মিনু চিনুর ট্রফি

মিনু চিনুর ট্রফি – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস

।।১।।

কলকাতা থেকে আটাশ মাইল উত্তরে গঙ্গার পশ্চিম তীরে, লঞ্চঘাট থেকে আধমাইল, জি টি রোড থেকে সিকি মাইল আর রেল স্টেশন থেকে এক মাইল দূরের মহাদেবপুর উপনগরীতে প্রায় চার হাজার লোকের বাস। মহাদেবপুর গড়েছে মহাদেব জুট অ্যান্ড টেক্সটাইল মিলস, সংক্ষেপে যাকে বলা হয় এম জে টি এম, তারই প্রতিষ্ঠাতা—মালিক মহাদেবদাস মাধোকিয়া। এই উপনগরীতে আছে দুটো বাজার, ছোট একটা হাসপাতাল, স্কুল, মন্দির, অডিটোরিয়াম, লাইব্রেরি, পাওয়ার হাউস, খেলার মাঠ, ছোটদের পার্ক, অফিসারদের ক্লাব—যেখানে আছে এক বিঘৎ ঘাস গজিয়ে যাওয়া একটা টেনিস কোর্ট, আর দুটি ক্যারম খেলার বোর্ড। মহাদেবপুর মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখানকার অনেক লোকেরই মোটরগাড়ি আছে, দরকার হলে চট করে কলকাতা ঘুরে আসতে পারে।

মহাদেবপুরের পৌরব্যবস্থা এম জে টি এম—এর নিজস্ব। তাদেরই খরচে এবং তদারকিতে এর দেখভাল করা হয়। এজন্য আলাদা একটা বিভাগ আছে এবং তার সর্বোচ্চচ কর্তা হলেন তন্ময় বসুমল্লিক। ইনি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, বলিষ্ঠ, দীর্ঘদেহী, চোখা নাক মুখ। দূরপাল্লার সাঁতারে নাম ছিল এবং অর্থনীতির এম এ। কলকাতা পৌরসভায় বছর চারেক চাকরি করে ভারত স্বাধীন হওয়ার দু’বছর পরই মহাদেবপুরে আসেন।

তন্ময় যেমন হাসিখুশি, সরল, তেমনই গোঁয়ার প্রকৃতিরও। সাবেকি রীতিনীতি মেনে চলতে অভ্যস্ত এমন পরিবারে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা; তিনি উদার মনের মানুষ, বড় চাকরি করলেও মেলামেশায় কোনও বাছবিচার করেন না। তাঁর স্ত্রী তপতী ইলাহাবাদের মেয়ে। বাবা সেখানকার নামী উকিল ছিলেন। বাড়িতে টেনিস কোর্ট ছিল। ভাইদের সঙ্গে বাড়িতে, পরে কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে টেনিস খেলেছেন। চ্যাম্পিয়ানের তিন—চারটে ট্রফিও পেয়েছিলেন। সাইকেল চালিয়ে বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার সময় একটা খ্যাপা ষাঁড়ের শিং থেকে বাঁচার জন্য তপতী রাস্তার পাশের নালায় সবেগে নেমে যাওয়ায় তাঁর ডান পায়ের গোড়ালির হাড় কয়েক টুকরোয় পরিণত হয়। দু’বার অপারেশনের পর পা যৎসামান্য ছোট হয়ে যায় বলে একটু জোরে হাঁটলেই ধরা পড়ে তিনি খোঁড়া।

স্বামী যতটা কালো, তপতী ততটাই ফরসা। ক্লাবে অনেকেই রসিকতা করে ওঁদের ‘পূর্ণিমা—অমাবস্যা’ বলে ডাকে। শুনে ওঁরা দু’জন হাসেন। স্বামীর মতো তপতীও জেদি কিন্তু গোঁয়ার নন। কোনও লক্ষ্য একবার স্থির করে ফেললে যতক্ষণ না তা পূরণ হচ্ছে, হাল ছাড়েন না। গোড়ালি ভাঙার পর বগলে ক্রাচ দিয়ে তাঁকে চলাফেরা করতে হত। বাড়ির সবাই ধরে নেয় আজীবন এইভাবেই তাঁকে চলতে হবে। কিন্তু মনের জোর আর স্বাভাবিকভাবে হাঁটার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা, এই দুইয়ে মিলে তাঁকে এমনই জেদি করে তোলে যে, দিনের পর দিন ব্যায়াম ও মালিশ করে এক বছরের মধ্যেই ক্রাচের ওপর নির্ভরতা থেকে তপতী নিজেকে মুক্ত করে নেন।

এই বসুমল্লিক দম্পতি নিজেরা খেলার চর্চা এক সময় করেছেন, খেলা ভালবাসেন। এঁদের দুই ছেলে, মৃন্ময় আর চিন্ময়। দু’জনেই পড়ে মহাদেবপুরের এম ডি এম স্কুলে, মৃন্ময়ের ক্লাস থ্রি, চিন্ময়ের ক্লাস ওয়ান। আজ ওদের স্কুলের বাৎসরিক স্পোর্টস।

খাওয়ার টেবলে তন্ময় টোস্টে জেলি মাখাতে মাখাতে হাতঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে হাঁক দিলেন, ”মিনু, চিনু, হারি আপ। ঠিক সাতটায় আমাদের পৌঁছতে হবে। কুইক ব্রেকফাস্ট শেষ করো, আর সময় নেই।”

”বাবা, আমি রেডি।” বলতে বলতে শোওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল মিনু। নয় বছর বয়স কিন্তু দেখতে দশ—এগারোর মতো। মায়ের মতো অতটা না হলেও, ফরসা, স্বাস্থ্যবান, চটপটে। সাদা হাফপ্যান্টের মধ্যে গোঁজা সাদা গেঞ্জি, সাদা মোজা, সাদা কেডস। চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। তন্ময় স্নেহভরে বড় ছেলের দিকে তাকালেন, চোখে ফুটে উঠল তারিফ। এক্কেবারে স্পোর্টসম্যানের মতো দেখাচ্ছে!

”বোস।” তিনি তাঁর পাশের চেয়ারটা দেখালেন। টোস্ট প্লেটে রেখে সেটা মৃন্ময়ের সামনে এগিয়ে দিয়ে তন্ময় বললেন, ”আজ কিন্তু একটার বেশি নয়। এর সঙ্গে এক গ্লাস দুধ আর একটা কলা। পেট হালকা থাকলে জোরে দৌড়নো যায়… চিনু কী করছে? চিনু হারি আপ। … দ্যাখো তো দেরি করছে কেন!”

তন্ময় জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন টেবলের উলটো দিকে। তপতী মন দিয়ে সেদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়াচ্ছেন। কথা না বলে তিনি উঠে গেলেন ছেলেদের ঘরে।

বিব্রত মুখে চিনু তাকাল মায়ের দিকে। বাঁ হাতের মুঠোয় পেটের কাছে প্যান্টটা ধরা।

”কী হল?” তপতী ভ্রূ কুঁচকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন। ”প্যান্ট অমন করে ধরে আছিস কেন?”

”বোতাম।” ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়া স্বর চিনুর।

”বোতাম!”

তপতী প্যান্টধরা চিনুর হাতটা টানতেই সেটা হাঁটুর কাছে নেমে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি সেটা ধরে চিনু টেনে তুলল। আধুলি মাপের একটা সাদা বোতামের ভাঙা অংশ প্যান্টে আটকে রয়েছে।

”হাতে আর সময় নেই, ব্রেকফাস্ট করেই বেরোতে হবে, আর এখন কিনা তোর প্যান্টের বোতাম ভাঙা… ইচ্ছে করছে তোকে একটা…।” ডান হাতটা তুলেও তপতী নামিয়ে নিলেন। অসহায় ফ্যালফ্যাল চোখে চিনু তাকিয়ে রয়েছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রং, রুগণ, দুর্বল শরীর। গেঞ্জি পরা না থাকলে ওর কণ্ঠা আর পাঁজরের হাড় দেখা যেত। পা দুটো সরু, দুটো হাতও তাই। তপতীর চোখের রাগ ধীরে ধীরে মায়ায় ভরে এল। স্কুল থেকে বলে দিয়েছে স্পোর্টসে সাদা প্যান্ট গেঞ্জি পরে যেতে হবে। দ্বিতীয় আর সাদা প্যান্ট নেই। চট করে যে লাগিয়ে দেবেন, ওই মাপের তেমন বোতামও ঘরে নেই। কী করা যায় এখন?

”বউদি, বরং একটা সেফটিপিন লাগিয়ে দাও।” ঘরের দরজা থেকে রাতদিনের কাজের লোক বেলা পরামর্শ দিল। হাতের চুড়ি থেকে সেফটিপিন খুলে তপতীর হাতে দিতে দিতে বলল, ”দাদা তাড়া দিচ্ছে, চেঁচামেচি শুরু করবে।”

তপতী আর কথা না বলে হাঁটু গেড়ে বসে কোমরের কাছে প্যান্টটা টেনে ধরে সেফটিপিন লাগিয়ে দিলেন। চিনুর হাত ধরে যখন তিনি খাবার ঘরে এলেন, তন্ময় তখন উৎসাহভরে মিনুকে স্টার্ট নেওয়ার কৌশল দেখানোয় ব্যস্ত। ছোট ছেলের দিকে তাকাবার ফুরসত নেই।

”যখন বলবে অন ইওর মার্ক… গেট… সেট…” তন্ময় ঘরের মেঝেয় হামা দেওয়ার ভঙ্গিতে, একটা পা সামনে, অন্যটা পিছিয়ে। সামনের পায়ের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে দু’হাতের আঙুলে ভর রেখে সামনে ঝুঁকে। ”কান খাড়া করে রাখবি, এটা খুব দরকারি ব্যাপার,… এই কানটা, বুঝলি? পিস্তল ফায়ারের আওয়াজ শোনামাত্রই…।”

”বাবা, আমাদের আন্টি বলেছেন হুইসল বাজানো হবে।”

”অ। একই ব্যাপার, মোটকথা ওই আওয়াজটা শোনার জন্য তুমি কান খাড়া করে রাখবে। যেই হুইসল বাজল অমনই তুমি…”, তন্ময় মোজাইক করা মেঝেয় পায়ে চাপ দিয়ে স্টার্ট নিতে গিয়ে প্রথম পদক্ষেপটিতেই পিছলে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।

তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে প্রথমেই তিনি সবার মুখ দেখে নিলেন। কোনও মুখেই হাসির টান পড়েনি। দেখে স্বস্তি বোধ করে বললেন, ”তা হলে মিনু স্টার্টিং ব্যাপারটা বুঝে গেলে, কেমন। এবার ঝালিয়ে নাও একবার।”

মিনু বাবার দেখানো মতোই মেঝেয় হামা দেওয়ার ভঙ্গিতে শরীরটাকে রেখে কানখাড়া করে রইল।

”কারেক্ট, নাউ… অন ইওর মার্ক… গেট… সেট… ফরররর।” তন্ময় মুখেই হুইসল বাজালেন। মিনু স্টার্ট নিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

”এ কী, পড়ে গেলি কেন?” তন্ময় বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন। ”বারে! তুমি তো এইভাবেই স্টার্ট নিলে।” মিনুর ভ্যাবাচাকা মুখ। গলদটা কোথায় হল বুঝতে পারছে না।

খুকখুক হাসির শব্দে তন্ময় মুখ ফেরালেন স্ত্রীর দিকে। জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে বললেন, ”এতে হাসির কী আছে?”

”তোমার বলে দেওয়া উচিত ছিল পিছলে পড়াটা স্টার্টিং টেকনিকের মধ্যে পড়ে না।” গম্ভীর মুখে কথাটা বলে তিনি ছোট ছেলের চেয়ারটা টেবলের নীচে আর একটু ঠেলে দিলেন। প্যান্টে আঁটা সেফটিপিনটা এখনকার মতো স্বামীর নজরে না পড়াই ভাল।

”গাড়ি বার করছি। তাড়াতাড়ি এসো।” তন্ময় দুটো ওয়াটারবটল টেবল থেকে তুলে বেরিয়ে গেলেন মিনুকে সঙ্গে নিয়ে।

”মা, আমি খাব না, খিদে নেই।” চিনু করুণ স্বরে বলল।

”ওসব বললে হবে না, খেয়ে নাও। বাবা মাখন মাখিয়ে দিয়েছে, একটা অন্তত খাও। কখন ফিরব তার ঠিক নেই, খালি পেটে থাকলে… আচ্ছা দুধটুকু খাও।” দুধের গ্লাস ছেলের মুখে তুলে ধরলেন তপতী। পাঁচন গেলার মতো মুখ করে চিনু গ্লাস শেষ করল।

”মা, আমিও কি ওইভাবে স্টার্ট নেব?”

”যেমন খুশি তেমনি ভাবে স্টার্ট নিবি, এটা ওলিম্পিকস নয়। এবার চল… আমার পেছন পেছন আয়, বাবার নজরে যেন সেফটিপিনটা না পড়ে, তা হলে দক্ষযক্ষ বেধে যাবে।”

”মা, দক্ষযজ্ঞ কী?”

”পরে বলব।”

বাইরে থেকে মোটরের হর্ন শোনা গেল। ওরা দু’জন প্রায় ছুটেই বাংলো থেকে বেরোল। একতলা টালির ছাদের বাড়ি। সামনের দিকে ছোট ফুলের বাগান। রাস্তার দু’পাশে বড় বড় গাছের সারি এবং একই ধরনের বাংলো রাস্তার দু’ধারে। সম—পদমর্যাদার লোকেরা এই রাস্তায় বাস করে। পুরনো ভক্সহল গাড়ির সামনে বসল তন্ময় ও তপতী, পেছনে দুই ছেলে। মোটরগাড়িটা এক সাহেবের কাছ থেকে কেনা।

স্কুলটা মহাদেবপুরের দক্ষিণ প্রান্তে গঙ্গার ধারে। স্কুলের লাগোয়াই, দুটো ফুটবল ম্যাচ একসঙ্গে খেলা যায় এত বড় মাঠ। একধারে শামিয়ানা, চেয়ার, টেবল, ফুলদানি, মাইক্রোফোন, স্তূপ করা প্রাইজসামগ্রী, খাবারের বাক্স ইত্যাদি। শামিয়ানার সামনে অভিভাবকদের জন্য কয়েক সারি চেয়ার। রঙিন কাগজের তৈরি শিকল গোটা বারো বাঁশের খুঁটিতে মালার মতো দুলছে। এক আন্টি অবিরাম ঘোষণা করে চলেছেন মাইকে। অনুষ্ঠান সভাপতি এম জে টি এম—এর জেনারেল ম্যানেজার এবং প্রাইজ হাতে তুলে দেবেন প্রধান অতিথি এক প্রাক্তন ফুটবলার, এঁরা দু’জন আসবেন স্পোর্টস শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে। সারামাঠে উদ্দীপনা, উৎসাহ, কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব।

বসুমল্লিক দম্পতি দুই ছেলে নিয়ে যখন হাজির হলেন তখন স্পোর্টস শুরু হয়ে গেছে। উঁচু ক্লাসের ছেলেদের ইভেন্টগুলো মাঠের অন্যদিকে পুরুষ শিক্ষকদের তদারকিতে চলছে। তাদের আটশো মিটার দৌড় তখন মাঝপথে। মাঠের মাঝে চুনকাম করা খুরি দশ মিটার অন্তর বসানো ট্র্যাক ঘিরে। গাড়ি থেকে নেমেই চিনু ফিসফিস করে মাকে বলল, ”ওইখানে আমাদের দৌড়তে হবে?”

”ওখানে বড় ছেলেদের দৌড় হবে। তুই তো পঞ্চাশ মিটরে দৌড়বি। এদিকে ওই যে লম্বা লম্বা দাগ, ওখানে তোদের দৌড়তে হবে।”

ওঁরা ‘গেস্ট’ লেখা সংরক্ষিত জায়গার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন—তখন সুবেশা, স্থূলকায়া এক মহিলা হাতছানি দিয়ে তপতীকে ডাকলেন। ”মিসেস বসুমল্লিক, আগে ওই টেবলে বসা মিস দাসের কাছে গিয়ে জানিয়ে আসুন আপনার ছেলেরা এসেছে। …ক’টা ইভেন্টে ওরা নামবে?”

”অনেক ইভেন্ট। মিনুর তো রানিং ইভেন্টই তিনটে, তা ছাড়া স্যাক রেস, অঙ্ক রেস, জিলিপি রেস, ব্যালান্স রেস… এক মিনিট মিসেস সেন, এসে বলছি।” তপতী কথা অসমাপ্ত রেখে মিস দাসের টেবলের দিকে ছুটলেন। সেখানে বাবা—মায়েদের ভিড়। সবাই হাজিরা জানাবার জন্য ব্যস্ত।

”প্রতীক ঘোষ, ক্লাস ফোর, সেকশন ‘এ’।”

”বিশ্বনাথ জানা, ক্লাস ফোর, সেকশন ‘এ’।”

”কিংশুক চ্যাটার্জি…”

”সুভাষ দত্ত…”

মিনিটপাঁচেক পর তপতী সুযোগ পেলেন। নাম, ক্লাস, সেকশন শুনে মিস দাস খাতা দেখে বললেন, ”মৃন্ময় তো সাতটা ইভেন্টে নাম দিয়েছে আর চিন্ময় চারটেতে। সবক’টাতেই ওরা নামবে তো?”

”নিশ্চয়।”

”পঁচাত্তর মিটার এখনই শুরু হবে। মৃন্ময়কে রেডি রাখুন। নাম অ্যানাউন্স করলেই স্টার্টিং লাইনে পৌঁছে দেবেন। তারপরই আছে চিন্ময়ের পঞ্চাশ মিটার।”

তপতী ফিরে এসে দেখলেন চিনু একা দাঁড়িয়ে।

”বাবা, দাদা কোথায়?”

”ওইদিকে।” আঙুল দিয়ে চিনু দেখাল ভিড়ের শেষে মাঠের একটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে তন্ময়ের নির্দেশে মৃন্ময় গা—ছাড়ানোর ব্যায়াম করছে।

”মা, আমিও কি এখন দাদার মতো করব?”

”না। অত করার তোর দরকার নেই।”

”মা, আমার কেমন ঘুমঘুম পাচ্ছে। আমার ইচ্ছে করছে না দৌড়তে।”

”ঘুম পাচ্ছে বললে কি এখন চলে? ওই শোন দাদার নাম অ্যানাউন্স হল। দৌড়ে গিয়ে ওদের ডেকে আন।”

ডাকতে আর হল না। তন্ময় আর মিনুকে এগিয়ে যেতে দেখা গেল স্টার্টিং লাইনে হাতে কাগজ—কলম আর মাথায় সাদা কাপড়ের ক্যাপ পরা ব্যস্তসমস্ত এক আন্টির দিকে।

মিনু পঁচাত্তর মিটার দৌড়ে শুধু প্রথমই হল না, দ্বিতীয় জনকে প্রায় পনেরো মিটার পেছনে রেখে দিল। দর্শকদের সবার চোখে তারিফ আর মুগ্ধতা। দৌড় শেষ করেই মিনু ছুটে এসে ফিনিশিং লাইনের ধারে দাঁড়ানো মাকে জড়িয়ে ধরল। ছেলের মুখ চুম্বনে ভরিয়ে তপতী তাকালেন স্বামীর দিকে। মিনু কোমর জড়িয়ে ধরেছে বাবার। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তন্ময়ের মুখে গভীর তৃপ্তির সঙ্গে ফুটে উঠল অহঙ্কার।

”যেভাবে স্টার্ট নেওয়াটা শিখিয়েছিলাম তাতে ফার্স্ট না হয়ে কোনও উপায় নেই। টেকনিক… ইটস টেকনিক, বুঝলে!”

”তার মানে, তোমার স্টার্টিং টেকনিকের জন্যই মিনু ফার্স্ট হল, ওর নিজের কোনও কৃতিত্ব এতে নেই?”

থতমত হয়ে তন্ময় বললেন, ”না, না, সে কী কথা! অবশ্যই মিনু নিজের ক্ষমতায় প্রথম হয়েছে।”

”তুমি শুধু মিনুকেই টেকনিক শিখিয়েছ, চিনুকে কিন্তু কিছুই শেখাওনি।”

”ওকে আর কী শেখাব, একদমই বাচ্চচা, তা ছাড়া খুবই দুবলা, ভেরি, ভেরি উইক।”

তপতী চুপ করে রইলেন। কথাটা খুবই সত্যি। তাঁর ছোট ছেলে খুবই দুবলা। ক্লাস ওয়ানের পঞ্চাশ মিটার দৌড়ের জন্য যখন নাম ডাকা হল, তপতী তখন চিনুকে স্টার্টিং লাইনে পৌঁছে দেওয়ার সময় বললেন, ”তুমি যেমন পারো তেমনই দৌড়িও, কেমন? এটা ওলিম্পিকস নয় যে, গোল্ড মেডেল পেতেই হবে। মজা মনে করো এই দৌড়টাকে। তোমাকে ফার্স্ট হতে হবে না।”

চিনু কথাগুলোর কী অর্থ করল কে জানে, তবে ঘাড় নাড়ল। স্টার্টিং লাইনে সব প্রতিযোগীই বাচ্চচা ছেলে, তার মধ্যে চিনুকে তার রুগণতার জন্য আরও বাচ্চচা দেখাচ্ছে। লাইনে দাঁড়িয়ে সে অসহায়ের মতো বারবার তাকাল মার দিকে। তপতী হাত নাড়লেন।

শুরুর হুইসল বেজে উঠতেই হইহই করে উঠল দর্শকরা, যার অধিকাংশই বাবা—মা। উৎসাহভরে অনেকেই প্রতিযোগীদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে লাগলেন দূরত্ব রেখে। দৌড় শুরু হতেই চিনু দশ মিটার মতো গিয়েই পেটের কাছে প্যান্টটা ধরে দাঁড়িয়ে মার দিকে তাকাল। তপতী হাত নেড়ে ওকে ছুটতে ইশারা করলেন।

”চিনু, দাঁড়িয়ে থেকো না, দৌড়ও।”

প্যান্ট মুঠোয় ধরে চিনু দৌড় শুরু করল আবার এবং সমাপ্ত করল হাঁসফাঁস করতে করতে সবার শেষে পৌঁছে। সফল প্রতিযোগীদের মায়েরা ছুটে গেল ছেলেদের কাছে, তাদের জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল। চিনু দৌড় শেষ করে মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তপতী পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে ঝুঁকে কপালে চুমু দিয়ে বললেন, ”তুমি ফিনিশ করেছ, এতে আমি খুব খুশি হয়েছি।”

কাঁধের কাছে জামায় চোখ মুছে চিনু হাসল। ”সেফটিপিনটা খুলে গেল।”

তন্ময় এগিয়ে এসে বললেন, ”তুই ওভাবে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?” তারপরই প্যান্টে আঁটা সেফটিপিনটার দিকে তাঁর নজর পড়ল। ”এ কী, প্যান্টে ওটা কী?”

”দোষটা আমারই। লন্ড্রি থেকে কেচে আসার পর লক্ষ করিনি বোতামটা ভেঙে গেছে। বেরোবার তাড়ায় আর সময় পাইনি নতুন বোতাম লাগাবার, তাই—।” তপতী অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন। তারপরই গলায় উচ্ছ্বাস এল, ”কিন্তু চিনু রেসটা কেমন শেষ করল বলো।”

”ইয়েস, ইয়েস,” চিনুর পিঠে হালকা চাপড় দিলেন তন্ময়। ”শেষ পর্যন্ত দৌড়েছে, রণে ভঙ্গ দেয়নি। এটাই তো চাই। মিনু তোর নেক্সট ইভেন্টের কল দিচ্ছে। এর পর চিনুর কী আছে?”

”বোধ হয় জিলিপি রেস।”

”মিনু চল, এটাতেও কিন্তু ফার্স্ট হতে হবে।”

ওরা দু’জন চলে যেতেই চিনু মায়ের কোমর জড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, ”আমি আর নামব না… আমার ভাল লাগছে না।”

”সে কী! জিলিপি রেস কী মজার, তা জানিস? দড়িতে জিলিপি ঝুলিয়ে দেবে, দৌড়ে গিয়ে লাফ দিয়ে দিয়ে কামড়ে ছিঁড়ে নিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে।”

”না মা, আমার ভাল লাগছে না। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।” চিনু অনুনয় করল। তপতী ছেলের কপালে হাত রেখে ভ্রূ কোঁচকালেন।

”তোর গা তো বেশ গরম। জ্বর হয়েছে বোধ হয়। থাক তা হলে, আর দৌড়োদৌড়ি করতে হবে না। আয় বসি।”

চিনুকে কোলে নিয়ে তপতী বসলেন একটা চেয়ারে। পেছন থেকে ঝুঁকে মিসেস সেন বললেন, ”আপনার বড় ছেলেটি খুব ভাল দৌড়েছে।”

মুখ ফিরিয়ে তপতী হাসলেন শুধু।

”মনে হয় সব ক’টাতেই ও ফার্স্ট হবে।”

তপতী আবার হাসলেন।

”আপনার ছোট ছেলের তখন হল কী, দাঁড়িয়ে পড়ল কেন?”

”প্যান্ট খুলে পড়ছিল। বোতামটা ভেঙে গেছে।”

”অ অ। আমি ভাবলুম ঘাবড়ে গিয়ে… ওর সঙ্গে যারা দৌড়চ্ছিল তাদের স্বাস্থ্য তো খুবই ভাল।”

তপতীর মাথা গরম হয়ে উঠল কথাটা শুনে। ভাল স্বাস্থ্য দেখে চিনু ভয় পেয়ে গেছল, এমন একটা ধারণা হল কী করে এই মহিলার! চিনু মায়ের বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে জড়িয়ে ধরে রয়েছে। তপতী ওর মাথায় গালে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”বাড়ি যাবি?” চিনু মাথা নাড়ল।

ছেলেকে নিয়ে তপতী উঠলেন। তন্ময়কে খুঁজে বার করে বললেন, ”চিনুকে বাড়ি নিয়ে যাব, পৌঁছে দাও। জ্বর জ্বর লাগছে। আমার মনে হয় এখন ওর শুয়ে থাকা দরকার।”

”আমি এখন যাব কী করে, এই শুরু হতে যাচ্ছে মিনুর ফিফটি মিটারটা। বরং তুমিই গাড়ি নিয়ে চলে যাও, আমরা রায়চৌধুরীর গাড়িতে চলে যাব।” তন্ময় গাড়ির চাবি তপতীর হাতে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে চলে গেলেন।

তপতী গাড়ি চালান, তবে মহাদেবপুরের মধ্যেই। কলকাতা বা অন্য কোথাও যেতে হলে তিনি স্টিয়ারিং ধরেন না। জি টি রোডের ট্রাফিককে তিনি ভয় পান। বাড়ি যাওয়ার পথেই ডাক্তার সিনহার কোয়ার্টার। তপতীর মনে হল চিনুকে একবার ওঁকে দিয়ে দেখিয়ে নেওয়া ভাল।

ডাক্তার কোয়ার্টারে নেই, কলকাতায় গেছেন সপরিবারে। তপতী ফিরে এসে চিনুকে শুইয়ে দিলেন। থার্মোমিটারে তাপ মাপলেন, প্রায় একশো ডিগ্রি। ছেলেকে জড়িয়ে তিনিও শুয়ে পড়লেন।

রীতিমতো হইহই করে তন্ময় ও মৃন্ময় বাড়িতে ঢুকল।

”হিপ হিপ হুররে…থ্রি চিয়ার্স ফর মৃন্ময় বসুমল্লিক… হিপ হিপ… হুররে।” তন্ময় বাড়ি কাঁপিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। তপতী প্রায় ছুটেই বসবার ঘরে এলেন। বাবা আর ছেলের হাত ভর্তি কাপ, মোট সাতটা। তার সঙ্গে একটা বাক্সে রুপোর মেডেল, চ্যাম্পিয়ানের পুরস্কার। এ ছাড়াও একটা তোয়ালে, একটা কিট ব্যাগ, একটা ওয়াটার বটল আর সার্টিফিকেটগুলো।

”ওমমা, মিনু তো বিপদে ফেলে দিল! এত কাপ এখন আমি রাখি কোথায়?”

তপতী ছেলেকে কাছে টেনে নিলেন। মিনুর মুখ লাজুক হয়ে উঠল।

”এই তো সবে শুরু।” কাপগুলো টেবলে সাজিয়ে রাখতে রাখতে তন্ময় বললেন। ”এবার থেকে বছর বছর গণ্ডায় গণ্ডায় কাপ—মেডেল আসবে। এগুলো এখন এখানেই থাক, লোকে দেখুক।”

দাদা, একটা কাচের আলমারি তৈরি করিয়ে তাতে সাজিয়ে রাখুন।” পরামর্শটা দিল বেলা।

”সেটা আমিও ভেবেছি। আসার সময় রায়চৌধুরীর বউ তো আজ রাতে মিনুকে নেমন্তন্ন করেছে। পায়েস খাওয়াবে। চিনুকেও পাঠিয়ে দিতে বলেছে।”

”চিনু যেতে পারবে না, জ্বর প্রায় একশো।” তপতী জানালেন।

”ডাক্তার দেখাতে হয় তা হলে।” তন্ময় ব্যস্ত পায়ে ছেলেদের ঘরের দিকে চলে গেলেন। ঘুমন্ত চিনুর কপালে হাত দিয়ে চিন্তিত মুখে বললেন, ”সিনহাকে কি একবার ডাকব?”

”ওঁরা সব কলকাতায় গেছেন। তুমি বরং কলকাতায় ফোন করে অপূর্ববাবুর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করো। চাইল্ড স্পেশালিস্ট দেখানোই ভাল।”

”হ্যাঁ দাদা, কলকাতার ডাক্তারই দেখান। চিনুর প্রায়ই জ্বর হয়, রাতে খুকখুক করে কাশেও।” বেলা এসব জানে, কেননা রাতে সে ছেলেদের ঘরের মেঝেয় শোয়।

রায়চৌধুরীরা, শুভা এবং রাজেন, বছরখানেক রয়েছে মহাদেবপুরে। মাসছয়েক মাত্র ওদের বিয়ে হয়েছে। ধনী পরিবারের সন্তান। রাজেন টেক্সটাইল এঞ্জিনিয়ার। মা আর বাবা মাঝে মাঝে এসে ছেলের কাছে থাকেন। রাজেন সাউথ ক্লাবে টেনিস খেলত, ক্যালকাটা হার্ডকোর্ট চ্যাম্পিয়ানশিপে দু’বার সেমিফাইনালে উঠে প্রেমজিত লাল নামে জুনিয়ার ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ানের কাছে হেরে গেছল। বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ানশিপের কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে যায় আর এক তরুণ জয়দীপ মুখার্জির কাছে। অতঃপর রাজেন বুঝে যায় টেনিসে বড় খেলোয়াড় হওয়ার মতো প্রতিভা তার নেই, অতএব পড়াশুনোয় মন দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। টেনিস ছেড়ে দিলেও রাজেন ক্লাব ছাড়েনি। ছুটির দিনে মোটরে সে কলকাতায় যায় শুভাকে নিয়ে। এলগিন রোডে তাকে বাপের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে চলে যায় কাছেই সাউথ ক্লাবে। অল্প খেলা, আড্ডা বেশি এবং পরদিন সকাল ছ’টার মধ্যেই মহাদেবপুরে ফিরে কাজে লেগে যাওয়া। এইভাবেই তারা কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে যাচ্ছে।

আজ তারা কলকাতায় যায়নি স্কুলের স্পোর্টস দেখবে বলে। রাজেনের মা পায়েস রেঁধেছেন। বেলার সঙ্গে রাতে মিনু গেল পায়েস খেতে। অবশ্য পায়েসের সঙ্গে লুচি—বেগুনভাজাও ছিল। মিনুকে পৌঁছে দিয়ে বেলা ফিরল একটা বড় বাটি ভর্তি পায়েস নিয়ে।

”শুভাদির শাশুড়ি দিলেন।” খাওয়ার টেবলে বাটিটা রেখে বেলা জানিয়ে দিল।

”কার জন্য দিলেন?” তন্ময় প্রশ্নটা করেই চামচেতে খানিকটা পায়েস তুলে মুখে দিল। ”নলেন গুড় আর গোবিন্দভোগ চাল, ফাস ক্লাস,… কত দিন যে টেস্ট করিনি এই গন্ধটা!”

”কার জন্য আবার, সবার জন্যই দিয়েছেন।” তপতী সতর্ক গলায় বললেন। ‘ফাস ক্লাস’ শব্দ দুটির আড়ালে কী ইচ্ছা উঁকি দিচ্ছে সেটা অনুমান করতে তাঁর অসুবিধে হয়নি।

”এইটুকু জিনিস কী করে সবাইকে দেবে তুমি!” তন্ময় যেন একটু বেশি রকম অবাক হলেন, ”তার থেকে বরং…” কথা শেষ হওয়ার আগেই তপতী হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বেলাকে বললেন, ”দাদা আজ রাতে কষ্ট করে ওইটুকু পায়েস খেয়েই থাকবেন, ওঁর খাবারটা তুলে রাখো। … মিনুকে ওদের বাড়ি থেকে কখন আনতে যাবে?”

”আনতে যেতে হবে না। শুভাদির শ্বশুর বললেন, পৌঁছে দেবেন। মিনু তো ওনার সঙ্গে দাবা খেলতে বসে গেছে।”

”দাবা?” স্বামী—স্ত্রী প্রায় একসঙ্গেই অবাক প্রশ্ন তুললেন।

”মিনু দাবা খেলতে পারে?” তন্ময় স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন।

তপতী বললেন, ”আমি তো জানি না! কোনও দিন তো খেলতে দেখিনি!”

বিস্মিত তন্ময় চেয়ারে বসে পায়েসের বাটিটা টেনে নিয়ে একবার স্ত্রীর দিকে তাকালেন, ”একটু চেখে দেখবে নাকি?”

”কালই আমি নলেনগুড় আর গোবিন্দভোগ চাল আনিয়ে পায়েস করে একা সব খাব।” তপতী ঘরে চলে গেলেন, ঝাঁঝালো স্বরে কথাগুলো বলে। থার্মোমিটারে চিনুর তাপ দেখলেন। একই রকম রয়েছে।

”মা আমি কি পায়েস খাব?” দুর্বল স্বরে চিনু বলল।

”খাবে, তবে আজ নয়। আগে সেরে ওঠো।”

”যদি ডাক্তারবাবু বারণ করেন?”

”তা হলে খাবে না।” কথাটা বলে তপতী কষ্ট পেলেন। পায়েস খাওয়ার ইচ্ছা কার না হয়। কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য, বিশেষ করে সন্তানের মঙ্গলের জন্য তিনি কঠোর হতে দ্বিধা করবেন না।

”যতদিন না ডাক্তারবাবু তোমায় পায়েস খেতে দিচ্ছেন ততদিন আমিও পায়েস খাব না!”

”কেন তুমি খাবে না?”

”খাব না এই জন্যই, আমার ছোট্ট চিনু পায়েস খেতে না পেয়ে কষ্ট পাচ্ছে, আমিও সেই কষ্টের ভাগ নেব। তা হলে চিনুর কষ্টটা অনেক কমে যাবে। তাই না?”

তপতীর মনে হল চিনুর জ্বরক্লিষ্ট মুখে হালকা একটা হাসি ফুটে উঠল। ”যাঃ, তুমি বাজে কথা বলছ। এইভাবে কি কষ্ট কমে? তোমার যখন পা ভেঙেছিল তখন তো তুমি বিছানায় শুয়ে থাকতে, তোমার মাও কি বিছানায় শুয়ে থাকত তোমার কষ্টের ভাগ নিতে?”

”সবার কষ্ট কি একরকমের হয়? তুমি ছোট, তোমার কষ্ট একরকমের, যখন আমার পা ভাঙে তখন তো আমি যথেষ্ট বড়, তাই আলাদা রকমের কষ্ট হত।”

”কী কষ্ট হত তোমার?”

তপতী একটুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ”খুব ভোরবেলায় উঠে বাগানে গিয়ে দেখতুম ফুলের নতুন কোনও কুঁড়ি ফুটেছে কি না, খালি পায়ে ভিজে ঘাসের ওপর হাঁটতুম, আমায় দেখলে টমি ছুটে এসে আমাকে ঘুরে ঘুরে লাফালাফি করত আর ল্যাজ নাড়ত, আমি তখন ছুটতুম, টমিও ছুটত… বিকেলে টেনিস খেলতুম দাদার সঙ্গে, বাবা তাড়াতাড়ি কোর্ট থেকে ফিরলে আমাদের সঙ্গে খেলতেন। এইসব কিছুই করতে না পারার জন্য কষ্ট হত।”

”মা, আমি টেনিস খেলব তোমার সঙ্গে। তোমার তো একটা র‌্যাকেট আলমারিতে তোলা আছে, আমি দেখেছি। ওটা দেবে আমায়?”

”নিয়ে কী করবি?”

”বাইরে বাগানে গিয়ে দেয়ালে বল মেরে মেরে খেলব। আমাকে একটা টেনিস বল কিনে দেবে?”

”দেব। এখন আর কথা নয় চিনু, এবার ঘুমো।”

”দাদাকে একটা র‌্যাকেট কিনে দিও, তা হলে দু’জনে খেলব।”

”কিনে দোব… এবার ঘুমো।”

”আমাদের এখানে টেনিস খেলার মতো জায়গা নেই, সেই ক্লাবে গিয়ে খেলতে হয়। এখানে একটা কোর্ট থাকলে খুব ভাল হত, তাই না?”

”হ্যাঁ, ভাল হত।”

”কপালে হাত দিয়ে দেখো, এখন আমার জ্বর নেই।” চিনু মায়ের হাতটা তুলে নিয়ে নিজের কপালে রাখল। তপতীর মনে হল, সত্যিই যেন জ্বরটা কম।”

”রাতে তোর কাশি হয়?”

”হ্যাঁ।”

”একদম ঠাণ্ডা লাগাবি না। এবার থেকে সবসময় সোয়েটার পরে থাকবি।”

ঘরের দরজা থেকে বেলা বলল, ”বউদি, দাদার খাবার কি তুলে রাখব, উনি তো পায়েস খাননি।”

তপতী তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে খাওয়ার ঘরে এসে দেখলেন বাটিতে পায়েস যেমন ছিল তেমনই রয়েছে। তন্ময় বসার ঘরে বড় সোফায় টানটান শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। তপতী বাটিটা থেকে একটা প্লেটে অর্ধেক পায়েস ঢেলে নিয়ে বেলাকে বললেন,”এটা দাদাকে দিয়ে এসো। আর বোলো কাল পায়েস করব সবার জন্য।”

বেলা ফিরে আসতেই তপতী বললেন, ”এই পায়েসটা তুমি খেয়ে নিয়ো।”

”সে কী বউদি, তুমি খাবে না!”

”না। চিনু ভাল হোক, ওর সঙ্গে খাব।”

এই সময়ই ধুপধাপ পায়ের শব্দ করে মিনু ফিরল, তার সঙ্গে রাজেনের বাবা ব্রজেন রায়চৌধুরী। বয়স প্রায় সত্তর। তামাটে রং, লম্বায় ছয়—দুই, ওজন একশো সত্তর পাউন্ড, মাথাভর্তি ধবধবে ব্যাকব্রাশ করা চুল। চোখে পড়ার মতো হল ওর গোঁফ। খুবই পুষ্ট এবং গোরুর শিঙের মতো ডগা দুটো ওপর দিকে তোলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি মেজর ছিলেন সেনাবাহিনীতে, স্বাধীনতার পর মিলিটারি ছেড়ে এক বিলিতি সওদাগরি অফিসে যোগ দেন। বছর তিনেক আগে বিভাগীয় ম্যানেজারের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। হাতের অফুরন্ত সময় কীভাবে কাটাবেন, ধর্মচর্চায় না গ্রামের বাড়িতে পোলট্রি করে, এই ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে অবশেষে দাবায় মন দেন। এখন তাতেই ডুবে আছেন।

পায়েসের নেমন্তন্ন রাখতে গিয়ে মিনুর চোখ পড়ে বসার ঘরের টেবলে রাখা দাবার ছকের ওপর। কৌতূহলী হয়ে সে ঘুঁটিগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে। ব্রজেন ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে সিগার খেতে খেতে তিনবার পড়া আগাথা ক্রিস্টির একটা গোয়েন্দা—বই পড়ছিলেন সময় কাটাবার জন্য আর কিছু না পেয়ে। হঠাৎই তাঁর চোখ পড়ল মিনুর ওপর। তাঁর মনে হল এই বাচ্চচা ছেলেটি দাবায় আগ্রহী। একে যদি খেলাটা শিখিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে সারাদিনে গোটা চল্লিশ হাই তোলা থেকে বোধ হয় রেহাই পাওয়া যেতে পারে।

”দাবা খেলবে?”

”হ্যাঁ।”

”খেলেছ কখনও?”

”না, তবে খেলতে দেখেছি।”

মিনুর সপ্রতিভ উত্তর ব্রজেনের ভাল লাগল। তিনি টেবলে উঠে গিয়ে সাদা ঘুঁটিগুলো ছকে সাজিয়ে বললেন, ”এবার তুমি কালো ঘুঁটিগুলো সাজিয়ে দিতে পারবে?”

মিনু সাজানো সাদা ঘুঁটি দেখে দেখে সাজিয়ে দিল কালো ঘুঁটি এবং বেশ দ্রুতই।

”ঘুঁটিগুলোর নাম জানো?”

”হ্যাঁ। এটা গজ, এটা ঘোড়া, এটা নৌকো, এটা রাজা।”

”কোনটের চাল কীরকম তা জানো?”

”জানি।”

”ঘোড়ার চাল দেখাও তো।”

মিনু আড়াই চাল দেখাল। ব্রজেন অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,”তুমি শিখলে কার কাছে? বাড়িতে কেউ খেলে না কি?”

”স্কুলে দু’জন সার টিফিনের সময় টিচার্স রুমে খেলেন। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি।” মিনুর দাঁত ঝলসে উঠল হাসিতে। ”দেখতে, দেখতে খানিকটা শিখে গেছি।”

”দেখি তো কেমন তুমি শিখেছ!” ব্রজেন উদ্দীপিত হয়ে উঠলেন। যদি একটা খেলার সঙ্গী জোটে। ”তোমার সাদা ঘুঁটি, আমার কালো। নাও চাল দাও।”

মিনু রাজার সামনের বোড়ে দু’ঘর এগিয়ে দিল। ব্রজেন তার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে প্রথম চাল দিলেন। দশ—বারো চাল খেলার পর তাঁর মনে হল, ছেলেমানুষি বুদ্ধিতে খেললেও এই বাচ্চচা ছেলেটিকে এক মাসের মধ্যে চলনসই প্রতিপক্ষ হওয়ার মতো করে গড়ে তুলতে পারবেন। মিনু তার প্রথম খেলায় হারল পনেরো চালে।

”ঘুঁটি সাজাও, এবার আমার সাদা।” ব্রজেন উত্তেজনা বোধ করছেন। নিভে যাওয়া সিগারটা ধরালেন।

”দাবা এখন থাক।” ব্রজেনের স্ত্রী তাড়া দিলেন। ”খেয়ে নিয়ে বরং আবার বোসো, লুচি ভাজতে শুরু করেছে বউমা।”

খাওয়ার সময় ব্রজেন মিনুর পিঠে হাত রেখে শুভাকে বললেন,”মিনু যে এত তাড়াতাড়ি খেলাটা ধরে ফেলবে, ভাবতেই পারিনি। আমার একটা সমস্যা মিটে গেল বউমা।”

”মিনু আজ কত প্রাইজ পেয়েছে যদি দেখতেন! আপনার ছেলে বলছিল, ও ন্যাচারাল অ্যাথলিট, যে খেলা ধরবে তাতেই ওপরে উঠবে। হবে নাই—বা কেন, বাবা—মা দু’জনেই অল্পবিস্তর স্পোর্টসের মধ্যে ছিল, বাবা সাঁতারে, মা টেনিসে। পরিবারের আবহাওয়াও তো অনেক সাহায্য করে ছেলেমেয়েদের।”

”তোমার এক ভাইকে দেখেছি, কী যেন নাম?” ব্রজেন জানতে চাইলেন মিনুর দিকে তাকিয়ে।

”চিন্ময়, চিনু। … কাকিমা, আমি আর একটা বেগুনভাজা খাব।”

ব্রজেন তারিফ ভরা স্বরে বললেন, ”মিনু তো দেখছি ভাল খাইয়েও। বউমা, একটা নয়, দুটো বেগুনভাজা আর লুচি, চলবে তো?” মিনু সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল। ”চিনু আজ ক’টা প্রাইজ পেল?” ব্রজেন প্রশ্ন করলেন মিনুকে।

”একটাও নয়। জ্বর এসে গেল, একটায় নেমে আর নামেনি।”

শুভা বলল, ”বড় রুগণ ছেলেটা, খেলাধুলো ওর দ্বারা হবে না।”

খাওয়ার পর ওরা দু’জন আবার খেলতে বসল। মিনু প্রতিপক্ষের ঘুঁটির দিকে হুঁশ না রেখে চাল দিলেই ব্রজেন প্রত্যেকবারই তার ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন।

”তুমি যে মন্ত্রীটা ওইখানে দিলে কিন্তু লক্ষ করলে না আমার গজ ওই কোণ থেকে এসে একে মেরে দেবে। নাও, চাল ফিরিয়ে নতুন চাল দাও। … আমি কিন্তু আর চাল ফেরত দেব না বলে রাখলাম।”

মিনু একবার ঘোড়া দিয়ে একটা বোড়েকে খেতেই ঘোড়ার খালি করে দেওয়া ঘরে ব্রজেন তাঁর মন্ত্রীকে তুলে মিনুর রাজাকে কিস্তি দিলেন। ”আমি ইচ্ছে করেই বোড়েটাকে তোমার ঘোড়ার মুখে ফেলে দিয়েছিলাম, দেখি তুমি টোপ গেলো কি না। তুমি গিলে ফেললে আর আমারও কিস্তি দেওয়ার রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেল। … ভাবো, সময় নিয়ে প্রত্যেকটা চাল দেওয়ার আগে ভাবো। সবদিক বিবেচনা করো। একদম তাড়াহুড়ো করবে না।”

হেরে গিয়ে মিনুর মুখ প্রায় লাল হয়ে উঠল। চোখে হেরে যাওয়ার লজ্জা, সেটা লক্ষ করে ব্রজেন বললেন, ”খেলা শিখেই কেউ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ান বটভিনিকের মতো খেলতে পারে না। তুমি এখন বারবার আমার কাছে হারবে, তারপর এমন একটা সময় আসবে যখন তুমিই আমায় বারবার হারাবে। হারা আর হারানো এই দুইয়ের মাঝে শুধু প্র্যাকটিস আর প্র্যাকটিস।”

”আর এক হাত খেলব।” মিনু চোখ নামিয়ে বলল।

”আর নয় আর নয়, রাত হয়ে গেছে।” শুভা তাড়া দিল। ”মিনু, বাড়ির সবাই ভাববে, এবার বাড়ি যাও।”

”খেলুক না বউমা।”

”না বাবা, দশটা বাজে। ওইটুকু ছেলের এখন শুয়ে পড়ার কথা।”

”ঠিক আছে, তা হলে কাল আবার আমরা বসব, কেমন? এবার চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”

।।২।।

তন্ময়ের বন্ধু অপূর্ব হালদারের চেম্বার ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে ধর্মতলা স্ট্রীটে। লন্ডন থেকে ডিগ্রি পাওয়া শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, তন্ময়ের স্কুলের সহপাঠী। চিনুকে দেখাবার জন্য তারিখ ও সময় ঠিক করতে তন্ময় ফোন করেছিল অপূর্বকে। ”তোর ছেলেকে দেখাবার জন্য আবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগবে নাকি! যেদিন খুশি, রবিবার বাদে সন্ধে ছ’টা থেকে আটটার মধ্যে চলে আয় চেম্বারে।” তন্ময় এই উত্তর পেয়েছিল।

”তা হলে আর দেরি করে লাভ নেই, কালই চলো।” উদ্বিগ্ন স্বরে বলেছিল তপতী। ”জ্বরটা রয়েই গেছে। বাড়ছে কমছে, সঙ্গে কাশিটাও, ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না।”

সুতরাং পরদিন যাওয়াই ঠিক হল। বিকেল পাঁচটা নাগাদ তারা মহাদেবপুর থেকে রওনা হয়। মিনুকে নিয়ে সামান্য ঝামেলা হল রওনা হওয়ার আগে। সাড়ে তিনটের সময় স্কুল থেকে ফিরেই সে বাড়ির কাছে একটা ছোট মাঠে ফুটবল খেলতে যেত। এখন আর যায় না। এখন যায় ব্রজেনদাদুর সঙ্গে দাবা খেলতে। দাবা তাকে রীতিমতো আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বল খেলার বদলে রোজ সে ঘণ্টা তিনেক বসে থাকে দাবার ছকের সামনে, একটা বুড়োমানুষের মতো।

সেদিন যথারীতি সে দাবার ছকের দিকে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিন্তায় মগ্ন। এমন সময় বেলা গিয়ে তাকে ডাকল। ”মিনু শিগগির এসো, ওরা সবাই রেডি হয়ে গেছে, তুমি গেলেই গাড়িতে উঠবে।”

মিনু তখন তার ঘোড়াকে বাঁচাবার জন্য কোথায় সরাবে ভেবে পাচ্ছে না। বেলার কথা শুনে রেগে উঠে সে বলল, ”আমি যাব না যাও। চিনুকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে তো আমি গিয়ে কী করব? এখন ভাগো।”

বেলা ফিরে এসে তন্ময় ও তপতীকে শুনিয়ে দিল মিনুর কথাগুলো। তন্ময় প্রায় লাফিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে তপতী বললেন, ”তোমায় যেতে হবে না, আমি যাচ্ছি।” তপতী দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।

”মিনু, বাবা অপেক্ষা করছেন।” তপতী কথাটা বলে ব্রজেনবাবুর দিকে তাকালেন, ”আমরা কলকাতা যাব, মিনুও সঙ্গে যাবে। আজ আর ও খেলবে না।”

”তোমরা যাও না…” আবদেরে নাকি সুরে মিনু বলতে শুরু করেছিল।

”মিননু।” কঠিন চাপা স্বরে তপতী তাকে থামিয়ে দিলেন, ”উঠে এসো।”

মায়ের চোখে ধকধকে আগুন দেখে মিনু উঠে পড়ল।

”মায়ের কথা শুনতে হয়। খেলা আজকের মতো অ্যাডজোর্নড রইল।” মিনুর পিঠে হাত রেখে স্নেহভরে ব্রজেনবাবু বললেন, ”ছকে ঘুঁটিগুলো যেমন আছে ঠিক তেমনই থাকবে। কাল আবার শুরু হবে, আমি প্রথমে চাল দেব, কেমন? এখন যাও। বাবা—মার অবাধ্য হতে নেই।”

তারা অপূর্ব হালদারের চেম্বারে পৌঁছল সওয়া ছ’টায়। বসার ঘর ভর্তি রোগী আর সঙ্গের লোক। তন্ময় ছাপা স্লিপে নাম লিখে পাঠাল। ডাক্তারকে দেখিয়ে একজন বেরিয়ে আসতেই তাদের ডাক পড়ল। অপূর্ব ছোটখাটো গোলগাল চেহারার মানুষ, চোখে চশমা, মুখে সবসময় হাসি। অনেকদিন পর দেখা হলে যেরকম কথাবার্তা হয় তাদের মধ্যে, তাই হল। বাইরে রোগীরা অপেক্ষা করছে, তাই ডাক্তার কথা বদল করে চিনুর দিকে নজর দিলেন। চোখ, জিভ, বুক, শ্বাস—প্রশ্বাস, গলার ভেতর, পেট ইত্যাদি শরীরের সাধারণ পরীক্ষাগুলো করতে করতে তিনি তপতীর কাছ থেকে চিনুর নিয়মিত জ্বর হওয়া, কাশি হওয়া সম্পর্কে খবর নিয়ে ভুরু কোঁচকালেন।

”ছেলেটা বড় রোগা। ওকে কি বড় ছেলেটার মতো স্বাস্থ্যবান করা যায় না?” তন্ময় কথাটা বলে মিনুর কাঁধে হাত রাখলেন সস্নেহে।

”কেন মোটা করা যাবে না! শরীরের যত্ন নিলে, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলো, ছোটাছুটি করলে, মন প্রফুল্ল থাকলে স্বাস্থ্য ভাল হবেই। তার আগে এখন দেখতে হবে ওর শরীরে অসুখটা কী।” অপূর্ব চিনুর মুখের দিকে চোখ রাখলেন। ডাক্তারের মুখে হাসি থাকলেও তপতীর বুক ছমছম করে উঠল। বেচারা চিনু। বসে—যাওয়া চোখমুখ এখন যেন আরও বসে গেছে।

ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে তন্ময়ের হাতে দিয়ে বললেন, ”বুকটা এক্স—রে করিয়ে নে আর সেইসঙ্গে মানটু টেস্টও।”

শুনেই তপতী প্রায় আর্তনাদের মতো স্বরে বললেন,”সে কী। এসব তো…।”

ভয়ে আর বাকি কথাগুলো বললেন না।

”এগুলো রুটিন চেক—আপ। টিবি যে হয়েছেই আপনি তা ধরে নিচ্ছেন কেন?” তপতীর উদ্বিগ্ন মুখের দিকে ডাক্তার তাকালেন। ”কিংবা যদি হয়েই থাকে তাতেই বা ভয় পাওয়ার কী আছে। টিবির অ্যালার্জি আছে কি না সেটা বোঝার জন্যই মানটু টেস্ট। অন্য অনেক রোগের ব্যাপারেও এই টেস্ট করা হয়। তা ছাড়া এমন এমন সব ওষুধ বেরিয়েছে, কমপ্লিটলি সারিয়ে দেবে। এখন প্রোটিন, ভিটামিন, আয়রন এইসব ওর দরকার। ওষুধগুলো লিখে দিলাম, ঠিকমতো খাওয়াবেন।” ডাক্তার খুব সহজ ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে গেলেন। কিন্তু তপতী তাতে আশ্বস্ত বোধ করলেন না। ছোট্ট চিনুর অবোধ সরল মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর চোখ জলে ভরে এল।

”তন্ময়, এক্স—রে—টা ভাল জায়গা থেকে করবি। তোদের ওখানে তো মিলের হাসপাতাল আছে, কেমন সেটা?”

”অফিসারদের জন্য ব্যবস্থা ভালই, তবে লেবারদের জন্য নয়।”

”এক্স—রে প্লেট আর মানটু টেস্টের রিপোর্ট আমাকে দেখিয়ে যাবি, আর ওষুধগুলো এখনই যাওয়ার পথে কিনে নিয়ে যা, আজ থেকেই খাওয়াতে শুরু কর। লিখে দিয়েছি কখন কতবার খাওয়াতে হবে।”

ওরা চেম্বার থেকে যখন বেরিয়ে আসছে ডাক্তার তখন বললেন, ”তন্ময়, তোর বড় ছেলেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন শরীরের ওজন একটু বেশিই। কত ওজন এখন? বয়স কত হল?”

”বলতে পারব না, ওজন কখনও করাইনি। বয়স নয় চলছে। জিজ্ঞেস করলি কেন, খারাপ কিছু?” তন্ময়কে উৎকণ্ঠিত দেখাল।

”বয়সের তুলনায় তো বড়ই দেখাচ্ছে। খারাপ কেন হবে, বেশ ভাল হেলথ। তবে এক্সারসাইজ না করলে মোটা হয়ে যেতে পারে। খেলাধুলো করে?”

”তা করে। স্কুলের স্পোর্টসে সাতটাতে ফার্স্ট হয়েছে।”

”গুড, ভেরি গুড।”

মহাদেবপুরে ফেরার পথে তন্ময় ওষুধগুলো কিনে নিলেন। গাড়ির পেছনের সিটে তপতী দুই ছেলেকে নিয়ে বসেছিলেন। সারা পথ তারা খুব কমই কথা বলল। একসময় মিনু জিজ্ঞেস করল, ”মা, টিবি কি একটা অসুখ?”

হ্যাঁ।

চিনুর কি টিবি হয়েছে? তপতী চমকে উঠে চিনুকে জড়িয়ে ধরলেন। ”না, হয়নি।”

পরদিন তপতী মিলের হাসপাতালে চিনুকে নিয়ে গেলেন। তাকে দেখে অল্পবয়সি ডাক্তার সিনহা অবাক হয়ে বললেন, ”কী ব্যাপার বউদি, আপনি এখানে! কিছু হয়েছে নাকি? দাদা কোথায়?”

”কারও কিছু হয়নি। সবাই ভাল আছে, শুধু আমার এই ছোট ছেলেটা ছাড়া। আপনাকে ভাই দুটো কাজ করে দিতে হবে। আপনার দাদার বন্ধু ডাক্তার হালদার কাল চিনুকে পরীক্ষা করে ওর বুকের এক্স—রে আর মানটু টেস্ট করাতে বললেন।”

তপতী প্রেসক্রিপশনটা বিস্মিত ডাক্তার সিনহার হাতে তুলে দিলেন। সেটা পড়তে পড়তে ডাক্তার বার—দুই চিনুর দিকে তাকালেন। তপতীকে কিছু বলতে গিয়েও বললেন না।

”আপনি একটু বসুন, ব্যবস্থা করছি।” ঘর থেকে ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন, এবং ফিরলেন মিনিট পাঁচেক পর। ”ওকে নিয়ে আসুন। আপনার ভাগ্য ভাল, এক্স—রে মেশিনটা আজ সুস্থ আছে, চারদিন ধরে কাজ করছিল না।”

চিনুর বুকের ছবি নেওয়া হল। ডাক্তার ওর বাঁ হাতের পুরো বাহুতে ছুঁচ ফুটিয়ে ওষুধ ঢুকিয়ে হাতের সেই জায়গাটায় একটা টাকার মাপের বৃত্ত এঁকে দিলেন কালি দিয়ে। বৃত্তের মধ্যে চামড়ার রং বদলায় কি না বা ফুলে ওঠে কি না সেটা তিনদিন লক্ষ করতে হবে। ব্যাপারগুলো চিনু কৌতূহলভরে দেখে গেল।

তিনদিন ধরে তপতী বার বার চিনুর হাতটা নজর করলেন। বৃত্তের মধ্যে চামড়া ক্রমশই গোলাপি হতে শুরু করল, ওখানকার চামড়াটা ফুলেও উঠল। আর সেই সঙ্গে তপতীও মনে মনে ভেঙে পড়লেন। যা ভয় করেছিলেন বোধহয় সেটাই তবে ঘটেছে। এবার আর নিজে নয়, তন্ময়কে তিনি চিনুর সঙ্গে পাঠালেন, হাসপাতালে। গম্ভীর মুখে আধঘণ্টা পর তন্ময় ফিরলেন ডাক্তার সিনহার মানটু টেস্ট রিপোর্ট পকেটে নিয়ে।

”কী লিখেছে রিপোর্টে?” ব্যাকুল তপতী জিজ্ঞেস করলেন।

”যা ভয় করেছিলে তাই, পজিটিভ। কালই ওকে নিয়ে অপূর্বর কাছে যাব। দেরি করব না চিকিৎসা শুরু করতে।” তন্ময় অধৈর্য কণ্ঠে বললেন।

.

এক্স—রে থেকে চিনুর ফুসফুসে সামান্য একটা স্পট পেয়েছিলেন ডাক্তার হালদার। তন্ময়কে তিনি বললেন, ”খাওয়ার ওষুধগুলো লিখে দিচ্ছি, ইঞ্জেকশন ওখানকার ডাক্তারকে দিয়ে দিইয়ে নিবি। তিনমাস পর আবার এক্স—রে করিয়ে আমায় দেখাবি। একদম ভয় পাবি না, ওর যা হয়েছে সেটা প্রায় কিছুই নয়।” এ ছাড়াও তিনি চিনুর খাওয়া, থাকা, পোশাক, ঘোরাফেরা ইত্যাদি বিষয়ে কী কী যত্ন নিতে হবে তাও তন্ময়কে বলে দেন।

এর পরই বসুমল্লিক পরিবারে একটা পরিবর্তন এসে গেল। আলো বাতাস রোদ আসে এমন ঘরে চিনুর থাকা দরকার আর সে রকম দক্ষিণ—পুব খোলা ঘর বাড়িতে একটাই। বসবার ঘর। তপতী বললেন, ”দরকার নেই আমার বাইরের লোকজন আসার, তাদের বসাবার জন্য ঘর। চিনু ওই ঘরেই থাকবে।” তন্ময় তাতে সায় দিয়ে বলেন,”সোফাটোফাগুলো খাওয়ার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি, কেউ এলে ওখানেই বসবে।”

পরিবর্তন এল খাওয়ার ব্যাপারেও। শুধু চিনুর জন্যই নয়, মিনুর জন্যও দুধ, মাখন, ছানা, ডিম, ভেজানো ছোলা—মটর। বেড়ে গেল ডাল ও সবুজ শাকপাতা, ডাঁটা, মাটির নীচে জন্মানো আনাজ। পেয়ারা, কলা বা মরসুমি ফল। মাছের পরিমাণও বাড়ল। সপ্তাহে তিনদিন চিকেন স্টু।

”রোগটা ছোঁয়াচে, আমার মনে হয় আলাদা বাসন থাকা দরকার চিনুর জন্য।” তন্ময়ের এই কথায় সায় দিলেন তপতী। সাবধানের মার নেই, বাড়িতে আরও একটা ছেলে রয়েছে। অতঃপর চিনুর জন্য প্লেট, গ্লাস, বাটি ইত্যাদি কেনা হল।

একদিন রাত্রে সকলের খাওয়াদাওয়ার পর চিনুকে ঘুম পাড়িয়ে তন্ময় ও তপতী খাওয়ার ঘরে বসে কথা বলছিলেন।

”এবার থেকে জল ফুটিয়ে খাওয়াই উচিত। এখানে ট্যাঙ্কের যে জল, তাতে কত যে ব্যাকটিরিয়া।” তপতীর কথাটাকে সমর্থন করলেন তন্ময়। যদিও তিনি মহাদেবপুরের পৌর বিভাগের কর্তা, তবু তিনি জলের পরিশুদ্ধতায় পুরো আস্থা রাখেন না।

”আমাদের এখন মনেপ্রাণে ছেলেদের স্বাস্থ্যের কথাটা ভাবতে হবে। কে ভেবেছিল এমন একটা রোগ, যেটা না খেতে পাওয়া, অস্বাস্থ্যকর জায়গায় থাকা লোকেদেরই হয়, সেই রোগ কিনা আমার ছেলের হল!” তন্ময়ের গলায় ক্ষোভ আর অসহায় ক্রোধ। ”কেন হবে চিনুর, কেন, কেন? এবার থেকে একটা রোগকেও আর বাড়িতে ঢুকতে দেব না। সাধ্যে যতটা কুলোয় আমি চেষ্টা করে যাব।”

”সেজন্য তা হলে খরচ করতে হবে।” তপতী দ্বিধাভরে বললেন। সংসারটা তাঁকেই চালাতে হয় এবং সেজন্য নির্ভর করতে হয় স্বামীর বাঁধা বেতনের ওপর।

”করব খরচ। ছেলেদুটোই তো আমাদের সবকিছু। ওদের সবল, সুস্থ রাখা, লেখাপড়া শিখিয়ে দশজনের একজন করে তোলা, এজন্য আমার শেষ কপর্দকও খরচ করব।” কথাগুলো বলে তন্ময় এমনভাবে তপতীর দিকে তাকালেন, যেন জটিল একটা অঙ্ক কষে ফেলে ফলটা ঠিক হয়েছে কি না জানতে চাইছেন।

”এজন্য আমাদের কষ্ট করতে হবে।” তপতী শান্তস্বরে বললেন।

”হবেই তো। কষ্ট না করলে কি সফল হওয়া যায়?” তন্ময় উত্তেজিত হয়ে তালুতে ঘুসি বসালেন।

”দেখো, আমার মনে হচ্ছে মিনুর এই দাবা খেলাটা বন্ধ করতে হবে। এটা নেশার মতো ওকে পেয়ে বসেছে। আগে বিকেলে মাঠে খেলতে যেত, এখন যায় না। এইটুকু ছেলের পক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকাটা ভাল নয়।”

”তা তো নয়ই, কিন্তু করবটা কী?” তন্ময়কে অসহায় দেখাল। ”কিছু একটা তো করতে হবে।” তপতীর স্বরে দৃঢ়তা ফুটে উঠল।

.

প্রতিদিনের মতো মিনু আর চিনুকে নিয়ে তপতী ভোরে বেড়াতে বেরিয়েছেন। রোজই তারা হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারে যায়। পিচঢালা রাস্তাটা ফেরিঘাটে শেষ হয়েছে। সেখানে একটা কাঠের বেঞ্চে তারা বসে। ভোরের নির্মল বাতাস নদীর ওপর দিয়ে এসে তাদের শরীরকে তাজা করে তোলে। বুকভরে তারা টাটকা বাতাস জমা করে। ফেরার সময় মিনু দৌড়য়। তখন চিনু বলে, ”মা, দাদার সঙ্গে আমিও দৌড়ে বাড়ি যাব।” তপতী ওকে দৌড়তে দেন না। ”আগে ডাক্তারবাবু বলুন, তারপর।”

কিন্তু আজ চিনু বায়না ধরল, সে দৌড়বেই। কী ভেবে তপতী বললেন,”আচ্ছা। কিন্তু জোরে নয়।”

.

মিনু লম্বা কদমে জোরেই ছুটতে শুরু করল, তার পেছনে চিনু। ভোরের নির্জন রাস্তায় তখন গাড়ি চলা শুরু হয় না। ওরা নিশ্চিন্তেই ছুটছিল। বড় রাস্তা থেকে বাঁ দিকে বেঁকে ওরা একটা সরু রাস্তায় ঢুকে গেল। তপতী হাঁটার বেগ বাড়ালেন, ছেলেরা তাঁর দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হতেই।

মিনুর অনেক পেছনে চিনু। রাস্তার দু’ধারে মিলের ব্যারাক। কম মাইনের শ্রমিকরা এখানে থাকে। একতলা টানা লম্বা বাড়িগুলো ছাড়িয়ে কিছুটা ফাঁকা মাঠ, তারপর ডান দিকে ফিরে আবার একটা চওড়া রাস্তা। মিনু ব্যারাকটার শেষপ্রান্তে যখন পৌঁছেছে তখন কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে মুখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়েই থেমে পড়ল। চিনু ভয়ে সিঁটিয়ে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আর দুটো কুকুর তাকে কামড়াবার জন্য তেড়ে যাচ্ছে পায়ের গোড়ালি তাক করে।

”চিইনউউ।” বলে চিৎকার করে মিনু পাগলের মতো ছুটতে শুরু করল ছোট ভাইয়ের দিকে। দাদাকে ছুটে আসতে দেখে চিনু প্রায় চোখ বুজে মিনুর দিকে ছুট দিল। সঙ্গে সঙ্গে কুকুর দুটো তার পিছু নিল। মিনু যখন জড়িয়ে ধরল ভাইকে, একটা কুকুর তখন চিনুর কেডসে প্রায় দাঁত ছুঁইয়ে ফেলেছে। চিনুকে পিছনে ঠেলে দিয়ে মিনু দু’হাত মুঠো করে শূন্যে এলোপাথাড়ি ঘুসি চালাতে শুরু করে দিল। কুকুর দুটো আর না এগিয়ে দাঁত বার করে বারবার তেড়ে যেতে লাগল।

সেই সময় ব্যারাক থেকে একটা লোক বেরিয়ে এসে, দুটো তেরিয়া কুকুরের সামনে একটি ছেলেকে ঘুসি চালিয়ে যেতে দেখে কুকুরদুটোকে ধমকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল, ”আর কিছু করবে না, এবার তোমরা যাও। তবে ছুটো না।”

মিনু ভাইয়ের কাঁধ একহাতে জড়িয়ে ধরে টানল, ”ভয় কী রে? আমি থাকতে ভয়ের কিছু নেই। চল, এবার হেঁটে হেঁটে যাই। খানিকটা গিয়ে আবার দৌড়ব।”

চিনু থরথর কাঁপছে। ভয়ে ফ্যাকাসে মুখে রক্ত তখনও ফিরে আসেনি। দাদার হাত আঁকড়ে ধরে বলল, ”কামড়ে আমার মাংস খুবলে নিত, না রে?”

”অত সোজা যেন, খোবলাব বললেই যেন খোবলানো যায়। টেনে এমন একটা লাথি মারতাম যে, দাঁতগুলো ভেঙে যেত।” মিনু লাথি ছুড়ে দেখাল। তাচ্ছিল্যে ঠোঁট বাঁকাল।

”দাদা, তুই মাকে বলে দিবি না তো?”

”বললে কী হয়েছে?”

”মা তা হলে আমায় আর ছুটতে দেবে না।”

”তা হলে ছোট আমার সঙ্গে। না ছুটলে অসুখ সারবে না।”

ঘটনাটার কথা তপতী জানতে পারেননি। তার বদলে জানতে পারলেন আর একটা কথা। যেভাবেই হোক চিনুর অসুখটার কথা গোপন করা সত্ত্বেও অনেকেই জেনে গেছল। একদিন মিনু স্কুল থেকে ফিরে এসে তপতীকে বলল, ”জানো মা, সুব্রত আজ আমার ওয়াটারবটল থেকে জল খেল না।”

”কেন? তুই জল দিতে গেছলি কেন?”

”ও আজ ওয়াটারবটল নিয়ে যেতে ভুলে গেছল। ক্লাসে ওর খুব তেষ্টা পেয়েছিল তাই দিলীপের কাছে জল চাইল। আমি বললুম, ‘আমারটা থেকে খা’, ও বলল, ‘তোর ওয়াটারবটল থেকে জল খাব না। তোদের বাড়িতে ক্ষয়রোগের রুগি আছে। তোর জল খেলে আমারও ক্ষয়রোগ হবে।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ক্ষয়রোগ কাকে বলে?’ ও বলল,’ক্ষয়ে ক্ষয়ে ভ্যানিশ হয়ে যায় বলে এর নাম ক্ষয়রোগ।’ হ্যাঁ মা, সত্যি? চিনু ভ্যানিশ হয়ে যাবে?”

শুনতে শুনতে তপতীর চোখে জল এসে গেল। কথাগুলো নিশ্চয় সুব্রত বাড়িতে শুনেছে বলেই বলেছে। বাড়ির লোকরা কী নিষ্ঠুরের মতো এইরকম কথাবার্তা বলেছে। সুব্রত মজুমদারের মা প্রতিভা খুবই অমায়িক, মিষ্টভাষী, প্রায়ই স্বামীর সঙ্গে অফিসার্স ক্লাবে যান, সেখানে গল্পের আসর বসান। তপতীকে দেখলেই বলেন, ”এই যে পূর্ণিমা, তোমার অমাবস্যাটি কোথায়?”

গরম লোহার শিকের মতো ‘ভ্যানিশ’ শব্দটা ঢুকে গিয়ে তপতীর মাথাটা গরম করে দিল। একটা জেদ তাঁকে ধীরে ধীরে পেয়ে বসল। তিনি স্থির করলেন আজই ক্লাবে যাবেন এবং চিনুকে সঙ্গে নিয়ে।

সন্ধ্যার পর বসুমল্লিকরা চিনুকে নিয়ে ক্লাবের সামনে ভক্সহল থেকে নামলেন। সঙ্গে ফুটোনো জলে ভরা ওয়াটারবটল। মিনুকে তাঁরা সঙ্গে আনেননি। ক্লাবের লনে ছোট ছোট টেবল ঘিরে চেয়ার। দশ—বারোটি দম্পতি এবং তাঁদের বাচ্চচা ছেলেমেয়েরা চেয়ার ভরিয়ে রেখেছে। একটি টেবল ঘিরে পাঁচজন মহিলা, তাদের মাঝে প্রতিভা মজুমদার হাত নেড়ে নেড়ে, ভ্রূ নাচিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন, বাকি চারজন মুগ্ধ হয়ে শুনছেন। তপতী আর তন্ময়কে দেখে প্রতিভা আজ আর হাত তুললেন না। ফিসফিস করে অন্যদের কী যেন বললেন। সকলেই মুখ ঘুরিয়ে বসুমল্লিকদের দিকে তাকাল।

লনের মাঝখানে লোহার পোস্টের মাথায় উজ্জ্বল বিদ্যুতের আলো। তার নীচে একটা ফাঁকা টেবলে ওঁরা বসলেন। বেয়ারা এল, কিছু খাবে কি না জানতে।

”কী আছে আজ?” তন্ময় জানতে চাইলেন।

”চিকেন পকৌড়া, শিঙাড়া, চানা—মটর।”

তন্ময় হাত তুলে বেয়ারাকে থামিয়ে দিলেন। ”ওসব খাবার চলবে না।”

”তিন গ্লাস জল দাও আগে, তারপর এক পট চা আর তিনটে কাপ।” তপতী ফরমায়েশ দিলেন। তারপর চিনুকে বললেন, ”যা, দোলনায় চড় গিয়ে।”

একধারে দুটি দোলনা, স্লিপ এবং সি—স্য রয়েছে বাচ্চচাদের খেলার জন্য। কিছু বাচ্চচা খেলছে। দোলনায় দুলছে দুটি মেয়ে। চিনু গিয়ে দোলনার পাশে অপেক্ষা করতে লাগল। হঠাৎই প্রতিভাদের টেবল থেকে একজন চেঁচিয়ে উঠল, ”শিলু, শিগগির চলে এসো এখানে।” কিন্তু শিলু নামের মেয়েটি মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে দুলেই চলল। তার মা উঠে গিয়ে দোলনা থামিয়ে শিলুর গালে চড় কষিয়ে টানতে টানতে নিয়ে এলেন।

খালি দোলনাটায় চিনু উঠতে পারছিল না, তপতী উঠে গিয়ে তাকে বসিয়ে দিয়ে দোল দিতে লাগলেন। মিনিট পাঁচেক পর ছেলেকে নিয়ে টেবলে ফিরে এলেন। বেয়ারা চা ও জল দিয়ে গেছে। একটা গ্লাস থেকে জল ফেলে দিয়ে বাড়ি থেকে আনা জল তাতে ভরে চিনুকে বললেন, ”একটু জল খা।”

চিনু যখন জল খাচ্ছে, তপতী আড়চোখে দেখলেন প্রতিভা তাঁদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তিনটি কাপে তিনি চা ঢাললেন, তবে একটিতে যৎসামান্য। সেটি চিনুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ”এক চুমুক, ব্যস।” জীবনে চা খায়নি চিনু, সে অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। ”যা বলছি কর, ঠিক এক চুমুক।”

চিনু তাই করল। তপতী আড়চোখে তাকালেন আবার এবং মনে মনে হাসলেন। সেই সময় ক্লাবে ঢুকল রাজেন এবং শুভা। বসুমল্লিকদের দেখতে পেয়ে তাদের টেবলেই ওরা এসে বসল। বেয়ারা এল। কী খাদ্য আছে, জানতে চাইল রাজেন এবং শুনে নিয়ে সে তন্ময়কে বলল, ”দাদা তা হলে পকৌড়াই আনাই। বউদি, শিঙাড়া চলবে?”

”না।” হেসে তপতী বললেন, ”কোনওটাই না।”

”সে কী! আমি তো আপনাদের খেতে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।”

”যে খাবার আমার ছেলেদের খেতে দিই না, সে খাবার এখন আমরাও খাচ্ছি না।” তন্ময় উত্তর দিলেন। ”আসলে চিনুর এই অসুখটাই আমাদের সচেতন করে দিয়েছে। আমাদের, মানে ছেলেদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারটা। ওদের ভাল স্বাস্থ্য গড়ে দেওয়ার কাজে আমরা নেমেছি। সেজন্য কিছু বিধিনিষেধ আমরা মানছি। তার মধ্যে রয়েছে এই খাওয়ার ব্যাপারটা। মুখরোচক এইসব খাবার ওদের খেতে দিই না, সেজন্য আমরাও খাই না।” তন্ময় হাসতে শুরু করলেন।

”দারুণ কাজে নেমেছেন তো।” এই বলে রাজেন পাশে দাঁড়ানো বেয়ারাকে বলল,”শুধু চা দাও।”

”কিছু খাবে না তোমরা!” তন্ময় বললেন কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হয়ে।

”না দাদা। কিছু বিধিনিষেধ আমিও আজ জারি করলাম। যে খাবার আপনারা খাবেন না, সে খাবার…।”

রাজেন শেষ করার আগেই তন্ময় হেসে উঠলেন। ”নিষেধ মেনে শেষ পর্যন্ত চলতে পারবে তো? বাঙালির নোলা বিশ্বাসঘাতকতায় খুব পটু।”

”আপনাদের একটা কাজের তো পরিচয় পেলাম, এর পর আর কী কাজে নেমেছেন?”

”নামা হয়নি, তবে নামার জন্য চিন্তা করছি।” তপতী বললেন। ”ওদের কোনও একটা খেলা শেখানোর ব্যবস্থা করা। শুধুমাত্র পুষ্টিকর খাওয়া দিয়েই তো স্বাস্থ্য হয় না, শরীর গড়তে পরিশ্রমেরও দরকার হয়।”

”আচ্ছা রাজেন, ওদের কোন খেলা শেখানো যায় বলো তো?”

তন্ময়ের বলার ভঙ্গিতে বোঝা গেল তিনি এটা নিয়ে চিন্তিত।

”এখানে খেলা শেখানো!” ভ্রূ কপালে তুলে রাজেন হতাশভাবে মাথা নাড়ল।

”এখানে মাঠটাঠ আছে, কিন্তু লোকের কোনও উৎসাহ নেই। এই দেখুন না ওই যে টেনিস কোর্টটা, কত বড় বড় ঘাস গজিয়ে গেছে, কেউ খেলে না বলেই তো! সবাই তাস আর ক্যারাম খেলে চা—শিঙাড়া খেয়ে বাড়ি চলে যায়। অথচ খেলার জন্য নেট, কিছু পুরনো বল ক্লাবে পড়ে আছে। ঘাস ছাঁটাইয়ের জন্য একটা লন—মোয়ারও রয়েছে।

”একদিন মিস্টার ভটচাযকে বলেওছিলাম, নতুন সেক্রেটারি হলেন, ক্লাবের হালটা একটু ফেরান। শুধু আড্ডা দেওয়া ছাড়াও মেম্বাররা যাতে একটু ছোটাছুটি করে ঘাম ঝরাতে পারে, তার ব্যবস্থা করুন না! উনি বললেন, ‘কী ব্যবস্থা করব বলুন? টেবল টেনিস বোর্ড কেনার জন্য কমিটি মিটিংয়ে প্রপোজাল দিলাম, সবাই হাঁ হাঁ করে উঠল। বলল, ‘বোর্ড পাতবেন, জায়গা কোথায়?’ আসলে বোর্ড পাতলে তাস খেলার টেবলগুলো তুলে দিতে হবে তো। বললাম, ‘টেনিস কোর্টটাকে ঠিকঠাক করে দেখুন না আবার চালু করা যায় কি না।’ উনি বললেন, ‘কিসসু হবে না, খেলার লোকই পাওয়া যাবে না। আপনাকে একা একাই খেলতে হবে।’ ভেবে দেখলাম, মিস্টার ভটচায বাজে কথা বলেননি। তবে লোকটা খেলা ভালবাসেন।”

রাজেন নিরুৎসাহিত গলায় কথাগুলো বলে চায়ের কাপ নেওয়ার জন্য শুভার দিকে হাত বাড়াল। তপতী মুখ ঘুরিয়ে অন্ধকার টেনিস কোর্টটার দিকে তাকালেন। কিছু একটা তিনি ভাবছেন। প্রতিভাদের টেবলের মহিলারা উঠলেন। বাড়ি যাওয়ার জন্য ছেলেমেয়েদের ডাকাডাকি শুরু হল।

”আমি একবার মিস্টার ভটচাযের সঙ্গে দেখা করব।” তপতী বললেন।

”কেন?” তন্ময় জানতে চাইলেন।

”যদি কোর্টটাকে আবার জাগিয়ে তোলা যায়। দেখি উনি ক্লাবঘরে আছেন কি না।” তপতী চেয়ার থেকে উঠলেন। কয়েক পা যেতেই পড়লেন প্রতিভার সামনে।

”তোমার ছোট ছেলের নাকি খুব অসুখ হয়েছে শুনলাম,” অত্যন্ত উদ্বিগ্ন মুখ প্রতিভার। অসুখটা যেন তাঁর নিজের ছেলেরই হয়েছে।

”হ্যাঁ।”

”আহা রে, একেই তো বরাবরের রুগণ, তার ওপর আবার অসুখ, ছেলেটার যে কী কপাল! অসুখটা কী?”

”টিউবারকুলাসিস, যাকে বলে ক্ষয়রোগ।” তপতী ধীর স্বরে বললেন।

”ও মা! টিইবিই! ভাল ডাক্তার দেখাচ্ছ তো?”

”দেখাচ্ছি।”

”এখন কেমন আছে? মুখ দিয়ে রক্ত টক্ত ওঠে?”

”ওই তো বসে রয়েছে দেখুন না! এখন চিনু ভোরে ওর দাদার সঙ্গে ছোটে।”

”না, না, না, ছোটাছুটি করিও না, ফুসফুস ড্যামেজ হলে ধুঁকতে ধুঁকতে সারা জীবন কাটাবে, চিরকালের মতো অক্ষম হয়ে যাবে।”

”আর নয়তো ক্ষয়ে ক্ষয়ে ভ্যানিশ হয়ে যাবে।” তপতী হাসতে শুরু করলেন। প্রতিভা সন্দিহান চোখে তপতীর হাসি দেখতে দেখতে গম্ভীর হয়ে গেলেন।

”যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে।” বলে প্রতিভা হনহনিয়ে এগিয়ে গেলেন।

ক্লাবের অফিসে বসে কমল ভটচায দু’জন মেম্বারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। প্লাইউডের পার্টিশন করা খোপের মতো একটা ঘর। দরজায় পাল্লার বদলে একটা পরদা ঝুলছে। তপতীকে দেখে কমল ভটচায অবাক হলেন।

”আপনি! কী ব্যাপার? বসুন, বসুন।”

”একটা বিষয়ে একটু কথা বলতে এসেছি।” একমাত্র খালি চেয়ারটায় বসে তপতী কোনও ভনিতা না করে বললেন, ”ক্লাবের টেনিস কোর্টটাতে খেলার ব্যবস্থা করুন। জানি মেম্বারদের খুব একটা উৎসাহ নেই, কিন্তু তাদের ছেলে মেয়েদের তো থাকতে পারে।”

কমল ভটচায আচমকা এমন একটা অনুরোধের সামনে পড়ে ভেবে পেলেন না কী জবাব দেবেন। কিন্তু কিন্তু করে বললেন, ”এমন একটা প্রস্তাব অবশ্য রাজেন রায়চৌধুরী একবার আমাকে দিয়েছিলেন। উনি তো একসময় কলকাতায় টেনিস খেলতেন, শুনেছি ভালই খেলতেন, তাই হয়তো টেনিস প্রীতিতেই কথাটা তুলেছিলেন। কিন্তু মিসেস বসুমল্লিক, অসুবিধেটা কী জানেন, মেম্বাররা সারাদিন নানান শিফটে মিল আর অফিস করে রিল্যাক্স করার জন্য এখানে আসেন, তাই কেউ আর টেনিস নিয়ে উৎসাহী হন না। তবে আপনি যেটা বললেন, ছেলেমেয়েদের কথাটা, হ্যাঁ, এটা ভেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু করে কে? কোর্টটায় শুধু বড় বড় ঘাসই নয়, বড় বড় গর্তও আছে। খোয়া, নুড়ি ছড়ানো, জমি অসমান। রীতিমতো মেহনত করতে হবে ওটাকে নিয়ে। এদিকে ক্লাবে একজন বেয়ারা, একজন কুক। মালি ছিল, তাকে এই মাসেই ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মাসের অর্ধেক দিন তার দেখাই পাওয়া যেত না।”

”আপনার অসুবিধেগুলো আমি বুঝতে পারছি।” তপতী নম্র আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন। ”কিন্তু কেউ যদি দায়িত্বটা নেয় তা হলে কি আপনি সাহায্য করবেন?”

”নিশ্চয় করব। কিন্তু সাহায্য বলতে কী বোঝাচ্ছেন? আপাতত আমার লোকবল নেই। বেয়ারা কি কুক, মাঠের কাজ করবে না বললে তাদের দিয়ে করাতে পারব না। অর্থবলও তেমন নেই যে, লোক ভাড়া করতে পারব। নামেই অফিসার্স ক্লাব, অর্ধেক মেম্বারই তিন—চার মাসের চাঁদা বাকি ফেলেছেন। তাই নিয়েই তো এঁদের সঙ্গে কথা বলছিলাম।” কমল ভটচায হাত দিয়ে দেখালেন এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা দু’জনকে।

”লোকজন বা টাকা কিছুই দিতে হবে না, শুধু কোদাল, ঝুড়ি, বালতি, জল এইসব; আর লন—মোয়ারটা দিলেই হবে।”

”মোয়ারটা খারাপ হয়ে পড়ে আছে। একটা চাকা আর কী যেন ভেঙেছে।”

”সে আমি সারিয়ে নেব।… তা হলে আপনি অনুমতি দিচ্ছেন।”

”অবশ্যই। যদি দায়িত্ব নিয়ে কোর্টটাকে উদ্ধার করতে পারেন তা হলে সত্যিই একটা কাজের কাজ হবে। কিন্তু মিসেস বসুমল্লিক—” কমল ভটচায থেমে গলা নামিয়ে বললেন, ”খেলার জন্য লোক পাবেন তো?”

”নেটের দু’ধারে দাঁড়াবার জন্য ইতিমধ্যেই দু’জনকে পেয়ে গেছি—আমার বড় ছেলে আর আমি।”

।।৩।।

পরদিন ভোরে ফেরিঘাট থেকে মিনু ও চিনু দৌড় শুরু করার পর তপতী হাঁটতে শুরু করলেন বাড়ির বদলে ক্লাবের দিকে। উদ্দেশ্য, দিনের আলোয় ভাল করে কোর্টের অবস্থাটা দেখে নেওয়া।

মিনিট কুড়ি পর তিনি পৌঁছলেন। রাত্রে ক্লাবঘরে শোয় বেয়ারা কান্তি। তার দেশ নদিয়া জেলার এক গ্রামে। বাড়িতে বউ, ছেলে মেয়ে আছে। বয়স্ক লোক, মানুষ ভাল। সে তপতীকে চেনে। এত সকালে ‘মেমসায়েব’কে ক্লাবে দেখে কান্তি হতভম্ব।

”মালি তার জিনিসপত্র কোথায় রাখে কান্তি, আমি একটু দেখব।”

ক্লাবঘরের পেছনে একটা ঢাকা জায়গায় মোয়ারটা দেয়ালে ঠেস দেওয়া। একটা চাকা খোলা, তবে ভাঙেনি। ছাঁটাই হওয়া ঘাস যে লোহার ডালাটায় পড়ে, সেটা ঝুলে রয়েছে। ঘাস ছাঁটাই করার একটা ব্লেড ভাঙা। কোদাল একটা আছে বটে, তার বাঁশের হাতলটা নেই। একটা শাবলও রয়েছে। কোনও ঝুড়ি নেই। টেনিসের নেটটা খুঁজে পাওয়া গেল না।

”আপনি কী করবেন এসব দিয়ে?” কান্তি তো অবাক!

”মাঠ বানাব। ওই টেনিস কোর্টটাকে খেলার যোগ্য করে তুলতে হবে।”

”আপনি করবেন?”

”লোক দিয়ে করাতে হবে।”

কোর্টের অবস্থা দেখে তপতীর কপালে দু—তিনটে ভাঁজ পড়ল। ঘাস এত লম্বা যে, প্রথমে হেঁসো দিয়ে না কাটলে মোয়ার চালানো যাবে না। জমিতে কয়েকটা জায়গায় মাটি ফেলতে হবে, গর্ত বোজাতে হবে, ঢিপির মতো উঁচু জায়গায় মাটি চাঁছতে হবে আর ভাঙা ইটের টুকরো, কাঁকর বাছতে হবে। এত ‘হবে’ কিন্তু তাঁকে দমাতে পারল না। প্রথমেই মোয়ারটা সারাতে হবে, একটা কি দুটো মাটি ফেলার ও তোলার ঝুড়ি চাই, কোদালের জন্য হাতলও।

”কান্তি, একজন কি দু’জন মজুর জোগাড় করতে পারবে? আর একজন ঘেসুড়ে?”

”তা পারা যাবে।”

”তোমাকে আমি পরশু বলব।”

তপতী যখন বাড়ি ফিরলেন সবাই তখন খাওয়ার টেবলে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল।

”কেমন দেখলে?” তন্ময় জানতে চাইলেন।

”যা দেখব ভেবেছিলাম তাই দেখলাম। তবে হয়ে যাবে। তোমার একটু সাহায্য চাই। মোয়ারটা ভাঙাচোরা, ওটাকে সারাতে হবে। তোমার তো অনেক মিস্ত্রি আছে, একজনকে পাঠিয়ে দাও না ওটা ঠিক করে দেবে।”

”পাঠাব। আর কী দেখলে?”

”দেখলাম বেশ কিছু টাকা খরচ করতে হবে, মিস্ত্রি লাগাতে হবে।”

”টাকা!” তন্ময় নড়েচড়ে বসলেন। চিনুর চিকিৎসা আর সুষম পুষ্টিকর খাদ্য চালু হয়ে সংসার খরচ যথেষ্ট বেড়ে গেছে। মাইনের টাকা হিসেব করে খরচ করতে হচ্ছে এবং খরচটা করে তপতী। সুতরাং টেনিস কোর্ট সংস্কারের জন্য খরচের টাকা যে তাঁদের পক্ষে দেওয়া কষ্টকর হবে, এটা তপতী জানেন।

”টাকা আমাদের খরচ করতে হবে নাকি! ক্লাব দেবে। মেম্বারদের ছেলেমেয়েরাই তো খেলবে।” তন্ময় মৃদু স্বরে আপত্তি জানালেন।

”মনে রেখো মেম্বারদের ছেলে মেয়েদের মধ্যে আমদেরও দুটো ছেলে আছে। ওদের মুখ চেয়ে একাজ আমায় করতেই হবে। আমি মেম্বারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলব।” তপতীর চোখ জ্বলজ্বলে, কণ্ঠস্বরে আবেগ এবং দৃঢ়তা।

”চাঁদা তুলবে! কত করে চাঁদা?”

”দশ টাকা প্রতি ফ্যামিলি। একবারই শুধু দিতে হবে।”

”দঅঅশ টাকা!” তন্ময়ের চোয়াল ঝুলে পড়ল। ”জানো, এই দশ টাকায় বারো সের চাল পাওয়া যায়, আড়াই মাস খবরের কাগজ কেনা যায়…।”

”দুটো হরলিকস কেনা যায়, চার সের সর্ষের তেল কেনা যায়, চার সের পাঁঠার মাংস কেনা যায়… তাতে কী হল?” তপতীর চোখে চ্যালেঞ্জ।

”এত টাকা কী কেউ বাচ্চচার খেলার জন্য দেবে?” তন্ময় স্পষ্টতই সন্দেহ প্রকাশ করলেন। ”প্রাইভেট টিউটর রাখার জন্য টাকা খরচ করতে বললে করবে কিন্তু ছেলে মেয়ের খেলার জন্য…।” তন্ময় কথা অসম্পূর্ণ রেখে মাথা নাড়লেন।

”এসব হতাশার কথা। আগে সবাইকে বলে তো দেখি।”

”ঠিক আছে, বলে দেখো।” তন্ময়ের মুখ দেখে মনে হল না তিনি হতাশা কাটাতে পেরেছেন।

মিনু—চিনু চুপ করে খেয়ে যাচ্ছিল আর বাবা—মার কথা শুনছিল। এবার মিনু বলল,”মা, আমি টেনিস খেলব?”

”হ্যাঁ।”

”আর কে খেলবে?”

”এখানকার সবাই খেলবে।”

চিনু ফিসফিস করে বলল, ”মা আমি?”

”সোমবার তোমার এক্স—রে করার দিন। কলকাতায় ডাক্তারকাকা সেটা দেখবেন। তারপর তিনি যদি খেলতে বলেন তো খেলবে।”

”মা, তুমিও খেলবে? আগে তো খেলতে!” মিনু বলল।

”হ্যাঁ, আমিও খেলব… যদি দরকার পড়ে।”

.

”আরে মিসেস বসুমল্লিক! কী ব্যাপার?” সুধা ঘোষাল অবাক হয়ে অভ্যর্থনা জানালেন তপতীকে। বাংলোর বারান্দায় বেতের চেয়ার টেনে বললেন, ”বসুন, বসুন। অনেকদিন পর এলেন।”

”মাসতিনেক প্রায়। ছোট ছেলের অসুখের জন্য কোথাও আর যেতে পারি না।” চেয়ারে বসলেন তপতী। সুধা ঘোষালের স্বামী এখানকার চিফ লেবার অফিসার। ওঁদের এক ছেলে সুধেন্দু ক্লাস সেভেন—এ পড়ে।

”ছেলে এখন কেমন আছে?”

”ভাল। অল্প অল্প ছুটছে, কোনও কষ্ট হচ্ছে না।”

”ভোরে তো দেখি দুই ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে বেরোন, খুব ভাল এটা। আমিও মাঝে মাঝে ভাবি সকালে একটু বেড়াই। কিন্তু মুশকিল কী জানেন, ডান হাঁটুতে একটু বাতের মতো হয়েছে, তা ছাড়া সুধেন্দুকে নিয়ে পড়াতে বসতে হয়। ক্লাস সেভেন থেকে যদি পড়ায় জোর না দেয় তা হলে স্কুল ফাইনালে ভাল রেজাল্ট করবে কী করে?”

”স্কুল ফাইনালের তো এখনও অনেক দেরি।”

”অনেক দেরি!” সুধা ঘোষাল আর্তনাদ করে উঠলেন। ”মাত্র চারটে বছর, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। একে আপনি অনেক দেরি বলছেন?”

তপতীর মনে হল, সুধা ঘোষাল এমনভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে, যেন একটা মানুষকে হঠাৎ বনমানুষে রূপান্তরিত হতে দেখলেন। তিনি অপ্রতিভ বোধ করে সুধা ঘোষালকে তুষ্ট করার জন্য বললেন,”সুধেন্দু তো পড়াশোনায় খুবই ভাল, অমন ছেলে ক’টা আর হয়, এবারও তো ফার্স্ট হয়ে উঠল।”

”সেটা তো স্কুলের ফার্স্ট, কিন্তু গোটা বাংলার তো নয়। ওর বাবা এম এসসি—তে ফার্স্ট ক্লাস সেকেণ্ড হয়েছিল, আমি বি এ—তে ডিস্টিংশন পেয়েছি। সুধেন্দুকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট তো হতেই হবে। ওর বাবা তো বলে, ‘ছেলে বাপকে ছাড়িয়ে না গেলে সে আর ছেলে কীসের?’ তবে ছেলেও বাপ—মায়ের মন বোঝে, সবসময় পড়ার বই নিয়ে থাকে।”

”কিন্তু মিসেস ঘোষাল, আপনাদের যেমন ইচ্ছে তেমনি ছেলেরও তো কিছু ইচ্ছে থাকতে পারে।”

”ছেলের ইচ্ছে! সুধেন্দুর? ওর একটাই ইচ্ছে, বাপ—মার মুখ উজ্জ্বল করা, আই এ এস, কি আই পি এস হয়ে সমাজের একজন হওয়া। সেইভাবেই আমরা ওকে তৈরি করতে চাই।”

”ওর বয়স এখন কত, তেরো?”

”হ্যাঁ।”

”এই বয়সের ছেলেদের তো খেলতে ইচ্ছে করে, আর সেইজন্যই আপনার কাছে আসা।” সুধা ঘোষালকে কথা বলার কোনও সুযোগ না দিয়ে তপতী বলে চললেন, ”ক্লাবে যে টেনিস কোর্টটা পড়ে আছে সেটাকে সংস্কার করে ছেলে মেয়েদের খেলার ব্যবস্থা করতে চাই, সেজন্য কিছু টাকার দরকার, তাই আপনার কাছে এসেছি যদি দশটা টাকা চাঁদা দেন। সুধেন্দুর বিকেলে একটা কিছু খেলা তো দরকার।” তপতী শেষ বাক্যটির ওপর ভরসা করলেন। ছেলের খেলার একটা ব্যবস্থা হলে কোন মা আর টাকা না দিয়ে থাকতে পারবেন। কিন্তু ফল হল বিপরীত।

”বিকেলে খেলা? …পাঁচটার সময় সুধেন্দুর ইংলিশ টিউটর আসে। এই তো ভেতরের পড়বার ঘরে ও এখন পড়ছে। সকালে আমি পড়াই, বিকেলে টিউটর, অফিস থেকে ফিরে ওর বাবা ওকে নিয়ে বসেন। ওর খেলার সময় কোথায়? আমরা তো ওকে বারবার বলি জীবনে এখনই পড়ার সময়, যা কিছু জ্ঞান এখনই আহরণ করে নাও, খেলার জন্য পরে অনেক সময় পাবে, ঠিক কি না বলুন?”

তপতী ঢোঁক গিললেন। ”বলছিলাম কী, যদি দশটা টাকা চাঁদা—”

”না, না, না, সুধেন্দুকে পড়া ফেলে খেলতে আমরা পাঠাব না। এই দেখুন আপনাকে চা দেওয়া হল না।”

”চা খাব না, আমি এখন উঠি। আরও কয়েকজনের কাছে যেতে হবে।” তপতী চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন।

.

”তপতীদি, আপনি যা করতে চাইছেন সেটা তো খুবই ভাল। ছেলে মেয়েদের সত্যিই এখানে নিয়মিত খেলার কোনও ব্যবস্থা নেই।” চন্দ্রিমা দত্ত তাঁর পাঁচ বছরের মেয়ে লঘিমাকে কোলের কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বললেন। ”আমি তো সেইজন্যই লঘুকে নাচের স্কুলে ভর্তি করিয়েছি।”

”খুব ভাল করেছ। তবে ফিজিক্যাল এক্সারসাইজটাও যদি ওই সঙ্গে করে, তা হলে নাচটা আরও ভাল হবে।”

”তা হয়তো হবে। কিন্তু তপতীদি, টেনিস আর নাচ দুটো চালানো ওর পক্ষে অসম্ভব! বাড়িতে রেগুলার নাচের প্র্যাকটিস, তার সঙ্গে টেনিস, এইটুকু বাচ্চচা, দেখছেনই তো শরীরের হাল, নিতে পারবে না।”

তপতী বুঝে গেলেন, চন্দ্রিমার কাছ থেকে কিছু পাওয়া যাবে না। নিজের ছেলে মেয়েরা না খেললে তারা চাঁদাও দেবে না। তবু তিনি বললেন, ”বেশ, লঘু নয় খেলতে পারবে না, কিন্তু অন্য অনেকের ছেলে মেয়ে তো খেলবে, তুমি চাঁদার দশটা টাকা দাও। স্রেফ চ্যারিটি।”

”উনি তো এখন নেই, বাড়ি আসুন, ওঁকে বলব।”

তপতী আর কথা বাড়ালেন না। ধরে নিলেন কিছু পাওয়া যাবে না।

.

সুভাষ সেন অমায়িক, মার্জিত এবং এম জে টি এম—এর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যানেজার। তপতীর কথা মন দিয়ে শুনে চশমার কাচ রুমালে মুছতে মুছতে বললেন, ”মিসেস বসুমল্লিক আপনার উদ্যোগের সঙ্গে আমি শতকরা একশো ভাগ একমত। কিন্তু মুশকিল একটাই, আর দু’মাস পর শঙ্কু শান্তিনিকেতন চলে যাচ্ছে। ওখানে পাঠভবনে পড়বে।”

”তা হলে তো আর কিছু বলার নেই।” তপতী মুখে হাসি টেনে আনলেন। বাংলোর সিঁড়ি দিয়ে যখন নামছেন, পেছন থেকে ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলেন সুভাষ সেনের হাতে মানিব্যাগ, তাই থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করেছেন। ”এটা নিয়ে যান।”

তপতী বাড়ি ফিরলেন তিরিশ টাকা সংগ্রহ করে। অনিরুদ্ধ আর গৌতমের বাবা—মা খুব উৎসাহিত হয়েই চাঁদা দিয়েছেন। তন্ময় জানালেন কাল সকালে মেশিন শপের একজন যাবে লন—মোয়ারটা নিয়ে আসার জন্য। একদিনেই সম্ভবত সারানো যাবে।

”কিন্তু তিরিশ টাকায় কী হবে?” তন্ময় প্রশ্ন তুললেন।

”বাকিটা আমাদেরই দিতে হবে।” তপতী শান্ত স্বরে স্বামীর চোখে চোখ রেখে বললেন। ”আমাদের ছেলেদের মুখ চেয়েই খরচ করতে হবে। একদিন বলেছিলে, ওদের সুস্থ সবল রাখা, ভাল স্বাস্থ্য গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব বাবা—মার। এজন্য শেষ কর্পদকটুকুও খরচ করবে।”

”বলেছিলাম।”

”তা হলে অমন চোখ করে তাকিয়ে আছ কেন?

”তাকিয়ে নেই, শুধু ভেবে যাচ্ছি। আমার অফিসের একটা ছেলের বিয়ে, নেমন্তন্ন করেছে। এগারোশো টাকা মাইনে থেকে সংসার খরচ, চিকিৎসা, গাড়ির পেট্রল, মেজ জ্যাঠার বাড়িতেও বিয়ে এই মাসেই। বিয়ের উপহার আর টেনিস কোর্ট—ম্যানেজ করব কী করে?”

”কিছু কিছু খরচ কমিয়ে ম্যানেজ করতে হবে। কমানোর প্রথম ধাপ হোক গাড়ি আর না চড়া। চিনু স্কুলে যায় না, মিনু হেঁটেই যাতায়াত করতে পারবে, আমি সঙ্গে যাব। তুমিও হেঁটে অফিস যাবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, ভুঁড়ি হয়ে যাচ্ছে তাই হাঁটছি।”

”পরশু এক্স—রে করিয়ে চিনুকে কলকাতা নিয়ে যেতে হবে। কীসে যাব, ট্রেনে?”

”মোটরে। এটা ব্যতিক্রম বলেই ধরতে হবে।”

পরদিন মিনুকে নিয়ে তপতী বেরোলেন স্কুলে পৌঁছে দিতে। দু’জনের মাথায় দুটো ছাতা। মিনু প্রথমে অবাক হয়েছিল হেঁটে স্কুলে যেতে হবে শুনে। তপতী তাকে বুঝিয়ে বললেন, ”আধ মাইল তো রাস্তা, এর জন্য গাড়িতে চড়ার কী দরকার? তুই তো রোজ এক মাইল হেঁটে ফেরিঘাট যাস আর দৌড়ে ফিরিস। পারবি না স্কুলে হেঁটে যেতে? অক্ষম তো নোস। তোর বাবা দু’মাইল হেঁটে স্কুলে যেতেন, দু’মাইল হেঁটে ফিরতেন।”

এই শেষ কথাটাতেই কাজ হয়ে গেল। ”মা আমি দৌড়ে স্কুলে যাব?” মিনু টগবগ করে উঠল।

”না, না, অত বাহাদুরিতে কাজ নেই।”

”জানো মা, আমাদের স্কুলের অনেক বড় ছেলে সাইকেলে আসে। আমাকে একটা সাইকেল কিনে দেবে?”

”দোব, যখন তুমি বড় ছেলে হবে।”

মিনুকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তপতী ক্লাবে গেলেন। কান্তির কাছে শুনলেন, সায়েবের পাঠানো একটা লোক সাইকেল রিকশায় তুলে মোয়ারটা নিয়ে গেছে।

”কিন্তু কান্তি, ঘাস কাটার ব্যবস্থা তো তাড়াতাড়ি করতে হবে। আর কোদালের হাতলের জন্য একটা বাঁশ কিংবা ডাণ্ডা দরকার।”

”যে লোকটা দুধ আর ডিম দিয়ে যায় তাকে কালই আমি বলে দিয়েছি। ও থাকে এই মাইল দুয়েক দূরে বল্লভপুরে। বলেছিল আজ সকালে পাঠিয়ে দেবে লোক। তা এখনও তো এল না!” কান্তিকে বিব্রত দেখাল।

”ততক্ষণে একটা কাজ করা যাক। নেট—টা কোথায় আছে দেখো তো।”

”দেখেছি। সেক্রেটারির আপিস ঘরে যে কাঠের আলমারিটা তার পেছনে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে। বার করব কী! যা ধুলো ঝুল ময়লা, হাত দিতে ঘেন্না করে?”

”দেখি তো।” তপতী একাই দেখতে গেলেন অফিস ঘরে।

তপতী আলমারির পেছনে উঁকি দিয়ে দেখলেন। কান্তি মোটেই বাড়িয়ে বলেনি। তালগোল পাকানো নেটটা যেন ধুলোর ঢিপি। তিনি ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে নেটের খানিকটা আঁকড়ে টেনে বার করলেন। সেই সঙ্গে বেরিয়ে এল তাঁত ছেঁড়া একটা র‌্যাকেট, যার হাতলে মুঠো করে ধরার জায়গার কাঠটা ফাটা। এটাও বোধ হয় ক্লাবেরই সম্পত্তি। নেটটাকে ঘর থেকে টানতে টানতে বাইরের লনে এনে ফেললেন। হাঁ হাঁ করে কান্তি ছুটে এল। ”আপনি কেন, আপনি কেন… আমাকে বললেই তো পারতেন।”

”কান্তি তুমি একদিকের দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকো, আমি আর একদিক ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে এটা খুলব।”

পুরো নেটটা খুলে তপতী হতবাক! অন্তত সাত—আট জায়গায় জালের সুতো ছিঁড়ে গর্ত হয়ে রয়েছে। সুতো কিনে ছেঁড়া গর্ত মেরামত করতে হলে যারা জাল বোনে তাদের কাউকে ডাকতে হবে। তার মানে খরচ! কিন্তু তার আগে নেটটাকে না ধুলে হাতই দেওয়া যাবে না। মহাদেবপুরে পানীয় জল সরবরাহ হয় উঁচু ট্যাঙ্ক থেকে। চব্বিশ ঘণ্টাই জল পাওয়া যায়। নেটটাকে তাঁরা দু’জন জলের কলের নীচে টেনে এনে কল খুলে দিলেন।

”এইভাবে থাকুক ঘণ্টাখানেক। ঝুল কালিটা অন্তত বেরিয়ে যাক।”

ইতিমধ্যে ঘাস কাটার লোক এসে গেছে। বৃদ্ধ এক চাষি। তপতী টেনিস কোর্টটা দেখিয়ে তাকে বললেন, ”এই যে জমিটা, এরই ঘাস মুড়োতে হবে, কত নেবে?”

চোখমুখ কুঁচকে জমিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বলল, ”পাঁচ টাকা দিতে হবে।”

”পাঁ—আ—আচ!” তপতী যতটা বিস্মিত হওয়া দেখানো সম্ভব দেখালেন। ”পারব না। ঘণ্টা দুয়েকের কাজ, আর বলছ কিনা পাঁচ টাকা!”

”ঘণ্টা দুয়েকের কাজ নয় মা, খাটুনি আছে। সাড়ে চার টাকা হলে করব।”

শেষ পর্যন্ত রফা হল সাড়ে চার টাকায়। তপতী কিছু পয়সা তো বাঁচালেন। ঘাস কেটে দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলার জন্য ঝুড়ি নেই। কান্তি রান্নাঘরের একটা বালতি এনে দিল। রান্না করে তার নিজের খাওয়ার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়। কান্তি সেইদিকে মন দিল। এরমধ্যেই ক্লাবের ক্যান্টিনের রাঁধুনিও এসে গেছে। সেও তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। কল থেকে তোড়ে নেটের ওপর জল পড়ছে। তপতী শাড়িটা একটু তুলে নেটের ওপর দাঁড়িয়ে লেফট—রাইট শুরু করলেন। গলগল করে কালো জল বেরোতে লাগল। মিনিট দশেক পর তিনি হাঁফিয়ে উঠে থামলেন। এর পর নেটটাকে টেনে আনলেন ক্লাব লনের ওপর, ছড়িয়ে দিলেন শুকোবার জন্য।

মাথায় গামছা জড়িয়ে, খালি গায়ে বৃদ্ধ উবু হয়ে বসে ঘাস নিড়িয়ে চলেছে। কাটা ঘাস বালতিতে রেখে কিছুক্ষণ পরপর বালতিটা খালি করে আসছে দূরে গিয়ে। ছাতা মাথায় তপতী কোর্টের ধারে একটা চেয়ারে বসে। কান্তি এক কাপ চা নিয়ে এল।

”এভাবে কতক্ষণ বসে থাকবেন মেমসাব, বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া করবেন না?”

”করব, ঘাসকাটাটা শেষ হোক আগে। না দেখলে তো যা—তা করে কাটবে। আর শোনো, নেটটা শুকিয়ে গেলে ভাঁজ করে পাকিয়ে তুলে রেখো। জালের মোটা সুতো কিনে এনে বুনে নেব।”

”আপনি বুনবেন? গঙ্গার ধারে ক’ঘর জেলে থাকে, ওদের বললে তো হয়?”

”লোক দিয়ে করাতে গেলে তো পয়সা লাগবে। কী আর এমন শক্ত কাজ! আর মাঠের ইঁট পাথর কাঁকর বাছার জন্য দুটো লোক চাই, জোগাড় করতে পারবে?”

”সে আর এমন শক্ত কী, আমি এই বুড়োকেই বলে দিচ্ছি।” কান্তি কথাগুলো বলে ঘাসকাটা বৃদ্ধের কাছে গেল। দু—চারটে কথা বলে ফিরে এসে জানাল, ”বুড়ো বলল ও নিজেই করবে, নাতনিকে সঙ্গে আনবে। মাটি চেঁছে দেবে, গত্তে মাটি ফেলবে, দশ টাকা নেবে।”

”দঅশ!” তপতী হতাশ হলেন। ”এইটুকু কাজ, কোনও খাটুনিই নেই আর বলে কিনা দশ টাকা! দরকার নেই আমার।”

দুপুর দুটোর সময় ঘাস কাটা শেষ হল। তপতী কোর্টে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। প্রায় একফুট লম্বা ঘাস চার ইঞ্চিতে নামিয়ে দিয়েছে। এরপর মোয়ার চালিয়ে আরও ছাঁটা হবে।

”এ কী! এখানে ঘাস তো একদমই কাটোনি।” তপতী দাঁড়িয়ে পড়ে আঙুল দেখালেন।

”কাটব কী মা! ওখানটায় তো মাটি উঁচু হয়ে রয়েছে। জমি সমান করতে গেলে তো আপনাকে মাটি তুলতেই হবে, সেইসঙ্গে ঘাসও।”

কথাটা সত্যি। মাটি তোলার মতো মাটি ফেলতেও হবে, তারপর সমান করা। সমান করতে তো জল ঢেলে মাটি নরম করে রোলার চালাতে হবে। কিন্তু রোলার কোথায় পাবেন?

”মা, আমার মজুরিটা দিয়ে দেন,” বৃদ্ধ গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, ”জমিতে ঢেলা বাছাইয়ের কাজ করাবেন তো কাল আসব।”

”দশ টাকা দিতে পারব না।”

”মা, ঘাসকাটার থেকেও এ কাজে খাটুনি বেশি। দেখছেন তো রোদ্দুর কেমন। দু’দিন তো লাগবেই।”

রোদে পোড়া বৃদ্ধের মুখ আর সারা দেহ দেখে তপতীর মায়া হল। তিনি বললেন, ”ঠিক আছে, কাল সকাল সকাল এসো।”

এবার তপতীর হুঁশ হল এখন তাকে বাড়ি যেতে হবে। বৃদ্ধকে টাকা দিয়ে, কান্তিকে নেটটা গুটিয়ে তুলে রাখতে বলে বাড়ির দিকে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলেন। পঞ্চাশ গজ হেঁটেই থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে এলেন।

”কান্তি, ওই যে ভাঙা র‌্যাকেটটা দেখলাম ওটা এনে দাও তো। দেখি সারানো যায় কি না।”

র‌্যাকেটটা নিয়ে ছাতা মাথায় বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে তপতীর মনে হল এইমাত্র যেন টুর্নামেন্টের প্রথম রাউন্ডের খেলা জিতে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠলেন। এর পর আছে তৃতীয় রাউন্ড, চতুর্থ রাউন্ড…। এতক্ষণে তপতী অনুভব করলেন তাঁর ভীষণ খিদে পেয়েছে।

সন্ধ্যায় তপতী আজকের অভিজ্ঞতা তন্ময়কে জানিয়ে বললেন, ”এখন দরকার জালের জন্য মোটা সুতো আর জমিটাকে সমান করা। এখানকার বাজারে সুতোটা যদি না পাওয়া যায় তা হলে কলকাতা থেকে তোমায় কিন্তু আনিয়ে দিতে হবে, সেইসঙ্গে দুটো টেনিস বলও। আর জমি লেভেল করার জন্য তোমাদের একটা রোলার যদি পাঠিয়ে দাও।”

”দোব। কাল চিনুকে নিয়ে কলকাতা যাব, তোমার যা যা দরকার তার একটা লিস্ট করে ফেলো। যে র‌্যাকেটটা এনেছ তাতে তাঁত বাঁধাতে কোন দোকানে যেতে হবে সেটাই তো জানি না।” তন্ময়ের হঠাৎই এই সময় মনে পড়ে গেল একটা কথা। ”আচ্ছা, তোমার একটা র‌্যাকেট মনে হচ্ছে যেন আলমারিতে তোলা আছে দেখেছি!”

তপতীকে সচকিত দেখাল। তিনি ভুলেই গেছলেন ওটার কথা। বিয়ের দু’বছর পর একবার বাপের বাড়ি থেকে ফেরার সময় তাঁর দাদা র‌্যাকেটটা হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ”মিছিমিছি এটা এখানে পড়ে আছে, তুই বরং সঙ্গে নিয়ে যা। যদি খেলার সুযোগ টুযোগ পাস তো দরকারে লাগবে।” র‌্যাকেটটা আলমারির ওপর তাকে জামাকাপড়ের তলায় সেই যে ঢুকেছে গত আট বছরে একবারও আর বেরোয়নি।

তপতী আলমারি খুলে জামাকাপড়ের স্তূপের তলা থেকে র‌্যাকেটটা বার করলেন। আট বছর আগের অবস্থাতেই রয়েছে। র‌্যাকেটের গায়ে সোনালি অক্ষরে ‘ডানলপ’ লেখাটা নতুনের মতোই ঝকঝকে। মুঠোয় ধরতেই অদ্ভুত একটা শিহরণ তিনি বোধ করলেন। তেরো বছর আগে পা ভাঙার পর আর খেলেননি। বাঁ হাতের তালুতে র‌্যাকেটের মাঝখানের তাঁত দিয়ে তিন—চারবার আঘাত করলেন পুরনো অভ্যাসবশে। এভাবে ঘা দিলে টানটান করে বাঁধা তাঁতে ‘পিং’ করে আওয়াজ ওঠে। আওয়াজটা শুনতে তাঁর ভাল লাগত। কিন্তু এখন আওয়াজের বদলে তিন—চারটে তাঁত ছিঁড়ে গেল। তিনি অপ্রতিভ হয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন।

”ছিঁড়ে তো যাবেই। গোরু কি মোষের নাড়িভুঁড়ি দিয়ে তৈরি তাঁত এত বছর পরও কি পচবে না? ভালই হল দুটো র‌্যাকেটই নিয়ে যাব, কিন্তু কোথায় এসব বাঁধায় তা তো জানি না।”

তপতী কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললেন, ”এ ব্যাপারে সেরা লোক রাজেন ঠাকুরপো। টেনিস খেলেছে, এখনও অভ্যাসটা ছাড়েনি। নিশ্চয় ও জানে কোথায় তাঁত বাঁধানো হয়।”

তন্ময় ঘড়ি দেখে বললেন, ”এখনি চলো।”

দু’জনের হাতে দুটো র‌্যাকেট, একটায় তাঁত নেই, রাজেন তো অবাক! ”কী ব্যাপার দাদা, খেলতে যাচ্ছেন কোথাও?”

”এই র‌্যাকেট নিয়ে খেলতে যাওয়া? ঠাট্টা হচ্ছে?” তন্ময় চেয়ারে বসলেন। ”তোমার বউদি তো টেনিস কোর্ট করার কাজ শুরু করে দিয়েছে। আজ ঘাস ছাঁটিয়েছে। নেটটা বার করে দেখে তাতে বড় বড় ছিদ্র, হাতি না হোক বেড়াল গলে যেতে পারে। সেটা সারাবার জন্য সুতো আনার হুকুম হয়েছে। উনি নিজে বসে বসে ছিদ্র বন্ধ করবেন। তারপর ইঁট পাথর বাছাই। পয়সা বাঁচাতে সেটাও বোধ হয় উনি নিজে করবেন। জমি লেভেলিং করার জন্য রোলার টানানোর অর্ডারও হয়েছে।”

”উরিব্বাস।” রাজেন চেয়ারের ওপর উবু হয়ে বসল। ”করেছেন কী! আপনি তো দেখছি যা ভাবেন তাই করেন।”

”তা করতেই হয়। এখানে এত শিক্ষিত লোক, সবাই ভাল চাকরিও করেন কিন্তু নিজেদের সন্তানদের জন্য ঠিকভাবে চিন্তা করেন না। আমার সন্দেহ হয় ছেলেমেয়েদের যথার্থই ওঁরা ভালবাসেন কি না। কিন্তু আমার সন্তানদের আমি ভালবাসি—অন্যদেরও।” বলে তপতী তাঁর চাঁদা তোলার অভিজ্ঞতার কথা রাজেনকে বললেন।

”কিন্তু শুধু চাঁদা দিলেই তো টেনিস খেলা যায় না, বউদি নিজের র‌্যাকেটও থাকা দরকার। বাচ্চচার বাবারা কি সেটা কিনে দেবে? … তবে দিক বা না দিক আমি দুটো র‌্যাকেট ডোনেট করব। ওদের জন্য দরকার হালকা ছোট মাপের র‌্যাকেট।”

”তা হলে আমাদের এই দুটোরও ব্যবস্থা করে দাও রাজেন।”

রাজেন ক্লাবের র‌্যাকেটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, ”এটার যা অবস্থা, উনুনে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।” তারপর দ্বিতীয় র‌্যাকেটটা তুলে ”ওরে বাবা এটা তো দেখছি ডানলপ! পেলেন কোথায়?”

”তোমার বউদির … এক সময় খেলত। ইলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়ানও হয়েছিল।”

রাজেনের বিস্ফারিত চোখ দুটি তপতীকে লজ্জায় ফেলে দিল। পা নামিয়ে বসে রাজেন সিরিয়াস গলায় বলল, ”এবার বুঝলাম কেন আপনি টেনিস চালু করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। নিজে খেলাধুলো না করলে কেউ খেলার মর্ম বোঝে না। কথা দিচ্ছি সাধ্যে যতটা কুলোয় আপনাকে আমি সাহায্য করব।”

”তা হলে কোর্টটা যাতে ভালভাবে তৈরি করা যায় সেই ব্যাপারে পরামর্শ দিন।” তপতী সাগ্রহে বললেন।

”বউদি, এখানে খেলবে সেইসব বাচ্চচা, যারা জীবনে কখনও র‌্যাকেট ধরেনি। ওদের জন্য উইম্বলডনের কি সাউথ ক্লাবের মতো সারফেস এখনই দরকার নেই। বলটাকে নেটের এপার ওপার করাটাই আগে শিখুক, র‌্যাকেটের সঙ্গে বলের সম্পর্কটা আগে গড়ে তুলুক, তারপর গ্রাউণ্ড স্ট্রোক শিখবে। নেটে বড় বড় ছ্যাঁদা থাকলেও কিছু আসে—যায় না। আপনি মাঠটাকে সমান করে দিন তারপর আমি মাপজোক করে চুনের দাগ কেটে দেব। সাউথ ক্লাবে পুরনো বল পাওয়া যাবে, এনে দেব। আপনার প্রধান যেটা দরকার সেটা হল খেলার লোক। খেলার জন্য দু’জনের প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন আর আপনার বড় ছেলে, মোট তিনজন।”

”চারজন। আমার ছোট ছেলের কথাটা ঠাকুরপো ভুলে যাচ্ছেন। আসলে সবাই চিনুকে ভুলে যায় ওর রুগণ দুর্বল শরীরের জন্য। শরীরটা তৈরি করানোর জন্যও ওকে খেলায় আনব।” তপতীর স্বরে ফুটে উঠল প্রত্যয় আর জেদ। ”একবার যখন ঠিক করে নিয়েছি কী করতে চাই, তখন যত পরিশ্রমই হোক, যত অর্থকষ্টই হোক কাজটা আমরা করবই।”

তপতী কথাটা বলে তন্ময়ের দিকে তাকালেন। সায় জানিয়ে তন্ময় মাথা নাড়লেন।

রাজেন অস্ফুটে বলল, ”অদ্ভুত আপনারা!”

।।৪।।

সকালে তপতী মিনুকে পৌঁছে দিয়ে হেডমিস্ট্রেস জয়ন্তী বসুর সঙ্গে দেখা করলেন।

”চিন্ময় তো ক্লাস করতে পারছে না, পড়াশুনোয় পিছিয়ে পড়ছে। আমি অবশ্য রোজ সন্ধ্যায় ওকে নিয়ে পড়াতে বসি। তা হলেও যেভাবে লেসনগুলো স্কুলে করানো হচ্ছে সেটা ফলো করা দরকার। বাড়িতে আমার পড়ানো আর স্কুলের পড়ানো একই হওয়া উচিত। তাই বলছিলাম কী, আমি যদি ক্লাসে বসে নোট নিই, তা হলে কি আপনার আপত্তি হবে? আপত্তি না থাকলে যদি অনুমতি দেন।” তপতী আবেদন জানালেন।

”নিশ্চয়, নিশ্চয়, আপত্তি হবে কেন। তবে ক্লাস ওয়ানে এমন কিছু পড়া হয় না যে, আপনাকে নোট নিতে হবে। যাই হোক আপনি চলুন এখন মিসেস বসাক ইংলিশ ক্লাস নিচ্ছেন, আপনাকে ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে আসি।” জয়ন্তী বসু চেয়ার ছেড়ে উঠলেন, ”চিন্ময় এখন আছে কেমন?”

”ভালই। আজ ডাক্তার ওর এক্স—রে দেখে জানাবেন সেরে উঠেছে কি না।”

”কমপ্লিটলি সেরে উঠলে ডাক্তারের সার্টিফিকেট দিয়ে ওকে স্কুলে পাঠাবেন। বুঝলেন তো অনেক গার্জিয়ান আবার খুব খুঁতখুঁতে হন। মিসেস বসুমল্লিক আপনার বড় ছেলেটি কিন্তু দারুণ অ্যাথলিট, পড়াশুনাতেও তেমনই ভাল।”

”হুঁ” বলা ছাড়া তপতী কোনও উত্তর দেননি। ‘খুঁতখুঁতে’ শব্দটিকে তিনি প্রসন্ন মনে নিতে পারেননি। সংক্রামক বিপজ্জনক রোগ কি শুধু তাঁর ছেলেরই হল? কত তো ছেলেমেয়ে রোগজীবাণু শরীরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। সবাইকে যদি পরীক্ষা করা যেত!

পরপর দুটি ক্লাসে পেছনের বেঞ্চে বসে তিনি পড়া বুঝে নিলেন। তাঁর মনে হল বাড়িতে তিনি চিনুকে যা পড়ান তার থেকে স্কুলের পড়া অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এখানে একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে পড়ায়, তাই গতিটা প্রথম দিকে মন্থরই হয়, এটা তপতী জানেন। এখন তাঁর মনে হচ্ছে, চিনুকে তিনি একটু বেশিই এগিয়ে দিয়েছেন, এটা ভাল না মন্দ হচ্ছে তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না।

ক্লাবের কাছাকাছি এসে দেখলেন, সেই বুড়ো আর একটা বছর দশেকের মেয়ে কোর্টের এক প্রান্তে উবু হয়ে বসে। তাদের সামনে বালতিটা। কান্তি জানাল, ঘণ্টাখানেক হল ওরা এসে কাজ শুরু করেছে। তপতী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের দেখলেন। দু’জনে ইঁট—পাথর বাছাই করে জড়ো করছে নিজেদের পাশে, পরে মেয়েটি দু’ হাতে সেগুলো তুলে বালতিতে ফেলছে। বালতি ভরে গেলে বুড়ো ফেলে দিয়ে আসছে কোর্টের অন্তত তিরিশ হাত দূরে।

তপতীর মনে হল, চুপচাপ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকার চেয়ে যদি তিনি নিজেও হাত লাগান তা হলে কাজগুলো এগিয়ে থাকবে, সময়ও বাঁচবে। কী কাজ করা যায়? সুতো থাকলে জালটার ফুটোগুলো বোনার কাজ করতে পারতেন। রাজেন ঠাকুরপো অবশ্য বলেছেন, ফুটোগুলো এখন তেমন অসুবিধে করবে না। কোর্টটার মাঝে উঁচু একটা বাধা তুলে দু’ভাগ করা, আপাতত এটাই হবে নেটের কাজ। বাচ্চচারা এখন প্রচণ্ড জোরে বল হিট করবে না। লন—মোয়ারটা যদি মেরামত করে দিয়ে যেত তা হলে সেটা দিয়ে ঘাস ছাঁটার কাজ শুরু করে দিতে পারতেন। কিন্তু মোয়ারটা এখনও ফেরত আসেনি।

কান্তি থলি হাতে কোথায় যেন বেরোচ্ছিল। তপতীকে দেখে বলল ”মেমসাব, কোদালের বাঁশটা খুঁজে পেয়েছি। দোকানে যাচ্ছি। এসে লাগিয়ে দেব।”

তপতীর নজরে পড়ল, কোর্টের অসমান জায়গাগুলো। কোদাল দিয়ে তো সমান করে ফেলার কাজটা করা যায়! যেমন ভাবা তেমনই শুরু করে দেওয়া। ভেতরে গিয়ে কোদালটায় বাঁশের হাতল লাগাবার চেষ্টা শুরু করলেন। বাঁশটা একটু সরু, কোদালে লাগালে ঢলঢল করছে। একটা কাঠের গোঁজ দিলে টাইট হবে। তিনি রান্নার জায়গা থেকে চ্যালাকাঠের একটা টুকরো সংগ্রহ করে এনে সেটা কোদালে গুঁজলেন হাতলের সঙ্গে। একটা আধলা ইট দিয়ে ঘা মেরে মেরে কাঠটাকে বসালেন। হাতল ধরে কোদালটা নাড়িয়ে পরীক্ষা করলেন, টাইট হয়ে বসেছে কি না। মনে হল এবার ব্যবহার করা যাবে। তাঁর মুখে সাফল্যের হাসি ফুটল।

কোর্টের যে জায়গাটা উঁচু বেশি, তপতী সেটাকেই প্রথম লক্ষ্যবস্তু করলেন। ঘাসের নীচে কয়েকটা ইটের মাথা জেগে রয়েছে। মাটির নীচে ইটের অনেকটাই গাঁথা। তপতী একটু ঝুঁকে কোদালটা খানিকটা তুলে জমিতে ঘা দিতেই ‘ঠক’ আওয়াজ হল। শক্ত করে আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে, ঠোঁট চেপে মনে মনে বললেন, ‘দেখাচ্ছি মজা, সবক’টাকে তুলব।’

প্রথমে তিনি কোদাল দিয়ে ঘাস চেঁছে জমির অনেকটা পরিষ্কার করলেন। গোটাপাঁচেক ইট, ভাঙা ভাঁড় মাটিতে গাঁথা। তপতী আড়চোখে দেখলেন, কাজ ফেলে বুড়ো আর নাতনি তাঁর দিকে তাকিয়ে অবাক চোখে। ‘দেখবেই তো, ওদের ধারণা এইসব মেহনতের কাজ শুধু ওরাই পারে … ফুঃ, করে দেখিয়ে দিচ্ছি।’ মনে মনে কথাগুলো বলে কোদালটা মাথার ওপর তুলে বড় একটা ইটের মাথা লক্ষ্য করে সজোরে কোদাল নামালেন। কোদালটার ধারালো দিকটা শক্ত ইটের ওপর পড়ে ছিটকে এসে তপতীর বাঁ পায়ের গোছের কাছে আঘাত করল জোরে। হাত থেকে কোদালটা পড়ে গেল।

তপতী কয়েক সেকেন্ড বিমূঢ় হয়ে রইলেন। ধীরে ধীরে শাড়ির প্রান্ত খানিকটা তুলে পায়ের দিকে তাকিয়েই তাঁর মাথা ঘুরে গেল। প্রায় পাঁচ ইঞ্চি লম্বা হয়ে পায়ের মাংস চেরা আর তার মধ্য থেকে উঁকি দিচ্ছে সাদা হাড়। মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিয়ে বিমূঢ় ভাবটা কাটিয়ে তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোলেন ক্লাবঘরের দিকে। বৃদ্ধ আর নাতনি তাঁর পায়ের দিকে তাকিয়েই ছুটে এল।

”হাসপাতাল যাব। তার আগে এটা ভাল করে বাঁধতে হবে, দেখছ কী রক্ত পড়ছে!”

”হাসপাতাল তো অনেকটা রাস্তা, যাবেন কী করে মা?” বৃদ্ধ বিশাল সমস্যার সামনে পড়ে গেল। ”এটা বাঁধার কাপড়ই বা এখানে পাব কোথায়?”

”দাদু, একটা গামছা শুকোচ্ছে।”

”না, না, না।” তপতী আঁতকে উঠলেন। ”আমার শাড়ির আঁচলটা থেকে বরং ছিঁড়ে বেঁধে নিচ্ছি।”

বৃদ্ধ নাতনিকে বলল, ”খানিকটা ঘাস চিবিয়ে জায়গাটায় চেপে ধর।” নাতনি ছুটে গিয়ে এক মুঠো ঘাস ছিঁড়ে মুখে পুরল।

তপতী বারণ করতে গিয়েও করলেন না। তিনি শুনেছেন, এইসব টোটকা চিকিৎসা খুব কাজ দেয়। মেয়েটি চিবোনো ঘাস তাঁর থেঁতলানো কাটা জায়গায় চেপে বসিয়ে দিল। তপতী শাড়িটা ছিঁড়লেন।

এইসময় দূরে দেখা গেল একটি ছেলে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। হ্যান্ডেলে ঝুলছে স্কুলব্যাগ, ”খুকি, দৌড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে ডাক তো ছেলেটাকে।”

বৃদ্ধের নাতনি চিৎকার করতে করতে ছুটল। ”অ্যাই সাইকেল, অ্যাই সাইকেল…।”

ছেলেটি সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। সেই সময় বৃদ্ধ তপতীকে বোঝাচ্ছিল, ”মা, যার কাজ তারে সাজে, অন্য লোকে লাঠি বাজে। … আপনি কেন মিছিমিছি কোদাল ধরতে গেলেন? আমাদের পয়সা দিতে তো আপনাদের কষ্ট লাগে, দর কষাকষি করে পয়সা কমান। … আমাকে বললে তো পারতেন, আমি করে দিতুম, তা হলে এই কাণ্ডটা ঘটত না।”

”তা হলে তো আবার টাকা চাইতে।” কাপড়ের পটি পায়ে জড়াতে জড়াতে তপতী বললেন।

”তা তো চাইতুমই।”

”আমার পুঁজি তিরিশ টাকা আর আমার চাঁদা দশ টাকা মোট চল্লিশ টাকা,…” তপতীর কথার মধ্যেই ছেলেটি এসে পড়ল।

”কী হয়েছে আপনার? মেয়েটা বলল পা নাকি দু—আধখানা হয়ে গেছে!” কিশোর ছেলেটির চোখে মুখে উৎকণ্ঠা।

”হতে পারত বাবা, কপালজোরে বেঁচে গেছি। আমাকে এখনই হাসপাতাল যেতে হবে।” পটিতে একটা গিঁট দিলেন তপতী। ”তুমি কি মহাদেব হাই স্কুলে পড়ো?”

”হ্যাঁ, ক্লাস টেন—এ। আপনি আমার সাইকেলের পেছনে বসবেন? তা হলে আমি সাইকেলটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিয়ে যেতুম। … মাসিমা, আপনাকে আমি স্কুলের স্পোর্টসে দেখেছি। আপনার ছেলে তো অনেক প্রাইজ পেল! … সাতটা, তাই না?”

”হ্যাঁ, মৃন্ময়, ক্লাস থ্রিতে পড়ে।” যন্ত্রণা হচ্ছে, তার মধ্যেই তিনি আরাম পেলেন ‘অনেক প্রাইজ পেল’ শুনে। পড়ায় ফার্স্ট হলে মিনু কি এমন বিখ্যাত হত?

তপতীকে সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে উঠে বসতে সাহায্য করল ছেলেটি এবং বৃদ্ধ। দু’জনে সাইকেলের দু’দিকের হ্যান্ডেল ধরে সন্তর্পণে হাঁটতে শুরু করল। মিনিট পাঁচেক পরই থলি হাতে কান্তিকে দেখা গেল বাজার থেকে ফিরতে। চোখ কপালে তুলে ঘটনার কথা শুনে কান্তি বৃদ্ধকে বলল, ”তোমাকে আর হাসপাতাল যেতে হবে না, আমি সাইকেল ধরছি। থলিটা নিয়ে যাও আর গিয়ে কাজে লেগে পড়ো।”

সাইকেল এবার ধরল ছেলেটি আর কান্তি। কয়েক গজ এগোবার পর তপতী ব্যস্ত হয়ে বললেন, ”থামো, থামো, কান্তি, বুড়োকে জিজ্ঞেস করে এসো তো কোর্টটা সমান করে দিতে কত টাকা নেবে?”

কান্তি ছুটে গিয়ে বৃদ্ধকে ধরল এবং সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এল। ”মেমসাব, বলল পাঁচ টাকা, দরাদরি চলবে না।”

”পাঁ—আ—আচ টাকা! বুড়োটা আমাকে মেরে ফেলবে কান্তি, ফতুর করে দেবে। চার টাকায় হয় না?”

”মনে তো হল, এক পয়সাও কমাবে না। বলল, মায়ের পা কেটেছে বলে পাঁচ টাকা, নয়তো ছ’টাকা চাইত।”

”কিন্তু টাকাটা তো আমার নিজের নয়, চাঁদার টাকা, পাঁচজনের টাকা। আমার তো অধিকার নেই নয়ছয় করে খরচ করার।” তপতী করুণ মুখে বললেন।

”মেমসাব, আপনার কী অত মাথাব্যথা খরচ বাঁচাবার! আমি বলে আসছি বুড়োকে,পাঁচ টাকাই পাবে।” কথাটা বলেই কান্তি উত্তরের অপেক্ষা না করে বৃদ্ধকে ধরার জন্য দৌড়ল।

ওরা যখন হাসপাতালে পৌঁছেছে, তন্ময় তখন চিনুকে এক্স—রে করিয়ে বেরোচ্ছেন। দ্রুত এমার্জেন্সিতে ভর্তি হলেন তপতী। তাঁর পায়ে আঠারোটা সেলাই হল এবং পর্যবেক্ষণের জন্য রাখা হল একটি কেবিনে।

”অতি অবশ্যই আজ চিনুকে নিয়ে কলকাতায় যাবে।” তন্ময়কে এই নির্দেশ দিয়ে চোখ বন্ধ করে তপতী ঘোষণা করলেন, ”না গেলে আমি মরে যাব।”

”উতলা হচ্ছ কেন, আমি অপূর্ব্বর কাছে আজই যাব।” উদ্বিগ্ন তন্ময় নিশ্চিন্ত করার চেষ্টা করলেন তপতীকে।

”সুতো আনবে। লন—মোয়ারটা আজ এসে পৌঁছয়নি। কালই যাতে আসে একটু দেখো। মিনুকে যদি পারো স্কুলে পৌঁছে দিয়ো আর বাড়ি এনো, গাড়ি করেই। এটা ব্যতিক্রম বলে ধরতে হবে। … যে বুড়োটা কাজ করছে তাকে টাকা দেওয়া হয়নি। দশটা টাকা এক্ষুনি কান্তির হাতে দিয়ে এসো, বেচারা গরিব মানুষ। আমি দিনকয়েক বোধ হয় হাঁটাচলা করতে পারব না। আজই আমি বাড়ি যাব।”

ডাক্তার রাজি হলেন না। আঘাতটা মোটেই হালকা ধরনের নয়। অন্তত তিনদিন তপতীকে পর্যবেক্ষণে থাকতেই হবে। তন্ময়ও ডাক্তারের সঙ্গে একমত। গম্ভীর স্বরে স্ত্রীকে তিনি শুধু বললেন, ”ডাক্তারবাবুর কথার ওপর আর একটা কথাও নয়।” কথা শেষ করেই তিনি কেবিন থেকে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন।

তন্ময় কেবিনে আবার ঢুকলেন রাত আটটা নাগাদ, সঙ্গে দুই ছেলে। চোখ—মুখ উদ্ভাসিত, হাতে এক্স—রে প্লেটের খাম, কলকাতা থেকে গাড়ি চালিয়ে সোজা হাসপাতালে এসেছেন। ”চিনু কিওরড … চিনু সেরে গেছে!” তন্ময় দু’ হাত তুলে ঝাঁকালেন।

ধড়মড় করে তপতী খাটে উঠে বসলেন এবং ফ্যালফ্যাল করে চিনুর দিকে তাকিয়ে থাকতে—থাকতে তাঁর চোখ জলে ভরে উঠল। লাজুক মুখে চিনু মা’র দিকে এগিয়ে গেল। দু’ হাতে ছেলেকে বুকে চেপে, চুম্বনে—চুম্বনে, মুখ ভুরিয়ে দিয়ে তপতী বললেন, ”আমাদের একটা দুশ্চিন্তা দূর হল, এবার টেনিস খেলাটা শুরু করতে পারলেই হয়।” দু’ হাত কপালে ঠেকিয়ে তিনি ভগবানকে প্রণাম জানালেন।

গলাখাঁকারি দিয়ে তন্ময় বললেন, ”এখনও কিন্তু চিনু কমপ্লিটলি সেরে ওঠেনি। লাংয়ের ওপর স্পটটা প্রায় মিলিয়ে এসেছে, সেরে উঠেছেই বলা যায়, তবে ওষুধপত্তর আরও তিন মাস চালিয়ে যেতে বলল অপূর্ব।”

”তিনটে মাস তো দেখতে দেখতে কেটে যাবে।” তপতী চিনুর মাথায় হাত বুলোতে লাগলেন।

কিন্তু তিনটে মাস তপতীর পক্ষে দেখতে দেখতে কাটল না। তাঁর ক্ষতটা তিনদিনের মধ্যেই বিশ্রী দিকে মোড় নিল। পায়ের মাংস, হাড়, স্নায়ু, শিরা, সব মিলিয়ে জখমের জের মারাত্মক হয়ে উঠল। ইঞ্জেকশনে ঝাঁঝরা হলেন, মুঠো মুঠো ওষুধের ট্যাবলেট গিলতে হল এবং বাড়ি ফিরলেন পাঁচ সপ্তাহ পর। তাঁর উঠে দাঁড়াতে সময় লাগল আরও দু’ সপ্তাহ। ততদিন সংসার চালিয়েছে বেলা। আর দুই ছেলেকে দু’ হাতে আগলে রেখেছিলেন তন্ময়।

এই সময় প্রায় প্রতিদিনই রাজেন এসে দেখা করে যেত তপতীর সঙ্গে। কোর্ট তৈরি করার দায়িত্ব রাজেন নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়ে এতদিনে প্রায় শেষ করে এনেছে, তাকে সহযোগিতা করেছে কান্তি। বুড়ো আর তার নাতনি ইট, পাথর, কাঁকর বেছে, জমি সমান করে দেয় মাটি ফেলে। লন—মোয়ার চালিয়ে কান্তি ঘাস ছেঁটে এক ইঞ্চি করে দিয়েছে। বহু জায়গায় জমিতে টাক দেখা দেয়, সেইসব জায়গায় নতুন করে ঘাস লাগানো হয়েছে। কোর্ট মেপে দড়ি বেঁধে সেই দড়ি বরাবর চুনগোলা দিয়ে লাইনগুলো টানার কাজও শেষ। নেটের ফুটোগুলো কান্তি লোক ধরে এনে সারিয়ে ফেলেছে। নিয়মিত জল দিয়ে জমি ভেজানো হয়। ক্লাবে যারাই আসে তকতকে সবুজ ঘাসে ঢাকা কোর্টটার দিকে প্রশংসাভরা চোখে তাকায়।

”কবে খেলা শুরু হবে রাজেন?” তন্ময় একদিন জানতে চাইলেন।

”বউদি সেরে উঠলে। উনি প্রথম সার্ভিস করে এই কোর্ট ওপেন করবেন। তার আগে এখানে কোনও খেলা হতে পারে না।”

অনিরুদ্ধ আর গৌতম, যাদের বাবা চাঁদা দিয়েছেন, তারা প্রায়ই উঁকি দিয়ে দেখে যায় তাদের তপতী কাকিমাকে। খেলার জন্য তারা অধৈর্য হয়ে পড়েছে। তপতীর র‌্যাকেটের তাঁত বাঁধিয়ে দিয়ে গেছে রাজেন, সেইসঙ্গে ছোট দুটি নতুন র‌্যাকেট আর কয়েকটা পুরনো বল।

তপতী সবকিছুই শোনেন বিছানা থেকে। এমনকী, বিকেলে খাওয়ার ঘরের দেওয়ালে লাগা টেনিস বলের শব্দ আর সেইসঙ্গে বেলার শাসানি। ”জিনিসপত্তর ভাঙলে কিন্তু দু’জনের ব্যাট—বল উনুনে দিয়ে দেব।”

”বেলামাসি, ব্যাট নয় র‌্যাকেট।” মিনুর গলা।

”ওই হল।”

মিনু দাবা খেলতে আর যায় না। এখন স্কুল থেকে ফিরেই তার নতুন নেশা র‌্যাকেট আর বল। আলমারির কাচ ভাঙা। আর দেওয়ালে বলের ছোপ ধরানোর পর এখন সে বাড়ির বাইরে গিয়ে দেওয়ালের সঙ্গে খেলে। চিনু স্কুলে যাচ্ছে না এখনও। তার কাজ বসে বসে দাদার খেলা দেখা। সে যথেষ্ট জোর দিয়ে মুঠোয় র‌্যাকেট ধরতে পারে না, কয়েকবার বল মারার জন্য চালালেই হাত ভার হয়ে যায়।

”মা, ফোরহ্যান্ড তো এইভাবে মারে।” মিনু শোওয়ার ঘরে একটা কাল্পনিক বলের দিকে র‌্যাকেট চালাল।

”হ্যাঁ, কে শেখাল?” বালিশে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে তপতী খাটের ওপর। মিনুর উৎসাহ তাঁকে তাজা করে তুলল।

”রাজেনকাকা দেখিয়ে দিয়েছে। … সার্ভিস করা দেখবে মা?”

”ঘরের মধ্যে সার্ভিস—ফোরহ্যান্ড কিচ্ছু নয়। সবকিছু বাড়ির বাইরে।”

”তুমি কবে সেরে উঠবে মা?”

তপতীর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি তাঁকে সেরে উঠতেই হবে। ডাক্তার বলেছেন, দিন সাতেকের মধ্যেই শোওয়ার ঘর থেকে বসার ঘর পর্যন্ত হাঁটার অনুমতি দেবেন।

অবশেষে তিনি এক বিকেলে হাঁটলেন দুই ছেলের কাঁধে হাত রেখে। এক—পা এক—পা করে বসার ঘরে পৌঁছতেই হাততালি দিয়ে উঠল মিনু আর চিনু। দু’হাত তুলে তপতী মুঠো ঝাঁকালেন। ”পেরেছি।” কথাটা দুই ছেলের মাথার মধ্যে ঢুকে গেল মায়ের দুই হাত তোলা ছবিটাকে সঙ্গে নিয়ে।

কোর্টের উদ্বোধনের জন্য ঠিক হল রবিবারের বিকেল। তন্ময়, রাজেন আর শুভা শনিবার সন্ধ্যায় ক্লাবে গিয়ে টেবল ঘুরে—ঘুরে সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানাল। নোটিশ বোর্ডেও একটা বিজ্ঞপ্তি শুভা সেঁটে দিল। প্রত্যেকেই তাঁরা আসবেন। প্রতিভা মজুমদার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন তপতী সম্পর্কে। ”দেখাল বটে তপতী! একা মেয়েমানুষ সাহস করে শুরু করেছিল বলেই তো আজ ছেলেমেয়েদের জন্য একটা খেলার ব্যবস্থা হল। তার ওপর ভাবো কী ঝঞ্ঝাটাই না পোয়াতে হল, প্রথমে ছোট ছেলেটা, তারপর নিজে পড়ল বিছানায়। অবশ্য রাজেন আর তন্ময়বাবু যে পরিশ্রম করে শেষ করলেন, সেটাও বলতে হবে।”

আর—একজন বললেন, ”কত খরচ হল বলুন তো? ক্লাব থেকে একটা পয়সাও তো দেওয়া হয়নি!”

”আচ্ছা, টেনিস তো খেলা হবে, কিন্তু খেলাটা তো শিখতে হবে, নাকি ছেলেমেয়েরা আপনাআপনিই শিখে যাবে?”

”তা বটে! মিসেস ঘোষাল তো মোক্ষম প্রশ্ন করেছেন!” প্রতিভা ঝুঁকে বসলেন। ”খেলা শেখাতে তো মাস্টার লাগবে।”

”মাস্টার নয়, মাস্টার নয়, কোচ লাগবে বলুন।” শুধরে দিলেন চন্দ্রিমা দত্ত।

”ওই হল। তা বাপু কোচ কোত্থেকে আসবে? তাকে তো পয়সা দিতে হবে।”

”কেন, মিসেস বসুমল্লিক নিজেই কোচিং করবেন। শুনেছি তো একসময় খেলতেন—টেলতেন, অনেক কাপ—মেডেলও পেয়েছেন।”

”আরে রাখো তো তোমার কাপ—মেডেল, অমন কাপ—মেডেল অনেকের ঘরেই পাবে।” প্রতিভা চাপা ধমক দিলেন। ”একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে সেটা কি লক্ষ করেছ? বিয়ের আগে একটা পা ভেঙেছিল, এবার আর—একটা পা—ও গেছে। ও শেখাবে খেলা!”

”প্রতিভাদি, কাল আসছেন তো?”

”কাল তো রোববার। কখন লোকজন এসে পড়ে তার কি ঠিক আছে?”

”যা বলেছেন। আমাকেও কাল দিদির বাড়ি যেতে হবে।” মিসেস ঘোষাল হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

পরদিন বিকেল পাঁচটায় ভক্সহল থেকে ওঁরা নামলেন ক্লাবের সামনে। তন্ময়ের হাত ধরে তপতী গাড়ির বাইরে পা রেখেই টলে পড়েছিলেন। মিনু তাড়াতাড়ি মায়ের হাত চেপে ধরল।

”আমি ঠিক আছি মিনু … হাত ছেড়ে দে।”

রাজেন এগিয়ে এল, সঙ্গে শুভা। কোর্টের ধারে একটা টেবল। তাতে রাখা হয়েছে দুটো র‌্যাকেট আর দুটো বল। চেয়ারে বসে আছেন ছ’—সাতজন। নেট খাটানো রয়েছে। চুনের দাগ দুপুরে টানা হয়েছে। শুভা হাত ধরে এনে তপতীকে টেবলের পেছনে একটা চেয়ারে বসিয়ে বলল, ”বউদি আপনার র‌্যাকেট কই?”

”গাড়িতে আছে।”

তপতী আজই প্রথম দেখলেন তাঁর বহু কাঙ্ক্ষিত টেনিস কোর্টটিকে। তাঁর মুখ প্রসন্নতায় ভরে উঠল। গৌতম, অনিরুদ্ধর হাফশার্ট, শর্টস, মোজা, কেডস মিনুর মতোই সাদা। ওদের বাবা ও মায়েরাও এসেছেন। কিন্তু কোর্টের ধারেকাছে কোনও লোক নেই, শুধু কান্তি ছাড়া।

”আজ আমাদের টেনিস কোর্টের উদ্বোধন হবে।” রাজেন এবার টেবলের ধারে দাঁড়িয়ে স্বরটা একটু উঁচু করে বলল, ”বক্তৃতা শোনাতে গেলে যত শ্রোতার দরকার হয়, তত লোক এখানে নেই। সুতরাং বেশি কথা বলব না। ছোটদের নিয়মিত খেলা দরকার, তারা খেলতে চায়। এই সত্যি কথাটা আমরা, বড়রা, বুঝতে চাই না। কিন্তু ছোটরা নিজেরা খেলার ব্যবস্থা করতে পারে না, পারার কথাও নয়। সংগঠন না থাকলে খেলা যায় না, আর এইটুকু—টুকু ছেলেমেয়ের পক্ষে একটা সংগঠন গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। এটা গড়ে দেয় বড়রা।

”এখানে ছোটদের খেলাধুলার কোনও ব্যবস্থা নেই, এই অভাবটা লক্ষ করেই শ্রীমতী তপতী বসুমল্লিক প্রথম উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসেন। কাজ শুরুও করেন, কিন্তু একটা দুর্ঘটনায় তাঁকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়তে হয়। তিনি যে—কাজ শুরু করেছিলেন, অবশেষে আমরা তাকে সম্পূর্ণ করতে পেরেছি। আমি বিশেষ করে ধন্যবাদ দেব গৌতম আর অনিরুদ্ধর অভিভাবকদের। তাঁরা তাঁদের ছেলেদের খেলার জন্য এখানে পাঠিয়ে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। আর ধন্যবাদ জানাব অফিসার্স ক্লাবের কর্মী কান্তি সাঁতরাকে। সে তদারক না করলে এই কোর্ট তৈরি হয়ে উঠতে পারত না। যাই হোক, বেশি কথা বলব না বলেও বলে ফেললাম। এবার অনুরোধ করব বউদি আপনি কোর্টে এসে প্রথম সার্ভিসটা করুন।”

তপতী চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই কান্তি ছুটে এল সাত—আটটা জবাফুলে গড়া একটা স্তবক নিয়ে। ”মেমসাব, আপনার জন্য।”

স্তবকটা হাতে নিয়ে টেবলে রাখলেন। গাড়ি থেকে তন্ময় তপতীর ডানলপ র‌্যাকেটটা নিয়ে এসেছেন, সেটা স্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিলেন।

”ঠাকুরপো, সার্ভিস তো করব, রিসিভ করবে কে?”

”কেন, আমি! … র‌্যাকেট তো আমিও এনেছি, শুভা, দাও তো।”

বল হাতে তপতী দাঁড়ালেন বেস লাইনে। তাঁর পায়ে নতুন কেডস। বাঁ পায়ের পাতা লাইনের বাইরে রেখে বাঁ হাতের মুঠোয় বলটা চেপে ধরে সামনে তাকালেন এবং তাকিয়েই ভয় পেয়ে গেলেন। তাঁর মনে হচ্ছে নেটটা অনেক দূরে। জীবনে তিনি টেনিস কখনও খেলেননি। সার্ভ করে বলটাকে নেটের ওপারে তিনি কখনোই পাঠাতে পারবেন না। সবাই কত আগ্রহ আর কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু ওদের মুখগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে, পা কাঁপছে। খুব অন্যায় করতে চলেছেন বলে তাঁর মনে হল। এভাবে লোক হাসাতে কেন তিনি রাজি হলেন?

”মা,” তপতী চমকে পেছনে তাকালেন। গুটিগুটি চিনু কখন যেন তাঁর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে তার রুগণ দুটি হাতের মুঠি তুলে ঝাঁকাল, ”মা, পেরেছি বলো।”

বাঁ হাত সামনে বাড়িয়ে তিনি বলটা শূন্যে ছুড়লেন। হাতটা আকাশমুখো সোজা হল। বল থেকে চোখ সরালেন না। র‌্যাকেট ধরা ডান হাতটা পেছনে টানলেন। শিরদাঁড়া, পিঠ পেছনে বাঁকল। তারপর সামনের দিকে একটা ধাক্কায় র‌্যাকেটটা আছড়ে পড়ল নেমে আসা বলের ওপর।

সবাইকে অবাক করে বলটা নেটের মাথা ঘেঁষে ওপারে গিয়ে পড়ল। রাজেন বলটা রিটার্ন করার জন্য দু’পা এগিয়ে এসে থমকে দাঁড়াল। তপতী মুখ থুবড়ে পড়ে গেছেন,পায়ে জোর না থাকায়।

”মা পেরেছ, দেখো।”

।।৫।।

”হল না, হল না… আবার মারো। দেখালাম তো, কতবার বলেছি র‌্যাকেটটা এইভাবে উঁচু করে, কাঁধ পর্যন্ত তুলে পেছনে টানো, তারপর নীচের দিকে নামাও।”

তপতী একটা কাল্পনিক বল লক্ষ্য করে ধীরগতিতে ফোরহ্যান্ড মারলেন। নেটের ওধারে দুটি ছেলে গভীর মনোযোগে তাঁকে নকল করে র‌্যাকেট চালাল।

”অনিরুদ্ধ, তোমার চোখ বল থেকে কিন্তু সরে গেল আর মিনু ফোরহ্যান্ড মারার সময় বাঁ পায়ে ভর রেখে ফিনিশটা ঠিক হচ্ছে না। …আচ্ছা, আবার আমি বল দিচ্ছি।” তপতী বল মারলেন অনিরুদ্ধর ডান দিকে। বলটা তার পাঁচ গজ আগে পড়ে উঠে এল কাঁধের ওপর। অনিরুদ্ধর ফোরহ্যান্ড বলের নাগাল পেল না।

”মুভ। মুভ, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টেনিস খেলা যায় না। … লক্ষ করো কোথায় বলটা পড়ছে, অনুমান করো কতটা লাফাবে, সেইমতো তুমিও এগিয়ে এসো। দু’পা এগোলেই বলটা পেয়ে যেতে… আচ্ছা, আবার …।”

গৌরবর্ণ, এগারো বছরের অনিরুদ্ধর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। প্রায় আধঘণ্টা ধরে তাকে আর মিনুকে ফোরহ্যান্ড গুলে খাওয়াতে চেষ্টা করছেন তপতী। দু’জনকে অন্তত তিরিশবার করে তিনি ফোরহ্যান্ড মারিয়েছেন। মিনু তাঁর কাছে সমস্যা নয়, কিন্তু গোলগাল, ভারী দেহের অনিরুদ্ধ তাঁকে বিব্রত করছে। ছেলেটির চলাফেরা কিঞ্চিৎ গদাইলশকরি, চটপট মাথাটাও কাজ করে না। কোর্টের ধারে চেয়ারে অনিরুদ্ধর ঠাকুমা চোখ কুঁচকে বসে রয়েছেন।

চিনুর হাতে র‌্যাকেট। সে একাই খেলছে নিজের সঙ্গে। বল আকাশের দিকে মেরে ছুটে যাচ্ছে জমিতে পড়ার আগেই বলটাকে আবার আকাশে তুলে দেওয়ার জন্য। গৌতম আজ আসেনি। সে থাকলে চিনু তার সঙ্গে বল দেওয়া—নেওয়া করে, যখন তপতী ব্যস্ত থাকেন মিনু আর অনিরুদ্ধকে নিয়ে।

”এবার মিনু।”

তপতী একটু জোরেই বল পাঠালেন এবং তাঁকে অবাক করে মিনু সপাটে বলটা ফেরত দিল তিন ফুট উঁচু নেট ঘেঁষে, ফোরহ্যান্ডে। মারটাকে তারিফ জানাবার সুযোগ পাওয়ার আগেই তাঁর র‌্যাকেটের দু’গজ বাইরে দিয়ে বলটা বেরিয়ে গিয়ে ক্লাবের সুরকির রাস্তা পেরিয়ে একটা নিমগাছের গুঁড়িতে ধাক্কা দিল। তপতী বলটা পাওয়ার জন্য দু’পা দৌড়বার চেষ্টা করেই থেমে গিয়ে হতাশ চোখে বলটার দিকে তাকালেন। চিনু ছুটে গেল বলটা ফিরিয়ে আনতে।

বলটা হাতে নিয়ে চিনু আলতো করে আকাশের দিকে ছুড়ে নেমে আসার সময় র‌্যাকেট দিয়ে মাথার ওপর থেকে হিট করল। তপতী দেখে অবাক হয়ে গেলেন। প্রায় নিখুঁত সার্ভিস! ওইটুকু ছেলে। কী চমৎকার তাঁকে নকল করে ফেলেছে।

”চিনু, তুই দাদার পাশে গিয়ে দাঁড়া। যেরকম করে ফোরহ্যান্ড দেখিয়ে দিয়েছি, মারতে পারবি?”

অনেকখানি মাথা হেলিয়ে চিনু বলল, ”হ্যাঁ—আআ।”

তপতী পরপর দশটা বল চিনুকে দিলেন আর সদ্য ছ’বছর পার হওয়া বাচ্চচা ছেলেটি হুবহু মাকে নকল করে ফোরহ্যান্ড মারল। গায়ে জোর কম, দুটো বল নেটে আটকে গেল, বাকিগুলো এপারে এল দুর্বল গতিতে।

”অনিরুদ্ধ, দেখলে তো? ওইটুকু ছেলে কী সুন্দরভাবে শট নিল। তাও ওকে কিছুই শেখাইনি। আর তোমাকে কতবার দেখালাম তবু তুমি পারছ না। নাও, আবার করো।”

তপতী অনিরুদ্ধকে নিয়ে আবার শুরু করলেন। কোর্টের একধারে মিনু আর চিনুও ফোরহ্যান্ড আয়ত্ত করার কাজে মন দিল। রীতিমতো গরম পড়ে গেছে। বাতাস নেই,গাছের পাতা নড়ছে না। দরদর ঘামছে সবাই। মহাদেবপুরের একটা কিনারে নির্জন এলাকায় এই ক্লাব। সন্ধ্যার আগে ক্লাব মেম্বাররাও এদিক মাড়ান না। এদিকে লোকচলাচলও কম। তবু পথিকরা, সাইকেল আরোহীরা পথ দিয়ে যাওয়ার সময় টেনিস কোর্টের দিকে একবার তাকাবেই। তাদের দ্রষ্টব্য বিষয় হল তপতী। সাদা তাঁতের শাড়ি গাছকোমর করে বাঁধা, পায়ে কেডস জুতো, অবিরাম চেঁচিয়ে যাওয়া একটা বউ, আর চারটি বা তিনটি বাচ্চচা ছেলে প্রকাশ্যে একটা অপরিচিত খেলা খেলছে, হোক না শিল্পশহর বা কলকাতা থেকে মাত্র আটাশ মাইল দূরে, এখানে সেটা দেখার মতো ব্যাপার।

কিন্তু ক্লাব মেম্বারদের বাড়ির কেউ কৌতূহলবশে বা নিছক উৎসাহ দিতেও বিকেলে আসেন না। রাজেনের কাজের ছুটি যখন হয় তখন তপতী ছেলেদের নিয়ে বাড়ির পথে। তবু ছুটির দিনে কলকাতার আড্ডা ফেলে দু’—তিনবার সে এসেছে।

”বউদি, বাচ্চচাদের আমি ঠিক হ্যান্ডল করতে পারি না, আমার ধৈর্যটা একটু কম। তা ছাড়া ছুটির পর এত টায়ার্ড লাগে!” রাজেন বলেছিল। ”কিন্তু প্রাথমিক যা করা দরকার, অ আ ক খ শেখানো, সেটা তো আপনি ভালভাবেই শেখাচ্ছেন।”

”ইলাহাবাদে যার কাছে প্রথম শিখেছিলাম, তিনি যা—যা করেছিলেন আমি সেটাই করে যাচ্ছি ঠাকুরপো। কিন্তু আমারও তো বিদ্যের একটা সীমা আছে। ওপরের দিকের খেলার কিছুই জানি না। খেলার বই কি ম্যাগাজিন, বিশেষ করে টেনিসের, কিছুই আমাদের দেশে নেই যে, পড়ে—পড়ে শিখব। বিদেশ থেকে হয়তো বইটই আসে, কিন্তু কোথায় পাওয়া যায় তাও জানি না।

”ছোটবেলায় আমরা খবরের কাগজে উইম্বলডনের রেজাল্ট কি দু—একটা ছবি দেখতাম। বিয়ের আগে দাদার কাছে অনেকের নাম শুনতাম। এখনও কয়েকটা নাম মনে আছে—ডোনাল্ড বাজ, ববি রিগস, ক্র্যামার, বরোত্রা, পাঞ্চো গঞ্জালেস; মেয়েদের মধ্যে লুই ব্রাও, মুডি, হার্ট। বিয়ের পর খেলা থেকে এতদূরে চলে গেলাম যে, খবরের কাগজের খেলার পাতাটাও আর দেখতাম না।” তপতীর স্বর ছেলেবেলার স্মৃতি আর বর্তমানের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে যেন বিষণ্ণতায় ভরে রয়েছে।

”বউদি, ছোটদের খেলা শেখানোর সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি কী জানেন? ভাল প্লেয়ারদের খেলা ওদের নিজের চোখে দেখানো। ওরা তা হলে নিজেরাই বুঝে নিতে পারবে কোনটা করতে হবে আর কোনটা করতে হবে না। একটা ছেলে দশটা বই পড়ে যা জানবে,মাত্র একটা ভাল ম্যাচ দেখেই সেটা সে শিখে নিতে পারবে। অবশ্য যদি তার মনে ইচ্ছা আর ঘটে কিছু বুদ্ধি থাকে। আর কিছুদিন পরই তো সাউথ ক্লাবে ইস্ট ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ানশিপ হবে। সুইডেনের হলস্ট্রোম ইন্ডিয়ান সার্কিটে এখন খেলছে,ওকে আনার চেষ্টা চলছে। আমাদের কৃষ্ণন, প্রেমজিত, জয়দীপ তো থাকবেই। ফাইনালের দিন ছেলেদের নিয়ে চলুন।” রাজেন অনুরোধ করেছিল খুব আন্তরিকভাবে। ”আমি আপনাদের সবাইকে নিয়ে যাব। এই বয়সে ওদের খেলা দেখাটা খুব দরকার।”

কিন্তু এখন তিনি অনিরুদ্ধকে বারবার বল দিয়ে দেখিয়ে এবং মুখে বলেও, ফোরহ্যান্ড মারার সঙ্গে সঙ্গে বাঁ কাঁধ কতটা ঘুরবে আর র‌্যাকেট কতটা উঠবে ফলো—থ্রুতে সেটা ঠিক করাতে পারলেন না।

”মা, অনিরুদ্ধটা একটা ভোঁদা।” মিনু বলে উঠল। চিনুর সঙ্গে খেলতে খেলতে সে লক্ষ করছিল তপতীর নাকাল অবস্থাটা।

”তুমি বরং আমাদের সঙ্গে খেলো।”

তপতীও তাই ভাবছিলেন,শুধুই পণ্ডশ্রম করে যাচ্ছেন। বাড়ির আদুরে এই ছেলেটির টেনিস কেন, কোনও খেলাই হবে না। বরং চিনু—মিনুকে বল দিয়ে গেলে ওরা ঝালাই করার কাজে এগোতে পারবে।

”ঠিক আছে অনিরুদ্ধ, তুমি এখন একটু রেস্ট নাও, আর দেখো ওরা কীভাবে স্ট্রোক করছে।”

তপতীর কথা সবে শেষ হয়েছে তখন একটা গম্ভীর গলা বলে উঠল, ”অনি, চলে আয়। আর তোকে খেলতে হবে না।” গলাটা অনিরুদ্ধর ঠাকুমার। তিনি মিনুর কথা শুনতে পেয়েছেন।

বাধ্য নাতির মতো অনিরুদ্ধ ঠাকুমার কাছে হাজির হল।

”বাড়ি চল।” ঠাকুমা উঠে দাঁড়ালেন। তপতী ছুটে গেলেন ওদের কাছে।

”সে কী মাসিমা, অনিরুদ্ধকে যে আবার প্র্যাকটিস করাব।

”করিয়ে কাজ নেই, ভোঁদা ছেলের পেছনে সময় নষ্ট না করে বরং নিজের ছেলেদেরই দেখো।” ঠাকুমা আর রাগ চাপতে পারলেন না। ”আমার নাতিটাকেই শুধু খাটিয়ে যাচ্ছ, যেন ও একটা কুলিমজুর। কই, নিজের ছেলেদের তো খাটাচ্ছ না। আমি তখন থেকে বসে বসে লক্ষ করে যাচ্ছি তুমি খালি ওর পেছনেই লাগছ।…দরকার নেই বাপু অমন খেলায়…এমন একচোখামি জম্মে কখনও দেখিনি, আয়।” ঠাকুমা অনিরুদ্ধর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিলেন।

”আমি তো ওর ভালর জন্যই খাটাচ্ছি মাসিমা।” তপতীর গলায় করুণ মিনতি। যাও—বা দুটো ছেলে পেয়েছেন, তার একটি যদি চলে যায় তা হলে মিনু—চিনু ছাড়া তো কিছুই থাকবে না!

”না, না, আর ভাল করতে হবে না, দেখেছ বাছার মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। আয়, খেলে তো চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করবি।”

”ঠাকুমা, বাবা গাড়ি নিয়ে আসবে যে!” অনিরুদ্ধ নিরস্ত করার চেষ্টা করল। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় অনিরুদ্ধর বাবা ওদের তুলে নিয়ে যান। নাতির কথা শুনে ঠাকুমা বসে পড়লেন।

কয়েক সেকেন্ড তপতীর নিজেকেই ভোঁদা মনে হল। তারপর ধীরে—ধীরে তাঁর দৃষ্টি কঠিন হয়ে উঠল। চোয়ালের পেশি দপদপ করে উঠল কয়েকবার। তিনি দ্বিতীয়বার অনুরোধ করলেন না।

”মিনু, এবার ভলি…দেখছিস তো আমার দুটো পা—ই পঙ্গু, তুই কি আমাকে কষ্ট দিবি? যদি কষ্ট না দিতে চাস, তা হলে এমনভাবে ভলিতে রিটার্ন করবি যেন আমাকে এক পা—ও নড়তে না হয়, সব বল যেন আমার র‌্যাকেটে আসে।…চিনু, যা বললাম শুনলি?”

দুই ভাই মাথা হেলাল। আড়চোখে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে নিল। তপতী সহজ করে বল জোগাতে লাগলেন। একবার মিনুকে, তারপর চিনুকে। মুখের সামনে, বুকের সামনে, কাঁধের পাশে, মাথার ওপর থেকে আসা জমি না ছোঁয়া বলগুলো দুই ভাই নেটের ওধারে মায়ের র‌্যাকেটে পৌঁছে দিতে লাগল। যদি কোনও রিটার্ন তপতীর থেকে একটু আগে বা একটু বেশি দূর হয়ে যায় তা হলে অন্য ভাই উৎকণ্ঠিত চোখে পাশের দিকে তাকায়।

এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ওরা বল ফেরাচ্ছে। তপতী এবার বলগুলো ফোরহ্যান্ডের দিকে একটু—একটু করে সরাতে লাগলেন। ডান হাত লম্বা করে পাশে বাড়িয়ে ওদের ভলি করতে হবে। দু’বার চিনু পারল না, ওর থেকে বলিষ্ঠ মিনু পারল। তপতী একটা ব্যাপারে সচেতন হলেন, গায়ের জোর না বাড়ালে তাঁর ছেলেরা খেলোয়াড় হতে পারবে না। এই প্র্যাকটিস বেশিক্ষণ নেওয়ার মতো গায়ের তাগদ চিনুর নেই, মিনুর কিছুটা আছে। কিন্তু যথেষ্ট নয়।

নিমগাছের সামনে অনিরুদ্ধর বাবার গাড়ি এসে থামল। তিনি গাড়ি থেকে নেমে দেখলেন, ছেলে চেয়ারে বসে তার ঠাকুমার সঙ্গে। অন্য দুটি ছেলে তাদের মায়ের সঙ্গে খেলছে। ভ্রূ কুঁচকে গেল তাঁর।

”অনি খেলছ না?” বাবা জানতে চাইলেন।

অনিরুদ্ধ ঠাকুমার দিকে তাকাল। ঠাকুমা ব্যাজার মুখে বললেন,”ওঠ।” নাতি চেয়ার থেকে উঠল র‌্যাকেট হাতে।

”কী ব্যাপার!” বিস্মিত বাবা তাঁর মায়ের দিকে তাকালেন।

”খেলবে না অনি।” ঠাকুমা নাতিকে টানতে টানতে গাড়ির দিকে রওনা হলেন।

”কী ব্যাপার মিসেস বসুমল্লিক, অনি খেলবে না কেন?”

তপতী ঘামে ভেজা মুখ আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন,”আমি ঠিক বলতে পারব না, তবে মাসিমার কথা থেকে মনে হল উনি পছন্দ করছেন না অনিরুদ্ধর ওপর কোনওরকম চাপ দিই। ওর ফোরহ্যান্ডটা ঠিক করার জন্য বারবার ওকে বল দিচ্ছিলাম। মাসিমা সেটাকে কুলিমজুরের মতো খাটানো মনে করলেন।”

অনিরুদ্ধর বাবার মুখ অপ্রতিভ দেখাল। তিনি আড়ষ্ট স্বরে বললেন, ”খেলাধুলো করতে গেলে তো খাটতেই হবে। আর খাটবার জন্যই তো ওকে এখানে পাঠিয়েছি। দিন—দিন কী রকম মোটা হয়ে যাচ্ছে!”

তপতীর মনে হল ভদ্রলোক তাঁর মায়ের উলটোটি। ছেলেকে মাত্রাতিরিক্ত যত্ন—আদর দিয়ে নষ্ট করতে চান না।

”অনিরুদ্ধর শরীর যথেষ্ট ফিট নয় বলেই ওর বডি কোঅর্ডিনেশন খারাপ। ওর হাত, পা, মাথা, কোমর একসঙ্গে কাজ করে না। সেটাই যথাসম্ভব করাবার চেষ্টা করছিলাম।”

”ঠিকই করেছেন। আমি ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে কী জানেন, আমার মার আবার নাতি—অন্ত প্রাণ, আমার স্ত্রীও একমাত্র ছেলেকে নয়নের মণি করে রেখেছেন। মার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বলাও যায় না। অনি সম্পর্কে একটু কড়া হলেই সংসারে অশান্তি বেধে যায়, তাই আমি আর কিছু বলি না। যাই, ওকে খেলতে আসার জন্য বলি গিয়ে।” হতাশ এবং তিক্ত মুখ করে তিনি গাড়ির দিকে এগোলেন।

ওরা তিনজন গাড়ির দিকে তাকিয়ে। অনিরুদ্ধর বাবা তাঁর মার সঙ্গে কথা বলছেন। মা হাত নেড়ে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে কিছু বলতে শুরু করলেন। তারপর গাড়ির দরজা খুলে নাতিকে নিয়ে উঠে বসলেন। তপতীদের দিকে একবার তাকিয়ে অনিরুদ্ধর বাবা মাথা নামিয়ে গাড়িতে উঠে স্টিয়ারিং ধরলেন।

”মা, অনি বোধহয় আর আসবে না।” মিনু বলল।

”না।”

”ভালই হল, মা শুধু গৌতম আর আমাদেরই এবার থেকে শেখাবে।” চিনু তারিয়ে মন্তব্য করল।

”গৌতমও আসবে না,” মিনু বলল, ”জানো মা, গৌতম আমাকে বলেছে টেনিস ওর ভাল লাগে না, ওর ভাল লাগে ক্রিকেট। ও বলেছে টেস্ট ম্যাচ খেলবে। হাফ প্যান্ট পরে খেলার থেকে ফুলপ্যান্ট পরে খেললে দেখতে সুন্দর লাগে।”

”মিনু আয়, ভলি এখনও বাকি।” তপতী কোর্টের দিকে এগোলেন।

”মা আমি?” চিনুর চোখে ভীরু আবেদন। তপতী ছোট ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন।

”তোর শরীরের সামর্থ্যের থেকে বেশি হয়ে যাচ্ছে না? একদিনেই এতটা করা ভাল নয়।” কথাগুলো বলে কী ভেবে তিনি মত বদলালেন, ”আচ্ছা আয়।”

রোদ পড়ে আসছে। আকাশ ম্লান, দূরের গাছপালা,বাড়ির রং ধূসর—কালো হয়ে উঠেছে। তপতী এইরকম সময়েই খেলা বন্ধ করে ছেলেদের নিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরেন।

”মা, আর পাঁচটা।” মিনু বলল।

তপতী পাঁচবার ভলির জন্য বল দিলেন। ”আর নয়, এবার বাড়ি।”

”মা, আরও পাঁচটা, এই শেষ, আর বলব না।” মিনু মিনতি জানাল।

তপতী দু’বার দিলেন চিনুকে। ব্যাডমিন্টনের শাটলকক ফেরাবার মতো করে মুখের সামনে থেকে ভলি মেরে সে উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে রইল। মাকে এক পাও নড়তে হল না দেখে আনন্দে ভরা চোখে সে দাদার দিকে তাকাল।

”মিনু, লাস্ট বল।” তপতী ইচ্ছে করেই বলটা মিনুর ডান দিকে প্রায় পাঁচ গজ দূরে উঁচু করে ফেললেন। দেখা যাক ছেলেটা পারে কি না। মিনু আশা করেনি তার অতদূরে বল আসবে। হুঁশ হওয়া মাত্র সে ডান দিকে দ্রুত দু’পা ছুটে ঝুঁকে র‌্যাকেট বাড়িয়ে দিল। কোর্ট প্রায় ছুঁয়েছে সেই অবস্থা থেকে সে বলটাকে তুলে দিল। আর নিজে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আলতো হয়ে উঁচুতে উঠে নেট পেরিয়ে বলটা অবাক তপতীর মাথার ওপর নেমে এল।

ধড়মড়িয়ে কোর্ট থেকে দাঁড়িয়ে উঠে দু’হাত তুলে মিনু লাফাল। ”পেরেছি…মা, আমি পেরেছি।”

.

ইস্ট ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ানশিপের ফাইনাল। হলস্ট্রোম খেলছে রামনাথন কৃষ্ণনের সঙ্গে।

মিনু আর চিনু বসেছে রাজেনের দু’পাশে। তপতী ও তন্ময় আসেননি। তপতীর বাঁ পায়ে যেখানে কোদালের আঘাতটা লেগেছিল সেই জায়গাটা গত রাতে ফুলে উঠে যন্ত্রণা শুরু হয়। ডাক্তার এসে ইঞ্জেকশন, ওষুধ দিয়ে গেছেন। তাঁর অবস্থা হাঁটাচলার মতো নয়। তন্ময় তাঁর জন্যেই বাড়িতে রয়ে গেছেন।

চতুর্থ সেট, নবম গেম। হলস্ট্রোম ৩—৫ এবং নিজের সার্ভিসে ০—৩০ পিছিয়ে। সে প্রথম সেট জিতেছিল ৬—৪, পরের দুটি সেট হেরেছে ১—৬; ২—৬। খেলা প্রায় দু’ ঘণ্টা গড়িয়েছে, জয়ের জন্য কৃষ্ণনের দরকার আর মাত্র দুটি পয়েন্ট।

হলস্ট্রোম সার্ভ করছে। রাজেন আড়চোখে তার ডানপাশে বসা চিনুর ডান হাতের আঙুলগুলোর দিকে তাকাল। হলস্ট্রোম বলধরা বাঁ হাত সামনে বাড়িয়ে উঁচুতে তুলতে—তুলতে বলটাকে শূন্যে ছুড়ে দিল। রাজেন দেখল, বাচ্চচা ছেলেটার বাঁ হাত গলার কাছে উঠে ফুলের পাপড়ির মতো আঙুলগুলো খুলে গিয়ে কাল্পনিক বলটাকে শূন্যে ভাসিয়ে দিল। ডান হাতের মুঠো কাঁধের কাছে, র‌্যাকেট ধরা কব্জিটা মোচড়ানো, পিঠটা ধনুকের মতো বাঁকিয়ে চেয়ারে কাঁধ ঠেকে গেছে। তারপরই চিনুর কোমর থেকে ঊর্ধ্বাঙ্গ হলস্ট্রোমের সার্ভিসের সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে ঝুঁকল আর ডান কব্জিটা চাবুক মারার মতো সামনে ঝাপটা দিল।

রাজেনের অবাক চোখ হঠাৎ চিনুর নজরে আসতেই সে লজ্জা পেয়ে হাত দুটো কোলের কাছে গুটিয়ে নিল। হলস্ট্রোমের সার্ভিস কৃষ্ণনের ডান দিকে সার্ভিস কোর্টের মাঝামাঝি পড়েছে, সে ডান দিকে সামান্য হেলে সপাটে ফোরহ্যান্ড রিটার্ন মারল ডাউন দ্য লাইন। বেস লাইনের ছ’ ইঞ্চি আগে সাইড লাইনে বল পড়ল। উত্তেজনায় মিনু উঠে দাঁড়িয়েছে।

”লাভ ফার্টি।” মাইকে ঘোষণা করলেন আম্পায়ার।

”মারটা মনে থাকবে তো?” রাজেন ফিসফিস করে বলল। মিনু মাথা হেলাল। ”কৃষ্ণনের ব্যাক হ্যান্ড মনে থাকবে তো?”

”হ্যাঁ। আর একটু হলেই বলটা বাইরে পড়ত।…রাজেনকাকা, কৃষ্ণন খুব প্র্যাকটিস করে?”

”করে, আর সেজন্যই মারগুলো এত মাপা হয়।”

”ফিফটিন ফর্টি।”

হলস্ট্রোমের লব কৃষ্ণনের মাথার ওপর দিয়ে বেস লাইনের কাছে পড়েছিল, কৃষ্ণন পিছু হটতে পারেনি।

”দেখলে মিনু, ফিজিক্যাল ফিটনেসে কৃষ্ণন কত পিছিয়ে। শুধু শট নিতে পারলেই হয় না, খুব চটপটে খুব ফাস্ট মুভ করার জন্য শরীরও তৈরি করতে হবে।”

”দৌড়লে হবে?” চিনুর প্রশ্ন।

”বড় প্লেয়াররা রোজ সাত—আট মাইল দৌড়য়! ব্যায়ামও করে।” রাজেন ফিসফিসিয়ে বলল।

”দাদা, আমরা কতটা দৌড়ই রে?”

”চুপ, চুপ।” রাজেন ঠোঁটে আঙুল দিল। হলস্ট্রোম সার্ভ করছে। ম্যাচে এই নিয়ে প্রায় আশিবার। এত সার্ভিস দেখার পর, রাজেনের মনে হল, বাচ্চচা দুটো নিশ্চয় এর ছবি মনের মধ্যে তুলে রেখে দেবে। প্রচণ্ড জোরালো সার্ভিস করে এই সুইড। কিন্তু শুধু জোরে সার্ভ করতে পারলেই যে ম্যাচ জেতা যায় না, কৃষ্ণন সেটা আজ বুঝিয়ে দিয়েছে।

”থার্টি ফর্টি।” হলস্ট্রোমের সার্ভিস এস হয়েছে।

আবার সার্ভ করল। ফোরহ্যান্ড রিটার্ন কৃষ্ণনের। বলটা উঁচু হয়ে মাঝ কোর্টে। ডান দিকে ভলি মারল হলস্ট্রোম। কৃষ্ণন যেন আগাম জানতই বল কোথায় আসবে। বাঁ দিকে সরে গিয়ে সে অপেক্ষা করছিল। হলস্ট্রোমের কোমরের পাশ দিয়ে আড়াআড়ি মারা একটা ঝলসানো ব্যাকহ্যান্ডে বলটা বেস লাইনের কাছে পড়ে বেরিয়ে গেল। বিস্ফারিত চোখে হলস্ট্রোম একবার তাকিয়ে দেখে নেটের দিকে এগিয়ে গেল হাত বাড়িয়ে। হাজার দুয়েক লোক দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিচ্ছে, তাদের সঙ্গে মিনু—চিনুও। উত্তেজনায় দু’জনের মুখ টসটস করছে।

মহাদেবপুরে ফেরার সময় গাড়ি চালাবার ফাঁকে রাজেন পাশে বসা দুই ভাইকে বলল, ”আজ যা—যা দেখলে সব যেন মনে থাকে।”

”অত জোরে জোরে মারলে যদি মায়ের পাশ দিয়ে বল বেরিয়ে যায়!” চিনুর সামনে এখন এটাই প্রকাণ্ড সমস্যা।

”তুমি কি এখনই অত জোরে জোরে মারতে পারবে?” হালকা সুরে রাজেন বলল।

”না। তবে দাদা জোরে মারতে পারে।”

”ধ্যাত, জোরে মারি নাকি? জোরে মারলে বল এধার—ওধার চলে যায়, মার তাতে অসুবিধে হবে না? জানেন রাজেনকাকা, মা যেখানে দাঁড়ায় ঠিক সেই জায়গাটা লক্ষ্য করে আমরা দু’জনেই বল মারি। আস্তে না মারলে কি ঠিক জায়গায় বল পাঠানো যায়?” বিচক্ষণের মতো মিনু বলল।

”তা বটে, আস্তে আস্তে মেরেই শুরু করতে হয়। কিন্তু মিনু, মার অসুবিধের কথা ভেবে কতদিন তুমি আস্তে মারবে? জোরে জোরে না মারলে বড় প্লেয়ার হবে কী করে? তুমি তো বড়ই হতে চাও, চাও না?”

রাজেনের কথাগুলো এবার মিনুকে সমস্যায় ফেলে দিল। মাকে সে ভালবাসে, আবার বড় প্লেয়ার হওয়ার ইচ্ছাটাও কৃষ্ণনকে দেখার পর তার মধ্যে আলোড়ন তুলছে। তার ছোট্ট মাথা এমন একটা কঠিন অবস্থায় আগে কখনও পড়েনি।

”তুমি তো দাবা খেলেছ। রাজার কিস্তি হতে পারে এমন একটা অবস্থা তো খেলায় একসময় আসবেই। সেজন্য তুমি আগে থেকে নিশ্চয়ই ভেবে রাখো কী কী চাল দেবে, রাখো না কি?” রাজেন সামনের ভিড়—রাস্তায় রাখা সতর্ক দৃষ্টিটা পলকের জন্য ঘুরিয়ে মিনুর মুখটা দেখার চেষ্টা করল। তার মনে হল ছেলেটি উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে।

হঠাৎ চিনু বলে উঠল, ”আচ্ছা রাজেনকাকা, কৃষ্ণন কি মায়ের সঙ্গে খেলত?”

হো হো করে হেসে ওঠার ইচ্ছেটা দমন করতে হল রাজেনকে। জি টি রোডের সালকিয়া, লিলুয়া, বেলুড়ের দিকটায় গাড়ি চালাতে চালাতে সন্ধ্যার মুখে হেসে ওঠা যায় না। সরু রাস্তা, রাস্তায় দোকান, গাঁক গাঁক করা ট্রাক আর বাস এবং ছুটির দিনের বিশৃঙ্খল ভিড় ঠেলে মোটর গাড়িকে এগোতে হয় চোখ কান খুলে।

”চিনু, তুমি কিন্তু নিজের অজান্তেই একটা ভাল বিষয় তুলেছ। কৃষ্ণন ছোট বেলায় মায়ের সঙ্গে নয়, বাবার সঙ্গে খেলত। ভদ্রলোক দিল্লিতে চাকরি করতেন। ঠিক করলেন ছেলেকে বড় টেনিস প্লেয়ার করবেন।” রাজেন ব্রেক কষল। এক স্ত্রীলোক ছুটে রাস্তা পার হচ্ছিল কোমরে একটা শিশুকে নিয়ে। হঠাৎ গায়ের পাশে গাড়ি দেখে দিশাহারা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

মিনুর তর সইছে না। আবার গাড়ি চলা মাত্র সে বলল ”তারপর?”

”তারপর তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে সবকিছু বিক্রি করে যা টাকা পয়সা পেলেন তাই নিয়ে দিল্লি থেকে তামিলনাড়ুতে গ্রামের বাড়িতে ফিরে এলেন। সেখানে একটা ক্লে কোর্ট বানালেন, গ্রামে মাটি দিয়ে লেপা উঠোন দেখেছ তো?”

”না দেখিনি।” মিনু বলল।

”মহাদেবপুরের পাশেই তো গ্রাম, একদিন গিয়ে দেখে নিয়ো। গোবর জল আর মাটি দিয়ে লেপা, একেবারে সিমেন্টের মেঝের মতো তকতকে হয়। সেইরকম কোর্টে তিনি ছেলেকে দিনের পর দিন হাতে ধরে টেনিস শেখালেন। ছেলেও রোজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্র্যাকটিস করল, সেই সঙ্গে লেখাপড়াও। তারপর এল মাদ্রাজ শহরে। তারপর একের পর এক চ্যাম্পিয়নশিপ জিতল। এখন কৃষ্ণন ভারতের সেরা।

”বুঝলে, মিনু, বাবা বিরাট ঝুঁকি নিয়ে ছিলেন ছেলেকে বড় প্লেয়ার বানাবার জন্য, ছেলেও সেটা বুঝেছিল। আর তাই সে মন প্রাণ দিয়ে খেটে গেছে বাবার স্বপ্নকে সত্যি করে তুলতে।”

”মাও খুব খাটে।” চিনু বলল।

কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। একসময় রাজেন আড়চোখে দেখল মিনু তার ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা বলছে। তার কানে এল দুটো কথা, ”মারও স্বপ্ন আছে।” চিনু বলল, ”বাবারও আছে।” শুনে রাজেনের মুখে হাসি ফুটে উঠল।

অধীর হয়ে তপতী অপেক্ষা করছিলেন ওদের ফেরার জন্য। ফিরে এসেই দুই ভাই কলকল করে শুরু করল যা দেখে এসেছে তার বর্ণনা দিতে। কৃষ্ণন আর হলস্ট্রোমের ভলি, লব, সার্ভিস, ফোরহ্যান্ড, ব্যাকহ্যান্ড যা কিছু দেখেছে, দুই ভাই র‌্যাকেট হাতে মাকে সেগুলো দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তন্ময় মুখে হাসি নিয়ে তপতীর মতোই চোখে বিস্ময় ফুটিয়ে দেখে গেলেন।

বেলা এসে তাড়া দিল রাতের খাবার খেয়ে নেবার জন্য। এই ব্যাপারে বাড়ির নিয়ম ভীষণ কড়া। অনিচ্ছুক দুই ভাই খাবার ঘরে চলে যেতেই তপতী বললেন, ”ঠাকুরপো, এদের উৎসাহ তো আপনি চাগিয়ে দিলেন, এবার আমি সামলাই কী করে।”

”উৎসাহের আগুন তো আপনিই জ্বালিয়েছেন, আমি শুধু একটু বাতাস দিলাম। কিন্তু সমস্যাটা সত্যিই এবার এসে পড়েছে। টপ ক্লাস টেনিস কী বস্তু, ওরা আজ তা দেখল; কিছু বুঝেছেও হয়তো। ওরা এবার চাইবে কৃষ্ণন কি হলস্ট্রোমের নকল করে বল মারতে। এবার তো সেই সুযোগগুলো ওদের জন্য করে দিতে হবে, অবশ্য যদি…” রাজেন থেমে গেল।

উৎকণ্ঠিত তন্ময় বললেন, ”যদিটা কী?”

”আগে ঠিক করুন ওদের বড় খেলোয়াড় বানাতে চান, না ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার,ব্যারিস্টার করতে চান? যদি ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার করতে চান তা হলে খেলাটাকে সিরিয়াসলি নেবার দরকার নেই। দুজনে যেভাবে চালাচ্ছে চালাক, একটু আধটু ছুটুক আর মন দিয়ে পড়াশুনো করুক। কিন্তু দাদা, দেশে প্রচুর ডাক্তার, উকিল, জজ—ব্যারিস্টার আছে, কজনের নাম দেশের লোক জানে? কিন্তু কৃষ্ণনের নাম করুন, বহু লোক তাকে চিনবে। মিলখা সিং, শৈলেন মান্না, পঙ্কজ রায়, ভিনু মানকাদ, লক্ষ লক্ষ লোক এঁদের নাম জানে, ঠিক কি না?”

স্বামী—স্ত্রী দুজনেই মাথা নাড়লেন।

”আমি লক্ষ করেছি টেনিস ওরা ভালবাসে, খেলতেও চায়। বড় প্লেয়ার হওয়ার জন্য যে ইচ্ছাটা থাকা দরকার, এই বয়সেই ওদের মধ্যে সেটা ফুটে উঠছে। সেটাকে যদি আরও ফুটিয়ে তোলা যায়, আমার ধারণা ওরা টেনিসে কিছু একটা করে দেখাবে।”

”তুমি বলছ রাজেন?” তন্ময়ের চোখ জ্বলজ্বল করছে ভেতরের উত্তেজনায়।

”হ্যাঁ বলছি। বিরাট ঝুঁকি নেওয়া হবে ঠিকই, কিন্তু কোনও বড় কাজই ঝুঁকি না নিয়ে করা যায় না। আপনি দুটো বছর ওদের সময় দিন। যদি বোঝেন কিছু হবে না, ভস্মে ঘি ঢালা হচ্ছে, তখন নয় বন্ধ করে দেবেন, যদি বোঝেন হবে, তা হলে অল আউট ওদের পিছনে খরচ করবেন।”

”খরচ!” তপতী নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন।

”হ্যাঁ খরচ। ওদের জন্য কোচ রাখতে হবে, তাকে টাকা দিতে হবে।”

”কত টাকা।”

”এখনই বলতে পারব না। খোঁজখবর করে দেখি ভাল কাউকে পাই কি না। এতটুকু ছেলেদের কোচ করতে কলকাতা থেকে আসতে কেউ রাজি হবে কি না সেটাও তো দেখা দরকার। তবে দাদা—বউদি, আপনাদের একটা কথা বলে রাখি, ভেবেচিন্তে নামবেন। শুধু আমার কথা শুনে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেবেন না।…টেনিস খেলে টাকা রোজগার করা যায় না ঠিকই, কিন্তু নাম করতে পারলে ভাল চাকরি, খ্যাতি, সম্মান এগুলো তো পাবে। …প্রতি বছর ভারতে লক্ষ লক্ষ ছেলে কলেজ থেকে বেরোচ্ছে, কিন্তু কৃষ্ণন তো একটাই।”

।।৬।।

রাজেন চলে যাবার পর তন্ময় ও তপতী অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। দুজনের মাথায় ঘুরছে একই চিন্তা আর কয়েকটা কথা—’দুটো বছর ওদের দিন’…’ওরা টেনিসে কিছু একটা করে দেখাবে’…কৃষ্ণন তো একটাই।’

”তা হলে কী করা যায়, কোচ রাখব?” তন্ময় স্ত্রীর কাছে পরামর্শর থেকে যেন সমর্থনই চাইলেন।

”খরচ বাড়বে, তা ছাড়া ঝুঁকিও রয়েছে।” তপতী চিন্তিত স্বরে মনে করিয়ে দিলেন।

”তোমার পায়ের যা অবস্থা তাতে ডাক্তার যা বলে গেলেন সেটাই করা উচিত, কোর্টে নামা একদম বন্ধ। আবার যদি ফুলে ওঠে কি যন্ত্রণা শুরু হয়, তা হলে কী হতে পারে সেটাও তো শুনলে ওঁর কাছে।”

”জন্মের মতো পঙ্গু হয়ে যেতে পারি। কিন্তু আমি কোর্টে না নামলে কে ওদের…।” তপতী থেমে গেলেন। স্বামীর মুখের দিকে অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আচমকা বললেন, ”আমি ঝুঁকি নেব।”

”পঙ্গু হয়ে যেতে পার শুনেও?” তন্ময় বিরক্তি চাপতে পারলেন না।

”ঝুঁকি নেব দুটো বছর। খরচ যাই হোক, মিনু কি চিনুকে দেশের লোক চিনবে—আমি তাই চাই। তুমিও কি চাও না ওরা টেনিসের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পাক?…ঝুঁকির ভয়ে আমি পিছিয়ে যাব না।” ধীর অচঞ্চল স্বরে তপতী বললেন। সঙ্কল্পে তাঁর মুখ কঠিন হয়ে উঠেছে।

”ভোরে বেরোনো বন্ধ হয়ে রয়েছে, আমিই ওদের নিয়ে বেরোব।” তন্ময় উঠে দাঁড়ালেন। ঝুঁকি নিতে তিনি প্রস্তুত এমন একটা ভাব তাঁরও মুখে।

পরদিন ভোরে মিনু এক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। বাথরুমে পা পিছলে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে তার কপাল কাটল, গালে কালশিটে পড়ল আর ডান হাঁটু ফুলে উঠল। দিন সাতেক লাগল তার সবগুলো আঘাত সেরে উঠতে।

অতঃপর এক ভোরে তন্ময় দুই ছেলের সঙ্গে ছুটতে বেরোলেন। যে পথ ধরে মিনু আর চিনু ফেরিঘাট পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসত, তিনজন সেই পথই ধরল। তন্ময়ের অভ্যাস নেই এতটা দৌড়বার। তিনি ফেরিঘাট পৌঁছবার আগেই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

”হ্যাঁ রে তোদের মা এতটা ছুটত কী করে?”

”মা তো ছুটত না, জোরে হাঁটত। আমরা ছুটতাম।” চিনু বলল, ”তুমি হাঁটো আমরা ছুটটে ফেরিঘাট ছুঁয়ে ফিরে আসছি।” মিনু খুবই সহানুভূতির সঙ্গে জানিয়ে দিল ”দশ মিনিটেই ফিরব।”

”তাই যা, আমি একটু জিরোই।” দুই হাঁটুতে হাত রেখে তন্ময় ঝুঁকে পড়লেন।

বাড়িতে ফিরেই তিনি স্ত্রীকে বললেন, ”আমার দ্বারা ছোটা হবে না, রাজেনকে আজই বলব একজন কোচ ঠিক করে দিক।”

”বিকেলে মিনুকে কি স্কুল থেকে ক্লাবে নিয়ে যেতে পারবে?”

”পারব। কিন্তু খেলতে তো পারব না তোমার মতো।”

”তোমায় খেলতে হবে না, ওরাই খেলবে। নিজেদের মতো করে।…অফিস থেকে বাড়ি এসে চিনুকে নিয়ে গাড়িতে করেই যেয়ো।”

তন্ময় যথেষ্ট আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে হেঁটে বাড়িতে এলেন। গাড়ি বার করে চিনুকে নিয়ে স্কুলে গেলেন, সেখান থেকে মিনুকে তুলে নিয়ে ক্লাবে। কোর্টের ধারে একটা চেয়ারে বসলেন।

নেটের দুধারে দুই ভাই, বয়স দশেরও কম। মিনু বলল,”আমি জোরে জোরে মারব তুই বল ধরে সঙ্গে সঙ্গে ছুড়ে ফেরত পাঠাবি। আমি আবার মারব।”

কথা মতোই চিনু কাজ করল। অবশ্য বল ধরতে তাকে কোর্টের নানা দিকে ছুটতে হল, কেননা মিনুর জোরালো মারের কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। একসময় চিনু হাঁফিয়ে পড়ল।

”দাদা, আমি আর পারব না। তুই একাই মারবি আর আমি বুঝি মারব না।”

”তা হলে তুই র‌্যাকেট ধর, আমি ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছি।”

ওরা যখন নিজেদের মধ্যে ফোরহ্যান্ড, ব্যাকহ্যান্ড, সার্ভিস ও ভলি মারায় ব্যস্ত সেই সময় নিমগাছের তলায় সাইকেল থেকে একটি বয়স্ক লোক নামলেন। এক হাতে সাইকেলটা ধরে তিনি দুটি ছেলের দিকে তীক্ষ্ন নজরে তাকিয়ে রইলেন।

লোকটির পরনে সাদা শর্টস আর নীল স্পোর্টস শার্ট। পায়ে সাদা ময়লা কেডস। লম্বায় ছ’ ফুটের ওপর, গড়ন ছিপছিপে হলেও পেশিগুলো শুকনো দরকচা নয়। বলিষ্ঠ দুটো পা দেখে বোঝা যায় লোকটি পরিশ্রমী, দুই কাঁধের পেশিতেও সেই আভাস। মুখ ঈষৎ লম্বাটে, নাকের পাশে গভীর ভাঁজ, গালেও। মুখখানি বহু অভিজ্ঞতায় পোড়খাওয়া। ছোট করে কাটা চুল কাঁচাপাকায় মেশানো। লোকটিকে ফিরে রয়েছে কঠিন এমন এক আবরণ, যা থেকে মনে হতে পারে তিনি লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করেন না। তাঁর বয়স অনুমান করা শক্ত, তবে পঞ্চাশের নীচে নয়, এইটুকু বলা যেতে পারে।

প্রায় আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে তিনি দুটি বাচ্চচার নিজেদের মধ্যে খেলা দেখলেন। দেখতে দেখতে তাঁর চোখে কখনও হাসি ফুটে উঠল, কখনও প্রসন্নতা, কখনও কুঁচকে উঠল কপাল। একটা বল তাঁর পায়ের কাছে এসে পড়লে তিনি বলটা হাতে তুলে দাঁড়িয়ে থাকেন। চিনু ছুটে এসেছিল।

”কার কাছে খেলা শিখছ?” লোকটি বললেন। মৃদু গম্ভীর অন্তরঙ্গ স্বর।

”মার কাছে।”

লোকটির ভ্রূ কুঁচকে উঠল। ”কোথায় মা, তোমরা তো একা একাই খেলছ!”

”মার পায়ে ব্যথা, আসেনি…বলটা দিন।”

”উনি কে, ওই যে চেয়ারে বসে?”

”বাবা।…দিন না।”

”নাম কী তোমার?”

”চিন্ময় বসুমল্লিক।”

চিনুর হাতে বলটা দেওয়ার সময় তিনি বললেন,”জুতোর ফিতেটা খুলে গেছে, বেঁধে নাও।”

পরের দিন সন্ধ্যায় রাজেন এল। তপতী তখন দুই ছেলেকে পড়াচ্ছিলেন।

”বউদি, একজনকে পেয়ে গেছি। সহদেব মিশ্র। আজ দুপুরে অফিসে এসে বলে গেলেন তিনি রাজি।…খুব অভিজ্ঞ, আমিও ওঁর কাছে কোচিং নিয়েছি কিছুদিন…খুব কড়া কোচ, সাউথ ক্লাবে অনেকদিন আছেন। এই মাইল ছয়েক দূরে হুগলিতে ওঁর বাড়ি, একা মানুষ, বউ মারা গেছে, মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন, বাড়ির একটা ঘরে থাকেন, বাকিটা ভাড়া দিয়েছেন। কোচিং আর ভাল লাগছে না তাই ছেড়ে দেবেন ঠিক করেছেন। বড়লোকদের ছেলেমেয়ে, কেউ বড় প্লেয়ার হওয়ার জন্য তো কোচিং নেয় না, অত খাটুনি ওদের পোষাবে কেন? একশো—দুশো টাকা দিয়ে কোচ রেখেছি, হাতে র‌্যাকেট নিয়ে ঘুরছি, অভিজাত ক্লাবে যাচ্ছি, এইটে দেখাবার জন্যই তো ওদের খেলার ভান করা। সহদেব মিশ্র তাই বিরক্ত হয়ে ঠিক করেছেন আর কোচিং করে সময় নষ্ট করবেন না। তবে মাসকাবারে কিছু টাকা তো ওঁর দরকার, তাই বাড়িতে গিয়ে ওঁকে ধরে বললাম,’সহদেবদা; দুটো বাচ্চচা ছেলে আছে, আপনার বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়, নেবেন ওদের?’ রাজি হননি। অনেক বলার পর বললেন,’আগে ওদের দেখব, তারপর হ্যাঁ কি না জানাব।’ আমার কাছ থেকে ক্লাবের হদিসও নিলেন।”

”মা, কাল একটা লোক অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আমাদের খেলা দেখছিল!” চিনু বলল।

”আমিও লোকটাকে দেখেছি। কাঁচাপাকা চুল, সাইকেলে এসেছিল!” তন্ময় বললেন।

”তা হলে এই লোকটাই সহদেবদা। উনি সাইকেলেই কাছেপিঠে ঘোরেন।”

”বললে ছ’ মাইল, সেটা কি খুব কাছেপিঠে হল!” তন্ময় অবাক হলেন।

”ছ’ মাইলটা ওঁর কাছে নস্যি, কোনও ব্যাপারই নয়। বারো—চোদ্দো মাইল রেগুলার সাইকেলে ঘোরেন শরীরটাকে ফিট রাখার জন্য।”

”ঠাকুরপো, মিনু—চিনু সম্পর্কে কী বললেন উনি?” তপতী অধীর হয়ে উঠেছেন তাঁর ছেলেদের দেখে কী ধারণা হয়েছে জানার জন্য।

”সহদেবদা কম কথার মানুষ, শুধু বললেন, ‘গুড’। আর জিজ্ঞেস করলেন বাবা—মা লেগে থাকতে পারবে তো? আমি ওঁকে আপনাদের সম্পর্কে সবই বলেছি।”

”কত নেবেন?” ভয়ে ভয়ে তপতী জানতে চাইলেন।

রাজেন কিন্তু কিন্তু করে বলল,”এক একজনের জন্য একশো টাকা মাসে, একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু উনি এর কমে রাজি নন।”

তপতী চোখ বন্ধ করলেন। কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন,”রাজি।”

”মাসে দুশো টাকা তো, হয়ে যাবে।” তন্ময় যোগ করলেন খুব সহজ গলায়।

তপতী দু’ হাতের তালু দুই ছেলের মাথায় রেখে হাসলেন। ওরা জড়িয়ে ধরল মাকে।

.

অতঃপর এক একটি ঋতু আসে আর চলে যায়, মিনু আর চিনু ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। দেখতে দেখতে কেটে গেল পাঁচটা বছর। সহদেব মিশ্রর কঠিন শিক্ষায় তারা ধাপে ধাপে খেলায় উন্নতি করে চলল। কোর্টের বাইরে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ স্নেহ আর শাসনের সতর্ক প্রহরার দ্বারা মসৃণ করে তোলার জন্য তপতী আর তন্ময় তাঁদের জীবনকে উৎসর্গ করে দিলেন। প্রতিদিন ভোরে কি শীতে কি বর্ষায় দুই ভাইকে ছুটতে দেখায় মহাদেবপুর অভ্যস্ত হয়ে গেছে। খরচ বেড়েছে। নতুন দু’ জোড়া র‌্যাকেট কিনতে হয়েছে। আর কিনতে হয় প্রতি মাসে দু’ ডজন বল। দু’ দিকের বেস লাইনের পেছনে ছ্যাঁচাবাঁশের দরমা দিয়ে দশ ফুট উঁচু বেড়া তোলার জন্য প্রায় পাঁচশো টাকা খরচ করতে হয়েছে তন্ময়কে। এই বেড়া দেওয়ার ব্যাপারে ছোটখাটো অশান্তিও ঘটে গেল ক্লাবে। কমিটির অনেকেই আপত্তি তুলেছিল এই বলে, টেনিস কোর্টের জমিটা ক্লাবের সম্পত্তি। সেটা প্রাইভেট কোচিংয়ের জন্য ব্যবহার করতে এবং বেড়া তুলতে দেওয়া যায় না।

প্রতিবাদ করেছিল রাজেন। তার বক্তব্য : মেম্বারদের ছেলেমেয়েদের যে কেউই চাঁদা দিয়ে খেলতে পারে, টাকা দিয়ে কোচিং নিতে পারে। কিন্তু দুটি ছেলে ছাড়া যদি আর কেউ না আসে তা হলে ক্লাব কী করতে পারে? ছেলে দুটিকে কি খেলা বন্ধ করে দিতে হবে? তা ছাড়া ক্লাবকে তো এখনও পর্যন্ত একটা পয়সাও খরচ করতে হয়নি? ক্লাব থেকে পাওয়া গেছে শুধু পুরনো ফুটোয় ভরা একটা নেট। কোর্টের ঘাসকাটা, জল দেওয়া, ঘাস লাগানো ইত্যাদি কাজ করে কান্তি। সেজন্য ক্লাবের কাছ থেকে সে বাড়তি পারিশ্রমিক কখনও চায়নি। তা হলে আপত্তি উঠছে কেন? রাজেন আরও বলেছিল, শুধু তাস আর ক্যারাম খেললেই ক্লাব হয় না, আউটডোর খেলারও ব্যবস্থা থাকা চাই। এর পরও রাজেন এম জে টি এম—এর ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে দেখা করে সবিস্তার জানায় তপতী ও তন্ময়ের এই টেনিস কোর্টটিকে পুনরুজ্জীবিত করার কথা। এজন্য তাদের কত কষ্ট ও পরিশ্রম করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে, সে কথাও রাজেন বলে। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে এবং সেক্রেটারি কমল ভট্টাচার্যকে ডাকিয়ে এনে এম ডি নির্দেশ দেন ক্লাব মেম্বারদের ছেলেরা প্রাইভেট কোচিংয়ের জন্য কোর্ট ব্যবহার করতে এবং খেলার সুবিধার জন্য বেড়াও তুলতে পারবে। তিনি মনে করিয়ে দেন মহাদেবপুরের যাবতীয় জমির মালিকই এম জে টি এম।

এই ধরনের ছোটখাটো বাধা ছাড়া মিনু বা চিনুর খেলা তরতরিয়ে এগিয়েছে। তপতী ভোরে আর ছেলেদের সঙ্গে বেরোন না, তবে অতিরিক্ত ধকল এড়াতে দুই ছেলেকে বাড়ি থেকে স্কুলে আর স্কুল থেকে টেনিস কোর্টে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি গাড়ি নিয়ে বেরোন। শুধু দু’বারই সারাদিনে ভক্সহলকে ব্যবহার করা হয়। সাড়ে তিনটেয় স্কুল ছুটি হওয়ামাত্র দু’জনে ছুটতে ছুটতে এসে গাড়িতে ওঠে। যেতে যেতে গাড়ির মধ্যেই তপতীর হাতে গড়া চিজ স্যান্ডুইচ আর কলা খেয়ে নেয়, জুতো, শর্টস, জামা বদলে নেয় যাতে কোর্টে নামতে একমিনিটও দেরি না হয়। ‘সার’ ছ’ মাইল সাইকেল চালিয়ে এসে কোর্টের ধারে চেয়ারে অপেক্ষা করছেন তাদের জন্য। দেরি হলে বলবেন, ”পাঁচ মিনিট পিছিয়ে পড়লে,পঁচিশটা সার্ভিস কমে গেল।”

ভোর ঠিক পাঁচটায় বাংলোর ফটকে ‘ক্রিং ক্রিং’ দুবার সাইকেলের বেল বাজবে। অন্ধকার থাকতেই সহদেব ছ’ মাইল সাইকেল চালিয়ে এসে হাজির হয়ে যান। মিনু—চিনু অপেক্ষা করে থাকে, বেল বাজার সঙ্গেই বেরিয়ে আসে র‌্যাকেট হাতে। ওরা ছুটতে শুরু করে, ওদের পাশে পাশে একটা নির্দিষ্ট গতিতে সাইকেল চালান সহদেব। প্রথমে দৌড়ত তিন মাইল, এখন সেটা উঠেছে পাঁচ মাইল। সারা মহাদেবপুরটাকে তিনবার চক্কর দিয়ে ওরা আসে কোর্টে।

বালতি ভর্তি দু’ ডজন বল নিয়ে শুরু হয় প্র্যাকটিস। কোর্টের একদিক থেকে পরের পর সার্ভ করে যায় মিনু। অন্যদিক থেকে সেগুলো রিটার্ন করে চিনু। সহদেব কোর্টের ধারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে শুধরে দেন কারোর কোনও ভুল হলে। নিজে পাশে গিয়ে দেখিয়েও দেন।

মিনুর একটা সার্ভ রিটার্ন করতে গিয়ে চিনুর র‌্যাকেটের কাঠে লাগল। বলটা অবশ্য মিস হিট সত্ত্বেও ফিরে এল নেটের এধারে।

”এখন তুমি নিজেকে কী বলবে?” সহদেব প্রশ্ন করলেন চিনুকে।

”বলটাকে নজর করো, বলটাকে নজর করো।”

”জোরে জোরে বলো যাতে শোনা যায়। ম্যাচ খেলার সময় তোমার হয়ে এই কথাগুলো আমি তো আর বলতে পারব না। তোমাকেই এটা সবসময় নিজেকে মনে করাতে হবে। জোরে বলো, কেউ শুনতে পেল কি না তাতে বয়েই গেল, নিজেকে শোনানোটাই আসল কথা।”

পরের বলটা যখন চিনুর দিকে আসছে সে চেঁচিয়ে বলল, ”বলটাকে নজর করো।” বলের দিকে চোখ রেখে সে মারল র‌্যাকেটের ঠিক মাঝখান দিয়ে। এর পর আবার একটা বল মিস হিট করতেই সারের শেখানো মতো সে চেঁচিয়ে নিজেকে ধমকাল,”বলটাকে নজর করছিস?”

সহদেব লক্ষ করেছেন মারের পেছনে জোর দেওয়ার জন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রয়োগের মধ্যে যে সামঞ্জস্য দরকার, চিনুর সেটা চমৎকারভাবে রয়েছে। ফলে সে তার শরীরের ওজন প্রতিটি স্ট্রোকে চাপিয়ে দিয়ে যে জোরটা বার করে আনে সেটা তার চেয়ে বেশি বলবান মিনুরই সমান বা তার চেয়েও বেশি। তিনি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যান ছোটভাইটির দৈহিক পরিবর্তন দেখে। পাঁচ বছর আগে দেখা রোগা, ছোটখাটো, দুর্বল গড়নের ছেলেটি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তার বদলে সতেজ চারার মতো বাহু ও পায়ের পেশি নিয়ে পাঁচ ফুটের কাছাকাছি লম্বা ছেলেটি যেন মহীরুহ হয়ে ওঠার আভাস দিচ্ছে। তিনি জানেন এর জন্য দায়ী হাড়ভাঙা নিয়মিত পরিশ্রম আর ছেলেটির মা।

সকালের কাজ, সহদেব বলেন, ‘ওয়ার্ক আউট’, চলে দেড়ঘণ্টা। কোর্টের দু’ধার থেকে অবিরাম একজন ব্যাকহ্যান্ড অন্যজন রিটার্নে ফোরহ্যান্ড মেরে যায় সহদেবের নির্দেশিত জায়গাগুলোয়। তিনি মনে মনে গোনেন।

হাত ব্যথা করায় কেউ যদি র‌্যাকেট নামিয়ে নেয় অমনই গর্জন ওঠে, ”ডোন্ট স্টপ, কন্টিনিউ, কন্টিনিউ…এখনও তেরোটা বাকি।”

ঘড়ি ধরে ঠিক আটটায় ওরা তিনজন বাড়ির পথ ধরে। মিনু জিজ্ঞেস করে, ”সার,আজ বিকেলে ভলি না সার্ভিস?”

”দুটোই। সার্ভ, রিটার্ন অ্যান্ড ভলি।…তিনবার বল হিট করার জন্য যদি কুড়ি সেকেন্ড ধরি, তা হলে মিনিটে তিনটে সার্ভ হলে দু’ ঘণ্টায় ক’টা হয়?” সহদেব নিরাসক্ত স্বরে সাইকেল ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলেন। দুই ভাই আমতা আমতা করছে দেখে বললেন, ”দু’ ঘণ্টায় হয় তিনশো ষাট…এত জানি পারবে না। আমাদের পাঁচ—ছ’ ডজন বল নেই যে মেশিনগানের মতো ফায়ার করে যাবে। তার চেয়েও বড় কথা, এজন্য যে স্ট্যামিনা আর পাওয়ার দরকার, সেটাও এখনও তোমাদের গড়ে ওঠেনি…কিন্তু না উঠলেই বা, খাটতে খাটতেই গড়ে উঠবে। আজ দেখব কতখানি তোমরা পারো।”

দুই ভাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।

”একটা ভাল ম্যাচ পাঁচ সেট গড়ালে কম করে পাঁচ মাইল কোর্টে ছোটাছুটি, বল হিট করতে হয়। এজন্য সবার আগে দরকার দুটো পায়ের জোর, শক্তি। যদি না বলের কাছেই যেতে পারো তা হলে বল মারবে কী করে?…যখন খুব টায়ার্ড হয়ে পড়ো তখন শরীরের কোন জায়গাটায় প্রথম ব্যথা শুরু হয়? তলপেটে। দৌড়লে তলপেটের মাসল মজবুত হয়। তোমরা এখন যতটা দৌড়চ্ছ সেটা আস্তে আস্তে এবার বাড়াতে হবে।”

”সার, স্কুলে যে ন’টার মধ্যে যেতে হবে!” দুই ভাইয়ের মধ্যে চিনু কিঞ্চিৎ অলস। সহদেবের দৌড় বাড়াবার পরিকল্পনাতে রাশ টানার চেষ্টায় সে বলল।

”ওইটেই তো হয়েছে মুশকিল…তোমাদের আর একটু বেশিক্ষণ কোর্টে থাকা দরকার।”

বাড়ি ফিরে স্নান সেরে খাওয়ার টেবলে বসে তিনজন। সহদেব আবার ছ’ মাইল সাইকেল চালিয়ে বাড়ি না গিয়ে, তন্ময় ও তপতীর অনুরোধে ছেলেদের ভাত খাওয়ার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করে নেন। চারখানা হাতে—গড়া রুটি, ডাল, তরকারি আর সামান্য আচার। মাছ—মাংস খান না। খেতে খেতে তিনি নজর রাখেন মিনু—চিনুর পাতের দিকে। ছেলেদুটির খিদে অসম্ভব বেড়ে গেছে, কিন্তু সেজন্য গোগ্রাসে পেট ভরিয়ে খাওয়া সহদেবের চোখের সামনে অন্তত চলবে না। তাঁর কথায়,”খাদ্যগুলোকে হজম হওয়ার জন্য নড়াচড়ার জায়গা দরকার, পেটটা একটু খালি রাখো। বলটা গায়ের কাছে এসে পড়লে স্ট্রোক নেওয়ার জন্য জায়গা করে নিতে হয়। মিনু, কথাটা বুঝলে?”

”বেলামাসি, আর ভাত নেব না।”

”নেবে না কেন? ভাত না খেলে গতর হবে কী করে?” বেলা ভাতের থালা হাতে কটমটিয়ে সহদেবের নির্বিকার মুখের দিকে তাকাল।

”গতর হবে, তবে গণেশ মার্কা নয়।”

”তবে কী মার্কা, মহিষাসুর?”

”হোক না মহিষাসুর! তবে ও নয়, ওর র‌্যাকেটটা।” সহদেব মুচকি হাসলেন, যেটা কদাচিৎ দেখা যায়। টেবল থেকে দুই ভাই উঠে পড়ল।

”দিদি, একটা কথা।” সহদেব তাকালেন এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা তপতীর দিকে। ”ওদের ওয়ার্ক আউটের সময় বাড়াতে হবে। স্কুল থেকে কি একঘণ্টা আগে ওদের ছুটি করানো যায়?”

”বলা মুশকিল। ওদের এখনকার হেডমাস্টার মিস্টার আচার্য চান মাধ্যমিকে ওঁর স্কুল থেকে নাইন্টি পারসেন্ট ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করুক। ছাত্ররা খেলাধুলো করুক, এটার ঘোর বিরোধী তিনি।”

”দুই ভাই স্কুল স্পোর্টসে এত যে ট্রফি জেতে, তার কোনও মূল্য নেই? ওদের জন্য স্পেশ্যাল কনসিডার করা উচিত, শুধু ওদেরই জন্য।”

”আজ বলব, জানি না কনসিডার করবেন কি না। …একটা কথা সহদেববাবু, আমরা দু’ বছরের জন্য মিনু—চিনুর টেনিসের পেছনে টাকা খরচ করব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু আপনার হাতে পড়ে ওদের উৎসাহ আর খেলার মান এমন বাড়তে শুরু করল যে,আমরা আর বন্ধ করতে পারলাম না। এতে আমাদের আর্থিক দিক থেকে খুবই অসুবিধে হচ্ছে। ওদের ভাল জামা জুতো কিনে দিতে পারি না, প্রায়ই কলকাতায় বেড়াতে নিয়ে যেতাম, কিন্তু খরচের কথা ভেবে এখন আর তাও যেতে পারি না। বছরে একবার বাইরে কোথাও—দার্জিলিং, কি পুরী, কি জয়পুর বেড়াতে গেছি, কিন্তু গত পাঁচ বছর এই মহাদেবপুর ছেড়ে কোথাও আমরা যাইনি। খরচের ভয়ে অনেক সামাজিক কাজেও আমরা মিথ্যা অজুহাত দিয়ে যাইনি। আড়ালে অনেকেই আমাদের কঞ্জুস বলে থাকে। এই সবই আমরা সয়েছি একটা লক্ষ্য সামনে রেখে—আমাদের ছেলে দুটোর দিকে একদিন দেশের লোক তাকিয়ে থাকবে। এখন বলুন আমাদের আশা, আমাদের স্বপ্ন সফল হতে পারবে কি না, মিথ্যা মরীচিকার পেছনে ছুটছি কি না?” তপতী আবেগ চাপতে চাপতে একটানা কথাগুলো বলে উন্মুখ হয়ে সহদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

সহদেব মাথা নামিয়ে জবাবটা গুছিয়ে নিতে সময় নিলেন। তিনি আবেগপ্রবণ নন। শুকনো স্বরে বললেন, ”আজ যদি বলেন আর আপনাকে টাকা দিতে পারব না আপনি বিদায় হোন, তা হলেও আধপেটা খেয়ে সাইকেল চালিয়ে এসে ভোরবেলায় আমি বেল বাজাব…।”

কথা অসমাপ্ত রাখলেন সহদেব, মিনু—চিনু পিঠে ব্যাগ আর ওয়াটারবটল হাতে হাজির হয়েছে। তপতী উঠলেন গাড়ি বার করার জন্য। এখান থেকে সহদেব আবার ফিরে যাবেন ক্লাবে। সেখানে দুপুরে দুটো টেবল জোড়া দিয়ে টানটান শুয়ে থাকেন চিত হয়ে। কান্তি তার মাথার বালিশটা দিতে চেয়েছিল, নেননি।

তপতীকে চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হল হেডমাস্টার আচার্যের দেখা পেতে। একজন শিক্ষক আসেননি, তাঁর ক্লাসটা নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে তিনি তপতীকে ডেকে পাঠালেন।

তিন মিনিটেই তপতী তাঁর আবেদন শেষ করলেন।

”তা কী করে হয়!”হেডমাস্টার চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিলেন। ”একঘণ্টা আগে ছুটি দিতে হবে খেলার জন্য? এ তো বড় অবাস্তব কথা। আপনার ছেলেরা শুধু খেলে, তার বেশি কিছু নয়। ওরকম তো শত শত ছেলে খেলে। তারা সবাই এসে যদি ছুটি চায় তা হলে স্কুল থেকে লেখাপড়ার পাট তো তুলে দিতে হয়। হ্যাঁ, যদি বুঝতাম ওরা কিছু একটা করেছে, এবার নিজেদের উন্নতির জন্য আরও বেশি ট্রেনিং দরকার, সেজন্য সময় দরকার, তা হলে কনসিডার করে দেখতে পারি। কিন্তু আপনার ছেলেরা যে মস্ত প্লেয়ার হবে সেই প্রতিশ্রুতির প্রমাণ তো চাই। একটা ট্রফি ফ্রফি এনে আগে তো দেখাক। মাপ করবেন মিসেস বসুমল্লিক, আমি ছুটি দিতে পারব না।”

পাংশু মুখে তপতী একটি কথাও না বলে হেডমাস্টারের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। বিকেলে দুই ছেলেকে নিয়ে গেলেন ক্লাবে। সহদেব একটা বালতিতে চব্বিশটা বল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ডানদিকের কোর্টের বেস লাইনের কাছে। নেটের ওধারে সার্ভিস বক্সের বাঁ কোণে একটা নীল রুমাল পাতা।

”মিনু, সার্ভিসগুলো ওই রুমালটায় ফেলতে হবে,…যাও শুরু করো।”

মিনু বালতি থেকে একের পর এক বল তুলে সার্ভ করে যেতে লাগল। শুধু দ্বাদশ সার্ভটা রুমালের কানা ছুঁয়ে গেল, তা ছাড়া পাঁচটা সার্ভ নেটে লাগল, চারটে পড়ল বাইরে। ওধারের বেস লাইন থেকে চিনু এগারোটা বল রিটার্ন পাঠাল। তার মধ্যে মিনু পাঁচটা ভলি করল চিনুর নাগালের বাইরে। সহদেব মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ”কিসসু হয়নি। রুমালে মাত্র একবার পড়ল, অন্তত দশবার ফেলতে হবে।…আবার।”

চিবুক থেকে ঘাম ঝরছে, মিনুর মুখ থমথমে। আড়চোখে চেয়ারে বসা মায়ের দিকে তাকাতেই তপতী মুখটা আকাশের দিকে তুললেন। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে মিনু আবার শুরু করল। এবার রুমালে বল পড়ল তিনবার। তোয়ালে দিয়ে মুখের ঘাম আর র‌্যাকেটের হাতল মুছে, মাটিতে তালু ঘষে মিনু বলল, ”আবার।”

নেটের কাছে এগিয়ে এসে চিনু বলল, ”স্যার, আমি সার্ভ করব না?”

”না। যতক্ষণ না চব্বিশটায় বারোটা বল ফেলছে, মিনু সার্ভ করে যাবে।”

মিনুর ছিয়ানব্বইটা সার্ভ শেষে সহদেব বললেন,”মোট তেরোবার, ফিফটিন পার্সেন্টও নয়। মিনু, তুমি সার্ভ করতে শিখেছ?”

”না সার। আমি আবার করব।” জেদি গলায় দাঁত চেপে মিনু বলল।

”হাত ভেরে গেছে তোমার, এবার চিনু।”

”না সার, আবার সার্ভ করব।”

”এখন থাক। তুমি কনসেনট্রেট করতে পারছ না। রুমালটা ছাড়া আর সব কিছু চোখ থেকে মুছে ফেলতে হবে মিনু। ওইখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকো পাঁচ মিনিট।”

সহদেব রুমালটা তুলে এনে এধারের সার্ভিস বক্সের মাঝামাঝি জায়গায় পাতলেন। ”শুরু করো।” রিটার্ন করার জন্য মিনুর বদলে র‌্যাকেট হাতে তিনি বেস লাইনে দাঁড়ালেন।

চিনু সার্ভ করল চব্বিশটা, তার মধ্যে আটটা পড়ল রুমালে। সহদেবের মুখে পলকের জন্য খুশির ছোঁয়া লেগেই মিলিয়ে গেল।

”মিনু এবার ওধারে যাও, চিনু আমার পাশে এসো।” সহদেব আর চিনু ডানদিকের কোর্টে বেস লাইনের মাঝামাঝি দাঁড়াল, নেটের ওধারে মিনু। দু’ জনে সোজাসুজি বল মারছে তার দিকে। মিনু ব্যাকহ্যান্ড বা ফোরহ্যান্ডে বল ফেরত দিতে লাগল। সহদেব ক্রমশ একটু দূরে বল পাঠিয়ে তাকে বাধ্য করলেন যাতে ছুটে গিয়ে বল মারতে হয়। এর পর তিনি মারের তীব্রতা বাড়ালেন। সারা কোর্ট চষে ফেলে, এগিয়ে—পিছিয়ে দু’ পাশে ছুটে গিয়ে মুহূর্তের জন্যও থামার অবকাশ না পেয়ে মিনুকে বল ফেরাতে হচ্ছে। কখনও ডানদিকে ছুটে লম্বা করে হাত বাড়িয়ে, তার থেকে ভলি করে বা বেস লাইন থেকে কুড়ি গজের ব্যাকহ্যান্ড মেরে। এলোপাতাড়ি ফেরানো নয়, যতটা সম্ভব চিনু আর সহদেবের নাগালের মধ্যে তাকে বল রাখতে হচ্ছে।

পাঁচ মিনিট পরই মিনু দাঁড়িয়ে পড়ল। হাপরের মতো ওঠানামা করছে তার বুক। র‌্যাকেট কোর্টের ওপর ঠেকিয়ে তাতে শরীরের ভার দু’ হাতে রেখে মুখ নামিয়ে। সহদেব দু’ মিনিট মিনুর দিকে তাকিয়ে থেকে কঠিন স্বরে বললেন,”আবার।”

”একটু জিরোই সার।”

”না।” সহদেব চেঁচিয়ে বললেন,”ম্যাচ খেলতে খেলতে হাঁপিয়ে পড়লে কি পেটে যন্ত্রণা শুরু হলে, তখন কি তুমি খেলা বন্ধ করে জিরিয়ে নেবে?…যন্ত্রণার সঙ্গে সড়গড় হও। যন্ত্রণাকে হেসে উড়িয়ে দাও।”

”সার, আমি তো এখন ম্যাচ খেলছি না।” মিনু কাতর স্বরে বলল।

”না খেললেই বা! মনে মনে নিজেকে দেখো একটা শক্ত ম্যাচ খেলছ। তুমি পাঁচ মাইল দৌড়েছ, হাজারবার বল মেরেছ, শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি যন্ত্রণায় টাটাচ্ছে। এগুলো সহজ করে দিতে পারবে যদি আগেই যন্ত্রণার সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়, যদি বুঝে নাও এটা কোনও বড় ব্যাপার নয়, এটা থাকবে না।” সহদেব কথা বলতে বলতে নেটের কাছে এলেন। ওয়ার্ক আউট থামিয়ে দিয়ে মাঝে মাঝে তিনি কথা বলেন দুই ভাইকে কাছে ডেকে নিয়ে। হাতছানি দিয়ে তিনি চিনুকে ডাকলেন।

”তোমরা হয়তো ভাবতে পারো চার মাইল পর্যন্ত দৌড়বার ক্ষমতা তোমাদের আছে, কিন্তু একটা কথা শুনে রাখো,যদি একটা বন্দুক তোমাদের মাথায় ঠেকাই তা হলে আবিষ্কার করবে আরও একটা মাইলও দৌড়তে পারো। এটা টেনিস ম্যাচেও খাটাও। বড় বড় প্লেয়াররা যখন খেলে, তখন একে অপরকে যন্ত্রণায় বিঁধোয়, তখন শুধু একটাই প্রশ্ন, কে আর একটু বেশি যন্ত্রণা দিতে ইচ্ছুক আর কে প্রথম পালাবে। হারতে যতটা সময় লাগে জিততেও ততটা সময় লাগে। ব্যাপারটা যদি তাই হয় তা হলে না জিতে শুধু শুধু যন্ত্রণার শাস্তিটা নেবে কেন? জেতার জন্য নিজেদের তৈরি করো। জিরোবার সবচেয়ে সহজ উপায় কী জানো?” সহদেব ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। ”ওই চেয়ারটায় গিয়ে বসে পড়া। চলো, আমরা বসব এখন।”

”না।” মিনু তীক্ষ্ন স্বরে বলে উঠল,”আপনি গিয়ে বসুন…আয় চিনু।”

সহদেব চোখ কুঁচকে নেটের দু’ দিকে দুই ভাইকে এগিয়ে যেতে দেখলেন। কী ভেবে তিনি কোর্ট থেকে বেরিয়ে এসে তপতীর পাশের খালি চেয়ারে বসলেন।

”আজ গেছলাম হেডমাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে।” তপতী প্রথম সুযোগেই কথাটা পাড়লেন। মিনু বা চিনু শুনুক এটা তিনি চান না। ”উনি বললেন, এক ঘণ্টা আগে ছুটি দিতে পারবেন না। ওরা শুধুমাত্র খেলে, তার বেশি কিছু নয়। মস্ত প্লেয়ার হবে এমন প্রতিশ্রুতির প্রমাণ না পেলে উনি ছুটি দিতে পারবেন না।”

”কী প্রমাণ চান উনি?” সহদেব ভ্রূকুটি করলেন।

”বলেছেন আগে একটা ট্রফি এনে দেখাক।…আমার মনে হয় হেডমাস্টার অন্যায্য কিছু বলেননি। সত্যিই তো, যে লোক খেলাধুলো বোঝেন না তিনি ট্রফি দিয়েই প্রমাণ চাইবেন।”

”তা হলে আমাদের এখন দরকার একটা ট্রফি। তার মানে ছেলেদুটোকে এবার বাইরে বেরোতে হবে।” সহদেব মাথা নিচু করে জমির দিকে তাকিয়ে রইলেন।

”আপনার কি মনে হয় আরও একটা—দুটো বছর—” ইতস্তত করে তপতী থেমে গেলেন।

”না, না, এই বয়সেই কম্পিটিশনের মুখে পড়া দরকার। কাল আমি বি এল টি এ অফিসে যাব কোথায় কী টুর্নামেন্ট হবে খোঁজখবর করতে।”

।।৭।।

দশদিন পর মিনু, চিনু এবং তপতী, বেলা বারোটায় সহদেবের সঙ্গে ট্রেন থেকে নামল হাওড়া স্টেশনে। তারা যাবে নর্থ ক্যালকাটা টেনিস ক্লাবের টুর্নামেন্টে। মিনু আর চিনু এন্ট্রি করেছে। প্রতিযোগিতাটা খুবই ছোট মাপের এবং বড়দের জন্য। সহদেব এন্ট্রি তালিকাটা আগেই দেখে নিয়েছেন। নামী খেলোয়াড় একজনও নেই। কিছু জুনিয়ার আর কিছু সদ্য খেলা ছেড়ে দেওয়া প্রাক্তন নাম দিয়েছে।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে তারা ট্যাক্সি ধরে ক্লাবের ফটকে এসে নামল। বিরাট একটা পার্কের একধারে ক্লাব। ফটক থেকে মোরামের সরু পথ কিছুটা গিয়ে দু’ ভাগ হয়ে দুটো টেনিস কোর্টকে বেড় দিয়ে মিলেছে ক্লাব—তাঁবুর সামনে। তাঁবুর বাইরে কয়েকটা বেঞ্চ আর চেয়ার। দু—তিনজন কথা বলল সহদেবের সঙ্গে। তাঁবুর বাইরে অল্প কিছু লোক। ওদের চেয়ারে বসিয়ে সহদেব তাঁবুর ভেতরে ঢুকে গেলেন। দুই ভাই সাউথ ক্লাব দেখেছে। সেখানকার গ্যালারি, ভিড়, ক্লাববাড়ি আর টানা বারান্দা তাদের মনে যে ছাপ ফেলেছে তার সঙ্গে এখানকার কোনও মিলই তারা পাচ্ছে না। তারা ভেবেছিল স্কুল স্পোর্টসের মতো জমজমাট একটা ব্যাপার দেখবে।

চিনু ফিসফিস করে মিনুকে বলল,”খেলবে কে রে?”

মিনু দু’ধারে তাকিয়ে বলল,”বোধ হয় আমরা আগে এসে পড়েছি।”

তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে সহদেব জানালেন, মিনুর খেলা যার সঙ্গে পড়েছে সে আসতে পারবে না জানিয়েছে, পা মুচকে এখন সে বিছানায়। মিনু সেকেন্ড রাউন্ডে উঠে গেছে। চিনুর সঙ্গে খেলবে অদ্বৈত মল্লিক, এই ম্যাচটা দিয়েই টুর্নামেন্ট শুরু হবে এখনই। সহদেবের কথা শোনা মাত্রই মিনুর মুখ থেকে উদ্দীপনার চকচকে ভাবটা মুছে গেল। আর চিনু খুঁজতে লাগল অদ্বৈত মল্লিককে।

ইতিমধ্যে কোর্টের ধারে কিছু লোক জমা হয়েছে। মালি কয়েকটা টুল রেখে গেল সাইডলাইন আর বেসলাইনের ধারে লাইন্সম্যানদের জন্য। বকের মতো গলা, কোট, প্যান্ট, টাই পরা এক লম্বা লোক, চোখে পুরু কাচ দেওয়া চশমা, স্কোরশিট হাতে নিয়ে আম্পায়ারের উঁচু চেয়ারে বসলেন। তাঁর মুখের কাছে মাইক্রোফোন। লাইন্সম্যানরা টুলে বসল। দু’ দিকের বেসলাইনের এবং নেটের দু’ দিকে বলবয়রা হাজির হল। আম্পায়ার দু’ বার গলাখাঁকরি দিয়ে মাইক পরীক্ষা করে প্লেয়ারদের নাম ডাকলেন।

চিনু ঢোঁক গিলে সহদেবের কানে চুপিচুপি কী একটা বলতেই তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ”টেন্টের মধ্যে ঢুকে একেবারে শেষে গিয়ে ডান দিকে। দেখবে দরজায় ‘জেন্টস’ লেখা আছে।”

মিনু ফিসফিস করে তপতীকে বলল,”চিনুটা ঘাবড়ে গেছে।”

”জীবনের প্রথম ম্যাচে সবাই ঘাবড়ায়, তুইও ঘাবড়াবি।”

”দেখা যাবে।”

অদ্বৈত মল্লিক কোর্টে নেমে পড়েছেন। হৃষ্টপুষ্ট, মাথায় সামান্য টাক, বয়স প্রায় চল্লিশ। অ্যাডভোকেট। বছর পনেরো আগে পর্যন্ত নিয়মিত প্রতিদিন খেলতেন, এখন শুধু শনি—রবিবারে। নর্থ ক্যালকাটা টুর্নামেন্ট দু’ বার জিতেছেন। মল্লিক গেলেন বাঁ দিকের কোর্টে। গোটা ছয়েক নতুন বল একজন গড়িয়ে দিল। মল্লিক একটা বল তুলে নিয়ে সার্ভ করলেন ওধারের ফাঁকা কোর্টে। বলবয় বল ছুড়ে দিল তাঁকে। তিনি আবার একটা সার্ভ করে তাকালেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর দেখা পাওয়ার আশায়।

”মা, চিনুর বোতামটা!” মিনু আঙুল দিয়ে দেখাল। তারপর চাপা গলায় বলল,”অ্যাই চিনু, কোমরের বোতাম লাগা।” কোমরে হাত দিয়ে চিনু জিভ কাটল।

কোর্টের ধারে একটা চেয়ারে নিরাসক্ত মুখ করে সহদেব একা বসে । চিনু মাকে প্রণাম করে, কপালে চুমু নিয়ে কোর্টের দিকে এগোতেই তপতী মনে করিয়ে দিলেন,”সারকে।”

সহদেব তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে প্রণামে নত চিনুকে দু’ কাঁধ ধরে তুললেন। বুকে জড়িয়ে মৃদু স্বরে বললেন,”আমার দিকে তাকাবে না, মনে রেখো কোর্টের মধ্যে তুমি একা, নিজেকে নিজেই দেখতে হবে।”

অদ্বৈত মল্লিক হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলেন চিনুর দিকে অন্তত কুড়ি সেকেন্ড। তিনি ভাবতে পারেননি একটা বালকের সঙ্গে তাঁকে খেলতে হবে। টস করার সময় মল্লিক জিজ্ঞেস করলেন,”খোকা, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?”

চিনু গম্ভীর স্বরে বলল,”ক্লাস সিক্স।”

মল্লিক টস জিতে সার্ভিস নিলেন। ওয়ার্ম—আপের শুরুতে তিনি ফোরহ্যান্ডে প্রথম বলটা পাঠালেন নেটের ওধারে। চিনুর ফোরহ্যান্ড রিটার্ন লাগল নেটে। মল্লিক আবার বল পাঠালেন। চিনু আবার নেটে বল মারল।

মল্লিক নেটের কাছে এসে হাতছানি দিয়ে চিনুকে ডাকলেন। ”র‌্যাকেট কাঁধের আর একটু ওপরে তুলে এইভাবে নামিয়ে ফোরহ্যান্ড মারো।” তিনি র‌্যাকেট চালিয়ে দেখিয়ে দিলেন কীভাবে মারতে হবে। ”মনে থাকবে?”

চিনু বিনীতভাবে মাথা নাড়ল।

প্রথম সার্ভিস করলেন মল্লিক। চিনুর ফোরহ্যান্ড নেটের এক ইঞ্চি ওপর দিয়ে সাইডলাইন বরাবর বেসলাইনের কাছে পড়ল। জীবনের প্রথম ম্যাচে প্রথম পয়েন্ট! সে প্রথমে সহদেবের, তারপর মা আর দাদার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকাল। সহদেব মাথাটা সামান্য হেলালেন, মিনু দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিল, তপতী দু’ হাত কপালে ঠেকিয়ে চোখ বুজলেন। মল্লিক দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। পরের সার্ভিসটার সঙ্গে চিনু একই আচরণ করল। মল্লিকের চোখ আর ভ্রূ কুঁচকে উঠল। তৃতীয় সার্ভিসের ফোরহ্যান্ড রিটার্ন মল্লিকের বুকের কাছে এল, তিনি ভলি করে চিনুর ডান দিকে বল ফেলতেই ফোরহ্যান্ডে সে বাঁ দিকের ফাঁকা কোর্টে বল মারল। চিনু জীবনের প্রথম গেমটা পেল মল্লিক ডাবল—ফল্ট করায়। সময় লাগল দু’ মিনিট। ম্যাচ শেষ হল পঁচিশ মিনিটে : ৬—১, ৬—০। হ্যান্ডশেক করার সময় মল্লিক বললেন,”আমার কথাগুলো মনে রেখেছিলে তা হলে…গুড মেমারি।”

ঘড়ি দেখে সহদেব বললেন,”মাত্র দুটো বাজে। চলুন দিদি, একবার সাউথ ক্লাব ঘুরে আসি। বেঙ্গলের ভাল জুনিয়াররা ওখানে প্র্যাকটিস করছে। ওরা একবার দেখুক।”

বাইরে বেরিয়ে এসে সহদেব বললেন,”বাসে করে চলে যাই, মিছিমিছি কেন ট্যাক্সি ভাড়া দেবেন।”

তপতী বললেন,”দোব। এটা ছেলেদের ব্যাপার।”

কিন্তু ছেলেরা একসঙ্গে বায়না ধরল তারা জীবনে কখনও বাসে—ট্রামে চড়েনি, সুতরাং বাসেই যাবে। চিনু বলল,”সার ট্রামে যাব।” সহদেব বললেন,”এখান থেকে ট্রাম টানা এলগিন রোড পর্যন্ত যায় না, এসপ্ল্যানেডে নেমে আবার ট্রামে উঠতে হবে। তা ছাড়া বাস তাড়াতাড়ি যায় ট্রামের থেকে।”

বাসে উঠে কুড়ি মিনিট পর চৌরঙ্গি—এলগিন রোডের মোড়ে নেমে ওরা হেঁটে সাউথ ক্লাবে পৌঁছল। আটটা কোর্টে তখন খেলা চলছে। চারদিকে শুধু খলব খলব খলব শব্দ। তিনজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। একটা কোর্টের ধারে সহদেব ওদের নিয়ে গেলেন, মাঝবয়সি একটি লোক সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান ষোলো—সতেরো বছরের একটি ছেলেকে নিয়ে খেলছে। সহদেব বললেন,”যে ট্রেনিং করাচ্ছে ওর নাম সৈদুল। আগে বলবয় ছিল, আমার চেনা।”

খুব জোরে মারা একটা ক্রশকোর্ট ফোরহ্যান্ডে সৈদুল র‌্যাকেট ছোঁয়াতে পারল না। বলটাকে কোর্টের বাইরে লুফল মিনু। সৈদুল বলটা চাইল র‌্যাকেট বাড়িয়ে ধরে, আর সেই সময় দেখতে পেল সহদেবকে। হাত তুলে সে চেনা দিল।

”সৈদু শোন,” সহদেব হাতছানি দিয়ে ডাকলেন।

”আরে দেবুদা, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?” একগাল হেসে সৈদুল হাত জড়িয়ে ধরল সহদেবের। ”কী করছ এখন? আছ কোথায়?”

”এই ছেলে দুটোকে নিয়ে আছি মহাদেবপুর বলে একটা জায়গায়, আমার বাড়ির কাছেই।”

সৈদুল হাসিমুখে মিনু—চিনুর দিকে তাকাল। ”এদের শেখাচ্ছ? ভাল।”

”তোর ওই ছেলেটা তো বেশ ভালই খেলে। নাম কী?”

”অরুণ, অরুণ মেটা। এখন জুনিয়ার বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ান। লাস্ট ইয়ারে জুনিয়ার ন্যাশানাল রানার্স হয়েছে, ফাইনালে হেরেছিল ম্যাড্রাসের মুথান্নার কাছে।”

”সৈদু একটা কাজ করবি? তোর ওই ছেলেটার সঙ্গে একে একটা সেট খেলাবি?” সহদেব আঙুল দিয়ে মিনুকে দেখালেন,”ওর নাম মৃন্ময়।”

”বেশ তো, খেলুক। তুমি যখন চাইছ তখন নিশ্চয় ওর স্ট্যান্ডার্ড ভাল।”

”সেইটে দেখার জন্যই খেলাতে চাই। মিনু এখনও পর্যন্ত একটা গেমও বাইরের কারো সঙ্গে খেলেনি।”

সৈদুল নেটের কাছে গিয়ে অরুণের সঙ্গে কথা বলে হাতছানি দিয়ে মিনুকে কোর্টে নামতে বলল। সহদেব মিনুর কাঁধ ধরে সাইডলাইন পর্যন্ত গেলেন,”এটা ম্যাচ খেলা নয় ফ্রেন্ডলি খেলা, রিল্যাক্সড থাকবে। সঙ্কোচে গুটিয়ে যেয়ো না, মনে রেখো অরুণ তোমার মতই জুনিয়ার, ঘাবড়াবার কিছু নেই। খোলাখুলি সহজ মনে হিট করো।”

”দাদা,” চাপা স্বরে চিনু বলল,”তুই ‘জেন্টসে’ যাবি না?”

আগুনে—চোখে ভাইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে মিনু কোর্টে নামল। ওয়ার্ম—আপ করার সময় কামানের গোলার মতো অরুণের প্রথম সার্ভিসটায় র‌্যাকেট ছোঁয়াতেই মিনুর মুঠোর মধ্যে র‌্যাকেটটা সামান্য ঘুরে গেল। সে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরল। মিনিট তিনেক পর সৈদুল নেটের পাশে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল,”নাউ স্টার্ট…সার্ভিস অরুণ মেটা, লাভ—অল।”

দশ মিনিটের মধ্যেই মিনুর সার্ভিস দু’বার ভেঙে অরুণ স্কোর নিয়ে গেল ৩—০। প্রচণ্ড জোরালো মারগুলো কোর্টের ঘাসগুলোকে নয়, যেন মিনুর মাথার মধ্যে আঘাত করে করে তাকে অসাড় করে দিয়েছে। তার র‌্যাকেট উঠছে না, দুটো পা চলছে না। শুধু দেখল তার দুপাশ দিয়ে বলগুলো ঘাসে পড়ে পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে।

অরুণ কোমরে হাত রেখে সৈদুলের দিকে প্রশ্নভরা চোখে তাকিয়ে। ‘আরও কি খেলতে হবে?’ এমন একটা ভাব তার দাঁড়াবার ভঙ্গিতে। মিনু তাকাল সহদেবের দিকে। ‘দেখি এবার তুমি কী করো’, এমন একটা ভাব সহদেবের মুখে।

চতুর্থ গেমে সার্ভিস করেই মিনু এতক্ষণ যা করেনি, নেটের দিকে ছুটে গেল। রিটার্নটা উঁচু হয়ে তার বাঁ দিকে এল। অরুণের নাগালের বাসরে সেটা ভলি করে মিনু পয়েন্ট পেল। তার পরের সার্ভিস পড়ল বক্সের কোণে। অরুণ দাঁড়িয়ে থেকে ‘এস’টা দেখল। পরের দুটো সার্ভিসও একই জায়গায় পড়ল। পরপর তিনটে সার্ভিস ‘এস’ হতে দেখে বিস্মিত সৈদুল হাততালি দিয়ে হাঁকল,”ওয়ান—থ্রি।”

চিনু ফিসফিস করে তার মায়ের কানে বলল,”সারের রুমালটাকে তিন বলে তিনবার হিট করল।”

মিনুর মাথার মধ্যে যে খিলটা পড়ে ছিল এবার সেটা খুলে গেছে। অরুণের জোরালো মারগুলো আর তাকে আড়ষ্ট করে দিচ্ছে না। সহজ বাতাস তার সারা শরীরের মধ্যে ভাসছে। সে স্বচ্ছন্দে এগোচ্ছে, পিছোচ্ছে, পাশে ছুটছে দ্রুতগতিতে। চার মিনিটের মধ্যে অরুণের সার্ভিস ভেঙে সে ৩—৩—এ স্কোর নিয়ে গেল। অরুণ তখন হাঁফাচ্ছে।

অরুণ সৈদুলের কাছে গিয়ে বলল,”আর খেলব না, পিঠের ব্যথাটা আবার শুরু হয়েছে।” র‌্যাকেট—ধরা হাতটা মিনুর দিকে একবার তুলে সে ক্লাবহাউসের দিকে হাঁটতে শুরু করল কোনওদিকে দৃকপাত না করে।

”বড়লোকের ছেলে কখন কী মর্জি হয়!” সৈদুল অপ্রতিভ স্বরে বলল। ”দিনে দেড়ঘণ্টার বেশি ট্রেনিং করে না। বলে বলেও ওকে দৌড় করাতে পারিনি। মৃন্ময়ের স্পিড, স্ট্যামিনা তো খুব ভাল!”

”অরুণের খেলা উচিত ছিল।” সহদেব বললেন। তাঁর মনে হয়েছে, অরুণের পিঠব্যথাটা অজুহাত, আসলে সে পালাল। যারা পালায় তারা কখনওই জেতে না। তবে মনে মনে তিনি খুশি। আজ একটা ব্যাপার তিনি জেনে গেলেন, মিনু বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ান হওয়ার মতো খেলা খেলতে পারে।

.

নর্থ ক্যালকাটা টুর্নামেন্টে চিনু দ্বিতীয় রাউন্ডে স্ট্রেট সেটে হেরে গেল প্রদীপ ঘোষের কাছে। যে গত বছর সিনিয়ার স্টেট চ্যাম্পিয়ানশিপের কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছেছিল। তিনদিন পর রবিবারে মিনু ২—১ সেটে প্রদীপ ঘোষকে হারাল ফাইনালে। একটা বড় কাপ, একটা মেডেল আর তিনজন আরোহীকে ভক্সহলে বসিয়ে তন্ময় মহাদেবপুর ফিরলেন। সহদেবকে এক পুরনো বন্ধু বাড়িতে ধরে নিয়ে যাওয়ায় তিনি আর এদের সঙ্গে ফেরেননি।

বাড়ির কাছে এসে তন্ময়ের কী মনে হল, তিনি বললেন,”চলো একবার ক্লাবটা ঘুরে আসি। রোববারে অনেকেই থাকবে।”

ক্লাব—লনের প্রায় সবক’টা টেবলই ভরা। একটা বড় কাপ দু’ হাতে ধরে মিনু আর তার পেছনে তন্ময়, চিনু আর তপতীকে ঢুকতে দেখে সকলেই অবাক চোখে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল।

তন্ময় একটু গলা চড়িয়ে বললেন,”আমাদের টেনিস কোর্টের প্রথম ফসল।” কাপটা তিনি মাথার ওপর তুললেন। ”মিনু আজ নর্থ ক্যালকাটা টুর্নামেন্ট থেকে জিতে আনল।”

হই—হইয়ের সঙ্গে হাততালির শব্দ উঠল। অবশ্য কেউ কেউ হাততালি দিলেন না, গলা থেকে আওয়াজও বার করলেন না। কান্তি চায়ের ট্রে নিয়ে আসছিল। একটা টেবলে ট্রে—টা রেখে ছুটে এসে কাপটা মাথায় তুলে এমনভাবে ঘুরতে শুরু করল, যেন সেটা সে নিজেই জিতেছে! টেনিস কোর্টটা প্রথম দিন থেকে তার হাতেই লালিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। উচ্ছ্বাস ধরে রাখা তার পক্ষে সত্যিই খুব কঠিন। প্রত্যেক টেবলে সে কাপটা দেখাতে দেখাতে অবশেষে প্রতিভা মজুমদারের টেবলে রাখল।

”দেখুন মেমসাব, সেই ছোট্ট মিনু কাপ জিতে এনেছে।”

”দেখেছি, এবার এটা টেবল থেকে সরাও, আর চায়ের একটা পট দিয়ে যাও।”

”দিচ্ছি। রুপোর কাপ তাই না? দাম কত হবে বলুন তো?”

”রুপো না ছাই। পেতলের ওপর রুপোর জল—করা।”

কান্তি অপ্রতিভ হয়ে কাপটা তুলে নিল।

”হোক পেতল, সবাইকে হারিয়ে জিতেছে তো!”

কান্তি চলে যেতেই সুধা ঘোষাল বললেন,”নর্থ ক্যালকাটা টুর্নামেন্টের নাম তো কখনও শুনিনি।”

”এরকম টুর্নামেন্ট কলকাতায় পাড়ায় পাড়ায় হয়, শুনবে কী করে?” প্রতিভা বললেন।

”প্রতিভাদি, দোকান থেকে কিনে এনে দেখাচ্ছে না তো?” চন্দ্রিমা দত্ত ফোড়ন কাটলেন।

”ওহহো, একটা কথা তো বলা হয়নি।” সুধা ঘোষাল টেবলে ঝুঁকে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটো মাথা। ”মিসেস বসুমল্লিক ছেলেদের খেলার প্র্যাকটিসের জন্য এক ঘণ্টা আগে স্কুল থেকে ছুটি করাতে হেডমাস্টার আচার্যর হাতে পায়ে ধরেছিলেন,জানেন কি?”

”না তো! তারপর কী হল?” প্রতিভার দমবন্ধ হয়ে এল এমন একটা খবরের সন্ধান পেয়ে। ”কে বলল তোমায়?”

”রমু বলল। ওর ক্লাসেই তো পড়ে হেডমাস্টারের ভাগ্নে। কিন্তু হেডমাস্টারকে জানেন তো, খুব কড়া লোক। তিনি ওসব হাতে পায়ে ধরাধরি, কান্নাকাটিতে গলে যাওয়ার পাত্র নন। দিলেন এককথায় তাড়িয়ে। বললেন,’কী এমন করেছে আপনার ছেলে। ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ান হয়েছে কি? একটাও বড় টুর্নামেন্ট জিতেছে কি? কী দেখে আমি ছুটি অ্যালাও করব?’ শুনেই মুখ চুন করে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে যান।”

”এবার তো উনি এই কাপটা নিয়ে গিয়ে হেডমাস্টারকে দেখিয়ে ছুটি আদায় করবেন।” চন্দ্রিমা বিপন্ন স্বরে বললেন।

”করলেই হল? রমুর বাবা কী বলল জানেন, তা হলে একটা কাপ কিনে হেডমাস্টারকে দেখিয়ে বলব, রমুকে এক ঘণ্টা আগে ছুটি দিতে হবে, ডায়মন্ড হারবারে ওয়াকিং কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছে, হাঁটায় ওর দারুণ প্রতিভা, ওর আরও প্র্যাকটিস দরকার।” বলেই সুধা ঘোষাল হাসতে হাসতে চন্দ্রিমার গায়ে প্রায় গড়িয়ে পড়লেন। অন্য দু’জনও খুকখুক শব্দ করলেন।

”একটা জিনিস লক্ষ করেছ, টেনিস খেলাকে ছুতো করে বসুমল্লিকরা জমিটাকে নিজেদের সম্পত্তি করে ফেলেছে। কাউকে তো খেলতেই দেয় না!”প্রতিভা বললেন গলায় ক্ষোভ নিয়ে।

”যা বলেছেন!” চন্দ্রিমা সূত্রটা ধরে নিয়ে যোগ করলেন,”অনিরুদ্ধ বাগচির কেসটা জানেন তো? ছেলেটা যে কী ভাল, কী বলব! রীতিতমতো চাঁদা দিয়ে টেনিস খেলতে পাঠিয়েছিল ওর বাবা। কোথায় খেলা! শুধু নিজের ছেলে দুটোকে খেলাতেই উনি ব্যস্ত, অনিরুদ্ধ বেচারি চুপচাপ শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। শেষে ওর ঠাকুমা রেগে গিয়ে যাচ্ছেতাই বলে নাতিকে নিয়ে চলে আসেন।”

”যাক গে এসব কথা, কান্তি চা আনছে, চুপ করো।” প্রতিভা হুঁশিয়ার করে দিলেন।

ওদের টেবলের পাশের টেবলেই স্ত্রী বরুণাকে নিয়ে বসে ছিলেন এম জে টি এম—এর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যানেজার সুভাষ সেন। ওঁর ছেলে শঙ্কু শান্তিনিকেতনে চলে যাবে, টেনিস খেলবে না, তবুও তিনি তপতীকে চাঁদা দিয়েছিলেন,কারণ বাচ্চচাদের খেলাধুলোর প্রয়োজনটা তিনি বোঝেন। পাশের টেবলের কথাবার্তার অনেকটাই তাঁদের কানে এসেছে।

”শুনলে, কী সব কথা বলল?” সুভাষ সেন স্ত্রীকে বললেন।

”কেউ ভাল কিছু করলে এইসব পুরস্কারই তার জোটে।”

”শঙ্কু যদি এখানে থাকত, তা হলে নিশ্চয় আমি ওকে টেনিস খেলতে পাঠাতাম। লক্ষ করেছ ওঁর দুটি ছেলের কী চমৎকার স্বাস্থ্য তৈরি হয়েছে! হাঁটাচলায় কত স্মার্ট! ছোটটি পাঁচ বছর আগে কী রুগণ দেখতে ছিল, রীতিমতো তো ধুঁকত। আর এখন?” সুভাষ সেনের স্বরে প্রশংসার সঙ্গে শ্রদ্ধাও ফুটে উঠল। ”সবই ওই দু’জনের জন্য।”

”সত্যিই, কষ্ট করেছেন ওদের বাবা মা।” বরুণার গলায় অকৃত্রিম সহানুভূতি। ”মিসেস বসুমল্লিককে ছেঁড়া ব্লাউজ সেলাই করে পরতে দেখেছি। তন্ময়বাবুর জুতোটা দেখেছ? তোমার বেয়ারাও ওর থেকে ভাল জুতো পরে। অথচ ছেলেদের জন্য খরচ করতে কার্পণ্য করেন না। টেনিসের কোচকেই ওঁরা দেন মাসে দুশো টাকা, ভাবতে পারো?”

ভাবতে পারেননি তপতী, মিনুর নর্থ ক্যালকাটা টুর্নামেন্ট জেতার প্রতিক্রিয়া এমন হবে।

সোমবার তিনি ছেলেদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার সময় কাপটাও সঙ্গে নিয়ে গেছলেন হেডমাস্টারকে দেখাবার জন্য। গিয়ে শুনলেন তিনি আজ স্কুলে আসবেন না, কলকাতায় মধ্যশিক্ষা পর্যদের মিটিংয়ে গেছেন। কাপটা হেডমাস্টারের টেবলের একধারে রেখে তপতী বেয়ারাকে বলে আসেন,”ওঁকে বোলো, ক্লাস এইটের বি সেকশনের মৃন্ময় বসুমল্লিক এটা জিতে এনেছে কলকাতা থেকে। আমি কাল এসে নিয়ে যাব।”

পরদিন গাড়ি থেকে নেমে তপতী দুই ছেলের সঙ্গে স্কুলের বড় ফটক দিয়ে ঢুকে স্কুলবাড়ির কোলাপসিবল ফটকের দিকে এগোচ্ছেন, তখন একটি বড় ছেলে চেঁচিয়ে বলল,”কী রে মৃন্ময়, কাকে হারিয়ে কাপটা পেলি, কৃষ্ণনকে, না জয়দীপ মুখার্জিকে?”

ওরা তিনজন থমকে পাঁচটি ছেলের জটলার দিকে তাকাল। চিনু চাপা গলায় বলল,”দাদা প্রণবেন্দু বলল, চুপ করে থাক, কথা বলিসনি।”

তিনজন কোলাপসিবল ফটকের কাছে পৌঁছেছে তখন তাদের কানে এল,”জিতে আনলি না কিনে আনলি?”

কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওদের পা অচল হয়ে পড়ল। তপতী তাকালেন মিনুর মুখের দিকে। অপমানে আর বেদনায় মুখটা দিশাহারা। ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল, জল ভরে আসছে চোখে। কথাগুলোর ধাক্কা ওর বুকে বেজেছে। ”তাড়াতাড়ি ক্লাসে যা।” তপতী দুই ছেলের পিঠে হাত রেখে ঠেলা দিলেন। ”এসব কথায় জবাব দিলে ওরা আশকারা পেয়ে আরও বলবে, ক্লাসে যা।”

”মা, আমি প্রণবেন্দুকে মারব।” চিনু জ্বলন্ত চোখে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে হাত মুঠো করল।

”মারবে? কেন?”

”দাদাকে অপমান করেছে, আমাদের সবাইকে, তোমাকে, বাবাকে মিথ্যেবাদী, জোচ্চচর বলল।”

”বলতে দে। মিনু ক্লাসে যা। চিনু খবর্দার,যদি মারপিট করিস তা হলে আমি লজ্জায় মরে যাব।”

ছেলেরা দোতলার সিঁড়ির দিকে এগোল। তপতী ঠোঁট কামড়ে চোখ বুজলেন। শরীরের ভেতরটা থরথর করছে। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন, দেয়ালে হাত রেখে মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে রইলেন। মনে মনে শুধু বলে গেলেন,”হায় ভগবান, এত পরিশ্রম, এত কষ্ট, এত সাধনা করল মিনু আর ওইটুকু ছেলের মাথায় কিনা এমন অপবাদের বোঝা তুলে দিল! ওর জীবন তো শুরুই হয়নি, আর এখনই ঈর্ষা হিংসার আঘাত ওকে পেতে হল! ভেঙে না পড়ে মিনুর নরম কাঁচা মন! ভগবান ওকে শক্তি দাও।”

তপতী হেডমাস্টারের ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন কাপটা টেবল থেকে মেঝেয় নামানো।

”আসুন মিসেস বসুমল্লিক।” হেডমাস্টার আচার্য তিনটি চেয়ারের মধ্যে একমাত্র খালি চেয়ারটার দিকে হাত দেখিয়ে বললেন,”বসুন।” অন্য দুটি চেয়ারে দু’জন অভিভাবক বসে।

”কাল এসে কাপটা রেখে গেছেন। বেশ বড় কাপ। আজ সকালে তিনটে কাগজে খুঁজলাম—কিন্তু মৃন্ময়ের নাম তো কোথাও দেখতে পেলাম না!” হেডমাস্টারের বিস্মিত চোখে তপতী দেখতে পেলেন প্রশ্ন,’কেন পেলাম না?’

”কেন পেলেন না সেটা তো আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, আমি তো কাগজের সম্পাদক নই।” তপতী শান্ত স্বরে পরিহাস মিশিয়ে বললেন।

”হয়তো ছাপার যোগ্য খবর নয় বলেই ছাপেনি।” হেডমাস্টারের গলা ঈষৎ তির্যক।

”তা হতে পারে।” তপতী উঠে দাঁড়ালেন। ”আমি এটা নিয়ে যাচ্ছি।”

”হ্যাঁ, নিশ্চয়। ওটা তো দেখা হয়ে গেছে।”

তপতী যত্নভরে কাপটা দু’হাতে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ধীর পায়ে।

বাড়ি ফিরে তিনি বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে রইলেন। বেলা একসময় খেতে ডাকল। ”মাথা ধরেছে”, ”খিদে নেই” বলে কিছু খেলেন না। গাড়ি নিয়ে স্কুলে গেলেন ঠিক সাড়ে তিনটেয়। চিনু—মিনু যখন গাড়ির দিকে আসছে তিনি তীক্ষ্নদৃষ্টিতে ওদের মুখের দিকে তাকালেন। দুই ছেলেরই মুখ গম্ভীর। জামাপ্যান্টে মারামারির কোনও চিহ্ন নেই দেখে তিনি খানিকটা আশ্বস্ত হলেন। তবে মুখের ভাব তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলল। সকালে শোনা কথাগুলো বোধ হয় ওদের মন থেকে মুছে যায়নি।

গাড়িতেই ওরা প্যান্ট শার্ট বদলে খাবার খেয়ে নেয়। কিন্তু আজ খানিকটা খেয়ে রেখে দিল। পোশাক বদলাল না।

”ড্রেস চেঞ্জ করবি না?” গাড়ি চালাতে চালাতে তপতী বললেন।

”না।” চিনু বলল।

”খেলবি না?”

”ভাল লাগছে না।…মা এই স্কুলে আর পড়ব না।” চিনুর স্বরে ক্ষোভ আর বিরাগের সঙ্গে তিক্ততা মাখানো রয়েছে। মিনু চুপ করে আছে।

তপতী উত্তর দিলেন না। তিনি বুঝতে পারছেন দু’জনের মনের অবস্থা। এখন কথা না বলাই ভাল। জমে ওঠা রাগ আর বেদনা ওরা বার করে দিক আগে।

সহদেব অপেক্ষা করছিলেন। তপতী নিজেই বললেন,”আজ আর ওয়ার্ক আউট করাবেন না সহদেববাবু, ওদের মন খুব বিক্ষিপ্ত রয়েছে।”

”সে কী! একটা তো মোটে টুর্নামেন্ট জিতল, এখনও অনেক জিততে হবে মিনুকে। আমি তো ঠিক করে রেখেছি ওকে এ—বছরই কলকাতার সব টুর্নামেন্টে নামাব।”

”তা নামাবেন। কিন্তু আজ থাক, কারণটা আমি পরে বলছি। বরং ওরা নিজেদের মধ্যে খেলুক তা হলে মনটাকে কিছুটা গুছিয়ে নিতে পারবে।”

সহদেব দু’জনকে ডাকলেন। ”ড্রেস করোনি কেন? যাও চেঞ্জ করে এসো…আজ দু’জনে সেকেন্ড সার্ভ প্র্যাকটিস করো। মিনু কাল তিনটে ডাবল—ফল্ট করেছ।”

”আজ আমি কোর্টে নামব না।” মুখ নিচু করে গোঁয়ারের মতো মিনু দাঁড়িয়ে রইল।

”চিনু?”

”আমিও না।”

সহদেব চোখে প্রশ্ন নিয়ে তপতীর দিকে তাকালেন।

”তা হলে আজ থাক।” তপতী বললেন।

”বেশ, তা হলে মন গুছিয়ে নেওয়ার খেলাই ওরা খেলুক।” সহদেব একটা বল তাঁর হাতের র‌্যাকেটের ওপর রেখে ঝাঁকুনি দিয়ে বলটাকে প্রায় পনেরো ফুট শূন্যে ছুড়ে দিলেন। পড়ন্ত বলটা তাঁত ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে র‌্যাকেটটা নীচে নামিয়ে নিতে নিতে বলটাকে তিনি তাঁতের ওপর স্থিরভাবে বসিয়ে নিলেন, যেন জালে ধরা পড়ল বলটা। দু’বার—তিনবার করলেন।

”মিনু র‌্যাকেট নাও। বলেছ যখন কোর্টে তোমায় আজ নামতে হবে না। এখন তুমি ওদিকে কুড়ি পা যাও।”

নির্দেশ মতো কোর্টের বাইরের জমিতে মিনু গুনে গুনে কুড়ি পা দূরত্বে গেল। সহদেব র‌্যাকেটে রাখা বলটা ছুড়ে দিয়েই বললেন,”র‌্যাকেটে ধরো।”

মিনু র‌্যাকেট আলতো করে বলের সঙ্গে নামিয়ে নিতে নিতে তাঁতের ওপর বলটা ধরল।

”ছুড়ে দাও, যেমনভাবে আমি দিলাম।”

এর পর সহদেব বলটাকে মিনুর পেছনে, দু’পাশে কখনও—বা পাঁচ গজ সামনে পাঠাতে লাগলেন। মিনু নিখুঁতভাবে প্রতিটি বল র‌্যাকেটে ধরে পাঠিয়ে দিল।

সহদেব ইশারা করলেন চিনুকে। ”তুমি এবার আমার জায়গা নাও।…এটা করে যাও তা হলে ‘টাচ’ তৈরি হবে, কন্ট্রোল আসবে।” কথাগুলো বলে তিনি তপতীর পাশে এসে বসলেন। ”হ্যাঁ বলুন কী বলবেন।”

তপতী সকালে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বললেন,”ওরা কতটা দাগা পেয়েছে বুঝতেই পারছেন, খেলতে এত ভালবাসে অথচ খেলতে চাইল না।”

শুনতে শুনতে সহদেবের মুখ থমথমে হয়ে গেল রাগে। কিছুক্ষণ কথা না বলে মুখ নামিয়ে রইলেন। একসময় মুখ তুলে বললেন,”দিদি, খেলাটা কোর্টে যতটা না হয় তার থেকেও বেশি হয় মনে। আর মন যদি এইসব কথা শুনে ছত্রাকার হয়ে যায় তা হলে খেলার অবস্থাটাও তাই হবে। ওদের যদি আর একটু বয়স বা অভিজ্ঞতা হত, তা হলে নিজেরাই নিজেদের সামলাতে পারত।…এই কাজটা কিন্তু এখন আপনাকেই করতে হবে। ওদের আড়াল করা, ওদের মনের চার পাশে দেয়াল তুলে শুধু ছাদটা খুলে রাখা, সেখান দিয়ে টেনিস ছাড়া আর কিছু যেন না দেখতে পায়।…পারবেন?”

”পারতে হবে।”

।।৮।।

”মিনু, চিনু তোমরা কী হতে চাও, তোমাদের জীবনের লক্ষ্য কী?”

”বড় টেনিস প্লেয়ার হতে চাই।”

”আমিও।”

খাওয়ার টেবলে ছড়ানো বই, খাতা, স্কুলব্যাগ। তপতীর ডান দিকে চিনু, টেবলের ওধারে মিনু। কোর্ট থেকে ফিরে প্রতি সন্ধ্যার মতো তিনি ছেলেদের নিয়ে পড়াতে বসেছেন। চিনুকে অঙ্ক বুঝিয়ে দিয়ে প্রশ্নমালা থেকে দশটা অঙ্ক করতে দিয়েছেন। তারপর মিনুকে করতে দেওয়া ট্রানস্লেশন সংশোধন করতে করতে হঠাৎই তিনি ছেলেদের প্রশ্নটা করলেন। বসার ঘরে সোফায় শুয়ে তন্ময় খবরের কাগজ পড়ছেন, কাগজটা নামিয়ে তিনি দরজা দিয়ে একপলক তাকিয়ে আবার পড়তে শুরু করলেন।

”বড় প্লেয়ার হতে গেলে প্রথমেই কী দরকার?”

উত্তরটা দুই ছেলেরই বহুবার মায়ের কাছ থেকে শোনা আছে।

”কঠোর পরিশ্রম।” মিনু বলল।

”আর?”

”লক্ষ্যপূরণের জন্য মনকে—” চিনু দাদার দিকে তাকাল।

”একমুখীন করতে হবে।” মিনু সম্পূর্ণ করে দিল।

”তোমরা কি তাই করছ?” তপতী ছেলেদের যখন গভীর কোনও কথা বলেন তখন ‘তুই’ হয়ে যায় ‘তুমি’। ”আজ তোমরা কোর্টে নামতে চাইলে না কেন? তোমাদের লক্ষ্য বড় প্লেয়ার হওয়া, কিন্তু আজেবাজে কথা শুনে…।”

”আজেবাজে? প্রণবেন্দু যে কথাটা বলল সেটা আজেবাজে?” রাগে ফুঁসে উঠল মিনু।

”হ্যাঁ আজেবাজে।” শান্ত ধীর স্বরে তপতী কথাটা বলে ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মিনু চোখ নামিয়ে নিল।

”তুমি জানো, পরিশ্রম করে কোনও অন্যায় সুযোগ না নিয়ে, পাঁচজন প্লেয়ারকে পরিচ্ছন্নভাবে হারিয়ে কাপটা জিতেছ।…নিজের কাছে তুমি সৎ। এটাই হল বড় কথা, একমাত্র কথা। জেতার জন্য তোমার মনের মধ্যে একটা সুন্দর অনুভূতি পেয়েছ, তোমার কাজ এই অনুভূতিটাকে বাঁচিয়ে রাখা। তা করতে পারলে দেখবে একটা দুর্লভ ট্রফি তুমি জিতে ফেলেছ।” তপতী কথা শেষ করে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। চিনু—মিনু উৎসুক কৌতূহলভরে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল।

”নিজেকে নিজের ভাল লাগছে—এটাই হল ট্রফি আর এই ট্রফিটা তোমাদের জিততে হবে। সেজন্য যা কিছু সুন্দর জিনিস, সংগ্রহ করে মনে ভরে রাখতে হবে। তা করতে পারলে দেখবে মন একমুখীন হয়েছে। কুৎসা ঈর্ষা রটনা এসব হল আবর্জনা। এগুলো দিয়ে মন ভরিয়ে ফেললেই দেখবে তোমাদের ভেতর দুর্গন্ধ জমে উঠেছে, শ্বাস নিতে পারছ না, ছটফট করছ। তখন মন আর একমুখীন হতে পারবে না…তোমরা বড় প্লেয়ার কেন, কিছুই হতে পারবে না।”

তপতীর নম্র স্বর সারা ঘরে একটা গম্ভীর পরিবেশ তৈরি করেছে। মিনু একদৃষ্টে টেবলের একটা বইয়ের দিকে তাকিয়ে। চিনু ইরেজারটাকে নখ দিয়ে খুঁটছে। তপতী আড়চোখে দেখলেন বসার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তন্ময় নিঃশব্দে হাসছেন।

”তাই বলে আমরা হজম করে যাব?” চিনু এখনও মানতে পারছে না সকালে স্কুলের ঘটনাটা।

”হজম করতে না পারলে কোরো না। আমরা কত আশা নিয়ে তোমাদের দিকে তাকিয়ে, তোমরা বড় প্লেয়ার হবে, আমাদের বুক গর্বে ভরে উঠবে। আমাদের দেখে লোকে বলবে ‘ওই যে মৃন্ময় বসুমল্লিকের মা, ওই যে চিন্ময় বসুমল্লিকের বাবা।’ আর আমরা বলব,’ওই দেখো আমাদের মিনু, ওই দেখো আমাদের চিনু, ওদের জন্য আমরা কত কষ্ট করেছি, কত অপমান—কুৎসা সয়েছি। আজ দ্যাখো ওদের কত নাম, কত যশ, ওরা বাবা—মা’র মুখ রেখেছে,ওরা বাবা—মা’কে ভালবাসে।…”’ তপতী থেমে গেলেন মিনুর চোখ ছলছল করছে দেখে। চিনু দু’ হাতে আঁকড়ে মায়ের ডান বাহুতে মুখ চেপে ধরল।

”…কিন্তু মিনু আর চিনু একটা বড় ভুল করে বসল। মায়ের কথা না শুনে ওরা লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে মনকে অশান্তিতে ভরিয়ে তুলল, তাই ওরা বড় হতে পারল না। মা আর বাবাকে দুঃখ দিল। কেউ আর বলবে না ওই যে মৃন্ময় বসুমল্লিকের মা, ওই যে চিন্ময়—।” তপতীকে থেমে যেতে হল।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে মিনু টেবলের বইগুলিকে দু’হাত দিয়ে ছত্রখান করে টেবলে একটা ঘুঁসি বসিয়ে চিৎকার করল,”না,না,না।” তারপরই সে ছুটে নিজেদের ঘরে চলে গেল।

”চিনু!” তপতীর বাহু কামড়ে ধরেছে চিনু।

”আমি হজম করব।”

মিনিটখানেক পর ব্যস্ত হয়ে বেলা হাজির হল। ”কী হয়েছে গো বউদি? মিনু বিছানায় উপুড় হয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কেন গো?”

”ও কাঁদছে আর এ কামড়াচ্ছে, কী করি বলো তো?” কৃত্রিম অসহায়তা ফোটালেন তপতী তাঁর গলায়।

দিনকয়েক পর তপতী কোর্টের ধারে বসে। চিনু—মিনুকে দাঁড় করিয়ে সহদেব কথা বলছেন।

”ভলি মারার জন্য, রিফ্লেক্সের স্পিড বাড়াবার জন্য, তোমাদের কব্জির আর হাতের জোর বাড়াবার জন্য নেট গেম প্র্যাকটিসটা আজ অন্যভাবে করতে হবে। বাঁ হাতটা পিঠে ঠেকিয়ে তোমাদের খেলে যেতে হবে। ব্যালেন্সের জন্য একটা হাত না থাকলে দেখবে তোমাদের আরও চটপট মুভ করতে হচ্ছে, উপরন্তু যাবতীয় চাপ পড়বে ডান হাতের ওপর। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ?” দু’জনে মাথা নাড়ল। ”এবার করে দেখা যাক।”

পাঁচ মিনিটের মধ্যে দু’জনেই তিন—চারবার কোর্টে পড়ে গেল ভারসাম্য হারিয়ে।

”আস্তে খেলো আস্তে, প্রথম দিনেই অত ফাস্ট মুভ করতে যেয়ো না…মিনু ব্যাকহ্যান্ডটা বড় দেরিতে হিট করছ তাই বল বাইরে যাচ্ছে, আরও তাড়াতাড়ি র‌্যাকেটটা পেছনে নাও, মাথাটা নামিয়ে দাও স্ট্রোক নেওয়ার সময়…লবটা আরও তুলে দাও চিনু, সূর্যের দিকে তাকাতে মিনুকে বাধ্য করো” সহদেব সমানে চিৎকার করে গেলেন এবং দশ মিনিট পরই ছেলে দুটি দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁফাতে শুরু করল।

”কী হল?” সহদেব ধমকে উঠলেন।

”সার দু’ মিনিট।” মিনু আবেদন জানাল। সহদেব ঘড়ি দেখতে লাগলেন।

”দু’ মিনিট হয়ে গেছে, স্টার্ট।”

বিকেল গড়িয়ে গেছে। চারদিক ধূসর হয়ে উঠছে। গাছে গাছে পাখিদের কিচিরমিচির। চিনু, মিনু ক্লাবের কলে মুখ হাত পা ধুয়ে ফিরে এল।

”চারটে ক্লাব টুর্নামেন্টে তোমাদের এন্ট্রি করিয়েছি, দুটো হবে হার্ডকোর্টে। শ্যামবাজার,কাশীপুর, অর্ডন্যান্স, স্যাটারডে, টানা প্রায় একমাস।

”নানারকমের কোর্টে, নানা কন্ডিশনে, নানা ধরনের প্লেয়ারদের সঙ্গে তোমাদের এখন খেলা দরকার, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তোমাদের ডেভেলপমেন্টের জন্য।”

সহদেব জুতোর ভেতর থেকে কাঁকর ঝেড়ে ফেলে ফিতে বাঁধলেন।

”একমাস তা হলে স্কুল করা হবে না।” মিনু মনে করিয়ে দিল।

”তা হবে না। যদি কলকাতায় থাকতে তা হলে হাফ স্কুল করেও খেলতে যেতে পারতে। কিন্তু এখান থেকে পৌঁছতেই তো দেড়—দু ঘণ্টা লেগে যাবে।…স্কুল কামাই করতেই হবে।” সহদেব চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানালেন।

”একমাস কামাই করলে আমাদের তো নাম কেটে দেবে।”

তপতী গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন,”আমি বরং একবার হেডমাস্টারমশাইকে বলে দেখি যদি মাসখানেকের জন্য ছুটি দেন।”

”যদি না দেয়?” চিনুর চোখে সংশয়।

”না দিলে কী আর করা যাবে, নাম কেটে দিলে দেবে।” তপতী সহজ সুরে কথাগুলো বললেন কিন্তু ঋজু ভঙ্গিতে। ”কেউ যদি অসুখে পড়ে একমাস স্কুলে না যায় তা হলে কি তার নাম কাটা যাবে?”

”আমাদের তো অসুখ নয়।” চিনুর আবার সংশয়।

”তার থেকেও বড় ব্যাপার, সুস্থ থাকার জন্য খেলা! হয়েছে এবার, চলো। সহদেববাবু আপনি টুর্নামেন্টের তারিখগুলো যদি দেন তো কথা বলতে সুবিধে হবে। তবে একটা কথা, ছুটি না দিলেও ওরা কিন্তু খেলতে যাবে।”

এক সপ্তাহ পর তপতী দেখা করলেন হেডমাস্টারের সঙ্গে। তপতীর কথা শুনে পুরো পনেরো সেকেন্ড তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন,”ছেলে দুটো লেখাপড়া শিখে মানুষ হোক, বড় হোক, এটা কি আপনি চান না?”

”মানুষ হোক এটা তো অবশ্যই চাই। কিন্তু লেখাপড়া শিখলেই মানুষ হবে, এ—ধারণাটাও তো ঠিক নয়। জীবনের আরও অনেক ক্ষেত্র রয়েছে, যেখান থেকে বড় হওয়া যায়। ছবি আঁকা,গানবাজনা, অভিনয় নাচের মধ্য দিয়ে যেমন, তেমনই খেলার মধ্য দিয়েও তো বড় হওয়া যায়, সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায়। এই স্কুলের সব ছেলেই কি স্টার পেয়ে পাশ করে? আমার ছেলেরাও নয় স্টার লেটার পাবে না কিন্তু অন্যদিকে তো স্টার পেতে পারে।” তপতীর গলা আবেগে একটু চড়ে গেল, সেটা বুঝতে পেরেই তিনি লজ্জিত হয়ে পড়লেন।

”তা ঠিক। সবাই স্টার লেটার পায় না।” হেডমাস্টার গম্ভীর মুখে সামনে ঝুঁকে বললেন। ”মৃন্ময়, চিন্ময় স্ট্যান্ড করে না বটে, কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্টও খারাপ নয়। কিন্তু এতদিন স্কুল কামাই করে খেলে বেড়ানো, এটা আমি সমর্থন করতে পারছি না।”

”আমরা ঝুঁকি দিয়ে দু’জনকে টেনিস প্লেয়ার তৈরি করছি, আপনিও একটু ঝুঁকি নিন না আমাদের সঙ্গে। এই স্কুলের দুটি ছেলে যদি খেলায় নাম করে তা হলে তো স্কুলেরও সুনাম হবে।” তপতী আশাভরে হেডমাস্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মনে হল,’স্কুলের সুনাম’ কথাটায় বোধ হয় কাজ হয়েছে। হেডমাস্টার ঠোঁট টিপে মাথা নাড়লেন, চোখ দুটো একটু বড় হল।

”এক মাস স্কুলে না এলে পড়াশুনোয় পিছিয়ে পড়বে।”

”আমি বাড়িতে পড়িয়ে সেটা মেকআপ করে দেব…গ্যারান্টি দিচ্ছি।

”বেশ, ওরা খেলুক। মিসেস বসুমল্লিক এই ফেভার কিন্তু এই একবারই; আর কিন্তু দেব না। আশা করি আপনিও আর চাইবেন না।”

”চাইব না।”

.

মিনু চারটে টুর্নামেন্টের তিনটিতে জুনিয়ার চ্যাম্পিয়ান হল একটা সেটও না হারিয়ে। চিনু তিনটির দুটিতে কোয়ার্টার ও একটিতে সেমিফাইনালে উঠেছিল। সহদেব শুধু অর্ডন্যান্স ক্লাবের টুর্নামেন্টে মিনুকে সিনিয়ার বিভাগে এন্ট্রি করিয়েছিলেন ওর যোগ্যতা ও ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য। সেমিফাইনালে উঠে সে ভারতের ডেভিস কাপার প্রেমজিত লালের সামনে পড়ে। ২—৬,৩—৬—এ হেরে যায় মিনু। ম্যাচটা গড়িয়েছিল পঁয়ষট্টি মিনিট। প্রতিটি পয়েন্টের জন্য মিনু লড়াই করেছে আর সেটাই ভাল লেগেছে দর্শকদের, বিশেষ করে বেঙ্গল লন টেনিসের প্রেসিডেন্ট ভাস্কর মুখার্জির, তিনি অল ইণ্ডিয়া লন টেনিসেরও ট্রেজারার। মিনুকে কাছে ডেকে বলেন,”শুনলাম তুমি সহদেবের হাতে তৈরি, তা হলে তো আর কিছু বলার নেই। তবে এখন তুমি স্টেট আর ন্যাশনাল লেভেলে খেলার কথা ভাবো। প্রেমজিতের কাছে তুমি যে হারবে এটা আমি ধরেই নিয়েছিলাম, কিন্তু কীভাবে হারো সেটাই দেখার ছিল। আমি খুশি তোমার খেলা দেখে। বয়স কত?”

”চোদ্দোয় পড়েছি।”

ভাস্কর মুখার্জির ভুরু উঠে গেল। ”তোমাকে তো ষোলো—সতেরো ভেবেছিলাম। এই বয়সেই প্রেমজিতের কাছ থেকে পাঁচটা গেম নিয়েছ!” মিনুর পিঠ চাপড়ে তিনি অন্য লোকের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত হলেন। ওদের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এক ইংরেজি কাগজের সাংবাদিক। তিনি ভাস্কর মুখার্জির কথা শুনেছিলেন। সাংবাদিক এক ফাঁকে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন ”বসুমল্লিক সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?” ”ওয়ান অব দ্য মোস্ট প্রমিসিং জুনিয়ারস ইন দ্য কান্ট্রি।” পরদিন সাংবাদিক তাঁর রিপোর্টে দুটি বাক্য লিখলেন মিনু সম্পর্কে: ”বসুমল্লিকের বয়স মাত্র চোদ্দো, কিন্তু লালকে ব্যস্ত রেখে সে পাঁচটা গেম ছিনিয়ে নিয়েছে। টেনিস রসিকদের ধারণা, এই কিশোর ভারতীয় টেনিসে একদিন উজ্জ্বল তারকা হয়ে উঠবে।”

পরদিন তপতী বাক্য দুটি পড়তে পড়তে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। ‘একদিন উজ্জ্বল তারকা হবে উঠবে’ এই স্বপ্নই তো তাঁদের চালিয়ে নিয়ে এসেছে পাঁচটা বছর।

সকালে খাওয়ার টেবলে কাগজটা সকলের হাতে ঘুরল। এর আগে মিনু যে তিনটি টুর্নামেন্টে জুনিয়ার খেতাব জিতেছে তাতে শুধু সিনিয়ারদের ফল কাগজে বেরিয়েছিল। আর এবার নামের সঙ্গে দুটো কথাও। তন্ময় বললেন ”এর কারণ অবশ্য প্রেমজিত লালের সঙ্গে খেলেছে বলে।”

তপতী প্রতিবাদ করলেন,”সে তো অনেকেই খেলেছে, কই এমন ভাবে তো তাদের সম্পর্কে লেখা হয়নি।”

”সহদেববাবু, মিনুর সম্পর্কে যা বলা হয়েছে সেটা এখনই বলার মতো খেলা কি খেলেছে?” তন্ময় সিরিয়াস স্বরে জানতে চাইলেন।

”ভাস্কর মুখার্জি বহু বছর ধরে বহু প্লেয়ারকে দেখেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, কৃষ্ণন, প্রেমজিত, জয়দীপের পরের একটা ব্যাচ তৈরির জন্য এ আই এল টি এ চারজন জুনিয়ারকে ইউরোপ ট্যুরে পাঠাবে। মিনু যদি জুনিয়ার ন্যাশনালের সেমিফাইনালেও উঠতে পারে তা হলে ট্যুরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।” সহদেব মিনুর দিকে তাকালেন। মুখে পাতলা হাসি। মুখ নামিয়ে মিনু ভাত খেয়ে যাচ্ছে।

”পারবি না মিনু?” তন্ময় আশান্বিত স্বরে জানতে চেয়ে একটা ইতিবাচক উত্তরের আশায় তাকালেন।

মুখ না তুলে মিনু ভাত মুখে একটা শুধু শব্দ করল। যেটা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দুইই হতে পারে।

”সেমিফাইনালে যেতে পারবি?” তন্ময় আবার বললেন।

”তন্ময়বাবু এসব কথা থাক এখন।” সহদেব প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য তাড়াতাড়ি যোগ করলেন, ”আগে জুনিয়ার বেঙ্গলটা উতরোক। ধাপে ধাপে জিনিসগুলো হওয়া ভাল।”

খাওয়া শেষ করে মিনু হাত ধোওয়ার জন্য উঠে যেতেই সহদেব বললেন,”জুনিয়ার ন্যাশনাল নিয়ে একটা কথাও ওকে বলবেন না। অযথা মনের ওপর একটা প্রেশার তৈরি হবে। আপনাদের আশা যত বাড়বে, প্রেশারটাও তত বাড়বে, বাচ্চচা ছেলে সেটা নিতে পারবে না।”

”আপনি ঠিকই বলেছেন।” কথাটা বলে তপতী চাহনি দিয়ে স্বামীর ভর্ৎসনা জানালেন। ”চিনু, এসব নিয়ে কারও সঙ্গে গল্প করবে না।”

খাওয়া চিনুরও শেষ হয়েছে। চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে সে বলল,”খবরের কাগজটা আমি স্কুলে নিয়ে যাব, সবাইকে দেখাব। নর্থ ক্যালকাটার কাপ জেতার থেকেও স্টাফ রিপোর্টারের এই কথাগুলো দাদার মান বাড়িয়েছে।”

”একদম নয় চিনু।” তপতী ছিলেছেঁড়া ধনুকের মতো দাঁড়িয়ে উঠলেন। ”কাউকে কিছু দেখাতে হবে না।…এখানকার কারোর কোনও প্রশংসা আমার দরকার নেই, আমার ছেলেদেরও দরকার নেই।” তপতী উত্তেজনায় কাঁপছেন।

”চিনু যদি তুমি এই কাগজ নিয়ে কাউকে দেখাও বা কাউকে এর উল্লেখ পর্যন্ত করো তা হলে র‌্যাকেট দিয়ে তোমার পিঠ ভাঙব।”

তুই নয় তুমি! মার মুখের দিকে তাকিয়ে চিনু বুঝে গেল র‌্যাকেট তার পিঠের সঙ্গে মাথাও ভেঙে দিতে পারে। সে একটি কথাও আর না বলে বেরিয়ে গেল। তপতীর হঠাৎ এমন আচরণে তন্ময় ও সহদেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এভাবে ওঁকে রেগে উঠতে তাঁরা কখনও দেখেননি।

”এখানকার কয়েকটা লোক এমন সব কথা রটিয়েছে, যা শুনলে মনে হবে পৃথিবীটা খুব খারাপ জায়গা…আমি চাই ছেলেরা জানুক পৃথিবীটা খুব ভাল জায়গা।…এরপর হয়তো শুনব কাগজের রিপোর্টারকে টাকা খাইয়ে লিখিয়ে নিয়েছি। এরা সব কিছুই বলতে পারে।”

তপতী বেরিয়ে গেলেন গাড়ি বের করতে। সহদেব নিচু গলায় বললেন,”দিদিকে কিন্তু আর রাগতে দেবেন না, তা হলে ছেলেদের ক্ষতি হবে।”

”আমি কি রাগিয়েছি না কি! রাগ বহুদিন জমে ছিল, আজ সেটা ফেটে বেরোল। তবে এটুকু বলতে পারি, আর কখনও রাগবে না।” তন্ময় নিশ্চিত স্বরে জানালেন।

বাইরে হর্ন বাজল। মিনু চিনু স্কুলব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল।

”তা হলে এবার?” তন্ময় বললেন।

”এবার জুনিয়ার বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ানশিপ।” সহদেব আড়মোড়া ভাঙলেন।

ছেলেদের পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় তপতী একটা শক্ত মলাটের সাদা এক্সারসাইজ খাতা কিনে আনলেন। বাড়ি এসে দেখলেন তন্ময় স্নান করতে কলঘরে গেছেন। খবরের কাগজ থেকে টেনিস ম্যাচের রিপোর্টের অংশটি কাঁচি দিয়ে কেটে গঁদ লাগিয়ে তিনি কাটিংটা খাতার প্রথম পাতায় সেঁটে দিলেন।

অফিসে যাওয়ার সময় খবরের কাগজটা খাওয়ার টেবলে ভাঁজ করা পড়ে আছে দেখে তন্ময় থমকে গেলেন। তপতী রান্নাঘরে। সেদিকে দু’বার তাকিয়ে চট করে কাগজটা তুলে হনহন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। অফিসে প্রথমেই তিনি গেলেন ম্যানেজিং ডিরেক্টরের ঘরে। তিনি ব্যস্ত টেলিফোনে কথা বলায়। তন্ময় খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে মুখ হাসি হাসি করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

”কী ব্যাপার বসুমল্লিক?” এম ডি ফোন রেখে বললেন।

”সার, আজকের কাগজে আমার বড়ছেলের সম্পর্কে দুটো সেন্টেন্স আছে। দেখুন।” তন্ময় গর্বিতভাবে স্পোর্টসের পাতাটা খুলে কাগজটা হাতে দিয়ে মুখ ফ্যাকাসে করে ফেললেন।

”কী হল!”

”সার একটা গোলমাল হয়ে গেছে। রিপোর্টটা কেউ কেটে নিয়েছে, বোধ হয় আমার স্ত্রী। আই অ্যাম ভেরি সরি।” তন্ময় কাঁচুমাচু।

এম ডি হাসি চেপে হাত বাড়িয়ে র‌্যাকে রাখা তিন—চারটে খবরের কাগজের থেকে একটা তুলে নিলেন। পাতা উলটে বললেন,”এই খবরটা?”

”হ্যাঁ, হ্যাঁ।” তন্ময়ের ধড়ে যেন প্রাণ এল।

এম ডি দু’বার পড়লেন। ভ্রূ কয়েকবার উঠল, নামল। তন্ময়ের মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন,”পাঁচটা গেম নিয়েছে, আ বিগ অ্যাচিভমেন্ট।”

.

”বেঙ্গল লন টেনিসের প্রেসিডেন্ট বলেছেন যদি ন্যাশনালের সেমিফাইনালেও উঠতে পারে তা হলে ইউরোপ ট্যুরের জন্য মিনু সিলেক্ট হতে পারে।”

এম ডি চোখ কুঁচকে বললেন,”ইউরোপ ট্যুরে? বলেন কী! এই মহাদেবপুর থেকে ইউরোপে খেলতে যাবে? মাই গড! এটা তো আমাদের পক্ষে খুব গর্বের ব্যাপার হবে।”

বুকপকেট থেকে পার্কার ফাউন্টেন পেনটা তুলে নিয়ে তন্ময়ের হাতে দিয়ে বললেন,”মৃন্ময়কে আমার উপহার।”

.

বেঙ্গল লন টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে রাজ্য জুনিয়ার চ্যাম্পিয়ানশিপ শুরুর দু’দিন আগে খেলার ফিক্সচার দেখে সহদেবের চোখ কুঁচকে উঠল। বত্রিশ জনকে নিয়ে চ্যাম্পিয়ানশিপ হচ্ছে। ফিক্সচারের ওপরের দিকে ষোলো জনের মধ্যে রয়েছে অরুণ মেটা। তলার দিকের ষোলো জনে রয়েছে মিনু, সেইসঙ্গে চিনুও। দু’জনেই যদি তাদের প্রথম দুটো ম্যাচ জেতে তা হলে কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হবে দুই ভাই।

সহদেব চিন্তায় পড়ে গেলেন। ব্যাপারটা তা হলে কী দাঁড়াবে? সন্দেহ নেই মিনুই জিতবে। চিনু হরিণের গতিতে তার খেলায় উন্নতি করেছে কিন্তু মিনু করেছে চিতাবাঘের গতিতে। দু’জনের মধ্যেকার ব্যবধানটা এতই যে, মিনু তার অর্ধেক খেলা খেলেই চিনুকে স্ট্রেট সেটে হারাবে। কিন্তু এর ফলে কোনও খারাপ প্রতিক্রিয়া ঘটবে না তো? দুই ভাইয়ের মধ্যে এত মনের মিল, একের জন্য অপরের এত ভালবাসা, হরিহর আত্মার মতো দু’জনের সম্পর্ক তাতে চিড় ধরবে না তো?

সহদেব বুঝে উঠতে পারছেন না মিনুর মনে ভাইকে হারিয়ে দেওয়ার দুঃখটা কতখানি বাজবে, কতদিন ধরে তাকে মানসিক অবসাদের মধ্যে রাখবে। চিনুর মনেও অভিমানের মেঘ কতটা জমবে সেটাও তাঁর অনুমানের বাইরে। অবশেষে তিনি ঠিক করলেন ব্যাপারটা ওদের বাবা—মায়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভাল। বিষয়টি নিয়ে তিনি ছেলে দুটির সামনে আলোচনা করতে চান না, তাই ওরা মায়ের সঙ্গে স্কুলে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। তন্ময় যখন খেতে বসেছেন তখন সহদেব তাঁকে সমস্যার কথা জানালেন।

তন্ময় শুনেই বললেন,”ফিক্সচারটা বদলানো যায় না?”

”অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন বদলানো যায় না।” সহদেব মাথা নাড়লেন।

”কিন্তু ভাইয়ের হাতে ভাই হারবে এটা তো মেনে নেওয়া যায় না।…যাই হোক, তপতী আসুক, ওঁর সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটার একটা নিষ্পত্তি করুন।”

তন্ময় বেরিয়ে যাওয়ার পর সহদেব অপেক্ষা করলেন তপতীর ফিরে আসার জন্য। মিনিট দশেকের মধ্যেই তিনি ফিরলেন।

”দিদি, আপনার জন্যই বসে আছি।” তপতী কিছু বলার আগেই সহদেব কথা শুরু করে দিলেন। তাঁর অপেক্ষা করার কারণটা তপতী শুনলেন। ”এটা নিয়ে এত ভাবার কী আছে? দু’জনকে যদি মুখোমুখি হতে হয়, হবে। সহদেববাবু আপনি অযথাই একটু বেশি বেশি ধরে নিচ্ছেন। খেলাটা ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের তো হবে না, হবে দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে। আপনিই তো বহুদিন ওদের বলেছেন, ‘নেটের ওধারের লোকটা তোমায় খতম করতে চায় তাই তোমার একমাত্র কাজ আগেই ওকে খতম করে দেওয়া। সব সময় ভাববে ও লোকটা তোমার শত্রু, ও তোমায় দয়া করবে না। তুমিও কখনও দয়া দেখাবে না।’ সহদেববাবু এখন কি ওদের অন্যরকম কিছু বলবেন?”

সহদেব চুপ করে রইলেন।

।।৯।।

প্রথম রাউন্ডের ষোলোটি ম্যাচ শেষ হওয়ার আগেই বোঝা গেল অন্তত পঁচিশজন খেলোয়াড়ের এই চ্যাম্পিয়ানশিপে খেলার কোনও যোগ্যতা নেই। মিনু তার প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারাল ৬—০, ৬—০। ষোলোটা ‘এস’ সমেত সে ম্যাচটা শেষ করল পঁয়ত্রিশ মিনিটে। চিনু জিতল ৬—১, ৬—২। দ্বিতীয় রাউন্ডে মিনু জিতল ৬—১, ৬—০, চিনু হারাল তার থেকে পাঁচ বছরের বড় একজনকে ৬—৩, ৬—১।

কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার আগের রাতে যখন ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া বিশ্বচরাচর নিঝুম, তখন মিনু হাত বাড়াল পাশের খাটের দিকে। চিনুর কাঁধে তার আঙুল ঠেকল।

”ঘুম আসছে না?”

”না।”

”কী ভাবছিস?”

”অনেকদিন আগে আমায় কুকুরে তাড়া করেছিল। তুই আমাকে আড়াল করে ঘুঁসি চালাচ্ছিলি। একটা লোক এসে কুকুরদুটোকে তাড়িয়ে দিল। তুই আমাকে পরে বললি ‘ভয় কী রে, আমি থাকতে ভয়ের কিছু নেই।’ এখন আবার বলবি কথাটা।”

”কেন?”

”আমার খুব ভয় করছে। কাল তুই বোধ হয় ইচ্ছে করে হেরে যাবি।”

মিনু হাত টেনে নিল। অনেকক্ষণ পরে সে বলল,”কাল আমি জিতব।…এবার ঘুমো।”

তপতী আর তন্ময় ইচ্ছে করেই দুই ছেলের খেলা দেখতে কলকাতায় গেলেন না। সন্ধ্যায় সহদেবের সঙ্গে তারা ফিরতেই বাবা—মা প্রথমেই দুই ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে খেলার ফল বোঝার চেষ্টা করলেন। দু’জনের মুখেই তৃপ্তির ছোঁয়া লেগে। তাঁরা সহদেবের দিকে তাকালেন। সেখানেও সুখের আভাস।

”সিক্স—থ্রি, সেভেন—ফাইভ। চিনু যে এমন খেলা খেলবে ভাবতে পারিনি। আপনারা যদি যেতেন তা হলে খেলার মতো খেলা একটা দেখতে পেতেন। কোর্টের ধারে অন্তত জনা ষাটেক লোক জমে গেছল। এত লোক এখনও কোনও ম্যাচে হয়নি। সেকেন্ড সেটটা নরেশকুমার দেখে বলল, ছোটভাইয়ের টাচ খুব ভাল, কৃষ্ণনকে মনে পড়িয়ে দেয় কিন্তু পাওয়ার আর স্পিড এই দুটোতেই ও বড় ভাইয়ের থেকে পিছিয়ে রয়েছে। এমন হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ দেখে কেউ বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে এরা দুই ভাই! রীতিমতো লড়ে মিনুকে জিততে হয়েছে।”

”যাক, আমার দুশ্চিন্তা দূর হল, বোধ হয় আপনারও।” তপতী বললেন সহদেবকে।

”কোথায় দূর হল, এখন তো চিনুর স্পিড আর পাওয়ার নিয়ে আমায় ভাবতে হবে। এখানে দু’জনের মধ্যে খেলায় তো এমন প্রচণ্ডভাবে ভেতরের জিনিস বেরিয়ে আসে না, যা আজকে দেখা গেল।”

.

আম্পায়ারের উঁচু চেয়ারের দু’পাশে দুটি চেয়ার। তার একটি মৃন্ময় বসুমল্লিকের জন্য,অপরটি অরুণ মেটার।

মিনু তার র‌্যাকেট কভারের চেন টেনে খুলল। সারের উপদেশ মনে পড়ল,’যতক্ষণ না রেডি হচ্ছ ততক্ষণ কোর্টে নামবে না।’ বাঁ কব্জিতে সোয়েটলেটটা আর একবার ঘুরিয়ে একটু তুলল। এখন তার দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে এসেছে। র‌্যাকেটটা চোখের সামনে ধরে হাতের তালুতে আঘাত করে তাঁতের বাঁধন টানটান আছে কি না অনুভব করল। বাতাসে কয়েকবার সে র‌্যাকেট চালিয়ে ব্যাকহ্যান্ড ও ফোরহ্যান্ড মারল।

”দেয়ার উইল বি আ থ্রি—মিনিট নক আপ।” আম্পায়ার জানিয়ে দিলেন দু’জনকে।

মিনু প্রথম বল মারার আগে হাতের খিল ছাড়াবার জন্য র‌্যাকেটটা ঘোরাতে লাগল। অরুণ বেস লাইনে এগিয়ে গেছে। এরপর দু’জনে র‌্যালি শুরু করতেই মিনুর হাতের আড়ষ্টতা কেটে যেতে লাগল। চারপাশের দর্শক, বাবা—মা, সার আর চিনুকে চোখের বাইরে রেখে ধীরে ধীরে সে তার দৃষ্টিকে গুটিয়ে আনল সাদা লাইন কাটা ঘাসের জমির মধ্যে, যে জমিতে শুধু টেনিস বল আর অরুণ মেটাকে নিয়ে এবার সে থাকবে।

”ওয়ান মোর মিনিট।”

অরুণ পরপর দুটো ভলি নেটে মারল। মিনুর মনে হল ও ভাল করে হাতটা তুলতে পারছে না, বল নজর করতেও যেন ওর অসুবিধে হচ্ছে।

প্রথম সার্ভ করল অরুণ। মিনু একটা পয়েন্টও নিতে না দিয়ে ওর সার্ভিস ভেঙে নিজের সার্ভিস ধরে রেখে ২—০ গেমে এগিয়ে গেল।

পরের দুটো গেম, মিনুর সার্ভিস ভেঙে অরুণ দখল করল। ২—২—এর পর পঞ্চম গেমে শুরু হল যেন তলোয়ারের খেলা। ভোঁতা ডগার তলোয়ার নিয়ে ওলিম্পিকসে যে প্রতিযোগিতা হয়—এই বাড়িয়ে দিচ্ছে,পাঁয়তারা করছে, ঝনঝন ঠোকাঠুকি হচ্ছে, একে অপরকে বুঝে নিচ্ছে—সেইভাবে যেন তারা খেলতে শুরু করল। ৩—৩, ৪—৪, ৫—৫। এর পরই খোঁচাখুঁচি আর আত্মরক্ষার ভঙ্গিটা বদলে এসে গেল আক্রমণ। এবার ভোঁতা ডগার তলোয়ারের বদলে ওদের হাতে উঠে এল তীক্ষ্ন ডগার ধারালো ফলার বাঁকা তলোয়ার। বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে এবার তারা নিধনের জন্য মেতে উঠল।

মিনুর কপাল থেকে গাল আর নাকের দু’ধার দিয়ে ঘাম ঝরছে। আঙুল দিয়ে কপাল থেকে ঘাম মুছল। সে জানে অরুণের থেকে তার শরীর মজবুত, ফুসফুসের ক্ষমতাও বেশি। এখন তাকে শুধু একটা কাজই করতে হবে—কোর্টে টিকে থাকা আর অরুণকে ছুটিয়ে খাটিয়ে ধীরে ধীরে যন্ত্রণার মধ্যে নিয়ে ফেলা।

প্রথম সেট মিনু জিতল ৭—৫। দ্বিতীয় সেট অরুণ পেল ৮—৬। তৃতীয় সেটে আবার শুরু হল জাঁতাকলে পেষাই। ঘাসের কোর্টে খেলার ধরন হয় সার্ভ আর ভলি, পয়েন্ট জেতা হয় খুব অল্প সময়ে। কিন্তু মিনু খেলার ধরনটা এমনই মন্থর করে দিয়েছে যেন খেলা ক্লে কোর্টে। বুদ্ধিটা, বলাবাহুল্য, সহদেবের। অরুণকে তার স্বাভাবিক খেলা খেলতে না দেওয়ার জন্যই এই কৌশল। কিছুদিন আগেই সৈদুলের কাছ থেকে সহদেব শুনে নিয়েছেন অরুণ সহনশীলতা বাড়াবার জন্য দৌড়য় না। ওকে অবসন্ন করে শেষ করে দেওয়ার নির্দেশ মিনুকে তিনি দিয়েছেন।

এখন দু’জনেই পরীক্ষায় নেমেছে শরীর আর মন কতক্ষণ কষ্ট সইতে পারবে তাই নির্ধারণের জন্য, কতক্ষণ অরুণ মনে রাখতে পারবে খেলায় সে জিততে চায়। যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মিনুর আগে আগুনের ওপর থেকে সে কখন হাত সরিয়ে নিয়ে জেতার বাসনা জুড়িয়ে ফেলবে, তারই খেলা চলেছে।

অরুণ বুঝতে পেরেছে মিনুর কৌশল। মরিয়া হয়ে এবার সে চেষ্টা শুরু করল দ্রুত পয়েন্ট জেতার জন্য। র‌্যালি কমিয়ে একটা মার থেকেই পয়েন্ট জেতার জন্য সে শট নিতে থাকল। কোর্টের এধার—ওধার থেকে প্রায় অসম্ভব শট ছোটাছুটি করে নিল। মিনুর র‌্যাকেট ধরা মুঠোয় আঙুলের ছাল উঠে গেছে। জড়ানো টেপের ফাঁক দিয়ে ঘাম ঢুকে আঙুল জ্বলছে। সে মুঠো শক্ত করল।

দর্শকরা শ্রান্ত হয়ে পড়ছেন টেনশনের জন্য। নিশ্বাস ধরে রেখে বেশিক্ষণ খেলা দেখা যায় না। অনেকে চেয়ার থেকে উঠে কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন, তখন কোর্টে খেলোয়াড় দু’জনও তাদের কাঁধে, তাদের মুঠোয়, পায়ের তলায় এবং হাজার হাজারবার সার্ভিস করায়, পাঁচ—ছ’ মাইল দৌড়োনোয় সাহায্য করা পেশিগুলোয় সেই শ্রান্তি বোধ করছে। বোধ করেও তারা কোর্টে দাঁড়িয়ে। পরস্পরের দিকে ওত পেতে। একে অন্যকে ডাইনে বাঁয়ে ছোটাচ্ছে,পেছনে হটাচ্ছে, নেট থেকে ঠেলে দিচ্ছে, শরীরকে শাস্তি দিচ্ছে, ক্রমশ চুপসিয়ে আসছে এবং এইরকমই চলবে যতক্ষণ না কোনও একজনের পেশির ওপর থেকে তার মস্তিষ্ক কর্তৃত্ব হারায়।

অরুণের মস্তিষ্ক তার দুই পা, দুই হাত এবং দুই চোখের কাছে কাজ করার দাবি জানাতে লাগল। কিন্তু পা দুটো মন্থর হতে শুরু করেছে, হাত দুটো দুর্বল হয়ে পড়ছে আর চোখ দুটো সেকেন্ডের ভগ্নাংশের দেরিতে বল দেখছে।

মিনু এবার সংহার শুরু করে দিল। ফেরত দেওয়া অসম্ভব, এমন কিছু সার্ভ আর ভলি পরপর মেরে সে অরুণকে ব্যতিব্যস্ত করল; আর অরুণের সার্ভগুলো গুঁড়িয়ে ভলিগুলোকে ঘুসিয়ে, আঘাতের পর আঘাত হেনে গেল যতক্ষণ না ১১—৯—এ অরুণ পরাজয় মানতে বাধ্য হল।

কোর্ট থেকে বেরিয়ে এষস মিনু চেয়ারে বসল। কথা বলার, জল খাওয়ার, এমনকী হাসার মতো ক্ষমতাও তার নেই। মুখটা ফ্যাকাসে, চোখ বসা। বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেছে। সহদেব জলের বোতল হাতে দিয়ে বললেন,”এখন চুপ করে বসে থাকো।”

সৈদুলের কাঁধে হাত রেখে ছাপান্ন গেম খেলা শ্রান্ত দেহটাকে টানতে টানতে প্রাক্তন রাজ্য জুনিয়ার চ্যাম্পিয়ান হেঁটে চলে গেল ড্রেসিং রুমে।

তপতী আঁচল দিয়ে মিনুর মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন,”কষ্ট হচ্ছে?”

মিনু মাথা নাড়ল। মায়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,”মা,আমি জিতেছি।” তার মুখে পাতলা একটা হাসি ভেসে উঠল। ”মা, তুমি খুশি?”

তপতী বুকে টেনে নিলেন ছেলের মুখ। চুম্বন করলেন ছেলের মাথা আর আশীর্বাদ জানালেন চোখের জল দিয়ে।

বিজয়ীর ট্রফি মিনু নিল ভাস্কর মুখার্জির হাত থেকে। ট্রফি দেওয়ার পর তিনি মৃদুস্বরে বললেন,”সামনের মাসে জুনিয়ার ন্যাশনাল বাঙ্গালোরে, জিতে আসতে পারবে তো?”

”চেষ্টা করব।”

খবরের কাগজের ফোটোগ্রাফারদের ফ্ল্যাশ বালব মুহুর্মুহু ঝলসাল। বহু অপরিচিত লোক মিনুর পিঠ চাপড়ে বলে গেলেন:”দারুণ খেলেছ।”

দাদার ট্রফিটা বুকে জড়িয়ে ধরে চিনু তার মাকে বলল,”এবার কি স্কুলে নিয়ে গিয়ে দেখাতে পারি?”

”না, কারও দেখার ইচ্ছে হলে আমাদের বাড়িতে এসে দেখে যাবে।”

তন্ময় একবার বললেন,”রাজেন এই সময়ই দেশের বাইরে। থাকলে খুব খুশি হত।” চার মাসের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে রাজেনকে স্কটল্যান্ডের ডান্ডিতে পাঠিয়েছে এম জে টি এম। শুভ্রা, ব্রজেনবাবু ও তাঁর স্ত্রী এখন রয়েছেন বাংলোয়। ”কাল বাংলা, ইংরেজি সবক’টা কাগজ কিনতে হবে, রাজেন এলে দেখাব।” আড়চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নিয়ে যোগ করলেন ”দুটো করে কিনতে হবে।”

”সরি সৈদুল।” সহদেব হাত ধরে বললেন।

”কনগ্রাচুলেশনস দেবুদা। আমি কিন্তু খুশি হয়েছি মৃন্ময় জেতায়। ছেলেটা অনেক উঠবে।”

”খেটেছে তাই উঠেছে, আরও খাটলে নিশ্চয় উঠবে।”

”আমিও কোচিং করি দেবুদা,ওর খাটনির পেছনে আর একজনকেও যে খাটতে হয়েছে সেটা বুঝতে পারি। তুমি ভাগ্যবান তাই এমন ছেলে পেয়েছ, আমি কুড়ি বছরেও পেলাম না।”

পরদিন বহু লোক এলেন অভিনন্দন জানাতে। কাপটা রাখা হয়েছে বাসর ঘরের টেবলে। সকালেই এসেছিলেন সুভাষ আর বরুণা সেন। তাঁরা ছোট্ট একট পোর্সেলিন টব হাতে করে আনলেন, তাতে একটা পাতাবাহার গাছ। গাছটায় কচুপাতার মতো পাতা, তাতে অজস্র সিঁদুরে টিপ। মিনুর হাতে দিয়ে সুভাষ বললেন,”তোমার জন্য আমাদের ভালবাসা এই গাছটার সঙ্গে বাড়বে।” মিনু প্রণাম করল।

এলেন রাজেনের বাবা ব্রজেনবাবু। বগলে দাবার বোর্ড আর ঘুঁটির বাক্স। তপতীকে বললেন,”বউমা, তুমি আমার পার্টনারকে কেড়ে নিয়ে গেছলে, তারপর থেকে আমি আর দাবা খেলি না, এগুলো মিনুকে দিয়ে যাচ্ছি। কবে সরে যাই তার ঠিক নেই। টেনিস থেকে রিটায়ার করার পর এই বোর্ড পেতে মিনু খেলবে আর আমাকে মনে করবে।” মিনুকে বুকে জড়িয়ে বিশালদেহী বৃদ্ধ মানুষটি বললেন,”সেই ছোট্ট মিনু আজ কত বড়টি হয়ে গেছে!”

চিনু ফিসফিস করে মাকে বলল,”আজ কি আমরা স্কুলে যাব?”

”যাওয়ার সময় তো পার হয়ে গেছে, ক’টা বাজে দেখেছিস?”

”সার বলেছেন দু’দিন ওয়ার্ক আউট বন্ধ থাকবে, উনি বুধবার থেকে আসবেন। আমরাও কি তা হলে বুধবার থেকে স্কুলে যাব?”

”না। কালই যাবে। এই ক’দিন কেউ বই নিয়ে বসোনি।” তপতী মনে রেখেছেন হেডমাস্টারকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি।

কান্তি এল শালপাতার ঠোঙা ভর্তি গুজিয়া নিয়ে। সেটা মিনুর হাতে দিয়ে বলল,”খেও। একদিন দুটো মিষ্টি খেলে মা কিছু বলবে না।” কান্তি তপতীর দিকে তাকিয়ে সম্মতি দিতে মিনতি করল চাহনি দিয়ে।

তপতী হেসে বললেন,”খাও।”

”অত! ওইটুকু ছেলে খাবে?” তন্ময় ঠোঙাটা মিনুর হাত থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিলেন।

”তুমি অফিস যাবে না? চান করে খেতে বোসো, ক’টা বাজে দেখছ?” তপতীর স্বরে কিছু একটা ছিল যেজন্য তন্ময় ঠোঙাটা মিনুর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন,”তাই তো, এখন তো ভাত খেতে হবে।”

বারোটা নাগাদ হইহই করে জনা দশেক ছেষল হাজির হল। মিনুর ক্লাসের বন্ধু। কী ব্যাপার?

”মৃন্ময়, আজ স্কুলে যাসনি কেন?”

”আজ থার্ড পিরিয়ডের পর স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, তোর জন্য।”

আনন্দ আর লজ্জায় আপ্লুত মিনু শুধু বলল,”য্যাহহ!”

”নোটিসে কী লিখেছে জানিস?…গর্বের সঙ্গে আমরা জানাচ্ছি আমাদের স্কুলের ছাত্র—”

”থাক, থাক, আর বলতে হবে না।” মিনু থামিয়ে দিল।

”কেন বলতে হবে না?” চিনু প্রতিবাদ করল। ”কী সব কথা শুনতে হয়েছে ভুলে গেছিস?”

বন্ধুদের প্রত্যেকে ট্রফিটা হাতে নিল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। ট্রফির গায়ে লেখা কথাগুলো পড়ল। সারা বাড়ি ভরে গেল খুশির কলকল উচ্ছ্বাসে। কান্তির গুজিয়াগুলোর সদ্ব্যবহার করলেন তপতী প্রত্যেকের হাতে একটা করে তুলে দিয়ে।

রাত্রে শোবার আগে ছেলেরা দুধ খায়। তপতী দুটো গ্লাস হাতে নিয়ে ছেলেদের ঘরে ঢুকতে গিয়ে ভেতর থেকে আসা চাপা স্বরের কথা শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালেন।

”না না, অনেক টাকা… এখন বলতে হবে না।”

”মোটরে স্কুলে যেতে ভাল লাগে? লজ্জা করে না? দুটো সাইকেলের কত আর দাম হবে?”

”যতই হোক…বাবার কষ্ট হবে, মারও।”

গলাখাঁকারি দিয়ে তপতী ঘরে ঢুকলেন। ”অনেকেই তো উপহার দিল, আমি কিছু দেব না।”

ওরা অবাক হল। মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

”আমি তো ভাবছি, মিনু তো বড় হয়েছে, এবার দেখেশুনে সাইকেল চালাতে পারবে।”

”মা, আমিও বড় হয়েছি।” চিনু তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠল।”

”হয়েছিস নাকি!” তপতী গম্ভীর হলেন। ”মিনু, ওর পাশে দাঁড়া তো।”

মিনু দাঁড়াল চিনুর পাশে। পলকের জন্য তপতী চোখ নীচে নামালেন। ”চিনু গোড়ালি নামা।”

ধীরে ধীরে চিনুর উচ্চচতা হ্রাস পেল।

পরদিন সকালে তন্ময় গাড়ি বার করলেন, তপতীও উঠলেন।

বাবাকে স্টিয়ারিংয়ে বসতে দেখে ওরা অবাক! গম্ভীর মুখে তন্ময় বললেন,”একটা জরুরি দরকার, আমাদের কলকাতায় যেতে হবে।” দুই ছেলেকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ওঁরা চলে গেলেন কলকাতায়। স্কুল ছুটির পর ছেলেদের গাড়ি করে আনলেন তপতী। তিনি গাড়ি গ্যারাজ করতে করতে শুনলেন দুই ভাইয়ের উল্লসিত চিৎকার। বাড়িতে ঢুকছেন যখন, ছুটে বেরিয়ে এল দুই ভাই। মিনু দু’হাতে মায়ের হাঁটু জড়িয়ে মেঝে থেকে দু’ ফুট ওপরে তাঁকে তুলে বনবন পাক দিতে লাগল। ঘুরে ঘুরে দু’ হাত তুলে নাচছে চিনু।

”ওরে ছাড় ছাড়, আমার পায়ে ব্যথা।…মাথা ঘুরছে।”

”আমাদের ট্রফি,…মা আমাদের ট্রফি…।” চিনু সুর করে গেয়ে চলেছে। ”হিপ হিপ হুররে…মা আমাদের ট্রফি, আমরা বড় হয়েছি…মাকে ট্রফি পেয়েছি…।”

”মা কখনও ট্রফি হয় নাকি!” তপতী দুহাতে মাথা টিপে ধরে বড় বড় চোখে বললেন।

”হয়, আমাদের মা হয়।” মিনু বলল।

”আমাদের কাছে তুমি আমাদের ট্রফি।” চিনু যোগ করল। ”এর থেকে সেরা ট্রফি আর কিছু নেই।”

”তোরা ট্রফি পেলি, আর আমার ট্রফি তা হলে কোথায়?”

দুই ভাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তপতী হাসতে হাসতে বললেন,”একটা নয়, আমার দুটো ট্রফি।”

দু’হাতে তিনি দুই ছেলেকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললেন,”মিনু এরপর ভারতের জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন হবে তারপর হবে সিনিয়র চ্যাম্পিয়ন…..তারপর উইম্বলডন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া…..লোকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আমাকে বলবে ওই যে মৃন্ময়ের মা।”

”চিন্ময়ের মা বলবে না?” চিনু ভারী গলায় অভিমানী স্বরে বলল।

”বলবে, দাদার পরেপরেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠে আসবে ভাই। আমরা তো এত বছর সেই স্বপ্নই দেখেছি রে।” তপতীর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরে পড়ল।

ভেতর থেকে তখন বেলার গজগজানি শোনা গেল। ”খাবার ঘরে এ দুটো রাখা চলবে না,তা হলে কিন্তু চারটে চাকাই ফুটো করে দোব।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *