সবাই যাচ্ছে

সবাই যাচ্ছে – মতি নন্দী – উপন্যাস

প্রতি সোমবার ভোরে সে অপেক্ষা করে কথাটা শোনার জন্য।

 ”আমি যাচ্ছি।”

 আমি আসি বা আমি চললুম নয়। প্রায় সাত বছর ধরে, যখন থেকে অলকা বর্ধমানের খড়িসোনা বালিকা বিদ্যালয়ের হেড মিস্ট্রেসের চাকরি নিয়ে সেখানে বাস করছে এবং প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় ফিরে সোমবার ভোরে ট্রেন ধরতে বেরোচ্ছে তখন থেকেই এই শব্দ দুটি তাকে শুনে আসতে হচ্ছে।

 আধঘুম-আধজাগরণের মধ্যে সন্দীপের শিথিল মস্তিষ্ক অভ্যাসবশতই অপেক্ষা করে মাড় দেওয়া শাড়ির খসখসানি বা দ্রুত চলাফেরার কিংবা রান্নাঘরে বাসন নাড়ানাড়ির শব্দগুলোর জন্য। কোনো কোনোদিন অলকার ব্যস্ত যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরও শুনতে পায়: ”চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

 তখন সে চোখ মেলে। আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে উপুড় হয়ে হাত বাড়িয়ে নিচু টুলটা থেকে কাপ তুলে নেয়। কিছু দরকারি কথা সাধারণত এই সময়ই হয়।

 ”শাড়ি আর্জেন্ট না অর্ডিনারি?”

 ”আর্জেন্টের কী দরকার? শুধুমুধু বেশি পয়সা দেওয়া।”

 ”শনিবার কি যেতে পারবে অমিয়র ছেলের পৈতেয়?”

 ”যদি তাড়াতাড়ি আসি, ট্রেন বড্ড লেট করছে আজকাল।”

 ”কী দেওয়া যায়?”

 ”বইটই দিয়ো, কি খেলার কিছু।”

 ”বড্ড দাম। মা কিছু বলেছে কাকার ব্যাপারে?”

 ”চেষ্টা করেছিলেন। এসব ঝগড়া আমার ভালো লাগে না।”

 ”ওষুধ নিতে ভোলনি তো?”

 ”নিয়েছি।”

 শুকনো খসখসে স্বরে দ্রুত জবাব দেয় অলকা শয়ন-স্নান-রান্নাঘরের মধ্যে ঘুরে ঘুরে কাজের সঙ্গে সঙ্গে। দিনের আলো তখনও যথেষ্ট ফুটে ওঠে না। তাই টেবিলল্যাম্পটা ঘরে জ্বালাতে হয়। একসময় বাঁ হাত তুলে ঘড়িতে চোখ রেখেই উৎকণ্ঠিত স্বরে বলে, ”আমি যাচ্ছি।”

 মাসের পর মাস, ছুটির দিনগুলো বাদে, পুনরাবৃত্তি হয়ে যাচ্ছে এই ভঙ্গির, চলনের, উৎকণ্ঠার এবং এই কথার। আজও তাই।

 ”বই খাতা কিছু ফেলে যাচ্ছ না তো, চাবি?”

 তিনতলা থেকে চটির শব্দ দোতলার কাছাকাছি নেমে গেছে। সিঁড়ি থেকে রুটিনমাফিকই উত্তর এল, ”নিয়েছি।”

 অলকা কখনো কিছু ভোলে না।

 প্রথম দিকে সন্দীপ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াত। বাড়ি থেকে বেরিয়ে অলকা ডানদিকে ষাট-সত্তর মিটার দূরের বাসস্টপে দাঁড়াবে। দিনের দ্বিতীয় কি তৃতীয় বাসটি সে ধরে। ভোরের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে মিনিট পনেরোর মধ্যে হাওড়া স্টেশন পৌঁছে যায়।

 অলকার উচ্চচতা পাঁচ ফুট। ওজন আটত্রিশ কিলোগ্রাম, গত দশবছর ধরে। ওর বাঁ কাঁধের ঝোলাটা হাঁটু ছাড়িয়ে যায়। প্রতি পদক্ষেপে হাঁটুর ধাক্কায় সেটা পেন্ডুলামের মতো দোলে। গত সাত বছরে এটা দ্বিতীয় ঝোলা। প্রথমটা চুরি যায় ট্রেনে। শ্যামবাজার থেকে কলেজস্ট্রিট চষে ঠিক আগেরটির মতো হলুদের উপর খয়েরি নকশার আর একটি কিনেছে।

 ওর মধ্যে কী কী জিনিস থাকে সন্দীপ ভালোভাবে আজও তা জানে না। কাচিয়ে নেওয়া শাড়ি, গায়ে মাখা সাবান বা খাতার গোছা অলকাকে ভরতে দেখেছে। একবার মুখের ক্রিম আর একটা ব্রাশিয়ারের বাক্স রাত্রে টেবলে দেখেছিল। অলকা তখন রান্নাঘরে। বাক্সে ছাপা ছবিতে বিস্ফারিত রমণীবক্ষের প্রতি কৌতূহলে সে ঝুঁকে পড়ে। তখন বাক্সের এককোণায় ”৩৪” সংখ্যাটি দেখে সে নিশ্চিন্ত হয়, জিনিসটা অলকার নয়। ওকে মুখেও কখনো কিছু মাখতে দেখেনি।

 ”সেক্রেটারির মেয়ের ওগুলো, কিনতে দিয়েছে।”

 ঠান্ডা, আবেগহীন, বিরক্তিমাখা গলায় কথাগুলো বলার আগে অলকা নিঃশব্দে কখন ঘরে ঢুকেছিল। এসব অদরকারি জিনিসকে কেউ তার ব্যাপার হিসেবে ভাবুক এটা সে চায় না। সন্দীপ অপ্রতিভ হয়ে টেবলের কাছ থেকে সরে গেছল।

 সেই প্রথমদিকে, আগ্রহের বা মমতার থেকেও কর্তব্যবোধের তাগিদ সন্দীপের মধ্যে কিছুটা প্রবলই ছিল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থমথমে ভারী নিবাত আবহাওয়ায় নিজেকে জারিয়ে অদ্ভুত একটা বিষণ্ণতা বোধ করেছে। তখন সে দেখেছে ফুটপাথে বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে ঘুমোন আধল্যাংটো মানুষ আর মাথার কাছে কুণ্ডুলি পাকানো কুকুর। অত সকালেই মানুষের ব্যস্ত হাঁটা, জলের কলে বালতি পেতে গৃহিণী এবং কিশোরীর দাঁড়িয়ে থাকা আর স্নানার্থীর অধৈর্যতা। বাস স্টপের কাছে মুরারির চায়ের দোকান থেকে মন্থর তামাটে ধোঁয়ার উপরে ওঠা ও বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া। প্রায় কুড়ি মিটার দূরে, রাস্তার ওপরে বধূটির জানলায় হেলান দিয়ে বাসি বিনুনি খুলতে খুলতে আনমনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকা। কোনো বাড়িতে ঝিয়ের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ বা ডাক্তারের নির্দেশে আয়ুঃপ্রার্থীর সমান গতিতে পদচালনা-এই সব নিয়ে সে বারান্দায় কিছুদিন সকালে ছিল।

 বারান্দার ধার ঘেঁষে ছাদ থেকে বৃষ্টিজলের ফাটাপাইপ নেমে গেছে। কালো শ্যাওলা মখমলের মতো পুরু হয়ে দেয়ালে, সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য আলোয় ঘন সবুজের আভা পায় কী করে, সন্দীপ সেটাই গভীর আগ্রহে লক্ষ করেছিল। খট করে শব্দ হলে মুখ ফেরাত। রাস্তা থেকে কাগজটা পাকিয়ে সুতোবেঁধে কখন যে হঠাৎ ছুঁড়ে দেয় কাগজওলা। অদ্ভুত টিপ! তিলতলায় পানুর বারান্দায়ও তো এটা পড়তে পারে! একদিনও তো হয়নি।

 সারাদিনের কোলাহল, শব্দ থেকে বিচ্যুত দিনের এই অংশটুকু অপারেশন ঘর থেকে বেরোনো রোগীর মতো আবছা ঘোর অবস্থা তার মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য তৈরি করে। সে অলকাকে দেখার জন্য তখন বাসস্টপে তাকায়। কিন্তু তিনতলায় বারান্দার দিকে অলকা কখনোই তাকায় না। পুব থেকে বাস আসবে, মুখ সেদিকে ফিরিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বাস স্টপে তখন যারা থাকে অভ্যাসবশত স্ত্রীলোক দেখে অলকার দিকে তাকায় এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়। তখন সে বুকে একটা মোচড় খায়, অলকার জন্য এবং তার নিজের জন্যও। মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়স অথচ দ্বিতীয়বার কেউ ওর শরীর চোখ দিয়ে চাটতে চায় না, সন্দীপ নিজেও নয়। অলকা সেটা জানে।

 ”আমি যাচ্ছি।”

 আজও সন্দীপ কথাটা শোনার জন্য বালিশটা বুকে আঁকড়ে চোখ বুজিয়ে অপেক্ষা করছে। অলকার যাবতীয় শব্দ রুটিনমাফিক একে একে সমাপ্ত হচ্ছে। শব্দ হয়েছে-কলঘর থেকে বেরোবার, চিরুনি রাখার, চটিতে ব্রাশ ঘষার, টেবিলে চাবির গোছা রাখার, এইবার-

 ”শুনেছ কি, হাসির স্বামী ফিরে এসেছে।”

 প্রশ্ন নয়, বিবৃতি। সন্দীপ চোখ খুলল। বেরোতে গিয়ে যেন মনে পড়ে গেছে এমনভাবে অলকা দরজার খোলা পাল্লায় হাত রাখে। খবরটা শুধু জানানো ছাড়া কোনো কৌতূহল বা আগ্রহ তার দাঁড়ানোয় নেই।

 ”শুনলে কোথায়?”

 ”মার কাছে, কাল রাতে বললেন।”

 বলরাম দত্তর প্রথম স্ত্রী দুই ছেলে সন্দীপ ও প্রদীপকে রেখে মারা যাবার পর তিনি আবার বিয়ে করেন আজ থেকে প্রায় আটাশ বছর আগে এবং শুভদীপের জন্মের দেড় বছরের মধ্যেই মারা যান। বিধবা ভারতী ও তাঁর ছেলে দোতলার অর্ধাংশ নিয়ে আলাদা রয়েছেন। স্বামীর প্রথমপক্ষের দুই ছেলেকে যেমন তিনি বরাবরই বিশেষ পছন্দ করেননি, তেমনি তারাও এই মা-র হৃদয়কে স্নেহে ও বাৎসল্যে টলমল করাতে আবেগ সঞ্চারের চেষ্টায় নিবৃত্ত থেকেছে। দু তরফের নৈকট্যের মাঝে অবিশ্বাস উদাসীনতা ও সন্দেহের একটা পর্দা ঝুলে থেকেছে সর্বদা। কিন্তু কখনোই কেউ পর্দাটা সরাবার জন্য হাত বাড়ায়নি বরং সন্তর্পণে হাত টেনেই রেখেছে আর সযত্নে তিক্ততা বিসম্বাদ এড়িয়ে গেছে। ফ্ল্যাটবাড়িতে তিন প্রতিবেশীর মতো পরস্পরের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে ওরা বাস করছে, অন্তরঙ্গতা ও আত্মীয়তা যতটা দরকার তার বেশি নয়।

 শুধু পারেননি একতলায় বাসিন্দা জগন্নাথ। সন্দীপের কাকা। বিয়ে করেননি, একটি ঘর নিয়ে থাকেন এবং এই বাড়ির অর্ধেক অংশের মালিক। দাদা বলরামের দ্বিতীয় বিবাহে তাঁর সায় ছিল না। নানান ব্যাপারেই বয়সে অন্তত ১২ বছরের ছোটো বউদির বা ভাইপো মানুর সঙ্গে তার বিবাদ হয়।

 হাসির স্বামীর প্রত্যাবর্তনের খবরটা অলকা কাল রাতেই জানতে পারত। কিন্তু তাহলেই এই নিয়ে একটা আলোচনার কারণ ঘটত এবং অলকা সেটা চায়নি। ওর সব ব্যাপারে কোনো কৌতূহল নেই।

 ”ভালো। তোমার বোধহয় দেরি হয়ে গেছে।”

 বাঁহাত তুলে অলকা ঘড়ি দেখেই বেরিয়ে গেল। সন্দীপ আড়মোড়া ভেঙে আবার বালিশটা বুকে জড়িয়ে নিল। শনিবারই হাসির সঙ্গে বিকেলে একমিনিটের জন্য দেখা হয়েছে।

 ধর্মতলায় রাণী রাসমণি রোড পার হচ্ছিল হাসি। একটা মন্থর দোতলা বাসের পাশাপাশি জোরেই আসছিল মিনিবাসটা। হাসি সেটা লক্ষ্য না করে রাস্তা পার হচ্ছিল। সে মিনিবাসের মুখে পড়ে যায়। একটা ব্রেকের শব্দ ছাড়া কোনো দুর্ঘটনা হয়নি। হাসি বিব্রত বিভ্রান্ত মুখে রাস্তার মাঝে সিমেন্টের আলের উপর উঠে পড়ে। চাপা না পড়লে এসব ব্যাপারের দিকে কেউ নজর দেয় না। এবার দুধার দেখে সে বাকি অর্ধেক রাস্তাটা পার হয়। সন্দীপ ওইখান দিয়েই তখন যাচ্ছিল। সে দাঁড়িয়ে পড়ে। হাসিকে দেখে।

 ”এভাবে রাস্তা পার হয় কেউ, যাচ্ছিলে তো আজ। এত ব্যস্ততা কীসের?”

 হাসি থতোমতো হয়ে হাসবার চেষ্টা করে। ”বাস ধরতে হবে, তাড়া আছে সানুদা।”

 হাসি ব্যস্ত হয়ে দু’পা এগিয়েই ঘুরে দাঁড়িয়ে কিন্তু কিন্তু করে বলল। ”ও ফিরে এসেছে জানো?”

 ”কে, সুহাস!”

 অকল্পনীয় ঘটনা। অনেকেরই ধারণা সম্ভবত মরে গেছে। নয়তো কানাডা কি নাইজেরিয়ায় গিয়ে বিয়ে করে ঘর সংসার করছে, অথবা ভারতেই কোথাও জেলে পচছে। সুহাস প্রায় এগারো বছর আগে নিরুদ্দেশ হয়।

 ”শরীর একেবারে গেছে, খুব ভালো অবস্থা নয়। তুমি এসো-না আমাদের বাড়ি।”

 ”সময় করাই তো শক্ত।”

 ”আমাদের টিফিনের সময় এসো, একটায়। তোমায় সব বলব।”

 সুহাস হাসির স্বামী এবং সন্দীপের জ্যাঠার ছেলে। প্রায় সমবয়সি তারা। জ্যাঠা বহুকাল আগেই আলাদা হয়ে মুরারির দোকানের পাশের রাস্তা অনিল কুণ্ডু লেনে বাড়ি কিনে উঠে যান। ওই গলিতেই হাসিরা ভাড়া থাকত। পাড়া বলতে সন্দীপ ও প্রদীপ এখনও বোঝে অনিক কুণ্ডু লেনকেই। তাদের বাল্য ও কৈশোর ওখানেই কেটেছে গলিতে ক্যাম্বিস বল খেলে, আড্ডা দিয়ে।

 মাসখানেক আগে সন্দীপ গলিতে ঢুকছিল। বাল্যবন্ধু সঞ্জিত ব্লক কংগ্রেস সম্পাদক, তারই খোঁজে গেছল যদি ওর ছেলেরা কয়েক লিটার কেরোসিন জোগাড় করে দেয়, তখন বাড়িটাকে অনেকদিন পর দেখে। প্রায় তিরিশ বছর আগে সুহাসের দিদির বিয়ের সময় যে মেরামত আর কলি হয়েছিল তারপর আর হাত পড়েনি। বাড়ির আধখানা জ্যাঠাই বিক্রি করেন মারা যাবার আগে। বাকি অংশের বাইরের দিকে পলেস্তরা সামান্যই লেগে আছে দেয়ালে, জানালার দুটো পাল্লাই ঝুলে পড়েছে কবজা থেকে, দু-তিনটে গরাদ নেই। সদরদরজায় টুকরো কাঠের তাপ্পি, চৌকাঠের জায়গাটায় গর্ত। একতলায় একখানা ঘর বিহারী কয়লাওলা পরিবারকে ভাড়া দেওয়া, উপরের দুটিতে হাসি থাকে তার বারো বছরের ছেলে বিভাসকে নিয়ে। হাসির জীবনটা কষ্টের।

 সন্দীপ আড়মোড়া ভেঙে কলঘরে গেল। মিষ্টি হালকা গন্ধ ভাসছে। অলকার শখ সুগন্ধী সাবান মাখার। আর কোনো শখ কি ওর আছে? একসময় ছ-সাত জোড়া চটি ছিল, এখন মাত্র একজোড়া। প্রতি রবিবার বাজার যেত, এখন মাঝে মাঝে। কলকাতায় স্কুলের কাজ নিয়েই তো বসে থাকে সারাক্ষণ।

 বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল সে। বাস আসছে। অলকা এবং তিনজন ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নামল। সামনের বাড়ির জানলাটা বন্ধ। দোকানের বেঞ্চে একটা বাচ্চচাছেলে ঘুমোচ্ছে। মুরারি মগভরা জল তার মুখে ছুঁড়ে চিৎকার করল। সন্দীপের কানে ”হারামজাদা” শব্দটা এল। ধড়মড়িয়ে ছেলেটা উঠে বসল।

 বারান্দার একধারে পাকানো খবরের কাগজটা পড়ে রয়েছে। সে ব্যস্ত হল না। থাকুক আপাতত। বাসটা যাচ্ছে বারান্দার সামনে দিয়ে। সে মুখ নীচু করে দেখতে দেখতে নীচের বারান্দায় পানুকে চেয়ারে বসে কাগজ পড়তে দেখল। একটু অবাক হল পানুর চাঁদিতে টাকের আকার দেখে। মুখোমুখি একদমই বোঝা যায় না ওর চুল কতটা উঠে গেছে। বছরখানেকের মধ্যেই চোখে পড়ার মতো হবে। জলের জন্য কি? পেট গরম হলেও নাকি টাক পড়ে। বংশে টাক আছে। বাবার ছিল, কাকারও রয়েছে।

 সন্দীপ লক্ষ করল, পানুর চুলেও পাক ধরেছে। মুখটা লম্বাটে, গায়ের চামড়া ঘন কফি রঙের, পাক্কা ছ’ফুট, শীর্ণ গড়ন। বুকের, কানের পাশে, রগের কাছে চুলগুলো সাদা। ওর বয়স এখন মাত্র সাঁইত্রিশ, তার থেকে প্রায় তিনবছরের ছোটো। পানু ছোটো থেকেই ঢ্যাঙা। ভালো গোলকিপার ছিল, কিন্তু অসুবিধা হত হাইটের টুর্নামেন্টে নামতে। কে বলেছিল, কোমরে শক্ত করে কষে দড়ি বাঁধলে শরীরের উপরাংশ নেমে আসে, হাইট কমে যায়। তাই শুনে একবার পেটে কাপড়ের পাড় বেঁধে, দুদিক থেকে দুজন ওকে যখন বেঁটে করবার চেষ্টায় টানতে থাকে তখন অসহ্য যন্ত্রণা সত্ত্বেও ওর মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোয়নি। চোখ দুটো শুধু বড়ো হয়ে ছলছলিয়ে উঠেছিল। নীরবে কষ্ট সইবার ক্ষমতাটা ওর জন্মগত।

 হাসিকে ভালোবেসেছিল পানু, বিয়ে করতেও চেয়েছিল। কিন্তু সুহাস সব ওলটপালট করে দেয়।

 কোলের উপর কাগজ বিছানো, মাথাটা ঝোঁকানো। ঘাড়টা আরও শীর্ণ লাগছে। সন্দীপ দুঃখবোধ করল পানুর জন্য। কাকা জগন্নাথ রোজ ব্যায়াম করতেন। তাদের একদিন ছাদে ডেকে এনে দুই হাতে দুই ভাইয়ের ঘাড় ধরে ঝাঁকানি দিয়ে বলেছিলেন, ”মরদের মতো চেহারা কর, বুঝলি, গায়ে জোর কর নয়তো যবন, ম্লেচ্ছদের হাত থেকে হিন্দুদের বাঁচাবি কী করে, দেশ গড়ার জন্য কাজ করবি কী করে? এই হাতে কটা মুসলমান মেরেছি জানিস?” তারা সিঁটিয়ে গিয়ে কাকার দুই পাঞ্জার দিকে তাকিয়ে ছিল। ওরা পাড়ার লোকের কাছে গল্প শুনেছে ছেচল্লিশের দাঙ্গায় শেখবাগান বস্তির অর্ধেক মানুষকে তিনি একাই কুপিয়ে শেষ করেছিলেন। সারা উত্তর কলকাতায় ”জগা” শব্দটা তখন ছড়িয়ে গেছল ভয় আর বিভীষিকার অপর নাম হিসাবে। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে সবাই আঙুল দিয়ে তাকে দেখাত, ফিসফাস করত। কপোÅরেশন ইলেকশনে প্রথম দাঁড়িয়ে এগারোজন প্রার্থীর মধ্যে শেষ স্থান আর বত্রিশ ভোট পেয়েছিলেন জগন্নাথ দত্ত। সন্দীপের এখনও মনে পড়ে, উঠোনে উনুন পেতে লুচি, আলুরদম, বোঁদে তৈরি হয়েছিল। ষাট-সত্তরজন ভলান্টিয়ারের অবিরাম আনাগোনা, চিৎকার। সারা বাড়িতে উত্তেজনার মধ্যে পানু তাকে ফিসফিস করে বলেছিল, ”কাকা হেরে যাবে, তুই দেখে নিস।” যবনদের হাত থেকে যাদের রক্ষা করলেন তাদের এহেন আচরণে বিমূঢ় হয়ে দিনতিনেক ঘরেই শুয়েছিলেন। এখনও প্রায় সারাদিনই একতলায় সদরদরজার বাঁদিকে তাঁর ঘরের মধ্যেই থাকেন। দরজার পাল্লা কোনো কারণে ফাঁক হয়ে গেলে তাকে দেখা যায় ইজিচেয়ারে, খোলা জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে।

 পানুটা সেদিন কী করে যে অমন ভবিষ্যদ্বাণী করে ফেলল! সন্দীপ শুধু অবিশ্বাসভরে তাকিয়ে থেকে বলেছিল, ”ছি^ঃ এমনকথা আজ বলতে নেই, কাকা শুনলে দুঃখ পাবেন।” পানু তখন তার হাতটা চেপে ধরেছিল ভয়ে।

 পাতলা একটা হাসি ভেসে গেল সন্দীপের ঠোঁটের উপর দিয়ে। মাথা নীচু করে আবার দোতলার বারান্দায় তাকাল। বাসি চায়ের কাপ হাতে পানুর পাশে দাঁড়িয়ে। সাত বছরের দেবু স্কুলের ইউনিফর্ম পরে জুতোহাতে অপেক্ষা করছে। হাত বাড়িয়ে নেবার সময় পানু শুধু কাপটার দিকেই তাকাল। বাণী কী একটা বলল, পানু কাগজে চোখ রেখেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ছেলেকে জুতো পরিয়ে দেবার জন্য বাণী উবু হয়ে বসল।

 বাণী মোটা হয়ে গেছে। বুক আর তলপেট ঝুলে পড়েছে স্ফীত হয়ে। ঘাড়ে একদলা মাংস। হাসির বিয়ের দুবছর পর পানু বিয়ে করে। তখন বাণীর ছিপছিপে, উত্তেজক, তীক্ষ্ন শরীর ছিল। তারকেশ্বরের কাছাকাছি এক গণ্ডগ্রামে গিয়ে সন্দীপই দেখে পছন্দ করে অষ্টম শ্রেণীতে পাঠরতা পাত্রীকে। তার মনে হয়েছিল, হাসির স্মৃতি থেকে রেহাই পেতে পানুর এখন ডুবে যাওয়া দরকার ভালো শরীরের কোনো মেয়ের মধ্যে। কি যে বোকার মতো ধারণায় একসময় মাথাটা ভরা ছিল। তখনও তার নিজের বিয়ে হয়নি। পানু অবশ্য কোনোদিন অনুযোগ করেনি বাণীর নির্বাচন নিয়ে। নীরবে যন্ত্রণা বহনের ক্ষমতা ওর আছে। সন্দীপ কুঁকড়ে থাকে এই ব্যাপারটিতে।

 কাকা গঙ্গাস্নানে যাচ্ছন। লুঙ্গি, গেরুয়া খদ্দরের ফতুয়া, হাতে প্লাস্টিক থলি। স্বাস্থ্যটা এখনও মজবুত। দুটো পুরোবাহু, ঘাড় এবং কাঁধের প্রস্থ তিরিশ বছর আগের মতোই রয়েছে। ওইসময়ই তিনি দুই ভাইপোকে ব্যায়ামে উৎসাহী করার চেষ্টা করেছিলেন। প্রথম ডনটি দিতে গিয়ে সন্দীপ কনুই সোজা করে আর উঠতে পারেনি। উপুড় হয়ে ছাদে শুয়ে পড়েছিল। পানু কিন্তু পরপর চারটে ডন দেয়।

 ”জীবনে তোর কিসসু হবে না।”

 কাকা বিরক্তিভরে তাকিয়েছিলেন। ছাদ থেকে নামার সময় সিঁড়িতে সে পানুকে চড় কষিয়েছিল।

 ”নিশ্চয় তুই আগে ডন দেওয়া প্র্যাকটিস করেছিস।”

 অস্বীকৃতি জানিয়ে পানু নীরবে মাথা নাড়ে। কিন্তু সে বিশ্বাসও করে। পানু তার কাছে কখনো মিথ্যা বলে না। ছোটো থেকেই ধর্মভীরু। সন্দীপের হঠাৎ মনে পড়ল প্রায় মাসখানেক সে কোনোরকম ব্যায়ামই করেনি। একসময় কাকার সামনে পঞ্চাশটা পর্যন্ত ডন দিয়েছে। এখন গোটা পনেরোর বেশি পারে না। পানু বোধহয় একটাও পারবে না। সন্দীপ তার কোমল দৃষ্টি পানুর মাথা ঘাড় বুক বাহুতে বুলিয়ে কাকাকে খুঁজল। লোকটি অস্বাভাবিক করুণ এবং ভারসাম্যহীন। দেশ আর দশের সেবা করার জন্য নিজে থেকেই একটা পথ বেছে নিয়ে চলতে গেছিলেন। শরীর চর্চা, অকৃতদার থাকা, নিত্য গঙ্গাস্নান ও গীতাপাঠ, নিরামিষ আহার প্রভৃতি সেই পথেরই পাথেয় ছিল। স্নান এখনও অব্যাহত, বিয়েটা করেননি, কিন্তু বাকিগুলি এখন পালন করেন কিনা সন্দীপ তা জানে না। ছোটোবেলায় সে ওঁর ঘরের দেয়ালে শ্রীকৃষ্ণের একটা রঙিন ছবি দেখেছিল। কুরুক্ষেত্রে রথের সারথি, বিমর্ষ অর্জুনের দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে। প্রতিদিন গঙ্গাস্নান থেকে ফিরে একটি বেল বা রজনীগন্ধার ছড়া ছবিতে ঝুলিয়ে দিতেন। তার নীচেই কাঠের ব্র্যাকেটে বসানো শিবাজীর ছোট্ট একটা আবক্ষ পিতল মূর্তি। গলায়ও একটা ছড়া। হয়তো এই নিত্যকর্মটি এখনও টিকে আছে।

 এইসব মানুষ, যাঁরা ঠিক-বেঠিক, ভালো-মন্দ, যেমনই হোক কিছু একটা বিশ্বাস করে এবং সেই বিশ্বাস আঁকড়ে থাকে ও সেইমতো চলে, সন্দীপ তাদের সমীহ করে। এবং কাকার প্রতি সমীহ জানাতেই সে বারান্দায় ডন দিতে শুরু করল।

 গুনে ষোলোটা ডন দেবার পর আর সে পারল না। বারান্দার রেলিং দুহাতে ধরে মুখ নীচু করে হাঁফাতে হাঁফাতে রেলিংয়ের ফাঁক থেকে দেখতে পেল মানু তার স্কুটারটা সদর থেকে নামিয়ে ফুটপাথে রাখছে আর স্কুল ইউনিফর্ম-পরা দেবু ছুটে তার কাছে এল। স্কুল-বাসের জন্য ছেলেটা সদরে এইসময় দাঁড়িয়ে থাকে।

 মানু ঘন ঘন মাথা নেড়ে দেবুকে প্রত্যাখ্যান করতে করতে রাস্তায় স্কুটার এনে স্টার্ট দিল। বিষণ্ণ দেবু পায়ে পায়ে আবার ফিরে এল সদরে।

 মানু এইসময় প্র্যাকটিশে যায়। সন্দীপ মুখ ফিরিয়ে ঘরের টেবলে রাখা টাইমপিসে সময় দেখল। অলকা এখন ট্রেনে।

 প্রায় ছয় ফুট, ছিপেছিপে মানুর গায়ে সবুজ ফুলছাপ দেওয়া শার্ট। মাথার চুল কপাল থেকে কানের প্রান্ত পর্যন্ত ফিলানের মতো কপালে ঢেকে সাজিয়ে নামানো। ঘাড়ের কাছে সমান্তরাল চাঁছা। পরচুলার বিভ্রম আনে এক একসময়। মুখটিতে বালকসুলভ কমনীয়তা দিয়েছে ওর কেশসজ্জা, কিন্তু গালদুটি বসা। এখন ওর ছাব্বিশ চলছে, কলকাতার নামি ফুটবলার। এখান দিয়ে যাবার সময় বহুলোক, বিশেষত ছেলেরা এই বাড়ির দিকে তাকায়। ছবি আর হেডলাইন মানু প্রায়ই পায় কাগজগুলোয়।

 স্কুটারে স্টার্ট দিয়ে মানু হাত নেড়ে দেবুকে ডেকে প্যান্টের পিছনের পকেট থেকে ব্যাগ বার করল। দেবু ছুটে এসেছে। সন্দীপ চারতলা থেকে স্পষ্ট দেখতে পেল মানু একটা দশ টাকার নোট ওর হাতে দিয়ে তর্জনী তুলে শাসানির ভঙ্গিতে কিছু একটা বলল। দেবু ফ্যালফ্যাল করে নোটটার দিকে তাকিয়ে। দশ টাকা পেয়ে যাওয়াটা ওর কাছে অকল্পনীয়, হয়তো চকোলেট কেনার জন্য পয়সা চেয়েছিল। দেবুর কাছে ওর কাকা হিরো। নিশ্চয় স্কুলে ওর প্রচণ্ড খাতির অন্য ছেলেদের কাছে যেমন তার অফিসেও অনেকের কাছে সে শুভদীপের দাদারূপে সম্ভ্রম পেয়ে থাকে।

 মানুর স্কুটার মুরারির দোকানের সামনে থামল। একমুঠো বিস্কুট হাতে মুরারি যেভাবে প্রায় ছুটে এল তাতে মনে হয় এটা নিয়মিত ব্যাপার। মানু বিরক্তিভরে বিস্কুটগুলোকে দেখে যেন ধমক দিল। মুরারি কাঁচুমাচু হয়ে অপরাধীর ভঙ্গিতে বারবার কী বলছে। ওর প্রসারিত হাত থেকে মানু একটা বিস্কুট তুলে নিয়ে মুখে দিল এবং ফু ফু করে সেগুলো মুরারির মুখে থুথু সমেত ছড়িয়ে এবং একচাপড়ে হাত থেকে বিস্কুটগুলো রাস্তায় ফেলে দিয়ে সে নির্বিকার ভঙ্গিতে স্কুটার চালিয়ে চলে গেল। ব্যাপারটা যেন সহজ ও সামান্য মানুর কাছে।

 সন্দীপের অদ্ভুত লাগে তার এই মত্ত ভাইটিকে। ছোটোবেলা থেকেই ওর মধ্যে ভারসাম্যের কিছুটা অভাব ছিল। গত তিন-চার বছরে ওর স্তাবক-ভক্তদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে, হাজার হাজার নগদ কালোটাকা হাতে আসায়, খবরের কাগজে ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রচার পেয়ে আর দলের অপরিহার্যরূপে গণ্য হয়ে ওর মানসিকতা একটা অবুঝ শিশু-দৈত্যের মতো হয়ে গেছে। সম্ভবত ও অসুখী।

 পানুর পাশের বারান্দাটা একই মাপের। দড়িতে টাঙ্গানো হ্যাঙ্গারে ঝুলছে মানুর গেঞ্জি। এককোণে দুটো টবে লঙ্কাগাছ। মা ঝাল খেতে ভালোবাসে। বাজারের লঙ্কায় আর ঝাল পাওয়া যায় না। রত্না একবার তাকে বলেছিল: ”সর্বনাশ করেছে ওই কেমিক্যাল সার, আনাজপাতির আর স্বাদই পাওয়া যায় না। উচ্ছেয় তেতো নেই, আদায় ঝাঁঝ নেই, লঙ্কায় ঝাল নেই, রসুনে গন্ধ নেই, পেঁয়াজ কাটতে আগে চোখ দিয়ে হু হু জল পড়ত…”

 আজই বিকেলে রত্নার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা, কিন্তু জায়গাটা যে কোথায় ঠিক হয়েছে সন্দীপের তা মনে পড়ছে না। মাঝে মাঝেই তার এই ধরনের বিস্মৃতি আজকাল ঘটছে। হাসির সঙ্গে পরশু দেখা হওয়ার পরই তার মনে পড়েছিল সুহাস তার একটা আলোয়ান চেয়ে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। ওটার রং ছিল বেলেরপানা। ঠিক কী কারণ দেখিয়ে সুহাস চেয়েছিল তা আর মনে করতে পারছে না। অলকা কাল গুঁড়োমশলা গুঁড়োসাবান কিনে রাখতে বলেছে, কিন্তু হাফ কেজি না এক কেজির বাক্স? যে-কোনোটাই কিনলে হয় বটে। কিন্তু এই কথাটা ইতিমধ্যেই সে ভুলে যাবে কেন? মস্তিষ্কের সজাগ থাকার ক্ষমতা বোধহয় কমে আসছে, শরীরেও তাই হচ্ছে।

 সন্দীপ আবার কয়েকটা ডন দেবার জন্য দুহাত মেঝেয় রেখে পা দুটো যখন পিছনে ছড়িয়ে দিতে যাবে তখন দরজায় টোকার শব্দ শুনল। কলিংবেল আছে, এখন তাহলে বিদ্যুৎ নেই। এত সকালে বাইরের কেউ নিশ্চয় তাকে ডাকছে না।

 ”বড়দা, গোটা পঞ্চাশ টাকা দেবেন।” বাণী সেকেন্ড দুয়েক থেমে আবার বলল, ”আগাম।”

 অলকা যখন থাকে না, সেই দিনগুলোয় সন্দীপের খাওয়ার দায়িত্ব বাণীর। পানু একটা বাংলা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে বছরখানেক আগে চাকরি পেয়েছে। তার আগে কাজ করেছিল একটা মাল পরিবহণ সংস্থায়। সেই চাকরিটা সন্দীপই সংগ্রহ করে দিয়েছিল। পানু তাকে না জানিয়েই চাকরি বদলেছে এবং মাইনে কমে যাওয়া সত্ত্বেও।

 ”পঞ্চাশ? মাসের এই সময়ে!”

 ”দেবুর স্কুলের জুতোটা একদমই গেছে, আর পরতে পারছে না। এমাসে আপনার ভাই পুরো মাইনে পায়নি।”

 দুবেলার খাওয়ার জন্য সন্দীপ দুশো টাকা দেয়। অলকা বিস্মিত হয়ে বলেছিল, ”দুউউ শোওও! এত লাগে নাকি? সকালে ভাত, রাতে রুটি, মাছ তো একবেলা, এত হবে কেন?”

 সন্দীপ বিরক্ত হয়েছিল। পানুর অভাব রয়েছে এই ছুতোয় সে কিছু সাহায্য করতে চায়। রাত্রে সে প্রায়ই খায় না। বাসি খাবার বাণী সকালে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ”বড়দা রোজ রোজ বাইরে খেয়ে আসেন আর এগুলো নষ্ট হয়।” সন্দীপ জানে কিছুই নষ্ট হয় না, গরম করে নিয়ে সকালে ওরা খায়।

 অলকাকে সে কড়া সুরে বলেছিল, ”আমি হিসেব কষে টাকা দিই না। পানু আমার ভাই টাকাটা তো বাইরের লোককে দিচ্ছি না।”

 বাণীর শাড়ি থেকে বাসি টোকো গন্ধ আসছে। কাপড় কাচা সাবান হয়তো ফুরিয়েছে। অভাবের সঙ্গে মানিয়ে চলার অভ্যাস ওর আছে। কোনো অভিযোগ কোনোদিন করেনি। উচ্চচগ্রামে কখনো স্বর তোলেনি, কথাও কম বলে। ওর চোখ দেখলে মনে হবে সর্বদাই যেন কী একটা ভয়ের মধ্যে আছে।

 ”জুতোর এত দাম? আমাদের ছোটোবেলায় সাত-আট টাকায় একজোড়া জুতো হয়ে যেত। আর এখন…”

 ”পঞ্চাশ ঠিক নয়, কিছু কমই হবে। আমার বোনের মেয়ের মুখেভাত, একটা স্টিলের বাটি কিনব।”

 সন্দীপ কাঠের আলমারিতে টাকা রাখে। চাবি দিয়ে যখন পাল্লা খুলছে, বাণী তখন প্রায় ফিসফিসিয়ে মৃদু স্বরে বলল, ”বড়দা, হাসি কেমন মেয়ে?”

 সন্দীপ রীতিমতো অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। এত বছর পর বাণী এই প্রসঙ্গে এল! ওর এতদিন লাগল পানুর এই ভালোবাসার ব্যাপারটা জানতে? নাকি জানতো কিন্তু মনের মধ্যেই রেখে দিয়েছিল।

 ”হঠাৎ একথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?”

 ”এমনিই।”

 ”উহুঁ, এমনি এমনি নয়।”

 ”বলুন না কেমন মেয়ে।”

 ”ভালো মেয়ে, যথেষ্ট ভালো মেয়ে। ছোটোবেলা থেকেই ওকে জানি।”

 ”তুমি হাসিকে দেখোনি?”

 ”না। শুনেছি খুব সুন্দর দেখতে।”

 পানুকে এখন বাঁচিয়ে কথাবার্তা চালাতে হবে। তবে ক্ষতি যা হবার তা হয়েই গেছে। বাণীর মনে সন্দেহের যে ঘুণ পোকাটি ঢুকেছে তা দাম্পত্যজীবনকে ফোঁপরা করবেই বা ইতিমধ্যে করে দিয়েছে। অবশ্য হাসি ছাড়াই যে এটা ঘটবে এমন একটা ধারণা সন্দীপের ছিল। পানুর জীবনে দরকার ছিল যে-কোনো একটি মেয়েকেই নয়, শুধুমাত্র হাসিকেই।

 ”ওর স্বামী নাকি পালিয়ে গেছল, আবার ফিরে এসেছে।”

 ”তোমায় কে বলল?”

 সন্দীপ সজাগ হল। অলকা যেখান থেকে শুনেছে সম্ভবত বাণীও সেই সূত্র থেকে খবর পেয়েছে। এ-বাড়িতে দুটি বউয়ের সঙ্গে এইসব আলাপ একজনের পক্ষেই করা সম্ভব।

 ”মা নিশ্চয়।”

 ”যেই বলুক।”

 সন্দীপের হঠাৎ গম্ভীর হওয়াকে অগ্রাহ্য করেই বাণী আবার বলল, ”অনেকেই নাকি ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিল? সত্যি?”

 ”দারুণভাবে সত্যি।”

 ব্যাপারটাকে হালকা করে দেওয়া দরকার। কী ধরনের কথা ওর কানে গেছে সন্দীপ তা আঁচ করতে পারছে।

 ”আমি পর্যন্ত হাসির প্রেমে পড়েছিলুম।”

 বাণী ফিকে হাসল। বিশ্বাস করল না। কিন্তু সত্যিই একসময় সন্দীপের ধারণা হয়েছিল সে হাসিকে ভালোবাসে। তখনকার বয়স কুড়ি-একুশ।

 লম্বা একটা খামের মধ্যে টাকা থাকে। সে বা অলকা, দুজনেরই এটা এজমালি তহবিল, দুজনেই এর থেকে টাকা খরচ করে। টাকা বার করলেই সঙ্গে সঙ্গে তারা অঙ্কটা খামে লিখে কত টাকা আর রইল সেটাও বিয়োগ দিয়ে রাখে। এজন্য খামের মধ্যে একটা ছোট্ট পেনসিল রাখা আছে।

 কে কত টাকা রাখবে সেটা অলকাই ঠিক করে দেয় এবং সন্দীপ কোনো যুক্তি বা তর্কের মধ্যে না গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তা মেনে নেয়। সে দেয় মাইনের অর্ধেক এবং অলকা যেহেতু বাইরে থাকে তাই তার ভাগে মাইনের এক-তৃতীয়াংশ। তাইতে সাত বছর আগে মোট হয়েছিল সাড়ে ন’শো টাকা। এর থেকেই সন্দীপ দুশো টাকা দেয় বাণীকে তার খাওয়ার জন্য। প্রতিবছর দুজনেরই মাইনে বাড়ে, কিন্তু এজমালি তহবিল বাড়েনি। একই সাড়ে ন’শোই রয়ে গেছে।

 খাম থেকে পঞ্চাশ টাকা বার করে সে আরও পঞ্চাশ বার করল নিজের জন্য। রত্নাকে আজ চীনে খাবার খাওয়াতে হবে কিংবা ঝাল দেওয়া পাঞ্জাবি মাংসের রান্না। ওর সঙ্গে আজ কোথায় যেন দেখা হওয়ার কথা।

 খামে টাকার অঙ্কটা লিখে সে ভ্রূ কোঁচকাল। তার মাইনে আগামী সোমবার, বোধহয় অলকারও। কিন্তু শনিবারের আগে সে টাকা খামে জমা পড়বে না। যা রইল হিসেব করে দিন সাতেক চলে যাবে। মানিব্যাগেও সত্তরের মতো আছে। প্রতিমাসের শেষে এই একটা চিন্তা সন্দীপের অস্বস্তির কারণ হয়। শেষের কটাদিন কিছুতেই টাকা থাকে না। দু-চারবার ব্যাঙ্ক থেকেও তুলতে হয়েছে।

 পাঁচটা নোট বাণীর হাতে দিয়ে সে মৃদু স্বরে বলল, ”হাসিকে নিয়ে অত চিন্তা করছ কেন? কিছু শুনেছ কি?”

 বাণী যেন বিচলিত হল। চোখ নামিয়ে মুঠোয় আঁচলটা শক্ত করে ধরে মাথা নাড়ল।

 ”কী শুনব আর।”

 ”পানু বেরোবে কখন?”

 ”বারোটায়। এখন বাজার গেছে।”

 ”কদিন ঝালের মাছ খাইয়েছ, আর নয়। এবার কম তেল কম ঝাল।”

 ”কেন, গোলমাল হয়েছে নাকি?” বাণী সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। ”আমি তো খুব বেশি তেল-ঝাল-মশলা দিয়ে রাঁধি না।”

 ”হয়নি, কিন্তু হতে তো পারে। সাবধান হওয়া ভালো। কাকাকে দেখছ, চিরকাল সেদ্দই খেয়ে গেলেন, কি স্বাস্থ্য রেখেছেন বল তো?”

 ”কাকা বিয়ে করেননি।”

 বাণীর মতো সন্দীপও হালকাভাবে একই কারণে হাসল। পাড়ারই বস্তিতে পাঁচ ছেলেমেয়ে আর এক-পা কাটা স্বামী নিয়ে শৈলবালা থাকে। গত পনেরো বছর জগন্নাথের ঘরের কাজ করছে। এই বাড়ির সকলের এমনকি পাড়ারও অনেকের অনুমান ওদের দুজনের অন্য সম্পর্কও আছে। দোহারা গড়নের, বছর পঁয়তাল্লিশ বয়সের শৈলবালা এ বাড়ির কারুর সঙ্গে কথা বলে না। সন্দীপ কিন্তু বিশ্বাস করে না কাকা কখনো কোনোরকম যৌন ব্যাপারে লিপ্ত হয়েছে বা হতে পারে। বাবার মৃত্যুর পর তাদের দুই ভাইয়ের জীবনের একটা দীর্ঘসময় আড়াল থেকে কাকার সতর্ক শাসনে কেটেছে। একই বাড়িতে থেকেও খুব কম তাদের দেখা হত, এখনও কদাচিৎ দেখা হয়।

 একসময় পাওয়া ”জগা” নামটা এখনও বোধহয় ওকে পাগল করে। এক একসময় ওর মাথা খারাপের মতো হয়। বন্ধ ঘরের মধ্যে তিনচারদিন শুধু পায়চারি আর বিড়বিড় করেন, কিছু খান না। একটা নেপালি কুকরি আর তিনহাত লম্বা একটা লোহার রড মেঝেয় রেখে অবিরত প্রদক্ষিণ করে যান। ওই দুটি দিয়েই শেখ বাগান বস্তিকে যবনশূন্য করার ব্রতে মেতেছিলেন। দরজা খোলা না পেয়ে শৈলবালা তখন ফিরে যায়। ঘরের মধ্য থেকে আহত জন্তুর গোঙানির মতো একটা আওয়াজ ছাড়া তখন আর কিছু শোনা যায় না। জানলার খড়খড়ি তুলে সন্দীপ ব্যাপারটা প্রথম দেখেছিল স্কুলে পড়ার সময়। পানুকে তখন বলেছিল। ও বিশ্বাস করেনি।

 মাস ছয় পর পানু একদিন বলে, ”কাকার উপর ভর হয়েছিল, আজ দেখলুম। কুকরিটা চুরি করে গঙ্গায় একদিন ফেলে দেব।”

 ”কাকাকে তোমরা যা ভাব তা কিন্তু নন।” সন্দীপ গম্ভীর করে কথাগুলো বলে লুঙ্গির কষিটা টেনে কোমরে গুঁজল। কয়েকটা ডন দিয়েই পেটটার বেড় যেন কমে গেছে।

 ”আমি কিছুই ভাবি না, যা কিছু মা-ই বলেন।”

 ”মার সঙ্গে কোনোদিনই ওর বনিবনা হয়নি। আর তুমিই বা মার সঙ্গে অত কথা বলো কেন?”

 ”কী করব যদি ডেকে কথা বলেন?”

 ”ক’দিন আগে মানু চেঁচাচ্ছিল কেন?”

 ”মদ খেয়ে এসেছিল। মা ওর জন্য পাত্রী খুঁজছেন। কী ভাবে যে টাকা ওড়ায় দেখলে বিশ্বাস করবেন না বড়দা, মনে হয় টাকা যেন ওর কাছে খোলামকুচি। তবে দেবুকে খুব ভালোবাসে, প্রায়ই এটা ওটা কিনে দেয়।”

 বাণী চলে যাবার পর সন্দীপ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শরীরের এক একটা খুঁত বার করতে লাগল। কোমরের দুধারে চর্বি ফেঁপে উঠেছে লুঙ্গির কিনার উপচে। ঘাড় থেকে কাঁধ বেয়ে বাহু ধরে কনুই পর্যন্ত অঞ্চলটা গোলগাল, পাঁজরের খাঁচার দুধারে চামড়া শিথিল হল দুহাত ঝুলিয়ে সামান্য ঝুঁকতেই। পা জোড়া করে কয়েকবার লাফিয়ে দেখল বুকটা থলথল করছে। চোয়ালটা চর্বি জমে দুধারে বেরিয়ে পড়েছে মুখের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে। দুই গালের বাঁধন আলগা। গলায় তিনটে ভাঁজ পড়ছে মুখটা সামান্য নামালেই। সন্দীপ তার শরীরে বাঞ্ছিত তীক্ষ্নতা বা এমন কোনো কর্কশ ডৌল খুঁজে পেল না যাকে পৌরুষোচিত বলতেই হবে।

 কতকাল তাহলে ভালো করে নিজের দিকে তাকাইনি? আয়নার চেহারাটার প্রতি বিরক্তিতে সে ভ্রূ কোঁচকাল। গোবরগণেশ মার্কা হবার মতো সে এমন কিছু বেশি খায় না, ঘুমোয় না বা আলস্যে দিনও যাপন করে না। খবরের কাগজে একবার পড়েছিল, উদ্বেগ, ভয়, দুশ্চিন্তার টানাপোড়েনে মানুষ মোটা হয়।

 ”দেখিস নি মাড়োয়ারিদের। অত মোটা হয় কেন? ব্যবসা, ফাটকা, কালোবাজার, কালোটাকা, ইনকাম ট্যাক্স, এনফোর্সমেন্ট…এক সেকেন্ডও রিলাক্স করতে পারে না।”

 প্রণবেশ ঠোঁট থেকে বীয়ারের ফেনা বাঁ তালুর উলটো পিঠ দিয়ে মুছে গ্লাসটা দুই হাঁটুতে চেপে বলেছিল, ”সিগারেট দে একটা।”

 গত বুধবার আউটরাম ঘাটের কাছাকাছি রাস্তা থেকে হাত কুড়ি ভিতরে কেল্লার জমিতে গাড়ি রেখে তারা দুজন কথা বলছিল। প্রণবেশ কলেজের বন্ধু, একসঙ্গে তারা বি এস-সি পড়েছে। এখন সে ছোটো একটা কারখানা করেছে যেখানে এমন যন্ত্রাংশ তৈরি হয় যা সন্দীপের অফিস অন্য জায়গা থেকে কেনে তাদের পাম্প মেসিন, সিলিং ফ্যান ইত্যাদি উৎপাদনের জন্য। প্রণবেশ এখানে সেঁধোতে চায়। যথোপযুক্ত লোকটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া এবং কাজ পাইয়ে দিতে ভিতর থেকে তাকে সাহায্য করার অনুরোধ নিয়ে সে সন্দীপকে সেদিন মোটরে তুলেছিল।

 মোটা হওয়ার কারণ নিয়ে প্রণবেশই কথা পেড়েছিল। নানা ধরনের ভাজাভুজি আর সিদ্ধ করা খাবার দোকানের ছেলেরা মোটরের জানলায় দাঁড়াচ্ছিল, কিছু চাই কিনা জানতে। সন্দীপ আলুচাট আনতে বলে।

 ”বীয়ার তার উপর আলু এবং চল্লিশ ছুঁতে যাচ্ছি। আমি খাব না, তুই খা, ছিয়াশি কে জি-তে রয়েছি, এবার ওজন কমাতে হবে।”

 ”কী ভাবে?”

 ”টেনশ্যন, স্ট্রেস এইসব থেকে বেরোতে হবে। এটাই আসল ব্যাপার। ছোটা, এক্সারসাইজ, ডায়টিং সব বাজে জিনিস। আমি তো আর বডিবিলডিং কম্পিটিশনে নামতে চাই না, ভালোভাবে দীর্ঘকাল বাঁচতে চাই। শুধু বেশি আলু খাসনি, ডায়বিটিস ধরবে!”

 সন্দীপ তর্ক করতে চায়নি। প্রণবেশ বোধহয় উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। বোতলটা মুখে দিয়ে দ্রুত শেষ করেই পায়ের কাছে পড়ে থাকা আর একটা বীয়ার তুলে নিল। ড্যাশবোর্ডে খোপে হাতড়িয়ে ছিপি খোলার চাবিটা না পেয়ে অশ্লীল কয়েকটা গালি দিল নিজেকেই। চাবিটা সন্দীপ পেল সীটের খাঁজে।

 ”গেলাসে ঢেলে খা।”

 ”একই ব্যাপার।”

 সন্দীপ গেলাসটা তুলে রাখল ড্যাশ বোর্ডের উপর।

 ”তুই এত আস্তে আস্তে খাচ্ছিস কেন। তাড়াতাড়ি শেষ কর। আর একটা নে। যা করবি কুইক করবি, কখন মরে যাবি তা তো জানিস না।”

 প্রণবেশ জানলা দিয়ে অন্ধকার কেল্লার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল।

 ”দীর্ঘকাল বাঁচাটা, কলকাতায় বাস করে অসম্ভব। এত রকমের ঝঞ্ঝাট, এত উৎপাত। আর এসব জ্ঞানের কথা বাঞ্চোৎ পণ্ডিতরা বলে যাচ্ছে আর ছাপা হচ্ছে যে শুনলেই তুই মরে যাবি। পৃথিবীর সব থেকে পলিউটেড শহরের একটা যে কলকাতা এটা সববাই জানে। জেনে দিব্যিই আছে। কিন্তু হিসেব কষে যন্তর দিয়ে মেপে যদি তোকে বলা হয়, কলকাতায় পাঁচ হাজার কারখানা, সাড়ে সাতাশ হাজার ফার্নেস, কয়েক লক্ষ উনুন, কয়েক হাজার গাড়ি থেকে রোজ হাজার টন ধোঁয়া বেরিয়ে ভিজে বাতাসে মাখামাখি হয়ে তোর মাথার উপর দিনরাত বিছানো রয়েছে একটা কম্বলের মতো, তাহলে এটা জানার পর তুই আর সুস্থ থাকবি?”

 প্রণবেশ তৃতীয় বোতল ধরার দিকে দ্রুত ঢক ঢক করে এগোতে লাগল। সন্দীপ তখন লক্ষ করল, চড়াইয়ের মতো উঠে যাওয়া জমিটা যেখানে অন্ধকারের মধ্যে ঢুকেছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে একজোড়া নারীপুরুষ। ওরা কাছাকাছি এলে সে মেয়েটিকে চিনতে পারল। প্রায়ই সন্ধ্যায় একে কার্জন পার্কে দেখেছে।

 ”এই হচ্ছে রিল্যাক্সেসন।”

 সন্দীপ মুখ ফিরিয়ে দেখে প্রণবেশও মেয়েটিকে লক্ষ করছে।

 ”তুলব?”

 ”না না, এসব নয়।”

 ”তোর চলে না বুঝি।”

 প্রণবেশের চোখ ওদের অনুসরণ করে গেল অনেক দূর পর্যন্ত। কিছুদূর গিয়ে পুরুষটি রাস্তা পার হল, মেয়েটি সোজা হাঁটছে।

 ”তোর তো ছোট্ট ব্যবসা, যাদের কোটি কোটি টাকার কারবার তাদের অবস্থাটা কী হয় বলতো?”

 ”কিসসু হয় না। হয় তাদের ভারী মাইনেওলা একজিকিউটিভদের। পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যেই বেশির ভাগ টেঁসে যায়। আমার অফিসের কাজ বন্ধ, কাজ করে একটা মেয়ে, ম্যারেড, মাঝেমাঝে ওকে নিয়েই রিল্যাক্স করি।”

 সন্দীপ আড়ষ্ট হয়ে আড়চোখে প্রণবেশের মুখে তাকাল। নির্বিকার, উত্তেজনাহীন এবং প্রভূত বোকামি মাখানো।

 ”ভালো মেয়ে, কাজের মেয়ে। একস্ট্রা কিছু নেয় না। তুই একদিন আমার অফিসে আয়, দেখাব, ছুটির পরই আয়।”

 সন্দীপ কৌতূহল বোধ করছিল। এই সেই প্রণবেশ যে দমদমে একটা কলোনিতে টালির চাল দেওয়া মাটির ঘরে থাকত। কলেজ থেকে মাত্র একদিনই সে গেছল ওর সঙ্গেই। অনটন আর দারিদ্র্য লুকোবার কোনো চেষ্টা ছিল না প্রণবেশের। স্বচ্ছন্দ, ঝরঝরে ব্যবহার। ওই সময়টা সন্দীপের জীবনে শূন্য, অন্ধকার, ক্ষুব্ধ একটা অধ্যায় ছিল। বাড়িতে একমাত্র পানু ছাড়া আর কোনো সঙ্গী নেই। মানু আর তার মা অন্য মহাদেশের মানুষের মতো ছিল। তাদের আচরণ রীতি এমনকি ভাষাও তার কাছে অপরিচিত মনে হত। পানু বেশিরভাগ সময়ই থাকত হাসিদের বাড়িতে। কাকার ঘরের দরজা তো বন্ধই ছিল। সবাই আলাদা আলাদা। এই বাড়ির ঐতিহ্য, স্মৃতি বা দুঃখের মধ্য থেকে কেউ যেন উদ্ভূত নয়। তার নিজেকেও মনে হত না এই বাড়ির অংশরূপে। জীবনের এই সময়টাকে ভাবলেই তার মন বিষাদে ভরে যায়। সেই সময় নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবলেই বিষণ্ণ বোধ করত। শুধুই অন্ধকার। অতি সাধারণ ছাত্র, উদ্যমহীন, মাঝারি পর্যায়ের ছাড়া নিজেকে আর কিছু ভাবতে পারত না।

 তখনই একদিন ইউনিয়ন নির্বাচনে ভোট চাইতে ক্লাসে এসে বক্তৃতা দিয়েছিল অলকা। শ্যামলা, রুগণ, চশমা পরা মেয়েটির বাকভঙ্গি, উচ্চচারণ, শব্দের বাছাই, প্রাঞ্জলতা, মাথা হেলিয়ে দাঁড়ানো, চাহনির ঔজ্জ্বল্য-সব মিলিয়ে এক ধরনের চটক মাখিয়ে দিয়েছিল যা তাকে বিহ্বল করে। প্রণবেশের দূর সম্পর্কে আত্মীয়া অলকা। ওই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। হতাশ, সঙ্গলোভী, সন্দীপই তখন আঁকড়ে ধরেছিল পরিচয়ের সুযোগটিকে।

 ”অলকা এখন কী করছে রে?”

 ”মাস্টারি; বর্ধমানের এক গ্রামে।”

 ”পলিটিক্স ছেড়ে দিয়েছে? লেগে থাকলে এম.এল.এ. কি মন্ত্রীও হতে পারত।”

 ”আমারও তাই মনে হয়।”

 ”সেই রকমই দেখতে না মোটাসোটা হয়েছে? সেই কলেজের পর আর দেখিনি।”

 ”সেই রকমই।”

 প্রণবেশ ঘুরে সন্দীপের দিকে তাকাল। সে লক্ষ করল, এইভাবে শরীরটা ঘোরাতে প্রণবেশকে মেহনত করতে হল। চোখে অবাক ভাব, যেন অলকার ‘সেই রকম’ থাকাটা খুবই অন্যায় ব্যাপার।

 ”আর ইউ হ্যাপি?”

 ”কেন নয়! আনহ্যাপি হওয়াটা কি সহজ নাকি?”

 ”না, সেজন্য চেষ্টা করতে হয়। আমি চেষ্টা করে আনহ্যাপি। যদি তোর মতো নিজের অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারতাম, অবস্থা ফেরাবার জন্য চেষ্টা যদি না করতাম তাহলে অর্ডার ধরার জন্য তোর পারচেস কনট্রোলারকে পটাতে ব্রেইনের বদমাইস সেলগুলোকে খোঁচাখুচি করার দরকারই হত না। দিব্যি এই সময়টায় গুলোদার ঘরে সাবুকে নিয়ে রিল্যাক্স করতাম।”

 ”সাবু কে?”

 ”আমার অফিসের মেয়েটা। মাঝেমাঝে ওকে নিয়ে গুলোদার ঘরে যাই, ভেরি সেফ প্লেস আর সস্তা। ওখানে গিয়ে আমি কোনো চেষ্টা করি না সাবুর সঙ্গে, আই ফিল হ্যাপি। আর একটা সেল।”

 প্রণবেশ ঝুঁকে বীয়ারের বোতলের জন্য হাতড়াতে থাকে।

. সন্দীপের ঘরের মেঝেয় আয়না, আলমারি, টেবল ও খাটের মধ্যে খালি জায়গাটুকুতে প্রায় আধঘণ্টা ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করে ঘাম শুকোতে বারান্দায় গেল। মাথায় সারাক্ষণই ছিল প্রণবেশের কথাগুলো। ব্যায়াম করার সময় অন্য চিন্তা করলে কোনো ফল হয় না। তখন শুধু নিজের শরীরের কথাই ভাবা উচিত। এতক্ষণের যাবতীয় পরিশ্রমটাই বোধহয় বিফলে গেল।

 বিরক্ত হয়েই সে প্রণবেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্তে এল-ওর কাজটা করে দেবার চেষ্টা সে করবে বটে কিন্তু ওকে এড়িয়ে চলবে। ”যদি তোর মতো নিজের অবস্থা নিয়ে…” এই কথাগুলো এখনও তার অবচেতনে যে রয়ে গেছে এবং থাকবেও এটাই সাংঘাতিক। তার মতো নিরুদ্যমী লোকের পক্ষে একই অবস্থায় থাকাটাই বোধহয় ভালো।

 রাস্তায় এখন ভীড় শুরু হয়েছে। যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। বাতাসে ভোরের স্নিগ্ধতা বজায় থাকার সময় অতিক্রান্ত। মানুর বাচ্চচা চাকরটা থলি হাতে বেরোল। গত তিন চারদিন ওর থুতনিতে একটা প্লাস্টার সাঁটা। জুতোয় কালি দিতে ভুলে যাওয়ার এবং এক-ডাকে সাড়া না পাওয়ার অপরাধে মানু জুতো ছুঁড়ে মেরেছিল। এসব খবর বাণীর কাছ থেকে পাওয়া।

 এবার তার খিদে পাচ্ছে। ভোরে রান্না করার সময় থাকে না তাই অলকা রবিবার রাত্রে দুজনের খাবার করে। নিজে খেয়ে সন্দীপের জন্য ঢাকা দিয়ে রেখে যায়। সপ্তাহের পাঁচদিন সকালের খাওয়ার ব্যবস্থাটা নিজেকেই করতে হয়। ন’টায় বাণী উপরে আসবে ভাত নিয়ে। তার আগে দু-আড়াই ঘণ্টার জন্য পেটে সামান্য কিছু দিলেই চলে। বহুদিন সে মুরারির দোকানে একটা অমলেট আর একটা টোস্ট দিয়েই কাজ সেরেছে।

 অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে ঢাকা রয়েছে চারখানা আটার পরোটা। প্রতিটি দু ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখা। অলকা অবশ্য রুটিই খেয়ে গেছে, ঘিয়ের বাসি খাবার অম্বলের জন্য খায় না। চারখানার বেশিও কখনো করে না। সে জানে একটু পরেই সন্দীপ ভাত খাবে। অযথা কিছু কোনোদিনই অলকা করেনি।

 পরোটার সঙ্গে রয়েছে একটুকরো পাটালি আর একটা মর্তমান কলা। চা তৈরি করে নিতে হবে। কিন্তু এখন কেরোসিন স্টোভ ধরিয়ে সেটা করার ইচ্ছে তারনেই। মুরারির চা কোনোক্রমেই খারাপ নয়।

 সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মানুদের দরজাটা খোলা দেখে সন্দীপ একপলক তাকাল। সিমেন্টের পুরনো মেঝের উপরে বসানো হয়েছে হালকা হলুদের উপর মাকড়সা জালের মতো সাদা নকশার মার্বেলাইট টালি। দেয়ালগুলোয় হালকা কমলা রঙের প্লাস্টিক পেইন্ট। ডাইনিং টেবলের পিছনে টি ভি সেট। রেকর্ড প্লেয়ার, স্টিরিয়ো। ভিতরের ঘরে সোফা আর কার্পেটের একটা কোণার অংশ দেখা যাচ্ছে। দেয়ালে মানুষ প্রমাণ মানুরই একটা ছবি, পিছনে আবছা একটা বোয়িং। রানওয়ের উপরে কোনো ভক্ত ফোটোগ্রাফার তুলে হয়তো উপহার দিয়েছে।

 টেবলের পাশে দাঁড়িয়ে মা চা ছাঁকছেন। অসম্ভব চায়ের নেশা, প্রতিঘণ্টায় অন্তত একবার চাই। সন্দীপকে দরজার সামনে দিয়ে তাকিয়ে চলে যেতে দেখে হাত তুলে দাঁড়াতে ইশারা করলেন।

 ”ভেতরে এসো, চা খাবে?”

 উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই, একটা কাপ টেনে নিয়ে লিকার ঢালতে লাগলেন।

 ”শুনেছ তো?”

 সতীন পুত্রদের ‘তুমি’ বলেন। ওঁর বিয়ের সময় মানুর বয়স ছিল বারো।

 সন্দীপ চেয়ারের পিঠ ধরে দাঁড়িয়ে রইল নির্বিকার মুখে। সামান্য ঔসুক্য দেখালেই অনর্গল কথার স্রোত বয়ে যাবে।

 ”দাঁড়িয়ে কেন!”

 ”বসব না তাড়া আছে, দাঁড়ি কামাতে যাচ্ছিলুম।”

 আচমকাই এটা মনে পড়ে যাওয়ায় সে গালে হাত বুলোল, রোজ দাড়ি কামানোটা এক বিরক্তিকর ঝামেলা, রবিবার সে কামায় না।

 ”বড় বউমার কাছে শুনেছ তো…ফিরে এসেছে? খুব খারাপ অবস্থা, বাঁচা শক্ত। না ফিরলেই পারত। যাহোক করে হাসি ছেলেকে নিয়ে তবু চালিয়ে যাচ্ছিল, এখন কি আতান্তরে পড়ল বল তো? মেয়েটার তো টাকার গাছ নেই। চিনি বেশি দিইনি…ব্যাংকে হাজার দুয়েক ছিল এখনও আছে কিনা জানি না, মাইনে আর কত-শ’ পাঁচেকও নয়, বাড়িভাড়া নব্বুই। ছেলেটাকে মানুষ করে তোলার জন্যও তো খরচ আছে।”

 হাসির আয়ের হিসেব মা কোথা থেকে জোগাড় করলেন? পাড়ার তিন-চারটে বাড়িতে অবশ্য নিয়মিত যাতায়াত আছে। হাসিদের বাড়ির অর্ধেকটা যারা কিনেছে তাদের কাছেও যান। খবরগুলো হয়তো এইসব সূত্র থেকেই পাওয়া।

 সে কোনো জবাব না দিয়ে চায়ের কাপটা তুলে নিল। চেয়ারে বসল না। তার যে তাড়া আছে এমন একটা ব্যস্ততা মুখে ফুটিয়ে রেখে কাপে চুমুক দিল।

 সন্দীপের বরাবরের বিস্ময়, এত অজস্র রকমের আর পরিমাণের খবর মা’র সংগ্রহে থাকায় কোনো একজনের সম্পর্কে উল্লেখ করলেই তার হাঁড়ির খবর পর্যন্ত বলে দেবেন। তবে যতটা জানেন তার থেকে কমই প্রকাশ করেন এবং নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে সবটা কখনোই ভাঙেন না।

 ”পানু কি জানে?…জানলে কী যে করবে…তবে ঠান্ডা মাথার মানুষ। এতদিনে নিশ্চয় এসব ভুলেটুলে গেছে…সংসারী হলে মানুষের রাগ শোক পড়ে যায়।”

 সন্দীপ মাথা নেড়ে গেল এবং মা সেটা লক্ষ করে আর একটু গলা নামাল।

 ”আমার স্থির বিশ্বাস, কাজটা সুহাসেরই। পানুকে ধরিয়ে দেবার পিছনে ও ছাড়া কেউ নয়। তুমি কি বলো?…পানুকে না সরালে ও তো হাসিকে বিয়ে করতে পারত না। বেচারা।”

 সন্দীপের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে আবার বললেন: ”পানুর কথাই বলছি। কোনো কালে রাজনীতি করেনি যে, তাকে কিনা নকশাল বলে ধরিয়ে দেওয়া, পুলিশের হাতে মার খাওয়ানো, জেল খাটানো..ভাবতে পার কী জঘন্য কাজ সুহাস করেছে?”

 ”কিন্তু সুহাসই যে তা করেছে এর তো কোনো প্রমাণ নেই।”

 ”এর আবার প্রমাণ লাগে নাকি? বোঝাই তো যায়, হাসিকে বিয়ে করল পানুকে ধরিয়ে দেবার দেড়মাস পরই পথের কাঁটা সরিয়ে দিয়ে, পাড়ায়ও সবাই তাই বলে। তখন তো সুহাস লালবাজার যেত, অনেকেই তা দেখেছে। পালিয়ে গেল তো নকশালদের ভয়ে, ওকে খুন করবে বলেছিল। কেন, পিণ্টু আর দুলাল নামে যে ছেলে দুটো ধরা পড়ল বস্তিতে, সেটাও তো সুহাসেরই কাজ। ছেলে দুটো যে ওখানে আছে তা তো ওই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল। পাড়ায় সে সময় বলাবলি হত, অনেকে জানতও সুহাস পুলিশের মাইনে করা চর। তখন ওর অবস্থাও তো জানি, হাসি কতদিন এসে এটা ওটা চেয়ে নিয়ে গেছে। মেয়েটার জন্য দুঃখ হয়, কেন যে অমন হতচ্ছাড়াটাকে বিয়ে করতে গেল। চেহারা সাজপোশাক, লম্বা লম্বা কথা এতেই কিনা মাথা ঘুরে গেল, হিরে ফেলে আঁচলে কাচ বাঁধল। পানুর মতো ছেলে কটা হয়? কী শান্ত, ভদ্র, সাত চড়ে রা কাড়ে না, রাগে না…ছোটো বউমা বলছিল, এখনও ওর পেটে মাঝেমাঝে যন্ত্রণা হয়, পুলিশের হাতে কম মারটা তো খায়নি…ও হল সেই ব্যথা, বউমাকে সেটা অবশ্য আর বলিনি ভয় পাবে বলে। বাবাঃ সে এক দিন গেছে বটে।”

 সন্দীপ একটা ঝাঁকুনি খেল কথাটা শুনে। পানুর তলপেটে এখনও যন্ত্রণা হয়, এটা সে জানে না, বাণীও কখনো বলেনি। পানু তো বলবেই না, অত্যন্ত কম কথা বলে। কোর্টে ওকে দেখেছিল কুঁজো হয়ে মুখ নীচু করে বসে থাকতে। দেখে মনেই হয়নি অত্যাচার হয়েছে শরীরে। শুধু চোখাচোখি হতে হাসবার চেষ্টা করেছিল। ওই সময় সবাই তা করে।

 ”পানুর এখনও পেটে যন্ত্রণা হয়! চিকিৎসা করায় না?”

 ”মানু তো বলেছিল ওর চেনা এক বিরাট ডাক্তার আছে, ওদের ক্লাবের, তাকে দিয়ে দেখিয়ে দেবে, কিন্তু পানু কোনো গা করল না,…সন্দেশ আছে খাবে, মানুর এক ফ্যান কাল পাঠিয়ে দিয়েছে।”

 ”না থাক, আমার দেরি হয়ে গেছে।”

 যখন সে দরজার দিকে এগোচ্ছে পিছন থেকে মা বললেন, ”পানুর তো যাতায়াত আছে হাসির বাড়ি, অবশ্য মাসদুয়েক আর যাচ্ছে না। অন্য কিছু নয়, ওর ছেলেকে পড়াটড়া দেখিয়ে দিতেই যেত।”

 সন্দীপ না শোনার ভান করল। একতলায় নামার সময় একবার ভাবল, পানুর যন্ত্রণার ব্যাপারটার খোঁজ নেবে। ওর সঙ্গে পাড়ার আরও তিনটি ছেলেকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছল, তাদের কাছেই শোনা, ওর পেটে তক্তা পেতে তিন-চারকজন নাচানাচি করেছিল। নিশ্চয় তখন টুঁ শব্দটি করেনি। করলে হয়তো ওরা খুশি হয়ে অল্পেই ছেড়ে দিত।

 এততলায় সিঁড়ির পাশেই তালাবন্ধ বৈঠকখানা ঘর। বাবা মারা যাবার পর তারা দুই ভাই দিনের বেশিরভাগ সময় এই ঘরেই কাটাত। মাস্টার মশাইয়ের কাছে এই ঘরেই পড়েছে। কাকা তার ঘরের দরজা খুলে কান পেতে রাখতেন, মাস্টার আর পড়ুয়ারা ফাঁকি দিচ্ছে কিনা ধরার জন্য। মাস্টারমশাই পড়িয়ে উঠবার সময় চেয়ার টানতেন। শব্দটা হলেই কাকার দরজা বন্ধ হয়ে যেত। পানুই এটা লক্ষ করেছিল।

 এখন ঘরটার ভিতরে লম্বা টেবলটা, ভাঙা চেয়ারগুলো, কাচ ভাঙা আলমারি দুটো আর কয়েক কিলোগ্রাম ধুলো ছাড়া বোধহয় আর কিছু নেই। এই ঘরে মানুও ছোটোবেলায় পড়েছে। তবে বছর তেরো বয়স থেকে সে যখন বেশি মনোযোগী হল ফুটবলে এবং গৃহশিক্ষক সন্ধ্যায় অপেক্ষা করে ফিরে যেতে লাগল তখন কাকাই একদিন ঘরে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে পড়ার হাত থেকে মানুকে রেহাই দেন।

 বছর দুই আগে মানু ঘরটা নিতে চেয়েছিল। ঘরের চাবি কাকার কাছে। বাড়ি ভাগ হয়নি, এক একজন একটা অংশ নিয়ে বসবাস করে যাচ্ছে। বাড়ির ট্যাক্সের টাকা প্রতি তিনমাস পানুর কাছে যে যার নিজের অংশের অনুপাতে জমা দেয়। এটা পানুই ঠিক করে দিয়েছে। ইলেকট্রিক মিটার সকলেরই আলাদা।

 নানান কাজে নানান ধরনের লোক এখন মানুর কাছে আসছে। ওর একটা ঘর চাই। কাকা ঘর দিতে রাজি হননি। একদিন দুপুরে মানু কোথা থেকে সাত-আটটা ছেলেকে এনে তালা ভাঙছিল। তখন কাকা তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। খালি গা, আটচল্লিশ ইঞ্চি ছাতি আর ষোলো ইঞ্চি বাইসেপস এবং হাতে ছিল লোহার গরাদটা।

 ”কি বলব বড়দা, কাকার শরীরের লোমগুলো তখন মনে হচ্ছিল খাড়া হয়ে উঠেছে, চোখ দুটো লাল”, বাণী পরে তাকে বলেছিল। ”বেড়ালে যেমন গুড়ি মেরে ন্যাজ নাড়ায় তেমনি করে পিছন দিকে ধরা হাতে লোহাটা নাড়াতে নাড়াতে খুব আস্তে বললেন, ‘হাঁটু ভেঙে দিয়ে তোর ফুটবল খেলা চিরকালের মতো ঘুচিয়ে দোব।’ তাই শুনে ঠাকুরপো ভয়ে সিঁটিয়ে তিন পা পিছিয়ে গেল। তখন যদি ওর মুখটা দেখতেন।”

 মানুর সঙ্গে তার কদাচিৎ দেখা হয়, সিঁড়িতে বা সদরে। মুখোমুখি হয়ে পড়লে দুজনেই হাসার চেষ্টা করে পাশ কাটিয়ে যায়। কখনো বা কথাও হয়।

 ”খোঁড়াচ্ছিস কেন, ইনজুরি?”

 ”এই অ্যাঙ্কেলটা, কাল…”

 কথাও শেষ করে না।

 ”এবার কোথায়, দিল্লি না বোম্বে?”

 ”রোভার্সে।”

 সন্দীপকে বুঝে নিতে হয় বোম্বে।

 মুরারির দোকানের পাশেই প্রভাতের চুল ছাঁটাইয়ের সেলুন। তার পাশেই ব্যাঙ্ক, যেখানে সন্দীপের একটা সেভিংস অ্যাকাউন্ট আছে। সকালের এই সময়টায় দুটি দোকানই ব্যস্ত থাকে।

 ”আসুন, কী দোব মামলেট টোস্ট।”

 ”শুধু চা।”

 রাস্তার দিকে মুখ করে সন্দীপ বসল। পাশেই উনুনটা, মুরারির হাত যত দ্রুত চা করছে বা রুটি সেঁকছে তার থেকেও দ্রুত তার মুখ চলছে। সন্দীপের সামনে সে একটা হাতপাখা রাখল।

 ”সেই ভোররাত থেকে লোডশোডিং তার ওপর গরম। মানুষের মনমেজাজ ঠিক থাকে না ব্যবসাপত্তর চালানো যায়! কখন যে পাখা আসবে…টুলটা নিয়ে বাইরে বসুন না, আমি চা দিয়ে আসছি।”

 ”না না আমি ঠিক আছি।”

 কয়েকজন খদ্দের তার দিকে তাকাল। মুরারির এত বিনীত খাতির এ অঞ্চলে দু-তিনজন মাত্র পায়। তার পাওয়ার কারণ সে মানুর দাদা, অফিসেও পায়।

 ”সন্দীপদা, ওর পিঠের ব্যাপারটা ঠিক হয়ে গেছে তো, কাল খেলছে তো?”

 ”সন্দীপবাবু একটু দেখবেন, মেম্বরশিপের জন্য দুবেলা এসে বসে থাকছে শালার ছেলেটা।”

 ”তুমি তো গাড়ি করে আসবে হে, ভাই তো এবার শুনলুম সত্তর হাজার পেয়েছে।”

 ”আপনার ভাইয়ের এই শ্রাবণেই নাকি বিয়ে?”

 ”তোমার সঙ্গে তোমার ভাইয়ের চেহারায় কিন্তু আকাশপাতাল তফাত, সত্যিই হ্যান্ডসাম সায়েবদের মতো দেখতে।”

 সন্দীপ রাস্তাটা খুঁটিয়ে দেখল বিস্কুটের কোনো চিহ্নই নেই। মুরারি কি তুলে নিয়ে বোয়ামের মধ্যে রাখল! দুটো বয়েমে দু ধরনের বিস্কুট। বোঝা যাচ্ছে না কোনগুলো সে মানুকে দেবার জন্য নিয়ে গেছল।

 ”মুরারি, রাস্তায় যে বিস্কুটগুলো পড়েছিল, গেল কোথায়?”

 অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে মুরারি কয়েক সেকেন্ডের জন্য গ্লাসে চামচ নাড়া থামাল।

 ”অ, আপনি দেখেছিলেন নাকি। সে কি আর এতক্ষণ পড়ে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে কাকে তুলে নিয়ে গেছে।”

 ”তোমার লোকসান হল তো।”

 ধন্য হয়ে যাবার অভিব্যক্তি ওর হাসিতে ফুটল।

 ”মানুদা ওই রকমই, কখন যে কী মেজাজ থাকে। চ্যারিটি ম্যাচের খানচারেক টিকিট এবার নোবই। এক একখানায় তিরিশ অন্তত পাব, গতবছরও পেয়েছিলুম।”

 ”পয়সাটা নাও।”

 কাকা গঙ্গাস্নান আর বাজার সেরে ফিরছেন। রগ থেকে ঘাম গাল বেয়ে থুতনিতে এসে জমেছে। মুখ নামিয়ে ছোটো ছোটো কদমে হাঁটেন, এমনকি রাস্তা পার হবার সময়ও। কেমন একটা বিব্রত ভঙ্গি ওর চলাফেরায় সবসময়ই থাকে। হাত না দুলিয়ে একমাত্র কাকাকেই সে হাঁটতে দেখেছে। অথচ বছর তিরিশ আগে বগলের ল্যাটিসিমাস ফুলিয়ে থুতনি তুলে হাঁটতেন। তখন সবাই ওকে ”জগা” বলত।

 প্রভাত সবে একজনের দাড়ি কামিয়ে হাতে লাগানো ফেনা ক্ষুর দিয়ে চেঁছে তুলছে। সন্দীপকে থুতনি দিয়ে সে চেয়ারটা দেখিয়ে দিল। বেঞ্চে বসে একজন কাগজ পড়তে পড়তে স্বগতোক্তি করল: ”আবার একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি।”

 ”কোথায়?”

 ”খিদিরপুরে।”

 ”এই তো কবে যেন শোভাবাজার হল।”

 ”সে তো পনেরো-ষোলো দিন আগে, তারপরও তো হল দুটো গয়নার দোকান।”

 ”আমাদের এদিকটায় এখনও হয়নি।”

 ”এবার হবে, দেখো হয়তো এটাতেই হবে।”

 লোকটি বুড়ো আঙুল দিয়ে তার পিঠের দিকের দেয়ালটা দেখাল। ওটা ব্যাঙ্কের বাড়ির দেয়াল।

 সন্দীপের নাকের নীচে বুরুশটাকে তুলির মতো সন্তর্পণে টানার কাজে ব্যস্ত থাকায় প্রভাত কথা বন্ধ রেখেছে।

 ”দুটো ডাকাতকে পিটিয়ে মেরেছে।”

 ”কোথায়?”

 ”হাওড়ায়।”

 ”সেদিন তো নদীয়ায় চারটেকে মারল।”

 ”চারটে নয় ছ’টাকে।”

 ”ওই হল।”

 প্রভাত হঠাৎ গলার স্বর নামাল।

 ”আপনার ভাইতো অ্যাদ্দিনবাদে ফিরেছে।”

 সন্দীপ চোখ বুজিয়ে ছিল, বুঝতে পারেনি প্রভাত তাকেই বলছে। সে আবার বলল, ”আমার কাছে কুড়িটা টাকা ধার নিয়েছিল।”

 ”কে?”

 সন্দীপ ট্যারা চোখে প্রভাতের মুখটা দেখল। কোনো ভাবান্তর নেই।

 ”সুহাসদা। তখন তো আর জানতুম না ফোরটোয়েন্টি লোক। কত লোকের যে টাকা মেরেছে।”

 ‘আপনার ভাই’ কথাটা সন্দীপকে অস্বস্তিতে ফেলেছে, খানিকটা রাগও হচ্ছে। একটা ঢপবাজ তার ভাই, এটা ঠান্ডা মাথায় হজম করা শক্ত।

 ”আমার ভাই কে বলল? ওতো দূর সম্পর্কের…সবাই জানে ও চিটিংবাজ, তুমি টাকা দিলে কেন?”

 ”ওনার বউয়ের কাছে তিন-চারবার চেয়েছিলুম। দিচ্ছি দোব করে আর দেননি। আমিও আর চাইনি। নিজের চোখেই তো দেখি ওর অবস্থাটা।”

 সন্দীপ আর কথা না বলে বাকি সময়টা কাটাল। বেরোবার মুখে আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে বলল, ”এখন তো ফিরেছে, এবার চেয়ে নাও।”

 ”গেছলুম। ওনার বউ বললেন খুব অসুখ, তবে দিনকয়েক পরেই দিয়ে দেবেন।”

 সন্দীপ ঠিক করল আজই দুপুরে সে হাসির সঙ্গে দেখা করবে। তারপর মনে পড়ল বিকেলে রত্নার সঙ্গেও দেখা হবে কিন্তু জায়গাটা মনে পড়ছে না।

 মাঝে মাঝেই রত্না দেখা হওয়ার জায়গা পালটায়। দিনকয়েক লালদিঘির দক্ষিণ-পুব কোণের ট্রাম-স্টপ, তারপর জায়গাটা ওর হঠাৎ একঘেয়ে মনে হওয়ায় ইলেকট্রিক সাপ্লাই অফিসের সামনে বদল করেছিল। গত সপ্তাহ পর্যন্ত ছিল আকাশবাণী ভবনের ফটক।

 এই এক ঝামেলা! অদ্ভুত এক অস্বাচ্ছন্দ্যে এবার সময় কাটবে। সন্দীপ বিরক্তি নিয়ে বাড়িতে ঢুকে বাঁ দিকের ঘরের আধভেজানো দরজা দিয়ে দেখল শৈলবালা ঘর মুছছে আর কাকা রজনীগন্ধার চূড়া পরিয়ে দিচ্ছে শিবাজীর গলায় যেটা বুক বেয়ে ঝুলছে শূন্যে।

 শৈলবালা ফিরে তাকাল এবং কাকাকে কিছু একটা বলল।

 ”সানু।”

 সন্দীপ বহু বছর পর কাকার এমন নরম গলা শুনল। জিজ্ঞাসু চোখে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। শৈলবালার বিপুল নিতম্বদ্বয়ের প্রতি চার চোখ কোনোক্রমেই যাতে নজর না দেয় সেজন্য হুঁশিয়ার রইল। শৈলবালার সঙ্গে রত্নার অনেকটা মিল আছে গড়নে। দুজনের শরীরেই সন্দেহজনক ধারণা দেবার মতো তথ্য রয়েছে। তবু সে বিশ্বাস করে না কাকার সঙ্গে ওর কোনো ব্যাপার আছে। বাল্য থেকেই সে দেখে এসেছে নরকের দ্বার ছাড়া নারী কাকার আর কোনো বিবেচনায় পড়ে না। দ্বার খোলার জন্য কাকা কখনো চেষ্টা করেনি।

 ”সুহাসকে একটু দেখিস, অনেকেরই তো রাগ আছে…হাজার হোক আমাদের বংশেরই একজন।”

 নিশ্চয় শৈলবালার কাছ থেকে শুনেছেন সুহাসের প্রত্যাবর্তনের খবর।

 ”খুব নাকি অসুখ ওর, হাসির কাছে শুনলুম।”

 ”ছেলেটা ভালোই ছিল। অনেক কিছু করতে পারত…”

 কাকা দরজার কাছে এগিয়ে এলেন। কপালে সিঁদুরের ফোঁটা। গঙ্গাস্নান করে ফেরার পথে কালীমন্দির থেকে নেওয়া। ঘরের একমাত্র আসবাব কাচের আলমারির মধ্যে দেখা যাচ্ছে লাল কাপড়ে জড়ানো কুকরিটা। সুভেনিরের মতো রেখে দিয়েছেন, যেমন গত তিরিশ বছর নিজেকেও আগলে রেখেছেন। কোথায়, কী যেন একটা বিপদ ওঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায় আছে, এমন একটা সতর্কতায় সর্বদা নিজেকে ঘিরে রাখেন। মৃত যবনরা হয়তো এখন ওকে ভয় দেখায়।

 পানুর বিয়ের সময় নিমন্ত্রণ পত্রে সম্মতি নিয়েই ওঁর নাম ছিল কিন্তু বউভাতের অতিথি অভ্যাগতদের সামনে আসেননি। ঘরের দরজা বন্ধ রেখেছিলেন। আশ্চর্য, কেউই ওর খোঁজ করেনি।

 ”কিন্তু লোভে পড়ে বিপথে চলে গেল। চরিত্রের জোর নেই, ধৈর্য নেই, তাড়াতাড়ি বড়ো হতে চায়। না হলে…পানু কি জানে?”

 ”বলতে পারছি না। হয়তো জানে, পাড়ায় তো সবাই জেনে গেছে।”

 হঠাৎ চোখদুটো নিথর করে, কাকা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে রইলেন। সন্দীপ যাবার জন্য উশখুশ করে বলল, ”আর কিছু?”

 ”সুহাসকে দেখো…মানুষ অনেক কিছু মনে রাখে প্রতিশোধ নেবার জন্য।”

 দরজাটা আচমকা বন্ধ করে দিলেন। সন্দীপ দোতলায় ওঠার সময় ভাবল, পানু কি প্রতিশোধ নেবে? তেমন মানসিকতা তো ওর নয়। স্বভাবে মৃদু, কখনো ঝগড়া করেনি, উত্তেজিত হতেও দেখা যায়নি। ওকে নিয়ে কখনো কোনো ঝামেলা হয়নি। ‘ভালো ছেলের’ মর্যাদা একমাত্র ওকেই দিয়েছে এই পাড়া। বাচ্চচাদের ক্লাব আর নানাবিধ অনুষ্ঠান নিয়েই ব্যস্ত থাকত। ক্লাবঘরটাতেই তার বেশি সময় কাটত। দুটো বোমা পুলিশ ওই ঘরেই পেয়েছিল। সেটাও কি সুহাসের কাজ? হাসি কি এতই কাম্য যে সুহাস এমন জঘন্য উপায় নেবে?

 পানুর দরজা বন্ধ রয়েছে। ভিতরে ভারী কিছু একটা টেনে নিয়ে যাওয়ার শব্দ। সন্দীপের হঠাৎ ইচ্ছা ছিল পানুকে সে একবার দেখবে। ওর পেটে এতদিন ধরে যন্ত্রণা হচ্ছে অথচ তাকে বলেনি, এজন্য সে ধমকাবে।

 দোতলায় সন্দীপকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মানুদের বাচ্চচা চাকরটা অবাক হয়ে তাকাতেই সে উপরের সিঁড়ি ধরল। ওর ডানহাতে বাজারের থলি থেকে লাউডগা বেরিয়ে ঝুলছে। আড়চোখে সে দেখল ছেলেটা কলিংবেল টেপার জন্য বাঁহাত তুলেছে। তিনতলায় পৌঁছনো পর্যন্ত বেল বাজার শব্দ পেল না। লোডশেডিং এখনও চলছে।

 ভাতের থালা নামিয়ে রাখা মাত্রই বাণীকে সে অনুযোগের সুরে বলল, ”এতদিন ধরে ব্যথা পুষে রেখেছে অথচ আমি জানি না। ট্রিটমেন্ট করাচ্ছে কি?”

 বাণী বুঝতে সময় নিল।

 ”খুব মারাত্মক হতে পারে।…ছেলেমানুষ তো নয়…লজ্জারও কিছু নয়। চুরি-ডাকাতি করে তো আর পুলিশের হাতে মার খায়নি, চেপে রাখার কি আছে!”

 সে বাণীর বিব্রত মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে ডালের বাটিতে আঙুল ডুবিয়ে নাড়তে লাগল।

 ”করছে কী এখন?”

 ”লিখছে।”

 পানুর লেখক হবার ইচ্ছাটা ছোটো থেকেই ছিল। স্কুলে মাস্টারমশাইরা ওর গদ্যের প্রশংসা করতেন। কম মাইনেয় পত্রিকায় চাকরি নেবার পিছনে নিশ্চয় ওর এই বাসনাটাই সক্রিয় ছিল। বছর দুই আগে একটা মাসিক পত্রিকায় ওর ধারাবাহিক উপন্যাস বেরোচ্ছিল। চার কিস্তি পর পত্রিকাটা উঠে যায়। সন্দীপ কখনো পানুর লেখা পড়েনি।

 ”লেখা ছাড়া বাড়িতে আর করে কী?”

 ”কী আর করবে, ছুটিছাটার দিনে দেবুকে কিছুক্ষণ নিয়ে বসে নয়তো ওই লেখা…কী যে লেখে, একটা পয়সাও তো পায় না।”

 ”তুমি জান না ওর পেটে মাঝে মাঝে ব্যথা হয়?”

 ”মাঝে মধ্য বলে তো…অম্বলের ব্যথা। কদিন আগে তো অপিসেই গেল না।”

 দ্বিধাজড়িত উদ্বিগ্ন বাণীর স্বর থেকেই সে বুঝল, পানু চায়নি তার বউ জানুক। জেনে কিই বা করতে পারবে। অলকা বা রত্নার মতো বাণী চলাফেরা, চিন্তা বা উদ্যোগ নিতে অক্ষম, অর্থ রোজগারে অক্ষম। একা কখনো রাস্তায় বেরোয়নি। এবং পানু কদাচিৎ ওকে নিয়ে বেরোয়। স্বামীর বা সংসারের উপরও প্রভাব নেই। বেচারা।

 ”ওর কীসের ব্যথা হয়?”

 উৎকণ্ঠায় বাণীর গলা বসে গেছে। হয়তো যন্ত্রণার কথা জানে। কিন্তু তার কারণটা সম্পর্কে সন্দেহ আছে তাই জেনে নিতে চাইছে।

 ”বিয়ের আগে একবার পুলিশে ধরেছিল নকশাল সন্দেহে, কোনো বদমাস লোকের কাজ। তুমি তো সে সময় কলকাতায় ছিলে না তাই দেখনি কী কাণ্ড হয়েছিল। হরদম বোমার শব্দ আর খুন। তখন যাকে পেত পুলিশে ধরত, থানায় মারধোর করত কথা বার করার জন্য। পানুকে ধরে নিয়ে যাবার পর পাড়ার দুটো ছেলে ধরা পড়ল…”

 ”উনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন?”

 ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে গিয়ে সন্দীপের আঙুলগুলো মুহূর্তের জন্য অসাড় হয়ে গেল।

 পানু ধরিয়ে দেবে কেন! সকলেই তো জানে এসব সুহাসেরই কাজ। হাসির চোখের আড়ালে পানুকে পাঠাবার দরকার ওর তখন হয়েছিল। এছাড়া কোনো কারণ, কোনো যুক্তি কি পানুর বিপক্ষে থাকতে পারে? মৃদু নম্রস্বভাব, কোনো রাজনৈতিক দলে নেই। কখনো ছিলও না, সৎ এবং ন্যায় এই দুটি পন্থা যথাসাধ্য অনুসরণ করে পানু বরাবর চলেছে।

 বহু উদাহরণ আছে, নিজে অকারণে আর্থিক বা মানসিক অসুবিধায় পড়েও যথার্থ কারণটিকে ধরিয়ে দেয়নি।

 ”তোমার একথা মনে হল কেন?”

 একটু রূঢ় হয়ে গেছল তার বলার ভঙ্গি, বাণী থতোমতো অসহায় হয়ে গেল।

 ”এতদিন ঘর করছ, তুমি চেনো না তোমার স্বামীকে?”

 ”আমি তা ভেবে বলিনি, দাদা। মা একদিন বলেছিলেন কিনা…”

 সন্দীপ জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বাণীর থেমে যাওয়া বাক্যটিকে সম্পূর্ণ করার আদেশ জানাল।

 ”মানে, হাসিদিকে উনি তখন নাকি বিয়ে করবেন ঠিক করেছিলেন…”

 ”হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে, বহুলোকের জীবনেই এমন ঘটে, ঘটবেও…বিয়ের পরেও ঘটে।”

 সে শেষের কথাটা যোগ করল সম্ভবত নিজেকে ভেবে, নিজেরই সমর্থনে। পরমুহূর্তে তার মনে হল এটা করার কোনো দরকারই ছিল না।

 ”ওসব অনেকদিনই চুকেবুকে গেছে। পানুর সঙ্গে হাসির সম্পর্ক আর নেই। তাছাড়া সুহাসও এসে গেছে।”

 ”উনি হাসিদির বাড়ি মাঝে মাঝে যান।”

 ”কে বলল?”

 বাণী জবাব না দিয়ে হঠাৎ চলে গেল। তবে সন্দীপের মনে হল ও যেন দরজার কাছে ধরা গলায় একবার স্বগতোক্তি করল, ”আমি জানি।”

 অলকাও কিছু জানে কি? জানলেও সে একটি কথাও বলবে না। নিজের মর্যাদা সম্পর্কে অত্যন্ত সতর্ক। তাচ্ছিল্য অবহেলা দেখাবে, না জানার ভান করবে। বাণীর মতো সে ভাবপ্রকাশে অভ্যস্ত নয়। অলকা সম্ভবত বোঝে দেহ বা আবেগের মতো বড়ো দুটি ব্যাপারে পুরুষদের থামিয়ে রাখার মতো বোকামি আর নেই।

 মিনিবাসে বহু মাস পর সন্দীপ আজ বসার জায়গা পেল, তাও জানলার ধারে। সকাল নটার পর, কলকাতায় কাজের দিনে এটা বিমূঢ় করার মতো অভিজ্ঞতা। গিরিশ পার্কে নেমে যাওয়া অবাঙালিনীদ্বয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল সন্দীপ।

 ”এই তো এই বাড়িটা…এই যে এই যে নীচে ব্যাঙ্ক, বাসনের দোকান…”

 কথাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে বাসে দাঁড়ানোরা কুঁজো হয়ে জানলা দিয়ে তাকাবার চেষ্টা শুরু করল।

 ”চোদ্দতলা ভাঙা চাট্টিখানি কথা নয়। বহু লাখ টাকা খরচ করেছে, সহজে ভাঙতে দেবে না।”

 ”তৈরি করল কী করে, অ্যাঁ, কর্পোরেশনের পারমিশান ছাড়াই?…ঘুমোচ্ছিল নাকি!”

 ”ঘুষ দাদা, ঘুষ…সবই করা যায়, কলকাতাটাই বেচে দিতে পারেন।”

 সন্দীপও ঘাড় বেঁকিয়ে আকাশের দিকে তাকাবার চেষ্টা করে বাড়িটার অর্ধেক মাত্র দেখতে পেল। ঘাড়ের কাছে মেরুদণ্ড যথেষ্ট মোচড় খেল না। ঘাড়ের ব্যায়ামটা করলে বোধহয় আর একটু বাঁকাতে পারত।

 কিন্তু এই বাড়িটা চোদ্দতলা পর্যন্ত উঠল কবে? প্রতিদিনই সে এই রাস্তা দিয়ে যায়, অথচ একদমই নজরে আসেনি। রাস্তার দুধারে যতটুকু বাসের জানলা দিয়ে দাঁড়ানো বা বসা অবস্থা থেকে দেখতে পেয়েছে, বড়োজোর তিনতলা পর্যন্ত, তার বেশি আর কিছুই জানে না। উপর দিকে তাকানোটাই তো বহু বছর হয়নি।

 সন্দীপ রীতিমতো অবাক হয়ে গেল। কাগজে হঠাৎ একদিন এই বাড়িটাকে নিয়ে মামলা, ভাঙার হুকুম, ইনজাংসন, ভাড়াটেদের দাবি, সুপ্রিমকোর্ট ইত্যাদির দ্বারা হইচই না উঠলে, কোনোদিন তো জানতেই পারত না, এমন লম্বা একটা বাড়ির পাশ দিয়ে রোজ দুবার সে যাতায়াত করে। কত জিনিসই দেখা হয় না সংকীর্ণ পথের জন্য। ময়দানের বা গঙ্গার ধার দিয়ে যাবার সময় দৃষ্টি কিন্তু অনেক উঁচুতে পৌঁছোয়।

 সংসারেও অনেক কিছু দেখা হয়নি, সংকীর্ণতার জন্য।

 আলোচনাটা চালু রয়েছে। অনেকেই তাদের অভিজ্ঞতার থলি থেকে তথ্য বার করছে। সন্দীপ তাতে মন দিল।

 ”আরে মশাই গরমেন্টের পতিত খাসজমি মাটি ঢেলে, রাস্তা ড্রেন বানিয়ে প্লট করে করে রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি হয়ে গেল। কোটি কোটি টাকার কারবার…লালে লাল হয়ে গেল। স্রেফ ল্যান্ড রেকর্ডস অফিসের কটা লোককে…কাউকে টাকা খাইয়ে কাউকে জমির একটা তিন টাকার তিনকাঠার প্লট দিয়ে হাপুস করে দিলে দলিলপত্তর। গরমেন্ট জানতেও পারল না। তার জমি লোপাট হয়ে গেছে। মজার কথা কী জানেন, রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে যখন জমির দরকার হল, গরমেন্ট তখন নিজের সেই জমিরই খানিকটা টাকা দিয়ে কিনল। কী বলবেন একে বলুন। দাদা তখন তো বললেন ঘুমোচ্ছিল নাকি! মোটেই ঘুমোয়নি, তখনই সব থেকে সজাগ ছিল।”

 গভীর মনোযোগে সারা বাস শুনছিল। সন্দীপের পাশের লোকটি এই সময় বিড়বিড় করল: ”করাপশ্যান…তলা থেকে ওপর পর্যন্ত পচে গেছে। ধরে ধরে গুলি করা উচিত।”

 ”ব্রেন আছে বটে।” কুঁজো হয়ে সন্দীপের মুখের কাছে মুখ রেখে যে লোকটি দুর্গন্ধ নিঃশ্বাস ছাড়ছে এবং ঊরুর উপর ফোটা ঘাম ফেলছে, তারিফ জানাবার ভঙ্গিতে তাকে উদ্দেশ্য করেই বলল।

 ”একসময় বাঙালিদেরও ব্রেন ছিল, ভেজাল খেয়ে খেয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। কীসে ভেজাল নেই, ওষুধে পর্যন্ত। লোক মরে যাচ্ছে পরোয়া নেই, টাকাতো আসছে। এইরকম মেন্টালিটি না হলে টাকা করা যায় না।”

 সন্দীপ জানলার বাইরে তাকাল। প্রণবেশের মুখটা ভেসে উঠছে তার মনে।

 ”সারাদেশটা লোকে থিকথিক করছে, কিছু মরা ভালো।”

 সন্দীপের পাশের লোক কোলে রাখা ব্রিফ কেসটার হাতল আঁকড়ে কথাটা বলেই উঠে পড়ল। বাস বৌবাজার মোড়ে থেমেছে।

 ”পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধু লাগবে মনে হয়। আমেরিকা তো এন্তার অস্ত্র ওদের দিচ্ছে।”

 লোকটি তার নিঃশ্বাসের শেষ কিস্তি সন্দীপের মুখে ছড়িয়ে পাশের খালি সীটে বসল। প্রণবেশের মুখটা মিলিয়ে গিয়ে এবার কাকার মুখ ভেসে উঠল। তার মনে হচ্ছে ওই দুজনই নানান ছদ্মবেশে বাসে রয়েছে।

 কুড়ি মিনিট দেরিতে সন্দীপ অফিসে পৌঁছালো। প্রতিদিন এইরকম দেরিই তার হয়। তাকে দেখে বেয়ারা সুজিত আঙুলের ইশারায় পারচেসিং কন্ট্রোলারের কেবিনটা দেখাল অর্থাৎ ওখানে খোঁজ পড়েছে।

 লেট হওয়ার জন্য এখানে ঝামেলা হয় না, সুতরাং খোঁজ পড়ার কারণ কী হতে পারে? দরজা ঠেলে কন্ট্রোলারের মুখটুকু চোখে পড়ার আগে পর্যন্ত সে একটি কারণও খুঁজে পেল না।

 ফোন করছিল লোকটি। ব্যবসায়িক কথাবার্তাই হবে, কেননা টেবলে কনুই রেখে ঝুঁকে কপালে ডানহাতের তালু ঘষছে। অব্যবসায়িক হলে চেয়ারে হেলান দেয়। সন্দীপকে চোখের ইশারায় চেয়ার নিতে নির্দেশ দিল।

 ”একটা ছোট্ট উপকার করে দিতে হবে। আপনার ভাইয়ের ম্যাগাজিনে ছোট্ট একটা রিপোর্ট ছাপিয়ে দিতে হবে, আর একটা ছবিও।”

 কাঁচুমাচু অথচ ব্যক্তিত্ব বজায়, দুটোই একসঙ্গে মুখে রয়েছে। সন্দীপ কোনটাকে প্রাধান্য দেবে বোঝার জন্য গম্ভীর হল।

 ”সিগারেট।”

 বিলিতি প্যাকেটটা এগিয়ে দিল। নিজের জন্য একটা দিশি প্যাকেটও থাকে। ওই ব্র্যান্ডেই নাকি গত পঁচিশ বছরে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তবে বাইরের লোকের সামনে বার করে না।

 সিগারেট ধরিয়ে প্রথম টানের ধোঁয়াটা সামনের দিকে না পাশে বার করবে তাই নিয়ে একটা ছোটো সমস্যায় সে পড়ল। কন্ট্রোলার তার অনেক ধাপ উপরের লোক।

 ”মানে, আমার শালীর মেয়ে পরশু গান করেছে একটা ফাংসানে, রবীন্দ্রভারতীতে। তারই রিপোর্ট…”’

 টেবিলের ড্রয়ার টানল।

 ”…আমিও শুনতে গেছলাম, ভালোই গেয়েছে, অবশ্য গানের তেমন কিছু বুঝি না তবে মানুষের ফিলিং তো বুঝি। দুটোর জায়গায় চারখানা গাইতে হয়েছে…আধুনিক আর হিন্দি গীত…খুব বড়ো করে লেখেনি, এইসব ফাংসানের খবর ছাপাবার তো আলাদা বিভাগ আছে!…আমি বলেছি আপনার কথা, ভাই কাজ করে, ছাপাবার কোনো অসুবিধেই হবে না।”

 সন্দীপ অনেক আগেই ধোঁয়া সামনের দিকে ছেড়েছে তবে মৃদু ভাবে। বোধহয় অঙ্কখাতার পাতা ছিঁড়ে লেখা হয়েছে। কাগজটার অন্য পিঠে তৃতীয় উপপাদ্যের ত্রিভুজটা আঁকা। গভীর মনোযোগে পড়ার জন্য সে কপাল কুঁচকোল।

 ”লেখাটা অবশ্য এধার ওধার করার দরকার মনে করলে করে নেবেন…একটা অল্প বয়সি নতুন গাইয়ে, তাকে তুলতে হলে কীভাবে লিখতে হবে সে ওরাই ভালো জানে…আর এইটে।”

 স্টুডিয়োতে তোলা ছবি। ফুলদানির পাশে চিবুকে আঙুল ঠেকিয়ে রাখা মুখ। ভরি পাঁচেক সোনা, দোকানে বাঁধা খোঁপা, দুটি দীর্ঘ চোখ এইসবই চোখে পড়ে।

 ”বলব ভাইকে।”

 ”বলাবলি নয়, ছাপিয়ে দিতেই হবে।”

 এর কাছেই প্রণবেশের কোটেশন অনুমোদন হবে কি হবে না বিচারের ভার। এখনই সুযোগ ব্যাপারটা তোলার। কিন্তু এই মুহূর্তে কথা পাড়লে, বুদ্ধিমান লোক, বুঝে নেবে। খুব সম্ভবত রাজি হবার ভান করে, শালার মেয়ের সংগীত রিপোর্ট ছাপিয়ে কাজ হাসিল করেই কলা দেখাবে। এই ধরনের গুণ না থাকলে সন্দীপ সযত্নে কাগজটা চার ভাঁজ করে ছবি সমেত মানিব্যাগের মধ্যে রাখল লোকটাকে নিশ্চিন্ত করতে। শালার বাড়িতে খাতির বাড়লে যে আত্মপ্রসাদ জমবে সেটা ভাঙিয়ে আদায় করাই ভালো। পানুকে বললেই হয়ে যাবে, নিশ্চয় এসব জঞ্জাল ছাপাবার ক্ষমতা ওর আছে। বড়জোর বলবে: ”তোমাদের কোম্পানি বিজ্ঞাপন দেয় কি?”

 আশ্চর্য, পানুরও কিছু ক্ষমতা আছে! ওর জন্যই এখন এই চোয়ারে বসে ভালো সিগারেট টানতে টানতে সামনের বিগলিত মুখটি দেখার সুযোগ সে পেল। মানুও যে তার ভাই এটাও নিশ্চয় জানে। সারা অফিস তো জানেই।

 মানুরই খ্যাতি পরিচিতিটা বেশি। অফিসেই একজন বলেছিল, ”আপনার ভাইয়ের নাম আর ছবি গত চার-পাঁচ বছরে যত ছাপা হয়েছে কোনো বড়ো বিজ্ঞানী কি মিউজিসিয়ান কি পেইন্টারেরও সারা জীবনও তা হয়নি।” মানু দুবার স্কুল-ফাইনাল ফেল করেছে। বছর তিন আগে বাণী জানিয়েছিল ওর পাসের ব্যবস্থা হয়েছে।

 ”আরে আর একটা কথা তো বলতে ভুলেই গেছি।”

 সন্দীপ দরজার কাছ থেকে ঘুরে দাঁড়াল।

 ”আপনার বন্ধুর ব্যাপারটা। ওটা আমি দেখব।”

 ”কোন বন্ধু?”

 আলটপকা কথাটা তার মুখ থেকে খসে পড়ল। কন্ট্রোলারের ভ্রূ বিস্ময়ে উঠে যেতেই সামলে নিয়ে সে বলল, ”প্রণবেশ। হ্যাঁ, কাল বলছিল আমায় আপনাকে একবার বলতে।”

 ”বলতে হবে না, আমার মনে আছে। বাঙালি ফার্ম, খেটেখুটে কম্পিটিশানের মধ্য দিয়ে দাঁড়াচ্ছে, চেষ্টা তো করতেই হবে হেল্প করতে…আচ্ছা যার কাছে গান শেখে, তার নামটা কি দেওয়া সম্ভব?”

 প্রণবেশ বলেছিল, ”মদ টদ খায় তবে মাত্রা রেখে, মেয়েছেলের ঝোঁক নেই। সল্ট লেকে জমি কিনেছে, টাকা-ফাকার ব্যাপারে যদি আসে রাজি আছি।”

 সন্দীপের মনে হল এখুনি বলে ফেলা যায়: ”স্যার কত টাকা আপনি নেবেন কোটেশান অ্যাপ্রুভ করতে, বলে ফেলুন।”

 ”কেন দেওয়া যাবে না! দেখি তো এরকম কত ছাপা হয়, অমুকের কাছে সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করেছেন বা অমুকের ছাত্রী।”

 ”তাহলে একটু দিয়ে দেবেন।”

 ”কার কাছে শিখেছে?”

 মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে ফ্যালফ্যালে দেখাচ্ছে। আজ সকালেই মানুর কাছে ধমক খাওয়া মুরারির মুখের সঙ্গে যেন পলকের জন্য মিলে গেল। খোলা ড্রয়ারের দিকে একবার তাকিয়ে বলল: ”লেখা নেই ওতে? আমার কাছেও তো নেই নামটা।”

 ”না, লেখা নেই।”

 ”বলেছিল কী একটা যেন। আচ্ছা ফোন করছি, না থাক, আমি বরং কালই আপনাকে জানিয়ে দেব। দেরি হবে না তো?”

 ”না সাপ্তাহিক তো, দু একদিনে আসে যায় না।”

 নিজের চেয়ারে এসে তার প্রথমেই মনে হল মানু বা পানুর পরিচিত মহলে কি কখনো কেউ বলে, ‘ইনি সন্দীপের ভাই’, কখনো কেউ কি ওদের বলে ‘দাদাকে দিয়ে এটা করিয়ে দাওনা ভাই।’ কিংবা তোমার দাদার একটা অটোগ্রাফ চাইই। বড্ড ধরেছে ছেলেটা।’

 প্রণবেশ তার সাহায্য চেয়েছে বটে কিন্তু আসলে সেটা পারচেসিং কন্ট্রোলারের অনুগ্রহ জোগাড় করে দেবার জন্য, তার নয়। নিজের অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট ওরা থাকেনি, পানু মানু প্রণবেশ কেউ নয়। সে অসন্তুষ্ট বটে কিন্তু কাউকে অনুগৃহীত করার মতো গভীর অসন্তাোষ বোধ হয় তার মধ্যে নেই। না থাকায় সে কি পিছিয়ে পড়েছে?

 অদ্ভুত একটা ঝাঁঝ তার মাথা থেকে পায়ের ডগা পর্যন্ত ওঠা-নামা করল। ক্রোধ নয়, হতাশা আর তিক্ততা এবং নিজের প্রতি অনুকম্পা ও বিরক্তি ছাড়া এটার কোনো মূল্য নেই। এইরকম অবস্থায় নিজেকে চাঙ্গা করার কথা ভেবে সে রত্নাকে ফোন করার জন্য উঠে গেল পাশের মার্কেটিং ডিভিশনের ঘরে।

 পি বি এক্স বোর্ডের মেয়েটা আড়ি পেতে শোনে, বিশেষত ওপ্রান্তে যদি কোনো মেয়ে কথা বলে। রত্না নৈর্ব্যক্তিক কণ্ঠে ঠিক দরকারি কথাগুলোই যদি বলতে পারত তাহলে সন্দীপ উলটো দিকে দুটো টেবল পরে ডেপুটি ম্যানেজারের ফোনটাই ব্যবহার করত। কিন্তু রত্না ধরা গলায় আধো আধো স্বরে এমন দু-চারকথা বলবেই যাতে এক্সচেঞ্জ বোর্ডের মেয়েটা উৎকর্ণ হয়ে উঠবে। তবে রত্নার দিকের ফোনটা ধরতে হয় খিটমিটে মাঝবয়সি সেকশান ইনচার্জের চেয়ার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। লোকটার ভীষণ ঝোঁক, মেয়েরা ফোন করতে এলে ঘাড় ফিরিয়ে শিল্পী সমালোচকের মতো তাদের নিম্নাঙ্গ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একফুট দূর থেকে দেখার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, তার নস্যির কৌটো বা পেনসিল সেই সময় টেবল থেকে পড়ে যায় এবং ঝুঁকে মেঝে থেকে সেটি তোলার সময় তার মাথা আলতো ছুঁয়ে যাবেই ঊরু বা নিতম্বে। সারা অফিস এটা জানে এবং মেয়েরা ফোন হাতে নিলেই ঘরে মুচকি হাসি শুরু হয়। রত্নার বারণ আছে, গুরুতর বিষয় ছাড়া, তাকে ফোন করার।

 ”খুবই জরুরি তাই, কোথায় দেখা করার কথা বল তো?”

 ”সেকি, এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল! এইতো আমার বরাত, আমার কথা তো…”

 ”আমাকেই শুধু বলতে হয়, ভিখারির মতো আমাকেই শুধু দেখা করো দেখা করো বলে দর্শন চাইতে হয়।”

 ”তোমার পাশের চেয়ারের লোকটা কিন্তু যা দেখার দেখছে, আমার হিংসে হচ্ছে।”

 ”থাক আর মিথ্যে বলতে হবে না, হিংসে যে কত হয় তা জানি, চেয়ারের লোকটার হাঁপানি বেড়েছে, ছুটিতে আছে, নতুন একজন চেয়ারে,” স্বরটা অস্পষ্ট হয়ে পড়ল, বোধহয় মুখ অন্যদিকে ফেরানো।

 ”দারুণ হ্যান্ডসাম, তোমার থেকেও।”

 ”তাহলে ফোন রাখছি।”

 ”না না…এই ঠাট্টা করছি।”

 রত্নার স্বরে ক্ষীণ উৎকণ্ঠার ছোঁয়া পেল। বোরডের মেয়েটা নিশ্চয় ঘড়ি দেখে সময়টা রাখছে পরে খোঁজ নেবে ঠিক এগারোটা-তেত্রিশে মার্কেটিং ডিভিশনের দুনম্বর টেবল থেকে কে ফোন করেছিল।

 ”আজকের জায়গাটা কোথায়?”

 ”বৌবাজার যাব, ওমাসে যে বালাটা গড়াতে দিলুম সেটা আজ দেবার কথা। সেখান থেকে বাসে কি ট্রামে উঠে…তুমি ঠিক ছ’টায় ইনডোর-স্টেডিয়ামের গেটে থেকো, হাইকোর্টের দিকে।”

 সন্দীপ রিসিভার রেখে দিল। আর না শুনলেও চলে। ঘড়ি দেখল সে, দুটোর সময় হাসির টিফিন হয়। ওর সঙ্গে দেখা করতেই হবে, সুহাস ফিরে এসে কিছু জট তৈরি করেছে। হেঁটে হাসিদের এম্পোরিয়ামে দুটোয় পৌঁছতে গেলে কখন বেরোতে হবে, তার একটা আন্দাজ করে নিয়ে সে নিজের চেয়ারে ফিরে এল।

 দরজা থেকেই হাসির সঙ্গে তার চোখাচোখি হল। তারা দুজনেই হাসল। কাউন্টারের ওধার থেকে হাসি বেরিয়ে এল। চিবুক তুলে সমুন্নত দেহে তেজি ভঙ্গিতে। সন্দীপের মনে হল এইটেই ওর সম্পর্কে সঠিক শব্দ। তেজি মেয়ে না হলে সরলভাবে, নম্রতা সহকারে এবং ভাগ্য যা কিছু ছুঁড়ে দিয়েছে তাই স্বীকার করে নিয়ে জীবনের মুখোমুখি দাঁড়ানো যায় না।

 অভিযোগ করার মতো যাবতীয় কারণ ওর আছে! ওর মুখমণ্ডল স্বচ্ছ, সবকিছুই স্বচ্ছ। ওর গায়ে সাদা ব্লাউজ, মেঘরঙা তাঁতের শাড়িতে সাদা বিজলি রেখা আর বৃষ্টির ছাট। এখানকার সব মেয়েই তাই পরেছে। হাসির কপালে সিঁদুরের টিপটা সে আগে কখনো দেখেনি।

 ”আমার মনে হচ্ছিল আজই তুমি আসবে।”

 ”কেন জানি মনে হল, তাড়াতাড়ি দেখা করাটাই বোধহয় ভালো।”

 ”চলো কোথাও বসে কথা বলি। এখানে একটা দোকান আছে।”

 হাসি তাকে নিয়ে যেখানে এল সেটা মুরারির দোকানের থেকে কুলশীলে মাত্র এক ধাপ উপরে। ভিতরে বসার জায়গা নেই, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কয়েকজন আলুরদম পাউরুটি খাচ্ছে। চেয়ার থেকে কেউ ওঠা মাত্রই ভিতরে অপেক্ষমানরা বসে পড়ছে। সন্দীপের নজরে পড়ল অফিসের ইউনিফর্ম পরা দুটি লোককে, কোনো অফিসের বেয়ারা বা ড্রাইভার হবে। হাতে গড়া রুটি আর তরকারির প্লেট প্রতি টেবলেই। মাংসের ঝোল নিয়েও কেউ কেউ। কর্মচারীদের হাঁক আর টেবলে প্লেট রাখার শব্দ ছাড়া আর সবই নীরব।

 ”দিদি আসুন, জায়গা আছে।”

 ভিতর থেকে হাতছানি দিল দোকানের ব্যস্ত পরিবেশক ছেলেটি। হাসিকে দেখে মনে হচ্ছে, সম্ভবত দুপুরেও এখানে খেতে আসে।

 ”এখানে বসে তো কথা বলা যাবে না, চল অন্য কোথাও যাই। বড্ড গরম।”

 হাসিকে বিব্রত দেখাল। অন্য কোথাও কত খরচ পড়বে তাই ভেবেই বোধহয়।

 ”তোকে আজ চীনে খাবার খাওয়াব। আমার চেনা একটা দোকান এখানেই আছে।”

 মিনিট চারেক হেঁটে ওরা ঢুকল সেই দোকানটিতে যেখানে প্রায়ই রত্নাকে নিয়ে সন্দীপ বসে। আজও তার ইচ্ছে ওকে নিয়ে এখানে কিছু খাওয়ার, এদের চিকেন-ছৌ ছৌ রত্নার ভালো লাগে। কিন্তু একই দিনে দুবার একজায়গায় খাওয়া যায় না।

 দেয়াল ঘেঁষে দু-তিনটে খালি টেবল। পিছনের দিকে একটা ওরা বেছে নিল। অন্যান্য টেবলে বীয়ারের বোতল এবং আরামলোভী মানুষ। সবাই মুখ ফিরিয়ে হাসিকে দেখল বা দেখছে। সন্দীপ বীয়ার চাইল আর হাসির জন্য পেট ভরানোর মতো ফ্রায়েড রাইস। ওয়েটার বীয়ারের সঙ্গে দুটি গ্লাস এনেছিল, সন্দীপ তর্জনী তুলে একটি গ্লাসেই বীয়ার ঢালতে নির্দেশ দিল।

 ”আজকাল মেয়েরাও খুব খাচ্ছে তাই ও…”হাসি প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চায় বলেই চোখেমুখে কোনো ঔৎসুক্য প্রকাশ করল না। কিছুক্ষণের জন্য ওরা কথা বলা বন্ধ রাখল।

 ”পানুদার সঙ্গে কি এরমধ্যে তোমার দেখা হয়েছে?”

 সন্দীপ মাথা নাড়ল।

 ”যদিও একই বাড়িতে থাকি, কারুর সঙ্গেই আমার বিশেষ দেখা হয় না।”

 ”ওর বউয়ের সঙ্গে হয়, তোমায় তো ভাত দিয়ে আসে।”

 হাসি এসব খবর তাহলে রাখে, পানুর তো যাতায়াত ছিল ওর কাছে, কিংবা মার সঙ্গে কোনোসময় রাস্তায় দেখা হয়ে থাকবে।

 ”মার কাছে শুনলাম, অবশ্য সেদিন তোর কাছেই প্রথম।”

 ”পানুদা জানে, তাই না?”

 ”বলতে পারব না, হয়তো জানে। পাড়ায় যখন সবাই জানে।”

 ”ওর সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার সানুদা…আমি নয়, আমার হয়ে তুমি বলবে। ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়া ভালো। তোমার ভাইকে আমি বুঝি। তোমাদের বাড়ির লোক কী ভাবে না ভাবে তাও জানি।”

 ওর মুখে বিভ্রান্তি উৎকণ্ঠা। সুন্দর গোলাকার দৃঢ় বুকদুটি দ্রুত ওঠা-নামা করছে। হাসি কাঁদছে না।

 ”যদি দেখতে কী অবস্থায় ও এসেছে।”

 ”বুঝতেই পারছি ওকে দেখে তোর দয়া হয়েছিল।”

 অস্ফুটে বলেই সন্দীপ অনুতপ্ত হল। বোঝা উচিত ছিল কথাটা ওকে আঘাত করবে, কিন্তু যা আশা করেছিল তার থেকেও তপ্ত প্রতিক্রিয়া ঘটল।

 ”ওর জন্য আমার দয়া হয়েছিল, এমন কথা শুনতে ভালো লাগে না, ইচ্ছেও করে না। তোমাদের যদি মনে হয়, ইচ্ছে করে, বিশেষত পানুদার, কেননা সবার থেকে তারই বেশি দয়া করার কথা, তাহলে তোমরা মিলে ওকে দয়া দেখাতে পার। কিন্তু আমার কাছে সে আমার স্বামী। সে বিভুর বাবা। সে একমাত্র মানুষ যাকে ভালোবেসেছি, এখনও বাসি।”

 শেষের বাক্যটি বলার সময় তার গলা ভেঙে গেল, মুখটা দেয়ালের দিকে ফেরাল। সেই সময় বেয়ারা ফ্রায়েড রাইসের প্লেট হাতে টেবলে এসে না দাঁড়ালে সন্দীপ ওর হাতটা স্পর্শ করে জানিয়ে দিত, বুঝেছি।

 ”স্বীকার করছি, ও দোষী”, নিজেকে সামলে তুলে হাসি আবার শুরু করল, ”ওর দোষ ঢাকার চেষ্টা আমি করছি না। কিন্তু সারাজীবনই কি মানুষটা শাস্তি পেয়ে যাবে, এটা কি ঠিক? ও তোমারই বয়সি সানুদা, কিন্তু আসলে ওর আর বয়স নেই। বাড়ির সামনে ওকে যখন দেখলাম, দোতলায় জানলার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে…”

 কাগজের ন্যাপকিনটা মুঠোয় পাকিয়ে দাঁতে চেপে ধরল। নিজেকে শান্ত রাখতে, কান্নায় ভেঙে না পড়ার জন্য। সন্দীপ এবার হাত বাড়িয়ে ওর হাতে আলতো চাপড় দিল বন্ধুর মতো।

 ”দেখ সানুদা”, নিঃশ্বাস চেপে হাসি মাথা এগিয়ে আনল কেননা তিন হাত দূরের টেবলে একাকী লোকটি তাদের কথা শোনার চেষ্টা করছে। ”তুমি তো ওকে জান। তোমার নিশ্চয় মনে আছে অল্প বয়সে ও কেমন ছিল, তোমাদের মধ্যে সব থেকে ভালো দেখতে, সব থেকে অহংকারী। তাই নিয়ে গোঁয়ার্তুমি ঔদ্ধত্যও ছিল, পৃথিবীকে তুচ্ছজ্ঞান করত। আর যে লোকটি সেদিন বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করছিল তাকে দেখে মনে হল একটা ভাঙা পোড়ো বাড়ি। ভিখিরির মতো দেখাচ্ছিল…

 ”আমি শুনেছিলাম, ওকে নাকি দেখা গেছে পাড়ারই কাছাকাছি পাতাল রেলের মজুরের কাজ করতে। খালপাড়ে ঝুপড়িতে নাকি থাকতে দেখেছে কেউ কেউ। বিশ্বাস করিনি…

 ”ভাবতাম বাড়িতে ফেরার সাহস বোধহয় হবে না…অনেকদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো যন্ত্রপাতি দিয়ে মাটি তোলার কাজ দেখার ছলে ওকে খুঁজেছি। চাইতাম ফিরে আসুক আবার বিভুর কথা ভেবে চাইতাম না…ভাবতাম ওকে টাকা পাঠাই…কিন্তু কীভাবে?

 ”জানলার পর্যার ফাঁক দিয়ে সেদিন ওকে দেখছিলাম। ঠাটা রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে দরদর ঘামছে, কঙ্কাল চেহারা, চোখ গর্তে বসা, হাত-পা কাঠির মতো, মারখাওয়া গোরুর মতো তাকাচ্ছে, একেবারে হেরে যাওয়া মানুষ একটা…যখন জানলার দিকে তাকাল আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না…ছুটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে দরজা খুলে ওকে ডাকলাম…

 ”এগিয়ে আসার আগে একটু ইতস্তত করল। দরজা পেরিয়ে ঢুকে এল আমার মুখের দিকে না তাকিয়ে, তারপর কী যে হল আমার, দরজা তখনও খোলা, আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম ওর বুকের ওপর।”

 হাসির হাতের উপর সন্দীপের হাত। ও খাচ্ছে না এবং কাঁদছেও না। সে চোখ ইশারায় খাবার দেখিয়ে বলল, ”ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

 মুখ নিচু করে হাসি খেয়ে গেল কিছুক্ষণ। ”তোমাদের বংশের অসুখটাই পেয়েছে। ওর বাবার ছিল, তোমার বাবারও ছিল। যখন অ্যাটাক হয় নিথর হয়ে বসে থাকে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে, হাতটুকু পর্যন্ত তুলতে পারে না। তোমার বাবার কথা তো মনে আছে? তাছাড়া পেটের গোলমাল, হজম ক্ষমতা একদমই নষ্ট হয়ে গেছে, কিছু খেতে পারে না…ডাক্তার বললেন, সেবাযত্ন আর নিয়ম মেনে চলা, এই একমাত্র চিকিৎসা…

 ”পানুদার সঙ্গে দেখা করব ভেবে একদিন ওর অফিস পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসেছি। মনে হল হয়তো এমব্যারাসড হবে। আমার জন্য অনেক করেছে, এই কাজটা পানুদাই চেষ্টা করে জোগাড় করে দিয়েছে, বিভু তো ওকে প্রায় বাবার মতই দেখে…

 ”সানুদা ওকে ফিরিয়ে দেওয়া আমার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, একেবারে শেষ হয়ে গেছে লোকটা, তুমি তো ওর চরিত্র জান, সামান্য এক ফোঁটা আশাও কোথাও যদি থাকত তাহলে এমন লজ্জাকর ভাবে মাথা নিচু করে ও ফিরে আসত না।”

 সন্দীপ অবশ্য হাসির মতো অত নিশ্চিত নয় এই ব্যাপারে, সুহাস ভান করায় ওস্তাদ এবং জীবনধারা বদলাবার প্রতিশ্রুতি এটাই তার প্রথমবার নয়। ব্যক্তিগতভাবে সন্দীপের কোনো রাগ বা বিদ্বেষ ওর প্রতি নেই। পানু হয়তো ওকে ক্ষমা করে দিয়ে থাকবে। কিন্তু হাসিকে তার স্বামীর হাত থেকে বা দয়া মায়া মমতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পানু কি চেষ্টা করবে না? গত দশ বছর ধরে হাসির উপর ওর একটা অধিকার এসে গেছে।

 ”ওর সম্পর্কে পাড়ায় অনেক কথাই হয়েছিল, তুমি নিশ্চয় সেসব জান। ওর জন্যই দুটো ছেলে পুলিশে ধরা পড়ে, নকশালরা ওকে পেলে খুন করবে, পানুদাকে…এসব কথা আমিও শুনেছি, ওহ কি দিনই না আমার গেছে। সারা পাড়া আমায় ঘেন্না করত। পানুদা তখন পাশে না দাঁড়ালে…ওর কাছে আমার ঋণ শোধ করার নয়।”

 ”সুহাস কি ভয়ের মধ্যে রয়েছে? এখন তো ওসব ব্যাপারে খুনটুন হচ্ছে না, গুণ্ডামি, ডাকাতি, চোরাকারবারের অধিকার নিয়েই তো যা কিছু হয় এখন।”

 ”ভয় নয়, বোধহয় লজ্জা। ও জানে তোমরা সবাই ওর সম্পর্কে কী ভাব। তোমাদের বিশেষত পানুদার, মুখোমুখি হলে কী ঘটবে তাই নিয়েই ওর কেমন যেন চিন্তা, আমার ঘাড়ে বসে খাবে এতেও ওর লজ্জা। এখনই কাজকর্মের কথা বলছে।”

 ”কী করতে চায়?”

 সুহাস কখনো বাঁধা কাজ করেনি, নিয়মমাফিক কাজ শেখেওনি। শুধুই লোক ঠকিয়ে গেছে।

 ”যা জোটে। আমাকে বলেছে বোম্বাইয়ে দিল্লি দরবার হোটেলে ডিশ ধোয়ার কাজ করেছে, একটা ফিল্ম স্টুডিয়োতে ছুতোর মিস্ত্রির হেল্পার ছিল বছরখানেক…”

 হাসি আবার চামচে হলুদভাত তুলল। বোঝা যায় খাওয়ার খুব ইচ্ছে নেই, শুধু কথা বলতে চায়।

 ঠিকই বলেছে হাসি: প্রথম যৌবনে সুহাস সুদর্শন, স্মার্ট, সবথেকে প্রতিশ্রুতিবান ছিল তাদের মধ্যে। বংশে অমন গৌর ত্বক, ঘন কোঁকড়া চুল, গভীর চোখের মণি আর তীক্ষ্ন নাক ও চিবুক কারুর হয়নি। সন্দীপের মনে আছে, সুহাস উপস্থিত থাকলে সেখানে সবাই মিইয়ে যেত, কথাবার্তার ধরন বদলে যেত। উদ্যম ছিল সুহাসের, ওকে দমানো বা থামানো যেত না। শুধু মেয়েরাই মুগ্ধ হত না, পুরুষরাও ওর ঝাঁঝালো প্রাণপ্রাচুর্যে আর কথায় চনমন করে উঠত। ঝকঝকে দাঁতের ঝিলিক দিয়ে তরুণ সুহাস যখন কুড়ি-বাইশে তখনই সে ক্যানিং থেকে মাছ কিনে এনে বাজারে স্টল নিয়ে বিক্রি করেছিল। ব্যবসাটা শুরুর পনেরো দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছিল। এরপর শিলিগুড়ি থেকে সে চোরাচালানি জিনিস কিনে কলকাতায় বিক্রির কাজে নামে। মাস তিনেক পর তাকে দেখা গেল একটা ছাপাখানা ইজারা নিয়ে সাপ্তাহিক সিনেমা পত্রিকা ছাপছে। সুহাসের কোনো উদ্যোগই নিজের টাকায় নয় যেহেতু টাকাই তার ছিল না। যাদের টাকা নিয়ে তার ব্যবসা, তারা কিন্তু পরে কোনো অভিযোগ তোলেনি বা আইনের আশ্রয় নেয়নি। লোককে বোঝাবার বা বিভ্রান্ত করার ক্ষমতা ওর ছিল।

 হাসি খাবারের এক-তৃতীয়াংশ ফেলে রেখে ক্ষমাপ্রার্থীর মতো মুখ করে বলল, ”আর পারছি না সানুদা।”

 ”থাক দরকার নেই।”

 ওরা রাস্তায় বেরিয়ে কিছুটা একসঙ্গে হেঁটে আলাদা পথ নেবার আগে একবার দাঁড়াল।

 ”পানুদার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি, নিশ্চয় শুনেছে। হয়তো ওর সঙ্গেই আমার বিয়ে হত যদি না সুহাস এসে পড়ত। তাহলে বোধহয় সকলের পক্ষেই ব্যাপারটা ভালো হত, তাই না?”

 সন্দীপ এবং হাসি হুবহু একই রকমের পাতলা স্বচ্ছ হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুলল যাতে কোনো দ্বিমত বা বিরোধ নেই।

 ”সারাজীবনই মাশুল গুনে যাবে একটা লোক, তা হয় না…একটা সময় আসে যখন…তুমি কি পানুদার সঙ্গে কথা বলবে? যদি চায় তাহলে আমি গিয়ে বরং দেখা করব…তোমায় যা যা বললাম তাই বলব, আমি ওর পায়ে ধরব, যা কিছু অন্যায় বিভুর বাবা করেছে ওর প্রতি…”

 ”কিন্তু শুধু তো পানুই নয়…”

 সারা পাড়ার ধারণা পিণ্টু আর দুলাল ধরা পড়েছিল সুহাসেরই দেওয়া খবরে। দুলাল মারা গেছে জেলে, পিণ্টুর আজও কোনো খোঁজ মেলেনি। মাকে নিয়ে দুলাল আশ্রিত ছিল মামাবাড়িতে। পিণ্টুর বাবা দু বছর আগে মারা গেছে। ওর একটা বোন যাত্রায় অভিনয় করে ছয়জনের সংসারটাকে ভাসিয়ে রেখেছে।

 ”পানুদা যদি ওকে ক্ষমা দেখান তাহলে অন্যরা সাহস পাবে না…”

 ”সুহাসকে নিয়েই কি জীবন কাটাবে?”

 ”ও আমার স্বামী।”

 ”বিভু কী বলছে?”

 ”বাবাকে ও এই প্রথম দেখছে। কথা বলে না, দূরে দূরে রয়েছে।”

 ”বাবার সম্পর্কে কিছু কথা নিশ্চয় ওর কানে গেছে।”

 হাসি মাথা হেলিয়ে ফ্যাকাশে মুখে বিড়বিড় করল।

 ”বাবার সম্পর্কে ওর ধারণা বদলে দিতে পারে শুধু পানুদা। ও যদি দেখে পানুমামা কথা বলছে বাবার সঙ্গে তাহলে…ওর কাছে পানুমামা ভগবানতুল্য।”

 ”আচ্ছা আমি কথা বলব ওর সঙ্গে।”

 স্বস্তি ফুটে উঠল হাসির মুখে। ওদের দু পাশ দিয়ে মানুষের স্রোত ভুলে গিয়ে সে সন্দীপের হাত দুই মুঠোয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য ধরে ছেড়ে দিল।

 ”তাহলে জানিও, আমি যাচ্ছি, দেরি হয়ে গেছে।”

 সমস্যার ছোপ মুখ থেকে মুছে হঠাৎ নিশ্চিন্তি এনে ওকে প্রফুল্লতা দেওয়ায় হাসিকে এখন কুমারীর মতো লাগছে। ওর যে বারো বছরের একটা ছেলে আছে কেউ তা বিশ্বাস করবে না। এক সময়ে ওকে ভালো লেগেছিল এটা আবার তার মনে পড়ল।

 ”বেচারা।”

 দ্রুত হেঁটে যাওয়া হাসির দিকে তাকিয়ে সে অলকা বা রত্নার সঙ্গে কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পেল না।

 অন্ধ একটা রাগ, একটা বিস্বাদ পলকের জন্য তাকে ঝাঁকুনি দিল, হাসি, পানু সুহাস এরা তার জীবনের একটা ক্ষুব্ধ, বিরক্তিকর সময়ের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। বাল্য, কৈশোর থেকে যৌবনের প্রথম কয়েকটা বছর পর্যন্ত যখন সে বাড়িতে বা বাইরে বন্ধুহীন, জগৎ সম্পর্কে সন্দিগ্ধ, সুকুমার বৃত্তিগুলি স্ফূরণে অনাগ্রহী তখন হাসিকে কেন্দ্র করে তারই বয়সি দুজন অন্য এক পৃথিবীতে চলে গেছিল তাকে ফেলে রেখে।

 আবার ওরা তার জীবনে ফিরে এল কিন্তু কোনো উপহার সঙ্গে আনল কি? হয়তো দশ বছরের সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, আত্মত্যাগ, …সুহাসের সঙ্গে বসবাস মানেই তো ধ্বংস হওয়া, এসবের সাহায্যে হয়তো সে হাসিকে বা ওর মতোদের শ্রদ্ধা করতে শিখবে। কিন্তু ব্যাপারটা অর্থহীন কেন নয়? হাসি মাত্র তেত্রিশ বা চৌত্রিশ বছরের। দেহ মন অনেক কিছু চায় নিশ্চয়। পানুকে নিয়েই জীবন কাটাতে পারে, দরকার কি ব্যর্থ একটা ভালোবাসাকে ধরে রাখার? সুহাস সুখী হবে না কিন্তু পানু হবে। হাসি কি জীবন উপভোগ করতে চায় না!

 কয়েক ঘণ্টা পর ট্রাম থেকে নামা রত্নাকে ইনডোর স্টেডিয়ামের গেটের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সন্দীপ আর একবার ভাবল, হাসির মতো নয়, রত্না চালাক, স্বার্থপরও কিন্তু জীবনকে হাতছাড়া করায় ব্যস্ততা ওর নেই। যা পায় কুড়িয়ে নেয়। বিয়ের বয়স, যদি শরীরের আকর্ষণের ভিত্তিতে বিচার করতে হয়, তাহলে পুরোমাত্রায় বজায় আছে, যদিও সে মধ্য তিরিশে।

 ”দেখ তো কেমন হল।”

 বাঁ হাত এগিয়ে ধরল রত্না, ম্যারাথন বিজয়ীর হাসি নিয়ে। মুখটিতে লাবণ্য কম। মুখ আর একটু কম রুক্ষ হলে বা গোলাকার না হলে এই হাসিকে স্নিগ্ধ বলা যেত। দেহের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে ঈষৎ বৃহদাকার মাথা। বালাটা চওড়া কবজির সঙ্গে মানিয়ে দরজার কড়ার মতো মোটা। রত্নার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্বাভাবিক আকারের রমণীদের থেকে বড়ো। কণ্ঠস্বর ভারী, নাকের নীচের পুরু লোম ত্বকের রঙের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় দূর থেকে চোখে পড়ে না।

 সন্দীপ একনজর তাকিয়েই তারিফ জানাল, ”বাহ বিউটিফুল তো..মানিয়েছে বেশ!”

 ”আনা ছয়েক সোনা আরও দিতে পারলে ভালো একটা ডিজাইনের করা যেত।”

 ”দিলে না কেন?”

 ”কি যে বলো, তাহলে আরও কত দিতে হত জান?”

 ওরা হাঁটতে শুরু করেছে। স্ট্র্যান্ড রোড দিয়ে দক্ষিণে বাবুঘাটের দিকে আপাতত যাচ্ছে। কতদূর যাবে সেটা নির্ভর করে রত্নার ক্লান্তির বা সন্দীপের পছন্দ মতো বসার জায়গা পাওয়ার উপর।

 একদিন সে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানে বসে সাধারণ স্বরেই বলেছিল, ”তুমি মোটা হয়ে যাচ্ছ, পেটে চর্বি জমছে।” রত্না তলপেটে হাত রেখে যথাসম্ভব মেরুদণ্ড খাড়া করে বলে: ”কোথায় চর্বি, দেখো।”

 সে হাতটা বাড়িয়ে ওর তলপেটের চর্বি আঙুলে ধরে টানতেই রত্না চাপা ধমক দিয়ে ওঠে। হাতটা অবশ্য সে অনেকক্ষণ রেখেছিল।

 ”তোমার আবার ছোটাছুটি করা উচিত, ডায়েটিংও।”

 রত্না একসময় শট ও ডিসকাস ছুঁড়ত। বিশ্ববিদ্যালয় আর বাংলা দলের প্রতিনিধি হয়ে বছর চারেক ভারতের কিছু জায়গায় গেছল। চাকরিটা তখনই পাওয়া এবং বিয়েও। অ্যাথলেটিকস জীবনের মতো ওর বিবাহিত জীবনও দ্রুত শেষ হয়ে যায়।

 একবার চণ্ডীগড় যাবার সময় টিমের কোচের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় ট্রেনে। সেটা চূড়ান্ত হয় কোচের ঘরে মধ্যরাত পর্যন্ত কাটিয়ে। ব্যাপারটা যথেষ্ট জানাজানি হয়েছিল। বাপের বাড়ির অমতে অবশেষে সেই কোচকেই রত্না বিয়ে করে।

 চারমাসের মধ্যেই স্বামীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটে। রত্নার কাছে লোকটি লুকিয়ে গেছল তার আগের বিয়ের কথা। মালদহের গ্রাম থেকে তার সতীন এক ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় এসে পৌঁছতেই সে বাপের বাড়ি চলে আসে। আজও সেখানেই আছে, কুমারী সময়ের পদবি নিয়ে।

 রত্নার বাবা ও বড়দা আলু ব্যবসায়ী, মেজদার ছিট কাপড়ের দোকান হাতিবাগানে, পরের ভাই ডেকরেটিং ব্যবসা শুরু করেছে, দুই বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। স্বচ্ছল পরিবার, রত্না সেখানে বোঝা নয়, কিন্তু চোখের মণিও নয়।

 সন্দীপ মাঝে মাঝে অফিস থেকে ফেরার পথে গল্প করতে যায় মাণিকতলায় উকিল বন্ধু প্রফুল্লর সেরেস্তায়। বাড়ির বৈঠকখানাটা কাঠের পার্টিশান দিয়ে এবং প্রচুর আইন বিষয়ক বই সাজিয়ে বারো বছর ধরে প্রফুল্ল বসছে। রমরমা পসার নয় তবে চলে যাচ্ছে।

 দেড় বছর আগে সেখানেই সন্দীপ প্রথম দেখেছিল রত্নাকে। খোরপোষের মামলা করার জন্য অফিসের একটি মেয়ের সঙ্গে ও এসেছিল প্রফুল্লর কাছে।

 ”সানু একে চিনিস, নামকরা অ্যাথলিট রত্না গড়াই।”

 ”নামকরা আর কি, অল্প কদিনই তো নেমেছিলুম। অল ইন্ডিয়াতেও তেমন কিছু করিনি।”

 ”গত বছরও তো আমাদের অফিসের অল ইন্ডিয়া স্পোর্টসে সেকেন্ড হয়েছিলি ডিসকাসে।” বান্ধবীর এই সংশোধন রত্না গায়ে মাখল না।

 ”হ্যাঁ, ভারী তো অফিস স্পোর্টস, সবই তো আমার মতই বুড়ি, আধবুড়ি। চাকরি রাখার জন্য নামা।”

 রত্নার সরল স্বীকারোক্তিতে সন্দীপ হাঁফ ছেড়েছিল। কেননা সে জীবনে এই মেয়েটির নাম শোনেনি। কিন্তু ওর খসখসে ভারী গলায় এমন একটা কিছু ছিল শোনামাত্র সন্দীপের নার্ভগুলো, এমনকি পেশিও শিরশির করে ওঠে। দেয়ালে নখ দিয়ে আঁচড়ালে যেমনটি হয়, বাহুতে কাঁটা উঠেছিল। সে অনুভব করেছিল যৌন উত্তেজনা। এর পর সে উকিল ও মক্কেলের মধ্যে দরকারি কথাবার্তা থেকে নিজেকে সরিয়ে খবরের কাগজে চোখ রাখে।

 বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল, বাজ পড়ারও কয়েকটা শব্দ হয়। তাই ওরা বাড়ি যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে প্রফুল্লর সেরেস্তা থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। রত্নার বন্ধুটি রাস্তাতেই বিদায় নেয়।

 ওরা সেদিন ট্রাম বাস পায়নি। কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেছল। মিনি বাসে ঘাড় হেঁট করে দাঁড়াতে দুজনেই রাজি না হওয়ায় তারা হেঁটে শ্যামবাজার পর্যন্ত যায়।

 সন্দীপ পরদিন খবরের কাগজে দেখে, কয়েক লাইনে বলা হয়েছে: একটি বালক সরকারি বাস চাপা যাওয়ায় জনতা বাসে অগ্নিসংযোগ করে, কয়েক রাউন্ড গুলি চলে, দুজন হত। তারপর রুট থেকে ট্রাম-বাস প্রত্যাহার করা হয়।

 ”আমি মামলা মোকদ্দমায় যেতে চাই না। দশ বছর তো হয়ে গেল, দিব্যিই আছি। কোনো অসুবিধে যখন হচ্ছে না তখন ঝুটঝামেলায় গিয়ে লাভ কি!” হাঁটতে হাঁটতে রত্না কথা বলে যাচ্ছিল। ”কিন্তু কি জানেন, লোকটা মহা খচ্চচর। আবার একটা মেয়ের সঙ্গে একই কাণ্ড করেছে যা আমার সঙ্গে করেছে। আপনি তো শুনলেন যা যা উকিল বাবুকে বললুম।”

 ”না আমি শুনিনি।”

 রত্না মুখ ফিরিয়ে অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়েছিল।

 ”ডাক্তার বা উকিলের কাছে মানুষ তার ব্যক্তিগত গোপন কথা বলে, ওসব শুনতে নেই বাইরের লোকের।”

 ‘তা ঠিক। তবে কোর্টে মামলা উঠলে তখন তো হাটে হাঁড়ি ভাঙে। আমার হয়েছে সেই মুশকিল। দাদার মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে, খুব কনজারভেটিভ ফ্যামিলি আমাদের, বংশে আমিই একমাত্র মেয়ে কলেজে পড়েছি, বি.এ. পাশটা করিনি অবশ্য।…আমাকে বিধবা বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছে পাত্র পক্ষের কাছে।”

 রত্না হেসেছিল শব্দ করে। দু-তিনজন পথচারী ফিরে তাকায়।

 ”বলেছিলুম এসব বলার কী দরকার, যা সত্যি তাই বলো! এমন তো কতই হচ্ছে, কত মেয়েকে পুরুষরা ঠকাচ্ছে, তাদের জীবনটাই নষ্ট করে দিচ্ছে…আমার অবশ্য নষ্টফস্ট হয়নি, চাকরি করছি খাচ্ছিদাচ্ছি ঘুরছি…কিন্তু দাদাবউদির কাছে এটা একটা মহাভারত অশুদ্ধ হওয়ার মতো ব্যাপার। আপনার কি মনে হয় এ ব্যাপারে?”

 ”এ রকম মানসিকতা আমাদের দেশে তো এখনো রয়ে গেছে।” সন্দীপ সাবধানে বিষয়টাকে পাশ কাটাতে চাইল। প্রথম আলাপেই বাড়ির কারুর সম্পর্কে কটু মন্তব্য ওর পছন্দ হবে কিনা সেটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। তবে রত্নার স্বচ্ছন্দ কথা বা ভঙ্গি তাকে আকর্ষণ করেছিল। আড়চোখে সে কয়েকবার ওর ঘাড় থেকে গলা বেয়ে ব্লাউজের কিনার পর্যন্ত নেমে যাওয়া ঢালু মসৃণ পেশির দিকে তাকিয়েছে। একদা ভারী লোহা নাড়াচাড়া করার রেশ কাঁধ ও বাহুতে ছড়িয়ে আছে। সন্দীপের মনে পড়ল সে অনেকদিন কোনো ধরনের ব্যায়ামই করেনি।

 ”এতদিন যখন মামলা করেননি, তখন আর করার দরকার কী?”

 এইসময় বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি নামে।

 ”আজই ছাতা না নিয়ে বেরিয়েছি…চলুন ওই বারান্দাটার নীচে।”

 দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট মানুষগুলোকে একধারে ঠেলে জড়োসড়ো দলা পাকিয়ে দিয়েছে। ওরা বারান্দার নীচে অন্যধারে দাঁড়াল যেখানে ভিজতে হবে বলে কেউ দাঁড়ায়নি।

 ”আমার কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজতে বেশ লাগে।”

 ”আমারও।”

 ”এখন বাড়িতে থাকলে ছাদে উঠে…”

 আকাশে ফাটল ধরিয়ে বিদ্যুৎ রেখা পুবের বস্তির মাথায় নেমে এল এবং বাজ পড়ল।

 ”উ বাবা।” দুহাতে কান চাপা দিয়ে রত্না কুঁজো হতেই সন্দীপের বাহুতে মাথা ঠেকল। হালকা সুগন্ধি তার নাকে এল।

 ”বড্ড ভয় করে বাজ পড়লে…আবার হয়তো পড়বে।”

 ”এক জায়গায় পরপর পড়ে না।” সন্দীপ অনিশ্চিত স্বরে বলল।

 কিছুক্ষণ পর রত্না বিষণ্ণ স্বরে বলল, ”আজ দুর্ভোগ আছে…যা বৃষ্টি হচ্ছে ট্রামতো বন্ধ হবেই, বাসেও ওঠা যাবে না, রিকশা যদি যায় তো দশ-পনেরো যা খুশি ভাড়া চাইবে।”

 ”আপনার কাছে টাকা নেই?”

 ”তা আছে।”

 ”উহুঁ মনে হচ্ছে নেই, কই দেখান তো?”

 ”ধার দেবেন, তারপর ধার শোধ করতে আপনি আসবেন আমার অফিসে।”

 সন্দীপ অপ্রতিভতার শেষ সীমায় পৌঁছে ফিরে আসার জন্য আঁকুপাকু করতে করতে একটা ব্যাপার বুঝল: ওর কথায় বিদ্রূপের হুল ফোটানোর চেষ্টা নেই এবং স্বাভাবিক বোধশক্তিটা প্রখর।

 ”সেটা মন্দ ব্যাপার হয় না, তাহলে আমার কাছে ঋণী হোন।”

 সন্দীপ একটা পাঁচ পয়সা ওর মুখের সামনে চিমটের মতো দু আঙুলে ধরল। রত্না নির্দ্বিধায় তার দু আঙুলে মুদ্রার বাকি অংশটুকু চেপে ধরে বলল, ”রোজ পাঁচটার সময় আমি জি পি ও-র সামনে মিনিবাসের লাইনে দাঁড়াই, হয়তো, কোনো একদিন দেখা হয়ে যাবে, তখন পয়সাটা ফেরত দিয়ে ঋণমুক্ত হব।”

 একটু গলা নামিয়ে সন্দীপ বলল, ”ঋণ বেশিদিন ফেলে রাখতে নেই, মার যাবার সম্ভাবনা থাকে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ফেরত না পেলে আমি কিন্তু ঋণ দিই না।”

 ছোট্ট মুদ্রাটিকে দুজনেই আঙুলে চেপে ধরে কথাগুলো বলে। আঙুলগুলো ছোঁয়ানো ছিল। পরে অবশ্য সন্দীপের মনে হয়, খুব দ্রুত তারা কাছাকাছি এসেছে, যা সাধারণত হয় না।

 ”পাঁচ পয়সার মতো সামান্য জিনিস মার যায় না, হাজার কি লক্ষ টাকার মতো হলেই ভাবনার ব্যাপার।”

 ”এটা পাঁচ পয়সা কে বলল! পাঁচকোটি টাকা এর দাম।”

 যতটুকু রাস্তার আলো পাওয়া যাচ্ছে তাতেই সন্দীপ দেখতে পেল রত্নার মুখে কোমলতা ছড়িয়ে যাচ্ছে।

 ”এত বছর এভাবে না কাটিয়ে বিয়ে করতে পারতেন।”

 ”কেন এইভাবে থাকতে অসুবিধে কী?”

 ”বাস্তব অসুবিধে আছে বইকি।…রোগভোগ, বার্ধক্য, অপরের সংসারে থাকার যন্ত্রণা…”

 ”ওসব নিয়ে অতশত ভাবি না…আপনি কি বিয়ে করেছেন?”

 ”হ্যাঁ।”

 ”ছেলেমেয়ে?”

 ”নেই।”

 ”বউ?”

 ”বাইরে থাকে, স্কুলে কাজ করে, শনি রবিবার আসে।”

 ”দুটো দিন তাহলে এনজয় করেন।”

 অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে ওর মুখের দিকে তাকাল। রচনার হাসিতে অশ্লীলতার চাপা আভাস। সন্দীপের ভালো লাগল দেখতে। উত্তেজিত হবার মতো প্রশ্রয় রয়েছে।

 ”আপনার একটা হাতের মাপে আমার বউয়ের একটা পা হবে।”

 ”রুগণ?”

 সন্দীপকে দেখিয়ে আঁচলে বাহু ঢেকে রত্না হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি মাপার চেষ্টা করল।

 ”চলুন যাওয়া যাক। আমাদের দত্ত বাগানের দিকটা খুব ভালো নয়, রোজই ছিনতাই হচ্ছে। অবশ্য গায়ে গয়নাটয়না নেই, তাহলেও…”

 হালকা এলোমেলো হাওয়ায় ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে ওরা রওনা হল। কিছু লোক রাস্তায় রয়েছে। যানবাহন অল্প। শ্যামবাজারে যে বাসগুলির যাত্রা শেষ সেগুলিতে হালকা ভীড়। রাস্তার গর্তে জমা জল ছিটকে উঠছে গাড়ির চাকার ধাক্কায়। কখনো ফুটপাথ দিয়ে কখনো বা রাস্তায় নেমে ওরা হেঁটেছে।

 ”এইসব মামলা আবার কাগজে বেরিয়ে যায়, ভয়টা সেখানেই, বাড়িতে বলছে যাকগে কিন্তু বিয়েতে পাওয়া হাজার দশেক টাকার জিনিস ফেলে রেখে এসেছি, চেয়েও পাইনি। গয়নাগুলোও দেয়নি। তা নয় না দিল, কিন্তু ব্যাটা আবার মেয়ে ঠকাতে শুরু করেছে।

 ”বউটাকে তো দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে, এখন একটা মেয়েকে নিয়ে খুব ঘোরাঘুরি করছে…ফর্সা ছিপছিপে সুন্দরী, সম্ভবত স্প্রিন্টার।

 ”একদিন ময়দান মার্কেটে মুখোমুখি পড়ে গেছল। আমাকে দেখে একগাল হাসল, আমি অবশ্য ন্যাচারালই ছিলাম। মেয়েটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমাকে খুব লক্ষ করছিল, হয়তো জানে আমি কে। খচ্চচরটা ‘কেমন আছ? ভালো আছ?’ ‘আমার ছাত্রী’ এইসব বলে তাড়াতাড়ি কেটে পড়ল।

 ”দেখলুম মেয়েটা কী জিজ্ঞেস করল, কী যেন বলে ও কাঁধ ঝাঁকাল। তারপর মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল…ঠোঁট বেঁকিয়ে কেমন যেন তাচ্ছিল্য আর ভয় দেখাল…খুব কষ্ট হল মেয়েটার জন্য, তাই ঠিক করেছি মামলা করব, এক্সপোজ করব, ব্যাটাকে রক্ত হাগিয়ে ছাড়ব, ক’টাকা আর মাইনে পায়..ফুটুনি মেরে বেড়ানো…আমার পায়ের ওপর কুত্তাটাকে টেনে আনতে যদি না পারি তো আমি রত্না গড়াই নই…”

 রত্নার গোঁয়ার চরিত্রের সঙ্গে প্রচ্ছন্ন মমতাও মিশে আছে। সন্দীপের মনে হয়েছিল ‘পুঁচকে মেয়েটা’ ঠোঁট না বাঁকালে ও উকিলের কাছে ছুটে আসত না।

 শ্যামবাজারের মোড়ে শেয়ারের ট্যাক্সিতে রত্নাকে তুলে দেবার সময় ওর আঙুল সে আলতো ছুঁয়েছিল। তখন সে দুটি সিদ্ধান্ত নেয় : বাড়ি ফিরে আজ রাত থেকেই ব্যায়াম শুরু করবে আর কাল পাঁচটায় মিনিবাস স্ট্যান্ডে থাকবে।

 রত্না অবশ্য মামলা করেনি। সন্দীপ পরে খোঁজ নিয়েছিল প্রফুল্লর কাছে।

 ”ব্যাটা একটা ঘোড়েল। নোটিস দিয়েছিলুম, একদিন কোর্টে আমার সঙ্গে দেখা করে বলল, ‘ওকে বারণ করুন মামলা করতে, না হলে অনেক কিছুই ফাঁস হয়ে যাবে, তাতে ও আর মুখ দেখাতে পারবে না। আমার সঙ্গে বিয়ের আগে কার সঙ্গে কবে কী করেছিল, কী চিঠিপত্র লিখেছিল, কোথায় গিয়ে অ্যাবোর্শন করিয়েছিল সব প্রমাণ হাতে আছে, ওর বাড়ির লোকও সব জানে। গয়নাগাঁটি, জিনিসপত্তর কিছুই ফেরত পাবে না, দোব না। ওকে বলুন আমাকে যেন ডিস্টার্ব না করে, তাহলে ওর কোনো ক্ষতি করব না।”

 ”রত্না গড়াইকে সব বললুম। শুনে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ‘কী প্রমাণ আছে? সব মিথ্যে কথা, এইসব বলে ভয় দেখাচ্ছে যাতে মামলা না করি কিন্তু আমি করবই। আমি ভয় পাওয়ার মেয়ে নই, ঢের ঢের অমন পুরুষ দেখেছি’। এইসব বলে টেবলে ঘুঁষি মেরে সেই যে চলে গেল আর আসেনি।”

 প্রফুল্ল হেসে বলেছিল, ”মামলার জন্য আগাম দুশো টাকা দিয়ে গেছল, ফেরত দিতে হবে। কোথাও যদি দেখতে টেখতে পাস, টাকাটা নিয়ে যেতে বলিস। চিনতে অসুবিধে হবে না যা একখানা চেহারা!”

 সেইদিনই সন্ধ্যার পর আউট্রাম ঘাটে গঙ্গার পাড়ে বসে রত্নার প্রথম চুম্বন সে পেয়েছিল।

 ওরা স্ট্র্যান্ড রোড ধরে ইডেনের পাশ দিয়ে ঘুরে মোহনবাগান মাঠের পিছনে কেল্লার র‌্যামপার্টের উপর কোনাকুনি একটা উঁচুনিচু কাঁচা রাস্তা ধরল যেটা দিয়ে রেড রোড ও ট্রামলাইনের মোড়ে পৌঁছনো যায়। মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গলের ফুটবল খেলা না থাকলে অল্প লোকই এই পথে চলে, সন্ধ্যার পর চলে না। গড়ের ধারের ঝোপ ঝাড় থেকে র‌্যামপার্টের জমি ঢালু হয়ে নেমে এসেছে। কেল্লার গঙ্গার দিকে প্রণবেশের গাড়িতে বসে সন্দীপ দেখেছিল এমনই ঢালু জমি দিয়ে অন্ধকার থেকে নেমে এসেছিল দুটি নারী পুরুষ।

 গঙ্গার ওপারে সূর্য ম্রিয়মাণ হয়ে আড়াল পড়ার পরও এই অঞ্চলে আলোর স্বচ্ছতা কিছুক্ষণ থাকে। কলকাতার গভীরে, অলিগলিতে তখন সন্ধ্যা নেমে যায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে জোড়ে জোড়ে কিছু নারী ও পুরুষ ঘনিষ্ঠভাবে বসে। ওদের মুখগুলো এখন আবছা, মেয়েদের রঙিন শাড়ির রং শুধু চেনা যাচ্ছে।

 রত্না পথ ছেড়ে কেল্লার গড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

 ”ওদিকে কোথায়? আর একটু বরং হাঁটি।”

 ”আর পারছি না বাবা, এবার বসব।”

 ইচ্ছে করেই রত্না ওদের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। যুবকটির হাতে মেয়েটির হাতটি ধরা। একবার চোখ তুলেই নামিয়ে হাত ছাড়িয়ে পিঠের উপর আঁচল টেনে দিল। রুগণ, মুখটি মিষ্টি। যুবক কাঠি নষ্ট করছে সিগারেট ধরাবার জন্য। পুরু গোঁফ, হাত দুটিতে ভিটামিনের অভাব।

 ঝোঁপের দিকে পিঠ রেখে ওরা বসল। দূরে চৌরঙ্গীর উপর বাড়িগুলো অস্পষ্ট, রাস্তার আলো জ্বালা হয়ে গেছে। মোটরের হর্ন এমনকি এঞ্জিনের শব্দও তারা শুনতে পাচ্ছে। তক্তাঘেরা তিনটে ফুটবল মাঠ আর মধ্যে মধ্যে তাঁবু নিয়ে গড়ের মাঠের এইদিকটা পরিত্যক্ত কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক খননক্ষেত্রের মতো দেখাচ্ছে। বহু দূরের নিওন বিজ্ঞাপনের দপদপানি এতক্ষণে বেরিয়ে আসছে। আশপাশে যারা বসে, অন্ধকার তাদের গলিয়ে মিশিয়ে দিচ্ছে নিজের সঙ্গে। একটা দুটো সাদা ছোপ, হয়তো সাদা জামাপরা কেউ।

 সন্দীপ হাত রাখল রত্নার ঊরুতে।

 ”এখন নয়…চুইংগাম আছে খাবে?”

 ”এই জিনিসটা আমার বিশ্রী লাগে।”

 ”কোন জিনিসটা তোমার ভালো লাগে? ঝালমুড়ি…খাব না, গরম আলুর চপ…খাব না, শশা….খাব না, ভিজে ছোলা কাঁচালঙ্কা পেঁয়াজ তাও নয়।”

 ”এগুলো প্রত্যেকটা মারাত্মক বীজাণুর ডিপো।”

 ”আমি তো কত খেয়েছি…আর একটু পরে…যখন স্পোরটসে আসতুম তিন টাকা চার টাকার ফুচকা উড়িয়ে দিতুম, কই অসুখ বিসুখ…আঃ বলছি এখন নয়, কে এসে পড়বে।”

 ”কার মাথাব্যথা পড়েছে এখন এখানে আসার।”

 ”একদিনের জন্যও আমার শরীর খারাপ হয়নি।”

 ”ওজন বেড়ে যাওয়াটাও একটা রোগ।”

 ”সত্যিই আমি কি মোটা হচ্ছি? ঠাট্টা কোর না, ঠিক ঠিক বলো। কই আর কেউ তো বলে না?”

 ”কেউ তো আমার মতো এত মন দিয়ে দেখে না।”

 ”খুব হয়েছে।”

 সন্দীপ ওর পিঠে হাত রেখে বুলোতে বুলোতে বগলের নীচে পৌঁছল। রত্নার বসার ভঙ্গি বদলে গিয়ে শিথিল হল।

 ”তোমার বউকে আজও দেখা হল না।”

 ”যখন আসে খুব বেশি বেরোয় না বাড়ি থেকে।”

 ”গিয়েও তো দেখা করতে পারি।”

 সন্দীপের দিকে ঘষড়ে সরে আসতে গিয়ে রত্না ”উঃ” বলে উঠল।

 ”ইঁট একটা।”

 রত্না কাত হয়ে নিতম্বের নীচে জমিতে হাত বুলোচ্ছে।

 ”কই ইঁট, দেখি?”

 ”বড্ড খচরামি করো, ওখানে কোথায় ইঁট?”

 ”কী পরিচয় দিয়ে দেখা করবে?”

 ”বলব একসঙ্গে একই অফিসে কাজ করি, কলিগ।”

 ”ধরে ফেলবে। তাছাড়া এমন কলিগের সঙ্গে হপ্তায় ছদিন কাটাই, এটা খুব ভালোমনে নেবে না।”

 সন্দীপ ভালোভাবেই জানে অলকা কোনো প্রশ্ন করবে না। ‘ও’, ‘আচ্ছা’, ‘বেশ’, ‘বসুন’ এইরকম কিছু বলে চশমাটা মুছতে মুছতে চেয়ারে বসে খাতা বা অন্য কিছু দেখতে শুরু করবে। তারপর এক সময় চা করতে উঠে যাবে। কোনোদিন রত্নার নাম শোনা যাবে না ওর মুখ থেকে। কৌতূহলী কোনো উল্লেখও নয়।

 এটা অদ্ভুত লাগে, তার সঙ্গে অলকার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হল না। দুজনের মধ্যে ঝগড়াও হয় না। যতক্ষণ দুজনে একসঙ্গে থাকে অপ্রয়োজনে কেউ একটা কথাও বলে না।

 ”তাহলে বলব দূরসম্পর্কের বোন।”

 ”আমার সব আত্মীয়স্বজনের পরিচয় ও জানে। হঠাৎ এখন একটা দূরসম্পর্কের বোন হাজির হলে…বাড়িতে ভাই, মা কাকা তারাও তো শুনবে, দেখবে…দরকার কি।”

 ”পাঁচ দিন একা থাকো…উঃ লাগছে, আস্তে আস্তে…এইভাবে মাঠে না বসে তোমার ঘরে…”

 ”অসুবিধে আছে। বাড়ির অন্যরা দেখবে, জিজ্ঞাসাও করবে।”

 ”তুমি বড় ভীতু। সাপও মারবে লাঠিও ভাঙবে না পলিসি দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছ।”

 সন্দীপ কাঠ হয়ে গেল মুহূর্তের জন্য। মাথার মধ্যে বিছুটি ঘষার মতো জ্বালা করে উঠতেই সে প্রায় হ্যাচকা টানে রত্নাকে কোলের উপর ফেলে ঝুঁকে গাল কামড়ে ধরল।

 রত্না সাড়া দিচ্ছে তার হাত দিয়ে, জিভ দিয়ে। শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হচ্ছে। নতুন বালাটা ঘাড়ের ছাল তুলে গলার দিকে যখন এগোচ্ছে তখনই সন্দীপ টের পেল কেউ তাদের খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

 ধীরে মুখ তুলে সে অন্ধকারের পটভূমিতে তিনটি গাঢ় নিথর মূর্তিকে প্রায় পাঁচ হাত দূরে দেখতে পেল।

 ”কী হল?”

 রত্না দমচাপা অধৈর্যের সঙ্গে বলল এবং সেই সঙ্গে সন্দীপের ধাক্কা পেয়ে গড়িয়ে পড়ার সময় সেও দেখতে পেল।

 তিনজন দ্রুত ওদের তিনদিকে গা ঘেঁষে দাঁড়াল। জমিতে টর্চের আলো পড়েই নিভে গেল, চকচকে বিঘৎখানেক লম্বা একটা ভোজালি সন্দীপ দেখতে পেল। রত্না তার বাহু আঁকড়ে ধরেছে।

 এখন কিছু করার নেই। কিছু করাও যায় না।

 ”কী চাই।”

 সন্দীপের স্বর ভাঙা, জিভটা ভিতর দিকে ঢুকে যাচ্ছে। চোখের শিরা দপদপ করছে।

 ”বালাটা খুলে দিন।”

 নম্র, ফিসফিস স্বরে যেন মিনতি করল।

 ”না।”

 ভোজালিটাকে রত্নার পেটের দিকে এগোতে দেখল সন্দীপ। অন্ধকারেও ইস্পাতের ঔজ্জ্বল্য নষ্ট হয়নি। ততক্ষণে পাশের লোকটি পেশাদারি দক্ষতায় তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে ব্যাগ তুলে নিল, কয়েক সেকেন্ডে খুলে নিল ঘড়িটা।

 চেঁচামেচি বা গাজোয়ারি করে লাভ নেই…খুলে নে।”

 একজন এগিয়ে রত্নার হাতটা চেপে ধরল। কিন্তু সে জানত না ওর গায়ে কত জোর।

 ”না না প্লীজ, পায়ে পড়ি আপনাদের, বালাটা নেবেন না…অনেক…কষ্টের…”

 লোকটা হাত মোচড়াতে গিয়ে পারছে না বরং রত্নাই তার হাতটা ধরেছে এবং সে ছাড়াবার চেষ্টা করছে। প্রায় আধমিনিট তারা সবাই দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তিটা লক্ষ্য করল। এরপর একজন এগিয়ে এসে রত্নার মুখটি হাত দিয়ে তুলে প্রচণ্ড চড় কষাল। ওর চাপা গোঙানিতে সন্দীপ বিচলিত হতেই তীক্ষ্ন খোঁচা লাগল তলপেটে।

 তবুও রত্না ছাড়ল না হাতটা।

 ”এটা নেবেন না, আমার সর্বস্ব যাবে…না না, দোব না আমি…”

 সন্দীপের আড়ষ্টতা অনেক কেটে গেল এই প্রতিরোধ দেখে। রক্ত ছুটে গেল মাথায়।

 ”একি করছেন, ওকে ছেড়ে দিন।”

 অসাড় করে দিয়ে জোরালো একটা ঘুঁষি ওর মুখে পড়ল। সেই সঙ্গে রত্নার বুকের উপরও দু-তিনটি। বুক দু হাতে চেপে অদ্ভুত একটা শব্দ করে ও উবু হয়ে বসে পড়ল। একজন দ্রুত পিছন থেকে ওর ঘাড়ে উঠে দুই ঊরুর মধ্যে মুখটা চেপে ধরে বসে পড়তেই মুখ থুবড়ে রত্না পড়ে গেল গড় করার ভঙ্গিতে। লোকটা চুল ধরে রত্নার মুখ মাটিতে ঘষড়াচ্ছে আর ও ঠেলে ওঠার চেষ্টায় পাছা দুটো তুলে বুনো ঘোড়ার মতো দেহকাণ্ডটিকে দাপাচ্ছে।

 ”গলা টিপে ধর।”

 তৃতীয় লোকটি সন্দীপের পিছন দিয়ে ঘুরে গিয়ে লাথি মারতে শুরু করল রত্নার পাছায়। দড়ি খোলা তাঁবুর মতো ধীরে ধীরে দেহ জমির উপর নেমে এল। কান্না, রাগ আর যন্ত্রণা মেশানো একটা শ্রান্ত গোঙানি দমকে দমকে বেরিয়ে আসছে ওর মুখ থেকে।

 ফলাটা আর একটু চেপে বসল সন্দীপের পেটে। মদের গন্ধ তার নাকে লাগছে।

 ”মেয়েছেলেরা সব দিতে চায় শুধু গয়না বাদে।”

 কানের কাছে ফিসফিস করে বলল ভোজালি ধরা লোকটা। স্বরে ক্ষীণ তারিফ। সন্দীপ জানে, কিছুই করা যাবে না। একটু নড়াচড়া করলেই অবলীলায় ইঞ্চি দশকে লোহা তার পেটে ঢুকে ডান থেকে বামে ঘুরে যাবে। এরা বেপরোয়া নয়, মরীয়া। কোনো ঝুঁকি নেবে না, শিকার ফেলে খালি হাতেও ফিরবে না।

 রত্না বোকামি করছে। বালাটা দিতেই হবে। এই অত্যাচারটা এড়াতে পারত খুলে দিয়ে দিলে।

 বহু দূরে রাস্তায় মোড় ঘোরা মোটরের হেডলাইটের আলো মাঠের উপর দিয়ে ঝলসে যাচ্ছে। বসে থাকা বহু নরনারী পোকার মতো নড়ে উঠেই অদৃশ্য হল। ওইদিকে একটা কাঠের বাক্সের মতো ঘরে রাইফেল হাতে পুলিশ আছে।

 ”দেরি হচ্ছে, হাতটা কেটে নে বরং।”

 ওরা বেশি কথার মানুষ নয়। চার-পাঁচ মিনিট সময় দিয়েছে, হয়তো এটাই ওদের রেকর্ড। কিছু একটা এবার তার করা উচিত। কিন্তু কী করতে পারে। যুদ্ধ করবে? চেঁচাবে? ছুটে পালাবে? সবকটাই নিরর্থক। তাই করে নিজের অপদার্থতা, ব্যর্থতা, অপ্রয়োজনীয়তা ঘুচবে না। একটা সরু কানাগলিতে যেন ঢুকে পড়েছে, বেরোবার রাস্তা পাচ্ছে না। এই মুহূর্তে কী ভাবনা হচ্ছে তা নিজেই জানে না। শুধু মনে হচ্ছে স্বাভাবিকত্বের সীমা সে পার হয়ে যাচ্ছে। চারপাশ অদ্ভুত অচেনা লাগলেও, একটা জগৎ যেন এখনও রয়েছে। দূর থেকে মোটরের হর্ন শোনা যাচ্ছে, রাস্তার আলো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তার ভিতরের জগৎ নিঃশব্দ, নির্জনতায় ভরাট।

 ওরা চলে গেছে। উপুর হয়ে রত্না শুয়ে, ওর ফোঁপানির শব্দ সে পাচ্ছে। হাতটা কি কেটে নিয়ে গেছে?

 সে সন্তর্পণে ঝুঁকে রত্নার কাঁধে তারপর বাহু দিয়ে হাতটা বুলিয়ে কবজি পর্যন্ত আনল। চটপটে রক্ত নেই, আঙুলগুলো যথাস্থানে।

 ”ওঠো।”

 কাঁধ ধরে তোলার চেষ্টা করল।

 ”কত কষ্টে জমানো টাকায় বালাটা করালুম…আর কিছু রইল না আমার…সব গেল সব গেল।”

 রত্না উঠে বসল। হাতড়াতে লাগল ব্যাগ খুঁজে। কাছেই পড়েছিল সেটা।

 ”আর এখানে নয়, চলো।”

 ওরা পরস্পর কথা না বলে অন্ধকার মাঠ থেকে দ্রুত উঁচুনীচু জমিতে ঠোক্কর খেতে খেতে রাস্তায় এল। রত্নার ঠোঁটে রক্ত, গালে ঘাড়ে ধুলো, চুলে বিন্যাস নেই। সন্দীপ রুমাল দিল।

 ”ভালো করে মুছে নাও।”

 রত্না হাত বাড়াতে গিয়ে কাতরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।

 ”শালারা হাতটা মুচড়ে বোধ হয় ভেঙে দিয়েছে।”

 সন্দীপ ওর বাঁহাতের কবজিতে কালো দাগ আর রক্তের ছড় দেখতে পেল।

 ”কোথায় ভেঙেছে?”

 ”কনুই, মনে হচ্ছে ভেঙেছে…না হলে খুলে নিতে পারত না। খানকির বাচ্চচাদের একবার পাই…”

 পাশ দিয়ে দুটি তরুণ তরুণী যাচ্ছিল। তারা মুখ ফিরিয়ে তাকাল। রত্না ওদের দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে আবার বলল, ”তুমি এমন ম্যাদামারা পুরুষ….হাঁ করে মজা দেখছিলে?”

 হঠাৎ গলা চড়িয়ে রত্না তাকে অপ্রতিভ করে দিল। সে আশা করছিল কিছু কথা তাকে শুনতে হবে কর্কশ অমার্জিত ভাষায় কিন্তু রাস্তার উপর নয়। তবু ভালো, পথচারী কম। চওড়া রেড রোডের দুধারে সারিবদ্ধ আলো, দ্রুতগামী গাড়ি, গাছের চওড়া কাণ্ড যে নিরাপত্তার স্বাভাবিক অনুভব ফিরিয়ে এনেছে সেটা রক্ষা করার জন্যই সে বলল, ”ছোরাটা আমার পেটে সিকি ইঞ্চি ঢোকানো ছিল।”

 এই শুনে ওর হৃদয় মায়া বা করুণায় ভরে উঠবে এমন প্রত্যাশা তার নেই, একটা কৈফিয়ত দরকার তার নিষ্ক্রিয়তার জন্য।

 রাগে ফুঁসছে রত্না। বাচ্চচাদের মতো ভেঙিয়ে বলল : ”সিকি ইঞ্চি ঢোকানো ছিল! ছিল তো কী হয়েছে, ঝটকা দিয়ে হাতটা চেপে ধরতে পারতে?”

 ”আরও দুজন ছিল।”

 হনহনিয়ে রত্না হাঁটতে শুরু করল উত্তরদিকে।

 ”আস্তে হাঁট, রাস্তাটা ভালো নয়।”

 রত্না থমকে দাঁড়িয়ে তিক্ত স্বরে বলল, ”আর নেবার আছে কি?”

 হঠাৎই যেন ওর মনে পড়ল হাতের ব্যাগটাকে। খুলে ভিতরের আঙুল দিয়ে নাড়ানাড়ি করেই বিস্মিত ধ্বনি মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল।

 ”নোটটা পায়নি।”

 একটা পাঁচ টাকার নোট ওর হাতে। সন্দীপ পকেট চাপড়ে হাসার চেষ্টা করল।

 ”তবু রক্ষে ফেরার সমস্যা মিটল।…পুলিশে গিয়ে কোনো লাভ নেই।”

 ”ভেতরে লুকোনো একটা খোপে সবসময় পাঁচ টাকা রেখেছি, কখন কী দরকার হয়…আজ হল।”

 ওরা হাঁটছে পাশাপাশি। দুজনেরই বহুবার হাঁটা এই পথ অথচ সন্দীপের সম্পূর্ণ অপরিচিত মনে হচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টগুলোর দিকে এগোবার সময় যখন নিজেদের ছায়া দেখতে পাচ্ছে না তখন তার মনে হচ্ছিল অবাস্তব ইন্দ্রিয়হীন শূন্যতার দিকে সে চলেছে। ল্যাম্পপোস্ট পেরিয়ে যাবার পর মুখ ফিরিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল ছায়া অনুসরণ করছে কিনা।

 এটা কি এক ধরনের নপুংসকতা? তার গভীরে কেউ তাকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছিল-‘বোকামি কোরো না, একটা আঙুল পর্যন্ত নাড়িও না, বেঁচে থাকাটাই প্রথম কথা’। বহু বছর ধরে লালিত অযোগ্যতা, হতাশা, নিশ্চেষ্টতা, অনিশ্চিতবোধই তাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, নয়তো ‘ঝটকা দিয়ে’ সে কিছু একটা করে ফেলত। এক্ষেত্রে কেউ কি প্রাণ অবহেলা করে বাহাদুরি নিতে যাবে?

 কার কাছে বাহাদুরি? অন্ধকারে কে দেখত? রত্না? জানোয়ারের মতো ওর অনুভূতি। কয়েকশো টাকার বালার জন্য এত লাঞ্ছনা নেওয়ার মানে হয় না, অযৌক্তিক। অনেকগুলো লাথি, ঘুঁষি, হাতে মোচড় নিয়েছে নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কি!

 রত্না পিছিয়ে পড়ছে। ডান মুঠোয় ধরে আছে বাঁহাতের কনুই। ওর বৃহৎ মুখে যন্ত্রণা, অসহায়তা আর সারল্য দেখে সন্দীপ মনে মনে কুঁকড়ে গেল। তার কি কোনো অপরাধ ঘটেছে? কী করতে পারত সে?

 ”ভেঙেছে মনে হচ্ছে কি?”

 ”জানি না, তাহলে তো মট করে আওয়াজ হত!”

 ”ডাক্তার দেখাতে হবে…আছে কেউ পাড়ায়? মনে হচ্ছে ফুলেছে।”

 ”আছে।…ছোটোবেলায় ডান হাতটা বাস থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে ছিল আর এখন গেল…কী বলব বাড়িতে?”

 রত্না মুখের দিকে তাকাল। সন্দীপ ভেবে পেল না কী বলবে। মুখ নামিয়ে নিয়ে সে হাঁটছে।

 ”কদিন বোধহয় অফিসেও যেতে পারব না। গায়ে ব্যথা হবে, লাথি…তোমার তো কিছুই হয়নি।”

 ক্ষীণ একটা অভিযোগ যেন ওর গলায় ফুটল। কিছু না হওয়াটা কি কাপুরুষতার পরিচায়ক?

 ”তোমারও হত না প্রথমেই যদি দিয়ে দিতে। অযথা বাধা দিতে গেলে। ওই রকম জায়গায়, অস্ত্র হাতে তিনটে লোকের সঙ্গে কি কিছু করা যায়?”

 রত্না মিইয়ে পড়েছে। তর্ক করল না, কর্কশ রুক্ষ ভাষায় তাকে বিদ্ধ করল না। রাস্তা পার হবার সময় বরং সাবধানে দুধারে তাকিয়ে সন্দীপের বাহু টেনে থামাল। একটা মিনি বাস!

 যা ছিল তাই দিয়ে বালাটা করিয়েছিলুম। গয়নাগুলোতো ফেরত পাইনি। শুনছি বাবা বিষয় সম্পত্তি ব্যবসা ভাগ করে দিচ্ছে ভাইয়েদের, হয়তো কিছু দিয়ে যাবেন….”

 ”তোমার বিয়ে করা উচিত ছিল।” ওরা জনবহুল রাস্তায় এসে পড়েছে। রত্না মাথা ঝুঁকিয়ে, পথচারীদের কাটিয়ে সন্তর্পণে হাঁটছে। অস্ফুটে একবার কী বলল, সন্দীপ মুখ নামিয়ে শুনল: ”এ সবই প্রায়শ্চিত্ত।”

 মিনি বাসে পাশাপাশি বসার জায়গা পেল। ভাড়া দেবার জন্য পকেট থেকে ব্যাগ বার করতে গিয়ে ফ্যাকাশে মুখে সে রত্নার দিকে তাকাল। ওর মুঠোয় পাঁচ টাকার নোটটা ধরা। এই প্রথম রত্না তার ভাড়া দিচ্ছে।

 এবার তার খেয়াল হল, ছাপিয়ে দেবার জন্য পারচেজিং কনট্রোলারের দেওয়া লেখাটা আর ছবিটা ব্যাগে ছিল। অবশ্য অসুবিধার কিছু নেই, ব্যাপারটা তার মনেই আছে। শুধু মেয়েটার নামটা একবার জিজ্ঞাসা করে নিতে হবে আর ছবিটা…ভালো ব্লক হবে না, অন্য আর একটা দিন, এই রকম কিছু একটা বলতে হবে।

 ”আজকেই ডাক্তার দেখাও…আর বোলো মেট্রোরেলের গর্তে পড়তে পড়তে বেঁচে গেছ।”

 রত্না শুনল কিনা বোঝা গেল না। মুখে অভিব্যক্তি নেই। শূন্য দৃষ্টি সামনের লোকটির মাথায় নিবদ্ধ। এখন আর কথা না বলাই ভালো। তার নিজেরও বলতে ইচ্ছে করছে না।

 বাড়ির কাছাকাছি আসতেই সন্দীপের মনে হল, কিছু একটা হয়েছে। অন্য দিনের থেকে রাস্তায় লোক বেশি, ছোটো কয়েকটা জটলা। উচ্চচস্বরে কথা এবং উত্তেজিত ভঙ্গি। রেলিংয়ের ধারে যুবকরা অন্য দিনের মতো তাকে উপেক্ষা করল না। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল এবং গলা নামিয়ে ফেলল। তার মনে হল, তাদের বাড়ি নিয়ে কিছু ঘটেছে।

 মুরারির দোকানের ভিতরে ভিড়। সে রাস্তায় দাঁড়িয়েই চা দিতে বলল মুরারিকে। আবার সেও কৌতূহলী হয়ে পড়েছে।

 ”একটু বেশি ভিড় যেন!”

 ”আর বলবেন না, একটু আগেই ঝামেলা হয়ে গেল।”

 মুরারির বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্নমনে হচ্ছে না। ঝামেলা যেন তাকে লাভবানই করেছে খদ্দের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে। বোমা, পাইপগান বা ছোরায় এখানে বিস্ময় সঞ্চার করা যায় না। তাহলে বোধহয় অন্য কিছু। সুহাসকে নিয়ে কি?

 ”কী হয়েছে? এ পাড়া-ওপাড়া বোমাবাজি?”

 মুরারি অন্য খদ্দেরদের আগে তাকেই চা দিল। খাতিরটা ভোলেনি।

 ”কি দিনকালই হচ্ছে, মাঠের ব্যাপার ঘর পর্যন্ত টেনে এনে কী লাভ বলুন? খেলায় হার-জিত-ড্র-তো হবেই। তাই বলে দল বেঁধে বাড়িতে এসে ইঁট ছোঁড়া, মা বোন মাসি তুলে খিস্তি করা…”

 ”মানুকে নিয়ে?”

 মুরারি শুধু মাথা নাড়ল।

 ”হ্যাঁ, ড্র হয়েছে। মানুদা আজ পেনাল্টি মিস করেছে, ভাবা যায় না!…শেষে কিনা…ভাবা যায় না, ভাইটাল একটা পয়েন্ট আমাদের গেল।”

. সন্দীপের পাশে দাঁড়িয়েছিল কিশোরটি। কথা বলার জন্য উদগ্রীব দেখাচ্ছে। মুরারি নিজের কাজে ব্যস্ত। একটা পুলিশ ভ্যান মন্থর গতিতে টহল দিয়ে গেল।

 ”ছেলেগুলো কেউ ওপারের নয়। একটাকে আমি চিনি নকশাল করত, যদু ভটচাজ লেনের দিকে থাকে। এক পয়েন্ট এখন লস করা মানে…ওরা বলছে মানুদা ঘুষ খেয়েছে। এটা একদম বাজে কথা। কিন্তু কে ওদের বোঝাবে? এক পয়েন্ট যাওয়া মানে লীগ থেকে বেরিয়ে যাওয়া।”

 কিশোরটিকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। মানুর অজস্র ভক্তের একজন কিন্তু এখন ওর জীবন-মরণ সমস্যা। একটা পয়েন্ট। কে যেন এদের নামকরণ করেছে ‘প্যাঙা।’

 ”আপনাদের নিচে যে থাকে, টাকমাথা বেঁটে, মোটাসোটা লোকটা…”

 মুরারি মুখ না ফিরিয়ে ডেকচি থেকে মাংসের টুকরো বাছতে বাছতে বলল, ”ওনার কাকা, মানুদারও।”

 ”জানি,” একটুও অপ্রতিভ না হয়ে ও বিরক্ত উদ্ধত ভঙ্গিতে মুরারিকে অগ্রাহ্য করল। ”একটা রড নিয়ে বেরিয়ে এসে ওদের তেড়ে গেল।…ওরা ডেঞ্জারাস ছেলে, রড-ফডে কি ওরা ভয় পায়! ওনার রডেই ওনার মাথা ফাটিয়ে দিল।”

 ”কাকার!’….এখন কোথায়?”

 চায়ের আধ ভর্তি কাপ সে নামিয়ে রাখল বালতির পাশে।

 ”হসপিটালে যেতে রাজি হলেন না। ডাক্তারখানায় আমিই নিয়ে গেলুম।” মুরারি তলানি চা রাস্তায় ফেলে বালতির জলে কাপ ডুবিয়ে দিল। ”ভালোই ফেটেছে, আটটা টিচ করতে হল। মাথায় সোজা পড়লে আর বাঁচতে হত না।…কি কাণ্ড বলুন তো, সোজা বসিয়ে দিল! শাসন-বারণ নেই, ভদ্রতা সভ্যতা বোধ নেই, শুধু মারো আর মারো…বাড়িতে ইঁট ছুঁড়বে, গালাগাল দেবে আর কেউ বারণ করলেই তাকে পিটোবে? য়্যা, শালাদের ধরে ধরে গুলি করা দরকার…”

 মুরারির স্বর ও ভঙ্গি যান্ত্রিক, কথাগুলোও বহুযুগ আগের কোনো প্রচলিত ধারণা ও অভ্যাসের জের টেনে যেন মুখস্থ বলল।

 সদর দরজা বন্ধ। কাকার জানলার পাল্লার জোড়ের ফাঁক দিয়ে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। মানুদের বারান্দা অন্ধকার, জানলাগুলো বন্ধ। পানুর ঘরের আলো বারান্দায়।

 কড়া নাড়ার শব্দে মানুর বাচ্চচা চাকর বারান্দা থেকে সন্তর্পণে উঁকি দিল।

 দরজা খুলে দিয়ে প্রায় ছুটেই ছেলেটা দোতলায় উঠে গেল। সিঁড়ির আলোটা জ্বলছে। কাকার ঘরের দরজা বন্ধ। সে টোকা দিল।

 ”কে?”

 ”আমি…সানু।”

 দরজা খুলতে সময় লাগল, বোধহয় শুয়েছিলেন। মাথার ব্যান্ডেজটা সাদা হেলমেটের মতো দেখাছে। চোখে ক্লান্তি। কুঁজো হয়ে দুর্বল ভঙ্গিতে উনি বিছানায় ফিরে গেলেন।

 বালিশটায় ধীরে ধীরে মাথা রাখার সময় মুখ দিয়ে কাতর শব্দ বেরল। কয়েকঘণ্টা আগে রত্নার গলা থেকে এমন শব্দই বেরিয়েছিল।

 ”যন্ত্রণা হচ্ছে?”

 উনি উত্তর না দিয়ে বাঁ হাতটা আড়াআড়ি ভ্রূর উপর রেখে চোখ ঢেকে সামান্য হাঁ করে রইলেন। কিছু দেখতে চান না এবং সম্ভবত বছর তিরিশ কিছু দেখেনওনি। তাহলে রড নিয়ে বেরোতেন না।

 ”কিছু ওষুধ দিয়েছে কি, ট্যাবলেট? ব্যথা কিন্তু হবে…আনব?”

 ”থাক আমার কিচ্ছু হয়নি।”

 প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন। হাতটা নামান নি। বোধহয় খালিগায়েই রড হাতে বেরিয়েছিলেন, কানের গোড়ায়, বাহু আর বুকের লোমে রক্তের ছিটে লেগে।

 ছত্রিশ বছর আগে যবন-নিধন করার সময়ও নিশ্চয় লেগেছিল। সন্দীপের সহানুভূতি সামান্য কঠিন হয়ে উঠল।

 ”খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা..পানুকে বরং বলি।”

 হাতটা তুললেন আপত্তি জানিয়ে। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। স্থিরদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সুস্পষ্ট ব্যঙ্গ ঠোঁটের কোণে মোচড় দিয়ে রয়েছে।

 বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন আছে? আমি জানতুম, দেশটা এই রকমই হবে, এই পথেই যাবে। এরপর দেখব অকারণে শুধুই সময় কাটাবার জন্য একজন আর একজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে…বাপ ছেলের উপর, স্ত্রী স্বামীর উপর…নখ দিয়ে ছিঁড়বে, বঁটি দিয়ে কাঁটবে…কিসসু নেই এদেশে, না চরিত্র না বিবেক, কিসসু নেই।”

 ক্লান্তি অথবা ঘৃণা, কোনো একটা কারণ ওকে নীরব করল। মানুষটি কখনো অন্যের দয়া গ্রহণ করেননি, ভাবালুতাকে প্রশ্রয় দেননি। বছরের পর বছর কঠিনভাবে জীবনযাপন করে হয়তো এখন বুঝতে পারছেন শুধু লোহার টুকরো হাতে নিয়ে তেড়ে বেরিয়ে দেশটাকে মনোমতো করা যায় না।

 কাকাকে এখন বলা যাবে না: যারা আপনাকে মারল তাদের বয়সে আপনিও ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ মানুষদের খুন করেছিলেন ধর্মের দোহাই দিয়ে। বীর গণ্য হয়েছিলেন। ত্রাতারূপে খাতির পেয়েছিলেন অল্প কয়েক দিনের জন্য এবং অচিরেই জানতে পেরেছিলেন আপনি সময়ের স্রোতের ধাক্কায় ভেসে চলে গেছেন। আজ এসব কথা বলে লাভ কী!

 ওর স্মৃতি কি এখনও কর্মঠ আছে?

 ”আমার সম্পর্কে কাউকে কিছু ভাবতে হবে না।”

 ”আপনার এখন নিজের হাতে রান্না করাটা বোধ হয় উচিত নয়। বাণীকে বলে…”

 ”আমার সম্পর্কে ভেবে অযথা সময় নষ্ট করবে না। আমি জানি তুমি কী ভাবছ।”

 ”কী ভাবছি আমি!”

 ”আমার খাওয়ার সমস্যা নিশ্চয় নয়।…না আমি অনুতপ্ত নই। ব্যস, এইটুকু শুধু জেনে রেখো। কটা ছেলে মিলে ঘিরে ধরে মাথা ফাটালেই যে ডিগবাজি খেয়ে বলব ‘পাপের প্রায়শ্চিত্ত হল’, তা আমি করব না। পাপ আমি করিনি। আমি বিশ্বাসী।”

 এই রকম কিছু একটা বিশ্বাস যদি বত্নার বা তার থাকত! প্রায়শ্চিত্তের চিন্তা থেকে রেহাই পাওয়ার মতো সুখ আর কীসে? অলকা কি তাকে কোনোদিন কাঠগড়ায় তুলে বলবে: ‘এই লোকটা ব্যভিচারী’ এবং রত্না: ‘এই লোকটা ন্যাদামারা’ এবং প্রণবেশ: ‘এই লোকটা নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট!’

 উঠে বসলেন এবং মাথায় যন্ত্রণা আছে এমন কোনো আভাস তার মুখে ফুটল না। এক দৃষ্টে সামনে শ্রীকৃষ্ণের ছবির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলেন, ‘আজও আমি পারি।”

 ”কী পারেন?”

 ”রক্ষার জন্য এগিয়ে যেতে। মানু বাড়ি নেই, তাহলেও ওরা মারতে এসেছিল তাই লোহাটা হাতে নিয়েছিলাম। একদিন মানু আমায় গালাগাল অপমান করে ও-ঘরের তালা ভাঙতে গেছল, সেদিন ওকে মারতেও লোহাটা হাতে নিয়েছিলাম। আমার এই অদ্ভুত ব্যাপারটার অর্থ বার করতে পার?…ঘোড়ারগাড়িতে চেপে একটা পরিবার পালচ্ছিল, আমি আর চারজন মিলে ধরলুম, পাঁচ মিনিটে কাজ শেষ করে চলে গেলুম। তারপর দেখি খালি গাড়ি নিয়ে ঘোড়াটা টেনে বেড়াচ্ছে। মায়া হল, লাগাম খুলে ছেড়ে দিলুম। রংটা বাদামির ওপর সাদা ছোপ, সুন্দর কেশর। ঘুরে বেড়াত রাস্তায়, রাত্রে এই ঘর থেকে শুনতে পেতুম নালের শব্দ…খপ খপ খপ। এমন অভ্যস্ত হয়ে গেলুম শব্দটার সঙ্গে যে প্রতীক্ষা করতুম কখন ও যাবে এখান দিয়ে। তারপর ঘোড়াটা একদিন মরে গেল। কেউ আর খেতে দিত না, কঙ্কালসার হয়ে গেছল। কিন্তু ওর শব্দটা রোজ রাতে আমার মাথার মধ্য দিয়ে হেঁটে যেত। কেন?”

 ”এবার ঘুমোন, এটাই এখন দরকার। ঘুমের জন্য ডাক্তার কি কিছু দিয়েছে?”

 ”ঘোড়ার হাঁটার সেই শব্দটা মাঝে মাঝে মাথায় আসে। কী করা যায়?”

 অসহায় শিশুর মতো তাকিয়ে। মায়া হচ্ছে তার কিন্তু সে নিজেও ক্লান্ত বোধ করছে। হাসি একটা কাজ দিয়েছে। পানুকে বোঝাতে হবে সুহাস নির্দোষ, নিঃশেষিত, ক্ষমার যোগ্য! একটা বাজে কাজ কিন্তু দুবার সে হাসির হাতটা আজ চেপে ধরেছিল আন্তরিক আবেগে।

 রত্নার ঘাড়ের উপর একটা লোক চেপে বসে ওর মুখটা মাটিতে ঘষড়াচ্ছে আর একজন পাছায় লাথি মারছে। বাধা দিতে সে এক ইঞ্চিও নড়েনি। তখন বোধহয়, এখন মনে হচ্ছে, লাথির শব্দে ‘খপ খপ খপ’-এর মতই কানে লেগেছিল। বহু বছর পর সে কি পানুর ছেলেকে বলবে, ‘কী করা যায়?’

 সে উঠে দাঁড়াল।

 ”ওরা বলছিল মানু ঘুষ খেয়েছে। এটা কি সত্যি? সম্ভব কি এই বাড়ির ছেলের পক্ষে?

 ”না, আর যাই হোক ঘুষ খাবে না।”

 মুখের উপর প্রশান্তির ছায়া ভেসে এল। উনি ধীরে ধীরে আবার বালিশে মাথা নামালেন। কোনো কাতর ধ্বনি এবার সে শুনতে পেল না।

 ”আমি যাচ্ছি।”

 ঘরের আলোটা নিভিয়ে, দরজা ভেজিয়ে সিঁড়ির কাছে এসে তার মনে হল, গত পঁচিশ বছরে কাকা একসঙ্গে এত কথা কখনো তাকে বলেননি। বোধহয় দুর্বল হয়ে গেছেন, একা থাকতে চাইছেন না। কিন্তু জেদ আর বোকামি নিয়ে বিশ্বাস ধরে রাখতে চাইছে। মনে কোনো সন্দেহ পোষেন না, দ্বন্দ্ব নেই, সরল সিদ্ধান্তে এসে গেছেন, বেঁচে থাকার দরকার নেই।

 অপরাজিত থেকে বিদায় নিতে চান। এ রকম আনডিফিটেড চ্যাম্পিয়ন তো ফুটবল লিগেই পাওয়া যায়। সেজন্য মানুরা আছে। আজ এ দল, কাল ও দল, যেখানে বেশি টাকা! কাকা বিশ্বাস বদলায়নি। হয়তো খুন, রক্ত, বীভৎসতার প্রাগৈতিহাসিক প্রবৃত্তিটা ওনার মধ্যে একটু বেশি।

 তার নিজের ক্ষেত্রে কি কখনো এমন কিছু ঘটেছে? ‘ন্যাদামারা’ না হয়ে যদি ঝাঁপিয়ে পড়ত তাহলে এখন হয়তো তার এবং সম্ভবত রত্নারও লাশ পড়ে থাকত ফোর্টের র‌্যামপার্টে। কিংবা কয়েকটা লাথি ঘুঁষি চুপচাপ হজম করতে হত। তার নিষ্ক্রিয়তার ফলেই হিংস্রতা, রক্তপাত ঘটল না। সামান্য কিছু গচ্চচা দিতে হল মাত্র।

 সারা দেশ যদি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়? কিছু গচ্চচা দিয়ে তাহলে সুসভ্য হওয়া বা রক্ত বন্ধ করা যাবে কি?

 ‘না চরিত্র, না বিবেক, কিসসু নেই।’ এসব গচ্চচা তো ওনার আমলেও দেওয়া হয়েছে। চরিত্র বা বিবেক বালা কিংবা হাতঘড়ির মতই। গেছে আবার হবে। তাই নিয়ে এত কপচাবার কী আছে?

 সন্দীপ লুঙ্গি পরে প্যান্ট ভাঁজ করে যখন হ্যাঙ্গারে ঝোলাচ্ছে তখন বাণীকে উঁকি দিতে দেখল দরজা থেকে।

 ”কী হল বলুন তো… কাকা কেমন আছেন?”

 ”নিচে গিয়েই তো সেটা জেনে নিতে পার।” তার রুক্ষ স্বরে বাণী কুঁকড়ে গেল। হঠাৎ তার এই রেগে ওঠার জন্য সঙ্গে সঙ্গেই সে অনুতাপ করল। আজ পর্যন্ত বাণী কাকার সঙ্গে কথা বলেনি।

 ”ভালোই আছে, কয়েকদিন নড়াচড়া কম করতে হবে।”

 ”আমি যেতাম, উনিই বারণ করলেন…বললেন, ‘যেমন কর্ম’ তেমনি ফল; এসেছে তো মানুকে অপমান করতে, দুটো চড়-চাপড় দিয়ে চলে যেত। এসব খেলতে গেলে হয়েই থাকে, তা উনি আবার রড নিয়ে কেন বেরোলেন? চুপ করে ঘরে বসে থাকলেই তো পারতেন।”

 ”পানু বাড়ি আছে? অফিস যায়নি?”

 ”কী একটা লেখা আছে তাই বিকেলেই ফিরেছেন।”

 ”তুমি কাল কাকার খাওয়ার ব্যবস্থা কোরো, ওর এখন শুয়ে থাকা দরকার।”

 ”কেন ওর তো শৈলবালা আছে, রেঁধে দেবে।”

 সন্দীপ না শোনার ভান করে দেরাজে হাতড়াতে লাগল ব্যাঙ্কের পাশবইটার জন্য। হাবিজাবি তুচ্ছ কাগজে অলকা বোঝাই করে রেখেছে। যা টাকা রয়েছে তাতে সাতদিন আর চলবে না।

 ”মা বলছিলেন আর এ বাড়িতে থাকবেন না।”

 ”কোথায় যাবে?”

 ”ঠাকুরপো কোথায় যেন ফ্ল্যাট কিনেছে সেখানে চলে যাবেন। ওর বিয়ে দিয়ে বউ নিয়ে যাবেন ভেবেছিলেন কিন্তু আজকের এই সবের পর আর থাকতে চান না। বড়ো বড়ো দুটো ইঁট একেবারে ঘরের মধ্যে…চাকরটা খুব বেঁচে গেছে। মাথার পাশ দিয়ে গিয়ে দেয়ালে লেগেছে।”

 ”পানুকে বোলো আমার ওকে একটু দরকার।”

 ”আজই দেখা করতে বলব?”

 সন্দীপ কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলল, ”কাল।” আজ তার বড় ক্লান্ত লাগছে।

 ভোর থেকে বিদ্যুৎ নেই, গাছের পাতাও নড়ছে না। ঘাম জবজবে শরীর নিয়ে বিরক্ত সন্দীপ বারান্দায় মোড়ায় বসে কাগজ পড়ছিল, তখন পানু এল। পাজামার উপর খদ্দরের পাঞ্জাবি। বুক পকেটে চশমার একটা কোণ দেখা যাচ্ছে। ও যে চশমা পরছে এটা সে জানত না, বোধহয় লেখাপড়ার সময়ই শুধু চোখে লাগায়। ভ্যাপসা গরমে গায়ে জামা রাখার জন্য সে অবাক হল না। পানুর এটা ছোটোবেলার অভ্যাস, গায়ে কিছু একটা না দিয়ে ও রাতে ঘুমোতেও পারে না। ঘর থেকে সে একটা মোড়া আনল।

 ”বোস, একটা ছোট্ট কাজ করে দিতে হবে। তোদের পত্রিকায় একটা ছবি আর সঙ্গে ছোট্ট একটা রিপোর্ট…যাত্রা নাটক ফাংশনের খবর যেখানে বেরোয়…আমাদের পারচেসিং কন্ট্রোলারের রিকোয়েস্ট…”

 ”দিও, তবে এই সংখ্যায় তো আর হবে না।”

 ”না, না দেরি হলে কিছু এসে যায় না। তোকে কাল-পরশু দোব।”

 প্রয়োজনের কথা শেষ। আর কিছু বলার আছে কিনা জানার জন্য পানু তাকিয়ে। সে কীভাবে হাসির প্রসঙ্গ তুলবে ভেবে পাচ্ছে না।

 ”কাকার বেশ ভালোই লেগেছে মনে হল।”

 ”কেন যে এইসবের মধ্যে যায়।”

 পানু বিরক্তি দেখাল। ঝগড়া বা মারপিট এমনকি চেঁচিয়ে তর্ক করলেও সহ্য করতে পারে না।

 ”আমিও তাই বললুম, কিন্তু কে শোনে। সেই আগের মতই রয়েছে। ভয় হয়, হঠাৎ কোনো কাণ্ডফাণ্ড কোনদিন করে বসবে।”

 ”কুকরি আর জানলার ভারী গরাদটা এখনও তো রেখে দিয়েছে। …ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি!”

 ”আজও বিশ্বাস পুষে রেখেছে, উনি এখনও দেশটাকে রক্ষা করতে পারেন…দেশের চরিত্র বিবেক ঠিকঠাক করে দিতে পারেন…অনেকবছর আগে তুই একবার বলেছিলি, কুকরিটা চুরি করে গঙ্গায় ফেলে দিবি…মনে আছে তোর?”

 পানু মাথা হেলাল। মুখে হাসি। বহুবছর আগের কথা মনে পড়লে এভাবে সবাই হাসে।

 ”অদ্ভুত ব্যাপার! ঘুরছে তো ঘুরছেই, কুকরি আর গরাদটা মাঝখানে রেখে…একধরনের অসুখ বোধহয়, মেন্টাল কেস। মানুরও তাই।”

 ”কেন ওর কী হল?”

 ”পেনাল্টি মিস কেন করল? অফিসে শুনছিলাম, ও নাকি একটা বাজে মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে, হয়তো বাধ্য হবে বিয়ে করতে। মেন্টালি খুব ডিস্টার্বড। তার উপর ওর বহু টাকা, প্রায় লাখ দুয়েকের মতো ছিল সঞ্চয়িতায়, তা আর ফেরত পাবার আশা নেই। এইসবের প্রতিক্রিয়া তো খেলায় পড়বেই।”

 কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইল। মানুর জন্য দুঃখে ওরা কেউই গভীরভাবে কাতর নয়। এই ভাইটিকে তারা রক্তের সম্পর্কে গড়া স্বাভাবিক অনুভূতির গণ্ডিতে কখনোই সহজভাবে পায়নি বা সেও আসেনি।

 ”ও কি খুব ভালো খেলে?”

 ”জানি না, আমি কখনো দেখিনি। তবে অনেক তো ভক্ত আছে।”

 ”হ্যাঁ, কাল তো সেই ভক্তরাই…কাল আমার সঙ্গে হাসির দেখা হয়েছে।”

 পানুর স্বচ্ছন্দভাবটা মৃদু থেকে মৃদু হতে হতে নিভে গেল। একটু কৌতূহলে তাকিয়ে রইল যেন হঠাৎ এই কথাটা বলার পিছনে কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা বুঝে নিতে চায়।

 ”তোমার কাছে কি এসেছিল?”

 ”কাল টিফিনে যাচ্ছিলাম ওদের এম্পোরিয়ামের সামনে দিয়ে, ও তখন বেরোচ্ছিল।”

 মনে হচ্ছে পানু বিশ্বাস করল না দেখাটা হঠাৎ হয়েছে, হাসির অভ্যাসগুলো সবার থেকে ওরই ভালো জানা।

 ”তোমাকে ধরেছে কেন?” তীক্ষ্ন স্বরে ও প্রশ্নটা করল। তাহলে ও বুঝে গেছে হাসি কী চায়।

 ”তোর কাছে যাবার সাহস পাচ্ছে না।”

 ”সেইজন্যই আমায় ডেকেছে?”

 ”না না, এটা একটা মাত্র কারণ। ছবিটা আর লেখা আর কাকার ব্যাপারে…”

 নীরবতা এল কিছুক্ষণের জন্য এবং সেটা ভরে রইল রাস্তার যানচলাচলের শব্দে।

 ”কী বলতে বলেছে?”

 ভাইয়ের সঙ্গে নিজের পার্থক্যটা এমন স্পষ্ট ভাবে আগে সে কদাচিৎই অনুভব করেছে। এমনকি ওর গলার স্বর, যা বাল্যে কৈশোরে প্রতিদিনই শুনে এসেছে, তাও এখন মনে হচ্ছে অপরিচিত লোকের। ওকে খুঁটিয়ে সে লক্ষ করল। কোনো চেহারার মিল চোখে পড়ল না। বাইরেতে ও স্থির শান্ত। যদি কোনো অশান্তি থাকে, তাহলে সেটা রয়েছে ওর ভিতরে।

 ”সুহাস তো ফিরে এসে রয়েছে হাসির কাছেই।”

 ”হ্যাঁ।”

 ”শুনলুম শরীর খুব খারাপ, একদম নাকি চেনাই যায় না।”

 পানু পায়ের উপর পা তুলে দিল এবং সে লক্ষ করল ওর পায়ের নখগুলো দীর্ঘ এবং তাতে ময়লা জমে।

 ”বেশ!” শুকনো স্বর। নিরাসক্ত থাকার জন্য ও চেষ্টা করছে।

 ”সুহাসের চিকিৎসার জন্য হাসিকে এখন খুব ব্যস্ত মনে হল।”

 ”বিভু কী বলছে তার বাবা সম্পর্কে?”

 ”জানি না, তবে হাসি নিশ্চয় মানিয়ে নেবে…বাপ-ছেলের মধ্যে সম্পর্কটা যাতে ভালো হয় সেই চেষ্টা তো করবেই।”

 ”ছেলে কি কিছু জানে না, পাড়ায় থাকে যখন কানে কি কিছু যায়নি?”

 ”হাসি সইয়ে দেবে আস্তে আস্তে। সেজন্যই ও চায় তুই সুহাসের সঙ্গে গিয়ে কথা বল, বিভু সেটা দেখুক, তাহলে বাপ সম্পর্কে ধারণাটা বদলাবে।”

 ”কী সই য়ে দেবে? বাপের অতীত কীর্তিকলাপ? আমি কথা বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে?”

 ”দ্যাখ পানু, যেভাবে তুই কথা বলছিস তাতে আমার পক্ষে কিছু বলা মুশকিলের হয়ে পড়ছে। হাসিকে আমি বলেছি, ওর হয়ে তোকে অনুরোধ করব।”

 ”রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলেছে?”

 ”প্রায় তাই-ই। অবস্থাটা সামাল দেবার জন্য ও যথেষ্ট চেষ্টা করছে, তেজি মেয়ে, ভেঙে পড়েনি। তুই ভালোই জানিস যে সবকিছু সত্ত্বেও সুহাসকে ও এখনও ভালোবাসে।”

 ”ও এইকথা তোমায় বলল?”

 ”হ্যাঁ। দু-তিনবার বলল, সারাজীবন ধরে মানুষ মাশুল গুণবে, দাম চোকাবে, মূল্য দেবে তা হতে পারে না, একটা সময় আসে যখন সব শোধ হয়ে যায়। সুহাস তার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।”

 তার মনে হল মোটামুটি হাসির বক্তব্যটা সে বলতে পেরেছে।

 ”সেই জন্যই কি ফিরে এসেছে?”

 গলার স্বর নীচু হলেও চিবিয়ে বলার ধরনটা এমনই আক্রমণাত্মক যে জবাবটা দ্রুত না দিয়ে সে পারল না।

 ”মানুষকে ক্ষমা করতে শেখ পানু। ভুলে যাস কেন মানুষ মাত্রেই দোষে গুণে…ক্ষমা মানুষের ধর্ম…”

 সে নেমে গেল। এসব কী আবোল-তাবোল প্রাগৈতিহাসিক কথা সে বলতে শুরু করেছে! পানু বাচ্চচা ছেলে নয়, লেখক হবার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।

 পানু বিস্মিত চোখে তাকিয়ে যেন হঠাৎ সে তার দাদার মধ্যে অপরিচিত একটা লোককে দেখতে পেয়েছে। কিছু না বলে চোখটা আকাশের দিকে তুলে একটা বড় শ্বাস ফেলে নামাল।

 ”তুমি বুঝতে পারছ কি বিপদ হতে পারে?”

 ”কার বিপদ?”

 ”বিভুর কথাই ধরো। লোকে অনেক কিছু ওর বাপ সম্পর্কে বলাবলি করেছে, সেগুলো শুনেছেও। কিন্তু শোনা এক কথা আর চাক্ষুষ রক্ত-মাংসে বাপকে দেখা, তার অধঃপতন লক্ষ করা, তার পাশাপাশি দিন কাটানো সস্মূর্ণ অন্য ব্যাপার।”

 ”বিভু যথেষ্ট বড়ো হয়েছে।”

 ”হাসির কথাটাই ধরো। ভালো মন্দ যাই হোক মোটামুটি সে গত আট-দশ বছরে নিজের জীবনটাকে গুছিয়ে ফেলতে পেরেছে, আঘাত সামলে নিয়েছে। কিন্তু ছ মাস, এক বছর পর যখন সুহাস সেরে উঠবে তখন কী হবে? নিশ্চয় ভিজে বেড়ালটি হয়ে থাকবে না। আবার সেই আগের মতো ফিটফাট বাবুটি হয়ে, নিজেকে চারদিকে দেখিয়ে, বড়ো বড়ো কথা বলে বেড়াতে শুরু করবে।”

 ”তাহলে আর কী করা যাবে?…এক্ষেত্রে ঝঞ্ঝাট চোকাতে ওকে মরতে দেওয়াই ভালো।”

 ”চুপ করো।”

 এবার তার পালা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ভাইয়ের মধ্যে অপরিচিত লোক খোঁজা।

 ”সুহাস তোকে সরাতেই চেয়েছিল। তোর পেটে নাকি মাঝে মাঝে এখনও ব্যথা হয়। তুই যদি তখন বেরিয়ে না আসতিস…”

 ”আমাকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে, আমি বেরিয়ে আসিনি।”

 তীব্র ঝাঁঝালো স্বরে ও যেন ধমকে উঠল, কিন্তু দাপটের অভাব রয়েছে। সন্দীপের মনে হল পানুর গলা যেন অতি অতি সামান্য কেঁপে উঠেছিল। ও জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরই পিণ্টু আর দুলাল ধরা পড়ে। সবার ধারণা কাজটা সুহাসের, কিন্তু পাড়ায় ও ঘৃণার পাত্র ছিল।

 কিন্তু ধরিয়ে দেওয়ার কাজটা সত্যিই কি সুহাসের? পানুরও কি তাগিদ ছিল না হাসির কাছাকাছি থাকার, বারবার ওকে দেখার, ওর দৃষ্টির সামনে থেকে সুহাসকে আড়ালে রাখার…হাসিকে জিতে নেওয়ার? সেজন্য জেল থেকে বেরিয়ে আসার দরকার ছিল, বিনিময়ে পুলিশকে কিছু দিয়ে।

 ছেলে দুটোর সঙ্গে পানুর ভালোই আলাপ ছিল…ক্লাব ঘর থেকেই ওরা ভোর রাতে ধরা পড়ে…কে জানত ওরা দুজন ওখানে থাকবে…চাবি থাকত পানুর কাছে। পাড়ায় সৎ উপকারী ভালো ছেলে হিসাবে পানুর নাম আছে, সুহাসের নেই।

 তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হল পানুর মুখ থেকে রক্ত সরে যাচ্ছে, চামড়া শুকিয়ে মড়মড়ে হয়ে ঝরে পড়ছে, কঙ্কালের ছায়া নেমেছে।

 নিজেকে তার দোষী মনে হতে শুরু করল। ‘যদি বেরিয়ে না আসতিস’ কথাটা বলা উচিত হয়নি। আসলে হাসির জন্য এই কথাবার্তা বলার কাজটা নেওয়াই ভুল হয়েছে। পানু তার বাইরের নির্বিকার ভাবটা বজায় রেখে যাচ্ছে। পায়ের উপর অন্য পা অলস ভাবে পড়ে রয়েছে। মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। কিন্তু তার মনে পড়ে না, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে একটা লোকের এই রকম অমানবিক চেষ্টা এত কাছ থেকে কখনো দেখেছে।

 তার সন্দেহ হচ্ছে, হিংস্র হয়ে ওঠার মতো একটা আবেগ যেন এখন পানুর মধ্যে ওথলাচ্ছে। এটা তার প্রত্যাশায় কখনোই ছিল না। আর আবেগটা যেন তাকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে বিশেষ করে সেটাকে দাবিয়ে রাখায় পানুর সাফল্যের জন্য।

 ”তুই তো হাসিকে তারপরও বিয়ে করতে কিংবা দুজনে অন্য কোথাও গিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকতে পারতিস। তা না করে…অবশ্য আমিই বলেছিলুম বিয়ে করতে, কিন্তু তুই রাজি হলি কেন?”

 পানুর যথেষ্ট বয়স, বুদ্ধিও পরিণত। ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো কথা বলা যায়, এক সময় তারা বলতও।

 ”ও সুহাসকেই চায়…এটা আমি তখন জানতুম না।”

 জানলে কী করত? জেলেই থাকত? কিন্তু জেলের থেকে কি এখন ওর দাম্পত্য জীবন বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের হয়েছে? বেচারা বাণী।

 ”ও কি সত্যি সত্যি তোমায় বলেছে সুহাসকে যেন ক্ষমা করি?”

 সন্দীপ মাথা হেলাল। চোয়ালের অবাধ্যতায় কথা বলতে যেন অসুবিধা হচ্ছে এমনভাবে পানু বলল, ”বিভুর সামনে, পাড়ার লোকেদের সামনে সুহাসের সঙ্গে হেসে, হাত ধরে কথা বলতে হবে?”

 ওর চোখের দিকে তাকাবার সাহস তার হল না। হাসি এই রকমই চায়, বোধহয় সুহাসই এটা ওর মাথায় ঢুকিয়েছে। ধূর্ত ফন্দিবাজ, অসুস্থ একটা জানোয়ার গুড়ি দিয়ে বাধ্য হয়েছে গর্তে ফিরে আসতে, বউয়ের কাছে ভান করছে অনুতাপ অনুশোচনা। বউকে আশ্রয় দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে আর নিজের ছেলের সঙ্গে জানা-পরিচয় হবার আগেই ফন্দি আঁটছে কী করে বাইরে চারদিকে নিজেকে নির্দোষ দেখানো যায়।

. হাসি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, নিশ্চয়ই বুঝেছে স্বামী তাকে দিয়ে কী করাতে চায়, তবু সে ক্ষমা করে দিতে বলছে। কিন্তু ওকি ওটা বোঝে না, সুহাস বদলাবার লোক নয়, তাকে আবার কেঁচে গণ্ডুষ করতে হবে? ওর কোনো ধারণা আছে কি, ছেলে আর এই রকমের স্বামী নিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনটা কী দাঁড়াবে?

 ”কবে যেতে হবে, সে সব কিছু বলেছে?”

 ”না, যে-কোনো দিন গেলেই হবে।”

 ”ব্যাপারটা আর কাউকে বলেছ?”

 ”না।”

 অস্বস্তিকর সময়টা পেরিয়ে গেছে। আপনা থেকেই তার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। এখন পানু আর তার বিবেকের উপরই ব্যাপারটা ছাড়া রয়েছে।

 কিছুক্ষণ তারা নীরবে রইল। তার মনে হচ্ছে এখন পানু যেন ধীরে ধীরে উদ্বেগের চাপ থেকে বেরিয়ে আসছে তার সামনে। পা মৃদু নাড়ছে। মুখটা আকার হারিয়ে টসটসে, সারা অবয়বে কোমলতা, অজ্ঞেয়তা।

 ”বেশ দেখা করব।” অবশেষে নীচু স্বরে বলল।

 কার সঙ্গে দেখা করবে সেটা আর সে জিজ্ঞাসা করল না। রাজি হয়েছে যখন, সুহাসের সঙ্গেও নিশ্চয় দেখা করবে।

 সে বিষাদ অনুভব করল। এইমাত্র সে, কেন এবং কীসের জন্য তা না জেনেই এমন একটা লোকের ঘাড়ে যন্ত্রণা তুলেছিল যে তার ভাই। এইমাত্র সে আবিষ্কার করল যে লোকটিকে বরাবরই সমস্যাবিহীন এবং প্রলোভনমুক্ত হিসাবে গণ্য করে এসেছে সে লোকটি দুর্বল এবং মুহূর্তের জন্য যে-কোনো কাজই করে ফেলতে পারে।

 পানু আত্মরক্ষার্থে এই বারান্দায় তার সঙ্গে কাটানো সময়টাকে নিশ্চয় ধরে রেখে দেবে সারা জীবন। মধ্যস্থের ভূমিকাটা মন্দ নয়, কোনো আঁচই গায়ে লাগে না। কিন্তু যতবার এই আবেগের লড়াইটা ওর মনে পড়বে, ততবারই ও শুধু তাকেই ভাববে, হাসিকে নয়।

 দরজার দিকে পানু এগিয়েছে। সে স্বতঃস্ফূর্ত দাঁড়িয়ে উঠে হাত বাড়িয়ে ওর কনুইটা ধরল কেননা কিছু কথা তার ঠোঁটে এসে গেছে।

 ”পানু।”

 ”বলো।”

 ”তুই যে আমার ভাই, আমার ভালো লাগছে এটা ভাবতে।”

 অবাক বিমূঢ় হয়ে পানু তাকিয়ে রইল। আশাই করেনি তার দাদা এতটা বিচলিত হয়ে উঠবে।

 ”এ কথা বলছ কেন?”

 ”এটা আমার মনে হল। এই প্রথম আমার সত্যিই মনে হল আমার একটা ভাই আছে।”

 খাপছাড়াভাবে ও হাসল। কিছু একটা বলার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে, মাথাটা বার দুই নেড়ে চলে গেল।

 সে আবার মোড়ায় বসল। খবরের কাগজটা তুলে চোখ বোলাতে বোলাতে সারাদিনটা কীভাবে কাটাবে তাই নিয়ে বিদঘুটে কিছু চিন্তা তার মাথায় এল, যেমন দোতলায় গিয়ে মা’র সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলা, মোটমাট কোনো একজনের সান্নিধ্য, তাকে উদ্দেশ্য করে কেউ কিছু বলছে এমন একটা স্বর শুনতে পাওয়া, এই ধরনের কিছু এখন তার পেতে ইচ্ছে করছে। কেননা এইমাত্র কোন মন্ত্রবলে, কিছুক্ষণের জন্য হঠাৎ তার সঙ্গে একটা প্রাণের যোগাযোগ ঘটে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সে পেয়েছে। যত সামান্যই হোক, তার ফলে যে উষ্ণতা নিজের মধ্যে অনুভব করছে সেটা ধরে রাখতে চায় সে।

 কিন্তু মার সঙ্গে কথা বলা মানে এই উষ্ণতাকে নষ্ট করা। তাহলে আর কার কাছে যাওয়া? রত্না সম্ভবত অফিসে আসবে না। কেউ তার জন্য আশা করে নেই, কেউ না। কারুর কাছে গেলেই সে ভাববে ব্যাপারটা কী! লোকটা কী চায়? এই গরমে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোও সম্ভব নয়।

 সন্দেহ নেই এই কলকাতা তার বাল্যের, কৈশোরের শহর যেখানে চারদিক থেকে জীবনটাকে ঘিরে ধরে আটকে দেওয়া, যেখানে করার মতো একটিই কাজ শুধু পারা যায়, একঘেঁয়েমিকে লালন।

 সন্দীপ ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পাশবালিশ জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ সে ঘুমোবে। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে হবে অফিস যাওয়ার আগে। অলকা প্রশ্ন করার সুযোগ পাবার আগেই সে হাতঘড়ি কিনে ফেলতে চায়।

 সে ঘণ্টাদুয়েক ঘুমিয়েছিল। তখনই বাণী ভাত রেখে গেছে। স্নান খাওয়া সেরে চেক লেখার সময় টাকার অঙ্কটা নিয়ে বিব্রত হল। হুবহু আগের ঘড়ির মতো একটা কিনতে এখন কত টাকা লাগবে, সে সম্পর্কে তার ধারণাই নেই। প্রায় দশবছর আগে বোধহয় দুশো দশ টাকার মতো পড়েছিল। এখন তাহলে কত হবে! সে চারশো টাকা লিখতে গিয়ে পাঁচশো লিখল।

 প্রভাতের সেলুনের পাশেই ব্যাঙ্কের দরজা। ঢুকেই বাঁ দিকে কাউন্টারের সারি। ছোটো শাখা, কর্মচারী জনাকুড়ি।

 দরজার কাছ থেকেই সে তুমুল ঝগড়া-চিৎকারের আওয়াজ পেল। বিদ্যুৎ নেই, আলো পাখা বন্ধ। কর্মচারীরা কাজ করবে না জানিয়ে বসে আছে। কাউন্টারের বাইরে অন্তত পনেরোটি লোক একসঙ্গে মারমুখো হয়ে চেঁচাচ্ছে।

 ”আমরা কিছু জানি না মশাই, ম্যানেজারকে গিয়ে যা বলার বলুন, বলেইছি তো আলো না হলে আমরা কাজ করব না।”

 ”কেন এই আলোতে কি কাজ করা যায় না?”

 ”না যায় না, টাকা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়, যদি এধার ওধার হয়ে যায় আমার পকেট থেকে দিতে হবে…কেন আমি রিস্ক নোব? তখন আপনি এসে কি আমার হয়ে টাকা দেবেন?”

 ”দয়া করে একটু উপকার করুন না দাদা, আমার ছেলে আজ বোমবাই যাবে ইন্টারভিউ দিতে, টাকা না হলেই নয়।”

 ”আপনি ম্যানেজারকে বলুন…ছ’মাস ধরে আমরা আলোর ব্যবস্থা করতে বলছি। হচ্ছে, হবে, হেড অফিসের স্যাংশন আসেনি, এইসব বাহানায় দিন কাবার হয়েছে। আজ আমরা বদ্ধপরিকর কোনো কাজ করব না। গড়িয়াহাট ব্রাঞ্চে মশাই লোডশেডিংয়ের সময় একজন দুশো টাকা ওভার পেমেন্ট করে ফেলেছে…বুঝি আপনাদের…”

 ”ঘোড়ার ডিম বোঝেন।”

 সন্দীপ কোলাপসিবল দরজার কাছেই দাঁড়িয়েছিল। দেখল মাঝবয়সি স্থূলকায় একটি লোক কাউন্টারের শিক দু হাতে ধরে চিৎকার করে উঠল।

 ”বাজে অজুহাতে, ছুতোয় আপনারা কাজ বন্ধ করে কত লোকের সর্বনাশ করছেন জানেন? এই আলোয় আলবাত কাজ করা যায়। ম্যানেজার কোথায়?”

 ”পিটিয়ে চামড়া তুলে নিলে তবেই…”

 ”কে পেটাবে, কই দেখি…”

 কাউন্টারের ভিতর থেকে বলিষ্ঠ এক যুবা লাফিয়ে উঠে বাইরে আসার জন্য এগোতেই সহকর্মীরা তাকে ধরে ফেলল।

 ”কুণ্ডু থাক থাক, ঝামেলা করে লাভ নেই।”

 ”চামড়া তুলবে বলল আর চুপ করে তা হজম করব?”

 ভিতরে মৃদু একটা ধস্তাধস্তি এবং ”ছেড়ে দে, কেমন চামড়া তোলে দেখব”, বারংবার তর্জনের সঙ্গে সঙ্গে কাউন্টারের বাইরের জনতা থেকে, ”আসুক না, পিটিয়ে লাশ ফেলব”, পালটা হুংকারের মধ্যেই সন্দীপ দেয়াল ঘড়িতে দেখল দুটো বাজতে বারো। আর অপেক্ষা করে লাভ নেই, আজ আর টাকা তোলা যাবে না, এই সিদ্ধান্তে সে পৌঁছল।

 ”দাদা আমার ছেলেটা আজ…”

 ”যে যেখানে আছেন থাকুন, নড়বেন না।”

 সন্দীপ লক্ষই করেনি, তার পাশ দিয়েই এরা কখন ঢুকেছে। রিভলভারটা সামান্য ডাইনে বাঁয়ে নাড়ে যুবকটি, পরনে কালো প্যান্ট, সাদা গেঞ্জি শার্ট দোহারা গৌরবর্ণ, যার মুখের নিম্নাংশ সাদা রুমালে ঢাকা। মুহূর্তে নীরবতা গ্রাস করল ঘরটিকে। প্রত্যেকটি লোকের চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত। দেহগুলি টানটান। কেউ ঠোঁট চাটছে, কারুর কণ্ঠনালি ঘন ঘন ওঠানামা করছে। ফিসফিসিয়ে শুধু একজন বলল, ”ডাকাত পড়েছে।”

 জনাচারেক ছেলে, প্রত্যেকেরই মুখের নিম্নাংশ রুমালে ঢাকা, হাতে রিভলভার, কাউন্টারের ভিতরে চলে গেছে। টেবিলগুলোর মধ্যে যেটি বড়ো এবং একটু তফাতে, তার পিছনে বসা লোকটিকে একজন টেনে তুলল। বোধহয় ক্যাশিয়ার বা অ্যাকাউন্টট্যান্ট।

 ”সিট থেকে উঠবেন না, যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন বসে পড়ুন, কেউ বুদ্ধিমান হতে যাবেন না।”

 দম দেওয়া পুতুলের মতো দাঁড়ানো লোকেরা বসে পড়ল। ভোজালি দিয়ে একজন ঘরের একমাত্র টেলিফোনটির তার ছিঁড়ে দিল।

 ”টেবলে হাত আর মাথা ঠেকিয়ে রাখুন, চটপট।”

 সন্দীপের পাঁজরে খোঁচা লাগল। কোলাপসিবল গেটের সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি রিভলভারের নল দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে ইশারা করল অন্যান্যদের সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াতে। সন্দীপ দেখল ছেলেটির থুতনিতে কিছু রোম, নাকের নিচে গোঁফের রেখা। একমাত্র এরই মুখ ঢাকা নয়।

 ”এক জায়গায় হোন, ঘুরে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ান…চটপট।”

 একটা ব্যস্ততা দেখা দিল। লম্বা জায়গাটার এককোণে যাবার জন্য ঠেলাঠেলি পড়ে গেল। সন্দীপও দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে ওদের সঙ্গে দাঁড়াল। চোখের সামনে পড়ল হাতে লেখা ব্যাঙ্ক ইউনিয়নের একটা বিবর্ণ পোস্টার যাতে সাত দফা দাবির তালিকা, তার পাশেই ছাপা রঙিন পোস্টার তাতে স্বল্প সঞ্চয়ের জন্য দুটো পরিকল্পনার বিবরণ। দুটো পোস্টার পড়তে পড়তেই সে আড়চোখে দেখল পাশের লোকটি ঠকঠক করে কাঁপছে।

 ”এরা কি গুলি করবে?”

 ”কী দুঃখে বুলেট নষ্ট করবে?”

 লোকটির বোকার মতো কথায় সন্দীপ বিরক্তি প্রকাশ করল। ”আপনি কি বাধা দেবেন?”

 ”একদমই নয়।”

 ”তাহলে ভয় পাচ্ছেন কেন?”

 ”যদি কেউ হঠকারিতা করে বসে!”

 ”তাহলে গুলি করবে।”

 লোকটির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সন্দীপ নিজেও যথেষ্ট উত্তেজিত তবু ক্ষীণভাবে একটা হালকা সুখ বোধ করল। চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি, দুটো এমন ঘটনার মধ্যে সে পড়ল যার মধ্যে মিল থাকলেও, এই মুহূর্তের ঘটনাটিকে সিনেমা দেখার মতো উপভোগ করতে পারছে, আর্থিক ক্ষতি বা দৈহিক পীড়ন হচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটা কেমন যেন বানানো, হাস্যকর লাগছে, অথচ সত্যি।

 দ্রুত চলাফেরার, অস্ফুট কয়েকটি নির্দেশ বাক্যের, চেয়ার সরানোর এবং ম্যানেজারের কাঠের দেওয়ালের ঘরটির ভিতর থেকে রুক্ষ কিছু টুকরো কথা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। শুধু একবার ধমক শুনল, ”ভল্টের চাবি চেনেন না?…হারি আপ।”

 কতক্ষণ সময় কাটল। পাঁচ, দশ, কুড়ি মিনিট? অভ্যাসবশে হাতটা তুলল, তারপর মুখ ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়িটা দেখার চেষ্টা করল।

 ”এদিকে তাকাবার কী আছে?”

 ধমকটায় রূঢ়তার সঙ্গে ত্রাসও মিশে আছে। সন্দীপের মনে হল, কাল রাতেও সে এই ধরনের ভয় ওদের গলায় পেয়েছিল।

 ”হঠকারী হবেন না দয়া করে।”

 ”এ শালার ব্যাঙ্ক লুট হওয়াই উচিত।”

 ”ইন্সিওর করা, ব্যাঙ্কের কিছু লোকসান হবে না।”

 ”কত টাকা নেবে মনে হয়?”

 ”দু লাখ?”

 ”মাত্র!”

 ”কাল কাগজেই পেয়ে যাবেন সব কিছু।”

 বিস্ময়ের ধাক্কাটা কাটিয়ে এরা স্বাভাবিক হয়ে আসছে। হালকা পায়ে ছোটার শব্দ এবং কোলাপসিবল দরজাটা খোলার এবং টেনে বন্ধ করার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কে বলে উঠল, ”ওরা চলে গেল।” বাইরে মোটর এঞ্জিনের শব্দ উঠল এবং দূরে চলে গেল শব্দটা।

 ”পুলিশে…পুলিশে খবর দিন…পাশের বাড়িতে দেখুন টেলিফোন আছে।” চিৎকার করতে করতে একটা লোক ছুটে বেরিয়ে গেল।

 একসঙ্গে প্রায় চল্লিশজন লোক ব্যস্ত হয়ে পড়ল কথা বলার জন্য। সন্দীপ ঘড়িতে দেখল ঠিক দুটো। প্রায় বারোমিনিট সে দেয়ালের দিকে তাকিয়েছিল, এটা তার জীবনে প্রথম।

 ”আমার ছেলেটা আজ ইন্টারভিউ দিতে যাবে বোম্বাইয়ে।”

 সন্দীপ কথা না বলে ভিড় কাটিয়ে বেরিয়ে এল। এবার পুলিশ আসবে, জেরা হবে। কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কে জানে। তার কিছুই বলার বা জানানোর নেই, কিছুই সে দেখেনি, একমাত্র লম্বাটে মুখ, রোগা একটি কিশোর, যার মতো লাখখানেক এই কলকাতায় খুঁজে পাওয়া যাবে।

 সেলুনের মধ্যে বেঞ্চে প্রভাত ঘুমোচ্ছে দরজার একটা পাল্লা বন্ধ করে। তার একবার ইচ্ছা হয়েছিল ওকে জাগিয়ে তুলে বলে, ”হয়েছে, এবার নিশ্চিন্ত হও।”

 রাস্তা পার হয়ে সে বাস স্টপে দাঁড়াল। মুরারি তার দোকান থেকে ঝুঁকে গোলমালের কারণটা বুঝতে চেষ্টা করছে। সন্দীপ যখন বাসে উঠল তখন ঊর্ধ্বশ্বাসে একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল।

 ”আপনাদের থেকে ডাকাতদের ডিসট্যান্স কতটা ছিল।”

 ”সামান্যই, বড়জোর দু হাত।”

 অফিসে সন্দীপের টেবিল ঘিরে জনাদশেক।

 আজকের মতো কাজ শেষ, এটা সকলেই ধরে নিয়েছে। এমন রোমহর্ষক ঘটনার জ্যান্ত সাক্ষীর মুখ থেকে বিবরণ শোনার সুযোগ কদাচিৎ মেলে।

 ”আপনার কি ইচ্ছে করেছিল রিভলভারটা কেড়ে নিতে?”

 ”কী আজেবাজে বকছিস, কেউ কি তখন এসব পাগলামোতে যায়, সন্দীপদা ঠিক কিনা?

 ”নিশ্চয়, আমার তো ওসব মনেই হয়নি।”

 ”আজকালকার ছেলেরা বড় ডেয়ারডেভিল, কখন যে চালিয়ে দেবে।”

 ”অ্যাম্বাসাডারটার রং নিশ্চয় কালো ছিল?”

 ”না, হালকা নীল।”

 ”তাহলে ডাকাতরা স্ট্র্যাটেজি বদলেছে। কাগজে তো বরাবর গাড়ি কালো রঙেরই লেখা হয়।”

 ”কেন, সেদিন তো যে ডাকাতিটা হল এন্টালিতে সেটায় তো সাদা অ্যাম্বাসাডারে এসেছিল।”

 ”রাখুন সাদা-কালো, সন্দীপবাবু যা বলছে সেটা আগে শুনুন না…তাহলে ওদের বয়স কুড়ি-বাইশ বলে মনে হল?”

 ”একজনকে তো আরও কম লাগল।”

 ”এখন এই বয়সের ছেলেরাই এসব শুরু করেছে, সোশিও-ইকনমিক প্রব্লেম যে কোথায়..একটু রাত হলে পাড়ায় ঢুকতে ভয় করে, প্রায় রোজ ছিনতাই হচ্ছে।”

 ”এর থেকেও মারাত্মক মশাই গণ-পিটুনি। পড়েছেন তো, ছেলেধরা বলে ওপেন ডেলাইটে একটা লোককে পিটিয়েই মেরে ফেলল…কলকাতা শহরে!”

 ”রাখুন ছেলেধরা…তাহলে বলছেন সবার হাতে রিভলভার ছিল, মাত্র বারো মিনিট টাইম নিল?”

 ”বেশি সময় নিয়েছে, আরও পাঁচ সাত মিনিট কম হওয়া উচিত ছিল। খড়দায় চারমিনিটে ডাকাতি করেছে, এটাই এখন পর্যন্ত রেকর্ড টাইম।”

 ”রেকর্ড মানে কলকাতার রেকর্ড কিংবা ইন্ডিয়ার। ওয়ার্ল্ড রেকর্ড হয়েছে ভিয়েনায়, আড়াই মিনিট। প্রায় সত্তর লাখ টাকার মতো লুট করেছিল।”

 ”ইসস, আড়াই মিনিটে সত্তর লাখ। মিনিটে প্রায় তিরিশ লাখ।”

 ”খড়দায় চারমিনিটে দেড়লাখ। সারা জীবনে একজন যা আয় করে চার মিনিটে তাই করল।”

 ”সন্দীপবাবু কী করলেন আর জীবনে, আসুন একটা ডাকাতি-টাকাতি করি।”

 ”আমি আসছি।”

 সন্দীপ উঠে পড়ল। মেয়েটার আর তার সংগীত গুরুর নামটা জেনে নেওয়া দরকার। ছবির কথাও বলতে হবে। টোকা দিয়েই হাতল ঘুরিয়ে পারচেজিং কন্ট্রোলারের ঘরে সে ঢুকল।

 ”আসুন আসুন, আপনার কথাই ভাবছিলুম। নামটা লিখে এনেছি।”

 কাগজের একটা টুকরো বুক পকেট থেকে বার করল।

 ”আপনার শালীর মেয়ের নামটা ঠিক বুঝতে পারছি না, এমন জড়ানো লেখাটা…”

 ”অনু, অনুপ্রভা…না না অনুপ্রিয়া বোধহয়, আমরা তো অনু অনু বলেই ডাকি, একদমই কি বোঝা যাচ্ছে না?”

 ”যাচ্ছে, তবু শিওর হওয়াই ভালো, ভুল নাম বেরিয়ে গেলে…”

 ”আমি আজই গিয়ে জেনে আসব।”

 ”আর একটা ফোটোও আনবেন। যেটা দিয়েছেন, আমার ভাই বলল, ছাপায় ভালো আসবে না, কালোর অংশটা বড় বেশি জ্যাবড়া হয়ে যাবে।”

 ”বেশ। আজই যাব।”

 মনে হচ্ছে লোকটি যেন খুশিই হয়েছে শালীর বাড়িতে যাবার অজুহাত পেয়ে।

 ”আমার বন্ধুটির কিছু কি করা যায়?”

 ঠিক এই সময়ে আবার কথাটা পাড়ার যে কি তাৎপর্য লোকটাকে সেটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। শালীর মেয়ের সংগীত প্রতিভার খবর ছাপানোর জন্য মূল্য ধরে দিতে হবে, এটা জানুক। পনেরো সেকেন্ডের বেশি নিশ্চয় লাগবে না। কথাটা বলতে। এত কম সময়ে কোনো ডাকাতি কি সম্ভব?

 ”বলছিল আপনার সঙ্গে একটু দেখা করবে, আমি বলেছি অফিসে তো খুব ব্যস্ত থাকেন, বাড়ি গিয়ে দেখা করাই ভালো।”

 ”হ্যাঁ হ্যাঁ, অফিসে এত ঝামেলা যে…বলবেন আটটার পরই যেন যায়…শুনলুম আপনি আজ নাকি একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতিতে পড়েছিলেন!”

 ”এমন কিছু নয়, সামান্যই।”

 ”কোনো ক্যাজুয়ালটি হয়নি?”

 ”না না, টেলিফোনের তার ছেঁড়ার জন্য শুধু ভোজালিটা একবার…তাছাড়া ভেরি পিসফুলি কাজ হয়েছে।”

 ”কত নিয়েছে…অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে জানা সম্ভব নয়। হিসেব করতে কিছুক্ষণ সময় লাগবে…আচ্ছা ডিটেইলে পরে শুনব, ছবি আর নাম কালই দোব আর বলে দেবেন আটটার পর।”

 ঘড়িটা হাতে থাকলে সময় দেখে রাখত এই কথাবার্তার জন্য কতটা সময় গেল, সম্ভবত দুমিনিট। প্রণবেশ কতটাকা লাভ করবে এই দু মিনিটের জন্য? আজই ওর অফিসে গিয়ে জানিয়ে এলে মন্দ হবে না। সন্দীপ সময় দেখার জন্য হাত তুলেই নামিয়ে নিল। জানি নেই, তবু ভুল করায় অভ্যাস, সে বিরক্ত হয়ে এটা ভাবতেই রত্নাকে মনে পড়ল।

 নিশ্চয় আজ ও অফিসে আসবে না। যা চোট পেয়েছে হয়তো কয়েকদিনই আসবে না। সন্দীপের মনে গত সন্ধ্যার কয়েকটা দৃশ্য দ্রুত ভেসে উঠল। দৃশ্যগুলো তাকে অবাক করল প্রচণ্ডতার এবং বোধরহিত কাজের জন্য। রত্না অযথা বাধা দিল, এজন্য হয়তো খুনও হতে পারত।

 আজ এবং গতকাল সে নিষ্ক্রিয় থেকেছে, কোনো ঘটনাতেই জড়ায়নি। তবু এক ধরনের চাঞ্চল্য বা সাহস তার মধ্যে নিশ্চয় জন্মেছে নয়তো এমন স্বচ্ছন্দে পারচেজিং কন্ট্রোলারকে মিথ্যা কথা বলল কী করে যে প্রণবেশকে সে বাড়ি গিয়ে দেখা করতে বলেছে! লোকটা ঘুষ খায় সবাই জানে, কিন্তু মুখোমুখি সেটা জানিয়ে দেওয়ার সাহস হঠাৎই যেন এসে গেল। সেও কি ডেসপ্যারেট হয়ে যাচ্ছে?

 টেলিফোনটার কাছে পৌঁছতেই পিছন থেকে অফিসেরই একজন ডাকল, ”সন্দীপবাবু কাল নাকি আপনাদের বাড়ি অ্যাটাক হয়েছিল?”

 ”কে বলল?”

 ”এসব খবর ঠিকই কানে আসে, অত বড়ো ফুটবলারের বাড়িতে কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে রটে যায়।”

 ”তা কী কী খবর আপনার কানে এল”?

 ”রেগে যাচ্ছেন কেন, কাকার মাথা ফেটেছে এটুকুও জানি। আরে শুভদীপ মিত্তির লাউ শাক দিয়ে না পুঁইশাক দিয়ে ভাত খেয়েছে তাও হাজারখানেক লোক খবর রাখে।”

 ঘরের দক্ষিণ প্রান্তে তারা বসে, কদাচিৎ কথা হয়। গত পাঁচবছরে দশটি বাক্য বড়জোর বিনিময় হয়েছে। হঠাৎ অযাচিত কথা এবং ঈষৎ বাঁকা স্বরে বলায় তার মাথা গরম হয়ে উঠেছে।

 ”কাল আপনার ভাই বাড়ি ফেরেনি রাতে।”

 ”হবে, আমি খোঁজ রাখি না।”

 ”কোথায় ছিল জানেন?”

 কৌতূহলী হল সন্দীপ। মানু সম্পর্কে তার কোনো আবেগ নেই তবে গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে।

 ”জানি না, কোথায় ছিল?”

 ”আমাদের পাড়ায় একটা বাড়িতে, প্রায়ই ওখানে রাতে থাকে। মা আর মেয়ে..মেয়েটি এখন প্রেগনান্ট, শুভদীপ মেন্টাল ট্রাবলের মধ্যে, যদি বেরিয়ে আসতে না পারে তাহলে ওর কেরিয়ার শেষ। এসব আপনি বোধহয় জানতেন না?”

 ”না তো।”

 ”আপনার মাকে চিঠি দিয়ে সবই জানিয়েছে মেয়েটির মা, বিয়ে দেবার জন্য চাপও দিয়েছে।”

 ”আমি এসব জানতুম না, জানতে চাইও না। আমরা আলাদা থাকি কাজেই…”

 ”তাও জানি।”

 কতদূর পর্যন্ত জানে বাইরের লোকেরা তাদের পারিবারিক সম্পর্ক? মানুর খ্যাতি তার বা পানুর ব্যক্তিগত জীবনকে একদমই স্পর্শ করে না বটে কিন্তু হাজার হাজার কৌতূহল, খবরাখবর রাখার চেষ্টা তাদের ব্যক্তিগত জীবনের উপরতল থেকে কতটা চুঁইয়ে নেমেছে সেটা জানা দরকার। সাবধান হতে হবে।

 ”মা কি জবাব দিয়েছে?”

 ”কিছুই দেননি। তবে…”

 লোকটি দুপা এগিয়ে তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মুখ ঝুঁকিয়ে ফিসফিস করল, ”খাণ্ডার মেয়েমানুষ, আপনাদের বাড়িতে গিয়ে ঝামেলা পাকাবার মতলবে আছে। আমার বউ ওদের বাড়ি মাঝেমধ্যে যায়, তার কাছেই শোনা, বিয়ে দিয়ে ছাড়বে নয়তো কোর্টে যাবে। এটা জানিয়ে দেবেন আপনার মাকে।”

 মানু কোথায় ফ্ল্যাট কিনেছে, ওরা বাড়ি ছেড়ে সেখানে চলে যাবে আর তার মূলে বোধহয় এই কারণটাই। ওর বিয়ের জন্য চেষ্টা হওয়ার পিছনেও এই কারণ। কিন্তু সন্দীপের এটা ব্যক্তিগত বিপদ নয় এজন্য সে উদ্বেগ বোধ করল না। ব্যাঙ্ক ডাকাতির মতো এটাও একটা সিনেমা।

 ”মানু কী বলছে?”

 ”বোধহয় রাজি নয় আবার রাজিও। বুঝলেন না মেয়েটা খুব সেক্সি আর খেলাটেলা করে যারা তারা তো খুব গরম ধরনের হয়, ছাড়তেও চায় না আবার বিয়ে করার মতো ঘরও নয়, ফাঁপড়ে পড়েছে।”

 আবার রত্নাকে তার মনে পড়ল। লম্বা ভারী চেহারা, বাহু, গলা, কাঁধ, ঊরুর পুরুষালি পেশী, বড়ো কিন্তু দৃঢ় স্তন ও নিতম্ব এসবই একদা প্রচুর ট্রেনিং থেকে গড়ে ওঠা। ওকে কি ”গরম ধরনের” বলা যায়? শরীরের থেকেও ভোঁতামি এবং রুচি মার্জনার অভাবের জন্যই রত্না হয়তো খোলামেলা হয়ে ওঠে। ওর খবর নেওয়া দরকার।

 ”আপনার ভাই টাকা দিয়ে মিটিয়ে ফেলতে চেয়েছিল, ওরা রাজি হয়নি।”

 ”কেন হল না?”

 ”ওরা বিয়ে চায়।”

 হাসিকে তার মনে পড়ল। বিয়ের আগেই পেটে বিভু এসেছিল। বিয়েও হল কিন্তু কি জীবনের মধ্যে হাসি নিজেকে ঠেলে দিল? রত্নারও এইরকম একটা ঘটনা আছে। দুজনের জীবনযাপনের বা চিন্তার ধরনে কি তফাত! রত্নার জন্য কেউ কষ্টভোগ করছে না।

 ”আপনার ভাইয়ের জন্য তো বিয়ের চেষ্টা হচ্ছে।”

 ”তাও জানেন?”

 ”এটা অনেকেই জানে।”

 ”আমি একটা ফোন করব, জরুরি।”

 ওদিক থেকে যে রিসিভার তুলেছে তার চাপা গলা সন্দীপ শুনতে পেল, ”রত্না গড়াইয়ের ফোন, ডেকে দিন।”

 নিছকই খোঁজ নেবার জন্য ফোন করা অফিসে কোনো খবর পাঠিয়েছে কিনা। কিন্তু ও যে আজ বেরোবে এটা কল্পনার বাইরে। অন্তত পাঁচদিন শুধু বিছানাতেই শুয়ে থাকার কথা।

 ”হ্যালো, কে?

 ”সন্দীপ, কেমন আছ?”

 ”স্প্রেন হয়েছে, হাতটা তুলে রেখেছি গলায় ব্যান্ডেজ ঝুলিয়ে…আর বিশেষ কিছু নয়।”

 ”ব্যথাট্যথা?”

 ”একটু হয়েছে, চেয়ারে বসতে কষ্ট হচ্ছে…ওসব জায়গায় মেয়েদের কিছু লাগে না।”

 সন্দীপ কল্পনায় দেখতে পেল রত্নার পাশের চেয়ারে বসা লোকটি একবার মুখ তুলে তাকাল এবং চোখ নামাবার সময় দৃষ্টিটা ঘষড়ে নিল নিতম্বে। রত্না ফোনেও মৃদুস্বরে কথা বলে না।

 ”এক্সরে করেছ?”

 ”ডাক্তার বলেছিল…অত পয়সা কোথায়?”

 ”সে ভাবনা আমার।”

 ”থাক, অত আদিখ্যেতায় দরকার নেই…আজ বেরোন হবে না, সোজা বাড়ি যাচ্ছি।”

 ”কেন?”

 ”দাদাদের হুকুম, একটু-আধটু তো মেনে চলা উচিত, ওদের গলগ্রহ হয়েই তো থাকতে হবে।”

 ”কাল কী বলেছ বাড়িতে?”

 ”যা শিখিয়ে দিয়েছিলে, পাতাল রেলের গর্তে। তাইতেই তো সন্ধ্যের আগে বাড়ি ফেরার অর্ডার জারি হয়েছে।”

 ”তাহলে কবে দেখা হবে? তুমি ঠিক বলছ সিরিয়াস কোনো ইনজুরি হয়নি?”

 ”ইনজুরির জন্য কোনো জায়গাই আর আমার শরীরে নেই।”

 হঠাৎ মৃদু এবং আবেগময় হয়ে উঠল রত্নার স্বর। সন্দীপ করুণা বোধ করল। হাসি তবু একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে, জীবনটাকে আকারে আনার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

 ”তাহলে কবে ফোন করব?”

 ”রোজ। যেদিন বুঝব সাহসী হয়েছ সেদিন বেরোব।”

 রত্না ফোন রেখে দিল উত্তরের অপেক্ষা না করে। ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল সন্দীপের মাথার মধ্যে। যদি রত্না ফোনটা না রেখে দিত তাহলে সে বলত, ”ইডিয়ট, সাহস দেখিয়ে তো লাথি খেয়েছ, এই সাহসে লাভ কি?”

 সাহস! সে যখন অফিস থেকে বেরোল তখন রাগটা চক্রবৃদ্ধি হারে তিনগুণ বেড়েছে। প্রচুর তর্ক মনে মনে হয়ে গেছে রত্নার সঙ্গে। সাহস যে কী ভাবে দেখাবে তার একটাও উপায় সে খুঁজে পেল না। সাহস মানে মারামারি, গায়ের জোর দেখানো, বিপদ বা মৃত্যু থেকে কাউকে উদ্ধার? হাসি সাহস দেখিয়েছে, পানু পারেনি। হাসিকে বিয়ে করার বদলে নিজে বিয়ে করে বসল দাদার প্ররোচনায়।

 মানুর বিয়ে করার সাহস নেই, টাকা ঘুষ দিয়ে পিতৃত্বের দায় এড়াতে চায়।

 বাণীর সাহস নেই উদাসীন অপ্রেম সহবাস দেওয়ার জন্য স্বামীকে ত্যাগ করার।

 কাকার সাহস নেই নিজের বিশ্বাসকে পরীক্ষা করানোর, একতলার ঘর থেকে বেরিয়ে জানোয়ারের মতো রাস্তায় এসে চোখ মেলে তাকানোর। গুহার মধ্যে জানোয়ারের মতো জীবন কাটানোকেই আদর্শ করে প্রায়শ্চিত্তের ভান এবং তাকে স্বীকার করতে ভয় পাওয়া।

 প্রত্যেকেরই একটা না একটা সমস্যা, প্রত্যেকেরই সামনে সাহস দেখাবার সুযোগ সাজানো রয়েছে অথচ তার জন্য কিছুই নেই। না সমস্যা না সাহসী প্রতিপন্নের কোনো উপায়। অলকা যদি সমস্যা তৈরি করে দেয় তাহলে সে বাঁচে কিন্তু ও এত নিস্পৃহ, এত দূরত্ব রাখে সংঘর্ষ এড়াতে!

 বিতৃষ্ণা আর বিরক্তি নিয়ে সে মৌলালির মোড়ের কাছে চারতলা একটা পুরনো বাড়ির সিঁড়ির পাশে পলেস্তারা খসা দেয়ালে ছোটো ছোটো সাইন বোর্ডের মধ্যে প্রণবেশের প্রতিষ্ঠানের নামটি খুঁজে বার করল। তাকে তিনতলায় উঠতে হবে।

 একটি মাঝারি ঘর, তার মধ্যেই দেয়াল ঘেঁষে প্লাইউড ও ঘষাঁকাচের দেয়ালে ঘেরা ছোটো এক ঘর। ছুটি হয়ে গেছে। দরজা থেকে সন্দীপ দেখল তিনটি টেবিলে অগোছালো কাগজপত্র, খাতা। কর্মচারীরা নেই। শুধু কোণের টেবিলে একটি স্ত্রীলোক টাইপ করে যাচ্ছে। ঈষৎ গোলমুখ, গৌরবর্ণা, শীর্ণকায়া, কপালটি ছোটো। জিজ্ঞাসু বড়ো চোখে তাকাল তার দিকে। এই বোধহয় সাবু।

 ”প্রণবেশ আছে কি?”

 আঙুল দিয়ে ছোটো ঘরটি শুধু দেখিয়েই টাইপ শুরু করল। দরজা বন্ধ, সে শুনতে পাচ্ছে ভিতরে কথার শব্দ। দরজায় টোকা দিয়ে সে আবার তাকাল টাইপরত স্ত্রীলোকটির দিকে।

 ”কে?”

 দরজা ঠেলতেই, তার চোখে পড়ল টেবলে মুঠো রেখে হাতা গোটানো পাঞ্জাবি পরা একটি লোককে, মুখটি চ্যাপটা, থুতনি ও ঘাড়ে চর্বির ভাঁজ, বুক পকেট ফুলে আছে কাগজের চাপে।

 পাল্লাটা আর একটু খুলতে টেবলের অপর ধারে প্রণবেশকে দেখা গেল। কয়েক সেকেন্ড বিস্ময়ে থেকে সে প্রায় চেচিয়ে উঠল, ”আয় আয়, বোস। কালকেই তোর কথা কীসে যেন মনে পড়ল…হ্যাঁ মনে পড়েছে, এক জায়গায় তর্ক হচ্ছিল…চেয়ারটা টেনে নে, আমার ছোটো ব্যবসা ছোটো অফিস, একটু কষ্ট করেই বসতে হবে, গুলোদা আর একটু সরে বসুন, এ হচ্ছে আমার ছোটোবেলার বন্ধু সন্দীপ আর এই হচ্ছে গ্রেট গুলোদা, তোকে বোধহয় এর কথা একবার বলেছি।”

 প্রণবেশের উচ্ছ্বাস অকৃত্রিমই মনে হল। গুলোদা স্মিত মুখে হাত তুলে নমস্কার করল। বাসিঘামের টোকো গন্ধ আসছে। দেয়ালে আঁটা ছোট্ট পাখাটার দিকে সে তাকাল। তাই দেখে প্রণবেশ দাঁড়িয়ে উঠে পাখার গায়ে লাগানো একটা বোতাম টিপল। পাখাটা এধার ওধার মাথা নাড়ানো শুরু করল। বাইরের থেকে টাইপের শব্দ আসছে।

 ”আমার কথা কেন মনে পড়ল?”

 ”বউ নিয়ে কথা হচ্ছিল, নানান ধরনের, এক সময় ফিগার নিয়ে কথা উঠল তখন…”

 আর একবার তার মাথার মধ্যে ঝাঁ করে উঠল। অলকার ক্ষীণ ভাঙাচুরো দেহ যে অজানা এক আড্ডার আলোচ্য বিষয় হতে পারে এটা তাকে যত না অবাক করছে তার থেকেও বেশি, সম্পর্কে ও প্রণবেশের বোন হয়। অলকার প্রতি সে মায়া বোধ করল। দেহটার জন্য ও দায়ী নয় এবং নিজেকে সরিয়ে গুটিয়ে রাখার মানসিকতা গড়ে উঠেছে অনাকর্ষণীয় দেহের জন্যই যে এটা বোঝা যায়। কিন্তু প্রণবেশ সেটা উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করবে কেন?

 তার অপ্রতিভ মুখ ও হঠাৎ গাম্ভীর্যে প্রণবেশ বিন্দুমাত্রও বিব্রত হল না। ফুৎকারে উড়িয়ে দেবার ব্যাপারের মতো ভঙ্গিতে বলল, ”বউদের ফিগারের সঙ্গে স্বামীদের হ্যাপি হওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা তাই নিয়েই শুরু হয়েছিল। তখন বলেছিলুম আমার এক বন্ধু আছে সে তো দিব্যি দিন কাটিয়ে যাচ্ছে যদিও তার বউয়ের ফিগারটিগারের বালাই নেই…অলকা তো হপ্তায় ছ’দিনই বাইরে থাকে তোর কোনো অসুবিধা হয়?”

 সন্দীপ বিনা চেষ্টাতেই মুখে হাসি ফোটাল এবং মাথা নাড়ল। মাইল দৌড়ে বিজয়ীর মতো উজ্জ্বল মুখে প্রণবেশ মাথা দুলিয়ে চোখ টিপল গুলোদাকে।

 ”তারপর আর কী খবর বল।”

 ”ভালো খবর, ওটা নিয়ে কথা বলেছি।”

 ”প্রণবেশ ভ্রূ কোঁচকাল। সে গুলোদার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ”সেই সাপ্লাইয়ের ব্যাপারটা।”

 ”ওহঃ, বলেছিস, কী হল।”

 ”বোধহয় হবে, তোকে দেখা করতে বলেছে, তবে বাড়িতে রাত আটটার পর।”

 ”ফাইন। কত খাওয়াতে হবে সেরকম কিছু হিন্টস দিল? কবে যাব?”

 ”না, যে-কোনো দিন।”

 ”মেয়েছেলে দিতে হবে? সে ব্যবস্থাও আছে।”

 প্রণবেশ আবার গুলোদার দিকে তাকিয়ে হাসল। ভাবখানা, এ তো অতি সহজ সামান্য ব্যাপার।

 ”জানি না।”

 ”তোর দরকার?”

 আবার মাথার মধ্যে মৃদু ভূমিকম্প ঘটল। হঠাৎই তার মনে হল বড় সামান্য, উদ্দেশ্যহীন জীব হয়ে সে বেঁচে রয়েছে। নিজের অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট পরিচিতিহীন একটা ন্যাদামারা। তার একটা পরিচয় দরকার, মানুর মতো বা প্রণবেশের মতো না হোক বেপরোয়া, প্রবল জীবনযাপনের শব্দ দিয়ে চারপাশকে সচকিত করে তোলা দরকার। সে অসন্তুষ্ট, এটা দেখাবার সাহস যে তার আছে সেটা এবার বলা দরকার। সে অসন্তুষ্ট, এটা দেখাবার সাহস যে তার আছে সেটা এবার বলা দরকার। কয়েক মিনিটেই একজনের সারাজীবনের আয় ডাকাতি করে নিচ্ছে বাচ্চচা ছেলেরা, ধরা পড়ছে কি পড়ছে না আর সে কিনা গোটা জীবনেও হাত-পা ছুঁড়তে পারল না!

 ”কি রে, এত কী ভাবছিস, লজ্জা করছে বলতে?…আরে গুলোদাই তো ভরসা…ঘরটর চাই তো বল, সব আমার খরচ। একবার তোদের কোম্পানিতে সেঁধোই তো।”

 ”তুই কি দালালি দিতে চাস?”

 ”অ্যাই দ্যাখো, রেগে গেলি তো! বন্ধুর জন্য বন্ধু করে না! গুলোদা একটু ব্যবস্থা করো, সাবুকে ডাকো, অরুণ আছে না চলে গেছে?”

 ”চলে গেছে, দাও আমাকেই দাও এনে দিচ্ছে।”

 ”ওর কাছে কালকের ক’টা টাকা আছে…সাবু!”

 প্রণবেশ গলা চড়াতেই টাইপের শব্দ থেমে গেল। দরজা ঠেলে সাবু ঢুকল আর সন্দীপ ফিকে একটা সুগন্ধ পেল।

 ”সন্দীপ এসেছে, একটু খাওয়ার ব্যবস্থা করো। কালকের টাকা কিছু আছে?”

 ”একত্রিশ টাকা… ঝাড়ুদারকে আজ দুটাকা দিয়েছি।”

 পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দরকারই মনে করল না, হয়তো তার সম্পর্কে প্রণবেশ অনেকবার বলেছে। ওর সম্পর্কে প্রণবেশ তাকে কী বলেছে সেটা নিশ্চয় ও জানে না। সে যথাসম্ভব আড়চোখে পাশে দাঁড়ানো সাবুর মুখ দেখার চেষ্টা করল। সিঁথিতে সিঁথিতে চিহ্ন অস্পট, দীর্ঘ পল্লবের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসা চাহনিতে কোনো ভাব নেই। বেশির ভাগ সময় অলকার চোখ এই রকমই থাকে, বীতস্পৃহ, নিরুৎসুক। তবে সাবুর এটা ইচ্ছাকৃত, সাময়িক, বাইরের লোকের সামনে।

 ”কী খাবি, রাম না হুইস্কি?…ওহ বীয়ার ছাড়া তোর তো অন্য কিছু চলে না।”

 ”না বীয়ার খাব না, রাম আনা।”

 ”গুড। গুলোদা তা হলে রাম…আর চাইনিজ না তন্দুরি?”

 প্রণবেশ সকলের দিকে একবার তাকাল।

 ”তন্দুরি চিকেনই ভালো।”

 গুলোদা অনুমোদনের জন্য তার দিকে তাকাতেই সে মাথা হেলাল। তার খিদে পাচ্ছে। প্রণবেশ ড্রয়ার থেকে ব্যাগ বার করে সাবুর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

 ”একশোতেই হবে, আমার কাছে তো…”

 ”থাক তোমার কাছে। গ্লাসগুলো বার করো, প্লেট ধুয়ে নিয়ো।”

 দুটো একশো টাকার নোট নিয়ে গুলোদা বেরিয়ে গেল এবং সাবুও।

 ”লোকটা করে কী?”

 ”টুকটাক এটা সেটা, দালালি, আমার মালও কিছু কিছু বেচে তবে মেইন ইনকাম ঘর ভাড়া দিয়ে। বনেদি আমলের বিরাট বাড়ি, শরিকও প্রচুর। গুলোদার অংশ বাড়ির পেছন দিকে একটা সরু গলিতে ওর সদর। যাওয়া আসায় লোকের নজরে পড়ার ভয় নেই কিন্তু পরিচিতরা না বললে ঘর দেয় না, রোজই খদ্দের থাকে।”

 ”ভালো ইনকাম করে।”

 ”তোকে কিন্তু তখন এমনিই ঠাট্টা করে বলেছিলুম, তুই যে চটে যাবি…”

 ”মোটেই চটিনি বরং বলব ভাবছিলুম ওর ঠিকানাটা নিয়ে রাখব।”

 প্রণবেশের মুখ থেকে হালকা ভাব অন্তর্হিত হয়ে বিস্ময় এবং মুহূর্তেই সেটা আন্তরিকতায় চলে গেল।

 ”সিরিয়াসলি?’

 ”নিশ্চয়, কেন তোর কি সন্দেহ হচ্ছে, আমি কি যেতে পারি না?”

 ”ব্যবসা করে খাই, কিছুতেই আর অবাক হই না, কাকে নিয়ে যাবি?”

 ”আছে।”

 গলায় অস্বাভাবিক জোর এসে গেল ”আছে” বলার সময়। তার নিজের কানেও এটা লেগেছে। প্রণবেশ একদৃষ্টে তাকিয়ে সম্ভবত তাকে বোঝার চেষ্টা করছে। কী বুঝতে চায়? ও কি ভাবছে এটা কৃত্রিম সাহস? অপ্রয়োজনীয়, গুরুত্বহীন লালসা?

 ”তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব, অদ্ভুত ধরনের মেয়ে, স্বামী ছেড়ে বাপের বাড়িতে আছে। অ্যাথলীট ছিল।”

 ”কী নাম?”

 ”রত্না গড়াই।”

 ”গুলোদার ওখানে যাবে?”

 ”নিশ্চয়।”

 আবার বোধহয় গলায় জোর এল ”নিশ্চয়” বলার সময়। সে প্রণবেশের মুখের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি বোধ করল। মুখে ভাবান্তর ঘটেনি।

 ”তুই কালকেই গিয়ে দেখা কর। ওর শালীর মেয়ের ছবি ছাপিয়ে দেব বলেছি আমার ভাইয়ের পত্রিকায়, ফাংশনে গান গেয়েছে।”

 ”দেখা যখন করতে বলেছে, জেনে রাখবি কাজ আমি পেয়েই গেছি।…সাবু।”

 ও যেন ডাকটার প্রত্যাশায়ই ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই এল। হালকা ধমকের সুরে প্রণবেশ বলল, ”কী করছ এতক্ষণ ধরে, আমরা দুজনেই কি শুধু গপ্পো করে যাব, বোস এখানে। জানিস, সাবু খুব ভালো মেয়ে।”

 ”আমি কিন্তু আজ তাড়াতাড়ি ফিরব, শাশুড়ির জ্বর একই রকম দেখে বেরিয়েছি।”

 ”আরে বেশিক্ষণ আমরাও বসব না। সানুকে নামিয়ে তোমাকে পৌঁছে দেব।”

 গুলোদার চেয়ারটায় সাবু বসল। সে এই প্রথম লক্ষ করল ওর রুগণ হাতে প্রচুর রোম, নখে রং, কণ্ঠার হাড় উঁচু।

 ”আপনার কথা অনেকবার শুনেছি।”

 সে বলতে যাচ্ছিল, আপনার কথাও শুনেছি, কিন্তু তার বদলে বলল, ”আজ একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতির মধ্যে পড়ে গেছলুম। টাকা তুলতে গেছি আর তখনই ডাকাতিটা হল।”

 অতঃপর সে ডাকাতির বিবরণ দিতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর দরজা ফাঁক হয়ে গুলোদার মুখ উঁকি দিতেই সাবু উঠে পড়ল। অতি সামান্য জায়গা দুটি চেয়ারের মধ্যে, সন্দীপের উচিত ছিল একটু হেলে কাঁধ সরিয়ে রাখার। সাবুর নিতম্বের স্পর্শের থেকেও সে বেশি খুশি হল নিজের অসঙ্কোচতায়। এটাও এক ধরনের সাহসিকতা!

 প্রণবেশ তাকে বাড়ির সামনে যখন নামিয়ে দিল তখন রাস্তা নির্জন হয়ে এসেছে। মুরারি বন্ধের উদ্যোগ করছে, তিনটে কুকুর দোকানের সামনে বসে। মোটর এঞ্জিনের শব্দে তারা ফিরে তাকাল। বাস স্টপে একটিমাত্র লোক। অপেক্ষায় রয়েছে। সিগারেটের দোকানটা মাঝরাত পর্যন্ত খোলা থাকবে।

 পানুর ঘরের আলো বারান্দায়, মানুদের জানলাগুলো বন্ধ। গাড়ি থেকে নামার সময় পা একটু টলে গেছল মাত্র। জিভটা অবশ লাগছে।

 পিছনের সীটে সাবু। জানলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে সন্দীপ বলল, ”গুড নাইট।”

 ”গুড নাইট।”

 সাবু তার হাতে আলতো করে হাত ছোঁয়াতেই সে মুঠোয় চেপে ধরল।

 ”তুই তাহলে যাস, কালকেই, আমি চেষ্টা করব বুঝলি…তুই ভাবিসনি, হয়ে যাবেই…তোর না হলে আমি কিছুতেই সন্তুষ্ট হব না, বুঝলি সন্তুষ্ট হব না…”

 ”সানু চলি, গুড নাইট।”

 গাড়ি থেকে হাতটা বার করার সময় সে সাবুর গালে হাত বুলোল। তারপর হাতটা নিজের গালে ছুঁইয়ে হাসল। গন্ধ শুঁকল। সাবু হাসল বোধহয়। গালটায় শুধুই চামড়া।

 গাড়িটা প্রায় পঞ্চাশ মিটার গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ভারী চোখের পাতা টেনে সে দেখতে পাচ্ছে সাবু নামল এবং সামনের দরজা খুলে প্রণবেশের পাশে গিয়ে বসল। ডান হাতে স্টিয়ারিং, বাঁ হাতে সাবুকে নিয়ে এবার গাড়ি চালাবে। সাবুও সাহসী!

 সদর দরজার দিকে যেতে যেতে এখন তার রত্নাকে মনে পড়ল। গুলোদা বলেছে খুব খুশি হবে তার সেবায় লাগলে। বড় বিনয়ী, আস্ত ঘুঘু। যে-কোনোদিন যে-কোনো সময় সে যেতে পারে।

 দরজায় টোকা দেওয়ার বদলে কিল বসাল, পরপর চারটে। কোনো সাড়া এল না উপর থেকে। আলো জ্বালিয়ে কি পানুরা ঘুমিয়ে পড়েছে? মানুর চাকরটা গেল কোথায়?

 সে আবার কিল মারল কয়েকটা। সামনের বাড়ির জানলা ফাঁক করে কেউ দেখছে। সে ঘুরে তাকাতেই পাল্লাটা বন্ধ হয়ে গেল।

 ”কে?”

 পানুর গলা। বোধহয় মন দিয়ে নভেল লিখছিল। তাছাড়া আলো জ্বেলে করবে কি! কুকুরগুলো ছুটোছুটি করছে খেলাচ্ছলে। তাদের একটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। ভঙ্গিতে সন্দেহের ভাবই বেশি। বারকয়েক ফোঁৎ-ফোঁৎ নাকে শব্দ করে তার দিকে এগিয়ে আসতেই অন্য দুটিও ছুটে এল এবং চাপা গজরানি শুরু করল।

 সন্দীপ ভয় পায় কুকুরকে, বিশেষ করে রাস্তার কুকুরকে। ছোটোবেলায় দেখেছিল তাদের চাকরের পায়ের ডিমে পাগলা কুকুরে কামড়েছিল। ছিঁড়ে তুলে নিয়েছিল মাংস। চোদ্দটা ইঞ্জেকসন নেবার পর ওর নাভির চারপাশ শক্ত হয়ে গেছল। ব্যথায় হাঁটতে পারত না। প্রতিবারই ধস্তাধস্তি করে ওকে শোয়াতে হত ইঞ্জেকশন নেবার জন্য।

 ঘাড়ের কাছে সিরসির করছে। দরজায় পিঠ লাগিয়ে সে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে। শরীরটা শক্ত হয়ে উঠেছে, আঙুলগুলো বাঁকানো। তার হাত দুটো মুখের সামনে। একটা কুকুর মাড়ি বার করে বিশ্রি চোখে তাকিয়ে। ওখান থেকে একলাফেই তার টুঁটি ধরতে পারে। ভয় তার দেহ বেয়ে ওঠা-নামা করছে। পানুর এত দেরি হচ্ছে কেন দরজা খুলতে? শুনতে পায়নি? ঘুমিয়ে পড়েছে? ইচ্ছে করে দেরি করছে?…রাসকেল।

 কুকুর তিনটে যখন হাত পাঁচেক দূরে, সে চিৎকার করে ওঠার জন্য বুকের মধ্যে বাতাস টেনেছে এবং বিলীয়মান সাহস সম্পর্কে হতাশ, তখনই খিল তোলার শব্দ পেল এবং পিঠ দিয়ে পাল্লাদুটোতে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে খুলে দিতেই পানু ”উহঃ” বলে উঠল। ওর মুখে আঘাত করেছে একটা পাল্লা।

 ”এত দেরি হয় কেন দরজা খুলতে, য়্যা, কচ্ছিলি কী? এখুনি কুকুরে কামড়াচ্ছিল। এত নিড়বিড়ে ন্যাদামারা কেন?”

 ভয় থেকে রেহাই পেয়েই সে অন্ধ একটা রাগের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। রাগটা এইমাত্র তৈরি হওয়া। কী বলছে সেটা তার কাছে সামান্যই ব্যাপার, রাগটাকে কত তীব্র ধারালো করে জখমের জন্য ব্যবহার করা যায় সেটাই এই মুহূর্তে সে দেখতে চায়। এখন তার মধ্যে তোলপাড় হচ্ছে আঘাত করার জন্য আবেগ।

 ”এত দেরি হল কেন?”

 হঠাৎ সে গলা চড়িয়ে চিৎকার করে উঠল। পানুর মুখটা ঝাপসা দেখাচ্ছে, জলেভেজা কাচের ওধারে যেন দাঁড়িয়ে। আলোটা ওর পিঠে, চুল ওঠা খুলিতে, শুকনো বাহুতে এবং বসে যাওয়া গালে কতকগুলো কালো দাগ তৈরি করেছে। সন্দীপ সেই দাগগুলোর উপর তার রাগ ছুঁড়ে মারতে একই কথা আবার বলল, ”আমাকে কুকুরে কামড়াতো আর একটু হলেই…অপদার্থ, চটপট নেমে এসে দরজা খুলতে পারিস না? এইজন্যই জীবনে কিছু হল না, কিছু করতে পারলি না।”

 ”ওপরে যাও, আর চেঁচাতে হবে না।” পানু কপালে হাত বোলাল। ফুলে উঠেছে।

 ”বেশ করব চেঁচাব, আমি কেঁউকেঁউ করে কথা বলি না, এ বাড়িতে আমি ক্লিনেস্টম্যান, ক্লিন অ্যান্ড অনেস্ট…আই হ্যাভ এভরি রাইট টু শাউট!”

 পানু তাকে কনুই ধরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে নেবার চেষ্টা করল। সেই সময় দরজা খোলার শব্দ হতেই সে ঘুরে দেখল কাকা দাঁড়িয়ে তাঁর ঘরের দরজায়। মাথার ব্যান্ডেজ থেকে একটা অংশ ঘাড়ে ঝুলে রয়েছে। পাশের ঘরেই থাকেন কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনো কাউকে দরজা খুলে দেননি। কেন দেয় না? কুকুর যদি কামড়াতো?

 এই যে মূর্তিমান শিবাজী? আটচল্লিশ ইঞ্চি বুকে মালা ঝুলিয়ে ঘোড়ায় চড়ে দেশোদ্ধার করছেন। ..খপ খপ খপ খপ, আওরঙ্গজেবের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন…হুঁশ নেই রোগাপটকা ছেলেগুলো পাইপগানের নল থেকে পেদে দিচ্ছে দেশের মুখে। আমায় যে কুকুর কামড়াচ্ছিল…”

 ”পানু ওকে ওপরে নিয়ে যা।”

 ”’চেষ্টা তো করেছি। মনে হয় একা থাকলে একসময় চুপ করে যাবে।…এই প্রথম।”

 ”তাহলে ওপরে চলে যা তুই, ও থাক।”

 কাকার দরজা বন্ধ হয়ে গল। পানু সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। সে দেয়ালে হাত রেখে এগোতে লাগল অনুসরণ করে।

 ”দরজা খুলতে এতো সময় লাগে, চটপটে হতে পারিস না? কোনোদিনই পারলি না, পারলে হাসি তোর হাতছাড়া হত না…মিছিমিছি দুটো ছেলেকে মারলি।”

 সে সিঁড়ির মাঝামাঝি, পানু তখন দোতলায়। তার মনে হল পানু থমকে দাঁড়িয়ে গেল। মুখ তুলে সে দেখার চেষ্টা করল। জড়িয়ে যাচ্ছে চোখ। বিশাল ঘুম তার উপর চেপে আসছে। প্রচণ্ড জল পিপাসায় জিভে টান ধরছে। পানুকে সে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু তার মনে হচ্ছে ও দাঁড়িয়ে রয়েছে। অপেক্ষা করছে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য।

 কিন্তু সে ভীরু নয়। তার গায়েও জোর আছে। এখনও সে কুড়ি, পঁচিশ, ত্রিশটা ডন দিতে পারে। পানুকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে দোতলা থেকে একতলায়। তাই বলে রেয়াৎ করবে না, কোনো ক্ষমা নেই…দু দুটো ছেলেকে মেরেছে। সে এবার তৈরি বদলা নিতে।

 সন্দীপ তিনতলায় পৌঁছল নির্বিবাদে। কেউ তার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল না।

. সন্ধ্যার সময়, শেয়ার ট্যাক্সি থেকে নেমে মিনিট চারেক হেঁটে ওরা সতেরোর-বি পেল।

 তখন লোডশেডিং বিদ্যুতের। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিন্যু পশ্চিম থেকে বেরিয়ে গলিটা ক্রমশ সরু এবং প্রচুর বাঁক নিয়ে আরও সরু হয়ে এলেও অন্ধকারে তাদের অসুবিধা হয়নি। সন্দীপ দু’দিন আগে অফিস যাবার পথে বাড়িটা দেখে গেছে। তখন গুলোদা ছিল না। একটি কিশোর তাকে জানায়, ”বাবাকে বিকেলে পারেন।”

 গলি থেকে একটা শাখাগলি বিশাল প্রাচীন একটা বাড়ির গা ঘেঁষে ঢুকে ইংরেজি ‘ওয়াই’ অক্ষরের মতো হয়ে দুটি বাড়ির খিড়কি দেয়ালে শেষ হয়ে গেছে।

 পলেস্তরা খসা দেয়ালের নোনাধরা ইঁটগুলো, কবজা ভাঙা রংচটা জানলা দরজা, বৃষ্টি জলের ভাঙা পাইপ এবং কার্নিশের বটগাছ ইত্যাদি দেখতে দেখতে বাড়িটাকে তার মনে হয়েছিল চামড়া ওঠা দগদগে একটা প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর শরীর। এর সদরদিক অন্য কোনো রাস্তার উপর, এটা বাড়ির পিছনের অংশ। এক সময় হয়তো রান্নাঘর, চাকরদের থাকার ঘর, গোয়াল বা আস্তাবল বা ছোটো ডোবাও হয়তো ছিল। মাথাসমান পাঁচিলের ভেঙে যাওয়া ফাঁকটা দিয়ে দেখা যায় ছোটো একটা জায়গা যেখানে মুণ্ড ও হাতভাঙা পরীমূর্তি ও ইঁটপাথরের টুকরো মাটিতে পড়ে এবং শীর্ণ বৃদ্ধ একটা চাঁপা গাছ। গুলোদার দরজা পাঁচিলের শেষেই।

 অন্ধকারে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রত্না ফিসফিসিয়ে বলল, ”লোডশেডিংয়ে ভালোই হয়েছে, কেউ দেখতে পায়নি আমাদের।”

 ”পেলেই বা, ভয়টা কীসের, আমরা তো একজনের বাড়িতে যাচ্ছি…যেতে পারি না কি? হাতটা ঝুলিয়ে রাখা উচিত ছিল ব্যান্ডেজে।”

 ”বড্ড তাকায় লোকে, সেজন্য আজ খুলে রাখলুম।”

 দরজার মতো কড়া দুটোও বোধহয় গত শতাব্দীর। এক একটা অন্তত এককিলো ওজনে। একটা কড়া ধরে সে ভাবল কতজোরে নাড়া উচিত। বিনীত, উৎসুক অথচ খুবই পরিচিত এমন একটা আওয়াজ বার করা দরকার, আশপাশে কেউ যেন কৌতূহলী না হয়।

 প্রথমেই যে শব্দ হল তাতে বিনয়ের সঙ্গে চাপা একটা অপরাধীভাব তার কানে বাজল। খানিকটা ভয়-ভয় ধরনের ব্যাপারও যেন রয়েছে! একটু স্ফূর্তি চাপল্য থাকলে ভালো হয়, এই ভেবে সে এমন কয়েকটা আওয়াজ কড়া থেকে বার করল যাতে রত্না চাপা ধমক দিল, ”তুমি কি মিনিবাস চালাচ্ছ নাকি?”

 সে অন্ধকার রাস্তার দুধারে তাকাল। এত সরু একটা রিকশাও যেতে পারবে না। গর্ত আর ঢিবিতে ভরা। বাঁকের পরই দেয়ালে একচাপড়া ঝাপসা আলো সামনের বাড়ির হারিকেনের। কোথাও সাড়াশব্দ নেই, পাঁচিলের ধারে চাঁপা গাছটায় পাখিদের ঝাপটানি ছাড়া।

 নিঃশব্দে দরজার একটা পাল্লা খুলে গেল এবং প্রথমেই কেরোসিন বাতি হাতে গুলোদার জিজ্ঞাসু মুখটি বেরিয়ে এল। ওর পরনে সবুজ লুঙ্গি সাদা পাঞ্জাবি। রত্না সরে এল সন্দীপের পিছনে।

 ”অ, আপনি, আসুন আসুন।”

 গুলোদা হাসিমুখে আপ্যায়নের ঢঙে সরে দাঁড়াল পথ দেবার জন্য। তার মনে হল রত্নাকে দেখার জন্যই মাথাটা কাত করেছিল। বাতির কাচে ভূষি, সেটাকে তুলে ধরে দ্বিতীয়বার বলল, ”ভেতরে আসুন। ছেলে বলেছিল আজ আসবেন। ভেবেছিলুম একটা দেরি করেই হয়তো…” দরজাটায় খিল দিয়ে গুলোদা গলা নামিয়ে বলল, ”ইতিমধ্যে আর একটা পার্টি এসে গেছে, ফেরাতে পারলাম না…নানান ব্যাপারে উবগার করে…চটালে মুশকিল, বুঝতেই তো পারছেন করেকম্মে চালাতে হয়তো…ওদের বসিয়ে দিয়েছি, ততক্ষণ আপনারা ভেতরের ঘরে একটু ওয়েট করুন, অসুবিধের কিছু নেই, শুধু এই লোডশেডিংয়ে গরমটা একটু লাগবে, এইমাত্র আধঘণ্টাও হয়নি কারেন্ট গেল…ওদের বেশিক্ষণ অবশ্য থাকার কথা নয়।

 বাতিটা তুলে গুলোদা এগোল। বাড়ির বাইরের দেয়ালের মতই ভিতরের অবস্থা। স্যাঁতসেঁতে, ভ্যাপসা আর একটা গন্ধ যা দীর্ঘকাল বন্ধ প্যাঁটরা খুললেই পাওয়া যায়। সদর থেকেই বাঁ দিকে ঘুরে গেছে যে সরু দালান তার প্রথমেই একটা বন্ধ দরজা। গুলোদা দরজাটার দিকে সামান্য মুখ ফেরাতেই সন্দীপের মনে হল এটাই বোধহয় সেই ঘর।

 তারপর একধাপ নেমে টানা একটা রোয়াক। বাঁ দিকে উঠোন, কলঘর এবং নিচু পাঁচিল এবং বাইরে ছোটো দরজা। এটা দিয়ে রাস্তায় বেরোন যায় না। খোলা রয়েছে দরজাটা। রোয়াকের শেষ প্রান্তে খোলা জানলা। সেখানে রোয়াকটা চওড়া হয়ে গেছে। জানলা দিয়ে হাওয়া আসছে না কেননা দেয়ালে কুলুঙ্গিতে মোমবাতির শিখা নিষ্কম্প। জানলার ধারে দেয়াল ঘেঁষে একটা হাতলওলা বেঞ্চ যার ঠেস দেওয়ার কাঠের একটা বাতা ভাঙা।

 রোয়াক থেকে ডানদিকে একটা সরু ফালি, দড়িতে রঙিন নকশা কাটা পর্দা ঝুলছে। ওদিকে নিশ্চয় গুলোদার পরিবার থাকে। ট্রানজিস্টার থেকে ক্ষীণ স্বরে নাটকীয় কথোপকথন ভেসে আসছে।

 ”আপনারা এই বেঞ্চে বসুন আমি একটু চায়ের কথা বলে আসি, না না অসুবিধে কিছু হবে না…হঠাৎ এসে পড়েছে, না বলতে পারলুম না, এখুনি হয়ে যাবে..বাতিটা আমি নিয়ে যাচ্ছি, আজই হ্যারিকেনের চিমনিটা ভেঙেছে…ওহ উনি আমার বাবা।”

 একধারে ইজিচেয়ারে চোখ বুজিয়ে রয়েছে এক বৃদ্ধ। ধবধবে সাদা বাবরি চুল আর দাড়ি এবং গাত্রচর্ম ঘোর কালো। ময়লা ফতুয়া আর ধুতি। নাক টিকালো।

 ‘আপিম খেয়ে আছেন, এই সময়টায় রোজই…তাতে আপনাদের কোনো অসুবিধে হবে না, এখন ঘণ্টা দুই এভাবেই থাকবেন।”

 গুলোদা পর্দার আড়ালে অদৃশ্য হতেই এতক্ষণ চুপ করে থাকা রত্না নীচু স্বরে বলল, ”ঠিক রবীন্দ্রনাথ। যদি পাশ থেকে দ্যাখো। কেমন স্ট্যাচুর মতো হয়ে রয়েছে।”

 ”কালো রবীন্দ্রনাথ।”

 ”রবীন্দ্রনাথের কাঁধ আরও চওড়া। তবে চুলটুল ঠিক আছে, দাড়ির সাইজটাও। নাকটা বোধহয় একটু উঁচু হওয়া দরকার।”

 দুজনেই গুলোদার বাবাকে খুটিয়ে দেখল। সে বিশেষ করে লক্ষ করল না যদি দেখা যায়!

 ”খুব খাতির দেখাচ্ছে, ব্যাপার কী?”

 ”প্রণবেশের অনুগৃহীত তাই, খাতিরটা আমাদেরকে নয়।”

 ”বড্ড গরম..ওই বন্ধ ঘরটাই মনে হল।”

 ”আমারও তাই মনে হচ্ছে।”

 ”পাখা আছে তো?”

 ”লোডশেডিং।”

 ”দেয়াল একটা ছবি, দেখেছ?”

 তিন হাত লম্বা একটা অয়েল পেইন্টিং যেটা এই প্রায়ান্ধকারে দেয়ালের সঙ্গে প্রায় মিশে রয়েছে। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, ধুতি পরা কৃষ্ণবর্ণ এক পুরুষ, মেরুদণ্ড সিধে রেখে চেয়ারে বসে। পৈতে এবং চোখ দুটিই শুধু জ্বলজ্বলে সাদা। জানুতে একটি হাত এবং হাতে ধরা একটি বই। নাসিকা তীক্ষ্ন। গুলোদারই কোনো পূর্বপুরুষ সম্পত্তি ভাগাভাগিতে এই দেয়ালে এসে পড়েছে।

 সন্দীপ কী যেন একটা মিল খুঁজে পেল তার কাকার সঙ্গে। সম্ভবত চোখ দুটোয়। সেদিনের পর কাকার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। বাণী কদিন মুখ ভার করে তাকে ভাত দিয়ে গেছল, কথা বলেনি। মানুদের দরজায় তালা, ওরা কোথায় গেছে তা একমাত্র বাণীরই জানার কথা।

 ”ব্যাপার কী, ওরা কোথায়?”

 অবশেষে সেই প্রথম কথা বলে। বাণী যেন এই বরফগলার অপেক্ষায়ই ছিল।

 ”সেদিন এক বিধবা এসে কি যাচ্ছেতাই গালাগালিই না মাকে দিয়ে গেল। ওর মেয়েকে ঠাকুরপো বিয়ে করবে বলে…সেকি খারাপ খারাপ কথা। মা কেঁদে ফেলেছিল। যাবার সময় বলে গেল, আবার আসবে, রোজ এসে পাড়ার লোক জড়ো করে রাস্তা থেকে চেঁচাবে। কি কাণ্ড বলুন তো! আপনার ভাই-ই মাকে বলল এখান থেকে কিছুদিনের জন্য চলে যেতে।”

 ”আর এসেছিল?”

 ”না।”

 বারান্দা থেকে সে পানুকে কাগজ পড়তে দেখে, কিন্তু ওর সঙ্গে আর কথা হয়নি। বাণীর হাত দিয়ে সে ছবিটা পাঠিয়ে দিয়েছে, নিশ্চয় ছাপাবে। নিজের ভাইকে সে চেনে।

 রত্না সন্তর্পণে তার হাতের আঙুল চেপে ধরল। এটা ভালোবাসা প্রকাশের জন্য না তার সাহসিকতাকে তারিফ জানাতে, সে বুঝে উঠতে পারল না। টেলিফোনে ও অনুত্তেজিত গলায় বলেছিল, ”জায়গা পেয়েছ বুঝি, কোথায়?”

 গুলোদা দু হাতে দুটো কাপ নিয়ে কিঞ্চিৎ বিব্রত মুখে এল। হাতটা তুলতে গিয়ে রত্নার বোধহয় ব্যথা করল, অন্য হাত বাড়িয়ে কাপ নিল।

 ”দেখুন তো চিনি ঠিক হয়েছে কিনা। বউ আবার চিনি কম খায়।”

 চুমুক দিয়ে সে মাথা নেড়ে বোঝাল মিষ্টি ঠিকই হয়েছে। চায়ে ভাতের ফ্যানের স্বাদ।

 ”ওরা এখুনি…কটা বাজে, ওহ ঘড়িটড়ি খুলে এসেছেন, আমার এখানে ওসব ভয় নেই তবে যা দিনকাল সব পাড়াতেই তো ছিনতাই রাহাজানি…আমারও ঘড়ি নেই। দরকার কি, এত লোকের হাতে রয়েছে জিগ্যেস করে নিলেই হয়। আপনারা বসুন।”

 গুলোদা অদৃশ্য হতেই সে উঠে জানলায় গিয়ে চাটুকু বাইরে ফেলে দিল।

 ”আমারটাও।”

 রত্নার কাপটা ভরাই রয়েছে। জানলা থেকে সে বাইরের কিছুই প্রায় দেখতে পেল না। খানিকটা জমি, একটা চালাঘরের আভাস, বাইরের পাঁচিল, একটা বাড়ির দেয়াল ছাড়া অন্ধকারে কিছু বোঝার উপায় নেই। ঘরে মুখ ফিরিয়ে দেখল রত্না তাকিয়ে আছে কালো রবীন্দ্রনাথের দিকে। বৃদ্ধ একইভাবে হেলান দিয়ে। ওর এই চোখ বুজে অনড় হয়ে থাকাটা সারা জায়গা জুড়ে সরীসৃপের মতো পিছলে বেড়াচ্ছে। বৃদ্ধ চোখ খুলে এখন যদি কথা বলে ওঠে, ”তোমরা কে?”

 রত্নার দৃঢ় চওড়া কাঁধ এবং বাহুর সবলতা, চিবুক, পুরু ঠোঁট, কপালের ঘাম, চুল ইত্যাদি তাকে এবার উত্তেজিত করছে। এই জন্যই আসা, নাকি অন্য কিছু প্রমাণ করতে?

 ওর কাঁধে ঠোঁট চেপে ধরে সে মৃদু কাপড় দিতেই রত্না কাঁধ ঝাড়া দিয়ে বলল, ”কে দেখে ফেলবে।”

 ”ওর দেহে মৃদু সুগন্ধ। একই গন্ধ সাবুর থেকেও পেয়েছে। হঠাৎই মনে হল রত্নার বদলে সাবু এখন যদি থাকত!

 ”এভাবে বসে থাকতে হবে জানলে পরে আসতুম।”

 ”রেগুলারই তা হলে খদ্দের হয়। নেয় কত করে? জায়গাটা অবশ্য খুবই বাজে, কত নেয়? রেট এখানে বোধহয় ঘণ্টা পিছু?”

 ”কিচ্ছু জানি না। পরে জেনে নেওয়া যায়।”

 ”নিয়ো তো।”

 ”কেন, আসবে নাকি কাউকে নিয়ে।”

 রত্না মুখের কাছে মুখ এনে চাপাসুরে বলল, ”এই রকম একটা রোজগারের ব্যবস্থা তো করা যায়। হেসেখেলে মাসে পাঁচ-ছশো তো হবেই।”

 ”কী করে?”

 ”গড়ে রোজ দুটো কিংবা একটাও যদি পাই…তা পেয়ে যাব মনে হয়, দুজনে যদি চেষ্টা করি…তোমার প্রণবেশ তো হেল্প করতে পারে, এই লোকটাকে না দিয়ে খদ্দের যদি আমাদের কাছে পাঠায়…তুমি জেনে নাও না কী রেটে টাকা নেয়। ঘরের ব্যবস্থা আমি করব।”

 ”তুমি কি পাগল হলে! এখন তুমি এইসব ভাবছ?”

 ”কেন, ভাবলে ক্ষতি কী? তুমি বড় গেঁতো।”

 ”তুমি একটা জন্তু।”

 ”থাক থাক খুব হয়েছে। এসব করে কি সারা জীবন চলবে নাকি? আমার শরীর যদ্দিন আছে তদ্দিনই তো তোমার প্রেম।”

 ”ঝিয়ের মতো কথা বলছ। শরীর ছাড়া আর তোমার আছেটা কি?”

 ”তোমারই বা কি আছে? লম্বা লম্বা কথা তো খুব বলো, তোমার জন্য আমার বালাটা গেল।”

 ”আমার জন্য! …তুমি কি নাবালিকা, ফুসলে নিয়ে গিয়ে বসেছিলুম?”

 রত্না মুখ ঘুরিয়ে নিল। সে রাগে হাত মুঠো করে রয়েছে। চোখে একটা হালকা কুয়াশার মতো কিন্তু ঝাঁঝালো আস্তরণ পড়েছে। মোমবাতির শিখাটা এই প্রথম কেঁপে উঠল। বাতাস আসছে জানলা দিয়ে। সে জানলায় গিয়ে দাঁড়াল। অতি মূল্যবান এই বাতাসটুকু।

 দূরে ক্ষীণভাবে একটা সমবেত চিৎকার হচ্ছে। আগুন লাগলে বা চাপা দিয়ে পালানো গাড়িকে তাড়া করার সময় এমন একটা হল্লা শোনা যায়। তার মনে হল চিৎকারটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে, দ্রুত ছুটে আসছে।

 সে ঘরের ভিতরে তাকাল। রত্না তাকিয়ে তার দিকে, কৌতূহল এবং জিজ্ঞাসা ওর চোখে। কোলে রাখা চামড়ার ব্যাগটা দু হাতে চেপে ধরে রয়েছে।

 ”কীসের চেঁচামেচি?”

 ”বুঝতে পারছি না।”

 তখনই একটা ভারী কিছু উপর থেকে মাটিতে পড়ার শব্দ হল জানলার অদূরে পাঁচিলের কাছে।

 ”কী যেন একটা গোলমাল হয়েছে।”

 রত্না উঠে এসে জানলায় উঁকি দিল। ঠিক তখনই গলিতে একসঙ্গে চার-পাঁচটি গলায় উত্তেজিত কথা শোনা গেল। অনেক পায়ে ছোটাছুটি হচ্ছে। দরজা খোলার শব্দ।

 ”এইদিকে এইদিকে এসেছে…আমি পায়ের শব্দ শুনেছি..চর্ট মার। সত্যি শুনছি।”

 ”ধ্যেৎ শালার ব্যাটারিও এখন…বাড়িতে গিয়ে বল নবাব টর্চটা দিতে।”

 ”ওদিকে আর গিয়ে কী হবে, পালিয়েই গেছে, কজন ছিলরে?”

 ”তিনজন। দুটো পালিয়েছে হরি ভটচাজ লেনের দিকে। আর এক ব্যাটা এটায় ঢুকেছে, আমি শিওর এদিকেই এসেছে..কালো প্যান্ট। এগলিতে আর যাবে কোথায় এখানেই তো শেষ।”

 ”ছুরি মেরেছে যখন তখন ওটা সঙ্গেই আছে। বোমাও নিশ্চয় এক-আধটা রেখেছে। নিতে পেরেছে কিছু? টাকা না গয়না নিয়েছে?”

 ”মেয়েছেলের কাছে টাকা কোথায় মশাই গয়নাই তো থাকবে। কিছু নিয়েছে কিনা জানি না, আমি তো চিৎকার শুনেই চেস করেছি।”

 ”যাকগে, পুলিশে বুঝবে ওসব..বিনু, নন্টু বাড়ি আয়..পড়তে পড়তে উঠে আসা, এই এক জ্বালা…ছেড়ে দাও ভাই, খোঁজাখুজি করে কোনো লাভ নেই, অন্ধকারে গয়না পরে বেরোনর ফল ভোগ করুক…ছুরিটা কি হাতে মেরেছে?”

 ”আরে মশাই ছেড়ে দোব কেন, পাড়ায় এসে ছিনতাই করে বেরিয়ে যাবে আর আমরা কোনো অ্যাকশান নোব না?”

 ”আচ্ছা ভীতু তো মশাই, বাড়ি যান বাড়ি যান।…মলয় ক্লাব থেকে লাঠি নিয়ে আয় সব বাড়ি সার্চ করব, তুই আর অশোক এখানে দাঁড়াবি, জটা, নরু আর কানাইকে খবর দিবি, ওরা জগদ্ধাত্রী ভাণ্ডারের সামনে আড্ডা দিচ্ছে। শালাকে পেলে হয় একবার।”

 পাথরের চোখ নিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দুজন দাঁড়িয়ে। হতবুদ্ধিকর পরিস্থিতি আবার একটা এসেছে। ওরা সব বাড়ি সার্চ করবে, এ বাড়িতেও ঢুকবে। অবশ্য তাদের দেখে নিশ্চয় ভাববে না ছুরি নিয়ে কোনো কাজ তারা করতে পারে, তবুও।

 ”আবার কী অবস্থায় পড়া গেল।”

 ”তুমিই তো এখানে আমাকে আনলে।”

 ”হ্যাঁ এনেছি তাতে কী হয়েছে?”

 ”চেঁচিও না জন্তুর মতো।”

 ”সে একটা কুৎসিত শব্দ উচ্চচারণ করতে গিয়ে থেমে গেল। ”জন্তু’ শব্দটা তাকে ফিরিয়ে দেবার জন্য যেন ও উপেক্ষা করছিল। রত্নার মুখে প্রত্যয়ের ছাপ। কিছু একটা সাফল্য যেন পেয়েছে।

 ”এখানে ততক্ষণ বসুন, একদম বেরোবার চেষ্টা এখন করবেন না।”

 ওরা ফিরে তাকাল। বাতি হাতে গুলোদা, তার পিছনে একটি লোক। বেঁটে, অবিন্যস্ত ঝাঁকড়া চুল, অসম্ভব ফর্সা, গাল দুটি শিশুদের মতো ফোলা, আতঙ্কে ভরে আছে মোটা ফ্রেমের চশমার কাচ। বুশশার্টের বোতাম পরানোর সময় হয়নি অথবা ভুলে গেছে। ঘন কালো লোমে বুক ভরা ।

 লোকটির পিছনেই একটি মেয়ে। হাত এবং পা রুগণ, বুক সমতল। রঙিন ময়লা ফ্রকটা লোলচর্মের মতো ঝুলছে হাঁটু ছাড়িয়ে। দেহের চামড়া অপুষ্টিতে পাণ্ডুর, খসখসে। মাংসহীন চোয়াল, চোখে নিস্তেজ ঘোলাটে চাহনি। দোকানে উলটে রাখা পাঁঠার মাথায় এমন চোখ দেখা যায়। লম্বা সরু কাঠামোটা সামান্য ঝোঁকানো।

 ”আপনারা এদের সঙ্গে বসুন। জিজ্ঞেস করে যদি বলবেন বন্ধুর বাড়িতে এসেছি। আর আপনারা।” গুলোদা রত্না ও সন্দীপকে উদ্দেশ্য করে বলল, ”বলবেন স্বামী-স্ত্রী আর এটি আপনার শালী। ঘাবড়াবেন না, কোনো ভয় নেই। বাইরে এখন ভিড়ভাট্টা, নতুন লোক দেখলেই মুখের দিকে তাকাচ্ছে তাই, ব্যাপারটা বুঝতেই তো পারছেন, এখন আর বার করছি না আপনাদের। টের পেলে বদনাম হয়ে যাবে বাড়ির। আমি সদরে যাচ্ছি।”

 ”একটা সিগারেট হবে?”

 ”দিচ্ছি, জামার বোতাম দিন।”

 গুলোদা বেঁটে লোকটিকে সিগারেট দিয়ে মোমবাতিটা তুলে এনে ধরিয়ে দিতেই লোকটি জোরে জোরে টানতে থাকল।

 বেঞ্চে সন্দীপের পাশে ওরা দুজন বসেছে। কথা বলার মতো মনের অবস্থা কারুরই নেই। জানলা দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে আক্রোশ, দর্প, হুমকি এবং চলাফেরার শব্দ আসছে। মানুষ শিকারে ওরা বেরিয়েছে। ওদের সংখ্যাটা যেন বাড়ছে।

 সন্দীপ গুলোদার দিকে তাকিয়েছিল। নতুন একটা মোমবাতি কুলুঙ্গি থেকে বার করে ধরিয়ে বসিয়ে দিচ্ছে।

 ”ছেলেটা কোচিংয়ে পড়তে গেছে। নইলে এইসব হুজ্জতে জড়িয়ে পড়ত।”

 গুলোদাকে বাতি হাতে সদরের দিকে যেতে যেতে থমকে এবং একপা পিছু হটতে দেখে সন্দীপ সিধে হয়ে বসল। কিছু একটা হয়েছে নইলে চোয়ালটা অত ঝুলে যাবে কেন! রোমহর্ষক কোনো দৃশ্যে যেন ওর চোখ আটকে গেছে।

 বেড়ালের মতো লাফ দিয়ে উঠোন থেকে একজন রোয়াকে উঠল। কালো প্যান্ট, খয়েরি গেঞ্জি, ছিপছিপে গড়ন।

 ”একদম চুপ।”

 গুলোদার কাঁধ ধরে ঘুরিয়ে পিঠে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিল তাদের দিকে।

 ”একটা আওয়াজ বার করলে পুরো ঢুকিয়ে টেনে দোব।”

 সন্দীপ অল্প আলোতেই দেখতে পেল প্রায় একবিঘৎ ইস্পাত ফলা গুলোদার তলপেটে লাগানো।

 ”চলো ওখানে।”

 প্রথমে ও তাদের দেখতে পায়নি। সতর্ক চোখে চারধার দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখ পড়তেই বিমূঢ় হয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল। দ্রুত কী যেন একটা হিসেব কষে নিল তাদের চারজনকে লক্ষ করতে করতে। ঝাঁপিয়ে পড়ার বা বাধাদানের সম্ভাবনা কতটুকু হয়তো সেটাই মেপে নিল। শুধু সুদীপের দিকেই একটু বেশিক্ষণ তাকিয়েছে।

 ”জানলাটা খোলা কেন?”

 বন্ধ করার জন্য এগিয়েও থেমে পড়ল।

 ”এই খুকি তুমি গিয়ে বন্ধ করো, চালাকি করবে না…দেখতে পাচ্ছ হাতে…”

 মেয়েটি উঠে দাঁড়াতেই সন্দীপ অবাক হল ওর দৈর্ঘ্যে। এত লম্বা সে ঠাওর করতে পারেনি। জানলা বন্ধ করে ও বেঞ্চে বসল। ওর ফ্রক থেকে একটা গন্ধ আসছে যেটা বাণীর কাপড়ে পাওয়া যায়। বেঁটে লোকটির হাত থেকে সিগারেট পড়ে গেছে। ফ্যালফ্যাল করে সবার মুখে তাকাচ্ছে। রত্নার চোখে পলক পড়ছে না। কিছু একটা ভাবছে, রগের কাছটায় দপদপাচ্ছে।

 ”ওরা বাড়ি বাড়ি সার্চ করবে।”

 গুলোদা মরণাপন্নের শেষ উক্তির মতো বলল।

 ”ওরা দেখেছে কালো প্যান্ট পরা একজনকে।”

 সন্দীপ বলল শুধু একটা খবর জানাবার জন্য সাদামাটা করে।

 ”আমিও শুনেছি। নড়াচড়া, আওয়াজ টাওয়াজ একদম নয়, যে যেমন তেমনি বসে থাকুন…আমার একটা কাপড় চাই, ধুতি।”

 ”ঘর থেকে আনতে হবে।”

 ”ঘরেফরে যাওয়া চলবে না, কে আছে ঘরে?”

 ”বউ। এদিকে এই সময় আসে না।”

 ছোকরার বছর বাইশ-চব্বিশ বয়স। গালে আবছা কয়েকটা গর্ত, বসন্ত হয়েছিল ছোটোবেলায়। মানু যেভাবে সাজায় সেইরকম ঢঙে চুল। ময়দানে এইভাবেই ছোরাটা তার শরীরে ঠেকানো ছিল, গুলোদা ঠিক তার মতই এখন দাঁড়িয়ে। ছোকরার মধ্যে ব্যস্ততাটাই বেশি, ওকে প্রাণ বাঁচাতে হবে। এখন কি ও ছোরাটা পেটে ঢোকাবার ঝুঁকি নেবে যদি গুলোদা ঝাঁপিয়ে পড়ে? কিন্তু কেউ ঝাঁপাবেই বা কেন!

 তার মুখে পাতলা হাসি ফুটে উঠেছিল। ছোকরা তাই দেখে মুখ কঠিন করল। আর চোখে কালো রবীন্দ্রনাথের দিকে দু-তিনবার তাকাল। চোখ বন্ধ করে একইভাবে আফিংয়ের মৌতাতে বুঁদ হয়ে রয়েছে বৃদ্ধ।

 ”ওর ধুতিটা খুলে দিন।”

 ”তাহলে চেঁচাবে।”

 ”তাহলে আপনার লুঙ্গিটা খুলুন, চটপট, খুলুন খুলুন।”

 অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ছোকরা নিজের কোমর থেকে বেল্ট খুলে প্যান্টটা গোড়ালি পর্যন্ত নামল হ্যাঁচকাটানে। ছোরাটা হাতছাড়া করেনি।

 ”খুলুন, লজ্জার কি আছে, প্রাণের থেকে কি লজ্জা বড়?”

 ছোরাটা গুলোদার পেটের দিকে এগোল, কিন্তু হিংস্রভাবে নয়। ছোকরা রক্তপাত চায় না।

 ”মেয়েরা রয়েছে আর কিনা ওদের সামনেই…”

 ”জাঙ্গিয়া পরে আছি তো।”

 দুটো পা থেকে প্যান্টটা ছাড়িয়ে ছোকরা এক টানে গুলোদার লুঙ্গিটা খুলে দিল। ওর পাঞ্জাবির দৈর্ঘ তাদের অস্বস্তি থেকে রক্ষা করল। সন্দীপের মনে হচ্ছে সে একটা হাসির ফিল্ম দেখছে। চরিত্রগুলো ঊনবিংশ শতাব্দীর কোনো প্রহসন থেকে সংগ্রহ করা। যুক্তি এবং পারম্পর্যের খেই সে পাচ্ছে না।

 লুঙ্গিটা পরেই ছোকরা গেঞ্জিটা খুলে ফেলল। গুলোদাকে ইশারা করল পাঞ্জাবিটা খুলতে, তারপর মেঝে থেকে প্যান্ট তুলে পকেটে হাত ঢোকাল এবং একটা সোনার হার বার করল।

 ”প্যান্টটা পরে নিন গুলোদা।”

 সন্দীপ মৃদু স্বরে বলল। ছোকরা তখন রত্নার মুখের দিকে তাকিয়ে। আস্তে আস্তে চোখটা সরু হয়ে এল। দ্রুত চিন্তা করছে। সকলের চোখ ওর মুখে চিন্তার ধরনটা আন্দাজ করতে।

 ”আপনাদের কারুর কোনো ক্ষতি করব না। আমি এখান থেকে বেরিয়ে যাব ওরা আসার আগেই। একা বেরোব না, দিদি আমার সঙ্গে যাবে।”

 ”এই ছোরা, হার এসব সঙ্গে নিয়ে বেরোবে? তারপর রাস্তায় যদি ধরে আর এগুলো যদি সঙ্গে পায়..কী হবে জান?”

 সন্দীপ কথা শেষে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। সমস্যার গুরুত্ব বোঝানোই তার উদ্দেশ্য।

 পাঞ্জাবিটা পরতে পরতে ছোকরা বলল, ”সেজন্যই তো উনি যাবেন। হারটা ব্যাগে রাখুন, ছোরাটা আমার কাছে থাকবে। বড় রাস্তা পর্যন্ত শুধু উনি আমার সঙ্গে যাবেন। নিন ব্যাগে রাখুন এটা। কেউ চেঁচাবেন না, বাড়ির বাইরে যাবেন না, তাহলে কিন্তু শেষ করে দোব।”

 ”কী ভাবে?”

 বেঁটে লোকটি এইবার তার নীরবতা ভাঙল বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে।

 ”দেখবেন কী ভাবে করি।”

 পাঞ্জাবি তুলে ছোরাটা লুঙ্গিতে গুঁজল। ওর স্বরে অনিশ্চয়তা। ছোরাটা হাতছাড়া করতে চায় না কেননা ওটা বাদ দিলে ওর কোনো অস্তিত্বই থাকে না। কিন্তু সত্যিই যদি পথে ওদের ধরে? রত্নার কী হবে? সে উদ্বিগ্ন হয়ে তাকাল। কিন্তু রত্না অনুত্তেজিত ধীরভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ”চলো।”

 ”আমরা তাহলে কখন বেরোব?”

 বেঁটে লোকটি ফিসফিস করল মেয়েটির ঘাড়ের উপর দিয়ে ঝুঁকে। ভয় থেকে বেরিয়ে এসেছে এতক্ষণে।

 রত্নাই সদরের দিকে প্রথমে এগিয়ে গেল। ছোকরা ইতস্তত করে অনুসরণ করল।

 ”দরজাটা বন্ধ করে আসবেন না?”

 বেঁটে লোকটি বলল গুলোদাকে। খালি গায়ে কালো প্যান্টে ওকে বিমর্ষ দেখাচ্ছে। হয়তো জীবনে প্রথম প্যান্ট পরল।

 ”না খোলা থাক।”

 ”গুণ্ডাটা পালাতে পারবে তো? দেরি হলে খুব মুশকিলে পড়ে যাব। অনেক দূর যেতে হবে।”

 কেউ জবাব দিল না ওর কথায়। গেঞ্জিটা কুড়িয়ে গুলোদা ভিতরে চলে গেল। মেয়েটি একইভাবে বসে, কুঁজো হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে। ঘাড়ের কাছে শিরদাঁড়ার গাঁট ফুলে উঠেছে, আঙুলের নখের, মধ্যে ময়লা, চটিতে কাদামাখা।

 ”এবার তো আমরা বেরোতে পারি।”

 ”হ্যাঁ, যান আপনারা।”

 বেঁটে লোকটি উঠে দাঁড়ানো মাত্রই দূর থেকে প্রচণ্ড একটা হল্লা মতো ফেটে দেওয়াল ভেদ করে ঘরে ঢুকল।

 ”কী হল, য়্যাঁ কি হল…ধরা পড়ল নাকি?”

 আশপাশের বাড়ি থেকে লোক বেরোনর আওয়াজ ওরা শুনতে পাচ্ছে। সন্দীপ জানলাটা খুলে দাঁড়াল।

 ”পেয়েছে, ব্যাটাকে পেয়েছে।”

 ”মার মার, একেবারে মেরে ফেলে দে…কোনো মায়াদয়া নয়, ব্যাটা গুণ্ডা ডাকাত…”

 ”অ শিবু যাসনি রে…”

 ”কী হল কী? ধরেছে নাকি?”

 সন্দীপ জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে। ঠিক এইরকম একটা অবস্থা তার শরীরে হয়েছিল সেদিন কুকুরগুলোকে এড়িয়ে আসতে দেখে। বাইরের অন্ধকার চুঁইয়ে চুঁইয়ে তার ভিতরে ঢুকছে। ভ্যাপসা বাসি গন্ধ।

 ”আমি যাচ্ছি।”

 ”মুখ ফিরিয়ে সে দেখল বেঁটে লোকটি গুলোদাকে পাশ কাটিয়ে প্রায় দৌড়েই সদরের দিকে চলে গেল।

 মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েছে। দিশাহারার মতো তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রোয়াকে এসে দাঁড়াল। ওর নিষ্প্রাণ চোখে ভয় ফুটে উঠেছে।

 ”মনে হচ্ছে ধরেছে?”

 ”আমারও তাই মনে হচ্ছে।”

 ”সঙ্গের ওনার কী হল, সেটা তো…”

 ”দেখি। ভালোই করেছেন প্যান্টটা ছেড়ে এসে। কাল প্রণবেশের কাছে যেতে পারি। এখন আপনি বাড়িতেই থাকুন।”

 পা বাড়াবার আগে সে দেয়ালের ছবিটা এবং ইজিচেয়ারে বৃদ্ধের দিকে তাকাল। চোখের পাতা খোলা। নির্নিমেষে তার দিকেই চেয়ে রয়েছে। চাউনিতে শূন্যতা। মনে হল অনেকক্ষণ ধরেই তাকিয়ে। তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

 গলিটা সরু থেকে ক্রমশ চওড়া হচ্ছে আর লোকের সংখ্যাও বাড়ছে। ছাদে, জানলায়, বারান্দায় আবছা বোঝা যায় মাথাগুলো। উত্তেজিত কথা, জটলা কিছুই তার মনে কৌতূহল জাগাচ্ছে না। সব থেকে বড় কথা সে নিজে ব্যস্ত নয়।

 রত্না অবশেষে একজনের উপর শোধ নিতে পেরেছে। তার কোনো সন্দেহ নেই, কিছু একটা ও করেছে। শান্ত স্থির পায়ে যখন ও সদরের দিকে যাচ্ছিল তখনই তার মনে হয়েছিল, কিছু একটা ঘটবে।

 ”আরে সেই মহিলা চেঁচিয়ে উঠলেন বলেই তো ওরা ধরল।”

 ”ছুটছিল নাকি?”

 ”না না, ছুটবে কেন। ছোরা দেখিয়ে একটা ছিনতাই করে আবার গলির মধ্যেই আর একটা..কী সাহস ভাবুন তো, এই আধঘণ্টাও হয়নি, তার মধ্যেই দু-দুটো..হ্যাঁ হ্যাঁ এই ব্যাটাই…”

 ”আগের কেসটায় ছোরা মারেনি মশাই, যত বাজে গুজব…গলা থেকে হার ছিনিয়ে নিয়েছে।”

 ”পুলিশ তো তখন এসেছিল। আর এখন বাবুদের টিকিটির দেখা নেই।”

 সন্দীপ ভিড় ঠেলে, পাশ কাটিয়ে অন্ধকারে এগোতে এগোতে এক জায়গায় থমকে পড়তে বাধ্য হল। সামনেই রাস্তার কিছুটা ফাঁকা, তারপর আবার ভিড়, বাঁদর খেলার সময় যেমনটি হয়। দু-তিনজনের হাতে হ্যারিকেন।

 সবাই দেখছে এবং স্থানটুকু অতিক্রম করার সময় সে দেখল, বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে উবুড় হয়ে থাকা একটি দেহ। সাদা পাঞ্জাবির একটা ফালি শরীরে দড়ির মতো জড়ানো। সবুজ লুঙ্গি নর্দমার কাছে পড়ে। হাতটা মুচড়ে পেটের নীচে, মুখ ফেরানো, চোখে সেই শূন্যতা যা একটু আগেই সে দেখে এল। মাথা থেকে কপাল বেয়ে নাকের কোল দিয়ে রাস্তায় পড়েছে রক্ত। এখনও বোধহয় চুঁইয়ে পড়ছে। মুখটা কুঁকড়ে রয়েছে। যন্ত্রণা পাচ্ছিল।

 ”কোনো চান্সই পায়নি লড়ার, ছোরাটা বার করবে কি…একসঙ্গে চারজন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।”

 ”কারা পড়ল?”

 ”তা বলতে পারব না ভাই, যা অন্ধকার!”

 ”যার ছিনতাই করতে গেছল সে কোথায়?”

 ”কে জানে কোথায়…দরকার কি তার থাকার।”

 বড় রাস্তা। মোটরের হেডলাইট, বাসের ভিতরের আলো, তাকে অসার অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনল। কয়েকটা দোকানে আলো জ্বলছে বিদ্যুতের, কিছু বাড়িতেও।

 পাতাল রেলের জন্য রাস্তা ঘেরা লোহার জাল ঘেঁষে মেয়েটি একা দাঁড়িয়েছিল। তাকে দেখেই চোখ উজ্জ্বল হয়ে আবার স্তিমিত হল।

 দাঁড়িয়ে কেন, গেল কোথায় তোমার লোক?”

 ”জানি না।”

 ”থাকো কোথায়?”

 ”শেয়ালদা।”

 ”চিনে যেতে পারবে?”

 মাথা নাড়ল।

 ”কাছে পয়সা আছে?”

 ”না।”

 ”তোমাকে কিছু দেয়নি?”

 ”না, বলেছিল দশ টাকা দেবে।”

 সন্দীপ দু টাকার একটা নোট এগিয়ে ধরল। মেয়েটি দ্বিধাভরে লোকটির দিকে তাকিয়ে অবশেষে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

 ”লজ্জা করে লাভ নেই। এখানেই দাঁড়াও শেয়ালদার দোতলা বাস পাবে।”

 ওর হাত ধরে নোটটা তালুতে রেখে সে উলটো দিকে হাঁটতে শুরু করল।

 কতক্ষণ ধরে সে হেঁটেছে তা খেয়ালে রাখেনি, কোনদিকে হাঁটছে তারও হুঁশ ছিল না। এক সময় যে লোডশেডিং এলাকা পেরিয়ে গেছে এটুকু বোধ ছিল। এক সময় তার মনে হল জায়গাটা তার চেনা। দোকান, বাড়ি, গাছ, সাইনবোর্ড, গাড়িবারান্দার নীচের বাসিন্দাদের কখনো কোনো এক সময় যেন দেখেছে। সম্ভবত স্কুলে পড়ার সময় যখন নানান রাস্তায় সে একা ঘুরে বেড়াত।

 ”আচ্ছা, তাহলে ওই কথাই রইল…পরশু। এখন আমি যাচ্ছি, দেরি হয়ে গেছে।”

. সে পিছন ফিরে দেখতে পেল পানুকে। চীনা পাঞ্জাবি রেস্তরাঁ থেকে এইমাত্র ওরা বেরিয়েছে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে হাসি, বিভু আর যে লোকটি, সেই সম্ভবত সুহাস। ওকে আর বিধ্বস্ত, অসহায় দেখাচ্ছে না। খাড়া দেহ, দুটি বসা গাল এবং ঝকঝকে চোখ ওকে আগের থেকেও যেন প্রখর করেছে। পানু ছুটে রাস্তা পার হল বাস ধরার জন্য। অফিস যাবে।

 বিভুর কাঁধে রেখে সুহাস হাঁটছে। এককদম পিছনে হাসি। সুহাস হাত নেড়ে কিছু একটা বোঝাচ্ছে। বিভু মুখ তুলে শুনছে, দৃশ্যটি সন্দীপের বড় ভালো লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *