১১. নারী-বেশধারী অর্জ্জুনের প্রবেশ

১১তম অধ্যায়

নারী-বেশধারী অর্জ্জুনের প্রবেশ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর পরমসুন্দর উন্নতকায় অর্জ্জুন স্ত্রীলোকের ন্যায়। কুণ্ডলযুগল, শঙ্খ, বলয় ও অঙ্গদ ধারণ এবং সুদীর্ঘ কেশকলাপ উন্মোচনপূর্ব্বক বিরাটরাজের সভামণ্ডপে গমন করিতে লাগিলেন। গমনকালে ভূমণ্ডল বিকম্পিত হইতে লাগিল। রাজা সেই পরম-তেজঃসম্পন্ন প্রচ্ছন্নরূপী গজেন্দ্ৰবিক্রম মহেন্দ্ৰ-তনয়কে নিরীক্ষণ করিয়া সভ্যগণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই ব্যক্তি কোথা হইতে আসিতেছেন? আমি পূর্ব্বেত কখনই এই রূপ দৰ্শন বা শ্রবণ করি নাই।” সভ্যেরা কহিলেন, “মহারাজা! ইনি যে কে, আমরা ইহার কিছুই বলিতে পারি না।”

অনন্তর বিরাটরাজ বিস্ময়োৎফুল্ল-লোচনে অর্জ্জুনকে কহিলেন, “হে মহানুভব! তুমি স্ত্রীলোকের ন্যায় কুণ্ডলযুগল, শঙ্খ, বলয় ও অঙ্গদ ধারণ এবং কেশ-কলাপ উন্মোচন করিয়াছ, অথচ পুরুষের ন্যায় শর, শরাসন ও বর্ম্মধারণ করিয়া সাতিশয় শোভা পাইতেছ; তোমার অমরসদৃশ রূপ ও মাতঙ্গসদৃশ বিক্রম দর্শনে তোমাকে ক্লীব বলিয়া কোন মতেই বিশ্বাস হইতেছে না। অতএব তুমি যানে আরোহণপূর্ব্বক স্বেচ্ছানুসারে ভ্রমণ কর। অদ্যাবধি তুমি আমার পুত্র বা আমারই তুল্য হইলে। আমি নিতান্ত বৃদ্ধ, সমস্ত রাজকাৰ্য্য-পৰ্য্যালোচনে একান্ত অসমর্থ হইয়াছি; অতএব তুমিই এক্ষণে মৎস্যদেশ শাসন কর।”

অর্জ্জুন কহিলেন, “মহারাজ! আমি নৃত্য-গীত ও বাদ্যে দক্ষতা লাভ করিয়াছি; অতএব দেবী উত্তরাকে নৃত্যশিক্ষা করাইবার নিমিত্ত আমাকে নিয়োগ করুন। আমার নাম বৃহন্নলা। যে কারণে আমি এইরূপ হইয়াছি তাহা আপনাকে আর কি বলিব, উহা স্মরণ হইলে আমার হৃদয় শোকে বিদীর্ণ হইয়া যায়। হে রাজন! আপনি আমাকে পিতৃ-মাতৃহীন পুত্র বা কন্যা বলিয়া জ্ঞাত হইবেন।” বিরাট কহিলেন, “হে বৃহন্নলে! আমি তোমার মনোরথ পূর্ণ করিতেছি, তুমি আমার কন্যা ও তদনুরূপ অন্যান্য নারীগণকে নৃত্যপ্রয়োগবিষয়ে সুনিপুণ কর। কিন্তু আমার মতে এই কাৰ্য্য তোমার সমুচিত হয় নাই। তুমি এই সসাগরা ধরাসনের উপযুক্তপাত্র।”

তদনন্তর মৎস্যরাজ অর্জ্জুনের নৃত্য, গীত, বাদ্য প্রভৃতি কলাসমূদয়ে বিশেষ নৈপুণ্য সন্দর্শনপূর্ব্বক মন্ত্রিগণের সহিত পরামর্শ স্থির করিয়া অবিলম্বে স্ত্রীলোক দ্বারা তাঁহার পরীক্ষা করাইলেন। পরে তাহাদিগের বাক্যে তাঁহাকে প্রকৃত ক্লাব স্থির করিয়া অন্তঃপুরগমনে অনুমতি করিলেন। তিনি তথায় নিরন্তর বাস করিয়া রাজকুমারী উত্তরা এবং তাঁহার সখী ও পরিচারিকাগণকে নৃত্য-গীত-বাদ্যে সম্যক শিক্ষা প্রদানপূর্ব্বক ক্রমশঃ তাঁহাদিগের একান্ত প্রিয়পাত্ৰ হইয়া উঠিলেন।

হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর অর্জ্জুন নর্ত্তকের কার্য্য অবলম্বনপূর্ব্বক নারীগণের সহিত অন্তঃপুরে বাস করিতে লাগিলেন; বাহ্যাভ্যন্তরচারী পুরুষেরা কেহই এই গুঢ় ব্যাপার অবগত হইতে পারিল না।