অলৌকিক দিলু

অলৌকিক দিলু – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস

”দিলু, এর পরই বাইগাছি। এবার দরজার দিকে এগোতে হবে।” এই বলে বোকামামা উঠে দাঁড়ালেন। ব্যাঙ্ক থেকে নাইলনের ব্যাগটা নামিয়ে বেঞ্চে বসা যাত্রীদের হাঁটু ঠেলতে—ঠেলতে বেরোতে লাগলেন, তার পিছু পিছু দিলীপ। তারও হাতে একটা ব্যাগ, কাঁধে কাপড়ের ঝুলি। ট্রেনের কামরা ভিড়ে ঠাসা। তাদের মতো আরও অনেকে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে।

বোকামামা গলা নামিয়ে বললেন, ”এদের পিছু—পিছু এগোবি, দেরি করলেই কিন্তু রান আউট হয়ে যাবি। হুড়মুড়িয়ে লোক এমনভাবে উঠবে যে, তোকে আর নামতে দেবে না, ঠেলতে ঠেলতে আরও পেছনে পাঠিয়ে দেবে। লোকাল ট্রেনে চড়ার অভ্যেস নেই তো।”

শুনে গলা শুকিয়ে গেল দিলুর। এতক্ষণ সে জানলা দিয়ে দেখে এসেছে এক—একটা স্টেশনে ট্রেন থেমেছে আর প্ল্যাটফর্মের লোকেরা টেনে ওঠার জন্য কীরকম ধাক্কাধাক্কি/করছিল। দু—তিনজনকে ছিটকে প্ল্যাটফর্মে গড়াগড়িও দিতে দেখেছে।

বোকামামা বললেন, ”ওঠার থেকে নামাটাই শক্ত। ব্যাগটা মাথার ওপর তুলে ধর, নয়তো হাত থেকে ছিটকে যাবে।”

দিলু হাতের ব্যাগ মাথায় তুলল। ট্রেন বাইগাছি স্টেশনে দাঁড়ানো মাত্র দরজার লোকেরা হুড়হুড় করে নামতে শুরু করল। পেছন থেকে ঠেলা খেয়ে দিলু হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে ওঠার সময় কে তার পা মাড়িয়ে দিল। ”আহ” বলে ওঠার আগেই সে প্ল্যাটফর্মে ছিটকে পড়ে গেল। বোকামামা তার হাত ধরে টেনে সরিয়ে না আনলে দু—তিনজন লোকের পায়ের তলায় সে পড়ে যেত।

দিলুর ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা থেঁতলে গেছে। ডান পায়ের চটির চামড়ার ফিতেটা ছিঁড়ে পা থেকে খুলে ট্রেনের কামরাতেই রয়ে যাওয়ায় সে ফ্যালফ্যাল চোখে ছেড়ে দেওয়া ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে রইল।

বোকামামা বললেন, ” তোর আর দোষ কী, কখনও তো বনগাঁ লাইনের ট্রেনে চড়িসনি। তিরিশ বছর যাতায়াত করছি আমি, কতবার যে ধুতি খুলে গেছে! তাই ট্রেনে চড়ার জন্য ধুতি ছেড়ে প্যান্ট ধরেছি। তুই যে আস্ত নামতে পেরেছিস—য়্যা! চটি কোথায়?”

দিলু করুণ স্বরে বলল, ”ট্রেনে।”

বোকামামা বিলীয়মান গার্ডের কামরার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ”তা হলে বাঁ পায়েরটা পরে থেকে আর কী হবে, ফেলে দে। একজোড়া নতুন চটি বরং কিনে দিচ্ছি। তবু ভাল, ব্যাগটা ধরে রাখতে পেরেছিস।”

দিলুর পায়ের দিকে এবার বোকামামা ভাল করে তাকালেন। চোখ কুঁচকে বললেন, ”হল কী তোর আঙুলে?” একটু ঝুঁকে দেখে বললেন, ”বুড়ো আঙুলের নখটা যে আধখানা উঠে গেছে। কী কাণ্ড দ্যাখ তো, মামার বাড়িতে বেড়াতে এসে দু—দুটো অ্যাকসিডেন্ট চটি গেল, নখ ওপড়াল। শিগগিরি চল ডাক্তারখানায়। ইঞ্জেকশন, ওষুধ, ব্যান্ডেজ করাতে হবে। অফিস ছুটির পরের ট্রেনে ওঠাটাই বোকামি হয়েছে।”

প্ল্যাটফর্ম থেকে লোকজন বেরিয়ে যাওয়ার পর ওরা দু’জন স্টেশন থেকে বেরিয়ে এল। ডাক্তারখানা শিবানী মেডিক্যাল হল পঞ্চাশ গজের মধ্যেই। ডাক্তারবাবু তখনও এসে পৌঁছননি। তিনি বিকেল চারটে থেকে হাবড়ায় এক ডাক্তারখানায় বসেন দু’ঘণ্টার জন্য। রোগীর ভিড় থাকলে সেটা আড়াই ঘণ্টাও হয়ে যায়। কম্পাউন্ডার মদনগোপাল বয়স্ক মানুষ। বললেন, ”ডাক্তারবাবুর ফি দেবেন কেন, আমিই যা করার করে দিচ্ছি, দশটা টাকা দেবেন।”

বোকামামা রাজি হয়ে গেলেন। মদনগোপাল অ্যান্টিটিটেনাস ইঞ্জেকশন দিয়ে মলম লাগিয়ে তুলো দিয়ে ঢেকে ব্যান্ড—এইড দিয়ে আঙুলটা মুড়ে দিলেন।

”সাবধানে থাকবে খোকা, ধাক্কাটাক্কা যেন না লাগে। জলটল লাগিও না। দিন পনেরো লাগবে ঠিক হয়ে যেতে।”

দিলুর খুব খারাপ লাগছে বোকামামার পঁচিশ টাকা খরচ করিয়ে দেওয়ায়। ‘পদসেবা’ জুতোর দোকানটা কুড়ি গজ দূরে। সবচেয়ে কমদামি হাওয়াই চটি। দিলু ঠিক করল, তাই কিনবে। কিন্তু বোকামামা দোকানে ঢুকেই বললেন, ”এই ছেলেটির পায়ের ভাল চটি আছে?”

সেলসম্যান বলল, ”আছে।” এই বলে সে একটা বাক্স এনে তার থেকে একজোড়া চটি বের করে দিলুর পায়ের সামনে রাখল।

বোকামামা হুকুম করলেন, ”পরে দেখ, বুড়ো আঙুলে লাগে কি না।”

দিলু চটি পরল। বুড়ো আঙুলে যে ফিতেটা রয়েছে সেটা নখে লাগছে হাঁটতে গেলেই।

বোকামামা দিলুর মুখ লক্ষ করে বুঝে গেলেন, লাগছে। বললেন, ”এই চটি চলবে না। পায়ের আঙুলে স্ট্র্যাপ থাকবে না এমন চটি আছে?”

সেলসম্যান দু—তিনটি বাক্স খুলে মাথা নেড়ে বলল, ”সব চটিতেই বুড়ো আঙুলে স্ট্র্যাপ দেওয়া।”

দিলু তখন বলল, ”মামা, হাওয়াই চটিতে বুড়ো আঙুলে লাগবে না।”

বোকামামা ক্ষুণ্ণ স্বরে বললেন, ”হাওয়াই বড় কমদামি, আচ্ছা ঠিক আছে আপাতত কাজ চালানো নিয়ে কথা।”

তিরিশ টাকার হাওয়াই চটি পায়ে দিয়ে দিলু মামার সঙ্গে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। সামনেই যশোহর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, বোকামামা বললেন, ”দিলু এদের ছানার জিলিপি বিশ্ববিখ্যাত, চেখে দেখবি?”

মামার অনেক টাকা সে খরচ করিয়ে দিয়েছে। খরচটা আর যাতে না বাড়ে তাই বলল, ”মিষ্টি আমার ভাল লাগে না।”

”সে কী রে, যশোরের ছানার জিলিপি। একটা অন্তত খেয়ে দেখ।”

বোকামামা দোকানে ঢুকলেন, তার সঙ্গে দিলুও। একটা লম্বা পালিশহীন কাঠের টেবিলে ওরা বসল। বোকামামা শিঙাড়া আর ছানার জিলিপি একটা করে দিতে বললেন।

”সেই কখন ভাত খেয়েছিস, নিশ্চয় খিদে পেয়ে গেছে। এই সময় শিঙাড়া ভাজা শুরু হয়। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় লোকে কিনে নিয়ে যায়। উত্তর চব্বিশ পরগনার বেস্ট শিঙাড়া এখানে হয়।”

কলাপাতায় গরম শিঙাড়া আর নধর চেহারার ছানার জিলিপি দিয়ে গেল। খিদে সত্যিই পেয়েছিল দিলুর। শিঙাড়ায় কামড় দিয়ে তার আর মনে হল না মামার টাকা খরচ করিয়ে দিল। সে ধরে নিল ভাগ্নে হিসেবে এটা তার প্রাপ্য।

ছানার জিলিপির একটা টুকরো ভেঙে মুখে দিতেই সেটা মসৃণভাবে মুখের মধ্যে ভেঙে মিলিয়ে গেল। এমন মিষ্টি সত্যিই সে কখনও খায়নি।

”মামা, তুমি এই ছানার জিলিপিকে বিশ্ববিখ্যাত বললে কেন? বিশ্বে আর কোথাও ছানার জিলিপি হয় কি না তা কি তুমি জানো?”

বোকামামা দুধঘাট উচ্চচ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার। স্কুলের প্যাডে ওঁর নাম হরিসাধন ঘোষের পর লেখা আছে এম. এ. বি. টি। তিনটি বিষয়ে ক্লাস নেন—ভূগোল, ইতিহাস ও অঙ্ক। বিশ্ব সম্পর্কে মোটামুটি একটা জ্ঞান তাঁর থাকার কথা এবং তাঁর ধারণা সেটা তাঁর আছে।

”এই পশ্চিমবাংলার বাইরে ছানার জিলিপি কোথাও হয় না, হলেও সেটা জিলিপি নয়, পান্তুয়া। আর এই রাজ্যে শুধু) বাইগাছিতেই এমন জিলিপি হয়। সুতরাং অনায়াসেই একে ওয়ার্ল্ড ফেমাস বলা যায়।”

”আর শিঙাড়াকে উত্তর চব্বিশ পরগনার বেস্ট বললে কী করে?”

বোকামামা ঠোঁট চওড়া করে হাসলেন। ”বত্রিশ বছর আগে বঙ্গবাসী কলেজে যখন পড়তুম তখন থেকে, দমদম টু গোবরডাঙা যত নামী খাবারের দোকান, সবক’টায় খেয়েছি, দমদম টু রানাঘাট মেন লাইনেও সব বড় দোকান দেখা হয়ে গেছে। এরকম ফুলকপির শিঙাড়া কেউ পারে না তৈরি করতে। কেমন লাগছে বল?”

”ভাল।”

”তা হলে আর একটা?”

দিলু মাথা কাত করল।

দোকান থেকে বেরোবার আগে বোকামামা দশটা শিঙাড়া কিনে নিলেন বাড়ির জন্য। ওরা ভ্যান রিকশা স্ট্যান্ডে এসে দুধঘাট যাওয়ার রিকশা পেয়ে গেল। জনা চারেক যাত্রী রিকশায় বসে। ওরা দু’জন চড়তেই রিকশা ছেড়ে দিল। আঙুল বাঁচাতে দিলু পা ঝুলিয়ে বসল। এক মাইল পথ, দশ মিনিটেই পৌঁছে গেল।

বোকামামা অর্থাৎ হরিসাধন ঘোষ দেশভাগের পর পাঁচ বছর বয়সে খুলনা জেলার স্বল্পবাহিরদিয়া গ্রাম থেকে বাবা ও জ্যাঠার এবং লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু পরিবারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিলেন। বোকামামার বাবা পঞ্চাননের এক বন্ধু থাকতেন বারাসাতে। তিনিই ব্যবস্থা করে দুধঘাটে ফলের বাগান সমেত পাঁচবিঘে জমি পুকুরসহ ছোট একটা বাড়ি কিনিয়ে দেন পঞ্চাননকে। সেই বাড়িতে দাদা দাশরথিকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন আটচল্লিশ সাল থেকে।

পঞ্চাননের একটি ছেলে হরিসাধন, দাশরথির একটি মেয়ে মল্লিকা, ডাকনাম মলু। মলু যখন দশ বছরের তখন দাশরথি সাতদিনের জ্বরে মারা যান। তখন ভাল ডাক্তার বা ওষুধপত্র দুধঘাটে পাওয়া যেত না। মলুর মা স্বামীর মৃত্যুর এক বছর পর পাকস্থলীর ক্যান্সারে মারা যান। পিতৃ—মাতৃহারা মলুকে নিজের মেয়ের মতো বড় করে তোলেন পঞ্চানন, তাকে বি—এ পাশ করিয়ে প্রচুর খরচ করে বিয়েও দেন কলকাতার এক উঠতি উকিলের সঙ্গে। হরিসাধনের দুই মেয়ে এবং দু’জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। বড়টি থাকে দুর্গাপুরে, ছোট মেয়ে কটকে। পঞ্চানন পঁচাশি বছর বয়সে এখনও বাগানের পরিচর্যা করেন, বাজারে যান, ছেলেকে ধমকান।

হরিসাধনের স্কুল—অন্ত—প্রাণ। এই স্কুলেই তিনি পড়েছেন। তখন ছিল তিনটি খড়ের চালের ঘর। শিক্ষকদের বসার ঘরের একধারে কাঠের পার্টিশান দেওয়া খুপরিতে বসতেন হেডমাস্টারমশাই। শিক্ষক ছিলেন আটজন।

দুধঘাটের প্রাক্তন জমিদার ও সরকারি কন্ট্রাক্টর ধনী ও শিক্ষানুরাগী অঘোর চক্রবর্তী নিঃসন্তান ছিলেন। টাকা জমানোয় তাঁর আগ্রহ ছিল না। তাঁরই দেওয়া জমি ও পাঁচ লক্ষ টাকা দুধঘাট স্কুল খোলনলচে বদলে ঝকঝকে আধুনিক চেহারা নেয় তিরিশ বছর আগে। এর চার বছর পর হরিসাধন ‘ফিফথ সার’ রূপে স্কুলে যোগ দেন।

স্কুলের এখন তিনটি পাকা বাড়ি, সায়ান্স ল্যাবরেটরি, খেলার বিরাট মাঠ এবং একুশজন শিক্ষক ও সাতশো ছাত্র নিয়ে এলাহি ব্যাপার। গত বছর হরিসাধনের স্কুল থেকে নব্বুইটি ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। পঁচাত্তরজন পায় ফার্স্ট ডিভিশন, আটজন পায় স্টার।

শুধু এই জেলাতেই নয়, সারা রাজ্যে দুধঘাট স্কুল বিখ্যাত পড়াশুনোয় এবং ফুটবল খেলাতেও। দিল্লিতে তিনবার সুব্রত কাপ ফাইনাল খেলে একবার কাপ জিতেছে। জেলার জুনিয়ার ভলিবল, কবাডি, খোখো দলে দুধঘাট স্কুলের ছেলে নেই এমন ঘটনা গত দশ বছরে ঘটেনি। পড়া এবং খেলায় যা কিছু খ্যাতি সবই হেডমাস্টার হরিসাধন ঘোষের অক্লান্ত আন্তরিক ও সৎ চেষ্টার ফসল। তিনি স্কুলে যেমন রাশভারী, কঠোর শৃঙ্খলনিষ্ঠ, নিয়মানুবর্তী, ঠিক তার উলটোটি হয়ে যান স্কুল থেকে বেরিয়ে এলেই।

হরিসাধন মাঝে—মাঝে কলকাতায় যান। হাতে সময় থাকলে বোন মলুর সঙ্গে দেখা করে আসেন। মৌলালির কাছে মলুর স্বামী তরুণ কর বিরাট একটা পুরনো বাড়ি কিনে সংস্কার করিয়ে বউবাজারে পৈতৃক বাড়ি থেকে ভিন্ন হয়ে এসে বসবাস করছেন। মলুর চার ছেলে, ছোট ছেলে দিলু। কলকাতায় প্রধান শিক্ষক সমিতির সভায় যোগ দিতে এসে হরিসাধন বোনের বাড়ি এসেছিলেন। মলুর সঙ্গে কথায়—কথায় জানতে পারেন দিলু ষান্মাসিক ক্লাস পরীক্ষায় একশোর মধ্যে ইংরেজিতে চব্বিশ, ইতিহাসে তিরিশ, অঙ্কে কুড়ি নম্বর পাওয়ায় স্কুল থেকে গার্জেনকে হুঁশিয়ার করে চিঠি দেওয়া হয়েছে এই বলে, অ্যানুয়াল পরীক্ষায় যদি একটি বিষয়েও ফেল করে তা হলে ক্লাস নাইনে ওকে প্রোমোশন দেওয়া হবে না। ওর পড়াশুনোর দিকে আপনারা নজর দিন।

”জানো বোকাদা, চিঠিটা পেয়ে এমন রাগ হল যে, দিলুকে আচ্ছা করে পেটালুম, সারাদিন খেতে দিলুম না। ওর বাবা বলল স্কুল ছাড়িয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে। কিন্তু লেখাপড়ায় খারাপ ছেলেকে তাও ক্লাস নাইনে কি নতুন স্কুলে ভর্তি করানো সম্ভব? বাড়ির কাছে আদর্শ বিদ্যাভবন নামে একটা স্কুল আছে কিন্তু সেখানে শুনেছি মাস্টাররাই ঠিকমতো ক্লাসে আসে না। তিরিশটা ছেলে মাধ্যমিক দিয়েছিল গত বছর। দু’জন কোনওক্রমে সেকেন্ড ডিভিশন, এগোরোজন ফেল। এমন স্কুলে ওকে দিলে তো আরও খারাপ হয়ে যাবে লেখাপড়ায়।”

হরিসাধন বললেন, ”দিলুর অসুবিধেটা কোথায়, ওকে পড়ায় কে? রোজ দু’বেলা কি পড়তে বসে?”

মল্লিকা বললেন, ”দু’বেলা? সকালে ঘুম থেকেই তো ওঠে আটটায়, পড়বে কখন? স্কুল থেকে ফিরেই ছুটবে খেলার মাঠে, সন্ধেবেলায় মাস্টারমশাই আসেন, পড়তে বসে ঢুলবে। উনি বিরক্ত হয়ে বলেন, যাও ঘুমোও গিয়ে, আর পড়তে হবে না। ঘণ্টাখানেক কানমলা, গাঁট্টা খেয়ে নমো নমো করে পড়া সেরে খেয়েদেয়েই বিছানায়। এই হল রোজকার রুটিন। ওয়ান ডে ক্রিকেট থাকলে স্কুলে যায় না, সারাদিন টিভির সামনে। এত মারধোর করি, এত বোঝাই, তবু শোধরাতে চায় না। কী যে করি, প্রব্লেম চাইল্ড হয়ে উঠেছে।”

হরিসাধন বললেন, ”তোর অন্য ছেলেরা কেমন?”

”সলু তো ল কলেজে বাবার পেশায় ঢুকবে, বিলু আর্ট কলেজে এ—বছর ভর্তি হল, কালু ডিগ্রি কোর্সে সায়ান্স পড়ছে। পড়াশুনোয় সবাই ভাল। কাউকে আমায় তাগিদ দিয়ে পড়ার কথা বলতে হয়নি। শুধু এই ছোট ছেলেটাই জ্বালিয়ে মারছে, কী যে করি।”

”কিছু করতে হবে না তোকে। তোর জ্যাঠার হাতে ওকে ছেড়ে দে। বাবা ঠিক ওকে তৈরি করে দেবে।”

মল্লিকা দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বললেন, ”এই বয়সে জেঠু ওকে সামলাবেন কী করে?”

হরিসাধন হেসে ফেললেন, ”বাবাকে তুই অনেকদিন দেখিসনি তাই বললি। হাঁটুর বাতে ইদানীং একটু কাহিল, তবু বহুদিন তেলকই খাননি বলে গতবছর নিজে হাতে জাল ফেললেন পুকুরে, হনুমানে আম নষ্ট করছিল, বন্দুক বের করে ফায়ার করলেন, ভাগ্যি ভাল মরেনি। যদি মরত তা হলে আমরা ও বাড়িতে আর টিকতে পারতুম না। বাবা পঁচাশি হলে কী হবে পাঁচ বছর আগেও কোদাল দিয়ে বাগানে মাটি কোপাতেন। তুই বাবার কাছে এক বছর ওকে রাখ। আমার স্কুলে ওকে ভর্তি করিয়ে নোব। পরীক্ষাটা দিয়েই দুধঘাটে চলে আসুক।”

দিলুর অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হওয়ার দশদিন পর হরিসাধন কলকাতায় আসেন নিজের কাজে। একটা ইতিহাস বই লিখেছেন নবম—দশম শ্রেণীর জন্য, প্রকাশকের কাছে তার পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে দুপুরে বোনের কাছে এলেন ছোট ভাগ্নের খবর নিতে।

”কী ঠিক করলি?” হরিসাধন প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিলেন, ”দুটো প্যান্ট আর শার্ট একটা ব্যাগে ভরে দে। ওকে আজ নিয়েই যাব। দিন সাতেক থেকে দেখুক। যদি মন বসে যায় তা হলে আমাদের কাছেই থাকুক। তোর বা তরুণের তাতে আপত্তি আছে?”

মল্লিকা বললেন, ”আপত্তি কী গো! আমরা তো বেঁচে যাই। আগের দিন তুমি যা বললে দিলুর বাবাকে সে সবই বলেছি। উনি তো শুনে আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। বললেন, অতবড় নামী স্কুলে পড়ার এমন সুযোগ, হেডমাস্টার মামা, দিলুর তো মহাভাগ্যি। এখানে আজেবাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশে গোল্লায় যাচ্ছে, সলু বলছিল, মা ওকে কোনও হস্টেলে পাঠিয়ে দাও।”

হরিসাধন আঁতকে ওঠার মতো দু’হাত তুলে বললেন, ”না, না, খবরদার নয়। এই ছেলেদের এলোমেলো প্রকৃতিটাকে বাঁধতে হবে, ঠিক পথে অর্থাৎ যে পথে গেলে ওর বিকাশ ঘটবে সেই পথে ওকে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। হস্টেলে ওকে বাঁধার লোক কেউ থাকবে না। কিন্তু দিলু কি দুধঘাটে গিয়ে থাকতে রাজি হবে?”

মল্লিকা ভ্রূ কুঁচকে একটু বিরক্তি মাখানো গলায় বললেন, ”ওর রাজি হওয়া—না হওয়ায় কী আসে যায়। ওর ভালর জন্যই আমরা ওকে পাঠাচ্ছি। এটা ওকে মেনে নিতে হবে।”

দিলুকে ডেকে আনলেন মল্লিকা। ভাল স্বাস্থ্যের জন্য বয়সের তুলনায় ওকে বড়ই দেখায়। বাবার মতো কালো গায়ের রং, কোঁকড়া ঝাঁকড়া চুলের সঙ্গে চিরুনির সম্পর্ক মাঝেমধ্যে ঘটে। চৌকো মুখের গড়ন চোখদুটি শান্ত কিন্তু চোখের আড়ালে একটা কঠিন জেদি মন ধিকধিক অবিরত জ্বলছে। হরিসাধন সেটা লক্ষ করলেন।

”দিলু যাবি আমার সঙ্গে দুধঘাটে গিয়ে ক’টা দিন থেকে আসবি।”

”যাব। কবে?”

”আজই।” হরিসাধন ঘড়ি দেখলেন, ”পাঁচটা চল্লিশের ট্রেনটা ধরব। রেডি হয়ে নে।”

পাঁচ মিনিট পর দিলু এসে বলল, ”বোকামামা, আমি রেডি!”

হরিসাধন ভ্রূ তুলে তার ছোট ভাগ্নের দিকে তাকালেন। রংচটা জিনসের ট্রাউজার্স, ছাপছোপ দেওয়া হাফহাতা গেঞ্জি, পায়ে চটি, কাঁধে ঝুলি, হাতে নাইলনের ব্যাগ। একে কি রেডি হওয়া বলে!

হরিসাধনের চাহনি থেকে দিলু বুঝে গেল তার বেশবাস মামার মনঃপূত হয়নি। সে বলল, ”এই তো ভাল, হালকা ঝরঝরে। যাব তো মামার বাড়ি, সাজগোজের দরকার কী। জিনস একটা দারুণ সুবিধের জিনিস, ময়লাটয়লা হলেও চলে যায়।”

আর কথা বাড়াননি হরিসাধন।

.

বাগানের মধ্যিখানে ছোট দোতলা বাড়ি। যিনি এটি বানিয়েছিলেন তিনি একজন সিনেমা প্রযোজক, কলকাতায় থাকতেন। বাগানবাড়ি হিসেবেই এটি ব্যবহার করতেন, বছরে তিন—চারবার আসতেন। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুরা দলে দলে এসে ফাঁকা জমিগুলো দখল করে ঘর তুলে বসতে শুরু করতেই প্রযোজকমশাই বাড়ি, বাগান এবং পুকুরটি বিক্রি করে দেন পঞ্চাননকে।

বাড়িটি চৌকো আকৃতির। পেছন দিকে দোতলায় দুটি ঘরের সামনে টানা একটি টালি ঢাকা বারান্দা। সেটি এত চওড়া যে, তাকে দালানই বলা যায়। দোতলার দু’টি ঘরের নীচে একটি হলঘর ছিল। পঞ্চানন তার মাঝখানে দেওয়াল তুলে দুটি ঘর করে নিয়েছেন। এর একটি ঘর হরিসাধনের পড়া ও লেখার এবং বাইরের লোকেদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। সকাল থেকে লোক আসে, বিশেষ করে স্কুলসংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে। রাত্রে বারোটা পর্যন্ত বই পড়া ও লেখা নিয়ে থাকেন এই ঘরে। দোতলার বারান্দার নীচেও লম্বা একটা সিমেন্টের চওড়া লাল চাতাল। সেখান থেকে কুড়ি মিটার এগোলেই তিরিশ মিটার চওড়া পঞ্চাশ মিটার লম্বা পুকুরে নামার শান বাঁধানো সিঁড়ি। দশটা ধাপ নামলে জল, বর্ষাকালে সাত ধাপ নামলেই।

ভ্যান—রিকশা থেকে নেমে পাশের একটা পথ ধরে কুড়ি মিটার এগিয়ে বাঁ দিকে পাঁচিল ঘেরা দিলুর মামার বাড়ি। ওরা বুকসমান উঁচু লোহার গেট ঠেলে ঢুকল। সন্ধ্যা উতরে গেছে, অন্ধকার গাঢ়। দু’দিকে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা গাছ। তার মাঝখান দিয়ে একটা পথ বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত। দরজার দু’পাশে উঁচু রক। চারধাপ সিঁড়ি ভেঙে ওরা রকে উঠতেই ”ঘেউ, ঘেউ” করে ছুটে এল একটা কুকুর অন্ধকার বাগান থেকে। দিলু সরে এল মামার গা ঘেঁষে।

হরিসাধন ধমক দিলেন, ”এই ভেলো, চুপ কর, চুপ।”

ভেলো ডাক বন্ধ করে, কাছে এল। হরিসাধন দরজার কড়া নাড়লেন। ভেলো দিলুর হাঁটু, চটি শুঁকেটুকে ল্যাজটা নাড়ল।

”ভেলোর কাজ ভয় দেখানো আসলে কিন্তু খুব ভিতু। বাগান পাহারা দেয়। শেয়াল তাড়া করে। এই অঞ্চলে চুরি ডাকাতি খুব বেশি। একবার আমাদের বাড়িতে ডাকাতির চেষ্টা হয়েছিল, তোর দাদু দোতলার বারান্দা থেকে বন্দুকের আওয়াজ করে ডাকাত তাড়ায়—”।

সদর দরজার মাথার ওপর আলো জ্বলে উঠল। দরজা খুলে দিল এক প্রৌঢ়া। হর্ষমুখী কাজের লোক, পনেরো বছর আছে। নামটা মুখে মুখে হয়ে গেছে ‘হষ্য’, এই বাড়িতে সারাদিন থাকে। প্রাক্তন জমিদার বিশ্বাসদের জমি বর্গায় চাষ করে তার স্বামী, আর আছে এক ছেলে বসুদেব ওরফে বাসু। ওরা তিনজন থাকে পাশের গ্রাম ছোট হুড়ায়। হরিসাধন বাসুকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন, এবার তার ক্লাস এইট হবে। পরীক্ষায় বাসু প্রথম পাঁচজনের মধ্যে থাকে। পঞ্চানন বাড়িতে সপ্তাহে দু’দিন বাসুকে পড়ান তাই নয়, তার বইপত্তর, খাতা, জামা—জুতো সবই কিনে দেন।

হর্ষমুখী দিলুকে দেখে অবাক হল। চেঁচিয়ে সে ডাকল দিলুর মামি সুলেখাকে, ”ও বউদি এসে দ্যাখো গো দাদার সঙ্গে কে এসেছে।”

সুলেখা ছিলেন দোতলায়। ব্যস্ত হয়ে নেমে এলেন। বাড়িতে একটাও ছেলেমেয়ে নেই। সারাদিন তার ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কেউ এলে সুলেখা খুশি হন নানারকম রান্না করে খাওয়াবার সুযোগ পেয়ে। ব্যাগ থেকে শিঙাড়ার ঠোঙাটা বের করে হরিসাধন হর্ষর হাতে দিয়ে বললেন, ”আমরা খেয়ে এসেছি, এগুলো তোদের জন্য, যশোর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের। বাবা বোধ হয় বাড়ি নেই, গোটা দুয়েক তুলে রাখিস।”

সুলেখা বললেন, ”দিলু কয়েকদিন থাকবে তো?”

দিলু বলল ”হুঁ।”

ছেলেবেলায় মায়ের সঙ্গে দিলু মামার বাড়িতে একবার এসেছিল। এখানকার সবই ভাল শুধু সময় কাটানোটাই হয় সমস্যার। তার সমবয়সী কেউ নেই। মন খুলে কথা বলতে না পারলে সেই জায়গা তার ভাল লাগে না।

হরিসাধন বললেন, ”কয়েকদিন বলছ কী, ভাল লাগলে দিলু এখানেই থেকে যাবে। মলুর সঙ্গে আমার সেরকমই কথা হয়েছে।”

শুনে দিলু মনে মনে হাসল। শুধু মামার বাড়িই নয়, মৌলালিতে নিজেদের বাড়িও তার ভাল লাগে না। নিঃসঙ্গ একঘেয়ে লাগে। দাদারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত, তার সঙ্গে কথা বলার সময়ই হয় না। কথা বললেও বয়সের তফাতটা তারা সবসময় মনে রেখে কথা বলে। মা সারাক্ষণ ব্যস্ত ঝি—চাকর, রান্না—খাওয়া নিয়ে। সারাক্ষণই খিটখিট করে যায় আর আপনমনে প্রায়ই একই কথা বলে—এতবড় সংসার সামলানো কি চাট্টিখানি কথা! দিলু লক্ষ করেছে, মা বি—এ পাশ হলেও বই পড়ে না, এমনকী খবরের কাগজও নয়। সন্ধে থেকে টিভি—র সামনে বসে হাবিজাবি যা দেখানো হয় তাই দেখে। বাবার সঙ্গে দিলুর কদাচিৎ দেখা হয়। সকাল আটটায় ঢোকে একতলার সেরেস্তাঘরে, তারপর সারাদিন কোর্টে, তারপর সন্ধে থেকে আবার সেরেস্তায়, রাত এগারোটা পর্যন্ত। দিলু মার কাছে শুনেছে বাবা জজের সামনে একবার দাঁড়ালেই মক্কেলকে আট হাজার টাকা দিতে হয়।

বাড়িতে থাকলে দিলু হাঁফিয়ে যায়। পাড়ায় একটা পার্ক আছে, অ্যালবার্ট স্কোয়ার। সেখানে সারা বছরই ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা চলে। এত ভিড় হয় যে, খেলার জায়গা পাওয়াই মুশকিল। বিজয়ী সঙ্ঘ, বন্ধু পরিষদ আর সিক্স বুলেটস—এই তিনটি ক্লাব মাঠটাকে ভাগ করে নিয়েছে। বুলেটসরা শুধুই ফুটবল আর বাকি দুটি ক্লাব প্রধানত ক্রিকেট খেলে। দিলু বিজয়ী সঙ্ঘের সদস্য। স্কুল থেকে ফিরেই সে পার্কে ছুটে যায়। খেলা ছাড়াও আছে তার বন্ধুবান্ধব। তাদের সঙ্গে সে শুধু খেলার গল্প করে যেটা বাড়িতে কেউ করে না।

মামিকে বলা বোকামামার কথাটা শুনে দিলু মনে মনে নিশ্চিন্ত হল এখানে থাকা তার হবে না। সমবয়সী কেউ নেই, যার সঙ্গে খেলা যায়, গল্প করা যায়।

”দিলু, হাতমুখ ধুয়ে নাও। হষ্য, ব্যাগ আর থলি মেসোমশাইয়ের ঘরে রেখে আয়। ওখানেই দিলু থাকবে।” সুলেখা তারে ঝোলানো গামছাটা দিলুর হাতে দিলেন।

পঞ্চানন বাড়ি ফিরলেন রাত আটটা নাগাদ। দিলু তখন বারান্দায় একটা চেয়ারে পুকুরের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। বারান্দার ইলেকট্রিক আলো জলে পড়ে চিকচিক করছে, চারধারে অন্ধকার, নারকেল আর সুপুরি গাছ পুকুরের পাড় ঘেঁষে সারি দিয়ে। জোর বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে, শব্দ হচ্ছে সরসর। দূরে দু—তিনটি বাড়িতে জ্বলা আলো ছাড়া দিলু কিছু দেখতে পাচ্ছে না। একটানা ঝিঁঝি—র ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ কানে আসছে না। কলকাতায় এই সময় এমন নিঃসাড় চুপচাপ পরিবেশের কথা সে ভাবতে পারে না। এইরকম শান্ত নির্জনতার মধ্যে বসে থাকাটা তার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা, বেশ ভাল লাগছে।

পঞ্চানন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে চেঁচিয়ে বললেন, ”আমার দাদু কোথায়?” বারান্দায় পৌঁছে বললেন, ”শুনলাম তোমার পায়ের নখ নাকি উঠে গেছে।”

দিলু উঠে দাঁড়াল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ”ও কিছু নয়। এরকম আগেও হয়েছে। ফরওয়ার্ড খেলেছি, বলটা ছিল ইয়র্কার, ফসকালুম, বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর বলটা পড়ল, নখটা ফেটে গেল। ওটা পচে গিয়ে পরে নতুন নখ গজাল, এবারও তাই হবে।”

যতক্ষণ কথা বলছিল দিলু, তার মুখের তাচ্ছিল্যের ভাবটা লক্ষ করছিলেন পঞ্চানন। আঘাত অগ্রাহ্য করতে গিয়ে একটা বেপরোয়া ঔদ্ধত্য নাতির কণ্ঠস্বরে ফুটে উঠল। তিনি মনে মনে তারিফ করলেন।

”দাদু, ওই যে বললে ইয়র্কার, সেটা কী জিনিস?”

দিলু চোখ কুঁচকে বলল, ”ফাস্ট বোলাররা দেয়, এটা ওদের একটা বড় অস্ত্র। বলটা সোজা ব্যাটের তলায় এসে পড়ে। এ বল সামলানো বেশ শক্ত। থামাতে গিয়ে ব্যাটের তলা দিয়ে গলে এল বি কি বোল্ড আউট করে দেয়।”

পঞ্চানন চোখ বিস্ফারিত করে বললেন, ”ওরে বাব্বা, এ তো দারুণ বল। তুমি এ বল করতে পারো?”

দিলু বলল, ”আমি ফাস্ট বোলার নই, ব্যাটসম্যান।”

যে লোক ইয়র্কার বল কাকে বলে জানে না, তার সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে দিলু আর আগ্রহ বোধ করল না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে সে বলল, ”দাদু, তোমার শোয়ার ঘরের দেওয়ালে একটা বন্দুক ঝুলছে দেখলাম। বোকামামা বলল তুমি নাকি ডাকাত তাড়িয়েছ গুলি ছুড়ে, সত্যি?”

পঞ্চানন বললেন, ”বলেছে নাকি বোকা? আরে ও কিছু নয়, অনেককাল আগের কথা, তখন এখানে এত ঘরবাড়ি হয়নি। এই বারান্দা থেকে ফাঁকা আওয়াজ করেছিলুম। ওরা তিন—চারটে বোমা ছুড়েই পালাল। ডাকাতিতে সবে হাতেখড়ি হয়েছে। পাকা ডাকাত হলে পালাত না।”

দিলু বলল, ”দাদু, আমাকে বন্দুক চালানো শিখিয়ে দেবে?”

পঞ্চানন অবাক হয়ে বললেন, ”শিখবে? কেন?”

দিলু বলল, ”শিকার করব।”

”বাঘ, সিংহ?”

”হ্যাঁ, তবে এখানে আর সিংহ পাব কোথায়? সেজন্য তো আফ্রিকায় যেতে হবে।”

”তুমি কোথাও মারার জন্য বাঘ—সিংহ পাবে না। সারা পৃথিবীতে আইন করে ওদের মারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওদের মেরে মেরে সংখ্যাটা এত কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, লোপাট হয়ে যাচ্ছে। যে ক’টা বেঁচে আছে তাদের বংশবৃদ্ধির জন্য আইন করে রক্ষা করা হচ্ছে। আমাদের দেশে আগে চিতাবাঘ ছিল, এখন একটাও নেই। যে চিতাটা শেষ বেঁচে ছিল দিল্লির চিড়িয়াখানায়, সেটা বছর চারেক আগে মারা গেছে। মজা কি জানো, কাগজে প্রায়ই দেখবে লেখা হয়, চিতাবাঘের আক্রমণে গ্রামবাসী নিহত বা গোরু—ছাগল মেরে খেয়েছে। আসলে ওটা লেপার্ড, দুটো আলাদা প্রাণী। লেপার্ডের কোনও বাংলা নেই, তাই চিতা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।”

”বেশ, তা হলে পাখি মারব।” দিলু জেদি গলায় বলল। বন্দুক চালানো তাকে শিখতেই হবে।

পঞ্চানন অবাক হয়ে বললেন, ”কেন! পাখি কি তোমার কোনও ক্ষতি করেছে? শুধু শুধু কেন তাদের খুন করবে?”

দিলু খুন শব্দটিতে অপ্রতিভ হয়ে পড়ল। আমতা আমতা করে কী একটা বলার চেষ্টা করল। পঞ্চানন ওকে কাছে টেনে নিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বললেন, ”শিকার যারা করে তারা জীবন ভালবাসে না, তারা নিষ্ঠুর লোক। বনের প্রাণীকে মানুষের সমাজের খুব দরকার। ওরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। কেঁচো, ব্যাং, ইঁদুর, সাপ, ফড়িং, পোকামাকড় এরাও প্রত্যেকেই কোনও না কোনওভাবে আমাদের উপকার করে।”

এবার তর্ক করার ঢঙে দিলু বলল, ”তা হলে আমরা মাছ ধরে খাই কেন, ওরাও তো প্রাণী।”

”নিশ্চয় প্রাণী। আমরা যদি মাছ না খাই তা হলে কী হবে? এই যে পুকুরটা ওতে মাছ আছে, যদি না ধরি তা হলে মাছগুলোর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থা হবে যে, পুকুরে ওদের চলাফেরার জায়গা থাকবে না, তখন ওরা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে মরবে। আমরা মাছ খাই তো প্রয়োজনে, খাবার হিসেবে। শুধু শুধু মজা পাওয়ার জন্য তো ওদের মারি না। আসলে এটাও প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখা। যাকগে এসব কথা, তোমার ইচ্ছে হয়েছে বন্দুক ছোড়ার, কেমন?”

দিলু মাথা হেলাল। পঞ্চানন ওর কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, ”ছুড়বে। আমি দেখিয়ে দোব।”

হষ্য এসে ডাকল খাওয়ার জন্য। ওরা নীচে নেমে এল। পরপর তিনটি কাঠের পিঁড়ির সামনে কাঁসার থালায় ভাত বেড়ে রাখা। বাবু হয়ে বসে শেষ কবে খেয়েছে, দিলু মনে করতে পারল না। জন্ম থেকেই বাড়িতে চেয়ার টেবলে খাওয়া। এই মামার বাড়িতেই তাকে মেঝেয় বসে কাঁসার থালা বাটি গেলাসে খেতে হচ্ছে। এটা তার খারাপ লাগে না। পঞ্চানন প্রাচীন মানুষ, জীবন যাপনও প্রাচীন ধারায়। বসবাসের জায়গা বদল করলেও সাবেকি অনেক কিছু বদলায়নি।

দিলু মাঝখানে, দু’পাশে হরিসাধন ও পঞ্চানন। পরিবেশন করছেন সুলেখা। খেতে খেতে হরিসাধন জিজ্ঞেস করলেন, ”বাবা, তা হলে কী ঠিক হল?”

পঞ্চানন বললেন, ”ঠিক হল নাইটগার্ড পার্টি তৈরি করা হবে। পাড়ার ছেলেরা পালা করে সারারাত পাহারা দেবে, বিশেষ করে পূর্ণেন্দুদের বাড়ির এলাকাটা। ওখানেই তো পরশু দুটো লোককে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে।”

হরিসাধন চিন্তিত স্বরে বললেন, ”ব্যাপারটা ভাবিয়ে তুলল। পূর্ণেন্দুকে বেশ সাবধানে থাকতে হবে। কিছুদিন যেন বাড়ি থেকে না বেরোয়।”

খাওয়া থামিয়ে পঞ্চানন বললেন, ”তাতে কী লাভ হবে? কতদিন বাড়িতে বসে থাকবে? একদিন না একদিন তো বেরোতেই হবে। কাজ করে কলকাতায়, ট্রেনে তো ওকে উঠতেই হবে। কাগজ খুললেই তো দেখি দিবালোকে ট্রেনের কামরার মধ্যে ডাকাতি, খুন ঘটে চলেছে।”

দিলু এইসব কথাবার্তার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে মামা আর দাদুর মুখের দিকে মাথা ঘুরিয়ে দু’বার তাকাল। শুধু তার মনে হল খুব গোলমেলে কোনও ব্যাপার এই পূর্ণেন্দু নামের লোকটা ঘঁটিয়েছে, তাই তার জীবনের ভয় আছে।

.

রাত্রে দাদুর পাশে বিছানায় শুয়ে দিলু সামনের দেওয়ালে ঝোলানো দোনলা বন্দুকটার দিকে তাকিয়ে ছিল। পঞ্চানন তা লক্ষ করলেন। বললেন, ”দাদু, কাল তোমাকে দেখিয়ে দোব কীভাবে বন্দুক চালাবে।”

”দাদু, নাইটগার্ডের কথা মামাকে তখন বলছিলে। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে কি মামাও থাকবে, তুমি থাকবে না?”

”আমি এই বুড়োবয়সে রাতপাহারা কি দিতে পারব? এসব অল্পবয়সীদের জন্য। সত্যি—সত্যি যদি গুণ্ডাবদমাশদের মুখোমুখি হতে হয় তা হলে তো এক থাপ্পড়ে আমায় ফেলে দেবে।”

দিলু বলল, ”কেন, তুমি বন্দুকটা নিয়ে পাহারায় বেরোবে। বন্দুক দেখলে ওরা চোঁ চোঁ দৌড় দেবে।”

পঞ্চানন হেসে ফেলে বললেন, ”দাদু, এখনকার গুণ্ডাদের কাছেও বোমা, পিস্তল, পাইপগান থাকে। এই বুড়ো বয়সে কি আমি পারব? তোমার মামাও পারবে না। বোকা আবার ভিতুও, বয়সও তো ওর পঞ্চাশ পেরিয়েছে। এবার তুমি ঘুমোও।”

দিলু পরদিন যথারীতি দেরিতে ঘুম থেকে উঠল। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দেখল টেবলে তারই বয়সী একটি ছেলে মাথা নামিয়ে মন দিয়ে খাতায় কী যেন লিখছে। পাশের চেয়ারে বসে দাদু ঝুঁকে খাতার দিকে তাকিয়ে।

”উহুঁহুঁ, হ্যাজবিন নয় হ্যাজবিন নয়, হ্যাডবিন হবে। সেদিন কতবার বলে দিলুম, কাজটা করে যাচ্ছিল তার মানে পাস্ট কন্টিনিউয়াস, অতীতের ঘটনা। যা বলে দিই সেটা বাড়িতে গিয়ে আবার ঝালিয়ে নিলে এই ভুলটা হত না।” পঞ্চানন যখন কথাগুলো বলছিলেন ছেলেটি তখন দিলুর দিকে তাকিয়ে ছিল।

”আরে দাদু, এসো, এসো, ঘুমোচ্ছ দেখে আর ডেকে তুলিনি। গ্রাম—পাড়াগাঁয় লোকের ঘুম সূর্য ওঠার সঙ্গেই ভাঙে, শুতেও যায় তাড়াতাড়ি। এখানে থাকলে তোমারও এই অভ্যেস হয়ে যাবে। এই হল বাসু, ভাল নাম বসুদেব, আমাদের হষ্যর ছেলে। সোমবার থেকে পরীক্ষা, ক্লাস এইট হবে। তোমার তো হবে নাইন। বাসু, এই হল দিলু।”

বাসু হাসল দিলুর দিতে তাকিয়ে। দিলু দেখল ঝকঝকে সাজানো দাঁত, পাতাকাটা চুল, আয়ত চোখে বন্ধুত্বের চাহনি, শীর্ণ লম্বাটে মুখ, রং শ্যামবর্ণ, ছোটখাটো রোগা শরীর।

দিলু অস্বস্তি বোধ করল দাদুর একটা কথায়, ”তোমার তো হবে নাইন। হবে কিনা কে জানে, পরীক্ষা দিয়েই তার মনে হয়েছে পাশ বোধ হয় করতে পারবে না।”

”দাদু নীচে যাও, দাঁত মেজে নাও। ব্রাশ এনেছ তো?”

আধঘণ্টা পর পঞ্চানন আর বাসু যখন একতলায় নামল, দিলু তখন একটা বড় বাটি ভর্তি চিঁড়ে দুধ কলা গুড় মাখা খাচ্ছে।

পঞ্চানন বললেন, ”ডাবের জল খাবে নাকি?”

দিলু মাথা কাত করে বলল, ”হুঁ।” ডাবের জল খেতে তার ভাল লাগে। আগের বার যখন এসেছিল, প্রতিদিন অন্তত দু’তিন গ্লাস ডাবের জল খেয়েছে।

”বাসু, রিদু তো এখনও আসেনি, তুই—ই ডাব পেড়ে দে।”

পঞ্চাননের কথা শেষ হওয়ামাত্র বই খাতা রেখে বাসু হর্ষকে বলল, ”মা, দড়িগাছাটা দাও তো।”

পুকুরের দু’ধারের পাড় ঘেঁষে সার দিয়ে সুপুরি আর নারকেলের গাছ। তার পেছনে সার দিয়ে গোটা কুড়ি বেগুন গাছ। তার লাগোয়া মাচায় করলা আর উচ্ছে ঝুলছে। তার নীচে জমির ওপর লতিয়ে রয়েছে কুমড়ো গাছ। আট নম্বরি ফুটবলের মতো দুটো সোনালি রঙের কুমড়ো জমিতে বিশ্রামরত। পঞ্চানন চোখ কুঁচকে গাছের নারকেলগুলো লক্ষ করে একটি গাছ দেখিয়ে বাসুকে বললেন, ”ওটায় ওঠ, ডাবগুলো কচি রয়েছে।”

বাসু জামা খুলে গাছটার দিকে এগোল। একটা কাঠবেড়ালি ল্যাজ তুলে তুড়ুক তুড়ুক লাফিয়ে গাছটা বেয়ে খানিকটা ওপরে উঠে বাসুতে দেখতে পেয়ে চটপট নেমে ঝোপের মধ্যে লুকোল। দেখে দিলুর খুব মজা লাগল। দড়ির দুটি প্রান্ত বেঁধে নিয়ে দুই পায়ের গোছে মালার মতো গোল করে আটকে বাসু দু’হাতে গাছটা জড়িয়ে টেনে টেনে নিজেকে তুলে নিচ্ছে ওপরে। প্রায় পাঁচতলা উঁচু গাছ। গাছটা হেলে রয়েছে পুকুরের দিকে। দিলু অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবল ওই রোগা শরীরে কী জোর আর কী সাহস। ফিসফিস করে সে পঞ্চাননকে বলল, ”দাদু, আমাকে নারকেল গাছে চড়া শিখিয়ে দেবে?”

উৎসাহিত গলায় পঞ্চানন বললেন, ”নিশ্চয় দেব। আগে তোমার পায়ের নখটা ঠিক হোক। নারকেল, সুপুরি সব গাছে উঠবে। প্র্যাকটিস করতে করতে দেখবে তুমি হুঁশিয়ার হয়ে গেছ, তোমার সাহসও বেড়ে গেছে, ইয়র্কার বল খেলতে তোমার আর অসুবিধে হবে না।”

বাসু গাছের মাথায় পৌঁছে গেছে। পাতার আড়ালে ওর হাঁটু পর্যন্ত গোটানো প্যান্ট আর পা দুটো দেখা যাচ্ছে। এক হাতে গাছ জড়িয়ে অন্য হাতে এক—একটা ডাব ধরে মুচড়ে মুচড়ে ছিঁড়ে নিয়ে বাসু পুকুরে ছুড়ে ফেলতে লাগল। গোটাছয়েক পুকুরে ফেলে সে যা করল তাতে দিলুর চোখ কপালে উঠল, হাঁ হয়ে গেল মুখ।

পায়ের দড়িটা নীচে ফেলে দিয়ে বাসু দু’ পা দিয়ে গাছে একটা জোর ধাক্কা দিল। পেছন ফিরে পুকুরের জলে প্রায়—বসা অবস্থায় সে ঝপাত করে পড়ল, পাঁচতলা সমান উচ্চচতা থেকে।

গলা শুকিয়ে গেছে দিলুর, ঠোঁট চেটে বলল, ”দাদু একটু ভুল হলে ও তো জলে না পড়ে ডাঙায়ও পড়তে পারত!”

”তা তো পারতই। কতবার ওকে বারণ করেছি এভাবে নামিসনি, কোনদিন মরবি, নয়তো সারাজীবন পঙ্গু হয়ে থাকবি। আসলে কী জানো, তোমাকে দেখে বাহাদুরি দেখাবার লোভ সামলাতে পারেনি।”

বাসু সাঁতার কেটে ডাবগুলো একে একে পাড়ে ছুড়ে দিয়ে ঘাটে এসে জল থেকে উঠল। বাড়ির ভেতরে গিয়ে ভিজে প্যান্টটা ছেড়ে গামছা পরে একটা কাটারি হাতে ফিরে এল। দুই কোপে ডাবের মুণ্ডু উড়িয়ে বাসু সেটা একগাল হেসে এগিয়ে ধরল দিলুর দিকে।

ডাবটা হাতে নিয়ে দিলু বলল, ”অত ওপর থেকে ঝাঁপ দিতে তোমার ভয় করল না?”

বাসু আবার হেসে মৃদুস্বরে বলল, ”না।”

ছোট ছোট ডাব, দিলু চারটে ডাবের জল খেল, ওরা কেউ খেল না। বাকি ডাবদুটো বাসু ভেতরে নিয়ে গেল। এই সময় দুটি ছেলে পঞ্চাননের সঙ্গে কথা বলতে এল।

তাদের একজন বলল, ”জ্যাঠামশাই, লালুদা জানাল, কাল দুপুরে দুটো অচেনা লোক ওর দোকানে এসে পূর্ণেন্দুর খবর নিয়েছিল। লালুদা তখন দোকানে ছিল না, ওর কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করে পূর্ণেন্দু বাড়ি থেকে বেরোয় কি না, বেরোলে কখন বেরোয় কোনদিকে যায়। আমাদের কিন্তু ব্যাপারটা সুবিধের মনে হচ্ছে না। আজ রাত থেকেই পাহারায় বেরোতে হবে। বড় টর্চ, লাঠি সবার তো নেই, তাই জোগাড় করতে বেরিয়েছি। আপনার কাছে কী আছে?”

পঞ্চানন বললেন, ”লাঠি তো নেই ছড়ি আছে, তাই দিয়ে তো গুণ্ডা সামলানো যাবে না। টর্চ আছে চার ব্যাটারির, সেটা দিচ্ছি। দিলু, দৌড়ে দোতলায় গিয়ে আমার ঘরের টেবলে একটা টর্চ আছে সেটা নিয়ে এসো তো।”

দিলু টর্চ এনে দিতে সেটা নিয়ে ছেলেদুটি চলে গেল।

”দাদু, ব্যাপারটা কী বলো তো?” কৌতূহলী দিলু জিজ্ঞেস করল। ”কাল তুমি আর মামা পূর্ণেন্দু নামের একজনের কথা বলছিলে। মনে হল ওর বিপদ ঘটেছে।”

”বিপদ বলে বিপদ! পূর্ণেন্দু চাকরি করে সল্টলেকে সেচভবনে। সাতদিন আগে বিধাননগর স্টেশন থেকে বাড়ি ফেরার জন্য ট্রেনে উঠেছে। ট্রেন যখন বামনগাছি পৌঁছেছে তখন কামরার মধ্যেই একটা ছেলেকে রিভলভার দিয়ে বুকে গুলি করে তিনজন প্ল্যাটফর্মে নেমে যাচ্ছিল। পূর্ণেন্দু ছিল দরজার কাছে, সে শেষের জনকে জাপটে ধরে। ধস্তাধস্তি হতে হতে ট্রেন ছেড়ে দেয়। এর পর কামরার লোকেরা এমন গণপিটুনি শুরু করে যে, গুণ্ডাটা তাইতে মারা যায়।”

পঞ্চাননকে থামিয়ে দিয়ে দিলু বলল, ”বুঝেছি, গুণ্ডারা এখন বদলা নেওয়ার জন্য পূর্ণেন্দুকে মারার চেষ্টা করছে, কেমন? এরকম ঘটনা আমাদের পাড়াতেও ঘটেছে, তবে রিভলভার নয়, প্রথমে বোমা মারে, রাস্তায় লোকটা পড়ে যায়, তখন ক্ষুর দিয়ে গলা কেটে ওরা মোটরবাইকে উঠে চলে যায়। লোকটা নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় খুন হয় সকালে বাজার করে ফেরার সময়।”

”কী মুশকিলে পূর্ণেন্দু পড়েছে বলো তো।” পঞ্চানন চিন্তায় পড়ে গেলেন, ”খুনি ধরে এখন নিজেই খুন হতে চলেছে। ওরা বাড়িটা ঠিক খুঁজে বের করেছে। আমাদের পাড়ার লোকেরা খুব ভাল, খুব মিলমিশ। কেউ বিপদে পড়লে পাশে দাঁড়ায়, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ওকে বাঁচাবার জন্য ছেলেরা রাতপাহারা দেবে। কিন্তু দিনের বেলাতেও তো ওকে মারার জন্য আসতে পারে। তোমাদের পাড়ায় যে খুনটা হয়েছিল সে তো সকালেই ঘটেছিল। আগে এসব রাতের অন্ধকারে হত, এখন দিনের বেলাতেও হয়। লোকভর্তি ট্রেনের কামরা আর তারই মধ্যে কিনা গুলি করে নেমে চলে যায়! ভাবতে পারো?”

দিলু বলল, ”দাদু, ওরা আচমকা হঠাৎ অ্যাটাক করে, এক মিনিট আগেও তুমি জানতে পারবে না। দুপুরে হয়তো সদর দরজায় কড়া নাড়ল। যেই দরজা খুলবে অমনই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে বোমা মেরে কি গুলি চালিয়ে ছুটে বেরিয়ে এসে মোটরবাইকে চেপে হাওয়া হয়ে যাবে। অ্যাকশনটা করতে লাগবে বড়জোর দু’মিনিট, তখন তোমার রাতপাহারাওলারা কোথায়?”

পঞ্চানন আরও চিন্তায় পড়ে গিয়ে বললেন, ”তাও তো বটে। আমি বরং পূর্ণেন্দুর বাড়ির লোকেদের বলে আসি সদর দরজা সারাক্ষণ বন্ধ রাখবে। আর কেউ কড়া নাড়লে জানলা দিয়ে আগে দেখে নেবে অচেনা লোক কি না।”

পঞ্চাননের সঙ্গে দিলুও বেরোল। গতকাল ভ্যানরিকশা থেকে যেখানে সে নেমেছিল তার থেকে পঞ্চাশ—ষাট মিটার এগিয়ে লালুর মুদির দোকানের উলটো দিকে পূর্ণেন্দুদের বাড়ি। একতলা নিচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। কাঠের ছোট্ট গেট। ইট বিছানো সরু পথ দিয়ে গিয়ে একটা চৌকো বারান্দায় উঠতে হয় দু’ধাপ সিঁড়ি ভেঙে। বারান্দাটার দু’দিকে হাঁটু সমান উঁচু দেওয়াল। তার ওপরে বসানো লোহার গ্রিল। গ্রিল ঘেরা থাকলেও বারান্দাটাকে দু’দিক খোলাই বলা যায় আর বাকি দু’দিকে ঘর। গ্রিলেরই দরজা। বাইরে থেকে এই দরজা দিয়ে বারান্দায় ঢুকে ঘরে যেতে হয়। একটা বেঞ্চ, একটা ছোট নিচু টেবল আর দুটো স্টিলের ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে বাইরের লোকেদের বসার জন্য বারান্দাটাকে ব্যবহার করা হয়। বাড়ির বাইরে দেওয়ালে পলেস্তরা নেই। বোধ হয় টাকায় কুলোয়নি তাই বাড়িটা সম্পূর্ণ করতে পারেনি, পরে টাকা জমিয়ে পলেস্তরা করে নেবে। এইরকম বাড়ি এই অঞ্চলে অনেক, দিলু দেখেছে। পূর্ণেন্দুদের বাড়িটার দু’পাশে কিছু জমি, তাতে একটা পেয়ারা আর কয়েকটা পেঁপেগাছ। জমিতে পড়ে আছে ভাঙা ইট, টালি, কাঠের টুকরো; দিলুর নজর গেল পেয়ারাগাছে, কয়েকটা পেয়ারা বেশ বড় আর ডাঁশা।

কাঠের গেট দিয়ে ঢুকে গ্রিলের দরজার পাশে দেওয়ালে কলিং বেল। পঞ্চানন বোতাম টিপলেন। বেল বাজার শব্দ হল না।

”নির্ঘাত লোডশেডিং। এই এক ঝামেলা। সারা সকাল, দুপুর এই চলবে।” পঞ্চানন বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে ডাকলেন, ”পূর্ণেন্দু, পূর্ণেন্দু….নবেন্দু, দিব্যেন্দু—”

ভেতরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন পূর্ণেন্দুর মা বিভা। বিধবা মহিলা।

পঞ্চানন বললেন, ”বাড়িতে কেউ নেই? পূর্ণেন্দু কোথায়, কী করছে? দেখতে এলুম।”

গ্রিলের দরজা ভেতর থেকে তালা দেওয়া। বিভা চাবি দিয়ে তালা খুলে বললেন, ”ছেলেরা এইমাত্র বেরোল। কলেজ, আপিস কামাই করে বাড়িতে বসে পাহারা ক’দিন দেবে। ভগবান আছেন দেখবেন, আর আছেন আপনারা। দাঁড়িয়ে কেন, বসুন।”

পঞ্চানন চেয়ারে বসলেন। এই সময় বারান্দার পেছনের ঘরের জানলার একটা পাল্লা ফাঁক করে উঁকি দিল একটা মুখ। চোখ দুটিতে ভয় চাপার চেষ্টা। দিলুর মনে হল এই লোকটিই পূর্ণেন্দু।

পঞ্চানন তাকে দেখে বললেন, ”বেরিও না এখন ঘর থেকে। অত ভয় পাওয়ারই বা কী আছে, আমরা তো রয়েইছি। তেমন কিছু মনে হলে আমাকে ডেকো।”

পূর্ণেন্দু বলল, ”দুপুরে আপনাকে ডাকতে হলে তো মাকে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে, তখন যদি ঢুকে পড়ে। দেখছেন তো বাড়িটা একদম খোলা, কোনওরকম প্রোটেকশন নেই।”

দিলু এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। এইবার বলল, ”দাদু, আমরা এসে তো দুপুরে থাকতে পারি। তুমি বন্দুকটা হাতে নিয়ে থাকবে। গুণ্ডারা এলেই গুলি চালাবে।”

”ঠিক বলেছিস।” পঞ্চানন উৎসাহে চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। হাঁটুতে বাতের উপদ্রব ঘটল। ”বন্দুক তো সেইজন্যই রাখা, ডাকাত গুণ্ডা তাড়াবার জন্য।”

দিলু বলল, ”তা ছাড়া বন্দুকে যাতে জং না ধরে সেজন্য মাঝে মাঝে ওটা ছোড়াও দরকার।”

বিভা জানতে চাইলেন, ”মেসোমশাই, এই ছেলেটি কেন?”

”নাতি, মলুর ছেলে। বেড়াতে এসেছে। ভাল লাগলে থেকে যাবে, এখানেই পড়াশুনো করবে বোকার স্কুলে।”

দিলু বলল, ”দাদু তা হলে কি আজ দুপুর থেকেই পাহারায় বসবে।”

”আজ নয়। বন্দুকটা ঠিক আছে কি না, কার্ট্রিজগুলো ছ’সাত বছর পড়ে রয়েছে, সেগুলো ফাটবে কিনা আগে পরখ না করে কি পাহারায় বসা যায়?”

বিভা ভেতরে গিয়ে একটা প্লেটে চারটে নারকেল নাড়ু আর এক গ্লাস জল নিয়ে এসে বললেন, ”প্রথম এলে, একটু মিষ্টিমুখ করো।”

দিলু ইতস্তত করছিল, পঞ্চানন চোখের ইশারায় খেয়ে নিতে বললেন।

বাড়ি ফেরার সময় দিলু বলল, ”দাদু, তুমি বলেছিলে বন্দুক চালানো শিখিয়ে দেবে, এবার সেটা শিখিয়ে দাও, তা হলে কার্ট্রিজ আর বন্দুকটা ঠিক আছে কি না তাও সেইসঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।”

”হ্যাঁ, এটা একটা যুক্তি বটে।” পঞ্চানন নাতির পিঠ চাপড়ে বললেন।

.

দোনলা বন্দুকটার ঘাড় মটকে দিয়ে পঞ্চানন এক চোখ বন্ধ করে পরপর নলের ভেতরে তাকালেন, গন্ধ শুঁকলেন, নাক কোঁচকালেন।

”বহুকাল পরিষ্কার করা হয়নি। আগে একটু তেল দিয়ে পরিষ্কার করেনি।”

পঞ্চানন আলমারি থেকে একটা শিশি বের করলেন। খুঁজে—পেতে একটা আড়াই হাত লম্বা কঞ্চি জোগাড় করে তার মাথায় ন্যাকড়া বেঁধে তাতে তেল ঢাললেন। এবার কঞ্চিটা নলের মধ্যে ঢুকিয়ে ঘষাঘষি করে ধুলোময়লা সাফ করলেন। সেফটি ক্যাচ দুটো টেনে পরপর ট্রিগার টিপলেন, খটাস খটাস শব্দ হল। বন্দুকের মটকানো ঘাড় সোজা করে, বাঁটটা বগলের কাছে কাঁধে ঠেকিয়ে বন্দুক তুলে বারান্দার বাইরে নারকেল গাছের দিকে তাক করলেন।

দিলু একমনে দাদুর সবকিছু লক্ষ করে যাচ্ছিল। এ পর্যন্ত যতটুকু দেখল তাতে তার মনে হলে বন্দুক ছোড়ার মধ্যে জটিলতা কিছু নেই। খেলনা পিস্তলে ক্যাপ লাগিয়ে সেফটি ক্যাচটা টেনে আঙুল দিয়ে ট্রিগার টেনে দিলে ‘ফটাস’ শব্দ হয়, সত্যিকারের বন্দুকে হয় ‘গুড়ুম’। তবে বন্দুক ধরা হাতটা স্থির রাখা দরকার আর নিশানাটাকে ঠিকভাবে একদৃষ্টে দেখা। ফাস্ট বোলার যখন ডেলিভারি করছে তখন ব্যাটসম্যান যেমন মাথাটা অনড় রেখে অপেক্ষা করে বলটাকে একদৃষ্টে লক্ষ করার জন্য, দিলুর মনে হল এটাও অনেকটা সেইরকম। তবে শুটার হওয়া তার ইচ্ছে নয়, সে হতে চায় ব্যাটসম্যান। শুধু শখ মেটানোর জন্য সে একবার বন্দুক ছুড়তে চায়।

পঞ্চানন একটা ছোট কাঠের বাক্স আলমারির মাথা থেকে নামালেন। ডালাটা খুলে তিনি দিলুকে বললেন, ”এই হচ্ছে কার্ট্রিজ, যাকে বাংলায় বলে কার্তুজ।”

দিলু দেখল ক্রিকেট বলের রঙের ইঞ্চি চারেক লম্বা মোটা চুরুটের মতো গোলাকার গোটাদশেক কার্ট্রিজ। একদিকটা পেতলে মোড়া, তবে মধ্যিখানে ছোট্ট একটা তামার টিপ। পঞ্চানন বুঝিয়ে দিলেন, ট্রিগার টিপলে এই তামাটায় সেফটি ক্যাচটা ঘা দেয়। আর তখনই ফায়ার হয়।

দিলু বলল, ”দাদু, তুমি আগে একটা গুলি ছুড়ে দেখাও, তারপর আমি ছুড়ব।”

পঞ্চানন দুটো নলে দুটি গুলি ভরলেন। বারান্দায় এসে এ—ধার ও—ধার তাকালেন, গুলি কোনদিকে কোথায় ছুড়বেন সেই লক্ষ্যটা নির্বাচন করতে। কিছুই তাঁর মনে ধরল না। অবশেষে নীচে তাকিয়ে চোখ পড়ল পুকুরে। ঠিক করলেন, জলেই গুলি ছুড়বেন।

”এইবার দেখো, বাঁ পা—টা একটু সামনে বাড়িয়ে বন্দুকের নলের এই জায়গাটা বাঁ হাতের চেটোর ওপর রেখে, বাঁটটা কাঁধের এইখানে চেপে নলের শেষে সর্ষে দানার মতো যে মাছিটা রয়েছে, একচোখ বন্ধ করে, মাছিটাকে তোমার টার্গেটের সমান লাইনে রাখো। ব্যাপারটা বুঝেছ?”

দিলু লক্ষ করছিল দাদুর ভাবভঙ্গি। পুকুরের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে ধরতেই সে সামনে তাকাল। তখন পুকুরের অপর পাড়ে একটা দশ বারো বছরের মেয়ে দড়ি ধরে একটা খয়েরি রঙের গোরুকে নিয়ে যাচ্ছে, পেছনে বাছুর।

পুকুরের মধ্যিখানে তাক করে পঞ্চানন ট্রিগার টিপলেন। নিস্তব্ধ পরিবেশ খানখান করে বন্দুকের শব্দ হতেই কোথা থেকে ভেলো ঘেউ ঘেউ ডেকে উঠল, গোরুটা থমকে দাঁড়িয়ে হাম্বা রব তুলে বাছুরের দিকে এগিয়ে গেল, গাছগুলো থেকে গোটা তিরিশ পাখি নানান রকম স্বরে ডাকতে ডাকতে ওড়াউড়ি শুরু করল।

পঞ্চানন বন্দুকটা দিলুর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ”দাদু, এবার তুমি ছোড়ো।”

দিলু আগে থেকেই নজর করেছিল বাগানে গাছে ঝুলে থাকা একটা এঁচোড়কে। বন্দুকটা হাতে পেয়ে সময় নষ্ট না করে এবং দাদু বুঝে ওঠার আগেই সে এঁচোড়টা তাক করে ট্রিগার টানল। আবার একটা প্রকৃতির শান্ততা এলোমেলো করা শব্দ। পাখিদের ভীত স্বরে ওড়াউড়ি, ভেলো দিশাহারা ডাক ডাকতে ডাকতে ছুটল বাছুরটারই দিকে, বাছুরটা ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে ছুটতে ছুটতে গিয়ে পড়ল পুকুরে।

এঁচোড়টা গাছ থেকে জমিতে পড়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে। দেখে দিলুর রোমাঞ্চ হল। প্রথম গুলি ছোড়াতেই সে শিকার করে ফেলেছে। পঞ্চানন মুগ্ধ স্বরে বলে উঠলেন, ”শাবাশ দাদু, শাবাশ।”

তখনই মেয়েটির আর্ত চিৎকার তারা শুনল, ”ওগো বাঁচাও, বাছুর ডুবে যাচ্ছে, বাঁচাও।”

দিলু বারান্দা থেকে দেখল বাছুরটা সাঁতরে পাড়ের দিকে এসেছে কিন্তু পাড়টা খাড়াই, ওখানে জল গভীর, দাঁড়াবার মতো তল নেই। বেচারা আঁকুপাকু করছে জমি পাওয়ার জন্য। কিন্তু পাচ্ছে না। ওর মা পাড়ের কিনারে এসে ডাকছে আর চারদিকে তাকাচ্ছে উদভ্রান্ত বিস্ফারিত চোখে।

মেয়েটি ছুটতে ছুটতে বারান্দার নীচে এল। মুখ তুলে চেঁচিয়ে বলল, ”ও দাদু, বাছুরটাকে তুলে দাও না, ও ডুবে মরে যাবে যে।”

দিলুর ইচ্ছে করল, বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়ে বাছুরটাকে জল থেকে তুলে আনতে। হায়, সে তো কলকাতার হাজার হাজার ছেলের মতো সাঁতার জানে না। বাছুর না হয়ে যদি মানুষের বাচ্ছা হত তা হলেও সে দূর থেকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারত না। সে ছয় মারতে পারে, জলে ঝাঁপ দিতে পারে না।

বারান্দা থেকে অসহায় দৃষ্টি ছাড়া আর কিছু না পেয়ে মেয়েটি সময় নষ্ট না করে বাড়ির ভেতরে ছুটে গেল, ”মামি ও মামি, ও হষ্য মাসি—” বলতে বলতে।

এর পরই দিলু দেখল, তার পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী মামি সুলেখা শাড়িটাকে গাছকোমর বাঁধতে বাঁধতে একটা ওলিম্পিক স্প্রিণ্টারের মতো ছুটে যাচ্ছে। বাছুরটা তখন জলে ডুবছে আর উঠছে। মামি পুকুরের পাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু—তিনটি হাত পাড়ি দিয়ে বাছুরটার কাছে পৌঁছে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।

পঞ্চানন ও দিলু যখন নীচে নেমে ঘাটে পৌঁছল তখন হর্ষ সেখানে এসে গেছে, আর সুলেখাও বাছুরটাকে বুকে জড়িয়ে সাঁতার কেটে ঘাটের নীচের ধাপে এসে দাঁড়িয়েছে। হর্ষ জলে নেমে বাছুরটাকে দু’হাতে তুলে ঘাটের ওপরের ধাপে এনে শুইয়ে দিল। জল খাওয়ার জন্য বাছুরটা বমি করছে। ছুটতে ছুটতে ওর মা এসে গেল। জিভ দিয়ে সে চাটতে শুরু করল বাছুরটার মাথা পিঠ বুক।

সুলেখা হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ”হষ্য, উনুনে পোস্ত চাপিয়ে এসেছি, দৌড়ে যা। এতক্ষণে বোধ হয় পুড়ে গেছে।”

পঞ্চানন বললেন, ”যাক পুড়ে। বউমা, তুমি না এসে পড়লে বাছুরটাকে আর বাঁচানো যেত না।”

”বাবা আমি বাঁচাবার কে, ভগবতীর সন্তান, মা—ই বাঁচিয়েছেন।” সুলেখা দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন।

দিলু ফিসফিস করে দাদুকে বলল, ”আমাকে সাঁতার শিখিয়ে দেবে?”

”দোব। বাসুর পরীক্ষাটা হয়ে যাক, ওকে বলব, ও ভাল সাঁতার জানে।”

”তুমি জানো না?”

”জানি। তবে এই পঁচাশি বছর বয়সে জলে নামার ক্ষমতা আর নেই। দেখলে না বাছুরটা ডুবছে দেখেও দাঁড়িয়ে রইলুম।” বিষণ্ণ হতাশ স্বরে পঞ্চানন বললেন। দাদুর মুখ অপরাধীর মতো দেখাচ্ছে দেখে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো স্বরে দিলু বলল, ”তোমার আর দোষ কী, বয়স তো সব মানুষেরই হয়, ইয়ং ম্যানের মতো ক্ষমতা কি চিরকাল কারুর থাকে? বুড়ো হলে আমারও থাকবে না।”

পঞ্চানন হেসে ফেললেন নাতির বিজ্ঞের মতো কথা শুনে। বললেন, ”ক্ষমতা থাকতে থাকতে একটা দাগ কেটে যাও।”

দিলু অবাক হয়ে বলল, ”দাগ। সে আবার কী!”

”মানুষ হয়ে জন্মেছ যখন এমন কিছু একটা করো যা চিরকাল সবার মনে থাকবে। আমার কথা নয়, স্বামীজির কথা।”

দিলু ভুরু কোঁচকাল। স্বামীজি! দাদু বোধ হয় স্বামী বিবেকানন্দর কথা বলছেন। সে নাম শুনেছে কিন্তু ওঁর কোনও লেখা পড়েনি। বই পড়তে তার ভাল লাগে না।

দুপুরে ঘুম আসে না দিলুর। কলকাতায় হয় তখন স্কুলে এবং ছুটি দিন হলে খেলার মাঠে। খেলা থাকলে স্কুল পালিয়ে খেলতে যায়, বাড়ির কেউ তা জানে না। দুপুরে ঘুমন্ত দাদুর পাশে চিত হয়ে শুয়ে দেওয়ালে ঝোলানো বন্দুকটার দিকে তাকিয়ে সে চলচ্চিচত্রের মতো মনের মধ্যে দেখে যাচ্ছে সকাল থেকে যা যা ঘটেছে।—দাদুর কাছে বাসুর ট্রানস্লেশন করা, নারকেল গাছে বাসুর ওঠা, সেখান থেকে পুকুরে ঝাঁপ দেওয়া, খচাখচ কাটারি দিয়ে ডাব কাটা। এর একটাও সে করতে পারবে না। এর পর পূর্ণেন্দুদের বাড়ি যাওয়া, সেখান থেকে ফিরে বন্দুক থেকে প্রথমবার গুলি ছুড়েই গাছ থেকে এঁচোড় ফেলে দেওয়া…ভাবতেই দিলুর শরীর গরম হয়ে উঠল। এটা তো মিরাকল। কীভাবে যেন ঘটে গেল। এটা দৈব ঘটনা ছাড়া আর কী হতে পারে!

এরকম ঘটনা তো ক্রিকেটেও ঘটেছে। দিলুর মনে পড়ল বিজয়ী সঙ্ঘের সঙ্গে সালকিয়ায় গিয়েছিল ম্যাচ খেলতে, অবশ্য রিজার্ভ প্লেয়ার হিসেবে। হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি নেমে মাঠে জল জমে গেল, খেলা বন্ধ। টিমের স্কোরার বলাইদা জমিয়ে ক্রিকেটের গল্প বলেন। তিনি শুরু করলেন ষাট সালে ব্রিসবেন মাঠে পৃথিবীতে প্রথম টাই হওয়া টেস্ট ম্যাচের গল্প। সেই টেস্ট খেলেছিল বিচি বেনোর অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ফ্রাঙ্ক ওয়ারেলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দু’দলেই বাঘা বাঘা প্লেয়ার। একদিকে সোবার্স, কানহাই, হল, হান্ট, রামাধিন, ভ্যালেন্টাইন, অন্যদিক ববি সিমসন, ডেভিডসন, হার্ভি, ও’নিল, গ্রাউট, ম্যাকডোনাল্ড, ক্লাইনের মতো ক্রিকেটাররা।

বলাইদা যেন মাঠে বসে নিজের চোখে ম্যাচটা দেখেছেন এমনভাবে প্রথমদিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত বর্ণনা দিয়েছিলেন:

”মিরাকল ছাড়া আর কী বলব। জেতার জন্য অস্ট্রেলিয়ার দরকার তিন রান, বাকি রয়েছে তিন বল, হাতে দুটো উইকেট। হলের বলে মেকিফ ব্যাট চালালো। বল স্কোয়ার লেগ বাউন্ডারির কাছে বড় বড় ঘাসে আটকে থেমে গেল। তীরবেগে ছুটে এসে হান্ট বলটা তুলে নিয়ে প্রায় নব্বই গজ দূর থেকে ছুড়ল। নিখুঁত ছোড়া, সোজা আলেকজান্ডারের গ্লাভসে। তখন দুটো রান নেওয়া হয়ে গেছে, তার মানে ম্যাচ টাই হয়ে গেছে। জিততে হলে আর একটা রান দরকার, ওরা সেই তৃতীয় রানটা নেওয়ার জন্য দৌড়ল। তখনই আলেকজান্ডারের হাতে বলটা পৌঁছল। গ্রাউট ডাইভ দিয়েও রান আউট থেকে রক্ষা পেল না। স্কোর তখন সাতশো সাঁইত্রিশ অল। দু’বল বাকি, জিততে এক রান দরকার। ক্লাইন এল ব্যাট করতে। এর পরই ঘটল সেই মিরাকল। ক্লাইন হলের প্রথম বলটা লেগের দিকে ঠেলে দিয়েই ছুটল। বারো গজ দূর থেকে ছোঁ মেরে সলোমন বলটা তুলেই ছুড়ল। ধীরেসুস্থে টিপ করে ছোড়ার সময় ছিল না। মাত্র একটা স্টাম্প ছাড়া আর কিছু তার নজর করার ছিল না। যদি ফসকাত তা হলে মেকিফ পৌঁছে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া জিতে যেত। বলটা কিন্তু সোজা গিয়ে লাগল স্টাম্পে। এক বল বাকি থাকতে ম্যাচ টাই, একে দৈব ঘটনা ছাড়া আর কী বলব।”

দিলু বিড়বিড় করল, ”মিরাকল, মিরাকল। আমারটাও মিরাকল।”

দাদু ঠিক যেমনটি বলেছিল সেইভাবেই বন্দুকটা ধরে গুলিটা ছুড়েছিল। কাঁধে একটা ধাক্কা লেগেছিল মাত্র। ছররাগুলো লেগেছে এচোড়ের বোঁটার কাছে। তার টিপ যে ভাল এটা সে ক্রিকেট মাঠে ফিল্ড করার সময় জেনে গেছল। ম্যাচে গোটা দুয়েক রান আউট সে করবেই।

 বিছানা থেকে উঠে দিলু বারান্দায় এল। সারা বাড়ি নিঝুম। পাশের ঘরটা বোকামামার। মামি এখন বোধ হয় ঘুমোচ্ছে। মামা স্কুলে। হাওয়াই চটিটা পায়ে দিয়ে দিলু নীচে নেমে এল। দালানে মাদুরে শুয়ে পাশ ফিরে হর্ষমুখী ঘুমোচ্ছে। দিলুর চটির শব্দে সে শোয়া অবস্থাতেই বলল, ”কে রে?”

”আমি দিলু।”

”কোথায় চললে?” হর্ষ উঠে বসল।

”ভাল লাগছে না। যাই একটু বাইরে ঘুরে আসি।”

”ভাল না লাগলে কাজ করো, জগৎ সংসার ভুলে থাকতে চাও যদি তা হলে মাছ ধরো। চলো তোমাকে একটা ছিপ দিচ্ছি।”

হর্ষ ভাঁড়ার ঘর থেকে পাঁচ হাত লম্বা বাঁশের কঞ্চি আনল। তার সরু প্রান্তটিতে প্রায় সাত হাত লম্বা শক্ত সুতো বাঁধা, সুতোর মাঝামাঝি বাঁধা শোলার চার ইঞ্চি একটা কাঠি, এটা ফাতনা। সুতোর প্রান্তে জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো সরু তারের বঁড়শি। ছিপটা, কলাপাতায় একমুঠো ভাত আর একটা বড় প্লাস্টিকের মগ হর্ষ দিলুর হাতে দিয়ে বলল, ”যাও ঘাটের নীচের ধাপে বসে পুঁটিমাছ ধরো আর এই মগে মাছ রাখো। দেখবে কেমন মজা লাগবে।”

দিলু লাজুক স্বরে বলল, ”কী করে ধরতে হয় একটু দেখিয়ে দেবে, কখনও তো মাছ ধরিনি।”

সে হর্ষর সঙ্গে পুকুরঘাটে এল। সিঁড়ির ধারের দিকে দাঁড়িয়ে বঁড়শিতে ভাত গেঁথে হর্ষ ছিপটা বাতাসে ছপাৎ করে মারল। বঁড়শিটা দূরে জলে গিয়ে পড়ল। বঁড়শি ডুবে গিয়ে ফাতনাটা ভাসছে।

”এবার ফাতনাটাকে নজর করো।”

দিলু দেখল একটু পরেই জলে স্থির হয়ে ভাসা ফাতনাটা তিরতির করে নড়ে উঠল। হর্ষ ছিপটা শক্ত করে ধরল। তার চোখ তীক্ষ্ন, ঠোঁটের কোণে হাসি।

”মাছ এখন ঠোকরাচ্ছে।”

ফাতনাটা একটা ডুব দিতেই সঙ্গে সঙ্গে হর্ষ ছিপে হ্যাঁচকা টান দিল। আঙুলখানেক লম্বা একটা পুঁটি বঁড়শিতে ছটফটাচ্ছে। মাছটাকে মুঠোয় ধরে হর্ষ বলল, ”এবার দেখো কী করে বঁড়শিটা মাছের মুখ থেকে ছাড়িয়ে নেবে।”

দিলু মন দিয়ে দেখল হর্ষ কীভাবে মাছের মুখের মধ্য থেকে বঁড়শিটা বের করল।

”এইবার তুমি নিজে মাছ ধরো, এ পুকুর পুঁটিমাছ ভরা। মাছ ধরে এই মগে রাখবে। আমি যাচ্ছি।” হর্ষ চলে গেল।

যেমনটি দেখিয়ে দিয়েছিল হর্ষ, সেইভাবে দিলু গভীর মনোযোগে আধঘণ্টায় আটবার ব্যর্থ হয়ে তিনটে পুঁটি বঁড়শিতে গেঁথে তুলল। তাইতে সে এত আনন্দ পেল যে, তার মনে হল ম্যাচে আট ওভার বল করে তিনটে উইকেট যেন পেয়েছে।

”কী দাদু, ক’টা হল?” পঞ্চানন বারান্দায় দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললেন।

”তিনটে, তবে হ্যাটট্রিক নয়।”

”হবে, হবে, এই তো সবে হাতেখড়ি। উইকেটের চরিত্র, ব্যাটসম্যানের মেজাজ ভাল করে বুঝে নাও, তারপর বড় হুইল ছিপ দোব। তখন আর চুনোপুটি নয়, রুই—কাতলা খেলিয়ে তুলবে।”

পঞ্চানন নীচে নেমে এসে ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়ালেন। দিলু তখনই টান মেরে বঁড়শি তুলল। তাতে মাছ নেই, ভাতও নেই।

ঠাট্টা করে পঞ্চানন বললেন, ”রান চুরি করে ব্যাটসম্যান পালাল। রান আউট করতে পারলে না। শুনেছি বড় বড় অনেক ক্রিকেটারের নাকি মাছধরার নেশা আছে, সত্যি?”

দিলু বঁড়শিতে ভাত গাঁথতে গাঁথতে বলল, ”আমিও শুনেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা একমনে ফাতনার দিকে তাকিয়ে কনসেনট্রেট করলে নাকি ব্যাটিংয়ের সময় সেটা কাজে লাগে। জানি না কথাটা সত্যি কি না, তবে মাছের সঙ্গে একটা বুদ্ধির লড়াই যে হয় পুঁটিমাছগুলো আমাকে তা টের পাইয়ে দিয়েছে। দাদু, আমার কিন্তু বেশ মজা লাগছে।”

”তা হলে মামার বাড়িতে থেকে যাও।”

দিলু বঁড়শি ছুড়তে গিয়ে থমকে গেল। কলকাতার বাড়িটা তার ভাল লাগে না ঠিকই, কিন্তু বাড়ির বাইরে অনেক বন্ধু আছে, ক্রিকেট আছে, ম্যাচ খেলা আছে, হার—জিতের উত্তেজনা আছে। কিন্তু এখানে কী আছে? এখানে তো একা—একাই থাকতে হবে, বাড়িতে সমবয়সী কেউ নেই যার সঙ্গে সমানে—সমানে কথা বলা যাবে। এটা ঠিকই সে নারকেল গাছে উঠতে পারে না, সাঁতার জানে না কিন্তু প্রথমবার বন্দুক হাতে নিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছে সে কী করতে পারে।

”দাদু, এখানে তো খেলার কোনও সুযোগই নেই।” দিলু বঁড়শি জলে ছুড়ে দিয়ে বলল।

”কে বলল নেই? কোন খেলাটা খেলতে চাও? ফুটবল, কবাডি, ভলি, খো খো, ক্রিকেট—”

”ক্রিকেট আছে!” দিলু একটু অবাক হয়ে বলল।

”অবশ্যই। তুমি কি দুধঘাটকে অজ পাড়াগাঁ ভেবেছ? পলিউশান, মিছিল, ট্রাফিক জ্যাম, উৎকট শব্দ, নোংরা ছাড়া কলকাতায় আর যা যা পাওয়া যায় তার অনেক কিছুই এখানে পাবে, মায় ডাকাত—গুণ্ডা ক্রিকেটও। ফুটবল—ক্রিকেটের কোচিং সেন্টার পর্যন্ত আছে। এখানে অনেক খেলার টুর্নামেন্ট হয়। পরীক্ষার জন্য খেলাধুলো এখন বন্ধ, শেষ হলেই শুরু হয়ে যাবে। আশপাশের সাত—আটটা গ্রামের ছেলেরা আসে খেলতে। তুমি বরং এখানে থাকো, সঙ্গীসাথী অনেক পেয়ে যাবে, টানো টানো—” পঞ্চানন চেঁচিয়ে উঠলেন।

সচকিত হয়ে দিলু বড়শিতে টান দিল। দাদুর কথা শুনতে শুনতে ফাতনা থেকে চোখ সরে গেছল। মাছ উঠল না। পঞ্চানন হাসতে হাসতে বললেন, ”ফাতনা থেকে চোখ একদম সরাবে না।”

দিলুর মনে পড়ল বলাইদার একটা কথা—”ব্র্যাডম্যান যখন ব্যাট করতেন, বল থেকে একদম চোখ সরাতেন না।” কী আশ্চর্য, দাদু হুবহু একই কথা বললেন, তবে ব্যাটিংয়ের নয়, মাছ ধরার সম্পর্কে। সে ছিপ গুটিয়ে বলল, ”আজ এই পর্যন্ত, আবার কাল হবে।”

পঞ্চানন বললেন, ”কাল দুপুরে কিন্তু পূর্ণেন্দুদের বাড়িতে পাহারায় বসতে হবে। তুমি সঙ্গে যাবে তো?”

”সঙ্গে করে বন্দুকটা নেবে কিন্তু।”

রাত্রে খেতে বসে হরিসাধন বললেন, ”শুনেছ বাবা কাল সকালে নেতাজি কলোনিতে কী কাণ্ড হয়েছে, আজ আমাদের রাধুবাবুর কাছে শুনলুম সব।”

পঞ্চানন অবাক হয়ে বললেন, ”কিছু শুনিনি তো, কী হয়েছে?”

”দোকানে বসে চা খাচ্ছিল লালু নামের একটা ছেলে, বছর চব্বিশ বয়স। তখন অটো রিকশায় দুটো লোক এসে দোকানের সামনে দাঁড়ায়, ওদের দেখেই লালু ছুটে দোকানের মধ্যে ঢুকে যায়। অটো থেকে নেমে দুটো লোক ওকে তাড়া করে দোকানে ঢুকে দুটো বোমা ফাটিয়ে অটোয় চেপে পালাতে থাকে। রাস্তার লোক অটোটাকে তাড়া করলে ভিড়ের মধ্যে জোরে চালাতে গিয়ে অটোটা উলটে যায়।”

দিলু বলে উঠল, ”তারপর লোকেরা ওদের ধরে গণপ্রহারে মেরে ফেলল, তাই তো?”

”সেটাই হয়ে থাকে।” হরিসাধন হেসে বললেন, ”এক্ষেত্রে তা হয়নি। লোকেরা ওই দু’জনকে আর অটোর ড্রাইভারকে ধরে রেখে থানায় খবর দেয়, পুলিশ এসে তিনজনকে ধরে নিয়ে যায়। আর লালুকে হাসপাতালে পাঠায়, ইনজুরি খুব বেশি নয়, বোধ হয় বেঁচে যাবে।”

পঞ্চানন জিজ্ঞেস করলেন, ”ছেলেটাকে মারতে এসেছিল কেন?”

”লালুও একটা গুণ্ডা, ল্যাংড়া ভোলার দলের। আর যারা ওকে মারতে এসেছিল তারা বাপির দলের। ট্রেনে যাকে গুলি করে মারল সে বাপির দলের ছেলে, আর তাকে মারল ল্যাংড়া ভোলার লোকেরা। খুনের বদলা নিতে আজ এসেছিল বাপিরা। এই ভোলার লোকেদের একজনকেই সেদিন পূর্ণেন্দু ট্রেনে জাপটে ধরেছিল। আর দু’জন ট্রেন থেকে নেমে পালায়। পুলিশ সন্দেহ করছে সেই পালানোদের একজন হল এই লালু।”

দিলু বলল, ”এই লালুই ট্রেনের খুনিদের একজন কি না সেটা তো সবচেয়ে ভাল বলতে পারবে পূর্ণেন্দুদা, উনি তো খুব কাছের থেকে দেখেছেন।”

হরিসাধন বললেন, ”দেখেছে বলেই তো ওর প্রাণসংশয়। ল্যাংড়া ভোলা তো সেজন্যই পূর্ণেন্দুকে খুঁজছে। ও যদি বলে, হ্যাঁ এই লোকটা সেদিন ট্রেনে খুনির দলে ছিল তা হলে পুলিশ লালুকে অ্যারেস্ট করবে। ভোলা এখন চাইবে পূর্ণেন্দুকে চুপ করিয়ে দিতে। কী গেরোয় যে ছেলেটা পড়ল, কেন যে গুণ্ডাকে জাপটে ধরতে গেল।”

পঞ্চানন রাগ চেপে গম্ভীর স্বরে বললেন, ”তুই কি বলতে চাস পূর্ণেন্দু অন্যায় কাজ করেছে?”

বাবার গলার স্বরে থতমত হরিসাধন বললেন, ”অন্যায় করেছে বলছি না, তবে এখন যা সময় পড়েছে তাতে—।”

”তাতে কী?”

”গুণ্ডা বদমাশদের না ঘাঁটানোই ভাল।”

”চোখের সামনে খুন করতে দেখলেও মুখ ঘুরিয়ে থাকবে, খুনিকে ধরার চেষ্টা করবে না। তুই একজন শিক্ষক হয়ে এই কথা বলছিস!”

বাবার ধমক খেয়ে তখন হরিসাধন মুখ নামিয়ে মৃদু স্বরে বললেন, ”চেষ্টা করে কী লাভ হল, এখন তো নিজেই বাড়ি থেকে বেরোতে পারছে না। ওরা তো বাড়িতে এসেও মেরে ফেলতে পারে, যা দিনকাল।”

দিলু এইবার কথা বলল, ”ইসস মারা যেন খুব সোজা, আমি আর দাদু কাল থেকে বন্দুক নিয়ে দুপুরে ওদের বাড়িতে বসে পাহারা দোব, আসুক না গুণ্ডারা, দেখা যাবে।”

হরিসাধন অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকালেন। পঞ্চানন বললেন, ”দুপুরে পাড়ার ছেলে—ছোকরারা থাকে না, ঠিক করেছি ওই সময়টায় বন্দুক নিয়ে পাহারা দোব পুর্ণেন্দকে।”

”বাবা, গুণ্ডা বদমাশদের কাছে সকাল দুপুর বিকেল রাত বলে কোনও সময় নেই। যখন ইচ্ছে তখন, যেখানে ইচ্ছে সেখানে ওরা খুন করে গটগটিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। কাগজ খুললেই রোজ একটা দুটো এমন ঘটনার খবর তুমি দেখতে পাবে। পাহারা দেবে দাও সেইসঙ্গে একটা চোঙাও হাতে রেখো, মুখে দিয়ে চেঁচিয়ে লোক জড়ো করতে হবে তো।”

হরিসাধনের পরিহাসটা গায়ে না মেখে পঞ্চানন নাতির দিকে তাকিয়ে ভ্রূ নাচালেন। ভাবখানা এমন, দেখেছ কী বুদ্ধি! দিলু চোখ টিপে সায় দিল।

রাতে পঞ্চানন খুঁজেপেতে একটা বড় পেস্ট বোর্ডের টুকরো জোগাড় করলেন, পানের খিলি সাজার মতো গোল করে পাকিয়ে চারটে আলপিন দিয়ে আঁটলেন! চোঙাটার মুখের দিকটা সরু, অনেকটা তালপাতার ভেঁপুর মতো, তবে যথেষ্ট মোটা।

দিলু বলল, ”দাদু, একটা ট্রায়াল দিয়ে দেখব চোঙাটার ক্ষমতা কতটা!”

”কী ট্রায়াল দেবে?”

”এই ধরো চিৎকার করে বলব, ”ডাকাত ডাকাত, বাঁচান বাঁচান, ধরুন ধরুন’।”

আঁতকে উঠে পঞ্চানন বললেন, ”খবরদার, এত রাত্তিরে এই ট্রায়াল দিলে কী হবে জানো? পিলপিল করে পাড়ার লোক বেরিয়ে আসবে আর ভেলোটা সারারাত চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলে রাখবে।”

খাওয়াদাওয়া সেরে দুপুর বারোটা নাগাদ দিলু বন্দুক ঘাড়ে আর পঞ্চানন পেস্টবোর্ডের চোঙা হাতে নিয়ে পূর্ণেন্দুদের বাড়িতে হাজির হল।

বিভা তালা খুলে ওদের ভেতরে নিয়ে এলেন। ”মেসোমশাই আপনারা এসে যে কী ভরসা জোগালেন, পুনু তো আধমরা হয়ে রয়েছে। খালি বলছে, ‘আর কখনও এমন বোকামি করব না, মরে গেলেও করব না,’ আপনি ওকে একটু বুঝিয়ে বলুন তো।”

পঞ্চানন ভেতরে গেলেন, সঙ্গে দিলু। জানলাগুলো বন্ধ, ঘর অন্ধকার।

”পূর্ণেন্দু জানলাগুলো খোলো, দমবন্ধ হয়ে এমনিতেই যে মারা যাবে। ওরা যখন আসবে তখন বন্ধ করে দিও। ভয় কী, আমার সঙ্গে দিলু আছে, বন্দুক আছে, লোক ডাকার জন্য চোঙা আছে।”

পূর্ণেন্দু একটা জানলা খুলে দিয়ে ওদের দিকে তাকাল। একজনের বয়স পঁচাশি, অন্যজনের পনেরো, দেখে সে খুব ভরসা পেল বলে মনে হল না। বলল, ”বন্দুকে গুলি ভরা আছে তো?”

দিলু বলল, ”নিশ্চয় আছে, দেখবেন?” সে বন্দুকের ঘাড় মটকে দেখিয়ে দিল দুটো নলেই কার্ট্রিজ ভরা।

দেখে আশ্বস্ত হল পূর্ণেন্দু। এবার সে আর একটা জানলা খুলল। দিলু জানলার বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ল পেয়ারাগাছ, ওপরের ডালে ক্রিকেট বল সাইজের চার—পাঁচটা ডাঁসা ডাঁসা পেয়ারা। তার জিভে জল এসে গেল। সে ফিসফিস করে দাদুকে বলল, ”পেয়ারাগুলো দেখেছ দাদু, দারুণ না?”

পূর্ণেন্দু বলল, ”খেতে ইচ্ছে করছে? যাও পেড়ে খাও। নার্সারি থেকে চারা কিনে এনে বাবা লাগিয়েছিলেন, খুব মিষ্টি, বিচি নেই।”

দিলু ঘর থেকে বেরিয়ে গ্রিলের দরজা খুলে বাইরে থেকে হাত গলিয়ে হুড়কোটা লাগিয়ে দিল। বাঁ দিকে বাড়ির আড়ালে গাছটা। কাঠের গেট থেকে সেটা দেখা যায় না। ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জানলা দিয়ে পঞ্চানন বললেন, ”দাদু, পায়ের আঙুলটায় নজর রেখো, ধাক্কাটাক্কা যেন না লাগে।”

পেয়ারাগুলো মগডালের কাছাকাছি। কীভাবে ওখানে পৌঁছনো যায় সেটা ভাল করে দেখে নিয়ে নীচের একটা মোটা ডাল লাফিয়ে ধরে ঝুলে পড়ল দিলু। দুলতে দুলতে জিমন্যাস্টদের বার—এর ওপর শরীর তুলে নেওয়ার মতো সে নিজেকে তুলে নিল। তারপর এ—ডাল সে—ডাল করে পৌঁছে গেল পেয়ারাগুলোর কাছে। হাত বাড়িয়ে একটা ছিঁড়ে নিয়ে প্যান্টের পকেটে রেখে আর একটা ছিঁড়ল।

ঠিক সেই সময়ই রাস্তায় মোটরবাইকের শব্দ শোনা গেল। দিলু পাতার আড়াল থেকে দেখল জিনসের ফুলহাতা জ্যাকেট গায়ে, মাথায় লাল ক্রিকেট ক্যাপ, চোখে কালো কাচের চশমা পরা একটা মোটা লোক মোটরবাইক চালিয়ে কাঠের গেটের সামনে এসে থামল। বাইকের পেছনে বসে রোগাপটকা একটা ছেলে। পরনে বুশ শার্ট, হাতে একটা ছোট থলি। সে গেটের পাল্লা খুলে ভেতরে ঢুকল। দিলু নিঃশব্দে গাছ থেকে নামতে শুরু করল।

”পূর্ণেন্দু….অ্যাই পূর্ণেন্দু, বাড়ি আছিস।” ছেলেটা কর্কশ স্বরে চিৎকার করে উঠল। ”কদ্দিন ইঁদুরের মতো গর্তে লুকিয়ে থাকবি। বেরিয়ে আয় বাইরে, নইলে পেটো মেরে তোর খুপড়ি উড়িয়ে দোব, তোর বাড়িব সবক’টার লাশ ফেলব।”

ছেলেটা যখন এইসব বলছে দিলু তখন গাছ থেকে নেমে ঘরের দেওয়ালের গা ঘেঁষে এগোচ্ছে। ঘরের জানলাটা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। দেওয়ালের কিনারে এসে খুব সন্তর্পণে একটা চোখ বের করে দেখল ছেলেটা ডান হাত তুলে দাঁড়িয়ে, হাতে ধরা বলের মতো গোল একটা বোমা যাকে পেটো বলে।

দিলুর হাতে পেয়ারা। আপনা থেকেই তার মুঠো শক্ত করে চেপে ধরল সেটা। সেই সময় ঘরের থেকে বেরিয়ে এলেন পঞ্চানন, হাতে বন্দুক।

”কী চাই, কী চাই? ভাগো এখান থেকে, গুণ্ডামি করার আর জায়গা পাওনি। গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দোব।”

দিলু এক চোখ দিয়ে দেখল ছেলেটা দাঁত বের করে হাসছে।

”ওরে বুড়ো ব্যাটা, বন্দুক হাতে খুব রোয়াব দেখছি। ওসব বন্দুক ফন্দুক অনেক দেখা আছে।”

এর পরই প্রচণ্ড একটা শব্দ আর ধোঁয়া। মুহূর্তে দিলুর মাথার মধ্যে লক্ষ ভোল্টের বিদ্যুতের ছোঁয়া লাগল, ঝলসে উঠল বলাইদার কথাগুলো—এর পরই ঘটল সেই মিরাকল, ক্লাইন হলের প্রথম বলটা লেগের দিকে ঠেলে দিয়েই ছুটল। বারো গজ দুর থেকে সলোমন ছোঁ মেরে বলটা তুলে নিয়েই ছুড়ল। ধীরে সুস্থে টিপ করে ছোড়ার সময় ছিল না। মাত্র একটা স্ট্যাম্প ছাড়া আর কিছু—দিলু দেওয়ালের আড়াল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল। টিপ করে ধীরেসুস্থে ছোড়ার সময় নেই। সে পেয়ারাটা ক্রিকেট বল ছোড়ার মতো ছুড়ল ছেলেটার মাথা লক্ষ্য করে।

”বাপস”, মাত্র একটা শব্দ করেই ছেলেটা গাছের কাটা ডালের মতো পড়ে গেল। পেয়ারাটা তার বাঁ কানের পাশে রগে লেগেছে।

মোটরবাইকের এঞ্জিন বন্ধ না করে লোকটা সিটে বসে ছিল। ছেলেটাকে পড়ে যেতে দেখে এঞ্জিন বন্ধ করে বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে এল। দিলু এবার পকেট থেকে দ্বিতীয় পেয়ারাটা বের করল। লোকটা তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে মুখের সামনে হাত তোলার আগেই পেয়ারাটা বের করল। লোকটা তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে মুখের সামনে হাত তোলার আগেই পেয়ারাটা দুই চোখের মাঝে নাকে গিয়ে লাগল।

ক্যাপটা মাথা থেকে উড়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল টাক। চশমাটা দু’ টুকরো। নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। লোকটা রীতিমত শক্তসমর্থ, অন্য কেউ হলে মুখ চেপে বসে পড়ত, তা না করে সে ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে এসে মোটরবাইকে উঠে স্টার্ট দিল।

দিলুও তাড়া করে গেট দিয়ে বেরিয়ে এল। বেরোবার মুখে ছোঁ মেরে জমি থেকে পেয়ারাটা কুড়িয়ে নিয়েছিল। বাইকটা বারো—চোদ্দো মিটার এগিয়ে গেছে, দিলু তখন মাথা লক্ষ্য করে পেয়ারাটা ছুড়ল। টাকের ধারে লেগে পেয়ারাটা ছিটকে গেল। লোকটা মাথা নিচু করে নিয়ে উধাও হয়ে গেল প্রচণ্ড স্পিড তুলে।

বোমাটা গ্রিলের লোহায় লেগে ফেটেছে। বন্দুক হাতে মেঝেয় উপুড় হয়ে থাকা পঞ্চানন অক্ষত এবং হতভম্ব, কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এমন একটা মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হবে এবং বেঁচে যাবেন সেটা স্বপ্নেও ভাবা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

”বাঁচান বাঁচান, খুন করে ফেলল….ছুটে আসুন, ডাকাত পড়েছে।” পূর্ণেন্দু ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে যাচ্ছে। চোঙাটা হাতে ঝুলছে।

”মুখে চোঙাটা লাগিয়ে চেঁচাও।” পঞ্চানন ধমকে উঠলেন।

পূর্ণেন্দুর চিৎকারে নয়, বোমার শব্দেই আশপাশ থেকে কয়েকজন ছুটে এল। তারা এসে দেখল একটা ছেলে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে, পাশে একটি থলি, বন্দুক হাতে পঞ্চানন, চোঙা হাতে পূর্ণেন্দু আর ঝাঁকড়া চুলের কৃষ্ণবর্ণের একটি কিশোর শান্ত চোখে একটা পেয়ারা নিয়ে লোফালুফি করছে।

একজন উত্তেজিত হয়ে বলল, ”গুলি করেছেন জ্যাঠামশাই, গুলি। কোথায় মেরেছেন, পেটে না মাথায়?”

পঞ্চানন অবাক হয়ে বললেন, ”গুলি করব কী, হতভাগাটা কি আমাকে টাইম দিল। ভাগ্যিস গ্রিলে লেগে ফেটে গেল, যদি ফোকর দিয়ে গলে ভেতরে এসে ফাটত, তা হলে,” পঞ্চানন শিউরে উঠে যোগ করলেন, ”বোমাটা ছোড়ার জন্য হাতটা তুলেছে দেখেই আমি তো মেঝেয় শুয়ে পড়েছিলুম মাথায় হাত চেপে।”

” তা হলে ডাকাতটা এভাবে পড়ে আছে কেন। দেখুন তো প্রণববাবু ওর কী হয়েছে।” লুঙ্গির কষি আঁটতে আঁটতে এক প্রৌঢ় বললেন।

”আমি কেন, আপনিই দেখুন না। আমাকে এখুনি কলেজে যেতে হবে।” বলতে বলতে প্রণববাবু পিছু হটে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

”এখন ওঁর পড়াতে যাওয়ার কথা মনে পড়ে গেল।” লুঙ্গি পরা প্রৌঢ় বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে গুণ্ডাটাকে চিত করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললেন, ”কই কোথাও তো রক্তটক্ত দেখছি না। তবে কপালের বাঁ দিকটা রক্ত জমে ফুলে রয়েছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা দিয়ে মারা হয়েছে। কিন্তু মারল কে?”

ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলল, ”এখন এটাকে নিয়ে কী করা হবে। অজ্ঞান অবস্থায় গণপ্রহার করা মনে হয় উচিত হবে না, বরং থানায় ফোন করে খবর দিন আর দেখুন ওর সঙ্গের কেউ আশেপাশে ঘাপটি মেরে আছে কিনা। মনে হচ্ছে ল্যাংড়া ভোলার দলের ছেলে।”

পূর্ণেন্দু বলল, ”একটা মোটরবাইক আসার শব্দ পেয়েছি, সেটা চলে যাওয়ার শব্দও শুনেছি।”

কয়েকজন রাস্তায় এসে এধার ওধার তাকিয়ে ফিরে এসে জানাল, রাস্তায় অচেনা কাউকে দেখা গেল না। আবার গুঞ্জন শুরু হল—তা হলে মারল কে? কী দিয়ে মারা হয়েছে?

একজন থলিটা তুলে ভেতরে দেখে বলল, ”আরে, দুটো বোমা এখনও রয়েছে এর মধ্যে।”

পঞ্চানন আঁতকে উঠে ব্যস্ত হয়ে বললেন, ”রেখে দাও, রেখে দাও, পূর্ণেন্দুকে যে খুন করার জন্যই এসেছিল ওটা তার প্রমাণ, নাড়ানাড়ি কোরো না।”

দিলু পেয়ারাটা প্যান্টে ঘষে পরিষ্কার করে নিয়ে চিবোতে শুরু করল। যেমন মিষ্টি তেমনই নরম। এখানকার কেউ তাকে চেনে না, তার দিকে কেউ তাকাচ্ছেও না। লোকজনের কথাবার্তা সে শুনছে আর মনে মনে হাসছে।

পূর্ণেন্দুকে আশ্বস্ত করে পঞ্চানন বললেন, ”আর কেউ তোমাকে মারার জন্য এ—তল্লাটের ধারেকাছেও আসবে না। হাতের বন্দুক হাতেই রয়ে গেল অথচ দ্যাখো ধরাশায়ী।” আঙুল দিয়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা গুন্ডাটাকে দেখালেন। এর পর দিলুর দিকে ফিরে বললেন, ”দাদু, তুমি তো তখন বাইরে ছিলে, কে ওকে মারল দেখেছ কি?”

দিলু তখন পেয়ারাটায় শেষ কামড় দিচ্ছে, অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ”আমি! দেখব কী করে, তখন তো আমি পেয়ারা গাছের ওপরে। বাব্বা, ওই সময় কেউ গাছ থেকে নামে? তবে দাদু তখন মনে হল, জাদুকর ম্যানড্রেকের মতো কালো কোট পরা মাথায় কালো টুপি একজন যেন চোখের পলকে এই পাঁচিলের ওপর দিয়ে হুসস করে লাফিয়ে বেরিয়ে গেল, সত্যি—সত্যি ম্যানড্রেক হলে তো মিরাকল!”

শুনে একজন বলল, ”দুধঘাটে ম্যানড্রেক! জেঠু আপনার নাতির কল্পনাশক্তির তারিফ করতেই হবে!”

দিলুর তখন বলতে ইচ্ছে করল, ‘আমিই মিরাকলটা ঘটিয়েছি।’ কিন্তু বাহাদুরি নেওয়া তার স্বভাবে নেই তাই বলতে পারল না। তা ছাড়া যদি প্রমাণ চায়! প্রমাণ তো সে খেয়ে ফেলেছে। কেউ তাকে পেয়ারা ছুড়তে দেখেনি, এই ব্যাপারে সে স্থিরনিশ্চিত। কিন্তু দিলু জানে মোটরবাইকে চড়া টেকো গুন্ডা, ল্যাংড়া ভোলা, তা দেখেছে।

.

কীভাবে যেন রটে গেল পূর্ণেন্দুকে রক্ষা করতে দৈবীশক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল। ল্যাংড়া ভোলার দলের বোমা ছোড়ার ওস্তাদ ডেয়ারডেভিল ছেলে শান্টু বোমা ছুড়েই অজ্ঞান হয়ে হয়ে। জ্ঞান ফেরে দুধঘাট থানায়। সে জানায়, কী একটা শূন্য থেকে তার রগে প্রচণ্ড ঘা দিল, তারপর আর কিছু তার মনে নেই। পূর্ণেন্দু, পঞ্চানন বা বাড়ির লোকেরা এবং যারা ছুটে এসেছিল তারা কেউই দেখেনি শান্টুর রগে কে, কী দিয়ে মারল। সবারই একই জিজ্ঞাসা, তা হলে কি ভূতে এসে মারল। না কি হেডমাস্টারের কলকাতা থেকে আসা ভাগ্নে যা বলল, জাদুকর ম্যানড্রেকের মতো পোশাক পরা একটা লোককে পাঁচিল ডিঙিয়ে পালাতে দেখল, সেটাই ঠিক?

গবেষণা হল লালুর মুদির দোকানে : ”পূর্ণেন্দুর মা রেগুলার রাধাগোবিন্দর মন্দিরে প্রণাম করতে যান, রেগুলার বাড়িতে সত্যনারায়ণের পুজো দেন। ও বাড়ি ঘিরে আছে দেবতার রক্ষাকবচ, ল্যাংড়া ভোলাফোলার ক্ষমতা কি ওখানে ট্যাঁফোঁ করে? গোবিন্দজি নিজে থাপ্পড় মেরেছেন শান্টুকে, ব্যাটা ভাগ্যবান।”

আলোচনা হল দশরথ হেয়ার কাটিং সেলুনে: ”আমার বউ বলল, উঠোনে যখন কাপড় শুকোতে দিচ্ছে তখন বিশাল একটা চাকতির মতো কী যেন নিঃশব্দে উড়ে গেল পূর্ণেন্দুর বাড়ির দিকে খুব নিচু দিয়ে, আর তাই থেকে লাঠির মতো সবুজ একটা আলো হঠাৎ একবার বেরোল। বউ নিজের চক্ষে দেখল আলোর লাঠিটা আধ সেকেন্ড জ্বলেই নিভে গেল। লোকে বলে এসব গাঁজাখুরি গপ্পো, আরে বাবা, আমার বউ তো গাঁজা খায় না, খবরের কাগজও পড়ে না, তা হলে সে কী করে বলল ফ্লাইং সসার উড়ে যেতে দেখেছে? লেসার বিম দিয়ে শান্টুকে যে হিট করেছে মঙ্গল গ্রহের ইউ ফো তাতে কোনও সন্দেহ নেই।”

শান্টুর অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার পেছনে কী রহস্য রয়েছে তাই নিয়ে যখন দুধঘাটে নানারকম গালগল্প চলছে তখন বাইগাছি স্টেশনে এক সকালে বোমা, পাইপগান, লোহার রড আর ভোজালি নিয়ে ঘণ্টাদুয়েক ধরে যুদ্ধ হয়ে গেল ল্যাংড়া ভোলার দলের সঙ্গে বাপির দলের। ভোলার দলের ‘খুনি’ দুটি ছেলে মারা গেল এবং তাকে তল্লাট ছেড়ে পালাতে হল, যদিও তার বাড়ি বাইগাছিতেই। পালাবার আগে সে বলে গেছে, ”শিগগিরি ফিরে আসছি, দেখে নেব বাপিকে।” এখন বাইগাছি স্টেশন রোডের ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের থেকে মাসিক তোলা আদায় করে শুধু বাপির গুন্ডারা, বাপি এখন সাইকেল ও ভ্যানরিকশা ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট।

পূর্ণেন্দু এখন নিশ্চিন্তে অফিস যাচ্ছে। দুধঘাট স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে, বাসু কিন্তু নিয়মিত সকালে আসে বাড়িতে কষা অঙ্ক পঞ্চাননকে দেখাতে এবং নতুন অঙ্ক শিখে নিতে। দিলুর পায়ের নখ ঢাকা ব্যান্ড—এডটা খোলা হয়েছে, নতুন নখ গজাচ্ছে। পঞ্চাননকে সে বলল, ”দাদু এখন তো সাঁতারটা শিখে নেওয়া যায়।”

তার নখ পরীক্ষা করে পঞ্চানন জানালেন, কাল থেকে বাসুর ট্রেনিংয়ে সে সাঁতার শিখবে। পরদিন দিলু জীবনে প্রথম কোনও জলাশয়ে নামল। বাড়িতে বরাবর শাওয়ারে স্নান করেছে। এক পা এক পা করে সিঁড়ির ধাপ মাড়িয়ে কোমর জল পর্যন্ত গিয়ে পিছু ফিরে ঘাটের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা দাদুর দিকে সে তাকাল।

পঞ্চানন চে�চিয়ে বললেন, ”জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার। আরও নামো, বাসু ওকে একটু ঠেলে দে তো।”

বাসু তার পাশেই কোমর জলে। দিলু বাধা দেওয়ার আগেই সে মুচকি হেসে তার পিঠে একটা ছোট্ট ঠেলা দিল। টলমল করতে করতে দিলু জলে পড়ে গেল। দাঁড়াবার চেষ্টা করে পায়ের তলায় ঠাঁই পেল বটে কিন্তু তখন মাথার ওপরে চার আঙুল জল। আঁকুপাকু করে মাথাটা তুলে ”হাফফ হাফফ” শব্দ মুখ দিয়ে বের করে আবার সে জলের নীচে নেমে গেল। এইভাবে পাঁচবার ওঠানামা করার পর পঞ্চানন হাঁক দিলেন, ”বাসু তোল।”

বাসু জলে নেমে দিলুর পেছনে গিয়ে পিঠে ঠেলা দিল। পায়ের নীচে সে সিঁড়ি পেল। হাত বাড়িয়ে দিলুকে টেনে কোমর জলে দাঁড় করাল। থমথমে রাগী মুখে দিলু সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে পঞ্চাননকে বলল, ”এটা কী হল দাদু, আমাকে নাকানি চোবানি করে জল খাওয়ালে।”

উৎসাহ ভরে পঞ্চানন বললেন ”তুমি তো সাঁতারের অর্ধেক শিখে ফেললে। জলের সঙ্গে পরিচয় তো হয়ে গেল, এবার ভাব জমাও। যাও যাও, আবার নামো।”

”না।” মুখগোঁজ করে দিলু বসে পড়ল।

”ক্রিকেট বল কখনও পায়ে হাতে মাথায় লেগেছে?” পঞ্চানন জানতে চাইলেন।

”অনেকবার।”

”সেজন্য তুমি কি ক্রিকেট খেলা বন্ধ করে দিয়েছ?”

দিলু কয়েক সেকেন্ড সময় নিল দাদু কী বলছে চাইছেন সেটা বুঝে নিতে। তারপরই উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। বাসু হাত বাড়িয়ে দিল।

”হাত—পা ছুড়ে যেমন—তেমন করে হোক ঘাটের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করো। আমি পাশে পাশে থাকব। ভয়ের কী আছে।” বাসু শান্ত গলায় ভরসা দিল।

ঘাটের শেষধাপ থেকে হাত দশেক দূরে বাসু তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল, ”যাও এবার।”

ভয়ে দিলুর বুকের মধ্যেটা হিম হয়ে রইল তিন—চার সেকেন্ড। ডুবে যাব, ডুবে যাব। বাঁচতে হবে, আমাকে বাঁচতে হবে। দিলুর বুকের মধ্যে কে যেন চিৎকার করে উঠে বলল, ”চেষ্টা করো দিলু, বাঁচার চেষ্টা করো।’

হাত—পা ছুড়ে সে ঘাটের দিকে নিজেকে টেনে নিয়ে গিয়ে বুকজলে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে সাফল্যের আনন্দে হাসিতে মুখ ভরিয়ে ফেলল।

”শাবাশ দাদু, শাবাশ।” দিলু মুখ তুলে পঞ্চাননকে বুড়ো আঙুল দেখাল।

”আর একবার হবে নাকি?” বাসু জলের মধ্যে দশ হাত দূরেই রয়েছে। সেখান থেকেই দিলুকে ডাক দিল।

”হবে। তুমি ওখানেই থাকো, আমি তোমার কাছে যাব।” চেষ্টা করে দশহাত যেতে পেরেছে, উত্তেজনা আর উৎসাহে এখন সে টগবগ করে ফুটছে। দিলু দু’হাত ছুড়তে ছুড়তে জল ঠেলে এগিয়ে গেল বাসুর দিকে। বাসু তিন—চার হাত পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়সাঁতার কেটে অপেক্ষা করছে। হাঁসফাঁস করতে করতে দিলু বাসুর কাছে পৌঁছেই প্রাণপণে তার গলা জড়িয়ে ধরল।

”আরে ছাড়ো ছাড়ো, এভাবে ধরলে ডুবে যাব যে। পেছন দিকে এসে আমার কাঁধ ধরে একটু জিরিয়ে নাও, তারপর আবার যাবে।” বাসু যথারীতি শান্ত অনুত্তেজিত স্বরে বলল, ”জোরে আঁকড়ে ধরবে না, তা হলে দু’জনেই ডুবব।”

দিলু ঘাটে ফিরল। তবে সাঁতরে নয়, বাসুর পিঠে চড়ে। দু’হাত দিয়ে দু’পাশে জল সরিয়ে সরিয়ে বাসু এগিয়ে চলল। দিলু আলতো করে তার দুটো কাঁধ শুধু ধরে রইল। তাকে ঘাটে পৌঁছে দিয়ে বাসু আপন খুশিতে সাঁতার কেটে পুকুরের অপর প্রান্তে প্রায় পঞ্চাশ মিটার চলে গেল।

”দাদু, আমি কবে ওপারে যেতে পারব?” দিলু উন্মুখ আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করল।

”আজ তো সবে হাতেখড়ি হল। অ আ হস্যই দিঘ্যির ওপর দাগা বুলোও কিছুদিন। অধৈর্য হলে চলে?”

দাগা বুলোতে হলে তো মামার বাড়িতে বেশ কিছুদিন থেকে যেতে হবে। সাঁতার শেখার এমন সুযোগ ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় ফেরা যায় না। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর আগে পুকুরের ওপারে যাবে এমন একটা প্রতিজ্ঞা মনে মনে করে ফেলল। ক্লাস নাইনে পৌঁছনোর থেকেও তার কাছে এখন পুকুরের ওপারটাই একমাত্র লক্ষ্য। তা ছাড়া মাছ ধরাটা, বিশেষ করে হুইল ছিপ দিয়ে বড় বড় রুই—কাতলা খেলিয়ে খেলিয়ে তোলা, দাদু বলেছেন টেস্ট ম্যাচে ছক্কা মারার মতো ব্যাপার। দু—তিনটে ছক্কা না মেরে কি দুধঘাট থেকে যাওয়া যায়!

তা ছাড়া নারকেল গাছে ওঠা, গাছ থেকে পুকুরে ঝাঁপ। এই মজাটা সে কলকাতায় কোথায় পাবে। কলকাতার ছেলেকে ডাউন দেওয়ার জন্য বাসুর বাহাদুরি দেখানোর জবাব দিয়ে যেতে হবে। দিলু মনে মনে বলল, দাঁড়াও। সাঁতার আর গাছে চড়াটা শিখে নি। দাদু তো হাতে করে শেখাবেন না, শেখাবে বাসু। ছেলেটা সত্যিই ভাল, সবসময় হাসে, ওর নাম হওয়া উচিত ছিল হাসু। ওর একটাই দোষ, বড্ড বেশি বই পড়ে, অঙ্ক কষে। দাদু বলেছিল গরিবের ছেলে, মানুষ হয়ে উঠতে হলে তো পড়াশুনো করতেই হবে। কিন্তু বাসু তো মানুষই, তা হলে মানুষ হয়ে ওঠাটা আবার কী জিনিস? দিলু কিছুক্ষণ ভেবে ধাঁধাটার উত্তর বের করতে পারেনি।

বাসু প্রতিদিন সকালে ছোট হুড়া থেকে দু’ মাইল হেঁটে এসে পঞ্চাননের কাছে পড়তে বসে এবং প্রতিদিনই দিলু ঘুম ভেঙে বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। বাইরে দালানে বেরোলেই তো দেখতে হবে দাদু বাসুকে হয় ব্যাকরণ ধরছেন নয়তো রচনা লেখা শেখাচ্ছেন। আর তাকে দেখলেই বলবেন, ‘এই যে দাদু ঘুম ভাঙল’—শুনতে এত খারাপ লাগে। তার চেয়ে বরং যদি বলেন, ‘আজ উঠতে দেরি করে ফেলেছ। যাও চট করে মুখ ধুয়ে এসে পড়তে বসে যাও’—এইরকম কিছু বললে বাসুর সামনে লজ্জায় পড়তে হয় না। কিন্তু পড়ার জন্য দাদু আজ পর্যন্ত একটা কথাও বলেননি। অবশ্য পরীক্ষার পর মামার বাড়ি এসে কেউ লেখাপড়া করতে বসেছে বলে সে শোনেনি। ‘মামার বাড়ি ভারী মজা কিল চড় নাই’ কথাটা তা হলে তৈরি হয়েছে কী জন্য!

একদিন সাঁতার কেটে উঠে বাসু বলল, ”তুমি দাবা খেলতে পারো?”

দিলু বলল, ”না। তাস দাবা পাশা, তিন কর্মনাশা। যেসব খেলা বসে বসে খেলতে হয় তা আমার ভাল লাগে না।”

”বসে ধৈর্য ধরে খেলতে হয় বলে তোমার ভাল লাগে না কিন্তু কর্মনাশা বলছ কেন? পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ লোক দাবা খেলছে, তাদের কি কর্মনাশ হচ্ছে? ঠাণ্ডা মাথায় হিসেব কষে যুক্তি দিয়ে দাবা খেলায় জিততে হয়। লুডো কি পাশার মতো এতে ভাগ্যের হাত নেই। সেইজন্যই তো দাদু আমাকে দাবা খেলা শিখিয়ে দিয়েছেন, যাতে ব্রেনের কাজ করার ক্ষমতা বাড়ে। দুধঘাটে তো দাবা কম্পিটিশন হয়, দাদু তিনবার জিতেছেন, কাপ পেয়েছেন, তুমি জানো না?” বাসু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

দাদুর এহেন গুণপনার কথা না জানার জন্য দিলু অপ্রতিভ বোধ করল কিন্তু মুখভাবে তা ফোটাল না। বলল, ”কতদিন আগে কাপ জিতেছেন? কই ঘরে তো কোনও কাপটাপ দেখিনি!”

”বছর দশেক আগে শেষ জিতেছেন। লোকজনকে দেখাবার জন্য কাপ মেডেল সাজিয়ে রাখা, সার্টিফিকেট বাঁধিয়ে রাখা দাদু একদম পছন্দ করেন না। বলেন, বিশ্ব কি ভারত চ্যাম্পিয়ান হওয়া তো নয়, দুধঘাট চ্যাম্পিয়ান। এ আর লোককে দেখাব কী! কাপগুলো আলমারির মাথায় পড়ে থেকে থেকে ধুলো জমছিল, মামি সেগুলো ঝেড়েমুছে নিজের ঘরে আলমারিতে সাজিয়ে রেখেছেন, তুমি দেখে এসো।”

দিলু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে নিচু স্বরে বলল, ”ধৈর্য আমার সত্যিই কম। ক্রিজে গিয়েই দুমদাম ব্যাট চালাই, লাগে তুক না লাগে তাক। আমার হায়েস্ট কত জানো—আট বলে পঁয়ত্রিশ তাতে পাঁচটা সিক্সার, একটা ফোর একটা সিঙ্গল। আমাকে নেয় শুধু ফিল্ডিংয়ের জন্য।”

”শুধু ফিল্ডিং দিয়ে কতদিন আর চান্স পাবে, সেইসঙ্গে ব্যাটিং বা বোলিংয়ের একটা তো চাই।”

দিলু মাথা নাড়ল ম্লান হেসে।

”তুমি কখন দাবা খেলো, কার সঙ্গে?”

”রোজ খেলি না, পড়তে পড়তে যখন মাথা ভার হয়ে যায় একঘেয়ে লাগে তখন বিশালাক্ষী মন্দিরে গিয়ে ওখানকার পুরুতমশাই গোবিন্দ ঠাকুরের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক খেলি। উনি খুব ভাল খেলেন, একবারও ওঁকে হারাতে পারিনি।”

”আচ্ছা বাসু, আর কতদিনে পারব ওপারে যেতে। কলকাতায় ফেরার আগেই পুকুর পার হতে চাই।” দিলু উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করল উত্তরের জন্য।

বিব্রত মুখে বাসু বলল, ”তোমার দেখছি তর সইছে না। শ্বাস নেওয়া আর ছাড়াটা এখনও ঠিক হয়নি। মাঝপুকুরে দম ফুরিয়ে গেলে বিপদে পড়বে।”

”তুমি তো আমার পাশে পাশে থাকবে।”

রাত্রে অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে দিলু চাপাস্বরে বলল, ”দাদু দাবা খেলাটা শিখিয়ে দেবে?”

”তোমায় কে বলল আমি দাবা খেলতে জানি!”

”বাসু। ও তোমার কাছে শিখেছে বলল।”

”দাবার বোর্ড আর ঘুঁটি বাসুকে দিয়ে দিয়েছি। কাল বাইগাছি বাজার থেকে কিনে এনে দেবে। ওখানে স্পোর্টস কর্নার নামে দোকানটায় পাওয়া যাবে। হঠাৎ দাবা শেখার ইচ্ছা হল যে?”

”আমার ধৈর্য কম সেটা তো বন্দুক ছোড়া দেখেই বুঝেছ। টিপ করার জন্য সময় না দিয়েই ফায়ার করেছি।”

”আর তাতেই এঁচোড় পড়ে গেল। আমার কী মনে হয় জানো দাদু, তুমি যদি সময় নিয়ে টিপ করে গুলিটা ছুড়তে তা হলে এঁচোড়টা গাছেই থেকে যেত। ধৈর্য কম বলে নয়, এটাকে তোমার গুণই বলো আর দোষই বলো তুমি জন্মগতভাবে পেয়েছ। বাসু খুব ব্রিলিয়ান্ট নয় কিন্তু খুব পরিশ্রমী, ও ভাল রেজাল্ট করে খাটুনির জোরে। যতটুকু ট্যালেন্ট আছে সেটাকে ও ডিসিপ্লিন দিয়ে গুছিয়ে নিয়ে কাজে প্রয়োগ করে এটা ও জন্মগতভাবে পেয়েছে।” পঞ্চানন এই পর্যন্ত বলে চুপ করলেন। কথাগুলো দিলু বুঝতে পারল বলে তার মনে হল না। প্রসঙ্গ বদল করে তিনি বললেন, ”দাবা খেলা শিখতে চাও কি ধৈর্য বাড়াবার জন্য?”

”হ্যাঁ, ব্যাটিংয়ের জন্য।”

”সুনীল গাওস্কর ছশো মিনিট আটশো মিনিট ব্যাট করত কি দাবা খেলে?” পঞ্চানন গম্ভীর স্বরে কথাটা বলে নিঃশব্দে হাসতে শুরু করলেন, অন্ধকারে দিলু তা দেখতে পেল না।

”জানি না দাবা খেলত কি না।”

”যতদূর জানি ক্রিকেট ছাড়া গাওস্কর আর কোনও খেলা খেলত না। যদি ব্যাটিংয়ে উন্নতি করতে চাও তা হলে মনপ্রাণ ঢেলে ব্যাটটাই করে যাও। দাবা খেলাটা শেখো, খেলো, এটা মাথার খেলা, ক্ষতিকর নয়। দাবাতে শুধু বুদ্ধির লড়াই হয় না এতে যুক্তি আর বিচারক্ষমতাও বাড়ে।”

”তা হলে কর্মনাশা বলে কেন?”

”যারা খেলাটা জানে না তারাই বলে। আসলে বহু বছর আগে যেসব লোকের কাজকম্মো ছিল না, কাজ করার দরকার হত না, তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে দাবা খেলে সময় কাটাত। এটা প্রায় একটা নেশার মতো। এই নিয়ে নানান গল্প আছে। একটা লোক দুপুরে বউকে ভাত বাড়তে বলে তেল মেখে গামছা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোল নদীতে গিয়ে চান করবে বলে। যাওয়ার পথে দেখল তার দুই পড়শি বাড়ির দাওয়ায় বসে দাবা খেলছে। দেখে লোকটা ওদের পাশে বসে পড়ল আর বাড়ি ফিরল পরদিন সকালে। এইবার বুঝলে তো দাবার নেশা কী মারাত্মক। ঘরসংসার, খিদে—তেষ্টা সব ভুলিয়ে দেয়।”

”ওরে বাবা, না দাদু, দাবা খেলা আমার দ্বারা হবে না। মাথার খেলা মাথাতেই থাকুক, তুমি অন্য কোনও খেলার কথা বলো যাতে আমার সময় কাটে। বড্ড একঘেয়ে লাগছে। পুঁটিমাছ কতক্ষণ ধরব বলো তো, আর সাঁতার তো সারাদিন ধরে কাটা যায় না।”

”বাসুকে বলব তোমাকে স্কুলের মাঠে নিয়ে যেতে। পরীক্ষা শেষ, এখন ছেলেরা খেলতে নেমে পড়েছে, ফুটবল ক্রিকেট ভলি কবাডি সব পাবে।”

পরদিন বাসুর সঙ্গে দিলু সাঁতার কেটে মাঝপুকুর পর্যন্ত গেছে, তখন বাসু বলল, ”এবার ফেরো, আজ এই পর্যন্ত।” দু’জনে যখন ঘাটের কাছাকাছি তখন হর্ষ হন্তদন্ত হয়ে ঘাটে এসে চেঁচিয়ে বলল, ”অ বাসু তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখ তো বিন্দুপিসির বাড়ির পেছনের বিশ্বাসদের শিমুল গাছটা কারা যেন কেটে ফেলছে। বুড়ি মানুষ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিল।”

বাসু ঝটপট হাত চালিয়ে ঘাটে পৌঁছল। হর্ষ তখনও বলে চলেছে, ”গাছটা নাকি ওরা বিক্রি করে দিয়েছে। আহা পঞ্চাশ—ষাট বছরের কতবড় গাছ, টাকার লোভে বিক্রি করে দিল! তুই দৌড়ে গিয়ে বিশ্বাসদের মেজো কত্তাকে গাছকাটা বন্ধ করতে বল।”

বাসু শুকনো প্যান্ট শার্ট পরে নিয়েই ছুটল বাড়ির দিকে। হর্ষ ছলছল চোখে বলল, ”লাল টকটকে ফুল মাটিতে পড়ে থাকত, ফুল কুড়োতুম, তুলো বের করে জমিয়ে জমিয়ে পুতুলের বালিশ—বিছানা করতুম, ও গাছ কি আজকের, জম্মো থেকে দেখছি।”

হর্ষর মুখের দিকে তাকিয়ে দিলুর মনে হল বাল্যসঙ্গী শিমুল গাছটার অপমৃত্যু ঘটছে শুনে খুবই আঘাত পেয়েছে। এখন তার মনে পড়ল খবরের কাগজে মাসছয়েক আগে একটা খবর বেরিয়েছিল, কলকাতায় একটা লোক তার বাড়ির সামনে রাস্তার একটা গাছের ডাল কাটিয়েছিল সেজন্য তার জরিমানা হয়। তাই নিয়ে বাবা আর দাদা বলাবলি করেছিল, অনুমতি ছাড়া গাছকাটা এখন বারণ। পরিবেশরক্ষার জন্য এই আইন করা হয়েছে। যদি কাটতেই হয় তা হলে সেখানে নতুন গাছের চারা লাগিয়ে কাটতে হবে।

দিলুর ইচ্ছে করল ছুটে গিয়ে আইনের কথাটা বিশ্বাসদের মেজো কর্তাকে বলে আসে। বাসুর সঙ্গেই তার ছুটে যাওয়া উচিত ছিল। বাসু কি জানে কাজটা বেআইনি। এতক্ষণে হয়তো গাছটা কেটে ফেলেছে।

আধঘণ্টার মধ্যে বাসু ফিরে এল। মুখ থমথমে। এক চোখে আগুন, অন্য চোখে জল।

”কী হল, গাছকাটা বন্ধ করেছে?” দিলু ব্যগ্রস্বরে জানতে চাইল।

”না, করল না। আমি বারণ করলুম, যে লোকটা গাছ কিনেছে সে আমাকে চড় মেরে বলল, ”তুই কে রে? যা ভাগ, পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গাছ কিনেছি, তোর কথায় কাটব না? দুটো লোক গাছে উঠে মোটা মোটা ডালগুলো দা দিয়ে কাটছিল। একজন নেমে এসে গলার কাছে দা ঠেকিয়ে বলল, ”মাথা নামিয়ে দোব যদি আর একটা কথা বলেছ।’ আমি তখন মেজো কত্তার খোঁজে গেলুম। ওঁর বাড়িতে বলল উনি কলকাতা গেছেন, আমি চলে এলুম।”

”গাছ কতটা কেটেছে?” দিলু উত্তেজিত স্বরে বলল, ”তোমার মাথা কেটে দেবে বলল, স্পর্ধা তো কম নয়!”

”বড় তিনটে ডাল কেটেছে, এখন বোধ হয় মাথাটা কাটছে। গাছের মালিক যদি গাছ বিক্রি করে দেয় আমরা কী করতে পারি।” হতাশ দেখাল বাসুকে।

”পুলিশ খবর দিতে পারি।”

”কোনও লাভ হবে না। পুলিশ ডায়রি নেবে না। নিলেও একটা পুলিশ আসবে চার ঘণ্টা পর, ততক্ষণে গাছ কাটা হয়ে যাবে। পুলিশের ওপর ভরসা নেই বলেই তো লোকেরা ডাকাত গুণ্ডা ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলে। তুমি কি জানো সেই লালু ছেলেটাকে, যাকে পুলিশ অজ্ঞান অবস্থায় পূর্ণেন্দুদার বাড়ি থেকে সেদিন নিয়ে গেল, সে এখন বাইগাছিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন সে ল্যাংড়া ভোলার দল ছেড়ে বাপির দলে। পুলিশকে বলে গাছ রক্ষা করতে পারবে না, করতে হলে নিজেদেরই করতে হবে।”

বাসুর কথা শুনতে শুনতে দিলু অবাক হল, ঘৃণায় রি রি করে উঠল তার মন। অবশেষে বলল, ”চলো তো একবার দেখি কী করা যায়। চড় মারা বের করছি।”

হুঁশিয়ার করে সুলেখা বললেন, ”কোনও গণ্ডগোল পাকিও না যেন। মুখে যা বলার ভালভাবে বলবে। মামা আসুক, যা করার তিনিই করবেন।”

হর্ষ বলল, ”গাছ কেটে ফেলার পর আর কী করার থাকবে বউদি? চল আমিও তোদের সঙ্গে যাব।”

তিনজনে মিলে রওনা হল ছোট হুড়ার দিকে, ছ’—সাত মিনিট হনহনিয়ে হাঁটার পর শুরু হল পাকা বাড়িগুলোর শেষ প্রান্ত। এবার দেখা যেতে লাগল বাঁশের দরমা আর খড়ের চালের বাড়ি। বড় রাস্তা থেকে দূরে বড় বড় গাছ আর তার আড়ালে গ্রামের আভাস। হর্ষ আর বাসু ডান দিকে গোরুর গাড়ি চলার মতো একটা ভাঙাচোরা রাস্তায় নামল। দিলু তাদের পেছনে। সে এধার—ওধার তাকিয়ে হর্ষ আর বাসুর অলক্ষ্যে ইটের দুটো টেনিস বল সাইজের টুকরো চট করে কুড়িয়ে পকেটে রাখল।

”ওই দেখো আমাদের ঘর আর ওই দেখো বিন্দুপিসির ঘর, ওর পেছনেই শিমুল গাছটা,” বাসু আঙুল তুলে দেখাল যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে একটা খালি গোরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে। কাছেই একটা খেজুর গাছে দুটো বলদ দড়ি দিয়ে বাঁধা। গাড়োয়ানকে দেখা গেল না। রাস্তাতেও লোকজন নেই। রাস্তার ধারের জলায় একটা ছোট মেয়ে কলমি শাক তুলছে।

বাসু বলল, ”গাড়িটা এনেছে কাটা গাছ নিয়ে যাওয়ার জন্য।”

ওরা আর একটু এগোল। এবার গাছটার ওপরের দিক স্পষ্ট দেখা গেল বিন্দুপিসির ঘরের চালের ওপর দিয়ে। খালি গায়ে লুঙ্গি গুটিয়ে নীচের ডালে দাঁড়িয়ে একটা লোক বড় দা দিয়ে ওপরের ডাল কোপাচ্ছে।

”তোমরা এগিয়ে গিয়ে কথা বলো, আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি। বাসু ওই লোকটাই কি তোমার গলায় দা ঠেকিয়েছিল?”

”হ্যাঁ। আর চড় মেরেছিল যে, সে নীচে দাঁড়িয়ে।”

হর্ষ আর বাসু এগিয়ে গেল। দিলুর থেকে গাছের লোকটা মিড অন থেকে স্ট্রাইকারের উইকেটের দূরত্বে। লোকটা মাথা নিচু করে নীচের দিকে তাকাল, বোধ হয় দু’জন নতুন লোককে দেখার জন্য। দিলু হর্ষমাসির তীক্ষ্ন গলার স্বর শুনতে পেল। কথা—কাটাকাটি শুরু হয়েছে। দিলু পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিন্দুর ঘরের চালের ওপর দিয়ে লোকটির মাথাটুকু দেখতে পাচ্ছে।

লোকটা দা হাতে নিয়েই মাটিতে পড়ল ”বাবা গো” বলে পাকা বেলের মতো। দিলু আর এক সেকেন্ড না দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে ছুটে গোরুর গাড়ির কাছে এসে একটা বলদের গলায় হাত বুলোতে শুরু করল। একটা হইচইয়ের শব্দ তার কানে আসছে। বলদটা আরামে চোখ বুজিয়ে ফেলল।

একটু পরেই দুটি লোক একজন অজ্ঞান রক্তাক্ত লোককে চ্যাংদোলা করে নিয়ে এল। লোকটার মাথায় বাঁধা গামছা, তাদের পেছনে হর্ষ এবং বাসু। বহনকারীদের একজন গাড়োয়ান। সে ব্যস্ত হয়ে বলদ দুটিকে গাড়িতে জুততে শুরু করল।

দিলু অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ”বাসু, হয়েছে কী?”

বাসু বলল, ”লোকটা গাছের ওপর ছিল, হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল।”

প্যান্ট আর বুশশার্ট পরা বেঁটে গোলগাল গড়নের মাঝবয়সী লোকটিকে দেখে দিলুর মনে হল এই বোধ হয় সে—ই, যে গাছটা কিনেছে এবং বাসুকে চড় মেরেছে। লোকটি চোখেমুখে উদ্বেগ, বিরক্তি, ভয় আর উত্তেজনা নিয়ে বলল, ”কী গেরোর ফেরে পড়লুম এখানে কোথায় ডাক্তার কোথায় ওষুধপত্তর, সেই বাইগাছি যেতে হবে। হাত—পা ভাঙলে তো হাসপাতাল ছাড়া গতি নেই। সেও সাত—আটমাইল, কত খরচ হবে কে জানে! দশ বছর ধরে অন্তত চারশো গাছ কেটেছে, একবারও পড়েনি আর আজই—ওরে যোতনে একটু তাড়াতাড়ি কর বাবা, মরেটরে গেলে বহু টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।”

হর্ষ বলল, ”পড়ে গেছে না অপদেবতায় ঠেলে ফেলে দিয়েছে। ও গাছে তেঁনার বাস আমার জন্মের আগে থেকে। তাঁকে বাসের ঘর থেকে উচ্ছেদ করলে তিনি সহ্য করবেন কেন।” দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে হর্ষ অবদেবতার উদ্দেশে প্রণাম জানাল।

”অপদেবতা!” লোকটি চমকে উঠল, ”তার মানে ভূত?”

”বেম্মদত্যি! সাদা ধুতি চাদর, এই মোটা পৈতে, পায়ে খড়ম। কতদিন রাতে খটমট আওয়াজ যে শুনেছি।”

”যোতনে তাড়াতাড়ি কর। ব্যাটাকে গাড়িতে তুলে শোয়া।” দু’জনে ধরাধরি করে আহত লোকটিকে তুলল। ”এই যাঃ, গাছ কাটার দা—টা তো ওখানেই পড়ে আছে, যোতনে দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আয় না বাবা।”

যতীন একগুঁয়ের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে বলল, ”আমি এখন গাছতলায় যেতে পারব না। আপনি গিয়ে নিয়ে আসুন।”

লোকটি কাঁচুমাচু মুখে বাসুকে বলল, ”খোকা তুমি যাবে আমার সঙ্গে?”

বাসু বলল, ”চলুন।”

ওরা দু’জন এগিয়ে যেতেই হর্ষ ফিসফিস করে দিলুকে বলল, ”কেমন ভয়টা দেখালুম বলো তো। ওই গাছটার ধারেকাছে জীবনে আর আসবে না।”

আহত লোকটার জ্ঞান ফিরে আসছে। উঁ উঁ শব্দ বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। যতীন ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল, ”কেমন আছিস রে বেচু, খুব যন্তাোন্না হচ্ছে?”

কোনওক্রমে বেচু বলল, ”কী হয়েছে আমার?”

যতীন বলল, ”কী আবার হবে, বেম্মদত্যির গাঁট্টা খেয়ে পড়ে গেছিস।”

.

বাড়ি থেকে দুধঘাট স্কুল এক মাইল। বাসুর সঙ্গে দিলু বিকেলে হাজির হল স্কুলের মাঠে। স্কুলের যে এতবড় ঘাসে ঢাকা মাঠ থাকতে পারে, দিলু তা ভাবতে পারে না। মাঠের মাঝখান থেকে তুলে পঞ্চাশ—ষাট মিটার বল মারলে ওভার বাউন্ডারি হবে। কলকাতায় তার স্কুলের কোনও খেলার জায়গা নেই, আছে একটা ছোট উঠোন। তাতে বড়জোর একটা বাস্কেটবল কোর্ট হতে পারে। তাকে খেলতে হয় পাড়ার পার্কে। সেখানে ঘাসের বালাই নেই, জমি এবড়োখেবড়ো। দুধঘাট স্কুলের মাঠ দেখে তার চোখ জুড়িয়ে গেল।

”বাসু, মাঠটা এত সুন্দর করে রেখেছে কী করে?” দিলু জিজ্ঞেস করল, ”মাঠের মালিক তো স্কুল নিশ্চয় অনেক টাকা খরচ করে।”

বাসু বলল, ”কত খরচ করে তা আমি জানি না, সেটা বলতে পারবেন তোমার মামা, হেডসার।”

মাঠের তিনধারে সার দেওয়া নারকেল আর সুপুরি গাছ, মামার বাড়ির পুকুরের ধারে যেমনটি, তবে এখানে গাছের সংখ্যা অনেক বেশি। চোখ বুলিয়ে দিলুর মনে হল, সব মিলিয়ে অন্তত একশো সুপুরি আর নারকেল গাছ রয়েছে।

”এখানে খেলাধুলোর জন্য যা খরচ হয় তা দেয় এরা।” বাসু আঙুল তুলে গাছগুলোকে দেখাল। ”স্কুলবাড়ির পেছনে আছে দিঘি, বড় বড় মাছ, তারাও দেয় খরচের টাকা। স্কুলের আর আশপাশের গ্রাম থেকে যারা খেলতে আসে তারা একটা পয়সাও দেয় না, শুধু দেয় পরিশ্রম। প্রতি মাসে একটা ছুটির দিনে শ’দুয়েক ছেলে নেমে পড়ি মাঠে। দিঘি থেকে জল পাম্প করে মাঠে ছিটোই, ঘাস লাগাই, চারপাশের আগাছা সাফ করি, মাঠে একটা ইটের টুকরোও পাবে না। হেডসার নিজে একটা চেয়ারে বসে থাকেন, আমরা কাজ করি।”

দিলুর এখন মনে পড়ল তাদের ক্লাসের নীলমণির কথা। বাংলার সেরা জুনিয়ার দাবাডু, জাতীয় জুনিয়ার চ্যাম্পিয়ানশিপ খেলতে কোজিকোড় গিয়ে তেরো দিন স্কুল কামাই হয়। রানার্স হয়ে ভারতের দু’নম্বর হয়েছে। নীলমণির বাবাকে ডেকে হেডমাস্টার বলেন, ‘হয় দাবা খেলুক নয়তো স্কুল ছাড়ুক। স্কুলে কামাই করে দাবাটাবা খেলা চলবে না।’ নীলমণি স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে দিনরাত দাবা খেলে, দাবার বই পড়ে, দাবার কথা ভাবে। সে গ্র্যান্ড মাস্টার হবেই হবে।

বাসুর গর্বে ঝলমল করা চোখের দিকে তাকিয়ে দিলুর খুব ভাল লাগল। নিজের হাতে যারা মাঠের যত্ন করে, সেবা করে, তারা মাঠকে ভালবাসবে, এ আর নতুন কথা কী। ভাল মাঠ না পেলে ভাল খেলা হয় না, দিলু তা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে জানে। কলকাতায় ভাল মাঠই তো নেই। বিশেষ করে বর্ষাকালে যা অবস্থা হয়। চটি খুলে হাতে নিয়ে দিলু বলল, ”চলো ঘাসের ওপর দিয়ে একটু হাঁটি। কলকাতায় তো এমন ঘাসের ওপর হাঁটা হয় না।”

মখমলের মতো নরম ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার শরীর শিরশির করে উঠল। সুন্দর একটা আমেজ তার শরীর ভরিয়ে দিল। মাঠের ধারে একটা পাকা ঘর, সেটা দেখিয়ে দিলু জানতে চাইল, ”ওটা কী?”

”ওখানে খেলার জিনিসপত্তর থাকে। গোলপোস্টের জাল, ক্রিকেটের নেট, ব্যাট বল প্যাড, উইকেট, ভলিবলের নেট, এইসব। মেডিকেলের কিট ব্যাগও আছে। আমাদের কোনও মালি নেই, হেডসার বলেছেন যেদিন মালির দরকার হবে সেদিনই স্কুলে খেলা বন্ধ করে দেবেন।”

উত্তরদিকের গোলপোস্টের পেছনে কবাডি আর ভলিবল কোর্টে তখন খেলা চলছে। দুটো কোর্টের ধারে জনা চল্লিশ বয়স্ক দর্শক, দুধঘাটেরই লোক। ওরা দু’জন সেদিকে এগিয়ে গেল। ফুটবল ক্রিকেট কেউ খেলছে না দেখে দিলু অবাক হল। তার কৌতূহল মেটাতে বাসু জানাল, ফুটবলাররা আজ মছলন্দপুরে গেছে টুর্নামেন্ট খেলতে, আর মাটি খুঁড়ে নতুন মাটি ফেলা হয়েছে প্র্যাকটিস পিচে গোবর সার দিয়ে ঘাস বোনা হচ্ছে, তারপর রোল করে নেট পড়বে। ওদিকে দক্ষিণদিকের গোলপোস্টের পেছনে, বর্ষা কেটে গেলে পুজোর আগেই হয়তো প্র্যাকটিস শুরু হবে। কথা হচ্ছে কংক্রিটের পিচ করার, তা হলে সারা বছরই প্র্যাকটিস করতে পারবে।

বাসুর কথা শুনতে শুনতে দিলুর হাত নিশপিশ করে উঠল। সে ব্যগ্রস্বরে জিজ্ঞাসা করল, ”এখানে রোজ খেলা হয়?”

”রোজ হয়। স্কুল ছুটির পরই শুরু হয়, যারা দূরে থাকে তারা খেলেটেলে বাড়ি ফেরে। ছুটির দিনে তো সকাল থেকে শুরু হয়ে যায়। তখন একটা দেখার মতো দৃশ্য, একসঙ্গে চার—পাঁচ রকমের খেলা মনে হবে খেলার হাট বসে গেছে। তুমি খেলতে না জানলেও তখন তোমার ইচ্ছে করবে ছুটে গিয়ে কোনও একটা খেলায় নেমে পড়ি। দাদু বলেন এজন্যই স্কুলের রেজাল্ট এত ভাল হয়।”

দিলু মনে মনে আক্ষেপ করল, তার যে এমন দাদু আর মামা আছে এটা সে আগে কেন জানত না! জানলে কী করত? তা হলে কি মামার বাড়িতে এসে থাকত? প্রশ্নটা তাকে দোনামনা অবস্থার মধ্যে ফেলে দিল।

বাড়ি ফেরার পরে দিলু বলল, ”আচ্ছা বাসু, ব্যাট বল নিয়ে খেলা নয় এখন বন্ধ, কিন্তু ফিল্ডিং প্র্যাকটিস তো করতে পারে।”

”পারে মানে!” বাসু থমকে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকাল। ”রোজ করে, প্রত্যেককে ব্যায়াম করতে হয়, দৌড়তে হয়, তারপর ফিল্ডিং, আজ সকালেও করেছে। প্রতাপদা না এলেও রোজ সকালে এসব করতেই হবে।”

দিলু জিজ্ঞেস করল, ”কে প্রতাপদা, কোচ?”

”হ্যাঁ। রঞ্জি ট্রফি শেষ, খেলেছেন আট বছর আগে, স্পিন বোলার ছিলেন। মোটরবাইক অ্যাক্সিডেন্টে পা ভেঙে যাওয়ার পর খেলা ছেড়ে দেন, বারাসাতে থাকেন, চাষের সার আর বীজের ব্যবসা, ওখান থেকেই বাইকে আসেন।”

”আমি ফিল্ডিং প্র্যাকটিস করব, তুমি প্রতাপদাকে একবার বলবে?”

”কাল সকাল ছ’টায় আমি মাঠে হাজির থাকব, কিন্তু তুমি কি ওই সময় আসতে পারবে? তোমার তো ঘুম ভাঙে—।”

বাসুর কথা শেষ করতে না দিয়ে দিলু তাড়াতাড়ি বলল, ”না, না, খুব ভোরে আমি উঠব, তুমি দেখে নিও।”

দিলু কথা রেখে ভোরে বিছানা ছাড়ল। স্কুলের গেটে পৌঁছে দেখল বাসু দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখে হাসল। হাসিটার অর্থ বুঝতে দিলুর অসুবিধে হল না—তা হলে সত্যি—সত্যিই ঘুম ভেঙেছে দেখছি।

মাঠটাকে পাক দিয়ে সাতটি ছেলে জগ করছে। দিলু হাওয়াই চটি খুলে বলল, ”চলো, আমরাও ওদের সঙ্গে জগ করি।”

ছেলেগুলির পেছন পেছন ওরাও জগিং শুরু করল। বাসুকে ওরা চেনে কিন্তু নতুন ছেলেটি কে? কৌতূহলে ওরা বারবার পেছন ফিরে তাকাতে লাগল। ওদের মধ্যে সর্দার ছেলেটি, যার পরনে সাদা হাফপ্যান্ট সাদা টি—শার্ট আর ক্রিকেট বুট, মাথা ন্যাড়া, সে সবার আগে ছুটছে। দিলু চারপাক সবে শেষ করেছে তখন ন্যাড়ামাথা হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে বলল, ”এবার স্ট্রেচিং।”

মাঠের ধারে ওরা ব্যায়াম শুরু করল। দিলু দেখল একটি ছেলে ফিসফিস করে বাসুকে কী জিজ্ঞেস করল বাসুও চাপাস্বরে জবাব দিল। দিলু জানে বাসু কী বলল—হেড সারের ভাগ্নে, কলকাতায় থাকে বেড়াতে এসেছে। ব্যায়ামরত ছেলেদের ফিটনেস দিলুকে অবাক করল। এভাবে সে আগে কখনও ব্যায়াম করেনি। ছেলেদের শরীরের নড়াচড়া দেখে বুঝে গেল সে যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে।

ব্যায়ামের পর শুরু হল ক্যাচ লোফা, গ্রাউন্ড ফিল্ডিং, উইকেটকিপারকে বল ছোড়া। মাঠের মাঝে একটা স্টাম্প পোঁতা, সেখানে প্যাড—গ্লাভস পরে দাঁড়িয়ে একটি ছেলে, তার পাশে ব্যাট হাতে ন্যাড়ামাথা। সে ব্যাট দিয়ে প্রথম বলটা তুলে মারল, বল নারকোল গাছের মাথা ছাড়িয়ে উঠে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে ফেলার মতো উচ্চচতায় উঠে গেছে। দিলুর ডান দিকে পাঁচ গজ দূরে যেটা ডানহাতি ব্যাটসম্যানের লং অফ, দাঁড়ানো ছেলেটির দিকে বল নামছে। সে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলটা লক্ষ করতে করতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তিন পা পিছিয়ে গেল। বল এবার জমিতে পড়বে। চিলের শিকার ধরার মতো ঝাঁপিয়ে ছোঁ মেরে ডান হাতের তালুতে বলটা ধরেই একপাক গড়িয়ে ছেড়ে দেওয়া স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠেই ছুড়ল উইকেটকিপারকে। বলটা জমি না ছুঁয়ে সোজা এসে লাগল সেই একমাত্র স্টাম্পটিতে।

সবারই চোখ কপালে উঠল। গত পাঁচ সেকেন্ডে তারা যা দেখল বিশ্বাস করতে পারছে না। একজন তো বলেই উঠল, ‘আনতাউড়ি হয়ে গেছে, ফ্রুক।” ন্যাড়ামাথা চেঁচিয়ে বলল, ”আর একবার করে দেখাতে পারবে?”

”চেষ্টা করে দেখব।” বলার পরই দিলুর চোয়ালের পেশি দপ করে উঠল।

ন্যাড়ামাথা বলটা তুলে ব্যাট দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল। বল উঠল একস্ট্রা কভারে দিলুর থেকে পনেরো গজ পেছনে। তিরাশির বিশ্বকাপ ফাইনালে ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচ ধরার জন্য কপিলদেব যেভাবে বলের দিকে তাকিয়ে ছুটেছিল, দিলু প্রায় সেইভাবেই কভার থেকে ছুটে বাঁ কাঁধের কাছে বলটা লুফেই শরীর ঘুরিয়ে ডান হাতে ছুড়ল। আগের মতোই বল এসে স্টাম্পে লাগল।

চোখগুলো কপালে না উঠে ছানাবড়ার আকার নিল। কারও মুখে কথা নেই, শুধু বাসু ছুটে গিয়ে দিলুকে জড়িয়ে ধরল। ”অদ্ভুত, অদ্ভুত! পরপর দু’বার! তুমি তো অর্জুনের মতো লক্ষ্যভেদ কর দেখছি।”

এমন সময় মোটরবাইকে প্রতাপ লাহিড়ি গেট গিয়ে ঢুকল। ছিপছিপে লম্বা, গোলগলা লাল রঙের গেঞ্জিপরা। বয়স বোঝা যায় না, দেখে মনে হয় পঁয়ত্রিশ, আসলে চল্লিশ। পায়ে স্নিকার। প্রতাপ কলকাতায় উত্তরপল্লী সঙ্ঘের ক্রিকেট সচিব, তারা সি এ বি লিগের প্রথম ডিভিশনে খেলে।

”কীসের লক্ষ্যভেদ রে?” প্রতাপ ওদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল।

একজন উত্তেজিত গলায় বলল, ”এই যে এই ছেলেটা, আজই প্রথম এসেছে। বাসু বলল হেডসারের ভাগ্নে কলকাতায় থাকে, নাম দিলু, দিলীপ। দুটো দারুণ ক্যাচ নিয়েই নিমেষে বল ছুড়ে স্টাম্পে দু’—দু’বার মারল ওই ওখান থেকে।” ছেলেটি আঙুল দিয়ে দেখাল দিলু যেখান থেকে বল ছুড়েছে।

প্রতাপের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। বল ছোড়ার দূরত্বটা চোখ দিয়ে মাপল। ওরা দাঁড়িয়ে ডীপ একস্ট্রা কভারে। প্রতাপ বলটা হাতে নিয়ে লং অফের দিকে তাকিয়ে আচমকা বলটা জোরে গড়িয়ে দিল, যেখানে স্কোয়ার লেগ আম্পায়ার দাঁড়ায় সেইদিকে। চিৎকার করে উঠল, ”গোওও, রান।”

দিলু ধনুক থেকে বেরোনো তিরের মতো ছুটে গিয়ে শর্ট স্কোয়ার লেগের কাছে জমি থেকে বলটা কুড়িয়েই শরীর মুচড়ে সেই একমাত্র স্টাম্পের দিকে ছুড়ল। প্রতাপ হতভম্ব হয়ে দেখল স্টাম্পটা ছিটকে চারহাত দূরে গিয়ে পড়েছে। সে বিড়বিড় কল, ”অবিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য, হতে পারে না। তা হলেও ভালভাবে দেখে নেওয়া দরকার।”

এবার ব্যাট হাতে নিল প্রতাপ। স্কোয়ার লেগ থেকে পয়েন্ট, আধখানা মাঠে তুলে তুলে এলোমেলো বল মারল। দিলু প্রত্যেকটা ক্যাচ ধরে স্টাম্পে ছুড়ল, এগোরোবার স্টাম্প ফেলে দিল, শুধু একটি সোজা জমা পড়ল উইকেটকিপারের গ্লাভসে।

প্রতাপের মুখ গম্ভীর থমথমে হয়ে উঠল উত্তেজনা চাপার চেষ্টায়। হাতের আঙুল কাঁপছে। একটা অসাধারণ আবিষ্কার তার চোখের সামনে। মনে মনে বলল, বারোবার পরীক্ষায় এগারোটাতে সফল, এটা কি আবিষ্কার নয়? বাংলা কি ভারত ছেড়েই দিলাম, পৃথিবীতেও কি একটা এমন ফিল্ডার এখন আছে? জন্টি রোডস। দুর, দুর বারোটায় বড়জোর পাঁচটা কি ছ’টা লাগাতে পারবে। ছেলেটাকে হাতছাড়া করা যাবে না। ও বোধ হয় জানে না কী ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা ওর মধ্যে রয়েছে। দিলুর সঙ্গে সে কথা শুরু করল:

”কলকাতায় তুমি থাকো কোথায়??”

”মৌলালিতে।”

”কোনও ক্লাবে কি খেলো?”

”অ্যালবার্ট স্কোয়ারে বিজয়ী সঙ্ঘ ক্লাবে।”

”ওখানে বলাই মিত্তির আছে না?”

”হ্যাঁ। বলাইদা আমাদের স্কোরার।”

”ময়দানে কখনও খেলেছ?”

”না। আমাদের ক্লাবের ময়দান পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা এখনও হয়নি।”

”যদি তোমাকে ময়দানের কোনও ক্লাব ডাকে, যাবে?”

চকচক করে উঠল দিলুর চোখ। ময়দান মানে সি এ বি লিগের ক্লাব। তারপর বেঙ্গল টিমে, তারপর ইন্ডিয়া টিমে। উত্তেজনা দমন করে স্বাভাবিক স্বরে সে বলল, ”আমায় ডাকবে কেন, কী এমন খেলেছি!”

প্রতাপ মনে মনে বলল, ‘যা দেখলুম তার অর্ধেকও যদি দেখাতে পারো তা হলে তোমায় নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে।’ কিন্তু মুখে সে বলল, ”কলকাতায় কবে ফিরছ? কোন স্কুলে কোন ক্লাসে পড়ো?”

উত্তর দিতে দিলু ইতস্তত করল। পরীক্ষার ফল বেরোতে এখনও সাতদিন বাকি। তার আগেই বাড়ি ফিরতে হবে। সে নব্বুইভাগ নিশ্চিত, পাশ করতে পারবে না। দাদাদের কিংবা বাবার মতো তার মগজ পড়াশুনোর জিনিসপত্রে ভরা নেই, এটা সে মাকে অনেকদিন আগেই জানিয়ে রেখেছে। মা শুধু বলেছিলেন, ‘নীচের ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে বসতে তোর লজ্জা করবে না?’

তার মনে এল বোকামামার কথাটা : ‘ভাল লাগলে দিলু এখানেই থেকে যাবে।’ এ—কথা শুনে সেদিন সে মনে মনে হেসেছিল। মায়ের সঙ্গে ছেলেবেলায় মামার বাড়িতে এসে নিঃসঙ্গ বোধ করত কিন্তু এবার সে করছে না, বরং ভালই লাগছে। এই ক’দিনে এমন কয়েকটা ব্যাপার ঘটে গেছে যাতে সে মজা পেয়েছে, অবাক হয়েছে, সবচেয়ে বড় কথা, এমন তকতকে একটা মাঠে খেলার সুযোগ আর খেলার জন্য এত ছেলে সে কোথায় পাবে?

”সরস্বতী ইনস্টিটিউশনে। ক্লাস এইটে পরীক্ষা দিয়েছি। কলকাতায় ফিরব কবে ঠিক নেই।” একটু আনমনা দেখাল দিলুকে।

প্রতাপ বলল, ”এখানে থাকলে তুমি সারা বছরই খেলার সঙ্গে যোগ রাখতে পারবে আর কলকাতাও তো বেশিদূর নয়, বরানগর থেকে বাসে ময়দানে পৌঁছতে যে সময় লাগবে এখান থেকেও ততটাই লাগবে। তুমি দুধঘাট স্কুলে ভর্তি হয়ে যেতে পারো, কলকাতার যে—কোনও ভাল স্কুলের থেকে একটুও খারাপ নয়। আচ্ছা, তোমার বয়স কত, তোমার গার্জেন কে, বাবা?”

বয়স বলতে গিয়ে দিলু বরাবরই লজ্জায় পড়ে যায়। তার দেহের আকার দেখে বেশিরভাগ লোকই ধরে নেয় সতেরো—আঠারো।

”পনেরোয় পড়ব দু’ মাস পর।” তারপরই সে তাড়াতাড়ি যোগ করল, ”আমাদের বংশের সবাই খুব লম্বাচওড়া, বাবা সওয়া ছ’ফুট, পঁচানব্বুই কেজি, আমার গার্জেন।”

প্রতাপ কী যেন ভাবল, তারপর বলল, ”আগে হেডসার হরিসাধনবাবুর সঙ্গে কথা বলি।”

বাসু এতক্ষণ অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল। এবার বলল, ”হেডসারের সঙ্গে নয় প্রতাপদা, আগে কথা বলুন দিলুর দাদুর সঙ্গে, উনি খেলা খুব ভালবাসেন।”

”এখুনি যাচ্ছি।” প্রতাপ তখনি বাইকে উঠে রওনা হল দিলুর মামাবাড়ির উদ্দেশ্যে, বাড়িটা সে চেনে, আগে দু—তিনবার গেছে। পুকুরধারের বেগুন খেতে পঞ্চানন তখন একটা টুলে বসে রিদুকে দিয়ে গাছগুলোর গোড়ায় মাটি খুঁড়িয়ে সার দেওয়ার কাজ দেখছিলেন, চার বছর আগেও তিনি এই কাজ নিজের হাতে করেছেন। এমন সময় হাজির হল প্রতাপ। পঞ্চানন তাকে দু’বার দেখেছেন এই বাড়িতে, হেডমাস্টারের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল। প্রতাপ পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে ঠিক করেই রেখেছিল এবং তাই করল। পঞ্চাননের মুখে দেখে মনে হল খুশি হয়েছেন, সে আশ্বস্ত হল।

”আমার নাম প্রতাপ লাহিড়ি, আমি—”

পঞ্চানন হাত তুলে বললেন, ”জানি, তুমি তো এ বাড়িতে আগে এসেছ, ছেলেদের ক্রিকেট শেখাও। বোকা তো এখন বাড়ি নেই।”

”আমি এসেছি আপনার কাছেই, আপনার নাতির খেলার ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে।” এই পর্যন্ত শান্তভাবে বলেই প্রতাপ উচ্ছ্বসিত হয়ে দু’হাত ঝাঁকিয়ে বলল, ”কী বলব আপনাকে, অদ্ভুত, আউট অব দিস ওয়ার্ল্ড, কখনও দেখিনি—”

পঞ্চানন চোখ পিটপিট করে বললেন, ”ব্যাপার কী, দিলু করেছে কী?”

”অসাধারণ, অবিশ্বাস্য ফিল্ডার। মাঠের যেখান—সেখান থেকে বল ধরেই বিদ্যুৎগতিতে ছুড়ে স্টাম্পে মারছে, একটা স্টাম্পে।”

”তাতে হয়েছে কী?” পঞ্চানন বুঝতে পারছেন না স্টাম্পে বল মারার মধ্যে অসাধারণত্বের কী আছে।

”হয়েছে কী!” প্রতাপ উত্তেজিত হতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ”মাঠে এইরকম একটা ফিল্ডার থাকলে ব্যাটসম্যানের অবস্থাটা কী হবে একবার ভেবে দেখুন। একটা রান নেওয়ার আগে চোদ্দোবার তাকে ভেবে দেখতে হবে, দুটো রান নেওয়ার আগে—নাহ, দ্বিতীয় রানটা নিতেই যাবে না যদি দেখে দিলু বলটা ফিল্ড করতে যাচ্ছে। এরকম একটা ফিল্ডার মাঠে থাকলে অপোনেন্টের রান কত কমে যাবে ভাবতে পারেন। রান আউট হয়ে যাওয়ার ভয়ে ক্রিজ ছেড়ে বেরোবেই না। যেদিকে দিলু থাকবে সেদিকে স্ট্রোক নেবেই না, আর অন্যদিকে মারতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনবে। এবার বুঝতে পারছেন আপনার নাতি কী জিনিস?”

পঞ্চানন শান্তস্বরে বললেন, ”বুঝলাম, তা আমার কাছে কেন, আমি তো আর ব্যাট করব না।”

”ওকে আমার ক্লাব উত্তরপল্লীতে খেলাতে চাই। ক্লাবটা বরানগরে। ফার্স্ট ডিভিশনে গড়ের মাঠে খেলে। বাচ্চচা ছেলে, ওর অভিভাবকদের অনুমতি নেওয়া উচিত বলে মনে হল, তাই আপনার কাছে এসেছি। বেশিরভাগ বাবা—মাই তো পড়াশুনো ফেলে খেলাধুলো পছন্দ করেন না।”

”আমি ওর বাবা নই, মা’ও নই। তুমি তাদের কাছেই যাও।”

”ছেলেটিকে আমি এখানে রাখতে চাই। এখানকার এত ভাল মাঠ, অফুরন্ত প্র্যাকটিসের সুযোগ, আর এত ছেলে, এ—সবই সম্ভব হয়েছে দুধঘাট স্কুল আর তার হেডমাস্টারের জন্য। এই স্কুল তো কলকাতার কোনও স্কুলের চেয়ে লেখাপড়ায় কম নয়। আমি বলি কী, দিলু মামার বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করুক আর ক্রিকেটটা কলকাতায় আমার ক্লাবের হয়ে খেলুক।” প্রতাপ হাত জোড় করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল।

পঞ্চাননের ঠোঁটে একচিলতে হাসি খেলে গেল। বললেন, ”দিলু যদি এখানে থাকে তা হলে আমি খুশিই হব, কিন্তু ওর বাবা—মা সেটা চাইবে কিনা তা আমি জানি না। আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলে দেখতে হবে।”

যাওয়ার আগে প্রতাপ বলে গেল, ”আমি কলকাতায় গিয়ে দিলুর বাবার সঙ্গে কথা বলব।”

একটু পরেই দিলু ফিরল। দাদুকে বেগুন খেতে টুলে বসে থাকতে দেখে সে কৌতূহলে এগিয়ে গেল। রিদু উবু হয়ে খুরপি দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে সরে যাচ্ছে করলার মাচার দিকে।

”তুমি নাকি অসাধারণ ফিল্ডিং করো, মাঠের যেখান—সেখান থেকে বল মারো স্টাম্পে!” পঞ্চানন বললেন, ”অবিশ্বাস্য কাণ্ড করেছ স্কুলের মাঠে।”

দাদু এরই মধ্যে জেনে গেছে, তার মানে ইতিমধ্যেই প্রতাপদা এসে বলে গেছে। দিলু প্রশংসা শুনলে আড়ষ্ট বোধ করে, লজ্জাও পায়। প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য বলল, ”দাদু, ওই কুমড়ো দুটো তো পেকে গেছে, কাটবে না?”

পঞ্চানন মুখ ফিরিয়ে করলার মাচার নীচে কুমড়োদুটোর ওপর চোখ রাখতেই চোখের মণি স্থির হয়ে গেল। মাচা থেকে একটা সাপ ঝুলছে, ফণা তুলে রয়েছে রিদুর মাথার একহাত ওপরে। রিদু পাশের বেগুনগাছের দিকে সরার জন্য নড়লেই ছোবল মারবে।

দাদু কথা না বলে একদৃষ্টে সামনে তাকিয়ে রইল কেন জানার জন্য দিলুও তাকাল। সাপটার ফণা অল্প অল্প দুলছে। শিরশির করে উঠল তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। সাক্ষাৎ যম রিদুদার মাথার ওপর।

”গোখরো।” পঞ্চানন ফিসফিসিয়ে বললেন, তারপর কুড়ি হাত দূরে উবু হয়ে বসা রিদুকে চাপা গলায় হুঁশিয়ার করলেন, ”রিদু যেমনটি আছিস ঠিক তেমনিই থাক, নড়বি না, তোর মাথার ওপর সাপ ঝুলছে।”

শোনামাত্র নিথর হয়ে গেল রিদু। বছর চল্লিশ বয়স। জীবনে সে অনেক সাপের মুখোমুখি হয়েছে। সে জানে এইরকম মুহূর্তে কী করতে হয়। দিলু জানে সাপের কান নেই, কিন্তু চোখ আছে, শুনতে পায় না কিন্তু দেখতে পায়। সে নীচে তাকিয়ে পায়ের কাছে দেখতে পেল একটা শক্ত মাটির ঢেলা। খুব ধীরে ধীরে হাঁটু ভেঙে ডান হাতটা নামিয়ে কুড়িয়ে নিল ঢেলাটা। স্ট্রোক নেওয়ার আগে ব্যাট পেছনে তোলার মতো সাপটা ফণা একটু পিছিয়ে নিল। পঞ্চানন একদৃষ্টে সাপের দিকে তাকিয়ে, তার কণ্ঠনালী নড়ে উঠল ঢোক গেলার জন্য। দিলু মাথাটা সামান্য ঘুরিয়ে চোখের কোণ দিয়ে তাকাল একবার, আর মুহূর্তের মধ্যে বাঘের লাফের মতো ঝলসে উঠল তার ডান হাত।

দু’হাত লম্বা সাপটা ছিটকে পড়েছে জমিতে, রিদুর সামনে। ছটফটাচ্ছে, পাকিয়ে পাকিয়ে মোচড়াচ্ছে শরীরটা। মাথাটা থেঁতলে রক্তাক্ত। পঞ্চানন তাকিয়ে রইলেন নাতির দিকে, ঢেলাটা যে সাপের মাথায় লাগল সেটা তিনি দেখেছেন এবং কে সেটা ছুড়ল তাও বুঝেছেন, তাঁর মুখে কথা সরল না। দিলুর মুখ নির্বিকার।

”রিদু, তুই যমের বাড়ি থেকে ফিরে এলি।” পঞ্চাননের মুখ দিয়ে বেরোনো এটাই প্রথম কথা। রিদু বাঁশের একটা খেটো দিয়ে সাপটাকে পিটিয়ে মারতে মারতে বলল, ”বড় কত্তা, সাপের এমন দশা হল কী করে বলো তো? খুব বাঁচা বেঁচে গেছি, এ তো গোখরো সাপ গো।” রিদু শিউরে উঠল।

দিলু বলল, ”দাদু, বাসু বাড়ি চলে গেছে, আজ আমি একাই পুকুরের ওপারে যাব।” এই বলে সে ছুটে বাড়ির মধ্যে চলে গেল।

পঞ্চানন রিদুকে বললেন, ”বাড়ি যা, আজ আর কাজ করতে হবে না। পরে বলব সাপটার দশা এমন হল কী করে।”

তেল মাখতে মাখতে দিলুকে পুকুরঘাটের দিকে যেতে দেখার পর বাড়িতে এসে পঞ্চানন সুলেখাকে বললেন, ”বউমা, আজ দুটো রহস্যের সমাধান করেছি, সেই লাল গুণ্ডার অজ্ঞান হওয়ার, আর গাছ কাটতে কাটতে লোকটার পরে যাওয়ার। বাড়ির বাইরের কাউকে যদি না বলো, হষ্যকেও নয়, তা হলে রহস্যটা ফাঁস করতে পারি।”

সুলেখা কথা দিলেন, কাউকে কিছু বলবেন না। পঞ্চানন তখন পুত্রবধূর কানে কানে বললেন, ”এসব দিলুর কাণ্ড।” তারপর তিনি বউমাকে জানালেন প্রতাপের কাছে যা শুনেছেন আর নিজের চোখে সাপটাকে যেভাবে মরতে দেখেছেন তার বিবরণ। অবশেষে বললেন, ”আমার এখন মনে হচ্ছে আগের ঘটনা দুটোও দিলুর কীর্তি। লেখাপড়ায় ওর মন নেই। শুধু ক্রিকেট খেলতে চায়, তাই খেলুক। প্রতাপ চাইছে ওকে এখানে এনে পড়াশুনো করাতে, তাই করাব।”

প্রতাপ একটা দিনও দেরি করতে রাজি নয়, পরের দিনই সে কলকাতায় গিয়ে বলাই মিত্তিরের খোঁজ নিল অ্যালবার্ট স্কোয়ারে। সেখানে একটি ছেলে বলে দিল তার বাড়িটা কোথায়। সে বাড়িতেই বলাইকে পেয়ে গেল। তাদের পরিচয় বহুদিনের। বলাই একসময় কালীঘাট ক্লাবে কয়েক সিজন উইকেট কিপিং করেছে, প্রতাপও তখন কালীঘাটে।

”বলাই তোদের ক্লাবে দিলীপ কর নামে একটা ছেলে খেলে, ওর বাবাকে চিনিস?”

বলাই অবাক হল, এমন একটা প্রশ্ন প্রতাপ প্রথমেই করায়।

”ব্যাপার কী বল তো হঠাৎ দিলুর খোঁজ? ওকে তোদের ক্লাবে নিতে চাস বুঝি?”

”না, না, তেমন কিছু নয়, মানে—” প্রতাপ বলাইয়ের কৌতূহলটায় বিব্রত হয়ে পড়ল। তার এই খোঁজ নেওয়ার আসল কারণটা জানাজানি হয়ে গেলে অনেক ক্লাবই দিলুর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে এটা সে জানে।

”তুই ওকে খেলতে দেখেছিস?” বলাই চোখ সরু করে তাকাল।

”না।”

”তা হলে ওর সম্পর্কে ইন্টারেস্ট নিচ্ছিস কেন?” বলাইয়ের ভ্রূ কুঁচকে উঠল।

”ওর ফিল্ডিং প্র্যাকটিস দেখেছি।” যা বলতে চায়নি অবশেষে প্রতাপ সেটাই বলে ফেলল।

”আহহ তাই বল। প্রতাপ লাহিড়ি কেন দিলুর বাবার খোঁজ নিচ্ছে এবার সেটা বুঝতে পারলুম। ওর বাবা তরুণ কর খুব বড় উকিল, প্রচুর পয়সা, থাকে এগারো নম্বর রিপন রো—এ, পাশের পাড়ায়। দিলু পড়াশুনোয় একদমই ব্রাইট নয়, ওর বাবা তাই খেলাধুলোর ওপর হাড়ে চটা। আমরা তো ওকে টিমে নিই শুধু ওর ফিল্ডিংটার জন্য। অন্তত তিনটে ক্যাচ নেবে কি রান আউট করবেই। যদি একটু ধরে ব্যাটটা করতে পারে তা হলে খুব তাড়াতাড়ি উঠে আসবে।”

প্রতাপ উঠে পড়ল। তার যা জানার জানা হয়ে গেছে, এবার তাকে তরুণ করের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তালতলায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে সময় কাটিয়ে রাত আটটা নাগাদ সে পৌঁছল রিপন রো—এ দিলুদের বাড়ি। সেখানে চারজন মক্কেল তখন অপেক্ষা করছে। তরুণ করের ক্লার্ক জানাল, ঘণ্টাখানেকের আগে দেখা করা সম্ভব হবে না। প্রতাপ একটা চেয়ারে হতাশ হয়ে বসে পড়ল। ঘরের দরজা দিয়ে বাড়ির অন্দর থেকে বেরিয়ে সদর দরজায় যাওয়ার পথটা দেখা যাচ্ছে, প্রতাপ সেইদিকে তাকিয়ে আকাশ—পাতাল ভেবে যাচ্ছে।

একসময় বাড়ির ভেতর থেকে দু’জন মহিলা বেরিয়ে সদর দরজার দিকে গেলেন। প্রতাপ শুনতে পেল—”খুব ভাল লাগল, কতদিন পরে এলে, আবার কিন্তু এসো।” দামি জরিপাড় হলুদ শাড়ি পরা মহিলা অন্দরের দিকে ফিরে যাচ্ছেন, প্রতাপের মনে হল ইনি এ—বাড়ির গিন্নি, দিলুর মা। সে লাফ দিয়ে ঘরের বাইরে এসে বলল, ”আপনি কি দিলুর মা?’

মল্লিকা ঘুরে অবাক হয়ে বললেন, ”হ্যাঁ, আপনি?”

নমস্কার করেই প্রতাপ তাড়াতাড়ি বলল, ”আমি দুধঘাট থেকে আসছি, হরিসাধনবাবু, পঞ্চাননবাবু আমাকে ভালই চেনেন। আমি আপনার কাছে একটা আর্জি নিয়ে এসেছি দিলুর সম্পর্কে।” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলার পরই তার মনে পড়ল নিজের পরিচয়টা দেওয়া হয়নি। ”আমার নাম প্রতাপ লাহিড়ি, আমি দুধঘাট স্কুলের মাঠে ক্রিকেট কোচিং করি।”

মল্লিকাকে কৌতূহলী দেখাল, ”দিলুর সম্পর্কে কী বলবেন?”

”আপনার ছেলে অসাধারণ প্রতিভাবান। ওর মতো ফিল্ডার পৃথিবীতে এখন আছে কিনা আমার জানা নেই।” প্রতাপের স্বর গদগদ পর্যায়ে পৌঁছল। ”ওকে আমাদের ক্লাবে খেলাতে চাই।”

”আপনি ঘরে এসে কথা বলুন।”

তরুণের চেম্বারের পাশের ঘরের দরজা খুলে ধরল মল্লিকা। কার্পেটে—সোফায় সাজানো বসার ঘর। দু’জনে মুখোমুখি বসল।

”আর্জিটা কী?” মল্লিকা সোজাসুজি কথা পাড়লেন।

”দিলুর ক্রিকেট ভবিষ্যতের কথা ভেবে বলছি ওকে এখানে না রেখে মামার বাড়িতে রাখুন। ওখানে খেলার ব্যবস্থা আর সুযোগ কলকাতার চেয়ে অনেক ভাল।”

”আমি আর দিলুর বাবা চাই আমার দাদা, জ্যাঠামশাইয়ের কাছে দিলু থাকুক, তবে শুধুই লেখাপড়ার জন্য, খেলার জন্য নয়। ওখানে গিয়েও যদি এখানকার মতো দিনরাত খেলা—খেলা করে তা হলে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। লেখাপড়ায় দিলু ভাল নয়, আর দুধঘাট স্কুলের সুনামের কথা আমরা জানি। দাদাও চান ওকে লেখাপড়া শেখার জন্য ভর্তি করে নিতে। হয়তো দিলু পৃথিবীর সেরা ফিল্ডার, জানি না কী দেখে পৃথিবীর সেরা বলে দিলেন, তবু মুখ্যু সেরা—ফিল্ডারের বাবা—মা হতে আমরা চাই না, ধরে নিতে পারেন এটা ওর বাবারও কথা। এবার আপনি আসতে পারেন।” মল্লিকা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানালেন। ওঁর দৃঢ় স্বর আর কঠিন ভঙ্গি প্রতাপকে আর কথা বাড়াতে সাহস জোগাল না।

কিন্তু প্রতাপ নাছোড়বান্দা। তার ধারণা, সে একটা বিরাট উপহার ভারতকে দিতে পারবে, দিলুর অবিশ্বাস্য ফিল্ডিং প্রতিভাকে তুলে ধরে। বাবা—মায়ের আপত্তিকে যেভাবেই হোক পাশ কাটিয়ে দিলুকে ময়দানে নামাবে এই প্রতিজ্ঞা করে প্রতাপ পরদিনই দেখা করল পঞ্চাননের সঙ্গে।

বিকেলে দোতলার বারান্দায় বসে দু’জনে যখন কথা বলছিল দিলু তখন স্কুলের মাঠে ফিল্ডিং অনুশীলন করায় ব্যস্ত।

”মলু বলল, মুখ্যু সেরা—ফিল্ডারের মা—বাবা তারা হতে চায় না, তা হলে কী হতে চায় সেটা কি বলেছে?” পঞ্চানন শীতল দৃষ্টিতে প্রতাপের দিকে তাকালেন।

”না, সেটা স্পষ্ট করে বলেননি, তবে বলেছেন, শুধুই লেখাপড়া করুক এটাই তিনি চান, আর সেজন্যই ওকে এখানে রাখতে রাজি।”

”লেখাপড়া বলতে আমরা যা বুঝি তা হল একটা ভাল চাকরি পাওয়া, নয়তো কোনও পেশায় যাওয়া। লক্ষ্যটা টাকা রোজগার, এর বাইরেও অবশ্য কেউ কেউ ব্যবসা—বাণিজ্য করে। কিন্তু লেখক হয়ে, গান গেয়ে, সেতার কি তবলা বাজিয়ে, ছবি এঁকে, মূর্তি গড়ে এমনকী খেলাধুলো করেও যে প্রচুর টাকা, নাম যশ খ্যাতি অর্জন করা যায়, এটা আর বাবা—মায়ের মাথায় ঢোকে না। এইসব লোকেদের কিন্তু আমাদের খুব দরকার। দিলুর মতো ছেলেদের তো এগিয়ে দিতে হবে, ওরা যা হয়ে উঠতে চায় তাই হয়ে উঠুক। দেখো বাবা, আমি কিন্তু মলুর চিন্তার সঙ্গে একমত নই। আমি পুরনো ধারার মানুষ কিন্তু মলু তো দেখছি একেবারে মান্ধাতার আমলে পড়ে রয়েছে, কী যে লেখাপড়া শিখল!” পঞ্চানন মাথা নামিয়ে আক্ষেপে নাড়লেন।

”তা হলে?” প্রতাপ ঝুঁকে আশার আলো দেখতে পাওয়ার মতো চোখে তাকিয়ে রইল।

”তা হলে আর কী!” পঞ্চাননের স্বর বদলে গেল, কঠিন ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসলেন, ”দিলু যদি এখানে থাকে তা হলে আমার ইচ্ছানুযায়ী তাকে পড়াব, শেখাব। এটা ওর বাবা—মাকে মানতে হবে।”

”তা হলে দিলুর খেলা বন্ধ হচ্ছে না।” প্রতাপ নিশ্চিত স্বরে বলল।

পঞ্চানন জবাব না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে পুকুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

চারদিন পর রবিবার দুপুরে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য হরিসাধন দিলুকে নিয়ে বাইগাছি স্টেশনে সাইকেল ভ্যানরিকশা থেকে নামলেন। নেমেই দিলু বলল, ”বোকামামা, তোমার বিশ্ববিখ্যাত জিনিসটা আর একবার চেখে দেখতে ইচ্ছে করছে।”

দারুণ খুশি হলেন হরিসাধন, ”নিশ্চয় হবে। তার আগে পদসেবা, এই হাওয়াই চটি পরে বাড়িতে গেলে তোর মা বলবে দাদাটা কিপ্টে হয়ে গেছে, একজোড়া ভাল চটিও ভাগ্নেকে কিনে দিলে না। আগে চটি, তারপর ছানার জিলিপি।”

দু’জনে পদসেবায় ঢুকল। সেই সেলসম্যানটি একা দোকানে বসে, ওদের দেখেই চিনতে পেরে হেসে বলল, ”বুড়ো আঙুলের নখটা ঠিক হয়ে গেছে?”

হরিসাধন বললেন, ”এখন একদম নতুন নখ। এবার বের করো তো সেই চটি জোড়া, প্রথম যেটা দেখিয়েছিলে।”

ছেলেটি বাক্স আনল। দিলু চটি পরে হাঁটল। হরিসাধন দেড়শো টাকা গুনে দিয়ে বললেন, ”হাওয়াইটা বাক্সে ভরে নে।”

এর পর তারা এল যশোহর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। যে টেবিলটায় ওরা বসে ছিল সেটাতেই বসল। একটা ছেলে টেবলে এসে দাঁড়াল। হরিসাধন জিজ্ঞেস করলেন, ”ক’টা বলব?” দিলু আঙুল দিয়ে ‘ভি’ দেখাল, ”হরিসাধন ছেলেটিকে বললেন, ”দুটো করে দাও।”

দিলু মোট তিনবার ‘ভি’ দেখায়। বোনের জন্য কুড়িটা ছানার জিলিপি দড়িবাঁধা হাঁড়িতে হাতে ঝুলিয়ে হরিসাধন টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াবার দশ মিনিটের মধ্যেই ট্রেন এসে গেল।

ট্রেনে হরিসাধন একবার জিজ্ঞেস করলেন, ”দিলু, আবার কবে আসবি?”

”শিগগিরই আসব, তবে এবার আসব থাকার জন্য। নীচের ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে বসা আমার দ্বারা হবে না।” এই বলে সে পায়ের পাতা উঁচু করে নতুন চটি ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে দেখতে লাগল।

.

হরিসাধনের সামনে গরম ফুলকো লুচি আর বেগুনভাজার প্লেট টেবলে রেখে মল্লিকা বললেন, ”বোকাদা একটা লোক এসেছিল, নাম বলল প্রতাপ লাহিড়ি, চেনো নাকি?”

”চিনি।” আহার্য বিষয় সামনে থাকলে হরিসাধনের কথাবার্তা সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়।

”কী করে বলো তো? এই ক’দিন আগে হঠাৎ এসে বলল, দিলুকে মামার বাড়িতে রেখে পড়ান। আমি তো অবাক, গায়ে পড়ে পরামর্শ দিতে এসেছে, ব্যাপার কী! বলল, তোমার স্কুলে নাকি খেলার ব্যবস্থা খুব ভাল, দিলুর মতো ফিল্ডার এখন পৃথিবীতে নেই, এইসব হাবিজাবি আমাকে বোঝাতে চাইছিল। আমি পরিষ্কার বলে দিয়েছি আগে পড়া, তারপর খেলা। দুধঘাটে যদি যায় তো লেখাপড়াই করতে যাবে, খেলতে নয়।”

”প্রতাপ এইসব বলেছে নাকি?”

”বলেছে ওর ক্লাবে দিলুকে খেলাবে। স্কুলে পড়া ছেলে ক্লাস না করে মাঠে গিয়ে খেলবে?”

”দূর দূর, যেতে দেবই না।” বেগুনভাজা লুচি দিয়ে মুড়তে মুড়তে হরিসাধন উত্তর দিয়ে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। মলুকে প্রতাপ কী বলেছে তা তিনি জানেন না। কিন্তু এটা বুঝে গেছেন প্রতাপের কথায় মলু বিগড়ে গেছে। ওকে খুশি করা দরকার।

”দারুণ লুচি, তোর করা?”

”নয় তো কে করবে, রাঁধুনি তো আসবে সন্ধেবেলায়।”

”আরও দুটো দে।” হরিসাধন আড়চোখে বোনের মুখটা দেখে নিলেন। কাজ হয়েছে।

মল্লিকা গোটাছয়েক লুচি আর গরম বেগুনভাজা নিয়ে এল। ততক্ষণে হরিসাধন কী বলবেন ভেবে নিয়েছেন। তিনি জানেন মল্লিকা স্কুলের এখনকার অবস্থা দেখেনি।

”মলু আমি ভাবছি স্কুলের মাঠটায় গোলাপ চাষ করব। স্কুলের বেঞ্চিগুলো ভেঙে ঝরঝর করছে। গভর্নমেন্ট টাকা দিতে পারে না। সারাবার খরচ তোলা যাবে গোলাপ ফুল বেচে। আগে খেলা না আগে ক্লাসে বসে পড়া?”

”আগে পড়া তো বটেই। তোমার স্কুলের অত ভাল রেজাল্ট, ভাল করে বসে পড়া না শুনলে রেজাল্ট কি ভাল থাকবে! তুমি খেলার মাঠ তুলে দিয়ে গোলাপ চাষই করো।”

”তুই তা হলে দিলুকে পাঠিয়েই দে।” বেগুন ভাজা ঠাণ্ডা হয়েছে কিনা আঙুল ছুঁইয়ে দেখে হরিসাধন কাজ শুরু করে দিলেন।

”কিন্তু দাদা, প্রতাপ যে বলল—”

”ও কিছু নয় কিছু নয়, ভাগিয়ে দোব। ক্লাবে খেলবে কী এইটুকু ছেলে!”

মল্লিকা প্লেটে চারটে সন্দেশ আনলেন।

”পারব না রে পারব না, ছ’টা ছানার জিলিপি খেয়ে ট্রেনে উঠেছি। হরিসাধন কাতর চোখে তাকালেন। পরেরবার এসে খাব। তরুণ কখন ফিরবে?”

”দশটার আগে তো নয়ই, তাসের আড্ডায় বসলে ওর বাড়ির কথা মনে থাকে না। পরশু দিলুর রেজাল্ট বেরোবে, কী হবে সে তো সবার জানাই আছে। বংশে এই প্রথম একটা মুখ্যু ছেলে হল, মুখ দেখানো দায় হবে।”

খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে হরিসাধন বললেন, ”চলি রে।”

”সামনের রোববারই ওকে দুধঘাটে পৌঁছে দিয়ে আসব।”

সবার যা জানা, দিলু সেটাকে অজানা হতে না দিয়ে পরীক্ষায় ফেল করল। একটা বড় সুটকেস এবং দিলুকে সঙ্গে নিয়ে পরের রবিবার সকালে মল্লিকা মোটরে রওনা হলেন দুধঘাটের উদ্দেশ্যে। তাসের আড্ডা ফেলে তাঁর স্বামী সঙ্গে যেতে রাজি হননি। জাতীয় সড়ক থেকে পিচের সরু ভাঙাচোরা একটা রাস্তা চলে গেছে দুধঘাটের দিকে। সেই রাস্তার ওপরে দুধঘাট স্কুল। মল্লিকার নির্দেশমতো ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে যখন স্কুলবাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছে তখন স্কুলের মাঠে খেলার মেলা বসে গেছে। শিউরে উঠে মল্লিকা দেখলেন ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে একটি ছেলে বলটা আকাশের দিকে তুলে মারল। দুটো ছেলে ছুটল ক্যাচ ধরতে। মল্লিকা আড়চোখে পাশেবসা ছেলের দিকে তাকালেন, দিলু তখন অন্য জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে।

”জেঠু দিয়ে গেলুম তোমার ফেল—করা নাতিকে। ” প্রণাম করে মল্লিকার এটাই প্রথম কথা, ”এবার পাশ করিয়ে দাও দেখি।”

পঞ্চানন একগাল হেসে দিলুর দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে বললেন, ”এবার থেকে দু’বেলা শুধু পড়া, পড়া আর পড়া।”

”নিশ্চয়। বি—এ—টা পাশ না করলে লোকে বলবে কী! স্কুলের মাঠে দেখলুম খুউব খেলা চলছে, বোকাদা বলল গোলাপের চাষ করে বেঞ্চি সারাবার টাকা তুলবে ওই মাঠ থেকে। তুলুক, তুলুক।”

”আমাকেও বোকা বলেছে। আমি বললুম খুব ভাল কথা, টাকা তো আসবেই। তা ছাড়া সামনে গোলাপ বাগান থাকলে স্কুলটাও কত সুন্দর দেখাবে। বোকার মাথায় বুদ্ধি আছে।” পঞ্চানন মিটিমিটি হাসতে লাগলেন।

”নীচে যাই, বউদি তো রান্নাঘরে ঢুকল, কী রাঁধছে দেখি গিয়ে। বউদির এই এক বাতিক, কাউকে পেলেই ধরে বেঁধে খাওয়াবে।” মল্লিকা বলতে বলতে সিঁড়ির দিকে এগোলেন।

”পরশু নারকেল পাড়িয়েছি। যাওয়ার সময় চন্দ্রপুলি নিয়ে যাবি কিন্তু।”

মা সিঁড়ি দিয়ে অদৃশ্য হওয়ামাত্র দিলু উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, ”দাদু, স্কুলের মাঠে গোলাপের চাষ, কী ব্যাপার?”

মাছি তাড়াবার মতো নাকের সামনে হাত নেড়ে পঞ্চানন বললেন, ”রাখ তো গোলাপ, ধানচাষ হবে বলেনি এটাই স্কুলের ভাগ্যি।”

কথার অর্থ বুঝতে পেরে দিলুর মুখ নিঃশব্দ হাসিতে ভরে গেল। গেঞ্জিটা খুলে জিনসের প্যান্ট খুলল। জাঙিয়া পরা অবস্থায় সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে তখন পঞ্চানন বললেন, ”যাচ্ছ কোথায়?”

”পুকুরে। মাকে দেখাব সাঁতরে ওপার পর্যন্ত যেতে পারি। আমাদের বাড়িতে কেউ সাঁতার জানে না, খুব অবাক হয়ে যাবে।”

”খবরদার নয়। সাঁতারও খেলার মধ্যে পড়ে। মা দেখলে এখুনি গাড়িতে তুলে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। সাঁতার টাতার সব কাল থেকে।”

সন্ত্রস্ত দিলু প্যান্ট পরে নিল চটপট।

”দাদু, বোকামামাও তা হলে মিথ্যে কথা বলে।”

”শুধু বোকামামা? যুধিষ্ঠির পর্যন্ত বলেছিলেন। বোকাকে তো একবার নরক দর্শন করতেই হবে।”

হরিসাধন ক্লাস এইটেই ভর্তি করালেন দিলুকে। ইচ্ছে করলে ক্লাস নাইনেও করাতে পারতেন। কিন্তু তা করালেন না একটা কারণে, আর সেটা শুধু বাবাকেই তিনি বলেছিলেন। ”দিলুর যা বিদ্যের বহর তাতে ওকে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করালে ঠিক হত। ওর আত্মসম্মানে আঘাত লাগবে বলে সেটা আর করলুম না। কী করে যে এইট পর্যন্ত উঠল, ভেবে পাচ্ছি না। তবে ক্লাস নাইনে উঠতে হলে ওকে আদাজল খেয়ে প্রথম থেকেই লাগতে হবে, বাবা তুমি একটু কড়া হও।”

প্রথম দিন বাসু ক্লাস ঘরের বাইরে দিলুর জন্য অপেক্ষা করে থেকেছিল, ওকে সঙ্গে নিয়ে বাসু ক্লাসে ঢোকে, দু’জনে পাশাপাশি বসে। দিলুকে ইতিমধ্যেই অনেক ছেলে চিনে ফেলেছে তার অবিশ্বাস্য ফিল্ডিং ক্ষমতার গল্প শুনে। সে যে একদিন নামকরা ক্রিকেটার হবে এমন একটা ধারণা স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে চাউর হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। ফলে সবারই নজর তার ওপর। এটা তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। শিক্ষকরা ক্লাসে তার প্রতি একটু বেশি মনোযোগী, কারণ দিলীপ হরিসাধনবাবুর ভাগ্নে, এটা তাকে বিপদে ফেলে দিয়েছে।

প্রতি সারই পড়াতে পড়াতে তার দিকে তাকিয়ে বলবেন, ”বুঝতে পেরেছ? না পারলে জিজ্ঞেস করো, বারবার করো যতক্ষণ না মাথায় ঢুকছে।” দিলু ঘাড় নেড়ে জানায় সে বুঝেছে। কিন্তু আসলে সে বিন্দুবিসর্গও বোঝেনি। আর সেটা বুঝতে পারে তার পাশে বসা বাসু। সে ফিসফিস করে দিলুকে বলে, ”ঘাড় নাড়লে যে কিছুই তো বোঝনি, সারকে জিজ্ঞেস করো।” জিজ্ঞেস করতে হলে বিষয়টি সম্পর্কে কিছুটা জানা থাকা চাই, তাও সে ভাল করে জানে না। কলকাতার স্কুলে তার এই ঝামেলা ছিল না। সাররা জানতেন তাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। শুধুই সময় নষ্ট, তাই কেউ তার দিকে দৃকপাতও করতেন না।

অন্ধকার ঘরে পঞ্চাননের পাশে রাত্রে চিত হয়ে শুয়ে সে ফিসফিস করে বলল, ”দাদু জেগে আছ?”

”আছি, কিছু বলবে?”

”হ্যাঁ। আমার খুব অসুবিধে হচ্ছে স্কুলে। সারেরা যা পড়ান আমি বুঝতে পারি না।”

”কেন পারো না সেটা কি ভেবে দেখেছ?”

”হ্যাঁ। পড়ায় আমি মন দিতে পারি না। সবসময় শুনি আমার মাথা নেই মাথা নেই, আমার দ্বারা লেখা পড়া হবে না, আমি মুখ্যু হয়ে থাকব। আচ্ছা দাদা, কী করলে পড়াশুনোয় ভাল হওয়া যায়, তুমি জানো?”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পঞ্চানন বললেন, ”জানি।”

”জানো?” দিলু পাশ ফিরে দাদুর মুখোমুখি হল।

”বল ধরে উইকেটে ছোড়ার সময় গোটা মাঠটা চোখের নজরে থাকে না, শুধু তিনটে স্টাম্প নজরে থাকে?”

”শুধু তিনটে স্টাম্প ছাড়া আর কিছু দেখি না। অন্য কিছু তখন দেখতে গেলে বলটা এধার—ওধার হয়ে যাবে।”

”অর্জুন পাখির চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখেননি, গল্পটা তো জানো।”

”জানি।”

”রোজ যেমন ফিল্ডিং প্র্যাকটিস করো তেমন রোজ দু’বেলা পড়া নিয়ে বসবে আর বোলারের হাত থেকে বেরিয়ে আসা বলটা সারা মনপ্রাণ দিয়ে যেভাবে বুঝতে চেষ্টা করো ঠিক সেইভাবে পড়ায় মনপ্রাণ আটকে দেবে, বুঝতে চেষ্টা করবে পড়াটা, তা হলেই পারবে।”

”বলছ পারব?” বালিশ থেকে দিলুর মাথা উঠে গেল।

”নিশ্চয় পারবে। পড়াশুনো ব্যাপারটা একদমই শক্ত জিনিস নয়। বাসুকে দেখো না, যখন পড়ে কি লেখে তখন ওর কানের পাশে অ্যাটম বোমা ফাটলেও শুনতে পাবে না।”

”বাসু তো খেলে না, আমি কি খেলা বন্ধ করে দোব?”

”একদম নয়। বাসু একধরনের, তুমি আর—এক ধরনের। ওর মনের ডিসিপ্লিনটা তুমি লক্ষ করবে, ওটা তোমার খেলাতেও লাগবে। গল্প শুনেছি গাওস্করের এই ডিসিপ্লিনটা ছিল, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে গিয়ে শুধু বলটাকেই দেখত। এই দেখাটাকে রোজ অভ্যাস করতে হয়, তুমি কখনও তা করোনি।”

দিলু চুপ করে রইল। পঞ্চানন আর কথা বাড়ালেন না, তিনি চাইলেন দিলু ভাবুক। লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকাটা ওর আত্মসম্মান বোধকে আঘাত করেছে, এটাই ভাল লক্ষণ।

পঞ্চানন ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন সূর্য ওঠার, সূর্যকে প্রণাম করে দিনের কাজ শুরু করেন। সেদিনও অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠে বারান্দায় এলেন। রেলিং ধরে পুকুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বাতাস এই সময় স্তব্ধ থাকে। পাখিদের ডাক ছাড়া প্রকৃতিতে কোনও সাড় নেই। নিজের মধ্যে মগ্ন হওয়ার এটাই ঠিক সময়। পঞ্চানন মগ্ন হয়ে গেলেন।

”দাদু।”

পঞ্চানন চমকে তাকালেন প্রায়ান্ধকার বারান্দার অপর প্রান্তে। চেয়ারে দিলু বসে, পঞ্চানন কাছে এলেন, ”দাদু তুমি! এখনও তো ভোর হয়নি।”

”শুধুই পাখির চোখ দেখার জন্য অর্জুন কী করেছিলেন সেটাই খুঁজছি। গাওস্কর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে যায় কী করে সেটা আমায় জানতে হবে।”

”খোঁজে, জানো। এটা তোমাকে নিজে—নিজেই করতে হবে।” পঞ্চানন ঝুঁকে দিলুর কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ”দাদু তুমি পারবে, তুমি আমার সেরা নাতি হবে।”

কয়েকদিন পর রবিবার সকালে মোটরবাইকে প্রতাপ এসে হাজির। দিলু তখন দোতলার বারান্দায় টেবলে বাসুর মুখোমুখি বসে ‘আধুনিক যুগ’ বিষয়ে ছোট ছোট দশটি প্রশ্নের উত্তর তৈরি করার জন্য ইতিহাসের বই পড়ে যাচ্ছে। বাসুকে লিখতে হচ্ছে রচনা। ক্লাসে বাংলার সার যেসব পয়েন্ট বলে দিয়েছেন খাতা থেকে সেগুলো দেখে সে ‘সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা’ সম্পর্কে লিখছে। পঞ্চানন একতলায় ছেলের বসার ঘরে তাকে খোঁজাখুজি করছেন বই। মোটরবাইকের শব্দ শুনে বেরিয়ে এলেন।

”মেসোমশাই দিলু আজ প্র্যাকটিসে যায়নি, কী ব্যাপার?”

”স্কুলে টাস্ক দিয়েছে তাই করছে।”

”ওকে একবার কলকাতা যেতে হবে সি এ বি—তে নামটা রেজেস্ট্রি করাতে, আমিই নিয়ে যাব।”

”কবে?”

”কাল কি পরশু।”

”প্রতাপ একটা কথা মনে রেখো, ওর বাবা—মা কিন্তু খেলার ঘোর বিরোধী। যদি জানতে পারে কলকাতার মাঠে খেলছে তা হলে আমাদের মুখ আর দর্শন করবে না মলু। আমি এই নিয়ে খুবই চিন্তার মধ্যে আছি।”

শুনে প্রতাপও চিন্তায় পড়ে গেল। সে বলল, ”তা হলে কি আপনি পিছিয়ে যাচ্ছেন? দিলুকে কি কলকাতায় খেলতে দেবেন না?”

”না, না, তা বলছি না। তবে এমন একটা কিছু ভাবো যাতে ওর বাড়ির লোকেরা যেন জানতে না পারে। পড়া নিয়ে এখন ও খুব খাটছে, মোটামুটি ধরে ফেলেছে। এখন ওর মানসিক উৎসাহটা চাই আর সেটা পাবে ওর সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা থেকে।”

”তা হলে তো ওকে মাঠে যেতে হবে।”

পঞ্চানন শঙ্কিত স্বরে বললেন, ”হবে, কিন্তু লুকিয়ে। যদি দিলু চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে, আমার ধারণা করবেই, তা হলে তো খবরের কাগজ ঝাঁপিয়ে পড়বে।”

”নিশ্চিত থাকুন মেসোমশাই, ময়দানে আমাদের খেলায় কোনও রিপোর্টার আসে না, সাধারণ পাবলিক তো আসেই না। প্লেয়ারদের আত্মীয় কি বন্ধুবান্ধব দু—চারজন হয়তো খেলা দেখে, আমরা তো মোহনবাগান—ইস্টবেঙ্গল নই। খবরের কাগজ দিলুর কথা জানবেই না।” প্রতাপকে নিশ্চিন্ত দেখাল।

পঞ্চানন অবাক হয়ে বললেন, ”বলছ কী, খবরের কাগজে না বেরোলে দিলুর ট্যালেন্টের কথা দেশের লোক জানবে কী করে? ওটাই তো আসল ব্যাপার। দিলুকে তো বাংলার ক্রিকেট কর্তাদের চোখে পড়তে হবে, নইলে ও উঠবে কী করে?”

”এ তো মহা সমস্যায় পড়া গেল। কাগজে নাম বেরোনো চাই অথচ বাড়ির লোক জানবে না, তা কী করে হয় মেসোমশাই। বাড়ির লোকেরা মুখ্যু তো নয়, খবরের কাগজ পড়বেই, খেলা পছন্দ করে না বলে হয়তো খেলার পাতা পড়বে না কিন্তু পাড়ার লোকজন কি বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে শুনে ফেলতে তো পারে।”

”তা তো পারেই, আর তা হলেই সর্বনাশটা হয়ে যাবে। তুমি এ বছরটা বাদ দাও প্রতাপ, পড়াশুনোয় একটু ভাল রেজাল্ট করলে ওর বাপ—মাকে তখন বুঝিয়ে সুঝিয়ে নরম করতে পারব।”

প্রতাপ হতাশ হয়ে বলল, ”একটা বছর নষ্ট হবে। ভেবেছিলুম পনেরো বছরেই ওকে ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলাব।”

”অত কম বয়সে এদেশে কেউ খেলেছে নাকি?” পঞ্চানন কৌতূহলী হয়ে উঠলেন।

”বলেন কী? পাঞ্জাবের ধ্রুব পাণ্ডভ! কী ট্যালেন্টেড ব্যাটসম্যান যে ছিল। দিল্লি থেকে ট্যাক্সিতে পাটিয়ালায় বাড়ি ফেরার পথে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল এই তো ক’বছর আগে বিরানব্বুই সালে। ছেলেটা তো পনেরো বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই রঞ্জি ট্রফিতে সেঞ্চুরি করেছিল।”

”আমি তো জানতুম শচীন টেন্ডুলকর সবচেয়ে বাচ্চচা বয়সে রঞ্জি ট্রফিতে সেঞ্চুরি করে।”

”না মেসোমশাই, ধ্রুব পাণ্ডভ মারা না গেলে ওর কথাই মনে রাখতেন, শচীন সেঞ্চুরি করে সাড়ে পনেরো বছর বয়সে। পাণ্ডভের আর একটা রেকর্ড, সবচেয়ে কম বয়সে এক মরশুমে হাজার রান ও—ই করেছে আঠারো বছর তখনও পূর্ণ হয়নি। রেকর্ড ছিল শচীনেরই। লক্ষ করে দেখবেন যারা বড় হয় তারা মাথাচাড়া দেয় পনেরো ষোলো সতেরো বছর বয়সেই। দিলুর কিন্তু এক্সপোজারটা এখনই হওয়া দরকার। পুজোর পরই নেট পড়বে তখন নজর দিতে হবে ওর ব্যাটিংয়ে। অন্তত চল্লিশ—পঞ্চাশটা রান করার মতো না হলে শুধু ফিল্ডিং দিয়ে কতটা আর এগোবে।”

”তুমি কি এই সিজনেই দিলুকে মাঠে নামাতে চাও?”

”পারলে তাই নামাব, কিন্তু যে বাধার কথা বললেন তাতে তো হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। কী যে মুশকিল হল!” প্রতাপের গলা নেতিয়ে পড়ল।

”দেখি একটু ভেবে, তুমি বিকেল পর্যন্ত আছ তো, একবার ঘুরে যেও।”

প্রতাপ চলে যাওয়ার পর পঞ্চানন দোতলায় এলেন। দিলু টেবলে ঘাড় নিচু করে লিখে চলেছে, বাসুও লেখায় ব্যস্ত। ওরা মুখ তুলে তাকাল না। পঞ্চানন রেলিং ধরে পুকুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে মনে ভেবে যাচ্ছেন দিলুর খেলার জন্য কী করতে পারেন।

”এভাবে দাঁড়িয়ে কী ভাবছ দাদু?”

দিলুর প্রশ্নে চমকে উঠে পঞ্চানন ফিরে তাকালেন। বই খাতা বন্ধ করে দিলু উঠে দাঁড়াল। বাসুও লেখা বন্ধ করল।

”হয়ে গেছে তোমাদের?”

বাসু ঘাড় নাড়ল। পঞ্চানন বললেন, ”বিকেলে খাতা দেখে দোব, এখন থাক।”

”মনে হচ্ছে আপনি খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন।” ভ্রূ কুঁচকে বাসু বলল।

”তা একটু পড়ে গেছি।” এই বলে পঞ্চানন প্রতাপের সঙ্গে তাঁর যা কথাবার্তা হয়েছে ওদের বললেন। শুনে দিলুর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। বাসু চুপ করে রইল।

একতলা থেকে হর্ষর গলা শোনা গেল ”অ দিলু—বাসু তোরা নাইতে যাবি না?” রবিবার দুপুরে বাসু এই বাড়িতে ভাত খায়। ওরা গামছা নিয়ে তেল মাখতে মাখতে পুকুরঘাটের দিকে যাচ্ছে, হঠাৎ বাসু দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ”দিলু একটা কাজ করলে হয় না, তোমার নামটা যদি বদলে দেওয়া যায়?”

অবাক হয়ে দিলু তাকিয়ে রইল, ”সে কী! নাম বদলাব?”

”হ্যাঁ বদলাবে। তা হলে কাগজে নাম বেরোলেও বাড়ির কেউ ধরতে পারবে না।”

”য্যাহহ, এভাবে কি খেলা যায়! খেলবে একজন আর নাম হবে আর একজনের।”

”নামটা শুধু বদলে নেওয়া, তাতে অসুবিধের কী আছে। কত লোকই তো ছদ্মনাম নেয়। এই তো যে অভিধানটা দাদুর ঘরে রয়েছে, চলন্তিকা, ওটা লিখেছেন রাজশেখর বসু, আবার উনিই গল্প লিখেছেন পরশুরাম নামে। দুটো নাম নেওয়া অনেক লোকই আছে তুমিও নয় থাকবে, তাতে অসুবিধে কী, বরং সুবিধের কথাটা ভাবো।”

বাসুর কথায় দিলু দ্বিধায় পড়ে গেল। মন থেকে বাসুর যুক্তি সে মানতে পারছে না, আবার খেলার সুযোগ তৈরি করার জন্য এই চালাকিটাও তার মন্দ লাগছে না। তাকে দোনামনার মধ্যে থাকতে দেখে বাসু বলল, ”আসল ব্যাপার তো ধরা না পড়ে খেলে যাওয়া, তুমি তো চুরি—ডাকাতি করার জন্য নাম বদলাচ্ছ না, বদলাচ্ছ একটা ভাল উদ্দেশ্যেই। যখন নাম হয়ে যাবে, দেখবে তোমার বাবা—মা কিছু বলবেন না। বরং গর্ব করে বললেন, দিলু আমাদের ছেলে, আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে।”

বাসুর কথা শুনতে শুনতে চকচক করে উঠল দিলুর চোখ। সে মনের চোখে নিজেকে দেখতে পেল ইডেনের মাঠ থেকে ক্লাব হাউসের ড্রেসিংরুমে ফিরছে, হাততালি দিতে দিতে পেছনে আসছে শচীন, সৌরভ, রাহুল। লোকে দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিচ্ছে, দিলু, দিলু নাম ধরে সারা স্টেডিয়াম থেকে চিৎকার ভেসে আসছে, ততদিনে লোকে অবশ্য জেনে গেছে তার আসল নামটা। নকল থেকে আসল নামে ফেরাটা কী আর এমন শক্ত ব্যাপার!

”দিলু, মানুষ বাঁচার জন্য অনেক সময় অন্য নাম নেয়, তোমার খেলাকে বাঁচাবার জন্য একটা কোনও নাম নিলে তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।” কথাটা বলেই বাসুর কী যেন মনে পড়ে গেল, বলল, ”জানো তো পাণ্ডবরাও অজ্ঞাতবাসের সময় বিরাটরাজের বাড়িতে এক—একজন ছদ্মনাম নিয়ে থেকেছিলেন। ওরা নিতে পারলে তুমিই বা পারবে না কেন?”

”ঠিক আছে, নোব।” বলেই দিলু দু’হাত বাড়িয়ে জলে ঝাঁপ দিয়ে হাত পাড়ি দিতে শুরু করল।

বিকেলে প্রতাপ এল। পঞ্চানন বারান্দা থেকে তাকে দোতলায় উঠে আসতে বললেন।

”ভেবে দেখলেন?” প্রতাপ দোতলায় উঠেই বলল।

”দেখেছি। তবে আমি নয়, বাসু।” পঞ্চানন হাসিমুখে বললেন। বাসু খেয়েদেয়ে দুপুরেই ছোট হুড়ায় ফিরে গেছে। ”ছেলেটার সত্যিই মাথা আছে।”

পঞ্চাননের মুখ দেখে প্রতাপ আশান্বিত হল। ”ব্যাপার কী বলুন তো! মনে হচ্ছে রাস্তা বের করে ফেলেছেন।”

”দিলুর নামটা বদলাতে হবে। কাগজে নাম বেরোলেও বাড়ির লোক ধরতে পারবে না। শুধু দেখতে হবে ছবি যেন না বেরোয়।”

প্রতাপ চোখ বুজে রইল কয়েক সেকেন্ড। চোখ খুলল বিশাল একটা হাসি মুখে মাখিয়ে। ”ছবি নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না মেসোমশাই। লোকাল ক্রিকেটের ছবি খবরের কাগজে কখনও বেরোয় না।”

.

উত্তরপল্লী সঙ্ঘ বরানগরের ক্লাব, সেখানে একটা ছোট মাঠে তাদের নেট প্র্যাকটিস হয়। দিলু প্র্যাকটিস করে দুধঘাট স্কুলের মাঠে। প্রতিদিন স্কুল ছুটির পরই মাঠে নেমে পড়ে ফিল্ডিং ঝালিয়ে নিতে। তারপর নেটে ব্যাটিং।

”ও কী ও কী, ড্রাইভ করলে কিন্তু বলটা উঠে গেল কেন? শর্ট একস্ট্রা কভার তো বুকের কাছে ক্যাচটা পেয়ে যাবে। আগের বলটাতেও দেখলাম এই ব্যাপার হল, লং অফে পল্লব ক্যাচটা নিল। অল অ্যালং দ্য কার্পেট বল যাবে এমনভাবে ড্রাইভ করো। মারার সময় মুখ উঠে যাচ্ছে, বডি থেকে ব্যাট দূরে থাকছে। পিচের কাছে পা পৌঁছচ্ছে না বলে।”

দিলু মুখ নামিয়ে প্রতাপের কথাগুলো শুনল। ব্যাট হাতে ক্রিজে আবার স্টান্স নিয়ে বলল, ”ঠিক আছে।” মনে মনে স্মরণ করল প্রতাপদার কথাগুলো: মাথা নড়বে না, স্থির রাখবে, সামনের পা বলের পিচের কাছে নিয়ে যাবে, মাথা একটু নামাবে। এর পর যদি শট কভারে দিকে মারতে চাও তা হলে বাঁ কাঁধটা সেই মুখো করে শরীরের ভর সামনের পায়ে আনবে। ফলো থ্রুটা হবে সোজা যেদিকে বল মেরেছ।

বোলার বল করল শর্ট পিচ অফ স্টাপের এক হাত বাইরে। দিলু স্কোয়ার কাট করতে গিয়ে ফসকাল।

”কেন ফসকালে? এমন বলেই তো ব্যাটসম্যানের আহ্লাদ হয়। তুমি পা একদম না নড়িয়ে একই জায়গায় রেখে ব্যাটটা চালিয়েছে। এই দ্যাখো।” এই বলে প্রতাপ দিলুর হাত থেকে ব্যাটটা নিয়ে দেখাল সে কীভাবে ব্যাট চালিয়েছিল। তারপর দেখাল শটটা নেওয়ার সময় ডান পা কোথায় নিয়ে যাবে। ”টিভিতে দেখো টেন্ডুলকর কীভাবে মারে।”

দিলু আবার স্টান্স নিয়ে দাঁড়াল, এবারের বলটা মন দিয়ে লক্ষ করে বুঝল হাফভলি আসছে সোজা তার সামনে। ছয় মারবে কি? মুহূর্তে বিচার বদলে ফেলে সে প্রতাপদার কথামতো ড্রাইভ করল। ঘাসের ডগা ঘষড়ে বিদ্যুৎগতিতে বোলারের বাড়ানো ডান হাতের পাশ দিয়ে বল বেরিয়ে গেল। প্রতাপ হাততালি দিয়ে বলল, ”দ্যাটস ইট।”

আরও কয়েকটা ড্রাইভ করল দিলু, বল উঠল না জমি থেকে। প্রতাপ বলল, ”অনেক তো শট নিলে, ক্রিকেটে শট না নেওয়ারও খেলা দরকার পড়লে খেলতে হয়। এবার তুমি দশটা বল ডিফেন্স করো। এগিয়ে বা পিছিয়ে এমনভাবে বল থামাও যেন ব্যাট লেগে বল সেখানেই পড়ে গাছ থেকে খসে পড়া আপেলের মতো।”

প্রতাপ তিনটি ছেলেকে দিলুর দু’পাশে তিন মিটার দূরে দাঁড় করিয়ে দু’জন অফ স্পিনারকে বল করতে দিল। প্রথম বলটা অফ থেকে একটা ঘুরে এল যে, দিলু একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্যাট সামনে বাড়িয়ে দিল। ব্যাটে লেগে বল শর্ট লেগের হাতে গেল। সে ফ্যালফ্যাল চোখে প্রতাপের দিকে তাকিয়ে রইল।

”ফুটওয়ার্ক কোথায়? যেখানে পিচ পড়ল পা বাড়িয়ে সেখানেই তো বলটা ব্যাট দিয়ে থাবড়ে দিতে পারতে। আবার বলছি ফুটওয়ার্ক ছাড়া ব্যাট করা যায় না। এতকাল শুধু ছয় মেরে গেছ এটা ব্যাটিং নয়, এবার ব্যাট করাটা শেখো।”

দিলু দশটা বল খেলল তাতে দু’বার ব্যাটের কানায় লাগল, দু’ বার লাগল প্যাডে, একটা ফসকাল, বাকিগুলো ঠিকঠাক আটকাল। বাসু নেটের বাইরে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিল। দিলু যখন পরের ব্যাটসম্যানকে দেওয়ার জন্য প্যাড খুলছে বাসু ডাকল, ”দুলু।” দিলু তখন মুখ নামিয়ে একহাঁটু মুড়ে অন্য প্যাড খোলায় ব্যস্ত, বাসুর দিকে তাকাল না। বাসু এবার একটু জোরে ডাকল, ”অ্যাই দুলাল।” দিলু মুখ তুলে তাকিয়ে কপালে কুঁচকে বলল, ”আমাকে বলছ?” তারপর হো হো করে হেসে উঠল। ”তাই তো ভুলেই গেছলুম আমি দুলাল কর।”

ভবানীপুর মাঠে উত্তরপল্লীর প্রথম লিগ খেলা ইয়াং ফ্রেন্ডসের সঙ্গে। উত্তরপল্লীর ক্যাপ্টেন সনৎ দত্ত যে প্লেয়ার্স লিস্ট আম্পায়ারকে দিলে তাতে এগারো নম্বরে লেখা ডি কর। নতুন ছেলে, বয়স কম, কারও সঙ্গে কথা বলছে না, টেন্টের বাইরে একা চুপচাপ। শুধু প্রতাপ লাহিড়ি ওর সঙ্গে বার দুয়েক কথা বলে সনৎকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ”সনৎ একে একটু দেখিস, ময়দানে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামছে।”

সনৎ স্মিত হেসে দিলুর কাঁধ ধরে ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ”নার্ভাস লাগছে?”

দিলু মাথা নেড়ে বলল, ”না।”

”আগে কোন ক্লাবে খেলেছ?”

”বিজয়ী সঙ্ঘ।”

সনৎ চোখ কুঁচকে প্রতাপের দিকে তাকাল। প্রতাপ তাড়াতাড়ি বলল, ”মৌলালির অ্যালবার্ট স্কোয়্যারের ক্লাব, খুবই ছোট ক্লাব।”

সনতের খেলোয়াড়—জীবনে এটাই প্রথম ঘটনা তার দলের এগারোজনের সবাইকেই সে চেনে না। এগারো নম্বরের ডি কর ব্যাট করে না বল করে তাইই সে জানে না। গতরাতে সেক্রেটারি প্রতাপ লাহিড়ি বাড়িতে ফোন করে বলেছিল, ”সনৎ একটা নতুন ছেলেকে কাল খেলাব। স্কুলে পড়ে। দেখা যাক টিকতে পারে কি না, পারলে মনে হয় অনেকদূর যাবে, একটু গাইড করিস।”

নতুন ছেলে সম্পর্কে সনৎ তখন কিছু জিজ্ঞেস করেনি। এরকম নতুন ছেলে প্রতিবছরই দু—তিনজন আসে, একটা দুটো ম্যাচ খেলিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়, এই ছেলেটাও হয়তো সেই রকম একটা দুটো ম্যাচের জন্য এসেছে। প্লেয়াস লিস্টে নামগুলো লিখে দিয়েছে প্রতাপ। ডি কর নামটা এগারো নম্বরে। দেখেই সনৎ ধরে নেয় বোলার।

”কী বল করো?” সনৎ জিজ্ঞেস করল। দিলু তাকাল প্রতাপের দিকে।

”দুলাল বোলার নয়।” প্রতাপ স্বর নামিয়ে বলল। সনৎকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে দেখে সে যোগ করল, ”সাত নম্বরে ব্যাট করবে।”

টস হল। জিতেছে ইয়াং ফ্রেন্ডস, তারা প্রথম ব্যাট করবে। মাঠে নামল সনতের সঙ্গে দশজন। ধর্মতলায় মাঠটা শহিদ মিনারের ধারেই বাসস্ট্যান্ডের লাগোয়া, আশেপাশে খাবারের দোকান, লোকজনের ভিড় লেগেই আছে। মাঠের আউটফিল্ডের বহু জায়গায় ঘাস নেই, যেখানে আছে ঘাস সেখানে বড় বড়। জমি অসমান, কাগজ, ফলের খোসা, ভাঁড়ের টুকরো, শালপাতা ইতস্তত ছড়িয়ে। দুধঘাটের মাঠ পলকের জন্য দিলুর চোখে ভেসে উঠল আর তখনই সনৎ তাকে আঙুল দিয়ে লং লেগের দিকটা দেখিয়ে বলল, ”ওখানে।”

যে ওপেন করল সে প্রথম তিনটি বল অফস্টাম্পের অনেকটা বাইরে দেখে ছেড়ে দিল। চতুর্থ বল মিড অফে ঠেলে দিয়ে একটা রান নিল। এবার বল পড়ল শর্ট পিচ, ব্যাটসম্যান সপাটে ঘুরিয়ে বাট চালাল। দিলু দেখল বল তার দিকেই আসছে। ফিল্ড করার সময় বলের জন্য সে অপেক্ষা করে না, তা করলে ব্যাটসম্যান রান নেওয়ার সময় পেয়ে যায়। তাই সে বলের দিকে ছুটে গিয়ে সময় কমিয়ে দেয়। এখনও সে তাই করল। বলটা ডান হাতে কুড়িয়েই ছুড়বে বলে সে নিচু হয়েছে আর তখনই অপ্রত্যাশিত জমির একটা উঁচু জায়গায় ঠোক্কর খেয়ে বলটা লাফিয়ে তার নাক আর কপালের মাঝে লাগল।

রক্ত ঝরছে তার নাক দিয়ে। রুমাল চেপে তাকে টেন্টে আনা হল। নাক ফুলে উঠেছে, সামান্য একটু কেটেছে। ”প্রথম ম্যাচে প্রথমবার বল ধরতে গিয়েই এমন অমুঙ্গুলে কাণ্ড!” প্রতাপকে বিচলিত দেখাল।

ডাক্তার খোঁজা হল, পাওয়া গেল না। ডেটল দিয়ে ধুয়ে প্লাস্টার লাগিয়ে দিলুকে একটা চেয়ারে বসিয়ে রাখা হল। একজন বরফ আনতে ছুটল। এক ঘণ্টা খেলার পর জলপান বিরতি। ইয়ং ফ্রেন্ডসের তখন বিনা উইকেটে চুয়াত্তর রান। ওপেনার দু’জন মারার বল প্রচুর পেয়েছে। এতক্ষণ রুমালে মোড়া বরফের টুকরো দিলু নাকে চেপে ধরে বসে ছিল। এবার প্রতাপের কাছে গিয়ে সে বলল, ”আমি নামব, ঠিক হয়ে গেছি।”

”গুড, ভেরি গুড, এই তো চাই।” প্রতাপকে খুবই উৎসাহী দেখাল। ”যাও, নেমে পড়ো।”

দিলু ছুটতে ছুটতে মাঠে গিয়ে বলল, ”আমি ফিট। সনৎদা এবার আমায় কভারে ফিল্ড করতে দিন।”

সাবস্টিটিউট মাঠ ছেড়ে ফিরে গেল। দিলু আম্পায়ারকে জানাল সে আবার খেলতে নেমেছে। সনৎ তাকে কভারেই রাখল। শুরু হল খেলা। ব্যাটসম্যান প্রথম বলটাই ড্রাইভ করল একস্ট্রা কভারে, কলকাতার মাঠে দুটো রান তো নেওয়া যায়ই। দিলুর ডান দিকে দশ মিটার দূর দিয়ে বল যাবে, সে তাড়া করল। চাঁদোয়ার নীচে স্কোরারের পাশের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল প্রতাপ, অস্ফুটে সে স্কোরারকে বলল, ”এবার একটা রান আউট দেখ।”

বলটা ছোঁ মেরে তুলে একই সঙ্গে সে বোলারের উইকেটে ছুড়ল। ওরা দ্বিতীয় রানটা নিচ্ছিল। বোলারের প্রান্তে যাচ্ছিল যে, পপিং ক্রিজের দু’মিটার আগে সে হতাশ হয়ে দেখল উইকেট ভেঙে গেল, বেলদুটো ছিটকে পড়ল তিন—চার হাত দূরে। ফিল্ডাররা ছুটে গেল দিলুর দিকে। অচেনা নতুন বাচ্চচা ছেলে তাই সবাই পিঠ চাপড়াল, নয়তো ওকে জড়িয়ে ধরত। এক উইকেটে পঁচাত্তর রান। তিন নম্বর ব্যাটসম্যান গার্ড নেওয়ার পর আধমিনিট ফিল্ডারদের অবস্থান দেখে স্টান্স নিল।

প্রথম বলটা সে মিড অফে পুশ করে সাত—আট পা এগিয়ে গেল, দিলুকে বলের দিকে ছুটে যেতে দেখে থেমে গেল। ঘুরে ক্রিজে ফিরতে লাগল অলস ভাবে হেঁটে। তার ভাবখানা, একটা রান তো ছিলই, নন—স্ট্রাইকার কেন যে বেরোল না। এর পরই সে হতভম্ব হয়ে চোখের সামনে দেখল তার অফস্টাম্পকে ডিগবাজি খেতে। তাড়াতাড়ি সে ক্রিজের ওপারে ব্যাট রাখল। উইকেটকিপার আর দু’জন স্লিপ ফিল্ডার চিৎকার করে অ্যাপিল করতেই স্কোয়ার লেগ আম্পায়ার আঙুল তুললেন। অবিশ্বাস্য রান আউট। ফিল্ডাররা ছুটে গিয়ে দিলুর কাঁধ ধরে ঝাঁকাল। একজন তো গলা জড়িয়ে ধরল। একজন বলল, ”মিরাকুলাস।”

ইয়াং ফ্রেন্ডসের দুই উইকেটে পঁচাত্তর। পরপর দু’বলে দুটো উইকেট পড়ে গেল এবং সে দুটো কোনও বোলার পায়নি।

এক নম্বর ব্যাটসম্যান এখনও ক্রিজে, এল চার নম্বর। সনৎ তাকে ঘিরে দিল তিনজন ফিল্ডার দিয়ে। দিলুকে আনল সিলি পয়েন্টে। ব্যাটসম্যান আড়চোখে তাকে দেখল, চোখে সন্দেহ আর ভয়, উঁচু করে দেওয়া অফস্পিন বল, ব্যাটসম্যান দু’পা বেরিয়ে পিচের কাছে পা বাড়িয়ে ঝুঁকে কপিবুক রক্ষণাত্মক খেলল। ব্যাটের কানায় লেগে বলটা ঘুরে গেল সিলি পয়েন্টে। ঝোঁকানো শরীর তোলার সময় নেই দেখে সে দ্রুত ডান পাটা জমিতে ঘষড়ে ক্রিজের দিকে ঠেলে দিল কিন্তু দাগের ওপারে পৌঁছল না এবং ততক্ষণে অফস্টাম্পে লাগা বল ছিটকে প্রথম স্লিপের পায়ের কাছে। সে—ই প্রথম ছুটে গিয়ে দিলুকে বুকে জড়িয়ে জমি থেকে এক ফুট তুলে ধরল।

”হ্যাটট্রিক হ্যাটট্রিক,” চাঁদোয়ার নীচে দু’হাত তুলে নাচছে প্রতাপ। ”ফিল্ডারের হ্যাটট্রিক শুনেছে কেউ কখনও, তিনটেই ডাইরেক্ট থ্রো থেকে, কারও সাহায্য ছাড়াই।” এর পর স্কোরারকে ধমকে বলল, ”হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে না থেকে তিনটে রান আউটের পাশে লেখো ডাইরেক্ট থ্রো বাই ডি কর।”

ইয়াং ফ্রেন্ডসের রান তিন উইকেটে পঁচাত্তর। এর পর দু’জন ব্যাটসম্যানের কেউই আর রান নিতে ভরসা পেল না, যেদিকে দিলু রয়েছে। কভারে দিলুকে রেখে সনৎ বোলারদের নির্দেশ দিল অফস্টাম্পের বাইরের দিকে বল করতে। তারা সেইভাবেই বল করে যেতে লাগল। ব্যাটসম্যানরা যা মারে সবই মিড অফে বা কভারে যাচ্ছে। দিলুকে ছুটে যেতে দেখলেই তারা রান নিতে আর দৌড়য় না। শেষে বেপরোয়া হয়ে এক নম্বর ব্যাটসম্যান অফ স্টাম্পের বাইরের একটা ওভারপিচ বল ঘুরিয়ে মিড উইকেটে মারল, ব্যাটে ঠিকমতো বলটা না—লাগায় ক্যাচ উঠে গেল কভারে, দিলু সহজেই ধরে নিল। ইয়াং ফ্রেন্ডস চার উইকেটে আশি।

দশ রান যোগ হওয়ার পর আর একটি উইকেট পড়ল। বোল্ড। পরের ব্যাটসম্যান, দিলু—ভীতি কাটাবার জন্য তুলে ছয়—চার মেরে তিরিশটা রান করল এগারো বলে। শেষ পর্যন্ত সে স্টাম্পড হল। ছয় উইকেটে একশো কুড়ি। আট নম্বর ব্যাটসম্যান এসে দ্বিতীয় বলটা ঠেলল পয়েন্টে দিলুর পাশ দিয়ে, বল কুড়োতে সে ছুটল প্রায় পঁচিশ মিটার, ব্যাটসম্যান সেইদিকে তাকিয়ে, এর পরই সে আবিষ্কার করল নন—স্ট্রাইকার তার পাশে উত্তেজিত স্বরে বলছে, ”ছোট ছোট।” স্ট্রাইকার বলল, ”এখন আর ছুটে কী হবে।” দিলুর ছোড়া বল ধরে বোলার ততক্ষণে বেল ফেলে দিয়েছে। ”বলটা কে চেজ করছে আগে সেটা দেখবি তো।” বলতে বলতে সে মাঠ ছাড়ল।

সাত নম্বর ব্যাটসম্যান এখনও রয়ে গেছে এবং ইনিংসের শেষ পর্যন্ত নট—আউট রয়ে গেল ছত্রিশ বলে ছয় রান করে। শেষ তিন ব্যাটসম্যান একটি লেগবাই বাউন্ডারি সহ তোলে আট রান। এগারো নম্বরের ক্যাচ দিলু নেয় ব্যাকোয়ার্ড পয়েন্টে। ইয়াং ফ্রেন্ডস এক উইকেটে ছিল পঁচাত্তর রানে, সেখান থেকে অল আউট একশো তেত্রিশে, দিলু মাঠে ফিরে আসার পর দশটা উইকেট পড়ে আটান্ন রানে।

ছয় নম্বরে নামার জন্য দিলু প্যাড পরেছিল। উত্তরপল্লী চার উইকেটে একশো পঁয়ত্রিশ করায় তাকে আর মাঠে নামতে হয়নি। প্রতাপের মুখ থমথমে, উত্তেজনা চেপে রাখার চেষ্টায়। গতরাত থেকে সে সিঁটিয়ে ছিল, মনে মনে বলে গেছে ”ডোবাসনি দিলু ডোবাসনি।” সকাল সাতটার মধ্যে সে মোটরবাইকে দুধঘাটে পৌঁছে দেখে দিলু পুকুরে সাঁতার কাটছে। আশ্চর্য, ছেলেটার কোনও টেনশন নেই, এই সময়ে কি কেউ জলে ঝাঁপাঝাঁপি করতে পারে! আটটার সময় দাদুকে মামাকে মামিকে প্রণাম করে সে প্রতাপের পেছনে বাইকে চড়ে বসে। দু’জনের মধ্যে সারা পথে একটাও কথা হয়নি।

প্রতাপকে জনে জনে জিজ্ঞেস করল, ”ছেলেটিকে পেলে কোথায়?”

”গ্রাম থেকে কুড়িয়ে পেয়েছি।” সে নিস্পৃহ স্বরে জবাব দেয়।

”নাম দেখছি ডি কর, ডি—টা?”

”ডি হল দুলাল।”

”গ্রামের নামটি কী?”

”ছোট হুড়া, ওখানে একটা স্কুলে আমি কোচ করি, দুলু সেই স্কুলে পড়ে।” প্রতাপ হুঁশিয়ার হয়ে বলল। দুধঘাট নামটা যেন চাউর না হয়ে যায়। কোনওভাবে যদি মৌলালির বাড়িতে কথাটা পৌঁছয়, ডি কর নামের একটা ছেলে দুধঘাটে থাকে সে ময়দানে তার প্রথম ম্যাচেই ফিল্ডিং—এ তাক লাগিয়ে দিয়েছে, তা হলে সন্দেহ আর কৌতূহল জাগবেই, ডি কর দিলু নয় তো? প্রতাপ তাই গ্রামের নামটা বদলে দিল।

ভবানীপুর মাঠের লাগোয়াই ক্রীড়া সাংবাদিকদের ক্লাবের তাঁবু। সব কাগজের লোক সেখানে বিকেলে জড়ো হয়। ময়দানে ছড়ানো মাঠগুলোয় যত খেলা হয়েছে তার স্কোরবুক নিয়ে ক্লাবের লোকেরা তাঁবুতে এসে সাংবাদিকদের জানায়। অবশ্য জনপ্রিয় বড় ক্লাবের লোকেরা আসে না, সাংবাদিকরাই তাদের ক্লাবে যায় রেজাল্ট নিতে। উত্তরপল্লীর স্কোরার ছেলেটি খাতা নিয়ে ক্রীড়া সাংবাদিকদের তাঁবুতে গেল। সে মুখচোরা, বুদ্ধিটাও কম। সে স্কোরবুকটা খুলে কথায় ব্যস্ত এক সাংবাদিকের সামনে এগিয়ে ধরল।

”দেখার সময় নেই, সেঞ্চুরি হয়েছে কি না বলো।”

”না।”

”হ্যাটট্রিক হয়েছে?”

”না।”

”ঠিক আছে, রেজাল্টটা বলো।”

”ইয়াং ফ্রেন্ডস একশো তেত্রিশ, উত্তরপল্লী সঙ্ঘ চার উইকেটে একশো পঁয়ত্রিশ তুলে ছ’ ছইকেটে জিতেছে।”

”আর কিছু হয়েছে?”

”উত্তরপল্লীর একটা ছেলে দারুণ ফিল্ড করেছে। দুটো ক্যাচ চারটে রান আউট—”

”ঠিক আছে। মোহনবাগান—ইস্টবেঙ্গলে খেলুক তখন রান আউট ক্যাচট্যাচ লেখা যাবে।”

স্কোরবুক বগলে নিয়ে ছেলেটি তাঁবু থেকে বেরোচ্ছে তখন একজন তাকে পেছন থেকে ডাকল, ”শুনুন।”

সে ফিরে তাকিয়ে দেখল শীর্ণ, চশমাপরা একটি অল্পবয়সী ছেলে, পায়ে চটি, তার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে চলল, ”তখন কী যেন কানুদাকে বলছিলেন—চারটে রান আউট দুটো ক্যাচ, একজনই কি করেছে?”

”তবে না তো বললুম কেন?”

”দেখি স্কোরবইটা?” এই বলে সে স্কোরবইটা বগল থেকে টেনে নিয়ে পাতা ওলটাল, স্কোর দেখতে দেখতে কপালে ভাঁজ তুলে বলল, ”এটা কী লেখা, কীসের হ্যাটট্রিক?”

”রান আউটের। পরপর তিন বলে তিনজনকে ডাইরেক্ট থ্রোয়ে উইকেট মেরে আউট করেছে, এমন ঘটনার কথা শুনেছেন কখনও?”

সেই নবীন সাংবাদিক এধার—ওধার তাকিয়ে স্কোরারকে তাঁবুর গেটের বাইরে টেনে আনল। স্কোরবই থেকে দরকারি তথ্য নোটবইয়ে টুকে নিয়ে ডি কর সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করল।

”আপনার কোন কাগজ?”

”প্রভাতী, নিশ্চয় নাম শোনেননি, যাদবপুর থেকে নতুন বেরিয়েছে। আচ্ছা ছোট হুড়াটা কোথায় বলুন তো?”

”জানি না। বারুইপুর কি শ্রীরামপুরের দিকে হবে।”

”আচ্ছা এই দুলাল আগে কোন ক্লাবে খেলেছে?”

”জানি না।”

ধর্মতলায় মোটরবাইক থেকে নেমে প্রতাপ ওষুধের দোকান থেকে কয়েকটা ক্যাপসুল কিনল। দিলুর হাতে দিয়ে বলল, ”এখনই একটা খেয়ে নাও, রাতে একটা খেও। আর কাল সারাদিনে তিনটে খাবে, ব্যথা কমে যাবে।”

প্রতাপ একটা সফট ড্রিঙ্কসের বোতল কিনে দিলুর হাতে দিয়ে বলল, ”এখানকার জল খুব খারাপ, এই দিয়ে ক্যাপসুলটা গিলে খাও।”

সন্ধ্যা উতরে গেল দুধঘাটে ওদের পৌঁছতে। বাড়ির সবাই অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সুলেখারই চোখ প্রথম পড়ল দিলুর নাকে।

”কী হল নাকে? বেশ ফুলে রয়েছে দেখছি।”

”কিছু না, একটা বল লেগেছে।” দিলু তাচ্ছিল্যভরে বলল। ”এখন ঠিক হয়ে গেছে। ওষুধ খেয়ে নিয়েছি।”

”প্রতাপ হল কী? খেলল কেমন?” হরিসাধন উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইলেন।

মুখে গাম্ভীর্য আর স্বরে ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে প্রতাপ বলল, ”চারটে রান আউট দুটো ক্যাচ, ভাবা যায়। আপনার ভাগ্নে যে কী জিনিস লোকে এইবার জানবে। ফিল্ডিং কাকে বলে আজ তা দেখাল। কত সহজে পটাপট উইকেটে মারল, ক্লাবের ছেলেরা তো থ বনে গেছে। মেসোমশাই আমি বলেছিলুম না আউট অব দিস ওয়ার্ল্ড, ওর ফিল্ডিং পৃথিবীর বাইরের ব্যাপার। ভাল মাঠ পেলে দিলু আজ দেখিয়ে দিত ফিল্ডিং কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়, ছ’জন আউট ওর হাতে। একটা বোলার ছ’টা উইকেট পেলে তাকে নিয়ে নাচানাচি শুরু হয়ে যাবে। দিলু শুধু ফিল্ডিংয়ের জোরেই দেখবেন কত ওপরে ওঠে।”

হরিসাধন ব্যস্ত হয়ে বললেন, ”ওর সামনে এত প্রশংসা কোরো না প্রতাপ, মাথা ঘুরে যাবে।”

পঞ্চানন বললেন, ”ঠিক কথা। তবে প্রশংসা অনেক সময় উৎসাহ বাড়িয়ে উজ্জীবিত করে তোলে, এটাও মনে রেখো। দাদু তা হলে তুমি আজ খেল দেখিয়েছ, কত লোক দেখল?”

প্রতাপ মিয়োনো স্বরে বলল, ”জনা পঞ্চাশেক হবে। বাইশটা প্লেয়ার, তিন—চারজন রিজার্ভ, দুটো করে স্কোরার আর আম্পায়ার, মালীটালি, ঝালমুড়ি, চা—ওলা আর ক্লাব অফিশিয়াল। তবে সবাই খেলা দেখছিল না।”

”খবরের কাগজের লোক?” পঞ্চানন জানতে চাইলেন।

”একজনও না, এসব ম্যাচে ওঁরা আসেন না সেটা একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে।” প্রতাপ হেসে পঞ্চাননের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। ”মৌলালি অন্ধকারে থাকবে।”

মৌলালি অন্ধকারে থাকলেও বাংলার জুনিয়ার নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান আশিস ঘোষ তার যাদবপুরের বাড়িতে সকালে চা খেতে খেতে টেবল থেকে নতুন বেরোনো কাগজ ‘প্রভাতী’ তুলে নিয়ে প্রথমেই খেলার পাতা খুলে চোখ বোলাতে বোলাতে ঝুঁকে পড়ল একটা মোটা হেডিং দেখে: ”সি এ বি লিগে রান আউটের হ্যাটট্রিক।” তার নীচে পাতলা হেডিং : ”গ্রামের ছেলের অবিশ্বাস্য ফিল্ডিংয়ে ছয়জন আউট।” আশিস দ্রুত খবরটা পড়ে নিয়ে টেলিফোন নম্বরের ছোট নোটবইটা থেকে একটা নম্বর বের করে ডায়াল করল।

”কে প্রতাপ?…আমি আশিস বলছি, আজ কাগজে একটা খবর…কাগজটার নাম প্রভাতী, আমাদের এখান থেকে নতুন বেরিয়েছে…না অন্য কোনও বড় কাগজে তো চোখে পড়ল না দুলাল কর যা করেছে সে তো ফ্যান্টাস্টিক। বয়স কত?…পনেরো? ছেলেটাকে দেখতে হবে তো, তোদের পরের খেলা কবে, কার সঙ্গে? …শনিবার, ক্যালকাটা ইউনাটটেডের সঙ্গে ওদের মাঠে? দেখতে যাব।”

.

ইউনাইটেড মাঠ ভবানীপুর মাঠের তুলনায় অনেক ভাল। ফুটবল মরশুম ছাড়া বছরের বাকি সময় এই মাঠের ওপর দিয়ে লোক চলাচল না—করায় ঘাস সমানভাবে চারিয়ে রয়েছে, মাঠের জমিও সর্বত্র সমতল। তাঁবুর ফেন্সিংয়ের বাইরে লোহার চেয়ারে বসে প্রতাপ, আশিস ঘোষের অপেক্ষায়। ব্যাট করছে ইউনাইটেড। প্রথম তিনটি উইকেট পড়ল আট রানে, তিনজনই রান আউট এবং দিলুর ছোড়া বলে। একস্ট্রা কভার আর ডিপ পয়েন্টের মাঝামাঝি জায়গায় সে ফিল্ড করছে। ডান দিকে ও বাঁ দিকে প্রায় চল্লিশ মিটার জায়গা জুড়ে তার রাজত্ব বিস্তৃত।

তিনজনই দ্বিতীয় রান নেওয়ার সময় আউট হয় এবং বোলার প্রান্তে, আউট হওয়ার ধরন আগের ম্যাচের মতোই। ইউনাইটেড ব্যাটসম্যানরা একটাই ভুল করেছে, তারা দিলুকে বুঝে নিতে একটু দেরি করে ফেলেছে, যখন বুঝল অফের দিকে একটা বিপজ্জনক ফাঁদ তাদের বধ করার জন্য পাতা রয়েছে ততক্ষণে তিনজন ফাঁদে ধরা পড়ে গেছে।

প্রভাতীর সেই সাংবাদিকটি, যার নাম অলোকেন্দু, স্কোরারদের টেবলের পাশে একটা চেয়ার টেনে এনে বসে গেছে। সে খুবই খুশি, এখন পর্যন্ত অন্য কোনও কাগজের লোক মাঠে হাজির নেই। সম্পাদক উত্তরপল্লীর আগের ম্যাচের লেখাটার প্রশংসা করে তাকে বলেছেন, ”অন্য কোনও কাগজে তো খবরটা নেই, তুমি ছেলেটার সব খেলা কভার করবে। ভেরি পিকিউলার, শুধু ফিল্ডিংয়েই ছ’—ছ’টা উইকেট নিচ্ছে একজন। ম্যাচটা অবশ্য তুচ্ছ, ব্যাটসম্যানরাও নির্বোধ, কিন্তু ওর ডাইরেক্ট থ্রোগুলো তো সত্যি।”

চোখের সামনে তিনটে থ্রো সোজা উইকেটে লাগল। আরও পাঁচটা মেরেছে কিন্তু তাতে কেউ রান আউট হয়নি। অলোকেন্দু প্রতিটি থ্রোয়ের হিসেব রেখেছে—আট থ্রো, তিন আউট। সে তাঁবুর পাশের রাস্তা দিয়ে একটি লোককে হেঁটে যেতে দেখে মনে মনে আঁতকে উঠল, সর্বনাশ সত্যসন্ধি কাগজের শতদলদা, এখানে এসে পড়বে না তো। শতদল মাঠের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অলোকেন্দুকে দেখে এগিয়ে এল।

”অলোকেন্দু এখানে কী করছ, মোহনবাগান মাঠে যাবে না? এখানে কারা খেলছে?”

অলোকেন্দু মনে মনে বলল, হে ভগবান এখন বল যেন দুলালের কাছে না যায়, ছুড়লেই তো উইকেটে মারবে। তাইতে শতদলদার যদি কৌতূহল জেগে ওঠে, আর এখানেই যদি বসে পড়ে।

”খেলছে উত্তরপল্লী আর ক্যালকাটা ইউনাইটেড। একটুখানি দেখেই মোহনবাগান মাঠে যাব, খেলা তো ইস্টার্নের সঙ্গে।”

”হ্যাঁ, এসো। আমি এগোলাম।”

অলোকেন্দু হাঁফ ছাড়ামাত্র দিলু লংঅফে উঁচু করে ওঠা বলে ক্যাচ ধরল প্রায় তিরিশ গজ ছুটে, গোলকিপারের মতো ঝাঁপিয়ে জমি থেকে চার আঙুল ওপরে। অ্যাপিলের চিৎকারে শতদল থমকে একবার মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে আবার হাঁটতে লাগল। অলোকেন্দু নোটবইয়ে হিসেব লিখল। হাত কাঁপছে। মনে মনে বলল, ভগবান আজ যেন সাতটা হয়, তা হলে চুটিয়ে লিখব। এক ইনিংসের ম্যাচে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বললে কি ভুল হবে? উইকেটকিপারের অনেক শিকার আছে এক ইনিংসে, কিন্তু ফিল্ডসম্যানের ক’টা আছে? দুলাল কর যদি আজ দশটা শিকার করে ফেলে। কেউ নেই, একজনও রিপোর্টার নেই, স্কুপ হয়ে যাবে।

অলোকেন্দু স্কুপ করল বটে তবে দিলুর শিকার—সংখ্যা ভগবান দশটার বদলে করে দিলেন আট। পাঁচ রান আউট, তিন ক্যাচ। মোট তেরোবার স্ট্যাম্পে বল লাগিয়েছে। ক্যালকাটা ইউনাইটেড পঁয়ষট্টি অল আউট। ফিল্ডাররা মাঠ থেকে ফিরছে। প্রতাপও চেয়ার ছেড়ে তাদের সঙ্গে তাঁবুতে ঢুকতে গিয়ে দেখল আশিস ঘোষ দাঁড়িয়ে। প্রতাপ বলল, ”এ কী এখানে দাঁড়িয়ে, কতক্ষণ এসেছিস? বাইরে বসলি না কেন?”

”ভাল করে দেখতে হলে লোকজন থেকে একটু তফাত হয়ে দেখতে হয়।”

”কেমন দেখলি?”

”প্রতাপ, এ ছেলেটা তো ভগবান রে!” আশিস দু’হাত বাড়িয়ে প্রতাপের হাত ধরল।” একাই তো শেষ করে দিল ইউনাইটেডকে। আমি ওর সবকটা রান আউট আর ক্যাচ এখানে দাঁড়িয়ে দেখেছি। যেখান—সেখান থেকে বল তুলে উইকেটে মারে, একটাও মিস করল না, এটা তো জন্মগত ক্ষমতা। না হলে হাজার প্র্যাকটিস করেও এ—জিনিস আয়ত্ত করা যায় না। ওকে চোখে চোখে রাখিস।”

”আমাকে আর রাখতে হবে না, ও যেখানে থাকে সেখানে চোখে রাখার ঠিক লোক আছে। আশিস, এই ছেলেটাকে অপেক্ষা করিয়ে পচিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। ওকে নিজের চোখে তো দেখলি, এবার ঠেলে তুলে দে।”

”আর একটা ম্যাচ খেলুক, ব্যাটটা কেমন করে দেখি, তারপর আন্ডার সিক্সটিনে ওকে ঢোকাবার জন্য মিটিংয়ে নাম তুলব।”

পঁয়ষট্টি রান টপকাতে উত্তরপল্লীর দুটো উইকেট খরচ হল। দিলু এই ম্যাচেও ব্যাট করার সুযোগ পেল না। খেলা আড়াইটের মধ্যেই শেষ।

অলোকেন্দু তখন ফোটোগ্রাফারের জন্য মাথার চুল ছেঁড়ার মতো অবস্থায়। দুলালের একটা ছবি তার চাই। কত ফোটোগ্রাফারই তো কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মাঠে ঘুরে বেড়ায় খবরের কাগজে ছবি বিক্রি করবে বলে। আর আজই কারও পাত্তা নেই। দৌড়ে মোহনবাগান মাঠে গিয়ে খোঁজ করে দেখবে ভেবে সে প্রতাপের কাছে গিয়ে বলল, ”দুলাল এখন দশ—পনেরো মিনিট থাকবে তো, আমি দৌড়ে একজন ফোটোগ্রাফার ধরে আনছি।”

”কীজন্য?” প্রতাপ মনে মনে সিঁটিয়ে প্রশ্ন করল।

অলোকেন্দু অবাক হয়ে বলল, ”কেন ছবি তোলার জন্য। কাল প্রভাতীতে বেরোবে। দুটো ম্যাচে চোদ্দো, ভাবতে পারেন! ওর ছবি বেরোবে না তো কার বেরোবে, প্লিজ দশ মিনিট একে থাকতে বলুন।” বলেই সে ছুটতে শুরু করল মোহনবাগান মাঠের উদ্দেশ্যে।

”দিলু, বিপদ ঘনিয়ে আসছে, কাগজে ছবি বেরোবার ব্যবস্থা হচ্ছে।” দিলুর কানে ফিসফিস করে প্রতাপ বলল, ”এখুনি কেটে পড়তে হবে।”

পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রতাপের মোটরবাইক ছুটল দুধঘাটের দিকে। যখন পৌঁছল তখনও বিকেল। ওরা যখন বাড়ির কাছাকাছি, দেখল রাস্তার ধারে একটা ইটের চাঙড়ের ওপর হর্ষ বসে। মোটবাইক দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল, ”থামো, থামো, এখন আর বাড়িতে যেও না। উফফ কখন থেকে তোমাদের জন্য বসে আছি। দুপুরে মলুদি এসেছে।”

”মা!” দিলুর মুখ শুকিয়ে গেল।

”দিলুর মা? সর্বনাশ করেছে। কী বলা হয়েছে ওঁকে?” প্রতাপ প্রমাদ গনল।

”বউদি বুদ্ধি করে বলেছে, ছোট হুড়োয় এক বন্ধুর বাড়িতে দিলুদাদা ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে গেছে, সন্ধের আগেই এসে যাবে। তোমাদের আগাম জানিয়ে দেওয়ার জন্য মেসোমশাই আমাকে বললেন হষ্য রাস্তায় নিমতলায় গিয়ে বসে থাক। ওদের আসতে দেখলেই কী বলতে হবে শিখিয়ে দিবি। আর বলবি, খুব ভাল হয় যদি দিলু মাছ হাতে বাড়ি ফেরে।”

”মা—আ—ছ! এখন কি বাজার বসেছে? আচ্ছা আমি বাইগাছি বাজারটা দেখে আসছি নয়তো বারাসাতে চলে যাব, আমার চেনা এক মাছওলা আছে।” প্রতাপ আর কথা বাড়াল না। বাইক ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটাল।

”দিলুদাদা তুমি এখন আর বাড়ি যেও না, একেবারে মাছ হাতে বাড়ি ঢুকবে, এখানে বসে থাকো।”

প্রতাপ বাইগাছি গিয়ে দেখল বাজার সুনসান। দেরি না করে মোটরবাইক ঘুরিয়ে ছুটল বারাসাত। সেখানেও মাছের বাজারে লোক নেই, এই সময় থাকার কথাও নয়। কাছেই তিনকড়ির বাড়ি, ছোটবেলার বন্ধু, বাজারে মাছের বড় কারবারি। প্রতাপ হাজির হল তার বাড়িতে।

”তিনু বড় বিপদে পড়ে গেছি, এখুনি একটা মাছ চাই, কিলো দুইয়ের মধ্যে হলেই হবে।”

”মাছ আসবে সন্ধেবেলায় হাওড়ার বাজার থেকে। ঘণ্টাখানেক বোস।” তিনকড়ি নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে সিগারেটে টান দিয়ে বলল।

”পারব না রে, এক ঘণ্টা বসতে পারব না। সকালের কোনও মাছ পড়েটড়ে নেই।”

”কাটা রুই আছে, সাতশো গ্রামের মতো, চলবে? তা হলে দিতে পারি।”

”চলবে চলবে, মুড়োটা আছে তো?”

”আছে, ল্যাজাটাও আছে। গাদা আর পেটি বিক্রি হয়ে গেছে।”

তিনকড়ি বাড়ি থেকে বাজারে এল। প্রতাপ ছোট একটা থলি কিনে নিল। কঠোর বাক্সে বরফ চাপা দেওয়া পলিথিনে মোড়া মাছ বের করে তিনকড়ি প্রতাপের থলিতে ঢুকিয়ে দিল।

”কত দাম বল।”

”দিতে হবে না। আমার ছেলেটাকে বরং দুধঘাট ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিস। তোর তো চেনা আছে হেডমাস্টারের সঙ্গে।”

”আছে, ভর্তি করিয়ে দোব।”

প্রতাপ প্রায় ছুটে গিয়ে বাইকে চড়ে বসল। আধঘণ্টা কাবার হয়ে গেছে। দিলুর মা যদি এখনও থাকেন তা হলে ভালই নিজের চোখে দেখে যাবেন ছেলে সত্যি মাছ ধরতে গেছল আর ধরেও ছিল একটা কিলো দুয়েকের রুই। অত বড় মাছ খাবার লোক বাড়িতে নেই, তাই সে আধখানা বন্ধুর বাড়িতে দিয়ে এসেছে। প্রতাপ মনে মনে একটা গল্প বানিয়ে ফেলল। তার মনে হল মোটামুটি এটা বিশ্বাসযোগ্যই হবে। তবে একটা মুশকিল, মাছের টুকরোগুলো বরফে ঠান্ডা হয়ে রয়েছে। দিলুর মা কি মাছে হাত দেবেন? প্রতাপের মনে খচখচানি ধরল।

নিমগাছতলায় ওরা দু’জন বসে অপেক্ষা করছে। হর্ষ হাত বাড়িয়ে আগে থলিটা নিয়ে ফাঁক করে দেখল।

”গোটা মাছ পেলুম না। কাটা ছিল তাই নিয়ে এলুম। একটা দু’ কিলোর রুই দিলু ধরেছিল, তার আধখানা বন্ধুর বাড়িতে দিয়ে এসেছে, ওদের ছিপ ওদের পুকুর, দিলু তো দিতেই পারে, পারে না?” প্রতাপ তার গল্পটা অনুমোদন পেতে দেখল হর্ষর মুখভাবে।

”খুব ভাল বলেছেন। আমি তাই বলব।”

ওরা বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। প্রতাপ ব্যস্ত হয়ে ডাকল, ”এই যে এই যে, মাছটা কিন্তু ঠাণ্ডা, বরফে ছিল সকাল থেকে।”

”সে আমি ঠিক করে নোব। দূর থেকে মলুদিকে দেখাব এমনভাবে যে, আর হাতই ছোঁয়াবে না।”

প্রতাপ বাইকে চড়ে ফেরার সময় গেট দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে দেখল একটা মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে। সে আশ্বস্ত হল, দিলুর মা এখনও ফিরে যাননি।

বাড়িতে ঢুকেই হর্ষ চেঁচিয়ে বলল, ”ও মলুদি, ও বউদি দেখে যাও দিলুদাদা কতবড় একটা মাছ ধরেছে।”

ওরা দোতলায় ছিল। হর্ষর বাড়ি—মাথায়—করা চিৎকারে তাড়াতাড়ি নেমে এল। ততক্ষণে একটা গামলায় মাছের টুকরোগুলো হর্ষ ঢেলে ফেলেছে।

”দ্যাখো গো মলুদি, তোমার ছেলের কিত্তি। কতবড় মাছ ধরে আবার আধখানা ওদের দিয়েও এসেছে।”

পঞ্চানন বললেন, ”এইরকমই তো হওয়া উচিত। আর হবে নাই বা কেন, মলুর ছেলে তো! দেওয়াথোওয়ার হাত তো দিলু মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছে।” আড়চোখে তিনি দেখলেন মলুর চোখ পুলকে জ্বলজ্বল করছে।

হর্ষ ব্যস্ত হয়ে বলল, ”বউদি, আমি চট করে দুটো মাছ মলুদিকে ভেজে দি।” বলেই সে মাছের গামলা নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।

মলু যথাসাধ্য উদ্বিগ্ন হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ”জেঠু পুকুরের ধারে বসে মাছধরাটা কিন্তু বিপজ্জনক, দিলু সাঁতার জানে না।”

”ঠিক কথা, এটা তো আমার মনে ছিল না। আচ্ছা মলু, ওকে সাঁতারটা শিখিয়ে দিলে কেমন হয়?” পঞ্চানন গম্ভীর মুখে বললেন।

”দাও, তবে যাকে—তাকে দিয়ে শেখাতে যেও না। ডুবে গেলে বাঁচাতে পারবে এমন কাউকে দিয়ে শিখিয়ো।”

মাছভাজা খেয়ে মলু চলে যাওয়ার পর পঞ্চানন জিজ্ঞেস করলেন দিলুকে, ”দাদু আজ ক’টা হল?”

”আটটা।”

”আজ খুব বাঁচান বেঁচে গেছ, তবে বারবার মাছধরার গল্প কিন্তু টিকবে না। পরের ম্যাচ কার সঙ্গে?”

”ব্রাদার্স ইউনিয়নের সঙ্গে, ওদের মাঠেই খেলা।”

”কলকাতা আমার পক্ষে দূরে হয়ে যায়, এই বেতো হাঁটু নিয়ে অত হাঁটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, খুব ইচ্ছে করে একবার তোমার খেলা দেখতে।”

”দাদু, শেষ কবে ময়দানে খেলা দেখেছ?”

”চুয়াত্তরের ডিসেম্বরে। পটৌডি ক্যাপ্টেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইডেনে হারল। ওহ ফোর্থ ডে—র সকালেই চন্দ্রশেখর বোল্ড করল লয়েডকে এখনও চোখে ভাসে, তারপর স্লিপে কালীচরণের ক্যাচ নিল বিশ্বনাথ, চন্দ্ররই বলে। ওখানেই শেষ হয়ে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দু’ চোখ ভরে দেখেছি বিশ্বনাথের ব্যাটিং। প্রায় ছ’ঘণ্টা ব্যাট করে একশো ঊনচল্লিশ রান করেছিল, গিবস আর অ্যান্ডি রবার্টস ছিল বোলার। অমন ব্যাটিং আর দেখা যাবে কি না জানি না। এখন তো যে সেঞ্চুরি করে তাকেই আর্টিস্ট বলা হয়, বিশ্বনাথের ওই খেলা দেখলে আর বলত না।” পঞ্চানন মাথা নাড়তে লাগলেন, দিলু বুঝতে পারল না দাদুর এই আক্ষেপটা বিশ্বনাথের মতো ব্যাটিং আর দেখা যাবে না বলে নাকি সবাই আর্টিস্ট হয়ে যাচ্ছে বলে!

পরের দিন স্কুল ছুটির পর দিলু নেটে ব্যাট করছিল। একটা বল জোরে ড্রাইভ করতেই ব্যাটের কানা ভেঙে একটুকরো কাঠ উড়ে গেল। দিলু অপ্রতিভ হয়ে নেট থেকে বেরিয়ে এল। আর একটা ব্যাট আছে কিন্তু সে আর নেটে ঢুকল না। মাঠের মাঝে কয়েকজনের সঙ্গে ক্যাচিং প্র্যাকটিস শুরু করল। একটু পরেই এল প্রতাপ।

”দিলু, কাল কেউ রান আউট হয়নি তো?”

”হর্ষ মাসি আর দাদুর রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে এত ভাল বোঝাপড়া, যে, মা কোনও চান্সই পায়নি স্ট্যাম্পে হিট করার।”

”আশিস ঘোষ দুপুরে ফোন করেছিল, এই নভেম্বরে আন্ডার সিক্সটিন বিজয় মার্চেন্ট ট্রফির খেলা। বেঙ্গল টিমের জন্য প্রবাবেলদের নিয়ে একটা ট্রায়াল ম্যাচ খেলতে চায়। তোমার নাম করল, ট্রায়ালে তোমাকে আর একটু দেখে নিতে চাইছে। আমি ভাবছি রবিবার দুধঘাটে খেলাটা করার জন্য বললে কেমন হয়; তোমার মামার সঙ্গে আজই কথা বলব, ওর পারমিশন ছাড়া তো খেলা সম্ভব নয়, সন্ধ্যায় উনি বাড়ি থাকেন কি?”

”মামা তো এখনও স্কুলেই রয়েছেন, ওঁর ঘরে গিয়ে দেখা করুন না।” প্রতাপ ব্যস্ত হয়ে রওনা হল হেডমাস্টারের ঘরের দিকে, মিনিট কুড়ি পরে টগবগিয়ে ফিরে এল হাসিমুখে। দিলু ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, ”মামা কী বললেন?”

”এক কথায় রাজি। তাই নয় লাঞ্চ, টি সবই স্কুল দেবে, এমনকী বাইগাছি স্টেশন থেকে এখানে আসার জন্য ভ্যান রিকশার ব্যবস্থাও করবেন বললেন। ওঁর ঘর থেকেই ফোন করলাম আশিসের বাড়িতে, পেলাম না; রাত্রে আর একবার করব, না পেলে কাল সি এ বি—তে যাব।” প্রতাপ অস্থিরভাবে দু’হাত কচলাল।

রাতে সে আশিস ঘোষকে ফোন করে পেয়ে গিয়ে বলল, ”ট্রায়াল ম্যাচটা আমাদের এখানে মানে দুধঘাটের স্কুলের মাঠেই কর না। চমৎকার মাঠ, তবে ইডেনের মতো অত বড় নয়। শেয়ালদা থেকে একঘণ্টা লোকাল ট্রেনে, হাজারদেড়েক লোক তো খেলা দেখবেই। তা ছাড়া লাঞ্চ—টি দিতে স্কুল রাজি।”

”খুব ভাল কথা, আগে দেবু ঘোষালের সঙ্গে কথা বলে নিই; দেবু কোচ, ওর মতামতই এ—ব্যাপারে চূড়ান্ত। ওকে এখুনি ফোন করে তোকে জানাচ্ছি, তুই বাড়ি আছিস তো?” আশিস ফোন রেখে দিল। প্রতাপ ফোনের পাশে বসে রইল। আধঘণ্টা পর ফোন বেজে উঠতেই সে ছোঁ দিয়ে রিসিভার তুলেই বলল, ”আশিস?”

গম্ভীর স্বর এল ”আমি দেবু! কে, প্রতাপদা বলছেন?”

”আশিস তোমায় বলেছে সব?”

”সব মানে, আপনি ট্রায়ালটা দুধঘাটে করাতে চান। ওখানে একটা স্কুল আছে না? শুনেছি খুব নামকরা স্কুল, স্টার লেটার পায় গণ্ডা গণ্ডা। মাঠটা ক্রিকেট খেলার উপযুক্ত কি!”

”আমি ওখানে কোচ করি। স্কুলের একটা ছেলে এ—বছরই কলকাতায় আমার ক্লাবে দুটো ম্যাচ খেলে ন’টা রান আউট করেছে, পাঁচটা ক্যাচ নিয়েছে। কুড়িটা উইকেটের চোদ্দোটা ও একা ফেলে দিয়েছে। ছেলেটাকে খেলিয়ে দেখতে পারো। ভারতে এখন এমন ফিল্ডার নেই, বয়স পনেরো। মাঠ সম্পর্কে বলতে পারি মোহনবাগান মাঠের মতোই মাঠ।”

”নাম কী ছেলেটার?”

”দুলাল কর।”

”কাগজে নামটা দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না।”

”নামকরা ক্লাবে খেললে দেখতে পেতে। তা হলে রবিবারে তোমরা খেলতে রাজি?”

”দেখুন প্রতাপদা, এটা সরকারিভাবে ট্রায়াল ম্যাচ নয়। বিজয় মার্চেন্ট ট্রফিতে ম্যাচ হয় তিনদিনের। একদিনের ম্যাচটা খেলতে চাই পনেরোটা ছেলে বেছে নেওয়ার জন্য, আমি ডিস্ট্রিক্টের ছেলে খুঁজছি। রবিবারে ট্রেন কখন?”

”সকাল আটটা পাঁচের ট্রেনে আসাটাই সুবিধের। বাইগাছি স্টেশনে আমরা রিসিভ করব, ওখান থেকে সাইকেল ভ্যানে স্কুলে। প্লেয়ারদের ইকুইপমেন্টস আর বল তোমরা আনছ, আমরা স্ট্যাম্প দোব আর তিরিশজনের লাঞ্চ—টি, আর কিছু?”

”আম্পায়ার দু’জন?”

”একজন আমি আর একজন আশিস বা তুমি। হোয়াইট কোট কিন্তু দিতে পারব না।”

.

হইচই পড়ে গেল দুধঘাটে। স্কুলের ছেলেরা পোস্টার লিখে বাইগাছি বাজারে, স্টেশনে, পোস্ট অফিসের, সিনেমা হলের, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দেওয়ালে পর্যন্ত সেঁটে দিল: ”বাংলার জুনিয়ার ক্রিকেটদলের ওয়ান ডে ম্যাচ/দুধঘাট উচ্চচ মাধ্যমিক স্কুল মাঠে/দলে দলে দেখতে আসুন/রবিবার দোসরা নভেম্বর।” আর—একটা পোস্টারে: ”আসুন দেখুন/বাংলার অলৌকিক ফিল্ডার দুধঘাট স্কুলের ছাত্র/দিলীপ কর/ অষ্টম শ্রেণী/এই ম্যাচে খেলিবে।”

স্কুলের মাঠে প্রতিদিন দিলুর ফিল্ডিং বহু ছাত্রই দেখেছে। কলকাতায় দুটো ম্যাচে তার কৃতিত্বের খবর বাসু মারফত সারা স্কুলে ছড়িয়ে যাওয়ায় দিলু এখন সবার দেখার পাত্র। স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকলেই ছেলেরা ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়। সুব্রত কাপ জেতা দুধঘাট স্কুলের ছেলেরাও এত নজর টানেনি, যা দিলু পেতে শুরু করেছে। বিকেলে তার ফিল্ডিং প্র্যাকটিস দেখার জন্য ছাত্ররা তো বটেই, গ্রামের লোকেরাও এখন ভিড় করে থাকে।

সৌরভ গাঙ্গুলি, টিভি, খবরের কাগজের দৌলতে ক্রিকেট এখন জনপ্রিয়তায়, বাইগাছি—দুধঘাটে ফুটবলকে দু’নম্বরে ঠেলে পয়লা জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে। স্কুলের ছেলেদের নিজেদের মধ্যে খেলা ম্যাচ ছাড়া স্থানীয় লোকেদের আর কোনও ক্রিকেট দেখার সুযোগ হয় না। দেখতে হলে যেতে হয় কলকাতায়। এখন কলকাতাই আসছে দুধঘাটে। বিজয় মার্চেন্ট ট্রফিতে বাংলার হয়ে যারা খেলবে তারা আসছে, আর তাদের সঙ্গে খেলবে দুধঘাটের ছেলে, এটা কি কম কথা!

উত্তেজনায় ফুটে উঠল দুধঘাট। হরিসাধন ডেকে পাঠালেন, যশোহর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক শঙ্কর নাগকে।

”শঙ্করবাবু, কলকাতা থেকে ছেলেরা খেলতে আসবে, ক্রিকেট। তাদের লাঞ্চে আমি আপনার ছানার জিলিপি খাওয়াব। মনে রাখবেন, আপনার জিলিপিকে আমি বিশ্ববিখ্যাত মনে করি।”

”সে ঠিকই করেন। স্পেশ্যাল কেয়ার নিয়ে বানাব। ক’জন খাবেন?” নাগমশাই নম্রস্বরে জানতে চাইলেন।

”তিরিশজন। ক’টা করে খাবে আমি বলতে পারছি না, তবে ছোটরা মিষ্টি খেতে ভালবাসে। আপনিই বলুন কত লাগবে।”

শঙ্কর নাগ মাথা চুলকোলন, সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কী যেন গোনাগুনি করলেন তারপর বললেন, ”কখন খাবে? লাঞ্চ তো খেলার মধ্যিখানে হয়। সেইরকম নিয়ম মেনেই তো খেলা হবে?”

”হ্যাঁ, একদলের ইনিংস শেষ হওয়ার পর লাঞ্চ হবে।” হরিসাধন হেসে উঠে বললেন।

”সার, লাঞ্চটা তো রান্না করতে হবে। সেটা কি স্কুলই করবে?”

”হ্যাঁ। সমরেশবাবুর বাড়ি কাছেই। বুবু কেটারার্সের লোক এসে ওর বাড়িতে তৈরি করবে চিকেন স্টু। সঙ্গে পাউরুটি, স্যালাড, কলা আর ছানার জিলিপি। এ তো বিয়েবাড়ি নয় যে, খাওয়াটাই আসল ব্যাপার, এরা আসছে খেলতে। এবার বলুন কটা লাগবে?”

‘মাথাপিছু পাঁচটা করেই ধরি?” নাগমশাই প্রশ্ন করে আশা নিয়ে তাকালেন।

”পাঁ—আ—চ—টা। বললুম না ওরা খেতে নয়, খেলতে আসবে।” হরিসাধনের মুখে বিরক্তি।

”তা হলে চারটে করে। তিরিশজনই তো আর খেলবে না। তা ছাড়া কারও ভাল লেগে গেলে, লাগবেই, সে আরও দুটো চাইবে। তখন কি আর নেই বলবেন? তাতে ইস্কুলের বদনাম হবে না?”

অকাট্য যুক্তি। স্কুলের বদনাম হরিসাধন হতে দিতে পারেন না। রাজি হয়ে গেলেন। ফিল্ড রেস্ট্রিকশনের তিরিশ গজের সার্কল, বাউন্ডারি লাইনে চুনের দাগ, পিচে জল দেওয়া, রোল—করা প্রতাপ দাঁড়িয়ে থেকে করাল। পঞ্চায়েত থেকে লাল—নীল—হলুদ কাগজের শিকল সুপুরি গাছগুলোয় জড়িয়ে মাঠ ঘেরা হল। লাঞ্চে জলপান বিরতির জন্য কাচের গ্লাস আর জাগ, চা এবং কাপ ডিশ কেটারারই দেবে। একতলায় ক্লাস ফাইভের দুটো ঘর ড্রেসিংরুম হবে। বেঞ্চগুলো, টিচার্স রুম থেকে দশটা চেয়ার আর দুটো টেবল আনা হবে মাঠের ধারে খাটানো ইউনিভার্সাল ডেকরেটরের চাঁদোয়ার নীচে। ফার্স্ট এড বক্স নিয়ে ডাক্তার পোদ্দার সারাক্ষণই থাকবেন কথা দিয়েছেন। দুটো ব্ল্যাকবোর্ড, ডাস্টার, খড়ি স্কোরবোর্ডের জন্য রেডি করে রাখা হয়েছে। নেট প্র্যাকটিসের নেটও চটজলদি খাটিয়ে নেওয়ার মতো অবস্থায় মাঠের বাইরে রাখা হবে। বলা যায় না খেলতে নামার আগে হয়তো ওরা নেট চাইতে পারে। টয়লেটে ব্লিচিং পাউডার দু’দিন ধরে দেওয়া হচ্ছে। মাইক তো থাকবেই।

দুধঘাট স্কুল প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। অবশেষে রবিবার এল। সেদিন সকালেও দিলু পুকুরে সাঁতার কাটল অন্যান্য দিনের মতো। দশটায় ম্যাচ আরম্ভ হবে। এখন আটটা। বর্গমূলের অঙ্ক করার জন্য বই আর খাতা নিয়ে সে টেবলে বসল। পঞ্চানন তখন বললেন, ”দাদু, আজ এসব থাক। এখন বরং তুমি মনে মনে ম্যাচটা খেলো। তুমি তো প্রতিদিন প্র্যাকটিস করে নিজেকে তৈরি করেছ, এখন চোখ বন্ধ করে নিজেকে দ্যাখো ফিল্ড করছ। ব্যাটসম্যান বল মারল, যেদিকে বল যাচ্ছে তুমি ছুটলে, বলের কাছে যত তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায় সেইভাবে ছুটলে, বলে চোখ রেখে তুললে, উইকেটের আন্দাজ নিলে, ছুড়লে। মনে মনে বারবার এটা করো সব ভুলে গিয়ে।” এই বলে পঞ্চানন নীচে নেমে গেলেন দিলুকে একা রেখে।

সওয়া ন’টায় মোটরবাইকে প্রতাপ হাজির হল। হরিসাধন সকাল থেকেই স্কুলে। প্রতাপের পেছনে বসার আগে দিলু বলল, ”দাদু মাঠে যাচ্ছ কখন?”

”এই একটু পরে টুকটুক করে হেঁটে চলে যাব।” পঞ্চানন দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ”দুর্গা দুর্গা।”

প্রতাপ বলল, ”আপনি রেডি হয়ে থাকুন। দিলুকে পৌঁছে দিয়েই আমি আসছি, আপনাকে নিয়ে যাব।”

স্কুল ফটকের সামনে দিলুকে নামিয়ে দিয়ে প্রতাপ বাইক ঘুরিয়ে নিল পঞ্চাননকে নিয়ে আসার জন্য। এক মিনিট পরেই বাইগাছি স্টেশন থেকে সারি দিয়ে ছ’টা সাইকেল ভ্যান রিকশায় পা ঝুলিয়ে বসা পঁচিশ—ছাব্বিশটি ছেলে পৌঁছল। তাদের পিছু পিছু এল আরও চারটি রিকশা। তাতে লম্বা লম্বা ব্যাগে তাদের ব্যক্তিগত খেলার সরঞ্জাম। ছেলেরা যে যার নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে ফটক দিয়ে ঢুকল। হরিসাধন এবং দু’জন শিক্ষক দাঁড়িয়ে।

”সোজা চলে যাও, একতলায় ডান দিকের দুটো ঘর ড্রেসিংরুম।” হরিসাধন স্কুলবাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন। ”দরজাতেই কাগজে টিমের নাম লেখা আছে।” গতকাল প্রতাপ জানিয়ে দেয় দুটো দলের নাম দেওয়া হয়েছে রেড আর ব্লু। ছেলেরা চারধারে চোখ বোলাতে লাগল। দিলু তাদের কাছেই দাঁড়িয়ে। শুনতে পেল তাদের কথা।

”কী বিউটিফুল গ্রাউন্ড আর সারাউন্ডিং। সারি দিয়ে কোকোনাট আর সরু সরু পামগাছ।”

”অংশু ওগুলো পাম গাছ নয় রে সুপুরি গাছ।” একজন সংশোধন করে দিল।

একজন বলল, ”দাদুর কাছে শুনেছি একসময় ইডেন ঘিরে ছিল দেবদারু গাছ। তখন একটা কংক্রিটের খণ্ডও ছিল না ইডেনে। গঙ্গার দিক থেকে হাওয়া আসত, পুরনো বলও সুইং করত।”

আর একজন বলল, ”এখানে ধানখেত থাকলে বলতুম অংশু ওই দেখ, ওই গাছ দিয়ে দারুণ তক্তা হয়।”

অংশু স্বাস্থ্যবান, ফরসা, চোখা নাকমুখ। দামি জিনস পরা। ওদের কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল, ”বল, বল, বলে যা, সারাক্ষণ ট্রেনে পেছনে লেগেছিস, আবার এখানেও। এবার একটু চুপ কর। এখানকার লোকেরা শুনলে—” সে এধার—ওধার তাকাল। চোখাচোখি হয়ে গেল দিলুর সঙ্গে, দিলু হাসতে লাগল। ”এই দেখ একজন হাসছে।”

ছেলেরা এগিয়ে যাচ্ছে ড্রেসিংরুমের দিকে। দিলু এখনও জানে না সে রেড না ব্লু কোন দলে পড়েছে। কলকাতায় দেবু ঘোষাল টিম করেছে, দিলু তাকে কখনও দেখেনি, সে আশিস ঘোষকেও চেনে না। কোন ঘরে ঢুকবে বুঝতে না পেরে একতলার করিডরে দাঁড়িয়ে রইল। সবাই দরজায় আঁটা কাগজ দেখে দুটো ঘরে আলাদা হয়ে ঢুকল দেখে দিলু বুঝে গেল ওরা জানে কে কোন দলের। ওরা নিশ্চয় বলতে পারবে দুলাল কর বা ডি কর, রেড না ব্লু কোন দলে।

সে কিন্তু কিন্তু করে রেড ঘরে ঢুকল। ছেলেরা প্যান্ট শার্ট বদলে জুতো পরায় ব্যস্ত। সামনেই অংশু বেঞ্চে বসে জুতোর ফিতে বাঁধছে। দিলু নিচু স্বরে তাকে জিজ্ঞেস করল, ”তোমাদের টিমে কি এখানকার কোনও ছেলে আছে?”

অংশু প্রথমে তার আপাদমস্তক দেখল। তারপর বলল, ”একেবারে ড্রেস করেই এসেছ দেখছি। বোসো। তোমার নামে পোস্টার দেখলুম স্টেশনে, লোকাল হিরো। আমি রেডের ক্যাপ্টেন অংশুমান সিনহা।” অংশু হাত বাড়িয়ে দিল, দিলু হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে ওর পাশে বসল। অংশুকে তার মনে হল পরিষ্কার স্বচ্ছ মনের, সহজেই বন্ধু হয়ে যেতে পারে। উত্তরপল্লীর সনৎদা বয়সে তার দ্বিগুণ। আচরণে কথাবার্তায় সবসময়ই বুঝিয়ে দেন তিনি ক্যাপ্টেন, দিলু আড়ষ্ট বোধ করেছে।

”দেবুদা বলেছেন তুমি দারুণ ফিল্ড করো, যে—কোনও পজিশনে। আমি উইকেটকিপার। তোমার নাম তো দুলাল কর, এই স্কুলে পড়ো, আমি লা মার্টিনিয়ারে।” বলতে বলতে অংশু লম্বা ব্যাগ থেকে ব্যাট প্যাড গ্লাভস এমনকী একটা হেলমেটও বের করল। দেখে দিলু অস্বস্তিতে পড়ল। তার মনে হল, এর প্রত্যেকটাই বেশ দামি। কৌতূহলে সে ব্যাটটা হাতে তুলে নাচাল। দাঁড়িয়ে ব্যাটটা ধরে স্টান্স নিয়ে দু’বার কাল্পনিক বলে ডিফেন্সিভ খেলল এক পা পিছিয়ে এসে। অংশু তাকে লক্ষ করছিল, বলল, ”তোমার প্লেয়িং কিটস কোথায়?”

”স্কুলের ঘরে রয়েছে।” দিলু বলতে পারল না তার নিজস্ব কোনও খেলার সরঞ্জাম নেই, ব্যাটও নেই। দুটো ম্যাচে তার প্যাড, ব্যাট, অ্যাবডোমেন গার্ড সবই ছিল উত্তরপল্লী ক্লাবের। স্কুলের ব্যাটটার কানা সেদিন ভেঙেছে। আর যে ব্যাটটা আছে তা দিয়ে ম্যাচ খেলা যায় না। অংশুর মতো তারও নিজের ব্যাট প্যাড গ্লাভস থাকা দরকার।

”হারি আপ বয়েজ।” দাঁড়িয়ে উঠে অংশু তাড়া দিল।

অংশুর গলার স্বর শুনে দিলু অবাক! কোথায় সেই হাসিখুশি হালকা ভাব, এ তো ক্যাপ্টেনের দাপুটে গলা।

অংশু বলল, ”নেট রয়েছে দেখলাম, ভবানী বলগুলো নিয়ে চল। রবি, নিমু, শান্তু ব্যাট নিয়ে নেটে যা।” দিলুকে বলল, ”তুমিও চলো। থ্রো করবে, আমি ধরব।”

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের ভিড় দেখে দিলু তাজ্জব বনে গেল। স্কুল মাঠের এমন চেহারা সে দেখেনি। সারা মাঠ ঘিরে বসে রয়েছে নানান বয়সী মানুষ, আর কমপক্ষে স্কুলের প্রায় পাঁচশো ছেলে। প্রতাপ তাকে দেখে হাতছানি দিয়ে ডাকল। দাদু কোথায়? দিলু চেয়ারগুলোর দিকে তাকিয়ে পঞ্চাননকে দেখতে পেল।

”দেবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি। তোমাকেই ও আজ বিশেষ করে দেখবে।”

কাছেই দাঁড়িয়ে দেবু ঘোষাল। কম কথার মানুষ। দিলুর কাঁধে হাত রেখে বলল, ”মনে হচ্ছে না টেনশনে রয়েছ। টিমের সঙ্গে মিশে যাও। তুমি তো অংশুর টিমে, ও খুব ম্যাচিওরড ছেলে।”

আশিস ঘোষ দেবুর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। দিলুর সঙ্গে কোনও কথা বলল না। মাঠের একধারে অংশু গ্লাভস হাতে পরে একজনের ছোড়া বল ধরে ফেরত পাঠাচ্ছে। গোল হয়ে দাঁড়ানো পাঁচজনকে একটি ছেলে ক্যাচিং প্র্যাকটিস করাচ্ছে। মাঠের আর একদিকে একই ব্যাপার হয়ে চলেছে। ওরা ব্লু দল। স্কুল মাঠে সাদা জামা সাদা ট্রাউজার্স পরা গুটিতিরিশেক ছেলে ব্যাট—বল নিয়ে নেমেছে এমন দৃশ্য আগে কেউ কখনও দেখেনি। দুধঘাটে এটা বিরাট ঘটনা।

আশিস ঘোষ আর প্রতাপ দুই আম্পায়ার। ওদের সঙ্গে মাঠের মাঝে গিয়ে টস করল অংশু আর ব্লু—এর ক্যাপ্টেন আরিফ মহম্মদ। আরিফ টস জিতে ব্যাট নিল। দুটো টিম করেছে দেবু। রেড দলে রেখেছে যারা ভাল ব্যাট করে, ব্লু দলে রয়েছে ভাল বোলাররা। মাইকে ঘোষিত হল টসের ফল এবং দুটো টিমের নাম। ডি কর নামটা উচ্চচারিত হওয়া মাত্র মাঠ ঘিরে হর্ষধ্বনি উঠল।

অংশু ড্রেসিংরুমে ফিরে এসে দিলুর সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিল। ”একে তোমরা আজই প্রথম দেখছ, এর নাম দুলাল কর। এই স্কুলেই পড়ে। ভাল ফিল্ড করে।” ছেলেরা একসঙ্গে বলে উঠল, ”হাই।”

দেবু দরজায় এসে বলল, ”মাঠে নামো, দেরি হয়ে গেছে পনেরো মিনিট। মনে রেখো চল্লিশ ওভারের খেলা। ফিল্ড রেস্ট্রিকশন থাকবে পনেরো নয়, তেরো ওভার।”

ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই ক্লাস টেনের দুটি ছাত্র দরজা বন্ধ করে পাহারায় দাঁড়াল। হেডসারের কড়া নির্দেশ, প্লেয়াররা ছাড়া আর কেউ ঘরে ঢুকতে পারবে না। মাঠে এসে অংশু দিলুকে বলল, ‘কোথায় দাঁড়াবে?”

”কভারে।” দিলু পছন্দ করে ওই জায়গায় ফিল্ড করতে।

ছিপছিপে লম্বা অমিতাভ দে মিডিয়াম পেসের বোলার। তার প্রথম বল লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে থেকে আউট সুইং করে অফ স্টাম্পে। ব্যাটসম্যান পিছিয়ে গিয়ে জোরে ড্রাইভ করল। দিলু কুঁজো হয়ে গুটিগুটি এগোচ্ছিল। বলটা তার ডান দিক দিয়ে যাচ্ছে। তার দিকে সে ঝাঁপিয়ে কোনওক্রমে বাঁ হাত বাড়িয়ে বলটা হাতে লাগাল। বলটা ছিটকে তিন মিটার গিয়ে থেমে রইল। নন স্ট্রাইকার কয়েক পা বেরিয়ে জমিতে পড়ে থাকা বলটার দিকে তাকিয়ে দোনামনা করে স্ট্রাইকারের দিকে মুখ ফেরাল। স্ট্রাইকার হাত তুলে তাকে যখন রান নিতে বারণ করছে ততক্ষণে দিলু ছুটে গিয়ে বলটা কুড়িয়ে ছুড়েছে বোলারের উইকেটে। স্টাম্প ছিটকে যাওয়ার পর নন—স্ট্রাইকারের ব্যাট স্পর্শ করল পপিং ক্রিজের পেছনের জমি। দু’হাত তুলে ফিল্ডাররা চিৎকার করে উঠতেই আঙুল তুলল আশিস ঘোষ। প্রথম বলেই ফিরে গেল একজন। অংশু ছুটে গেল দিলুর কাছে, অন্যরাও ছুটে এসে হাই ফাইভ করার জন্য ঠেলাঠেলি শুরু করল।

অংশু বলল ”স্টেশনে পোস্টার দেখে খুব তো হাসাহাসি করেছিলিস, তখন আমি কিন্তু হাসিনি, এইবার হাসব।”

পরের ছেলেটি মাঠে নামছে। ব্যাটসম্যান এগিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে লাগল দিলুকে দেখিয়ে। নবাগত ঘাড় নেড়ে জানাল সে বুঝেছে। বাকি পাঁচটা বল অফস্টাম্পের বাইরে দিয়ে গেল, অংশু ধরল।

দ্বিতীয় ওভার। বল করবে সুনন্দ। ব্যাটসম্যান বাঁ হাতি। বেঁটে, গাট্টাগোট্টা। তৃতীয় বলে গালিতে ক্যাচ, ফিল্ডারের হাত থেকে পড়ে গেল। পরের বলে কাট করে গালির পাশ দিয়ে দুটো রান নিল। পঞ্চম বলে সোজা ড্রাইভে চার রান, ওভারের শেষ বলে হল নো বল এবং গ্লান্স করে এক রান।

চারটে ওভার বিনা ঘটনায় কেটে গেল, রান এক উইকেটে চোদ্দো। পঞ্চম ওভারে বাঁ—হাতি সোজা ছয় মারল অমিতাভকে। দর্শকদের মধ্যে হইহই পড়ে গেল। ছাত্ররা ”উই ওয়ান্ট সিক্সার” স্লোগান তুলল। বাঁ—হাতি পরের বলে আবার ছয় মারল, বল পড়ল স্কুলের পাঁচিলের বাইরে। তুমুল চিৎকার নারকেল গাছের মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেল। নিচু ক্লাসের ছেলেরা মাঠে ঢুকে নাচানাচি শুরু করতেই লাইফ সায়ান্সের সার ছুটে গেলেন, ”কোয়ায়েট, কোয়ায়েট” বলে ছেলেরা দৌড়ে দর্শকদের ভিড়ে মিশে গেল। পর পর দুটো ছয় আর দর্শকদের উচ্ছ্বাস তার মাথায় রক্ত চড়িয়ে দিয়েছে।

অমিতাভ পরের বল দিল গতি একটু কমিয়ে, আগের দুটো ছয় যেভাবে ব্যাট চালিয়ে মেরেছিল বাঁ—হাতি, এবারও সেইভাবে ব্যাট চালাল। বলটা দুটো নারকেল গাছের উচ্চচতায় উঠে একস্ট্রা কভার বাউন্ডারির দিকে যাচ্ছে এবং বলে চোখ রেখে দিলুও সমানে ছুটছে। সম্ভবত ওভার বাউন্ডারি হবে। বলের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিলু ঝাঁপাল, দু’পাক গড়িয়ে উঠে দাঁড়াল বল হাতে।

সারা মাঠ চুপ। যখন বুঝল দিলু ক্যাচ ধরেছে, ফিল্ডাররা ছুটে গেল, হাততালি দিয়ে চিৎকার করতে লাগল ‘দি ই লি ই প, দি ই লি ই প”। দিলু ফিরে তাকিয়ে চাঁদোয়ার নীচে চেয়ারে বসা দাদুকে দেখতে পেল ডান হাত মুঠো করে তুলে দাঁড়িয়ে।

ফিরে এসে উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে অংশু প্রথম স্লিপকে বলল, ”হ্যাঁ রে, কী বলছে ওরা শোন তো!”

প্রথম স্লিপ শুনে বলল, ”দিলীপ দিলীপ বলছে মনে হচ্ছে।”

অংশু বলল, ”দিলীপ কেন, ওর নাম তো দুলাল। দেবুদা তো তাই বললেন।”

প্রথম স্লিপ কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলল, ”নাম যাই হোক, ক্যাচটা কীরকম নিল দেখলি। পোস্টারে ঠিকই লিখেছে।”

”বুদ্ধি করে অমিতাভ স্লোয়ার দিল বলেই ক্যাচটা উঠল।” অংশু মনে করিয়ে দিল।

এর পরে যে ছেলেটি ব্যাট হাতে নামল সে এক হাস্যকর পরিস্থিতি তৈরি করল। অফের দিকে মারা কোনও বলেই সে রান নিতে রাজি নয়। সহজ সিঙ্গল থাকলেও সে ”নোও ও” হাঁক দিয়ে উলটোদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। চারদিকে হাসাহাসি শুরু হল, তার পার্টনার বিরক্ত হয়ে তার সঙ্গে কথা বলল। কিন্তু সে নিজের বিবেচনা বোধে অনড় রইল। তবে লং লেগে দুটো চার সে মেরেছে আর মিড উইকেট থেকে দুটো সিঙ্গল নিয়েছে।

অতিরিক্ত লেগবাই নিয়ে ব্লু—এর রান দু’ উইকেটে চল্লিশ, এগারো ওভারে। দুই ব্যাটসম্যানই উইকেটের গতি ও বাউন্সের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। বড় একটা পার্টনারশিপ ধীরে ধীরে তৈরি হওয়ার পথে। ওপেনার ছেলেটি অমিতাভর বদলি নতুন বোলার রাজীব জয়সোয়ালকে কাট করে সহজ রান আছে দেখে ”ইয়েস” বলে ছুটল। মাঝপথে গিয়ে দেখল নন স্ট্রাইকার বেরোয়নি। সে চেঁচিয়ে উঠল, ”রান, রান”।

দিলু বাঁ পাশে ঝাঁপিয়ে বলটা ধরে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। ধড়মড়িয়ে উঠে হাঁটু গাড়া অবস্থাতেই ডান হাতে ফাঁকা স্ট্রাইকার প্রান্তে বল ছুড়ে অফস্টাম্প ফেলে দিল। রাগ চাপতে চাপতে ছেলেটি মাঠ ছাড়ল। তেরো ওভার সম্পূর্ণ, চুয়াল্লিশ রান তিন উইকেটে, রানরেট প্রায় সাড়ে তিন।

অংশু এবার আনল তার অফ স্পিনার বুদ্ধদেব চ্যাটার্জিকে। মাঠে ফিল্ডার রাখার বাঁধাবাঁধি এখন আর নেই। অংশু ফিল্ডারদের ছড়িয়ে দিল গণ্ডির বাইরে। দিলুকে নিয়ে এল সিলি মিডঅফে ব্যাট থেকে দশ হাত সামনে। আর একজনকে রাখল ব্যাকওয়ার্ড শটলেগে ব্যাটসম্যানের পিঠের কাছে।

সামনে নাকের কাছে একজন পেছনে পিঠ ঘেঁষে একজন, ব্যাটসম্যানটি অস্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে তুলে তুলে দেওয়া চারটি বল পা বাড়িয়ে ঝুঁকে থামিয়ে দিল। একটা বল ব্যাট থেকে সামান্য উঠে গেছল, দিলু সামনে ঝাঁপিয়েও ক্যাচটা পেল না। হতাশ ব্যাটসম্যান ঠিক করল আক্রমণই আত্মরক্ষার সেরা উপায়। পঞ্চম বলটায় প্রচণ্ড জোরে ড্রাইভ করল। জমি থেকে ইঞ্চি দুয়েক ওপর দিয়ে বলটা পা ফাঁক করে ঝুঁকে থাকা দিলুর দিকে জ্বলন্ত গোলার মতো সোজা ধেয়ে গেল।

দু’হাতের তালু চকিতে নামিয়ে দিলু বলটা ধরে নিয়েই মাথার ওপরে ছুড়ে দিয়ে আবার লুফল। দু’জনকে রান আউট, দুটো ক্যাচ কোনওটাই সহজ ছিল না। হাতের ডায়েরি বইটা দেখতে দেখতে দেবু ঘোষাল পাশের লোককে চাপা গলায় বলল, ”এরকম অলরাউন্ড ফিল্ডার জীবনে দেখিনি! চারটে উইকেট তো ওরই।”

চতুর্থবার ছুটে যাওয়ার উৎসাহটা একটু স্তিমিত হয়ে গেল ফিল্ডারদের। রাজর্ষি দিলুর হাতের তালু দুটো পরীক্ষা করে ঠাট্টার সুরে বলল, ”দেখ, বলটারই হয়তো লেগেছে।”

বুদ্ধদেব বাংলার একজন প্রতিশ্রুতিমান স্পিনার, প্রথম ডিভিশান লিগে ফুলবাগান দলে খেলে। লেংথ আর লাইন বজায় রাখায় নিখুঁত, ফ্লাইটের হেরফের ঘটানোতেও ওস্তাদি দেখিয়েছে, স্পিন করানোর ব্যাপারটায় এখনও নিয়ন্ত্রণ আসেনি, টপ স্পিন আয়ত্ত করার জন্য খাটছে। ওর বলে উইকেটের আশেপাশে প্রচুর ক্যাচ ওঠে, সেগুলো ধরার লোক পাওয়া যাচ্ছে না।

প্রথম চারজন আউট হয়ে গেছে। পাঁচ ও ছয় নম্বর ব্যাটসম্যান শূন্য রানে ব্যাট করছে। ব্লুয়ের উঠেছে চুয়াল্লিশ রান, হাতে রয়েছে ছয় উইকেট আর পঁচিশ ওভার। ব্লু দুশো রানে পৌঁছবার আশা করতে পারেই, যদি এই জুটিটা দাঁড়িয়ে যায়। জয়সোয়ালের বলে একটা চার আর তিনটি সিঙ্গল হল।

এবার বুদ্ধদেবের ওভার। সে দিলুকে আর একটু এগিয়ে ব্যাট থেকে ছ’হাত দূরে দাঁড়াতে বলল। তুলে প্রথম বলটা দিল, লেংথের একটু শর্ট, স্পিন ছিল না। ছেলেটি পিছিয়ে ব্যাট দিয়ে থামাল। এবারের বল আর একটু তুলে একই লেংথে, তবে স্পিন করিয়ে। আবার পিছিয়ে এসে ব্যাট দিয়ে আটকাল।

ব্যাটসম্যানের কপালে ফুটল দুশ্চিন্তার রেখা। সেটা লক্ষ করল দিলু। তার মনে হল, এবার ও ভুল করবে।

তৃতীয় বল আর একটু তুলে এবার গুডলেংথে। ব্যাটসম্যান তাড়াতাড়ি ঝুঁকে ডিফেন্সিভ ব্যাট পাতল। ব্যাট থেকে লোপ্পা হয়ে বল জমা পড়ল দিলুর হাতে। লাফিয়ে উঠে এবার দিলুই ছুটে গেল বোলারের কাছে, জড়িয়ে ধরল বুদ্ধদেবকে।

অংশু বলল, ”দুলাল দৌড়ে গিয়ে অ্যাবডোমেন গার্ড পরে এসো, আর আমার হেলমেটটা। সিনগার্ড নেই, থাকলে ভাল হত।”

দিলু ড্রেসিংরুমের দিকে ছুট লাগাল।

ঠিক সেই সময় বাইগাছি স্টেশনে ট্রেন থেকে নামল মলু। মোটরগাড়ি গ্যারাজে গেছে সেল্ফস্টার্টারের গোলমাল সারাতে। স্টেশনে টিকিট কালেক্টর থাকে না, মলু হাতের টিকিট হাতে নিয়ে বেরোতেই চোখে পড়ল লাল কালিতে লেখা পোস্টার—আসুন, দেখুন/বাংলার অলৌকিক ফিল্ডার দুধঘাট স্কুলের ছাত্র।

এর পরই মলুর চোখ সরু হল ও ভ্রূ জুড়ে গেল দিলীপ কর নামটা দেখে। পোস্টারের দিকে আধ মিনিট তাকিয়ে থেকে সে রিকশা স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখল জায়গাটা ফাঁকা। কী ব্যাপার! একজন নাপিত একটি লোকের দাড়ি কামিয়ে দিচ্ছে। সে তাকেই জিজ্ঞেস করল, ”স্ট্যান্ডে রিকশা নেই। কী ব্যাপার, ধর্মঘট নাকি?”

খুর চালাতে চালাতেই লোকটি বলল, ”খালি যাচ্ছে আর আসছে, দুধঘাট ইস্কুল মাঠে আজ কিরকেট খেলা আছে না। একটু দাঁড়ান, এখুনি ফিরে আসবে।”

মলুকে মিনিট তিনেক দাঁড়াতে হল। ততক্ষণে পাঁচজন লোক জুটে গেল। তাদের কথা শুনে সে বুঝল, ওরাও স্কুল মাঠে যাবে।

”ছেলেটা নাকি সত্যিই অলৌকিক, যেখান—সেখান থেকে যা ছোড়ে তাই লেগে যায়।”

”আমিও তাই শুনলুম দুধঘাট স্কুলে পড়ে একটা ছেলের কাছে। রোজ ছুটির পর মন দিয়ে বল ছোড়া, ক্যাচ ধরা প্র্যাকটিস করে। দেখি গিয়ে কেমন অলৌকিক।”

”ছেলেটা হেডমাস্টার মশাইয়ের ভাগনা। উনি খুব উৎসাহ দেন খেলাধুলোয়।”

মলু স্তম্ভিত হয়ে শুনে গেল। ভ্যান রিকশা পর পর তিনটি এসে হাজির।

”দুধঘাট স্কুল, দুধঘাট স্কুল।” এর রিকশাওলা জানান দিল চেঁচিয়ে।

ওরা ছ’জনই উঠে বসল রিকশার তিনদিকে পা ঝুলিয়ে। স্কুলের ফটক থেকেই ভিড় শুরু হয়েছে। পাঁচিলের ওপর লোক দাঁড়িয়ে। মলু কোনওক্রমে ঠেলেঠুলে ঢুকে দাঁড়াবার জায়গা করে নিল। মাঠে চোখ বুলিয়ে সে খুঁজে পেল না দিলুকে। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটিকে সে জিজ্ঞেস করল, ”আচ্ছা, দিলীপ কর খেলছে না?”

ছেলেটি খুবই অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ”সে কী, এতক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করছেন দিলীপ খেলছে কিনা?”

অপ্রতিভ মলু বলল, ”আমি এইমাত্র এলাম।”

”খেলছে তো দিলীপই, পাঁচজনকে আউট করেছে। ওই তো হেলমেট পরা উবু হয়ে বসে।” ছেলেটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে দিতেই চেঁচিয়ে উঠল ”কট কট। দিলু আবার ক্যাচ নিয়েছে।”

মলু দেখল, ব্যাটসম্যানের পায়ের কাছে এক হাত বাড়িয়ে দিলু শুয়ে, হাতে লাল রঙের বল। সারামাঠ চিৎকার করছে আর লাফাচ্ছে। চাঁদোয়ার পাশে স্ট্যান্ডে খাড়া করা ব্ল্যাকবোর্ডে একটি ছেলে ৫১—৫ মুছে খড়ি দিয়ে লিখল ৫৯—৬।

”এই নিয়ে ছেলেটা ছ’জনকে একাই ফিরিয়ে দিল, অবিশ্বাস্য প্রতিভা।” মলুর পেছনে কে একজন বলল।

”ছেলেটার সম্পর্কে যা সব শুনতাম মনে হত বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছে। এখন দেখছি একটুও বাড়ানো কথা নয়। অবিশ্বাস্য প্রতিভা বলছেন কী, অলৌকিক বলুন। অনেকদূর যাবে, বিরাট নাম করবে।”

মলু ধাঁধায় পড়ে গেল। এসব কথা দিলুর সম্পর্কেই কি বলা হচ্ছে? এত লোক উচ্ছ্বসিত হচ্ছে কি দিলুর জন্য? আশ্চর্য তো। দিলু অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান, কই আমরা কেউ তো জানতুম না। মলু ভিড়ের মধ্যে পথ করে বাউন্ডারির ধারে গিয়ে দাঁড়াল।

অংশু বোলার বদল করে আবার আনল অমিতাভকে। দিলুকে বলল প্রথম স্লিপে দাঁড়াতে।

”হেলমেটটা রেখে আসি।”

”লাইনের ধারে টুয়েলফথম্যান রয়েছে, ওর হাতে দিয়ে এসো।”

হেলমেট খুলে হাতে নিয়ে দিলু বাউন্ডারি লাইনে দৌড়ে গেল। ছেলেটির হাতে হেলমেটটা দেওয়ার সময় চোখে পড়ল মা দাঁড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে।

ছ্যাঁত করে উঠল তার বুকের মধ্যে। ধরা পড়ে গেছি। তারপরই দেখল, মা ডান হাতটা তুললেন, মুখে মা—দুর্গার মতো একটা হাসি।

আশীর্বাদ। দিলু মাথাটা হেলিয়ে হাসল, তারপর ছুটে এসে দাঁড়াল স্লিপে। অমিতাভ প্রথম বলটা ঠুকে দিতে গিয়ে শর্ট পিচে ফেলল। কাঁধের কাছে ওঠা বলটা মারার জন্য ব্যাটসম্যান সপাটে ব্যাট ঘোরাল। বল ব্যাটের কানায় লেগে দিলুর মাথার অনেক ওপর দিয়ে থার্ডম্যান অঞ্চলে উঠে গেল। দিলু ক্যাচ নেওয়ার জন্য দৌড়চ্ছে, থার্ডম্যানে ফিল্ড করছে যে সেও দৌড়ে আসছে। দু’জনে মুখোমুখি হয়ে থমকে দাঁড়াল। বলটা তাদের মাঝখানে পড়ে লাফিয়ে উঠতেই দিলু বল ধরে নিয়েই ঘুরে গিয়ে ছুড়ল। অংশু দিলুর দিকে মুখ করে, উইকেটের পেছনে ছোড়া বলটা ধরার জন্য। ব্যাটসম্যানরা দ্বিতীয় রানটা নিচ্ছে, রান নেওয়া সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই অংশুর গায়ে ছিটকে এসে লাগল স্টাম্পের একটা বেল। ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা হল ৭১—৭।

মলু এধার—ওধার তাকাতে—তাকাতে দেখতে পেল জেঠুকে। পাশের চেয়ারে বসা এক পাকাচুলকে মাথা নেড়ে কী বোঝাচ্ছেন। মলু ভিড় ঠেলে এগোতে লাগল।

অংশু ঠাট্টা করে দিলুকে বলল, ”সাতটা তো হল, বাকি তিনটে আর পড়ে থাকে কেন, নিয়ে ফেলো।”

দিলু মাথা চুলকে বলল, ”স্পিনার আসুক, তখন দেখা যাবে।”

দেখা অবশ্য হল না। চার ওভার পর আবার বুদ্ধদেব বল করতে এল। তার প্রথম ওভারেই দুটো চার, একটা দুই নিয়ে ব্লু—র ইনিংস একশোয় পৌঁছল একত্রিশ ওভারে। পাঁচ আর আট নম্বর ব্যাটসম্যান এখন ক্রিজে। আট নম্বর বেপরোয়া হয়ে ব্যাট চালাচ্ছে। সুনন্দকে দুটো ছয় মারার পর দুটো ডট বল, তারপরের বলটায় বোল্ড হয়ে গেল। নবাগত প্রথম বলেই পিছিয়ে এসে ডাইভ করেই পিছলে পড়ল। ডানপায়ের গোড়ালি লাগল অফ স্ট্যাম্পে, বেল পড়ে গেল। শেষ ব্যাটসম্যান লাজুক মুখে এল। সে ব্যাট করতে পারে না সবাই জানে এবং সেটা সে জানিয়েও দেয় ঝাড়ু দেওয়ার মতো ব্যাট চালিয়ে। ঝাড়ু মেরে এক রান পেয়ে সে মস্ত বড় করে হেসে নিল। আশাতীত সৌভাগ্যে।

পাঁচ নম্বর তখনও নট আউট চল্লিশ রানে। তার লক্ষ্য একটি অর্ধশত রান পাওয়ার, হাতে রয়েছে চল্লিশ বল। ঝাড়ুদারকে বাঁচিয়ে রেখে আরও দশটি রান তাকে করতে হবে, যেভাবেই হোক বোলিং থেকে ওকে সরিয়ে রাখতে হবে। ওভারের বাকি আরও চার বল। শেষ বলে একটা রান নিয়ে ওধারে যাবে ঠিক করে সে তিনটে বল থামাল। ঝাড়ুদারকে মাথা নেড়ে ইশারায় বলল, এইবার রান নিতে তৈরি হও।

বুদ্ধদেব বল করার আগে অংশু ব্যাটসম্যানের উদ্দেশ্যটা বুঝে ফিল্ডারদের কাছে নিয়ে এল। দুই বা চার রান যদি পায় পাক, এক বা তিন রান যেন না পায়। বুদ্ধদেব বলটা করল আচমকাই মিডিয়াম পেসে, প্রায় ইয়র্কার। পাঁচ নম্বর তাড়াতাড়ি ব্যাট নামাল। ব্যাটে লেগে বল পিচের মাঝখানে এসে থেমে গেল। এদিকে দু’জনেই সেকেন্ড তিনেক ইতস্তত করে রান নিতে ছুটল। বুদ্ধদেব ছুটে এসে বল কুড়িয়েই ছুড়ল। অংশু বলটা ধরেই উইকেট ভেঙে দিল। ঝাড়ুদার রান আউট। ব্লু—র ইনিংস শেষ একশো তেরো রানে।

আম্পায়ার প্রতাপ লাহিড়ি আঙুল তোলামাত্রই স্কুলের প্রায় পঞ্চাশটি ছেলে রে রে করে মাঠে ঢুকে পড়ল। দিলুকে একজন কাঁধে বসাবার চেষ্টা করে পারল না। দু’জন চেষ্টা করল পাঁজাকোলা করতে, পারল না। অবশেষে ছ’জন তাকে ধরে মাথার ওপর লম্বা করে তুলল এবং সেই অবস্থায় বহন করে নিয়ে গেল ড্রেসিংরুমে। দিলু মুখ ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করল মা আর দাদুকে। ভিড়ে তারা আড়াল পড়ে গেছে, সে দেখতে পেল না।

.

ডেসিংরুমে সুনন্দ বলল, ”ভাগ্যিস এখানে খেলতে এসেছি তাই এমন একটা দৃশ্য দেখার সুযোগ হল।”

দেবাংশু ফিসফিস করে তার কানে বলল, ”আর এমন ফিল্ডিং দেখার কথাটাও বল।”

”নিশ্চয় বলব। তবে এখানে নয়, কলকাতায় ফিরে।”

অংশু বলল দিলুকে, ”বাকি তিনটে আর হল না। বিজয় মার্চেন্টে আমাদের প্রথম খেলা কটকে ওড়িশার সঙ্গে, সেখানে আশা করব এক ইনিংসে দশটাই।”

দিলু বিভ্রান্ত স্বরে বলল, ”বেঙ্গল টিমে আমি। কী এমন করলুম?”

অংশু বলল, ”দুশো তেরোটাকে একশো তেরো করে দিয়েছ। ব্লু টিমে যেসব ব্যাটসম্যান রয়েছে তাদের চারজন লাস্ট উইকে ফিফটি করেছে, আজ দশের বেশি করেনি। তুমি টিমে আসছই। কত নম্বরে ব্যাট করবে?”

”যতয় পাঠাবে।”

”দেবুদার সঙ্গে কথা বলে দেখি।”

হরিসাধন এসে তাড়া দিলেন লাঞ্চ খাওয়ার জন্য। দুটো টিম দোতলায় টিচার্স রুমে গেল। চারটে টেবল জোড়া দিয়ে তাতে রাখা হয়েছে চিকেন স্টু, কলা, স্লাইসড পাউরুটি, স্যালাড আর ছানার জিলিপি। প্রত্যেকে প্লেট হাতে ইচ্ছেমতো স্যালাড, পাউরুটি ও চিকেন তুলে নিয়ে দেওয়ালের ধারে রাখা চেয়ারে বসে খেতে শুরু করল।

হরিসাধন বললেন, ”আয়োজন খুবই সামান্য, যতটুকু আমাদের সাধ্য—”

তাকে হাত তুলে থামিয়ে আরিফ বলল, ”ক্লাব ম্যাচে আমাদের এমন খাওয়া জোটে না, চিকেন তো ভাবাই যায় না!”

অংশু বলল, ”এখুনি তো মাঠে নামতে হবে, বেশি খেলে নড়াচড়া করতে পারব না। এইরকম হালকা খাবারই ভাল।”

ছেলেদের খাওয়া দেখে হরিসাধন বিষণ্ণ হলেন। প্রচুর পাউরুটি আর স্টু পড়ে রইল। ওরা শুধু স্যালাড খেল, বেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রত্যেকে হাতে নিল একটা করে কলা। তিনি এবং গণেশ নাগ সবচেয়ে দুঃখ পেলেন ছানার জিলিপির দুটো প্লেট দেখে। দেওয়া হয়েছিল পঞ্চাশটা, নিঃশেষ হলে আরও পঞ্চাশটা স্টিলের ট্রে—তে চটপট টেবলে আনার জন্য রেডি করে রাখা আছে, তাও ফুরিয়ে গেলে আরও পঞ্চাশটা আসবে। কিন্তু প্রথম পঞ্চাশটাই ফুরোল না। দেখা গেল গোটা বারো প্লেটে পড়ে রয়েছে।

”সার আপনি বলেছিলেন ছোটরা মিষ্টি খেতে ভালবাসে।” গণেশ নাগ মাথা চুলকোলেন।

”শ্রাদ্ধ আর বিয়েবাড়িতে সাপ্লাই দিয়ে দিয়ে খাওয়ার একটা হিসেব আপনার মাথায় বদ্ধমূল হয়ে গেছে—মাথাপিছু পাঁচটা। আপনাকে বলেছিলুম ওরা খেতে নয়, খেলতে আসছে। এখনকার ছেলেরা ভীষণ হেলথ কনশাস মনে রাখবেন।”

”সার, মিষ্টি খাওয়ানোর প্রস্তাবটা তো আপনারই ছিল।” ভয়ে ভয়ে বললেন গণেশ নাগ।

”বলেছি তো কী হয়েছে। যত জিলিপি রয়ে গেছে স্কুলের যে সব ছেলে কাজ করছে তাদের একটা করে দিয়ে দিন।”

ব্যাটিং অর্ডার তৈরি করেছে দেবু ঘোষাল। দিলুকে রেখেছে পাঁচ নম্বরে, তিনজন আউট হলে নামবে। অংশুকে ঘরের বাইরে ডেকে নিয়ে সে বলল, ”তখন স্পিনার এসে যাবে, খেলাও তখন কুড়ি ওভারে পৌঁছবে। মনে রাখিস চল্লিশ ওভারের খেলা, কুড়ি থেকে তিরিশ ওভার—ওই সময়টায় এক—দুই করে রান নিয়ে ওভারে ছ’টা করে রান, দেখি ছেলেটা ওইসময় কেমন ব্যাট করে।”

ঘরে ফিরে এসে অংশু ব্যাটিং অর্ডার পড়ে শোনাল। প্রথম চারজন প্যাড পরতে শুরু করল। দিলু তাকিয়ে রইল ওদের ব্যাট প্যাড গ্লাভসের দিকে। সবই নিজেদের, দেখেই বোঝা যায় বেশ দামি। নিজস্ব সরঞ্জাম বলতে জুতো জোড়া ছাড়া তার কিছুই নেই। সবই স্কুলের। কমদামি প্যাডজোড়া ময়লা, বাঁশের কঞ্চি আর তুলো দিয়ে তৈরি, ওজনে ভারী। প্যাডের একটায় ওপরের বাকল নেই, দুটো বাকলে টাইট করে পায়ে ধরে রাখা যায় না, একটু ছুটলেই প্যাড নেমে আসে। অথচ এদেরগুলো কী হালকা, বাকল দেওয়া নয়। তিনটে পট্টি চেপে লাগিয়ে দিলে আঠার মতো এঁটে থাকে। গ্লাভসেও কবজির কাছে জড়ানো ওই আঠার মতো পট্টি। আর ব্যাট।

দিলু অংশুর ব্যাটটা তুলে ওজনটা অনুভব করতে করতে পাশে বসা সুনন্দকে হালকা চালে জিজ্ঞেস করল, ”ব্যাটটার দাম কত?”

সুনন্দ দশ নম্বরে ব্যাট করবে। দেরি আছে মাঠে নামতে, হয়তো নামতেও হবে না। তার আগেই একশো চোদ্দো রান উঠে যাবে। জুতোর ফিতে খুলছে মুখ নিচু করে। দামটা বলল, কিন্তু দিলু স্পষ্টভাবে শুনতে পেল না।

”কত বললে?”

”সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।” সুনন্দ মুখ তুলে একটু চড়িয়ে বলল।

দিলু বলল, ”দিশি ব্যাটের দামও কি এইরকম?”

সন্দীপ একটু অবাক হয়ে বলল, ” এটা তো দিশি ব্যাটই। আমাদের কাশ্মীরি উইলোয় তৈরি পি ডি এম বা লারসন তো সাহেবরাও কিনছে।”

দিলু ব্যাটটা সযত্নে বেঞ্চের ওপর রেখে দিয়ে স্কুলের কানা ভাঙা ব্যাটটা দুই হাঁটুর মধ্যে চেপে ধরল। দাম জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে আর তার নেই।

ভরত আর কমলেশ দুই ওপেনার ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, দু—তিনজন বলে উঠল, ”বেস্ট অব লাক।” দিলু ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লম্বা করিডরে দাঁড়াল। এখান থেকে দুটো উইকেটই দেখা যায়। ওয়ান ডাউন রাজর্ষি তার পাশে এসে দাঁড়াল।

”দুলাল, তুমি কি এখানেই থাকো?”

”হ্যাঁ, কেন বলো তো!” দিলু অবাক হল প্রশ্নটায়।

”অ্যালবার্ট স্কোয়ারে বন্ধু পরিষদে খেলতুম, তখন তোমায় দেখেছি। তোমার বাড়ি তো মৌলালিতে। তা হলে এখানে কেন?”

”এখানে মামার বাড়ি। পরীক্ষায় ফেল করে এখানে এসে স্কুলে ভর্তি হয়েছি।”

দিলুর সরল স্পষ্ট উত্তর রাজর্ষির মনে দাগ কাটল। ‘ফেল করে’ কথাটা কত সহজে বলল। রাজর্ষিও সহজ ভাবে বলল, ”তোমার ব্যাটটা তো দেখলুম কানাভাঙা, একটা ভাল ব্যাট কিনে নাও।”

কত সহজে বলে দিল ‘কিনে নাও।’ নিশ্চয় পয়সাওলা ঘরের ছেলে। দিলুর বলতে ইচ্ছে করল, দামি ব্যাট দিয়ে খেললেই কি দামি ইনিংস খেলা যাবে?

রাজর্ষি মাঠের দিকে তাকিয়ে। ভরত গার্ড নিল প্রতাপ লাহিড়ির কাছ থেকে। বোলিং শুরু করবে আরিফ। প্রথম বল ভরত ব্যাট তুলে ছেড়ে দিল, দ্বিতীয় বলটায় আধা ফরওয়ার্ড খেলল, ব্যাট—প্যাডের মধ্য দিয়ে বলটা গলে এসে অফ স্টাম্প ফেলে দিল।

দিলুর দিকে তাকিয়ে হেসে রাজর্ষি এগোল মাঠে নামার জন্য। ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা হল ০—১। দিলুর পাশ দিয়ে ভরত ড্রেসিংরুমে ফিরে এল। রাজর্ষি প্রথম বলেই পিছিয়ে খেলে বলটা ফস্কে এল বি ডবলু হল। রেড দল ০—২। দিলু ঘরে এসে প্যাড পরা শুরু করল। দেবাংশু নামল ব্যাট করতে। মাঠ ঘিরে সাড়াশব্দ নেই। প্রথম ওভারেই পড়েছে দুটো উইকেট দু’বলে। দর্শকদের মধ্যে কে একজন বাঁজখাই গলায় চিৎকার করল, ”হ্যাটট্রিক চাই।”

লোকটির দাবি পূরণ করতেই যেন আরিফ কপিলদেবের মতো অসাধারণ আউটসুইং করিয়ে বলটা ফেলল অফ স্টাম্পে। দ্বিতীয় স্লিপ গোড়ালির কাছে ক্যাচটা ধরেই গড়িয়ে পড়ল।

হ্যাটট্রিক প্রথম ওভারেই। রেড ০—৩। দুধঘাটে হ্যাটট্রিক একটা বিরাট ঘটনা। দিলুকে ব্যাট হাতে নামতে দেখে বিশাল অভ্যর্থনা গাছের কাকগুলোকে ভয় পাইয়ে উড়িয়ে দিল।

ওভারের দুটো বল বাকি। দিলু আউট সুইঙ্গারগুলো দেখে নিয়ে ছেড়ে দিল। কানা ভাঙা ব্যাট দিয়ে সুইং করা বল খেলতে যাওয়া মানেই বিপদ ডেকে আনা, এটা সে বুঝে গেছে। দ্বিতীয় ওভার, কমলেশ খেলবে অরুণ মেহটার বলে। পাঁচটা বল খেলল একটা বাই বাউন্ডারি, মিড উইকেট থেকে দুই নিয়ে কমলেশ মিড অফে ক্যাচ তুলে ফিরে গেল। রেড ৬—৪। ছয় রানে চার উইকেট পড়ে গেছে। ক্রিজে এল অংশু।

”দুলাল ডাউন দ্য শাটার, ঝাঁপ ফেলে দাও।” অংশুকে নড়বড়ে দেখাল। প্রথম ওভারেই এতবড় ধাক্কা পেলে কোন অধিনায়ক না নার্ভাস হয়ে পড়বে।

পরের ওভারে বল করতে এল আদিত্য মজুমদার। ইনসুইং করায়, মাঝে মাঝে দেয় লেগকাটার। অংশু মারার বল মারল না, সিঙ্গল রান নিতেও রাজি নয়। মেডেন ওভার।

হ্যাটট্রিক করে আরিফ উৎসাহে ফুটছে। তার দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলটা ওভার পিচ। দিলু স্ট্রেট ড্রাইভ করল। ফলো থ্রুতে আরিফ বলটা থামাতে পারল না। চার হল। অংশু কপাল কুঁচকে শুধু তাকাল। পরের বলে দিলু আবার স্ট্রেট ড্রাইভে বাউন্ডারিতে বল পাঠাল। তৃতীয় বলটা আরিফ বাম্প করাতে চেষ্টা করল, দিলুর কাঁধের কাছে বল উঠতেই সে পুল করল। মিড উইকেটের ওপর দিয়ে ছয় হল। আরিফকে প্রথমে অবাক, তারপর নিজের ওপর বিরক্ত; এখন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। চতুর্থ বল গুড লেংথে, কিন্তু সুইংটা বড় হয়ে গেল। দিলু স্কোয়ার ড্রাইভ করল। পয়েন্ট ও কভারের মাঝ দিয়ে বাউন্ডারিতে যাওয়া বলের দিকে সবাই তাকিয়ে, দিলু তাকিয়ে তার ব্যাটের দিকে। ভাঙা জায়গাটা থেকে ছোট্ট একটা কুচি খসে গেছে।

মাঠ ঘিরে পাগলামির স্রোত বইছে। বল বাউন্ডারিতে পৌঁছলেই বাচ্চচা ছাত্ররা মাঠে ঢুকে নাচানাচি করছে। লাইফ সায়ান্স মাস্টারমশাই হাল ছেড়ে দিলেন। হরিসাধন অতিকষ্টে নিজেকে সংযত রেখেছেন। সবাই জানে দিলু তাঁর ভাগ্নে, চিৎকার করা বা দু’হাত তুলে অঙ্কের বরদাবাবুর মতো লাফালে পক্ষপাতিত্ব দেখানো হয়ে যাবে। তবে আরিফের হ্যাটট্রিক হতেই তিনি দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিয়েছেন। মলু, যে ক্রিকেটের কিছুই বোঝে না, সেও চারপাশের গনগনে উত্তেজনার আঁচে ঝলসে মুখ লাল করে ফেলেছে। ফিসফিস করে সে পাশে বসা জেঠুকে বলল, ”দিলুটা করছে কী?”

পঞ্চাননও চাপা স্বরে বললেন, ”মাকে বলছে তুমি আমাকে চেনোনি, বোঝোনি। আমি তোমার সেরা ছেলে।”

আরিফের পঞ্চম বলটা সোজা নারকেল গাছের পাতায় গিয়ে লাগল। দিলু চোখের সামনে ব্যাট তুলে দেখল, ভাঙা জায়গাটায় চিড় ধরেছে, আবার একটু কুচি খসে পড়বে। অংশু এগিয়ে এল। দিলুর হাত থেকে ব্যাটটা নিয়ে নিজের ব্যাট তার হাতে দিয়ে হাসল। দিলু ইতস্তত করে বলল, ”দামি ব্যাট। যদি ভেঙে যায়?”

”ভাঙুক। এর চেয়েও দামি টিমের উইন।”

কথাটা শুনেই ঝিনঝিন করে উঠল দিলুর সারা শরীর। দু’বার ব্যাটটা হাতে নাচিয়ে সে স্টান্স নিল। আরিফ এবার জোরে ফুল পিচে বল করল সোজা কাঁধের সমান উচ্চচতায়। আশিস ঘোষ নো বল ডাকল কিন্তু দিলু বলটাকে পুল করে ছয় মেরে দিল লং লেগ বাউন্ডারিতে। এক এবং ছয় রান হল। এক ওভারে একত্রিশ রান নিল দিলু।

অংশু এগিয়ে এল কথা বলতে। দিলু বলল, ”শাটারটা আটকে গেছে, ডাউন করতে পারছি না।”

”আরিফ শ্যাটারড। আর ও বল করবে না মনে হচ্ছে। শাটারটা তুমি আর একটু ওপরে তোলো।”

হাতে দুটো ব্যাট নিয়ে কমলেশ মাঠে ছুটে এল। অংশু একটা বেছে নিয়ে দিলুর ভাঙা ব্যাটটা তার হাতে দিল। আদিত্যর প্রথম বলে পয়েন্ট থেকে অংশু একটা রান নিল। তার রান এবং এই রানটাতেই সে রইল যখন রেড টিমের টোটাল চার উইকেটে সাতান্নয় পৌঁছল। দিলুর পঞ্চাশ, একুশ বল খেলে। একস্ট্রা হয়েছে ছয় রান।

দিলু ব্যাটটা চাঁদোয়ার দিকে লম্বা করে দেখিয়ে দু’বার ঝাঁকাল। পঞ্চানন মলুকে বললেন, ”তোকে দেখাচ্ছে। ওঠ, উঠে হাত নাড়।” মলু সদ্য ঘুমভাঙার মতো ধড়মড়িয়ে উঠে দু’হাত নাড়তে লাগল। পেছন থেকে কে বলে উঠল, ”দিলুর মা।” লোকে তাকে দিলুর পরিচয়ে চিনেছে। মলুর কান গরম হয়ে উঠল।

শতরানে দিলুর পৌঁছতে যখন পনেরো রান বাকি, জয়ের জন্য রেডের তখন দরকার ষোলো রান। আগ্নেয়গিরির মতো মাঠ তখন ফুটছে। হবে কি হবে না। বাজি ধরা শুরু হয়ে গেছে।

”বলছি হবে। সেঞ্চুরি হবেই। বাজি?” এক যুবক বলল, পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে। ”যশোহরের ছানার জিলিপি যত প্যারিস।”

”গেল গেল গেল।” আঁতকে উঠল আর এক যুবক। দিলু ওভারের শেষ বলে এক রান নিচ্ছিল, শর্ট লেগে বল ঠেলে দিয়ে। অংশু দৌড় শুরু করে দেখল, এক ফিল্ডার বল কুড়িয়েছে। অংশু থমকে দাঁড়িয়ে চে�চিয়ে বারণ করল রান না নেওয়ার জন্য। কিন্তু দিলু তখন পিচের মাঝামাঝি এসে গেছে। ফিল্ডার বল ছুড়ল উইকেটকিপারকে আর অংশু অতিক্রম করল দিলুকে। তখনই উইকেটকিপার তিনটি স্টাম্প হাতের ধাক্কায় ফেলে দিল। দিলুর দিকে তাকিয়ে অংশু হাসল মাত্র, তারপর হাঁটা শুরু করল। সারা মাঠ হাততালি দিয়ে তার স্বেচ্ছায় এই রান আউট হওয়াকে তারিফ জানাল।

একটা কিছু ঘটে গেল দিলুর মধ্যে। পরের ওভারে সে পেল এক বাঁ হাতি স্পিনারকে। প্রথম চারটে বলে সে অন আর অফে ড্রাইভ করে তিনটি চার এবং সোজা একটা ছয় মেরে রেড—এর ইনিংস একশো পনেরো রানে পৌঁছে দিল। তার শতরান হল চল্লিশ বলে।

এরপর আবার দেখা গেল সেই দৃশ্য। দিলুকে ঘাড়ে শুইয়ে মাঠ থেকে ড্রেসিংরুমে নিয়ে যাওয়া। তবে এবার তাকে বহন করল অংশুর ক্যাপ্টেন্সিতে রেড দলের ছেলেরা।

পাঁচ মিনিট পর ড্রেসিংরুমের বাইরে মলু, পঞ্চানন আর প্রতাপ। ব্যাটটা হাতে নিয়ে দিলু বেরিয়ে এল। মুখে একগাল হাসি, কপালে ঘাম, এলোমেলো চুল আরও এলোমেলো।

মলু হাতব্যাগ খুলে চিরুনি বের করল।

”কাছে আয়।”

দিলু এগিয়ে এসে মাথা নিচু করল। আঁচড়ে দিতে দিতে মলু বলল, ”চুল তো নয় কাকের বাসা, এবার ন্যাড়া করে দোব।” আঁচল দিয়ে দিলুর মুখের ঘাম মুছে দিল। ব্যাটটা দেখে বলল, ”কার ব্যাট?”

”অংশুর। জানো মা, এটার দাম সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা!”

”অ। তরুণ করের ছেলে আর কখনও যেন পরের ব্যাট নিয়ে না খেলে।” মলু গম্ভীর কঠিন গলায় কথাটা বলে প্রতাপের দিকে তাকাল। ”ব্যাটম্যাট কোনটে ভাল কোনটে মন্দ, আমি বুঝি না। আপনি কাল আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে দোকানে নিয়ে যাবেন। ব্যাটের সঙ্গে আর কী কী লাগবে তারও একটা লিস্টি করে আনবেন। ব্যাট লিখবেন দুটো। একটা ভেঙে গেলে অন্যটায় খেলবে। পরের ব্যাট নিয়ে খেলা উচিত নয়।”

প্রতাপ ঘাড় নাড়ল। মলু এবার পঞ্চাননের দিকে তাকাল। ”জেঠু, তুমিই হচ্ছ পালের গোদা। লেখাপড়া করতে তোমার কাছে রাখলুম, আর তুমি—!”

মলু আঁচলে চোখ মুছল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *