নীলথলি – মতি নন্দী – উপন্যাস

নীলথলি – মতি নন্দী – উপন্যাস

কাল পৌনে দশটা থেকে দশটার মধ্যে তিনজন একসঙ্গে আসবে। দশটা পনেরোয় ওরা যে যার বাড়ির দিকে রওনা হয়ে যাবে। প্রতিদিনই এমন, অবশ্য স্কুলের ছুটির দিনগুলো বাদে।

শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের যে মাথাটা থেকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডের ধড়টা দক্ষিণে শেয়ালদার দিকে প্রসারিত, সেই মাথায় এসে প্রতিদিন ওরা গাড়িবারান্দার নীচে দাঁড়ায়-নরেন্দ্র বালিকা শিক্ষা নিকেতনের প্রাথমিক বিভাগের তিন শিক্ষয়িত্রী: গীতা চ্যাটার্জি, অর্চনা মাইতি আর বেলা দাস। তিনজনেই বিবাহিতা।

ওরা কথা বলতে বলতে স্কুল থেকে বেরোয়। কিছু কথা ওদের থাকেই যেটা টিচার্স রুমে অন্যদের সামনে আলোচনা করতে চায় না। এই মোড়ে দাঁড়িয়ে, ট্রামে-বাসে ওঠার বা হেঁটে রওনা হওয়ার আগে সেই কথাগুলো ওরা বলে এবং শোনে। অবশেষে প্রায়শই বিষয়টি অসম্পূর্ণ রেখে, কিছু প্রশ্ন, বিস্ময় বা সিদ্ধান্ত সঙ্গে নিয়ে ওরা তিন দিকে চলে যায়। গীতা উলটোডাঙায়, অর্চনা পাইকপাড়ায় এবং বেলা আহিরিটোলায়।

একসময় ওদের প্রিয় বিষয় ছিল হেডমিস্ট্রেস অরুণা পোদ্দার। স্বল্পবাক, কটুজিহ্বা, মধ্যবয়সি এই মহিলা বেলেঘাটায় সি আই টি ফ্ল্যাটে একা কেন থাকেন এবং তিনি স্বামী-পরিত্যক্তা। কুমারী, তাই নিয়ে ওরা বাদানুবাদ করেছিল এই মোড়ে দাঁড়িয়ে।

অরুণা পোদ্দার নামের আগে মিসেস অথবা মিস না লিখে শ্রীমতী লেখেন। এতদ্দ্বারা কিছু বোঝায় কী?

‘কুমারী মেয়েদের নামের আগেও শ্রীমতী লেখা যায়।’

‘যায় না। শুধু বিবাহিতাদের বেলায়ই লেখা হয়, তাই হয়ে আসছে… এটা তফাত বোঝাবার জন্য, রবীন্দ্রনাথ তাই-ই বলেছেন।’

রবীন্দ্রনাথের নাম হতেই গীতা চুপ করে যায়। অর্চনার স্বামী একসময় কলেজে বাংলা পড়াত। এখন বিরাট এক চামড়া রপ্তানি প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ বিভাগে তিন নম্বর পদে রয়েছে।

গীতা আর জিজ্ঞাসা করল না কবে কোথায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন।

বেলা মুখচোরা, লাজুক ধরনের। এই সব তর্কে সে অস্বস্তি বোধ করে। ছোটোবেলা থেকেই সে ঝগড়া বা তর্ক এড়িয়ে চলেছে। এটা জন্ম থেকেই ওর চরিত্রে ছিল, আরও বিকশিত হয় বাড়ির পরিবেশের জন্য। গীতা বা অর্চনা যখন কথা বলে সে প্রায়শই চুপ করে থাকে।

আজ তাদের বিষয় নতুন শিক্ষয়িত্রী দেবিকা দাশগুপ্ত।

এপ্রিলের মাঝামাঝি, দশটাতেই রোদ অসহনীয় চিড়বিড়ে হয়ে ওঠে। দরদর ঘাম গড়ায় গাড়িবারান্দার নীচে ছায়াতে দাঁড়িয়েও। ওরা মিনিট চারেক হেঁটে স্কুল থেকে এখানে পৌঁছেছে এবং ঘামছে। এখন কলকাতা নেমে পড়েছে ঊর্ধ্বশ্বাস কাজে।

অথচ সকাল ছ-টায় বেলা যখন এই জায়গাতেই বাস থেকে নামে তখন শান্ত, প্রায় নির্জনই থাকে। স্টেশনারি আর মিষ্টির দোকানগুলো খুলে যায়। বাচ্চচাদের স্কুলে পৌঁছে দেবার পথে বাবা কিংবা মা চট করে খাতা বা কেক কিনে নেয় কিংবা সন্দেশ। চায়ের দোকানে কিছু লোক খবরের কাগজ পড়ায় ব্যস্ত থাকে। দুধের ডিপোয় লাইন, লুঙ্গি বা পাজামা পরা লোকেরা থলি হাতে বাজারে যাচ্ছে, তখনও চোখে ঘুম। খবরের কাগজের ডাঁই বন্ধ দোকানের সিঁড়িতে রেখে বা ফুটপাথের রেলিংয়ে ঝুলিয়ে বিক্রি করে যাচ্ছে কাগজওয়ালা। স্তূপাকার ডাব নিয়ে কাটারি হাতে রোজই ফুটপাথে বসে থাকে দু-তিনজন। বেলা দ্রুত স্কুলের দিকে যেতে যেতে রোজ এই সবই দেখতে পায়। প্রায় একই দৃশ্য। সে এখন আর কিছু লক্ষ করে না। শুধু সতর্ক থাকে তখনও যারা ফুটপাথে ঘুমিয়ে তাদের গায়ে যেন পা না লাগে।

কিন্তু চার ঘণ্টার মধ্যেই পাঁচমাথার মোড়টা বেগবান ভারী মোটা একটা চাকার মতো ঘুরতে থাকে। থিকথিকে জনতা, প্রত্যেকেই ব্যস্ত। অধিকাংশের তিরিক্ষে মেজাজ, প্রত্যেকেরই মাথার মধ্যে একটা কিছু উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন, কেউই দরকার ছাড়া স্থাণু নয়। এদের মাঝে বেলা নিজেকে এই সময় বেমানান বোধ করে। তবু ভালো লাগে এই পরিবেশটা। ধাতব বা মনুষ্য নানান মারুতি, রং, ভঙ্গি, গতি এবং ব্যস্ততার একটানা শব্দ আর অজস্র মুখের আসা-যাওয়ার, ঝকঝকে রোদের, ট্রাম বাস মোটর থেকে রিকশা বা ঠেলাগাড়ির ক্রমশ এগিয়ে আসা ও চলে যেতে যেতে বাড়ির আড়াল পড়ার… এর মধ্যে বেলা এক ধরনের উৎকণ্ঠিত চাঞ্চল্য বোধ করে।

শিব দত্ত লেনে একতলা বাড়ির একখানা ঘর আর ছাদের জীবন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটা জগৎ যার খানিকটা নিয়ে সে রোজ বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে। কিন্তু তিমিরের কোনো আগ্রহ বা ঔৎসুক্য নেই। নিজের ছোট্ট জগৎটাকে কিছুতেই বিব্রত করতে ও যেন রাজি নয়। যেমন-

‘আজ দেখলাম, একটা পকেটমারকে বাস থেকে নামিয়ে কী মার মারলো।’

‘ঠিকই করেছে।’

‘মরে যেতে পারে…রক্ত বমি করছিল। দেখে গাটা যা করে উঠল।’

‘দ্যাখো কেন!’

তিমির নিরাসক্ত স্বরে কথাগুলো বলেই গভীর মনোযোগে কাচা পর্দাগুলোয় জল ছিটোতে থাকে ইস্ত্রি করার জন্য।

গীতার থলথলে বাহু থেকে ঘাম গড়িয়ে কনুই পৌঁছে গেছে। আঁচল দিয়ে মুছে নিল। সপসপ করছে ব্লাউজ, সুতোর মতো পাউডার গলার চামড়ার ভাঁজে, পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স।

‘আজ গরমটা যেন আরও বেশি। পরশু তো একশো দুই ছিল। কাল কত ছিল কে জানে।’

‘কাগজ থেকে দেখে নিলেই তো হয়।’

অর্চনা পত্রিকা সাজানো দোকানটার দিকে এগিয়ে গেল। শোনার দূরত্বের বাইরে সে পৌঁছতেই গীতা গলা নামিয়ে বলল:

‘আমার কিন্তু মনে হয় বীরেনবাবু ঠিকই দেখেছে, ওইসব জায়গায় ভদ্রলোক রেগুলারই যান…অর্চনা যতই চাপার চেষ্টা করুক না। ওদের ফ্ল্যাটে অনেক খালি বোতল দেখেছি। ফুর্তিটুর্তি করবে না কেন, উপরি আয় আছে তো।’

‘কিন্তু খুব ভালো করে না জেনে একজন টিচারের নামে এ ধরনের কথা বলা উচিত নয়, বীরেনবাবু কি দেবিকা দাশগুপ্তকে চেনেন?’

ততক্ষণে বেলা আরও কিছু বলত, কিন্তু অর্চনা ফিরে এসেছে। বেলার শেষ বাক্যটি তার কানে গেছে।

‘কাল একশো পয়েন্ট চার…ওঁর সঙ্গে যে বন্ধু ছিল সে দেবিকাকে চেনে…চেনে মানে এক পাড়াতেই থাকে। আমি অবশ্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেরা করেছি, আমাদের কলিগের নামে যা-তা বললে অমনি মেনে নেব?’

‘কী বলল?’

গীতা এবং বেলা দু-জনেই ঘেঁষে এল অর্চনার কাছে।

‘গীতাদি বলব কী তোমায়, যা যা বলল সব মিলে যাচ্ছিল। বাঁ হাতের মাঝের আঙুলে নীলপাথর বসানো রুপোর আংটি, বাঁ কানের নীচে তিল, চ্যাপটা নেপালি-নেপালি মুখ, ঘাড় পর্যন্ত চুল, ফর্সা ছিপছিপে, আমাদের থেকেও আধ ফুট লম্বা। বিশ্বাস করবে না, যে শাড়ির কথা বলল, ঠিক সেই রকমই মুর্শিদাবাদি সিল্ক পরে ও ক-দিন আগেই স্কুলে এসেছিল।’

‘কালোর ওপর ছাই-ছাই আর সাদা নকশা?’

‘হ্যাঁ ওটাই। তবে ব্যাগটা মেলেনি…বলল লালব্যাগ হাতে ছিল, হয়তো দু-তিনটে আছে।’

দেবিকা দু-মাস স্কুলে এসেছে। সব টিচারের থেকে বয়স কম সাতাশ-আটাশ, বাসকেটবল খেলেছে বাংলার হয়ে, বিয়ে হয়নি। সকলের মতো বেলারও প্রথমেই চোখে পড়ে ওর উচ্চচতা।

‘খুব লম্বা তো তুমি, বাঙালিদের মধ্যে বড়ো একটা চোখে পড়ে না।”

বেলা এইভাবেই প্রথম আলাপ করেছিল।

‘আপনি হলেন সাতশো ছাপ্পান্নতম যিনি আমাকে এই কথাটা বললেন।’

দেবিকা তারপর হেসে উঠেছিল। চমৎকার সাজানো দাঁত।

‘উঁচু তাক কী আলমারির মাথা থেকে কিছু পাড়তে হলে ডাকবেন…মুশকিল কি জানেন, নিজেকে কোথাও লুকোতে পারি না। ‘ওই যে ঢ্যাঙা মেয়েটা’ ব্যস সবাই বুঝে যায় কে মেয়েটা। আচ্ছা, খুব কী লম্বা? দাঁড়ান তো পাশে…কই, কতটা আর।’

বেলার মাথাটা হাত দিয়ে নিজের কাঁধের কাছে চেপে ধরে দেবিকা তাকিয়ে থাকা গীতাকে বলেছি: ‘বলুন তো কতটা?’

‘আমাদের সবার মধ্যে বেলাই লম্বা, তুমি তার থেকেও এক মাথা, কী আর একটু বেশিই হবে।’

‘বেলাদি, আপনার হাইট কত?’

বিব্রত হয়েছিল বেলা। নিজের উচ্চচতা সে জানে না, কখনো মাপায়নি। তিমিরের বুকের কাছে তার মাথা পড়ে। বিয়ের দিন-দশেক পর, ছাদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে চুমু খেয়ে তিমির বলেছিল : ‘আর একটু লম্বা হলে ভালো হয়। হাইট কত?’

বেলা অস্বস্তি বোধ করেছিল। দাঁড়িয়ে চুমু খাওয়ার মতো কোনোরকম অবস্থা যাতে তৈরি না হয় সেদিকে সজাগ থাকত। তবে বছরখানেক পরই তিমির নিস্পৃহ হয়ে গেছল। গত তিন-চার বছরে সে কদাচিৎ চুমু খেয়েছে।

‘ইনি তো দেবিকাকে দেখেননি, তাহলে এত মিলন কী করে? নামটাও বলেছিল।’

বেলার চোখ পড়ল ট্রাম রাস্তার ওপরে আনাজের বাজারে নানান মাপের ফুটবলের মতো তরমুজের স্তূপ। এক বুড়ি উবু হয়ে বাছাবাছি করছে।

‘যদি সত্যি হয় তাহলে এমন মেয়েকে টিচার রাখা উচিত নয়। এতে স্কুলের বদনাম হয়।’

‘উনিও তাই বলছেন, ধরো যদি কোনো গার্জেন চিঠি দেয়! বাচ্চচারা যদি শোনে তাদের টিচার পার্ক স্ট্রিটের রেস্টুরেন্টে গিয়ে…’

‘রেস্টুরেন্ট বলে না বার বলে? বইয়ে তো বার-ই পড়ি।’

‘ওই হল, পাঁচ-ছজন পুরুষমানুষ নিয়ে মাঝরাত পর্যন্ত বসে মদ খাচ্ছে; এটা যদি বাচ্চচারা শোনে ওদের মনের ওপর কী এর প্রভাব পড়বে না?’

অর্চনার রক্তশূন্য পাণ্ডুর মুখ ক্রমশ লালচে হয়ে উঠছে। গরমে কিংবা উত্তেজনায়। কথা বলছে দ্রুত চড়া স্বরে। চোখের মণি বড়ো হয়ে চশমার কাঁচ জুড়ে ফেলেছে।

গভীর চিন্তার মধ্য থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসার মতো শ্লথ-কণ্ঠে গীতা বলল: ‘না না, ওরা অতটা হয়তো বুঝবে না, কিন্তু বদনাম হবে আমাদেরই। লোকে ভাববে আমরাও হয়তো…’

গীতা চ্যাটার্জির চোখ ছিল বেলার উপর। সে দেখল বেলার ঠোঁট ফাঁক হয়ে একটা পাতলা হাসি বেরিয়ে আসছে।

‘অবশ্য বদনাম পাবার মতো বয়স কী চেহারা আর আমার নেই, সে বরং তোমাদেরই আছে।’

অর্চনার লম্বাটে তোবড়ানো গাল আবার পাণ্ডুর হল।

‘আর ঠাট্টা কোর না আমাকে নিয়ে। বরং বেলারই ছেলেপুলে নেই, বাঁধনছাঁদন ঠিক রেখেছে।’

দু-জনে তার দিকে তাকিয়ে। বেলার মনে হল অনেকক্ষণ সে কথা বলেনি, এবার কিছু একটা বলা দরকার যাতে এরা খুশি হয়।

‘আমার বাঁধনছাঁদনটা কোথায় দেখলে! তোমাদের কারোর মতোই তো আমার রং নয়, চোখ মুখ নাকও নয়। গায়ে মাংসও এমন কিছু নেই, তাহলে?’

গীতা মুখটিপে হাসল। অর্চনা মুখে একটা শব্দ করল বেলার বুক পেটের উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে।

কী আছে তার শরীরে বা এদের ঈর্ষার কারণ? সাধারণ, অতিসাধারণ তাকে দেখতে এটা বেলা জানে। তার বয়স এখন তেত্রিশ, অগাস্টে চৌত্রিশে পড়বে। অর্চনা তার থেকে ছ-মাসের ছোটো। এখনও তার বুক শক্ত, তলপেটে চর্বি জমেনি, চামড়া মসৃণ, কুঞ্চন বা দাগ নেই, কাঁধ কি বাহু ডৌল হারায়নি, হালকা গোল চওড়া পাছা বেমানান নয় কোমরের সঙ্গে।

শরীর নিয়ে সে খুব ভাবে না। আলাদা যত্ন নেয় না। তার শরীর এইভাবেই বেড়ে উঠেছে শৈশব থেকে বাল্য, কৈশোর, যৌবন…এখনও তার যৌবন চলছে। কিন্তু কীভাবে? বাইরে বেরোলে পুরুষরা তাকে কী লক্ষ করে? যদিইবা করে তাতে কী?

‘তবে দেবিকার থেকে আমার কিন্তু বেলার গড়নই ভালো লাগে। দেবিকা কীরকম যেন কেঠো কেঠো, পুরুষালি ধরনটাই বেশি, তাই না গীতাদি?’

দেবিকার শরীরে এক মিলিগ্রামও বাড়তি মেদ নেই তাই ওকে উচ্চচতার থেকে লম্বা দেখায়। মুখশ্রী ভালো নয়, হাঁ-মুখ বড়ো, ঠোঁট পুরু, গোঁফের ক্ষীণ আভাস দেখা যায়, কাঁধটা পুরুষের মতো চওড়া। বেলা নিজেই একবার অর্চনাকে বলেছিল, ‘প্যান্ট শার্ট পরলে ওকে ছেলে মনে হবে।’

অথচ ভালো লাগে। একটা স্ফূর্তি উদ্ধত ভঙ্গিতে দেবিকার কাঠামোর মধ্যে নড়াচড়া করে। সবসময়ই তাজা খটখটে। বেলা এটাই পছন্দ করে। কোনোরকম বিষণ্ণতা ছড়ায় না ওর শরীর! সবল আস্থা।

‘এসব নিয়ে আলোচনার দরকার কী।’

গীতা ঘাম মুছল। অস্বস্তি জানাল, ‘উফফ’ বলে। অর্চনা ঘড়ি দেখল। গীতা ছাতাটা ছড়িয়ে দেবার জন্য ঝাঁকাল। ওদের দিকে পরিচিতের মতো হেসে এক মহিলা চলে গেল। হয়তো কোনো ছাত্রীর মা।

‘বড্ড গরম, কাল যেন কত হয়েছিল?’

‘একশো এক পয়েন্ট চার।’

‘আজ ছয়-সাত হবে। যাই, বড্ড তেষ্টা পাচ্ছে। বাড়ি গিয়েই তো আর ফ্রিজের জল পাব না।’

গীতা প্রায়ই কথাটা বলে। অনেকটা যেন আপনমনে। অর্চনা হাসবার চেষ্টা করল। স্কুলের টিচারদের মধ্যে শুধু তারই ফ্রিজ আছে। কিছুদিন ধরেই সে টিভি কিনবে বলছে।

ব্রেক কষার কর্কশ শব্দ হল। সবার মতো ওরাও তাকাল। একটা প্রাইভেট বাসের সামনে থতোমতো এক প্রৌঢ়। ছুটে অশ্বারোহী নেতাজি মূর্তির দ্বীপটায় উঠে পড়ল লোকটি এবং ব্যস্ত হয়ে অপর দিকে চলে গেল, একবারও ফিরে তাকাল না। এরা তিনজন মুচকি হাসল। এরকম দৃশ্য প্রায়ই দেখতে হয়।

গীতা চলে যাবার পর অর্চনাও ইতস্তত করল।

‘বীরেনবাবু ঠিক দেখেছেন?’

‘তবে কি বানিয়ে বানিয়ে বলল?’

‘উনিও ওখানে যান?’

‘ন্যাকামো করিসনি। বলেছি তো কোম্পানির কাজে বড়ো বড়ো পার্টির লোকেদের এন্টারটেন করাতে মাঝেসাঝে নিয়ে যেতে হয়। গীতাদির মতো তুইও একই কথা বার বার বলিস।’

‘বারবার আর কবে বললাম, ব্যাপারটা সিরিয়াস তাই…দেবিকা সত্যিই খাচ্ছিল?’

‘দূর থেকে কী বোঝা যায়, সফট ড্রিঙ্কও হতে পারে, তুই কিন্তু এই নিয়ে আর কাউকে কিছু বলিসনি। গীতাদিকে বলাটাই ভুল হয়ে গেছে, যা লোক। কারোর ভালো একদম দেখতে পারে না।’

‘কার ভালো, দেবিকার?’

‘আহা, দেবিকার কেন, ওকি ভালো কাজ করছে! ফ্রিজ নিয়ে গীতাদির এই যে ঠেস দেওয়া কথা…কেনরে বাবা, আমার যদি ফ্রিজ কেনার ক্ষমতা থাকে তাহলে কিনব না কেন? ভোগ করব না কেন?’

‘সিগারেট খাচ্ছিল?’

‘ও খায়নি।’

‘নাচ?’

‘ওই কাঁধ আর কোমর ধরে, সিনেমায় হোটেলের সীনে যেমন দেখি, একটু খালি জায়গায় একগাদা মেয়ে-পুরুষ, নাচ বলতে ওই পাছা দুলিয়ে দুলিয়ে…।’

‘ক-জনের সঙ্গে?’

‘তা অত জিজ্ঞাসা করিনি।’

‘একদিন গেলে হয়।’

‘কোথায়?’

অর্চনা হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে। বেলার মজাই লাগল।

‘তুই আর আমি চুপিচুপি একদিন…শুধু কী রাতেই হয়? বীরেনবাবুকে জিগ্যেস করে দেখিস তো দুপুরের দিকে নাচটাচ হয় কিনা আর খরচ কত পড়বে।’

‘ঠাট্টা করছিস।’

‘সত্যিই। বীরেনবাবুর সঙ্গেই নয় যাব। বলে দেখিস না একবার!’

অর্চনা ঘড়ি দেখল। এসব বাজে কথা শোনার দরকার নেই এমন মুখভঙ্গি করে বলল:

‘তাহলে দেবিকার সঙ্গে কথা বললেই তো পারিস!’

বাসস্টপের দিকে অর্চনা এগোচ্ছে। বেলা তাকিয়ে থাকতে থাকতে কলকাতার অন্যতম এই ব্যস্ত অঞ্চলের ধ্বনি, রং, দুর্গন্ধ নোংরা রাস্তা মালিন্য এবং চলমানতা সম্পর্কে সচেতন হল।

তরমুজের স্তূপের দিকে তাকিয়ে বেলার মনে হল, বহু বছর সে বোধহয় তরমুজ খায়নি। বাজার করে তিমির, বললেই নিশ্চয় আসবে। আসলে সে কখনো বলেনি। না বলার কারণ হয়তো, তিমিরের শরীর ভারী জিনিস বয়ে আনার মতো নয়। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। রুগণ, হাঁপানি আছে। ওর কষ্ট হবে। কিংবা শখ ব্যাপারটাই তার নিজের মধ্যে নেই। তরমুজ খাওয়া তো এক ধরনের শৌখিনতাই।

দেবিকাও কি শখ করে পার্ক স্ট্রিটের বারে গেছল? হতেও পারে। নানান মানুষের নানারকম শখ থাকতে পারে। বেলা সতর্ক চোখে দু-ধারে তাকাল রাস্তা পার হবার জন্য। একটা বাসের দরজায় উন্মত্ত ঠেলাঠেলির মধ্যে অর্চনা সেঁধোবার চেষ্টা করছে।

পরপর দুটো রাস্তা, প্রফুল্লচন্দ্র রোড ও বিধান সরণি পার হয়ে ভূপেন বসু অ্যাভিন্যুর ফুটপাথে বেলা উঠল। হাঁটা কঠিন। সরু ফুটপাথ তাকে আরও সরু করে দিয়েছে মাটিতে বসা পসারিরা।

‘দিদি, চলে যাচ্ছেন যে, নেবেন না? আজই জনতা লটারির খেলা।’

না দেখার ভান করে বেলার চলে যাওয়া আর হল না।

কোমর-উঁচু কাঠের কাউন্টার। তার উপর ভারতের যাবতীয় লটারির টিকিট সাজানো। ফুটপাথের রেলিংয়ে ছোটো একটা বোর্ড ঝুলছে লটারির নাম ও খেলার তারিখ জানিয়ে। কাউন্টারের একধারে বড়ো লাল অক্ষরে লেখা ‘পরশমণি’। লোকটার মাথার উপর দেওয়ালে একটা পোস্টার : ‘আপনি লাখপতি কিন্তু আপনি তা জানেন না।’

‘না, এবার থাক।’ টিকিটগুলোর উপর চোখ রেখে বেলা বলল। বহু টাকার টিকিট সে কিনেছে। তাড়া করে বাঁধা আছে এখনও।

‘না, না, ফেলতে হবে না।’

‘কী হবে! খেলা তো কবে হয়ে গেছে!’

‘হয়তো তুমি জান না তোমার নম্বরটাই উঠেছিল। কিন্তু তুমি লক্ষ করোনি। কিংবা হয়তো রেজাল্ট ভুল ছাপা হয়েছে-পরে ধরা পড়ে যদি ঠিক নম্বরকে প্রাইজ দিতে যায়…বলা যায় না হয়তো সেটা তোমারই নম্বর, ওগুলো রেখে দিতে ক্ষতি কী।’

তিমিরই তুলে রেখেছে। খুঁটে অনেক কিছুই ও রেখে দিয়েছে…দেরাজের হাতল, ইলেকট্রিকের ভাঙা সুইচ, ছেঁড়া চটি, ভাঙা কাঁচি, শাড়ির পাড়, পুরোনো ব্লেড ও প্রচুর স্মৃতি সতর্কতা এবং উদবেগ।

‘কিছুই নেবেন না?…মধ্যপ্রদেশ নিন না, ডেইলি খেলা, প্রথম পুরস্কার পাঁচ হাজার। নাগাল্যান্ড প্রথম প্রাইজ লাখ টাকা, মিনি খেলায় দশ হাজার…ত্রিপুরার তিনটে ফার্স্ট প্রাইজ লাখ টাকার, রয়্যাল ভুটানের সাপ্তাহিক খেলা এক লাখ কুড়ি হাজার, তিনটে সেকেন্ড দশ হাজার করে, আয়কর মুক্ত।’

লোকটা ঘাম মুছল কপালের। একটানা মুখস্থ বলেছে। বেলা ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে না। চোখাচোখি হলে, টানা সুরে এভাবে বলে যেতে অসুবিধে হবে। ওর স্বরে যে আবেদনটা রয়েছে সেটা তার ভালো লাগছে।

‘…তিরিশ লাখ টাকা!’

‘কী বললেন?’

‘রাজস্থানে ফার্স্ট প্রাইজ তিরিশ লাখ টাকা, সেকেন্ড তিন লাখ। খেলার আর আটাশ দিন বাকি।’

‘তি-রি-শ লাখ।’

বিশ্বাস করতে পারছে না বেলা। সন্দেহই ফুটে উঠল তার কথায় এত টাকা কী করে দেওয়া সম্ভব। মিথ্যে, লোক ঠকানো ব্যাপার নয়তো! কত কোটি লোক তাহলে টিকিট কেনে!

‘বিশ্বাস সত্যিই করা যায় না, কিন্তু টিকিটে তো লেখাই রয়েছে, গুনে দেখুন…কটা শূন্য তিনের পর, এক দুই…ছটা শূন্য আছে কিনা দেখে নিন।’

এগিয়ে ধরা টিকিটে শূন্যগুলো একটার সঙ্গে আর একটা জড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি শূন্যের পিছনে কত টাকার প্রতিশ্রুতি? কেউ পেয়েছে কি একসঙ্গে এতটাকা? নিশ্চয় পেয়েছে। পেয়ে কী করেছে?

‘বলা যায় না, তিরিশ লাখ হয়তো এই টিকিটটা থেকেই উঠতে পারে। দিদি আপনার ঠিকুজি আছে কী, থাকলে একবার জ্যোতিষীকে দেখিয়ে নিন। আমার দেওয়া টিকিটে একজন পশ্চিমবঙ্গের, আর একজন হরিয়ানার সেকেন্ড প্রাইজ জিতেছে।’

‘অনেক তো কিনলাম, হল কী?’

‘এক একজন পাঁচ বছর, সাত বছর কিনে যাচ্ছে। পরপর নম্বরে পঁচিশটা, তিরিশটাও অনেকে কেনে। কেন কিনছে?’

লোকটার মতো চোখের উপরের চামড়া কী তারও এইরকম কোঁচকায়, স্বরও কী বুজে আসে যখন সে ক্লাসে বোঝায়!

‘খরগোশটা যদি একলাফে পঞ্চাশ কিলোমিটার অতিক্রম করে তাহলে পঞ্চাশ মিটার যেতে…পাঁচশো লাফ কী করে হয়? কত মিলিমিটারে এক মিটার? চুপ করে আছ কেন?’

‘বলুন কেন তাহলে কিনছে? পাবার আশা আছে বলেই তো?…বরাত, বুঝলেন দিদি বরাত, থাকলে পাবেনই। কতদিকে কতভাবেই টাকা নষ্ট হচ্ছে, মাত্র এক টাকা দু টাকার তো ব্যাপার!…হ্যাঁ, বলুন দাদা?’

‘একটা পশ্চিমবঙ্গ দিন।’

বেলা সরে দাঁড়াল। হাতে রেশন থলি, রুগণ কালো লোকটার পাঞ্জাবি শরীরে লেপটে রয়েছে ঘামে। ভঙ্গিতে ব্যস্ততা। টিকিট নিয়েই চলে যাচ্ছিল।

‘একটা রাজস্থান এবার…’

‘না।’

লোকটা মুখ না ফিরিয়েই বলে গেল।

স্ট্রিক্ট প্রিন্সিপালের লোক। ছ মাস ধরে রেগুলার শুধু একটাই কিনে যাচ্ছেন।’

‘একটা রাজস্থান তাহলে দিন।’

‘দুটো সিরিজে দুটো নিন, ডবোল চান্স থাকবে।’

‘না।’

বেলা সদ্য টিকিট ক্রেতাটির স্বরই প্রায় গলায় এনে ফেলল। স্ট্রিক্ট প্রিন্সিপালের লোক হবার চেষ্টায় কী? কড়া হওয়া তার ধাতে নেই, চেষ্টা করে দেখেছে।

যদি পেয়ে যায়। তিনের পর শূন্যগুলোর দিকে তাকিয়ে বেলা অদ্ভুত এক উৎকণ্ঠা আর তাজা আরামবোধ করল। এই নিয়ে কতবার যে এই আরামটা সে পেল। টিকিটটা ব্যাগে রেখে লোকটির মুখের দিকে না তাকিয়েই সে হাঁটতে শুরু করল।

তিরিশ লাখ টাকা হয়তো পেয়ে যেতে পারে…পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, এমন একটা চিন্তায় অন্তত সাতদিন সে আচ্ছন্ন থাকবে। এক ধরনের ভয়-ভয়ও করবে। এই মুহূর্ত থেকেই সেটা শুরু হয়ে গেছে।

যদি টিকিটটা হারিয়ে যায়, চুরি যায়…কিংবা ব্যাগটা যদি ছিনতাই হয়? বেলা বাসস্টপে দাঁড়িয়ে ব্যাগের মুখটা অল্প ফাঁক করে টিকিটের নম্বরটা পড়ার চেষ্টা করল। শুধু ‘জেড’ আর দুটো সংখ্যা ছাড়া আর পড়তে পারল না। বাড়িতে পৌঁছেই নম্বরটা ডায়েরিতে লিখে রাখতে হবে।

বাসস্টপে ভিড়। এখান থেকে বত্রিশ রুটের বাস তার পাড়া দিয়ে যাবে। আরও তিন-চারটে রুটের বাসে সে যেতে পারে বটে তবে মিনিটপাঁচেক হাঁটতে হবে। আর এখান থেকে হাঁটলে কুড়ি মিনিট। এই চিড়বিড়ে রোদে ছাতা মাথায় প্রায়ই তাকে হেঁটে ফিরতে হয়। এটা অভ্যাস হয়ে গেছে। তবু সে বাসস্টপে আসে, যদি বরাত জোরে…’বরাত’ শব্দটা লটারিওলাও ব্যবহার করেছে। দাঁড়িয়ে যাবার মতো জায়গা যদি বাসে পাওয়া যায়।

বত্রিশ নম্বর বাসটা দেখে বেলা মনে মনে কাতরে উঠল। অসম্ভব।

একটা স্কুলের মেয়ে, বুকের কাছে বই ধরে বাসটা থেকে নামতে চাইছে। সামনের লোককে ধাক্কা দিচ্ছে মুখবিকৃতি করে। দুটো লোক একসঙ্গে ঠেলে উঠতে চাইছে। মেয়েটি নামার আগেই বাসটা ছেড়ে দিল। হইচই উঠল প্রতিবাদের। মেয়েটি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছে। রাস্তায় বইগুলো ছড়িয়ে। বাসটা থমকে রয়েছে।

‘বেঁচে গেল…পেছনের চাকায় যেত।’

বেলার পাশে দাঁড়ানো লোকটি শান্তস্বরে বলল।

মেয়েটি উঠে পড়েছে। একজন বইগুলো কুড়িয়ে দিল। কিছু লোক আবার বাসে ওঠার চেষ্টা শুরু করেছে। কনুই আর হাঁটু থেকে রক্ত পড়ছে। সাদা ফ্রকটায় ধুলো লেগে। মেয়েটার মুখে ভয় এবং লজ্জা। বাসটা রওনা হয়ে গেছে।

‘টিটেনাস ইঞ্জেকশান নেওয়া উচিত!’

বেলা কর্ণপাত করল না কথাটায়। সে বুঝতে পারছে লোকটি তার গলা-বুক দেখছে। এই প্যাচপ্যাচে ঘাম আর রোদে ব্যাপারটা বিরক্তিকর বিশেষত সামনেই যখন মিনিট কুড়ি হাঁটার একটা কাজ রয়েছে!

সে হাঁটতে শুরু করল। ভূগর্ভ রেলের জন্য খোঁড়া হবে তাই টিন দিয়ে ঘিরে ফুটপাথ কমিয়ে রাস্তার একদিকটা চওড়া করার কাজ চলছে। বেলাকে সন্তর্পণে হাঁটতে হচ্ছে টুকরো ইট, ঢিপি, গর্ত সামলে। কতদিন লাগবে রেল চালু হতে? টিচার্সরুমে একদিন কথা উঠেছিল।

‘পরের শতাব্দীতে মনে হয় চলবে।’

‘আমাদের নাতিনাতনিরাই চড়বে।’

‘যা বলেছ, আমরা আর দেখে যেতে পারব না।’

‘কেন, পরের শতাব্দী পর্যন্ত কী বাঁচবেন না!’

ওরা সবসময়ই নৈরাশ্যকর ভাবভঙ্গি আর কথা বলে চারপাশে একটা গুমোট তৈরি করে রাখে। তিমিরও অনেকটা এই ধরনের। কখনো জোরে হাসে না, জোরে কথা বলে না। স্তিমিত একঘেঁয়ে কণ্ঠস্বর। হয় খুটখাট সাংসারিক কাজ করে নয়তো পায়ের উপর পা তুলে জানলায় ঠেস দিয়ে মেঝেয় বসে থাকে। কথা যা বলে, ট্রাম-বাস-অফিস থেকে কুড়িয়ে আনা মামুলি।

‘লোডশেডিং থেকে এ জন্মে আর রেহাই মিলবে না।’

‘তার মানে আরও কত বছর?’

‘দশ-পনেরো, বড়োজোর বিশ।’

এই ক-টা বছরের বেশি বাঁচার কথা তিমির ভাবতে পারে না। কুড়ি বছরই যদি হয় তাহলে তিমির প্রায় সত্তর আর সে নিজে চুয়ান্ন বছর পর্যন্ত বাঁচছে। মাত্র চুয়ান্ন, তার জন্য বরাদ্দ!

বাজার থেকে ফিরে তিমির একদিন বলল : ‘কী দাম হয়েছে জিনিসের। খেয়ে পরে বাঁচতে হলে এবার চুরিডাকাতি করতে হবে। চিনি সাত টাকা…ভাবতে পার! আসছে, দিন আসছে, পঞ্চাশ টাকার নোট নিয়ে তখন বাজারে যেতে হবে।’

বেলা রাস্তা পার হবার জন্য দাঁড়াল। ফুটপাথে ছোট্ট একটা শান-বাঁধানো নীচু রেলিং ঘেরা হাতচারেকের চত্বর। তার মাঝে একটা পাথর, মেঝেয় পোঁতা ত্রিশূল, কিছু ফুল ছড়ানো এবং কাঁসার থালায় কয়েকটি রেজগি। বেলা একটা দশ পয়সা থালায় ছুড়ে দিল।

এইখান থেকেই সে প্রতিবার রাস্তা পার হয়। তার ধারণা, এই জায়গাটা নিরাপদ। এইরকম কিছু কিছু যুক্তিহীন সংস্কার অনেক বিষয়েই তার আছে। ছাদের দক্ষিণ দিকের কোমরসমান পাঁচিলে সে ঝোঁকে না, তাহলে নিশ্চয়ই উলটে নীচে পড়বে…সিলিং ফ্যানের ঠিক তলায় শোয় না, পাখার হাঁড়িটা মাথায় খুলে পড়তে পারে। লজেন্স খায় না, গলায় আটকে যাবে। ভয়গুলো এসেছে এই ধরনের এক-একটা ঘটনা শোনার পর।

চিলড্রেনস পার্কটা পার হয়ে বি কে পাল অ্যাভিন্যুর দিকে ঘুরতেই বেলা দেখল রাস্তায় একটা কুকুর চেপটে রয়েছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঘটেছে কোনো ভারী ট্রাক বা বাসের দ্বারা। গাড়িগুলো অবিরত পিষে পিষে যাওয়ায় মাংসগুলো ফ্যাকাসে ছিবড়ে হয়ে রাস্তার এখানে ওখানে ছড়িয়ে। কয়েকটা কাক ওড়াউড়ি করে খুঁটে খুঁটে মাংস তুলে নিচ্ছে।

এই দৃশ্যটা থেকে রেহাই পেতে সে হনহনিয়ে আহিরিটোলার দিকে এগোল। চিৎপুরের মোড়ে এসে ওষুধের দোকানটা দেখে তার মনে হল কয়েকটা ট্যাবলেট কিনে নেবে কিনা। অম্বলে কদিন ধরে বুকে জ্বালা ধরছে। তারপর মনে হল, লন্ড্রি থেকে শাড়ি নেবার তারিখ ছিল গতকাল, বিলটা আছে কিনা দেখার জন্য সে ব্যাগ খুলল।

‘দিদি, বাড়ি যাচ্ছেন?’

বেলাদেরই ভাড়াটে বিমল। এখানেই ফুটপাথে ওর চায়ের দোকান। হাতে হরলিকসের একটা বোতল, তার অর্ধেকটায় ভরা দুধ।

‘সকালের দুধটা কেটে গেছে, গরমেন্টের কারবার তো। বিস্কুট ছাড়া বুলিটার পেটে কিছু পড়েনি। দোকান ফেলে যেতেও পারছি না এখন…’

বিমল আবলুস কালো বেঁটে ভারী গড়নের মানুষ। বয়স সম্ভবত তিরিশ। টকটকে লাল পলিয়েস্টার স্পোর্টস শার্টটা পরে আছে। গায়ে এই জামাটাকে বেলা একদমই সহ্য করতে পারে না। শুধু চোখই নয়, তার প্রতিটি স্নায়ুও ঝিমঝিম করে ওঠে।

বোতলটা হাতে নিয়ে বেলা এগিয়ে যাচ্ছে, পিছন থেকে চে�চিয়ে বিমল বলল : ‘পিসিকে বলবেন গরম করাই আছে।’

মাসখানেক আগে সাগরিকা একবছরের ছেলে বুলবুল এবং বিমলকে ফেলে চলে গেছে। দিনসাতেক আগে বিমল বলেছিল : দিদি, আমার মনে হচ্ছে প্রভাসই ওকে ফুসলে বার করে নিয়েছে।’

বেলা কোনো কথা বলেনি। সে জানত, সাগরিকা কিছু একটা করবে। এটা সে জানত।

শিব দত্ত লেনটা একটা ‘দ্র’ অক্ষরের মতো, বি কে পাল অ্যাভিন্যু থেকে শুরু হয়ে বেলাদের একতলা বাড়ির দেয়ালে শেষ হয়েছে। সোয়া কাঠার উপর এই বাড়িটার বয়স কমপক্ষে আশি বছর। মালিকানা দু-হাত ঘুরে অবশেষে তিমিরের বাবার হাতে আসে। এই বাড়ি এবং পাশের বাড়ির মাঝে দু ফুট চওড়া একটি মাটির পথ আছে যেটা একদা খাটা পায়খানা থাকার সময় কাজে লাগত। পথটা যুক্ত করেছে বেলাদের বাড়ির দক্ষিণে তিন হাত চওড়া পগারের সঙ্গে শিব দত্ত লেনকে।

পাঁচ-ছটি বাড়ির খিড়কি দরজা এই পগারে। একদা জঞ্জাল ফেলার জন্য ছাড়া পগারটির আর কোনো ভূমিকা ছিল না। এখন এটি ওই পাঁচ-ছটি বাড়ির পিছনের অংশের বাসিন্দাদের রীতিমতো সদরপথ। পগারের দক্ষিণে নীচু পাঁচিলের ওধারে খোলার চালের প্রায় ষোলো ঘর পরিবার বাস করে। বেলা তার শোবার ঘরের দক্ষিণের জানলা দিয়ে বস্তির এক-চতুর্থাংশ দেখতে পায়।

বছরে দু-তিনবার চোর পড়ে এই পাড়ায়। বেলাদের বাড়ির গা-ঘেঁষে পাঁচিলের সরু পথটা দিয়েই নাকি বস্তির দিক থেকে চোর আসে। বস্তির অনেক জায়গায়ই ভাঙা, বাচ্চচা ছেলেরাও সেখান থেকে ডিঙিয়ে আসে। প্রতি বাড়ির পগারের দিকের জানলায় লোহার জাল লাগানো। লগা দিয়ে ঘরের মধ্য থেকে জিনিস টেনে নেওয়া এতে বন্ধ হয়েছে।

‘বাবার বিয়ের শালটা খাটের গায়ে ছিল শুধু এক রাত্রির জন্য নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরেছে, মা বলল, ‘একটা রাত্তির তো থাক কাল সকালে আলমারিতে তুলবোখন, ব্যস, সকালে আর দেখা গেল না।

আর একবার তিমির বলেছিল:

‘বস্তির পাঁচিল সব কী আর আপনা থেকে ভেঙেছে, ভেঙে ফেলা হয়েছে যাতে পুলিশ তাড়া করলেই চট করে বস্তি দিয়ে পালাতে পারে। নকশাল পিরিয়ডে কী কাণ্ড যে এই গলিতে হয়েছে তা তো জান না। রোজ বোমা, ছুরি, পাইপগান আর একটা দুটো মার্ডার।’

‘তুমি দেখেছ?’

‘কী, মার্ডার? গোটাচারেক দেখেছি।’

‘ভাগ্যিস আমার তখন বিয়ে হয়নি।’

‘তিমির হেসেছিল। চোখ বন্ধ করে মৃদু মৃদু মাথা নেড়ে বলেছিল। ‘পাড়ার লোকের গায়ে কিন্তু কখনো একটা আঁচড়ও পড়েনি।’

বিমল তারপর এ বাড়িতে ভাড়া আসে, সাগরিকা আর সদ্যোজাত বুলবুলকে নিয়ে।

সীমার মা একদিন বিকেলে বাসনমাজার পর বেলাকে বলে, ‘তোমাদের ওপাশের ঘরটা তো খালিই পড়ে থাকে, ভাড়া দাওনা ক-টা টাকা তো পাবে।’

‘কী দরকার টাকায়, দুটো মানুষ নির্বিবাদে তো চলে যাচ্ছে ভাড়াটে মানেই ঝামেলা।’

‘ঝামেলার কী! মাঝের দরজাটা বন্ধ করে দিলেই তো আলাদা। আগে কী তোমাদের ভাড়াটে ছিল না? পগারের দরজা দিয়েই তো ভাড়াটে বাইরে যাতায়াত করবে, কল, পায়খানাও আলাদা, রান্না করবে কলঘরের পাশের চাতালটায়…তবে অসুবিধে হবে বর্ষায়, একটা চালা বরং করে নেবে। শুধু ছাদে যেতে হলেই তখন তোমাদের দিকে এসে সিঁড়িতে উঠতে হবে। বলো না দাদাবাবুকে।’

‘কে ভাড়া নেবে, তোমার চেনা কেউ?’

‘বিমল বলছিল ট্রাম লাইনের ধারে ফুটপাথে চায়ের দোকান করেছে, তুমি দ্যাখোনি বোধহয়, লাল একটা জামা পরা ছেলে…’

বেলার মনে হল, লাল জামা গায়ে একজনকে দেখেছে বটে স্কুল থেকে ফেরার সময়। রাস্তায় সে মানুষজনের দিকে বিশেষ তাকায় না।

‘বিয়ে করেছে। বউ এখন বাপের কাছেই আছে, ঘর খুঁজছে, বাচ্চচা হবে। আমাকে বলে রেখেছিল, মাসি একটু সন্ধান কোরো, বড্ড দরকার। বামুনের ছেলে হয়ে ছোটোজাতের মেয়েকে বিয়ে করেছে বলেতো নিজের বাড়ির সঙ্গে আর সম্পর্ক নেই।’

‘বউ কেমন?’

‘তা জানি না। এক-আধবারই যা দেখিছি দূর থেকে। খুব ফর্সা, গড়ন ভালো, মুখচোখ সুন্দর, মাথায় অনেক চুল-ভালোই দেখতে। আর সুন্দরী না হলে বিমল ঘর ছেড়ে বিয়েই বা করবে কেন বলো?’

‘কদ্দিন দোকানটা করেছে? বিমল আগে করত কী?’

‘কী আর করবে, খুচখাচ কীসব ব্যবসা করত, তবে ভদ্দর বনেদি ঘরের ছেলে, তোমাদের কোনো অসুবিধে হবে না। বরং সুবিধেই হবে। বিপদে আপদে ছোটাছুটি করার দরকার হলে, কী এটা ওটা যখন বাজারে পাবে না তখন জোগাড় করে দেওয়া…একাই তো বেশিরভাগ সময় থাকো বরং কথা বলার একটা লোক পাবে।’

নাইট ডিউটির পর কারখানা থেকে তিমির বাজার হয়ে বাড়ি ফেরে। বউ তখন স্কুলে থাকে। রান্না তিমিরই করে। বেলা রাঁধুনি রাখতে চেয়েছিল, তিমির রাজি নয়। লোকের হাতের রান্না তাদের বংশে নাকি কখনো কেউ খায়নি। তিমিরের মা রান্নাঘরেই জীবন কাটিয়ে গেছে।

‘সীমার মা-কে বলেছে, তাই ও বলছিল।’

‘গুন্ডা ক্লাসের ছেলে…ভদ্দরঘরের তাতে কী হয়েছে? লেখাপড়া শেখেনি কেন? য়্যা, ঘর ভালো হলেই কী ছেলেমেয়ে ভালো হবে?…কত ভাড়া দেবে? ঠিকমতো ভাড়া দিতে পারবে কী?’

তিমির রাজি হয় না। এর তিন দিন পরই বিমল ফুটপাথেই বেলার পা চেপে ধরে।

স্কুল থেকে ফিরছিল। সম্ভবত সীমার মা ওকে বলেছে,-একটা ঘরের সন্ধান আছে, নয়তো বিমল এমন নাটকীয় কাণ্ড করত না দোকান থেকে লাফিয়ে এসে।

‘দিদি, আমি তিনমাসের ভাড়া জমা রাখব…কোনো ঝুটঝামেলা হবে না।’

উবু হয়ে বিমল তখন বেলার পায়ের পাতা চেপে ধরে আছে।

-‘এ কী কচ্ছেন, ছাড়ুন ছাড়ুন।’

বেলা পিছিয়ে গেছল। আশপাশের দোকান থেকে লোকে তাকাচ্ছে, মুচকি হাসছে। পথচারীরা তাকিয়ে যাচ্ছে।

‘না দিদি, আগে আপনি কথা দিন। বউ নিয়ে আপনার ভাই কী রাস্তায় দাঁড়াবে? এই মাসেই ডেলিভারি…কোথায় যাব বউ বাচ্চচা নিয়ে, আপনিই বলে দিন?’

এমন বিব্রত বেলা আর কখনো হয়নি। বিমলের চায়ের দোকানের টুলে বসেছিল একটি যুবক এবং এতক্ষণ একদৃষ্টে সে বেলার মুখের দিকে তাকিয়েছিল।

‘দাদাকে বলবেন, দরকার হলে ছ-মাসের ভাড়া অ্যাডভান্স করব।’

যুবকটি উঠে এগিয়ে এসেছে, প্যান্ট বুশশার্ট দামি কাপড়ের। লম্বা দোহারা গড়ন, চুল ঘাড় পর্যন্ত। চোখদুটো বড়ো বড়ো ভাসানো। মোটামুটি সুশ্রী। কণ্ঠস্বর ভারিক্কি এবং কর্কশ। কথার ঢঙে বোঝা যায় হুকুম করার অভ্যাস আছে।

‘আমি তো এ ব্যাপারে কথা বলার কেউ নই, আপনারা বরং…।’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমরা নয় দাদার সঙ্গেই কথা বলে নেব। আপনি একটু বলে রাখবেন।’

যুবকটি কর্কশ স্বরকে যথাসম্ভব মোলায়েম ও বিনীত করার চেষ্টা করে কথাগুলো বলল। বিমলকে চোখ দিয়ে ইশারায় এমন একটা ভাব দেখাল যেন, চিন্তার কিছু নেই, হয়ে যাবেখন।

হয়েও গেল। মাসে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া। অগ্রিম দিল তিনশো টাকা।

‘একেবারে ফাঁকা বাড়ি, তুমি একা থাকো…দিনকাল সুবিধের নয়।’

তিমির যখন নাইট শিফটে তখন বেলার সঙ্গে দেখা হয় এই সময়, সে স্কুল থেকে ফিরলে। এই সপ্তাহে তিমিরের ডে-শিফট চলছে।

‘ওদিকটা তো পড়েই থাকে, মাসে মাসে পঞ্চাশটা টাকা…তবে মাঝের দরজাটা বন্ধ থাকবে। সদর ব্যবহার করতে পারবে না বলেই দিয়েছি।’

বেলা পরে জেনেছিল ওই যুবকটির নাম প্রভাস কুণ্ডু, বিমলের মুরুব্বি। নিমতলায় কাঠের ব্যবসা আছে আর একটা ট্রাকের মালিক। কাঁচা টাকা হাতে থাকে এবং খরচও করে। প্রভাসই অগ্রিম টাকাটা দিয়ে গেছে। তারই টাকায় বিমলের চায়ের দোকান হয়েছে।

সদর দরজায় তালা দিয়ে যায় তিমির। বেলার কাছেও একটা চাবি আছে। সকালে দু-জনের মধ্যে অল্পক্ষণই দেখা হয়। যখন ডে-শিফটে থাকে তিমির ভোরে বাজার যায় এবং বেলা স্কুলে বেরোবার মুখেই ফেরে। তিমির তার বিরলতম রসবোধের পরিচয় দিয়ে একবার বলেছিল, ‘স্টেশনে ক্রসিং হল।’ তারপর তাদের দেখা হয় সন্ধ্যায় যখন বেলা টিউশনি থেকে ফেরে।

তালা খুলে বাড়িতে ঢুকে বেলা দুধের বোতলটা দিয়ে এল পিসিকে। সত্তরের কাছাকাছি বয়স, চোখ এবং কান ভালো কাজ করে না, কুঁজো হয়ে পড়েছে। তবে খুটখুট করে রান্নাটি মোটামুটি করে দেয়। বিমল খোঁজখবর নিয়ে সাগরিকার এই পিসিকে সংগ্রহ করে এনেছে বুলির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।

‘পিসি, দুধটা পাঠিয়েছিল বিমল, খাইয়ে দিন, গরম করাই আছে।’

কাত হয়ে বুলি ঘুমিয়ে রয়েছে। শীর্ণ শিশুটির দিকে তাকিয়ে বেলা মায়াবোধ করল। বেচারার ভাগ্যটাই খারাপ। এখনও অবোধ, এটাই ওকে রক্ষা করছে। একটু বড়ো হলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াত কে জানে।

‘বউমা ঝিনুকটা খুঁজে পাচ্ছি না, দেখবে একটু।’

বেলা ঝিনুক খুঁজে পেল খাটের নীচে। তাতে বাসি দুধের দাগ রয়েছে, ধুয়ে দিল।

নিজের ঘরে এসে অভ্যাসমতো প্রথমেই সে টেবলে দুধের গ্লাসের নীচে রাখা চিরকুটটা তুলে নিল।

‘সীমার মা আজ আসেনি। ফিরে এসে বাসনগুলো মাজব।’

‘কাপড়গুলো কেচে রেখেছি। শুকোতে দিয়ো।’

‘বিকেলে কেরোসিন দেবে, বিমলকে বলে রেখো-দু লিটার।’

‘দেরি করে খেয়ো না।”

তাড়াতাড়িতে লেখা অপরিচ্ছন্ন অক্ষরে। প্রতিদিনের মতো প্রায় একই ধরনের কথা…সতর্ক, হিসেবি গৃহস্থ।

ঘরের পশ্চিমে জানলা দিয়ে বিমলের ঘরের জানলাটা দেখা যায়। এর মাঝে সাত-আট হাতের একফালি সিমেন্টের উঠোনটা ভাড়াটের অধিকার। পগারের দিকে এক মানুষ সমান পাঁচিল।

কাপড় বদলাবার জন্য বেলা অভ্যাসবশত পশ্চিমের জানলাটা বন্ধ করার সময় দেখতে পেল পিসি দুধ খাওয়াচ্ছে বুলিকে। তিমির দুধভরতি গ্লাস রেখে গেছে। ডাক্তারের নির্দেশ সকালে দুধ খাওয়ার। বেলা একচুমুকে দুধটা শেষ করল। পাখাটা ঘোরাতে সুইচ টিপে দেখল বিদ্যুৎ নেই।

ছাদে কাপড়গুলো তারে মেলে দিয়ে বেলা দক্ষিণের পাঁচিলে দাঁড়াল। নীচেই পগার। বস্তিতে দুই নারীকণ্ঠে তীব্র ঝগড়া চলছে। প্রায়ই হয়। এসব শোনায় সে অভ্যস্ত। ঝাঁ ঝাঁ রোদে ছাদগুলোয় কোনো লোক নেই। সব বাড়ির জানলাই খোলা।

বেলা সরে এল পশ্চিম দিকে। নীচে বিমলের জানলায় বুলি রড ধরে দাঁড়িয়ে। ন্যাংটো জিরজিরে ছেলেটা তাকে দেখতে পায়নি।

সাগরিকাও প্রথমে তাকে দেখতে পায়নি। একতলা থেকে যাতে কেউ দেখতে না পায় সেজন্য জানলার নীচের পাল্লাদুটোই শুধু বন্ধ করে রাখা ছিল। ছাদে কেউ থাকবে এবং পাঁচিলের ধারে দাঁড়াবে ওটা বোধহয় ওরা ভাবেনি। তাহলে উপরের পাল্লাদুটোও বন্ধ করত।

খাটে-শোয়া সাগরিকার দেহের আধখানা বেলা দেখতে পাচ্ছিল… সম্পূর্ণই অনাবৃত। প্রভাসের মুখ ওর ঘাড়ে গোঁজা, হাতের আঙুলগুলো খুবলে ধরেছে দুটো কাঁধ। হঠাৎ সে উন্মত্তের মতো সাগরিকার গালে কপালে গলায় কামড়াতে শুরু করল, নগ্ন পিঠটা কুঁকড়ে বেঁকে উঠল। শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া বাঘের মতো প্রভাস তার সারা শরীর দিয়ে সাগরিকাকে আঁকড়ে ধরে ঝাঁকাচ্ছে।

বেলা পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিল। বুকের মধ্যে নিশ্বাস আটকে গেছে। পাঁচিল থেকে সরে যাবার ক্ষমতাটুকুও হাঁটুতে নেই। বোধহয় দশ-বারো সেকেন্ডের জন্য দৃশ্যটি তার চোখের সামনে ভেসে রয়েছিল। সাগরিকা হঠাৎ বন্ধ চোখদুটো মেলতেই, পাঁচিলের ধারে দাঁড়ানো বেলার সঙ্গে চোখাচোখি হল। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো বেলা তখন ছিটকে সরে আসে।

বুক থেকে বাতাস বেরিয়ে যাবার পর থরথরিয়ে কেঁপে উঠেছিল। সে জানে ওরা কী করছিল। অদ্ভুত এক ধরনের বিহ্বল ভয়কে সে সাগরিকার চোখে ফুটে উঠতে দেখেছে।

‘বুলি বুলি…টি টি…বুলি।’

বেলা হাত নাড়ল। বাচ্চচাটি উপর দিকে মুখ তুলে চোখ পিট পিট করে বোঝার চেষ্টা করছে কোথা থেকে আসছে কণ্ঠস্বর। এখনও ভালো করে মানুষ চেনে না।

‘টা টা বুউলি!’

বুলি হেসে ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কাছাকাছি কোথাও বোমা ফাটার শব্দ এবং একসঙ্গে কিছু লোকের চিৎকার হল।

সাধারণত এমন সময় মারামারি হয় না। সন্ধ্যার পর, বিশেষত রাতেই এই শব্দগুলো পাওয়া যায়। বেলা একটু অবাক হল।

কয়েক সেকেন্ড পর আরও দুটো শব্দ, আরও জোরে চিৎকার।

বেলা সদর দরজার দিকে পুবের পাঁচিলে এল কৌতূহল নিয়ে। চিৎকারের একটা রেশ ক্রমশ বিকট হয়ে শিব দত্ত লেনের মধ্যে ঢুকেছে।

সাদা গেঞ্জি গায়ে, খালি পা, মুখে খয়েরি রুমাল বাঁধা একটা লোক ঊর্ধ্বশ্বাসে গলিতে বাঁক নিয়েই থমকে পিছনে তাকিয়ে আলতো করে কি যেন ছুড়ল।

বেলা এই প্রথম বোমা ছোড়া দেখল। প্রচণ্ড শব্দ ও ধোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসা চিৎকারটা দু-তিন সেকেন্ডের জন্য থমকে গিয়ে আরও জোর হয়ে উঠল। দরজা-জানলা বন্ধের শব্দ হচ্ছে। গলির বাঁক ঘুরে কেউ এগোতে সাহস পাচ্ছে না।

বেলাদের বাড়ির গা-ঘেঁষে দুটো বাড়ির মধ্যের পথটায় লোকটা ঢুকে গেল। তখন সে ওর হাতে একটা নীল ক্যাম্বিসের থলি দেখতে পায়।

‘পগারের দিকে চলে গেছে…ওই যে পগারে, পগারে…ওদিক দিয়ে ঘুরে যান।’

একটা বাড়ির ছাদের উপর থেকে একটি কিশোর হাত নেড়ে উত্তেজিত স্বরে চিৎকার করে কাদের যেন জানাচ্ছে। বেলা মুখ তুলে ছেলেটিকেই দেখতে লাগল।

‘…বস্তি দিয়ে পালাচ্ছে বেরিয়ে যাচ্ছে খাটালের পাশ দিয়ে…।’

বেলা উত্তেজিত হয়ে ছুটে গেল দক্ষিণের পাঁচিলে। বিস্মিত বিভ্রান্ত বস্তির কয়েকজন মেয়ে আর শিশু ছাড়া আর কিছু সে দেখতে পেল না। পগারে ইতিমধ্যে জনাপনেরো লোক এসে পড়েছে। অনেকের হাতে লাঠি।

‘চারজন ছিল, চারজন…এ বেটা ছিটকে এদিকে এসে পড়েছে।’

‘কে বলল চারজন! তিনজন ছিল, আমি দেখেছি!’

‘একটাকে ধরেছে…আর দুটো গাড়িতেই ছিল…’

‘কালো অ্যাম্বাসাডার কী?’

‘কী হয়েছে রে নেনো?’

কোন বাড়ি থেকে নারীকণ্ঠের প্রশ্ন।

‘ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিতে এসেছিল জেঠিমা। গাড়ি থেকে নেমে ব্যাঙ্কে ঢুকবে, তখন বম্ব চার্জ করে টাকার থলি নিয়ে পালাতে গিয়ে আর পারেনি। থলিটা নিয়ে এক ব্যাটা বস্তি দিয়ে পালিয়েছে। …একটাকে পাবলিক ধরেছে, এতক্ষণে বোধহয় শেষ হয়ে গেছে।’

‘ভালোই করেছে, তুই আর তাড়াটাড়া করতে যাসনি যেন।…বাব্বাঃ যা আওয়াজ হল গলিতে।…কত টাকা ছিল রে?’

পগার থেকে ভিড়টা সরে গেল। উত্তেজিত টুকরো কথাবার্তা এ বাড়ি ও বাড়ির জানলা থেকে শোনা যাচ্ছে। নতুন অভিজ্ঞতা বেলার কাছে। আকস্মিকতার ধাক্কাটা কেটে যাবার পর সে কৌতূহলী হয়ে উঠল। তার ইচ্ছা করছে ঘটনাটা সবিস্তারে জানতে, কারোর সঙ্গে কথা বলতে।

‘হ্যাঁগো বউমা, হয়েছে কী?’

নীচের থেকে পিসি চেঁচিয়ে জানতে চাইছে।

পাঁচিলের মুখ বাড়িয়ে বেলা বলল : ‘ডাকাত পড়েছে, ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিতে এসেছিল তখন…’

বেলা কথা শেষ করল না। তার চোখ উঠোনে বিমলের ঘরের জানালার নীচে স্থির হয়ে আটকে রইল।

ডাকাতের হাতে সে ওইরকমই একটা নীলথলি দেখেছে। চোপসানো বেলুনের মতো কয়েকটা ভাঁজ। আকারে রেশনের থলির মতোই। মুখটা দেওয়ালের দিকে তাই দেখা যাচ্ছে না কীভাবে বাঁধা আছে।

‘তুমি আর ছাদে একা থেকো না, নেমে এসো।’

নিজের অজান্তেই বেলা পাশের এবং পিছনের দুটো বাড়ির দোতলা এবং তিন তলার দিকে তাকাল। কোনো ছাদে কেউ নেই। দুটি জানালা থেকে তাদের ছাদটা শুধু দেখা যায়, ছাদের পাঁচিলে আড়াল পড়া নীচের উঠোনটা নয়। জানলা দুটোয়ও কেউ নেই। বস্তির দিক থেকে দেখাদেখির প্রশ্নই ওঠে না।

কিন্তু থলিটা উঠোনে এল কী করে? ডাকাতটার হাতে কী এটাই ছিল? গলিতে বাঁক নিয়ে বোমাটা ছুড়ে তাদের বাড়ি পর্যন্ত ছুটে আসতে কতটুকু সময় লেগেছিল? পাঁচ সেকেন্ড…বড়োজোর দশ। ওইটুকু সময়ই ডাকাতটাকে সে দেখেছে। দু-পাশের তিনটে বাড়ি থেকে কেউই তখন গলির দিকে তাকিয়ে ছিল না। তারপর সে আর ডাকাতটাকে দেখেনি।

ছেলেটা ছাদ থেকে চিৎকার করছিল। হাতে থলি ছিল কিনা, ওকি লক্ষ করেছে? বেলার যতদূর মনে পড়ছে, ছেলেটা থলি সম্পর্কে কোনো কথা বলেনি। হয়তো থলিটা হাতে ছিল বলেই। কিংবা ও জানেই না ডাকাতের হাতে একটা নীলথলি ছিল।

পা টিপে দ্রুত সে নীচে নেমে এল, বুলির দুধ দিয়ে আসার পর মাঝের সবুজ দরজাটা সে আর বন্ধ করেনি। দরজাটার কবজা আলগা হয়ে যাওয়ায় বন্ধ করতে অসুবিধা হয়। তাই কিছুদিন হল আর ছিটকিনি দেওয়া হয় না।

বেলা দরজা ঠেলে একইভাবে চুপিসারে উঠোনে পৌঁছেই থলিটা তুলে নিল।

‘কে, কে ওখানে…বউমা নাকি?’

ঘরের মধ্য থেকে বুড়ি পিসি চেঁচিয়ে উঠেছে। ভালো দেখতে পায় না, নিশ্চয় জানলা দিয়ে, ছায়ার মতো কিছু একটা দ্রুত সরে যেতে দেখে চেঁচিয়েছে।

ঘরে এসেই, থলিটা সে কোথায় রাখবে ভেবে পেল না। তাকে? তোরঙ্গের পেছনে? খাটের নীচে?…কাঠের দেরাজের মাথায় কিংবা ভিতরে?

মাঝের দরজাটা খুলে রাখা ঠিক হবে না। আলগা কবজার জন্য একটা পাল্লা তুলে চৌকাঠে বসাতে হয়। তবু ছিটকিনিটা আগের মতো আর সহজে লাগানো যায় না। বেলা এক হাতে পাল্লা চেপে ধরে লাগাতে গিয়ে ছিটকিনির খোঁচায় ব্যথা পেল আঙুলে।

‘একদিন ছুতোর এনে বাড়ির সব কাঠের কাজগুলো করিয়ে নেব। যা পুরোনো বাড়ি…কোনো জানলা দরজাই ঠিকমতো লাগবে না।’

‘দেরাজের ভেতরের ড্রয়ারের লকটা গোলমাল করছে, ওটাও সারাতে হবে।’

বেলার কথায় তিমির ছোট্ট করে ভ্রূ কুঁচকোয়।

‘এতদিন বলনি কেন?…গয়নাগুলো আনসেফ রেখে দিয়েছ?’

‘কীইবা এমন গয়না আর কেইবা চুরি করবে। দেরাজে তো চাবি দেয়াই থাকে।’

বিয়ের সময় বাপের বাড়ি থেকে বেলা সোনার কোনো জিনিস পায়নি, দেবার ক্ষমতা ছিল না। তিমিরের মায়ের একটা দু-ভরি বালা আর একটা মফচেন ছাড়া আর কিছু তার নেই।

পগারের দিকে ভারী জুতোর শব্দ আর কথাবার্তার শব্দ এগিয়ে এসে বেলাদের খিড়কির দরজার কাছে থামল।

‘এই দিক দিয়ে ছুটে এসেছে, স্যার।’

‘দ্যাখো তো ওদিকটা।’

বেলা দক্ষিণে পগারের জানলায় এসে মাথা কাত করে দেখার চেষ্টা করল।

পুলিশ। সঙ্গে সঙ্গে সে ঘরের মাঝখানে ফিরে এসে নীলথলিটা তুলে এধার-ওধার তাকিয়ে দেরাজের চাবি খুঁজল।

আশ্চর্য! সে জানে, অথচ এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না কোথায় চাবির রিংটা, তিমির প্রতিদিন একই জায়গায় রেখে দিয়ে যায়, অথচ আলনার হুকে? দেরাজের মাথায়…আজ, মনে পড়েছে।

খাটের গদির কোণটা তুলেই বেলা পেয়ে গেল। দেরাজ খুলে থলিটা নীচের তাকে গুঁজে রেখে পাল্লাটা বন্ধ করছে, সে তখন পগারের দরজা ধাক্কানোর শব্দ পেল।

দরজাটা খুলে দেখল কালো ডোরাকাটা সাদা বুশশার্ট পরা মাঝবয়সি একটি লোক, তার পাশে পুলিশের খাকি পোশাকে, কাঁধে তারা লাগানো আর একজন এবং পিছনে আরও কিছু ইউনিফর্ম পরা বা সাদা পোশাকের পুলিশ। পাড়ারও কিছু লোক কৌতূহল মেটাচ্ছে তফাতে দাঁড়িয়ে।

‘আপনি এই বাড়িতে থাকেন?’

সাধারণ স্বর, যেন নম্বর ধরে বাড়ি খুঁজে ফিরছে, এমনই ভঙ্গি।

‘হ্যাঁ।’

‘যে ডাকাতটা এখান দিয়ে পালিয়েছে, তাকে দেখেছেন?’

‘না।’

সিঁটিয়ে গেল বেলা। হঠাৎ ‘না’ শব্দটা কী করে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল। নিশ্চয় সে ভয় পেয়েছে। দেরাজের চাবিটা এখনও তার হাতে।

‘তখন কোথায় ছিলেন, কী করছিলেন।’

স্বরটা হঠাৎ যেন তীক্ষ্ন হয়ে উঠল, মুখের দিকে তাকিয়েছিল নিশ্চয় কিছু সন্দেহ করেছে।

‘ছাদে ছিলাম, কাপড় মেলছিলাম।’

তারকা কাঁধে অফিসারটি এইবার কথা বলল : ‘ছাদ থেকে তো খালি দেখা যায়।’

প্রশ্ন নয়, একটা মন্তব্য।

‘অনেক লোকের চেঁচামেচি আর বোমার শব্দ পেয়েছিলাম, কিন্তু দূর থেকে। তাই গলির দিকে মুখ বাড়াইনি। হঠাৎ একেবারে বাড়ির কাছে বোমা ফাটতে, ভয় পেয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটে যাই।’

অফিসারটি অনুমোদনসূচক মাথা নাড়ল। পুলিশের কয়েকজন পাঁচিল ডিঙিয়ে বস্তিতে নেমে গেছে। কয়েকটা বাচ্চচাছেলে কাছে এসে বেলার সঙ্গে পুলিশের কথোপকথন শুনছে।

‘একটা বাড়ির ছাদ থেকে, ঠিক জানি না কোন বাড়ির বেশিরভাগই তিনতলা বাড়ি তাই আমাদের একতলার ছাদ থেকে দেখা যায় না…ছেলেটা দেখতে পেয়েই বোধহয় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে-‘পগারের দিকে চলে গেছে, বস্তি দিয়ে পালাচ্ছে, খাটালের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল’ এই সব বলছিল। আমি তখন পাঁচিলের কাছে গিয়ে বস্তির দিকে তাকাই। কাউকে দেখতে পাইনি।’

‘কাউকেই না?’

‘মানে ডাকাতকে নয়। বস্তির কতকগুলো বাচ্চচা আর তিন-চারজন মেয়েছেলেকে দেখেছি।’

মিথ্যে কথা, কিন্তু কেমন সে অবলীলায় বলে গেল। তবে ‘ডাকাতকে দেখিনি’ বলা ছাড়া আর সবই তো সত্যি। হাতের আঙুলগুলো কাঁপছে। চাবির রিংটাকে মুঠোয় শক্ত করে সে চেপে ধরল।

থলিটার জন্যই কী সে মিথ্যা বলেছে? দেখেছি বললেই প্রশ্ন উঠত, ‘হাতে কিছু ছিল কিনা দেখেছেন?’

‘হ্যাঁ ছিল, একটা নীল রঙের ক্যাম্বিসের থলি।’

‘আর কিছু?’

‘মাত্র পাঁচ-দশ সেকেন্ড…অত লক্ষ করিনি।’

‘মুখ দেখতে পেয়েছেন?’

‘না, একটা খয়েরি রুমালে চোখের নীচের দিকটা ঢাকা ছিল। সাদা-কালো চেকের প্যান্ট, সাদা হাফ হাতা কলার দেওয়া গেঞ্জি, খালি পা…আর কিছু দেখিনি।’

কিন্তু এসব কথাবার্তার বদলে ডোরাকাটা বুশশার্ট পরা লোকটি তার কানের পাশ দিয়ে বাড়ির ভিতরটা লক্ষ করতে করতে বলল:

‘আপনি কী করেন?’

‘স্কুলে পড়াই, সকালে প্রাইমারি সেকশানে, এইমাত্র ফিরেছি।’

‘আর কে আছে বাড়িতে।’

‘ভাড়াটে, একজন বুড়ি আর একটা বাচ্চচা, এই নীচের ঘরেই…আমার স্বামী টাইম-কিপার। বেলঘরিয়ায় ফ্রিম্যান জৈন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কারখানায়।’

পুলিশরা চলে যাবার পর, বেলা ঘরে এসে পগারের জানলাটা বন্ধ করল। বিমলের ঘরের দিকের জানলা দিয়ে বুলিকে দেখা যাচ্ছে, রড ধরে দাঁড়িয়ে।

দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বেলা মেঝেয় বসল। এবার কিছু একটা ঘটুক। নয়তো সে বুঝতে পারছে না এখন তার করণীয় কী। তার বলা উচিত ছিল, ডাকাতটাকে সে দেখেছে, থলিটাও, পুলিশকে দিয়ে দেওয়াই উচিত। কী বলবে সে পুলিশকে?

‘কোথায় পেলেন? কী করে?’

‘আমাদের উঠোনে, পাঁচিলের গা-ঘেঁষে ভাঙা ইট, লোহা, কাঠকোঠ জমা আছে, সেখানেই পড়েছিল। আপনারা যখন এলেন, তখনও চোখে পড়েনি।’

‘কী করে চোখে পড়ল?’

‘কলঘরে স্নান করতে গেছি, তখন জানলা দিয়ে।’

‘সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কাছে এলেন না কেন?’

‘কীরকম যেন নার্ভাস বোধ করলাম তখন।’

বেলা দু-হাতে মাথা চেপে ধরল। এখন তার কী করা উচিত। চল্লিশ মিনিট আগেও জানত না এইরকম অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে সে পড়বে।

সত্যিই সে ভয় পেয়েছে। পুলিশের হাতে থলিটা দিয়ে দিলেই পারত। এখন আরও বিপদ আরও ঝঞ্ঝাট বাড়ল। তিমির শুনলে কী বলবে?

‘সেকি, দিয়ে দাওনি? থলির মধ্যে টাকা আছে, কী চোরাই মাল আছে, কী গাঁজা কোকেন আছে-জানো না আর রেখে দিয়েছ?’

‘বলাবলি করছিল ব্যাঙ্কে জমা দিতে এসেছিল, তাহলে তো টাকাই হবে।’

‘ওমনি লোভে পড়লে! তাই যদি হয়,…টাকা তো পরের, আমাদের নয়। এ টাকায় আমাদের কোনো অধিকারই নেই। রাখা অন্যায়, ডাকাতির মতোই ক্রিমিনাল কাজ।’

বেলা দু-হাতে আরও জোরে মাথাটা আঁকড়ে চুলের গোড়ায় টান দিল।

‘আমিও সৎ।’

ছোটো থেকে সে কোনো অন্যায় করেনি। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে বাবা-মা-ভাইদের জন্য, আত্মীয় প্রতিবেশী সহকর্মীদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছে। বিয়ের পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাকরি করে যাচ্ছে। বিশ্রী ক্লান্তিকর ওই স্কুলে পড়ানোর কাজ সে কার জন্য করছে? সে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে দিনের পর দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে বেরোনো আর ফিরে এসে তিমিরের চাপিয়ে রেখে যাওয়া কুকারের সেদ্ধগুলো গিলতে।

কষ্টে সে অভ্যস্ত ছোটো থেকেই। বাবাও স্কুল মাস্টার ছিল। সামান্য আয়, সংসারে আটজন লোক, দাদাকেও দুটো টিউশনি করতে হত স্কুল-ফাইনাল করার আগেই। বেলাও টিউশনি করেছে, এখনও একটা করে।

কিন্তু সে কী এবার কিছু সুখ, কিছু আরাম পেতে পারে না কি? সে শৌখিন নয়, আজেবাজেভাবে টাকা নষ্ট করে না। ফ্রিজ, টিভি কেনার কথা কোনোদিনই ভাবেনি। দু-গাছা সোনার চুড়ি আর একটা হার না পরলেই নয়, এগুলোও নিজের টাকায় কিনেছে। তার আর তিমিরের মাইনে যোগ করে, সাদামাটা জীবনটা তারা কাটাচ্ছে।

একটা অপরাধীর গ্লানি নিয়ে এখন এই অবস্থায় পড়ল, এটা কী তার প্রাপ্য?

যদি পুলিশ সন্দেহবশে বাড়ি সার্চ করতে ঢুকত? দেরাজটা নিশ্চয় খোলাত। ডাকাতির মাল রাখার জন্য নিশ্চয়ই আরেস্ট করত। এ খবর পেয়ে তিমির কী করবে? গীতাদি, অর্চনা, অন্যান্য টিচাররা কী ভাববে? কিন্তু পুলিশ আবার তো খোঁজখবর করতে আসতে পারে।

বেলা ভেবে পেল না, ডাকাতটা এই বাড়িটাই বেছে নিল কেন থলিটা ফেলার জন্য? হয়তো আগেই খোঁজ নিয়ে জেনেছে এই সময় শুধু বেলাই থাকে। ভীরু, নিরীহ, সৎ, বোকা মেয়েছেলে। ডাকাতরা যদি স্বচ্ছন্দে পালাতে পারত তাহলে থলিটা ছুড়ে ফেলার দরকারই হত না। হায় ভগবান, কেন নিরাপদে ওরা পালাতে পারল না। তাহলে সে এতক্ষণে স্নান সেরে ভাত খেয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ত।

কেন এমন হল? কেন এটা? কেন ওটা? কেন সে? কেন সবকিছু?

দেরাজ থেকে থলিটা সে বার করল। দড়ি দিয়ে মুখটা বাঁধা। এটা কী সে খুলবে? আইনগত তার অধিকার নেই খোলার। কিন্তু বা ঘটে গেছে তাতে কী মনে হয় না, এর ভিতরে কী আছে সেটা জানা দরকার, অত্যাবশ্যক?

কর্তব্য নয় কৌতূহল, এটা সে আপাতত মানতে চাইল না। তা ছাড়া, আত্মরক্ষার প্রশ্নটাও রয়েছে। একটা অপরাধী যে অভিজ্ঞতা লাভ করে এই থলিটা তাকে সেই অভিজ্ঞতাই দিয়ে যাচ্ছে। যেজন্য ডাকাতি, তার পুরো রহস্য এর ভিতরে রয়েছে এবং সেটা জেনে রাখা দরকার।

গিঁটটা শক্ত করে বাঁধা। ব্লেড দিয়ে দড়িটা কেটে থলির মুখটা ছড়িয়ে দিতেই সে তাড়া তাড়া ব্যাঙ্ক নোট দেখতে পেল।

বেশিরভাগই একশো টাকার। করকরে নতুন পিন দিয়ে গাঁথা। পুরোনো নোটেরও কয়েকটা বান্ডিল রয়েছে সুতো বাঁধা, সেগুলো পঞ্চাশ টাকার।

বেলার প্রথম প্রতিক্রিয়া হল, জানলা দিয়ে বিমলের ঘরের দিকে তাকানো। বুলিকে চাপড়ে চাপড়ে ঘুম পাড়াচ্ছে পিসি।

‘না, এখুনি নয়…’ বেলা নিজেকে শুনিয়ে বলল।

এখন নয়। আগের বুকের মধ্যে ধড়ফড়ানিটা কমুক চিন্তা করার ক্ষমতা ফিরে আসুক। নিঃশেষ হয়ে গেছে সে। আর স্বাভাবিক বোধ করছে না। মানসিক ভারসাম্য ফিরে পাওয়া দরকার।

থলিটা আবার দড়ি দিয়ে বেঁধে সে দেরাজে তুলে রাখল। কয়েকমিনিট পর কলঘরের দরজা বন্ধ করে সে স্নান করার জন্য শাড়ি ব্লাউজ প্রভৃতি খুলতে শুরু করল।

জীবনে সে এমন লগ্ন এমন নিঃসঙ্গ আর কখনো বোধ করেনি।

স্নান করে খাটে শুয়েছিল বেলা। বিদ্যুৎ এসে গেছে। পাখাটা জোরে ঘুরলে দোলে। একঘেয়ে কিচমিচ একটা শব্দ হচ্ছে পাখা থেকে। চোখ বুজে শব্দটা শুনতে শুনতে তার তন্দ্রা আসছে।

ডাকাতটা কি তাকিয়েছিল তার দিকে? হয়তো। নিশ্চয় দেখে রেখেছে, আবার দেখলে হয়তো বেলাকে চিনতে পারবে। কিন্তু চিনে রাখার মতো সময় ধরে কী সে তাকিয়েছিল?

ডাকাতটা কী পালাতে পেরেছে? যদি পেরে থাকে তাহলে থলিটা উদ্ধারের চেষ্টা করবেই। কীভাবে করবে?

উদ্ধার করতে আবার কী ডাকাতি করবে? নয়তো কোনো দুপুরে সোজা বাড়িতে এসে কী বলবে, থলিটা ফেরত চাই।

যদি ধরা পড়ে? তাহলে নিশ্চয় পুলিশকে বলে দেবে কোন বাড়িতে থলিটা ফেলে দিয়েছিল। পুলিশ মারের চোটে ঠিকই ওর মুখ দিয়ে আদায় করে নেবে। তাহলে পুলিশ আসবেই। কবে?

কিন্তু ওতো নাও বলতে পারে!

বেলা উঠে বসল। নিজেকে প্রশ্ন করে চলেছে, খাপছাড়া এলোমেলো প্রশ্ন।

‘দেরি করে খেয়ো না…’

খিদে নেই। সকাল থেকেই তার পেটে কিছু পড়েনি। খাওয়ার কোনো ইচ্ছা তার হচ্ছে না। দেরাজে গুপ্তধন রয়েছে। কত টাকা থলিটায় তা সে এখনও জানে না। তবে মনে হয়েছে অনেক টাকা, হয়তো একটা লটারির প্রথম প্রাইজের টাকাই।

বেলা খাট থেকে নামল। বিমলের ঘরের থেকে এই ঘরটার ভেতর কতটা দেখা যায় তা সে জানে না। বিমল দুপুরে খেতে আসে। এখনও আসেনি। এলেই ওর গলা শোনা যাবে, বুলির সঙ্গে কথা বলতে শুরু করবে। তাকে দেখতে পেলেও চেঁচিয়ে ‘এই যে দিদি’ বলে শুরু করে দেবে। আজ তো ওর কথা বলার অনেক ব্যাপার ঘটেছে।

‘বিকেলে কেরোসিন দেবে বিমলকে বলে রেখো…’

বেলা জানলাটা বন্ধ করে আলো জ্বেলে থলিটা বার করল।

নতুন একশো টাকার নোটের প্রত্যেক তাড়ায় রয়েছে একশো করে নোট। এটা সে নম্বর থেকেই পেয়ে গেল এবং অঙ্কে অভ্যস্ত মস্তিষ্ক মুহূর্তে জেনে গেল, পকেট ডায়েরির মতো সরু ওই এক-একটা তাড়ায় আছে দশ হাজার টাকা। আটটি তাড়া রয়েছে। আশি হাজার টাকা।

পঞ্চাশ টাকার পুরোনো নোটের বান্ডিল চারটি। একটা বান্ডিলের সুতো খুলে সে গুনতে শুরু করল। এতগুলো নোট একসঙ্গে কখনো সে গোনেনি। মাইনে পায় সে দশ টাকার নোটেই। ক্যাশিয়ারবাবুকে অনুরোধ করলে এবং যদি তার কাছে থাকে তাহলে অবশ্য কয়েকটা পাঁচ টাকার নোটও কখনো কখনো পায়। তিমির মাইনে নেয় একশো টাকার নোটে। ধুতিতে গিঁট দিয়ে বেঁধে, পেটে গুঁজে আনায় তাতে সুবিধে হয়। ওর কখনো পকেটমার হয়নি।

পঞ্চাশ টাকার বান্ডিলে সে পেল একশোটা নোট। পাঁচ হাজার টাকা। আরও তিনটি রয়েছে, তার মনে হল ওগুলোতেও একই সংখ্যক নোট আছে, না গুনলেও চলবে।

কুড়ি হাজার টাকা! মোট একলাখ! ঝিমঝিম করছে তার মাথার মধ্যে। ঘামের স্রোত নাকের পাশ দিয়ে ঠোঁটের কোলে পৌঁছেছে এবং দুটো হাতই কাঁপতে শুরু করেছে। এখনও সে মনস্থির করেনি টাকাগুলোর কী করবে। এখন লুকিয়ে রাখতে চাইছে তবে বরাবরের জন্য নিশ্চয় নয়। খোঁজখবর করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

হঠাৎ তার মনে হল, এই থলিটা তিমির যেন না দেখতে পায়। এখুনি লুকিয়ে বা সরিয়ে ফেলা দরকার।

কোথায় লুকোবে? নোটগুলো বার করে থলিটা কোথাও ফেলে দিয়ে এলে… লোকে দেখে ফেলবেই। কোনো মেয়েছেলে একটা প্যাকেট রাস্তায় ছুড়ে ফেলছে, বা কোথাও ফেলে চলে যাচ্ছে, এটা কেউ-না-কেউ লক্ষ করবেই। দিনের বেলায় তো সম্ভবই নয়। রাতেও বাড়ি থেকে বেরোনো অসম্ভব। তিমির বাড়ি থাকবে।

আর হতে পারে, টিউশনিতে যাবার সময় থলিটা নিয়ে বেরোবে। একটু দেরিতে রাত করে ফিরবে এবং ফেরার সময় কোথাও….পার্কের ধারে ভিখিরিদের আস্তানার কাছে জায়গাটা অন্ধকার, হাঁটতে হাঁটতে টুক করে ফেলে দেবে, যেন হাত থেকে পড়ে গেছে। কেউ যদি দেখতে পেয়ে ডেকে হাতে তুলে দেয়, তখন নয় ‘ওহ তাইতো! ধন্যবাদ।’ বলা যাবে।

কিন্তু এসবই বেলার কাছে বিপজ্জনক প্রস্তাব মনে হচ্ছে। আপাতত বাড়ি থেকে দু-হাতে কিছু নিয়ে বেরোনো একদমই নয়।

ঘরের সর্বত্র চোখ বুলিয়ে বেলা আজই প্রথম বুঝতে পারছে কোনো জিনিস লুকিয়ে রাখার মতো জায়গা এই ঘরে নেই। খুঁতখুঁতে তিমির কখন যে কোথায় চোখ দেবে বলা যায় না। যেকোনো সময় তোশক ওলটাতে পারে, দেরাজের মাথা থেকে স্ক্রু ড্রাইভার পাড়তে পারে, খাটের নীচে হানা দিয়ে ঢুকতে পারে একটা কাগজের কুচি কুড়োবার জন্য।

আর একটা ব্যাপার বেলার চোখে পড়ল, ঘরের আসবাবগুলো অত্যন্ত পুরোনো, সেকেলে জবড়জং। কোনোটাই বর্ণনা করার মতো নয়। এইরকম ঘর আর আসবাব কলকাতায় নিশ্চয় হাজার হাজার পরিবারের আছে।

এই ঘর তবু ভালো তার বাপের বাড়ির থেকে। দাদা মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে মারা যায়। বলা হয় নিউমোনিয়ায়, আসলে হয়েছিল টি বি। একতলায় আলো বাতাস রোদবিহীন একটা ঘরেই তারা একত্রিশ বছর কাটিয়েছে। মা বাতে ভুগেছে জীবনের অর্ধেক বছর। বেচারা, বছরে দু-তিনবারের বেশি বাড়ি থেকে বেরোবার সুযোগই পেত না।

সে চোর নয়। টাকাগুলো খরচ করার বাসনা তার নেই যদিও এগুলো এই মুহূর্তে কারোরই নয় বলেই মনে হচ্ছে। তাই কী? কারা যেন ব্যাঙ্কে জমা দিতে এসেছিল।

ওরা নিশ্চয় কয়েকদিন আগেই ডাকাতির প্ল্যান করেছে। নিশ্চয় জানত আজ একলাখ টাকা জমা দিতে আসবে। কীভাবে ডাকাতি করবে…নিশ্চয় এটাও ভেবেছিল, যদি ব্যর্থ হয় তাহলে কোন রাস্তা দিয়ে পালাবে। শিব দত্ত লেনে ঢুকেছে যখন, বুঝতে হবে ওরা আগেই দেখেশুনে গেছে পথটা। হয়তো এটাও ঠিক করেছিল, নিরাপদ হবার জন্য থলিটা এই বাড়িতেই ফেলবে।

কেন এই বাড়িটা। নিশ্চয় ওরা স্টাডি করেছে বাড়ির লোকেদের। ওরা লক্ষ করেছে এগারোটা নাগাদ বেলা ছাড়া আর কেউ থাকে না। ওরা নিশ্চয় তাকে ফলো করেছে স্কুলে যাওয়া-আসার সময়, টিউশনিতে যাওয়া-আসার সময়ও। কিছু কী লক্ষ করেছে?

দু-দিন দেবাংশুবাবু তাকে এগিয়ে দিয়ে গেছে বি কে পাল অ্যাভিন্যুর মোড় পর্যন্ত।

‘এই লোডশেডিংয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে একা যাবেন কী! চলুন এগিয়ে দিচ্ছি।’

‘না না আমি পারব, চেনা রাস্তা, আপনাকে আর কষ্ট করে…’

লোকটা কথা শোনেনি। টর্চটা বার দুয়েক জ্বালিয়ে ব্যাটারির তেজ পরীক্ষা করে বলেছিল: ‘আসুন, আমারও একটা দরকার আছে ওদিকে।’

জোরালো ভারী গম্ভীর গলা। একসময় নাকি বডি বিল্ডিংয়ে বছর পনেরো ব্যয় করেছে তার ছাত্রী রীনার এই অবিবাহিত জ্যাঠা। এখন কোনো এক ওষুধ কোম্পানিতে বড়ো চাকুরে।

রীনাকে পড়াবার সময় বেলা লক্ষ করেছে দেবাংশু বারান্দায় গেঞ্জি গায়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে থাকে। দেবাংশুর কাঁধ বাহু বুক ঘাড় এমনকী মসৃণ টাকও সে পর্দার ফাঁক থেকে দেখতে পায়। থাক থাক পেশি, আঁকাবাঁকা শক্ত লাইন টেনে শরীরটাকে রুক্ষ করে রেখেছে। মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে ঘরের দিকে তাকায়। বারকয়েক ধরাও পড়েছে বেলার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে।

একদিন পড়িয়ে বেরোবার পর বেলা কিছুটা হেঁটে মুখ ফিরিয়ে বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখেছিল দেবাংশু দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে একটু অবাকই হয়েছিল কিন্তু আর কখনো তাকায়নি। তার ধারণা, প্রতিদিনই বেরিয়ে যাবার সময় দাঁড়িয়ে উঠে তাকে দেখে। কী দেখে?

ওরা কী এটা লক্ষ করেছে?

‘রাস্তাগুলো খোঁড়াখুঁড়ি করে এমন করে দিয়েছে, কোথায় যে হুমড়ি খাবেন কী পা ভাঙবেন…ভিখিরিগুলোও যেখানে সেখানে…তার ওপর আছে কুকুর।’

তার গা-ঘেঁষে চলতে চলতে দেবাংশু বলেছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বেলা সতর্ক ছিল কোনোভাবেই শরীর যেন স্পর্শ না করে। কিন্তু হঠাৎই তার বাহুটা বিরাট শক্ত মুঠোয় চেপে ধরবে, এটা সে ভাবেনি। তখন তারা রাস্তা পার হতে যাচ্ছিল।

‘আর একটু হলেই…’

আবছায়া এক সাইকেল আরোহী বেলার সামনে দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে যেতেই সে চমকে পিছিয়ে এসেছিল।

‘লোকটার সাইকেলে আলো থাকা উচিত ছিল।’

এই বলে তার হাতটা ছেড়ে দেয়। কয়েকসেকেন্ড মাত্র। খুবই নিরীহ ব্যাপার।

এটা কী ওরা লক্ষ করেছে? অসম্ভব, অত অন্ধকারে দু-হাত দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছিল না। তা ছাড়া এত আচমকা কম সময়ের জন্য। হাত ধরাটাও পূর্ব পরিকল্পিত নয়। এভাবে যে-কেউই অন্যকে আঘাত থেকে বাঁচাবার জন্য, ধরবে। ‘ধরবে’ শব্দটা বেলার নিজের কাছেই বিশ্রী ঠেকল। ‘রক্ষা করবে।’

কিন্তু এই মুহূর্তে কী করলে সে রক্ষা পাবে? এইসব আজেবাজে চিন্তা কেন আসছে যখন সে থলিটাকে চোখের আড়াল করতে চাইছে? আশ্চর্য, একটাও জায়গা নেই এই বাড়িতে!

হঠাৎ তার মনে হল, থলিটা তো পুড়িয়ে ফেলা যায়!

ধড়মড়িয়ে সে উঠে দাঁড়াল। কোথায় পোড়াবে? রান্নাঘরে? ছাদে? কলঘরে? তাই ভালো, কলঘরেই।

থলিটা ভাঁজ করে সে কলঘরে ঢুকে ছোট্ট জানলাটা বন্ধ করে দিল। থলিটাকে কেটে কয়েকটুকরো করে নিলে কেমন হয়? দেশলাই দিয়ে হয়তো ধরানো যাবে না। কেরোসিন দিয়ে ভিজিয়ে নিতে হবে।

বেলা রান্নাঘর থেকে বঁটি আর কেরোসিনের বোতল আনল। থলিটাকে আট টুকরো করে তাতে কেরোসিন ঢালল।

‘এ কি! আধবোতল কেরোসিন রেখে গেছলাম গ্যালো কোথায়?’

তিমিরের চোখ এড়ানো যাবে না। বাতিক, প্রত্যেক বিবাহিত দম্পতিরই এমন কিছু বাতিক থাকবেই। বিমলকে দিয়ে দু লিটার আনিয়ে বোতলটাকে ঠিক আগের মতোই ভরে রাখতে হবে। ওকে বিকেলের আগেই ধরতে হবে। ‘ধরতে হবে’ শব্দ দুটিতে বেলার আপত্তি হল না।

অল্পই সময় লাগল থলিটা পুড়ে যেতে। কলঘরটা ধোঁয়ায় ভরতি হয়ে গেছে। বিশ্রী একটা গন্ধে বেলার পাকস্থলী মুচড়ে উঠল। সন্তর্পণে জানলাটা খুলে দিয়ে দেখল উঠোনে বা বিমলের জানলায় কেউ নেই।

মর্গ দিয়ে চৌবাচ্চচা থেকে জল তুলে কলঘরের মেঝে সে ধুয়ে দিল। আধপোড়া কালো কিছু টুকরো ছিবড়ের মতো পড়ে রয়েছে। দেখে অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না কীসের পোড়া। তবু সাবধান হবার জন্য সেগুলো খুঁটে খুঁটে তুলে পায়খানার প্যানের ভিতরে ফেলে কয়েক বালতি জল ঢেলে দিল।

কী চমৎকারভাবে কাজগুলো তার মাথায় এসে যাচ্ছে। নিশ্চয় ডিটেকটিভ বই পড়ার ফল। বিয়ের আগে সে গোয়েন্দা বইয়ের পোকা ছিল। এখনও পেলে পড়ে। রীনার মা লাইব্রেরি থেকে বই আনায়। কয়েকবার বেলা চেয়ে এনে পড়েছিল।

কলঘরে সে বুক ভরে শ্বাস টেনে বাতাস শুঁকল। কেরোসিনের গন্ধ সামান্য পাওয়া যাচ্ছে। তিমির আসার আগেই হয়তো মিলিয়ে যাবে।

‘কলঘরে কেরোসিনের গন্ধ পেলুম!’

‘হ্যাঁ, ওখানে বোতল নিয়ে গিয়ে টিনটা থেকে ঢাললুম। ঘরের মেঝেয় পড়লে বড্ড গন্ধ হয়, পায়ে পায়ে ঘরেও আসে।’

পোড়ানোর ব্যাপার এখানেই শেষ, এবার নোটগুলো। ছেঁড়া একটা বালিশের খোল পড়ে আছে। ওটাকে ঘর মোছার জন্য ব্যবহার করতে বলেছিল তিমির। এখনও করা হয়নি।

নোটগুলো খোলটার মধ্যে থাক দিয়ে ভরে, তার একমাত্র ট্রাঙ্কে শাড়ির নীচে রাখতে গিয়ে বেলা থমকাল। নোটগুলো জাল নয়তো? পরীক্ষা করে দেখতে দোষ কী!

পঞ্চাশ টাকার নোটগুলো পুরোনো, ব্যবহৃত। জাল হলে আগেই ধরা পড়ে যেত। কিন্তু একশো টাকারগুলো?

বেলা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে তাড়ায় গাঁথা পিনের ভাঁজকরা মুখ সোজা করে একশো টাকার একটি নোট বের করে নিল।

চোরের মন নিয়ে সে এটা করছে না। সে শুধু জানতে চায় এগুলো জাল না আসল। নিজের আচরণ ঠিক রাখার জন্য এটা জেনে রাখা দরকার নয় কী?

ট্রাঙ্ক বন্ধ করে, তালা দিয়ে, চাবিটা সে দেরাজে না রেখে হাতব্যাগে রাখল। যখন সে বাড়ির বাইরে, তখন কোনো কারণে তিমির হয়তো ট্রাঙ্ক খুলতে পারে। অবশ্য কোনোদিনই সে ওটায় হাত দেয়নি, তবু বলা যায় না। কে ভাবতে পারে একলাখ টাকা উড়ে এসে বাড়িতে পড়বে?

বেলা বিছানায় শুয়ে, ভাববার চেষ্টা করল, পুরো ঘটনাটাই মিথ্যা অলীক মরীচিকা। বড়ো বেশি সে ভাবছে। তার শান্ত থাকা উচিত। নয়তো কোথায় কার কাছে বেফাঁস বলে ফেলবে। এত টাকা নিয়ে কী করবে সেসব চিন্তা পরে করা যাবে। এখন স্বাভাবিক থাকতে হবে।

পাতলা হালকা ঘুমেরই মতো একটা আচ্ছন্নতার মধ্যে সে ভাসতে শুরু করল।

‘…আমি তো দোকান থেকে সবার আগে লাফিয়ে বেরিয়েছি বোমার আওয়াজ পেয়েই।…দুটো গাড়িতে এসেছিল।’

‘বেরোলি কেন, যদি তোর গায়ে মারত!’

‘আরে রাখো, অত সোজা না…ব্যাটাদের গাড়িও এমন, আসলটাই স্টার্ট নিল না…তাহলে।’

বিমলের গলা। আজ দেরি করে এসেছে। বেলা উঠে বসল। ব্যাপারটা শুনতে হবে, শোনা দরকার। কৌতূহলী হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত একটা ডাকাত তাদের গলিতে ঢুকে বোমা ছুড়েছে বাড়ির গা-ঘেঁষে পালিয়েছে।

‘কী হয়েছে বিমল?’

বেলা মাঝের দরজাটা খুলে বিমলদের অংশে এসে ওর ঘরের দরজায় দাঁড়াল।’

‘দিদি, কী বলব, ব্যাটারা যে এত কাঁচা কাজ করবে ভাবিনি। এসব কাজে কেউ গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে? আপনিই বলুন, য়্যাঁ…বাইচান্স যদি স্টার্ট না নেয়! আর হলও তাই।’

প্যান্ট ছাড়ার জন্যে লুঙ্গিটা মাথা দিয়ে গলিয়ে একটা প্রান্ত দাঁতে ধরে প্যান্টের বেল্ট খুলছে। এ সময় দাঁড়িয়ে থাকাটা কুরুচিকর জেনেও বেলা দাঁড়িয়ে রইল। সে সত্যিই কৌতূহল বোধ করছে।

‘ঠিক করা ছিল মাল নিয়ে ওই গাড়িতেই উঠবে। স্টার্ট না হতেই ব্যাটারা দিশেহারা হয়ে ছুটল…আরে আর একটা গাড়ি আছে তাতে উঠে পড়! …দুটো ধরা পড়েছে। একটাকে তো পাবলিক…আমার দোকানের সামনে দিয়েই দৌড়চ্ছিল, হাতের কাছে কিছু না পেয়ে গ্লাসটাই ছুড়ে মারলুম তাক করে। ঠিক লাগল।’

কৃতিত্ব জ্ঞাপনের জন্য বিমলের দাঁত বেরিয়ে এল। কোমরে লুঙ্গির কষি বেঁধে প্যান্টটা ভাঁজ করে দড়িতে ঝুলিয়ে রাখল। পিসিমা ভাত সাজাচ্ছে থালায়, বুলি ঘুমোচ্ছে।

‘তবে বাঁচবে না, যা গণধোলাই পড়েছে।…যে ব্যাটা আমাদের গলি দিয়ে পালাল, তার কাছেই মাল ছিল। দেখেছেন নাকি?’

‘না। আমি তখন ভয়ে ছাদ থেকে নেমে আসছিলুম। একটা বোমা তো আমাদের প্রায় দোরগোড়াতেই ফাটল।’

‘হ্যাঁ, তাই শুনলুম বস্তি দিয়ে পালিয়েছে।’

‘আচ্ছা আর একটা গাড়ির কী হল?’

‘আর দাঁড়ায়! সব গোলমাল হয়ে গেল দেখে হাওয়া…সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে শ্যামবাজারের দিকে চলে গেল।’

‘ক-জন ছিল?’

‘তা অত দেখিনি। অন্তত জনাচারেক তো থাকবেই।’

‘মুখে রুমাল বাঁধা ছিল?’

‘না বোধহয়, যারা দেখেছে তারা তাহলে বলত।’

‘এই ডাকাতটার মুখে ছিল…মানে বলাবলি করছিল তাই কানে এল।’

একটুর জন্য সে ধরা পড়ে যাচ্ছিল। ডাকাতটাকে সে দেখেনি, এটা মনে রাখতে হবে। বিমলের অবশ্য কোনো খটকা লাগল না।

‘বুঝলেন, দিদি, এসব করতে হলে নার্ভ লাগে। দিন-দুপুরে অত লোকজন রাস্তায়, যন্তর দেখিয়ে বোমা মেরে টাকা লুঠ করে পালানো কী মেয়েমানুষ নিয়ে পালানোর মতো অত সোজা ব্যাপার।’

মেয়েমানুষ মানে সাগরিকা। প্রসঙ্গ যাতে না আসে তাই বেলা তাড়াতাড়ি বলল: ‘টাকাটা কাদের?’

‘এক গুজরাটি পার্টির, বিড়ি-তামাকের ব্যবসা করে। দুটো লোক আর একটা দারোয়ান, সঙ্গে বন্দুকও নেই। অবশ্য থাকলেও কিছু হত না।’

‘কেন?’

‘যার হাতে বন্দুক তাকেই তো আগে খতম করবে।’

‘কত টাকা ছিল?’

‘কেউ বলছে পঞ্চাশ হাজার, কেউ বলছে একলাখ।…দোকান ফেলে ওসব কে আর শুনতে যায়, লাভ কী আমার বলুন? টাকা কী আমার? না আমি টাকা পাব?’

‘পঞ্চাশ হাজার হলেও, কম নাকি!’

‘কম মানে! আমি পেলে এখুনি দশ হাজার টাকা সেলামি দিয়ে পালেদের কোণের ঘরটা নোব। দেখেছেন ঘরটা? কী দারুণ পোজিশান…আপনাকে দেখাব। প্রভাস বলেছিল ঘরটা করিয়ে দেবে।’

বিমলের গলায় বিষ নেই। প্রভাস সম্পর্কে তার বিশেষ ঝাঁঝ নেই যতটা আছে সাগরিকার জন্য।

‘পঞ্চাশ হাজার পেলে ওই ঘরটা নেবে, আর যদি লাখ পাও?’

খাটে বসে বিমল হাতটা আলতো করে বুলির মাথায় বোলাচ্ছে। পিসি ভাতের থালা নিয়ে ঘরে ঢুকল।

‘চান করবি তো কর।’

‘যাচ্ছি…ওসব স্বপ্নেই পাওয়া যায়, ওসব আমি দেখি না…ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন!’

বিমলের গলা তাচ্ছিল্যে মৃদু। মুখের শুকনো ত্বকে একটা নরম আভা। মোটা, কর্কশ আঙুলগুলো অতিযত্নে মেয়ের গায়ে বুলিয়ে যাচ্ছে। বেলা লক্ষ করল, ওর বাহুদুটো শরীরের তুলনায় ছোটো। কানের পাশে দু-তিনটে পাকা চুল। একসময় প্রভাসের মতো ঘাড় পর্যন্ত চুল ছিল, এখন ছেঁটে ফেলা। ঘাড়ে একটা ইঞ্চিতিনেক গভীর দাগ। বছরদশেক আগে নকশালরা নাকি ওকে খুন করার চেষ্টা করেছিল। তিমির বলেছিল, গুল মেরেছে। জেটি থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দিচ্ছিল তখন লোহার খোঁচা লাগে।

‘লাখ টাকা যদি হয়, তাহলেও তো কম টাকা নয়!’

‘একটা গাড়ি, পাইপগান, রিভলভার, বোমা আর শুধু সাহস, ব্যস…পাঁচটা জীবনেও যা পারব না পাঁচ মিনিটে তাই রোজগার। দিদি সবই জোগাড় হয় শুধু হয় না ওই সাহসটাই। ওটা পেলে আমিও লাখপতি হবার চেষ্টা করতুম। কাগজে দেখুন, রোজই দু-চারটে হচ্ছে,…রোজ ট্রাম-বাস ঠেঙিয়ে অফিস নয়, রোজ দোকানে বসা নয়, শুধু পাঁচ মিনিটের জন্য সাহস, তারপর লাখপতি।’

‘একা একা এসব করা যায় না। লাখপতি কী আর একজন হয়, ভাগ করতে হয় তো টাকাটা?’

‘একজনের কাজ তো নয়ই। এই যে আজ হল…খবর পেয়েছে আজ টাকা জমা দিতে আসছে। পেল কী করে খবরটা? নিশ্চয় ভেতরে লোক আছে, তাকেও বখরা দিতে হবে। নানাদিকে ওয়াচ রাখতে হয়, লোক লাগে, টাকাও ভাগ হয়। কাউকে ফাঁকি দিলেই বিপদ, নয়তো রিভেঞ্জ নিতে পুলিশকে জানিয়ে দেবে।’

ওয়াচ! বেলা সিঁটিয়ে গেল মনে মনে। এবার তাকেও, বাড়ির সকলকেই ওরা ওয়াচে রাখবে। যে ডাকাতটা থলি ফেলে দিয়ে পালাল সে কী ধরা পড়েছে? পড়লেই বা কী সুবিধে হবে। পুলিশের কাছে মারের চোটে ঠিকই বলে দেবে কোন বাড়িতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে গেছে।

‘তুমি এবার খেয়ে নাও। আর, ভাই, একটা কাজ করে দিতে হবে, দু লিটার কেরোসিন এনে দিয়ো। দোকানে বলেছে আজ নাকি তেল আসবে।’

‘টিনটা দিয়ে যান।’

টিন আর টাকা নিয়ে আসার সময় বেলার কানে এল পিসির গলা।

‘অ বিমল, আমাদের চৌবাচ্চচায় তো জল নেই, চান করবি কী করে?’

‘এক বালতি মতো হবে না?’

‘তুমি আমাদের কলঘরে যাও না, অনেক জল আছে।’

বেলার দিকে অবাক চোখে পলকের জন্য তাকিয়ে বিমল গামছাটা হাতে নিল। মাঝের দরজা পার হবার এই প্রথম সুযোগ তাকে দেওয়া হল।

খাটে শুয়ে বেলা আবার ভাবতে শুরু করল। ধরা পড়ে ডাকাতটা নিশ্চয় পুলিশকে সব বলে দেবে। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে আসবে।

শিব দত্ত লেনের মুখে ভ্যান এসে দাঁড়াবে। অফিসারদের সঙ্গে রাইফেল হাতে বেশ কিছু কনস্টেবলও আসবে। বাড়িতে বাড়িতে সাড়া পড়ে যাবে। জানলা, দরজা, বারান্দা, ছাদে ফিসফিস জল্পনা হবে। কোথায়? কাদের বাড়িতে? কেন?

হাতকড়া দেওয়া, কোমরে দড়ি বাঁধা ডাকাতটাকেও নিশ্চয় সঙ্গে করে আসবে, বাড়ি চিনিয়ে দেওয়ার জন্য।

‘কোনখান দিয়ে থলিটা ছুড়ে ফেলেছিলে?’

ও দেখাবে।

‘ফেলার সময় কাউকে দেখতে পেয়েছিলে?’

‘ছাদে পাঁচিলে একটা দেখেছিলুম, মেয়েছেলের।’

‘দ্যাখো তো ইনিই কিনা।’

ভ্রূ কুঁচকে, অনিশ্চিত চাহনিতে তার মুখের দিকে তাকাবে। ভয়, উত্তেজনার মধ্যে ছুটতে ছুটতে দু-তিন সেকেন্ডের জন্য মুখটা উপরে তুলে তাকিয়েছিল। চিনে রাখা সম্ভব নয়।

‘হ্যাঁ, ইনিই মুখ বাড়িয়েছিলেন।’

‘ঠিক বলছ? ভালো করে দ্যাখো।’

‘হ্যাঁ, ঠিক বলছি…ইনিই।’

‘যখন থলিটা ছুড়ে ফেললে, তখন কী ইনি সেটা দেখেছেন?’

‘বলতে পারব না, তখন কুঁজো হয়ে ছিলুম যাতে না কেউ দেখতে পায়। পাঁচিলের ওপরে ছুড়ে দিয়েই পালিয়েছি…পেছনে তাকাবার সময় ছিল না।’

‘তুমি কি জানতে তখন এই বাড়িতে ওই সময় কারা কারা রয়েছে?’

‘হ্যাঁ। আগেই আমরা খবর নিয়ে রেখেছি।’

‘মিসেস দাস, এবার আমরা বাড়িটা সার্চ করব।’

কাতরে উঠে বেলা উপুড় হয়ে বালিশে মুখ চেপে ধরল। না, ও যেন ধরা না পড়ে। পালাক, যেখানে খুশি। এই চল্লিশ-পঞ্চাশ লক্ষ লোকের শহরে অনায়াসেই লুকিয়ে থাকতে পারবে। এটাও কী ওরা ভেবে রাখেনি যে, অত টাকা ডাকাতি করে পালিয়ে লুকিয়ে থাকতে হবেই?

কাল কাগজে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই বেরোবে। ক-জন ধরা পড়ল জানা দরকার। তিন-চারটে কাগজ কিনতে হবে। লাখ টাকা ডাকাতি, একটা বড়ো ব্যাপার। তার থেকেও বড়ো নিজেকে নিরাপদ করা।

‘আপনাকে আজ কেমন যেন দেখাচ্ছে, শরীর ভালো?’

বেলা অস্বস্তি বোধ করল। ভেতর থেকে রীনার গলা পাওয়া যাচ্ছে। কোনো একটা ব্যাপারে মা-র কাছে আপত্তি জানাচ্ছে। টিভি-তে আজ কোনো ফিল্ম দেখাবে কি?

‘হ্যাঁ, ভালোই তো আছি।’

এটা পড়ার ঘর নয়, লোকজন এলে বসানো হয়। দেবাংশু এই ঘরের লাগোয়া রাস্তার দিকের বারান্দায় অন্য দিনের মতো অফিস থেকে ফিরে আজও বিশ্রাম নিচ্ছিল ইজিচেয়ারে। এবং অন্য দিনের মতোই বেলাকে রাস্তায় দেখামাত্র সদর দরজার কাছে এসে অপেক্ষা করেছে। দরজা খুলেই সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কথাটা বলে।

চোখে মুখে তাহলে কী উদবেগ, ভয় ফুটে উঠেছে? মাত্র ছ-সাত ঘণ্টার মধ্যেই কী তার এতটা বদল ঘটেছে যে ভেতরের গোলমালের ছাপ মুখে পড়ে গেছে? কিন্তু সে তো প্রাণপণে বিকেল থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছে স্বাভাবিক থাকতে। স্বাভাবিক আচরণ, চলাফেরা, কথাবার্তা।

‘বিমল, তোমার ওই লাল জামাটা এবার ছাড়ো। লোকে তোমাকেই এবার ডাকাত ভাববে।’

‘ডাকাতরা বুঝি লাল জামা পরে! খুব বুদ্ধি আপনার, এরকম ব্রাইট জামা পরলে তো চট করে স্পট করে ফেলবে।…আর আমি যদি ডাকাত হই তো সবাই ডাকাত। নিন, পয়সাগুলো গুনে নিন।’

বিমল কেরোসিনভরা টিনটা মেঝে থেকে তুলে রান্নাঘরে রেখে এল। বেলা পয়সা গোনেনি।

‘একটু সাবান দিনতো, হাতে গন্ধ হয়ে গেছে।’

বেলাদের কলঘরে হাত ধোবার সময় বিমল বলেছিল : ‘কীরকম পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছিলুম চান করার সময়।’

‘ভাতটা পুড়ে গেছল, কলঘরে হাঁড়ি পরিষ্কার করেছি।’

‘নিশ্চয় তাহলে খাওয়া হয়নি, তাই কেমন যেন শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে?’

বিমলও লক্ষ করেছে কিছু একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার তার ঘটেছে। তবু ভালো, চট করে ভাতপোড়ার কথাটা বলায় সে অন্য কিছু ধরে নিল। অফিস থেকে ফিরে তিমিরেরও নিশ্চয় চোখে পড়বে আর এমন কিছুই বলবে।

‘কই কিছুই তো আমার হয়নি।’

নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে বেলা লাজুক হাসল। দেবাংশুও তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চট করে চোখ বুলিয়ে হাসল।

‘ঠিক অন্যদিনের মতো দেখাচ্ছে না।’

‘অন্যদিন কীরকম দেখায়?’

বেলা এখন কারোর সঙ্গে কথা বলে মনের মধ্যে এমন একটা আবহাওয়া তৈরি করতে চায়, যেখানে শিব দত্ত লেনের চিন্তা থেকে সে রেহাই পাবে। এই লোকটি বোকা নয়, অমার্জিতও নয়। বোধহয় ভরসা করা যায়।

‘আরও তাজা, আরও মিষ্টি…ফুলের মতো।’

দেবাংশুর গৌরবর্ণ গালদুটোয়, কপালে রক্ত ছুটে এসেছে বোধহয়। হঠাৎ গোলাপি হয়ে উঠল। বেলা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিল ভেতরে ভেতরে সে ব্যস্ত মরিয়া হচ্ছিল, যেকোনো ধরনের একটা ব্যাপারের মধ্যে চলে যাবার জন্য। এবার মাথার পিছনে দুটি হাত রেখে পা ছড়িয়ে দিয়ে শরীরটা টান টান করল আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিতে।

তার বুক, গলা খুব খারাপ নয়। দেবাংশুকে লক্ষ করতে করতে সে হঠাৎ সচেতন হয়ে হাতদুটি নামিয়ে বুকের কাপড় টানল। আজকের ডাকাতির কথা ওকে না বলাই উচিত। আজ বিকেলেই তার মনে হয়েছে নোটগুলো সরাতে হবে, হয়তো ও সাহায্য করতে পারে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগসূত্র কিছুই নেই। দেবাংশু মারফত করা যায়।

‘ফুল তো আর চিরদিন তাজা মিষ্টি থাকে না। বয়স তো হচ্ছে।’

‘কারোর কারোর হয় না।’

দেবাংশুর গলা কাঁপল। প্রায় পঞ্চাশে এসে এই অবিবাহিত দৈত্যটি এবার বোধহয় কিছু মধুর স্মৃতি চায়। বেলা মমতা বোধ করল।

‘হয়। ফিজিয়োলজির নিয়মে হতে বাধ্য। তবে আপনার ক্ষেত্রে…’

বেলা বাক্যটি অসমাপ্ত রেখে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামায় ঢাকা চওড়া ভারী আকৃতিটির দিকে ক্ষণেকের জন্য দৃষ্টি রাখল। বুকটা একটু ফুলিয়ে দেবাংশু স্মিত হাসল। তার বডিবিল্ডিং প্রয়াস এতদিনে যেন কিছু একটা লক্ষ্যে পৌঁছেছে।

সেই সময় রীনা ঘরে এল বইভরা সুটকেস নিয়ে, মুখটা থমথমে, বিরক্ত। বেলা মুখে গাম্ভীর্য টানার আগে, বারান্দায় যেতে উদ্যত দেবাংশুকে বলল : ‘একটা ব্যাপারে আপনার একটু পরামর্শ চাই।’

”কী পরামর্শ?’

‘কাগজে দেখি নানান কোম্পানির ডিপোজিট স্কিমের বিজ্ঞাপন… কিছু টাকা রাখব, আচ্ছা পরে বলবখন।’

লোডশেডিং হয়নি তবু দেবাংশু তার সঙ্গে শিবদত্ত লেনের মুখ পর্যন্ত এল।

‘কালকেই আসুন, দুটো-তিনটে নাগাদ। অফিস চিনতে কোনো অসুবিধে হবে না।’

‘সে আমি ঠিক চলে যাব। আচ্ছা…’

বেলা ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দিল দেবাংশুকে আর এগিয়ে দিতে হবে না।

সদর দরজার তালাটা নেই। তিমির এসে গেছে। কড়া নাড়ার পরে প্রতিদিনের মতো তাকে সেকেন্ড দশেক অপেক্ষা করতে হল।

দরজা খুলেই তিমির মৃদুস্বরে অনুযোগের ভঙ্গিতে বলল: ‘দুপুরে খাওনি।’

‘যা কাণ্ড হল, খিদেটিদে মাথায় উঠে গেল।’

‘স্বাস্থ্যকে অবহেলা করা উচিত নয়।’

সকালের ডাকাতি সম্পর্কে তিমিরের কোনো ঔৎসুক্যই নেই। নিশ্চয় শুনেছে, কেননা বাড়ি ফেরার পথে প্রতিদিনের মতো নিশ্চয় মোড়ের দোকানে পাঁউরুটি কিনতে ঢুকেছিল।

তিমির রান্নাঘরে ফিরে গেছে। ঘরে এসে ব্যাগটাকে নিয়ে বেলা ইতস্তত করল। একশো টাকার নোটটা এর মধ্যে রয়েছে। তিমির অবশ্য কখনো তার ব্যাগে হাত দেয় না তবু…।

ব্যাগের মুখ ফাঁক করে নোটটা মুঠোর মধ্যে নিয়েই সে খোলা দরজার দিকে চোখ রেখে দেরাজ খুলল। থাক করে রাখা শাড়ি আর ব্লাউজের মাঝে নোটটা রাখতে গিয়ে তার চোখে পড়ল সকালে কেনা লটারির টিকিটটাও নোটের সঙ্গে উঠে এসেছে। দুটোই সে একটা ব্লাউজের ভাঁজে রেখে দিল।

মাথা ধরার অজুহাতে সে কপালে হাত রেখে শুয়ে রইল। এই সময় তিমির তার সঙ্গে কথা বলবে না, এটা সে জানে।

‘একটু কিছু খেয়ে নাও।’

‘ছাত্রীর বাড়ি খেয়েছি, রাতে আর খাব না।’

এক কাপ চা ছাড়া রীনারা আর কিছু দেয় না। গীতাদিকে নাকি রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু-না-কিছু আনিয়ে দেয়। ছাত্রীর বাবাই মালিক।

বেলার সত্যিই খিদে নেই। সকাল থেকে কিছু না খেয়ে এইভাবে থাকা, দাদা মারা যাওয়ার দিনও ঘটেছিল বটে কিন্তু দুটো ঘটনা একজাতের নয়।

তাদের সারা সংসার দাদার মুখের দিকে আশা করে তাকিয়েছিল। চমৎকার কলেজ রেজাল্ট নিয়ে নম্র, পরিশ্রমী, স্নেহপ্রবণ এই তরুণ স্বাচ্ছল্য এনে দেবে, ভাইদের দাঁড়াতে সাহায্য করবে, মোটামুটি মধ্যবিত্ত স্তরে তাদের তুলে নিয়ে যাবে। চুরমার আশা এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সুব্রত দুর্গাপুরে এক মোটর গ্যারেজে আছে, ভালো করে লিখতে-পড়তে জানে না হয়তো চিঠিপত্রও দেয় না। সুবীরের হাতের লেখা ভালো, ধরে ধরে ওকে হাতের লেখা করাত বেলা। মাসছয়েক আগে সুবীর লিখেছিল বোম্বাইয়ে এক হোটেলে বয়-এর কাজ করছে। আর সে লেখেনি।

এখন এদের কথা সে মনে করতে চায়নি, তবু হুড়মুড় করে ওরা চিন্তার মধ্যে ঢুকে আসছে। সে এখন ভাবতে চায় আগামীকাল কী করবে। দেবাংশুর অফিসে যেতে হবে। ঠিকানা লিখে দিয়েছে।

‘টাকা নিয়ে যাব কী?’

‘আসতেও পারেন….যদি কালই হয়ে যায়! কত টাকা?’

ওর অফিসেও টাকা ধার নেবার স্কিম চালু আছে। কাল অফিসে গিয়েই খোঁজ নেবে।

কিন্তু একসঙ্গে সব টাকার নয়। একশো টাকার থোকগুলো করকরে, নতুন পিন গাঁথা। সিরিয়াল নম্বর এক থেকে একশো পর্যন্ত। নিশ্চয় মালিকের লিখে রাখা আছে পুলিশ ইতিমধ্যে তা জানিয়েও দিয়েছে সব ব্যাঙ্ককে। নোটগুলো তার কাছ থেকে যে কোম্পানিই পাক নিশ্চয় বেলা দাসের নামটা সিরিয়াল নম্বরের সঙ্গে লিখে রাখবে। তারপর যখন তারা ব্যাঙ্কে পাঠাবে সেখানে ডাকাতির নোটের নম্বরের সঙ্গে মিলছে কিনা তা দেখা হবে।

এইরকম একটা ঘটনা সম্পর্কে লেখা কোন এক গোয়েন্দা পত্রিকায় সে যেন পড়েছে। জাপান না কোথায়, একটা নামি চোর দু-বছর পর নোট ভাঙিয়ে হিরে কিনতে গিয়ে ধরা পড়ে।

বরং অনেক নিরাপদ সুতুলি বাঁধা পঞ্চাশ টাকার পুরোনো নোটের তাড়াগুলো। নানান সিরিয়াল নম্বরের নোট ওতে আছে আর নিশ্চয়ই কেউ তা টুকে রাখেনি। চারশো নোট…অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু কুড়ি হাজার একসঙ্গে বার করলে সন্দেহ দেখা দেবে না কি? বড়ো বড়ো কোম্পানির কাছে এটা কোনো টাকাই নয়। ওখানকার লোকেরা রোজই লাখ-দু লাখ নাড়াচাড়া করে। কুড়ি হাজার নিয়ে চিন্তাই করবে না। কিন্তু দেবাংশু? সে ভাবতে পারে, সামান্য প্রাইমারি স্কুলটিচার, সামান্য কারখানা কেরানি-এরা এত টাকা জমালো কী করে? তারপর যদি কখনো শোনে, কতদূরেই বা থাকি নিশ্চয়ই কানে যাবে, এই পাড়াতেই একটা ব্যাঙ্কে ডাকাতি হয়েছে, ডাকাতটা টাকার থলি নিয়ে বেলাদেরই বাড়ি ঘেঁষে পালিয়েছে, আর বেলা তারপরই ডিপোজিট স্কিমে টাকা রেখেছে, তাহলে কী…

‘দাও, মাথাটা টিপে দি।’

বেলার পাশে বসে, তিমির হাত রাখল কপালে।

‘না থাক…এখুনি কমে যাবে।’

তার চিন্তার মাঝে, এ ধরনের বিঘ্ন বেলা এমন চায় না। চায় গভীর একাকিত্ব। সে চুরি করেনি বা কাউকে ঠকিয়ে অর্জন করেনি। এ টাকা বলা যায়, তার কাছে জমা রাখা হয়েছে। এ টাকার মালিক সে নয়, কিন্তু ঘটনাক্রমে হতেও তো পারে। তার দরকার। এত টাকা যদি ধরা পড়ে তাহলে সে কি জবাবদিহি করবে?

‘সারা দিনে এত পরিশ্রম, সকালে স্কুল বিকেলে টিউশনি… শরীরে সইবে কেন।’

তিমির হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কপালে, মাথায়। বেলা কিছু অনুভব করতে পারছে না। শুধু তিমিরের নিশ্বাসের আর বাসি ঘামের গন্ধটা তাকে বিরক্ত করছে।

‘দরকার কী টিউশনির, ছেড়ে দাও।…আমাকে ওভারটাইম করতে বলছে, তাতে পঞ্চাশ টাকার অনেক বেশিই মাসে পাব।’

তিমিরের মৃদু শান্ত গলাটা তার বোলানো হাতের মতোই ব্যথিত, কাতর মনে হল। বেলা এখন ক্লান্ত বোধ করছে।…দেবাংশুর অফিসটা চিনে বার করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ওইসব অঞ্চলে কখনো সে যায়নি। ট্যাক্সিওয়ালাকে বললে হয়তো ক্যামাক স্ট্রিটে পৌঁছে দেবে, কিন্তু অতবড়ো রাস্তায় বাড়ি খুঁজে বার করা কী সম্ভব হবে!

‘…একটা সিনেমা-থিয়েটারও দেখা হয় না, ভালো শাড়িও কিনে দিতে পারি না, কোথাও বেড়াতে যাব যে…একবার প্ল্যান করেছিলুম আমরা দার্জিলিং যাব, মনে পড়ে?’

বেলা ঘুমের ভান করে উত্তর দিল না। তিমির সন্তর্পণে হাত বুলিয়ে চলেছে, অসুস্থ কন্যার প্রতি মায়ের মমতা নিয়ে।

ও জানে না খাটের নীচে ট্রাঙ্কে এক লক্ষ টাকা রয়েছে। এখন জানালে কী করবে? হয়তো জানানো উচিত ছিল। হয়তো কেন এমন ব্যাপার স্বামীকেই মেয়েরা সর্বাগ্রে জানায়।…কিন্তু কেন যে পারল না! পুলিশকে নয়, তিমিরকেও নয়। জানানোটা তো কোনো ভয়ের ব্যাপার নয়!

বেলার ক্লান্ত মস্তিষ্কের সঙ্গে ক্রমশ বহির্জগতের যোগাযোগ খসে পড়ছে। আবছা হয়ে আসছে চেতনা।…জানলে তিমির কী করবে? তাকে ধিক্কার দেবে? বলবে, চোর বাটপাড়? টাকা নিয়ে আমায় নিয়ে কী ফেরত দিয়ে আসবে? গঙ্গায় ফেলে দেবে? তিমির অত্যন্ত ভীতু প্রকৃতির। তা না হলে ওকে সৎ বলা যেত।

ফেরতই দিক, তাই করুক। আর সহ্য করা যাচ্ছে না এই উদবেগ, মানসিক অশান্তি। এই যন্ত্রণা সে সেধে নিয়েছে। হয়তো লোভ, অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে ঘাপটি দিয়ে লুকিয়ে ছিল যা সে জানত না, থলিটা ফেরত দেওয়ার আর প্রশ্নই ওঠে না। তাকে গোপন রাখতে হবে এই টাকার খবর, চিরকাল।

‘কিছু বলছ?’

তিমির ঝুঁকে পড়ল মুখের উপর। অস্ফুট গোঙানির মতো একটা শব্দ বেলার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে।

এবার সে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে।

সকালে খবরের কাগজ দিয়ে যায় বেলা স্কুলে বেরোবার পর।

শ্যামবাজারে পাঁচমাথার মোড়ে বাস থেকে নেমেই খবরের কাগজ কিনল। প্রথম পাতায় উপর থেকে চোখ বুলিয়ে নীচের দিকে নামতেই একটা হেডিংয়ে চোখ স্থির হয়ে গেল।

দু-পাশে তাকিয়ে সে ফুটপাথের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল। কোন খবরটায় তার আগ্রহ এটা আশপাশের লোককে সে জানাতে চায় না।

 হেডিং থেকে বেলার কৌতূহল খবরের মধ্যে ঢুকল।

‘…সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ বি কে পাল অ্যাভিন্যুয়ে এক ব্যাঙ্কের সামনে মোটর থেকে নামামাত্র এক গুজরাটি বস্ত্র ব্যবসায়ীর এক লক্ষ টাকা লুট হয়েছে। জনতার হাতে প্রহৃত হয়ে এক ডাকাত প্রাণ হারিয়েছে। আর এক ডাকাত এখন আর জি কর হাসপাতালে, তার অবস্থা এখন-তখন। দু-জনেরই বয়স কুড়ির নীচে। আর একজন এক লক্ষ টাকার নোটের বান্ডিল ভরা নীলরঙের থলিটি হাতে নিয়ে দৌড়ে কাছের এক গলিতে ঢুকে পড়ে। জনতা তাড়া করায় সে বোমা ছুড়ে চম্পট দিতে সক্ষম হয়। আর কেউ ধরা পড়েনি। টাকা উদ্ধার এবং অপরাধীদের ধরার জন্য পুলিশ জোর তদন্ত শুরু করেছে।…’

ডাকাতটা ধরা পড়েনি! বেলার হৃদস্পন্দন আর একটু দ্রুত হল। তাহলে একমাত্র সেই পলাতক ডাকাত ছাড়া আর কেউ জানে না। গুজরাটি বস্ত্র ব্যবসায়ী, অথচ বিমল বলেছিল বিড়ি পাতার ব্যবসায়ী। তিমিরই ঠিক, বিমল রং চড়িয়ে বলে। খবরের কাগজে জেনেশুনেই লেখা হয়।

কাগজটা ভাঁজ করে সে দ্রুত পায়ে স্কুলের দিকে এগোল। বাকি অংশটুকু স্কুলে পড়ে নেবে।

আর একটা রাস্তা দিয়েও দেবিকাও স্কুলের দিকে আসছে, বেলা দূর থেকে হাত তুলে তাকে থামতে ইশারা করে এগিয়ে গেল।

‘কী ঘটেছে জান আমাদের পাড়ায়! এক লাখ টাকা রাস্তায় ডাকাতি!’

‘তাই নাকি।’ দেবিকা একটুও আশ্চর্য হল না।

‘এতো রোজই দু-পাঁচটা হচ্ছে। আমাদের ওদিকে ছ-টা ছেলে ডাকাতি করতে এসে ট্যাক্সিতেই সবাই ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। পরশু দিনের ঘটনা। সবাই ষোলো-সতেরো বছরের।’

‘আমাদের ওখানেও কুড়ি বছরের নীচে…এই তো কাগজে লিখেছে। পড়ে দ্যাখো।’

বেলা খবরের কাগজটা এগিয়ে ধরল।

‘পরে পড়ব চলুন দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

‘আমার ভাই কিন্তু ভয় কচ্ছে।’

বেলা হঠাৎ গলা নামিয়ে ফেলায় দেবিকা মন্থর হয়ে অবাক চোখে তাকাল ঘাড় ফিরিয়ে। দু-জনেই তখন স্কুলগেটের কাছে পৌঁছে গেছে।

‘এখানে নয়…ছুটির পর একটু অপেক্ষা কোরো বলব, তোমাকে দরকার আছে।’

অস্বস্তি ভরে বেলা ক্লাসগুলো শেষ করল। বার বার কাগজ খুলে ডাকাতির ঘটনা পড়ল। সে ঠিক করেই রেখেছিল কারোর সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে কথা বলবে না। কেউই এত সকালে কাগজ পড়ে আসেনি সুতরাং তাকে প্রশ্নের সামনে পড়তে হবে না।

‘পুলিশ জোর তদন্ত শুরু করেছে’, বলতে কী বোঝায়? এটা রুটিনমাফিক কথা। প্রত্যেক চুরি-ডাকাতির খবরের শেষে এটা থাকে। কিন্তু এক লাখ টাকা সামান্য জিনিস নয়।

কাগজ খুলে হেডলাইনটা চোখের সামনে রেখে সে অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে থেকেছে। কোনোদিনই সে ক্লাসে পড়ানোয় ফাঁকি দেয় না। সৎ এবং কর্তব্যনিষ্ঠ হিসাবে তার সুনাম আছে। কিন্তু আজ সে কোনোভাবেই পড়াতে পারছে না।

খবরটার মধ্যে আগাগোড়া কোনো সহানুভূতি নেই মৃত ডাকাতটার জন্য। ডাকাত নয়, ছেলে বা তরুণই বলা উচিত। ‘গণধোলাই’ বা ‘চম্পট’ ধরনের চটুল শব্দ যেন ব্যাপারটার গুরুত্ব কমিয়েই দিয়েছে। ডাকাতি বা খুন এখন আর নাড়া দেবার মতো ঘটনা নয়, বরং লোকে যেন মজাই পায়। দেবিকার কোনো প্রাতক্রিয়াই হল না। হোক ডাকাত একটা তাজা ছেলে তো!

‘…কাছেই আর একটি কালো অ্যাম্বাসাডারে অপেক্ষা করছিল আরও তিনজন। তারা বেগতিক দেখে গাড়ি নিয়ে সটকে পড়ে। ধৃত অ্যাম্বাসাডারটি এন্টালি অঞ্চলে চুরি করা বলে পুলিশ জানিয়েছে। তার মধ্যে থলিভরতি বোমা, একটি ভোজালি…ধৃত ডাকাতটির নাম মন্টু বাগচি, যাদবপুর বাঘা যতীনের…ডাকাতি হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় পুলিশ খবর পায়। উত্তর কলকাতার ডেপুটি কমিশনার…মন্টু বলেছে তাদের দলের সাকরেদের সকলেরই দোনম্বরি নাম ও ঠিকানা। গোপনীয়তার জন্য সাংকেতিক ভাষায় তারা কথাবার্তা বলত।’

এদের একটা দল আছে, অবশ্যই তাদের একজন সর্দার আছে। জমায়েত হবার ঘাঁটিও আছে। যে ছেলেটা পালিয়েছে, সে ইতিমধ্যেই ঘাঁটিতে পৌঁছে গেছে বা লোক মারফত বা টেলিফোনে খবর দিয়েছে থলিটা কোন বাড়িতে ফেলে গেছে।

ওরা আজ থেকেই বাড়ির উপর, বাড়ির লোকেদের উপর নজর রাখতে শুরু করবে, কিংবা করেছে।

একদৃষ্টে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বেলা। কপালে ঘাম ফুটে উঠেছে। স্নায়ুগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে অসম্ভব ভার। ক্লাসের বাচ্চচাদের মুখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না।

জামরুল গাছের কয়েকটা ডাল জানলা ঘেঁষে। আকাশ স্বচ্ছ নীল। হঠাৎ এত নীল বছরের এই সময়! বেলা অবাক হল এবং মনে মনে হাসল। এখন এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো দরকারই নেই। তার দরকার, লক্ষ টাকা নিয়ে চিন্তা করার।

কয়েক বছর আগে, একটা ঘটনার কথা সে পত্রিকায় পড়েছিল। হঠাৎ এখন সেটা তার মনে পড়ল। তার এই ব্যাপারটার সঙ্গে অনেকটা মিল আছে। বোধহয় আমেরিকাতেই ঘটেছিল। ব্যাঙ্ক আর বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের লক্ষ লক্ষ টাকা আনা-নেওয়ার জন্য একটা ফার্ম ছিল। ইস্পাতে মোড়া ট্রাকে আর প্রাইভেট পুলিশের দল নিয়ে তারা এই কাজ করত।

কয়েকটা লোক সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে লক্ষ করলেন ট্রাকগুলোর যাওয়া-আসা। অবশেষে আবিষ্কার করল প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে বিরাট অঙ্কের টাকা ওই ফার্মের অফিসে কয়েক ঘণ্টার জন্য রাখা হয় ট্রাকে তোলার আগে।

অফিসটা প্রায় দুর্গের মতোই। লোকগুলো এক বছর ধরে প্ল্যান করে ডাকাতি করল। বলা হয়েছিল, শতাব্দীর দুঃসাহসিক ডাকাতি।

বেলার খুঁটিনাটি মনে পড়ছে না। সাত-আট লক্ষ ডলার ডাকাতি করে চার-পাঁচজন লোক উধাও হয়ে যায়।

পুলিশ বছরের পর বছর ধরে নিঃশব্দে খোঁজ করে চলে। কয়েকটা লোককে তাদের সন্দেহ হয়। লোকগুলো রোজ একটা বার-এ গিয়ে মদ খেত। পুলিশ ওদের অনুসরণ করে যেতে থাকে।

বৈধভাবে রোজগার নয় এমন একটা পয়সাও লোকগুলো খরচ করত না। তাদের একজনও এমন কোনো খরচ করত না, যা সাধ্যের বাইরে। পুলিশ কিছুতেই ধরাছোঁয়ার মধ্যে তাদের পাচ্ছিল না।

প্রত্যেকটি ব্যাঙ্কে আর বড়ো বড়ো দোকানে ডাকাতি হওয়া নোটের নম্বর জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রায় দশ বছর ধরে ওই নম্বরি নোট, আমেরিকায় বা বিদেশেও, বাজারে দেখা যায়নি।

আমেরিকার আইনে, রক্তপাত ঘটেনি এমন কোনো অপরাধের সময়সীমা দশ বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকে। আর কয়েক সপ্তাহ মাত্র বাকি ছিল দশ বছর পূর্ণ হতে।

এমন সময় একটা ছোটো স্থানীয় ব্যাঙ্ক পুলিশকে জানাল, তারা দশ ডলারের একটা নোট পেয়েছে। যেটার নম্বর চোরাই লিস্টে রয়েছে। এক দোকানদার নোটটা জমা দিয়েছিল। তার মারফত এক সন্দেহভাজনকে খুঁজে পাওয়া গেল এবং সময়সীমা পেরিয়ে যাবার ঠিক পাঁচ দিন আগে গোটা দলটাই ধরা পড়ল।

পাঁচটা লোক দুঃখকষ্ট, দারিদ্র্য, ক্ষুধা উপেক্ষা করে প্রায় দশ বছর ধৈর্য ধরেছিল। নিজেদের ধরে রেখেছিল লোভের হাতে থেকে। টাকাগুলো এক পোড়ো কবরে পুঁতে রেখে ওরা শুধু পাহারা দিয়ে গেছল।

কিন্তু একজন পারেনি। তার ছেলে মৃত্যুশয্যায়। চিকিৎসার জন্য টাকার দরকার। গভীর রাতে সে দলের কাউকে না জানিয়ে কয়েকটা নোট তুলে এনেছিল।

ঘটনাটা বেলাকে তখন দারুণভাবে আচ্ছন্ন করেছিল। ভাগ্যের পরিহাস বা নিয়তির প্রতিশোধ-এমন ধরনের। কিছু কথা তখন তার মনে এসেছিল। সে জানত না, ওই লোকগুলোর মতোই প্রায় তারও অবস্থা আসবে। শুধু পুলিশ নয়, আরও কিছু ভয়ংকর লোকের ছুরি, বোমা, রিভালবার তার জন্য তৈরি হয়ে উঠছে। ওরা এখনও জানে না, কিন্তু জেনে যাবেই। আজ না হোক, দশ বছর পরে জানবে। ওরা নিশ্চয় অপেক্ষা করে থাকবে।

বেলার পা-দুটো অসাড় হয়ে এল। কপাল থেকে চিবুক বেয়ে ঘাম পড়ছে। পেনসিলধরা আঙুল কাঁপছে। নিজের কানেই বুকের দপদপানি যেন ধরা পড়ছে। তার এবার আড়াল চাই, আশ্রয় চাই, শুধু একজন নয় কয়েকজন এখন জানে এক লাখ টাকা কোথায়।

‘বেলাদি আপনার বুঝি অসুখ করেছে?’

হতভম্বের মতো বেলা কচি মুখটার দিতে তাকিয়ে থাকে। ছাত্রীদের চোখেও তাহলে ধরা পড়ছে।

‘বড্ড মাথা ধরেছে… তোমরা কথা না বলে বসে থাক।’

ছুটির পর গীতা ও অর্চনার সঙ্গে যাতে না বেরোতে হয়, সেজন্য বেলা অজুহাত তৈরি করল।

‘না গীতাদি, দুজন গার্জেনকে দেখা করতে বলছি…কিচ্ছু পড়াশুনো করে না মেয়েরা, টাস্কও করে আনে না, তোমরা বরং আজ এসো!’

‘বেলাকে কেমন অসুস্থ দেখাচ্ছে, তাই না গীত্যদি?’

‘কাল সারারাত ঘুম হয়নি, অম্বলের ব্যথাটা আবার…’

অর্চনার মুখ দেখেই বেলা বুঝল সে কী বলবে। তার পাড়ায় এক কবিরাজ আছে, সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী। তার ননদের হাঁপানি সারিয়েছে, এক মামি বাতে কষ্ট পেত, এখন পায় না। অম্বলের রোগ হরদমই সারিয়ে দিচ্ছে। বেলা যদি একবার যায় তো…

‘দেখি ওরা এসে দাঁড়িয়ে আছে বোধহয়।’

টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে লম্বা করিডরে ছাত্রীদের ভিড় ঠেলে বেলা স্কুলের গেটের কাছে এল। অপেক্ষারতদের অধিকাংশই মা কিংবা বাড়িরই কোনো মেয়ে। দেবিকা উঠোনেই রয়েছে, সারি দিয়ে মেয়েদের বেরিয়ে যাওয়া তদারকি করতে।

বেলা আবার টিচার্স রুমে ফিরে এল। গীতা বা অর্চনা নেই। স্কুলের পিছনের দজরা দিয়ে ওরা নিশ্চয় বেরিয়ে গেছে।

মিনিট দশেক পর দেবিকা এল।

‘কীসের ভয় করছে বেলাদি?’

‘দেখেছ তো কীরকম সব ডাকাতি হচ্ছে রাস্তার উপর, দিনের বেলাতেই। অথচ আজই আমায় টাকা নিয়ে ক্যামাক স্ট্রিটে যেতে হবে একটা অফিসে, যাবে আমার সঙ্গে?’

‘কত টাকা?’

‘হাজার কুড়ি।’

‘অ্যাতো! বাবাঃ আপনার টাকা?’

‘হ্যাঁ।’

বেলা মনে মনে বিব্রত হল একটু। টাকাটা তার নিজের, এই ধারণা তার যেন বদ্ধমূল হচ্ছে। এত উদবেগ, মানসিক টানাপোড়েন তাহলে সে সইছে কেন?

‘তা আমি কী করব? ডাকাত বুকে রিভলবার ঠেকালে চেঁচাতেও পারব না, টাকা নিয়ে টানাটানিও পারব না।’

‘তা আমি জানি। তবে সঙ্গে কেউ থাকলে একটা ভরসা হয়। তাছাড়া ডাকাতি যে হবেই তার কী মানে আছে। ডাকাতি করে আগে খবর পেয়ে, আমি আজ টাকা নিয়ে যাব, এটা তো কেউ জানে না। তোমাকেই প্রথম বললাম, অনেক দিনের, অনেক কষ্টে জমানো তো?’

‘যাবেন কোথায়?’

‘ক্যামাক স্ট্রিটে। কাগজে দেখনা বড়ো বড়ো কোম্পানি আমানত প্রকল্প খুলেছে, পাবলিকের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে তেরো-চোদ্দো পার্সেন্ট সুদে। সেইরকমই এক বিরাট ওষুধের ফার্মে টাকাটা দিতে যাব। ওখানকার একজনের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি, তিনি আজ তিনটে নাগাদ যেতে বলেছেন। মুশকিল কী জান, ওদিককার পথঘাট আমি একদমই চিনি না, তুমি হয়তো চেন।’

‘কী করে বুঝলেন?’

বেলা অপ্রতিভ হল। কী করে বুঝল সেটা তো দেবিকাকে বলা যাবে না।

‘আজকালকার মেয়ে তোমরা, কত জায়গায় তো খেলতে গেছ, তাই বললুম।’

ওদিককার স্কুলগুলোয় তো বাস্কেট খেলা হয়। নিশ্চয় দেবিকা খেলতে যেত।

‘যাবে আমার সঙ্গে? ট্যাক্সি করে যাব।’

‘আপনি এক কাজ করুন। আড়াইটের সময় গণেশ অ্যাভিন্যুর দিকে খাদি গ্রামোদ্যোগের দরজার সামনে আমি দাঁড়িয়ে থাকব, ট্যাক্সি নিয়ে আপনি চলে আসুন, ওখান থেকে একসঙ্গে যাব।’

‘বাঁচালে।’

দেবিকা কথানুযায়ী যথাসময়ে দাঁড়িয়েছিল। বেলাকে কয়েক সেকেন্ডের বেশি ট্যাক্সি থামাতে হয়নি।

‘টাকা এই ব্যাগেই রয়েছে?’

বেলা ভীত চোখে শিখ ট্যাক্সিওলার পিঠের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ টিপে দেবিকাকে ইশারায় বলল, টাকা নিয়ে কথাবার্তা নয়। তারপর কোলের ব্যাগে আলতো চাপড় দিয়ে বুঝিয়ে দিল। নোটের চারটে তাড়া রুমালে বেঁধে ছোট্ট একটা পুঁটলি করে নিয়েছে। ব্যাগের মধ্যে বেশি জায়গা নেয়নি। বাড়ি থেকে বেরোবার পর গা ছমছম করেছিল বেলার। কিন্তু একটা জিনিস সে ঠিক করেই ফেলেছে আচরণে বা কথাবার্তায় অস্বাভাবিক কিছু যেন ফুটে না ওঠে, সন্দেহজনক না হয়। তিনটে ট্যাক্সি সে ছেড়ে দিয়েছে, ড্রাইভারদের চেহারার জন্য। ওদের রোগা মুখ ক্ষুধার্ত লোভী চোখ এবং নোংরা জামা থেকে তার মনে হয়েছে এরা নিরাপদ নয়। ট্যাক্সিওলাদের সম্পর্কে অজস্র ভীতিকর গল্প তার শোনা আছে। অবশেষে এই শিখ আধবুড়ো লোকটিকে সে বেছে নেয়।

‘তোমাদের পাড়ায় আর কোনো গোলমাল হয়নি?’

‘আজ সকালে একটা খুন হয়েছে।…ওই যে বললাম তখন ছ-টা ছেলে ধরা পড়েছে, তারই জের।’

বেলাকে ‘জের’ শব্দটা কাঁটা করে দিল। ধরা পড়ার জের খুন!

‘…চায়ের দোকানে ছেলেটা কাজ করত। আজ সকালে জনাচারেক এসে ওকে ডেকে কাছেই একটা গলিতে নিয়ে গিয়ে ছুরি মারে, মারার পর বোমা মারে। সঙ্গে সঙ্গে ডেড। দু-মিনিটেই কাজ শেষ করে লোকগুলো একটা গাড়িতে উঠে চলে যায়।’

‘মারল কেন?’

‘সবাই বলছে, ছেলেটাই পুলিশকে খবর দিয়েছিল তাইতেই ছ-জন ধরা পড়ে। খবর না পেলে পুলিশ কী ধরতে পারত? দলের লোকেরা তার শোধ নিল।’

বেলা আর কথা বলেনি। দলের লোকেরা এক লাখ টাকা ছেড়ে দেবে না নিশ্চয়। এজন্য দলের লোক ধরা পড়েছে, একজন মারাও গেছে…নিশ্চয় ছেড়ে দেবে না। ওরা তাহলে আমার পিছু নেবেই। পুলিশও তো ছেড়ে দেবে না এক লাখ টাকা, তারাও ওৎ পেতে থাকবে।

বাড়িটার নাম ‘শান্তিবন’ নতুন, ছ-তলা। খুঁজতে হল না। দেবাংশুর কথানুযায়ী, পার্ক স্ট্রিট দিয়ে ঢুকে একটা মোড় পেরিয়েই ডানদিকে বাড়িটা।

দোতলায় অফিস। দুটো লিফটের সামনে লাইন দিয়ে লোক দাঁড়িয়ে। দেওয়ালে পিতলের অক্ষরে লেখা সারি সারি অফিসের নাম।

‘বেলাদি, চলুন হেঁটেই উঠি।’

সাদা মার্বেলের সিঁড়ি। পরিচ্ছন্ন ফিকে হলুদ দেওয়াল। ব্যস্ত উর্দিপরা বেয়ারারা। কোনো আজেবাজে কোলাহল নেই, জুতোর শব্দ আর টুকরো কথাছাড়া। বেলা এমন একটা জায়গায় এই প্রথম এল।

রিসেপশনিস্ট মেয়েটি অপাঙ্গে দেবিকাকেই বারকয়েক দেখল। বেলা এই প্রথম লক্ষ করল, দেবিকার পরনে মুর্শিদাবাদি সিল্ক, ব্লাউজটা শুধুমাত্র ব্রেসিয়ারকে লোকচক্ষু থেকে আড়াল করছে, হালকা গোলাপি আভা ঠোঁটে। ওকে মোটেই স্কুল শিক্ষিকা মনে হচ্ছে না। এখন যদি অরুণা পোদ্দার দেখে তাহলে, কালকেই দেবিকার ডাক পড়বে ওর ঘরে।

‘বলে রেখেছেন আপনি আসবেন…করিডর দিয়ে বাঁদিকে থার্ড দরজা।’

করিডরে টিক প্লাইউডের দেওয়ালে তিন-চার মিটার অন্তর দরজা। ঝকঝকে হাতল। বেলা ইতস্তত করে দেবিকার মুখের দিকে তাকাল। কোথায় দুবার কলিং বেল বাজল।

দেবিকা দরজা খুলে বেলাকে ঠেলে এগিয়ে দিয়ে ওর পিছনে ঢুকল। ঘরটা বেশ বড়ো। ছ-টা টেবল। রাবার জাতীয় মসৃণ দিয়ে মেঝে ঢাকা। কাচের জানালাগুলো বন্ধ।

ঘরে ঢোকামাত্র একটা আরামদায়ক ঠান্ডায় বেলা কিছুটা বিহ্বল হয়ে গেল। দেবাংশু সামনের টেবলেই। চোখে সামান্য বিস্ময়, সম্ভবত দেবিকার জন্য।

‘আসুন।’

দেবাংশু উঠে টেবল ঘুরে এগিয়ে এল। পাশের টেবলের সামনে থেকে খালি চেয়ারটা তুলে আনল। প্রতি টেবলের সামনে শুধু একটি করেই চেয়ার। দুটি টেবলে লোক নেই, হয়তো ঘরের বাইরে গেছে কিংবা ছুটিতে। বাকি তিনজন গভীর মনোযোগে কাগজপত্র ছড়িয়ে কাজ করছে। একজন প্রৌঢ়, টকটকে গায়ের রং, মোটা ফ্রেমের চশমা মনে হয় অবাঙালি। অন্য দু-জন চল্লিশের কাছাকাছি সাদামাটা। কিন্তু গলায় প্রত্যেকেরই টাই রয়েছে, দেবাংশুরটা ঘন মেরুন। এই ঘরে সবাইকে একই পর্যায়ের চাকুরে এবং পদস্থই মনে হল বেলার।

‘আমরাই স্কুল কলিগ, দেবিকা দাশগুপ্ত। আর ইনি দেবাংশু ঘোষ।’ নামে কিছূটা মিল আছে।

নমস্কার বিনিময় হল মৃদু হেসে।

‘ওকে সঙ্গে এনেছি টাকাগুলোর জন্য।’

‘বডিগার্ড হিসেবে।’

দেবিকা তার হাসিটা চোখ দিয়ে প্রকাশ করল। দেবাংশুও হেসে ভ্রূ তুলে জানাল সে অবাক হয়েছে।

‘দারুণ বডিগার্ড তো!’

টাকা লুঠ করার চেষ্টা করবেন না তাই বলে। আমার বডিগার্ড আপনার সঙ্গে গায়ের জোরে পারবে না।’

বেলার সঙ্গে দেবিকাও তাকাল দেবাংশুর ভারী কাঠামোর দিকে।

‘আপনার ফর্ম আমি এনে রেখেছি।’

দেবাংশু অপ্রতিভ হয়ে প্রসঙ্গ বদলাল। একটা ফাইল তুলে কয়েকটা ছাপা কাগজ বার করল। বেলার মনে হল দরকারমাত্র হাতের কাছে পাবার জন্য যেন গুছিয়েই রেখেছে। পরিচ্ছদের মতো ওর টেবলটাও পরিপাটি। অফিসের এই ঘরের মধ্যে ওকে অন্যরকম লাগছে-আরও মার্জিত ব্যক্তিত্ববান এবং উজ্জ্বল।

‘কিন্তু একটা অসুবিধা হয়েছে, না না তেমন কিছু নয়। যে ভদ্রলোক আমাদের অ্যাকাউন্টান্ট, সই করবেন তিনি কাল থেকে আসছেন না, ফ্লু হয়েছে।’

‘তাহলে?’

বেলার স্বর চিরে গেল এই একটি শব্দ উচ্চচারণ করতে গিয়ে। হাতব্যাগটা আঁকড়ে ঝুঁকে পড়ল।

‘টাকা তাহলে…?’

‘আজ আর নেওয়া যাবে না। ফরমগুলো এখন ফিলাপ করে দিয়ে যান…’

‘না।’

কোণের টেবলের প্রৌঢ় মুখ তুলে একবার বেলার দিকে তাকাল। বেলার মনে হল, সে বোধহয় চেঁচিয়ে উঠেছে। টাকাগুলো তাকে কতখানি ভীত করেছে তা সে বুঝতে পারছে না।

দেবাংশু আর দেবিকা তার মুখের দিকে তাকিয়ে। বেলা লজ্জা পেল।

‘দিন, ফিলাপ করে দি। আসলে, এত টাকা নিয়ে রাস্তায় চলাফেরা করতে ভয় করে। ভেবেছিলাম টাকাগুলো জমা দিয়ে, বেশ ঝাড়া হাত-পায়ে কোথাও বসে খাব, তারপর রীনাকে পড়াতে চলে যাব।’

দেবাংশু ফরমগুলো বেলার সামনে মেলে ঝুঁকে পড়ল।

‘আপনি বলেছিলেন তিনবছরের জন্য, সুদ চোদ্দো পারসেন্ট, যদি দু-বছর রাখেন…’

‘না না, তিন বছরই।’

‘মন দিয়ে পড়ে যান, অসুবিধে হবে না ফিলাপ করতে। যেখানে যেখানে সই করতে হবে ক্রশ দিয়ে রেখেছি।’

‘একগ্লাস জল খাব।

দেবিকার উপস্থিতি যেন এই প্রথম সচেতন হল এমন একটা ভাব দেখিয়ে দেবাংশু কলিং বেল টিপতে টেবলের নীচে হাত ঢোকাল।

‘চা?’

‘না, শুধু-জল।’

‘আমার জন্যও।’

মিনিট দশেক পর, ফরমগুলো একটা খামে ভরে টেবলের ড্রয়ারে রাখতে রাখতে দেবাংশু বলল: ‘এখান থেকেই সোজা রীনাকে পড়াতে যাবেন?’

‘তাইতো ঠিক করে রেখেছিলাম, কিন্তু এত টাকা হাতে…’

‘চলুন একসঙ্গেই যাব। এবার নয় আমিই আপনার বডিগার্ড হব।’

দেবিকার দিকে তাকিয়ে দেবাংশু হাসল। খালি জলের গ্লাসদুটো নিয়ে গেল বেয়ারা।

‘তার আগে বেলাদি কোথাও খাবেন আর আমাদেরও নিশ্চয় খাওয়াবেন।’

‘নিশ্চয় খাওয়াব।’

‘কী খাওয়াবেন…এখন তো সবে বিকেল। পেট ভরে খাওয়া তো সম্ভব নয়।’

প্রায় একসঙ্গেই তিনজন ঘড়ি দেখল।

বাড়ি থেকে বেরোবার সময় সদরে তালা দিয়েও বেলা আবার সেটা খুলে ঘরে ফিরে আসে। হঠাৎ তার মনে হয়েছিল একশো টাকার নোটটাকে পরীক্ষা করলে কেমন হয়? এমন কোন জায়গা, যেখানে একশো টাকা হরদমই হাত বদলাচ্ছে, ক্যাশের লোক শুধু জলছাপটা দেখেই বাক্সের মধ্যে ছুড়ে রেখে দেয় বা ক্লিপে আরও এই ভেবে নোটের সঙ্গে আটকে রাখে, এমন কোথাও গিয়ে নোটটা ভাঙাবে। সে ব্লাউজের ভাঁজ থেকে ওটা বার করে নিয়েছে।

‘পেট ভরে খেতে হলে রাত হওয়ার জন্য তাহলে অপেক্ষা করতে হবে। আমি তো অতক্ষণ…টিউশুনি আছে।’

‘আমারও কাজ আছে বেলাদি ছ-টার মধ্যে এক জায়গায় যেতে হবে।’

টেলিফোন বেজে উঠল বেলার পিছনের টেবলে।

‘ঘোষ, ইওরস।’

দেবাংশু উঠে গেল ব্যস্ত হয়ে। দেবিকা ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করল: ‘এ ভদ্রলোক কে?’

‘আমার ছাত্রীর জ্যাঠা…ব্যাচিলার। আচ্ছা কোথায় গিয়ে খাওয়া যায় বলো তো?’

‘কত খরচ করবেন?

‘একশো।’

দেবিকা চোখ বড়ো করল। হাঁ করল অবাক দেখাতে।

‘তাহলে তো একটু ভালো জায়গায়ই খাওয়া যায়।’ ‘পার্ক স্ট্রিটে?’

‘হবে এই টাকায়?’

‘খুব হবে। এই বিকেলে কে আর পেট ভরে খাবে। আমি তো একটা সফট ড্রিঙ্ক ছাড়া কিছু নেব না।…বাব্বাঃ অনেক টাকা জমিয়েছেন তো।’

‘একশো আবার টাকা নাকি এই বাজারে…তুমি কিন্তু কাউকে কিছু বোল না।’

‘স্কুলে?…নাহ, বড়ো বাজে ওরা।’

‘আর জাস্ট পাঁচ মিনিট…’ একটা ফাইল টেবল থেকে তুলে নিল দেবাংশু। ‘আমি আসছি, তারপর বেরোবে।’

মাত্র একটি লোক বসে বিয়ার পান করছে। এক কোণে। তা ছাড়া এতবড়ো রেস্টুরেন্ট খালি। বেয়ারারা জটলা করে ভিতরের দিকে দাঁড়িয়েছিল, একজন এগিয়ে এসে ঘরের মাঝামাঝি চারজনের বসার একটা টেবল দেখাল।

‘বসবেন নাকি ওটায়? বরং এই কোণেরটায়…’

দেবাংশু ডানদিকে দেওয়ালঘেঁষা একটা টেবলে তাদের নিয়ে গেল। চারজনই বসা যায়। দেবাংশুর মুখোমুখি বেলা ও দেবিকা।

‘কী ফাঁকা!’

‘এইবার আসতে শুরু করবে। এসব পাড়ায় দুপুরে লাঞ্চ টাইমে একটা ভিড় হয়, আবার সাড়ে পাঁচটা থেকে।’

দেবাংশু বুঝে ফেলেছে সে এই পাড়ায় আনাড়ি। বুঝুক, মিথ্যা তো নয়। হাতিবাগানে মিষ্টির দোকানে বা পাঁচমাথার মোড়ে দু-একবার রেস্টুরেন্টে কষামাংস আর রুটি খাওয়া ছাড়া তার আর কোনো অভিজ্ঞতা নেই।

অন্য আর এক বেয়ারা এসে ছাপা মেনু টেবলে রাখল।

‘আমি একটা কোল্ড সফট কিছু নেব।…না বেলাদি এই সময় আর কিছু খাব না।’

‘তোমার মতো এমন অল্পবয়সি, এত ভালো স্বাস্থ্য অথচ খেতে আপত্তি…. জানেন দেবাংশুবাবু দেবিকা দারুণ বাস্কেট খেলে, বেঙ্গল রিপ্রেজেন্ট করেছে।’

‘খেলে নয়, একসময় খেলতাম।’

‘আপনাকে দেখেই কিন্তু মনে হয়েছিল আপনি স্পোর্টসম্যান… সরি… স্পোর্টস উওম্যান।’

দেবাংশুর চোখে তারিফ। বেয়ারাটি অপেক্ষা করছে। বেলা উশখুশ করল।

‘কিছুই খাবে না?’

‘আপনি বরং ফুঁট জুস নিন, নইলে মিসেস দাস শান্তি পাবেন না।’

‘বেশ।’

‘আমিও তাই। আপনিও তো?’ দেবাংশু হাত নেড়ে বেয়ারাকে ডাকল। বেলা হতাশ হল। ওরা দু-জন এত সামান্য জিনিস খেলে, নোটটা ভাঙাবে কী করে! ওদের সঙ্গে তাকেও ফ্রুট জুস খেতে হবে। এতে কত টাকারই বা বিল হবে। ভাঙিয়ে দেবে তো! খদ্দের বলতে জনাচারেক! ক্যাশে টাকা আছে তো!

বেয়ারাদের গায়ে সাদা উর্দি। কোথাও ময়লা নেই, কোঁচকানি নেই। প্রত্যেক টেবল সাদা চাদরে ঢাকা দাগ নেই। টেবলের মাঝে ফুলদানিতে ফুল। বেলা তাদের টেবলের ফুলগুলোয় আঙুল ছুঁইয়ে দেখল প্লাসটিকের নয়। বিয়ের পর তিমির শখ করে প্লাসটিকের কিছু লতাপাতা-ফুল কিনে এনেছিল। মাস কয়েক পর ধুলোয় সেগুলো আর চেনা যাচ্ছিল না।

তিনটি লোক ঢুকল। দু-জনের হাতে অ্যাটাচি কেস। এক বেয়ারা এগিয়ে গেল। এইবার বোধহয় লোক আসতে শুরু করবে। মৃদু স্বরে কোথা থেকে পশ্চিমা সুরের বাজনার আওয়াজ আসছে। বেলা চমকে উঠল দেবাংশুর জুতো তার চটিতে টোকা দিয়েছে।

‘আজও গুমোট। এইজন্যই অফিসে বসে থাকতে ইচ্ছে করে।’

‘তাহলে এখানে এসে আপনাকে কষ্ট দিলুম।’

‘না না, মোটেই না। এই কষ্টটা যদি রোজ পেতাম।’

দেবাংশু মুচকি হাসছে। বেলাও হাসল। পা সরিয়ে নেবে কিনা ভাবল।

‘এখানেও তো ঠান্ডা।’

হ্যাঁ তবে এই ঠান্ডা গায়ে লাগাতে পয়সা লাগে।’

দেবিকা ‘বেশ’ বলার পর আর একটি কথাও বলছেনা। আঙুল দিয়ে টেবলে আঁকিবুকি কাটছে। অন্যমনস্ক থাকার ভান করে। দেবাংশু ওর কাছে একদমই অপরিচিত, কী-ই বা কথা বলবে। বেলাকেই কথা বলে যেতে হবে।

কিন্তু তার কাছেও তো দেবাংশু খুব পরিচিত নয়। রোজ দেখা হয়, কয়েকটা পোশাকি কথাও মাঝে মাঝে হয়েছে। কিন্তু এইরকম পরিবেশে কেমন একটা অন্য মানসিকতা তাকে প্রভাবিত করছে। সে নিজেও জানত না কমবয়সিদের মতো চটুল হালকা ভাব তার কথার মধ্যে আসবে। এসব তার ভিতরে লুকিয়েছিল তাহলে। আরও কী লুকিয়ে আছে কে জানে!

আরও কিছু লোক ঢুকল। টেবলগুলো এবার ভরে উঠছে। তার দু-জন ছাড়া আর ঘরে একটিও মেয়ে নেই। বেলা অস্বস্তি বোধ করল।

তিনটি গ্লাসে আপেলের রস এনে দিল বেয়ারা। ব্যাগটা তার আর দেবিকার মাঝে রয়েছে। ওটা দেওয়ালের দিকে রাখবে কিনা বেলা একবার তা ভাবল। ভয় নিয়ে সে বোধহয় বাড়াবাড়িই করছে। এখান থেকে কেউ বা কারা ডাকাতি করে নিয়ে যাবে, সম্ভব নয়। তা ছাড়া দেবাংশু রয়েছে। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, মাথায় টাক কিন্তু যুবকদের মতো শরীর। প্রতিবার গ্লাসটা মুখে তোলার সময় ওর ফুলহাতা জামার ভিতর হাতের গুলি ফুলে উঠেছে। এটা এখন বিরাট নির্ভরতা।

‘আচ্ছা প্রত্যেক টেবলেই দেখছি শুধুই লাল বোতল ওই কি বিয়ার?’

দেবাংশু কোনো টেবলের দিকে না তাকিয়েই ঘাড় নাড়ল।

‘গরমের দিনে এটাই ভালো লাগে।’

‘মেয়েরাও নাকি খায়?’

‘বহু মেয়ে খায়। এখানেই দেখতে পাবেন।’

‘নেশা হয়?’

‘সামান্য একটা গোলাপি গোলাপি আমেজে আসে। তবে বেশি খেলে হয়।… নির্ভর করে শরীরের ধাতের ওপর।

‘আপনি খান?’

চট করে দেবিকার মুখের দিকে তাকিয়ে দেবাংশু মাথা নাড়ল।

‘নাহ।’

বেলার কাছে এটা একদমই অন্য জগৎ। যেসব মেয়ে এখানে এসে বিয়ার খায়, তারা থাকে কোথায়? কী করে? একা আসে না স্বামীর সঙ্গে? নেশা হলে বাড়ি ফেরে কী করে? তারা নিশ্চয় পয়সাওলা ঘরের, ট্রামে-বাসে ফিরতে হয় না, নিজেদের গাড়িতেই ফেরে।

তার কাছে এখন এক লক্ষ টাকা রয়েছে। আজ সকালেও খবরের কাগজ তন্নতন্ন করে দেখেছে। মাত্র চারলাইন-‘গতদিনের লক্ষ টাকা ডাকাতির ব্যাপারে পুলিশ আর কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি বা টাকাও উদ্ধার করতে পারেনি। ধৃত ডাকাতের কাছে থেকে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছে তাতে পুলিশের ধারণা আন্তঃরাজ্য চক্রের সঙ্গে এই ডাকাতরা জড়িত।’

ঠিক ডেটেকটিভ উপন্যাসের ভাষা! জোর তদন্ত চলছে, এমন একটা কথা শেষে লাগিয়ে দিলেই হত। একটানা গুঞ্জনে আর সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘরটার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। লোকেদের খুঁচিয়ে লক্ষ করল। সাধারণ জামা প্যান্ট, সাধারণ ভাবভঙ্গি, চেহারা। কাউকেই তার মনে হল না, এক লক্ষ টাকার নোট একসঙ্গে কখনো চোখে দেখেছে। তবে ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার যদি কেউ থাকে তাহলে আলাদা কথা কিংবা সেই লোকগুলো যারা টাকা জমা দিয়ে এসেছিল। কিন্তু ওরা কেউ-ই মালিক নয় লক্ষ টাকার।

বেলা নিজেকে কখন যেন ওই লক্ষ টাকার মালিক ভাবতে শুরু করেছে। তখন যেন নিজেকে বুঝিয়ে ফেলতে পেরেছে, টাকাগুলো বৈধভাবে তারই অর্জিত।

‘এখন যদি গীতাদি বা অর্চনা আমাদের দেখে কী ভাববে বলো তো?’

বেলা নীচুগলায় বলল, দেবিকা ফিকে হেসে গ্লাসের তলানিটুকু শেষ করল।’

‘এবার আমি উঠব।’

‘সেকি এই যে বললে….’ বেলা ঘড়ি দেখল।

‘একটা দরকারের কথা মনে পড়ল, একদমই ভুলে গেছলাম।’

‘যাবে কোথায় এখন?’

‘কাছেই মিনিট কয়েক হেঁটে রাসেল স্ট্রিটে… ডক্টর পালের চেম্বারে। সন্ধেবেলায় ওখানে আমি রিসেপসনিস্ট। আপনারা টিউশনি করেন, আমি এই কাজটা করি।’

‘কাজের ব্যাপার নয়তো তোমাকে জোর করে বসাতাম। আমিও অবশ্য এবার উঠব।’

‘বসুন না আপনি, এখনি উঠবেন কেন।’

দেবিকা হালকা চিমটি কাটল বেলার ঊরুতে। ইঙ্গিতটায় সে সন্ত্রস্ত হল। দেবিকা কিছু ভেবে নিয়েছে? সেরকম কিছু কী তার মুখে ভেসে উঠেছে?

‘আপনার ফেরার ভাবনা আর নেই, বডিগার্ড তো পেয়েই গেছেন…ঠিকমতো গার্ড দেবেন কিন্তু! বেলাদি কাল দেখা হবে।’

দেবিকা উঠে দাঁড়াতেই ঘরের প্রায় সবাই তার দিকে তাকাল।

‘নিশ্চিন্ত থাকুন, ওঁকে এখুনি পৌঁছে দিচ্ছি।’

দেবিকা চলে যাবার পর বেলা বলল: ‘চমৎকার ফিগার, তাই না?’

‘শুধু কী ওরই।’

কথাটা বেলাকে তিরতিরে একটা কম্পন দিল পা থেকে গলা পর্যন্ত। কিন্তু না-শোনার ভান করে বলল: ‘আপনি কিন্তু কিছুই খেলেন না।’

‘এবার খাব।’

তুড়ি দিয়ে দেবাংশু বেয়ারাকে ডাকল।

‘কী বিয়ার আছে…ব্ল্যাক লেবেলই দাও, মেনুটা দেখি।’

‘আপনি বিয়ার খান! এই যে বললেন…’

‘আপনার কলিগ ছিল বলে তাই, কী আবার ভাববেন।…আপনি কিছু খান?’

বেলা সামান্য উত্তেজনা বোধ করল, একটি লোক প্রায় দেড়হাত দূরে বসে বিয়ার পান করবে, এটা ভেবেই। দেবাংশু গভীর মনোযোগে মেনু দেখছে। বেলার পায়ের পাতার উপর হালকা চাপ পড়ল।

‘তন্দুরি চিকেনই বলি।’

‘ভাজাভুজি এখন খাব না।’

‘ভাজা নয় সেঁকা শুকনো মাংস, খুব ভালো হজম হয়, একটাই যথেষ্ট আর লাগলে পরে বলছি।’

বেয়ারাকে বরাদ্দ জানিয়ে দেবাংশু কী ভেবে আবার তাকে ডাকল। গলা নামিয়ে বলল: ‘ছোটো জিন, লাইম আর সোডা না শুধু জল দিয়ো।’

‘বড়ো না ছোটো।’

‘বড়োই দাও।’

বেলা ওদের দু-জনের ফিসফিসানি থেকে অনুমান করল রহস্যময় কিছু আনতে বলা হচ্ছে। দেবাংশুর চোখে দুষ্টুমির ভাব।

‘আমাকে কিন্তু ছ-টার মধ্যে পৌঁছতে হবে। রীনার উইকলি পরীক্ষা শনিবার।’

‘আজ কামাই করুন, এক-আধ দিন করতে হয়।’

পায়ের উপর চাপটা একটা বাড়ল, বেলা ভ্রূ উঁচিয়ে জানিয়ে দিল ব্যাপারটা সে গ্রাহ্য করছে। পা টেনে নিতে তার ইচ্ছে করছে না। কেন, তা সে জানে না। এই মুহূর্তে সারা পৃথিবী তার কাছে উপভোগ্য মনে হচ্ছে।

পাশে রাখা কুড়ি হাজার টাকার নোট ভরা ব্যাগটাও আর তার কাছে আতঙ্কের বস্তু নয়।

‘জীবনে সবই কী ছক বেঁধে চলে? ছক ভাঙতে হয়।’

‘সবাই কী আর তা পারে। সবাই কী সাহসী হয়? কতরকমেরই অসুবিধা মানুষের থাকে।’

‘সাহসী কেউ হয় না, হয়ে ওঠে। অবস্থা পরিস্থিতি করে তোলে। আসলে আপনার জীবনে কোনো পরিস্থিতি কোনো ঘটনাই আসেনি।’

হায়, এই লোকটি জানে না কী ঘটনা তার জীবনে কাল ঘটে গেছে। পৃথিবীতে কারোর কপালে বোধহয় এমন ব্যাপার ঘটেনি। বললে তো চমকে উঠবে, বিশ্বাসই করবে না। কী প্রচণ্ড সাহসে এখনও সে গোপন করে রেখেছে, তা যদি লোকটি জানত।

বিমলের কথাটা মনে পড়ল বেলার। শুধু দরকার সাহস, তাহলেই পাঁচটা জীবনের আয় পাঁচ মিনিটে করা যায়। সত্যিই যায় কী? ধরা পড়ে গেলে? সে যদি ধরা পড়ে তিমিরের কাছে? এত টাকা কতদিন কীভাবে লুকিয়ে রাখবে।

‘কী ভাবছেন?’

বেলা হাঁটুর পাশে মৃদু ধাক্কা পেল। দেবাংশু ঝুঁকে রয়েছে টেবলে। ছক ভেঙে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত কী এটা! প্রতিদিনই বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে, আজ সাহস করে ছক ভাঙার জন্য পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে। প্রগলভ হয়েছে।

‘ভাবার কী আছে?’

বেয়ারা দু গ্লাস জল ছাড়াও দুটো গ্লাস বেলার আর একটা দেবাংশু সামনে রেখে বিয়ার বোতলের ছিপি খুলতে লাগল।

অবাক হয়ে গেল সে। তার সামনে এ দুটো কী! দেবাংশু হেসে এক গ্লাসের জিনিস অন্য গ্লাসে মিশিয়ে তাতে জল ঢালল।

‘চমৎকার খেতে লাগবে। লাইম বেশিই দিলাম। টকটক চাটনির মতো মনে হবে।’

‘কী এটা?’

‘খেয়েই দেখুন না, বিষ নয়।’

ফেনা সমেত বিয়ারে চুমুক দিয়ে গ্লাসের অর্ধেকটা খালি করে দিল দেবাংশু। নাকের নীচে লাগা ফেনা তালু দিয়ে মুছল।

বেলা প্রথমে শুঁকল তারপর গ্লাসে ছোট্ট চুমুক দিল। টক তো বটেই, তার সঙ্গে একটু তিতকুটে ভাব। দেবাংশু হাসছে। অন্যান্য টেবলের কেউ লক্ষ করছে কী? হয়তো ওরা ভেবেছে স্বামী-স্ত্রী।

ছ-সাত গজ দূরে বাঁদিকে ধোঁয়াটে কাচের চশমাপরা একটি যুবক, বেলার মনে হল, তার দিকেই তাকিয়ে। বোধহয় একাই কেননা অনেকক্ষণ বসে আছে টেবলে কারোর সঙ্গে কথা না বলে। সামনের গ্লাসটা ঘোলাজলের মতো পানীয়ে আধভরা। বেলার মনে পড়ছে না একবারও ওকে চুমুক দিতে দেখেছে। এতক্ষণ সে ওকে গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি, এবার আনল।

‘কেমন লাগল?’

‘মন্দ নয়।’

‘আপনাকে অন্যমনস্ক লাগছে, ব্যাপার কী?’

মনে হচ্ছে চশমা পরা এদিকেই যেন তাকিয়ে! চোখটা দেখা যাচ্ছে না। এইরকম কাচের চশমা তো নজরে রাখার জন্যই পরে গোয়েন্দারা বা অপরাধীরা। বেলার সারা শরীর অবশ হয়ে এল। হাঁটুর নীচে আর একবার চাপ লাগল কিন্তু পা সরিয়ে নেবার শক্তিটুকুও এখন তার নেই। মুখ নীচু করে গ্লাসে চুমুক দিল। চশমাপরা লোকটার দিকে আর তাকানো ঠিক হবে না।

‘এতগুলো টাকা নিয়ে চলাফেরা…চিন্তা হচ্ছে।’

‘বলেছি তো পৌঁছে দেব। আমার উপর ভরসা রাখতে কি অসুবিধা আছে?’

‘না তা নয়। তবে মিছিমিছি কামাই করলাম।’

‘আমরা এই যে বসেছি, এটা কী মিছিমিছি? আমি যে রোজ আপনাকে দেখার জন্য বারান্দায় থাকি তাও কী মিছিমিছি?’

দেবাংশুর স্বর গাঢ় হয়ে উঠছে। চোখদুটি চকচক করছে। মুখের রেখাগুলো তীক্ষ্ন এবং দপদপ করছে কপালের দুই প্রান্ত। ও যেন বদ্ধপরিকর হয়েছে অপ্রত্যাশিত এই সুযোগটিকে ব্যবহার করতে।

বিয়ার শেষ হয়ে গেছে। বেয়ারাকে খোঁজার জন্য সে ঘাড় ফেরাল।

‘না থাক, আর নয়।’

বেলা ঘড়ি দেখল। এখানে আর সে থাকতে চায় না। চশমাপরা লোকটা কোন দিকে যে তাকাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। তা ছাড়া গ্লাসেও চুমুক দিচ্ছে না। বসে থাকার অছিলা ওই গ্লাসটা।

‘আর একটা। এভাবে মুখোমুখি আর হয়তো বসার সুযোগ পাব না।’

‘আমার আর থাকতে ভালো লাগছে না….এত ধোঁয়া দমবন্ধ হয়ে আসছে।’

‘তন্দুরি চিকেন বলা হয়েছে।’

‘আমার খাবার ইচ্ছে নেই।’

‘আমারও নেই।’

কোলের উপর রেখে সে সন্তর্পণে ব্যাগের মুখ ফাঁক করে একশো টাকার নোটটা বার করল।

লোকটা কী লক্ষ করছে তার ব্যাগ থেকেই এটা বেরোল। বেলা সাহস পেল না ওদিকে তাকাতে।

‘আপনি সব দেবেন? শেয়ার করি।’

দেবাংশুর হতাশ স্বরে মেশানো রয়েছে কিছুটা ক্ষোভও। কিন্তু বেলা নিরুপায়।

‘আমিই ডেকে এনেছি, আমিই দেব।’

ওর বোধহয় ধারণা, দু-জনে মুখোমুখি গল্প করব বলেই এখানে আসা। কিন্তু ও জানে না, নোটটা ভাঙাবার জন্য বেলা একটা জায়গা চাইছিল।

‘বেয়ারা।’

ব্যস্ত হয়ে একজন টেবলের পাশে এল।

‘একটা তন্দুরি চিকেনের অর্ডার ছিল ওটা প্যাক করে দাও নিয়ে যাব, জলদি….আর বিল।’

দেবাংশু হেলান দিয়ে মুখটা উপর দিকে তুলল। পা দুটো গুটিয়ে নিয়েছে। বেলার মনে হল, ও রাগছে। চোখের উদাসীন ভাবটা থেকেই বোঝা যাচ্ছে কিন্তু একটা দমন করার চেষ্টা চলছে ভিতরে।

‘আর একদিন তো আসতে হবেই টাকাটা দেবার জন্য।’

বেলা কয়েক ইঞ্চি এগিয়ে দিল তার পা। জায়গাটা ফাঁকা। অপ্রতিভ বোধ করে টেনে নিল।

বিল আর ফিতে বাঁধা কাগজের একটা বাক্স আনল বেয়ারা। বেলা ঝুঁকে বিলটার যোগফলটুকু দেখল। একান্ন টাকা পঁয়ত্রিশ পয়সা। নোটটা রাখার সময় তার হাত একবার কেঁপে গেল।

এইবার অপেক্ষা। সিরিয়াল নম্বর কী ইতিমধ্যেই এখানে পৌঁছে গেছে? যদি পৌঁছে গিয়ে থাকে তাহলে কী করবে?’

‘আপনি কি এই নোট দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ। কেন, কী হয়েছে?’

‘আমি এখানকার ক্যাশিয়ার। দয়া করে একবার এদিকে আসবেন কী?’

‘কেন? কিছু গোলমাল আছে কী?’

‘রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সার্কুলারে চোরাই নোটের যে নম্বর রয়েছে তার সঙ্গে আপনার দেওয়া নোটের নম্বর মিলছে। আমরা পুলিশকে টেলিফোন করে দিয়েছি। আপনি ততক্ষণ ভিতরে এসে বসুন?’

ধীরে ধীরে বেলার মাথা ঝুঁকে পড়ল। দেবাংশুর মুখের দিকে তাকানো সম্ভব নয়। ওকেও পুলিশ নিয়ে যাবে সহযোগী হিসেবে। সত্যি ব্যাপারটাই পুলিশকে সে বলবে কিন্তু ওরা বিশ্বাস করবে না। দু-জনকে নিয়েই পুলিশ যাবে শিবদত্ত লেনে। পুলিশের গাড়ি থেকে তাদের নামতে দেখলেই ভিড় জমে যাবে। তাদের পিছু পিছু বিরাট জনতা হাঁটবে। দরজা খুলে দেবে তিমির। পুলিশদের দেখে থতমত হবে ভিড়ের উপর দিয়ে বোকার মতো চোখ বুলিয়ে তারপর বেলার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাবে।

‘বিল?’

চমকে উঠল বেলা। ট্রে-র উপর বিল, কয়েকটা পুরোনো নোট, খুচরো পয়সা। একটা পিতলের প্লেটে মৌরী আর টুথ পিক। বেলা ফ্যালফ্যাল করে ট্রে-র দিকে তাকিয়ে থেকে বুকের মধ্যে দু-তিনটি ঝাঁকুনি খেল। এখানে তাহলে কোনো খবর আসেনি। হয়তো কলকাতার বহু দোকানেই আসেনি।

বেয়ারার মুখের দিকে সে তাকাল। তারপর দেবাংশুর মুখের দিকেও। নোটগুলো আর খুচরো আঙুল দিয়ে স্পর্শ করল।

কত বখশিস দিতে হবে? এখানে নিয়ম কী? যদি নাই দেয় তাহলেই বা কী হয়? চশমাপরা লোকটা হয়তো লক্ষ করছে। যা রেট, তার বেশি দিলে বুঝে নেবে এ টাকা সহজে উপার্জিত। কিন্তু রেট কী?

দেবাংশু ওর ফাঁপরটা বুঝতে পেরেই একটা দু-টাকার নোট আর খুচরোগুলো রেখে বাকিগুলো তুলে নিতেই বেলা হাঁফ ছাড়ল। বেয়ারা ডান হাত কপালে ঠেকাল যান্ত্রিক ভঙ্গিতে, খুশি হয়নি। কথা না বলে একসঙ্গেই দু-জনে উঠল। দেবাংশুর হাতে বাক্সটা।

বেলা আড়চোখে দেখে নিল, গ্লাসটা মুখের কাছে তুলেছে লোকটা। মাথা সামান্য নোয়ানো। তাদের বেরিয়ে যাওয়া লক্ষ করছে না। হয়তো ফলো করবে না।

লোকটা কী কোনো ছাত্রীর বাবা? তাদেরই কোনো টিচারের স্বামী? হয়তো তাকে চেনে। বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে বলবে…

গরমের প্রথম ধাক্কাটা রেস্টুরেন্টের বাইরে পা দেওয়া মাত্র বেলাকে আর এক বাস্তবে নিয়ে গেল। ব্যাগটাকে বুকের কাছে সে আঁকড়ে ধরল।

রাস্তার আলোয় আর দোকানের নিয়ন সাইনে ঝকঝক করছে পার্ক স্ট্রিট। সে এত সুদৃশ্য এবং সজ্জিত নরনারীবহুল রাস্তা কখনো দেখেনি, যদিও তার জন্ম এখান থেকে দুই কী আড়াই মাইল দূরে। কাউকে বললে বিশ্বাস করবে না, দেবাংশুও।

পশ্চিমে একটা ক্ষীণ ফিকে হলুদ রেখা আকাশে থাকলেও, সন্ধ্যা উত্তরে যাবার সব লক্ষণই কলকাতায় এখন দেখা যাচ্ছে। বেলার ইচ্ছে করছে কিছুক্ষণ হাঁটতে।

ওপারে একটা ট্যাক্সি থামল। দেবাংশু ব্যস্ত হয়ে রাস্তা পার হবার জন্য এগিয়ে গিয়েও পারল না ট্র্যাফিকের জন্য। বেলা দেখল আরোহীরা নামার আগেই একটি লোক ছুটে গিয়ে ট্যাক্সির দরজার হাতল চেপে ধরেছে। হতাশা এবং বিরক্তি নিয়ে দেবাংশু ফিরে এল।

‘চলুন না আর একটু এগিয়ে এসপ্ল্যানেডের দিকে যাই।’

‘আপনার তো ভীষণ তাড়া আছে ফেরার।’

‘আছে, তবে আপনি যতটা রেগেছেন ততটা ভীষণ নয়।’

‘কে বললে রেগেছি?’

‘কেউ বলে-কয়ে রাগে না। ওটা বোঝা যায়।’

‘ওহ আপনার টাকাগুলো তখন থেকে হাতেই রয়ে গেছে।’

দেবাংশুর বাড়ানো হাত থেকে নোটগুলো এবং তন্দুরি বাক্সটা নিয়ে বেলা বিরল ধরনের স্বস্তি বোধ করল। একশো টাকার নোটগুলোর প্রথমটি নিরাপদে ভাঙানো গেছে। এবার একে একে বাকিগুলোও ভাঙানো যাবে। আটশো নোট, অনেকদিন সময় লাগবে। ফ্রিজ বা টিভি ধরনের বড়ো কিছু সে কিনতে পারবে না, তাহলে অনেকগুলো নোট একসঙ্গে বার করতে হবে। সেটা নিরাপদ হবে না। তা ছাড়া তিমিরও রয়েছে তাকে কী বলে বোঝাব?

‘ট্যাক-সিইই।’

দেবাংশু চিৎকার করে হাত তুলে ছুটে গেল ধীর গতিতে চলা এক খালি ট্যাক্সির দিকে। ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি থামিয়েছে। দেবাংশু জানলায় ঝুঁকে কথা বলছে। বেলা দ্রুত এগিয়ে যেতে যেতে দেখল কয়েকজন পথচারী মুখ ফিরিয়ে ট্যাক্সির দিকে তাকাচ্ছে, দু-তিনজন থেমেও পড়েছে।

‘আর একটি কথাও নয়, যেখানে যেতে বলছি চলো।’

বেলা দেখল দেবাংশুর মুঠোর মধ্যে ট্যাক্সিওয়ালার গলা, চোখ দুটো ঠিকরে বেরোতে চাইছে। ঠোঁট ফাঁক হয়ে রয়েছে। তার সহকারীটি দেবাংশুর হাত ধরে টানতে টানতে চিৎকার করছে: ‘মেরে ফেলবেন নাকি, এ কি কাণ্ড, ছাড়ুন বলছি…পুলিশ ডাকব।’

‘ডাক তোর পুলিশ।’ দেবাংশু বাঁ হাত নেড়ে বেলাকে ইশারা করল ‘উঠুন।’

ট্যাক্সিওয়ালা শীর্ণকায় যুবক। তখনও তার মাথাটি পিছনে হেলানো সিটের সঙ্গে লেপটে রয়েছে। চোখে ভয় এবং বিস্ময়। দরজা খুলে বেলা ভিতরে ঢুকেছে দেখে দেবাংশু গলা থেকে হাতটা তুলে সেই হাতের উলটো দিক দিয়ে সহকারীটির গালে আঘাত করল। সে সিটের কোণে সরে গেল।

বিরাট চেহারাটাকে ভারী নিশ্বাসে ফুলিয়ে দেবাংশু কয়েক সেকেন্ড ফুটপাতে জড়ো হওয়া ছোটো ভিড়ের দিকে তাকিয়ে থেকে, ট্যাক্সিটার সামনের দিক ঘুরে দরজা খুলে পিছনের সিটে বসল।

‘চলো।’

ড্রাইভার গুম হয়ে রয়েছে। সহকারীটি গালে হাত বোলাতে বোলাতে তিনজনের মুখের দিকে পর পর তাকাচ্ছে।

‘কী হল?’

গর্জনের মতো শোনাল দেবাংশুর স্বর। ড্রাইভার মুখ না ফিরিয়েই বলল: ‘যাব না।’

দেবাংশুর ডান হাত ড্রাইভারের ঘাড়ের দিকে এগোবার সময় বেলার বাম বাহুতে ধাক্কা দিল।

‘আহ হ…’

‘আর এক সেকেন্ড দেরি করলে ঘাড় ভেঙে দোব।…. ভাড়া দোব, যেখানে যেতে বলব যাবে, একটি কথাও নয়।… পুলিশটুলিশ আমিই ডাকব তবে ঘাড়টা ভেঙে দেবার পর।’

‘লাগছে, ছাড়ুন।’

ট্যাক্সিওয়ালার স্বরে এমন একটা আর্তনাদ ছিল যা বেলাকে মমতায় অভিভূত করল। দেবাংশুর বাহুটা দু-হাতে আঁকড়ে টেনে নিয়ে, ধরে রইল।

‘করছেন কী। কিছু একটা হয়ে যায় যদি?’

‘হোক না। কলকাতার ট্যাক্সিওলাদের বদমাইসি…ওদের পছন্দমতো জায়গা না হলে ওরা যাবে না, কেন?’

ট্যাক্সি চলতে শুরু করেছে।

‘সোজা সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যু দিয়ে গ্রে স্ট্রিট তারপর আহিরীটোলা।’

দেবাংশু হেলান দিয়ে শরীরটা শিথিল করে দিল। ব্যাগ এবং বাক্সটা বেলার কোলে। তার কাঁধের সঙ্গে কাঁধটা লাগানো। ডান বাহুটা তখনও দু-হাতে বেলা ধরে আছে। তার বাম স্তনের প্রায় উপরেই ভারী পেশির দপদপানিটাকে মনে হচ্ছে যেন সন্তর্পণ স্পর্শ। ওর তালুটা পড়ে রয়েছে তার বাম ঊরু ঘেঁষে।

কিছুটা কৌতূহলেই বেলা, আঙুলের বেড় দিয়ে ধরার চেষ্টা করল দেবাংশুর বাহুটা। অর্ধেকও এল না মুঠোর মধ্যে। পাথরের মতো শক্ত, মসৃণ। আঙুলগুলো সে কাঁধ পর্যন্ত নিয়ে গেল। কচ্ছপের পিঠের মতো একটা জায়গা, ক্রমশ ফুলে উঠে নেমে গেছে ঘাড়ের দিকে।

‘আপনি সত্যিই রেগেছেন।’

বেলা ফিসফিস করে বলল।

‘এখনও বোঝা যাচ্ছে?’

‘হ্যাঁ যাচ্ছে।’

বেলা দু-আঙুলে বাহুর পেশি টেপার চেষ্টা করল। আঙুল ডেবে বসছে না।

‘এখনও রেগে আছেন।’

দেবাংশু মুখ ফিরিয়ে তাকাল। বেলা মৃদু একটা ঝাঁঝালো গন্ধ পেল ওর মুখ বা নিশ্বাস থেকে, যা কখনো তার ঘ্রাণে আসেনি। কখনো সে এমন কঠিন, পুষ্ট পুরুষ পেশিকে ছোঁয়নি। এত বছরের জীবনে, এমন একটা জায়গায়, পরপুরুষের সঙ্গে মুখোমুখি বা পাশাপাশি বসবে স্বপ্নেও ভাবেনি। এ সবই ঘটে যাচ্ছে ওই নীল থলিটা কুড়িয়ে নেওয়ার পর থেকে। কীভাবে যে সে বদলে যাচ্ছে, নিজেও বুঝতে পারছে না। সুপ্ত কামনা-বাসনাকে ভাসিয়ে তুলছে এক লক্ষ টাকা এবং অজানা এক ভয়কেও।

‘শুধু সাহস…আর কিছু নয় পাঁচ জীবনের রোজগার পাঁচ মিনিটে…’

ঠিকই বলেছে বিমল। শুধু সাহসটুকুর অভাবেই এই বঞ্চিত জীবন একনাগাড়ে, একঘেঁয়ের মতো টেনে চলা। এক জীবনের সুখ এক জীবনেই পাওয়া অসম্ভব কেন হবে? লাখ টাকা পাবার জন্য ডাকাতরা যদি সাহসী হতে পারে, কেন তাহলে সাহসী হব না লাখ টাকা মুঠোয় পেয়ে গিয়ে?

দেবাংশু ডান তালু রাখল বেলার হাঁটুর কাছে ঊরুর উপর। বেলা আড়চোখে দেখল, ওর ঠোঁট হাসিতে বেঁকে রয়েছে। পাঁচ আঙুলের থাবার মধ্যে টেনে জড়ো করছে ঊরুর মাংস। তীক্ষ্ন একটা যন্ত্রণা বেলার স্নায়ু কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে সারা শরীরে রমণীয় এক কম্পন অনুভব করল।

‘না।’

বেলা আঁকড়ে ধরল দেবাংশুর তালু। বড়ো বেশি সাহসী হয়ে উঠছে। সামনেই দুটো লোক রয়েছে যারা এই মুহূর্তে তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা আর রাগ নিয়ে বসে আছে। ওরা কী ভাববে!

‘কোলের উপর এগুলো রেখেছেন কেন, দিন।’

দেবাংশু তুলে নিয়ে তার পাশে ব্যাগ আর বাক্সটা রাখল। বেলা দরজার দিকে সরে যাবার চেষ্টা করতে গিয়ে পারল না। দেবাংশু তার বাহু ধরে আছে এবং ক্রমশ কাছে টানছে।

‘আজ একটা অন্যায় করেছি।’

কানের কাছে দেবাংশুর মুখ। সেই ঝাঁঝালো গন্ধ, বিয়ারেরই বোধ হয়।

‘মদ খাইয়েছি।’

‘কাকে?’

‘তোমাকে।… খুব অল্প, এত অল্প যে নেশা হবে না গন্ধও মুখে হবে না।’

বেলা পাথরের মতো জমাট বেঁধে গেল। তার বুকের উপর দিয়ে দেবাংশুর আঙুলগুলো নড়াচড়া করছে, নেমে যাচ্ছে তলপেটে-এ সব কিছুই সে অনুভব করছে না। এখন তার দেহ বড়ো ধরনের যেকোনো অপারেশন তাকে অজ্ঞান না করেই বোধহয় করা যায়।

মাথাটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে তার। মদ শব্দটাকে সে ছোটোবেলা থেকে ভয় পেয়েছে, ঘৃণা করেছে। আর আজ, সে কয়ফোঁটাই হোক, সে নিজে পান করল। আশ্চর্য, কী অদ্ভুতভাবে সে বদলে যাচ্ছে! কোনো অনুশোচনা, অনুতাপ তাকে দগ্ধ করার জন্য জ্বলে উঠছে না, তাকে অপরাধীর গ্লানিতে বিষণ্ণ করছে না। অজান্তে নাকি কোনো কিছুই দোষণীয় নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে তার শরীরটাকে পাশের এই লোকটির হাতে ছেড়ে দেওয়া-নিশ্চয় অজান্তে নয়। কিন্তু নীল থলিটা কী অজান্তেই সে তুলেছিল?

ট্রাফিক লাইটে ট্যাক্সি থেমেছে। তাদের দু-পাশে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। বাঁদিকে একটা মোটরে বোধ হয় স্বামী-স্ত্রী। প্রৌঢ়। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ডানদিকে বেলার তিন হাত দূরে একটা ডাবল-ডেকার বাস। মুখ তুলতেই সে দেখল বাসের একতলার জানালায় দুটি কৌতূহলী পুরুষ মুখ জুলজুলে চোখে ট্যাক্সির ভিতরে তাকিয়ে।

বেলা ঝটকা দিয়ে দেবাংশুর হাত সরিয়ে দিল। তার মনে হল, বাসের মুখ দুটো হাসিতে যেন ভরে গেল প্রত্যাশিত দৃশ্যটি দেখতে পেয়ে।

‘এবার আপনি রেগেছেন।’

‘হ্যাঁ বাড়াবাড়ি হচ্ছে।’

চাপা স্বর দু-জনেরই। সামনের দুটি লোক সম্পর্কে দু-জনেই সচেতন। কাঠের মতো বেলা বসে। দৃষ্টি সামনে। বাসের লোক দুটো নিশ্চয় এখনও তাকিয়ে।

ট্রাফিক আলোর মুক্তি সংকেত পেয়ে গাড়ি চলতে শুরু করার পর বাসটা পিছিয়ে পড়তেই বেলা হাঁফ ছাড়ল। অনেকক্ষণ কেউ আর কথা বলল না।

এসপ্ল্যানেড, বউবাজার, মহাত্মা গান্ধী রোড পেরিয়ে বিবেকানন্দ রোডের মোড় থেকে সামনের দিকে তাকিয়ে বেলার মনে হল, দূরে অন্ধকার লোডশেডিং। ছ্যাঁৎ করে উঠল বুকের মধ্যে। তাদের পাড়াতেও তাহলে অন্ধকার।

এতগুলো টাকা নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে রাস্তায় নামা, গলি দিয়ে যাওয়া দরজার তালা খুলে অন্ধকার বাড়িতে ঢোকা…যদি ওরা ওৎ পেতে থাকে?

ট্যাক্সি থেকে নেমে গলির মধ্যে ঢুকে কয়েক পা এগোতে-না-এগোতেই তিন-চারজন ঘিরে ধরবে অন্ধকারে। একটা ছুঁচলো শক্ত কিছু পেটে ঠেকবে।

‘টাকাগুলো এখুনি চাই… কোথায় রেখেছেন।’

ফিসফিস করে একজন বলবে।

‘কিসের টাকা?’

‘ন্যাকামো থাক, এইখানেই লাশ পড়ে যাবে যদি এখুনি টাকা না পাই।’

ছুরিটা পেটে চেপে ধরবে আর একটু।

‘চলুন বাড়ির দিকে….চ্যাঁচামেচি করলেই…’

‘কিন্তু আমি তো…’

‘আবার মিথ্যে কথা…টাকা পেয়ে গেলে কিচ্ছু করব না… চলুন।’

কিংবা ওদের কেউ হয়তো পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢুকে অপেক্ষা করছে। এ সময় বাড়িতে পিসি আর বুলি ছাড়া কেউ থাকে না। বিমল চায়ের দোকানে। তিমির তো ফিরবে প্রায় আটটায়।

দরজা খুলে ঢোকামাত্রাই লুকিয়ে থাকা আততায়ী সোজা তার পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেবে ছুরিটা। তারপর ব্যাগটা কুড়িয়ে ভিতরে পাবে কুড়ি হাজার টাকা আর চাবির গোছাটা। চাবি দিয়ে দেরাজ খুলবে তারপর ট্রাঙ্কটা। কিংবা খুন না করে, বুকে ছুরি ঠেকিয়ে ঘরের মধ্যে নিয়ে যাবে।

‘বার করুন টাকার থলিটা।’

‘আমি কিচ্ছু জানি না।’

‘কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন?’

টর্চের আলো সারা ঘরে বোলাবে। দেরাজের পাল্লা টেনে খুলবে। কাপড়গুলো ছুড়ে ছুড়ে ফেলবে। বন্ধ ড্রয়ারের চাবি চাইবে। ব্যাগ থেকে সে চাবি বার করে দেবে।

ড্রয়ারে কিছুই পাবে না। কিন্তু খাটের নীচে ট্রাঙ্কটা এবার দেখতে পাবে।

‘খুলুন ওটা।’

‘বলেছি তো আমি কিছু জানি না।’

‘চটপট খুলুন। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, আমরা ওয়াচ রেখেছি আপনার উপর, আপনি কোথা থেকে আসছেন তাও জানি, একশো টাকার নোট বার করে বিল দিয়েছেন তাও টেলিফোনে খবর পেয়ে গেছি।’

বেলা আঁকড়ে ধরল দেবাংশুর হাত।

‘বাড়িতে পৌঁছে দেবেন? কী অন্ধকার দেখেছেন? সঙ্গে অতগুলো…আমাদের পাড়াটা ভালো নয়।’

দেবাংশু হাতটা চেপে ধরল নরমভাবে, কৃতজ্ঞতায়।

‘রাগ করে থাকলে কি বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া উচিত?’

‘না না, রাগ নয়, আসলে তখন পাশের বাস থেকে…আপনার কার্যকলাপ ওয়াচ করছিল।’

বেলা ষড়যন্ত্রীর মতো দেবাংশুর মুখের কাছে মুখ এনে বাকিটুকু বলল: ‘মদ খাইয়ে যে অপরাধ করেছেন তার শাস্তি এটা।’

‘এমন শাস্তি পাবার জন্য জন্ম জন্ম অপরাধ করতে রাজি…বাঁয়ে গ্রে স্ট্রিট দিয়ে।’

ট্যাক্সি বাঁদিকে ফিরল। ঘন অন্ধকারকে মাঝে মাঝে ছেঁদা করে দিচ্ছে দোকানের হারিকেন বা মোমবাতির আলো। পথের মানুষগুলো ট্যাক্সির হেড লাইটের আলোর মধ্যে এসেই পিছনে চলে যাচ্ছে ভৌতিক দৃশ্যের মতো মিলিয়ে গিয়ে। বাড়িগুলোর জানালায় ম্লান হলুদ চৌকো মোমবাতি বা হারিকেনের আলো। সামনের সিটে নির্বাক দুটি অপমানিত, প্রহৃত মানুষ। সন্ত্রস্ত কুকুরের ডাক ভেসে আসছে গলির মধ্য দিয়ে।

শিব দত্ত লেনের মুখেই ট্যাক্সি থেকে ওরা নামল। ব্যাগ এবং বাক্সটা বেলার হাতে। মিটারের আলো জ্বেলে সহকারীটি পড়ার চেষ্টা করছে। দেবাংশু একটা দশ টাকার নোট ড্রাইভারের দিকে ছুড়ে দিয়ে ফেরত অর্থের জন্য অপেক্ষা করল না।

‘চলুন।’

বেলার হাত থেকে সে প্রায় ছিনিয়েই নিল ব্যাগ এবং বাক্সটা। ফুটপাতে জটলা করছে কিছু ছেলে। বেলার মনে হল, বিমলের দোকানে যেন অন্ধকারই দেখেছে। লোডশেডিংয়ের জন্য কী বন্ধ করে দিয়েছে? অবশ্য ফুটপাথের দোকান বন্ধ করা বা না করা একই কথা। শুধু উনুনটা ছাড়া আর সব কিছুই, একটা কাঠের বাক্সে ভরে পাশের গ্যারেজে রেখে আসে।

শিব দত্ত লেন যেন আরও অন্ধকার। পাশের লোককেও ঠাওর করা যায় না। কর্পোরেশনের এবং ইলেকট্রিকের লোকেদের খোঁড়াখুঁড়ির জের হিসেবে কতকগুলো ঢিবি এবং গর্ত ইতস্তত ছড়ানো আছে। বেলার সেগুলো মুখস্থ।

এমন অন্ধকারে যদি কেউ বা কয়েকজন তাদের ঘিরে ধরে! দেবাংশুর গায়ের জোর কী পারবে ওদের ঠেকাতে? ছুরি মেরে তারপর বোমা ছুড়ে হয়তো পালাবে। ছুরি কি ভেদ করতে পারবে দেবাংশুর অমন পাথুরে শরীর?

‘আপনি এই দিকে আসুন, গর্ত আছে।’

‘তার থেকে বরং…’

দেবাংশু ওর বাহু ধরল।

‘এখন আমি একদমই অন্ধ, পথ দেখান।’

বেলা কিছুটা আশ্বাস পেল যেন ওর ছোঁয়া পেয়ে।

‘মনে রাখবেন এখন আমি আপনার বডিগার্ড।’

দেবাংশুর হাত ওর কোমর বেড় দিয়ে ধরার চেষ্টা করছে। বেলার মনে হল, কেউ একজন আসছে সামনে থেকে। হাতটা সে সরিয়ে দিল। কয়েকটা বাড়ির খোলা জানলা দিয়ে আসা হারিকেন আর মোমবাতির আলো গলিতে আবছা একটা ছায়া তৈরি করেছে। কেউ তীক্ষ্ন চোখে তাকালে তাদের নিশ্চয়ই দেখতে পাবে।

‘আপনি এখনও রেগে।’

সত্যিই একটি লোক আসছিল।

‘কে রে, মনু নাকি?’

লোকটি অপ্রতিভ হয়ে ‘আ যা অন্ধকার’ বলে এগিয়ে গেল।

‘বডিগার্ডের কাজটুকু) করতে দেবেন না?’

‘আমরা এসে গেছি।’

আরও দুটো বাঁক, কিন্তু ওকে নিরস্ত রাখতেই এটা বলা। একটু তফাত হল দেবাংশু।

‘এই জায়গাটাই বড়ো ভয় করে, আলো থাকলেও। এখানে ছিনতাই কী খুন করে গেলেও, চট করে বোঝা বা ধরা যাবে না।’

দেবাংশু হাত ধরে ওকে সামনে টেনে আনল।

‘আপনি আগে চলুন।’

বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেলার বুকটা একবার কেঁপে উঠল। কেউ এখনও ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েনি বা ঘিরেও ধরেনি। তবে কি বাড়ির মধ্যে ওৎ পেতে আছে?

‘আপনি তালাটা খুলুন?’

‘কেউ কী নেই বাড়িতে?’

অন্ধকারেই চাবির গুচ্ছ থেকে তালার চাবিটা বার করে দেবাংশুর হাতে দিয়ে এবং ওর হাতের জিনিস দুটো নিতে নিতে বেলা বলল: ‘উনি আরও পরে অফিস থেকে ফেরেন। ওর কাছেও একটা চাবি আছে।’

তালাটা খুলে দেবাংশু পাল্লা দুটো মেলে দিল। ভিতরে আরও ঘন অন্ধকার। বেলা বুকের কাছে আঁকড়ে ধরল ব্যাগটা, ভিতরে ঢুকতে তার ভয় করছে।

‘আপনি দেশলাইটা জ্বালুন।’

‘নেই, আমি সিগারেট খাই না।’

দেবাংশু দুটো ধাপ উঠে গেল।

‘এবার কোনদিকে, আমি তো এই প্রথম।’

‘দাঁড়ান, আমি আগে যাই।’

দরজা পেরিয়েই বেলা ধমকে দাঁড়াল। কান পাতল কোনো পায়ের বা কারোর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ যদি শোনা যায়। বিমলদের দিক থেকেও কারোর কণ্ঠস্বর কী বাসন নাড়ানাড়ির শব্দ এল না। ওর মনে হল, একটা রাক্ষস ধরনের বিরাট জন্তুর হাঁ-এর মতো সামনের সরু দালানটা, এগোলেই তাকে গিলে ফেলবে।

খসখস শব্দ সে যেন শুনতে পেল। আরশুলা? এ বাড়িতে অনেক আছে। কী একটা আবছা, যেন মানুষেরই মূর্তি… বেলা পিছিয়ে যেতেই ধাক্কা খেল দেবাংশুর দেহে আর সঙ্গে সঙ্গে দুটো হাত পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল।

‘ভয় কী, আমি তো আছি।’

জীবনে এই প্রথম বেলা এমন আশ্বাসদায়ক কথা শুনল। কথা দুটো তার মর্মে যে ঘূর্ণি তুলল, তা তাকে কাঁপিয়ে দুলিয়ে নিরাপত্তার জন্য অতলে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল। আর মনে হল, একটা আগ্নেয় পাহাড় যেন তাকে আড়াল করে আশ্রয় দিচ্ছে। কর্কশ, রুক্ষ পাথরের সঙ্গে ঘর্ষণে তার দেহ ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, তবু তো একটা কঠিন শক্তির আড়াল সে পেয়েছে। আততায়ী যেকোনো সময় ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। ওরা ছাড়বে না, খোঁজ নিয়ে এখানে আসবেই। এখন তার সাহায্য চাই, নির্ভর করার জন্য কাউকে চাই এবং কী দারুণ পুরুষ এই দেবাংশু!

‘দরজাটা বন্ধ করুন।’

বেলার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে দেবাংশুর দুই বাহুর প্রচণ্ড চাপে। শিথিল হাত থেকে ব্যাগ আর বাক্সটা পড়ে যাচ্ছিল প্রায়, কোনোক্রমে সে বলতে পারল: ‘ঘরে…।’

আলিঙ্গন আলগা হয়ে গেল। বেলার পিছনে সন্তর্পণে পা ঘষড়ে কাঁধে হাত রেখে সে ঘরের মধ্যে এল। হাঁফাচ্ছে।

‘আপনি এবার চলে যান।’

‘কেন?’

বেলা খাটের দিকে সরে গেল। ব্যাগ আর তন্দুরি চিকেনের বাক্স খাটের উপর রাখল।

‘কেউ দেখতে পায়নি আমি এসেছি। কেউ দেখতে পাবে না যখন চলে যাব।’

দেবাশু ওর সামনে দাঁড়িয়েছে।

‘তবু…’

বেলা শেষ করতে পারল না কথাটা। ততক্ষণে সেই নির্ভরযোগ্য অধৈর্য পাহাড় তার উপর ভেঙে পড়েছে। খাটের উপর এলিয়ে পড়তে পড়তে বেলা তাকাল উঠোনের দিকের জানলা দিয়ে। অন্ধকার উঠোনের ওপারে বিমলের ঘরের দেওয়ালটা লম্পোর আলোয় কাঁপছে।

বেচারা! শুধু একটু সাহস ও চায়। সাহস তার নিজেরও কী ছিল? নীল থলিটা পাবার আগে পর্যন্ত… বেলা তার ব্লাউজের বোতাম ছেঁড়ার শব্দ শুনতে শুনতে ভাবল, আমি কী ছিলাম।

ধীরে ধীরে বেলার চোখ দুটি মুদে এল এবং দুটি হাত উঠে এসে জড়িয়ে ধরল দেবাংশুর গলা। দুটি পা ছড়িয়ে দিয়ে যেন সে বলতে চাইল-আর কত সাহসী হতে পারি? বদলে, অস্ফুটে বলল: ‘আস্তে…লাগছে।’

এবং সেই মুহূর্তে সে মুখ ফিরিয়ে একবারের জন্য বন্ধ চোখ খুলে জানলায় তাকাল।

মনুষ্যাকৃতির মতো একটা গাঢ় ছায়া, তার মনে হল, জানলার কাছে নিথর হয়ে রয়েছে। চিৎকার করে, ‘কে ওখানে’ বলতে গিয়েও পারল না। গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। জিভটা ভিতর দিকে টানা রয়েছে। শুধু চাপা গোঙানির মতো একটা আওয়াজ মুখ থেকে বেরিয়ে এল।

শরীরের উপর আর একটা শরীর দাপাচ্ছে কিন্তু বেলা কিছুই অনুভব করছে না। একদৃষ্টে সে জানলার দিকে তাকিয়ে। মনে হল, ছায়াটা একটু এগিয়ে এল। দৃষ্টিকে তীক্ষ্ন করে সে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল ওটা জীবন্ত কোনো প্রাণী না অন্য কিছু।

‘বেলা বেলা বেলা…’

দেবাংশু তার উন্মুক্ত বুকে মুখ রগড়াচ্ছে। বেলা কোনো শিহরণ বোধ করছে না।

‘এত ঠান্ডা, এত কোল্ড কেন?’

বেলা স্থির চোখে জানালার দিকে তাকিয়ে এবং ভয়ের প্রথম বিহ্বলতা কাটিয়ে যখন উঠছে…দপ করে ঘরের আলো জ্বলে উঠল।

এক কী দুই সেকেন্ডের জন্য বেলা মুখটা দেখতে পায়। জানলার রডের ফাঁক দিয়ে সে নির্ভুল চিনেছে।

ছিটকে উঠে পড়েছে দেবাংশু। হাঁটুর কাছ থেকে নিমেষে প্যান্টটা টেনে তুলে নিল।

‘এমন হঠাৎ যে কারেন্ট এসে পড়বে…’

প্যান্ট ঠিক করতে করতে বিরক্ত অপ্রস্তুত দেবাংশু চারপাশে তাকাল এবং বেলার শাড়ি পা পর্যন্ত নামিয়ে দিল। বেলা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে জানলার দিকে । তারপর দু-হাতে চোখ ঢেকে ফেলল।

কতক্ষণ কেটে গেছে। দেবাংশু কী যেন বলার চেষ্টা করছিল। কখন চলে গেল, বেলা কিছুই জানে না। সে উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুধু ভেবেই গেছে-এবার কী হবে। আর বার বার চোখে ভেসে উঠেছে, সাগররিকার সেই চাহনি। ছাদ থেকে জানলা দিয়ে সে যা দেখেছিল, ঠিক সেই দুটি চোখই কী তখন তার নিজের…

দরজার কাছে খসখস শব্দ আর গলা খাঁকারি।

‘টাকাগুলো আমার চাই।’

বেলা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়েই কেউ বলল কী?

‘নীল রঙের একটা থলে…’

বেলা মুখ তুলে তাকাল। ঘরের মধ্যে বিমল দাঁড়িয়ে। জ্বরে পোড়ারোগীর মতো চোখ, একটু কুঁজো হয়ে ঝুঁকে নিজেরই দুটি তালু আঁকড়ে নিজেকে সামলাচ্ছে।

‘কে বলল আমার কাছে আছে?’

‘আমি বলছি। আজ সন্ধেবেলা একটা লোক আমাকে দোকান থেকে ডেকে গাড়িতে তুলে গঙ্গার ধারে নিয়ে গেল।’

বিমলের মুখটা তার বলার সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে। বেলার মনে হল, ওর গালে দু-তিনটে নতুন ভাঁজ, যার একটিও আগে ছিল না। চোখে এবার পাগলামির ছায়া। কাঁধটা কুঁকড়ে যাচ্ছে কুঁজো হয়ে রয়েছে। শুধু শান্ত হয়ে দুটো হাত।

‘দু-জন দুটো পিস্তল পেটে ঠেকিয়ে আমার কাছে থলিটা চাইল। সেদিন আমি তখন দোকানে বাড়িতে আপনি ছাড়া কেউ নেই…চটপট থলেটা এবার বার করে দিন।’

‘কিন্তু আমি তো থলে…’

‘পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি…ওরা আমাকে দুদিন সময় দিয়েছে। আমি দেব ঠিক পাঁচ মিনিট। দোকান বন্ধ করে অন্ধকারে বসেছিলাম। আপনাদের আসতে দেখে আমিও পিছু পিছু বাড়ি ঢুকি। ঘরের আলো জ্বালালেন না দেখে জানলায় গিয়ে…আর কথা বাড়াব না, বার করুন। আমাকে দুদিন সময় দিয়েছে।’

‘তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে?’

বিমল বিনা শব্দে হাসল, বরং বলা যায় ব্যাদন করল। বেলা খাট থেকে নেমে দাঁড়াল। চোখ থেকে বোঝা যাচ্ছে বিমল বদ্ধপরিকর।

‘তুমি ধরে নিয়েছ ওরা যা বলছে তাই সত্যি। এই বাড়িতে নীল রঙের থলে কোথা থেকে আসবে?’

বিমল তো পাঁচ মিনিটের জন্য সাহস ধরে রাখবে। বেলা ভাবল, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সহ্য করেছি অসহনীয় যন্ত্রণা। এত সহজে কেন টাকাগুলো তুলে দেব ওর হাতে!

‘ওদের একজন পালাবার সময় ফেলে দিয়ে গেছে।’

‘বাজে কথা। তোমাকে ভড়কি দিয়ে পরীক্ষা করেছে।’

বিমলের চোখে দ্বিধা। এইবার সে গোলমালের মধ্যে পড়েছে।

‘তোমাকে ভাঁওতা দিয়ে ওরা দেখছে।’

‘কীসের ভাঁওতা? ওদের যে লোক ফেলে গেছে সেই বলেছে। আর থলিটা অন্য কেউ তো পাবে না এই বাড়ির লোক ছাড়া, পুলিশেও পায়নি।…আপনার চাবিটা দিন সব খুলে দেখব।’

‘কেউ পায়নি মানেই কি আমি পাব?’

‘তা ছাড়া আর কে পাবে?’

বেলা বুঝতে পারছে এই নিয়ে তর্ক করা বৃথা। বিমল বুঝেই গেছে টাকা তার কাছে।

‘যদি আমি না দিই।’

এবার বিমলের ভঙ্গি ধীরে ধীরে নরম শিথিল হয়ে এল।

‘ওরা তাহলে আপনার সঙ্গে দেখা করবে, আমি বলে দেব।’

‘ওরা কি আমায় খুন করবে?’

‘নিশ্চয়।’

‘টাকা কী তাহলে পাবে? আমি যদি অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলি…কালকেই।’

‘সেখানে ওরা যাবে।’

‘ওরা কী জানে আমিই থলিটা সরিয়ে রেখেছি?’

‘ওদের ধারণা আমিই রেখে দিয়েছি, আমার কথা অবশ্য বিশ্বাস করেনি ওরা…কিন্তু আমি তো জানি আমি নিইনি।”

‘ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করলে বলব, তুমিই সরিয়ে রেখেছ। আমি নিজে চোখে দেখেছি একটা নীল থলি উঠোনে পড়েছিল, সেটা তুমি দোকান থেকে ফিরে কুড়িয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকলে।…তাহলে?’

‘একটি কথা যদি আর বলেন, তাহলে যা আমি দেখলুম…আপনার স্বামী, পাড়ার লোক, আপনার স্কুলে…’

”বলে দেবে? তাতে আর কী হবে, নয় চাকরিই ছেড়ে দেব, পাড়াও ছেড়ে চলে যাব।”

‘আর স্বামী?’

‘তোমার বউও তো ছেড়ে চলে গেছে।’

বেলা অবাক হয়ে গেল কথাটা বলেই। মুখ থেকে এমন ধরনের যুক্তি কত স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে এল! তার মানে, তিমির কি তার কাছে গুরুত্বহীন অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে না লক্ষ টাকার মালিক হবার জন্য সে সবকিছু করতে রাজি?

‘আপনি স্বামীকেও ছেড়ে দেবেন টাকার জন্য?’

‘সাগরিকা তোমায় ছেড়ে গেছে কেন?’

বিমলের বিস্মিত মুখ নিমেষে পাংশু হয়েই রাগে থমথমে হয়ে উঠল। পুরুষের দুর্বল জায়গায় আঘাত পড়েছে। বেলা সাবধান হল এবং হাসল।

‘আজেবাজে কথা বলে দেরি করিয়ে দিচ্ছেন।’

‘আজেবাজে কেন হবে, কাজের কথাই বলছি।’

”আমার বউয়ের চলে যাওয়ার সঙ্গে কী সম্পর্ক এই টাকার?’

অধৈর্য হয়ে বিমল হাতের মুঠো ঝাঁকাল। স্বর সামান্য চড়িয়ে ফেলেছে।

‘আস্তে কথা বলো পগার দিয়ে লোক যাতায়াত করে।’

গলা নামিয়ে কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে, যার কোনোই দরকার নেই, বিমল বলল:

‘সাগরিকার সঙ্গে প্রভাসের লটঘট চলছে আমি জানতুম…হ্যাঁ, বিয়ের আগে থেকে চলছিল। ওদের ব্যাপারটা না জানার ভান করে থাকতুম। সাগরিকাকে আমার সঙ্গে প্রভাসই ভাব করিয়ে দেয়; বিয়ে করলে টাকা দিয়ে দোকান করে দেবে বলায় বিয়ে করেছি। টাকা আমার দরকার, বেকার বসে থাকার চেয়ে এটা কী এমন খারাপ? ও আমাকে ছেড়ে যায়নি, আমিই ছেড়ে দিয়েছি। প্রভাসকেও বলেছি, এভাবে পালাবার কোনো দরকারই ছিল না।’

‘টাকার জন্যই এটা করেছ, আশ্চর্য আর আমাকেই কিনা বলছ টাকা ছেড়ে দিতে? তোমার যেমন টাকার দরকার, তেমনি আমারও দরকার।’

দেবাংশুকে মনে পড়ল। ব্যাপারটা কী অদ্ভুতভাবে যেন ঘটে গেল। এটা ঘটত না, যদি সে ভয়ে দিশাহারা হয়ে না পড়ত। দেবাংশুকে সে ভালোবাসে না তবু ওর হাতে শরীর তুলে দিয়েছিল। কী গ্লানিকর সমর্পণ। এটা নিজেকেই অপমান করা। নিজের মুখে থুথু দেওয়ার কোনো উপায় আছে কী?

‘দরকার।’

বিমল কুঁজো হয়ে এগিয়ে এল, বেলা মাথাটা পিছনে হেলিয়ে দেবার আগেই ওর হাতের দশটা আঙুল গলা চেপে ধরল।

বেলা দু-হাত গলার কাছে তুলে এনে মাথা নাড়ল। বিমলের দুটো হাতের আঙুলগুলো তার গলায় বেড় দিয়ে রয়েছে। ধীরে ধীরে চেপে বসছে। অস্পষ্ট একটা গোঙানি ছাড়া, বেলার আর কিছু করার ইচ্ছে হল না। বাধা দেবার জন্য শরীরের সামর্থ্য জড়ো করে তুলতে গিয়েও পারল না। সে ক্লান্ত বোধ করছে।

‘এইভাবে ওরা খুন করবে, হয় আমাকে নয় আপনাকে। যদি বাঁচতে চান তাহলে দিয়ে দিন…আমি ঝুঁকি নোব।’

আঙুলগুলো আগলা করল বিমল। ঘাড়ের গভীর দাগটা, তিন-চারটে পাকা চুল, বেলা দেখতে পাচ্ছে। ওর দু-চোখে ক্ষ্যাপাটে চাহনি, তাহলে সাহস জোগাড় করে ফেলেছে। পাঁচ মিনিটের জন্য…তারপর লাখপতি।’

বুলির কান্না শোনা গেল। বেলার অসাড় ইন্দ্রিয়গুলো এবার চারপাশের পৃথিবীকে গ্রাহ্যের মধ্যে পাচ্ছে। রেডিয়োতে খবর পড়ছে…বস্তিতে কীসের তর্ক চলছে…দরজায় লাথি মারছে কেউ পাশের বাড়িতে…পিসি থামাবার চেষ্টা করছে বুলির কান্না।

বেলা বাস থামাবার ভঙ্গিতে ডান হাতটা তুলে বিমলকে অপেক্ষা করতে ইশারা করল। গলা থেকে বিমল হাত নামাল।

‘থলিটা যে আমি নিইনি, টাকা যে আমার কাছে নেই এটা ওরা জানবে কী করে?’

বেলা বুঝতে পারছে, এতক্ষণে ঘটনার ঝড়ে তার মানসিক তরণী যে টালমাটাল অবস্থায় ছিল তা আর এখন নেই। ভারসাম্য রেখে তরতর করে এবার সে এগোতে পারবে। বিমলকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। পাঁচমিনিটের জন্য ওর সাহসী হয়ে ওঠা আর হল না।

‘আপনি খুব নোংরা কাজ করছেন, আপনি যে এত খারাপ তা আমি জানতুম না। ঘেন্না হচ্ছে আপনাকে দেখে। বাজারের মেয়েমানুষও আপনার থেকে সচ্চচরিত্র…আপনার মুখে থুথু দিতে ইচ্ছে করছে।’

‘দাও, কিন্তু টাকা আমি ছাড়ব না।’

‘ও টাকা আপনি ভোগ করতে পারবেন?’

‘তুমিই কী পারবে?’

‘আমি পালাব। কেউ খুঁজে পাবে না এমন জায়গায় চলে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করব…ব্যবসা করব, বিয়ে করব…আমার বয়স আছে, আপনার কী আছে? পালাবেন বলছেন, কোথায়? ওরা ঠিকই খুঁজে বার করবে?

বেলার মনে হল, বিমল বোধহয় ঠিকই বলছে। এ টাকা সে ভোগ করতে পারবে না। কোথাও পালাতেও পারবে না। শুধু একটা আতঙ্ক ছাড়া আর কিছুই তার লাভ হবে না।

‘আমাকে দেখতে না পেলেই ওরা বুঝে যাবে, আপনাকে ঝামেলায় ফেলবে না আর।’

‘এই টাকার জন্যই আমাকে আজ….’

‘কাউকে বলব না। এমন একটু-আধটু ফুর্তি লুকিয়ে চুরিয়ে সবাই করে।’

বিমল এগিয়ে এসে খাটের উপর থেকে বেলার হাতব্যাগটা তুলে নিল। বেলা শূন্য দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইল।

ব্যাগ খুলে উপরের জিনিসগুলো বার করতে করতে থমকে সে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। তারপর বেলার মুখের দিকে তাকাল।

‘এই কী সব? পুরো এক লাখ?’

বিমলের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বেলা চাবি বার করল। ব্যাগটা আবার ফেরত দিল ওকে।

ট্রাঙ্কটা বার করে দাও।’

বিমল হ্যাঁচকা টানে খাটের নীচ থেকে ট্রাঙ্কটা বার করে আনল।

‘পালাবে? কিন্তু ওরা তোমায় খুঁজে বার করবেই।’

‘দেখা যাক।’

আটটা তাড়া আর চারটে বান্ডিল বুকে চেপে ধরে বিমল থরথরিয়ে কাঁপছে আর হাসছে। এত ভয়ংকর বীভৎস হাসি বেলা কখনো কারোর মুখে দেখেনি।

‘সাহস এইবারই দেখাতে হবে, আমার লাস্ট চান্স।’

‘বুলিকেও নিয়ে যাবে তো।’

‘পাগল! ও সঙ্গে থাকলে একদিনেই ধরা পড়ে যাব। ওকে আপনারাই দেখবেন নয়তো ওর মা-র কাছে পাঠিয়ে দেবেন।’

প্রায় ছুটেই বিমল বেরিয়ে গেল। বেলা খালি ব্যাগটা খাটের উপর থেকে তুলতে গিয়ে দেখল, খাবারের বাক্সটা চ্যাপটা হয়ে ফেটে রয়েছে আর তার ফাঁক দিয়ে তন্দুরি চিকেনের একটা ঠ্যাং বেরিয়ে। বাক্সটা নিয়ে সে ছাদে গেল। পগারে ছুড়ে ফেলার পর নীচে নামতে নামতে দরজায় খুট খুট কড়ার শব্দ সে শুনতে পেল।

দরজা খুলেই বেলা বলল: ‘এত দেরি করে ফেরো কেন?’

পরদিন ভোরে বেলা যথারীতি স্কুলে বেরোল। স্কুলে যথারীতি পড়াল। একসময় দেবিকা জিজ্ঞাসা করল: ‘কখন ফিরলেন?’

‘তুমি যাবার মিনিট দশেক পরেই।’

যথারীতি সে, গীতা এবং অর্চনা পাঁচমাথার মোড়ে দাঁড়াল ছুটির পর।

‘হ্যাঁরে বেলা, তোদের ওদিকে একটা দারুণ ডাকাতি হয়েছে নাকি!’

‘বলাবলি করছিল বটে পাড়ার লোক, লাখ টাকা নাকি নিয়ে গেছে রাস্তার ওপর থেকে। আর কিছু জানি না, ভালো লাগে না এসব খবর শুনতে।’

এরপর তারা দেবিকা, গরম, হেডমিস্ট্রেস এবং জিনিসের দাম নিয়ে কথা বলল।

বেলা হেঁটেই বাড়ি ফিরল এবং তখন লটারিওলার দিকে তাকিয়ে সে একবার হেসেও ছিল।

বিমলের দোকান খোলেনি। কোনোদিনই আর খুলবে না। বেলা শুধু একবার মাথা নেড়ে ‘বেচারা’ শব্দটি আপনমনেই বলেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *