কানাইলালের রেহাই

কানাইলালের রেহাই – মতি নন্দী – উপন্যাস

প্রাচীন বাড়িটার দুটো ভাগ। কাঠের বিশাল দুই পাল্লার ফটক দিয়ে ঢুকলে দু-দিকে দুটো ঘর, মাঝের জমিটা মাটির। তারপর একটা বড়ো উঠোন, এটিও মাটির। বাঁদিকের ঘরের পাশ দিয়ে উঠেছে চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। দোতলা থেকে চারতলা ছয়টি ফ্ল্যাট। বাড়িটার ডানদিক জরাজীর্ণ অবস্থায়। দু-হাত চওড়া ভিতের দেওয়াল থেকে চুনসুরকির পলেস্তরা খসে গিয়ে ইটে শ্যাওলা জমা। রেইন ওয়াটার পাইপের প্রতিটির নীচের দিক ভাঙা। কার্নিশে অশ্বত্থ গাছ একটু বড়ো হয়ে উঠলে হাত বাড়িয়ে উপড়ে ফেলা যতটা সম্ভব করার জন্য গাছগুলোর শৈশবাবস্থা কখনোই ঘোচে না। বড়ো বড়ো জানলাগুলোয় কাঠের খড়খড়ি। খড়খড়ির বহু পাখি ভেঙে পড়ে গেছে। জং ধরা পাল্লার কবজা এবং স্ক্রু-র মধ্যে সম্পর্কটা দু-পাশের শরিকদের মতোই আলগা, কোনোক্রমে নড়বড়ে আত্মীয়তা টিকিয়ে রাখার মতন। পুরোনো কাঠের সিন্দুক থেকে লেপ কম্বল ইত্যাদি বার করার সময় যে গন্ধ পাওয়া যায় বাড়িটির ডানদিকের অংশ তেমন একটা গন্ধ সতত ভেসে থাকে। এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন পাট ব্যবসায়ী মরিস অ্যান্ড সিম্পসন কোম্পানির মুৎসুদ্দি বাবু কৃষ্ণকিশোর সিংহ।

মোহনবাগান যখন মহারাজা দুর্গাচরণ লাহার শ্যামপুকুরের মাঠে ফুটবল খেলত তখন কৃষ্ণকিশোর মোহনবাগানে সেন্টার হাফ ছিলেন এবং মুৎসুদ্দিগিরিতে শিক্ষানবিশি তার আগেই সতেরো বছর বয়সে শুরু করে দিয়েছেন। খুব দ্রুত তিনি বিত্তশালী হয়ে ওঠেন। ফুটবল খেলা ছাড়লেও ক্লাব তিনি ছাড়েননি। ত্রৈমাসিক আট আনা চাঁদা নিয়মিত দিয়ে সদস্যপদ ও মোহনবাগান-প্রেম বজায় রেখেছিলেন। এগারো নম্বর উপেন দত্ত রোডে পৈতৃক বারো কাঠা জমিতে এই দু-মহলা বাড়িটি তৈরি করে গৃহপ্রবেশ করেন যে বছর অর্থাৎ ১৯০৮-এ মোহনবাগান ট্রেডস কাপ জয়ের হ্যাটট্রিক করে। ক্লাবের এগারোজন ফুটবলারকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে ভূরিভোজ করান। এর তিন বছর পর মোহনবাগান আইএফএ শিল্ড জিতে বাঙালিদের এবং কৃষ্ণকিশোরের মগজে ভূকম্পন ঘটিয়ে দেয়। তিনি শান্তিপুর থেকে কীর্তন কুলনিধি শ্যামাপদ আচার্যকে আনিয়ে বাড়ির উঠোনে কীর্তন গাওয়ান, বাড়ির সামনে রাস্তায় মেরাপ বেঁধে যাত্রাপালা আর তরজা গানের আসর বসান, প্রায় দুশো কাঙালিকে এক আনা দক্ষিণাসহ খিচুড়ি খাওয়ান। তারা কেষ্ট সিঙ্গি আর মোহনবাগানের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে বলে ‘বছর বছর শিল্ড জিতুক।’

অবশ্য কেষ্ট সিঙ্গির জীবদ্দশায় শিল্ডটি মোহনবাগানের আর জেতা হয়নি। মারা যাবার আগে উইল করে বাড়িটি আধা-আধি দুই ছেলে নন্দলাল আর কানাইলালকে দিয়ে যান। বাঁদিকের অংশটি পান নন্দলাল, তিনি বি এ বি এল। একতলার ঘরটিতে সেরেস্তা সাজিয়ে ওকালতি করেন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে। ফৌজদারি মামলার উকিল হিসাবে জমজমাট পসার করেন, প্রচুর অর্থও উপার্জন করেন। তার দুই ছেলে এক মেয়ে।

বাড়ির ডানদিকের অংশের মালিক কানাইলাল। তিন বছরের চেষ্টায় তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। বাবার মোহনবাগান সদস্য কার্ডটি সযত্নে রক্ষা করা এবং ধুতি পাঞ্জাবি পরার রেওয়াজটি বজায় রাখা ছাড়া সাংসারিক কোনো ব্যাপারে মনোযোগ দেননি। দেওয়ার দায়টা তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন স্ত্রী কামিনীবালার হাতে। কামিনীবালা চারটি কন্যা ও তিনটি পুত্র কানাইলালকে উপহার দিয়ে সংসারটিকে ভরভরন্ত ও একটি ডুবন্ত স্টিমারে রূপান্তরিত করেন। অবশ্য এজন্য তিনি একা দায়ী নন। তিনি বুদ্ধিমতী, বুঝে গেছলেন পুত্রকন্যাসহ ভেসে থাকতে হলে নিজেকেই হাল ধরতে হবে। হাল মানে আয় এবং আয় করার জন্য তিনি নজর দিলেন উঠোনটিতে এবং এইখান থেকেই শুরু হল ভাশুরের সঙ্গে সংঘর্ষ এবং দুই পরিবারের মধ্যে তিক্ততার সূচনা যা ক্রমশই বেড়েছে।

কানাইলাল জনসমক্ষে রোজগেরে প্রমাণের জন্য ব্যবসা শুরু করেন। একতলার বাঁদিকের ঘরটা দাদার সেরেস্তা। ডানদিকের ঘরে বসে তিনি পুরোনো শিশিবোতল ও খবরের কাগজ কেনাবেচায় মন দেন। কম লাভের কিন্তু নিরাপদ ব্যবসা এবং মোহনবাগানের খেলা দেখার বিঘ্ন ঘটায় না। কানাইলাল সুখে থাকলেও কামিনীবালা ছিলেন না। সংসারে মুখ বাড়ছে আয় সামান্য। স্বামীকে পরামর্শ দিলেন উঠোনটা ভাড়া দাও।

বিভ্রান্ত কানাইলাল বললেন, ‘কাকে দেবে?’

‘যমকে দেবে।’ কামিনীর চাপা গর্জনে কানাইলাল আরও বিভ্রান্ত। ‘শিশি বোতল আর খবরের কাগজ বেচে সংসার চলে? ফুলির মা বলল হারু ডেকরেটর জায়গা খুঁজছে মালপত্তর রাখার, উঠোনটা ওকে ভাড়া দাও না।’

‘উঠোন তো আমার একার নয়, দাদারও। বাবা উইলে উঠোন ভাগ করে দিয়ে যায়নি। বুদ্ধিমান লোক কেন যে এই ভুলটা করলেন! ভাড়া দিতে গেলে দাদাকে জিজ্ঞেস করে দিতে হবে।’

কামিনী বললেন,’তা হলে দাদাকে জিজ্ঞেস করে এসো।’

কানাইলাল জিজ্ঞেস করতে গেলেন সেরেস্তায় নন্দলালের কাছে। শোনামাত্র তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন নন্দলাল।

‘একদম নয়। ভাড়াটাড়া দেওয়া চলবে না। ভাড়াটে বসানো মানে পাঁচজনকে জানিয়ে দেওয়া আমরা গরিব, সংসার চালাতে পারি না।’

দাদার ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বরে মিইয়ে পড়েন কানাইলাল। শুকনো মুখে ঢোঁক গিলে বলেন, ‘কথাটা তো ঠিক।’

‘কীসের ঠিক?’ ধমক দেন নন্দলাল। ‘আমার সংসার তো চলছে। তোর চলে না তাই বলে কি আমারও চলে না? এটাই লোকে জানবে? উঠোনটা জয়েন্ট প্রপার্টি। ভাড়া দিলে আমারও তো অর্ধেক মান অপমানের দায় ঘাড় পেতে নিতে হবে।’ নন্দলাল হতাশভাবে হাতের বইটা টেবলে ছুড়ে চেয়ারে শরীর এলিয়ে বললেন, ‘আড্ডা না মেরে, বাবুগিরি না করে, সিনেমার হিরো হতে গিয়ে পয়সা না উড়িয়ে, মোহনবাগান মোহনবাগান না করে, অমূল্য সময় কাজে লাগিয়ে যদি নিজেকে তৈরি করার দিকে মন দিতিস তা হলে আজ আর তোর এই অবস্থা হত না।’

কানাইলাল মাথা নীচু করলেন। চুল উঠে গিয়ে মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে। তপ্তকাঞ্চনের মতো গাত্রবর্ণ ছিল, এখন গাঢ় তামাটে। মুখের লালিত্য ফুলের শুকনো পাপড়ির মতো বিবর্ণ, নাকের দু-পাশে অভাব আঁচড় বসিয়েছে। কানাইলাল একসময় কান্তিময় সুদর্শন ছিলেন, তার ছিটেফোঁটা এখনও মুখে লেগে আছে। বিয়ের আগে তিনি একটি চলচ্চিচত্রে যুগ্ম প্রযোজক হয়ে টাকা ঢেলে নায়ক হন, ছবিটি একসপ্তাহ পর প্রেক্ষাগৃহ থেকে অন্তর্হিত হয়, আর ফিরে আসেনি। এই ছবির জন্য তার চল্লিশ হাজার টাকা দেনা হয়।

দাদার কাছে তিনি ঋণ চান। নন্দলাল তখন পরামর্শ দেন, ‘ধার করবি কেন বিয়ে কর। বনেদি বড়ো বংশের ছেলে, নিজের বাড়ি রয়েছে, দেখতে সুন্দর, চল্লিশ হাজার নগদ দিয়ে তোকে জামাই করার জন্য অনেকে টাকার থলি নিয়ে এগিয়ে আসবে। বলিস তো আমি মেয়ে দেখি।’

নন্দলাল পাত্রী নয়, পাত্রীর পিতাকে আবিষ্কার করেন। তারই মক্কেল বড়োবাজারের খ্যাংরাপট্টিতে মশলা আর মোমের আড়তদার যুগলচাঁদ পাইনের পঞ্চম কন্যা কামিনীবালাই সেই পাত্রী। যুগলচাঁদ নগদে, যৌতুকে ও গহনায় লক্ষ টাকা ব্যয় করে নিষ্কর্মা অলস কানাইলালকে সংগ্রহ করেন।

বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই কামিনী বুঝে যান তার নরম স্বভাবের বুদ্ধিহীন কিন্তু বনেদি গর্বে স্ফীত স্বামীটিকে চালনা করতে হবে তাকেই। কামিনীবালা মুখরা ও দাপুটে প্রকৃতির। নন্দলালের স্ত্রী সোনামুখী স্বামীকে বলেছিলেন, ‘ঠাকুরপোর জন্য ঠিক মেয়েকেই বউ করা হয়েছে। উঠতে বসতে ঝাঁটাপেটা করার মতো বউই দরকার ছিল তোমার ভাইয়ের। ভাগ্যিস সংসারটা একান্নবর্তী নয় তা হলে তো জান কয়লা করে দিত।’

কামিনীর তাড়নাতেই অর্থ উপার্জনের জন্য কানাইলাল তার এক বাল্যবন্ধুর সঙ্গে, চিৎপুরে অন্নপূর্ণা অপেরায় হাজির হন। সিনেমা-হিরোর ছাপ নামের সঙ্গে থাকায় গ্রামেগঞ্জে তার নামটা সামনে রেখে ব্যবসায়ে সুবিধা হবে ভেবেই কানাইলালকে তারা নায়ক করে নেন তাদের ‘নয়া আনারকলি’ পালায় সেলিমের চরিত্রে। আর কী আশ্চর্য, প্রচণ্ড হিট করল এই পালাটি। ডুয়ার্স থেকে ধানবাদ, চা-বাগান থেকে কয়লাখনি বিপুল ব্যবসা করল অন্নপূর্ণা অপেরা। কানাইলালের তখন রমরমা অবস্থা এই একটি পালা ঘিরেই। তখন তিনি বলেন, ‘দাদা উঠোনটা ভাড়া না দিতে দিয়ে ঠিকই করেছিল, সিংগি বাড়ির মানসম্মান লুটিয়ে যেত।’

কামিনী বলেন, ‘আর যাত্রার হিরো হয়ে খুব বাড়িয়েছ মানসম্মান।’

‘মানসম্মান তো টাকা দিয়ে তৈরি হয়। সব ব্যাটা তো টাকাকেই খাতির করে। দ্যাখোনি যখন গাড়ি করে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায় তখন পাড়ার লোক কীভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। দাদা তো সেকেন্ড হ্যান্ড অ্যাম্বাসাডার কিনেছে, আমি নতুন কিনব, শিবু গাঙ্গুলি নতুন একটা পালা লিখছে আমাকে হিরো করে। বলছে লেগে যাবে, আগুন জ্বালিয়ে দেবে। শুয়োরের বাচ্চচা ভবেশটাকে প্যাঁচ মেরে তখন মাইনেটা বাড়িয়ে নোব, তা হলেই নতুন গাড়ি।’

‘একেই বলে গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল! পালা এখন লেখা হচ্ছে তারপর আসরে নামবে, তারপর হিট করবে, তারপর ভবেশ সাহা মাইনে বাড়াবে, তারপর গাড়ি কিনবে। এসব চিন্তা এখন রাখো। সুধীরা ষোলোয় পড়বে সামনের মাসে, পাত্তর এখন থেকেই দ্যাখো।’

বড়ো মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে হবে ভেবেই অলস কানাইলালের মাথায় বাজ পড়ল। অবশ্য তিনি ভালোই জানেন এই কাজটি কামিনীবালা তার স্বামীর হাতে ছেড়ে দেবেন না, স্বামীর আনা কোনো সম্বন্ধই তার পছন্দসই হবে না এবং সব তিনি বাতিল করে নিজের মনোমতো পাত্রের সঙ্গেই সুধীরার বিয়ে দেবেন এবং তাই-ই দিলেন। কলুটোলার মধু শীলের নাতি জয়দেব নিউ মার্কেটে তাদের পঁচাত্তর বছরের রেডিমেড পোশাকের দোকানে বসতে শুরু করেছে। কামিনীবালা খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন, ছেলেটি সৎ চরিত্রের, নেশাভাঙ করে না, বি এ পাশ, দেখতে খুবই ভালো, ব্যবসাটা পারিবারিক, বংশটা বনেদি, বয়স চব্বিশ এবং স্বাস্থ্যবান। আর কী চাই? পাত্রটি যাতে হাতছাড়া হয়ে না যায় তাই ‘পাত্রী পছন্দ হয়েছে’ শোনামাত্র কামিনীবালা একমাসের মধ্যে ক্লাস টেন-এ পড়া সুধীরাকে পাত্রস্থ করে হাঁফ ছাড়েন।

কিন্তু হাঁফ ফেলার ফুরসত মিলল না কানাইলালের, মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন না, প্রস্তুত হচ্ছিলেন নতুন মোটর গাড়ি কিনে দাদাকে টেক্কা দেওয়ার জন্য। পাত্রের বাবার খাঁই মেটাতে তার জমানো টাকা তো বটেই, ভবেশ সাহার কাছেও হাত পাততে হয়। আগামী ‘হিট পালা’টির কথা ভেবে ভবেশ পঞ্চাশ হাজার টাকা অগ্রিম দেন। সদর দরজায় ঝকঝকে নতুন গাড়ি বাঁধা রাখার স্বপ্ন আবার যে কবে থেকে দেখতে শুরু করবেন এমন একটা ভাবনায় মুষড়ে হতাশ হয়ে পড়েন কানাইলাল।

হতাশাটা বউয়ের কাছে প্রকাশ করার সাহস না থাকায় মনে মনে গজরান আর ঝগড়া করে যান: ‘তোমার আর কী। শুধু তো পেট থেকে বাচ্চচা বার করা। তাদের খাওয়ানো, পরানো, লেখাপড়া শেখানো সবই তো আমার ঘাড়ে। বিয়ের জন্য এই যে দু-লাখ টাকা খরচ হল এটা তো আমাকেই জোগাড় করতে হয়েছে, এখন মুখের রক্ত তুলে ভবেশকে শোধ করতে হবে। প্রথা, সামাজিকতা, বংশের নিয়ম, মর্যাদারক্ষা তাই এই চাই, সেই দিতে হবে নইলে লোকে কী বলবে, তাই পাড়া প্রতিবেশী জ্ঞাতি গুষ্টি বন্ধুবান্ধবদের নেমন্তন্ন করে খাওয়াও, টাকার ছেরাদ্দ করো।’

কানাইলাল বিয়েথা চুকে যাবার পর একদিন কথা প্রসঙ্গে বউকে বলেন, ‘আচ্ছা ছেলের তো ঘড়ি আছে, জুতো ছাতাও আছে তবু বিয়ের সময় এসব চায় কেন বল তো?’

কামিনীবালা এককথায় স্বামীকে চুপ করিয়ে দেন, ‘তোমার বিয়ের সময়ও তো আমার বাবাকে ঘড়ি আংটি খাট বিছানা হিরের বোতাম দিতে হয়েছিল।’

শিবু গাঙ্গুলির লেখা ‘রামী চণ্ডীদাস’ পালায় রামী ধোপানির ভূমিকায় বহু টাকা খরচ করে আনা চিৎপুরের সেরা গায়িকা উৎপলা দত্ত এবং সেরা সুরকার তরুণ বেরা থাকা সত্ত্বেও ধোপে টিকল না। কানাইলাল প্রাণ ঢেলে ‘চণ্ডীদাস’কে জীবন্ত করে তোলার চেষ্টা করেন। পাবলিক কিন্তু এই গানের পালাটি নেয়নি। পরিষ্কার ফ্লপ করল। অন্নপূর্ণা অপেরার ড্রেসমেকার থেকে মেকআপ ম্যান সবাই একবাক্যে বলল : ‘অচল, একেবারে অচল। বছর তিরিশ আগে এসব চলত, এখন টেস্ট বদলে গেছে গ্রামের লোকেরও। ঢিমে তালের ক্লাসিকাল সুরে বাঁধা গান এখন তারা আর চায় না। টেঁটিয়া ডায়লগ, অ্যাকশন আর সেক্স দিয়ে গুঞ্জন অপেরার ‘জানোয়ার শ্বশুরকে সতীর লাথি’ দেখুন কীরকম ব্যবসা করে যাচ্ছে। শিবদাকে বলুন ভবেশবাবু ওইরকম পালা লিখতে।’

অন্নপূর্ণা অপেরার মালিক বোকা লোক নন, তিনি শিবু গাঙ্গুলিকে হুকুম দিলেন, ‘শ্বশুরবাড়ি জুতোরবাড়ি’ নামে একটা পালা দু-সপ্তাহের মধ্যে লিখে দিতে। ঠিক দু-সপ্তাহেই লেখা হয়ে এক মাসেই আসরে নেমে গেল ‘শ্বশুরবাড়ির জুতো বউয়ের বাড়ির ঝাঁটা।’ কানাইলাল ভিলেন শ্বশুরের ভূমিকায় দাপিয়ে অভিনয় করে তার হারানো জমি উদ্ধার করে নিলেন। তিন মাসেই শোধ করে ফেললেন দেনা। আবার তিনি নতুন মোটর গাড়ির স্বপ্ন দেখার জন্য তোড়জোড় শুরু করলেন।

নিউ মার্কেটে জয়দেবের ঠাকুরদা মধু শীল প্রতিষ্ঠিত দোকানের মালিক এখন তার দুই ছেলে হরিচরণ ও গুরুচরণ। দোকানের দায়িত্বে ও তত্ত্বাবধানে রয়েছেন বড়ো ছেলে হরিচরণ। দুই ভাইয়ের ছয় ছেলে। দোকানের মালিক ও অংশীদার হবে তারাই বাবাদের মৃত্যুর পর। এই ছয় জ্ঞাতি ভাইদের মধ্যে তিনজন দোকানে বসে এবং বেতন পায় কর্মচারীদের মতো। এদেরই একজন জয়দেব। সে বুঝে গেছে ছয়ভাগের একভাগ হয়ে থাকলে জীবনে স্বচ্ছলতার মুখ দেখা হবে না। জয়দেব উচ্চচাকাঙ্ক্ষী, ভেবে ঠিক করল তাকে আলাদাভাবে কিছু একটার ব্যবসা শুরু করতে হবে। সে খোঁজ নিতে লাগল এবং জ্যাম, জেলি, পেস্ট্রি, চকোলেট ইত্যাদির বিক্রেতা বন্ধু গৌরাঙ্গর দোকানে বসে গল্প করতে করতে শুনল নিউ মার্কেটের পাশেই ‘গুডলাক’ নামে চারতলা বাড়ি উঠবে, তাতে থাকবে শুধুই দোকান ঘর। ঘর ভাড়া নেওয়ার জন্য আগাম বুকিং শুরু হয়ে গেছে। গুডলাকের প্রোমোটার কেতন ভিমানী গৌরাঙ্গর পরিচিত। সে বাড়ির তলার বেসমেন্টে একটা কুড়ি ফুট বাই পনেরো ফুট ঘর বুক করে ফেলেছে তিন লাখ টাকা সেলামি দিয়ে।

চমৎকৃত জয়দেব বলল, ‘তোর তো একটা দোকান রয়েছে তা হলে আবার তিন লাখ দিয়ে ঘর নিতে গেলি কেন?’

‘আমার ব্যবসার মালিক আমি একা হতে চাই। ভাইয়ের সঙ্গে পার্টনারশিপে দোকান চালাতে পারব না, বাড়িতে এই নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়ে গেছে। হাঁড়ি আলাদা, সিঁড়িও আলাদা হয়ে গেছে।’

জয়দেব বলল, ‘তোর তো দেখছি অনেকটা আমার মতোই ব্যাপার। আমার অবশ্য ঝামেলা এখনও শুরু হয়নি তবে শুরু হতে কতক্ষণ! আমাদের দোকানের ক-টা অংশীদার তা তো জানিস। কারোর সঙ্গে কারোর মনের মিল নেই। ভবিষ্যতে গণ্ডগোল বাঁধবেই। আমি সিওর এ ব্যাপারে। তাই ভাবছি আলাদা একটা কিছু করে এই জামাকাপড়ের দোকান থেকে বেরিয়ে যাব। রেডিমেড গারমেন্টসে এখন কোটিপতিরা এসে গেছে, ওদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারা যাবে না। জ্যাঠার যা ব্যবহার সত্যিকারের কর্মচারী হলে বরং সহ্য করা যায়।’

গৌরাঙ্গ বলল, ‘তা হলে তোর দোকানের শেয়ারটা বেচে দিয়ে গুডলাকে একটা ঘর নে। ভিমানী আমার বন্ধু, আমি বললে দিয়ে দেবে। জ্যাঠার সঙ্গে কথা বল।’

‘কী কথা বলব?’

‘বলবি আমার অংশটা বেচব আপনি কিনে নিন।’

সেদিন বাড়ি ফিরে জয়দেব তার বাবার সঙ্গে কথা বলল। বাবা অশক্ত, ডায়াবেটিসের রোগী, সঙ্গে উচ্চচ রক্তচাপ। বেশিরভাগ সময় ঘরেই কাটান। তিনি শুনেই বললেন, ‘আলাদা ব্যবসা করতে গেলে টাকা লাগে, পাবি কোথায় টাকা? তা ছাড়া দাদাই বা কিনবে কেন? যদি না কেনে তখন কী করবি? বাবা উইলে বলে গেছে তার বংশের বাইরের কাউকে দোকান বিক্রি করা যাবে না। আর যদি বিক্রি করতেই হয় তা হলে প্রত্যেক শরিকের কনসেন্ট নিতে হবে। রাজি হলেও ভাইয়েরা মনে হয় না বেচবে। তোর জ্যাঠা বাইরের কাউকে বেচতে কনসেন্ট দেবে না, জ্যাঠার কাছেই বেচতে হবে। বেচলে কত টাকা চাইবি ঠিক করেছিস? আগে সেটা ঠিক কর, তারও আগে ঠিক কর কীসের ব্যবসা করবি।’

জয়দেব পরদিনই জানতে চাইল গৌরাঙ্গর কাছে, কত টাকা দাম চাইবে সে।

গৌরাঙ্গ বলল, ‘দ্যাখ জয়, দোকানের আসল দাম ঠিক হয় লোকেশান, পজিশান আর স্পেস কতটা তার উপর, মালপত্র কত টাকার আছে সেটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মার্কেটে যেখানে ঢোকার মুখেই তোদের দোকান, খদ্দেরের আসা-যাওয়ার সুবিধা দেখলে, যতটা জায়গা নিয়ে, তাতে কম করে কুড়ি লাখ তো দাম হবেই। কিন্তু দোকানের মালিক তো তোর জ্যাঠা আর বাবা। এখনও তো তুই ভাগীদার হোসনি। যদি তোর বাবা তার ভাগটা বেচে সেই টাকা তোদের তিন ভাইকে ভাগ করে দেন আগে সেটা ঠিক কর।’

তিক্তমুখে জয়দেব বলল, ‘হবে না। বাবাকে বেচতে দেবে না জনার্দন আর বিষ্টু। ওরা দোকানের কর্মচারী হয়েই নির্ঝঞ্ঝাটে থাকতে চায়। রোজগার বাড়াবার কোনো উদ্যোগ ওদের নেই।’

গৌরাঙ্গ হেসে বলল, ‘জানি, অনেকদিন তো তোর ভাইদের দেখছি। বিষ্টুটা তো মদ ধরেছে।’

‘কালও বাড়িতে রাতে ঝামেলা করেছে। সহ্য করতে না পেরে ঠেঙিয়েছি, আমাকে দেখে নেবে বলেছে। জ্যাঠাও ওকে আর ক্যাশে বসতে দেয় না, গোলমাল করেছে টাকাপয়সার। বাবাকে জ্যাঠা বলেছে যে, গুরু, আর একবার যদি দেখি ক্যাশে শর্ট পড়েছে বিষ্টুকে তা হলে আর দোকানে ঢুকতে দোব না। বাবা তো লজ্জায় মরে যাচ্ছে।’

‘একটা কাজ তো করতে পারিস, বাবাকে বল না দোকানটা পার্টিশান করে নিতে। দুই কর্তা বেঁচে থাকতে থাকতে কাজটা সেরে রাখা ভালো, তোর জ্যাঠতুতো ভাইয়েরাও তো এক-একটা বিষ্টু-জনার্দন। লাঠালাঠি শুরু হবার আগে সম্পর্ক ভালো থাকতে থাকতেই আলাদা হয়ে যা। জ্যাঠা তো আশির কাছাকাছি, এখনও শক্ত রয়েছে কিন্তু কতদিন আর থাকবে?’

জয়দেব গৌরাঙ্গর যুক্তিগুলোই বাবার কাছে পেশ করে বলল, ‘সাইজে ছোটো হয়ে যাবে ঠিকই তবে আমাদের ইচ্ছেমতো অন্য কিছুর ব্যবসা করতে কিংবা কাউকে লিজ দিয়ে দিতে পারব। যাক, সেটা পরের ব্যাপার, আগে জ্যাঠামশাইয়ের কাছে কথাটা পেড়ে দ্যাখো তো।’

গুরুচরণ দোকান ভাগের প্রস্তাব দেওয়ামাত্র এককথায় হরিচরণ রাজি হয়ে গেলেন, অবাক হয়ে গেলেন গুরুচরণ। তিনি ধরেই রেখেছিলেন শোনামাত্র দাদা তিরিক্ষে স্বরে বলে উঠবেন, ‘দোকান ভাগ? তোর মাথা খারাপ? উনিশশো তিরিশ সালে বাবা দোকান দিয়েছিলেন, এত বছর পর কী এমন ঘটল যে, সেই দোকান কেটে দু-আধখানা করতে হবে?’

ভাইয়ের মুখ দেখে হরিচরণ বললেন, ‘খুব অবাক হয়ে গেলি দেখছি! কোনো একদিন আমিই তোকে বলতুম, গুরু দোকানটা বিক্রি করে তেলেভাজার ছ-টা দোকান ছ-টা ছেলের জন্য করে দিয়ে চল কাশী চলে যাই। এরা দোকান রাখতে পারবে না। রাখতে গেলে টাকা ঢালতে হবে, ঝকমকে করে তুলতে হবে। নামি কোম্পানির দামি মাল না রাখলে ব্যবসা চালানো অসম্ভব।’

হরিচরণের দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ শুনে মাথা নামিয়ে গুরুচরণ বলেন, ‘ছেলেগুলো যদি মানুষ হত। তবু জয়টার মধ্যে একটা চেষ্টা আছে দেখছি। দেখা যাক, ভাগ হয়ে যাবার পর ওর হাতেই দায়িত্ব তুলে দিয়ে বলব তুই এবার চালা।’

এরপর দু-জনে কথা না বলে, একজন জানলা দিয়ে বাইরে, অন্যজন মেঝের দিকে তাকিয়ে, মিনিট তিনেক বসে রইলেন। অবশেষে গুরুচরণ বললেন, ‘দাদা চলি।’

‘আয়। ওষুধ ঠিকঠাক খাচ্ছিস তো?’

অন্নপূর্ণা অপেরার পর পর দুটো পালা বাজারে খেয়ে গেল। ‘ধনীর দুলালির মুখে চুনকালি’ আট লক্ষ টাকার এবং ‘তুমি ভারী দুষ্টু’ বারো লাখ টাকার ব্যবসা দিল ভবেশ সাহাকে। দূর গ্রামেগঞ্জে কানাইলাল অভিনয় শেষ করেই মোটরে ছুটেছেন আর এক আসরে নামার জন্য। এখন তিনি নামি অভিনেতা। সুদর্শন রোমান্টিক নায়ক চরিত্র দিয়ে শুরু করে এখন তিনি দুর্ধর্ষ খলনায়করূপে খ্যাতির মধ্যগগনে। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনে তার ছবি থাকে, নামের আগে লেখা হয় ‘নট দুলাল’। মোটরে দু-ঘণ্টার দূরত্ব হলে তিনি অভিনয় শেষে কলকাতায় বাড়ি ফিরে আসেন এবং ফেরেন প্রায় দিনই মত্ত অবস্থায়। ব্যস্ত জীবনের খাটাখাটুনির ধকল সামলাতে অবসন্ন শ্রান্ত স্নায়ুগুলোকে চাগিয়ে তুলতে তিনি মদ খেতে শুরু করেছেন।

কানাইলাল প্রথম যেদিন মদ খেয়ে বাড়ি ফেরেন কামিনী তাকে সিঁড়ির দেওয়ালে হাত রেখে একপা একপা করে উঠতে দেখে ভয়ে ‘তোজু তোজু’ বলে বড়ো ছেলের নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন। তেজেশ ছুটে আসে। বাবাকে সে দু-হাতে জড়িয়ে শোবার ঘরে নিয়ে খাটে শুইয়ে ধীর গলায় মাকে জানিয়ে দেয়, ‘মদ খেয়েছে। চেঁচিয়ো না। ওবাড়ির ওরা হাসবে।’ ওবাড়ি মানে জ্যাঠা নন্দলালের বাড়ি।

স্বর নামিয়ে কামিনী গজরান, ‘জানতুম, প্রথম থেকেই আমার মন বলেছিল যাত্রায় বদসঙ্গে পড়বে। মদ ধরবে তারপর মেয়েমানুষ নিয়ে কেলেঙ্কারি করবে। দরকার নেই আর যাত্রা করে।’

কানাইলাল চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন। এবার চোখ খুলে হাসলেন। ‘যাত্রা আর করব না। তুমিই সংসার চালিয়ো।’ বলে চোখ বন্ধ করলেন।

কামিনী জোরালো উত্তর দিতে গিয়ে থমকালেন, তারপর বললেন একটু তেজ দেখিয়েই, ‘হ্যাঁ, আমিই চালাব। তেমন হলে লোকের বাড়ি ঝি-রাঁধুনির কাজ করে চালাব।’

‘শিবু গাঙ্গুলিও এমন পচা ডায়লগ এখন আর লিখবে না, অন্যকিছু ছাড়ো। সংসারে লোক ক-টা গুনে দেখেছ? তোজু, বিজু, নীলা, সুষি, সুরো, তুমি, আমি, ধীরার বিয়ে হয়ে গেছে। ও থাকলে, আঙুলের কর গুনে কানাইলাল জানালেন, ‘আটজন। ধীরা নেই সাতজন, পারবে? পারলে কালই যাত্রা ছেড়ে দেব।’

নিজেকে ঠেলেঠুলে তুলে কানাইলাল উঠে বসে তোজুর দিকে তাকালেন। বড়ো ছেলেটি তার খুবই বাধ্য এবং আদরের। বাবার মতোই সুদর্শন। তার বড়ো গুণ সে শান্তিপ্রিয় ও নরম চরিত্রের, যেটা প্রায় ব্যক্তিত্বহীনতার পর্যায়ে পড়ে যায়। লেখাপড়ায় মনোযোগী। কেমিস্ট্রিতে এখন ষষ্ঠ বর্ষের ছাত্র। বাবা কী বলতে চায় বুঝে নিয়ে তোজু বোতামগুলো খুলে পাঞ্জাবিটা মাথার উপর দিয়ে টেনে বার করে নিল, আলনা থেকে পাজামাটা এনে বলল, ‘পরো।’

কানাইলাল উঠে দাঁড়ালেন। টলে গেলেন, তোজু ধরে ফেলল। ধুতিটা খুলে খাটের উপর ছুড়ে দিলেন। আন্ডারওয়্যারের দড়ি ধরে টান দিতেই কামিনী, ‘অসভ্যতার একটা সীমা আছে। লজ্জা-ঘেন্নাটাও যাত্রা করে ঘুচিয়েছ?’ বলেই তিনি দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

‘দে।’ কানাইলাল হাত বাড়ালেন। তোজু পাজামাটা এগিয়ে দিল।

খাটে আবার শুয়ে ক্লান্ত জড়িত স্বরে কানাইলাল বললেন, ‘লেখাপড়া করেনি, বাড়ি থেকে বেরোয়ও না। তোর মা মধ্য যুগে পড়ে আছে। সি ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড মাই পরিশ্রম মাই টেনশন। বয়স বাড়ছে রে তোজু। নায়ক ছিলুম এখন খলনায়ক। দেহপট সনে নট সকলি হারায়, কী দারুণ একটা কথা রসরাজ বলে গেছেন। তোকে দেখলে আমি চল্লিশ বছর আগে ফিরে যাই। তুই বাবা আমার কাছে কাছে থাকিস।’ বলেই তিনি পাশ ফিরে কোলবালিশটা জড়িয়ে ধরলেন এবং দু-মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন।

এরপর তিনি মদ খেয়ে ফিরলেও কাউকে টের পেতে দিতেন না। তার গাড়ি থামার শব্দ পেলে তোজু নীচে নেমে দরজায় দাঁড়াত। কানাইলাল পছন্দ করতেন না কেউ তাকে ধরে দোতলায় তুলে দিক। ছেলের কাঁধে হাত রেখে সিঁড়ি ভেঙে উঠতেন। একদিন তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করলেন। ঘরে এসে ঘামছিলেন। তার মুখের দিকে তাকিয়ে তোজু বলল, ‘শিগগিরি শুয়ে পড়ো।’ পাখার রেগুলেটর ঘুরিয়ে ফুলস্পিড করে দিয়ে সে কামিনীকে ডেকে আনল।

উদবিগ্ন মুখে তিন মেয়ে বাবার মাথার কাছে দাঁড়াল।

‘আমি ডাক্তার রায়কে ডেকে আনছি।’ তোজু বেরিয়ে গেল।

‘ব্যথা করছে? কষ্ট হচ্ছে?’ কামিনী স্বামীর বুকে হাত রেখে ভীত গলায় বললেন। মেজোমেয়ে সুনীলা বলল, ‘বাবা বড্ড পরিশ্রম করে। কয়েক মাস রেস্ট নিতে বাড়িতে থাকুক।’

‘বললেই কী আর শুনবে।’ সেজোমেয়ে সুষমা ফ্রক ছেড়ে সালোয়ার-কামিজ সদ্য ধরেছে, সে ঠোঁট বাঁকিয়ে নীচু স্বরে বলল, ‘বাড়িতে থাকলে ওসব খাওয়া তো বন্ধ হয়ে যাবে।’

ছোটোমেয়ে সুরমা দিদিদের কথায় যোগ দিল না, শুধু মাকে মনে করিয়ে দিল, ‘মা উনুনে কিছু চাপিয়ে এসেছ কি?’

‘হ্যাঁ, তাইতো, সুধি দৌড়ে গিয়ে গ্যাসটা বন্ধ করে আয়। চা পরে খাব আগে ডাক্তার আসুক।’

হাতে ছোটো কার্ডিয়োগ্রাফ যন্ত্র ঝুলিয়ে ডাক্তার এলেন। যন্ত্রে হার্টের অবস্থা পরীক্ষা করে কাগজের ফিতেয় আঁকাবাঁকা উঁচুনীচু স্পন্দন রেখার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তেমন কিছু তো দেখছি না। ভয় পাওয়ার মতো কিছু নয় তবে সাবধানে থাকতে হবে। ওর যা পেশা তাতে হার্টের ওপর স্ট্রেইন হবেই। এক মাস অন্তত রেস্টে থাকুন।’

সুনীলা তোজুর দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞের মতো বলল, ‘আমি তো একথাই বলেছি একটু আগে। আমাদের ক্লাসের শিপ্রার বাবাকে ডাক্তার ঠিক এই কথাই বলেছিল।’

ব্লাড প্রেশার পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু ভ্রূ কোঁচকালেন। চারটে ওষুধ লিখে দিয়ে চারশো টাকা নিয়ে ডাক্তার চলে যাবার আগে কামিনীকে বলে গেলেন, ‘ড্রিঙ্কস একদম বন্ধ, সিগারেট একটাও নয়।’

তোজু ওষুধ কিনতে বেরোবার আগে ফোন করল ধীরাকে আর ভবেশ সাহাকে। আধঘণ্টার মধ্যে হাজির হল জয়দেবকে সঙ্গে নিয়ে ধীরা। জয়দেবকে দেখে কানাইলাল অবাক হয়ে বললেন, ‘এ কী চেহারা হয়েছে তোমার। অসুখ-বিসুখ হয়নি তো?’

জয়দেবের মুখে ফুটে উঠল বেদনার ছাপ। সে শুকনো হেসে বলল, ‘গ্যাস্ট্রিকটা ইদানীং বেড়েছে। চিন্তার তো শেষ নেই, খাওয়া-দাওয়াটাও ঠিকমতো হচ্ছে না।’ মুখ থেকে বেদনা সরিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার এরকম কেন হল?’ তোজু বলল ‘একটা মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে, ডাক্তারবাবু ওকে তাই বলেছেন।’

‘সব বাজে কথা। আমাকে ভয় দেখাবার জন্য বলেছে যাতে বাড়িতে বন্দি করে রাখা যায়। এই দ্যাখ আমি ফিট।’ বলেই কানাইলাল তড়াক করে বিছানায় উঠেহাঁটু গেড়ে বসে একটা ডিগবাজি দিয়ে সদর্পে জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

‘গ্যাস জমে বুকে সামান্য ব্যথা হয়েছিল। সেটাকেই মাইল্ড অ্যাটাক বলে রটাচ্ছে।’

এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল ধীরা। সে বলল, ‘বাবা বাহাদুরি আর দেখিয়ো না। এই বয়সে ডিগবাজি দিলে মটাস করে শিরদাঁড়া ভেঙে যাবে। ডাক্তার যা বলবেন তাই করো। দেখছ না ডাক্তারের কথা অগ্রাহ্য করে ওর চেহারা কী হয়েছে? দুশ্চিন্তা বলে দুশ্চিন্তা! ব্যবসায় টানাপোড়েন তার সঙ্গে মামলা।’

কানাইলাল জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন জামাইয়ের দিকে। জয়দেব বলল, ‘কী কুক্ষণেই যে দোকানটা ভাগ হয়েছিল। আগে জ্যাঠামশাই ছিলেন মাথার ওপর, তিনিই সব কিছু চালাতেন। এখন আমাদের ভাগের দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। সেটা পছন্দ হল না আমার দুই ভাইয়ের। ওদের বললুম এই রেডিমেড গার্মেন্টসের দোকান যেভাবে চালানো হচ্ছে সেভাবে আর চলবে না। মডার্ন টেস্টের মালপত্তর রাখতে হবে, নতুন করে দোকান সাজাতে হবে। এজন্য দরকার কম করে দু-লাখ টাকা, অথচ হাতে টাকা নেই। বললুম তোরা টাকা জোগাড় কর, না পারলে অন্য কোনো ব্যবসা ধরা যায় কি না সেটা দেখ, ভেবেচিন্তে কিছু একটা কর।’

ধীরা বলল, ‘তোমরা কথা বলো আমি ওঘরে যাচ্ছি। পরশু মা ফোন করেছিল কী যেন বলবে আমাকে, শুনে আসি।’

ধীরা বেরিয়ে যাবার পর জয়দেব শুরু করল, ‘জনা এক মাড়োয়ারি ছোকরাকে আনল। সে আইসক্রিম পার্লার করতে চায় দোকানের অর্ধেকটা ভাড়া নিয়ে। এককথায় ভাগিয়ে দিলুম। তাইতে জনা রেগে আগুন। যাচ্ছেতাই বলল আমাকে। বিষ্টুও আনল একটা পার্টি কিন্তু একই ব্যাপার ফিফটি-ফিফটি পার্টনারশিপে উপহারের, ঘর সাজাবার জন্য পেতলের কাঠের, পাথরের জিনিস বিক্রি করবে। মালপত্তর ওরা দেবে আমরা দেব ঘর। ক্যাশেও বসবে ওদের লোক, আমরা হব সেলসম্যান। পত্রপাঠ বিদেয় করি। একটা ফ্রেঞ্চ কোম্পানি, ওয়ার্ল্ড ফেমাস, নানারকম চামড়ার ব্যাগ আর সুটকেস তৈরি করে, ওরা কলকাতায় সেলস আউটলেট খুঁজছে। কপাল ঠুকে চিঠি দিলুম, ইন্সপেক্ট করে লোকেশন পছন্দ হল ওদের। কমিশন দেবে থার্টিথ্রি পারসেন্ট। তবে আর্নেস্টমানি তিন লাখ দিতে হবে। নিউ মার্কেটের মতো জায়গা যত ছোটোই হোক কেউ কি ছাড়ে? ভাইদের বসিয়ে বললুম তোরা রাজি হ, ওদের সঙ্গে তা হলে এগ্রিমেন্ট করি। ওরা ঘাড় নাড়ল, বলল, ধারধোর করে দু-জনে এক লাখ টাকা তুলে দেবে, বড়দা, বাকি দু-লাখ তুমি জোগাড় করো। আমি কোথা থেকে জোগাড় করব? ধীরা বলল বাবাকে বলে দেখি।’

কানাইলাল বললেন, ‘কই ধীরা তো আমাকে কিছু বলেনি! বললে নিশ্চয় চেষ্টা করতুম। চিৎপুরে এখনও আমাকে পাবার জন্য অনেক গদিওয়ালা মুখিয়ে আছে। ভেবো না, দু-লাখ জোগাড় হয়ে যাবে। তুমি তো সোজা আমাকেই বলতে পারতে, আমিও কি তোমার বাবা নই?’

জয়দেব দু-হাতে কানাইলালের দুটো পা আঁকড়ে ধরল, ‘বাবা আমাকে বাঁচান। ভাইয়েরা আমার নামে মামলা করেছে, আমি নাকি ওদের বঞ্চিত করে দোকানটা দখল করতে চাইছি। ওদের সম্মতি ছাড়া আমি যেন কোনো এগ্রিমেন্ট কারোর সঙ্গে না করি। কোর্ট ওদের পক্ষেই রায় দিয়েছে। এখন দু-লাখ পেলে ভাই দুটোকে বুঝিয়ে দিতে পারব আমি তোদের ঠকিয়ে দোকানটা কবজা করতে চাই না। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন মহলে ওরা রটিয়ে দিয়েছে দাদা ওদের ভাগিয়ে দোকান দখল করতে চাইছে। কী লজ্জার কথা!’

কানাইলাল অবাক হয়ে বললেন, ‘অ্যাতো কাণ্ড হয়ে গেছে অথচ আমি এর বিন্দুবিসর্গও জানি না! অবশ্য বিয়ে হয়ে গেলে মেয়ে তো আর বাবার থাকে না, তখন সে শ্বশুরবাড়ির, বাবা তখন পর। কিছুদিন অপেক্ষা কর, বাড়ি থেকে আগে বেরোই।’

কানাইলাল মনে মনে দ্রুত ভেবে নিলেন ব্যাঙ্কে আর পোস্ট অফিসে ছয় বছর মেয়াদি সার্টিফিকেটে কত টাকা আছে। লাখখানেক তো হবেই। জয়দেবকে দিতে অসুবিধা হবে না। টাকা জমাচ্ছেন গাড়ি কেনার এবং নীলার বিয়ের জন্য। এ ছাড়া আর কোনো খরচ আপাতত আছে বলে তার মনে হল না। নিশ্চিন্ত বোধ করে তিনি জয়দেবকে বললেন, ‘নীলা তো এবার পার্ট-টু দেবে। একটা ভালো ছেলে দেখে দাও তো।’

জয়দেব বলল, ‘এখনই কেন, বি এ-টা পাশ করুক। ভালো ছেলেরা বি এ পাশ বউ চায়।’

‘তোমার বউ তো বি এ পাশ নয়, তার মানে কি তুমি ভালো ছেলে নও?’ কানাইলাল সস্নেহে জামাইয়ের দিকে তাকালেন। জয়দেব লাজুক হেসে মুখ নামিয়ে বলল, ‘ভালো ছেলে আর হলুম কই! আপনার মেয়ে ছেঁড়া শাড়ি সেলাই করে বাড়িতে পরে! নতুন শাড়ি কিনে দেবার ক্ষমতা যার নেই তাকে ভালো ছেলে বলবেন?’

এই সময় দু-কাপ চা নিয়ে এল নীলা। মেয়েদের মধ্যে কানাইলালের সেজোমেয়েটিই বাবার মতো গৌরবর্ণ, লম্বা এবং আকর্ষণীয় গড়নের। কথাবার্তাতেও পটু।

দু-জনের হাতে কাপদুটো দিয়ে নীলা বলল, ‘বাবা ডাক্তারবাবু কিন্তু কথা কম বলতে বলেছেন।’

‘কখন বলল?’

‘সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দাদাকে বলে গেছেন। বোনাইবাবু ভাত খেয়ে যাবেন কিন্তু।’

জয়দেব তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আমাকে দোকান যেতে হবে। আমি উঠি এখন।’ দ্রুত চুমুক দিয়ে দিয়ে কাপের চা শেষ করে সে উঠে দাঁড়াল, ‘তোমার দিদি বরং খেয়ে যাক। বাবা আমি আসি। ফোনে খবর নোব কিংবা আপনিও খবর দিতে পারেন।’

জয়দেব চলে যাবার পর নীলা জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা, কীসের খবর তুমি দেবে?’

‘তেমন কিছু নয়। ব্যবসার একটা পার্টনার খুঁজছে যে টাকা ঢালবে। বললুম খোঁজ পেলে জানাব। আজকের খবরের কাগজটা কোথায় রে?’

তোজু ওষুধ কিনে এনেছে। দুটো বড়ি বাবাকে খেতে দিয়ে বলল, ‘দুপুরে খাওয়ার পর এইটা, রাতে খাওয়ার পর এইটা।’ ওষুধের দুটো পাতা তুলে দেখাল। ‘এখন তো বেশ ভালোই আছ মনে হচ্ছে। তবে বাড়ির বাইরে ক-টা দিন আর যেয়ো না। ভারী কিছু তুলো না, ছাদে গিয়ে একটু হাঁটতে পারো, হজম হয় এমন হালকা খাবার খেতে হবে। দুটো ব্লাড টেস্ট করিয়ে নিতে বললেন ডাক্তারবাবু।’

‘আর? উপুড় হয়ে নয়, চিৎ হয়ে শুতে হবে, রোজ নয় দু-দিন অন্তর দাড়ি কামাতে হবে।’

‘ঠাট্টা নয়। তোমার ব্লাড প্রেশার নর্ম্যালের অনেক ওপরে। দুশ্চিন্তা, উত্তেজনা হয় এমন ব্যাপার থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।’

‘দুশ্চিন্তা তো তুই মাথায় ঢুকিয়ে দিলি অতগুলো নিষেধ জারি করে।’

বিকেলে ভবেশ সাহা এলেন। সদাব্যস্ত মানুষ। অবশ্য ব্যস্ত থাকারই কথা। চারটে ব্যবসা। দুটো দোকান ছাড়াও সামলাতে হয় অন্নপূর্ণা অপেরাকে। ধুতি ফুটশার্ট পাম্পশ্যু, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, পাঁচ ফুট দু-ইঞ্চি, ঘাড়ে গলায় চর্বি। খসখসে কণ্ঠস্বর, ভবেশ সাহার এটাই বাইরের চেহারা। ভিতরের রূপটি সম্পর্কে নানান মত আছে। কেউ বলেন ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা হিসেবের খাতা। অনেকের মতে খাতা নয় কপাল। কোনো ব্যবসায় লোকসানের মুখ দেখেননি।

‘কী হল কানাইবাবু? ছেলে তো ফোন করে বলল বাবার স্ট্রোক হয়েছে, কতবার আপনাকে বলেছি ওইসব ছাইপাঁশ খাবেন না। ডাক্তার কী বলছে? আপনাকে তো এখন বেশ ফিট দেখাচ্ছে।’ ভবেশের স্বরে কিঞ্চিৎ সন্দেহের মিশেল। কোনো কিছু প্রথমেই তিনি বিশ্বাস করে নেন না, ওর ব্যবসায়িক সাফল্যের এটা অন্যতম কারণ।

‘দেখাচ্ছে তো বটেই, আমি তো চিকেন পক্সের রোগী নই যে চামড়ায় রোগ ফুটে থাকবে। টেবলে কার্ডিয়োগ্রাফটায় সব বলা আছে, দেখে নিন।’ কানাইলাল আঙুল দিয়ে দেখালেন। সত্যমিথ্যা সন্দেহ ভঞ্জনের জন্য ভবেশ টেবলের কাছে গিয়ে কাগজের ফিতেটা দেখলেন। কী বুঝলেন কে জানে। প্রেসক্রিপশনটা পড়লেন, ওষুধের পাতাগুলো নাড়াচাড়া করে ফিরে এলেন।

‘ডাক্তার কী বললেন?’

‘রেস্ট। দু-মাস।’ শান্তমুখে বললেন কানাইলাল।

‘ওটা দু-হপ্তা হয় না?’

‘হয়। পাঁচ লাখ টাকার একটা লাইফ ইন্সিয়োরেন্স যদি করে দেন।’

‘ইন্সিয়োরেন্স আপনার করা নেই!’ ভবেশ তাজ্জব হয়ে গেলেন।

‘আপনার করা আছে?’

ভবেশ ডান হাত তুললেন বললেন, চার আঙুলে পাথর বসানো আংটি। ‘পঁচাশি বছরের আগে মরব না। মিছিমিছি প্রিমিয়ামের টাকা গুনব কেন? দু-হপ্তা না হলে বেশ তিন হপ্তা? সত্যচরণকে দিয়ে নয় চালিয়ে দোব এই ক-টা দিন। মালদা আর বহরমপুরে চারটে বায়না রয়েছে সামনের মাসে। আপনি আর আলপনা আসরে না নামলে কোনো পার্টি ফুল পেমেন্ট করবে না বলেছে। কানাইবাবু, বহু হাজার টাকা লোকসান হয়ে যাবে। শিবুকে দিয়ে নতুন পালা লেখাচ্ছি, পৌরাণিক। এখন দেবদেবীদের লীলাখেলা লোকে আবার দেখতে চায়। টিভি সিরিয়ালগুলো দেখেন না তো, দেখুন। যদি সমাজকে বুঝতে চান তা হলে রামায়ণ মহাভারত দেখুন। রাস্তা সুনসান ফাঁকা। সারা দেশ টিভির সামনে বসে। এই পাবলিকই আমার লক্ষ্মী। শিবুকে বলেছি পাশা খেলা আর বস্ত্রহরণের ঘটনাদুটো নিয়ে মহাভারতের একটা পিস হাইলাইট করে পালা লিখে দিতে।’

‘আপনি বলছেন লোকে দেখবে?’

ভবেশ ঊরুতে চাপড় মেরে বললেন, ‘দেখবে না মানে গোগ্রাসে দেখবে! নট দুলাল শকুনি পাশা খেলছে, সাট্টার রমরমা দেখেননি? ভাগনেদের কুপরামর্শ দিচ্ছে, বোকা যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বাজি ধরল, হারল। তারপর দুঃশাসনের খেল। আলপনা দাঁড়িয়ে থাকবে আর তরুণ শাড়ির আঁচল ধরে ওকে ঘুরে ঘুরে শাড়ি খুলবে, খুলতে খুলতে শায়া-সিনটা একবার ভাবুন আলপনার ফিগারটাও সেই সঙ্গে ভাবুন।’

‘ভেবেছি। এই মহাভারত আগে লেখা হোক তো, অনেক দেরি আছে। তবে তিন মাস আমি বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি না।’ কঠিন গলায় কানাইলাল কথা শেষ করলেন। ওর মুখের ভাব লক্ষ করে ভবেশ আর কথা বাড়ালেন না।

‘বেশ। শরীর মানুষের সম্পদ, আপনাকে সম্পদ নষ্ট করতে বলব না। হাজার ষাটেক টাকা গচ্চচা যাবে, যাক। শরীরও সম্পদ টাকাও সম্পদ তবে শরীরের দাম বেশি। টাকা গেলে টাকা আসে, শরীর গেলে আর আসে না।’ ভবেশ উঠে দাঁড়ালেন। ‘আপনাকে আমার দরকার, আপনারও আমাকে দরকার।’

ভবেশ দরজার বাইরে জুতোয় পা গলাচ্ছেন তখন কানাইলাল তাকে ডাকলেন।

‘একটা অনুরোধ করব। রাখলে আপনার অনুরোধটাও রাখব।’

জিজ্ঞাসু চোখে ভবেশ তাকিয়ে রইলেন।

‘তিন সপ্তাহ পর্যন্ত আমাকে রেস্ট দিতে চেয়েছেন তিন মাসের বদলে। আমি দু-সপ্তাহ রেস্ট নিয়ে আবার যাত্রা করব।’

ভবেশ জুতো থেকে পা বার করে ঘরে ঢুকে এলেন।

‘আমাকে এক লাখ টাকা দিতে হবে।’

‘কী ব্যাপার? অ্যাতো টাকা!’

‘অ্যাডভান্স, যাত্রা করে শোধ দোব। রাজি?’

‘হলদিয়ায় একটা গেস্ট হাউস করতে যাচ্ছি। এক লাখ টাকা এখন তো দেওয়া মুশকিল। মেরে কেটে হাজার পঞ্চাশ দিতে পারি। না কানাইবাবু এর বেশি পারব না।’ হাতজোড় করলেন ভবেশ সাহা।

‘তা হলে আমিও প্রাণের ঝুঁকি নেব না।’ কানাইলাল মনে মনে বললেন, পিঁপড়ে টিপে গুড় বার করো ভবেশ, তোমাকে হাড়ে হাড়ে চিনি।

‘এই তো আমাকে আবার খেলাচ্ছেন। পঁচাত্তর, রাজি হয়ে যান। গেস্ট হাউসে অনেক টাকা লাগাতে হবে।’

‘এক পয়সাও কম নয়।’ কানাইলাল স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন ভবেশের দিকে। বুঝলেন লোকটা দ্রুত হিসেব কষছে।

‘আচ্ছা এক লাখ তবে এক্ষুনি দিতে পারব না। মাসখানেক সময় দিন।’

কানাইলাল ভেবে নিলেন জয়দেবকে এই এক লাখ ছাড়া আরও এক লাখ দিতে হবে। সেটা দিতে হলে পোস্ট অফিসের অনেকগুলো সার্টিফিকেট ভাঙাতে হবে। সরকারি ব্যাপার, তিনদিনে যে কাজ হওয়া উচিত সেটা একমাসও লেগে যেতে পারে। ওগুলো ম্যাচিওর করেনি, এখনও ছ-মাস থেকে চার বছর বাকি। সেজন্য সুদের টাকা কম পাওয়া যাবে, ব্যাঙ্ক থেকে তুলে বাকিটা পূরণ করে দু-লাখ হয়ে যাবে।

‘এক মাস, ঠিক বলছেন নড়চড় হবে না?’

‘ঠিক বলছি। আজ সতেরো তারিখ সামনের সতেরোয় ক্যাশ দিয়ে যাব।’

‘সামনের পয়লা তারিখে আমি গদিতে যাব তারপর।’

কানাইলাল বিকেলে ছাদে পায়চারি করছেন। আট বছর পর ছাদে উঠলেন। শেষবার উঠেছিলেন বিশ্বকর্মা পুজোর দিন।

বারো বছরের মজু বাবার ঘুড়ি ওড়ানো দেখছিল। ওর দুই দিদি ধীরা, নীলা আর দাদা তোজুও ছিল ছাদে। একটা ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে ভেসে যাচ্ছিল ছাদের উপর দিয়ে, পাঁচিল ঘেঁষে রাস্তায় নেমে যাচ্ছে। মজুর মাথার উপর দিয়ে কাটা ঘুড়ির সুতো চলে যাচ্ছে। সে সুতোটা ধরার জন্য ছুটল। নীচু পাঁচিলে ঝুঁকে হাত বাড়ায় ধরার জন্য। কোমর থেকে শরীর বার করে সুতো ধরতে গিয়ে ভার সামলাতে পারেনি। চারজনের চোখের সামনে মজু উলটে দিয়ে নীচের রাস্তায় পড়ে যায়। দুর্গাপুজোয় পরার জন্য মজুর নতুন জামা প্যান্ট আর জুতো কামিনী আলমারিতে তুলে রাখে। প্রতি বছর বিশ্বকর্মা পুজোর দিন সেগুলো বার করে শোয়ার ঘরের টেবলে সাজিয়ে ফুল ছড়িয়ে দেয়।

ছাদে পায়চারি করতে করতে কানাইলাল পাঁচিলের ধারে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে নীচে তাকালেন। গাঁথুনি চুন সুরকির, পাঁচিলের উপরের ইটের পলেস্তারা খসে পড়ে ইট আলগা হয়ে রয়েছে। কানাইলাল সরে এলেন। তার মধ্যেই দেখে ফেলেছেন কার্নিশে একটা অশ্বত্থ গাছ ডালপালা মেলে ঝাঁকড়া হয়ে উঠেছে। ছাদের মেঝেয় ফাটল ধরে নীচের কলঘরে জল পড়ত। তোজু পিচ লাগিয়ে ফাটল বোঁজায়। একটা কালো সাপের খোলসের মতো হয়ে রয়েছে। কানাইলাল পায়চারি করতে করতে স্থির করলেন শুধু ছাদটাই নয় গোটা বাড়িটাই সারাতে হবে, পুবমুখো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দাদা বাড়িটা প্রমোটারকে দিয়ে ভেঙে নতুন তিনতলা ফ্ল্যাট বাড়ি তুলেছে। নিজের জন্য নীচের তলা বাকি দুটো প্রমোটারের। চার ঘর পরিবার তাতে বাস করে। ফ্ল্যাটগুলো প্রশস্ত।

ওবাড়ির ছাদে একটি ফ্রকপরা মেয়ে শুকনো কাপড় দড়ি থেকে তুলছে। কানাইলাল পাঁচিলের ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। মেয়েটি বার দুই-তিন তার দিকে তাকাল। কানাইলাল হাসলেন, মুখ নামিয়ে মেয়েটি তাড়াতাড়ি ছাদের দরজার দিকে চলে গেল। তার মনে হল মেয়েটি গ্রাম থেকে এসেছে, কৈশোর শরীর ছুঁয়েছে। এইরকম একটি মেয়ে তাদের সংসারেও কাজ করতে এসেছিল হুগলির এক গ্রাম থেকে। বছর দুয়েক পর চোদ্দো বছরের মেয়েকে ওর মা বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যায় বিয়ে দেবার জন্য, এই মেয়েটি কতদিন থাকবে? বড়োজোর আর বছরখানেক।

‘বাবা বিকেলের ওষুধটা খেয়েছ?’

তোজু ছাদে উঠে এসেছে। কানাইলাল হাত তুলে বললেন, ‘হ্যাঁরে বাবা খেয়েছি। তোজু তুই ছাদে আর উঠিস না বোধহয়, কী অবস্থা হয়েছে দেখেছিস? এবার সারাতে হবে। বহু বছর কলি পড়েনি সেই ধীরার বিয়ের সময় ঘরগুলো আর দালানটা চুনকাম হয়েছিল। তোর চেনা রাজমিস্ত্রি থাকলে আসতে বল, একটা এস্টিমেট আগে দিক। আর শঙ্করের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নে। সার্টিফিকেটগুলোয় তো পাঁচদিন আগে সই করিয়ে নিয়ে গেল। কবে টাকা পাওয়া যাবে সেটা যদি বলতে পারে।’

‘টাকা তোলার হঠাৎ দরকার পড়ল কেন?’ বাবার পাশে হাঁটতে হাঁটতে তোজু কৌতূহল দেখাল। কানাইলাল দাঁড়ালেন।

‘একটাই কারণ। জয়দেব ভাইদের আর দোকানটা নিয়ে বিপদে পড়েছে।’ কানাইলাল আবার চলতে শুরু করলেন। ‘ওর ভাই দুটো কী জিনিস জানিস তো। ছেলেটার উচ্চচাকাঙ্ক্ষা আছে, বড়ো হতে চায়। নতুনভাবে ব্যবসা করতে চায়। এটা আমার খুব ভালো লেগেছে। ওকে আমি সাহায্য করতে চাই। কাউকে বলিনি, জয়দেব আমার কাছে দু-লাখ টাকা চেয়েছে। এক লাখ ব্যাঙ্ক আর পোস্টাপিস থেকে ম্যানেজ করতে পারব, বাকি এক লাখ চেয়েছি ভবেশের কাছে। ও দেবে বলেছে তবে ওর লোকসান যাতে না হয় সেটা আমায় দেখতে হবে।’

তোজু থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দেখতে হবে মানে? কীভাবে দেখবে?’

‘যাত্রা করে দেনা চোকাব বলেছি।’

‘এই শরীর নিয়ে যাত্রা!’

‘আমি এখন ফিট। মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে বলে তো রোজগার বন্ধ করে বাড়িতে বসে থাকা যায় না। স্ট্রোক হওয়া মানুষদের ব্যক্তিগত নানান সমস্যা থাকে, ডাক্তাররা তো সেটা বোঝে না। ওরা কেতাবি বিদ্যেমতো রুটিন আউড়ে যায়। ওসব মানলে আমার চলবে না। তোর লেখাপড়ার খরচ, বাড়িটা সারানো, জয়দেবের সমস্যা মেটানো, নীলার বিয়ের কথা ভাবতে হচ্ছে, সেটাও তো বড়ো এক খরচের ব্যাপার, আপাতত এইগুলোই আমাকে দুর্ভাবনায় ফেলেছে। তোজু, যাত্রায় আমাকে নামতে হবেই আর এই পয়লা থেকেই। জানি তুই কী বলবি কিন্তু আমি তা শুনব না। বাঁচতে হলে ভালোভাবে বাঁচা উচিত। যেসব কাজ করে যেতে পারলে সুখ বোধ করব, সেই কাজগুলো করতে পারাই ভালোভাবে বেঁচে থাকা। তোজু, তুই আমাকে সাহায্য কর, আমাকে ভালোভাবে বাঁচতে দে।’

তোজু শুনতে শুনতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল। বাবার কনুই চেপে ধরে বলল, ‘বাবা এক্ষুনি যাত্রা শুরু করলে তোমার প্রাণসংশয় হতে পারে। ডাক্তার রায় এমনই আমাকে বলেছেন, খুব সাবধানে এখন তোমায় জীবন কাটাতে হবে।’

‘তোজু, এক একজনের সাকসেস এক এক ভাবে আসে। আমি গণ্ডমুখ্যু। আমি শম্ভু মিত্র নই, তারাশঙ্কর মেঘনাদ সাহা নই, উদয়শঙ্কর সত্যজিৎ নই, হেমন্ত মুখুজ্জেও নই। যতটুকু সাকসেস পেয়েছি অন্নপূর্ণা অপেরার দৌলতে যাত্রার অ্যাকটর হয়ে। এটা ছাড়া আমার সামনে আর কোনো রাস্তা ছিল না নিজেকে জাহির করার। খুব বড়ো একটা কিছু করছি বলে কোনোদিন ভাবিনি। শুধু ভেবেছি সংসার চালানোর জন্য রোজগার করতে হবে। তাই করতে করতে নাম করে ফেললুম। এটা স্রেফ পড়ে পাওয়া ধন চোদ্দো আনা। দেখছিস যাত্রার অভ্যেস কীরকম মজ্জায় ঢুকে গেছে! তোকে কেমন একটা ডায়লগ ঝেড়ে দিলুম।’ কানাইলাল হাসতে শুরু করলেন, হাসিতে শব্দ হল না। ‘যদি এনকোর দিস তা হলে কিন্তু রিপিট করতে পারব না।’

‘বাবা, তোমার নিজস্ব কোনো শখ কি সাধ ছিল না যা পূর্ণ করতে পারনি?’ বাবার বাহু ধরে হাঁটছে তোজু, স্বর নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

‘শখ? সাধ?’ কানাইলাল সামনে নন্দলালের ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ‘একটা নতুন অ্যাম্বাসাডার। দাদা কিনেছিল সেকেন্ডহ্যান্ড, আমি কিনব নতুন। টাকা জমাচ্ছিলুম, ধীরার বিয়েতে খরচ হয়ে গেল। আবার জমাতে শুরু করি এটাও খরচ হয়ে যাবে। খরচগুলো এমন আচমকা ঝপ করে সামনে লাফিয়ে এসে পড়ে না? জানি এবারও আর গাড়ি কেনা হবে না। যাক গে।’ কানাইলাল মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলেন বিষয়টা।

ওবাড়ির তিনতলার ছাদে দুটি তরুণী গল্প করতে করতে ঘুরছে। ওদের দিকে তাকিয়ে কানাইলাল বললেন, ‘ওবাড়িতে কারা থাকে বল তো? সব ফ্ল্যাটেই তো এসি মেসিন দেখি, পয়সাওলা লোক, কী করে জানিস?’

‘সবার জানি না। তিনতলায় স্বামী-স্ত্রী স্কুল মাস্টার, স্বামীর টিউটোরিয়াল আছে, তার পাশে ডাক্তার। দোতলায় অবাঙালি, মণিমুক্তোর ব্যবসা করে আর একজন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। একতলাটা তো জ্যাঠামশায়ের।’

‘সনৎ তো দিল্লিতে থাকে?’

‘হ্যাঁ। ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড কমার্স মিনিস্ট্রিতে আছে।’

‘প্রচুর টাকা নিয়ে দাদা ওর বিয়ে দিয়েছে, তেমনি প্রচুর টাকা দিতেও হয়েছে মেয়ের বিয়েতে। পূর্ণ এখনও হায়দ্রাবাদেই আছে, জামাই বদলি হয়নি?’

‘বলতে পারব না। ওদের অত খোঁজখবর রাখি না। শুধু জানি সঞ্জীবদা ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। তারপর কীভাবে যেন ম্যানেজ করে নেয়।’

সেই ফ্রক পরা কাজের মেয়েটিকে কানাইলাল আবার দেখতে পেলেন, ছাদে দুই তরুণীর সঙ্গে কথা বলছে। এখন ফ্রক নয়, সালোয়ার-কামিজ পরা, চুলে রিবন। মুখ পরিষ্কার ঝকঝকে।

তোজু বলল, ‘ওই মেয়েটাকে সেদিন ধমক দিয়েছি। দুপুরে সিঁড়ির জানলায় বসে টোপা কুল খাচ্ছে আর বিচিগুলো ছুড়ে ছুড়ে আমাদের কলঘরের মধ্যে জানলা দিয়ে ফেলছে, আমি তখন কলঘরে ছিলুম দেখতে পায়নি। টেনে এক ধমক দিতেই দুড়দুড় করে নীচে নেমে গেল।’

‘কলঘরের জানলার নতুন পাল্লা লাগাতে হবে, কাপড় টাঙিয়ে আর চলছে না। তুই রাজমিস্ত্রির খোঁজ তাড়াতাড়ি নে সেইসঙ্গে ছুতোর মিস্ত্রিরও। হাতে টাকা থাকতে থাকতে ব্যাপারগুলো সেরে ফেলতে হবে। কলঘরটা বড্ড বেআব্রু জানলার জন্য। চল এবার নীচে যাই।’ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললেন, ‘মাঠে যাসটাস? কার্ডটা রিনিউ করতে কখনো ভুলিসনি।’

পয়লা তারিখে সন্ধ্যায় নিমতলা স্ট্রিটে অন্নপূর্ণা অপেরার গদিতে কানাইলাল হাজির হলেন। ব্যস্ত হয়ে উঠলেন ভবেশ সাহা। হাঁকডাক করে কোকাকোলার বোতল আনালেন। কানাইলাল খেলেন না, কাজের কথায় এলেন।

‘নেক্সট যাত্রা কবে?’

‘সামনের শনিবার শক্তিগড়ে। অন্তত তিরিশবার করেছেন ‘ছেঁড়া চটি ছেঁড়া আঁচল।’ পরিশ্রম কম হবে, ভোরেই বাড়ি পৌঁছে যাবেন। শিবু নতুন একটা কমিক সিন ঢুকিয়েছে তাতে অবিশ্যি আপনি নেই। তবে রবি সোম পরপর দু-দিন আছে, তমলুকে আর বাজকুলে, কাছাকাছি। তমলুকে হোটেলে থাকবেন। পুরোনো পালা ‘লক্ষ্মীর ঘরে অলক্ষ্মী,’ একবার পড়ে নেবেন নাকি?’ ভবেশ পাঁচালি পড়ার মতো বলে গেলেন।

‘হ্যাঁ, খাতাটা দিন। আজকাল মেমারিটা কেমন গোলমাল করছে। আপনার মালদা বহরমপুরটা কবে?’

‘বাজকুলের পর গঙ্গার ওপারে আপাতত বায়না নেই। এপারে মালদা দিয়ে শুরু তারপর বহরমপুরে, বসিরহাটে, শেষ মধ্যমগ্রামে।’

‘ফোন করে জানিয়ে দেবেন শনিবার কখন গাড়ি পাঠাচ্ছেন।’

নাটকের খাতা নিয়ে কানাইলাল ফেরার পথে ট্যাক্সি থামিয়ে হুইস্কি কিনে বাড়িতে ঢুকলেন।

রাত্রে খাটে উঁচু বালিশে পিঠ রেখে পা ছড়িয়ে কানাইলাল ‘লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী’ পড়ছিলেন, পাশের টুলে হুইস্কির গ্লাস। শুতে এলেন কামিনী।

‘আর কতক্ষণ পড়বে? পড়ারও একটা ধকল আছে।’

‘হ্যাঁ, যাত্রা করার থেকেও বেশি ধকল।’ নিস্পৃহ স্বরে বললেন কানাইলাল।

কামিনী চুপ করে রইলেন। কানাইলাল খাতাটা পাশে রেখে বললেন, ‘ধীরা আর কিছু বলল?’

‘ফোনে আর কত বলা যায়। ভাইয়েরা জয়দেবকে মারধোর করেছে শুধু এইটুকু বলল। আর বলল, বাবা টাকা জোগাড় কবে করবে?’

‘তোজু কাল একবার প্রণবেন্দুর বাড়িতে যাক। পোস্টাফিসের এজেন্ট, ও ব্যাপারটা বোঝে। টাকা তোলার জন্য অথরিটি লেটার তো ওকে দিয়েছি। জিপিও থেকে অর্ডার এল কি না সেটা প্রণবেন্দুকে খোঁজ নিতে বলুক। ধীরাকে ক-টা দিন অপেক্ষা করতে বলো। শনিবার শক্তিগড় যাব তারপর থেকে তো টানা যাত্রা চলবে। আমি আর সময় পাব না।’

‘ধীরা বলছিল শ্বশুরবাড়িতে থাকাটা খুব নিরাপদ মনে করছে না।’

‘তা হলে এখানে চলে আসুক। তোমার কোনো অসুবিধে হবে কি?’

‘মেয়ে এসে থাকবে এতে আমার আবার অসুবিধের কী!’ তারপর স্বগতোক্তির মতো করে কামিনী বললেন, ‘ভালো ছেলে বড়ো ঘর দেখে মেয়ের বিয়ে দিলুম, শেষে অদৃষ্টে এই ছিল! জয়দেবেরও বাপু মানিয়ে গুছিয়ে চলা উচিত ছিল, বড্ড গোঁয়ার ধরনের। কী দরকার ছিল দোকান ভাগ করে আলাদা হওয়ার? আলাদা হয়ে ব্যবসা করার টাকা তো নেই। ভাইয়েরা কি আর সাধে চটেছে?’

কানাইলাল এক চুমুকে গ্লাস খালি করে আলো নিভিয়ে শুয়ে বললেন, ‘আমার মুখে মদের গন্ধ। ওপাশ ফিরে শোও।’

পরদিন তোজু জানাল, ‘যে অথরাইজেশন লেটারটা প্রণবেন্দুদাকে দিয়েছ তাতে সই করেছ কানাই সিনহা বলে, হবে কানাইলাল সিনহা। নতুন একটা চিঠি লিখে দাও। এই ভুলটা না করলে এতদিনে টাকা পাওয়া হয়ে যেত।’

‘আবার কেঁচে গণ্ডূষ! এটা তো প্রণবেন্দুর তখনই দেখা উচিত ছিল। কত ক্ষতি হয়ে গেল বল তো! চিঠিটার একটা জেরক্স কপি আছে, সেটা দে আর কাগজ কলম দে। বেচারা জয়দেব!’

চিঠি লিখে দিয়ে তোজুকে তিনি বললেন, ‘রাজমিস্ত্রির কথাটা মনে রাখিস, কাজ শুরু করতে দেরি করব না।’

শুক্রবার রাতে ভবেশ টেলিফোন করে জানালেন, ‘শনিবার ঠিক ছ-টায় গাড়ি যাবে, রাত দশটায় পালা শুরু হবে। দুপুরে খেয়ে দেয়ে ভালো একটা ঘুম দিয়ে নেবেন।’

কানাইলাল দুপুরে তার প্রিয় পুঁইশাক মাছের তেল ও কাঁটা দিয়ে রাঁধা ব্যঞ্জন দিয়ে প্রচুর ভাত খেয়ে আরামে ঘুমিয়ে বিকেলে উঠলেন, স্নান করলেন। পায়জামা পাঞ্জাবি পরে অপেক্ষা করছেন তখন সদর দরজা থেকে মোটরের হর্ন বাজল।

কামিনী জানলা দিয়ে উঁকি দিলেন, ‘একটা মেয়ে গাড়ি থেকে নামল। বোধ হয় যাত্রার মেয়ে, রংচঙ করা মুখ।’

সদর খোলা থাকে। মেয়েটি দোতলার দরদালানে উঠে এসে উঁচু স্বরে ডাকল, ‘কানাইদা আছেন? আমি আলপনা।’

ঘর থেকে কানাইলাল গলা তুলে বললেন, ‘কে রে আলু? ভেতরে আয়।’ কামিনীকে বললেন, ‘ওকে ভেতরে আনো।’

কামিনী দালানে বেরিয়ে বছর তিরিশের ছিপছিপে সুশ্রী আলপনাকে কড়া চোখে দেখে নিয়ে বললেন, ‘ভেতরে এসো।’

‘আপনি বউদি?’ আলপনা প্রণাম করল, কামিনীর চাহনি একটু নরম হয়ে গেল।

‘এখনও তো দশ মিনিট বাকি ছ-টা বাজতে। সঙ্গে আর কে আছে, চা খাবি?’ আলপনা ঘরে ঢুকতেই স্নেহমাখা গলায় কানাইলাল বললেন। কামিনীর দিকে তাকালেন, ‘সিমলের কড়াপাক আছে না? দুটো দাও আর চা।’

‘সঙ্গে তরুণ। কিন্তু ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পেটটা দম মেরে আছে। চা থাক শুধু একটা সন্দেশ। দাদার বাড়িতে প্রথম এলুম একটু মিষ্টি মুখে না দিলে বউদি শুনবেন কেন?’

কামিনী বেরিয়ে যেতেই কানাইলাল গলা নামিয়ে বললেন, ‘সঙ্গে নিয়েছিস তো?’

‘দুটো পাঁইট, গাড়িতে আছে।’ আলপনা ফিসফিসিয়ে বলল।

রাত সাড়ে ন-টায় গাড়ি পৌঁছল শক্তিগড়ে। আরও আগে পৌঁছনোর কথা, ট্র্যাফিকের জন্য তা সম্ভব হয়নি। আজ হঠাৎ গরম পড়ে গেছে, নভেম্বরে এটা হয় না। গাড়িতে কানাইলাল একটা পাঁইটের অর্ধেকেরও বেশি শেষ করেছেন, পুরোটাই করতেন আলপনা বোতল কেড়ে নেওয়ায় পারেননি। সেজন্য তিনি যৎপরোনাস্তি ক্ষুব্ধ। ক্ষোভটা তিনি উদ্গিরণ করলেন বিভূতি প্রামাণিকের উপর। বিভূতিকে এককথায় বলা যায় ভবেশ সাহার চোখ-কান-নাক, পোশাকি পদ অন্নপূর্ণার ম্যানেজার। দলের সঙ্গে সর্বত্র যান বগলে একটা ছোটো ব্যাগ নিয়ে। অতি বিনয়ী, মৃদুভাষী।

‘বিভূতি, খাওয়ার কী ব্যবস্থা হয়েছে?’ ঈষৎ জড়ানো স্বরে কানাইলাল বললেন।

‘এরা তো ভাত মাংসের ব্যবস্থা করেছে।’ বিভূতির সতর্ক গলা।

‘ভাত নয় আমি লুচি খাব। আর ল্যাংচা। শক্তিগড়ে এসে যে ল্যাংচা না খায় সে ব্যাটা মিষ্টির কিসসু জানে না। খাব আর এক হাঁড়ি নিয়ে যাব।’ দ্বিরুক্তি না করে বিভূতি সাজঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন লুচি আর ল্যাংচার ব্যবস্থা করতে। কানাইলাল সার দিয়ে মেঝেয় বসে মেক আপে ব্যস্ত অভিনেতাদের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। ঘামছেন। রুমালে কয়েকবার মুখ মুছলেন। তক্তপোশে রাখা তাকিয়া টেনে কোলে নিয়ে ঝুঁকে বসলেন।

একটু পরে বিভূতি এলেন। কানাইলালের কানে কানে বললেন, ‘দাঁয়েদের বাড়িতে আপনার আর মেয়েদের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। বলে দিয়েছি আপনি লুচি খাবেন। মেয়েরা ওই বাড়িতেই একতলার একটা ঘরে মেক আপ নিচ্ছে। বৃন্দাবন দাঁ ভীষণ বড়োলোক।’

রুক্ষ স্বরে কানাইলাল বললেন, ‘কথাটা বললে কেন? ভীষণ বড়োলোক তো আমার কী?’

‘আপনার বাবার নাম করতেই বললেন, ‘ওরে বাবা বেনেটোলার কেষ্ট সিংগির ছেলে! খুব নামি ঘর।’ বললেন আপনার এক কাকার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে ওনার ছোটোপিসির।’

‘ভদ্রলোকের নামটা কী, বয়স কত?’ কানাইলাল কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন।

জিভ কেটে বিভূতি বললেন, ‘ওটাই তো জানা হয়নি। আচ্ছা আমি জেনে এসে বলছি।’

বিভূতি জানতে গেলেন। কানাইলাল তাকিয়ায় মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লেন। তরুণ এক অভিনেতা সশ্রদ্ধ স্বরে বলল, ‘কানাইদা মেক আপ করবেন না? আপনার তো প্রথম সিন।’

কানাইলাল উঠে বসলেন। যেটুকু নেশা হয়েছিল তা ছুটে গেছে। মেক আপ অবশ্য সামান্যই। সামাজিক যাত্রা, দরিদ্র পরিবারের বাবা হতে হবে। চুল আর মুখে রং বদলানো ছাড়া আর কিছু করার নেই। আধময়লা ধুতি আর বগল-ছেঁড়া গেঞ্জিটা পরে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন নায়িকা আলপনার জন্য, একসঙ্গে দু-জনে আসরে যাবেন। বিভূতি একটি লোককে তখন সঙ্গে করে হাজির হলেন।

‘কানাইদা ইনি বৃন্দাবন দাঁর পাড়ার লোক। একে জিজ্ঞেস করুন।’

‘নামটা জানলুম বৃন্দাবন, শুনলুম ভীষণ বড়োলোক। তা টাকাটা হল কীভাবে?’

লোকটি বিগলিত ‘নট দুলালের’ সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্যে। মাথা চুলকে বলল, ‘ওদের বিষয়-সম্পত্তি মেলা। দু-তিন পুরুষের টাকা। এককালে হাজার বিঘে ধানি জমি ছিল। চালের ব্যবসা, রাইস মিল, একটা সিনেমা হল, বর্ধমানে ওষুধের দোকান। আজকের যাত্রার খরচ তো উনিই দিচ্ছেন।’

কানাইলাল আঁতকে ওঠার ভান করে বললেন, ‘ওরে বাবা এ তো দেখছি টাকার তিমি, ভবেশ সাহার পূজ্যপাদ হবার যোগ্য। এমন একজনের সঙ্গে আত্মীয়তা রয়েছে, দূরসম্পর্কের হলেও, জেনে খুব গর্ব হচ্ছে! বিভূতি তাড়াতাড়ি আসতে বলো আলপনাকে।’

রাত দুটোয় যাত্রা শেষ হল। সাজঘরে বিভূতির পাশে এক বেঁটেখাটো স্থূলকায় উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মধ্যবয়সি লোক, গলায় কণ্ঠি। গেরুয়া পাঞ্জাবি। দু-হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে। টাক ঢাকার জন্য চুল পাতাকাটা।

‘কানাইদা ইনি হলেন বৃন্দাবনবাবু। এর বাড়িতে আপনার খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছে। আর দেরি করা নয়, চলুন যাওয়া যাক। ওখানেই মেকাপ তুলে নেবেন।’

‘হ্যাঁ আসুন।’ বৃন্দাবনের কণ্ঠস্বর মোলায়েম। ‘আপনার নামই শুনেছি আজ চোখে দেখলুম, অভিনয় চোখ জুড়িয়ে গেল। শিশির ভাদুড়ি দেখিনি, অহীন চৌধুরি, ছবি বিশ্বাসও দেখিনি, কলকাতায় কালেভদ্রে গেছি। দু-বার দেখেছি আমাদের কমল মিত্তিরকে রংমহলে, কী গলা ছিল আর আজ দেখলুম কানাই সিংগিকে। জানেন তো, আপনার কাকা হলেন আমার পিসেমশাই, আপন।’

কানাইলাল মনে করতে পারলেন না তার কাকাকে। তুতো কাকা তো পাঁচজন। তিনি কারোরই খবর রাখেন না। বৃন্দাবনের বাড়িটি যাত্রার আসর থেকে হেঁটে দু-মিনিট। লোহার গেট। বাড়িটি তিনতলা। বাইরের বারান্দা গ্রিল দিয়ে সুরক্ষিত।

একতলাতেই বিরাট খাবার ঘর। টেবলটায় আটটা চেয়ার। চারটি মেয়ে, বিভূতি আর কানাইলাল বসলেন। বাড়ির লোকেরা টেবল থেকে দূরে দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যে তিন-চার জন বাড়ির মেয়ে। সাদা খোলের চওড়া পাড় শাড়িপরা, নাকে কানে হিরের সঙ্গে দু-হাতে সোনার ঝলসানি দিয়ে যে বয়স্কা মহিলা প্লেটে প্লেটে লুচি রাখলেন তিনিই যে বাড়ির কর্ত্রী সেটা বুঝতে কারোরই অসুবিধে হল না। কানাইলাল অনুভব করলেন তার শরীরের ভিতরটা মাঝে মাঝে থরথর করছে, মাথা ভারভার লাগছে। উঠে পড়তে ইচ্ছে করলেও বসে থেকে ধীরে ধীরে খেতে থাকলেন।

‘রান্না কেমন হয়েছে বলুন?’ কর্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বেশি রাত হবে যাত্রা ভাঙতে, তখন বেশি খেলে শরীর খারাপ লাগবে তাই অল্পই রান্না করেছি। আর একটা মাছ?’

‘না না, এই যথেষ্ট। আপনি ঠিকই বলেছেন। বেশি রাত হয়ে গেলে বেশি খাওয়া যায় না। মাছ আবার মাংস! এত করতে গেলেন কেন? বাড়িতে আমি রাতে দুটো রুটি আর একটু তরকারি ব্যস। আজই বরং বেশি খেয়ে ফেললুম শুধু রান্নার গুণে। নিশ্চয় আপনার হাতের কাজ।’ কানাইলাল আড়চোখে গৃহকর্ত্রীকে দেখে নিলেন। পুলক ও রোমাঞ্চ লাগলে কিশোরীদের মুখে যেমনটি হয় পঞ্চাশোর্ধ মহিলার সেই অবস্থা দেখে তার মজা লাগল।

‘নিরিমিষ্যি যা কিছু সব আমার করা, আমিষ করেছে রাণু, আমার মেজোমেয়ে। এই যে।’ তিনি ঠেলে সামনে এনে দিলেন বেনারসির মতো শাড়িপরা মায়ের মতোই একটি গোলগাল বছর কুড়ির মেয়েকে। এর অঙ্গে গহনার পরিমাণ মায়ের থেকে কিছুটা কম। কালো রঙের মুখে কিছু একটার প্রলেপ থাকায় বেগুনি আভা ফুটেছে। ভুরুর কেশ তুলে খিলেন করা। খোঁপায় জড়ানো গোড়ের মালা। দেখে মনে হয় বিয়ে বাড়ি যাবে। কানাইলাল বুঝলেন, যাত্রা এদের কাছে একটা বিরাট উৎসবের মতো। যাত্রার নামি নায়ক-নায়িকাকে বাড়িতে আনা, খাওয়ানো নিজেদের মর্যাদা বৃদ্ধির একটা উপায়। কলকাতায় টেস্ট ক্রিকেটারদের নিয়ে যা হয়ে থাকে অনেকটা সেইরকম।

‘মাংসটা তুমি রেঁধেছ?’ কানাইলাল ঠিক করে রাখলেন ‘হ্যাঁ’ শোনামাত্র দারুণ, অসাধারণ, ফাইভস্টার হোটেলের মতো, এমন একটা কিছু বলবেন।

কিন্তু তিনি খোনা স্বরে বলা একটা বাক্য শুনলেন, ‘আমি আবার কোথায় রাঁধলুম! সব তো লীলামাসি করেছে।’

কানাইলাল প্রথমে চমকে উঠেছিলেন রাণুর নাকি স্বর শুনে, এবার হতভম্ভ হলেন তার বুদ্ধির বহর দেখে। মা-কে এইভাবে ডুবিয়ে দিল যে তার মাথার মধ্যে কী থাকতে পারে ভেবে পেলেন না। দেখলেন যাত্রার মেয়েরা অবাক চোখে রাণুর দিকে খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে। একটা অস্বস্তিকর অবস্থা। কথাবার্তা অন্যদিকে ঘোরাবার জন্য কানাইলাল বললেন, ‘বৃন্দাবনবাবুর কাছে জানলাম আপনারা আমার আত্মীয়। একবার আসুন না আমাদের বাড়িতে।’

বৃন্দাবন বললেন, ‘নিশ্চয় যাব। দক্ষিণেশ্বরে কল্পতরু উৎসবে যাব তখন দেখা করে আসব।’

‘আপনাদের বাড়িতে কে কে আছেন?’ বললেন বৃন্দাবন-পত্নী।

‘স্ত্রী পুত্র কন্যারা। বড়োমেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, আরও তিনটির বিয়ে দিতে হবে।’

রাণুর মা বললেন, ‘ছেলেরা কী করে?’

‘একটিই ছেলে এম এসসি পড়ে এইবার ফাইনাল দেবে।’

রাণুর মা স্বামীর দিকে তাকালেন। বৃন্দাবন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পাশ করে কী করবে?’

‘আগে তো পাশ করুক তারপর দেখা যাবে। রিসার্চের লাইনে যাবে না চাকরি করবে, না কলেজে পড়াবে।’

‘আমেরিকায় যাক না।’ রাণুর মা পরামর্শ দিলেন।

‘হ্যাঁ, কানাইদা একবার আমেরিকাটা ঘুরে আসুক।’ এতক্ষণে বিভূতি কথা বলার সুযোগ পেলেন।

‘ইচ্ছে করলেই কি যাওয়া যায়? আমেরিকা যাওয়া কি শক্তিগড়ে যাওয়া? টাকা লাগে নয়তো পরীক্ষার রেজাল্ট লাগে। নাও এবার ওঠো। কলকাতা পৌঁছতে পৌঁছতে দেখবে লোকে থলে হাতে বাজার যাচ্ছে।’

মোটরে ফেরার সময় কানাইলাল জিজ্ঞাসা করলেন আলপনাকে,’আলু, কেমন মনে হল রে? এই বৃন্দাবন আর তার গোপীটিকে?’

আলপনা বলল, ‘ভাবছিলুম মেয়েটাকে অন্নপূর্ণা অপেরায় নিয়ে নিলে কেমন হয়। অমন স্বর নিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ কি যাত্রা করেছে কানাইদা?’

‘করেছে কি না কী করে বলব, যেটা রয়ে গেছে বার কর।’

আলপনা তার কাঁধে ঝোলাবার চামড়ার থলিটা থেকে হুইস্কির পাঁইটটা বার করল।

‘আর একটা ছিল আসার সময় পুরোটা খাইনি।’

‘ওটুকু তরুণকে দিয়ে দিয়েছি, নতুন খেতে শিখেছে।’

‘বিভূতি একটা হাঁড়ি তুলে দিয়েছে, ওটা তুই নিয়ে নিস। ওতে ল্যাংচা আছে। তখন কী যেন জানতে চাইলি? নাকি স্বর নিয়ে যাত্রা? মেয়েরা আর ক-বছরই বা যাত্রায় এসেছে? আমি তো তেত্রিশ বছর এই লাইনে রয়েছি, এমন শাঁকচুন্নি মার্কা গলা শুনিনি। তুই একবার ভাব বাপমায়ের অবস্থাটা, এই মেয়েকে বিয়ে দেবে কী করে! শুধু তো গলা নয়, মাথাটাও! কীভাবে মাকে, পুরো ফ্যামিলিটাকে বসিয়ে দিল একটা সেনটেন্সে।’

দমদম চিড়িয়ামোড় ছাড়িয়ে গাড়ি যখন টালা ব্রিজে উঠছে কানাইলাল খালি বোতলটা রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘গাড়ি থেকে যখন নামব তুই নামবি না। আমি একা দোতলায় উঠব দেওয়ালে হাত না ছুঁইয়ে।’

সেইভাবেই উঠলেন কানাইলাল। শোবার ঘরের দরজা পর্যন্ত গেলেন তারপরই সোজা অবস্থায় মেঝেয় আছড়ে পড়লেন।

ডাক্তার রায়কে ঘুম থেকে তুলে আনল তোজু। তিনি কানাইলালকে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করে বললেন এখুনি হাসপাতালে নিয়ে যান, সল্টলেকের নামি ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান প্রাইভেট হসপিটালের সঙ্গে তিনি যুক্ত। সেখানেই নিয়ে যেতে বললেন। যাবার আগে তোজু মাকে বলল, ‘কিছু টাকা দাও। ওখানে দরকার পড়বে।’

কামিনী কুড়িয়ে কাড়িয়ে ছশো টাকা পেলেন। তাই নিয়েই তোজু রওনা হল ট্যাক্সিতে। কানাইলালের অবস্থা দেখে অক্সিজেন নল নাকে লাগিয়ে ই এম হসপিটালের ডাক্তার কাগজে ইঞ্জেকশনের নাম লিখে বললেন, ‘এখুনি এটা এনে দিন।’

ওষুধের দোকান কাছেই, তোজু ছুটে গেল। দোকানি জানাল ইঞ্জেকশনটার দাম পাঁচ হাজার টাকা। শুনে স্তম্ভিত তোজুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল একটি শব্দ ‘অ্যাতওও’, সে দোকান থেকেই বাড়িতে টেলিফোন করল, ‘মা, পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে দাও নীলার হাত দিয়ে, একটা ইঞ্জেকশন কিনতে হবে।’

কামিনী বললেন, ‘টাকা পাব কোথায়!’

জোতু বলল ‘যেখান থেকে পার ধারধোর করে নয়তো গয়না বাঁধা দিয়ে। দেরি কোরো না। আমি ই এম হাসপাতালের রিসেপশন রুমে অপেক্ষা করছি, নীলা ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসুক।’ বলার পর তার মনে পড়ল ভবেশ সাহার কথা। ‘মা, তুমি ভবেশ সাহার কাছে ফোন করে টাকা চেয়ে দেখো একবার।’

এরপর তোজু হাসপাতালে ফিরে এসে অপেক্ষা করতে থাকে। কামিনী ফোন নম্বর লেখা নোটবই থেকে ভবেশ সাহার নম্বর বার করে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন। দু-মিনিট ধরে ফোন বেজেই গেল কেউ রিসিভার তুলল না। নীলাও ডায়াল করল। একইভাবে বেজে চলল।

‘মা, ফোনটা বোধহয় আউট অফ অর্ডার হয়ে আছে।’

নোটবইয়ে একটা নাম দেখে কামিনী কয়েক সেকেন্ড ভাবলেন। আলপনা দত্ত, যাত্রার সেই মেয়েটাই হবে। দেখি একটা চেষ্টা করে। নম্বর দেখে নিয়ে ডায়াল করলেন, দু-বার রিং হবার পর রিসিভার উঠল।

‘কে বলছেন?’ পুরুষ গলা বলল।

‘আমি কানাইলাল সিংহের বউ, আলপনা আছে?’

‘ঘুমোচ্ছে, আপনি ধরুন ডেকে দিচ্ছি।’

কামিনী আঁচলে মুখ মুছে নার্ভাস চোখে নীলার দিকে তাকালেন। তিন মিনিট পর ফোনে বলে উঠলেন, ‘কে আলপনা? বউদি বলছি, ভীষণ বিপদে পড়ে গেছি। তোমার দাদা এখন হাসপাতালে। একটা ইঞ্জেকশন কিনতে হবে, আমার হাতে একটা পয়সা নেই, তুমি ধার দিতে পার? এক্ষুনি, পাঁচ হাজার টাকা।’

ঘুম জড়ানো গলায় আলপনা বলল, ‘কানাইদা কোন হাসপাতালে রয়েছেন?’

‘সল্টলেকে ই এম হাসপাতালে। দেবে টাকা?’

‘বউদি, আমাকে হাতে ধরে কানাইদা অভিনয় শিখিয়েছেন। গর্তে পড়া থেকে বাঁচিয়েছেন তাই আজ আমি আলপনা হতে পেরেছি। হাসপাতালে দাদার সঙ্গে কেউ কি আছেন? আমার চেনা এক ভদ্রলোক সল্টলেকে থাকেন তাকে ফোন করছি, দশ মিনিটের মধ্যে টাকা নিয়ে তিনি হাজির হবেন।’ আলপনার স্বরে নিশ্চিত প্রত্যয়ে ‘দশ মিনিট’ শব্দ দুটি বেজে উঠল।

‘ওখানে অপেক্ষা করছে আমার ছেলে তেজেশ।’

দুপুরে বাড়ি ফিরে এল তোজু। সে জানাল, বাবা এখন ভালো আছে। কয়েকটা পরীক্ষা ওরা করেছে আরও করবে। টাকা নিয়ে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন কিন্তু আরও টাকা চাই। দিন সাতেক অবজার্ভেশনে ওরা রাখবে। অ্যাঞ্জিয়োগ্রাফ করাতে হবে তাতেই পনেরো হাজার টাকা পড়বে।’

কামিনী ভীত স্বরে বললেন, ‘সাতদিনে কত পড়বে?’

‘ঠিক করে বলতে পারল না। বলল ‘পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকার মতন হবে।’

‘এত টাকা সাতদিনে জোগাড় করব কী করে তোজু? তাহলে তো গয়না বিক্রি করতে হবে! তুই একবার প্রণবেন্দুর কাছে যা, যদি টাকা পোস্টাপিসে এসে গিয়ে থাকে।’

দু-দিন পরই সার্টিফিকেট ভাঙানোর টাকা দিয়ে গেল প্রণবেন্দু। এক লাখ তিয়াত্তর হাজার টাকা। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সিংহি বাড়ি। টাকাগুলো গুনে পলিব্যাগে ভরে কামিনী সিন্দুকে রেখে দিলেন। ইতিমধ্যে কোথা থেকে খবর পেয়ে ভবেশ সাহা হাসপাতালে কানাইলালকে দেখতে যান। ডাক্তারদের সঙ্গেও কথা বলেন। এবং তখনই স্থির করে ফেলেন অন্নপূর্ণা অপেরায় কানাইলাল সিংহকে রাখার আর কোনো দরকার নেই, অতএব লাখ টাকা অগ্রিমটাও তিনি দেবেন না। দিলে টাকাটা যে উশুল করা যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, কেননা কানাইলাল ভালো হয়ে উঠলেও যাত্রা করার ধকল এবার আর সামলাতে পারবেন না, টাকা জলে যাবে।

কানাইলাল যখন হাসপাতালে তখনই ধীরা সকালে হাজির হল বাবার বাড়িতে। কপালে ব্যান্ডেজ, হাতে ও কাঁধে থলি, তাতে জামাকাপড়। মায়ের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়ে জানাল, আর সে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে পারবে না। দেওররা উঠতে বসতে অপমান করছে, এবার গায়েও হাত তুলেছে। জনার্দন পেটাচ্ছিল তার দাদাকে, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে থামাতে গেছিল দেওর তার ঘাড় ধরে দেওয়ালে মাথা ঠুকে এই অবস্থা করেছে বলে ব্যান্ডেজটা দেখাল।

‘মা আমাকে এখানে থাকতে দাও নয়তো গলায় দড়ি দিয়ে মরব।’ ধীরা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। ‘দোকানের জন্য বাবা যে টাকা দেবে বলেছিল তার কী হল? সেই টাকা না দেখালে দেওররা বলেছে দাদাকে আর দোকানে ঢুকতে দেবে না, তিনদিন হল ঢুকতে দিচ্ছেও না। শ্বশুর-শাশুড়ি দুই ছেলের ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে। তোমার জামাই বলল এখন মা-র কাছে গিয়ে থাকো। বাবা টাকাটা দিলে ভাইয়েরা অন্তত বিশ্বাস করবে আমি বাজে কথা বলিনি। এদিকে যে কোম্পানির মাল দোকানে রেখে বিক্রি করার কথা হয়েছে সেই কোম্পানি দোকানের মালিকদের মধ্যে ঝগড়া-মামলা দেখে এখন দোনোমনা করছে। বোধ হয় তারা এগ্রিমেন্ট করার জন্য আর এগোবে না। তা হলে ওর অবস্থাটা কী দাঁড়াবে!’

সব শুনে কামিনী শুকনো মুখে বললেন, ‘তোর বাবার শরীরের এখন-তখন অবস্থা দেখে হাসপাতালে দিতে হল, ঠিক সময়ে ইঞ্জেকশনটা পড়ায় বেঁচে গেছে। সাতদিন থাকতে হবে। ইঞ্জেকশনটার দামই পড়ল পাঁচ হাজার টাকা। একটা কী পরীক্ষা যেন করতে হবে তাতে লাগবে পনেরো হাজার টাকা। যাত্রার একটা মেয়ের কাছে ধার পেলুম পাঁচ হাজার। এখন বাকি টাকা কোথা থেকে পাব নারায়ণই জানেন।’

নারায়ণের মতো ধীরা অন্তর্যামী নয়। তা যদি হত তা হলে সে জেনে যেত মায়ের সিন্দুকে তখন প্রায় পৌনে দু-লক্ষ টাকা রয়েছে। মায়ের কথা শুনতে শুনতে ফ্যাকাশে হয়ে গেল ধীরার মুখ। বিড়বিড় করে বলল, ‘তা হলে টাকাটা পাওয়া যাবে না! আমি তো শুনেছিলুম বাবা পোস্টাপিস আর ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে ওকে দেবে বলেছিল।’

‘আমাকে তো সেসব কিছু বলেনি।’ কামিনী স্বর নামিয়ে বললেন, ‘উনি আসুক তখন জিজ্ঞেস করিস। আমার এখানে থাকবি তো থাক না।’ কামিনীর গলা আন্তরিক, ‘ব্যবস্থা কিছু একটা হয়ে যাবে, জয়দেব আর কোথাও চেষ্টা করেনি? ওর মামারা তো শুনেছি খুব পয়সাওলা।’

ধীরা বলল, ‘মামাদের কাছে ও হাত পাতবে না।’

বাবাকে দেখতে তোজু রোজই বিকেলে হাসপাতালে যায়, সঙ্গে যান কামিনী। সেদিন ধীরাও তাদের সঙ্গী হল। কামিনী তাকে বলে দিয়েছিলেন, ‘ডাক্তার বলেছেন এখন ওকে হালকা মন মেজাজে থাকতে হবে। টেনশন হয় এমন কোনো কথা একদম ওকে বলবেন না। তোর কপালের ব্যান্ডেজটা কেন জিজ্ঞেস করলে বলবি কলতলায় পিছলে পড়ে মাথা ঠুকে গেছে। টাকার কথা একদম তুলবি না তা হলেই টেনশন হবে।’

মা যা বলে দিয়েছিল ধীরা তাই বলল বাবাকে। কানাইলাল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জয়দেব দোকানে গিয়ে বসছে? ওর ভাইয়েরা ওকে নাকি খুব হেনস্থা করে। একবার বাড়ি যাই টাকার ব্যবস্থা করে দোব। ভবেশ সাহা অর্ধেক দেবে বাকি অর্ধেক আমি দেব। তুই চিন্তা করিসনি।’

শুনে স্বস্তির হাসি ফুটল ধীরার মুখে। কামিনীর মুখে কোনো ভাবের সঞ্চার ঘটল না। কানাইলাল সাতদিন পর সকালে বাড়ি ফিরলেন। তোজু আগের দিন জেনে গিয়েছিল কত টাকা চিকিৎসাবাবদ হাসপাতালকে দিতে হবে। বাড়ি ফিরেই সে মাকে জানায়, ‘বিল হয়েছে একচল্লিশ হাজার টাকার। শুনে তো আমার চক্ষু চড়ক গাছ। এই পরীক্ষা সেই পরীক্ষা এই ওষুধ তাই ওষুধ কত রকমের খরচ। কী এক্সপেন্সিভ হয়ে গেছে মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট। শুধু বড়োলোকরাই বেঁচে থাকবে। বাবা ভাগ্যিস সার্টিফিকেটগুলো ভাঙাতে দিয়েছিল নয়তো-।’

কামিনী ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করার জন্য ইশারা করলেন।

‘আস্তে কথা বল ও ঘরে ধীরা রয়েছে। এ টাকা জয়দেবকে দেবার জন্য পোস্টাপিস থেকে তোলা হয়েছে, ওনার প্রাণ বাঁচানোর জন্য কাজে লেগে গেল। নারায়ণ যা করেন মঙ্গলের জন্য। আগে প্রাণ তারপর মান।’

বাড়িতে আসার সময় কানাইলাল ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হসপিটালের টাকাটা কোথায় পেলি? প্রণবেন্দু দিয়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ। একলাখ তিয়াত্তর হাজার টাকা।’

‘তার থেকে একচল্লিশ হাজার চলে গেল। রইল একলাখ বত্রিশ। ভবেশ দেবে একলাখ। ওহহো সতেরো তারিখে দেবে বলেছিল মনে করিয়ে দিতে হবে সময় বুঝে। ভবেশ টাকা দেওয়ার কথা ভুলে যায়। ওর একলাখটা পেলে জয়দেবকে দু-লাখ দিয়ে দিতে পারব।’ কানাইলালকে প্রফুল্ল দেখাল।

একতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার আগে তোজু বলল, ‘এবার থেকে ওঠানামা করবে এইভাবে।’ সে বাবাকে দেখাবার জন্য দুটো ধাপ নিজে উঠে দেখাল। একধাপ উঠে দু-পা রেখে দাঁড়াল। পরের ধাপে উঠে আবার দু-পা রেখে দাঁড়াল। ‘নাও এবার ওঠো। এভাবে উঠলে হার্টের উপর চাপ কম পড়বে। থেমে থেমে উঠতে হবে।’

বিব্রত মুখে কানাইলাল বললেন, ‘তা তো বুঝলুম। কিন্তু দোতলায় পৌঁছতে পৌঁছতে যে বিকেল হয়ে যাবে।’

সতেরো তারিখ বা তার আগে ভবেশ টাকা দেবেন বলেছিলেন। প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দিতে কানাইলাল ফোন করলেন ষোলো তারিখে রাত আটটায় গদিতে। তিনি জানেন ওই সময় ভবেশ প্রতিদিন ওখানে আসেন। ফোন ভবেশই তুললেন।

‘আরে কানাইবাবু, কবে বাড়ি ফিরলেন? আমি একদম সময় করে উঠতে পারিনি আপনাকে দেখতে যাবার। হলদিয়ায় গেছলুম, গেস্ট হাউস করতে যে এত ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হবে আগে জানতুম না, টাকার ছেরাদ্দ হচ্ছে। এর থেকে ফাইভ স্টার হোটেল বানানো অনেক সোজা কাজ। বলুন শরীর এখন কেমন, ডাক্তার কী বলছে?’

টাকা দেওয়ার ধারেকাছে যায় এমন কথার দিকে ভবেশ গেলেন না। কানাইলাল হালকা চালে বললেন, ‘যা বলে ডাক্তাররা, জোরে হাঁটবেন না জোরে কথা বলবেন না। আরে বাবা, আসরে মাইক থাকলেও চিৎকারের জায়গায় মুখ দিয়ে চিৎকার ঠিক বেরিয়ে আসবে। একগাদা ওষুধ লিখে গিয়েছে। যাকগে অসুখের কথা, কাল আসছেন টাকাটা নিয়ে?’

ভবেশ আকাশ থেকে পড়লেন, ‘টাকা! কীসের টাকা?’

‘যেটা আগাম দেবেন বলেছিলেন, একলাখ।’

‘ও হো হো, হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়ছে। কিন্তু কানাইবাবু এখন আমি একদম ভিখিরি, হাতে একটা আধলা নেই। হলদিয়া আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। কথা রাখতে পারছি না বলে লজ্জা করছে।’

কানাইলালের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। দপদপ করে উঠল রগ। অনেক ভরসা করেছিলেন ভবেশের প্রতিশ্রুতির উপর। চোখে অন্ধকার দেখলেন। ভাবলেন ওকে একটু ভয় দেখাই, ‘টাকাটার খুবই দরকার ছিল ভবেশবাবু, দেখি শক্তি কুণ্ডুর কাছে পাই কি না। মুশকিল হল উনি টাকা ঠিকই দেবেন কিন্তু একটা কড়ারে। ওর চৈতন্য অপেরায় নাম লেখাতে হবে। দু-বছর আগে ঝুলোঝুলি করেছিল, যাইনি। এখন তো আমাকে ভেবে দেখতে হবে।’

‘টাকা যদি পান তা হলে যাবেন না কেন, ভাবাভাবির কী আছে? আপনার মতো গুণী মানুষ বসে থাকবেন এটা তো হতে পারে না। শক্তিবাবু কেন আরও অনেকেই চাইবেন অবশ্য তারা যদি আপনার হার্টের খবর না রেখে থাকেন।’

কানাইলালের মনে হল ওধারে যেন একটা হাসির শব্দ হল। লোকটা টাকা দেবে না বুঝে গিয়ে তিনি রিসিভার রেখে দিলেন। ভবেশ করিতকর্মা লোক। সারা যাত্রাপাড়া জেনে যাবে বা জেনে গেছে কানাই সিংগির হার্টের রোগ হয়েছে। অন্নপূর্ণা ওকে ছাঁটাই করেছে।

কানাইলাল গুম হয়ে বসে রইলেন। ওকে দেখে কামিনী আঁচ করলেন খারাপ কিছু একটা ঘটেছে। একসময় জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন, ‘কিছু কী হয়েছে? অমন মুখ করে রয়েছ?’

‘আমার যাত্রা করা শেষ হয়ে গেল, ভবেশ সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে। যে ক-টা টাকা রয়েছে ভেবেচিন্তে এবার থেকে খরচ কোরো, অন্তত তোজু যতদিন না নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে ততদিন। মেয়েদের বলে দিয়ো নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরা যেন তৈরি করে নেয়। ধীরাকেও বলে দিয়ো-।’ কানাইলাল থেমে গেলেন। যে কথাটা বলতে গিয়ে বলতে পারলেন না, তার মনে হল বললেই ভবেশ সাহা হয়ে যাবেন। ভবেশের মতোই কথা দিয়েছেন এখন ভবেশের মতো কথার খেলাপ করে পিছিয়ে যাওয়া যায় না। জয়দেব তো তার মতোই প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছে। একবার ভবেশ আর একবার জয়দেব হতে হতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন।

‘যে ক-টা টাকা আছে থাকুক। তোমার শরীর যে আবার খারাপ হবে না এমন তো কোনো কথা নেই, জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করা হয়েছে। তার ওপর কাজকর্ম রোজগারও বন্ধ হয়ে গেল। এই ক-দিন দু-বেলা ছোটাছুটি করে তোজুর পরীক্ষার পড়ারও ক্ষতি হল।’ কামিনী মন্থর স্বরে কথাগুলো বললেন। ‘শরীরের কথা ভেবে তুমি কিন্তু সাবধানে থেকো। মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে তোমাকেই। তোজুর ঘাড়ে সব চাপিয়ে দিয়ো না।’

বৃন্দাবন দাঁ যে সত্যি সত্যিই হাজির হবেন তাও সস্ত্রীক, কানাইলাল ভাবেনি। বিকেলে জানলায় দাঁড়িয়ে রাস্তায় ছেলেদের বল খেলা দেখছিলেন। একটা সাদা অ্যাম্বাসাডার তাদের সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়াতে তিনি কৌতূহলী হয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। দেখামাত্র চিনতে পারলেন। চেঁচিয়ে নীলাকে ডাকলেন, ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘তোর মাকে বল শক্তিগড়ের যাদের বাড়িতে খেয়েছিলুম, আসবে বলেছিল আমাদের বাড়িতে, তারা এসেছে, তুই ওদের ওপরে নিয়ে আয়, সম্পর্কে আত্মীয় হয়।’

নীচের থেকে মিহি গলার ডাক শোনা গেল, ‘কানাইবাবু বাড়ি আছেন নাকি?’

‘যাই-ই।’ সিঁড়ির মাথায় এসে কানাইলাল উত্তর দিলেন ‘ওপরে আসুন।’

বৃন্দাবন আর তার স্ত্রীকে দরদালানে বেতের চেয়ারে বসালেন।

‘কখন বেরিয়েছেন বাড়ি থেকে?’ কানাইলাল আলাপের যবনিকা তুললেন।

‘এগারোটায় দক্ষিণেশ্বর হয়ে সোজা এখানে। কী ভিড় কী ভিড়! গত বছরের থেকেও মনে হল এবার ভিড়টা বেশি। পুজো দিতে প্রায় একশো লোকের পিছনে দাঁড়াতে হল।’

ওরা উপরে পাশে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘর মেঝে কড়িকাঠ দেখতে লাগলেন। দাঁ গিন্নি বললেন, ‘কতদিনের পুরোনো বাড়ি?’

‘বেশি পুরোনো নয়, একশো বছরের একটু বেশি। আমাদের এই অঞ্চলে বহু দেড়শো বছরের বাড়ি আছে, এ বাড়ি ঠাকুরদা করেছেন যখন তিনি অল্পবয়সি, তখন মোহনবাগান ক্লাব তৈরি হয়, উনি প্রথম কয়েকটা বছর খেলেছেন।’

বৃন্দাবন বললেন, ‘আপনি খেলেছেন?’

‘না। খেলা দেখতুম। শৈলেন মান্না রিটায়ার করল আমিও মাঠে যাওয়া ছাড়লুম। তারপর সিনেমায় তারপর যাত্রায়। এবার যাত্রাও ছাড়ব।’

দাঁ গিন্নি জানাতে চাইলেন, ‘ছেড়ে কোথায় যাবেন?’

ডানহাতের তর্জনী সিলিংয়ের দিকে তুলে কানাইলাল হাসতে হাসতে বললেন, ‘চিরযাত্রায় যাব!’

‘বালাই ষাট। আপনি একশো বছর বাঁচুন।’

ভিতর থেকে কামিনী, তার সঙ্গে চার মেয়ে বেরিয়ে এল। কানাইলাল দেখলেন কামিনী শাড়ি পালটেছে, চুল আঁচড়েছে, এক হাতে সোনার বালা, যেটা দশ মিনিট আগেও হাতে ছিল না। পঞ্চাশ পেরোনো কামিনীকে বেমানান লাগছে না মেয়েদের পাশে।

নমস্কার বিনিময় শেষ হতেই কানাইলাল বললেন, ‘এদের কথা তো তোমায় বলেছি। কী খাওয়াটাই না খাইয়েছিলেন। মাংসটা অসাধারণ রান্না হয়েছিল।’

‘এরা সবাই আপনার মেয়ে?’ দাঁ গিন্নি কথা ঘোরালেন।

‘হ্যাঁ এটি বড়ো, বিয়ে হয়েছে। বাকিরা কলেজে স্কুলে পড়ছে।’

‘জামাই কী করে?’

‘ব্যবসা। নিউমার্কেটে দোকান আছে। আপনার ক-টি ছেলেমেয়ে?’

‘ছয় মেয়ে এক ছেলে। প্রথম দুটির বিয়ে হয়ে গেছে। একজনের কাটোয়ায় আর একজনের মেমারিতে। ইচ্ছে আছে সেজোটির বিয়ে দেব কলকাতায়। ছেলে খুঁজছি। ছেলেটি ভাইবোনের মধ্যে ছোটো। ক্লাস এইটে পড়ে। আপনারও তো এক ছেলে। সে কি বাড়ি আছে?’

নীলা বলল, ‘দাদা ওর বন্ধুর সঙ্গে ঘরে পড়ছে। সামনেই পরীক্ষা।’

বৃন্দাবন ও কানাইলাল চুপ করে শুনে যাচ্ছেন দুই গৃহিণীর আলাপ।

কামিনী বললেন, ‘ধীরা চায়ের জল বসা।’

ধীরার সঙ্গে বাকি তিনজন অন্তর্হিত হল। দাঁ গিন্নি বললেন, ‘পুরোনো বাড়ি দেখতে বেশ লাগে।’

কামিনী বললেন, ‘আসুন না। আগে ঘরগুলো তারপর ছাদটাও দেখবেন।’

ওরা দু-জন উঠে যেতে কানাইলাল বলল, ‘বৃন্দাবনবাবু, চেয়ারে বেশিক্ষণ বসে থাকলে কোমরে ব্যথা করে, চলুন ঘরে গিয়ে খাটে বালিশ নিয়ে বসা যাক।’

ওঁরা প্রায় দেড়ঘণ্টা রইলেন। ছোটোমেয়ে সুরমা পাড়ার দোকান থেকে শিঙাড়া রসগোল্লা কিনে আনে, দাঁ দম্পতি চায়ের সঙ্গে সেগুলি খান। তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বারবার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে শক্তিগড় থেকে ভাড়া করে আসা প্রাইভেট ট্যাক্সিতে চড়ে ফিরে যান। ওরা চলে যাওয়ার পর কামিনী কানাইলালকে ঘরে ডেকে বললেন, ‘কেন এসেছিল জানো? তোজুকে দেখতে। ওর ঘরে ঢুকে অনেকক্ষণ ধরে দেখে বলল আপনার ছেলেটি বেশ দেখতে।’

‘কথা বলল?’

”কী কথা বলবে? অপরিচিত একটা ছেলের সঙ্গে হঠাৎ আলাপ করা যায় নাকি? আর মায়ের বয়সি অচেনা কারোর সঙ্গে তোজুই বা কী কথা বলবে? একবার মুখ ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে আবার সোমনাথের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। আরে শোনো না, ছাদে গেছি তখন উনি বললেন, ওদের বাড়িতে সেদিন তুমি বলেছিলে ছেলে এম এসসি পড়ে তখনই ওদের মাথায় ঢুকে যায় তোজুকে জামাই করার চিন্তাটা, ওকে না দেখেই। আজ দেখার পর তো মাথা ঘুরে গেছে।’

উত্তেজিত হয়ে কানাইলাল গলা চড়িয়ে বললেন, ‘কী সাহস! তুমি দেখনি আমি দেখেছি। তোমায় তো বলেছি সেদিন মেয়েটা কী কথা অত লোকের মাঝে বলেছিল। একেবারে ইডিয়ট জড়বুদ্ধি। আর বুদ্ধিমতী যদি হয়ও ওই শাঁকচুন্নির মতো খোনা গলার স্বর! অসম্ভব, ভাবা যায় না। অন্ধকারে যদি হঠাৎ কথা বলে ওঠে শুনে তোমার ধাত ছেড়ে যাবে। ওদের কি কাণ্ডজ্ঞান নেই? কার দিকে হাত বাড়াচ্ছে সেটাও কি বোঝে না? একটা হুঁতকো রুচিহীন জড়বুদ্ধি অশিক্ষিত, তার ওপর খোনা। তোজুকে কিংবা মেয়েদের কাছে এই নিয়ে কিছু বোলো না।’

‘পাগল। বলা যায় নাকি! ভদ্রমহিলা তারপর কি টোপ দিলেন জানো? রাজকন্যার সঙ্গে অর্ধেক রাজত্ব। মোটর গাড়ি, চল্লিশ ভরি সোনা, পাঁচ বিঘে ধানি জমি, নগদ এক লাখ টাকা, তা ছাড়া সাজিয়ে দেবে ঘর। শুনতে শুনতে হাত-পা কাঁপছিল। এ তো ছেলে কেনা। আবার বলল আমেরিকায় যদি পড়তে চায় তারও খরচ দেবে।’

‘শুনে আমারও হাত-পা কাঁপছে। এমন একটা প্রস্তাব দিতে পারে যারা তারা কী ভয়ংকর লোক ভাবতে পারো? এ তো পিশাচের মতো প্রস্তাব। আমার মনে হয় মেয়েটাকে ওদের মেরে ফেলা উচিত।’

‘এ কী কথা বলছ! তোমার কথাটাও তো পিশাচের মতো।’

‘হতে পারে। টাকার লোভ দেখিয়ে কার্যোদ্ধার একটা নোংরা ব্যাপার। নোংরা মানে মেয়েটাকে প্রচুর টাকার যৌতুক দিয়ে একটা পিশাচের হাতে তুলে দেওয়া, যে বিয়ে করে মেয়েটার গায়ে আগুন লাগাবে বা গলা টিপে মেরে ঝুলিয়ে দিয়ে বলবে আত্মহত্যা। এইসব পাপ কাজ বাবা-মা করার সুযোগ পাবে না যদি তার আগেই মেয়েকে মেরে ফেলে একটা ছেলেকে করাপ্ট হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেয়। ভেবে দেখো যে প্রস্তাব ভদ্রমহিলা তোমায় দিলেন, যেহেতু তুমি লোভটা সামলাতে পারলে ছেলের মঙ্গল চেয়ে কিন্তু সেটা অন্য কাউকে দিলে তারা লোভ নাও সামলাতে পারে। মনে রেখো গরিব অশিক্ষিত লোভীদের দেশ এটা।’

কামিনী বলেছিলেন বটে ছেলে বা মেয়েদের কাউকে বলবেন না। কিন্তু বলে ফেললেন তোজুকে। ছেলের বিছানার চাদর বদলাবার সময় কথা বলতে বলতে বললেন, ‘জানিস সেদিন যে মহিলাটি এসেছিলেন, ঘরে ঢুকে তোকে দেখলেন তার কী উদ্দেশ্য ছিল?’

‘কী উদ্দেশ্য?’

‘মেয়ের সঙ্গে তোর বিয়ে দেবে।’

তোজু ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। ‘পরীক্ষা আর ক-দিন পর, মরার সময় নেই। পাশ করেই চাকরির জন্য হাঁটাহাঁটি শুরু করতে হবে। এর মধ্যে বিয়ের চিন্তা আসে কী করে?’

‘এই মেয়েকে বিয়ে করলে সব চিন্তা ঘুচে যাবে। কম করে দশ লাখ টাকা খরচ করবে, আমেরিকাতেও পড়তে পাঠাবে।’

‘শুনে তো বেলুনের মতো আমার ইগো ফুলে উঠছে, এবার পিনটা ফুটিয়ে দাও। মেয়েটি কেমন?’

কামিনী একচোট হেসে নিয়ে বললেন, ‘তোর বাবা দেখেছে, বলল হুঁতকো ইডিয়ট অশিক্ষিত তার ওপর গলার স্বর খোনা। টাকার টোপ দিয়ে ছেলে ধরতে চায়।’

‘তোমরা কী বললে?’

‘কিছু বলিনি শুধু শুনে গেছি। ওনার হাবভাব দেখে মনে হল এমন একটা প্রস্তাব আমরা হাতছাড়া করতেই পারব না। সত্যিই তো এত টাকা কোন মূর্খ ছেড়ে দেবে! ওদের শখ লেখাপড়া জানা সুন্দর দেখতে জামাই লোককে দেখানো।’

তোজু মুখ নামিয়ে ফাইল খুলে কাগজ ওলটাতে শুরু করল। কামিনী বললেন, ‘ওরা ফোন নম্বর দিয়ে গেছে, আমাদেরটাও নিয়ে গেছে।’ ছেলে মুখ তুলল না দেখে তিনি পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

দু-দিনের মধ্যে মেয়েরাও জেনে গেল ব্যাপারটা। বিশাল টাকা দিয়ে তোজুকে জামাই করার প্রস্তাব দিয়ে গেছে সেদিনের অতিথিরা। প্রথমে কেউ বিশ্বাসই করতে পারেনি। তাই এক সন্ধ্যায় ধীরাই সাহস করে বাবাকে জিজ্ঞাসা করল। ‘এটা কি সত্যি?’

কানাইলাল চশমা খুলে মেয়ের দিকে তাকালেন, ‘কোন সত্যির কথা বলছিস? তোজুর বিয়ের ব্যাপারটা? হ্যাঁ সত্যি।’

‘দিয়ে দাওনা বিয়ে। অতগুলো টাকা ছেড়ে দেবে!’

‘বলছিস কী!’ হাতের খবরের কাগজ ভাঁজ করে তিনি সোজা হয়ে বসলেন। ‘তোজুর একটা জীবন আছে। টাকার জন্য সেটা নষ্ট করতে বলছিস?’

ধীরার চাহনি ধীরে ধীরে বদলে গেল। করুণ আতুর চোখদুটো ঘন কালো হয়ে উঠল। তাতে বিদ্যুৎ চমকাল। তাতে হিংস্রতার ঝলক দপ করে উঠে স্তিমিত হয়ে গেল।

‘ওর জীবন নষ্ট কেন হবে। বউকে সরিয়ে দেবে।’

‘কোথায়?’

‘এই পৃথিবী থেকে।’

শুনেই থরথর কাঁপতে শুরু করলেন কানাইলাল। এলিয়ে পড়লেন বালিশের উপর।

‘তোমাকে বাইপাস করতে বলেছে ডাক্তার। দেড় লাখ টাকা লাগবে। তোমার জামাইকে দু-লাখ টাকা দেবে বলেও দাওনি। সে আজ হাঘরে ভিখিরি হয়ে গেছে, আমি বাপের বাড়িতে পড়ে আছি। পোস্টাপিস থেকে সার্টিফিকেট ভাঙিয়ে টাকা তুমি পেয়েছ, ব্যাঙ্কেও টাকা আছে। এসব লুকিয়েছ আমার কাছে, পাছে কথা রাখার জন্য জামাইকে টাকা দিতে হয়, ঠিক কি না?’

‘হ্যাঁ ঠিক। আমাকে জবাব দিয়েছে অন্নপূর্ণা, ভবেশ সাহা আর আমাকে চায় না। এই হার্টের রোগীকে নিয়ে ওরা কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। আমার অনেক রকম খরচের ব্যাপার রয়েছে। মাসে মাসে ওষুধ কেনার টাকা চাই, তোর বোনেদের বিয়ে- বাইপাস সার্জারির কথা বাদই দিচ্ছি।’ কানাইলালের স্বর কাতর হয়ে আসছে। ‘জয়দেব তো একজন, আমরা অনেকে। কোনদিকে আমি যাব বলে দে।’

‘তোজুও তো একজন। আমরা অনেকে, কোনদিকে যেতে হবে আমি জানি। ও তোমার বাধ্য পিতৃভক্ত, তুমি যা বলবে তাই করবে, ওকে এই মেয়েটাকে বিয়ে করতে বলো। তোমার বাইপাস হবে, ওষুধ কেনার টাকাও পাবে, সবার বিয়েও দেওয়া যাবে, আমিও শ্বশুরবাড়ি ফিরে যেতে পারব।’

‘অসম্ভব!’ কানাইলাল চিৎকার করে সটান হয়ে উঠে বসলেন। ‘জীবন জীবনই। তা একজনের হোক আর দশজনেরই হোক। আমি পারব না, ওকে বলতে পারব না।’

‘বাবা তুমি বোকা স্বার্থপর। অনেক সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারতে যদি দরদ থাকত।’

বুকের বাঁদিকে পিন ফোটানোর মতো ব্যথা অনুভব করলেন কানাইলাল। হাত নেড়ে ধীরাকে চলে যেতে ইশারা করলেন। ধীরা মুখ বিকৃত করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কানাইলাল একটু পরে ছাদে গেলেন। পায়চারি করতে করতে পাঁচিলের ধারে একটা জায়গায় দাঁড়ালেন। ঘুড়ি ধরতে ঠিক এই জায়গাটা থেকে মজু পাঁচিল থেকে উলটে গিয়ে রাস্তায় পড়েছিল। তিনি ঝুঁকে রাস্তা দেখলেন, অনেকটা নীচে রাস্তা। ব্যথা লেগেছিল মজুর। কতটা! আন্দাজ করার জন্য মাথা নীচু করে ঠুকলেন পাঁচিলে। ব্যথা একটা লাগল কিন্তু খুব বেশি নয়। ইচ্ছে করে ঠুকলে ব্যথা কম লাগে। মজু ইচ্ছে করে পড়েনি। ব্যথা লেগেছিল। এক সেকেন্ড কি দু-সেকেন্ড, তারপরই সব ব্যথার ওধারে চলে যায়। তিনি আবার পায়চারি শুরু করলেন।

ছাদ থেকে নেমে এসে চোখেমুখে জল দিয়ে রান্নাঘরের দরজায় এসে কানাইলাল দাঁড়ালেন। কামিনী আটা মাখছেন, মুখ তুলে বললেন, ‘কী ব্যাপার আবার চা চাই নাকি?’

‘লুচি খেতে ইচ্ছে করছে, অনেকদিন খাইনি।’ কানাইলালের গলায় বাচ্চচাছেলের মতো আবদার।

‘লুচি খাওয়া তোমার বারণ। হার্টের রুগিদের ভাজাভুজি খেতে নেই।’কামিনী ছোট্ট করে ধমক দিলেন।

‘আজই শেষ, আর চাইব না।’ কানাইলাল মিনতি করলেন, ‘একবার ক-টা লুচি খেলে হার্টের এমনকিছু সর্বনাশ হবে না। একটু-আধটু অনিয়ম সবাই করে। প্লিজ আজ লুচি খাওয়াও আলু ছেঁচকি দিয়ে।’

কামিনী কয়েক সেকেন্ড মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘এই শেষবার কিন্তু, মনে থাকে যেন।’

দরদালানের একপ্রান্তে বসে মেয়েরা বাংলা সিরিয়াল দেখছে টিভিতে। কানাইলাল তাদের পাশ দিয়ে ঘরে ফিরে এলেন, কেউ তার দিকে তাকাল না।

রাতের খাবার শোয়ার ঘরের টেবলে বসে খান। লুচি আর ছেঁচকির সঙ্গে থালার একধারে লেবুর আচার দেখে কানাইলাল বললেন, ‘দারুণ, অনেকদিন লেবুর আচার খাইনি!’

কামিনী ঠোঁট টিপে বললেন, ‘এটাও কিন্তু এই শেষবারের মতো। আর কিন্তু চাইলে পাবে না।’ তিনি দাঁড়িয়ে স্বামীর খাওয়া দেখতে লাগলেন। এক এক গ্রাসে এক-একটা লুচি শেষ করে কানাইলাল তাকালেন কামিনীর দিকে।

‘আরও চাই?’ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে কামিনী বললেন, ‘আর কিন্তু চাইলেও পাবে না। শেষবার বলে তাই দিচ্ছি।’

খাওয়ার পর দালানে পায়চারি করে কানাইলাল বিছানায় শুলেন। একটু পরে কামিনী এলেন।

‘মেয়েরা শুয়েছে? তোজু?’

কামিনী বললেন, ‘হুঁ। তোমার একটা ওষুধের বড়ি আর দুটো মাত্র আছে, কালকেই আনিয়ে নিয়ো। আলো জ্বালা থাকবে না নিভিয়ে দোব?’

‘থাক জ্বালা। বইটা পড়ব। তুমি শুয়ে পড়ো।’

কামিনী আলো থেকে মুখ বিপরীতে রেখে কানাইলালের পাশে শুলেন। কানাইলাল মাইকেল রচনাসম্ভার বইটি বুকের ওপর তুলে নিলেন। পাতা খুলে অক্ষরের দিকে তাকিয়ে রইলেন বটে কিন্তু চোখের তারা স্থির। তিনি ভাবতে শুরু করেছেন। কামিনীর অভ্যাস, বিছানায় শুলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে পারেন এবং অভ্যাস বজায় রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন।

বই বন্ধ করে কানাইলাল বার দুয়েক মুখ ফিরিয়ে স্ত্রীকে দেখে নিশ্চিত হলেন ঘুমিয়ে পড়েছে। খাট থেকে নেমে টেবল ল্যাম্প জ্বেলে তিনি নিভিয়ে দিলেন ঘরের আলো। লেখার প্যাড আর ডটপেন নিয়ে চেয়ারে বসে সামনের দেওয়ালে তাকিয়ে চোখ বুঁজে ভাবতে শুরু করলেন কলমটা কপালে ঠেকিয়ে। কিছুক্ষণ পর উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বিড়বিড় করে কথা বলতে লাগলেন। চোয়াল চেপে রাখার জন্য গালের পেশি শক্ত হয়ে ডেলা বেঁধে উঠেছে। দপদপ করল রগের শিরা, পায়চারি থামিয়ে চেয়ারে বসে কলমটা প্যাডে ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে কার সঙ্গে যেন তর্ক জুড়লেন। আবার উঠে পড়লেন। এবার তার পদক্ষেপ দ্রুত এবং নিঃশব্দ। জানলায় দাঁড়িয়ে নির্জন রাস্তায় একটা কুকুর দেখতে পেলেন, পেটটা ফুলে রয়েছে, বাচ্চচা হবে। মুখ তুললেন। পরিষ্কার আকাশ তারায় ভরা।

কানাইলাল জানলা থেকে ফিরে এসে চেয়ারে বসলেন। টেবল থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার মতো করে কলমটা তুলে ঝুঁকে লিখতে শুরু করলেন।

‘প্রাণাধিকেষু তোজু,

ভেবে দেখলুম আমার চলে যাওয়া দরকার। এ কথাটা একমাত্র তোকেই বলা যায় অন্যদের বললে তারা বুঝবে না। আমি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় চলে যাব কারণ আমি তোদের মানে এই পরিবারকে কিছু আর দিতে পারব তো নাই-ই বরং অনেক কিছু থেকে তোদের বঞ্চিতই করতে থাকব। সেটা করলে স্বার্থপরতা হবে। দরদহীনের মতো আচরণ হবে। ধীরা আজ আমার মধ্যে একটা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, একদিকে একজন অন্যদিকে অনেকজন, কোনদিকে যাব? একদিকে আমি, আমার অসুখ আর তার চিকিৎসার জন্য টাকা, মেয়েদের বিয়ে, জয়দেবকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখা, এসবের সমাধান হতে পারে, যদি অনেক টাকা পাওয়া যায়। সেই টাকাটা পাওয়ার একটা উপায় দেখা দিয়েছে। যদি তুই শক্তিগড়ের মেয়েটাকে বিয়ে করিস তা হলে এইসব সমস্যার সমাধান হতে পারে, কিন্তু তা করলে তোর জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। জীবন একটা অমূল্য জিনিস, মানুষের কাছে এর থেকে মহার্ঘ আর কিছু নেই। সেই জীবন শেষ করে দে একথা আমায় তোকে বলতে হবে। এমনই কথা বলে গেল ধীরা। বুঝতেই পারছিস কথাটা ওর একার নয়, তোর মা-বোনেদের ইচ্ছাটা ধীরার মুখ দিয়ে বেরিয়েছে।

‘তোজু, প্রত্যেক মানুষেরই তো অধিকার আছে নিজের জীবনকে রক্ষা করার। পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যাপার নেই যেটা জীবনের থেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তা হলে আমি কোন মুখে বলব এই পরিবারটাকে বাঁচাবার জন্য তুই এই বিয়েটা করে মরে যা। একদিকে তুই আর একদিকে আমরা সবাই। ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না, একদিকে একজন অন্যদিকে অনেকজন। এক্ষেত্রে তো অনেকজনের পক্ষ নেওয়াই উচিত। কিন্তু নিতে পারছি না, কোথায় যেন বাধছে। তোর জীবনটা তো তুই-ই তৈরি করেছিস। নিজের বিচারবুদ্ধি দিয়ে যেটা করলে জীবন ঠিকভাবে গড়ে উঠবে সেইসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো তো তুই নিজেই নিয়েছিস। আমি এখন কেন নাক গলাতে যাব তোর জীবনে? তা হলে কি তুই আর আমাকে সম্মান করবি, মর্যাদা দিবি? তোর চোখে চোখ রেখে আমি তো আর তাকাতেই পারব না।

‘এই বিয়েটা করা না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায় তোর উপরেই ছেড়ে দিলুম। যদি বলি করিসনি তা হলে সারাজীবন অভিশাপ কুড়োতে হবে এই পরিবারের। যদি বলি বিয়েটা করে ফেল তা হলে বিবেক আজীবন আমাকে কুরে কুরে খাবে। তোজু তুই নিজেই ঠিক কর কী করবি, আমাকে রেহাই দে। আমি চললাম। ইতি তোর হতভাগ্য বাবা।’

প্যাড থেকে কাগজটা খুলে ভাঁজ করার আগে কানাইলাল চিঠিটা পড়ল। তার মনে হল ‘মহার্ঘ’ শব্দটার বানানে বোধহয় একটা ‘য’ ফলা বসবে। ঘরে অভিধান নেই। থাকগে,তোজুকে জাগিয়ে তুলে অভিধান চাওয়ার মানে হয় না। তিনপাট করে চিঠিটা ভাঁজ করে তাতে বড়ো অক্ষরে লিখলেন, শ্রীমান তেজেশচন্দ্র সিংহ। টেবলের মাঝখানে চিঠিটা রেখে, ময়লা গেঞ্জিটা খুলে সাদা পাঞ্জাবি আলমারি থেকে বার করে পরলেন। চিরুনি দিয়ে চুলের পাট ঠিক করলেন। টেবল ল্যাম্প নিভিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদের সিঁড়ি ধরলেন।

দু-মিনিট পর রাস্তায় বিশ্রী একটা ভারী কিছু পড়ার শব্দ হল। আর ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল আতঙ্কিত একটা কুকুর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *