২৫. গোয়েঙ্কার প্রত্যাশিত ফোন এসেছে

গোয়েঙ্কার প্রত্যাশিত ফোন এসেছে এবং সোমনাথের মত পাল্টেছে শুনে নটবর মিত্র বেশ খুশী হলেন। হ্যান্ডসেক করে বললেন, “এই তো চাই! সত্যি কথা বলতে কি, যে-পূজোর যে মন্তর!”

নাকে এক টিপ নস্যি গুঁজে নটবরবাবু বললেন, “মেয়েমানুষকে ব্যবসার কাজে লাগাতে বাঙালীদের যত আপত্তি কিন্তু জাপানের দিকে তাকিয়ে দেখুন। বড় বড় বিজনেস ট্রানজাকশন গীসা বাড়িতে বসেই হয়ে যাচ্ছে। মেয়েমানুষ-খরচার রসিদ পর্যন্ত অফিসে জমা দিয়ে জাপানীরা টাকা নিচ্ছে দেখুন তার ফলটা। পৃথিবীতে আজ খ্যাঁদা জাপানীর একটিও শত্রু, নেই।”

সোমনাথ মাথা নিচু করে রইলো।

নটবর বললেন, “অত দরেই বা যাবার দরকার কী? বাঙালী মেয়েদের ব্যবসায় লাগিয়ে কত শেঠজী এই কলকাতা শহরে লাল হয়ে যাচ্ছে!”

সোমনাথ নিজের স্নায়ুগুলো শান্ত করবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে।

গোয়েঙ্কা যে আজই কলকাতায় আসছেন নটবরবাবু বুঝতে পারেননি। খবরটা শুনেই তিনি লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, “যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়। গোয়েঙ্কা আর দিন পেলো না? আজকে আমি যে ভীষণ ব্যস্ত। এক বড় পার্টিকে মেয়েমানুষ দিয়ে খুশী করাতে হবে। অথচ এখনও কিছুই ব্যবস্থা করা হয়নি। বেরুবো-বেরবো করছি, এমন সময় আপনি হাজির হলেন।”

ঘড়ির দিকে তাকালেন নটবরবাবু। বললেন, “আপনার তো চুনোপটি কেস। এই পাটি আমার এক বন্ধুকে দমাসে ছেষট্টি হাজার টাকা পাইয়ে দিয়েছে। অনেক রিকোয়েস্টের পর পার্টি বন্ধুর নেমন্তন্ন নিয়েছে আর আমার বন্ধুটি আপনারই মতন। ব্যবসা করছে, টাকা কামাচ্ছে, কিন্তু এসব লাইনের কোনো খোঁজই রাখে না। আমার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে বসে আছে। সকাল থেকে তিনবার ফোন করেছে—দাদা খরচের জন্যে ভাববেন না। লোকটি বড় উপকারী বন্ধ। কোনোরকম বিপদ, কষ্ট বা ক্ষতি না হয় যেন ভদ্রলোকের। আমি ্বললাম, সেদিকে নিশ্চিন্ত থেকো। এ-লাইনে একবার যখন নটবর মিত্তিরের কাছে এসেছে, তখন নাকে মাস্টার্ড অয়েল ঢেলে ঘুমিয়ে থাকো। নটবর মিত্তির ইজ নটবর মিত্তির।”

সোমনাথের কথা হারিয়ে যাচ্ছে। সে শুধু শুনেই চলেছে। নটবরবাবু মাথা চুলকে দুঃখ করলেন, “দুটো কেস একসঙ্গে পড়ে গেলো। তবে আপনি চিতা করবেন না। গোয়েঙ্কা যে আপনার কাছেও জীবনমরণের ব্যাপার, তা বুঝতে পারছি। আপনার একটা ব্যবস্থা করে দিতেই হবে। তবে ভাই আমার সঙ্গে ঘুরতে হবে—কারণ দুটো কেস একই সঙ্গে তো! একটার পুরো দায়িত্ব ঘাড়ে চেপে রয়েছে। বন্ধও এখানে নেই—পার্টিকে আনতে গাড়ি নিয়ে কলকাতার বাইরে চলে গেছে!”

ঘড়ির দিকে তাকালেন নটবর। তারপর হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “মুখটখ শুকিয়ে যাচ্ছে কেন? ভাবছেন, নটবর মিত্তির অনেক খরচ করিয়ে দেবে? আপনার কেসে তা হবে না। ওই আপনার বাহাত্তর নম্বর ঘরের শ্রীধর শর্মা, ওর কাছ থেকে প্রতি কেসে কান মলে দেড়-হাজার দ-হাজার টাকা আদায় করি। কিন্তু আপনার কেসে মা কালীর দিব্যি বলছি একটি পয়সা লাভ করবো না।”

আবার ঘড়ির দিকে তাকালেন নটবর মিত্তির। বললেন, “গোয়েঙ্কা উঠছে কোথায়? না, আপনাকেই জায়গার ব্যবস্থা করতে বলেছে?”।

গ্রেট ইন্ডিয়ান হোটেল শুনে খুশী হলেন নবির মিটার। “একটুখানি সুবিধা হলো। আমার বন্ধুর পার্টিকেও ওখানে নিয়ে যাবো ভাবছিলাম।”

নটবরবাবু দশ মিনিট সময় চাইলেন। বললেন, “ঠিক দশ মিনিট পরে পোন্দার কোর্টের সামনে আপনি অপেক্ষা করনে আমি চলে আসবো।”

রবীন্দ্র সরণি ও নতুন সি-আই-টি রোডের মোড়ে একটা বিবর্ণ হতশ্রী ল্যাম্প পোস্টের কাছে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে সোমনাথ ব্যানার্জি।

রিকশা, ঠেলাগাড়ি, বাস, লরি, টেম্পোর ভিড়ে ট্রাফিকের জট পাকিয়েছে। এরই মধ্যে একটা সেকেলে ট্রামের বদ্ধ ড্রাইভার বাগবাজার যাবার উৎকণ্ঠায় টং টং করে ঘণ্টা বাজাচ্ছে। সোমনাথের মনে হলো, একটা প্রাগৈতিহাসিক গিরগিটি কেমনভাবে কালের সতক প্রহরীকে ফাঁকি দিয়ে কলকাতায় এই জন-অরণ্য দেখতে এসে আটকে পড়েছে। বন্ধ গিরগিটি মত্যুযন্ত্রণায় মাঝে মাঝে কাতরভাবে আর্তনাদ করছে। মায়া হচ্ছে সোমনাথের। পৃথিবীতে এতো প্রশস্ত রাজপথ থাকতে কোন ভাগ্যদোষে বেচারা এই জ্যাম-জমাট রবীন্দ্র সরণিতে এসে আটকে পড়লো। আগেকার দিন হলে, সোমনাথ সত্যিই একটা কবিতা লিখে ফেলতো। নাম দিতো জন-অরণ্যে প্রাগৈতিহাসিক গিরগিটি।

আজ যে ১লা আষাঢ় তা আবার সোমনাথের মনে পড়লো। আকাশের দিকে তাকালো সোমনাথ। না, ১লা আষাঢ়ের সেই বহু প্রত্যাশিত মেঘদতের কোনো ইঙ্গিত নেই আকাশে। বিরাট এই শহরটা মরভূমি হয়ে গেছে। এখানে আর বষ্টি হবে না। বৃষ্টি হলে সোমনাথের কিন্তু খুব আনন্দ হতো। এখানে দাঁড়িয়ে সে ভিজতো। আষাঢ়ের প্রবল বর্ষণে যদি সব কিছু কালগড়ে তলিয়ে যেতো, তাহলে আরও ভালো হতো।

রবীন্দ্র সরণি ধরে কত লোক দ্রুতবেগে হাঁটছে। দু-একজন পথচারী সোমনাথের দিকে একবার তাকিয়েও গেলো। এরা কি জানে তরণ সোমনাথ ব্যানার্জি কেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে? কোথায় সে যাচ্ছে।

এইখানে দাঁড়িয়েই তো এক অন্তহীন অতীত পরিক্রমা করে এলো সোমনাথ। তার জীবনের প্রতিটি ঘটনা সোমনাথ এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকালো সোমনাথ। নটবর মিত্র দেরি করছেন। নির্ধারিত দশ মিনিট হয়ে গেছে।

দূর থেকে এবার হাঁপাতে-হাঁপাতে নটবরবাবুকে আসতে দেখা গেলো। বললেন, “কী ব্যাপার বলুন তো? আজ ১লা আষাঢ় বলে অনেকের মনেই রোমান্স জাগছে নাকি? অফিস থেকে উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় আপনার বন্ধু, শ্রীধরজীর ফোন। ওঁর এক পার্টির জন্যে একটু ব্যবস্থা করতে চান। আমি স্রেফ বলে দিলাম আজ আমার পক্ষে আর কোনো কেস নেওয়া সম্ভব নয়। খুব যদি আটকে পড়ো, নিজে রিপন স্ট্রীটে মিস সাইমনের কাছে যাও।”

“চলুন চলুন মশাই, আগে গ্রেট ইন্ডিয়ান হোটেলটা সেরে আসি।” নটবরবাবু নিজের ঢলঢলে প্যান্ট কোমর পর্যন্ত তুলে সোমনাথকে তাড়া লাগালেন।

গ্রেট ইন্ডিয়ান হোটেলে নিজের পাটির জন্যে স্পেশাল কামরা রিজার্ভ করলেন মিস্টার মিটার। ওঁর সঙ্গে হোটেল রিসেপশনের লোকদের বেশ চেনা মনে হলো।

“আপনার বুকিং কে করবে?” নটবর মিত্র এবার সোমনাথকে জিজ্ঞেস করলেন।

সোমনাথ তো তা জানে না। এবারে নটবরবাবু মদ, বকুনি লাগলেন। “ডোবাবেন মশাই? গোড়ার জিনিসগুলো খোঁজ নেবেন তো? গোয়েঙ্কা হোটেল বুকিং করেছেন কিনা, না আপনাকে করতে হবে? দেখি একবার খোঁজ নিয়ে।”

খবর নিয়ে জানা গেলো মিস্টার গোয়েঙ্কার নামে একুশ নম্বর কামরা আজ সকালেই বকে করা হয়েছে। হাঁপ ছাড়লেন নটবর। “বাঁচা গেলো—আজকাল হট করলেই গ্রেট ইন্ডিয়ানে বুকিং পাওয়া যায় না।”

হোটেল থেকে সোমনাথ বেরিয়ে আসছিল। নটবরবাবু আবার বকুনি লাগালেন। “বিজনেসে যদি টিকে থাকতে চান জনসংযোগটা ভালোভাবে শিখুন। আমাদের এসব কেউ বলে দেয়নি—ঠেকে-ঠেকে, ধাক্কা খেতে-খেতে টোয়েন্টি ইয়ারস ধরে শিখতে হয়েছে। এখানে বসে গোয়েঙ্কাজীর নামে একটা মিষ্টি চিঠি লিখুন। লিখুন—ওয়েলকাম ট ক্যালকাটা। সব ব্যবস্থা পাকা। আপনি সন্ধ্যে সাতটার সময় আসছেন।”

মন্ত্রমুগ্ধের মতো সোমনাথ চিঠি লিখে ফেললো। নটবর মিত্তির বললেন, “খামের উপর গোয়েঙ্কার নাম লিখন বাঁদিকের ওপরে লিখন, টু অ্যাওয়েট অ্যারাইভাল।”

নস্যি নিলেন নটবর মিটার। জিজ্ঞেস করলেন, “এসব করলম কেন বলুন তো? আপনার পার্টি বুঝবে মিস্টার ব্যানার্জির ম্যানেজমেন্ট খুব ভালো। হোটেলে পা দিয়েই চিঠি পেলে গোয়েঙ্কার আর কোনো উদ্বেগ থাকবে না—উটকো পাটি এসে সত্তা কোনো লোভ দেখিয়ে ভাঙিয়ে নিতে পারবে না।”

তারপর বললেন, “দিন দশ টাকা। হচ্ছে যখন, সব কিছু ভালোভাবে হোক।’

রিসেপশনিস্ট মিস্টার জেকবকে নটবর বললেন, “মিস্টার গোয়েঙ্কা আসা মাত্র একুশ নম্বর ঘরে কিছু ফ্লাওয়ার পাঠিয়ে দেবেন ব্রাদার। ফলের সঙ্গে মিস্টার ব্যানার্জির এই কার্ড দিয়ে দেবেন।”

আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে নটবর মিটার বললেন, “প্রমিক কাজ সব হয়ে গেলো। রিটায়ার করে, লোকাল ছেলেদের ট্রেনিং-এর জন্যে একটা স্কুল খুলবো ভাবছি, মিস্টার ব্যানার্জি। বাঙালীদের সব গণ আছে, শুধু এই জনসংযোগটা জানে না বলে কমপিটিশনে পিছিয়ে যাচ্ছে।”

“নাউ!” মিস্টার নটবর টাকে হাত রাখলেন। এবার স্পেশিফিকেশন। আমার বন্ধুর পাটি যা পেশিফিকেশন দিয়েছে, তাতে আমি তো মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি। গোয়েঙ্কাজীর পছন্দ কী বলুন?”

এবার সত্যিই বিরক্ত হলেন নটবর মিটার। “না মশাই, আপনার দ্বারা কিছু হবে না। বিজনেস লাইন ছেড়ে দিন। একজন সম্মানিত অতিথিকে আপ্যায়ন করবেন, অথচ তাঁর পছন্দ-অপছন্দ জেনে নিলেন না? যে লোক কাটলেট ভালোবাসে তাকে কমলালেবু, দিলে সে কি পছন্দ করবে? এখন ভদ্রলোককে কোথায় পাই। ফোন করেও তো ধরা যাবে না।”

দুরূহ সমস্যার সমাধান নটবর মিটার নিজেই করলেন। বললেন, “কথাবার্তা যতটকু শুনেছি, তাতে মনে হয় ভদ্রলোকের গাউনে রচি নেই—শাড়ির দিকেই ঝোঁক। জাতের কথা আমি মোটেই ভাবছি না। এই একটা ব্যাপারে নিজের জাতের ওপর টান নেই গোয়েঙ্কাজীদের। পছন্দসই বেঙ্গলী গাল পেলে খুব খুশী হবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো হাল্কা না ভারি? খুব ডিফিকাল্ট কোশ্চেন! এই পয়েন্টে বোকামি করেই তো শ্রীধরজী সেবার ফিফটি থাউজেন্ড রপিজের অড়ার হারালেন। পারচেজ অফিসার একটু সেকেলেপন্থী স্বাস্থ্যবতী মেয়েমানুষ পছন্দ করে। উনি সেসব না বুঝে নিয়ে গেলেন আধুনিকা রত্না সাহাকে—একেবারে গাঁজার ছিলিমের মতো রোগা চেহারা, ফরাসী সাহেবরা যা প্রেফার করে। রত্নার বত্রিশ সাইজের জামার দিকে একবার নজর দিয়েই পার্টি বেকে বসলো—বললো, ছেলে না মেয়ে বুঝতে পারছি না, এখন খুব ব্যস্ত আছি, হঠাৎ একটা মিটিং পড়ে গেছে, পরে দেখা হবে। গেলো অর্ডারটা। মাঝখান থেকে রত্না সাহাকেও টাকা গুনতে হলো শ্রীধরজীর। আবার শাঁসালো মেয়েমানুষে প্রচণ্ড অরুচি এমন পাটিও যথেষ্ট দেখেছি। তারা কঞ্চির মতো সঙ্গিনী চায়।”

সোমনাথের মাথা ধরে গেলো। ঘাড়ের কাছটা দপদপ করছে। চিন্তিত বিরক্ত নটবর বললেন, “ভেবে আর কী হবে? চলুন এনটালির দিকে। রিস্ক নেওয়া যাক। মলিনা গাঙ্গুলীর চেহারা মাঝামাঝি। রোগাও না মোটাও না। আপার বডিটা একটু হেভি, কিন্তু খুব টাইট গোয়েঙ্কার অপছন্দ হবে না।”

গাড়ি চলছে। ধর্মতলা ও চৌরঙ্গীর মুখে দুর থেকে সোমনাথ যাকে দেখতে পেলো তাতে তার মুখ কালো হয়ে উঠলো। অনেকগুলো বই হাতে তপতী বাসের জন্যে অপেক্ষা করছে নিশ্চয় কনস্যুলেট লাইব্রেরি থেকে বই নিয়েছে। তপতী বোধহয় সোমনাথকে লক্ষ্য করেছে—না হলে অমনভাবে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে কেন?

সোমনাথ দ্রুত উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। ব্যাপারটা নটবর মিত্তির দেখলেন এবং রসিকতা করলেন, “কী মিস্টার ব্যানার্জি? মেয়েমানুষেরা কি বাঘ? অমনভাবে ঘামছেন কেন? বাস স্ট্যান্ডের এক মহিলা আপনার দিকে যেভাবে তাকালেন। এককালে আমাদেরও সময় ছিল! এখন এই চাপাটির মতো টাক পড়ায় কেউ আর ফিরে তাকায় না।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *