সরলা

সরলা – মতি নন্দী – উপন্যাস

সরলার সংসার খুবই সুখের। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুরা ও প্রতিবেশীরা তাইই মনে করে। করার কারণও আছে।

সরলা নিজে দেখতে শুনতে ভালো। মুখের গড়নটি ডিমের মতো। গায়ের রং কাঁচা হলুদের বা দুধেআলতা, এমনকী পাকা সোনার মতো না হলেও গৌরবরণই তবে ফ্যাকাসে নয়। নাকটা টিকোলো হলে মুখের গড়নের সঙ্গে মানাত না, তাই টিকোলো নয়। মধ্যিখানটা ঈষৎ বসা। কপালটা ঢালু না হয়ে সামান্য উঁচু হওয়ায় দেখতে ভালোই লাগে। চোখদুটি হরিণের মতো নয় বরং লেপচা-ভুটিয়াদের আদলে পেস্তাচেরা। ওর মুখমণ্ডলে এই একটিই খুঁত কিন্তু এটিও মানিয়ে গেছে। চিবুক থেকে গলাটা নেমেছে সরু থেকে চওড়া হয়ে ছড়িয়ে পড়া ফুলদানির গলার মতো। কাঁধের বিস্তার বাহুতে ঢলে পড়ার সময় চর্বি বা মাংসের অনাবশ্যক ঢিপি তৈরি করেনি। ঝুলে থাকা হাতটার আঙুলের ডগা পর্যন্ত চমৎকার সামঞ্জস্য রেখেছে পাশের দীর্ঘ, মেদহীন দেহকাণ্ডটির সঙ্গে। বক্ষ, কটি ও নিতম্বের সমন্বয়ে ওই দেহটি যে ছন্দ তৈরি করেছে সেটি সে বজায় রেখেছে এবং আজও তাইতে লোকেশ মুগ্ধ রয়েছে, বিবাহের আঠারো বছর পরও। সুতরাং সরলা সুখী।

লোকেশের মতো শিক্ষিত, যথেষ্ট সচ্ছল, মিশুকে, সুদর্শন এবং মোটামুটি স্বাস্থ্যের স্বামী পেলে সরলা কেনই বা সুখী হবে না? লোকেশ তাকে দেখার জন্য মলিদের বাড়িতে এসেছিল। তার বাল্যবন্ধু মলির অর্থাৎ মালবিকাদের বাড়ি আর সরলার বাপের বাড়ি, সামনে আর পিছনে।

সরলার বাবা ট্রাম কোম্পানিতে ক্যাশিয়ার ছিলেন। চার মেয়ে, দুই ছেলের বাবা। ছয়জনের মধ্যে সরলা পঞ্চম এবং তৃতীয়া কন্যা। তখন কমলা ও রমলা, বড়ো দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা দুই ছেলেকে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘লেখাপড়া শিখিয়ে তোমাদের মানুষ করেছি। দুজনেই চাকরিতে ঢুকেছ। এবার তোমরা বাকি দুই বোনের বিয়ে দাও। আমার যা কিছু ছিল সবই তোমাদের জন্য আর দুই মেয়ের বিয়ে দিতে শেষ হয়ে গেছে।’

সমীর আর সনৎ গভীর প্রকৃতির। তারা স্বীকার করে বাকি দুই বোনের বিয়ের দায় তাদেরই নেওয়া উচিত। তারা সরলার জন্য পাত্র খোঁজার চেষ্টা করে বটে তবে ব্যস্ততা নিয়ে নয়। সরলা তখন একুশ বছরে, বি এ দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। মেয়েদের বিয়ে তো তেইশ-চব্বিশেও হচ্ছে, সুতরাং আরও দু-তিন বছর দেখা যেতে পারে। তা ছাড়া তাদের বোন দেখতে তো খারাপ নয়। ডানাকাটা পরি না হলেও, একবার-দু’বার ফিরে তাকাতে হয়।

তার বিয়ের কথা ভাবা হচ্ছে সরলা তা জানে। বন্ধু মলিকেও সে বলেছে। মলি তার বাড়ির লোকেদের কাছে কথায় কথায় বলেছি, ‘সরির জন্য ছেলে দেখা হচ্ছে। কাকিমা বলল, তোর দাদার সঙ্গে তো অনেকের চেনা, একটু বলিস না, ভালো ছেলের সন্ধানটন্ধান যদি পায়।’

মলির দাদা মানব রাজনীতিতে তখন দিনের দুই-তৃতীয়াংশ সময় দিয়ে পৌর প্রতিনিধির জন্য নমিনেশন পাবার মতো জায়গায় প্রায় এসে গেছে। খুবই ব্যস্ত মানুষ কিন্তু তার মধ্যেই সে লোকেশকে চিহ্নিত করে, বোনের বন্ধু ও পিছনের বাড়ির মেয়ে সরলার জন্য পাত্র হিসাবে। তার সঙ্গে লোকেশ কলেজে পড়েছে, বি এসসি পাশ করে বেরোনোর পরও যোগাযোগ আছে।

ওষুধের ডিলারশিপের পৈতৃক ব্যবসায়ে লোকেশ সাধারণ কর্মচারীর মতনই কাজ করত। ব্যবসার কর্তা ছিলেন জ্যাঠামশাই। দাম্ভিক, রাশভারী অমৃতলাল দত্তই আশি ভাগের মালিক। বছর ছয়েক কাজ করার পর তার সঙ্গে জ্যাঠার খিটিমিটি শুরু হতে থাকে। মনোমালিন্যের বীজ বহু বছর ধরেই দুই পরিবারে বোনা হয়ে ছিল। লোকেশের ধারণা তার বাবাকে ব্যবসায় হিস্যা থেকে ঠেকিয়ে জ্যাঠা বঞ্চিত করেছে। রাগ অবশেষে ঝগড়ায় এবং জ্যাঠার কাছে কর্মচারী হয়ে থাকার সম্পর্কটা ঘুচিয়ে ফেলায় পৌঁছয়। তবে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হওয়ার মতো পর্যায়ে যায়নি। জ্যাঠার পৌত্রের অন্নপ্রাশনে লোকেশ নিমন্ত্রণ খেয়ে এসেছে।

একশো দশ বছরের দরদালান দেওয়া বাড়িটা লোকেশের বাবা জীবিত থাকতেই ভাগ হয়ে গেছিল। উঠোনে পাঁচিল তোলার পর তাদের অংশে পড়েছিল যতটুকু, তাইতে রাস্তার উপর একটা সদর দরজা আর দোতলা ও তিনতলার সিঁড়ি তৈরি করে নিতে হয়। একতলায় একফালি উঠোন, দুটো বৃহদাকার ঘর আর কল-পায়খানা। দোতলায়ও দুটি ঘর এবং রাস্তার উপর ছোটো বারান্দা। বিটুর আট বছর বয়সে দুটি ঘরকে সে তিনটি করে নিয়েছে। ছেলেকে নিয়ে এক বিছানায় রাত্রে শোয়া, যখন সবকিছু বুঝতে শেখার বয়স হচ্ছে, অতএব আর উচিত নয় বিধায় লোকেশ একটি ঘরকে খণ্ড করে। বিটু তখন থেকেই নিজের ঘরে বাস করছে। বাকি খণ্ডের ঘরটি তার পড়ার এবং বাইরের কেউ এলে বসানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।

এই সংসারে সরলা বউ হয়ে, পা দেয় একেবারে গৃহিণী হয়েই। মা মারা যাবার পর সংসারের আর একমাত্র ব্যক্তি প্রায় অথর্ব বাবার জন্যই লোকেশ নিজের বিয়ের কথা ভাবছিল। তখন সে হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে ক্লার্ক ট্যালবট ওষুধ কোম্পানির মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে ওষুধের দোকানে দোকানে, হাসপাতালে, ডাক্তারদের চেম্বারে ঘুরে বেড়ায়। ঠিক ঝি এবং তেরো বছরের চন্দন রান্না সমেত বাড়ির সব কাজ করলেও কোনো কাজের মধ্যে শৃঙ্খলা বা পারিপাট্য ছিল না। লোকেশ বুঝতে পারে ঘরের কাজ মেয়েদের জন্যই অতএব বউ আনা দরকার।

কিন্তু এনে দেবে কে? তার সঙ্গে একটি মেয়েরও প্রণয় হয়নি। না পাড়ায়, না কলেজে কোনো মেয়ে তার প্রতি হৃদয় সম্পর্কিত দুর্বলতা দেখায়নি। লোকেশকে এই ব্যাপারটা বহুদিন বিস্মিত রেখেছিল। কবিতা না লিখলেও সে ভালো কথা বলতে পারে, গায়ক বা খেলোয়াড় না হলেও সুদর্শন তবু একটি মেয়েও তার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক পাতাতে ঔৎসুক্য দেখায়নি। সে ভেবেছিল, নিশ্চয় তার মধ্যে একটা কোনো গোলমাল রয়েছে যেজন্য এগোরার বয়সি মেয়েরাও তার দিকে এগোল না।

যাক গে, বলে লোকেশ এই নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি। প্রেম সবার জন্য নয়, এটা কপালের ব্যাপার এমন সিদ্ধান্ত পৌঁছে সে জ্যাঠার কাছে চাকরিতে ঢুকে পড়েছিল। তারপর সে শুধু আর্থিক উন্নতির চেষ্টাই করে গেছে। দিনে ষোলো ঘণ্টা পরিশ্রম করে তার নিজের কাজের অন্ধিসন্ধি বুঝতে চেষ্টা করেছে এবং উন্নতিও করেছে।

তার গর্ব সে ‘সেল্ফ মেইড ম্যান’। এটা সে প্রায়ই বলে বিশেষ করে বিটুর সামনে। কিন্তু বিয়ের জন্য পাত্রী সংগ্রহে নেমে সে বুঝতে পারে ‘সেল্ফ মেইড’ কোনো কাজে আসছে না। এসব ব্যাপার মা-বাবা, কিংবা মাসি-পিসি, কাকি-জ্যেঠিরাই করে থাকেন। মা নেই, বাবা অশক্ত, তা ছাড়া ওঁর বোধবুদ্ধির উপরও তার ভরসা নেই। মাসিদের সঙ্গে সম্পর্কটা এমন নয় যে, তাদের বলা যায় ‘বিয়ে করব, একটা মেয়ে দেখে দাও’। পাশের বাড়ির কাউকে অর্থাৎ দুটি জ্যেঠি বা জ্যাঠাদের তো বলার কথাই ওঠে না!

তখন এক একসময় লোকেশের মনে হত, পশ্চিমবাংলা কেন, এই কলকাতাতেই কয়েক হাজার মেয়ে বর পাবার জন্য দিন গুণে চলেছে আর সে কিনা বউ জোগাড় করতে পারছে না! ওদের আত্মীয়স্বজনরা যদি একবার জানতে পারত কলকাতায় নিজের বাড়ি, একমাত্র ছেলে আর বাবার সংসার, শিক্ষিত, দেড় হাজারের উপর রোজগেরে একটা পাত্র বউ পাবার জন্য কি মুশকিলেই না পড়েছে, তা হলে আঠোরোর-এক দুর্গাদাস মিত্র লেনের দরজায় লাইন পড়ে যেত। ভেবেচিন্তে সে ঠিক করল, তার মুশকিলের কথাটা দেশবাসীকে জানাবে। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেবে।

কলেজের সহপাঠী গোবর্ধন ওরফে গোবরা চাকরি করে আনন্দবাজারের বিজ্ঞাপন বিভাগে। লোকেশ তার সঙ্গে দেখা করতে গেছিল। সে শুনেছে, ভিতরে লোক থাকলে বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ার মতো ভালো জায়গায় বেরোবার ব্যবস্থা নাকি করা যায়। গোবরার টেবলে পৌঁছে দেখল মানব বসে রয়েছে। ওকে দেখেই লোকেশের মনে হল, ব্যাপার কী, মানবও বিয়ের জন্য বিজ্ঞাপন দিতে এসেছে না কি!

লোকেশ প্রথমে ইতস্তত করেছিল। তারপর গোবরাকে বলেই ফেলে, ‘একটা ব্যাপারে তোর একটু সাহায্য চাই। একটা বিয়ের বিজ্ঞাপন দেব।’

‘কার বিয়ে?’

‘আমারই। বাড়িতে এমন একটা অবস্থা যে, কোনো মেয়েছেলে নেই, খুব অসুবিধে হচ্ছে।’

লোকেশের গলায় কৈফিয়ত দেবার সুর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার লজ্জাও করছিল। বিজ্ঞাপনের বয়ান লেখা কাগজটা ব্যাগ থেকে বার করছে তখন মানব বলল, ‘তুই বিয়ে করবি?’

‘হ্যাঁ।’

‘পাত্রীর জন্য বিজ্ঞাপন দিতে এসেছিস?’

‘হ্যাঁ।’

‘দিতে হবে না। আমার হাতে ভালো মেয়ে আছে।’

লোকেশের প্রথমেই মনে হল, মানব বোধহয় নিজের বোনের কথা বলবে। তা হলে তাকে খুবই অস্বস্তিতে পড়তে হবে। কেননা মলি যদিও খুব ভালো মেয়ে কিন্তু বেঁটে এবং বেঢপ। যত প্রয়োজনই থাক লোকেশ ওকে বিয়ে করতে পারবে না। সুতরাং সে কাঠ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল মানবের পরের কথা শোনার জন্য।

‘ছোটোবেলা থেকেই দেখছি, পিছনের বাড়ির, মলির খুব বন্ধু। বি এ সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। আমাদের বাড়িতে রোজই আসে। আর বেশ লম্বা, ফর্সাও, মজবুত স্বাস্থ্য।’ মানব ‘বন্ধুগণ’ বলে বক্তৃতা শুরু করার আদলে কথাগুলো বলল।

‘তা হলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল।’ গোবরা চোখেমুখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার মতো ভাব ফুটিয়ে বলল, ‘বাপের অবস্থা কেমন?’

‘ভালো নয় খুব। চার মেয়ে দুই ছেলে। বড়োছেলে স্কুল মাস্টারি করে বাইরে, অন্যটি রেলে ঢুকেছে। ভদ্রলোক ট্রামে ক্যাশিয়ার। দুটি মেয়েকে পার করতে গিয়ে হাত খালি হয়ে গেছে।’

‘তার মানে কিছু দিতে পারবেন না।’ গোবরা বরকর্তার ভূমিকা নিয়ে ফেলেছে।

লোকেশ প্রতিবাদ করে ঈষৎ উত্তেজিত স্বরে বলে, ‘দিতে পারবেন না মানে? আমি কি ভিখিরি নাকি যে, খাট, বিছানা, ঘড়ি, আংটি, বাসনকোসন কী সোফা, আলমারি, ফ্রিজ, টিভি দিতে বলব?’

‘আহা, তুই রাগছিস কেন। সমাজে এসব চলে আসছে, চলছে, বলেই বললুম।’ গোবরা কিঞ্চিৎ অপ্রভিত হয়ে গলা নামিয়ে বোঝাল সে ভুল করে ফেলেছে।

‘না, না, রাগ আমি করিনি। আমার বাবা-জ্যাঠারাও তো বিয়েতে প্রচুর নিয়েছে। দিলে কে আর ছাড়ে! কিন্তু আমি পুরুষ মানুষ, সেল্ফ মেইড ম্যান, এতে আমি কালি লাগতে দেব না। শ্বশুরের দেওয়া খাটে শোব, শ্বশুরের দেওয়া ঘড়ি পরব, অসম্ভব! বউয়ের শ্রদ্ধাও তো স্বামীরা চায়, তাই না?’

‘তা হলে একটা ঝামেলা চুকে গেল, এবার নেক্সট এবং আসল গাঁট, মেয়ে পছন্দ।’ মানবকে অনেকটা নিশ্চিত দেখাল। ‘কবে মেয়ে দেখবি বল, কালকেই?’

‘আমি ওই সাজগোজ করানো সামনে ঘাড় হেঁট করে বসে থাকা পুতুল দেখতে রাজি নই। ঘরে রোজ স্বাভাবিক অবস্থায় যেভাবে থাকে, চলাফেরা করে, তেমনভাবে দেখতে চাই।’

‘বেশ সেইভাবেই দেখাব।’

বিজ্ঞাপন দেওয়া আর হয়নি। বেরিয়ে আসার সময় গোবরা বলেছিল, ‘বিয়েতে নেমন্তন্ন করিস।’

এরপর কফি হাউসে বসে লোকেশ জিজ্ঞাসা করেছিল মানবকে, ‘গোবরার কাছে তুই কেন এসেছিলি?’

‘ধরাধরির ব্যাপার। একটা ছোট্ট খবর দিয়েছিলাম, আমাদের পাড়ায় রক্তদান শিবিরের উদ্বোধন করেছি, চল্লিশজন রক্ত দিয়েছে। দশদিন হয়ে গেল এখনও বেরয়নি। তাই গোবরাকে ধরতে এসেছি, ও যদি চিফ রিপোর্টার কী আর কাউকে বলে দু-লাইন বার করাতে পারে। বিজ্ঞাপনে থাকলেও ওদিকে চেনাজানা তো থাকতে পারে।’

‘এইসব খবর বের হলে তার কোনো লাভ হয়?’

‘হয়। শুধু তো পাবলিকেরই নয়, নেতাদেরও চোখে পড়ে। রাস্তায় রাস্তায় বক্তৃতা করে জীবন শেষ করার জন্য তো আর রাজনীতিতে আসিনি। নিজের ঢাক নিজে না পেটালে কেউ আমার দিকে তাকাবে না। উপরে উঠতে হলে অনেক কিছু করতে হয়। যাকগে এসব কথা, তুল কাল-পরশুই চলে আয়।’

‘যাব। একটা কথা জানা হয়নি, সোনার বেনে তো?’

‘তা না হলে তোর জন্য বলব কেন! ওরা মল্লিক।’

লোকেশ দু-দিন পর হাজির হয়েছিল। তখন সকাল এগারোটা। মানব বাড়ি ছিল না। মলি বলল, ‘তাতে কী হয়েছে, আমিই আপনাকে মেয়ে দেখিয়ে দেব। লুকিয়ে দেখবেন তো ছাদে চলুন আর কাছের থেকে দেখতে চান যদি তা হলে ডেকে আনছি। না না সরিকে কিছু জানাব না।’

প্রথমে দূর থেকে দেখাই ভালো, এক ঝলকেই যদি পছন্দ না হয়, তা হলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সৌন্দর্য আবিষ্কার করেও কোনো লাভ নেই। এই সিদ্ধান্তে এসে লোকেশ ছাদের থেকে দেখাই সমীচীন বোধ করল।

ছাদের একধারে তারে শাড়ি শুকোচ্ছে। লোকেশ তার আড়ালে শুধু চোখ দুটি বার করে দাঁড়াল। মলি অন্য ধারের পাঁচিল থেকে চেঁচিয়ে ডাকতেই উত্তর এল, ‘দিদি, কলঘরে কাপড় কাচছে।’ লোকেশ উঠোনে একটি তরুণীকে দেখতে পাচ্ছে। অবশ্যই সরলার বোন, না হলে দিদি বলবে কেন!

মেয়েটি মোটামুটির থেকে অনেক উপরে, প্রায়-সুন্দরীর পর্যায়ে। প্রত্যাশায় টানটান হয়ে উঠল তার স্নায়ু।

‘খুব দরকার রে রুমি, সরিকে একবার উঠোনে আসতে বল না রে।’

কলঘর থেকে সরলা বেরিয়ে এল। দেহে আবরণ বলতে শুধু শাড়িটি। হাঁটুর নীচে জবজবে ভিজে। দু-হাতে সাবানের ফেনা মাখা। তালুর উলটো পিঠ দিয়ে কপাল থেকে চুল সরাতে সরাতে সে উপরে মুখ তুলল। সায়া, ব্লাউজ, ব্রেসিয়ার ছাড়া পাত্রী দেখার সৌভাগ্য অনেকেরই হয়, তাতে অনেকেই হর্ষ-রোমাঞ্চ বোধ করে, অনেকে মুহূর্তেই বিয়েতে সম্মত হয়ে যায়। লোকেশ নিজের ইন্দ্রিয়সমূহের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার উপর ভরসা রাখতে পাচ্ছে না। চোরাবালির মতো ডুবিয়েও তো দিতে পারে।

‘সরি, কখন কলেজ যাবি রে, আমার একটা জিনিস তোকে কিনতে দিতাম।’

‘কী জিনিস?’

গলা চড়িয়ে বললেও কণ্ঠস্বরটি লোকেশের ভালো লাগল।

‘শাড়ির ফলস।’

‘সাড়ে বারোটায় বেরোব, তখন নিয়ে নেব।’

সরলা কলঘরে ফিরে গেল। মিনিট খানেকের দর্শন তাতেই লোকেশের কপালে ঘাম দেখা দিয়েছিল।

‘আপনি কি কাছের থেকে দেখবেন, তা হলে একটু বসে যান।’

লোকেশ বসেনি, ঘণ্টা দেড়েক দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছিল বাসস্টপে, সরলাকে দেখার জন্য। সে দেখল চার মিটার দূরত্ব থেকে। সরলা অপেক্ষমাণদের উপর একবার চোখ ফেলেছিল, তাদের মধ্যে লোকেশও ছিল। মিনিট তিনেক পর বাস আসে, ওই সময়টুকুর মধ্যে দু-বার স্থানবদল করে সে সোজা মুখের উপর ও আড়চোখে দেহের উপর চোখ ফেলে সরলার পা থেকে মাথা পর্যন্ত কয়েকবার দ্রুত দেখে নেয়।

এই দেখার সময়ই সে ওই দেহটিতে আসক্ত হতে থাকে। প্রবল একটা আকর্ষণ, যেভাবে গ্রহদের টেনে রেখেছে সূর্য, সরলার দেহও লোকেশকে তার কামনার কক্ষপথে স্থাপন করে সেইভাবে আকর্ষিত করল।

সে সরলার সঙ্গেই বাসে উঠল। পুরুষদের জন্য বসার জায়গা নেই। লেডিস সিটে’বসা সরলার সামনে সে দাঁড়াল কিন্তু পূর্ণদৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নিল না। কেননা ইতিমধ্যে সে স্থির করে ফেলেছে, ওই দেহটি আজীবন দখলে রাখার, স্বত্বাধিকারী হওয়ার সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবে না। তার চেনাজানা লোকেদের মধ্যে একজনের বউয়েরও এমন আকর্ষণীয় গড়ন নেই।

একটা ঘোর তার চেতনায় কুয়াশার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছিল। ঝাপসা দৃষ্টিতে সে বাসের যাত্রীদের দিকে তাকাল এমন একটা ভাব নিয়ে যেন বলতে চায়, মশাইরা কেমন লাগছে আমার সামনের এই মেয়েটিকে? ও কিন্তু আমার বউ, আর কিছুদিন পরেই হবে। আমার পছন্দটা কেমন বলুন তো? আমিই এই ফুলটির শোভা দেখব, সুবাস নেব, আপনারা নন। শুধুই আমি।

সরলার পিছু পিছুই সে বাস থেকে নেমেছিল। সরলা চলেছে আর এধার সেধার দাঁড়ানো কলেজের ছেলেরা তার দিকে তাকাচ্ছে। লোকেশ বাস থেকে নেমে আর এগোয়নি। কলেজের ফটক পর্যন্ত সে চোখ দিয়ে সরলাকে অনুসরণ করতে করতে একটা জ্বলুনি বোধ করল। জীবনে এমন জ্বালা এই প্রথম। সবাই তাকাচ্ছে ওর দিকে। ঝালমুড়িওলা, চায়ের দোকানের ছোকরটা পর্যন্ত! কেন? সবাই কি ওকে চায়?

তিন সপ্তাহ পর বিয়ে হয়ে যায়।

সরলার ছোড়দা সনতকে ডাকিয়ে এনে মানব বিয়ের কথা পাড়ে। পাত্র সম্পর্কে যতটুকু জানে সেটা জানিয়ে দিয়ে বলে, ‘তোমরাও খোঁজ নাও। তবে এটুকু বলতে পারি, স্বভাবচরিত্রে, চেহারায়, বংশমর্যাদায় এমন ছেলে চট করে পাবে না। বন্ধু বলেই ভেব না, এ কথা বলছি। সবথেকে বড়ো সুবিধে কী জান, একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট সংসার। আর বি এ পরীক্ষা? সে হয়ে যাবে’খন। প্রচুর বিবাহিতা মেয়ে কলেজে পড়ছে, সরিও পড়বে।’

বিয়ের আগে সরলা একবার মাত্র লোকেশকে দেখেছিল। এই দেখিয়ে দেওয়ার কাজটি করেছিল মলি। দেশবন্ধু পার্কের পশ্চিম ফটকে ব্যাগ হাতে লোকেশ অপেক্ষা করেছিল, সরলাকে কলেজ থেকে নিয়ে আসে মলি। যখন দূর থেকে তাকে হেঁটে আসতে দেখল লোকেশ তখন বুকের কাছে টাইটা আঁকড়ে ধরে টানতে থাকে। বিহ্বলতা বা মুগ্ধতা নয়, সে মাথার মধ্যে জ্বলুনি বোধ করছিল। তাকে অপছন্দ করবে এমন অযোগ্য সে নয়, এই ধারণাটা অবশ্য লোকেশের ছিল, কিন্তু ওর কোনো প্রেমিক তো থাকতে পারে! হয়তো সরলা নামক এই ফুলটি অনাঘ্রাত নয়!

লোকেশ ব্যাগটা জমিতে রেখে নমস্কার করে তার সাজানো দাঁতগুলো ঝলসে দিতেই সরলা থতমত হয়ে কোনোরকমে দুই মুঠি বুকের কাছে জড়ো করে। ভাবী স্বামীর সঙ্গে মৌখিক পরিচয় এবং দর্শন করিয়ে দেবে, এই বলেই মলি ওকে এনেছে। সুতরাং আচমকা সাক্ষাৎ নয়। লোকেশের ভ্রু একবার কুঁচকে উঠেছিল সরলার এই প্রতিক্রিয়ায়। এইরকম সময় বহু মেয়েই নার্ভাস হয় ঠিকই, কিন্তু যদি ওর কোনো প্রেমিক থাকে, তা হলে এই থতমতানিটাকে নার্ভাসনেস বলা যাবে না। লোকেশ এইরকম চিন্তা মাথায় নিয়ে আবার হেসে বলেছিল, ‘আমার নাম লোকেশ দত্ত, এটা নিশ্চয় জানেন। আপনার নামও আমি জানি। চলুন পার্কে কোথাও বসা যাক।’

তারা বেঞ্চে নয়, লোক চলাচল কম অঞ্চল, পার্কের পুব দিকে ঘাসের উপর বসেছিল। এইরকম পরিস্থিতিতে কীভাবে, কী বিষয় নিয়ে কে কথাবার্তা শুরু করে প্রাথমিক জড়তাটা কাটিয়ে তুলবে, সেটাই হয়ে ওঠে আসল কাজ। মলি যেহেতু তৃতীয় পক্ষ, সরলার সখি স্থানীয়া, কথা বলতে এবং হাসিতে খুশিতে থাকতে ভালোবাসে তাই কাজটা সে-ই নিল।

‘আপনারা চুপচাপ কেন, কথা বলুন? যার যা প্রশ্ন করার আছে করুন। আমি বরং একটু ততক্ষণ ঘুরেটুরে বেড়াই।’ মলি উঠে পড়ার উদ্যোগ করল।

‘না, না, বোস।’ সরলা হাত টেনে ধরল।

‘না কেন?’ মলি ধমকে উঠল। ‘কী সব জিজ্ঞেস করবি বলেছিলি, কর।’

‘হ্যাঁ করুন না।’ লোকেশ বলল খুবই সহৃদয় ভরসা দিয়ে। ‘বিয়ে হবে কি হবে না, এখনও সেটা পাকা নয়। মানে, এখনও আপনি আমায় অপচ্ছন্দ করে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’

সরলার বিব্রত মুখে ঘাম এবং রক্তচাপ দেখা গেল। মুখ নামিয়ে সে ঘাস ছিঁড়ল। মলি ওর কানে কানে বলল, ‘কেমন দেখছিস? পছন্দ হয়েছে?’

‘অসভ্যতা করিস না।’ চাপা গলায় সরলা ধমকায়।

‘তা হলে বলে দিই পছন্দ হয়েছে?’ মলি এবার একটু জোরেই বলল লোকেশকে শুনিয়ে। পুলকিত লোকেশ তখন না শোনার ভান করে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল দূরের বাড়িগুলোর দিকে।

‘লোকশদা, সরি বলছিল’, মলি সেকেন্ড পাঁচেক নীরব থেকে আবার বলল, ‘আপনি ক-টা ছেলেমেয়ের বাবা হতে চান?’

সরলা হতভম্বের মতো দুজনের দিকে তাকিয়ে তারপর মলির বাহুতে প্রচণ্ড চিমটি কেটে বলে, ‘কী হচ্ছে তোর, এইসব কথা কখন আমি বললুম তোকে?’

‘মাস দুই আগেই তো বলেছিলি।’ মলি এবার লোকেশকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ওদের বাসনমাজার ঝি আরতির মা-র আটটি ছেলেমেয়ে, আবার একটা হবে। সরিই আমাকে বলেছিল-বাব্বা পারে কী করে! আমি হলে তো মরেই যেতুম। স্বামীটার কি মায়াদয়া নেই? একটা কি দুটোর বেশি কিছুতেই আমি হতে দেব না। … তা হলে বলুন আমি কি অন্যায় কিছু জানতে চেয়েছি?’

কথাটা এমন একটা বিষয় নিয়ে লোকেশের তাতে মজাই লাগল। অচেনা তরুণীর সঙ্গে আদিরস ঘেঁষা কথাবার্তায় মন্দ কী, বিশেষত বিয়ে যখন হবেই। হ্যাঁ, লোকেশ বুঝে গেছে সরলার তাকে প্রথম দর্শনেই ভালো লেগেছে।

‘এটা তো জানতে চাওয়া স্বাভাবিকই।’ লোকেশ হালকা স্বরে সমর্থন করল মলিকে। ‘আমিও তো এই প্রশ্নটাই করতুম, অবশ্য ওনার এ বিষয়ে আলোচনায় আপত্তি থাকতে পারে।’

‘কেন?’ মলির জিজ্ঞাসা।

‘বাহ, আমি তো সম্পূর্ণই বাইরের লোক। এই সব ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা উনি আমার সঙ্গে কইবেন কেন?’

‘কেন কইবে না? কলেজে পড়ে, টিউশনি করে, ট্রামে বাসে চড়ে, বাইরের লোকেদের সঙ্গে কথা বলার অভ্যেস আছে।’

‘কিন্তু তাদের সঙ্গে ক-টা ছেলেপুলে চান, এই ধরনের কথা কি উনি বলেন?’

‘তারা আর আপনি কি ওর কাছে সমান?’

‘কেন নয়? আমি তো এখনও জানিই না, টোপর পরার অনুমতি পাব কি না! তারপর তো বাবা হওয়ার প্রশ্ন উঠবে।’ লোকেশ মিটমিট হাসতে লাগল সরলার দিকে তাকিয়ে।

‘আপনার পছন্দ হয়েছে সরিকে?’

লোকেশ সোজা সরলার মুখের উপর চোখ রাখল। ঘাড় নীচু করে সরলা ঘাসে হাত বুলোচ্ছিল। হাতটা এবার অনড় হয়ে গেল। উত্তর শোনার জন্য ওর মনপ্রাণ নিবদ্ধ হয়ে রয়েছে বুঝতে পেরে লোকেশ চুপ করে নিঃশব্দ হাসিতে মুখ ভরিয়ে ফেলল। সে প্রত্যাশা করছে, উত্তর না পাওয়ার কারণ জানতে সরলা মুখ তুলে একবার তার দিকে তাকাবে। তাকাবেই।

এবং তাকিয়েছিল। এখনও, আঠারো বছর পরও সেই সভয় উৎকণ্ঠা আর আকুলতা মেশানো সরলার চকিত চাহনিটা ছবির মতো তার স্মৃতিতে টাঙানো রয়েছে। অতীতের বহু ঘটনা ধুলো জমে অন্তরালে চলে গেছে। বহু কথা নীরব হয়ে গেছে। কিন্তু তার দিকে প্রার্থনার মতো তাকানো সরলার মুখ, জীবনে সেই প্রথম লোকেশকে ভালোবাসায় অবগাহন করিয়ে দেয়।

মলি আবার বলেছিল, ‘পছন্দ হয়েছে কি না বলুন না।’

‘তোমায় বলব কেন? যার শোনার, তাকে বলা হয়ে গেছে।’ লোকেশ তার গলায় আবেগ ও রহস্য মিশিয়ে ছিল।

‘বলা হয়ে গেছে! কখন? যাচ্চচলে, আমি তো শুনতেই পেলুম না!’ মলি অবাকই হয়ে গেছিল। ‘এই সরি, বলেছে?’ জবাব না দিয়ে সরলা মুখ ঘুরিয়ে থুতনিটা ডানকাঁধে রেখে শুধু হেসেছিল।

‘আমারও জানতে ইচ্ছে করছে, ওনার পছন্দ হয়েছে কিনা।’ কথাটা বলে লোকেশ কৌতুকভরে সরলার দিকে তাকায়। সেকেন্ড দশেক নৈঃশব্দ বিরাজ করে তিনজনকে ঘিরে। তারপর মুখটা ধীরে ধীরে বাঁদিকে ঘুরিয়ে গভীরভাবে লোকেশের চোখে চোখ রেখে সরলা হেসেছিল। বিয়ের পর একদিন কথায় কথায় লোকেশ বলেছিল, ‘হাসিটা ছিল অনেকটা মোনালিসার মতো। কিছুই বোঝা যায় না।’

কিন্তু লোকেশের সেদিন মনে হয়েছিল শুধু পছন্দই নয় সরলা ইতিমধ্যে ভালোওবেসে ফেলেছে। মনে হওয়াটার মধ্যে অবশ্যই বাড়াবাড়ি ঘটে গেছল, কেননা প্রথম দেখার কয়েক মিনিটের মধ্যে ভালোবেসে ফেলা, একটি সাবালিকার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তখন লোকেশের মানসিক অবস্থা যেমন হয়ে রয়েছিল তাতে সে ওইরকমই কিছু চেয়েছিল। হয়তো অল্পবয়সে বাংলা ফিল্ম প্রচুর দেখার বা একধরনের পুজো সংখ্যার উপন্যাস বিস্তর পড়ে ফেলার জন্য তার মধ্যে ভালোবাসা বিষয়ে লঘু ধারণা তৈরি হয়েছিল। তবে আঠাশ বছর বয়সি উন্নতি অভিলাষী, পরিশ্রমী লোকেশের মতো যুবক যদি মনে করে শ্রীময়ী কোন যুবতী তাকে দেখামাত্রই ভালোবেসে ফেলবে তাহলে তাকে মাপ করে দিয়ে শুধু বলা যায়, বাপু হে একটু রয়ে সয়ে, ভালোবাসা ছেলের হাতের মোয়া নয়।

সেদিন লোকেশ মলির সপ্রশ্ন দৃষ্টির জবাবে বলেছিল, ‘আমিও উত্তর পেয়ে গেছি।’

‘কীভাবে?’ মলি উত্তর পাবার জন্য আগ্রহ দেখাল। কিন্তু সে দুজনের চাহনি ও হাসি লক্ষ করে বুঝে ফেলেছে, বিয়েটা হচ্ছেই।

লোকেশ অর্থপূর্ণ হেসে প্রসঙ্গ বদলায়। ‘বিয়ের পর মেয়েরা লেখাপড়া চালিয়ে গেলে আমার আপত্তি নেই।’

সরলা তখন বলেছিল, ‘যদি চাকরি করতে চায়? করবে। তবে স্বামী যদি ভালো আয় করে, বাচ্চচাকাচ্চচা যদি থাকে, তাহলে চাকরির দরকার কী? আমার তো মনে হয়, ঘরসংসারটাই ভালো করে মেয়েদের করা উচিত। ওটাই তো আসল জায়গা যেখান থেকে সুখ আর দুঃখ তৈরি হয়। তা ছাড়া চাকুরে মেয়েদের দেখেছি কেমন যেন নীরস, শুকনো দেখায়, ইমোশান কমে যায়, রোমান্টিক মন আর থাকে না, বাস্তববাদী হয়ে পড়ে। বউ এমন হয়ে যাক এটা আমি চাইব না।’

‘এত মেয়ে চাকরি করছে, সবাই কি এমন হয়ে যায়?’

সরলার মৃদুস্বরের মধ্যে তর্কের ইচ্ছা নেই, ছিল যুক্তির জন্য আবেদন। লোকেশ চুপ করে গেছিল কিছুক্ষণ। তার মনে হয়েছিল, সরলার শুধু মনই নয় একটা মাথাও আছে আর সেটাকে ব্যবহারও করে। তার আরও মনে হয়েছিল, তাদের দুজনের চিন্তা বহু ব্যাপারে হয়তো মিলবে না।

লোকেশ তখন সরলার জিজ্ঞাসা এড়িয়ে হালকা গলায় বলেছিল, ‘একটা দরকারী কথা জানিয়ে দেবার আছে, আমি জীবনে কখনো কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করিনি, আমার কোনো প্রেমিকা ট্রেমিকা নেই।’

কথাটা বলে সে মুখ টিপে হাসতে থাকে আর অপেক্ষা করে। এইবার সরলাও তাহলে বলবে-আমারও কোনো ছেলের সঙ্গে কখনো প্রেম হয়নি, প্রেমিক ট্রেমিক নেই। কিন্তু সরলা কিছুই বলল না, শুধু একটু হাসল মাত্র। লোকেশ বুঝতে পারছে না, হাসিটাকে সে কীভাবে নেবে। না প্রেমিক নেই, ছিল কিন্তু এখন নেই, আছে কিন্তু সিরিয়াস কিছু নয়, গভীরই তবে লোকেশের মতো স্বামী পেলে ভুলে যেতে রাজি। কিন্তু সে এই একটা ব্যাপারে আপোস করতে রাজি নয়, সরলাকে তার যতই ভালো লাগুক না কেন। সে ওর কাছ থেকে স্পষ্ট শুনতে চায়, কখনো প্রেম করেছে বা এখনও করছে কি না? শতকরা একশো ভাগ বিশুদ্ধ টাটকা প্রথম প্রণয়ের শরিক সে হতে চায়।

‘কী ব্যাপার, আপনি চুপ করে রইলেন যে?

‘কী বলব? একটা মেয়ে স্কুল কলেজে পড়লে, রাস্তা দিয়ে হাঁটাচলা করলে অনেকেই তো তার সঙ্গে কথা বলতে, মিশতে চাইবেই।’

‘মিশেছেন?’

‘না।’ লোকেশ আশ্বস্ত বোধ করলেও মনের মধ্যে একটা অস্বস্তির কাঁটা ফুটে গেল। সত্যি বলল কি? এই ব্যাপারে কখনো কি কেউ সত্যিকথা বলে? এই রকম প্রশ্ন করাটাই তো বোকামি। হাজার হাজার মেয়ে প্রেম করার পর বাপ-মার ধরে দেওয়া পাত্রকে বিয়ে করেছে, স্বামীকে সুখী করেছে, সুন্দরভাবে ঘরসংসারও করেছে। এতে কারুরই তো কোনো ক্ষতি হয় না।

তখন এইসব ভেবেই লোকেশ নিজেকে প্রবোধ দিয়েছিল বা সামলাবার চেষ্টা করে ছিল। কিন্তু তার চেতনার গভীরে ঘড়ির মতো কী যেন একটা টিকটিক করে চলে আসছে আজ আঠারো বছর ধরে। সন্দেহ? ঈর্ষা? অন্য কিছু? লোকেশের মাঝে মাঝে মনে হয়েছে সরলার মতো আকর্ষণীয়া দেহের মেয়েকে তার বিয়ে করা উচিত হয়নি। ও যদি মানবের বোন মলির মতো বেঁটে বা মোটা হত, একবার দেখেই চোখ ফিরিয়ে নেবার মতো মেয়ে হত, তাহলে সে নিশ্চিত হতে পারত, তাহলে মনের অনিশ্চিত এই টিকটিকানিটা বন্ধ থাকত।

আসলে লোকেশ ভয় করে সরলার দেহের মাদকতাকে। সে নিজে যখন মত্ততা বোধ করেছে, তার দৃঢ় ধারণা অন্য পুরুষরাও তাই করবে। তারা চাইবে ওর মন জয় করে দেহটা অধিকার করতে। তা যদি হয় তাহলে সেটা তার পৌরুষত্বের পক্ষে বিরাট হার বলে গণ্য হবে। তার মনে হয়েছিল, এক্ষেত্রে উচিত সরলার মনের চারধারে একটা পাঁচিল তুলে দেওয়া। ওকে সুখে শান্তিতে স্বস্তিতে রাখলে, ওর ইচ্ছা অনিচ্ছাকে মান্য করলে, আবদার অভিমানকে প্রশ্রয় দিলে এবং হৃদয়ে অধিষ্ঠিত একমাত্র রমণী এই ধারণাটি অবিরত ওর কাছে পৌঁছে দিলে পাঁচিলটা তৈরি হয়ে যাবে। তাতে এমন কোনো ছিদ্র থাকবে না যার মধ্যে দিয়ে কোনো পরপুরুষ গলে আসতে পারবে কিংবা সরলা উঁকিঝুঁকি দিয়ে বাইরে তাকাবার সুযোগ পাবে।

ফল হল এই, আজ আঠারো বছর ধরে সরলা নিজেকে সুখী ছাড়া আর কিছু ভাবার সুযোগ পায়নি। লোকেশ একাগ্র মনে পাঁচিল তোলার কাজ চালিয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুরা ও প্রতিবেশীরা বলে সরলার সুখের সংসার। সে-ও বিশ্বাস করে তার সংসারে কোনো অপূর্ণতা নেই। একটা নিম্নবিত্ত ঘরের বাঙালি মেয়ের যা কিছু কাম্য। তার পাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু একটা জিনিস সে জানত না, তার স্বামী আঠারো বছর ধরে কাঁটা হয়ে আছে একটি ব্যাপারে, কখন তার স্ত্রীর স্ফূরণ ঘটবে!

লোকেশ অপেক্ষা করে আছে, কখন ঘটনাটা ঘটবে!

বিয়েটা ধুমধাম করে হয়নি আবার নমো নমো করেও নয়।

লোকেশের নিমন্ত্রণ তালিকায় প্রথমেই ছিল দুই জ্যাঠামশাই অমৃতলাল ও নৃত্যলালের পরিবারবর্গ। শিবেন্দ্রলাল, মাথা, বুক ও পায়ের নানান ব্যধিতে জীর্ণ শরীর নিয়ে ছেলের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে গেছলেন দাদাদের বাড়িতে। পাশাপাশি সদর। একটাই ছাদ তাতে দুটো পাঁচিল তুলে তিনটে ভাগ করা। অমৃতলালের বাড়িতে গিয়ে বউদি, দুই ভাইপো মহাদেব ও সুদেব, তাদের বউদের এবং যে ক-টি নাতি-নাতনিকে সামনে পেলেন যথাযোগ্য ভাবে বরযাত্রী হবার জন্য ও বউভাতে আসতে বললেন। নৃত্যলাল চারমেয়ের বাবা। চারজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। বুড়োবুড়ি স্বামী-স্ত্রীর এখানে সংসার। ওরা নিমন্ত্রণ পেয়ে খুশি হলেন।

সামনের বাড়িতে তিনঘর ভাড়াটে। বাড়িওলা বঙ্কুবিহারী ছাড়া আর কারোর সঙ্গে পরিচয় নেই। শিবেন্দ্র তাকে নিমন্ত্রণ করলেন। দুর্গাদাস মিত্র লেনে বহু ভাড়াটে, তাদের কাউকেই তিনি চেনেন না। সুতরাং নিমন্ত্রণ করার কথাই ওঠে না। শুধু পুরোনো চার-পাঁচ ঘর বাসিন্দাকে পত্র দিয়ে আসেন।

লোকেশ তার অফিসের কয়েকজন ছাড়া আর কাউকে বলেনি। পাড়ায় তার বন্ধুস্থানীয় কেউ নেই। আত্মীয়স্বজনদের অবশ্য সে নিজে গিয়ে বলে এসেছে। কাজের সূত্রে যেসব দোকানে বা ভাণ্ডারদের কাছে যেতে হয়, নার্সিং হোমে বা হাসপাতালে ঘুরতে হয় লোকেশ সযত্নে তাদের তালিকা তৈরি করে নিমন্ত্রণ করে ছিল। প্রায় দুশো লোক বউভাতে খেয়েছে, বরযাত্রী গেছল জনা কুড়ি।

মনোমালিন্য এবং চাপা নিন্দামন্দ যতই দুই বাড়ির মধ্যে থাকুক না কেন, লোকেশের বড়ো জেঠি-বিয়ের আচার অনুষ্ঠান ভার নিজ হাতে নিয়ে, বরণ করে বউ ঘরেও তুলেছিলেন এই বলে, ‘হাজার হোক লোকু দত্ত বংশেরই তো ছেলে।’ তবে বরযাত্রীতে জ্যাঠার বাড়ির বয়স্করা কেউ যায়নি। নতুন জুতো জামা আর প্যান্ট পরা চন্দন বরের টোপর হাতে নিয়ে মোটরে লোকেশের সঙ্গে কনের বাড়িতে গেছল।

‘সেলফ মেইড’ লোকেশ তার কথা রেখে ছিল। শ্বশুর বাড়ি থেকে সে একটি কুটোও নেয়নি। শিবেন্দ্র আট খানি নমস্কারি শাড়ি চাওয়ায় সে বলেছিল, ‘এসব সংস্কার বন্ধ হওয়া উচিত। সাধারণ গেরস্ত পরিবার, যদি একশো টাকা করেও এক-একটা শাড়ির দাম হয়, তাহলে আটশো টাকা, এতে ওদের উপর কতটা চাপ পড়বে তা কী বুঝতে পারছ?’

শিবেন্দ্র অসহায়ভাবে বলেছিলেন, ‘লোকু এটা মানমর্যদার ব্যাপার। ওরা ভাববে ভিখিরির ঘরে ছেলের বিয়ে দিয়েছি।’

ওরা মানে তার দুই দাদার পরিবার। লোকেশ আটটি তাঁতের শাড়ি কিনে এনে বাবার অথবা শ্বশুরবাড়ির মর্যাদা রক্ষা করে ছিল। হাজারখানেক টাকা এজন্য খরচ হলেও যে আত্মপ্রসাদ সে বোধ করে তারই জের ফুলশয্যায়ও আছড়ে পড়ে।

‘তুমি কি জান, তোমাকে প্রথম কীভাবে দেখেছিলুম?’

‘জানি, মলি বলেছে।’

‘তোমার গায়ে শাড়ি ছাড়া আর কিছু ছিল না।’

‘সেইজন্যই পছন্দ হল?’

‘এইট্টি পার্সেন্ট সেজন্য।’

সরলা তৃপ্ত হয়েছিল কথাটা শুনে। কিছুক্ষণ পর কথায় কথায় লোকেশ বলে, ‘পয়সাওলা ঘর থেকে অনেক সম্বন্ধ এসেছিল। অনেক কিছু দেবে বলেছিল।’

মিথ্যা কথাটা কেন যে বলল, লোকেশ পরে ভেবে দেখেছিল। মাথামুণ্ডু খুঁজে পায়নি। একটি মেয়ের কাছে নিজেকে মহৎ বীর করে তোলার জন্য ছেলেরা অনেক কিছু বানায়। কিন্তু এই ধরনের সাজানো বীরত্বে তার কোনো দরকার আছে কি?

সরলা বলেছিল, ‘তাহলে ওখানেই বিয়ে করলে না কেন?’

‘তোমাকে দেখার পর আর কাউকে বিয়ে করা যায় কি?’ জবাবটা ভালোই হয়েছিল কেননা পুলকিত সরলা তাহলে কোমরে চিমটি কাটত না। নিজেকে আর একধাপ তোলার জন্য তখন লোকেশ বলে, ‘আমি সাধারণ এক মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, পৈতৃক বিষয়- সম্পত্তি বলতে এই বাড়িটা, বয়স একশো পেরিয়ে গেছে। জানলা দরজার অবস্থা দেখে বুঝতে পারছ টাকার অভাবে সারানো কি রংকরা হয়নি। তবু এই বিয়ের সব খরচ আমিই করেছি, তোমাদের কাছ থেকে কিছুই নিইনি। এমনকী নমস্কারি শাড়ি পর্যন্তও নয়।’

‘জানি।’ সরলা কৃতজ্ঞতা জানাতে লোকেশের বুকে মাথা রাখে। ‘সবাই বলেছে আমার ভাগ্যটা খুব ভালো, নইলে কী এমন স্বামী পায়! আমিও চেয়েছিলাম এমন একজনকে যে খুব উদার হবে, আধুনিক হবে।’

‘শুধুই এই?’ লোকেশ তার উচ্ছ্বাস দমন করতে গিয়ে শ্বাসকষ্টে পড়ে গেছল।

‘এখন পর্যন্ত এই, তারপর তো আস্তে আস্তে আরও জানতে পারব।’

‘কী কী জানার আছে?’

‘অনেক কিছু। এসব তো টোয়েন্টি পারসেন্ট, বাকি এইট্টি হল আমার মতো একটা পাঁচপাঁচি দেখতে মেয়েকে কেমন ভালোবাসো, কদ্দিন ভালোবাসো সেটাই।’

‘ভালো শুধু আমিই বাসব আর তুমি শুধু ভালোবাসা নেবে, দেবে না?’

সরলা চুপ করে থাকে।

‘কী হল, বললে না তো ভালোবাসবে কিনা?’

অকস্মাৎ সরলা নিজেকে লোকেশের দেহের উপর তুলে উপুড় হয়ে ছড়িয়ে দিয়ে, দু-হাতে মুখটি ধরে তীব্র আবেগে তাকে চুমু খেতে শুরু করে। ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিত ছিল। লোকেশের কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল সরলার কাছ থেকে প্রথম চুম্বন পাওয়ার সুখ অনুভব করার জন্য।

ধীর, আপাত শীতল, নম্র স্বভাবের সরলার এহেন তপ্ত আবেগ তাকে মাদকতা এনে দেয়। কিন্তু চুম্বনের ধরনটিতে কেন জানি তার মনে হল, সরলার এটিই প্রথম চুম্বন নয়। যেভাবে তার মুখগহ্বরের মধ্যে জিভটা ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেভাবে ওষ্ঠ এবং অধর কামড়ে ধরছে, লোকেশ তাতে অভিজ্ঞতার ছোঁয়া পায়। অন্তত তার তখন মনে হয় প্রথমবারের জড়তা, আড়ষ্টতা এতে নেই।

লোকেশের মাথার মধ্যে টিকটিক করে একটা সন্দেহের কাঁটা ঘুরতে শুরু করা মাত্রই সে থামিয়ে দিয়েছিল। এখন অন্য কোনো চিন্তা নয়। একটি সুগঠিত কোমল দেহ তার শরীর ঢেকে ছড়িয়ে রয়েছে, একে যথাযোগ্যভাবে উপভোগ করার জন্য নিজের মধ্যে আবেগ সঞ্চার করানো দরকার। কুটিল সন্দেহের ঘড়িটা চালিয়ে রেখে একশো ভাগ সুখ সংগ্রহ করা যায় না। সুতরাং লোকেশ তাদের প্রথম রাতটিকে রমণীয় করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে।

দু-সপ্তাহ পর, সরলা তখন সংসারে গৃহিণীরূপে অধিষ্ঠ হয়ে গেছে, সকালে তাড়াতাড়ি স্নান সেরে উঠে আসতেই লোকেশ জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।

‘আজ কলেজ যাব।’

লোকেশ ভ্রূ কুঁচকে বলে, ‘আর ক-টা দিন যাক না।’

‘দুপুরে একা একা ভালো লাগছে না।’

‘এতদিন কলেজ কামাই করলে-‘

‘এত তাড়াহুড়োর কি আছে? বি এ পাশ না করলেও কিছু আসে যায় না। চাকরি তো আর করতে হবে না। কয়েকটা দিন বরং চাঁদুর সঙ্গে ক্যারম খেল কিংবা পাড়ার লাইব্রেরির মেম্বার হয়ে যাও।’

‘বই পড়ে কি সময় কাটে? বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথা বলা, ক্লাস করা আর চাঁদুর মতো বোকা নিরেটের সঙ্গে বসে ক্যারাম খেলে সময় কাটানো কি এক হল?’

লোকেশ আর কথা না বলে গালে জল মাখিয়ে শেভিং ক্রিম লাগাতে ব্যস্ত হয়। বন্ধুবান্ধবী না বলে বন্ধুবান্ধব বলল কেন? একবারের জন্য তার মনে প্রশ্নটা ভেসে উঠেই ডুবে যায়। সঠিক বললে, জোর করে সে ডুবিয়েই দিল। তখন সে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলেছিল, একটা বদঅভ্যাস দেখছি আমার মধ্যে তৈরি হচ্ছে। আজেবাজে সন্দেহ করাটা বাতিক হয়ে উঠলে তো জীবনে শান্তি পাওয়া যাবে না! লোকেশের অনুশোচনা প্রকাশ পেল তার কথায়, ‘কলেজ থেকে কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরবে।’

সরলা উদ্ভাসিত মুখে মাথা কাত করে ‘হ্যাঁ ফিরব’ বলেই জানতে চাইল, ‘এ পাড়ায় লাইব্রেরি আছে নাকি? মেম্বার করিয়ে দিয়ো তো।’

‘খুব পুরোনো লাইব্রেরি, জ্যাঠামশাইরা যখন স্কুলে পড়ত তখন পাড়ার ক-জন ছেলে মিলে শুরু করে আমাদেরই এই নীচের ঘরটায়।’ একতলায় রাস্তার উপর ঘরটায় কোচিং চালাচ্ছেন এক স্কুল শিক্ষক। ভাড়া দেন দেড়শো টাকা।

ব্রাশ ঘষে গালে ফেনা তৈরি করতে করতে লোকেশ বলল। ‘বাড়ি পার্টিশানের সময় ওটা উঠিয়ে নিয়ে যায় সমাজপতি রোডে, দুলাল স্যাকরার একতলার দুটো ঘরে। তখনই প্রায় হাজার দুয়েক বই। এখন কত হয়েছে কে জানে, হাজার আট-দশ হয়তো হবে।’

‘তুমি মেম্বার হওনি কখনো?’

ছিলুম। স্বপনকুমার পড়তুম। উপন্যাস গল্প ভালো লাগে না, ভ্রমণ কাহিনি পড়তে ভালো লাগে। তোমাকে বিয়েতে কে যেন ইংরিজি একটা বই দিয়েছে, মনে হল সমুদ্রে নৌকোয় অভিযানের ব্যাপার নিয়ে লেখা।’

বইটা ভালো করে দেখিনি এখনও। ইংরেজি পড়তে অসুবিধে হয়, সব কথার মানেও বুঝি না। কেন যে দিল। ষাট টাকা দাম।’

‘কে দিয়েছে?’ বাঁ হাতটা মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে ঝুলফিতে আঙুল চেপে লোকেশ সেফটি রেজারের প্রথম টানটা দিল।’

‘প্রণব। আমাদের সঙ্গেই পড়ে।’

লোকেশ দ্বিতীয় টান দিতে গিয়ে থেমে গেল। ‘তোমার বন্ধু?’

‘হ্যাঁ। ওর সঙ্গে রেখার প্রেম, মাস ছয়েক হল। রেখাও এসেছিল। ও একটা পেতলের অ্যাসট্রে দিয়েছে।’

লোকেশ দ্বিতীয় টান দিয়ে বলল, ‘ধরেই নিয়েছে আমি সিগারেট খাই।’

‘বাইরের লোকজনের জন্য দরকার হবে।’

‘হ্যাঁ। এবার তো একটা বাইরের ঘর দরকার হবে। শঙ্করবাবুকে বলতে হবে কোচিংটা এবার অন্য কোথায় সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করুন।’

‘বললেই কি ঘর জোগাড় করতে পারবে?’

‘আহা, চেষ্টা শুরু করুক। এখন থেকে করলে ছ-মাসের মধ্যে কি পাবে না? আর মানুষটাও খুব ভদ্র। যাকগে এসব, তুমি দেখ চাঁদুটা রান্নাঘরে কী করছে।’

লোকেশ আঠারো বছর আগে সরলাকে অরুণোদয় পাঠাগারের মেম্বার করে দিয়ে ছিল। আর সেখানেই তার দেখা হয় তপুর, তপতীর সঙ্গে।

বই, লেখককে নাম ও সংখ্যা লেখা ছাপা ক্যাটালগটা একটা দড়ি দিয়ে ‘কাউন্টারের কাঠের গরাদে বাঁধা। ক্যাটালগ যারা কেনেনি তারা এটা দেখেই বই বাছাই করে রিকুইজিশান স্লিপে লেখে। নতুন বইয়ের নামের তালিকা কাগজে লিখে দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়। সরলা মুখ তুলে নতুন বইয়ের নাম পড়ছিল। তার পাশে আরও কয়েকজন যাদের সে লক্ষ করেনি। তখন প্রায় ফিসফিস করে তার ঠিক পিছনেই একজন বলে ওঠে, ‘সরলাদি না!’

সে চমকে পিছনে তাকায়। এ পাড়ায় কে তাকে সরলাদি বলল? কয়েক সেকেন্ড মুখটার দিকে তাকিয়ে সে বলেছিল, ‘তপু না?’

সরলা খুবই অবাক হয়ে গেছল। তপু তার বাপের বাড়ির পাড়ার মেয়ে, ছোটোবোন অমলার বন্ধু। মাঝে মাঝে তাদের বাড়িতে আসত। তপুর বাবার রেডিমেড জামাকাপড়ের দোকান আছে নিউমার্কেটে। মধ্য বয়সে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আবার বিয়ে করেন। প্রথমপক্ষের এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েটি তপু। বিয়ের পর বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র কোথায় বাড়ি কিনে তপুরা পাড়া ছেড়ে চলে যায় পাঁচ বছর আগে। সরলা তারপর আর তপুকে দেখেনি এবং ওকে মনেও রাখেনি।

সরলার মনে হল, পাঁচ বছরে মেয়েটা অনেক বড়ো হয়ে গেছে তো বটেই মুখও কিছুটা বদলেছে। তপু বেশ সুন্দরই হয়েছে। ওকে শাড়ি পরা এই প্রথম দেখল।

‘তপু তুই এখানে?’

‘আমরা তো এখানেই থাকি, সমাজপতি রোডে চব্বিশের বি বাড়িতে। তুমি এখানে?’ বলতে বলতেই তপুর চোখ পড়ল সরলার সিঁথিতে। ‘তোমার বিয়ে হয়ে গেছে?’

‘আমার শ্বশুরবাড়ি দুর্গাদাস মিত্র লেনে, আঠারোর এক।’

অনেক লোক দাঁড়িয়ে তালিকা দেখতে চাইছে। ওরা দুজন সরে এল জায়গা ছেড়ে দিয়ে।

‘কবে তোমার বিয়ে হল?’

‘একমাসও হয়নি। তুই আয় না। আমাদের বাড়িতে লোক এত কম যে হাঁফ ধরে যায়। আমরা কত্তা-গিন্নি, শ্বশুর আর একটা কাজের ছেলে। তুই এখন কী করছিস, স্কুলে না কলেজে?’

‘স্কুলে। ইলেভেনে পড়ছি। একটা বছর পড়া বন্ধ ছিল।’

‘কেন?’

‘সে অনেক ব্যাপার। একদিন যাব তোমাদের বাড়ি, আঠারোর-এক তো? জামাইবাবুর নাম কী?’

‘লোকেশ দত্ত। এলে বিকেলে আসিস। সকালে খুব ব্যস্ত থাকি, কত্তার অফিস, আমার কলেজ, বুড়ো শ্বশুরকে দেখা।’

দু-দিন পর তপু এল। পুরোনো দিনের গল্প কিছুক্ষণ করার পর সরলা বলল, ‘তোর একবছর পড়া বন্ধ ছিল বললি, কেন?’

‘বাড়ি থেকে বেরোন বন্ধ ছিল বলে।’

‘কেন?’

‘মায়ের হুকুম। আমি নাকি খারাপ হয়ে গেছি, আমার জন্য ছোটোভাই-বোনেরা খারাপ হয়ে যাবে, তাই আমাকে ভালো করতে বন্দি রাখার ব্যবস্থা হয়।’

‘কী করেছিলি?’

‘প্রেম।’ তপু স্বচ্ছন্দে বলল সরলার চোখে চোখ রেখে। বরং সরলাই অস্বস্তিতে পড়ল। হাজার হোক সে ওর বন্ধুর দিদি, এসব কথা মুখের উপর বলে দেওয়াটা আশোভন তাই, বড়োদের সম্মান নষ্ট হয়। মনে মনে ক্ষুণ্ণ হলেও সে কৌতূহল ধরে রাখতে পারল না।’

‘কে?’

‘একটা ছেলে ছাড়া আবার কে?’ তপু ঝরঝর হেসে উঠল।

চা নিয়ে এল চাঁদু। হাফ প্যান্ট আর বুশ শার্ট পরা, গৌরবর্ণ, সুদর্শন কিশোরটির দিকে তপু কৌতুকভরে তাকিয়ে বলল, ‘আমি নীচে জিজ্ঞেস করলুম এখানে লোকেশ দত্ত থাকেন? ও খুব গম্ভীর মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, আপনার কি দরকার তাকে?’ বললুম, তার বউয়ের সঙ্গে দরকার। বলল, ‘বউদি কলেজ থেকে এসে বিশ্রাম নিচ্ছেন।’ বললুম, শুয়ে আছেন? বলল, ‘না পাশের বাড়ির বউয়ের সঙ্গে গল্প করছেন জানালায় দাঁড়িয়ে।’ বোঝ সরলাদি এই হল তোমার বিশ্রাম নেওয়া! আমার এত হাসি পেল জ্যাঠামশায়ের মতো ওর বলার ধরন দেখে।’

সরলাও হাসল। ‘চাঁদু বয়সের তুলনায় একটু পাকা, তাই না রে চাঁদু?’

মুখ গম্ভীর করে চাঁদু বলল, ‘দাদার জন্য খই আনতে হবে, পয়সা দাও।’

সরলা হাত ব্যাগ থেকে ওকে টাকা দিল। যাবার সময় বিরক্ত চোখে চাঁদু তার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘গল্প করাটা বিশ্রাম না তো কি?’

জোরে হেসে উঠে তপু বলেছিল, ‘সরলাদি ওকে প্রথম দেখে মনে করেছিলুম তোমার দ্যাওর ট্যাওর হবে। ভদ্দরলোকের ছেলের মতোই দেখতে। পেলে কোত্থেকে?’

‘তোর জামাইবাবুই জোগাড় করেছে, এসেছে মাস ছয়েক, তারকেশ্বরের দিকে বাড়ি ষাট টাকা মাইনে। আমার সঙ্গেও জ্যাঠামো করে কথা বলে তবে একদমই গবেট, মাথায় বুদ্ধি বলে কিসসু নেই।’

‘একদিক দিয়ে ভালোই, চালাকচতুর হলে তো এতদিন থাকত না।’

‘খাওয়ার লোভ নেই, টাকাকড়ির ব্যাপারেও হাতটান নেই।’

‘এ তো সোনায় সোহাগা! একটু তোয়াজে রেখো।’

‘তোর জামাইবাবুও এই কথা বলে। কী যে তোয়াজ করব, আমি তো ভেবে পাই না। এই পাশের বাড়ির বউ রঞ্জনা, বছর তিন বিয়ে হয়েছে, একটা বাচ্চচা, বলছিল একটা দিনরাতের ঝি দেখে দিতে।’ যে ছিল সে বেশি মাইনেতে কাজ পেয়ে চলে গেছে। তবে শাশুড়ি ননদরা আছে বলে আসুবিধে হচ্ছে না।’

‘তোমার কি অসুবিধে হবে।’

সরলার লাজুক হাসি যোগ দিল তপুর মিটমিট চোখের সঙ্গে। ‘আমার এখন ওসব হবে টবে না। অন্তত বি এ পরীক্ষার আগে তো নয়ই।’

‘পিল খাচ্ছ?’

সরলা থতমত এবং ক্ষুণ্ণ হল। তপু তার বয়স এবং সম্পর্কের এলাকার বাইরে এসে সখীর মতো হতে চাইছে। মলিকে তার মনে পড়ল। এসব কথা ওর সঙ্গেই বলা যায় কিন্তু মলি আসব বলে একদিনও আসেনি।

তপুর প্রশ্নটা এড়াবার জন্য সে বলল, ‘কাল কেক কিনে এনেছে দাঁড়া তোকে দিই।’

তাড়াতাড়ি সরলা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। লোকেশ শ্বশুর চাঁদু, কলেজ আর সংসার চব্বিশ ঘণ্টা ভরিয়ে রাখার পক্ষে যথেষ্ট। তাহলে অনেকগুলো ফাঁক থেকে যায়। রঞ্জনা বাইরে থেকে মাত্র তিন বছর বউ হয়ে এই পাড়ায় এলেও, বহু বাড়ির হাঁড়ির এবং শোবার ঘরের খবর রাখে। সে একটা ফাঁক ভরাট করে দেয়। কিন্তু ওর কাছে মন খুলে নিজের প্রাণের খবর দেওয়া যায় না। দিলেই পাড়ায় চাউর হয়ে যাবে। কিন্তু মলির সঙ্গে সব কথা বলা যায়।

কেক-এর প্লেট তপুর হাতে দিয়ে সরলা বলে, ‘তোরা তো এক ভাই এক বোন?’

‘ছিলাম। এখন আরও দুই অর্থাৎ, টোটাল চার এবং এটার সঙ্গে আরও যোগ হবে। আমার এই সৎমা-টি একখানা চিজ। ফিল্মে যেরকম সৎমা দেখা যায় ইনি ঠিক তাই। দাদাকে আর আমাকে যতরকমে পারে হেনস্থা করে। আমরা বাইরের লোকের মতো বাড়িতে থাকি। খাওয়া-পরার মতো ছোটোখাটো তুচ্ছ ব্যাপারেও এত নীচতা দেখায় যে, মাঝে-মাঝে ইচ্ছে করে বাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে যাই।’

‘বাবাকে বলিস না?’

‘হুঁউউ।’ তপু নাক দিয়ে বাতাস ঝেড়ে দিল মুখটা অবজ্ঞায় বেঁকিয়ে। ‘আমার সৎমা-র বয়স এখন বছর তিরিশ, একটা গতরও আছে। তোমার মতোই সেক্সি।’

সরলা সন্ত্রস্ত বোধ করল। এমন কথা লোকেশের মুখে শুনলে একরকম লাগে কিন্তু তপুর মুখ থেকে একদমই রোমাঞ্চ লাগবে না।

‘গতরটা তিনি সারাদিন খাটান সংসারে। আর রাতে বাবা কাছে।’ তপুর মুখভাব বদলে গেছে। অনেক দিনের জমানো ক্রোধ বার করার চেষ্টায় মুখে হিংস্রতা ফুটে উঠেছে।

‘বাবা সম্পর্কে এভাবে বলতে নেই তপু।’

‘খুব আছে। আমাকে বলে কিনা নোংরা চরিত্রের? আমি প্রেম করেছি তো কারোর ক্ষতি করে নয়? বাচ্চচা বাচ্চচা ভাইবোনেরা নাকি খারাপ হয়ে যাবে, কী বোঝে ওরা? বাবা যেমন অশিক্ষিত, আনকালচার্ড, তার থেকেও বেশি এই মেয়েমানুষটা। ক অক্ষর গোমাংস, বাপটা মুদির দোকানে কাজ করে। জানো সরলাদি, বাবাকে দিয়ে আমাকে মার খাইয়েছে!’

‘স্কুলে পড়া বন্ধ করে দিয়েছিল?’

‘হ্যাঁ। শেষকালে দাদার সঙ্গে বাবার কথা হয়। সম্পত্তির অংশ আমাদের দেবে না তবে দাদাকে একটা দোকান করে আলাদা করে দেবে আর আমার বিয়ের খরচ দেবে। ওই বাড়ির সঙ্গে আমাদের দুজনের চিরকালের মতো কোনো সম্পর্ক থাকবে না। দাদাও বলে, তপুকে স্কুলে পড়তে দিতে হবে, বাড়ির বাইরে যেতে দিতে হবে। আমিও লিখে দিয়েছি, হ্যাঁ লিখে দিয়েছি কখনো কোনো ছেলের সঙ্গে মিশব না যতদিন বাবার বাড়িতে থাকব।’

তপুর কথাগুলো শেষের দিকে মন্থর ও ক্ষীণ হয়ে আসছিল। সরলা দেখল ওর দু-চোখে জল টলটল করছে।

‘তা সেই ছেলেটি এখন কী বলছে? তুই একেই বিয়ে করবি তো? বয়স কত, কী করে?’

তপু নিঃশব্দে হাসতে শুরু করল। ‘সরলাদি তুমি সত্যিই সরলা। স্কুলের দু-তিনজনের কাছে শুনলাম, সে এখন একটা মেয়ের সঙ্গে ঘুরছে। কয়েকমাস আমায় দেখেনি তো! বি এ পাশ, রেডিয়োয় রবীন্দ্রসংগীত গায়, দেখতে ভালোই তাই প্রেমে পড়েছিলুম। মাধ্যমিকে কোনোরকমে সেকেন্ড ডিভিশন হয়েছে তবে এখন আমি পড়াশুনোয় মন দিয়েছি। এম এ পাশ করতেই হবে।’

‘তোর কথা শুনে প্রথমে মনেই হচ্ছিল না যে, তুই এত সিরিয়াস।’

‘তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল আমাকে তুমি অন্য কিছু ধরে নিয়েছ, বাজে টাইপের, তাই না?’

সরলা হেসেছিল, অকপটেই সে বলে, ‘তুই অমুর বন্ধু তো তাই পিল টিল নিয়ে তোর সঙ্গে কথা বলাটা উচিত মনে হয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তুই অনেক ম্যাচিওরড। তুই যদি রোজ আসিস আমার খুব ভালো লাগবে। ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব, দেখবি, তোরও খুব ভালো লাগবে। ও খুব উদার আর মডার্ন।’

সেদিন রাত্রে সরলা খেতে খেতে লোকেশকে তপুর কথা বলেছিল। লোকেশ মন্তব্য করে ছিল, ‘বার্থ কন্ট্রোলের মতো ব্যাপারগুলো খুবই পার্সোনাল, প্রাইভেট। এসব নিয়ে বাইরের লোকের সঙ্গে আলোচনা কেউ করে না।’

সরলা অপ্রতিভ হয়ে যায়। বলে, ‘আমি অবশ্য কিছুই বলিনি। শুধু বলেছি, বি এ পাশ করার আগে জনসংখ্যা বৃদ্ধি করব না।’

লোকেশ পাতলা হেসে বলেছিল, ‘মনে থাকে যেন।’

এর তিন মাস পরই সরলা জানাল সে সন্তানসম্ভবা। ভয়ে সে সিঁটিয়ে ছিল কয়েক দিন। লোকেশকে খবরটা জানাতে ভরসা পায়নি। সে হিসেব করে দেখেছে, বি এ ফাইনাল পরীক্ষার পাঁচমাস আগে তাকে মা হতে হবে। পরীক্ষার জন্য তৈরিই বা হবে কী করে? কলেজে যাওয়াও তো বন্ধ করতে হবে শেষের কয়েকটা মাস। বাচ্চচা সামলে পড়ার কাজ ঝঞ্ঝাটের মধ্যে তখন করে ওঠা যাবে না। ফেল করতেই হবে। এর থেকে লজ্জার আর কি হতে পারে! পাশের রঞ্জনাদের বা জ্যাঠামশাইদের বাড়িতে তার কলেজে যাওয়া নিয়ে যে ঠোঁট বাঁকিয়ে কথাবার্তা হয় সেটা তার কানে এসেছে ঠিকে ঝি বাসনা মারফত। এই পাড়ায় কলেজে যাওয়া বউ একজনও নেই।

সরলা খুবই মুষড়ে পড়ে ছিল। ভুলটা নিশ্চয় তারই। প্রত্যেক সন্ধ্যায় সে বড়ি খায়। নিশ্চয় কোনোদিন সে ভুলে গেছল। তার মনে হল, যেদিন অ্যাকাডেমিতে থিয়েটার দেখতে যাবার জন্য তাড়াহুড়ো করে বিকেলে বেরিয়েছিল সেইদিন খাওয়া হয়নি। এই ভুলের কথা শুনলে লোকেশ যে কী প্রচণ্ড রাগবে!

সে তপুকে বলে, ‘তোর চেনাজানা কোনো ডাক্তার আছে, লেডি ডাক্তার?’

‘কেন, কী হয়েছে তোমার?’

‘একবার দেখাতাম। কীরকম যেন লাগছে। মনে হচ্ছে…….।’

তপুর উদবিগ্ন মুখে অতঃপর হাসি ছড়িয়ে পড়ে। ফিসফিস করে বলে, ‘নতুন মানুষ আসার গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছ?’

‘ঠাট্টা করিস না, আমার অনেক কিছু নির্ভর করছে এর উপর। এখন আমার বাচ্চচা হলে খুব ক্ষতি হবে। তোর জামাইবাবু তো চায়ইনা, আমিও চাই না। আছে তোর জানাশোনা কেউ?

কী করবে? অ্যাবোর্শন?’

শব্দটা ধাক্কা দিয়েছিল সরলাকে। কেমন একটা অনৈতিক লজ্জাকর অপরাধের ছোপ লাগানো রয়েছে।

জন্ম থেকে সে শুনে এসেছে : ‘এসব কাজ যারা করে তাদের চরিত্রের ঠিক নেই। ভদ্দরঘরের মেয়েরা পেট খসায় না।’ কিন্তু যে বিড়ম্বনায় এখন সে পড়েছে তাই থেকে রেহাই পেতে হলে আর কী পথ খোলা আছে?

‘আর কী করতে পারি?’

‘দরকার কী? হোক না বাচ্চচা’ তপুর স্বরে প্রচ্ছন্ন মিনতি ছিল।

‘না, না, এখন এসব নয়। আমার বি এ পরীক্ষা তাহলে আর দেওয়া হবে না। একবার ড্রপ করলে জীবনে আর আমার বি এ পাশ করা হবে না। দ্যাখ না রে তোর কেউ চেনা ডাক্তার আছে কি না।’

‘জামাইবাবুকেই বল না।’

‘ওরে বাবা, শুনলে নির্ঘাত খেপে উঠবে। আমার ভুলেই তো হয়েছে, কাউকে আমি এ ব্যাপারে বলতে পারব না। তোকে বিশ্বাস করি, তুই আর কাউকে বলবি না তাও জানি।’

‘সরলাদি আমার জানাশোনা ডাক্তার তো কেউ নেই তবে খোঁজ নেব। গাইনি কিনা জানি না, এক ডাক্তারের মেয়ে আমাদের সঙ্গে পড়ে কিন্তু তাকে তো কথাটা খুলে বলতেই হবে।’ অবশ্য ওরা থাকে বেলগাছিয়ায়, এখান থেকে অনেক দূরে।’

‘তোর জামাইবাবুর অনেক ডাক্তারের সঙ্গেই চেনা আছে যদি এর সঙ্গেও চেনা থাকে?’

‘অত ভাবলে চলে না। দাঁড়াও আগে আমি মেয়েটাকে বলে দেখি, এত ব্যস্ত হবার কী আছে? তুমি যা ভাবছ তাতো না-ও হতে পারে, এরকম ভুল শুনেছি অনেকের ক্ষেত্রে ঘটেছে।’

তিনদিন পর তপু খবর নিয়ে এল। এই তিনদিন সরলা কাঁটা হয়ে কাটিয়েছে। তার জীবনে এমন সংকট এই প্রথম।

‘বিকেল পাঁচটা থেকে সাতটা পর্যন্ত বসেন শ্যামবাজারে, সুদর্শন মেডিক্যাল হল নামে একটা ওষুধের দোকানে। গাইনিকলজিস্টই, কুড়ি টাকা ফী। তারপর যান বরানগরে সেখানে সাড়ে সাতটা থেকে….’

‘দরকার নেই বরানগর। তুই কিন্তু আমার সঙ্গে যাবি, যাবি তো?’ কাকুতি জানাল তপুর হাত ধরে।

‘যাব। আমি কিন্তু বলেছি তুমি আমার বউদি।’

‘ভালো করেছিস, নামটাও অন্য কিছু বলতে হবে।’

‘শান্তিসুধা…..আমার সৎমায়ের নাম।’ বলেই তপু জোরে হেসে ওঠে। ‘ওরও বাচ্চচা হবে।’

সরলা পরদিন পাঁচটার আগেই কলেজ থেকে বেরিয়ে সুদর্শন মেডিক্যাল হলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। বুক ঢিবঢিব অবশ্যই করছিল, যদি লোকেশ ট্রামে বা বাসে এখান দিয়ে যেতে যেতে তাকে দেখে ফেলে? একটা মিথ্যাকিছু বানাবার চেষ্টা করছিল তখনই তপু স্কুল থেকে এসে পড়ে।

ভিড় ছিল কিন্তু ডাক্তারবাবু সরলাকেই আগে ডেকে নেন। সৌম্য দর্শন, প্রৌঢ়, ছিপছিপে, দুই চোখে হাসি, সরলার ভরসা জেগেছিল দেখা মাত্র।

‘আমার মেয়ের কাছে কিছুটা শুনেছি, কিন্তু মা তুমি অ্যাবোর্শন চাইছ কেন সেটা আমার কাছে খুব পরিষ্কার নয়। পরীক্ষা দিতে অসুবিধে হবে?’ ডাক্তারবাবুকে চিন্তিত দেখাল। যেন সমস্যাটা তারই। সরলা এবং তপু যেসব যুক্তি দিয়েছিল ডাক্তারবাবু শুনতে শুনতে মাথা নাড়ছিলেন। ‘না মা, এগুলো কোনো কথা নয়। এত ভালো স্বাস্থ্য, বাচ্চচার মা হবার পক্ষে আদর্শ বয়েস, টাকাকড়িরও অভাব নেই। স্বামীকে বুঝিয়ে বলো। কী করেন উনি?’

সরলার আগেই তপু বলে ওঠে, ‘এঞ্জিনিয়ার। দাদা দুর্গাপুরে চাকরি করেন।’

‘শিক্ষিত, নিশ্চয় বুঝবেন। তুমি বরং ওকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো।’

‘বলব।’ সরলা মাথা নামিয়ে বলেছিল। ‘তোমরা মা হতে এত অনিচ্ছুক হও কেন? লেখাপড়ার জন্য তো সারাজীবনই পড়ে রয়েছে। এখন তাজা শরীর, তাজা মন, ছেলেমেয়েকে গড়ে তোলার জন্য পরিশ্রমের এটাইতো বয়স।’ কথাগুলো বলার সঙ্গেসঙ্গে ডাক্তারবাবু তার নাম লেখা প্যাডের কাগজে খসখস করে কী সব লিখছিলেন। ‘তোমার নাম?’

তপু কিছু বলার আগেই সরলা বলল, ‘আমার নাম, সরলা দত্ত। তপু ক্ষণিকের জন্য অবাক হয়ে, মাথা হেলিয়ে অনুমোদন জানায়।

এরপর ডাক্তারবাবু কাগজটা হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ইউরিন পরীক্ষার রিপোর্টটা তাকে দেখাতে তিনি ফী নিতে অস্বীকার করেন।

ফিরে আসার সময় তপু বলে, ‘ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আমি কিন্তু একমত।’

সরলা কথা বলেনি। তার মনে হচ্ছিল, জীবনের একটা অধ্যায় আজ শেষ হল। বিয়ের দিনও যা মনে হয়নি আজ সেটাই মনে হল, বউ হওয়ার থেকে মা হওয়া অনেক বড়ো ব্যাপার। বড়ো হওয়াই তার পছন্দ।

সেদিন রাতেই সে লোকেশকে জানিয়ে দিল। অবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ড সরলার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নীচু গলায় সে বলে, ‘তুমি নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মারলে। আমার কিছু বলার নেই।’

‘এক্সটার্নাল হয়ে পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করব।’

‘দেখ।’

সরলার মনে হল, এখন থেকে তাদের মধ্যে আগের সর্ম্পকটা বোধহয় থাকবে না। লোকেশ যদি এখন ঠান্ডা মেজাজে, বিরক্ত না হয়ে ব্যাপারটা গ্রহণ না করত তাহলে সে স্বস্তি পেত।

‘তুমি যদি না চাও তাহলে কোনো নার্সিং হোমে ব্যবস্থা করে তো চুকিয়ে ফেলা যায়।’

খাটে আধশোয়া লোকেশ খবরের কাগজটা চোখের সামনে তুলে পড়তে শুরু করে। সরলাকে উত্তর দেয়নি। তার মন এখন হালকা, ভারমুক্ত, শিথিল। সরলার কলেজ যাওয়া বন্ধ হবে, এটাই তাকে প্রসন্নতায় ভরিয়ে দিচ্ছে। সে কখনোই চায়নি তার বউ একা বাড়ির বাইরে যাক এবং অজস্র পুরুষের চোখের দ্বারা ধর্ষিতা হয়ে ফিরে আসুক। যা দিনকাল পড়েছে, কে বলতে পারি সত্যি সত্যি তা ঘটে যাবে না?

খবরের কাগজটা নামিয়ে সে দেখল, সরলা ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে পায়ের কাছে বসে রয়েছে। সে হেসে, ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে সরলাকে টেনে বুকের কাছে এনে বলল, ‘এসে পড়েছেই যখন তাহলে আসুক। ফিরিয়ে দিলেও তো পরে আবার আসবে।’ মিনিট দুই পর সরলা বলল, দরজাটা আগে বন্ধ করে দাও।

লোকেশ উঠতে গিয়ে দেখল দরজায় চাঁদু দাঁড়িয়ে। এইমাত্র এসে পড়েছে বলে তার মনে হল না। নিশ্চয় এতক্ষণ ধরে দেখছিল। সরলার উরু থেকে সায়া নামিয়ে দিতে দিতে লোকেশের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। দ্রুত এগিয়ে গেল এবং চাঁদুর গালে প্রচণ্ড চড় কষাল। টলে গিয়ে চাঁদু দেয়ালে ধাক্কা খেল। ‘হারামজাদা’। দাঁত চেপে লোকেশ বলল এবং দরজার পাল্লা সশব্দে ভেজিয়ে দিল। ‘দিল মেজাজটা নষ্ট করে।’

‘অত জোরে মারলে!’ সরলা খাটে উঠে বসল।

‘মুখ ফাটিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। অতবড়ো দামড়া তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলে তার কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিনা দেখছে! একটা সাধারণ বোধবুদ্ধির ব্যাপার।’

‘ওর বুদ্ধিটা খুবই কম।’

‘থাক ওর হয়ে আর তোমায় কিছু বলতে হবে না। আমি অনেকদিন দেখেছি তুমি আমি ঘরে থাকলেই নানা ছুতোয় ও ঘরে চলে আসে। লক্ষ করেছ ও তোমাকে কীভাবে দেখে? বয়সটা খারাপ, মেয়েদের অ্যানাটমি দেখার আগ্রহ তো এই বয়সেই শুরু হয়। ‘তাই বলে এভাবে মারবে? বুঝিয়ে বলতে পারতে।’

এইভাবেই ওদের বোঝাতে হয়। যাদের যা দাওয়াই তাই দেওয়া উচিত।’

‘এখন ও যদি কাজ ছেড়ে চলে যায়?’

লোকেশ কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। তার রাগ অন্ধত্ব ত্যাগ করে ধীরে ধীরে স্বচ্ছ দৃষ্টি ফিরে পাচ্ছে। চাঁদুর মতো কাজের ছেলে যদি চলে যায় তাহলে সংসারে বিশৃঙ্খলা তো তৈরি হবেই তার এবং সরলারও খাটুনি বাড়বে। নানান মানসিক চাপ আসবে, আরাম ও শান্তি নষ্ট হবে। ঝি বা চাকর টাকা ফেললেই মেলে না। এটা স্রেফ বরাতের উপর নির্ভর করে। চাঁদুকে সে বরাত জোরেই পেয়ে গেছল।

‘যাবে কোথায় এমন সুখের চাকরি ছেড়ে দিয়ে?’ লোকেশের গলার স্বরে কিন্তু প্রত্যয় নেই। সে বুঝে গেছে চড় মারাটা ভুল হয়েছে।

‘ও হেসেখেলে যেকোনো মাড়োয়ারির বাড়িতে দেড়শো টাকা পাবে। ভাংচি দিয়ে ভাগিয়ে নেবার লোকের তো অভাব নেই। তখন তো আমাকেই কাপড়কাচা, রান্না করা আর দোকান যাওয়ার কাজগুলো করতে হবে।’ সরলা বিরক্তি দেখাতে কার্পণ্য করেনি।

লোকেশ ঘর থেকে নীরবে বেরিয়ে চাঁদুকে দোতলায় খুঁজে একতলায় গেল। রান্নাঘরে রুটি বেলছিল। মুখ তুলে লোকেশের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। চোখে আশঙ্কা।

‘উঠে আয়’।

কুণ্ঠিত ভাবে চাঁদু উঠে দাঁড়াল। লোকেশ এই প্রথম কাছের থেকে ওর মুখ খুঁটিয়ে নজর করল। রীতিমতো আকর্ষণীয় চোখ নাক, কপাল, ঠোঁট। প্রকৃত হ্যান্ডসাম, সিনেমার হিরো হতে পারবে বারো চোদ্দো বছর পর। ওর বুদ্ধিশুদ্ধি যে মোটা দাগের মুখে কিছু তার কোনো প্রতিফলন নেই। গালে লালচে ছোপ পড়ে গেছে।

লোকেশ আলতো আঙুল চাঁদুর গালে বুলিয়ে স্নেহমাখা স্বরে বলল, ‘খুব লেগেছে?’

‘না।’

‘না কি? আমার হাত জ্বলছে আর বলছিস লাগেনি? আসলে হয়েছে কি….।’ লোকেশ আড়ষ্ট হয়ে পড়ল। কেন চড়টা মেরেছে, সেটা ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হলে চাঁদুকে যা বলতে হয় সেটা তাকে লজ্জায় ফেলে দিল।

চাঁদুকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে সে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘তোর বউদি আমাকে খুব বকল। তুই কিছু মনে করিস না, কেমন। আজ আমরা সবাই রাবড়ি খাব, যা চট করে সত্যনারায়ণ থেকে কিনে নিয়ায়।’

‘রুটি বেলে নিয়ে যাচ্ছি।’ চাঁদুকে উৎসাহিত দেখাল।

‘না না, এখুনি যা, বউদি বেলে নেবে।’

রাত্রে সরলা আর লোকেশ খাবার সময় চাঁদু দাঁড়িয়ে ছিল টেবলের কাছে। দুজনের থালায় রাবড়ি তুলে সরলা বেশিরভাগটা ভাঁড়ে রেখে বলল, চাঁদু তুই এবার খেয়ে নে, রাত হয়ে গেছে, ভাঁড়টা নিয়ে যা।’

‘তোমরা আরও নাও।’ চাঁদু নিমন্ত্রণ কর্তার ঢঙে বলল।

‘এটা তোর জন্যই আনা, আমরা তাই থেকে ভাগ বসালুম। যা নিয়ে যা। লোকেশ মিষ্টি গলায় হুকুম দিল। চাঁদু নীচে চলে যেতেই সরলা বলল, ‘ছেলেটার স্বভাবটা খুব ভালো।’

‘দেখতেও ভালো।’

‘হ্যাঁ।’

লোকেশের ভ্রু তার অজান্তেই নড়ে উঠল। চাঁদুর বয়স খুবই কম। তাহলেও…..।

‘তুমি ভালো করে ওর মুখটা দেখেছ? আমি আজ দেখলাম সিনেমায় নামিয়ে দেওয়া যায়।’

‘আশ্চর্য, আমারও একবার তাই মনে হয়েছিল।’

লোকেশ চট করে সরলার মুখ দেখে নিল। সহজ, অজটিল মুখভাব। কোনো গোপন ইচ্ছার বীজ বোনা হয়েছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না। নিজেকে নিয়ে কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হল। এই বাতিকটা, সরলা ভ্রষ্টা হতে পারে ভাবাটা কীভাবে কেন যে মাথায় মাঝে মাঝে টিকটিক করে উঠে এখনও সে তা বুঝে উঠতে পারছে না।

ছোটোবেলা থেকে দেখেছে এই বাড়ির বউ-মেয়েরা পর্দানশীন। জেঠিমা এখনও রিকশার সামনে পিছনে পর্দা না দিয়ে চড়েন না। লেডিজ সিটে ছাড়া সিনেমা দেখে না মেয়েরা। ছোটোবেলায় অবিভক্ত বাড়িতে সে দেখেছে, বিয়ের পর জ্যাঠার বড়োছেলে মহাদেব বউ নিয়ে চৌরঙ্গিতে চীনে দোকানে খেতে গিয়ে ফিরে এসেছিল কেবিনে জায়গা না পেয়ে। পরপুরুষদের চোখের সামনে বউ খাবে এটা তিনি বরদাস্ত করতে পারেন না। রাস্তার দিকে বারান্দায় মেয়েদের পা রাখা, পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে বয়স না হলে সেটা বেহায়াপনা গণ্য হয়। আশ্চর্যের কথা, এগুলো কখনো কাউকে বলে দেওয়া হয় না, নিজের থেকেই বুঝে নেয়।

কড়াকড়ি সত্ত্বেও কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা ঘটে ছিল। লোকেশের তখন সাত বছর বয়স। একদিন মাঝরাত্রে চাপা শোরগোলে ঘুম ভেঙে দেখে ঘরে কেউ নেই। গুটি গুটি ঘর থেকে বেরিয়ে অন্ধকার বারান্দায় আসে। সারা বাড়িতে আলো জ্বলছে শুধু সিঁড়িতে আর তিনতলার ছাদের ঘর ছাড়া।

একতলায় সিঁড়ির গোড়ায় কাকে যেন মারা হচ্ছিল। ছেলেমেয়ে বউয়েরা বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে। মেজোবউদিকে সে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করেছিল কারণটা। ‘চোর, চুরি করতে এসে ধরা পড়েছে। যা সরে যা, ছোটোদের এসব দেখতে নেই।’ মেজোবউদি তাকে ঠেলে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।

পরদিন সে শুনেছিল জগৎ নামে তাদের চাকরটিই ছিল সেই চোর। অল্পবয়সি, বলিষ্ঠ জগৎ খুব অমায়িক ও মৃদুভাষী ছিল। চালচলন কথাবার্তা ছিল লেখাপড়া জানা লোকের মতো। লোকেশ বাড়িতে তার বালবিধবা বছর চল্লিশ বয়সের ছোটো পিসিকেও দেখতে পায়নি। বড়দার মেয়ে তারই সমবয়সি অমিতা চুপিচুপি বলেছিল, ছাদের ঘরে দেখে আয় কে রয়েছে।’ লোকেশ জানতে চেয়েছিল, কে রয়েছে? অমিতা বলতে চায়নি। সে ছাদে গিয়ে ঘরের দরজা তালা বন্ধ দেখে মাকে তখন জিজ্ঞাসা করেছিল, ঘরে কে, কাকে তালা দিয়ে রাখা হয়েছে মা তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেছিল, ‘যেই থাকুক না, এই নিয়ে কোনো কথা বলবি না। বাইরের কারোর সঙ্গে একদম নয়। বললে কিন্তু জ্যাঠামশাই মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দেবে আর ছাদের সিঁড়ি একদম মাড়াবি না।’

চার দিন পর স্কুল থেকে ফিরে সে দেখে, তাদের বাড়িতে অ্যাম্বুলেন্স গাড়ি আর পুলিশ এসেছে। পাড়ার লোক ভিড় করে বাড়ির সামনে, মেয়েরা ছাদে বারান্দায়, সদরে দাঁড়িয়ে। ছোটোপিসি ছাদের ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। দত্ত বাড়িতে এরপর ছোকরা কি মাঝবয়সি চাকর আর কখনো রাখা হয়নি।

বছর দশেক পর, দিনরাতের ঝি রানীবালাকে সোনার চুড়ি চুরি করার দায়ে যখন পুলিশে দেবার ভয় দেখানো হচ্ছিল তখন সে গলা চড়িয়ে বলেছিল, ‘যান যান, আমাকে আর পুলিশ মুলিশ দেখাবেন না, আমিও তাহলে আপনাদের পুলিশ দেখিয়ে দেব। ছোটো পিসিমা কী করে মরল তা কি আমি জানি না? ওর গলায় ফাঁস কে দিয়েছিল তাও আমি জানি। জগতের বিছানা থেকে রাত্তিরে কে তাকে চুলের মুঠি ধরে তুলেছিল তাও আমি জানি।’

দশ মিনিটের মধ্যে রানীবালা তার বকেয়া মাইনে আদায় করে দপদপিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছল। ও চলে যাবার পর কোনোদিন কেউ আর রানীবালা নামটা মুখে আনেনি, যেন ওই নামের কেউ এ বাড়িতে কখনো কাজ করেনি। দত্তবাড়িতে জগৎ কাজে লেগেছিল চাঁদুর বয়সেই। তাই লোকেশের বুকের মধ্যে অসুনী ছায়া ভেসে এল যখন সরলা বলল, ‘আমারও তাই মনে হয়েছিল।’

‘কি মনে হয়েছিল, সিনেমার হিরো হবার মতো চেহারা?’

‘হ্যাঁ। ওকে কেউ চাকর বলে প্রথমে বুঝতে পারে না, ভাবে তোমার ভাই কী ভাইপো।’ সরলা মুচকি হাসল বলা শেষ করে। শুনেই লোকেশের মুখ কঠিন হয়ে উঠল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘তোমার ছেলে বা মেয়ের কাকা বলে ভাববে এরপর। তখন শুনতে কেমন লাগবে?’

‘কেমন আবার লাগবে, বহু বাড়িতে পুরোনো চাকরদের তো দাদা কী কাকা বলে সে বাড়ির ছেলেমেয়েরা। কোনো বাড়িতে পুরোনো কাজের লোক থাকাটা তো সেই বাড়ির ইজ্জত বৃদ্ধি। লোকে বুঝতে পারে বাড়ির আচার-আচরণে ছ্যাঁচড়ামি নেই, ব্যবহারে ভদ্র, উদার নইলে লোক টিকে থাকত না। দেখ না অধিকাংশ বাড়িতে ঝি-চাকর আসছে আর চলে যাচ্ছে। কাজের লোকেদের পরিবারের একজন করে নিতে পারে না বলে তো।’ মুখে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে সরলার। সরু চোখ দুটি আরও সরু হয়ে প্রায় বুজে গেছে। ‘তুমি তাহলে শ্রীমান চন্দন গড়াইকে এই পরিবারের একজন করবে ঠিক করেছ।’ লোকেশ সরলার পাত থেকে এক টুকরো সর তুলে নিল।

‘আমি তো ওকে লিখতে পড়তে শেখাব ভাবছি। অশিক্ষিত লোক নিয়ে বড্ড অসুবিধে হয়।’

‘শেখাও।’ লোকেশ উঠে পড়ল হাত ধোবার জন্য। ‘তবে বাড়াবাড়ি করো না। ও পুরুষমানুষ এই হুঁশটা যেন তোমার থাকে।’

বারান্দার অন্য প্রান্তে প্লাস্টিকের ড্রামে জল রাখা। চাঁদু দু-বেলা নীচের থেকে জল তুলে ওটা ভরিয়ে রাখে। হাত ধুয়ে লোকেশ ফিরে না আসা পর্যন্ত সরলা টেবলে বসে রইল। লোকেশের শেষ বাক্যটির তাৎপর্য বোঝার জন্য সে ভাবছে।

‘হঠাৎ তুমি ওই কথাটা বললে কেন, চাঁদু পুরুষমানুষ আমি যেন হুঁশ রাখি? আমি কি জানিনা ও পুরুষমানুষ?’

‘নিশ্চয় জান। কিন্তু তুমি এটা কি জান তোমায় দেখলেই পুরুষমানুষরা মাখনের মতো গলে যেতে শুরু করে, যেমন গলেছি আমি। বলে লোকেশ ঝুঁকে সরলার ঠোঁটে আলতো চুমু খেয়েই ভয় পাবার ভান করে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ব্যাটা আবার লুকিয়ে দেখছে না তো!’

গম্ভীর মুখে সরলা চেয়ার থেকে উঠে এঁটো বাসন সাজিয়ে রাখতে শুরু করল। ‘একেবারে মোক্ষম সময়ে চাঁদুটা ডিস্টার্ব করল। তাড়াতাড়ি এসো।’ লোকেশ চপল গলায় কথাটা বলে ঘরের দিকে যাবার সময় সরলার নিতম্বে হাত বুলিয়ে নিল। ‘কাজটা ফিনিশ করতে হবো তো।’

সরলা ভ্রু তুলে শুকনো হাসল। নিজেকে অসুখী বোধ করার কোনো কারণ বিয়ের পর থেকে সে এখনও খুঁজে পায়নি। লোকেশ কত শান্তভাবে গর্ভসঞ্চারের খবর শুনল, মেনে নিল বুঝদার স্বামী। হ্যাঁ সে সুখীই।

সরলা নার্সিং হোমে যাবার বারো দিন আগে তপু লাইব্রেরিতে বই বদলিয়ে সোজা আসে তার কাছে। দু-চারটে কথার পর বলেছিল, ‘আমাদের বাঁশবেড়ের বাড়িটা বাবা দলিল করে দাদাকে দিয়ে দিয়েছে। এই বাড়িটায় আমার বা দাদার কোনোরকম দাবিদাওয়া আর রইল না, এটা পাবে সতাতো ভাইয়েরা। দাদাকে রেডিমেড জামাকাপড়েই দোকান করে দেবে চন্দননগরে। দাদা রাজি হয়েছে।’

‘আর তোর জন্য?’

‘আমার জন্য বিয়ের টাকা আর গয়না। মেয়েদের জীবনের লক্ষ্য তো বিয়ে করা, তাই।’

‘বাড়ির অংশ?’

‘পাব না। আমার নিজের মায়ের দশভরি সোনা আর চল্লিশ হাজার টাকা আমি বিয়ের জন্য পাব।’

‘বিয়ে তো আর এখনই হচ্ছে না। পড়াশুনোটা তো চালিয়ে যাবি।’

‘যাব। তবে বাবার বাড়িতে থেকে নয়। আমি আর দাদা এই মাসেই বাঁশবেড়েতে চলে যাচ্ছি। ওখান থেকেই কলকাতায় যাতায়াত করে পড়ব।’

‘কষ্ট হবে খুব।’

‘হোক। এম এ পাশ করার আগে বিয়ে নয় নিজে রোজগার না করতে পারলে সরলাদি, ঘরে বাইরে কোথাওই জোর নিয়ে দাঁড়ানো যায় না। আমার মাকে দেখেছি তো, সারাজীবনই বাবার ঝি হয়ে কাটিয়েছে। আচ্ছা সরলাদি, বিয়ে করতেই হবে এমন কোনো মাথার দিব্যি কি মেয়েদের দেওয়া আছে?’

সরলা শুধু স্মিতমুখে কথাগুলো শুনে গেল। রোজগার করতে না পারা বা ঝি হয়ে জীবন কাটানো ইত্যাদি কথাগুলোর খোঁচা তার মনে কিছুটা বিঁধেছে। এক সময় সেও এইভাবে কথা বলেছে, ভেবেছে। বি এ পাশ এবং চাকরি দুটোই কিন্তু আর করা হল না। মনের কলকবজাগুলো নিশ্চিন্তি আর সুখ পেয়ে জং ধরে যায় এটা সে এখন বুঝতে পারছে। তপুর ঝাঁঝ যে তার গায়েও লাগছে মেয়েটা তা বুঝতে পারছে না। প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য সে বলল, ‘বাঁশবেড়ে চলে গেলে আর তো তোর সঙ্গে দেখা হবে না।’

‘হবে না কেন? কলকাতায় তো রেগুলার আসা যাওয়া করতেই হবে। তোমার বাচ্চচা হওয়ার আগে আমি যাচ্ছি না।’

ডাক্তারের আনুমানিক তারিখেই বিটু জন্মেছে। সরলার মা চেয়েছিলেন নার্সিং হোম থেকেই মেয়েকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যেতে। লোকেশ রাজি হয়নি। আবার কেন শ্বশুরের টাকা খরচ করানো! অনভিজ্ঞ নতুন মায়ের পক্ষে বাচ্চচা নাড়ানাড়ি করায় অসুবিধা হবে ভেবে সে নিজেই শাশুড়িকে বলেছিল, ‘আপনি বরং কয়েকটা দিন এসে থাকুন।’ তিনি রাজি হয়ে চারদিন মেয়ের বাড়ি ছিলেন।

তপু নার্সিং হোমে আসতে পারেনি। বিটুর জন্মের আগের দিন সে আর তার দাদা অজয় বাঁশবেড়ের বাড়িতে চলে যায়। দিন সাতেক পরে সে সরলাকে দেখতে আসে, প্লাস্টিকের ঝুমঝুমি হাতে নিয়ে। সরলা খুব খুশি হয়েছিল ওকে দেখে। তপু বেশিক্ষণ থাকেনি ট্রেন ধরার তাড়া থাকায়। যাবার সময় ঝুমঝুমিটা বিটুর মুখের কাছে নাড়িয়ে সে বলেছিল, ‘বুঝলে সরলাদি এখন একেবারে নতুন জীবন। মুক্ত স্বাধীন বলতে যা বোঝায় এখন আমি ঠিক তাই। অধীনতা শুধু এই ট্রেনের কাছে, ওর সময় ধরে এখন চলতে হচ্ছে।’

‘আমারও এবার শুরু হবে আর একটা জীবন। তবে তোর মতো মুক্ত স্বাধীন নয়।’

‘কী নাম রাখবে ছেলের?’

‘নাম ওর বাবা রাখবে, আমি এ ব্যাপারে নেই।’

‘আমাকে যদি বলো তাহলে আমি রাখব ধ্যানেশ, লোকেশের সঙ্গে মিলিয়ে।’

বিটুর নাম ধ্যানেশই রাখা হয়। তপুর দেওয়া নামটা সরলার কাছে শুনে লোকেশ বলেছিল, ‘বাহ, চমৎকার নামটা তো! আমি তো ভাবছিলুম গণেশ কি প্রাণেশ রাখব। তাহলে এটাই থাক।’

বিটুকে দেখতে জ্যাঠাইমা ও তার বড়োবউ এসেছিলেন। দুটো ফ্রক আর একশো টাকা দিয়ে ছেলের মুখ দেখলেন। দ্যাওর শিবেন্দ্রর সঙ্গে দু-চার কথা বলে, চলে যাবার আগে সরলাকে বললেন, ‘এবার একজন দিনরাতের ঝি রাখ। কলেজের পড়া আর বাচ্চচা মানুষ করা একসঙ্গে হয় না।’

‘আমিও তাই ভাবছি।’

এই সময় নীচের থেকে বালতিতে জল নিয়ে চাঁদু উঠে এল। তোমার লোক বলতে তো ওই ছেলেটা।’ জেঠিমা চোখ কুঁচকে চাঁদুকে জরিপ করে বললেন ‘ওকে তো আর বেশিদিন রাখতে পারবে না, আর তো ছোটো নেই! বাচ্চচাকে নাওয়ানো, খাওয়ানো, মোতানো, এসব কাজ বাপু বড্ড ঝামেলার, খুব নজর রাখতে হয়। তুমি একটা মেয়েছেলে রাখার কথা লোকুকে বলো।’

জেঠিমার কথা শেষ হবার পরই তার পুত্রবধূ পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সি সরযূ, বললেন, ‘আমাদের বাড়িতে বাপু অল্পবয়সি চাকর রাখার নিয়ম নেই।’

‘নিয়ম নেই মানে’, জেঠিমা তাড়াতাড়ি এর কারণ দর্শালেন, ‘বড্ড হাত টান হয় এই ছোঁড়াদের, যেমন ফাঁকি দেয় তেমনি মুখের ওপর তক্কোও করে। তা ছাড়া পাড়ার ঝিয়েদের সঙ্গে এমন সব কাণ্ড করে যে লজ্জায় পড়ে যেতে হয়। তাই ছেলেছোকরা রাখার চল নেই। তুমিই বলো বাইরের একটা মদ্দো ঘোরাফেরা করলে বউঝিদের অসুবিধে হয় না? কাপড়চোপড় গায়ে কখন ঠিক থাকে না থাকে তা কি বলা যায়?

শাশুড়ির কথা শেষ হতেই সরযূ যোগ করলেন, ‘তুমি বাপু রাস্তা দিয়ে চলার সময় ঘোমটা দাওনা এটা আমি লক্ষ করেছি। মাথায় কাপড় না দিয়ে আমরা বারান্দাতেও বেরোই না।’

‘যা বললুম, লোকুকে কিন্তু ঝি রাখার কথা বলো।’

সরলা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ল। ‘আপনার ছেলে এলেই আমি বলব।’

সরলা অবশ্য লোকেশকে কিছুই বলেনি। এরপর এক দুপুরে এল রঞ্জনা। দুটো কাঁথা আর দুটো কোলোট উপহার দিল বিটুকে। জিনিস দুটো দরকারী, সরলা খুশি হয়ে বলল, ‘এতবার ভিজেছে যে কেচে রোদ্দুরে দিতে দিতেই আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। তোর এগুলো খুব কাজে লাগবে।’

‘নিজে করিস কেন, বাসনাকে বল মাসে দশটা টাকা বেশি দেব কাঁথাটাথাগুলো দু-বেলা কেচে দেবে।’

‘বলব। তবে চাঁদুও আমাকে খুব সাহায্য করে।’

‘তোর ভাগ্যি ভালো তাই অমন একটা চাকর পেয়েছিস। এত কাজ করে যে, আমরা তো বলাবলি করি, চাঁদু চলে গেলে তোরা খুব বিপদে পড়বি।’

সরলা হাসল। মাথানেড়ে বলল, ‘চাঁদু এ বাড়ি ছেড়ে যাবে না, কখনো যাবে না। ও নিজেই বলেছে। ওর বাপ-মা কেউ নেই। আমি দেখেছি, একটু মিষ্টি কথা, একটু স্নেহ, একটু আত্মীয়ের মতো আপন করা ব্যবহার পেলে বর্তে যায়।’

‘ভালো।’ রঞ্জনা ঘরের সর্বত্র চোখ বোলাল। ‘ছেলেটাকে দেখতেও ভালো, আপন করে নেওয়ার মতোই চেহারাটা।’

সরলা হাসতে পারল না রঞ্জনার সঙ্গে। তার মনে হল হাসলেই সে নোংরা হয়ে যাবে। রঞ্জনার স্বভাবের গতিপ্রকৃতি গত একবছরের আলাপেই বুঝে গেছে। বারান্দা থেকে ডেকে কথা না বললে তাই সে কথা বলে না।

‘এর পরের বাচ্চচাটা কবে হবে, ঠিক করেছিস?’ রঞ্জনা নিজে অন্য কথায় চলে এল।

‘হবে না আর।’

‘অ্যাঁ।’ অবাক হয়ে গেল রঞ্জনা। একটাই, ব্যস? লাইগেশন করিয়ে নিয়েছিস?’

‘হুঁ। যা দিনকাল পড়েছে একটাকে মানুষ করে তোলাই শক্ত। কালকেও তো পাড়ায় বোমাবাজি হচ্ছিল।’ সরলার চোখে বিরক্তি ফুটে উঠল।

‘এ আর কি এমন, দু-তিন বছর আগে যা হত তা দেখলে তো তোর হাত-পা পেটে সিঁধিয়ে যেত। বারান্দা থেকে দেখেছি ছেলেদের চ্যাংদোলা করে ধরে এই গলি দিয়ে নিয়ে যেত খুন করার জন্য। সে কি চিৎকার আর কান্না! ওরে আমায় ছেড়ে দে, আমায় তোরা মারিসনি, তোদের পায়ে পড়ছি, তোরা আমার বন্ধু, বাপ- মা, সে আরও কতকি! আমায় বাঁচান, আমায় বাঁচান বলে পাড়ার লোকেদের দিকে তাকিয়ে যেভাবে বলত। জীবনে আমি সেই মুখগুলো ভুলব না, মনে পড়লে বুকের মধ্যে কেমন যেন করে ওঠে। তুই বেঁচে গেছিস তখন তোর বিয়ে হয়নি বলে।’ রঞ্জনার মুখে দু-বছর আগের ভয় ফিরে এসেছে।

‘পাড়ার লোকেরা কিছু করত না, বাধা দিত না?’

‘হুউস’ নাক দিয়ে তাচ্ছিল্যের শব্দ বার করে রঞ্জনা বলল, ‘কে বাধা দিতে যাবে? তাহলে হয় ছোরা নয়তো বোমায় মরতে হত। কত্তা তো আমাকে একবার টান মেরে ঘরে ঢুকিয়ে বারান্দার দরজা বন্ধ করেই একটা চড় মেরেছিল। বোঝ, কলেজে পড়ায় যে লোক তারও কীরকম বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়ে গেছল।’

‘উনিতো বলেন এখনকার দিনে সন্তান মানুষ করে তোলা, বিশেষ করে ছেলেদের ভদ্র শিক্ষিত করে তোলা খুব কঠিন। বাইরে ওরা কী করছে, কাদের সঙ্গে মেলামেশা করছে কিছুইতো জানা যাবে না। উনিই তাই ঠিক করলেন একটাই যথেষ্ট, আর হয়ে দরকার নেই।’ সরলা স্নেহভরে একবার বিটুর দিকে তাকিয়ে তার কথা অনুমোদিত হল কিনা দেখার জন্য রঞ্জনার মুখ লক্ষ্য করল। মুখে তিক্ততা মাখানো চাহনি জানলার বাইরে। সরলা সংকোচ বোধ করল। তার কথায় এমন কিছু তো নেই যে ওর ভাবান্তর ঘটবে!

‘কি রে হঠাৎ চুপ করে গেলি?’

‘কী আবার বলব?’ রঞ্জনার নিরাসক্ত স্বর। ‘তোর ভাগ্যটা খুব ভালো। ভালো ঘর, বর, একটামাত্র ছেলে, বরের ভালো আয়, দেখতেও তুই সুন্দরী, লেখাপড়া করিস, কলেজ যাস, সংসারেও কোনো ঝক্কি ঝঞ্ঝাট নেই-একটা মেয়ের যা যা চাওয়ার সবই পেয়েছিস, সোনার সংসার। তোকে দেখে এক একসময় খুব হিংসে হয়।’

সরলা কী যে বলবে ভেবে পেল না। রঞ্জনার মুখ করুণ দেখাচ্ছে। ‘কিছু বদলায়নি, সব সেই একশো বছর আগের মতোই রয়েছে।’

‘চা খাবি?’ অবশেষে সরলা বলল।

‘না।’ রঞ্জনা উঠল। ‘সুখ ধরে রাখতে হয়, না হলে পালিয়ে যায়। এটা মনে রাখিস।’

‘সরলা আঠারো বছর সুখ ধরে রেখেছে। বছরগুলো যে কীভাবে সাঁই সাঁই করে পিছনে চলে গেল, কীভাবে তার বয়স বাড়ল, সংসারের বাড়বাড়ন্ত ঘটল তার কোনো ধারাবাহিক স্মৃতি সে ধরে রাখেনি। রাখার দরকার বোধ করেনি। আঠারো বছরে কিছুই ঘটেনি তার জীবনে। মসৃণ দিনরাতের পথ দিয়ে সে ব্যস্ত বেগে চলে এসেছে।

বিটু জন্মাবার একমাস পর লোকেশ সন্ধ্যাবেলায় একটা লোককে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরেছিল। কী ব্যাপার?

‘বাচ্চচা হবার পর তলপেটের মাসল, ফাইবার ঢিলে হয়ে যায়। পেটটা ক্রমশ ঝুলে পড়ে। ওটাকে টাইট করে বেঁধে রাখা দরকার।’ লোকেশ তাকে বুঝিয়ে ছিল।

‘ধ্যাৎ, ঝুলে পড়বে আবার কি! এই তো ঠিকই রয়েছে।’ সরলা তলপেটে হাত রেখে বলেছিল।

‘ঠিক তুমি বলছ, আমি বলছি নেই।’ লোকেশ বলতে বলতে সরলার তলপেটে হাত রেখে খামচে ধরল। ‘আহ, লাগে, কী হচ্ছে, চাঁদু এসে পড়বে।’

‘দেখলে তো, ঢিলে হয়ে গেছে বলেই ধরা গেল। এজন্যই তোমায় কাপড়ের বেল্ট পরতে হবে। লোক এনেছি, মাপ নিয়ে বেল্ট তৈরি করে দেবে।’

সরলা মাপ দিল, বেল্ট তৈরি হয়েও গেল। হাঁটু গেড়ে বসে লোকেশ সরলার তলপেটে বেল্ট জড়িয়ে বকলেসে লাগিয়ে টানল।

‘উহহ, লাগছে।’

‘লাগুক, সারাক্ষণ টাইট করে এটা পরে থাকতে হবে। শরীরের এত সুন্দর জায়গাটা নষ্ট হলে আমি….’ লোকেশ মুখ তুলে তাকাল। সরলা তখন কী যেন ওর চোখে দেখতে পায় যাতে সে রমণীজীবন সার্থক হয়েছে ভাবতে পেরেছিল। লোকেশ ওর তলপেটে মুখ চেপে ধরে অস্ফুট স্বরে বলেছিল, ‘তোমার এই শরীরটা পাওয়া মানে ভগবানের বর পাওয়া।’

শিবেন্দ্রর তাগিদেই বিটুর কোষ্ঠী করানো হয় যখন ওর এক বছর বয়স।

হলুদ রঙের পাকানো কাগজটা খুলে সরলার চোখের সামনে ধরে লোকেশ বলেছিল, পরে পড়ে নিয়ো আগে শোন কী ভবিষ্যদ্বাণী করছে…না থাক।’ কোষ্ঠীটা আবার পাকিয়ে সে সরলার কৌতূহলকে টানটান করে দিয়েছিল।

‘থাক কেন, কোনো অমঙ্গুলে কথা আছে নাকি? আয়ু কত হবে বলেছে?’

‘বলেছে, উনআশি বছর।’

‘সরলা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ‘মাত্তর!’

‘মাত্তর মানে এটা বেশিই তো! ইন্ডিয়ানদের গড় আয়ু কত জান? এখন বাহান্ন, বাবাদের আমলে ছিল পঁয়ত্রিশ। সেই তুলনায় উনআশি তো কলকাতা থেকে হেঁটে চাঁদে পৌঁছনোর মতো সময়। আমরা তো তখন মরে ভূত হয়ে যাব।’

‘এসব নিয়ে ঠাট্টা আমার ভালো লাগে না।’ আর কী লিখেছে?’

‘আর লিখেছে জাতকের মা দিনে দিনে সুন্দরী হবে আর বাবাটা কুচ্ছিত হবে।’

‘ছিঁড়ে ফেলে দাও কোষ্ঠীটা।’ সরলা কোপ প্রকাশ করে মুখ ঘোরাল।

‘দিচ্ছি, আর লিখেছে বিটু অত্যন্ত মেধাবী হবে, দেশ জোড়া খ্যাতি পাবে, যশ আর ধনলাভের প্রবল সম্ভাবনা।’

‘ফাঁড়া?’

‘ছিঁড়ে ফেলি এবার?’ লোকেশ দু-হাতে কোষ্ঠীটা ধরে ছেঁড়ায় উদ্যত হল।

‘আঃ ফাজলামো রাখো, ফাঁড়ার কথা কিছু বলেছেন? মা বলছিল, বদ্যিনাথ বাবার কাছ থেকে মাদুলি এনে বিটুকে পরাবে।’

লোকেশের মুখ থেকে চাপল্য ঘুচে গিয়ে গাম্ভীর্য দেখা দিল। ‘ওর একত্রিশ থেকে চৌত্রিশ বছরের মধ্যে কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আছে। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম জ্যোতিষীমশাইকে সম্ভাবনা বলতে কী বোঝায়? উনি রোব থেকে শনি যাবতীয় গ্রহের নাম, তাদের যাতায়াত, কে কবে কাকে ধাক্কা মারবে তার হিসেব বুঝিয়ে শেষকালে বললেন স্বস্ত্যয়ন করলে গ্রহশান্তি লাভ হবে। স্রেফ পয়সার ধান্দা। আমাকেও রত্ন ধারণ করতে বললেন, গোমেদ আর পলা।’

থমথমে হয়ে গেল সরলা। ক্ষীণস্বরে বলল, ‘ওই একটাই ছেলে, আর হবে না, আমি কোনো চান্স নোব না।’

‘আর একটা কথাও কোষ্ঠীতে আছে, পুত্রভাগ্যে পিতার ধনলাভ হবে।’

‘হোক। স্বস্ত্যয়ন আমি করব।’

‘লেখাপড়া শিখেও তুমি এসব বিশ্বাস কর? সায়ান্স আর টেকনলজির অবিশ্বাস্য এই….। কিন্তু কথা শেষ করতে পারল না।

‘আমি স্বস্ত্যয়ন করাব।’ উদ্ধতভাবে সরলা মুখ তুলে, জ্বলজ্বল চোখে বলল, কাটাকাটা স্বরে। লোকেশের তর্ক করার সব ইচ্ছা মিইয়ে এল সরলার প্রতিবাদী ভঙ্গির সামনে।

‘উনি বলেছেন এক্ষুনিই যে করাতে হবে তার কোনো মানে নেই। তিরিশ বছরেও এটা করা যায়। ফাঁড়া তো একত্রিশের পর।’

‘তা হোক, তুমি ওর সঙ্গে দেখা করে বলো আমরা স্বস্ত্যয়ন করাব আর তুমিও রত্নধারণ করবে।’

এর ছয়দিন পর খবরের কাগজে রাজ্য লটারির সাপ্তাহিক ফলের নম্বরগুলোয় চোখ বোলাতে গিয়ে লোকেশ চমকে উঠল। চিৎকার করে সরলাকে ডেকে সে মানিব্যাগ থেকে লটারির টিকিটটা বার করে নম্বর মেলাল।

‘দ্যাখ দ্যাখ, চতুর্থ পুরস্কারে আমার নম্বরটা রয়েছে, পঞ্চাশ জন পাবে দেড় হাজার টাকা!’

সরলাও টিকিটের নম্বর মেলাল। অবাক ভাবটা কাটিয়ে ওঠার পর বলল, ‘বিশ্বাস হল তো? কোষ্ঠীতে কী লেখা আছে? পুত্রভাগ্যে পিতার ধনলাভ! বি এসসি পাশ করেছ বলে তো খুব অবিশ্বাস করো, এইবার কী বলবে?’

লোকেশ চুপ করে রইল।

‘এই টাকা দিয়েই স্বস্ত্যয়ন করাব। আজও যাও জ্যোতিষীমশায়ের কাছে।’

লোকেশ জবাব দেয়নি। হোম যজ্ঞ করে স্বস্ত্যয়ন হয়েছিল দু সপ্তাহ পরই।

তপু মাঝে মাঝে আসত। বি এ পাশ করার পর খবরটা দিতে এসেছিল। তখনই জানায়, ওর দাদা অজয় বিয়ে করেছে চন্দননগরের একটি মেয়েকে। দোকানেই আলাপ হয়েছিল। ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়া, অত্যন্ত মুখরা এবং তপুর সঙ্গে একদমই বনছে না।

‘সরলাদি তোমাদের একতলার ঘরটা খালি দেখলাম, কোচিংটা কি উঠে গেছে?’

হ্যাঁ, উনি অনেকদিন আগেই বলে দিয়েছিলেন ঘরটা দরকার। মাস দুই হল সমাজপতি রোডে একটা বড়ো ঘর পেয়ে উঠে গেছে।’

‘ঘরটায় আমায় থাকতে দেবে? তাহলে আর দাদার বউয়ের ট্যাঁকট্যাকনি শুনতে হয় না। ভাড়া দেবো। তোমাদের পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকব।’

‘কিন্তু তোর জামাইবাবু যে ওটাকে বসার ঘর করবে বলে ঠিক করেছে। এখন তো উনি ফিল্ড সুপারভাইজার, বাইরের লোকজন আসে, তাদের বাবার ঘরে বসালে খুব অসুবিধে হয়। পরে যখন আরও উপরে ডিভিশনাল ম্যানেজার হবেন, একদিন হবেনই, তখন তো ঘরটায় কার্পেট পাততে হবে।’

এরপর তপু আর আসেনি। তবে তিন বছর পর দিল্লি থেকে ওর একটা চিঠি এসেছিল। তপু তার জেদ বজায় রেখেছে। এম এ পাশ করে তবেই বিয়ে করেছে। শ্বশুরবাড়ি দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে। স্বামী ব্যাঙ্কের অফিসার। চিঠির শেষে লেখা, ‘প্রেম করে নয়, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে দাদা যোগাযোগ করে। দিল্লি থেকে পাত্র আমাকে দেখতে আসে এবং পাঁচ দিনের মধ্যেই বিয়েটা হয়ে যায়। তাই কাউকেই জানাতে পারিনি। ওরা চল্লিশ বছর দিল্লির বাসিন্দা। আগে থাকত করোলবাগে। বিয়ের আগে বরকে ওইটুকুই দেখেছি। বাড়ির বড়োছেলে, মানুষ ভালো, রসকস একটু কম, অফিসের কথাই বেশি বলে। এরা বেশ কনজারভেটিভ। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠি। কলকাতায় গেলে ওকে নিয়ে তোমাদের বাড়ি যাব।’ চিঠির নীচে পুঃ দিয়ে বাচ্চচা কমপক্ষে তিন বছরের আগে নয় যদিও বাচ্চচা আমি ভালোবাসি।’

বিটু এখন ইংরিজি মিডিয়াম সেন্ট জন স্কুলের ছাত্র। তার আগে বাড়ির কাছাকাছি এক নার্সারি স্কুলে পড়েছে। বাসে স্কুল যায় চাঁদুর সঙ্গে, ফেরেও তার সঙ্গে। চাঁদু এখন ধোপদুরস্ত ধুতি আর শার্ট পরে। অবশ্য বাড়ির যেসব কাজ আগে করত তা করে যাচ্ছে। ওর মাইনে এখন একশো টাকা। ইংরেজিও বাংলায় নাম সই করতে পারে, যোগ-বিয়োগটাও শিখেছে। সরলা ওকে ব্যাঙ্কে নিয়ে গিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলিয়েছে। মাইনের সবটাই সে জমায়। টেলিফোন ধরে অপরিচিত লোকের সঙ্গে বিনীত ভঙ্গিতে কথা বলে বা ফোন নাম্বার লিখে রাখার দরকারটাও সে বোঝে।

বিটু যখন আট বছরের শিবেন্দ্র মারা গেলেন কিডনির অসুখে। ডাক্তার বলেছিলেন একটা কিডনি বদলাতে হবে। হিসেব করে দেখা গেল এজন্য খরচ হবে প্রায় লাখ টাকার কাছাকাছি। চারবার ডায়লিসিস করিয়েই লোকেশ চিন্তায় পড়ল। প্রতিবাদের জন্য খরচ হয়েছে আটশো টাকা। বাবাকে বাঁচিয়ে রাখতে মাসে যদি সাত-আটবার ডায়লিসিস করাতে হয় তা হলে মাসে কম করেও অন্তত ছ-হাজার টাকা লাগবে যেটা তার এখনকার মাইনের থেকেও বেশি। মাসে মাসে এত টাকা চলে যাবে আটষট্টি বছরের এই লোকটিকে জীইয়ে রাখতে! ভাবতে ভাবতে লোকেশ এমন এক মানসিক অবস্থায় পৌঁছায় যখন সে মনের আগোচরেই বিদ্রোহ করল নিজের কর্তব্যবোধ এবং সুকুমার অনুভূতিগুলির বিরুদ্ধে।

কত বছর ধরে বাবাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সে মাসে মাসে এত টাকা দিতে পারবে? কিডনি বদল করে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে শুধু কিডনি কিনতেই হাজার পঞ্চাশ হাজার টাকা বেরিয়ে যাবে। সে নিজে যদি একটা কিডনি দেয় তাহলে অবশ্য এই টাকাটা বাঁচবে। সরলাকে বলতেই সে আঁতকে উঠেছিল। ‘সে কি গো। না না তুমি কিডনি দেবে না। জানি একটা কিডনি নিয়েও লোকে বেঁচে থাকে। কিন্তু ভগবান না করুন, যদি সেটা খারাপ হয়, তাহলে? আমার কথা বাদ দাও, বিটুর কথাটা ভাব।’

‘তাহলে লাখখানেক টাকা আমি পাব কোথায়? লোকে তো বলবে ছেলে চিকিৎসা করায়নি বলে বাপ মনে গেল।’

‘লোকেরা কেউ জানে না বাবার কী অসুখ হয়েছে। আমি কাউকে কিছু বলিনি।’

‘চারবার গাড়ি করে নার্সিং হোমে ডায়ালিসিস করাতে নিয়ে গেলুম পাড়ার বহু লোকই দেখেছে। ও বাড়ির বড়দার ছেলে কার্তিক তো আমায় জিজ্ঞাসাও করল কোথায় নিয়ে যাচ্ছি। কিডনি ফেইলিওয়ের কথা অবশ্য বলিনি। কিন্তু জেনে তো যেতে পারে।’

‘জানুক না, তাতে হয়েছে কী?’

‘হয়েছে নয় হবে। সবাই তখন কী চিকিৎসা হচ্ছে জানার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বে। এতবড়ো চাকরি করে আর বাপের জন্য লাখ টাকা খরচ করবে না, তা কী হয়? কিন্তু লাখ টাকা তো আর জমানো নেই যে চেক কেটে দিয়ে দেবে, প্রভিডেন্ড ফান্ডেও অত টাকা নেই বাড়িটা বিক্রি করে অবশ্য চেষ্টা করা যায়, এটা তো বাবারই।’

‘তা হয় না। নিজের বাড়ি ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে থাকা! পারবে তুমি?’

জবাব না দিয়ে মুখ নীচু করে লোকেশ গোমেদের আংটিটা আঙুলে ঘোরাতে থাকে। সরলা তখন একদৃষ্টে তাকিয়েছিল ছবিটার দিকে। চিড়িয়াখানার হরিণটাকে ছোলা খাওয়াচ্ছে তিন বছরের বিটু। ভয় আর আনন্দ মুখটাকে জমার করে দিয়েছে, শক্ত করে ওর হাত ধরে আছে সরলা। ছবিটা লোকেশের তোলা।

ওরা একই সঙ্গে হঠাৎই পরস্পরের দিকে তাকাল। দুজনেই কী একটা ভাবছিল এবং ভাবনাটা মিলে যাওয়ায় চমকে উঠল। ‘তাহলে কী ঠিক করলে?’ সরলা শুকনো গলায় ফিসফিসিয়ে বলল।

‘দেখি ভেবে দেখি।’

পঞ্চমবারের ডায়ালিসিসের জন্য লোকেশ তার বাবাকে নিয়ে গেল না। চাঁদু শুধু বলেছিল, আজ বুধবার, দাদুকে নিয়ে যাবার দিন।’

লোকেশ গম্ভীর মুখে বলে, ‘জানি।’ তারপর সে টেলিফোন তুলে ডায়াল করল।

‘হ্যালো, সানি নার্সিং হোম?…..আচ্ছা কাল আমার অফিসে আপনারা ফোন করে জানিয়ে ছিলেন আপনাদের ডায়ালিসিস মেশিনটা খারাপ হয়ে গেছে, সেটা কি সারানো হয়েছে?……হয়নি, পার্টস ভেঙে গেছে।…..

কোনো দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না? তাহলে তো বিপদে পড়লাম।…..হ্যাঁ, হ্যাঁ, প্লিজ, সারানো হলেই ফোনে একবার জানিয়ে দেবেন।’

টেলিফোন রেখে লোকেশ চাঁদুর মুখের দিকে তাকাল। ‘মুশকিল হল।’

‘অন্য কোথাও করানো যায় না?’ চাঁদু উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল।

‘না। মাত্র এই একটা জায়গাতেই হয়। বিলিতি মেশিনও যে খারাপ হয়। তুই একটা ফোনের কাছাকাছি থাকিস যদি খবর দেয়।’

লোকেশ অফিস বেরিয়ে যাবার আগেই বিটুকে নিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিতে গেল চাঁদু। ফিরে এসে কাজের মধ্যেই কান পেতে রইল ফোন বাজার শব্দের জন্য। পিটুকে স্কুল থেকে বাড়িতে এনে সে আবার কান পেতে রইল। বিকেলে ফোন বাজল। সে ছুটে গিয়ে দেখল সরলা কথা বলছে।

‘না, নার্সিং হোম থেকে এখনও কোনো ফোন আসেনি। চাঁদু? ও এখানেই দাঁড়িয়ে…..তুমি আর একবার ওদের ফোন করো। ……নিজেই যাবে?…..আচ্ছা।’

‘কী হবে বউদি?’ ভীত চোখে চাঁদু তাকিয়ে। সরলা চোখ সরিয়ে নিল।

‘কী আবার হবে, মেশিন আজকালের মধ্যে নিশ্চয় সারাবে, তখন বাবাকে নিয়ে গেলেই হবে।’

শিবেন্দ্রকে আর নিয়ে যাওয়ার সুযোগ এলনা, কেননা ডায়ালিসিস মেশিনের পার্টসের খোঁজে বোম্বাইয়ে যে লোক গেছে সাত দিনেও সে ফিরে আসেনি। অগত্যা শিবেন্দ্র আর অপেক্ষা না করে পরপারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন। সরলা ও লোকেশ কেঁদেছিল, চাঁদু পারেনি।

শিবেন্দ্রকে শেষবারের মতো দেখতে এসেছিলেন তার দাদা আর ভাই। অমৃতলাল নীরবে কিছুক্ষণ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় লোকশকে বলেছিলেন, ‘শিবু এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে ভাবিনি। কিই বা বয়স হয়েছিল।’

‘মেশিনটা ঠিক থাকলে দাদু চলে যেতেন না।’ পিছন থেকে চাঁদু বলে ওঠে। লোকেশ চমকে ফিরে তাকিয়েই অস্বাভাবিক স্বরে চিৎকার করে, ‘তোকে ওস্তাদি মেরে কথা বলতে কে বলেছে? চাকর চাকরের মতো থাকবি।’

ফ্যালফ্যাল করে চাঁদু তাকিয়ে থাকে। এমন রূঢ় কথা এই বাড়িতে সে প্রথম শুনল। জ্যাঠামশাইও অবাক হয়ে লোকেশের দিকে তাকিয়েছিলেন ভ্রু তুলে। নিজের শোকগ্রস্ত অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে লোকেশ কয়েক সেকেন্ড সময় নেয়। ‘ছোটো থেকে আছে তো তাই আশকারা পেয়েছে।’

জ্যাঠামশাই নির্বিকার মুখে বলেন, ‘একটু বেশিই পেয়েছে, পরে না পস্তাতে হয়। যেখানে যেখানে খবর দেবার দিয়ে দাও। মেজো আর সেজো পিসিকে ফোন করো, ওদের মেজদাকে শেষবারের মতো দেখে যাক আর খাটটা একটু ভালো কিনো।’

শিবেন্দ্রর মাথার কাছে বসে নৃত্যলাল হু হু করে কেঁদে ফেলেন। চাঁদু তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,

‘কেঁদে আর এখন কী হবে। দাদা তো এত চেষ্টা করলেন কিন্তু মেশিন যদি ঠিক না করা যায়, দাদা আর কী করতে পারে।’

চাঁদুই শবযাত্রার আগে খই আর পয়সা ছড়াতে ছড়াতে গিয়েছিল তার পিছনে ছিল কীর্তনের দল। বাবার শ্রাদ্ধে লোকেশ আলাদাবাড়ি ভাড়া নিয়ে প্রায় পাঁচশো লোক খাওয়াল, বারোজন ব্রাহ্মণকে পিতলের থালা গ্লাস ও একশো টাকা দক্ষিণা দিল, লাইব্রেরিকে দান করল বাবার কাচের আলমারিটা, তাতে সাদা অক্ষরে লেখা,’শিবেন্দ্রলাল দত্তের স্মৃতিতে।’

আত্মীয় কুটুম্ব ও বন্ধুবর্গের ভোজনের পর ভাড়া করা শ্রাদ্ধবাড়ি থেকে রাত বারোটা নাগাদ লোকেশ ও সরলা ফিরেছিল।

ইদানীং লোকেশ যৎসামান্য মদ খেতে শুরু করেছে। অফিসের নানান কাজে আসাম বা উড়িষ্যায় প্রায়ই যেতে হয়, তখনই সে অল্পস্বল্প খেতে শুরু করে। কলকাতায়ও সে কয়েকবার খেয়েছে তবে লোকের বাড়িতে নিমন্ত্রণে এবং সামান্যভাবে। শুধু সরলা ছাড়া বাড়ির আর কেউ তা জানে না। বাড়িতেও সে প্রায়শই খায়। বিটু ঘুমিয়ে পড়লে, দরজা বন্ধ করে রাত্রে আলমারি থেকে বোতল বার করে দু পেগ খেয়েই শুয়ে পড়ে। তার একটাই ভয় বাবা যেন না জানতে পারে। শিবেন্দ্র বলেন, মদ খেয়ে মানুষ নষ্ট হয় না, নষ্ট হয়ে মানুষ মদ খায়। লোকেশ বাবার চোখে নষ্ট ছেলে হতে কোনোভাবেই চায় না।

‘এতে হার্ট ভালো থাকে। এক্সারসাইজ তো একদমই হয় না, অ্যালকোহলে হার্টটা জোরে দপদপ করে, রক্ত চলাচল দ্রুত হয়।’ লোকেশ যুক্তি দিয়েছিল সরলাকে।

সরলা তা মেনে নিয়ে বলেছিল, ‘তবে দেখ বাপু বাড়িয়ে ফেল না। ও বাড়িতে তোমার মেজদা এক একরাতে বাড়ি ফিরে যা তুলকালাম করে।’

না, ওরকম হবে না। মেজদার ওরকম হয় ডীপ ফ্রাস্ট্রেশন থেকে। ক্ল্যাসিকাল গান শিখতে যেত ওস্তাদের কাছে সেখানে ভাব হয় একজনের সঙ্গে, আমি তাকে দেখেছি। শিক্ষিতা এবং সুন্দরীও। তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল মেজদা। জ্যাঠামশাই না বলে দেয়। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবে, এইসব হুমকি দিয়ে মেজদার তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিল। তারপর থেকে কীরকম যেন হয়ে গেল, গানও ছেড়ে দিল।’

‘সম্পত্তি হারাবার ভয়ে বিয়ে করার সাহস হল না।?’ সরলা তখন শাড়ির আঁচল দাঁতে কামড়ে বুকের সামনে ঝুলিয়ে ব্লাউজ খুলছিল। লোকেশ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছে অনাবৃত কাঁধের দিকে।

‘এখনই শোবে নাকি? দাঁড়াও এইটুকু রয়েছে শেষ করেনি।’

‘যা গরম পড়েছে। ঘাম সারাক্ষণই লেগে রয়েছে।’ সরলা দু-হাত পিঠের দিকে মুচড়ে ব্রেসিয়ার খোলার উদ্যোগ নিল। তারিফের স্বরে লোকেশ বলল, ‘তোমার ওটা না পরলেও চলে, কোনো দরকারই নেই।’

‘হ্যাঁ তাই করি আর তোমার মুখঝামটা খাই। দরকার নেই আমার। জানি তো তোমায়। ব্লাউজের ঝুল কম নিয়ে কীসব খারাপ কথা বললে মনে আছে? তার আগে একদিন বললে, বগলকাটা ব্লাউজ পরলে আমাকে দারুণ দেখাবে। কোনটে যে তোমার মনের কথা এতদিনেও আমি বুঝতে পারলাম না।’

‘রাতে এই সময় একবার পরতে পার।’

‘এই সময়? শোবার আগে একবার পরা?’ সরলা দরজার ছিটকিনি খুলল বাইরে যাবার জন্য।

‘কোথায় যাচ্ছ এখন?’ লোকেশ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল।

‘ভিজে তোয়ালেতে গা মুছব।’

‘দাঁড়াও আমি তোয়ালে ভিজিয়ে আনছি। বারান্দায় কে আছে না আছে, বুক খুলে……’ লোকেশ ব্যস্ত হয়ে বেরোল।

‘এত রাতে বারান্দায় কে আবার থাকবে।’ সরলা বিরক্তি প্রকাশ করেছিল।

ভিজে তোয়ালে নিয়ে ফিরে লোকেশ উত্তর দিয়েছিল ‘আমি ছাড়াও তো এ বাড়িতে পুরুষমানুষ আছে।’

‘তুমি চাঁদুর কথা বলছ?’ সরলা অবাক হয়ে গেছল। লোকেশ একঢোঁকে বাকিটা শেষ করে। জবাব দেয়নি।

রাত বারোটায় শ্রাদ্ধ বাড়ি থেকে ফিরেই লোকেশ আলমারি খুলে বোতল বার করেছিল। মাস দুয়েক আগে বোম্বাইয়ে সেলস সম্পর্কে হায়ার একজিকিউটিভ ট্রেনিংয়ের জন্য গেছল। তখন সেলস ম্যানেজার তাকে একটা জনিওয়াকারের বোতল উপহার দেয়। সেটা এতদিন তুলে রেখেছিল বিশেষ কোনো উপলক্ষে খুলবে বলে।

সরলা ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আজ না খেলেই তো পারতে।’

‘কেন শ্রাদ্ধটাদ্ধ তো চুকে গেছে। বাবাকে তো ঘটা করেই….।’ লোকেশ ছিপির প্যাঁচ কাটার জন্য মুখটা বিকৃত করে মোচড় দিল। কট কট শব্দ হল। একবার সে সরলার মুখের দিকে তাকিয়েই গ্লাসে ঢালল এবং পরিমাণটা বেশিই।

‘বরফ এনে দেব?’

‘থাক।’ লোকেশ কাচের জাগ থেকে গ্লাসে জল ঢেলে চোখের সামনে তুলে ধরল। ‘বিলিতি। আমার উন্নতি হয়েছে বাবা সেটা দেখে গেছেন।’ এই বলেই একচুমুকে গ্লাস শেষ করে সরলার দিকে তাকিয়ে, বাহবার দাবি জানানোর মতো করে হাসল।

গ্লাসে আবার ঢেলে লোকেশ চোখ কুঁচকে বিটুর হাত থেকে হরিণের ছোলা খাওয়ার ছবিটা দেখতে দেখতে বলল, ‘সুন্দর দৃশ্য, ভালোই তুলেছি। এটাকেই তো বাঁচিয়ে রাখতে চাই।

উঠে গিয়ে সে ছবির সামনে দাঁড়াল। গ্লাসটা একবার ছবির কাচে ঠেকিয়ে চুমুক দিল।

‘বিটুকে বিদেশে পাঠাব। না আমেরিকা ফ্যামেরিকা নয়, গাদাগুচ্ছের ওখানে গিয়ে জুটেছে। জাপান পাঠাব।’

লোকেশ বাঁ হাতের তালু মাথায় বোলাল। তবলায় চাঁটি মারার মতো আঙুল দিয়ে বাজাল। সরলা অবাক চোখে শুধু দেখে যাচ্ছে।

‘জীবনে এই দ্বিতীয় বার ন্যাড়া হলুম। খুব ছোটোবেলায়, বিটুর থেকেও ছোটো, খুব ফোড়া হত। বাবা কেষ্ট নাপিতকে দিয়ে কামিয়ে দিয়েছিল। তোমার কখনো ফোড়া হয়েছে মাথায়।’

‘না।’

‘বিটুর হয় না। ওর ধাতটা তোমার মতোই হয়েছে।’ লোকেশ আবার এক চুমুকে গ্লাস শেষ করল। এবার হাতটা একটু কেঁপে উঠল।

‘তুমি বেশি খাচ্ছ।’

‘খাই একটু। আজ স্পেশাল অকেশন তো।’ লোকেশ বোতল থেকে গ্লাসে ঢালল। সরলা গ্লাসে জল ঢেলে দিতে জাগটা তুলল।

‘থাক আমিই ঢালছি। বিটুকে জাপান পাঠাব। ওরা ভালো মেশিন তৈরি করে। জার্মানিও করে কিন্তু আমি জাপানেই পাঠাব। ওদের মেশিন খারাপ হয় না কখনো, নেভার। এই যে রেডিয়ো ওটা জাপানি, টেপ রেকর্ডারটাও জাপানি, টিভি-টার সার্কিট জাপানি নকশা থেকে, ভালো কথা কালার টিভি আসবে আমাদের দেশে। এলে একটা কালার টিভি কিনব তবে এদেশি নয়, জাপানি কালার টিভি। কেন বলতো?’ লোকেশ গ্লাসে জল ঢেলে চুমুক দিল।

সরলা চুপ। তার মনে হচ্ছে লোকেশের এইসব অনর্থক আবোল তাবোল, মনের একটা ভয়ংকর অবস্থা থেকে রেহাই পাবার জন্য। আর সেই ভয়ংকর অবস্থাটা যে কী, সেটা সে আন্দাজ করতে পারছে।

‘জাপানি মেশিন খারাপ হয় না, খারাপ হয় ব্যাড হ্যান্ডলিংয়ের মানুষও খারাপ হয় এই কারণেই। সাহস না থাকলে, ‘সেল্ফ কনফিডেন্স না থাকলে, বিশ্বাস না থাকলে হ্যান্ডল করবে কী করে। তোমার সাহস আছে? আমি যদি আজ মরে যাই পারবে এই পৃথিবীকে ফেস করতে? পারবে? বিটু পারবে?…আমি কিন্তু পারব। আই অ্যাম সেলফ মেইড।’ লোকেশ গ্লাসটা বুকে ঠেকাল।

‘তুমি এতবার মেশিনের কথা বলছ কেন?’

লোকেশ যেন শুনতে পায়নি, পূর্ব কথার জের টেনে সে বলল, ‘আমি খেটেছি, বুদ্ধি খরচ করেছি, ভাগ্যও ফেভার করেছে। একটা ভালো চাকরি করছি। সুন্দরী বউ…না না প্রতিবাদ করো না, তুমি অত্যন্ত অ্যাট্রাকটিভ, আমায় দুনিয়ার পুরুষরা হিংসে করে কেন জান? তোমার সঙ্গে বিছানায় শোয়ার ছাড়পত্র আমার আছে, কিন্তু তাদের নেই বলে। …এ ছাড়া একটিমাত্র ছেলে, সেও দেখতে সুন্দর, স্বাস্থ্যবান, পড়াশুনায় মন আছে। কেমন একটা পারফেক্ট মেশিন আমি বানিয়েছি, সর্বাঙ্গসুন্দর, নিখুঁত। এটা কখনো খারাপ হবে না বলেই আমার ধারণা ছিল।’

লোকেশ খাটে সরলার পাশে বসল। মুখ নীচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে মাথা নাড়তে শুরু করল। সরলা ওর বাহু আঁকড়ে ধরল।

‘এবার শুয়ে পড়ো। সারাদিন ধকল গেছে।’

‘হ্যাঁ গেছে। তাতে কী হয়েছে, আমার অভ্যেস আছে। তুমি বরং শুয়ে পড়ো….একটু খাবে?’ লোকেশ গ্লাসটা সরলার মুখের কাছে ধরল। ‘অনেকেই খায়। ও বাড়ির মেজো বউদিকে রাতে দরজা বন্ধ করে মেজদা খাওয়াত। ছাদ থেকে আমাদের চাকর দেখেছিল খোলা জানালা দিয়ে। সে আমাকে বলেছিল, তখন আমি বিটুর বয়সে।’ বলেই লোকেশ হেসে উঠে সামনে ঝুঁকে পড়ল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়ই সরলা দু-হাতে জড়িয়ে ধরল।

‘এবার শোও, কাল তো সকাল সকাল উঠতে হবে।’

‘ঠিক আছি, আমার কিছু হয়নি। এটা হল স্কচ।’ লোকেশ গ্লাস বাড়িয়ে দিল সরলার মুখের কাছে। ‘খাও।’

ওর চোখ মুখের অবস্থা লক্ষ করে সরলা গ্লাসটা হাতে নিল।

‘সামান্যই তো, খেয়ে নাও। এতে চরিত্র নষ্ট হবে না।’

সরলা এক চুমুকে গ্লাসটা খালি করে তাকিয়ে রইল লোকেশর মুখের দিকে। মুখটা একবার বিকৃত করল মাত্র।

‘ভালো না?’

‘হ্যাঁ। এবার শোও।’

‘তুমি ব্লাউজ খুলবে না?’

‘না।’

‘ইসস একটু দেখতুম।’

‘আজ এসব থাক।’

‘থাকবে। কেন? ন্যাড়া হয়েছি বলে?’ লোকেশ মাথায় হাত বুলিয়ে চাঁটি মারল।’ বাবা ভালো তবলা বাজাত, জ্যাঠামশাই এস্রাজ বাজাত। গানবাজনার চর্চা ছিল দত্তবাড়িতে। এখন কিছুই নেই। এস্রাজ তো কেউই বাজায় না!….ব্লাউজ খুলবে না?’

‘বললুম তো আজ থাক।’

‘কেন থাকবে? সটান দাঁড়িয়ে উঠল লোকেশ। আমাকে অমান্য? কেন আজ থাকবে?’ চাপা গর্জনের মতো কথাগুলো শোনাল।

সরলার মুখ ফ্যাকাসে দেখাল। কথা না বলে সে ঘরের দরজা বন্ধ করতে গেল।

‘দরজা কেন বন্ধ করছ? জানালা বন্ধ করো, ছাদ থেকে রাত্তিরে কে দেখছে তুমি কি তা জান? চাঁদু এখন কোথায় তা কি তুমি জান?…. দরজা বন্ধ করা হচ্ছে, হুঁউ।’

সরলা জানলাগুলো বন্ধ করতে লাগল।

‘মেইনট্যানন্স, হ্যান্ডলিং-এর উপর নির্ভর করে মেশিনের আয়ু। আমার মেশিন খারাপ হতে দেব না। আই মেড ইট, আমার দ্বারা নির্মিত, আমিই ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্বকর্মা। আজ রাত আমি ডেডিকেট করব শিবেন্দ্রলাল দত্তকে, আমার বাবাকে….ডেডিকেট, ডেডিকেশ্যান, মানে জানো? উৎসর্গ, বাবাকে উচ্ছুগ্যো করব, খোলো।’

ধমক দিয়ে ঘোলাটে চোখে লোকেশ তাকিয়ে রয়েছে। সরলা একটা জিনিস এত দিনে বুঝে গেছে, কোনোরকম প্রতিবাদ বা আপত্তি এই সময় করা উচিত নয়। করলে মারাত্মক ফল ফলবে, লোকেশ আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। সে ব্লাউজ খুলল। আঙুল নেড়ে লোকেশ ইসারা করল ব্রেসিয়ারটাও খোলার জন্য।

‘আসলে কি জানো? লোকেশ এগিয়ে এল। টলছে না। কিন্তু কথাগুলো জড়ানো। ‘আমার মেশিনের একটা পার্টসও আমি খারাপ হতে দেব না। আমি ঠিকমতো সবকিছু মেইনটেইন করব। দরকারের সময়ে, প্রাণ নিয়ে টানাটানির সময়ে তুমি যে বলবে মেশিন খারাপ হয়ে গেছে, তা আমি বলতে দোব না। হুঁ-হুঁ বাব্বা, আমি অনেক চালাক, আমি শিবেন্দ্রলাল নই। আমার মেশিন জাপান থেকে তৈরি করে আনবে বিটু। মাই অনলি সান…খুলেছ?’

লোকেশের চোখ দুটো ছোটো হয়ে এসেছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। সরলার দুই কাঁধ ধরে সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে।

‘হাউ আই লুক, কেমন দেখাচ্ছে আমাকে, ন্যাড়া লোকেশকে? তুমি কি জান আমরা কি করেছি?’

‘কিছু করিনি।’

‘বলছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমার মেশিন ঠিক আছে, চলছে, পারফেক্ট?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে বলছ কেন আজকে নয়?’

সরলা চুপ।

‘তাহলে একটা কথা জেনে রাখ, কিছুই থেমে থাকে না, বন্ধ থাকে না। তুমি কি রোজ রাতে বাবাকে শ্রদ্ধা জানাতে ব্রেসিয়ার পরে ঘুমোবে? নিশ্চয় নয়, তাহলে বুঝব মেশিন কাজ করছে না।’ লোকেশের ঘোলাটে দৃষ্টি সরলার মুখে। কিছুই সে দেখতে পারছে না, চোখ বড়ো করে সে প্রাণপণে দেখার চেষ্টা করতে করতে সরলার গালে, কাঁধে এবং বুকে হাত বুলিয়ে বলল, ‘আমার ছাড়পত্র আছে। কিন্তু বাবাকে বাঁচাবার জন্য…শুধু তখনই মেশিন খারাপ হয়ে যায়। আশ্চর্য!’

বলতে বলতে লোকেশ সরলাকে টানতে টানতে নিজেই খাটের উপর গড়িয়ে পড়ল। সরলা তার মুখের উপর ঝুঁকে বলল, ‘এবার শান্ত হও, ঘুমোও।’

‘অবশ্যই, অবশ্যই ঘুমোব। কিন্তু শাস্তি পেতে হবে। ভগবান সব দেখছে, সব জানে। হোম, যজ্ঞি, স্বস্ত্যয়ন, শালা সব বোগাস।’ আচমকা ধড়মড়িয়ে উঠে বসল লোকেশ। সরলা ভয়ে এক পা পিছিয়ে গেল।

‘তুমিও শাস্তি পাবে, ভগবান সব জানে ইউ আর আ কোলাবোরেটর, হাত মিলিয়ে ছিলে।’

‘আমি মেশিন খারাপ হওয়ার কথা বলিনি। এটা তোমার মাথা থেকে বেরিয়ে ছিল।’

‘কিন্তু বারণও তো করেনি। চাঁদু, হারামজাদা চন্দন গড়াই বিশ্বাস করেছে, তুমিও কি করেছিলে? মিথ্যে কথা বোল না, করেছিলে?’

‘না।’

‘তাহলে এসো।’

সরলার কাঁধ ধরে লোকেশ হ্যাঁচকা টান দিল। খাটের উপর সরলা চিৎ হয়ে পড়ে যেতেই পায়ের কাছ থেকে শাড়িটা কোমর পর্যন্ত তুলে লোকেশ হুমড়ি খেয়ে পড়ল বুকের উপর এবং নিথর হয়ে রইল। তার বড়ো করে নেওয়া শ্বাসপ্রশ্বাস এখন স্বাভাবিক হতে শুরু করল।

মিনিট দশেক পর বেহুঁশ লোকেশকে বিছানায় লম্বা করে শুইয়ে দিয়ে সরলা তার পাশে শুল। ভোর রাতে ঘুম না আসা পর্যন্ত সে অনেক কিছু ভাবল এবং অবশেষে একটি ব্যাপারে নিশ্চিত হল, লোকেশ এবং সে ঠিকই আছে। সংসারে অনেক কিছুই ঘটে, সবই সাময়িক, কেউ তা মনে করে রাখে না।

সত্যিই কেউ মনে করে রাখেনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে লোকেশ বলেছিল, ‘ঘুমটা ডীপ হয়েছিল, বেশ ঝরঝরে লাগছে শরীরটা, আর এক কাপ চা খাব।’

সরলা সুখ বোধ করল লোকেশকে প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিক দেখে। এই সুখবোধ নিয়ে তারা কয়েকটা বছর স্বচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে গেল।

বিটু মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম ডিভিশনে পাশ করেছে। ফল বেরোনোর পরের দিনই বিকেলে ছেলেকে নিয়ে তপু হাজির। হাতে বাক্স ভরা সন্দেশ। সরলা তো অবাক আনন্দে শুধু তাকিয়ে রইল।

‘সরলাদি কত বছর পর এলাম বল তো?’

‘বিটু তখন ক-দিনের মাত্র। নার্সিং হোম থেকে সবে ফিরেছি, আমার মা তখন এখানে। সতেরো বছর, না না বিটুর এখন ষোলো হয়ে তিন মাস। এইটি তোর ছেলে? বয়স কত, নাম কী? ভারি মিষ্টি মুখখানি তো!’ সরলা ছেলেটিকে কোলে টেনে নিয়ে চুম্বন দিল।

‘ওর নাম প্রতাপাদিত্য রায়, ডাক নাম তাপা, তপুর সঙ্গে মিলিয়েই। বয়স ছয়।’

‘চোখ দুটো ঠিক তোর মতোই হয়েছে।’ বলেই সরলা তাকাল তপুর চোখের দিকে এবং তখনই খেয়াল করল তপুর সিঁথেয় সিঁদুর নেই।

সরলার মুখভাব বদলাতেই তপু বলল, ‘তারপর দু-বছর বয়সে ওর বাবা মারা গেছে। অফিস থেকে স্কুটারে বাড়ি ফিরছিল। কালকাজির কাছে একটা সার্কেল ঘোরার সময় মোটরে ধাক্কা লাগে। হাসপাতালে তিন দিন কোমায় থেকে মারা যায়।’

তপু খুব সহজ গলায়, যেন অন্য কারোর বৈধব্যের খবর জানাল। চোখমুখে শোক বা বিষণ্ণতার কোনো স্পর্শ নেই। সরলা ফাঁপরে পড়ল। সে নিজে কত বেদনাহত হবে তপুকে দেখে আন্দাজ করতে পারছে না, তপু সেটা লক্ষ করল।

‘সরলাদি, চার বছর হয়ে গেছে। শোক তাপ যা করার এত দিনে করে ফেলেছি। এখন সামনের দিকে তাকিয়ে আমায় চলতে হবে। দিল্লি বরাবরের জন্য ছেড়ে চলে এসেছি।’

‘য়্যাঁ! তোর শ্বশুরবাড়ি তো ওখানেই, ছেড়ে দিয়ে কোথায় এলি?’

‘মেয়েরা যেখানে যায়, বাপের বাড়ি। আমার ক্ষেত্রে দাদার বাড়ি, বাঁশবেড়ে।’ ‘সেখানে তো ভাজ-এর সঙ্গে তোর বনিবনা হত না।’

‘মনে আছে তোমার? হ্যাঁ হয়নি, এখনও হয় না। তবে টাকা দিয়ে থাকি তো! আসলে অন্য কোথাও ঘর নিয়ে থাকার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তাপাটা এত ছোটো, আলাদা কোথাও থাকতে ভরসা হয় না। সারাদিন একটা ওইটুকু ছেলে একা থাকবে।’

‘তাহলে সারাদিন তুই কী করিস?’

‘চাকরি, অ্যাসোসিয়েটেড ব্যাঙ্কে।’

তাপা ইতিমধ্যে গুটি গুটি বারান্দায় চলে গেছে। রাবারের বল দিয়ে ফুটবল খেলা হচ্ছে রাস্তায়। তপু বারান্দায় গিয়ে তাকে বারণ করে এল না-ঝুঁকতে।

‘বউদি চা করে আনব?’ দরজার কাছ থেকে চাঁদু বলল।

তপু অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘এই তোমার সেই চাঁদু না? ওরে বাবা, কত বড়ো হয়ে গেছে গো! রীতিমতো একজন ম্যান…জেনটেলম্যান! প্রথম দিন আমাকে বলেছিল বউদি বিশ্রাম করছেন,’ তপু হেসে উঠল শব্দ করে। ‘এখনও ওইভাবে কথা বলে?’

চাঁদু চোখ নামিয়ে লাজুক হাসল। সরলা বলল, ‘বলে না আবার! ওর দাদা যতক্ষণ বাড়ির বাইরে ততক্ষণ ওর কত্তামি চলে বাড়ির সবার ওপর।’

‘চা আনব?’ চাঁদু সন্দেশের বাক্সটার দিকে তাকাল। ‘ওটা ফ্রিজে তুলে রাখি?’

‘তপুর ছেলেকে দে, তপুকেও দে।’

‘না না আমায় নয়, মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি, দেখছ না কীরকম মোটা হয়ে গেছি।’

এবার সরলা ভালো করে লক্ষ করল তপুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। একটু ভারী হয়েছে। ঘাড়ে আর গলায় সামান্য চর্বি, কোমরটাও আর পাতলা নয়। অমলার বন্ধুর কতই বা বয়স হবে, তার থেকে তিন-চার বছরের হয়তো ছোটো। হালকা লিপস্টিকটাই যা বেমানান মনে হচ্ছে যেহেতু তপু বিধবা। এটা ওর উচিত হয়নি। কিন্তু ওর সারা অবয়বে, বিশেষ করে দুটি চোখে কেমন একটা ছেলেমানুষি চাপল্য, ছটফট করে চলেছে যেটা ওর সাদামাটা রূপের উপর আলাদা একটা সৌন্দর্যের প্রলেপ দিয়েছে। বয়সটাও যেন তার ফলে কম কম দেখাচ্ছে। ঝরঝরে, সহজ, ন্যাকামো বর্জিত কথাবার্তা, যার মধ্যে দিয়ে ওর নিজের উপর ভরসা আর বুদ্ধি ফুটে বেরিয়ে আসে, এটাই বোধহয় ওর ব্যক্তিত্ব যা প্রবলভাবে পুরুষদের টানে। সরলার মনে হল, টানবার এই ধরনের ক্ষমতা তার মধ্যে নেই।

‘তুই মোটা হয়ে গেছিস কি রে? কি চমৎকার ফিগার তোর, দেখলে…।’

‘থাক, থাক সরলাদি থাক, আর আমাকে গাছে চড়িয়ো না। তোমার পাশে আমি? কত হল তোমার চল্লিশ ছুঁয়েছে? শেষ যা দেখেছি তার থেকেও সুন্দরী হয়েছে।’

‘তপু বাজে কথা বন্ধ কর তো।’ আপ্লুত সরলার মুখ পুলকে ভেসে গেল।

‘দেখ বাপু, আমি পুরুষ হলে তবু ধরে নেওয়া যেত তোমাকে পটাবার জন্য বলছি কিন্তু একটা মেয়ে যখন আর একটা মেয়ের রূপের প্রশংসা করে, তখন কত জ্বালা কত ঈর্ষা দমিয়ে রেখে যে তা করে সেটা কি তুমি জেনেছ কখনো?’

শিবেন্দ্রলালের ঘরটা দেয়াল তুলে দুটি ঘর হয়েছে। একটি বিটুর শোবার, অন্যটি একাধারে বসার ও খাবার ঘর। এখানেই রয়েছে কালার টিভি সেটটা আর দর্শকদের জন্য সোফা।

‘ডাইনিংয়ে চা দিয়েছি, আপানারা আসুন।’ চাঁদু কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে ঘোষণা করল।

‘চল, খাবার ঘরে যাই।’ সরলা কনুই ধরে তপুকে নিয়ে এল।

টেবলে টি পট, পেয়ালা ইত্যাদি সাজিয়ে রাখা এবং প্লেটে শিঙাড়া ও রাজভোগ। তপু ধরে নিয়েছিল তার আনা সন্দেশই তাকে দেওয়া হবে। চাঁদু নিজেই এটা করেছে।

‘আপনার ছেলেকে আমি বারান্দাতেই দিয়ে আসছি।’ চাঁদু আর একটা প্লেট নিয়ে বেরিয়ে গেল।

‘তুমি খুব ভাগ্যবতী সরলাদি তাই এমন একজন গৃহিণী পেয়েছে। কতদিন হল রয়েছে?’

‘আমার বিয়ের আগে থেকেই তো রয়েছে! তিন কুলে কেউ নেই, যাবেই বা কোথায়! লেখাপড়া একটু আধটু আমিই ধরেকরে শিখিয়েছি। চেহারাটা ভালো, বাইরের লোকজনের সামনে বার করা যায় নইলে বুদ্ধিশুদ্ধিতে গবেট। যাকগে এসব, তোর ব্যাঙ্কটা কোথায়, কতদিন চাকরি কচ্ছিস?’

‘আমার ব্যাঙ্ক কাঁকুড়গাছিতে। দিল্লির রাজিন্দর নগর ব্রাঞ্চ থেকে সোজা বদলি হয়ে এখানে এসেছি। ও মারা যেতে ব্যাঙ্ক আমায় চাকরি দিল। অবশ্য চাকরি আমিই চেয়েছিলাম। তোমায় বহুদিন আগে লিখেছিলাম, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আমার মতের বা মনের মিল হচ্ছিল না। চাকরি নেওয়ায় ওদের সবারই আপত্তি ছিল কিন্তু জোর করেই আমি নিই। এর পর নানানভাবে শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর মিলে আমার পিছনে লেগে এমন অসুবিধা সৃষ্টি করতে লাগল যে মাথা ঠিক রাখা শক্ত হয়ে পড়ল। ঝগড়াঝাঁটি শুরু হল। বাড়ির বউ তাও কিনা আবার বিধবা বউ, চাকরি করলে ওদের নাকি মানমর্যাদা ধুলোয় গড়াগড়ি দেবে। আমি বললাম, দেয় তো দেবে! অসহ্য হয়ে উঠতে শেষকালে জানালাম এখানে আর থাকব না, দাদার কাছে চলে যাব। ওরা রাজি হল তবে শর্ত দিল, একটা জিনিসও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না, এমন কী বিয়ের গহনাগুলোও নয়। আমি তাতেই রাজি হয়ে গেলাম।’

‘গয়না তো দশ ভরির, ছেড়ে দিয়ে এলি!’ সরলা বিশ্বাস করতে পারছে না তপু এমন বোকার মতো কাজটা কেন করল!

‘ওরা বলল তপাকে যদি নিয়ে যেতে চাও তাহলে গহনা পাবে না। কাজেই সোনা ফেলে দিয়েই চলে এলাম। অবশ্য চলে আসাটা বলার মতো এত সহজ ছিল না। দিল্লি থেকে বদলি হতে পেরেছি বলেই আসা হল। অ্যাসোসিয়েশনের দিল্লি ইউনিটের সেক্রেটারি ভদ্রলোক আমার জন্য তদবির লেখালেখি করে এটা করিয়েছেন। প্রথমে এক বছর ছিলাম দমদম নাগেরবাজারে । কী কষ্ট করে যে বাঁশবেড়ে-নাগেরবাজার দুবেলা করতে হত, কী বলব, তোমায়।’ কথা বলতে বলতে তপু শিঙাড়া ভেঙে ভেঙে খেয়ে যাচ্ছিল। সরলা লক্ষ রেখেছিল প্লেটে।

‘রাজভোগ দুটো শেষ করবি কিন্তু। একদিন খেলে মোটা হয়ে যাবি না। …তাহলে তো তোর উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে।’

‘নাগেরবাজার ব্রাঞ্চে এক নতুন অফিসার, সোমনাথ কয়াল, অনেক চেষ্টাচরিত্র করে বাঁশবেড়ের দিকে একটু ঠেলে দিতে পেরেছে, তাতে মিনিট কুড়ি সময় কমেছে। তবে আমি কাঁকুড়গাছির দিকে যদি ফ্ল্যাট পাই এখুনি চলে আসব। তপার লেখাপড়ার দিকটা আগে দেখতে হবে তো!’ তপু আস্ত রাজভোগ মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বলল, ‘সত্যনারায়ণের?’

‘হ্যাঁ।’

‘মনে আছে সরলাদি তোমার কাছে নীচের ঘরটা ভাড়া চেয়েছিলাম? দেখো আজও ঘর খুঁজে যাচ্ছি!’ তপুর মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল।

‘দালাল লাগা পেয়ে যাবি।’

‘সোমনাথকে একজন একটা ফ্ল্যাটের সন্ধান দিয়েছে, ব্যাঙ্কের কাছাকাছি সেটাই এখন দেখতে যাব। ও মানিকতলার মোড়ে অপেক্ষা করে থাকবে ছ-টার সময়।’ তপু ঘড়ি দেখল।

সরলার কানে ‘সোমনাথ’ নামটা খট করে বাজল। আগের ব্রাঞ্চের অফিসার চেষ্টাচরিত্র করে বদলিতে সাহায্য করেছে, ল্যাটা তো ওখানেই চুকে গেল। এরপর ঘর দেখে দেওয়াতেও উৎসাহ কেন? এত আঠা কীসের?

‘কত ভাড়া, কিছু বলেছে?’

‘দেড় হাজার। সেলামি নেবে না। দু-খানা ডাইনিং স্পেস, বারান্দা। চারতলায়।’ ঝরঝর করে তপু বলে গেল ফর্দ পড়ার মতো স্বাভাবিক স্বরে।

‘দেড় হাজার! অ্যাতো টাকা! কত মাইনে পাস যে অ্যাতো ভাড়া দিবি?’ সরলা চমৎকৃত হল।

‘একার টাকা হলে পারতাম না, দুজনের টাকায় পারব।’

‘দুজন! আর একজন কে?’ সরলার কাছে অন্য জনটি এখন আন্দাজের আওতায় আসছে। সে রোমাঞ্চ বোধ করল।

‘সোমনাথ।’ তপুর চোখ উজ্জ্বল হয়েছে। চেয়ারে নড়ে বসে সে মিটমিট হাসল। সরলা নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত দেখাবার চেষ্টা করল।

‘তোরা বিয়ে করবি?’

‘হহুঁউ। …জানি এবার কী বলবে। ওদের দেশ ক্যানিংয়ের কাছে তালদিতে। সেখানে বাবা মা ভাই বোন সবাই আছে। বিধবা বিয়েতে তাদের ঘোরতর আপত্তি তো বটেই, এক পয়সা পাওনা থোওনাও হবে না এটাই ওদের মাথা খারাপ করে দিয়েছে আমার দাদারও প্রচণ্ড আপত্তি সোমনাথ নীচু জাত বলে। তা ছাড়া বিধবা বোন প্রেমট্রেম করাতেও তিনি লজ্জিত। অতএব আমরা নিজেরাই ঠিক করলাম,’ তপু সুর করে গেয়ে উঠল, ‘একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে।’

‘সোমনাথ দেখতে শুনতে কেমন, শিক্ষাদীক্ষা বয়স, কালচার? তোর সঙ্গে মিলবে?’

‘বয়স আমার সমান, দু মাসের ছোটোই। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন আর সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়েছে, কথায় মাঝে মাঝে দোখনো টান বেরিয়ে পড়ে, ওকে ভ্যাঙাতে গিয়ে আমার কথাতেও টানটোন এসে যাচ্ছে। এ ছাড়া, দেখতে শুনতেই খুবই সাধারণ, তোমার চাঁদুকে ওর পাশে উত্তমকুমার মনে হবে।’

‘তাপাকে নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না?’

‘বিন্দুমাত্র না। তাপার নিজের বাবাকে প্রায় ভুলেই গেছে আর সোমনাথের সঙ্গে ভালোই বন্ধুত্ব হয়েছে। দুজনে দুজনকে পছন্দও করে খুব।’

‘সোমনাথ নিজের সন্তান তো চাইতে পারে!’ সরলা উদবিগ্ন চোখে তাকাল।’ ‘তুই লাইগেশন করিয়ে নিয়েছিস?’

‘না। আর চাইতে পারে বলছ কি? আমি বলেছি…’তপু বাঁ হাতের তর্জনীটা উঁচিয়ে ধরল। ‘এর বেশি নয়। ও বলেছে…’ তপু তিনটি আঙুল ওঠাল।

সরলা থ হয়ে রইল। তার আজন্ম পোষিত বোধ থেকে সে তপুকে বুঝে উঠতে পারছে না। এটা ওর সাহসের না বেহায়াপনার, প্রশংসার না নিন্দার কোন ধরনের কাজ, সেটা তার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। গল্প-উপন্যাসে কী সিনেমায় এই ধরনের ব্যাপার সে পেয়েছে। যাহোক একটা গোঁজামিল দিয়ে সমস্যা মেটানো হয়। কিন্তু সত্যিসত্যিই, চেনাজানা একটা মেয়ে যে এমন ব্যাপার ঘটাবে, তার সামনে বসে অনায়াস স্বচ্ছন্দে বলে যাবে, এতটা সে ভাবতে পারছে না।

‘তোরা এই নিয়ে আলোচনা করেছিস তাহলে।’

‘নিশ্চয়।’

সরলার মনে পড়ল দেশবন্ধু পার্কে লোকেশের সঙ্গে পরিচয় হবার জন্য গেছল। মলিই কথাটা তুলেছিল, ‘আপনি ক-টা ছেলেমেয়ের বাবা হতে চান?’ লোকেশ সরাসরি স্পষ্ট কোনো জবাব দেয়নি, হালকা চালে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছল।

ধুপধাপ সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল।

‘মা, মা-‘ বলতে বলতে ঢুকল লম্বা চওড়া দেহের এক কিশোর, চোখে চশমা। তপুকে দেখে থমকে সরলার দিকে তাকাল।

‘আমার ছেলে বিটু। এবার মাধ্যমিক পাশ করল, ফার্স্ট ডিভিসনে। তোর মাসি হয়, তপু মাসি।’

বিটু হাত তুলে নমস্কার করল, তপুও তাই করল। পলকের জন্য সরলার মুখ নিষ্প্রভ দেখাল। ‘তপু দিল্লিতে থাকত, এখন কলকাতায়, ব্যাঙ্কে চাকরি করে। ওর ছেলে তাপা…দ্যাখ তো বারান্দায় ঝুঁকছে কি না?’

‘ঝোঁকেনি, আমি নজর রেখেছি।’ ঘরের বাইরে থেকে চাঁদুর গলা শোনা গেল।

‘মা, রাজেশ, বাপ্পা, শান্ত সব মোটরে ওয়েট করছে, ট্যাংরায় চায়নাটাউনে খেতে যাব। চট করে, একটু বাইরে এসো বলছি।’ বিটু দ্রুত ব্যস্ত গলায় বলল।

‘তপু সামনেই বল না, টাকা চাই তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘কত?’

‘একশো দাও। চাঁদা করে বিল দেব।’

‘এই সেদিন পঞ্চাশ দিলুম, পরশুই তো, আজ আবার…’ বিটু গলা জড়িয়ে ধরায় কথা অসমাপ্ত রেখে তপুর দিকে তাকিয়ে সরলা অত্যন্ত সুখের হাসি হাসল।

‘সরলাদি আমি এবার উঠি। ছ-টার সময় সোমনাথ অপেক্ষা করবে।’

‘আবার কবে আসবি? দাঁড়া একটু, টাকাটা দিয়ে দি। ছেলে তো নয়, কাবলিওলা!’

টাকা নিয়ে বিটু ছুটে নীচে নেমে গেল। তপু বলল, ‘দেখে কে বলবে বয়স ষোলো-সতেরো! আমি তো ভেবেছিলাম তোমার দাদাটাদা হবে। এই বয়সি এমন বড়ো চেহারার ছেলে আরও কয়েকজন চোখে পড়েছে। জেনারেশনটার গ্রোথ খুব ভাল হয়েছে।’

‘সব জেনারেশনেরই গ্রোথ ভালো যদি বাবা দু-বেলা দুধ-মাখন, মাছ-মাংস খাওয়ায়। ছেলের স্বাস্থ্য আর ফিগার ঠিক রাখার জন্য তোর জামাইবাবু যা করে!’

‘শুধু ছেলের জন্যই? বউয়ের বয়স তো আঠারো বছর ধরে একই জায়গায় তিনি দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। আমি এবার, তাপা এসো।’

সিঁড়ি দিয়ে ছেলের হাত ধরে নামতে নামতে তপু দাঁড়াল। ‘সরলাদি আমাদের বিয়েতে তুমি উইটনেস হবে? আত্মীয়স্বজন তো কেউ আসবে না, তুমি এলে বলতে পারব দিদি এসেছে।’

সরলা প্রস্তাবটা শুনেই কুঁকড়ে গেছল। ‘দিদি এসেছে’ কথাটা হৃদয়ের অনেক ভিতরে ঢুকে মৃদু একটা বিস্ফোরণ ঘটাল।

‘কবে বিয়ে তোদের?’

‘এই মাসে নোটিস দেব, সামনের মাসেই ঠিক করেছি।’

‘বলিস।’ সরলা হাত রাখল তপুর কাঁধে।

সন্ধ্যাবেলায় খাবার ঘরে সোফায় হেলান দিয়ে সরলা টিভি-তে বাংলা সিরিয়াল দেখছিল। খাওয়ার টেবলের চেয়ারে বসে চাঁদু। অফিস থেকে ফিরে পায়ের শব্দ না-করে লোকেশ দোতলায় উঠে খাবার ঘরের দরজায় দাঁড়াল।

তাকে দেখেই চাঁদু চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। সরলা সোজা হয়ে বসে বুকের কাপড় ঠিক করে বলল, ‘এইমাত্র শুরু হল, দেখবে নাকি?’

‘না। চা দাও।’ লোকেশ শোবার ঘরের দিকে গেল। সরলা তাকে অনুসরণ করল।

‘চাঁদুকে চেয়ারে বসার পারমিশন কে দিয়েছে? ওকে চেয়ারে পাশে বসিয়ে, গা এলিয়ে তুমি টিভি দেখছ?’ লোকেশ বিরক্তি এবং ক্ষোভ জানাতে হাতের অ্যাটাচি কেসটা বিছানায় ছুড়ে বারান্দার পর্দার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কোঁচকাল। ‘পই পই বলি পর্দাটা ঠিক করে টেনে রাখবে, সামনের বাড়ির রাসকেলটা তো হাঁ করে ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকে।’

সরলা কথা বলল না। এই ধরনের কথায় সে অভ্যস্ত। প্রতিদিনই লোকেশ অফিস থেকে ফিরেই কিছু না কিছু ত্রুটি বার করে ধমকধামক শুরু করবে। সরলা পর্দাটা টেনে দিয়ে বলল, ‘আমি তো খাবার ঘরে, তাহলে এ ঘরের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ ব্যথা করবে, এমন বোকা কেউ নেই।’

‘আছে কি নেই, তুমি আর কি জান?’ লোকেশ মুখ নীচু করে জুতোর ফিতে খুলছে। তাকাল না সরলার দিকে। ‘চান করেই আমি বেরোব, ভটচাযের কাছে যাব, ওকে নিয়ে যাব হোটেল হিন্দুস্থানে। আমাদের এক ডিরেক্টর এসেছে।’

‘খেয়ে ফিরবে?’

‘বলতে পারছি না।…হয়তো খেয়েই ফিরব।’

লোকেশ পাজামা পরে খাটে বসেছে, চা দিয়ে চাঁদু বেরিয়ে গেল। তখন সরলা বলল, ‘আজ কে এসেছিল জান?….সেই তপু। মনে আছে ওকে। সেই যে আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছল, তারপর বাঁশবেড়েতে চলে গেল।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওর তো দিল্লিতে বিয়ে হয়েছিল। একটা চিঠি লিখেছিল, শ্বশুরবাড়ি নাকি খুব কনজারভেটিভ,…মেয়েদের এই এক বাঁধাবুলি, শ্বশুরবাড়ির লোকেরা পাজি, বদমাস, হুটহাট বেরোতে দেয় না, ঘরের কাজকর্ম করতে বলে, ঝিয়ের মতো খাটায়।’

‘কথাটা অনেকটাই তো সত্যি, এই তো পাশের বাড়ির রঞ্জনাকেই তো দেখছি।’

‘থাক ওর কথা আর বোল না। আমরা এখন যে কথা বলছি, তুমি কাল ওকে জিজ্ঞেস কোরো, দাঁড়ি কমা সমেত সব তোমায় বলে দেবে।’ লোকেশ হাসল। কয়েক বছর হল তার হাসি কমে এসেছে, যেমন চাঁদি থেকে চুল ঝরে টাক জেগে উঠছে। ‘মনে পড়ে, বাবার শ্রাদ্ধের পর রাতে মদ খেয়েছিলাম। সেই অত রাতে বারান্দায় কানখাড়া করে উনি সব শুনেছিলেন। ওর হাজব্যান্ডটাও তেমনি…।’

‘তপুর স্বামী মারা গেছে, ও বিধবা হয়ে ছেলেকে নিয়ে চলে এসেছে।’ সরলা নীচু স্বরে বলল।

লোকেশ অপ্রতিভ, হতভম্ব। ‘স্যাড, ভেরি স্যাড। কী হয়েছিল?’

সরলা যা যা শুনেছে তপুর কাছ থেকে সবই বলল। কলকাতায় থাকার জন্য ফ্ল্যাট খুঁজছে কিন্তু কেন খুঁজছে, তার পুরো কারণটা বলল না। তার মনে হল তপুর আবার বিয়ে করার ব্যাপারটা এখন না বলাই ভালো।

স্নান করতে যাওয়ার সময় লোকেশ আলগাভাবে বলল, ‘বয়স তো বেশি নয়, পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ, মেয়েদের এই বয়সটায় অ্যাট্রাকটিভ দেখায়, ওকে একটু সাবধানে থাকতে বোলো।

ক-দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য ধরে আবার শুরু হয় বিকেলে। রাস্তার দিকের বারান্দায় রেলিংয়ে ভিজে তোয়ালেটা মেলে দিয়ে সরলা দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক বাসনওয়ালি স্টিলের বাসনের ঝুড়ি মাথায় আর পুরোনো কাপড়ের পোঁটলা পিঠে নিয়ে হাঁক দিতে দিতে এগিয়ে আসছিল, সতেরো নম্বর বাড়ি থেকে কেউ ডাকায় সে থেমে পড়েছে। পুরোনো শাড়ি, জামা প্যান্ট কিছু জমেছে যদি একটা বড়ো ঢাকনাওলা বাটি পাওয়া যায়, এই আশা নিয়ে সরলা দাঁড়িয়ে।

‘ওম্মা, সকাল থেকে দুবার আমি বারান্দায় ঘুরে গেছি!’ রঞ্জনার কথা শুনে সরলা ফিরে তাকাল।

‘কেন?’

‘কেন কি রে, আজকের কাগজ দেখিসনি?’

”না, দুপুরে খাওয়ার পর দেখি।’

‘দেখ, দেখ, তাড়াতাড়ি দেখ, একটা কি অদ্ভুত রকমের খবর বেরিয়েছে।’

‘কী খবর!’ সরলা অবাক হল এবং অস্বস্তি বোধ করল। বাড়িতে ইংরিজি কাগজ নেওয়া হয় কিন্তু ভাষাটা সে ভালো করে বুঝতে পারে না বলে ছবিটবি দেখে রেখে দেয়। তার দু-বছর বি এ পড়ার বিদ্যা দিয়ে খবরের কাগজের ইংরাজি থেকে অর্থোদ্ধারের কাজ যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সে কষ্ট করতে অনিচ্ছুক কেননা দুনিয়ার খবর না জেনেও সে সুখেই আছে।

‘সরলা দত্ত নামে একটা বউ খুন হয়েছে।”

শোনামাত্র সরলার বুকটা হিম হয়ে গেল। অর্থহীন একটা হাসি সে হাসল।

‘আমার নামে? অদ্ভুত তো?’

‘কাগজটা দেখ, খুব বড়ো বড়ো করে আমাদের কাগজে হেডিং দিয়েছে। আমি তো ভেবেছি তুই পড়েছিস। আর শুধু কি নামেরই মিল, আরও অনেক মিল আছে!’

সরলা প্রায় ছুটে ঘরের মধ্যে এসে খবরের কাগজ খুলল খুনের ইংরিজি মার্ডার। সে বড়ো বড়ো হেডিংয়ে ‘মার্ডার’ শব্দটা খুঁজল। পাতার পর পাতা উলটে, তন্নতন্ন করে সে খুনের খবর পেল মাত্র দুটি। পড়ে বুঝল একজন গুন্ডা তার আগের দলের হাতে ছুরি খেয়ে মরেছে আর গ্রামে জমিজমা নিয়ে বাবাদে ভাইপোর হাতে কাকার মুণ্ডু ধড় থেকে খসেছে। কোথায় সরলা দত্তের নামের বউ?

খবরটা খুঁজে না পেয়ে সরলার কৌতূহল বেড়ে গেল। সে বারান্দায় এসে ঝুঁকে রঞ্জনাদের ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে ওর ছোটো মেয়েটিকে দেখতে পেল। ‘এই গোবি তোর মাকে একবার ডাক তো।’

কিছুক্ষণ পর রঞ্জনা এল।

‘তোদের কাগজটা দে, আমাদের ইংরিজি কাগজে খবরটা নেই।’

‘আমাদের কাগজ এখন ভাসুরের ঘরে, ওর পড়া না হলে এখন দিতে পারব না।’

‘কি লিখেছে কি? কি মিল আছে।’

মিল মানে সরলা দত্ত নাম, বয়স চল্লিশ, দেখতে সুন্দরী, একমাত্র ছেলে উচ্চচ মাধ্যমিক পড়ছে, বাড়িটা আমাদের এই শ্যামপুকুর থানার এলাকাতেই আর…’

রঞ্জনা থেমে গেল। পিছনে ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে, বারান্দায় ঝুঁকে, উত্তেজিত নীচু গলায় বলল, ‘খুন করেছে বাড়ির চাকর, দুপুরে গলা টিপে মেরেছে।’

রঞ্জনার চোখেমুখে, বলার ভঙ্গিতে কী যেন একটা ইঙ্গিত সরলা দেখতে পেল। তার মাথা মুহূর্তের জন্য ঘুরে উঠল।

‘শোবার ঘরে বিছানায়, সায়া ছাড়া গায়ে একটুকরো কাপড়ও ছিল না। ধস্তাধস্তির মতো চিহ্ন অবশ্য বিছানায় ছিল তবে সেটা কিসের ধস্তাধস্তি, কে জানে!’ রঞ্জনা এক চোখ টিপে ঠোঁট ওলটাল। ভ্রু তুলল। আর একবার পিছন ফিরে সন্তর্পণে ঘরের দিকে তাকিয়ে নিল। আরও ঝুঁকে ফিসফিস করল, ‘ছোকরা জোয়ান চাকর!’

‘সকালে উনি কাগজ পড়তে পড়তে আমাকে ডাকলেন। ছেলেমেয়েদের সরিয়ে দিয়ে বললেন, এই দ্যাখো। আমার তো পড়েই হাত পা পেটে সিঁধিয়ে গেল। উত্তর কলকাতা, শ্যামপুকুর থানার অধীন, এক ছেলের মা, বয়সটাও মিলছে, দুপুরে একা আর বাড়িতে শুধু চাকর! খুন করেছে যে সেও পুরোনো চাকর তবে ছ-বছরের পুরোনো। উনি ঠাট্টা করে বললেন, এত মিল তার ওপর নামটাও একই, দ্যাখোতো একবার উঁকি দিয়ে উনি বেঁচেটেচে আছেন কি না। আমি বললুম, পাশের বাড়িতে দুপুরে এমন কাণ্ড ঘটলে পুলিশ আসবে, পাড়ায় জানাজানি হয়ে লোক জমে যাবে। সে সব কিছুই হয়নি! তা ছাড়া বিকেলে আমি চাঁদুকে দেখেছি লন্ড্রি থেকে কাপড় নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে!’

‘কাগজটা পড়া হলে আমায় একবার দিবি।’

সরলার এখন একমুহূর্তও রঞ্জনার সামনে থাকতে ইচ্ছা করছে না। সে জিনিস কেউ কখনো ভাবে না, অনুমানও করবে না, সেই সব কথাই ও বলবে বা মাথায় ঢুকিয়ে দেবে।

ঘরে এসে সে খাটে শুয়ে পড়ল। মাথার মধ্যে একটা নাগরদোলা ঘুরতে শুরু করেছে। নানান মুখ, তাদের অভিব্যক্তি, তাদের কথাবার্তা ঘুরতে ঘুরতে উঠছে আর নামছে। কাগজের এই খবর লোকেশ পড়বে, বিটু পড়বে, পাড়ার লোকেরা বিশেষ করে পাশের জ্যাঠার বাড়ির লোকেরা পড়বে। বাবা মারা না গেলে নিশ্চয় পড়তেন। দাদা-বউদিরা, মা, দিদি, জামাইবাবুরা এমনকী তপুও পড়বে।

সে বেঁচে আছে জেনে সবাই হাঁফ ছাড়বে ঠিকই কিন্তু কীসের একটা নোংরা সম্ভাবনা সবার মনের মধ্যে বোধহয় এবার পাঁচড়া তৈরি করে দিয়ে গেল, আরাম পাবার জন্য যেটা অনেকেই মাঝে মাঝে চুলকোবে। অনেক দিন পর্যন্ত সবাই এটা নিয়ে গল্প করবে, এই আশ্চর্য মিল-এর কথার সঙ্গে সঙ্গে নোংরা একটা ছবি তাকে নিয়ে পলকের জন্য হলেও আঁকা হবে। ভাগ্য, একেই বলে ভাগ্য। সরলা বালিশে মুখ চেপে ধরল।

‘ভাত দিয়েছি, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’ দরজায় দাঁড়িয়ে চাঁদু। সরলা জবাব দিল না। একটু পরেই ফোন বেজে উঠল।

রিসিভার তুলে ‘হ্যালো’ বলতেই লোকেশ ওধার থেকে বলল, ‘আজকের কাগজে একটা খুনের খবর বেরিয়েছে, দেখেছ নাকি?’

সরলার গলা শুকিয়ে গেল। কোনোক্রমে বলল, ‘না তো।’

‘আমিও জানতুম না, ভট্টাচার্য আমায় দেখাল।’

থেকে কয়েক সেকেন্ড পর লোকেশ বলল, ‘চাঁদু কী করছে?’

‘বলতে পারব না, আমি শুয়ে ছিলুম। মাথাটা ভীষণ ধরেছে।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

ফোন রাখার পর সরলা ইতস্তত করল। লোকেশ জানতে চাইল চাঁদু কী করছে এবং কেন জানতে চাইল সেটা সে বুঝতে পেরেছে। ঘরের জানলা থেকে জ্যাঠামশাইদের ছাদ দেখা যায়। সে মুখ তুলে তাকাতেই বড়দার মেয়ে অমিতা সরে গেল পাঁচিলের ধার থেকে। মেয়েটা আগে কখনো এই বাড়ির দিকে এইভাবে তাকিয়ে থেকেছে বলে তার মনে পড়ে না।

‘সরলা, অ্যাই সরলা।’

রঞ্জনা বারান্দা থেকে ডাকছে। সরলা দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ‘এই নে, আধঘণ্টা পরে নেব। শাশুড়ি পড়বে।’

কাগজটা হাতে নিয়েই সরলার মনে হল একটা কেউটে সাপ সে যেন ধরল। কাগজটা ভাঁজ করে খবরটা সাজিয়েই রাখা, খোঁজাখুজি করে বার করার আর দরকার হবে না। ভয়ে ভয়ে সে হেডিংয়ে চোখ রাখল।

উত্তর কলকাতায় গৃহবধূকে খুন করে ধর্ষণ, গৃহভৃত্য পলাতক

স্টাফ রিপোর্টারের লেখাটি নাটকীয় ভঙ্গিতে শুরু হয়েছে : ‘প্রায় বিবস্ত্র সরলা দত্তর নিষ্প্রাণ দেহটিকে শোবার ঘরের বিছানায় প্রথম দেখতে পায় তার একমাত্র পুত্র উচ্চচ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণির ছাত্র পরিমল। স্কুল থেকে ছুটির পর বাড়ি ফিরে খোলা সদর দরজা দিয়ে সে দোতলায় উঠে আসে। ভৃত্য বলাইকে দেখতে না পেয়ে সে নাম ধরে ডাকাডাকি করে, খাবার টেবিলে ঢেকে রাখা খাবার খেতে বসে যায়। খাওয়ার পর সে নিজের ঘরে যায়। তারপর সে মায়ের শোবার ঘরে গিয়ে দেখে বিছানায় তার মা সরলা চিৎ হয়ে শুয়ে, দেহে শুধুমাত্র সায়া ছাড়া আর কোনো আবরণ নেই। মৃতার কানের পাশে রক্ত শুকিয়ে রয়েছে। সম্ভবত ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। মাকে এই অবস্থায় দেখে কিশোর পুত্র বিমূঢ় হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি সে মেঝেয় পড়ে থাকা শাড়িটা দিয়ে মা-র দেহ ঢেকে দেয়।’

সরলা চোখ বন্ধ করে ফেলল। কল্পনাতেও সে নিজেকে এইরকম অবস্থায় ভাবতে পারবে না। কিন্তু সে ভাবতে না পারলেও অন্যরা তো পারবে। শুধু সায়া পরিয়ে তাকে মুহূর্তের জন্যও একবার দেখার চেষ্টা করবে তার চেনাজানারা।

সে বাকিটুকু কি পড়বে? সরলা চোখ খুলল। ‘পরিমল চিৎকার করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। প্রতিবেশীরা, ছুটে আসেন। খবর পেয়ে শ্যামপুকুর থানার ওসি দ্রুত পৌঁছে যান। লালবাজার থেকে আসেন মার্ডার স্কোয়াডের অফিসাররা। পুলিশের কুকুরও আনা হয় কিন্তু আততায়ীর হদিশ করায় সে ব্যর্থ হয়। ভূপেন বসু অ্যাভিনুয়ের বাস স্টপে এসে কুকুরটি গৃহভৃত্যের গন্ধের খেই হারিয়ে ফেলে।

‘পুলিশের অনুমান, সম্ভবত হাওড়া স্টেশন যাবার জন্য বলাই বাসে উঠে দক্ষিণ দিকে গেছে। তার বাড়ি মেদিনীপুর জেলার জোনাক গ্রামে। মৃতার স্বামী, এক মালটি ন্যাশনাল সংস্থার উচ্চচপদস্থ অফিসার নরেনবাবু জানালেন, ঘরের কোনো জিনিসই চুরি হয়নি। মৃতার দেহের কোনো গহনা খোয়া যায়নি। বালিশের নীচে আলমারির চাবি ছিল কিন্তু আলমারি খোলা হয়নি। তিনি আরও জানান, বলাই ছয় বছর তাদের বাড়িতে কাজ করছে। নম্র এবং মার্জিত কথাবার্তার জন্য বাড়ির সবাই তাকে খুব পছন্দ করত। তিনি এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে বলাই এমন কাজ করতে পারে।

‘প্রতিবেশী গোপেন সিকদার বললেন, বলাইকে তার চেহারা, কথাবার্তার জন্য অপরিচিতরা প্রথমে ধরে নিত সে দত্ত পরিবারেরই কেউ। ওর চালচলনও ছিল সেইরকম। ওর মধ্যে এমন নৃশংসতা যে লুকিয়ে থাকতে পারে, বিশ্বাসের এমন জঘন্য প্রতিদান যে মানুষ দিতে পারে তা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না।’

‘প্রতিবেশিনী জয়শ্রী বসাক জানালেন, মৃতা সরলার সঙ্গে তার প্রায় পনেরো বছরের পরিচয়। সরলা অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের এবং পতি অন্ত প্রাণ বলতে যা বোঝায় সেইরকম চরিত্রেই মহিলা ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেন না যে বলাইয়ের সঙ্গে তাঁর কোনো প্রণয় জনিত সম্পর্ক ছিল।

‘রাত্রে লালবাজারে পুলিশের এক মুখপাত্র বললেন, গহনা বা টাকা চুরি না হওয়ায় এবং ধর্ষণের আগে খুন করায় মনে হয় আততায়ী মানসিক বিকারগ্রস্ত। বলাইকে ধরার জন্য জোর তল্লাশ শুরু হয়েছে। কলকাতা থেকে গোয়েন্দা দল আজই মেদিনীপুর রওনা হয়েছে।’

সরলা খুঁটিয়ে আর একবার পড়ল। বারান্দা থেকে রঞ্জনার ডাক শুনতে পেল। কাগজটা হাতে নিয়েই রঞ্জনা বলল, ‘পড়লি?’

‘হ্যাঁ। এরকম খুন তো প্রায়ই হয়, এই নিয়ে অবাক হবার কি আছে?’ সরলা স্বাভাবিক থাকার মতো ভাব গলায় আনল।

‘বলছিস কি! অবাক হব না? পুলিশ কী বলেছে সেটা পড়িসনি? লোকটার মানসিক বিকার ঘটেছিল নাহলে খুন করে তারপর একটা মরাকে এই জিনিস করতে পারে? অথচ লোকটা নম্র, মার্জিত, এই বলে স্বামীই তো সার্টিফিকেট দিয়েছে। সত্যিই বাবা, মানুষের বাইরেটা দেখে কিছু বোঝা যায় না। অত বছরের পুরোনো চাকর আর তার মনের মধ্যে কিনা এই ছিল!…এটাকে তুই হালকাভাবে নিতে পারিস, আমি পারব না।’

‘আমি হালকাভাবে নিচ্ছি কে বলল? আমি বলেছি অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার এটা নয়। রেপ তো হরদমই হয়, এটাও তাই। এক্ষেত্রে সরলা দত্ত হয়তো এমন বাধা দিয়েছিল যে শেষপর্যন্ত তাকে খুন করে তবেই রেপ করা সম্ভব হয়েছে।’

‘হ্যাঁ, সেটাই হওয়া সম্ভব, বাধা তো দিয়েছেই। কিন্তু ওই বলাই চাকরটার কথা ভাব। বাড়ির লোকের মতো ব্যবহার পেয়েছে, ছ-বছর থেকেছে আর কিনা… উনি বলেছেন খোঁজ নিয়ে বার করবেন বাড়িটা কোথায়, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একজন ঠিকই বেরিয়ে পড়বে। যাই শাশুড়ি এবার চেঁচাতে শুরু করবে।’

বিকেলে বিটু স্কুল থেকে ফিরল গম্ভীর মুখে। অন্যান্য দিনের মতো প্রথমেই খাবার টেবিলে গিয়ে বসল না। নিজের ঘরে খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল।

উদবিগ্ন হয়েই সরলা ছেলের কপালে তালু রেখে তাপ দেখল। কলকাতায় কখন যে কি অসুখ তৈরি হয় তার ঠিক আছে? আশ্বস্ত হল তার স্বাভাবিক অনুভব করে।

‘শুয়ে পড়লি যে, খাবি না?’

‘আজ কাগজে একটা খবর বেরিয়েছে।’ বিটু শান্ত স্বাভাবিক গলায় বলল।

সরলার বুক ধক করে উঠল। ছেলের চোখে সে রাগ বা ক্ষোভ দেখল না, কেমন যেন আহত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে।

‘হ্যাঁ, পড়েছি।’

‘কী বিশ্রি, ভালগার স্টাইলে যে লেখে! পরনে শুধু মাত্র সায়া, এটা কি খুব গুরুত্বপূর্ণ? বলতেই হবে?’ বিটুর স্বর তিক্ত। সে উঠে বসল। ‘এই নিয়ে বাপ্পা আর রাজেশের সঙ্গে আমার একচোট হয়ে গেল। ওরা বলছে রিপোর্টে এটা না জানালে, রিডাররা ক্রাইমের গুরুত্বটা বুঝবে না, ইমপ্যাক্টটা জোরালো হবে, না, এটা সেক্সকে সুড়সুড়ি দেওয়ার জন্য নয়…ব্লাডি শিট!’ বিটুর চোখ দুটো বড়ো হয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

‘এই সব জিনিস নিয়ে তোরা তর্ক করিস কেন?’ সরলা মৃদু ধমক দিল।

‘কাগজে লিখলে বহুলোক পড়ে, তাই নিয়ে আলোচনা, তর্ক হতেই পারে। কিন্তু ওরা ব্যাপারটাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেল…আমাদের বাড়িতে ক্লাসের অনেক ছেলেই তো এসেছে, তোমাকে, চাঁদুদাকে দেখেছে।’ বিটু হঠাৎ থেমে গেল। সরলার ধুকপুকুনি গলায় এসে আটকে গেল। বিটু ইতস্তত করে বলল, ‘যত মাথাব্যাথা ওদেরই।’

‘কী জন্য?’

‘এই দুপুরে তুমি বাড়িতে একা থাকো।’ বিটু খাট থেকে দ্রুত নেমে কলঘরে চলে গেল। সরলা মনে মনে ভগবানকে ডাকল। শেষকালে ছেলের বন্ধুরাও কিনা সায়া পরা সরলা দত্তর দিকে উঁকি মারছে! কি লজ্জার!

লোকেশ অন্যদিনের থেকে একটু আগেই ফিরল। সরলা তখন দোতলায়। সে শুনতে পেল, নীচে রান্নাঘরের সামনে লোকেশ বলছে, ‘হ্যাঁরে তোর দেশের ঠিকানাটা কী?…অ, ওপরে আয়, লিখে রাখব।’

উপরে এল লোকেশ। সরলা তীক্ষ্ন নজরে মুখভাব লক্ষ করল। স্বাভাবিক। প্রতিদিনের মতো অ্যাটাচি কেসটা খাটে ছুড়ে দিল। সরলা পিছনে এসে দাঁড়াতেই দুটো হাত পিছনে বাড়াল। সরলা কোটটা খুলে নিল।

‘উফফ আজ বড্ড ভ্যাপসানি। বৃষ্টি হলেই দেখছি কষ্টটা বেশি হয়।’ টাই খুলতে খুলতে লোকেশ বলল।

‘ঠান্ডা ঘরে সারাদিন থাকলে, একটু বেশিই লাগে। আমার তো অত লাগছে না।’ সরলা মনে মনে স্বস্তি বোধ করল। লোকেশ যে উগ্র মেজাজে সরলা দত্ত খুন নিয়ে কথা শুরু করেনি, এটাই এখন তার ভালো লাগছে।

‘উপরেই ছাদ, দুপুরে তো ঘরটা গুমোট হয়ে যায়!’

‘আমার তো তেমন লাগে না। ঘরের দরজা-জানলা সব বন্ধ করে দিই।’

‘একতলাটা খুব ঠান্ডা।’ বাইরের ঘরটায় চাঁদু দুপরে নিশ্চয় খুব আরামেই কাটায়।’

চাঁদু নামটা শুনেই সরলা তটস্থ হল। দুপুরে টেলিফোনে ‘চাঁদু কী করছে’ শুনেই সে ধরে নিয়েছিল লোকেশ আর স্বাভাবিক থাকতে পারবে না।

‘তোমার হঠাৎ যে মাথা ধরল? আগে কখনো ধরেছে বলে তো জানি না।’ জাঙ্গিয়া পরা লোকেশ পিছন ফিরে নীচু পাজামা গলাচ্ছে। সরলা মুখটা দেখতে পেল না।

‘ কী জানি, কেন যে ধরল। আগে তো কখনো-‘ সরলা আর কথা খুঁজে পেল না।

‘দুপুরে বাইরের ঘরে গিয়ে তো থাকতে পার। অসুবিধে কী?’

‘নীচে চাঁদু থাকে।’

‘ওহ হ্যাঁ।’

চাঁদু দরজায় এসে দাঁড়াল। ‘চা দিয়েছি।’

‘হ্যাঁ যাচ্ছি। লোকেশ অ্যাটাচি খুলে ছোট্ট ডায়েরি বইটা আর ডট পেন নিয়ে খাবার ঘরে গেল। সরলা তাকে অনুসরণ করতে গিয়েও থমকে গেল। কী যেন একটা ভয়, যা গত আঠারো বছর তার মধ্যে ছিল না, এখন সে অনুভব করছে। এই প্রথম সে নিজেকে অনিরাপদ ভাবল। ধীরে ধীরে সে খাটের উপর বসল।

একটু পরেই লোকেশ ঘরে এল ডায়েরি আর কলমটা যথাস্থানে রাখার জন্য। সরলাকে বসে থাকতে দেখে বলল, ‘মাথা এখনও ধরে আছে নাকি?’

‘কী লিখে রাখলে?’ সরলা ধীরস্বরে বলল।

‘চাঁদুর দেশের ঠিকানাটা। তিনকপি পাসপোর্ট ফোটোও কাল দোকানে গিয়ে তোলাতে বলেছি, থানায় দিয়ে রাখতে হবে।’ লোকেশ ব্যস্তজরুরি ভাবে কথাগুলো বলেই স্নান করতে গেল। সে শুনতে পেল না সরলার কথাগুলো-‘ওযে ছোটোবেলা থেকে আমাদের বাড়িতে রয়েছে!’

পরের দিন সরলা দত্ত খুন সম্পর্কে আরও খবর দিল ওই বাংলা কাগজটি।

রঞ্জনাই সরলাকে ডেকে পড়তে দিল। দেবার আগে বলল, ‘আমার যা মনে হয়েছিল সেটাই লিখেছে।’

সন্দেহ : ভৃত্যের সঙ্গে প্রণয়ে লিপ্ত ছিলেন গৃহবধু

হেডিংটা দেখেই সরলা পাথর হয়ে গেল। যখন সাড় ফিরে এল, তার মাথায় বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো তীক্ষ্ন একটা যন্ত্রণা খোঁচা দিতে শুরু করল। দৃষ্টি ঝাপসা হয়েই আবার ফিরে আসছে। রেলিং দু-হাতে আঁকড়ে সে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখল।

‘কী হল তোর? এই সরলা, অমন করছিস কেন?’ রঞ্জনা ভীত ব্যাকুল স্বরে চেঁচিয়ে উঠল। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে একটি লোক মুখ তুলে তাকাল।

সরলা ফিকে হাসল। ‘কিছু হয়নি। যেভাবে লিখেছে প্রথম লাইনটা- ‘পুলিশের সন্দেহ, মৃত্য ও ধর্ষিতা ঘরের বউ সরলা দত্ত ও তাদের গৃহভৃত্যের মধ্যে অবৈধ প্রণয় সম্পর্ক ছিল,’ পড়েই শরীরটা কীরকম গুলিয়ে উঠেছিল। আর পড়ার ইচ্ছে নেই আমার।’ হাত বাড়িয়ে সে কাগজটা ফিরিয়ে দিল রঞ্জনাকে।

‘তা তো হবেই, নিজের নামে ওইরকম একটা নোংরা খবর দেখলে……… আমার নামে বেরোলে আমারও গা গুলিয়ে উঠত। তুই তো ভেতরের লেখা আর পড়লি না। পুলিশের সন্দেহটা কেন হয়েছে জানিস, ওর স্বামীই বলেছে, অনেকবার চাকরটাকে ছাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু বউ ভীষণ আপত্তি করে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিত।

একদিন কোনো এক মন্ত্রী মারা যাওয়ায় অফিস হাফ ছুটি হয়ে যায়। ভদ্রলোক বাড়ি চলে এসে দেখেন বউ বিছানায় শুয়ে আর চাকরটা মাথা টিপে দিচ্ছে, ভদ্রলোক চাকরটাকে চড় মারেন, বউকে ধমকান। তাইতে চাকরটা চোটপাট করে ওর সঙ্গে কথা বলে, খুন করবে বলেও ভয় দেখায়। তক্ষুনি উনি চাকরটাকে বিদায় করে দেন। তাইতে বউ নাকি গলায় দড়ি দিতে গেছল, ছেলে দেখতে পেয়ে মাকে ধরে থামায়। কী ঘেন্নার কথা! বোঝ এত কাণ্ড তলায় তলায় হয়েছে! অথচ কাল প্রতিবেশীরা কত গুণগানই না করল রিপোর্টারের কাছে। অবশ্য তাদেরই বা কি দোষ, বাইরে থেকে যেমন যেমন দেখেছে সেই মতোই বলেছে। আমার ঘরে কী হয় না হয় তুই কী তা বলতে পারবি?’

সরলা চুপ করে শুনে গেল। বলার মতো কথা তার নেই। তার মনে হচ্ছে আজ দুপুরেও লোকেশ অফিস থেকে ফোন করবে। জিজ্ঞাসা করবে, চাঁদু কী করছে।

তার অনুমান মতো সত্যিই লোকেশের ফোন এল।

‘আজও মাথাটা ধরেছে নাকি?’

‘না,’ তারপরই সরলা বলল, ‘কী ব্যাপার তুমি দুপুরে ফোন করছ যে? কাল করলে আবার আজও।’

‘এমনিই, কেন করা নিষেধ নাকি? আঠারো বছর বিয়ে হয়েই কি প্রেমট্রেম শুকিয়ে যাবে?’

‘প্রেমালাপ করার জন্য দুপুরে অফিস থেকে ফোন!’

‘দুপুরই তো প্রেমের সময়।’

‘গৃহবধূকে খুনেরও সময়।’ কথাটা মনের অগোচরেই সরলার মুখ থেকে বেরিয়ে এল। ওধার থেকে সঙ্গে সঙ্গে জবাব এল না।

দুজনেই ফোন কানে ধরে চুপ। অবশেষে নীরবতা ভাঙল লোকেশ। ‘পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব।’ সে ফোন রেখে দিল।

বিকেলে ফোন বেজে উঠতে সরলা ধরল।

‘হ্যালো কে বলছেন?’ এক মহিলার গলা।

সরলার মনে হল চেনা চেনা, ‘আপনি কে বলছেন? আমি সরলা দত্তকে চাই, আমার নাম মালবিকা।’

‘মলি! হতচ্ছাড়ি, মুখপুড়ি, এত কাল কোথায় ছিলিস?’ সরলা উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করল। ‘কোথা থেকে ফোন করছিস? এত বছর হল একটা চিঠিও দিসনি। বাপের বাড়ি আসিস আর আমার সঙ্গে একবারটি দেখা করিস না। তুই তো ইম্ফলে ছিলিস এখন কোথায়? বর, ছেলে মেয়ে কেমন আছে?’

‘দাঁড়া দাঁড়া বাপু দাঁড়া। তুই তো কোশ্চেনের লিস্ট ধরিয়ে দিলি। একে একে, আমি এখনও ইম্ফলেই, সেখান থেকেই ফোন করছি। কর্তার অফিস থেকে অতএব পয়সা লাগবে না। টেলিফোনের বড়োসাহেব হওয়ার এই এক সুবিধে। আমরা সবাই খুব ভালো আছি। চার নম্বর এখন আমার পেটে যন্ত্রস্থ, আর দু-মাস পরেই প্রকাশিত হবে।

‘হ্যাঁ, তোমাকে ভালোবাসি।’

লোকেশ নীরব রইল। সরলা জিজ্ঞাসা করল, ‘আর কিছু জানতে চাও?’

‘চাঁদুকে ছাড়িয়ে দেব, তুমি কিন্তু না বোল না।’

সরলার মনে হল তার আসল খুঁটিটা হেলে গেছে। এখন তার সোজা হয়ে দাঁড়াবার কোনো অবলম্বন আর নেই। লোকেশের শেষ কথাটা, ‘তুমি কিন্তু না বোল না’-র মধ্য দিয়ে জানা হয়ে গেল ওর মনের মধ্যে তার সম্পর্কে কী বিপজ্জনক ধারণা তৈরি হয়ে রয়েছে।

‘বোলপুরে আমাদের এক ডিলারের দোকানে ওর ব্যবস্থা করে দেব। এখানের থেকে বেশি মাইনে পাবে।’

সরলা মনে মনে বীভৎস একটা চিৎকার করল। একটা প্রচণ্ড লাথি মনে মনে কষাল, একদলা থুতু মনে মনে ছুড়ে দিল এবং মনে মনে বলল, ঘেন্না করি, ঘেন্না করি-সবই লোকেশের উদ্দেশ্যে।

সন্ধ্যায় তপু এসেছিল সঙ্গে সোমনাথ। যে ফ্ল্যাটটা ওরা দেখতে গেছল সেটাই ভাড়া নিচ্ছে। এবার ওরা বিয়ে করবে এই মাসেরই এগারো তারিখে, আর মাত্র চারদিন বাকি। রেজেস্ট্রি হবে ওদেরই এক বন্ধুর বাড়িতে, বেলেঘাটায়। সোমনাথ কাগজে নকশা এঁকে বুঝিয়ে দিয়েছে, কত নম্বর বাসে কোথায় নামতে হবে বা ট্যাক্সিতে কত ভাড়া পড়বে।

‘সরলাদি জামাইবাবুকে বলব?’ তপু আগ্রহ নিয়ে বলেছিল।

‘বলে লাভ নেই।’ সরলা অম্লানবদনে মিথ্যা কথা বলে। ‘দশ তারিখে উনি ভুবনেশ্বর যাবেন তারপর আরও কতকগুলো জায়গায়। আমি একাই যাব।’

‘ঠিক সাতটায়। তুমি কিন্তু একজন উইটনেস। লোকজন বেশি হবে না, জনা দশেক বড়োজোর।’

‘ভাবিসনি, যাব বলেছি যাব।’

ফার্নিচারের দোকানে যাবার তাড়া তাই ওরা আধ ঘণ্টার বেশি থাকেনি। চাঁদু চা-এর কথা বলেছিল ওরা খায়নি। যেমন হুড়মুড়িয়ে আসা তেমনিভাবেই যাওয়া। সরলা আলমারির লকার থেকে গহনার বাক্স বার করে তার তিনটি আংটির থেকে একটি বেছে নিয়ে আঙুলে পরল। তপুকে বিয়ের পর এটা সে দেবে।

অফিস থেকে ফিরে জুতো খুলতে খুলতে লোকেশ বলল, ‘একজনের কথা বলল আমাদের বেয়ারা। মুর্শিদাবাদে ওদেরই গ্রামের মেয়ে, স্বামী নিরুদ্দেশ। নিউ আলিপুরে এক উকিলের বাড়িতে বছর দুই কাজ করছে। শ-খানেক পায়। তেরোটা লোকের সংসারে সব কাজই করছে। স্বভাবটভাব ভালো। আমি বলেছি আমরা মাত্র তিনজন, দেড়শো দোব, নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি। দেরি করলে ওদিকে বোলপুরটাও শেষকালে হাতছাড়া হয়ে যাবে। বলেছে তো কাল পরশু যাবে।’

সরলা চুপ করে শুনে গেল। কথা বলতে বলতে লোকেশ মুখ তুলে তাকাচ্ছিল। লক্ষ করছিল তার কথা শুনে সরলার প্রতিক্রিয়াটা কেমন হয়। কিছুই হতে না দেখে সে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমার কি পছন্দ হচ্ছে না?’

‘কেন হবে না।’

লোকেশ যখন খেতে বসেছে সরলা তখন বলল, ‘তপু এসেছিল। ওর বিয়ে।’

খাওয়া থামিয়ে লোকেশ তাকিয়ে রইল। ‘কী বললে?’

‘তপু বিয়ে করছে। আগে যে ব্রাঞ্চে কাজ করত সেখানকার একটি ছেলেকে।’

‘কবে?’

‘এই তো এগারোই। বেলাঘাটায় ওদের এক বন্ধুর বাড়িতে, সন্ধ্যে সাতটায়। আমি উইটনেস হব।’

‘তুমি! এই বিয়েতে?’

‘কেন, কি হয়েছে যদি সাক্ষী থাকি?’

‘না।’

‘কেন?’

‘কৈফিয়ত দিতে পারব না। একটা পুরুষকে ভোগ করে তৃপ্তি হয়নি, এখন আর একটা।’ কথাটা বলে লোকেশ দরজার বাইরে তাকাল।

ছলাৎ করে সরলার মাথায় রক্ত উঠে এল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘এ কথা বলার মানে? আমি জানি কাকে উদ্দেশ্য করে এ কথা বললে।’

‘জান তো ভালোই।’

‘তোমার মন অত্যন্ত নোংরা। আজ নয়, বিয়ের পর থেকেই দেখেছি তুমি আমাকে সন্দেহ কর। কেন?’

লোকেশ মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘সন্দেহ করি না, ভয় পাই। তোমার ওই শরীরটাকে খুব ধারালো লাগে।’

‘বাজে ন্যাকামো রাখ। ষোলো আনা সুখ কোনোদিনই তুমি আমায় পেতে দাওনি। বরাবরই তুমি চাঁদু আর আমাকে নিয়ে নোংরা চিন্তা করছে।’

লোকেশ ছিলেছেঁড়া ধনুকের মতো ছিটকে উঠল। ‘মুখ সামলে। আর একটা কথা বলেছ কী-‘ -লোকেশ নিজেকে সামলে নিল।

‘কী করবে তুমি, মারবে?’

লোকেশ টেবল থেকে উঠে গেল এবং কিছুক্ষণ পর নেমে গেল একতলার বাসার ঘরে। তিনটে দিন ওরা নেহাত দরকারি কথা ছাড়া পরস্পরের সঙ্গে কথাই বলল না। সরলা রাত্রে বিটুর ঘরে শুয়েছে। বিটু এখন বন্ধুদের সঙ্গে দার্জিলিং বেড়াতে গেছে।

এগারো তারিখে তপুর বিয়ের দিন, লোকেশ যখন অফিসে বেরোচ্ছে সরলা তাকে বলল, ‘আজ তপুর বিয়ে, আমি যাব।’

লোকেশ একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু পরের কথাটা শুনে থমকে গেল।

‘চাঁদুকে সঙ্গে নিয়ে যাব।’

উপেক্ষা, ঔদ্ধত্য, অস্বীকৃতি সরলার সর্বাঙ্গে। থুতনি তুলে সে লোকেশের দিকে তাকিয়ে। জ্বলজ্বল করছে চোখ।

চোয়ালটা একবার শান্ত করে লোকেশ মুখ দিয়ে শব্দ বার করল। যে শব্দে কোনো অর্থ নেই।

লোকেশ অফিস থেকে ফিরল অসময়েই। তখন বিকেল পাঁচটা। সরলা এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করল না কৌতূহল দেখাল না। সে যেন জানতই লোকেশ তাড়াতাড়ি ফিরবে তার যাওয়া বন্ধ করতে। সে গা ধুয়ে মুখে প্রসাধনী দিল। সযত্নে লিপস্টিক মাখল ঠোঁটে। চুল বাঁধল। তারপর আলমারি থেকে একটা বেগুনি কাঞ্জিভরম বার করল। বিছানায় চিৎ হয়ে কপালে দু-বাহু রেখে লোকেশ দেখে যাচ্ছে। তার সামনেই সরলা শাড়ি বদলাল। হাত ব্যাগটা খুলে ভিতরটা দেখল। ঘড়ি পড়ল। আংটিটা খুলে ব্যাগে রেখে আবার কী ভেবে আঙুলে পরল। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘চাঁদু তোর হল, ছ-টা বাজতে যাচ্ছে।’

নীচ থেকে চাঁদু কী একটা বলল।

‘তাড়াতাড়ি কর। ট্যাক্সি ধরাও তো এক ঝকমারির ব্যাপার।’

ঘরে ফিরে এসেই দেখল লোকেশ উঠে বসেছে। চোখে কর্কশ চাহনি।

‘তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।’

সরলা জবাব না দিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগল।

‘এখনও বলছি তোমার যাওয়া হবে না।’

‘কেন হবে না?’

‘আমার পছন্দ নয়।’ লোকেশ খাট থেকে নেমে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে নিল।

‘একি! তুমি আমায় ঘরে আটকে রাখবে নাকি?’

লোকেশের পাশ দিয়ে সরলা দরজা খোলার জন্য যেতে গিয়ে বাধা পেল। সে ধাক্কা দিল লোকেশকে। ‘কী ছেলেমানুষি-।’

মুঠোয় সরলার চুল ধরে টেনে এনে এনে তাকে খাটের উপর প্রায় ছুড়ে দিল লোকেশ।

‘এ ঘর থেকে এক পা বেরিয়েছ কি তোমায় মোক্ষম শাস্তি দেব। এ বাড়িতে আর তা হলে তুমি ঢুকতে পারবে না। তোমার ছেলেকে বলব, তোর মা চাকরের সঙ্গে দুপুরে প্রেম করত। একসঙ্গে ওদের আমি বিছানায় শুতে দেখেছি। ধরা পরে গিয়ে ভয়ে দুজনেই পালিয়েছে। পাড়ার লোকেদের, তোমার বাপের বাড়ির লোকেদেরও তাই বলব।’ লোকেশ ধীর পায়ে গিয়ে ছিটকিনিটা নামাল। দরজা খুলে বেরিয়ে যাবার আগে পিছন ফিরে তাকাল। সরলা বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে। দৃষ্টিতে কোনো অর্থ নেই।

নিজে গিয়ে লোকেশ ডাকল চাঁদুকে। ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি আর চটি পরে সে তখন তৈরি।

‘বউদি যাবে না। ভীষণ মাথা ধরেছে। আর তুই কালই সকালে নটা-পঞ্চান্নর শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে বোলপুর রওনা হবি। আজ আমাকে টেলিফোন করে বলেছে, কাল যদি তুই না যাস তা হলে অন্য লোক রাখবে। ছ-শো টাকা মাইনের কাজ জীবনে তুই পাবি?’

‘দাদা আমার কিন্তু এখানেই-‘

‘কাল আটটার মধ্যে রওনা হবি। তারপর আর যেন তোকে এ বাড়িতে না দেখি। জামাকাপড় খুলে ফেল। এককাপ চা করে দে?’

লোকেশ ধীর পায়ে সিঁড়ির দিকে এগোল। ফ্যাল ফ্যাল করে চাঁদু তাকিয়ে। দোতলায় পৌঁছেই সে ফোন বাজার শব্দ পেল। দ্রুত গিয়ে রিসিভার তুলল।

‘হ্যাঁ বলুন, সরলাদি উনি এখন খুব অসুস্থ, মাথায় একটা যন্ত্রণা হচ্ছে বলে…হ্যাঁ, ওহ তপু তুমি!’

‘আপনি কলকাতায় থাকবেন না বলেছিলেন সরলাদি। নইলে আপনাকেও নিমন্ত্রণ করতাম। আজই তো আমার বিয়ে। রেজিস্ট্রি।’

‘কনগ্রাচুলেশনস, খুব ভালো খবর। অবশ্যই বিয়েতে যেতাম। কিন্তু এমনই দুর্ভোগ বাইরেও যেতে পারলাম না তোমার সরলাদির জন্য। যে এক মাথার অসুখ বাধিয়েছে।’

সরলাদি সাক্ষী থাকবেন বলেছিলেন, তাই ওকে আবার মনে করিয়ে দিতে ফোন করছি। অবশ্য সাক্ষী হবার মতো লোক আছে, তবু আমার নিজের দিকের কেউ থাকলে খুব ভালো লাগত। আচ্ছা রাখছি, আমি যাব একদিন।’

‘নিশ্চয় আসবে।’

ফোন রেখে লোকেশ ফিরে তাকাল। সরলা একইভাবে খাটে পড়ে রয়েছে।

বারান্দায় সরলা দাঁড়িয়ে। এখন কলে জল আসার সময়, দুটি ঝি কাজে যাচ্ছে। সরলা চেঁচিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ গো আমাদের বাড়ি কাজ করবে?…দাঁড়াও না, কাজ করবে? শোনই না, কথা কানে নাও না কেন বল তো?’

ঝি দুজন দাঁড়াল না। শুধু একজন অপর জনকে বলল, ‘বউটার মাথা খারাপ, ছ-মাসে পাঁচটা বাসনমাজার লোক কাজ করেছে। এ বাড়িতে লোক টেকে না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *