ছোটবাবু

ছোটবাবু – মতি নন্দী – উপন্যাস

এক

ঘটনাটা প্রায়ই ঘটে।

 ছুটির প্রথম ঘণ্টার পরই স্কুল ফটক থেকে প্রথমে স্রোতের মতো একটা দল বেরিয়ে আসে প্রচণ্ড কলরব তুলে। এরা একেবারেই বাচ্চচা, নিচু ক্লাসের ছাত্র। এদের অনেকের জন্য বাড়ির লোকেরা, ঝি চাকর বা মায়েরা ফটকে অপেক্ষা করে। জলের প্লাস্টিকের বোতল, বইয়ের বাক্স বা ব্যাগ তাদের হাতে তুলে দিয়ে বাচ্চচারা বাড়ির দিকে রওনা হয় সমানে বকবক করতে করতে।

 এরা বেরিয়ে যাবার পর দ্বিতীয় ঘণ্টা বাজে। এবার হইচই করে বেরিয়ে আসে আর একটু বড়ো আকারের ছেলেরা। এরা তর্ক করে উঁচু গলায়, কখনো হাতাহাতিও করে তর্কের মীমাংসা ঘটাতে। কেউ অশ্লীল গালি দেয়, কেউ চুপচাপ গম্ভীর হয়ে পথ চলে।

 স্কুলের ঘণ্টা তৃতীয়বার বাজলে বেরিয়ে আসে উঁচু ক্লাসের দীর্ঘকায় ছাত্ররা। থুতনিতে হালকা দীর্ঘ রোম, গোঁফের অস্পষ্ট কালো রেখা। অনেকেরই হাতে ঘড়ি বা চোখে চশমা। বেশিরভাগই ট্রাউজার্স পরা। দু-তিনজনের ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে বা একলাই হাঁটে। যার বাড়ি দূরে সে বাস স্টপে দাঁড়িয়ে থাকে। কিশোরী বা তরুণীদের দেখলে এদের অনেকেই সামনে তাকিয়ে কাঠের মতো হয়ে যায়। কেউ কেউ বেপরোয়ার মতো তাকায়।

 তৃতীয়ের পর আর কোনো ঘণ্টা বাজে না। আর কেউ বেরিয়ে আসে না শুধু একজন ছাড়া। সে ছোটো ছোটো দ্রুতপায়ে বইয়ের সুটকেসটি হাতে নিয়ে বাড়িগুলোর ধার ঘেঁষে, যেন কেউ তাকে না দেখতে পায় এমন একটা তাড়া-খাওয়া বেড়ালের মতো হেঁটে যাচ্ছে। অথচ রাস্তায় তখন খুব লোকজন থাকে না।

 কপাল ও কানের উপর ঝুলে আছে কোঁকড়া চুল। ঘন ভ্রূর নিচে গোলাকার বড়ো বড়ো চোখদুটি দিয়ে কখনো ভয়ে কখনো কৌতূহলে ইতস্ততঃ তাকাচ্ছে। একসঙ্গে দু-তিনজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেই মন্থর হয়ে যাচ্ছে। সন্তর্পণে, নিশ্বাস চেপে, চোখ নামিয়ে তাদের পার হয়ে আবার দ্রুত হাঁটছে। জামার মধ্যে থলথলে চর্বির নড়াচড়া হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠছে। ওর কাঁধ বুক পেট কোমর সমানভাবে বর্তুলাকার। বস্তুত ওর ঊর্ধ্বাঙ্গ অনেকটা কাপড়ে আচ্ছাদিত ঢোলকের মতো দেখাচ্ছে। সে ওদের দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারে সকলের চোখ তার দিকে। না তাকিয়েই বুঝতে পারে প্রতিটি চাহনিতে চাপা কৌতুক আর বিস্ময়।

 বাড়িগুলো ঘেঁষে মিনিট দুই তিন হাঁটার পর বাঁদিকে একটা গলিতে তাকে ঢুকতে হবে। স্কুলের পাঁচ ছ’জন ছেলে প্রায়ই এখানে তার জন্যে ওতপেতে থাকে। আজও তারা ছিল। দূর থেকে সে ওদের দেখতে পায়নি কেননা ওরা গলির ভিতরের দিকে দাঁড়িয়েছিল। গলির মুখে পৌঁছে ঘুরে ঢোকামাত্র ওরা তাকে ঘিরে ফেলে। পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। একজন সামনে এসে গুটিগুটি এমনভাবে চলতে শুরু করে যে তার পক্ষে দ্রুত কেন ধীরে হাঁটাও অসম্ভব হয়ে পড়ল। তার গৌরবর্ণ লম্বাটে মুখটা তখন ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে এল। সে জানে এখন পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে গেলেই দুজন দুপাশে এসে তার দুটি হাত চেপে ধরবে। পিছন থেকে কেউ চুল টানবে, নয়তো জুতো দিয়ে তার গোড়ালিতে ঠোক্কর মারতে থাকবে, হাঁটু দিয়ে তার পাছায় ধাক্কা মারবে।

 তাই সে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল না, কোনো প্রতিবাদও নয়। সে জানে কোনো রকমের বাধা দিলেই ওরা অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। মুখে নানারকম তীক্ষ্ন বিদঘুটে শব্দ করে রাস্তার লোকেদের দৃষ্টি তার দিকে ফিরিয়ে দেবে। এই ব্যাপারটিকেই সে সবথেকে ভয় পায়। কেউ তার দিকে তাকাক এটা সে কোনোমতেই চায় না।

 চুপ করে মাথা নামিয়ে সে হাঁটার চেষ্টা করে। সামনের ছেলেটি আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ে এক পা পিছিয়ে আসে। ফলে সে ছেলেটির পিঠের উপর পড়ামাত্র ছেলেটি তার পিছনে এসে ধাক্কা দেয়। দুজনের মাঝে সে চ্যাপটা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর ওরা ঘেঁষাঘেঁষি করে তাকে ঘিরে এমনভাবে হাঁটতে থাকে যে রাস্তার লোকেরা কয়েকটি ছেলের একটি জটলা ছাড়া আর কিছু বুঝতে পারে না। সেইসময় তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে। জামার হাতায় চোখ মুছে সে ওদের মাঝখানে থেকে প্রায় অদৃশ্য অবস্থায় হেঁটে যেতে থাকে। অন্যমনস্ক পথিকরা ওকে তখন দেখতেই পেল না। উপরে বারান্দায় দাঁড়ানো কেউ কেউ এই বিচিত্র শোভাযাত্রা দেখে হেসে ফেলে।

 দুটি বড়ো রাস্তাকে সংযোগকরা গলিটা দৈর্ঘ্যে ছোটো। আবার চওড়া বড় রাস্তায় পড়ে ওরা তাকে প্রায় ঠেলতে ঠেলতে একটা মিষ্টির দোকানের সামনে এনে দাঁড় করাল। এখানে এই সময় গরম শিঙাড়া ভাজা হয়।

 ”গোণ তো রে আমরা কজন?”

 ”সাত। ওকে নিয়ে আট।”

 ”ওকে বাদ দিয়ে বল। …হাঁরে, দুটো করে শিঙাড়া আর একটা করে অমৃতি, মাথাপিছু এক টাকা হবে তো?”

 দলনেতা সবথেকে লম্বা ছেলেটি তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। একজন দোকানিকে ইশারা করে শিঙাড়া দিতে বলল। দোকানি হাসছিল। সে এই ব্যাপারটায় অভ্যস্ত। এই ঘটনা বহুবার ঘটেছে।

 ”কিগো ছোটবাবু, বন্ধুদের খাওয়াবে না?” দোকানি একগাল হাসির মধ্যেই চোখ টিপল লম্বা ছেলেটিকে। এদের মধ্যে একজন ছাড়া সবাই তার দু ক্লাস নিচে পড়ে। বাকিজন তিন ক্লাস নিচে।

 ”আমার কাছে অত পয়সা নেই।”

 এই প্রথম সে কথা বলল। ঈষৎ তীক্ষ্ন অথচ ভরাট স্বর। আড়ালে শুনলে মনে হবে বয়স্ক কেউ যেন বলল।

 ”পয়সা নেই কিরে! সেই সকালে ভাত খেয়ে স্কুলে এসেছি, খিদেতে নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাচ্ছে…নে নে দিতে বল। কতদিন খাওয়াসনি বলতো?”

 ”লাস্ট শনিবারের পর আজ, তাইতো রে ভোলা?”

 ”কিগো ছোটোবাবু, দোব?” দোকানি ফুঁ দিয়ে কাগজের ঠোঙার মুখ খুলে থালায় রাখা সদ্যভাজা শিঙাড়ার দিকে হাত বাড়াল।

 ”আমার কাছে আজ পয়সা নেই।” সে আবার বলল। ওর চোখে কাকুতি আর ভয়। চশমাপরা একটি ছেলে ওর কোমরের চর্বি ও চামড়া দু আঙুলে চিমটি দিয়ে টেনে ধরে নির্বিকারমুখে দাঁড়িয়ে রইল।

 যন্ত্রণার একটা অস্ফুট শব্দ ছাড়া আর কিছু বেরলো না ওর মুখ থেকে। ও জানে যেকোনো প্রতিবাদ দ্বিগুণ অত্যাচারের কারণ হবে।

 ”কত পয়সা আছে তোর কাছে?” কথাটা বলেই লম্বা ছেলেটি ওর পিছনে দাঁড়িয়ে প্যান্টের দুই পকেটে দুটি হাত ভরে দিল। তার মুঠোয় উঠে এল কাগজে মোড়া হজমি, ইরেজারের টুকরো, গাওয়া ঘিয়ের হ্যান্ডবিল, বাসের টিকিট, লুডোর সবুজ ঘুঁটি আর কিছু খুচরো পয়সা।

 ”সুটকেসটা খুলে দ্যাখ না।”

 একজন ওর হাত থেকে সুটকেসটা নিয়ে সেটা খুলল তোলা-হাঁটুর উপর রেখে। বইখাতা হাতড়ে সে কিছুই পেল না। হতাশ হয়ে সে ডালা বন্ধ করে ফিরিয়ে দেবার সময় সুটকেসটা দিয়ে ওর পেটে গোঁতা মারল। ব্যথা লাগলেও ওর মুখে সেটা প্রকাশ পেল না।

 ”তাহলে?”

 ওরা বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তখন একজন বলল, ”ওতো ধারে খাওয়াতে পারে।”

 দোকানি কথাটা শুনে বলল, ”নাও না। ছোটবাবুতো কাল স্কুলে যাওয়ার সময়ই দিয়ে দেবে। তাইতো ছোটবাবু?”

 ”কিরে, কাল শোধ করে দিবি তো?”

 ”হাঁ।”

 ”আরে ওর বাবা বেশ মালদার। ডেকরেটিং ব্যবসা, অনেক টাকা আছে, নিজেদের বাড়ি, চাইলেই দিয়ে দেবে তাই না রে?”

 ”চল চল, ভেতরে বসে খাই। তুই খাবি?

 ”না।”

 ”মাথাপিছু তাহলে এক টাকা নয় দু’টাকা কেমন? দশ দিন আর তোকে আমরা কিচ্ছু বলব না। আর শোন, কেউ যদি তোর পেছনে লাগেটাগে তাহলে আমাদের বলে দিবি।”

 ”তুই খুব ভালো ছেলে, কোনো ভয় নেই, আমরা আছি। যা এবার…কালকেই টাকা দিয়ে দিবি মনে থাকবে তো?”

 সবাই দোকানে ঢুকে গেল। ওর চোখ থেকে ভয়ের ছায়া মিলালো না। দোকানের ভিতরে একবার তাকিয়ে ধীরে ধীরে সে বাস স্টপে এসে দাঁড়াল।

 কয়েকটা বাস চলে যাবার পর তাঁর গন্তব্যের বাসটি আসতেই সে হাত তুলল। আরও পাঁচ-ছ’জন বাসে ওঠার জন্য এগিয়ে গেল। ভিড় রয়েছে। ঠেলেঠুলে ভিড়ের মধ্যেই একহাতে সুটকেস অন্যহাতে রড ধরে বাসের উঁচু পাদানিতে সে পা পৌঁছে দিতে পারছিল না। বাস ছেড়ে দিচ্ছে তখন কে একজন তাকে জাপটে সিঁড়িতে তুলে দিয়ে নিজেও উঠে পড়ল। ভিড়ের চাপে প্রায় দমবন্ধ অবস্থায় সে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখার সুযোগ পেল না কে এই উপকারটি করল।

 কিছুক্ষণ পর সিঁড়ির দু-ধাপ উপরে উঠে ভিড়ের মধ্য দিয়ে সে আড়চোখে দেখল বারো ক্লাসের সেই ফুটবলার যাকে স্কুলে সবাই ‘রিভা’ বলে ডাকে, পাদানিতে দাঁড়িয়ে শরীরটা বাইরে হেলিয়ে রাখা ডানহাতে রড ধরা বাঁ হাতে দুটো বই আর খাতা। ভিতরে এসে দাঁড়াবার মতো জায়গা রয়েছে কিন্তু ও ঝুলেই চলেছে। ওর মুখে অদ্ভুত একটা প্রসন্ন বীরত্বের আভা। রিভা এগারো ক্লাসে একবার ফেল করেছে। গতবারের উচ্চচমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেনি। রিভা নামে খুব নামী একজন ফুটবলার আছে ইতালিতে। তারই নামে ওর এই নাম।

 রিভা একবারের জন্যও বাসের ভিতরের দিকে তাকাচ্ছে না। সে অবশ্য চাইল একবার অন্তত তাকাক তাহলে চোখ দিয়ে হেসে কৃতজ্ঞতা জানাবে। লোকেদের চাপে এবং ঠেলায় সে ক্রমশ বাসের ভিতরে ঢুকে যেতে যেতে আবার ভয় পেল। ধরে দাঁড়াবার মতো কিছু একটা সে পাচ্ছে না। সিটের পিঠে বা মাথায় হাত রেখে দাঁড়ানো ছাড়া তার উপায় নেই। কিন্তু নিকটতম সিটের কাছে যাওয়াই এখন দুঃসাধ্য। বাস থামা বা যাত্রা শুরু করলেই পাশের লোকের গায়ে সে হেলে পড়ছে। দুটো পা ফাঁক করে কন্ডাক্টরদের মতো যে দাঁড়াবে তেমন জায়গাও নেই। মেয়েদের সিটের সামনে সে দাঁড়িয়েছিল। একজন নামবার সময় পিঠে চাপ পড়তেই সে হুমড়ি খেয়ে মাঝবয়সি এক মহিলার কোলের উপর পড়ল। তিনি ‘আঃ, বলে উঠেই তাকে ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিলেন। সে করুণমুখে মহিলার দিকে তাকিয়ে বোঝাতে চাইল, আমি নিরুপায়। মহিলা অবশ্যই বুঝলেন এবং মুখ জানালার দিকে ঘুরিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন।

 বাস থেকে নামার সময় রিভা ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। তাতে ও খুব খুশি হল। অনেকেই তাকে দেখে অনেকভাবে। হাসে কিন্তু সে তাতে দুঃখ পায়, লজ্জা পায় এমনকি রেগেও যায়। কিন্তু সে জানে তার দুঃখ, লজ্জা বা রাগ দিয়ে অন্যের কিছুই আসে যায় না। রিভার হাসিটার মধ্যে অন্য কিছু ছিল। সেটা যে কি তার ষোলো বছর বয়স দিয়ে সে বুঝতে পারছে না। বাবা-মা ছাড়া আর কারুর কাছ থেকে এমন স্নেহ-মাখানো যত্ন বা হাসি সে পায়নি।

 বাস থেকে সে যেখানে থামল সেই অঞ্চলটা নতুন। বছর পনেরো আগে কলকাতার এদিকটা আধা-গ্রাম ছিল। ঝোপজঙ্গল-বাগান-ডোবা-টালির ঘর আর মাঝে মাঝে একতলা পাকা বাড়ি। ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট পাকা চওড়া রাস্তা বানিয়ে, মাটি ফেলে জমির উন্নতি করে খণ্ডে খণ্ডে বিক্রি করেছে নিলামে। বাস রাস্তার দু-ধারে বাড়ি উঠে গেছে। রাস্তা থেকে মিনিট পাঁচেক ভিতরে হাঁটলে পুরনো জীর্ণ পাকা বাড়ি, পুকুর, মন্দির, নারকেল বা কাঁঠাল গাছ দেখা যাবে।

 বাস স্টপ থেকে গলিতে ঢুকে লোহার ফটকওয়ালা বাড়িটা এবং লাগোয়া আরও দুটি বাড়ি ছাড়ালেই অসমান, ভাঙা গর্তে-ভরা খোয়ার রাস্তা। ধাঙড়দের একটা বস্তি সেই রাস্তার শুরুতেই। বাঁয়ে এবং ডাইনে আরও দুটি রাস্তা চলে গেছে। সদ্য তৈরি হওয়া বা তৈরি হচ্ছে এমন কয়েকটা বাড়ি সেই রাস্তায়। এছাড়া পড়ে আছে কয়েকটা ফুটবল মাঠ হয়ে যাবার মতো শুকনো আর জলা জমি। ধাঙড়দের পোষা শুয়োর আর গোয়ালাদের মোষ প্রায় সারাক্ষণই এইসব জমিতে ঘুরে বেড়ায়, কখনো-বা রাস্তার উপরেও। এতে সে ভীত বা বিব্রত বোধ করে না।

 তার একমাত্র ভয় ধাঙড় বস্তির কুকুরগুলোকে। সাত-আটটা থাকে ঠিক মোড়টায় যেখান থেকে তার বাড়ির দিকে যাওয়ার রাস্তাটা শুরু হয়েছে। ওর মধ্যে সবথেকে হিংস্র হৃষ্টপুষ্ট কালোটা যার দুই চোখের উপরে বাদামি ছোপ এবং কানদুটো খাড়া। ওরা কাল্লু বলে ডাকে। কাঁধে থলি বা হাতে ব্যাগ নিয়ে কাউকে দেখলেই কাল্লু ঘেউঘেউ করে তেড়ে যায়। কয়েকজনকে কামড়ে হাত-পায়ের মাংস তুলে নিয়েছে। পাড়ার লোকেরা কুকুরদের বিরুদ্ধে থানায় নালিশ করে ফল পায়নি। বস্তির লোকেরা দলবেঁধে পুলিশকে শাসিয়েছে, কুকুরদের গায়ে হাত দিলে ভদ্রবাবুদের এখানে বাস করতে দেবে না।

 সুটকেস হাতে সে থমকে দাঁড়াল। দূর থেকে সে দেখতে পাচ্ছে মোড়ের উপর কাল্লু হাত-পা ছড়িয়ে বসে। আর এগোবে কি এগোবে না ভাবতে ভাবতেই দেখল কাল্লু তার দিকে তাকিয়ে সম্ভবত বোঝার চেষ্টা করছে, লোকটা কে? ভয়ে তার গায়ে কাঁটা দিল।

 একজন সাইকেলে তার পাশ দিয়ে এবং কাল্লুকে অতিক্রম করে সোজা চলে গেল। দুটি স্ত্রীলোক নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে কাল্লুর প্রায় গা ঘেঁষেই হেঁটে এল। দেহটা মুচড়ে মুখ ঘুরিয়ে কোমরের কাছে দাঁত দিয়ে কামড়ে কামড়ে পোকা তোলায় কাল্লু ব্যস্ত। সে ভাবল এই সুযোগ, কুকুরটার এখন অন্যদিকে তাকাবার ফুরসত নেই। তাছাড়া ধুতি-পাঞ্জাবিপরা এক প্রৌঢ় তার পিছনদিক থেকে আসছে, তার সঙ্গে পাশে-পাশে হেঁটে গেলে কাল্লু হয়তো কিছু করবে না।

 সে লোকটিকে ডানদিকে রেখে প্রায় গা ঘেঁষেই হাঁটতে লাগল। দু-তিনবার তার দিকে লোকটি তাকাল এবং হাসল। সে যে ভয় পেয়েছে এটা বুঝে গেছে লোকটি। সারা শরীরের স্নায়ু এবং পেশি টানটান। পা দুটি থরথর করছে, শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ, আড়চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে কাল্লুর কাছাকাছি এসে গেছে।

 ”কুকুরকে ভয় পাও বুঝি?” লোকটি বলল।

 ও মাথাটা অল্প নাড়ল। গলা শুকিয়ে গেছে।

 ”ভয়ের কী, আমি আছি।”

 তখনই কাল্লু মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই তার সঙ্গে চোখাচোখি হল। কুকুরটির চাহনিতে সে সন্দেহপরায়ণ সজাগতা দেখল এবং সঙ্গে সঙ্গে তার সুটকেস ধরা মুঠিটা শক্ত হয়ে গেল, মুখ থেকে অস্ফুটে একটা কাতর শব্দ বেরিয়ে এল।

 দ্রুতপায়ে সে কুকুরটিকে পেরিয়ে যাবার সময় লক্ষ্য করল ওর চোখ তার সুটকেসের উপর এবং শুনতে পেল চাপা একটা গরগরানি। এরপরই সে ছুটতে শুরু করল বাড়ির দিকে।

 পিছনে কয়েকবার ক্রুব্ধ ডাক এবং রাস্তার ইটের উপর নখের আঁচড়ের শব্দ থেকে সে বুঝে গেল কাল্লু তার দিকে ছুটে আসছে। সে ডানদিকে দুটো বাড়ির মাঝখানে ঘাসের সরু পথ দেখে ঢুকে পড়ল এবং কয়েক মিটার যেতে-না-যেতেই প্রায় পায়ের কাছে কাল্লুর মাথা দেখতে পেয়ে কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। একতলায় লোহার গরাদ ঘেরা একটা বারান্দা, সে গরাদে পিঠ লাগিয়ে প্রাণভয়ে বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠল সুটকেসটা মুখের কাছে তুলে ধরে।

 কাল্লু থমকে গেছে। কুঁজো হওয়া ঘাড়ের রোঁয়া ফুলে রয়েছে। উপরের পাটির দাঁতগুলো বেরিয়ে। ওর পিছনে খর্বাকৃতি আরও দুটো কুকুর এসে গেছে। তারা অবিরাম চিৎকার করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে এগিয়েও আসছে।

 ও দুধারে তাকিয়ে দেখল। গরাদে পিঠ ঘষড়ে ডানদিকে এক পা এক পা করে সরে যেতেই কাল্লু তার জুতোর কাছে দাঁত নিয়ে এগিয়ে এল। ‘না না না’। সে ভীত কান্না জড়ানো স্বরে কাতরে উঠে সুটকেসটা পায়ের কাছে নামিয়ে আনল।

 ”চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক, একদম নড়বে না।”

 ঠিক তার পিছনে কে বলে উঠল কথাটা।

 ও পলকের জন্য পিছনে তাকাল। মনে হল একটি মেয়ে।

 গরাদের ফাঁক দিয়ে একটা ক্রাচ বেরিয়ে এল।

 ”এটা হাতে নাও আর সুটকেসটা আমায় দাও।”

 একগাছি সোনার সরু চুড়িপরা হাত পিছন থেকে এগিয়ে এল। সে সুটকেসটা হাতে তুলে ক্রাচটা নিল।

 ”ওটা সামনের দিকে বাড়িয়ে ধর। কুকুরগুলো তাহলে ওটাকে কামড়াতে যাবে। আর তুমি সেই ফাঁকে আস্তে আস্তে ডানদিকে সরে এসো। দরজা খুলে দিচ্ছি, চট করে ঢুকে পড়বে।”

 কথামতো সে কাঠের দণ্ডটি সামনে বাড়িয়ে ধরতেই কাল্লু একহাত পিছু হটেই হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে ক্রাচের ডগাটা কামড়ে ধরল। সে হ্যাঁচকা টানে সেটি ওর দাঁত থেকে ছাড়িয়ে নিয়েই পাগলের মতো ঘোরাতে ঘোরাতে ডানদিকে পিছু হটতে হটতে খোলা দরজা পেয়েই ঢুকে পড়ে পাল্লা বন্ধ করে দিল।

 হাঁফাচ্ছিল সে। শরীর থরথর করে কাঁপছে। কপাল থেকে চিবুক বেয়ে ঘাম টপটপ করে ঝরে পড়ছে। দরজার বন্ধ পাল্লা দু-হাতে চেপে ধরে সে বাইরে কুকুরদের চিৎকার শুনছে।

 ”আর ভয় নেই।”

 ও ঘুরে দাঁড়াল। হাসিমুখে একটি মেয়ে তার থেকে পাঁচ-ছ হাত পিছনে দাঁড়িয়ে। পরনে খয়েরি ও হলুদ প্রিন্টের সালোয়ার আর ছোটো হাতা কামিজ। মাজা রং, ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা চুল, শীর্ণ এবং লম্বা। বাঁ বগলে একটা ক্রাচ। মুখটি ডিম্বাকৃতি, চোখের মণিদুটো ঝকঝকে এবং গাঢ়।

 ক্রাচটা ফিরিয়ে দেবার জন্য এগিয়ে ধরল। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে নিয়ে ডান বগলের নিচে রাখল।

 ”খিলটা লাগিয়ে দাও। কিছুক্ষণ চেঁচাবে তারপর চলে যাবে।”

 খিলটা ধরে ও লাগাবার জন্য তুলে নাগাল পেল না। মুখ ঘুরিয়ে বিপন্নদৃষ্টিতে তাকাল। মেয়েটি দুই ক্রাচে ভর দিয়ে এগিয়ে এসে খিল লাগাল তার পিছুপিছু সে। বারান্দায় কাঠের ছোটো টেবল আর একটা চেয়ার। টেবলে খোলা একটা বই উপুড় করে রাখা।

 ”এখন একটু বসো।” মেয়েটি বারান্দার দিকে এগোল।

 ”এত কুকুর ডাকছে কেন রে মণি?

 পাশের বাড়ির দোতলার এক মাঝবয়সি গৃহিণীর মুখ দেখা গেল।

 বারান্দার গরাদের ধারে সরে এসে মেয়েটি মুখ তুলে বলল, ”তাড়া করেছিল।”

 ”কাকে?”

 ”আমার এক বন্ধুকে।”

 মণি হাসল ওর দিকে তাকিয়ে। বন্ধু শব্দটি ব্যবহার করার জন্য যেন চোখদুটি অনুমোদন চাইছে। ও বাইরে তাকাল। কাল্লু হতাশ হয়ে তার দল নিয়ে চলে যাচ্ছে।

 হঠাৎ ওর মনে হল সে এখন নিরাপদ এবং ধীরে ধীরে একটা হাসি তার মুখে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বরফের মতো ভয়টা ভেঙে গিয়ে শরীরে যেন রোদ ছড়িয়ে যাচ্ছে।

 ”বসো এখন। একটু পরে যেয়ো।” বাধ্য ছেলের মতো ও চেয়ারে বসেই উঠে দাঁড়াল।

 ”না না, তুমি বসো, আমি মোড়া আনছি।” সে আবার বসল।

 বারান্দার লাগোয়া ঘরটায় মেয়েটি ঢুকে গেল পর্দা সরিয়ে। ওর ক্রাচের খটখট শব্দে সে কান পেতে রইল। দু-হাতে যদি ক্রাচটা বগলের নিচে ধরে থাকতে হয় তাহলে মোড়াটা আনবে কী করে! চিন্তাটা তার মাথায় আসামাত্র সে উঠে দরজার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে ভিতরে তাকাল। মাঝারি আকারের ঘর। ছিমছাম, বাহুল্যবর্জিত। জানালাগুলিতে পর্দা, একটা কাচের আলমারি। তাতে বই আর পুতুল। দেয়ালে বড়ো আকারের হাস্যোজ্জ্বল যুবকের একটি ছবি টাঙানো। ছোটো টেবলে দেয়ালে হেলান দেওয়া গেরুয়া কাপড়ের খোলেভরা তানপুরা। মেঝেয় জলচৌকিতে লক্ষ্মীর পট। প্রথম নজরে এগুলিই তার চোখে পড়ল।

 মণি খাটের তলা থেকে নিচু একটা মোড়া বার করে সেটাকে পা দিয়ে ঠেলেঠেলে দরজার দিকে এগোচ্ছিল। ওকে দরজায় দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে হাসল। ও এগিয়ে এসে মোড়াটা তুলে বারান্দায় এনে নিজে তাতে বসল। চেয়ারটা উঁচু, ওর মনে হল এজন্য মণির বসতে সুবিধা হবে।

 ”তোমাকে আমি অনেকদিন স্কুল থেকে ফিরতে দেখেছি…এই চেয়ারটায় বসলে রাস্তার খানিকটা দেখা যায় তো। তোমরা নতুন এখানে তাই না?”

 ”হ্যাঁ, জানুয়ারিতে এসেছি।”

 ”আমরা দু’বছর প্রায়। তোমাদের নিজেদের বাড়ি?” ও মাথা হেলাল।

 ”আমরা ভাড়া। শোবার ঘর আর এই বারান্দাটা এরমধ্যেই আমার ঘোরাফেরা, প্রায় বন্দিই বলতে পারো।”

 ”বাইরে যাও না? যেতে তো পার?”

 ”যাই, ওই রাস্তা পর্যন্ত। আর বেশি গিয়ে কী হবে, এখানে আমার সমবয়সিতো কেউ নেই।”

 মণি হাসল। করুণ বিমর্ষ হাসি। দেখে ও দুঃখবোধ করল।

 ”স্কুলে যাও না?”

 মণি মাথা নাড়ল।

 ”এখানে ধারেকাছে কোনো স্কুল নেই আর বাসে চেপে দূরে কোথাও…”

 টেবলে হেলিয়ে রাখা দুটো ক্রাচের দিকে তাকিয়ে মণি মাথা নাড়ল।

 দুজনে আর কথা বলল না কিছুক্ষণ। ও মেঝের দিকে তাকিয়ে আর মণি গরাদের বাইরে তাকিয়ে।

 ”আমারও বাসে খুব অসুবিধা হয়। ধরে দাঁড়াবার মতো কিছুতো হাতে পাই না।”

 মণির সঙ্গে একটা ব্যাপারে নিজেকে সমান করে কৃতজ্ঞতা জানাতে পেরে ও স্বস্তি পেল।

 ”কুকুরটা মারাত্মক ফেরোসাস, ওকে মেরে ফেলা উচিত। অনেককে কামড়েছে।”

 ”না না, মেরে ফেলা ভালো নয়। জীবজন্তুকে মারতে নেই।”

 মণির স্বরের কোমলতা, ভঙ্গির আন্তরিকতা ওকে অপ্রতিভ করল।

 ”যদি আমাকে কামড়াতো তাহলেও এই কথা বলতে?”

 মণি চুপ করে রইল। তাইতে ও একটু দমে গেল। এমন কিছু বলা ঠিক হবে না যাতে মণি বিব্রত হতে পারে।

 ”তুমি গান করো?”

 মণি ওর মুখের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর হাসি ছড়িয়ে বলল, ”তানপুরাটা আমার নয়, মায়ের। তবে এখন আমিই শিখি। মা রেডিয়োয় গাইত। বাবাও গাইত, রেডিয়ো অফিসে ওদের প্রথম আলাপ।”

 ”কী নাম মায়ের?”

 ”রেবা দত্ত। অবশ্য খুব একটা নামী গাইয়ে ছিল না। বাবা মারা গেছে আট বছর। মাকে একবারের জন্য গুনগুনও করতে শুনিনি এই আট বছর।”

 ”কী গান গাইতেন?”

 ”কীর্তন। আর মাঝেমাঝে গাইতেন রবীন্দ্র-সংগীত।”

 ”আর তুমি?”

 ”মাস্টারমশায়ের কাছে এখন খেয়াল শিখছি।”

 ”পড়াশুনো কর না?”

 ”পড়ি, রাত্রে মা’র কাছে।”

 ”মা কোথায়?”

 ”অফিসে। বাবার অফিসেই চাকরি পেয়েছে। আসতে সন্ধে হয়ে যায়, ট্রেনে যা ভিড়।”

 ”ট্রেন!”

 ”শ্যামনগরে হনুমান জুট মিলের অফিসে মা কাজ করে। ওদের কোয়ার্টার আছে, মা চেষ্টা করছে পাবার জন্য।”

 ওরা আবার কথা খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইল। নির্জন নিস্তব্ধ এই এলাকাটা। কোথা থেকে ঘুঘুর ডাক ভেসে আসছে। একটা শালিক বারান্দার গরাদের ফাঁকে খুব কাছেই উড়ে এসে বসল। দুজনে শালিকটার দিকে তাকিয়ে হাসল।

 ”একটা শালিক দেখতে নেই।”

 ”ধারেকাছে ওর জোড়াটা নিশ্চয় আছে। রোজ আসে এই টেবলে এঁটোকাঁটা খেতে।”

 ”আমি এবার যাব।”

 ”মা ভাববেন?”

 ”হ্যাঁ।”

 ”আর কে কে আছেন?”

 ”বাবা।”

 বলেই সে পাংশু হয়ে গেল। বাবা থাকাটা তার কাছে এই মুহূর্তে অস্বস্তিকর লাগল।

 ”আর কে আছে ভাই, বোন, ঠাকুমা?”

 ”না, আর কেউ নেই। বাবা মা আর সেবক আমাদের চাকর। তোমার কেউ নেই?”

 ”আছে ঠাকুমা, ঠাকুর্দা, কাকারা। ওরা আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি, ওদের অমতে বাবা বিয়ে করেছিল তো।”

 ”আমার জ্যাঠা জয়পুরে থাকেন। কাকা আছে মিলিটারিতে, মেজর।”

 ”বাবা কী করেন?”

 ”ডেকরেটিংয়ের ব্যবসা। সিমলেয় দোকান। জানো, কোথায় সিমলে?”

 মণি মাথা নাড়ল।

 ”আমি কিচ্ছু চিনি না। আগে থাকতাম টালায়। সেখানেও বাড়ি থেকে বেরোতাম না।”

 ”তোমার কী হয়েছে?”

 ”ডান পা-টায় পোলিয়ো, চার বছর বয়স থেকে। একদম সরু কাঠির মতো।”

 ”ডাক্তার দেখাও না?”

 মণি ম্লানভাবে হাসল। ও তীক্ষ্নদৃষ্টিতে মণির মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ”আমাকেও অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছে, ওষুধ, ইঞ্জেকশন অনেক নিয়েছি।”

 ”মা রোজ রাতে আমাকে মালিশ করে দেয়। কিছুই হয়নি, তবু মা হাল ছাড়েনি।”

 ”আমারও কিছু হয়নি।”

 ও উঠে দাঁড়াল। সুটকেসটা মেঝে থেকে তুলল। মণি ক্রাচ দুটো বগলে লাগিয়ে দু’পা গিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, ”ওই দ্যাখো ওই দ্যাখো জোড়াটা।”

 পাশের বাড়ির কার্নিসে পাশাপাশি দুটো শালিক। ও বলল, ”এদুটোই কি রোজ খেতে আসে?”

 মণি নিশ্চিত-ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। দরজার খিল খুলে সে বলল, ”চলো, রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিই।”

 ”কি দরকার?”

 ”কুকুরগুলো যদি কাছাকাছি থাকে?”

 ও মেনে নিল। রাস্তায় এসে দেখল কোথাও কুকুরদের চিহ্নও নেই।

 ”মিনিটখানেক গিয়ে রাস্তাটা ডানদিকে যেখানে বেঁকেছে সেখানে একটা লাইটপোস্ট, তার পাশ দিয়ে সরু একটা ইঁট বাঁধানো রাস্তা, একটু এগোলেই বাঁদিকে আমাদের একতলা বাড়ি। তুমি আসবে?”

 ”আমি একা, কি করে যাব বাড়ি ফেলে রেখে। তুমিই বরং আবার এসো…তোমার নাম এখনও জানা হল না।”

 ”দীপাঞ্জন, ডাকনাম দীপ। তোমার ভালো নাম কী?”

 ”রতনমণি।”

 ”বাঃ, নামটা তো তোমার সুন্দর। কে রেখেছে?”

 ”আমার বাবা।”

 ”এবার আসি, কেমন?”

 দীপ কয়েক পা গিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখল মণি তার দিকে তাকিয়ে। কী ভেবে সে ফিরে এল।

 ”তোমাকে আমি একটা কথা বলব, হাসবে না?”

 ”না।”

 ”ঠিক বলছ?”

 মণি মাথা কাত করল।

 ”তোমার সঙ্গে আমার অনেক মিল রয়েছে।” এই বলেই সে ছুটতে শুরু করল বাড়ির দিকে। ঝাঁকড়া চুল আর চার ফুট উচ্চচতার বামন ছেলেটির চর্বিভরা থপথপে দেহ নিয়ে অদ্ভুত দৌড় দেখতে দেখতে মণির মুখ একটা চাপা আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দীপ কিন্তু একবারও পিছু ফিরে তাকাল না।

 বাড়ির সদর দরজায় কলিং বেলের বোতাম মেঝে থেকে চার ফুট উপরে। দীপের জন্য নানান ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যাতে সে সমস্যায় না পড়ে। বাড়ির সব খিল, ছিটকানি, বিদ্যুতের সুইচবোর্ড, জলের কল, লেটার বক্স দীপ যাতে হাতের লাগালে প্রায় এমনভাবে লাগানো। চৌবাচ্চচার দেয়াল নিচু, খাবার টেবলে তার চেয়ারটি উঁচু এবং তাতে একটি ধাপ আছে পা রেখে উঠে বসার জন্য। দীপের জন্য আলাদা ঘর সেখানেও বাচ্চচাদের মতো ছোট্ট খাট। চেয়ার, টেবল, আলমারি তো বটেই জানলাও নিচু। বস্তুত একতলা এই বাড়ির মধ্যেই যেন আর একটা বাড়ি। বাড়ির সকলেরই উচ্চচতা স্বাভাবিক শুধু একজনের ছাড়া।

 অন্যদিনের তুলনায় আজ স্কুল থেকে ফিরতে দীপের দেরি হয়েছে। ওর মা উৎপলা উদ্বিগ্ন হয়ে সেবককে বাস স্টপে গিয়ে দাঁড়াবার জন্য বলেছিল, ঠিক সেই সময়েই দীপ ফিরল। দৌড়ে আসার জন্য তখনও সে হাঁফাচ্ছে। মুখ লাল।

 উৎপলা ওর মুখ-চোখের অবস্থা দেখে আরও উৎকণ্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করল। পাড়ার লোকের, প্রতিবেশীদের, এমনকি বাড়ির সহ ভাড়াটেদের উত্যক্ত করার, যেটা কখনো কখনো অত্যাচারে পরিণত হত বা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করার জন্যই তারা এখানে বাড়ি করে উঠে এসেছে। অঞ্চলটা ফাঁকা ফাঁকা, এখনো অনেক জমি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। লোকজন বিশেষ করে দীপের বয়সিদের সংখ্যা কম।

 ওকে সবথেকে বেশি জ্বালাতন করে সমবয়সিরাই। দীপ যেন অন্য গ্রহের জীব এইভাবে সবাই তাকায়, ওর পিছু নিয়ে দেহ সম্পর্কে অপমানকর মন্তব্য করতে করতে হাঁটে, কেউ কেউ ঢিলও মেরেছে। বহুদিন দীপ বাড়ি ফিরে কেঁদেছে, স্কুল যেতে চায়নি, অসুখের ভান করে শুয়ে থেকেছে। তিনবার স্কুল বদল করেছে, শুধু এইজন্যই।

 কৃষ্ণচন্দ্র সকাল আটটায় বেরিয়ে দুপুরে খেতে আসে, আবার বিকেলে বেরিয়ে যায় এবং রাত্রে ফেরার কোনো ঠিক নেই। ব্যবসা খুব বড়ো নয় তাই পরিশ্রম প্রচুর। ছেলের সঙ্গে বাবার সারাদিনে অল্পক্ষণই দেখা হয়। দীপ বাড়ি থেকে বেরোতে চায় না, বাড়ির বাইরে গিয়ে খেলতে চায় না। তাই একসময় কৃষ্ণচন্দ্র খেলনা, রেডিয়ো আর ঘরে বসে খেলার জন্য দাবা, ক্যারম প্রভৃতি কিনে দিয়েছে। এছাড়া গল্পের বই আর ম্যাগাজিনে দীপের ঘর ভরা। উৎপলা ছেলেকে নিয়ে ঘরে বসে খেলত। কিন্তু একসময় তাও একঘেয়ে হয়ে যায়। দীপ ছাদে উঠত কিন্তু পাঁচিল তার মাথার উপরে। টুলে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বিকেল কাটাত। নিঃসঙ্গ থাকতে থাকতে সে স্বল্পবাক হয়ে গেছে। অপরিচিতদের দিকে সে সন্ধিগ্ধ চোখে তাকায়।

 দীপ তাদের একমাত্র সন্তান। ওকে সুখে এবং নিরাপদে রাখার জন্য তাদের ব্যাকুলতা ও দুর্ভাবনা অপরিসীম। বহুদিন স্বামী-স্ত্রী কপালে হাত রেখে বিষণ্ণমুখে বসে থেকেছে নির্বাক হয়ে। কেন এমন হল, এই প্রশ্ন একসময় পরস্পরকে করত এখন আর করে না। উৎপলা জাগ্রত দেবদেবীর কথা শুনলেই ছুটে গেছে। হত্যে দিয়েছে মানত করেছে অন্তত কুড়ি-পঁচিশ জায়গায়। কৃষ্ণচন্দ্র চেয়েছিল আর একটি সন্তান হোক। উৎপলা রাজি হয়নি। যদি দীপের মতোই বামন হয়। তার থেকেও মারাত্মক যদি সে স্বাভাবিক আকৃতির হয়? দীপের পক্ষে সেটা মর্মান্তিক হবে। উৎপলা বলেছিল, ”আমার একটিই ভালো। জানি না কী পাপ করেছিলাম যেজন্য ভগবান এমন শাস্তি দিলেন!”

 দীপকে লম্বা করার জন্য চার-পাঁচজন ডাক্তার দেখানো হয়েছিল। কিছুদিন ইঞ্জেকশন, ট্যাবলেট, অর্থব্যয় ছাড়া কোনো ফললাভ হয়নি। ওরা এখন মেনেই নিয়েছে দীপ এরকমই থাকবে। এক ডাক্তার বলেছিলেন, ইউরোপে হিউম্যানগ্রোথ হরমোন ইঞ্জেকশন করে চিকিৎসা শুরু হয়েছে। এই হরমোন সদ্যমৃত মানুষের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে সংগ্রহ করা হয়। টানা দু’বছর চিকিৎসা করতে দরকার পঞ্চাশ থেকে একশোটা পিটুইটারি গ্রন্থি যেগুলো সংগ্রহ করতে হয় মানুষের মস্তিষ্ক থেকে। এই চিকিৎসায় দেখা গেছে বছরে উচ্চচতা বাড়ে দুই থেকে ছয় ইঞ্চি।

 শুনে ওরা একসঙ্গে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠেছিল ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তারবাবুর পরের কথাটিতে ওরা ঢোঁক গিলে চুপ করে বসে থাকে।

 ”এই হরমোন কিনে চিকিৎসা করতে বছরে খরচ পড়ে ছ’লাখ টাকার মতো।”

 ”আজ আমাকে কাল্লু তাড়া করে কামড়ে দিচ্ছিল।” দীপ উত্তেজিতস্বরে বলল বাড়ির মধ্যে ঢুকেই।

 ”কে কাল্লু?” উৎপলা অবাক হয়ে দীপের জুতোর ফিতে খোলা বন্ধ রেখে তাকিয়ে থাকে।

 ”একটা কুকুর, ওই মোড়ে বসে থাকে আর সবাইকে কামড়াতে যায়, বড়োদেরও।”

 ”কী সর্বনাশ! তুই কী করলি?”

 ”একটা মেয়ে আমায় বাঁচিয়ে দিল।”

 উৎপলা প্রশ্ন করে জেনে নিল কিভাবে সে বাঁচাল। এক সময় মন্তব্য করল, ”মেয়েটি খুব ভালো তো!” তারপর বলল, ”কাল থেকে আমি বাস স্টপে থাকব, সঙ্গে করে নিয়ে আসব।”

 রাতে মশারি গুঁজে দিচ্ছিল উৎপলা। তখন দীপ ফিসফিস করে বলল, ”আমার জন্য কালিকাপুরে পুজো দিতে যাবে বলেছিলে, কই গেলে না তো?”

 উৎপলার মনে পড়ল দিন সাতেক আগে এক সকালে ঠিকে ঝি রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলেছিল, কালিকাপুরে শিব ও কালীর জোড়া মন্দির আছে। ওখানে মানত করে, হত্যে দিয়ে অনেকের অনেক মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। উৎপলা বলেছিল তাকে একবার নিয়ে যেতে। দীপ যে কথাগুলো তার ঘর থেকে শুনেছে তা জানত না।

 ”যাব।”

 ”তাহলে মণির জন্যও পুজো দিয়ো। কাল্লুকে মেরে ফেলতে ও বারণ করেছে, মনটা ওর খুব নরম।”

 উৎপলা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল আলো নিবিয়ে দীপ ডাকল।

 ”দশটা টাকা দেবে।”

 ”কেন? ইদানীং প্রায়ই তুই পাঁচ-দশ টাকা নিচ্ছিস।”

 ”এমনি।”

 ”এইটুকু ছেলের এমনি এমনি টাকার দরকার হয়?”

 ”খাওয়াব।”

 ”কাকে?”

 দীপ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ”বন্ধুদের। ওরা আমাকে খুব হেল্প করে।”

 ”আচ্ছা।”

 উৎপলা চলে যাবার পর চিত হয়ে বুকের উপর দুই হাত রেখে দীপ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় যখন ঘুমিয়ে পড়ল দুই চোখের কোল তখন ভিজে।

 পরদিন দীপ বাস থেকে নামতেই উৎপলা তার হাত থেকে সুটকেসটা নিয়ে নিল।

 ”থাক না আমার হাতে।” দীপ অনুযোগ জানাল।

 ”উৎপলা কর্ণপাত না করে ওর কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে শুরু করল। বাড়িগুলো পেরিয়ে কাঁচা রাস্তায় এসেই দীপ সুটকেসটা চেপে ধরল।

 ”আমায় দাও। আমাকে তুমি বাচ্চচা ছেলে ভাব কেন?”

 ওর কণ্ঠস্বরে জেদ আর চাপা রাগ ছিল। উৎপলা তাইতে অবাক হয়ে বলল, ”তুই তো বাচ্চচাই।”

 ”কত বাচ্চচা, সাত, আট, নয়? আমার হাইট তো ওদের থেকেও কম…চার, পাঁচ, ছয়? আমাকে কি অতোটাই বাচ্চচা ভাব? আমার বয়স তো এখন ষোলো, তাই না?

 দীপ দাঁড়িয়ে পড়েছে। এরকম বিশ্রী মেজাজে উৎপলা ওকে আগে দেখেনি। তার মনে হল, নিশ্চয় কিছু একটা আজ হয়েছে। শান্ত গলায় প্রায় অনুনয়ের সুরে সে বলল, ”মায়ের কাছে ছেলে তো চিরকালই বাচ্চচা, এজন্য তুই অমনভাবে বলছিস কেন!”

 কথা না বলে সুটকেস থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে দীপ বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে হাঁটতে শুরু করল উৎপলাকে পিছনে ফেলে। লম্বা পায়ে উৎপলা ওর পাশে পৌঁছে বলল, ”কেউ কিছু বলেছে তোকে?”

 দীপ জবাব দিল না।

 ”বল না, কিছু কি হয়েছে?”

 ”স্কুলে স্পোর্টস হবে, নাম দিতে গেছলুম। নিল না।”

 ”কেন!”

 ”সমরবাবু বললেন বড়োদের সঙ্গে দৌড়ে আমি পারব না। আমি বললুম সবাই তো আমারই বয়সি, বড়ো আবার কে?…উনি বললেন, বয়সে নয় মাথায় বড়ো। ওদের এক পা নাকি আমার তিন পায়ের সমান, আমি হেরে যাবই তাই মিছিমিছি নেমে লাস্ট হয়ে কী লাভ!”

 ”ঠিকই তো বলেছেন উনি।”

 দীপ মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকাল। ক্ষোভ জিজ্ঞাসা বিস্ময় মিলিয়ে অদ্ভুত হয়ে আছে মুখটা। ভিতরের অব্যক্ত এক যন্ত্রণায় গালের পেশি কুঁকড়ে রয়েছে, দুই চোখে অভিযোগ এবং ভর্ৎসনা।

 ”আমি পারব না?”

 ছেলে কি বলতে চায়, ওর মনের মধ্যে কি জ্বলছে সেটা উৎপলা ধরতে পারল না। সান্ত্বনা দেবার মতো ভঙ্গিতে বলল, ”সব জায়গায় সব মানুষ কি পারে?”

 ”তাহলে আমি কোনোদিনই পারব না।”

 দীপ সামনে তাকিয়ে আপনমনে কথাটা বলল কিছুটা হতাশ কিছুটা উদাসস্বরে। কাল্লুকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। দু-তিনটি কুকুর ধাঙড় বস্তির ভিতরে ঘোরাঘুরি করছে। এখানে খোলা আকাশ দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। একটা মুখপোড়া ঘুড়ি টাঙ্কির টানে আকাশে লাফাচ্ছে। দীপের চোখ ঘুড়িতে আটকাল। অনুমান করতে চেষ্টা করল কোন ছাদ থেকে ওটাকে ওড়াচ্ছে।

 ঘুড়ি ওড়াবার শখ তার খুবই কিন্তু উৎপলা এই একটি ব্যাপারে ছেলের প্রতি বাৎসল্য দেখাতে শত কান্নাকাটিতেও রাজি হয়নি। ছোটোবেলায় সে সামনের বাড়ির একটি যুবককে চোখের সামনে চারতলার ন্যাড়া ছাদ থেকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখেছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায় কিন্তু তার আগে শরীরের খিঁচুনি এবং ফাটা মাথার রক্তে মাখামাখি মুখটির দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছিল। এর পর বহু রাতে ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে সে বিছানায় বসে থেকেছে। ঘুড়ির প্রতি তার আতঙ্ক আজও কাটেনি।

 হাঁটার গতি কমিয়ে দীপ ডানদিকে তাকাল। এখন তারা মণিদের গলিটার সামনে। গরাদগুলোর ফাঁক দিয়ে বারান্দার ওপারে কী আছে বোঝা গেল না। একটু ইতস্তত করে সে বলল, ”মা এক মিনিট, আমি আসছি।”

 সে দৌড়ে বারান্দার কাছে গিয়ে দেখল কেউ নেই। আস্তে ডাকল, ”মণি।”

 ঘরের ভিতর থেকে হালকা একটা খটখট শব্দ আসার জন্য সে কান পেতে রইল।

 ঘরের পর্দা সরিয়ে মণি উঁকি দিতেই সে পকেট থেকে কাগজে মোড়া একটা ডেলা বার করে গরাদের ফাঁক দিয়ে বাড়িয়ে ধরল।

 ”কী ওটা?”

 ”দেখই না খুলে।”

 মণি একপায়ে ভর দিয়ে ছোট্ট একটা লাফে বারান্দায় বেরিয়ে এল দেয়াল ধরে। চেয়ারের পিঠ, টেবল তারপর গরাদে পৌঁছে গেল দু-তিনটে লাফে। দীপের হাত থেকে নিয়ে কাগজ খুলেই সে চেঁচিয়ে উঠল, ”ইইইই হজমি! দারুণ, আমার খুব ভালো লাগে।”

 ”কাল তাহলে, আবার।”

 দীপের মুখ ঝলমল করে উঠল। সে এক দৌড়ে অপেক্ষমাণ মায়ের কাছে ফিরে এল।

 ”এই মেয়েটিই?”

 ”হ্যাঁ।”

 সন্ধ্যায় রঞ্জনবাবু পড়াতে আসেন। প্রায় সত্তরবছর বয়সি, ধীর স্বভাবের এই প্রাক্তন স্কুলশিক্ষক যে-মমতায় ও যত্নে দীপকে গ্রহণ করেছেন তাতে কৃষ্ণচন্দ্র ও উৎপলা উভয়েই কৃতজ্ঞ। রঞ্জনবাবু পড়াতে শুরু করার পর থেকে স্কুল-পরীক্ষায় প্রথম চারজনের মধ্যে দীপ গত চার বছর ধরে রয়েছে। সে মেধাবী নয় কিন্তু পরিশ্রমী। এই বৃদ্ধের সে অত্যন্ত অনুগত, ওকে খুশি করার জন্য সে পরীক্ষার ফল ভালো করার দিকে যত্নবান। গৃহশিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে স্নেহ ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক ধীরে ধীরে গড়ে উঠে দুজনকে আত্মিক ঘনিষ্ঠতার স্তরে পৌঁছে দিয়েছে।

 দীপ পড়তে বসেই তার আজকের অভিজ্ঞতার কথাটা বলল।

 ”ওরা মাথায় বড়ো বলে কি ওদের সঙ্গে আমি পারব না?”

 রঞ্জনবাবু হাসিমুখে এতক্ষণ দীপের কথা শুনছিলেন, এবার গম্ভীর হলেন।

 ”তুমি দৌড়তে পার?”

 ”নিশ্চয়ই পারি।”

 ”পড়াশুনোর মতো দৌড়টাও শিখতে হয়, প্র্যাকটিস করে করে উন্নতি ঘটাতে হয়, তুমি কি কখনো তা করেছ?”

 দীপ চুপ করে রইল।

 ”দৌড়তে তো সবাই পারে কিন্তু ওলিম্পিকে কি সবাই প্রথম হয়? যে হয় সে বছরের পর বছর কষ্ট করে ঘাম ঝরিয়ে দৌড় শিখে তবেই প্রথম হয়। স্কুলের মাস্টারমশায় ঠিকই তো বলেছেন।”

 ”উনি আমার হাইটের জন্য বলেছেন। ওরা একপা ফেলে যতটা যাবে আমি নাকি তিন পা ফেলে ততটা যাব।”

 ”ভুল বলেননি।”

 দীপ তাকিয়ে রইল মুখে তার একটা অভিমানী প্রশ্ন-আপনিও! রঞ্জনবাবুর সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। তিনি ওর কাঁধে হাত রাখলেন।

 ”তুমি যে ছোটো মানুষ এটা অস্বীকার করে কোনো লাভ হবে না। এটাকে স্বীকার করো, মেনে নাও।”

 ”আমি মেনে নিয়েছি।”

 ”তোমার চারপাশে সবাই তোমার থেকে লম্বা এবং সেটা এই জগতের সঙ্গে মানানসই।”

 ”আমি বেমানান!”

 ”হ্যাঁ।”

 ”আমি তা জানি।”

 রঞ্জনবাবুর মনে হল বয়সের তুলনায় দীপের অনুভব ও চেতনা কখনো কখনো প্রবীণত্বের স্তরে উঠে আসে। এই কিশোর ছেলেটি জানে সে বামন, সে দৈহিক প্রতিযোগিতায় হেরে যাবে তার পরিবেশের সঙ্গে এবং এই জ্ঞানটুকু সে ইতিমধ্যে ধীরভাবে মেনে নিয়েছে। রঞ্জনবাবু কষ্ট পেলেন দীপের জন্য।

 ”তুমি কি জানো পৃথিবীটা শুধু উপরের দিকেই লম্বা নয় পাশের দিকেও চওড়া।”

 দীপ একদৃষ্টে বৃদ্ধের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তার মনে হচ্ছে কথাগুলোর মধ্যে কিছু একটা গূঢ় অর্থ লুকিয়ে আছে। অবশেষে সে বলল, ”আমি দৌড় প্র্যাকটিস করব।”

 রঞ্জনবাবু এমন কোনো কথা আর বললেন না, যাতে দীপ নিরুৎসাহিত হয়।

 ”নিশ্চয় করবে। আমি তো বলব ভাবছিলাম তোমার ওজন কমানো দরকার, তুমি দৌড় শেখো।”

 পরদিন স্কুলে টিফিনের সময় দোতলার বারান্দা থেকে রিভাকে উঠোনে দেখতে পেয়ে দীপ নেমে এল। দুটি ছেলের সঙ্গে রিভা কথা বলছে। নিশ্চয় কোনো হাসির ব্যাপার, কেননা তিনজনেই হাসছে।

 দীপ একটু দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় রইল, রিভাকে একা পাওয়ার জন্য। সেই সময় পিছন থেকে বিকৃতস্বরে চেঁচিয়ে ‘এই যে আমার ছোটবাবু’ বলে রবি তাকে জড়িয়ে ধরল।

 আশপাশে প্রচুর ছেলে, তারা মুখ ফিরিয়ে তাকাল। হাসল।

 ”খিদে পেয়েছে, খাওয়া।”

 ”পয়সা নেই।”

 ”রোজই বলিস পয়সা নেই, দেখি তো।” রবি ওর প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছু খুচরো বার করে আনল। গুনে দেখে হাসল।

 ”হয়ে যাবে।”

 ”এগুলো আমার বাস ভাড়ার পয়সা।”

 ”এইটুকু তো রাস্তা, বাসে না গিয়ে আজ হেঁটে যাবি। মাঝে মাঝে হাঁটবি চর্বি ঝরে যাবে।”

 রবি দু-হাতে ওর বুকের চর্বি খামচে ধরে মুখে অশ্লীল শব্দ করল। অনেকে হেসে উঠল। ওকে ছেড়ে দিয়ে স্কুলগেটের দিকে এগিয়ে গেল। টিফিনের সময় ছাত্রদের বাইরে যাওয়া নিষেধ যদি না টিফিন পাস থাকে। কিন্তু রবি যেকোনো সময়ই বাইরে যায় দারোয়ান কিছু বলে না।

 দীপের চোখে জল এসে গেছে। হেঁটে বাড়ি ফেরার কথা ভেবে নয়। এত ছেলের সামনে এইভাবে হতমান হওয়ার লজ্জা লুকোতে সে ধীরে ধীরে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল।

 একটু পরে লক্ষ্য করল রিভা একা দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে শাঁখালুর খোসা ছাড়াচ্ছে। গুটিগুটি দীপ এগোলো।

 ”সেদিন আমায় হাত দিয়ে টেনে বাসে তুলে না নিলে আমি পড়ে যেতুম।”

 রিভা শাঁখালুতে কামড় দিয়ে এক চাকলা মুখে ভরে চিবোতে লাগল। দীপের কথার জবাব দিল না।

 ”তুমি ভালো ফুটবল খেল শুনেছি সেইজন্য কি তোমাকে রিভা বলে ডাকে? তোমার নিজের নাম কী?”

 ”প্রশান্ত। তোমাকে যে ছোটবাবু বলে ডাকল আসল নাম কী?”

 ”দীপাঞ্জন। আমি তোমাকে কিন্তু রিভাই ডাকব।”

 ”ডেকো। কিন্তু তোমাকে ছোটবাবু বলল কেন, চেনা?”

 ”আমাকে দেখে কি বুঝতে পারছ না?” একটু থেমে দীপ ফিকে হেসে আবার বলল, ”আমাকে দৌড়নো শিখিয়ে দেবে?”

 প্রশান্তর মুখে কৌতূহল ফুটে উঠল। চিবোন বন্ধ করে বলল, ”মানে। দৌড়ে কি করবে?”

 ”দেখব আমার থেকে অন্যরা কতটা এগিয়ে থাকে।”

 ”হুমম। শুধু দেখার জন্যই।”

 ”হ্যাঁ, আমাকে দিয়ে আর কি হবে?”

 ”ছুটির পর এই সামনের চিলড্রেনস পার্কে এসো।”

 চেনা কাউকে দেখতে পেয়ে প্রশান্ত হাত তুলে চেঁচিয়ে এগিয়ে গেল স্কুলবাড়ির মধ্যে। দীপও নিজের ক্লাসে এসে অঙ্কের খাতাটা খুলে মাথা ঝুঁকিয়ে দিল। তার মাথায় এখন চিন্তা, হেঁটে বাড়ি ফিরতে দেরি হবে। মা বাস স্টপে দাঁড়িয়ে থাকবে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে।

 ওরা পার্কে এল একসঙ্গে। প্রশান্ত ছুটির পর অপেক্ষা করেছিল স্কুলের ফটকে। দীপ অন্য দিনের মতো আজও দেরি করে বেরিয়েছে।

 ”আমি ইচ্ছে করেই দেরি করি। ছুটির ঘণ্টা পড়লেই ছেলেদের মন-মেজাজ কেমন বদলে যায়, এটা কি তুমি লক্ষ্য করেছ?”

 প্রশান্ত অবাকচোখে ওর দিকে তাকাল। তার মনে হল, এই বামনটি একটু বেশিই যেন মাথা খাটায় বয়সের অনুপাতে।

 ”সারা দুপুর স্কুলে যা একঘেয়ে লাগে। ছুটি হওয়া মানে যেন জেলখানা থেকে বেরোনো। তখন পেছনে লাগতে ওদের ভালো লাগে!”

 ”তোমার পেছনে লাগে দেখেছি।”

 প্রশান্তর পাশাপাশি হাঁটার চেষ্টা করে দীপ প্রায় দৌড়চ্ছেই। প্রশান্ত হাঁটার গতি কমাল।

 ”ওদের খুব খিদে পায়, আমি বুঝতে পারি।” দীপ নরম স্বরে বলল। রবি বা তার সঙ্গীদের সম্পর্কে কোনো উষ্মা সে প্রকাশ করল না। দু-ধার দেখে প্রশান্তর সঙ্গে রাস্তা পার হয়ে সে আবার বলল, ”আমি ওদের সঙ্গে ভাব করতে চাই…সকলের সঙ্গেই চাই। সেটাই উচিত, তাই নয়?”

 প্রশান্ত জবাব দিল না। পার্কটা ছোটো। তিনদিকে বাড়ি দিয়ে ঘেরা। পার্কের ভিতরে কংক্রিটের রাস্তার পাড়। মুখোমুখি চারটি সিমেন্টের বেঞ্চের উপরে পাকা ছাদ। রেলিংয়ের অনেকখানি অংশ অন্তর্হিত।

 পার্কটি এমনিতেই নিরিবিলি। বিকেল সবে শুরু হয়েছে তাই লোক এখন যৎসামান্য। তবে ফেরিওয়ালারা এসে গেছে। ছ’সাত বছরের কয়েকটি ছেলে চোর-পুলিশ খেলায় ব্যস্ত বেঞ্চগুলিকে ঘিরে। দীপের দিকে নজর পড়তেই ওরা থমকে তাকাল। নিজেদের মধ্যে চাপাস্বরে বলাবলি করল।

 ”আমি দৌড়চ্ছি, বডিটা কেমন কোমর থেকে সোজা রাখছি হাঁটু কতটা ভাঙছি, পায়ের পাতা কীভাবে পড়ছে, হাত দুটো কীভাবে রাখছি, মাথাটা কেমনভাবে রয়েছে, সব আগে লক্ষ্য করো, কেমন।”

 পার্কটাকে তিন চক্কর দৌড়ে প্রশান্ত একাকী দৌড়তে বলল দীপকে। সুটকেসটা প্রশান্তর জিম্মায় রেখে জুতো খুলে সে যখন একা দৌড়তে আরম্ভ করল, বাচ্চচা ছেলেগুলি খেলা বন্ধ রেখে ওর দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করল।

 এক চক্কর দিয়ে দীপ থেমে গেল।

 ”তোমার মতো হচ্ছে না জানি তবে প্র্যাকটিস করতে করতে হয়ে যাবে …কিছুটা হবে, তাই নয়।”

 ”কিন্তু আমি আর থাকতে পারব না, এবার যাব।”

 ”আর একবার।”

 দীপ আবার দৌড় শুরু করল। এবার তার সঙ্গে বাচ্চচারাও নেমে পড়ল। তারা ওর প্রায় গা ঘেঁষে দৌড়চ্ছে আর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। দীপও হাসতে শুরু করল। সে মুখ ভ্যাংচাল, বাচ্চচারা জোরে হেসে উঠল। সে মজা পেল।

 একটা সুখবোধ তার সারা অঙ্গে প্রবাহিত হয়ে তাকে ক্রমশ গ্রাস করছে। সে অন্যদের মজা দিয়ে আনন্দ দিতে পারে, এটা সে আবিষ্কার করছে।

 দীপ মাঝপথে দাঁড়িয়ে গেল। লেফট-রাইট করার ভঙ্গিতে সে পা ওঠানামা করতে লাগল। ওরাও তাকে নকল করল। সে জোরে হেসে উঠতেই ওরাও হাততালি দিয়ে উঠল। আবার সে দৌড় শুরু করল।

 ”ওরে ওরে দ্যাখ একটা বামন কেমন দৌড়চ্ছে।”

 প্রশান্ত মুখ তুলে দেখল বারান্দায় একটি বউ দুহাতে একটি শিশুকে তুলে ধরে দেখাচ্ছে। আর একটি কমবয়সি বউ ছুটে বেরিয়ে এল ভিতর থেকে। প্রশান্তর চোয়ালদুটি শক্ত হয়ে উঠল। সে চিৎকার করল, ”দীপ, দীপ…থাম আর দৌড়তে হবে না।”

 সুটকেসটা তুলে নিয়ে প্রশান্ত পার্কের ভাঙা রেলিংয়ের ফাঁক গলে রাস্তায় এসে হাঁটতে থাকল।

 ”রিভা দাঁড়াও, রিভা…”

 হাঁফাতে হাঁফাতে দীপ ছুটে তার পাশে এল।

 ”একটু আস্তে হাঁটো…বারণ করলে কেন ছুটতে?”

 ”মজা দেখছিল বারান্দা থেকে।”

 ”দেখুক না, তাতে কি হয়েছে!”

 ”তোমার অপমান লাগে না?”

 প্রশান্ত সুটকেসটা ওর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে পাশের রাস্তায় ঢুকল লম্বা পায়ে দীপকে পিছনে ফেলে।

 ”রিভা।”

 দীপের ডাকটা আর্তনাদের মতো প্রশান্তর কানে ঠেকল। সে দাঁড়াল।

 ”না, আমার আর অপমান লাগে না, দুঃখও লাগে না। আমার এই শরীর আমিতো বানাইনি। ভগবান করে দিয়েছেন। অপমান যদি কারুর হয়তো তাঁরই হবে। আমি যেটা পারি…”

 ”কী পার?”

 ”মজা দিতে। ছোটবাবু হয়ে আনন্দ দিতে। আমি তাই করব, সারা জীবন।”

 দীপ থরথর কাঁপছে একঝোঁকে কথাগুলো বলে। মুখটা লাল, গোল চোখদুটি আরও বড়ো হয়ে উঠেছে। টসটস ঘাম ঝরছে চিবুক থেকে।

 ”আমার এক দাদা ছিল তোমার মতো। চার ফুট চার ইঞ্চি। তোমার মতো ষোলো-সতেরো বয়সে বেলগাছিয়া রেলের লাইনে গলা দিয়ে আত্মহত্যা করে।”

 প্রশান্তর মুখ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠল কথাগুলো বলতে বলতে। দীপের চোখে বিষণ্ণতা নেমে এল।

 ”তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি দীপ।”

 দীপ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে। এক চিলতে হাসি তার পাতলা গোলাপি ঠোঁটদুটিতে হালকাভাবে লেগে রয়েছে।

 ”আমার ওরকম কিছু হবে না।”

 ”ভালো।”

 প্রশান্ত হনহনিয়ে চলে গেল। ওর দীর্ঘ সুঠাম দেহ-কাঠামোর দিকে যতক্ষণ পারল দীপ তাকিয়ে রইল। তারপর হাঁটতে শুরু করল বাড়ির দিকে, দীর্ঘ পথ।

 উৎপলা বাস স্টপে অপেক্ষা করে করে বাড়ি ফিরে আসার প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর দীপ ফিরল।

 ”এত দেরি হল?”

 ”পকেটে যা ছিল পুওর ফান্ডের বাক্সে ফেলে দিয়েছি। খেয়ালই ছিল না যে সঙ্গে আর পয়সা নেই। বাসে ওঠার আগে পকেটে হাত দিয়েই চক্ষু চড়কগাছ …হেঁটে এলুম।”

 ”আর আমি এদিকে ভেবে ভেবে…”

 ”এত ভাববার কি আছে, আমি তো বড়ো হচ্ছি। চিরকালই কি পুতুপুতু করে আমাকে আগলাবে?”

 উৎপলা বিপর্যস্ত চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ”কী করে তুই বড়ো হবি! বয়স বাড়লেই কি বড়ো হয়?”

 দীপ কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেল। অসম্ভব ক্লান্ত সে। খাটে গা এলিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।

 ঘুম আপনা থেকেই ভেঙে যায়। ঘরে আলো জ্বলছে, জানলার বাইরে অন্ধকার। মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই দেখল রঞ্জনবাবু চেয়ারে বসে বই পড়ছেন।

 ধড়মড়িয়ে উঠে বসে লজ্জিতস্বরে বলল, ”ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।”

 রঞ্জনবাবু শুধু হাসলেন। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে দীপ বলল, ”এবার থেকে ভোরে আমি দৌড়ব।”

 ”চোখে জল দিয়ে এসো আর খেয়ে নাও, স্কুল থেকে ফিরে না খেয়েই তো ঘুমোচ্ছ।”

 পরদিন ভোরে হাফ প্যান্ট, গেঞ্জি আর কেডস পরে দীপ যখন বেরোল তখন পুব আকাশ ছাই রঙ থেকে ফিরে হলুদে রূপান্তরিত হচ্ছে। সে ধীরে ধীরে ছুটতে থাকল যেদিকে কাঁচা রাস্তাটা ঘন গাছপালার ফাঁকে মাটির ঘর, ঝিরঝিরে বাতাস আর মাটির গন্ধের লোভ দেখিয়ে ক্রমশ মাঠ পেরিয়ে গ্রামের দিকে চলে গেছে। প্রশান্তকে যেমন দেখেছে চেষ্টা করল সেইভাবে দৌড়তে। লোক চলাচল শুরু হয়েছে। হাঁসের দল পুকুরে নেমে গেছে, মোরগের ডাক তখনও অব্যাহত, বাসনহাতে বউয়েরা পুকুরঘাট থেকে ফিরছে, ভ্যানরিকশায় আনাজের ঝুড়ির উপর বসা চাষি, সবাই তারা অবাক হয়ে তাকাল দীপের দিকে।

 দম ফুরিয়ে হাঁফিয়ে পড়তেই সে দৌড় বন্ধ করে যখন হেঁটে ফিরে আসছে তখন মধুর এক বিস্ময়ের সামনে পড়ে গেল।

 মণি দুই ক্রুচে ভর দিয়ে একটা পুকুরের ধারে পাঠশালার চালাঘরের পাশ থেকে আচমকা বেরিয়ে এল।

 দুজনের কেউই কথা বলতে পারল না বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে না ওঠা পর্যন্ত।

 ”তুমিও ভোরে বেরোও? মণির মুখ ঝলমল করে উঠল।

 ”আজই প্রথম। কিন্তু তুমিতো বলোনি?”

 ”এই ভোরে বেড়ানোর কথা? বলব কী করে, তুমিতো আর আসোইনি।”

 ”যাব কী করে সময় কোথায়?”

 ”খুব কাজের লোক।”

 মণির বলার ভঙ্গিটা দীপের ভালো লাগল। ঈষৎ অভিমান চেপে রাখতে পারেনি। ওরা দুজন বাড়ির দিকে চলতে লাগল।

 ”আমার রোজ একটু নড়াচড়া দরকার, সারাদিনই তো বাড়িতে বন্দি। মা এখন ঘরে রয়েছে তাই বেরিয়েছি। ডাক্তারও বলেছেন।

 ”আমারও রোজ দৌড়নো দরকার। যা মোটকা আমি, এজন্য আরও বেঁটে দেখায়। বড্ড চর্বি, এবার থেকে ব্যায়ামও করব।”

 তার জন্য দীপকে মন্থরগতিতে হাঁটতে হচ্ছে লক্ষ্য করে মণি চলার গতি বাড়াতেই দীপ হাত দিয়ে ওর ক্রাচ চেপে ধরল।

 ”তাড়া নেই। জোরে চললে তোমার বগলে লাগবে।”

 ”একটুও লাগবে না। আমার অভ্যেস হয়ে গেছে, দেখবে?”

 মণি জোরে চলার জন্য ক্রাচ দুটো লম্বা পা ফেলার মতো দূরে ফেলে দ্রুত এগিয়ে গেল। দীপ অবাকচোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে দৌড়ে ওর পাশে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে লাগল। এরপর ইচ্ছে করেই সে মণিকে ছাড়িয়ে গজ দশেক এগিয়ে গেল।

 উপরের ঠোঁট দাঁত চেপে ধরা, চোখে তীব্রতা, ক্রাচদুটো বড়ো করে সামনে বাড়িয়ে শরীরটা দোলাতে দোলাতে মণি তাকে ধরার জন্য এগিয়ে আসছে। দীপ আবার কিছুটা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে পিছনে তাকাল।

 মণির চোখে জেদ। সে আরও বেশি দূরত্বে ক্রাচ বাড়িয়ে দ্রুত আসার চেষ্টা করতেই ডান ক্রাচটা হড়কে গেল একটা আলগা ইঁটের উপর পড়ে। মুখ থুবড়ে মণি পড়ে যেতেই, চাপা একটা চিৎকার করে দীপ ছুটে এল।

 উবুড় হয়ে ডান হাতটা সামনে ছড়ানো, বাঁ হাতের ক্রাচটা শক্ত মুঠিতে ধরা। মুখ রাস্তায় ঘষড়ে গেছে। দীপ ওর বগলের নিচে দু হাত রেখে টেনে তুলে বসাল। দৌড়ে গিয়ে ক্রাচটা কুড়িয়ে আনল।

 মণির নাক কপাল আর কানের পাশে ছড়ে গেছে। কিন্তু ও হাসছে অপ্রতিভের মতো। দুজন স্ত্রীলোক, সম্ভবত মজুর, ওদের পিছনেই আসছিল। তারা দাঁড়িয়ে পড়তেই মণি তাড়াতাড়ি বলল, ”আমার কিছু হয়নি।”

 সে ক্রাচ ধরে উঠে দাঁড়াল। স্ত্রীলোক দুজনের একজন চলে যেতে যেতে মন্তব্য করল: ”রাস্তার যা মরণদশা।”

 ”রুমাল আছে? তোমার মুখে ধুলো লেগে রয়েছে।”

 মাথা নেড়ে মণি মুখটা তার কাঁধে ঘষতে লাগল।

 ”উহুঁ দাঁড়াও, মুখটা নামাও তো।”

 মণি গলা নিচু করে মুখ ঝুঁকিয়ে দিল। তার হাঁটুঝুল কামিজটা তুলে সন্তর্পণে ধুলো মুছিয়ে দিতে দিতে দীপ চোখবন্ধ করা মুখের প্রতিটি অংশ অবাক হয়ে দেখল। মা ছাড়া আর কোনো মেয়েকে সে আগে কখনো এত কাছের থেকে দেখেনি। মণির ত্বক, রোমকূপ, চোখের পাতা, ঠোঁটের চামড়ার কুঞ্চন, নাকের নিচে ঈষৎ ঘন রোম এবং চিবুকের তলায় ছোট্ট তিল দীপকে নতুন ধরনের অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করল। নিজের অজান্তেই সে মণির বুকের দিকে তাকাল এবং আড়ষ্ট হয়ে এক পা পিছিয়ে গেল।

 ”হয়েছে? কিছু বোঝা যাবে নাতো?”

 ”মা কিছু বলবে?”

 ”যদি আর না বেরোতে দেয়!”

 ”মাকে ভয় কর?”

 ”কেন তুমি কর না?”

 ”না। তোমার পায়েটায়ে লাগেনি তো?”

 মণি তার পঙ্গু পায়ের দিকে একবার তাকাল।

 ”হাঁটুর কাছটায়…ও কিছু না, চলো, মাকে সাতটায় বেরোতে হয়।”

 আবার ওরা চলতে শুরু করল। রোদ লেগেছে গাছের মাথায়। ওদের ছায়া পড়েছে রাস্তায়। দীপ মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে মণির মুখের দিকে। চামড়া ছড়ে গিয়ে লালচে আভা ফুটেছে আঘাতের জায়গায়।

 ”তোমার বাড়িতে ওষুধ আছে, মলম?”

 ”আছে।”

 ”গিয়েই লাগিয়ে দিয়ো।”

 মণিদের বাড়ির বারান্দার কাছে দীপ থেমে গেল।

 ”আর যাব না।”

 ”কেন, এসো না।” মণি আন্তরিকভাবে বলল।

 ”মা’র সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব, অবশ্য মা এখন ব্যস্ত থাকে। অন্তত চা খেয়ে যাও।”

 ”চা খাই না।” দীপের অস্বস্তি হচ্ছে। মণির মুখের দিকে তাকালে যে কেউ-ই বুঝে যাবে ও রাস্তায় পড়ে গেছল। মা নিশ্চয় ওকে বকবেন। তখন সামনে থাকলে বিশ্রী লাগবে।

 বারান্দায় বেরিয়ে এলেন এক মহিলা। দীপ সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।

 স্কুল যাবার সময় দীপ রাস্তা থেকে যথাসাধ্য দেখবার চেষ্টা করল বারান্দাটা। কিছু বুঝতে না পেরে এগিয়ে এসে গরাদের ফাঁক দিয়ে তাকাল।

 ”মণি।” প্রায় ফিসফিসিয়ে সে ডাকল।

 ”আসছি।” ঘরের ভিতর থেকে সাড়া এল।

 মণি বেরিয়ে আসতেই সে উৎকণ্ঠিত হয়ে ওর মুখের দিকে তাকাল। আঘাতের জায়গাগুলোয় কিছু একটা লাগানো হয়েছে। তেলতেলা দেখাচ্ছে। চামড়া লাল হয়ে উঠেছে।

 ”মা কিছু বলেছেন?”

 ”বলবে না আবার! এবার একা বেরোন একদম বন্ধ।”

 দীপের বুকটা ভারী হয়ে গেল। সে বিষণ্ণমনে মাটির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল।

 ”তোমার তো কোনো দোষ নেই, আমিই তো ব্যাপারটা করলাম।”

 দীপ ম্লান হেসে বলল, ”এখন কী করছ?”

 ”মা অঙ্ক দিয়ে গেছে। এত শক্ত লাগছে…একটাও বুঝতে পারছি না।

 দীপের মুখ উৎসাহে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ”অঙ্ক! কী অঙ্ক? কই দেখাও তো।”

 ”ঐকিক নিয়মের।”

 ”এ তো খুব সোজা অঙ্ক। আচ্ছা তোমায় বুঝিয়ে দিচ্ছি।”

 দীপ সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে দিয়ে মণি প্রথমেই বলল, ”তোমার স্কুল আছে না?”

 ”রোজই তো যাই। আজ যাব না। একদিন না গেলে কিছু হবে না।”

 ”না।”

 মণির স্বরে এমন একটা দৃঢ়তা রয়েছে যা দীপকে কুঁকড়ে দিল। একা একটা মেয়ে সারা দুপুর একটা ছেলের সঙ্গে বাড়িতে থাকতে আপত্তি করতেই পারে। হঠাৎ তার মনে হল সে বড়ো হয়ে গেছে, পুরো একটা পুরুষ মানুষ। বামনদেহটা খোলসের মতো খসে পড়েছে তার পায়ের কাছে। মণি তাকে লম্বা করে দিল শুধু একটি শব্দে। দেহের সীমা ছাড়িয়ে সে এখন একটা এলাকায় পৌঁছে যাচ্ছে সেখানে উচ্চচতায় সে আর সকলের মতোই।

 ”আমি স্কুলে যাচ্ছি এখন, ফেরার সময় বুঝিয়ে দেব।”

 দীপ সপ্রতিভ ভঙ্গিতে ঘুরে পিছনে না তাকিয়ে হেঁটে চলে গেল। বাসে যাবার সময় তার মনে হল, মণি কি তাকে নোংরা চরিত্রের ভেবেছে নয়তো ‘না’ বলল কেন? আবার সে ভাবল, মণির কি তাকে ভালো লেগেছে? কিন্তু ওর ব্যবহার আজও তো প্রথম দিনের মতোই! ‘না’ বলার সময় ওর মুখটা কী কঠিন হয়ে গেছল? মণি কি খুশি হবে স্কুল থেকে ফেরার সময় ওর কাছে গেলে? যদি না যাই? মণি কি জানে ওকে আমার খুব ভালো লাগে, ওর সঙ্গে কথা বলতে, ওর সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করে? যদি জানে তাহলে কি অন্যরকম ভাববে?

 দীপ আপনমনেই বারকয়েক উচ্চচারণ করল র-ত-ন-ম-ণি।

 ফেরার সময় দীপ বাস থেকে নেমে দেখল মা দাঁড়িয়ে। উৎপলা হাত বাড়াল সুটকেসটা নিতে দীপ দিল না। কিছুটা এগোতেই দেখল রাস্তায় একটা জটলা। সবার মুখই উত্তেজিত। কৌতূহলে সে একজনের কাছে ব্যাপারটা জানতে চাইল।

 ”দুপুরে কুকুরে কামড়েছিল ওই ওদিকের পাড়ার একজনকে। তারপর দলবল এসে পাইপগান দিয়ে গুলি করে কুকুরটাকে মেরে ধাঙড়দের শাসিয়ে গেছে।”

 ”কোন কুকুরটা, খুব বড়ো কালো রঙের, চোখের ওপরটা বাদামি?”

 ”কে জানে কী রঙের?”

 লোকটা কথা বলায় আর ঔৎসুক্য দেখাল না। একটি বাচ্চচাছেলে, যাকে সে অনেকবার দেখেছে যাতায়াতের পথে, দীপ তাকেই জিজ্ঞেস করল, ”কোন কুকুরটা?”

 ”সেই কাল্লু, যেটা সবাইকে তাড়া করত।”

 দীপ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ”যাক আর তোমায় বাস স্টপে আসতে হবে না।” এবং কিছু পরে হাঁটতে হাঁটতে আপনমনে বলল, ”জীবনজন্তুকে মারতে নেই।”

 মণিদের বাড়ির কাছ দিয়ে যাবার সময় ওর কানে এল গলা সাধার শব্দ। বোধহয় আজ মাস্টারমশায় এসেছে। দীপ ঠিক করল কয়েক দিন সে মণির সঙ্গে দেখা করবে না।

 স্কুলের স্পোর্টসে দীপ অদ্ভুত এক দৃশ্যের অবতারণা করল। শেষ অনুষ্ঠান ‘যে যেমন সাজো’। বেদে, ঝাড়ুদার, পাগল, মুটে, মুড়িওয়ালা, বৈষ্ণব, ভিখারি ইত্যাদি সাজা ছাড়াও একজন অজ্ঞান হয়ে পড়তেই ছুটে এল এক ডাক্তারবাবু। চার চাকার এক ঠেলা ধীরে ধীরে আনা হল তার উপর নিথর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর বিখ্যাত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ডান হাতটা আকাশমুখী তোলা।

 একটা মেলার মতো ব্যাপার। বেদে তার ঝাঁকা থেকে হাঁড়িকুড়ি বার করে কাঠ জ্বেলে রান্না চড়াল। সঙ্গে দড়িতে বাঁধা একটা কুকুর আর ছাগল। বৈষ্ণব করতাল বাজিয়ে গান গেয়ে ঘুরছে। মুড়িওয়ালা ঠোঙায় ঝালমুড়ি নিয়ে শিক্ষকদের কাছে বিক্রি করছে। মুটে ঝাঁকাহাতে ঠিকানা লেখা কাগজ নিয়ে জনে জনে জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছে। পাগলের পাগলামি, ভিখারির ভিক্ষা চাওয়া ইত্যাদিতে গণ্যমান্যদের বসার সামিয়ানার সামনেটা যখন সরগরম তখন হঠাৎ ভিড়ের পিছন থেকে আর্তনাদের মতো চিৎকার শোনা গেল, ‘ওমা, কোথায় তুমি…ওমা কোথায় তুমি!’

 হঠাৎ কোলাহল বন্ধ হয়ে গেল। উৎসুক হয়ে সবাই খুঁজতে লাগল এমন আর্তস্বরের মালিককে।

 ‘ওই তো, ওই তো।’ কে একজন আঙুল দিয়ে দেখাল। দর্শকদের ভিড়ের মধ্য দিয়ে একটি ছোটোছেলে বেরিয়ে আসছে। তার পরনে বাচ্চচাদের নেকার-বোকার। একটা ডলপুতুল বুকের কাছে আঁকড়ে ধরা, চোখে কাজল, কপালে কাজলের টিপ, সিঁথি কাটা চুল পাট করে আঁচড়ানো, হাতে লোহার বালা, লাল মোজা, লাল জুতো।

 ”ওমা কোথায় গেলে?” কান্নাজড়ানো গলায় ছোটো ছেলেটি ডুকরে উঠল। সে হারিয়ে গেছে। জনে জনে সে জিজ্ঞাসা করছে, ”আমার মাকে দেখছ? আমাকে পুতুল কিনে দিয়ে, দাঁড়াতে বলে কোথায় যে চলে গেল।”

 হাসি চেপে সবাই মাথা নাড়ছে। ছেলেটি হেডমাস্টারমশায়কে, অনুষ্ঠানের সভাপতিকেও প্রশ্ন করল। ওরা মাথা নেড়ে নিজেদের মধ্যে কীসব বলাবলি করলেন।

 অবশেষে বালকটি তার পুতুলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মাটিতে বসে দুই ঊরুর মধ্যে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল।

 হাততালি আর সহর্ষ চিৎকারে জায়গাটা ফেটে পড়ল। পাথর হয়ে থাকা শ্রীরামকৃষ্ণ পর্যন্ত সন্তর্পণে একবার মুখ ঘুরিয়ে বিমর্ষ দৃষ্টিতে ব্যাপারটা দেখে নিল। হারিয়ে-যাওয়া বালককে সান্ত্বনা দিতে মুড়িওয়ালা এক-ঠোঙা মুড়ি উপহার দিল। হঠাৎ কয়েকটি ছেলে রবির নেতৃত্বে ছুটে গিয়ে বালককে কাঁধে তুলে নিল।

 ”ছোটবাবু…ছোটবাবু।”

 দীপের দুটি চোখ উত্তেজনায় ও আনন্দে জ্বলজ্বল করছে। এখন সে সবার মাথা ছাড়িয়ে, সবার থেকে লম্বা।

 ”খাওয়াবি তো আজ?”

 ”খাওয়াব।”

 বাড়ি ফেরার সময় দীপ ইতস্তত করে পায়ে পায়ে মণিদের বারান্দার কাছে গেল। কাউকে দেখতে পেল না। রঙিন কাগজে-মোড়া লাল ফিতেয় বাঁধা প্রথম পুরস্কারের স্টিলের বড়ো রেকাবিটা গরাদের ফাঁক দিয়ে সে মেঝেয় নামিয়ে দিল। সামান্য একটু শব্দ হয়েছিল। ঘরের ভিতর থেকে মণির গলা শোনা গেল, ”কে”?

 দীপ ছুটে পালিয়ে গেল। সে জানত না মণির মা হঠাৎ-ই শ্যামনগরে কোয়ার্টার পেয়ে তিনদিনের মধ্যেই মণিকে নিয়ে চলে যাবে।

দুই

দীপাঞ্জন রায় যখন বি.এ. পড়তে কলেজে এল প্রথম দিনেই আলাপ হল দেবুর সঙ্গে।

 বারান্দায় নোটিশ বোর্ডে টাঙান রুটিনে দেওয়া ছিল কোন ক্লাস কত নম্বর ঘরে, কটার সময়। ভিড় আর ঠেলাঠেলিতে দীপ বোর্ডের কাছাকাছি যেতে পারছিল না। ভিড়ের মধ্যে একবার ঢোকার চেষ্টা করে কপালে কনুইয়ের ধাক্কা খেয়ে বেরিয়ে এসে লম্বা বারান্দার একধারে সে দাঁড়িয়েছিল। সেই সময় ভিড় থেকে খাতা হাতে বেরিয়ে এল একটি ছেলে। লম্বা, ছিপছিপে, চৌকো মুখ। পরনে ঢিলে পাজামা আর খয়েরি পাঞ্জাবি। বয়স সম্ভবত পঁচিশের কাছে; বি.এ. পড়তে আসার পক্ষে বেশিই।

 সে একটু অবাক হয়েই দীপের দিকে তাকিয়েছিল। দীপ হেসে বলল, ”ওখানে ঢোকা আমার পক্ষে অসম্ভব, বোর্ডটাও আমার পক্ষে যথেষ্ট উঁচু।”

 ”ফার্স্ট ইয়ার?”

 গমগমে গভীর গম্ভীর গলা। বারান্দার এপ্রান্ত থেকে একটু গলা চড়ালে ও প্রান্তের লোক শুনতে পাবে।

 দীপ মাথা সামনে নেড়ে বলল, ”বাংলা অনার্স।”

 ”তাহলে ‘এ’ সেকশান, আমারও তাই। আমার থেকে টুকে নাও।”

 বারান্দার পাঁচিলটা দীপের পক্ষে উঁচু। খাতাটা কোথায় রেখে টুকবে তাই খুঁজতে এধার ওধার তাকাচ্ছিল।

 ”তুমি আমার খাতা দেখে বলো, আমি তোমার খাতায় লিখে দিচ্ছি।”

 দীপ খাতার মলাটে নামটা পড়ে নিয়েছিল: দেবব্রত ঘোষ। তার মনে হয়েছিল দেবু ওর ডাকনাম, নিশ্চয় একটা ভালো নাম আছে। হয়তো ডাকনামেই পরিচিত হতে চায়।

 খাতায় লিখতে লিখতে দেবু মৃদুস্বরে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, ”কত নম্বর পেয়েছ?”

 ”পরীক্ষায়? ছ’শ একানব্বই।”

 দেবু মাথা ঘুরিয়ে ওকে একবার দেখে মন্তব্য করে, ”ভালো ছেলে।”

 সেই সময় দুটি মেয়ে যেতে যেতে দেবুকে দেখে থমকে দাঁড়ায়।

 ”দেবু, রুটিন নাকি রে?”

 ”বোর্ড থেকে টুকে নে।”

 ”কী করে টুকব, অবস্থাটা একবার তাকিয়ে দেখ।”

 ”হুঁ…বলো, শুক্রবার এগোরাটা পঁয়তাল্লিশ স্পেশাল বেঙ্গলি, টি.কে.এস, তারপর?”

 মেয়ে দুটি, দীপ যা ভেবেছিল, তার দিকে তাকিয়ে এবং নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করে মুখ টিপে হাসল।

 রুটিন লেখা শেষ হবার পর দীপই বলল, ”চলো, চা খেয়ে আসি।”

 ”চা? বেশ। ক্যান্টিনে ভিড়, চলো বাইরে যাই।”

 কলেজের কাছেই পাশাপাশি দুটো রেস্তোরাঁ। যথেষ্ট ভিড়। সব টেবলই ভরে আছে। মৌমাছি গুঞ্জনের মতো অবিরাম কথা বলার শব্দ। মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে ওঠা বা হাসি। পাখা ঘুরছে তবু অনেকে ঘামছে। কাঠের সিলিংয়ের জন্য ঘরটা নিচু। দেড়তলায়ও বসার ব্যবস্থা আছে। কাঠের সিঁড়ি ক্যাশ কাউন্টারের পাশ দিয়ে উপরে উঠে গেছে। দেবু সিঁড়ির অর্ধেকটা উঠে একবার তাকিয়েই নেমে আসছিল, তখন উপর থেকে মেয়ে গলায় কেউ ডেকে উঠল, ”অ্যাই দেবু, অ্যাই দেবু।”

 চোখে বিস্ময় নিয়ে দেবু উঠে গেল। দীপ নিচে অপেক্ষা করতে লাগল।

 যে মেয়েদুটি দেবুর কাছে রুটিন চেয়েছিল তারা এই সময় রেস্টুরেন্টে ঢুকল। ওকে দেখে তারা হাসি চেপে যে-টেবলে চারটি মেয়ে বসে সেইদিকে এগিয়ে গেল।

 এসব তার গা-সহা হয়ে গেছে। সে বাইরের দিকে তাকিয়ে রাস্তার ওপারের দোকানগুলোর সাইনবোর্ড পড়তে লাগল। হঠাৎ তার কানে এল, ”ডাক না, ডাক না।”

 পিছনের ওই মেয়েগুলিরই কেউ বলছে। সে কান খাড়া করল।

 ”আমি পারব না, তুই ডাক।”

 ”বসবে কোথায়, চেয়ার কই?”

 ”জোড়া দিয়ে বসব।”

 ”আমার পাশে বসালে আমি কিন্তু হাসি চাপতে পারব না।”

 দীপের মুখে পাতলা হাসি ফুটল। ভাবল, নিজে থেকেই ওদের কাছে গিয়ে আলাপ করলে কেমন হয়! তারপর মনে হল, দরকার নেই।

 ”আপনি যদি বসতে চান আমাদের সঙ্গে বসতে পারেন।”

 কোনো ব্যস্ততা নেই এমনভাবে ঘুরে দীপ মেয়েটির দিকে তাকাল, হাসল। মেয়েটির মুখটি মিষ্টি, মাজা গায়ের রঙ, কথা বলার সময় গালে টোল পড়ে, চোখে কালো হালকা ফ্রেমের চশমা, সাধারণ স্বাস্থ্য। হলুদ তাঁতের শাড়িটিতে প্রায় আধ হাত সবুজ ও কালো পাড়।

 ”অসুবিধা হবে নাতো?”

 ”না না কিচ্ছু হবে না। আমাদের একজন এইমাত্র চলে গেল, ম্যানেজ করে ঠিক বসা যাবে।..আপনার কি আজই কলেজে প্রথম?”

 ”হ্যাঁ।”

 ”আমরাও।”

 একদিকে তিনটি চেয়ার জুড়ে নিয়ে চারজন, টেবলের অন্যদিকে দুটি চেয়ারে দীপ ও সেই মেয়েটি যে তাকে ডেকে আনল।

 ”আমার নাম দীপাঞ্জন রায় সবাই ডাকে দীপ বলে।” সবার মুখের ভাব লক্ষ্য করে সে জুড়ে দিল, ”হাইট চার ফুট এক ইঞ্চি, ওয়েট…ঠিক বলতে পারব না, এজ প্রায় কুড়ি, দেরিতে স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য বয়সটা বেশিই, বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।”

 দীপ মিটমিটিয়ে হাসতে লাগল। সে বুঝতে পেরেছে তাকে নিয়ে মজা করার জন্যই এই আমন্ত্রণ। তাই প্রথমেই জানিয়ে দিল সেও মজা চায়। অপরিচয়ের অস্বস্তিটা মেয়েদের মধ্যে থেকে সরে গেল ওর বলার ভঙ্গিতে।

 ”আমি জ্যোতি…জ্যোতির্ময়ী মল্লিক, দুই বোন, দুই ভাই। হাইট ওয়েট জানি না, বয়স উনিশ।”

 দীপের পাশের মেয়েটি কথাগুলো বলল অতি দ্রুত হালকা স্বরে। এরপর সামনের মেয়েরা চটপট বলে গেল।

 ”তাপসী দে, পাঁচ বোন, বয়স…”

 ”উঁহুহু…মেয়েদের বয়স বলতে নেই, বললেও কর্ণপাত করতে নেই।” দু-হাত তুলে দীপ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল।

 ”কেন? আপনি কি বিশ্বাস করেন মেয়েরা বয়স কমিয়ে বলে?”

 ”আপনি নয় তুমি, আমরাতো একই ইয়ারের সুতরাং আজ থেকে সবাই বন্ধু কেমন?”

 সবাই ঘাড় নাড়ল ইতস্তত করে। এমন এক অস্বাভাবিক আকৃতির সঙ্গে চট করে স্বাভাবিক বন্ধুত্ব পাতাতে ওরা আড়ষ্ট বোধ করছে।

 ”হাঁ, যা বলছিলে, মেয়েরা বয়স কমিয়ে বলে এটা মোটেই বিশ্বাস করি না, একদমই বাজে কথা। পাজি পুরুষদের ছড়ানো গুজব, রটনা। আমার এক মাসিকে জানি। বিয়ের সম্বন্ধ এল, পাত্রপক্ষ চায় তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে বয়সের মেয়ে, কেননা দোজবরে পাত্রের বয়স পঞ্চাশের বেশি। বড়োলোক। কলকাতায় সাত-আটটা বাড়ি, মোটরগাড়ি, জহরতের বড়ো ব্যবসা। কিন্তু মাসির বয়স পঁচিশ। ছ’বছর বাড়িয়ে একত্রিশ বছর বলে বিয়ে দেয়া হল এবং মাসির তাতে একশো একভাগ সায় ছিল।”

 ”তুমি কি বলতে চাও বাড়ি গাড়ি টাকার লোভে মেয়েরা বয়সের কারচুপি করতে পারে?” জ্যোতি বলল, তীব্রস্বরে, তর্কে নামার ইচ্ছা নিয়ে। দীপের ভালো লাগল জ্যোতির এই ভঙ্গিটা।

 ”আমি কি তাই বলেছি?…ভালো কথা চা বলি?” প্রসঙ্গটা এড়াবার জন্যই যেন সে চায়ের কথা বলল।

 ”এই তো খেলাম।” টেবলের ওদিকে মাঝে বসা লাল টিপ পরা, অত্যন্ত ফর্সা, লম্বা নাক, চিবুকহীন মেয়েটি বলল।

 ”চা একবার কেন বারবার খাওয়া যায়।” দীপ হাত নেড়ে রেস্টুরেন্টের ছেলেটিকে ডাকল। কাছে আসতেই জিজ্ঞাসা করল, ”কী খাবার পাওয়া যাবে?”

 ”ফিশ ফ্রাই, ভেজিটেবল চপ, মটন চপ, মামলেট, টোস্ট…”

 ”ফাউল কাটলেট আছে।”

 ”বিকেলে পাবেন।”

 ”আমি কিন্তু কিছু খাব না।”

 ”কেন খাবে না, তুমি তো নিজের নাম এখনও বলোনি।”

 ”লীনা মজুমদার। দুই দাদা, বাবা নেই, তিন দিদির বিয়ে হয়ে গেছে আর বয়স বলাতো বারণ। হাইট পাঁচ-এক, ওয়েট তেতাল্লিশ কেজি।”

 ”তেতাল্লিশ! তাহলে তো তোমার এখুনি একটা মটন চপ খাওয়া উচিত ওয়েট বাড়াতে।”

 ”এই কিছুক্ষণ আগে ভাত খেয়েছি।”

 ”সেইজন্যই তো দুটোর বদলে একটা বললাম।…তাহলে ছ’টা চপ ছ’টা চা।”

 ছেলেটি চলে যেতেই দীপ বাকি দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ”তোমরা এখনও নাম বলোনি যখন, আমাকে নিশ্চয় তাহলে পছন্দ হয়নি।”

 ওরা প্রায় একসঙ্গে প্রতিবাদ করে নিজেদের নাম বলল: বেহুলা ঘোষ আর হৈমন্তী পাইন।

 বেহুলা কিঞ্চিৎ নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলল, ”মা আর আমি আলাদা থাকি…চেহারা দেখে বুঝে নাও বয়স, ওয়েট, হাইট। মা একটা ফার্মে রিসেপসনিস্ট।”

 সকলের মধ্যে বেহুলা একটু আলাদা, তার সাজগোজে। দীর্ঘ চোখদুটি চঞ্চল, ব্লাউজটা তার স্বভাবের বেপরোয়া দিকটা উদঘাটন করছে, দেহের ডৌলে ও গঠনে স্বাস্থ্য ভরে আছে কিন্তু লাবণ্য কম। জুতো, ঘড়ি বা হাতব্যাগটি দেখেই বোঝা যায় ভালো জায়গা থেকে কেনা। সবার মধ্যে একমাত্র তারই ঠোঁটদুটি রঙিন এবং চুল ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা। নিজের সম্পর্কে সে যে অতি সচেতন সেটা বুঝতে দীপের অসুবিধা হল না।

 হৈমন্তী বলল, ”কলকাতায় মাসির বাড়িতে থাকি, দেশ সুন্দরবনে। হাসনাবাদ থেকে এগারো মাইল ভিতরে, বাড়িতে ভাইবোন সব মিলিয়ে তেরোজন।”

 ”তাহলে তো সুন্দর…বোন তুমি।”

 হৈমন্তী হাসিতেই ধরা পড়ল সে অর্থ বোঝেনি। বুঝিয়ে দিল জ্যোতি: ”বোন মানে সিস্টার, সুন্দর মানে সুন্দর।”

 বেহুলা হাতঘড়িতে সময় দেখল। তাপসী চোখ টিপে বলল, ”কিরে, সময় হয়ে গেছে?”

 বেহুলা মৃদু হেসে ভ্রু কোঁচকাল।

 ”কীসের সময়? দীপ কৌতূহল জানাল।

 ”ওর বয়ফ্রেন্ডের আসার।” তাপসী হাসছে।

 ”তোমরা কি সব একই স্কুলের?”

 ”চারজন। বেহুলা, আমি…মানে জ্যোতি বাদে সবাই। জ্যোতি হল লীনার বন্ধুর বন্ধু, পরীক্ষা দেবার সময় আলাপ। একই ঘরে আমাদের সিট পড়েছিল।”

 ”আমার কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। ” কথাটা বলেই মণিকে তার মনে পড়ল। জুট মিলের কোয়ার্টারে এখন সে একা বসে কী করছে! সেখানে কোনো বারান্দা আছে কিনা কে জানে।

 একবার সে খুঁজতে গেছল। ট্রেন থেকে নেমে রিকশায় সে জুট মিলের ফটক পর্যন্ত আসে। ফটকের লোহার চাদরের মধ্যে একটা কাটা জায়গা, একজনমাত্র গলতে পারে। সেখানে খাকি পোশাকের বয়স্ক এক দারোয়ান তাকে আটকায়।

 ”কোয়ার্টারে যাব।”

 দারোয়ান বিরক্ত হয়ে জানতে চায়, ”কোয়ার্টারে কার কাছে?”

 ”রেবা দত্ত। এখানে অফিসে কাজ করেন।”

 ”কী কাজ করেন?”

 দীপ বলতে পারেনি। সেই সময় একটি লোক ভিতর থেকে বাইরে যাবার জন্য বেরিয়ে আসতেই দারোয়ান তাকে জিজ্ঞাসা করল, ”ব্যানার্জিবাবু, রেবা দত্ত বলে কই আপনার অফিসে কাজ করে?”

 ব্যানার্জিবাবু নামক লোকটি দীপের আপাদমস্তক দেখতে দেখতে বলল, ”করে। কিন্তু তিনি তো দু’হপ্তার ছুটি নিয়ে তার বাপের বাড়ি গেছেন, বোধহয় মায়ের অসুখ।”

 ”কেউ নেই তার কোয়ার্টারে?”

 ”মিসেস দত্ত আর তার খোঁড়া মেয়ে ছাড়া আর কেউ থাকে বলে তো জানি না।”

 ”কোয়ার্টারটা কোন দিকে?”

 ”তুমি কে হও?”

 দীপ ইতস্তত না করে বলল, ”উনি আমার মাসি হন।”

 ”এই গেটে নয়, এই লম্বা পাঁচিল যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে আরেকটা গেট আছে। ভেতরে ঢুকলেই পরপর দুটো টানা দোতলা বাড়ি বাঁদিকে পড়বে। প্রথমটার শেষদিকে একতলায়।”

 ট্রেনে ফিরে আসার সময় তার মনে হল, ব্যানার্জিবাবুর কাছ থেকে যদি ঠিকানাটা চেয়ে নিত তাহলে সে চিঠি লিখতে পারত।

 ওদের খাওয়া তখন প্রায় শেষ, তাপসী কনুইয়ের খোঁচা দিল বেহুলাকে। ফিসফিসিয়ে ওর কানে বলল, ”এসেছে।”

 মেয়েরা রাস্তার দিকে তাকাল। চোখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। দীপ পিছনে মুখ ঘুরিয়ে দেখল রাস্তার ওপারে একটা সাদা অ্যাম্বাসাডার। তার সামনে দাঁড়িয়ে কালো কাচের চশমাপরা একটা লোক রাস্তা পার হবার জন্য দু’ধারে তাকাচ্ছে। সে বুঝে গেল এই হচ্ছে বেহুলার বয়ফ্রেন্ড।

 বছর ত্রিশ-বত্রিশ বয়স। রঙিন টি-শার্ট, একহারা শরীরে এঁটে রয়েছে। চুল ঘন এবং কোঁকড়া, রঙ শ্যামলা। মুখের গড়ন লম্বাটে, বাঁ গালে গভীর একটা প্রায় দু ইঞ্চি কাটা দাগ। গলায় সোনার সরু চেন। হাতে চশমাটা আর চাবির রিং, আঙুলে বড়ো পাথর বসানো দুটো আংটি।

 ”কখন থেকে রাস্তার দিকে হাপিত্যেশ নয়নে বসে আছে বেচারা!” হৈমন্তী নাটুকে স্বরে যুবকটিকে বলল।

 ”হা-পিত্যেশ না আরও কিছু। আর পাঁচ মিনিট দেখতাম তারপর সোজা বাড়ি চলে যেতাম।” বেহুলার ঠোঁট অভিমানিনীর মতো ফুলে উঠল।

 ”সত্যিই দেরি হয়ে গেল। একটা পার্টির সঙ্গে দেখা করার জরুরি দরকার ছিল। হঠাৎ সকালে ফোন করে বলল, দুপুরের ফ্লাইটে বম্বে যাচ্ছি এয়ারপোর্টে দেখা করো।”

 ”দেখা করে কাজ হল?” তাপসীর ভঙ্গিতে উদ্বেগের আধিক্য ঘটল।

 ”তা কিছুটা হল।”

 ”তাহলে দেরি হওয়ার জন্য বেহুলার রাগ করার কোনো কারণ নেই।”

 ”রাগ করতে বয়ে গেছে আমার।”

 দীপ সকলের মুখের দিকে পরপর তাকিয়ে যাচ্ছে। তার পাশে জ্যোতিও স্মিতমুখে চুপ করে আছে। জ্যোতি যে ওদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ নয় এটা সে বুঝে গেছে।

 যুবকটি কয়েকবার সকৌতুকে দীপের দিকে তাকিয়েছিল। সেটা লক্ষ্য করে লীলা বলল, ”আমাদের নতুন বন্ধু দীপাঞ্জন রায়, সদ্য আলাপ, বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছে।”

 দীপ নমস্কার জানাতেই যুবকটি জমকালোভাবে প্রতি নমস্কার করল কোমর থেকে কিছুটা ঝুঁকে।

 ”খুশি হলাম।”

 ”কী করে হলেন! আমি চার-এক আপনাকে, কতটা ঝুঁকে নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হবে জানেন?”

 ”একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়ুন।” জ্যোতি বলল। অন্যরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

 ”না, আর বসব না।” বেহুলা উঠে দাঁড়াল।

 ”যাবি তো চল তোরা।” জ্যোতি বাদে অন্যরাও উঠে দাঁড়াল।

 ”নীরেনদা আজ ব্যান্ডেল চার্চ দেখাতে নিয়ে যাবে কথা ছিল।” তাপসী বলল জ্যোতি এবং দীপকে লক্ষ্য করে।

 ”পরে একদিন ভালো করে আলাপ করা যাবে।” নীরেনদা নামক যুবকটি নমস্কার করল।

 ”চলি রে জ্যোতি…চলি দীপ।”

 ওরা বেরিয়ে যাবার পর রেস্টুরেন্টের ছেলেটি মৌরি ছড়ানো প্লেট টেবলে রেখে দাঁড়াল। ”আগের পাঁচ কাপের দাম কে দেবেন?”

 ”আমি।” জ্যোতি তার হাতব্যাগ খুলতে যাচ্ছিল, দীপ হাত তুলে নিষেধ করল।

 ”না না, তুমি কেন দেবে। কত হয়েছে?”

 ”আড়াই টাকা।”

 ”আর আমার কত?” দীপ জানতে চাইল।

 ”বারো টাকা।”

 দীপ লক্ষ্য করল জ্যোতির ব্যাগে নানান টুকরো কাগজ তার মধ্য থেকে খুঁটে খুঁটে সে রেজগি বার করছে। সে মানিব্যাগ থেকে দুটো দশ টাকার নোট নিয়ে প্লেটে রাখল। ইশারায় ছেলেটিকে জানাল দুজনেরই দাম ওই থেকে নিতে। ছেলেটি নির্বিকারভাবে কাউন্টারে চলে গেল। মেয়েদের বিল ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও ছেলেরাই যে মেটায়, এটা সর্বদাই সে দেখেছে।

 জ্যোতি এবার কী কী বলবে দীপ সেটা অনুমান করতে পারছে।

 কিন্তু ব্যাগ বন্ধ করে জ্যোতি সামনে তাকিয়ে রইল। কথা বলল না। মৌরির প্লেটে নোট ও খুচরো ফিরে আসতেই দীপ দু’টাকার নোটটি রেখে বাকি সব তুলে নিল। ছেলেটি এমন বহরের বকশিশে অভ্যস্ত নয়, অবাক হয়ে সে নোটটার দিকে তাকাল। দীপ আঙুল নেড়ে তুলে নেবার ইঙ্গিত জানাতেই একটা বড়ো দরের সেলাম পেল।

 ”চলো এবার, তুমি কোথায় যাবে?” দীপ চেয়ারের কিনারে এসে প্রথমে বাঁ পা মেঝেয় ঠেকিয়ে তারপর ডান পা রাখার সময় শক্ত করে টেবলটা ধরল।

 ”বাড়ি যাব। তুমি?”

 ”আমিও।”

 বেরোবার সময় দেড়তলা থেকে দেবুর গমগমে গলার স্বর শুনতে পেয়ে দীপ সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গিয়েও ফিরে এল। রাস্তায় নেমে জ্যোতি জিজ্ঞাসা করল, ”উপরে চেনা কেউ আড্ডা দিচ্ছে নাকি?”

 ”হ্যাঁ, চা খাব বলে একসঙ্গে এলাম। আমাকে দাঁড় করিয়ে উপরে গিয়ে আমার কথা বেমালুম ভুলে গেল, অদ্ভুত না?”

 ”অদ্ভুত কেন! এই তো চা খেয়ে দিব্যি পয়সা দিতে ভুলে গিয়ে চারজন কেমন চলে গেল মোটরে করে বেড়াতে।”

 জ্যোতির গলায় বিরক্তি ক্ষোভ। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে দীপ জিজ্ঞাসা করল, ”লোকটা কে? কী করে?”

 ”কে জানে কী করে। শুনেছি দুটো বাস আছে, একটা ওষুধের দোকান আছে আর রাস্তা, ড্রেন, বাড়িটাড়ি তৈরি করার কন্ট্রাক্টরি করে।”

 ”পয়সা আছে।”

 ”তা আছে, খরচও করে। ক’দিন আগে পার্ক স্ট্রিটে সবাইকে নিয়ে গিয়ে চাইনিজ খাইয়েছে।”

 ”তুমিও গেছলে?”

 জ্যোতির ঠোঁট মুচড়ে গেল তাচ্ছিল্যে। আঙুল দিয়ে নেমে আসা চশমাটা ঠেলে তুলে দিল।

 ”নাহহা। অল্প আলাপ…হইচই ভালোবাসে, কালচার প্রায় নেই-ই।”

 দীপ এবার খানিকটা বুঝতে পারছে জ্যোতিকে। ওর জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হল, রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া অন্য কোনো গান শোনো কিনা, বইমেলায় গিয়ে লেখকদের সই নাও কিনা বা সত্যজিৎ কি মৃণালের ফিল্ম প্রথম সপ্তাহেই দেখে ফেল কিনা।

 ”আমি কখনো চাইনিজ খাইনি, খেতে খুব ইচ্ছে করছে।” ইচ্ছে করেই সে মিথ্যে কথা বলল জ্যোতির প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।

 ”তোমাকে তাহলে চৌরঙ্গি পাড়ায় যেতে হবে, এদিকে কোনো দোকান নেই।”

 ওরা ট্রাম স্টপে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। স্টপেজে অপেক্ষমাণরা দীপের দিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে জ্যোতিকে লক্ষ্য করতে লাগল। তাদের দৃষ্টি যেন ওকে বলছে, তুমি কি করে এই বামনটার সঙ্গিনী হলে? সে ট্রামের খোঁজে দূরে তাকিয়ে রইল, কথা বলায় আর কোনো উৎসাহ দেখল না।

 ”ঠিক জানো এদিকে দোকান নেই?”

 ”থাকতে পারে, আমি জানি না।

 এই সময় ওপারে থামা একটা বাস থেকে চিৎকার হল: ”ছোটবাবু…অ্যাই ছোটবাবু…দাঁড়া।”

 দীপ দেখল জানালায় হাত নেড়ে রবি দ্রুত সিট থেকে উঠতেই বাস তখন চলা শুরু করল।

 চলন্ত বাস থেকে নেমে রবি একগাল হাসি নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে এল।

 ”আরে ব্যাটা, তুই এখানে!…আমি ভাবলুম ভালো নম্বর পেয়েছিস প্রেসিডেন্সি কি স্কটিশে ভর্তি হবি। বাদল বলল তুই নাকি আমেরিকা গেছিস লম্বা হবার জন্য ডাক্তার দেখাতে! খাওয়া, পাশ করার খাওয়াটা বাকি আছে।”

 জ্যোতি চোখ সরু করে একবার তাদের দিকে তাকিয়েই পায়ে পায়ে সরে গেল। দীপ অপ্রতিভ হয়ে নিজেই অন্যদিকে সরে গিয়ে চাপাস্বরে বলল, ”সব জায়গায় সব সময় ইয়ার্কি মানায় না। রবি।”

 রবি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দীপের দিকে এবং চারপাশে তাকিয়ে বলল, ”এখানে আবার সভ্যতা দেখাবার মতো কে…হ্যাঁরে, মেয়েটা তোর চেনা? বাস থেকে দেখলুম কথা বলছিস।”

 ”হ্যাঁ।”

 ”লাইন করেছিস?”

 ”ভদ্রভাবে বল…আজই আলাপ হল।”

 ”লাইন করিয়ে দোব, লজ্জা করিসনি…একটা জিনের প্যান্ট দিবি শুধু, বল, করিয়ে দোব?

 জ্যোতির দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে দীপ মানিব্যাগ থেকে পাঁচটাকার একটা নোট বার করে রবির তালুতে গুঁজে দিল।

 ”এখন যা।”

 ”পারবি পটাতে?”

 ”বলছি চলে যা।”

 ”যাচ্ছি। মাঝে মাঝে খোঁজ নিতে আসব কিন্তু।”

 ট্রাম এখনও আসেনি। দীপ পায়ে পায়ে জ্যোতির কাছে এসে দাঁড়াল।

 ”একই স্কুলের না পাড়ার ছেলে?” জ্যোতির বলার ভঙ্গিতেই বোঝা গেল সে মজা পেয়েছে।

 ”স্কুলের। এরা ক’জন খুব জ্বালাতন করত।”

 ”ওকে টাকা দিলে যেন মনে হল! তোমার কি খুব টাকা আছে? রেস্টুরেন্টে টিপসই তো দিলে দু টাকা।”

 ”মোটেই খুব টাকা নেই।”

 ”কী করেন তোমার বাবা?”

 ”ডেকরেটিং ব্যবসা।”

 জ্যোতির সঙ্গে কথা বলতে তার ভালো লাগছে। ওর সান্নিধ্যটা কী করে বাড়ানো যায়, দীপের মাথার মধ্যে এখন সেই মতলব ঘুরতে লাগল।

 ”যদি কখনো দরকার হয় বোলো, ব্যবস্থা করে দেব।”

 ”দিদির বিয়ে সামনের মাসেই, আঠাশে শ্রাবণ।”

 ”কোথায় তোমাদের বাড়ি?”

 যথারীতি অপেক্ষারতরা তাদের দিকে তাকাচ্ছে। দেবু এবং তার সঙ্গে পাঁচ-ছজন কথা বলতে বলতে তাদের দিকেই আসছে। ওদের মধ্যে একজন মেয়ে, বয়স একটু বেশিই, কাঁধে রঙিন ঝোলা।

 ট্রাম আসছে। জ্যোতি কয়েক পা এগিয়ে গেল বাঁ হাত সামান্য তুলে।

 ”পরে তোমায় বলব, কেমন?”

 দীপ ঘাড় নেড়ে ”আচ্ছা” বলার আগেই জ্যোতি ট্রামের হাতল ধরে উঠে গেল।

 ট্রামটা চলে যাবার পর সে ফিরে তাকিয়ে দেখল দেবু আর তার সঙ্গীরা ট্রাম স্টপে দাঁড়িয়ে।

 ”শম্ভু মিত্তিরের মতো গলা করলেই তো আর শম্ভু মিত্তির হওয়া যায় না। পল্লবকে একদমই মানাচ্ছে না, তবু ওর অমন গলা করা চাই। এ ধরনের একটা সাবমিসিভ ক্যারেকটারের রোলে অমন গলা একদমই মানায় না। ওকে এটা বন্ধ করতে বলো আরতি নয়তো ওকে বাদ দিতে বাধ্য হব।”

 দেবুর গলার স্বর রাস্তার ওপারের লোকও শুনতে পাচ্ছে। দীপ কৌতূহলে তাকিয়ে থেকে ভাবল দেবুকে জিজ্ঞাসা করবে কিনা, দাঁড় করিয়ে রেখে সেই যে উপরে গেলে, তারপর বেমালুম ভুলেই গেলে। কিন্তু সে দেবুর দিকে এগোল না। সবেমাত্র আলাপ, তাকে যে খুব মনে করে রাখতে হবে এমন কোনো কথা নেই। হয়তো এমন আড্ডায় বসে পড়েছে যেখানে একটা বামনের কোনো ভূমিকা নেই অপ্রতিভ হওয়া ছাড়া।

 দীপ হাঁটতে শুরু করতে যাবে তখনই দেবু ভারী গলায় ডাকল, ”শোনো।”

 সে কাছে আসতেই ওদের কথা বন্ধ হয়ে গেল।

 ”তুমি কোথায় চলে গেলে? আমি দেখতে পেলুম না।”

 দীপ একটু অবাক হয়ে গেল। দেবু তাকে খুঁজেছে অথচ সে জানে না। অবশ্য মেয়েদের সঙ্গে টেবলে বসেছিল সিঁড়ির দিকে পিঠ ফিরিয়ে, কিন্তু তাকে দেখতে না পাওয়ার কথা নয়।

 ”তুমি নিচে এসে দেখেছিলে?”

 ”উপর থেকে উঁকি দিয়ে দেখলুম সিঁড়ির গোড়ায় নেই, ওখানেই তো তখন দাঁড়িয়েছিলে।”

 ”বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হল, ওদের টেবলেই বসলাম।”

 ”ভালো।” দেবু তার সঙ্গীদের দিকে ফিরে বলল, ”বেশি দেরি তো আর নেই, এবার থেকে রোজই রিহার্সাল বসতে হবে, রঞ্জিত, অশোক, স্মৃতিকে বলে দিয়ো আর স্টেজ রিহার্সালের তারিখটা পাকা করে আসতে বলো নন্তুকে।”

 ”বাচ্চচাটা নেহাতই বাচ্চচা হয়ে গেছে আর একটু বড়ো হলে ভালো হত।” আরতি বলল।

 ”আমারও তাই মনে হচ্ছে।”

 দেবুকে লক্ষ্য করে একজন বলল। অন্যদের মুখে কথাটার সায় ফুটে উঠেছে। দীপ বুঝতে পারছে কোন নাটকের ব্যাপারে ওরা কথা বলছে। সে ইতস্তত করছে চলে যাবার জন্য।

 ”আপনি কথা বলুন, আমি যাচ্ছি।”

 দেবু তার বিদায় নেওয়ার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করল না। দীপ হাঁটতে শুরু করল। বাড়ি যাওয়া ছাড়া আর কোথাও তার যাবার জায়গা নেই, প্রয়োজনও নেই। সে নিঃসঙ্গ থাকতে অভ্যস্ত। এতে তার আর কষ্ট হয় না। কলেজে প্রথম দিনেই অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়ে যাওয়ায় তার ভালোই লেগেছে। মোটামুটি সবাই পরিণত, এখানে কেউ অন্তত রবিদের মতো উত্যক্ত করবে না।

 বাস বদল না করে সোজা বাড়ি যেতে হলে যে বাসটা তার দরকার সেটার জন্য মিনিট বারো হাঁটতে হবে। দীপ হাঁটতে হাঁটতে সারা দিনের কথাবার্তা, মানুষগুলোর চেহারা, ভাবভঙ্গি মনে করতে লাগল। একটা ব্যাপারে সে খুশি, তাকে সবাই গ্রহণ করেছে। আরও খুশি হচ্ছে রেস্টুরেন্টের দাম মেটাতে পেরে। ক্লাস ভালো করে শুরু হোক, অন্যান্যদের সঙ্গে আলাপের গণ্ডিটা বাড়লে সে বন্ধুত্ব কিনবে রেস্টুরেন্টে খাইয়ে। সে জানে দুপুরে বা বিকেলে কী ভীষণ খিদে পায়।

 রাত্রে সে উৎপলাকে তার হাত খরচের টাকা বাড়ানোর জন্য বলল।

 ”কেন রে?”

 ”বন্ধুদের খাওয়াতে হবে।”

 মায়ের মুখ ভাব লক্ষ্য করে সে মুখ নামিয়ে মৃদু স্বরে বলল, ”আমাকে এখানে তিনটে বছর তো কাটাতে হবে।”

 কিছুক্ষণ দুজনেই নির্বাক রইল।

 ”কত টাকা লাগবে?”

 ”ঠিক জানি না, শ’-দুই দিতে পারবে?”

 উৎপলা অনেকক্ষণ পর বলল, ”আচ্ছা।”

 ইংরেজি ক্লাস আট নম্বর ঘরে। থাক থাক গ্যালারি। পাশ ও অনার্স সব ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে বসে। গ্যালারির প্রথম দুই সারিতে বসে মেয়েরা। ক্লাসে ঢুকে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে যাবার সময় সামনের বেঞ্চে হৈমন্তী বসে আছে দেখে সে বলল, ”কেমন লাগল ব্যান্ডেল চার্চ?”

 ”ভালো। তোমার কথা নীরেনদা যেতে যেতে বলছিল।”

 ”কেন!”

 ”চারটে মেয়ের সঙ্গে একজন পুরুষ সেজন্য ওর অস্বস্তি হচ্ছিল। পার্টিটার ঠিক ব্যালান্স হচ্ছিল না।”

 ”আমাকে দিয়ে কি সেটা হত?” দীপ অবাক হলেও মিটমিট হাসতে লাগল। ”এইটুকু মানুষ দিয়ে কি ব্যালান্স আনা যায়?”

 অধ্যাপক ঘরে ঢুকেছেন। দীপ আর কথা না বলে গ্যালারির উপরের শেষ বেঞ্চে দেয়ালের দিকে বসল। সেখান থেকে অধ্যাপককে দেখা যাচ্ছে না এবং সেও দেখতে পাচ্ছে না। সেজন্য তার কোনো অসুবিধা নেই। পড়ার ব্যাপারটা তো বাড়িতেই হয়।

 শীর্ণ, কুঁজো এবং কর্কশ গলার অধ্যাপক ছাত্রদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে রোল নম্বর ডেকে যাচ্ছিলেন। কেউ সাড়া না দিলে তখন মুখ নামিয়ে খাতায় আঁচড় দিচ্ছিলেন।

 ”সিক্সটি ওয়ান।”

 ”ইয়েস প্লিজ।”

 অধ্যাপকের ভ্রূ কুঁচকে গেল। তিনি আবার ডাকলেন, ‘সিক্সটি ওয়ান।”

 ”ইয়েস প্লিজ।”

 দীপ দাঁড়িয়েই ছিল। ঘরের পিছন দিকটা একটু অন্ধকার। বিদ্যুৎ না থাকায় পাখা বন্ধ আলোও জ্বলছে না। সে হাত তুলে আবার বলল, ”ইয়েস প্লিজ।”

 ”কই দেখতে পাচ্ছি না, উঠে দাঁড়াও।”

 পাশের ছেলেটি দীপকে বলল, ”বেঞ্চের উপর উঠে দাঁড়াও।”

 দীপ তাই করল। সারা ক্লাস তার দিকে তাকিয়ে। বিস্ময় কৌতূহল আর মুচকি হাসি তার দিকে প্রবাহিত হচ্ছে।

 ”ব্যাপার কি। তুমি…” অধ্যাপক থেমে গেলেন। সামনের বেঞ্চ থেকে একজন চাপা গলায় তাকে কিছু বলল।

 ”তুমি সামনে এসে বোস।”

 দীপ নেমে এল। অধ্যাপক খুঁজে খুঁজে মেয়েদের ঠিক পিছনের বেঞ্চের মাঝামাঝি এবং ওঠানামার পথের ধারে একটা জায়গা আঙুল দিয়ে দেখালেন। ওরা সরে গিয়ে জায়গা করে দিল। দীপ বসল ঠিক বেহুলার পিছনে।

 পরের ক্লসগুলিতে এমন ঘটনা না ঘটলেও দীপ মেয়েদের পিছনের বেঞ্চেই বসল।

 কয়েকদিন পর অনার্স ক্লাস থেকে বেরিয়ে সে দেখল জ্যোতি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।

 ”দীপ একটা কথা ছিল।”

 বারান্দায় তখন গিজগিজে ভীড়। ঘর বদলে অন্য ঘরে যাওয়ার ব্যস্ততা।

 ”এখুনি বলবে? আমার এখন পল সায়েন্সের ক্লাস রয়েছে। তোমার কি ক্লাস শেষ হয়ে গেছে?”

 ”হ্যাঁ, আমি তাহলে লাইব্রেরিতে আছি। দিদির বিয়ের ডেকরিটিংয়ের ব্যাপারে…”

 ”ক্লাসটা করেই যাচ্ছি।”

 তিনতলায় লাইব্রেরির রিডিং রুমে ভীড় নেই। কোণের দিকে টেবলে জ্যোতি একটা বই ওলটাচ্ছিল। দীপ ওর পাশের চেয়ারে বসল।

 ”বলো।”

 ”বাবাকে বললাম, আমার ক্লাসের এক বন্ধুর ডেকরেটিংয়ের ব্যবসা আছে।”

 ”আমার নয়, আমার বাবার।”

 জ্যোতি হেসে বলল, ”ওই হল। বাবা বললেন, কীরকম খরচ টরচ পড়বে জেনে নিতে।”

 ”সেটা নির্ভর করছে কতটা এরিয়া কভার করবে, কী কী জিনিস লাগবে।”

 ”তুমি কি একবার বাবার সঙ্গে কথা বলবে, আসবে আমাদের বাড়িতে?”

 ”বেশ তো চলো। আমি কিন্তু এসবের কিছুই জানি না, বুঝিও না। যা কিছু সব বাবাই করেন।”

 ট্রাম থেকে নেমে প্রায় দশ মিনিট হাঁটতে হল। একটা পুরনো, সরু গলির মধ্যে, কিছু ইঁট বেরিয়ে যাওয়া বাড়ি, কয়েকটি আস্তাকুঁড়, রোয়াক, একটি টিউবওয়েল পেরিয়ে জ্যোতিদের পৈতৃক বাড়ি। কেরানির চাকরি থেকে অবসর নেওয়া দীনেন মল্লিক শোবার ঘরে পালিশ ওঠা বড়ো একটা পালঙ্কে শুয়ে বই পড়ছিলেন। ওরা ঘরে ঢুকতেই উঠে বসলেন। দীপ কোথায় বসবে সেটাই সমস্যা। পালঙ্কটা ওর কাঁধ সমান উঁচু।

 ”ব্যস্ত হবেন না, আমি ঠিক আছি।”

 নিছকই কথার কথা। জ্যোতির বাবা, মা বিব্রত হয়ে কী করবেন বুঝতে পারছেন না।

 ”কাকার ঘরে চেয়ার আছে।”

 জ্যোতি ছুটে বেরিয়ে গেল। দীনেনবাবু সাধারণ আলাপ শুরু করলেন। জ্যোতির মা রান্নাঘরে গেলেন। একটু পরেই জ্যোতি তার কাকার তিনবছর বয়সি ছেলের ক্যানভাসের চেয়ারটি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল।

 ”দ্যাখো তো এটায় বসতে পারবে কিনা।”

 দীপ হেসে উঠে বলল, ”আমার ওজন এর ওপর চাপালে ভেঙে পড়ে যাবে। তাও তো আগের ওজন এখন নেই, দৌড় আর ব্যায়াম করে কমিয়েছি।”

 এই বলেই সে মেঝেয় পা ছড়িয়ে বসল দু হাতের উপর ভর রেখে দেহটা পিছনে হেলিয়ে।

 জ্যোতির বাবা বললেন, ”ছাদেই ম্যারাপ হবে। জ্যোতি দেখিয়ে আন না।”

 ”পরে দেখবে, আগে চা খাক।”

 ”এছাড়া ভিয়েন হবে উঠোনে, সেটাও ঢাকতে হবে। টেবিল-চেয়ার, রান্নার, পরিবেশনের বাসনও লাগবে। বরের বসার জন্য গালচে, তাকিয়া, ফুলদানি, সদরের পর্দা। বরযাত্রী বসবে সামনের বাড়ির একটা ঘরে আর কিছু চেয়ার পেতে রাস্তায়। মোটামুটি এই আর কী।”

 ”আমি জেনে গেলাম। বাবাকে বলব, তিনি লোক পাঠিয়ে যা করার করবেন।”

 ”টাকা কত পড়বে সেটা জেনে নিতে পারলে ভালো হত। রিটায়ার করেছি, বড়ো ছেলে ফুড কর্পোরেশনে টাইপিস্টের চাকরিতে সবে ঢুকেছে, ছোটোটা বেকার বসে আছে। মেয়ে তো আমার দুটো, বুঝতেই পারছ তো বাবা খরচ বুঝে সুঝে করতে হবে।”

 ”সেজন্য আপনি ভাববেন না। কত লাগবে সেটা আমি বুঝব।”

 ”তবু…একটা আন্দাজ পেলে…”

 তার দিকে প্রত্যাশা ভরা চাউনি মেলে খাটের বাজু ধরে জ্যোতি দাঁড়িয়ে ওর বাবার চোখের মতোই চাইছে দীপ এমন কিছু একটা বলুক যা আশ্বস্ত করবে। ওর বড়ো সুখবোধ হল। এমন কিছু একটা সে বলবে যাতে ওরা অভিভূত হয়ে যায়, তার উচ্চচতা বেড়ে যায় এদের কাছে।

 ”আমার একদমই ধারণা নেই তবে হাজার টাকার মধ্যেই হবে মনে হচ্ছে।”

 ওরা চুপ করে রইল। এরপর কথাবার্তা অন্যদিকে মোড় নিল। জ্যোতির দিদির সঙ্গে আলাপ হল। ছোটো ভাই একবার ঘরে এসেই কী একটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। তার সঙ্গে কেউ দীপের পরিচয় করাল না।

 দীপ যখন উঠল তখন সন্ধ্যা নামছে। সদরে দাঁড়িয়ে জ্যোতি ওর কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলল, ”যেখানে যতটুকু সাশ্রয় হয় সেই চেষ্টাই করি, যদি কিছুটা কমসমে হয় তাহলে সত্যিই উপকার হয়।”

 ওর এই কাঁধে হাত রাখাটা দীপকে অসম্ভব নাড়া দিল। তার ইচ্ছা করল জ্যোতির মুঠো একবার নিজের মুঠোর মধ্যে নেয়। কিন্তু সাহস হল না।

 ”আমি কাল তোমায় বলব।”

 রাত্রে সে পড়ার অজুহাতে খেতে বসায় দেরি করল যতক্ষণ না বাবা ফেরে। কৃষ্ণচন্দ্র সাধারণত রাত দশটায় ফেরে, আজও ফিরল। দীপ অপেক্ষা করে রইল খাওয়ার টেবলে বাবার বসার জন্য।

 দুজনে মুখোমুখি খেতে বসল। কৃষ্ণচন্দ্র দু বেলা একাই খেতে বসে। আজ ছেলেকে দেখে সে খুশিই হল।

 ”কলেজ কেমন লাগছে?”

 ”ভালোই।”

 ”সবার সঙ্গে আলাপ হচ্ছে?”

 ”হুঁ।”

 দুজনে চুপচাপ খেয়ে যেতে লাগল। এক সময় দীপ মুখ নিচু করে মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে বলল, ”ক্লাসের একটি মেয়ের দিদির বিয়ে। আমি বলেছি ডেকরেটিংয়ের যা যা দরকার আমি দোব।”

 ”দোব মানে।”

 ”টাকা নোব না।”

 দীপ সন্তর্পণে মুখ তুলে বাবার দিকে তাকাল। কৃষ্ণচন্দ্র অবাক হয়ে তার দিকেই তাকিয়ে।

 ”টাকা নোব না মানে?”

 দীপ চুপ করে রইল। উৎপলা নীরবতা ভেঙে বলল, ”তুই কি বলে দিয়েছিস টাকা দিতে হবে না?

 ”হ্যাঁ।”

 উৎপলা স্বামীর দিকে তাকাল। গম্ভীর মুখে কৃষ্ণচন্দ্র ভাত নাড়াচাড়া করছে।

 ”আমি বলতাম না বিনি পয়সায় করে দেবার জন্য। কিন্তু আমাকে তো লম্বা হতে হবে।”

 দীপের গলার স্বরে ওরা দুজনে সচকিত হয়ে তাকিয়ে রইল।

 ”তোমরা তো আমার মতো বামন নও। তোমরা লম্বা লোক, তোমাদের চার পাশে তোমাদের হাইটেরই লোক, কি করে বুঝবে আমার অসুবিধেটা। সবার মধ্যে আমাকে আমার এই কুৎসিত বিসদৃশ দেহটাকে নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। আমার সঙ্গে কেউ মিশবে না, কেউ পাত্তা দেবে না যদি না আমি তাদের খুশি করি। সেজন্য আমায় টাকা খরচ করতে হয়, উপকার করতে হয়। আমার এই শরীরটার জন্য আমি তো দায়ী নই…কেউই দায়ী নয়। ভগবান আমায় মেরে দিয়েছেন।”

 দীপ তার চেয়ার থেকে নেমে বেসিনে গিয়ে হাত ধুল এবং নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

 পরদিন সকালে উৎপলা চা দিতে এসে বলল, ”তোর বাবা বলেছে করে দেবে টাকা নেবে না।”

 কলেজে ঢোকার সময় ফটকের কাছে লীনা আর তাপসীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দীপ এগিয়ে গেল।

 ”আর যে তোমাদের দেখতেই পাই না।” হালকা চটুল স্বরে দীপ বলল। ”ঘোষ কেবিনে আর যাওনা?”

 ”কেন যাব না, কালও তো গেছি। বরং তুমিই আসো না।” তাপসী বলল।

 ”বটে! তাহলে আজ…একটা পঁয়তাল্লিশে অফ আছে, তোমাদের?”

 ”আমাদের অফ থাকুক বা না থাকুক মোটকথা যাচ্ছি।” লীলা যথাসাধ্য প্রগলভ হবার চেষ্টা করল সুদর্শন একটি ছেলেকে সামনে দিয়ে যেতে দেখে।

 একটা-পঁয়তাল্লিশে বেরিয়ে দীপ ঘোষ কেবিনে ঢুকে দেখল লীনা, তাপসী এবং হৈমন্তী চা খাচ্ছে। তাদের সামনে খালি প্লেট, তাতে পেঁয়াজের কুচি আর সস লেগে রয়েছে।

 ”দীপ বড্ড খিদে পেয়েছিল, তুমি আসার আগেই আমরা তোমার কাজ এগিয়ে রেখেছি।”

 ‘খুব ভালো খুব ভালো।” খালি চেয়ারটায় উঠতে উঠতে দীপ বলল।

 ”অ্যাই ওর জন্য চপ আনতে বল।” হৈমন্তী বলার সঙ্গে সঙ্গেই সেলাম দিয়ে ছেলেটি দীপের পাশে দাঁড়িয়েছে।

 ”একটা চপ?”

 দীপ ঘাড় নাড়ল। ”তোমরা আজ তিনজন যে?”

 ”বেহুলা আসেনি, কাল বলেই দিয়েছিল আসবে না। আর জ্যোতিকে ইংরিজি ক্লাসে দেখেছিলুম, তুমিও তো দেখেছ।”

 ”দেখেছি। আর কিছু খাবে?” দীপ সবার মুখের দিকে পর পর তাকাল। ওরা ইতস্ততঃ করছে। হঠাৎ হৈমন্তী বলল, ”আমি আর একটা চপ খাব।”

 ”তাহলে আমিও।” তাপসী জুড়ে দিল।

 ”লীনা?”

 ”একটা মামলেট।”

 দীপ তুড়ি দিয়ে ছেলেটিকে ডাকল। অন্যান্য টেবল থেকে আড়চোখে অনেকেই তাদের দিকে তাকাচ্ছে। অনেকের চোখে কৌতূহলের বদলে ঈর্ষা।

 ”তাপসী, কালই বেহুলাকে বলতে হবে আমরা যাব কি যাব না, তুই যাবি তো?” লীনা বলল।

 ”তুই আমার মাকে গিয়ে বলবি, নয়তো মা ছাড়বে না। রোববার না হয়ে অন্যদিন হলে কলেজে যাবার নাম করে চলে যেতুম।”

 হৈমন্তী ঝুঁকে বলল, ”দিন ঠিক হয়ে গেছে কি?”

 ”সেটাই তো কাল বলে দিতে হবে। নীরেনদা তো আমাদের ওপরই ছেড়ে দিয়েছে।”

 ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে যাচ্ছে। সামনে বসা দীপের যেন অস্তিত্বই নেই ওদের কাছে। অবশ্য সেজন্য সে কিছুই মনে করছে না। জ্যোতি না থাকায় সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে কথা বলতে।

 তবু এক সময় সে বলল, ”মনে হচ্ছে তোমরা যেন কোথাও যাবার প্ল্যান করছ।”

 ”নীরেনদার সঙ্গে আমরা পিকনিকে যাব। ওর বন্ধুর বিরাট বাগান আছে নৈহাটির কাছে।”

 ”আমরা মোটরে যাব।”

 ”ওহ তোমাদের হিংসে হচ্ছে। আমি কখনো পিকনিকে যাইনি।”

 ”তাহলে চলো না আমাদের সঙ্গে।” হৈমন্তী কথাটা বলতেই তাপসী ওকে চিমটি কাটল।

 ”এটা নীরেনদার পিকনিক। তাকে না বলে কাউকে ইনভাইট করাটা ঠিক হবে না।”

 ”দীপ যাবে শুনলে আপত্তি করবে না।”

 ”তুই জানিস?”

 ”হ্যাঁ জানি। সেদিন কি বলল শুনিসনি! ‘দীপের হাতে যে-কোনো মেয়েকে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দেওয়া যায়, ছেলেটা খুব ভালো।’ এমন কথা কটা ছেলের সম্পর্কে বলা যায়?”

 দীপ হাসছিল কিন্তু তার বুকের মধ্যে একসঙ্গে দশটা ছুঁচ বেঁধার যন্ত্রণা হচ্ছে। তাকে পুরুষ মানুষ রূপে নীরেনদা গ্রাহ্যই করে না এবং এই মেয়েরাও। তার কাছে মেয়েরা নিরাপদ, এ কথা যে-কোনো যুবকের কাছে লজ্জার। ওরা ধরেই নিয়েছে তার ইচ্ছা তার প্রয়োজন তার শরীরের মতোই ছোটোখাটো এবং সেগুলো যথেষ্ট নয় পুরুষ হয়ে ওঠার জন্য।

 ”দীপ তুমি কি যাবে আমাদের সঙ্গে?”

 ”নিশ্চয় যাব। কিন্তু এখন আমার চণ্ডী মঙ্গলের ক্লাস রয়েছে সুতরাং…।”

 বড়ো সেলাম নিয়ে দীপ বেরিয়ে এল তার সঙ্গে তিনটি মেয়েও। কলেজের দোতলার বারান্দায় সে জ্যোতিকে দেখতে পেয়ে হাসল, জ্যোতিও হাসল। হঠাৎ তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ”টিকিট কেটে ছিলাম সুবিনয় রায়ের একক অনুষ্ঠানে এক বন্ধুকে শোনাব বলে। হতভাগা আজ বলল যেতে পারবে না। টিকিটটা নষ্ট হবে না যদি তুমি যাও।” আজকের কাগজেই সে এই অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেখেছে।

 ”আর কাউকে তো দিতে পার।”

 ”দিতে ইচ্ছে করছে না। যে গান বুঝবে তাকেই তো দেওয়া উচিত।”

 ”কবে?”

 ”রোববার সকালে, রবীন্দ্রসদনে।”

 ”পরে বলব।”

 ”কাল বাবার সঙ্গে কথা বলেছি ওই ব্যাপারটা নিয়ে।”

 জ্যোতি উৎসুক চোখে তাকাল। দীপ গম্ভীর হয়ে বলল, ”হাজার টাকার কমে হবে না।”

 ”ওহ।”

 দীপ হাসতে শুরু করল। জ্যোতি বিভ্রান্ত হয়ে বলল, ”হাসছ কেন?”

 ”বাবা বলল, তোর বন্ধুকে বলিস, এক পয়সাও লাগবে না।”

 রবিবার পর্যন্ত দীপ পালকের মতো হাওয়ায় ভাসল। জ্যোতি টিকিট নিতে রাজি হওয়ার পর সেই বিকেলেই, বিজ্ঞাপন দেখা টিকিট বিক্রির জন্য নির্দিষ্ট স্থানগুলোর একটা, শ্যামবাজারের মোড়ের দোকানটা থেকে সে দুটি টিকিট কিনে নিল।

 ইতিমধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপারে দীপ জড়িয়ে পড়ল। দেবু তার জন্য ক্লাসের বাইরে বারান্দায় অপেক্ষা করছিল। ক্লাস থেকে বেরোতেই সে তাকে ধরল।

 ”কথা আছে। আমার সঙ্গে চারটের সময় যেতে পারবে?”

 ”কোথায়?”

 ”যেখানে আমাদের রিহার্সাল হয়। এখান থেকে হেঁটে মিনিট দশেক।”

 ”আমি কী করব?”

 ”কিছুই করবে না। চারটের সময় গেটে থাকব।”

 দেবু লম্বা পা ফেলে চলে গেল। কৌতূহলে দীপ ছটফটাল চারটে পর্যন্ত। দেবু গেটে দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে দেখেই হাতঘড়িটা চোখের সামনে তুলে ”চলো” বলেই হাঁটতে শুরু করল।

 ”ব্যাপারটা কী?”

 ”আমি শুনেছি তুমি ভালো অভিনয় করতে পারো।”

 ”সে কি! জীবনে মাত্র দুই কি তিনবার আমি থিয়েটার দেখেছি, অভিনয় তো দূরের কথা।”

 ওর কথাগুলো ধর্তব্যের মধ্যে না এনে দেবু বলল, ”স্কুলের গো অ্যাজ ইউ লাইকে তুমি একটা হারিয়ে যাওয়া বাচ্চচা ছেলে হয়েছিলে, অসাধারণ নাকি করেছিলে।”

 ”কে বললে তোমায়, ধ্যুৎ, বাজে কথা। ওটা কোনো অভিনয়ই নয়।”

 ”দেখা যাক। আমরা যে নাটকটা নামাচ্ছি জার্মান লেখক হার্মান গ্যোহরের ফরেস্টস অব ইডেন। নাম শোননি নিশ্চয়, অবস্কিওর লেখক। অমিই অ্যাডাপ্ট করেছি। তাতে একটা বাচ্চচার ছোট্ট একটা রোল আছে।”

 ”আমাকে করতে হবে!”

 ”যে বাচ্চচাটাকে দিয়ে করাব ভেবেছিলাম, কয়েকটা রিহার্সালও দিয়েছে, হঠাৎ সে পা ভেঙে শয্যাশায়ী। বছর আষ্টেকের ছেলে।

 ”তার জায়গায় আমি?”

 ”অসুবিধেটা কী?”

 দেবু প্রায় ধমকের সুরে বলল। দীপ আমতা আমতা করে আর কথা বাড়াল না। বড়ো রাস্তা থেকে তারা গলিতে ঢুকল। তারপর আবার একটা মাঝারি রাস্তায়। একটা মুদির দোকানের গা ঘেঁষে সরু পথ ধরে টালির চালের একতলা একটা বাড়িতে তারা পৌঁছল।

 চারজন যুবক শতরঞ্চিতে বসে। তাদের দেখেই নড়েচড়ে বসল।

 ”বাবলুর রোলটা এ করবে।”

 চারজোড়া চোখের তীক্ষ্ন দৃষ্টি দীপকে গেঁথে ফেলল। অবশেষে একজন বলল, ”মুখটা তো কচি ছেলের মতো নয়। শরীরের মাসলগুলোও স্টিফ।”

 দেবু অধৈর্য স্বরে বলল, ”মেক আপে সব ঠিক হয়ে যাবে। সময় সাতদিনও নেই এখন বাচ্চচা খুঁজে বার করব কোথা থেকে?”

 এরপর ওরা আর কথা বলল না। দুজন সিগারেট ধরাল। বাসি খবরের কাগজ পড়তে শুরু করল তৃতীয় জন। বাকি জন চিৎ হয়ে শুয়ে পায়ের উপর পা তুলে নাচাতে লাগল।

 দেবু সংক্ষেপে কাহিনিটা দীপকে বলেছিল, স্বামী, স্ত্রী এক বাচ্চচার সংসার। নিত্য অশান্তি। স্ত্রীকে মারধোর করে স্বামী মদ খেয়ে এসে। বাচ্চচাটা তখন বাবাকে জড়িয়ে ধরে চেঁচায়: মেরো না মাকে মেরো না বলে। এমন ঘটনা নাটকে দুবার ঘটবে। অবশেষে মা তার প্রেমিকের সঙ্গে চলে যাবে। যাবার সময় বাচ্চচা বলবে: মা এবার থেকে বাবাকে কে রেঁধে দেবে, কে জামা-প্যান্ট ইস্ত্রি করে দেবে। এইরকম দু-চারটে সেন্টিমেন্টাল ডায়লগ। ব্যাস, এখানেই বাচ্চচার রোল শেষ।

 ”না পারার কি আছে? আজই রিহার্সাল দিয়ে দ্যাখো।”

 দীপ দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগই পেল না। কিছু বলতে গেলেই দেবু তার গমগমে গলায় ”আচ্ছা আচ্ছা” আর ”হবে হবে” বলে থামিয়ে দেয়।

 চিৎ হয়ে পা নাচানো লোকটিই বাবা। দীপ যখন তাকে জড়িয়ে ধরছে লোকটির ক্রুদ্ধ মুখে হাসি ফুটে উঠছে।

 ”অমিয় সিরিয়াস, বি সিরিয়াস।” দেবু হুঁশিয়ার করে দেয়।

 একসময় অমিয় বলল, ”দেবু ভয়েসটাতো বাচ্চচার মতো নয়।”

 ”চলে যাবে।”

 ওখান থেকে ছাড়া পেয়ে দীপ যখন বাড়ি ফিরছে তখন অদ্ভুত একটা উত্তেজনার ঘোরে সে আচ্ছন্ন। মঞ্চে উঠবে, কয়েকশো লোকের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হবে এটা সে জীবনে ভাবেনি। মাত্র তিন চারটি ছোটো বাক্য। মুখস্থ করারও দরকার লাগে না। মঞ্চে শুধু সামান্য ঘোরাফেরা তাকিয়ে থাকা মাত্র দুটি দৃশ্যে। দুর্দান্ত দারুণ অভিনয় করে দর্শকদের চমৎকৃত করার বাসনা কোনোদিন তার ছিল না কিন্তু এখন তার হচ্ছে।

 পরদিন ঘোষ কেবিনে বসে পাঁচটি মেয়েকে যখন জানাল সে নাটকে অভিনয় করছে তখন পাঁচজনই প্রায় বিমূঢ় হয়ে গেল। কতকগুলো বিস্ময়সূচক ধ্বনি একসঙ্গেই তার উপর আছড়ে পড়ল। অবশেষে জ্যোতিই বলল, ”তাহলে তো দেখতে যাবই।”

 ”না না, এটাই জীবনে প্রথম। তোমরা গেলে নিশ্চিত ঘাবড়ে যাব।” দীপ যেভাবে বলল তাতে ওদের মনে হল সে ইতিমধ্যেই নার্ভাস।

 ”আমরা যাবই।” বেহুলা টেবলে ছোট্ট কিল বসাল।

 ”আমরা টিকিট কেটে যাব, তুমি যাওয়া আটকাবে কি করে? বেহুলা তুই নীরেনদাকে বলিস তো। আমি দেবুকে বলে রাখব টিকিটের জন্য।”

 ”ও শিলিগুড়ি গেছে, বোধহয় রবিবারই ফিরবে।”

 ”ঠিক আছে আমরাই টিকিট কেটে নেব।”

 ”না না প্লিজ। যদি ভালো হয় তাহলে পরের বার তোমরা যেয়ো।”

 ”ওরে বাবা, প্রথম শো কি মিস করতে আছে!”

 মেয়েরা যত জিদ ধরে দীপ ততই মনের গভীরে অদ্ভুত একটা সুখের গড়াগড়ি অনুভব করে। সে ভুলে যায় তার দেহের কথা। নিজেকে লম্বাদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে-কোনো সুযোগই সে হাত বাড়িয়ে নিতে রাজি।

 ওরা একসঙ্গে ঘোষ কেবিন থেকে বেরিয়ে আলাদা হয়ে গেল শুধু জ্যোতি আর দীপ ছাড়া। ট্রাম স্টপে দাঁড়িয়ে বলল, ”তাহলে রোববার সকালে?”

 ”আমার টিকিটটা দাও।”

 ”কেন থাক না, এসপ্ল্যানেডে মিট করে একসঙ্গেই যাব।”

 ”আমার ঠিক নেই বেরোবার, সকালে অনেক কাজ থাকে।”

 ”তোমার আবার কী কাজ, মা আছে দিদি আছে!”

 ”মা আছে কী দিদি আছে তা নিয়ে অত কথায় দরকার কী, টিকিটটা যদি সঙ্গে থাকে তাহলে দাও।” জ্যোতি ঝাঁঝালো স্বরে কথাগুলো বলে তার দিকে তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে রইল। দীপ মানিব্যাগ থেকে টিকিট বার করে ওর হাতে দিল। একটু ম্লান হাসলও। হঠাৎ ঝেঁঝে ওঠার মতোই জ্যোতি মুহূর্তে নরম হয়ে গেল।

 ”সত্যিই রোববার আমার কাজ থাকে, অনেক রকমের।”

 অনেক রকমের কাজটা যে কী তা আর বলল না। দীপের মনে হল জ্যোতি যেন চায় না প্রকাশ্যে তার সঙ্গে থেকে লোকের চাউনি সহ্য করতে। এটা সে বহুবার অন্যদের সঙ্গে থেকেও লক্ষ্য করেছে। সঙ্গীরা অস্বস্তি বোধ করে, দূরে দূরে সরে থাকে অপরিচিতের ভান করে। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি দেখেছে। তার সঙ্গে যারা থাকে তারাও যেন হাসির পাত্র হয়ে ওঠে।

 ”তাহলে রবীন্দ্র সদনেই দেখা হবে। দশটায়।”

 রবিবার সকাল এগোরোটা পর্যন্ত দীপ বিছানায় গড়াল। অভিমান নয় রাগও নয়, সেদিন ট্রাম স্টপেই সে ঠিক করে ফেলেছিল রবিবার সে যাবে না এবং হঠাৎই তার মণিকে মনে পড়তে থাকে। তার সঙ্গে বেরোতে মণি অন্তত লজ্জা পেত না। সেদিন ভোরে মণির সঙ্গে হঠাৎ দেখা হওয়ার, ওর পড়ে যাওয়ার, দৃশ্যগুলো পরপর তার চোখে ভেসে উঠতে থাকল। স্টিলের রেকাবিটা দেখে মণি আর তার মা কীরকম অবাক হয়ে গেছল তা আর জানা হয়নি।

 দুপুরে সে শ্যামনগর স্টেশনে নেমে সাইকেল রিকশায় উঠল। রিকশাওয়ালা তাকে উঠতে সাহায্য করল। ব্যানার্জিবাবুর কথামতো জুট মিলের পাঁচিলের শেষ প্রান্তের গেট দিয়ে ঢুকে বাঁদিকে দোতলা বাড়ি দেখে রিকশা থেকে নামল। ‘বাঁদিকে দুটো বাড়ির প্রথমটার শেষ দিকে, একতলায়’ ব্যানার্জিবাবুর নির্দেশটা তার মুখস্থ হয়ে আছে।

 রিকশাওলাকে ভাড়া মিটিয়ে সে সন্তর্পণে এগোল শ্বাস বন্ধ করে, অ্যাডভেঞ্চারে যাবার মতো উত্তেজিত হয়ে। একতলার শেষের ঘর বা কোয়ার্টার। জাল দেওয়া ছোট্ট বারান্দা, তার পাশে ছোটো সরু দরজা। দীপ জাল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তাকাতেই দেখল মেঝেয় মাদুরে উপুড় হয়ে শাড়িপরা কে একজন খাতায় কী টুকছে বই থেকে।

 কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে সে মণিকে চিনতে পারল। সে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। বড়োজোর আড়াই বছর কেটে গেছে শেষবার দেখার পর। কত বড়ো হয়ে গেছে মণি, কত সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। দেয়ালে হেলান দেওয়া ক্রাচ দুটো এইবার তার চোখে পড়ল। এখনও ব্যবহার করতে হয়, সারাজীবনই করতে হবে।

 মিলের ভোঁ বেজে উঠল। মণি নড়েচড়ে কিছু একটা চিন্তা করতে করতে মুখটি তুলল এবং দীপকে দেখতে পেল। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকার পর হুড়মুড়িয়ে উঠে সে বিনা ক্রাচে লাফিয়ে এসে জাল আঁকড়ে ধরল দু হাতে।

 ওর আঙুলগুলোকে দীপ আঁকড়ে ধরল নিজের আঙুলে।

 ”আমি একবার এসেছিলাম। তোমরা তখন ছিলে না।”

 ”তোমাদের বাড়ির ঠিকানাটা নেই, নইলে চিঠি দিতাম।”

 কথা নেই। দুজনে নির্নিমেষে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে। দুচোখ ভরা হাসিতে। মাঝখানে জাল। আঙুলগুলো কেউই সরাচ্ছে না।

 ”তুমি অনেক বড়ো হয়েছ…সুন্দর দেখাচ্ছে আগের থেকেও।

 মণি কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। দীপের মনে হল তার সম্পর্কে কিছুই বলার নেই। সে যেমন ছিল তাই আছে। কিছু বলতে না পারায় মণির মুখে কষ্ট ফুটে উঠেছে দেখে দীপ বলল, ”আমি ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করে কলেজে পড়ছি।”

 উজ্জ্বল হয়ে উঠল মণি।

 ”রেকাবিটা তুমি বারান্দায় রেখে গেছলে?”

 ”না তো!”

 ”মিথ্যুক। তুমি ছাড়া কে আর অমন হাঁদারাম আছে! যেমন দিয়েছিলে তেমনি ভাবেই ওটা রেখে দিয়েছি।”

 দীপ বলতে যাচ্ছিল: বাইরেই কি দাঁড়িয়ে থাকব? কিন্তু এভাবে ওকে ছুঁয়ে থাকা তাহলে আর হবে না। বরফির মতো জালের ফাঁকগুলো খুব ছোটো। হাত গলাবার মতো বড়ো হলে সে মণির মুখে হাত বুলোত। কিন্তু তার হাত তো অত উঁচুতে পৌঁছবে না। ভীষণ লম্বা হয়ে গেছে ও।

 ”তুমি খুব লম্বা হয়ে গেছ।”

 ”সত্যি! তুমিও রোগা হয়েছ।”

 দীপ হাসল। আঙুলে মৃদু চাপ দিল। মণি জালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।

 ”এভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলতে কেমন যেন লাগছে।”

 ”খারাপ লাগছে?” দীপ গম্ভীর হতে গিয়েও হল না।

 ”না। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আর আমাদের দেখা বোধহয় হবে না।”

 ”আমি জানতাম দেখা হবে।”

 ”জানতে? কী করে?”

 দীপ অদ্ভুতভাবে হাসল। কথা বেরোল না মুখ থেকে। শুধু ঠোঁট দুটি নড়ল।

 ”আমি আর গান শিখি না। মাস্টারমশাইকে তো এতদূরে আসতে বলা যায় না, তাহলে অনেক টাকা দিতে হবে।”

 দীপের মুখে দুঃখ ছড়িয়ে পড়ল। অস্ফুটে বলল, ”গান ছেড়ো না, তাহলে কী নিয়ে থাকবে?”

 ”জানি না। প্রাইভেটে মাধ্যমিক দেব সামনের বার।”

 ”তাই পড়ছিলে বুঝি। অঙ্ক পার?”

 ”একদম নয়।”

 ”আমি শিখিয়ে দিতে পারি, কিন্তু শেখাব না।”

 মণির চোখ বড়ো হয়ে উঠল অবিশ্বাসে তারপর কী যেন মনে পড়তেই মাথা নেড়ে বলল, ”মনে করে রেখেছ। আচ্ছা এবার ভেতরে এসো।”

 ”মা কোথায়?”

 ”পাশের একজনদের কোয়ার্টারে গেছে, এখনি আসবে।”

 ”জানো আমি একটা নাটকে অভিনয় করব পার্টটা অবশ্য খুব ছোট্ট।”

 ”সত্যিইই! ইসস আমি দেখতে পাব না।”

 দীপ ফিরে এল রাতের খাওয়া সেরে। মণির মায়ের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে। গম্ভীর, ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা। খুটিয়ে খুটিয়ে দীপের বাড়ির খোঁজ নিলেন। মণি কোয়ার্টারের ফটক পর্যন্ত দীপের সঙ্গে এসেছিল। রিকশায় ওঠার জন্য দীপকে সাহায্য করতে সে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই হাত ধরেই সে ওঠে এবং কিছুক্ষণ ধরে রেখে তাকিয়েছিল গভীর দৃষ্টিতে। মণির মুখটিকে সে উজ্জ্বল দেখেছিল।

 ”তাহলে আবার আসব।”

 রিকশা চলতেই সে চেঁচিয়ে বলেছিল। পরদিন জ্যোতির সঙ্গে মুখোমুখি হতেই দীপ কিছু একটা বলবার চেষ্টা করে। জ্যোতি শুকনো হেসে পাশ কাটিয়ে চলে গেছল।

তিন

এমন বিপর্যয় কেউ ভাবতে পারেনি। অথচ দীপ রিহার্সালে চমৎকারভাবে অভিনয় করে গেছে। নাটকের চতুর্থ দৃশ্যে তাকে প্রথম মঞ্চে ঢুকতে হবে। উইংয়ের পাশে দেবু তাকে শেষবারের মতো বুঝিয়ে দেয় কী তাকে করতে হবে। সেই সময় তার পা প্রথম কেঁপে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে গলা শুকিয়ে আসে। সে জলের জন্য ভিতরে এসে গ্রিন রুমের কাছে একটা কলসি আর গ্লাস পেয়ে জল গড়িয়ে সবে চুমুক দিয়েছে তখনি দেবুর চাপা গর্জন শুনল: ”কোথায় বামনটা, স্টেজে ইন করার সময় চলে যাচ্ছে।”

 দীপ বিষম খেল এবং কাশতে কাশতেই সে ছুটে বা দেবুর ধাক্কা খেয়ে স্টেজে ঢুকল। বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে কাঁদতে কাঁদতে বলবে: মাকে মেরো না মেরো না।

 তার বদলে সে স্টেজের মাঝে দাঁড়িয়ে কাশতে শুরু করল। স্টেজের উপর প্রধান অভিনেতা ও অভিনেত্রী হতভম্ব হয়ে দাঁড়াল। কাশি সামান্য কমতেই সে ছুটে গিয়ে বাবার বদলে মাকে জড়িয়ে ধরে চেরা গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ”মাকে মেরো না, মাকে মেরো না।”

 সারা হলঘর প্রথমে মুচকি হেসে উঠেছিল এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

 দীপ বিভ্রান্ত হয়ে গেল। অভিনেত্রীটি ওকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় ছিটকে ফেলে দিতে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে, ”আমাকে নয় ইডিয়ট, ওদিকে ওদিকে।”

 দীপ ছুটে গিয়ে এবার তার নাটকের বাবাকে জড়িয়ে ধরল। সেই সময় দর্শকদের মাঝামাঝি জায়গা থেকে কে চেঁচিয়ে উঠল, ”ওরে এ যে আমাদের ছোটবাবু। শিং ভেঙে বাছুর সেজেছে।”

 উটের পিঠে এটাই ছিল শেষ কুটো। দীপ দর্শকদের দিকে তাকাল এবং পরিচালকের নির্দেশমতো বাবার পা জড়িয়ে ধরে লাথি খাওয়ার ঘটনাটা না ঘটিয়ে পিছিয়ে গেল। বাবা তখন অগত্যা নাটক রক্ষার জন্য ছুটে গিয়ে ছেলের পিছনে লাথি মারল। লাথিটা ঠিক নাট্যসম্মত না হয়ে যথেষ্ট জোরালোই হয়। মায়ের মতো বাবাও তখন দাঁত ঘষছিল।

 দীপ স্টেজের উপর পড়ে রয়েছে। দর্শকরা হইচই করে উঠল।

 ”মরে গেছে, মরে গেছে।”

 ”বল হরি হরি বল।”

 ”ওরে এবার ওঠ, খুব হয়েছে।”

 ”আরে মশাই, একটা দামড়া বামনকে নিয়ে কি বাচ্চচার পার্ট হয়?”

 দীপ কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিল। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। দর্শকদের দিকে তাকাতেই তার মনে হল বেহুলা আর জ্যোতি যেন তৃতীয় সারিতে বসে।

 স্টেজ থেকে সে বেরিয়ে এল। গ্রিন রুমে ঢুকে সে ড্রেসারের দেওয়া জামাটা খুলে নিজের জামা, জুতো পরল। ঘড়ি এবং মানিব্যাগ নিয়ে সে সোজা বেরিয়ে এল রাস্তায় মুখে রঙ মাখা অবস্থায়।

 ট্যাক্সি পেল না। বাসের যাত্রীরা তার দিকেই তাকিয়ে ছিল যতক্ষণ না সে নেমে যায়। উৎপলা ওকে দেখেই আঁতকে উঠল। ”একি রে? যাত্রাটাত্রা করে এলি নাকি?”

 ”নাটক ছিল।” দীপ জুতো খুলতে খুলতে হালকা গলায় বলল।

 ”বলিসনি তো, তাহলে দেখতে যেতুম।”

 ”ওইজন্যই বলিনি।”

 ”কেমন করলি?”

 ”লোকে খুব হাততালি দিয়েছে। মজা পেয়েছে।”

 ”কী পার্ট ছিল তোর?”

 ”ছোটবাবুর।”

 রাত্রে কৃষ্ণচন্দ্র উৎপলাকে বলল, ”বিজয়কে পাঠিয়েছিলুম দীপের সেই বন্ধুর বাড়িতে। কী লাগবে না লাগবে জেনে এল।”

 কীভাবে যেন সারা কলেজে নাটকের ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়েছে। সারা বাড়িতে হাসাহাসি চলছে। দীপকে শুনিয়ে ”বাবা মেরো না বাবা মেরো না” বলে চেঁচিয়ে উঠেছে বিকৃত গলায়। ক্লাসে ছেলেরা অভিনয় করে দেখাল কীভাবে দীপ স্টেজে ঢুকল, ধাক্কা খেল, লাথি খেয়ে পড়ে গেল। মেয়েরা মুখে আঁচল বা রুমাল দিয়ে হাসতে লাগল।

 দীপ কিন্তু রোজই ক্লাসে এসেছে। সে শুনেছে, দেখেছেও তাকে নিয়ে কীভাবে ভেংচি কাটা চলছে। হৈমন্তী, বেহুলারা তাকে দেখে এড়িয়ে যায়, সে দুঃখ পায়। প্রায়ই তার মনে হয়, কেন নাটক করতে গেল। সকলের কাছে সে হাস্যকর একটা ভাড় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে।

 ক্লাসের পর কলেজ থেকে বেরোবার সময় পিছন থেকে জ্যোতি তাকে ডাকল।

 ”দিদির বিয়ে।”

 লাল প্রজাপতি ছাপ দেওয়া হলুদ খাম সে এগিয়ে ধরল। দীপ সেটা নিয়ে হাসল।

 ”বুধবার। তুমি অতি অতি অবশ্য আসবে। বাবা, মা সবাই বিশেষ করে বলে দিয়েছে।”

 জ্যোতির স্বরে আন্তরিকতা। দীপকে সেটা স্পর্শ করল। সে মাথা হেলিয়ে বলল, ”যাব। আর কাকে বলেছ?”

 ”ওদের চারজনকেও বলেছি। তোমার বাবা-মাকেও বলব, কাল আমাকে নিয়ে যেয়ো।”

 ”মা এখানে নেই আর বাবা গ্যাস্ট্রিকের রুগি কোথাও খান না।”

 দীপ মিথ্যা কথা বলল এবং ঠিক করে ফেলল সে নিজেও যাবে না।

 জ্যোতি চলে যাবার পর তার মনে হল, এভাবে মুখ নামিয়ে একা থাকার কোনো মানে হয় না। তাকে আবার সবার মাঝে ফিরে আসতে হবে আগের মতো হয়ে। তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টার জবাব দিতে হবে। পূর্ণদেহীর সব কাজ তাকে করে দেখাতে হবে সে করুণার পাত্র নয়।

 বহুদিন পর সে ঘোষ কেবিনে এল দুপুরের ভীড় এখন নেই। বেহুলারা চারজন একটা টেবলে। ওকে দেখে তারা আড়ষ্ট হয়ে গেল।

 ”কী ব্যাপার, তোমরা কি আমায় বয়কট করলে নাকি? আর কথাই বলো না।”

 দীপ টেবিলের পাশে দাঁড়াল। মেয়েরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল।

 ”আমিই নয় কেলেঙ্কারি করেছি, তোমরা তো করোনি। অথচ আমার থেকে দেখছি তোমরাই বেশি লজ্জা পাচ্ছ। আরে ধ্যাৎ…বসতে দাও আমায়।”

 ওরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। একসঙ্গে সবাই কলকল করে উঠল।

 ”খিদে পেয়েছে, আগে খাওয়া। বলো…?”

 ”দীপ আর চপ খেতে ভালো লাগে না, আজ ফাউল কাটলেট হোক।” তাপসী বলল।

 ”তথাস্তু।”

 এরপর জ্যোতির দিদির বিয়েতে তারা সবাই মিলে কী দেবে এবং সেজন্য বরাদ্দ কত সেই নিয়ে আলোচনাটা তর্কে পৌঁছতেই দীপ বলল, ”আচ্ছা সেই যে পিকনিকে যাবার কথা হয়েছিল তার কী হল?”

 প্রসঙ্গটা মুহূর্তে ঘুরে গেল। ওদের কথা থেকে সে জানতে পারল। কবে পিকনিক হবে তার দিন ঠিক করা আজও সম্ভব হয়নি। নীরেনদা বলেছেন বোরবার হলেই ভালো শুধু চব্বিস ঘণ্টার নোটিশ চাই। এদিকে লীনা বলছে রোববারে ওর মা বেরোতে দেবে না। তাপসীরও এতদিন অসুবিধে ছিল কেননা মা হাসপাতাল থেকে বাচ্চচা নিয়ে ফিরেছে। সংসার তাকেই দেখতে হচ্ছিল। এখন অবশ্য সে ঝাড়া হাত-পা। হৈমন্তীর অবশ্য যেকোনোদিনে আপত্তি নেই।

 ”তোমরা আমাকে নেবে না?”

 ”ও মা তোমাকে তো সেই কবে বলা হয়েছে। মনে নেই আমি বললুম নীরেনদা বলেছে দীপ খুব ভালো ছেলে, যে-কোনো মেয়েকে ওর হাতে ছেড়ে দেওয়া যায়, মনে আছে?”

 ”খুব। তাহলে আমিও যাব। দিন আজই ঠিক করো।”

 ”সামনের রোববার।” এতক্ষণে বেহুলা কথা বলল।

 ”পাক্কা। নীরেনদাকে তাহলে জানিয়ে দাও।” দীপ বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল তুলে ধরল।

চার

”কি দীপাঞ্জন, সিগারেট চলবে নাকি?”

 বাঁ হাতে স্টিয়ারিং ডান হাতে লাইটার। ঠোঁটে ঝোলানো সিগারেটটা ধরাবার চেষ্টা করতে করতে নীরেন বলল।

 ”না।”

 নীরেনের পাশে বেহুলা তার পাশে দীপ। পিছনের সিটে তাপসী, লীনা এবং হৈমন্তী।

 ”না কেন, তুমি অ্যাডাল্ট নও?”

 বাতাসে লাইটার নিভে যাচ্ছে। নীরেনের ঠোঁট থেকে সিগারেটটা তুলে নিয়ে বেহুলা নিজের ঠোঁটে রেখে কুঁজো হয়ে সিগারেট ধরাল এবং লম্বা টান দিয়ে নাকমুখ থেকে ধোঁয়া ছেড়ে নীরেনের ঠোঁটে গুঁজে দিল।

 পিছনের তিনজন পরস্পরকে চিমটি কাটল।

 ”দীপ লজ্জার কী আছে, আমরা তোমার মা না মাসি।” লীনা বলল।

 ”কখনো খাইনি।”

 ”তাহলে আজ থেকে শুরু করো। বিলিতি বেনসন হেজেস টানলে কষ্ট হবে না।” বেহুলা বলল।

 ”তুই জানিস কষ্ট হবে কি না?” পিছন থেকে চ্যালেঞ্জের মতো কথাটা এল।

 বেহুলা সিটের উপর রাখা প্যাকেট থেকে একটা বার করে ঠোঁটে রেখে ধরাল এবং পরপর টান দিয়ে গেল।

 পিছনের তিনজন এবার মুষড়ে পড়ল। সিগারেট খাওয়ার মতো যথেষ্ট আধুনিকা না হওয়ার জন্য। ওরা জানে চিমটি কেটে কোনো লাভ নেই, মজাও নেই।

 তাপসী হঠাৎ বলল, ”আমার এক বন্ধুর সঙ্গে ছাদে বসে দুপুরে লুকিয়ে খেয়েছিলাম।”

 ”কটা?” নীরেন জানতে চাইল।

 ”আধখানা।”

 ”তাহলে আজ একটা গোটা শেষ করো।”

 ”উরে বাবা।”

 ”খাবি তো খা।” বেহুলা প্যাকেটটা পিছন দিকে বাড়িয়ে দিল।

 ”না, না কেমন মাথা ঘোরে।”

 ”আমাকে একটা দাও।” দীপ হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিল। বেহুলা ধরিয়ে দিল।

 ”দীপ তাহলে অ্যাডাল্ট হল।” লীনা মন্তব্য করল। কেউ কথা বলল না। গাড়ি ব্যারাকপুর ছাড়িয়েছে। পলতা এবং ইছাপুর ছাড়াতেই দীপ উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসল। শ্যামনগর আসছে। সিগারেটটায় কয়েক টান মাত্র দিয়েছে। ফেলে দিল।

 জুট মিলের রাস্তা দিয়েই গাড়ি যাচ্ছে। গিজ গিজ করছে রাস্তাটা। অবিরত হর্ন, ব্রেক আর গিয়ার বদল করতে করতে নীরেন বিরক্ত। দীপ উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে মণিদের কোয়ার্টারটা দেখার জন্য। যদি ও বাইরে থাকে তাহলে পলকের দেখাও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ঠিক ফটকের কাছেই নীরেন গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল এবং দীপের মুখ থেকে অস্ফুট যন্ত্রণা কাতর একটা ”আহ” ধ্বনি বেরিয়ে এল।

 ”কি হল?” বেহুলা জানতে চাইল।

 ”কিছু না।” দীপের এখন ইচ্ছা করছে নেমে যেতে। পিকনিকের থেকে তার অনেক বেশি কাম্য মণির কাছে বসে কথা বলা। ফেরার সময় সে এখানে নেমে যাবে, এমন একটা চিন্তা মাথায় নিয়ে সে চুপ করে রইল।

 নৈহাটির আগেই কাঁকিনাড়ার কাছে গাড়ি বাঁদিকে ঘুরে রেললাইন পার হয়ে চলতে থাকল। সরু মাটির রাস্তা এঁকে-বেঁকে ক্রমশ গ্রামের দিকে গেছে। একটা বাঁক পেরোনোর মুখেই হঠাৎ এক ছাগল ছানা লাফিয়ে গাড়ির সামনে পড়ল এবং বাম্পার ধাক্কা খেয়ে ছিটকে গেল।

 ব্রেক কষে নীরেন শুধু বলল, ”ঝামেলায় পড়লাম।”

 ছানাটা পা ছুঁড়ে ছটফটাচ্ছে। মরেনি। কিন্তু কোথা থেকে যেন পিলপিল করে জনা কুড়ি মেয়ে পুরুষ হাজির হয়ে গাড়িটা ঘিরে ধরল।

 বেহুলা ভয়ে আঁকড়ে ধরল নীরেনের বাহু। পিছনে তিনজন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে, চাপা দিলে গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, গাড়ির লোকেদের বেদম মারা হয় এসব কথা বহু শুনেছে, দৃশ্য দেখেছেও। ওরা থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু করল। দীপও ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

 হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে নীরেন গাড়ি থেকে নামাল। দু’পা ফাঁক করে, বুক চিতিয়ে পেটাই স্বাস্থ্যটা জানতাকে দেখাল।

 ”মরেনি তো, তবে এত হুজ্জুত কীসের। আর মানুষও নয় একটা ছাগলছানা।”

 নীরেনের কর্তৃত্ববাচক কণ্ঠস্বরে ওরা চুপ করে থাকল।

 ”কার ছাগল?”

 মাঝবয়সি একটি বউ এগিয়ে এল।

 ”ছাগল না ছাগলী ওটা।”

 ”ছাগল।”

 নীরেন পিছনের পকেট থেকে জাঁদরেল একটা ওয়ালেট বার করে একশো টাকার একটা নোট বউটির হাতে দিল।

 ভীড়ের মধ্য থেকে কে বলে উঠল, ”একশো নয় দুশো দিতে হবে।”

 নীরেন সেদিকে তাকিয়ে ভ্রূ কোঁচকাল। বউটিকে বলল, ”ছাগল তোমারই রইল।”

 গাড়িতে এসে স্টার্ট দিতেই ভীড় দুভাগ হয়ে পথ করে দিল।

 কিছু পথ যাবার পর নীরেন শিস দিয়ে হিন্দি গানের সুর ভাঁজতেই, তাপসী বলল, ”ওরা গাড়িটা জ্বালিয়ে দিলেও কিছু করার ছিল না।”

 ”তা ঠিক।” নীরেন বলল। ”মারধোর করলেও কিছু করার ছিল না।”

 ”উফফ, বেঁচে গেছি। নীরেনদার কি সাহস!”

 দীপ কাঠের মতো বসে আছে। কথা বলার ক্ষমতা তার নেই।

 অল্প পরেই তারা পৌঁছে গেল। দোতলা ছোট্ট একটা বাড়ি। খোয়া ফেলা পথ ফটক থেকে বাড়ি এবং পুকুরঘাট পর্যন্ত। নারকেল, আম, কাঁঠাল, সুপারি গাছ পুকুরের চারধারে। একদিকে নিচু পাকা পাঁচিল। প্রায় পনেরো বিঘের বাগান। পুকুরের একধারে ছোট্ট একটা টালির ঘর।

 নীরেন বাজার করেই এনেছে। রান্নার সরঞ্জাম সব এখানেই আছে। পাশের গ্রামে মালির বাড়ি থেকে কাল রাতে খবর এসেছে তার ছেলে জলে ডুবে মারা গেছে। তাই মালি অনুপস্থিত।

 রান্নার জন্য ব্যবস্থা করতে সবাই মেতে উঠল। সন্দেশের বাক্স হাতে হাতে ঘুরে শেষ হয়ে গেল। অনেকগুলো কলা পড়ে রইল। ডিম সেদ্দ দুটোর বেশি কেউ খেতে পারল না।

 সবাইকে ডাব খাওয়াবার জন্য নীরেন একটা হাফপ্যান্ট পরে খালিগায়ে একটা নারকেল গাছে ওঠার চেষ্টা করল। কুড়ি-বাইশ ফুট উঠে হাল ছেড়ে নেমে এল।

 ”বড্ড পিছল। মালির ছেলেটা এই সময়ই ডুবে মরল। থাকলে পেড়ে দিত।”

 দীপ ঘুরে বেড়াচ্ছিল বাগানে। রান্নায় ব্যস্ত হৈমন্তী আর নীলা। অন্যরা পুকুর ঘাটে বসে গল্প করছিল। কিছুক্ষণ পর আর গল্প জমল না। নীরেন চেঁচিয়ে বলল, ”দীপাঞ্জন সাঁতার জানো?”

 ”একটু একটু।” দীপ ওপার থেকে সাড়া দিল।

 ”ওদিকে যেয়ো না, সাপ থাকতে পারে।”

 কথাটা বলে নীরেন অন্যদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। প্রায় ছুটেই দীপ ফিরে এল।

 হাফপ্যান্টটা নীরেন খুলে ফেলল। ভিতরে কস্ট্যুম। বেহুলা বাদে বাকি মেয়েরা মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল এবং বারবার অন্যমনস্ক হল।

 নীরেন কিছুক্ষণ জলে ঝাঁপাঝাপি করে মেয়েদের ডাকতে লাগল জলে নামার জন্য।

 ওরা বলল, কেউই সাঁতার জানে না।

 ”তাতে কী হয়েছে, আমায় ধরে সাঁতার কাটবে।”

 তিনজনে শুধু হাসল। বেহুলা শাড়ি পরেই জলে নেমে গেল। তাকে পিঠে নিয়ে নীরেন সাঁতরাতে শুরু করল।

 ”বেহুলাটা বড্ড বাড়াবাড়ি করে।”

 ”লোক দেখলে একটু বেশিই করে।”

 ”এখানে লোক আর কোথায়?”

 ”কেন আমরা। ও তো আমাদেরই বেশি করে দেখায়। সিগারেট কি না খেলেই চলত না?”

 তিনজন যখন এইসব কথা বলে চলেছে, দীপ তখন সিঁড়িতে জলে পায়ের পাতা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল সাঁতার কাটা।

 হঠাৎ তাপসী বলল, ”অ্যাই দীপ, জলে নামো।”

 ”সেই কবে হেদোয় শিখেছি। তাও বেশিদূর যেতে পারি না। প্র্যাকটিশও নেই।”

 ”তাতে কী হয়েছে। নীরেনদা কেমন কাটছে আর তুমি প্র্যাকটিশ নেই বলে পাশ কাটাচ্ছ।”

 হঠাৎ লীনা ছুটে গিয়ে দীপকে ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দিল।

 ”এইবার প্র্যাকটিশ করো গে।”

 দীপ হাত-পা ছুঁড়ে হাঁ করে বাতাস টানছে। একবার ডুবছে আর উঠছে আর পাগলের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে ”ওহ ওহ” শব্দে চিৎকার করে যাচ্ছে।

 মেয়েরা প্রথমে ভেবেছিল দীপ মজা করছে। তারপরই বুঝতে পারল দীপ ডুবে যাচ্ছে।

 ওরা সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নীরেন সাঁতরে এসে দীপের চুলের মুঠি ধরে এবং বেহুলাকে পিঠে নিয়ে পাড়ে এল।

 দীপ মূহ্যমানের মতো সিঁড়িতে বসে। বেহুলা নীরেন বাড়ির মধ্যে গেছে। মেয়েরা মুখে হাত দিয়ে অবাক বিমূঢ়।

 ”এই যে বলল সাঁতার শিখেছিল! শিখলে কি কেউ ভোলে?”

 ”গুল মেরেছে।”

 ধীরে ধীরে দীপ সিঁড়ি ভেঙে উঠে এল। ওদের দিকে তাকিয়ে হাসল। নীরেন আবার হাফপ্যান্ট পরে ফিরে এসেছে।

 ”দীপ কি ডুবে যাচ্ছিল নীরেনদা?”

 ”বোধ হয়।”

 ওদের মুখ কিছুক্ষণের জন্য শুকিয়ে গিয়ে আবার বিরক্তিতে ভরে গেল।

 লীনা বলল, ”অপদার্থ।” হৈমন্তী সায় দিল। দীপ ক্লান্ত মুখটা তুলে ওদের দিকে তাকাল।

 মাংস ভাত ছাড়া আর কিছু রান্না হয়নি, কলকাতা থেকে আনা হয়েছে দই। সব কিছুই পরিমাণে বেশি।

 ”এত পড়ে থাকবে! তা হবে না। ওরা না খায় না খাক, আমরা ভাগাভাগি করে, বুঝলে দীপাঞ্জন, শেষ করে দিতে হবে।”

 মাংসের ডেকচিটা মাঝে বসানো ছিল। নীরেন হাতায় করে দীপের পাতে তুলে দিতেই সে আঁতকে উঠল।

 ”আরে আমিও তোমার সঙ্গে জয়েন করছি।”

 নিজের পাতেও সে প্রচুর মাংস নিল এবং স্বচ্ছন্দে খেয়ে যেতে লাগল।

 মেয়েরা দীপকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। পেটে হাত দিয়ে সে বলল, ”বিশ্বাস করো আর পারছি না।”

 ”তুমি পারোটা কি বলোতো?”

 দীপ করুণ মুখে তাকিয়ে হাসল।

 খাওয়ার পর দোতলার বারান্দায় ওরা পা ছড়িয়ে গল্প করতে শুরু করল।

 নীরেন আর বেহুলা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল, ভ্রূকুটি করছে, জিভ দেখাচ্ছে আর মাঝে মাঝে গল্পে যোগ দিচ্ছে। হঠাৎ বেহুলা একতলায় নেমে গেল। কিছুক্ষণ পর নীরেনও উঠল-”কী করছে দেখি তো” অজুহাত দিয়ে।

 মেয়েরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ঝিমিয়ে রইল।

 ”চল বাগানে ঘুরে আসি।”

 ”সাপ আছে।”

 ”ওদিকে যাব না।”

 ওরা এবং দীপ একতলায় নেমে এল। বাগানে ছড়িয়ে পড়ে ঘুরতে থাকল। টালির চালের ঘরটার কাছে এসে হৈমন্তী থমকে দাঁড়াল। তালাটা নেই কিন্তু ভিতর থেকে বন্ধ। ছুটে সে লীনার কাছে এসে বলল, ”ব্যাপার দেখবি আয়।”

 দুজনে ঘরের কাছে এসে দেয়ালে কান ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ পর ফিরে এল পাংশু মুখে।

 ”নীরেনদা আর বেহুলা।”

 ”আগে থেকেই বোধহয় বলা-কওয়া ছিল।”

 ”এরকম জায়গায় আমাদের আসার কোনো মানে হয় না।”

 ”দীপ ছাড়া আর একটা পুরুষও নেই।”

 ”ওটাকে পুরুষ বলিস?”

 তাপসীকে ডেকে ওরা খবরটা দিল। দীপ পাঁচিলের ধারে একটা প্রায় তিনতলা উঁচু নারকেল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ঢিল ছুড়ে ডাব পাড়ার চেষ্টা করছিল।

 ”দ্যাখ বামনটার কাণ্ড দ্যাখ।”

 ”চলতো ওটাকে একটু শিক্ষা দি।”

 তিনজন দীপের কাছে এল। ওদের দেখে লাজুক হেসে বলল, ”এভাবে পাড়া যায় না।”

 ”যায় না তো গাছে উঠে পাড়ো না।”

 ”বড্ড উঁচু।”

 ”নীরেনদা উঠতে গিয়ে ফেল করেছে। তুমি পারবে না?”

 ”দীপ পারবে না?”

 ”দীপ ডাউন দিতে হবে।”

 ”দীপ পারতেই হবে।”

 ”দীপ পুরুষ মানুষ তুমি। না বোল না।”

 দীপের মুখে একগাল হাসি। বলল, ”পেড়ে দিতে পারলে কী দেবে আগে বলো।”

 ”তাহলে।” হৈমন্তী ঠোঁট কামড়ে বলল, ”আমাদের যাকে চাও ওই ঘরে নিয়ে যেতে পারবে।” আঙুল দিয়ে সে টালির ঘরটা দেখাল।

 ”না না।” দীপ মাথা নাড়ল। ”আমি শুধু বন্ধুত্ব চাই।”

 ”তাই হবে। কিন্তু যদি না পারো?” তাপসী হাত চেপে ধরল দীপের।

 ”তাহলে আর আমার মুখ দেখতে পাবে না। অন্য কলেজে ট্রান্সফার নেব।”

 ”না না, পারতেই হবে। হবে হবে হবে।” তাপসী অদ্ভুত গলায় বলল। দীপ অবাক হয়ে তাকিয়ে উত্তেজিত, হিংস্র, কাতর মুখগুলির থেকে কোনো অর্থ বার করতে পারল না।

 খালি গায়ে পাজামাটা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে দীপ ওঠার চেষ্টা শুরু করল। ওরা গাছটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে, কিছুটা উঠেই সে, নেমে এল।

 ”পেটে বড্ড চাপ লাগছে।”

 ”জানতুম এইরকম একটা অজুহাত দেবে।” দু হাত ঝাঁকিয়ে হৈমন্তী বলল প্রায় চিৎকার করে।

 দীপ আবার ওঠার চেষ্টা শুরু করল। ধীরে ধীরে প্রায় দোতলা পার হয়ে গেল। মেয়েদের মুখে বিস্ময় ফুটল। ওরা হাততালি দিয়ে উঠল। দীপ গাছটা জড়িয়ে হাঁফাচ্ছে। দুটো পা পিছলে যাচ্ছে বারবার। আঙুলগুলো বেঁকিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইছে, পারছে না।

 একটা ইটের টুকরো নিয়ে হৈমন্তী শাসানি দিল, ”দীপ খবরদার, এক ইঞ্চি নেমেছো কি মাথা ফাটিয়ে দেব।”

 হৈমন্তী ইটটা ছুঁড়ল। গাছে লেগে শব্দ হতেই দীপ ধড়ফড়িয়ে ওঠার চেষ্টা শুরু করল। কয়েক হাত উঠে আবার সে গাছটা জড়িয়ে রইল। শরীর থরথর কাঁপছে, নিশ্বাস নিতে হাঁ করল।

 তিনজনে একসঙ্গে ইঁট ছুঁড়ল। তারপর আবার একঝাঁক।

 ”পারতে হবে। পারতেই হবে।” উন্মাদের মতো লীনা চেঁচাল।

 ”আর একটু দীপ, আর একটু।” তাপসী আবার ছুঁড়ল। দীপের পাশ দিয়ে সেটা বেরিয়ে গেল। আর থরথর করে কেঁপে দীপ পড়ে গেল।

 মাথাটা প্রথমে পাঁচিলে পড়ল সেখান থেকে ছিটকে এল হাত পাঁচেক দূরে। বার কয়েক পা দুটো খিঁচিয়ে দীপের শরীর স্থির হয়ে গেল।

 আধ ঘণ্টা পরে অ্যাম্বাসাডারটা শ্যামনগরের জুট মিল কোয়ার্টারের ফটক পেরিয়ে কলকাতার দিকে চলে গেল। পিছনের সিটে বসা-ভঙ্গিতে দীপের নিস্পন্দ দেহটা রাখা ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *