দাঁড়াবার জমি

দাঁড়াবার জমি – মতি নন্দী – উপন্যাস

‘আজ এখানে ভাষণ দেবে অগ্নিযুগের প্রখ্যাত বিপ্লবী’ যাঁকে দেশবাসী একসময় স্নেহভরে ‘অগ্নিপুত্র’ বলে ডাকতেন, যাঁকে বছরের পর বছর ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, আমার সেই পরম শ্রদ্ধেয়, আরাধ্যও বলতে পারেন, কেননা ওঁর আদর্শে, বৈপ্লবিক মানবসেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে, ওঁর সান্নিধ্যে মানুষ হয়েই আমি জনসেবার দীক্ষা গ্রহণ করি।’

বক্তা, ব্রজরাখাল মুখুজ্জে। স্থান, রামরাখাল উচ্চচ শিক্ষায়তনের বাইরের মাঠের মণ্ডপ। উপলক্ষ, শিক্ষায়তনের পঁচিশ বছর পূর্তিতে রজতজয়ন্তীর উদবোধন সভা। সারাবছর ধরে এই জয়ন্তী পালিত হবে।

ব্রজরাখাল একটানা কথাগুলো বলে থামলেন দম নেবার এবং মহলা দেওয়া অংশ মনে মনে ভেঁজে নেবার জন্য। শ্রীমন্ত বলে দিয়েছিল তিন জায়গায় ড্রামাটিক পজ নিতে। প্রথম পজটা ঠিক এই জায়গাতেই নিতে হবে কি না সেটা তার মনে পড়ছে না। নাই পড়ুক, সামনে তাকিয়ে চেয়ারে বসা এবং তার পিছনেও পাশে দাঁড়ানো শ্রোতাদের মুখ দেখে তাঁর মনে হচ্ছে, লেগেছে। কথাগুলো মনে লেগেছে।

ব্রজরাখাল খুশি হলেন শ্রীমন্তর উপর। তিনশো চেয়ার ভাড়া করা হয়েছে। সবই এখন ভরা। দাঁড়ানো ভিড়টাও ভালোই, শ দুয়েক হবে। পাঁচশো লোকের একটা মিটিং খুদিনগর মিউনিসিপ্যালিটির ইলেকশনের দেড় মাস আগে পাওয়া তো কল্পতরু বা চেরাপুঞ্জি লটারির চারটে ফার্স্ট প্রাইজের মতো!

রৌপ্যজয়ন্তীর উদবোধন, স্কুল জন্মের তারিখ ধরে করলে আরও এক মাস পরে হওয়া উচিত। কিন্তু বজ্ররাখাল এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা-প্রেসিডেন্ট, যেহেতু স্কুলটি তাঁর বাবার নামে এবং স্কুল কমিটির দু-তিনজন বাদে সবাই তাঁর হাতের লোক, তাই ইলেকশনের তারিখ ঘোষণা হওয়ামাত্রই তিনি নির্বাচন অভিযানে পা ফেললেন রৌপ্যজয়ন্তীর উদবোধন করে। এই জয়ন্তীর পরামর্শটা তাঁকে দিয়েছে তাঁর ভাগনে, শ্রীমন্ত। ব্রজরাখাল জনসংযোগ সংক্রান্ত ব্যাপারগুলোয় ভাগনের পরামর্শকে খাতির করেন।

ব্রজরাখাল পজ ভেঙে আবার শুরু করলেন: ‘কারাগারে উনি ব্রিটিশ পুলিশের বহু নির্যাতন বরণ করেছেন, অনশন করেছেন, লাঠি খেয়েছেন, অপমান সয়েছেন কিন্তু ভেঙে পড়েননি, তাঁকে নোয়ানো যায়নি। ওঁকে অন্তরিন করেও রাখা হয়েছিল কিন্তু ওনার বৈপ্লবিক চেতনাকে বিনাশ করা যায়নি। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে এই অষ্টাশি বছর বয়সেও-‘

এইখানে আবার পজ আর বাঁ দিকে ঘুরে ড্রামাটিক্যালি হাত তুলে দেখানোর কথা। ব্রজরাখাল ঠিক তাই করলেন। সভার চোখও সেই দিকে ঘুরে গেল।

লম্বা মঞ্চের একদিক ঘেঁসে টেবল। সেখানে বসে আছে-সভাপতি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, প্রধান অতিথি জেলার প্রধান স্কুল পরিদর্শক, বিশেষ অতিথি স্থানীয় বিধায়ক, উদবোধক এই স্কুলের ছাত্র সিনেমা নায়ক স্বদেশ চট্টোপাধ্যায়, বিশিষ্ট দুই অতিথি রবীন্দ্র পুরস্কার পাওয়া অভিজিত ঘোষ আর ভারতের ফুটবল অধিনায়ক সুধেন্দু প্রামাণিক। এরপর একটা তিন ফুট উঁচু মঞ্চে বসানো রামরাখাল মুখুজ্জের দু-হাত লম্বা আবক্ষ তৈলচিত্র। ছবিটা একটু কাঁচা হাতেই ফোটো থেকে আঁকা। গৌরবর্ণ, গোলাকৃতি ক্ষুদ্র চোখ, চ্যাপটা নাক, উচ্চচ ললাট এবং টাকমাথার মধ্যে পুত্রকে তিনি দিয়ে গেছেন গায়ের রং, উঁচু কপাল এবং টাকটি আর বিষয়সম্পত্তি ও অর্থ। কিন্তু ব্রজরাখাল মনে করেন, এই সবই তুচ্ছ। উত্তরাধিকার হিসাবে বাবার দেওয়া ‘বিপ্লবীর ছেলে’ পরিচিতিটাই তাঁর সেরা পাওয়া। আলিবাবার চিচিং ফাঁকের মতো বহু বন্ধ দরজা খুলে দিয়ে এই দুটি শব্দ।

রামরাখাল মুখুজ্জেও বিপ্লবী ছিলেন। জেল খেটেছেন, পিস্তল চালিয়েছেন, সাম্যবাদী ও গান্ধীবাদী দুটিই হয়েছেন এবং কলকাতায় দুটি বস্তি, চল্লিশটি রিকশা, একটি ছাপাখানা এবং খুদিনগরে একটি বাজার, আট বিঘা জমি ও বিরাট একটি বাড়ি ও সেকেন্ডহ্যান্ড কেনা রোভার মোটরগাড়িটি রেখে একত্রিশ বছর আগে যখন মারা যান তখন তিনি খুদিনগরের এম এল এ। ব্রজরাখালের বয়স তখন বাইশ। বলা বাহুল্য বাবার কাছ থেকে পাওয়া জিনিসগুলো পুত্র বহুগুণ বাড়িয়েছে সময়ের স্রোতের সঙ্গে চমৎকার ভেসে থেকে।

ব্রজরাখাল রিকশাগুলো বেচে দিয়ে এখন চারখানি বাসের মালিক। ছাপাখানায় লাইনোর বদলে অফসেট মেশিন বসেছে। বাজারটা রূপান্তরিত হয়েছে চারতলা সুপার মার্কেটে। বস্তি দুটো অবশ্য আগের মতোই রয়ে গেছে। এক গুজরাতি প্রোমোটারের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছেন চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি বানাবার ইচ্ছা নিয়ে।

কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি ব্যস্ত এবং উদবিগ্ন পুর নির্বাচন সম্পর্কে। গতবার বাম ও দক্ষিণ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পার্টিই তাঁকে কথা দিয়েছিল যদি ‘টাই’ হয় তা হলে তাঁকেই চেয়ারম্যান করে বোর্ড গড়বে। তেরোজন কমিশনারের জন্য নির্বাচনে, কংগ্রেসের ছয়জন, বামফ্রন্টের ছয়জন এবং নির্দল প্রার্থী হয়ে তিনি জিতেছিলেন। দশ দিন ধরে দুই পক্ষের প্রস্তাবগুলি বিবেচনা করে অবশেষে তিনি যান বামফ্রন্টে। চেয়ারম্যান পদের জন্য প্রতিশ্রুতিমতো বামফ্রন্ট তাঁকেই মনোনয়ন দেয়, কংগ্রেস দেয় সত্য মিশ্রকে।

সাত-ছয় ভোটে তাঁর জেতা হয়েই গেছে ধরে নিয়ে মিছিলের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ফল হয়েছিল ঠিক বিপরীত। ব্রজরাখাল ছয়-সাত ভোটে হেরে গেছলেন। ক্রস ভোটিংয়ের ফলে সত্য মিশ্র জিতে যায়। বামফ্রন্টের কেউ একজন গোপন ব্যালটে নেওয়া ওই নির্বাচনে ডিগবাজি খেয়ে, ব্রজরাখালকে হাসির লক্ষ্যবস্তু করে দিয়ে, নিজেদের মধ্যের ঝগড়াটা খবরের কাগজে তুলে দিয়েছিল।

এবারের নির্বাচনে তিনি অতীব হুঁশিয়ার হয়ে শ্রীমন্তকে পাবলিসিটির দায়িত্বে রেখেছেন। ছেলেটা ঘাঁতঘোত জানে এবং বোনের ছেলে। রক্তের সম্পর্ক আছে বলেই তাঁর বিশ্বাস, পিছন থেকে ছুরি মারবে না। শ্রীমন্তর পরামর্শেই তিনি-

‘…আমাদের সৌভাগ্য, এই বয়সেও সতেজ এবং সুস্থ মস্তিষ্কে অকামামা, মানে অক্ষয়ধন মিত্র আমাদের মধ্যে উপস্থিত রয়েছেন।’

অকামামাকে সামনে রেখে নির্বাচনী অভিযান চালানোর প্ল্যানটা শ্রীমন্তরই। বলেছিল, ‘আপনিই ওকে বাড়িতে এনে রেখেছেন, খাওয়াচ্ছেন, পরাচ্ছেন, চিকিৎসা করাচ্ছেন। যখন যা চায় বছরের পর বছর দিয়ে আসছেন। এবার ওকে ভাঙিয়ে কিছুটা উশুল করুন।’

শ্রীমন্ত সাফ সাফ কথা বলে। এটাই ব্রজরাখালের পছন্দ। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করে না। কিন্তু অস্বস্তিও ধরে। ‘উশুল করুন’ কথাটা তাঁর কানে ভালো শোনায়নি। অন্যরকম ভাবে বক্তব্যটা পৌঁছে দিলে মনের মধ্যে খচখচানি ভাবটা আর আসত না। অকামামার কাছে তাঁর বাবা রামরাখাল কোন এক সময় চরম বিপদে নাকি সাহায্য পেয়েছিলেন বলেই বিপদটা যে কী ধরনের ছিল, সেটা কেউ জানে না, ব্রজরাখালও নন। অক্ষয়ধন তখন রাজি হননি। রামরাখাল মারা যাওয়ার পর তাঁর বিধবা স্ত্রী সুরুচি, কলকাতার শ্যামপুকুরের বাপের বাড়ি থেকে কান্নাকাটি করেই তাঁর ছোড়দাকে নিয়ে আসেন খুদিনগরে।

‘আমার বাবা, যার নামে এই বিদ্যায়তন, আজকের রজতজয়ন্তী বর্ষের উদবোধন হচ্ছে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, এই শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠার প্রেরণা আমি পেয়েছিলাম আমার বাবা আর এনার কাছ থেকে।’

আবার ড্রামাটিক পজ। দর্শক-শ্রোতারা মঞ্চের ডান দিকে বিশেষভাবে রাখা, ঢাউস একটা সোফার জঠরে ঢুকে থাকা ছোটোখাটো লোকটির দিকে আর একবার তাকাল। মাথাটা কাঁচা-পাকা আধ ইঞ্চি উচ্চচতার চুলে ভরা। কামানো গাল, বয়সোচিত বলিরেখা পড়েনি। শীর্ণ গলায় কণ্ঠনালির কাছে চামড়া সামান্য ঝুলে পড়েছে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। চোখের রং ঈষৎ ধূসর। গেরুয়া ফুলহাতা খদ্দরের পাঞ্জাবি ও ধুতি, পায়ে চটি। ওঁকে দেখে বোঝা যায় না যে অষ্টআশি চলছে।

ব্রজরাখালের বক্তৃতা ওঁর কানে ঢুকছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। মেরুদণ্ড কখনো সোজা রেখে, কখনো সামনে ঝুঁকে, কখনো মাথাটা পিছনে হেলিয়ে অক্ষয়ধন অধৈর্যতা প্রকাশ করছেন।

‘এই বিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠা করি তখন খুদিনগর পুরসভা এলাকায় একটাও হাইস্কুল ছিল না। কী কষ্ট করে যে তখন একে চালিয়েছি, বাঁচিয়েছি তা জানেন শুধু তখনকার শিক্ষকমশাইরা। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন এখনও শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন, ওই যে সামনেই বসে রয়েছেন বিমলবাবু, অনুকূলবাবু ওঁরা বলতে পারবেন…তখন পুরসভা, সরকারি শিক্ষা বিভাগ, কোথাও থেকে একটা টাকাও সাহায্য পেতাম না। কিন্তু আপনাদের শুভেচ্ছা, শিক্ষার জন্য আপনাদের আগ্রহ, সমর্থন যা না থাকলে কোনো পাবলিক কাজ করা যায় না তা আমি পেয়েছিলাম বলেই আজ এই বিদ্যায়তন রজতজয়ন্তী পালন করতে পারছে।’

ব্রজরাখাল এবার মঞ্চের নীচে, বাঁ দিকে রাখা টেবলটার দিকে তাকালেন। টেবলের তক্তার জোড়ে গোঁজা একটা পেস্টবোর্ডে লাল কালিতে মোটা হরফে বাংলায় লেখা ‘প্রেস’। তিনটি পুরুষ টেবলে বসে। ব্রজরাখালের ‘নিবেদন’ ছেপে বিলি করা হয়েছে, ওরা তাই পড়ছে। কিন্তু টিভি-র লোকজন কোথায়? বক্তৃতা কতক্ষণ আর চালাবেন! লোকেরা উশখুশ শুরু করেছে। ব্রজরাখালের চোখ সভার এধার-ওধার খুঁজতে লাগল শ্রীমন্তকে।

শ্রীমন্ত ঠিক তখনই স্কুল গেটের বাইরে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। বয়স পঁচিশ-ত্রিশের মধ্যে। প্রায় ছয় ফুট, ব্যায়াম করে তৈরি শরীর, চোখা মুখ, ফাঁপানো কোঁকড়া চুল, চওড়া ঝুলফির সিল্কের চুড়িদার পাঞ্জাবির সঙ্গে মানানো গায়ের রং। কাঁধে মণিপুরী কাপড়ের ঝোলা। ওর সারা অবয়বে একটা কাঠিন্য আছে যেটা ঝরে পড়ে সামান্য একটু হাসলেই। শ্রীমন্ত তার হাসিটাকে তুরুপের মতো মাঝেমধ্যে ব্যবহার করে ফল পেয়েছে। দরকার বুঝে কণ্ঠস্বরকে সে উদাত্ত বা মিহি করতে পারে।

এই মুহূর্তে সে একটু সংকটে। টিভি থেকে তাদের একজন স্ট্রিঙ্গার আসার কথা। তাকে বউবাজারের বাড়ি থেকে আনার জন্য গাড়ি পাঠিয়েছে কিন্তু এখনও এসে পৌঁছয়নি। ওই গাড়ি কলকাতা থেকে দু-জন রিপোর্টারকেও আনবে। রিপোর্টার না হোক, টিভি-র লোক না এলে ব্রজমামার কাছে তার মাথা কাটা যাবে, কিছু কড়া কথা শুনতেই হবে।

মামার কাছে তার উপযোগিতা কমে গেলে শ্রীমন্ত মুশকিলেই পড়বে। ব্রজরাখালের কাছে সে চাকরি করে না বটে তবে নানান ধরনের কাজ করে দেওয়ার জন্য মাসোহারা পায়। কোনোক্রমে উচ্চচমাধ্যমিক এবং কলেজে মাত্র এক বছর পড়েই মামার আশ্রয়ে এসে, বাসের আর সুপার মার্কেটের দেখাশোনার কাজ দিয়ে শুরু করেছিল। এখন সে মামার কাছের লোক। আপার ডিভিসন ক্লার্কের মতোই তার আয়।

রামরাখাল তাঁর মেয়ে সুপ্রভার বিয়ে দিয়েছিলেন উত্তর কলকাতায় তাঁর শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি দর্জিপাড়ায়, বংশ-কৌলিন্য দেখে। জামাই সনৎ তাস আর ক্যারাম খেলা ছাড়া দক্ষতা অর্জন করেছিলেন আধুনিক গান গাওয়ায়। শরিকানি বিষয়-সম্পত্তির অংশ থেকে পাওয়া টাকায় তাঁদের সংসার চলত। বিয়ের সময় সনতের নিয়মিত কোনো রোজগার ছিল না। তখন রেডিয়োয় বছরে তিনি তিনবার গান গাইতেন, পুজোর পর কিছু জলসায় গান গেয়ে কয়েকটা টাকা পেতেন, দুটো রেকর্ডও হয়েছিল। একটা গানের স্কুলে সপ্তাহে একদিন গান শেখাতেন।

শ্রীমন্তর জন্মের পর সনৎ একটা ফিল্মে কোরাসে গলা দেবার সুযোগ পান, তারপর সহকারী সংগীত পরিচালক হবার প্রতিশ্রুতি পেয়ে স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে প্রযোজকের হাতে টাকা তুলে দেন। সেই ফিল্ম আর তৈরি হয়নি কিন্তু সনৎ চোটটা আর সামলে উঠতে পারেননি। পারিবারিক সম্পত্তিগুলো বহুদিন ধরেই বিক্রি হতে হতে যখন জানা গেল বিক্রির জন্য আর কিছু অবশিষ্ট নেই, তখন সনতের সাংসারিক অবস্থাও শোচনীয়। এই সময় রামরাখাল সাহায্য না করলে তাঁর মেয়ে এবং নাতিদের প্রকৃতই ভিক্ষা করতে হত। জামাইকে তিনি নিমতলায় তাঁর ছাপাখানায় বসিয়ে কাজকর্ম তদারকির ভার দেন।

সন্ধ্যায় হেঁটে নিমতলা থেকে দর্জিপাড়ায় ফেরার পথে সনৎ, একঘেয়ে, মন্থর জীবনে বৈচিত্র্যের ও উত্তেজনার স্বাদ পাওয়ার জন্য গরানহাটার মধ্য দিয়ে কয়েকটা গলি বেছে নিয়েছিলেন যেখানে মেয়েরা মুখে চড়া প্রসাধন করে, কেউ বা খোঁপায় মালা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদেরই একজনের ঘরে অবশেষে একদিন তিনি প্রমোদের জন্য যান। তিনি তাঁর সঙ্গ উপভোগ করেন এবং প্রায়ই যেতে শুরু করেন।

বালক শ্রীমন্তকে তার পাড়ারই এক বন্ধু এই খবরটি দেয়। ‘কাকার বন্ধুর চপ-কাটলেটের দোকান, মাঝে মাঝে কাকা খেয়ে আসে। কাল কাকা খেতে গেছল। বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে, তখন দেখল তোর বাবা দোকানের সামনের, একটা খুব খারাপ বাড়িতে ঢুকল।’

‘খারাপ বাড়ি মানে?’

‘বেশ্যাবাড়ি।’

‘তাতে কী হয়েছে?’ শ্রীমন্ত বেশ্যা শব্দটি শুনেছে কিন্তু জানত না বেশ্যাবাড়িতে ঠিক কী ঘটে।

‘তোর বাবার লুজ ক্যারেক্টার।’

‘কে বলল?’

‘কাকা বাড়িতে বলছিল।’

শ্রীমন্ত কাউকে কিছু বলেনি। তবে কৌতূহলের তাড়নায় পরদিন সে ছাপাখানার কাছে সন্ধ্যার সময় দাঁড়িয়ে থাকে। বাবা বেরোতেই সে অনুসরণ করে। দূর থেকেই সে দেখল বাবা একটা বাড়িতে ঢুকল যার দরজায় পাঁচ-ছটি মেয়ে, বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে যাওয়ার মতো সাজগোজ করে দাঁড়িয়ে। কিন্তু বাড়িটাকে তার মোটেই খারাপ বলে মনে হল না। তাদের পাড়াতেও এরকম দেখতে অনেক বাড়ি আছে। সে এগিয়ে এসে দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরটা দেখার জন্য উঁকি দিয়েছিল তখন ওদের মধ্যে মোটাসোটা সবথেকে বয়স্ক মেয়েটি খিঁচিয়ে উঠে বলেছিল, ‘অ্যাই এখানে কী কোত্তে এয়েচিস, কান ছিঁড়ে দোব, য্যা পালা, পুলিশ ডেকে নইলে ধরিয়ে দেব।’ শ্রীমন্ত ফেরামাত্র তার কান ধরে মা বলেছিল, ‘সন্দের পর বাড়ির বাইরে কোনো ভদ্দরবাড়ির ছেলে থাকে?’

ভদ্দরলোক হওয়ার ঝামেলা যে কী কঠিন ব্যাপার বাল্য বয়স থেকে সেটা জানতে জানতে শ্রীমন্ত বড়ো হয়েছে। সংসার খরচের জন্য যে পরিমাণ টাকা দিতেন, তা কমতে শুরু করে। মাসের কুড়ি দিনের পর আধপেটা খেতে হত। একদিন রামরাখাল এসে মেয়েকে জানালেন, তিনি আর জামাইকে কাজে রাখবেন না। টাইপের সিসে চুরি করে বিক্রি করছে। শ্রীমন্ত দেখেছিল দাদামশাইয়ের পা জড়িয়ে ধরে মায়ের কান্না আর অনুনয়। চাকরিটা যায়নি কিন্তু তিন মাসের মধ্যে ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন রামরাখাল। চিকিৎসা না করিয়ে সিফিলিস পুষে রাখার ফল সনৎ পেলেন, শ্রীমন্ত যখন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক বিকৃতির নানান লক্ষণ অনেক দিন ধরেই সবার নজরে পড়ছিল। অবশেষে এক মাঝরাতে নগ্ন হয়ে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান এবং পরদিন সকালে সেই অবস্থায়ই তাঁকে ধরে পাড়ার কয়েকজন লোক বাড়িতে ফিরিয়ে আনে।

সনৎ সাত মাস আগে মারা গেছেন। শ্রীমন্ত অবশ্য দশ বছর আগে থেকেই পাগল বাবার সঙ্গে তার মা, তিন ভাই ও একটি বোনের সংসারকে টানতে শুরু করে দিয়েছিল। কৈশোর ফুরোবার আগেই তার ঘাড়ে এই বোঝাটা তুলে দেওয়ার জন্য সে বাবার উপর কখনো রাগ করেনি। কখনো কপাল চাপড়ে নিজের ভাগ্যকে পোড়া বলেনি। বরং সে প্রবলভাবে সামাজিক হওয়ার চেষ্টা করেছে, রঙ্গরসিকতার জন্য সবার প্রিয় হয়েছে, মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনস্টির সুযোগ পেলে তা ছাড়েনি এবং এক ধরনের নির্মমতাকে সে আয়ত্ত করে নিয়েছে, যেটা তাকে সাহায্য করে বাধাবিঘ্ন ঠেলে উপরে উঠে আসতে।

কিন্তু এই মুহূর্তে, রামরাখাল উচ্চচ শিক্ষায়তনের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যে বিপত্তির আশঙ্কায় সে রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছছিল, সেটিই ঘটল। একটা অ্যাম্বাসাডর তার সামনেই এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নামল শুধু একটিমাত্র মেয়ে।

ক্যামেরা হাতে টিভি-র লোক কই? দু-জন রিপোর্টারও আসার কথা, তারাই বা কই? শ্রীমন্ত গাড়ির ড্রাইভারের কাছে গিয়ে ঝুঁকে গলা নামিয়ে বলল, ‘যাদের আসার কথা, তারা কই?’

‘টিভি-র লোকের বাড়িতে গেছলুম। তিনি বললেন, তাঁর ক্যামেরাটা আজ সকালেই গন্ডগোল করেছে, ফ্লিম ঠিকমতো রোল করছে না, সারাতে দিয়েছেন তাই আসতে পারবেন না। আর যে দু-জন রিপোর্টারকে তুলতে বলেছিলেন তার একজনের জন্য মানিকতলায় ছায়া সিনেমার সামনে কুড়ি মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলুম। আর এনাকে উলটোডাঙার মোড় থেকে এনেছি।’ ড্রাইভার মুখ ফেরাল মেয়েটির দিকে।

পলকের জন্য শ্রীমন্তর মুখ শুকিয়ে গিয়েই সঙ্গে সঙ্গে হাসিতে ভরে গেল। নমস্কার জানাতে জানাতে মেয়েটিকে বলল, ‘আসুন, আসুন, একটু দেরি করে ফেলেছেন অবশ্য দোষটা আপনার নয়।’

‘দেরি হত না যদি বিদ্যুৎবাবু আগেই আমাকে জানাতেন…আমার নাম অসীমা পাল, সমাচার থেকে-।’

‘ওহোও, বিদ্যুৎদা মানে বিদ্যুৎ ঘোষ….এইদিক দিয়ে আসুন….কিন্তু আমি তো সাত-আট দিন আগে ওঁকে বলে এসেছি, কার্ডও দিয়েছি! বলেছিলেন ভবনাথ গুপ্তকে পাঠাবেন।’

‘আজ দুপুরে সমাচার অফিসে যেতেই বিদ্যুৎদা বললেন, তোমার বাড়ির দিকেই একটা স্কুলের সিলভার জুবিলি ইয়ারের ইনঅগুরেশন আছে, ভবনাথকে কভার করতে বলেছিলাম কিন্তু ফোন করে জানাল আজ অফিসে আসতে পারবে না, ছেলেকে স্কুলে ভরতি করানোর ব্যাপারে ব্যস্ত থাকবে। ওর জন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে উলটোডাঙায়, তা তুমিই চলে যাও।’ কাঁধ থেকে ঝোলা ফোমলেদার ব্যাগটা থেকে উঁকি দেওয়া ছাতার মাথাটা চেপে বসিয়ে অসীমা হাসল।

প্রেস লেখা টেবলে সাত-আটটা চেয়ার রাখা এবং সবগুলোতেই লোক বসে। শ্রীমন্ত তাদের মুখগুলো দেখে তিন জনকে চিনল। বাকিদের একজনকে খুব বিনীত স্বরে বলল, ‘আপনি কোন কাগজ থেকে?’

লোকটি থতমত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘না না আমি কাগজের নই, খালি দেখে বসেছিলাম।’

‘বসুন।’ শ্রীমন্ত খালি চেয়ারটা অসীমাকে দেখাল। কাঁধের ঝোলা থেকে ব্রজরাখালের এককপি ‘নিবেদন’ বার করে দিল অসীমার হাতে। পাশের তিনজন ভ্রূ কুঁচকে কৌতূহলে অসীমার দিকে আড়ে তাকাল।

শ্রীমন্তর ভ্রূও একবার নড়ে উঠেছিল। সমাচারে মেয়ে রিপোর্টার! অনেকবারই সে ওদের অফিসে গেছে কিন্তু কোনো মেয়েকে তো চোখে পড়েনি! এখন অনেক কাগজেই মেয়েরা রিপোর্টিং করছে, ডেসকে কাজ করছে কিন্তু সমাচার তো ততটা আধুনিক নয়। ব্রজমামার প্রহসন দেখতে কলকাতা থেকে রিপোর্টার সেজে এখানে আসতে পারে শুধুমাত্র বদ্ধ উন্মাদ নয়তো অকাদাদুর কোনো বাল্যবন্ধু। কিন্তু এই অসীমা পাল যে তার কোনোটাই নয়, সেটা তো ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

প্রধান অতিথি বক্তৃতা দিচ্ছেন। শ্রীমন্ত দাঁড়ানো দর্শকদের পিছনে চলে এসে নিজেকে ব্রজমামার দৃষ্টির বাইরে রাখল। টিভি ক্যামেরা দেখতে না পেয়ে ওঁর মানসিক ভারসাম্য যে হেলে পড়বেই শ্রীমন্ত তা জানে। আজ সকালেও মামা মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কিন্তু এটাই, ফেভারেবল প্রেস রিপোর্টিং। কোনো ত্রুটি যেন না হয়….টিভি থেকে আসছে তো?’

‘আসবে। তাকে আনার জন্য গাড়িও রেডি আছে। সেই সঙ্গে দু-জন রিপোর্টারও আসবে।’

ব্রজরাখালের মুখ দেখে শ্রীমন্তর মনে হয় তার কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না তাই যোগ করেন, ‘অকাদাদুর নাম করেছি, তাঁর বিষয়ে যা যা বলার বলেছি। উনি সভায় থাকবেন, এটা যে একটা বিরল ঘটনা, তাও বলেছি।’

‘তোকে যা বলে রেখেছি সেইমতো ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে সঙ্গে থাকবি।….ওসব অকাদাদুফাদু ছাড়, আমার ছবি যাতে নেয় সেই ব্যবস্থা করবি।’

‘কিন্তু মামা আমি চাইলেই কী ওরা, মানে….নিউজের গুরুত্ব বুঝেই তো ওরা ছবি তুলবে।’

‘আহাহা তুলুক না, সে তো একশোবার তুলবে, সেটাই তো নিউজম্যানের কাজ। কিন্তু তোর কাজটাও তো তুই করবি। খরচের কথা তো তোকে ভাবতে বলিনি….খাওয়া, যত টাকা লাগে খাওয়া। টিভি-তে একবার একটুখানি মুখ দেখাতে পারলে আমার কাজ কতটা এগিয়ে যাবে বল তো? লোকে এখন টিভি-কে ভক্তি করে, শ্রদ্ধা করে, মানে। স্ক্রিনে ফুটে উঠলেই লোকে বুঝে নেয়, হেঁজিপেজি নয় নিশ্চয় একজন সেলিব্রেটি। শ্রীমন্ত আমার এখন ওই সেলিব্রেটি ইমেজটা দরকার।’

‘কিন্তু মামা, খুদিনগরের সাত নম্বর ওয়ার্ডের ভোটাররা তো সেলিব্রেটি-ফ্রেটি বোঝে না। তুমি দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তার কাঁচা নর্দমা সাফ করাবে কিনা, জলের পাইপ বসাবে কিনা সেই ইমেজটাই আগে তৈরি করো।…স্থানীয় সংবাদে দু সেকেন্ড তোমাকে স্ক্রিনে দেখালেই কী ঝপাঝপ তোমার সিম্বলে ছাপ পড়বে ভেবেছ? লোকে কী এতই বোকা?’

কথাটা শুনে ব্রজরাখাল খুব বিরক্ত হয়ে এরপর বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে টিভি-র জন্য তুই চেষ্টা করিসনি, তাই এই সব বোঝাচ্ছিস।’

এখন শ্রীমন্ত প্রায় শিউরে উঠল, টিভি ক্যামেরা না-দেখা ব্রজমামার প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে। রগচটা মানুষ। টাকাপয়সা বাড়ানোর বুদ্ধিটার বাইরে, নিজের স্বার্থের গণ্ডির বাইরে দুনিয়ার হালচাল বোঝার বা দেখার দরকার আছে বলে মনে করেন না। এবং এইভাবেই তিনি দিব্যিই মসৃণভাবে চলে যাচ্ছেন হোঁচট না খেয়ে।

ভাড়া করে দু-জন ফোটোগ্রাফারকে শ্রীমন্ত কলকাতা থেকে আনিয়েছে। ওরা ফুটবল ক্রিকেট মাঠে ছবি তুলে বিক্রি করে। শিখিয়ে পড়িয়েই সে এনেছে আর ব্রজরাখালকে বলেছে, আনন্দবাজার আর স্টেটসম্যান থেকে এসেছে। শুনে খুশি না হয়ে ব্রজমামা বলেছিলেন, ‘এখানে সাত নম্বর ওয়ার্ডে সবথেকে বেশি লোক পড়ে সমাচার, এ কথা তুই-ই আমায় বলেছিলি। আর নিয়ে এলি কিনা-‘

‘সাত নম্বর ওয়ার্ডের লোকেরা মানে ভোটাররা কাজকর্ম করে, লোকজনের সঙ্গে কথা বলে, আলোচনা করে, মতামত শোনে যেখানে, সেখানে কী সবাই সমাচারের পাঠক? বেশিরভাগ লোক ভোট দেয় অন্যের কথা শুনে আর সেই অন্য লোকেদের কথা ভেবেই এই দুটো কাগজের ফোটোগ্রাফার এনেছি। এতবড়ো কাগজ থেকে এসেছে এটাই তো বলার মতো ব্যাপার, তুমি পাবলিসিটির এই দিকটাও দ্যাখো!’

‘ছাপা কী হবে?’

শ্রীমন্ত কপালে হাত ঠেকিয়ে মুখ উপরে তুলে শুধু বলেছিল ‘উনিই জানেন।’

কিন্তু এখন তাকে জানতে হবে এই অসীমা পাল সত্যিই সমাচারের স্টাফ রিপোর্টার কি না। জানার সহজ পদ্ধতি বিদ্যুৎ ঘোষকে টেলিফোন করা। স্কুলের টেলিফোনটা হেডমাস্টারের ঘরে। শ্রীমন্ত টেলিফোন করার উদ্দেশ্যে প্যান্ডেলের বাইরে দিয়ে ঘুরে এগোচ্ছিল তখন দেখা হয়ে গেল পুরসভার চেয়ারম্যান সত্য মিশ্রর সঙ্গে। ব্যস্ত হয়ে তিনি গেট দিয়ে ঢুকছেন।

‘সত্যবাবু! এত দেরি করে?’

‘আর বলো না। কলকাতায় গেছলুম, ফেরার পথে কেষ্টপুরের কাছে গাড়ি বিগড়ে….খুব নাকি পাবলিসিটির ফায়দা তোলার ব্যবস্থা করেছ, টিভি এসেছে নাকি?’

শ্রীমন্ত হাতঘড়ি দেখে ধীরগলায় বলল, ‘গাড়ি পাঠিয়েছি, এখনও ওদের আসার সময় হয়নি।’

‘আমি গিয়ে বসি। বক্তৃতা টক্তৃতা কিছুক্ষণ তো চলবে?’

‘আদ্দেকের বেশি হয়ে গেছে, দাদুরটা বাকি। তারপর একটা কত্থক নাচ, ম্যাজিক শো, রবীন্দ্রনাথের শ্যামা দিয়ে শেষ হবে। আপনি-‘ শ্রীমন্ত ওকে একটা ‘নিবেদন’ দেবার জন্য ঝোলায় হাত ঢোকাল এবং খালি হাত বার করল। দরকার নেই নষ্ট করে। ‘আপনি এই ডান দিক দিয়ে এগিয়ে যান।’

সত্য মিশ্রর জন্য মঞ্চে বসার ব্যবস্থা নেই। ব্রজরাখালের ঘোরতর আপত্তির বাধাটা শ্রীমন্ত টপকাতে পারেনি।

‘ওকে মঞ্চে বসানো উচিত। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, তার একটা মর্যাদা আছে। ওর এলাকাতেই এই স্কুল। ওকে না হোক ওর চেয়ারটাকে তো-।’

‘সেই জন্যই ওকে মঞ্চে চেয়ার দেব না।’ ব্রজরাখালের চাহনি আর শক্ত হয়ে ওঠা চোয়ালের পেশি জানিয়ে দিচ্ছে এই ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্ত অটল। ‘ওই চেয়ারটা আমারই পাবার কথা ছিল, সারা খুদিনগর তাই জেনেছিল। সত্য মিশ্রর দল তলায়-তলায় যে কী চক্রান্ত করেছিল সেটা তো আর এখন অজানা নয়।’

‘মামা, রাজনীতি কখনো চক্রান্ত বাদ দিয়ে করা যায় না। সিপিএমের এক কমিশনার আপনাকে ভোট না দিয়ে কংগ্রেসকে দিল কেন তাও আপনি জানেন। মনে করে দেখুন, বাজার তুলে দিয়ে সুপারমার্কেট করতে গিয়ে তখন যে আন্দোলনের সামনে পড়েছিলেন তাতে আপনি একটা ইটও গাঁথতে পারতেন না। বিমল চক্রবর্তী বলেছিল সুপারমার্কেটে একখানা ঘর তাকে ফ্রি দিলে আন্দোলন বন্ধ করিয়ে দেবে। আপনি রাজি হলেন, সুপারমার্কেটের বাড়ি উঠল কিন্তু ঘর কী তাকে দিয়েছেন?….তাহলে সে কেন বদলা নেবে না?’

‘ফ্রি আমি মোটেই দেব বলিনি। ওদের লোকাল কমিটির সেক্রেটারিকে, কংগ্রেসের দু-জনকে যে দামে দিয়েছি সেটাই চেয়েছিলাম। তুই জানিস, ক্রসভোটিংয়ের জন্য বিমল চক্রবর্তীকে পার্টি থেকে বার করে দেওয়ার সুপারিশ জেলা কমিটি করেছিল কিন্তু লোকটা রয়ে গেছে রাজ্য কমিটিতে খুঁটির জোর আছে বলে। এখন ওর কথাতেই সত্য মিশ্র ওঠাবসা করে আর সেই সত্যকে আমি মঞ্চে তুলে পাবলিকের কাছে দেখাব? এতে ও কতটা পাবলিসিটি পেয়ে যাবে জানিস? এর উপর টিভি-র ছবির মধ্যে যদি চলে আসে-‘ ব্রজরাখাল এক কাল্পনিক টিভি স্ক্রিনে সেই ছবি দেখতে পেয়ে শিউরে উঠলেন।

শ্রীমন্ত জানে, ব্রজমামার পক্ষে চেয়ারম্যান না হতে পারার শোক কাটিয়ে ওঠা তখনই সম্ভব হবে যদি এবারের নির্বাচন জিতে সাতটা ভোটের ব্যবস্থা করতে পারেন। শুধু মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্যই নয়, আট বিঘা পৈতৃক জমিটা বাঁচাবার জন্যও তাঁকে চেয়ারম্যান হতে হবে।

খুদিনগর স্পোর্টিং ক্লাব তৈরি করে রামরাখাল মুখুজ্জেই তাঁর আট বিঘে জমিতে ক্লাবকে শুধু ব্যবহারের অনুমতিই দিয়ে যাননি, মায়ের নামে কৃষ্ণভামিনী স্মৃতি চ্যালেঞ্জ শীল্ড ফুটবল প্রতিযোগিতাও চালু করে দিয়েছিলেন যাতে উদ্বাস্তুরা জমিটা দখল করে ঘর বানিয়ে ফেলতে না পারে। সেই ক্লাব এখন পাকা ঘর তুলে তো ফেলেছেই, তাদের সেক্রেটারি রামানন্দ সরখেল বলতে শুরু করেছে, এই জমি নাকি ক্লাবেরই সম্পত্তি। তারা অধিকার ছাড়বে না।

খুদিনগর ক্লাবে শ্রীমন্ত চার বছর ব্যায়াম করেছে। সবাইকে চেনে, রামানন্দ তো খুবই পরিচিত। কিছুদিন ওর যোগাসন শেখার ক্লাসে শ্রীমন্ত তালিম নিয়েছিল। কিন্তু রামানন্দর শিক্ষাদান পদ্ধতিতে হাত দুটোর অযথা অবাঞ্ছিত স্থানে গমনের প্রয়োগ থাকায় সে ক্লাস করা বন্ধ করে দেয়। এজন্য রামানন্দ এখনও দুঃখ করে বলে, ‘বেনারস থেকে ভারত যোগশ্রীটা তোকে দিয়ে বাংলায় আনাতুম। মিছিমিছি ছেড়ে দিলি।’

শ্রীমন্ত কাচুমাচু মুখ করে প্রতিবারই বলে, ‘কী করব রামাদা, বুকের সেই ব্যথাটা সম্পর্কে ভয় দেখিয়ে ডাক্তারে যা বলল তাতে বাড়ির সবাই এমন-‘

‘বাড়ি মানে তো তোর মামাটা। আমার সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে বেড়ায়, আমি নাকি যোগের কিছুই জানি না।’

এই রামানন্দ যোগব্যায়ামের স্কুল খুলে দু-বেলায় সত্তর-আশি জন নানান বয়সি নরনারীকে অভ্যাস করায়, শিক্ষা দেয়। অম্বল, আমাশা, গেঁটেবাত নাকি সারিয়ে দিতে পারে। গত বছর তার স্কুলের শাখা খুলেছে ইছাপুরে ও মধ্যমগ্রামে।

শ্রীমন্তর ‘মামাটা’কে ঘোল খাওয়াবার জন্যই রামানন্দ জমির কিছুটা বেড়া দিয়ে ঘিরে নিয়েছে। ব্রজরাখালের ওই জমির বিঘে প্রতি দাম এখন চার লাখ টাকার উপর এবং মাসে মাসেই দাম বেড়ে উঠছে। জমি উদ্ধারের জন্য শ্রীমন্তকে মাথা ঘামিয়ে বুদ্ধি বার করার দায়িত্ব দিয়েছে ব্রজরাখাল। মামাকে তার প্রথম পরামর্শ ছিল: তোমাকে চেয়ারম্যান হতে হবে আর সেজন্য অকাদাদুকে সামনে খাড়া করে তোমাকে এগোতে হবে।

‘অক্ষয়ধন মিত্রর মতো মানুষ, যিনি একদা স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবের মশাল হাতে নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছিলেন বাংলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, যদি আপনারা ভাবেন আজ তিনি রণক্লান্ত তাহলে ভুল করবেন…সমাজসেবার জন্য, এই খুদিনগরের জনগণের মঙ্গলের জন্য, আবার তিনি নিভে যাওয়া মশাল….।’ স্কুল কমিটির সেক্রেটারির গলা দাউ দাউ করে লাউডস্পিকার থেকে বেরিয়ে আসছে। শ্রীমন্ত জানে ইনি মামার হাতের লোক।

কিন্তু এখন টেলিফোন করে তাকে জেনে নিতে হবে অসীমা পাল আসলে কে?

হেডমাস্টারের ঘর তালাবন্ধ তবে দরজার সামনে বেয়ারাকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘তালা দেওয়া কেন? একটা জরুরি ফোন করতে হবে যে।’

‘ফোন তো আজ এগারো দিন হল অচল। খবর দেওয়া হয়েছে।’

কাছাকাছি ফোন ব্রজরাখালের বাড়িতে। সেটা অচল নয়। কিন্তু এখন তার যাওয়া সম্ভব নয়। সে দূর থেকে প্রেস টেবলে বসা অসীমার দিকে তাকাল। ব্যাগটা টেবলে রাখা। নোটবইয়ে কিছু একটা লিখতে গিয়েও লিখল না। শ্রীমন্তর মনে হল, বোধ হয় সত্যি রিপোর্টারই। অসীমার উপর দিয়ে সে চাহনিটা দু-বার বোলাল। মুখ শুকনো, থুতনির কাছটা ছুঁচলো, চওড়া কপাল, চোখা নাক, কেশ উপড়ানো সরু বাঁকানো ভ্রূ, পাতলা ঠোঁট, মুখের গড়ন ডিমের মতো, মঙ্গোলীয়দের মতো চোখ ও গায়ের রং, কাঁধ চওড়া কিন্তু রোগাই, চোয়ালের হাড় সামান্য প্রকট হয়ে সারা মুখটাকে শক্ত কাঠামো দিয়েছে যে জন্য চোখ দুটোয় একটা কড়াধাত এসেছে। বাম বগলের কাছে কাপড়, তাঁতের, বেশি দামি নয়, সরে রয়েছে। বুকে স্বাস্থ্য আছে। মাঝ দিয়ে সিঁথি করা চুল খোঁপায় বাঁধা। বাঁ হাতের কবজিতে ঘড়ি ছাড়া কোনো অলংকার নেই। হাতটার গড়ন ভালো। কিন্তু মেয়েটি সম্পর্কে কোনো ধারণা তার তৈরি হল না।

ফোটোগ্রাফদের একজনকে ভিড় ঠেলে বেরোতে দেখে শ্রীমন্ত এগিয়ে গেল। ‘এখন কোথায় চললে?’

‘রোলটা শেষ, নতুন ভরতে হবে।’

‘যেমন বলেছি, প্রত্যেক ফ্রেমে মামা যেন-।’ শ্রীমন্তর চোখ মঞ্চে পড়ল। ব্রজরাখালের ‘নিবেদন’ ছিঁড়ে সরু করে পাকিয়ে অকাদাদু কানে ঢুকিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছেন। চোখ দুটো আরামে বোজানো। মঞ্চের একদিকে পঁচিশটা প্রদীপ জ্বালিয়ে জেলাশাসক রজতজয়ন্তীর যে উদবোধন করেছিলেন, তার গোটা দশেক নিভে গেছে। জ্বালিয়ে দেওয়া দরকার। কথক, ম্যাজিক আর শ্যামার জন্য দায়িত্ব তার নয়। ওটা ব্রজরাখালের বড়ো ছেলে, তার মামাতো ভাই অঞ্জনের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে।

প্রেস টেবল থেকে একজন তাকে দেখতে পেয়ে হাতছানি দিচ্ছে। শ্রীমন্ত ব্যস্ত হয়ে প্রায় ছুটেই ভিড় ঠেলে চেয়ারের পিছনে গিয়ে ঝুঁকে বলল, ‘কিছু বলছেন?’

‘হ্যাঁ। বক্তৃতায় তো সেই একই কথা।… গাড়ির ব্যবস্থা করুন। যা নেবার নেওয়া হয়ে গেছে। কী দিলীপ তুমি থাকবে নাকি?’

‘না দাদা, আমিও যাব। কত আর লিখব, কাগজে জায়গা কোথায়।’

শ্রীমন্ত আর একটু ঝুঁকে বলল, ‘দু-মিনিটেই ব্যবস্থা করছি। কিন্তু তার আগে ব্রজরাখালবাবুর বাড়িতে গিয়ে একটু মিষ্টি মুখ আর যৎসামান্য উপহার….।’ এই ড্রামাটিক পজটা ইচ্ছাকৃত নয়। হঠাৎই তার খেয়াল হল রিপোর্টার মানেই পুরুষ এটা ধরে নিয়েই সে উপহার কিনেছে প্যান্টের কাপড়। কিন্তু একটা মেয়ে এসে পড়ে গোলমালে ফেলে দিল। ওকে কী প্যান্টলেংথ দেওয়া যায়?

‘আবার উপহার কেন।’ তিনজনের মধ্যে যিনি বয়স্ক, উদাসীন স্বরে যেন অনুযোগ করলেন। ‘অফিসে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে।’

‘কিচ্ছু দেরি হবে না, কুড়ি থেকে তিরিশ মিনিটে পৌঁছে দেবে।’

‘ঠিক বলছেন, পারবেন?’

‘নিশ্চয়। আমরা তো রেগুলার কলকাতা যাই।’ এরপর শ্রীমন্ত অসীমার দিকে ফিরে বলল, ‘আপনার কোনো তাড়া নেই তো?’

‘না না, আমার এখন অফিস যাওয়ার কী এখনি লিখে দেওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। তা ছাড়া আমি তো কাছেই লিচুতলায় থাকি। বাসে চলে যেতে পারব।’

‘লিচুতলা!’ শ্রীমন্ত অবাক হল। বাসে কলকাতার দিকে তৃতীয় স্টপ, হেঁটেও যাওয়া যায়। এত কাছে একজন কাগজের রিপোর্টার!

বয়স্ক জন অসীমাকে লক্ষ করে বললেন, ‘আপনি কী সমাচারে রিসেন্ট জয়েন করেছেন? আগে কখনো দেখিনি তো!’

‘আমি স্টাফ নই, ফ্রি ল্যান্সার। এখানে ওখানে টুকটাক লিখি। বিদ্যুৎদা মাঝেমাঝে কাজ দিয়ে পাঠান, এখানেও কভার করতে পাঠালেন।’

শ্রীমন্ত এইবার নিশ্চিন্ত হল। অসীমা পাল বেকারই, খুব ক্ষীণভাবে তার মতোই। তাদের দু-জনকেই হাজিরা খাতায় সই করতে হয় না। তবে এখানে ওখানে টুকটাক লিখে বাংলা খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন থেকে যা পাওয়া যায় তার থেকে সে বেশিই পায়।

‘লিচুতলায় কোথায় থাকেন?’ শ্রীমন্ত প্রশ্নটা করল, যেহেতু এই সময় এটাই করা উচিত মনে করে।

‘বাসস্টপের কাছেই, মিনিট চারেক হাঁটতে হয়।’

উত্তরের ভঙ্গিতে ও সুরে আলাপটাকে পাশ কাটানোর ইচ্ছা স্পষ্ট। শ্রীমন্ত মনে-মনে বলল, রিপোর্টটা ছাপা হলে তুমি কিছু টাকা পাবে সুতরাং মাথাব্যথা করাটা একা আমারই কাজ নয়। বাড়ি ফিরবে হেঁটে না বাসে সেটা তোমার মর্জি, আমার কর্তব্য গাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা।

‘গাড়ি আপনাকে বাড়িতে দিয়ে আসবে। আপনি বসুন আমি বরং ততক্ষণ এঁদের-‘ শ্রীমন্ত বাকি তিনজনের দিকে অনুমোদন চাওয়ার মতো করে তাকাল।

‘যান, আপনি গাড়ির জোগাড় দেখুন। বক্তৃতা তো প্রায় সব হয়েই গেছে।’

শ্রীমন্ত ভিড়ের থেকে বেরিয়ে স্কুলের ফটকের কাছে এল। এখন তাকে কিছুক্ষণ গা-ঢাকা দিয়ে রিপোর্টারদের বসিয়ে রাখতে হবে। অকাদাদুর ভাষণ থেকে দু-চারটে কথা ওদের রিপোর্টে থাকা দরকার। ভাষণ না শুনিয়ে তো ছাড়া যাবে না। ব্রজরাখালের অ্যাম্বাসাডারটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে এগিয়ে গেল।

‘হ্যাঁরে সমীর, গাড়িটা এখন কোথাও যাবে নাকি?’

ড্রাইভার দরজায় ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। তালুর মধ্যে সিগারেটটাকে চট করে মুড়ে ফেলে বলল, ‘এই তো তবলা-হারমোনিয়াম নিয়ে এলুম, এখন আর কোথাও যেতে পারব না। রেস্ট নোব।’

‘তাই নে। আমি একটু গাড়িতে বসছি।’

শ্রীমন্ত ড্রাইভারের আসনে বসে সামনে তাকিয়ে রইল। প্রায় চল্লিশ গজ দূরে কাঠের খুঁটিতে দুটো বালব ময়লা আলো জ্বালিয়ে পুরসভার মান রাখছে। লাউডস্পিকার দুটো ফটকের দুদিকে দুই মুখে। হেডমাস্টার মশাইয়ের বক্তৃতা চলছে। শ্রীমন্তর কানে ঢুকছে না একটা কথাও। সে ভাবছে, এই পুরসভায় ব্রজমামাকে আবার নির্বাচিত করাতে হবে। তেরোটা ওয়ার্ড থেকে কারা কারা দাঁড়াবে এখনও তা জানা যায়নি। তবে যারা কমিশনার রয়েছে তারা অবশ্যই যে প্রার্থী হবে তা তো নিশ্চিতই।

মামা জিতে ঠিকই বেরিয়ে আসবে কিন্তু চেয়ারম্যান হতে পারবে কিনা সেটা এবার বামফ্রন্টের ভিতর আকচাআকচির বহর কতটা তার উপর নির্ভর করবে। বিমল চক্রবর্তীকে সুপারমার্কেটে একটা ঘর বিনা সেলামিতে দেবার জন্য মামাকে বলবে। মামা শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে ঠিকই উঠবে কিন্তু বোঝাতে হবে। তেরো কমিশনারের পুরসভায় কমপক্ষে সাতটা ভোট না পেলে মামার অপমানের ঘা শুকোবে না।

গতবার নিশ্চিত সাত হয়ে গেল ছয়। এবার একটু সাবধান হয়ে কমপক্ষে আটটা ভোট নিশ্চিত করতে হবে। কংগ্রেস কী নির্দল থেকে একটাকে ভাঙিয়ে আনা দরকার। আগে সবাই নমিনেশন সাবমিট করুক তারপর কে কে জিততে পারে হিসেব করে একজনকে টার্গেট করতে হবে। ভোটের ফল বেরোলেই কথাবার্তা, দর কষাকষির জন্য মামার ভরসা সে-ই।

‘আমি আর কী বলব। যা বলার সবই তো তোরা বলেছিস।’

শ্রীমন্তর চটকা ভাঙল। লাউডস্পিকার থেমে মঞ্চের কথাবার্তা আর মাইক ঠিক করার ঘড়াং ঘড়াং শব্দ বেরিয়ে আসছে।

অকাদাদুর গলা ওটা। নিশ্চয় সোফার কাছে মাইক নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অবশ্য দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়ার মতো পায়ের জোর ওঁর এখনও আছে। শ্রীমন্তই বলেছিল, ‘মামা, দাদুকে বসিয়েই বক্তৃতা দেওয়াবেন, এতে ওঁর সম্পর্কে আপনার দরদ, যত্ন আর শ্রদ্ধাই শুধু প্রকাশ পাবে না, দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগবে, সহানুভূতি টানবে।’ মামা তখন পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘গুড আইডিয়া।’

‘আমরা আর কী বললাম। এই স্কুলের জন্ম বলতে গেলে আপনার হাতেই হয়েছে, আমি তো নিমিত্ত মাত্র।’ ব্রজরাখালের কণ্ঠস্বর খুব জোরেই শোনা গেল। শ্রীমন্তর বুঝতে অসুবিধা হল না, মামা কথাগুলো বললেন দাদুর দিকে নয়, মাইকের দিকে মুখ ফিরিয়ে।

‘উপস্থিত সুধীবৃন্দ, ছোটো ছোটো ভাইবোনেরা, মায়েরা।….স্কুলটা জন্মায় পঁচিশ বছর আগে, তখন দিনকাল মানুষজন যা ছিল এখন তো আর তা নেই, অবশ্য থাকার কথা নয়, উচিতও নয়। আমরা একরকম পরিবেশে স্কুলে পড়েছি মাস্টারমশাইরা একরকমের পদ্ধতিতে ক্লাস নিতেন, পাঠ্য বইও ছিল একরকমের….এখন সেটা অন্যরকম হয়ে গেছে। পরাধীন দেশের ছেলেদের কাছে বড়ো হবার লক্ষ্য যা ছিল, দেশ সম্পর্কে চিন্তা যা ছিল এখন সেটা বদলে গেছে। স্বাভাবিকই।’

শ্রীমন্তর কানে অকাদাদুর গলার স্বর সামান্য গম্ভীর, শান্ত শোনাল। সরু খনখনে ভাবটা বোধ হয় থেমে-থেমে বলার জন্যই ধরা পড়ছে না।

‘বদলটা সবার সঙ্গে-সঙ্গে আমারও ঘটেছে। স্বাধীনতা পাবার পর থেকেই ঘটেছে। বোমা পিস্তল রাইফেল নিয়ে বিদেশি শাসক তাড়ানোর জন্য। বিপ্লবের দিন শেষ হয়ে আর এক ধরনের বিপ্লবের সময় এসে গেল। সামাজিক বিপ্লব, দেশবাসীর উন্নতির, সমৃদ্ধির জন্য বিপ্লব। এজন্য হাতিয়ার হিসেবে যা যা দরকার তার একটা হল শিক্ষা। সেই লক্ষ্য নিয়েই এই রামরাখাল উচ্চচ শিক্ষায়তনের জন্ম। কিন্তু সেই লক্ষ্য কী-।’

অকাদাদুর কথার স্বচ্ছন্দ গতি হোঁচট খেয়ে থেমে গেল। ব্যাপার কী! শ্রীমন্ত লাউডস্পিকারটার দিকে জিজ্ঞাসু চাহনি রাখল।

‘আমি বক্তৃতা দেওয়ায় অভ্যস্ত নই তাই কথার খেই হারিয়ে ফেলি। আমি অন্য এক জেনারেশনের লোক তো, এখনকার লোকেদের চিন্তার সঙ্গে নিজেকে বহু ব্যাপারে মানাতে পারি না। আমার কাছে দেশের, দেশের মানুষের ভালোমন্দের চিন্তাটা অন্যভাবে দেখা দেয়।

‘আমার মনে হচ্ছে খুব বোকার মতো আমরা বাঁচার কাজগুলো করছি। ধরুন, সিগারেট খেলে ক্যানসার হতে পারে জেনেও ওই জিনিসটা ত্যাগ করছি না। বিয়েতে পণ বা যৌতুক নেওয়া অন্যায় জেনেও আমরা তা নিয়ে থাকি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সর্বনাশ হয় জেনেও দাঙ্গা করে যাচ্ছি। যথার্থ শিক্ষা দেওয়া হয়নি বলেই তো আমরা বোকামিগুলো করছি।

‘পরিবেশ দূষণ কথাটা আপনারা নিশ্চয় শুনেছেন বা পড়েছেন। আমাদেরই দোষে, আরাম-বিলাস পাওয়ার লোভে, টাকার লোভে আমরা এই পৃথিবীটার ক্ষতি করছি, একে দূষিত করছি নানান ধরনের রাসায়নিক আবর্জনা দিয়ে, ধোঁয়া দিয়ে। যার ফলে এর পরিবেশগত ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হতে শুরু করেছে। ব্রিটেন শীতকালেও গরম থাকছে, আল্পস পাহাড়ে তুষার কমে গেছে, সমুদ্র তেতে উঠছে, আফ্রিকায় খরার কারণও এজন্য। পৃথিবীর তাপ আধ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়ে গেছে, চল্লিশ বছর পর এটা চার ডিগ্রিতে দাঁড়াবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন একশো বছর পর সমুদ্র চোদ্দো ফুট উঁচু হয়ে যেতে পারে। ভেবে দেখুন মানুষের ভবিষ্যতের কথা। সমুদ্র তিন ফুট উঁচু হলেই তিরিশ কোটি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়বে, বাংলাদেশের তিন ভাগের এক ভাগ জলের নীচে চলে যেতে পারে।’

শ্রীমন্ত বিভ্রান্ত বোধ করছে। রামরাখাল স্কুলের রজতজয়ন্তীতে অকাদাদু এসব কী আবোল-তাবোল বকতে শুরু করেছেন? ওঁর তো বন্ধু, ভগ্নীপতি, সহযোদ্ধা রামরাখালের স্মৃতিচারণ করার; তাঁর ছেলে, এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ব্রজরাখালের শিক্ষানুরাগের, দানশীলতার খুদিনগরের উন্নয়নের জন্য সতত চিন্তার-এই সব নিয়ে বলার কথা! অকাদাদুকে তো সে তাই শিখিয়ে পড়িয়ে এনেছে। পরিবেশ দূষণ নিয়ে কথা বলার জন্য কী ওঁকে মঞ্চে তোলা হয়েছে নাকি?

‘পৃথিবী যতই গরম হয়ে উঠবে, বৃষ্টিপাতের ধরনটাও বদলে যাবে, শস্য জন্মাবে না, তার ফলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। এমন অবস্থার খুব দেরি নেই। পঞ্চাশ কী একশো বছর তো দেখতে-দেখতে কেটে যাবে। আমিই তো মনে হচ্ছে এই সেদিন জন্মালাম অথচ দেখছি নাতিনাতনিদের ছেলেপুলে হয়ে গেছে। তারা বড়ো হয়ে কেমন পৃথিবীতে বাস করবে সেটাই এখন আমাকে ভাবায়। ওদের নাতিপুতিরা নিশ্বাস নিতে কষ্ট পাবে, তাদের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, গরমে হাঁফাবে, তাদের ক্যানসার হবে, অন্ধ হয়ে যাবে, ফসল জন্মাবে না, সমুদ্রের জলে ভিটেমাটি ভেসে যাবে, সাইক্লোন-টাইফুন ঘনঘন আছড়ে পড়বে-এমন একটা পৃথিবী তাদের আমরা দিচ্ছি তার কারণ ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা ভাবি না, তার কারণ আমরা সেভাবে শিক্ষিত করিনি আমাদের চেতনাকে, তার কারণ এই পৃথিবীটাকে নষ্ট করেছি আমরাই আমাদের লোভের, অশিক্ষার পাপে। পৃথিবীকে সুস্থ, নির্মল, বাসযোগ্য করে তোলার দায় তাই আমাদেরই। এটাও তো একটা বিপ্লব।’

কথাগুলো শুনতে-শুনতে শ্রীমন্তর মনে হল, অকাদাদুর মাথায় যে এই সব ভাবনা ঘুরছে তার বিন্দুবিসর্গও সে জানত না। অথচ প্রায় পাশাপাশি ঘরেই তারা থেকেছে। মামার বাড়ি আর দর্জিপাড়ায় পৈতৃক বাড়ি, দু জায়গাতেই ইদানীং, যখন যেমন দরকার সেইমতো সে বাস করছে। এখন সে খুদিনগরে রয়েছে গত তিন সপ্তাহ যাবৎ। ব্রজমামার ইলেকশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে তার নড়া চলবে না। অকাদাদুর সঙ্গে তার খোলাখুলি বন্ধুর মতোই কথাবার্তা হয় অথচ পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে বুড়ো যে এত ভাবে, সেটা তাকে একবারও জানায়নি। আশ্চর্য, বিপ্লবীর ট্রেনিং একেই বলে!

‘কোনো দেশে ভূমিকম্প হলে কী বন্যা হলে বা গৃহযুদ্ধ হলে আর্ত, নিরাশ্রয়, অভুক্তদের সাহায্যের জন্য সারা পৃথিবী সাহায্যের হাত বাড়ায়। এখন সারা পৃথিবী বিপন্ন, এখন আমাদের এই খুদিনগরের ঘাড়েও দায় চেপেছে পৃথিবী রক্ষায় সাহায্য করার। মনে রাখবেন খুদিনগরও রক্ষা পাবে না যদি পৃথিবী না বাঁচে। পরমাণু যুদ্ধের ভয় থেকে বেরিয়ে এসে এখন কিন্তু তার থেকেও হাজার গুণ বড়ো ভয়ের মধ্যে এবার আমরা ঢুকে গেছি।

‘আপনারা বলবেন একটা স্কুলের রজতজয়ন্তীতে এসব কথা কেন বলছি। কারণ, আমার কথা শোনানোর জন্য নানান বয়সের এতগুলো লোক আমি আর জীবনে কখনো পাব না। ব্রজরাখাল আমার সম্পর্কে প্রচুর ভালো-ভালো কথা বলল। বেশ লাগছিল শুনতে। বলল, আমার মস্তিষ্ক সতেজ ও সুস্থ রয়েছে এই বয়সেও। আরও বলল, আমার বিপ্লবী চেতনাকে নাকি বিনাশ করা যায়নি। কেন যে বলল তা আমি জানি না। তবে কথাগুলো এক অর্থে ঠিকই। আমার মস্তিষ্ক আর চেতনা ঠিকঠাক কাজ করে বলেই আমি রাজনীতি থেকে দূরে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পেরেছি। এখন কোনো ভদ্রলোক রাজনীতি করে না। এখন রাজনীতি করা মানেই ক্ষমতা দখলের লড়াই। রাজনীতি এখন ব্যাবসা।’

শ্রীমন্ত সভয়ে লাউডস্পিকারের দিকে তাকাল। ব্রজমামার মুখটা এখন যদি ওই চোঙার মধ্য দিয়ে দেখা যায়। তার চোখ পড়ল স্কুল ফটকে। ছাপা শাড়ি পরা রেবা, চটি ফটফটিয়ে ব্যস্ত পায়ে ভিতরে ঢুকছে। বছর ত্রিশের এই বিধবা, এক ছেলের মা, ব্রজরাখালের বাড়িতে ঠিকে কাজ করে। মালিপুকুরের নেতাজিপল্লিতে থাকে। মিষ্টি মুখ, সুডৌল স্বাস্থ্য, মাজা গায়ের রং। অকাদাদুর ঘরে সাদাকালো টিভি আছে। রেবা তার নিয়মিত দর্শক, বিশেষত সিনেমার। তাকে দেখলেই রেবা যে একটু বিহ্বল হয়ে যায় শ্রীমন্ত তা লক্ষ করেছে। ভালোই লাগে।

‘বড়ো পুঁজি রাজনীতিকে এখন পকেটে পুরেছে। টাকা ছাড়া ভোট হয় না। টাকার জোরে ভোটবাক্স দখল করা হচ্ছে, যুবকদের গুন্ডায় পরিণত করা হচ্ছে। চেতনার বিকৃতি ঘটছে। ক্ষুদিরাম, কানাইলাল, সূর্য সেনেদের যুগে রাজনীতি করে নেওয়ার কোনো চিন্তা ছিল না। তখন রাজনীতি মানে ছিল দেশের সেবা। আমরা ছিলাম বিপ্লববাদী। বিপ্লব মানে মানুষের মধ্যে একটা জাগরণ সৃষ্টি করা। তখন যে জাগরণের কথা ভেবে কাজ করেছি তার ফল কী হয়েছে দেখুন। রাজনীতিকরা দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে।’

রেবা দাঁড়িয়ে পড়ে এধার-ওধার তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজছে। কী ভেবে শ্রীমন্ত গাড়ি থেকে নেমে গেটের দিকে এগিয়ে গেল।

‘আরে রেবা!’

‘ফাংশান শুনতে এসেছি।’

‘দারুণ শাড়িটা আগে কখনো তো পরতে দেখিনি!’

‘তোলা থাকে, একখানাই তো।’

‘সাজলে তোমায় খুব সুন্দর দেখায়।’

‘আহহা, সেজেছি আবার কই। চুলটা একটু বেঁধেছি শুধু। মুখে ঠোঁটে কিছু কী দিয়েছি?’

‘না দিয়েই এই, দিলে যে কেমন দেখাত সেটা আর ভাবতে পারছি না।’

‘থাক আর ভাবতে হবে না…কত যে ভাবেন।’

পুলকে আনন্দে রেবার চোখ ঝকঝক করে উঠল। হঠাৎই কিশোরীর মতো কণ্ঠস্বর, শরীরের মোচড়, ঠোঁটের কুঁকড়ে যাওয়া দেখে শ্রীমন্তর মনে হল, মজাটা এই পর্যন্ত রাখাই ভালো। এত লোক এখান দিয়ে যাতায়াত করছে, তাদের সামনে বাড়ির সুশ্রী ঝিয়ের সঙ্গে দুটোর বেশি তিনটে কথা বললেই লোকে তাকাবে আর একটা অনুমান মাথায় ঢুকিয়ে ফেলবে।

‘দাদু বক্তৃতা দিচ্ছে, শোনো।’

‘ওমমা, আমাদের দাদু নাকি?’ রেবা লাউডস্পিকারের দিকে মুখ তুলল। শ্রীমন্ত ব্যস্ততা দেখিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল।

‘গাছেরও প্রাণ আছে, জগদীশ বসুর এই আবিষ্কারটা মিথ্যা নয়। অথচ এই গাছকে আমরা নিষ্ঠুর নির্মমভাবে হত্যা করি। পরের বাচ্চচাকে দেখলেও আমরা আদর করি, আমাদের মায়ামমতা উথলে ওঠে; পোষা পাখি বা বেড়াল কুকুরকেও কত যত্ন করি অথচ যে গাছ আজকের এই পরিবেশ দূষণ থেকে আমাদের অনেকখানি বাঁচাতে পারে কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নিয়ে, বাতাসকে যে নির্মল করে, জমিকে উর্বর করে, মরুকে দূরে হঠিয়ে রাখে, আমাদের চোখকে জুড়িয়ে দেয় তার শোভা দিয়ে, আমাদের প্রাণের জন্য যে মায়ের মতো কাজ করে তার প্রতি আমরা, তার ছেলেরা খুনির মতো ব্যবহার করি। আমরা মাতৃঘাতী….মাফ করবেন আমি আর কিছু বলতে পারব না, শরীরটা কেমন যেন খারাপ লাগছে।’

পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে। সভাস্থলে হই-হট্টগোল চলছে। ধৈর্য ধরে দর্শকরা অপেক্ষা করছিল যেজন্য এবার সেই ফাংশন শুরু হবে। ছুটে গিয়েই পিছনের কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে শ্রীমন্ত মঞ্চে ঢুকে পড়ল। অকাদাদু সোফায় হেলান দিয়ে মিটমিট হাসছেন। পকেট থেকে একটা ওষুধের বড়ি বার করে তার মোড়কটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন, ‘একটু খাওয়ার জল।’

একজন ছুটে গেল জল আনতে। শ্রীমন্ত বলল, ‘ওষুধ খাচ্ছেন যে, আবার কোথায় ব্যথা হল?’

‘সেই ঘাড়ের ব্যথাটা আবার।’

‘এই মুঠো মুঠো বড়ি খাওয়াটা আপনার এক বাতিক হয়ে উঠেছে। নিজেই নিজের ডাক্তারি করাটা এবার বন্ধ করুন। এসব ওষুধ, কাগজে দেখেছেন তো বহু দেশেই ব্যানড করে দিয়েছে।’

‘এতক্ষণ কী বাজে কথাটাই না বললাম। পৃথিবীর দূষণ বন্ধ করা দরকার বলেই নিজেকে দূষিত করার ওষুধ খাচ্ছি। এই হচ্ছে বিপ্লবী!’ অক্ষয়ধন মিত্র হাত বাড়িয়ে জলের গ্লাস নিলেন।

এবার রিপোর্টার তিনজনকে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হয় আর অসীমা পাল যদি ওদের সঙ্গে যায় তো ভালোই। শ্রীমন্ত মঞ্চ থেকে নেমে প্রেস টেবলে এল।

‘কী ব্যাপার, গাড়ির ব্যবস্থা করতে গিয়ে আপনি তো মহাপ্রস্থানে চলে গেছলেন!’

‘কী করব, একখানাই গাড়ি। আর্টিস্ট আনতে গিয়ে এইমাত্র ফিরল, মাফ করে দেবেন, আসুন, একটু মিষ্টিমুখ করিয়েই পৌঁছে দেব।’

তিনজন উঠে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসছে, অসীমা পাল বসেই রইল। নাচ-গান ম্যাজিক দেখার জন্যই বোধ হয়, তবু ভদ্রতা করে একবার জিজ্ঞাসা করা উচিত ভেবে শ্রীমন্ত বলল, ‘যাবেন না দেখবেন? অবশ্য গাড়ি আপনার জন্য থাকবে।’

‘আমি একটু অক্ষয়ধনবাবুকে মিট করতে চাই, কিছু প্রশ্ন আছে আর কিছু জানারও আছে।’

‘আমি মিট করিয়ে দেব, আপনি বসুন।’

মোটরে দু-মিনিটে ব্রজরাখালের বাড়ি। প্লেট ভরা রাধাবল্লভি, ফিশ-ফ্রাই আর মিষ্টি খেয়ে, দেড়শো টাকা দামের একটি বস্ত্রখণ্ডের প্যাকেট হাতে নিয়ে তিনজন গাড়িতে ওঠার পর শ্রীমন্ত হেঁটেই ফিরে আসছিল আর তখন ভাবছিল, দুটো প্যাকেট তো রয়ে গেছে, কিন্তু কোনো মেয়েকে প্যান্ট লেংথ উপহার দিলে সে কী তাকে উজবুগ বা এটাকে নিম্নস্তরের রসিকতা বলে ধরে নিতে পারে? বাড়িতে প্যান্ট পরার মতো পুরুষ নিশ্চয় আছে, তাদের কাউকে দিয়ে তো দিতে পারবে! তার থেকে বরং একটা শাড়ি যদি কিনে দিই তা হলে কেমন হয়?

ব্রজরাখালের নতুন আকাশি রঙের মারুতি শ্রীমন্তর পাশ দিয়েই বাড়ির দিকে চলে গেল। অকাদাদু পিছনের সিটে একা হেলান দিয়ে। আর একটু এগিয়ে শ্রীমন্ত দেখতে পেল অসীমা বাস-রাস্তার দিকে হেঁটে চলেছে। তার একটু পিছনে সত্য মিশ্র ও দুটি লোক।

‘এই যে শুনছেন, এই যে, একটু দাঁড়ান….অসীমা একটু দাঁড়ান।’

শ্রীমন্তর ডাকে অসীমাসহ সত্য মিশ্ররাও দাঁড়িয়ে পড়ল। সে হনহনিয়ে এগোল।

‘তোমার মামার কী একটুও ভব্যতাবোধ নেই শ্রীমন্ত।’ সত্য মিশ্র ঈষৎ উত্তেজিত স্বরে এগিয়ে আসা শ্রীমন্তকে বলল। ‘যে মিউনিসিপ্যালিটির মধ্যে স্কুল তার চেয়ারম্যানকে ডায়াসে বসানো উচিত। জানো কোথায় বসতে দিয়েছিল?’

‘ক্ষমা চাইছি সত্যবাবু। ভুল হয়ে গেছে।’ শ্রীমন্ত হাতজোড় করল।

‘ভুল! এটাকে ভুল বলছ? প্রাক্তন ছাত্র বলে তিনটে চ্যাংড়াকে তো ডায়াসে বসাতে ভুল হয় না!….স্কুল কমিটিতে আমারও লোক আছে, আমি কিন্তু এটা নিয়ে আলোচনা চাইব….আর তোমার টিভি-র কী হল? অ্যাঁ, এই শুনলুম টিভি-তে নাকি জনে জনে মুখ দেখানো হবে! এখন তো জনে জনে মুখ টিপে হাসছে। তা সেই সব হাসিমুখই কী ক্যামেরায় তোলা হল নাকি?’

‘প্রেস লেখা একটা টেবিলও দেখলাম।’ সত্য মিশ্রর সঙ্গীদের একজন টিপ্পুনি কাটল। ‘ফটো-টটোও খুব তোলা হচ্ছিল।’

‘কাগজে ছবি দেখব, রিপোর্টও পড়ব।’ সত্য মিশ্র কথাটা বলেই অসীমা পালের দিকে একনজরে তাকিয়ে এগিয়ে গেল মুচকি হেসে।

‘আপনি কী চলে যাচ্ছেন? গাড়ি আপনাকে দিয়ে আসবে, আসুন আসুন একটু মিষ্টিমুখ না করলে কী হয়? অকাদাদুর সঙ্গেও তখন কথা বলে নেবেন।’

‘ওঁর খোঁজ নিতে গিয়ে শুনলাম বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আচ্ছা চলুন, কথা বলে একটা দিন ঠিক করে আবার আসব।’

দু-জনে ব্রজরাখালের বাড়ির পথ ধরল। শ্রীমন্তর ঘাড়ে যে দায়িত্ব তার অর্ধেকটা আজকের মতো শেষ, শুধু অসীমা পালকে আপ্যায়নটাই বাকি। এর পর রিপোর্ট আর ছবি ছেপে বার করার জন্য কাগজের নিউজ এডিটরদের ত্যালানোর কাজ শুরু হবে। এটা লটারির টিকিট কাটার মতো। এক কলম ছবির সঙ্গে এক প্যারা লেখা ছাপা হলে ফার্স্ট প্রাইজ পাওয়া হয়েছে মনে করতে হবে। তবে শ্রীমন্ত ধরেই রেখেছে, ছবি ছাপাতে তাকে বিজ্ঞাপন বিভাগের সঙ্গেই কথা বলতে হবে।

‘আমি ভেবেছিলাম আপনি বাকি অনুষ্ঠান দেখে যাবেন।’ শ্রীমন্ত এই বলে আলাপ শুরু করল।

‘না, নাচগান ম্যাজিক আর ভালো লাগে না।’ শুকনো নিস্পৃহ স্বর। বোধ হয় অসীমা পাল ক্লান্ত। মুখের দিকে আড়চোখে শ্রীমন্ত তাকিয়ে নিল।

‘দাদুর বক্তৃতা কেমন লাগল?’

‘খুব সংক্ষেপেই বললেন। আরও কিছু শুনতে চাই বলেই ওঁকে ইন্টারভিউ করব। এই পরিবেশ দূষণ নিয়ে কে কীরকম ভাবছেন তাই নিয়ে একটা লেখা লিখব।’

‘কোথায়?’

‘দৈনিকে নয় কোনো ম্যাগাজিনেই, দেখি কথা বলে।’

আলাপের এইখানেই সমাপ্তি। শ্রীমন্তর মনে হল অসীমা যেন নিজের ওজন বাড়াবার জন্য শব্দগুলোকে আলুর সাইজ বাছাইয়ের মতো মেপে মুখ থেকে বার করল।

‘দাদু খুব ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার।’

কোনো উত্তর এল না।

‘বিয়ে করেননি কিন্তু খুব রসিক লোক।’

এতেও উত্তর এল না।

‘উনি কিন্তু নিজের অতীত জীবন নিয়ে কখনো কথা বলেন না।’

এবারও উত্তর নেই। সাধারণ ভদ্রতাবোধটুকুও নেই নাকি? তাকে কী এলেবেলে ভেবে কথা বলার যোগ্য মনে করছে না? শ্রীমন্তর মাথাগরম শুরু হতেই নিজেকে বলল : বাপু হে, ঠান্ডা হও। তোমার দরকার রিপোর্ট ছাপানো আর এই মহিলা সেটি লিখবেন। একে এখন খুশি রাখ। তোমাকে যে কাজের জন্য ব্রজমামা টাকা দেয় সেই কাজটা মন দিয়ে করো নইলে এক লাথিতে তোমাকে আবার দর্জিপাড়ায় পাঠিয়ে দেবে। আর রামরাখাল উচ্চচ বিদ্যায়তন রজতজয়ন্তী উদযাপন কমিটির তরফে ব্রজমামার নাম করে একটা শাড়ি কালই ওকে দিয়ে এসো।

‘আমি ওঁর অতীত জীবন জানতে চাই না।’ অবশেষে একটা উত্তর এল। ‘বর্তমান সম্পর্কে ওঁর চিন্তাভাবনাটা শুধু চাই।’

শ্রীমন্ত উত্তর দিল না। শোধ নেওয়ার জন্য নয়, আসলে সে অকাদাদুর সঙ্গে কখনো গম্ভীর বিষয় নিয়ে কথাই বলেনি। ওঁর চিন্তাভাবনার হদিশ তার জানা নেই।

‘হ্যাঁ, কথা শুনে ওঁকে ইন্টারেস্টিংই মনে হল।’

তা হলে তার কথা কানে ঢুকেছে, মাথাতেও এতক্ষণ ধরে রেখেছিল। শ্রীমন্ত এবার তার বিশেষ ধরনের হদিশটা ঠোঁটে লাগিয়ে অসীমার দিকে মুখ ফেরাল। ঠিক সেই সময় মুখ নীচু করে অসীমা, ভ্রূ কুঁচকে কী যেন একটা ডিঙিয়ে যাচ্ছে। হাসিটার অপমৃত্যুতে সে ক্ষুণ্ণ হল।

ফাংশন শুনতে ব্রজরাখালের স্ত্রী, পুত্র, শ্বশুরবাড়ি থেকে আসা মেয়ে স্কুলে গিয়েছে। যাননি ব্রজরাখালের মা, শ্রীমন্তর দিদিমা সুরুচি। বয়স চুয়াত্তর, দাদা অক্ষয়ধনের মতোই ছোটোখাটো আকৃতির, উজ্জ্বল শ্যামা। নারকেল ছোবড়ার মতো কাঁচাপাকা ছাঁটা চুল ঘাড়ের কাছে ইঞ্চি তিনেক ঝুলছে। দেহ সামর্থ্য স্থূলকায়া পুত্রবধূর থেকে বেশি, দাপটে থরহরি না হলেও ব্রজরাখালের মাথাটা মায়ের সামনে দাঁড়ালেই পাঁচ ডিগ্রি ঝুঁকে যায়।

বাড়ির সামনে মারুতিটা দাঁড়িয়ে। শ্রীমন্ত ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলল। বৈঠকখানায় বসেই অসীমা বলল, ‘অক্ষয়ধনবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করব।’

‘নিশ্চয়।’

শ্রীমন্ত ব্যস্ত হয়ে ভিতরে গেল। মোজাইক করা লম্বা দালানের বাঁদিকে প্রথমেই উপরে যাবার সিঁড়ি। তার পাশে ব্রজরাখালের অফিসঘর। দালান থেকে দু-ধাপ নামলে একটা পাথর বসানো উঠোন। এই উঠোনকে বেড় দিয়ে দালানটা পশ্চিম থেকে পুবে গেছে। সেখানে পরপর কয়েকটি ঘর। তারই একটিতে থাকেন অক্ষয়ধন। এর পর দালানটা ডানদিকে ঘুরে সরু হয়ে শেষ হয়েছে শ্রীমন্তর ঘরে।

দালানে আলো জ্বলছে। পুরনো, মাঝবয়সি চাকর বিজয় সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিল। অকাদাদুর ঘরের দরজা বন্ধ দেখে শ্রীমন্ত তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘দাদু তো এইমাত্র ফিরলেন, গেলেন কোথায়?’

‘ঘরেই আছেন, বললেন মাথা ধরেছে। শুয়ে পড়লেন।’

‘ওঁকে এই রোগ আবার কবে ধরল!’ বলেই উদবিগ্ন হয়ে এক পা এগিয়েই বলল, ‘বিজয়দা একটা প্লেট সাজিয়ে দাও, একজন এসেছে।’ তারপর সে বন্ধ দরজার সামনে এসে নীচু গলায় ডাকল, ‘দাদু, ঘুমিয়েছেন নাকি?’

‘শ্রীমন্ত? ভেতরে আয়।’

দরজা ভেজানো ছিল। ভিতরে অন্ধকার।

‘আলো জ্বালব?’

‘না, থাক। কিছু বলবি?’

‘শরীর খারাপ? তখন বক্তৃতাটা হঠাৎ যে বন্ধ করলেন?’

‘মনে হল অনর্থক অকারণে বলছি, কেউ শুনছে না। তা ছাড়া পেটে তখন এমন একটা অস্বস্তি শুরু হল যে-।’

‘হজমের গোলমাল? আপনার কাছে অ্যান্টাসিড কিছু থাকে তো খেয়ে নিন।’ শ্রীমন্ত খাটের পাশে এসে দাঁড়াল।

‘না না ওসব কিছু নয়।’

‘একটি মেয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। কাগজেটাগজে লেখালেখি করে, যাকে বলে ফ্রি-ল্যান্সিং। আজ এখানে এসেছে সমাচারের হয়ে রিপোর্ট করার জন্য। আপনার কথাগুলো ওর খুব ভালো লেগেছে, এই নিয়ে কিছু প্রশ্ন করতে চায়। আলাদা প্রবন্ধ লিখবে।’

‘আজ থাক। দু-দিন পরে আসতে বল।’

শ্রীমন্ত চুপ করে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে আসছে, অক্ষয়ধন আবার বললেন, ‘আমি এমন কী বলেছি যে প্রশ্ন জাগতে পারে? কী জানি!….তুই ওকে দিনকয়েক পরেই আসতে বল।’

বৈঠকখানায় শ্রীমন্তর সঙ্গেই খাবারের প্লেট আর জলের গ্লাস হাতে বিজয়ও ঢুকল। অসীমার সামনে টেবলে প্লেট রাখামাত্র সে বলল, ‘আমি কিছু খাব না।’

শ্রীমন্ত বিস্মিত ও বিনয়াবনত হয়ে গেল।

‘সে কী! আতিথেয়তার সুযোগ পেয়েও হারাব? একটু মিষ্টিমুখ না করলে কিন্তু দুঃখ পাব।’

‘আমি মিষ্টি খাই না আর ভাজাভুজি মানে তেল-ঘি পেটে একদমই সহ্য হয় না। কিছু মনে করবেন না।’

‘গ্যাস্ট্রিক?’

‘অক্ষয়ধনবাবু কী বললেন?’

তার প্রশ্ন অর্থাৎ কৌতূহলটাকে কোনো পাত্তা না দিয়ে অসীমা পালের পালটা জিজ্ঞাসায় শ্রীমন্ত অপ্রতিভ হয়ে মনে মনে চটে উঠল। তাই দ্বিগুণ বিনয় সহকারে বলল, ‘দাদুর শরীরটা খুব খারাপ, শুয়ে পড়েছেন। আপনি কি দিনদুয়েক পর আসতে পারবেন?’

‘কেন পারব না! তাই আসব।’ ঝোলাটা হাতে নিয়ে অসীমা উঠে দাঁড়াল। ‘সকালের দিকেই তো ওনার সুবিধে?’

‘সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধে যখন খুশি আসতে পারেন। উনি দুপুরে ঘুমোন না।’

অসীমা দরজা পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্লেটের দিকে তাকাল। ‘কম মিষ্টি আছে কোনটাতে?’

শ্রীমন্তর চার-পাঁচ সেকেন্ড লাগল কথাটা বুঝে উঠতে। তারপরই ব্যস্ত হয়ে প্লেটটা তুলে এগিয়ে এল।

‘ওই চৌকো সন্দেশটা নিন, কম মিষ্টি।’

দু-আঙুলে সন্দেশটা তুলে মুখে ফেলার আগে অসীমা বলল, ‘অভব্য ভাবার সুযোগ দিতে আমি রাজি নই।’

‘না না, তা ভাবব কেন! অনেকে অনেক কিছুই খায় না, তার পিছনে নানান কারণও থাকে। বাবা মারা যাবার পর আমার মা ফুলকপি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন, কারণ বাবা ফুলকপি খুব ভালোবাসতেন। ….নিন আর একটা।’

‘না না, একটাই….আপনার অনুরোধ রাখতেই খেলাম।’ অসীমা জলের গ্লাস তুলে নিল। শ্রীমন্ত প্রীত বোধ করল কিন্তু ধরেই নিল অনুরোধ-টনুরোধ বাজে কথা, আসলে খিদে পেয়েছে। সন্ধ্যার ঠিক পরেই এই সময়টায় সবারই খিদে পায়।

‘আপনার কথায় সাহস পেয়ে তা হলে আর একটা অনুরোধ করব।’

ধাঁধায় পড়া চোখে অসীমা চেয়ে রইল। শ্রীমন্ত কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বলল, ‘রজতজয়ন্তী কমিটি অতিথিদের জন্য সামান্য উপহার রেখেছে, আপনি যদি দয়া করে নেন।’

‘উপহার! কী জন্য?’

‘আপনি আসায় আমরা আনন্দ পেয়েছি, তাই।’

কথাটা বলেই শ্রীমন্তর মনে হল বড্ড কাঁচা, ভ্যাদভেদে ডায়লগ। এতটা ন্যাকামো করে না বললেও চলত। বুদ্ধি রাখে, হয়তো মনে মনে হাসছে। তা ছাড়া এই মেয়ে বিনা উপহারেই, নিজের গরজেই যা লেখার লিখবে। ভদ্রতার বাড়াবাড়ি করলেই বরং বিগড়ে যেতে পারে।

‘কী উপহার দেবেন? আমার কলমের রিফিলটা শেষ অবস্থায়, যদি একটা দিতে পারেন-।’

শ্রীমন্ত হাঁফ ছাড়ল। বুকপকেট থেকে কলম তুলে এগিয়ে ধরে বলল, ‘রিফিলটা কালই কলমে ভরেছি, এটাই নিন। কলমটার দাম এক টাকা সুতরাং আপনি একে নিশ্চয় উপহার পর্যায়ে ফেলবেন না।’

অসীমা হাসল এবং এই প্রথম শ্রীমন্তর মনে হল মেয়েটির একটা আলগা লাবণ্য আছে। ওর মুখের শুকনো কঠিন ভাবের নীচে বিছানো আছে কোমল আস্তরণ।

কলমটা ঝোলার মধ্যে রেখে অসীমা বলল, ‘গাড়িটাড়ির দরকার নেই, বাসেই চলে যাব।’

‘আমার দরকার আছে নাগেরবাজার যাওয়ার, আপনাকে লিফট দিতে পারি।’ শ্রীমন্ত মিথ্যাকথাটা বলল একটা উদ্দেশ্যেই, অসীমার বাড়িটা চিনে রাখার জন্য।

গাড়িটা বাসরাস্তার দিকে ঘোরার সময় অসীমা বলল, ‘তখন ওই লোকটি কী বলতে চাইছিল বলুন তো?….ওই যে রাস্তায় আপনি যখন ডেকে আমায় দাঁড় করালেন?’

‘ওহহ….সত্য মিশ্র, এখানকার মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান। ওঁকে মঞ্চে না তুলে নীচে চেয়ারে বসতে দেওয়ায় রেগে গেছেন। ব্যাপারটা ঠিক হয়নি মানছি তবে এটা কেন হল বুঝতে হলে এখানকার রাজনীতিটাও জানা দরকার। তা বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে, দরকার নেই এখন শুনে, তবে আমার মামা ব্রজরাখাল মুখুজ্জে গতবার চেয়ারম্যানশিপের জন্য বামফ্রন্টের ক্যান্ডিডেট ছিলেন কিন্তু ক্রস ভোটিংয়ে এই সত্য মিশ্র বেরিয়ে গেলেন। সেই থেকে মামার রাগ তাই ওঁকে মঞ্চে জায়গা দেননি।’

‘এখানে আপনার মামার বাড়ি?’

‘হ্যাঁ। এখানেই আছি।’

‘নিজের বাড়ি তা হলে কোথায়?’ শ্রীমন্ত অস্বস্তি বোধ করল। কথাবার্তা ব্যক্তিগত দিকে মোড় নিচ্ছে। হয়তো এবার জানতে চাইবে কেন মামারবাড়ি থাকেন? কী কাজ করেন? অবশ্য অতদূর কৌতূহলকে টানবে না কিন্তু মনে মনে তার সম্পর্কে একটা কিছু তো ধারণা করবেই।

‘আমি থাকি কলকাতায়, দর্জিপাড়ায়। এখানে মাঝে মাঝে আসি। মামার নানারকমের ব্যাবসা, বিষয়সম্পত্তি, তার উপর রাজনীতিতে জড়িয়ে আর সামলাতে পারে না। এক ছেলে, সে কিছুই বোঝে না, দেখে না, কলকাতাতেই সারাদিন কাটায়, রবীন্দ্রসংগীত গায়।….আমি মামাকে হেল্প করি।’

‘ইলেকশন তো এসে গেল।….আমার নামার জায়গাও এসে গেল। গাড়িটা একটু থামান।’ ড্রাইভারের দিকে ঝুঁকে অসীমা বলল। গাড়ি থামল।

‘এটা তো বাসস্টপ। এই যে বললেন এখান থেকে ভেতরে হেঁটে-।’

‘হ্যাঁ, মিছিমিছি কেন আবার যাবেন। হেঁটেই চলে যাব।’

‘না, না, বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি যাবে, রাস্তাটা বলে দিন।’

‘আপনার আতিথেয়তায় একটুও খুঁত রাখবেন না দেখছি।….ডানদিকে সোজা, তারপর আবার ডানদিক।’

গাড়ি ডানদিকে ঘুরল। এটা খুদিনগর পুরসভা এলাকা নয়। তবে খোয়া ওঠা রাস্তার গর্ত, আলো না জ্বলা বাতিস্তম্ভ, নর্দমার পাঁকের গন্ধ খুদিনগরেরই মতো। গাড়ি খুব মন্থর চলেছে।

‘ইলেকশন আসছে, এখন কিছু কাজ দেখানো হবে। এইসব পুরসভা কেন যে আছে, কী যে কাজ করে-।’ অসীমা হতাশ, বিরক্তস্বরে বলল সামনে তাকিয়ে।

‘এই নিয়েই তো ফিচার লিখতে পারেন। এই জেলার সব কটা পুরসভার একটা সার্ভে করে যদি কোথাও পর পর ছাপাতে পারেন….লোকে মানে ভোটাররা তা হলে একটু সচেতন হতে পারে।’ শ্রীমন্ত ইতিমধ্যেই একটা চমৎকার সম্ভাবনার হদিশ দেখতে পেয়েছে। যদি পুরসভা নিয়ে কিছু লেখার জন্য অসীমাকে উসকে দেওয়া যায় তা হলে খুদিনগর নিয়ে লিখবেই। একে যদি ভালো করে ব্রিফ করা যায় তা হলে মামার ক্যাম্পেনে সুবিধা হবে। ওইসব লেখা থেকে তুলে তুলে বলার সুযোগ পাওয়া যাবে।

 এবার ডানদিকে….কে ছাপবে। ঘোরাঘুরি করে লিখতে তো পারি….ব্যস ব্যস।’

‘সমাচার তো ছাপতে পারে।’

‘আমি কী সমাচারের মালিক নাকি যে লেখা দিলেই ছাপা হবে!’ অসীমা গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়াল।

‘আপনি বিদ্যুৎদাকে কথাটা বলে দেখুন না। আপনাকে আমি নানান মেটিরিয়াল দিতে পারব, বিশেষ করে আমাদের পুরসভার।’

‘আচ্ছা, বলে দেখব।’

রাস্তা থেকে দু-তিন গজ দূরেই নীচু পাঁচিল। কাঠের একপাল্লার বেড়ার আগল। সেটা খুলে অসীমা ঢুকল।

গজ দশেক ভিতরে পলেস্তরাহীন, অসমাপ্ত একতলা দু-খানা ঘর। বাইরে ছোটো দালান। লুঙ্গি পরা শার্ট গায়ে এক বৃদ্ধ, মাদুরে বসে কম ওয়াটের বালবের আলোয় একটি শিশুকে স্লেটে লেখাচ্ছেন। দালানটা সিমেন্ট দিয়ে পাকা করা নয়। ঘরের গায়ে নীচু টালির চালের রান্নাঘর। সেখানে লম্ফ জ্বেলে কেউ রান্না করছে। গাড়ি ছেড়ে দেবার আগে শ্রীমন্ত শুধু এইটুকুই দেখার সময় পেল।

‘নাগেরবাজার?’ ড্রাইভার জানতে চাইল।

‘না, বাড়ির কাছে আমাকে নামিয়ে দিয়ে তুমি স্কুলে চলে যাও। আর আমার গাড়ির দরকার নেই।’

বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে শ্রীমন্ত হেঁটে ফিরে এল। বৈঠকখানায় জয়ন্তকে দেখেই সে অবাক হয়ে বলল, ‘তুই! কী ব্যাপার?’

জয়ন্ত বড়দাকে দেখামাত্র উঠে দাঁড়িয়েছে। থমথমে, গম্ভীর মুখ। চাপা গলায় বলল, ‘বলছি, তোমার ঘরে চলো।’

নিজের ঘরে এসে শ্রীমন্ত আলো জ্বালল। ঘরটা প্রায় ফাঁকাই। দেওয়াল-আলনায় দুটো প্যান্ট, টিশার্ট, পাজামা আর গামছা। ঝুলছে একটা ছোটো আয়না। টুলের উপর কুঁজো আর গ্লাস, একটা তক্তপোশে হ্যান্ডলুমের রঙিন বেডকভারে ঢাকা বিছানা, পাল্লা বন্ধ দেওয়াল আলমারিতে কিছু জিনিসপত্র আর একটা পলিথিনের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। একটা টেবল বা চেয়ারও নেই।

‘বল। আবার কোনো গোলমাল?’

‘হ্যাঁ, তবে মেজদাকে নিয়ে নয়।….দু-দিন হল দিপু বাড়ি নেই।’ জয়ন্ত বিছানায় বসে তার বড়দার মুখের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন শ্রীমন্ত জানে তাদের বোন কোথায়।

চার ভাইয়ের পর সুদীপা বা দিপু। বয়স একুশ। স্কুলে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণিতে ওঠার জন্য চার বছর সময় নিতেই শ্রীমন্ত বলেছিল, ‘আর ওকে পড়িয়ে টাকা নষ্ট করে লাভ নেই। স্কুলে সিট না পেয়ে কত ভালো মেয়ে ভরতি হতে পারে না। একটা সিট খালি হলে হয়তো এমন কেউ পড়তে পারবে যাকে দিয়ে পরিবারের বা সমাজের উপকার হবে।’

পড়াশুনো আর করতে হবে না জেনে দিপু হাঁফ ছাড়ে বটে, তবে দু-খানি ঘরের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখার কোনো ইচ্ছা তার চঞ্চল চরিত্রে ছিল না। বিরাট পুরোনো তিনতলা বাড়িতে নিকট-দূর সম্পর্কের কাকা-জ্যাঠাদের এগারোটি সংসার। পোষা বেড়াল ও কুকুর ছাড়াও প্রায় অর্ধশত প্রাণী এই বাড়িতে মাথা গুঁজে আছে ঈর্ষা, বিদ্বেষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা চাপাচুপি দিয়ে। দিপু এই চাপ থেকে বেরিয়ে দ্বিতীয় হাঁফ ছাড়তে পাড়ার বান্ধবীদের গৃহে বা অন্য কোথাও গমনটা বাড়িয়ে ফেলল। শ্রীমন্ত বাড়িতে থাকলে হয়তো এটা লক্ষ করতে পারত কিন্তু যেটুকু সময় সে থেকেছে তাতে দিপুর বহির্মুখিনতা তার নজরে আসেনি।

‘বাড়ি নেই তো কোথায়? খোঁজখবর করেছিস?’ শ্রীমন্ত তার সন্ত্রস্ত বোধটা বিরক্তি দিয়ে মুড়ে দিল।

‘করেছি, পাড়াতেই শ্যামল বলে একটা ছেলের বাড়িতে আছে….বিয়ে করে।’

শ্রীমন্ত ভীষণ স্বস্তি বোধ করল। বিছানায় কাত হয়ে বালিশটা বগলের তলায় রেখে বলল, ‘তা হলে এত চিন্তার কী আছে। খবর যখন পেয়েছিস, আর বিয়েও যখন করে ফেলেছে….বিয়ে করেছে তো?’

‘হ্যাঁ। রেজিস্ট্রি করে করেছে, সাক্ষী ছিল পাড়ারই দুটো ছেলে আর শ্যামলের কাকা।’ জয়ন্ত বিড়বিড় করে বেদনায় মুহ্যমানের মতো গলায় বলল।

‘ছেলেটা পাড়ার কোথায় থাকে, কী করে? এমন লুকিয়েই বা করতে গেল কেন? তোরা কিছু জানতিস না?’

‘শ্রীদুর্গা ভাণ্ডারের গা দিয়ে যে সরু গলিটা আঠারো নম্বর মাঠকোটায় গেছে সেই মাঠকোটায় থাকে। পাড়ার রুস্তম ছিল….লেখাপড়া জানে না….মিনিবাসে কন্ডাক্টরি করে।’ জয়ন্ত এরপর বিষণ্ণ চাহনি নিজের তালুতে রেখে বলল, ‘জাতে ছোটো।’

শ্রীমন্ত কিছুক্ষণ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। জয়ন্তর বয়স তেইশ, সিরিয়াস ধরনের, বি-এ পার্ট টু পড়ছে। বোন না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে বলে নয়, আঘাতটা অন্য দিক থেকে ও পেয়েছে।

‘তা এখন কী করার আছে?’

‘পাড়ায় সবাই হাসাহাসি করছে, বাড়ির সবার কথা তো ছেড়েই দিচ্ছি। বাড়ি থেকে বেরোলে পাড়ার লোক তাকিয়ে দেখে….শেষকালে আমাদের বংশের মেয়ে কি না বিয়ে করল একটা ছোটো জাতকে! এর থেকে লজ্জার আর কিছু আছে?’ রাগে উত্তেজনায় লালচে দেখাল জয়ন্তর মুখ। স্বর কেঁপে গেল।

শ্রীমন্ত আশ্চর্য বোধ করতে লাগল। এত অল্পবয়সি শহুরে, কলেজ-ছাত্রর মনের মধ্যে, বিংশ শতাব্দীর আশির দশকেও এমন একটা সংস্কার দিব্যি কেমন টাটকা রয়েছে!

‘ছেলেটা যদি মিনিবাস কনডাকটর না হয়ে মিনিবাসের মালিক হত, তা হলে তুই লজ্জা পেতিস?’

জয়ন্ত একটু দিশাহারা হয়ে, উত্তর হাতড়াতে শুরু করল, ‘তুমি বুঝতে পারছ না দাদা আমাদের সবার অবস্থাটা, কেউ মুখ দেখাতে পারছি না।’

শ্রীমন্তর মনে পড়ল, উলঙ্গ পাগল বাবাকে রাস্তা থেকে পাড়ার লোকেরা ধরে এনে যখন বাড়িতে দিয়ে গেছল। তারা সবাই লজ্জা পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু পাড়ার কেউ মুখ টিপে হাসেনি, বেদনা আর সহানুভূতি নিয়ে বাবার অবস্থা জানতে কথা বলত। তাদের আর কখনো লজ্জা পাওয়ার কথা ভাবতে হয়নি।

‘দু-চারদিন লোকে ফিসফাস করবে, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে, তারপর নিজেদের এতরকম সমস্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে যে কেউ আর এই নিয়ে সময় নষ্ট করবে না।’ শ্রীমন্ত লজ্জার গর্ত থেকে ভাইকে টেনে তোলার জন্য সান্ত্বনা দিল। ‘আজ যে মুখ টিপে হাসছে তার মেয়েই যে এমন একটা কাণ্ড বাধাবে না, এর কী কোনো গ্যারান্টি আছে?’

‘কিন্তু দাদা চোখের সামনে দিপা এখন সিঁদুর মাথায় পাড়া দিয়ে হাঁটাচলা করবে আর আমাদের তা দেখতে হবে?…মা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, তুমি একবার চলো।’

‘যাব। আজ এখানে খুব জরুরি কাজ রয়েছে, বাড়ি গেলে মামা ভীষণ চটে যাবে। তুই যা এখন, কাল যাব। আর মাকে বুঝিয়ে বল, এসব ঘটনা আকছারই হচ্ছে। কুড়ি বছর বয়স, সাবালিকা নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই যখন ঠিক করে নিয়েছে তখন আমাদের আর বলার বা দুঃখ পাবার কী আছে?….তবে লুকিয়ে চুরিয়ে করাটাই যা খারাপ লাগছে, এতে আমাদের প্রতি যেন অবিশ্বাস, অনাস্থাই দেখানো হল।….তোরা কি কিছুই আঁচ করতে পারিসনি?’

‘এতটা যে গড়িয়েছে, কিছু বোঝা যায়নি। পাড়ার অনেক ছেলের সঙ্গেই কথা বলত, ওর সঙ্গেও বলত। কিন্তু তাই থেকে যে-।’ জয়ন্ত উঠে দাঁড়াল। ‘কালই তুমি এসো আর একবার দিপার সঙ্গে দেখা করে ওকে বলো, পাড়া ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকুক। চোখের সামনে ওকে আর সহ্য করা যায় না।’

শ্রীমন্ত চুপ করে রইল। জয়ন্ত বেরিয়ে যাচ্ছিল, দাদার ডাকে দাঁড়াল। পাল্লা খুলে দেওয়াল আলমারি থেকে পলিথিনের একটা থলি বার করে শ্রীমন্ত ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা নিয়ে যা, দর্জিকে দিয়ে করিয়ে নিবি।’

‘কী এটা?’

‘প্যান্টের কাপড়।’ কথাটা বলে শ্রীমন্তর মনে মুহূর্তের জন্য গ্লানির ছায়া পড়েই সরে গেল। প্যান্টের কাপড়গুলো সাংবাদিকদের উপহার দেবার জন্য মামার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কেনা। দুটো কাপড় বেঁচে গেছে, কিন্তু তার একটা নিজের ভাইকে দেওয়াটা ঠিক চুরিই কি না শ্রীমন্তর তা স্বীকার করতে দ্বিধা হচ্ছে।

জয়ন্ত আর একবার বলে গেল, ‘কাল অবশ্যই যেয়ো।’

উপহার দেওয়ার মধ্যে অসাধু একটা মতলব তো রয়েছেই সুতরাং সেটা কে পেল তার বিচার করে লাভ কী! বিছানায় টানটান হয়ে চোখের উপর দিয়ে আড়াআড়ি হাত রেখে শ্রীমন্ত ভাবল, সে শুধু বাটপাড়ি করেছে মাত্র। খবরের কাগজের ওই তিনটে লোকের তো উপহার পাওয়ার কথা নয়, দিলেও নেওয়া উচিত নয়। কিন্তু একটা গরিব পরিবারের ছাত্রের….শ্রীমন্ত নিজেদের পরিবারকে মনে মনে গরিব ভাবতে দ্বিধা করল না। জয়ন্ত খুব কষ্ট করেই কলেজে পড়ছে, একটা ছোটো প্রতিষ্ঠানের তৈরি ফিনাইল আর পোকামাকড় মারার ওষুধ বাড়ি বাড়ি বিক্রি করত, হয়তো এখনও করে। প্যান্ট পিসটা ওরই পাওয়া উচিত। ব্রজরাখাল মুখুজ্জের মতো ধুরন্ধর, পয়সাওলা, হামবাগের কয়েকটা টাকা গেল তো কী হয়েছে, লোককে টুপি পরিয়ে কম টাকা তো উপায় করেনি!

বিমল চক্রবর্তীকে একটা ঘর দেব বলে কাজ হাসিল করে মামা কলা দেখিয়েছিল। বিমল তার শোধ নিয়েছিল ক্রস ভোটিং করে। এটা এখন সবাই জানে। এবারও লোকটা হেসে-খেলে গতবারের মতো দু-হাজার মার্জিনে জিতবে আর আবার ব্রজরাখালকে চেয়ারম্যান হতে দেবে না। বিমলের সঙ্গে এবার ভিড়েছে আরও দু-জন কমিশনার। ওরাও এবার দাঁড়াবে আর জিতবে। খুদিনগর স্পোর্টিং ক্লাবের রামানন্দ সরখেল তো বিমল গোষ্ঠীরই লোক। সুতরাং মামার আট বিঘে ফিরে পাওয়ার আশা ক্ষীণই।

শ্রীমন্তর মুখে হাসি ফুটল। এই সব গোলমেলে ব্যাপার ম্যানেজ করার জন্যই এখন মামা তার উপরই নির্ভর করছে। কিন্তু এতদিনে ওকে সে যতটা চিনেছে তাতে জানে, কাজ হাসিল হলে তাকেও কলা দেখাবে! সেটা যাতে না পারে তেমনভাবে আটঘাট বাঁধা দরকার। আর সেজন্যই পাবলিসিটির ব্যাপারটায় মামাকে ইমপ্রেস করতেই হবে।

‘বড়োবাবু তোমায় ডাকছে।’ দরজা থেকেই কথাটা জানিয়ে চলে গেল বিজয়। এ বাড়িতে বড়োবাবু ব্রজরাখাল, ছোটোবাবু অঞ্জন। এ ছাড়া আর কোনো বাবু নেই। মামা তা হলে ফিরে এসেছে।

অফিস ঘরে একাই, গদি আঁটা একমাত্র চেয়ারটায় ব্রজগোপাল বসে ভ্রূ কুঁচকে একটা কাগজ পড়ছিলেন। শ্রীমন্তকে দেখেই বললেন, ‘তোর টিভি-র কী হল? য়্যা, দুটো ফোটোগ্রাফারকেই তো শুধু ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম, ক্যামেরা কোথায়?’

‘আসতে পারেনি।’ তিনটে কাঠের চেয়ারের একটায় শ্রীমন্ত বসল।

‘কেন? আনতে পারিসনি কেন?’ ব্রজরাখাল টেবলে মৃদু চাপড় মেরে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। শ্রীমন্ত জানে এখন ওঁকে বোঝালেও বুঝবেন না। সে অন্য প্রসঙ্গে যাবার চেষ্টা করল।

‘সত্য মিশ্র দারুণ চটেছে। স্কুলকমিটির মিটিংয়ে গোলমাল পাকাবে।’

‘পাকাক, ওতে আমার কিছু আসে যায় না। কিন্তু টিভি এল না। কত লোক টিভি আসবে শুনে এসেছিল জানিস? আমার আর মুখ রইল না। আমি তখন তোর কথা শুনেই বুঝেছিলাম তুই চেষ্টা করবি না।’

‘গাড়ি কথামতোই লোকটাকে আনতে গেছল। কিন্তু ওর ক্যামেরাটা আজ সকালেই খারাপ হয়েছে, ফিল্ম রোল করছে না। ড্রাইভার ফিরে এসে আমায় জানাল। এরপর আমি আর কী করতে পারি!’ মৃদু বিষণ্ণ স্বরে কথাগুলো বলে শ্রীমন্ত অসহায়ভাবে দু-হাতের তালু মেলে ধরল। বজ্ররাখাল কাগজটা তুলে নিয়ে পড়ার ভান শুরু করতেই শ্রীমন্ত জানাল, মামার রাগ এবার পড়বে।

‘কাগজের রিপোর্ট আর ছবি বেরোবার ব্যাপারটা ভালো করে দেখ। সমাচার থেকে এসেছিল?’

‘এসেছিল মানে!’ শ্রীমন্তর জোরালো বিস্ময় মুখেচোখে উপচে পড়ল। ‘বিদ্যুৎদা তার বেস্ট রিপোর্টারদের একজনকে পাঠিয়েছিল…অসীমা পাল।’

‘অসীমা! মেয়ে?’

‘হ্যাঁ, তোমার কী চোখে পড়েনি? প্রেস টেবলেই তো বসেছিল।’

‘একটা মেয়েকে যেন দেখলাম! ও যে রিপোর্টার সেটা আর বুঝব কী করে।’

‘একটাই মুশকিল হয়ে গেছে মামা। পুরুষদের কথা ভেবেই প্যান্টের কাপড় কিনেছিলাম কিন্তু একটা মেয়ে যে এসে পড়বে এটা জানতাম না তাই উপহার আর ওকে দেওয়া হয়নি।’

‘সে কী, দেওয়া হয়নি!’ ব্রজরাখাল উদবিগ্ন হলেন, ‘সমাচারের লোক পায়নি?’

‘এ নিয়ে ভেব না, ভাবছি একটা শাড়ি কিনে কালই দিয়ে আসব ওর বাড়িতে।… তবে একটা কাজ করেছি, ভোটের আগে সমাচার সব পুরসভাগুলোর একটা সার্ভে করবে।’ শ্রীমন্ত একটু থেমে, কীভাবে জিনিসটা বানিয়ে গুছিয়ে বললে মামাকে উসকে দেওয়া যাবে সেটাই ভেবে নিল।

‘সার্ভে মানে? সেটা কী?’

‘পুরসভাগুলো কী অবস্থায় রয়েছে, কেমন কাজ হয়েছে, নাগরিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য বেড়েছে না কমেছে, লোকেরা কী বলছে, দলাদলি কেমন, কোন পার্টির জেতার আশা আছে, চেয়ারম্যানের বক্তব্য….এই সব নিয়েই লেখা হবে।’

‘খুদিনগর পুরসভা নিয়েও হবে?’

‘নিশ্চয়। আর সেটা লিখবে এই অসীমা পাল, বুঝতে পারছ?’

শ্রীমন্তর ‘বুঝতে পারছ’টা বুঝতে ব্রজরাখাল সেকেন্ড দশেক সময় নিয়েই ব্যগ্রস্বরে বললেন, ‘খাওয়া, মেয়েটাকে খাওয়া। টাকার পরোয়া করিস না।….আজেবাজে শাড়ি নয়, বেনারসি কিনে দে।’

শ্রীমন্ত মনে মনে অট্টহাস্য শুরু করল। মাথামোটা, নির্বোধ। টাকা দিয়ে কার্যোদ্ধার করে করে ভেবে নিয়েছে সবই বুঝি কিনে ফেলা যায়। টাকা যখন আছে তখন কিছু খরচ করুক। তবে সে টাকা অবশ্যই অসীমার কাছে পৌঁছবে না।

‘আমি বলেছি খুদিনগর মিউনিসিপ্যালিটির কাজকর্ম সম্পর্কে ভিতরের সব তথ্য আমার কাছে আছে, আপনাকে আমি সাপ্লাই করব।’

‘শুনে কী বলল?’

‘বলল, তা হলে তো খুবই ভালো, খাটুনির হাত থেকে বেঁচে যাব।’

‘কিন্তু চেয়ারম্যানের বক্তব্য, মানে সত্য মিশ্রর বক্তব্য ছাপা হলে তো জিনিসটা ঠিকমতো দাঁড়াবে না।’ ব্রজরাখাল চিন্তিত স্বরে বললেন।

‘চেয়ারম্যানের কথা তো লেখায় রাখতেই হবে। সার্ভে তো নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়েই করতে হবে। তা থাকুক না সত্য মিশ্রর বক্তব্য, তার পালটা যেসব কথা থাকবে তাতেই ও ডুবে যাবে। তা ছাড়া খুদিনগরের উন্নয়নের জন্য তোমার যেসব প্ল্যান আছে সেগুলোও তুমি বলবে।’

‘প্ল্যান? কী প্ল্যান?’

‘খেলার মাঠটা ফিরে পাবার প্ল্যান। ওই জমিতে তুমি দিদিমার নামে একটা আউটডোর ডিসপেনসারি নিজের খরচে করে দেবে যদি পুরসভার কর্তৃত্ব হাতে পাও। এজন্য স্থানীয় জনগণ আর সব রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসতে হবে, এ কথাটাও জানিয়ে রাখবে। অবশ্য আসলে বিমল চক্রবর্তীর সঙ্গে তোমার একটা রফায় আসতেই হবে যদি লক্ষ লক্ষ টাকা দামের ওই জমিটা তুমি উদ্ধার করতে চাও। এই লোকটাই শেষ পর্যন্ত জনগণের মঙ্গলের জন্য ডিসপেনসারির দাবি তুলে, আন্দোলন করে খুদিনগর ক্লাবকে জমি থেকে উৎখাত করবে, যেমন তোমার সুপার মার্কেটের জন্য একসময় করেছিল। এ ছাড়া আর কোনোভাবেই কিন্তু তুমি আট বিঘে জমি ফিরে পাচ্ছ না।’ শ্রীমন্ত শেষ বাক্যটি এত কঠিনভাবে বলল যে, ব্রজরাখাল কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন এবং চুপ করে ভাবতে শুরু করলেন।

‘লোকটা যে ইনফ্লুয়েন্সিয়াল তা তুমি জানো। ওর পকেটে তিনটে ভোট, এবারও তোমার চেয়ারম্যান হওয়া আটকে দিতে পারে, দেবেও।’

ব্রজরাখাল মাথা নামিয়ে টেবলে আঙুলের টোকা দিচ্ছেন। শ্রীমন্ত বুঝল, আত্মম্ভরিতাকে ডুবিয়ে দিয়ে এবার ভেসে উঠেছে লোভ। সেটাকে আরও ভাসিয়ে তোলা দরকার বলে তার মনে হল।

‘এখন কুড়ি হাজার টাকা কাঠা ওই জমির। সামনে একটা দাতব্য চিকিৎসালয় করে দিয়ে পিছনে একটা নার্সিংহোম করো, এই অঞ্চলে তো একটাও নেই, এখন ভালো ব্যাবসা। বাচ্চচাদের জন্য ইংলিশ মিডিয়াম কেজি স্কুল করো, ভালো চলবে, ভালো আয় হবে। স্বাস্থ্য বা শিক্ষার নামে আন্দোলন করে ক্লাবকে হটাবার জন্য জনসমর্থন নিতে হবে। রিয়েল পলিটিসিয়ানের মতো ঝগড়াঝাটি সরিয়ে এবার কাজে নাম।’

‘কী কাজ?’ ব্রজরাখালের গলা খুবই নরম। মনে হচ্ছে একটা সিদ্ধান্ত তিনি নিয়ে ফেলেছেন।

‘পথের কাঁটা সরিয়ে দাও….বিমল চক্রবর্তীদের সঙ্গে হাত মেলাও, ওর প্রাপ্য মিটিয়ে দাও।’

‘তুই তা হলে ওর সঙ্গে কথা বল।’

‘বেশ, বলব।’ শ্রীমন্ত উঠে দাঁড়াল।

‘রামানন্দর যোগ ব্যায়াম স্কুলটা তোলা সহজ কাজ হবে না, ওটা থেকে ভালো টাকা কামায়।’ ব্রজরাখাল তাঁর দুর্ভাবনাটা জানালেন।

‘এ নিয়ে পরে ভাবা যাবে। রামানন্দ সহজে ছাড়বে কেন, ওকেও কিছু দিতে হবে। অনেককেই কিছু কিছু দিতে হবে।’

‘বাবা যে কেন ক্লাবটাকে বসিয়ে গেল! এখন খেলার মাঠ চাই বলে যদি পালটা আন্দোলন হয়?’ ব্রজরাখাল আক্ষেপ জানিয়ে ভীত চোখে শ্রীমন্তর দিকে তাকালেন।

‘হলেও টিকবে না। আমাদের খেলাধুলোর হাল দেখে বুঝতে পারো না এটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। খেলার জন্য একজনও ঝান্ডা তুলবে না, তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।’

ঘর থেকে বেরোতে গিয়েও শ্রীমন্ত ফিরে এসে হাসিমুখে বলল, ‘তোমার বলাটা বেশ ভালো হয়েছে, লোকে মন দিয়ে শুনছিল।’

হাসিতে ব্রজরাখালের মুখ ভরে গেল। প্রশংসা নীরবেই গ্রহণ করে শুধু গলাখাঁকারি দিলেন।

‘অন্যরা কে কেমন বলল? আমি সবার বক্তৃতা শুনিনি।’

‘ভালোই বলেছে। ডি এম ছোট্টর ওপর সুন্দর বললেন, ডিস্ট্রিক্ট স্কুল ইন্সপেক্টরও ভালো বললেন…’ ‘আচ্ছা অকামামা কী আজেবাজে কথা শুরু করলেন বল তো? তোর কথাতেই ওঁকে মঞ্চে রাখলাম কিন্তু-?’ ব্রজরাখাল জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।

‘খুব ভালো বলেছেন। এইরকম বক্তৃতাই তো চাই। তোমার ভালোমন্দ লাগা দিয়ে কী এসে যায়, ভোট দেবে যারা, তাদের কেমন লাগছে সেটাই ভালোমন্দের মাপকাঠি।’

‘কিন্তু যেসব কথা বললেন…এখন কোনো ভদ্রলোক রাজনীতি করে না, রাজনীতি এখন ব্যাবসা, বড়ো পুঁজি রাজনীতিকে পকেটে পুরেছে, টাকা ছাড়া ভোট হয় না… এসব কথা কী আমার এগেনস্টেই যাচ্ছিল না?’

‘না। তোমার মামা বলছেন। লোকে ধরে নিচ্ছে ভাগনের পক্ষেই বলছেন। ক্যাম্পেনে তুমি তো এই কথাগুলোই মামার নাম করে লোকের কাছে বলবে। লোকে বুঝবে তুমি ভদ্রলোক, তুমি টাকা ছড়িয়ে ইলেকশন জিততে আসনি। ব্যাপারটা ঠান্ডা মাথায় বোঝ। তোমার অ্যাঙ্গেলটা হবে, জাগরণ চাই, বিপ্লব চাই। টাকা আর গুন্ডামির রাজনীতি নয় ভদ্রলোকের রাজনীতি চাই।…পরে তোমার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলব, এখন তুমি কিছু টাকা দেবে আমায়।’ শ্রীমন্ত নৈর্ব্যক্তিক মুখে অনুরোধ বা আবেদন জানাল না, যেন একটা সিদ্ধান্ত পেশ করল।

‘টাকা! কত?’ ব্রজরাখালকে থতমত দেখাল।

শ্রীমন্ত আন্দাজ করেছে বিজ্ঞাপন হিসাবে ছবি ছাপাতে হাজার তিনেক টাকা বোধ হয় লাগবে। সমাচার ছাড়া অন্য কাগজে তার ঔৎসুক্য নেই। তবে সব কাগজেই দিয়ে আসবে, যদি কেউ ছাপে তো ভালোই। রামরাখাল স্কুলের রজত জয়ন্তী সভার ছবি সংবাদ হিসেবে সমাচার যে ছাপবে না এটা সে জানে।

‘হাজার তিনেক…আপাতত।’

ব্রজরাখাল ইতস্তত করে বললেন, ‘কাল সকালে নিস।’

ঘরের বাইরে জনা তিনেক লোক অপেক্ষা করছে। এরা ব্যবসায় ও বিষয় সংক্রান্ত কাজের কর্মচারী। শ্রীমন্ত বেরিয়ে আসতে তারা ঢুকল। উঠোনের ওপারে অকাদাদুর ঘরের বন্ধ দরজার নীচে একটা সাদা রেখা। ঘরের ভিতর আলো জ্বলছে। দাদু তাহলে জেগে আছেন।

দরজায় টোকা দিয়ে সে বলল, ‘আমি শ্রীমন্ত।’

‘ভেতরে আয়।’

অকাদাদু বালিশে ঠেস দিয়ে আধবসা, হাতে ইংরেজি খবরের কাগজ। ঘরটা বেশ বড়োই। নানা ধরনের বইয়ে দু-টো র‌্যাক ভরা তা ছাড়াও একটা টেবলের উপর স্তূপাকার। আর একটা ছোটো টেবলে ওষুধের শিশি আর ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল ছড়ানো। একটা আলনায় খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি। টুলে বসানো জল ফিলটারের ড্রাম। ঘরের লাগোয়া স্নানঘরের দরজাটা আধখোলা। দেওয়াল উজ্জ্বল সাদা। প্লাস্টিকের বাজে কাগজের চুবড়ি টেবলের পাশে। মোজাইকের মেঝে ঝকঝকে। মন্থর গতিতে পাখা ঘুরছে। কাঠের ক্যাবিনেটের উপর বসানো টিভি সেট। বিছানার চাদর বা বালিশের ওয়াড় দুধসাদা।

শ্রীমন্ত লক্ষ করেছে, অকাদাদুর জন্য তার মামা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, যে কারণেই হোক খরচে কখনো হাতটান করে না। আর তার দিদিমা সুরুচি তীক্ষ্ন নজর রাখেন, তাঁর দাদার স্বাচ্ছন্দ্যের উপর। এই ঘর পরিচ্ছন্ন ও পরিষ্কার রাখার বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া আছে রেবাকে। পরামানিক রোজ সকালে দাড়ি কামাতে আসে।

‘মনে হচ্ছে এখন যেন একটু ভালো আছেন, হয়েছে কী?’

শ্রীমন্ত খাটের উপর এসে বসার আগে স্নানঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল। মেঝেয় ট্যাবলেট-মোড়কের ছেঁড়া টুকরো পড়ে। বোধ হয় ছুড়ে চুবড়িতে ফেলতে গিয়ে পড়েনি, সে তুলে নিয়ে চুবড়িতে ফেলল।

‘কিছুই নয়। তলপেটটা কেমন যেন টাইট লাগছিল, বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল।’

‘একটা ট্যাবলেট এখুনি বোধ হয় খেয়েছেন।’

‘ঘাড়ের ব্যথাটা কমছে না দেখে খেলাম। …যাক গে, পৃথিবীতে কী ঘটছে সেই খবর দে।’

‘আপনি দু-টো খবরের কাগজ রোজ তন্নতন্ন পড়েন, আমি একটা। খবর তো আপনিই দেবেন।’

‘একই খবর, পঞ্জাবে টেররিস্টরা গুলি করে লোক মারছে এখানে খ্যাপা বাঙালিরা গণপিটুনিতে লোক মারছে।’

‘আপনারাও তো টেররিস্ট ছিলেন।’

‘আমি ছিলাম রেভেলিউশনারি। এর সঙ্গে টেররিজমের বিরাট প্রভেদ। রামুদা ছিল টেররিস্ট। পিস্তল নিয়ে মানুষ… থাক ওসব কথা।’

‘থাকবে কেন, বলেই ফেলুন না।’ শ্রীমন্ত একটা বাড়তি বালিশ টেনে, বগলের তলায় রেখে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল।

‘দাদামশাই কী করত বলুন তো? দেশ স্বাধীন হবার আগেই নাকি বড়োলোক হয়ে গেছলেন… মা-র কাছে শুনেছি।’

শ্রীমন্ত লক্ষ করল, শোনামাত্র অকাদাদুর কপালে ভাঁজ পড়ল। ধূসর মণি দুটো মুহূর্তের জন্য ছোটো হয়ে গেল, ঠোঁট দুটো চেপে ধরলেন। এই সব কিছুই যেন, অতীতের দিকে স্মৃতিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা থেকে তৈরি হওয়া। অকাদাদুর মনে রাখার ক্ষমতাটা প্রচণ্ড। শ্রীমন্ত বহুবার তার প্রমাণ পেয়েছে।

‘তোর মা, সুপ্রভা, যখন জন্মাল তখন আমি হিজলি জেলে। আমাদের ‘সি’ ব্লকে ছিল হরেন, খুব ভালো স্বভাবের ছেলে, বছর একুশ-বাইশ, বি এ পড়তে পড়তে এ দিকে চলে আসে। জেলে গুলি চলল, ষোলোই সেপ্টেম্বর, বুধবার।’

‘বুধবার না মঙ্গলবার, ঠিক জানেন?’

‘জানি, কারণ হরেন একটি মেয়েকে ভালোবাসত, তার দেখা করতে আসার দিন ছিল বৃহস্পতিবার। কিন্তু হরেন তখন জেল হাসপাতালে। আগের দিন বুধবার রাতে একদল সিপাই জেলের মধ্যে বেধড়ক লাঠি পেটা করে, গুলিও ছোড়ে, তাতে সন্তাোষ মিত্তির আর তারকেশ্বর সেনগুপ্ত মারা যায়। হরেনের মাথায় কাঁধে লাঠি পড়ে। অজ্ঞান অবস্থায় ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার মেয়েটি এসেছিল। ওই সঙ্গে বরিশালের দুই ভাই, কালিবিলাস আর শ্রীমন্তর বিধবা মা-ও এসেছিলেন ছেলেদের সঙ্গে দেখা করতে। তখন তো আর আজকের মতো জেলখানার অত্যাচারের খবর বাইরে প্রকাশ পেত না! সেই রাতের লাঠি, গুলি, মৃত্যুর ঘটনার কথা সব লিখে, তারকেশ্বরদার মুখের একটা স্কেচও করে ফেলা হয়। দুটোই লুকিয়ে মেয়েটির হাতে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওখানে একজন গার্ড বোধ হয় সন্দেহ করে কিছু একটা ওর হাতে লুকিয়ে দেওয়া হল আর মেয়েটিও সেটা বুঝতে পেরে ধরে নেয় তার বডিসার্চ করা হতে পারে। তাই সে বুদ্ধি করে তক্ষুনি শ্রীমন্তর মায়ের হাতে কাগজ দুটো পাচার করে দেয়। তিনি সেটি আনন্দবাজারে পৌঁছে দেন। খবর ছাপা হতেই তো সারা দেশে তুমুল কাণ্ড, বিরাট বিক্ষোভ শুরু হল, রবীন্দ্রনাথ ‘প্রশ্ন’ কবিতাটাও লিখে ফেললেন।…সুপ্রভা জন্মায় গুলি চলার পরের বুধবার, তেইশে।’

অক্ষয়ধন কাগজটা তুলে চোখের সামনে ধরে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘তোর মা আর কী বলেছে?’

‘বাবার সম্পর্কে মেয়ে আর কী বলবে। তবে আমার বাবার কাছে শুনেছি, বিপ্লব-টিপ্লব সব বাইরের ভড়ং আসলে উনি ডাকাতি করে টাকা করেছিলেন। তাই দিয়েই বিষয়-সম্পত্তি, ব্যাবসা।’ শ্রীমন্ত হালকা সুরে, মজার কথা বলার মতো ভঙ্গিতে বলল।

কাগজে চোখ রেখে অক্ষয়ধন স্মিত হাসলেন মাত্র কিন্তু কপালের চামড়া কুঁচকে রইল।

‘বাবা অবশ্য শ্বশুরের উপর খুব চটা ছিল। বানিয়ে বানিয়েও বলতে পারে। দাদু তো মেয়েকে বিষয়-আশয়, টাকাপত্তর কিছুই দিয়ে যাননি!…দিয়ে যেতে পারতেন। জামাইকে না হোক, মেয়েকে কিছু দিতে পারতেন তাহলে আজ আর আমাদের এমন দুর্দশার মধ্যে কাটাতে হত না।’ বলতে বলতে শ্রীমন্ত উত্তেজনা বশে উঠে বসল। ‘আমার বোনের একটা ভালো ছেলের সঙ্গে তাহলে বিয়ে দিতে পারতাম।’

অক্ষয়ধনের চোখ কাগজেই আটকে রইল। শ্রীমন্ত ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে এল।

‘যাক গে এসব কথা, বোনের বিয়ে আর দিতে হবে না, সে নিজেই বিয়ে করে ফেলেছে।’

‘কবে করল! কাকে?’

‘এই দিন দুই আগে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে পাড়ারই একটা ছেলেকে, মিনিবাস কনডাকটর, জাতে ছোটো…সেটা অবশ্য কিছু নয়। একদিক থেকে ভালোই হল, এমনি বিয়ে দিতে হলে যে টাকা আমাকে খরচ করতে হত সেটা বেঁচে গেল।’ শ্রীমন্ত হাসার চেষ্টায় মুখ থেকে খকখক আওয়াজ বার করল।

অক্ষয়ধন কাগজ থেকে চোখ তুলে ধীর স্বরে বললেন, ‘কেউ যদি নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করে তো করুক না। তোর দিদিমাও তো নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করেছিল, বাড়ির সবার অমতে। রামুদা ওর থেকে অন্তত কুড়ি বছরের বড়ো।’

‘আপনারও মত ছিল না?’

অক্ষয়ধন চুপ করে থেকে শ্রীমন্তর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

‘কি, আপনারও মত ছিল না?’

‘ছিল না।’

‘বয়সের তফাতের জন্য?’

‘না, অন্য কারণে…দরকার কী ওইসব পুরোনো কথা এখন তুলে। যারা বিয়ে করেছে তারা যদি সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে তাহলে ভালো বিয়েই বলতে হবে। কিছুদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে দেখ ওরা কেমন রয়েছে।’

অক্ষয়ধনের স্বর ও বসার ভঙ্গি যেভাবে বদলাল তাতে শ্রীমন্ত বুঝল এই বিষয়ে আর কোনো কথা উনি পছন্দ করবেন না। সে নিজেও বসা থেকে আবার বালিশ আঁকড়ে কাত হয়ে পড়ল।

‘আপনার আজকের বক্তৃতায় ওইটে দারুণ বলেছেন, রাজনীতিকরা দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে।’

‘তুই সবটা শুনেছিস? আমার তো মনে হচ্ছে খুব এলোমেলো বলেছি। যা সব বলতে বলেছিলিস তখন কিছুতেই যেন মনে করতে পারছিলাম না আর ভয় হচ্ছিল তোর বকুনি নির্ঘাত খেতে হবে।’

‘কিন্তু পরিবেশ দূষণ নিয়ে এত যে আপনি ভাবছেন, তাতে লাভটা কী? জীবনের এই সময়ে তো মানুষ ভগবানের নাম করে, তীর্থধর্ম করে, নয়তো স্মৃতিকথা লেখে!’

‘আমি তো ভগবানে বিশ্বাস করি না কাজেই নাম করার প্রশ্নই ওঠে না আর স্মৃতিকথাও অনেকে লিখে ফেলেছে। আমার কলম ধরার কোনো দরকার নেই। নিজের পিঠ নিজে চাপড়াতে যে স্কিলটা লাগে তা আমার নেই। এক্ষেত্রে খাওয়া আর ঘুমোনো ছাড়া এই বয়সে আমার আর কিছুই করার থাকে না।’

‘কিন্তু বিপ্লববাদকে স্বীকার করেছিলাম কী শুধুই দেশ স্বাধীন করার জন্য? যেই দেশ স্বাধীন হল অমনি আমি আর বিপ্লবী রইলাম না?…আসলে সত্যিই আমি আর ছিলাম না। হাভাতে-হ্যাংলারা এমনভাবে দেশটার উপর ঝাঁপিয়ে খুবলে খুবলে খেতে শুরু করল…’

‘ব্রজরাখাল মুখুজ্জের মতো লোকেরা?’

অক্ষয়ধন মিটমিট করে হেসে, ঠোঁটে আঙুল রেখে শ্রীমন্তকে শাসন করলেন। ‘মনে রাখিস ওর দয়াতেই তুই খাচ্ছিস পরছিস।’

‘ব্রজমামারা যখন দেশটাকে খোবলাচ্ছিল তখন আপনি কী করছিলেন?’ শ্রীমন্ত পালটা মিটমিট হাসল।

‘কোণঠাসা মনে হচ্ছিল কিন্তু কিছু করার ছিল না কেননা আমার কোনো দল, পার্টি নেই। লোকে পড়ে না এমন পত্রপত্রিকায় বড়োজোর দু-চারটে প্রবন্ধ লিখতে পারতাম কী কোনো ক্লাব ঘরে বসে গোটা কুড়ি লোকের কাছে আমার চিন্তা প্রকাশ করতে পারতাম। তার বেশি কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এত তাড়াতাড়ি রাজনীতির চরিত্রটা যে বদলে যাবে ভাবতে পারিনি। এত স্থবিরতা এত নির্বুদ্ধিতা, এত অবক্ষয় আর অচেতনতা কেন গ্রাস করবে আমাদের?’

‘তাই আপনি আর বিপ্লবী রইলেন না! ব্রজমামাদের হাত থেকে দেশটাকে স্বাধীন করার যে কাজ সামনে রয়েছে সেটাকে পাশ কাটিয়ে আপনি এখন পরিবেশ দূষণ নিয়ে জাগরণ ঘটাতে চাইছেন…একেই কিন্তু পলায়নি মনোবৃত্তি বলে।’ শ্রীমন্ত ঢোলকে চাপড় দেওয়ার মতো বিছানায় তালু বসাল শব্দ করে। টেবলে একটা ছোট্ট কৌটো দেখে সে হাত বাড়িয়ে তুলে নিল। ঢাকনা খুলে আঙুলে বাছাবাছি করে একটা লবঙ্গ নিয়ে মুখে ফেলতে গিয়েই চোখ পড়ল অকাদাদুর দিকে।

লকআপে মার খাওয়ার যন্ত্রণা চাপার চেষ্টার মতো নয়, দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে কেউটের ফণার সামনে দাঁড়ানোর মতোও নয়, অকাদাদুর মুখটা কালো হয়ে রয়েছে অসহ্য লজ্জা আর অপমানের ছায়ায়। শ্রীমন্ত লবঙ্গটা আর মুখে দিতে পারল না। তার বুকের মধ্যে হায় হায় করে উঠল। এ কী কথা বলে ফেললাম! বাহাদুরি করে এতটা বেড়ে যাওয়ার কী দরকার ছিল? সৎ, নিষ্ঠাবান, আন্তরিক এক বৃদ্ধ বিপ্লবীকে তো সে একটি শব্দে প্রায় হত্যাই করল।

‘দাদু, আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই কিছু না ভেবে, ইডিয়টের মতো মন্তব্য করেছি।’ শ্রীমন্ত ভেবে পাচ্ছে না; অকাদাদুর পায়ে সে হাত রাখবে কি না।

অক্ষয়ধন হাসার চেষ্টা করলেন, হাসলেনও। ‘হয়তো ঠিকই বলেছিস। দেশটাকে আবার স্বাধীন করার কাজ সামনে রয়েছে, এখন অন্য কিছু নিয়ে মেতে ওঠাটা, একরকম তো পালানোই।’

‘না না দাদু, পরিবেশও একটা অত্যন্ত জরুরি সমস্যা, ভয়ংকর সমস্যা, সারা পৃথিবীর সমস্যা। এটা নিয়ে আমাদের দেশের লোক একদমই মাথা ঘামাচ্ছে না। আপনি যেসব কথা-‘

শ্রীমন্ত যখন কথাগুলো বলছিল, অক্ষয়ধন তখন খাট থেকে নেমে স্নানঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। ভিতরে ঢুকে তিনি শ্রীমন্তর কথার মাঝেই দরজাটা বন্ধ করে দিলেন একবারও পিছনে না তাকিয়ে।

অসীমা পালের বাড়ির সামনে শ্রীমন্ত যখন পৌঁছল তখন সকাল প্রায় ন-টা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে বাড়ির কোনো লোকজন দেখতে পাচ্ছে না। আগলটার কাছে গিয়ে বন্ধ লোহার হুড়কোটা টেনে যখন খুলছে তখন সাইকেলে একজন এসে নামল।

‘কাকে চাই?’ লোকটি সাইকেল হাতে ধরে এগিয়ে এল। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স, আধময়লা প্যান্ট ও বুশ শার্ট, হাওয়াই চটি। শীর্ণ গড়ন। মুখের আদলে অসীমার আত্মীয়ই মনে হয়। সাইকেলটার সঙ্গে বাড়ির বাইরের চেহারার মিল রয়েছে।

‘অসীমা পালকে একটু দরকার।’

‘কোথা থেকে আসছেন…আমি ওর দাদা।’ লোকটির স্বর কর্কশ তবে সেটা জন্মগত। চোখে-মুখে কোনো অপ্রসন্নতা নেই কিন্তু মার্জিত ভঙ্গি রক্ষা করার দায়ও মানা হচ্ছে না।

‘আমি আসছি খুদিনগর মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার ব্রজরাখাল মুখুজ্জের কাছ থেকে। কাল ওখানকার স্কুলের-।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি, রজতজয়ন্তীর সভা ছিল তো। অসীমা গেছল রিপোর্ট করার জন্য, গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছে।’

‘আমিই পৌঁছে দিয়ে গেছি।’ শ্রীমন্ত বিনীত স্বরে পেশ করল। গাড়িতে পৌঁছে দেওয়াটা, বলার মতো একটা সম্মানবৃদ্ধিকর ঘটনা এদের কাছে। শ্রীমন্ত দ্রুত আঁচ করে নিল, অসীমাদের আর্থসামাজিক অবস্থান কতটা নীচের দিকে।

‘অসীমা তো সকালে টিউশুনিতে যায়, ফিরেছে কি না…আসুন আপনি।’ অসীমার দাদা ভিতরে যেতে যেতেই চেঁচাল, ‘খুকু ফিরেছে নাকি মা?’

‘না তো, কেন?’ ঘর থেকে উত্তর এল পুরুষের গলায় এবং বেরিয়ে এলেন গত রাতে দেখা বৃদ্ধ লোকটি।

‘এই ভদ্রলোক এসেছেন খুকুর খোঁজে।’

অসীমার দাদা ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকে গেল। বৃদ্ধ বললেন, ‘এখনই ফিরবে ও। একটু অপেক্ষা করবেন কী?’

‘এই দুটো জিনিস ওঁকে দেবার ছিল আর কিছু কথাও বলার ছিল।’ শ্রীমন্ত তার হাতের পলিথিন থলিটা দোলাল। ওর মধ্যে আছে কুড়ি টাকার সন্দেশ আর দুশো দশ টাকা দিয়ে খুদিনগর সুপার মার্কেটে কেনা একটা টাঙ্গাইল। ব্রজরাখালের দেওয়া তিন হাজার টাকা থেকে এটাই প্রথম খরচ। বাকি টাকাটা এখন তার প্যান্টের পকেটে রয়েছে।

‘তা হলে বসুন।’

বৃদ্ধ একটা টুল আনলেন ঘর থেকে। দালানের নীচে বাড়ির ছায়ায় জমিতে টুলটা রেখে বললেন, ‘এখানেই বসুন, হাওয়া আছে।’

‘আমাকে কলকাতায় যেতে হবে।’ টুলে বসে শ্রীমন্ত বৃদ্ধকে ভালো করে লক্ষ করল। গত রাতে যে লুঙ্গি আর শার্ট দেখেছিল পরনে তাই রয়েছে। স্বাস্থ্যের মধ্যে অভাবের হস্তাবলেপ স্পষ্ট হলেও মুখভাব ও আচরণে শিক্ষা আর ভদ্রবোধ পুরোনো জের টেনে রেখেছে।

কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে? জিনিস দুটো এঁর হাতে দিয়ে গেলেও চলে। কিন্তু শ্রীমন্তর অন্তরের গভীরের ইচ্ছাটা, অসীমাকে একটু দেখা আর কথা বলা, সেটা তা হলে অপূর্ণ থেকে যাবে। কাল রাতে অকাদাদুর ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর সে অসহনীয় একটা শূন্যতার মধ্যে নিজেকে ভেসে যেতে দেখেছিল। ক্রমশ সে আবিষ্কার করছিল, যে খুঁটিটার সঙ্গে শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসের সূক্ষ্ম সম্পর্কে সে বাঁধা ছিল সেই খুঁটিটাকেই সে নিজের হাতে উপড়ে ফেলেছে। অকাদাদুর স্নানঘরের দিয়ে এগিয়ে যাওয়া আর দরজা বন্ধ করে দেওয়ার দৃশ্যটাই বার বার তার চোখের সামনে ফুটে উঠছিল।

শূন্যতার মধ্যেই সে কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে হাত বাড়িয়ে প্রথমেই পেয়ে গেল অসীমাকে। সে অবাক হয়ে গিয়েছিল। এত কিছু থাকতে শুধু অসীমাই বা কেন তার চেতনায় ভেসে উঠল! ওর কঠিন অথচ সহজ কথাবার্তা, হাবভাবের মধ্যে, কণ্ঠস্বরে বা পদক্ষেপে সে কোনো ঋজু সততার, মর্যাদাকর অস্তিত্বের আভাস কী পেয়েছে? কিন্তু সে নিজেও কী এখন দূষিত পরিবেশের সঙ্গে চমৎকারভাবে নিজেকে মানিয়ে নেয়নি? তা হলে কেন নির্মল বাতাসের ঝলকের জন্য তার এত আকুলতা!

হঠাৎ সে সচেতন হয়ে পড়ল থলির মধ্যেকার জিনিস দুটি সম্পর্কে। অসীমাকে সন্দেশ আর শাড়ি উপহার দিতে যাওয়ার মতো নির্বোধ সে এত অল্প সময়েই হয়ে গেল কী করে! শ্রীমন্ত এখন নিজেকে নিয়ে গভীর লজ্জা বোধ করল। বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ না পেলে এমন দুঃসাহস বোধ হয় করা যায় না। এটা যে স্পষ্টতই ঘুস আর অসীমা শুধু প্রত্যাখ্যানই করবে না, তার সম্পর্কেও যে একটা হীন ধারণা পোষণ করবে, তাতে শ্রীমন্ত কোনোরকম অস্পষ্টতা পাচ্ছে না। আসলে এইভাবে কার্যোদ্ধার করে করে এটা বোধ হয় তার অভ্যাসের অন্তর্গত হয়ে গেছে।

‘আমি আর অপেক্ষা করব না, জরুরি কাজ রয়েছে, দেরি হয়ে যাবে। আপনি ওঁকে বলে দেবেন’, শ্রীমন্ত দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ‘অক্ষয়ধন মিত্র এখন ভালোই আছেন, উনি যদি কথা বলতে চান তা হলে গিয়ে কথা বলতে পারেন।… নামটা মনে থাকবে? অক্ষয়ধন মিত্র।’

‘মনে থাকবে।’ বৃদ্ধ ঘাড় নাড়লেন।

‘আর আমার নাম শ্রীমন্ত ব্যানার্জি, ওনারই নাতি।’

শ্রীমন্ত এরপর হাতের থলিটা গুটিয়ে ছোটো করে, দ্রুত পায়ে অসীমাদের বাড়ির চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে এসে স্বস্তি বোধ করল। বাসরাস্তার দিকে হাঁটার সময় তার পাশ দিয়েই সাইকেলে চলে গেল অসীমার দাদা। মুখ ঘুরিয়ে একবার তার দিকে তাকালও। বোধ হয় তার হাতের থলিটাকেই দেখল।

একটা বি বা দী বাগ-গামী মিনিবাস পেয়ে শ্রীমন্ত উঠে পড়ল। বাসটা খুদিনগর থেকে ছাড়ে। এখনও ভিড় হয়নি। পিছনের সিটে পাঁচজন বসার কথা কিন্তু আজকাল বসছে ছ-জন। নিজেরাই নড়েচড়ে শ্রীমন্তর জন্য জায়গা বার করে তাকে ষষ্ঠ ব্যক্তি করে নিল। বসার পর বাসের অন্যান্য লোকেদের দিকে তাকাতে গিয়ে চোখে পড়ল বিমল চক্রবর্তী বসে আর তার পাশে জানলার ধারে এক রুগণা তরুণী চোখে পুরু কাচের চশমা। বিমল তার সঙ্গে কথা বলল দেখে আর উঁচু কপালে পিছিয়ে থাকা চুল, নাক ও চিবুকের গড়ন থেকে শ্রীমন্ত আন্দাজ করল ওর কোনো আত্মীয়াই হবে। হয়তো মেয়ে।

বিমল চক্রবর্তী খুদিনগরে বিমল বা বিমলদা। প্রভাবশালী নেতা, পুর এলাকায় অধিকাংশ মানুষ ওকে চেনে। চল্লিশ বছর পার্টি করছে, চাকরি করে রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদে, অফিসে যায় ইচ্ছামতো। বারো নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার, থাকে সঙ বাজার এলাকায়। ওর ছ-টি মেয়ে, তাদের একজনকেও সে দেখেনি।

ওর পাশের সিটটায় বসতে পারলে কথা বলার সুযোগ পাওয়া যেত। শ্রীমন্তর দরকার হবে ওর সঙ্গে দেখা করার। তারই প্রস্তাবনাটা ওর পাশে বসে এখন করা যেতে পারত। মামাকে সে বলেছে পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে দরকার বিমল চক্রবর্তীদের সঙ্গে হাত মেলানো। এই মেলাবার দায়িত্বটা সে নিয়েছে। রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং দায়। সফল হতে পারলে নিশ্চয় পুরস্কার সে দাবি করতে পারবে। প্রেস, বাস, বস্তি, বাজার, এর যেকোনো জায়গায় তিনটে ভাইয়ের কাজের ব্যবস্থা করার কথা সে ইদানীং ভাবতে শুরু করেছে। সোজাসুজি চাইলে মামা কাজ দেবে না। কিছু না পেলে ব্রজরাখাল কিছু দেয় না।

ব্রজরাখালের পার্টি নেই, ছেলেও নেই কাজ করার। টাকা দিয়ে ঠিকে কাজ করায়। গতবার জেতার জন্য কত টাকা দিয়ে বিমল চক্রবর্তীর কর্মীদের ‘উদাসীন’ রেখেছিল ব্রজরাখাল তা শ্রীমন্তর কাছে ভাঙেনি। এবার ব্যাপারটা অন্যরকম। বিমল চক্রবর্তী সম্পর্কে টাকাপয়সা সংক্রান্ত দুর্নীতির কথা শোনা যাচ্ছে, লোকাল কমিটিতে ওর বিরুদ্ধে একটা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, রাজ্য কমিটিতে ওর খুঁটিটা নাকি নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। তা হলেও লোকটির প্রভাব কিছু কমেনি। ওর সঙ্গে শ্রীমন্তর মুখচেনার থেকে একটু বেশিই আলাপ হয়েছিল, যখন শিরদাঁড়ায় একটা ব্যথার জন্য সে রামানন্দর কাছে যোগব্যায়ামের তালিম নিতে আসত। বিমল চক্রবর্তী জানে সে ব্রজরাখালের ভাগনে, এখন দেখা হলে চোখ নাচিয়ে মাথা হেলায়।

যাত্রীদের ভিড় ক্রমশই বাড়তে বাড়তে একসময় বিমল চক্রবর্তী আড়ালে পড়ে গেল। তরুণীর সরু ঘাড় আর মাথাটি শ্রীমন্ত দেখতে পাচ্ছে কিন্তু দ্বিতীয়বার আর দেখার ইচ্ছা হচ্ছে না। তার চোখের উপর দিয়ে অসীমা কয়েকবার চলাফেরা করে গেল। বাড়ি ফিরে খবর পেয়ে অসীমা আজই কী অকাদাদুর সঙ্গে দেখা করতে যাবে? না গেলেই ভালো, কেননা আজ সে খুদিনগরে ফিরবে না। সুতরাং ওকে দেখার সুযোগ সে হারাবে। বিকেলের দিকে খবরের কাগজের অফিসগুলোয় সে তদবির করতে যাবে, ফোটোগ্রাফার দু-জনের সঙ্গেও দেখা করে জেনে নেবে ছবিগুলো কবে পাওয়া যাবে।

শ্যামবাজারের মোড়ে বিমল চক্রবর্তী ও সেই তরুণী নেমে গেল। কয়েক মিনিট পর শ্রীমন্ত নামল হাতিবাগানে। এখন প্রায় এগারোটা, গিজগিজে ভিড়। ফুটপাতে পসরা এমনই সাজানো যে হাঁটাচলা দায়। এরই মধ্য দিয়ে যতটা সম্ভব দ্রুত হেঁটে সে স্টার থিয়েটার ছাড়িয়ে কর্পোরেশনের বাড়ির সামনে পৌঁছে ট্রাম রাস্তা পার হল। আর একটু হেঁটে ডানদিকের একটা গলিতে ঢুকল পথ সংক্ষেপ করতে। দুটো মোড় ঘুরে সে এসে পড়ল একটা মুদির দোকানের সামনে।

দোকানটা ছাড়িয়ে এগোতে গিয়েই সে থমকে পড়ল। শ্রীদুর্গা ভাণ্ডার। পাশ দিয়ে হাত চারেক চওড়া সিমেন্টের গলি। দিপু এখন এই গলির মধ্যে আঠারো নম্বর বাড়িতে বাস করছে। বাড়িটা সে বারো-তেরো বছর আগে শেষবারের মতো দেখেছে যখন চোর-পুলিশ খেলায় এই গলি দিয়ে ছুটতে হত পুলিশের তাড়া খেয়ে। একতলায় ইটের গাঁথুনি, দোতলায় কাঠের মেঝে, টিনের দেওয়াল, বাড়ির চালাটা করোগেটেড টিনের। একটা কাঠের বারান্দা আছে দোতলায়।

শ্রীমন্ত গলিতে ঢুকল। দিপুর সঙ্গে দেখা করে তাকে জানতে হবে, কেন সে এমন একটা করে বসল। জয়ন্ত যেসব কারণে লজ্জায় অপমানে মুষড়ে পড়েছে শ্রীমন্ত সেই ছোটো জাত, কনডাকটর, অশিক্ষিত বা মাঠকোটা নিয়ে মোটেই ক্রুদ্ধ বা দুঃখিত নয়। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা কী ভাবছে তাই নিয়েও তার মাথাব্যথা নেই। কিন্তু বিয়ে করতে যাচ্ছে, এই ব্যাপারটা চেপে রেখে সে কী এটাই বোঝাল না যে, তোমাদের কাউকে বিশ্বাস করি না, পরোয়া করি না!

বাড়িটার পাশের দিকে ছোটো সদর দরজা। শ্রীমন্ত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করল। দরজা থেকেই চওড়া রক, তার পাশে পরপর ঘর এবং দোতলার সিঁড়ি। রকেই রান্না হচ্ছে। দিপু একতলায় না দোতলায় থাকে?

উবু হয়ে মাঝবয়সি এক স্ত্রীলোক রান্না করতে করতে মুখ ফিরিয়ে তাকাল শ্রীমন্তর দিকে। আদুড় পিঠে কাপড় টেনে ঢাকতে ঢাকতে বলল, ‘কাকে খুঁজছেন?’

‘দিপু নামে একটা মেয়েকে…নতুন বিয়ে হয়েছে।’

‘ওই সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যান।’

সরু কাঠের সিঁড়ি দিয়ে শ্রীমন্ত দোতলায় উঠে এল। টানা বারান্দা, তার একধারে কয়েকটা ঘর। সে কাউকে দেখতে পেল না। দিপু কোন ঘরটায় থাকে?

‘দিপু।’ নীচুগলায় শ্রীমন্ত ডাকল।

‘কে?’ কাছের ঘরটা থেকেই দিপুর গলা ভেসে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে বেরিয়ে এল।

‘বড়দা!’ বিস্ফারিত চোখে দিপু তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টিই বুঝিয়ে দিচ্ছে একটা ট্রামগাড়ি দোতলায় উঠে এলেও সে এত অবাক হত না।

দিপুকে শেষ যা দেখেছে, এখন শ্রীমন্তর ঠিক তেমনই লাগছে, শুধু সিঁথিতে চওড়া করে দেওয়া সিঁদুরটাই যা নতুন। এখন বউ হয়েছে, এটা ঘোষণা করতে যেন ওর ভালো লাগছে।

‘বড়দা তুমি! আমি তো ভাবতেই পারছি না। ঘরে এসো, ঘরে এসো।’

তক্তপোশে জমকালো নকশার বেডকভারে ঢাকা বিছানা, দেওয়ালে আয়না, ডিম্বাকৃতি কোয়ার্জ ঘড়ি। কাচের পাল্লার নীচু আলমারি, তার উপর একটা পোর্টেবল টিভি সেট, প্রসাধনের কিছু কৌটো আর শিশি, একধারে আলনা, জলচৌকিতে বাসন আর কেরোসিন-স্টোভ। থালা দিয়ে ঢাকা একটা বড়ো বালতি, টেবল ফ্যান। বাঁশের চ্যাটাইয়ের সিলিং আর টিভি সেটের পাশে নিকেলের ফ্রেমে দাঁড় করানো একটা ফোটো, যাতে ঘোমটা দেওয়া দিপু ও একটি যুবক। শ্রীমন্ত ঘরটায় একবার চোখ বুলিয়ে অবশেষে বোনের মুখে তাকাল।

দিপু উৎকণ্ঠা নিয়ে লক্ষ করছে দাদাকে। শ্রীমন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘আমাদের বাড়ির থেকে ভালো।’

ঘরের দু-পাশে তাকিয়ে নিয়ে দিপু বলল, ‘তুমি তো ওকে দ্যাখোনি, ওইটে ওর ছবি।’

শ্রীমন্ত এগিয়ে এসে আলমারির সামনে দাঁড়াল। শ্যামল অবশ্যই সুদর্শন। চোখা, বুদ্ধিদীপ্ত, কষ্টসহিষ্ণু এক বাস্তববাদীর মুখ। গলায় ও কাঁধে শক্তির আভাস আছে। চোখের স্বপ্নাতুর ভাবটা বোধ হয় ছবি তোলার জন্যই এসে গেছে।

দিপু সাগ্রহে শ্রীমন্তর মুখভাব লক্ষ করে যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে তার মুখে হাসি ফুটল। তারপর শ্রীমন্তর হাতের পলিথিন থলিটার দিকে তার চোখ পড়ল।

‘এতে কী আছে?’ দিপুর স্বরে প্রত্যাশার মতো কিছু একটা যেন শ্রীমন্তর কানে ঠেকল। প্রথমে সে থলি ধরা হাতটা গুটিয়ে ফেলেছিল। এসব অসীমার কথা ভেবে কেনা।

‘বাড়ির জন্য?’ দিপুর স্বর নিস্পৃহ। এটা শ্রীমন্তর কানে বাজল। চঞ্চল, ছটফটে, চটুল স্বভাবের। বাড়ির কাউকে না জানিয়ে একটা বিয়েই শুধু করেছে, আর কিছু তো করেনি। এই তো দিব্যি সংসার পেতেছে একটা ছেলের সঙ্গে। বাড়ি থেকে দেখেশুনে বিয়ে দিলেও তো এই একইরকম হত! তফাতের মধ্যে ছেলেটা হত বামুন, গ্র্যাজুয়েট, আর কেরানি।

‘বাড়ির জন্য নয় রে, তোর জন্য!’

শ্রীমন্ত থলিটা বাড়িয়ে ধরল। দপ করে জ্বলে উঠল দিপুর মুখ। শ্রীমন্ত মুগ্ধ হয়ে মনে মনে বলতে বাধ্য হল, কী সুন্দর ওকে দেখতে। অথচ দিপুর দেহে অসাধারণ স্বাস্থ্যটুকু ছাড়া চলতি মানদণ্ডের সৌন্দর্য ওর মুখে নেই।

থলিটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়েই শাড়ি আর সন্দেশের বাক্সটা বার করল। শাড়ির পাট খুলে কাঁধের উপর ঝুলিয়ে দিপু আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

‘আঁচলটার কাজ খুব সুন্দর।…তুমি জানলে কী করে আমি হালকা জমির সঙ্গে হালকা পাড় পছন্দ করি! লক্ষ করেছ, না?…বাড়িতে না থাকলে কী হবে, সব কিন্তু তুমি ঠিকই নজর করো। ম্যাচ করে একটা ব্লাউজ পিসও আনলে না কেন?’

খুশিতে বকবক করে যাচ্ছে দিপু। মনে কোনো সংকোচ, ভয়ের লেশমাত্র নেই। আর শ্রীমন্ত গ্লানিবোধ করছে। মোটেই ওর কথা ভেবে, ওর জন্য যে কেনা নয়, এ খবর পেলে দিপার এই আনন্দ নিমেষে কালো হয়ে যাবে। যার জন্য কেনা সে কী এমন উচ্ছল হয়ে পড়ত? অসীমার গম্ভীর কঠিন মুখটা ঝলসে উঠত-‘উপহার! কীজন্য?’

‘বড়দা চা খাবে?’

‘খাব।… তোর রান্নাবান্না হয় কোথায়? ভালো কথা, এখন তোর পদবি কী?’

‘পদবি রায়। রান্নাবান্না আমি করি না। এই তো এখানে এলুম।’

কেরোসিন-স্টোভ, কেটলি নিয়ে ঘরের কোণে দিপু বসে পড়ল। কাজের সঙ্গে চলল তার কথা।

‘বাবুদার দর্জির দোকানের পাশে যে ভাতের হোটেলটা আছে, ওখান থেকে ডাল মাছ তরকারি দিয়ে যায়, ভাতটা আমি ঘরে করে নি। মাসকাবারি ব্যবস্থা। আর টুকটাক যা কিছু… মামলেট খাবে?’

‘না।’

‘কেন, খাও না!’ দিপু সরল চোখে শ্রীমন্তর মুখে তাকাল।

দিপু মনে করে নিতে পারে, সামাজিক স্তর থেকে ও নেমে গেছে বলে বড়দা তার হাতে খেতে চায় না। ওকে বিচ্ছিন্ন করে এক ধরনের হরিজন বানানোটা বন্ধ করতে হবে। জীবনে এই প্রথম ও আতিথেয়তার, গৃহিণীপনার সুযোগ পেয়েছে স্বাধীনভাবে। ওর উৎসাহে ভাটা পড়ুক শ্রীমন্ত তা চায় না।

‘দে। মামলেট নয়, পোচ কর। তেল-ঘি কম খাওয়াই ভালো।’ বলার সময় আবার অসীমাকে তার মনে পড়ল। মনে মনে হাসলও। ‘ভাজাভুজি মানে তেল-ঘি পেটে…’, অসীমা তাকে প্রভাবিত করছে কী!

‘ও তো কাঁচাই খায়। বলে এতেই নাকি বেশি উপকার, সত্যি?’

‘কী জানি।’

খাটে পা ঝুলিয়ে বসে শ্রীমন্ত লক্ষ করে যাচ্ছে। খ্যাচ খ্যাচ করেও মা ওকে দিয়ে ঘরের কাজ করাতে পারত না। আর এখন। নিজস্ব মালিকানা মানুষকে যে কাজের করে তোলে দিপুই তার একটা উদাহরণ।

‘তোর বর কোথায়?’ শ্রীমন্ত ‘জামাই’ শব্দটা ব্যবহার করল না। মনের কোথায় যেন বাধবাধ ঠেকল।

‘কাল রাতে শিলিগুড়ি গেছে, কালই ফিরে আসবে।’

‘শিলিগুড়ি!’ শ্রীমন্তর ভ্রূ কুঁচকে গেল। ‘শুনেছি মিনিবাসে কাজ করে।’

‘বাস তো বসে গেছে। মালিকদের সঙ্গে বোনাস, ছুটি, ডিউটি এসব অনেক কিছু নিয়ে ঝামেলা চলছে, না মিটলে বাস বেরোতে দেবে না…মাসের সব দিন তো কাজ থাকে না, ক-টা টাকাই বা হয়। তাতে কী চলে?’

‘তুই এইসব জানতিস?’ শ্রীমন্ত বোঝাতে চাইল এইরকম অবস্থা জেনেও বিয়ে করলি?

‘হ্যাঁ। আমাকে তো সবই বলেছে।’ দিপু কেটলি নামিয়ে গরম জলে চা ভেজাতে দিয়ে একটা সসপ্যান স্টোভে বসাল।

‘শিলিগুড়িতে গেছে কেন?’

‘মাল আনতে। এ মাসে তো এই নিয়ে তিনবার গেল। একা তো নয়, তিন-চারজন মিলে যায়।’

কেন যায়, কী মাল আনতে যায় শ্রীমন্ত তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলল না। সে জানে কলকাতা থেকে বহু ছেলে চোরাচালানী জিনিস সীমান্তের কয়েকটা জায়গা থেকে নিয়মিত আনে। শুধু বলল, ‘খুব রিস্কি কাজ।’

‘হ্যাঁ, রিকস তো আছেই। দু-বার তো ওকে ধরেও ছিল, টাকা খাইয়ে ম্যানেজ করেছে। …টাকায় সব হয় বড়দা।’ ডিম ভেঙে সসপ্যানে ঢেলে দিপু কাজে ব্যস্ত থেকে কথাগুলো বলল। স্টোভ থেকে সেটা নামিয়ে রেখে সে ঘুরে বসল।

‘এখানে একটা খাবারের দোকান দেবে। ওর চেনা একজনের আলুর দম-পাউরুটির দোকান আছে টাউন স্কুলের রাস্তার উপর। লোকটা আমাশায় মরে গেছে। তার বউ এখন দোকান চালাচ্ছে। কিন্তু পারছে না চালাতে। জায়গাটা বেচে দিতে চায়। ও বলেছে নেবে, নিয়ে বেঞ্চি পেতে বড়ো সাইজের পুরি, শুকনো আলুর দম, মাংসের ঘুগনি প্লেটে করে বেচবে যাতে ভদ্রলোকও খেতে আসে। শালপাতাফাতা কী দাঁড়িয়ে খাওয়া আর চলে না। তোমায় কী বলব বড়দা, সস্তায় পেট ভরে, মুখেও স্বাদ লাগে এমন খাবারের যে কী ডিম্যান্ড তা বলা যায় না! তিনদিন আমি দাঁড়িয়ে লক্ষ করেছি, যে ক-টা খাবারের দোকান, তারা তো বেচে কূল পায় না। তুমি কী বল, লাভ হবে না? অবশ্য লোক রাখতেই হবে, দরকার হলে আমিও গিয়ে বসব।’ দিপু উত্তর পাবার জন্য আগ্রহ দেখাল না।

শ্রীমন্ত সন্ত্রস্ত চোখে তাকাল। তাদের বাড়ির মেয়ে টাউন স্কুলের রাস্তায় ঘুগনি, আলুর দম বেচবে? দিপু ভাবতে পারল কী করে? বিয়ে করে ওর চিন্তাভাবনায় এই পরিবর্তন এসেছে নাকি পরিবর্তনটা ঘটে গিয়েছিল বলেই এই বিয়েটা করল? রাস্তা দিয়ে বাড়ির, পাড়ার লোকেরা যেতে যেতে দেখবে বনেদি বাঁড়ুজ্যে বাড়ির মেয়ে ঘুগনি বেচছে! বাড়াবাড়িই করবে, বিয়েটার থেকেও।

‘লজ্জা প্রথম প্রথম করবে।’ চা ছেঁকে দিপু দুধ-চিনি মেশাচ্ছে। মুখে ভাবান্তর নেই। ‘দু-দিনেই অবশ্য ওটা কেটে যাবে। ও বলেছে দু-তিনমাস প্রচণ্ড খেটে দাঁড় করাতেই হবে। ঝাল কষা মাংসটা যদি স্টার্ট করতে পারি তাহলে বছরখানেক পরই…’ কেউ চায়ের কাপ শ্রীমন্তর হাতে তুলে দিল।

প্রথম চুমুক দিয়ে শ্রীমন্ত বলল, ‘হ্যাঁ বছরখানেক পর?’

‘বলেছে ফ্রিজ কিনে দেবে।’

আনন্দের শিহরনটা দিপুর সারা মুখে কয়েক সেকেন্ড ছোটাছুটি করে স্থির হয়ে রইল। আর শ্রীমন্ত অবাক হয়ে শুধু চেয়ে থাকল। দিপু নিজেকে সামলে তাড়াতাড়ি বলল, ‘বললেই কী আর হয়, কপালও থাকা চাই। দোকান চলবে কী চলবে না তার ঠিক কী? গাছে কাঁঠাল আর গোঁপে তেল দিয়ে থাকার মেয়ে আমি নই…তবে ও ভীষণ খাটতে পারে। আমাদের তো কোনো সহায়সম্বল নেই যে…।’

দিপু কী বলতে চায়? সহায়সম্বল মানে বাপের বাড়ি? দাদাদের সাহায্য? তা চাইবার কোনো মুখ ওর আছে কী? এটা নিশ্চয় ও ভালো করেই জানে।

‘বাড়িতে কী বলছে আমার সম্পর্কে?’ পোচটা প্লেটে নিয়ে শ্রীমন্তর কাছে দাঁড়িয়ে দিপু নীচু গলায় বলল। ঔৎসুক্য, উৎকণ্ঠা, বিষাদ সব মিশে আছে ক-টা শব্দে।

‘আমি এখনও বাড়ি যাইনি, খুদিনগর থেকে সোজা আসছি।’

‘জানলে কী করে, ছোড়দা গিয়ে বলেছে? …ও নাকি বলেছে আমি এ পাড়ায় থাকলে ও পাড়া ছেড়ে চলে যাবে। আমার এক বন্ধু মা-র কাছ থেকে শুনে এসে আমায় বলল। আচ্ছা আমি এখানে থাকলে কী এমন ওর ক্ষতি হবে? লোকে নিন্দেমন্দ করবে তো আমাকেই, ওকে তো নয়। আর আমিও তো ও বাড়িতে আর যাব না।’

‘যাবি না?’

‘তোমরা ঢুকতে দেবে?’ দিপু স্বচ্ছ নিশ্চিতভাবে হাসল।

শ্রীমন্ত জানে না এর উত্তর। যদিও সে-ই এখন পরিবারের প্রধান এবং প্রভাবশালী সদস্য, তার মতামতই শেষ কথা, কিন্তু এই ক্ষেত্রে সে নিরুপায়। কে কীভাবে ব্যাপারটা নিয়েছে শুধু জয়ন্ত ছাড়া আর কারোর মনোভাব সে এখনও জানে না।

‘বাড়ি তো আমার একার নয়, তা ছাড়া তুই কিছুই না জানিয়ে এটা করেছিস। একবার অন্তত কথাটা পেড়ে কী প্রতিক্রিয়া হয় সেটাও তো দেখে নিতে পারতিস। হয়তো সবাই মেনে নিত, তা হলে আর…।’

‘না মানত না, আমি জানি, মানত না।’

এতক্ষণে দিপু বোধ হয় তার কয়েকদিনের উৎকণ্ঠার চাপ থেকে নিজেকে বার করার সুযোগ পেল। এই আলোচনাটা হোক যেন সে চাইছিল।

‘জন্ম থেকে সবাইকে দেখছি, আমাদের বাড়ির লোক কে কীরকম তা আমি জানি। দু-খানা ঘর, সাতটা লোক তার মধ্যে একজন পাগল। দু-বেলা উনুন ধরবে কি না সেই চিন্তা ছাড়া আর কোনো চিন্তা ছিল না। তুমি কলেজ ছেড়ে রোজগারের জন্য মামার কাছে চলে গেলে। মেজদা, সেজদা লেখাপড়া করল না, তাদের পড়াতে বসানোর লোক কেউ ছিল না। বাড়ির বাইরেই আড্ডা দিয়ে কাটাত। ছোড়দাটা অন্যরকম হয়েছে, ও বুঝেছে পড়াশুনো না করলে দাঁড়ানো যাবে না। আর আমার কথা কে ভাবে?’

দিপু দম নেবার জন্য আবেগ সামলে নিয়ে আবার শুরু করার জন্য একটু থামতেই শ্রীমন্ত এক হাত তুলে বলল, ‘থাম। দরকার নেই এখন এসব কথায়।’ শ্রীমন্ত খালি চায়ের কাপ মেঝেয় নামিয়ে প্লেটটা দিপুর হাত থেকে নেবার জন্য হাত বাড়াল।

‘কেন থামব, কেন দরকার নেই? আমি যদি ভাইদের ভরসায় বাড়িতে পড়ে থাকতুম, তা হলে জীবনেও আমার বিয়ে হত না।…টাকার অভাব যে কী জিনিস, তার থেকেও বড়ো কথা বংশমর্যাদা আঁকড়ে ধরে ভদ্দরলোক সেজে থাকার যে কত বজ্জাত সেটা তো আমাদের বাড়িতেই দেখেছি। সরিৎজ্যাঠার মেয়েদেরই দেখ না, মিনুদির তো আজও বিয়ে হল না, আর হবেও না। তিনুদিকে তিন ছেলেমেয়ের বাপ একটা হেঁপো দোজবরের সঙ্গে গ্রামে বিয়ে দিল, তিনুদি বনেদি বাড়িতে খুব সুখেই আছে, কেমন? বিনুদি একটু দেখতে শুনতে ভালো, বি এ পাশ, জাত মিলিয়ে এক কেরানি বামুনের ছেলেকেই লটকালো, বিয়ের সাতমাস পর বাচ্চচা হল। বুঝি না কিছু, না?’

‘দিপু।’ ধমকে উঠতে চেয়ে শ্রীমন্তর গলা দিয়ে কাতর মিনতির মতো হয়ে শব্দটা বেরোল। একগ্রাসে পোচটা মুখে পুরে সে ইশারায় জল চাইল।

বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এক মাঝবয়সি স্ত্রীলোক ‘কী কচ্ছ গো সুদীপা…’ বলেই ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে গেল শ্রীমন্তকে দেখে।

‘মাসিমা, এখন ফিরছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমার বড়দা।’ দিপু মুহূর্তে বদলে গিয়ে উচ্ছল গলায় বলল, ‘এই দেখুন শাড়ি এনেছে আর সন্দেশ।’

শাড়িটা তুলে মাসিমার হাতে দিয়ে সে সন্দেশের বাক্স খুলতে খুলতে বলল, ‘জানো বড়দা, মাসিমা গান জানেন, উনি বাবাকে গান গাইতে শুনেছেন, হ্যাঁ অ্যা অ্যা।’

দিপু সন্দেশের বাক্সটা মাসিমার সামনে এগিয়ে ধরল, ‘নিন নিন, না বললে শুনব না, আমার বাপের বাড়ির জিনিস-।’

মাসিমা ইতস্তত করে একটা তুলে নিল। ওর তোলার ভঙ্গিটা দেখে শ্রীমন্তর আবার মনে পড়ল অসীমাকে। ও কী আজই অকাদাদুর সঙ্গে কথা বলতে যাবে? যেতে বলার কথাটা না বললেই ভালো হত।

‘সুদীপা, তা হলে তো মন কষাকষির পালা শেষই হয়ে গেল, শাড়ি মিষ্টি নিয়ে বড়দাই যখন হাজির!’ মাসিমার কণ্ঠস্বরে উদবেগ অবসানের সুর। ‘আপনার বোনের মনে খুব কষ্ট ছিল, বাড়ির কেউ এই বিয়ে মেনে নিতে পারেনি বলে। যাক তাড়াতাড়িই যে আপনারা মেনে নিলেন এটাই সুখের। আমিও বলেছিলাম, মা দাদারা কতদিন আর পারবেন তোমাকে ত্যাজ্য করে রাখতে? প্রাণ ঠিক কাঁদবেই। শ্যামল ছেলে খুব ভালো, মনটা সাদা, বছর তিন দেখছি তো ওকে।’ সন্দেশটা মুখে না দিয়ে মাসিমা ধীর স্বরে যখন বলে চলেছে, শ্রীমন্ত অস্বস্তিতে তখন মেঝের দিকে তাকিয়ে। দিপুর চোখেমুখে এই খুশির আভা তার অর্ধেকটাই যে কৃত্রিম, তার কাছে এটা অসহ্য লাগছে। সম্পর্কের বাঁধন ছিঁড়ে দিপু বেরোতে পারেনি। বাড়ির লোক তাদের মেনে নিয়েছে এটা সবাইকে জানাবার দুর্বলতা থেকে তৈরি হল এই অভিনয়। অথচ বাড়ি এদের মানতে রাজি নয়। শ্রীমন্ত নিজেকেই দায়ী করতে লাগল এই মিথ্যা ধারণাটা এখানে বয়ে আনার জন্য। হাতে এই শাড়ি আর সন্দেশের বাক্সটা না থাকলে…।

‘আমি আসি এখন।’ মাসিমা নমস্কার করল। শ্রীমন্ত এটার জন্য তৈরি ছিল না। তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে সে প্রতি নমস্কার জানাল।

‘কে?’ শ্রীমন্ত দরজার দিকে তাকিয়ে দিপুকে জিজ্ঞাসা করল।

‘আমার পাশের পাশের ঘরে, একা থাকেন। এখানে রয়েছেন বছর তিন, নার্সিং হোমে আয়ার কাজ করেন। তিরিশ বছর বিধবা। এক মেয়ে ছিল, কষ্ট করে টাকা জমিয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন, দেড় বছর পর মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে আগুনে পুড়ে মারা যায়।’

‘ওহ।’ কেন বা কী কারণে পুড়ল, সেই কৌতূহলের দিকে না গিয়ে শ্রীমন্ত বলল, ‘তোর শ্বশুরবাড়ি কোথায়, কে কে আছে?’

‘নিজের কেউ নেই, এক জ্ঞাতি কাকা থাকে, গৌরীবেড়েতে।…বড়দা…’ দিপু কী যেন বলতে গিয়ে দ্বিধাভরে চুপ করে গেল।

‘বল।’

দিপু মুখ নীচু করে নাক খুঁটতে শুরু করল। শ্রীমন্ত অধৈর্য স্বরে বলল, ‘কী বলবি বল, এখন আমায় যেতে হবে।’

‘আমার জন্য কাপড় না এনে ওর জন্য যদি কিছু একটা আনতে।’

‘এই দ্যাখো, ইসস, কী ভুলই না হয়ে গেল! দেড়শো টাকা দিয়ে একটা প্যান্টের কাপড় কিনে শেষকালে কিনা ফেলে রেখে এসেছি। এবার যেদিন আসব নিয়ে আসব।’

মিথ্যার উপর ভর করে যখন শুরু হয়েছেই তখন যতক্ষণ পারে চলুক, এমন এক মনোভাবে শ্রীমন্ত এখন আক্রান্ত। দিপুর মুখের খুশি কতদিন বজায় থাকবে তা সে আন্দাজ করতে না পারলেও একটা দায় থেকে সে অন্তত রেহাই পেয়েছে। ভবিষ্যতে যদি স্বামীর সঙ্গে অবনিবনা হয়, তা হলে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে সে অপরাধী করতে পারবে না। তবে বিদ্যাবুদ্ধি অনুযায়ী দিপুর বাসনার চাহিদা, শ্রীমন্তর মনে হল, বোধ হয় অপূর্ণ থাকবে না। যেহেতু ও ভদ্দরলোক হবার ধার ধারে না।

‘মাকে বোলো আমি ভালো আছি, একটুও যেন না ভাবে আমার জন্য। আর বোলো, আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।…না এটা বোলো না, তা হলে কান্নাকাটি শুরু করবে, তার থেকে বরং…’ দিপু চোখ কোঁচকাল। কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘মাকে আসতে বল না, দুপুরে, কেউ জানতে পারবে না। বলবে?’

‘বলব।’

বাড়িতে এসে শ্রীমন্ত কাউকে বলল না সে এইমাত্র দিপুর কাছে গিয়েছিল। শরিকি বাড়ির দোতলার পিছন দিকে তাদের দু-খানা ঘর আর রান্নার জায়গা। সাবেক আমলের খাট, আলমারি, জানলার পাল্লা ঝুলে পড়া, দেওয়ালের পলেস্তরা খসা, মেঝের সিমেন্ট চটা দুটো ঘরের অনেকটা জায়গাই খেয়ে ফেলেছে। তারা চারভাই শোয় বড়ো ঘরটায়, দিপু শুতো মায়ের সঙ্গে অন্য ঘরে যেটার কিছু অংশ ভাঁড়ারও।

জয়ন্ত খেতে বসেছে। শ্রীমন্তকে একবার দেখেই সে মুখ নামিয়ে খেয়ে চলল। সুপ্রভা ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘ভাত খাবি তো?’

‘খাব।’

ভাত খেয়ে শ্রীমন্ত মায়ের ঘরেই খাটে শুয়ে পড়ল। জয়ন্ত বেরিয়ে গেছে। অনন্ত আর বসন্ত একসময় এল। বড়দা এসেছে জানতে পেরেই বোধ হয়, ভাত খেয়েই বেরিয়ে গেল। ওদের আসা যাওয়াটা শ্রীমন্ত তন্দ্রার মধ্যেই জানল।

বিকেলে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় সে মাকে বলে গেছল রাত্রে থাকবে। দিপু প্রসঙ্গে কোনো কথাই সে বলেনি। প্রথমে গেল ফোটোগ্রাফারদের স্টুডিয়োতে। ফিল্ম ডেভেলাপ করে দু-দিনের মধ্যে প্রিন্ট দেবার জন্য তাগিদ দিল। তারপর তিনটি খবরের কাগজের অফিসে গিয়ে চিফ রিপোর্টার ও নিউজ এডিটরের কাছে কয়েক মিনিট বসল।

যে রিপোর্টাররা কাল রামরাখাল স্কুলে গেছল তাদের মধ্যে দু-জনের সঙ্গে দেখা হল। একজন বলল, এখনও লিখে ওঠা হয়নি, আজই লিখে দেবে। অন্যজন বলল, কালই লিখে দিয়ে গেছে, স্থানাভাবে বেরোতে পারেনি। দু-জনকেই বাইশ টাকা দামের বিলিতি সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে একই কথা বলল, ‘নিন দাদা, আজ সকালেই এক পার্টি এসে দিল আমায় কিন্তু আমি তো খাই না, তাহলে কাকে এটা দিই ভেবে শেষকালে নিয়ে চলে এলাম।’ রিপোর্টারদের একজন বলল, বড়ো করেই লিখবে। অন্যজন কথা দিল, তাড়াতাড়ি যাতে বেরোয় সেটা দেখবে।

শ্রীমন্ত সমাচার অফিসে দেখা করল বিদ্যুৎ ঘোষের সঙ্গে। অসীমা আজ আসেনি।

‘কোথাও পাঠালে পরের দিনই লেখা জমা দিয়ে যায়, খুব রেসপন্সেবল মেয়ে, হয়তো কোনো কাজটাজে আটকে গেছে।’

‘উনি কী এই সব লেখা ছাড়া অন্য কাজ করেন নাকি?’ হয়তো অবাঞ্ছিত কৌতূহল দেখানো হয়ে গেল, এই ভেবে শ্রীমন্ত তাড়াতাড়ি যোগ করল, ‘এইভাবে লিখে ক-টা টাকাই বা হয়, ওঁর বাড়ি দেখে মনে হল…।’

‘তুমি ওর বাড়ি দেখেছ নাকি?’ বিদ্যুৎ ঘোষ প্রশ্ন করে তাকিয়ে রইলেন। শ্রীমন্তর মনে হল, উনি যেন বুঝে নিতে চান, বাড়ির কতটা সে দেখেছে।

‘যা দেখেছি সেটা অবশ্য না দেখারই মতো। কাল গাড়িতে ওঁকে পৌঁছে দিতে গিয়ে যতটুকু অন্ধকারে সম্ভব।’

‘অসীমার বাবা জ্যোতির্ময় পাল, রাজশাহিতে আমাদের গ্রামেরই লোক। আমার বাবা, মা ওঁকে চিনতেন। এদেশে আসার পর আমাদের বাসায় আসতেন মাঝে মাঝে, ছোটোবেলায় ওকে আমি দেখেছি। বহু বছর পর, মাস তিনেক আগে একদিন উনি এই অফিসে এসে আমার সঙ্গে দেখা করলেন খবর ছাপাবার জন্য। উনি কাজ করতেন বিষ্ণুপুর পেপার মিলের অ্যাডমিনিসট্রেটিভ সেকশ্যানে, একুশ মাস মিল বন্ধ, মাইনে পাচ্ছে না সতেরোশো কর্মী, তার মধ্যে আছেন উনিও। মাঝে মাঝেই এসব খবর কাগজে বেরোয়। কিন্তু জ্যোতির্ময়কাকা আটপাতার একটা লেখা সঙ্গে এনেছেন, তাতে কারখানার বন্ধ হওয়ার ইতিহাস, কর্মচারীদের দুরবস্থা, ইউনিয়নগুলোর আর নেতাদের আন্দোলন আর সংগ্রামের ধাপ্পাবাজি, রাজ্য সরকারের অসহায়তা-এই সবই ছিল। আমি বললাম, করেছেন কী! এতবড়ো লেখা ছাপব কোথায়? বুড়ো মানুষ, ফিরিয়ে দিতেও কেমন মায়া হল। বললাম, এটা ছোটো করে দু-পাতার মধ্যে লিখে দিন মেইন পয়েন্টসগুলো রেখে। উনি, ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেলেন।’

বিদ্যুৎ ঘোষ টেবলে এসে দাঁড়ানো এক তরুণ সাব-এডিটরের দিকে মুখ তুললেন, ‘কী হল?’

‘এটার বাংলাটা-‘ টেলিপ্রিন্টার কপিটা বিদ্যুৎ ঘোষের হাতে দিয়ে তরুণটি বলল, ‘এই শব্দটা…পারফরম্যান্স! এককথায় কী হবে এর বাংলা?’

বিদ্যুৎ ঘোষ বাক্যটি দু-তিনবার পড়লেন, ভ্রূ কোঁচকালেন। ‘শ্রী গান্ধী বলেন, শ্রীলঙ্কায় এ পর্যন্ত আই পি কে এফ-এর যা পারফরম্যান্স, মানে…যা প্রদর্শন করেছে… এ পর্যন্ত যে কাজ করেছে, অর্থাৎ…সাফল্য-অসাফল্য মিলিয়ে যা দেখিয়েছে-‘ অসহায়ভাবে তিনি তরুণটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

‘তাহলে ‘প্রদর্শন করেছে’টাই লিখি।’

‘তাই লেখো।’ বিদ্যুৎ ঘোষ হাঁফ ছেড়ে শ্রীমন্তর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাংলা ভাষাটা যে কত দুর্বল। আজই আমার কাগজে বেরিয়েছে ‘তিনি খুব ভারসাম্যের সঙ্গে জয়টিকে গ্রহণ করেছেন।’ এটা কী একটা বাংলা হল?’

শ্রীমন্ত সবজান্তার মতো মুচকি হাসল। ভাষা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারটা তার প্রতিভার আওতায় পড়ে না।

‘কী যেন বলছিলাম?’

‘উনি আচ্ছা বলে চলে গেলেন, মানে জ্যোতির্ময় পাল-‘

‘আর ঠিক দু-দিন পরই একটি মেয়ে এসে হাজির হল। প্রণাম করে বলল, আমার নাম অসীমা, বাবা জ্যোতির্ময় পাল। দু-পাতা লেখা হাতে দিয়ে বলল বাবাকে বলেছিলেন ছোটো করে লিখে দিতে, এনেছি। ছোটোর মধ্যে গুছিয়ে, ঝরঝরে লুসিড বাংলায় এত সুন্দর লেখা! জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওটা ওরই লেখা। একুশ মাস কারখানা বন্ধ থাকলে কর্মচারীদের পরিবারে কী অবস্থা হয় সেটা তুলির কয়েকটা আঁচড়ে স্কেচ করে দেবার মতো ওইটুকু লেখার মধ্যেই একজনের আত্মহত্যার ঘটনা তুলে এঁকে দিয়েছে, সঙ্গে স্ট্যাটিসটিকস। এরপর ওকে দিয়ে অনেক লেখা লিখিয়েছি যাতে কিছু টাকা পায়। বুঝতেই তো পারছি বাড়ির অবস্থাটা কেমন। এরই মধ্যে আবার ওর দাদার খুব ভারি অসুখ গেছে, অপারেশন করতে হয়েছিল।…এলে তিনটে-চারটের মধ্যেই আসে, হয়তো কালই এসে দিয়ে যাবে।’

‘একটা লেখার বিষয়ের কথা কাল ওঁকে বলেছিলাম। কিন্তু আপনার অনুমতি না পেলে তো উনি লিখতে পারবেন না।’ শ্রীমন্ত অত্যন্ত বিনীত ভঙ্গিতে ভূমিকা ফাঁদল। অসীমা সম্পর্কে ইতিমধ্যেই এমন একটা সম্ভ্রম তার মনে তৈরি হয়ে গেছে যে নামটি উচ্চচারণে তার বাধবাধ ঠেকল।

বিদ্যুৎ ঘোষ জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে। শ্রীমন্ত ঝুঁকে টেবলে কনুই রেখে বলল, ‘সারা রাজ্যে মিউনিসিপ্যাল ইলেকশন তো এসে গেল। এবার আপনারা সব পুরসভাগুলোর একটা সার্ভে করান না। উত্তর চব্বিশ পরগনার ভার যদি ওঁকে দেন তাহলে আমি সাহায্য করব, এটা ওঁকে বলেছি। উনি বললেন, লিখতে তো পারি কিন্তু ছাপবে কে?’

‘এরকম একটা প্রস্তাব সার্কুলেশন ম্যানেজার অবশ্য আগেই দিয়েছে, ঠিকও হয়ে গেছে কাকে কোথায় পাঠানো হবে। অসীমা তো আমাদের স্টাফ নয়, ওকে দিয়ে এসব কাজ করানো যায় না।’

‘যায় না!’ শ্রীমন্তর চোখেমুখে হতাশা স্পষ্ট হয়ে উঠল। ‘একটা পুরসভাও, আমাদের খুদিনগরটাও কী ওঁকে দিয়ে লেখানো যায় না? বলতে গেলে ওই এলাকাতেই থাকেন, দুটো বাসস্টপ, পুরসভার ব্যাপার স্যাপার বোঝেন, ফার্স্ট হ্যান্ড নলেজ আছে। তা ছাড়া ভেতরের খবরও আমি দিতে পারব।’ তার স্বরে একটা অস্বাভাবিক আকুতি ফুটে উঠছে বুঝতে পেরে শ্রীমন্ত নিজেকে সংবরণ করল।

‘পরে ভেবে দেখব, ইলেকশনের আরও তো অনেক রকম বিষয় আছে।’ বিদ্যুৎ ঘোষ সাদামাটা স্বরে প্রসঙ্গটা এড়াতে চাইলেন।

বাইরের দু-জন লোক কথা বলার জন্য টেবলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎ ঘোষ তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, বলুন? বসুন।’

শ্রীমন্ত উঠে দাঁড়াল। চেয়ার দখল করে বসে থাকার আর উপায় নেই। ‘বিদ্যুৎদা, আজ তাহলে আসি…একটা ছবি দিয়ে যাব কি? যদি জায়গা-টায়গা হয়-।’

‘দিয়ে যেতে পার, বেরোবে কিনা বলতে পারছি না।’

শ্রীমন্ত সমাচার অফিস থেকে বেরিয়ে বাসের দরজায় ভিড়ের চেহারা দেখে সেন্ট্রাল অ্যাভিনু ধরে হেঁটে বাড়ি রওনা হল। প্রথমে সে খুবই বিরক্ত বোধ করল পথের অবস্থায়। ফুটপাত ভাঙাচোরা গর্তে ভরাই শুধু নয়, দোকান পেতে চৌকি, উনুন, ঝুড়ি, বেঞ্চি দিয়ে চলাচলে আরও অসুবিধা তৈরি করেছে। দু-বছর আগে মেট্রো রেলের জন্য খোঁড়া রাস্তার মাঝখান দিয়ে খালের মতো যে বিশাল গহ্বর সে দেখেছিল আজও তা ঠিক একই রকম রয়েছে। কবে বৃষ্টি হয়েছিল, তারই জমা জলে সবুজাভ রং ধরেছে।

হাঁটতে হাঁটতে বিরক্তিটা সয়ে গেল বিদ্যুৎ ঘোষের কথাগুলো মনে পড়তে শুরু করায়। শুধু ভালোই লাগছিল নয়, একুশ মাস যে পরিবারের প্রধান আয় বন্ধ তারা ভিক্ষা না করে বেঁচে আছে কী করে এটাই তাকে অবাক করছিল, এখন আবার করতে শুরু করল। অসীমাকে দেখে, তার কথার, আচরণের ডাঁটালো ভাব থেকে একটুও বোঝার উপায় নেই কী অসম্ভব কষ্টের জীবন তাকে কাটাতে হচ্ছে। অভাবের মালিন্য ওকে স্পর্শ করেনি। বিদ্যুৎদা যখন ওর লেখার গুণগান করছিলেন কেন জানি তখন তার বুকের মধ্যে সুখের একটা কম্পন সে অনুভব করছিল।

স্কুলে পড়ার সময় শ্রীমন্তর বাসনা হয়েছিল খবরের কাগজের রিপোর্টার হবার। তার ক্লাসের বন্ধু বারিদের বড়দা বিদ্যুৎ ঘোষকে দেখেই সাধটা জেগেছিল। ওদের বাড়িতে তখন তার যাতায়াত ছিল। সমাচারের সাপ্তাহিক ছোটোদের বিভাগে ‘কুঁড়ি’-র পাতায় তার চারটি গল্প ছাপা হয়, অবশ্যই বিদ্যুৎদার সুপারিশে। কাগজ থেকে সেগুলো কেটে সে একটা খামে ভরে রেখে ছিল। এখনও আছে কি?

পুরোনো অনেক জিনিসই নেই। সাত-আট মাস আগে বাড়িতে তন্নতন্ন খুঁজে শ্রীমন্ত তার বাবার গাওয়া রেকর্ড দুটোর হদিশ পায়নি। গানের কথাগুলো তার মনে নেই। একটার প্রথম লাইন শুধু এখনও মনে আছে : ‘ফিরে কেন ডাকলে আমায় দুয়ার হতে’। গ্রামোফোন ছিল, একগাদা রেকর্ডও ছিল। মাঝে মাঝে বাবা বাজাতেন, কিন্তু নিজের গানের রেকর্ড দুটো বাদ দিয়ে। ‘দুর, ও গান শোনার মতো নয়, বরং শচীনদেবের এই গানটা শোন।’ রেকর্ডগুলো শ্রীমন্তই বিক্রি করে দিয়েছিল সত্তর টাকায় শুধু বাবার দুটো তুলে রেখে। গ্রামোফোনটার জন্য খদ্দের পায়নি।

দিপুর পাশের পাশের ঘরের মাসিমা নাকি বাবাকে গান গাইতে শুনেছেন। শ্রীমন্তর চেনাজানাদের মধ্যে অনেকেই শুনেছে কিন্তু একজন অচেনাকে সে এই প্রথম পেল। আধুনিক গানের জগতে বাবা কী পর্যায়ের গাইয়ে ছিলেন সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। শেষ জীবনটা এমন মর্মান্তিকভাবে না কাটালে হয়তো বাবার সম্পর্কে সে আগ্রহ রাখতে পারত। ওঁর মৃত্যু, খোলাখুলিভাবেই তারা সবাই কামনা করত।

দিপুর ব্যাপারটা নিয়ে বাড়ির কারোর সঙ্গে কথা হয়নি। কিন্তু কী কথাই বা আর এখন বলার আছে? যা হবার হয়ে গেছে এখন মেনে নাও, এইটাই তাকে বলতে হবে। তবে জয়ন্তর ভীষণ লজ্জা, রাগ, দুঃখ, ছোটো জাত এক মিনিবাস কনডাকটরের বউ দিপু সিঁদুর মাথায় পাড়া দিয়ে হাঁটবে আর সেটা কিনা তাকে দেখতে হবে! ওর দাবি, দিপু পাড়া ছেড়ে অন্য কোথাও যাক। কিন্তু দিপু যাবে না।

শেষকালে জয়ন্তই যদি বংশমহিমা রক্ষার জন্য অন্য কোথাও চলে যায়! শ্রীমন্ত বিব্রত বোধ করল। এই ভাইটার উপরই তার যা কিছু ভবিষ্যতের ভরসা। নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে একদিন সংসারের হাল ধরায় জয়ন্ত তাকে সাহায্য করবে, এটাই সে ধরে রেখেছে। দিপুর ব্যাপারে বিগড়ে যেতে দিলে সংসারের প্রতি ওর টানটা নিশ্চয় ঢিলে হয়ে যাবে।

চিন্তা মাথায় নিয়েই শ্রীমন্ত বাড়িতে ঢুকল। সদরে দেখা হল ছোটো ঠাকুরদার তরফের ঘুনুকাকার সঙ্গে। মেপে কথা বলেন। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি আর মাথাজোড়া টাক। হাইকোর্টে রেজিস্ট্রারের অফিসে চাকরি করেন। দোতলায় সামনের অংশের মালিক।

‘শ্রীমন্ত, বাড়ির ট্যাক্সের ব্যাপারটা তো মুশকিলে ফেলল। শুনেছিস বোধ হয়, পটল আর বাসুদা বলেছে, ওদের অংশ ছোটো আর পেছন দিকে, ওরা কেন সামনের অংশের সমান ট্যাক্স দেবে! পার্টিশান না করলে এর তো কোনো সুরাহা হবে না।’ ঘুনুকাকা যেন জটিল একটা সম্পাদ্যের সম্মুখীন হয়েছেন এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন।

‘এসব কথা তো আজ দু-বছর ধরেই শুনে আসছি। এই নিয়ে ঝগড়াঝাঁটিও হয়েছে। আমিও তো বলে ছিলাম বাড়ি পার্টিশান না করলে এই সমস্যা মিটবে না। যে যার নিজের পোরশানের ট্যাক্স দিক, মেরামত করুক, ইলেকট্রিকের কী জলের লাইন আনাক, কোনো ঝামেলা থাকবে না।’

‘পটল কী বাসুদার কাছে তুই কথাটা পেড়ে দ্যাখ না, আমি তো রাজিই।’ ঘুনুকাকা বাড়ির ভিতরে যাবার জন্য পা বাড়ালেন। শ্রীমন্ত বাড়াল না। ঘুনুকাকা আশা করেছিলেন শ্রীমন্তও তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে অন্তত সিঁড়ি পর্যন্ত যাবে। তা না হওয়ায় তিনি সামান্য আহত বোধ করেও থমকে গিয়ে বললেন, ‘কিন্তু আর কেউ কী রাজি হবে? পার্টিশান হলেই একটা খরচের মধ্যে পড়তে হবে, সবার কী সে ক্ষমতা আছে?’

শ্রীমন্ত জানে বেশিরভাগেরই নেই, এমনকী তার নিজেরও নেই। তাই সে ঘুনুকাকার প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘সবাইকে আপনিই বলুন, একদিন বসে এই নিয়ে কথা বলার জন্য। কার কী বক্তব্য সবাই সেটা সবার সামনেই জানাক। মেজরিটি যদি পার্টিশানের পক্ষে মত দেয় তাহলে পার্টিশান হবে। খরচ বইবার ক্ষমতা যার নেই তারটা অন্যেরা শেয়ার করে দিয়ে দেবে।’

সে জানে অন্যের খরচের দায় ভাগ করে নেবার জন্য এই বাড়ির একজনও রাজি হবে না। বাড়ির সেরা, সুবিধার অংশটা এই ঘুনুকাকার। ওঁরই আগ্রহ বেশি কিন্তু টাকা খরচ করতে চান না। অথচ ওঁরই অবস্থা সবার থেকে ভালো। সে জানে এই বাড়ির কোনোদিনই পার্টিশান হবে না, ছুতোনাতায় ঝগড়া বেধে যাওয়াটা বরং বাড়বে আর এরই মধ্যে তাকে আজীবন বাস করতে হবে।

‘এসব বুদ্ধি তোর মাথায় কে ঢোকাল?…অন্যেরা শেয়ার করে দিয়ে দেবে? কেন দেবে? তুই কল-পায়খানা করবি, সিঁড়ি বানাবি আর খরচ দেব আমি?’

‘হ্যাঁ দেবেন যদি নির্ঝঞ্ঝাটে থাকতে চান।’ শ্রীমন্ত গলাটা একটু কঠিন করেই বলল।

‘হ্যাঁ দেবেন!’ ঘুনুকাকা চ্যালেঞ্জের চাহনি এনে চোখ দুটি বিস্ফারিত করলেন। ভাবখানা, এতবড়ো কথা তার মুখের উপর বলার সাহস দেখাল! ‘না দিলে ঝঞ্ঝাট হবে?…তুইও কী বাপের মতো পাগল হলি?’

কথাটা শোনামাত্র শ্রীমন্তর মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। সে এগিয়ে ঘুনুকাকার মুখের কাছে মুখ এনে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘বাবা পাগল ছিল, কিন্তু আপনার তো কোনো ক্ষতি করেনি।’

‘না করেনি, শুধু ন্যাংটো হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়ে আমাদের বাড়িটাকে হাসির বস্তু করে দিয়ে গেছে যেমন আবার করল তোর বোন!…তোদের ফ্যামিলিটা যে কী নুইসেন্স-‘

কথা শেষ হবার আগেই শ্রীমন্ত তার গলায় ধাক্কা দিয়ে পিছনে ঠেলে দিল। ঘুনুকাকা উলটে পড়ে গিয়েই তারস্বরে ছেলেদের নাম ধরে চেঁচাতে শুরু করলেন।

‘ওরে অনু, ওরে শঙ্কু, আমায় মেরে ফেললে রে…শিগগিরি আয়, আয় ওরে শিগগিরি আয়-।’

দুই যুবক ছেলে দোতলা থেকে হুড়মুড় করে নেমে এল। একজনের হাতে দু-হাত লম্বা একটা জলের পাইপ। ওরা বাবাকে মেঝেয় পড়ে থাকতে দেখেই শ্রীমন্তর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে বাড়ির কয়েকজন ছুটে এসে ওদের মাঝে দাঁড়িয়ে হাতাহাতিটা বন্ধ করল। শ্রীমন্তর মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল, একজন তাকে টেনে নিয়ে গেল পাড়ার এক ডাক্তারের কাছে।

অন্ধকার ঘরে বিছানায় মা-র পাশে শুয়ে ঘটনাটার কথা ভাবতে ভাবতে শ্রীমন্ত নিজের সম্পর্কে একটা ভয় পাওয়ার মতো ধারণায় পৌঁছল। উসকানি যতই থাক তার এমনভাবে নাড়া খেয়ে ওঠাটা উচিত হয়নি। ফ্যামিলিটা নুইসেন্স, দুটি মাত্র শব্দ যে তাকে এইভাবে ক্ষেপিয়ে দিতে পারে, এটাই তার আবিষ্কার। খুবই প্রখর একটা আবেগ সংসারকে ঘিরে তার মধ্যে টলমলে অবস্থায় রয়েছে, সেটা ভালো না খারাপ তাই নিয়ে চিন্তা সে করছে না, তবে একটা ব্যাপার সে বুঝে ফেলেছে, মা, বোন, ভাইয়েরা অর্থাৎ সংসারটাকে হৃদয়ের অত্যন্ত কাছাকাছি এনে ফেলে সে আবেগটাকে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। অল্প বয়সেই পাঁচটি মানুষকে রক্ষার দায়িত্ব পেয়ে আর এখনও পর্যন্ত তাতে সফল হয়ে এটাকেই সে তার জীবনের অন্য ব্যর্থতাগুলো ঢাকনা হিসাবে হয়তো ব্যবহার করছে। কিছুটা দূরত্ব রেখে সংসারের সঙ্গে চলাই ভালো। যদি চলত, তাহলে সারা পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে যাওয়া এই ঘটনাটা ঘটত না। ঘুনুকাকাকে সে জন্ম থেকেই দেখছে, যদিও আত্মীয়, একই বাড়িতে বাস কিন্তু তাদের সঙ্গে সদভাব একদমই নেই তবু প্রতি বিজয়ায় প্রণাম করতে যায়, মুখোমুখি হলে ঠোঁটে হাসিও ফোটায়। লোকটা নিকৃষ্ট ধরনের, তবু ওর সঙ্গে এমন রূঢ় ব্যবহার করাকে কোনোভাবেই সে সায় দিতে পারছে না।

সাতটা সেলাই নিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা মাথাটাকে শ্রীমন্ত দু-পাশে নাড়াতেই সুচ বেঁধার মতো তীক্ষ্ন যন্ত্রণা পেল। কাতর শব্দ শুনে সুপ্রভা বললেন, ‘কষ্ট হচ্ছে?’

‘না।…ভাবছি। আজ সারাদিনটা কী ভাবেই না কাটল।’

সুপ্রভা চুপ করে রইলেন।

‘খুদিনগর থেকে আসার সময় দিপুর কাছে গেছলাম।’

শ্রীমন্ত অনুভব করল তার মা মুহূর্তে টানটান হয়ে উঠল। স্বাভাবিকই। এবার সে প্রশ্নের অপেক্ষায় রইল। দীর্ঘ একটা মিনিট ঘরটা বাকশূন্য রইল।

‘মা, একটা কথা বলব?…তোমরা এটা মেনে নাও। তোমাদের আপত্তিগুলো এখন আর চলে না। এই দ্যাখো না, আজ এ বাড়িতে যা হল, এটা কী আমাদের বংশে, যা আমাদের মর্যাদা, সম্মান ছিল, তাতে কী এই সব হওয়ার কথা? কিন্তু হচ্ছে, আরও হবে।…আমরা অতীতের ছায়ার আওতায়ই রয়ে গেছি…দিপুই প্রথম রোদ্দুরে বেরোল।…এবার ওকে একটা ছাতা দাও।’

শ্রীমন্ত শুনতে পাচ্ছে ঠোঁট চেপে মা-র কান্না। সে হাত বাড়িয়ে সুপ্রভার কাঁধটা পেল। কোনো সান্ত্বনা দিল না।

‘ভাইয়েদের বল।’

‘বলব।’

সকালে শ্রীমন্ত ডাকল বসন্তকে। বালিশে হেলান দিয়ে সে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘বোস।’

বসন্ত খাটের কিনারে বসল। মুখ পাংশু।

‘দিপুর বিয়ে দেব বলে সব ভাইয়ের কাছে কিছু কিছু টাকা চাইব ঠিক করেছিলাম, তা দিপু তো তোমাদের রেহাই দিয়েছে। কিন্তু আমি তো রেহাই দিতে পারব না।’ শ্রীমন্ত প্রথমেই একটা চাপ ওর ঘাড়ে তুলে দিয়ে প্রতিরোধটা দুমড়ে দেবার পন্থা নিল।

‘চেষ্টা তো করছি। আর্ম পুলিশে তোমার চেনাজানা কেউ আছে? বিজ্ঞাপন দিয়েছে রিক্রুটমেন্টের।’

‘দরখাস্ত করেছিস?’ শ্রীমন্তর মনে হল, বসন্ত তাকে মিথ্যা কথা বলে বেপথে নিয়ে যেতে চাইবে।

‘না।’

‘না করেই চেনাজানার কথা বলছিস? তোর বুকের ছাতি কত? হাইট, ওজন কত?’

‘মুরুব্বি থাকলে সব ম্যানেজ হয়ে যায়।’

‘যায় বুঝি! আচ্ছা তাহলে দরখাস্ত একটা কর, আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি চেনা কেউ আছে কিনা।’

কথাবার্তা শেষ ধরে নিয়ে বসন্ত উঠে দাঁড়াল।

‘দাঁড়া। সামনের মাস থেকে অনন্ত আর তুই দুশোটা করে টাকা মাকে দিবি। এতকাল আমি টেনে এসেছি আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ শ্রীমন্ত তীক্ষ্ন চোখে ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইল।

‘কিন্তু আমি তো চেষ্টা…।’

‘আর শোন, দিপুর বর শ্যামলকে তো চিনিস?’

বসন্ত মাথা নেড়ে বোঝাল, চেনে।

‘ওর সঙ্গে লেগে থাক। রোজগারের একটা কিছু রাস্তা তোকে বাতলে দিতে পারবে। শিলিগুড়ি গেছে ফিরেছে কিনা খোঁজ নে।’

‘কে, শ্যামল গেছে?’

বসন্তর গলার স্বর থেকে শ্রীমন্ত বুঝল, ওর প্রশ্নটা হল, তুমি সেটা জানলে কী করে?

‘হ্যাঁ, শ্যামল গেছে। দিপুর সঙ্গে কাল আমি ওর বাড়িতে গিয়ে দেখা করেছি।’

প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য শ্রীমন্ত তাকালও না। জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুধু বলল, ‘বসে বসে খাওয়ার লজ্জা থেকে বেরোবার চেষ্টা কর।’

দুপুরে অনন্তকে আর ডাকতে হল না। সেই নিজেই এসে খাটের কিনারে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বড়দা একবার তুমি রাতেও আমাকে বললে না? আমি তো ভাবলুম ঘর অন্ধকার করে শুয়ে পড়েছ। মা-ও যদি তখন বলত তাহলে ওই অনু আর শঙ্কুকে তখনই ঘর থেকে টেনে বার করে হাত দুটো ভেঙে দিতুম।’

‘ব্যস, শুধুই হাত?’ শ্রীমন্ত বিদ্রুপটা একটু বেশি করেই গলায় ঢালল যাতে অনন্ত সেটা বুঝতে পারে। ওর থতমত হওয়া থেকে বুঝল, বুঝেছে।

‘ওদের দু-জনের হাত থেকে দেবার মতো গায়ের জোর আমার ছিল, এখনও আছে। কিন্তু আসল অপমানটা তো অন্য জায়গায়। ঘুনুকাকা আমাদের বাবা আর বোনকে ঠেস দিয়ে আমাদের ফ্যামিলিকে নুইসেন্স বলেছে…এর শোধ নেব। তুই দিপু আর শ্যামলকে নেমন্তন্ন করে আসবি। ওরা দু-জন এই বাড়িতে ভাত খাবে।’

অনন্ত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল প্রথমে। তারপর ধাতস্থ হয়ে বলল, ‘ওদের নেমন্তন্ন করে আনব!’

‘হ্যাঁ। তার আগে একটা সোনার আংটি কিনে মাকে দিতে হবে, জামাইকে দেবার জন্য।… তোর যদি এতে আপত্তি থাকে তো বল, তাহলে আমি নিজেই যাব।’

দরজার কাছে জয়ন্ত এসে দাঁড়িয়েছিল, শ্রীমন্ত তা লক্ষ করেনি। তাকে ঘরে ঢুকতে দেখে সে বলল, ‘আয়, কথা আছে।’

‘দিপুদের ডেকে আনার কথা তো? আন, আমি আর কী বলব।’ নিস্পৃহ শুকনো স্বরে জয়ন্ত বলল। ওর অনুমোদন নেই বুঝতে ঘরের কারোরই অসুবিধা হল না।

জয়ন্ত বেরিয়ে যাচ্ছিল, শ্রীমন্ত ডাকল।

‘তোর আপত্তির কারণ আমি জানি, তুইই বলেছিস।’ শ্রীমন্ত দুই ভাইয়ের এবং মায়ের উপর একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘আমার এই ব্যান্ডেজটার কারণ যারা, তারা এই বাড়িরই লোক। এদের সঙ্গে ছোটো জাত, অশিক্ষিত, একটা মিনিবাস কনডাকটরের পার্থক্য কতখানি, সেটা কী কেউ আমায় বুঝিয়ে বলবে?’

‘আমি তো বলেইছি, ওদের ডেকে আনতে ইচ্ছে হয় তো আন।’ জয়ন্তের গলায় আগেরই স্বর এবং তাতে যোগ হয়েছে অল্প একগুঁয়ে কাঠিন্য।

‘দশ বছর ধরে টাকা রোজগারের জন্য যেসব কাজ আমায় করে যেতে হয়েছে, তার খবর তোমরা রাখ না। শুধু আমিই জানি সেসব কাজের জন্য কত নোংরা লোকের কাছে কতটা নীচু আমাকে হতে হয়েছে। সেই কাজ করে পাওয়া টাকায় এই সংসারের লোকেরা ভাত খেয়েছে। আমার মনে হয় দিপুর কাজ নিয়ে আপত্তি তোলার অধিকার আমাদের কারোরই নেই।’

‘বড়দা, ভাত খাওয়ার কথাই যদি বলো, তাহলে বলতে হয় পৃথিবীতে কোনো ভাতই পরিচ্ছন্ন নয়, শুধু উপোস করে থাকলে তবেই নিজেকে গ্লানির হাত থেকে বাঁচানো যায়। ভাত খাওয়ার খোঁটাটা এভাবে না দিলেই পারতে।’ জয়ন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ছে দেখে শ্রীমন্ত অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করল। কথাটা এইভাবে বলা ঠিক হয়নি।

‘এটা খোঁটা নয় জয়ন্ত, তোর আপত্তিতে যে যুক্তি নেই সেটাই বোঝাবার চেষ্টা করেছি। যাই হোক, তর্ক করে এসব বিষয়ে মত বদলানো যায় না, এসব রক্তের মধ্যে থাকে। আত্মসম্মান বোধ যে যেরকমভাবে দেখে সেইভাবে সে গ্রহণ করে। আমি তোকে কম্প্রোমাইজ করতে বলব না, শুধু বলব ভুলভাবে তুই এটা দেখছিস। তুই লেখাপড়া করছিস ভালো একটা চাকরি পাবার জন্য কী ব্যাবসা করার জন্য। ধর, তোর উপরওয়ালা যদি হয় শ্যামলের কোনো কাকা বা দাদা তাহলে তুই উঁচু ঘর, উঁচু জাত বলে তাকে দেখে কি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াবি না?’

জয়ন্তর মুখটা শ্রীমন্তর কথাগুলো শুনতে শুনতে কর্কশ হয়ে উঠছিল। ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে এনে সে বলল, ‘এতসব যুক্তির দরকার নেই, আমার যা বলার তা বলে দিয়েছি।’ কথাটা বলেই আচমকা সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

শ্রীমন্তর মনে হল জয়ন্ত যেন এই সংসার থেকেই বেরিয়ে গেল। সে এবার অনন্তর মুখের দিকে তাকাল। নির্বোধের মতো মুখ। যে ভাইয়ের কাছে খাওয়া পরা জুটবে তাকেই মান্য করবে। ওকে নিয়ে সমস্যা হবে না।

‘এখন থাক। আমি একটু ভেবে দেখি। আর শোন, ঘুনুকাকাদের সঙ্গে কোনোরকম ঝামেলা করিস না।’

মাথায় একটা দপদপ যন্ত্রণা হচ্ছিল। শ্রীমন্ত সারাদিন শুয়েই কাটাল। সুপ্রভা একসময় তাকে চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হ্যাঁরে দিপুকে আনবি বললি, ওসব কি তোর মনের কথা?’

‘হ্যাঁ, মনেরই কথা। দ্যাখো মা, কতকাল আর আমি এই সংসার একা একা টানব? ভাইয়েরা এবার পাশে এসে দাঁড়াক! ওদের মানসিকতা না বদলালে ওরা দাঁড়াতে পারবে না, সেজন্য ধাক্কা দেওয়া দরকার। বড্ড আলসে, বড্ড কুঁড়ে হয়ে গেছে, সেজন্যই দিপুর ব্যাপারটা দিয়ে শুরু করলাম। দিপু খুব তাজা মেয়ে…ওকে নিয়ে তুমি ভেবো না।’

তিনদিন বাড়িতে কাটিয়ে শ্রীমন্ত খুদিনগর বাজারে সকাল আটটায় বাসস্টপে যখন নামল তখন সে ঘুণাক্ষরেও জানত না মামার বাড়ি গিয়ে কী পরিস্থিতির সামনে পড়বে।

বৈঠকখানায় কিছু লোক বসে, এটা সে রাস্তা থেকেই দেখে নিয়ে, সদর দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা অন্দরে যাবার জন্য ডানদিকের দরজায় এগোল। এখন নানান ধরনের উমেদার, স্তাবক, পরামর্শদাতা এবং সত্যিকারের কাজ নিয়ে আসা লোকেরা ব্রজরাখালের সঙ্গে দেখা করতে আসে। গুরুত্ব বুঝে ভিতরের অফিসঘরে কাউকে কাউকে নিয়ে গিয়ে সে কথা বলে।

শ্রীমন্ত ভিতরের দালানে ঢুকেই দেখল ট্রে হাতে ব্রজরাখালের অফিসঘর থেকে বেরিয়ে আসছে বিজয়। তাকে দেখে বিজয় দ্রুত এগিয়ে এসে চাপাস্বরে বলল, ‘একদিনের জন্য থাকবে বলে তিনদিন কাটিয়ে এলে? এদিকে কী কাণ্ড হয়েছে জান? …মামাবাবুকে নার্সিং হোমে ভরতি করানো হয়েছে, খুব খারাপ অবস্থা!’

‘কবে? কী হয়েছে অকাদাদুর?’ শ্রীমন্তর মাথায় একঝলক রক্ত উঠে এল। ঝুলে গেল দুটো হাত।

‘তুমি যেদিন চলে গেলে সেদিন বিকেলেই ডাক্তার আনতে হল…পেচ্ছাব বন্ধ হয়ে গেছল, চারদিন ধরে হচ্ছিল না। …এত বয়স পর্যন্ত রোগভোগ যে এতদিন হয়নি এটাই আশ্চর্যের।’

শ্রীমন্ত অকাদাদুর ঘরের দরজাটা বন্ধ দেখল। এই সময় খোলা দরজায় পর্দাটা টানা থাকে। এ ছাড়া অন্য দিনের মতোই বাড়িটাকে মনে হচ্ছে। দোতলায় রেডিয়ো খোলা, বাউল গান ভেসে আসছে। মাসিমা তার নাতিকে চেঁচিয়ে বকলেন।

‘কোন নার্সিং হোমে গেছেন? … কেমন আছেন?’

‘কলকাতায়, খুব বড়ো নার্সিং হোম, দিনে দুশো টাকা শুধু থাকারই ভাড়া, ডাক্তারবাবু ওখানেই ভরতি করাতে বললেন।’

‘কে ডাক্তারবাবু?’

‘নাম জানি না, চিনিও না। যে মেয়েটি মামাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল কাগজের আপিস থেকে সেই তো ফোন করে ডেকে আনল ডাক্তার…আরে তখন তো বাড়িতে কেউ ছিলই না। না বড়োবাবু, না একটা ব্যাটাছেলে।’

শ্রীমন্ত আর কথা না বলে ছুটে গেল ব্রজরাখালের অফিসঘরের দিকে, দরজা ভেজানো হয়েছে। তার মানে গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা চলছে। চলুক, এটাও গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে।

মাঝবয়সি দুটি লোক টেবলের এ ধারে। শ্রীমন্ত তাদের চেনে। গতবারের ইলেকশনে এই কিশোরী জোয়ারদার আর মনু ঘোষ ছিল ব্রজরাখালের দুটি বিশ্বস্ত হাত। ইলেকশনের পোলিং এজেন্ট ভাড়া করা থেকে শুরু করে বিজয় মিছিলের মাইক্রোফোন ভাড়া করার মধ্যে যত খুঁটিনাটি কাজ থাকতে পারে, সবই এরা দু-জন করেছিল।

শ্রীমন্ত ঘরে ঢোকামাত্রই ব্রজরাখাল কথা বন্ধ করে তাকালেন। যেন গাড়ি থামাচ্ছে এমন ভঙ্গিতে হাত তুলে বললেন, ‘পরে…পরে আসিস।’

এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে না এসে উপায় নেই। কিন্তু কতক্ষণ সে অপেক্ষা করবে? অকাদাদুর খবর জানতে শ্রীমন্ত এত ব্যস্ত হল যে, কদাচিৎ যেটা সে করেছে তাই করল, দোতলায় উঠে এল।

লম্বা দালানটা তখন জল-ন্যাতা দিয়ে রেবা মুছছে। শ্রীমন্তকে দেখেই বলল, ‘দাদুর খবর শুনেছেন?’

‘হ্যাঁ, দিদিমা কোথায়?’

‘রান্নাঘরের দিকে দেখুন।’

দোতলায় শ্রীমন্ত আসে না, যেহেতু দরকার হয় না। মামারবাড়ির লোকেদের থেকে সে নিজেকে যতটা সম্ভব বিচ্ছিন্নই রাখে। এরাও তাকে নিজেদের একজন হিসেবে কাছে টেনে নেয়নি। দিদিমা সুরুচি কালেভদ্রে নীচে নামেন শুধু তাঁর দাদার সঙ্গে কথা বলতে তখন যদি দেখা হয়ে যায় সুপ্রভার খোঁজখবর তার কাছে নেন। শ্রীমন্ত প্রতিবারই জানায়, ভালোই আছে। একটা ব্যাপার সে বোঝে না, এত ধনসম্পত্তি, বিত্ত যাদের রয়েছে তারা কেন বাড়ির গরিব মেয়েকে নিয়মিত সাহায্য করে না। এমনকী কোনো উৎসব অনুষ্ঠানেও ডাকে না, একখানা কাপড়ও দেয় না। তাকে এই বাড়িতে থাকতে দেওয়া হয়েছে যেন কর্মচারী হিসাবেই, তার দৌহিত্র বা ভাগনে পরিচয়টা এদের বিড়ম্বিত করে।

দোতলার পিছন দিকে রান্নার আর ভাঁড়ার ঘর। তার লাগোয়া ছোটো একটা টালির চালায় ঢাকা ছাদ। সেখানে একটা কাঠের চেয়ারে সুরুচি বসে ছিলেন। ঝি আনাজ কুটছে। শ্রীমন্ত কাছে এসে দাঁড়াল। সুরুচিই প্রথম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখন এলি?’

‘হ্যাঁ, দাদুর কী হয়েছে?’

‘পেচ্ছাব হচ্ছিল না। চাপা লোক তো, সহ্যশক্তিও তেমনি, কাউকে কিছু বলেনওনি। একবার যদি আমাদের বলতেনও তাহলে তো কত আগেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারতুম। বাইরের একটা মেয়ে এসে…হ্যাঁ রে মেয়েটা কে রে?’ সুরুচির অনুযোগ একটু উত্তেজিত কণ্ঠেই প্রকাশ পেল।

‘মেয়ে! আমি ঠিক বুঝতে পারছি না! …এইমাত্র তো এলাম।’ শ্রীমন্তকে আকাশ থেকে পড়ার মতো দেখাল। অবশ্য সে বিজয়ের কথাতেই বুঝে গেছল মেয়েটি অসীমা আর সত্যি সত্যিই তখন অবাক হয়েছিল। খবর পেয়ে অসীমা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসবে! এত কৌতূহল অকাদাদু সম্পর্কে!

‘যে মেয়েটাকে তুই আসতে বলেছিলি দাদার সঙ্গে দেখা করার জন্য।… কথাবার্তা কেমন ধারা যেন, বলে কিনা চার দিন ধরে অসুস্থ অথচ কেউ খোঁজ রাখেনি? এই সব লোককে তুই আসতে বলিস এ বাড়িতে?’

শ্রীমন্ত চুপসে গেল দিদিমার বিরক্তি ভরা ধমকে। কৈফিয়ত দেবার মতো সুরে বলল, ‘আমি কী করে জানব ওর কথাবার্তা কেমন, ওকে কী আমি ভালো চিনি? সমাচার কাগজের থেকে এসেছে, দাদুর ইন্টারভিউ চেয়েছিল তাই আসতে বলেছিলাম। …দাদু আছে কেমন?’

‘ক্যাথিটার দিয়ে পেচ্ছাব করিয়েছে। তবে ডাক্তার বলেছে দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে।… গাদা গাদা ওষুধের বড়ি খেয়ে নিজের সব্বোনাশ নিজেই করেছে তা আমরা আর করব কী?’

‘দুটো কিডনি নষ্ট হলে তো…’ শ্রীমন্ত ভীত স্বরে বলল, ‘কোন নার্সিং হোমে আছে জান?’

‘না, ব্রজ বলতে পারবে। …তবে যখন তখন গেলে দেখা করতে দেয় না। বিকেল চারটে থেকে দু-ঘণ্টা শুধু।’

সুরুচি অতঃপর কুটনো কোটার দিকে মনোনিবেশ করলেন। শ্রীমন্ত মিনিটখানেক চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে পায়ে পায়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, দিদিমার ডাকে ঘুরে দাঁড়াল।

‘দিপু নাকি একটা নীচু জাতের ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে, সত্যি?’

শ্রীমন্ত প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল। আশ্চর্য তো! খুদিনগরে বসে চুয়াত্তর বছরের দিদিমা এ কথা জানল কী করে! কে পৌঁছে দিয়ে গেল? সুরুচিও বুঝতে পেরেছেন ঠিক এই জিজ্ঞাসাটাই নাতির মাথায় এখন ঘুরছে।

‘আমি অনেক খবরই পাই রে। তোদের চেনে জানে এমন লোকও তো এখানে আছে যে ব্রজর কাছে বলে দিয়ে গেছে। বল না কথাটা কি সত্যি?’

‘সত্যি। কিন্তু তাতে হয়েছেটা কী?’

শ্রীমন্ত উদ্ধত ভঙ্গিতে, এবার পালটা প্রশ্ন তুলল। সুরুচি ভ্রূ তুলে নাতির রুক্ষ মুখভাব লক্ষ করে মুখ শক্ত করলেন। ‘ইলেকশনের আগে এসব খবর রটলে ভোটারদের কাছে অনেক নীচু হয়ে যেতে হয়। ব্রজর এলাকাটা গেরস্তদের নিয়ে।’

‘ভোটাররা এসব গ্রাহ্য করে না, তাহলে দাদামশাই ভোটে জিতে এমএলএ হতে পারতেন না।’

‘মিত্তিরের মেয়ে মুখুজ্জেকে বিয়ে করলে তাকে নীচু জাতে করা বলে না। তোর দাদামশাই গুন্ডা বদমায়েশও ছিলেন না।’

শ্রীমন্তর মাথার মধ্যে হঠাৎই দাউ দাউ করে, চেপে রাখা দিশেহারা রাগটা জ্বলে উঠল, যেটা ঘুনুকাকার কথাতেও জ্বলে উঠেছিল।

‘দাদামশাই বিপ্লবী ছিলেন। দেশকে স্বাধীন করার জন্য বোমা পিস্তল নিয়ে নাকি শত্রুদের সাবাড় করতে আত্মগোপন করে থাকতেন। কপর্দকহীন গরিবের ছেলে ছিলেন। মা-র কাছেই এসব শুনেছি, আর…।’ শ্রীমন্ত নিজেকে সামলে নিল। আর একটা কথা বললেই তাকে বিপদের মধ্যে পা বাড়াতে হবে। এখানকার পাট চুকিয়ে ফিরে যাওয়ার কথাটাই তার মনে ঝলসে উঠল।

সুরুচি ঠান্ডা চোখে তাঁর দৌহিত্রের দিকে তাকিয়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে। শুধু ঠোঁট দুটি নাড়িয়ে বললেন, ‘আর…আর কী?’

‘আর কিছু নয়।’

সুরুচির কোনো পরিবর্তন ঘটল না। শুধু স্বরটা একটু নামিয়ে বললেন, ‘দাদা?…কিছু বলেছে?’

‘না।’

‘ঠিক করে বল।’

‘দাদু কখনো তাঁর অতীত নিয়ে কথা বলেন না।’

‘জানি…আচ্ছা আয় এখন।’

অত্যন্ত চিন্তিত এবং ত্রস্ত মনে শ্রীমন্ত নীচে নেমে এল। মামার অফিস ঘরের দরজা এখনও ভেজানো। সে তালা খুলে নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। তার চিন্তাটা আর অকাদাদুকে নিয়ে নয়।

বোকার মতো দিদিমাকে সে চটিয়ে দিল। তবু শেষ মুহূর্তে চুপ করে গিয়ে খানিকটা সামলাতে পেরেছে। তাহলেও ওই ঠান্ডা চাহনিটা খুবই সন্দেহজনক। যেকোনোদিনই মামা তাকে ডেকে বলতে পারে : ‘এবার এখান থেকে বিদেয় হ। তোর মতো লোক আমি টাকা দিয়ে অনেক পাব। …বাবার সম্পর্কে অপমানজনক কথা বলিস কিনা তারই বাড়িতে বসে? আজ তোদের পরিবার খেয়েপরে বেঁচে আছে তারই দয়ায়। মাসে মাসে যে টাকা পাস, সেটা তো আসছে রামরাখাল মুখুজ্জেরই গড়া বিষয় আর ব্যাবসা থেকে। আর তার সম্পর্কেই ব্যঙ্গ করে বলিস, ‘বোমা-পিস্তল নিয়ে নাকি’… ‘নাকি’ মানে? …এখুনি দূর হ।’

‘দাদা ঘুমুচ্ছেন?’

দরজার কাছ থেকে রেবার কুণ্ঠিত গলা শোনা গেল। শ্রীমন্ত মাথাটা সামান্য তুলে বলল, ‘কী দরকার?’

ঘরের মাঝামাঝি এসে রেবা বুকের উপর কাপড় টানল, যদিও দরকার ছিল না।

‘আপনার মাথায় কী হয়েছে?’ রেবার স্বরে একটু উদবেগ।

এ বাড়িতে আজ এই প্রথম একজন তাকে লক্ষ করেছে। শ্রীমন্তর ভালো লাগল। সে পূর্ণ দৃষ্টি রাখল রেবার মুখে। সহানুভূতি মাখানো রয়েছে, মমতা চোখের মণিতে।

‘উপর থেকে একটা সিমেন্টের চাঙড় খসে হঠাৎ মাথায় পড়ল। খুব বেশি কাটেনি…হ্যাঁ আমাদের বাড়িতেই। ছাদটা খুব পুরনো, একশো বছরের উপর বয়স। কিছু বলবে?’ শ্রীমন্ত উঠে বসল।

রেবার হাতে একখণ্ড কাগজ রয়েছে শ্রীমন্ত তা নজর করেনি। সেটা এগিয়ে ধরে কুণ্ঠিত স্বরে সে বলল, ‘এটায় যা যা লিখতে হবে একটু লিখে দেবেন?’

একটা আবেদনপত্র। শ্রীমন্ত চোখ বুলিয়ে বলল, ‘অনাথ আশ্রমে কাকে দেবে?’

‘ছেলেকে। কথা বলে খোঁজটোজ নিয়ে এসেছি।’

‘ছেলেকে? ও অনাথ নাকি? তুমি মা রয়েছ, তাহলে অনাথ কীসে?’

‘ওখানে ছাড়া আর কোথায় রাখব, আমার টাকা কোথায় যে আলাদা কোথাও রেখে মানুষ করব? এখানে থাকলে ও নষ্ট হয়ে যাবে।’

‘এই ফর্মে বলছে, ছেলের বাবা-মা কেউ নেই, কবে, কোথায়, কীভাবে তারা মারা গেছে, দু-জন নিকট আত্মীয়ের নাম-ঠিকানা, কার কাছে এতদিন রয়েছে, তার আয় কত, এইসব লিখে দিতে হবে। কিন্তু তুমি তো বেঁচে আছ!’

‘লিখে দিন মা মরে গেছে, মাসির কাছে রয়েছে। মাসি তিন বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে, আড়াই শো টাকা মাসে রোজগার। মাসি আর এখন সংসার চালাতে পারছে না বলে বোনপোকে আশ্রমে দিতে চাইছে।’

রেবার বলার ধরন থেকে শ্রীমন্ত বুঝল, কথাগুলো আগে থেকেই ভেবেচিন্তে তৈরি করে রাখা।

‘যা বললে তার মধ্যে সত্যি কথা ক-টা?’

‘সবই সত্যি…একটা ছাড়া।’ রেবার হাসি ওর মুখটাকে করুণ করে দিল।

‘নিজেকে মেরে ফেলছ।’

‘ছেলেকে বাঁচাতে গেলে…আপনি জানেন না আমরা যেখানে থাকি সে জায়গাটা কী খারাপ! ওকে লেখাপড়া শেখাতে চাই। এখানে থাকলে ও খারাপ হয়ে যাবে।’

‘তোমার স্বামী কী করত, কীভাবে মারা গেল?’

‘ভ্যান রিশকা চালাত, নেশা করত। চার বছর আগে লরির ধাক্কায় একটা পা গেল। সেটা কেটে বাদ দিতে সেখানে ঘা হল। হাসপাতালে বলল ক্যানসার, বাড়ি নিয়ে যাও। বাড়িতে আসার তিন হপ্তার মধ্যে মরে গেল। ছেলে রমু তখন তিন বছরের।’

‘তারপর থেকে তুমি রোজগেরে নামলে?’

‘ঝিয়ের কাজ একবাড়িতে আগেও কত্তুম, পরে আরও দুটো বাড়ি ধরলুম।’

‘এই কাজ ছাড়াও আর কিছু?’

রেবার মুখ কয়েক মুহূর্তের জন্য বোধরহিত শূন্যতায় ভরে রইল। তারপর সহজভাবে প্রশ্নটাকে নিল। ‘একজন হপ্তায় দু-দিন আসে আমার কাছে, সুপার বাজারে মুদির দোকান আছে। সেই তো এই অনাথ আশ্রমের খবরটা আমায় দিয়েছে।’

‘লোকটা কত দেয় তোমায়?’ শ্রীমন্ত কৌতূহল আর চাপতে পারল না। কিন্তু প্রকাশ করেই বুঝল নিজেকে খেলো করে ফেলেছে কেননা রেবার এতক্ষণের বিড়ম্বিত, সংযত চাহনিতে হঠাৎ চাপল্যের আভা ফুটে উঠল।

‘তা জেনে আপনি কী করবেন?’

‘কী আবার করব।’ শ্রীমন্ত মুখ একটু বেশিই গম্ভীর করল। ঝোলাটা থেকে কলম বার করে ভারি গলায় বলল, ‘যা যা জিজ্ঞেস করছি জবাব দাও।’ ফর্মটা বিছানায় একটা খাতার উপর রেখে সে ঝুঁকে বসল।

‘বাবার নাম?…তোমার স্বামী।’

‘বিনোদচন্দ্র পাইক।’

‘গ্রাম, পোস্ট অফিস, থানা?’

‘গ্রাম আর পোস্টাপিস একই, বড়ো কুরকুরিয়া, থানা কুলতলি।’

দরজার কাছে গলাখাঁকারির শব্দে ওরা দু-জন তাকাল। বিজয় আঙুল দিয়ে ব্রজরাখালের অফিসঘরের দিকে খোঁচা দিয়ে বলল ‘ডাকছে।’

‘পরে লিখে দেব, এখন এটা তোমার কাছেই রাখ।’ শ্রীমন্ত ব্যস্ত হয়ে খাট থেকে নেমে চটির দিকে এগোল। রেবা দরজার কাছে গিয়ে চাপা স্বরে বলল, ‘মাসে আড়াইশো দেয়।’ কথাটা বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেল।

ভেজানো দরজা খোলাই রয়েছে। মামার হাতে সমাচার। উপর থেকে নীচ সরসর করে চোখ ওঠানামা করছে। একটা খবরও পড়ার যোগ্য বলে তার মনে হচ্ছে না।

‘আয়, বোস।’

আর একবার কাগজে চোখ বুলিয়ে ব্রজরাখাল গম্ভীর মুখে শুরু করতে যাবার আগেই শ্রীমন্ত বলল, ‘অকাদাদুর অবস্থা কেমন? দেখতে যাব, আছেন কোথায়?’

‘ভালোই আছেন।’ ব্রজরাখাল সহজ নিরুদবিগ্ন গলায় দুটি শব্দেই বুঝিয়ে দিলেন অক্ষয়ধন মিত্র বিষয়ে কথাবার্তা এখন চলবে না। ‘কিশোরী আর মনুর কাছ থেকে কতকগুলো খবর পেলাম। পার্টি থেকে এবারও বিমল চক্রবর্তীকে চেয়ারম্যানের জন্য ক্যান্ডিডেট করবে না, আমাকেই আবার করবে। তাইতে বিমল পার্টি ছাড়বে কিনা সেটা পরে পরিস্থিতি বুঝে ঠিক করবে। আমার মনে হচ্ছে, শোধ নেবার জন্য ও বামফ্রন্টকে ডোবাবে। তার মানে, আগের বারের মতোই আমাকে চেয়ারম্যান হতে দেবে না। তিনটে কমিশনার তিনটে ভোট ওর হাতে।’

শ্রীমন্ত মামার মুখের দিকে তাকিয়ে নীরব রইল। এখন তার কথা বলার দরকার নেই। তার মাথায় এখন অকাদাদু। চোখে ভেসে উঠছে শেষবার তাকে দেখার ছবিটা… সেই তাকানো, সেই দরজা বন্ধ করে দেওয়া।

‘এইবার যে কাজটা সেটা কিশোরীদের কাছে একদম গোপন রেখে করতে হবে। মনে আছে তুই সেদিন কী বলেছিলি? রিয়েল পলিটিসিয়ানের মতো এবার কাজ করতে হবে। …বিমল চক্রবর্তীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতে হবে। হ্যাঁ ওর প্রাপ্য ওকে তো দিতেই হবে। ব্যাবসা করি, এটা আমি মানি।…আট বিঘে জমি চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। বহু বহু লাখ টাকা ওর দাম। আমারই জমি অথচ আমার তাঁবে নয়, আমি মালিক নই! এর থেকে অন্যায় অন্যায্য ব্যাপার আর হতে পারে?’ ব্রজরাখাল চেঁচিয়ে উঠে হাতের কাগজটা টেবল-এ ছুড়ে ফেললেন। রাগে জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে।

‘দুটো কিডনিই নাকি নষ্ট হয়ে গেছে?’

ব্রজরাখালের ক্ষোভ ভেদ করে প্রশ্নটা ঢুকতে সময় লাগল। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘রাখ তো তোর কিডনি। নষ্ট হয়ে গেছে তো আমি কী করব? ডাক্তার বলেছে এখন থেকে ডায়ালিসিসের উপরই রাখতে হবে, তাই করে যতদিন বাঁচিয়ে রাখা যায়।’

‘আমি ওঁকে দেখতে যাব। কোথায় আছেন?’

‘সান ফ্লাওয়ারে, পার্ক সার্কাস ট্রাম ডিপোর কাছে। তোর ওই রিপোর্টার মেয়েটা, কী যেন নাম, ওরই চেনা স্পেশালিস্ট ডাক্তারকে কল দিয়ে আনিয়েছিল, খুব কাজের মেয়ে। …কাগজগুলো দেখেছিস রজতজয়ন্তীর রিপোর্ট?’

‘না। মাথায় এই চোটটা পেলাম, সিলিং থেকে টালি খুলে পড়েছিল। কিছু পড়া টড়ার মতো মাথার অবস্থা এই ক-দিন আর ছিল না।’ শ্রীমন্ত আশা করছে না, তার মাথার চোট নিয়ে মামা ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। তবু যদি তার সুস্থতা বিষয়ে উদবেগ দেখান তাহলে কী কী বলবে সেটাও সে তৈরি করে রেখেছে। শুধু তার একটাই অস্বস্তি, দিপুর বিয়ের কথারই যে সূত্র থেকে মামা জেনেছেন সেখান থেকেই হয়তো মাথা ফাটার আসল কারণটাও জেনে যাবেন।

সমাচার তো আমার সম্পর্কে কিছুই লেখেনি, শুধু অক্ষয়ধন মিত্রেরই কথা। বিপ্লব মানে জাগরণ, এই নিয়েই ফলাও করে লেখা, এটা কী মিটিং-এর রিপোর্ট? পরিবেশ দূষণ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে হবে, রাজনীতিকরা দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে…আরও কীসব হাবিজাবিতে ভরা, আসল জিনিসটাই রিপোর্টে নেই? আমার কথা বাদ দাও, আরও তো অনেক ডিগনিটারিজ বক্তৃতা দিয়েছে তাদের উল্লেখও তো দু-চার লাইন থাকবে!… ওই মেয়েটাই তো লিখেছে?…ঠিকমতো খাতিরযত্ন করেছিলি?’

‘খায়নি, উপহারও নেয়নি।…আমার পড়া হয়নি, কাগজগুলোর কাটিং আছে?’

ব্রজরাখাল হাত বাড়িয়ে পাশের র‌্যাক থেকে একেকটা খাতা তুলে শ্রীমন্তর সামনে ছুড়ে দিলেন।

‘পরে পড়িস। এখন যা বলছি শোন।’ ব্রজরাখাল টেবলে ঝুঁকে পড়লেন। আড়চোখে দরজার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘বিমল চক্রবর্তীর সঙ্গে এবার গিয়ে কথা বল। ও স্ট্রেটকাট লোক। বেশি ধানাইপানাই করতে হবে না, সোজাসুজিই বলবি, ব্রজরাখাল মুখুজ্জে অন্যায় করেছে, এবার সেটা শুধরে নিতে চায়। সুপারমার্কেটে তিনতলায় দুটো ঘর এখনও খালি আছে, দুটোই দেব, কোনো সেলামি লাগবে না। তার বদলে কী চাই, তা তুই ওকে বলবি।’

‘যদি রাজি না হয়?’

‘রাজি করাতে হবে… সেজন্যই তো আছিস।’

শ্রীমন্তর বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠল। এইজন্যই মামা তাকে মাসে মাসে টাকা দেয়। আর রাজি করাতে না পারলে যেকোনোদিনই তাকে বিদায় করে দেবে।

‘যদি আরও বেশি কিছু চেয়ে বসে?’

‘আর কী চাইবে! টাকাপয়সা?’

‘হতে পারে! ও তো একা নয়, অনেককেই কিছু কিছু খাওয়াতে হবে। তা ছাড়া জমির ব্যাপারটা একটা সেপারেট ইস্যু। ওটার জন্য বিমল চক্রবর্তী আলাদা দাম চাইবেই।’

ব্রজরাখাল চিন্তায় পড়ে গেলেন। চোখ বুজে কিছুক্ষণ কাটিয়ে বললেন, ‘ঠিকই বলেছিস। তুই গিয়ে আগে কথা বল। ওর কী রিয়্যাকশন সেটা আমায় জানা, তারপর দেখব। …পারলে আজকেই যা। আমি এখন কলকাতায় যাব। প্রেসে একটা কাজ সেরে তারপর যাব নার্সিং হোমে। মামাকে আজ ডায়ালিসিস করবে। ওঁকে নিয়েই আসব ভাবছি, দিনে দুশো টাকা গচ্চচা দিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না। বাড়ি থেকে গিয়েও তো ডায়ালিসিস করিয়ে আসা যায়।…তুই বিমল চক্রবর্তীকে দ্যাখ।’

খাতাটা হাতে নিয়ে শ্রীমন্ত উঠে দাঁড়াল। ব্রজরাখাল চেয়ারে হেলান দিয়ে শিথিল হয়ে বললেন, ‘সেই সার্ভের কথাটা মনে রাখিস।’

‘কোন সার্ভে?’ প্রশ্নটা করেই শ্রীমন্তর মনে পড়ল। ‘ওহ হ্যাঁ, সমাচারের নিউজ এডিটারের সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা করবে তবে দূরেরগুলো আগে শুরু করবে, কলকাতার কাছেরগুলো পরে। ভালোই হল, ইলেকশনের কাছাকাছি সময়ে হলে ইমপ্যাক্টটা টাটকা থাকবে।’

‘ওই মেয়েটাই তো লিখবে।’

সেইরকমই ঠিক হয়ে আছে।’ একটুও না ভেবে শ্রীমন্ত জবাবটা দিল।

‘ওকে একটু জপা। ইয়াং মেয়ে …বাড়িতে গিয়ে আলাপ টালাপ কর।’ ব্রজরাখাল তির্যক চোখে তাকিয়ে হাসিটাকে রহস্যময় করলেন।

ঘর থেকে বেরিয়েই শ্রীমন্ত ভাবল, অসীমার বাড়িতেই বরং এখন যাই। অকাদাদুর জন্য ডাক্তার ডেকে এনেছে, নিশ্চয় তাহলে জানে ওঁর অসুখের অবস্থাটা কেমন। সে ডায়ালিসিস শব্দটিই শুনেছে মাত্র। এটার দ্বারা অকাদাদুকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, এর মানেটা কী?

কলঘর থেকে বালতি হাতে রেবা বেরিয়ে আসছিল, শ্রীমন্তকে উঠোনের ওধার দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে ধমকে দাঁড়াল। শ্রীমন্ত সেটা লক্ষ করেও না দাঁড়িয়ে দালান পেরিয়ে চলে গেল কেননা দোতলার বারান্দায় মামি নাতিকে কোলে নিয়ে টিয়াপাখির সঙ্গে তখন কথা বলছে। ফর্ম ভরার কাজ অন্য সময়েও করা যাবে।

বাসে চড়ে কলকাতায় অফিস করতে যাওয়ার সময় পেরিয়ে গেলেও, ভিড় প্রচণ্ড। শ্রীমন্ত ঘড়ি দেখল। এইটুকু তো পথ তাই সে বাসে ওঠার কথা ভাবল না। সেদিন ন-টার সময় অসীমা টিউশনি থেকে ফেরেনি, বাবা বললেন এখনি ফিরবে। এখন পৌনে দশটা, নিশ্চয় ফিরেছে।

বেড়ার আগলটা ঠেলে শ্রীমন্ত দু-পা এগোতেই দেখল রান্নাঘরে পিছন ফিরে অসীমা উবু হয়ে ঝুঁকে কিছু খাচ্ছে। পরনে রং ফিকে হয়ে যাওয়া লাল ছাপা শাড়ি, খয়েরি ব্লাউজ। নিতম্ব থেকে কাঁধ পর্যন্ত দেহের পিছন দিক এত প্রখরভাবে বস্ত্রের আচ্ছাদনকে অগ্রাহ্য করছে যে শ্রীমন্ত ঝটতি চোখ সরিয়ে বাইরের দালানের দিকে তাকাল। সেখানে তখন ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন এক প্রৌঢ়া, যাঁর মুখে অসীমার আদল। শ্রীমন্ত গলাখাঁকারি দিল।

ওরা দু-জনে একই সঙ্গে ফিরে তাকাল।

‘আরে আপনি!’ অসীমা উঠে দাঁড়াল। ‘আসুন, আসুন…আগেও একবার এসে ফিরে গেছেন শুনলাম।’

হাত ধুয়ে অসীমা ঘর থেকে টুল এনে বাড়ির ছায়ায় রেখে, ঠিক ওর বাবার মতোই বলল, ‘এখানে বসুন, হাওয়া আছে।’

‘টিউশনিতে গেছলেন, আমি আর অপেক্ষা করিনি…একটা কথা জানতে এসেছি।’ টুলে বসেই শ্রীমন্ত লক্ষ করল অসীমার শাড়িতে সেলাই, ব্লাউজের কাঁধেও।

‘বসুন বসুন, চা খাবেন? গতকাল থেকে পড়াতে যাচ্ছি না, ছাত্রীর হাম হয়েছে।’

‘খাব।’

অসীমা রান্নাঘরের দরজা পর্যন্ত গিয়ে, মাকে চা করার কথা বলে ফিরে আসা পর্যন্ত শ্রীমন্ত ওর উপর থেকে চোখ সরায়নি। একটু হতাশই হল, কেননা ‘অসীমা শাড়ির আঁচল দিয়ে ইতিমধ্যে ঊর্ধ্বাঙ্গ মুড়ে ফেলেছে।

‘বলুন?’ দালানে পা ঝুলিয়ে অসীমা মুখোমুখি বসল।

‘দাদুর কী হয়েছে?’

‘টার্মিনাল রেনাল ফেলিয়োর…বুঝলেন কিছু? আমিও বুঝি না আর বেশি বোঝার চেষ্টাও করি না। কিডনি আর কাজ করছে না, শুধু এইটুকুই জানি।’

‘আপনি গিয়ে দেখলেন কী? আপনার সঙ্গে ওনার কথাবার্তা হয়েছে?’

‘কথা বলার মধ্যেই তো বাথরুমের দিকে যেতে গিয়ে টলে পড়লেন। আর এই রোগে অসুস্থ মানুষের চেহারা কেমন হয় তা আমার দেখা আছে। ওঁকে দেখেই কেন জানি মনে হল, তাই জিজ্ঞেস করতে বললেন, চারদিন ধরে পেচ্ছাপ বন্ধ।’

শ্রীমন্ত জিজ্ঞাসু চোখে শুধু তাকিয়ে রইল। অকাদাদু খুবই চাপা স্বভাবের। অসুখের কথা কাউকেই বলবেন না, মরে গেলেও নয়। কিন্তু অসীমার কাছে বলেছেন। হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন আর চেপে রাখাটা ঠিক হবে না। তা ছাড়া অল্পক্ষণের মধ্যে আস্থা জিতে নেবার ক্ষমতা অসীমার আছে।

‘আপনাকে উনি বললেন, চারদিন বন্ধ?’

‘হ্যাঁ, তখনই তো বুড়ো মতন কাজের যে লোকটি, তাকে বললাম বাড়িতে কে আছেন শিগ্গিরি ডেকে আনুন। ডেকে আনল আপনার দিদিমাকে। তাঁকে বললাম এক্ষুনি একজন ইউরোলজিস্টকে আনুন। তিনি আর কী বোঝেন, আমাকেই তখন ফোন করে ডাক্তার সুবিমল পাইনকে আনতে হল। আমাকেই সঙ্গে করে সানফ্লাওয়ার নার্সিংহোমে যেতে হল। টাকার অভাব যখন নেই তখন ভালো জায়গাতেই যান। তা ছাড়া ওখানে ডায়ালিসিস করা হয়…কিডনি ট্র্যান্সপ্ল্যান্টও।’

‘তা হলে অবস্থাটা এখন?’

‘তিনদিন অন্তর ডায়ালিসিস করে করে ওনাকে বেঁচে থাকতে হবে। প্রতিবারের জন্য খরচ ধরুন, আটশো-সাড়ে আটশো।’ অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে অসীমা কথাগুলো বলে দিল।

শ্রীমন্ত হতবাক। মাসে তা হলে তো প্রায় আট-ন হাজার টাকা! অকাদাদুকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতি মাসে এত টাকার দরকার? এটা তো একটা অবাস্তব কথা, অবিশ্বাস্য! এত টাকা কী মামা খরচ করে যাবে? সে অন্যমনস্ক হয়ে একদৃষ্টে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল।

‘চা ধরুন।’

মা-র হাত থেকে কাপটা নিয়ে অসীমা এগিয়ে ধরল। নেবার সময় অসীমার আঙুলে তার আঙুল স্পর্শ করল কিন্তু শিহরন বোধ করার মতো মনের অবস্থা তার তখন নেই। শুধু অস্ফুটে বলল, ‘বাঁচিয়ে রাখতে হলে এত টাকা লাগবে?’

‘ওঁর যা বয়স, তাতে এমনিতেও তো আর কতদিন বাঁচবেন?’

‘তা বটে।’ চায়ে চুমুক দিল শ্রীমন্ত। চিনি আর গরম জল। ‘কিন্তু তাই বলে ওঁর মতো লোককে তো মরে যেতে দেওয়া যায় না।’

‘দেবেন কেন মরতে, আপনার মামার তো প্রচুর টাকা…এক কাজ করুন, ওনার একটা কিডনি বদলে ফেলুন। তা হলে আর ডায়ালিসিসের ঝামেলা থাকবে না।’

‘হ্যাঁ তা করলেও হয়। মামাকে বলতে হবে। ব্যাপারটা কী জানেন, আপনি যাবার আগের দিন রাতে দাদুর সঙ্গে আমার কথা হয়। আমি খুব অন্যায় একটা কথা ওঁকে বলেছি। দেশটাকে পলিটিশিয়ানরা খুবলে খুবলে যখন শেষই করে দিচ্ছে তখন আপনি আর বিপ্লবী না থেকে, এদের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করার কাজে না নেমে পাশ কাটিয়ে, শুধু পরিবেশ দূষণের কথাই বলছেন। এটা পলায়নি মনোবৃত্তি।…কথাটা ওঁকে ভীষণভাবে আঘাত করেছে। আমি ওঁর মুখ দেখেই বুঝেছি খুব কষ্ট পেয়েছেন। উনি আমার সঙ্গে তারপর আর একটিও কথা বলেননি।’ শ্রীমন্তর গলা ধরে এল। ‘জীবনের শেষে এসে এমন কথা ওঁকে শুনতে হল।…আমি কিন্তু সিরিয়াসলি মোটেই বলিনি।’ অসহায়ের মতো শ্রীমন্ত তাকিয়ে রইল অসীমার গম্ভীর এবং বিব্রত মুখের দিকে।

‘আপনার মাথায় কী হল?’ প্রসঙ্গ বদলাবার জন্য অসীমা বলল।

‘সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পিছলে পড়ে ঠুকে গিয়েছিল।’ কোনোক্রমে জবাবটা দিয়েই শ্রীমন্ত তার আগের কথার জের ধরে বলল, ‘…কেন জানি, আমার এই অকাদাদুকে খুব ব্যর্থ বলে মনে হয়। ওঁকে আবার একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। মানে, উনি একটা ভালো, দরকারি কাজই তো করতে চাইছেন, সারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে সঙ্গে এদেশের মানুষেরও মঙ্গল হোক চাইছেন,…আপনার কী মনে হয়?’ শ্রীমন্ত ব্যগ্র প্রত্যাশা ভরা চোখে তাকাল। অসীমার মুখে হালকা কৌতূহল বিচরণ করছে।

‘আপনি একটু উপরের স্তরে বিচরণ করছেন। পৃথিবী, দেশ, মানবজাতি এইসব লেভেলে ওঠা আমার মতো লোকের পক্ষে একটু কঠিনই। আমার বাবা একটা খুব বড়ো কাগজের মিলে কাজ করতেন, সেই মিল আজ দু-বছর বন্ধ, দু-বছর মাইনে পান না। স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, ছেলের বউ আর চার বছরের নাতি, তারা খাবে কী? না, না, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন একটা মাত্র পরিবারের কথা নয়, আমাকে লেখার জন্য ঘুরে ঘুরে তথ্য জোগাড় করতে হয়েছে। এই রাজ্যে কমপক্ষে একশো তিরিশটা বড়ো কলকারখানা বন্ধ। ছোটো-ছোটো আঠারো-উনিশ হাজার শিল্প বন্ধ। মোট প্রায় তিন লাখ লোকের কাজ বন্ধ। এদের পরিবারের লোক যদি ধরেন তা হলে উপোসী মানুষের সংখ্যাটা কত হবে? এর সঙ্গে যোগ করুন সরকারি খাতায় নাম লেখানো তেতাল্লিশ লাখ বেকারকে।…এই সব সংখ্যাগুলো দিয়ে অক্ষয়ধনবাবুকে প্রশ্ন করেছিলাম, পরিবেশ দূষণের থেকেও আমাদের সামাজিক-রাজনীতিক-আর্থনীতিক দূষণটা বেশি মারাত্মক কি না?’

শ্রীমন্ত নিষ্পলক তাকিয়ে অসীমার মুখের দিকে। একটা প্রবল আবেগ কোনো মেয়ের মুখের চামড়ার নীচে ধিকধিক করলে তাকে যে কত উজ্জ্বল দেখায় এটা সে এই প্রথম দেখছে।

‘উনি সরাসরি জবাব না দিয়ে অনেকক্ষণ ভাবলেন।’ অসীমার মুখের উজ্জ্বলতা এখন অনেকটাই কমে এল। গলার স্বর নামিয়ে এনে বলল, ‘তারপর এলোমেলোভাবে ভেজাল, ঘুস, পণপ্রথা নিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বললেন, আজ যে এই দূষণ দেখছ এসব হঠাৎ তো হয়নি, নানান গলদ গোড়া থেকেই ঘটে গেছে। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা, বিশেষ করে বাঙালি ছেলেরা বোমা-পিস্তল নিয়ে এত বড়ো একটা দেশকে স্বাধীন করবে, তা কখনো হয়? এই বলে তিনি ওঁর জানা একটা ঘটনার উল্লেখ করলেন। খুব ইন্টারেস্টিং গল্পটা। কলকাতার এক বন্দুকের দোকানের জন্য ইংল্যান্ড থেকে দশবাক্স পিস্তল আর গুলির চালান আসে। সেই পিস্তল, সংখ্যায় পঞ্চাশটা, বিপ্লবীরা হাতিয়ে নেয় খিদিরপুর থেকে আসার পথে। বিপ্লবীদের মধ্যে চুয়াল্লিশটা বিলি হয় আর ছ-টা নিয়ে একজন বিপ্লবী সরে পড়ে।

‘এরপর তিনবছরের মধ্যে সারা বাংলায় চুয়ান্নটা ডাকাতি হয়, খুনও যথেষ্ট হয়। আর এই সব খুন ডাকাতির নায়ক সেই একজনই। পরে সে ধরা পড়ে আর পুলিশের অত্যাচারে সব স্বীকারও করে। ফাঁসি হওয়ার বদলে তার মাত্র দেড় বছরের জেল হল। জেল থেকে তার বেরোবার পরেই বিপ্লবীদের কয়েকটা গোপন ডেরায় পুলিশ হানা দিল, কিছু বিপ্লবী ধরা পড়ল, বিপ্লবীদের বহু প্ল্যান পুলিশ কীভাবে যেন জেনে যেতে লাগল। শেষকালে তারা জানতে পারল তাদের মধ্যেই একজন পুলিশকে ভিতরের খবর পাচার করছে আর সে হল এই লোকটিই যে দেড় বছর জেল খেটে বেরিয়ে এসেছে। বিপ্লবের জন্য টাকা তোলার নামে ডাকাতি আর খুন করে সে টাকা আর গহনার অর্ধেকটাই নিজের কাছে রাখত।

‘সাব্যস্ত হল ওকে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিতে হবে। এ কাজের জন্য ভার দেওয়া হল এমন একজনকে যার বোনকে বিয়ে করেছে সেই বিশ্বাসঘাতক।’

অসীমা এই পর্যন্ত বলে থেমে রইল। শ্রীমন্তর বুকের মধ্যে হঠাৎই জেট বিমানের ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল। শেষ বাক্যটা তার কীরকম যেন চেনা লাগল। সে প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করল অকাদাদু সেদিন ঠিক কী বলেছিলেন…’রামুদা ছিল টেররিস্ট, পিস্তল নিয়ে মানুষ…থাক ওসব কথা।’ কেন প্রসঙ্গটা বন্ধ করলেন?

সে যখন বলল ‘দেশ স্বাধীন হবার আগেই নাকি বড়োলোক হয়ে গিয়েছিলেন, মা-র কাছে শুনেছি’, তখন দাদুর চোখমুখ আচমকাই কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। কেন হয়ে গিয়েছিল?

তা হলে অকাদাদুর উপরই কী ভার পড়েছিল…?

‘থামলেন কেন, বলুন।’ শ্রীমন্ত নিজেকে শান্ত রেখে, স্বাভাবিকভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নেবার চেষ্টা করল।

‘আর উনি বলতে পারেননি। উঠে পড়লেন, বাথরুমের দিকে এগোলেন আর টলে পড়ে গেলেন।’

‘উনি কোনো নাম বলেননি?’ শ্রীমন্ত নিরীহ কৌতূহল দেখাল। অসীমা মাথা খাটায়। কে জানে ওর মাথাতেও খটকাটা লেগেছে কি না!

‘না। একটা নামও নয়।’

বাচ্চচা ছেলেটা বাইরে কোথাও ছিল, এখন সে অসীমার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘ভাইপো। দাদা একটা মুদির দোকান করেছে, বউদিও দোকানে বসে। ভালোই চলে।’

‘আপনার বাবাকে দেখছি না?’

‘বাবার কথা আর বলবেন না। কোথা থেকে শুনেছেন মিলের গোডাউনে যে কোটি টাকার তৈরি কাগজ পড়ে আছে তা নাকি বিক্রি করে কিছু মাইনে দেওয়া হবে। তাই সক্কাল বেলায়ই ছুটেছেন মিলে খবর নিতে। মিল অবশ্য বন্ধ, ওই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে জটলা হবে। এরকম কতবার কত আশ্বাস যে দু-বছরে শোনা হল।’

‘দাদুকে কি তারপর আর দেখতে গেছেন?’

‘না, বড্ডই দূর তা ছাড়া সময়ও করে ওঠা যায় না।’

‘কাল ওঁকে বাড়িতে আনা হবে। আসবেন ওঁকে দেখতে?’ শ্রীমন্তর সন্দেহ হল তার মুখে আবেদন জানানোর মতো কিছু একটা বোধ হয় ফুটে উঠল। নয়তো অসীমার কপালের চামড়া নড়ে উঠবে কেন?

‘পারলে যাব, আপনাদের ওখানে ভিজিটিং আওয়ার্স নেই তো?’

শ্রীমন্ত হাসল। এই সময় রান্নাঘর থেকে ‘খুকু’ ডাক শুনে অসীমা উঠে গেল এবং ফিরে এসে বলল, ‘আপনি কাঁঠাল খান?’

কাঁঠালে তার আসক্তি নেই কিন্তু আরও কিছুক্ষণ অসীমার সান্নিধ্য পাবার ইচ্ছাটাকে ফলপ্রসূ করতে হলে তাকে উৎসাহ দেখাতে হবে। ‘নিশ্চয় খাই। বহুদিন খাইনি।’

একটা বাটিতে মুড়ির উপর পাঁচ-ছটি বড়ো আকারের কোয়া নিয়ে এল অসীমা। ‘খাজা, রসা কাঁঠাল নয়, মা মুড়িও দিয়ে দিল।’

খেতে খেতে শ্রীমন্ত বলল, ‘সকালে আমাদের জলখাবার ছিল মুড়ি, ফুলুরি, আর পেট ভরিয়ে জল, ব্যস, দুপুর পর্যন্ত নিশ্চিন্তি।’

‘এদেশি লোকেরা তেলেভাজাটা খুব খায়।’

‘এদেশি লোকেরা নয় গরিবরা। ওই যে বললাম তেলেভাজার উপর জল, ওতে অনেকক্ষণ খিদে মেরে রাখে।’

‘আপনারা গরিব নাকি!’ অসীমা দ্বিধাগ্রস্ত চোখে তাকাল।

‘খুদিনগরের ওই বাড়িতে থাকি বলে কী আপনি ধরে নিয়েছেন আমি বড়োলোক? আপনাকে সেদিন বলেইছি তো এটা মামার বাড়ি। আমার নিজের বাড়ি দর্জিপাড়ায়…যথেষ্টই গরিব আমরা।’ কথাটা এই পরিবেশে এই বাড়িতে বসে বলতে পেরে শ্রীমন্ত অত্যন্ত তৃপ্ত বোধ করল। অসীমার সঙ্গে যেন একই স্তরে নিজেকে আনতে পারল। আরও সহজভাবে তারা কথা বলতে পারবে।

‘আপনাকে দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। ধুতি-পাঞ্জাবিতে সেদিন…’

‘ব্যস ব্যস, ওই একটাই ধুতি আর একটাই র সিল্কের পাঞ্জাবি। মামার দেওয়া পাবলিক রিলেশন করার ইউনিফর্ম, চটিটাও। ভালো কথা, সেদিন সাংবাদিকদের দেবার জন্য উপহার ছিল একটা করে প্যান্ট পিস, আপনাকে দেখে খুব বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। ফট করে একটা মেয়ে এসে হাজির হবে এটা তো আর ভাবিনি! বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম, প্যান্ট পিস নিয়ে আপনি কী করবেন? তবু রক্ষে আপনি উপহার রিফিউজ করেছিলেন।’

‘আরে আপনি আগে বলবেন তো কী উপহার দিচ্ছেন! বাড়িতে তো প্যান্ট পরার লোক থাকতে পারে।’ অসীমা মজা করেই বলল কিন্তু শ্রীমন্তর কানে ক্ষীণভাবে যেন একটা আক্ষেপও ধরা পড়ল।

‘একটা পিস কিন্তু এখনও রয়ে গেছে।’ শ্রীমন্ত বাজিয়ে দেখতে চায় আক্ষেপটা সত্যিই কিনা। ‘এনে দেব?’

অসীমা হাসছে। ‘লেখাটা বেরিয়ে গেছে আর সেটা ব্রজরাখাল মুখোপাধ্যায়ের মনোমতো হবে বলে তো মনে হয় না। ‘স্বাগত ভাষণ দেন’ বলে শুধু তাঁর নামটুকু বেরিয়েছে… এর পরও উপহার দেবেন?’

‘কেন দেব না! মামার প্রচুর টাকা, ব্ল্যাকমানি, অ্যাম্বিশন মন্ত্রী হওয়া এবং কোনো একটা ডান কী বাম পার্টিতে ঢুকে একদিন হবেনও। বাবা বিপ্লবী, বাড়িতে পুষে রেখেছেনও এক বিপ্লবীকে সুতরাং-।’

‘কিন্তু অক্ষয়ধন মিত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে মাসে মাসে যে টাকা খরচ করতে হবে সেটা কী করবেন?’ অসীমা তার সন্দেহটা জানিয়েই শ্রীমন্তর হাত থেকে খালি বাটিটা নিয়ে উঠে গেল, ফিরে এল জলের গ্লাস হাতে।

‘মামার মাথায় ঢোকাতে হবে, এটার দারুণ একটা পাবলিসিটি ভ্যালু আছে। বিপ্লবীকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা মানে তো বিপ্লবকেই বাঁচাবার চেষ্টা, সেজন্য অকাতরে অর্থব্যয় করে আপনি নিজেই একজন বিপ্লবীর ইমেজ পেয়ে যাবেন আর ইন দি লংরান এটা আপনাকে বহু দূর, রাইটার্স পর্যন্তও নিয়ে যাবে-বুঝলেন, এইভাবে যদি বোঝাতে পারি তাহলে মামার হাত থেকে টাকা গলবে।’

মাথাটা ডানদিকে কাত করে অসীমা বেশ জোরেই হাসছে। হাসির দমকে দেহ কাঁপছে। ব্রেসিয়ার না পরার জন্য যে আন্দোলন শ্রীমন্ত স্বচ্ছন্দ মনেই তা দেখতে দেখতে হঠাৎই রেবার চেহারাটা মনের উপর দিয়ে ভেসে গেল। ‘মাসে আড়াই শো দেয়’, কথাটার মানে কী? অমন করেই বা বলল কেন?

‘তাহলে তো উপহার নিতেই হয়, উফফ… এত বোকা লোক!…।’

‘প্যান্টের কাপড়টা কী আমি এখানেই-‘

কথাটা শেষ করার আগেই শ্রীমন্তর মনে পড়ল দিপুকে। তাকে সে কথা দিয়ে এসেছে। বলেও এসেছে, প্যান্ট পিস শ্যামলের জন্য কিনে রেখেছে। তাহলে? …তাহলে?

বিমূঢ়ের মতো সে অসীমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অসম্পূর্ণ বাক্যটি অসীমাই শেষ করে দেবে যেন সেই অপেক্ষায় রয়েছে সে।

ভাইপো ওর কানে কানে কী বলছে, অসীমা মাথা নাড়ছে।

‘এখন খেলে বিকেলে কিন্তু পাবে না।’

‘না চাইব না।’

দু-জনে উঠে ঘরে গিয়ে ঢুকল।

শ্রীমন্তর মনে হচ্ছে, ঘনকুয়াশা তার মাথার মধ্যে থমকে গেছে। সে পরিষ্কারভাবে যুক্তি দেখতে পাচ্ছে না।

একদিকে বোনকে স্বীকার করে নেওয়ার, তার কাজকে অনুমোদন করার একটা মানবিক দায়; বন্ধ ডোবার মতো তাদের বাড়িটায় নতুন একটা স্রোত আসার চেষ্টা হিসাবেই সে প্যান্ট পিসটা শ্যামলকে দিতে চায়।

আর একদিকে শুধুই অসীমাকে খুশি করা। কীজন্য? ওর মন জয়ের জন্য? এক যুবক নিজের জন্য তো এটা চাইতেই পারে, এতে অন্যায়টাই বা কী? কিন্তু সে তো সংসারী ছেলে, গত দশবছর ধরে বাড়ির সবাই তো এই বলেই তাকে প্রশংসা করে যাচ্ছে। তার নিজের জন্য কোনো মন নেই। থাকলে কী সে মামার কাজ করত।

ভাইপোর সঙ্গে ঘর থেকে কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে অসীমা অবাক হয়ে এধার- ওধার তাকিয়ে বলল, ‘ওমা, উনি চলে গেলেন!’

সামান্য হলেও প্যান্ট পিসটা শ্রীমন্তকে উদব্যস্ত করে দিল। সে কোন দিকে যাবে, সবার দিকে না নিজের দিকে? অসীমাদের বাড়ি থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসাটা, এই দোটানারই ফল। যদি অসীমা বলে, হ্যাঁ পিসটা নেব! তাহলে সে কী করত? সহজ সমাধান একটা তো আছেই, শ্যামলের জন্য আর একটা কিনে ফেলা।

কিন্তু তার তখন ওই ভয়টাই মনে কাজ করছিল-যদি অসীমা বলে, হ্যাঁ নেব! ওকে দেখে সে কেমন জানি, নিজের উপর সহজ একটা আস্থা বোধ করতে শুরু করছিল। কারোর উপর ভরসা না করে, নিজের জোরে যতটুকুই, যত সামান্যভাবেই হোক বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টার একটা ছবি সে দেখতে পাচ্ছিল। ছবিটায় কালি লাগুক এটা সে চায়নি।

অবশ্য অসীমা যে উপহারটা নেব বলতই, এমন কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। ‘তাহলে তো উপহার নিতেই হয়, উফফ’, কথাটা তো নেহাতই ঠাট্টার ছলে বলা। কিন্তু জন্ম থেকেই সে এমনভাবে বড়ো হয়ে উঠেছে যে সব ব্যাপারের কালো দিকগুলোই তার চিন্তায় প্রথমে ভেসে ওঠে, সে শুরুতেই দমে যায়। ধরে নেয়, পারবে না।

নিজের এই মনোভাবটাই বদলাতে হবে। শ্রীমন্ত হাঁটতে হাঁটতে নিজের ত্রুটির কথা স্বীকার করে, শোধরাবার জন্য প্রথমেই বেছে নিল বিমল চক্রবর্তীকে। এই লোকটা একটা চ্যালেঞ্জ। একে তার স্বার্থ, তার মানে মামার স্বার্থরক্ষার জন্য কাজে রাজি করাতে হবে। লোকটা একসময় সৎ আদর্শবাদী ছিল। খেটেছে, কষ্ট স্বীকার করেছে পার্টির জন্য। পরিচ্ছন্ন চরিত্রের জন্য বিমল চক্রবর্তীকে সবাই শ্রদ্ধেয় নেতা বলে স্বীকার করেছে। কিন্তু জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ পেরিয়ে এসে উনি, অকাদাদুর কথায়, ‘বড়ো পুঁজি রাজনীতিকে এখন পকেটে পুরেছে…রাজনীতিকরা এখন দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে’-দেখে দেখে, অবশেষে স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতরাবার ইচ্ছাটা হারিয়ে ফেলেছেন।

এখন বিমল চক্রবর্তী ক্লান্ত। এখন তলিয়ে যাবার জন্য সে তৈরি। মামার কাছে সুপার-মার্কেটে বিনা সেলামিতে ঘর চেয়েছিল গোপনে। ওর তাঁবের ছেলেরা মামার বিরুদ্ধে গতবার কাজ করেনি। সেজন্য কত টাকা ওকে দিতে হয়েছিল মামা সেটা অবশ্য ভাঙেনি। এই লোকটি ধানাই পানাই পছন্দ করে না, স্ট্রেটকাট কথা বলে।

সঙবাজার অঞ্চলটা খুদিনগর সুপারমার্কেট থেকে আধমাইল দূরে, বারো নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে, পুরসভা এলাকার শেষপ্রান্তে। বিমল চক্রবর্তীর একতলা বাড়িটা চারবছর আগে তিনখানি শোবার ঘর নিয়ে উঠেছিল। এখন দোতলায় একটি ঘর তৈরির কাজ চলছে। দু-পাল্লার ছোটো লোহার ফটক, তারপর দু-ধাপ সিঁড়ি, একটা ছোটো চৌকো বারান্দা বা দালান। তার দেওয়াল ঘেঁষে বেঞ্চ এবং কাঠের চেয়ার। বিমল এখানেই লোকজনের সঙ্গে দেখা করে। সবসময়ই এই জায়গায় নানান ধরনের মানুষ বসে থাকে।

এখন বারান্দাটা জনশূন্য। শ্রীমন্ত ফটকের বাইরে থেকেই বুঝে গেল বিমল চক্রবর্তী তাহলে বাড়ি নেই। সম্ভবত অফিস গেছে। ফিরে যাবে কি না ভাবছে, তখন ভিতর থেকে ‘আরে শ্রীমন্ত না!’ বলে কে চেঁচিয়ে উঠল।

যে লোকটি বেরিয়ে এল তাকে চিনতে শ্রীমন্তর তিন সেকেন্ডও সময় লাগল না। চার বছর স্কুলে তারা একসঙ্গে পড়েছে, উচ্চচমাধ্যমিক পাশ করেছে। তবে ঘনিষ্ঠতা ছিল না।

‘সুবিনয়! তুই এখানে?’

‘এটা তো আমার পিসির বাড়ি।’

শ্রীমন্ত ভিতরে ঢুকল। ফ্রক আর শালোয়ার-কামিজ পরা দশ থেকে পনেরো বছর বয়সি তিনটি মেয়ে বারান্দায় এসে উঁকি দিয়ে চলে গেল। বিমল চক্রবর্তীর ছয় মেয়ে, এরা বোধ হয় তারই অর্ধেক।

‘এখানে তুই, ব্যাপার কী?’ সুবিনয় জানতে চাইল। ‘বোস, বোস।’

শ্রীমন্ত চেয়ারে বসল ঘরের খোলা জানালার দিকে মুখ করে। বিমল চক্রবর্তীর আর্থিক সংগতির কিছুটা আঁচ ঘরের অবস্থা দেখে তো পাওয়া যাবে। লোডশেডিং চলছে, হাওয়ার জন্য জানলার পর্দা সরানো। রবীন্দ্রনাথের বহু প্রচলিত মুখের ছবি বাঁধিয়ে দেওয়ালে। দেওয়াল আলমারিতে একই রকমের মলাটের সাত-আটটি বই, বোধ হয় রবীন্দ্র রচনাবলী, নীচের তাকেও বই। টেবলের একটা কোণ দেখা যাচ্ছে তাতে কিছু খাতা, টেবল ল্যাম্প। দেওয়ালে আর ঝুলছে মাদুরের উপর আঁকা বাঁশঝাড়ের মাথায় চাঁদ।

‘ব্যাপার হল, বিমলদার কাছে একটা কাজে এসেছি। উনি বোধ হয় এখন নেই।’ শ্রীমন্ত স্থির করেছে ‘বিমলদা’ বলবে। এতে নৈকট্য আসে।

এই সময় ঢুকলেন বিমল চক্রবর্তীর স্ত্রী। শীর্ণকায়া, ছোটোখাটো আকৃতি। বয়সের তুলনায় বুড়িয়ে গেছেন। চোখ দুটি জ্বলজ্বলে। পনেরো বছর আগেও পার্টির কাজ করতেন।

‘পিসিমা আমার ছোটোবেলার বন্ধু শ্রীমন্ত, পিসেমশাইকে ওর দরকার।’

‘উনি তো অফিসে গেছেন।’ ভারি কিন্তু মিষ্টি স্বর।

‘তাই ভেবেছিলাম। তবু যদি পেয়ে যাই এই ভেবেই এলাম। আমার নাম শ্রীমন্ত, ব্রজ মুখুজ্জের ভাগনে বললেই বিমলদা চিনবেন।’

শোনামাত্র ভ্রূ নড়ে উঠল, চোখ সরু হল মুহূর্তের জন্য। বিমলের স্ত্রীর ধাঁধায় পড়ারই কথা। ব্রজ মুখুজ্জের ভাগনে কী মনে করে, এমন একটা ভাব তাঁর চোখে ফুটে উঠল। শ্রীমন্ত সেটা লক্ষ করল।

‘খুব একটা দরকারেই আসা। আচ্ছা কখন এলে ওঁকে একটু আলাদাভাবে পাওয়া যাবে?’

তেমনভাবে নির্দিষ্ট কোনো সময় তো বলা শক্ত, বাড়ি থাকলেই লোক আসে। তবে ওরই মধ্যে আলাদা করে কথা বলে নেওয়া…চা খাবে বাবা?’

‘এখন, এই বারোটার সময়! না বউদি থাক। আমি রাত্তিরে আসব।’ শ্রীমন্ত উঠে দাঁড়াল। ‘বাবা’ সম্বোধন তার ভালো লেগেছে।

‘অরেঞ্জ স্কোয়াশ আছে তো, তাই দাও না…মিলু, মিলু।’ সুবিনয় ব্যস্ত হয়ে বাড়ির ভিতর দিকে মুখ করে চিৎকার করল।

‘একটু কিছু মুখে দাও, এই প্রথম এলে।’ বিমলের স্ত্রী অনুরোধ ফেলতে শ্রীমন্ত ভরসা পেল না। তার সম্পর্কে কোনো মন্দ ধারণা যেন ওঁর স্বামীর কাছে না পৌঁছয়।

‘শোন।’ সুবিনয় যাকে উদ্দেশ করে বলল শ্রীমন্ত তাকে মিনিবাসে পিছন থেকে দেখেছে। পুরু চশমার লেন্সের জন্য চোখের তারা দুটি ছোটো দেখাচ্ছে। মায়ের মতোই শীর্ণা, সরু কাঁধ দুটি অল্প ঝোঁকানো। উঁচু চওড়া কপাল, নাক ও থুতনি চাপা। ‘চটপট দু গ্লাস অরেঞ্জ স্কোয়াশ করে দিবি?’

ঘাড় নেড়ে মিলু চলে গেল। সুবিনয় এরপর খোঁজখবর শুরু করল শ্রীমন্তর। অল্প কথায় জবাব দিয়ে সে কৌতূহলের পাশ কাটাতে কাটাতে লক্ষ করল বিমলের স্ত্রী তাকে সাগ্রহে দেখছেন।

‘মামার পি এ হয়ে থেকেই কী আর সারাজীবন কাটাব, কিছু একটা ধরব ভাবছি।’

‘ভেবেছিস কিছু?… ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে আয়, পয়সা আছে। গভর্নমেন্টের বহুরকমের প্রোজেক্ট হচ্ছে, টেন্ডার দে, ভেতরে ধর, ব্যাঙ্ক লোন নে, বিল পাশ করা আর চেক পকেটে ভর।’ সুবিনয় চেয়ারে হেলান দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। শ্রীমন্তর মনে হল চেক যেন ওর পকেটে এসে গেছে! সে জানে এই লোকগুলোই অপদার্থ, স্রেফ মুখে মুখে ব্যাবসা করে যারা লাভের কড়ি গুনতে বসে।

ওদের কথার মাঝে বিমলের স্ত্রী বললেন, ‘তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?’

‘বাবা নেই, মা আর তিন ভাই। একটিই বোন, বিয়ে হয়ে গেছে।’

‘নিজেদের বাড়ি?’

‘হ্যাঁ।’

‘তুমিই কি বড়ো?’

‘হ্যাঁ।’ শ্রীমন্ত এমন ব্যক্তিগত প্রশ্ন আশা করেনি। বিমল চক্রবর্তীকে সে কাঠখোট্টা প্রকৃতিরই জানে। তার স্ত্রীর আন্তরিকতায় সে যেন আশ্বাস পেল সফল হবার। নিজের একটা ভালো ধারণা বোধ হয় সে এখানে রাখতে পেরেছে। কে জানে, তার প্রস্তাব বিবেচনা করার আগে বিমল চক্রবর্তী বউয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে নেবে কিনা!

দুটো গ্লাস দু-হাতে নিয়ে মিলু এল। গ্লাসটা নেবার সময় শ্রীমন্ত সৌজন্য জানাতেই তার সেরা হাসিটা বার করে এনে বলল, ‘আপনাকে সেদিন মিনিবাসে বিমলদার সঙ্গে দেখলাম। শ্যামবাজারে আপনারা নেমে গেলেন।’

‘দাঁত তোলাতে ডেন্টিস্টের কাছে যাচ্ছিলাম।’ মিলু লাজুক হাসল। গালে টোল পড়ল। শ্রীমন্ত দুই চুমুকে গ্লাস খালি করল।

‘মিলু গত বছর এম এ পাশ করেছে, বাংলায়। হাই সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে।’ অযাচিতভাবেই মিলুর মা খবরটা দিলেন। শ্রীমন্ত বিস্ময় ও শ্রদ্ধা মুখে ফুটিয়ে তুলল।

‘খুদিনগর গার্লস স্কুলে এখন তো পড়াচ্ছে। ওর খুব ইচ্ছে রিসার্চ করার।’

শ্রীমন্ত বাঁ হাত তুলে নাক চুলকোবার ছলে ঘড়ি দেখে নিল। পৌনে একটা।

‘তুমি খুদিনগর ক্লাবে ব্যায়াম করতে, না?’

শ্রীমন্তর মতোই সুবিনয় অবাক হয়ে বলল, ‘পিসিমা তুমি এই খবরটাও জান?’

পিসিমা মুচকি হাসলেন। শ্রীমন্ত বলল, ‘ওখানেই বিমলদার সঙ্গে আলাপ, তাই হয়তো জেনেছেন।’

‘মিলুও যেত যোগব্যায়াম করতে। এখনও আসন করে বাড়িতে। ওকে দেখলে বুঝতে পারবে না কী পরিশ্রমী!’

‘তোমার মতো পার্টির কাজটাজ করে?’ সুবিনয় জানতে চাইল। বিমলের স্ত্রী ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘ওর বাবা মেয়েদের একদম ওদিকে যেতে দেননি। বলেন পড়াশুনো করুক, বিয়ে-থা করে ঘর সংসার করুক, রাজনীতি করে আর কাজ নেই। তুমি কী বল বাবা?’

শ্রীমন্ত হুঁশিয়ার হয়ে গেল। রাজনীতি সম্পর্কে বিমল চক্রবর্তীর বিতৃষ্ণার কথা সে এই প্রথম শুনল। শুনে ভরসা পাচ্ছে। নেতাদের ছেলেমেয়েরা রাজনীতিকেই ব্রত করেছে এমন ব্যাপার এদেশে প্রায় ঘটেই না। তবে এখন এটা তো ব্যাবসা, যদি ছেলে থাকত তাহলে বিমল চক্রবর্তী তাকে হাতে ধরে রাজনীতিতে আনত না কি?

‘মেয়েদের রাজনীতিতে না আসাই ভালো।’ শ্রীমন্ত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইল বাঁ হাত তুলে।

‘আমারও তাই মত।…তুমি কি রাত্রে আসবে, তাহলে ওকে বাড়িতে থাকতে বলব।’

‘হ্যাঁ, বিমলদাকে একটু থাকতে বলবেন। কিছু দরকারি কথা ওঁকে বলতে মামা আমাকে পাঠিয়েছেন।’

শ্রীমন্ত এরপরই বাড়ির দিকে রওনা হল। একটা ভালো, স্বস্তিকর ধারণাই সে পেয়েছে। লোকটি জঙ্গি, সংগ্রামী বলে যতই খ্যাতিমান হোক, নিজের সংসারে তার ছাপ ফেলতে দেয়নি। কিংবা হয়তো কোনো একসময় বুঝেছে ছয়টি মেয়েকে বড়ো করে তাদের বিয়ে দিতে হলে জঙ্গি ইমেজটা কোনো সাহায্যে আসবে না।

বাড়ির সদর থেকেই তার মনে হল, একতলায় যেন লোকজন বেশি। অকাদাদুর ঘরের থেকে দূরে দালানে মাসি, মামাতো বোন দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিজয় আর রাঁধুনি বউটি, আরও দু-জন ঝি ও চাকর তাদের পিছনে জটলা করছে। অকাদাদুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সুরুচি ও ব্রজমামা। শ্রীমন্ত এগিয়ে গেল।

‘মামাকে নিয়েই এলাম। ওখানে থাকাও যা এখানে থাকাও তাই…অযথা কেবিন চার্জ দেব কেন?’ ব্রজরাখাল তাঁর ভাগনেকে কথাটা বললেও শেষাংশটা মা-র দিকে তাকিয়ে বললেন। সুরুচি মাথা নাড়লেন।

‘ডায়ালিসিস হয়েছে?…এলে কতক্ষণ…কীসে, তোমার গাড়িতে?’

‘আধঘণ্টাটাক। ওদের অ্যাম্বুলেন্স আছে, একা আমার পক্ষে কী আনা সম্ভব? হ্যাঁ আজ সকালেই ডায়ালিসিস করেছে। এবার থেকে প্রতি তিনদিন অন্তর করতে হবে। ওদের অ্যাম্বুলেন্সেই নিয়ে যাবে পৌঁছে দেবে।’

শ্রীমন্ত ঘরের ভিতরে তাকাল। একজন অপরিচিতা মাঝবয়সি মহিলাকে দেখে তার মনে হল বোধ হয় নার্স। যদিও মাথায় শাদা অ্যাপ্রনটা নেই বা পরনের নীলপাড় শাড়িটাও থান নয়।

‘ওখান থেকেই একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে এলাম, নয়তো কে আর দেখাশোনা করবে? চার-পাঁচ রকমের ওষুধ খাওয়ানো, দু-বেলা ইঞ্জেকশান, টেম্পারেচার লিখে রাখা, মেপে অল্প করে জল খাওয়ানো, পেচ্ছাপ করিয়ে তার পরিমাণ লিখে রাখা, এত রকমের ব্যাপার! অবশ্য এরা সবই জানে।’ ব্রজরাখাল ঘরের ভিতরে তাকিয়ে একটা জটিল কাজ সুষ্ঠুভাবে করে ফেলার মতো তৃপ্ত আমেজে মুখ ভরিয়ে ফেললেন।

‘ঠাকমা, একবার দেখে আসব?’ ব্রজরাখালের মেয়ে দূর থেকে বলল। সুরুচি মাথা নেড়ে আসতে বললেন। মা আর মেয়ে গুটিগুটি এগিয়ে অকাদাদুর ঘরের সামনে এল। দরজার দিকে মাথা করে খাটে শুয়ে আছেন। হাঁটু থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত শুধু দেখা যাচ্ছে। ধুতিটা লুঙির মতো করে পরানো। অকাদাদু প্রবলভাবে লুঙি-বিরোধী কিন্তু এখন নিরুপায়।

‘ঘরের ভেতরে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। দাদু ভালোই আছেন, তবে খুবই দুর্বল, কথা বললেই হাঁপিয়ে পড়ছেন। একদম তাই ওঁর সঙ্গে কথা বলা বারণ।’ সুরুচি তাকালেন শ্রীমন্তর দিকে। নির্দেশটা যে তাকেই সেটা বুঝতে শ্রীমন্তর বুদ্ধি খরচ করতে হল না।

‘দেখা হয়েছে তো, এবার যাও।’ সুরুচির হুকুম মেনে পুত্রবধূ ও নাতনি সেখান থেকে সরে গেলেও শ্রীমন্ত নড়ল না।

‘ব্রজ, রাতে উনি কোথায় শোবেন? মেঝেয় তো শুতে বলা উচিত নয়, একটা খাটের ব্যবস্থা কর।’ বলতে বলতে সুরুচি দালান ধরে এগোলেন সিঁড়ির দিকে, সঙ্গে ব্রজরাখাল।

শ্রীমন্ত ঘরে ঢুকল। অকাদাদু চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে, হাত বিছানায় ছড়ানো। শ্বাস স্বাভাবিক। কিন্তু মুখে কষ্টের ছাপ। যা আগে কখনো সে দেখেনি, আলতো করে দাদুর কপালে সে তালু রাখল। চোখ খুলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উনি কী যেন বললেন, এত ক্ষীণ, দুর্বল স্বর শ্রীমন্তর কানে পৌঁছল না। সে ঝুঁকে পড়ল।

‘এবার পলায়ন…ইহলোক থেকে…সময় হয়ে গেছে।’

অকাদাদুর ধূসর চোখ দুটো কৌতুকে জ্বলজ্বল করে উঠল। আর ফ্যাকাশে হয়ে গেল শ্রীমন্তর মুখ। পলায়ন শব্দটা দাদুকে আঘাত দিয়েছে, এখনও ভোলেননি।

‘আমি আপনার কাছা ধরে থাকব। যেখানে যাবেন আমিও সেখানে যাব।’ শ্রীমন্ত রসিকতার পথ ধরল।

‘আমার তো কাছাটাছা আর নেই…কাপড়টা কীভাবে পরিয়েছে দ্যাখ।’

শ্রীমন্তর মনে হল, কথা বলতে ওঁর কষ্ট হচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক নয়। দরজার কাছে বিজয় এসে ডাকল, ‘দিদিমণি শুনুন।’

খাটের ধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন নার্স মহিলা। বিজয়ের ডাকে ঘরের বাইরে গেলেন।

শ্রীমন্ত তার মুখটা দাদুর বুকে ঠেকিয়ে বলল, ‘আমিও কোণঠাসা দাদু, সংসার আমাকে খোবলাচ্ছে। ভাঁড়ামো করে টিকে আছি শুধু।…কিচ্ছু বদলায়নি।’

‘আপনি ওঁর সঙ্গে আর কথা বলবেন না।’ নার্স ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘পেশেন্টের কথা বলা বারণ। এখন উনি রেস্টে থাকবেন।’

অর্থাৎ ঘর থেকে বিদায় হও। বিজয়কে দিয়ে বোধ হয় দিদিমাই নির্দেশটা বলে পাঠালেন। শ্রীমন্তর কান দুটো কয়েক সেকেন্ড গরম হয়েই আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। ঘর থেকে বেরিয়েই তার মনে হল, কতদিন এরা এত টাকা খরচ করে চিকিৎসা চালাবে? অকাদাদু মারা যাক, এটাই এখন মনে মনে এরা চাইছে। তবে লোক দেখিয়ে চিকিৎসার ঘটা হবে। হোক, তাতেও তো কিছুদিন বাঁচবেন।

শ্রীমন্ত রাত ন-টায় বিমল চক্রবর্তীর বাড়ির সামনে পৌঁছল। বাইরের বারান্দায় আলো জ্বলছে। দুটি লোক বসে। চেনা মুখ তাই ইতস্তত করল। ব্রজ মুখুজ্জের ভাগনে এই বাড়িতে কথা বলতে এসেছিল, এটা খুদিনগরে রটে যাক তা সে চায় না, শ্রীমন্ত বাড়ি ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এল।

‘সুবিনয় আছিস…সুবিনয়?’

‘কে?…সুবিনয় কে?’ দুটি লোকের একজন চেঁচিয়ে জানতে চাইল। ফটক খুলে শ্রীমন্ত বারান্দায় উঠে এল। ওরা তাকে চিনতে পেরে কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

‘আমার বন্ধু সুবিনয় এখানে এসেছে। সে আছে কী?’

ওরা কিছু বলার আগেই ভিতর থেকে বিমলের এক মেয়ে বেরিয়ে এল।

‘সুবিনয়দার জ্বর হয়েছে, শুয়ে আছে। আপনাকে ভেতরে যেতে বললেন।’ দ্রুত স্বরে মেয়েটি বলল, চোখ নামিয়ে রেখে।

‘হ্যাঁরে বিলু, বিমলদা কলকাতায় মিটিংয়ে গেছে, ঠিক জানিস?’ অপেক্ষমাণদের একজন জিজ্ঞাসা করল।

‘তাই তো বলে গেছে।’

‘আর দশ মিনিট দেখি।’

মেয়েটির সঙ্গে শ্রীমন্ত বাড়ির ভিতরে এল।

সুবিনয়ের কথাটা হঠাৎই মনে পড়ে গেল, কিন্তু ও যে এখনও পিসিমার বাড়িতে রয়েছে এটাই তার কাছে অবাক লাগছে। বাঁ দিকে দুটি ঘরের দরজায় পর্দা, ভিতরে আলো জ্বলছে এবং মেয়েদের গলার স্বর সে শুনতে পেল। এরপর ছাদের সিঁড়ি তার পরের ঘরটার পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটি বলল, ‘বাবা ভেতরে আছে।’

বিস্ময়ের ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠার সময় তার কানে এল পাশের ঘর থেকে বিমলের স্ত্রীর গলা, ‘বিলু চলে এসো।’

পর্দা সরিয়ে শ্রীমন্ত বলল, ‘বিমলদা, আমি শ্রীমন্ত।’

ইজিচেয়ারে দেহ এলিয়ে বাঁ হাত মাথার উপর রেখে বিমল চক্রবর্তী জেরক্স করা কয়েক পাতার একটা ইংরেজি লেখা পড়ছিল। পরনে পাজামা ও খদ্দরের পাঞ্জাবি। টেবলল্যাম্পটা মুখের ডানদিকে দেওয়াল-তাকে তার পাশে জলপাই রঙের টেলিফোন আর ডিরেক্টরি। চশমাটি খুলে বলল, ‘এসো।’

চটি বাইরে খুলে রেখে শ্রীমন্ত ঘরে ঢুকল।

‘বোস।’ বিমল বাঁ দিকে শোয়ার খাটটা আঙুল দিয়ে দেখাল। খাটে বসে সামনে তাকিয়েই সে চোখ পিটপিট করল। বিমল সেটা লক্ষ করে বলল, ‘ল্যাম্পটার মুখ নীচের দিকে করে দাও, অসুবিধে হবে না।’

শ্রীমন্ত তাই করে দিয়ে এসে আবার বসল। ঘরটার বেশিরভাগই আবছা হয়ে শুধু বিমলের পায়ের কাছে আলো ছড়িয়ে রইল।

‘মামা পাঠিয়েছে?’

‘হ্যাঁ’, শ্রীমন্ত কেশে গলা সাফ করে কথা শুরু করার আগেই বিমল বলল, ‘অক্ষয়ধনদার অবস্থাটা বিশেষ তা হলে ভালো নয়।’

শ্রীমন্তর কাছে এই ঘরে এই প্রসঙ্গটা অপ্রত্যাশিত। অক্ষয়ধনদাই বা কেন? অকাদাদুর সঙ্গে এঁর কী পরিচয় আছে?

‘তোমার দাদামশাই রামরাখাল মুখুজ্জে মারা যাবার পর অক্ষয়ধনবাবু এখানে এসে ভাগনের বাড়িতে বাস করছেন। উনি অমন নামি একজন বিপ্লবী আর আমি তখন রাজনীতিতে নতুন, পোস্টার লিখি, মিছিলে স্লোগান দি। নিজেই গিয়ে আলাপ করেছিলাম।’

‘কী মনে হয়েছিল আপনার?’ শ্রীমন্ত নিজেকে উত্তেজনার মধ্যে ঠেলে দিয়ে উত্তরের আশায় রইল।

‘তখন বছর ত্রিশ আগে যা মনে হয়েছিল এখন সেই ধারণাটা অবশ্য নেই।’ বিমল দেহ এলিয়ে দিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল সিলিংয়ে। বহুরকম স্মৃতির মধ্য থেকে বাছাবাছি করে অবশেষে বলল, ‘উনি একবার আমায় বলেছিলেন-মানুষের অভাবের সুযোগ নিয়ে আমরা তাদের আত্মমর্যাদা বোধটাকেই চুরি করেছি, মানুষকে কাঙাল বানাচ্ছি। শুধুই হাত পেতে দাও দাও করতে শেখাচ্ছি। আর একবার বলেছিলেন অধিকার অর্জন করতে হয়। নিজের কাজকর্ম চিন্তার মধ্য দিয়েই মানুষ নিজেকে তৈরি করে আর সেই পথেই আসে আত্মবিশ্বাস, দেশপ্রেম, মনুষ্যত্ব বোধ। কিন্তু তোমরা দেশ আর মানুষ গড়ার দায়-দায়িত্বের বাইরে থেকে গিয়ে ইয়ে আজাদি ‘ঝুঠা’ হ্যায় বলে দেশাত্ম বোধটাকে অসাড় করে, অবিরাম শুধু নেতি নেতি, ধ্বংস ধ্বংস শেখাচ্ছ। ট্রামবাস পুড়িয়ে আর ধর্মঘট ডেকে, লাঠি আর গুলির সামনে অবোধদের ঠেলে দিয়ে বিপ্লব…এই সবই আর কী। তখন মনে হয়েছিল লোকটা ভীষণ রিয়্যাকশানারি, গরিব দুঃখীর কথা ভাবে না।’

‘আর এখন?’

মাথা হেলিয়ে শ্রীমন্তর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিমলের দৃষ্টি ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে এল। গম্ভীর স্বরে বলল, ‘দরকারের কথাটা বল।’

‘মামা চান না আপনি তাঁর সম্পর্কে রাগ পুষে থাকুন। তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন আর সেটা শোধরাতেও চান।’ শ্রীমন্ত কোনোক্রমে কথাগুলো বলে ফেলেই দুরু দুরু ভয় নিয়ে তাকিয়ে রইল। ঠিকভাবে ঠিক কথাগুলো বলা হয়েছে তো? বিমল চক্রবর্তীর বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস আছে, এই তো পঁচিশ-তিরিশ বছর আগে শোনা কথাগুলো সাজিয়ে কেমন বলে দিল!

বিমলের চোখ থেকে কাঠিন্য মুছে গিয়ে পরিষ্কার এবং ভাবশূন্য হয়ে গেল। ‘চার বছর আগের ভুল, চার বছর আগেই শোধরাতে চাইলে যা বলতাম এখন আর বলা সম্ভব নয়। ইলেকশন এসে গেলে সবারই তখন ভুল শোধরাবার কথা মনে পড়ে। …তোমার মামা সম্পর্কে তোমার নিজের কী ধারণা?’

শ্রীমন্ত ফাঁপরে পড়ে গেল। মামাকে ছোটো করে দেখাতে তার মর্যাদায় বাধছে। অথচ বুদ্ধিমান, চতুর এই লোকটির কাছে বোকা সাজলে তাকে গুরুত্ব দিয়ে আর কথা বলবে না। সুতরাং সত্যি কথা বলাই ভালো।

‘আমাকে আপনি বেশ মুশকিলেই ফেলে দিলেন বিমলদা। মামা একটু জটিল চরিত্রের, মানে-‘

‘কোনো জটিলতা ব্রজ মুখুজ্জের চরিত্রে নেই। প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল একটা নীচ, ইতর, লোভী। আজ বিকেলেই একজনের কাছে শুনলাম, তোমার মামা সগর্বে বলেছে, গত পাঁচদিনে দশ হাজার টাকা খরচ করেছে বিপ্লবী অক্ষয়ধন মিত্রের চিকিৎসায়, ওঁকে বাঁচাতে দশ লাখও যদি ঢালতে হয় তাও নাকি চলবে। উনি মারা গেলে চন্দন কাঠে পোড়াবে…এই সব কথা বলার মানে কী? ইলেকশনে কাজে দেবে? বিপ্লবী-টিপ্লবী এখন আর কোনো ফ্যাক্টর নয় ভোট ধরায়।…গর্দভ। তোমাকে কী বলতে পাঠিয়েছে, সুপারমার্কেটে একখানা ঘর-‘

‘দু-খানাও দিতে রাজি। সেলাম নেবেন না।’

বিমলের উপরের ঠোঁট বেঁকে উঠল তাচ্ছিল্যে।

শ্রীমন্ত প্রমাদ গুনল। লোকটা বোধ হয় আরও বড়ো কিছু দাঁও মারার কথা ভাবছে।

মাথা নাড়তে নাড়তে বিমল বলল, ‘চেয়ারম্যান হওয়ার লোভ ওর বড্ড বেশি। ওই চেয়ারে চেষ্টা করলে আমিও বসতে পারি। কিন্তু রাজনীতি আমি এবার ছাড়ব।’ দরজায় ঝোলা পর্দার দিকে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে রইল বিমল।

‘আপনি একেবারে ছেড়ে দেবেন!’ শ্রীমন্ত নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। ‘আপনি এখনও তো যথেষ্ট অ্যাক্টিভ, পপুলার, ডায়নামিক!’

‘পপুলার ঠিকই, বাকি দুটো নয়। জীবনের সেরা সময়টা পার্টিকে দিয়েছি।’

বিমল হাসল, গাছ থেকে ঝরে পড়া মরা পাতার মতো হাসিটা অনেকক্ষণ ধরে ঘরের শূন্যতায় ভেসে বেড়াল। অস্ফুটে বলল, ‘সাংসারিক দায়িত্ব পালন করার কথা ভাবতে হচ্ছে…ছ-টা মেয়ে। একখানা, দু-খানা ঘর থেকে কী আর পাব! বড়দরিয়া থেকে কাটাখালি তিন মাইল রাস্তা বেরোবে, তাতে মাটি ফেলার কন্ট্র্যাক্ট আমি পেতে পারি। কিন্তু কাউকে সামনে রেখে তার নামেই কাজটা করতে হবে আর সেজন্যই সুবিনয়কে ডেকে এনেছিলাম। কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলে একদমই ভরসা পেলাম না। শুধুই কথার ফুলঝুরি, পরিশ্রমও করতে পারবে না।’

বিমল চোখ বন্ধ করে কী যেন ভেবে নিয়ে চোখ খুলেই বলল, ‘তোমার মতো ছেলে পেলে কাজটা নিতাম!’

‘বেশ তো, নিন না।’ শ্রীমন্তর কণ্ঠস্বর পুরোপুরি লঘু হল না। মনের গভীরে ক্ষীণ একটা আশা মাথা তুলে ফেলেছে। বিমল চক্রবর্তী তাকে নির্বাচিত করলেও করতে পারে।

‘শ্রীমন্ত, আমি ঠেকে শিখেছি। নিকট কোনো আত্মীয়তার বন্ধন কী টান না থাকলে বাইরের কাউকে দিয়ে এই ধরনের কাজ করাতে গিয়ে ফাঁকিতে পড়ার সম্ভাবনাটাই বেশি। সুবিনয়কে ভেবেছিলাম এইজন্যই যে সে আত্মীয়, ঠকালেও বেশি ঠকাবে না। কিন্তু তুমি যে একেবারেই অনাত্মীয়।…সব দিয়েথুয়েও নেট চার লাখ টাকা আসবে।’

বিমল অদ্ভুত প্রত্যাশাভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে। শ্রীমন্তও অস্বস্তি বোধ করল। মামার কবল থেকে বেরিয়ে আসার একটা সুযোগ এল আর আধ মিনিটের মধ্যে চলে গেল। পৃথিবীতে হাজার হাজার লোক দু-নম্বরী কারবার করছে, সবাই কী তাদের আত্মীয়দের দিয়েই করাচ্ছে?

‘শ্রীমন্ত, তুমি তোমার মামার কাছ থেকে মাইনে পাও, যতদূর জানি দেড় হাজার টাকার মতো। সুবিনয়ের কাছে তোমার বাড়ির অবস্থাও শুনলাম। তুমি স্বাস্থ্যবান, সুদর্শন, বুদ্ধিমান…তুমি উপরে উঠতে চাও না?’

ধক করে উঠল শ্রীমন্তর বুকের মধ্যে। কে বলল সে চায় না? অবশ্যই চায়। ‘কেন চাইব না। সুযোগ পাচ্ছি আর কই?’

‘আমার আত্মীয় হবে?’

‘মানে?’

‘জামাই হবে?’

ঠিক তখুনি ঘরে ঢুকলেন বিমলের স্ত্রী। হাতের প্লেটে ধবধবে ফুলকো লুচির স্তূপ আর ফুলকপির ডালনা। খাটের তলা থেকে নীচু টুলটা টেনে বের করে তার উপর প্লেটটা রেখে বললেন, ‘হাত ধোবে? বাইরে বালতিতে জল আছে।’

শ্রীমন্ত ফ্যালফ্যাল করে শুধু দু-জনের মুখ পর্যায়ক্রমে দেখে যাচ্ছে। বলে কী বিমল চক্রবর্তী? লোকটার কী মাথা খারাপ হয়ে গেল! নাকি, তারই শুনতে ভুল হল?

‘কী বললেন?’

‘মিলুকে তুমি তো দেখেছ।’ খাটে বসলেন বিমলের স্ত্রী। বিমল আবার দেহ এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। যা কিছু বলা-কওয়ার ভার যেন স্ত্রীর হাতেই ছেড়ে দিয়ে অবসর নিল।

বিয়ে? মিলুকে! শ্রীমন্তর কাছে সারা ঘর একটা অবাস্তব খাঁচার মতো লাগছে। চিন্তাভাবনার কোনো খেই সে পাচ্ছে না। খাঁচার দরজায় এরা দু-জন দাঁড়িয়ে, কী অদ্ভুত প্রস্তাব! তাকে ধরার জন্য এরা প্ল্যানটা করল কখন? নিশ্চয় আজই দুপুরে তাকে দেখে বিমলের স্ত্রীর মাথায় বুদ্ধিটা খেলেছে। দুটো দোকান ঘরের থেকে একটা জামাই অনেক দামি জিনিস।…ছ-টা মেয়ের বাবা-মার ভাবনা সে বুঝতে পারবে না ঠিকই, কিন্তু জীবনটার কথা তো তাকেই ভাবতে হবে।

মামার কাজ উদ্ধার করে দিতে সে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে রাজি কেননা সেজন্য মামার কাছ থেকে সে টাকা পায়, সেই টাকায় দর্জিপাড়ার…কিন্তু তাই বলে মিলুকে বিয়ে করে কাজে সফল হতে হবে? জীবনটাকে নষ্ট করে দিয়ে?…তা ছাড়া আর কী?

শ্রীমন্ত উঠে দাঁড়াল। ‘হাত ধোব।’

‘হ্যাঁ, বাইরে বালতিতে-‘ বিমলের স্ত্রী ওঠার আগেই শ্রীমন্ত দরজার পর্দা সরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। একটা প্লাস্টিকের বালতিতে জল আর মগ। এটা সে আসার সময় দ্যাখেনি। বালতির পাশে মিলু দাঁড়িয়ে, হাতে তোয়ালে। তার মুখের দিকে না তাকিয়ে শ্রীমন্ত দালান ধরে প্রায় ছুটেই বাইরে যাবার দরজার দিকে এগোল। এই সময় ক্ষীণ একটা সেন্টের গন্ধ সে পেয়েছিল।

এই নিয়ে আজ দ্বিতীয়বার সে পালাল।

একতলায় সে মামাকে খুঁজে পেল না। অকাদাদুর ঘরের দরজায় পর্দা টানা। পর্দা সরিয়ে দেখল দাদু শুয়ে, নার্স চেয়ারে বসে টিভি দেখছে। পর্দা ফেলে দিল।

দোতলা থেকেও টিভি চলার শব্দ আসছে। শ্রীমন্ত লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠল। দোতলার বসার ঘরের সোফায় পরিবারের সবাই। সে সোজা তাকাল ব্রজরাখালের দিকে। ‘মামা, খুব দরকারি একটা কথা আছে।’

ভ্রূ কুঁচকে বিরক্ত মুখে ব্রজরাখাল বললেন, ‘একটু পরে। তুই নীচে যা, আমি আসছি।’

‘এখুনি শুনতে হবে, টিভি দেখার থেকেও এটা জরুরি।’…শ্রীমন্তর তীক্ষ্ন উত্তেজিত, চড়িয়ে বলা স্বরে ঘরের সকলে তার দিকে তাকাল। …বিমল চক্রবর্তীর কাছ থেকে আসছি।’

‘অহহ।’ ব্রজরাখাল ব্যস্ত হয়ে উঠে এলেন।

শ্রীমন্ত ঘর থেকে বেরিয়ে বড়ো দালানে এসে বলল, ‘বিমল চক্রবর্তী শয়তানি চাল চেলেছে। ভয়ানক ধড়িবাজ আর লোভী…ওর সঙ্গে কোনো সমঝোতা আর সম্ভব নয়।’

‘কী বলল কী? তুই ওকে কী বললি?’

‘একটা নয়, দুটো ঘর দেব বললাম। কিন্তু ও আর ওর বউ অন্য জিনিস চায়।’

‘অন্য আবার কী জিনিস, টাকা?’

‘না।…আমাকে।’

‘তোকে! তার মানে? সেটা কী ব্যাপার?’

‘ওর বড়োমেয়েকে বিয়ে করতে হবে।’

‘বিয়ে! তোকে করতে হবে!…ব্যাপারটা খুলে বল, আয়।’ ব্রজরাখাল শ্রীমন্তকে বাহু ধরে টেনে নিয়ে গেলেন বারান্দার রেলিংয়ের ধারে। সেখান থেকে অকাদাদুর দরজার পর্দা শ্রীমন্ত দেখতে পাচ্ছে।

‘খুলে আর বলব কী, বিমল চক্রবর্তী রাজনীতি ছেড়ে ব্যাবসায় নামবে ঠিক করেছে।’

‘ভালো কথা। কী ব্যাবসা?’

‘ঠিকেদারি।’

‘নামুক, কবে থেকে? ইলেকশনের আগে না পরে?’

‘তা কিছু বলেনি। তবে ব্যাবসা চালাবার জন্য একটা আপনজন চাই। আমি যদি জামাই হই-‘

‘হয়ে যা।’ ব্রজরাখাল ব্যগ্র এবং উত্তেজিত স্বরে বললেন। ‘আমার কাজ করে দেবে তো?’

শ্রীমন্ত অবাক চোখে মামার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ব্রজরাখালের গৌরবর্ণ মুখের চামড়া লাল হয়ে উঠেছে।

‘তুই কী বলে এলি? রাজি?’

‘তুমি মেয়েটাকে দেখেছ?’

‘দেখাদেখির কী আছে! বিয়ে তো একদিন করবিই, তা হলে এখনই করে ফেল। তোর কাছে এটা তো একটা বিরাট চান্স নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াবার। ঠিকেদারিতে পয়সা কত জানিস? তুই কী বলেছিস?’

‘কিছু বলিনি।’

‘আচ্ছা আমি তা হলে ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলছি। ওর নম্বরটা…অফিসঘরে আয়।’ কথা বলতে বলতে ব্রজরাখাল যুবকের মতো দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলেন, পিছনে শ্রীমন্ত জরাগ্রস্তের মতো।

অফিসঘরের দরজার বাইরে সে ইতস্তত করল। মামার কথা শোনা যাচ্ছে।

‘…ও কী করে তক্ষুনি তক্ষুনি কথা দেবে আমাকে না জিজ্ঞাসা করে, আরে না না…এটা শুনে ভালো লাগছে যে আপনাদের ওকে খুব পছন্দ হয়েছে, অ্যাঁ মিসেস চক্রবর্তীর? আপনার হয়নি?…তাই বলুন। এটা আপনি জেনে রাখবেন আমার ভাগনে অশিষ্ট নয়, মানীকে মান দিতে জানে। ওভাবে চলে এসেছে লজ্জা পেয়ে। আমাকে সেকথাই বলল।…হ্যাঁ, হ্যাঁ, হুম…সেই ভালো, আমিও তাই চাই। সরাসরি মুখোমুখিই কথা বলে নেওয়া…আপনার অফিসে? কাল একটায়? বেশ যাব।…তা হলে ওই কথাই রইল। শ্রীমন্ত সম্পর্কে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। এমন একজন শ্বশুর পাওয়া…আমি আর মেয়ে দেখব কী। আমার বোন যদি মানে শ্রীমন্তর মা যদি দ্যাখে তো দেখবে। তা হলে কাল একটায়…আরে না না, এসব আমায় বলতে হবে না, কাকপক্ষী টের পাবে না…হ্যাঁ নমস্কার।’

‘আমি কিন্তু বিয়ে করছি না।’ টেবলের সামনে দাঁড়িয়ে শ্রীমন্ত ঠান্ডা, কঠিন স্বরে বলল। ব্রজরাখাল স্থির চোখে তার মুখ লক্ষ করতে লাগলেন।

‘কাল আমি বিমল চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলে আসি। আগে দেখি, লোকটা কতটা আমাকে সাহায্য করবে। মুখে করব বললেই কী বিয়ে হয়ে যাবে নাকি? কাজ উদ্ধার করে যদি আমাকে বুড়ো আঙুল দেখায়?’

‘কিন্তু আমি বিয়ে করছি না।’

‘জমিটার কথা কাল আমি পাড়ব।…আট বিঘে, তার মানে একশো ষাট কাঠা, পার কাঠা এখন কুড়ি হাজার চলছে। টোটাল কত টাকা হয় বল তো? জমি থেকে ক্লাবটাকে তুলে দেবার কথা না দিলে এ বিয়ে হবে না। তুই কী বলিস?’

‘আমার বক্তব্য তো জানিয়েই দিয়েছি।…সম্ভব নয় আমার পক্ষে।’

ব্রজরাখাল কয়েক সেকেন্ড বিরক্ত চোখে তাকিয়ে নরম মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘অসম্ভবই বা কেন? একটাই তখন সমস্যা হবে, বাড়িতে আর এখনকার মতো টাকা দিতে পারবি না। কিন্তু এটা কোনো প্রবলেমই নয়। তোর তিনটে তো ভাই রয়েছে, তার একজনকে কী দু-জনকে আমি কাজ দিয়ে দোব। ঘরভাড়া নিয়ে তোরা এখানেই থাকবি, ভাড়ার টাকাটা আমিই দেব। মাইনেটাও বাড়াব,…ভেবে দ্যাখ শ্রীমন্ত, এতগুলো সুবিধে তুই পাবি। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলিসনি।’

এইবার শ্রীমন্তও মনে মনে বিচলিত হল। তার চিন্তার গভীরে যে সাংসারিক মানুষটি গত দশ বছর ধরে বসবাস করে চলেছে সে এবার কথা বলে উঠল: শ্রীমন্ত এখুনি তুমি না বলো না। আগে বাড়ির সবার কথা ভাব, নিজের কথা ভাব। স্বনির্ভর সচ্ছল জীবনই কী তুমি এতদিন চাওনি?…তা হলে এত পছন্দ-অপছন্দ কেন? মিলু অশিক্ষিত বা বিকলাঙ্গ নয়। তার প্রতি এত বিতৃষ্ণা কীসের জন্য?…অসীমা পালই কী-!

‘আজ রাতটা তুই ভেবে দ্যাখ। আমার কাছে তুই, তোরা সবাই অনেকভাবে ঋণী…এবার শোধ কর।’

শ্রীমন্ত সারারাতই আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে ভোরে ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘুম ভাঙল মেঝেয় ভারী কিছু ঘষার শব্দে। চোখ খুলে আবার বন্ধ করে ফেলল। ঘর মুছছে রেবা। উবু হয়ে একটু ঝুঁকে অর্ধচক্রাকারে হাতটা ঘোরাচ্ছে আর সেই সঙ্গে তার দেহের নিম্নদেশও দুলছে। চোখ খুলল শ্রীমন্ত। সে দেখবে। তার ইচ্ছা করছে। এই ইচ্ছাটা পূরণ করাই তার বিদ্রোহ-নিজের বিরুদ্ধে।

বালতিটা ঠেলে দিয়ে রেবা ঘুরে বসেই শ্রীমন্তকে দেখল, একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে। সে কাঁধ থেকে কাপড় টেনে বুকের উপর নামাল।

‘তোমার ফরমটা নিয়ে এসো, আজ লিখে দেব। এত ব্যস্ত ছিলাম যে-‘

‘লেখা হয়ে গেছে।’ রেবা ঘুরে মুছে যেতে লাগল।

‘ভালো। কে লিখে দিল?’

‘কেন, লেখার লোকের অভাব আছে নাকি?’

হালকা তাচ্ছিল্যের রেশ রেবার ঘরে। শ্রীমন্তর ঘুম ভাঙা শান্ত আলস্যটা নাড়া খেয়ে গেল। সে বলল, ‘না, লোকের অভাব তোমার নেই। যাক, কেউ লিখে দিলেই হল।’

মুছতে মুছতে রেবা খাটের কাছে সরে এসেছে। শ্রীমন্তর কথা শুনে মুখ তুলে তাকাল। চোখে এক ধরনের তীব্রতা, যেটা ক্ষোভ, অনুযোগ আঘাতের মিশ্রণে তৈরি।

‘আপনি জানলেন কী করে যে আমার লোকের অভাব নেই। অভাব না থাকলে কী আপনার কাছে প্রথমে আসি?’

দেড় হাত দূরে রেবার মুখটা। শ্রীমন্ত এই প্রথম ভালো করে দেখার সুযোগ পেয়েছে। সে উত্তর না দিয়ে দেখতে লাগল। তার চোখে এমন কিছু একটা ফুটে উঠেছিল যেটা দেখতে পেয়ে রেবা ধীরে ধীরে মুখ নামিয়ে নিল। শ্রীমন্ত তখন একটা কাণ্ড করল। হাত বাড়িয়ে ওর থুতনি ধরে মুখটা তুলে রইল। রেবা আপত্তি জানাবার কোনো চেষ্টা দেখাল না বরং তার চোখেও এমন কিছু একটা ফুটে উঠেছিল যেটা শ্রীমন্তকে দেড় হাত দূরত্বটা ঝুঁকে অতিক্রম করিয়ে রেবার ঠোঁটে দ্রুত হালকা চুমু দেওয়াল।

চোখ বুজে নিথর হয়ে রেবা বসে। শ্রীমন্তর মাথার মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করছে। হুট করে এটা কী করে ফেলল? সারা রাত মিলুকে বিয়ে করার বিরুদ্ধে সে কোনো বাস্তব যুক্তি সংগ্রহ করতে পারেনি শুধু একটিমাত্র ছাড়া-মিলুর কোনো দৈহিক আবেদন নেই। এটা শুধু তারই আপত্তি। কিন্তু এই আপত্তিটা আঁকড়ে থাকলে সে অনেকের কাছে ভিলেন হয়ে যাবে। যতই সে ভেবেছে ততই তার মাথা গরম হয়ে উঠেছে। তাকে ইচ্ছা-অনিচ্ছা বিসর্জন দিয়ে ভালো ছেলে হতেই হবে, এর কোনো মানে আছে?

এর যেকোনো মানে নেই, এটা জাহির করতেই সে রেবাকে চুমু খেল কী? শ্রীমন্ত ওর গাল থুতনি ঠোঁটের উপর হালকাভাবে একটা আঙুল বোলাতে বোলাতে বলল, ‘আমি খুব গরিব…আড়াইশো টাকা দেবার ক্ষমতা আমার নেই।’

রেবা চোখ খুলে গভীরভাবে কিছুক্ষণ শ্রীমন্তর মুখের দিকে তাকিয়ে, ঘর মুছতে শুরু করল। চিৎ হয়ে শ্রীমন্ত সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে দুটো হাত কপালের উপর আড়াআড়ি রাখল। ঘর মোছার বালতি টানার শব্দ ছাড়া আর কিছু তার কানে আসছে না। এক সময় শব্দটা থেমে গেল।

‘পৃথিবীতে টাকাটাই কী সব?’

রেবার অস্ফুটে বলা কথাটা শ্রীমন্তর কানে খুব জোরেই লাগল।

‘কেন নয়? টাকার জন্যই মানুষ কাজ করে, খাওয়াপরা, বাঁচার ব্যবস্থা করে। এই টাকার জন্যই হয়তো আমাকে শেষ পর্যন্ত বিয়েও করতে হবে।’

‘বিয়ে!…কাকে?’

‘একটা মেয়েকে, আবার কাকে?…ওহহ।’ কাতরে উঠে শ্রীমন্ত পাশ ফিরে দেওয়ালের দিকে মুখ ঘোরাল।

‘টাকা পাবেন যদি তা হলে বিয়ে করে ফেলুন।’

শ্রীমন্ত বুঝতে পারল না, অভিমানে না সিরিয়াস হয়েই রেবা কথাটা বলল। সে আবার পাশ ফিরে রেবার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

‘বিয়ে করতে বলছ?’

‘যদি খাওয়াপরা বাঁচার জন্য করতে হয়…কী দেবে?’

‘নিজের পায়ে দাঁড়াবার জমি।’

‘ওটা তো আগে দরকার। আমার জমি নেই বলেই তো আমাকে এভাবে চলতে হয়…’ রেবার গলা ধরে এল। চোখ ছলছলে। ‘নইলে আমারও তো সাধ হয় নিজের মনের ইচ্ছেমতন কাজ করতে…নিজের মনের সুখের জন্য-‘

‘আমি যদি বিয়ে করি, তোমার কী দুঃখ হবে?’

‘না…কেন হবে?’ মুখে হাসি ফুটে উঠল রেবার, ‘আপনি তো জমির জন্য বিয়ে করবেন।’

শ্রীমন্ত হাসবার চেষ্টা করেও পারল না। একসঙ্গে ভিড় করে এল অনেক স্মৃতি, বাল্যকাল থেকে আজ পর্যন্ত। অনেক মানুষ, অনেক ঘটনা, অনেক কথা, অনেক কাজকর্ম। সবই শুধুই খাওয়াপরা বাঁচার জন্য।

এই একটা ব্যাপার যেটা মানুষকে জন্ম থেকেই তাড়া করে। এর হাত থেকে বাঁচতে হলে দাঁড়াতে হবে এমন একটা জমিতে যাকে ঘিরে টানা থাকবে নিরাপত্তার একটা গণ্ডি। এই গণ্ডিটা কীভাবে তৈরি হল, এর দাগে কতটা কালি লেগে সেসব দেখলে তাড়া খাওয়া আর জীবনে বন্ধ হবে না।

রেবা বালতিটা হাতে তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অপেক্ষা করছে কখন শ্রীমন্ত অন্যমনস্কতা ভেঙে তার দিকে তাকাবে। একসময় তার চটকা ভাঙল। সে তাকাল রেবার দিকে। ঝি, অশিক্ষিত, সুন্দর দেহ, তাকে পছন্দ করে, রোমান্টিক মন আছে, কিন্তু বাস্তববাদী। রেবার সঙ্গে অসীমা পালের বিরাট পার্থক্য। সে একটা হাত বাড়িয়ে রেবাকে কাছে আসার ইঙ্গিত জানাল।

‘না।’ রেবা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েও পিছিয়ে এল। দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘আগে বিয়ে করুন…আমি তো আছিই।’

এই হল বাস্তববাদী। শ্রীমন্ত ফাঁকা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত বোধ করতে লাগল। সংগ্রামের বিপ্লবের কথা কী বাজে, কী ছেঁদো যে মনে হচ্ছে এখন। জমিটা কোথায় যেখানে দাঁড়িয়ে ‘আমারও তো সাধ হয়’টা মেটাব?

ঘণ্টাখানেক পর, খবরের কাগজ পড়া শেষ করে শ্রীমন্ত বাড়ি থেকে বেরোবে ভেবে আলনা থেকে টি-শার্ট নামিয়ে দেখল যথেষ্ট ময়লা। আর একটা আছে আলমারিতে। সেটা খুলতেই চোখে পড়ল পলিথিনের ঝোলাটা। ওর মধ্যে রয়েছে শেষ প্যান্ট-পিসটা। কী করবে সে এটা নিয়ে?

অসীমার কাছে যাবার এটাই তার হাতে শেষ ছুতো। কথাটা ভেবেই সে চটপট শার্ট-প্যান্ট পরে, পলিথিনে মোড়া প্যান্টের কাপড়টা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরোল। অকাদাদুর ঘর থেকে তখন বেরিয়ে এলেন নার্স। শ্রীমন্ত জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছেন?’

‘একই রকম, পায়খানা হচ্ছে না, ঘুমোননি সারারাত।’

‘ডাক্তারকে জানানো হয়েছে?’

‘আমি তো ওনাকে সকালে জানিয়েছি।’ বলেই নার্স দোতলার দিকে তাকালেন। শ্রীমন্তর চোখও দোতলার বারান্দায় উঠে গেল। সুরুচি দাঁড়িয়ে তাদের দিকেই তাকিয়ে। শ্রীমন্ত সদরের দিকে হাঁটা শুরু করল।

লিচুতলার মোড় থেকে মিনিট দুই হাঁটার পরই শ্রীমন্ত দেখল অসীমার দাদা সাইকেলে আসছে, বোধ হয় বাড়ি থেকেই। মুদির দোকান আছে, সেখানেই হয়তো যাচ্ছে। তাকে দেখে সাইকেল থামিয়ে নামল।

‘খুকু তো এই কিছুক্ষণ আগে বেরোল। কলকাতায় গেছে।’

‘দেখুন তো, পৌনে এগারোটাতে এসেও ওঁকে পেলাম না। সেই কবে থেকে এই জিনিসটা ওঁকে দেবার জন্য-‘ শ্রীমন্ত পলিথিন ব্যাগটা দেখাল। ‘অবশ্য আসলে এটা ওঁর কোনো কাজে লাগবে না, লাগবে আপনার।’ শ্রীমন্ত জানে কাপড়ের দোকানের নাম ছাপা ব্যাগটা অসীমার দাদা প্রথম দিন দেখেছে।

‘আমার!’

‘এটা একটা প্যান্টের কাপড়! অসীমা নিয়ে কী করবেন?’

কৌতূহলী হয়েছে লক্ষ করে শ্রীমন্ত আবার বলল, ‘বার বার হাতে করে আনা আর ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া, তার থেকে আপনিই রাখুন, ওকে দিয়ে দেবেন।’ শ্রীমন্ত ওর ইতস্তত ভাব দেখে হাতেই গুঁজে দিল। ‘চলুন একটু চা খাই কোথাও।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ আসুন, এই তো সামনেই দোকান।’

রাস্তার ধারেই দোকান। দুটো বেঞ্চ বাইরে পাতা। ভিতরেও বেঞ্চ এবং লম্বা টেবল। আলুর দম-পাউরুটি এবং পান আর সিগারেটও বিক্রি হচ্ছে। অসীমার দাদাই চেঁচিয়ে চায়ের বরাদ্দ জানিয়ে বাইরের বেঞ্চে বসল। শ্রীমন্তকে দেখে চা-ওয়ালা বলল, ‘গেলাসে না কাপে?’

‘গেলাসেই।’ শ্রীমন্ত জানিয়ে দেবার পর অসীমার দাদাকে বলল, ‘আপনার নাম এখনও জানলাম না।’

‘রমেন পাল।’

‘মুদির দোকান দিয়েছেন? চলে কেমন?’

‘খুব খারাপ নয়, আবার খুব ভালোও নয়। আমাদের এই জায়গাটায় বড়ো বড়ো কয়েকটা দোকান আছে তো, আমার ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার টাকায় করা দোকানে কত আর মাল থাকবে? ওদের ঘরে লাখ টাকার মাল!…দুটো কিডনি তো আর বেচা যায় না!’ রমেন শুকনো হাসল।

শ্রীমন্ত রীতিমতো অবাক! দুটো কিডনি বেচা যায় না মানে? কী ব্যাপার!

‘দুটো কিডনি…বুঝলাম না।’

‘দুটো কিডনি না থাকলে তো মানুষ মরেই যাবে। একটা থাকলে কাজ চলে যায়, এই তো আমি চলছি।’

‘আপনার একটা কিডনি! আর একটা নষ্ট হয়ে গেছে?’

‘বেচে দিয়েছি। সেই টাকাতেই তো দোকান?’ রমেনের হাসিতে এবার চাপা গর্ব। শ্রীমন্ত জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল কেন বেচলেন, কিন্তু তার আগেই রমেন বলল, ‘খুকু আপনাকে বলেনি?’

‘আপনার বাবা কাজ করতেন যে কাগজের মিলে সেটা বন্ধ হয়ে যাবার পর আপনাদের খুব দুর্দশায় পড়তে হয়েছিল, সেটা বলেছেন।’

‘তখনই তো আমি রক্ত বেচতে শুরু করি। একটা প্রাইভেট ব্লাড ব্যাঙ্কে। হপ্তায় তিনবার করে দিতুম। বেআইনি এটা, কেননা তিনমাসে একবার রক্ত দেওয়াই আইন। কিন্তু কে মানে আইন! খেতে পরতে হবে না? ত্রিশ টাকা করে বোতল, হপ্তায় নব্বুই টাকা, তাই দিয়ে তখন সংসারটা বেঁচে ছিল। এরপর খুকুও রক্ত বেচতে শুরু করল আমার সঙ্গে।’

শ্রীমন্তর বুকটা অসাড় হয়ে আসছে। অসীমাও রক্ত বেচেছে। ‘আপনার বাবা-মা অ্যালাও করলেন?’

‘জানতে পারলে তো! আমরা ভাইবোন একদমই টের পেতে দিইনি বাবা-মাকে। জানতে পারলে আত্মহত্যা করতেন। আজও ওঁরা কিছু জানেন না। আমার বউ এক বাড়িতে রান্নার কাজ নিয়েছিল। এটা অবশ্য ওঁরা জানতেন। খেটে পয়সা রোজগারে লজ্জার কী আছে? তাই না?’

শ্রীমন্ত শুধু মাথা নাড়ল। তার কাছে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে আসছে, বেঁচে থাকার জন্য কোনো কাজই বোধ হয় অন্যায় নয়। চা এসে গেছে। চুমুক দিয়ে সে বলল, কতদিন এভাবে চালালেন?’

‘বছর দেড়। শেষে দেখলাম এভাবে সামান্য সামান্য টাকা পেয়ে কোনো লাভ নেই। একসঙ্গে বেশ কিছু পেলে বরং সেটা দিয়ে ব্যাবসা করা যায়। এক দালাল ছিল, নিলুদা বলতাম, সানফ্লাওয়ার বলে একটা নার্সিং হোমের সঙ্গে ওর কনট্র্যাক্ট ছিল। নিলুদা কিডনি কেনাবেচার দালাল। তাকে বললাম আমার একটা কিডনি বিক্রি করে দিন। বরাত এমনই ওই সময়ই এক বিরাট বড়োলোকের বউয়ের কিডনি বদলাবার দরকার হল। আমার ব্লাড গ্রুপ নিলুদা জানত, সেই বউটার ব্লাড গ্রুপও আমার সঙ্গে মিলে গেল। এইচএলএ টেস্টও ম্যাচ করে গেল, ব্যস।’ রমেন সাফল্যের আনন্দে উদ্ভাসিত চোখে তাকাল।

‘কত পেলেন?’

‘চল্লিশ হাজার। নিলুদা নিশ্চয় পঞ্চাশ-ষাট ঝেড়েছে।’

‘এটা কে কে বাড়িতে জানেন?’

‘খুকু আর বউ। বাবা-মাকে বলা হয়েছে অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন করাতে ভরতি হচ্ছি। ওদের একদিনও নার্সিং হোমে যেতে দেওয়া হয়নি।’

‘আচ্ছা রমেনবাবু, এই রক্ত বেচা, কিডনি বেচা, যাতে আপনি মারা যেতে পারতেন-‘

‘পারতাম কী, এখনও পারি!’ রমেন ব্যস্ত হয়ে ভুল শুধরে দিল।

‘এ কাজ করলেন কেন?’

‘মানে?’ বিভ্রান্ত হয়ে রমেন তাকিয়ে রইল।

‘কার জন্য এসব করলেন?’

প্রশ্নটার গূঢ় অর্থ যেন ধরতে পেরেছে এমন একটা ভাব ফুটে উঠল রমেনের মুখে। সরল হাসিতে তার মুখ ভরে গেল।

‘কেন, সবার জন্য।’

শ্রীমন্ত উঠে দাঁড়াল।

ব্রজরাখাল মুখুজ্জে চেয়ারে গা এলিয়ে তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে। তাঁর চোখ থেকে দ্বিধা সন্দেহটা এখনও সরে যায়নি। আবার সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই মন থেকে বলছিস তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘তা হলে বিমল চক্রবর্তীকে জানিয়ে দি?’

‘দাও।’

ব্রজরাখাল ফোনের দিকে হাত বাড়ালেন। টেবলে দামি সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার। ফোন ডায়াল করতে করতে আড়চোখে তিনি দেখলেন প্যাকেট থেকে শ্রীমন্ত একটা সিগারেট বার করে ঠোঁটে চেপে ধরল। চোখের দৃষ্টি সে ঘুরিয়ে নিল। ওধার থেকে সাড়া দেবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে লাইটার জ্বালার খস-খস শব্দ পেল।

‘হ্যালো, হ্যাঁ আমি ব্রজ মুখুজ্জে। আমি তো বলেই ছিলাম রাজি হবে। আপনার মেয়েকে ভাগ্নেবউ করার সৌভাগ্য…আরে না না, আমার বাবা বিপ্লবী ছিলেন তাতেই এই পরিবারের মর্যাদা, সম্মান, আমি আর কতটুকু কী করেছি…’ ব্রজরাখাল আড়চোখে দেখলেন শ্রীমন্ত চেয়ার থেকে উঠে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

ঘরের বাইরে এসে শ্রীমন্ত উঠোনের ওধারে অকাদাদুর ঘরের পর্দার নীচে আলো দেখতে পেল। সিগারেটটা ফেলে পায়ে মাড়িয়ে সে দাদুর ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল।

পর্দা সরিয়ে সে সোজা দাদুর খাটের ধারে এসে দাঁড়াল। নার্স একটা বই পড়ছিল, চমকে উঠে দাঁড়াল। চোখ বন্ধ ছিল, শ্রীমন্তর হাত কপালে পড়তেই খুললেন। ঝুঁকে এল শ্রীমন্তর মুখ।

‘তোমাকে যখন পিস্তল দিয়ে বিশ্বাসঘাতকটাকে মারতে বলা হয়েছিল, তুমি মারনি…কেন?’

অক্ষয়ধন মিত্রের চোখ ধীরে ধীরে স্ফীত হয়ে উঠল। ঠোঁট দুটো কাঁপছে। কিছু একটা বলতে চেয়েও বলতে পারছেন না। আর সেই না পারার যন্ত্রণাটা তাঁর দুটো হাতের আঙুলগুলোকে বেঁকিয়ে দিল।

‘দাদু তুমি ক্ষতি করেছ।…দাদু আমি তোমায় শ্রদ্ধা করি।’

শ্রীমন্ত আর কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, চিরদিনের জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *