কলাবতী

কলাবতী – মতি নন্দী

স্পোর্টিংলি আমাকে বিচার করবেন

”কম্পিটিটারস ফর দ্য গো অ্যাজ ইউ লাইক ইভেণ্ট, প্লিজ বি রেডি।”

অ্যামপ্লিফায়ারে কথাটা দুবার গাঁক গাঁক করল। তাই শুনে লেডিজ পার্কের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মেয়েরা তাড়াতাড়ি এগোল শামিয়ানার দিকে।

কাঁকুড়গাছি উচ্চচ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের বাৎসরিক স্পোর্টসের শেষ ইভেণ্ট টিচারদের ব্যালান্স রেস তখন শুরু হতে যাচ্ছে। এটা আসলে ছিল ১০০ মিটার দৌড়।

কিন্তু অনেকেই আপত্তি জানান, অতটা দৌড়তে গেলে তাদের দমে কুলোবে না। তিন দিন তর্কের পর ঠিক হয়, ৫০ মিটার ব্যালান্স রেস। এরপর চার দিন গভীর আলোচনা হয়, কী দিয়ে ব্যালান্স হবে? মাথায় কলসি, হাঁড়ি, সরা, বই—খাতা না দাঁতে চেপে থাকা চামচে রসগোল্লা নিয়ে?

দেশে খরা চলছে, দুঃস্থ মানুষদের কষ্ট বিবেচনা করে খরচ কমাবার কথা ভেবে অবশেষে মাটির সরা মাথায় রেখে ব্যালান্স দৌড়ই স্থির হয়, অবশ্যই বিঁড়ে ছাড়া।

শামিয়ানার নীচে একটা লম্বা টেবল। তাতে প্রাইজ সাজানো। প্লাস্টিকের রঙ—বেরঙের ঝুড়ি, বালতি, টিফিন বাক্স, স্টেইনলেস স্টিলের রেকাবি, ট্রে ইত্যাদি। ফোম রাবারের তিনটি মেয়েদের হাতব্যাগ আর একটা শিল্ড। সভাপতি একজন প্রবীণ সাংবাদিক। তিনি হাজির হওয়ামাত্রই, ওয়ার্ক এডুকেশনের টিচার অসীমা দত্ত শ’খানেক সার্টিফিকেট তাঁর সামনে রেখে যান সই করার জন্য। সভাপতি ঘাড় গুঁজে সই করতে করতে মাঝে মাঝে জিরোবার জন্য পাশের চেয়ারে বসা হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখার্জির সঙ্গে স্কুলের খেলার ব্যবস্থা নিয়ে দু’চার কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন। হেডমিস্ট্রেসকে টিচাররা বড়দি বলেন। বয়স প্রায় চল্লিশ, দেখতে সুন্দরী, শিক্ষা বিষয়ে বিলিতি ডিগ্রি আছে। কেন যে বিয়ে করেননি টিচার বা ছাত্রীরা তাই নিয়ে প্রচুর মাথা ঘামিয়ে কিছুই আবিষ্কার করতে পারেনি।

”স্কুলের মাঠই নেই, খেলার ব্যবস্থা করব কী করে?” একটু থেমে ”তবে খেলাধুলোয় উৎসাহ আমরা দিই, খুবই দিই। আমাদের একটি মেয়ে… অসীমা, কী যেন নাম, ওই যে সাঁতারে…”

”সেভেন বি’র রেবা বাড়ুরি, স্টেট চ্যাম্পিয়ানশিপে দুটো রেকর্ড করেছে।”

”হ্যাঁ হ্যাঁ রেবা, ওকে আমরা খুব উৎসাহ দিই। প্র্যাকটিসে যায় বলে দু’ পিরিয়ড আগে ওকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর একটি মেয়ে, কলাবতী সিংহ, এবার মেয়েদের ক্রিকেটে বেঙ্গল টিমে খেলেছে। ক্লাস ইলেভেনে পড়ে, স্টেডি ব্যাট। ইউ.পি—র এগেনস্টে দু’ ঘণ্টা ক্রিজে থেকে বেঙ্গলকে জিতিয়েছে, দারুণ ড্রামাটিক ম্যাচ হয়েছিল, তাই না অসীমা?”

সভাপতি খুবই ঔৎসুক্য দেখিয়ে অসীমা দত্তর দিকে তাকালেন। সেই সময়ই ফিজিক্যাল সায়ান্স আর ইতিহাসের টিচার দু—জন মুখ ভার করে হাজির হলেন।

”কী কাণ্ড দেখুন তো বড়দি। ননীগোপালবাবু আর বসন্তবাবু বলছেন তাঁরাও ব্যালান্স রেসে নামবেন। ওঁরা বলছেন, পুরুষ টিচারদের নামা বারণ এ কথা তো কোথাও বলা নেই। শুধু মেয়েরাই নামবে আর প্রাইজ নেবে, এটা নাকি অগণতান্ত্রিক, তাই ওঁরা দুজন নামবেনই।”

”আচ্ছা, বড়দি, আমরা কি প্রাইজের দিকে তাকিয়ে রেসে নামছি? ওঁরা এমন একটা হিণ্ট দিলেন যে, সব মেয়ে টিচারই খুব রেগে গেছে, বলছে রেস বয়কট করবে।”

বিব্রত হেডমিস্ট্রেস, ”অ্যাঁ! তাই নাকি? কী কাণ্ড?” এই তিনটি শব্দ ছাড়া বলার মতো আর কথা পেলেন না। তিনি একটু ভয়ও পেয়ে গেলেন ‘অগণতান্ত্রিক’ আর ‘বয়কট’ শব্দ দুটোয়। দেশ হোক, রাজ্য হোক, আর মেয়েদের স্কুলই হোক, যাঁরাই এসব চালনার দায়িত্বে আছেন, তাঁদের কাছেই এইসব শব্দ এখন টাইমবোমার মতো। কখন যে ফাটবে কেউ তা জানে না।

”তাহলে কী করা যায়?”

হেডমিস্ট্রেস পরামর্শের আশায় সভাপতির দিকে তাকিয়ে রইলেন। সভাপতি না শোনার ভান করে সার্টিফিকেটগুলোয় সই করে যাচ্ছেন।

”মাত্র দু জন তো, নামুক না। পুরুষদের ব্যালান্স মেয়েদের থেকে কমই হয়।”

”বা রে, মেয়েদের সঙ্গে রেসে পুরুষরা নামবে, এ কেমন কথা?”

”তা ছাড়া ননীবাবুর বাড়ির কাছে পাতাল রেলের কাজ দু বছর ধরে চলছে, হাঁটাচলায় ওঁর ব্যালান্স অনেক বেড়ে গেছে। উনি ফার্স্ট হবেনই।”

”হয় যদি হোক, তাই বলে ওঁর পার্টিসিপেশন তো বন্ধ করা যায় না, সেটা খুবই অগণতান্ত্রিক হবে তাহলে!”

”কিন্তু উনি যে আনডিউ অ্যাডভাণ্টেজ নিয়ে নামবেন তাও আমরা হতে দেব না। বয়কট করব।”

হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখার্জি বিব্রত হয়ে আবার সভাপতির দিকে তাকালেন। সভাপতি মুচকি হাসছেন অর্থাৎ কথাবার্তা সবই তাঁর কানে গেছে। গলাখাঁকারি দিয়ে তিনি বললেন, ”অংশগ্রহণই আসল কথা, পুরস্কার পাওয়াটা নয়। ঘোষণা করে দিন, ব্যালান্স রেসে কোনো পুরস্কার নেই।”

”অ্যাঁ, প্রাইজ থাকবে না।”

ফিজিক্যাল সায়ান্স আর ইতিহাস হতাশায় ভেঙে পড়লেন। এই রেসের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করে একটু বেশি দাম দিয়ে তিনটি লেডিজ হ্যাণ্ডব্যাগ কেনা হয়েছিল। টেবলের একধারে সেগুলো সাজিয়ে রাখা। দুজনে ব্যাগগুলোর দিকে কটমট করে একবার তাকিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন।

”বাঁচালেন। নইলে কী মুশকিলেই যে…”

হেডমিস্ট্রেসের কথা শেষ হবার আগেই গাঁক গাঁক শব্দে ঘোষণা হল: ”যথেষ্ট সংখ্যক প্রতিযোগীর অভাবে টিচারদের ব্যালান্স রেস শুরু করা যাচ্ছে না, মাত্র দুজন—ননীবাবু আর বসন্তবাবু স্টার্টিং লাইনে এসেছেন। অনুরোধ করা হচ্ছে বাকি টিচাররাও তাড়াতাড়ি আসুন।”

টিচাররা দৌড়বেন, কিংবা, বলা ভাল, মাথায় সরা নিয়ে হাঁটবেন, অতএব মেয়েরা প্রবল উৎসাহে স্টার্টিং লাইনের কাছে ভিড় করে দাঁড়াল। কিন্তু প্রতিযোগীরা অনুপস্থিত।

অ্যামপ্লিফায়ারে আবার অনুরোধ হল যাকে বিদীর্ণ হলোও বলা যায় : ”আবার অনুরোধ করা হচ্ছে…” ইত্যাদি।

”বড়দি, কেউ তো আসছে না।”

বিপন্ন মুখে অসীমা দত্ত বললেন। হেডমিস্ট্রেস ভীতমুখে তাকালেন সভাপতির দিকে। গোটা পনেরো সার্টিফিকেটে সই করা তখনও বাকি। এঞ্জিনের পিস্টনের মতো কলম চালাতে চালাতে সভাপতি মুখ না তুলেই বললেন, ”এক্ষেত্রে পাবলিক অর্থাৎ ছাত্রীদের হাতে রেসের ব্যবস্থাটা তুলে দিন। ওরাই টিচারদের টেনে নিয়ে দাঁড় করাবে। আপনি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলুন। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, অফিসে যেতে হবে।”

হেডমিস্ট্রেস অসীমা দত্তর দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালেন।

”বুঝেছি।” এই বলে অসীমা দত্ত মেয়েদের ভিড়ের দিকে হনহনিয়ে এগিয়ে গেলেন।

মিনিট দুই পরেই দেখা গেল টিচাররা যেখানে জটলা করে আলাদা দাঁড়িয়ে ছিলেন, অন্তত জনা কুড়ি ছাত্রী সেদিকে হইহই করে ছুটে যাচ্ছে।

”রেবাদি, আপনাকে ছুটতেই হবে।”

”অন্নপূর্ণাদি, নামতেই হবে।… আপনার ছোটা আজ দেখব।”

”না, না, কোনো কথা শুনব না আমরা, সেদিন ক্লাসে আপনি যে বললেন বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন!”

”বলেছিলাম। কিন্তু বড্ড মাথা ধরেছে…”

”ধরুক মাথা, এইটুকু তো দৌড়বেন।”

মেয়েরা টিচারদের ঘিরে হাত ধরে টানাটানি শুরু করল। একটু দূরে ননীগোপালবাবু আর বসন্তবাবু মিটমিট করে হাসছেন। মেয়েদের কলরব তখন কোলাহলে পৌঁছে গেছে। কী করে ওরা যেন জানতে পেরেছে, মেয়ে টিচাররা রেস বয়কট করেছেন। হঠাৎ একটি ছাত্রী মুঠোকরা হাত আকাশের দিকে তুলে চিৎকার করল : ”আমাদের দাবি মানতে হবে, দিদিদের রেসে নামতে হবে।”

সঙ্গে—সঙ্গে আর একজন চিৎকার করল: ”ব্যালান্স রেস, ব্যালান্স রেস।” জনা দশেক মেয়ে একসঙ্গে বলল: ”হবেই শেষ, হবেই শেষ।”

”ব্যালান্স রেস বয়কট…”

”মানছি না, মানব না।”

”কাঁকুড়গাছি উচ্চচ মাধ্যমিক…”

”জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।”

এই সময় হঠাৎ অ্যামপ্লিফায়ার আর্তনাদ করে উঠল : ”গো অ্যাজ ইউ লাইকের প্রতিযোগীরা, তোমরা এবার শামিয়ানার সামনে এসো। তোমাদের প্রতিযোগিতা শুরু হচ্ছে।”

মেয়ে টিচাররা এতক্ষণ নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছিলেন। হঠাৎ সাত আটজন একসঙ্গে এগিয়ে গেলেন স্টার্টিং লাইনের দিকে। ছাত্রীরা স্লোগান বন্ধ রেখে হইহই করে তাদের সঙ্গ নিল।

দুই পুরুষ টিচারের সঙ্গে সাতজন মেয়ে টিচার মাথায় এক হাতে সরা ধরে স্টার্টারের হুইসলের অপেক্ষায়। রেস শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সরাধরা হাতটা নামিয়ে ওঁরা এগোবেন।

সারা মাঠে রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা। ছাত্রীরা, সংখ্যায় প্রায় দেড়শো, তাদের সঙ্গে আসা বাড়ির লোকেদের ধরলে দুশো—কথা বন্ধ রেখে স্টার্টিং লাইনের দিকে তাকিয়ে। সভাপতি সই করা বন্ধ রেখে ফিসফিসিয়ে বললেন, ”আপনার স্কুলের মেয়েরা খুবই প্রগতিশীল।”

হেডমিস্ট্রেস মাথা হেলিয়ে আরো ফিসফিস করে তৃপ্তকণ্ঠে বললেন, ”কাল ওরা ছুটি চেয়েছে, ভাবছি দু—দিন দেব।”

হুইসল বাজল। মেয়েদের কণ্ঠ থেকে ”হা আ আ” একটা শব্দ পার্কের এবং আশপাশের কাক পায়রা চড়াইদের চমকে দিয়ে আকাশের দিকে উঠে গেল।

রেস শুরু হয়ে গেছে। পনেরো মিটার যাবার পরই অঘটন। চার ফুট দশ ইঞ্চির এবং পঁচাত্তর কিলোগ্রামের, সংস্কৃতের অন্নপূর্ণা পাইন কীভাবে যেন হোঁচট খেয়ে ননীগোপালবাবুর পিঠের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। দুজনের মাথা থেকে সরা তো ছিটকে গেলই, পিঠের উপর পঁচাত্তর কিলোর বোঝা নিয়ে জমি থেকে উঠতে গিয়ে ননীগোপালবাবুর ডান হাতের কবজিটাও মুচকে গেল।

বসন্তবাবু চমৎকার ব্যালান্সে সরা মাথায় রেখে দু—হাত পাশে ছড়িয়ে ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর সামনে ছিলেন আরতি ঘটক এবং তিরিশ মিটারের মাথায় তাঁর সরা পড়ে যাবার উপক্রম হতেই হাত দিয়ে সরা ধরে ফেলে বাতিল হয়েছেন। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির ও পঞ্চাশ কিলোগ্রামের ভূগোলের ব্রততী বেদজ্ঞ, যিনি ঠিক বসন্তবাবুর পিছনেই আসছেন, হঠাৎ তাঁর পদক্ষেপ দীর্ঘ করলেন। আর পায়ে পা জড়িয়ে বসন্তবাবু টলে পড়তে পড়তে সামলে নিয়ে দেখলেন সরাটা মাথা থেকে মাটিতে পড়ে চার টুকরো হয়ে গেল। ফিনিশং লাইন থেকে তখন তিনি সাত—আট মিটার দূরে।

রাগে ক্ষোভে বসন্তবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ”ফাউল, ফাউল… ব্রততী আমারে ল্যাং মারসে। আমি প্রোটেস্ট করত্যাসি। দিস ইজ আনফেয়ার।”

”চোওপ, প্রোটেস্ট ফ্রোটেস্ট আবার কী… ল্যাং মেরেচে তো বেশ করেচে।”

প্রায় দুশো জোড়া চোখ বিস্ফারিত, দুশো হৃৎপিণ্ড কণ্ঠনালিতে আটকানো অবস্থায় দেখল ছিপছিপে পাতলা গড়নের একটি শ্যামলা রঙের ছেলে, চোখে কালো কাচের চশমা, মাথায় হলদে কাপড়ের টুপি—সাধারণত তাসা নাচের ছেলেরা যা পরে, টুপির তলায় কিছু চুল ঝুলে রয়েছে ঘাড় আর কানের উপর। শরীর ঢেকে ঢলঢলে ফুলহাতা লাল জামা আর জিনস। চিবুক ঢেকে হালকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়িটা পাতলা মুখের গড়নকে কিছুটা ভারিক্কি করে তুলেছে। পরিষ্কার এক মস্তান। পার্কের দুধারেই বস্তি, সম্ভবত সেখান থেকেই উদ্ভূত। কোমরে হাত রেখে পা ফাঁক করে ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গি থেকেই বোঝা যায়, হিন্দি ফিল্মের পোকা। বাঁ হাতে শিখদের মত একটি লোহার বালা।

”ল্যাং তো খাবেনই মাস্টারমোসাই, আপনিও কি পরীক্ষার খাতায় ল্যাং মারেন না?”

কোমর দুলিয়ে মস্তান এগিয়ে এল বসন্তবাবুর সামনে। বসন্তবাবু তিনপা পিছিয়ে ব্রততী বেদজ্ঞ নামক সুপুরিগাছের পাশে চলে এলেন।

”কিন্তু আপনি কেন ল্যাং মারলেন দিদি?”

মস্তান ডান হাতের তর্জনী তুলে ব্রততী বেদজ্ঞকে প্রশ্নটা করল। ব্রততী বটের গুঁড়ির অর্থাৎ অন্নপূর্ণা পাইনের পিছনে সরে গিয়ে বললেন, ”আ… আ… আমি আবার কখন ল্যাং মারলুম, অ্যাঁ… অন্নপূর্ণাদি, তুমি কি দেখেছ? আমি তো…”

”আলবাত, লেঙ্গি মেরেচেন।” মস্তান তার ঊরুতে ফটাশ করে চাপড় মেরে একটু কুঁজো হয়ে স্বরটা খসখসে ভীতিপ্রদ করে বলল, ”এখানে হচ্ছে স্পোটস আর আপনারা হচ্ছেন স্পোটসম্যান, স্পোটিং ইস্পিরিট নিয়ে আপনারা তো লড়বেন, ঠিক কিনা?”

স্তব্ধ ফ্যালফ্যালে মেয়েদের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে মস্তান দুবার মাথা নাড়তেই কয়েকটি মাথা দ্রুত হেলে গেল।

”আপনারাই যদি আনস্পোটিং কাজ্যকলাপ করেন তাহলে মেয়েরা কী সিকবে আপনাদের দেকে? আমি পাঁচিলের ওধারে তকন থেকে দাঁড়িয়ে সব দেকচিলুম, অনেক কথা কানে আসচিল। আপনারা প্রাইজের লোভে স্পোট করতে নেমেছেন, তাই না?”

”না না, কে বলল আমরা প্রাইজের লোভে…” অন্নপূর্ণা পাইনের বেদনাহত স্বর আর কথা খুঁজে পেল না।

”ননীবাবু, আপনিই বলুন আমরা কি…” আর এক মেয়েটিচার বললেন।

”আমরা প্রাইজ নেবই না।”

”অন্যায়ভাবে নেব কেন, আমরা সবাই স্পোর্টসম্যান।”

”দিদি, স্পোর্টসউওম্যান হবে।” ভিড়ের মধ্য থেকে কে বলল।

মস্তানের এবার হাসার কথা। সুতরাং কোমরে হাত দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে ‘শোলে’—র গব্বর সিংয়ের মতো ‘হা হা’, হো হো’ করে বিকটস্বরে, দেহ কাঁপিয়ে সে হাসতে শুরু করল।

”প্রাইজ নেবে না… হা হা হা…, দিদিমণিরা বলচেন… হো হো হো… মাইকে অ্যালাউন্স করে দিন…।”

মস্তানের দাঁতগুলি সাজানো ঝকঝকে। তবে উপরের পাটিতে ডান কষের একটা দাঁত যে নেই, সেটা এবার দেখা গেল।

‘অ্যাই, অ্যাই,” ভিড়ের মধ্যে একটি মেয়ে পাশের জনের কানে ফিসফিস করে বলল, ”আমাদের কালু রে।”

”যাহ।”

”আমি বলছি। দাঁতটা ওর অনেকদিন ধরেই নড়ছিল, পরশু ছুটির পর আমরা একসঙ্গে যখন বাড়ি ফিরছিলুম, তখন এক হ্যাঁচকা টানে ও দাঁতটা উপড়ে ফেলল।”

”কী মেয়ে রে বাবা। কী দারুণ মেকআপ নিয়েছে। কোথা থেকে এভাবে সাজল বল তো? আমাদের কিচ্ছুটি বলেনি।”

”একেবারে ছেলের মতো দেখাচ্ছে।”

”একদম। কী সাহস বাব্বা, বসন্তকে শীত বানিয়ে দিয়েছে।”

”পাইন ফরেস্টও সাফ।”

”যখন জানতে পারবে, কী হবে।”

”এখন কাউকে বলিসনি, চেপে থাক।”

ওদিকে হেডমিস্ট্রেস হাত নেড়ে স্কুলের দরোয়ান মিশিরকে কাছে ডেকে ভয়ার্তস্বরে বললেন, ”করছ কী তুমি, তাড়িয়ে দাও গুণ্ডাটাকে। মেয়েদের সঙ্গে যদি অসভ্যতা করে তাহলে গার্জেনরা কী বলবেন আমাদের? যাও, বার করে দাও।” মিশির তার ভুঁড়িতে হাত রেখে করুণস্বরে বলল, ”বড়দিদি, এখানকার গুণ্ডারা বড় খারাপ আছে। এদের সঙ্গে চাকু, ক্ষুর, ছোটখাটো বন্দুকও থাকে।”

”তাহলে দৌড়ে পুলিশ ডেকে আনো।”

হেডমিস্ট্রেসের চেয়ারের হাত চারেক দূরে মাইক্রোফোনটা তখন সচল ছিল। লাউড স্পিকার থেকে আবছাস্বরে ওদের কথাগুলো সবাই শুনতে পেল।

”অ্যাই, দারোয়ান।” মস্তান চিৎকার করে দৌড়ে গেল শামিয়ানার দিকে। ”পুলিশ বোলানেকে লিয়ে যানেকা আগেই তুমহারা ভুঁড়িমে…” মস্তান হিপ পকেট থেকে ছুরি বার করে স্প্রিং টিপতেই ছয় ইঞ্চি ফলা ছিটকে বেরোল। কবজি নাড়িয়ে ফলাটা এপাশ—ওপাশ করে ঝিলিক দিতে দিতে কুঁজো হয়ে সে গুটিগুটি মিশিরের দিকে এগোতেই সে ”হায় রামজি, মর গিয়া” বলেই বড়দিদির চেয়ারের পিছনে আশ্রয় নিল।

সভাপতি প্রথমদিকে ভ্রূ কুঁচকে দেখছিলেন। এই রকম স্পোর্টসে বহুবার ‘সভাপতি’ বা ‘প্রধান অতিথি’ হয়ে এখন ঝানু। ব্যাপার বুঝতে তাঁর বিশেষ দেরি হয়নি। মুচকি হেসে পাশের ফ্যাকাসে মুখ হেডমিস্ট্রেসকে বললেন, ”দারুণ করছে, কী বলেন?”

কথাটা বড়দিদির কানে গেল না। তিনি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন, ”চলে যাও, যাও এখান থেকে। মেয়েদের স্পোর্টসে এসব অসভ্যতা বাঁদরামি চলবে না। আমি পুলিশ ডাকব, অ্যারেস্ট করাব তোমায়।”

”আমাকে বাঁদর বললেন?”

”নিশ্চয় বাঁদর।”

”তাহলে আমার ন্যাজ কই?”

হেডমিস্ট্রেসের কানে মেয়েদের হাসির রোল পৌঁছতেই তিনি আরো রেগে উঠলেন। মিশির এই সময় পিছু হটতে হটতে হাত দশেক দূরে গিয়েই দৌড়বার জন্য সবে ঘুরেছে, আর তখনই মস্তান চেঁচিয়ে উঠল, ”অ্যাই মিশির, খাড়া রহো। এক কদম বাড়েগা তো এই চাক্কু ভুঁড়িমে…।” ছুরিটা বাতাসে বিঁধিয়ে ডান—বাম আড়াআড়ি চালিয়ে মস্তান বুঝিয়ে দিল পরের ঘটনা কী ঘটবে।

”দিদিমণিরা তো প্রাইজ নেবে না, তাহলে কী হবে?”

”যাই হোক, তুমি এখান থেকে দূর হও।”

”তাহলে আমিই নোব।”

মস্তান টেবল থেকে ব্যাগ তিনটি তুলে নিয়ে চোখের সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলল, ”বাঃ, বাঃ, নিজেদের জন্য সুন্দর সুন্দর ব্যাগ আর মেয়েদের জন্য প্লাস্টিকের চিপ জিনিস, বাঃ, খুব ভাল।”

আর একবার মেয়েদের হাসির হলকা হেডমিস্ট্রেসকে ঝলসে মুখটা লাল করে দিল। তিনি প্রায় ঝাঁপিয়েই মাইক্রোফোনটা ধরে মুখের কাছে এনে চিৎকার শুরু করলেন, ”পুলিশ পুলিশ… হেল্প হেল্প, গুণ্ডা এসে মেয়েদের আক্রমণ করেছে, বাঁচান, আমাদের বাঁচান…।”

মেয়েদের বিশেষ করে গার্জেনদের মধ্যে এবার কলরব শুরু হল। কেউ কেউ দু—চার পা এগিয়ে এলেন। মস্তানকে এবার নার্ভাস দেখাল। ফলা মুড়ে সে ছোরাটা পকেটে রাখল। এধার ওধার তাকাচ্ছে বোধহয় পালাবার পথ খুঁজতে।

”বড়দি আমরা কি গুণ্ডাটাকে এবার ধরব?” একটি মেয়ে চেঁচিয়ে জানতে চাইল।

”না, না, ধরতে যেও না, সঙ্গে ছোরা আছে, পুলিশ এসে ধরবে।”

গো অ্যাজ ইউ লাইক—এর প্রতিযোগীরা একধারে দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যে রয়েছে ঝাড়ুদারনি, ভিখারী, বৈষ্ণবী, চানাচুরওলা, পাগলি, ডাকপিয়ন, বাসানউলি আর ত্রিশূল হাতে ভৈরবী। ওরা যে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। সব চোখ আর মন কেড়ে রেখেছে মস্তান।

এই সময় ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ ‘আঁ আঁ আঁ’ শব্দ শোনা গেল এবং সেই সঙ্গে মাটিতে একটি মেয়ে পড়ে গেল মূর্ছিতা হয়ে।

”ফেণ্ট ফেণ্ট, সুস্মিতা ফেণ্ট হয়েছে।”

”জল, জল আন… বাতাস কর। ভয়ে বোধহয় অজ্ঞান হয়েছে।”

গুণ্ডা থেকে সবার মনোযোগ চলে গেল সুস্মিতা নামের মেয়েটির দিকে। হুড়োহুড়ি, চেঁচামেচি শুরু হল। দিদিমণিরা ছুটে গেলেন, সেই সঙ্গে হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখার্জিও। সভাপতি কিন্তু চেয়ারে হেলান দিয়ে আবার মুচকি হাসতে হাসতে লক্ষ করলেন, মস্তানটি তীরবেগে পার্কের গেটের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে।

”গুণ্ডা পালাচ্ছে, বড়দি, গুণ্ডা পালাচ্ছে।”

সব চোখ যখন গেটের দিকে তাকাল, তখন লাল জামাটা গেটের বাইরে ডানদিকে ঘুরে অদৃশ্য হচ্ছিল।

মিনিট দুই পরে জলের ঝাপটা আর খাতার হাওয়া খাওয়ার পর সুস্মিতা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।

তারপর এক গাল হেসে বলল, ”কেমন করলুম বল তো, নইলে কালুটা পালাতে পারত না।”

”যাক গুণ্ডাটা নিজেই তাহলে পালিয়ে গেল।” বড়দি আবার তাঁর প্রশান্তি ফিরে পেয়ে সভাপতিকে খবরটা দিলেন।

‘হ্যাঁ, ভালই হল। ফার্স্ট প্রাইজটা ওই পাবে।”

”কিসের ফার্স্ট প্রাইজ!”

”গো অ্যাজ ইউ লাইকের।”

হেডমিস্ট্রেস এমন ভাবে তাকিয়ে রইলেন যেন তাঁর স্কুলের পঁচাত্তর জন মেয়েরই ফার্স্ট ডিভিশনে উচ্চচ মাধ্যমিক পাশ করার খবর শুনলেন।

”গুণ্ডা কোথায়, ও তো মেয়ে!” সভাপতির বিস্ময় চোখমুখে ফুটে উঠল। ”আপনার স্কুলেরই নিশ্চয়, দারুণ করল কিন্তু।”

বলতে বলতে সভাপতি দেখতে পেলেন পার্কের গেট দিয়ে ঢুকছে সবুজ খয়েরি নকশার চুড়িদার ও কামিজ পরা এক শ্যামলা মেয়ে। ছিপছিপে বেতের মতো শরীর, মাথার চুল ছেলেদের মতো ছোট করে ছাঁটা, মিষ্টি মুখের গড়নটি পানের মতন। কয়েকটি মেয়ে ওকে দেখামাত্র ছুটে গেল। ও হাসতেই দুটি চোখ এবং দাঁতের সারি ঝকঝক করে উঠল। ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ায় সভাপতি আর মেয়েটিকে দেখতে পেলেন না।

”আমার স্কুলে এমন মেয়ে?” হেডমিস্ট্রেস কাঁদো কাঁদো হয়ে সামনে মেয়েদের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেই সময় অসীমা দত্ত এসে বড়দির কানে কানে কিছু বলতেই তিনি, ”এত বছর ধরে ক্লাসে পড়াচ্ছ অথচ তোমরা কেউ চিনতেই পারলে না!” বলে গম্ভীর হয়ে গেলেন।

পুরস্কার প্রদান শুরু হল। একে একে প্রাপকরা নেবার পর সবশেষে ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’—এর প্রথম পুরস্কার নেবার জন্য নাম বলতে গিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে অসীমা দত্ত দুবার গলা খাঁকারি দিলেন এবং দুবার ঢোঁক গিলে বললেন, ”প্রথম হয়েছে, ইলেভেন বি—র কলাবতী সিংহ। ও সেজেছিল গুণ্ডা।”

তুমুল হাততালি আর চিৎকারের মধ্যে কলাবতী হাসিমুখে তার পুরস্কার নিল সভাপতির কাছ থেকে। তারপর সে অসীমা দত্তর কাছে গিয়ে বলল, ”দিদি মাইকটা দিন, আমি একটা কথা বলব।”

তিনি একবার বড়দির দিকে তাকিয়ে কী ভেবে সরে দাঁড়ালেন।

”মাননীয়া বড়দি এবং অন্যান্যরা,” কলাবতী সহজভঙ্গিতে কোনো কুণ্ঠা প্রকাশ না করে বলল, ”আজ আমার আচরণে, কথাবার্তায় যদি আপনারা আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে সেজন্য ক্ষমা চাইছি। আমার সবটাই অভিনয়। একজন কম্পিটিটর হিসাবেই সব করেছি, এই কথা মনে রেখে আপনারা স্পোর্টিংলি আমাকে বিচার করবেন। গুরুজনরা সবাই আমার শ্রদ্ধাপ্রণাম নেবেন।”

সভাপতি মাথা দুলিয়ে মলয়া মুখার্জিকে বললেন,”আপনার স্কুলের শিক্ষা, রুচি, কালচার এই মেয়েটির মধ্যে ফুটে উঠেছে। অন্যসব স্কুলে যা দেখি সে আর কহতব্য নয়, টিচারদের সম্পর্কে কোনো শ্রদ্ধা নেই, ভালবাসা নেই, ডিসিপ্লিন নেই।”

শুনতে শুনতে হেডমিস্ট্রেস আনন্দে, গর্বে বরফের মতো একবার গললেন, আবার বাষ্পের মতো ভেসে বেড়াতে লাগলেন।

”কলাবতীর ঠাকুর্দা আটঘরার জমিদার, এখন অবশ্য জমিদারি নেই, কিন্তু বনেদী পরিবারের শিক্ষাটা তো আছে। আমাদের বকদিঘির পাশেই আটঘরা গ্রাম। ওদের সবই জানি, ওরাও আমাদের সব জানে। ওরা যেমন কালচার্ড তেমনি… ” মলয়া মুখার্জি থেমে গেলেন। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, ”তেমনি জেদি।”

”আচ্ছা আচ্ছা! গ্রামের নামদুটো শোনা শোনা মনে হচ্ছে যেন, ওদের মধ্যে কি বছরে একবার একটা ক্রিকেট ম্যাচ হয়? কয়েক বছর আগে কাগজে খবর দেখেছিলাম মনে হচ্ছে।”

সভাপতির দিকে তাকিয়ে মলয়া মুখার্জি হাসতে শুরু করলেন। ”এই এক অদ্ভুত রেষারেষি দুই জমিদারবাড়ির মধ্যে। একেবারে ছেলেমানুষি কাণ্ড। বুড়ো বুড়ো লোকেরা যে কী রকম অবুঝ বাচ্চচা হয়ে যায় তখন, না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না।”

”বটে, তাই নাকি, তাহলে তো দেখতে হয়। এবারের ম্যাচটা কি হয়ে গেছে?”

”হয়নি, হবে, বোধহয় সামনের রবিবারেই।”

কয়েকজন মেয়ে টিচার এবং ননীবাবু খাবারের বাক্স হাতে শামিয়ানার পিছন দিক থেকে বেরোলেন।

”শুনুন ননীবাবু, শোনো ব্রততী, ইনি কী বলছেন।” হেডমিস্ট্রেস উত্তেজিত কণ্ঠে ওদের ডাকলেন। ”কলাবতী তো ওনাকে দারুণ ইমপ্রেস করেছে, ওর মধ্য দিয়ে নাকি আমাদের স্কুলের শিক্ষা রুচি কালচার ফুটে উঠেছে… সবাই ওকে দুষ্টু বলো, শুধুই ক্রিকেট খেলে একদমই পড়াশুনো করে না বলো, অথচ দ্যাখো উনি কত প্রশংসা করলেন।”

”না না, দুষ্টু তো নয়, অন্নপূর্ণাদি, আমরা কি কখনো তাই বলেছি?”

”সে কী! কলাবতীর মতো বাধ্য মেয়ে আমি তো কুড়ি বছরের টিচারি জীবনে একজনও দেখিনি।”

সভাপতির জন্য প্লেটভরা মিষ্টি আসতেই টিচারদের কলাবতী প্রশস্তি আর এগোল না।

.

তিন পুরুষে খেলে রেকর্ড করব

বাড়িটা ঊনবিংশ শতাব্দীতে তৈরি। একতলার দেয়ালগুলো তিন হাত চওড়া। ঢালাই লোহার নকশাদার ফটকের একটা পাল্লা বন্ধই থাকে। রাজশেখর সিংহ বছরে তিন—চারবার তাঁর ১৯২৮ সালে কেনা চালবিহীন ফোর্ড গাড়িটা নিজে চালিয়ে যখন বেরোন, শুধু তখনই দুটো পাল্লা খোলার দরকার হয়।

এবারের ভিণ্টেজ কার র‌্যালিতে চুয়াত্তর বছরের, সওয়া ছ’ ফুট, গৌরবর্ণ, দশাসই রাজশেখর জমিদারবেশে তাঁর ফোর্ড নিয়ে নেমেছিলেন। ডান হাতে স্টিয়ারিং, বাঁ হাতে গড়গড়ার নল। গাড়ি চালাতে চালাতে মাঝে মাঝে নল মুখে দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছিলেন। কাঁধে গামছা, ধুতি ফতুয়া পরা কলাবতী চাকর সেজে ছিলিমে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছিল, পিছনের সিটে পাগড়ি মাথায় চাপকান পরা বেয়ারা সেজে কলাবতীর কাকা সত্যশেখর একটা কিংখাবের খয়েরি রঙের ছাতা জমিদারবাবুর মাথার উপর ধরে বসে। বছর পনেরো ব্যারিস্টারি করছে কলকাতা হাইকোর্টে, পসার কিছুটা জমেছে এবং অবিবাহিত।

গাড়িটা যখন মানিকতলা মেইন রোড দিয়ে বাগমারি হয়ে কাঁকুড়গাছির মোড় ঘুরছিল তখন দর্শকদের ভিড়ের মধ্যে কলাবতী দেখতে পায় ফুটপাথের কিনারে দাঁড়িয়ে বড়দি মলয়া মুখার্জি ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে তাদের গাড়িরই ছবি তুলছেন। সেই সময় তার ৪৫ বছর বয়সী ব্যারিস্টার কাকা বীরদর্পে বিশাল নকল গোঁফটা ডানহাতে চুমরোতে চুমরোতে জিভ বার করে ভেংচি কাটল। কলাবতীর মনে হয়েছিল ভেংচিটা বড়দির উদ্দেশেই, কেননা মোড় ঘোরার সময় গাড়ি যখন ফুটপাথ ঘেঁষে এসেছিল, বড়দি তখন ক্যামেরার শাটার টিপেই বেশ জোরে বলে উঠেছিলেন, ”বাঁদর কোথাকার।”

কথাটা রাজশেখরের কানেও পৌঁছয়।

”মলয়া না? মুখুজ্জেদের মেয়ে কাকে বাঁদর বলল?”

কলাবতী আড়াচোখে পিছনের সিটে তাকিয়ে দেখল, কাকা একমনে সি আই টি রোডের গাছগুলোর মগডাল পর্যবেক্ষণ করছে। সে ঝুঁকে দাদুর কানে কানে বলল, ”কাকাকে।”

”কেন?”

”কাকা বড়দিকে ভেংচি কেটেছে।”

”সতু।”

”আজ্ঞে।” পিছন থেকে ভয়ার্ত কণ্ঠ ভেসে এল।

”ভেংচি কেটেছ?… জবাব দাও। বুড়ো বয়সেও তোমার এই স্বভাবটা গেল না, চিরকাল তুমি … কোর্টে সওয়াল করার সময় কোনোদিন হয়তো জজকেও ভেংচি কেটে বসবে। … তাছাড়া মলয়া নিশ্চয় ওর বাবাকে এটা জানাবে। উফফ… হরিশঙ্কর মুখ বেঁকিয়ে শেয়ালের মতো হাসছে, এটা তো এখনই আমি দেখতে পাচ্ছি… আমি জানি ও বলবে ‘সিংগিবাড়ির ওরা বরাবরই ছোটলোক, হিংসুটে’। আমি শুনতে পাচ্ছি, হরিশঙ্কর এই কথাই বলছে আর … উফফ…।”

”দাদু সামনে… সামনের রাস্তায় চলো।”

রাজশেখর উল্টোডাঙার মোড়ে এসে স্টেশনের দিকে গাড়িটা চালিয়ে ফেলেছিলেন। ডানদিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নজরুল ইসলাম সরণি ধরলেন এয়ারপোর্টের উদ্দেশে, যেখানে পৌঁছে র‌্যালি আবার ফিরে আসবে রাজভবনের সামনে।

রাজশেখরের ফোর্ড এই র‌্যালিতে চতুর্থ হয়েছিল।

কিন্তু সেইদিন রাতেই রাজশেখর দোতলার লাইব্রেরিতে বসে একটা চিঠি লিখে কলাবতীকে ডাকেন।

”এটা কাল তোমার হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখুজ্জেকে দেবে, স্কুল বসার আগেই। ভুলো না যেন।”

চিঠি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় সে থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, ”দাদু, শেয়ালের হাসি তুমি দেখেছ? কেমন দেখতে?”

”হরিশঙ্কর একটা শেয়াল। সে হাসলেই সেটা শেয়ালের হাসি। সেই ছোটবেলা থেকে ওকে জানি, এক স্কুলে পড়েছি, ক্রিকেটও খেলেছি ওর সঙ্গে। আমি টাউনে, ও এরিয়ানে। দারুণ ধূর্ত।”

নিজের ঘরে এসে কলাবতী চিঠিটা পড়েছিল। তাতে লেখা : ‘কল্যাণীয়া মলয়া, গতকাল আমার পুত্র তোমাকে জিহ্বা প্রদর্শন করায় আমি যৎপরোনাস্তি লজ্জিত ও সন্তপ্ত। সিংহসন্তানের পক্ষে এহেন মর্কটোচিত আচরণ অকল্পনীয়, জানি না কোথা হইতে সে এই কু—অভ্যাস অর্জন করিয়াছে। বিলাত গিয়া সে কীরূপ মানুষের সহিত মেলামেশা করিয়াছিল জানি না। আমি তাহার এবং আমার পূর্বপুরুষদের পক্ষ হইতে তোমার নিকট মার্জনা চাহিয়া লইতেছি। আশা করি তুমি আমার পুত্রের অভব্যতা ভুলিয়া যাইবে। আশীর্বাদক, ভবদীয়, রাজশেখর সিংহ।” পুনশ্চ—’বাঁদর অতিশয় বজ্জাত প্রাণী এবং ইহার একটি লাঙ্গুল আছে, আমার পুত্রের লাঙ্গুল নাই।’—রা সি

পরদিন প্রথম পিরিয়ডের আগেই কলাবতী দাদুর চিঠিটি বড়দির বেয়ারা মিশিরের হাতে দিল। শেষ পিরিয়ডে মিশির একটি খাম ক্লাসে এসে কলাবতীকে দিয়ে যায়। খামের উপরে লেখা : ‘পূজনীয় শ্রীরাজশেখর সিংহ!’ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই সে খামটা দাদুর টেবলে রেখে দেয়। সন্ধ্যায় দাদু তাকে ডেকে পাঠান।

”মলয়া কী লিখেছে জান? সতু নাকি বিলেতেও ওকে দুবার জিভ দেখিয়েছিল। তার মানে আজ থেকে পনেরো বছর আগে। কিন্তু তার থেকেও মারাত্মক, আর কী বলেছে জানো? ‘লাঙ্গুলহীন সিংহসন্তানও যে সম্ভব, তা জানা ছিল না। আপনার ছেলেকে চিড়িয়াখানায় পাঠানো উচিত…’ টিপিক্যাল হরিশঙ্করের মেয়ে।”

”দাদু, তুমিই তো গোলমাল বাধিয়েছ। পুনশ্চটা ল্যাজের মতো জুড়তে গেলে কেন? তাহলে তো এই লাঙ্গুল ধরে টানাটানিটা হত না।”

রাজশেখর কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন। তারপর হঠাৎ বলে উঠলেন, ”এবার আমি ক্রিকেট ম্যাচে খেলব। মুখুজ্জেদের মুখ আমি পুড়িয়ে ছাড়ব।”

”মুখপোড়া হনুমান!”

”দ্যাটস ইট। হনুমান বানাব। আটঘরায় কালই চিঠি দিয়ে পরমেশ, মতি, নন্তু, ওদের ডেকে আনব। টিম করব।”

”এই বয়সে তুমি খেলবে?”

”কেন খেলব না? গ্রেস, হবস, রোডস, সি কে, দেওধর, ওরা কি পঞ্চাশের পরেও খেলেনি?”

”কিন্তু তোমার যে সত্তর হয়ে গেছে।”

”সে তো পাঁজিপত্তরের হিসেবে, কিন্তু মনের হিসেবে আমি তো পঁচিশের একদিনও বেশি নই, এখনো চল্লিশটা বৈঠক, দশটা ডন দিই, এক মাইল জগ করি। এখনকার কটা ছোকরা পারে? সুতরাং আমি খেলব। বহুদিন আটঘরায় যাওয়া হয়নি। লাস্ট খেলেছি তখন তুমি জন্মাওনি, তিন রানে হেরে গেছলাম।”

রাজশেখর আহত সিংহের মতো অস্থির পায়চারি শুরু করলেন। কলাবতীর তখন মনে হল, দাদুর বয়স সত্যিই পঁচিশ। উত্তেজনায় আর ক্রোধে শরীর থেকে পঞ্চাশটা বছর যেন খসে পড়েছে। লম্বা লম্বা দ্রুত পা ফেলে, শিরদাঁড়া খাড়া রেখে রাজশেখর দেয়াল থেকে দেয়াল পর্যন্ত যাতায়াত করে যাচ্ছেন। দেখে কলাবতীর বেশ অবাক লাগল। এত সামান্য ব্যাপারেই কী রাগ।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে রাজশেখর মুচকি হেসে ফেললেন। ”বুঝলি কালু, তোর বড়দি ইচ্ছে করেই সিংহের ল্যাজ মাড়িয়েছে। আমার ছেলেকে কিনা ল্যাজকাটা সিংহ বলল… অ্যাঁ, চিড়িয়াখানায় পাঠাতে বলল। আশ্চর্য, কী সাহস!”

দাদু ‘তুমি’ থেকে যখন ‘তুই’—এ চলে আসেন, কলাবতী তখন বুঝে যায় গুরুগম্ভীর রাশভারিত্বের জোব্বাটা মেজাজ থেকে খুলে এবার উনি নিজের আসল মজাদার হালকা স্বভাবে ফিরে এসেছেন। এখন তিনি বন্ধু।

”কিন্তু তোমার পুনশ্চটাই তো গোলমেলে। বাঁদরজাতীয় অনেকেরই তো ল্যাজ নেই—শিম্পাঞ্জি, গোরিলা, ওরাং ওটাং।”

রাজশেখর থমকে দাঁড়ালেন। তাঁকে বিচলিত দেখাচ্ছে। অবশেষে অপ্রতিভের মতো হেসে, মাথা চুলকে তিনি চেয়ারে বসলেন।

”এসব তো ভেবে দেখিনি। তাই তো … টার্জনের শিম্পাঞ্জিটাকে কতবার দেখেছি, ল্যাজ আছে বলে তো মনে পড়ছে না।”

”তাহলে ভুলে যাও সিংহের ল্যাজের কথাটাও। ক্রিকেট ম্যাচ খেলে তোমার দরকার নেই।”

”না, না, একবার যখন মুখ থেকে বেরিয়েছে, সে কথা রাখবই, আমি খেলবই। আর সতু খেলবে, তুইও খেলবি, তিন পুরুষে খেলে এই অ্যানুয়াল ম্যাচের রেকর্ড করব।”

”কিন্তু ওরা যদি আমাকে খেলতে না দেয়? পুরুষদের খেলায় কোনো মেয়ে খেললে প্রোটেস্ট তো করতেই পারে।”

রাজশেখর ধাঁধায় পড়লেন। আমতা—আমতা করে বললেন, ”তা বটে, তা বটে। রেকর্ডটা হলে অবশ্য খুবই ভাল হত। তবে দু’ পুরুষ এই ম্যাচে কখনও খেলেছে কিনা সেটাও খোঁজ নিতে হবে। আমি কালই আটঘরায় চিঠি দিচ্ছি, সতুকেও বলে রাখতে হবে যেন অতি অবশ্য খেলে।”

কলাবতীর কাকা সত্যশেখরের মামলা ছিল কৃষ্ণনগর কোর্টে। ফিরে এসেই অপেক্ষমাণ মক্কেলদের নিয়ে চেম্বারে বসে যায়। রাত দশটায়, এই বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী তাকে খাবার টেবলে আসতে হল।

”তোমাকে বিলেতে পাঠিয়েছিলুম বার—অ্যাট—ল হবার জন্য, ভেংচি কাটার জন্য নয়।”

”কিন্তু আমি তো…”

”একটি কথাও নয়।”

রাজশেখরের চাপা ধমকে সত্যশেখর মিইয়ে গেল।

”হরির মেয়েও তখন ওখানে কী যেন পড়তে গেছল। তাকে তুমি জিভ দেখিয়েছিলে। … দু’বার। থাক থাক, চাপা দেবার চেষ্টা কোরো না, সব আমি জেনে গেছি। কিন্তু কেন?”

ইতস্তত করে সত্যশেখর মুখ নিচু করে রুটি ছেঁড়ায় ব্যস্ত কালুর দিকে বার দুই তাকিয়ে বলল, ”সিংহিদের অপমান করেছিল। তোমার পাঠানো বড়ি আর লঙ্কার আচার থেকে ওকে খানিকটা দিতে চেয়েছিলুম, নেয়নি। বলেছিল সিংহিরা আবার বড়ি আচার তৈরি করতে শিখল কবে? এতে কি রাগ হবে না?”

কলাবতী হঠাৎ বিষম খেয়ে মুখটা আরো নামিয়ে ফেলল। দাদু তীব্রদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন।

”কালু, এটা হাসির ব্যাপার নয়… আর দ্বিতীয়বার কীজন্য জিভ দেখিয়েছিলে?”

”কার্ডিফে গ্ল্যামোরগানের সঙ্গে পতৌদির টিম খেলছিল সোফিয়া গার্ডেন্সে। ভীষণ বৃষ্টি। দু’ দলের ফার্স্ট ইনিংসই পুরো খেলা হল না। খুব শীত, মলয়ার সঙ্গে ছিল একটা কাশ্মীরি শাল, আমায় বলল ভাঁজ করে ম্যাকিনটোসের নীচে গলায় জড়াতে।”

”তুমি নিলে?”

”হ্যাঁ।”

”ওফফ!”

”তারপর ল্যাঙ্কাশায়ারের সঙ্গে ইন্ডিয়ানসদের সাউথপোর্টে খেলা।”

”কাকা, ল্যাঙ্কাশায়ারের মাঠ তো ওল্ডট্র্যাফোর্ড, ম্যাঞ্চেস্টারে।”

”হ্যাঁ, কিন্তু বৃষ্টিতে মাঠের অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় ম্যাচটা সাউথপোর্টে হয়েছিল। খুব ভাল রোদ উঠেছিল। শালটা ফেরত দেবার জন্য নিয়ে গেছলুম। ও বলল ম্যাচ থেকে ফেরার সময় নেবে। এরপরেই লিডস—এ ফার্স্ট টেস্ট, তাই প্র্যাকটিস নিতে আমাদের ছেলেরা খুব কেয়ারফুলি ব্যাট করে। পতৌদি এক ঘণ্টার উপর ক্রিজে থেকে করে ছয়, সূর্তি তিন ঘণ্টায় চুয়ান্ন। মলয়া এই নিয়ে পাশের এক মেমসাহেবের সঙ্গে গলা মিলিয়ে খুব বিরক্তি দেখাচ্ছিল। তাইতে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কথা কাটাকাটি হতে হতে আমি শালটা ছুঁড়ে দিই ওর দিকে। বলেছিলুম, ”মুখুজ্জেদের মেয়ে তো, তাই ক্রিকেটের ‘ক’—ও বোঝো না।’ ব্যস, আগুনে ঘি পড়ল। গটগট করে স্ট্যাণ্ড থেকে নেমে যাবার আগে বলল, ‘যে শালটা ছুঁড়ে দিলে, জানো কি, এইট্টিন এইট্টি ফোরে লখনৌর নবাব ওয়াজিদ আলি যখন মেটিয়াবুরুজে থাকতেন তখন নিজের হাতে ওটা বাবার ঠাকুর্দাকে দিয়েছিলেন? এসব জিনিসের কদর সিংহিবাড়ির লোকেরা কী বুঝবে?’ এই বলে ও একাই মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল। মিনিট দশ পর আমি মাঠ থেকে বেরিয়ে ওকে খুঁজছি, তখন একটা বাসের জানলায় ওকে দেখি। বাসটা ম্যাঞ্চেস্টার যাচ্ছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই … সেটাই দ্বিতীয়বার।”

রাজশেখর গুম হয়ে গেলেন। সত্যশেখর আমতা—আমতা করে বলল, ”শালটার যে হিস্টরিক ভ্যালু আছে তা আমি জানব কী করে?”

”তা বটে। তবে হরির ঠাকুর্দা যখন ওয়াজিদ আলি শাহের মেহফিলে বসে নাচ গান আর শায়ের শুনছে তখন আমার ঠাকুর্দা নাটোরের টিমে ক্রিকেট খেলছে।”

এই বলে রাজশেখর গর্বিত চোখে কলাবতীর পিছনের দেয়ালে তাকালেন। ওখানে ক্রিকেট ব্যাট হাতে বলেন্দ্রশেখরের অয়েল পেইন্টিং ঝুলছে। ‘ডবলু জি’—র মতো মুখ ভরতি দাড়ি। মাথায় কাউন্টি ক্যাপ। কোমরে বেল্টের বদলে কালো কাপড়ের পট্টি। হাঁটুর নীচে ছোট প্যাড। ভুঁড়িতেই শুধু ডবলু জি—র এক ষষ্ঠাংশ অনুপস্থিত। এর পাশে, হুবহু রঞ্জির মতো গোঁফওয়ালা, অ্যালবার্ট চুল, ফুল—হাতা জামাপরা ছিপছিপে সোমেন্দ্রশেখর। লেগ গ্লান্স করছেন। কলাবতীর দৃঢ় ধারণা গ্রেস ও রঞ্জির ছবি সামনে রেখে আর্টিস্ট মুখটুকু বাদে বাকি সব এঁকেছে।

”আমাদের হল ক্রিকেটিং ফ্যামিলি। ক্রিকেট ইজ দ্য নোবলেস্ট স্পোর্ট অব অল। শুধু মাঠেই নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ক্রিকেটকে পাবে… ফর লাইফ ইজ এ গেম, আফটার অল—টু আস, স্পোর্টসমেন, অ্যাট অল ইভেন্টস।”

কলাবতী খুকখুক করে উঠল। রাজশেখর চকিতে তার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কোঁচকালেন।

”ওহ, ইয়েস ইয়েস, ভুলেই গেছলাম, আমাদের বংশে এখন তো আবার একজন স্পোর্টসউওম্যানও এসে গেছে। ফিফথ জেনারেশন ক্রিকেটার। সতু তোর কী মনে হয়, কালু ইন্ডিয়া রিপ্রেজেন্ট করবে?”

সত্যশেখর উৎসাহে নড়েচড়ে বসল।

”নিশ্চয় করবে। আমি তো ওর দুটো ইনিংস এবার কানপুরে দেখলাম। শান্তা রঙ্গস্বামীও দারুণ প্রেইজ করল। গ্রিট, ডিটারমিনেশন, ক্যারেজ অ্যান্ড টেকনিক, সবই আছে, তবে হাতে আরো দু চারটে মার থাকা দরকার।”

”হবে হবে, আগে ডিফেন্সটা পোক্ত হোক। ভাবছি বাগানের উত্তরে বকুল গাছটার ধারে কালুর জন্য প্র্যাকটিস পিচ করে দেব।”

”দারুণ হবে দাদু।”

কলাবতী প্রায় লাফিয়ে উঠল, দু’ হাত তুলে। রাজশেখর মিটমিট করে তাকিয়ে বললেন, ”আমি এবার তোকে কোচ করব, নেটে আমি বল করব।”

সত্যশেখর হঠাৎ বিষম খেল।

”দাদু, কাকা কিন্তু হাসছে।”

”কেন?”

”মোটেই হাসিনি। মোটরে এসেছি, বেশ ঠাণ্ডা লেগে গেছে, যাই দেখি ট্যাবলেট কিছু যদি…”

সত্যশেখর টেবল থেকে উঠে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

”দুই ছেলের একজনও ক্রিকেটার হল না।” রাজশেখর বিষণ্ণমুখে কলাবতীর দিকে তাকালেন। বড় ছেলে দিব্যশেখর সন্ন্যাসী হয়ে গেছে কলাবতীর মা মারা যাবার পরই। ছোট থেকেই সে ছিল কোমল ও ধীর স্বভাবের, পড়ুয়া ও ঈশ্বরবিশ্বাসী।

রাজশেখর চেষ্টা করেও তার হাতে ক্রিকেট ব্যাট ধরাতে পারেননি। মা—মরা দু’ বছরের কলাবতীকে তার মাসি পুনেতে নিয়ে যান। সে দাদুর কাছে ফিরে আসে দশ বছর বয়সে।

ছোট ছেলে সত্যশেখর সুদর্শন, মার্জিত, সুরসিক ও বুদ্ধিমান তো বটেই, এবং আড্ডাবাজও।

ছাত্র হিসাবে সাধারণ, কিন্তু জাগতিক নানান ব্যাপারে অল্পবিস্তর ধারণা রাখে। পসার বৃদ্ধিতে সম্প্রতি একটি ফিয়াট মোটরগাড়ি কিনেছে (বাবার অনুমতি নিয়ে) স্বোপার্জিত অর্থে। কোর্টে যাতায়াত ছাড়া গাড়িটি পারতপক্ষে সে ব্যবহার করে না। তবে ভাইঝিকে গাড়ি চালানো শিখিয়ে দেবার জন্য ইদানীং ভোরবেলায় তাকে বেরোতে হয়েছে। কলাবতীর ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার মতো মোটামুটি শিখে গেছে।

সত্যশেখর ব্যারিস্টার হয়ে আসার পর গত পনেরো বছরে রাজশেখর মাত্র তিনবার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন সে বিয়ে করতে ইচ্ছুক কিনা। ‘এখন ইচ্ছে নেই’, ‘কালু একটু বড় হোক’, এবং তৃতীয়বারে কাঁচা পাকা চুলে আঙুল ডুবিয়ে বলেছিল, ‘তাড়াহুড়োর কী আছে’। বাবাকে সে শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে এবং যমের মতো ভয় পায়। তবু ক্রিকেটে সে দ্বিতীয় ডিভিশন ক্লাবেরও উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। ঘুড়ি, লাট্টু, ডাংগুলি বা উড়ন তুবড়িতে তার যে দক্ষতা, তার সিকিভাগও সে ক্রিকেটে অর্জন করতে পারেনি।

”আমার ছেলেরা ক্রিকেট শিখল না। আরে, ক্রিকেট কি শুধু মাঠেই হয়? এটা একটা খেলা, যেমন জীবনটাও একটা খেলা… লাইফ ইজ এ গেম। সোলজাররা বলে, ব্যাটল অব লাইফ—এর কথা, তেমনিই নাবিকরা বলে সাগরের, অভিনেতারা বলে থিয়েটারের কথা, কবিরা জীবনস্বপ্নের গান গায়, আর সাধারণ খেটে—খাওয়া মানুষ একেই বলে জীবনের চলা। আমরা, যারা ব্যাট—বল খেলি, একে গেম অব লাইফ তাহলে বলব না কেন?”

কলাবতী মাথা হেলিয়ে সমর্থন করল।

”চল লাইব্রেরিতে গিয়ে বসি।”

ওরা খাবার টেবল থেকে উঠে লাইব্রেরিতে এসে বসল। দেয়াল—আলমারিতে সার দেওয়া তিন পুরুষের সংগ্রহ। এ—ঘরে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ, কলাবতীই শুধু ব্যতিক্রম।

”আমার কী মনে হয় জানিস, জীবনটা যেন সিঙ্গল—উইকেট ম্যাচ, সবার বিরুদ্ধে সবাই, প্রত্যেকেই এখন নয় তো পরে ব্যাট করার সুযোগ পাবে। সব ব্যাপারেই যেমন গুড লাক কি ব্যাড লাক কাজ করে, তেমনি এক্ষেত্রেও আছে, তবে কেউ যদি স্কোর করতে না পারে, সেজন্য দায়ী হবে সে নিজেই।”

কলাবতী মুখের সামনে হাত রেখে হাই তুলল। রাজশেখর সেটা লক্ষ করলেন।

”খেলায় ভাল মন্দ দু—রকম পার্টনারই আছে, যেমন জীবনেও থাকে, সব রকমের বোলিংই খেলতে হয়। কিন্তু ক্রিকেটে যে ট্রেনিং একটা লোক পায়, যেমন—চটপট বিচারবোধ গড়ে তোলার অভ্যাসটা আর সাহসভরে নিশ্চিতভাবে সেটাকে কাজে লাগানো কিংবা ইচ্ছাশক্তিকে জবরদস্ত করা যার ফলে লোপ্পাই বলের কি ফুলটসের টোপের লোভটা সামলে নিতে পারবে, কিংবা হঠাৎ মাথা গরম করে এলোপাথাড়ি ব্যাট যাতে না চালায়—এই যে সব গুণ, এর সঙ্গে সাহস আর ধৈর্য, এ সবই ওই ২২ গজের ঘাসের জমিটা থেকেই তো শেখে, সেটা জীবনের খেলার ক্ষেত্রেও অমূল্য সাহায্য করে।”

”দাদু তোমার বিচারবোধের এই মুহূর্তে চটপট একটা সিদ্ধান্তে আসা দরকার।”

”এসে গেছি। তুই এখন ঘুমোতে যাবি।”

”কারেক্ট ডিসিশন। কিন্তু তুমি ম্যাচটা খেলার যে সিদ্ধান্ত…”

”ওটা পাকা। তিন পুরুষের যদি না হয়, দু—পুরুষের খেলার রেকর্ডটা তো করে রাখি। আটঘরায় কালই পরমেশ, মতি, নন্তুদের চিঠি দিচ্ছি।”

কলাবতী যখন উঠে চলে যাচ্ছে, রাজশেখর পিছন থেকে বললেন, ”তোর আগামী দুষ্টুমির প্রোগ্রাম কী?”

”স্কুলের স্পোর্টসে… আমাদের ক্লাসের সুস্মিতার সঙ্গে একটু পরামর্শ করা দরকার।”

লেডিজ পার্কের গায়েই সুস্মিতাদের বাড়ি। দুজনের দিন—দুয়েক চাপা আলোচনা হয়। এরপরই স্পোর্টসের গো অ্যাজ ইউ লাইকে মস্তানবেশে কলাবতীর আবির্ভাব। সেদিন সে ছুটে পার্ক থেকে বেরিয়ে সুস্মিতার বাড়িতে গিয়ে মস্তানের ছদ্মবেশ খুলে ফেলে। চুড়িদার ও কমিজ পরাই ছিল প্যান্ট—শার্টের নীচে। তারপর সে আবার ভালমানুষের মতো পার্কে ফিরে আসে।

সুস্মিতাদের বাড়িতে দুপুরের খাওয়া সেরে বিকেল নাগাদ বাড়ি ফিরে সে দাদুর কাছে শুনল আটঘরা থেকে পরমেশ এসেছিল। টিম একটা মোটামুটি হয়ে গেছে। গতবছর যারা খেলেছে, তারাই খেলবে, তবে রাজশেখর ও সত্যশেখরের জন্য কোন দুজন বাদ পড়বে তাই নিয়ে একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে।

”পরমেশ বলছে দারোগাবাবু, ব্যাঙ্ক—ম্যানেজার আর হেডমাস্টার খেলতে চায়, এরা সবাই নতুন। গোপীনাথ ঘোষ একসময় পার্লামেন্টের মেম্বার ছিল, জানিয়েছে তার ছোট ছেলের খুবই খেলার ইচ্ছে, ছেলেটি কলকাতায়ই বরাবর রয়েছে, সে নাকি কখনো আটঘরা দেখেনি, তাই… গোপীনাথ তো এখন এম.এল.এ, ওকে চটানো ঠিক হবে না।”

”দাদু এই ম্যাচে খেলার এলিজিবিলিটি তো আটঘরা বা বকদিঘিতে তেরাত্তির বাস, তা গোপীনাথ ঘোষের ছেলে কি তিন রাত কাটিয়েছে?”

”পরমেশ তো বলল কাটিয়েছে। তেরো বছর আগে গোপী ঘোষ যখন এম পি ছিল, তখন একবার আম্পায়ার হয়েছিল। ওখানকার লোকেরা আজও বলে আমপায়ারিং তো নয়, হয়েছিল গোপী ঘোষের ‘এমপিয়ারিং’। সেই সময় গোপী ঘোষের সঙ্গে ওর তিন বছর বয়সী ছেলেটি নাকি আটঘরায় গেছল আর দিন পাঁচেক তার পিসির বাড়িতে ছিলও। সে প্রমাণ নাকি আছে খেলার পর তোলা গ্রুপ ফোটোতে।”

”তাহলে কারা বাদ যাবে?”

”নন্তু আর মতিকেই শেষ পর্যন্ত বাদ দিতে হবে, ওরা নিজেদের লোক কিছু মনে করবে না। কিন্তু বকু বোস, ভুবনেশ্বর সিংহি বা তার কম্পাউণ্ডার চণ্ডীকে বাদ দিলে তো বিক্ষোভ মিছিল, ঘেরাও, অবস্থান, প্রতিরোধ, আর কীসব যেন হয়, তাই হয়ে যাবে। ওরা বহু যুদ্ধের হিরো তো!”

”কিন্তু তোমার তিন পুরুষ খেলার রেকর্ড গড়ার কী হবে?”

রাজশেখর বিমর্ষ থেকে আরো বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। মাথা চুলকোনো শুরু করতেই কলাবতী বলল, ”বুঝেছি, আমার খেলায় আপত্তি হবে।”

”মানে, পরমেশ বলল মতিকে একবার জিজ্ঞাসা করা দরকার, ও তো ক্রিকেটের আইনকানুনের বই বাংলায় লিখেছে, ব্যাপারটা বোঝে। ফোন করা হল মতির অফিসে। সে বলল, আইনে কিছু বলা নেই যে পুরুষ টিমে, কোনো মেয়ে খেলতে পারবে না। কিন্তু এরকম নজিরও তো কোথাও পাচ্ছি না, তবে বকদিঘি যদি রাজি হয়…। তাই পরমেশ বলল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে পতু মুখুজ্জেকে একবার সাউণ্ড করে দেখবে, পতুই তো বকদিঘির সব, ক্রিকেট আইন নাকি ভালই জানে টানে।”

”আইনে যদি কিছু বলা না থাকে তাহলে আমি খেলতে পারব না কেন?”

কলাবতী গোঁয়ারের মতো ঘাড় বেঁকাল।

”ক্রিকেট আইনে অনেক কিছুই বলা নেই। হতে হতে, চলতে চলতে সেগুলো প্রথায় দাঁড়িয়ে যায়। এই ধর পোশাকের ব্যাপারটা, সাদা শার্ট—ট্রাউজার্স গোড়া থেকে চলে আসছে তাই ওটাই প্রথা হয়ে গেছে। ছাপকা ছাপকা রঙিন জামা কি কেউ পরে, না পরার দাবি তুলেছে? আবার প্রয়োজনেও অনেক কিছু হয়। কেউ দশ বছর আগেও হেলমেট পরত না, কিন্তু এখন অনেকেই পরছে। তোর সম্পর্কে আপত্তি যদি হয় তো … সেইরকম আর কী।”

কলাবতী চুপ করে রইল। কিন্তু মনে—মনে সে যেন তখন কিছু একটা ভেবে চলেছে। রাজশেখর মিটমিট করে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ”মনে হচ্ছে কালুর মাথায় দুষ্টুমি ঘুরপাক খাচ্ছে।”

ছেলেটাকে যেন চেনাচেনা লাগছে

ফিয়াট গাড়ি চালাচ্ছে সত্যশেখর। তার পাশে কলাবতী। পিছনের আসনে রাজশেখর। ওরা যাচ্ছে আটঘরায়। পৌঁছতে ঘণ্টা দুয়েকও লাগবে না। গাড়ির পিছনে বুটিতে আছে একটা সুটকেশ আর ব্যাটিং সরঞ্জাম। দর্জি তিন দিনের মধ্যে দুজনের শার্ট আর ট্রাউজার্স বানিয়ে দিয়েছে। মাপমতো বুট দোকানেই পাওয়া গেছে। কলাবতীর সবই আছে, নতুন কিছুর দরকার হয়নি।

দক্ষিণেশ্বরে বিবেকানন্দ সেতুর উপর পিছনে আর একটা গাড়ির হর্ন শুনে সত্যশেখর আয়নায় তাকিয়ে দেখল সবুজ একটা অ্যাম্বাসাডার অধৈর্য হয়ে পথ দেবার জন্য ফাঁক খুঁজছে আর হর্ন দিচ্ছে। ভ্রূ কুঁচকে উঠল সত্যশেখরের। নিজের গাড়ি রাস্তার মাঝখানে এনে গতি মন্থর করল। কলাবতী জানলা দিয়ে পিছনে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলল, ”কাকা, বড়দিরাও যাচ্ছেন।”

”তাই নাকি!”

বিস্ময়টা বাড়াবাড়ি রকমের হওয়ায় সে বুঝে গেল, কাকা ইচ্ছে করেই অ্যাম্বাসাডারকে জব্দ করতে চাইছে।

কিন্তু মিনিট কয়েক পরেই রাজশেখর উত্তেজিত হয়ে বললেন, ”থামা, থামা!”

সত্যশেখর হকচকিয়ে রাস্তার কিনারে এনে মোটর থামাতেই অ্যাম্বাসাডারটা পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় কলাবতী দেখল পিছনের আসনে বসা বড়দি ঝুঁকে কটমটিয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে, আর তাঁর পাশে দাদুর মতো চেহারার এক বৃদ্ধ বুড়ো আঙুল তুলে তাদের কলা দেখালেন। ”হরি গেল না?”

”হ্যাঁ।”

”সঙ্গে কে, মলয়া?”

”বোধহয়।” সত্যশেখর গম্ভীরস্বরে বলল।

”হরি কলা দেখাল… আমি স্পষ্ট দেখেছি। বোধহয় আমাদের বাঁদর বলে গেল।”

রাজশেখর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ”একটা লোক ডাব বেচছে, দেখ তেষ্টা পেয়ে গেল।”

”দাদু, ফ্লাস্কে তো জল রয়েছে।”

‘কর্পোরেশনের জলে আর প্রকৃতির জলে অনেক তফাত।”

রাজশেখরের সঙ্গে তাঁরা হেঁটে খানিকটা পিছিয়ে এল যেখানে গণ্ডাচারেক ডাব নিয়ে একটা লোক বসে আছে।

ডাবের জল খেয়ে মিনিট দশ পর ওরা আবার রওনা হল। দিল্লি রোড ধরে এল দিয়াড়া মোড়। এরপর নসিবপুর, সিঙ্গুর হয়ে কামারকুণ্ডু। ঘড়ি দেখে সময় হিসাব করে রাজশেখর বললেন, ”খেলা শুরুর আগেই আমরা পৌঁছে যাব।”

দু’ধারে মাঠ, দূরে গাছপালার আড়ালে গ্রাম। সাইকেল আরোহী, পথচারী, মাঝে মাঝে যাত্রীভরা বাস আর ট্রাক ছাড়া পথে আর কিছুর সঙ্গে তাদের দেখা হল না।

রাস্তাটা এক জায়গায় ভাঙা। বড় বড় গর্তগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো সরু পথ রয়েছে। কুমড়ো বোঝাই একটা সাইকেল ভ্যান সরু পথটা দিয়ে আসছে। সত্যশেখর গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করল।

”কাকা, এইবার আমাকে দাও।”

”এটা পেরিয়ে গিয়ে।”

ভ্যানটা চলে যাবার পর গাড়িকে সন্তর্পণে ভাঙা জায়গার পাশ কাটিয়ে এনে সত্যশেখর নামল। কলাবতী স্টিয়ারিংয়ে বসল।

আধ কিলোমিটার পরেই বর্শাফলার মতো রাস্তাটা বেঁকে গেছে। কলাবতী একটা গোরুর গাড়িকে পাশ কাটিয়ে বাঁক ঘুরেই অচল সবুজ অ্যাম্বাসাডারের ঘাড়ে ফিয়াটকে নিয়ে ফেলত, যদি না তার কাকা পা বাড়িয়ে ব্রেকটা চেপে ধরত।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে মলয়া এবং হরিশঙ্কর। ড্রাইভার বনেট খুলে মুখ নামিয়ে কী করছে।

”শার্প বেণ্ডের মুখে এভাবে কেউ গাড়ি রাখে?” সত্যশেখর গলা বাড়িয়ে বলল, ”এখুনি একটা কাণ্ড ঘটে যেত।”

রাজশেখর গাড়ি থেকে নামলেন বেশ প্রসন্নমুখে। একটু দূরে গাছতলায় দাঁড়ানো হরিশঙ্করের কাছে গিয়ে কোমরে হাত রেখে এক মিনিট সেইভাবে তাকালেন, নতুন ব্যাটসম্যান ক্রিজে এসে যেভাবে সাজানো ফিল্ড পর্যবেক্ষণ করে। তারপর পিচে ব্যাট ঠুকে ঠুকে আর কাঁকরধুলো বাছাবাছি করে বাগান করার মতো ভঙ্গিতে বললেন, ”খেলা দেখতে যাচ্ছিস?”

”হ্যাঁ, তুই?”

”খেলতে।”

হরিশঙ্করের চোখদুটো এবার বড় হয়েই ভ্রূ কুঁচকে গেল। রাজশেখরের সাদা ট্রাউজার্স আর শার্টের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ”হারবি।”

”বাজি!”

”বাজি।”

কলাবতী গাড়ি থেকে নেমে এসে মলয়ার দিকে এগোচ্ছিল, থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ”এক কাঁদি মর্তমান কলা।”

”সিংহরা এখন তাহলে নিরিমিষ্যি খাচ্ছে?”

হরিশঙ্করের বাঁকানো হাসির দিকে তাকিয়ে রাজশেখর বললেন, ”খাচ্ছে আর খাওয়াবে ভাবছে।”

ড্রাইভারের সঙ্গে মলয়াও উঁকি দিয়ে দেখার ভান করছিল, তার কাঁধের থেকে ঝুলছে নিক্কন ক্যামেরা। কলাবতী এসে বলল, ”বড়দি, কী হল?”

”ফ্যানবেল্ট ছিঁড়ে গেছে। সঙ্গে একস্ট্রাও নেই যে…”

সত্যশেখর গাড়ি থেকে নামেনি। সে চেঁচিয়ে বলল, ”কালু, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের, ঠিক সময়ে পৌঁছতে হবে।”

কলাবতী ছুটে এল। ”কাকা, ফ্যানবেল্ট ছিঁড়ে গেছে।”

”তা আমরা কী করব, ওঠ এখন, দাদুকে ডাক।”

”ওঁরা যাবেন কী করে?”

”হেঁটে, নয়তো অপেক্ষা করুক, যখন বাস আসবে উঠবে।”

‘যযআহ, এইরকম নির্জন জায়গায় ওরা পড়ে থাকবেন, তাই কি হয়? আমাদের গাড়িতে ওঁদের উঠিয়ে নাও।”

”বাঁদরদের গাড়িতে ওরা কি চড়বে?”

”এখন রাখো তো ওসব কথা, বিপদে পড়েছে না?” কলাবতী কাকাকে প্রায় ধমকে দিল। তারপর সে চেঁচিয়ে বলল, ”দাদু, ওঁরা আমাদের সঙ্গে চলুন।”

রাজশেখর এগিয়ে এলেন। ”আমিও তাই হরিকে বলছি, ড্রাইভার তারকেশ্বরে নেমে ফ্যানবেল্ট কিনে, বাসে এখানে ফিরে এসে যা করার করুক। আর তোদের আমরা বকদিঘিতে নামিয়ে দিচ্ছি। চেপেচুপে এঁটে যাবে, কী বলিস?”

”ছ’জন কেন ধরবে না? বড়দি, চলে আসুন।”

গম্ভীর মুখে মলয়া পিছনের আসনে বসল। গাড়ি স্টার্ট দেবার সময় কলাবতীর মনে হল কাকা আয়না দিয়ে পিছনে তাকাল আর জিবটা বার করতে গিয়েও করল না, শুধু বলল, ”পিছনের ডানদিকের অ্যাবজর্বারটা কাল একবার চেক করিয়ে নিতে হবে।”

”কেন, খারাপ হয়েছে?”

‘হবে।”

গাড়ির ডানদিকেই মলয়া বসেছে। তার মুখ আরো গম্ভীর হয়ে গেল।

তারকেশ্বরে ড্রাইভারকে আর বকদিঘিতে দু’জনকে নামিয়ে ওরা আটঘরার ফুটবল মাঠে যখন পৌঁছল, খেলা শুরু হতে তখন কুড়ি মিনিট বাকি। বকদিঘির অধিনায়ক পতু মুখুজ্জে অপেক্ষা করছে টস করার জন্য।

”এসে গেছে, এসে গেছে, আমাদের ক্যাপ্টেন এসে গেছে।”

শোরগোলে পড়ে গেল মাঠের পুবদিকে নীল শামিয়ানার চারধারে। কলাবতী এই প্রথম এসেছে, তাই প্রচণ্ড ভিড় আর উদ্দীপনা দেখে সে তো অবাক।

মাঠের পশ্চিমে হলুদ রঙের আর একটা শামিয়ানা। ওটা বকদিঘির। মাঠের ধারে মাঝামাঝি জায়গায় পাঁচ হাত লম্বা, আড়াই হাত চওড়া একটা টেলিগ্রাফিক স্কোরবোর্ড আট হাত উঁচু বাঁশের মাচায় বসানো। তার নীচে স্কোরারদের টেবল।

দুটো শামিয়ানাই আকারে ও প্রকারে দেখতে একইরকম। পক্ষপাতিত্বের দোষ কোনোক্রমেই দেওয়া যাবে না। শামিয়ানার সামনের দিকে কিছু চেয়ার প্লেয়ারদের জন্য। ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের বাড়ি থেকে চেয়ে এনে এবার একটা সোফা রাখা হয়েছে রাজশেখরের জন্য। পিছন দিকে কাপড়ে ঘেরা একটি ঘর—ড্রেসিং—রুম। তার দরজায় পর্দা ঝুলছে। এবার জলপানের বিরতির সময় মাঠে জল নিয়ে যাবার জন্য স্টিলের জগ ও ট্রে আর ফুল আঁকা কাচের গ্লাস দিয়েছেন দারোগাবাবু।

শামিয়ানার নীচ থেকে প্লেয়াররা মাঠে যাবে শতরঞ্চের উপর দিয়ে। অনেকে চেয়েছিল ডেকরেটরের কাছ থেকে গালিচা ভাড়া করে আনতে। কিন্তু পঞ্চায়েতপ্রধান পটল হালদারের আপত্তিতে তা আর হয়নি। তার বক্তব্য ছিল : দেশে মর্মান্তিক খরা চলছে, এখন বিলাসিতার সময় নয়।

শতরঞ্চের দু’ধারে সারি সারি বেঞ্চ পাতা। আটঘরা হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুল থেকে, পঞ্চাশ টাকা ‘কশান মানি’ জমা দিয়ে সেগুলো আনা হয়েছে। গত বছর বকদিঘির আম্পায়ার এক ওভারেই চারজন আটঘরিয়াকে রান আউট দেওয়ায় যে কাণ্ড ঘটে, তাতে বেঞ্চ মেরামত করতে স্কুলের বিশ টাকা খরচ হয়ে যায়। এবার বেঞ্চ দিতে স্কুল রাজি হয়নি, কিন্তু পঞ্চায়েতপ্রধানের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে তা সম্ভব হয়েছে। তবে পরমেশের কাছে তিনি আড়ালে বলে রেখেছেন, সোফা ছাড়া আর কোথাও তিনি বসবেন না।

বেঞ্চে ঠাসাঠাসি দর্শক, তার তিন ভাগই গিন্নিবান্নি আর কুচোকাঁচা। যাত্রা দেখতে গিয়ে বসার জায়গা নিয়ে যে ঠেলাঠেলি, চিৎকার, ঝগড়া হয়, সেইরকমই হচ্ছে। দুই রঙের কাগজের শিকল জড়াজড়ি করে মালার মতো মাঠটাকে ঘিরে রয়েছে। পঞ্চায়েত প্রধান, যাকে আড়ালে বহু লোকই ‘পটল প্রধান’ বলে থাকে, তার নির্দেশে দুই গ্রামের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের লড়াকু মোর্চা বজায় রাখতেই মাঠকে এই মাল্যদান। অ্যামপ্লিফায়ারে গতবছর ‘ডিসকো’ গান বাজানো হয়েছিল। পটল প্রধান সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ‘অপসংস্কৃতি’ আর চলবে না। দুই শামিয়ানার মাথায় লাগানো চোঙা থেকে এবার তাই বেরোচ্ছে ভূপেন হাজারিকা আর সুচিত্রা মিত্র।

কলাবতীর চোখে পড়ল, লম্বাচুল, তারই বয়সী তারই আকৃতির একটি ছেলে এক কোণে চেয়ারে পাংশুমুখে বসে। বারবার ঢোঁক গিলছে আর চেয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরছে। তার মনে হল এই বোধহয় গোপীনাথ ঘোষের ছোট ছেলে।

”নাহ, হলো না।”

কলাবতী তার পাশে এসে দাঁড়ানো পরমেশের দিকে মুখ ফেরাল।

”পতু মুখুজ্জে রাজি নয়। তিন পুরুষে খেলার রেকর্ড করতে দেবে না। অপোনেন্ট আপত্তি করলে তোমায় নামাই কী করে বলো?”

রাজশেখর টস করে ফিরে এলেন। নিখুঁত ক্রিকেটের পোশাক, মাথায় যৌবনকালের ক্যাপ আর ঋজু দেহে তাঁকে টেস্ট ক্রিকেটারের মতো দেখাচ্ছে। সারা মাঠ তাঁর দিকেই তাকিয়ে।

”ওদের ব্যাট করতে দিলুম।… উইকেটকিপার, প্যাড আপ… এগারোজন ঠিক আছে তো? … সতু কোথায়? … পরমেশ; কে আমাদের ওপেনিং বোলার, ওয়ান চেঞ্জ কে? আমায় সব মাঠে বলে দেবে।”

রাজশেখর ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁকে দেখে অন্যরাও ব্যস্ত হবার জন্য ছোটাছুটি শুরু করে দিল, এমন কী সত্যশেখরও। সেই সময় কলাবতী গিয়ে বসল গোপীনাথ ঘোষের ছেলের পাশে।

”তুমি কি আজ খেলছ?”

”হ্যাঁ… তবে…”

”তবে কী, নার্ভাস লাগছে?”

”পেটের মধ্যে কী রকম গুলোচ্ছে!”

”বমি বমি ভাব আসছে তো?”

”হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেকটা তাই।”

”তার মানে আজ তুমি ক্যাচ ফেলবে। ইজি সিটার মিস করবে।” কলাবতী নিশ্চিতস্বরে বলল। ”আজ তুমি নির্ঘাত পায়ের ফাঁক দিয়ে বল গলিয়ে বকদিঘিকে গোটা দশেক বাউণ্ডারি পাইয়ে দেবে।..ওহ, লিমিটেড ওভার ক্রিকেটে এক একটা রানের যা দাম! ফিল্ডিংই তো আসল ব্যাপার, আর তোমার জন্য যদি আটঘরা হেরে যায়!”

”তাহলে কী হবে?”

”গত বছরের ব্যাপার শোনোনি? লাস্ট ওভারে সিলি মিড—অন লোপ্পাই ক্যাচ ফেলে দেওয়ায় আটঘরা জেতা ম্যাচটা হেরেছে। খেলার পর এখানকার ছেলেরা সিলি মিড—অনের চুল খাবলা খাবলা করে কেটে রিকশায় চাপিয়ে সারা আটঘরা ঘুরিয়েছিল। উফফ, সে যে কী লজ্জার ব্যাপার না, তোমায় কী বলব।”

ছেলেটি আঁতকে উঠে তার সযত্নে তৈরি ‘অমিতাভ বচ্চচন’ চুলে হাত রেখে বলল, ”তাহলে?’

”তাহলে তুমি আর নেমো না, বরং ড্রেসিংরুমের বেঞ্চে গিয়ে শুয়ে পড়ো। বলবে হঠাৎ ম্যালেরিয়া ধরেছে। যাও যাও, শিগগিরি যাও। আর শোনো, এক—আধবার কোঁ কোঁ, হুঁ হুঁ শব্দ কোরো।”

”আম্পায়াররা মাঠে নেমে গেছে, হারি আপ, হারি আপ।”

উইকেটকিপার বকু বোস কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ”প্যাডের বকলেসটা ছিঁড়ে গেল নন্তুবাবু, একটা দড়িটড়ি…”

”অত জোরে টানতে গেলেন কেন… এখন কোথায় যে দড়ি পাই…”

”হারি আপ, হারি আপ।”

”ওরে, গোপী ঘোষের ছেলে যে ড্রেসিংরুমে শুয়ে ম্যালেরিয়ায় কঁকাচ্ছে, কী হবে এখন?

”টুয়েলফথম্যান কে হয়েছে?”

”সে তো হাবু ময়রার ছেলে বিশু। ডাক ডাক ওকে।”

বিশুর বেলবটম আকাশী—নীল রঙের প্যান্ট দেখেই রাজশেখর ভ্রূ কোঁচকালেন।

পরমেশ কানে কানে বলল, ”ছেড়ে দিন জ্যাঠামশাই, লাঞ্চের সন্দেশ আর দই হাবু দিচ্ছে। আমি গিয়ে ততক্ষণে অপোনেন্ট ক্যাপ্টেনের পারমিশনটা নিয়ে আসি সাবস্টিটিউট নামাচ্ছি বলে।”

পরমেশ ছুটে মাঠের মধ্য দিয়ে হলুদ শামিয়ানার দিকে চলে গেল। রাজশেখর তাঁর দল নিয়ে মাঠে নামলেন।

আড়াই ঘণ্টা পর ৪০ ওভারের শেষে বকদিঘির ইনিংস শেষ হল নয় উইকেটে ১৭৪ রানে। দুই দল নিজেদের শামিয়ানায় ফিরে গেল লাঞ্চের জন্য। বকদিঘি প্রথম পাঁচটি উইকেট হারায় ১৪ রানে—তিনটি রান আউট, দুটি স্টাম্পড।

দর্শকদের মধ্যে যাঁরা এই ম্যাচের রীতিনীতি জানেন তাঁরা আটঘরা তরফের স্থায়ী আম্পায়ার অঙ্কের শিক্ষক বুদ্ধদেবস্যারের অবিমৃশ্যকারিতায় ভয় পেলেন।

”বুদ্ধস্যার এটা কী করলেন, খেলার গোড়াতেই পাঁচটা উইকেট নিলেন! এবার বড় রান করার মতো যদি কেউ খেলে দেয়, তখন কী করবেন? তাকে কী করে আউট করবেন?”

ভয়টা সত্যি হল যখন ষষ্ঠ উইকেটে অতুল মুখুজ্জে আর বিষ্টু মিশির ৩১ মিনিটে ৬৯ রান তুলল। রান আউট, স্টাম্পড, এল বি ডবলু থেকে শুরু করে হিটিং দ্য বল টোয়াইস এমন, কী হ্যান্ডলড দ্য বল—কোনো আইনেই দু’জনকে আউট দেবার সুযোগ বুদ্ধদেবস্যার পেলেন না। ওরা প্রতি বল ব্যাটে খেলেছে এবং বেলচা ও কাস্তে চালানোর মতো ব্যাট চালিয়ে বলগুলো প্রায়শই বাউন্ডারির উপর দিয়ে ফেলেছে। তাই করতে গিয়ে অবশ্য মিশিরজি তিনবার ও অতুলবাবু একবার এক্সট্রাকভার, থার্ডম্যান, লং অন ও পয়েন্ট বাউন্ডারিতে ক্যাচ দেয় এবং প্রতিবারই হাবু ময়রার ছেলে বলের নিকটতম ফিল্ডার ছিল। বস্তুত দুটি ক্যাচ তার তালু থেকে ছিটকে গেছে, একটি তার মাথা চাপা দেওয়া হাতে পড়েছে, এবং শেষেরটি তার এক হাত পিছনে পড়ে এবং সে ধরার কোনো চেষ্টাই করেনি। প্রথম স্লিপ থেকে রাজশেখর বিষণ্ণ, স্তম্ভিত ও বিরক্ত হবার পর তাঁর শেষ ক্রুদ্ধ মন্তব্য দুই শামিয়ানার লোকেরাও শুনতে পায়।

”এটাকে কান ধরে বার করে দাও।” ওভার শেষে রাজশেখর বলেছিলেন।

পরমেশ কাতরস্বরে তখন বলেছিল, ”জ্যাঠামশাই, হাবুর দোকান থেকে এখনো একটা হাঁড়িও পৌঁছয়নি। আমি লক্ষ রেখেছি, হাঁড়িগুলো এলেই ওকে বসিয়ে অন্য কাউকে নামাব।”

ষষ্ঠ উইকেট জুটি ভেঙেছিল রাজশেখরের বলে। পাক্কা সাড়ে সাত মিনিট ধরে তিনি ফিল্ড সাজিয়ে এবং না ছুটে শুধু এক জায়গায় দাঁড়িয়েই বল করেন। প্রথম বলটি তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে উঠতে শুরু করে। বলের ওড়া দেখতে দেখতে অতুল মুখুজ্জের মুখ আকাশমুখো হয়ে যায় এবং বল তাঁর টাক লক্ষ করে অবতরণ করায় তিনি আত্মরক্ষার জন্য পিছিয়ে যেতে যেতে হিট উইকেট হন। নবাগত ব্যাটসম্যান একটা লেগবাই নেয়, যখন বলটা তাঁর পিঠের উপর পড়ে ফাইন লেগের দিকে যায়। মিশিরজি পরের বলেই উইকেটকিপারের পিছনে ওভার বাউন্ডারি মারার জন্য সিলি পয়েন্টের কাছে সরে গিয়ে ব্যাট চালায় এবং ফশকায়। বেলের উপর বল পড়ায় একটা বেল দু টুকরো হয়ে যায়।

ফিল্ডাররা ছুটে এসে রাজশেখরকে ঘিরে নানাভাবে বিস্ময়, প্রশংসা, উল্লাস জানায়। সত্যশেখর উত্তেজিত হয়ে বাবার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে পিঠও চাপড়ে দেয়। তিনি সারা মুখে স্মিতহাসি ছড়িয়ে শুধু বলেন, ”তেত্রিশ বছর পর বল করলুম।” তারপর হলুদ শামিয়ানার দিকে মুখ করে ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা মাথার উপর তুলে ধরেন।

মুকুন্দ মালখণ্ডি রাজশেখরের পরের ওভারে পাঁচটি ওভার বাউন্ডারি মারায় তিনি নিজের উপর জবরদস্ত ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে আর বল করেননি। বকদিঘির সর্বোচ্চচ রান করেছিল ‘অতিরিক্ত’ মশাই। ৪৩ রানের অতিরিক্তে বাই ছিল ৩৯। স্থানীয়দের মতে বকু বোসের জীবনে এটাই তার সেরা কিপিং।

বুদ্ধদেবস্যারের অবিমৃশ্যকারিতাজনিত আশঙ্কা সত্যে পরিণত হল লাঞ্চের পর। আটঘরা প্রথম ওভারেই চারটি উইকেট হারাল এক রানে। চারটিই এল বি. ডবলু। তার মধ্যে একটি বল ভুবন সিঙ্গির কপালে, আর দুটি ফুল টস অফ স্ট্যাম্পের দু’ফুট বাইরে ছিল। চতুর্থটির ক্ষেত্রে বল শুধু প্যাড ‘ঘেঁষে’ ছয় ইঞ্চি বাইরে দিয়ে বেরিয়ে গেছল। আশ্চর্যের ব্যাপার, এরপরও স্কুলের বেঞ্চগুলো অক্ষত রইল।

বকদিঘির স্থায়ী আম্পায়ার হরিশ কর্মকার একবার শুধু ভ্রূ তুলে বুদ্ধুস্যারের দিকে তাকিয়ে ওভার শেষে স্কোয়্যার লেগে যাবার সময় মুচকি হাসে। কোথা থেকে এক ফাস্ট বোলার আনিয়েছে বকদিঘি (অবশ্যই খেলার কোয়ালিফিকেশন আছে), যার ছোটার এবং বলের গতি এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো, তার তিন ওভারে একটি বল গুড লেংথে এবং উইকেট—সোজা পড়ে।

সত্যশেখর ওপেন করে শূন্য রানে নট আউট ছিল। চণ্ডী কমপাউন্ডার ক্রিজে আসার পরই দুজনে মিলে ৩০ ওভারে ঝড়ের মতো রান নিয়ে গেল ১৪৪—এ। বিষ্টু মিশির আর অতুল মুখুজ্জের স্ট্রোকগুলি একত্র করেই সত্যশেখর স্ট্রোক দিয়ে গেল। বল্লমের মতো ব্যাট চালিয়ে বোলারের মাথার উপর দিয়ে ত্রয়োদশতম ছয়টি নিয়ে সে ১০৪—এ পৌঁছয়।

উল্লাসে ভেঙে পড়ল মাঠ। পিলপিল করে লোক ছুটল মাঠের মধ্যে। সত্যশেখরকে কাঁধে তুলে নাচানাচি হল। তখন, কলাবতী দূর থেকেও দেখতে পেল, কাকার জিবটা হলদে শামিয়ানা লক্ষ করে বারচারেক বেরিয়ে এল। কলাবতীর চোখ পড়ল, বড়দি তার বাবার পাশে সামনের সারিতেই বসে। ক্যামেরাটা চোখের কাছে ধরা।

পটল হালদার উত্তেজিত হয়ে বলল, ”হিস্ট্রিতে এই প্রথম আটঘরার পক্ষে শত রান… আমার প্রধানত্বে এত বড় ব্যাপার ঘটল, কালই পঞ্চায়েত মিটিং ডাকব, চাঁদা তুলব, শত রান স্তম্ভ তৈরি হবে, উদ্বোধন করাব পূর্তমন্ত্রীকে দিয়ে, সংবর্ধনা দোব, মিছিল বেরোবে…”

”এখন খরা চলছে রে পটলা।” ভিড়ের মধ্য থেকে কে একজন ফোড়ন কাটল।

”হোক খরা… সে তো বহুবার হয়েছে, আবার হবে, কিন্তু এই শত রান, এই সেঞ্চুরি হয়তো এই সেঞ্চুরিতে আর ঘটবে না।” পটল হালদার উদ্দীপনায় সংগ্রামী ভঙ্গিতে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল।

গোপীনাথ ঘোষের ছেলে হইচই হট্টগোলে ড্রেসিংরুম থেকে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিচ্ছিল। কলাবতী ছুটে গিয়ে তাকে ঠেলে ভিতরে পাঠাল।

”করছ কী, ম্যালেরিয়া না তোমার?”

”সেই কোন সকালে খেয়েছি আর তোমরা তো লাঞ্চে রসগোল্লা খেলে।”

”বোধহয় হাঁড়িতে কয়েকটা এখনো রয়েছে, দাঁড়াও দেখছি।”

এক মিনিটের মধ্যে কলাবতী হাঁড়ি এনে বেঞ্চের নীচে রাখল।

”গোটা পনেরো আছে। ওদিকে মুখ করে শুয়ে হাত বাড়িয়ে একটা একটা করে তুলবে, কেউ যেন টের না পায়, কেমন?” এই বলে কলাবতী ড্রেসিংরুমের একটা কোণের কাপড় তুলে হামা দিয়ে বেরিয়ে সবার অলক্ষ্যে চলে গেল পিছনে রাখা তাদের ফিয়াট গাড়ির দিকে।

পতু মুখুজ্জে কটমট করে হরিশ কর্মকারের দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে দু—চারটে কথা বলার পরই আটঘরার ইনিংস ১৪৪—২ থেকে ১৫৮—৮ হয়ে গেল তিন ওভারের মধ্যে। সত্যশেখর ১০৪ আর চণ্ডী কম্পাউন্ডার ৩১ রানে ফিরে আসে স্টাম্পড ও রান আউট হয়ে। পা দিয়ে একটা স্নিক থামিয়ে গাঁটে চোট পাওয়ায় রানার নিয়ে ব্যাট করতে নামলেন রাজশেখর। তাঁর নিখুঁত কেতাবি স্টান্স, ব্যাট তুলে বল ছেড়ে দেওয়া, এগিয়ে—পিছিয়ে ডিফেন্স করা, প্রতি বল লাইনে গিয়ে খেলা দেখে মাঠে হঠাৎ গাম্ভীর্য নেমে এল। দারোগাবাবু এবং ব্যাঙ্ক—ম্যানেজার রান আউট হলেন ১৫৮ রানের সময়। ব্যাট করতে বাকি হেডমাস্টার আর গোপী ঘোষের ছেলে।

রাজশেখর ১১ রানে ক্রিজে। দুটি গ্লান্স ও একটি লেটকাট থেকে পাওয়া রান। দারোগাবাবু আউট হয়ে চলে যাবার সময় তিনি বলে দিলেন, ”আর সতেরো রান জিততে, ছেলেটাকে নামাতেই হবে।”

”ভাববেন না স্যার, আঠারো বছর পুলিশে আছি, কী করে নামাতে হয়…”

কিন্তু দারোগাবাবু বাউন্ডারি লাইন পেরোবার আগেই দেখা গেল গোপী ঘোষের ছেলে ব্যাট হাতে মাঠে নামছে। ম্যালেরিয়ায় একেবারে কাহিল। ফুলহাতা সোয়েটারে, ঘাড়, গলা, চিবুক ঢাকা মাফলারে আর কপাল ঢেকে চেপে বসানো পানামা টুপিতে ছেলেটার নাক আর চোখ ছাড়া মুখের কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে ঠকঠকিয়ে কেঁপেও উঠছে।

ছেলেটি ক্রিজে আসতেই তাকে পরিস্থিতি বুঝে খেলার জন্য দু—চার কথা বলতে রাজশেখর এগিয়ে আসছিলেন। কিন্তু ছেলেটি হাত তুলে তাঁকে ফিরে যাবার নির্দেশ যে—ভঙ্গিতে দিল, তাতে তিনি হকচকিয়ে ফিরে গেলেন।

ঝানু ব্যাটসম্যানের মতো ‘লেগ—মিড’ গার্ড নিয়ে বুটের ডগা দিয়ে মাটিতে আঁচড় টানল। পতু মুখুজ্জের মুখে শেয়ালের ধূর্তামি ফুটে উঠেছে। সব ফিল্ডারদের ডেকে সে উইকেট ঘিরে দাঁড় করিয়ে দিল।

এক্সপ্রেস বোলারের ওভার চলছে। বল মুঠোয় নিয়ে সে বীভৎস দৃষ্টিতে গোপী ঘোষের ছেলের দিকে তাকাচ্ছে। প্রথম বলটা পিচের মাঝামাঝি পড়ে মাথাসমান উঠল। ছেলেটি কুঁজো হয়ে মাথা সরিয়ে নিল। বকদিঘির সমর্থকদের মুখে হাসি দেখা দিল। পরের বল গুড লেংথে পড়ে অফ থেকে সরে স্টাম্পের দিকে যাচ্ছিল। ইঞ্চি দুয়েক তোলা ব্যাটটা ঝপ করে নামিয়ে দিল। বলটা ব্যাটের কিনারে লেগে স্লিপের মধ্য দিয়ে বাউন্ডারিতে গেল। জেতার জন্য আর ১৩ রান দরকার। পরের দুটো বলও অবিশ্বাস্যভাবেই গুড লেংথে পড়ল এবং ছেলেটি পিছিয়ে গিয়ে ব্যাট বুকের কাছে তুলে আটকাল। রাজশেখর তারিফ জানাতে মাথা নাড়লেন। মাঠের দু’ধার থেকে দুরকম দীর্ঘশ্বাস পড়ল—আশাভঙ্গের এবং আশাতীতের।

পরের ওভারে মালখণ্ডীর অফস্পিনগুলোকে রাজশেখর সহজেই খেলে দিলেন। তবে একটা বল ব্যাট—প্যাড হয়ে সামান্য উঠেছিল। ফরোয়ার্ড শর্ট—লেগ ঝাঁপিয়ে মাটি থেকে বল তুলে ‘হাউজ দ্যাট’ বলে। হরিশ উপরদিকে আঙুল কিছুটা তুলেছে তখন রাজশেখরের কণ্ঠ থেকে বাজ ডাকার মতো ‘নট আউট’ গর্জে উঠতেই বজ্রাহত আঙুল নিঃসাড়ে নীচে পড়ে যায়।

এক্সপ্রেস বোলার ওভার শুরু করার আগে পতুর সঙ্গে গভীর পরামর্শ করে লংলেগে আর মিড উইকেটে দুজন ফিল্ডার রাখল। গোপী ঘোষের ছেলের আবার জ্বরের কাঁপুনি দেখা দিল। বুকের কাছে মুখ নামিয়ে কুঁকড়ে হিহি করছে। বকদিঘির ফিল্ডাররা তার দিকে তাকাচ্ছে সেইভাবে, বেড়াল ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে যেভাবে ইঁদুরের দিকে তাকায়।

পটল হালদার চুকচুক করে সহানুভূতি জানিয়ে তখন বি ডি ও—কে বলল, ”আটঘরার জন্য জীবন বিপন্ন করেও এই যে সংগ্রাম… জানলেন, আমাকেও উদ্বুদ্ধ করছে। আমি চাঁদা তুলব, স্তম্ভ গড়ব…”

বাবার অনুপস্থিতিতে বহুক্ষণ পর সিগারেট খাওয়ার সুযোগ পেয়ে সত্যশেখর সুযোগের সদ্ব্যবহার করছিল। সে শুধু মিটিমিটি হেসে বলল, ”ও বুর্জোয়া বাড়ির ছেলে।”

প্রথম বলটা যথারীতি শর্টপিচ। গোপী ঘোষের ছেলে ডান পা অফ স্ট্যাম্পের দিকে এনে বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটটা ঝলসাল আর মাথা থেকে টুপিটাও তখন পড়ে গেল। ফিল্ডাররা সবাই বলের দিকে তাকিয়ে। ছেলেটি তাড়াতাড়ি টুপি কুড়িয়ে মাথায় চেপে বসাল। রাজশেখরের চোখ অবাক হয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে। কিছু একটা বলতে গিয়ে ঢোঁক গিলে নিলেন।

চোখ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে মলয়া মুখার্জি বিস্মিত কণ্ঠে পাশে—বসা বাবাকে বললেন, ”ছেলেটাকে যেন চেনাচেনা লাগছে!”

নিখুঁত হুক থেকে ছয় রান। আর দরকার সাত রান মাত্র। দ্বিতীয় বল অফ স্ট্যাম্পের বাইরে, আবার শর্টপিচ। কড়াত করে রাইফেল থেকে বুলেট বেরোবার মতো আওয়াজ হল। স্কোয়্যারকাট করা বলটা নিমেষে পয়েন্ট বাউন্ডারিতে পৌঁছেছে।

দরকার আর তিন রান। ঝপ করে একটা দমবন্ধ করা থমথমে নৈঃশব্দ্য মাঠটাকে ঘিরে ফেলল। উল্লাসের ঝড় ওঠার আগের অবস্থা।

এক্সপ্রেস বোলারের চোখে এবার ভয়ের আভাস। ফিল্ডাররা ত্রস্ত। পতু মুখুজ্জে দিশাহারা। নয়জন ফিল্ডার বাউণ্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে গেল তার নির্দেশে। গোপী ঘোষের ছেলে আবার হিহি করে কাঁপছে।

এক্সপ্রেস ঝড়ের গতিতে ছুটে এসে বল ছাড়ল। একেবারে মাথা লক্ষ করে ফুলটুস। রাজশেখর চোখ বন্ধ করে ফেললেন। মাঠের অনেক জায়গায় ইশশ শব্দ উঠল শিহরন জানিয়ে। কিন্তু ব্যাটসম্যান স্থির, অচঞ্চল। সে ব্যাটটাকে পাখায় বাতাস করার মতো মুখের সামনে ছোট্ট করে নাড়ল। বলটা মিড উইকেটের দিকে আকাশে উঠতে উঠতে বাউণ্ডারি যখন পেরিয়ে যাচ্ছে, এবং সবাই যখন মুখ তুলে হাঁ করে বলের উড়াল দেখছে, তখন গোপী ঘোষের ছেলে তীরবেগে নীল শামিয়ানার দিকে ছুটতে শুরু করল এবং তাকে কাঁধে তুলে নেবার জন্য যারা তাকে তাড়া করেছিল, তাদের পিছনে ফেলে ড্রেসিংরুমে ঢুকে গেল।

পটল হালদার দু’হাত ছড়িয়ে উচ্ছ্বসিত ভিড়ের সামনে বা বন্যার সামনে বাঁধের মতো দাঁড়িয়ে পড়লেন।

”অসুস্থ। ছেলেটির ম্যালেরিয়া হয়েছে, ওকে আপনারা বিশ্রাম করতে দিন…হবে হবে, পরে ওর সংবর্ধনার ব্যবস্থা হবে…।”

মাঠ থেকে রাজশেখর ফিরে এলেন ভিড় ঠেলে। সত্যশেখর এগিয়ে এসে আড়ালে ডেকে ফিসফিস করে কিছু বলল। রাজশেখরের অট্টহাসিতে শামিয়ানা ভরে গেল।

”তাহলে তিন পুরুষের খেলার রেকর্ড হল।”

ভিড়ের মধ্যে পতু মুখুজ্জের গলা শোনা গেল, ”কই গোপী ঘোষের ছেলে কোথায়, একবার তাকে দেখি।”

”সে ড্রেসিংরুমে শুয়ে আছে।” পটল হালদার বুক চিতিয়ে দাঁড়াল, ”এখন তাকে বিরক্ত করা উচিত নয়।”

”বিরক্ত করব না, শুধু চেহারাটা দেখব।”

কিছুক্ষণ তর্কাতর্কির পর পতু মুখুজ্জে ড্রেসিংরুমের পর্দা সরিয়ে উঁকি দেবার অনুমতি পেল আধ মিনিটের জন্য। পর্দা সরিয়ে সে দেখল, একটা আলোয়ানে আপাদমস্তক ঢাকা একটা শরীর, শুধু নাকটুকু দেখা যাচ্ছে। শরীরটায় মাঝে মাঝে কাঁপুনি ধরছে। আর ”অঃ অঃ” শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাথার কাছে টুপি, ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস ছড়ানো। ড্রেসিংরুমের কাপড়ের দেয়ালের তলার দিকে খানিকটা ফাঁক রয়েছে।

”রাজশেখর সিংগির নাতনি কোথায়?”

”আছে কোথাও।” পরমেশ উদাসীন ভাবে বলল। ”তাকে তো তোমরা খেলতেই দিলে না।”

পতু মুখুজ্জে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ”আমি প্রমাণ দেব সে খেলেছে। ছবি তোলা হয়েছে। প্রিন্ট হয়ে আসুক, তারপর দেখাব মজা। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্সে তুলব, এম সি সি—কে চিঠি দোব…কী করে রেকর্ড হয় দেখব।”

বাইরে সেই সময় পটল হালদারের নেতৃত্বে বিজয় মিছিল থেকে আওয়াজ উঠল, ”আটঘরার সংগ্রামী ক্রিকেট…জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ…”

ডায়েট চার্ট

পেটই হচ্ছে স্বাস্থ্যের মূল ঘাঁটি

কলাবতী রাতে খাওয়ার টেবিলে এল বড় একটা খাম হাতে।

দাদু তখন রুটির গোছা থেকে বেছে ফোস্কা—পড়া চারখানা রুটি প্লেটে তুলে নেওয়ায় ব্যস্ত। রাতে চারখানা রুটি নিজের জন্য বরাদ্দ করেছেন সত্তর বছরে পা দেওয়ার দিন থেকে। চার বছর আগেও তিনি ষোলখানি রুটি খেতেন, যে জন্য আধ কেজি আটা দরকার হত। আটা থেকে ভুষি বাদ দেওয়ার তিনি ঘোরতর বিরোধী। ভূষিতে প্রচুর নাকি পুষ্টি আছে। বয়োবৃদ্ধি এবং খাটুনি হ্রাস, ওই দু’য়ের সঙ্গে মানিয়ে পাকযন্ত্রকে ব্যবহার করলে শরীর অবাঞ্ছিত আচরণে মন দেয় না, আয়ুও বাড়ে, এইরকম একটা ধারণা রাজশেখর সিংহ চিরকালই পোষণ করে আসছেন। আর সেইজন্যই পুত্র সত্যশেখর এবং নাতনি কলাবতীর খাদ্যের পরিমাণ কতটা হবে সেটা তিনি ঠিক করে দিয়েছেন। দু’জনের জন্য কতটা ক্যালরি শরীরে দিলে কর্মক্ষমতা সতেজ থাকবে এবং চর্বি জমবে না, সে—সব তিনি নানান বইপত্র পড়ে এবং নামকরা এক খাদ্যবিশারদের সঙ্গে পরামর্শ করে (খাদ্যবিশারদকে ৬৪ টাকা ফি দিয়েছিলেন) ঠিক করে দিয়েছেন।

এজন্য তিনি ছেলে ও নাতনিকে জেরাও করেছিলেন। যেমন:

রাজশেখর: সতু, সারাদিনে তুমি কতক্ষণ চেয়ারে বসে কাটাও, কতটা পথ চলাফেরা করো, আর কতক্ষণ বিছানায় শুয়ে কাটাও?

সত্যশেখর হকচকিয়ে তারপর আমতা—আমতা করতেই রাজশেখর ধমক দিয়ে ওঠেন, ”অত মাথা চুলকোবার কী আছে আর কড়িকাঠ গোনারই বা দরকার কী? আমিই বলে দিচ্ছি, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তুমি দশ ঘণ্টা ঘুমোও, দু’ঘণ্টা মোটরে, আর চেম্বারে মক্কেলদের সঙ্গে চেয়ারে বসে, দু’বেলায় মোট ছ’ঘণ্টা, আর হাইকোর্টে বসে কাটাও ছ’ঘণ্টা। এ ছাড়া হাঁটাচলার বা দাঁড়িয়ে থাকার জন্য তোমার সারাদিনে সময় যায় এক ঘণ্টা। কেমন, ঠিক বলেছি?

সত্যশেখর অসহায়ভাবে ভাইঝি কলাবতীর দিকে তাকিয়ে বলল, ”কালু আমি কি দশঘণ্টা ঘুমোই?”

কলাবতী গম্ভীরমুখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ”দাদুর হিসেবে একটু ভুল হয়ে গেছে। চব্বিশ ঘণ্টায় শোয়া—বসা—চলার যে হিসেব তুমি দিলে, সেটা যোগ করলে হয় পঁচিশ ঘণ্টা।”

”অ্যাঁ, পঁচিশ। বেশ তাহলে চেম্বার থেকে একঘণ্টা কমিয়ে দিচ্ছি।”

”আমি তো রোজই ঘুমোতে যাই এগারোটায় আর মুরারির কাছ থেকে খবরের কাগজ নিই ভোর ছ’টায়, বারান্দায় চা খেতে খেতে রোজই তো দেখি, তুমি আর কালু জগ করতে করতে ফিরছ। সাত ঘণ্টার বেশি আমি ঘুমোই না।”

রাজশেখর টেবিলে রাখা কাগজে কী যেন লিখে নিলেন। তারপর গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন, ”আলুকাবলি আর ফুচকা এখনও তুমি খাও, ঠিক কিনা? ঘুগনি? তাও নিশ্চয়?…ব্যস ব্যস, তর্ক করতে যেও না, গত বুধবার মুরারিকে দিয়ে কী কিনে আনিয়ে চেম্বারে বসে গপ গপ করে খেয়েছিলে তা কি আমি জানি না?”

সত্যশেখর প্রবলভাবে প্রতিবাদ জানাতে যাচ্ছিল, কিন্তু বাবার কঠিন দৃষ্টি তাকে ম্রিয়মাণ করে দিল, কেননা রাজশেখর একটুও মিথ্যে বলেননি।

”উফফ, এই সব বদভ্যাস এখনও ছাড়তে পারলে না। আজেবাজে রেস্তোরাঁয় নিশ্চয় চপ—কাটলেট গেলো?”

সত্যশেখর টেবিলের দিকে চোখ নামিয়ে চুপ।

”পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স তো হয়ে গেছে, এবার একটু স্বাস্থ্যের দিকে নজর দাও। খাওয়া দাওয়া রেস্ট্রিক্টেড করো, ব্যায়াম—টায়াম তো জীবনে করোনি…সেদিন কে যেন বলল, বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি থামিয়ে তুমি নাকি শর্মার দোকানে ঢুকেছিলে?”

”মাত্র আড়াইশো গ্রাম রাবড়ি…”

”মাত্র হল! উফফ…ওই আড়াইশো গ্রাম হজম করতে কমপক্ষে আড়াই মাইল দৌড়নো দরকার।”

”আমার ওজন লাস্ট টেন ইয়ার্স একই আছে, সত্তর কেজি।” প্রায় বিদ্রোহ করার ভঙ্গিতে সত্যশেখর বলল।

”গুড, ভেরি গুড।”

রাজশেখর কাগজে আরও কিছু লিখে নিয়ে বললেন, ”ডায়েট চার্ট করে দোব, তাই ফলো করবে এবার থেকে।”

এরপর তিনি কলাবতীকে প্রশ্ন শুরু করেন।

”রাত বারোটা—একটা পর্যন্ত রোজ ঘরে আলো জ্বলে। তার মানে গল্পের বই। সকালে মাইল তিনেক দৌড়, টায়ার্ড অবস্থায় পড়ার টেবিলে মিনিট পনেরো, স্কুলে ঘণ্টা ছয়—সাত, বিকেলে জলে সাঁতারের নাম করে ঘণ্টাখানেক কাটানো, কিম্বা জুডো না ক্যারাটে কি যেন বলে, তাই শেখা, তারপর মাস্টারমশায়ের সামনে ঘণ্টা দুই বসে ঢুলুনি, এছাড়া…”

কলাবতী আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দু হাত তুলে ‘ব্যস, ব্যস’ বলে উঠতেই সত্যশেখর গম্ভীর মুখে বলল, ”কালুর জন্যও ডায়াট চার্ট দরকার।”

রাজশেখর দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে মুচকি হেসে বলেন, ”তিনজনের জন্যই চার্ট হবে। খাওয়া একটা গুরুতর ব্যাপার। ঠিকমতো, ঠিক সময়ে, ঠিক পরিমাণ না হলে শরীরের জোর কমে যায়, রোগ জন্মায়। তাছাড়া রান্নার মতো ভোজনও একটা শিল্পকলা, দেখার মতো একটা জিনিস। যখন তখন হাবিজাবি এটা ওটা গেলা, ফেলে ছড়িয়ে পাতটাকে নোংরা করা। আগেরটা পরে পরেরটা আগে খাওয়া, আঙুলগুলোকে সাজিয়ে বাটি থেকে খাবার তোলা, থালায় মাখা, মেপে হাঁ করা, গ্রাস মুখে দেওয়া, তারপর চিবোনো, আহ, দেখার মতো এসব ব্যাপার…এইজন্যই তো লোকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ায়।”

রাজশেখর যতক্ষণ কথা বলে যাচ্ছিলেন, সত্যশেখর আর কলাবতী তার মধ্যে চোখাচোখি করে মুচকি হেসেছিল। স্ত্রী মারা যাবার পর থেকে প্রায়ই উনি নানান বাতিকের মধ্যে ঢুকে পড়েন, আর হাতের কাছে যাদেরই পান নাজেহাল করে ছাড়েন। কলাবতীর মায়ের অকালমৃত্যু এবং কলাবতীর বাবা দিব্যশেখর সন্ন্যাস নিয়ে বাড়ি থেকে চলে যাওয়া তাঁকে যথেষ্ট আঘাত দিয়েছিল। এরপর তিনি নাতনিকে আশ্রয় করে নিজের জন্যে আলাদা একটা জগৎ বানিয়ে ক্রমশই ছেলেমানুষ হয়ে যেতে থাকেন। বাবার বেদনা আর নিঃসঙ্গতা বুঝে সত্যশেখর তালে তাল দিয়ে প্রশ্রয় দিয়ে যায়। বিরাট বাড়িতে ছেলে আর নাতনি ছাড়া ঝি, চাকর, বামুন নিয়েই তাঁকে দিন কাটাতে হয়। তিনি যে এককালের দোর্দণ্ড আটঘরার জমিদারদের বংশধর, এটা কখনও ভোলেন না এবং তাঁর রাশভারিত্ব ও আভিজাত্য থেকে কখনও টলেন না।

সত্যশেখর ও কলাবতী নিজেদের মধ্যে মুচকি হাসার তিন দিন পরেই ডায়াট চার্ট অনুযায়ী কাজ শুরু হয়ে যায়।

সকালে খবরের কাগজে চোখ রেখে সত্যশেখর হাত বাড়িয়ে মুরারির কাছ থেকে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিয়েই চেয়ার থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়।

”থানকুনি পাতার রস।”

মুরারির শান্ত সাদামাটা মুখে বা কণ্ঠস্বরে কোনোরকমে বিকার ফুটল না ছোড়দার লাফ দিয়ে দাঁড়ানো বা ‘ওয়াক ওয়াক’ করতে দেখে। মুরারি এ বাড়িতে আছে আটত্রিশ বছর। ব্যাপার স্যাপার বোঝে।

”রাস্কেল, এই কি চা?”

”না, এটা চা নয়। চা আসবে কাঁচা হলুদ, নিমপাতা, ভিজে ছোলা—আদার পর, অবিশ্যি কর্তাবাবু যদি মনে করেন।”

”মনে করেন মানে?”

”এসব খেয়ে তোমার কেমন লাগল, কেমন ব্যাভার করলে, সেসব আমার কাছ থেকে শুনে তারপর ঠিক করবেন চা না দুধ না কালমেঘের রস, কোনটা দেওয়া হবে।”

সত্যশেখরের চোখে জল এসে গেল। মুরারির দুটো হাত চেপে ধরে শুধু বলল, ”আমাকে বাঁচা।”

কলাবতীর হাতে থানকুনি রসের কাপ তুলে দিয়ে মুরারি পিরামিডের স্ফিঙ্কসের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। গন্ধটা বারদুয়েক শুঁকে রসে আঙুল ডুবিয়ে কলাবতী জিভে ঠেকায়।

”উমম, টেস্টটা খুব খারাপ নয়। মুরারিদা, এই বস্তুটি কাকা খেয়েছে?”

”অদ্ধেক।”

কলাবতী এক ঢোঁকে রসটা খেয়ে নিল।

”দাদু খেয়েছে?”

”সবার আগে।”

কাঁচা হলুদ, নিমপাতা, ছোলা—আদা পর্ব শেষ হবার পর, রাজশেখর দুজনকে ডেকে পাঠালেন, এবং হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, ‘সপ্লেন্ডিড। ভাবতেই পারিনি তোরা এত সিরিয়াস হবি হেলথ সম্পর্কে। এই তো চাই। একটা ডায়েট চার্ট করছি। সকাল থেকে রাতের খাওয়া চার্ট অনুযায়ী চলবে। কম খাবি, কিন্তু আসল জিনিসটা খাবি। এই যে চা খাওয়া, এতে কী লাভ। বরং বেলের পানা খাও।”

”অ্যাঁ, পানা!…বাবা, সাতটায় আমার মক্কেল আসার কথা আছে, আজ আর্লি আওয়ারেই হেয়ারিং হবে, তাই…।”

”তাহলে যাও। মুরারি চেম্বারে ফল আর দুধ দিয়ে আসবে’খন।”

”চা দেবে না?”

চা শব্দটা রাজশেখর যেন এই প্রথম শুনলেন এমনভাবে দশ সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, ”কালমেঘের রস খুব উপকারী, চায়ের পর ওটা খেলে হজমে খুব সাহায্য করে।”

”না না,, চায়ে আমার খুব একটা আসক্তি নেই।” বলতে বলতে সত্যশেখর প্রায় দৌড়ে চলে গেল।

”কালমেঘ দারুণ লাগে আমার।” কলাবতী এমনভাবে জিভে আওয়াজ করল যেন সর্ষে দিয়ে কাঁচা আমবাটা নাকের সামনে ধরা হয়েছে।

রাজশেখরের দুটি চোখ ঝকঝক করে উঠল। ছ’ফুটের দশাসই কাঠামোটা টানটান করে পেটে আলতো কয়েকটা চাপড় মেরে বললেন, ”পেটই হচ্ছে স্বাস্থ্যের মূল ঘাঁটি। এটাকে জোরালো রাখতে হলে একটা রেজিমেন্টকে যে রকম ডিসিপ্লিন্ড হতে হয় সেই রকম হতে হবে খাওয়ায়। কালমেঘ, চিরেতা, ব্রাহ্মি শাক, ত্রিফলা এসব হচ্ছে বাংলার নিজস্ব জিনিস। ছোটবেলায় মা খাওয়াতেন, দ্যাখ আজও কেমন শরীরটা রয়েছে। সতুটা দিনদিন পেটুক হয়ে যাচ্ছে, শুনেছি কাঁচাগোল্লা খেতে নাকি মছলন্দপুর গেছল।”

সত্যশেখর সত্যিই গেছল এবং কলাবতীর জন্য প্রায় আধকিলো কাঁচাগোল্লা এনে দিয়েছিল। আর কলাবতীর কাছ থেকে ভাগ পেয়েছিল মুরারি। কিন্তু এ খবর তো দাদুর অজানা থাকারই কথা, তাই সে মনে মনে সাবধান হয়ে গেল।

”সত্যিই কাঁচাগোল্লা খুব বাজে জিনিস। লাখ টাকা দিলেও আমি খাব না। দাদুকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে কলাবতী ঘর থেকে বেরিয়ে এসে খুঁজতে লাগল মুরারিকে। দোতলায় উঠোনের বারান্দা থেকে সে দেখতে পেল, মুরারি একটা গ্লাসের উপর রেকাবি বসিয়ে কাকার চেম্বারের দিকে যাচ্ছে। এক নজরে সে চিনতে পারল রেকাবিতে কলা, শশা, কমলালেবু, আঙুর আর গ্লাসে বোধহয় বেলের পানা।

”মুরারিদা, দাদু জানল কী করে কাকার কাঁচাগোল্লা খাওয়ার কথা?”

সত্যশেখর ভীতিগ্রস্ত চাহনির নীচে রেকাবি আর গ্লাসটা টেবলে রেখে মুরারি ভারিক্কি চালে ”এগুলো শেষ করো” বলে যখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সেই সময় কলাবতী উত্তেজিত হয়ে চেম্বারে ঢুকল।

”তুমি বিট্রে করেছ।”

মুরারি আকাশ থেকে পড়ল। দু’হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে কাঁদো—কাঁদো গলায় বলল, ”মা কালীর দিব্যি, আমি কিচ্ছুটি বলিনি। বিশ্বাস করো, কত্তাবাবুকে আমি…”

”হুমম।”

সত্যশেখর টেবলে যে ঘুঁষিটা বসাল, তাতে মহম্মদ আলি নকআউট হয়ে যেতে পারে।

”এবার বুঝলুম কে আমার সম্পর্কে বাবার কাছে লাগায়। মুরারি…” সত্যশেখর রক্ত জল করা হুঙ্কার দিল চাপা গলায়, ”পরশু তোকে পাঁচ টাকা দিয়েছিলুম ফেলুর দোকান থেকে রাধাবল্লভী আনতে। দশটার বদলে পেয়েছি আটটা, বাকি দুটো কী হল? পয়সা মেরেছিস না খেয়েছিস? মালাই বরফওলাকে ও—মাসের জন্য দিতে হবে বলে বাষট্টি টাকা নিয়েছিস অথচ আমার হিসেবে হচ্ছে বাহান্ন টাকা। কী ভেবেছিস আমাকে? গোরু ভেড়া না মন্ত্রী? বাবাকে এবার বলে দেব, নির্ঘাত বলে দেব।”

”ছোড়দা, তাহলে মরে যাব।”

মুরারির চোখ দিয়ে টপটপ জল ঝরতে শুরু করল।

”কাঁদলে কী হবে, এবার দাদুকে বলে তোমারও ডায়েট চার্ট করাব, কালমেঘের রস, চিরেতার জল, গিমে শাক, ব্রাহ্মীশাক…।”

”এই কান মুলছি, এই নাক খত দিচ্ছি…”

মুরারি কুঁজো হয়ে টেবলের এক ধার থেকে অন্য ধার পর্যন্ত নাক ঘষড়ে গেল।

”কত্তাবাবুর সামনে মিথ্যে বলতে কেমন ভয় ভয় করে। তবু তো রেখে ঢেকে বলি, নইলে তুমি যে চেম্বারে মক্কেল বসিয়ে রেখে রাস্তায় গিয়ে মালাই বরফ খাও, তা কি কখনো বলেছি?”

”বলবি কী করে, তুইও তো আমার সঙ্গে খাস।”

”কাকা তো চেম্বারে, বরফওলাকে ডেকে আনে কে?”

”আমি।”

আসামি অপরাধ কবুল করেছে, জজ এবার কী রায় দেবেন! এমন একটা কৌতূহলী ভঙ্গিতে কলাবতী তাকাল কাকার দিকে। সত্যশেখর রিভলভিং চেয়ারে ডাইনে—বাঁয়ে ঘোরাঘুরি করতে করতে ”হুমম…হুমম” শব্দ করে যেতে লাগল চোখ বুজে।

”ছোড়দা, নিত্যানন্দে আটটার পর আর কিন্তু জিলিপি ভাজে না, শিঙাড়া সাড়ে আটটা পর্যন্ত।”

সত্যশেখর চোখ খুলে দেয়াল—ঘড়ির দিকে তাকিয়েই ”অ্যাঁ, তাই তো”, বলেই ড্রয়ার থেকে মানিব্যাগ বার করল।

”কত দেব?”

”কালুও রয়েছে, টাকা দশেকই দাও। নরম বোঁদেও যদি দেখি…।”

টাকা নিয়ে মুরারি বেরিয়ে যাচ্ছিল, কালু হাত ধরে টানল।

”এগুলো কী হবে?”

”ঠিক মুরারি, এই কলা, শশা, বেলের পানা…সক্কালবেলায় এসব কী হবে?”

বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে মুরারি গ্লাস তুলে চোঁ—চোঁ করে বেলের পানা খেয়ে ফেলল।

”ওগুলো এখানেই থাক, পরে এসে খেয়ে নেব।”

”না, এখুনি তোকে খেতে হবে।”

মুরারি কথা না—বাড়িয়ে মিনিট তিনেকের মধ্যে সব ফল কচমচ করে খেয়ে ফেলে রেকাবি আর গ্লাসটা নিয়ে বেরিয়ে গেল।

একটু পরে রাজশেখর নাতনির কাছ থেকে জানলেন তাঁর ছেলে গোগ্রাসে সব ফল খেয়েছে আর এক চুমুকে বেলের পানা।

”ভাতের সঙ্গে উচ্ছে আর পেঁপে—সেদ্ধ, নিম—বেগুন, তারপর সুক্তো, মাগুর কিংবা শিঙ্গির ঝোল হবে মশলা ছাড়া, আনাজের খোসা একদম ছাড়ানো চলবে না। আর কম্পালসারি শাক, ডাঁটা, কচু কিংবা ওল কিংবা থোড় বা মোচা, বিচে কাঁচকলা, মাসকড়াই, গাজর, এইসবের একটা তরকারি আর টক দই। ভাজাভুজি একদম বন্ধ। একমাস পর দেখবি ডায়েট চার্ট ফলো করে লোহা চিবিয়ে তোরা হজম করে ফেলছিস।”

এ তো বিশ্বনাথের ইনিংস!

একমাস পর সেদিন রাত্রে কলাবতী খাওয়ার টেবলে এলে বড় একটা খাম হাতে। রাজশেখর তখন চারখানি রুটি নিজের প্লেটে রাখছিলেন।

”মলয়াদি কতকগুলো ছবি দিলেন তোমায় দেখাবার জন্য।”

”কে মলয়া?” রাজশেখর গভীর মনোযোগে রুটিগুলোর প্রতি—মিলিমিটার যথোপযুক্ত সেঁকা হয়েছে কিনা পরীক্ষা করতে করতে অন্যমনস্কের মতো জানতে চাইলেন। অবশ্য মলয়াকে তিনি খুব ভালোই চেনেন।

”আমাদের স্কুলের বড়দি, হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখার্জি।”

”হুঁ উ উ…হরিশঙ্করের মেয়ে?”

”হ্যাঁ।”

এখানে এবার কিছু পূর্বকথা জানিয়ে রাখা দরকার। হুগলি জেলায় আটঘরা আর বকদিঘি নামে পাশাপাশি দুটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম আছে। দুই গ্রামের দুই জমিদার—বংশ সিংহ ও মুখুজ্যেদের মধ্যে আকচাআকচি প্রবল। সামান্য বা অসামান্য সব ব্যাপারেই উভয়ের মধ্যে রেষারেষি। জমিদারি প্রথা উঠে যাবার পর সেটা কেন্দ্রীভূত হয়েছে দুই গ্রামের মধ্যে বছরে একবার একটি ক্রিকেট ম্যাচকে উপলক্ষ করে। মহা ধুমধামে দুর্গোৎসবের মতো এই বাৎসরিক ম্যাচ হয়। এক মাস আগে থেকেই দুই গ্রামের ছেলে—বুড়ো—মেয়ে পুরুষ টেনশ্যনে ভুগতে শুরু করে। প্রতিবার এই খেলায় একটা—না—একটা ঝঞ্ঝাট বাধেই, আর তাই নিয়ে হুলুস্থুলু পড়ে যায়।

আটঘরার জমিদারবাড়ির নাতনি কলাবতী বাংলার মেয়ে ক্রিকেট দলে খেলে। খুবই সম্ভাবনাময় ব্যাটসউওম্যান, টেস্টম্যাচ খেলার জন্য যে ডাক পাবেই তাতে সন্দেহ নেই। ওর খুবই ইচ্ছে, এবং রাজশেখরেরও, এই বাৎসরিক ম্যাচে খেলার। কিন্তু বকদিঘির অধিনায়ক পতু মুখুজ্যে সাফ জানিয়ে দেয়, কোনো মেয়েকে এই ম্যাচে তারা খেলতে দেবে না।

প্রাক্তন এম পি এবং বর্তমানে এম এল এ গোপীনাথ ঘোষের ছেলে ব্রজদুলাল ওরফে দুলু গতবারের ম্যাচে আটঘরা দলে ছিল। খেলা শুরুর ঠিক আগে কলাবতীর পরামর্শে দুলু ‘হঠাৎ’ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে ড্রেসিংরুমে শুয়ে থাকে। তার হয়ে ফিল্ড করে সাবস্টিটিউট হাবু ময়রার ছেলে বিশু। কিন্তু ব্যাটিংয়ের সময়, হাতে মাত্র দুটি উইকেট নিয়ে জয়ের জন্য আটঘরার যখন ১৭ রান দরকার, তখন ম্যালেরিয়ায় কাহিল দুলু ব্যাট হাতে নামে ফুলহাতা সোয়েটারে, মাফলারে এবং পানামা টুপিতে এমন ভাবে নিজেকে ঢাকাঢুকি দিয়ে যে, নাক আর চোখ দুটি ছাড়া তার আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। দুলুর ব্যাটিংই শেষ পর্যন্ত যখন জয় এনে দেয় তখন নন—স্ট্রাইকার ছিলেন ১১ রানে অপরাজিত রাজশেখর।

তবে এই জয়ে সত্যশেখরেরও অবদান ছিল। তেরোটি ওভারবাউন্ডারি মেরে আচমকা একটা সেঞ্চুরি করে ফেলে সে রীতিমতো নার্ভাস হয়ে যায়। আটঘরার জনতা মাঠের মধ্যে নেমে এসে তাকে কাঁধে তুলে নাচানাচি করে—এই বাৎসরিকীতে আগে কেউ সেঞ্চুরি করেনি। সুতরাং সেঞ্চুরিটি ঐতিহাসিক।

একটা বল হুক করার সময় দুলুর মাথা থেকে পানামা টুপিটা পড়ে গেছল। ফিল্ডাররা সবাই তখন বলের দিকে তাকিয়ে। সেই অবসরে দ্রুত টুপিটা কুড়িয়ে সে মাথায় পরে নেয়। বকদিঘি শিবিরে দর্শকদের মধ্যে ছিল হরিশঙ্কর এবং নিত্যসঙ্গী নিক্কন ক্যামেরাটি হাতে নিয়ে মলয়া। বহু ছবি সে ম্যাচ চলার সময় মাঠের চারপাশ ঘুরে—ঘুরে তোলে। বিশেষ করে সত্যশেখর ও ব্যাটসম্যান দুলুর।

ম্যাচশেষে পতু মুখুজ্যে আটঘরা শিবিরে এসে রাজশেখর সিংগির নাতনির খোঁজ করেছিল। কিন্তু কলাবতীকে পাওয়া যায়নি। তবে ড্রেসিংরুমে আপাদমস্তক মুড়ি দেওয়া ম্যালেরিয়ায় কাহিল দুলুকে কোঁকোঁ আওয়াজ করে কাঁপতে দেখা গেছল। পতু মুখুজ্যেকে অবশ্য বেশি কথা বলতে দেয়নি আটঘরা গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান পটল হালদার। তবে পতু বলে গেছল সে ছবি দিয়ে প্রমাণ করে দেবে, গোপী ঘোষের ছেলে দুলুর বদলে রাজশেখর সিংগির নাতনি কালু ব্যাট করেছে। পটল হালদার তখনই ঘোষণা করে সত্যশেখরের সেঞ্চুরিকে স্মরণীয় করে রাখতে সে একটা স্তম্ভ গড়ে দেবে।

রাজশেখর রুটি পরীক্ষা শেষ করে মুচকি হেসে বললেন, ”কীসের ছবি?…তুই ব্যাট করেছিলি তারই প্রমাণ?”

কলাবতী ঘাড় নাড়ল। দেয়াল—ঘড়িতে দশটা বাজছে। সত্যশেখর একতলা থেকে এইসময় উঠে এল। রাজশেখরের শেষ কথাটি কানে যাওয়ায় কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করল, ”প্রমাণ! কীসের প্রমাণ?”

কলাবতী খামটা থেকে একগোছা রঙিন ছবি বার করল। কয়েকটা দিল দাদুকে, কয়েকটা কাকাকে।

”হরির মেয়ের হাত দেখছি খুবই পাকা, ছবিগুলো ভালোই এসেছে।” রাজশেখরের চোখে তারিফ ফুটে উঠল। রুটিতে যতটা মনোযোগ দিয়েছিলেন, ছবিগুলোয় ততটাই দিলেন।

”হাত পাকা হবে না কেন, বিলেতেই তো ক্যামেরা কিনে শুরু করে। এতদিনে হাত পাকবে না!” সত্যশেখর হাতের ছবিগুলো টেবলে সাজিয়ে রাখল। এইসময় বারান্দার দিকের দরজায় মুরারির মুখ উঁকি দিতে দেখা গেল। সত্যশেখরের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সে হাত নাড়ছে।

”কাকা, এই ছবিটা কেমন?”

কলাবতী একটা ছবি নিজের মুখের কাছে ধরল। সত্যশেখর ছবি দেখার জন্য মুখ তুলতেই সে চোখের ইশারায় মুরারিকে দেখিয়ে দিল। সত্যশেখর তাকাতেই মুরারির হাতছানি দেখে বোঝা গেল জরুরি কিছু বলার আছে।

”ওহহো, দেখেছ, ড্রয়ারে চাবি দিয়ে আসতে ভুলে গেছি।”

সত্যশেখর ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বারান্দার অন্ধকার কোনায় গিয়ে সে বলল, ”কী হল, ডাকছিস কেন?”

”বলতে একদমই ভুলে গেছি, আজ সকালে তোমাকে কালমেঘ দিইনি, কত্তাবাবু বারণ করিছে। মাঝে—মধ্যে সব বন্ধ থাকবে। ডাট চাট অনুযায়ী খাওয়া দাওয়া হঠাৎ বন্ধ রেখে কত্তাবাবু পরীক্ষা করবেন, তোমাদের খাওয়ার বহর কমিছে কি না, তোমাদের নোলা ঠিকঠাক তৈরি হইছে কিনা।”

”আজ সকালে তাহলে আমাকে কালমেঘের রস দিসনি? মানে খাইনি? বইটি www.boiRboi.blogspot.com থেকে ডাউনলোডকৃত।

”না।”

”কাঁচা হলুদ…”

”ওসব কিচ্ছু খাওনি।”

”কাল রাতে ইসবগুলও খাইনি তো?”

”না, তাও নয়।”

”কী ভাবে নোলা পরীক্ষা করবেন?”

”গাড়ি নিয়ে আজ বেইরেছিলেন। রয়েলের চাপ, সাবিরের রেজালা, মাধবের ঝাল আলুদ্দম, বিজলীর ফিশ ওর্লি, অম্বরের তন্দুরি চিকেন, অনাদির মোগলাই পরোটা, অমৃতের দই, নকুড়ের কড়াপাক…”

”থাম থাম।”

”আরো আছে যে…তপসে ভাজা, ভাপা ইলিশ।”

”মরে যাব উফফ, মরে যাবে।”

”সামনে থাকবে কিন্তু খাবে না, খেয়েছ কি ডাট চাট লম্বা হয়ে যাবে। তুমি কালুকে জানিয়ে দাও এখুনি।”

”এখন কী করে বাবার সামনে জানাব, আগে বলতে হয়তো, পাঁঠা কোথাকার।”

”ইশারা করে করে মানা করে দিও, কালুর খুব বুদ্ধি আছে, ধরে ফেলবে।”

সত্যশেখর পাংশু নার্ভাস অবস্থায় ফিরে এসে চেয়ারে বসল। কলাবতী জিজ্ঞাসু কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে দেখে সত্যশেখর বাবার দিকে চোখের ইশারা করে, মুখের কাছে আঙুল দিয়ে গ্রাস তুলে মাথা নেড়ে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করতে যাচ্ছিল, তখন রাজশেখর ছবি থেকে চোখ তুলে বেশ জোরেই হেসে উঠলেন। কলাবতী কাকার ইশারার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে খুবই ধাঁধায় পড়ে গেল।

”মেয়েটা টিপিক্যাল হরির মতোই হয়েছে বটে। সিংগিদের কী করে জব্দ করা যায় সেটা খুব ভালোই শিখে গেছে।”

”এজন্য তো কাকাই দায়ী। কাকাই তো বড়দিকে খেপিয়ে দেয় জিভ দেখিয়ে।”

”আমি, কক্ষনো না! লাস্ট ওকে জিভ দেখিয়েছি নাইন্টিন সিক্সটি সেভেনে, বিলেতে। তারপর ওর সঙ্গে আমার দেখা এই ক্রিকেট ম্যাচে।”

এখানে আবার একটা পূর্ব কথা বলে রাখা দরকার।

সত্যশেখর আর মলয়া তাদের বাবাদের মতোই বাল্যবয়স থেকেই পরিচিত। দুজনের যত ভাব, তত ঝগড়া। অবশ্য ঝগড়ার কারণগুলোর প্রত্যেকটাই ঠিক তাদের বাবাদের মতোই বংশগত মানমর্যাদাকে কেন্দ্র করে। দুজনের দেখা হলেই ওদের মধ্যে বুনো ওলের সঙ্গে বাঘা তেঁতুলের মতো একটা সম্পর্ক দেখা দেয়। সত্যশেখরের ছোটবেলার অভ্যাস জিভ দেখিয়ে মলয়াকে রাগিয়ে দেওয়া। চুলে পাক ধরলেও সে আজও অভ্যাসটা ছাড়তে পারেনি। ব্যারিস্টার হবার জন্য সে যখন বিলেত যায়, মলয়াও তখন সেখানে শিক্ষা ও মনস্তত্ত্ব বিষয়ে পড়াশুনো করতে গেছল। দুজনের প্রায়ই দেখাসাক্ষাৎ হত, এবং সাক্ষাৎগুলি অবশ্যম্ভাবী পরিণত হত ঝগড়ায়। একজন যদি বলে সূর্য পশ্চিমদিকে ওঠে তাহলে অন্যজন অবধারিত বলবে, ‘কিন্তু অস্ত যায় উত্তরে।’ দুজনে প্রায় একই সময়ে দেশে ফিরে আসে। একজন এখন প্র্যাকটিস করছে কলকাতা হাইকোর্টে আর অন্যজন কাঁকুড়গাছিতে মেয়েদের স্কুলে হেডমিস্ট্রেস এবং সেই স্কুলেই কলাবতী পড়ে। ছিপছিপে, চল্লিশের কাছাকাছি অবিবাহিতা বড়দি যে কালুকে একটু বেশিই স্নেহ করেন, এটা স্কুলের দারোয়ান থেকে টিচার্স—রুমের প্রত্যেকেই জানে।

রাজশেখর একটা ছবি তুলে বললেন, ”সতুকে যখন কাঁধে তুলে নাচছিল, তখন যে ওর জিভটা বেরিয়ে গেছল সেটা কি লক্ষ করেছিলিস কালু?”

”তখন কেমন যেন মনে হয়েছিল কাকা একবার না একবার জিভ বার করবেই। বড়দির হাতে ক্যামেরা অথচ কাকার জিভ শান্তশিষ্ট, তাই কখনো হয়।”

সত্যশেখরের হঠাৎ বিষম লাগায় দুজনে মুচকি হাসল।

”দাদু, এই ছবিটায় কি বোঝা যাচ্ছে এটা আমিই?”

রাজশেখর ঝুঁকে পড়লেন কলাবতীর হাতের ছবিটার উপর। সেই অবসরে সত্যশেখর আবার ইশারা করে বোঝাতে চাইল খাবার—দাবার সম্পর্কে খুব সাবধান, এখনি ডায়েট চার্টের প্রতিক্রিয়া জানার পরীক্ষা হবে, লোভ দমন করতে হবে। কিন্তু এবারও কলাবতী ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে আরও বিভ্রান্ত হয়ে গেল।

”কালু, তোর নাকটাই যা গোলমাল করছে। গোপী ঘোষের ছেলের নাক কি এত টিকোলো?” রাজশেখর চোখ তুলে নাতনির নাক দেখতে গিয়ে ভ্রূ কোঁচকালেন। ”কালু, মুখটা অমন করে আছিস কেন, পেট কামড়াচ্ছে? বাইরে কিছু খেয়েছিস নিশ্চয়?”

”কিচ্ছু খাইনি তো, শুধু—শুধু পেট কামড়াবে কেন!”

”কালুর বোধহয় খুব খিদে পেয়েছে। আচ্ছা বাবা, থানকুনি পাতার রসে কি খিদে বাড়ে?”

”নিশ্চয়! তা ছাড়া পেট ঠান্ডা রাখে, অম্বল—টম্বল হয় না।”

”তাই। আমার ইদানীং যা খিদে বেড়েছে কী বলব। কাঁঠালের বিচি আর ওল—ভাতে যে এত টেস্টফুল, কচুর মুখি যে এত প্যালেটেবল, জানতামই না। বোধহয় নিমপাতা আর কাঁচা হলুদের অ্যাকশন, তাই না?”

”হতে পারে।” রাজশেখর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। ঘাড় বেঁকিয়ে তিনি দরজার দিকে তাকাতেই অপেক্ষমাণ মুরারি এগিয়ে এল।

”সব রেডি আছে, আনব কি?”

”হ্যাঁ, এদের খুব খিদে পেয়েছে মনে হচ্ছে।”

মুরারি বেরিয়ে যাবার সময় করুণভাবে একবার সত্যশেখরের দিকে তাকিয়ে গেল।

”দাদু এই ছবিটা দিয়ে কি প্রমাণ করা যাবে আমিই খেলেছি?” কলাবতী একটা ছবি তুলে শূন্যস্থান পূরণের মতো টেবলে খাবার এসে পৌঁছবার আগের সময়টা ভরাট করার জন্যই বলল।

”ডিফিকাল্ট, ভেএরি ডিফিকাল্ট। দুলু আর কালু দৈর্ঘ্যে প্রস্থে প্রায় এক। তা যদি না হত, তাহলে সেদিনই ধরা পড়ে যেত। তবে এই ছবিটা দিয়ে পতু মুখুজ্যে হয়তো জল ঘোলা করার চেষ্টা করবে। তা এখানে তো একজন আইনজানা লোক রয়েছে, সে কী বলে?”

রাজশেখর ভ্রূ তুলে ব্যারিস্টার ছেলের দিকে ট্যারা চোখে তাকালেন।

সত্যশেখর দু’বার কেসে বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে কপালে টোকা মারতে মারতে প্রচণ্ড গম্ভীর হবার জন্য বারো সেকেন্ড সময় নিল।

”আইন বলতে এখানে ক্রিকেটের আইন।” সত্যশেখর ফিল্মি ব্যারিস্টারদের মতো কাল্পনিক একটা চশমা চোখ থেকে খুলে ফেলার ভঙ্গি করল। ”ইয়েস, ক্রিকেটের আইন আমি দেখেছি। কোথাও লেখা নেই যে, মেয়েরা খেলতে পারবে না পুরুষদের টিমে।”

”বাট, এটা তো ক্রিকেটের একটা সাধারণ আইন। কিন্তু প্রত্যেক টুর্নামেন্টেরই কিছু নিজস্ব আইন তো থাকে।” রাজশেখর প্রায় চিফ জাস্টিদের মেজাজে কথাটা বললেন। প্রসঙ্গত, গত কুড়ি বছরে তিনজন চিফ জাস্টিসের সঙ্গে তাঁর তুই তোকারির সম্পর্ক ছিল।

”হ্যাঁ থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে কি কোনো লিখিত আইন আছে এই ম্যাচ সম্পর্কে?”

রাজশেখর কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে মাথা নাড়তে লাগলেন।

”না, আই অ্যাম শ্যূওর, কোনো লিখিত আইন নেই। শুধু কনভেনশনের উপর খেলা চলে আসছে। আর কনভেনশন তো যে—কোনো সময় ভাঙা যায়।”

”কিন্তু তার একটা কারণ থাকা দরকার। ইচ্ছেমতো যখন খুশি তো প্রথা ভাঙা যায় না। কালু ইচ্ছে করলেই স্পোর্টিং ইউনিয়ন বা কালীঘাটের হয়ে কি লিগ ক্রিকেট খেলতে পারবে? যদিও ওর যোগ্যতা আছে।”

কলাবতী লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠতে পারল না যেহেতু তার গায়ের রঙ কালো। শুধু হাত তুলে বলল, ”আচ্ছা আচ্ছা, খুব হয়েছে। ভারী তো খেলি।”

”তোমার কথাটা ঠিকই, যখন খুশি প্রথা ভাঙা যায় না, কিন্তু আমি, তুমি আর কালু তিনপুরুষ একটা ম্যাচে খেলবে এটা কি একটা স্পেশাল অকেশন নয়? এটা তো একটা গৌরবের ব্যাপার এক্ষেত্রে কি…”

মুরারি এবং তার পিছনে আরও দুজন, বলরাম আর অপুর মা, প্রত্যেকের হাতে নানান আকারের নানান গড়নের চিনেমাটির স্টিলের, কাচের ও কাঁসার পাত্র দু’হাতে ধরা। একটার উপর আর একটা—কুতব মিনার, শহিদ মিনার, একটা তো পিসার হেলানো টাওয়ারের মতো।

টেবলের অর্ধেকটাই ভরে গেল। ঝুঁকে রাজশেখর প্রত্যেকটা থেকে ঢাকনা তুলে নিতে নিতে জোরে নিশ্বাস টেনে, ”আহহহ” বলে মাথা নাড়তে লাগলেন। কখনও বললেন, ”ডিলিশাস”, কখনও ”আহ, মার্ভেলাস।”

সত্যশেখর করুণ চোখে খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। কলাবতীর চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। বেরিয়ে যাবার সময় মুরারি দুঃখভরা, বিষণ্ণ চোখ সবার মুখের উপর বোলাল।

”দাদু, এসব কী, অ্যাঁ, অ্যাত্তো…কই বলোনি তো আগে!”

”আগে বললে কি এমন মিষ্টি—অবাকটা পেতিস? আগে ভাজা দিয়ে শুরু, তুলে নে যত খুশি। মানিকতলা বাজারে টাটকা তপসেটা পেলাম, ইলিশটা শোভাবাজারের। কই, সতু, তোল তোল।”

সত্যশেখরের মুখটা দ্রুত সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো হয়ে গেল। খুবই শান্ত ভঙ্গিতে বলল, ”নাহ, এসব খাবার দেখলেই এখন গা গুলিয়ে ওঠে। মুখরোচক নিশ্চয়ই, কিন্তু পেটের পক্ষে একদমই ভালো নয়।”

শুনতে শুনতে রাজশেখর খুশিতে বারদুয়েক মাথা ঝাঁকালেন।

”কাকা, কী বলছ তুমি! এই তো কদিন আগে…” কলাবতী থেমে গেল সত্যশেখরের কটমট চাহনি দেখে। তারপর বলল, ”না খাও না খাবে, আমি কিন্তু খাব।”

সত্যশেখর প্রচণ্ড অনিচ্ছায় বেগুনির মতো দেখতে ফিশ ওর্লির আধখানা আর ইলিশের পেটি থেকে একচিমটে ভেঙে নিল। তপসে ছুঁলই না। আলুর দমের একটা আলু মুখে দিয়েই ”ওরে বাবা কী ঝাল” বলে ফেলে দিল। আর রেজালার মাংসে লাগা ঝোল রুটি দিয়ে চেঁছে ফেলে তবেই মুখে ঠেকাল।

”এত তেল—মশলা—ঘি, পেটের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর।” সত্যশেখর তার বাবার সামনে থেকে রেজালার পাত্রটা সরিয়ে নিয়ে বলল, ”বাবা এসব তুমি খেও না, বরং তন্দুরি চিকেনটা নাও, ওতে ঘি—মশলা নেই।”

রাজশেখর বিস্ময় চাপতে চাপতে আনন্দে প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থায় পৌঁছে গেছেন। কলাবতী রেজালা শেষ করে আঙুলগুলো চাটতে চাটতে মটন চাপের প্লেটটার দিকে তাকিয়ে বলল, ”দাদু তুমি যে রয়্যালের গল্প করতে, সেখান থেকেই কি এনেছ?”

”নিশ্চয়, এখনও সেই টেস্ট, সেই ফ্লেভার।”

”কাকা যদি না খায়…খাবে তুমি?”

সত্যশেখর সভয়ে সঘৃণায় মাথা নাড়ল।

”তাহলে আমাকে সবটা দাও।”

রাজশেখর ভ্রূ তুলে গম্ভীরভাবে কলাবতীর দিকে পুরো প্লেটটাই এগিয়ে দিলেন। সত্যশেখরের করুণ চোখ যেন বলে উঠল: কালু করছিস কী? এই চাপ যে পরে চাপচাপ কচু, ওল, উচ্ছে, ঢ্যাঁড়স, কাঁচাপেঁপে হয়ে টেবলে ফিরে আসবে।

কলাবতীও অবাক হয়ে যাচ্ছে খাওয়ার প্রতি কাকার অরুচি দেখে। যে—সব জিনিস টেবলে সাজানো রয়েছে, কাকার তো ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। প্রত্যেকটাই ওর প্রিয় খাদ্য, অথচ কেমন মনমরা হয়ে রয়েছে। দু আঙুলে চিমটি দিয়ে তুলে কোনোরকমে জিভে ঠেকিয়েই ফেলে দিচ্ছে, যেন নিম বা উচ্ছে। দিন পাঁচেক আগে কোর্ট থেকে ফেরার সময় নিজামের আঠারোটা শিককাবাব আর দশটা পরোটা এনে মুরারিকে দিয়ে গরম করিয়ে গ্যারাজে মোটরের মধ্যে বসে কাকা একাই বারোটা শিক আর সাতটা পরোটা শেষ করার পর চেম্বারে গিয়ে বসে। বাকিগুলো ছিল তার আর মুরারির জন্য। অথচ পাঁচদিনের মধ্যেই কী পরিবর্তন। হয়তো আজ জজের কাছে ধমক খেয়েছে, মন খারাপ, কিংবা ফেরার পথে গাঙ্গুরাম বা গোল্ডেন ড্র্যাগন কী ওয়ালডর্ফে ঘুরে এসেছে।

সত্যশেখর একটার পর একটা প্লেট ঠেলে সরিয়ে দিল, আর কলাবতী সেগুলো টেনে নিল। দই আর কড়াপাক যখন এল, কলাবতীর তখন আইঢাই অবস্থা।

”কতদিন পর এমন দারুণ দারুণ জিনিস…উফ।”

কলাবতী হাঁফাচ্ছে। কপাল থেকে দরদর ঘাম চিবুকে নেমে এসেছে। সিলিং পাখার দিকে তাকিয়ে হাওয়াটা মুখে লাগাতে লাগাতে বলল, ”দাদু, তোমার ডায়েট চার্ট ফলো করতে করতে কাকার খিদে মরে গেছে, আর আমার খিদে বেড়ে গেছে।”

”মোটেই আমার খিদে মরেনি।” সত্যশেখর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে দই আর কড়াপাকের দিকে সেইভাবে তাকাল, বাউন্সার—হুক—করা ব্যাটসম্যানের প্রতি ফাস্ট বোলার যে—ভাবে তাকায়।

”আসলে স্বাস্থ্যকর, পুষ্টিকর খাদ্য খেয়ে খেয়ে আমার এখন অন্য কিছু বিশেষত ভাজাভুজি, ঝালঝোল, মশলা দেওয়া কিছু আর মুখে তুলতে ইচ্ছে করে না। বাঙালিরা এই সব খায় বলেই তো যত রাজ্যের পেটের রোগে ভোগে, অকালে বুড়িয়ে যায় আর অল্পবয়সে মারা যায়, তাই না বাবা?”

”তার থেকে বড় কথা, সতু”, রাজশেখর এক কেজি ভাঁড় থেকে এক চামচ দই তুলে প্লেটে রাখতে রাখতে বললেন, ”খারাপ স্টমাক নিয়ে পরিশ্রম, চিন্তা, কল্পনা কোনোকিছুই করা যায় না, তাই তো বাঙালি ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে।”

রাজশেখর দইয়ের প্লেট নাতনির দিকে এগিয়ে দিলেন। সত্যশেখরের মুখ কুঁকড়ে গেল। জিভ দিয়ে গত আধঘণ্টায় ষোড়শতম ঠোঁট চাটা শেষ করে সে কাতর চোখে ভাইঝির দিকে চেয়ে রইল।

”খাওয়া মরে গেছে বললে ভুল হবে, সুষম খাদ্য মানে ব্যালান্সড ডায়েটের জন্য খিদেটাও ব্যালান্সড মানে পরিমিত হয়ে গেছে। বাবা, কালুর খিদেটা অপরিমিত হল কেন বলো তো?”

”হুমম সেটাই তো বোঝার চেষ্টা করছি। এবার বোধহয় ওর কালমেঘের ডোজটা বাড়াতে হবে, সেইসঙ্গে এককাপ করে আনারস—পাতার রসের সঙ্গে তুলসীপাতার রস, দুবেলা। বাগানের যেদিকটায় কালুর জন্য প্র্যাকটিস পিচ করব ভাবছি, তার পিছনে দেয়াল ঘেঁষে আনারস আর তুলসী গাছ লাগাব।”

”দাদু, খিদে হওয়াটা তো হেলথেরই লক্ষণ, পাকযন্ত্র যে দারুণ ফর্মে আছে, সেটাই তো প্রমাণ করছে পারফরম্যান্স দিয়ে। কোথায় তুমি প্রশংসা করবে, তা না, ডোজ বাড়াবার কথা বলছ!”

কলাবতী রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়ে খাবলা দিয়ে দই তুলে মুখে ভরল।

”একগাদা খাওয়াকে পারফরম্যান্স বলে না।” রাজশেখর ন্যাপকিনে গোঁফের দই মুছলেন। সন্দেশের প্লেটটা ছেলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ”গাওস্কর গাদাগাদা রান করেছে, কিন্তু সেভেন্টি ফাইভে মাদ্রাজে বিশ্বনাথের নট আউট নাইন্টিসেভেন অন এ ফায়ারি পিচ এগেনস্ট এ ডেডলি অ্যান্ডি রবার্টস, একেই বলে পারফরম্যান্স। এই এখন, সতু যেভাবে বেছে বেছে খাবার চুজ করল, পিক করল, এ তো বিশ্বনাথের ইনিংস। কী বিস্ময়ের সঙ্গে, ক্যাজুয়ালি অথচ কত প্রচণ্ডভাবে তন্দুরি চিকেনের শুধু পিছনের একটা ঠ্যাং ছিঁড়ে নিয়ে পরিচ্ছন্নভাবে খেল, যেন পারফেক্ট একটা বিশ্বনাথ—ফ্লিক টুয়ার্ডস মিড উইকেট। অফ স্টাম্পের ওপর আউটসুইঙ্গারটা নিখুঁত হিসেব কষে ছেড়ে দেওয়ার স্টাইলে রেজালার ঝোলটা কেমন ছেড়ে দিল। তপসে ভাজাটাকে তো লাস্ট মোমেন্ট পর্যন্ত দেখে নিয়ে ডেড ব্যাটে নামিয়ে দিল। নকুড়ের কড়াপাক মানে র‌্যাঙ্ক লংহপ। দ্যাখো কী এলিগ্যান্টলি পরপর দুটোকে ডেসপ্যাচ করল পয়েন্ট বাউন্ডারিতে।”

রাজশেখর যতক্ষণ ধরে তাকে পারফরম্যান্স বোঝাচ্ছিলেন, কলাবতী তার মধ্যেই গোটা ছয়েক সন্দেশ শেষ করে ফেলল, সত্যশেখরের লোলুপ চাহনি অগ্রাহ্য করে।

”সত্যি দাদু, কাকার স্টাইল, এলিগ্যান্স, ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচ, এ সব কিছুরই তুলনা একমাত্র বিশ্বনাথ। আমি কিন্তু গাওস্করপন্থী। ভালো ব্যাটিং উইকেট পেলে গপাগপ রান তুলব।” চেয়ার থেকে উঠে হাত ধোবার জন্য বেসিনের দিকে যেতে—যেতে কলাবতী আর একটু যোগ করল, ”কিন্তু খিদে হওয়াটা যে হেলথেরই লক্ষণ এটাকে তোমার অস্বীকার করা উচিত হবে না।”

তখন রাজশেখর মুখ ফিরিয়ে দেখলেন তাঁর ছেলে তাকিয়ে আছে টেবলে ছড়ানো খালি পাত্রগুলোর দিকে। তার চাহনি ছলছলে, জিভটা ঠোঁটের উপর তুলির মতো বোলাচ্ছে, একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস আটকে থাকায় মুখটা লাল।

”তোর এমন বিচক্ষণতা আগে কখনও দেখিনি সতু, কিপ আপ বয়, কিপ আপ।”

হাফভলিতে রসগোল্লা তুলবে আর মুখে ফেলবে

গোপীনাথ ঘোষের বড় মেয়ের বিয়ে। আটঘরা, বকদিঘির বহু লোককেই তিনি নিমন্ত্রণ করতে ইচ্ছুক, বিশেষত বাৎসরিক ক্রিকেট ম্যাচের খেলোয়াড় এবং আয়োজকদের। এই ম্যাচ উপলক্ষেই তো তাঁর আম্পায়ারিং সিদ্ধান্ত হৈচৈ ফেলে তাঁকে বিখ্যাত করে দিয়েছে। সুতরাং সবাইকে একসঙ্গে জড়ো করে আপ্যায়িত করার এই সুযোগটা তিনি হাতছাড়া করতে চান না।

রবিবারের সকালে তিনি এবং পুত্র দুলু, হাতে একগোছা নিমন্ত্রণপত্র আর ঠিকানা লেখা একটা ফর্দ নিয়ে গাড়িতে চেপে বেরিয়েছেন। একদিনেই সব সেরে ফেলবেন তাই প্রথমেই গাড়ির ট্যাঙ্ক পেট্রলে ভরে নিলেন। তাঁর হিসেব ছিল প্রতিটির জন্য আট মিনিট সময় দিয়ে একদিনে গড়ে পঁচাত্তরটি হিসেবে দুশো পঁচিশজনকে নিমন্ত্রণ তিনদিনে সারবেন। তারপর গাড়ি নিয়ে বেরোবেন দুলুর মা আত্মীয়স্বজনদের নিমন্ত্রণ করতে।

গোপী ঘোষ তেত্রিশতমটি পর্যন্ত গড় ঠিক রেখে বকদিঘির হরিশঙ্কর মুখুজ্যের কাছে গিয়ে স্টাম্পড হলেন। সেখানে আধঘণ্টারও বেশি সময় দিয়ে সোজা এলেন আটঘরার জমিদারবাড়িতে।

রাজশেখর তখন বাগানে বকুলগাছ তলায় টুলে বসে প্র্যাকটিস পিচ তৈরি করার তদারকিতে ব্যস্ত। দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা ১০×৬ ফুট জমি মুরারি কোদাল দিয়ে সকালেই কুপিয়েছে। এখন বলরাম কোপানো জমি থেকে অবাঞ্ছিত বস্তু বাছাইয়ের কাজে ব্যস্ত। রাজশেখরের তীক্ষ্ন নজর এই কাজের উপর। একটু দূরে দু’বালতি গোবর পড়ে রয়েছে।

”বলরাম, প্র্যাকটিস পিচ ইজ দ্য মোস্ট ভাইটাল থিং ইন দ্য মেকিং অফ এ ক্রিকেটার। এখান থেকেই ব্যাটসম্যান গড়ে ওঠে, পিচের বাউন্স যদি অসমান হয়, পিচে যদি একটা সর্ষেদানার মতোও কাঁকর থাকে…” রাজশেখর একটা অ্যাম্বাসাডারকে ফটক দিয়ে ঢুকতে দেখে কথা বন্ধ করলেন।

একটু পরেই মুরারি এসে গোপীনাথ ঘোষের আগমন বার্তা জানাল।

”বসিয়েছিস?…শরবত দে।”

মিনিট পাঁচেক বাদে রাজশেখর বৈঠকখানায় এলেন। গোপী ঘোষ আর দুলুর হাতে কাঁচা আমের শরবতের গ্লাস। সত্যশেখর কথা বলছে ওদের সঙ্গে।

”আরে গোপীবাবু যে, কী সৌভাগ্য আমার…বসুন বসুন…বোসো খোকা। তারপর?”

”আমার বড়মেয়ের বিয়ে এই সামনের আঠাশে, অনুগ্রহ করে আপনাকে পায়ের ধুলো দিতে হবে।” গোপী ঘোষ জোড়হাতে নিবেদন করলেন।

”কিন্তু বিয়েবাড়ি যাওয়া তো আমি অনেকদিনই বন্ধ করেছি।”

”বাবা, সেই কথাই তো আমি ওঁকে বলছিলাম যে, গত পঁচিশ বছর আপনি কোনো বিয়েবাড়িতে যাননি।”

”তা না যান, আমার মেয়ের বিয়েতে কিন্তু যেতেই হবে। এই তো একটু আগে হরিশঙ্করবাবুও বললেন তিনি কোথাও যান না। সবাই যদি না যান বলেন…মতি, নন্তু, পরমেশ ওইদিনই ওদের নেমন্তন্ন আত্মীয়বাড়িতে, কেউই আসতে পারছে না, হরিশঙ্করবাবুও…”

”কে? হরিশঙ্কর…হরি?”

”আজ্ঞে হ্যাঁ, বকদিঘির।”

”কতদিন যায় না বলেছে?”

”তা জিজ্ঞেস করিনি।”

”করে আসুন। খাওয়ার নেমন্তন্ন পেলে ওই পেটুকটা যাবে না আবার? বুঝলি সতু…”

এই সময় কলাবতী বৈঠকখানার পাশ দিয়ে বাড়ির ভিতরে যাচ্ছিল। দুলুকে দেখতে পেয়ে সে থমকে দাঁড়াল। তারপর ঘরে ঢুকে ”হাই” বলে সে কাকার পাশে বসল।

”সেই ম্যাচের পর এই প্রথম দেখা…সেদিন আমরা চলে আসার পরেই নাকি মাঠে খুব ঝঞ্ঝাট হয়েছিল?” কলাবতী জিজ্ঞাসা করল দুলুকে।

”ঝঞ্ঝাট তো বাধালে তুমিই। এমন প্যাঁচে ফেললে যে আমায় ম্যালেরিয়ার রুগি সেজে কাঁপতে হল সারাক্ষণ বকদিঘির লোকেদের দেখিয়ে। তার উপর লাঞ্চটাও খেতে পেলাম না। তিনদিন গায়ে ব্যথা ছিল শরীর কাঁপাতে গিয়ে।”

”সরি, ভেরি সরি। কিন্তু ড্রেসিংরুমে যে বেঞ্চে তুমি শুয়ে ছিলে তার তলায় একটা রসগোল্লার হাঁড়ি লাঞ্চের পর চুপিচুপি রেখে এলাম যে? তাতে তো গোটা পনেরো অন্তত ছিল।”

”মাত্র পনেরোটায় কিছু হয়?”

”কারেক্ট, ঠিক বলেছ ওইটুকু টুকু পিং পং বল সাইজের রসগোল্লায় কী হয়? সাইজ হবে এইরকম ডিউজ বলের মতো।” প্রবল উৎসাহে সত্যশেখর ডান হাতের তালু দিয়ে আকারটা বোঝাল। ”তাহলে ওভারবাউন্ডারি হাঁকিয়ে সুখ আছে। হাফভলিতে আঙুলে তুলবে আর টকাস করে মুখে ফেলবে।”

বিরাট হাঁ করে সত্যশেখর কাল্পনিক রসগোল্লাটা মুখের মধ্যে ফেলতে গিয়ে চোখাচোখি হল রাজশেখরের সঙ্গে। হাতটা ধীরে—ধীরে নেমে এল আর গলা দিয়ে অস্ফুট আর্তনাদের মতো বেরিয়ে এল, ”রসগোল্লা কিন্তু আমার একদমই ভালো লাগে না।”

”সিংগিমশাই, তাহলে আপনি কিন্তু আসছেন।”

”হরি শেষ পর্যন্ত কী বলল, আসবে?”

”জিজ্ঞেস করলেন কী কী আইটেম হবে। শুনে উনি সাজেস্ট করলেন ফুলকপির রোস্ট আর পেস্তার বরফি। কিন্তু আসবেন কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চয়তা দিতে পারলেন না। ওইদিনই আবার ওনার বন্ধুর নাতনির বিয়ে। সেখানে ওঁকে যেতে হবেই।”

”হরি আসবে। বছর চল্লিশ আগে জানি একরাতে তিন জায়গায় বিয়ের নেমন্তন্ন খেয়েছিল। বাজি ধরে বলতে পারি, হরি আপনার মেয়ের বিয়েতে খেতে আসবে।”

”তাহলে আপনি…”

”হরি আইটেম সাজেস্ট করবে আর আমি তাই খেতে যাব?”

”না না সে কী কথা!” গোপী ঘোষ জিভ কেটে শিউরে উঠলেন। ”আমি আটঘরার লোক, আমি কেন বকদিঘির সাজেশান মানতে যাব। তবে বকদিঘি তো আমার কনস্টিটিউয়েন্সির মধ্যেই তাই ভাবছি ফুলকপি রেখে রোস্ট বাদ দেব আর পেস্তা বাদ দিয়ে বরফি রাখব। ফুলকপির বরফি করা যায় কি না এ সম্বন্ধে হালুইকরের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ভাবছি নতুন একটা খাদ্য তৈরি করব।”

”আমি যাব কি না সে সম্পর্কে হরি কিছু বলল?”

”আবার সেই ছেঁদো কথা। বললেন, আটঘরা জোচ্চচুরি করে ম্যাচ জিতেছে। একজনের বদলে এমন একজন খেলেছে, টিমের লিস্টেই যার নাম নেই। পতু মুখুজ্যে নাকি কোর্টে যাবে।”

”প্রমাণ আছে?”

”ছবি তোলা আছে।”

”সে—ছবি দেখেছি। কালুর নাকটা ছাড়া আপনার ছেলের সঙ্গে ওর কোনো অমিল নেই।” রাজশেখর কলাবতীর মুখের দিকে চোখ সরু করে তাকালেন। কলাবতী নিজের নাক দু আঙুলে ধরে দুলুর পাশে গিয়ে বসল।

”আমারটা কি খুব লম্বা?”

সত্যশেখর নানান দিক থেকে দুজনের নাক পরীক্ষা করে মাথা নেড়ে বলল, ”প্রমাণ করা শক্ত।”

গোপী ঘোষ বললেন, ”আগে কোর্টে যাক তো, তারপর দেখা যাবে…তাহলে আপনারা, সতুবাবু কলাবতী সবাই আসছেন। …না না, কোনো আপত্তি শুনব না, আঠাশে বুধবার…আইটেমে রাজভোগ আছে, তবে ওটাকে ডিউজ বল সাইজের করতে বোধহয় অসুবিধে হবে না, হালুইকরের সঙ্গে একবার কথা বলব…আর ফুলকপির বরফিটা যদি করা যায়, একটা নতুন আবিষ্কার হবে…আটঘরার টুপিতে আর একটা নীল ফিতে!”

কলাবতী গাড়ি পর্যন্ত এল ওদের সঙ্গে। দুলুকে সে জিজ্ঞাসা করল, ”পরীক্ষা তো হয়ে গেল এখন কী করছ?”

”ম্যাজিক শিখছি।”

”ম্যাঅ্যাঅ্যা…জিক। দারুণ, কার কাছে, কোথায় শিখছ?”

”পাড়াতেই একজন বুড়ো লোক আছেন, অনেক রকমের ম্যাজিক জানেন।”

”আমার খুব ইচ্ছে করে শিখতে।”

”জিজ্ঞেস করব। যদি তোমাকে শেখাতে রাজি হন তো জানাব।”

”ঠিক?”

”ঠিক।”

ফাঁসির খাওয়া খাব

বাড়ির সামনের ফুটপাথ রঙিন কাপড়ে ঘিরে চেয়ার পেতে অভ্যাগত আর বরযাত্রীদের বসার ব্যবস্থা হয়েছে আর বাড়ির লাগোয়া খালি জমিটা তাদের খাওয়ানোর ব্যাপারে লেগেছে। বাড়ির রকে সানাই বসেছে।

নাতনিকে পাশে নিয়ে রাজশেখর ১৯২৮—এর ফোর্ড গাড়িটা চালিয়ে যখন পৌঁছলেন, তখন গিজগিজে ভিড়। বর এসে গেছে। তিনটে মিনিবাস রাস্তার মোড়ে। তাছাড়া গোটা পঁচিশ মোটর সার দিয়ে রাস্তার দুধারে। রাজশেখর তাঁর ফোর্ডকে কোথায় রাখবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সামনে কোথাও রাখার স্থান না পেয়ে গাড়িটাকে পিছু হটিয়ে আনছিলেন কলাবতীর নির্দেশ অনুসরণ করে।

”দাদু, বড়দিদের গাড়ি।” কলাবতী গলা নামিয়ে চাপাস্বরে বলল।

”কই?”

রাজশেখর ব্রেক প্যাডেলে পা চাপলেন।

”ওপারে, সবশেষের সবুজ অ্যাম্বাসাডারটা।”

”ঠিক দেখেছিস, হরিরই তো?”

”হ্যাঁ ঠিক দেখেছি। বড়দি তো ওটাতেই রোজ স্কুলে আসেন।”

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ফোর্ড এসে সবুজ অ্যাম্বাসাডারের পিছনে এমনভাবে দাঁড়াল যে, উভয়ের বাম্পারের মধ্যে দূরত্ব রইল ইঞ্চি—ছয়েক। সামনের স্টেশন ওয়াগনটা বা পিছনের ফোর্ড জায়গা না দিলে অ্যাম্বসাডার বেরোতে পারবে না।

”সতুর আজকেই কিনা মক্কেলদের দিয়ে গুজুর—গুজুর করার তাড়া পড়ল। একসঙ্গে এলে কত ভালো দেখাত।” গাড়ি থেকে নেমে লুটোনো কোঁচাটা বাঁ হাতের দু’ আঙুলে আলতো তুলে ধরে রাজশেখর কাঁধের মুগার চাদরটা ডান হাতে গুছিয়ে নিতে নিতে ক্ষুব্ধ কণ্ঠেই বললেন।

”কাকার এখন নাম হয়েছে, পসার হচ্ছে,” কলাবতী বিজ্ঞের মতো সান্ত্বনা দেবার স্বরে বলল, ”এখন ফাঁকি দেওয়াটা ঠিক হবে না।”

উপহারের জন্য শাড়ির বাক্সটা সে গাড়িতেই ফেলে রেখে নেমে পড়েছিল। রাজশেখর মনে করিয়ে দিতেই সে ”ইসস” বলে জিভ কাটল।

দু’জনে বিয়েরবাড়ির সামনে পৌঁছতেই গোপী ঘোষ এগিয়ে এলেন দুই কর জোড়া করে।

”আমার কী সৌভাগ্য, আপনি এলেন….এইমাত্র হরিশঙ্করবাবুও পৌঁছলেন আর এক জায়গায় নেমন্তন্ন সেরে….হেঁ হেঁ, ঠিকই আপনি বলেছিলেন…যাও মা, তুমি ভিতরে যাও, ওরে, দুলুকে ডাক। …আপনি এদিকের ঘরে এসে বসুন, ওদিকটা বরযাত্রীদের জন্য।”

রাজশেখরকে তিনি যে—ঘরে আনলেন, সেটি তাঁর আম দরবার। তাঁর বিধানসভা এলাকার লোকেদের সঙ্গে এই ঘরে দেখা করেন। ঘরের তিন দেয়াল ঘেঁষে লম্বা সোফা। একটা বিরাট টেবল। সোফায় বসে আছেন হাইকোর্টের এক জজ, খবরের কাগজের একজন সম্পাদক, আর হরিশঙ্কর।

”আয় রাজু, আয়।”

হরিশঙ্কর উৎফুল্লভাবে সোফায় তাঁর পাশের খালি জায়গাটা চাপড়ে বললেন। ঘরের সবাই গৌরবর্ণ দশাসই চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল। তিনি হরিশঙ্করের পাশে গিয়ে বসলেন।

”একটা তো সেরে এলি, আবার এখানেও খাবি?”

”ভগবান একটা পেট দিয়েছেন, সেটার সেবা করতে হবে তো!”

”ভগবান সবাইকেই পেট দিয়েছেন, কিন্তু তাই বলে….”

এইভাবে দেখামাত্র দুজনে তর্ক বাধিয়ে যখন কথার পিঠে কথা চাপাতে লাগলেন, তখন দুলু কলাবতীকে পৌঁছে দিয়েছে কনের ঘরে। সাজগোজ করা মেয়েদের ভিড়ের মধ্যে ঘরের এককোণে বড়দিকে দেখে কলাবতী তো স্তম্ভিত। হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখার্জি যে এত সুন্দরী, সে এতদিন বুঝতে পারেনি।

বড়দির হাতছানিতে সে ভিড় কাটিয়ে পাশে গিয়ে বসল।

”কী দারুণ আপনাকে দেখাচ্ছে না!”

মলয়া বিব্রত এবং রক্তিম মুখ সামলাতে সামলাতে বলল, ”আচ্ছা আচ্ছা, তোমাকেও তো সুন্দর দেখাচ্ছে….কখন এলে, সবাই এসেছ?”

”এইমাত্র, দাদু আর আমি এসেছি।”

”শুধু দুজনে!”

কলাবতীর মনে হল, বড়দির মুখটা পলকের জন্য যেন হতাশ ম্লান দেখাল।

”কাকা চেম্বারের কাজ শেষ করেই আসবে, হয়তো ইতিমধ্যে এসেও গেছে।”

তার মনে হল, বড়দির মুখ এবার আগের থেকেও ঝকঝকে হয়ে উঠল।

”ওহ, তোমার কাকাও আসবে বুঝি?”

”তাই তো কথা আছে।”

ওরা দুজন যখন ঘরের মধ্যের প্রভূত সোনা, বেনারসি ও সুগন্ধী নির্যাসে ডুবে গিয়ে গলা নামিয়ে কথা বলছে তখন গোপী ঘোষের আমদরবারে রাজশেখর আর হরিশঙ্করের দিকে সারা ঘরের চোখ আর কান তটস্থ হয়ে নিবদ্ধ।

”খাওয়ার তুই কী বুঝিস? কচুরি আর রাধাবল্লভীর তফাত জানিস? মুলো—ছেঁচকি আর থোড়—ছেঁচকি খেতে দিলে বলতে পারবি কোনটে কী? ছানাবড়া আর কালোজামের কথা তো ছেড়েই দিলাম।”

রাজশেখর মিটমিটিয়ে হাসছিলেন আর শুনছিলেন। বললেন, ”সব জিনিস কি আর সবাই জানে, আইনের ব্যাপারে জজসাহেব যতটা জানবেন, কাকে খবর বলে সেই সম্পর্কে সম্পাদকমশাই যতটা জানেন, তুই—আমি কি ততটা জানব? ক্রিকেটের আমি কিছুই জানি না, তবু যতটা জানি, তুই তো তাও জানিস না। হ্যাঁ, রান্নার তুই কিছু—কিছু বুঝিস এটা আমি মানব, কিন্তু রান্না আর খাওয়া তো দুটো আলাদা ব্যাপার, একেবারেই এক জিনিস নয়। রেঁধে পাতে সাজিয়ে দেওয়া পর্যন্ত একটা পর্ব। তারপর শুরু হয় বাকি পর্ব। এই শেষেরটা সম্পর্কে তোর থেকে আমি ভালোই জানি। কচুরি—রাধাবল্লভীর মধ্যে তফাত জানতে একবার করে কামড় দিলেই তো জানা যাবে, সেজন্য কি গবেষণার দরকার হয়? রসগোল্লা আর রাজভোগের মতোই একটা হুক আর একটা পুলের মধ্যে তফাত বুঝতে কি মাথার চুল ছিঁড়তে হবে? চোখ থাকলেই বোঝা যায়।”

এই সময় দরজার কাছে সত্যশেখরকে হাসি মুখে উঁকি দিতে দেখা গেল। কিন্তু ঘরের মধ্যে টাকমাথা এবং আশু মুখুজ্যে—গোঁফ সম্বলিত জজসাহেবকে দেখেই সে জিভ কেটে শটকান দিল। রাজশেখর সঙ্গে সঙ্গে ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। জজসাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ”এইমাত্র যে উঁকি দিল…ব্যারিস্টার সিনহা, গতকাল আমার বেঞ্চেই আর্গু করতে করতে অন্তত পাঁচবার আমাকে জিভ দেখিয়েছে।”

হরিশঙ্কর মুচকি হেসে চোখ টিপলেন রাজশেখরকে।

‘আপনি কিছু বলেননি?” হরিশঙ্কর খুবই ভালোমানুষী গলায় বললেন।

”নিশ্চয়। বলেছি ফারদার জিভ বার করলে আমার এজলাসে আর ঢুকতে দেব না।”

”তারপরও কি আর জিভ বেরিয়েছে ?” রাজশেখর গম্ভীরভাবে জানতে চাইলেন।

”না, তারপর এখানে এইমাত্র দেখলুম।”

”ব্যারিস্টার সিনহা এরই ছেলে।” হরিশঙ্কর ভিজে বেড়ালের মতো চোপসান স্বরে এবং মুখটি নিরীহ করে বললেন। রাজশেখর কটমটিয়ে তাঁর দিকে তাকালেন। জজসাহেব অপ্রতিভ হয়ে টাকে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ”ইয়ে, কিছু মনে করবেন না, আমি জানতাম না যে….”

”মনে করব কেন।” রাজশেখর ধমকের ধমকের মতো কণ্ঠে বললেন, ”ঠিকই বলেছেন ওকে, আমি হলে তো, তিনবারের পরই এজলাস থেকে বার করে দিতাম। …উফফ, কতদিন আমি এটাই ভয় করেছি যে, সতু এমন কাণ্ড করবে। ওর এই বদ অভ্যাসটা তৈরি করেছে তোর মেয়ে।”

”মলয়া!”

”নিশ্চয়। হাতে সব সময় ক্যামেরা, আর সতু জিভ বার করলেই ছবি তুলে নেয়। ছবি তোলাবার লোভ থেকে সতুর তাই জিভ বার করার অভ্যাসটা দাঁড়িয়ে গেছে।”

”তোর ছেলে তো সিংগি, তাহলে ষাঁড়েদের মতো স্বভাব কেন?”

”মানে?”

”ষাঁড়ের সামনে লাল কাপড় নাড়লেই খেপে যায়। তোর ছেলের সামনে ক্যামেরা ধরলেই…”

”কিনিয়ার সাফারি পার্কে আমি খুব কাছের থেকে সিংহদের ছবি তুলেছি, কিন্তু সিংহরা তো একবারও খেপে যায়নি!” খবরের কাগজের সম্পাদক বললেন।

”আফ্রিকার সিংহরা একরকম আটঘরার সিংহরা আর—একরকম।” হরিশঙ্কর বিনীত ভঙ্গিতে জানালেন, ”ওরা হরিণ খায়, শুওর খায়, জেব্রা খায়, আর এরা খায় কলা!”

”সিংহ খায় কলা!” ঘরের সবাই বিস্ময়ে একসঙ্গে বলে উঠলেন।

”ওঁকেই জিজ্ঞেস করুন। ক্রিকেট ম্যাচে বাজি ধরেছিল রসগোল্লা বা সন্দেশ নয়…কলা।”

রাজশেখর মুখ লাল করে নীরব রইলেন।

ঘরের অনেকেই মুচকি হাসলেন। এইসময় বাইরে সামান্য কোলাহল শোনা গেল। একব্যাচ খেয়ে উঠে বেরিয়েছে, সম্ভবত এরা বরযাত্রী। শামিয়ানা—ঘেরা বসার জায়গায় কন্যাপক্ষের লোকদের মধ্যে বকদিঘির বিষ্টু মিশির, ক্যাপ্টেন পতু মুখুজ্যে আর হরিশ কর্মকারকে দেখা যাচ্ছে। একটা ম্যাচে হরিশ এবং গোপী ঘোষ আম্পায়ার ছিল। তাই হরিশের নিমন্ত্রণ। মিশিরের স্টোরেজে গোপী ঘোষের খেতের আলু থাকে।

আটঘরার চণ্ডী কম্পাউন্ডার, পঞ্চায়েত—প্রধান পটল হালদার রয়েছে ওদের সামনের সারির চেয়ারে।

”পটলবাবু, এবারের ম্যাচে লাঞ্চের জন্য হাবু ময়রা নাকি মাত্র দু’ হাঁড়ি রসগোল্লা দিয়েছিল?”

পতু মুখুজ্জে কী বলতে চায়, তা বুঝতে না পেরে পটল হালদার সাবধান হয়ে গেল।

”দু হাঁড়ি কি দশ হাঁড়ি তাতে কী এসে যায়, সবাই পেটভরে তৃপ্তি করে খেয়েছে কি না, সেটাই বড় কথা।”

”তা তো ঠিকই, নিশ্চয়, আসলকথা হল তৃপ্তি। কিন্তু আমি শুনেছিলাম রসগোল্লা কম পড়ে গেছল? আর তাইতে নাকি আধপেটা সতু সিংগি রেগে বকদিঘির বোলারদের পিটিয়ে সেঞ্চুরি ভক্ষণ করে!”

”একদম বাজে কথা।” পটল হালদারের উত্তেজিত কনুই পাশে বসা আটঘরার মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান চণ্ডী কম্পাউন্ডারকে খোঁচা দিল। চণ্ডী তখন ব্যাকুল চোখে শামিয়ানার প্রবেশপথের ফাঁক দিয়ে খাওয়া দেখছিল। হঠাৎ পাঁজরে খোঁচা খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ”রসগোল্লার সাইজটা বেশ ভালোই মনে হচ্ছে।”

”দূর মশাই রসগোল্লার সাইজ, পতুবাবু কী বললেন তা শুনেছেন?”

”শুনিনি মানে? রসগোল্লা কম খেলে রাগ হয়, আর তাহলেই সেঞ্চুরি ভক্ষণ করে রাগ মেটাতে হয়। তাই তো?”

এই সময় দেখা গেল সত্যশেখর কাঁচুমাচু মুখে কেমন জড়োসড়ো ভঙ্গিতে বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। ওকে দেখেই পটল হালদার উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল।

”সতুবাবু….এদিকে, এই যে, এখানে একবার আসুন তো।”

মনে হল সত্যশেখর এই আহ্বান শুনে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কোঁচাটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে প্রায় ছুটে এল।

”আচ্ছা বলুন তো, আপনার সেঞ্চুরি করার পিছনে কীসের প্রেরণা ছিল?”

এমন একটা প্রশ্নের সামনে যে পড়তে হবে, সত্যশেখর তা ভাবেনি। ফ্যালফ্যাল করে সে সদাসংগ্রামশীল ও বিপ্লবী আটঘরা অঞ্চল সমিতির প্রধান পটল হালদারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

”আমার তো মনে হয় আটঘরার প্রগতিশীল মেহনতি মানুষের ঐক্য জোরদার করার জন্যই, তাদের বুর্জোয়া বিরোধী চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই আপনি ব্যাট হাতে দেখিয়ে দিয়েছেন কী করে শত্রুর মোকাবিলা করতে হয়। আর এর পিছনে ছিল আটঘরার জনগণের সমবেত শুভেচ্ছা ও শত্রুর প্রতি বৈপ্লবিক ঘৃণা, যা সংগ্রামের সঠিক পথে চালিত হবার জন্য মদত দিয়েছিল। ঠিক বলছি কিনা?”

সত্যশেখর মুহূর্ত বিলম্ব না করে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।

”আপনার সেঞ্চুরি যে জনগণকে সঠিক পথ দেখাবে, এটা নিশ্চয় আপনি জানতেন?”

”নিশ্চয় জানতুম।”

”আপনার সেঞ্চুরি যে প্রতিক্রিয়াশীলদের কবর খুঁড়বে, তা নিশ্চয় আপনি জানতেন?”

”অবশ্যই জানতুম।”

”অথচ দেখুন এরা তথ্যকে বিকৃত করে প্রচার করছে আপনি নাকি বুর্জোয়া সংস্কৃতির অন্যতম ধারক যে রসগোল্লা, শোষক সম্প্রদায়ের লোভ দেখানোর বস্তু যে রসগোল্লা, তাই ভক্ষণ থেকে বঞ্চিত হয়ে নাকি সেদিন সেঞ্চুরি করেছিলেন, শত্রুকে প্রহার করে অতৃপ্তির শোধ নিয়েছিলেন?”

”হতে পারে।”

”সে কী, জনগণের প্রতি নিবিড় ভালোবাসা কি আপনার প্রেরণা ছিল না? আপনি কি বকদিঘির অপপ্রচারকে সমর্থন করবেন?”

”অ্যাঁ! বকদিঘি এই রকম কথা বলছে?” সত্যশেখর বিপন্ন হয়ে তাড়াতাড়ি যোগ করল, ”রসগোল্লা আমি যে মোটেই ভালোবাসি না, পতুবাবু আপনি কি তা জানেন না?”

”আমি কী করে জানব! আপনি উচ্ছে ভালোবাসেন না করলা ভালোবাসেন, তা কি আমার জানার কথা?”

এই সময় চণ্ডী কম্পাউন্ডার ঝুঁকে হরিশ কর্মকারকে বলল, ”লক্ষ করলি, সন্দেশের মতো কী একটা দুবার রিপিট করল, কিন্তু কেউ নিল না! শুঁকেই পাতে ফেলে রাখছে।”

”বোধহয় মিষ্টি বেশি হয়ে গেছে।”

”এটা উচ্ছে—করলার প্রশ্ন নয়, পতুবাবু।” অঞ্চল—প্রধান চোখ বুজে দু’হাত নাড়ল। ”আপনি রসগোল্লাকে প্রেরণা বলছেন, অথচ উনি রসগোল্লাই ভালোবাসেন না, খান না….দেখতে পর্যন্ত পারেন না। আপনি ভুল তথ্য দিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করছেন।”

”পটলদা, তুমি যে বলেছিলে সতুবাবুর সেঞ্চুরির জন্য সভা করবে, মিছিল করবে, শতরান—স্তম্ভ গড়বে, সে—সবের কী হল?” হরিশ সরল বোকাবোকা মুখ করে জানতে চাইল।

”হবে। সভা হবে, মিছিলও হবে। সতুবাবু ব্যস্ত মানুষ, সময় যেদিন দিতে পারবেন সেদিনই….” সত্যশেখরকে কিছু একটা বলার জন্য হাঁ করতে দেখেই পটল হালদার দ্রুত যোগ করল, ”জানি জানি আপনি কাজের লোক, তাই তো বিরক্ত করিনি।”

”পটলদা, স্তম্ভটা?”

”হাইট কতটা হবে তাই নিয়ে নিয়মিত আলোচনায় বসছি। আপাতত তিন ফুট থেকে চার ফুটে আমরা উঠেছি।”

বাড়ির ভিতর থেকে এই সময় একটা চিৎকার ভেসে এল ”আর দু’মিনিট পর মেয়েদের নামতে বলরে, পাত রেডি হচ্ছে।”

বিষ্টু আর চণ্ডী একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল। পান চিবোতে চিবোতে লোকেরা বেরিয়ে আসছে।

”বেশ খাইয়েছে…..ফ্রাইটা জোর সাঁটিয়েছি।”

”আমি তেরোটার বেশি আর টানতে পারলুম না।”

”আরে মিহিদানাটা অত খাচ্ছিলিস কেন বোকা! সরভাজা আছে জানতিস না?”

”বিরিয়ানিটাই বেস্ট….কী একটা বরফি বলে দিল, মাগো, যা বোঁটকা গন্ধ! অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসছিল।”

শুনতে শুনতে চণ্ডীর চোখমুখ কখনও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল, কখনও চুপসে যাচ্ছিল। কাতর স্বরে সে বলল, ”পটলদা, পেটের মধ্যে খিদের স্তম্ভটা যে দশ ফুট ছাড়িয়ে গেছে। এবার তো দেখছি মেয়েরা বসবে…ভেতরে গিয়ে হালচাল বুঝে এসো না।”

বিষ্টু বলল, ”তুমি হলে গিয়ে অঞ্চল—প্রধান, দেখবে না আমাদের? হলামই বা আমরা বকদিঘির।”

পতু মুখুজ্যের পাকস্থলিতেও মোচড় দিচ্ছে। সে গাম্ভীর্য বজায় রেখে উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বলল, ”যাদের ট্রেন ধরতে হবে, তাদের আগে ছেড়ে দেওয়া উচিত।”

পটল হালদার আমতা—আমতা করে বলল, ”কিন্তু আমি তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না….”

”বাড়ির ভেতরে যান। গোপীবাবু ভেতরে আছেন আর তিনি তো আপনাকে বিলক্ষণই চেনেন।” পতু মুখুজ্যে সেকেন্ড স্লিপকে থার্ডম্যানে যেতে বলার মতো বাড়ির দরজার দিকে আঙুল দেখাল।

পটল হালদার গুটিগুটি এগোল। তখন সত্যশেখর খপ করে তার হাত টেনে ধরে বলল, ”ঢুকেই বাঁ দিকের ঘরে বাবা, হরিকাকা বসে আছেন। দেখবেন ফর্সা, টেকো, গুঁপো, একটা প্যাঁচামুখো লোকও আছে। লোকটা কখন বিদেয় হবে সেটা কায়দা করে জেনে আসতে হবে, পারবেন?”

”হেঁ হেঁ হেঁ, কায়দাই যদি না জানি, তা হলে কি অঞ্চল প্রধান হতে পারতুম। নিশ্চিন্ত থাকুন, দু’ মিনিটে খাওয়ার ব্যবস্থা আর আপনার খবর…”

সত্যশেখর তাকিয়ে রইল পটল হালদার বাঁ দিকের ঘরটায় না ঢোকা পর্যন্ত। তখন দোতলা থেকে মেয়েরা আর বাচ্চচারা কলকল করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। কে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ”এখনও রেডি হয়নি…একটু অপেক্ষা করুন, আর দু’ মিনিট।”

দুলু এবং ক্যামেরা হাতে একটি ছেলের সঙ্গে কলাবতী গল্প করতে করতে নামছিল। দূরে কাকাকে দেখে সে মুখের কাছে গরাস ধরে ইশারায় জানতে চাইল খাওয়া হয়েছে কি না। পেটে হাত রেখে সত্যশেখরের বিষণ্ণ মাথা নাড়া দেখে কলাবতী পিছনে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ”বড়দি, এখনও কাকার খাওয়া হয়নি।”

”এসেছেন বুঝি?”

”হ্যাঁ। মনে হচ্ছে খুবই কষ্ট পাচ্ছে। দাদুর ডায়েট চার্টের এফেক্ট শুরু হয়ে গেছে। আজকাল যা খিদে পায় না কী বলব!”

”এই যে বললে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমরা খাও।”

”খেলেই বা! ইদানীং দাদুর কেমন যেন সন্দেহ হয়েছে আমরা ডায়েট চার্ট ফলো করছি না। মুরারিদাকে প্রায় সাসপেন্ড করে রেখেছেন। বাড়ির বাইরে এক পা—ও যেতে দেন না। বলরাম দোকান—বাজার করে। দাদু নিজের হাতে এখন আমাদের ভোর থেকে রাত পর্যন্ত সামনে বসে খাওয়ান…উফফ বড়দি, সে যে কী ভীষণ, বোঝাতে পারব না! এখন রাক্ষসের মতো খিদে হয়েছে, কাকার তো আরও বেশি! আজই বলছিল, ফাঁসির খাওয়া খাব।”

সিঁড়ির মুখে ভিড় জমে গেছে। পাশের ঘরে দাদুকে দেখতে পেয়ে কলাবতী বড়দিকে বলল, ”ভিতরে যাবেন?”

মলয়া একটু ইতস্তত করে বলল, ”বড্ড গরম লাগছে, আমি বাইরেই থাকি, তুমি দেখা করে এসো বরং।”

কলাবতী তখন দুলু আর তার ক্যামেরা—হাতে বন্ধুটিকে বলল, ”চলো মজার ব্যাপার দেখবে, দুই বুড়োর ঝগড়া!”

”মজা!” দুলু অবাক হয়ে ঘরের ভিতরে তাকিয়ে বলল, ”জীবনে এই প্রথম বাবাকে ধমক খেতে দেখছি, ওই দ্যাখো।”

ফুলকপির বরফি সেম অ্যাজ লেগ গ্লান্স

ওরা তিনজন ঘরের মধ্যে ঢুকে একধারে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বহুবার ঝলসাল, কিন্তু ঘরের কেউ তাতে ভ্রূক্ষেপ করল না।

”বলেন কী, আমার অ্যাডভাইস আপনি নিলেন না?” হরিশঙ্করের গর্জনে গোপী ঘোষ আর—একটু কুঁকড়ে গেলেন। ”ফুলকপির রোস্ট আর পেস্তার বরফি করেননি?”

”ভাবলুম নতুন একটা কিছু করি, তাই দুটো থেকে আধখানা করে মানে রোস্ট আর পোস্তাটা বাদ দিয়ে করেছি ফুলকপি বরফি….অসাধারণ, নতুন ব্যাপার। ষাট ঘণ্টা ফুলকপিগুলো ভিজিয়েছি পোস্তবাটা জলে। ধুয়ে নিয়ে মাখিয়েছি গোলমরিচ, হিং আর আদা; এগারো ঘণ্টা ধুয়ে সেদ্ধ করে চটকে মাখন মাখিয়ে ছ’ঘণ্টা উনুনে শুধু পাক হয়েছে। তারপর খোয়া ক্ষীর, ছানা, কাঁচা আলু বাটার সঙ্গে মিশিয়ে আবার পাক। তারপর চিনেবাদাম বাটা, চিঁড়ে বাটা….।”

”থাক থাক আর বলতে হবে না।” দু’ হাত মাথার উপর তুললেন হরিশঙ্কর।

”এটা আটঘরার একটা আবিষ্কার।” রাজশেখর উদাসীন ভঙ্গিতে প্রথম জজসাহেবের দিকে তাকিয়ে কথাটা শুরু করে মুখটা সম্পাদকের দিকে ফিরিয়ে ”এডিটোরিয়ালের জন্য ভালো সাবজেক্ট” বলে শেষ করলেন।

”আটঘরার আবিষ্কার মানে তো অখাদ্য। ইসস, পেস্তার বরফিটাই খাব বলে বন্ধুর বাড়িতে কিছুই খেলাম না, শুধু আটটা ফ্রাই আর গোটা দশেক কড়াপাক…ওহ, কী ভুলই করেছি!” হরিশঙ্কর কপালে করাঘাত করার জন্য হাত তুলেই নামিয়ে নিলেন পটল হালদারকে দেখে।

”গোপীবাবু,” পটল পিছন থেকে ঝুঁকে গোপী ঘোষের কানে ফিসফিসিয়ে বলল। হরিশঙ্করের ক্রোধ—গর্জনে গোপী ঘোষ নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। চমকে পিছন ফিরে পটলকে দেখেই রেগে উঠলেন।

”গোপীবাবু কী করবে? এ ঘরে অঞ্চল—প্রধানের কী দরকার? অ্যাঁ….এখানে শ্রেণীসংগ্রাম চলবে না বলছি।”

”আজ্ঞে সংগ্রাম নয়, আমাদের খিদে পেয়েছে।”

”পেয়েছে তো বসে পড়ুন।”

পটল হালদার বসার জায়গার জন্য এধার—ওধার তাকাতে লাগল। জজসাহেবের পাশের খালি জায়গাটুকু নজরে পড়তেই সে এগিয়ে এসে ‘একটু সরুন তো’ বলেই জজের পাঞ্জাবির হাতা চটকে, লোটানো ধুতির কোঁচা মাড়িয়ে সোফায় বসল।

জজসাহেবের গোঁফের ফাঁক থেকে কোলাব্যাঙ ডাকার মতো একটা শব্দ বেরিয়ে এল। পটল হালদার লজ্জিত হয়ে বলল, ”মাপ করবেন….আমি দেখতে পাইনি, ক্ষমা চাইছি।”

”দেখতে পাননি? কী নাম আপনার?”

”পটল হালদার।”

”কী করেন।”

”আটঘরা অঞ্চল সমিতির প্রধান। …আপনি?” বিনীতভাবে পটল জানতে চাইল।

”আমি হাইকোর্টের একজন বিচারপতি।”

”অ।” বলেই পাঁচ সেকেন্ড পর পটল হালদার স্প্রিংয়ের মতো সিধে হয়ে বসল। ”তাই বলুন! আপনিই সেই জজ, যার কথা সতুবাবু বলে দিলেন।”

”কে সতুবাবু? কী বলেছেন?”

”সত্যশেখর সিংহ, চেনেন না? আপনাদের হাইকোর্টেরই তো ব্যারিস্টার। ….আহা, কী ব্যাটটাই না এবার করলেন। শতরান—স্তম্ভ আমি তুলবই, স্যার আপনাকে গিয়ে উদ্বোধন করতে হবে…না না, কোনো কথা শুনব না….আটঘরার জনগণ আপনাকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।” পটল হালদার জজসাহেবের ঊরুতে দু’হাতের তালু রেখে মিনতি জানাল।

”উহুহু, করছেন কী?”

”আপনাকে যেতেই হবে। আমার প্রধানত্বে আটঘরায় কিনা হাইকোর্টের জজ! ….উহহ, ভাবতে পারেন কতবড় প্রাপ্তি হবে সেটা?”

দুই তালু দিয়ে এবার সে ঊরু খামচে ধরল। জজসাহেব রেগে হাতদুটো সরিয়ে দিলেন।

”আপনি বড্ড বেয়াড়া লোক তো!”

”যেতেই হবে। নইলে হাইকোর্টে মিছিল আনব, ধর্না দেব, ঘেরাও করব।”

”তিনমাসের জন্য তাহলে চালান করব।”

”মানে?”

”মানে ঘানি ঘোরাবার ব্যবস্থা করব। ….হাত সরান।”

পটল হালদার মাথাটা কাত করে সরু চোখে আট সেকেন্ড জজসাহেবের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ”আপনি কেমন বিচারপতি, মশাই, জনগণের ইচ্ছাকে….সতুবাবু দেখছি ঠিকই বলেছিল, আপনি প্যাঁচামুখোই বটে।”

”কে, কে, কে বলেছে।”

ঘরের অন্যদিকে তখন হরিশঙ্করের মুখের কাছে মুখ এনে রাজশেখর দাঁত চেপে গজরালেন, ”আটঘরার আবিষ্কার অখাদ্য? আবিষ্কার কথাটার মানে জানিস? আবিষ্কার হচ্ছে নতুন জিনিস, ইনভেনশন, যা আগে কখনও পৃথিবীতে ছিল না….সুইং বোলিং আর গুগলি কী করে খেলতে হয়, প্রথম দেখাল জ্যাক হবস, লেগ গ্লান্স প্রথম দেখাল রঞ্জি, একেই বলে আবিষ্কার। আটঘরার ফুলকপির বরফিও সেম অ্যাজ লেগ গ্লান্স….লোকের পাতে পড়বে আর গণ্ডায় গণ্ডায় বাউন্ডারি পেরিয়ে যাবে। গোপীবাবু, গোটাকতক হরিকে এনে দিন তো।”

”এখুনি মেয়েদের ব্যাচ বসবে, একেবারে সেখানেই তো….”

”না না, মেয়েদের সঙ্গে বসে নয়। এখানে এখুনি ওকে দিন। আটঘরার আবিষ্কার অখাদ্য কি না সেটা জজসাহেব রয়েছেন, এডিটার রয়েছেন, ওঁদের সামনেই প্রমাণ হয়ে যাক।”

”হ্যাঁ, এঁদের থেকে যোগ্য ব্যক্তি….হাইকোর্টের জজ, কাগজের এডিটার….আর কে হতে পারেন?” পটল হালদার ছিলে—ছেঁড়া ধনুকের মতো দাঁড়িয়ে উঠল। ”যদি হরিশঙ্করবাবু বলেন অখাদ্য, তাহলে এনারা চেখে দেখবেন। এনারা যদি বলেন সুস্বাদু, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, আটঘরা অঞ্চল সমিতি তার এলাকার প্রতিটি মেহনতি মানুষকে এক কেজি করে এই আবিষ্কার উপহার দেবে এবং সেই উপহার—অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন…” পটল মুখ নামিয়ে বলল, ”স্যার অনুষ্ঠানে আপনাকে যেতেই হবে…না না, আর আপত্তি করবেন না, এবার রাজি হয়ে যান।”

”আগে তাহলে বলুন, আমাকে প্যাঁচামুখো কে বলেছে?”

পটল হালদার ফ্যাকাসে বিব্রত মুখে গোপী ঘোষের দিকে তাকিয়ে দেখল তিনি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, কলাবতীরা হাসি চাপছে, রাজশেখর ব্যস্ত হয়ে সম্পাদকের দিকে ঝুঁকে আফ্রিকার সিংহদের কেশর গির—সিংহদের থেকে ঝাঁকড়া কিনা জানতে চাইলেন।

হরিশঙ্কর নখ খুঁটতে খুঁটতে আনমনে বললেন, ”পটলবাবু তখন যেন সতুর নাম বললেন বলে মনে হল।”

”সতু কে? ডাকুন তো তাকে।” জজসাহেবের কণ্ঠে এজলাসের স্বর ফুটে উঠল।

হরিশঙ্কর টিপ্পনী কাটলেন, ”আসবে কি?”

”সতু আমার ছেলে, একটু আগেই তাকে দেখেছেন।” রাজশেখর কেশর—ফোলানো সিংহের মতো তেজি ভঙ্গিতে হরিশঙ্করের দিকে তাকালেন। ”নিশ্চয় সে আসবে, সিংগিবাড়ির ছেলে যখন, ভয় পাবে কেন…কালু, ডেকে আন তো কাকাকে।”

সেই সময় বাইরে থেকে শোনা গেল : ”দুটো পাত খালি রয়েছে, আর—কেউ থাকেন তো পাঠিয়ে দাও।”

তাই শুনে বিষ্টু আর চণ্ডী একসঙ্গে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। দুজনের চোখ হরিশ অর পতু মুখুজ্যের উপর। কী দেখল কে জানে, ওরা দুজন আবার ধীরে—ধীরে চেয়ারে বসে পড়ল।

”মাত্র দুটো পাত।”

”আমরা চারজন।”

”পটলদা সেই যে গেল!”

উদ্বোধন ভক্ষণ সেঞ্চুরি দিয়ে

ঘরের মধ্যে তখন ঘোর উত্তেজনা। কাগজের রেকাবিতে মাখা—ময়দার মতো দেখতে হরতন—আকৃতির পাতলা কয়েকখণ্ড বরফি নিয়ে গোপী ঘোষ দাঁড়িয়ে। মুখে গদগদ ভাব। হরিশঙ্কর দুই আঙুলে চিমটের মতো একটি বরফি সন্তর্পণে তুলে নাকের কাছে এনেই মুখ বিকৃতি করলেন। কয়েক সেকেন্ড রাজশেখরের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার শুঁকলেন। ঘরের সবাই প্রবল উৎকণ্ঠায় তাঁর মুখভাব লক্ষ করে যাচ্ছে। হরিশঙ্করের নাক কুঁচকে রয়েছে, শরীর যেন ঘোলাচ্ছে।

”হরিবাবু তো বিরোধী পক্ষ, ওনার কাছে আটঘরার আবিষ্কার তো খারাপ লাগবেই।”

পটল হালদার তার সুবিজ্ঞ সিদ্ধান্ত পেশ করে মিটিমিটি হাসতে লাগল।

”তা বটে। নিরপেক্ষ কারুর মতামতই এক্ষেত্রে গ্রাহ্য হওয়া উচিত, কী বলেন জজসাহেব?” সম্পাদক বললেন।

”তার আর দরকার হবে না।” ফুলকপির বরফি খুবই পরিতোষের সঙ্গে চিবোতে চিবোতে হরিশঙ্কর জানালেন। ”অসাধারণ, সত্যিই আবিষ্কার! নেহাত একটা নেমন্তন্ন খেয়ে এখানে এসেছি, নইলে…” হরিশঙ্কর কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবার বললেন, ”….নইলে এখুনি খাওয়ার সেঞ্চুরি করে দিতাম। অদ্ভুত জিনিস, সত্যিই একটা আবিষ্কার।”

”সেঞ্চুরি করা সোজা ব্যাপার নয় হরিশঙ্করবাবু, সেজন্য প্রেরণা চাই…চাই জনগণের শুভেচ্ছা। সতুবাবুর সেঞ্চুরির পিছনে আছে জনগণকে সঠিক পথ দেখাবার ইচ্ছা।”

”তাহলেই সেঞ্চুরি করা যাবে?” জজসাহেব কৌতূহলী হয়ে উঠলেন।

”নিশ্চয় যাবে। বকদিঘি থেকে রটনা হচ্ছে, লাঞ্চে রসগোল্লা খেতে না পেরে সতুবাবু নাকি সেই রাগে বেধড়ক ব্যাট চালিয়ে সেঞ্চুরি করেছেন…..এটা কি একটা যুক্তি হল?”

”রাগটা নিশ্চয় খুব মহান ছিল!” তির্যক মন্তব্য করলেন হরিশঙ্কর।

”খিদের চোটে মানুষ অবশ্য অনেক কিছু অবিশ্বাস্য কাজ করে ফেলে।” সম্পাদক টীকা যোগ করলেন।

”পৃথিবীতে বিপ্লবের জন্মই তো খিদে থেকে।” পটল হালদারের কণ্ঠ থেকে দৃপ্ত শব্দগুলি বেরিয়ে আসতে না আসতেই দরজার কাছ থেকে কাতর স্বর ভেসে এল, ”পটলদা!”

সবাই চমকে উঠে দেখল চারটি লোক বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে। তাদের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে আর—একটি ভীত মুখ। পটল হালদার হাত তুলে তাদের অপেক্ষা করতে বলল।

”বাবা, তুমি ডাকছ আমায়?” জড়োসড়ো সত্যশেখরের ক্ষীণ স্বর ঘরে ভেসে এল।

”এখানে এসো।” সিংহ—গর্জনে আহ্বান গেল।

মেঝেয় চোখ রেখে সত্যশেখর এগিয়ে এল রাজশেখরের সামনে। তার পিছনে কলাবতী এবং মলয়া।

”জজসাহেবকে জিভ দেখিয়েছিলে আর্গু করার সময়?”

সত্যশেখর মাথা হেঁট করে রইল। রাজশেখর কড়া চোখে মলয়ার দিকে তাকালেন। ”সঙ্গে ক্যামেরা এনেছ নাকি?”

বিভ্রান্ত মলয়া মাথা নেড়ে বলল, ”না তো!”

”জজসাহেবকে প্যাঁচামুখে বলেছ?”

চমকে পটল হালদারের দিকে তাকাল সত্যশেখর।

পটল কুঁকড়ে গেল। পাংশু মুখটা ফিরিয়ে সে দরজায় দাঁড়ানো চারজনের দিকে অসহায় চোখ রাখল।

”হ্যাঁ।” সত্যশেখর ঢোঁক গিলে কাঁদোকাঁদো মুখে জজসাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল।

রাজশেখর গর্বভরে হরিশঙ্করের দিকে এমনভাবে ভ্রূ তুললেন যেন বলতে চান, একেই বলে সিংহ।

”কিন্তু জজসাহেবের মোটেই প্যাঁচার মতো মুখ নয়। এখনও ওনাকে বাংলা ফিল্মের নায়কের ভূমিকায় নামানো যায়। তোমার অবজার্ভেশন যে এত খারাপ, আমি জানতুম না। কী করে যে আইন নিয়ে….যাক গে, জজসাহেব, আপনি যা শাস্তি দিতে চান দিন।”

জজসাহেব বিমূঢ় হয়ে আমতা—আমতা শুরু করলেন। ব্যাপারটা যে এই পর্যায়ে আসবে বুঝতে পারেননি। রুমালে ঘনঘন মুখ মুছতে লাগলেন।

গলা খাঁকারি দিয়ে হরিশঙ্কর বললেন, ”শাস্তি কেন? এই সত্যবাদিতার জন্য সত্যশেখরকে তো তারিফ করা উচিত।”

”ঠিক, ঠিক।” জজসাহেব যেন অকূলে কূল পেলেন। ”শাস্তি নয়, বরং অভিনন্দন জানানোই ভালো।”

”মানপত্র দেওয়া যেতে পারে।” পটল হালদারের মুখে স্বাভাবিক রঙ ও কণ্ঠস্বরের উদ্দীপনা ফিরে এসেছে।

”আটঘরা—বকদিঘি বাৎসরিক ক্রিকেট ম্যাচ এতবছর ধরে চলছে। কিন্তু সত্যশেখর ছাড়া কেউই আজ পর্যন্ত সেঞ্চুরি করতে পারেনি।” হরিশঙ্কর যেন বকদিঘির নয়, আটঘরার লোক, এমনভাবে কথাগুলো বললেন। ”আমার মনে হয় এই প্রথম এবং একমাত্র কৃতিত্বকে যথার্থ সম্মান দেওয়া হবে যদি আটঘরার আবিষ্কার ফুলকপির বরফি দিয়ে প্রথম সেঞ্চুরি করার সুযোগটাও সত্যশেখরকে দেওয়া হয়। এই সুস্বাদু আবিষ্কারের জন্য ব্যাপক পাবলিসিটিও তো দরকার।” সম্পাদকের দিকে তাকিয়ে হরিশঙ্কর মাথা দোলালেন। সম্পাদকের মাথাও দুলে উঠল সায় দিয়ে, ”নিশ্চয় নিশ্চয়, স্পেশাল স্টোরি করা উচিত।”

”আমাদের কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে।” দরজার কাছ থেকে কথাগুলো ভেসে এল।

”পাক। আর—একটা সংগ্রাম সামনে, আটঘরার আবিষ্কারের উদ্বোধন—ভক্ষণ হবে সেঞ্চুরি দিয়ে আর সতুবাবুর থেকে সুযোগ্য কেই বা আছেন এই কাজের জন্য? ….উফফ, দু’দুটো স্তম্ভ গড়তে হবে…স্যার, আপনাকে কিন্তু দুটোরই…না না, কোনো আপত্তি শুনব না।”

সত্যশেখর বলল, ”বাবা, এসব খাওয়া কি উচিত হবে? ডায়াট চার্টে তো বরফি নেই!”

রাজশেখর একটু ভেবে গম্ভীর হয়ে বললেন, ”আটঘরা বা সিংগিবাড়িরই নয়, তোমার নিজের সম্মানও বিপন্ন। জিভ দেখিয়ে, প্যাঁচামুখো বলে যে গোলমাল পাকিয়েছ, তাতে সেঞ্চুরি না করলে…” হরিশঙ্করের দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করলেন, ”মুখ দেখানো যাবে না।”

”আমি কি বরফি এখানেই আনতে বলব?” গোপী ঘোষ জজসাহেবকেই প্রশ্ন করলেন।

”তাই বলুন।”

চিরেতা, ত্রিফলা, থানকুনি হল গিয়ে নেট প্র্যাকটিস

সত্যশেখরের মুখ ইতোমধ্যে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। শুধু তাই নয়, একটু ঔজ্জ্বল্যও যেন ফুটে উঠেছে। ঘাড় ফিরিয়ে কলাবতীর দিকে তাকাল, তারপর মলয়ার দিকে। তখন জিভটা ঠোঁটের বাইরে একটু বেরিয়ে এসেছিল। জজসাহেব সেটা লক্ষ করে গম্ভীর হলেন।

”পটলদা, উনি একা—একা সেঞ্চুরি করবেন কী করে?” হরিশ মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করল। ”বল করবে কে? ফিল্ড করবে কে? নো—বল কিংবা ওয়াইড হলে ডাকবে কে? অন্তত জনাচারেক যদি মাঠে না থাকে…।”

”ঠিক কথা, তোমরাও তাহলে সতুর সঙ্গে নেমে পড়ো।” রাজশেখর চারজনকে ঘরের মধ্যে আসার জন্য হাত নাড়লেন।

”ব্যাট তো দুজনে করবে, তাহলে আর একজন….?” জজসাহেব সারা ঘরে চোখ বোলালেন।

”আমি হব কাকার পার্টনার।” কলাবতী এগিয়ে এল।

”আসল লোককেই ঠিক করা হল না, স্কোরার, গুনবে কে?”

মিনিট কয়েক বাদানুবাদ চলল। অবশেষে মলয়া বলল, ”আমি স্কোরার হব। স্কুলে অঙ্কের টিচার না এলে আমিই ক্লাস নিই, যোগ—বিয়োগে কোনো অসুবিধা হয় না। অবশ্য কেউ যদি আপত্তি তোলেন…।” মলয়া কথা শেষ করল সত্যশেখরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে।

মলয়াই স্কোরার নিযুক্ত হল পটল হালদারের আপত্তি সত্ত্বেও, কেননা জজসাহেব বা সম্পাদক ছাড়া রাজশেখরও মলয়ার পক্ষে সায় দেন।

কলাবতী ফিসফিস করে বলল, ”কাকা, বড়দিকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে।”

সত্যশেখর একটু গলা চড়িয়ে বলল, ”সিংগিদের জব্দ করার ব্যবস্থা হলেই কেউ কেউ সুন্দর হয়ে যায় মজা দেখব বলে। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা দেখতে দেব না।”

হঠাৎ সারা ঘরে একটা হালকা কিম্ভূত ধরনের দুর্গন্ধের সঞ্চার হল। গোপী ঘোষ ঘরে ঢুকলেন, তার পিছনে দুটি লোকের কাঁধে ট্রে ভর্তি বরফি। ট্রে দুটি তারা টেবলে রেখে চলে গেল। সারা ঘরের চোখ ট্রের উপর।

”গন্ধ কীসের?” জজসাহেব রুমাল দিয়ে নাক মুছলেন।

”আজ্ঞে, গোলাপজলের।” গোপী ঘোষ একগাল হাসলেন।

”উঁহু।” সম্পাদক পকেট থেকে রুমাল বার করলেন। ”শুধু গোলাপজল নয়, আরও কিছু যেন….বলুন তো কীসের?” প্রশ্নটা জজসাহেবকে।

”বোকা পাঁঠার।”

”তাই কি?” সম্পাদক পতু মুখুজ্যের দিকে তাকালেন।

”মনে হচ্ছে গোবর—পচানো সারের।”

পটল নড়ে—চড়ে বসল। ডান হাতের মুঠি এক গজ উপর থেকে নামিয়ে বাম তালুতে সশব্দে রাখল। ”এসব অপপ্রচার। আমি তো গোলাপজলের ছাড়া অন্য কোনো গন্ধ পাচ্ছি না।”

”কিন্তু জজসাহেব পেয়েছেন।” পতু হুঙ্কার দিল। পটলের মুখ শুকিয়ে গেল।

”বোধহয় একটু ভেপসে গন্ধ হয়েছে।” গোপী ঘোষ কাঁচুমাচু হয়ে জানালেন।

”আমি দেখেছি, কেউ খাচ্ছিল না….সবাই পাতে ফেলে রাখছিল।” চণ্ডী কম্পাউন্ডার একটা গূঢ় রহস্য ফাঁস করার মতো ফিসফিস স্বরে বলল।

”চঅন…ডী।” পটল হালদার দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধ সংবরণ করল। ”মনে রাখিস, তুই আটঘরার লোক….এটা আটঘরার আবিষ্কার।”

চণ্ডীর ফ্যাকাসে মুখে ভয় ছড়িয়ে গেল। বিভ্রান্তের মতো বলল, ”আমি তো….আমি তো বলিনি বরফি খাচ্ছিল না। নিশ্চয় খেয়েছে, আলবাত খেয়েছে।”

হরিশঙ্কর মুচকি হেসে বললেন, ”চণ্ডী হয়তো ভুল দেখেছে। আলবাত খেয়েছে, রাজু তো বলল রান্না এক জিনিস আর খাওয়া আর—এক জিনিস। রান্নার পর্ব তো হয়েই গেছে, এবার খাওয়ার পর্ব আমরা দেখব। সবাই তো শুনেছেনই রাজু বলছে এটা আবিষ্কার, এডিটোরিয়াল লেখার সাবজেক্ট! ভালো কথা। খাওয়ার ব্যাপারটা নাকি সিংগিরাই ভালো বোঝে! হবেও বা। এখুনি তা প্রমাণ হয়ে যাবে।”

কথাটা কীভাবে যেন ছড়িয়ে পড়েছিল। দরজার কাছে ভিড়, ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেছে। জানালা ভরে গেছে উঁকি—দেওয়া মুখে। যারা পরিবেশন করছিল, তাদের কয়েকজনকে ভিড়ের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। দুলু দু’হাত ছড়িয়ে ভিড় ঠেলতে—ঠেলতে বলল, ”আপনারা কেউ ঘরের মধ্যে ঢুকবেন না, তাহলে কনসেন্ট্রেশন নষ্ট হয়ে যাবে।”

দুলুর বন্ধু ইতোমধ্যে কয়েকটা ছবি তুলে ফেলেছে। টেবলের ধারে কলাবতী আর সত্যশেখর দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে কথা বলছে।

”কাকা, পারবে তো?”

ঠোঁট বেঁকিয়ে সত্যশেখর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। ”কালমেঘের থেকেও খারাপ লাগবে কি? গ্যাঁদাল পাতা, ব্রাহ্মী শাক, চিরেতা, ত্রিফলা, থানকুনি…এই সব হল গিয়ে নেট প্র্যাকটিস। তুই শুধু মেডেন ওভার দিয়ে যাবি আর নজর রাখবি মলয়ার দিকে, মনে হচ্ছে স্কোরে গোলমাল করবে।”

”সাইলেন্স….সাইলেন্স।” জজসাহেবের প্রচণ্ড স্বর গমগম করে উঠতেই ঘরটা স্তব্ধ হয়ে গেল। ”হরিশঙ্করবাবুকে অনুরোধ করছি, এই ভক্ষণ—ম্যাচের রুলস সম্পর্কে আমাদের অবহিত করতে।”

”খুবই সরল আইন।” হরিশঙ্করকে সিরিয়াস হতে দেখা গেল। ”বকদিঘির বিষ্টু মিশিরজি ছ’টা বরফি তুলে দেবে আটঘরার সত্যশেখরের হাতে। হরিশ দেখবে বরফিগুলো আস্ত না ভাঙা, ঠিকমতো মুখের মধ্যে গেল কি না, বা মুখ থেকে ফেলে দেওয়া হল কি না, খেতে অযথা দেরি করা হচ্ছে কি না। মলয়া গুনবে কটা খাওয়া হল। সময় রাখবেন গোপীবাবু। জলপান—বিরতির ব্যাপারটা খুবই ভাইটাল। সারা দিনে তিনবার মাঠে জল আসে, তাছাড়া লাঞ্চ অ্যান্ড টি আছে। এখানে তাই পাঁচবার জল দেওয়া যাবে আর দশ মিনিট আর পাঁচ মিনিটের দুটো ব্রেক। মিশিরজির পর পতু বরফি দেবে কালুকে। মানে কলাবতীকে।” ঘরের সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে হরিশঙ্কর অনুমোদন প্রত্যাশা করলেন। অনেকেই মাথা নাড়িয়ে তাঁকে সমর্থন জানাল।

”এখানে কি আউট নেই?” জানলার বাইরে থেকে অজানা কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন এল।

”নিশ্চয় আছে। এদের মধ্যে কেউ খাওয়ায় নিবৃত্ত হলে আটঘরার অন্য কেউ নামবে। এই তো চণ্ডী রয়েছে, পটলবাবু রয়েছেন….।” হরিশঙ্করের আঙুল পটল হালদারের দিকে উঁচিয়ে রইল।

”অ্যাঁ! আআআ…মি!” পটল হালদার বরফির স্তূপের দিকে সভয়ে তাকিয়ে বলল। ”আমি তো ক্রিকেট কখনও খেলিনি।”

”খেলেননি ঠিক কথা। কিন্তু কখনও কি কিছু খাননি…..ভাত ডাল তরকারি মাছ এইসব?” জজসাহেব তার বিপুল গোঁফের ভেতর থেকে একটা মুচকি হাসি বার করলেন।

”তা খেয়েছি। কিন্তু তাতে তো এমন গন্ধ…মানে এটা নতুন জিনিস তো, সমিতির নির্দেশ না পেলে….”

”পটলদা, এটা সংগ্রাম, ঝাঁপিয়ে পড়ো।” চণ্ডীর আবেদন পটল হালদারকে বিচলিত করার আগেই রাজশেখর জলদকণ্ঠে বললেন, ”থাক, আমি তো আছি।”

চণ্ডী বিড়বিড় করল। শোনার জন্য বিষ্টু মিশির গলা বাড়িয়ে দিল।

”অ্যাঁ। কী বললি? দুর্গন্ধ? এমন আবিষ্কার কি কেউ বিয়েবাড়িতে খাইয়ে বউনি করে?”

”গোলাপজল ঢেলে গন্ধ চাপতে গিয়েই কেস খারাপ করে ফেলেছে। ওদিকে পাতে এতক্ষণ বিরিয়ানি নিশ্চয় এসে গেছে। ব্যাচটা উঠলেই বসে পড়ব।”

”আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাস ভাই।”

মেলবোর্ন টাই—টেস্টের মতো এক্সাইটিং

হঠাৎ নির্ঘোষ শোনা গেল হরিশের গলায়, ”প্লে”।

নাক কুঁচকে বিষ্টু গুনে গুনে ছ’টা বরফি ট্রে থেকে তুলে বাড়িয়ে ধরল। সত্যশেখর ছ’টাই খপ করে তুলে নিয়ে মুখে পুরে কোঁত করে গিলে ফেলল। সবিস্ময়ে হর্ষধ্বনি উঠল দরজায়, জানলায়।

”ছক্কা, প্রথমে ওভারেই ছক্কা!”

”জনগণ আপনার সাথে আছে; সতুবাবু, চালিয়ে যান।” পটল হালদার প্রবল উদ্দীপনায় তার পাশের ঊরুতে চাপড় মারল।

”আবার আপনি…”

”আর হবে না, স্যার….কিন্তু আপনাকে আমি আটঘরায় নিয়ে যাবই।”

কলাবতী অবাক হয়ে কাকার মুখের দিকে তাকিয়ে। সত্যশেখর তাচ্ছিল্যের ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ”বাটা নিমপাতা এর থেকেও কুইক গিলতে পারি।”

এবার পতু মুখুজ্যের পালা। মুখবিকৃতি করে সে ছ’টা বরফি তুলল। কলাবতী প্রত্যেকটা থেকে সামান্য ভেঙে মুখে দিয়ে হাত নেড়ে জানাল আর খাবে না।

”মেডেন দিল। খুব চালাক মেয়ে তো!” সম্পাদক ফিসফিস করে জজসাহেবকে বললেন। হরিশঙ্করের মুখে মৃদু হাসি ভেসে বেড়াচ্ছে। আপনমনে বললেন, ”দেখা যাক।”

সাত মিনিট পর দেখা গেল সত্যশেখর সাতটি ওভার বাউন্ডারি এবং একটি বাউন্ডারি গিলে হাফ সেঞ্চুরির দরজায় পৌঁছে গেছে। স্টাইল দেখাতে ছুঁড়ে মুখের মধ্যে পাঠাতে গিয়ে দুটো বরফি ঠোঁটে লেগে মাটিতে পড়ে না গেলে সে আটচল্লিশে পৌঁছে যেত। কলাবতী এখনও স্কোর করেনি।

”দারুণ চালাচ্ছে তো আপনার ছেলে।” জজসাহেব ঝুঁকে রাজশেখরকে বললেন। ”মনে হচ্ছে সেঞ্চুরি করবে।”

”মনে হচ্ছে মানে?” পটল হালদার সোফা থেকে এক বিঘত উঠে দুই মুঠো ঝাঁকিয়ে বলল, ”দুটো স্তম্ভের আবরণ আপনাকে উন্মোচন করতে হবে। ….সতুবাবু, এগিয়ে চলুন।”

স্কোর পঞ্চাশ পার হতেই তুমুল হাততালির কোলাহলের এবং ঘনঘন ক্যামেরার আলোর ঝলসানির মাঝে বাইরে শোনা গেল : ‘ওরে, বরকে ছাঁদনাতলায় নিয়ে আয়!”

”গোপীবাবুকে তো এবার যেতে হবে।” সম্পাদক বললেন। বাইরে সানাই বেজে উঠল।

”অসম্ভব! আটঘরার প্রেস্টিজ এখন কঠিন সঙ্কটে।”

চণ্ডী ফিসফিস করল, ”হ্যাঁ রে, মনে হল ওদিকে যেন পান আনতে বলল। এবার তো রেডি হতে হয়।”

বিষ্টু ঝুঁকে হরিশের কানে কানে বলল, ”নতুন ব্যাচ বসবে, তাড়াতাড়ি শেষ করে না দিলে…”

হরিশ বলল, ”তিনটে তিনটে দিয়ে ওভার করুন….আর পতু মুখুজ্যে যেন টের না পায়।”

কলাবতী তার কাকাকে তখন বলল, ”স্কোরিং রেট খুব ফাস্ট হচ্ছে, এবার গোটাকতক মেডেন দাও।”

”উঁহু, তাহলে ওরা মাথায় চড়ে বসবে।” এই বলে সত্যশেখর তার জিভ ইঞ্চি তিনেক বার করে মলয়ার দিকে ঘুরে তাকাল। মলয়ার চোখ কটমট হয়ে উঠতেই জজসাহেব স্মিত হেসে বললেন, ”পারমিসিবল, ফিফটি হয়ে গেছে তো; তবে সেঞ্চুরির পর উনি আর একবার মাত্র দেখাতে পারবেন।”

এরপর প্রবল উত্তেজনা আর চিৎকারের মধ্য দিয়ে স্কোর ষাট থেকে সত্তরের কোঠায় উঠল। সত্যশেখরকে অবশ্য এর মধ্যে কয়েকবার বিস্মিত হয়ে বিষ্টুর দিকে তাকাতে দেখা গেছল।

ছিয়াত্তর থেকে বিরাশিতে পৌঁছতেই সম্পাদক বলে উঠলেন, ”উফফ, এ যে মেলবোর্ন টাই—টেস্টের মতো এক্সাইটিং লাগছে।”

রাজশেখর আড়চোখে হরিশঙ্করের দিকে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিলেন। হরিশঙ্করের গম্ভীর মুখ আরও গম্ভীর হল।

নিরানব্বুই! পটল হালদার দু’হাত বাড়িয়ে সত্যশেখরের দিকে ছুটে যাচ্ছিল। জজসাহেব তার কাছা টেনে ধরলেন।

”এখনও শেষ হয়নি, একটা বাকি রয়েছে যে!”

পটল হালদার সোফায় ফিরে এল কাছাটা জজসাহেবের মুঠো থেকে ছাড়াতে না পেরে।

”আপনি যাবেন তো, জোড়া স্তম্ভ…”

”যাব যাব, সুস্থির হয়ে বসুন তো।”

পতু মুখুজ্যে খুঁতখুঁতে গলায় হরিশ কর্মকারকে বলল, ”ঠিকমতো দেখেছ তো? ষাট থেকে স্কোরটা বড্ড ফাস্ট উঠল যেন!”

”উঠবেই তো, চোখ….মানে স্টমাকটা সেট হয়ে গেছে তো।”

নিরানব্বুই!

জজসাহেব রুমালে কপাল মুছলেন, ঠোঁট চাটলেন। সম্পাদক হাতছানি দিয়ে দুলুর বন্ধুকে ডেকে বললেন, ”সেঞ্চুরি করছে….সবে মুখের মধ্যে দিয়েছে, এমন একটা ছবি চাই, এক্সক্লুসিভ।”

সত্যশেখর একটা বরফি পতুর হাত থেকে তুলে কী ভেবে আর—একটা তুলল। পেটে হাত বুলিয়ে ঘরের চারপাশে তাকিয়ে হাসল। তারপর একসঙ্গে কপাত করে মুখে পুরে ঢোঁক গিলে বিরাট হাঁ করে মুখের মধ্যে পুরে ভিতরটা দেখাল। ক্যামেরার আলো ঝলসাল বারবার।

এরপর ঘরের মধ্যে কী হুলুস্থুলু কাণ্ড ঘটল তা বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

সর্বাগ্রে হরিশ, বিষ্টু আর চণ্ডী খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ভিড় ঠেলে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেছল। পটলের কাছা জজসাহেবকে দু’হাতে টেনে রাখতে হয়েছিল। সম্পাদক গোপী ঘোষকে আগামীকাল সকালে রেডি থাকতে বললেন, চিফ রিপোর্টার আসবে ইন্টারভ্যু করতে। পতু বারবার মলয়াকে জিজ্ঞাসা করেছিল ঠিকমতো গোনা হয়েছে কি না। রাজশেখরের চোখ দিয়ে শুধু কয়েক ফোঁটা জল ঝরেছিল। জজসাহেব রুমালটা এগিয়ে দিতে তিনি ধন্যবাদ জানিয়ে সেটি নিয়ে চোখ মোছেন, আর বলেন, ”আশা করি ওর জিভ বার করা মার্জনা করবেন।” জজসাহেব জিভ কেটে বললেন, ”কী যে বলেন। এত বড় গুণী আমি জানতাম না। নিশ্চয় জিভ দেখাবে…কিন্তু আপনি কি সিরিয়াসলি মনে করেন সিনেমায় নায়ক হওয়ার মতো…”

রাজশেখর ততক্ষণে হরিশঙ্করের দিকে তাকিয়ে হাসছেন।

”রাজু, তোর ছেলে পারল কী করে বল তো? সত্যি বলছি, এমন উৎকট গন্ধওলা জিনিস আমি জীবনে দেখিনি!”

”সিংগিবাড়ির ছেলে তো….বংশের মান রাখতে…”

”না না, ভুল বলছেন, আটঘরার জনগণের নিবিড় প্রেরণা….জনগণকে সঠিক পথ দেখাবার…”

.

বাড়ি ফেরার সময় রাজশেখর ট্র্যাফিকের লাল আলো দেখে গাড়ি থামাতেই কলাবতী বলল, ”দাদু, সেঞ্চুরির জন্য আমাদের কোনো উপহার দেবে না?”

”নিশ্চয় নিশ্চয়, কী চাই তোদের?”

পাশে একটা সবুজ অ্যাম্বাসাডার এসে থামল। রাজশেখর মুখ ফিরিয়ে তাকালেন।

”তোমার ডায়েট চার্ট এবার বন্ধ হোক।”

”অ্যাঁ! আমি তো ভাবছিলাম কাল থেকে চার্টে আরও কয়েকটা…”

”চার্ট বন্ধ না করলে কাল থেকে আমি আর কাকা অনশন শুরু…”

বলতে বলতে কলাবতী পিছনের সিটের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখল সত্যশেখর জিভ বার করেছে আর পাশের গাড়ির জানালা দিয়ে বড়দি গম্ভীর মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *