ননীদা নট আউট

ননীদা নট আউট – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস

ক্রিকেট সিজনের শুরুতেই সি সি এইচ—এর অর্থাৎ ক্রিকেট ক্লাব অফ হাটখোলার নেট পড়ে মহামেডান মাঠের পাশে, মেম্বার গ্যালারির পিছনে।

চার শরিকের মাঠ। সি সি এইচ দেয় বছরে চারশো টাকা। হেড মালী দুর্যোধন মহাপাত্র। পুজো শেষ হলেই মাঠের মাঝে একখণ্ড জায়গার চারকোণে বাঁশ পুঁতে দড়ি দিয়ে ঘিরে দেয়। জল ঢেলে আর কয়েকদিন রোলার টেনে ডলাই—মলাই করে, দুর্যোধন যখন সগর্বে ঘাসবিহীন পাথুরে পিচের দিকে হাত তুলে বলল, ‘কী একখানা পিচো বনাইছি দেখ ননীবাবু, লরি চালাই দাও কিছু হবেনি।”

তখন ননীদা গম্ভীর থেকে আরও গম্ভীর হয়ে উঠলেন। তারপর খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ”ক্রিকেট লরি—ড্রাইভারদের খেলা নয়, দুর্যোধন।”

”মো কি সে কথা বলিছি। গত বৎসর আপোনি বলিলেন, কড়া ইস্তিরি—করা শার্টের মতো পেলেন পিচ না হলি ব্যাটোসম্যান স্টোরোক করি খেলবি কেমনে? তাই এবছর ইস্তিরির মতো করি রোলার টানিছি।”

”ক্রিকেট ধোপাদেরও খেলা নয়, দুর্যোধন।”

দুর্যোধন একটু ঘাবড়ে গেল ননীদার আরও ঠাণ্ডা গলার স্বরে। ক্ষুণ্ণ হয়েই সে বলল, ”গত বৎসরের আগের বৎসরো বলিলেন, কী পিচ বনাইছিস, এ যে খেতি জমি, ধানো ছড়াই দিলি গাছো হই যিব।”

”ক্রিকেট চাষাদেরও খেলা নয়, দুর্যোধন।”

এবার দুর্যোধন ভ্রূ কুঁচকে বিরক্ত চোখে ননীদার ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ”কিরিকেট তবে কারা খেলে?”

”ভদ্রলোকেরা।” ননীদা আকাশবাণী ভবনের গম্বুজ থেকে শহিদ মিনারের ডগায় উদাস চাহনিটাকে সুইপ করে নিয়ে গেলেন। ”পিচ হবে স্পোর্টিং, বোলার আর ব্যাটসম্যানকে ফিফটি—ফিফটি সুযোগ দেবে।”

দুর্যোধনের বেঁটে শরীরটা জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো বেঁকে গেল একটা অদৃশ্য ভারী গদা তুলতে গিয়ে। দাঁত কিড়মিড় করে সে বলল, ”তংকা বাড়াও, ইডেন মতো মো পিচো বনাই দিব।”

”তারপর এই মাঠেই গ্যালারি বসিয়ে টেস্টখেলা হোক আর কী।” ননীদা শহিদ মিনারের গা বেয়ে সরসর করে চোখটাকে নামিয়ে এনে হা হা করে ছুটে গেলেন—”বাইরে দিয়ে, বাইরে দিয়ে। বাহারসে যাইয়ে।”

লোক দুটো থমকে গেল পিচের কিনারে এসে। পরস্পরের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ”কাহে বাহার সে যায়গা?”

”পূজা হোগা। হোম যজ্ঞকে লিয়ে এই স্থান সাফ কিয়া থা।” ননীদা সসম্ভ্রমে পিচের দিকে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ”ক্রিকেট দেওতা কা পূজা হোগা।” শুনেই ওরা অবনত মস্তকে পিচের উদ্দেশে করজোড়ে প্রণাম করে, মহমেডান মাঠের বেড়া ঘেঁষে হাইকোর্ট মাঠের দিকে চলে গেল, সম্ভবত চিড়িয়াখানা কি ভিকটোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকে।

এতক্ষণ আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ও শুনছিলাম। ননীদা কাছে আসতেই বললাম, ”এটা কী হল?”

”ট্যাকটিকস, কুইক আউট করে দিলুম। যদি বলতে—ইয়ে হ্যায় ক্রিকেট পিচ, ইসকা উপর সে হাঁটা মানা হ্যায়, তা হলে অনেক তর্ক, অনেক ঝামেলা শুরু হত। ব্যাটসম্যানকে সেটল করতে দেবার আগেই ফিরিয়ে দেবে। মনে রেখো মতি, এবছর তুমি সি সি এইচ—এর ক্যাপ্টেন। তোমাকে ট্যাক্টফুল হতে হবে।”

সবিনয়ে ঘাড় নেড়ে বললাম, ”নিশ্চয়। তা ছাড়া আপনি তো আছেনই, দরকার পড়লে পরামর্শ নিশ্চয় করব।” খুশি করার জন্য কথাগুলো বলিনি, বিপদে ননীদাকে সত্যিই দরকার হবে। ননীদার ট্যাকটিকস, যাকে আমরা ‘ননীটিকস’ নামে আড়ালে অভিহিত করি, কতবার যে সি সি এইচ—কে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে তা লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। তবে দু’চারটের কথা অবশ্যই উল্লেখ করব।

ননীদা গত বছর পর্যন্ত আমাদের ক্লাবের ক্যাপ্টেন ছিলেন। কত বছর ছিলেন সেটা আমার পক্ষে খাতাপত্তর না দেখে বলা শক্ত। সম্ভবত সিকি—শতাব্দী। বারো বছর মাত্র এই ক্লাবে আছি। তার মধ্যে ননীদাকে যে রূপে দেখেছি তা বোঝাতে হলে, প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি, ট্রেজারার, সিলেকটর, স্কোয়ার, মালী, সাবস্টিটিউট ফিল্ডার, ক্যাপ্টেন প্রভৃতিকে একত্রে একটি লোকের মধ্যে ভরে দিলে যা হয়, উনি তাই। ওঁর মুখের উপর কথা বলতে পারে বা ওঁর কথা অগ্রাহ্য করার সাহস দেখাতে পারে এমন কাউকে এখনও সি সি এইচ—এ দেখিনি। অনেককে গাঁইগুই করতে শুনেছি, কিন্তু আড়ালে। দুর্যোধনের পোষা নেড়িকুত্তাটা পর্যন্ত ননীদার গলার আওয়াজ পেলে লেজটাকে নামিয়ে সরে যায়। ননীদাকে এল বি ডবল্যু আউট দিয়ে এক আম্পায়ারকে দেখেছিলাম খেলা শেষে উইকেট থেকে তাঁবুতে না ফিরে হনহনিয়ে উলটোদিকে বঙ্গবাসী কলেজ—মাঠ পেরিয়ে একটা চলন্ত বাসে লাফ দিয়ে উঠে পড়তে।

ননীদার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ বারো বছর আগে সি সি এইচ—এর এই নেটে।

আমাদের পাড়ার বিশ্বনাথদা চুয়াল্লিশ সালে মোহনবাগানে ক্রিকেট খেলেছেন সেই বছর রঞ্জি ট্রফিতে বাংলা দলের পনেরোজনের মধ্যেও নাকি ছিলেন। আমরা ওঁকে খুব খাতির করি, বিশেষ করে আমি আর চিতু, অর্থাৎ চিত্তপ্রিয়। আমাদের দুজনের ইচ্ছে বিশ্বনাথদার সুপারিশে মোহনবাগানে ঢোকা, তারপর খেলা দেখিয়ে উন্নতি করা। উন্নতি বলতে টেস্ট খেলা।

বিশ্বনাথদাকে বলতেই তো চোখ পিটপিট করে বললেন, ”মোহনবাগানে?” আমাদের আপাদমস্তক বার চারেক দেখে আবার বললেন, ”খেলবি? বলিস কী! তোদের সাহস তো কম নয়!”

চিতুটা টেঁটিয়া ছেলে। ফস করে বলল, ”আপনি খেলেছেন, আমরা পারব না কেন?”

”দুখিরামবাবুর ডাইরেক্ট শিষ্য ফকিরবাবুর কাছে আমি তালিম নিয়ে তবেই মোহনবাগানে খেলার কথা চিন্তা করেছি। আর তোরা? এখনও রাস্তায় ক্যাম্বিসবল পেটাস, ঘাস চিনলি না গড়ের মাঠের, ফুলটস আর ইয়র্কারের প্রভেদ জানিস না, অথচ মোহনবাগানে খেলতে চাস। পিচের উপর একটা আধলা রেখে তার উপর বল ফেলতে পারতুম। কেন জানিস? এবেলা চারঘণ্টা ওবেলা চারঘণ্টা, নাগাড়ে আন্ডার দ্য ওয়াচফুল আইজ অফ ফকিরবাবু আমি বল করেছি নেটে। যখন আউট অফ হানড্রেড পঁচানব্বুইটা বল আধলায় ফেললুম তখন ফকিরবাবু বললেন, এবার তোকে রিজার্ভে আনব। এই রকম ব্যাপার ছিল আমাদের সময়। গুরু ছিল, কঠিন সাধনা ছিল। আর এখন?”

চিতু বলল, ”আমরাও সাধনা করতে রাজি যদি কেউ দেখিয়ে দেন একটু। আপনি দেবেন?”

”আমি!” বিশ্বনাথদা আকাশ থেকে পড়লেন, ”আমি অফিস ফেলে এখন ক্রিকেট শেখাব? বরং তোরা ননীর কাছে যা। আমার গুরুভাই, গুড কোচ, ক্রিকেট নিয়েই দিনরাত পড়ে আছে, ভেরি হার্ড টাস্কমাস্টার। আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি তাই নিয়ে দেখা কর। আগে ছোট ক্লাবে খেলে তারপর বড় ক্লাবে খেলতে হয়, বুঝেছিস।”

বিশ্বনাথদার চিঠি নিয়ে আমি আর চিতু এক দুপুরে গড়ের মাঠে ক্রিকেট ক্লাব অফ হাটখোলার তাঁবুতে হাজির হলাম। মাঠে চারটি ক্লাবের চারটি নেট পড়েছে। প্রতি নেটে গড়ে দশজন। চিতু বলল, ”কোনটা সি সি এইচ—এর হবে বল তো?”

আমি অত্যন্ত মনোযোগে চারটি নেট লক্ষ করে শেষে বললাম, ”ওই ডানদিকেরটা—যেখানে টাকমাথা, ঢলঢলে প্যান্টপরা, বেঁটে কালো লোকটা কথা বলছে, ওই বোধ হয় ননীদা।”

”কী করে বুঝলি?”

”প্যান্টটা দেখ, মনে হচ্ছে নাকি ওটা ফকিরবাবুর আমলের তৈরি? আর কেউ কি অমন প্যান্ট পরে এখানে আছে?”

চিতু সারা মাঠে চোখ বুলিয়ে বলল, ”চল তা হলে ওর কাছে।”

”আপনিই কি ননীবাবু?” চিতু কাছে গিয়ে খুব স্মার্টলি লোকটিকে বলল।

ব্যাট হাতে লোকটি তখন চশমাপরা রোগা ফরসা একটি ছেলেকে নেটের বাইরে থেকে বোঝাচ্ছিল কীভাবে ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলতে হয়। ছেলেটি তটস্থ হয়ে শুনছে। লোকটি বাধা পেয়ে বিরক্ত চোখে একবার চিতুর দিকে তাকাল মাত্র। ছেলেটিও তাকাল।

”লুক হিয়ার।” লোকটির বাজখাঁই কণ্ঠস্বরে ছেলেটির সঙ্গে আমিও চমকে উঠলাম। চিতু এক—পা পিছিয়ে এল।

”এই হচ্ছে স্টান্স।” লোকটি দেখাতে শুরু করল। ”লেফট শোলডার থাকবে এইভাবে, আমার পা লক্ষ করো, শরীরের ওজন সমানভাবে দুপায়ে চারিয়ে দিয়েছি, বোলারের দিকে মুখটা…ভাল কথা, তুমি লেফট—হ্যান্ডার না?”

”আজ্ঞে হ্যাঁ।” ছেলেটি ঢোঁক গিলে বলল।

”গুড, ভেরি গুড। আমি একটা লেফট—হ্যান্ডারই চাইছি। হ্যাঁ, তা হলে হবে রাইট শোলডার। বোলার বল করতে আসছে…এখন ডেলিভারি স্টাইলে, দ্যাখো ভাল করে দ্যাখো…এইভাবে ব্যাট উঠছে, ব্যাক লিফট কমপ্লিট…তারপর কী করবে?”

”ফরোয়ার্ড খেলব।” ছেলেটি প্রবল উৎসাহে চটপট বলল।

লোকটি সেকেন্ড পনেরো ওর মুখের দিকে ঠায় তাকিয়ে রইল, যেন চাঁদের নুড়ি দেখছে। তারপর ধীরস্বরে বলল, ”গবেট।” ছেলেটির ফরসা মুখ লাল হয়ে উঠল।

”আমি কি বলেছি বলের ডেলিভারি হয়েছে? বল এখন তো বোলারের হাতে। উইকেটের পেস কেমন, বাউন্স কেমন তাই জান না, আর আগে থেকেই বলে দিলে ফরোয়ার্ড খেলব?”

”আপনি ফরোয়ার্ড কীভাবে খেলতে হয় শেখাচ্ছেন তো, তাই বললুম।” ছেলেটি প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল। লোকটি আবার সেকেন্ড পনেরো তাকিয়ে থেকে বলল, ”বলটা শর্ট পিচ কি ওভার পিচ, স্টাম্পের মধ্যে না বাইরে, কতটা সুইং বা কতটা স্পিন, এসব না দেখেই ফরোয়ার্ড খেলবে?”

ছেলেটির ভ্যাবাচাকা মুখ দেখে চিতু হাসি সামলাতে পারল না। লোকটি সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতের তর্জনীটি চিতুকে লক্ষ্য করে বাঁকিয়ে ঘুড়িতে টুঙ্কি দেবার মতো তিনবার নেড়ে বলল, ”কাম হিয়ার!”

চিতু খুব স্মার্ট ছেলে। সঙ্গে সঙ্গে সে বিশ্বনাথদার চিঠিটা এগিয়ে ধরল। ”আপনিই যে ননীবাবু, তা দেখেই বুঝে গেছি।”

”বটে”, লোকটি চিঠিটা পড়তে পড়তে বলল, ”বুঝে গেছ?”

”আমি নয়, মতিই আপনাকে চিনেছে ঢোলা প্যান্টটা দেখে।”

ননীদা সেকেন্ড দশেক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কেমন ভয়—ভয় অস্বস্তি শুরু হল আমার, চিতুটার উপর রাগও ধরল। ফোঁপরদালালি করে এত কথা বলার কী দরকার! ননীদা কিছু বলার জন্য ঠোঁট ফাঁক করেছেন, চিতু অমনি বলল, ”আমার নাম চিত্তপ্রিয়, আই অ্যাম এ লেফট—হ্যান্ডার।”

ননীদার খোলা ঠোঁট দুটি একটা ফাস্ট ইয়র্কারকে সামাল দেবার মতো ঝটিতি বন্ধ হয়ে গেল।

”অ্যান্ড অ্যান ওপেনিং ব্যাট লাইক নরি কন্ট্রাক্টর।” চিতু বুক চিতিয়ে বলল। কন্ট্রাক্টর তখন দারুণ খেলছে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আগের বছরই একটা সেঞ্চুরি করেছে টেস্টে।

”তোমার লোয়েস্ট রান কত?”

চিতু একটু থতমত হলেও বেশ দ্রুতই বলল, ”ঠিক মনে পড়ছে না, তবে দশের কম নয়।”

”কটা জিরো করেছ?”

”একটাও না।”

লক্ষ করলাম ননীদার ঠোঁট দুটো এবার ফুলটস দেখে ব্যাট তোলার মতো খুলতে শুরু করল এবং সপাটে পুল করল—”তার মানে এখনও খেলাই শেখোনি।”

অবধারিত বাউন্ডারি, সুতরাং রানের জন্য দৌড়বার দরকার নেই, এইরকম ভঙ্গিতে ননীদা চিতুর দিকে পিছন ফিরলেন এবং এতক্ষণ অপেক্ষমাণ ছাত্রটিকে উদ্দেশ করে বললেন, ”ব্যাট যখন ওপর থেকে নামবে একদম পারপেন্ডিকুলার, স্ট্রেট নামবে। এসো দেখাচ্ছি।”

নেটের মধ্যে ননীদা যখন একটা বল গুড লেংথ বরাবর পিচের উপর রেখে ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলার মহড়া দিচ্ছিলেন, তখন চিতুকে বললাম, ”এখানে পেঁয়াজি করিসনি, লোকটা কড়া আর খেলাও বোঝে।” চিতু তাচ্ছিল্যভরে কাঁধ ঝাঁকাল।

ননীদা নেট থেকে বেরোলেন। তাঁবুর লোহার ফেন্সিংয়ের ধারে একটা জায়গার দিকে আঙুল দেখিয়ে ছাত্রটিকে বললেন, ”ওখানে গিয়ে যেমনটি দেখালুম, ঠিক সেইভাবে ফরোয়াড ডিফেন্সিভের শ্যাডো প্র্যাকটিস করো পঞ্চাশবার, যাও।” তারপর চিতুর দিকে ফিরে বললেন, ”ইয়েস মিস্টার নরি কন্ট্রাক্টর, প্যাড অন।”

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ”তোমার নাম মতি, ফাস্ট বল করো?”

”আজ্ঞে হ্যাঁ।” এবং নিমেষে লিন্ডওয়ালকে হুক করার জন্য প্রয়োজনীয় ফুটওয়ার্কের দ্রুততার যোগ করলাম, ”মানে চেষ্টা করি।”

”দেখি কেমন চেষ্টা করো। যাও কন্ট্রাক্টরকে বল করো।”

এইবার আমার উভয়—সংকট। চিতু আমার বলে সুবিধা করতে পারে না, বিশেষ করে শর্টলেংথগুলো। যদি তেড়ে বল করি তা হলে ননীদার সামনে চিতুর অবস্থা কাহিল হয়ে পড়বে। হয়তো সি সি এইচ—এ ওকে নেবেই না। আবার আমি যদি চিতুর মুখ চেয়ে ঢিলে বল করি, তা হলে আমাকেই হয়তো আউট হতে হবে। মাঝামাঝি পথ নিলাম। যত জোরে পারি উইকেটের বাইরে দিয়ে বল করতে লাগলাম। বলের পেস কেমন ননীদা সেটুকু বুঝলেই হল।

নেটের পিচ খুবই খারাপ। কয়েকটা বল বিশ্রীভাবে লাফিয়ে উঠল, শুট করল। চিতু ডাইনে—বাঁয়ে গাঁইতির মতো ব্যাট চালাল। যেগুলো ব্যাটে—বলে হল তার বেশির ভাগই ব্যাটের কানায় লেগে স্লিপ বা উকেটকিপারের (যদিও নেটে কেউ ছিল না) মাথার উপর দিয়ে নেট টপকে গিয়ে মহমেডান মাঠের বেড়ায় ঠকাস ঠকাস শব্দ করল।

আড়চোখে ননীদার দিকে তাকালাম। দেখি, একদৃষ্টে তিনি নভেম্বর আকাশের শোভা নিরীক্ষণ করছেন। নেটের মধ্যে কী হচ্ছে না—হচ্ছে সে সম্পর্কে উদাসীন। ফ্রেন্সিং—এর ধারে ননীদার ছাত্রটি সমানে টিউবওয়েল হ্যান্ডেল টেপার মতো ব্যাট হাতে সামনে ঝুঁকে ওঠানামা করে যাচ্ছিল। পাম্প করা থামিয়ে এখন সে ফ্যালফেলিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে। ননীদা তাঁর দৃষ্টি আকাশ থেকে আকাশবাণী ভবনের চূড়া এবং তারপর ইডেনের প্রেসবক্স হয়ে মোহনবাগান মাঠের সবুজ গ্যালারির উপর রেখে বাজখাঁই গলায় বললেন, ”কটা হল?”

বোলিং মার্কে ফিরে যাচ্ছিলাম। থমকে বললাম, ”গুনিনি তো!”

ননীদা আর একটু গলা চড়িয়ে বললেন, ”পঞ্চাশটা হয়েছে?”

সঙ্গে সঙ্গে ফেন্সিং—এর ধারে দ্রুত টিউবওয়েল পাম্প শুরু হল। ননীদার আঙুলের তিনটি টুঙ্কিতে চিতু নেট থেকে বেরিয়ে এল।

”উই ডোন্ট প্লে ফর ফান। ক্রিকেট একটা আর্ট, আয়ত্ত করতে সাধনা লাগে। দু’রকমের ক্রিকেটার হয়, একদল ব্যাটকে কোদাল ভাবে, বাকিরা ভাবে সেতার। একদল কুলি, অন্যরা আর্টিস্ট।”

”পিচ যদি কোদাল চালাবার মতো হয় তা হলে ব্যাটকে কোদালই করতে হয়।” প্যাড খুলতে খুলতে চিতু বলল।

ননীদার মুখ থমথমে হয়ে গেল। আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, ”উইকেট—সোজা বল করবে আর লেংথে বল ফেলবে, কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখো, লেংথ আর ডিরেকশন। এ দুটোয় কমান্ড আনতে না পারলে বোলার হতে পারবে না। শুধু তখনই এই দুটো জিনিস ভুলবে যখন কুলিরা ব্যাট করবে। সোজা মাথা টিপ করে তখন বল ছাড়বে। তুমি কাল থেকে নেটে আসবে রেগুলার। আর, ওহে কন্ট্রাক্টর, তুমি অন্য ক্লাব দেখতে পারো।”

ননীদা কথা শেষ করেই তাঁবুর দিকে হনহনিয়ে চলে গেলেন। চিতুর জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেল এক যাত্রায় পৃথক ফল হওয়াতে। অপমানে চিতুর মুখটা তখনও বেগুনি হয়ে আছে। ওকে বললাম, ”চল বরং অন্য ক্লাব দেখি আমরা। ঢের ঢের ক্লাব আছে গড়ের মাঠে।”

চিতু গোঁজ হয়ে রইল। ননীদার ছাত্রটি চুপ করে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। চশমার কাচ রুমালে মুছতে মুছতে বলল, ”প্রথম দিন আমায় বলেছিলেন বছর তিনেক দুর্যোধনের সঙ্গে পিচে জল দেওয়ার কাজ করতে। তাতে যদি ক্রিকেট সম্পর্কে কিছু জ্ঞান হয়।”

”তারপর পাঁচ বছর রোলার টানার কাজ!” চিতু তিক্তস্বরে মন্তব্য করল। ওকে সান্ত্বনা দেবার জন্য আমিও খুব বিরক্তিপূর্ণ ভঙ্গিতে বললাম, ”এই রকম একটা পাগলের কাছে আসতে হবে জানলে, কে আর আসত। ভাবা যায়, ব্যাট নিয়ে পঞ্চাশবার করে করে ওঠানামা করা?”

”কাল ব্যাক লিফট শিখেছি, গুনে একশোবার ব্যাট তুলতে হয়েছে আর নামাতে হয়েছে।”

”বলেন কী!” আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। ”এরপর ড্রাইভ, হুক, কাট, পুল এসবও কি পঞ্চাশবার একশোবার ওইভাবে করতে হবে?”

শিউরে উঠে ছেলেটি বলল, ”না, না, তারও আগে ফিলডিং শিখতে হবে বলেছে। কমপ্লিট ক্রিকেটার তা না হলে হওয়া যায় না। দু’শো থ্রো আর দু’শো ক্যাচ লোফা, রো—ও—জ।”

”রানিং বিটুইন দ্য উইকেট?” আমি ওকে পাওয়াবার জন্য বললাম। ”প্যাড পরে ব্যাট হাতে একশোবার ছোটাছুটি করতে হবে না?”

চিতু এবার বিরক্ত স্বরে বলল, ”বাজে কথা রাখ তো, এভাবে উজবুকেরাই খেলা শেখে।”

এরপর চিতু আমাকে ফেলেই রেড রোড অভিমুখে চলে গেল। পরদিনই সি সি এইচ—এর চির প্রতিদ্বন্দ্বী রূপোলি সঙ্ঘের সম্পাদকের সঙ্গে সে দেখা করল। আমি কিন্তু হাটখোলাতেই রয়ে গেলাম। ননীদার ছাত্রটির সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গেল। ওর নাম অঞ্জন কর। বড়লোকের ছেলে। ক্রিকেটের বই অনেক পড়েছে। ব্র্যাডম্যানের ‘আর্ট অফ ক্রিকেট’ বইটা পড়ে প্রচুর জ্ঞান সংগ্রহ করে ফেলেছে কিন্তু ক্রিকেট কখনও খেলেনি। তাই প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং নিতে এসেছে ননীদার কাছে, বড় খেলোয়াড় হবার মোটেই ইচ্ছে নেই। ভদ্র এবং লাজুক অঞ্জন আমাকে একবার বলেছিল, ”খুব ইচ্ছে করে নেভিল কার্ডাসের মতো লেখক হতে। ওর সব বই আমার পড়া হয়ে গেছে।” আমি তখনও কার্ডাসের নাম জানতাম না, তাই বোকার মতো শুধু হেসেছিলাম আর মনে মনে বলেছিলাম, ছেলেটা আমারই বয়সি, কিন্তু পণ্ডিত। ওকে আমার ভাল লাগে এইজন্য যে, অনেক জেনেও চালিয়াত নয়, বাজে তর্ক করে না এবং ক্রিকেটে তার যে কিছুই হবে না, অকপটে তা স্বীকার করে। অঞ্জন এরপর এনজিনিয়ারিং পাশ করে বিলেত যায়। ফিরে এসে এখন দুর্গাপুরে বড় চাকরি করছে। সি সি এইচ—এর সঙ্গে ওর সংযোগ কখনও ছিন্ন হয়নি। ক্রিকেটকে ও সত্যিই ভালবাসে।

বারো বছর পর আজ আমার হঠাৎ সি সি এইচ নেটে প্রথম দিনের কথা মনে পড়ল।

নেটের ধারে আমি, ননীদা এবং ভবানী দাঁড়িয়ে প্র্যাকটিস লক্ষ করছি। এখন আমি ক্লাবের সিনিয়ার প্লেয়ার। এ বছরের ক্যাপ্টেন। প্রতিবারের মতো এবারও নতুন কয়েকটি ছেলে এসেছে। আমরা তিনজন সিলেকশন কমিটিরও মেম্বার, অবশ্যই নামকা ওয়াস্তে। কেননা ননীদা যা সিলেক্ট করেন আমরা তাতেই সই করে দিই বিনা প্রশ্নে। দ্বিতীয় ডিভিশন ক্লাব, প্লেয়াররা কেউ চাঁদা দেয় না। বছরের বাজেট প্রায় দু’হাজার টাকা। কীভাবে যে টাকা আসে একমাত্র ননীদাই তা জানেন।

ম্যাচ খেলার দিন তিনটি ব্যাটের মুখ দেখা যায়। খেলার শেষে ননীদা ব্যাটগুলি কাঠের বাক্সটায় ভরে তালা এঁটে নিজের কাছে চাবি রাখেন। ব্যাট তিনটি দিয়ে অন্তত আশিটা ম্যাচ খেলা হয়েছে। এ বছর নতুন একজোড়া না কিনলেই নয়। ননীদাকে সেকথা বলতেই উনি ঘাড় নেড়ে বলেছিলেন, ”হবে, হবে। একখানা যা মক্কেল এবার পাকড়েছি। ব্যাট কেন, গ্লাভস, প্যাড, নেট সব হবে।”

ক্লাবের প্যাড চার জোড়া। ব্যাটিং গ্লাভস তিন জোড়া। ব্যবহার করতে করতে ঢলঢলে হয়ে গেছে সেগুলো, আঙুল থেকে খুলে পড়ে। ঘামে এবং ময়লায় এখন এমন দুর্গন্ধ ছড়ায় যে উইকেটকিপাররা পর্যন্ত পিছিয়ে বসে। গৌতম জানিয়েছে, নতুন উইকেটকিপিং গ্লাভস না পেলে সে এবছর ম্যাচে চল্লিশটা বাই দেবেই। প্র্যাকটিসের জন্য একটা ব্যাট ঠিক করা আছে। কেউ বলে সেটা কাঁটাল কাঠের কেউ বলে শালের। কেউ সঠিক বলতে পারে না, যেহেতু প্রায় পুরো ব্লেডটাই কালো সুতোর ব্যান্ডেজ ঢাকা। যেটুকু দেখা যায়, সেটার রং দুশো বছরের পুরনো কাগজের মতো। ওজন ছ—সাত পাউন্ড, হ্যান্ডেলটা মচমচ করে। গোটা চারেক বল নেট প্র্যাকটিসের জন্য বরাদ্দ থাকে।

সি সি এইচ সাধারণত একটি বলে দু—তিনটি ম্যাচ খেলে। আমি একবার আপত্তি তুলে বলেছিলাম, ”ননীদা, বলের ব্যাপারে অন্তত খরচ কমাবার চেষ্টা করবেন না। নতুন বল না হলে সুইং করানো যায় না। তা ছাড়া পুরনো বল নিয়ে খেলতে নামছি এতে কি ক্লাবের প্রেসটিজ থাকে?”

ননীদা পনেরো সেকেন্ড আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তারপর বলেছিলেন, ”আইনে কি বলা আছে, নতুন বল নিয়ে খেলতে হবেই, নয়তো খেলতে দেওয়া হবে না?”

”তা লেখা নেই।” মাথা চুলকে বললাম।

”বল সুইং করলেই ম্যাচ জেতা যাবে?”

”না, তা কেন, কিন্তু সম্ভাবনা তো—”

”জেতার জন্যই খেলা। পুরনো কি নতুন যে বলেই খেলবে।”

এরপর আর কথা চলে না। ম্যাচে খেলা বলগুলি ননীদা কাঠের বাক্সটায় রেখে দেন। প্র্যাকটিসের বল নরম হয়ে তুবড়ে ফুলে উঠলে বা সেলাই ছিঁড়ে গেলে বাক্স থেকে বার করে বদলি করে দেন।

সাতটি ছেলে নেটে রয়েছে। ননীদা ঘড়ি ধরে এক—একজনকে ব্যাট করাচ্ছেন। অধিকাংশ সেকেন্ড ডিভিশনের তুলনায়ও কাঁচা। বিরক্তিতে ননীদার মুখ কুঁচকে রয়েছে। এক—একজনের দিকে মিনিটখানেক তাকান আর আকাশে চোখ তুলে বিড়বিড় করেন, ”যত্তসব এসে জোটে আমারই ঘাড়ে।” তারপর চেঁচিয়ে ওঠেন, ”নেক্সটম্যান।”

ভবানী এতক্ষণ আমার পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করছিল, ”একটাও পাশ করবে না, দেখে নিস, আজ নিয়ে আঠারোটা ছেলের ট্রায়াল হল। সোবার্স—কানহাই না পেলে বুড়োর মন উঠবে না। আরে বাবা এটা কি টেস্ট টিমের ট্রায়াল? থাকব তো আমরা লিগটেবলের তলার দিকে, অত বাছাবাছি করে নেবার দরকার কী! য়্যা, ক্লাবে চিরকাল থাকতে তো আর আসছে না, আমাদের মতো। ডানা গজালেই ফুড়ুক করে উড়ে পালাবে। আমার মতে ভাল প্লেয়ার নেয়াই উচিত নয়। তুই কী বলিস?”

ভবানীকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। কিছু বললেই সেটা ননীদার কানে তুলে দেবে। তাই চুপ করে রইলাম। তাতে ওর কথা বলায় কোনও অসুবিধা হল না। ”এই ছেলেটাকে দ্যাখ। স্টাইলটা ভালই মনে হচ্ছে।” ভবানী খুব মন নিয়ে, নেটে ব্যাট করছে যে ছেলেটি তার দিকে নয়, ননীদাকে লক্ষ করতে লাগল। ননীদা বেশ আগ্রহ ভরেই ছেলেটিকে দেখছেন। দু—একবার মাথা নেড়ে যেন তারিফ করলেন। ভবানী সঙ্গে সঙ্গে ”লাভলি” বলে চেঁচিয়ে উঠল। ননীদা ভ্রূ কোঁচকালেন, ভবানী ”ওহ নো নো” বলে উঠল সখেদে। ভবানীর খুব শখ, অন্তত একবার সি সি এইচ—এর ক্যাপ্টেন হওয়ার। কিন্তু ননীদা বাদ সেধেছেন। দু—দুবার তিনি ভবানীর দাবি নাকচ করেছেন এই বলে, ”টিমটাকে কি ডোবাতে চাও। ক্যাপ্টেনসি মানেই ট্যাকটিকস অর্থাৎ বুদ্ধির খেল দেখাতে হবে। ওর বুদ্ধির ভাঁড়ে তো মা ভবানী।”

ভবানী কিন্তু হাল ছাড়েনি। সমানে ননীদাকে খুশি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভবানী তার অফিসে নিজেকে ক্লাবের ক্যাপ্টেন রূপে পরিচিতি দিয়েছে। তা ছাড়া যে মেয়েটিকে সে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছে, সে ভবানীর অফিসেই চাকরি করে। বিবাহে মেয়েটি এখনও গড়িমসি করছে। তার মতে ভবানীর নাকি যথেষ্ট ব্যক্তিত্ব নেই। তাই মাঠের মাঝে কর্তৃত্ব ও দাপট, মেয়েটিকে দেখাবার ইচ্ছা তার খুবই। আমাকে অনুরোধ করেছে চুপিচুপি, ”দু—একটা ম্যাচে তুই বোস না, তা হলে আমি ক্যাপ্টেনসির চানস পাই সিনিয়ারমোস্ট প্লেয়ার হিসেবে। প্লিজ মতি, আমার অনুরোধটা রাখ। নয়তো আমার বিয়ে করা হয়ে উঠবে না। মিনুকে যে ভাবেই হোক ইমপ্রেস করতেই হবে।”

আমি ওকে কোনও কথা দিইনি। তাইতে ও মনে মনে চটে আছে আমার উপর, আমিও সাবধানে আছি ওর সম্পর্কে। কখন বিপদে ফেলে দেবে, কে জানে। ভবানীর একমাত্র গুণ—অনেকক্ষণ উইকেটে থাকতে পারে রান না করে। এজন্য টিমে ওকে অবশ্যই রাখতে হয়। ভবানীকে চটাবার ইচ্ছে আমার একদমই নেই, যেহেতু এবছর আমি ক্যাপ্টেন। জানি, ওর শরণাপন্ন হতেই হবে কোনও না কোনও সময়। ঠিক করেই রেখেছি, একটা সহজ ম্যাচের আগে আঙুলে চোট লাগার অজুহাত দিয়ে বসে যাব।

”হল না, হল না,” বলতে বলতে ননীদা নেটের মধ্যে ঢুকে ছেলেটির হাত থেকে ব্যাটটা ছিনিয়ে নিলেন। ”বলের লাইন হচ্ছে এই, আর তোমার বাঁ পা থাকছে ওখানে…লাইনে পা আনো, বাঁ কাঁধটা এইভাবে।” ননীদা কাল্পনিক বলের লাইনে পা রেখে ব্যাট চালালেন এবং একস্ট্রা কভারে কাল্পনিক বলটির বাউন্ডারি লাইন পার না হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে রইলেন। ”এইভাবে ড্রাইভ আর ফলো—থ্রু হবে, মাথা আর কাঁধ আসবে বলের পিচের উপর!”

ব্যাটটা ওর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে, ননীদা আমার পাশে এলেন। ”বুঝলে, স্ট্রেট ব্যাট আর ডিফেন্স হল ব্যাটসম্যানশিপের নাইনটি পারসেন্ট। অথচ আজকালকার ছোকরারা এ দুটো রপ্ত না করেই ব্যাট চালায় সোবার্সের মতো।”

নেটের মধ্যে থেকে ছেলেটি মুখ ঘুরিয়ে ননীদার দিকে তাকাল একবার। কাঁধটা ঝাঁকিয়ে স্টান্স নিল।

বল করছে তিনটি ছেলে। তার মধ্যে একটি মাঝে মাঝে গুগলি ছাড়ছে। ননীদা বিড়বিড় করল, ”লেংথে বল ফেলা শিখল না, বাবু এখনি গুগলি দিচ্ছে। কিসসু হবে না।” ওর প্রথম বল লেগ স্টাম্পের বাইরে পড়ে অফ ব্রেক করে বেরিয়ে গেল। ব্যাটসম্যান ছেড়ে দিল। ননীদা বলে উঠলেন, ”ভেরি গুড।” ভবানী সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ”কারেক্ট।”

এর পরের ছেলেটির কাছ থেকে এল সোজা একটি হাফ ভলি। ব্যাটসম্যান ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলে আস্তে বোলারের কাছে বলটা ঠেলে দিল। ননীদা ভ্রূ কুচঁকে বললেন, ”এটা লং অন বাউন্ডারিতে পাঠানোর কথা।” ভবানী চিৎকার করে উঠল, ”ড্রাইভ, ড্রাইভ, হিট হার্ড মাই বয়।”

ছেলেটি বিরক্ত চোখে আমাদের দিকে তাকাল। পিচে বোধহয় ইটের কুচি আছে, তৃতীয় বলটি হঠাৎ ফণা তোলার মতো সোজা খাড়া হয়ে ছেলেটির কানের পাশ দিয়ে নেট ডিঙিয়ে গেল। মুহূর্তের জন্য ওর মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হল।

”হুক করার বল ছিল।”

”হুক হুক। সপাটে। ডোন্ট বি অ্যাফ্রেড।”

পরের বলটি পিচে পড়ার আগেই ছেলেটি লাফিয়ে দু—গজ বেরিয়ে বলটিকে সোজা সত্তর গজ দূরে কাস্টমস টেন্টের উপর ফেলে দিল। ননীদা উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ”দ্যাখো, বলের লাইন থেকে পা কত দূরে ছিল।”

”তার আগে দেখুন বলটা কত দূরে গেল।” ছেলেটি কাস্টমস টেন্টের দিকে ব্যাটের ডগা তুলে বলল। ”এতে ছ’টা রান পাওয়া যাবে। আর রানের জন্যই ব্যাট করা, তাই না?”

ননীদার মুখ থমথমে হয়ে গেল। ভবানী অসহায় ভাবে আমার আর ননীদার মুখের দিকে তাকাতে লাগল। হঠাৎ ”দুর্যোধন, দুর্যোধন” বলে ডাকতে ডাকতে ননীদা টেন্টের দিকে রওনা হয়ে গেলেন।

ভবানী বলল, ”ঠিক জবাব দিয়েছে, কী বলিস?”

এড়িয়ে গিয়ে বললাম, ”আগের থেকে ননীদার সহ্যশক্তি অনেক বেড়ে গেছে।” তারপর চেঁচিয়ে ছেলেটিকে বললাম, ”তোমার নাম কী ভাই?”

”তন্ময় বোস।” এই বলেই তন্ময় লেগব্রেক করা বলটাকে অফ স্টাম্পের উপর থেকেই লেটকাট করল।

সঙ্গে সঙ্গে আমি ননীদাকে দেখার জন্য তাঁবুর দিকে তাকালাম। ফেন্সিংয়ের গেটের কাছে ননীদা কথা বলছেন দুর্যোধনের সঙ্গে, কিন্তু তাকিয়ে আছেন নেটের দিকে। দেখলাম বিরক্তি ভরে মাথাটা নাড়ছেন। আমি জানি মনে মনে এখন উনি কী বলছেন। বারো বছর আগে আমায় বলেছিলেন, ”ফ্যান্সি শট, এ সব হচ্ছে ফ্যান্সি শট। সিজন শুরু হবার একমাসের মধ্যে খবরদার লেটকাট করবে না।”

”ন্যাচারাল ক্রিকেটার। ছেলেটার হবে মনে হচ্ছে।” ভবানী বিজ্ঞের মতো বলল। ”অবশ্য যদি গেঁজে না যায়।”

”কিন্তু এখনই লেটকাট করল! এ সম্পর্কে ননীদা কী বলেন, তোর মনে আছে কি?” ভবানীকে উশকাবার জন্য বললাম।

”নিশ্চয় মনে আছে।” ভবানী ভারিক্কি চালে নেটের কাছে গিয়ে বলল, ”দ্যাখো তন্ময় লেটকাট—ফাট জানুয়ারি মাসের আগে আমাদের ক্লাবে মারা বারণ।”

তন্ময়ের মুখে অকৃত্রিম বিস্ময় ফুটে উঠল। মনে হল, হাসবে না রাগবে ঠিক করে উঠতে পারছে না। ভবানী ভারী গলায় এবার বলল, ”উই ডোন্ট প্লে ফর ফান।”

”তা হলে কী জন্য খেলেন?” তন্ময় আরও অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

ভবানী ভ্যাবাচাকা খেয়ে আমার দিকে তাকাল। ও আশা করেনি এই রকম একটা প্রশ্নের সম্মুখীন কোনওদিন হতে হবে। আমি কিঞ্চিৎ খুশি হয়েই মুখে বিব্রত ভাব ফোটালাম। ভবানী জবাবের জন্য আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বললাম, ”ননীদা বলেন, আমরা খেলি জেতার জন্য।”

”নিশ্চয়, আমিও সেই জন্য দেখতে চাই।” তন্ময় নেট থেকে বেরিয়ে প্যাড খুলতে খুলতে বলল। ”কিন্তু মজাটাকে বাদ দিয়ে নয়। মজা না পেলে খেলা আর খেলা থাকে না, খাটুনি হয়ে যায়। আমি তো মজা পাব বলেই ক্রিকেট খেলতে এসেছি। পা কিংবা কাঁধ বলের লাইনে এল কি না, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। বলটা ব্যাটের ঠিক মাঝখানে লাগার সুখটা পেতে চাই।”

ভবানী বলল, ”সুখ চায় যারা স্বার্থপর। কিন্তু ক্রিকেট টিমগেম। দলের কথা ভেবে খেলতে হয়।”

তন্ময় বলল, ”স্বার্থপর কিছু প্লেয়ার আছে বলেই লোকে খেলা দেখতে আসে। যারা পিটিয়ে খেলে, তাদের খেলাই কি দেখতে ইচ্ছে করে না?”

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভবানী ‘ননীদা বোধহয় ডাকছেন” এই বলে হঠাৎ তাঁবুর দিকে চলে গেল। আমি জানি, তন্ময়ের কথাগুলি ননীদার কানে তুলে দেবার জন্যই ও গেল।

তন্ময়ের নিকষ কালো রং। ছিপছিপে লম্বা বেতের মতো শরীর, বাড়তি মেদ ও মাংস কোথাও নেই। মাথার চুল হাল আমলের বিবাগীদের মতো ঝাঁকড়া হয়ে ঝুলে পড়েছে ঘাড় পর্যন্ত, জুলপিটাও ইঞ্চি চারেক। ওর বুটটা পুরনো আর তালি—মারা। জামা, প্যান্ট ময়লা। চোখের চাহনিতে ঔদ্ধত্য ও চ্যালেঞ্জ ঝকঝক করছে। ক্যাপ্টেন হিসেবে কেমন একটু আশ্বস্ত বোধ করলাম। এইসব ছেলেরাই হারা ম্যাচ হঠাৎ জিতিয়ে দিতে পারে।

নিজের নাম বলে ওকে জানালাম, এ বছর আমি সি সি এইচ—এর ক্যাপ্টেন। তারপর বললাম, ননীদা বা ভবানীর মনোভাবের সঙ্গে আমার ক্রিকেট ধারণার একদমই মিল নেই। ওঁরা গোঁড়াপন্থী, খেলাটাকে জীবন—মরণ সমস্যা বলে ধরে নেন। কিন্তু খেলাকে আমি ধরি নিজেকে প্রকাশ করার একটা উপায় হিসেবে।

আমার কথা তন্ময় ঠিকমতো বুঝল কি না জানি না, তবে হাসল। ”আমাকে কি এরা খেলাবে?”

”খেলানো তো উচিত। ব্যাটসম্যান দু—তিনজনের বেশি নেই।”

”এরা পয়সাকড়ি কিছু দেবে কি?”

আমি অবাক হয়ে বললাম, ”তুমি কি ফুটবল পেয়েছ? কলকাতায় ক্রিকেট প্লেয়ার ক’জন টাকা পায়, তাও সেকেন্ড ডিভিশন ক্লাবে।”

”আমাকে বুট কিনতে হবে, জামা—প্যান্টও করাতে হবে।”

আমি চুপ করে রইলাম। টেনেটুনে একজোড়া বুটের দাম হয়তো সি সি এইচ দিতে পারবে, কিন্তু তার আগে তন্ময়কে প্রমাণ করতে হবে—সে অপরিহার্য।

”আচ্ছা ওই টাকমাথা, বেঁটে কালো লোকটা এই ক্লাবের কে?”

”ক্রমশ টের পাবে ননীদা এই ক্লাবের কে এবং কতখানি!”

তন্ময় পকেট থেকে একটা দোমড়ানো সিগারেট বার করে আমায় বলল, ”দেশলাই আছে দাদা?”

প্রতি বছর মরশুম শুরুর আগে ক্লাব সদস্যদের মধ্যে একটা ম্যাচ খেলা হয়। সভাপতির একাদশ বনাম ননীদার একাদশ। ম্যাচ না বলে ফিস্ট বলাই ভাল। লাঞ্চের নামে হয় ভুরিভোজ। তারপর আর কারুর খেলায় উৎসাহ থাকে না, অবস্থাও থাকে না। মিষ্টি নরম রোদে ঘাসের উপর বেশির ভাগই গড়িয়ে পড়ে। রিজার্ভে যে ছেলেরা থাকে তারাই তখন খেলে।

ননীদা খেলাটাকে প্রীতি—সম্মেলন হিসাবে দেখেন পঞ্চাশ ভাগ। পৃষ্ঠপোষকদের তোয়াজ করার জন্য পঁচিশ ভাগ রেখে, বাকি অংশটুকু নবাগতদের ট্রায়াল হিসেবে গণ্য করেন। সভাপতি হন তাঁর নিজের টিমের ক্যাপ্টেন, আর একদিকের ননীদা। ক্লাবের যাবতীয় কর্মকর্তা ও তাদের বাচ্চচা ছেলেরা থাকে সভাপতির দলে আর জনা দশেক অতিরিক্ত নিয়মিত প্লেয়ার ও একজন উইকেটকিপার। খেলা শুরুর আধঘণ্টার মধ্যেই একে একে অতিরিক্তদের মাঠে ডাক পড়ে। ননীদার দলে থাকে নবাগত ছেলেরা ও ননীদার সমসাময়িক ও তদূর্ধ্ব বয়সি বিগত দিনের কয়েকজন প্লেয়ার।

যদিও দুটি দলের নামে ‘একাদশ’ শব্দটি আছে, আসলে সেটা অষ্টাদশ কি ত্রয়োবিংশও হতে পারে। নির্ভর করে মাঠে খেলার আগে ক’জন হাজির হয়েছে। সদস্যরা গেস্টও আনতে পারে, সেজন্য মাথাপিছু পাঁচ টাকা দিতে হয়। ভবানীর গেস্ট এবার মিনতি ওরফে মিনু; অফিসের দারোয়ান—ইন—চার্জ কাম রিসেপশনিস্ট গুঁপো রঞ্জনবাবু আমার গেস্ট। অফিসে যত লোক দেখা করতে আসে রঞ্জন সেনগুপ্ত তার শতকরা পাঁচজনকে ভিতরে যেতে দেয়। আশা করছি এরপর আমার সঙ্গে যারা দেখা করতে আসবে তারা ওই শতকরা পাঁচজনের অন্তর্ভুক্ত হবে। টপ কর্মকর্তারা, যারা বাৎসরিক মোটা দক্ষিণা দেয়, তাদের গেস্টদের জন্য চাঁদা নেওয়া হয় না। তাদের সঙ্গে আসে স্ত্রী—পুত্রকন্যারা।

ক্লাব প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও ননীদার হাতে। অর্থবান, যশোলোভী, ঈষৎ বোকা ধরনের, তোষামোদপ্রিয় লোক খুঁজে বার করে, তাকে নানানভাবে জপিয়ে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে (ননীদা বলেন, ‘ট্যাকটিকস প্রয়োগ করে’) মোটা টাকা আদায় করার দায়িত্ব ননীদাই এতকাল বহন করে আসছেন। এই টাকার উপরই ক্লাবের জীবন—মরণের অর্ধেক নির্ভর করে।

আগের প্রেসিডেন্ট ছিল কাউন্সিলার দুলাল দাঁ। ইলেকশনে হেরে গিয়ে ডোনেশন ছাঁটাই করে, ১/৬—এ নামিয়ে এনেছে। ননীদা প্রতিশ্রুত ছিলেন ইলেকশনে সি সি এইচ খাটবে। কিন্তু কাজের সময় লুচি—আলুর দমের বাক্স সংগ্রহ ছাড়া ছেলেরা আর কিছুই করেনি। এবার ননীদা নাকি শাঁসালো একজনকে পাকড়িয়েছেন। চাঁদমোহন শ্রীমানী টেস্ট ম্যাচের পাঁচটি টিকিট চেয়েছে, বিনিময়ে দেড় হাজার টাকা দেবে। ননীদা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সি এ বি—তে তাকে কোনও একটি কমিটিতে ঢুকিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবেন। শ্রীমানী, বলাই বাহুল্য, এ বছর আমাদের প্রেসিডেন্ট। গুড়, ঘি ও চালের আড়তদার, গোটা পাঁচেক রেশন দোকানের সে মালিক।

শ্রীমানীকে প্রথম দেখলাম এই খেলার দিন। গৃহিণী ও দুই ছেলেকে নিয়ে ওর মোটর পৌঁছতেই ননীদা ছুটে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। গাড়ি থেকে প্রথমে যখন শ্রীমানীর পা বেরোল, কে যেন পিছন থেকে আস্তে বলল, ”এ যে হাথি মেরা সাথি।” পিছন ফিরে দেখলাম, তন্ময় আর গুটি চারেক নতুন ছেলে ফিক ফিক হাসছে। শ্রীমানী নামার পর হাঁফ ছেড়ে গাড়ির স্প্রিং এক ইঞ্চি উঁচু হয়ে গেল। শ্রীমানী—গিন্নি নামার পর আর এক ইঞ্চি উঠল। দুই ছেলে নামতে ৩/৪ ইঞ্চি আরও উপরে উঠল। গাড়িতে রয়েছে পাঁচ বাক্স সন্দেশ, পাঁচ হাঁড়ি দই, এক ঝুড়ি কমলালেবু। সেগুলো নামানো হল না। ননীদা বললেন, ”গাড়িতে চাবির মধ্যে থাকুক। লাঞ্চের সময় বার করব। এখন টেন্টে নিয়ে গিয়ে রাখলে কিছু বাকি থাকবে না।”

”কেন, ক্লাবে বুঝি চোর—ফোর খুব আছে।” শ্রীমানী বলল। মনে হল বাঘ ডাকছে।

ননীদা কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ”ছেলেপুলেরা একটু দুষ্ট হয়ই, বোঝেনই তো, হেঁ হেঁ, হেঁ, চুরি করে খেতেই ওদের ভাল লাগে। কিন্তু চোর ওরা নয়।”

”নয় যে, বুঝলেন কী করে? ক্রিকেটাররা বুঝলেন, রিলেতে শুনেছি, খেলতে খেলতে মাঠের মধ্যেই চুরি করে। পুষ্পেন সরকারকে পরিষ্কার বলতে শুনেছি—অম্বর রায় একটা রান চুরি করল এই ফাঁকে। বুঝন মাত্র একটা রান, কতই বা তার দাম। কিন্তু লোভ সামলাতে পারল না।” শ্রীমানী—গিন্নি ক্ষুব্ধস্বরে বলল।

শ্রীমানী—পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে টেন্টের দিকে এগোতে লাগলাম। ননীদা আমায় চোখ টিপলেন। মুখে গদগদ ভাব এনে শ্রীমানীকে বললাম, ”আপনি যে ক্রিকেট খেলতেন তা আপনার হাঁটা দেখেই বোঝা যায়।”

”এখন একটু মোটা হয়ে গেছি,” শ্রীমানীর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ”একসময় দারুণ খেলতাম। খালি ছক্কা মারতাম। বল মাটিতে পড়ার আগেই পাঁচ হাত বেরিয়ে হাঁকড়াতাম। তখন অনেক রোগা ছিলুম। আমায় নামতে দেখলেই ফিল্ডাররা আপনা থেকেই বাউন্ডারির ধারে সরে যেত।”

”আজ তা হলে আপনার ছক্কা দেখা যাবে।” বলতে যাচ্ছিলুম ‘দেখার সৌভাগ্য হবে’, কিন্তু তন্ময়দের দলটা কাছেই থাকায় বলতে পারলাম না।

”ভাল বোলার আছে কি? ফাস্ট বোলার? ব্যাঘ্রকণ্ঠে শ্রীমানী বলল। ”ফাস্ট বল না হলে আমি ঠিক ভাল খেলতে পারি না।”

ননীদার দিকে তাকালাম সঠিক ট্যাকটিকসের জন্য। ননীদা ইশারায় আমাকে চুপ করতে বলে, খুব বিষণ্ণ গলায় বললেন, ”ফাস্ট বোলার! নাহ আমাদের ক্লাবে নেই। কোথাও নেই, না বেঙ্গলে না ইন্ডিয়াতে। তাই তো ভাল ব্যাটসম্যানও পাওয়া যাচ্ছে না। আপনাদের আমলে বাঘা বাঘা বোলার ছিল তাই আপনারাও বাঘের মতো ব্যাট করেছেন।”

”ঠিক ঠিক। এখন বোলাররা ইঁদুর, তাই ব্যাটসম্যানরা ইঁদুর হয়ে গেছে।” শ্রীমানী গর্জন করে উঠল।

”আপনারা যদি একটু ইন্টারেস্ট নেন তা হলে আবার নিশ্চয় ফাস্ট বোলার পাব। মাঝে মাঝে আপনি যদি আমাদের ম্যাচগুলোয় নামেন তা হলে আপনার হাঁকড়ানোর ঠেলা খেয়ে বোলাররা জোরে বল করার জন্য ইন্সপায়ারড হবে।”

”বুঝলেন ননীনাবু, আমার খুবই খেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ব্যবসায় এত টাইম দিতে হয় যে—” ইঞ্জিনের স্টিম ছাড়ার মতো শ্রীমানীর দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

সব থেকে মজবুত লোহার চেয়ারটা দেখিয়ে ননীদা ওকে বললেন, ”আপনি বিশ্রাম করুন।” আর লোহার চেয়ার ছিল না। দৌড়ে টেন্ট থেকে আর একটি শ্রীমানী—গিন্নির জন্য আনলাম। দুটো আঙুল দিয়ে চেয়ারটার বসার জায়গা টিপে পরীক্ষা করে তিনি বসলেন।

সারসের মতো গলা ও ঠ্যাং নিয়ে ভাইস—প্রেসিডেন্ট অ্যাটর্নি মাখন দত্ত সস্ত্রীক হাজির হলেন। বছরে ইনি ত্রিশ কিলো আলু, দশ কিলো মাংস, পঞ্চাশ পাউন্ড পাউরুটি ও পাঁচ কিলো সরষের তেল দেবেন। ওঁর জন্য বরাদ্দ দুটি টেস্টম্যাচ টিকেট। দত্ত—গিন্নিকে বসালাম শ্রীমানী গিন্নির পাশে। মাখন দত্ত, শোনা যায় কলেজ টিমে দু—চারবার খেলেছে।

কতকগুলো গোপন নিয়ম এই ম্যাচের জন্য স্থির করা আছে। খেলার দুই আম্পায়ার, স্কোরার এবং আমার মতো পুরনো দু—একজনই তা জানে। নিয়মগুলি ননীদার তৈরি। খেলার প্রথম একঘণ্টা আমি স্কোরার। শাঁসালো কেউ শূন্য রানে কোনওক্রমেই যাতে আউট না হয়, সেটা দেখবে আম্পায়ার। স্কোরারের কাজ দশকে পনেরো এবং পনেরোকে কুড়ি করা। বাই রান খুব সাহায্য করে টোটালকে তিরিশ—চল্লিশ রান বাড়াতে।

ভবানী আজ খুবই ব্যস্ত। শ্রীমানী একাদশের বিপর্যয় রোধ করার দায়িত্ব আজ তার ঘাড়ে। মিনুকে সে দত্ত—গিন্নির পাশে বসিয়েছে। শ্রীমানী নিজে ব্যাটিং অর্ডার করেছে। ভবানীকে রেখেছে দ্বাদশ স্থানে। তাই নিয়ে ভবানী খুবই অসন্তুষ্ট। অত দেরি করে নেমে কী খেলা সে মিনুকে দেখাবে? একটা লেমনেড মিনুর হাতে দিয়ে সে হাত নেড়ে কী সব বলছে। কানে এল ওর গলা, ”ভাল রিলায়েবল ব্যাটসম্যানরাই শেষদিকে থাকে। যখন গোড়ার দিকে ফেল করে তখন তারা আটকায়। যেমন সোবার্স এখন ছয়—সাতে নামছে।”

মিনু বলল, ”শুনেছি ব্র্যাডম্যান তিন নম্বরে নামত।”

”নামবে না কেন, ওদের তো এগারো নম্বরও সেঞ্চুরি করতে পারে। আমাদের টিমে সেরকম কেউ তো আর নেই। তাই আমাকে—”

শ্রীমানী—গিন্নি কটমট করে তাকিয়ে আছে দেখে ভবানী থমকে পড়ল।

”তোমাদের টিমের ক্যাপ্টেনটা ঠিক রোড রোলারের মতো। দৌড়বে কী করে, রান আউট হয়ে যাবে যে!” মিনু হাসতে হাসতে ঠোঁটে স্ট্র চেপে ধরল।

শ্রীমানী—গিন্নির দিকে তাকিয়ে ভবানী বলল, ”আমি চট করে রান্নার দিকটা একবার দেখে আসি। তুমি বরং এখানে থাকো।” বলতে বলতে ভবানী টেন্টের পিছন দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

শ্রীমানী—গিন্নি একটু চেঁচিয়ে দত্ত—গিন্নিকে বলল, ”ক্রিকেট মাঠে আজকাল, বুঝলেন দিদি, বড় আজেবাজেরা খেলা দেখতে আসে। এমন সব মন্তব্য তারা করে যে খেলা দেখাই দায় হয়ে ওঠে। চলুন আমরা বরং ওধারটায় বসি।”

”সেই ভাল।” দত্ত—গিন্নি উঠে দাঁড়ালেন।

ওরা এসে স্কোরারের টেবলের পিছনে একটা বেঞ্চে বসল।

ননীদা টসে জিতে সভাপতির দলকে ব্যাট করতে দিলেন। লাঞ্চের পর খেলার ইচ্ছা ওদের থাকে না বলেই, সভাপতির দলকেই প্রথমে ব্যাট করতে দেওয়া হয়। প্রথমে ব্যাট করতে নামল মাখন দত্ত আর পল্টু চৌধুরী। নামার আগে শ্রীমানী দুজনকে জানিয়ে দিল, ”তাড়াহুড়ো করবেন না। দেখে দেখে খেলবেন, বলের পালিশ উঠলে তবেই সামান্য হাত খুলবেন। তারপর আমি তো আছিই।”

নতুন একটি ছেলেকে ননীদা বল করতে দিয়েছেন। প্রবল উৎসাহের জন্যই ওর প্রথম বলটি ফুলটস হয়ে গেল। মাখন দত্ত ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে যাবার সময় ব্যাটটিকে হাতপাখার মতো সামনে একবার নেড়ে দিল। ব্যাটে লেগে বলটি শ্লিপে দাঁড়ানো তন্ময়ের পাশ দিয়ে তিরবেগে থার্ডম্যান বাউন্ডারিতে পৌঁছল। হই হই করে উঠল দর্শকরা। ব্যাঘ্র গর্জন উঠল, ”তাড়াহুড়ো নয়, বি স্টেডি।”

দত্ত—গিন্নি পুলকে লাল হয়ে শ্রীমানী—গিন্নিকে বলল, ”বিয়ে হওয়ার পর এই প্রথম ব্যাট ধরলেন।”

”তাই নাকি, ওমমা! দেখে তো মনে হল না।” শ্রীমানী—গিন্নি বিস্ময় প্রকাশ করল। ”উনিও বড় ছেলে হবার পর আর মাঠমুখো হননি। খেলার কোনও জিনিসই তো আর নেই, তাই আর্জেন্ট অর্ডার দিয়ে প্যান্ট জামা বুট করালেন। কী যে শখ।”

মাখন দত্তর অফ স্টাম্প ঘেঁষে পর পর দুটি বল বেরিয়ে যাওয়া মাত্র ননীদা বোলারের কাছে গিয়ে কী যেন বললেন। ছেলেটি অবাক হয়ে কী যেন বলতে গেল কিন্তু ননীদা তা শোনার জন্য অপেক্ষা না করে শর্ট লেগে নিজের জায়গায় ফিরে এলেন।

পরের তিনটি বল লোপ্পাই ফুলটস এবং লেগস্টাম্পের বাইরে। মাখন দত্ত হুমড়ি খেয়ে তিনবার ঝাড়ু দিলেন, ব্যাট বলে লাগল না। পরের ওভারে ননীদা বল নিলেন। ভাল লেগব্রেক করাতেন, এখনও পারেন, পল্টু চৌধুরীকে দুটি বল অফ স্টাম্পের বাইরে লেগব্রেক করালেন। শ্রীমানীর নির্দেশ ভুলে গিয়ে পল্টু চৌধুরী ব্যাটটাকে ছিপের মতো বাড়িয়ে রইল। বল ব্যাটে লেগে তিনবারই পয়েন্টের দিকে গেল।

”ইয়েয়েস”, মাখন দত্ত রান নেবার জন্য দৌড়ল, তন্ময় শ্লিপ থেকে ছুটে গিয়ে ব্যাকোয়ার্ড পয়েন্ট থেকে বলটা কুড়িয়ে সোজা উইকেটকিপারের গ্লাভসে বল পাঠাতেই সে উইকেট ভেঙে দিল। মাখন দত্তের তখন ক্রিজে পৌঁছতে চার হাত বাকি।

”হাউউজ দ্যাট!” কোরাসে আবেদন হল।

দ্বিধাহীন কণ্ঠে স্কোয়ার লেগ আম্পায়ার হাবলোদা বলল, ”নট আউট।”

নতুন ছেলেরা এমন ডাহা অন্যায়ের প্রতিকার প্রার্থনার ভঙ্গিতে ননীদার দিকে তাকাল। ননীদা বললেন, ”বেনিফিট অব ডাউট দিয়েছে আম্পায়ার।”

”চার হাত বাইরে, এতে কোনও ডাউট থাকতে পারে?” তন্ময় বিরক্ত হয়ে বলল।

ননীদা কথাটা শুনেও শুনলেন না। তন্ময় বিরক্ত হয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে কোমরে হাত দিয়ে শ্লিপে দাঁড়িয়ে রইল। এই ম্যাচের গোপন নিয়মগুলো তন্ময়ের জানার কথা নয়। জানলে হয়তো এভাবে রাগ দেখাত না। সি সি এইচ—এর মতো ছোট ছোট ক্লাবগুলো কাদের দয়ায় চলে সে কথা যেদিন জানবে, সেদিন ও নিশ্চয় ক্লাবকে ভাল না বেসে পারবে না।

এক ঘণ্টা খেলার পর সভাপতি দলের স্কোর পাঁচ উইকেটে ৮১। মাখন দত্ত ৩১ নট আউট। যে পাঁচজন আউট হয়েছে তার মধ্যে ভুলু গোঁসাই একডজন বল দেয়, বিকাশ মাইতি দেয় একশো টাকা। গোঁসাইকে ২০ আর মাইতিকে ২৫ রানের মাথায় আউট দেওয়া হয়েছে। হাবলোদা আর পটাবাবু এ পর্যন্ত নির্ভুল আম্পায়ারিং করে চলেছে। তারা দুজনে এগারোটা এল বি ডব্লু, সাতটা রান আউট, নটা স্টাম্পিং ও তিনটে ক্যাচ আউটের আবেদন নাকচ করেছে। ঠিক করা আছে শ্রীমানীকে হাফ—সেঞ্চুরি করাতেই হবে, নয়তো পরের বছর ওকে প্রেসিডেন্ট পদে ধরে রাখা যাবে না।

পঞ্চাননদা এসে আমার কানে কানে বললেন, ”পোলোয়া চড়ানো হল এখন, তারপর চাটনি।”

ঘড়ি দেখে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। চাটনি নামলেই লাঞ্চ। বড় মন্থরগতিতে রান উঠছে, এতক্ষণে মাত্র পাঁচটি উইকেট পড়েছে। অথচ লাঞ্চের আগেই শ্রীমানীকে অন্তত হাফ—সেঞ্চুরি করিয়ে দিতে হবে। ব্যাটিং অর্ডারে সে নিজেকে রেখেছে ভবানীর আগে, এগারো নম্বরে। নবম উইকেট না পড়লে শ্রীমানী নামছে না, তার মানে দুটোর আগে নয়। কিংবা আড়াইটেও বাজতে পারে, কেন না আর এক ভাইস—প্রেসিডেন্ট দয়াশঙ্কর যোশির (তিন জোড়া প্যাড) আট বছরের পুত্র আট নম্বরে। তাকে ১৫ রান করাতেই হবে।

ভাবলাম শ্রীমানীকে বলি, আপনি ৯ নম্বরে এসে লাঞ্চটাকে তাড়াতাড়ি করিয়ে দিন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, ব্যাটিং অর্ডার তৈরি করার সময় নিজের নামের পাশে ১১ লিখে শ্রীমানী বলেছিল, ‘তলার দিকে নিজেকে রাখলুম কেন বলুন তো?” ননীদা এবং আমি তখন, বাঘ মিউ না হালুম করে কেন, এমন এক প্রশ্নের জবাব খোঁজার মতো মুখ করে তাকিয়ে ছিলাম। শ্রীমানী মুচকি হেসে বলেছিল, ‘যদি ঝরঝর করে উইকেট পড়ে তা হলে আটকাবে কে?’ ওর বিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতায় স্তম্ভিত আমার মুখের দিকে ননীদা সপ্রশংস চোখে তাকিয়েছিলেন। তখন ভবানী কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মিনুকে এগিয়ে আসতে দেখে ‘রান্নার দিকটা একবার ঘুরে আসি’ বলে দ্রুত মিলিয়ে যায়।

শ্রীমানীকে বিপর্যয়রোধের সুযোগ দেওয়া ও লাঞ্চকে ত্বরান্বিত করার জন্য মাঠে ননীদার কাছে চিরকুট পাঠালাম—”পোলাও চড়েছে। সভাপতিকে নামাবার ব্যবস্থা করুন।”

চিরকুট পাঠাতে ননীদা হাত তুলে বোঝালেন, ব্যস্ত হবার কিছু নেই। দুটি টুঙ্কি দিয়ে শ্লিপ থেকে তন্ময়কে ডেকে এনে, হাতে বল তুলে দিলেন। তারপর আম্পায়ারের দিকে তাকিয়ে মাথাটা হেলালেন। হাবলোদাও একই ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন। দুর্যোধনকে ডেকে আমি বললাম, ”কলাপাতা, খুরি, গেলাসগুলো এবার ধুয়ে রেডি করে রাখ।”

হঠাৎ চোখে পড়ল আমার গেস্ট গুঁপো রঞ্জনবাবু আসছে। কাঁধে একটা ক্যামেরা ঝুলছে। আমায় দেখে একগাল হেসে বলল, ”ক্যামেরাটাও আনলুম। ক্রিকেটের ছবি তোলা আমার দারুণ হবি। ভাল অ্যাকশন পেলে তুলব। লাঞ্চের কদ্দুর?”

বললাম, ”খুব শিগগিরই।” মাথায় তখন একটা আইডিয়া এসে গেছে। শ্রীমানীর ছবি তুলে প্রেজেন্ট করলে কেমন হয়। নেটটা একদম অচল হয়ে গেছে। নতুন একটা কি খুশি হয়ে দেবে না?

”রঞ্জনবাবু, দারুণ অ্যাকশন পাবেন যদি ওই লোকটার ছবি তোলেন।”

”কোন লোকটা বললেন? ওই মোটা হোঁদল—কুতকুতের?”

”আস্তে, রঞ্জনবাবু আস্তে।” বলেই পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি শ্রীমানী—গিন্নি রঞ্জনবাবুকে দেখছে।

”আরে দূর মশাই, অমন মোটার আবার অ্যাকশন! ফরোয়ার্ড খেললে তো হাতির মতো দেখাবে, ব্যাক খেললে গণ্ডার মনে হবে।”

”প্লিজ রঞ্জনবাবু, ছবি চাই না, চুপ করুন।”

”আরে দূর মশাই, ভাল সাবজেক্ট পাব বলে ক্যামেরাটা—” রঞ্জনবাবু থেমে গিয়ে চোখ দুটো সরু করে টেন্টের পিছন দিকে দৃষ্টি পাঠিয়ে দিল। প্যাড পরে ভবানী গদগদ হয়ে মিনুকে কী বলছে। মিনুর হাতে ভবানীর ব্যাট। সে ব্যাটটা দোলাতে দোলাতে ভবানীর কথা শুনছে।

”দ্যাটস এ গুড আনন্দবাজার রবিবাসরীয়—র সাবজেক্ট।” বলেই ক্যামেরা বাগিয়ে রঞ্জনবাবু কুঁজো হয়ে শিকারির মতো এগোল। শ্রীমানী—গিন্নি জ্বলন্ত চোখে রঞ্জনবাবুকে লক্ষ করে যাচ্ছে।

শ্রীমানী ব্যাট করার জন্য তৈরি হয়ে হাজির। স্ত্রীর কাছে গিয়ে বলল, ”ওগো, গাড়ি থেকে সন্দেশ, দই, লেবুগুলো আনিয়ে রাখো।”

”আনবখন।” শ্রীমানী—গিন্নি মন্দ্রকণ্ঠে ঘোষণা করল।

শ্রীমানী কী একটা বলতে যাচ্ছিল, তখনই মাঠ থেকে ননীদার বিকট চিৎকার উঠল, ”আউজাট?” পটাবাবু কট অ্যান্ড বোল্ড হওয়া মাখন দত্তকে বিদায় সঙ্কেত জানাতে এবার আর দ্বিধা করল না। ৩১ রানেই ডগমগ হয়ে মাখন দত্ত ফিরল।

”ওয়েল প্লেড”, শ্রীমানী তারিফ ছুড়ে দিল।

আমি বললাম, ”মিস্টার শ্রীমানী, আপনাকে কিন্তু কয়েকটা ছক্কা আজ দেখাতেই হবে।”

হাই তুলে শ্রীমানী মুখগহ্বরের ফটকে কয়েকটা তুড়ি দিয়ে বলল, ”ফাস্ট বোলার তো তেমন দেখছি না। ছক্কা মারব কাকে?”

আমি মাথা চুলকে সরে এলাম। পরের ওভারেই দুটি উইকেট পড়ল। শ্রীমানী গ্লাভস পরতে শুরু করল। সভাপতির দল আট উইকেটে ৯৭। তন্ময়ের ওভারের প্রথম বলেই নবম উইকেটের অফ স্টাম্পের বেল উড়ে গেল। শ্রীমানী উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল।

চাঁদমোহন শ্রীমানী মন্থর গতিতে উইকেটে পৌঁছল। তন্ময় কোমরে হাত দিয়ে একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে। ননীদা লেগ ও অন থেকে যাবতীয় ফিল্ডসম্যান সরিয়ে অফে পাঠাতে শুরু করলেন। সাবধানের মার নেই। ফট করে কেউ ক্যাচ ধরে ফেলতে পারে। তারপর তন্ময়কে ডেকে কানে কানে কী বললেন। বাধ্যের মতো তন্ময় মাথা নাড়ল।

শ্রীমানী মিনিট চারেক ক্রিজের চার বর্গগজ এলাকা গভীর মনোযোগে ঘাড় হেঁট করে পরীক্ষা করল। গুটি চারেক কাঁকড় আবিষ্কার করে খুঁটে তুলে ফেলে দিল। ব্যাট দিয়ে কয়েকটি স্থান দুরমুশ করে ক্রিজে দাঁড়িয়ে গার্ড চাইল, ওয়ান লেগ। হাবলোদা নিখুঁত গার্ড দেবার জন্য মিনিট পাঁচেক সময় নিল। তারপর বুটের ডগা দিয়ে ক্রিজে দাগ কেটে শ্রীমানী শুরু করল ফিল্ড প্লেসিং নিরীক্ষণ। তাও হয়ে যাবার পর স্টান্স নিল।

তন্ময় এতক্ষণ বোলিং মার্কে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে দেখছিল। এবার বল করার জন্য ছুটতে শুরু করল এবং যখন মধ্যপথে, শ্রীমানী উইকেট থেকে তাড়াতাড়ি দু—পা পিছিয়ে গেল।

কী ব্যাপার! সকলের চোখ সাইট স্ক্রিনের দিকে ফিরল। দুর্যোধনের কুকুরটা সেখানে ঘাড় চুলকোতে ব্যস্ত।

হাবলোদা হেট হেট করে ছুটে যেতেই, বিস্মিত ও বিরক্ত হয়ে কুকুরটা লং অফ বাউন্ডারির দিকে সরে গেল। শ্রীমানী আবার চারিদিক পর্যবেক্ষণ করে তৈরি হয়ে দাঁড়াল। মুখে মৃদু হাসি।

অদ্ভুতভাবে তন্ময়ের অফ কাটারটা আধহাত বাইরে থেকে ভিতরে ঢুকে শ্রীমানীর অফ স্টাম্পটাকে শুইয়ে দিল। বেচারা শ্রীমানী। যে কোনও প্রথম শ্রেণীর ব্যাটসম্যান ওই বল সামলাতে হিমসিম খেয়ে যাবে।

দর্শকদের গুঞ্জন থেমে গেল। শ্রীমানী ফ্যালফ্যাল করে শায়িত স্টাম্পটির দিকে তাকিয়ে। তন্ময় কোমরে হাত রেখে হাসছে। ননীদা শুধু আম্পায়ারের উদ্দেশ্যে মাথাটা দু’বার নাড়লেন।

”নো বল।”

চমকে সবাই তাকিয়ে দেখল, হাবলোদা নির্বিকার মুখে ডান হাতটি ট্র্যাফিক পুলিশের মতো বাড়িয়ে দিয়েছে। শ্রীমানী ক্রিজ থেকে রওনা হয়েছিল, দাঁড়িয়ে পড়ল। ফিল্ডাররা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। তন্ময় ঘুরে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত চোখে হাবলোদার দিকে তাকিয়ে বোলিং মার্কে ফিরে গেল।

শ্রীমানী ক্রিজে দাঁড়িয়ে উইকেটকিপারকে বলল, ”নো বলটা ডাকতে লেট না হলে একটা ছক্কা দেখাতুম।”

পরের বল সোজা কপাল টিপ—করা। শ্রীমানী মুখের সামনে ব্যাটটা তোলার সময়টুকু মাত্র পেয়েছিল। বলটা কনুইয়ে লাগতেই খটাং শব্দ হল। তারপর টাল সামলাতে না পেরে ঘুরে পড়ল উইকেটের উপর। মড়াৎ করে স্টাম্প ভাঙার শব্দ হল। তন্ময় ঘুরে দাঁড়িয়ে আম্পায়ার হাবলোদাকে বলল, ”নো বল।”

মাঠের মধ্যে সর্বাগ্নে ছুটে গেল ক্যামেরা হাতে রঞ্জনবাবু, তারপর আমি। শ্রীমানীকে আটজন চ্যাংদোলা করে যখন আনছে, শ্রীমানী—গিন্নি রাগে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এল।

”দারুণ সাবজেক্ট মতিবাবু, দারুণ।” স্ন্যাপ নিতে নিতে রঞ্জনবাবু মহাফুর্তিতে বলে উঠল।

খপ করে শ্রীমানী—গিন্নি ক্যামেরাটা ছিনিয়ে নিয়ে মাটিতে আছাড় মেরে বলল, ”নিকুচি করেছে তোর সাবজেক্টের। হতভাগা মিনসে ছবি তোলার আর জিনিস পেল না। যা না মুখপোড়া ওই ফড়িংয়ের মতো মেয়েটার ফস্টিনস্টির ছবি তোল না গিয়ে।”

রঞ্জনবাবু নির্বাক। আমরা সবাই কী বলব বা করব ভেবে পাচ্ছি না। তন্ময় শান্ত গলায় বলল, ”এখুনি হাসপাতালে নিয়ে যান, বোধহয় কনুইয়ের হাড় ভেঙেছে।”

সপরিবারে শ্রীমানীকে গাড়িতে তুলে ননীদা পি জি হাসপাতালে রওনা হলেন। আমরা মুহ্যমান হয়ে নিচু গলায় কথা বলছি। দুর্যোধন এসে বলল, ”পাতা পাতি দিব কি?”

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। এরপর আর খেলার দরকার কী! রঞ্জনবাবু ক্যামেরার ভাঙা টুকরোগুলো হাতে নিয়ে আমার কাছে এসে বলল, ”মতিবাবু, আমার দামি ক্যামেরাটা আপনার জন্য ভাঙল।”

”আমার জন্য!”

”নিশ্চয়। আপনিই তো বলেছিলেন হোঁদল—কুতকুতটার ছবি তুলতে।” রঞ্জনবাবুর গলা ভারী হয়ে এল। কয়েক ফোঁটা জল চোখ থেকে নেমে গোঁফ ভিজিয়ে দিল। আমার তখন একটা কথাই মনে হল, অফিসের দরজা দিয়ে হাতি ঢুকে গেলে রঞ্জন সেনগুপ্ত তাকাবে না, কিন্তু আমার পরিচিত একটি মাছিকেও আর গলতে দেবে না।

ভবানী ভীষণ মনমরা হয়ে বলল,, ”এখুনি লাঞ্চ করার দরকার কী, আমার ব্যাটিংটা হয়ে গেলেই তো হতে পারত। মিনুর আবার কবে মাঠে আসার সময় হবে কে জানে।”

লাঞ্চের সময় তন্ময় বলল, ”সরি, আই অ্যাম রিয়েলি সরি। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দই সন্দেশ লেবুও গাড়ি করে চলে যাবে এটা একদম ভাবিনি। লাঞ্চটা আমিই মাটি করে দিলুম।”

কিন্তু সি সি এইচ—এর কী ক্ষতি হল, সেটা আমার মতো দু—চারজন ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারল না।

এইবারই আমার প্রথম ক্যাপ্টেনসি। রীতিমতো ভয় ভয় করছে। এতকাল ননীদার আওতায় খেলে এসেছি, কোনও ভাবনাচিন্তা ছিল না। পাহাড়ের আড়ালে ছিলাম। এখন বুঝতে পারছি ননীদাকে কতখানি দরকার। আমার অনভিজ্ঞতার কথা বলে ওঁর সাহায্য প্রার্থনা করতেই, ননীদা একগাল হেসে পিঠে গোটা চারেক থাপ্পড় মারলেন।

”অত ঘাবড়াবার কী আছে! এবারের টিম তো খুব খারাপ নয়! তাছাড়া ম্যাচ জেতা কিংবা হার বাঁচানো, সেটা তো আর সব সময় টিমের শক্তি দিয়ে হয় না, হয়—” ননীদা আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, অনুক্ত শব্দটি পূরণ করে দেব এই আশায়।

আমি বললাম, ”স্ট্র্যাটেজি।”

ননীদা ভীষণ খুশি চাপতে চাপতে বললেন, ”পারবে, তুমি পারবে। তবে তুমি একটু ভিতু গোছের আর চক্ষুলজ্জাটা একটু বেশি। ওসব থাকলে কিন্তু বিপদ কাটিয়ে বেরোতে পারবে না।”

”সেইজন্যই তো আপনার কাছে এলাম।”

ননীদা কয়েক মুহূর্ত ভেবে বললেন, ”স্ট্র্যাটেজি নির্ভর করবে স্থান, কাল আর পাত্র বিচার করে। এজন্য তিনটে জিনিসের উপর জোর দেবে; এক আইনের ফাঁক খুঁজে বার করে তার সুযোগ নেওয়া। বেশির ভাগই তো ক্রিকেট আইন না জেনে খেলতে নামে, তাছাড়া আইনের নানান ব্যাখ্যাও করা যায়। তুমি দেখো, অনেক ফাঁক বেরিয়ে পড়বে যেখান দিয়ে গলে যেতে পারবে। দুই, আম্পায়ারদের স্টাডি করবে। উকিলরা যেমন জজকে স্টাডি করে, তার মনের প্রবণতা, দুর্বলতার সুযোগ নেয়, তেমনি। সব আম্পায়ার যে আইনের মারপ্যাঁচ বোঝে তাও নয়। তা ছাড়া আইনের ব্যাখ্যা আর প্রয়োগ বেশ শক্ত ব্যাপার। মানুষ মাত্রই চাটু কথা পছন্দ করে, এটা ভুলে যেয়ো না। তিন অপোনেন্ট প্লেয়ারদের ঘাবড়ে দিয়ে নার্ভাস করা, ধাঁধাঁয় ফেলা। ডবলু জি গ্রেস এটা করত। জিততে হলে সব কিছু করতে হবে। ভদ্রতা করলে কোনও কিছুতেই জেতা যায় না, এই কথাটা বরাবর মনে রাখবে।”

ননীদার উপদেশ শিরোধার্য করে বিদায় নিয়েছিলাম। না করে উপায় নেই। ওই তিন থিওরি অনুসরণ করে ননীদা যে কতবার সি সি এইচ—কে উদ্ধার করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। কয়েকটার কথা জীবনে ভুলব না।

তরুণ মিলনের সঙ্গে খেলার কথা মনে পড়ল। ওদের ৪৮ রানে নামিয়ে দেওয়ার পর আমরা করলাম ৮ উইকেটে ৩২। হার অবধারিত। ননীদা তখন খেলতে নামলেন। আর একদিকে ব্যাট করছে অঞ্জন। ননীদা—নির্দেশিত ‘টিউবওয়েল টেপা’ ফরোয়ার্ড ডিফেনসিভ খেলে প্রায় আধঘণ্টা উইকেটে রয়েছে। ননীদা ক্রিজে পৌঁছে বলে দিলেন, ”বলের লাইনে পা, মাথা নিচু, স্ট্রেট ব্যাট। বাকি যা করার আমি করছি।”

এরপর ননীদা ননস্ট্রাইকার এন্ডে গিয়ে এগারো রানে ছয় উইকেট পাওয়া তরুণ মিলনের ওয়েস হলের সঙ্গে আলাপ শুরু করলেন। আমাদের দুজনের কপালে আলু তৈরি এবং একজনের দুটি দাঁত কমিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে এই বোলারটিই দায়ী। বাইশ পা দূরের বোলিং মার্কে ফিরে যাচ্ছে বোলারটি, ননীদাও তার সঙ্গে চললেন কথা বলতে বলতে।

”অনেক বড় বড় স্পিনার দেখেছি—ভেরিটি থেকে শুরু করে প্রসন্ন পর্যন্ত, কিন্তু কোনও স্পিনারকে আপনার মতো এতটা দৌড়ে এসে বল করতে দেখিনি।” ননীদা দারুণ বিস্মিত স্বরে বললেন।

”স্পিনার!” বোলারটি থেমে গেল। ”আমি স্পিনার? আপনি অন্ধ নাকি! আমার বল দেখে কি আপনার তাই মনে হল?”

”সেই রকমই তো লাগছে!” নিরীহ মুখে ননীদা একগাল হাসলেন।

রাগে বোলারটির চোখ দুটি ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম। কথা না বলে সে আবার বোলিং মার্কের দিকে চলল, সঙ্গে ননীদাও।

”তবে মানতেই হবে, গুপ্তে কি রামাধিন কি বেনোর থেকে কিছুটা জোরে বল করেন।”

মার্কে পৌঁছে বোলারটি ঘুরে দাঁড়াল। দু’চোখ দিয়ে এবার আগুন বেরোচ্ছে। ননীদা ভ্রূক্ষেপ না করে বলে চললেন, ”আপনার বোলিং অ্যাকশন অনেকটা ফাস্ট বোলারেরই মতো, চেহারাটাও বেশ, তা হলে জোরে বল করেন না কেন?”

”আম্পায়ার!” তরুণ মিলনের ওয়েস হল বাইশ পা দূর থেকে চিৎকার করে উঠল।

”আপনি কি এ লোকটার কাণ্ড দেখতে পাচ্ছেন না? একে থামাবেন তো!”

আম্পায়ার কী একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ননীদা চিৎকার করলেন, ”আম্পায়ার, আইনে কোথাও কি বলা আছে যে, বোলারের সঙ্গে কেউ হাঁটতে পারবে না?”

মাথায় টোকা দিতে দিতে আম্পায়ার খুবই বিজ্ঞের মতো বলল, ”ঠিক ঠিক। আইনে বারণ করা নেই।”

বোলারটি বিড়বিড়িয়ে কতকগুলো অনুচ্চচার্য শব্দ মুখ থেকে নির্গত করে ছুটতে শুরু করা মাত্র ননীদাও ওর সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে লাগলেন—”নো বল যেন না হয়। বোলিং ক্রিজের দিকে নজর রাখুন।”

তখনি বোলারটির দৌড়ের মধ্যে কী একটা গোলমাল হয়ে গেল, ফলে ডেলিভারির সময় ডান পাটি বোলিং ক্রিজের এক হাত বাইরে বেরিয়ে গেল। অঞ্জন ‘নো বল’ শোনামাত্র ননীদার নির্দেশ ভুলে গিয়ে চোখ বুজে ব্যাট চালাল। মাঠের সবাই মাথা তুলে দেখল, বলটি চমৎকারভাবে মিড উইকেট বাউন্ডারি টপকে ছটা রান সংগ্রহ করছে।

বোলারটি কটমট করে ননীদার দিকে তাকাতেই, ননীদা বিমর্ষ কণ্ঠে বললেন, ”বলেছিলুম বোলিং ক্রিজের দিকে নজর রাখুন। কথাটা শুনলেন না।”

পরের বল দেবার জন্য বোলার বোলিং মার্কে যাবার সময় ননীদা আবার তার সঙ্গ নিল।

”আম্পায়ার, দেখতে পাচ্ছেন না লোকটা কী করছে!”

”দেখেছি”, আম্পায়ার উদাসী গলায় বলল, ”সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। আইনে বারণ করা নেই।”

বল করার জন্য ছুটতে শুরু করামাত্র ননীদা চাপাস্বরে বললেন, ”এবার যেন নো বল না হয়, বোলিং ক্রিজে নজর রাখুন।”

এবার নো বল হল না। কিন্তু বোলিং ক্রিজে চোখ রাখার ফলেই, বল হাত থেকে বেরিয়ে যে—পথ ধরে এগোল তাতে থার্ড শ্লিপের পরলোকগমন অবশ্যম্ভাবী ছিল, যদি না সে ‘বাপরে’ বলে গালির ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ত। আম্পায়ার ওয়াইড সঙ্কেত দেখাতে গিয়ে বাই বাউন্ডারি সঙ্কেত দেখাল।

আট উইকেটে ৪২। আর সাত রান করলেই আমাদের জিত। ননীদা ছায়ার মতো বোলারকে অনুসরণ করে চললেন। এবার বোলারটি আর সহ্য করতে না পেরে হাতা গুটিয়ে ননীদার দিকে এগোতেই, ননীদা ছুটে আম্পায়ারের কাছে এসে বললেন, ”দেখুন, মারতে আসছে।”

”ইউ ব্লাডি…(ছাপার অযোগ্য)…ইউ উল্লুক…(ছাপার অযোগ্য)…খুন করে ফেলব।”

”শুনলেন আম্পায়ার, শুনলেন!” ননীদা ঢালের মতো আম্পায়ারকে সামনে রেখে চেঁচাতে লাগলেন। ”ক্রিকেটের মতো খেলায় এই রকম অসভ্য গালাগাল!”

”নিকুচি করেছে তোর ক্রিকেটের।” বোলারটি সোজা এক রাইট হুক চালাল। ননীদা দক্ষতার সঙ্গে ঢালের আড়ালে আশ্রয় নিলেন। আম্পায়ার ”বাবা রে” আর্তনাদ করে ধীরে ধীরে বাঁ গালে হাত চেপে বসে পড়ল।

এক সপ্তাহ পরে আম্পায়ারের রিপোর্টের ভিত্তিতে সি এ বি লিগ সাব—কমিটি আমাদের পুরো পয়েন্ট দেয়। বোলারটি এক বছরের জন্য সাসপেন্ড হয়। তখন ননীদা শুধু বললেন, ”ট্যাকটিকস।”

স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমার দ্বারা এইরকম ট্যাকটিকস উদ্ভাবন সম্ভব নয়। কথাবার্তা ভাল করে গুছিয়ে বলতে পারি না, গায়ে পড়ে আলাপও জমাতে পারি না। অথচ ননীদার ট্যাকটিকস প্রয়োগ করতে হলে কথা বলাটাকে যে শিল্পের পর্যায়ে উঠিয়ে আনতে হবে, সেটা একবার হৃদয়ঙ্গম করেছিলাম ইস্ট সাবার্বানের সঙ্গে খেলায়।

মাঠে নামার মুখে আম্পায়ার দুজনের মধ্যে যে বয়স্ক, ননীদা তার সঙ্গে আলাপ শুরু করে দিলেন।

”আরে অনেকদিন পর দাদার সঙ্গে দেখা হল, আছেন কেমন?”

”আর থাকা। চলে যাচ্ছে একরকম করে। আপনি কেমন আছেন?” আম্পায়ার যথোচিত সৌজন্য দেখাল।

”আপনি যা বললেন, চলে যাচ্ছে একরকম করে।” ননীদা ঝট করে গলা নামিয়ে ফেলে বললেন, ”বুড়ো বয়সেও খেলতে নামতে হচ্ছে। এখনকার ছোকরার কিসসু জানে না। বোঝেও না। আমাকে এখনও ঠেকা দিয়ে যেতে হচ্ছে। স্টান্ডার্ড যে কোথায় নেমে গেছে, আপনাকে আর বোঝাব কী, নিজের চোখেই তো দেখছেন।”

আম্পায়ার অনুমোদনসূচক মাথা নাড়ল।

”ক্রিকেট খেলতে আসে অথচ ক্রিকেটের আইন জানে না। আজেবাজে অ্যাপিল করে, ঝগড়া করে, জোচ্চচুরি করে, খেলাটাকেই মাটি করে দেয়, যাকগে ওসব কথা, বাতের ব্যথাটা এখন কেমন?”

”মাঝে মাঝে চাগাড় দিচ্ছে।” আম্পায়ার যথেষ্ট অবাক হয়েই বলল। অবাক হবার কারণ, ননীদা জানল কী করে?

”আমাদের পাড়ায় এক কোবরেজের অদ্ভুত একটা তেল আছে। আমার কাকিমার পনেরো বছরের পুরনো বাত, মাত্র দু’ হপ্তা ব্যবহার করেই সেরে গেল।”

”সত্যি!” আম্পায়ার ব্যস্ত হয়ে বলল, ”ঠিকানাটা দেবেন?”

”উহুঁ ননীদা দুষ্ট দুষ্টু হেসে বললেন, ”কোবরেজের ঠিকানা নয়, আপনার ঠিকানা দিন। তৈরি করিয়ে আমি নিজে আপনাকে দিয়ে আসব। খেলার শেষে বরং আমাকে লিখে দেবেন।”

এইখান থেকেই ইস্ট সাবার্বানের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। ননীদা যখন বল করতে এলেন, তখন সাবার্বানের বিনা উইকেটে ৪১ রান। ওর প্রথম বলটা অনেকখানি ঘুরল, অফ স্টাম্প থেকে শর্ট ফাইন লেগে। সুইপ করতে গিয়ে ব্যাটসম্যান ফসকাল এবং প্যাডে লাগল। আম্পায়ারের দিকে ঘুরে ননীদা দু’হাত তুলেই জিভ কাটলেন। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে যেন নিজের মনেই বললেন, ”হয়নি হয়নি, আপিল করা চলে না। বেরিয়ে যাচ্ছিল বল।” তারপর বেশ গম্ভীর হয়ে আম্পায়ারকে বললেন, ”এখনকার ছোকরারা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করত।”

বাতের হাত থেকে মুক্তিকামী আম্পায়ার দ্রুত ঘাড় নেড়ে ননীদাকে খুশি করল। দুটি বল পরেই অফ স্টাম্পের এক হাত বাইরে, ব্যাটসম্যান প্যাড প্লে করতেই ননীদা লাফিয়ে ”হা—আ—আ—উ” বলেই হাত দিয়ে মুখ চেপে আপিলটা আর সম্পূর্ণ করলেন না। ঘাড় বেঁকিয়ে বলের পিচের দিকে ২৫ সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন। তারপর প্রায় অনুনয়ের সুরে বললেন, ”ইগনোর ইট আম্পায়ার, কমপ্লিটলি ইগনোর দ্য আপিল। সরি, ভেরি সরি আপনাকে বিরক্ত করার জন্য।”

”তাতে কী হয়েছে, উত্তেজনায় ও রকম মুখ থেকে বেরিয়ে যায়ই।” আম্পায়ার সান্ত্বনা দিয়ে বলল।

কিন্তু কেন বেরোবে?” ননীদা অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হতে বললেন, ”ডেড শ্যিওর না হয়ে কেন আপিল করব?”

ওভার শেষে মাথা নাড়তে নাড়তে ননীদা মিড অনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আম্পায়ার গেল স্কোয়ার লেগে। পরের ওভারের দ্বিতীয় বলে ব্যাটসম্যানরা বিপজ্জনক একটি রান নিল। ননীদা বলটা উইকেটকিপারকে ছুড়তেই সে যখন উইকেট ভেঙে দিল, নন—স্ট্রাইকার তখন পপিং ক্রিজে পৌঁছে, পেরিয়ে গেছে। ননীদা চিৎকার করে উঠলেন রান আউটের আপিল করে। স্কোয়ার লেগ আম্পায়ার দ্বিধা না করে আঙুল তুলল।

”গুড ডিসিশ্যান।” ননীদা আম্পায়ারকে শুনিয়ে তারিফ করলেন। বিস্মিত ব্যাটসম্যানটি আম্পায়ারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রওনা হল। আমি ছিলাম সেকেন্ড শ্লিপে। এমন ডাহা বাজে রান আউট কল্পনা করা যায় না। একসময় ননীদাকে চাপা গলায় বললাম, ”ব্যাপার কী?”

”সাইকোলজি।” ননীদা জবাব দিলেন।

”ওর বাত আছে, সেটা কি জানতেন?”

”একদমই নয়। তবে পঞ্চাশ বয়সের উপর শতকরা ষাটটা বাঙালিরই তো বাত, নয়তো অম্বল আছে। তেল নয়তো বড়ি, দুটোর একটা লেগে যাবেই।”

”যদি লোকটার বাত না থাকত?”

”তা হলে ওর বাবা মা জ্যাঠা জ্যাঠি কারুর না কারুর তো পাওয়া যাবেই।”

ননীদার আপিলে সেই আম্পায়ারের কাছ থেকে চারটি এল বি ডবল্যু, দুটি কট বিহাইন্ড, একটি স্টাম্পিং ও দুটি রানআউট পেয়ে আমরা বিনা উইকেটে ৪১ রানের ইস্ট সাবার্বানকে ৬২ রানে নামিয়ে দিলাম।

কয়েকদিন পরে ননীদাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, তিসির তেলে রসুন, গোবর, কাঁচা লঙ্কাবাটা মিশিয়ে এক শিশি পাঠিয়ে দিয়েছেন আম্পায়ারকে। আমরা পরে ননীদার এই সব ট্যাকটিকসের নাম দিয়েছিলাম—ননীটিকস।’

আর একটি ননীটিকসও সিজনের প্রথম খেলার দিন সকালে মনে পড়ে গেল। ব্যাটসম্যান যখন খেলার জন্য তৈরি হচ্ছে এবং বোলার বল করায় উদ্যত, তখন সেকেন্ড শ্লিপ থেকে উইকেটকিপারের সঙ্গে ননীদার কথা বলে যাওয়া। ব্যাটসম্যান বল খেলুক, খেলতে গিয়ে ফসকায় বা ইচ্ছে করে ছেড়ে দিক—ননীদা কিন্তু সমানে ”আ হ হ হ” ”উ হ হ হ”, ”ই স স স”, ”আর একচুল যদি বলটা ঘুরত,” ”এবার নির্ঘাত গালিতে হয়ে যাবে” ইত্যাদি রানিং কমেন্টারি করে যাবেনই। স্টাম্পের এক গজ বাইরে গিয়ে বল বেরিয়ে গেলেও এমন করবেন যেন উইকেট ভেদ করে গেল।

নতুন ব্যাটসম্যান উইকেটে এসে দেখত ননীদা ভুরু কুঁচকে গম্ভীর মুখে গুডলেংথের কাছাকাছি একটা জায়গার দিকে তাকিয়ে। তারপর ব্যাটসম্যানকে শুনিয়ে আমাকেই বলতেন, ”একই রকম আছে হে মতি, ঠিক সেই রকম। কালও দুর্যোধনকে পইপই বলেছি, ভাল করে রোলার টানবি, নয়তো কোনদিন যে মানুষ খুন হবে কে জানে।

এই সময় আমার কাজ হল লক্ষ করা—ব্যাটসম্যান উৎকর্ণ হয়েছে কি না। যদি হয় তা হলে বলব, ”সত্যিই খেলা যায় না। তপনের কথা ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে…ভাল কথা, ননীদা কাল হাসপাতালে গেছলেন?”

”না গেলেই ভাল ছিল, চোয়ালটা ঠিকমতো সেট হয়নি, মুখটা বেঁকে আছে। সামনের দাঁত দুটোরও কিছুই করার নেই।”

”তা হলে চিত্তকে আস্তে বল করতে বলুন।” আমি ভীষণভাবে উদ্বেগ দেখাই।

”এখনও তো বল লাফায়নি। আগে দেখি লাফায় কি না।”

এরপর ব্যাটসম্যানের টিকে থাকা বা না থাকা নির্ভর করে তার নার্ভের ক্ষমতার উপর। তবে প্রায় ক্ষেত্রেই দু’ওভারের মধ্যেই তারা ফিরে যায়। ননীদা তাঁর এই ট্যাকটিকসকে বলেন—প্রোপাগান্ডা।

আমার প্রথম ম্যাচ, ভ্রাতৃসঙ্গের বিরুদ্ধে ননীদার প্রোপাগান্ডা ট্যাকটিকস প্রয়োগ করলাম। ওদের সাত নম্বর ব্যাটসম্যানটি এগারো রান করে আট ঘণ্টা ধরে অটল অনড় হয়ে রীতিমতো জ্বালাচ্ছে। শুরু করলাম নতুন উইকেটকিপার বিষ্ণু মিশ্রের সঙ্গে পিচের ভয়াবহতা এবং গত ম্যাচে তপনের মুখমণ্ডল কী আকৃতি ধারণ করেছে সেই বিষয়ে উদ্বেগজনক আলোচনা। বিষ্ণু রীতিমতো অবাক হয়ে বলল, ”তপন তো লং অনে ফিল্ডিং করছে।”

চট করে লক্ষ করলাম, ব্যাটসম্যানটি আমাদের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসছে। তাতে বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম। অবশেষে আর থাকতে না পেরে পরের ওভারে তাকে বললাম, ”পিচটা খুবই খারাপ, তাই না?”

ব্যাটসম্যান লাজুক হাসল।

”আগের ম্যাচে আমাদের বেস্ট ডিফেনসিভ ব্যাট তপন ঘোষের চোয়াল আর দাঁত ভেঙেছে। মালীটাকে এবার তাড়াতেই হবে, কিসসু কাজ করে না।”

ব্যাটসম্যান আবার লাজুক হাসল।

”তারককে অবশ্য বলে দিয়েছি, ওভারপিচ হয় হোক, তবু ওই স্পটে যেন বল না ফেলে। ম্যাচ জেতার জন্য তো আর মানুষ খুন করা যায় না।”

ব্যাটসম্যান এবারও হাসল আরও জড়োসড়ো হয়ে। আমি অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে গেলাম। পরের ওভার শুরুর আগে অপর ব্যাটসম্যানকে বললাম, ”আপনার পার্টনারটি কেমন লোক মশাই, একটা কথারও জবাব দেয় না, শুধু হাসে?”

সখেদে উত্তর পেলাম, ”আমাদেরও এই একই মুশকিল হয়, হাবু একদমই কালা আর বোবা।”

ননীটিকসকে এই প্রথম ব্যর্থ হতে দেখলাম।

চাঁদমোহন শ্রীমানী জানিয়ে দিয়েছে তার ব্যবসায় এখন মন্দা যাচ্ছে, পাঁচশো টাকার বেশি দিতে পারবে না। আমরা বুঝলাম তন্ময়ের জন্যই ক্লাবের হাজার টাকা জরিমানা হল। এত বড় ধাক্কা সামলানো ক্লাবের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। ননীদা দারুণ মুষড়ে পড়লেন। আমি বললাম, ”গোটা চার—পাঁচ ম্যাচ খেলে বরং এই সিজনের মতো খেলা বন্ধ করে দেওয়া যাক, তাতে খরচ বাঁচবে।”

”সে কী কথা!” ননীদা যতটা না অবাক হলেন তার থেকে বেশি রেগে উঠলেন। ”একটা বাঁদরের উৎপাতে সি সি এইচ খেলা বন্ধ করে দেবে? আমাদের ট্র্যাডিশন আছে, তা থেকে সরে আসব আমি বেঁচে থাকতে?”

এরপর আর আমি সাহস পাইনি জিজ্ঞাসা করতে—বাঁদরটা কে, শ্রীমানী না তন্ময়?

দ্বিতীয় লিগ ম্যাচে তন্ময় ১০৮ নট আউট রইল। ম্যাচ জিতলাম। এগারো বছর পর এই প্রথম সি সি এইচ—এর কেউ সেঞ্চুরি করল। ক্লাবের ট্র্যাডিশন, কেউ সেঞ্চুরি করলেই একটা নতুন ব্যাট পায়। এ কথাটা ননীদা প্রতি বছর সিজনের শুরুতেই জানিয়ে দেন। এ বছরও দিয়েছেন।

খেলা শেষে তন্ময় কথাটা মনে করিয়ে দিল ননীদাকে। খুব মেজাজে ছিলেন ননীদা, বললেন, ”আলবৎ পাবে। কথার খেলাপ আমার হয় না।”

”তাই বলে কাঁঠাল কাঠের ব্যাট যেন দেবেন না। জি কে—র ব্যাট চাই।”

”নিশ্চয় নিশ্চয়।”

”কবে দিচ্ছেন?”

”সামনের হপ্তায়ই পেয়ে যাবে।”

ননীদাকে একসময় বললাম, ”শ’খানেক টাকার কমে তো ব্যাট হবে না। পাবেন কোত্থেকে? ক্লাবের যা অবস্থা!”

”আরে টাকা ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে। দেখলে, ফাস্ট বোলারটাকে যে ছয়টা মারল সেকেন্ড ওভারে? এগিয়ে যেই দেখল পাবে না, সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে ব্যাকফুটে স্ট্রেট বোলারের ওপর দিয়ে। ছেলেটার হবে, বুঝলে মতি! এত বছর গড়ের মাঠের ঘাসে চরছি, বুঝতে ঠিকই পারি। তবে বড্ড ডেয়ারিং, অধৈর্য, রিস্কি শট নেয়। ওকে তুমি একটু কন্ট্রোল করো। আমার কথা তো শুনবে না।”

বললাম, ”আমার কথাও শুনবে না। আজকাল ছেলেরা একটু অন্য রকম, বোঝেনই তো।”

পরের ম্যাচ খেলতে নামার আগে তন্ময় তাঁবুর মধ্যে চিৎকার করে সবাইকে শুনিয়েই বলল, ”ব্যাটটা যে এখনও পেলুম না। দেবেন তো, নাকি ক্যালকাটা কর্পোরেশন হয়ে থাকবেন?”

”না, না, অবশ্যই দোব।” ননীদা খানিকটা কাঁচুমাচু হয়ে বললেন।

এ খেলায় তন্ময় ১০১ করল। ননীদা আহ্লাদে যে কী করবেন, ভেবে পেলেন না। আমি শুধু বললাম, ”আর একখানা ব্যাট দিতে হবে, মনে থাকে যেন!”

”রেখে দাও তোমার ব্যাট!” ননীদা ধমকে উঠলেন। ”কলকাতার ক’টা ব্যাটসম্যান পারে লেগ স্টাম্পের বাইরে সরে এসে লেগের বল অমন করে স্কোয়ার কাট করতে? মতি, তুমি ব্যাটের কথাই শুধু ভাবছ, ছেলেটা যে আর্টিস্ট সেটা বলছ না!’

চুপ করে রইলাম। লাঞ্চের সময়ই, যা আন্দাজ করেছিলাম তাই ঘটল। তন্ময় টেবিলে বসেই হেঁকে বলল, ”আগের ব্যাটটা তো এখনও পেলুম না। আর কতদিন সময় দিতে হবে, ননীদা?”

”পাবে, পাবে! এক সঙ্গেই দুটো পাবে!”

”ঠিক আছে! তবে সামনের ম্যাচের আগে না পেলে আমি আর আসছি না।”

কথামতোই তন্ময় এল না পরের ম্যাচে। দুটো কেন, একটা ব্যাট দেওয়ার সামর্থ্যও সি সি এইচ—এর নেই। তন্ময় ব্যাট না পাওয়ায় অন্য প্লেয়াররাও গুঞ্জন তুলল। আমরা চার উইকেটে ত্রিবেণী ইউনাইটেডের কাছে হারলাম। পরের খেলা রূপোলি সঙ্ঘের সঙ্গে। এখন রূপোলির ক্যাপ্টেন চিতু। দুটো ম্যাচ খেলে, তন্ময় একাই ম্যাচ দুটো জিতিয়ে দিয়েছে। মনের মধ্যে একটা ক্ষীণ আশা জেগেছে, সি সি এইচ চ্যাম্পিয়ন হবার চেষ্টা করলে এবার বোধ হয় হতে পারবে। শক্ত গাঁট রূপোলি সঙ্ঘ। ওরা আর আমরা যেন মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল। একের কাছে অন্যের হার কল্পনাতীত ব্যাপার।

রূপোলি সঙ্ঘের সঙ্গে সি সি এইচ—এর হাড্ডাহাড্ডির শুরু পঁচিশ বছর আগে শনিবারের একটা ফ্রেন্ডলি হাফ—ডে খেলা থেকে। ননীদা এমন এক ননীটিকস প্রয়োগ করে ম্যাচটিকে ড্র করান, যার ফলে এগারো বছর রূপোলি সঙ্ঘ আমাদের সঙ্গে আর খেলেনি। গল্পটা শুনেছি মোনা চৌধুরীর (অধুনা মৃত) কাছে। মোনাদা এ খেলায় ক্যাপ্টেন ছিলেন। উনি না বললে এটাকে শিব্রাম চকরবরতির লেখা গল্প বলেই ধরে নিতাম।

সি সি এইচ প্রথম ব্যাট করে ১৪ রানে সব আউট হয়ে যায়। মোনাদা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন ড্রেসিং রুমে। সবারই মুখ থমথম। এক ওভার কি দু’ওভারেই রূপোলি সঙ্ঘ রানটা তুলে নেবে। ওদের ড্রেসিং—রুম থেকে নানান ঠাট্টা এদিকে পাঠানো হচ্ছে। ক’টা বলের মধ্যে খেলা শেষ হবে তাই নিয়ে বাজি ধরছে। রূপোলির ক্যাপ্টেন এসে বলল, ”মোনা, আমরা সেকেন্ড ইনিংস খেলে জিততে চাই, রাজি?” মোনাদা জবাব দেবার আগেই ননীদা বলে উঠলেন, ”নিশ্চয় আমরা খেলব। তবে ফার্স্ট ইনিংসটা আগে শেষ হোক তো!”

সবাই অবাক হয়ে তাকাল ননীদার দিকে। রূপোলির ক্যাপ্টেন মুচকি হেসে, ”তাই নাকি?” বলে চলে গেল। ননীদা বললেন, ”এ ম্যাচ রূপোলি জিততে পারবে না। তবে আমি যা বলব তাই করতে হবে।”

মোনাদা খুবই অপমানিত বোধ করছিলেন রূপোলির ক্যাপ্টেনের কথায়, তাই রাজি হয়ে গেলেন। তখন বিষ্টুকে একধারে ডেকে নিয়ে ননীদা তাকে কী সব বোঝাতে শুরু করলেন আর বিষ্টু শুধু ঘাড় নেড়ে যেতে থাকল। তিরিশ মাইল রোড রেসে বিষ্টু পর পর তিন বছর চ্যাম্পিয়ন। শুধু ফিলডিংয়ের জন্যই ওকে মাঝে মাঝে দলে নেওয়া হয়। ব্যাট চালায় গাঁইতির মতো, তাতে অনেক সময় একটা—দুটো ছক্কা উঠে আসে।

রূপোলি ব্যাট করতে নামল। ননীদা প্রথম ওভার নিজে বল করতে এলেন। প্রথম বলটা লেগস্টাম্পের এত বাইরে যে, ওয়াইড সঙ্কেত দেখাল আম্পায়ার। দ্বিতীয় বলে ননীদার মাথার দশ হাত উপর দিয়ে ছয়। তৃতীয় বলে পয়েন্ট দিয়ে চার। পরের দুটি বলে, আশ্চর্য রকমের ফিল্ডিংয়ে কোনও রান হল না। শেষ বলেই লেগবাই। বিষ্টু লং অন থেকে ডিপ ফাইন লেগে যেভাবে দৌড়ে এসে বল ধরে, তাতে নাকি রোম ওলিম্পিকের ১০০ মিটারে সোনার মেডেল পাওয়া যেত। তা না পেলেও বিষ্টু নির্ঘাত বাউন্ডারি বাঁচিয়ে যখন উইকেটকিপারকে বল ছুড়ে দিল, রূপোলির দুই ব্যাটসম্যান তখন তিনটি রান শেষ করে হাঁফাচ্ছে।

ওভার শেষ। স্কোর এখন সমান—সমান। দু’দলেরই ১৪। বিষণ্ণতায় সি সি এইচ—এর সকলের মুখ ম্লান। শুধু ননীদার মুখে কোনও বিকার নেই। সাধারণত অতুল মুখুজ্জেই এরপর বল করে। সে এগিয়ে আসছে কিন্তু তাকে হাত তুলে নিষেধ করে ননীদা বলটা দিলেন বিষ্টুর হাতে। সবাই অবাক। বিষ্টু তো জীবনে বল করেনি। কিন্তু কথা দেওয়া হয়েছে, ননীদা যা বলবেন তাই করতে দিতে হবে। বিষ্টু গুনে গুনে ছাব্বিশ কদম গিয়ে মাটিতে বুটের ডগা দিয়ে বোলিং মার্ক কাটল। ব্যাটসম্যান খেলার জন্য তৈরি। বিষ্টু তারপর উইকেটের দিকে ছুটতে শুরু করল।

বোলিং ক্রিজে পৌঁছবার আগে অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটল। বিষ্টু আবার পিছু হটতে শুরু করেছে। তারপর গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করল। সারা মাঠ অবাক, শুধু ননীদা ছাড়া।

বিষ্টু কি পাগল হয়ে গেল? ঘুরছে, পাক খাচ্ছে, ঘুরছে আবার পাক খাচ্ছে, লাফাচ্ছে, বোলিং মার্কে ফিরে যাচ্ছে, ডাইনে যাচ্ছে, বাঁয়ে যাচ্ছে কিন্তু বল হাতেই রয়েছে।

”এ কী ব্যাপার।” রূপোলির ব্যাটসম্যান কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল, ”বোলার এভাবে ছুটোছুটি করছে কেন?”

ননীদা গম্ভীর হয়ে বললেন, ”বল করতে আসছে।”

”এসে পৌঁছবে কখন?”

”পাঁচটার পর। যখন খেলা শেষ হয়ে যাবে।”

এরপরই আম্পায়ারকে ঘিরে তর্কাতকি শুরু হল। ননীদা যেন তৈরিই ছিলেন, ফস করে পকেট থেকে ক্রিকেট আইনের বই বার করে দেখিয়ে দিলেন, বোলার কতখানি দূরত্ব ছুটে এসে বল করবে, সে সম্পর্কে কিছু লেখা নেই। সারাদিন সে ছুটতে পারে বল ডেলিভারির আগে পর্যন্ত।

বিষ্টু যা করে যাচ্ছিল তাই করে যেতে লাগল। ব্যাটসম্যান ক্রিজ ছাড়তে ভরসা পাচ্ছে না, যদি তখন বোল্ড করে দেয়। ফিল্ডাররা কেউ শুয়ে, কেউ বসে। ননীদা মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছেন আর হিসেব করে বিষ্টুকে চেঁচিয়ে বলছেন, ”আর দেড় ঘণ্টা!” …”আরও এক ঘণ্টা!”…”মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট!”

কথা আছে পাঁচটায় খেলা শেষ হবে। পাঁচটা বাজতে পাঁচে নতুন এক সমস্যার উদ্ভব হল। বল ডেলিভারি দিতে বোলার ছুটছে, তার মাঝেই খেলা শেষ করা যায় কি না? দুই আম্পায়ার কিছুক্ষণ আলোচনা করে ঠিক করলেন, তা হলে সেটা বেআইনি হবে।

সুতরাং বিষ্টুর পাক দিয়ে দৌড়নো বন্ধ হল না। মাঠের ধারে লোক জমেছে। তাদের অনেকে বাড়ি চলে গেল। অনেক লোক খবর পেয়ে দেখতে এল। ব্যাটসম্যান সান্ত্রীর মতো উইকেট পাহারা দিয়ে দাঁড়িয়ে। সন্ধ্যা নামল। বিষ্টু ছুটেই চলেছে। চাঁদ উঠল আকাশে। ফিল্ডাররা শুয়েছিল মাটিতে। ননীদা তাদের তুলে ছ’জনকে উইকেটকিপারের পিছনে দাঁড় করালেন, বাই রান বাঁচাবার জন্য। এরপর বিষ্টু বল ডেলিভারি দিল।

রূপোলির ব্যাটসম্যান অন্ধকারে ব্যাট চালাল এবং ফসকাল। সেকেন্ড শ্লিপের পেটে লেগে বলটা জমে গেল। ননীদা চেঁচিয়ে উঠলেন, ”ম্যাচ ড্র।”

রূপোলির ব্যাটসম্যান প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, বল ডেলিভারির মাঝে যদি খেলা শেষ করা না যায়, তা হলে ওভারের মাঝেও খেলা শেষ করা যাবে না। শুরু হল তর্কাতর্কি। বিষ্টুকে আরও পাঁচটা বল করে ওভার শেষ করতে হলে, জেতার জন্য রূপোলি একটা রান করে ফেলবেই—বাই, লেগবাই, ওয়াইড যেভাবেই হোক। কিন্তু ননীদাকে দমানো সহজ কথা নয়। ফস করে তিনি আলোর অভাবের আপিল করে বসলেন। চটপট মঞ্জুর হয়ে গেল।

আমার ধারণা, মোনাদা কিছুট রং ফলিয়ে আমাকে গল্পটা বলেছেন। আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তগুলো, ফ্রেন্ডলি ম্যাচে হলেও, সঠিক হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু ননীদাকে যারা ঘনিষ্ঠভাবে জানে, তারা কেউ এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন তুলবে না।

তন্ময়ের অনুপস্থিতিতে আমাকে ব্যস্ত করে তুলল।

ঠিকানা জোগাড় করে তন্ময়ের বাড়ি হাজির হলাম। সরু গলি। আধা—বস্তি অঞ্চল। নম্বর অনুযায়ী কড়া নাড়তে এক প্রৌঢ়া দরজা খুললেন। তাঁর চেহারা ও বেশে দারিদ্র্যের তকমা আঁটা কিন্তু কথায় ও আচরণে প্রাক্তন আভিজাত্যের ছাপ। উনি তন্ময়ের মা।

”তমু তো দু’ দিন হল বাড়ি নেই। বর্ধমানের কোথায় যেন ফুটবল খেলতে গেছে।”

গ্রামাঞ্চলে শীতকালেই ফুটবল টুর্নামেন্টগুলো হয়। কলকাতার ফার্স্ট ডিভিসন ফুটবলারদের তখন ভাড়া পাওয়া যায়। তা ছাড়া, ধান ওঠার পর অবসর ও অর্থ দুই—ই তখন হাতে আসে। এক—একটা গ্রামের ফুটবল টিমে কলকাতারই এগারোজনকে দেখা যায়। এই রকমই কোনও টিমের হয়ে তন্ময় ভাড়া খেলতে গেছে। আমার ঠিকানা দিয়ে বললাম, ”তন্ময় ফিরলেই যেন আমার সঙ্গে দেখা করে।”

দু’দিন পরই তন্ময় আমার বাড়িতে এল।

”হল না, মতিদা। পরপর দুটো জায়গায় সেমিফাইনাল আর ফাইনাল খেললুম। দুটোতেই ডিফিট, মোট একশো কুড়ি টাকা পাওয়ার কথা—পেলুম পঞ্চান্ন।”

”ফুটবল খেললে ক্রিকেটের বারোটা বাজবে!” ক্ষুণ্ণস্বরে বললাম, ”কখন চোট লাগবে কে বলতে পারে!”

তন্ময় হাসল। বলল, ”বাঁ—কাঁধটা নাড়তে কষ্ট হচ্ছে, ব্যাকটা এমন ঝাঁপিয়ে পড়ল।” তারপরই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, ”আমি জানি কেন দেখা করতে বলেছেন। দুটো সেঞ্চুরির জন্য দুটো ব্যাট আমার পাওনা হয়েছে। না পেলে আমি যাব না আর।”

”কিন্তু আমাদের ক্লাব গরিব, কুড়িয়ে বাড়িয়ে কোনওক্রমে টিকে আছে। তুমি এ দিকটা নিশ্চয় বিবেচনা করবে।”

”আমিও গরিব। কুড়িয়ে বাড়িয়েই চলে আমাদের সাত জনের সংসার। বাবার যা রোজগার তাতে টেনেটুনে পনেরো দিনের বেশি চলে না। আমি বড় ছেলে, প্রি—ইউ পাশ, মাঝে মাঝে ফুটবল খেলার কয়েকটা টাকা বাড়িতে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই সাহায্য করতে পারি না। ব্যাট দুটো পেলে বিক্রি করে কিছু টাকা মাকে দিতে পারব। ক্লাব যদি ব্যাটের বদলে তার দামটা দেয় তা হলে আমি যাব। আমার এখন একটা চাকরি ভীষণ দরকার।”

”চাকরি বা টাকা, কোনওটা দেওয়াই আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”

”তা হলে আমার পক্ষেও খেলা সম্ভব নয়।”

কথাটা ননীদাকে জানালাম।

বললাম, ”রূপোলির কাছে গত দশ বছর আমরা হারিনি। ভবানী জানিয়েছে, পুরী বেড়াতে যাচ্ছে, তাই খেলতে পারবে না, বিষ্টুর পেটের গোলমাল, কাল থেকে অফিস যাচ্ছে না। কাকে নিয়ে তা হলে খেলব?”

শুনে ননীদা শুকনো হেসে বললেন, ”আচ্ছা, ব্যাটের টাকা জোগাড় করছি।”

রূপোলি সঙ্ঘের সঙ্গে খেলার দিন তন্ময়কে কিটব্যাগ হাতে হাজির হতে দেখে অবাক হলাম। ননীদা কোন ননীটিকস প্রয়োগ করে ওকে হাজির করালেন, সেটা জানার জন্য ননীদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ”টাকা পেলেন কোথায়?”

”কীসের টাকা?”

”ব্যাটের দাম না পেয়েই তন্ময় এল?”

”ওহ!” ননীদা হঠাৎ ভ্রূ কুঁচকে কী যেন মনে করতে চেষ্টা করলেন, তারপরই যেন মনে পড়ল।

”পিচটা দেখেছ কি? দুর্যোধনকে বলেছিলুম আজ যেন একদম জল না দেয়। ওদের একটা ভাল স্পিনার আছে…” বলতে বলতে ননীদা মাঠের দিকে প্রায় দৌড়লেন।

তন্ময়কে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, আজ সকালে ননীদা একশো টাকা ওকে দিয়ে এসেছেন। আরও তিরিশ টাকা দেবেন ও—মাসে। ননীদা এবং ক্লাব দুয়েরই অবস্থা জানি, তাই বিস্মিত হয়ে যখন ভাবছি, টাকাটা এল কোত্থেকে, তখন একগাল হেসে চিতু প্যাভেলিয়ানে ঢুকল। দু—চারটে কথা হবার পরই চিতু বলল, ”হ্যাঁরে, তোদের ক্লাবে একটা ছেলে নাকি দারুণ ব্যাট করছে? আজ খেলবে নাকি?”

আমি ঘাড় নাড়লাম। ও বলল, ”দেখতে হবে তো কেমন খেলে!”

রূপোলি ১৬৭ রান করল। অবিশ্বাস্য দুটো ক্যাচ ধরল তন্ময়, যার ফলে রূপোলির দুই ওপেনিং ব্যাটসম্যান ৪ রানেই আউট হয়। এরপর ওদের থার্ড উইকেট পার্টনারশিপে ৫১ রান উঠতে তন্ময় শ্লিপ থেকে স্কোয়ার লেগে ছুটে গিয়ে বল ধরে সোজা উইকেটে মেরে রানআউট করল। ফোর্থ উইকেটে চিতু এল এবং এলোপাথাড়ি পিটিয়ে একাই ৪৭ রান করল। বোল্ড হয়ে যাবার সময় একগাল হেসে আমায় বলল, ”কোদাল চালিয়েই তোদের কবর খুঁড়ব।”

তন্ময় অবশ্য তা হতে দিল না। দেখে দেখে অত্যন্ত সাবধানে এবং ধীরে খুটখাট করে খেলে দেড় ঘণ্টায় পঞ্চাশ করল। সাধারণত এত মন্থর ও খেলে না। আমাদের প্রথম চারটে উইকেট ২৩ রানেই পড়ে যায়। কিন্তু সেজন্য এত সময় ব্যয় করে তন্ময় খেলবে ভাবিনি। ৫০ থেকে ৫১ করতে ওর দশ মিনিট লাগল। ৬০—এ পৌঁছতে আরও আধঘণ্টা।

সি সি এইচ যখন ৫ উইকেটে ১০৭, তখন আমি নামলাম। খেলার আর বাকি আধ ঘণ্টা। তন্ময়ের রান ৭৫। আমরা যে হারব না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেছি। রূপোলিও বুঝে গেছে তারা জিতছে না।

চিতু একসময় আমায় বলল, ”ছোকরা আজ তোদের অনেক টাকা খসাবে।”

বলেই চিতু পিটপিট করে হাসল। আমি বললাম, ”কেন। টাকা খসাবে মানে?”

”সেঞ্চুরি করবে। করলেই নতুন ব্যাট সি সি এইচ—কে দিতে হবে। এবার আমি বল নোব, তিনটে লং হপ আর তিনটে ফুলটস, ব্যস, তোর ননীদার পাঁজর খুলে যাবে।”

ননীদা মানেই সি সি এইচ। চিতু দুষ্টু বুদ্ধি যে হাটখোলার সঙ্গে এতদূর পর্যন্ত খেলবে কল্পনা করিনি। তন্ময় এখন ৮৫। খেলা শেষ হতে পনেরো মিনিট বাকি। চিতু ওকে এক ওভারেই পনেরো রান দিয়ে দেবে। তা হলেই হাটখোলার একশো টাকা খরচ। উপায়? ক্লাবের যা অবস্থা, একটা ব্যাট কিনতে হলে এই সিজনে আর পুরো ফিক্সচার খেলা যাবে না। তন্ময় সেঞ্চুরি করলে তার নিজের নাম বাড়বে কিন্তু ক্লাবের কোনও উপকার হবে না। একমাত্র ক্ষতি ছাড়া। তা হলে উপায়?

ওভার শেষ হল। আমি এবার স্ট্রাইকার। তন্ময় এগিয়ে এসে বলল, ”মতিদা, সময় তো খুবই কম, আপনি একটা রান নিয়ে এদিকে চলে আসুন।”

ওর কথাটা শোনামাত্র হঠাৎ আমার মাথায় সি সি এইচ—এর লোকসান বাঁচানোর স্ট্র্যাটেজি খেলে গেল। আমি বললাম ”আমি কল দিলেই বেরোবে, রেডি থেকো।”

প্রথম বলটা পেলাম অফ স্ট্যাম্পের উপর হাফ ভলি। চমৎকার অফ ড্রাইভ করতে পারতাম। না করে, বোলারের কাছে ঠেলে দিলাম, তন্ময় কিছুটা বেরিয়ে এসেছিল রানের আশায়। হাত নেড়ে ওকে ফিরে যেতে বললাম।

দ্বিতীয় বলটা একই রকমের। এবার ড্রাইভ করলাম বেশ জোরে। বল ধরার জন্য বোলার হাত পেতেই তুলে নিল। এক্সট্রা কভার থেকে ফিল্ডার ছুটে যাচ্ছে, আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে তাই দেখতে থাকলাম। তন্ময় বেরিয়ে এসে পিচের মাঝ বরাবর পৌঁছে চেঁচাচ্ছে, ”মতিদা, রান, রান।”

ফিল্ডার বল ধরে বোলারের উইকেটে ছুড়েছে, তখন আমি চেঁচিয়ে বললাম, ”নো নো, গো ব্যাক, গো ব্যাক।”

তন্ময় ঘুরে আবার উইকেটে পৌঁছবার আগেই চিৎকার উঠল—”হাউজা।” আম্পায়ার স্বচ্ছন্দে হাত তুলে দিল। আমি মনে মনে কেমন একটা আরাম পেলাম। সি সি এইচ—এর বেশ কিছু টাকা বাঁচল। তন্ময় আমার দিকে তাকাতে তাকাতে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল। আমি এবার চিতুর দিকে তাকিয়ে হাসলাম। মনে হল, ও যেন দাঁত কিড়মিড় করল।

খেলা ড্র হল। মাঠ থেকে আসতেই ননীদা বললেন, ”এটা কী করলে তুমি—”

ননীদাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ”আর একটা ব্যাট কিনে দেবার ক্ষমতা কি হাটখোলার আছে?”

ননীদা সেকেন্ড দশেক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ”ভেরি গুড স্ট্র্যাটেজি।”

হেসে মুখ ফিরিয়ে নিতে গিয়ে দেখলাম চিতু হাত নেড়ে তন্ময়কে কী বলছে আর তন্ময়ের মুখ থমথমে হয়ে উঠছে। বুঝলাম, চিতুর দুষ্টবুদ্ধি এখনও খেলা করছে।

দুই দলের খেলোয়াড়রা যখন চা খাচ্ছে তন্ময় হঠাৎ সকলকে শুনিয়েই আমাকে বলল, ”ব্যাট আমার চাই না, কিন্তু সেঞ্চুরিটা হতে দিলেন না কেন?”

”তার মানে?” আমি বললাম, ”কে তোমার সেঞ্চুরি হতে দেয়নি?”

”আপনি। ইচ্ছে করে রানআউট করালেন, অতি সহজ রান ছিল। কিন্তু একটা ব্যাট দেবার ভয়ে এই নীচতা আপনি করলেন।”

তন্ময় এরপর অকথ্য ভাষায় কয়েকটা কথা বলল, যাতে রূপোলির ছেলেরাও না শোনার ভাণ করতে বাধ্য হল। অপমানে মুখ কালো করে আমি আর ননীদা চুপ করে রইলাম। চিতু ফিসফিস করে কানের কাছে বলল, ”কী রে, ননীদাকে যে ঘোল করে ছেড়ে দিল। ছেলেটাকে সামনের বছরই রূপোলিতে নিয়ে নেব।”

আমি তখন জ্বলছি। জবাব দিলাম না।

পরের ম্যাচ স্টার স্পোর্টিং—এর সঙ্গে। হাটখোলার ক্যাপ্টেন ভবানী। পুরী যাওয়া বন্ধ করেছে ভবানী এই জন্য। আমি মাঠে এসেছি দর্শক হিসেবে। বলা বাহুল্য, একটা চেয়ারে মিনুকে দেখতে পেলাম। তন্ময়কে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে তার অভব্যতার জন্য।

পরশুদিন রাতে ননীদা আমার বাড়িতে এসে অনুরোধ করেন, ”মতি, এই ম্যাচটায় তুমি বসে যাও।”

”কেন?” সবিস্ময়ে প্রশ্ন করি।

”টাকার দরকার। ব্যাটটা কিনে দেব তন্ময়কে। নয়তো সি সি এইচ—এর মান থাকবে না। ভবানী বলেছে সে একশো টাকা দেবে যদি সামনের ম্যাচে ক্যাপ্টেনসি করতে দেওয়া হয়! তুমি তো বোঝই কী ভাবে ক্লাব—”

ননীদা অসহায়ভাবে থেমে গেলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই। তারপর কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম, ”আগের দুটো ব্যাটের জন্য একশো টাকা তন্ময়কে কী ভাবে দিলেন?” ননীদা প্রশ্নটা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন অন্য কথা তুলে। চেপে ধরতে বলে ফেললেন, ”তোমার বউদির একজোড়া কানপাশা ছিল, বিক্রি করলাম।” নিঃসন্তান ননীদার স্ত্রী বছর দশেক আগে মারা গেছেন।

ভবানী যথারীতি হাঁকডাক করে দারুণ ব্যস্তভাবে টেন্ট আর মাঠ করছে। মাঝে মাঝে মিনুর কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে।

”কী যে করব ভেবে পাচ্ছি না। ওয়ান ডাউন রাজেন বলছে সিক্স ডাউন খেলবে।”

”কেন?” মিনু বলল।

”ভয় পেয়েছে। স্টারের একটা ফাস্ট বোলার আছে, দারুণ পেস।”

”তা হলে তুমি নামো ওয়ান ডাউন।”

”আমি?” ভবানী একটু যেন ঘাবড়ে গেল। ”আমি তো রেগুলার সিক্স ডাউন নামি।”

”আজ তা হলে ওঠো।”

”ইন—কেস যদি কোল্যাপস করে তা হলে কে আটকাবে? ভেরি ইমপরট্যান্ট এটা, তুমি ঠিক বুঝবে না, কতবার এরকম হয়েছে, শেষে আমি গিয়ে ঠেকাই।” বলতে বলতে ভবানীর খেয়াল হয়, আমি ওদের কথা শুনতে পাচ্ছি। চুপ করে গেল সে।

ভবানী ওয়ান ডাউনেই নামল এবং হাটখোলা পনেরো মিনিটেই পাঁচ উইকেটে ১১ রান হল। ভবানী তার মধ্যে এক রান করে নট আউট। স্টারের ফাস্ট বোলারটি একাই উইকেট পাঁচটি নিল। কিন্তু ভবানী সত্যিই আজ পরাক্রান্ত, দুর্ভেদ্য। একবারও কোনও সুযোগ দেয়নি, যেমন বল তেমন খেলছে। সত্যিই অধিনায়কোচিত খেলা। ছয় উইকেটে ১৮, ভবানী তখনও এক রানে দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে ক্রিজ থেকে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। মিনু তার রুমালটা তখন নাড়ায়, তাই দেখে ভবানী দ্বিগুণ উদ্যমে লড়াই শুরু করে।

সাত উইকেটে ৩২ হল। ভবানী তিন রান করেছে। মিনু এই সময় প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ”আমরা কি হেরে যাব?”

স্কোরবোর্ড দেখে আমারও মুখ শুকিয়ে এল। বললাম, ”ক্রিকেটে কিছুই বলা যায় না। হয়তো ভবানী এখন একটা সেঞ্চুরি করে ফেলতে পারে।”

”ও কিন্তু দারুণ খেলছে!” মিনু বলল।

”অসাধারণ! কী অথরিটি নিয়ে স্ট্রোক দিচ্ছে, মনেই হচ্ছে না সাতটা উইকেট পড়েছে।” আমি যথাসাধ্য ভবানীর প্রশংসা করলাম।

কথা শেষ করেছি আর ভবানী একটা ছয় মারল। আমরা হইহই করে উঠলাম, মিনু রুমাল নাড়ল। এরপর ভবানীর উপর যেন দৈব ভর করল। পরের তিন ওভারে সে ৫২ রানে পৌঁছল। হাটখোলার সাত উইকেটে ৮৬। পরের দু’ওভারে ভবানী করল আরও ২৯ রান, অর্থাৎ ৮১ হল। এরপর দুটো উইকেট পড়ল ১২ রান যোগ করে। এখন হাটখোলার ৯ উইকেটে ১২৭ রান। শেষ ব্যাটসম্যান নামতেই মিনু উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, ”ওর কি সেঞ্চুরি হবে না?”

বললাম, ”ক্রিকেটে কিছুই বলা যায় না।”

এবং শেষ পর্যন্ত হল না। ভবানী তার ৯৭ রানের মাথায় তাড়াহুড়ো করে রান নিতে যাওয়ায় এগারো নম্বর রান আউট হয়ে গেল। মিনু রুমালে চোখ মুছতে শুরু করল।

ভবানী ফিরে এসে দার্শনিকের মতো বলল, ”ক্রিকেট আর জীবন একই রকম।”

মিনু বলল, ”পরের বার ঠিক সেঞ্চুরি হবে, আমি বলছি হবে। যদি না হয় তো—”

.

পরের ম্যাচ সত্যসন্ধির সঙ্গে। ভবানী প্রথম বলেই বোলড হয়ে গেল। এবারও আমি মাঠের বাইরে দর্শক। মিনু চোখে রুমাল চেপে ধরেছে। ভবানী ফিরে এসে বলল, ”ক্রিকেটের সঙ্গে জীবনের কতটুকুই বা সম্পর্ক!”

দুটি ম্যাচেই সি সি এইচ হেরে গেছে। ভবানী জানিয়েছে, আর সে অধিনায়ক হতে চায় না, প্রয়োজনও নেই। পরের ম্যাচ পাইকপাড়া স্পোর্টিংয়ের সঙ্গে। ভবানী পুরী চলে গেছে, তন্ময় আর আসে না, টিমের আরও দু’জন পরীক্ষার জন্য খেলতে আসে না। দুটো বাচ্চচা ছেলে ওদের বদলে খেলল এবং হারতে হারতে আমরা ড্র করলাম।

এখন আমরা লিগ টেবিলের মাঝামাঝি কয়েকটা ক্লাবের সঙ্গে সমান পয়েন্ট। উপরের প্রথম তিনটি ক্লাবের পয়েন্টও সমান—সমান। তার মধ্যে রূপোলিও আছে। ওদের সঙ্গে সি সি এইচ—এর তফাত মাত্র দুই পয়েন্টের। লড়তে পারলে আমরা এখনও চ্যাম্পিয়ন হতে পারি।

ননীদার ইচ্ছা নয় চ্যাম্পিয়ানশিপ লড়াইয়ে। ফার্স্ট ডিভিশনে উঠলে তো ক্লাবের খরচ বেড়ে যাবে। এখনই আমরা পাঁউরুটি আর আলুর দম দিয়ে লাঞ্চ শুরু করেছি। প্লেয়াররা রীতিমতো অসন্তুষ্ট। আমি কিন্তু চ্যাম্পিয়ানশিপ ফাইট করারই পক্ষে। ফার্স্ট ডিভিশনে যে করেই হোক একবার উঠতেই হবে। পরের বছরই নয় নেমে যাব, তবু তো বলতে পারব, আমার অধিনায়কত্বে সি সি এইচ একবার ফার্স্ট ডিভিশনে উঠেছিল। প্লেয়ারদের ক’দিন ধরেই তাতাচ্ছি ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার ইজ্জতের লোভ দেখিয়ে।

ক’দিন ধরে ননীদা মাঠে আসছেন না। একটা ম্যাচ খেলা হয়ে গেল ননীদার উপস্থিতি ছাড়াই। আমরা জিতলাম শুধু ফিল্ডিং—এর জোরে। বেলেঘাটা স্পোর্টিং—এর কাছে আচমকা রূপোলি সঙ্ঘ এক উইকেটে হেরে আমাদের সমান হয়ে গেল। হঠাৎ আমার তন্ময়কে মনে পড়ল। এই সময় ও যদি থাকত, তা হলে বাকি ম্যাচ ক’টা বোধ হয় জিততে পারব, এইরকম একটা ধারণা আমার মনে উঁকি দিতে লাগল। ভাবলাম ননীদাকে বলি, যদি দরকার হয় তন্ময়কে বাকি ক’টা ম্যাচ খেলবার জন্য ডেকে আনি। কিল খেয়ে অনেক সময় কিল চুরি করতেই হয়। তা ছাড়া, অপরাধী তো আমিই। ওকে ইচ্ছে করে রান আউট করে দেওয়ার পর থেকেই আমার মনে খচখচ করে একটা কাঁটা বিঁধছে। সেটা উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত স্বস্তি পাব না।

বলামাত্র ননীদা তেলে—বেগুনে হয়ে উঠলেন।

”তোমার লজ্জা করে না, মতি? যেভাবে, যে ভাষায় বাইরের টিমের সামনে আমাদের অপমান করেছে, তারপরও তুমি ওকে আনতে চাও? কী আছে ওর খেলায়, য়্যাঁ? কী আছে? নেমেই দুমদাম ব্যাট চালায়, বরাতজোরে ব্যাটে—বলে হয়ে গেছে তাই রান পেয়েছে। একটু বুদ্ধিমান বোলারের পাল্লায় পড়লে তিন বলে ওকে তুলে নিয়ে যাবে। ক্রিকেট অত সোজা ব্যাপার নয়, এটা ফুটবল নয় যে গোল খেলেও গোল শোধ দেওয়ার সুযোগ পাবে। প্রত্যেকটা বলের ওপর ব্যাটসম্যানের বাঁচা—মরা নির্ভর করে, একটা ভুল করেছ কি তোমার মৃত্যু ঘটে যাবে। কী ভীষণ ডিসিপ্লিনড হতে হয়, কী দারুণ কনসেনট্রেশন দরকার হয় বড় ব্যাটসম্যান হতে গেলে। তোমার ওই তন্ময়ের মধ্যে তা কি আছে?”

আমি চুপ করে ননীদার উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই লোকটিই, মাসখানেক আগে যার ব্যাটিং দেখে উচ্ছ্বসিত হতেন, আজ তাকে ব্যাটসম্যান বলতে রাজি নন! ননীদা একদৃষ্টে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ”খেলাটাই বড় কথা, টাকাই সব কিছু নয়।”

”কিন্তু ননীদা, টাকা অত্যন্ত দরকারি জিনিস। প্লেয়ারের বেঁচে থাকার জন্য এটা প্রথমেই দরকার। এখানে টাকা না পেলে তন্ময় ফুটবলে চলে যাবে। ছেলেটা ফুটবলও ভাল খেলে।”

”তাই খেলুক। যে ক্রিকেট ভালবাসে সে অন্য খেলা খেলবে কেন?”

আমি চুপ করে রইলাম।

বাড়িতে ফিরে দেখি তন্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রথমেই বলল, ”মতিদা, আমি খেলব।”

অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, ”হঠাৎ যে!”

ও ইতস্তত করল কিছু বলার জন্য। মাথা নামিয়ে রইল। আমি আবার বললাম, ”খেলবে, সে তো ভাল কথা, কিন্তু আর আসবে না বলে আবার নিজে থেকেই এসে খেলতে চাইছ, ব্যাপার কী?”

তন্ময় বলল, ”আমার একটা চাকরি পাবার সম্ভাবনা আছে ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাঙ্কে। ওরা ক্রিকেট টিম করে লিগে সামনের বছর খেলবে। প্রায় তিনশো টাকা মাইনে। ক্রিকেট সেক্রেটারি আর ডেপুটি ম্যানেজার আমার খেলা দেখতে চায়।”

”চাকরি দেবে তো? অনেক সময় দেব বলে খেলিয়ে নিয়ে আর চাকরি দেয় না।”

”তা জানি না। তবে যদি দেয়, একটা চান্স নিয়ে তো দেখি। ওদের ফুটবল টিম অফিস লিগে খেলে। সেখানেও আমাকে খেলাতে পারবে। চাকরি সত্যিই আমার দরকার। সংসার প্রায় অচল হয়ে এসেছে।”

”তা হলে সামনের রোববার খেলো। একটা ক্রুশিয়াল ম্যাচ রয়েছে কসবা ভ্রাতৃসঙ্ঘের সঙ্গে। যদি জিততে পারি তা হলে ফ্রেন্ডস স্পোর্টিং আর আমরা সমান পয়েন্ট হয়ে লিগ—টেবলের টপে চলে যাব। রূপোলি তা হলে দু’পয়েন্ট পিছিয়ে যাবে আমাদের থেকে।” বলতে বলতে আমার হাসি পেল। রূপোলি সঙ্ঘ আমাদের পিছনে থাকবে এটাই বড় কথা, লিগ চ্যাম্পিয়ান হই বা না হই—এই মনোভাব দেখছি আমার মধ্যেও বদ্ধমূল হয়ে গেছে।

তন্ময় বলল, ”ননীদা কোনও আপত্তি করবেন না তো?”

”করে যদি তো কী হবে? আমি ক্যাপ্টেন, আমি যাকে খেলাব সেই খেলবে। কেউ আপত্তি করলেও শুনব না।”

ননীদা কিন্তু আপত্তি করলেন না তন্ময়কে দেখে। রবিবার আমাদের মাঠেই ভ্রাতৃসঙ্ঘের সঙ্গে খেলা। সাতজন মাত্র আমাদের প্লেয়ার হাজির হয়েছে। শুকনো মুখে আমি আর ননীদা তাঁবুর মধ্যে যাচ্ছি আর ফিরে আসছি। খেলার কুড়ি মিনিট মাত্র তখন বাকি। এমন সময় তন্ময় এসে পৌঁছল। ননীদা কপাল এবং ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন।

বললাম, ”তন্ময় আজ খেলবে।”

”আমি তো জানতাম না! টিমে তো ওর নাম দেখছি না?”

”আপনাকে বলতে ভুলে গেছি আজ তন্ময় খেলছে। টিমের কাউকে বসিয়ে দিয়ে ওকে খেলালেই হবে।” আসলে আমি ইচ্ছে করেই আগে বলিনি। ননীদা যদি বাগড়া দেন এই ভয়ে।

”টিমে যে আছে তাকে বিনা দোষে বসানো উচিত নয়।” এই বলে ননীদা আবার তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু তন্ময়কে না খেলিয়ে উপায় ছিল না। চারজন খেলোয়াড় আর এলই না। লিগের শেষ দিকে এইরকমই অবস্থা হয় আমাদের ক্লাবে।

ননীদাকে বাইরে এসে ধরলাম। ”তন্ময়কে আজ খেলাতে চাই কেন জানেন, শুধু আমাদের দরকারেই নয়, ওরও দরকার! একটা চাকরি পাবার কথা হচ্ছে। সেক্রেটারি আজ খেলা দেখতে আসবে ওর। যদি শো করাতে পারে তা হলে চাকরিটা হয়েও যেতে পারে।”

”কাউকে চাকরি করে দেবার জন্য তো আমরা লিগ খেলি না।”

”কিন্তু খেলে যদি কেউ চাকরি পায়ই তাকে আমাদের সাহায্য করা উচিত নয় কি? ননীদা, আপনি বউদির গহনা বিক্রি করেও ওকে ব্যাটের টাকা দিয়েছিলেন কেন?”

”ক্লাবকে অপমান থেকে বাঁচাতে।”

”মোটেই নয়, আপনি বলেছিলেন ছেলেটা আর্টিস্ট। ওর ক্রিকেট আর্টে মুগ্ধ হয়ে পুরস্কার দিয়েছিলেন।”

”সেজন্য আমি দুঃখিত। বিনা পরিশ্রমে আর্টিস্ট হওয়া যায় না। এ ছেলেটা ফাঁকিবাজ।” ননীদা আর কথা না বলে যথারীতি দুর্যোধনের খোঁজে চলে গেলে।

তন্ময়কে নিয়ে আটজন। অবশেষে ননীদাকেও নামতে হল। একটা বাড়তি ট্রাউজার্স আমার ব্যাগে থাকেই। সেটা পরলেন। ঝুলে বড়, কোমরে ছোট, ঘের অর্ধেক। কেডস জোগাড় হল। সাদা পাঞ্জাবিটা ট্রাউজার্সে গুঁজে নিলেন। আমরা টসে জিতে ন’জনে ফিল্ড করতে নামলাম।

ননীদা স্লিপে প্রথম দু’ওভারে তিনটি ক্যাচ ফেললেন। তা সত্ত্বেও ভ্রাতৃসঙ্ঘ সুবিধা করতে পারল না, আমাদের নতুন মিডিয়াম পেসার ছেলেটির বলে। তিন উইকেটে ৭৪ থেকে সবাই আউট হল ৯৬—এ।

ননীদা বললে, ”আমাকে উপরদিকে বাট করতে পাঠিও না, মাঝামাঝি রেখো।”

তন্ময় একটি লোকের সঙ্গে কথা বলছিল। সে আমার দিকে হাত তুলে ছুটে এল। ”মতিদা, ওরা এসেছে।”

”তা হলে ওয়ান ডাউন যাও।”

”না না, আর একটু তলায় দিন।”

তন্ময়কে বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছে। নিজের উপর যেন আস্থা রাখতে পারছে না। বললাম, ”খেলা যদি দেখাতে চাও তাহলে তলার দিকে ব্যাট করে লাভ কী হবে। যদি সবাই আউট হয়ে যায়, তুমি শুধু নট আউটই থাকবে। কিন্তু ওরা এসেছে তোমার স্কোর দেখতে।”

আমাদের দুটি উইকেটে ২২, তন্ময় নামল। নেমেই প্রথম বলে এক্সট্রা কভারে চার। হাঁপ ছাড়লাম আমি অপর উইকেটে দাঁড়িয়ে। এরকম কতকগুলো মার মারতে পারলে কনফিডেন্স পাবে। ৩২ রানের মাথায় আমি স্ট্যাম্পড হলাম ভ্রাতৃসঙ্ঘের অফস্পিনারের বল হাঁকড়াতে গিয়ে। এরপরই তন্ময়ের খেলা কেমন যেন গুটিয়ে গেল। ১১ রান করে ও আর ব্যাট তুলতেই চায় না। আধ ঘণ্টা কোনও রান করল না।

ননীদা হঠাৎ আমায় বললেন, ”ব্যাটিং অর্ডারটা একটু বদলাও, এরপর আমি ব্যাট করতে যাব।”

আমার মনে একটা খারাপ চিন্তা এল।

তন্ময় যে অপমান করেছে তার চমৎকার শোধ ননীদা এখন নিতে পারেন। ওর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনার দফা রফা হয়ে যাবে, ঠিক যে ভাবে আমি ওর ব্যাট পাওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট করেছিলাম। ননীদা এখন মাঠে নেমে যদি তন্ময়কে রান আউট করে দেন? বললাম, ”ননীদা, আমাদের তো দুজন কম। আপনি যদি ফাইভ কি সিক্স ডাউন যান তা হলে ভাল হয়। শেষদিকে আটকাবার কেউ নেই।”

কী ভেবে ননীদা বললেন, ”আচ্ছা।”

পরপর আমাদের দুটো উইকেটে পড়ল ৪৬ ও ৪৯ রানে। ননীদা খুব মন দিয়ে খেলা দেখছেন। এবার আমাকে বললেন, ”অফস্পিনারটা ভাল ফ্লাইট করাচ্ছে। তন্ময়টা বোকার মতো খেলছে, এখুনি শর্ট লেগে ক্যাচ দেবে।”

হঠাৎ চিতুকে দেখি আমাদের স্কোরারের পিছনে দাঁড়িয়ে স্কোর বুকে উঁকি দিচ্ছে। আমাকে দেখে বলল, ”পাঁচ উইকেটে উনপঞ্চাশ, পারবি না তোরা। হাতে আছে তিন উইকেট। সাতচল্লিশ তুললে তবেই জিত। পারবি না, হেরে যাবি।” বলে চিতু হাসতে লাগল।

”তোর খেলা নেই আজ?”

”হচ্ছে, গ্রিয়ার মাঠে। আমরা ব্যাট করছি। আমি আউট। ভাবলাম, দেখে আসি এ মাঠে কি হচ্ছে। আমরা প্রায় জিতে গেছি। তোদের তো শোচনীয় ব্যাপার।”

মাঠে একটা হায় হায় শব্দ উঠল। তন্ময়ের সহজ ক্যাচ শর্ট লেগ ফেলে দিয়েছে। তন্ময়ের মুখ পাংশু। পঞ্চাশ মিনিট খেলে রান করেছে ১৮।

”ব্যাপার কী? তন্ময় যে আজ এমন করে খেলছে?” ননীদা প্যাড পরতে পরতে আমায় বললেন।

”যাদের আসার কথা তারা খেলা দেখতে এসে গেছে। তাই নার্ভাস হয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে।”

”সেলফিশ। নিজের জন্য খেলছে, টিমের জন্য খেলছে না।” গম্ভীর হয়ে ননীদা বললেন আর তখনি ৫৭ রানের মাথায় আউট হল ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান। অফস্পিনারের পঞ্চম শিকার।

”তোদের হয়ে গেল।” চিতু চেঁচিয়ে বলল, ননীদা মাথা নিচু করে গ্লাভস পরছিলেন। চিতুর দিকে তাকালেন।

”কী হয়ে গেল?” ননীদা গম্ভীর স্বরে চিতুকে প্রশ্ন করলেন।

”ম্যাচ হয়ে গেল।”

”আজও তুমি ক্রিকেটের ‘ক’ বুঝলে না। একটা কুলিই রয়ে গেলে।”

চিতুর রাগী মুখটা দেখার জন্য ননীদা আর অপেক্ষা করলেন না।

উইকেটে পৌঁছে তন্ময়কে ননীদা কী যেন বললেন, অফস্পিনারটি বল করছে। ননীদা প্রত্যেকটা বলে পা বাড়িয়ে ব্যাটটা শেষ মুহূর্তে তুলে নিয়ে প্যাডে লাগাতে লাগলেন। ওদিকে হঠাৎ তন্ময় পরপর দুটো স্ট্রেট ড্রাইভ থেকে আট রান নিল।

ননীদার দিকে রয়েছে অফস্পিন বোলারটি। ওকে একটার পর একটা মেডেন দিয়ে যেতে লাগলেন ননীদা। কিন্তু তন্ময়কে এদিকের উইকেটে খেলতে দিচ্ছেন না। দু একবার রান নেবার জন্য তন্ময় ছুটে এসেছে, ননীদা চিৎকার করে বারণ করেছেন।

নিজের ৪৮ রানে পৌঁছে তন্ময় গ্লান্স করেই দৌড়ল দুটি রান নিয়ে হাফ—সেঞ্চুরি পূর্ণ করবে বলে। দৌড়বার আগে লক্ষই করেনি শর্ট স্কোয়ার লেগ বল থেকে কতটা দূরে। তন্ময় যখন পিচের মাঝামাঝি, ননীদা ওকে ফেরত যাবার জন্য চিৎকার করছেন। তন্ময় ফিরে তাকিয়ে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। আর কিছু করার নেই তার। স্কোয়ার লেগের ছোড়া বল উইকেটকিপার ধরেছে। তন্ময় চোখ বন্ধ করে ফেলল।

”হাউজ্যাট?” চিৎকারে অন্য মাঠের লোকও ফিরে তাকাল। তন্ময় আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখল ননীদা হাসছেন। তারপর মাথাটা কাত করে রওনা হলেন। তন্ময় চোখ বুজিয়ে থাকায় দেখতে পায়নি, ননীদা কখন যেন ছুটে তাকে অতিক্রম করে নিজে রান আউট হলেন।

ননীদা প্যাড খুলছেন। বললাম, ”কী বাপার?”

বললেন, ”ক্রিকেটে অসাবধান হলেও যেমন মৃত্যু আছে, তেমনি আত্মহত্যাও আছে। সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি করে এখন আমার হবেটা কী? তার থেকে যার ভবিষ্যৎ আছে, সে খেলুক।”

পরের ওভারে তন্ময় দুটি ওভার বাউন্ডারি মারল। আমরা জিতে গেলাম। ওকে কাঁধে তুলে আনার জন্য আমরা মাঠে ছুটে গেলাম।

বহুক্ষণ পর, তাঁবু তখন প্রায় ফাঁকা। দুর্যোধন এসে আমায় বলল, ”বাবু দেখিবারে আসো।”

ওর সঙ্গে তাঁবুর পিছনে গিয়ে দেখি, ফেন্সের ধারে তন্ময় ব্যাট নিয়ে একটা কাল্পনিক বলে ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলে স্ট্যাচুর মতো হয়ে আছে। আর ননীদা পিছনে দাঁড়িয়ে।

”দ্যাখো, পা—টা কোথায়? বলের লাইনের কত বাইরে? কাল থেকে দু’ শোবার রোজ স্যাডো প্র্যাকটিস করবে। দু’শোবারে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *