ফেরারি

ফেরারি – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস

”আজ যা কিছু হল, সব তোরই জন্য।”

ধীর, ফিসফিস স্বরে মোটরচালক কথাগুলো বলল। তার পাশে বসা যুবকটি সামনে তাকিয়ে চুপ করে রইল। এই ভাবে সে গত আধ ঘণ্টারও বেশি বসে আছে।

”কী ভুল যে তুই করলি।”

সামনে থেকে হু হু করে ভারী ট্রাক আসছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। তার ধাঁধানো আলো থেকে চোখ বাঁচাবার জন্য মোটরটা বাঁ দিকে সরিয়ে মন্থর করে চালক বলল, ”কোথায় নামাব?”

যুবকটি এতক্ষণ যেন গভীর কোনও ভাবনার মধ্যে ডুবে ছিল। চটকা ভেঙে জানলা দিয়ে বিভ্রান্তের মতো তাকাল। দু’পাশে বড় বড় গাছ। সরু শাখাপথ তৈরি করেছে ছোট ছোট মোড়। দোকান। বেড়া বা পাঁচিল দেওয়া একতলা পাকা বাড়ি, পুকুর, সবজি বাগান, ধানখেত। অন্ধকার পিচের রাস্তায় মাঝে মাঝে টিমটিমে বাতি। বাড়ির আলো দূরে দূরে।

”ঠিক বুঝতে পারছি না” যুবক আমতা আমতা করে বলল, ”সামনের দোকানটায় একটু জিজ্ঞেস করে—”

”একদম নয়।” চাপা তীক্ষ্ন স্বরে মোটরচালক ধমকে উঠল। ”তোর মুখ যেন কেউ না দেখতে পায়। কলকাতা থেকে মাত্র বারো—চোদ্দো মাইল, এখানকার সব লোকই নিশ্চয় ইতিমধ্যে ঘটনা জেনে গেছে। এসব অঞ্চল সারথির সাপোর্টারে ভরা। নিশ্চয় আজ অনেকেই মাঠে গেছল, এখন তোকে পেলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে, আমাকেও শেষ করে গাড়ি জ্বালিয়ে তার মধ্যে ফেলে দেবে।… মানুষ এখন ভীষণ হিংস্র হয়ে উঠেছে, জানোয়ারও লজ্জা পাবে। সামান্য সামান্য কারণে দলবেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলছে।”

হঠাৎ ব্রেক কষে মোটর থামিয়ে চালক গম্ভীর স্বরে বলল, ”এইখানেই নেমে যা।”

যুবক ফ্যালফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে যেন কথাটার অর্থ বুঝে উঠতে পারেনি! এই লাল স্পোর্টস শার্ট পরা, প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সি, ফরসা, সুদর্শন, কলকাতার অন্যতম বনেদি বাড়ির সন্তান দুলালচাঁদ শীল তাকেই কি ‘নেমে যা’ বলল?

অনুপম নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

অথচ এই দুলালচাঁদ—যাকে সারতি সঙ্ঘের মালি থেকে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত দুলোবাবু, দুলোদা বা দুলো বলে—আজ দুপুরেও প্রায় এক ঘণ্টা এই আকাশি রঙের মারুতি গাড়িটা নিয়ে অপেক্ষা করেছে তাকে নিয়ে সারথির টেন্টে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

গত পাঁচ বছর দুলোদা তাকে নিয়মিত গাড়িতে করে মাঠে আনেন, আবার বেলেঘাটায় তার ফ্ল্যাটে নামিয়ে দিয়ে সল্ট লেকে নিজের বাড়িতে চলে যান।

যখনই কোনও দরকারে গাড়ি চেয়েছে, দুলোদা পেট্রল ট্যাঙ্ক ভর্তি করে মারুতি বা অ্যাম্বাসাডার ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। নিজের গাড়ির মতোই সারাদিন সে ব্যবহার করেছে।

আর সেই দুলোদা এখন এই অপরিচিত, অন্ধকার রাস্তায় তাকে হুকুম করল—নেমে যা!

অনুপম ঢোঁক গিলল। একটা অভিমান বুকের থেকে ঠোঁটে এবং চোখে ধোঁয়ার মতো উঠে আসছে। ঠোঁট কামড়ে, চোখ বন্ধ করে সে নিজেকে সামলাল।

অনেক কথাই এখন সে শুনিয়ে দিতে পারে দুলোদাকে। কিন্তু না, এখন সে কোণঠাসা। এখন সে পলাতক, ফেরারি।

তাকে পালিয়ে গিয়ে কোথাও লুকিয়ে থাকতে হবে। ম্যাচটা শেষ হওয়ার দশ সেকেন্ডও আগে, টাই ব্রেকারের শেষ কিকটার আগে পর্যন্ত যারা তার অন্ধ ভক্ত ছিল, তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাকে গা—ঢাকা দিতে হবে।

চোর বা জালিয়াত সে নয়, কিন্তু আজ প্ল্যাটিনাম জুবিলি কাপ সারথির হাতে উঠেও হাত থেকে পড়ে গেল শুধুমাত্র, হ্যাঁ একমাত্র সে—ই এজন্য দায়ী।

গত তিন বছর সারথি গর্ব করে বলার মতো একটাও মেজর ট্রফি জেতেনি। ক্লাব—সমর্থকরা বুভুক্ষের মতো সারি দিয়ে আজ মাঠে এসেছিল। গোয়ার ডেম্পোর জয় চেয়ে ক’জন সমর্থক গ্যালারিতে ছিল? ছিল তো সব সারথিরই। .. পঁচিশ হাজার? তিরিশ হাজার? আর মাঠের বাইরে কত লক্ষ? … পাঁচ লাখ, দশ লাখ? রেডিয়ো রিলে হয়েছে, মাঠে টিভি—ক্যামেরাও ছিল। লাখ লাখ লোক শুনেছে, দেখেছে অনুপম বিশ্বাসের মুখ।

সে এই মুহূর্তে একটা ঘৃণ্য মানুষ। তাই বা কেন,…. একটা আততায়ী। একটা খুনির থেকে এখন তাকে কেউ অন্য কিছু ভাববে না।

এই দুলোদাও বোধ হয় ভাবছে না। নয়তো কয়েক ঘণ্টার মধ্যে লোকটা এভাবে বদলে গেল কেন?

”অনুপম, আর আমি তোকে বয়ে বেড়াত পারব না, নাম।”

”কিন্তু দুলোদা, এখানে…”

”কিন্তু ফিন্তু নয়, কোথায় তেঁতুলতলা, কোথায় তোর রবিদা, এবার তুই খুঁজে বের কর।”

”চারদিক বড্ড অন্ধকার, কী করে বের করব? মনে হচ্ছে ছাড়িয়ে এসেছি।’

সামনে থেকে একটা যাত্রীবাহী বাস এসে ওদের পাশ দিয়েই বেরিয়ে গেল। রাস্তাটা গ্রামের মধ্য দিয়ে জেলার মহকুমা সদরে, অনেকগুলো গ্রামের মধ্য দিয়ে জেলার মহকুমা সদরে পৌঁছেছে। মিনিট দশেক হাঁটলে রেল স্টেশন। সেখান থেকে বাস ছাড়ে। এখানকার মানুষ ট্রেনে কলকাতা যাতায়াত করে। রাস্তার ধারে একতলা—দোতলা পাকা বাড়ির সঙ্গে টিনের বা খড়ের চাল দেওয়া কাঁচা মাটির কিছু বাড়িও আছে। মাঝে মাঝে পৌরসভার ইলেকট্রিক বাতির কাঠের থাম, কিন্তু বেশির ভাগেরই বালব নেই বা জ্বলছে না।

”নেমে খুঁজে দ্যাখ। আগে তো এখানে এসেছিস।’

”বছর চারেক আগে। মনে আছে একটা বড় অশ্বত্থ গাছের পাশ দিয়ে রাস্তাটা নেমে গেছে। সাইকেল রিকশা যায়। গাছের গোড়াটা বাঁধানো, একটা শিবের পাথর আর একটা ত্রিশূল আছে। পুজো হয়।”

”কই, তেমন তো কিছু চোখে পড়ল না, বোধ হয় আরও এগিয়ে হবে। নাম এখন, হেঁটে গিয়ে দ্যাখ।”

দুলোদা ড্যাশ বোর্ডের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলল, ”ইসস, প্রায় দশটা বেজে গেল।”

অনুপম ইতস্তত করে বলল, ”হাঁটুতে রড মেরেছে, ব্যথা বড্ড। গাড়িটা আর একটু…”

”আরে হাঁটুফাটু একটু রাখ। ওদিকে আমার বাড়িতে আবার হুজ্জুতি ফুজ্জতি হল কি না কে জানে। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে আমাকে।”

”দুলোদা আর একটু যদি সামনে…”

”আবার সামনে কী? অনেক সামনেই তো তোকে এনে দিয়েছি। তার কোনও প্রতিদান তুই দিয়েছিস?”

দুলোদা হঠাৎ গলা চড়িয়ে উত্তেজিত থাপ্পড়টা স্টিয়ারিঙের ওপর কষাল। তার চোখে হতাশা, ক্ষোভ, ঘৃণা মিশে অদ্ভুত এক চাহনি তৈরি করেছে। ঠোঁটের কোণ মুচড়ে সে বলল, ”আজ অনেকগুলো প্রাণ তুই নিয়েছিস। নিরপরাধ মানুষ, তারা শুধু এসেছিল সারথির জিত দেখতে। তারা তোকে এতকাল মাথায় তুলে রেখেছিল, মনে মনে তোকে পুজো করত। যখনই ভাল খেলেছিস, ম্যাচ জিতিয়েছিস, ওরা তোকে কাঁধে তুলে দিত, যুগ যুগ জিয়ো বলত তোর নাম করে। আর তাদেরই তুই…।”

অনুপম একদৃষ্টে তার বাঁ হাতের আঙুলে চুনি বসানো আংটিটার দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বলল, ‘ক’জন মারা গেছে, জানো?”

”টেন্টের সামনের লনে আটটা বডি এনে রেখেছিল। তা ছাড়া মরো মরো অবস্থায় কতজনকে যে হাসপাতালে নিয়ে গেছে তা বলতে পারব না।”

দরজা খুলে অনুপম বাঁ পা জমিতে রেখে বেরোবার জন্য শরীরের ভর পায়ের ওপর দিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করেই কাতরে উঠল।

দুলোদা চোখটা কোঁচকাল মাত্র, কিন্তু সহানুভূতি জানাতে একটা শব্দও মুখ থেকে বের করল না।

দু’বারের চেষ্টায় অনুপম সোজা হয়ে দাঁড়াল।

”একটা কথা বলে রাখি তোকে। এখন তোর জীবন তোর হাতে। ইউ আর ইন রিয়েল ডেঞ্জার। তিরিশ বছর মাঠ করছি, কিন্তু মানুষকে এমন ভাবে খেপে যেতে কখনও দেখিনি। তোকে পেলে পিটিয়ে আজ শেষ করে দিত। সারা জীবন মনে রাখবি, এই দুলোদাকে, আজ তোকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আর এটাও মনে রাখবি, সারথির সাপোর্টার সর্বত্র রয়েছে, তাই সাবধান … খুব সাবধান, খুব সাবধান।”

দৈববাণীর মতো শেষের কথাগুলো বলতে বলতে দুলোদা স্টার্ট দিল এবং কোনও বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়েই মারুতিকে একটু এগিয়ে নিয়ে রাস্তার চওড়া জায়গায় ঘুরিয়ে নিল।

চোখ—ঝলসানো দুটো হেডলাইট জ্বলা মারুতির মধ্যে একটা আবছা মাথা সাঁ করে অনুপমের চোখের সামনে দিয়ে কলকাতার দিকে চলে গেল। দুলালচাঁদ একবার মুখ ফিরিয়ে তাকালও না তার দিকে। রাস্তার দু’ধারের গাছগুলো আলোয় ভেসে উঠেই অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। মারুতির পেছনে লাল আলো দুটো অন্ধকারকে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে আলোর পেছন পেছন।

অনুপমের বুকের মধ্যে অজানা একটা ভয় গুড় গুড় করে উঠল। এইবার কি ওই দুটো রক্তচক্ষুর নজরে থাকা অন্ধকারের মধ্যে তাকে ঢুকতে হবে? তার কি আলোর দিন শেষ!

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। সকালে মিনিট পনেরোর বৃষ্টিতে শীত বিদায় নিতে নিতেও আজকের মতো থমকে গেছে। রাস্তায় লোক চলাচল করছে না। গাছের ফাঁক দিয়ে বাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। অনুপমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল।

এখন তাকে তেঁতুলতলা খুঁজে বের করতেই হবে। সারারাত অন্ধকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকলে চলবে না, রবিদার বাড়ি তাকে পৌঁছতেই হবে, সেই অশ্বত্থ গাছ আর শিবের চত্বরটার হদিস আগে চাই।

অনুপম সন্তর্পণে বাঁ পা ফেলল। লোহার রডটা পেছন থেকে চালিয়েছিল, বোধ হয় কোমর লক্ষ্য করে। ঠিক সেই সময় কে যেন ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। রডটা হাঁটুর পেছনে লেগে পিছলে গেলেও চোটটা দিয়ে গেছে।

পায়ে ভর রেখেই সে ‘আহহ’ বলে চোয়াল শক্ত করে ফেলল। সতেরো বছর বয়সে ময়দানে সেকেন্ড ডিভিশনে সে খেলতে এসেছিল। দুটো পা এগোরো বছর ধরে কম চোট তো পায়নি! জখম হওয়ার অভ্যাস তার আছে। এক পা হেঁটেই সে বুঝতে পারল হাড়ে লেগেছে। এখন দরকার গরম জল ঠাণ্ডা বরফ জল আর বিশ্রাম। হাঁটাচলা একদম না করা। রবিদার বাড়িতে রেফ্রিজারেটার আছে, এত রাতে বরফও পাওয়া যাবে।

মা হলে বলতেন, ”রাখ তোর ঠাণ্ডা—গরম জল, চুন—হলুদ করে দিচ্ছি, লাগা। এই লাগিয়েই তো এত বড়টা হলি।”

তাদের বিদ্যুৎপুরের বাড়িতে অনুপম গত বছর বাবা—মায়ের জন্য টিভি সেট কিনে দিয়ে এসেছে। বাবা ফুটবলের ভক্ত, মা নন। বড়দা দেবোপম স্কুল শিক্ষক। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্কুল ও কোচিং নিয়েই ব্যস্ত। টিভি দেখার সময়ই পায় না। ছেলে—মেয়েদের দেখতে দেয় না লেখাপড়ার ক্ষতি হবে বলে।

আজকের খেলা বাড়ির কেউ কি দেখেছে? বাবা নিশ্চয়, ভাইপোরাও, মা—ও হয়তো মাঝে মাঝে টিভির সামনে এসেছেন। খেলাশেষের ঘটনাগুলো কি দেখানো হয়েছে? নির্মম, বীভৎস পাশবিক দৃশ্য কি টিভিতে দেখাবে? কিন্তু টাই ব্রেকারের শেষ কিকটির নেওয়াটা ওরা নিশ্চয় দেখিয়েছে।

ডেম্পোর পঞ্চম কিকটা নিয়েছিল মিগুয়েল, রাজীব বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে বলটা পেয়ে যায়। ফল তখন ডেম্পোর পক্ষে ৪—৩। সারথির পঞ্চম কিকটা বাকি। একটা বিশাল টাইফুন মাঠের তিনদিকের গ্যালারির ওপর দিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল। অনুপমকে পেনাল্টি মারার জন্য এগিয়ে যেতে দেখেই সেটা স্তব্ধ হয়ে পড়ল। অবধারিত ৪—৪। তারপর সাডন ডেথ। কিন্তু তার আগে ৪—৪ তো হওয়া চাই। আর হবে নাই বা কেন? কিক নিচ্ছে তো অনুপম বিশ্বাস! টাইফুনের যদি প্রাণ থাকে তা হলে তখন সে নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছিল ডেম্পোর গোলের মধ্যে বল দেখার জন্য।

বাঁ পা টেনে টেনে অনুপম অন্ধকারের মধ্যে এগোচ্ছে। ঘড়িটা হাতে নেই, বোধ হয় পকেট থেকে কোথাও পড়ে গেছে। খালি গায়ে, কালো হাফ প্যান্টটা পরে, শর্ট আর ট্রাউজার্সটা পাকিয়ে বগলে নিয়ে তাঁবুর পেছন দিকের জানলা গলে অন্ধকারের মধ্যে মাটিতে নেমেছিল। হামাগুড়ি দিয়ে সে ক্যান্টিনের পেছনে কাঠের বেড়া পর্যন্ত যায়। বৃদ্ধ সহদেব মালি বেড়ার নীচের একটা তক্তা সরিয়ে বলেছিল, ”রাস্তার দিকে একদম যাবে না, অন্ধকার অন্ধকার মাঠ দিয়ে কেল্লার ওই কোনায় চলে গিয়ে চুপচাপ মাটিতে শুয়ে থাকবে। খারাপ লোকেরা এখন মাঠে ঘুরে বেড়ায়। দুলোবাবু গাড়ি নিয়ে আসবে, দেখতে পেলেই ছুটে গিয়ে উঠে পড়বে।… যাও, যাও, আর এ—মুখো হয়ো না। এত নামডাক, এতবড় পেলেয়ার…”

অনুপমের আর কিছু শোনার মতো মনের অবস্থা তখন ছিল না। কিন্তু এখন তার কানে সহদেবের কথাটা স্পষ্ট বেজে উঠল, ”যাও, যাও, আর এ—মুখো হয়ো না।” কয়েক পা গিয়েই সে আবার শুনল, ”যাও, যাও।” অনুপম বুঝতে পারছে না, ভয় না ঘৃণা, কী ছিল ওর স্বরে?

রাস্তাটা ধনুকের মতো বেঁকেছে। বাঁক ঘুরেই অনুপমের মনে হল কিছু দূরেই একটা বাজার আর মোড়। অনেকগুলো দোকানের সাইনবোর্ড সে দেখতে পাচ্ছে, তবে বেশিরভাগই বন্ধ। রাত দশটায় মফস্বলে দোকান খোলা রাখা নির্ভর করে লোক চলাচলের ওপর। একটা মিষ্টির দোকান, তার পাশে বিড়ি—সিগারেটের দোকান আর সেলাই মেশিনে ব্যস্ত এক দরজি শুধু দোকান খোলা রেখেছে দেখল। এই মোড় থেকে একটা রাস্তা স্টেশনে গেছে।

বাজারের আগে রাস্তার ডানদিকে অন্ধকারে যে একটা অশ্বত্থ গাছ রয়েছে, কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত অনুপম তা বুঝতে পারেনি। গাছতলায় বাঁধানো গোল চত্বরটা ঠাহর হতেই সে স্বস্তির শ্বাস ফেলল।

এই তো রবিদার বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা।

.

চার বছর আগে রবিদা হঠাৎই এক দুপুরে তার ব্যাঙ্কে হাজির হয়েছিল দুটি যুবককে সঙ্গে নিয়ে।

‘কী ব্যাপার রবিদা!”

”অনু, তোকে জ্বালাতন করতে এলুম। কী করব বল, বিখ্যাত ভাইয়ের দাদা হওয়া যে কী দুর্ভোগের, এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তুই আমাকে বাঁচা।”

”আমি বিখ্যাত? দুপুরবেলা এত পথ ঠেঙিয়ে ঠাট্টা করতে এলে?”

”যা সত্যি তাই বলেছি। সারা ভারতে এখন সেরা মিডফিল্ডার বলতে তো শুধু একজনই, অনুপম বিশ্বাস।”

কথাটা বলে রবিদা সঙ্গের যুবক দু’জনের দিকে তাকিয়েছিল। তারা বিগলিত হাসি দিয়ে জানিয়ে দেয়, সিদ্ধান্তটা তর্কাতীত।

”অনু, আমার ওখানে অনেকদিন তুই যাসনি। এগারোই, এই রোববারের পরের রোববার আয়।”

”কী ব্যাপার, কিছু আছে টাছে নাকি?”

”আমাদের মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের মায়ের নামে শিল্ড চালু হয়েছে, এই বছরই প্রথম, রোববার তাই ফাইনাল। এরা এসে ধরল আপনার ভাইকে প্রধান অতিথি করে দিতে হবে। কার্ডফার্ড সব ছাপিয়েও ফেলেছে।”

”অ্যাঁ, আমাকে জিজ্ঞেস না করেই?”

”কেন, তোর অনুমতি নিতে হবে নাকি আমার ওখানে যাওয়ার জন্য?” রবিদা তার স্বভাবসিদ্ধ হাসিখুশি ঢঙে কথাটা বলেছিল।

”আমার অসুবিধে থাকতে পারে তো ওই দিন। প্রতি রোববারই হয় সভাপতি নয়তো প্রধান অতিথি হওয়া…. অন্তত একমাস আগে আমায় না বললে…।” অনুপম গম্ভীর স্বরে ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে রবিবার মুখ থেকে আমুদে সজীবতাটা মুছে দিয়েছিল।

অপ্রতিভ রবিদা যুবক দুটির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে কুণ্ঠিত স্বরে বলে, ”আমি তো এদের বলেছি তোকে নিয়ে যাব। হ্যাঁরে দু—চার মিনিটের জন্যও কি সময় করতে পারবি না? তুই না গেলে আমার তো—”

মাথা কাটা যাবে! অনুপম তখন মনে মনে রেগে উঠেছিল। এরা সব ভাবে কী! ধরেই নিয়েছে যেন, অনুপম বিশ্বাস ফুটবল খেলে এত নাম এত সম্মান পেয়েছে এদেরই অনুগ্রহে, তাই যখন খুশি ওকে ডাকলেই যেতে হবে।

 আর এই রবিদা। তার নিজের দাদা নয়, দূর সম্পর্কের মামার ছেলে। বিদ্যুৎপুরে তাদের বাড়িতে থেকেই মানুষ। লেখাপড়া স্কুল ফাইনাল পাশ, তবে অসম্ভব পরিশ্রমী আর উদ্যোগী। অল্প বয়স থেকেই খুচখাচ ব্যবসা করত। বছর দশেক আগে তেঁতুলতলায় দোতলা বাড়ি করেছে, এখানেই শ্বশুরবাড়ি। এখন আলুর বড় ব্যবসায়ী, কোল্ড স্টোরেজের অংশীদার, সার আর বীজের দোকান আছে। নিঃসন্তান।

রবিদা ভাল ফুটবল খেলত। অনুপমের শিশু বয়সে তরুণ রবিদাই ছিল তার হিরো। তার ফুটবলকে ভালবাসার প্রথম শিখাটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল যে রবিদাই—এটা অনুপম মনে মনে স্বীকার করে।

এক সময় বাড়িতে তার ফুটবল খেলা নিয়ে ঘোরতর আপত্তি উঠেছিল, যখন সে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করল। তখন রবিদা যদি না….

”ঠিক আছে, যাব।” অনুপম তার গাম্ভীর্য সরিয়ে হালকা চালে বলেছিল। রবিদার মুখ চোখে ঔজ্জ্বল্যের দপ করে নিভে যাওয়াটা তার মনে খচখচ শুরু করে দিয়েছিল। ব্যাপারটা হালকা করার জন্য সে তখন বলেছিল, ”কিন্তু রবিদা, আমি দুপুরে বউদির রান্না খাব। ঠিক এক বিঘত লম্বা কই মাছের ঝাল আর পোস্তর বড়া রাঁধতে বলবে।”

রবিদার মুখে আবার ফিরে এসেছিল আমুদে উচ্ছলতা। যুবক দুটির সামনে সে নানা ভাবে দেখাবার চেষ্টা করল—তোমাদের এই হিরো অনুপম বিশ্বাস আমার খুব অনুগত ভাই। আমায় খুব মান্য করে। অনুপম স্মিত হেসে রবিদার সব কথাই মেনে নেয়।

ওরা চলে যাওয়ার পর তার মনে হয়েছিল, সে যেন অনেক বদলে গেছে। কেমন যেন এক ধরনের দাম্ভিকতা, পায়াভারী ভাব তার মধ্যে আসতে শুরু করেছে যেটা মাঝে মাঝে তাচ্ছিল্য দেখানো ঔদ্ধত্যের মতো তার নিজের কাছেই মনে হয়েছে। অনুপম তখন জানত না একদিন অবস্থার ফেরে পড়ে, ঘটনাচক্রে তাকে এই রবিদার বাড়ি খুঁজে বের করার জন্য রাত্রির অন্ধকারে পথ হাতড়াতে হবে।

অশ্বত্থ গাছের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সরু রাস্তাটার দিকে অনুপম তাকাল। একটা সুড়ঙ্গের মতো দেখাচ্ছে। চার বছর আগে এখানেই সে মোটর গাড়ি থেকে নেমেছিল। রবিদার সঙ্গে যে দু’জন যুবক তার ব্যাঙ্কে গেছল তাদেরই একজন, গোপাল নাম ছিল, তাকে বেলেঘাটা থেকে মোটরে নিয়ে এসেছিল।

অনুপম মোটর থেকে নেমে বলেছিল, ”এখান থেকে কতটা হাঁটতে হবে?”

গোপাল বিব্রত হয়ে বলেছিল, ”মিনিট—তিনেকের পথ, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি মোড় থেকে একটা রিকশা নিয়ে আসি।”

”আরে না, না। তিন—চার মিনিট হাঁটলে আমার পা খুলে পড়বে না। অতটা অথর্ব এখনও হইনি।”

মাত্র চার বছরের মধ্যে কথাগুলো কেমন বুমেরাং হয়ে ফিরে এল। এখন গোপাল যদি অন্ধকার ফুঁড়ে তার সামনে এসে হাজির হয়!

অশ্বত্থ তলার বাঁধানো জায়গাটায় বাঁ পা—কে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য বসে অনুপম দ্বিধান্বিত মনে ভাবল, তা হলে কি সে বেঁচে যাবে? গোপাল যে তার অন্ধ ভক্ত সেটা বুঝে নিতে তার তিরিশ সেকেন্ডও লাগেনি। ওর চোখ মুখই বলে দেয়, অনুপম আর সারথি সঙ্ঘকে সে পুজো করে। সেদিন সারাক্ষণ গোপাল ছায়ার মতো তার সঙ্গে সঙ্গে ফিরেছে। অন্য ভক্তদের কাছে আসতে না দিয়ে আগলে রেখেছিল, যেন অনুপম একা তারই সম্পত্তি।

আগের দিন বিকেলে পুকুরে জাল ফেলিয়ে এক বিঘত লম্বা কই পাওয়া যায়নি, গোপাল কলকাতায় এসে তিন—চারটে বাজার ঘুরে নাকি এক বিঘতের কাছাকাছি মাপের কই মাছ কিনে রাত সাড়ে দশটার ট্রেনে ফিরেছিল। দুপুরে খাওয়ার সময় অনুপম মাছ দেখে বলেছিল, ”ইস, কত বড়! যদি আজ না আসতাম তা হলে তো জীবনের একটা বিরাট আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতাম। রবিদা, তোমার পুকুরে এত বড় কই আছে জানলে তো আমি হপ্তায় দু’বার করে আসতাম।”

রবিদা আঙুল তুলে দরজার কাছে দাঁড়ানো গোপালকে দেখিয়ে বলেছিল, ”ওর জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে। বুঝলি অনু, আমাদের এই অঞ্চলটাই সারথির সাপোর্টার। তোর কী দরকার সেটা শুধু একবার বলবি। তারপর দ্যাখ এই গোপাল আর ওর মতো কয়েকটা সারথি—পাগল ছেলে কী করতে পারে। এখানকার পুজো প্যান্ডেলের শামিয়ানার কাপড়ে, সাইনবোর্ডে, পরদায়, ঘুড়িতে, সব ব্যাপারেই সারথির ফ্ল্যাগের কলাপাতা আর গাঁদাফুল রং তুই পাবি। এখানে কার্ড হোল্ডার মেম্বার কত আছে জানিস? অন্তত এগারোজন শুধু তেঁতুলতলাতেই।”

”তেরোজন!” গোপাল রবিদার ভুলটা শুধরে দিয়েছিল।

”সারথি পয়েন্ট লস করলে বা হারলে এখানে বহু বাড়িতেই অরন্ধনের উপবাস চলে। গত বছর লিগে যুগের যাত্রীর কাছে হারের পর শক্তিপ্রসাদ বলে একটা ছেলে এগারো দিন না খেয়ে ছিল।”

”কিন্তু আমরাই শেষপর্যন্ত লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।” অনুপম বলেছিল।

”এবারেও হব তো?” গোপাল তার ব্যাকুলতা গোপন না রেখেই ব্যগ্র স্বরে জানতে চেয়েছিল।

”নিশ্চয়ই। আমি তো সিজনের শুরুতেই বলেছিলাম, এবারও সারথিকে চ্যাম্পিয়ন করাব।”

চার বছর আগের কথা। সত্যিই লিগ চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল সারথি। তারপর আর হয়নি। কিন্তু প্রতি সিজনের শুরুতেই অনুপম বলে গেছে, চ্যাম্পিয়ান করাব। প্রতি সিজনে সে টাকার দাবি বাড়িয়েছে এবং আদায়ও করেছে, কিন্তু বড় ট্রফি এনে দিতে পারেনি। সমর্থকরা প্রথমে বিস্মিত হয়েছে, তারপর বিরক্ত। এখন হাসাহাসি করে।

গোপালও কি এখন তাকে দেখে হাসবে? আজ আটটা বডি টেন্টের লনে রেখেছিল। এটা নিয়ে হাসাহাসি হবে? রডটা চালিয়েছিল তার কোমর ভেঙে দেওয়ার জন্য, ভাগ্যক্রমে লাগেনি। ভেঙে গেলে কি হাসাহাসি হত? পঙ্গু অনুপম বিশ্বাসকে কেউ কি মনে রেখে দেবে?

রাস্তা দিয়ে একটা সাইকেল এগিয়ে আসছে। অনুপম শক্ত হয়ে গেল। তাকে দেখতে পেয়ে যদি লোকটা কাছে আসে? এখানকার লোক নয় অথচ অন্ধকারে নির্জনে বসে রয়েছে। চোর, ডাকাত, ছিনতাইবাজ ভেবে চেঁচামেচি করে যদি লোক জড়ো করে।

”কে রে, পাগলা নাকি?”

লোকটা সাইকেল না থামিয়েই কথাটা বলে গেল। পেছনের কেরিয়ারে একটা বস্তা। অনুপম সাড়াশব্দ দিল না।

আর বসে থাকা ঠিক নয়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটলেই মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যাবে, কিন্তু পথে যদি ওদের কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়? অন্ধকারে নিশ্চয় তাকে চিনতে পারবে না। কিন্তু সঙ্গে যদি টর্চ থাকে? মফস্বলে, গ্রামে রাতে টর্চ ছাড়া মানুষ বেরোয় না। বিদ্যুৎপুরে সন্ধেবেলা কেউ বেরোলেই বাবা মনে করিয়ে যেন, ”সঙ্গে টর্চ নিয়েছিস তো, পথে যা সাপখোপ।”

সাপ! অনুপম সরু রাস্তাটায় নামতে নামতে থমকে গেল। কিন্তু এই অন্ধকারে সে দেখবে কী করে। শব্দ করলে ওরা ভয়ে সরে যায়, কিন্তু ওরা তো শুনতে পায় না। পা দিয়ে জমিতে ধপধপ করে চললে মাটিতে যে কম্পন হয় সেটা ওরা অনুভব করে সরে যায়। বাবাই একদিন বুঝিয়ে বলেছিলেন। তবে এখনও শীত যায়নি, ওরা এখনও গর্তের মধ্যেই রয়েছে।

কিন্তু অন্য ওরা?

তারা যদি ধপধপ শুনে এগিয়ে আসে। মুখে টর্চের আলো ফেলে। যদি চিনতে পারে!

দুলোদা বলে গেল, ”সাবধান, খুব সাবধান।”

রবিদা বলেছিল, ”তারপর দ্যাখ, এই গোপাল আর ওর মতো কয়েকটা সারথি—পাগল ছেলে কী করতে পারে।”

কী পারে? পিটিয়ে মানুষ মারতে কি পারবে? কী খাতির—যত্নই না গোপালরা করেছিল। ভৃত্যের মতো ক্রীতদাসের মতো পেছন পেছন ঘুরছিল তার কী দরকার জানার জন্য। ওরা চোখের চাউনি দিয়ে সারাক্ষণ তাকে পুজো পাঠিয়ে গেছে। চার বছরেই কি ওরা বদলে যাবে? ওদের ভক্তি, ভালবাসা কি এতই ঠুনকো? কিন্তু দুলোদা তো কয়েক ঘণ্টাতেই বদলে গেল। বড় ভাল লাগত এদের স্তুতি, এদের মুগ্ধতা, এগুলোকে সে সত্যি বলে, স্থায়ী বলেই ধরে নিয়েছিল।

পা ঘষটে অনুপম এগোতে লাগল রাস্তার দিকে চোখ রেখে। দু’পাশে বাড়ি। জানলাগুলোও বন্ধ। কোনও বাড়ি পাঁচিল ঘেরা, কোনওটায় বাইরের দালানে লোহার গ্রিল। তিনতলা পুরনো বাড়িও আছে কয়েকটা। টালির চালের বাড়িটার পরই একটা ডোবা।

কাছে এবং দূরের থেকে একই রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে আসছে। রেডিয়োয় গাইছে কোনও মেয়ে। এই গান বাদে সারা বিশ্বচরাচর অনুপমের কাছে শব্দহীন মনে হচ্ছে। কলকাতার বিকট আওয়াজের মধ্যে বাস করার জন্য তার স্নায়ু যে চড়া সুরে বাঁধা হয়ে পড়েছে তাতে মফস্বলের রাতের এই নৈঃশব্দ্য তাকে খুব জোরে আঘাত করল। তার শরীরে ক্লান্তি নেমে এল এবং সঙ্গে সঙ্গে সে অভ্যাসবশেই ভীত হয়ে উঠল। ম্যাচ শেষ হতে অনেক সময় বাকি, এখনই টায়ার্ড হয়ে গেলে চলবে না। তাকে পালাতে হবে, সারথির লোকেদের, ভক্তদের, অনুগতদের হাত থেকে বাঁচতে হলে এখন কোথাও লুকিয়ে থাকতে হবে।

তেঁতুলতলায় আসাটাই ভুল হয়েছে। কেন যে সেই দিশাহারা, তুলকালাম, নারকীয় পরিস্থিতির মধ্যে তার রবিদাকেই মনে পড়ল! ঠাণ্ডা, নরম, স্নেহশীল। ওর কাছে সাহায্য চাইলে প্রত্যাখ্যান করবে না, এই ধারণাটা তার মধ্যে কী ভাবে তখন যে এল, অনুপম তা ভেবে পেল না।

সে তো বিদ্যুৎপুরেও বাবা—মা দাদার কাছে চলে যেতে পারত। কিন্তু ষাট—পঁয়ষট্টি মাইল দূরে কে তাকে এক রাতে গাড়ি করে পৌঁছে দিত? দুলোদা দশ—বারো মাইল পর্যন্ত যে এসেছে, আজকের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই অদ্ভুত ব্যাপার। হয়তো কৃতজ্ঞতা বোধের ছিটেফোঁটা এখনও ওর মধ্যে রয়েছে। সারথির একজিকিউটিভ কমিটিতে ওকে ঢোকাবার জন্য শেষ পর্যন্ত অনুপমকে ভোট জোগাড়ে নামতে হয়েছিল।

বাঁ দিকে টানা একটা নিচু পাঁচিল। বাড়িটার বাইরের দালানে একটা টিভি সেট। অনেকগুলো মানুষ। বাড়ির লোক ছাড়াও বাইরের লোকও বোধ হয় রয়েছে। হিন্দি কোনও সিরিয়াল হয়তো। দালানের আলো নেভানো কিন্তু ভেতরের ঘরের আলো জ্বলছে। চেয়ারে দু—তিনজন, বাকিরা মেঝেয় বসে। অনুপম মাথা নামিয়ে কুঁজো হয়ে এগোল।

পাঁচিলের মাঝে একটা ফাঁকা জায়গা। লোহার গেট। ওর সামনে দিয়ে তাকে যেতে হবে। অনুপম থমকে গিয়ে ভাবল, দালান থেকে কেউ কি দেখে ফেলতে পারে?

মাথাটা তুলে দূরত্ব আর অন্ধকার সম্পর্কে একটা আন্দাজ করে নিয়ে সে স্বাভাবিক হেঁটে ছ—সাত হাত চওড়া গেটের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হোঁচট খেল।

”আহহ।” হাঁটুতে ধাক্কাটা পেয়ে অনুপমের মুখ থেকে একটু জোরেই কাতরানিটা বেরিয়ে এল। পাঁচিলের ওধার থেকে ডেকে উঠল একটা কুকুর।

”কে, কে, কে রে?”

অনুপম ছুটল। হাঁটুর যন্ত্রণা ভুলে সে প্রায় পঞ্চাশ—ষাট গজ ছুটে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। রাস্তাটা এখান থেকে দু’ভাগ হয়ে দু’দিকে গেছে। সে বুঝতে পারছে না কোনটা ধরে এগোলে রবিদার বাড়ি পৌঁছনো যাবে।

অন্য দিন, অন্য সময় হলে সে রাস্তার লোককে কি কোনও বাড়ির লোককে ডেকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিত। এখন ওসব ভাবাই যায় না। বাঁ পা তুলে ডান পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সে শ্রবণশক্তি তীক্ষ্ন করল।

কুকুর ডাকছে না। মানুষের গলাও শোনা যাচ্ছে না। আবার সব আগের মতোই নিস্তব্ধ। অনুপমের বুকের মধ্যে ছমছম করে উঠল। বলটা স্পটে বসিয়ে কিক নেওয়ার জন্য যখন পিছিয়ে যাচ্ছিল, সারা মাঠ তখন এইরকম নিশ্বাস বন্ধ করা শব্দহীনতার মধ্যে ডুবে ছিল।

এখন তার দরকার যা হোক কোনও শব্দ। অনুপমের মনে হল ডানদিকের রাস্তাটাতেই রবিদার বাড়ি। কেন যে মনে হল, তার কোনও ব্যাখ্যা সে দিতে পারবে না। এই রকম অনুভূতির জন্যই সে অনেক বার এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে বল পেয়েছে, যেখানে বল আসার কোনও সম্ভাবনা তখন ছিল না। সবাই বলে, তার সিক্সথ সেন্স নাকি খুব তীক্ষ্ন। দারুণ ভাবে কাজ করে। করে বলেই আজ সে প্রাণ নিয়ে এখনও টিকে রয়েছে।

লোহার রডটা কোমরেই লাগত যদি না ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে সে তিন—চার পাক গড়িয়ে যেত। তারপর লাফিয়ে উঠে সে তাঁবুর দিকে ছোটে। তিরিশ—চল্লিশ গজ মাত্র। দু’দিক থেকে জনতা ছুটে আসছে, কয়েকজন মাত্র পুলিশ লাঠি তুলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। অনুপম তাঁবুর মধ্যে পৌঁছে যেতে পেরেছিল।

কী ভাবে যে তাঁবুটা রক্ষা পেল, সে এখনও বুঝতে পারছে না। অন্য কোনও ফুটবলারকে ওরা মারধোর করার খুব বেশি সুযোগ পায়নি। সরল আর অপূর্বর মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল। পুলকেশ চিত হয়ে কাতরাচ্ছিল, বোধ হয় পাঁজরের হাড় ভেঙেছে। রঞ্জনের বাঁ চোখটা বন্ধ হয়ে গেছে, থু—থু করে রক্ত ফেলছিল মুখ থেকে।

তাঁবুর কোলাপসিবল গেটটা বন্ধ করে দেওয়ার মুহূর্তে ছোটখাটো চেহারার একটা লোক ছুটে এসে ধাক্কাধাক্কির মধ্যে তাঁবুতে ঢুকে পড়েছিল। পরে সে ড্রেসিংরুমের কোণে আধো—অন্ধকারে বসে থাকা অনুপমের কাছে গিয়ে মুখের কাছে মুখ এনে, পানের ছোপ ধরা দাঁতগুলো দেখিয়ে বলেছিল, ”অনু, তোর উত্থান আমি দেখেছি, এখন পতনটাও খুব কাছ থেকে দেখব বলে ঢুকে পড়েছি।”

অনুপম তখন বোবা চোখে শুধু তাকিয়ে থেকেছিল প্রভাতী সংবাদের স্টাফ রিপোর্টার, পাঁচ ফুট দু’ ইঞ্চি, বাহান্ন কেজি, আটত্রিশ বছর বয়সি সুপ্রিয় গুপ্তর দিকে।

”তোর একটা ফাইনাল ইন্টারভিউ নেব… অনু না বলিস না, তোর দেওয়া অপমানগুলো আমি এখন ভুলে যেতে রাজি… জাস্ট ওয়ান ইন্টারভিউ, হার্ট টু হার্ট টক….”

”সামনে থেকে সরে যাও সুপ্রিয়দা। তোমার মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে না।” অনুপম চাপা স্বরে চোয়াল চেপে বলেছিল।

”আমাকে সরিয়ে দিতে তুই পারিস, কিন্তু আমি কি তোকে সরিয়ে দিতে পারব আমার মন থেকে? তুই যতক্ষণ থাকবি, যেখানে থাকবি, আমিও সেখানে—”

কে? কে যেন আসছে? অনুপম শক্ত হয়ে গেল। একজন, না কয়েকজন? তার বুকের মধ্যে আবার টাই ব্রেকার কিক নেওয়ার আগের মুহূর্তটা ফিরে এল। যতজনই হোক অন্ধকার পথে কেউ কাউকে দেখলেই বলবে, ”কে?” পরিচয় নিতে চাইবে। তখন সে কী বলবে? রবিদার নাম করে বলবে তার বাড়িতে যাচ্ছি! তাইতে বাড়ির রাস্তা বাতলে দিয়ে চলে যেতে পারে কিংবা আরও কৌতূহলী হয়ে টর্চ জ্বেলে কিংবা সিগারেট ধরাবার ছলে দেশলাই জ্বেলে তার মুখটা দেখে!…. যদি দেখেই ভ্রূ কোঁচকায়? তারপর হনহন করে অন্ধকারে ছুটতে ছুটতে যদি চেঁচায়। ”ওরে অনুপম বিশ্বাস, আমাদের তেঁতুলতলায় অনুপম বিশ্বাস… তোরা শিগগির বেরিয়ে আয়, পালিয়ে যাবে। ধর ওকে, লাশ ফেলে দে।”

রডটা পায়ে লাগার আগে সে শুনতে পেয়েছিল—”শেষ করে দে। টাকা হাতে না পেলে বাবু পায়ে বল ছোঁবে না।” বিদ্রূপে মোচড়ানো স্বরে কুৎসিত নোংরা গালাগালিতে আরও বলেছিল, ”বছর বছর প্যাঁচ কষে টাকাই শুধু বাড়িয়েছিস। ট্রোফি আর আনতে পারিসনি।”

দুলোদার কথাটা মনে পড়ল—”সাবধান, সাবধান। … এখন তোর জীবন তোর হাতে। সারথির সাপোর্টার সর্বত্র রয়েছে।”

অনুপম বাঁ দিকে দুটো খেজুর গাছ দেখতে পেল। ঘেঁষাঘেঁষি করে একটা মোটা থামের মতো হয়ে দাঁড়িয়ে। সে গাছ দুটোর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।

দুটো ছায়ামূর্তি আসছে। আকার দেখে সে বুঝল ওদের একজন নেহাতই অল্পবয়সি।

”বলিস কী, ছোটমামা রেডিয়োটা আছড়ে ভেঙে ফেলল?”

”হ্যাঁ বাবা বলল, ঘুষ খেয়েছে। টাকা খেয়ে ইচ্ছে করে পেনালটি মিস করল।…গুলি করে মারা উচিত। ক্লাবের মধ্যে পলিটিক্স করবে, প্লেয়ারদের নিয়ে জোট বেঁধে…”

অনুপমের পাঁচ—ছ’ হাত সামনে দিয়ে ওরা চলে গেল। ছেলেটার বয়স কতই বা, নয় কি দশ। যা শুনেছে তাই বলল। এইসব শুনতে শুনতে বড় হবে, বিশ্বাসও করবে, অনুপম ঘুষ নিয়ে খেলত।

বুকের মধ্যে হঠাৎই একটা বিশাল কালো গহ্বর তৈরি হয়ে গেল বলে তার মনে হল। কিছুদিন আগে কাগজে পড়েছিল, আমেরিকার বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মিল্কি ওয়েতে পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা সূর্যের থেকে দশ লক্ষ বড় ব্ল্যাক হোল পেয়েছেন। সেটা নাকি প্রতি পাঁচ থেকে দশ হাজার বছরে একটা করে নক্ষত্র গিলে ফেলছে। পড়ার সে কল্পনা করতে চেয়েছিল বিশাল একটা অন্ধকার গহ্বরকে। কিন্তু পারেনি। সূর্যটা যে কত বড়, পৃথিবী থেকে চোখে দেখে কোনও ধারণা পাওয়া যায় না। কিলোমিটার আর মাইলে গড়া ব্যাসার্ধ বা পরিধির কথা বলেও কিছু আন্দাজ হয় না। সূর্যের দশ লক্ষ গুণ যে কত বড় হতে পারে, সে কিছুই ধারণায় আনতে পারেনি।

এখন সে অনুভব করতে পারল।

আটজন নাকি মঠেই মারা গেছে। কথাটা সে দশ—বারোবার শুনেছে। তাঁবুর গেট আর জানলাগুলো বন্ধ করে কে চেঁচিয়ে বলেছিল, ”চুপচাপ সবাই বসে থাক।… ডেডবডি এনে শুইয়ে রেখেছে সামনের লনে। জানলা ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করিসনি।”

অন্ধকার তাঁবুর মধ্যে গিসগিসে ভিড়। আর একজন চাপা গলায় বলেছিল, ”পাপ। পাপের ভারে পূর্ণ হয়ে গেছে সারথির পথ। তাই চাকা বসে গেল।”

কেউ সেই কথার প্রতিবাদ বা সমর্থন করেনি। শুধু সরল তার পাশ থেকে বলেছিল, ”মাথার চুল না কামিয়ে কি জায়গাটা সেলাই করা যায় না?”

”তা কী করে হয়! যে ভাবে রক্ত বেরোচ্ছিল, তাতে কম করে বারো—চোদ্দোটা স্টিচ তো তোর লাগবেই।” প্রকাশ বলল।

”সরল, তোর বিয়েটা কবে?’ আর—একজনের প্রশ্ন।

”আঠারো দিন বাকি।”

”তদ্দিনে চুল গজিয়ে যাবে, আর তা নইলে কামানো জায়গাটায় চুল লাগিয়ে নিবি।”

অনুপম দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ চেপে দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে বসে ছিল। কেউ তার সঙ্গে ইচ্ছে করেই কথা বলছে না, এটা সে বুঝতে পারছিল। সে জানে তার প্রতি কারও কোনও সহানুভূতি নেই। এই ঘটনায় বরং সবাই মনে মনে খুশিই হয়েছে এই ভেবে—অনুপম বিশ্বাস ফিনিশ হয়ে গেল। আর মাঠে ফেরা সম্ভব হবে না।

একটা অস্ফুট গোঙানি অনুপমের মুখ থেকে বেরিয়ে এল। খেজুর গাছে কপালটা ঘষার জন্য জ্বালা করছে। এখন তাকে পেছনে নয় সামনে তাকাতে হবে। জীবন এখন নিজের হাতে, এটা কোনও ভাবেই ভুললে চলবে না।

রাস্তায় উঠে সে হাঁটতে শুরু করল। বাঁ হাঁটু ভাঙতে পারছে না, অসাড় হয়ে গেছে। তাতে অসুবিধে বোধ করছে না। এখনও পর্যন্ত ওদের কারও সঙ্গে দেখা হয়নি।

চার বছর আগে ফাইনাল ম্যাচে তাকে মঞ্চে তোলার আগে, মাঠের চারধারে তাকে জোড় হাতে ঘুরতে হয়েছিল অন্তত হাজার পাঁচেক দর্শকের অভিনন্দন—উচ্ছ্বাস—হাততালিতে আপ্লুত হওয়ার জন্য। মনে হচ্ছিল, দুটো দলের ফাইনাল খেলা তো নয়, অনুপম বিশ্বাসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। গোপাল আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কাকুতি মিনতিতে সে রাজি হয়ে গিয়েছিল।

রবিদাও বলেছিল, ”অনু যা, সব সারথিরই সাপোর্টার, তোর দারুণ ভক্ত। ওদের নিরাশ করিসনি। তোকে দেখার আশাতেই ওরা এসেছে। না গেলে তোকে অহঙ্কারী ভাববে।”

অতগুলো লোক তাকে চিনে রেখেছে। কিন্তু চার বছরে কি তার মুখটা বদলায়নি? বা চার বছরে কি ওদের স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসেনি?

সেও কি জনতার সেদিনের কোনও মুখ মনে করে রেখেছে? সবই তো এক রকম! গদগদ, কৃতার্থ, দাঁত বের করা, হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা, অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য কলম আর খাতা এগিয়ে… আহহ, একটা মুখ মনে পড়ছে, একটা মুখ।

রুগণ, লম্বাটে মুখ, ফরসা রং। পাতাকাটা চুল কপালে ঝুলে ছিল। ড্যাবড্যাবে চোখের মণি দুটো ঘন কালো। বছর বারো বয়স হবে। ওরই বয়সি অনেকে অটোগ্রাফ নিচ্ছে দেখে বোধ হয় ইচ্ছে হয়েছিল। একটা হ্যান্ডবিল কুড়িয়ে এনে তার সাদা উলটো পিঠটা এগিয়ে ধরেছিল একটা পেনসিল হাতে নিয়ে। অনুপম তখন বিরক্ত হয়ে উঠেছিল সই দিতে দিতে। হ্যান্ডবিলটা দেখে তার মেজাজ রুক্ষ হয়ে উঠেছিল।

”আমার নাম জানো?”

ছেলেটি থতমত হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। গভীর, সরল, লাজুক চোখ।

”আমি কোন ক্লাবে খেলি জানো?”

ছেলেটির মুখে হাসি ফুটেছিল। ”আপনি অনুপম বিশ্বাস, সারথি সঙ্ঘে খেলেন।”

”কোন পজিশানে?”

ছেলেটির চোখে বিড়ম্বনা ফুটে উঠেছিল। আমতা আমতা করছে, তখন দুষ্টুমি করেই একজন ফিসফিসিয়ে ছেলেটিকে বলেছিল, ”বল, গোলে খেলেন।” সঙ্গে সঙ্গে ও বলে ওঠে, ”আপনি তো গোলকিপার।”

হোহো করে তাকে ঘিরে থাকা ভিড়টা হেসে উঠেছিল আর অনুপমের সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠেছিল। তাকে চেনে না এই বয়সি একটা ছেলে? তা হলে তার কীসের নাম, কীসের খ্যাতি! এতগুলো হাসি যেন তাকেই বিদ্রূপ করে উঠল।

হ্যান্ডবিলটা মুঠোয় দলা করে পাকিয়ে ছেলেটির কপালে সে ছুড়ে মেরে বলেছিল, ”আমি কে, সেটা আগে জেনে এসো, তারপর সই নিয়ো…. অটোগ্রাফ বুকে, এ রকম বাজে কাগজে নয়।”

ড্যাবড্যাবে চোখের সেই অপ্রতিভ চাহনিটা টিভি রিপ্লের মতো অনুপমের স্মৃতিতে ফিরে এল মন্থর গতিতে। ছেলেটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সই নেওয়ার জন্য জায়গা করে দু—তিনজন এগিয়ে এসেছে। চোখের কোণ দিয়ে সে দেখেছিল, পায়ে পায়ে ছেলেটি ভিড়ের বাইরে চলে গেল। গোপালরা তাকে ভিড় থেকে উদ্ধার করে মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় ছেলেটি তার মুখোমুখি পড়ে যায়। তাকে দেখে রুগণ মুখটায় লাজুক হাসি ফুটিয়ে ও অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে থাকে।

জীবনে প্রথমবার অপমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার বিস্ময়ই কি ছেলেটির চাহনিতে ছিল? অবাক হয়ে দেখছিল কি অভব্যতা, দাম্ভিকতার প্রতিমূর্তিকে?

চার বছরে এখন ছেলেটি কিশোর। এতদিনে সে কি জেনেছে অনুপম বিশ্বাস কে?

ঝাঁঝি আর কচুরিপানা পুকুর থেকে তুলে পাড়ে রাখা হয়েছে। সেগুলো থেকেই আঁশটে সোঁদা গন্ধটা আসছে। তাঁবুর মধ্যে দরজা—জানলা বন্ধ অবস্থায় এইরকম একটা গন্ধ তার লেগেছিল। অতগুলো মানুষের শ্বাস—প্রশ্বাস আর ঘাম থেকে, তাঁবুর ওপর এসে পড়া ইট কাঠ, লোহার টুকরো থেকে, ভয়ার্ত ফিসফাস আর বাইরে থেকে আসা বীভৎস চিৎকার আর গালিগালাজ থেকে একটা আবহাওয়া তৈরি হয়ে উঠেছিল, যার মধ্যে অনুপম এই পুকুরপাড়ের গন্ধটা পেয়েছিল।

কে একজন তখন বলেছিল, ”শুধু অনুপমকে এর জন্য দায়ী করছ কেন? সবাই তো ক্লাবটাকে ডুবিয়েছে।”

”সবাই বলতে কাকে বোঝাচ্ছিস?”

”তুমি, আমি, প্লেয়াররা, অফিসিয়ালরা। যে যার নিজের স্বার্থ আগলাতে গিয়ে এমন সব আশকারা প্লেয়ারদের দিয়েছে, এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে ডোবাবার জন্য…”

”থাক, থাক, এখন এই নিয়ে ঝগড়া করার সময় এটা নয়। … যা কখনও হয়নি তাই হল আজ, মানুষ খেপে উঠে মানুষ মারল।”

”ইচ্ছে করে মারেনি। ভিড়ের চাপে, পায়ের চাপে….ওরা পালাতে যাচ্ছিল।”

”ধোঁয়া দেখেছিলাম, আগুন লাগিয়েছে কোথাও।”

”পুলিশের উচিত হয়নি গ্যালারিতে উঠে লাঠি চার্জ করা।”

”না করলে অবস্থা কী হত জানিস? সারথির একটা প্লেয়ারও প্রাণ নিয়ে মাঠ থেকে বেরোতে পারত না।”

”কিন্তু এখন আমরা বেরোব কী করে? পুলিশ কী করছে?”

অনুপমের তখন ভোঁতা হয়ে পড়ছিল মানসিক প্রখরতা। পেশিগুলো যেন জরাগ্রস্ত। ঝিমুনি এসেছিল। চোখ আর খুলে রাখতে পারছিল না। তবু সে বাস্তব পরিস্থিতিকে মন থেকে ছিটকে যেতে দেয়নি। সে বুঝে নিয়েছিল। তাকে সবাই বলির পাঁঠা করবে। জল্লাদের সামনে তাকেই ঠেলে দিয়ে সবাই বাঁচতে চাইবে।

পুকুরের পাশ দিয়ে রাস্তাটা এবার ধনুকের মতো ঘুরে গেছে। এইটুকু পথ আসতে কতটা সময় লাগল? অভ্যাস মতো বাঁ হাত তুলল ঘড়ি দেখার জন্য। কোথায় পড়ে গেল কে জানে!

বাতাস বইছে না, তাই কনকনে ঠাণ্ডা ভাবটা নেই। হাঁটুর ওপরে হাত বুলিয়ে দেখল ফুটে উঠেছে কি না। ব্যথা হবে, কাল সকাল থেকেই বুঝতে পারবে আঘাতটা কত জোরে হয়েছে। আজ রাতেই ঠাণ্ডা—গরম করতে পারলে ভাল হয়। অনুপম ধীরে ধীরে, যতটা সম্ভব হাঁটু না ভেঙে হাঁটতে লাগল।

কীসের যেন শব্দ হল।

রাস্তার কিনারে খাড়াই ঢাল নেমে গেছে পুকুরে, এই সময় পুকুরে জল প্রায় থাকে না। ঢালে আগাছা ঝোপ আর একটা পাতা ছাড়া মাঝারি আকারের গাছ। এই ঢালে গুঁড়ি মেরে কেউ থাকতে পারে।

দরদরিয়ে ঘেমে উঠল অনুপম। কেউ কি রয়েছে! একজন, দু’জন বা তিনজন! জানল কী করে আমি এখান দিয়ে রবিদার বাড়ি যাব। ফলো করেছিল? শিবের চত্বরে যখন বসে ছিলাম, তখন কেউ দেখে থাকবে, হয়তো সেই সাইকেলওয়ালাই। তারপর অন্য কোনও পথ ধরে এইখানে এসে অপেক্ষা করছে।

পিটিয়ে খুন করার পক্ষে জায়গাটা চমৎকার। একদিকে ফাঁকা জায়গা, বড় বড় গাছ ঘেরা কয়েকটা পাকা বাড়ি, অন্যদিকে পুকুর। নির্জন, অন্ধকার। চিৎকার করলে কোনও বাড়ি থেকে কেউ ছুটে আসবে না। কুকুরগুলো দু—চারবার ঘেউ ঘেউ করবে মাত্র।

আবার সরসর শব্দ হল। ঝোপ যেন নড়ে উঠল। চোখের ভুলও হতে পারে। অনুপম কাঠ হয়ে গেছে। কোনও মানুষ, নাকি জানোয়ার? ইঁদুর, বেড়াল, সাপ, গিরগিটি, শেয়াল কিংবা ছোটখাটো চিতাবাঘ! বুক আর পিঠ বয়ে ঘাম নামছে। মনে হচ্ছে পিঁপড়ে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে।

ছুটব কি? অনুপম কুঁজো হয়ে বাঁ পা বাড়াল রেসে স্টার্ট নেওয়ার ভঙ্গিতে। কিন্তু কতটা ছুটে পালাতে পারব? রাস্তাটা বেঁকে পুকুর ঘুরে আর একটু গেলেই রবিদার বাড়ি দেখা যাবে। তার আগেই কেউ তাকে ধরে ফেলবে। এখন তার থেকেও জোরে দৌড়তে পারবে যে—কেউই, একটা বাচ্চচা ছেলেও।

অনুপমের চেতনা জুড়ে হঠাৎই একজোড়া ড্যাবড্যাবে চোখ ভেসে উঠল। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেই দুটো চোখের দিকে। নিষ্পাপ, সরল, গভীর দৃষ্টি মেলে যেন বুঝতে চেষ্টা করছে, তার অপরাধটা কী? সেও তো আর সকলের মতো সই নিতেই গিয়েছিল। সই নেওয়াটা তো শ্রদ্ধা, অনুরাগেরই প্রকাশ!

চার বছর ধরে কি মনে করে রেখে দিয়েছে! চার বছর মানুষ কত বদলায়। অনুপম কান আর চোখ তীক্ষ্ন করে ঝোপের দিকে তাকাল। মনে হচ্ছে না ওখানে কোনও মানুষ আছে। থাকলে এতক্ষণে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। চার বছর সে নিজেও কত বদলে গেছে, ছেলেটাও নিশ্চয়ই কঠিন, নিষ্ঠুর, হিংস্র পরিবেশের থেকে রেহাই পায়নি।

অনুপম এগোতে লাগল। একটা টালির বাড়ি। একটা জানলা আধভেজানো। হ্যারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে। ঠং করে বাসন রাখার শব্দ এল। সে আশ্বস্ত বোধ করল। মিছিমিছিই ভয় পাচ্ছিল এতক্ষণ। এতদূর পর্যন্ত ধাওয়া করে কে আসবে তাকে মারতে? কী জন্যই বা তাকে মারবে? আটজন মারা গেছে, এটা খুবই দুঃখের। কিন্তু সেজন্য তাকে কেন দায়ী করা হবে, সে কি নিজের হাতে তাদের মেরেছে? তাকে মারধোর করে কী লাভ, হারা ম্যাচটা কি তাতে জেতা যাবে? তাকে মেরে ফেললে সারথির ট্রফি জেতার রাস্তা পরিষ্কার হবে?

”যত্তসব আজেবাজে ভয়।” অনুপম নিজের মনে বিড়বিড় করে মুখ তুলে রবিদার বাড়ির দিকে তাকাল।

ব্যাপার কী, সদর দরজার দু’ধারে বসার জন্য সিমেন্টের রক। তার ওপরের বালবটা এত রাতে জ্বলছে যে! দোতলায় দক্ষিণের দুটো ঘরের খোলা জানলা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে, বারান্দাটা অন্ধকার। একতলার ঘরের জানলা বন্ধ, ভেতরে আলো জ্বলছে। গ্রিল ঘেরা বাইরের দালানটাও অন্ধকার। সদরের কাঠের দরজা আর কোলাপসিবল গেট পুরো বন্ধ নয়। ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ আসছে না। এত রাত্রে অন্ধকারে গ্রামের মধ্যে আলো—জ্বলা অথচ নিঝুম বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অনুপম হতভম্ব হয়ে গেল। তার মনে হল, কিছু একা ঘটেছে আর সঙ্গে সঙ্গে সে দু’ পা পিছিয়ে গেল।

রবিদার বাড়ি কি ওরা অ্যাটাক করেছিল। হতে পারে। অনুপম বিশ্বাসের আত্মীয় বলে হয়তো আক্রোশে রবিদাকেই মারধোর করেছে। অবশ্য রবিদা এখানকার নানান ব্যাপারে টাকা খরচ করে। খুবই জনপ্রিয়, নির্বিরোধ, আমুদে। কিন্তু মানুষকে তো এখন বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। দুলোদা তাকে তো প্রায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে গেল।

অনুপম সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল। বাঁ দিকে দোতলার সিঁড়ি। রবিদা আর বউদি দোতলায় থাকে। একতলায় এক দম্পতিকে চার বছর আগে সে ভাড়া থাকতে দেখেছিল। হয়তো এখনও তারা রয়েছে। কিন্তু অন্য কেউ…..ওরা কেউ আছে কি না সেটা বুঝে নিতে হবে। এই সময় সদর দরজা খোলা। আলো—জ্বলা যথেষ্ট অস্বাভাবিকই।

অনুপম বাড়ির বাইরে এসে প্লাস্টার না—হওয়া পাশের একতলা বাড়ির দিকে এগোল। রবিদার বাড়ির সঙ্গেই লাগোয়া নিচু পাঁচিল, ঘরের জানলায় পরদা, ভেতরে আলো জ্বলছে। এদেরও বাইরের দালানে গ্রিল দেওয়া। ভেতরে যাওয়ার দরজাটা খোলা। বাড়ির ছাদে অ্যান্টেনা নেই দেখে সে আশ্বস্ত হল।

বয়স্কার গলার শব্দ ভেতর থেকে ভেসে এল, ”বউমা, দালানের দরজাটা বন্ধ করে দাও, সন্তু এলে বরং খুলে দিয়ো… দ্যাখো আজ আর ফেরে কি না।”

সরে এল অনুপম। এই বাড়ির সন্তু নামে কেউ এখন বাইরে। রবিদার ওপাশের বাড়িটা একটু তফাতে, জঙ্গুলে একটা পোড়ো বাগানের মধ্যে। ইট বের করা, জরাজীর্ণ। ভাঙা দোতলা বাড়ি। তেঁতুলতলারই একদা ধনী, প্রাচীন কোনও পরিবার থাকে।

”কে?”

অনুপম চমকে উঠে থরথরিয়ে কাঁপল। দোতলা থেকে কেউ তাকে লক্ষ্য করেই বলল। মুখ তুলে রবিদার বারান্দায় সে আবছা একটা মাথা দেখল। আপনা থেকেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘রবিদা আছে? আমি অনু।”

মাথাটা সরে গেল। কয়েক সেকেন্ড পর আর—একজন এল ব্যস্ত ভঙ্গিতে। ঝুঁকে তাকে দেখেই ”ওহ নাহ” ধরনের একটা শব্দ করে বলল, ”অনু ঠাকুরপো!… ওপরে চলে এসো, তাড়াতাড়ি।”

শুনেই কেঁপে উঠল অনুপম। কী রকম যেন চাপা ভয় আর উত্তেজনা নিয়ে ‘তাড়াতাড়ি’ শব্দটা তার দিকে ছুড়ে দিল!

আবার সে বাড়ির মধ্যে ঢুকে দোতলার সিঁড়ির দিকে ঘুরতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। একতলায় ভাড়াটেদের দরজা অল্প ফাঁক করে একটি বছর চারেকের শিশু দাঁড়িয়ে, তার পেছনে একটি বউ, বোধ হয় ওর মা।

বউটির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ছ্যাঁত করে উঠল অনুপমের বুক। একটা অসহায় করুণ আর্তি নিয়ে দুটি চোখ তার কাছে কিছু যেন জানতে চাইছে।

চার বছর আগে এই বাড়িতে কয়েক ঘণ্টার জন্য থাকলেও নীচের ভাড়াটেদের সে দেখেনি। বউটিকে সে এই প্রথম দেখল। শিশুটি এক পা পিছিয়ে শাড়ির আঁচল ধরল। টানা টানা চোখ দুটি ঘুমের ভারে শ্রান্ত। এখনও বাচ্চচাটা ঘুমোয়নি কেন?

”কোনও খবর পেলেন?” ব্যাকুল কিন্তু মৃদু স্বরে জানতে চাইল বউটি। অনুপম বিভ্রান্ত হল। কারও জন্য অপেক্ষা করছে বোধ হয়।

”কীসের খবর?”

”আপনি কি ওদের সঙ্গে কলকাতায় গেছলেন?”

অনুপমের সিক্সথ সেন্স সজাগ হয়ে উঠল। তার মনে হল, কিছু একটা ঘটেছে এখানে, যে জন্য এত রাতেও আলো জ্বলছে, সবাই জেগে। নিশ্চয়ই কোনও বিপদ—আপদ।

”না তো!” অনুপম চোখের কোণে দেখল সিঁড়ির বাঁকে মুখ বাড়িয়ে বউদি হাতছানি দিয়ে তাকে ওপরে আসতে ইশারা করছে।

”না, আমি তেঁতুলতলার লোক নই।”

কথাটা বলেই অনুপম সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত উঠতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বাঁ হাঁটু ভাঙতে না পারায় ঠোক্কর খেয়েছে। অপ্রতিভ হয়ে পেছন ফিরে দেখল দু’ জোড়া চোখ দরজার ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে। অবসন্ন, হতাশ, উদ্বেগে কাতর আর কৌতূহলী বিস্ময় নিয়ে সারল্যে ভরা দু’ রকম চাহনি। অনুপম হাসল, যে হাসির কারণটা সে নিজেও জানে না।

সিঁড়ি থেকেই বউদি হাত ধরে তাকে টেনে ঘরে নিয়ে এল।

”কী ব্যাপার বউদি, রবিদা কোথায়?”

”চুপ, আস্তে। তোমার দাদা পাড়ার দু’ জনকে নিয়ে কলকাতায় গেছেন।”

বউদির ত্রস্ত চোখ খোলা জানলায় গিয়ে পড়ল। জানলার পাল্লা বন্ধ করে দিয়ে এসে ঘরের দরজায় দাঁড়ানো ফ্রকপরা কিশোরীটিকে ধমক দিয়ে বলল, ”অমন হাঁ করে কী দেখছিস, রান্নাঘরটা ধুয়ে পরিষ্কার কর।”

”করেছি।”

”তা হলে দালানে গিয়ে বোস, ঘুমোসনি। সদর দরজা বন্ধ করে দিয়ে আয়, কতক্ষণ আর খোলা রাখা যায়। আলোটা জ্বালাই থাক আর রাস্তার দিকে নজর রাখিস। মেসোমশাইরা কখন ফিরবেন কে জানে!”

অনুপম বিমূঢ়ের মতো বউদির কথা শুনে যাচ্ছিল আর নিশ্চিত হচ্ছিল, বড় ধরনের কোনও বিপর্যয় এই বাড়িতে আজ ঘটে গেছে। কী সেটা?

”নিয়তির কী পরিহাস ঠাকুরপো, তুমি কিনা আজই এলে?”

”কী হয়েছে?”

বউদি যে ভাবে খাটের ওপর বসে পড়ল তাতেই অনুপম বুঝল টেনশনটা আর নিতে পারছে না।

”না এলেই ভাল হত, তোমার আর আমাদের…. সবারই একদিক থেকে ভাল হত। এখন সমস্যাটা আরও বেড়ে গেল।”

”হয়েছে কী, সেটা তো আগে বলবে? আমি খুব বিপদে পড়েই এখানে এসেছি। তোমাদের যদি কোনও অসুবিধে হয় আমি চলে যাব, আজ রাতটা থেকে কাল ভোরেই চলে যাব।”

ঘরের একধারে টেবল আর চেয়ার। অনুপম চেয়ারটার দিকে এগোবার সময় খোঁড়াল। বউদি সেটা লক্ষ করে বলল, ”কী হয়েছে পায়ে?’

”লেগেছে … লোহার রড দিয়ে মেরেছে।”

চাপা আর্তনাদ করল বউদি।

”কখন, কোথায়… মাঠেই?”

”হ্যাঁ।”

অনুপম চেয়ারে বসে আলতো স্বরে আহহ” বলল। অনেকক্ষণ পর হাঁটুটা ভারমুক্ত হল।

”খুব কি গোলমাল হয়েছে?… অনেক লোক নাকি মারা গেছে?” বউদি ঝুঁকে ফিসফিস করে এমন ভাবে বলল, যেন কোনও গুপ্তকথা ফাঁস করে দিচ্ছে।

”আমি দেখিনি, দেখার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না। পরে শুনেছি আটজন নাকি স্পট ডেড। ভয়ে পালাতে গিয়ে ভিড়ের চাপে আর পায়ের নীচে পড়ে … আর বহু লোককে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।”

”কোন হাসপাতালে?”

”বোধ হয় পিজি—তে। আমার তখন ওসব খবর জানার মতো অবস্থা ছিল না বউদি, আমি নিজেই তখন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলাম। দেখছ না, নিজের ঘরে কি আর কোথায় না গিয়ে তোমাদের এখানে এসেছি রাতের অন্ধকারে … একটা চোরও আমার থেকে এখন অনেক নিরাপদ, কেননা কেউ তাকে চেনে না বা দু—চারজন চেনে। সে সাহসভরে রাস্তায় হাঁটতে পারবে কিন্তু আমি পারব না। আমি বিখ্যাত। আমার ছবি বহুবার কাগজে, ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে, টিভিতে কতবার দেখানো হয়েছে। সারা দেশ আমার মুখটা চেনে। আমাকে এখন মানুষের চোখের আড়ালে চলে যেতে হবে, লুকিয়ে থাকতে হবে…. তাই তো এখানে চলে এলাম।”

একটানা কথাগুলো বলে অনুপম উত্তেজিত হয়ে উঠল। ঝুঁকে, ব্যগ্র চাহনিতে বহু ধরনের প্রশ্ন রেখে সে বউদির দিকে তাকিয়ে রইল। সে বুঝতে চেষ্টা করছে, এখানে আজ তাকে আশ্রয় দেওয়া হবে কি না।

”এমন হল কেন?” আগের মতো ফিসফিস স্বরে বউদি বলল, ”তোমার এত নাম, যশ, সম্মান, হাজার হাজার লোকের এত শ্রদ্ধা, ভালবাসা, টাকাও যথেষ্ট করেছ, তবু কেন আজ এই দশায় পড়লে?…. তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো পালাতে হচ্ছে কেন?”

জবাব না দিয়ে অনুপম শুধু চোখের পাতা টেনে নামাল। কী বলবে সে মাঠ থেকে বহু দূরে জীবনযাপন করে এমন এক গৃহস্থ বউকে! কেন, কেন, কেন… সব কেনর কি উত্তর হয়? একটা ফুটবলার কি সারাজীবন একই পর্যায়ে ফর্ম রেখে খেলে যেতে পারে? এটা কি রান্না করা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা?

”জানো, আজ কী ব্যাপার হয়েছে?”

অনুপম সন্ত্রস্ত হয়ে গেল বউদির কণ্ঠস্বরে। তার মন বলছে, কিছু একটা ঘটেছে যার সঙ্গে সে সরাসরি না হলেও জড়িত। ভাল নয়, আজ কিছুই তার পক্ষে ভাল নয়। সর্বনেশে কিছু একটা বউদি তাকে বলবে।

”কী হয়েছে।” অনুপমের গলা বসে গেল। ঘড়ঘড়ে একটা শব্দ বেরিয়ে আসছে শুধু। সে বলতে চাইছিল—আমার জন্যই কি?

”নীচের ভাড়াটে, প্রদীপবাবু… প্রদীপ হালদার, দেখেছ কি ওকে?”

”না। অনেক লোক সেদিন আলাপ করতে এসেছিল, মনে হয় না তোমাদের ভাড়াটে বলে রবিদা কারও সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়েছিল।”

”তখন সবে এসেছে বউ আর সঙ্গে চার মাসের ছেলে। অফিসের পরীক্ষায় পাশ করে আমাদের এখানকার ব্যাঙ্কেই প্রথম পোস্টিং। চাষিদের লোনটোন দেওয়ার ভার ওর ওপরেই। খেলাধুলোয় কোনও আগ্রহই নেই। তোমার দাদা ওর কাছে তোমার কথা বলতেন। একদিন বলল, ‘দেবেন তো একটা টিকিট, একদিন আপনার ভাইয়ের খেলা দেখে আসব।’ তাই তোমার দাদা টিকিটটা ওকে—”

”আজ খেলা দেখতে গেছল।” বউদিকে শেষ করতে না দিয়ে অনুপম নিজেই কথাটা সম্পূর্ণ করে তিক্ত মুখে তাকিয়ে রইল।

‘হ্যাঁ।”

”এখনও বাড়ি ফেরেনি।”

”না।”

দু’জনেই চুপ করে রইল। একটা ভয়ঙ্কর আশঙ্কায় ছেয়ে গেল দু’জনের ভাবনা। যে আটজন মারা গেছে তাদের মধ্যে হয়তো প্রদীপ হালদার রয়েছে।

”কখনও বড় ম্যাচ দেখতে মাঠে যায়নি?”

”ছোট কি বড় কোনও ম্যাচই নয়, জীবনে এই প্রথম কলকাতার মাঠে খেলা দেখতে গেল। কী বিচ্ছিরি একটা ব্যাপারে জড়িয়ে পড়লুম বলো তো। টিকিট দিয়ে তোমার দাদাই তো পাঠিয়েছিলেন। কে জানত যে, এই রকম একটা কাণ্ড খেলার মাঠে ঘটবে।”

বউদি অসহায় চোখে অনুপমের দিকে তাকাল। চোখ সরিয়ে সে দরজার দিকে রাখল। তারপর মুখ ফিরিয়ে ট্রলির ওপর রাখা টিভি সেটটায় দৃষ্টি নিবন্ধ করল।

”টিভিতে খেলা দেখেছিলে?”

”তোমার দাদা আর পাড়ার কয়েকজন দেখছিলেন।”

”মাঠে গোলমাল দেখিয়েছে।”

”আমি তো খেলা দেখিনি, ওসব কিছু বুঝিটুঝি না, দেখিয়েছে কি না বলতে পারব না। নীচে মণির সঙ্গে, প্রদীপের বউ, ওর সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন। ওপরে খুব হইচই চেঁচামিচি হচ্ছিল, তারপর কেন যেন চুপ হয়ে গেল। তোমার দাদা গুম মেরে বারান্দায় বসে রইলেন।”

”তা হলে মাঠে যে গোলমাল হয়েছে সেটা জানলে কী করে?”

”সাতটা নাগাদ গোপাল আর ক’জন খেলা দেখে ফিরে এসে মাঠের ঘটনা বলতেই তো আমরা জানলুম। শুনে তো আমার রক্ত জল হয়ে গেল। পঞ্চাশ—ষাটজন নাকি পায়ের চাপে থেঁতলে মারা গেছে। তারপর কী খারাপ খারাপ কথাই না ওরা তোমার সম্পর্কে বলল যে…”

”রবিদা শুনে কী বলল?”

অনুপম জানতে চায়, তার পক্ষ নিয়ে অন্তত একজনও বিরোধিতার সামনে তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে। রবিদা ছাড়া আর কেউ যে এখন তার সহায় হবে না, এমন একটা আশা নিয়ে সে প্রশ্ন করল।

”উনি আর কী বলবেন, মুখ বুজে সব শুনে গেলেন! ওরা চলে যাওয়ার পর বললেন, অনুর জন্যই আজ মাঠে এতগুলো নিরীহ লোক মারা গেল। এখানকার লোকে বলবে, আমার ভায়ের জন্য একটা মেয়ে আর তার বাচ্চচা পথে বসল। আজীবন এই কথা শুনতে হবে।”

”এই কথা বলল রবিদা!”

”হ্যাঁ। বললেন, এখন আমি ঘরে বসে থাকলে ব্যাপারটা খুব খারাপ দেখাবে, অমানবিক হবে। আমিও বললাম, খোঁজ নিতে যাওয়া তোমার কর্তব্য, দোষের ভাগী তো তুমিও।”

অনুপম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কপালে ঘামের বিন্দু ফুটছে। মাথার মধ্যে হাজার হাজার গলায় তালগোল পাকানো চিৎকার ওঠানামা করছে। মনে মনে সে আউড়ে গেল, ভুল করেছি, মারাত্মক ভুল করেছি এখানে এসে।

”ঠাকুরপো আজ তোমার এখানে আসা কেন জানি ভাল ঠেকছে না। প্রদীপের খবর না পাওয়া পর্যন্ত মনের মধ্যে কী যে এখন হচ্ছে। ওরা ভাল খবর আনুক, ভগবানের কাছে এই প্রার্থনাই করে যাচ্ছি।”

নীচে সিঁড়িতে কার গলার শব্দ শোনা গেল। অনুপম চকিতে বউদির দিকে তাকিয়ে দেখল মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।

”কে? রবিদার গলা তো নয়!”

”বুঝতে পারছি না। দেখছি।” বউদি ব্যস্ত পায়ে ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় দরজার পরদাটা টেনে দিল। অনুপম প্রায় লাফিয়ে সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে ঘরের আলোটা নিভিয়েই ভাবল স্টিলের আলমারিটার আড়ালে দাঁড়াবে কি না।

একটু পরেই বউদি ফিরে এল। ঘর অন্ধকার। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অনুপমকে উদ্দেশ করে বলল, ”আলো নেভানোই থাক। তুমি এখন ঘরের বাইরে এসো না। কাছেই থাকে একটা ছেলে, খোঁজ নিতে এসেছিল। বলল, বাজারে স্টেশনারি দোকানের মালিকের ছোট ভাই খেলা দেখতে গেছল, সেও ফেরেনি। তোমাদের দু’জন প্লেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আর গড়ের মাঠের অনেক জায়গায় নাকি নিরীহ লোকদের ধরে ধরে মারা হয়েছে, চৌরঙ্গিতে অনেক দোকান ভাঙচুর করে লুটপাট হয়েছে, ট্রামে—বাসে ঢিল মেরেছে। আমাদের সাবধানে থাকতে বলল।”

”তোমাদের এখানে আর কী হবে?”

‘হবে না, এ—কথা বোলো না।” বউদির স্বরে আতঙ্কের ছোঁয়াটা স্পষ্ট বোঝা গেল। ”তোমার দাদা পঞ্চমুখে এখানকার লোকের কাছে তোমার খেলা সম্পর্কে যে প্রশংসা করেন….”

যে—কথা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল তা বুঝে নেওয়ার মতো বুদ্ধি অনুপম এখনও হারায়নি। তার এখানে আসাটা বউদি পছন্দ করেনি। গৃহকর্ত্রীর অপছন্দ সত্ত্বেও আজ রাতটা অন্তত তাকে এখানে থাকতে হবে।

”আমি কালকেই চলে যাব। এখানে রয়েছি, এটা জানাজানি না হওয়াই উচিত। কেউ আমাকে এখানে আসতে দ্যাখেনি সুতরাং তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”

অন্ধকারে সে বুঝতে পারল না, তার কথা শুনে বউদির মুখে কতটা স্বস্তি ফুটে উঠল।

”না, ভয় আমি পাচ্ছি না। ভয় এখন তোমাকে নিয়ে। এখানে দু’দিন ধরে ছেলেধরার কথা শোনা যাচ্ছে। গ্যাঁদালপাড়ায় কার ছেলেকে নাকি ফুল শুঁকিয়ে অজ্ঞান করে পুকুরপাড়ে ফেলে রেখে গেছে। আর একটা বাচ্চচাকে ভুলিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দোকানে বিস্কুট কিনছিল। দোকানির সন্দেহ হওয়ায় দু—চারটে প্রশ্ন করতেই লোকটা সাইকেল চেপে পালায়। অচেনা অপরিচিত লোক দেখলেই এখানে ঘিরে ধরছে।”

”আর যাই হোক ছেলেধরা বলে আমাকে অন্তত এখানকার লোক পিটোবে না। তবে তোমরা যাতে হ্যারাশমেন্টের টার্গেট না হও, সেটাই এখন দেখা দরকার। রবিদা কখন বেরিয়েছে?”

”গোপালরা এসে বলার পরই উনি আমাকে বললেন, দ্যাখো তো প্রদীপ ফিরেছে কি না। নীচে গিয়ে দেখলুম ফেরেনি। মণি বলল, তাড়াতাড়িই ফিরবে বলে গেছে। ওঁকে নিয়ে দোকানে গিয়ে ফ্রিজ পছন্দ করে আসার কথা বলে সেজেগুজে অপেক্ষা করছেন। তারপর ন’টা যখন বাজল তোমার দাদা বললেন, ভাল মনে হচ্ছে না, বেরিয়ে একটু খোঁজখবর করি। পাশের বাড়ির সন্তুকে গিয়ে বললেন, তারপর আরও দু’তিনজনের সঙ্গে কথা বলে, এখানে প্রাইভেটে ভাড়া খাটায় একজন, তার গাড়িতে সন্তুকে নিয়ে উনি কলকাতা রওনা হয়ে গেলেন। বললেন, আগে লালবাজারে খোঁজ নেবেন, তারপর হাসপাতালে।”

অনুসন্ধিৎসু হয়ে অনুপম কোনও প্রশ্ন করল না। করার কিছু নেইও। প্রদীপ হালদার আটজনের একজন হতে পারে, নাও পারে। আহতদের মধ্যে থাকতে পারে, নাও পারে। যা হওয়ার হয়ে গেছে, এই নিয়ে ভেবে তার নিজের সঙ্কটের কোনও সুরাহা হবে না।

”বউদি, তোমার ফ্রিজ চলছে?”

”হ্যাঁ, কেন?”

”বরফ চাই আর গরম জল, পাওয়া যাবে? রডটা হাঁটুতে লেগে মুশকিলে ফেলেছে, ভাল করে চলতে পারছি না। তোমাদের বাজারের কাছাকাছি শিবতলায় একজন মোটরে নামিয়ে দিয়ে গেল, সেখান থেকে হেঁটে আসছি। এখন আর হাঁটু ভাঙতে পারছি না। পেলে একটু ঠাণ্ডা—গরম লাগাতাম।”

”এখুনি বরফ আর গরম জল দিচ্ছি।” বউদি ঘর থেকে বেরিয়ে ”পঞ্চি, এই পঞ্চি”, বলতে বলতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

অন্ধকার ঘরে দুই তালুতে মুখ ঢেকে, সামান্য কুঁজো হয়ে অনুপম বসে রইল। এই মুহূর্তে তার অতীত ও ভবিষ্যৎ ছাড়া আর কিছু নেই। বর্তমানটা তালগোল পাকিয়ে একটা ফুটবলের রূপ নিয়েছে, যেটা খেলতে তার কোনও আগ্রহ নেই।

অতীতের দিকে কত দূর পর্যন্ত অনুপম এখন যাবে? রবিদার সময় পর্যন্ত? যখন রবিদা তাদের বাড়িতে থাকত। বিদ্যুৎপুর স্পোর্টিং ক্লাবের মাঠে গোল পোস্টের পেছনে দাঁড়িয়ে খেলা দেখত একটা কারণেই। খেলার উদ্দেশ্য গোল দেওয়া, তাই বল মারা হত গোলের দিকে। বেশির ভাগ বল গোলেই বাইরে দিয়ে চলে যেত। অনুপম দৌড়ে কুড়িয়ে এনে হাই কিক করে সেটা মাঠের ভেতর পাঠিয়ে দিত। শুধু এই কিকটা করার উত্তেজনা বা সুখ পাওয়ার লোভ তাকে ‘বল কুড়োনে অনু’ নামে স্কুলে চিহ্নিত করে।

বড়দের মাঠের লাগোয়া ছোট জমিটায় খেলত ছোটরা। অনুপমের ফুটবল খেলার শুরু সেখান থেকেই। কী করে ফুটবল খেলতে হয় সেটা একজনও তাকে শেখায়নি। স্বাভাবিক ভাবেই খেলাটা তার কাছে এসেছে। বড়দের খেলা দেখে দেখে, বিশেষ করে রবিদার, সে অনুকরণের চেষ্টা করত। বড়রা মাঝেমধ্যে কলকাতায় গিয়ে খেলা দেখে এসে সেই ভাবে খেলতে চাইত। তবে তাদের মধ্যে ফুটবল খেলে প্রতিষ্ঠা অর্জনের কোনও চিন্তা ছিল না।

খেলার আগে যখন দুটো দল তৈরির জন্য ছেলেরা জড়ো হত, তখন মুশকিল হত অনুপমকে নিয়ে। দু’দলই তাকে চাইত। তাই নিয়ে ঝগড়া, হাতাহাতিও হয়েছে। অনেকদিন তাকে দুই দলের হয়েই আধাআধি করে খেলে খুশি করতে হয়েছে দু’পক্ষকে।

লাথালাথি, ঘুসি, খিমচে দেওয়া, এগুলো হতই। প্রায় সবাই ছিল তার থেকে বয়সে বড়। অনুপম বল ধরলেই পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে বা পায়ের গোছে লাথি মেরে বা সররা কেটে ফেলে দিয়ে তাকে বলচ্যুত করাই ছিল বিপক্ষের অন্যতম সফল কাজ। প্রথম প্রথম সে খেপে উঠত, চিৎকার করত, খেলা ছেড়ে মাঠের ধারে গিয়ে বসে থাকত। কিন্তু এসব সত্ত্বেও সে মার খাওয়া থামাতে পারেনি।

একদিন খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ি ফিরল। রবিদা কারণ জিজ্ঞেস করে, সব শোনার পর শুধু বলেছিল, ”তুই মার খাচ্ছিস যেহেতু তুই ওদের থেকে ভাল খেলিস। যখন মার খাবি না তখন বুঝবি তুই খারাপ খেলছিস, সেটাই তখন দুর্ভাবনার বিষয়। যে যত বড় হয় ততই লোকে তার নিন্দেমন্দ করে, তার দোষ খোঁজে, তার পেছনে লাগে। এটা আমাদের স্বভাব। এবার থেকে তুই চেষ্টা কর নিজেকে বাঁচিয়ে খেলার।”

রবিদার কথাগুলো তার যে কী উপকারে লেগেছিল সেটা অনুপম বহুবার মনে মনে স্বীকার করেছে ভারতের এক নম্বর মিডিও হয়ে। সেই বিদ্যুৎপুরের ছোটবেলার ফুটবল থেকেই সে জানতে পারে, হঠাৎ যদি নিজের দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দেয় কিংবা বল ধরার সময়টাকে নিখুঁত আন্দাজে বুঝে নিয়ে যদি এগোয় তা হলে বিপক্ষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে পারবে। কখন তাকে মারতে আসবে, সেটা বুঝে নেওয়ার ক্ষমতাও সে ওই সময় পেয়ে গিয়েছিল।

লোকে এটাকেই তার সিক্সথ সেন্স বলে। এটাই তাকে আজ বাঁচিয়েছে, এটা কি তাকে কাল বাঁচাবে?

অবশ্যই তাকে চলে যেতে হবে এখান থেকে। রবিদাকে হেনস্থা হতে হবে সে জন্য নয়। নীচের প্রদীপ হালদারের বউ আর বাচ্চচাটির জন্যই তার এখানে থাকা সম্ভব নয়। ঘুরেফিরে মাঠের এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডটার জন্য সব দায় তার ঘাড়েই চাপবে। দুলোদার কথাগুলো—”আজ অনেকগুলো প্রাণ তুই নিয়েছিস,” আমৃত্যু তার কানে ফিসফিস করে যাবে। সব মৃত্যু, সব আঘাত, সব ক্ষয়ক্ষতির দায় তাকেই বইতে হবে। কারণ গোল থেকে বারো গজ দূরে বসানো একটা বলে সে যে শটটা নিয়েছিল সেটা বারের ওপর দিয়ে উড়ে চলে যায়।

অনুপমের মুখ থেকে একটা যন্ত্রণাকাতর শব্দ গোঙানির মতো বেরিয়ে এল। সেটা হাঁটুর ব্যথার জন্য হতে পারে। সে অন্ধকার ঘরে এধার—ওধার তাকিয়ে টিভি সেট, খাট, আলমারি, টেবল ছাড়া আর কী কী আছে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। এত অন্ধকার, কিছুই আন্দাজে আসছে না। অথচ পরদার তলা দিয়ে দালানের আলো সে দেখতে পাচ্ছে। কথাবার্তার শব্দ ভেসে আসছে।

অনুপম এটুকু বুঝতে পারল, তার ইন্দ্রিয়গুলো একেবারে অসাড় হয়ে যায়নি।

বউদি ঘরে এসে আলো জ্বালল। বেরিয়ে গিয়ে আবার ঢুকল ডেকচি হাতে। তাতে গরম জল থেকে ধোঁয়া উঠছে।

”বরফ ভাল জমেনি। দুপুর পর্যন্ত লোডশেডিং ছিল। ধারেকাছে কারও বাড়িতে ফ্রিজও নেই যে, আনিয়ে নেব।”

”ঠাণ্ডা জল থাকে তো তাতেও হবে। দুটো বালতি আর একটা মগ দাও… জলটা বড্ড গরম, এতে একটু ঠাণ্ডা জল ঢেলে দাও।”

অনুপম উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পায়ে জোর পেল না। চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে অপ্রতিভ হেসে বলল, ”রেস্ট পেলেই ঠিক হয়ে যাবে। এসব আমার অভ্যেস আছে।”

বউদি অনুপমের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ”তোমার বোধ হয় খিদে পেয়েছে ঠাকুরপো।”

”না, না, একদম নয়। আজ রাতটা উপোস দেব, শরীর ফিট থাকবে।” যদিও ঘণ্টা দশেক তার পাকস্থলীতে শক্ত কোনও খাদ্য পৌঁছয়নি তবু অনুপম বিন্দুমাত্র খিদে বোধ করছে না।

বউদি বালতি, মগ, তোয়ালে, ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা জল ভরা দুটো বোতল ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস ঘরে এনে দিয়ে বলল, ”মেঝেয় যদি জল পড়ে তো পড়ুক, আমি মুছে দেব। রাতে অল্পবয়সি বউটা বাচ্চচা নিয়ে একা থাকবে, আমি এখন নীচে গিয়ে রাতটা ওর সঙ্গেই থাকব। বেচারা একেবারে….।”

বউদিকে থামিয়ে অনুপম অসহায় এবং কিছুটা ভীত স্বরে বলে উঠল, ”আমি কোথায় থাকব। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই এই ঘরটা, বাইরের কেউ যদি এসে পড়ে?”

বউদিকে বিচলিত দেখাল। সমস্যার এই দিকটা বোধ হয় ভেবে দ্যাখেনি। ইতস্তত করে বলল, ”কাজের মেয়েটা জিজ্ঞেস করেছিল তুমি কে হও। ও আগে তো তোমায় দ্যাখেনি। তুমি আমাকে বউদি বলছ তাই বাপের বাড়ির কেউ হও বলতে ভরসা হল না। আবার ওনার ভাই হও বললে যদি পঞ্চি বাইরে কারও কাছে বলেটলে বসে এই ভেবে তাও বলতে পারলাম না। শেষমেষ বললাম, তোর মেসোমশায়ের আলুর ব্যবসার একজন বড় খদ্দের, ভাইয়ের মতো। আলু নিয়ে কলকাতায় যাচ্ছিল, টেম্পোটা উলটে গিয়ে পায়ে চোট লেগেছে তাই রাতটায় থাকতে এসেছে।”

শেষকালে আলুর খদ্দের! তাকে এখন দেওর বা ভাই বলে পরিচয় দিতে ভয় পেল। মুহূর্তের জন্য অনুপমের মনে হল শিকড়হীন একটা গাছের মতো সে খাড়া রয়েছে। আঁকড়ে ধরার মতো জমি তার নীচে নেই। তার নিজের কেউ নেই, কিসসু নেই।

”পঞ্চি বোকাসোকা মেয়ে, যা বলবে বিশ্বাস করবে। কিন্তু ভেতর দিকে ঘর বলতে, কলঘরের পাশে একটা আছে, হাবিজাবি ভাঙাচোরা জিনিস রাখা হয়। থাকতে পারবে? তবে চট করে কেউ দেখে ফেলতে পারবে না।”

”খুব থাকবে পারব।”

বউদি ইতস্তত করতে লাগল। অনুপম জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে।

”খুব নোংরা হয়ে রয়েছে, আর একটা মাত্র জানলা।”

”চারটে দেয়াল আর মাথায় ছাদ আছে এমন যে—কোনও জায়গায় এখন আমি থাকতে পারব।”

”লোহার ফোল্ডিং খাটটা তা হলে বের করতে বলি পঞ্চিকে।”

বউদি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট পনেরো পর পঞ্চি ঢুকল। খালি গায়ে তোয়ালে পরা অনুপমকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।

”মাসিমা কোথায়?”

”বিছানা করে মশারি টাঙাচ্ছে।”

ঠাণ্ডা—গরম জলে সেঁক দিয়ে অনুপমের মনে হচ্ছে হাঁটুটা যেন একটু সহজ লাগছে। চেয়ারে বসে পা দুটো সামনে তুলে আবার নামাল। কয়েকবার করল। প্যান্টটা দু’পায়ে গলিয়ে, উঠে দাঁড়িয়ে টেনে পরে নিল।

”টেম্পোটা উলটোল কী করে?” পঞ্চির কৌতূহলী প্রশ্ন।

”খুব জোরে যাচ্ছিল। সামনে হঠাৎ একটা ছাগলছানা ছুটে আসতেই সেটাকে বাঁচাতে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল আর ব্যস সঙ্গে সঙ্গে বে—টাল হয়ে কাত হয়ে পড়ল।”

”আলুগুলো কী হল?”

”বস্তার মধ্যে ছিল তাই আর ছড়িয়ে যায়নি।”

”আর যারা ছিল তাদের কী হল?”

”কিছু হয়নি। শুধু আমারই হাঁটুটায় লেগেছে। ওরা সব টেম্পোটাকে তুলে সোজা করে বসাল। বস্তাগুলো তুলল। কিন্তু গাড়ির একটা পাইপ ভেঙে গেছে, না সারালে চলবে না। ওরা মিস্ত্রি খুঁজতে গেছে, কখন ফিরবে কে জানে। আমি দেখলাম কাছেই দাদার বাড়ি তাই চলে এলাম।”

”মেসোমশাইও নীচের দাদাকে খুঁজতে বেইরেচে, এখনও ফেরেনি।…. কখন ফিরবে কে জানে!”

”নীচের দাদা কোথায় গেছে?” অনুপম প্রশ্নটা করেই ভাবল জিজ্ঞেস না করলেই ভাল হত। তাকে জড়িয়ে যে দুঃখের ঘটনা ঘটেছে বা হয়তো ঘটেনি, সেটা নিয়ে আর নাড়াচাড়ার দরকার কী! কিন্তু মনের গভীরে কী এটা অস্বস্তি খচখচ করে বিঁধে চলেছে, যে জন্য সে কৌতূহলও সংবরণ করতে পারছে না।

”আজ কলকাতায় ফুটবল খেলা ছিল, খুব বড় খেলা! মেসোমশাইয়ের ভাই, সে খুব ভাল, নামকরা প্লেয়ার, সে খেলবে। আপনি জানেন না? এখান থেকে কত লোক খেলা দেখতে গেছে। আমাদের এখানে টিভি দেখতেও কত লোক এসেছিল। নীচের দাদা তো খেলা দেখতে কলকাতায় গেছে, এখনও ফেরেনি।”

”কেন? খেলা তো অনেকক্ষণ শেষ হয়ে গেছে।”

”সেইজন্যই তো এত ভাবনায় সবাই পড়েছে।” পঞ্চি হঠাৎ গলা নামিয়ে দিয়ে যোগ করল, ”খেলার মাঠে আজ খুব মারপিট হয়েছে, অনেক লোক মরেছে। আপনি জানেন না?”

”না তো! তুমি জানলে কী করে?”

”এখানে সবাই বলছিল। মেসোমশাইয়ের ভাইয়ের জন্যেই—”

ঘরে ঢুকল বউদি।

”পঞ্চি তুই শুতে যা। ঠাকুরপো এসো, ঘরটা দেখিয়ে দিই।”

বউদি যে ঘরটিতে অনুপমকে নিয়ে গেল সেটি লম্বায় দশ ফুট, চওড়ায় আট ফুট। লোহার পাইপের নাইলন ফিতের খাটে তোশক পাতা। একটা নীল রঙের মশারি তিনদিকের দেয়ালে দড়ি দিয়ে বাঁধা। তার আর একদিকের দড়িটা দরজা বন্ধ করে ছিটকিনিতে বাঁধতে হবে। ঘরে এক হাত চওড়া দু’ পাল্লার একটা বন্ধ জানলা। ঘরে জ্বলছে একটা টিউব বাতি।

বাঁশের ধামা, চটের বস্তা, থাক দেওয়া খালি টিনের কৌটো, ক্যানেস্তারা থেকে পুরনো খবরের কাগজ, ছবির ফ্রেম, ভাঙা হ্যারিকেন, পুরনো ছেঁড়া জুতো এবং অন্যান্য জিনিসের একধারে খাটটা পাতা। ঘরে পা ফেলার জায়গা নেই বললেই হয়।

ঘরে ঢোকা মাত্র অদ্ভুত একটা বোঁটকা গন্ধ অনুপমকে থমকিয়ে দেয়। সে কোনও ভাবান্তর প্রকাশ করেনি। এখন পছন্দ—অপছন্দ প্রকাশের সময় নয়। ভাগ্য যা দিচ্ছে সেটাই মুখ বুজে মেনে নেওয়া উচিত। সে ধনী বা সম্পন্ন পরিবারের সন্তান নয়। বিদ্যুৎপুরের বাড়িতে জন্ম থেকে যেভাবে থেকেছে সেটা এই গন্ধের মতো এতটা উৎকট না হলেও, মলিনতায়, অপরিচ্ছন্নতায় কাছাকাছিই।

”কী করব বলো, ভাল ঘর দুটো বাইরের দিকে। বিচ্ছিরি লাগছে তোমাকে এখানে—”

অনুপম থামিয়ে দিয়েছিল, বউদিকে।

”পাশেরটাই তো কল—বাথরুম, এটাই বিরাট লাভ। হাঁটতে বেশি হবে না।” অনুপম এই বলে বউদির সঙ্কোচ কাটাতে চেষ্টা করেছিল।

বউদি চলে যাওয়ার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যায়। তখন তার মনে পড়ল, কটা বাজে জিজ্ঞেস করা হল না। আলোর সুইচটা বোধ হয় ঘরের বাইরেই। জলতেষ্টা পেলে কলঘরে গিয়ে কল থেকেই খেতে হবে।

মশা আছে। ইতিমধ্যেই সে হাতে কামড় খেয়েছে। মশারি খাটিয়ে শুতে হবেই, কিন্তু কী দমবন্ধ করা গরম এই ঠাণ্ডার দিনেও! বোধ হয় বস্তাগুলোর জন্যই।

হাতড়ে হাতড়ে সে খাটটার অপর ধারে গিয়ে জানলায় হাত রাখল। ছিটকিনি তুলে ঠেলা দিল। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার জন্য পাল্লা দুটো আটকে গেছে। জোরে ধাক্কা দিয়ে ঠেলতেই শব্দ করে আছড়ে খুলে গেল।

ঠাণ্ডা বাতাস সারা মুখে যেন আদর বোলাল। অনুপম আজ এই প্রথম সহানুভূতির ছোঁয়া পেল প্রকৃতির কাছ থেকে। বন্ধ চোখ কিছুক্ষণ পর খুলে বাইরে তাকিয়ে সে গাঢ় অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না। না পাওয়ার জন্য তার কোনও খেদ হচ্ছে না। তাকে কেউ যেন না দেখে এটাই সে এখন চায়।

মশারির চতুর্থ দড়িটা লাগিয়ে সে বিছানায় শুয়ে পড়ল পা দুটো লম্বা টানটান করে। সারাদিনে এই প্রথম তার বিশ্রাম নেওয়া। চোখ বুজল সে।

ঘুমের মধ্যে সে বারবার পাশ ফিরল। তার খুবই গাঢ় ঘুম হয় কিন্তু আজ হল না। কী এক অস্বাচ্ছন্দ্যে সে ছটফট করে গেল। পাতলা ঘুমের মধ্যেই একসময় তার মনে হল মোটর গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ, দরজা খোলা ও বন্ধের শব্দ যেন সে শুনতে পেল। আবার ফুঁপিয়ে চাপা কান্নার আওয়াজও পেল।

ঘুম ভেঙে চোখ মেলতেই চৌকো একটা উজ্জ্বলতা তাকে আঘাত করল। জানলাটা ঠিক তার পায়ের ওপরেই। প্রখর রোদে আকাশটা ঝকঝকে। অনুপম আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে রইল অনেকক্ষণ। একটা শালিখ জানলার পাল্লায় বসে কর্কশ ডাকে তাকে বিরক্ত করতেই সে সচেতন হল।

বিছানায় উঠে বসে মশারি তুলে পা দুটো মেঝেয় নামাল। কিন্তু দু’ কদম গিয়েই সে বন্ধ দরজার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। নিথর হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দরজা খুলল। বাঁ হাটু কংক্রিটের মতো জমাট আর ভারী লাগছে। সারা বাড়িতে কোনও সাড়াশব্দ নেই। বউদি, পঞ্চি, এরা সব গেল কোথায়? ছমছমে একটা চিন্তা নিয়ে সে কলঘরে ঢুকল।

মশারিটা পাকিয়ে বিছানার একধারে রাখা। চাদরটা পরিপাটি করে বিছানো। ইতিমধ্যে পঞ্চি এইসব কাজ সেরে রেখে গেছে। অনুপম পা টেনে টেনে দালানে এল।

কেউ নেই, তবে রান্নাঘরের দিক থেকে বাসনের শব্দ ভেসে এল। নিচু গলায় সে ডাকল, ”বউদি।”

”যাই।” পঞ্চির গলা।

ব্যস্ত হয়ে এল পঞ্চি, হাতে একটা ন্যাতা। ”মাসিমা বলে গেছে উঠলেই আপনাকে খেতে দিতে। আগে চা খাবেন?”

”হ্যাঁ, কিন্তু বউদি কোথায়, আর সব?”

”সবাই তো ভোরবেলায় চলে গেছে। মেসোমশাই মাঝরাতে কলকাতা থেকে এল। তারপর মাসিমাকে আলাদা ঘরে নিয়ে গিয়ে কী সব বলল। মাসিমা নীচে গেল। তারপর নীচের বউদিকে নিয়ে তিন জন কলকাতা চলে গেল। যাওয়ার আগে বাচ্চচুকে পাশের বাড়িতে রেখে আমাকে বলে গেল, দাদা হাসপাতালে, অবস্থা ভাল নয় তাই মণিকে নিয়ে যাচ্ছি। ঠাকুরপো রইল, কাল থেকে না খেয়ে রয়েছে, ভাল করে দেখিস, উঠলেই খেতে দিস। আমি বললুম, সে তোমায় ভাবতে হবে না। রান্নাবান্না, জলখাবার করা সব আমি পারি। আপনাকে মামলেট করে দোব, টোস দিয়ে খাবেন?”

পঞ্চির কথা শুনতে শুনতে অনুপমের মনে হল নতুন কিছুই সে শুনছে না। রাতে ঘুমের মধ্যেই সে এসব জেনে গেছে।

দালানে খাবারের টেবিল আর চারটে চেয়ার। অনুপম একটা চেয়ারে বসল। টেবিলে আজকের খবরের কাগজ ভাঁজ করা অবস্থাতেই পড়ে রয়েছে। কেউ হাত দেয়নি। বারান্দায় যাওয়ার দরজা দিয়ে দূরে নারকেল গাছের মাথা আর আকাশ দেখা যাচ্ছে। সেদিকে শূন্য দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল।

একবার কাগজটার দিকে তাকাল। দেখেই বুঝতে পারল, ”প্রভাতী সংবাদ”। কালকের ঘটনার কথা কী ভাবে লিখেছে জানার জন্য তার এখন আর কোনও কৌতূহল হচ্ছে না। সুপ্রিয় গুপ্ত এই রকম একটা সুযোগই খুঁজছিল, পেয়ে গেছে। সত্যি—মিথ্যে যা খুশি লিখে দেবে তার বিরুদ্ধে। কে প্রতিবাদ করবে? লোকে তো এখন তাকে শয়তান রূপেই দেখতে চায়।

কিন্তু সে সত্যিই কি শয়তান? প্রদীপ হালদারের যদি কিছু হয়ে যায়, তা হলে ওর বউ—ছেলে কি পথে বসবে? এর মধ্যে তার শয়তানিটা কোথায়! প্লেন ক্র্যাশ করে, ট্রেন অ্যাকসিডেন্ট হয়ে তো এর থেকেও বেশি লোক মরে, সেটা কি পাইলটের বা ড্রাইভারের ইচ্ছাতে হয়?

ঘুমের মধ্যে যেন কান্নার শব্দ পেয়েছিল। নিশ্চয় মণি নামের ওই বউটির। হাসপাতালে কেউ ভর্তি হয়েছে শুনলেই তো মেয়েরা আগে কাঁদতে শুরু করে। প্রদীপ হালদারের সিরিয়াস কিছু নাও হতে পারে। যদি বড় ধরনের অপারেশন করতে হয় বা ভাল নার্সিংহোমে রাখার দরকার হয় তা হলে খরচ দেওয়ার সামর্থ্য কি ওদের আছে? পাশ করে কিছুদিন হল অফিসার হয়েছে, কত আর পায়, তিন—চার হাজার!

চিকিৎসার জন্য যদি টাকার দরকার হয় তা হলে আমিই দিয়ে দেব। অনুপম একটা গুমোট আলো—বাতাসহীন ঘরের জানলা খুলে দিয়ে যেন হাঁফ ছাড়ল। আমিই টাকা দেব। বেলেঘাটায় তার আলমারির লকারে বারো হাজার টাকা পরশুই সে রেখেছে।

ফুটবলারদের পাওনাগণ্ডা মেটাবার ভার বারিন দত্তের। তাকে সে দু’ বার জানিয়ে দিয়েছিল গত বছরের বারো হাজার টাকা হাতে না পেলে সে আর পায়ে বল ছোঁয়াবে না। কথাটা অন্য ভাবে ঘুরিয়ে রং ফলিয়ে প্রভাতী সংবাদে বেরোয়। ক্লাবের ভেতরের সব খবর বারিন যে গোপনে সুপ্রিয়কে জোগায় এটা অনেকেই জানে, আর সেই খবরগুলো সবই বারিন গোষ্ঠীর স্বার্থের পক্ষে আর বিরোধী গোষ্ঠীর, যার অন্যতম নেতা দুলাল শীল, তাদের স্বার্থের বিপক্ষে যাতে যায়, সেই ভাবেই সুপ্রিয় লেখে।

সকালে প্র্যাকটিসের পর মাঠ থেকে তাঁবুতে যাওয়ার সময় সে সুপ্রিয়কে গ্যালারিতে বসে থাকতে দেখে উঠে আসে।

একগাল হেসে সুপ্রিয় তাকে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই অনুপম ওর জামা ধরে টেনে তোলে।

”অনু, অ্যাই কী করছিস!” সুপ্রিয় অবাক হয়ে বলেছিল। গ্যালারি এবং মাঠের ধারে তিরিশ—চল্লিশজন সারথি—ভক্ত ছেলে তখন মজা দেখার সম্ভাবনা নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল।

অনুপম বুকের কাছে জামাটা ধরে শীর্ণকায় সুপ্রিয়কে এমন ঝাঁকাতে থাকে যে, ফড়ফড় করে ফেঁসে যায় পুরনো জামা।

”অ্যাই দ্যাখো, থাম থাম, এটা যে নিউজ হয়ে যাবে রে।”

”নিকুচি করেছে তোমার নিউজের। বারিন দত্ত কত টাকা দেয় তোমায় আমার বিরুদ্ধে লেখার জন্য? বলো, বলো।” অনুপম ধাক্কা দিয়ে সুপ্রিয়কে বসিয়ে দেয়।

”এক পয়সাও নয়। যা সত্যি, যা খবর, তাই লিখি। তুই বুকে হাত দিয়ে বল, ও কথা তুই বলিসনি? টাকা না পেলে পায়ে বল ছুঁবি না বলিসনি?”

”হ্যাঁ বলেছি, কিন্তু তুমি যেভাবে লিখেছ সেভাবে নয়। সারথির এখন ক্রাইসিসের সময়ে তুমি এমন ভাবে আমাকে প্রেজেন্ট করলে। যেন ক্লাবের ওপর আমার দরদ নেই, ভালবাসা নেই, শুধু টাকার সঙ্গেই সম্পর্ক, একটা অর্থপিশাচ? হাজার হাজার মেম্বার, সাপোর্টার কী ধারণা করছে আমার সম্পর্কে, সেটা কি জানো?”

”ওই হল। প্ল্যাটিনাম জুবিলি ট্রফিটা গোল দিয়ে জিতে নে, দেখবি সব ধারণা উলটে গেছে। আবার তোকে মাথায় তুলে সাপোর্টাররা নাচবে। কবে কী বলেছিস কেউ মনে রাখবে না।”

”সুপ্রিয়দা, ট্রফি নেব, গোলও দেব আর তোমার কলমটাও সেদিন ভেঙে দু’ টুকরো করব।”

তখন ওদের ঘিরে জড়ো হয়ে গিয়েছিল অনুপম—ভক্তরা। তারা সুপ্রিয়কে গালি দিয়ে বিদ্রূপ করতে থাকে। সুপ্রিয় নেমে আসার সময় দু—চারজন পেছন থেকে তাকে চড়চাপড় মেরেছিল। কেউ একজন ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলেও দেয়। অনুপমই টেনে তোলে। তখন সুপ্রিয় মুখে হাসি নিয়ে বলেছিল, ”গোল দিয়ে ট্রফি নিতে না পারলে এরাই কিন্তু তোকে ছিঁড়ে খাবে।”

পরদিনের প্রভাতী সংবাদে শিরোনাম হয়েছিল : ‘অনুপমের দম্ভ : গোল দেব, ট্রোফি নেব।’ খবরের মধ্যে সাংবাদিকের জামা ধরা ও ছেঁড়া মারধোরের কথা ছিল। শেষদিকে লেখা হয়—”গত বছরের বকেয়া বারো হাজার টাকা না পেলে অনুপম আর পায়ে বল ছোঁবে না।” এই কথা প্রভাতী সংবাদে প্রকাশিত হওয়ায় ফুটবল কমিটির সদস্য বারিন দত্ত ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘ক্লাবের আর্থিক সঙ্কট চলছে। এই সময় টাকার জন্য এই ভাবে চাপ দেওয়া ক্লাবের কোনও হিতাকাঙ্ক্ষীর পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকেরই টাকা বাকি আছে কিন্তু তারা কেউ পায়ে বল ঠেকাবে না বলেনি। অনুপম বড় খেলোয়াড়। সে জানে তাকে ছাড়া টিম করা যাবে না। ওকে বলেছি প্ল্যাটিনাম ট্রফি সেমিফাইনালে উঠলেই যতটা সম্ভব ওর টাকা মিটিয়ে দেব।’—এ ব্যাপারে অনুপমের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করেও তাকে রাতে বাড়িতে পাওয়া যায়নি।”

খবরটা সারথির সাপোর্টারদের মধ্যে অনুপম—বিরোধী একটা বিষাক্ত মনোভাব তৈরি করে দেয়। কিন্তু প্ল্যাটিনাম ট্রফি জেতার আশায় তারা বুক বেঁধে থাকে। কিন্তু দুলোদা অনুপমকে বলেছিল, ”বাড়াবাড়ি করলি। গোল দেব, ট্রফি নেব, এতটা বলা তোর উচিত হয়নি। ফুটবলে কেউ আগে থাকতে জিতবেই, বলতে পারে না।”

”আরে রাখো তোমার ওসব কথা। অনুপম বিশ্বাস যদি খেলব মনে করে তা হলে ইন্ডিয়ায় এমন কোনও টিম নেই যে, তাকে আটকাতে পারে।”

দুলোদা অবিশ্বাসভরে তো বটেই, বিরক্তিমাখানো চোখে তাকিয়ে বলেছিল, ”এতটা অহঙ্কার কিন্তু ভাল নয়। এই ট্রফিটা আমাদের চাই—ই, না হলে ক্ষমতা থেকে আমরা ছিটকে যাব। বারিন দত্ত গ্রুপ ড্যাংডাঙিয়ে ভোট তুলে নেবে। মনে রাখিস ইলেকশান আসছে।”

”তুমি নিশ্চিন্ত থাকো দুলোদা, ভোটে তোমরা জিতছ। ট্রফি পেলেই হাওয়া ঘুরে যাবে। কিন্তু একটা কথা, বাকি টাকা না পেলে আমি কিন্তু মাঠে নামব না।”

বারিন দত্ত আর সুবোধ বোস টাকা নিয়ে টুর্নামেন্ট শুরুর আগের দিন তার ফ্ল্যাটে এসেছিল। আধঘণ্টা থেকে চলে যাওয়ার সময় সুবোধ বলে, ”কাউকে আর টাকা দিচ্ছি না, শুধু তোকেই দিলাম। পুলকেশ, রঞ্জন, অপূর্ব ওদেরও বাকি আছে, চেয়েওছে। বলেছি, কাউকেই দিচ্ছি না, টুর্নামেন্ট থেকে না পেলে দিতেও পারব না। জোট করে বলেছিল খেলব না, কিন্তু শেষমেশ রাজি হয়েছে। অনু তোকে যে এই বারো হাজার দিলাম এটা যেন ওরা জানতে না পারে। এটা যদি লিক হয়ে যায় তা হলে কিন্তু ওরা প্রচণ্ড ঝামেলায় ফেলে দেবে। তুই শুধু বলবি সেমিফাইনালে উঠলে বারিনদা কিছু টাকা দেবে বলেছে তাই খেলছি। মনে থাকবে?”

অনুপমকে কিছু বলতে হয়নি। প্রথম খেলা ছিল আই. টি. আই—এর সঙ্গে। সরল আর রঞ্জনের দেওয়া গোলে ম্যাচ জেতার রিপোর্টের সঙ্গেই আলাদা একটা খবরে বলা হল, ”বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেল, অনুপম বিশ্বাস আজকের ম্যাচ খেলতে সকাল দশটা পর্যন্তও রাজি ছিল না। কয়েকজন কর্মকর্তা তাকে হাতেপায়ে ধরেও রাজি করাতে পারেননি। অবশেষে তার ফ্ল্যাটে গিয়ে একজন বারো হাজার টাকা পৌঁছে দেওয়ায় সে মাঠে আসে।”

খবরটায় যেন আগুনে ঘি পড়েছিল। সমর্থকদের মধ্যে তো বটেই, টিমের অন্যরাও রাগে ফেটে বলেছিল, ”তা হলে অনুপমই খেলুক। শুধু একজনই টাকা পাবে আর বাকিরা সব ফালতু, তা হলে ফালতুর মতোই এবার আমরা খেলব।”

সেই খেলাটা তারা ফাইনালে উঠে ডেম্পোর সঙ্গে খেলল।

কিন্তু তার আগে দুলোদাই হুঁশিয়ারি করে অনুপমকে বলেছিল, ”তোকে শেষ করে দেওয়ার মারাত্মক চাল বারিন চেলেছে রে। কাউকে জানাতে মানা করে টাকা দেওয়ার খবরটা সুপ্রিয়কে দিয়ে কাগজে বের করল। শুধু মেম্বার—সাপোর্টাররাই নয়, প্লেয়াররাও তোর ওপর খেপে রইল।”

”কিন্তু দুলোদা, আমি তো অন্য কারও নয়, শুধু নিজের পাওনাটা নিয়েছি, কারও বাড়া ভাতে তো ছাই দিইনি।” অনুপম অসহায়ভাবে নিজেকে বাঁচাতে চেয়ে বলেছিল।

”এ—কথা আমাকে বলে কোনও লাভ নেই। সুপ্রিয়কে বললে আরও খারাপ হবে, দেখবি পরের দিন উলটো কথা কাগজে বেরিয়েছে। তার থেকে বরং চুপচাপ থাক আর খেলে যা। গাবিয়ে কথা বলাটাই তোর সর্বনাশ করছে। এখন ট্রফি যদি না আসে তা হলে বারিনরা বলবে, বারো হাজার টাকা তো দিলাম, অনুপম কী করল? টিমের মধ্যে ঝগড়া তৈরি করা ছাড়া ওর অবদানটা কী? বারিনরা ভাল করেই জানে, তোকে টাকা দেওয়ার খবর ফাঁস হলে কয়েকজন মাঠে নেমেও খেলবে না। তাতে সারথি হারবে, আর তার ফলে আমরাও কমিটি থেকে আউট হয়ে যাব, সেটাই ওদের লক্ষ্য। টাকাটা এখন নিয়ে ভুল করলি অনু…. এই বারো হাজার তোকে ডোবাবে।”

.

না, ডোবাবে না।

অনুপম টেবিলে রাখা রেকাবে পোড়া পাউরুটি আর পেঁয়াজ—লঙ্কা—ডিমের একটা ঘণ্টার দিকে তাকিয়ে আপন মনে মাথা নাড়ল। বারো হাজার টাকা এবার সে যথার্থ একটা ভাল কাজে লাগাবে। একটা প্রাণ….একটা পরিবার যদি তাতে রক্ষা পায়।

”আপনি খাচ্ছেন না যে?” পঞ্চি ভয়ে ভয়ে রেকাবের দিকে তাকিয়ে কুণ্ঠিত স্বরে বলল।

”হ্যাঁ, খাচ্ছি।” একটা টোস্ট তুলে অনুপম কামড় দিল। ”খুব ভাল হয়েছে।”

উজ্জ্বল হয়ে উঠল পঞ্চির মুখ। ”মেসোমশাই বলে, শক্ত ঝামার মতো টোসের সঙ্গে মামলেট খেতে খুব ভাল লাগে।”

অনুপম সায় দিয়ে কী একটা বলতে যাচ্ছিল তখন নীচের থেকে কেউ পঞ্চির নাম ধরে ডাকল। চেয়ার থেকে স্প্রিংয়ের মতো উঠে দাঁড়িয়েই অনুপম টলে পড়ে যাচ্ছিল। বাঁ পা তার ভার নিতে পারছে না।

”কে?” পঞ্চি ছুটে বারান্দায় গিয়ে ঝুঁকে নীচে তাকাল। কাকে যেন অপেক্ষা করতে বলেই ফিরে এসে সিঁড়ির দিকে এগোল।

”শোনো।” অনুপমের ভীত তীক্ষ্ন স্বরে পঞ্চি থমকে অবাক হয়ে তাকাল। ”কে এসেছে?”

”পাশের বাড়ির ছেলে তিলু। বাচ্চচুর গরম জামা, দুধের কৌটো, খাওয়ার ওষুধ নিতে এসেছে।”

”ও কি ওপরে আসবে?”

”না। সব তো নীচের ঘরে রয়েছে।”

”তিলুকে দিয়ে সদর দরজা বন্ধ করে দেবে।”

পঞ্চি নেমে যাওয়ার পর অনুপমের খাওয়ার ইচ্ছাটা মরে গেল। রাতের ভয় দিনের আলোয় যেন আরও বেশি করে তাকে পেয়ে বসেছে। খবরের কাগজটা একই ভাবে পড়ে আছে। হাত বাড়িয়েও সে টেনে নিল।

ভাঁজ—করা প্রথম পাতায় একটা চার কলাম ছবির খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। পাঁজাকোলা করে একটা লোককে একজন নিয়ে যাচ্ছে। মাথাটা আর বাঁ হাতটা ঝুলছে। চোখ বন্ধ। পেছনে আবছা ভিড়। তবু বোঝা যাচ্ছে একটা ছেলে ইট ছুড়ছে। হেলমেট পরা পুলিশ একটা লাঠি উঁচিয়ে ছুটে যাচ্ছে। আকাশের দিকে পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া।

ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল অনুপম। এসব তারই সৃষ্টি। যে লোকটাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে কি মৃত? ইট, লাঠি, আগুন বের করে আনল একটা খেলা! দোষটা কি খেলারই, না কি যারা খেলে আর খেলায়, তারাই আসল অপরাধী?

”আপনি খাবেন না?” পঞ্চি উঠে এসেছে।

”না। জ্বর জ্বর লাগছে। পায়ের ব্যথাটা যেন আরও বেড়েছে। তুমি আমাকে এক ডেকচি জল গরম করে দাও আর ফ্রিজ থেকে বরফ দাও।…. আর শোনো।” অনুপম ইতস্তত করে বলল, ”কেউ এলে যেন বোলো না আমি এখানে আছি। সদর গেট সব সময় বন্ধ করে রাখবে।”

”মাসিমাও তাই বলে গেছে। জানেন আমাদের এখানে ছেলেধরা বেরিয়েছে! হ্যাঁ সত্যি! আমাদের গাঁদালপাড়ায়, যেখানে আমাদের বাড়ি, পরশু সেখানে অবনীকাকার ছেলে পল্টুকে, ছ’ বছর বয়স, একটা লোক ডেকে, ফুল নেবে বলে একটা লাল ফুল দিল। পল্টু ফুলটা শুঁকেই অজ্ঞান হয়ে যায়, তখন ওখান দিয়ে পল্টুর জেঠি যাচ্ছিলেন, তিনি ওকে শুয়ে থাকতে দেখে চেঁচিয়ে ওঠেন। তখন লোকটা একটা সাইকেলে চড়ে পোঁ পোঁ করে আমাদের এইদিক দিয়ে পালায়। আচ্ছা, ওরা নাকি বাচ্চচাদের ধরে নিয়ে গিয়ে রক্ত চুষে খায়, সত্যি?”

”সত্যি।”

”তা হলে তো বাচ্চচুকে সাবধানে চোখে চোখে রাখতে হবে!” পঞ্চি দায়িত্বের ভারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

”সেই জন্যই তো বলছি সদর মোটেই খোলা রাখবে না। নীচে কেউ নেই, চোর টোর ঢুকেও চুরি করতে পারে। তা ছাড়া আমি এখন তো খোঁড়া, ছেলেধরা এলে কিছুই করতে পারব না।”

এত কথা বলার পর অনুপমের মনে হল পঞ্চির মনে কৌতূহল জাগাবার মতো কোনও কথা কি সে বলে ফেলেছে? বোলো না আমি এখানে আছি’টা একটা সন্দেহ জাগাবার মতোই কথা। এর অর্থ, লুকিয়ে রয়েছে। তবে রক্ষে, মেয়েটা মোটেই চালাক—চতুর নয়। ওকে একটু খুশি রাখা দরকার।

অনুপম পোড়া টোস্টের ওপর চামচ দিয়ে ডিম তুলতে তুলতে বলল, ”খেয়েই ফেলি, এত সুন্দর লাগল না। তুমি গরম জল আর বরফ এনে দাও।”

নীচে থেকে আবার তিলুর গলা পাওয়া গেল। পঞ্চি নেমে গেল। অনুপম চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। সার দিয়ে মুখগুলো ভেসে আসছে—রবিদা, বউদি—মণি, বাচ্চচু—সেই ছেলেটা, চার বছর আগে অটোগ্রাফ নিতে আসা ছেলেটা, রোগাটে লম্বা মুখ, পাতাকাটা চুল কপালে ঝুলে, ঘন চোখের মণি দুটো বড় বড় চোখ জুড়ে—অবাক, সরল আর আহত চাউনি। দলাপাকানো হ্যান্ডবিলটা ঠিক কপালে—অনুপম সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বজ্রাহত হল। তারপর চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে দু’ হাত ঠকঠকিয়ে কেঁপে উঠল।

”দেখুন না, এই লোকটা আমার কথা শুনল না, ওপরে উঠে এল। আমি পইপই বললুম বাড়িতে এখন কেউ নেই।”

পঞ্চির অনুযোগ, কৈফিয়ত কিছুই ঢুকল না অনুপমের কানে। সে তার সামনে সাক্ষাৎ নিয়তিকে যেন দেখতে পাচ্ছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু গলা দিয়ে স্পষ্ট কোনও কথা বেরোল না।

”খুব অবাক হয়ে গেছিস তাই না?” পানের ছোপধরা দাঁতগুলো বেরিয়ে এল। সুপ্রিয় গুপ্ত হাসছে।

”তুমি এখানে! জানলে কী করে?”

রেকাবির দিকে তাকিয়ে সুপ্রিয় প্রশ্নটা অগ্রাহ্য করে বলল, ”খাচ্ছিলি?”

”না, খিদে নেই। জ্বর জ্বর লাগছে।”

”তা হলে আমি খেয়ে নিচ্ছি। খুকি এক গ্লাস জল দাও তো।”

সুপ্রিয় চেয়ারে বসে ঠাণ্ডা টোস্ট আর ওমলেট মুখের মধ্যে গুঁজে চিবোতে চিবোতে আবার চোখ বুঝল।

”খুব ভোরে বেরিয়েছি, কিচ্ছু খাওয়া হয়নি, দাঁত পর্যন্ত মাজা হয়নি।”

স্বয়ং শিব এসে তার সামনে দাঁড়ালে অনুপম এত অবাক হত না। কী ভাবে জানল সুপ্রিয়! একমাত্র দুলোদা ছাড়া আর কেউ জানে না সে কোথায় এসে উঠেছে। তেঁতুলতলার একটা রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে গেছে, রবিদার বাড়িটাও দুলোদা জানে না। তা হলে আর কার কাছ থেকে জানল? কখনও কারও কাছে সে তো রবিদা বা তেঁতুলতলার নাম পর্যন্ত উচ্চচারণ করেনি।

”কী ভাবছিস। কেমন করে খোঁজটা পেলুম?” সুপ্রিয় খালি জলের গ্লাস পঞ্চির হাতে দিয়ে বলল, ”আর এক গ্লাস।”

অনুপম মাথাটা নাড়ল।

”ওসব জেনে তোর আর এখন কী লাভ হবে। এখানে পালিয়ে এসে ভালই করেছিস, কাল তোর ফ্ল্যাটে বিরাট ভাঙচুর হয়েছে। জিনিসপত্তর ভেঙে ছড়িয়ে লণ্ডভণ্ড করে, তোর চাকরটাকে পিটিয়ে আধমরা করে দিয়েছে। এখন সে হাসপাতালে। তোকে যদি পেত ওরা—।”

”ওরা কে?”

এবার সুপ্রিয়র অবাক হওয়ার পালা। সে পিটপিট করে অনুপমকে কয়েক সেকেন্ড নিরীক্ষণ করে বলল, ”সেই তারাই, যাদের সম্পর্কে বলেছিলাম—গোল দিয়ে ট্রফি নিতে না পারলে তোকে ছিঁড়ে খাবে।”

”তুমি এখানে কী করতে এসেছ?” কথাটা সুপ্রিয়কে বলে অনুপম কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পঞ্চির দিকে তাকাল।

”আপনার গরম জল আর বরফ—”

”থাক, লাগবে না এখন, তুমি যাও।”

সুপ্রিয় গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীর হয়ে উঠল। অনুপম তার মুখের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি কাটাতে চুলের মধ্যে আঙুল ঢোকাল।

”তোর আজকের এই অবস্থায় পৌঁছোনোটা একদিনে হয়নি। ধাপেধাপে হয়েছে। তুই ভাল খেলে নাম করেছিস, তোকে নিয়ে এ—ক্লাব ও—ক্লাব টানাটানি করেছে, তোর দরও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে, চল্লিশ হাজার থেকে আজ দু’ লাখে…. কিন্তু তুই দারুণ ভাবে বদলে গেলি।”

”তোমরাই আমাকে বদলে দিয়েছ।”

”কী ভাবে?”

”আমার সম্পর্কে এমন ভাবে লিখতে শুরু করলে যেন ভারতে আমার মতো ফুটবলার আগে কখনও জন্মায়নি। ‘ভারতের জিকো’ ‘কলকাতার প্লাতিনি’ এসব তোমাদেরই দেওয়া টাইটেল। আমি স্বীকার করছি—” অনুপম থেমে গেল সুপ্রিয়কে পকেট থেকে নোটবই বের করতে দেখে।

”বলে যা।”

”স্বীকার করছি এসব বিশেষণ আমার ভাল লেগেছিল। চারদিকে তখন ভক্ত, যেখানে যাই সবাই আমার দিকে তাকায়, কথা বলতে চায়, বিশেষ ভাবে খাতির দেখায়। এসব আমার ভাল লাগত। সুপ্রিয়দা, এইসঙ্গে আমার বয়সটার কথাও মনে রাখবেন, তা ছাড়া লেখাপড়াও তো বিশেষ করিনি, স্কুল ফাইনালটা কলকাতায় এসে পাশ করেছি, কিন্তু কী ভাবে করেছি সেটা না বলাই ভাল। পড়তে আমার একদমই ভাল লাগে না, খবরের কাগজ, ম্যাগাজিনের হেডিং আর ছবি দেখে রেখে দিই… হ্যাঁ, সিনেমার খবর পড়ি।”

অনুপম কথাগুলো টানা বলে গেল যেন মহলা দেওয়াই ছিল। বলতে তার ভাল লাগল। সুপ্রিয়র ডটপেন নোটবইয়ে দ্রুত সরছে। মুখ ঘুরিয়ে অনুপম বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকাল। অটো রিকশা চলে যাওয়ার আর দূর থেকে বাসের হর্নের শব্দ ছাড়া শ্রবণকে আঘাত করার মতো আর কিছু এখানে নেই।

”আমাকে প্রভাবিত করেছিল আপনাদের স্তাবকতা। আপনারা প্রভাবিত করেছিলেন ফুটবলপাগল মানুষদের। তাদের কাছে আমাকে রাজপুত্র বানিয়ে ঠেলে দিয়েছিলেন, রূপকথার রাজপুত্র। মানুষ তো রূপকথা ভালবাসে, তাই তারা আমাকে লুফে নিয়েছিল। তারা আপনাদের কাগজ কেনে আমার সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানতে, আমার কথা শুনতে, আমাকে তারা বীর হিসেবে দেখতে চায় আর আপনারা তাই দেখাবার জন্য লিখতেন।…

”কেন? আপনাদের কাগজের বিক্রি বাড়াবার জন্য। আমি নিজের ফাঁদে নিজেই পড়ে গেলাম,…. নিজেকে ফাঁপিয়ে বড় করে দেখার ফাঁদ। আমার সম্পর্কে প্রশংসা করে, গুণ গেয়ে যা নই তার থেকেও বড় করে দেখিয়ে প্রচুর মিথ্যে কথা যখন লিখেছেন তখন আমি তার প্রতিবাদ করিনি, চুপচাপ সেসব মেনে নিয়েছি কেননা মিথ্যে কথাগুলো, ভানগুলো আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে।”

”কিন্তু অনেকে তোর বিরুদ্ধে লিখেছে, কড়া কথা বলেছে।”

”হ্যাঁ। লিখেছে, বলেছে আর তাতে আমি বিরক্ত হয়েছি, রেগেও গেছি। আমার মেজাজ, ব্যবহার সব সময় স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকে না—,” অনুপমের চোখে ভেসে উঠল, অবাক দুটি সরল চোখের ওপরে লেগে একটা পাকানো হ্যান্ডবিলের ছিটকে যাওয়ার ছবিটা।

”কেন থাকে না তা আমি জানি না, সত্যি বলছি সুপ্রিয়দা, তা আমি জানি না। সতেরো বছর বয়সে গ্রাম থেকে কলকাতায় এসেছিলাম খেলতে। অমানুষিক পরিশ্রম করে, উপেক্ষা, অবজ্ঞা, অপমান ঠেলে ওপরে উঠেছি।”

”তখন অনেকেই তোকে সাহায্য করেছিল কিন্তু পরে তুই তাদের ভুলে গেছিস।”

অনুপম চুপ করে রইল।

”তোর দেশের বাড়িতে একবার গেছলাম। দেখেছি তোরা কত গরিব ছিলিস, তোর বাবা—মা কত কষ্ট করতেন, আজও করেন। তুই ওঁদের নিয়ে এসে কলকাতায় নিজের কাছে রাখতে পারতিস, কিন্তু তা করিসনি। শেষ বয়সে তা হলে ওঁরা একটু সুখের মুখ দেখতেন।”

”আমি আনতে চেয়েছিলাম সুপ্রিয়দা, কিন্তু বাড়ি ছেড়ে ওঁরা আসতে রাজি হননি।”

”মিথ্যে কথা বলিসনি, অনুপম, তুই আনতে চাসনি। মাসে মাসে টাকা পাঠিয়েছিস ঠিকই, কিন্তু নিজের অতীতকে তুই এড়িয়ে যেতে চেয়েছিস। আধুনিক, দ্রুতগতির জীবন তোর ভাল লেগে গেছল। সেখানে গ্রামের মানুষরা মিসফিট, বেমানান। তাদের মানসিক ধারা থেকে তুই নিজেকে ছিঁড়ে বের করে নিয়ে যেতে গিয়েই তুই, আমার মনে হয়, বিপত্তি ঘটিয়েছিস। তোর কী মনে হয়?”

”তুমি কী উদ্দেশ্যে এমন সময়ে এখানে এসেছ? এই সব কথা বলার জন্য?”

”মনে পড়ে, কাল কী বলেছি তোকে? তোর উত্থান দেখেছি, পতনটাও খুব কাছ থেকে দেখতে চাই। বড় তাড়াতাড়ি তুই পড়ে গেলি। হাবিবকে দেখেছিস? হায়দরাবাদ থেকে তোর মতো বয়সেই কলকাতায় এসে কত বছর ধরে খেলে কত নাম কত টাকা করে গেল। বাঙালি ছেলেরা কোথায় দুর্বল, কোথায় পিছলে যায়, আমি সেটাই জানতে চাই বলে সাবজেক্ট হিসেবে তোকে বেছে নিয়েছি। তোকে নিয়ে লিখব।”

অনুপম পাংশু মুখে উঠে দাঁড়াল। সুপ্রিয় জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে হাত নেড়ে বসতে ইঙ্গিত করল।

”যাচ্ছিস কোথায়? বারান্দায় কি জানলায় এখন যাসনি। এই বাড়ি খুঁজে বের করতে বাস থেকে নেমে অনেক লোককে জিজ্ঞেস করেছি। রবিদা নামটা আর চার বছর আগে তার বাড়িতে এসেছিলি, এইটুকু ইনফরমেশন শুধু সম্বল। তোর নাম করে আমি যা গালাগাল শুনলাম সেটা কাল সারথির টেন্টের সামনেও শুনেছি। এখানকার লোক যদি একবার জানতে পারে—”

অনুপম চেয়ারে বসে পড়ল। নীচের দরজাটা পঞ্চি বন্ধ করেছে কি না, সুপ্রিয়র সামনে তা জিজ্ঞেস করলে ভয় পেয়ে গেছে ভাবতে পারে। সে তাচ্ছিল্যভরে বলল, ”জানলে কী আর হবে, দল বেঁধে এসে মারবে?…. পিটিয়ে মেরে ফেলবে?”

”এখন তো দল বেঁধে পিটিয়ে মারাই হয়। এ—রাজ্যে এটাই তো এখন টপমোস্ট ফেবারিট গেম। কাগজে দেখিস না, ডাকাত সন্দেহে, ছেলেধরা সন্দেহে গেরস্থ ভালমানুষরাও পাঁচজনে মিলে খুন করছে প্রকাশ্যে আর গণপ্রহার বলে খুন করার দায় থেকে হাত ঝেড়ে ফেলছে। দশ—বারোটা লোক যে—কোনও ছুতোয় তোকে দিনদুপুরে বড় রাস্তায় হাজার লোকের সামনে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে, একজনও বাধা দেবে না। আজকের কাগজগুলো পড়েছিস?”

টেবিলে পড়ে থাকা প্রভাতী সংবাদটার দিকে সুপ্রিয় তাকাল। হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে ভাঁজ খুলে প্রথম পাতায় চোখ রেখে বলল, ”প্রত্যেকটা কাগজে লিখেছে তুই আজ এত বাজে না খেললে, টাই ব্রেকারের পেনাল্টিটা মিস না করলে এত কিছু ঘটত না। এগারোটা লোক মারা গেছে—”

”এগারো! আটটা নয়?”

”মাঠেই আট, হাসপাতালে আরও তিন। মরার মতো অবস্থায় চারজন, সিরিয়াস আহত, মানে হাসপাতালে অ্যাডমিটেড সাতাশজন, তার মধ্যে তোর চাকরটাও রয়েছে। লুটপাট, আগুন, রেড রোড আর ধর্মতলায় মোটর গাড়ির কাচভাঙা, এসব তো আছেই। এসব ঘটনায় তোর রিঅ্যাকশান জানতে কাল তোকে গোরু—খোঁজা খুঁজেছি। সহদেব মালি বলল, তোকে গাড়িতে করে নিয়ে গেছে দুলাল শীল।”

”তা হলে দুলোদা তোমায় বলল আমি এখানে!”

”সুপ্রিয়র মুখে কুটিল একটা ফিকে হাসি খেলে গেল। সে হ্যাঁ বা না, কিছুই বলল না।

”দুলোদা বলে দিল?” অনুপম নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না। ক্লাবে তার সবচেয়ে বড় হিতৈষী বলে যাকে সে জানে, অভিভাবকের মতো যার কথা শুনে চলে, যাকে কমিটিতে আনার জন্য সে ক্লাব পলিটিক্সে মাথা গলিয়ে শত্রু বাড়িয়েছে, শেষকালে সেই লোকই কিনা তাকে বিপদে ঠেলে দিল তার হদিস বলে দিয়ে!

সে কি চিৎকার করে উঠবে? সে কি চোখের জল মুক্ত করে দেবে? সে কি কলকাতায় ছুটে গিয়ে দুলালচাঁদের গলা টিপে ধরবে? অনুপম ডান হাতের তালুতে চোখ ঢাকল।

”ওর গাড়িতে তোর পকেট থেকে ঘড়িটা পড়ে গেছল, পাঠিয়ে দিয়েছে। নে ধর।”

অনুপম হাত বাড়াল না। সুপ্রিয় ঘড়িটা টেবিলে রাখল।

”জীবনে অনেক কিছু তোর শেখার বাকি।”

”কিন্তু কেন?”

”আমার যতদূর মনে হয়, যা ঘটে গেল এর পর সারথি তোকে আর রাখবে না। এখন ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো তোকে ফেলে দেবে। কাল তোকে নামিয়ে দিয়ে দুলাল শীল সোজা গেছল বারিন দত্তর বাড়ি। দু’জনে হাতে হাত মিলিয়েছে। ওদেরও তো বাঁচতে হবে। শুধু তোকে আগলে, বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে তো দুলাল নিজের আখের খোয়াতে পারে না। তোকে দিয়ে যতটা পাওয়ার তা পাওয়া হয়ে গেছে, এখন তুই একটা বোঝা।”

”এসব কি তুমি লিখবে?”

”না। এরা হচ্ছে আমার খবর পাওয়ার সূত্র, আমার ওপর এদের আস্থাটা নষ্ট করব কেন? আমাকে বিশ্বাস করে বারিন দত্ত গত বছরই বলেছিল লিগে ক’টা ম্যাচ সারথি কিনেছে, কিন্তু আমি লিখিনি। তুই কি জানিস, কে. এস. টি—র সঙ্গে সেমিফাইনাল ম্যাচটাও কেনা ছিল?”

অনুপম চুপ করে তাকিয়ে রইল। সে জানে। দুলোদা আগের দিনই তাকে জানিয়ে দিয়েছিল। শোনা মাত্র বুকের মধ্যে একটা বরফের চাঁই নেমে এসেছিল। সোজাসুজি খেলে ম্যাচ জেতবার ক্ষমতা আর তার নেই। অথচ সবার চোখে সে বড় ফুটবলার হয়ে রয়েছে। চোখ দুটো জ্বালা করে উঠেছিল। অপমানে, না হীনতাবোধে, সে ঠিক বুঝতে পারেনি।

”অনুপম, সারথি তোকে ছেড়ে দিলে যাবি কোথায়?”

সুপ্রিয়র ডটপেন অপেক্ষা করছে উত্তরের জন্য। অনুপম এমন একটা প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল না। আরও দুটো সিজন পরে সে এটা নিয়ে হয়তো ভাবত। এখনও তার যা খেলা রয়েছে তাতে কলকাতার মাঠে তার দাম পড়বে না।

”অন্য ক্লাব তোকে নেবে কি না জানি না, নিলেও পঞ্চাশ—ষাট হাজারের বেশি দেবে না।”

”এসব নিয়ে আমি এখন কিছু ভাবতে রাজি নই।”

”হ্যাঁ, এখন তো প্রাণ বাঁচানোটাই সবার আগে। এখানে কত দিন লুকিয়ে থাকবি?”

”জানি না। রবিদা আসুক, নীচের এক ভদ্রলোক কাল রাতে ফেরেননি—”

”জানি, এখানকার একজনের মুখেই শুনলাম। কাল খেলা দেখতে গিয়ে আর ফেরেনি। এখানে ধারণা, গোলমালের মধ্যে পড়ে লোকটা হয় মারা গেছে নয়তো গেছে হাসপাতালে। তোকেই এজন্য দায়ী করছে। আর কী আশ্চর্য, শেষকালে তুইই কিনা এই বাড়িতে!”

”সুপ্রিয়দা প্লিজ, এখন এই আলোচনা বন্ধ করুন। আমার পায়ে এখন সেঁক দিতে হবে, বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।”

”কী ভাবে লাগল! কোথায়, দেখি?” সুপ্রিয় ঝুঁকে হাত বাড়াল অনুপমের পায়ের দিকে।

”থাক, থাক, তোমাকে আর পরীক্ষা করতে হবে না, এটা ফলস নয়। সত্যি ইনজুরি।”

নীচে কোলাপসিবল গেটের চাকা সরার শব্দ হল। ”রবিদা” বলে হাঁক দিয়ে কেউ উপরে উঠে আসছে। অনুপম ছিলে—ছেঁড়া ধনুকের মতো উঠে দাঁড়িয়েই পাশের ঘরের পরদা সরিয়ে ঢুকে গেল। আর তখনই দুটো লোক দোতলায় উঠে এল।

”রবিদা ফিরেছে নাকি রে?”

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসা পঞ্চিকে লক্ষ্য করে একজন বলল।

”মেসোমশাই, মাসিমা কেউ ফেরেনি, বউদিও না।”

”তুই একা বাড়িতে।” বলেই লোকটি সুপ্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলল, ”আপনি?’

”আমার নাম সুপ্রিয় গুপ্ত, প্রভাতী সংবাদ থেকে আসছি। রবিবাবুর কাছে দু—একটা খবর নেব।”

লোক দুটির ভ্রূ কুঁচকে মুখ থমথমে হয়ে গেল। ওদের একজন, বেঁটে, গাঁট্টাগোট্টা, বছর পঁয়ত্রিশ বয়স, পরনে লুঙ্গি ও খদ্দরের পাঞ্জাবি, গম্ভীর স্বরে বলল, ”আপনিই সেই সুপ্রিয় গুপ্ত, যিনি সারথির মন্দ ছাড়া ভাল দিকটা দেখতেই পান না, সারথির গায়ে কাদা না মাখালে যার ভাত হজম হয় না, সারথির ভেতরের কেচ্ছা তারিয়ে তারিয়ে লেখেন।”

সুপ্রিয় সরল হাসিতে মুখ ভরিয়ে শুধু তাকিয়ে রইল। এই রকম লোকের সম্মুখীন জীবনে সে বহুবার হয়েছে। সে জানে তর্ক করা বৃথা, চুপ করে মেনে নেওয়াই এখন বুদ্ধিমানের কাজ।

”রবিদাকে জিজ্ঞেস করে আবার কী খবর নেবেন? উনি তো খেলেন না, খেলে ওঁর ভাই অনুপম। তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন।”

অন্যজন, আরও কমবয়সি, কর্কশ স্বরে প্রায় ধমক দিয়ে তার মেজাজের অবস্থাটা জানিয়ে রাখল।

”তাকে তো পাচ্ছি না বলেই রবিবাবুর কাছে এলাম। শুনেছি এককালে উনি অনুপমদের গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন, ওকে বাল্যকাল থেকে দেখেছেন, ওর সম্পর্কে জানেনও অনেক কিছু।” সুপ্রিয়র কোমল বিনীত কণ্ঠ আবহাওয়াকে আর তপ্ত হতে দিল না।

”এখন অনুপমকে নিয়ে লেখার এটাই কি সময়? আপনার আক্কেলকে বলিহারি! ক্লাবটাকে ডুবিয়ে আজ পথে বসাল যে—”

”অনুপমের প্রশংসা করব বলে তো এখানে আসিনি। সারথি সত্যিই ডুবেছে। এবার তাকে টেনে তুলতে হলে বোঝা কমাতে হবে। সবচেয়ে বড় বোঝা এখন অনুপম আর তার মতো প্লেয়াররা, ঠিক কি না?”

”আলবাত। আগে ওটাকে তাড়ানো দরকার।”

”আপনারাই তো লিখে লিখে একটা পাঁঠাকে সিংহ বানিয়েছেন। মশাই এখন পেলে ওকে বলি দিয়ে কোর্মা বানিয়ে খেতুম।”

সুপ্রিয় মুখে স্মিত হাসি লাগিয়েই রেখেছিল, শুধু ওদের কথা শুনতে শুনতে সেটাকে ছোট বড় করে নিচ্ছিল। নিজের দিক থেকে আক্রোশটা অনুপমের দিকে ঘুরে গেছে বুঝে সে মাতব্বরি ঢঙে বলল, ”ক্লাবটা তো এক দিনে ডোবেনি, তেমনই তুলে ভাসানোটাও একদিনে সম্ভব নয়। লিগে যতটা করা যায় তা আমি করব কিন্তু মেম্বাররা, হিতৈষীরা যদি এগিয়ে না আসেন তা হলে হাজার লিখেও কিসসু করা যাবে না। আপনারাই পারেন সারথিকে বাঁচাতে। এগিয়ে আসুন, প্রেসার দিন কমিটি মেম্বারদের, নানান জায়গায় মিটিং করুন।”

”তাই করতে হবে এবার।” বেঁটে লোকটা ঘড়ি দেখল। ”রবিদারা এখনও যখন আসেনি, তার মানে সিরিয়াস কিছু হয়েছে। আপনি আর কতক্ষণ বসে থাকবেন?”

”দূর থেকে আসছি, দেখি আরও কিছুক্ষণ।”

লোক দুটি নীচে নামার পর গেট বন্ধ করার শব্দ পর্যন্ত অপেক্ষা করে সুপ্রিয় ডাকল, ”বেরিয়ে আয়।”

অনুপমের মুখ এই কয়েক মিনিটেই বসে গিয়ে চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। প্রবল তৃষ্ণার্তের মতো চাহনি। দরজার পরদা ধরে সে নিজেকে খাড়া রেখেছে।

”এখানে আর তোর থাকা উচিত নয়। নীচের লোকটার যদি যদি খারাপ কিছু হয় তা হলে তুই খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ে যাবি।”

”কিন্তু এখন আমি যাব কোথায়? কীভাবেই বা এখান থেকে বেরোব?”

সুপ্রিয় মাথা নামিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বলল, ”দুটো থেকে আড়াইটের, না সাড়ে তিনটের সময় আমি গাড়ি নিয়ে আসব। আসা মাত্র উঠে পড়বি।”

”কোথায় যাব?”

”তুই বল কোথায় যাবি, পৌঁছে দেব।”

”কলকাতায় যাব না…. দেশের বাড়িতে যাব।”

”সেই ভাল।”

সুপ্রিয় গুপ্ত কোনও বিদায় না জানিয়ে দ্রুত নেমে গেল। অনুপম সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবল, ওর সঙ্গে যাওয়াটা কি উচিত হবে? লোকটা কোনও বজ্জাতি করবে না তো! নানান ধরনের বিপদের কথা তার মনে আনাগোনা করতে লাগল। তারপর ভাবল, যা থাকে কপালে! দেখাই যাক না কী হয়! এইভাবে নিজেকে নিজে কয়েদ করে কত দিন চলা যায়!

পঞ্চি এসে দাঁড়াল। ”গরম জল আর বরফ দোব?’

সারা বাড়ির কর্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়ে ওর কর্মতৎপরতা বেড়ে গেছে।

”না থাক। আমার জ্বরটা কম লাগছে, খিদেও পাচ্ছে। ভাত খাব। কাল বউদি বলল, তোমার হাতের রান্না নাকি খুব ভাল।”

খুশিতে আনন্দে পঞ্চির মুখ থেকে কথা সরল না। অনুপম গত চব্বিশ ঘণ্টায় এই প্রথম হৃদয়ের গভীরে একটা শান্ত সুখ অনুভব করল মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে।

আড়াইটে থেকেই অনুপম উৎকর্ণ হয়ে দালানে বসে অপেক্ষা করছে। পঞ্চি ঘরের মধ্যে মেঝেয় ঘুমোচ্ছে। ঘড়িতে দেখল তিনটে বেজে পাঁচ। উঠে গিয়ে সন্তর্পণে মুখটা জানলার কাছে নিয়ে তাকাল। একটা কাঁঠাল গাছ দৃষ্টির অনেকটা আড়াল করে থাকলেও রাস্তার কিছু অংশ দেখতে পেল। জনপ্রাণী নেই।

সে আবার এসে চেয়ারে বসল। কলকাতায় গিয়ে গাড়ি জোগাড় করে এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসা কি সম্ভব? গাড়িই বা পাবে কোত্থেকে, সুপ্রিয়র নিজের তো গাড়ি নেই!

তা হলে কি দুলোদার কাছ থেকে চেয়ে আনবে! অসম্ভব, ওই লোকটার কোনও দয়া সে নেবে না। যদি দুলোদার গাড়ি নিয়ে আসে তা হলে সে যেতে অস্বীকার করবে। গত বছর সে একদিন তাই করেছিল, তবে প্রবল ঘৃণায় নয়, প্রচণ্ড রাগে।

.

সারথি কোচ বদল করে নতুন কাউকে আনবে এটা গত বছর সিজনের আগেই কমিটি ঠিক করে। একটার পর একটা টুর্নামেন্ট হেরে, লিগ চ্যাম্পিয়নশিপে চতুর্থ হওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত অবধারিতই ছিল। টিম নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর জন্য বাড়তি বাজেটও বরাদ্দ হয়।

তা ছাড়া রোভার্স কাপের সেমি ফাইনালে লিডার্স ক্লাবের কাছে ৩—০ হারের পর অনুপমের যে ইন্টারভিউটা প্রভাতী সংবাদে বেরোয়, সেটা নিয়েও কমিটিতে কথা হয়। তাতে অনুপম বলেছিল, ‘সারথি এখন ভরে গেছে অযোগ্যদের ভিড়ে। কেউই কন্ডিশনে ছিল না, দুজন ভাইটাল প্লেয়ার ইনজুরির কথা চেপে গিয়ে খেলতে গিয়েছিল। টিমকে তারাই ডুবিয়েছে, আর আমার বিরুদ্ধে এখন তারাই বলে বেড়াচ্ছে সিনসিয়ার ছিলাম না।’

ক্লাবে তো বটেই, বাইরেও সমর্থকদের মধ্যে এই ইন্টারভিউটা নিয়ে তোলপাড় হয়। টিমের মধ্যেও প্রবল অসন্তাোষ দেখা দেয়। অনুপম কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। দুলোদার গাড়িতে সেদিন একটা বউভাতের নিমন্ত্রণে যাচ্ছিল। দুলোদা তখনই তাকে বলেছিল, ”তোর জন্য টিম স্পিরিট সাফার করছে। কেন তুই সুপ্রিয়কে ইন্টারভিউ দিতে গেলি। মুখ বন্ধ করে থাকতে পারিস না? ক্লাব সম্পর্কে তুই সিনসিয়ার ঠিকই, কিন্তু নিজের প্রতি তুই ইনসিনসিয়ার। তোর খেলা দেখে বোঝা যায় এখন আর তুই খাটিস না, প্র্যাকটিসে মন নেই।”

অনুপম প্রতিবাদ করে বলেছিল, ”এইসব রদ্দি লোকের সঙ্গে খেলে খেলে আমি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছি।”

”আগে তুই একাই খেলা দিয়ে এদের ঘাটতি পুষিয়ে দিতিস, টিমকে টেনে নিয়ে যেতিস। কিন্তু এখন আর তা পারছিস না। ভাল প্লেয়ার কলকাতায় আর কোথায়, উঠে আসছে কই? এইসব রদ্দি লোক দিয়েই কাজ চালাতে হবে। তুই এদের মধ্যে মিসফিট, এখন তোকেই মাঠে ফালতু বলে মনে হয়। তোর খেলা এরা বোঝে না, তোকে একটা বল দিতে পারে না, তোর কাছ থেকে নিতেও পারে না।”

”অল্পবয়সি কিছু ভাল ছেলেকে এবার আনুন, আমি তৈরি করে নেব। আমি কোচ করব। এই হেমন্ত সেনকে দিয়ে আর চলে না।”

”অ্যাঁ, তুই কোচ করবি!” দুলোদা এমন মুখভাব করল যেন সারথির জার্সি পরে রোসি বা জিকোকে মাঠে নামতে দেখছে। ”হ্যাঁ, কোচ এবার বদলাবার কথা উঠেছে। যে টিমে ট্যালেন্ট নেই সেই টিমকে অন্যভাবে কোচ করে খেলাতে হয়। ছেষট্টির ইংল্যান্ডের ববি মুর, ববি চার্লটন আর ব্যাঙ্কস ছাড়া ছিলটা কী, অথচ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ান হল! স্কিল, ইমাজিনেশন, ফ্লেয়ার এ সবের ঘাটতি এনডিওরেন্স আর স্ট্যামিনা দিয়ে পোষাতে হয়। অবিরাম বলের পেছনে তাড়া করে গেলেও সেটা ফল দেয়।”

”তাকে কি তুমি ফুটবল খেলা বলবে?”

”আমার দরকার ম্যাচ জেতা, ট্রফি আনা। যদি হামা দিয়ে খেলে ম্যাচ জেতা যায়, তা হলে আমি হামাই দেব। আর্টিস্টিক, অ্যাটাকিং ফুটবল খেলব, যখন অমন করে খেলার মতো ট্যালেন্ট পাব। ছক কেটে অঙ্কের মতো করে এবার সারথি খেলবে। নতুন কোচ ভাবা হচ্ছে সুজিত ঘোষকে। প্রস্তাবটা আমারই।”

অনুপম চিৎকার করে বলে উঠেছিল, ”সুজিত ঘোষকে তুমি আনছ…তুমি? গাড়ি থামাও।”

অবাক হয়ে দুলালচাঁদ ব্রেক কষে। গাড়ি থেকে নেমে অনুপম বলেছিল, ”সুজিত ঘোষকে যে লোক সারথিতে আনতে চায় তার গাড়িতে আমি চড়ব না।”

আগের বছর কলম্বোয় এশিয়ান চ্যাম্পিয়ানশিপের জোনাল প্রতিযোগিতায় ভারতের কোচ সুজিত ঘোষ দুটো খেলায় থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অনুপমকে নামায়নি।

দুলালচাঁদের গাড়িতে তাকে প্রাণ বাঁচাতে তেঁতুলতলায় আসতে হল। কিন্তু এখান থেকে যেতেও হবে কি ওর গাড়িতে?

.

মোটরের ইঞ্জিনের আওয়াজ যেন শুনতে পাচ্ছে। অনুপম চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।

হ্যাঁ, গাড়িরই। সে বারান্দায় গিয়ে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করল। একটা কালো পুরনো অ্যাম্বাসাডারের বনেটের একধার, হেডলাইট আর সামনের দরজাটা দেখেই সে পিছিয়ে এল। দুলোদার গাড়ি এটা নয়। সুপ্রিয় তা হলে অন্য কারও গাড়ি এনেছে।

পঞ্চিকে ঘুম থেকে তুলে বলে যাবে কি না, অনুপম ভাবল। দরকার নেই। যেমন আচমকা এসেছি তেমনভাবেই চলে যাচ্ছি। কেউ কিছু মনে করবে না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে সে প্রদীপ হালদারের বন্ধ দরজাটার সামনে থমকাল। তালা ঝুলছে। ঘুরে সদরের দিকে এগোতে গিয়ে সে আর পা বাড়াতে পারল না।

গাড়ি থেকে নেমে রবিদা আর বউদি এগিয়ে আসছে। যুবক আর একজন, এই বোধ হয় সন্তু, পাশের বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে। কোলপসিবল লোহার ফাঁক দিয়ে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে সে শুভ না অশুভ, সেই খবরটা জানার চেষ্টা করল। ঝুঁকে পড়া, বিধ্বস্ত, ক্লান্ত শরীর, উদ্বেগে ঝলসানো রাতজাগা চোখ, রুক্ষ চুল, পায়ে যেন লোহার জুতো পরা।

ধীর পায়ে এগিয়ে অনুপমই গেট খুলে দিল। ওরা দু’জন স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে। রবিদা নিশ্চয়ই শুনেছে সে কাল রাত এখানে এসেছে—তাই কোনও বিস্ময় ফুটল না। অনুপমের চোখে বিহ্বলতা দেখে রবিদা শান্ত স্বরে বলল, ”শ্মশান থেকে আসছি, ওপরে আয়।”

দোতলায় উঠে এসে চেয়ারে বসে শরীর এলিয়ে দিয়ে রবিদা অস্ফুটে ”আহহ” বলে চোখ বন্ধ করল। অনেকক্ষণ পর চোখ খুলে অনুপমকে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, ”বোস। রাতেই এসেছিস। কাল রাত থেকে ছোটাছুটি চলছে। বউমার বাপের বাড়ি বেহালায় গেলাম। অত রাতে বাড়ি খোঁজাও এক দুর্ভোগ, তারপর আবার এলাম এখানে, তোর বউদি আর বউমাকে নিয়ে যেতে। হাসপাতাল, ডাক্তাররা অবশ্য খুব হেলপ করেছে নইলে এত তাড়াতাড়ি বডি বের করতে পারতাম না। বউমার ভাইয়ের, কাকা, পাড়ার ছেলেরা রয়েছে, তারাই যা কিছু করার করছে। প্রদীপ হাসপাতালে যখন পৌঁছয় তখনও প্রাণ ছিল, ঘণ্টা দুই বেঁচে ছিল। আমাদের আর কিছু করার ছিল না তাই চলে এলাম।… তোর পায়ে নাকি বড় চোট পেয়েছিস?”

”নীচের উনি ফিরলেন না? ওঁর ছেলেটি তো এখানেই রয়েছে।” মাথা নিচু রেখেই অনুপম বলল।

”না, বউমাকে আর আসতে বললাম না। কী হবে এসে? বাপের বাড়িতেই নিয়ে গেল। বাচ্চচুকে কাল আমি পৌঁছিয়ে দিয়ে আসব।”

বউদি ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। পঞ্চি ঘুমভাঙা চোখে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

”একটু চা খাওয়াবি রে।” রবিদার শ্রান্ত গলা থেকে সজল করুণ একটা সুর যেন বেরিয়ে এল।

পঞ্চির ঘুমের ঘোর কাটেনি। সে সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেলল, ”নীচের দাদা এসেছে?”

রবিদাই শুধু নয়, অনুপমও প্রশ্নের আকস্মিকতায় অপ্রতিভ হয়ে গেল। সেটা কাটিয়ে উঠে রবিদা নরম স্বরে বলল, ”আনতে পারলাম না রে।”

উত্তরটা বোধগম্য না হওয়ায় পঞ্চি তাকাল অনুপমের দিকে। একটা ঝাঁঝালো রাগ তখন অনুপমের দু’চোখ দিয়ে মাথার মধ্যে ঢুকে গেল।

”মারা গেছে।” সে ঝলসানো শব্দ দুটো মুখ থেকে বের করে আনল কঠিন গলায়।

”অ্যাঁ, দাদা মরে গেছে!… দাদা মরে গেছে!… তা হলে বাচ্চচুর কী হবে, ও মেসোমশাই কার কাছে বাচ্চচু থাকবে…” বলতে বলতে পঞ্চি সারা বাড়ির অব্যক্ত শোককে মুখর করে ফুঁপিয়ে উঠল। কেউ তাকে কাঁদতে বারণ করল না।

রবিদার চোখের পাতা ধীরে ধীরে নেমে এল। অন্ধ দৃষ্টি আকাশের দিকে তুলে ফিসফিস করে শুধু বলল, ”টিকিটটা আমিই দিয়েছিলাম।”

অনুপম তখন দালানে আবদ্ধ ফোঁপানো বাতাসের উদ্দেশে মনে মনে বলল, ”পেনাল্টিটা আমিই মিস করেছি।”

কারও মুখ থেকে পঞ্চির জন্য একটিও সান্ত্বনা—বাক্য বেরোল না। কাঁদতে কাঁদতে সে ঘরে গিয়ে তার মাসিমার কাছে মনের কষ্ট, বেদনা জানাতে লাগল। কিন্তু সেখানেও কোনও জবাব না পেয়ে সে চোখ মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

”সন্তুকে বলেছি বাচ্চচুটাকে আজ তোদের কাছেই রাখ। ওরও একটা দু’ বছরের বাচ্চচা আছে, ভালই থাকবে।” রবিদা মন্থর ম্লান গলায় বলল।

”কাল ওকে কখন দিতে যাবে?” অনুপম চেয়ারে বসে, কিছু একটা বলে সজীবতা তৈরি করার জন্য কথা বলল। কালকের ঘটনা এবং তার জন্য কে বা কারা দায়ী, এই ধরনের কথাবার্তা থেকে দূরে থাকতে চায় সে।

”সকালেই যাব। ছ’টার সময় গাড়িটাকে আসতে বলেছি। আমাদের নিয়ে কাল রাত থেকে গাড়িটা খাটছে। সফিকুলের আজ সকালে কাকদ্বীপে যাওয়ার বুকিং ছিল, সেটা ক্যানসেল করে অ্যাডভান্স ফিরিয়ে দিয়েছে। একবার পেট্রল নিল দশ লিটার, দাম দিতে গেলাম, নিল না।… সফিকুলের বাড়ির অবস্থা কিন্তু মোটেই ভাল নয়, ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে পুরনো গাড়িটা কিনেছে।” রবিদা মুখ ফিরিয়ে অনুপমের মুখের দিকে তাকিয়ে অবশেষে বলল, ”ছেলেটা তোদেরই বয়সি।”

চোখ নামিয়ে নিল অনুপম। রবিদার এই শেষ কথাটা বলার উদ্দেশ্য কী। সফিকুল আমারই বয়সি তো কী হয়েছে? ও ভাল কাজ করে আর আমি খারাপ কাজ করি?

”তোর পায়ের অবস্থা এখন কেমন?”

”ভাল।”

সেই সময় পঞ্চি দু’জনের জন্য চা এনে ওদের হাতে দিল।

”ইতিমধ্যে কোনও অসুবিধে হয়েছি কি তোর? ডাক্তার দেখাবার মতো সিরিয়াস কিছু হয়ে থাকে…।”

বাইরে থেকে মোটরের হর্নের শব্দ ভেসে এল। কাউকে ডাকার মতো ছোট ছোট করে দু’বার বাজল। অনুপমের হাতের কাপটা একবার নড়ে উঠেই স্থির হয়ে গেল। সুপ্রিয় গুপ্ত গাড়ি নিয়ে এসেছে।

”রবিদা, কাল সকালে বাচ্চচুকে নিয়ে তোমার আর যাওয়ার দরকার নেই। আমি ওকে নিয়ে গিয়ে ওর মায়ের কাছে পৌঁছে দেব।” ধীর এবং দৃঢ় গলায় অনুপম কথাটা বলে পঞ্চির দিকে তাকাল। ”দ্যাখ তো, মোটর গাড়িটা এই বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে কি না।”

”তুই ওকে নিয়ে যাবি!” বিশ্বাস করা রবিদার সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। ”তোর নিজের কথা তুই ভাব, এসব নিয়ে চিন্তা আমি করব।”

”আমি ভেবেচিন্তেই বলেছি।”

পঞ্চি ছুটে ফিরে এল। ”হ্যাঁ গো, দুপুরে যে লোকটা এসেছিল, সে আর ব্যাগ কাঁধে একটা লোক গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে।”

”দুপুরে কে এসেছিল?” রবিদার বিস্মিত প্রশ্ন।

”প্রভাতী সংবাদের রিপোর্টার সুপ্রিয় গুপ্ত।”

”জানল কী করে তুই এখানে…. উদ্দেশ্যটা কী?”

”উদ্দেশ্য নিজের স্বার্থ, নিউজের সন্ধানে আসা, আমি তো এখন বড় নিউজ। এত বড় ঘটনার পর উধাও…. সেই পলাতক ভিলেনকে তার গোপন ডেরায় খুঁজে বের করে তার ইন্টারভিউ নেওয়া…. ডিটেকটিভ গল্পের মতো গা—ছমছম করা একটা লেখার সুযোগ পেলে সুপ্রিয় গুপ্ত ছাড়বে কেন!”

আবার হর্নের শব্দ। এবার একটু বড় করে। পঞ্চি আবার ছুটে গেল বারান্দায়।

”যে আমাকে কাল এখানে পৌঁছে দিয়েছে সে—ই ওকে জানিয়েছে। সুপ্রিয় গুপ্ত আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবে বলে গাড়ি এনেছে।” অনুপম চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে বলল, ”কিন্তু আমি যাব না। আমি যাব কাল, বাচ্চচুকে নিয়ে।”

”লোকটা হাত নেড়ে আমাকে নীচে ডাকল, যাব?” উত্তেজিত পঞ্চি তাকাল রবিদার দিকে।

”দরজা খুলে ওপরে নিয়ে এসো।” অনুপম শান্ত স্বরে নির্দেশ দিল।

”নিয়ে আয়।” রবিদা অনুমোদন করতেই মেয়েটি নীচে নেমে গেল।

”রবিদা, গত চব্বিশ ঘণ্টা আমাকে চব্বিশ হাজার বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে গেছে, জানি না আরও কত আমাকে দেবে।”

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। ওরা তাকিয়ে রইল। প্রথমে সুপ্রিয়, তার পেছনে পঞ্চি, তারপর ব্যাগ কাঁধে বেঁটে, টাকমাথা, স্থূলকায় অরবিন্দ পাইন, হাতে ফ্লাশ লাগানো ক্যামেরা।

”কী রে, তুই রেডি হসনি?” ঈষৎ বিরক্ত ও ব্যস্ত স্বরে সুপ্রিয় সিঁড়ি থেকেই বলল।

হেসে অনুপম বলল, ”বসুন। সুপ্রিয়দা।”

আলোর ঝলসানিটা চোখকে সইয়ে সে অরবিন্দর ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে একটু বড় করে হেসে বলল, ”ভাল করে অনেকগুলো নিন অরবিন্দদা আর আমাকে কিন্তু গোটা দুই কপি দেবেন।”

অরবিন্দ কম কথা বলে। মাথা নেড়ে সে কোন অ্যাঙ্গেল থেকে রবিদা ও পঞ্চিসমেত অনুপমের ছবি নেবে সেটাই ঠিক করায় মনোযোগী হয়ে পড়ল।

সুপ্রিয় চেয়ার টেনে বসে বলল, ”আপনিই রবিদা, নমস্কার, কী ঝামেলায় যে একটু আগে পড়ে গেছলাম।…. অনু। তোকে ক’ ঘণ্টা আগেই বলে গেলাম না, আমাদের ফেভারিট গেম এখন ডাকাত কি ছেলেধরা বলে লোককে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা, সেটাই ঘটতে যাচ্ছিল আমাদের প্রায় চোখের সামনে, এই এখানকার বাজারের কাছে। অশথ গাছটার নীচে একটা পাথর বসিয়ে যেখানে পুজোটুজো হয়, তার থেকে দু—তিনশো হাত আগে, বাসা—রাস্তাতেই!…. আমাদের উলটো দিক দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে সাইকেল চালিয়ে একটা ছোকরা মোটরের গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল আর তার ষাট—সত্তর গজ পেছনে তাড়া করে আসছিল তিরিশ—চল্লিশটা লোক। সাইকেলটাকে ধরতে পারেনি, বাঁ দিকে একটা রাস্তায় নেমে গেল। শুনলাম আর একজনকে ধরে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেছে। হয়তো এতক্ষণে লাশ ফেলে দিয়েছে।… নে, তাড়াতাড়ি চল, কিছু নেওয়ার তো নেই?”

সুপ্রিয় উঠে দাঁড়াল। অনুপম স্থির হয়ে বসে রইল। রবিদার ভ্রূ কুঁচকে উঠেছে। পঞ্চি ছেলেধরার গল্প শুনে রোমাঞ্চিত।

”আমি যাচ্ছি না সুপ্রিয়দা।”

”সে কী! অফিস থেকে ব্যবস্থা করে গাড়ি আনলাম, তোর থাকারও ব্যবস্থা করেছি, দেশে আর তোকে যেতে হবে না। আমাদের চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্টের দাদার খালি বাড়ি রয়েছে উলুবেড়েয়, গঙ্গার ওপর। চল, এখন না বেরোলে সন্ধে হয়ে যাবে পৌঁছতে।”

”যা বলার বলে দিয়েছি, যাচ্ছি না। নীচের ভদ্রলোক গতকাল হাসপাতালে মারা গেছেন। আমি তাঁর বাচ্চচা ছেলেটাকে কাল সকালে বেহালায় পৌঁছে দিয়ে আসব মায়ের কাছে। সেখানে ফোটোগ্রাফার নিয়ে আসুন, আমাদের ফেভারিট গেমের রিপোর্ট করার, ছবি তোলার প্রচুর সুযোগ তখন পাবেন।”

অনুপমের মুখভাব এবং কণ্ঠস্বর থেকে সুপ্রিয় জেনে গেল, সিদ্ধান্তটার নড়চড় হবে না। থমথমে হয়ে উঠল তার মুখ। একটা দুর্দান্ত স্টোরির টোপ ফেলে, সম্পাদককে রাজি করিয়ে সে গাড়িটা এনেছে। এখন সে খালি হাতে ফিরে গিয়ে বলবে কী?

”তা হলে তুই এটা আগে বললি না কেন? এত তেল পুড়িয়ে, সময় নষ্ট করে এভাবে হ্যারাসড হওয়ার কোনও দরকার ছিল না।”

”কে বলল দরকার ছিল না। এটাই তো তোমার স্টোরি। অনুপম বিশ্বাসটা যে কত পাজি, শুধু সারথি থেকে কেন, ভদ্রসমাজ থেকেই তাকে তাড়ানো যে কত মঙ্গলজনক কাজ হবে সেটা এবার তুমি কলম খুলে লিখতে পারবে। সুপ্রিয়দা, এতগুলো লোকের মৃত্যু, জখম, কেউ কেউ পঙ্গুও হতে পারে, এ সবের জন্য আমি একা দায়ী নই। যে সিস্টেমে, যে কাঠামোয়, যে পদ্ধতিতে আমাদের ফুটবল চলছে তাই থেকেই বেরিয়ে আসছে এই বিষ। অপরাধের বোঝা আমি একা কেন বইব, অনুশোচনা, অনুতাপ একা আমি কেন করব? সবাইকে বইতে হবে, করতে হবে, আপনাকেও এর ভাগ নিতে হবে। চারদিকে শুধু তো শুঁয়োপোকার ভিড়। মানুষ … বুদ্ধিমান, হৃদয়বান মানুষ কোথায়? কলকাতার ফুটবল চালাচ্ছে যারা, ক্লাব চালাচ্ছে যারা, সেখানে কাদের দাপট, কাদের প্রতিপত্তি? ধান্দাবাজ, আত্মমর্যাদাবোধহীন, পা—চাটা, চোর—জোচ্চেচার ক্লাসের বারিন দত্ত, দুলাল শীল, সুবোধ বোসদের হাতে ফুটবল গেলে এই অবস্থাই হয় ; আগুন জ্বলে, টেন্ট ভাঙে, মানুষ মরে। আর বলির পাঁঠা করার জন্য প্লেয়াররা তো আছেই। আর আছেন আপনারা।”

সুপ্রিয় উঠে সিঁড়ির দিকে এগোতেই অনুপম ঝটিতি হাত বাড়িয়ে ওর বাহু ধরে টান দিল। সুপ্রিয় টানের চোটে পিছিয়ে টেবিলে ধাক্কা খেল। অনুপমের দু’চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে, রগ দুটো দপদপাচ্ছে, ফুলে উঠেছে গলার দু’ধারের শিরা। মুঠো করা পুরো বাহুর পেশি স্ফীত।

সুপ্রিয় এবং অরবিন্দ কিছুটা ভয় পেয়ে রবিদার দিকে তাকাল। অনুপম কিছু যদি ঘটিয়ে ফেলে তা হলে এই লোকটি তাদের রক্ষাকর্তার ভূমিকায় যেন অবতীর্ণ হয়, এমন একটা প্রত্যাশা তাদের দৃষ্টিতে। কিন্তু রবিদার হাবভাবে এই ভূমিকা পালনের কোনও ইচ্ছা ফুটে উঠেছে বলে তাদের মনে হল না। বরং মনোযোগী শ্রোতার ভূমিকাটাই তাদের চোখে পড়ল।

”অনুপম গলাবাজি তো এখন খুব করছিস। কিন্তু গড়াপেটা ম্যাচে গোল দিয়ে ছোট ছোট টিমগুলোকে হারিয়ে বীরদর্পে যখন মাঠ থেকে বেরোস, ভক্তদের সাষ্টাঙ্গ প্রণামগুলো অবলীলায় যখন গ্রহণ করিস, তখন তোদের এই ন্যায়—নীতি বোধগুলো থাকে কোথায়? তোরা যদি ফুটবলটা খেলতে জানতিস, পরিশ্রম করে খেলাটা শিখতিস, তা হলে কি ম্যাচ গড়াপেটা করার দরকার হত?” সুপ্রিয় এবার কোণঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মরিয়া হয়ে গলা চড়াল।

কেউ খেয়াল করেনি ঘরের পরদা সরিয়ে বিষাদে আচ্ছন্ন, ফোলা ফোলা দুটি অশ্রুসজল চোখ নিয়ে বউদি দরজায় দাঁড়িয়ে। রবিদার দৃষ্টি হঠাৎ সেই দিকে পড়তেই সচেতন হয়ে নম্র স্বরে বলে উঠল, ”এই নিয়ে এখন তর্কাতর্কি এখানে না করলেই ভাল হয়। বাড়ির কারও এখন মন ভাল নেই।”

রবিদার কথা গ্রাহ্যে না এনে সুপ্রিয় সমানে গলা চড়িয়ে বলে চলল, ”আমরা লিখে—লিখে তোর পপুলারিটি, তোর ইমেজ ধরে রেখেছি অনুপম, তা যদি না করতাম তা হলে আজ তুই দেড় লাখ—দু’ লাখ এইরকম খেলে কামাতে পারতিস না। তুই একটা বেইমান, তাই কাগজকে দোষী করছিস। তোকে যে কোনও সময় ময়দান থেকে বিদেয় করে দিতে পারি, সেটা যেন মনে রাখিস।”

”তার আগে আমিই তোমায় এখান থেকে বিদেয় হতে অনুরোধ জানাচ্ছি, নইলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে—” অনুপম দু’পা এগোল সুপ্রিয়র দিকে।

”অনু।” ধমক দিয়ে রবিদা দাঁড়িয়ে উঠল। অরবিন্দ ততক্ষণে সিঁড়ির মাঝামাঝি নেমে গেছে। সুপ্রিয় নামতে নামতে মুখ ঘুরিয়ে বিষাক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, ”একটা ক্রিমিনালের মতো ফেরার থেকে ভেবেছিস বেঁচে যাবি। দেখি কেমন করে তুই বাঁচিস।”

সুপ্রিয় গুপ্ত নেমে গেল। একটু পরেই গাড়ি স্টার্ট নেওয়ার শব্দ শোনা গেল। অনুপম তখন স্বগতোক্তি করল, ”আপদ বিদায় হল।”

এর পর বউদি আর পঞ্চি পাশের বাড়ি গেল বাচ্চচুকে দেখার জন্য। রবিদা নীচে নেমে এসে সদর দরজার বাইরের রকটায় বসল। কলকাতা থেকে সে ফিরেছে জানলে প্রদীপ হালদার সম্পর্কে খবর নিতে কেউ কেউ নিশ্চয় আসবে। বাড়ির বাইরেই তাদের সঙ্গে কথা বলা ভাল, তা হলে দোতলায় অনুপম নির্বিঘ্ন হতে পারবে।

.

বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যার এগিয়ে আসাটা অনুপম ঘরের পেছনের জানলা দিয়ে দেখছিল। কালকের থেকে ঠাণ্ডাটা কম, গরম জামা পরার মতো নয়। বাড়ির খিড়কি দরজা খুললেই ডোবার মতো একটা পুকুর। তাকে ঘিরে নারকেল গাছ। আরও কিছু গাছ রয়েছে যার মধ্যে পেয়ারা, আম আর বাতাবিলেবু গাছগুলোকে সে চিনল।

এই সবের পেছনে পুরনো, ভেঙেপড়া ইটের পাঁচিল—ঘেরা দোতলা বাড়ি, যেটা সে কাল দেখেছিল। ইটগুলো ক্ষয়ে যাওয়া, শ্যাওলায় কালো। জানলায় রং নেই, শিকও সবগুলোতে নেই। এইরকম এক সময়ের অবস্থাপন্ন কিন্তু এখন কোনওক্রমে দিন গুজরান করা পরিবার সে মফস্বলের বা গ্রামের যেখানেই গেছে, দেখেছে। বাড়িটার পেছনে ও পাশে বড় বড় গাছ আর আগাছার জঙ্গল।

ম্লান হয়ে আসা আলোয় ক্রমশ আবছা হয়ে আসছে পুকুরে ছায়া ফেলা গাছেরা। অনুপমেরা বুকের মধ্যে দম বন্ধ করা স্মৃতিগুলো জানলা দিয়ে খোলা প্রকৃতির মধ্যে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। এই বাড়িতে আর কিছুক্ষণ থাকলে সে পাগল হয়ে যাবে কি না, এমন চিন্তাও তার মধ্যে এল।

সিঁড়িতে দ্রুত উঠে আসা পায়ের শব্দ আর উত্তেজিত চাপা গলায় রবিদার, ”অনু, অনু… কোথায় তুই” শুনে অনুপম বলল, ”এই যে, ঘরে।”

”সব্বোনাশ হয়েছে। এ বাড়িতে নাকি ছেলেধরা তাড়া খেয়ে ঢুকেছে। আর তাকে নাকি আমি লুকিয়ে রেখেছি ভাই পরিচয় দিয়ে!”

ঘরের দরজায় রবিদা ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। এখন তাকে দেখেই অনুপমের গা শিরশির করল।

”সে কী, কে বলল?”

”ছুটতে ছুটতে এসে পাড়ার ছেলে দেবাশিস খবর দিল, গ্যাঁদালপাড়া বাঁশতলার লোকে খেপে উঠেছে। তারা দলবেঁধে আসতে পারে।”

”এসব রটাল কারা?”

”দেবাশিসকে একজন বলেছে, মোটরে করে যাচ্ছিল দুটো লোক, গাড়ি থামিয়ে তারা বলল, যে ছেলেধরাটাকে সবাই তাড়া করেও ধরতে পারেনি, সেই লোকটাকে চুপিচুপি রবি সরকারের বাড়িতে ওরা ঢুকতে দেখেছে। … তোর সেই রিপোর্টারের কাজ। কী শয়তান লোক! অনু কোনও রিসক নেওয়া নয়। তোকে খিড়কির দরজা দিয়ে—”

রবিদার কথা শেষ হওয়ার আগেই চিৎকার করতে করতে একটি ছেলে ওপরে উঠে এল, ”রবিকাকা, রবিকাকা ওরা এসে পড়ছে, অনেক লোক… আপনি শিগগির নীচে গিয়ে কথা বলে আটকান, নয়তো….”

ছেলেটি আসার মতোই বেগে নেমে গেল। রবিদা উদভ্রান্তের মতো এধার—ওধার তাকাচ্ছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। অনুপমের সিক্সথ সেন্স বলল, এ বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকা নয়। জনতা মানেই বোধবুদ্ধিহীন, অন্ধ এক দানব। ঘটনা ঘটিয়ে তারপর ভাবতে বসে।

কোলাহলের মতো শব্দ ভেসে এল। অনুপম ধাক্কা দিয়ে রবিদাকে সিঁড়ির দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ”খিড়কির দরজাটা কোথায় দ্যাখাও।”

একতলায় সিঁড়ির পাশে বাড়ির পেছনে যাওয়ার দরজা। সেখানে সিমেন্টের উঠোন, টিউবওয়েল, পাম্প, কলঘর ইত্যাদি এবং বাইরের পুকুরে যাওয়ার ছোট দরজা। অনুপম দরজা দিয়ে বেরিয়ে নিজেই টেনে বন্ধ করার আগে রবিদাকে বলল, ”বলবে, কেউ আসেনি… খিলটা দিয়ে দাও।”

কোলাহলটা এখন চিৎকার আর তর্জনগর্জন। কিছু কিছু কথা স্পষ্টই শোনা যাচ্ছে।

রবিদা বলছে, ”আস্তে আস্তে, কালকেই এই বাড়ির একজন মারা গেছে, বাড়ির মানুষ এখন শোকে দুঃখে…”

”রাখুন রাখুন, ওসব অনেক শোনা আছে।”

”বের করুন, নয়তো বাড়ি জ্বালিয়ে দেব।”

রবিদা বলছে, ”আমি এখানে এতদিনকার বাসিন্দা, আমি কেন এখানকার ছেলে চুরি করব! এখানে আমার ব্যবসা, দোকান … বাড়িতে এখন একটা লোকও নেই।”

”আরে মশাই পুরনো বাসিন্দে ফাসিন্দে বুঝি না। ব্যবসা—দোকান আছে বলে পয়সার গরম দেখাচ্ছেন? ছেলে ধরে বিদেশে পাচার করার, সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত বের করে নেওয়ার কারবারেও অনেক পয়সা। বড়লোকেরাই এসব করে।”

”ভেতরে ঢোক, ব্যাটাকে টেনে বের করি।”

অনুপম পুকুরধার দিয়ে, নারকেল গাছগুলো ঘেঁষে পায়ে—চলা সরু জমি ধরে এগোল। তার লক্ষ্য, যত তাড়াতাড়ি দূরে সরে যাওয়া। ওরা শুধু তো বাড়ির মধ্যেই খুঁজবে না, পুকুরের দিকেও আসবে। শুধু একটাই আশা, অন্ধকার হয়ে এসেছে। কিন্তু ওদের কারও সঙ্গে যদি টর্চ থাকে। এখানে ঘন ঝোপজঙ্গল নেই যে, সে আড়াল নেবে। তা ছাড়া দলবেঁধে ওরা খুঁজবে, লুকোনো কাউকে পেলে এক সেকেন্ডও খরচ করবে না পিটিয়ে মারতে।… রডটা চালিয়েছিল এক সেকেন্ডেই মনঃস্থির করে। কিংবা তখন মন বলে কিছু ছিলই না।

পাঁচিলের ধারে এসে অনুপম উচ্চতা অনুমান করে দু’ হাত তুলে লাফাল। পাঁচিলের মাথা দু’হাতের আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরতেই ঝুরঝুর করে গুঁড়ো চুন—সুরকি এবং তারপর দুটো ইট নিয়ে সে জমিতে পড়েই হাঁটুর যন্ত্রণায় কাতরে উঠল।

রবিদার বাড়ির দোতলা থেকে অনেক লোকের গলা আসছে। ওরা ঘরে ঘরে খোঁজ চালাচ্ছে। ছাদেও নিশ্চয় যাবে। সেখান থেকে পুকুরের দিকে চোখ পড়বেই, আর কিছু লোক খুঁজতে আসবেই।

অনুপম আর একটু সরে গিয়ে পাঁচিলে কয়েকটা কিল মেরে বুঝতে চেষ্টা করল, কতটা মজবুত। তারপর আবার দু’হাত বাড়িয়ে লাফাল।

শক্তই। মনে হয় ইট খসে আসবে না। দু’হাতে চাড় দিয়ে বুক পর্যন্ত উঠে একটা পা পাঁচিলের ওপর রেখে বাকি শরীরটা তুলে নিয়ে পাঁচিলে রাখা। অনুপম চাড় দিয়ে উঠল।

খিড়কির দরজা খোলার শব্দ হল। সে ডান পা তুলল। পাঁচিলের ওপর রেখে বাকি শরীর তোলার জন্য পায়ের ওপর ভর দিতেই ইটটা খসে পড়ল আর সেই সঙ্গে ডান পা ঝুলে নেমে এল।

ইট পড়ার শব্দটা সন্ত্রস্ত করে দিল অনুপমকে। কিছু লোক বেরিয়ে পুকুরের ঘাটলার সিঁড়িতে। মুখ ফিরিয়ে সে কয়েকটা সাদা ধুতির নড়াচড়া দেখতে পেল।

”খিড়কিতে আলো নেই? বললেই হল! জ্বেলে দিতে বল।”

”শিগগির একটা টর্চ নিয়ে আয়। খোঁজ ব্যাটাকে।”

অনুপমের কনুই দুটো জ্বালা করছে। কিন্তু তাই নিয়ে উহু—হু করার সময় এটা নয়। এখন বাঁচা আর মরার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এই পাঁচিল। প্রতিটি সেকেন্ড এখন….। সে আবার লাফিয়ে পাঁচিল ধরল। ডান পা সবেগে পাঁচিলের মাথায় পৌঁছে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একই ঝোঁকে গোটা শরীরটাকে পাঁচিলের ওপর তুলে দিয়ে নিজেকে সে আধপাক গড়িয়ে দিল। আন্দাজ করে নিয়েছিল এদিকের মতো ওদিকেও জমি আট—ন’ ফুট নীচেই হবে।

শরীরে একটা পাক দিয়ে নীচে পড়ার সময় তার মনে একটা ভয়ই তখন ঝলসে গেল—ইট পাথর বা লোহার কোনও খোঁচা জমিতে পড়ে নেই তো! কিন্তু ভয়টা অমূলকই। আঘাত পাওয়ার মতো কিছু ওধারে ছিল না।

পাঁচিল ঘেঁষে দুই তালু আর হাঁটুর ওপর ভর রেখে অনুপম শক্ত জমিতে পড়ল এবং মুখ দিয়ে তার প্রথম কথাই বেরোল, ”হাঁটুটা গেল।”

যন্ত্রণায় সে ধীরে ধীরে কাত হয়ে গড়িয়ে পড়ল। বাঁ হাতের আঙুলগুলো হাঁটুর ওপর নিজের থেকেই এগিয়ে গেল সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে। দেড় বছর আগে ডা. চ্যাটার্জি বলেছিলেন, বাঁ পায়ের কার্টিলেজ অপারেশন করিয়ে নিতে, ‘আবার যদি চোট পাও, তা হলে কিন্তু খেলা ছাড়তে হবে।’ অপারেশনে তার ভীষণ ভয়। তখন সে রাজি হয়নি। এখন তার মনে হল, বোধ হয় এবার খেলা ছাড়তেই হবে।

চিত হয়ে সে শুয়ে রইল। পরিষ্কার আকাশ, কয়েকটা তারা দেখা যাচ্ছে। মাটির আর গাছপালার নিজস্ব মিষ্টি গন্ধ আছে। গাছে পাখির ডানা ঝাড়ার শব্দ। অনুপম উৎকর্ণ হল পাঁচিলের ওধারে গলার আওয়াজে। দূর থেকে ফেলা টর্চের রশ্মিটা পাঁচিলের ওপর দিয়ে একটা সাদা লাঠির মতো ঘোরাফেরা করল।

”আরে, সে কি আর এতক্ষণ বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে আছে, দ্যাখগে ভালমানষির মতো মুখ করে সন্তাোষের দোকানে বসে এখন চা খাচ্ছে।”

”দেখলে তুই চিনতে পারবি?”

”খুব পারব।”

কথাগুলো ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে এল। উঠে বসল অনুপম। কাদের বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে এসে পড়লাম? এরা কেমন লোক? সারথির সাপোর্টার কি? তাকে চিনতে পারলে কি রড দিয়ে পিটিয়ে মারবে? ছেলেধরার লোকগুলো এখন কত দূরে? এখানে কতক্ষণ বসে থাকা যায়? ঝোপজঙ্গলে, বিশেষ করে পাঁচিলের ধারে গর্তে সাপ থাকতে পারে। শীতের ঘুমে যতই আচ্ছন্ন হয়ে থাকুক, ওদের বিশ্বাস নেই।

সুপ্রিয় গুপ্তকেও সে বিশ্বাস করে না। খবর খুঁজে বের করতে না পারলে, বাড়িয়ে লেখায় সিদ্ধহস্ত। মান—অপমান বোধটাও কম, চক্ষুলজ্জারও বালাই নেই। লোকটা যে কী ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসাপরায়ণ, এখন সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

কাছেই একটা কুকুর ডেকে উঠল আর অনুপম ব্যস্ত হয়ে কোনওক্রমে উঠে এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। তার আর একটি ভয় এখন কাছাকাছিই চার পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলে নিরাপদ হওয়া যাবে কি না, এই নিয়ে যখন সে দ্বিধার মধ্যে, তখন আরও কাছে কুকুরটার ডাক সে শুনতে পেল। আর ডাকের ভঙ্গিটা মোটেই বন্ধুজনোচিত নয়।

অন্ধকারে অপরিচিত লোক দেখলে তেড়ে এসে কামড়াতে পারে। ছুটে পালানোর ক্ষমতা এখন আর নেই। তা ছাড়া পালিয়ে সে যাবে কোথায়! ইট ছুড়ে মারলে বরং আরও চেঁচাবে, আরও তেড়ে আসবে। তা ছাড়া অন্ধকারে এখন কোথায় সে ইট—কাঠ খুঁজবে! অন্ধকার থেকে বেরোনোটাই এখন দরকার। চেহারা দেখলে কুকুরটা কামড়াবার আগে একটু ভেবে দেখবে, ও তো গণপ্রহারের কাজে নামেনি।

অনুপম বাঁ পা ফেলেই কাতরে উঠল। সে মাথা নেড়ে বিড়বিড় করল, ”অসম্ভব, অসম্ভব।” তারপরই দেখল হাত—কুড়ি দূরে কুকুর। মাঝারি আকৃতির, গায়ের রং নিশ্চয় সাদা নয়, তা হলে ঘোলাটে দেখাত। ভয় পেয়েই অনুপম, ”হ্যাট, হুশশ, হুশশ” শব্দ করল মুখ দিয়ে, আর সঙ্গে সঙ্গে জেনে গেল ভীষণ বোকামি করে ফেলেছে।

কুকুরটা মুখ নিচু করে, হিংস্র ডাক ছেড়ে তেড়ে এল তার দিকে। পায়ের ব্যথা ভুলে অনুপম খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়িটার দিকে এগোল। কুকুরটা পেছন থেকে এসে ডান গোড়ালির কাছে তার প্যান্ট কামড়ে টান দিল।

”অ্যাই, অ্যাই।” অনুপম পা ছুড়ল। নিচু হয়ে হাতড়ে হাতড়ে একটা মাটির ঢেলা পেয়ে কুড়িয়ে নিল। কুকুরটা চার—পাঁচ হাত দূর থেকে গজরাচ্ছে।

ঢেলাটা ভেঙে একটা টুকরো ছুঁড়েই সে বাড়িটার দিকে মরিয়া হয়ে এগোল। প্রায় ছুটেই। পেছনে আবার গজরানি এবং বাঁ পায়ের ডিমের কাছে প্যান্ট ভেদ করে দাঁত বসানোটা টের পেয়েই সে ঘুরে নিচু হয়ে ঘুসি চালাল। কুকুরটার মাথায় লেগেছে। একটু পিছিয়ে গিয়ে তারস্বরে জানোয়ারটা চিৎকার করতে লাগল।

”পল্টন, আয় আয়, পল্টন।” বাড়ির ভেতর থেকে পুরুষকণ্ঠের ডাক শোনা গেল। পল্টন নিশ্চয় এই কুকুরটাই, কেননা ওর ঘেউ ঘেউ আরও বেড়ে গেল ডাকটা শুনে কিন্তু আর কামড়াতে এগোল না।

বাড়ির সামনের দিকে যাওয়ার পথটা যে কোনদিকে অনুপম তা ঠাওর করতে পারছে না। সেই সময় দোতলার জানলা থেকে বয়স্ক পুরুষ গলায় কে বলল, ”দ্যাখ তো, পল্টনটা চেঁচাচ্ছে কেন। শুনছি ছেলেধরা নাকি তাড়া খেয়ে এদিকে এসেছে।”

”দয়া করে একটু কুকুরটাকে ডেকে নেবেন?” ডুবন্ত মানুষ সামনে দিয়ে ভেসে যাওয়া কাঠের টুকরো দেখলে যেমন মরিয়া হয়, অনুপম সেইভাবেই বলল, ”আমি আপনাদের পাশের রবি সরকারের বাড়ির লোক।”

দোতলায় বিস্ময়জনিত একটা শব্দ হল। ”আপনি এখানে কী করছেন… পল্টন, এই পল্টন।” ধমকে উঠল লোকটি। ”আয়, ভেতরে আয়।”

অনুপমকে এড়িয়ে ঝোপের পাশ দিয়ে কুকুরটা ছুটে চলে গেল। দোতলা থেকে নির্দেশ এল, ”ডানদিক দিয়ে ঘুরে আসুন।”

অনুপমের আর হাঁটার ক্ষমতা নেই। বাঁ পা ফেললেই হাঁটু থেকে একটা তীক্ষ্ন যন্ত্রণা মাথার তালু পর্যন্ত পেশি, শিরা, অস্থি চিরে চিরে উঠে আসছে। জ্বালা করছে পায়ের ডিমের কাছটা। দাঁত বসিয়েছে তো বটেই, মাংসও তুলে নিয়েছে কি না সে বুঝতে পারছে না।

সে জমিতে দুই তালু রেখে হামা দিতে গেল। পারল না। ব্যথাটা আরও অসহ্য হয়ে তাকে উপুড় করে প্রায় শুইয়ে দিল। কুকুরটা যদি ফিরে আসে তা হলে কিছুই তার করার থাকবে না। তবে ওটা কুকুরই, প্রভুর আদেশ মেনে চলে।

বাড়ির কোনও লোক যদি এখন এসে পড়ে তা হলে সে এই অসহায়তা থেকে রেহাই পেতে পারে। অনুপম করুণ চোখে জানলাটার দিকে তাকাল। অন্ধকার। কুকুরটা বাড়ির মধ্যে একবার ডেকে উঠল।

আজ এই অবস্থা আমার হল কেন? মাটিতে মুখ ঠেকিয়ে অনুপম চোখের জল আটকে রাখার কোনও চেষ্টা করল না। এত অপমান, এত হীনতা স্বীকার, এত ভয় পাওয়া, এত হেনস্থা আর লাঞ্ছনা! কী পাপ আমি করেছি? মাটিতে গড়াগড়ি খেতে হবে কেন? কী আমার দোষ? ভারতের এত বড় ফুটবলার এমন শাস্তি পাবে কোন রুলস বইয়ের নিয়মে?

টর্চের আলো তার দেহের ওপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ”ওমা!” বলে একটা ভয়—পাওয়া কণ্ঠস্বর অনুপমের মাথার কাছে থমকে পড়ল।

মুখ তুলে তীক্ষ্ন রশ্মির আঘাতে সে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

”কে আপনি? এখানে কেন?” একটি ছেলের গলা। অনুপম ওঠার জন্য দু’ হাতে ভর দিয়ে দেহটা তুলতে গিয়ে পারল না।

”আমাকে একটু ধরে তুলে দেবে ভাই। আমার বাঁ পা—টা জখম হয়েছে, চলার ক্ষমতা নেই।”

”নিশ্চয়, নিশ্চয়।”

হাতের লাঠিটা আর টর্চ মাটিতে রেখে অনুপমকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল ছেলেটি। ”আমি বাড়ি থেকে বরং কাউকে ডেকে আনি। দু’জনের কাঁধে ভর না রাখলে আপনি চলতে পারবেন না। ততক্ষণ লাঠিটায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন।”

ছেলেটি দ্রুত ডেকে আনল একজনকে। দু’জনের কাঁধ ও গলা জড়িয়ে ধরে অনুপম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এল নিচু তক্তপোশ পাতা একটা ঘরে, যার বিবর্ণ দেয়ালে তেলরঙে আঁকা ধূলিমলিন অস্পষ্ট দুটি ছবি। ভারী কাঠের একটা টেবলে পড়ার বই ছড়ানো। ঘরের একমাত্র বালবটা কম পাওয়ারের।

অনুপমকে ওরা চেয়ারে বসাল। এতক্ষণে সে ভাল করে লক্ষ করল তার উদ্ধারকারীদের। মুখের মিল থেকে অনুমান করল বাবা ও ছেলে। কিন্তু ছেলেটির মুখ যেন তার চেনা চেনা মনে হল। কবে, কোথায় যেন সে দেখেছে! চোখ বুজে মাথাটা পেছনে হেলিয়ে সে মনে করার চেষ্টা করল।

ওরা অবাক হয়ে দেখছিল অনুপমকে। সারা মুখ মাটি আর ময়লা মাখা। জামা আর প্যান্টের সামনের দিকও তাই। প্যান্টের তলা ছেঁড়া। পায়ে রক্ত লেগে।

”পল্টন বোধহয় কামড়েছে। চন্দন তাড়াতাড়ি গরম জল করতে বল, তুলো আর ডেটল আন। মারকিউরোক্রোম দিলেই হবে। আর ওনার মুখ হাত ধোয়ার জন্য এক বালতি জলও আনিস।”

বয়স্ক লোকটি উবু হয়ে অনুপমের প্যান্টটা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে তুলে পরীক্ষা করে অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ”বাড়ির পোষা কুকুর, কামড়ালেও ইঞ্জেকশন নেওয়ার দরকার হবে না। কিন্তু আপনি কে? বাগানে এখন এলেনই বা কীভাবে?”

”বাবা, ইনি বিখ্যাত ফুটবল প্লেয়ার অনুপম বিশ্বাস। রবি জ্যাঠামশায়ের ভাই, এখানে একবার এসেছিলেন।”

কথাটা শুনেই অনুপম চোখ খুলল। চন্দনের সঙ্গে চোখাচোখি হল। মুখে হাসি ছড়িয়ে চন্দন ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

এইবার মনে পড়েছে। সেই ফরসা, রুগণ, লম্বাটে মুখ। সেইভাবেই পাতাকাটা চুল কপালে ঝুলে রয়েছে। চারটে বছর ওকে আর একটু বড় করে দিয়েছে আকারে। চোখ দুটিকেও। গলার স্বর অতটা মিষ্টি আর নেই। গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া সবই তো আগের মতো।

তাই কি? সেই চাহনি, সেই দৃষ্টি! সরল, গভীর আয়ত চোখে ফুটে ওঠা অপমানের ব্যথাটা তো অনুপম দেখতে পাচ্ছে না! অত লোকের সামনে অপ্রতিভ হওয়ার লজ্জা কাটাতে হাসির জন্য মর্মান্তিক চেষ্টাটা এখন আর ওর ঠোঁটে নেই। কাগজটা পাকিয়ে ছুড়েছিল ওর কপালে। বাইরে কোনও ইনজুরি হয়নি, কোনও আঁচড় স্মৃতিতে পড়েছিল কি? ওর কি কিছুই মনে নেই! তাই কি হয়!

‘আমি কে সেটা আগে জেনে এসে…’, হায় রে, কে এখন অনুপম বিশ্বাস? তাকে এবার নিজের মুখে নিজের পরিচয় দিয়ে ভিখিরির মতো বলতে হবে, আমাকে বাঁচাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও।

”আমাকে যদি রবিদার বাড়ি পৌঁছতে একটু সাহায্য করেন—” অনুপম ওঠার চেষ্টা করতে করতে আবার বসে পড়ল চেয়ারে।

”নিশ্চয়। গরম জলে আগে জায়গাটা ধুয়ে ওষুধ লাগিয়ে নিন। রবিদার আর আমাদের বাড়ির পেছন যদিও পিঠোপিঠি, তবে দুটো বাড়ির সদর দুই রাস্তায়। আপনাকে ঘুরে অনেকটা হেঁটে যেতে হবে। আমি বরং রবিদাকে খবর দিয়ে আনাচ্ছি।… খুব কি যন্ত্রণা হচ্ছে? আসলে জানেন, কুকুরটাকে আমরা সন্ধের সময়…”

বিব্রত ও উদ্বিগ্ন ভদ্রলোককে থামিয়ে অনুপম বলল, ”যন্ত্রণা হচ্ছে, কিন্তু কুকুর কামড়ানোর জন্য নয়। দাঁতটা সামান্যই বসেছে। আমি রবিদার কথা ভাবছি। একদল লোক ওর বাড়িতে হামলা করতে ঢুকেছিল ছেলেধরা খোঁজার নাম করে। তাদের হাত এড়াতে আমি পাঁচিল টপকে আপনাদের বাগানে নেমেছি।” অনুপম কয়েক সেকেন্ডের জন্য নীরব থেকে, মাথা নামিয়ে মৃদুস্বরে আবার বলল, ”আমার জন্য, এ সবই আমার জন্য। মানুষের ক্ষতিই শুধু করে গেলাম।… কী যে খেললাম এতদিন ধরে! কারও কোনও উপকারে এলাম না।”

হতভম্ব ভদ্রলোক ওর ব্যথিত বিষণ্ণ কথা শুনে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি বললেন, ”আমি অবশ্য খেলাটেলা বুঝি না, খোঁজখবরও রাখি না, তবে আপনার নাম আমি শুনেছি। বিরাট প্লেয়ার আপনি—”

”বাজে কথা। সব বানানো, সব তৈরি করা। অবিরত লিখে লিখে বিশ্বাস করিয়ে দেওয়া হয়েছে। হতে পারতাম… বড় প্লেয়ার হতে পারতাম। সেই স্বপ্ন নিয়ে বারো বছর আগে ঘর ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিলাম। প্রচণ্ড খাটতাম, খেলাই ছিল আমার সব কিছু, আমার ধ্যানজ্ঞান, আমার জীবন।”

অনুপম ম্লান চোখ দেয়ালে টাঙানো ম্লান ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। অন্যমনস্কের মতো কিছু যেন ভাবছে। ভদ্রলোক ওর ভাবনায় ব্যাঘাত না ঘটিয়ে চুপ করে রইলেন।

স্বীকারোক্তি করার মতো নিচু গলায় অনুপম কথা বলছে। এই সময় এই সব কথা বলার কী দরকার, তা সে বুঝতে পারছে না। কথাগুলো নিজের থেকে বেরিয়ে এল অন্তর ভেদ করে।

”নিজেকে নিজেই তৈরি করে নিয়েছি, সেজন্য অনেক ব্যাপারে স্বার্থপর হয়েছি। সবাই বলবে অন্যায় করেছি, বলুক তারা। মানুষকে আনন্দ দেওয়া আমার কাজ, এর একটা গুরুত্ব সমাজে আছে। সারথির হাজার হাজার সাপোর্টারকে আনন্দ দিয়েছি, এর কি কোনও দাম নেই?”

অনুপম ছবি থেকে চোখ সরিয়ে রাখল ভদ্রলোকের মুখে। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে নড়ে বসে বললেন, ”আজকের কাগজে দেখলাম—”

”জানি, কী দেখেছেন। আমিই সেই লোক যার জন্য মাঠে এত হিংসা, রক্ত, মৃত্যু ঘটে গেল। ভালবাসার কথা, ভাল কাজ করার প্রেরণা, মঙ্গলের পথ দেখানো—আমার খেলা দিয়ে জানাতে পারিনি, দেখাতে পারিনি।” অনুপমের কণ্ঠস্বর প্রান্তরে হা হা রবে বয়ে—যাওয়া বাতাসের মতো শোনাল।

জল নিয়ে চন্দন ঘরে ঢুকল। শুশ্রূষার দায়িত্ব তাকে দিয়ে তার বাবা রবিদাকে খবর দিতে চলে গেলেন। বালতির জলে মুখ ও হাত থেকে ধুলো—মাটি ধুয়ে ফেলল অনুপম। গরম জলে ক্ষত পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছিল চন্দন। অনুপম ওর শান্ত, অচঞ্চল মুখের দিকে তাকিয়ে আলাপ শুরু করল, ”স্কুলে পড়ো।”

”হ্যাঁ, ক্লাস টুয়েলভ হবে।”

”খেলা দ্যাখো… ফুটবল?”

”আমাদের টিভি নেই। তবে এখানকার খেলা দেখি।”

”কালকের খেলায় যা ঘটেছে তা শুনেছ, পড়েছ?”

”আমাদের পাড়ার একটা ছেলে খেলা দেখতে গেছল, তার কাছে শুনলাম খুব হাঙ্গামা হয়েছে। কাগজেও পড়লাম, লোক মরেছে… আপনার জন্যই সব ঘটেছে।”

”কী করে জানলে আমার জন্যই ঘটেছে?”

”কাগজে লিখেছে।”

তা হলে সুপ্রিয় গুপ্ত সফল। খেলা দেখে না যে ছেলে, তাকেও বুঝিয়ে দিতে পেরেছে অনুপমই সব কিছুর মূলে।

”ট্রাইবেকারে শেষ কিকটা ছিল আমার। যদি গোল দিতাম তা হলে ম্যাচটা ড্র হত, আমরা যুগ্ম বিজয়ী হতাম। আমার কিকটা বারের ওপর দিয়ে চলে গেল। না গেলে আমাকে কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত, এত সব কিছুই হত না।” অনুপম হাসার চেষ্টা করল।

”গোল একটা অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না?”

প্রশ্নটা এড়িয়ে চন্দন বলল, ”পল্টন খুব বেশি কিছু করেনি, দু’দিনেই শুকিয়ে যাবে। ভয়টয় দেখায়, তাড়া করে, তবে ফেরোসাস নয়। আপনার প্যান্টটা গোটানোই থাক, নইলে ওষুধ লেগে যাবে।”

ফুটবল নিয়ে কথা বলায় ছেলেটির কোনও আগ্রহই নেই। অথচ চার বছর আগে আমার অটোগ্রাফ চেয়েছিল! অনুপম এই প্রথম দেখছে, তার উপস্থিতি একদমই উত্তেজিত করল না একটি কিশোরকে।

”তোমার মনে আছে কি, একটা হ্যান্ডবিল নিয়ে তুমি তাতে আমার অটোগ্রাফ চেয়েছিলে?”

”হ্যাঁ।” চন্দনের মুখে লাজুক হাসি ফুটল। ”আপনি দেননি।”

‘সেটা ছুড়ে তোমার কপালে মেরেছিলাম।”

”হ্যাঁ, কিন্তু আমার লাগেনি।”

”তাতে তুমি দুঃখ পাওনি।”

”একটু, তারপর ভুলে গেছলাম।” চন্দনের বড় বড় চোখ দুটিতে অনুপমকে গ্রাহ্যে না এনে তাচ্ছিল্য দেখানোর কোনও চেষ্টা নেই। সরল, অকপট, আন্তরিক চাহনি। অনুপমের ভেতরটা কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেল।

”বাবা বলেছিলেন, খুব অন্যায় করেছিস। অতবড় প্লেয়ারকে ওইরকম একটা বাজে কাগজে সই চেয়ে তাকে অসম্মান করেছিস। তারপর আমি ভেবেছিলাম আপনাকে চিঠি লিখে ক্ষমা চাইব। কিন্তু কেমন লজ্জা করল, তাই লেখা হয়নি।…. আচ্ছা এখন যদি আপনার কাছে মাফ চাই?”

অনুপম অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে চন্দনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বলছে কী! ওকে তো আমিই অপমান করেছি, ওরই তো রেগে থাকার কথা। তার বদলে ও আমায় শ্রদ্ধা দিল। একটা আবেগ অনুপমের বুক থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে লাগল আর সে আবিষ্কার করল তার শরীর থেকে ব্যথা—যন্ত্রণা ক্রমশ যেন মিলিয়ে যাচ্ছে।

”এখন কার কাছে তুমি মাফ চাইবে, আমি তো সেদিনের মতো অত বড় প্লেয়ার আর নই। আজ আমি মার খাওয়ার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমার জন্য, কাগজে পড়েছ তো, কত কিছু ঘটে গেল।”

”আপনি নিশ্চয় আবার পরিশ্রম করে বড় হয়ে উঠবেন।” চন্দন খুব সাধারণ গলায় বলল। ”আমি ক্লাস নাইনে ইতিহাসে খুব কম নম্বর পেয়েছিলাম, মাত্র পঞ্চান্ন। বাবা বললেন, একটু জোর দাও, আলাদা যত্ন নাও। প্রতিদিন পনেরো মিনিট সময় দিয়েছি ইতিহাসকে। একদিনও বাদ যায়নি। মাধ্যমিকে লেটার পেলাম। আপনিও যদি… না না, পনেরো মিনিটে হবে না জানি। যতটা দরকার, যদি ততটা সময়—।”

চন্দনের পক্ষে বলা সম্ভব নয় একজন ফুটবলারের কী কী করা দরকার। তাই সে কথা থামিয়ে ফেলল। কিন্তু অনুপমের মনের মধ্যে অজস্র কথা ঘুরপাক খেয়ে উঠল।

”চন্দন, তুমি পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতে চাও কেন?”

মুশকিলে পড়ে গেল চন্দন। এভাবে কেউ এই প্রশ্ন তাকে এখনও করেনি। সে বিব্রত হয়ে বলল, ”ভাল রেজাল্ট তো সবাই করতে চায়, আমিও চাই। ওপরের দিকে থাকলে খুব ভাল লাগবে, সবাই প্রশংসা করবে।”

”আমিও তাই চেয়ে খুব পরিশ্রম করেছিলাম। কিন্তু কিছুটা উঠেই আর করিনি। আমার কাজটা হয় বডি দিয়ে, তোমারটা ব্রেইন দিয়ে, এইখানেই আমাদের বড় পার্থক্য। শরীরের ক্ষমতা এক সময় তো কমতে শুরু করবেই কিন্তু তোমার ক্ষমতাটা যত চর্চা করবে, তত বাড়তেই থাকবে।”

কথা বলতে বলতে অনুপমের নিজেকে হালকা মনে হতে লাগল। যে গ্লানিটাকে চার বছর ধরে বয়ে চলেছিল, সেটা যেন চন্দনের সঙ্গে কথা বলে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।

”আপনার শরীরের ক্ষমতা কি কমে গেছে? বাবা বলেন, কখনও নেগেটিভ চিন্তা কোরো না, তা হলে তুমি ব্যর্থ হবেই। আর শুধুই চিন্তা করে সফল হওয়া যায় না, কাজও করতে হয়। কাজে কখনও ঢিলে দিয়ো না।”

অনুপম চুপ করে রইল। শরীরের ক্ষমতা এই ঊনত্রিশ বছর বয়সে কমবে কেন, তা হলে তার মধ্যে কী ঘটল? নেগেটিভ চিন্তা? কজে ঢিলেমি?

”তোমার বাবা কী করেন?”

”ক্লার্ক। ইস্টার্ন রেলে, হাওড়া অফিসে।”

”তোমাদের বাড়িটা খুব বড়, আর পুরনো।”

”একশো কুড়ি বছর আগের তৈরি। এখানে আমাদের অনেক জমিজমা ছিল।”

”এখন নেই?’

চন্দন হেসে, জবাব না দিয়ে দরজার দিকে তাকাল। পল্টন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে। মাঝারি গড়নের, কালো আর বাদামি রঙের দো—আঁশলা কুকুর। চন্দন হাত নেড়ে ওকে চলে যেতে নির্দেশ দিল। পল্টন দু’ পা পিছিয়ে বসে পড়ল।

”এখন আমাদের কিছুই নেই বাড়ি আর বাগানটা ছাড়া। বাবা বলেন, ধনসম্পত্তি আর ফিরিয়ে আনা যাবে না, কিন্তু মানমর্যাদা তো চেষ্টা করলে ফিরে পাওয়া যেতে পারে।”

”কীভাবে?” অনুপম টানটান হয়ে বসল। চন্দনের উত্তর তার কাজে লাগতে পারে।

”আমি যদি বড় হতে পারি। বড় মানে ধরুন… খুব বড় বিজ্ঞানী, বড় ডাক্তার, সুপ্রিম কোর্টের জজ, ব্যারিস্টার কি ভাইস চ্যান্সেলার, ইকনমিস্ট। তা হলে আবার আমাদের বাড়ির কথা এই অঞ্চলের লোকেরা বলবে, তাতে আমারও গর্ব হবে।”

”গর্ব তুমি চাও?”

”নিশ্চয়।” চন্দন এমনভাবে তাকাল যেন অঙ্কের সার বোর্ডে দুই আর দুইয়ে পাঁচ লিখে ফেলেছেন। অনুপমের মনে হল, চন্দন যাকে ‘আমাদের বাড়ি’ বলল, সেটাই তার কাছে সারথি সঙ্ঘ। সারথির মান—মর্যাদা তিন বছর ধরে ধুলোয় লুটোচ্ছে, তাই তারও আজ কোনও সম্মান নেই। এই ছেলেটি আবার তার বংশের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার জন্য মন দিয়ে লেখাপড়া করছে। আর সে?

অনুপমের সারা শরীর মুহূর্তের জন্য শক্ত হয়েই পেশিগুলো ধকধক করে উঠল। এখনই যেন ভেতরে কোনও বিস্ফোরণ ঘটে যাবে। রক্ত চলাচল দ্রুত হয়ে উঠছে। তার ইচ্ছে করছে এখনই বল নিয়ে মাঠে ট্রেনিংয়ে নেমে পড়তে। এক মিনিটও আর সে অপেক্ষা করতে পারবে না।… চন্দনের বয়সে তার এমনই হত!

আর সেই সময়েই চন্দনের বাবা ফিরে এলেন, সঙ্গে রবিদা। আর তাদের পেছনে অনুপম যাকে দেখল, তাতে তাজ্জব হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

ডা. চ্যাটার্জি, তাঁর পেছনে বারিন দত্ত আর দুলাল শীল!

”এখানে শুয়ো পড়ো, পা—টা দেখি।” ডা. চ্যাটার্জি ব্যস্ত এবং কড়া গলায় প্রথম কথাটি বললেন।

”আপনারা?”

”ওসব পরে শুনো। আগে শোও।”

অনুপমকে দু’ পাশ থেকে ধরে তুলল বারিন দত্ত ও দুলাল শীল। তাদের কাঁধে ভর দিয়ে সে তক্তপোশের ওপর বসল। পা তুলে ছড়িয়ে দেওয়ার সময় যন্ত্রণায় আবার সে কাতরে উঠল।

”এটা কী?”

”কুকুরে কামড়াতে গেছল, পারেনি।” চন্দন সবার আগে উত্তরটা দিল। ”বাড়ির পোষা কুকুর।”

ডা. চ্যাটার্জি হাঁটুর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে মুখ গম্ভীর করে মাথা নাড়লেন। তারপর আলতো করে আঙুল রেখে সামান্য চাপ দিতেই অনুপম ”উহহ লাগছে” বলে উঠল। হাঁটুটা মুড়ে ওপরে তুলতে গেলেন। অনুপম, ”না, না, পারব না।” বলে পিঠ বাঁকিয়ে তুলল।

”আর দেখার কিছু নেই। এখনই কলকাতায় নিয়ে চলুন। এক্স—রেটা আজই করাতে হবে। কালই অপারেশন করব।” ডা. চ্যাটার্জি সাদামাঠা শান্ত পেশাদারি গলায় বললেন।

সারা ঘর চুপ। প্রথম কথা বলল দুলাল শীল। ”ফেডারেশন কাপে খেলতে পারবে তো? আর দেড় মাস পরেই—”

”থাম দুলো,” বারিন দত্ত হাত তুলে বিরক্ত দৃষ্টিতে দুলালকে মৃদু ধমকাল। ”ডাক্তার চ্যাটার্জি যা বলছেন…. গাড়িটা ভেতরে আনতে বল। আমার অ্যাম্বাসাডারেই যাবে।… দেড়মাসে কি কখনও হাঁটু ঠিক হয়? তিরিশ বছর ধরে হাঁটুর চোট কম তো দেখিনি। তাড়াহুড়ো করে মাঠে নামিয়ে দিয়ে কত ছেলের কেরিয়ারও শেষ হতে দেখেছি। ফেডারেশন আমার দরকার নেই, সামনের লিগটা নিয়েই আমি ভাবছি।”

”এই পা নিয়ে হাঁটাচলা করলে কী করে?” ডা. চ্যাটার্জির বিস্ময় দেখে অনুপম ফিকে হাসল। শুধু হাঁটাচলাই নয়, আট—দশ ফুট ওপর থেকে একটা লাফও সে দিয়েছে।

”ফুটবলারের পা।” এতক্ষণে রবিদা একটা কথা বলার সুযোগ পেয়ে বলল।

বাইরে মোটর এঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। অনুপম রবিদাকে জিজ্ঞেস করল, ”ওরা কোনও ঝামেলা করেনি তো?”

”না, না। সারা বাড়ি ঘুরে, পেছনে পুকুর টুকুর দেখে বেড়াচ্ছে, তখন পঞ্চি পাশের বাড়ি থেকে এসে হাজির। লোকগুলো তো সব ওর পাড়ারই—গাঁদালপাড়া, বাঁশতলার। মেয়েটা চেঁচিয়ে মেচিয়ে বলল, এ বাড়িতে কোনও বাইরের লোক ঢোকেনি, কোনও লোক দু’দিন ধরে আসেও নি। তাই শুনেই ওরা সরে পড়ল।”

”রবিদা, আমি বলেছিলাম কাল সকালে বাচ্চচুকে নিয়ে আমি—” অনুপম উৎকণ্ঠায় উঠে বসল।

”থাক এখন ওসব। তোর নিজের অবস্থার কথা আগে ভাব। দেরি করলে তোর ক্ষতি হতে পারে, ফুটবল—জীবনটাই শেষ হতে পারে, কিন্তু—বাচ্চচুরা তো রইলই। কোন কাজটা তা হলে আগে করা উচিত?” রবিদা শান্ত গলায় কথাগুলো বলে ওর মাথায় হাত রাখল। ”যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন যে ক্ষতি হতে পারে সেটা বন্ধ হোক।”

অনুপম অসহায় বেদনার্ত চোখে সবার দিকে তাকিয়ে অবশেষে চন্দনের মুখের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাল, যেন তার কী করা উচিত সেটাই বলে দিক চন্দন।

কিন্তু চন্দন চোখ নামিয়ে ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে চলে গেল।

”আর দেরি নয়, রাত হয়ে যাবে পৌঁছতে।” দুলাল শীল তাড়া দিল।

”না।”

ঘরের সবাই সচকিতে অনুপমের দিকে তাকাল। ওর গলার স্বরের সঙ্গে একটা অটল ইচ্ছা বেরিয়ে এসেছে যেটা সবারই কানে ধরা পড়েছে।

”আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। আমাকে কথা রাখতে হবে।” অনুপম দাঁড়িয়ে উঠে বলল। এক পায়ে জোর না থাকায় সে টলছে।

”কীসের প্রায়শ্চিত্ত?” বারিন দত্ত অবাক এবং বিব্রত হয়ে অনুপমকে ধরার জন্য হাত বাড়াল।

”আমার ভাড়াটে ভদ্রলোক কাল খেলা দেখতে গিয়ে মারা গেছে। তারই চার বছরের একমাত্র ছেলে বাচ্চচু। অনু বলেছিল ওকে বেহালায় কাল সকালে মামার বাড়িতে নিজে গিয়ে দিয়ে আসবে।” রবিদা মৃদুকণ্ঠে ধীরে ধীরে কথাগুলো বলল।

”একটা বাচ্চচা পিতৃহারা হল কেন, কী জন্য, কার জন্য?” অনুপম সবার মুখের দিকে এক এক করে তাকাল। কোনও মুখ থেকেই সে উত্তর খুঁজে পেল না।

”আমি, এই আমি।” অনুপম নিজের বুকে আঙুল ঠেকাল। তারপর ফিসফিস করে বলল, ”আমার জন্য, আমার জন্য।”

”শুধু তোর জন্য কেন, ফুটবল কি আর একজনের খেলা? গোটা টিমটাই…।”

”না, না দুলোদা, আমি শুধু আমিই দায়ী।” অনুপম উত্তেজিত হয়ে এগোতে গিয়ে টলে উঠল। বারিন দত্ত তাকে জড়িয়ে ধরে না নিলে পড়েই যেত।

”ছ—সাত বছর আগেও আমি একাই টেনে নিয়ে যেতে পারতাম সারথিকে, আজ আর পারি না। … কেন, কেন এমন হল? আমার নিজের কাছে আমার কোনও মর্যাদা নেই, এর থেকে যন্ত্রণাকর আর কিছু কি হতে পারে?… আমাকে খুঁজে দেখতে হবে কেন এমন হল। আমাকে আবার গোড়ায় যেতে হবে যখন আমি ছিলাম অনামা অখ্যাত এক উঠতি প্লেয়ার, সেই সময়ে যেতে হবে যখন আমি খাটতুম বড় হবার স্বপ্ন নিয়ে, যখন আমার মোটিভেশন ছিল।” অনুপমের উত্তেজনা, আবেগ তার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে দেহকেও থরথর কাঁপাচ্ছে। কথাগুলো যে তার অন্তরের গভীর থেকে উঠে আসছে সেটা বুঝতে পারছে সবাই।

”দুলোদা, বারিনদা, মানমর্যাদা চেষ্টা করলে ফিরে পাওয়া যেতে পারে, আমি আবার চেষ্টা করব।”

”তা হলে তাড়াতাড়ি চল।” দুলোদা ঘড়ি দেখল, ”এক্স—রে আজ আর বোধহয় করা যাবে না, কসবায় আমাদের এক মেম্বারের এক্স—রে প্লান্ট আছে, ব্যবসা করে। তাকে গিয়েই ধরব যদি আজই করে দেয়।”

অনুপম মাথা নাড়ল। বারিন দত্ত জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

”বাচ্চচুকে নিয়ে ওর মার কাছে যাব বলেছি—এইখান থেকেই শুরু হবে আমায় গোড়ায় ফিরে যাওয়া। বারিনদা, আগে এক্স—রে নয়, আগে বাচ্চচু—আমার মোটিভেশন।”

”অনু ওকে নিয়ে বেহালায় যেতে যেতে অনেক রাত হয়ে যাবে।” রবিদা বোঝাবার চেষ্টা করল। ”আগে বরং এক্স—রেটা করিয়ে নে। কাল তো আমি দিয়ে আসবই। তুই পরে নয় বেহালায় একদিন গিয়ে—।” তার কথায় কান না দিয়ে, মাথা নাড়তে নাড়তে অনুপমকে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে রবিদা কথা থামিয়ে ফেলল।

ঘরের বাইরে দালানে চন্দন উবু হয়ে বসে পল্টনের মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল আর পল্টন চোখ বুজিয়ে তার লেজ মৃদু মৃদু নাড়ছিল। অনুপমকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে চন্দন উঠে দাঁড়াল।

”রবি জ্যাঠামশাই যে কথাটা বললেন সেটাই কিন্তু করা উচিত—আগের কাজ আগে।” চন্দন মৃদু শান্ত স্বরে অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল।

”কোন কাজটা আগে করার কথা বলছ?” অনুপম থতমত হল আচমকা এমন একটা কথা শুনে।

”একটু আগে যে বললেন আপনার কাজটা করতে হয় বডি দিয়ে! তা হলে এখন আগের কাজ হল, বডিটাকে হান্ড্রেড পারসেন্ট ফিট রাখা, তৈরি রাখা। তা না রাখলে আপনার মধ্যে নেগেটিভ চিন্তা আসবেই। হাঁটুতে জখম থাকলে আপনি কি পুরো ক্ষমতা নিয়ে খেলতে পারবেন?….. মোটিভেশন যতই থাকুক না।”

”তা হলে?” অনুপমকে বাচ্চচাছেলের মতো অসহায় দেখাচ্ছে।

ডা. চ্যাটার্জি অনুপমের পিছনে দাঁড়িয়ে চন্দনের কথাগুলো শুনেছেন। তিনি এবার বললেন, ”তা হলে উচিত এখনি এক্স—রে করা। আর আমার যা মনে হচ্ছে, অপারেশন করতেই হবে, কালকেই। প্রচণ্ড ক্ষতি, তা না হলে কিন্তু হয়ে যাবে।”

অনুপম মুখ নামাল ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য। পায়ের কাছে মুখ তুলে পল্টন বসে। দুজনে চোখাচোখি হতেই পল্টন কানদুটো ঘাড়ের সঙ্গে মিশিয়ে লেজ নেড়ে ছোট করে একটা ”ভ্যাক” করল। অনুপম ঝুঁকে দুহাত বাড়াতেই পল্টন সামনের দুপা তুলে দাঁড়িয়ে উঠল। ওর মাথাটা ধরে পেটের কাছে টেনে এনে হাত বোলাতে বোলাতে অনুপম বলল, ”বাচ্চচুর সঙ্গে দেখা করতে বেহালায় আমি যাব, রবিদা তুমি আমায় নিয়ে যেয়ো। বারিনদা, দুলোদা, সামনের বছরের জন্য যে টাকাটা আমাকে দেবেন সেটা বাচ্চচুর মায়ের হাতে… আচ্ছা পরে এ নিয়ে কথা বলব। চলুন তা হলে।” অনুপম হাত বাড়িয়ে চন্দনের কাঁধ ধরে গাড়ির দিকে এগোল।

সামনের আসনে বারিন দত্ত, পেছনে দুলাল শীলের কোলে পা ছড়িয়ে আধশোয়া অনুপম। অন্য গাড়িতে ডা. চ্যাটার্জি। গাড়ি ছাড়ার সময় দুলাল স্বগতোক্তি করল, ”কী ভয়ঙ্কর যে চব্বিশটা ঘণ্টা কেটে গেল!”

অনুপম চোখ বন্ধ করল। জানলা থেকে রবিদার গলা শোনা গেল, ”তোকে নিয়ে একদিন বেহালায় আমি যাব।”

গাড়ি তেঁতুলতলা থেকে পাকা বাস—রাস্তায় পড়তেই অনুপম দু’হাতে চোখ চেপে ধরল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *