক্ষেপ করিতে নিতান্ত অসম্মত।”

“ইন্দ্ৰ কহিলেন, “তোমার কিছুমাত্র ভয় নাই, তুমি শীঘ্র আমার বচনানুরূপ কাৰ্য্য কর; আমার প্রসাদে তোমার অস্ত্ৰ বজ্ৰকল্প হইবে।”

“সূত্রধর কহিল, আপনি কে, কি নিমিত্তই বা এই নৃশংস ব্যাপারে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, যথার্থ করিয়া বলুন, শুনিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে।”

“ইন্দ্ৰ কহিলেন, “আমি দেবরাজ ইন্দ্ৰ, তুমি কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া সত্বর আমার বাক্যানুরূপ কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হও।”

“সূত্রধর কহিল, “হে সুররাজ! আপনি এই ক্রুরকর্মে প্রবৃত্ত হইয়া কি নিমিত্ত লজ্জিত হইতেছেন না? আর এই ঋষিকুমারের নিধনজনিত ব্ৰহ্মহত্যাপাপে লিপ্ত হইতে কি নিমিত্তই বা ভীত হন না?”

“ইন্দ্ৰ কহিলেন, “আমি এই পাপ হইতে বিমুক্ত হইবার নিমিত্ত পরে অতি কঠোর ধর্ম্মানুষ্ঠান করিব। এই মহাবীৰ্য্যসম্পন্ন পুরুষ আমার পরম শত্রু; আমি বজ্রাঘাতে ইহাকে সংহার করিয়াছি, তথাপি আমার শঙ্কা দূর হয় নাই, ইহার তেজঃপ্রভাবে নিতান্তই ভীত হইতেছি, অতএব তুমি সত্বরে ইহার শিরশ্ছেদন করিয়া আমার উদ্বেগ দূর কর। আমি বরপ্রদান করিতেছি যে, অদ্যাবধি মানবগণ যজ্ঞানুষ্ঠানসময়ে তোমাকে যজ্ঞভাগাস্বরূপ পশুমস্তক প্ৰদান করিবে।”

ইন্দ্রাদেশে সূত্রধরকর্ত্তৃক ত্রিশিরার শিরচ্ছেদ

“তখন সূত্ৰধর ইন্দ্রের বচনানুসারে কুঠারদ্বারা ত্রিশিরার মস্তকত্ৰয় ছেদন করিলে তৎক্ষণাৎ তন্মধ্য হইতে কপিঞ্জল, তিত্তির ও কলবিঙ্ক, এই তিন প্রকার পক্ষী নিষ্ক্রান্ত হইল। মহাতেজাঃ ত্রিশিরা যে মুখে বেদাধ্যয়ন করিতেন, তাহা হইতে কপিঞ্জলসকল বহির্গত হইতে লাগিল; তাঁহার যে মুখ দেখিলে বোধ হইত যে, যেন তিনি ঐ বদনদ্বারা সমুদয় দিগবিদিক গ্ৰাস করিতে উদ্যত হইয়াছেন, সেই মুখ হইতে তিত্তিরসমুদয় বিনির্গত হইল এবং তিনি যে মুখে সুরা পান করিতেন, তাহা হইতে কলবিঙ্কসকল নিষ্ক্রান্ত হইতে লাগিল। এইরূপে সুররাজ ইন্দ্র আপনাকে কৃতকার্য্য জ্ঞান করিয়া হৃষ্টচিত্তে সুরলোকে গমন করিলেন, সূত্ৰধরও স্বগৃহে প্ৰতিগমন করিল।

“এ দিকে প্রজাপতি তুষ্ট ইন্দ্ৰকর্ত্তৃক স্বীয় পুত্ৰ বিনষ্ট হইয়াছে শ্রবণ করিয়া রোষকষায়িতলোচনে কহিতে লাগিলেন, “আমার পুত্ৰ ক্ষমাশীল, দান্ত ও জিতেন্দ্ৰিয় হইয়া তপস্যানুষ্ঠান করিতেছিল, দুরাত্মা পুরন্দর বিনা অপরাধে তাহাকে বিনষ্ট করিয়াছে। আমি এই অপরাধে তাহাকে সংহার করিবার নিমিত্ত বৃত্রকে উৎপাদন করিব। এক্ষণে সমুদয় লোক ও সেই দুরাত্মা শতক্ৰতু আমার তপঃপ্রভাব অবলোকন করুক।” ত্বষ্টা এই কথা বলিয়া ক্রোধাভরে আচমনপূর্ব্বক অগ্নিতে আহুতি প্ৰদান করিয়া বৃত্ৰকে উৎপাদন করিলেন এবং কহিলেন, “হে ইন্দ্রশত্ৰো! তুমি আমার তপঃপ্রভাবে বর্দ্ধিত হও”। প্রজাপতি ত্বষ্টা এই কথা কহিবামাত্র সুয্যাগ্নিসন্নিভ বৃত্রের কলেবর আকাশ ভেদ করিয়া ক্ৰমে বৰ্দ্ধিত হইতে লাগিল। তখন সে প্রজাপতিকে কহিল, “মহাশয় আজ্ঞা করুন, কোন কাৰ্য্য সাধন করিতে হইবে?” ত্বষ্টা কহিলেন, “তুমি সুরলোকে গমনপূর্ব্বক ইন্দ্রকে সংহার কর।”

ত্বষ্টার উৎপাদিত বৃত্ৰাসুরসহ ইন্দ্রের যুদ্ধ

“প্রলয়কালসমুদিতদিবাকরসন্নিভ মহাপ্রভাবশালী বৃত্র ত্বষ্টার আজ্ঞানুসারে সত্বর সুরপুরে গমন করিয়া ইন্দ্রের সহিত ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ করিল; পরিশেষে ক্রোধাভরে সুররাজকে আক্রমণপূর্ব্বক স্বীয় বক্তমধ্যে নিক্ষেপ করিল দেখিয়া দেবগণ সসম্ভ্রমে বৃত্ৰবিনাশার্থ জৃম্ভিকাস্ত্র [যাহাদ্বারা প্রহৃত ব্যক্তি কেবল হাই তোলে] পরিত্যাগ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত বৃত্ৰ জৃম্ভিকাস্ত্র-প্রভাবে মুখবাদানপূর্ব্বক জৃম্ভণ [হাই ত্যাগ] করিবামাত্র দেবরাজ স্বীয় শরীরসঙ্কোচনপূর্ব্বক সত্বর নিষ্ক্রান্ত হইলেন। তদ্দর্শনে সুরগণের আর আহ্লাদের পরিসীমা রহিল না। হে মহারাজ! জৃম্ভা সেই অবধি লোকের প্রাণবায়ু আশ্রয় করিয়া রহিল।

“অনন্তর বৃত্র ও বাসবের পুনরায় ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। উভয়েই রোষাভরে বহুক্ষণ যুদ্ধ করিলেন। পরিশেষে মহাবলপরাক্রান্ত বৃত্ৰ ত্বষ্টার তপঃপ্রভাবে সমরাঙ্গনে পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিল দেখিয়া সুররাজ সাতিশয় ভীত হইয়া রণ পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিলেন। তখন দেবগণ যৎপরোনাস্তি দুঃখিত ও ত্বষ্টার তেজে বিমোহিত হইয়া মুনিগণসমভিব্যাহারে মন্দরপর্ব্বতের শিখরদেশে ইন্দ্রের সমীপে আগমনপূর্ব্বক বৃত্রের বিনাশসাধনের নিমিত্ত মন্ত্রণা করিয়া মনে মনে মহাত্মা বিষ্ণুর শরণ গ্রহণে কৃতনিশ্চয় হইলেন।”