বাওবাব

বাওবাব – মতি নন্দী – উপন্যাস

এক

দিনটা নভেম্বর ১৭। কলকাতায় সেদিন সন্ধ্যা থেকে মুষলধারে বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া। গত সাত দিনে তিনটি সন্ধ্যা বৃষ্টির হাতে মার খেল।

শীত আসছে আসছে করেও ভাইফোঁটা পর্যন্ত মোটামুটি গরম ছিল। রাতে পাখা চালিয়ে ঘুমিয়েছে কলকাতার মানুষ। শুধু শেষরাতে একটা চাদর গায়ে টেনে দিত। সাত দিন আগে সকাল থেকে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করে। আন্দামানের তিনশো কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ায় ঝোড়ো বাতাস আর বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা আছে-এইরকম একটা খবর রেডিয়ো জানিয়ে দিতেই ঝানু লোকেরা গরম পোশাক বার করে তৈরি হয়ে যায়। নভেম্বরে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে শীত এবার একটু তাড়াতাড়িই এল।

দমকা উত্তুরে হাওয়ার এক-একটা ঝাপটার সঙ্গে এক ডিগ্রি করে শীতের দাঁত শরীরে বসে যাচ্ছে, তার উপর বৃষ্টির প্রলেপ। এসপ্ল্যানেডে কাঁপতে কাঁপতে মিনিবাসে ওঠার সময় উমা নিজেকে ধিককার দিল, কার্ডিগান বা অন্তত আলোয়ান নিয়ে তার বেরোনো উচিত ছিল এবং ছাতাটিও। যদি ছাতা খুবই হাস্যকর অবস্থা তৈরি করত এই হাওয়ার মধ্যে। এইমাত্র সে দেখেছে ছাতার শিক উলটে গিয়ে একটি মেয়েকে অপ্রতিভ হয়ে যেতে।

মিনিবাসের মধ্যে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। বাসে উঠে দরজার সামনের সিটটা খালি দেখেই, বিরল সৌভাগ্যে হৃষ্টচিত্তে উমা ঝপ করে বসে পড়ল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই খোলা দরজা দিয়ে আসা কনকনে হাওয়ায় কেঁপে উঠে সে বুঝল অন্য যাত্রীরা কেন এই সিটটা এড়িয়ে গেছে। কিন্তু প্রচুর চর্বিওলা এক পুরুষ যখন তার পাশে বসল যে স্বস্তি বোধ করল। তারপর সে ভাবল মানিকতলা মেইন রোডে কতটা জল জমবে, কাঁকুড়গাছির মোড়ের বা তার আগের স্টপে বাসটা দাঁড়ালে কতটা জল ভেঙে হাঁটতে হবে।

”এক মাসের আগে আর পিচ রেডি হচ্ছে না।”

”তারপরই লিগ শুরু বিনা প্র্যাকটিসেই!”

উমার পিছনেই দুই তরুণ। তারই অঞ্চলে কোথাও ওরা থাকে। গুণেন ভবনের সামনের মাঠটায়, পুজোর পর মাঝে মাঝে সকালে ব্যাট-বল নিয়ে ওরা নামে। গুণেন ভবনের দোতলায় তার পাশের ফ্ল্যাটের পুলকও সকালে খেলত এদের সঙ্গে। দু’বছর আগে পুলু শেষবারের মতো খেলেছে।

একদিন সকালে খেলার সময়ই গুটি পাঁচেক ছেলে হঠাৎ কোথা থেকে এসে মাঠের মধ্যেই পুলুকে ঘিরে ধরে। উমা শুনেছে, ক্ষুর দিয়ে পুলুর গলার নলিটা কেটে ওরা অপেক্ষা করে। দু’হাতে গলা চেপে পুলু বাড়ির দিকে ছুটে আসছিল। পথ আটকে মাঠের দিকে ওরা বারবার তাকে ঠেলে দেয়। পুলুর সহখেলোয়াড়রা, প্রায় জনা ছয়েক, যাদের মধ্যে এই ছেলে দুটিও, নিস্পন্দ হয়ে ব্যাপারটা দেখে যায়। ওরা পরে বলে, তাদের দেহে তখন নাকি সাড় ছিল না। শান্ত, নিখুঁত এবং এমন দ্রুত ব্যাপারটা ঘটে যায় যে মাঠের ধারের রাস্তা দিয়ে একটি লোক তখন যাচ্ছিল, তারা বা গুণেন ভবনের কোনো ফ্ল্যাটের কেউ জানতেও পারেনি। পুলু মাটি আর রক্তে মাখামাখি হয়ে যখন ঘাসের উপর মুখ রগড়াচ্ছে ছটফটাচ্ছে তখন অদ্ভুত এক ধরনের চিৎকার করতে করতে ছুটে এসেছিল হাবা। একটা বাঁশের খোঁটা ছিল হাবার হাতে। দু’হাতে সেটা মাথার উপর তুলে সে ছুটে আসতে গিয়ে পড়ে যায় হুমড়ি খেয়ে। আততায়ীরা গোটা দুই-তিন পটকা ফাটিয়ে চলে যায়। সেই ঘটনার দু’বছর পর হাবার লাশ মাঠে পড়ে থাকতে দেখা গেল, মাত্র পাঁচ দিন আগে ভোরবেলা।

গত পাঁচ দিন সুনীতও বাড়িতে নেই। উমা আজও দুপুরে সুনীতের অফিসে ফোন করেছে। চিন্ময় ঘোষ একই উত্তর দিয়েছে। গুণেন ভবনের ‘এ’ ব্লকের আটটি ফ্ল্যাটের কেউই এখনও জানে না তার স্বামী পাঁচ দিন নিরুদ্দেশ। ‘বি’ ব্লকের কারুর সঙ্গে তাদের আলাপ-পরিচয় নেই। সুবল দিনে অন্তত চার-পাঁচবার ব্যাপারটা তোলে, উদ্বেগ প্রকাশ করে, উমাকে তাগিদ দেয় আরও খোঁজখবর নেবার জন্য। বুনো মানুষটি গত পাঁচ বছরে একবারও নিজেকে রাঁধুনি বা চাকর ভাবতে পারেনি। সুনীত বাচ্চচাছেলে নয়, বয়স প্রায় আটত্রিশ, তাই কি, বোধহয় সাঁইত্রিশ।

উইন্ডস্ক্রিন ওয়াইপারটা অনর্থকই আঁচড়ে যাচ্ছে বৃষ্টিধারাকে কাচের উপর লেপে দিয়ে। তাইতে রাস্তার আলোকে আরও ঘোলাটে দেখাচ্ছে কাচের ওধারে। পাশে বসা বিরাটকায় যাত্রীটি উমার স্পর্শ বাঁচাতে যথাসম্ভব কুঁকড়ে বসেছে। ফলে দেহের অর্ধেকটাই সিটের বাইরে। চাকা গর্তে পড়ে বাসটা ঝাঁকিয়ে উঠলেই লোকটি সামনের সিট আঁকড়ে ধরছে টাল সামলাতে। উমা একবার ভাবল, ওকে সরে বসতে বলবে। শেষ পর্যন্ত আর বলা হয়নি। মানিকতলার মোড়ে লোকটি নেমে গেল।

স্টপ থেকে তিরিশ গজ এগিয়ে মিষ্টির দোকানের গাড়িবারান্দার সামনে সম্ভবত দয়াপরবশ হয়েই ড্রাইভার বাসটা থামাল। উমা ছুটে বারান্দার নীচে এল। হাওয়ার বেগ এখন একটু কম, বৃষ্টিও। স্তিমিত চোখে মিষ্টিওলা তার দিকে একবার তাকাল। জনাচারেক পথচারী, একটি কুকুর ও এক ঝালমুড়িওলা বারান্দার নীচে আশ্রয় নিয়েছে। রাস্তার ওপারে ইলেকট্রিকের ও মদের দোকানের সিঁড়িতে এবং দেয়াল ঘেঁষেও কিছু লোক দাঁড়িয়ে রাস্তার বাতিগুলোর বালব ঘিরে বাতাসে শ্যামাপোকার মতো ভনভন করছে বৃষ্টির জল। ব্রিজের উপর জানলা বন্ধ ট্রেন গড়গড় শব্দে একটা কালো আঁচড় টেনেই আবার তা মুছে গেল।

একটা স্টেট বাস এল। সেটা থেকে কয়েকজন নামল, দুজন ছুটে এল বারান্দার নীচে। কেউই কথা বলছে না। কনকনে হাওয়ার দিকে পিঠ ফিরিয়ে চোয়াল শক্ত মুখগুলোয় হতাশ ও বিরক্তি নিঃশব্দে ছড়িয়ে আছে। নীরব বিষণ্ণ একটি সন্ধ্যা কাঁকুড়গাছির মোড়ে।

উমা হাত বাড়াল। মনে হল কমেছে। আরও দু-তিনজন হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ধারাবেগ অনুমান করল। ইতস্তত করে একজন হাঁটা শুরু করতেই বাকিরা চঞ্চল হয়ে উঠল।

আঁচলটা মাথায় ছড়িয়ে, ব্যাগটা বগলে চেপে উমা রাস্তাটা পার হবার আগে দু’ধারে তাকাল। রাস্তায় দুই বাতিস্তম্ভের মাঝে ঘন ঝোপের মতো অন্ধকার। তার মধ্যে থেকে একটা রিকশা বেরিয়ে এসে আবার সেঁধিয়ে গেল আর এক অন্ধকারে। শাড়িটা বাঁ হাতে পায়ের গোছের উপর তুলে, ডান হাতে মাথার আঁচলটা চেপে ধরে কুঁজো হয়ে সে দ্রুত রাস্তা পার হল। চুলকাটার সেলুনের পাশ দিয়ে দক্ষিণে চলে গেছে গোলাপবাগান রোড। উমা সেটায় ঢুকল।

তাকে মিনিট চারেক হাঁটতে হবে। দু’পাশের বাড়িগুলোর চেহারা বলে দেয় অঞ্চলটি পুরনো। পুবে দেড়শো মিটার দূরেই নতুন পাতা সি আই সি রোড, দমদম এয়ারপোর্টে যাতায়াতের পথ। দু’ধারের সারিবদ্ধ নতুন বাড়িগুলো পাঁচিলের মতো খাড়া হয়ে দমচাপা, ঘিঞ্জি পুরনো অঞ্চলকে আড়াল করে রয়েছে।

গোলাপবাগান রোডের বাতিগুলোয় তেজ কম। একটি করে বালব একটি করে স্তম্ভে। কয়েকটি প্রায়শই জ্বলে না। রাস্তা অসমান এবং গর্তবহুল। উমা যথাসম্ভব সতর্ক হয়েই দুটি বাঁক অতিক্রম করল। এরপরই এলাকাটি তার প্রাচীনত্বের অবসান ঘটিয়েছে। বাড়ির সংখ্যা এখান থেকে কমে গেছে। তিরিশ বছর আগে গোলাপবাগান রোড এই পর্যন্ত এসে থেমে ছিল। তারপর ছিল জঙ্গল। শিয়াল ডাকত। ষোলোটি ফ্ল্যাট নিয়ে চারতলা গুণেন ভবন এবং আরও কিছু বাড়ি তৈরি হবার পরও দীর্ঘকাল এদিকটা ফাঁকাই ছিল। এখন যতটুকু বসত, গত দশ বছরে তা গড়ে উঠেছে।

গোলাপবাগান রোড থেকে ‘দ’-এর আকৃতিতে একটা কাঁচা রাস্তা বেরিয়ে শেষ হয়েছে গুণেন ভবনের কোলাপসিবল গেটে। তারপর পাঁচিল ঘেরা একখণ্ড জমি, যেটায় ছোট্ট একটা বাড়ি উঠেছে। রাস্তাটার বাঁ ধারে কাঁচা দেয়ালের খাটাল, তার পিছনে বিহারি গোয়ালাদের টালির চালের ঘর। ডান দিকে মাঠ যেখানে ছোটোরা ক্রিকেট, ফুটবল খেলে। মাঠেরই কিছুটা জমি নিয়ে গোলাপবাগান রোডের ধারে ছেঁচাবেড়া ও টিনের চালায় তৈরি তিনটি দোকান-কয়লার, মাংসের এবং চায়ের।

উমা ইতস্তত করল কাঁচা খাটালের রাস্তাটায় ঢোকার আগে। ভাঙা ইটে, কাদায় ও গর্তে ভরা এই রাস্তা বৃষ্টির জলে এখন বিশ্বাসঘাতকের মতো মসৃণ হয়ে আছে। এই খাটালের রাস্তা ছাড়িয়ে, তিনটি দোকান অতিক্রম করে গজ পঁচিশেক এগিয়ে মাঠে নেমে গুণেন ভবনের গেটে পৌঁছানো যায়। ব্যস্ততা না থাকলে সে মাঠের উপর দিয়েই যায় অবশ্য যদি রাস্তার বাতিটা নিভে না থাকে।

বাতিটা আজ জ্বলছে। দিন দুই আগেও বালবটা কাটা ছিল। একটা জিপ মাঠের ধারে গোলাপবাগান রোডের উপর দাঁড়িয়ে। দেখেই চেনা যায় এটা পুলিশের। এই অঞ্চলের ওয়াগন ব্রেকারদের কাজকর্মের জন্য প্রায়ই গাড়িগুলো আসা-যাওয়া করে। সোমবারও একটা পুলিশের ভ্যান এসেছিল হাবার খুনের তদন্তে।

বৃষ্টি এখনও একটানা ঝিরঝিরে। উমার দেহে শাড়িটা সপসপে লেপটে রয়েছে। দমকা হাওয়া কিছুটা শান্ত কিন্তু ঠান্ডায় অসাড় হয়ে যাচ্ছে তার পাঁজরের দু-পাশ। কুঁকড়ে থাকার জন্য পিঠের পেশিতে ব্যথা করছে।

উমা খাটালের রাস্তা ধরল। ‘দ’-এর বাঁকটা পার হয়ে, বাঁ দিকে খাটালের শেষ ও গুণেন ভবনের পঁচিলের মাঝে হাত পাঁচেক লম্বা ও হাত তিনেক চওড়া ক্যানেস্তারা চালার একটা নিচু মাটির ঘর। বউকে নিয়ে হাবা এটায় থাকত। ওর খুনের তদন্তেই কি আবার পুলিশ এসেছে? উমা তার ডান দিকে মাঠের ওপারে পুলিশ জিপটার দিকে তাকাল। ক্যানভাসের পর্দাটা জানলায় নামানো। ভিতরে কেউ আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। সে বাঁ দিকে হাবার ঘরের দিকে তাকাল। দরজা জানলার কোনো ব্যাপার নেই। একটা ছেঁড়া চট পর্দার মতো ঝুলছে। উমার মনে হল চটটা সরিয়ে কেউ যেন তাকে দেখল। নিশ্চয় হাবার বউটা। গুণেন ভবনের দুটি ঘরে ও বাসনমাজার কাজ করে।

কোলাপসিবল দরজার উপরেই একটা বালব আছে। এখন জ্বলছে না। দরজার পরেই একটা ছোটো চত্বর। তার দু-ধারে ‘এ’ ও ‘বি’ দুটি ব্লকের সিঁড়ি, লেটার বক্স ও ইলেকট্রিক মিটারগুলো সারি দিয়ে সিঁড়ির দু-ধারে। চত্বরের পরেই দারোয়ান চরিত্তর সিংয়ের ও জলের পাম্পের ঘর এক বিরাট এবং ঢাকা চৌবাচ্চচা। চল্লিশ ওয়াটের একটা বালব চত্বরটাকে যতটা সম্ভব আলোকিত রাখার চেষ্টা করছে। একটা লোক ‘এ’ ব্লকের সিঁড়ির গোড়ায় দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। বাঁ হাতে ওয়াটারপ্রুফ, ডান হাতের আঙুলে সিগারেট। উমাকে দেখেই সিধে হয়ে দাঁড়াল।

কারুর জন্য অপেক্ষা করছে। উমা একবার মাত্র তাকিয়ে লোকটির পাশ দিয়ে সিঁড়িতে উঠল এবং তার সহজাতবোধ থেকেই টের পেল লোকটি তাকে লক্ষ করছে এবং দৃষ্টি যে কোথায় তা-ও অনুভব করল। ভারী নিতম্বে চামড়ার মতো সেঁটে থাকা শাড়ির উপর আঁচল টানার জন্য হাতটা পিছনে আনতে আনতে সে একবার মুখ ফেরাল। লোকটি মুখ নিচু করে গামবুট দিয়ে সিগারেট চটকাচ্ছে।

কলিংবেলের বোতামে চাপ দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দিল সুবল। যেন দরজার পাশেই অপেক্ষা করছিল।

”নিচে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে কি?”

”হ্যাঁ।”

”পুলিশ। প্রথমে দত্তবাবুদের ঘরে এসেছিল, তারপর এখানে।”

”এখানে!”

উমার মনে হল সে শুনতে বোধহয় ভুল করছে। সুবলের কথা মাঝে মাঝে জড়িয়ে যায় বিশেষত যখন উত্তেজিত হয়। বয়স ওর প্রায় তিন কুড়ি।

”কেন?”

”দাদার খোঁজ করল। ক’দিন বাড়ি নেই, ইতিমধ্যে কেউ এসেছিল কি না, আমি কদ্দিন কাজ করছি, কারা কারা এখানে আসে…”

কলিংবেল বেজে উঠল।

”কাপড় ছাড়ো, সদ্দিজ্বর লেগে যাবে।”

দরজার খিলে হাত দিয়ে সুবল অপেক্ষা করছে যতক্ষণ না উমা শোবার ঘরে ঢুকে দরজা ভেজায়।

কলিংবেলে দু’বার সংকেত বেজে উঠল। জরুরি, অধৈর্য, কর্তৃত্বব্যঞ্জক। আলনা থেকে শুকনো শাড়ি টেনে নেবার সময় উমার কানে এল সুবলের বিনীত স্বর, ”বসুন, বউদি এখন কাপড় পালটাচ্ছেন।”

দালানে খাবার টেবিলের চেয়ার সরানোর শব্দ হল। বাইরের লোক এলে সাধারণত এখানে বসে। শুকনো ব্লাউজের পিঠের হুক লাগাতে লাগাতে দু’হাত পিছনমোড়া অবস্থাতেই উমা মেঝেয় পড়ে থাকা ভিজে কাপড় পা দিয়ে সরিয়ে দেয়াল ঘেঁষে রাখল। মাঝের হুকটা কিছুতেই গর্তে লাগানো যাচ্ছে না। চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে উমা ঘর থেকে বেরোল।

বৃষ্টির জন্য ফ্ল্যাটের সব জানলাই বন্ধ। গুমোট এবং ভ্যাপসা গন্ধ। লোকটি তাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছে।

”বসুন।”

যথাসাধ্য মিষ্টি করে উমা হাসার চেষ্টা করল। ”বৃষ্টি বোধহয় ধরে গেছে, জানলাগুলো খুলে দি।”

অনুমতি দেবার ভঙ্গিতে লোকটি মাথা হেলাল। উমা অস্বস্তি বোধ করল। পুলিশ, ইনকাম ট্যাক্স, হাসপাতাল, কোর্ট ইত্যাদি সম্পর্কে সুনীতের মতো তারও অস্বস্তি মেশানো ভয় আছে। তবে এই লোকটা জাঁদরেল ধরনের নয়। বয়স বোধহয় সুনীতেরই কাছাকাছি। গাল দুটো ভারী হতে শুরু করেছে, থুতনি ও ঘাড়ে ভাঁজ পড়েছে। আঙুলে দুটি আংটির মধ্যে একটি পলার। নিস্পৃহ চাহনির আড়ালে গেরস্ত সহৃদয়তা উঁকি দিচ্ছে। কালো প্যান্টে যেখানে সাদা শার্টটা গোঁজা সেখানে ফেঁপে উঠছে চর্বির সামান্য উচ্ছ্বাস।

জানলা খুলতে খুলতে উমা আবার টের পেল লোকটির চাহনি এখন তার দিকেই। মাঝের হুকটি লাগানো নেই, পিঠ অনেকটা খোলা। লোকটির চোখের পরই আঁচল টেনে ঢেকে দেবার ভরসা সে পেল না। সেকশান ইনচার্জ বিনয় মৈত্র কথা বলতে বলতে যখন বুকের দিকে বারবার তাকায় তখন ওকে দেখিয়ে আপনা থেকেই হাতটা উঠে এসে বিন্যস্ত কাপড়টাকে অনাবশ্যকই বুকের উপর টেনে দেয় এবং মধ্যবয়সি লোকটির মুখ মুহূর্তের জন্য পাংশু হয় আর হালকা একটা বেদনা মুখের উপর দিয়ে ভেসে যায়। তারপর বিনয় মৈত্র সারাদিনের জন্য খিটখিটে হয়ে যায়, নানা ছুতোয় কাজের ভুল ধরে। উমার মনে হল, এই লোকটিকে অর্থাৎ পুলিশকে ব্যাজার না করাই ভালো।

”প্রায় থেমে গেছে।”

লোকটি অনুমোদনসূচক মাথা নাড়ল। ঠান্ডা ভিজে হাওয়ার ঝাপট মুখের উপর দিয়ে বয়ে যেতেই উমা জানলা থেকে সরে এসে একটা চেয়ারের পিঠ ধরে দাঁড়াল। নীরবে কয়েক সেকেন্ড তারা পরস্পরকে লক্ষ করল। রান্নাঘরে চামচ নাড়ার শব্দ হচ্ছে। দু’কাপ চা দিয়ে যাবার মতো বুদ্ধি সুবলের নিশ্চয়ই আছে। উমা মাথা ঝাঁকিয়ে চুলের ডগার জল ঝাড়ল। জবজবে ভিজে রয়েছে শায়াটা।

”লালবাজার থেকে আসছি, ইনস্পেকটার বসাক।”

মুখস্থ বলার মতো। বহুবার নিজের পরিচয় জ্ঞাপনের অভ্যাস থেকে ভঙ্গিটা তৈরি হয়েছে। উমা নার্ভাস বোধ করল।

”সুনীত মুখার্জি আপনার স্বামী, কতদিন বাড়িতে নেই?”

”আপনার স্বামী” বলার পর উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই প্রশ্ন। দত্তদের ফ্ল্যাটে নাকি একটু আগে গেছল। উমা সতর্ক হল।

”পাঁচ দিন, গত রবিবার থেকে।”

”কোথায় গেছেন?”

”জানিনা, কিছু বলে যাননি।”

ভ্রূ কুঁচকে উঠল। উমা এতক্ষণে লক্ষ করল ইনস্পেকটারের দুই ভ্রূর মাঝে একটা কাটা দাগ আছে।

”খোঁজ করেছেন?”

”কেন, কিছু হয়েছে কি ওর?”

উমা ঝুঁকে পড়ল টেবিলে। ইনস্পেকটার ওর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ধীরে মাথা নাড়ল।

”জানি না। স্বামী পাঁচ দিন বাড়ি আসেনি, স্ত্রীর তো উচিত খোঁজ নেওয়া।”

”সোমবার দুপুরে ওর কলিগ চিন্ময় ঘোষকে ফোন করেছিলাম।” উমা দেখল ইনস্পেকটারের হাতে বলপয়েন্ট কলম ও নোটবুক। তিনি বললেন, ”পুলিশে আর হাসপাতালের খোঁজ নেবেন।”

”কোথা থেকে ফোন করেছিলেন?”

”আমার অফিস, ওরিয়েন্টাল ফার্মাসিউটিক্যাল থেকে। রাত্রেই উনি এসে জানিয়ে যান কোথাও খবর মেলেনি। আর কী করতে পারি এ ছাড়া। বাচ্চচাছেলে তো নয় যে হারিয়ে যাবে বা চুরি যাবে?”

”কী বলে বেরিয়েছিলেন, রোববার তো ছুটির দিন, কোথায় যেতে পারেন বলে মনে হয়?”

”কিছুই বলেননি? শুধু, ফিরতে রাত হবে আর খাব না, এইটুকুই বলেছিলেন।”

”কী পরে বেরিয়েছিলেন?”

”কালোর উপর ছাই রঙের স্ট্রাইপ দেওয়া প্যান্ট, ফিকে নীল বুশশার্ট আর পাম্প শু।”

ইনস্পেকটার লেখায় ব্যস্ত। সুবল দু’কাপ চা এনে টেবিলে রাখল। একটি সসারে চারখানি বিস্কুটও। ইতস্তত করে ইনস্পেকটার চায়ের কাপ তুলে নিয়ে, ”বেশ ঠান্ডা পড়েছে” বলতে বলতে চুমুক দিল। চাপা আরাম ছড়িয়ে পড়ল মুখে। আশ্বস্ত হয়ে উমাও কাপ তুলল।

”উনি কি কোনো রাজনৈতিক দলে আছেন, মানে কোনো রাজনৈতিক মতবাদে…”

উমা একটু জোরেই মাথা নাড়ল।

”কোনোদিন নয়। রাজনীতি ওর কাছে ভীষণ বিরক্তকর ব্যাপার। ইলেকশনের সময় সামনের মাঠে মিটিং হবে শুনলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন। প্রায়ই বলতেন এত অশিক্ষিত এত দরিদ্র দেশে পার্লামেন্টারি ডিমোক্রেসি একটা ঢলঢলে জামার মতো আমাদের গায়ে ঝুলছে। আমাদের প্রয়োজন অনুসারে আমাদের পলিটিক্যাল সিস্টেমটা মাপজোক করে বানানো হয়নি।”

”তার মানে উনি কি এখনকার এই সিস্টেমটা বদলাবার পক্ষপাতী?”

”আমি ঠিক বলতে পারব না। হয়তো বদলাবার পক্ষেই।”

”কীভাবে, ভায়োলেন্স দিয়ে? খুন করে… শ্রেণি শত্রুদের উৎখাত করে?”

উমা সচেতন হয়ে উঠল প্রশ্নের ধরনে। এসব কথা কেন? তার সঙ্গে রাজনীতির আলোচনা করতে কি এই কনকনে ঠান্ডায় লালবাজার ইনস্পেকটার পাঠিয়েছে।

”পাশের ফ্ল্যাটের পুলক দত্ত ছেলেটিকে কারা খুন করে যায় শুনেছেন কি কিছু সে সম্পর্কে?”

”না।”

”ওর সঙ্গে আলাপ ছিল আপনাদের?”

”সামান্যই।”

”আপনার স্বামী ওর সঙ্গে কি রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেন?”

”কখনও শুনিনি বা দেখিনি, তা ছাড়া ছেলেটা নেহাতই বাচ্চচা।”

”আপনার বয়স কত?”

”তেত্রিশ।”

”আপনার স্বামীর?”

”সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ।”

”ক’বছর বিয়ে হয়েছে?”

”নয়।”

”লাভ ম্যারেজ?”

”হ্যাঁ।”

”সন্তান?”

”নেই।” একটু থেমে, ”আমরা চাই না।”

ভ্রূ কোঁচকাল। উত্তরটা যেন মনঃপূত হয়নি।

”আপনাদের পড়াশুনো?”

”আমি এম এ ফিলজফিতে, ও ইকনমিক্সে পড়তে পড়তে ছেড়ে দেয় ফিফথ ইয়ারেই, হাই সেকেন্ড ক্লাস ছিল অনার্সে।”

”কেন ছাড়েন?”

”অর্থনৈতিক কারণে। স্কুলে চাকরি নিয়ে চলে যান জয়নগরের দিকে একটা গ্রামে। মাস চার-পাঁচ পড়িয়েছিলেন?”

”তারপর।”

”এখন যে অফিসে। জনসন ফোকস অ্যান্ড হাজরা লিমিটেড, ইলেকট্রনিক্স আর ইলেকট্রিক্যাল জিনিসপত্র তৈরির কোম্পানি। পাবলিক রিলেশনসে আছেন।”

”চৌরঙ্গির হেড অফিসে?”

উমা মাথাটা কাত করল।

”আপনাদের আলাপ, বিয়ের কতদিন আগে?”

”চার বছর আগে, টাইপ স্কুলে।”

ইনস্পেকটার নোটবই থেকে চোখ তুলে আর কী প্রশ্ন করবে ভাবার জন্য দালানে রাখা ফ্রিজটার দিকে তাকিয়ে রইল।

”আপনারা দুজনে রোজগার করেন, সচ্ছলই।”

উমা শুকনো হাসল।

”কিন্তু আপনি কেন এসেছেন বুঝতে পারিছ না।”

”মার্ডারটা সম্পর্কে খোঁজখবর করতে।”

”ওই হাবাটার খুনের…।”

উমা বিস্ময়ে কথা শেষ করতে পারল না।

”পুলককে যারা মার্ডার করে তাদের বাধা দিতে গেছল এই হাবা একটা বাঁশ নিয়ে।”

”কিন্তু সে তো দু’বছর আগে! এতদিন পরে রিভেঞ্জ নেওয়া? কী লাভ তাতে, লোকটা রুগণ দুর্বল নিরীহ, ভীষণ গরিব।”

ইনস্পেকটারকে স্পষ্টতই বিব্রত দেখাল।

”হয়তো ওর পলিটিক্যাল কানেকশনস ছিল। সবই অনুমান। হয়তো আপনার স্বামীরও পলিটিক্যাল কানেকশনস আছে। আপনি তা জানেন না বা জেনেও চেপে যাচ্ছেন। দুটো ঘটনাই একই সময়ের-হাবার খুন আর সুনীত মুখার্জির নিরুদ্দেশ।”

”তার মানে! ও খুন করেছে হাবাকে। কেন, কী উদ্দেশ্যে? ভিখিরি বললেই হয়, ওকে খুন করে লাভ?”

”খুনটা আপনার স্বামীরই কাজ এমন কথা বলিনি। শুধু বলেছি কোয়েন্সিডেন্সটা অদ্ভুত-খুন আর নিরুদ্দেশের। আচ্ছা, ওর প্রাইভেট লাইফ সম্পর্কে কিছু জানেন?”

”কার, হাবার?”

”আপনার স্বামীর।”

”ওর প্রাইভেট লাইফ, তা তো আমার সঙ্গেই…”

”না না, বাইরের জীবন সম্পর্কে…”

ইনস্পেকটার অপ্রতিভ হয়ে একটা বিস্কুট তুলে নিল।

”কিছুই জানি না। খুবই কম কথা বলেন ঘরে কিংবা বাইরে। এক সময় কবিতা লিখতেন, আট-ন’বছর আগে একদমই ছেড়ে দেন। একটা বই নিজের টাকায় বার করেছিলেন তার একটা কপিও নিজের জন্য রাখেননি।”

”কেন লেখা ছাড়লেন?”

”বহুদিন আগে কথাপ্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন, ছন্দটন্দ মেলাতে পারলেই তো আর কবি হওয়া যায় না। যা নই তার পিছনে সময় নষ্ট করে লাভ?”

”অনেস্ট ম্যান। বন্ধু-বান্ধব কারা?”

”বোধহয় কেউ নেই, অন্তত আমি দেখিনি। শুধু ওর অফিসের চিন্ময় ঘোষ মাঝে মাঝে আসে।”

”আত্মীয়স্বজন?”

”আছে কিন্তু কারুর সঙ্গেই সম্পর্ক নেই। বাবা থাকেন কৃষ্ণনগরে, হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, নাম অদিতিকুমার মুখার্জি, বয়স এখন প্রায় সত্তর। ‘বিজয়ায় একটা পোস্টকার্ড’ পাঠানো ছাড়া ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই চলে।”

”আপনার শ্বশুরের ঠিকানা?”

”বলতে পারব না, শুনেছি গোয়াড়ি না কোথায় যেন থাকেন।”

ইনস্পেকটার লিখে নিল।

”আর এক কাপ চা?”

রান্নাঘরের দরজায় উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুবলের দিকে তাকিয়ে উমা মাথা নাড়ল। সুবল ব্যস্ত হল চায়ের জল বসাতে।

”শোবার ঘরটা একবার দেখব।”

ঘরটা যথেষ্ট প্রশস্ত। ডবল বেড খাট, ড্রেসিং টেবিল, স্টিল আলমারি, বইয়ের র‌্যাক, ছোটো একটা টেবিল, আলনা প্রভৃতি সত্ত্বেও চলাফেরার কিছুটা জায়গা আছে। খুঁটিয়ে ঘরের প্রতিটি বস্তু দেখতে দেখতে ইনস্পেকটার র‌্যাক থেকে বই তুলে নিল। সেই সময় উমা মেঝে থেকে ভিজে কাপড় তুলে নিয়ে ঘরের বাইরে এসে দালানে খাটানো দড়িতে মেলে দিতে দিতে ঘরের ভিতরে তাকাল।

ইনস্পেকটারের হাতের বইটা মাঝামাঝি জায়গায় খোলা। মুখে পাতলা হাসি। সুনীতও অনেকটা এইভাবেই বই পড়তে পড়তে হাসে।

উমা ঘরে ঢুকতেই বইটা বন্ধ করে র‌্যাকে রেখে দিল।

”পথের পাঁচালি যতবারই পড়বেন… এই জানলাটা দিয়ে…।”

ইনস্পেকটার নিজেই জানলাটা খুলল। কপালটা গরাদে চেপে মাথাটা কাত করে কত দূর পর্যন্ত দেখা যায় সেটা পরিমাপ করতে লাগল। উমার মনে পড়ল ঠিক এইভাবেই সুনীতকে সে বহুদিন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে জায়গাটায়। পুরুষরা বহু ব্যাপারে একই ভঙ্গি নেয়।

”এখান থেকে দেখছি সারা মাঠটাই দেখা যায়…আপনার স্বামী কি মদ খান?”

”না তো।”

”কখনও খাননি? ঘরে বসে একটু আধটু বা বাইরে থেকে খেয়ে কখনও আসেননি।”

”না।”

ইনস্পেকটার র‌্যাক থেকে দু’খানা মোটা বই বার করে ফাঁকা জায়গাটার দিকে আঙুল তুলল। ফ্যাকাশে হয়ে গেল উমার মুখ।

ইনস্পেকটার সন্তর্পণে বোতলটা বার করল।

”হোয়াইট হর্স, প্রায় অর্ধেক খালি।” ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে, বোতলটা যথাস্থানে রেখে সন্তর্পণে ফাঁকা জায়গাটা ভরাট করে দিল বই দুটি দিয়ে।

”আপনি খান?”

”না।”

”আপনাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কের কি কোনো রকমের হেরফের ঘটেছে, মানে প্রাইভেট লাইফ এখনও কি আগের মতোই আছে?”

উমা ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। এই লোকটি নিঃশব্দে তাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করে দিয়েছে। বুকের ভিতর হঠাৎ শূন্য বোধ করায় বা মাথার মধ্যে অসাড় হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সে এমন করে কখনও পায়নি। তার যাবতীয় ব্যক্তিত্ব এখন চুরমার। সুনীতের চরিত্র সম্পর্কে ভালো একটা ধারণা লোকটাকে দেওয়া ছাড়া তার আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। ধীরে ধীরে সে খাটের উপর বসল।

”বোতলটা যে ওখানে আছে, বিশ্বাস করুন আমি তা জানতাম না। হ্যাঁ প্রায়ই খান, বাড়িতেও বাইরেও!”

ইনস্পেকটারের চোখ দুটো ঠান্ডা স্থির। গলার স্বরও বদলে গেছে।

”কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সক্রিয় সম্পর্ক আছে কি না, কোনো মতবাদ সমর্থন করেন কি না, এবার কি সত্যি কথাটা বলবেন?”

উমা মাথা নাড়ল।

”নেই। যতদূর জানি নেই। এত বছর তো দেখছি, ও সত্যিই ঘেন্না করে, ডান-বাম অহিংসা-হিংসা সব রাজনীতিকেই। জীবন থেকে ও সরে গেছে গত পাঁচ-ছ’বছর, নিছক যান্ত্রিক ওর প্রাইভেট লাইফ, আমাদের দুজনের সম্পর্কও।”

দুজনে কয়েক সেকেন্ড চোখে চোখ রাখল। বিভ্রান্ত ও কঠিন দু’জোড়া চাহনির মাঝখান দিয়ে ঠান্ডা একঝলক বাতাস বয়ে গেল।

”ছবিটা আপনার স্বামীর?”

ড্রেসিং টেবিলে স্টিল ফ্রেমে বাঁধানো মুখোমুখি দুটি ছবি। সুনীত ও উমার।

”হ্যান্ডসাম… কত বছর আগে তোলা?”

উমার ছবিটি এবং তার এখনকার চেহারার সঙ্গে মিলিয়ে দেখে যে-কেউই প্রশ্নটা করতে পারে।

”বিয়ের পরেই তোলা, প্রায় ন’বছর আগে।”

”চশমার পাওয়ার কত, প্লাস না মাইনাস?”

”দু’বছর আগে আরশুলা রঙের মোটা ফ্রেম করায়, কাচও বদলায়, নতুন পাওয়ার কত জানি না, আগে ছিল মাইনাস ফোর পয়েন্ট টু ফাইভ।”

ফ্রেম থেকে সুনীতের ছবিটা খুলে নিল ইনস্পেকটার।

”এটা আমি নিচ্ছি।”

হঠাৎ উমা ফিসফিসিয়ে বলল, ”অসম্ভব, অবাস্তব… সুনীত খুন করেছে ওই হাবাকে তাও কিনা পলিটিক্যাল মোটিভে, হাস্যকর।”

ইনস্পেকটারের ভ্রূ জোড়া কুঁচকে উঠেই ছড়িয়ে পড়ল পাতলা হাসিতে। সুবল চা নিয়ে এসেছে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আপন মনে বলল, ”শীতটা তাড়াতাড়িই এল তাহলে।” দাঁড়িয়ে থাকা সুবলের দিকে ভ্রূকুটি করল। পায়ে পায়ে সুবল ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

”নানান দিক থেকে সন্দেহ আমরা করবই। পলিটিক্যাল মার্ডার যে এটা নয় তা আমরা বুঝি। তাহলে কীজন্য লোকটা খুন হল? ওর সম্পত্তি বা টাকাকড়ি নেই, টি-বিতে ভুগছিল, থাকার মধ্যে একটা বউ…।”

”সুনীতকে কেন সন্দেহ?”

”মাঠের চা-ওয়ালাটা দোকানেই রাতে ঘুমোয়। রোববার রাতে ওর ঘুম ভেঙে যায় শব্দ শুনে। কেউ যেন হাঁসফাঁস করছে, ঝটাপটি হচ্ছে বলে ওর মনে হয়, এরপর শক্ত জায়গায় লাঠি ঠোকার মতো দু-তিনটে শব্দ আর চাপা চিৎকার। ছ্যাঁচা বেড়ার দেয়ালের ফাঁক দিয়ে চা-ওয়ালাটা তখন দেখে একটা লোক মাঠের মধ্যে, নিচু হয়ে কী একটা কুড়োল তারপর মাঠ থেকে ছুটে এসে ওর দোকানের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। বৃষ্টি পড়ছিল, রাস্তার আলোটা টিমটিমে আরও দূরেও তাই চিনতে পারল না। তখন ও ”কে কে” বলে চেঁচিয়ে ওঠে। লোকটা চ্যাঁচানি শুনেই এধার ওধার তাকিয়ে গোলাপবাগান রোড ধরে দক্ষিণ দিকে ছুটতে শুরু করে। ওদিকটা অন্ধকার, বাড়িও কম। চোখে চশমা ছিল কি না, চা-ওয়ালা তা বলতে পারেনি তবে ডেডবডির কাছে চশমার একটা লেন্সের টুকরো পাওয়া গেছে, পাওয়ার টেস্ট করতে পাঠানো হয়েছে।”

একচুমুকে চাটুকু শেষ করে ইনস্পেকটার আর একবার ঘরের আসবাবে চোখ বোলায়। হাতের নোটবইটায় চোখ বোলাল।

”আপনার স্বামী কত টাকা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিলেন?”

”বলতে পারব না, তবে সাধারণত পঞ্চাশ-ষাট টাকা সঙ্গে রাখে।”

”ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে?”

”এই মোড়েই স্টেট ব্যাঙ্কে, আমাদের জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট।”

”ওটা কীসের দরজা?”

”একটা ছোটো ঘরের মতো, মালপত্র রাখার জায়গা।”

”একবার দেখব।”

ইনস্পেকটার আলনাটা টেনে সরিয়ে ছিটকিনি নামাল। পাল্লা দুটো ধাক্কা দিয়ে খুলতে হল। ঘরের যতটুকু আলো পড়েছে তাতে দেখা গেল ভাঙা বেতের চেয়ার, পুরনো ট্রাঙ্ক, পাকিয়ে দড়ি বেঁধে রাখা লেপ, নারকেল দড়ির বান্ডিল, ছেঁড়া শতরঞ্চি, খালি বোতল। দেশলাই জ্বেলে জায়গাটা দেখে ইনস্পেকটার নিজেই দরজাটা বন্ধ করল।

”এদিকটায় নতুন করে আবার অ্যাকটিভিটিজ শুরু হয়েছে।”

ইনস্পেকটার চলে যাবার পর সুবল তোয়ালেটা উমার হাতে দিয়ে বলল, ”মাথাটা মুছে নাও।”

উমার মনে হচ্ছে সচরাচর যেভাবে কাজ করে থাকে মস্তিষ্কটা সেইরকমভাবে আর কাজ করছে না। গত পঁয়তাল্লিশ মিনিটে এমন একটা পরিবেশ তার চারধারে গজিয়ে উঠেছে যেখানে যুক্তির পারম্পর্য নেই, কথাবার্তাগুলোও আগের মতো অর্থ বহন করছে না বা জিনিসপত্রের চেহারাও যেন বদলে গেছে। সে দুঃখিত বা অভিভূত নয়, ক্রুদ্ধও নয়। বরং নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলার মতো অনুভূতিটাই বেশি। এখন সে নিজের গায়ে চিমটি কেটে নিশ্চিত হবার জন্য দেখতে পারে সত্যিই সে উমা মুখার্জি কি না।

বৃষ্টি হঠাৎ আবার জোরে নামল। সুবল ব্যস্ত হয়ে ঘরে এসে জানলা বন্ধ করতে করতে তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে থাকা উমাকে বলল, ”তোমাদের ছেলেপুলে থাকলে ভালো হত।”

অন্যমনস্কের মতো মাথা নেড়ে কথাটার অর্থ বোঝার জন্য উমা ধীরে ধীরে আবার খাটের উপর বসল।

দুই

সুনীত স্বপ্ন দেখছিল-এবং সে তা জানে-কিন্তু জানে না কীসের স্বপ্ন।

এমনভাবে মনের উপর দিয়ে পিছলে যাচ্ছিল বিভ্রান্তিকর বিশৃঙ্খল ছবিগুলো, এত দ্রুত চলে যাচ্ছিল যে কোনোভাবেই সে একটিকে ধরে রাখতে পারছিল না। একটিরও পরিচ্ছন্ন স্পষ্ট রূপ সে মনে রাখতে পারেনি।

তার আবার এইরকম ঘটল। ঘুম ভাঙার পর সে বলতে অক্ষম কী নিয়ে স্বপ্ন দেখছিল। আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল ছবিগুলোকে স্পষ্টভাবে দেখার জন্য এবং তাই করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠে নিজেকে প্রায় নিঃশেষ করে তুলেছিল ঘুমের মধ্যে। ছবিগুলোর মধ্যে এমন কিছু তাৎপর্য নিশ্চয়ই প্রচ্ছন্ন আছে যেটা তাকে মূল্যবান সূত্র ধরিয়ে দিতে পারত এবং তাই ভেবে ধীরে-ধীরে সে মনমরা হয়ে যাচ্ছে।

স্বপ্নের একমাত্র যে ব্যাপারটি সে মনে করতে পারছে… কিন্তু সে কীভাবে যে কথাগুলোকে সাজিয়ে প্রকাশ করবে তা ঠিক করতে পারছে না। একটাকেও সঠিক মনে হচ্ছে না। মনের মধ্যে যতই নাড়াচাড়া করছে, শব্দ ও বাক্যগুলো ততই পরস্পরের বিরোধিতা করতে করতে গুটিয়ে যাওয়া ছিটিয়ে পড়া এক ধরনের ঝাঁঝালো রাগ তৈরি করছে। এমন ধরনের রাগ যাতে আক্রমণের মেজাজ নেই, যেটা মানুষের জগতের থেকেও বেশি করে নির্গত হয় জড়বস্তুর এবং বহু দূরে দেখতে পাওয়া ঝাপসা দৃশ্যাবলির অচেতন জগৎ থেকে।

তার স্বপ্নের মধ্যে কোনো মানুষ ছিল কি? হয়তো ছিল। থাকলে নিশ্চয় তাদের মুখ ছিল না। তার আরও চেষ্টা করা উচিত ছিল। তাহলে ভাসা-ভাসা ছবিগুলোর মধ্যে থেকে জমাট স্পষ্ট কিছু একটা বার করতে পারত। এই অক্ষমতাটা বুঝে ওঠার পর থেকেই সে মনমরা হতে শুরু করে।

সুনীত এবার সচেতন হল সময় সম্পর্কে। আধা-ঘুমে আধা-জাগরণের মধ্যে সে ঘরের বাইরে মাটির উঠোনে ঝাঁট দেওয়ার শব্দ পাচ্ছে। দরজার কাছে এসে কেউ ফিরে গেল। সম্ভবত বাদলবাবুর বড়োমেয়ে শুভ্রা। জানলার বাইরে বাছুর ডাকল। সুনীত অপেক্ষা করল আর একটা ডাক শোনার জন্য। বাড়ির ভিতর দিকের গোয়াল থেকে সেটা ভেসে এল। সে হাসল। কাত হয়ে দরজা দিয়ে তাকাল। সামনেই পলেস্তরা খসা জীর্ণ ইটের পাঁচিল। বাড়িটা পাঁচিলে ঘেরা।

পাঁচিলের মাথায় ছোট্ট ঝোপ। সুনীত বুঝতে পারছে না ওটা কীসের ঝোপ। চশমাটা প্যান্টের পকেটে রয়েছে। ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে ঝুলছে তার প্যান্ট-শার্ট। চশমার একটা কাচ নেই, ওটা চোখে পড়লে লোকেরা মুখের দিকে তাকাবে, অবাক হবে এবং মনে করে রেখে দেবে।

ওরা যদি জিজ্ঞাসা করে? ধরা যাক স্টেশনের টিকিট কালেক্টার যে অত সকালেও প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে টিকিট সংগ্রহ করছিল। মুখের দিকে তাকায়নি বললেই চলে। কিন্তু এককাচ-ভাঙা চশমা দেখলে নিশ্চয় কৌতূহলী হত। সাক্ষীর কাঠগড়ায় লোকটা কী বলত?

”ফার্স্ট ট্রেনে উইকডেজে বিশেষ করে সোমবারে খুব কম লোকই কলকাতা থেকে আসে। রোববারে একটু ভিড় হয়, মাছটাছ মারতে অনেকেই আসে। …না আমি সচরাচর মুখটুখ অত লক্ষ করি না কিন্তু অচেনা অপরিচিত লোকের চশমার একটা কাচ ভাঙা দেখে একটু যেন কেমন লাগল।”

”কেমন লাগল?”

”এককাচ-ভাঙা চশমা তো কেউ পরে না, তাই। তা ছাড়া চোখ ফুলোফুলো, লালও হয়েছিল, যেন সারারাত ঘুমোয়নি। প্যান্টের তলার দিকে কাদা, জামার কাঁধে, বুকের কাছেও কাদা।”

চোখ দুটো ফুলো-ফুলো এবং লাল হাওয়াটা বাদলবাবু প্রথমেই লক্ষ করেছিলেন, জামা-প্যান্টের কাদাও।

সুনীত স্টেশনের বেঞ্চে সময় কাটিয়ে বকরিহাটি হাই স্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। শীত করছিল খুব। স্কুল ফটকের পাশেই গোপালের মিষ্টির দোকান। বাঁশের ঠেকনোয় তুলে রাখা ঝাঁপটার নীচে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে সে কাঁপছিল। দোকানের মধ্যে উনুনে বড়ো একটা কড়াই চাপানো, সেটাকে বেড় দিয়ে লাল আগুনের গনগনানি। লোভীর মতো সুনীত দোকানে ঢুকে উনুনের কাছের বেঞ্চটায় বসে। গায়ে ময়লা গেঞ্জি, রুগণ একটি ছেলে কাছে এসে দাঁড়ায়।

কতগুলো শিঙাড়া নিমকি আর কাঁচাগোল্লা সে খেয়েছিল মনে নেই। পকেটে সাতাত্তর টাকা আর কিছু খুচরো ছিল। উনুনের ওমে শরীরে সাড় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে খিদেও ফিরে আসে। তখন ক্লান্তিতে তার চোখ জুড়ে আসছিল। ঘুমোতে চেয়েছিল সে, দিনের পর দিন ঘুমিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল।

ঘুমের জন্য প্রবল সেই ইচ্ছাটা গত পাঁচ দিন তাকে ফেউয়ের মতো তাড়া করে আছে। এই ঘরের বাইরে সে কদাচিৎ বেরিয়েছে। বাড়ির বাইরে গেছে তিন-চারবার। তার পুরনো সহকর্মীদের মধ্যে শরৎ মুখুজ্জে এক সন্ধ্যায় দেখা করতে এসেছিল। টিপটিপ বৃষ্টি আর ঠান্ডা লাগার ভয়ের ভান করে সে ঘরের মধ্যেই রয়ে গেছে।

ন’বছর আগে বকরিহাটি হাই স্কুলে পাঁচ মাসের জন্য সুনীত শিক্ষকতা করেছিল। তখন থাকত বাদল নস্করের এই ঘরটিতেই। তেইশ বছর মাস্টারি করে বাদলবাবু এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার। বেঁটে চেহারাটা গোলগাল হয়েছে, টাক পড়েছে পিছন দিকে, চুল পেকেছে। সুনীতের প্রথমে অসুবিধা হয়েছিল ওকে চিনতে।

মিষ্টির দোকানের বাইরে ঝাঁপটার নীচে দাঁড়িয়ে সে ছাত্রদের দেখছিল। একজনকেও সে চিনতে পারল না। তিনজন শিক্ষককে চিনল। একজন দোকানে এসে একটা টাকা ভাঙিয়ে নিয়ে গেল। তখন একবার সুনীতের দিকে তাকিয়েছিল। সে তখন অস্বস্তি বোধ করেছিল প্যান্ট ও শার্টে লেগে থাকা কাদার জন্য।

নিশ্চয় ওরা জানতে পারবে একদা এই স্কুলে পড়াতাম। খোঁজ নিতে আসবে। তখন লংক্লথের পাঞ্জাবি পরা, বোধহয় বিপুলবাবু এর নাম… এই বিপুলবাবু বলবে, ”সোমবার সকালে গোপালের দোকানের সামনে একজনকে দেখেছিলুম বটে। হ্যাঁ, অনেকটা যেন সুনীতবাবুর মতোই লেগেছিল। তবে যেরকম ফিটফাট থাকতেন সেরকম তো লোকটা ছিল না। কেমন যেন উসকোখুসকো, মুখটা শুকনো, প্যান্ট-জামায় কাদা, চোখে চশমাটাও ছিল না। তাই বুঝতে পারিনি যে উনিই… ন’বছর আগের দেখা তো। তা ছাড়া উনি তো আমাদের সঙ্গে খুব একটা কথাবার্তা বলা কি মেলামেশা করতেন না। ক্লাস না থাকলে টিচার্স রুমের এককোণে বই মুখে দিয়ে বসে থাকতেন। ঘণ্টা পড়লেই ক্লাসে যেতে এক মিনিটও দেরি করতেন না। না…, ছাত্রদের কখনও মারতে বা বকতেও দেখিনি। হি ওয়াজ এ গুড টিচার, আইডিয়াল টিচার, একটু আত্মম্ভরী হলেও, এ গুডম্যান।”

সুনীত ঠিক করে বকরিহাটে এসে পড়ে ভুল করেছে, এখুনি ফিরে যাওয়াই ভালো। এবং কোথায় সে যেতে পারে, এই ভাবনাটা যখন তার মাথার মধ্যে কুরে-কুরে গর্ত তৈরি করছে তখনই পাশ থেকে শুনল, ”কী আশ্চর্য সুনীতবাবুই তো!”

অথচ বাদল নস্কর তার সামনে দিয়েই স্কুলের দিকে হেঁটে গেছে। তারপর ফিরে এসে কথাটা বলেছিল।

”ভেবেছিলাম চিনতে পারবেন না। স্টেশন থেকে বেরিয়েই রাস্তায় পিছলে পড়ে দেখেছেন কী অবস্থা হয়েছে, চশমাটাও ভেঙেছে। যাক তাহলে চিনতে পেরেছেন।”

”না পারার কী আছে, আপনাকে যে দেখবে সেই মনে রাখবে।”

শুনেই সিঁটিয়ে গেছল সুনীত। কেউ মনে রাখুক এখন সে তা চায় না।

”এখানে দাঁড়িয়ে কেন, স্কুলের ভিতরে আসুন। দেখবেন কত বদলে গেছে, সে-স্কুল আর নেই। দেখছেন তো দোতলা হয়েছে, ও-ধারটায় ল্যাবরেটরি। আসুন আসুন।”

”না না বাদলবাবু এভাবে এই কাদামাখা অবস্থায়… পরে দেখব। স্ত্রীকে বারাসাতে বাপের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ভোরের ট্রেনেই শেয়ালদায় নেমে ভাবলাম সাত দিন তো ছুটি নিলাম, ঘরেও কেউ নেই তাহলে এখন কী করা যায়! স্টেশনে দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ল বকরিহাটিকে, আপনাকে। অনেকদিন প্রায় ন’বছর আপনাকে দেখিনি।”

বাদলবাবু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে।

”য়্যাঁ, আমায় মনে পড়ল! কী আশ্চর্য। থেকে যান তাহলে ছুটির ক’টা দিন আমার বাড়িতে। না না, কোনো কথা শুনব না, দাঁড়ান স্কুল থেকে চট করে ঘুরে আসি, দু’মিনিট।”

সুনীত আবার তখন ভেবেছিল, এই ফাঁকে চলে যাই। কিন্তু কোথায় যাব? স্টেশন থেকে বেরিয়েই পিছলে পড়ায় কাদা লেগেছে বলাটা বোধহয় বোকামি হল। স্টেশন থেকে স্কুল পর্যন্ত পিচের রাস্তায় কোথাও কাদা নেই।

অপ্রত্যাশিত আচমকাই ঘটেছিল। সেজন্য কোনো প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা ছিল না। নিয়তি বা দৈবের হাত ছিল কি না তা সে জানে না। কখনও সে কোষ্ঠীঠিকুজি, তাবিজ মাদুলিতে বিশ্বাস করেনি। ঈশ্বর সম্পর্কে তার কোনো মতামত নেই।

গুণেন ভবনের গেটের আলোটা নেভানো। রাত তখন অন্তত দেড়টা। গেটে তালা দেওয়া, তার একটা করে চাবি সব ফ্ল্যাটেই আছে। সুনীত কিছুক্ষণ আগেই ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করেছে। এত রাতে গোলাপবাগান রোডে ট্যাক্সি নিয়ে সে ঢুকবে না। ঢুকতেই হবে। পয়সা দোব যখন যাবে না কেন?

বৃষ্টি আর ঠান্ডার জন্য পথে একটি লোকও ছিল না। পানের দোকানটারও ঝাঁপ বন্ধ। সুনীত ঠিক করে ফেলে ট্যাক্সি থেকে নামবে না। ”থানায় চলো”, সম্ভবত এই কথাটাই বলেছিল।

ট্যাক্সিওলার সঙ্গীটি তখন, ”নিকুচি করেছে মাতালের,” এই বলে দরজা খুলে গলার কাছে জামাটা ধরে হিঁচড়ে তাকে নামায়। লোকটা চড় মেরেছিল। তখন সুনীতের ছড়ানো ঝাপসা দৃষ্টি ধীরে-ধীরে সংকুচিত হয়ে জমাট এবং তীক্ষ্নতা লাভ করে। টলুনি থেমে যায়।

ট্যাক্সিটা চলে গেল। ঘুম হয়ে সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। অপমানের জ্বালাটা আবার সে অনুভব করতে শুরু করে। গত ছ’ঘণ্টার মধ্যে দু’বার ঘটল। এবারের অপমানটা চড় খাওয়ার জন্য নয়। ভাড়া না নিয়েই ট্যাক্সিটা চলে গেল। অন্তত দশ টাকা পাওয়া হয়েছিল। ট্যাক্সিওয়ালারা গরিবই হয় তবু টাকাটা ছেড়ে দিল। এটা কি অনুগ্রহ, দান, তাচ্ছিল্য, অবহেলা… সুনীতের মাথার মধ্যে বাষ্পের মতো ঝাঁঝালো একটা রাগ কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠল। রাগটা তাকে ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে আনল গুণেন ভবনের কাছে।

বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে, পকেটে হাত ঢুকিয়ে চাবিটা খুঁজে পাচ্ছিল না। টিপটিপ বৃষ্টিটা তখন হঠাৎ জোরে নামল। সে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল অসহায়ভাবে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো শীতল সূচ ঢোকাচ্ছে শরীরে, চটের পর্দাটা তুলে কে যেন দেখছে তাকে। সুনীত এগিয়ে গেল সেদিকে। কেন? বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্যই কি?

সে জানে না। এখনও সে বুঝতে পারছে না কেন হাবার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অন্ধকার কিছুটা চোখে সয়ে এসেছিল। দূরে গোলাপবাগান রোডের বাতি থেকে আলো চুঁইয়ে আসছে বৃষ্টিধারা ভেদ করে অতি স্তিমিতভাবে। সেই আলোয় গুণেন ভবনকে অতিকায় আবছা একটা প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো দেখাচ্ছিল।

সুনীতের আবার গোলমাল ঘটতে শুরু করে। ঝড়ের বেগে একটা দমকলের গাড়ি ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে মাথার মধ্যে ছুটে আসছে। সে দেখতে পাচ্ছে শুধু দুটো হেডলাইট, সাদা দুটো বিন্দুর মতো।

আর একটু ঝুঁকে সে ভালো করে তাকাল। মুখে ভাতের গন্ধ, সর্ষের তেলের গন্ধ, চ্যাপটা নাক, পুরু ঠোঁট এইসব নিয়ে চৌকো মুখের মাঝখানে বড়ো বড়ো গোল চোখ দুটোর সাদা অংশ স্থির হয়ে আছে। কালো মণি দুটো এক একবার ছড়িয়ে গিয়ে সাদাকে ঢেকে দিয়েই আবার গুটিয়ে আসছে। সুনীত হুমড়ি খেয়ে পড়ল দু’হাতে হাবার বউকে মেঝেয় ফেলে দিয়ে।

আঁকড়ে ধরেছিল হাবার বউ তার দুটি কাঁধ। ওর দ্রুত নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে ওঠানামা করছে বুক। ও যখন কামড়ে ধরে সুনীতের ঠোঁট চুষছিল তখন সে মা’র বুকে হামলাকরা কুকুরছানার কুঁইকুঁই শব্দের মতো কিছু একটা শুনতে পাচ্ছিল। তখন সে ধীরে ধীরে ওর নিটোল স্তনে দুটি হাত রাখে।

সেই সময়ই হাবা তার পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে…।

”কে, কে, কে ওখানে?”

সুনীত ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। ঘুম ভাঙার পর চেতনায় ছড়ানো কুয়াশার মতো তন্দ্রায় স্নায়ুকোষগুলি তখনও স্তিমিত। তার মনে হচ্ছিল, ড্যাবড্যাবে দুটো চোখ তার দিকে এগিয়ে আসছে। কার চোখ সে বুঝতে পারছিল না।

”কাকাবাবু আমি, চা এনেছি।”

সুনীত অপ্রতিভ বোধ করল। শুভ্রার হাত থেকে চায়ের কাপ নেবার সময় তার মনে হল মেয়েটি তাকে নিবিষ্টভাবে লক্ষ করছে।

”স্বপ্ন দেখছিলাম… বাবা উঠেছে?… সেই ডান দিকের শিংভাঙা গোরুটা আছে?”

কথাগুলো বলেই সুনীত বুঝতে পারল বোকার মতো সে অপ্রতিভতা কাটাতে চাইছে। স্বপ্ন দেখাটা, চেঁচিয়ে ওঠার কারণ হতে পারে না; গ্রামের মানুষ ভোরেই বিছানা ত্যাগ করে সুতরাং জিজ্ঞাসা করাটা অহেতুক; গোরু সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ ঘুম থেকে উঠেই! শুভ্রার জন্য লক্ষ করার টোপ তো সে নিজেই দিয়েছে।

”বছর দুই হল মরে গেছে, এখন যেটা দেখছেন সেটা ওর মেয়ে। বাবা জাল ফেলাচ্ছে বড়ো পুকুরে দেখে আসুন না।”

সুনীত বালিশের তলা থেকে হাতঘড়ি বার করল।

”সাড়ে ছ’টা বেজে গেছে!”

শুভ্রা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। ধীরভাবে গ্রামটি সক্রিয় হয়ে উঠছে কিন্তু তার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। জামগাছের পাতাগুলো বৃষ্টিতে ধুয়ে গাঢ় সবুজ, আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি থেমে গেছে। একটা কাঠবেড়ালি পাঁচিলের উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে চলে গেল। এসবই সে বিনা চশমায় ঝাপসাভাবে বুঝল। কলকাতায় সে এইসময় চা এবং খবরের কাগজের অপেক্ষায়। সাতটার আগে খবরের কাগজ এই গ্রামে পৌঁছয় না।

হয়তো আজকের কাগজে খবরটা বেরিয়েছে। কিংবা না-ও বেরোতে পারে। অতি তুচ্ছই ঘটনা, এমন ব্যাপার প্রতিদিন কলকাতায় আট-দশটা ঘটছে। সবই কি বেরোয়?

কী ভাবল শুভ্রা, কিছু কি অনুমান করল? সন্দেহ? যদি ওরা জিজ্ঞাসা করে, কী সাক্ষী তাহলে দেবে?

”সাড়ে ছ’টায় চা দিতে যাই।”

”অস্বাভাবিক কিছু দেখেছিলে?”

”কেমনভাবে যেন ‘কে কে ওখানে’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন।”

”তাতে কী মনে হল?”

”স্বাভাবিক মানুষ ওরকমভাবে চেচিয়ে ওঠে না।”

”কী মনে হল?”

”কেউ যেন ওকে তাড়া করছে তাই লুকোবার জন্য জায়গা খুঁজছেন আর বারবার পিছনে তাকাচ্ছেন। প্রথম থেকেই দেখেছি উনি মানুষ এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, ঘর থেকে বেরোতেনই না। বলতেন, চশমা নেই, সর্দিকাশির ধাত।”

”কে কে ওখানে বলে চেঁচালেন কেন?”

”স্বপ্ন দেখেছিলেন বললেন।”

”কী স্বপ্ন?”

”বলেননি, তবে মনে হল লজ্জা পেয়েছিলেন চেঁচিয়ে।”

”ওকে প্রথম দেখে কেমন লেগেছিল? ন’বছর আগে যেমন দেখেছিলে, সেই লোকটিই কি?”

”তখন আমার বয়স সাত-আট বছর ছিল। শুধু মনে আছে এখনকার থেকে আরও ফরসা, আরও ছিপছিপে ছিলেন, মাথায় অনেক চুল ছিল। অনেকটা… অনেকটা সিনেমায় নামবার মতো চেহারা ছিল। মজার মজার গল্প বলে আমাকে বাবাকে হাসাতেন। মা কখনও ওর সামনে আসত না। পোস্ত আর ট্যাংরামাছ ভালোবাসতেন। হাসিখুশিই ছিলেন, স্কুলের স্পোর্টসে দৌড়তে দেখেছি, গানের সুন্দর গম্ভীর গলা, মাঝে মাঝে গাইতেনও। আমাকে ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ গানটা শেখাবেন বলেছিলেন কিন্তু শেখাননি, তারপরই চলে যান। হ্যাঁ, প্রতি শনিবারই কলকাতায় যেতেন। একবার একজন মেয়ে… মহিলা, শুনেছিলাম অফিসে চাকরি করেন, সুনীতকাকুর সঙ্গে বিয়ে হবে, তিনি এখানে এসে দু’দিন ছিলেন, নাম উমা।”

”কোথায়, ওর ঘরে?”

”না না, আমাদের ঘরেই রাতে ছিলেন, আমি, মা আর তিনি একসঙ্গে খাটে শুয়েছিলাম।”

”আর অন্য সময় তিনি কি ওর ঘরেই কাটাতেন!”

”সব সময় নয়, মাঝে-মাঝে যেতেন। মা’র সঙ্গে রান্নাঘরেও গল্প করতেন, দু-একটা রান্নাও শিখে নিয়েছিলেন। মা পরে বলেছিল, ‘হিসেবি মেয়ে মেপে চলতে জানে।’ ওরা দুজন সারা বিকেল গ্রামটা ঘুরে খালের ধারে গিয়ে বসেছিল; আমিও সঙ্গে ছিলাম।”

”কী কথা বলছিল ওরা?”

”তেমনি কিছু নয়, তা ছাড়া সব কথা শুনতেও পাইনি। আমি কাছে থাকলে ওরা আজেবাজে কথা বলত। শুধু একবার কানে আসে সুনীতকাকাকে উনি বলছেন, ‘পদ্য টদ্য লেখার পক্ষে জায়গাটা ভালোই… এখানেই পড়ে থাকবে নাকি’?”

”কী বললেন তাইতে?”

”বললেন পদ্য আর লিখি না।”

”এবার যখন ওকে দেখলে কীরকম মনে হল?”

”কেমন যেন গম্ভীর অন্যমনস্ক। আমায় দেখে শুধু বললেন, ‘অনেক বড়ো হয়ে গেছ।’ তাকালেন আমার দিকে কিন্তু মনে হল কিছুই দেখছেন না। কী যেন সব সময়ই ভাবছিলেন। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, অর্ধেকই পাকা, চোখ দুটো লাল, মনে হচ্ছিল রাতে ঘুমোননি। মা বললেন, আগের থেকে পেটটা একটু বেড়েছে। সব মিলিয়ে বুড়োটে বুড়োটে লাগছিল। দু’বার বলেছিলেন ‘বড্ড টায়ার্ড’। আমিই লেপ তোশক বার করে বাইরের ঘরে বিছানা করে দি।”

”আর কিছু?”

”ওর জামা আর প্যান্টে কাদা লেগেছিল। বললেন কেচে দিতে। আমিই সাবান দিয়ে কেচে দি। সেদিন স্কুলে আর যাওয়া হয়নি।”

সুনীত অস্বস্তি বোধ করল এইভাবে এক উদ্ভিন্ন যৌবনার দ্বারা নিজেকে পরীক্ষা করিয়ে। কথোপকথন যে ঠিক এইভাবেই হবে তার কোনো সঠিকতা নেই বটে কিন্তু এ ছাড়া আর কী বলবে! ন’বছর কতটা বুড়ো হয়েছি নাকি সেদিন ন’ঘণ্টাতেই বয়স বেড়ে গেছে। দাড়িতে হাত বুলিয়ে সে দেয়ালে তাকাল। শেয়ালদা থেকে একটা আয়না কিনে এনে ওখানে সে রেখেছিল। আয়নাটার তলার দিকে তাকালে মুখটা ফজলি আমের আঁটির মতো লম্বা হয়ে যেত।

দাড়ি যদি রাখা যায় তাহলে নিজেকে অনেকখানি আড়াল করা যাবে। ওরা নিশ্চয় আমার ছবি জোগাড় করে ফেলেছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর যেটা আছে সেটাই নেবে। খুব বড়ো একটা গোটা মুখ, মিলিয়ে চিনে নিতে সুবিধাই পাবে। অ্যালবামেও আছে গ্রুপ ফোটোর মধ্যে। দু’বছর আগে অফিসের পিকনিক হয়েছিল উলুবেড়িয়ার ফুলেশ্বরে। জনা সাত-আটের একধারে সে দাঁড়িয়ে। তার পাশে রুবি। তারপর চিন্ময় ঘোষ আর তার বউ। অনেকেই বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে গেছল, সুনীত বাদে। ছবিটায় তাকে অনেক তাজা, তরুণ মনে হয়। উমা অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে বলেছিল, ”তোমাদের এই রুবি দেখতে স্মার্ট বটে কিন্তু বয়সও অনেক হয়েছে।”

দাড়িটা রাখা দরকার। সুনীত লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পরল। পকেটে যা আছে বার করল। পাঁচদিন সে প্যান্ট পরেনি। বাদলবাবুর লুঙ্গি আর আলোয়ানেই কাজ চালিয়েছে। পার্স, ট্রেনের টিকিট, দেশলাই, চশমা, গুণেন ভবনের গেটের চাবি, আর মেরুন জমিতে ছাই রঙের চৌকো ঘরকাটা একটা রুমাল।

রুমালটা কী করে এল পকেটে। রুবি হাতে দিয়ে বলেছিল মুখটা মুছে নাও। কিন্তু তারপর কি ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি? তখনই কলিংবেলটা বেজে ওঠে আর রুমির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছল। তাদের দুজনের চোখাচোখি হতেই রুবি বলেছিল, বম্বে থেকে তো ওর সোমবারের ইভনিং ফ্লাইটে ফেরার কথা।

ও অর্থাৎ পঙ্কজ আচার্য, যিনি জনসন, ফোকস অ্যান্ড হাজরার পাবলিক রিলেশনস অ্যান্ড পাবলিসিটি ম্যানেজার, রুবি কাঞ্জি যার একান্ত সচিব, সুনীত যার তিনধাপ নীচের কর্মচারী, রুমির এই ফ্ল্যাটের ভাড়া যিনি দেন এবং সপ্তাহে দু-তিনদিন মধ্যরাত পর্যন্ত এখানে থাকেন।

রুমালটা যদি ওরা পায়? ওরা নিশ্চয় অফিসে যাবে, পঙ্কজ আচার্য, রুবি, চিন্ময়কে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। রুবির রুমাল পকেটে পাওয়া গেছে সুতরাং একটু বেশি করেই ওকে জিজ্ঞাসা করবে। কী প্রশ্ন করবে?

”আপনার সঙ্গে কতদিনের আলাপ?”

”বছর চারেকের। অফিসেই হয়।”

”আপনি একা থাকেন?”

”হ্যাঁ, ঝি আছে।”

”আপনার ফ্ল্যাটে উনি কি যেতেন?”

”মাঝেমাঝে।”

”রাতে থাকতেন?”

”কোনোদিন নয়।”

”ওর সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?”

”ভালো ছাত্র ছিল, উচ্চচাকাঙ্ক্ষা ছিল বড়ো কিছু একটা হবে। ইদানীং অসুখী অতৃপ্ত মনে হচ্ছিল ওকে। উলটোপালটা কথা বলত, অস্থির হয়ে উঠত। প্রায়ই বলত চারদিকটা কেমন একঘেঁয়ে হয়ে যাচ্ছে, শরীরে তেমন করে আর রক্ত চলাচল করছে না।”

”কখনও কি খুন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন?”

”না।”

”খুব কি ভিতু ছিলেন?”

”পরীক্ষা করে দেখিনি। তবে প্রাণের ভয় করত না।”

”কীভাবে জানলেন?”

”আমার বাবা-মা, ভাই-বোনরা থাকে মানিকতলায়। মাসে একবার যাই টাকা দিয়ে আসতে। বোমা, গুলি ছুরির আমলের কথা। রাতে আমি যেতে ভয় পাচ্ছিলাম। সুনীত আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। যখন আমরা পাড়ায় ঢুকছি ঠিক তখনই বোমা পড়তে শুরু করে। আমি পিছিয়ে আসি। সুনীত আমার হাত ধরে টানতে টানতে গলিতে ঢোকে। অচঞ্চলভাবে হেঁটে যায়। পরে বলেছিল, বিপদের মধ্যে ঢুকলে রক্ত চলাচল হয়। একঘেঁয়েমিটা কিছুটা কাটে।”

”আপনার রুমালটা কী করে উনি পেলেন?”

”বলতে পারব না, হয়তো আমি ওর টেবিলে ফেলে গেছলাম।”

এটা অবশ্যই মিথ্যা কথা। রুবি কখনও কিছু টেবিলে ফেলে যায় না, নিজের টেবিলেও নয়। তা ছাড়া আর যা বলেছে সেগুলো সত্যি। কোনো-না-কোনো সময় সুনীতকে সে কথাগুলো বলেছে। অসুখী, অতৃপ্ত, অস্থির এগুলো রুবি নিজের সম্পর্কেও তো বলত।

সুনীত বড়ো পুকুরের দিকে যাবার সোজা পথটা ছেড়ে ঘুরপথে এগোল। এদিকটায় বাড়ি কম, লোকজনও কম। প্রায়ই সে স্কুল থেকে ফেরার সময় এই পথটা দিয়ে ঘুরে আসত। তখন ভাবত, এখানেই থেকে যাবে। স্টেশনের ধারে কয়েকটা দোতলা বাড়ি উঠেছিল, উমাকে বিয়ে করে ওই বাড়িগুলোরই কোনো একটায় ঘর ভাড়া নিয়ে থাকবে। এক একদিন সকালে খালি পায়ে গেঞ্জি আর পাজামা পরে সে গ্রামের প্রান্তে এসে দাঁড়াত। ‘ছিন্নপত্রের’ নানা অংশ তখন তার মনে পড়ত। সেই সঙ্গে মাটির সোঁদা গন্ধ, হঠাৎ কোনো পাখির ডাক, দূরে জমিতে হাল দেওয়ায় ব্যস্ত চাষি আর জগৎজোড়া শান্ততা তাকে আপ্লুত করত।

কিন্তু ধীরে ধীরে টানাপোড়েন শুরু হল তার মনে। মাস দুয়েকের পরই সে দূরের খড়ের চালাবাড়ি, গাছ, সবুজ চারাধান, ভিজে বাতাসে মাটির গন্ধ আর নৈঃশব্দ্যের মধ্যে অস্থির বোধ করতে শুরু করে। তার মনে হয়, এই তুষ্ট, জড় ভূপ্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে পড়লে নিথর অপরিবর্তনীয় এক ক্লান্তির গর্ভে সে নিক্ষিপ্ত হবে। মারমুখো, বিচ্ছিন্ন দ্বন্দ্বময় কলকাতার কাছ থেকেও সে ক্লান্তি পায়। কিন্তু তার মধ্যে ঝাঁঝালো একটা আমেজ আছে, দ্রুত পরিবর্তনীয় এবং তাতে সংকীর্ণতা নেই। পছন্দ বা বাছাই করার সুযোগ আছে। সে বুঝতে পারে এখানে রয়ে গেলে তার অপমৃত্যু ঘটবে, উমারও তীব্র অনিচ্ছা ছিল। সে তার বিছানা ও সুটকেস নিয়ে গ্রীষ্মের ছুটি পড়তেই কলকাতায় চলে আসে। ট্রেনে তুলে দিতে এসে বাদল নস্কর তার দুটি হাত ধরে বলেছিল, ”সত্যি সত্যিই ফিরে আসবেন তো? কলকাতার মানুষ পাড়াগাঁয়ের স্কুলে থাকতে চায় না। দুজন এসেছিলেন, দু-তিন মাস থেকেই চলে গেলেন। আপনি কিন্তু আসবেন।”

সুনীত ঘাড় নেড়েছিল এবং তার ন’বছর পর ফিরে এল। কীজন্য? অন্য কোথাও তো যেতে পারত সে! বাদল নস্করের সহৃদয় সরল এই আবাসটি অবচেতনে ন’বছর ধরে কী অপেক্ষা করছিল ভয়ংকর কোনো উৎক্ষেপের জন্য। স্নেহ মমতা যত্নের আকাঙ্ক্ষায় তার ভিতরে অতৃপ্তি তিলতিল করে জমে উঠেছিল কি? পকেট থেকে চশমাটা বার করল। একটা কাচ না থাকলেও দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু কাচবিহীন চোখে চাপ পড়ছে ফলে অন্য চোখের দৃষ্টি প্রকৃতির কোনো বিষয়ের উপরই সঠিক মাত্রায় বসতে পারছে না। পিছলে যাচ্ছে। একটা চোখ বন্ধ করে সে বলল, ”আমার জীবন?”

বড়ো পুকুরের দিকে যাবার পথে একটা নির্জন এবং খেজুরগাছের আড়াল পাওয়া জায়গায় দেশলাই জ্বেলে রুমালটা পুড়িয়ে দিল। পায়ের চাপে ছাইগুলো গুঁড়িয়ে দিতে দিতে মুখ তুলেই অবশ হয়ে গেল তার বুকের মধ্যেটা। একটা লোক!

ফতুয়া, রঙিন লুঙ্গি, থুতনিতে নুর, পায়ে চটি। ঢ্যাঙা লোকটি আদাব জানাল।

”মাস্টারমশায়ের কাছে শুনলাম আপনি এয়েছেন। বললেন, এখন খুব বড়ো কোম্পানির ম্যানেজার হয়েছেন তাই দেখা কত্তি যাচ্ছিলাম। আমারে অবিশ্যি মনে থাকার কথা নয়… কাগজ পোড়ালেন নাকি?”

”হ্যাঁ।”

আর একজন সাক্ষী ওরা পেল। রুমালটাকে ইটে জড়িয়ে পানাপুকুরটায় ফেলে দিলেই তো হত। বোকামি করছে সে।

”ঠিক চিনতে পাচ্ছি না তো তোমায়।”

”আপনি যখন এখানে পড়াতেন তখন আমার ছেলে ইদ্রিস কেলাস সেভেনে। ফেল করল চারটে বিষয়ে।”

সুনীতের মনে পড়ল লোকটিকে। শেখ মঞ্জিল এর নাম। এক সময় নাকি ডাকাত দলে ছিল, জমিজমা যথেষ্টই আছে। অ্যানুয়েল পরীক্ষার ফল বেরোবার পরদিনই ছেলেটাকে মারতে মারতে টিচার্স-রুমে ঢুকেছিল। ‘ধিক তোরে ধিক। মাস্টারমশায়রা অ্যাতো কষ্ট করে যত্ন নিয়ে পড়ান আর তুই ব্যাটা ভক্তিভরে তা মগজে নিলি না? বেশ হয়েছে ফেল করেছিস,… যা পরণাম কর সকলকে, বল এবার থেকে ছদ্ধাভরে পড়ালেখা করব… যা যা পায়ে ধরে…’ মঞ্জিল ছেলের পাছায় দারুণ এক লাথি কষায়। ইদ্রিস নতমস্তকে প্রস্তুতই ছিল যেন। গোলকিপারের মতো ডাইভ দিয়ে সামনেই যে দুটি পা পেয়েছিল আঁকড়ে ধরে এবং তা সুনীতেরই। হাঁ হাঁ করে উঠেছিল সে। ‘না না, ধরতে দ্যান। বলুক কেলাস এইটে মন দিয়ে পড়বে আর ফেল করবে না।’ মাস্টার মশাইদের একজন তখন বলেন, ‘ক্লাসে তুলে দেবার ক্ষমতা আমাদের নেই। কমিটির মিটিং হবে তারপর যা হয়। তুমি পাঁচ-ছ’দিন পরে এসো।’

”ইদ্রিস কী করছে এখন।”

”সে আর বলবেন না। এইট কেলাসে তো আপনারা তুলে দিলেন, তারপর ছোঁড়া মাতল ফুটবল নিয়ে। কলকাতার কেলাবে দু’বছর খেলে হাঁটু জখম করে খেলা ছাড়ল।”

”গোলে খেলত?”

”আজ্ঞে না, হাফে খ্যালত, ভালোই খ্যালত… তারপর শাদি দিলাম, এখন দুটো ব্যাটার বাপ, বসে আছে আমার ঘাড়ে কাজকম্মো নাই, বেকার। আপনে তো বড়ো কাজ করেন শুনলাম, একটা পিয়োন-বেয়ারার চাকরি করে ওরে দ্যান বাবু।”

শেখ মঞ্জিল ঝপ করে বসে সুনীতের পা চেপে ধরল। সুনীত ‘একী একী’, বলে তিন-পা পিছিয়ে গেল।

এসব ব্যাপার খুব তাড়াতাড়ি চুকিয়ে দেওয়া যায় রাজি হয়ে গিয়ে। তাড়াতাড়ি সে বলল, ”আচ্ছা দেখব’খন, তুমি বরং আমার অফিসে সামনের হপ্তায় যে-কোনোদিন ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়ো। ঠিকানাটা মাস্টারমশায়ের কাছে রেখে যাব!”

বাদল নস্কর আসছে পিছনে জাল হাতে দুটি লোক। মঞ্জিলকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে উঠল। তারপরেই কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ”কিছুই পেলাম না, পুজোর সময় সব বিক্রি করলাম তো। তবে দুটো হাফ কেজি মিরগেল, কই আর গলদার বাচা…”

”কী দরকার ছিল!”

”বলেন কী? অ্যাতো বছর পর পায়ের ধুলো দিলেন। একটু যত্ন করে শান্তি পাব, নাকি তা-ও পেতে দেবেন না।… তুই কী কত্তে, ছেলের চাকরির জন্য? আর সময় পেলি না।” মঞ্জিল মাথা চুলকোতে লাগল। বাড়ি ফেরার পথে বাদল নস্কর বকবক করে চলল। ”জোষ্টি আষাঢ়ে আসবেন। আম, লিচু, কাঁটাল যত খেতে পারেন খাওয়াব, ওনাকেও আনবেন নেমন্তন্ন করে রাখলাম। আর খাওয়াব ওল। কী আপনারা সাঁত্রাগাছির ওলের কথা বলেন, খাবেন বকরিহাটির ওল, মনে হবে ছানার ডালনা খাচ্ছি। আপনি তো খেয়ে গেছেন, সে-কথা কালই শুভ্রার মা বলল, আপনাকে রেঁধে দিয়েছিল খেয়ে বুঝতেই পারেননি। তারপর যেই শুনলেন ওল খেয়েছেন অমনি গলা কুটকুট করার বাতিকে পেয়ে বসল। হয়, ওরকম হয়।”

শেখ মঞ্জিল সংকোচভাবে বলল, ”আমি বরং ও-বেলা একটা মুরগি দিয়ে যাব।”

”আজ নয়, বরং কাল সকালে এনো। আমি রাতে মাংস খাই না।”

”সেই ভালো আজ শুধু মাছ দিয়েই হোক। তুই এবার কেটে পড় তো। বিশ্রাম করতে এয়েছেন উনি, চাকরি-বাকরির কথা কলকাতায় গিয়ে বলিস।”

শেখ মঞ্জিল রাস্তা থেকেই বিদায় নিল।

বাড়িতে ঢুকে বাদল নস্কর রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। সুনীত ঘরে ঢুকে তক্তপোশে বসল। চোখ বন্ধ করে সে ভাবল, বকরিহাটি এবার অসহ্য এবং বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। ক্রমশই তার অবস্থিতি জানাজানি হয়ে যাচ্ছে। অবাঞ্ছিত কাজ ঘাড়ে চেপে বসেছে।

গতরাত্রে ভূগোলের মাস্টারমশাই শরৎবাবু আবার এসেছিলেন।

”আচ্ছা সুনীতবাবু আপনি বাওবাব গাছ দেখেছেন কি? শুনেছি বালিগঞ্জের লেকের উত্তর-পশ্চিম দিকে একটা নাকি আছে, খুবই ছোটো আকারে এই সজনেগাছের মতো।”

সুনীত অবাক হয়ে শরৎবাবুর চশমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। বাওবাব শব্দটাই সে এই প্রথম শুনল।

”কী গাছ ওটা?”

‘গীতার সেই ঊর্ধ্বমূলমধঃশাখমশ্বত্থং’, সাগর মন্থনে উঠেছিল যে কল্পতরু, বাওবাব হচ্ছে সেই। বছরে ছ’মাস বাওবাবের পাতা থাকে না তখন এর ডালগুলোকে ঠিক শেকড়ের মতো দেখায়, মনে হয় যেন শেকড়গুলো আকাশের দিকে উঠেছে আর গাছটা নীচের দিকে বেড়েছে। আসলে এ-গাছ পূর্ব আফ্রিকার। এর গুঁড়ির বেড় তিরিশ মিটার পর্যন্ত নাকি হয়, কল্পনা করতে পারেন তি-রি-শ-মি-টা-র।”

”এত মোটা গুঁড়ি ভাবতেই পারি না। হয় নাকি?”

”আছে আছে প্রয়াগের কাছে গঙ্গার পুব তীরে শুনেছি একটা আছে। ভাবছি একবার দেখে আসব। তার আগে ওটাকে দেখতে হবে। আপনি একটু খোঁজ নিয়ে জানাবেন সত্যিই ওটা বাওবাব কি না।”

”দেখে কী হবে, কল্পতরুর কাছে কি কিছু চাইবেন?”

কথাটা বলেই সুনীতের মনে হয়েছিল, এরকম একটা গাছ থাকলে ভালো হত। তাহলে সে চাইত হাবাটা বেঁচে উঠুক। যথারীতি গোলাপবাগান রোডে বসে চিনেবাদাম বেচুক আর তার খকখক কাশি সন্ধ্যা থেকে গুণেন ভবনের মানুষদের জ্বালাক।

কিন্তু এই মুহূর্তে তক্তপোশে একা চোখ বন্ধ করে বসে তার মনে হচ্ছে, কল্পতরুর কাছে সে চাইবে চিরকালের জন্য গা-ঢাকা দিয়ে থাকার এমন একটা জায়গা যেখানে চেষ্টা করলেও মানুষের সঙ্গ পাওয়া সম্ভব নয়। যেখান থেকে ওরা তাকে খুঁজে বার করে কোমরে দড়ি বা হাতে হাতকড়া দিয়ে কোর্টে নিয়ে যেতে পারবে না। ফাঁসি না হলেও অন্তত সাত কি দশ বছরের জন্য জেল তো বটেই।

সুনীত ঢোক গিলতেই গলা ব্যথা বোধ করল। কপালে হাত দিয়ে তাপ বোঝার চেষ্টা করল। চোখ জ্বালা করছে, শরীর শ্রান্ত লাগছে। প্রতি বছরই তাকে শীতকালে সর্দিজ্বরে ভুগতে হয়। ধীরে ধীরে সে বিছানাটায় নিজেকে এলিয়ে দিল। এইরকম সময়ে উমা ট্যাবলেট আর জলের গ্লাস এগিয়ে দেয়। উমা…।

”কাকাবাবু।”

শুভ্রার হাতে অমলেট আর হালুয়ার প্লেট। সুনীত উঠে বসল। কালকের মতো চিঁড়েভাজা দিলে ভালো লাগত।

”তোমার তো পরীক্ষা এসে গেল, কেমন তৈরি হয়েছে।”

মেয়েটি রুগণ। বাড়িতে ফ্রক পরে। হাত-পা দেখলেই বোঝা যায় যত রকমের ভিটামিন লভ্য সবই ওর শরীরে দরকার। ওকে দেখে মায়া হয়।

”এক রকম হয়েছে।”

”আমি যখন ছিলাম তখন কোন ক্লাসে পড়তে?”

সুনীত চামচ দিয়ে অমলেট কাটতে কাটতে ওকে লক্ষ করল।

”তখন স্কুলে ভরতি হইনি।”

”ওহ, হ্যাঁ, মনে ছিল না। তুমি কলকাতায় যাও?”

”খুব কম! এ-বছর কালীপুজোর আলোর সাজ দেখতে গেছলুম।”

”এবার যখন যাবে, আমার ওখানে যেয়ো, কেমন।”

ঘাড় নেড়ে শুভ্রা দাঁড়িয়ে রইল। কী যেন বলব বলব করছে। তারপরই খাপছাড়া প্রশ্ন করল : ”আপনি তো পদ্য দেখেন, কাল রাতে মা বলছিল একটা বইও আছে।”

মুখে অমলেট রেখে সুনীত তাকিয়ে রইল। কী ব্যাপার! এই পরিবারটি ক’দিন ধরেই ন’বছর আগের স্মৃতিগুলোকে খোঁড়াখুঁড়ি করে যাচ্ছে। ন’বছর আগে কুমারী উমা এক মধ্য রাতে শুভ্রাদের ঘর থেকে চুপিসারে এই ঘরে এসে ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে গেছল। ফিরে গিয়ে কিছু পরেই সে টের পেয়েছিল শুভ্রার মা জেগে রয়েছে। এই তথ্যটি কি আলোচিত হয়েছে, অবশ্যই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে!

অস্বস্তি এবং বিরক্তিতে ভরে উঠল সে। এই জায়গাটায় কেন যে এলাম।

”সব মানুষই ভুল করে, আমিও করেছিলাম। আর করি না… আর পদ্য লিখি না।”

”আমি একটা-দুটো লিখেছি। দেখবেন?”…

সুনীত এর থেকে বেশি আশ্চর্য হত না যদি এখুনি চারটে পুলিশ ঘরে ঢুকে পড়ত। গ্রামের এই এগারো ক্লাসের মেয়ে পদ্য লেখে!

”স্কুলের ম্যাগাজিনে লিখেছি, ছাপা ম্যাগাজিন। আর বকরিহাটি লাইব্রেরির যখন থিয়েটার হল, তার বইয়েও একটা বেরিয়েছে। দেখবেন?”

”পরে দেখব।”

লাজুক মুখটা হতাশ হলো। সুনীত আন্দাজ করছে, নিশ্চয় প্রকৃতি বিষয়ক নয়তো স্বাদেশিক ব্যাপার নিয়ে।

”আপনি লেখেন না কেন?”

কী বলা যায়। এই সামান্য কৌতূহলের জবাব দিতে হলে তাকে গত ন-দশ বছরের মধ্যে সেঁধিয়ে উত্তর সংগ্রহ করতে হবে। সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

”সময় পাই না আর… অফিসে খাটুনি, বাড়ি ফিরে এত টায়ার্ড লাগে।”

পদ্য লেখা ছেড়ে দেবার এটা এক-চতুর্থ কারণ। বাকিটা, একে বললেও বুঝতে পারবে না। আদতে আমি কবি নই, যা লিখেছি সেগুলো কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে শব্দের পর শব্দ বসিয়ে যাওয়ায় যা হোক একটা কিছু হয়ে যাওয়া। নতুন শব্দ, অভিজ্ঞতা, অনুভূতি বা রূপকও নয়। শব্দ জড়ো করে যাওয়ার মজুর মাত্র। এসব কথা ওকে বলে লাভ কী!

”দেখবেন আমার লেখা?”

”ছাপা লেখা?”

”খাতাও আছে। আমি আনছি।”

কী নিস্তব্ধ এই গ্রামটা। বাদলবাবু বোধহয় স্কুলে যাওয়ার জন্য তোড়জোড়ে ব্যস্ত। এক সময় কিছু লিখেছিলাম বটে, তখন উমার সঙ্গে প্রণয় চলছে। প্রেমই বিষয় হয়ে উঠত। বছর বারো আগে সাতাশ জন তরুণ কবির কবিতা সংকলনে তারও একটা কবিতা স্থান পেয়েছিল। কাব্যগুণে নয়, বইটি প্রকাশের খরচ বাবদ পঞ্চাশ টাকা চাঁদা দিয়েছিল। বইটা সে শুভ্রার বাবাকে দেখিয়েছিল।

এই ঘরে বাস করার সময় প্রথম মাসেই সে গুটিচারেক কবিতার খসড়া করেছিল। যতদূর মনে পড়ে প্রকৃতিই যেন প্রাধান্য পেয়েছিল। তারপরই কেমন যেন ক্লান্ত বোধ করতে শুরু করে। কাগজগুলো ফেলে দিয়েছিল।

বিয়ের পর লেখার কথা আর সে ভাবেনি। কবিত্বের আবহাওয়া থেকে একটু একটু করে ভেসে চলে যায়। সে আর উমা, নিম্নমধ্যবিত্ততার স্তর থেকে ওঠার জন্য, সুখ সংগ্রহের অভিলাষে তখন থেকে শুধু বৈষয়িক উন্নতির কথাই ভেবেছে, খেটেছে আর ক্লান্ত হয়েছে। পরস্পরের কাছে তারা বিবর্ণ, অপ্রফুল্ল, বিস্ময়সৃষ্টিতে অসমর্থ দুটি আয়নার মতো বসবাস করছে।

সঠিকভাবে সে মনে করতে পারবে না কবে, কখন, কে তাদের মধ্যেকার যোগসূত্রটা ছিঁড়ে দেবার কারণ হয়েছে। বছর চারেক আগে হয়তো রুবির সঙ্গে পরিচয় হওয়া থেকেই সে বুঝতে পারছিল উমা আর তার মধ্যে কোনো যোগ নেই। এখন হয়তো তাদের দুজনের কল্পনায়ই শুধু যোগসূত্রটা টিকে আছে।

কিন্তু কারুর সঙ্গে কোনো প্রকারের একটা যোগ চাই, যার মারফত নিজেকে বার করে দেওয়া যায়, ভরিয়ে নেবার মতো কিছু পাওয়া যায়। ধর্মে নয়, রাজনীতিতে নয়, প্রতিষ্ঠানে নয়, কবিতায় সে যোগসূত্র পেতে চেয়েছিল। সেটাও গেছে। জগদীশ আধ-মাতাল অবস্থায় কিছুদিন আগে হো হো অট্টহাসিতে শরাবখানার লোকেদের চমকে দিয়ে বলেছিল, ”আমি যে কবি নই, এটা বুঝতে বুঝতেই কুড়ি বছর কেটে গেল। তুই ব্যাটা চালাক আগেই বুঝে ফেলেছিস।… মুশকিল কী জানিস আমার পক্ষে লেখা ছাড়া এখন আর সম্ভব নয়… বিখ্যাত হয়ে গেছি যে। অসমালোচিত জীবন কোনোক্রমেই যাপনযোগ্য নয় এটা কি জেনেছিস?”

হালুয়াটা সুনীত খেতে পারল না। তেতো লাগছে, অত্যন্ত গুড় দেওয়া। শুভ্রা একটু যেন বেশি সময় নিচ্ছে অর্থাৎ কবিতা জড়ো করছে। স্তূপ হাতে আসবে।

কী অবশিষ্ট রইল তার জন্য? দুজনের সংসার, চাকরি, বিছানা, চারপাশের বোকামি আর রুবি কাঞ্জি? প্রথমে সে তাই-ই আশা করেছিল। তবে উমার জায়গাটা রুবি নিয়েছে এমন দাবি করলে সেটা ভুল করা হবে। রুবি কারুরই জায়গা নেয়নি। সে একটা শূন্যতা ভরিয়েছে, এই শূন্যতার কারণ…।

ওদের মাথায় এই কারণাটা একবারের জন্যও আসেনি যে, ওরাই তাকে ডুবিয়েছে। ওদের দুজনের কেউ-ই তাকে কিছু দেবার জন্য ব্যস্ত হয়নি। …কী দেবার জন্য? শব্দটা কী খুঁজতে শুরু করল। এবং বুঝতে পারল খোঁজাখুঁজির দরকার নেই। ”দেওয়া” শুধু এইটুকুই তো… ব্যস, যথেষ্ট। কিছু একটা তাকে দেবে সেটাই তো দেওয়া।

খুবই ব্যস্ত হয়ে বাদল নস্কর ঘরে ঢুকল। সারা গায়ে সর্ষের তেল। বাহুর উপর থেকে নীচ দ্রুত তালু ঘষতে ঘষতে বলল,

”আড়াইশো-টাক মৌরলা মাছ পেয়েছে শুভ্রার মা, বাড়িতেই বেচতে এসেছিল… কী করবে, ভাজা না টক? টকই করুক, তাই বলেছি। মঞ্জিলকে আপনার অফিসের ঠিকানা দেব কি? গিয়ে তো ভ্যাজর ভ্যাজর করে জ্বালিয়ে মারবে… আজ একটু তাড়াতাড়িই ইসকুলে যেতে হবে, হেডমাস্টারমশাই এইমাত্র খবর পাঠালেন, দারোগা নাকি আসবে…।”

সুনীতের উঠে বসার ভঙ্গিতে বাদল নস্করের কথা থমকে গেল। দারোগা! ওরা কি জেনে গেছে সে বকরিহাটিতে রয়েছে। বাদলবাবু অমন অবাক চোখে তাকিয়ে কেন! মাথার মধ্যে তালগোল পাকানো ভয়টাকে দমিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টাটা যেন কিছুতেই মুখের উপর ভেসে উঠতে না পারে। জিভটা অসাড় লাগছে, একটা সিগারেট পেলে ভালো হয়।

”কেন?”

সুনীত তীক্ষ্ন চোখে তাকাল। বাদল নস্করের মুখের একটি পেশিরও নড়াচড়া সে দৃষ্টি থেকে হারাতে রাজি নয়। কোনোরকম সন্দিগ্ধতা, কিছু চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছে কি না, জানতে হবে।

”কে জানে কেন, এই অঞ্চলে নিত্যই তো কত ঘটনা ঘটছে…।”

কী ঘটছে? খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ… ওরা কি আমার জন্য ডেকে পাঠিয়েছে? গ্রামে নতুন লোক এসে রয়েছে সোমবার থেকে, এ খবর নিশ্চয় পেয়ে গেছে।

”গত এক মাসে তিনটে খুন হয়েছে, তার একটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের স্কুলেরই একটা ছেলে, অমিয়… গা-ঢাকা দিয়েছে। হয়তো ওর সম্পর্কেই… আপনার জ্বর এসেছে নাকি!”

”না না, ভালোই আছি। কাকে খুন করেছে?”

”আর বলবেন না, বুড়ি বিধবা পিসিকে হামানদিস্তে দিয়ে থেঁতলে মেরেছে মাত্তর আটটা টাকার জন্য। বুড়ির সোনাদানা ছিল তাতে হাত দেয়নি… এখনকার ছেলেরা কী যে হয়েছে, কত অল্পেই যে প্রাণ নিয়ে বসে। আমি তো ইসকুলে কারুর গায়ে আর হাত দিই না, মাস্টারমশাইদেরও বলে দিয়েছি ঝামেলার মধ্যে যাবেন না, দিনকাল আর আগের মতো নেই। …তাহলে টকই করুক আর দু-চারটে ভেজে দিক।”

বাদল নস্করকে তার সম্পূর্ণ অপরিচিত মনে হচ্ছিল যতক্ষণ কথা বলে যাচ্ছিল। সে জানে লোকটি কথা বলে যাচ্ছে কিন্তু ওর একটি কথাও কানে ঢুকছিল না কিংবা কোনো অর্থ তৈরি করছিল না। তার কেমন যেন মনে হচ্ছিল জীবন থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, একটা কৃত্রিম পৃথিবীতে সে আটকে পড়ে স্থির হয়ে রয়েছে। ভয়ে দিশাহারা হয়ে সে বেরিয়ে আসতে চায় এবার। এই লোকটা সম্পর্কে কিছুই সে জানে না। এই গ্রামটা সম্পর্কেও। এদের আছে নিজস্ব সমস্যা, নিজস্ব জীবন, নিজস্ব ছোটোখাটো পৃথিবী যাকে ঘিরে এরা আবর্তিত হচ্ছে খুবই সিরিয়াস ভঙ্গিতে। এটা তার জায়গা নয়। এখান থেকে তাকে চলে যেতে হবে। স্থানান্তর ঘটাতে হবে।

কোথায় যাব? চোখের মধ্যে শিরা উপশিরাগুলো দপদপ করছে। সুনীল জানলা দিয়ে আকাশে তাকাল। চশমাটা পরতে গিয়েও পরল না। হলুদ রেখাটা বিস্তৃত হয়েছে আকাশে। হলুদটা উজ্জ্বল হয়েছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। কালো একটা বিন্দু ভেসে যাচ্ছে অলস মন্থর গতিতে।

শুভ্রা একটা গামলা হাতে টিউবওয়েলের দিকে যাচ্ছে। মুখ ফিরিয়ে তাকাল। গামলাটা তুলে সুনীতকে দেখাল।

”মাছগুলো কাটতে বসিয়ে দিল।… স্কুল থেকে এসে দেখাব’খন।”

সুনীত শান্তভাবে মাথা হেলাল। তার মাথার মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। এখন সে জানে বাদল নস্কর ও শুভ্রা বাড়ি থেকে বেরোলে কিছু সময় অপেক্ষা করে সে-ও বেরিয়ে পড়বে।

এখন যদি সে কল্পতরুর দেখা পেত! তাহলে বলত, ”পৃথিবীটা ঝিরঝিরে গুমোট ভ্যাপসা আর অচেনা কিন্তু তবু একটা পৃথিবী তো বটে। এখানে এই শরীরটাকে ভয় থেকে মুক্তি দেবার মতো একটা জায়গা দিতে পারো… বাওবাব, বাওবাব!”

দু’হাত তুলে জানলার গরাদ ধরে সে অপেক্ষা করতে লাগল।

তিন

বারুইপুর স্টেশনে ট্রেন প্রায় পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে। কামরায় ভিড় নেই। এই সময় কলকাতার দিকে যাওয়ার লোক কমই থাকে। চাপদাড়িওয়ালা বৃদ্ধটি এখানে নেমে যেতেই সুনীত জানলার ধারে সরে এসেছে।

লোকটির দাড়িই শুধু নয়, চওড়া চৌকো কপাল আর টিকোলো নাকের সঙ্গেও মিহিরের অদ্ভুত একটা সাদৃশ্য আছে। ফোটোগ্রাফার মিহির অফিসে মাঝে মাঝে আসত রুবির কাছে। দু-চারটে কথা বলেই চলে যেত। কাচের প্যানেলের ওধারে দুজনের ভাবভঙ্গি, চাহনি, ঠোঁট নাড়া থেকে ওদের সম্পর্কটা বুঝে নেবার জন্য সুনীত ইন্দ্রিয়গুলোকে যথাসাধ্য সজাগ করে তুলত। রুবি সেটা লক্ষ করেছিল।

একদিন মিহির চলে যেতেই রুবি ভ্রু কুঞ্চিত করে কাচের ওধার থেকে সুনীতের দিকে তাকায়। তারপর সুনীতদের ঘরে আসে।

”মুখার্জি, অমন প্যাটপ্যাট করে কী দেখছিলে?”

রুবি তখন সুনীতকে ‘মুখার্জি’ বলত।

সামনের টেবিলে চিন্ময় মুখটা একবার তুলেই নামিয়ে নেয়। সুনীত না তাকিয়েই টের পায় চিন্ময় মুচকি হাসছে। রুবি চলে গেলেই ও আদিরসাত্মক টিপ্পুনি কাটবে।

টেবিলে দু’হাতে ভর দিয়ে রুবি ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল। হাতাবিহীন ব্লাউজের বড়ো ফাঁদের গলা এবং নাভির নীচে শাড়ির কষি সুনীতকে সন্ত্রস্ত করছিল। কোথায় চোখ রাখবে ভেবে পাচ্ছিল না। ওর শরীর কিছুই অবহেলায় নয়, উদ্বৃত্ত নয়।

”ঈর্ষা বোধ করছিলাম।”

দুজনের সম্পর্কটা তখন হাস্যপরিহাসের থেকে অন্তরঙ্গতায় নেমেছে।

”বেল পাকলে কাকের কী? তোমার ঈর্ষায় তুমিই শুধু জ্বলে মরবে।”

”বেলটা তো একদিন খসে মাটিতে পড়ে ফাটবে, সেজন্যই কাক অপেক্ষা করে।”

”আপাতত খসছে না, আর যখন পড়ে ফাটবে দেখবে ভেতরটা একদম পচা।”

খইয়ের মতো সাদা সাজানো দাঁতের উপর হালকা গোলাপি ঠোঁটদুটি রুবি টেনেছিল তখন। উপরের পাটি সামান্য এগিয়ে নীচেরটির থেকে। এজন্য ওর মুখমণ্ডলে গা শিরশির করা শ্বাপদ তীক্ষ্নতা ফুটে ওঠে যখন হাসে, মুখের হনু চওড়া, চোখ দুটি জ্বলজ্বলে এবং ক্ষুদ্র। হাসলে পাতায় চোখ ঢেকে যায়। কফি রঙের গায়ের চামড়ার নীচে পাতলা চর্বির স্তর ঔজ্জ্বল্য এবং নিটোলত্ব দিয়েছে অবয়বে।

রুবি একটু চাপা স্বরে বলেছিল, ”হয়েছে হয়েছে, তোমার সঙ্গে মিহিরের পরিচয় করিয়ে দেবো’খন; ছেলেটি ভালো, সাদাসিধে তবে একটু খ্যাপাটে। ভালো লাগবে।”

সুনীত জানলা দিয়ে স্টেশন মাস্টারের ঘরের দিকে তাকাল। বিনা চশমায় ঝাপসা লাগছে। চশমার জন্য বুক পকেটে হাত দিয়েই, নামিয়ে নিল। হঠাৎ ভাঙা চশমা পরতে দেখলে লোকে তাকাবে। সন্তর্পণে সে সামনের বেঞ্চে বসা তিনজনের মুখ লক্ষ করল। উদাস, বিরক্ত, উদ্বিগ্ন তিনটি মুখ। ট্রেনের হল কী! তার কেটেছে? কারেন্ট বন্ধ? ফিশপ্লেট খুলে নিয়েছে? অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে? যে-কোনো একটা হতে পারে, ভেবে লাভ নেই। রুবির হাইহিলের টকটক শব্দ ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর চিন্ময় বলেছিল, ”অবগাহনের নিমিত্তই বিধাতা কর্তৃক রমণী-রূপ সরোবর নির্মিত হইয়াছে… ব্রেসিয়ার পরেনি নিশ্চয় লক্ষ করেছিস।”

শেষের অংশটি এড়িয়ে সুনীত বলে, ”কাকে কোট করছিস?”

”কালিদাস, রঘুবংশ… কমনীয় ভুজলতাদ্বয় তার মৃণাল, মুখ তার পদ্ম, লাবণ্যের তরঙ্গ-লীলা সেই সরসীর জল, নিয়তচঞ্চল সশঙ্ক নয়ন সরোবরের শফর-মৎস্য, ঘনকৃষ্ণ কেশকলাপ তার শৈবাল পীনপয়োধর যুগল সরোবরের চক্রবাক মিথুন আর নিতম্বতট সেই জলে অবতরণের সোপান… বৎস সুনীত মনে হচ্ছে মদনের শরানলে দগ্ধ হয়ে তুমি সরসীতে অবতরণ করে জুড়োতে চাও।”

”এতটা মুখস্থ করে রেখেছিস?”

”ক্ল্যাসিক জিনিস মনে গেঁথে থাকে রে। এই বয়সেও ব্রেসিয়ার দরকার হয় না, ওটাও ক্ল্যাসিকাল ব্যাপার।”

”তোর মুখ থেকে শোনার আগে পর্যন্ত কালিদাসকে এমন ভালগার মনে হয়নি।”

চিন্ময় উঠে এসে সুনীতের টেবিলে রাখা প্যকেটটা থেকে সিগারেট বার করে ধরাল। ওর মুখে আর হাসি নেই।

”মানুষের শরীর ব্যাপারটা খুবই সুখের, তাই দরকারি। তোর কি সুখ দরকার নেই?”

”নিশ্চয় আছে।”

”একই মেয়েমানুষের সঙ্গে রাতের পর রাত… একই শব্দ, একই ভঙ্গি, একই কথা, একই গন্ধ, একই স্বাদ, একই বিরক্তি, একই… যদি সুখ বলা যায়, তাহলে ওই সুখ তোর ভালো লাগে?”

সুনীত উত্তর দেয়নি। হাত বাড়িয়ে প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে ধরাতে ব্যস্ত হয়। চিন্ময় কি খুব বাজে কথা বলছে? মনের মধ্যে উমার ছবিটা বিবর্ণ হয়ে এসেছে পাঁচ বছরেই, তার উপর নতুন একটা ঝকমকে ছায়া পড়েছে, রুবি। রসিকা, বুদ্ধিমতী এবং কামনা জাগাবার মতো শরীর। এর বেশি আর কী চাই। ইদানীং রুবির সঙ্গে প্রায়ই সে উমার তুলনা করতে শুরু করেছে। তার ফলে উমা ক্রমশই আবছা হয়ে যাচ্ছে।

”কীসের অন্যায় যদি আমি মেয়েমানুষের পিছনে ছুটি, যদি কাউকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে একঘেঁয়েমি ভাঙাই, তাজা হই শরীরটাকে সুখ দিয়ে। আমার তো আঁতেল মার্কা চেহারা নয়, পদ্যও লিখি না যে রুবি এসে টেবিল ঝুঁকে বুক দেখাবে, সাদা ভাল্লুকের মতো ক্ষমতাবানও নই, বছরে সওয়া লাখ মাইনেও পাই না যে রুবিকে বেঁধে রাখব।”

চিন্ময়ের চোখে মুখে কর্কশ তিক্ত আবেগ ফুটে উঠেছিল। ওর ভিতরে প্রচণ্ড একটা রাগ, বোধহয় স্ত্রীর বা সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধেই, ফেঁপে উঠে ফেটে পড়তে চাইছে। জীবনে ওর কি কিছু আকাঙ্ক্ষা ছিল? বোধহয় নিজেও তা জানে না।

”যদি পারিস তো লুটে নে, তবে সাদা ভাল্লুকটা যেন টের না পায়। তাহলেই পাটনা কি গৌহাটিতে বদলি করে দেবে… যারা মেয়েমানুষ পোষে তারা ভীষণ ঈর্ষাপরায়ণ হয়, বিশেষ করে বুড়োরা।”

”সাদা ভাল্লুক” পঙ্কজ আচার্য। সাড়ে ছ’ফুট লম্বা, অন্তত একশো কেজি, দেহভার। গায়ের চামড়া সাদা। ভারী জমাট ঘাড়ের উপর বড়ো মাথাটায় ঝাঁকড়া কাঁচাপাকা চুল কান ঢেকে কাঁধ পর্যন্ত নামানো। বক্সারদের মতো চাপা নাক। বিরাট দেহটি সামনে ঝুঁকিয়ে দু’বাহু দোলাতে দোলাতে হাঁটে। তালুতে মানানসই মোটা আঙুল। রুক্ষ মেজাজি পঙ্কজ আচার্য সুপুরুষ না হলেও প্রবলভাবে পুরুষ, ছাপ্পান্ন বছরেও। ”সাদা ভাল্লুক” নামটি চিন্ময়েরই দেওয়া, অফিসের দু-তিনজন তা জানে, রুবিও জানে এবং শুনে হো হো করে হেসে বলেছিল, ”নামটা ঠিকই দিয়েছে চিন্ময় ঘোষ, কিন্তু ওকেও একটা নাম দেওয়া দরকার… বাদামি ছুঁচো, ঠিক দিলাম কি সুনীত?”

সুনীতের মুখে একচিলতে হাসি ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রেনটা ছাড়ল। চোখ বন্ধ করে সে মাথাটা পিছনের কাঠে চেপে ধরল। বাদল নস্করের বাড়িতে নিশ্চয়ই এখন হুলুস্থুলু। অত রান্না খাবে কে! পদ্য দেখাতে পারল না শুভ্রা, বেচারা।

”এবার কোথায় যাব।”

শিয়ালদায় প্ল্যাটফর্মের গেটে কালো কোট পরা লোকটির হাতে টিকিট জমা দিতে সুনীত ব্যস্ত স্টেশনের একধারে দাঁড়াল। যে বেঞ্চটায় বসে গত রবিবার রাতটা কাটিয়েছিল এখন সেটায় ঘেঁষাঘেঁষি সাতজন বসে। গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে থাকা লোকটার পা সরিয়ে সে ঘণ্টা তিনেক ওই বেঞ্চে বসেছিল। একবার লোকটা পা দিয়ে তাকে ধাক্কা দেয়, বোধহয় দুঃস্বপ্ন দেখছিল। বুকে জড়িয়ে ধরা থলিটা দেখে সুনীতের মনে হয়েছিল ও কোনো ফেরিওয়ালা, শেষ ট্রেন ফেরি করার পর আর বাড়ি ফেরেনি। ওর তীক্ষ্ন কণ্ঠা, প্রকট হওয়া চোয়ালের হাড়, শিরাভরতি পুরোবাহু দেখতে দেখতে তার মনে পড়েছিল ন’বছর আগে ট্রেনে ঠিক এইরকম চেহারার এক কলম ফেরিওয়ালার কাছ থেকে সে ডটপেন কিনে বাদল নস্করের ছোট্ট মেয়েটিকে দিয়েছিল। তখন সে বকরিহাটি স্কুলের শিক্ষক, সপ্তাহান্তে কলকাতায় আসত।

লোকটিই তাকে মনে পড়িয়ে দেয় তাই সে বকরিহাটি গেছল। এখন কি কেউ তাকে এমন কারুর কথা মনে পড়িয়ে দিতে পারে যার কাছে সে যেতে পারে।

সুনীত এলোপাথাড়ি দেখতে শুরু করল মানুষের মুখ। কোনোদিন সে এভাবে অজানা অচেনা মুখের দিকে তাকায়নি। সবাই যেন একটি মুখোশই লাগিয়ে রেখেছে-ক্লান্ত, অনিশ্চিত, উদ্বিগ্ন দুটি চোখকে ঘিরে নানা রঙের নানা আকৃতির এক-একটি মুখ তার বুকের মধ্যে একটা হিমবাহ ভেঙে গিয়ে শিরাগুলোর মধ্য দিয়ে কনকনে স্রোত সারা দেহে ছড়াল।

ড্যাবড্যাবে দুটি চোখ, চৌকো মুখ, পুরু ঠোঁট এবং কালো চামড়ার একটি বউ দুটি খালি আনাজের ঝুড়ি বগলে চেপে উবু হয়ে বসে। ওর একটি স্তন দেখা যাচ্ছে এবং তাইতেই সুনীতের মন পড়ল…। কিন্তু যাকে মনে পড়াল এখন তার কাছে যাবে কী করে?

চাষি-বউটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখের উপর ঝলসে উঠল ঘটনাটা!

হাবাকে পিঠ থেকে ঝেড়ে ফেলে, কিছু না ভেবেই সে পালাবার জন্য অন্ধকার মাঠের দিকে ছুটে গেছল এবং দশ-বারো গজ গিয়েই পিছলে পড়ে যায়। তখন তার মাথার মধ্যে বিকট একটা লজ্জা পাগলাঘণ্টি বাজিয়ে যাচ্ছিল, ”ধরা পড়েছ… এবার বাঁচার চেষ্টা করো।”

বাঁশের খোঁটাটা সেই সময় তার মাথা ঘেঁষে মাটিতে আঘাত করে। অন্ধকারে হাবা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে, না হলে খুলিটা কয়েক টুকরো হত। তখন সে আত্মরক্ষার তাগিদে লাথি ছোড়ে, সেটা হাবার হাঁটুতে লাগে, ও পড়ে যায়। লাফিয়ে উঠে সুনীত ওর হাত থেকে খোঁটাটা যখন কেড়ে নিচ্ছিল তখন হাবা, গর্জনের চাপা ভারী একটা শব্দ করে।

তাই শুনে সুনীতের স্নায়ুগুলো কুঁকড়ে স্প্রিংয়ের মতো তার ভয়কে টেনে রাখে। অপ্রত্যাশিত অপ্রতিভতায় সে ছেয়ে যায়। শব্দটার মধ্যে বীরত্বের একপ্রকার ধরন ছিল, যা সে আশা করেনি এই অকিঞ্চিৎকর লোকটির কাছ থেকে, যা সে নিজেও প্রকাশ করতে পারেনি ট্যাক্সিওয়ালার সাগরেদের কাছে চড় খেয়ে বা তারও কয়েক ঘণ্টা আগে সাদা ভাল্লুকের থাবার আঘাতে ছিটকে পড়ে।

এইখানেই তার ঘাটতি, তার কাপুরুষত্ব। পুলুকে ঘিরে ধরে ক্ষুর দিয়ে যখন ওর নালিটা কেটে দেয় তখন সে জানলার একটা পাল্লা বন্ধ করে তার আড়ালে দাঁড়িয়ে, হাবার বউ তখন উবু হয়ে বসে গোবর চটকাচ্ছিল ঘুঁটে দেবার জন্য। সুনীত সেইদিকেই তাকিয়েছিল। কিন্তু ঘটনাটা সে আগাগোড়া এবং স্পষ্ট দেখেছিল। জানলার অপর পাল্লা বন্ধ করে, বিছানায় এসে খবরের কাগজটা তুলে নেয়। শুনেছিল হাবা একটা খোঁটা নিয়ে পুলুকে বাঁচাতে বা আততায়ীদের আক্রমণ করতে ছুটে গেছল।

মাটি থেকে হাবার উঠে দাঁড়ানোর প্রয়াস দেখতে দেখতে তার গোটানো স্নায়ুর স্প্রিং তাকে কাঁপিয়ে দিয়ে ছাড়া পায়। হাবা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। উপহাস করতে? বীরত্বের জন্য? তার মেয়েমানুষকে দখল করার বিরুদ্ধে?

মাথার মধ্যে দপ করে আগুন জ্বলে উঠেছিল। তারপর সে জানে না কী করেছিল। গত পাঁচ দিনে অন্তত চল্লিশবার সুনীত মনে করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।

সম্ভবত আধ মিনিট সে অন্ধকারের গর্ভে ডুবে ছিল। তারপর চশমাটা কুড়িয়ে নেয় অভ্যাসবশেই। পিছনে পায়ের শব্দের মতো কিছু একটা শুনে সে দ্রুত এগিয়ে চায়ের দোকান ঘেঁষে দাঁড়ায়। দোকানের মধ্যে থেকে তখন একজন চেঁচিয়ে উঠেছিল-”কে, কে ওখানে?”

শেয়ালদা সাউথ স্টেশন থেকে বেরিয়ে সুনীত পথে দাঁড়াল। এখন তার মনে হচ্ছে, অত্যন্ত গরিব, সরল বোকা অকালবৃদ্ধ লোকটার পৃথিবীতে একমাত্র সম্পত্তি ছিল ওর বউ। ওর পৌরুষে, অধিকারে বা ব্যক্তিত্বে হয়তো এগুলো ছিল এবং সুনীত সেগুলোকে আঘাত দিয়ে ওকে আহত করে। রাস্তায় বসে চিনেবাদাম বিক্রি করে রোগগ্রস্ত ফুসফুস সম্বল করা অতি তুচ্ছ জীবনকে সে হয়তো এই একবারই উচ্চচতা দেবার চেষ্টা করেছিল।

সুনীত বিমর্ষ বোধ করতে লাগল। নানাবিধ যানবাহনের শব্দ, ব্যস্ত চলাফেরা এবং ম্লান বিকেলের কিনারে দাঁড়িয়ে সে হাবাকে স্মরণ করল। হাঁটু পর্যন্ত তোলা ময়লা লুঙ্গি, জিরজিরে বুক, রুক্ষ চুল হাত নেড়ে জানোয়ারের মতো শব্দ করে ভাবপ্রকাশ, এ-ছাড়া আর কিছু তার মনে পড়ছে না। ওর থাকা-না-থাকায় কারুরই কিছু এসে যায় না। ওর বউয়ের এজন্য কোনো অভাববোধ হবে না। এটা নিছকই অনুমান কেননা জীবনধারণের ব্যাপারে বউটি স্বাবলম্বী।

তবু হাবার একটা প্রাণ ছিল এবং সেটি হরণ করে সে এখন খুনি। এই মুহূর্তে যত লোককে সে দেখতে পাচ্ছে, এদের মধ্যে কেউ কি তার মতো ত্রস্ত ভীত! কিন্তু যে লোকটির জীবনের কোনো অর্থ হয় না তার জন্য জেলে ঢোকার কী মানে হয়? উমাকে হেয় বা করুণার পাত্রী করারও অধিকার তার নেই।

কতজন জেনেছে ইতিমধ্যে? কেউই তো দেখেনি। কেউ নিরুদ্দেশ হলেই তো আর খুনি প্রমাণ হয় না। তবে জড়িয়ে ফেলে ওরা দীর্ঘকাল মামলা চালাবে। হাবার বউ অন্ধকারে না দেখতে পেলেও সেই প্রধান ও একমাত্র সাক্ষী। কী বলবে ও?

”খোঁটাটা কোথায় থাকত?”

”আমার ঘরে।”

”তুমি দেখলে এটা তুলে নিয়ে তোমার স্বামী ওর পিছনে দৌড়ল?”

”হ্যাঁ।”

”তুমি তখন কী করলে?”

”আমিও দৌড়লুম।”

”তারপর?”

”শব্দ হল। কে যেন খোঁটাটা দিয়ে মারছে।”

”ক’টা শব্দ?”

”দুটো।”

”গিয়ে কী দেখলে?”

 ”হাবা পড়ে আছে, সাড় নেই।”

”তখন কী করলে তুমি?”

সুনীত জানে না তারপর কী হয়েছিল। সে জানে না হাবার বউ কী বলবে।

মাঝবয়সি এক পুলিশ সাব-ইনস্পেকার স্টেশনের ফটকে দাঁড়িয়ে। ওর পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় সুনীত একবার তার মুখের দিকে তাকাল। কোনো কৌতূহল বা তীক্ষ্নতা চাহনিতে নেই। তবু অস্বস্তি থেকে সে নিজেকে ছাড়াতে পারল না। সে ইতস্তত করেনি। ডেইলি প্যাসেঞ্জারের মতো একটা ব্যস্ততা চলনে এনে সামনে দিয়ে হেঁটে এল। প্রতিদিন লাখদশেক লোক এই ফটক দিয়ে এইভাবেই তো ঢোকে এবং বেরোয়।

কিন্তু এই ভিড়ের ধাক্কাধাক্কির মধ্যে কেন দাঁড়িয়ে? হয়তো ডিউটি এখানেই কিংবা বাড়ির কেউ ট্রেনে উঠবে তাই তুলে দিতে কিংবা খবর আছে কোনো পলাতক ট্রেন ধরতে আসবে বা ট্রেন থেকে নামবে।

ও কি জানে তার চেহারাটা কেমন?

হয়তো কোনো ফোটো দেখানো হয়েছে ওকে। একটা কপিও হয়তো পকেটে আছে।

যদি সেটা পুরনো, বেশ কয়েক বছরের পুরনো চেহারার ফোটো হয়?

তাহলে চিনে নেওয়া শক্ত হবে।

ও কি জানে পরনে কী কী আছে?

নিশ্চয় জানে, সে-সব খোঁজ ওরা অবশ্যই নিয়ে রাখে। জামা প্যান্ট জুতো ঘড়ি চশমা…।

কিন্তু পলাতক তো ওর ইউনিফর্ম দূর থেকে দেখলেই সটকে পড়বে। এসব কাজ তো সাদা পোশাকের গোয়েন্দারাই করে।

তা করে। হয়তো এই বিস্কুটওলাটাই।

সুনীত স্থির করল এখুনি জামাটা বদলাতে হবে। চশমাটা পরা চলবে না, জুতোর বদলে চটি, ঘড়িটা পকেটে রাখা দরকার। প্যান্টটাও চিনিয়ে দিতে পারে। কিন্তু যত টাকা কাছে রয়েছে তাই দিয়ে কি এত বদল সম্ভব?

দক্ষিণে কয়েক পা হাঁটলেই ফুটপাথে সার দেওয়া দোকান। সুনীত চোখ ফেলতেই দোকানি হা-হা করে উঠল।

”কী চাই দাদা, প্যান্ট বুশ-শার্ট? এদিকে আসুন দেখে পছন্দ করুন।”

খুব তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। দরাদরি নয়, বাড়তি কথা নয়।

”শার্ট আছে?”

”আছে, টেরিকট, আপনার?”

”হ্যাঁ, কত পড়বে?”

”আগে দেখুন না, পছন্দ করুন, দামের কথা পরে।”

”দামটা আগে জেনে নিই।”

”চল্লিশ, সত্তর, তিরিশ…।”

”ওর কমে, টাকা তিরিশের মধ্যে, সুতির?”

”হবে।”

হলুদ জমিতে কালো ডোরা তার মাঝে লাল ফুটি ফুটি শার্টটা পছন্দ করল সুনীত। একটু ছেলেমানুষি ভাব থাকা দরকার। ওরা যা-সব শুনে তার রুচি সম্পর্কে ধারণা তৈরি করবে, শার্টটা তাই থেকে কিছুটা আড়াল হয়তো করবে।

তিরিশ টাকা দাম। কাগজে মুড়ে দিতে যাচ্ছিল সুনীত ইতস্তত করে বলল, ”পরে দেখি ফিট করল কি না।”

বুশ-শার্টটা খুলে জামাটা পরল। একটু আঁটো লাগছে। কাচলে আরও ছোটো হবে নিশ্চয়, কাচার দরকার কী?

”পরাই থাক বরং এই জামাটা মুড়ে দিন।”

এইবার একটা চটি। ফুটপাথে তক্তার উপর দু-তিনটি দোকান। দূর থেকে দেখে সে ঠিক করল জামা কেনার মতো প্রথম দোকানটা থেকেই চটি কিনবে। দোকান ঘুরে ঘুরে নিজেকে চিনিয়ে রাখাটা বোকামি হবে।

কুড়ি টাকা চটি পায়ে দিয়ে দুটি কাগজের মোড়ক হাতে সুনীত বউবাজারের মোড়ে এক ঘিঞ্জি অপরিচ্ছন্ন চায়ের দোকানে ঢুকল। কেউই তাকাল না বা তার উপস্থিতি লক্ষ করল না। আশ্বস্ত বোধ করার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রবল ক্ষুধায় আক্রান্ত হল।

চা, টোস্ট, অমলেট দ্বারা আধঘণ্টা সময় অতিক্রম করে আবার যখন সে রাস্তায় নামল তখন স্রোতের মতো ঘরমুখো মানুষ স্টেশনে চলেছে। এর মধ্যে একজনও কি চেনা লোক তাকে দেখতে পাবে না!

গজ পঞ্চাশ দূরে ব্রেক কষার কর্কশ শব্দে সুনীত তাকাল। কিছু লোকের মতো সে-ও চমকে উঠে এবং কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল। নীল শাড়ির কিছুটা সে দেখতে পাচ্ছে বাসটার ওপাশে রাস্তায় লুটিয়ে। ঊরু পর্যন্ত অনাবৃত। মনে হল কিশোরী। দেহের উপর চাকা ওঠেনি, হয়তো বেঁচে যাবে। ভিড়ের একটা চাক বাসটাকে ঘিরে ফেলেছে। কিন্তু ওই লোকটা! গুণেন ভবনের ‘বি’ ব্লকে, সুনীতের ফ্ল্যাটের উলটোদিকেই থাকে, কান্তি নামের লোকটিকে দেখে সে আর এগোল না। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স, বেঁটে, রুগণ, বউবাজারে আয়নার দোকান আছে কান্তির। সাদা শার্ট আর ধুতি পরে কিন্তু সুনীত কখনোই সেগুলো পরিচ্ছন্ন অবস্থায় দেখেনি। দাঁতগুলো হলুদ, দেশলাই কাঠি দিয়ে সর্বদাই খোঁটে। ওর থেকে অন্তত পঁচিশ বছরের ছোটো দ্বিতীয় পক্ষের বউ। বহুবার কান্তিকে সে দেখেছে কটমটিয়ে সুনীতের উপরের ফ্ল্যাটের দিকে তাকাতে। ওখানে এক যুবক আছে। খাবার টেবিলে বসে সুনীত বহুদিন লক্ষ করেছে, শান্ত নিরীহ বউটি সর্বদাই কিছু-না-কিছু গেরস্থালির কাজ করে যাচ্ছে।

উমা প্রশংসা করে বলেছিল, ”ছেলেমেয়ে তিনটে যে ওর নিজের পেটের নয়, বোঝায় যায় না। কী যত্নটাই না করে। আদর্শ মা।”

এবং আদর্শ বউ, মনে মনে সুনীত তখন বলেছিল। বলদের মতো সারাদিন মুখ বুজে কাজ করে, যা দেবে খাবে, যা দেবে পরবে। এইসব বলদ এদেশেই পাওয়া যায় এবং কান্তিদেরও।

কয়েকটা লোক বাসের ড্রাইভারকে হিঁচড়ে টেনে নামাচ্ছে, তার মধ্যে কান্তিও। ড্রাইভার দরজা আঁকড়ে ধরে ঝুলছে। কান্তি চিৎকার করছে, কানের নীচে মোটা দড়ির মতো পেশি, চিৎকারের দমকের সঙ্গে সেটা ফুলে ফুটে উঠছে। ঘুসি পাকানো সরু পুরোবাহুর শিরাগুলো বা দুই কণ্ঠার মাঝের গর্তটার থেকেও সুনীতের কাছে আকর্ষণীয় মনে হল চোখ দুটো। যে-কোনো মুহূর্তে গর্ত থেকে চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে পারে। সাদা ফেনা ঠোঁটের কোণে। ও যেন কিছু একটা বার করে দিতে চায়, যেটা দীর্ঘকাল ধরে মনে জমে আছে। কান্তি স্বাভাবিক হতে চাইছে।

”শালাকে মেরে ফেলুন…গাড়ি চালায় এমনভাবে যেন মনেই করে না রাস্তায় মানুষ আছে, ভাবে সবাই গোরু ভেড়া। মারুন, মারুন মেরেই ফেলুন। গোরু ভেড়া…।”

কান্তি কাউকে উদ্দেশ করে বলছে না। সুনীতের সঙ্গে চোখাচোখি হল। সাদা ম্যাপে আঁকা নদীর মতো লাল শিরা কান্তির চোখে।

”মেরে ফেলা উচিত এদের, শিক্ষা পাওয়া উচিত। তাহলে অন্য ড্রাইভাররাও…।”

তাকে চিনতে পারেনি।

সুনীত পিছিয়ে এল। এখন এমন এক মানসিক অবস্থায়, চেনা লোককেও কান্তি চিনতে পারবে না। লোকটা খেপে গেছে। হয়তো এইরকম খেপে উঠেই হাবাকে… কিন্তু সুনীত মুখার্জি আর এই লোকটার মধ্যে কি একই বোধ, একই অনুভূতি, একই প্রবৃত্তি কাজ করছে? দুজনে কি একই স্তরে? সুনীত অস্বস্তিতে পড়ল।

”একটা নয়, সব ক’টা বাসের ড্রাইভারকে ধরে ধরে পেটানো উচিত।”

মাঝবয়সি একজন ধীরগম্ভীর স্বরে সুনীতের পাশেই বলল।

”যত বাস এখান দিয়ে যাচ্ছে থামিয়ে, এক একটাকে টেনে…”

কে একজন ফিসফিস করল : ”পুলিশের গাড়ি।”

সুনীত চমকে তাকিয়ে দেখল একটা কালো ভ্যান।

মাথা নিচু করে হনহনিয়ে সে জগদীশ বোস রোড ধরে হাঁটতে শুরু করল। এবার বাস ধর্মঘট শুরু হবে হয়তো।

এখন কোথায় যাব!

মৌলালির মোড়ে দাঁড়িয়ে সে ইতস্তত তাকাল। কোথায় যেতে পারি? রাশি রাশি সময় এখন হাতে। কিন্তু একটা আশ্রয় চাই। নিজের পরিচয় মুছে দিয়ে… ধ্বংস করে এবার বাঁচতে হবে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পরিচয়হীন কাটাতে হবে। কতগুলো বছর! আরও পঁচিশ, তিরিশ। বংশে দীর্ঘজীবীদের সংখ্যা কম নয়। ঠাকুর্দা বিরাশি পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। এলাহাবাদে মেজোজ্যাঠা এখনও বেঁচে, আশি চলছে বোধহয়। বাবা কৃষ্ণনগরে সত্তর-বাহাত্তর।

সুনীত আকাশে তাকাল। বৃষ্টি হবার সম্ভবনা নেই। বাতাসটা বন্ধ হয়ে গেছে। কনকনানি ব্যাপারটাও বন্ধ বরং গুমোটে একটা অস্বস্তি সে বোধ করল। হয়তো আঁটো জামাটার জন্যই। আবছা মেঘের আড়ালে অস্পষ্ট নীল দেখা যাচ্ছে কি? চশমাটা বার করে সে পরল। একচোখ বন্ধ করে অন্য চোখে কাচের মধ্য দিয়ে তাকাল। কাচের সঙ্গে চোখটাকে মানিয়ে নিতে এখন অসুবিধা হচ্ছে। চশমাটা সে পকেটে রেখেছিল। কয়েকদিনেই চোখজোড়া অভ্যস্ত হয়ে গেছে চশমা ছাড়াই পরিবেশকে দেখার পক্ষে। হালকা ধূসর একটা আলো মেঘ থেকে চুঁইয়ে স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া তৈরি করেছে।

এখন তাকে ঘিরে ত্রিশ লক্ষেরও বেশি মানুষ, দোকান, অফিস, সিনেমা, থিয়েটার, বাজার; তার অফিসের সহকর্মীরা, কলেজের সহ-পড়ুয়ারা, বিস্মৃত কবিবন্ধুরা, ওরা সবাই তারই মতো এই মুহূর্তে কোনো-না-কোনো সমস্যায় পীড়িত, অন্তত ওদের কোনো একজন হয়তো তারই মতো ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে এখন সময় কাটাচ্ছে। এই মুহূর্তে কোথাও হয়তো কেউ ওত পেতে রয়েছে, অনেকেই হয়তো খুঁজে বেড়াচ্ছে, এই অবিশ্রান্ত উদ্দেশ্যপূর্ণ চলমানতার মধ্য থেকে তাকে সরিয়ে একটা বন্দিশালার মধ্যে আটকে রাখার জন্য। সারা পৃথিবীটাই পড়ে রয়েছে আর এখানে প্রায় উনচল্লিশ বছরের একটা লোক দাঁড়িয়ে, যার হাতে অফুরন্ত সময় এবং যার কোনো যাবার জায়গা নেই।

সুনীত স্থির করল যে কৃষ্ণনগর যাবে, বহু বছর বাবাকে দেখেনি।

গত দশ বছরে সে এমন চাপা ঠাসা দমবন্ধ করা পরিবেশের মধ্যে পড়েনি। তার ধারণা ছিল না অফিস ছুটির পর ট্রেনগুলির কী অবস্থা হয়।

কয়েক হাজার উত্তেজিত, উদ্বিগ্ন ও শ্রান্ত মানুষের সঙ্গে তিন ঘণ্টা প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করার পর সে ট্রেনে ওঠে। অ্যামপ্লিফায়ারের নির্দেশ শুনে দু’বার তারা ছুটে গেল অন্য প্ল্যাটফর্মে। কোনো স্টেশনের জনতা নাকি ট্রেনের সামনে বসে আছে, সময় ধরে ট্রেন চলাচলের দাবিতে। তাই শুনে সুনীতের পাশে দাঁড়ানো দীর্ঘ ঝুলফি, ঝোলানো গোঁফ এবং নিখুঁত গ্রন্থিতে টাই পরা সুশ্রী তরুণটি যার হাতের ভারী ব্যাগটা দেখে মনে হয় ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি, তিক্তস্বরে বলেছিল, ”তিনদিন আগেও এই অবস্থা হয়েছিল… চালের চোরাচালানিদের সঙ্গে পুলিশের ক্ল্যাশ, গুলিও চলে।”

”আমিও একবার রাত দু’টায় বাড়ি পৌঁছেছিলাম।” মুখ ঘুরিয়ে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই বলল সুনীতের সামনে দাঁড়ানো স্ত্রীলোকটি। অবিবাহিত, যৌবনের রেশ মুখে লেগে আছে, পিঠটা একটু কুঁজো। হয়তো রাইটার্সে চাকরি করে।

সুনীত শিউরে উঠল, এভাবে যদি তাকে রোজ অফিসে যাতায়াত করতে হত। বহুদিন সে আধমাইল হেঁটে টার্মিনাসে গিয়ে বাসে উঠে অপেক্ষা করেছে। এজন্য তাকে বেরোতেও হয় আধ ঘণ্টা বা তারও আগে যখন উমা স্নানে ব্যস্ত থাকে। ভিড়ে উমা অসুবিধা বোধ করে না। শুধু মানসিকতারই নয়, শরীরের সহনশীলতার ধরনটাও তাদের আলাদা। ঘাম, দুর্গন্ধ, ময়লা কাপড়, চাপাচাপি, অপরিচ্ছন্ন শরীর প্রভৃতিতে উমা বাল্য থেকেই অভ্যস্ত। বিয়ের আগে সুনীত কুমারটুলিতে ওদের কাকা-জ্যাঠার যৌথ পরিবারে একখানি ঘরের সংসারে তিন-চারবার গেছল।

ধাক্কাধাকি, ঝগড়া, গালাগালি, হাতাহাতি এবং নির্বিকারতা ভেদ করে সুনীত কামরাটায় উঠতে পেরেছে। ট্রেনের দুলুনির সঙ্গে কামরার মানুষগুলোর মতো সে-ও দুলছে আর ঘামছে। নভেম্বরকে আর অনুভব করা যাচ্ছে না।

একটা জলবিন্দু সুনীতের রগ থেকে চোখের কোণে চুঁয়ে চিবুকের দিকে নামছে। অসহ্য একটা শিরশিরনিতে মুখটা কুঁকড়ে উঠল। প্যাকেট দুটো একহাতে, অন্য হাত ধরে রডে ঝোলানো আংটা। বাহুর জামায় সে মুখ ঘষল। কয়েক সেকেন্ড পরই আর একটা বিন্দু রগ থেকে নামতে শুরু করল।

সামনে, পিছনে, দু’পাশ থেকে মানুষের চাপ, শক্ত হয়ে দাঁড়াবার জন্য মধ্যিখানের সবাই হাত তুলে রডটা ধরে আছে। পাশে যারা কামরার দেয়াল বা সিটের পিঠ ধরেছে। অনেকে কিছুই পায়নি হাত দিয়ে ধরার মতো। শ্বাসপ্রশ্বাস, ঘাম ও নোংরা কাপড়ের গন্ধে সুনীত বার দুই দীর্ঘক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে হাঁফিয়ে পড়ল।

ঘামের বিন্দুটা চিবুকের কাছে আসতেই সে আবার বাহুতে মুখ ঘষল। সামনের লোকটির মুখ দেখার চেষ্টা করল। মুখটা ফেরানো। মাংসহীন গাল, তীক্ষ্ন চোয়ালের হাড়। মাঝে মাঝে ঢোক গিলছে, নলিটা ফুলে উঠছে। কনুইয়ে সাঁটা ময়লা তুলোর কিনারে শুকিয়ে আসা ঘা।

পাশের লোকটির মুখ থেকে দুর্গন্ধ আসছে, সম্ভবত পাইওরিয়ার। সুনীত মুখ ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করতে গিয়েও করল না। চোখের কোণ দিয়ে দেখল, গোলাকার একটা তামাটে মুখ, কপাল থেকে মাথার মাঝ বরাবর চুল ওঠা। সুনীতের চোখে চোখ পড়তেই লোকটি মুখ নামিয়ে নিল।

আর একটা ঘামের বিন্দু নামছে। বিরক্তিটা এবার চাপা রাগ হয়ে সুনীতকে ঝাঁঝাতে শুরু করল। হাঁটুর কাছে একটা শক্ত থলির কোনা চেপে রয়েছে। অবস্থান বদলাবার জন্য পা সরাতে চেষ্টা করল। পিছনের লোকটি কিছু যেন বলল। পাশের লোকের শ্বাসপ্রশ্বাসে কানে গরম হাওয়া লাগছে। অনেকেই কথা বলছে কিন্তু কারুরই ঠোঁট নড়ছে না। সবাই একই ছন্দে দুলছে। কান্তিকে মনে পড়ল তার।… ”মেরে ফেলা উচিত…।”

প্রেসিডেন্সি বা আলিপুর জেল কি এর থেকেও জঘন্য? তিন ঘণ্টা কি আড়াই ঘণ্টা এই চোয়াল, এই ঘায়ের তুলো, এই পাইওরিয়া, এই ভ্যাপসানি, পায়ে থলির খোঁচা সহ্য করার থেকে কি একটি সেলে দশ বছর বাস করা বেশি অসহনীয়? সুনীতের চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে। ট্রেনের দুলুনি, চিটচিটে ঘাম, ভিড়ের চাপ এবং গরম, অদ্ভুত একটা ঘোর তৈরি করছে তার মধ্যে। স্টেশনে ট্রেন থামছে এবং ছাড়ছে এইটুকুমাত্র সে বুঝতে পারছে। চারদিক থেকে যে জমাট রক্তমাংসের চাপটা তাকে পিষে আছে, সেটা হালকা হচ্ছে না। তবে সে জানে, ট্রেন যত এগোবে কামরাটা ক্রমশ হাঁফ ছাড়বে।

কিন্তু আপাতত, এই ঘোরটা তার রাগটাকে দমিয়ে রাখছে। রাগ যে কার উপর সে বুঝতে পারছে না। সম্ভবত নিজের উপর। কেন? ট্রেনে ওঠার জন্য… নাকি যে কাজটা করে ফেলে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে, তার জন্য? যদি বাস-ড্রাইভারটা মরে যায়, তাহলে কান্তি এবং অন্যান্যরা কি ফেরার হবে?

দেশলাই কাঠি দিয়ে হলদে দাঁতের ফাঁক থেকে আবর্জনা খোঁটা বন্ধ রেখে কান্তি দু’হাতে জড়িয়ে বউকে চুমু খাচ্ছে, এমন একটা ছবি সুনীতের মনে ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল। ”….ভাবে সবাই গোরু ভেড়া?… মারুন মারুন।”

সুনীত চোখ খুলল। চোখের পাতা চটচট করছে। পাতলা বাষ্প চোখের সামনে। এখন আর কোনো গন্ধ পাচ্ছে না সে। জামাটা গায়ে আছে কি না বুঝতে পারছে না। চামড়ায় চিটচিটে একটা আবরণ। ইন্দ্রিয়গুলো বোধশক্তি হারিয়েছে। সকলের মাথার উপর দিয়ে সে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করল।

হাতগুলো উপর দিকে তোলা। রড থেকে ঝোলানো আংটাগুলোকে আঁকড়ে রয়েছে। অনেকগুলো হাত… ঊর্ধ্বমূলধঃশাখমশ্বত্থং? মূল ঊর্ধ্বদিকে শাখা অধোদিকে কিন্তু বকরিহাটির ভূগোলের মাস্টারের মতে এটা অশ্বত্থগাছ নয়, বাওবাব। এই গাছ নাকি ঢাকুরিয়া লেকের উত্তর-পশ্চিম কোণে আছে, অথচ কেউ জানে না।

ভদ্রলোক ঘণ্টাখানেক বকবক করছিলেন। সুনীত চোখ বন্ধ করে মনে করতে চেষ্টা করল : ”ভুল বলেছেন কৃষ্ণ।” মাস্টার বুঝিয়েছিল, ”উনি এমন এক গাছের কথা বলেছেন যা পথেঘাটেই দেখা যায়। অশ্বত্থ কি অব্যয়? শ’খানেক বছর তো মাত্র বাঁচে, বাওবাব বাঁচে দু-তিন হাজার বছর। তা ছাড়া কৃষ্ণ কেনই যা বললেন, না রূপমস্যেহ তথোপলভ্যতে… এই গাছের স্থিতি, রূপ, আদি অন্ত মধ্য কিছুই বোঝা যায় না। অশ্বত্থের কি কিছুই বোঝা যায় না? গোলমালটা কোথায় জানেন, কেউ আর মিলিয়ে দেখেনি কৃষ্ণ যা বলেছেন সেরকম গাছ এদেশে আছে কি না। তা ছাড়া বাওবাব তো ভারতে দু-পাঁচটার বেশি নেই যে চট করে মিলিয়ে নেওয়া যায়। বুঝলেন এই বাওবাবই হচ্ছে কল্পতরু যা সাগরমন্থনে উঠেছিল, ইলোরা গুহায় নাকি পাথরে খোদাই কল্পতরুর চেহারা আছে, সত্যি? আপনি জানেন?”…সুনীত মাথা নেড়েছিল। সে কিছুই জানে না। কিন্তু সে বাল্যকাল থেকে জানে কল্পতরুর কাছে যা চাওয়া যায় তাই নাকি পাওয়া যায়।

সুনীত আবার চোখ খুলল। পাতাঝরা গাঁটওলা শুকনো ডালের মতো কনুই, শিরা, হাড় আঙুল নিয়ে এক একটা হাত উঁচু হয়ে রয়েছে। শূন্যে ছড়ানো শিকড়! কৃষ্ণও জানে না, ভূগোলের মাস্টারও জানে না কল্পবৃক্ষের স্বরূপ।

”জীবন্ত বোধ করার জিনিসগুলো এখুনি আমার শরীরে ফিরিয়ে দাও,” বাষ্পাচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে সে হাতগুলির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, ”শুধু এইটুকুই…বাওবাব।”

চার

কালো কাঠের বোর্ডে বাংলায় সাদা অক্ষরে লেখা ছিল নামটা : ডা. অদিতিকুমার মুখার্জি (হোমিও)।

রাস্তার ইলেকট্রিক আলো যথেষ্ট দূরে এবং দেয়ালটা শ্যাওলায় কালো হয়ে আছে। সুনীত দরজার একবিঘত কাছে মুখটা এনে তন্ন তন্ন খুঁজল। তারপর হাত বুলিয়ে দেয়ালে পোঁতা দুটো হুকের মাথা পেল। বোর্ডটা আর নেই।

সে উপরে তাকাল। বড়ো ঘরটা অন্ধকার। তার পাশে ছোট্ট ছাদটাও অন্ধকার। রাস্তা থেকে এর বেশি দোতলার কিছু দেখা যায় না। বাবা কি বাড়িতে নেই? এই সময় কোথায় যেতে পারেন, কোনো মন্দিরে বা কোনো আড্ডায়? কখনও সে বাবাকে ধর্মপ্রাণ হতে দেখেনি, আড্ডা একটা ছিল বটে সত্যসখাবাবুদের বাড়িতে, কিন্তু সে শুনেছে, লোকজনের সঙ্গে বাবা আর মেলামেশা করেন না। তাহলে কি ঘুমিয়ে পড়লেন?

সুনীত ঘড়ি দেখার চেষ্টা করল। সামান্য আলোয় কালো ডায়ালে সে কাঁটার অবস্থান বুঝতে পারল না। রিকশা থেকে নামার সময় একটা ওষুধের দোকানের দেয়ালঘড়িতে দেখেছিল আটটা-পঞ্চান্ন। দু’ঘণ্টার কিছু বেশি সময় ট্রেনে ছিল। রিকশা নিয়ে গলিতে ঢুকতে চায়নি। অনেকেই আছে যারা এত বছর পরও হয়তো তাকে চিনে ফেলতে পারে। কৌতূহলী দৃষ্টি সে এড়াতে চায়। তা ছাড়া এখানকার থানায়ও নিশ্চয় খবর এসেছে, রিকশাওয়ালাটা ইনফর্মার কি না কে জানে। এই বাড়িতে নতুন কোনো লোক এলেই হয়তো থানায় খবর দেওয়ার নির্দেশ আছে।

সদর দরজা ভেজানো। ফাঁক দিয়ে ভিতরে আলো দেখা যাচ্ছে। দরজার পাশের জানলায়ও আলো। ঘরের ভিতর রেডিয়োয় সম্ভবত নাটক হচ্ছে, নীচের পাল্লা দুটো বন্ধ থাকায় ভিতরটা সে দেখতে পেল না। এক বুড়ি এবং বাচ্চচা একটা মেয়ে সুনীতের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। সে চেনার চেষ্টা করল বুড়িটাকে এবং চিনতে না পেরে আশ্বস্ত হল।

নিঃশব্দে লোকটি যে কখন দরজা খুলেছে সে টের পায়নি। কী যে বলবে, এই মুহূর্তে ভেবে উঠতে পারল না। বাবাকে চাই? নিজের কানে কথাটা হাস্যকর শোনাবে। এত রাতে নিজের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে যদি কেউ বলে ”বাবাকে চাই”, তাহলে সেটা মনে রাখার মতো একটা ব্যাপার হবে। তার মানে আর একজন সাক্ষী তৈরি করা।

”ডাক্তারবাবুকে চাই।”

অন্ধকারে মুখ দেখা না গেলেও লোকটির চুপ করে থাকা দেখে সুনীত বুঝতে পারল অবাক হয়েছে। বছর পাঁচেক আগে বাবা লিখেছিলেন, একতলাটা ভাড়া দিয়েছেন। লোকটি হয়তো ভাড়াটেদেরই কেউ।

”ওপরে থাকেন যে বুড়ো ভদ্রলোক? অদিতিবাবু?”

”হ্যাঁ।”

”দাঁড়ান।”

লোকটি ভিতরে চলে গেল অন্তর্পণে দরজা ভেজিয়ে। ফিরে এল মিনিট তিনেক পর।

”আপনার নাম?”

”বলুন কলকাতা থেকে…”

অনুভূতি সুনীতকে নির্দেশ দিল নাম না বলার জন্য।

…”গাবলু এসেছে।”

লোকটি আবার দরজা ভেজিয়ে ফিরে গেল।

গাবলু। সুনীত অবাক হয়ে ভাবল, নামটা কী করে তার মনে পড়ল। শেষবার এই নাম ধরে, বছর সাত-আট আগে বাস থেকে চেঁচিয়ে ডেকেছিল প্রিয়ব্রত। কৃষ্ণনগরে তারা একসঙ্গে স্কুলে পড়েছে।

তাকাতেই, প্রিয়ব্রত বাসের জানলার রডে থুতনি চেপে দ্রুত বলেছিল, ”তোকে খুব দরকার, কোথায় পাব? কোন অফিসে আছিস?”

সুনীত তার অফিসের নামটি বলেছিল, তবে চেঁচিয়ে নয়। বাস স্টপে তখন অনেক লোক এবং তাদের শুনিয়ে চিৎকার করে অফিসের নাম বলতে সে আড়ষ্ট বোধ করেছিল।

”কী নাম…জোরে বল।”

বাসটা তখনই ছেড়ে দেয়। প্রিয়ব্রতর দরকারটা আর জানা হয়নি। পাড়ার অনেকেই এবং বন্ধুরা তাকে ‘গাবলু’ নামে ডাকত, আর এই বাড়িতে একমাত্র মা। বাবা ‘সুনীত’ ডেকে গেছেন বরাবর। তার এগারো বছর বয়সে ক্যানসারে যখন মা মারা যায় তখন বাবা মধ্য-চল্লিশ, কঠিন পেশিতে মোড়া দীর্ঘদেহী পুরুষ। যুবকরা ম্লান হয়ে যেত তার কান্তি ও সমুন্নত ভঙ্গির পাশে।

”আপনার নাম কি সুনীত?”

”হ্যাঁ।”

”ওপরে যান…ডান দিকে সিঁড়ি।”

সদর দরজার পাশের ঘরটা ছিল রোগীদের বসার এবং ডিসপেনসারি। তার পিছনের ঘরটায় বাবা বসতেন, দরজায় পর্দা ঝুলত। সকাল-সন্ধে ভিড় লেগেই থাকত। সিঁড়ির বালবটা আগের মতোই কম পাওয়ারের এবং বিষাদময়, যেজন্য সন্ধ্যার পর থেকেই বাড়িটাকে তার বিষণ্ণ মনে হত।

সিঁড়িটা ঘুরে উঠে দোতলার দালানে পৌঁছেছে। দালানের মাঝখানে বাবা দাঁড়িয়ে। সিলিং থেকে ঝোলানো আলো মাথা এবং ঘাড় বেয়ে ঝরে পড়ছে। সুনীল মুখের কয়েকটা জায়গায় অন্ধকার দেখতে পেল।

”কী ব্যাপার, হঠাৎ এত রাত্রে?”

”এমনি। বহরমপুর গেছলাম অফিসের এক কলিগের বাড়িতে। ফেরার পথে ভাবলাম…।”

কণ্ঠস্বরে একটুও তারতম্য ঘটেনি। গম্ভীর, স্পষ্ট এবং জুয়ারি। মিথ্যা বলতে বুক কাঁপে।

”আমি ভাবলাম কিছু একটা…বউমা ভালো আছে?”

”হ্যাঁ।”

উমাকে উনি এখনও পর্যন্ত দেখেননি।

”ঠান্ডা পড়েছে, গরম জামা গায়ে দাওনি কেন?”

”কোট ছিল। কাল কাদার উপর পিছলে পড়ে এমন অবস্থা হল যে কোটটা কাচার জন্য বহরমপুরেই রেখে এলাম। বন্ধুর শার্ট পরে এসেছি, জুতোটাও কাদায় গেছে।”

”ঘরে বোসো।”

সুনীত বড়ো শোবার ঘরটায় সন্তর্পণে ঢুকল। চটিটা সিঁড়ির শেষ ধাপে খুলে রেখে এসেছে। কেমন যেন তার মনে হচ্ছে নিজের বাড়িতে সে আসেনি; শৈশব, বাল্য, কৈশোর এবং প্রথম যৌবন যেন এখানে সে কাটায়নি। কীসের একটা কুণ্ঠা তাকে চেপে ধরেছে।

দীর্ঘকাল বাবার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখার জন্যই কি! বছরে একটা দুটো চিঠি লেখালেখি তো হয়ই। স্বাভাবিক সৌজন্য, কুশল কামনা, টুকিটাকি দু-চারটে খবর ছাড়া বাবার চিঠিতে কোনো কৌতূহল, দুঃখ, হতাশা বা বিরাগ কখনও প্রকাশ পায়নি। কখনও বাড়িতে আসার আমন্ত্রণও জানাননি।

কাঠের দেরাজ খুলে উনি জামা-কাপড়ের স্তূপের মধ্যে বাছাবাছি করছেন। কাঠে হেলান দিয়ে সুনীত দেয়ালে ঝোলানো মায়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে। বহুদিন আগে তার একবার মনে হয়েছিল, ছবিটা সে চাইবে। রক্তের সম্পর্ক আছে এমন কারুর ছবি চোখের সামনে থাকলে একটা ভরসা পাওয়া যাবে, মনে হবে খুঁটি আছে, শিকড় আছে, শ্যাওলার মতো ভাসছি না। কিন্তু বাবার কাছে চাইতে সাহস হয়নি। এখন যদি চাওয়া যায় দেবেন? নাকি বলবেন, ”তেজ দেখিয়ে বলেছিলে এ-বাড়ির কুটোটি পর্যন্ত ছোঁব না, এ-বাড়ির উপর সব দাবি ত্যাগ করলাম, তাহলে কেন…।”

”ওটা চাই?”

সুনীত চমকে উঠল। নস্যি রঙের গরম পাঞ্জাবিটা খাটের উপর রেখে অদিতিকুমার বললেন, ”দ্যাখো তো এটা গায়ে হয় কি না। সিজন চেঞ্জের সময় সাবধানে থাকা উচিত।”

”আমার খুব একটা শীত লাগছে না।”

”না লাগলেও পরা উচিত, চোরা ঠান্ডা ঠিক বোঝা যায় না। তোমার তো সর্দির ধাত।”

মনে রেখেছেন! সুনীত অস্বস্তি ভরে ওধার-এধার তাকাল। ঘরটা মিউজিয়মের মতো সাজিয়ে রাখা। জ্ঞান হওয়া থেকে সে এই ঘরের যে জিনিসটা যেখানে দেখেছে, আজও সেটি সেখানে। ঘরের কোণে রঙিন খদ্দরের ঘেরাটোপে সেলাইয়ের মেশিন, তার পাশে গ্রামোফোন। দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো পশমেবোনা ফুলের সাজি, আয়নার সামনে কাঠের ব্র্যাকেটে ধূপদানি এমনকী জলচৌকিতে কাঁসার পানের বাটাটিও। প্রত্যেকটি ধাতু, কাঠ, কাচ ও কাপড় ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন। বোঝা যায় নিয়মিত যত্ন নেওয়া হয়। ঘরের আর এক কোণে টেবিলে অর্ধসমাপ্ত চিঠি, ফাউন্টেন পেন, মোটা ফ্রেমের চশমা এবং টেবিল ল্যাম্প। এগুলো আগে ছিল না। টেবিলটা ছিল ডিসপেনসারিতে। চশমাটা সুনীত এই প্রথম দেখল।

”নিশ্চয় খিদে পেয়েছে? আমি অবশ্য আটটার মধ্যেই খেয়ে নিই।”

উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সুনীত লক্ষ করছে যা কিছু কথাবার্তার উদ্যোগটা ওনারই, সে শুধু উত্তরদাতা। বহুদিন পর একমাত্র ছেলেকে দেখে কোনো ভাবান্তর বা আচরণে কোনো বিহ্বলতা নেই। আওতার মধ্যে পেয়ে ব্যক্তিত্বের দাপট দেখাচ্ছেন তা-ও নয়। এসবই ওঁর স্বাভাবিক ভঙ্গি। শুধু একবার…সুনীত সেই ঘটনাটা ভেবে একটু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করল।

মা মারা যাবার পর সে আর বাবা এই খাটেই শুত। এর আগে পাশের ছোটো ঘরটা, যেখানে একটি চৌকি এবং টেবিল ছাড়া কিছু নেই, বাবা সেখানেই শুতেন। তখন রান্না, বাসন মাজা, ঘর মোছা ইত্যাদি সাংসারিক কাজ করত ভোলার মা। বুড়ি নিখুঁতভাবে পেরে উঠত না সব কাজ। একদিন সে নিজেই অবসর নিয়ে পনেরো মাইল দূরে তিতলেপোতায় ছেলের কাছে ফিরে যায় এবং পাঠিয়ে দেয় নাতনি কমলাকে।

সুনীতের ভালো লেগেছিল ওকে। বছর বাইশ বয়স। গ্রামের মেয়েরা যেমন হয়, ভীরু, শান্ত ঠান্ডা স্বভাবের। সুনীত তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্র। ভীরু ভাবটা কেটে যাবার পর প্রচুর কথা বলত তার সঙ্গে। বয়সের ব্যবধানটা ঘুচে গেছল কমলার মানসিক অপরিণতি এবং সারাক্ষণ প্রায় একাকী জীবনযাপনের জন্য। দিনরাতের অধিকাংশ সময়ই বাবা থাকতেন একতলায় বা বাড়ির বাইরে। সুনীত এবং কমলা ছাড়া দোতলায় আর কেউ ছিল না। দুজনের মধ্যে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

সুনীত ওকে অক্ষর পরিচয় করাবার দায়িত্ব নিয়েছিল। বর্ণপরিচয় কিনে পড়াতেও শুরু করে। সন্ধ্যায় যখন সে টেবিলে পড়ত কমলা মেঝেয় বসে শ্লেটে দাগা বুলোত। সুনীত জীবনে সেই প্রথম নিজের ব্যক্তিত্ব ঘনিয়ে ওঠার অনুভব পায়। কমলা তার অনুগত বাধ্য ছাত্রী ছিল। দু’মাসের মধ্যে সে প্রথমভাগের মাঝামাঝি পৌঁছে যায়।

একদিন সন্ধ্যায় কমলা টেবিলের ধারে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে সুনীতকে হাতের লেখার খাতা দেখাচ্ছিল। কী একটা বলার জন্য সুনীত মুখ তুলতেই দেরাজের পাল্লায় বসানো আয়নায় দেখতে পায়, ঘরের দরজায় বাবা দাঁড়িয়ে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন।

সুনীত সঙ্গে সঙ্গে আড়ষ্ট হয়ে খাতাটা ঠেলে সরিয়ে দেয়। কমলা সচকিতে পিছনে তাকায় এবং খাতাটা তুলে নিয়ে আঁচলে ঢাকে। বাবা ভিতরে ঢুকতেই সে বেরিয়ে যায়।

দেরাজ থেকে একটা চওড়া খাম বার করে নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে বাবা থমকে দাঁড়ান।

”কী করছিল ও?”

”আমার কাছে পড়ে।”

”তোমার নিজের পড়া নেই? সময় নষ্ট করো কেন?”

রাত্রে দালানে সুনীত একা যখন খাচ্ছে, কমলা হঠাৎ বলে, ”বাবাকে তুমি ভয় পাও, না?”

সুনীত জবাব দেয়নি।

”আমারও ভয় করত… এখন আর করি না।”

ওর কণ্ঠস্বরে কী একটা যেন ছিল… চপল তাচ্ছিল্য, যেজন্য সুনীত মুখ তুলে তাকিয়ে ছিল। বাবার প্রতি এমন হালকা ভঙ্গি কোথা থেকে সংগ্রহ করল জানার জন্য কমলার চোখের দিকে তাকিয়ে সেদিন কিছুই বুঝতে পারেনি।

এর মাস ছয়েক পরেই কমলা মারা যায়। রাতে ঘুমিয়ে থাকার জন্য সুনীত জানতেই পারেনি পাশের ছোটো ঘরে কমলা রক্তস্রাব করতে করতে মারা যাচ্ছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরের বাইরে যাবার জন্য দরজার কাছে আসতেই সে শুনতে পায় : ”কী ব্যবস্থা করবে?… হাসপাতালে?… বরং পুলিশে আগে…।”

বাবার কণ্ঠস্বরে, উত্তেজনা ছাপিয়েও ফুটে উঠেছিল ত্রাস যা কখনও সে শোনেনি।… ”জানাজানি হবেই, আমি মুখ দেখাতে পারব না… সুনীতও জানবে।” একটা অস্ফুট ক্রোধ হঠাৎ আর্তনাদে পরিণত হয়ে কাতরে উঠল। ”… আমাকে সুইসাইড করতে হবে।”

বাবা দালানে পায়চারি করছিলেন, মুখ ফ্যাকাশে। চোখ বসে গেছে। সেই প্রথম তার চোখে পড়ে, বাবা যেন একটু কুঁজো হয়েছেন। সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিল সুকুমারবাবু, বাবার কম্পাউন্ডার। সুনীতকে দেখেই বাবার চোখে ভয় ফুটে উঠেছিল। অসহায়ভাবে সুকুমারবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

”সুনীত ক’টা দিন নয় আমার বাড়িতেই থাকবে।”

বৃদ্ধ সুকুমারবাবুর স্বর ছিল অনুত্তেজিত। সুনীত কৌতূহলী চোখে তাকায়।

”কমলা অসুস্থ, রোগটা ছোঁয়াচে তাই তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব।”

ছোটো ঘরের পাশ দিয়ে কলঘরে যাবার সময় সে তাকায়। কমলা মেঝেয় শুয়ে। চোখ বন্ধ। বাবার একটা ধুতি তার দেহের উপর গলা পর্যন্ত বিছানো। কলঘরের একধারে সে দেখে রক্তমাখা কমলার শাড়ি।

সুকুমারবাবুর বাড়িতে তিন দিন থেকে সুনীত ফিরেছিল এবং তিন মাস পরে অ্যানুয়াল পরীক্ষার ফল বেরোতেই তাকে হাওড়ার সেন্ট পিটার্স স্কুলের বোর্ডিংয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ওই তিন মাসের মধ্যেই সুনীত জানতে পেরে যায় কেন কমলা মারা গেল।

অদিতিকুমার ডিসপেনসারি বন্ধ করে দিয়েছিলেন, বাড়ি থেকেও বেরোতেন না। সদর দরজাটা সারাদিনে কদাচিৎ খোলা থাকত। একতলার যে-ঘরে রোগী দেখতেন সেখানেই ক্যাম্পখাট পেতে রাতে শুতেন আর সেগুন কাঠের ভারী ইজিচেয়ারে সারাদিন হেলান দিয়ে থাকতেন ঘরের জানলা বন্ধ করে।

ছেলের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে নিয়েছিলেন একতলার ঘরে নিজেকে বন্দি করে, কিন্তু বাইরের জগৎ থেকে ছেলেকে আড়াল করতে পারেননি। জানতেন, পারা সম্ভবও নয়। কানাঘুষোগুলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে সুনীতের কানে আসছিল। সে লক্ষ করে, পাড়ার বয়স্ক লোকেরা তাকে দেখলেই তাকায় এবং সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নেয়। জানলায় বা বারান্দায় মেয়েদের কথা বন্ধ হয়ে যায় তাকে দেখে এবং মুখ টিপে নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে। ক্লাসে তার বিশেষ এক বন্ধু ছিল না প্রিয়ব্রত ছাড়া।

এই প্রিয়ব্রতই তাকে একদিন বলে, ”সবাই তোর বাবার নামে যা-তা বলছে। তোদের ওই ঝিয়ের সঙ্গে নাকি তোর বাবার…”

সুনীতের ফ্যাকাশে মুখ দেখে সে থেমে যায়। এক রাত্রে ঘুম ভেঙে যেতে সুনীত দেখেছিল বাবা বিছানায় নেই। কিন্তু ভাবেনি তাই নিয়ে। এখন সে ভাবল এবং প্রিয়ব্রতর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলে, ”সব বাজে কথা।”

”তোর বাবা নাকি ওষুধ খাইয়ে পেট খসাতে গিয়ে মেরে ফেলেছে।”

”সব বাজে কথা।”

”পুলিশকে কুড়ি হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ধামাচাপা দিয়েছে নয়তো যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হত।”

”এসব কে বলেছে তোকে?”

”কে আবার বলবে, সবাই জানে। সবাই বলছে তোর বাবা দুশ্চরিত্র, খুনি।”

সুনীত রাগে থরথর কেঁপেছিল। কারুরই জানার কথা নয়, সে নিজে পর্যন্ত কিছুই জানে না। চিৎকার করে কিছু বলার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখে স্বর বেরোল না, চোখের সামনে একটা কালো পর্দা কাঁপছে। পর্দাটার পিছনে দাঁড়িয়ে দু-হাতে ওটাকে ধরে কেউ যেন দোলাতে দোলাতে এগিয়ে আসছে তার দিকে। সুনীত আবার চিৎকার করার চেষ্টা করে।

”কী ব্যাপার, স্বপ্ন দেখছিলে নাকি।”

চোখ খুলে সুনীত দেখল সে খাটের উপর শুয়ে। কখন শুয়ে পড়েছে জানে না, কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতে পারেনি। বাবা ঝুঁকে রয়েছেন। মুখে মৃদু হাসি। সুনীত উঠে বসল।

”আলুভাতে-ভাত হয়ে গেছে, একটু দই কিনে আনি!”

”তুমি বাইরে বেরোও।”

অপ্রতিভতার একটা ঝলক দুজনের মুখের উপর দিয়ে পিছলে গেল। দুজনেই চোখ সরিয়ে নিল। কথা না বলে অদিতিকুমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। বোকার মতো মুখ ফসকে কেন যে কথাটা বেরোল! সুনীত কপালে তালুর উলটোদিকে ঠেকিয়ে ভাবল, জ্বর আসবে বোধহয়।

পসার, প্রতিপত্তি, মর্যাদাচ্যুত হয়ে, নিজেকে বন্দি করে রাখতে বাধ্য হওয়া লোকটি এখন বৃদ্ধ। বেঁচে থাকলে কমলা এখন পঞ্চাশের কাছাকাছিই হত। ও মরে না গেলে, দুজনে এখন কীভাবে জীবনযাপন করত! বাবা এতগুলো বছর ধরে এই বলে কি আক্ষেপ করেছেন, শারীরিক তাড়না এড়াতে পারলে জীবনে এমন বিপর্যয় নেমে আসত না! উনি কি জানেন, তার ছেলে এখন ঠিক তাঁর মতো অবস্থায় পড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। জানলে কি অট্টহাসিতে ফেটে পড়বেন? বলবেন কি, ”পুত্র আমাকে তুমি রক্ত মাংস মেদ মজ্জায় বহন করছ, আমায় আর ঘৃণা কোরো না। তার থেকে পাপ, আর কিছু হতে পারে না। এইবার আমি মুক্ত।”

জিজ্ঞাসা করতে হবে, এখন তুমি কী ভাবছ, কী করে দিন কাটাও! কখনও কি স্ত্রীর কথা তোমার মনে পড়ে? বলেছিলে আত্মহত্যা করবে যদি আমি জানতে পারি, জেনেছি, কিন্তু করোনি। কেন? জীবন সম্পর্কে কোনো লেকচার নয়, শুধু জানতে চাই আত্মহত্যা করোনি কেন?

কী জবাব দিয়েছিলে যখন সেন্ট পিটার্স স্কুল বোর্ডিঙের ফাঁকা ভিজিটার্স রুমে কথাটা জিজ্ঞাসা করেছিলাম?

”তুমি এখন ছোটো, তুমি বুঝবে না…”

”কী বুঝব না, কেন বুঝব না?”

”আগে তোমার দেহ তৈরি হোক, সম্ভোগের সুখ জানুক, তারপর আমায় জিজ্ঞাসা কোরো। এসব কথা এখন থাক, তুমি আমার সঙ্গে কৃষ্ণনগরে যাবে কি?”

”না।”

”কেন, লজ্জা করছে?”

”কোনোদিনই আমি যাব না, ও-বাড়িতে আর পা দেব না…।”

আরও অনেক কথা সে বলেছিল প্রচণ্ড রাগে। বাবা শুধু শূন্য দৃষ্টিতে মুখের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন। যাবার সময় বলেছিলেন : ”শরীরকে অগ্রাহ্য কোরো না সুনীত, সে কখন যে কী চেয়ে বসবে তা কেউ জানে না, আমিও জানতাম না। এখনও আমার শরীর বাঁচতে চায়, তাই আত্মহত্যা করিনি।”

তাই কি আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি? এই শরীর, উমার কাছ থেকে দীর্ঘকাল যত্ন সেবা সান্ত্বনা ইত্যাদি পেয়েই কি লোভী হয়ে পড়েছে! বাবার ক্ষেত্রেও কি ঠিক এইরকমই ঘটেছিল? সুনীত ভেবে পাচ্ছে না হঠাৎ কেন হাবার বউয়ের শরীরটাকে দখলের ইচ্ছা তার হল। ওর থেকে কিছুটা ভালো… চিন্ময় যাদের কাছে যায়, তেমন মেয়েদের কাছেও তো সে যেতে পারত… এটা কি অনুকরণের ইচ্ছা থেকে? কমলার জায়গায় হাবার বউ… বাবার সমকক্ষ হওয়ার জন্য একটা বাসনা তার মধ্যে সুপ্ত কোনো বোধকে কি জাগিয়ে তুলেছিল যেটার অস্তিত্ব সম্পর্কে সে কোনোদিনই সন্দিহান হয়নি বা যেটা দীর্ঘদিন উমার সঙ্গে সহবাসের জন্য চাড়া দিয়ে ওঠেনি?

কিন্তু এটা কি তার অধিকারের মধ্যে পড়ে না? প্রত্যেকেরই এই অধিকার কি নেই, জীবনে এক-আধবার বিশেষ কিছু করার, এমন কিছু যেটা নিত্যনৈমিত্তিকের বাঁধা গৎ থেকে কিছুটা উপরে তুলে দেবে?

সুনীত তার মায়ের ছবির সামনে দাঁড়াল। কপালের কাছে সিঁদুরের টিপ ছিল, এখন নেই। সে ভাবল,ছবিটা নিয়ে গিয়ে কোনো লাভ আছে কি? বাবার জীবনে এবং তার জীবনেও এই মহিলার কোনো অবদান নেই।

সে টেবিলের কাছে ঝুঁকে দেখল অদিতিকুমার যা লিখছিলেন।

চিঠিই, কেউ বোধহয় টাকা চেয়েছে, তাকে জবাব দিচ্ছেন। ”বীরু, গতমাসে তোমাকে পঞ্চাশ টাকা পাঠাইয়াছিলাম এবং সেইসঙ্গে জানাইয়াছি আগামী দুইমাস কিছু পাঠাইতে পারিব না, কিন্তু…।”

”তুমি কি প্যান্টটা ছেড়ে একটা ধুতি পরবে?”

সুনীত চমকে পিছন ফিরেই চিঠিটাকে হাত দিয়ে প্রায় ঠেলে সরিয়ে দিতে যাচ্ছিল। পরের চিঠি পড়ার অন্যায় কাজটা ধরা পড়ত না যদি কৌতূহলটাকে সে সামলে নিতে পারত। একটার পর একটা অপ্রতিভ ব্যাপার বাবার প্রতি তার মানসিক বিরোধিতাগুলোকে যে ধসিয়ে দিচ্ছে এটা সে এবার বুঝে পারছে। অবশ্য এত বছর পর এখানে আসাই তো তার দুর্বলতাকে বাবার কাছে ধরিয়ে দিয়েছে।

দালানের কোণে দেয়াল ঘেঁষে একটা ছোট্ট টেবিল। তার উপর ডেকচিতে গরম ভাত। সুনীত চেয়ারে বসে কয়েক হাতা ভাত তুলে থালায় রাখল। অদিতিকুমার গাওয়া ঘি ঢেলে দিলেন। ভাত থেকে ধোঁয়া উঠে তার মুখটা ভিজিয়ে দিতেই সে প্রচণ্ড খিদে বোধ করল। বিকেলে রেস্টুরেন্টেও সে এমন খিদে অনুভব করেছিল। এক ডেকচি ভাত আর এই ক’টা আলু, তার মনে হল খুবই কম, খিদের তুলনায়।

সুনীত গোগ্রাসে গরম ভাত খেতে শুরু করল।

বাবা দাঁড়িয়ে দেখছেন। একটা আরাম গলা দিয়ে পাকস্থলীতে পৌঁছে সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। ঝিম লাগছে, ভারী হয়ে আসছে শরীর। মদ খেতে খেতে ঘোর যখন প্রথম আক্রমণ করে, সুনীতের মনে হল, সেই রকম এখন লাগছে। বাস্তবতা ও মস্তিষ্কের মধ্যে যোগাযোগ ঘটাবার ব্যবস্থাটা এবার যেন ভেঙে পড়বে।

”তুমি দাড়ি কামাওনি কেন?”

”ব্রণর মতো কয়েকটা ফুসকুড়ি হয়েছে, প্রায়ই হয়।…রান্নাবান্না কি নিজেই করো?”

”না…একটি মেয়ে করে। ক’দিন হল সে বাড়ি গেছে, কালই আসবে।”

”একটি মেয়ে,” শুনেই সুনীত মুখ তুলে একবার তাকিয়েছিল। নির্বিকার ধৈর্যপরায়ণ অদিতিকুমারের মুখ, মৃদু আলোয় প্রস্তরফলকের মতো লাগছে।

”মেয়েটি কমলার ভাইঝি।”

সুনীত চমকাল না বা আবার মুখ তুলে প্রশ্নবোধক চাহনি দেখাল না। কথাটা বললেন কেন? কমলার নামটা তো না করলেও পারতেন। করেছেন অযথা, ইচ্ছে করেই, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে। কী প্রতিক্রিয়া হয় ছেলের মধ্যে তাই দেখতে চান?

দেখাব না। সুনীত ভাতে দই মাখতে মাখতে ঠিক করে ফেলল বাবাকে সে জানিয়ে দেবে বয়সের সঙ্গে তারও বোধবুদ্ধি বেড়েছে। চিন্তা ও বিচার ক্ষমতা তার আছে। কমলা নামক ব্যাপারটাকে সে স্বাভাবিক এবং বাস্তবসম্মত হিসাবেই গণ্য করে।

”দোকান-বাজার কি ওই করে?”

”হ্যাঁ। বহুবছর পর আজ বাড়ি থেকে বেরোলাম, প্রায় পনেরো বছর।”

”পনেরো।”

হতভম্বের মতো সুনীত তাকিয়ে রইল তার বাবার মুখের দিকে।

”দু-তিন বছর কমও হতে পারে। সুকুমারবাবু মারা যেতে দেখতে গেছলাম ওর বাড়িতে, তারপর আর বেরোইনি। নীচের ভাড়াটেরাই আছে বছর পাঁচেক।”

”আর এই মেয়েটি?”

”চার বছর…এখন বছর একুশ বয়েস।”

বয়স জানানোর দরকারই ছিল না। নিশ্চয় চাইছেন ছেলের কাছে নিজের আত্মম্ভরিতা জাহির করতে কিংবা তাকে অপমান করতে।

”এত বছর, এভাবে জীবন কাটাবার উদ্দেশ্য?”

”এমনি। দইটা কেমন? ষষ্ঠী ঘোষ মারা গেছে কিন্তু এখনও সেইরকমই দই ওর ছেলে করে।”

”বাপের গুণ পেয়েছে।…কিন্তু এমনি এমনি এইরকম বন্দি জীবনযাপন, মানুষ পারে কী করে!”

”জেলে কয়েদিরা কী করে পারে?”

”তাদের বাধ্য করানো হয়।”

”আমাকে বাধ্য করিয়েছে…আমি নিজেই।…হাত ধোবার জল ছাদে বালতিতে রয়েছে।”

স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সে হাত ধুয়ে ঘুরে এসে খাটে বসল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অদিতিকুমার তার দিকে তাকিয়ে যেন পরের প্রশ্নটির অপেক্ষায়। সুনীত ঠিক করেই ফেলেছে, কৌতূহল দেখাবে না।

”আমি নিজেই ঠিক করি শাস্তি নেব। নেওয়া উচিত, নেওয়া দরকার। খবরের কাগজ পড়া বন্ধ করি, রেডিয়োটা ভাড়াটেদের দিয়ে দিই। মাঝে মাঝে দু-চারজন রোগী আসত, তাদেরও আসা বন্ধ করে দিই, একটা চাকর ছিল দোকানবাজার করে দিত। খাটে শুতাম না। নিজে হাতে কাপড় কাচা, ঘর মোছা, রান্না সবই করতাম, চাকরটা বসে থাকত। পৃথিবীতে কী ঘটছে, এমনকী পাড়াতেও, আমি কিছুই জানি না। বাইরের জগৎ, জীবনের সঙ্গে যেখানে যত রকমের সম্পর্ক ছিল, সব ছিঁড়ে ফেলি একে একে। শুধু একটা-দুটো চিঠি, কয়েদিরা তো চিঠি পেয়ে থাকে, তাই আর বন্ধ করিনি। মাসে একবার ভাড়াটেদের একজন এসে টাকা দিয়ে যায়।”

”কত দেয়?”

”নব্বুই।”

”চলে?”

”হাতে কিছু তো আছে, ক্যাশ সার্টিফিকেট আর জমিজমাগুলো বিক্রি করে দিয়েছি।”

”মা-র গহনা?”

”নেই। ওই ব্যাপারটাতেই বাঁধা দিয়ে তক্ষুনি টাকার জোগাড় করে বাঁচতে হয়েছিল। ওগুলো আর ছাড়ানো যায়নি।”

সুনীত বালিশটা টেনে নিয়ে বিছানায় কাত হয়ে শুল। তার মনে হচ্ছে, কারুর কাছে বিবৃতি দেবার জন্য বাবা যেন এতকাল অপেক্ষায় ছিলেন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক কাঠিন্য ভেঙে পড়েছে। কিন্তু বলার ভঙ্গিতে কুণ্ঠা নেই, এটাই শুধু তাকে অবাক করছে।

”তুমি খাটের ওই দিকটায় লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে পড়ো, আমি এদিকটায় শোব।”

”খাটে শোবে! এই যে বললে…”

”আমি এখন খাটেই শুই, আট বছর ধরে শুচ্ছি।”

”যেদিন থেকে মেয়েটিকে রাখলে?”

সুনীত বিদ্রূপটা স্পষ্ট করার জন্য ঠোঁট টিপে হাসির ভান করল। সেটা উপেক্ষা করে অদিতিকুমার দালানের আলো নিভিয়ে ঘরে এসে চেয়ারে বসলেন। সুনীতের চোখের পাতা ভার লাগছে। তার ঘুম পাচ্ছে।

”আমার তখন মনে হয়েছিল যথেষ্ট শাস্তি আমি পাচ্ছি না। বাইরের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে কষ্ট হচ্ছিল বটে কিন্তু ক্রমশ সেটায় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। লক্ষ করলাম আর কষ্ট লাগছে না। শরীর সব অসুবিধাই নিয়ে নিচ্ছে। তাই-তোমার বোধহয় এই সময় সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস।”

”না, ঠিক আছে।”

”নীচে গিয়ে একটা চেয়ে আনতে পারি।”

”দরকার নেই।”

কথাটা অগ্রাহ্য করে অদিতিকুমার উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সুনীত বালিশটা জড়িয়ে চোখ বুজল। বাসি সোঁদা গন্ধ উঠছে বালিশটা থেকে। সারা বাড়িটা থেকেই গন্ধ উঠছে। পলেস্তরা-খসা দেয়াল, ভাঙা জানালা, সিমেন্ট-চটা মেঝে, শ্যাওলামাখা ছাদ, পাঁচিলের কিনারে বটের ঝোপ, তার মনে হল না শুধু এগুলোর জন্যই সে গন্ধটা পাচ্ছে।

আসলে এই বৃদ্ধ লোকটির অস্তিত্বই এই বিশেষ গন্ধটা তৈরি করেছে। সুনীত ভাবল, বোধহয় এর একটা বিশেষ কার্যকারিতা আছে নয়তো মাথার মধ্যে এমন অবশ করা প্রশান্তি ঘনিয়ে আসছে কেন।

কাল সকালে, মেয়েটি আসবে। দেখতে হবে কতটা মিল আছে কমলার সঙ্গে। বোধহয় মিল আছে বলেই বাবা ওকে রেখেছে। কমলার স্মৃতি জাগিয়ে রাখা? কিন্তু মায়ের স্মৃতি…অদিতি মুখুজ্যে তার স্ত্রীর স্মৃতিরক্ষার্থে কী করেছে। একটি পুত্র উৎপাদন এবং পুত্রটি তার পিতাকেই অনুকরণ করেছে।

আমাকেও কি এইরকম বন্দিদশায় পচতে পচতে বন্ধ হতে হবে? এইরকম একটা গন্ধ তৈরি করতে হবে? তবু ভালো, সন্তান নেই। সুনীত পাশ ফিরে দেরাজের আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল। ঘরের দরজার ফ্রেমে চৌকো একটা অন্ধকার আয়নায় প্রতিফলিত।

বন্দিত্বের বদলে ফেরার হয়ে থাকা। কোথায় থাকব? সুনীতের দিশাহারা হবার উপক্রম হল। এর বাড়ি তার বাড়ি ক’দিন করা সম্ভব! ওরা একদিন ধরে ফেলবেই। কিংবা হাজার মাইল দূরে কোথাও চলে গিয়ে, নিজের পরিচয় মুছে এমন চাকরি করা যাতে সার্টিফিকেট দেখাতে হবে না।…চায়ের দোকানের চাকরি, স্টেশনের কুলি, ধোপার সহকারী। বাবার থিয়োরি অনুযায়ী বলা যায়, এটাও এক ধরনের শাস্তি নেওয়া। কয়েদিদের তো পাথর ভাঙা, ঘানি ঘোরানোর কাজ করতে হয়।

দরজার ফ্রেমের অন্ধকারটা বিস্রস্ত করে ঢুকলেন অদিতিকুমার।

”ওরা শুয়ে পড়েছে, ডেকে তুলে আর বিরক্ত করলাম না।”

”আমার সিগারেট না হলেও চলে। এজন্য ব্যস্ত হতে হবে না।”

”না, ব্যস্ত ঠিক নয় তবে যার যেমন অভ্যাস তাকে সেইভাবে রাখলে সে খুশি হয়।”

অদিতিকুমার চেয়ারে বসলেন। একদৃষ্টে মেঝের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বললেন, ”বহু বছর পর তোমায় দেখছি, আমি তো ভেবেছিলাম জীবনে আর দেখতে পাব না। তোমাদের তো সন্তান হয়নি।”

”না।”

”তোমার চেহারা যতটা বদলানো উচিত ছিল, ততটা বদলায়নি।”

”আমি আসায় তুমি খুশি না অখুশি?”

বিব্রত না হয়ে অদিতিকুমার হাসলেন।

”মানুষ আমার কাছে খুব দরকারি জিনিস নয়। তোমার কি অসুবিধা হবে যদি আলোটা নিভিয়ে দিই?”

”না।”

আলো নিভিয়ে উনি আবার চেয়ারেই বসলেন।

”তোমাকে তখন যা বলছিলাম…এক সময় মনে হল যথেষ্ট শাস্তি আমি পাচ্ছি না। বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাহ্যিক কতকগুলো অসুবিধা, কষ্টের মধ্যে পড়েছি মাত্র, ভিতরে কিন্তু আমি শান্ত, বিশেষ কোনো কষ্ট নেই। ভাবলাম, তাহলে কি আমার ফাঁসি হয়ে গেল, আমি মরে গেছি, কিন্তু ফাঁসি হওয়ার মতো অপরাধ তো আমার নয়। যে অপরাধের যে শাস্তি সেটাই আমি নেব, তার কম বা বেশি নয়…”

সুনীত ভাবল অট্টহাসির কি এই একটা চমৎকার সুযোগ। বৃদ্ধের মুখে কি ছেলেমানুষের মতো কথা, ‘কম বা বেশি’ উনি নেবেন না! হিসেব জ্ঞানটা টনটনেই ছিল।

”কমলার ভাই বীরু এল দেশ থেকে। ওকেও কিছু টাকা দিতে হয়েছিল, তাই দিয়ে একজোড়া বলদ কেনে। বলল, মেয়েটাকে বাড়ির কাজে লাগাতে চায়, যদি কোথাও আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি। বললাম, আমি পারব না। বলল, আপনার কাছেই রাখুন, বললাম, দরকার নেই। তখনও পর্যন্ত মেয়েটিকে আমি দেখিনি। বীরু নেমে গেল, আমি জানলায়। ওরা রাস্তায় বেরোতেই চোখে পড়ল মেয়েটিকে। আমি চোখ ফেরাতে পারলাম না সে কিশোরীকে দেখে। হুবহু কমলা। দপ করে জ্বলে উঠল শরীর, আমি বহু বহু বছর পর কামনা অনুভব করলাম। এক পা এক পা করে ও বাবার সঙ্গে চলে যাচ্ছে আর আমার শিরাগুলোকে গোছা করে ধরে শরীর থেকে টেনে বার করে নিচ্ছে। ওদের ডাকলাম। আমি যে চেঁচাতে পারি এটা জানতাম না। এরা ফিরে এল।”

অন্ধকার ঘরে নিচু গলায় থেমে থেমে অদিতিকুমার বলে যাচ্ছেন। মন্থর গম্ভীর ধ্বনিপুঞ্জ তাদের দূরত্বকে বিস্তৃত করে ভেসে বেড়াচ্ছে। একঘেঁয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠস্বরের এই স্বীকারোক্তি সুনীতকে যেন আবেদন জানাচ্ছে এই বৃদ্ধের প্রতি করুণা দেখাবার জন্য।

”মেয়েটিকে আমি যখনই দেখি তখনই আমার এই বৃদ্ধ শরীর…” অদিতিকুমার গলা আরও নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ”সুনীত তুমি তো কমলাকে দেখেছ, কল্পনা করো তাকে। মেয়েটির রূপ নেই, লাবণ্য নেই কিন্তু আগুনের চাবুকের মতো শরীর। শুধুই রক্ত মাংস চামড়ায় তৈরি একটা প্রলোভন, যার থেকে রেহাই পাবার জন্য নিজেকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলেছি। যতই ওর ভাবভঙ্গি চলাফেরা তাকানো আমাকে খেপিয়ে দেয়, ততই ইচ্ছে করে ওকে শরীর দিয়ে ধ্বংস করে ফেলি। আর আমি নিজেকে তখন নিরস্ত করি। কী কষ্ট যে হয় নিজেকে ধরে রাখতে। এক একদিন পাগল হয়ে যাই প্রায়, নিজেকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখার কথাও ভাবি।”

”মেয়েটি কিন্তু এসবের কিছুই জানে না। চার বছর ধরে আমি এই চাবুক খাচ্ছি, ভাবতে পারো, চা-র-ব-ছ-র! কিন্তু এটাই চাই, এইজন্যই ওকে রেখেছি। চার বছরে তিলেতিলে চাবুকটা যত তীক্ষ্ন হয়েছে, ততই অসহ্য বোধ করছি আর…এই শাস্তিটা, সুনীত, দাগড়া দাগড়া করে দেয়। ওকে কিছুই বুঝতে দিই না…আমাকে ও ‘দাদু’ বলে।”

”তোমার শরীর এখনও এইসবে সাড়া দেয়?”

”দেয়।”

”বাবা, তুমি কি সুখী?”

সুনীত উত্তর পেল না।

”বিপজ্জনক খেলা এটা। যে-কোনো সময়ই নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারো।”

”কিন্তু চার বছর তো হারাইনি!”

”তাতে প্রমাণ হয় না পাঁচ বছরে হারাবে না। তখন কী করবে?”

উত্তর নেই।

”তুমি একটা মনস্টার।”

অস্ফুট একটা আর্তনাদ শুনে সুনীত স্থির করল, কাল ভোরের ট্রেনে সে কলকাতায় ফিরে যাবে।

পাঁচ

একদিন মিহিরের স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়ে তারা তিনজন হাঁটছিল পার্ক সার্কাসের দিকে আমির আলি অ্যাভিনিউ ধরে। রাত প্রায় ন’টা। ট্র্যাফিক কমে গেছে। পথচারীও যৎসামান্য। মোটরগুলো বেগে ছুটে যাচ্ছে। যেখানে আলোর স্তম্ভ তার পনেরো গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে আলোকবৃত্তের বাইরের রাস্তা আবছায়া।

মিহির হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে পিছন ফিরে তাকাল। একটা স্টেটবাস আসছে। সে হতাশায় মাথা নাড়ল। সুনীত এই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ার কারণ বুঝতে না পেরে রুবির মুখের দিকে তাকাল।

”অ্যাই মিহির, বারণ করেছি না। আর এসব খেলা নয়।”

রুবি এগিয়ে এসে মিহিরের হাত ধরল।

প্রায় ষাট কিলোমিটার বেগে একটা ফিয়াট আসছে। রুবির হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মিহির ফুটপাথের কিনারে এল।

”মিহির না।”

মোটরটা তখন পনেরো থেকে কুড়ি গজ। মিহির রাস্তা পার হবার জন্য আলোকবৃত্তের দিকে এগোল। মোটরটা এবং সে একই লাইনে।

সুনীত চোখ বন্ধ করে রাস্তায় টায়ার ঘষার কর্কশ শব্দ এবং ড্রাইভারের নোংরা গালাগাল শোনার পর চোখ খুলে দেখল মিহির ট্রামলাইন পেরিয়ে ওধারে নেমেছে ততক্ষণে।

রুবির ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে সুনীত বলেছিল, ”মাথা খারাপ নাকি?”

”ও বলে, ড্রাইভারের রিফ্লেক্স পরীক্ষা করছি। একদিন এইভাবেই ও মারা যাবে।”

ওপার থেকে মিহির হাতছানি দিচ্ছে।

”চলে এসো, চলে এসো এপারে।”

”সুনীত যেয়ো না, খবরদার যেয়ো না। ও এখন বারবার এই খেলা খেলবে যতক্ষণ আমরা ওর সঙ্গে থাকব…ট্যাক্সি, ট্যাক্সি।”

রুবি ট্যাক্সি থামিয়ে ছুটে গিয়ে উঠেছিল, ওর সঙ্গে সুনীতও। ট্যাক্সিটা ছাড়তেই সুনীত মুখ ফিরিয়ে কাচ দিয়ে দেখেছিল, মিহির অভিমানী বাচ্চচাছেলের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে।

”ও কি আত্মহত্যা করতে চায়?”

”জানি না, অন্তত পঞ্চাশবার আমি ওকে এমন কাণ্ড করতে দেখেছি। এইভাবেই ও মরবে।”

রুবির কণ্ঠস্বরে তার মনে হয়েছিল মিহিরকে ও ভালোবাসে। ঈর্ষার ছোট্ট একটা দংশন সে রোধ করতে পারেনি।

ট্রেনের জানলা দিয়ে বিস্তীর্ণ প্রান্তরের উপর দৃষ্টি মেলে, কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতার দিকে যাবার সময় সুনীতের মনে পড়ল ঘটনাটা। এমন নিস্তব্ধ শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ মিহিরকে কেন সে মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলল? রুবি সেদিন পালিয়েছিল মিহিরকে সম্ভাব্য মৃত্যুর হাত থেকে সরিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু আমার এই পালানোটা নিজের জন্য, তবে মিহিরের স্মৃতি এখন কেন? মিহির মারা গেছে, মোটরের ধাক্কায় নয়। পিন দিয়ে দাঁত খোঁটার অভ্যাস ছিল। মাড়িতে খোঁচা লেগে সেপটিক হয়। শেষ সময়ে ও নিজেই হাসপাতালে যায়। মারা যাবার চার দিন পর রুবি খবর পেয়ে সুনীতকে জানাবার সময় বলেছিল, ”কতদিন ওকে বারণ করেছি, পিন দিয়ে দাঁত খুঁটো না।” ওর দিকে তাকিয়ে থাকার সময় জানতাম না বরাবরের জন্য সেই অভিমানী মুখটার ফোটো তুলে রাখছি। প্রকৃতির মধ্যেও কী অভিমান আছে।

সকালের প্রথম ট্রেন। অন্ধকার থাকতেই সুনীত নিঃশব্দে উঠে পড়ে। জামা-প্যান্ট পরে সিঁড়ি দিয়ে যখন নামছে, তখন বাবার চাপা গলা শুনতে পায়।

”ছবিটা নেবে না?”

”না।”

”গরম পাঞ্জাবিটা পরে যাও।”

”দরকার হবে না।”

”তোমার জুতো আর জামাটা?”

সুনীত ভুলে গেছল। বাবা ও-দুটো হাতে নিয়েই দাঁড়িয়েছিল। হাত থেকে নেবার সময় সুনীত বলেছিল, ”যা বলেছি ভুলে যাও।…আর স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করো।”

”স্বাভাবিক!”

সুনীত চেষ্টা করেও অন্ধকারে মুখটা দেখতে পায়নি। রাগ না অভিমান, কী ছিল সেই মুখে?

ভোরের ট্রেনে এত ভিড় হবে ভাবেনি। যখন সে কামরায় ওঠে তখন খালিই ছিল। একটার পর একটা স্টেশন এসেছে আর যাত্রী বেড়েছে। সুনীত কৌতূহল বোধ করল না কারুর মুখের দিকে তাকাতে, বা হকারদের চিৎকারে কান দিতে। জানলা দিয়ে কখনও তাকিয়ে, কখনও চোখ বন্ধ রেখে সে আড়াই ঘণ্টা পর শিয়ালদায় পৌঁছল।

আবার সেই সমস্যা, কোথায় যাব? এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। অন্তত পকেটে যে ক’টা টাকা এখনও আছে তা ফুরিয়ে যাবার আগেই। নিজেকে কপর্দকহীন ভাবতেই সুনীতের বুকের মধ্যে একটি নতুন অনুভূতি কেঁপে উঠল। সেই সঙ্গে আর একটা প্রশ্ন উঁকি দিল-আর কখনও কি স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচা সম্ভব?

ট্রামলাইনের কাছে গেট দিয়ে বেরোবার সময় সুনীত দু’ধারে তাকিয়ে পুলিশ আছে কি না দেখল এবং হাসল। ভয় ব্যাপারটাই এমন। বাদল নস্কর আর তার মেয়েকে মনে পড়ল ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে। জীবনে আর বকরিহাটি সে যাবে না। গতদিন বিকেলে যে রেস্টুরেন্টে খেয়েছিল, সেটিতেই ঢুকল। একই জিনিস খেল। ভেবেছিল ছোকরাটি তাকে চিনবে কিন্তু তার ব্যস্ততার মধ্যে চেনাচেনির কোনো লক্ষণ সে পায়নি। সুনীত একমনে খেতে খেতে ভেবে গেছে, এখন কী করবে!

কী করে তারা যাদের কোনো কাজকর্ম নেই। ঘুরে বেড়ায় নয়তো কোথাও আড্ডা দেয়, নয়তো ঘুমোয়। সুনীত ঘোরাঘুরি বা আড্ডা বাতিল করে দিল। বাকি রইল ঘুম। বহুদিন আগে, উমার সঙ্গে সে একটা বাংলা ফিল্ম দেখেছিল। বেকার নায়ক চাকরির খোঁজে হাঁটছে আর হাঁটছে, অফিসে অফিসে ঢুঁ দিচ্ছে আর ম্লান বিষণ্ণ মুখে বেরিয়ে আসছে। অবশেষে কার্জন পার্কে গাছতলায় ক্লান্ত হয়ে বসল এবং ঘুমিয়ে পড়ল।

অফিসযাত্রীদের ভিড় এইবার শুরু হবে। ট্রামগুলোয় বাসের তুলনায় কম ভিড়। হাসপাতালের স্টপে একটা ট্রাম প্রায় পুরো খালি হয়ে যেতেই সুনীত উঠে পড়ল এবং বসার জায়গাও পেল। সে ঠিক করল ট্রামটার টার্মিনাস পর্যন্ত যাবে।

কন্ডাক্টরকে টাকাটা দেবার সময় সে বলল ”কোথায় যাবে?”

”পার্ক সার্কাস।”

শোনামাত্র ধক করে উঠল তার বুক। রুবির ফ্ল্যাট পার্ক সার্কাসেই। ওর কাছে গেলে কেমন হয়! কিন্তু আজ শনিবার, এখন ও অফিসে বেরিয়ে গেছে। যাক, কোথাও অপেক্ষা করব। আজ ও চারটের মধ্যেই ফিরবে।

নভেম্বরের শেষাশেষি, দুপুরের রোদে জাদু আছে। ক’দিন আগের বৃষ্টি পেয়ে ঘাসগুলো তরতর বেড়েছে, পুষ্ট ও সবুজ হয়েছে। পার্কের রেলিংয়ের ধারে গাছের ছায়াটা পেয়ে সুনীত প্যাকেটের উপর মাথা রেখে চিত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তিন ঘণ্টায় ছায়াটা সরে গিয়ে তাকে রোদের মধ্যে রেখে গেছে।

ঘুম ভাঙতেই সে মুখ ফিরিয়ে রেলিংয়ের মধ্য দিয়ে, বিরাট ফ্ল্যাট বাড়িটার গেটের দিকে তাকাল। ঘড়ি দেখল এবং সময়ের হিসাব করে আবার চোখ বুজল। রুবির ফিরতে এখনও ঘণ্টা দুয়েক অন্তত বাকি। চারটের মধ্যেই কি ফিরবে? কিংবা না-ও ফিরতে পারে।

কোথায় যেতে পারে? সিনেমা, বাবা-মা’র কাছে, কিংবা ভাল্লুকটার সঙ্গে কোথাও?

কোথাও বলতে তো এই ফ্ল্যাট। দিনের বেলা শ্বেত ভাল্লুক এখানে আসে না, তা ছাড়া ওর আসার দিন ঠিক করাই আছে-বুধ আর শনি। আজ আসবে। ঘড়ি ধরে সাতটায় আসে।

গত রবিবার অপ্রত্যাশিত আচমকা এসে পড়েছিল, তখন সুনীত ছিল ফ্ল্যাটে। পঙ্কজ আচার্য শনিবার সকালের প্লেনে বোম্বাই গেছল, কথা ছিল সোমবার ফিরবে। হঠাৎ রাত সাড়ে ন’টায় কলিংবেল বেজে ওঠে। রুবির ঝি সাধু ছুটে এসে ফিসফিস করে ”সাহেব এসেছে”, বলার সঙ্গে সঙ্গে পঙ্কজ আচার্যের বিরাট দেহটা শোবার ঘরের দরজায় দেখা যায়। সুনীত জামাটা পরে নেওয়ার সময়টুকু পায়নি। তবে রুবির মুখ থেকে স্কচের উষ্ণ রংটুকু বা চোখ থেকে ঔজ্জ্বল্য মুহূর্তে মুছে গিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

শ্বেত ভাল্লুক দরজায় দাঁড়িয়ে প্রথমেই টেবিলের উপর স্কচের বোতলটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে। আলমারিতে যতগুলো বোতল বা রেফ্রিজারেটার বা ফোম রাবারের শয্যা, যাবতীয় আরামদ্রব্যই পঙ্কজ আচার্যের অর্থে কেনা। এরপর ওর চোখ পড়ে দেয়ালে টাঙানো ছবিটার উপর। দেয়াল থেকে ঝোলানো পুরু পর্দার আড়ালে রুবির ছবিটা সর্বদাই ঢাকা থাকে। শ্বেত ভাল্লুকের নির্দেশেই ছবিটা আড়াল করা থাকে কেননা একমাত্র তিনি ছাড়া এই ছবি দর্শনের অধিকার আর কাউকে দিতে তিনি রাজি নন।

পর্দা তখন সরানো ছিল। দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকে উন্মুক্ত ছবিটার উপর পর্দা টেনে দিয়ে ঘুরে দাঁড়ান রুবির দিকে। ধীরে ধীরে ডান হাতটা তুলে আবার ধীরে ধীরে নামালেন, তারপর সুনীতের দিকে এগোলেন।… এর কয়েক ঘণ্টা পরই হাবা মরে।

সুনীত ঝাঁকড়া নরম ঘাসের উপর দিয়ে একপাক গড়িয়ে আবার চিত হয়ে রইল। মুখের উপর রোদ। মোটরের হর্নের শব্দে তাকাল মাথা তুলে। মোটরেও আসতে পারে রুবি, শ্বেত ভাল্লুক বাড়ি যাবার পথে বহুদিন নামিয়ে দিয়ে গেছে। রংটা দেখে নিয়েই সুনীত আবার চোখ বন্ধ করল, এটা মাখন রঙের নয়।

বেশ কিছু লোক এখন পার্কের ঘাসে গড়াচ্ছে। ঝুড়ি মাথায় একটা লোক পার্কে ঢুকল। নিঃসন্দেহে চিনাবাদামওলা, সুনীত হাত নেড়ে ডাকল। দেখতে পেল না ও।

”অ্যাই, অ্যাই বাদাম।”

চেঁচিয়ে উঠেই তার মনে হল, এটা তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। চারধারে তাকাল। কেউ ভ্রূক্ষেপও করছে না।

”অ্যাই বাদামওলা।”

সুনীত আরও জোরে, প্রায় চিৎকারই করল এবং হাত তুলল। লোকটা ফিরে তাকিয়ে এগিয়ে এল।

প্রথমে পঞ্চাশ গ্রাম কিনল। পরিমাণ দেখে আরও পঞ্চাশ গ্রাম। বেশ কিছুটা সময় একটা কিছু নিয়ে তাকে কাটাতে হবে।

এখন সে স্বচ্ছন্দ বোধ করছে। বাদামওলাকে ডাকার জন্য এমন জোরে চিৎকার শেষ কবে সে করেছে। বরাবরই মৃদু, ধীর, নম্র স্বরের লোক হিসাবে সে আলাদা এক দূরত্ব পেয়ে এসেছে। দূরত্বটার মধ্যে মেশবার বা সাধারণভাবে কথাবার্তা বলার যত চেষ্টাই সে করেছে, নিজের কাছেই তা কৃত্রিম ঠেকেছে। আবেগ বা অনুভবগুলোকে যদি কান্তির মতো সঙ্গে সঙ্গে কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারত, তাহলে হয়তো সে অনেক সরল জীবনযাপন করত।

খোসা ভেঙে একটি একটি করে বাদামের দানা মুখে দেওয়ার সঙ্গে সুনীত চোখ রেখেছে গেটের দিকে। একটা মোটর স্বচ্ছন্দে ঢুকে যেতে পারে। নোংরা দেওয়াল, চওড়া ছোটো ছোটো ধাপের সিঁড়ি ধরে তিনতলায়। পরপর তিনটি দরজা, শেষেরটি রুবির, বাড়ির পিছন দিকে ওর ফ্ল্যাটটা।

গেটের পাশেই ফোটোগ্রাফারের দোকান। সাইনবোর্ডের অক্ষরগুলো ময়লা। পকেট থেকে চশমাটা বার করে সুনীত চোখে দিল, ‘ইউনির্ভাসাল আর্ট…’ তারপর আর পড়া যাচ্ছে না। দরজার দু’পাশের শো-কেসে ছবি সাজানো। নানান মুখ। বসা এবং দাঁড়ানোর ভঙ্গিগুলো যা হয়ে থাকে। সুনীত দেখতে না পেলেও জানে স্বামী-স্ত্রীর যুগ্ম বা পারিবারিক গ্রুপ ছবিতে কে কেমনভাবে অবস্থান করছে। কৃষ্ণনগরে দাদু, জ্যাঠা, বাবা এবং তাদের পরিবারবর্গকে নিয়ে তেরোজনের একটা ছবি ছিল। বয়স্করা চেয়ারে আড়ষ্ট হয়ে, দুই ঊরুর উপর হাত রেখে, সোজা হয়ে বসে। তাদের পায়ের কাছে বাচ্চচারা, পিছনে দাঁড়িয়ে যুবকরা। সুনীত ছিল মায়ের কোলে, বয়স তখন চার মাস।

বহুদিন সুনীত চার মাসের শিশুটিকে মন দিয়ে লক্ষ করেছে, তার আকার গঠন এবং বাইরের রূপ থেকে কল্পনা করতে চেষ্টা করেছে, সে কোন কোন জায়গায় এই শিশুটি থেকে আলাদা হয়ে গেছে। কোনো মিল খুঁজে না পেয়ে অবাক হয়ে যেত।… প্রথম যেদিন রুবির ফ্ল্যাটে সে যায়, ওর শোবার ঘরের দেয়ালে ফাঁক করা পর্দার মাঝে ফ্রেমে বাঁধানো একটা বিভ্রান্তিকর জিনিসের দিকে তার চোখ পড়েছিল।

রুবি মুখ টিপে হেসে বলেছিল, ”ওটা কী বলো তো?”

সুনীত চোখ সরু করে তাকিয়ে থাকে। প্রথমে মনে হয়েছিল শঙ্খের একটা টুকরো তারপর মনে হয় বালিয়াড়ির স্ফীত একটু অংশ। অসহায়ভাবে সুনীত মাথা নাড়তেই রুবি দু’ধারের পর্দা আর একটু সরিয়ে দেয়।

”এবার বলো।”

”বুঝতে পারছি না।”

রুবি আরও ইঞ্চি চারেক সরায়। সুনীত আবার মাথা নাড়ে। তার মনে হচ্ছে ঘোড়ার মসৃণ পিঠ… পাথরে গড়া কোনো ঢালু উপত্যকা যদি উঁচু থেকে দেখা যায়…বা মেঘের অংশ।

পর্দাটা সম্পূর্ণ সরিয়ে, রুবি হাসতে থাকে। এক জানলা থেকে অন্য জানলা পর্যন্ত প্রায় পাঁচ ফুট বিস্তৃত দেওয়ালে ছবিটা সাঁটা। এক রমণী সোফায় উবুড় হয়ে শুয়ে। মাথা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নগ্ন। অন্ধকারের মাঝে পাশ থেকে আসা মৃদু আলোয় দেহটির উপর নরম আলোছায়ার রহস্য। বালিশে ডোবানো মুখ ঘিরে অন্ধকার। তুলির একটা জোরালো টানে যেন কাঁধ থেকে নিতম্বের বহিঃরেখা আঁকা হয়ে আছে। হাঁটু থেকে পায়ের পাতা তরল হয়ে গলে পড়েছে আলোর মধ্যে।

রুবি হেসেছিল।

”কে তুলেছে?”

”মিহির। বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করতে বলে দু’বছর আগে একদিন ওর স্টুডিয়োতে নিয়ে গিয়ে আমার অনেকগুলো ছবি তুলেছিল। তারই একটা এনলার্জ করে, বাঁধিয়ে দিয়ে গেছে। আমি তো কিছুতেই রাজি হচ্ছিলাম না। তবে মিহিরকে না বলা খুব কঠিন। ভালো হয়নি?”

সুনীত স্তম্ভিত হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকেছিল। ছবির কারিগরি না দেহটি, কার যে প্রশংসা করবে ভেবে পায়নি।

”এভাবে ঢেকে রেখেছ কেন?”

”সবাই দেখুক এটা আমি চাই না।”

”বিজ্ঞাপনে ব্যবহার হলে, লক্ষ লক্ষ চোখ দেখবে।”

”তারা তো জানবে না ছবিটা কার।”

”তোমার তখন কিছু হচ্ছিল না?”

”কিছু! তুমি বলছ লজ্জাটজ্জা?…নাহ।”

‘নাহ’ ধ্বনিটি খুব স্বাভাবিকভাবেই রুবির মুখ থেকে বেরিয়েছিল। তারপর একটা ইংরেজি ইঞ্জিনিয়ারিং পত্রিকা খুব বিজ্ঞাপনটা দেখায়…বিরাট একটা যান্ত্রিক হাতুড়ির নীচে দেহটি, যেন থেঁতলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে নিশ্চিন্ত সারল্যে। সুনীত শিউরে উঠেছিল।

”কী ভয়ংকরভাবে ব্যবহার করেছে তোমাকে।”

”মিহির ওইরকমই, এক এক সময় মনস্টার হয়ে যায়।”

‘মনস্টার’ শব্দটা তাহলে রুবিই মাথায় পুঁতে দিয়েছিল। মিহির এবং বাবা দুজনেই উত্ত্যক্ত হতে চায় হয়তো জীবন্ত থাকার জন্য। সুনীত ভাবল তাকেও কি উত্ত্যক্ত হতে হবে নাকি। কীভাবে?

ধড়মড়িয়ে সে উঠে বসল। খেয়াল করেনি তখন রুবি এসে পড়েছে। গেটের মধ্য দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে খয়েরি সিল্কের শাড়ি পরা একজন, কোমর থেকে নিম্নাঙ্গের সুঠাম চলনেই বোঝা যায় রুবি। ওকে কিছুক্ষণ সময় দিতে হবে। তিনতলায় উঠবে, শোবে বা বসবে, ফ্রিজ থেকে জল বার করে খাবে, আয়নার সামনে দাঁড়াবে তারপর হয়তো স্নান করতে বাথরুমে ঢুকবে। কিন্তু এই ঠান্ডার দিনে কি স্নান করবে?

সুনীত ঠিক করল, মোটামুটি আধ ঘণ্টা সময় রুবিকে দেবে ক্লান্তি ও বিরক্তি কাটিয়ে ওঠার জন্য।

আধ ঘণ্টা পর সুনীত কলিংবেলের বোতামে চাপ দিল। একটু সময় নিয়ে দরজার পাল্লা ফাঁক হল। সুনীতকে দেখেই রাধুর মুখটা পাংশু হল এবং দরজার পাল্লা খুলবে কি না, তাই নিয়ে যেন দ্বিধায় পড়ল।

”কে?”

ভিতর থেকে রুবির স্বর ভেসে এল।

”আমি।”

এই দ্বিতীয়বার সুনীত আজ গলার স্বর চড়াল। নিজেই পাল্লাটা ঠেলে, রাধুকে সরিয়ে ভিতরে ঢুকল। খাবার টেবিলের পাশে রুবি চেয়ারে বসে। টেবিলের উপর যে জিনিসগুলো রয়েছে তাই থেকে সুনীত অনুমান করল মাছের চপ তৈরিতে রুবি ব্যস্ত।

শুকনো হেসে রুবি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। অস্বস্তি বোধ করল সুনীত, তার মনে হচ্ছে এখানে সে অবাঞ্ছিত। রবিবারের পর রুবি নিশ্চয়ই তাই ভাবতে পারে; শ্বেত ভাল্লুক শুধু অফিসেই কর্তা নয়, এই ফ্ল্যাটেও।

”তুমি অফিস যাওনি?”

সুনীতের মনে হল অফিস থেকে ফিরে আধ ঘণ্টার মধ্যেই এমন জাঁকিয়ে খাবার তৈরিতে বসে যাওয়া সম্ভব নয়। নিশ্চয় সে তাহলে অন্য কাউকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখেছে। যার শরীরের গড়ন রুবিরই মতো।

”না, ছুটি নিয়েছি। তুমিও তো যাচ্ছ না।”

সুনীত বলতে যাচ্ছিল, ‘কে বলল?’ নিশ্চয় শ্বেত ভাল্লুকই খবরটা দিয়েছে। ওরা এসেছিল কি না, রুবি সে সম্পর্কে কিছু জানে কি?

”কেউ কি খোঁজখবর করেছে?”

”জানি না।”

”আসার কথা আছে?”

”কেন?”

রুবি তাকে বসতে বলেনি। প্যাকেটটা টেবিলে রেখে সুনীত চেয়ার টেনে বসল। রুবি একবার তাকিয়েই সিদ্ধ আলুর মোড়কে পুর ভরার কাজে মন দিল। সুনীত জবাব দিল না।

রুবি থালাটা ঠেলে সরিয়ে রাখল। কাজ শেষ হয়ে গেছে। সুনীত গুনে দেখল সতেরোটি চপ। শ্বেত ভাল্লুক অন্তত গোটা দশেক খাবে।

”কেন?”

”চাকরি ছেড়ে দেব।”

রুবি ভ্রূ কোঁচকাল তারপর হাসল। হাতঘড়ি দেখে আবার ভ্রূ কোঁচকাল।

”ব্যস্ত? কেউ আসবে?”

”নাহ, প্যাকেটে কী আছে?”

”জামা আর জুতো।”

”কোথাও যাচ্ছ নাকি! এটা কী গায়ে পরেছ?”

”রবিবার থেকে আমি বাড়ি যাইনি।”

অবাক চোখে রুবি তাকাবে এটা সে ধরেই রেখেছিল। কিন্তু এতটা রুক্ষতা ফুটে উঠবে ভাবেনি।

”কেন যাওনি?”

না যাওয়ার কারণটা সুনীত বলতে পারল না। তার মনে হচ্ছে, সহ্যক্ষমতার কিনারে এখন সে পৌঁছেছে। খুন করেছে শুনলে, রুবির হৃদয়ের দরজাগুলো অবশ্যই বন্ধ হয়ে যাবে। এখন কিছু একটা অবলম্বন তার চাই যেটা ধরে সে খাড়া থাকতে পারে। তার মস্তিষ্ককে সজাগ ও সক্রিয় রাখা দরকার সিদ্ধান্তে পৌঁছতে, জেলে যাবে না নিজের পরিচয় ঘুচিয়ে কোথাও নিজেকে গোপন করে রাখবে?

”কোথায় ছিলে তাহলে এই ক’দিন?”

”রাস্তায়। ভাবছি কোথাও চলে যাব।”

”বউকে সঙ্গে নিয়ে?”

”না, একাই।”

”চাকরি ঠিক করে ফেলেছ?”

”না।”

”তবে?”

সুনীত মুখ নিচু করে, থালায় সাজানো চপগুলো আবার গুনল। এগুলো ভাজা হলে রং কেমন হবে? শ্বেত ভাল্লুকের তালুর রঙের মতো কি? সুনীতের চোখের সামনে ডান হাতের তালুটা উঠেছিল এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার বাঁ-গালের উপর বিস্ফোরিত হয়েছিল। সে ছিটকেই পড়ত, যদি স্টিল আলমারিটা আর এক হাত দূরে থাকত। বিশ্রী একটা শব্দ হয়েছিল আলমারির গায়ে আছড়ে পড়ার। আশ্চর্য, চশমাটা কিন্তু নাকের উপরই ছিল ওই প্রচণ্ড ধাক্কা সত্ত্বেও। পঙ্কজ আচার্যের মার্জিত শিক্ষিত সুসভ্য মুখটা থেকে ছিঁড়েখুঁড়ে বেরিয়ে আসছিল অনিয়ন্ত্রিত হিংসা এবং আবেগ। যখন দু’হাতের থাবায় তার কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছিল তখন ওই বিশাল দেহের কাছে নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়েছিল। দেহের আকার একটা বড়ো ব্যাপার! রুবির সামনে অপমানিত, নিগৃহীত হওয়া সত্ত্বেও সুনীতের তখন মনে হয়েছিল, এই লোকটা নির্ভরতা পাবার জন্য একটা দখল চায়।

সেই দখলে সে হাত বাড়িয়েছিল। তার কয়েক ঘণ্টা পর হাবাও দখলচ্যুত হতে চায়নি। কিন্তু কী ভাগ্য বেচারার। পঙ্কজ আচার্য দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, ”থিফ…ইউ ব্লাডি থিফ।” হাবাও নিশ্চয় কিছু একটা বলেছিল।

”ভাবছি নতুন করে জীবন শুরু করব।”

”সেটা কী ব্যাপার? জীবনটা পুরনো হল কবে?”

কী করে একে বোঝাব জীবনে কী ঘটে গেছে। সুনীত ফাঁপরে পড়ে চশমাটা নাক থেকে নামিয়ে হাতে নিল। রুবি লক্ষ করেছে একটা কাচ নেই কিন্তু কিছু বলল না।

”এসব আলোচনা এখন থাক।”

”সেই ভালো।… বলো কীজন্য এসেছ।”

”এমনিই, কেন আমি কি অকারণে আসতে পারি না?”

চোখে চোখ রেখে পরস্পরকে যেন মেপে নিচ্ছে, এমনভাবে ওরা তাকিয়ে রইল। কে প্রথম চোখ সরাবে।

সুনীতই সরাল। রুবির চোখে অনাগ্রহ এবং প্রত্যাখ্যান লুকোনো নেই। সুনীত ধীরে মুখটা ফিরিয়ে শোবার ঘরের দিকে তাকাল। দরজার পর্দাটা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। তার মনে হল কী যেন একটা সে দেখতে পাচ্ছে না। চশমাটা পরল। পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের দেওয়ালটা দেখা যাচ্ছে। ছবিটা নেই।

সুনীত তাকাল রুবির মুখের দিকে। রুবি দ্রুত মুখ ফিরিয়ে থালাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

”রাধু, এগুলো নিয়ে যা তো।”

রুবি শোবার ঘরের দিকে যেতে গিয়েও থমকে ফিরে এসে, টেবিলে এক হাতের ভরে শরীর রেখে ঝুঁকে পড়ল।

”আর তুমি এসো না। আমাকে ভুলে যাও…পারবে, অনায়াসেই পারবে, খুব ছেঁদো শোনালেও ভুলে যাওয়া এমন কিছু শক্ত কাজ নয়…আমার অসুবিধে আছে, সুনীত খুব অসুবিধে আছে। খেয়েপরে বেঁচে থাকাটাই সবথেকে বড়ো ব্যাপার…ভালোবাসা, আত্মা, স্বাধীনতা এসব নিয়ে এখন আর কিছু বোলো না।”

রুবির কাঁধ, ঘাড়, গলা বা ব্লাউজের স্ফীতি সুনীতকে আর উত্ত্যক্ত করছে না। এখন ভয় তাকে গ্রাস করতে এঁকেবেঁকে উঠে আসছে শিরদাঁড়া বেয়ে। রুবির প্রথম চুম্বনের সমু সে এই অনুভবই পেয়েছিল। মনে হচ্ছিল রুবি শুষে নিচ্ছে তার মস্তিষ্ক। বাস্তব বোধ এবং যুক্তি সে বোধহয় আর ফিরে পাবে না।

”চাকরিটা আমি হারাতে পারব না, কিছুতেই পারি না। তুমি তো জানো, বাবা-মা ভাই বোন, আটজনের সংসার আমাকেই দেখতে হয়। আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার জন্য ওদের তো বিপন্ন করতে পারি না, পারি?”

রুবির কণ্ঠস্বর শুকনো, আবেগবর্জিত। নিশ্চয় এই ক’দিন ধরে ও ভেবেছে, সিদ্ধান্তে এসেছে। সুনীত ভাবল, তাহলে আমার কী সিদ্ধান্ত!

”কেন পারা যায় না? বাঁচাটাই যদি বড়ো কথা হয় তাহলে চুটিয়ে বাঁচো। আমাদের জীবনের মাপ খুবই ছোটো, তার অর্ধেকই তো কেটে গেল। বলদের মতো আর কেন অন্যদের ভার বওয়া। ঝুঁকি নাও, আধপেটা শরীরকে পুষিয়ে দেবে তোমার মনের…।”

রুবি হাত তুলেছে। হাতটা টেবিলে আছড়ে নামাল। বিরক্তিতে ভ্রূ কোঁচকানো। কণ্ঠস্বরে তিক্ততা।

”তুমি যে এইসব বলবে মোটামুটি তা আমি জানি।…প্লিজ সুনীত তর্কাতর্কি নয়। অভাব আর খিদে কী জিনিস তা তুমি জানো না।”

”তাহলে…।”

”চাকরি ছাড়ার পাগলামি কোরো না, এত টাকা মাইনের চাকরি কোথাও পাবে না। ঘরে বউ আছে, দায়িত্ব আছে, কর্তব্য আছে এটা মনে রেখো।”

সুনীত উঠে দাঁড়াল। এবার তাকে যেতে হবে, কিন্তু কোথায়? সোজা থানায় গিয়ে ওদের চমকে দিয়ে কী বলবে, ”আত্মসমর্পণ করতে এসেছি…আর পারলাম না, কোথাও জায়গা নেই।”

রুবির ছবিটা তার দেখতে ইচ্ছে করল। কিন্তু দেয়ালে নেই। কেন খুলে ফেলল, ব্যাপার কী!

”আমি চলে যাবার পর, কিছু কি হয়েছিল তোমার সঙ্গে?”

”না।”

”ছবিটা কোথায়?”

”ঘরেই আছে।”

এত অনিচ্ছুক ক্লান্ত উদাসীন স্বর কেন!

সুনীত এগিয়ে এসে পর্দা সরিয়ে ঘরের মধ্যে তাকাল। সামনে নেই, ডাইনে বামে দেওয়ালেও নেই, তার গা ঘেঁষে দরজার পাশেই প্রায় একমানুষ লম্বা…চমকে এক পা পিছিয়ে এল সে।

স্মিত হাসি ভরা মুখে পঙ্কজ আচার্য তাকিয়ে। বিরাট শরীরটা বারান্দার রেলিংয়ে হেলিয়ে রাখা। পিছনে ময়দানের কয়েকটা গাছ এবং তার পিছনে আকাশ। ঊর্ধ্বমূল নয়, লোকটি যেন হাজার বছরের একটি কাণ্ড। ওরই পাতাবিহীন শাখাপ্রশাখাগুলো, সুনীতের সন্দেহ হল, বোধহয় তার নিজের শরীরের মধ্যেই বিছিয়ে আছে। ফোটোটার দিকে মুখ তুলে সে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের মধ্যে তীব্র কটু একটা গাছের গন্ধ পেল। নিজের বাহুতে হাত বুলোল-কর্কশ রুক্ষ পুরু ছাল!

এখন যদি আকাশমুখো হাত তুলি, সুনীত ভাবল, তাহলে কি বাওবাব হয়ে যাব?

ছয়

গুণেন ভবনের দক্ষিণ ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে একতলা বাড়িটা। তৈরির কাজ বন্ধ হয়ে এখন অর্ধ সমাপ্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। পাঁচ ফুট উঁচু পাঁচিলে ঘেরা, পুবদিকে পাঁচিলের খানিকটা খোলা লরিতে মাল আনার জন্য। বাড়ির পিছন দিকে পশ্চিমে ফুটবল মাঠটা। এই বাড়ির পরই বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটা সদ্য তৈরি বাড়ি আর অপেক্ষায় আছে ঝোপঝাপ ভরা প্লট। তারপর অযত্ন অবহেলায় ক্ষতবিক্ষত একটা পিচ ও পাথরকুচির রাস্তা যেটা এঁকেবেঁকে সি আই টি রোডে পড়েছে। গুণেন ভবনের দক্ষিণ দিকের ফ্ল্যাটগুলো থেকে বিস্তীর্ণ জমি এবং গাছপালা দেখা যায়। দক্ষিণের ঘরগুলোয় এত হাওয়া যে হালকা ছবি দেয়াল থেকে পড়ে যায়। অধিকাংশ সময় জানলা বন্ধ রাখতে হয় হাওয়ার উৎপাতে।

মশারা ছেঁকে ধরেছে সুনীতকে। শব্দ না করে সে ঘাড়ে চাপড় দিল। তালুতে আঙুল ঘষে ভিজে ভিজে নরম একটা জিনিস অনুভব করল। এই নিয়ে বোধহয় এগারোটা। ঠান্ডায় আড়ষ্ট শরীরে মশার কামড়ের জ্বলুনি কমই লাগে।

মুখ তুলে তাকাল সে। গুণেন ভবন অন্ধকার। জানলাগুলো বন্ধ। গোলাপবাগান রোডের দিকে রাস্তায় আলো জ্বলছে না। সি আই টি রোডের আলো জ্বলছে। পরিষ্কার আকাশে ঝকঝকে তারাগুলোর জন্য অন্ধকারটা পাতলা হয়ে সুনীতকে সাহায্য করছে তার চারপাশের জিনিসগুলোকে দেখতে।

সে বসে আছে সারিবদ্ধ ইটের মাঝে একটা তক্তার উপর ইটে ঠেস দিয়ে। হাত কয়েক দূরে ইট ভেজবার চৌবাচ্চচা। বৃষ্টির জল জমে আছে বোঝা যায় তারার আলোর প্রতিবিম্ব থেকে। বাঁশ আর তক্তা এবং ভাঙা ইট ইতস্তত ছড়ানো। বহুবার তার সিগারেট খেতে ইচ্ছে করেছে, কিন্তু পকেটে হাত দিয়েও বার করতে ভরসা পায়নি। অন্ধকারে বহু দূর থেকে আগুনের ফোঁটা দেখা যায়।

সে ঠিক করে ফেলেছে কীভাবে কাজটা করবে। পাঁচিলটা টপকে গুণেন ভবনের গা ঘেঁষে নামতে হবে। গলা সমান উঁচু পাঁচিল। সে এটুকু জানে, দু’হাতের চাড় দিয়ে নিজেকে টেনে তোলার মতো জোর শরীরে নেই। ব্যায়াম না করলে এটা সম্ভব নয় এবং কোনোদিনই সে করেনি। কিছু ইট পাঁচিলের কাছে নিয়ে গিয়ে ধাপ বানাতে হবে।

সুনীত নড়েচড়ে বসল। বারকয়েক দাড়িতে তালু ঘষল। সিগারেট কেনার সময় দোকানটার আয়নার মুখ দেখেছিল। কামিয়ে ফেলবে কি না ভেবেছিল। তারপর ঠিক করে থাকুক। দাড়িটা সাত দিনে এমন কিছু বড়ো হয়নি যে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে বরং ব্যক্তিত্ব বদলে সাহায্য করছে। জামা এবং চটিই বরং বেমানান লাগছে দাড়ির সঙ্গে।

পকেটে ছিল প্রায় এগারো টাকা। এগুলো রেখে দেবার কোনো যুক্তি সে পেল না। উমা খুশি হবে টাকাটা পেলে। সঙ্গে সঙ্গে মাটির ঘটের মধ্যে ফেলবে নোটগুলো ভাঁজ করে করে। তারপর একদিন ঘটটা ভেঙে রেজগি আর নোটগুলো গুনতে বসবে ব্যাঙ্কে জমা দিতে যাবার আগে।

শেষবারের মতো কী খাওয়া যায়, যা আর সম্ভব হবে না। সুনীতের বহুরকম খাদ্যের কথা মনে পড়ে এবং ভেবে দেখে আশ্চর্য হয় সব খাবারই সে উমাকে দিয়ে আনাতে বা তৈরি করিয়ে নিতে পারে। তবে মদ আনানো সম্ভব নয় এবং এখন তার কাছে মদ খাওয়ার মতো টাকাও নেই বা থাকলেও সে খাবে না। তখন সে একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকে আটটা রাজভোগ খায়। খেতে কোনোরকম অসুবিধা বোধ করেনি।

দোকান থেকে বেরিয়ে সে এক কনস্টেবলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, গোলাপবাগান রোড কোনদিক দিয়ে যাবে? লোকটি কিছুক্ষণ ভেবে বলেছিল, জানে না। তার ইচ্ছা হয়েছিল তর্ক করতে, মানিকতলার মোড়ে দাঁড়ানো পুলিশ কেন বলতে পারবে না? গোলাপবাগান রোড বেশি দূরে নয়, তা ছাড়া বোমা, ছোরা, খুনের জন্যও রাস্তাটার খ্যাতি আছে। কিন্তু কথা না বাড়িয়ে সুনীত সরে যায়। নিশ্চিন্ত হয়, তার ফোটো এই লোকটা দেখেনি বা তার পোশাক ও দৈহিক বিশেষত্বগুলি জানিয়ে সুনীত মুখার্জিকে দেখলেই পাকড়াও করার নির্দেশ একে দেওয়া হয়নি। হয়তো পুলিশবাহিনীর কাউকেই দেওয়া হয়নি কিংবা দেওয়া হয়েছে কিন্তু এই কনস্টেবলটি বোকা ধরনের কিংবা কর্মতৎপর হওয়ার কোনো ইচ্ছা এর নেই।

সিনেমা-বাড়ির গেটের লাগোয়া দেওয়ালে ঠেস দিয়ে এক থুরথুড়ে বুড়ি বসেছিল আলোর নীচেই। ডান হাতটি জমির উপর পেতে রাখা, তালুতে একটি পাঁচ পয়সা। বুড়ি মুখ তুলে ঘোলাটে চোখদুটিও পেতে রেখেছে পথচারীদের মুখে। সুনীত থমকে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত ঢোকায়। বাকি পয়সা একেই দিয়ে যাবে। বুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার মনে হয় এইরকম চোখ সে আগে দেখেছে। ধীরে ধীরে তার মনে পড়ে বহু বছর আগে, প্রায় তেরো-চোদ্দো বছর হবে, এই সিনেমা হলেই উমার সঙ্গে একটা হিন্দি ফিল্ম দেখেছিল। গল্পটাও তার মনে পড়ছে, এমনকী কোন সিটে তারা বসেছিল তা-ও। সেই ফিল্মে ঠিক এইরকম এক বুড়ি ভিখারিকে তিরিশ সেকেন্ডের জন্য দেখা গেছল। তারপর আরও খুঁটিনাটি তার মনে ভেসে ওঠে-সিনেমা হল থেকে ম্যাটিনি শো দেখে যখন তারা বেরোয় তখন রোদের ঝাঁঝ কেমন ছিল, আকাশের রং কী ছিল, দুজনে একটা দোকানে চা খায়, দোকানটার নাম বিষ্ণু কেবিন।

আর একটু চেষ্টা করলে সে মাস, সপ্তাহ এমনকী বার-এর নামও মনে করতে পারে। এই সিনেমা হলটার সামনে দিয়েই সে প্রতিদিন অফিসে যাতায়াত করে কিন্তু কখনও তার স্মৃতিতে ভেসে ওঠেনি। তারা দুজনে আর কখনও এই হলে সিনেমা দেখেনি। তার আফসোস হল, মনের এই প্রাঞ্জলতা, তৎপরতা দেখার মতো কেউ এখন সঙ্গে নেই। ফোটোগ্রাফি মাফিক পুঙ্খানুপুঙ্খতায় তার স্মৃতি এখন কাজ করছে। কাহিনির ক্ষুধার্ত নায়ক গোগ্রাসে যখন একটা পাঁউরুটি খাচ্ছিল তখন এক বুড়ি ভিখারি জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকে। নায়ক তক্ষুনি আধখাওয়া রুটিটা তার হাতে দিয়ে চলে যায়।

পকেটে বাকি যা ছিল, প্রায় সাড়ে তিন টাকা, সুনীত ওই বুড়ির তালুর উপর রাখে। তালুটা সঙ্গে সঙ্গে মুড়ে ফেলে ঘড়ঘড় শব্দে সে কিছু একটা বলে। সুনীত বুঝে যায়, বুড়ি জানে না কত পয়সা এখন তার মুঠোয় রয়েছে।

বুড়িকে রেখে সে হেঁটেছিল। পরে তার মনে হয় বুড়িকে না দিয়ে ওই পয়সায় রাত্রির শো-এ সিনেমা দেখলে সময় অনেকখানি কাবার করা যেত। সুনীত ভেবে রেখেছিল, জামা এবং চটি ত্যাগ করবে। যা পরে গত রবিবারে বেরিয়েছিল তাই পরেই ফিরবে।

জামা ও চটি জলের মধ্যে ফেলে দেওয়াই নিরাপদ। রেললাইনের ধারে টানা একটা খালের কথা তার মনে পড়ে। কিন্তু রাত্রে অন্ধকারের মধ্যে মানুষ দেখলে রেলরক্ষী পুলিশ যদি চ্যালেঞ্জ করে? এই ভেবে সে রেললাইনের বাঁধের তলা থেকেই ফিরে এসেছে।

সুনীত এখন ভাবল জামা এবং চটি ইট ভেজানোর চৌবাচ্চচাটায় ডুবিয়ে রাখলে কেমন হয়! মিস্ত্রি মজুরদের মধ্যে যে প্রথম দেখবে তারই লাভ হবে। কাগজের মোড়ক খুলে সে নীল বুশশার্ট ও পাম্প শু বার করে পরে নিল এবং পরিত্যক্ত জিনিস দুটি চৌবাচ্চচায় ফেলে দিল। তারপর গোটাদশেক ইট বয়ে নিয়ে গেল পাঁচিলের তলায়।

পাঁচিল টপকাতে খুব অসুবিধা হল না। অপর দিকে জমিতে পা রাখার পর সুনীতের দুটো কনুই জ্বালা করতে শুরু করেছে। পাঁচিল থেকে লাফ দিলে, কনুই ঘষড়ে ঝুলে নামার দরকার হত না। কিন্তু লাফ দেবার মতো জোর, সে জানে, তার হাঁটুতে নেই।

সে ভেবেই রেখেছে এবার কী করবে। ডানদিকে গুণেন ভবন, বাঁদিকে মাঠ এবং সর্বত্র অন্ধকার। এখন শেষরাত, ঘুম এখন গাঢ়তম। কোলাপসিবল গেটে তালা দেওয়া। ভিতরের আলো নেভানো। সুনীতের মনে হল তার জন্য যেন পরিবেশটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। চাবিটা সাত দিন ধরে তার পকেটে। তালা খুলে, একটি মানুষ গলে যাবার মতো ফাঁক করল। ভিতরে এসে গেট বন্ধ করে তালা দিল। চরিত্তর সিং ভোরবেলায় গেটের তালা খোলা দেখে যেন অবাক না হয়। অবাক হওয়ার কারণটা খুঁজে পাওয়ার বাতিক অনেক মানুষেরই থাকে।

সে ভেবেই রেখেছে এরপর কী করবে। উঠোনে সিমেন্টের ঢাকা ট্যাঙ্কটায় এবার উঠতে হবে। ট্যাঙ্কের তলা পরিষ্কার করতে ভিতরে নামার জন্য এর উপর উঠতে হয় এবং ওঠার জন্য চারধাপ পাকা সিঁড়ি আছে। সেখান থেকে, সে যাকে ‘ব্রিজ’ বলে, সেই চারগজ লম্বা দোতলার বারান্দাটায় পৌঁছতে হবে দেয়ালের খাঁজে পা রেখে, পাইপ ধরে। বারান্দাটাকে সে ‘ব্রিজ’ বলে যেহেতু কলঘর পায়খানা তাদের ফ্ল্যাট থেকে একটা দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন এবং খোলা বারান্দাটার দ্বারা যুক্ত। প্রত্যেক ফ্ল্যাটেরই এই ‘ব্রিজ’ রয়েছে চারতলা পর্যন্ত থাক দিয়ে।

উমা বলেছিল, খোলা বারান্দা দিয়ে কলঘরে যাওয়া-আসাটা অশ্লীল ঠেকে। সুনীত মিস্ত্রি এনে বারান্দার কোমর সমান পাঁচিলের উপর কাঠের ফ্রেম বসিয়ে তাতে ত্রিপল লাগিয়ে দেয়। রোদ, বৃষ্টি, বাতাস প্রভৃতি কালক্রমে জীর্ণ করে দেওয়ায় এখন ত্রিপলের সবটাই খসে গেছে, ফ্রেমের কাঠও খুলে গেছে দু-তিন জায়গায়।

বহুবার মাঝরাতে কলঘরে আসার জন্য দরজা খুলে সুনীত দাঁড়িয়ে থেকেছে। কেন যেন তার মনে হত, কেউ হয়তো অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আছে। বুকটা কেঁপে উঠত। যদি চোর এসে লুকিয়ে থাকে। বারান্দা দিয়ে কেউ এলেই মাথায় ডান্ডা মেরে অজ্ঞান করে, ফ্ল্যাটে ঢোকার জন্য হয়তো অপেক্ষা করছে। তখন সে ভাবত, চোরটা কীভাবে আসতে পারে? সেই ভাবনা থেকেই সে বারান্দায় উঠে আসার ঘাঁতঘোঁতগুলো বার করে ফেলে।

সুনীত খসে যাওয়া ত্রিপলের ফাঁক দিয়ে বারান্দায় উঠে এল। চমৎকারভাবে নির্ঝঞ্ঝাটে এ পর্যন্ত সে প্রতিটি কাজ করেছে, চরিত্তরের ঘরটা ট্যাঙ্কের পাশেই, ভয় ছিল যদি শব্দটব্দ হয়।

কেউ দেখেনি, কারুরই ঘুম ভাঙেনি এই শীতের ভোর রাতে। কিন্তু সুনীত ঘামছে। কনুই দুটো জ্বালা করছে ঘাম গড়িয়ে নামায়। এবার সব থেকে কঠিন অংশটা বাকি। তাকে অপেক্ষা করতে হবে। ভোরের আলো ফুটলেই আর এই ব্রিজের উপর অপেক্ষা করা চলবে না। ‘বি’ ব্লকের কেউ দেখে ফেলতে পারে বিশেষত কান্তির ফ্ল্যাট থেকে।

প্রথমে ওঠে সুবল। দরজার খিল খুলে সে পেচ্ছাব করতে আসবে। কিন্তু কোথায় করতে আসবে, কলঘরে যে নর্দমাটা আছে সেখানে না পায়খানায়? সুনীত এইবার দিশাহারা হল। সুবল এতদিন কোথায় পেচ্ছাব করে আসছে এই তথ্যটা তার জানা নেই। যদি কলঘরে যায় তাহলে সে পায়খানায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে থাকবে। কাজ সেরে ফেরার পর ও বারান্দার দরজাটা বন্ধ করবে না। যতক্ষণ না দুধ আনার জন্য ফ্ল্যাট থেকে বেরোবে ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। সুবল খুঁতখুঁতে সাবধানী লোক।

পায়খানা ও কলঘর পাশাপাশি। সুনীতের মনে হল কলঘরে গিয়ে এবার সে সিগারেট খেতে পারে। আকাশে তাকিয়ে বুঝল আর কিছু পরেই ভোর হবে। পরপর লরি চলার শব্দ এবার শুরু হয়েছে। উপরের ফ্ল্যাটে কাশতে কাশতে কে দরজা খুলল কলঘরে যাবার জন্য। কাছাকাছি একটা বাড়ির ছাদে পোলট্রি আছে। একটা মোরগ কয়েকবার ডেকে উঠল।

সুনীত সিগারেট ধরিয়ে প্রথম টান দিয়েই নিভিয়ে ফেলল। এতটা অসাবধানী সে কী করে হল। সিগারেটের গন্ধে কলঘর ভরে থাকলে সুবল কি চমকে উঠবে না?

এইবার থেকে তাকে সাবধানে, হিসেব করে প্রতিটি মুহূর্ত চলতে হবে। একটি ভুল করলেই সে ফাঁস হয়ে যাবে। বদ্ধ, সংকুচিত, গতিহীন জীবন, তার সঙ্গে উদ্বেগ আর ভয় এবার থেকে তাকে নিয়ন্ত্রিত করবে। সুনীত বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। বাইরের পৃথিবী তার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে। চৌবাচ্চচার পাড়ে বসে দু’হাতে সে মুখ ঢাকল।

দরজা খোলার শব্দ হয়েছে।

সুনীত ভেবে পাচ্ছে না কোথায় লুকোবে। সময় নেই ভাববার। যা থাকে বরাতে…সে প্রায় লাফিয়ে পায়খানায় ঢুকে দরজার পাল্লা সন্তর্পণে ভেজিয়ে দিল।

সুবলের পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। সদ্য ঘুমভাঙা মানুষের অনিশ্চিত মন্থর পদক্ষেপ। জড়ানো গলায় কী যেন বিড়বিড় করল। কলঘরে বালতি সরাবার শব্দ। সুনীত উৎকর্ণ হয়ে রইল এবার আর একটা শব্দ শোনার জন্য এবং তা পেতেই বুকের মধ্যে জমে ওঠা বাতাস আস্তে আস্তে ছেড়ে দিল।

জল ঢেলে সুবল বারান্দা দিয়ে ফ্ল্যাটের মধ্যে ফিরে গেল। নীচে খড়মের শব্দ হচ্ছে, চরিত্তর উঠেছে। গেটের তালা খুলে বাইরে যাবে, দাঁতন করবে। পাল্লা ফাঁক করে সুনীত তাকিয়ে দেখল গুণেন ভবনের দেওয়ালে, জানলার এবং সিমেন্টের উঠোনে ভোরের ফিকে আলো হালকাভাবে পড়েছে। কুয়াশার মধ্য থেকে যেন বাড়িটা ফুটে উঠছে। সুবল আলো জ্বেলেছে দালানের। ওর ছায়াটার চলাফেরা মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয় দালানের জানলা দুটোও খুলেছে।

সুবল দালান ঝাঁট দিল। বালতি নিয়ে কলঘরে এল এবং জল নিয়ে ফিরে গেল। কিছুক্ষণ পরেই সে বেরোবার জন্য দরজা খুলল। ফ্ল্যাট অরক্ষিত যেহেতু উমা এখনও ঘর থেকে বেরোয়নি সুতরাং বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে দুধ আনতে যাবে। সুনীত পায়খানা থেকে বেরিয়ে হাঁটু ভেঙে, কুঁজো হয়ে, দেয়াল ঘেঁষে নীচের দিকে তাকাল। সিঁড়ির শেষ তিনটে ধাপ এখান থেকে দেখা যায়। ওই ধাপক’টা দিয়ে সুবলের পাজোড়া নেমে যাবার পরই সে একটা নিশ্চিন্তির মধ্যে এবার আশ্রয় নিতে পারবে। চারপাশে দেয়াল, মাথায় ছাদ এবং প্রয়োজন মেটাবার জিনিসগুলো অন্তত পাবে।

উমা নিশ্চয় এখনও বিছানা থেকে ওঠেনি। ও কি ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে। সুনীত কোনোদিন তা দেখেনি কিন্তু এখন সে নেই বলে যদি খিল দেয়! ভাবতে গিয়ে সে বিরক্ত হল। বুড়ো সুবল ছাড়া চড়াও হবার মতো আর কে আছে এই ফ্ল্যাটে।

হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তোলা, সুবলের লিকলিকে পা দুটি দেখামাত্র সুনীত প্রায় ছুটেই বারান্দা অতিক্রম করে দালানে এল। আলো জ্বলছে, জানলা দুটো খোলা। সুনীত ঝপ করে বসে পড়ল। পর্দা ঝুলছে বটে কিন্তু জানলার সবটা ঢাকা নেই। কান্তির বউ খুব ভোরে রান্নাঘরে এসে উনুন ধরাবার তোড়জোড় শুরু করে। সেখান থেকে এই দালান দেখা যায়।

শোবার ঘরের দরজা বন্ধ। হামাগুড়ি দিয়ে দরজার দিকে যাওয়ার সময় তার মনে হল, জুতো পরে বারান্দা দিয়ে ছুটে আসাটা বোকার মতো কাজ হয়েছে। হামাগুড়ি দেওয়া উচিত ছিল। মৃদু আলোর মধ্যে, দুই তিন কি চার সেকেন্ডের জন্য হলেও, একজন ছুটে গেল, এবং তা যদি কেউ ঘুমভাঙা চোখে দেখে থাকে তাহলে সেটা গল্প করার মতো বিষয় হয়ে উঠতে পারে।

দরজায় চাপ দিতেই খুলে গেল। ঘর অন্ধকার, জানলাগুলো বন্ধ। ঘুমন্ত মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এই অন্ধকারে উমাকে গায়ে হাত দিয়ে জাগালে ও ধড়মড়িয়ে উঠে বসবে এবং চিৎকার করতে পারে। আলো জ্বেলে নিলে? ঘুমভাঙা অসাড় অসংলগ্ন চেতনায়, একটা সাত দিনের দাড়িওলা, উসকোখুসকো চুলভরা মুখ যদি হঠাৎ ছায়া ফেলে তাহলে কী প্রতিক্রিয়া হবে? তার থেকে বরং স্বাভাবিক ওর ঘুমভাঙার জন্য অপেক্ষা করা যেতে পারে। এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে বসে থাকতে পারে। এটা তার নিজের ঘর।

ঘরের কোথায় কোন জিনিস সে জানে, অবশ্য এই সাত দিনে যদি উমা অদলবদল করে না থাকে। সন্তর্পণে জানলার পাল্লা সে একটু ফাঁক করল। কোমল আলোর ভাপ ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে এসে অন্ধকারকে ঠেলে সরাতে পারল না। কাত হয়ে কুঁকড়ে থাকা উমাকে সে বুঝতে পারছে।

সুনীত বিছানার কাছে এগিয়ে এল। সাবধানে খাটে বসল। প্রায় অসহায় সরল ঘুমন্ত মুখখানি ঘিরে কালোচুলের রাশ। ঘুমের গভীরে নেমে প্রশান্তির মধ্যে উমা এখন অবগাহনে ব্যস্ত। ব্লাউজের উপরের বোতাম দুটি খোলা, রাত্রে শোবার আগে ও ব্রেসিয়ার খুলে রাখে।

মনে পড়ছে না তার, এতখানি বয়সেও সে এমন অসামান্য বিমোহনকারী কোনো দৃশ্যের সম্মুখীন হয়েছে। হয়তো দিনের এই প্রথম আলোর মায়া কিংবা আশ্রয় লাভের স্বস্তি তাকে মুগ্ধ হতে সাহায্য করছে। শূন্য থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসা তুলোর আঁশের মতো সন্তর্পণ কোমলতা এখন উমার সারা অবয়বে। নীচের ঠোঁট আলগা হয়ে নেমে রয়েছে। অভিমানীর মতো। ওর কাঁধ, বালিশ চাপা গাল, ভুরু, চোখের পাতা সে আজই প্রথম খুঁটিয়ে লক্ষ করতে করতে আবিষ্কার করল, উমা একটি শিশু। পুতুল বুকে জড়িয়ে এইভাবে ওরা ঘুমোয়।

রুবির ছবিটা তার মনে পড়ছে। সুপরিণত একটি রেখা, এক টানে কাঁধ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত আঁকা। তাকিয়ে থাকলে প্রগাঢ় ইচ্ছার বাষ্পে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। চাপ চাপ বলিষ্ঠ মাংস রেখাটির তলায় ছড়িয়ে রাখা। রুবি আলাদা, এমন মৃদু কোমলতা ওর মধ্যে নেই। সুনীত নিচু হয়ে উমার দিকে হাত বাড়িয়ে কাঁধে আঙুল ছোঁয়াল। একটা ক্ষীণ কম্পন উমার শরীর দিয়ে বসে গেল, যেন এই স্পর্শ পথ কেটে ওর স্বপ্নের মধ্যে প্রবেশ করল।

কাঁধ থেকে আঙুলগুলো ধীরে ধীরে সে নিয়ে গেল ব্লাউজে। মমতা শব্দটি সুনীত বহুকাল শোনেনি, নিজেও ব্যবহার করেনি, এমনকী চিন্তায়ও। অথচ মমতাভরেই সে উমার উন্মুক্ত স্তনে হাত রাখল। নাতিউষ্ণ এবং ভারী বোধ করল সে মুঠোর মধ্যে। উমা ঈষৎ চমকে উঠল এবং মোমের আলোর ক্রমশ বিস্তারের মতো একটা চাপা স্নিগ্ধ হাসি ওর মুখে ছড়িয়ে পড়ল।

কেন যে এমন ইচ্ছা তার হল সুনীত তার কোনো ব্যাখ্যা বা অজুহাত খোঁজার চেষ্টা করল না। বিছানা থেকে উঠে সে জানলার ধারে দাঁড়াল। ফাঁকটুকু দিয়ে সে ফুটবল মাঠ, গোলাপবাগান রোড, কিছু পথিক এবং বাড়ি দেখতে পাচ্ছে। ধীর বাতাসের ছোঁয়া, রৌদ্রের এবং কোলাহলের প্রস্ফুটন অনুভব করছে। সে একটি জিনিস সম্পর্কে নিশ্চিত সারাজীবনে নিজেকে কখনও তার এত বিশুদ্ধ মনে হয়নি।

উমা আড়মোড়া ভাঙার সঙ্গে ‘উ উ উ উ’ শব্দ করতেই সুনীত ফিরে তাকাল। দু’হাত মুঠো করে মাথার উপর তুলে চোখ পিটপিট করছে।

”ক’টা বাজে,…সুবল কি এখনও চা দিয়ে…।”

সুনীত যেজন্য অপেক্ষা করছে এইবার তা ঘটতে যাচ্ছে। উমার চোখ বিস্ময়ে বড়ো হচ্ছে, মুখগহ্বর বড়ো হচ্ছে।

”না।”

সুনীত চাপা তীক্ষ্ন স্বরে চিৎকার করল, হাত তুলে। ভয়ে, উমা নিজের মুখ চেপে ধরল।

বাইরে দরজা খোলা এবং বন্ধ করার শব্দ হতেই সুনীত ছুটে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে খিল দিল।

”জোরে কথা বলবে না।”

উমা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে।

”যা কিছু বলার পরে বলব, এখন প্রশ্ন কোরো না। শোনো, আমি এখানে থাকব…তুমি ছাড়া কাকপক্ষীতেও যেন তা জানতে না পারে, সুবলও নয়। জানাজানি হলে আমি শেষ, সেই সঙ্গে তুমিও।”

”কেন?”

”আমাকে আশ্রয় দিয়ে লুকিয়ে রাখার জন্য!”

”কেন, কেন তুমি লুকোবে? তুমিই কি…।”

”হ্যাঁ, আমিই। অবাক হওয়ারই কথা, কিন্তু ওসব পরে হবে আপাতত যা বললাম মনে রেখো…কেউ টের যেন ঘুণাক্ষরেও না পায়। মনে থাকবে?”

সুনীতের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে চাপা একটা হুমকি তার নিজের কানেই বাজল। এটা সে চায়নি কিন্তু বিনা প্রয়াসেই ওটা গলায় এসে গেছে। সে বুঝতে পারছে ভয় তার সঙ্গ ছাড়েনি। এতক্ষণ অনুসরণ করে এসেছে, এবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

উমা ঘাড় নাড়ল।

কী বুঝল ও? এবার তাকে কীভাবে গ্রহণ করবে, কীভাবে মানিয়ে নেবে এই পরিস্থিতি।

”বউদি উঠেছ? চা দোব?”

দরজায় তিন-চারটে টোকা পড়ল।

”হ্যাঁ…দাও, যাচ্ছি।”

উমার স্বর যান্ত্রিক। এখনও সে হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে ওঠেনি। সুনীত ট্রানজিস্টারের চাবি ঘোরাল। কোনো এক মহাপুরুষের বাণী পাঠ করা হচ্ছে। একটা শব্দের জটলা এখন দরকার যাতে তাদের কথোপকথন ডুবে যায়। সে আলনাটা টেনে ভিতরের ঘরের দরজাটা খুলতে গিয়ে ভাবল আগে জানলাগুলো খোলা দরকার।

পর্দাগুলো টেনে বিছিয়ে সে দুটো জানলা খুলল। আলোয় ভরে যাবার পর সে ভিতরের ঘরের দরজা খুলল। ভ্যাপসা গন্ধটা সইয়ে নিয়ে সে একটা ছোট্ট জানলা আছে এবং সেটিও মাঠের দিকে। জানলা খুলবে কি না, তাই সে দ্বিধায় পড়ল। বরাবরই এটা বন্ধ আছে হঠাৎ যদি কেউ খোলা দেখে তাহলে কী ভাববে? নিশ্চয় ওয়াচ রেখেছে ওরা। অস্বাভাবিক ব্যাপারটা নজরে পড়বেই।

এখন বন্ধই থাক, রাতে খুলবে। ঘরের মেঝেটায় অসম্ভব ধুলো, ভাঙাচোরা এবং আজেবাজে জিনিসগুলো একধারে সরিয়ে জায়গা করতে হবে। ভাঙা চেয়ারের উপর ছেঁড়া তোশকটা তুলতেই দুটো আরশুলা ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এল। সুনীত হাত থেকে তোশকটা ফেলে দিল। আরশুলা সে সহ্য করতে পারে না। জায়গাটা পরিষ্কার করতে গেলে প্রায় সব জিনিসই বার করে রাস্তায় ফেলে দিতে হবে। কিন্তু কে বার করবে। সুবল? উমার পক্ষে এ কাজ সম্ভব নয়, ব্যাপারটা চোখে পড়ার মতো হবে। তাহলে কি এইসব জঞ্জাল, পোকামাকড় নিয়ে বাস করতে হবে?

সুনীত শোবার ঘরের দিকে তাকাল। উমা খাটে বসে রয়েছে দরজার দিকে মুখ করে। ওর পিছনে এসে কানের কাছে মুখ এনে চাপা গলায় সে বলল, ”আমি ওই ঘরটায় থাকব।”

সে ভেবেই রেখেছে কীভাবে দিন এবং রাত কাটাবে। অসহ্য লাগবে, কিন্তু দিনের পর দিন একটা ছোট্ট আবদ্ধ জায়গায় তো অধিকাংশ বউই কাটাচ্ছে, যেমন সামনের ফ্ল্যাটের কান্তির বউ। এটা অভ্যস্ত হওয়ার জিনিস। বাবা কী করে কাটিয়েছেন?

”রাতে এই খাটেই শোব, সকালে সুবল যখন বাজার যাবে তখন কলঘরে যাব…খাওয়ার ব্যাপারটা তোমাকে ম্যানেজ করতে হবে। কীভাবে করা যায় সেটা…”

উমা থরথর করে উঠে উপুড় হয়ে বালিশে মুখ চেপে ফোঁপাতে শুরু করল। সুনীত বিভ্রান্ত হয়ে কাঁধ ধরে চেষ্টা করল ওকে টেনে তোলার।

”করছ কী? সুবল যে শুনতে পাবে।”

থামল না উমা। গোঙানির মতো শব্দ করে যেতে লাগল। সুনীত ভেবে রেখেছিল, ভয় পাবে, রেগে উঠবে, ধিক্কার দেবে আর যদি কান্নাকাটি করেও তাহলে এভাবে নয়, নাটকীয়ভাবে করবে।

”প্লিজ চুপ করো, তোমাকে পরে বলছি সব। আগে এদিকের ব্যাপারগুলো বুঝে নাও…”

”বউদি দরজা খোলো, কী অ্যাতক্ষণ ধরে ঘুমোচ্ছ…চা জুড়িয়ে যাচ্ছে আর…রোববার বলে কি…।”

সুবলের বিরক্ত স্বর রান্নাঘরের দিকে চলে যেতেই উমা খাট থেকে নেমে কাপড়ে চোখ মুছল।

”বেরিয়েই দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ো। সুবল কি এ ঘরে আসবে?…যাতে না আসে সেই ব্যবস্থা করো। ওকে বাজারে পাঠাও, আমি পায়খানায় যাব আর চা করে দিয়ো তখন। খিদে পাচ্ছে…কলঘরে তোয়ালে সাবান, ব্রাশ সব রেখে এসো…”

বলতে বলতে সুনীত ভিতরের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। যদি সুবল হঠাৎ শোবার ঘরে আসে!

দেয়ালটা পাতলা, ওপাশে রান্নাঘর। সুনীত দেয়ালে কান লাগিয়ে বাসনের শব্দ এমনকী কথাবার্তার চাপা আওয়াজও শুনতে পাচ্ছে। কথাগুলো বোঝা যাচ্ছে না তবে দেয়ালের কাছে এসে যখন বলছে শুনতে পাচ্ছে।

”পাঁউরুটি দুটো।…এই পরশু বললে খরচ কমাতে হবে…ডিম আনব? দুটো…”

পাল্লার জোড়ে সাদা রেখা দেখা যাচ্ছে। দুটো কাঠের মধ্যে ফাঁক। আলো আসছে। সুনীত চোখ রাখল সেই ফাঁকে। বিছানার আধখানা, শোবার ঘরের দরজা, তার পাশে হাতখানেক দেওয়াল ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। সে আবার রান্নাঘরের দেওয়ালে কান চেপে ধরল। মনে হল সুবল বাসন বাজছে। ট্রানজিস্টারটা খোলাই, পুরুষগলায় রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছে। দূর থেকে মোটরবাইকের শব্দ এল, উপরের ঘরে কেউ স্কিপিং করছে। বাইরের জগতের সঙ্গে কান দিয়েই যোগাযোগ রাখতে হবে এটা সে বুঝতে পারছে।

এখন তার খিদে পাচ্ছে। কীভাবে উমা তাকে খাওয়াবে। সারাদিনই তো সুবল থাকবে, তার নজর এড়িয়ে কী করে দু’বেলা ভাত দেবে? উমা অফিসে বেরিয়ে যাবে সাড়ে ন’টার মধ্যে, তারপর সুবল একা। এখন থেকে অবশ্য দুজন…সুবল নিশ্চয় দুপুরে বাইরের দালানে ঘুমোবে। উমা ফিরবে সন্ধ্যায়, তখন এইভাবে এই ঘুপচি জায়গাটায় দুর্গন্ধের মধ্যে আরশুলাগুলোর সঙ্গে সময় কাটাতে হবে!

কিন্তু খাব কীভাবে? খাওয়া যে এতবড়ো ব্যাপার তা, হৃদয়ঙ্গম করার মতো অবস্থায় সে কখনও পড়েনি। ”খিদে কী জিনিস তা তুমি জানো না।” সুনীত হাসল। রুবির সঙ্গে কখনও দেখা হলে বলতে হবে, জেনেছি। এইবার সে বুঝতে পারছে তার টিকে থাকার জন্য বাতাস ও জলের মতোই খাদ্য দরকার এবং সেটা সংগ্রহ করতে বিরাট অসুবিধা তার সামনে, অন্য সময় এটাকে সে হাস্যকর অসুবিধা ভাবত কিন্তু এখন নয়।

অসুবিধাটা সুবল।

সুবল না থাকলে তার অসুবিধা নেই, তাহলে ওর না থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। সুবলকে ছাড়িয়ে দেওয়া দরকার। তার বদলে একটা ঠিকে ঝি রাখা যেতে পারে। সকালে এসে, দোকান বাজার বাসনমাজা লন্ড্রি, রেশন আনা আর কী দরকার? রান্নাটা উমা নিজে করবে। অফিসে যাওয়ার সময় বাইরের দরজায় তালা দিয়ে যাবে।

খসখস শব্দ শোবার ঘরে। সুনীত পাল্লার জোড়ে চোখ রাখল। উমা তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে অর্থাৎ বন্ধ দরজার দিকে। সুনীত পাল্লাটা ফাঁক করল সামান্য তারপর আরও। ইশারায় জানতে চাইলে সুবল বেরিয়ে গেছে কি না। উমা মাথা হেলাল।

সুনীত বেরিয়ে এল।

”কলঘরে সব দিয়ে এসেছি।”

কথা না বলে সুনীত শোবার ঘর থেকে দালানে বেরিয়েই যেন কারুর ধাক্কা খেয়েই পিছিয়ে এসে ঘরে ঢুকল, ”দালানের পর্দা ফেলে দাও। সামনের ওরা দেখতে পায়… বরং জানালাগুলোই ভেজিয়ে দাও।”

বারান্দার দরজায় এসে সুনীত থমকে গেল। বারান্দা দিয়ে হেঁটে গেলে কেউ দেখে ফেলবেই। ছেঁড়া, ঝুলে পড়া ত্রিপল তাকে আড়াল করতে পারবে না। অসহায়ভাবে সে উমার মুখের দিকে তাকাল।

হামাগুড়ি দিয়ে তাকে চার গজ জায়গাটা পার হতে হবে। ব্যাপারটা হঠাৎ তার মনে হল লজ্জাকর, নিজের ব্যক্তিত্বকে গুঁড়িয়ে ধুলো করে ফেলা, ভাগ্যের কাছে বশ্যতা স্বীকার করা এবং এসবই নিছকই এই শরীটাকে জিইয়ে রাখার জন্য।

সুনীত উবু হয়ে হাত দুটি মেঝেয় রাখল। পিঠটাকে নামিয়ে দিল, এবং এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে। কলঘরের কাছাকাছি এসে উঠে দাঁড়াবার আগে সে একবার মুখ ফিরিয়ে পিছনে তাকাল।

উমা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে তার দিকে। ওর চাহনি তার হৃৎপিণ্ডটাকে একবার কচলে নিয়ে ছেড়ে দিল। নতুন জাতের কোনো জানোয়ার উমা যেন দেখছে। এবার থেকে উমাই খাওয়াবে পরাবে। সুনীত কলঘরের দরজা বন্ধ করতে করতে ভাবল, বিশ্বস্ত কুকুর হতে হবে!

একইভাবে হামাগুড়ি দিয়ে সে ফিরে এল। কিছু আলুভাজা, ফুলকপি ভাজা আর রাতে জল দিয়ে রাখা মুঠো কয়েক ঠান্ডা ভাত খাওয়ার টেবিলে রেখে উমা বসে আছে।

”আর কিছু ঘরে নেই এ ছাড়া।”

কোনো কথা না বলে সুনীত মিনিট দুয়েকের মধ্যে সেগুলো শেষ করে ফেলল।

”এখন মাসের শেষ…।”

সুনীত ঘাড় নাড়ল।

”প্লেটগুলো তাড়াতাড়ি ধুয়ে রাখো, সুবলের চোখে পড়তে পারে।”

সুনীত শোবার ঘরে ঢুকল। জামা এবং প্যান্ট বদলাতেই হবে। স্টিল আলমারির হাতল ঘোরাতে গিয়ে বুঝল চাবি দেওয়া।

”উমা শোনো।”

বলার সঙ্গে সঙ্গেই কলিংবেল বেজে উঠল। সুবল? ভিতরের ঘরের মধ্যে এসে সুনীত পাল্লা দুটো আধভেজিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

উমা কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। কথার শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসছে। আস্তে আস্তে দরজা বন্ধ করে দিল সুনীত। সুবল নয়, অপরিচিত পুরুষ কণ্ঠস্বর।

”পিসিমা আমি আর বসব না, এখুনি যাব সেজোকাকার বাড়ি সেই কসবায়। যদি আগেই যেতে চান তাহলে বিকেল পাঁচটা পঁয়ত্রিশের স্টিল এক্সপ্রেসে যেতে পারেন।”

”বড়দার একটা চিঠি মঙ্গলবার অফিসে পেয়েছি কিন্তু এর মধ্যেই যে অবস্থা এতটা খারাপ হবে… আমি নিশ্চয় যাব, তবে আজকেই পারব কি না… তুমি কি একটু বসবে না?”

”না না, আমি এখুনি যাব।”

”তোমার নামটা কী বললে?”

”অংশুমান।”

”খুব ছোট্ট দেখেছি তোমায়। বছর বারো আগে একবার জামসেদপুর গেছলাম, তখন তোমার বয়স বোধহয় ন-দশ বছর ছিল। তোমার পরে তো এক বোন ছিল, বিয়ে হয়ে গেছে?”

”না।”

”তুমি কী করছ?”

”যাদবপুরে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি। পিসিমা আমি এবার আসি।”

”হ্যাঁ এসো… কেউ তো আর আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি। বড়দারই সবথেকে বেশি আপত্তি ছিল আমার বিয়েতে। বাবা বললেন, জীবনে আর আমার মুখদর্শন করবেন না, সত্যিই করেননি। ওঁর মৃত্যুর খবরটা পর্যন্ত কেউ দিল না তাই শেষ দেখাও হয়নি। দু’হপ্তার পর ছোটোবউদির চিঠিতে জানতে পেরেছিলাম। কী যে কষ্ট হয়েছিল। মাকে জামসেদপুর নিয়ে গেল বড়দা তা-ও জেনেছি ছোটোবউদির চিঠিতে…হ্যাঁ এসো। আমি নিশ্চয় যাব।”

দরজা বন্ধ হবার শব্দর পর সুনীত বেরিয়ে এল।

”কী ব্যাপার, তোমার মা-র কিছু হয়েছে নাকি?”

”বড়দার ছেলে খবর এনেছে মা-র এখন-তখন অবস্থা। আমাকে দেখতে চেয়েছে।”

”তুমি জামসেদপুর যাবে নাকি?”

”হ্যাঁ।”

”কী হবে গিয়ে।”

”মাকে শেষবারের মতো একবার দেখব না!”

”দেখে কী লাভ। এত বছর তো দ্যাখোনি, কোনো অসুবিধা হয়েছে কি? ওদেরও কোনো অসুবিধা হয়নি তোমায় না দেখে। যেমন দিন কাটছে তেমনই কাটুক না, কী দরকার যাবার।”

উমার চোখে বিরক্তি এবং ক্ষোভ লক্ষ করে সুনীত সাবধান হয়ে গেল।

”তুমি চলে গেলে আমি কিন্তু মুশকিলে পড়ব।”

”সেজন্য কি আমি মাকে দেখতে যাওয়া বন্ধ করব? তোমার কী হবে না হবে তাই বিবেচনা করে কি এখন আমায় চলতে হবে!”

”ব্যাপারটা তুমি…।”

”পুলিশ এসে জিজ্ঞাসা করেছিল কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে কি না। কিন্তু আমি জানি রাজনীতি তুমি জীবনে করোনি, করতে পারবেও না। তাহলে এ-কাজ কেন করলে…কেন কেন? আমি এই ক’দিন ঘুমোতে পারিনি, খেতে পারিনি, শুধু ভেবেছি তোমার পক্ষে সম্ভব হল কী করে একটা মানুষ খুন করা।”

”আস্তে উমা, আস্তে।”

সুনীতের এখন একটাই ভয়। বোধবুদ্ধির সীমা ছাড়িয়ে উমা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। ওর চাহনি থেকে জানোয়ারের নখ বেরিয়ে আসছে।

”পরশু রাতে বোমা পড়েছে, পুলিশের সঙ্গে পাইপগান নিয়ে লড়াই হয়েছে মাঠে, সামনের রাস্তায়। পুলিশের তাড়া খেয়ে পাশের বাড়ির পাঁচিল টপকে ওরা পালায়। সেই রাতে আমাদের ফ্ল্যাটে পুলিশ এসেছিল।”

”কেন?”

”তোমার খোঁজে। ওদের ধারণা তুমিও দলে আছো।”

শুনতে শুনতে সুনীতের মনে হল একটা সুযোগ তার সামনে এসে গেছে, এটা হাতছাড়া করা উচিত হবে না। গোলাপবাগান রোডের এক বাড়ির দেয়ালে একসময় লেখা দেখেছিল, ”খতম মানে খুন নয়, শ্রেণিঘৃণার চরম প্রকাশ মাত্র।” হাবা খুন হয়নি খতম হয়েছে, এইভাবে উমার কাছে ব্যাপারটা তুলে ধরলে সেই রাতের ঘটনার চরিত্রটাই আমূল বদলে যাবে।

”তোমার এ ধারণা কী করে হল যে আমি রাজনীতিতে যেতে পারি না, মানুষ খতম করতে পারি না?”

”পারার মতো বয়স তোমার নেই, পারার মতো মনের জোর তোমার নেই, জীবন সম্পর্কে কৌতূহল তোমার নেই, তুমি এক ধরনের ভীরু, তোমার অতৃপ্তি আমাকে নিয়ে…আমি জানি, আমি জানি রুবি কাঞ্জি সম্পর্কে অনেক কথাই জানি…তুমি খতমের রাজনীতিতে ঢুকবে, মরে গেলেও তা বিশ্বাস করব না। মানুষের মধ্যে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা তোমার নেই, নিজেকে ছাড়া তুমি আর কিছু ভাবতে পারো না।”

সুনীতের মাথার মধ্যে একটা রাগ এবার দপদপ করে উঠল। রুবি সম্পর্কে অনেক কথা কে বলল উমাকে? চিন্ময় ঘোষ হয়তো। নিশ্চয় কারও কাছ থেকে তার নিরুদ্দেশের খবর শুনে এখানে এসেছিল সহানুভূতি বা সাহায্য দেবার ছলে। হয়তো তখন কুটকুট করে লাগিয়েছে।…ব্যাটা ছুঁচো। এখন প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়া দরকার।

 ”জামা-প্যান্ট বার করে দাও, এগুলো বদলাতে হবে, গন্ধ ছাড়ছে।”

উমা নিজেকে সামলে নিয়েছে, কথার জের টেনে কথা বাড়াল না।

আলমারি খুলে বলল, ”যা যা দরকার বার করে নাও।”

একটি প্যান্ট এবং নীল টেরিলিন গেঞ্জি টেনে নিয়ে সুনীত ইতস্তত করল হাতকাটা সোয়েটারটাও বার করবে কি না। স্নান করে শীত-শীত লাগছে।

”তুমি কি মাকে দেখতে যাচ্ছ?…না না অন্য কিছু নয়। এইভাবে একা আমি থাকব, বুঝতেই পারছ কী ধরনের অসুবিধে হবে।”

”আমি কী করতে পারি বলো। তুমি যে এভাবে আসবে, আমার ধারণারই বাইরে। কিন্তু মাকে তো দেখতে যেতেই হবে, বোধহয় আর বাঁচবে না, প্রায় পঁচাত্তর হল।”

”আজই তো যাচ্ছ না।”

”হাতে টাকা নেই, নইলে যেতাম। কাল মাইনের দিন, অফিসে গিয়ে টাকাটা নিয়ে ওখান থেকে স্টেশন চলে যাব।”

সুনীতের মনে পড়ল তার মাইনের তারিখ দিন পাঁচেক পর। কিন্তু সে আনতে যেতে পারবে না।

”কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে যেতে পারবে? বিস্কুট বা চিঁড়েমুড়কি বা ওই ধরনের কিছু আর-”

কলিংবেলের শব্দ হল। সুনীত কথাটা অর্ধসমাপ্ত রেখে পিছিয়ে গেল।

দরজার পাল্লা বন্ধ করে সে প্যান্ট-শার্ট বদলাল। এখন তার ঘুম পাচ্ছে। মেঝেটা পরিষ্কার করা হল না। বেড কভার আর একটা বালিশ যদি আনার কথাটা তার মনে থাকত। চটপট এখনও আনা যায়। শোবার ঘরে সুবল দু-তিনবারের বেশি সারাদিনে আসে না।

পাল্লা ফাঁকা করে সুনীত দেখল উমা দরজাটা মাত্র ভেজিয়ে রেখেছে। বিছানার উপর ঝাঁপিয়ে সে বেডকভার ও একটি বালিশ টেনে নিয়ে ভিতরের ঘরে এল। কাঁপছে তার হাঁটু এবং হাত, তারপর সে হাসল। কিন্তু কেন যে হাসল, তা সে জানে না।

আধো-ঘুম আধো-জাগরণের মধ্যে সুনীত অনেকক্ষণ ভাসতে ভাসতে, গত পাঁচ দিনের নানান টুকরো সংলাপের এবং বিভিন্ন দৃশ্যের তরঙ্গে দুলতে শুরু করেছে। কিছু মুখ সে স্পষ্ট দেখতে পেল, যেমন বুড়ি ভিখারির, ট্যাক্সি ড্রাইভারের সহকারীর, পুলুর এবং মুখে পাইওরিয়ার গন্ধওলা লোকটির।

”…বুঝলেন সুনীতবাবু লেকের উত্তর-পশ্চিম কোণে গাছটা আছে। একবার গিয়ে দেখে আসতে হবে। মুশকিল কী জানেন, চিনতেই পারব না। কল্পতরু…বাওবাব নাকি বিশাল, কিন্তু শুনেছি এটা নাকি খুবই শিশু, আইডেন্টিফাই করতেই হয়তো পারব না।”

”যদি করতে পারেন তাহলে কল্পতরুর কাছে কী চাইবেন?”

”কী আর চাইব, টাকাপয়সা সুখশান্তি এই সবই তো দরকার…তবে বুঝলেন, লিভিংস্টোন প্রথম দর্শনেই থ হয়ে গেছল, বলেছিল বিশ্বের অষ্টম বিস্ময়। আসলে আমি চাইব অবাক হয়ে যেতে… বিরাট কিছু জীবনে তো আর দেখলুম না।”

সুনীত ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল দরজায় খুটখট আওয়াজে।

”কে কে?”

সুনীত ধড়মড় করে উঠে বসল।

দরজাটা খুলে গেল। উমা প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে।

”খেয়ে নাও, সুবলকে পাঠিয়েছি দুটো কোসাভিল কিনতে। এক্ষুনি এসে পড়বে।”

উমা মেঝের উপর ভাতের প্লেট রেখে চলে যাচ্ছে, সুনীত সন্ত্রস্ত হয়ে বলল : ”জল, আমার ভীষণ জলতেষ্টা পাচ্ছে।”

”দিচ্ছি।”

”একটা বালতিতে দাও, পরেও তো তেষ্টা পাবে।”

ভাতের মধ্যে গর্ত করে ডাল। আর একটি গর্তে ডিমের ঝোল। ডিমটি আধখানা। একটা ছোট্ট কাচের বাটিতে টোম্যাটোর চাটনি। সুনীত তাকিয়ে দেখতে দেখতে অসম্ভব খিদে বোধ করল। ডাল এবং ঝোল একসঙ্গে চটকে, গোগ্রাসে খেতে শুরু করল।

একটা ছোটো প্লাস্টিকের বালতিতে জল আনল উমা, একটি কাচের গ্লাসও।

”আর নেই, ভাত?”

”দুজনের মতো মাপ করে সুবল চাল নিয়েছে, আমার ভাগ থেকে তোমাকে দিয়েছি। সেজন্যই তো সুবলকে ছুতো করে বাইরে পাঠালাম।”

”ওকে ছাড়িয়ে দাও।”

”সেকী!”

”ও থাকলে অসুবিধে হবে, বরং একবেলার জন্য একটা ঠিকে ঝি রাখো, কাজ তো সামান্যই।”

”তা হয় না। বুড়ো মানুষ হঠাৎ ছাড়িয়ে দিলে যাবে কোথায়, খাবে কী?”

”কিন্তু আমার যে অসুবিধাটা হচ্ছে সেটা কি দেখবে না!”

দুজনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে সুনীত বুঝতে পারল, সুবল থাকবে। ওকে উমার দরকার। হয়তো তার থেকেও বেশি দরকার।

ভাতের শূন্য প্লেটের দিকে তাকিয়ে সুনীতের মনে হল, গৃহপালিত জীবকে যেভাবে খেতে দেওয়া হয় অনেকটা সেইরকমই এখন দেখাচ্ছে পরিবেশটাকে। তার পেটে এখনও প্রচুর খিদে কিন্তু সে-কথা বলতে পারল না।

”এখানে ফিরে না এলেই পারতে।”

উমার কণ্ঠে এবং চাহনিতে বিষণ্ণতা, দুঃখ। সুনীত ভেবে পাচ্ছে না কী জবাব দেবে। ও কি চায় সে চিরতরে আড়ালেই থাকুক, তার প্রয়োজন কি উমার কাছে ফুরিয়ে গেছে?

”সুবলকে ছাড়ানোটা খুবই অন্যায় হবে। তা ছাড়া এভাবে ক’দিন তুমি লুকিয়ে কাটাবে! মানুষ কি এভাবে থাকতে পারে? নিজেও তো বুঝতে পারছ এটা অসম্ভব ব্যাপার।”

”ভেবে পাচ্ছি না আমি কী করব। দূরে কোথাও চলে যেতে হবে কিন্তু কোথায় থাকব, কী খাব! চাকরি পাব না, কিছু টাকা পেলে বরং ব্যবসা করা যায়।”

সুনীত মাথা নামিয়ে রইল। উমা নীরবে প্লেটটা তুলে নিয়ে গেল। দরজাটা আর বন্ধ করল না সুনীত।

কলিংবেল বাজছে। দরজা ভেজানোর জন্য সে ব্যস্ততা বোধ করল না। সে জানে উমা শোবার ঘরে সুবলকে এখন আসতে দেবে না।

”একেবারে তিনটে ট্যাবলেট আনলুম, বারবার অত দূরে কে আর যায়।”

”ভালোই করেছ…আর শোনো কাল আমি মাকে দেখতে জামসেদপুর যাব।”

সুনীত কান চেপে ধরল দেওয়ালে। ওরা এখন রান্নাঘরে। কী বলছে ওরা বোঝা যাচ্ছে না। উমা কী ব্যবস্থা করে যাবে? বুড়ো মানুষটা বাইরে বেশি যায় না। সারাদিন তাহলে তো তাকে এই ছোটো জায়গাটাতে কাটাতে হবে, শোবার ঘরেও তখন রাত্রে ছাড়া যাওয়া যাবে না। উমাকে বলতে হবে শোবার ঘরের দরজায় যেন তালা দিয়ে না যায়। কলঘরে যাওয়া তাহলে বন্ধ হয়ে যাবে।

একমাত্র সুবল ঘুমিয়ে পড়ার পর, গভীর রাতে ছাড়া সে বেরোতে পারবে না। উমার দরকার কী মাকে দেখতে যাওয়ার? ন’বছর কোনো সম্পর্ক নেই, সেজন্য কোনোদিনই হা-হুতাশ করতে দেখিনি অথচ এখন ওকে যেতেই হবে! কেন? স্মৃতিগুলোকে ঝালিয়ে নেবার জন্য? সেইজন্যই কি সে-ও কৃষ্ণনগরে গেছল! নিজের সম্পর্কে একটা চাপা রাগ সুনীতের পা থেকে মাথায় উঠে এল। এভাবে চলা যায় না, এভাবে বাঁচা সম্ভব নয়। কোনোকিছুই আর আগের মতো অর্থ নিয়ে তার মগজে ধাক্কা দিচ্ছে না। তার অবাক লাগছে ভাবতে, এই ছ-সাতটা দিন সে এভাবে কাটাতে পারল কী করে! সবথেকে ভয়ংকর ব্যাপার। এই সন্দেহটা তার মনে জন্মাতে শুরু করেছে যে সবাই যেন ঠিকঠাক রয়েছে, এমনকী তার বাবাও। এটা তার নিজেরই দোষ।

প্রভূত পরিশ্রম করে সে সচ্ছল অবস্থায় এসেছে এবং এটাই তো তার নিজের উপর আস্থা বাড়াতে পারত কিন্তু তা হয়নি। চাকরি এবং বৈষয়িক উন্নতির দিকে যদি না যেত তাহলে হয়তো কবিতা লেখার কথাই ভাবত, দু’চারটে ভালো কবিতা লিখেও ফেলত।

সন্দেহ নেই সে ঠকিয়েছে, সবাইকে মিথ্যা কথা বলে গেছে। সকলকেই। বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা। কখনই সে একই মানুষ থাকেনি, বাদল নস্করকে এক রকম, বাবাকে অন্য রকম। শেখ মঞ্জিল, রুবি, উমা প্রত্যেককে আলাদা আলাদা। যখন যেখানে তখন সেই ভূমিকায়। অফিসে চিন্ময়ের সঙ্গে শ্বেত ভাল্লুককে নিয়ে হাসাহাসি, আবার পরমুহূর্তে পঙ্কজ আচার্যের সামনে তটস্থ। আবার সে বদলে যাচ্ছে রুবির শোবার ঘরে, উমার সামনে খাবার টেবিলে।

এগুলোরই যোগফল, সে কিছুই নয়। একটা শূন্য মাত্র। তার সুনির্দিষ্ট ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, মানসিক বিন্যাস ও ভঙ্গি, যার দ্বারা বিশিষ্ট হওয়া যায়, সে-সবের কিছুই তার মধ্যে নেই। শুধু কয়েকটা প্রাকৃতিক অনুভূতি ছাড়া। আজ সকাল থেকে, গত সাতদিন ধরে, বছরের পর বছর সে খুঁজে চলেছে হয়তো নিজেকেই-এটাই হল আসল ব্যাপার।

মাঠ থেকে বিরাট এক সমবেত চিৎকার সুনীতের কানে ধাক্কা দিল। ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। গুণেন ভবন থেকে বেরিয়ে মাঠের ধারে গিয়ে দাঁড়াবার তীব্র একটা ইচ্ছা তার বুকের মধ্যে ফেঁপে উঠল। রাস্তার লোক, গাড়ি, বাস, দোকানের দ্বারা আবার পরিবৃত হবার প্রয়োজন সে বোধ করছে।

হাবার বউ নিশ্চয় পুলিশকে বলেনি হাবার মৃত্যুর পিছনে কী কারণ ছিল। তাহলে পুলিশ এটাকে রাজনৈতিক খুন হিসাবে গণ্য করত না। পুলিশরা অবশ্য সহজ ব্যাপারকে জটিল করে তুলতে না পারলে তৃপ্ত বোধ করে না। হাবার বউ কেন বলেনি এখন তার জানতে ইচ্ছে করছে। ও কি ভাবছে, সুনীত আবার কখনও এসে সেই রাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে? ওর চোখের ঝকঝকে সাদা অংশটা হাবা কি কখনও দেখেছে বৃষ্টির দিনে, দূর রাস্তার আলোয় সন্ধ্যার পর বা রাতে ফেরার সময় সুনীত ওকে চালাঘরটায় দেখতে পেত রান্নায় ব্যস্ত অথবা শুধু বসে আছে চটের পর্দাটা তুলে। তাকে দেখলেই ওর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠত, পুরু ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে যেত। সুনীতের মনে হত যেন তার জন্যই অপেক্ষা করে। যতক্ষণ দেখা যায় চোখ দিয়ে অনুসরণ করে যেত।

সুনীত তখন নিজেকে একটা অন্য রকম বোধ করত। যদি কোনোদিন হাবার বউকে না দেখতে পেত, সে মনে মনে দমে যেত, ছটফট করে উঠত। সে ঘুরে উলটোদিকে হাঁটত। চায়ের দোকানে কিছু সময় কাটিয়ে আবার সে গুণেন ভবনের দিকে আসত। যদি ওকে দেখতে পেত অজানা এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করত যা উমা বা রুবির কাছ থেকে সে পেত না। ক্ষীণভাবে কৈশোর তার দেহে ফিরে আসত, কমলাকে মনে পড়ত।

সে ভয় পেয়ে গেছল নিজের এইরকম ব্যাপারটাকে আবিষ্কার করে। এটাকে সে অধঃপতন বলবে কি না ভেবে পায়নি। বউটির শরীর, চাহনি, পুরু ঠোঁট, স্তন, নিতম্ব সব মিলিয়ে তাকে নিংড়ে অবশ করে দিত। মনে হত এটা হয়তো তার মুখে ছাপ রেখে যাচ্ছে, যে-কেউই ধরে ফেলতে পারে। এক এক সময় মনে হয়েছে, কাউকে ব্যাখ্যা করে তার খুলে বলা উচিত। সবাইকে নয়, শুধু একজনের কাছে। হয়তো বাবাই একমাত্র তার সমস্যাটা বুঝতে পারত, কিন্তু তখন মনে পড়েনি। আর কখনও দেখা হবে কি না কে জানে!

আজকের এই অবস্থার সূত্রপাত কবে? শেখ মঞ্জিল তাকে কেওকেটা ভেবে ছেলের জন্য চাকরি চেয়েছে। এখন সে নিজেই দূরে কোথাও একটা চাকরি চায়। কতলোকই তো তাদের সমস্যা জানিয়ে তাকে সমাধান বাতলাতে অনুরোধ করেছে, আর এখন দুনিয়ায় এমন একজনও নেই যাকে সে ওই অনুরোধই করতে পারে। তাকে বোধহয় কেউ ঠিকঠাক বুঝতে পারেনি। নিজের দুর্বলতা, ত্রুটি, ঘাটতি সম্পর্কে সে বরাবরই সচেতন, এটাই তাকে উদ্যমী করেছে স্কুল মাস্টারি ছেড়ে চাকরিতে ঢোকায়, স্টেনোগ্রাফার থেকে ছোটোখাটো অফিসার হওয়ায়। একদিন হয়তো শ্বেত ভাল্লুকের চেয়ারেও সে বসত। অন্যদের থেকে তার মনের জোর বেশি এটাই সে ভাবত। একদমই ভুল ভাবনা।

উমা যে অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে আছে সুনীত তা বুঝতে পারেনি, নিজের ভাবনায় ডুবে থাকার জন্য। হঠাৎ চোখ পড়তেই সে অস্বস্তিতে উঠে দাঁড়াল। শূন্য, নিস্পৃহ চোখে তার স্ত্রী যেন একটা আসবাবের দিকে তাকিয়ে।

”তুমি খাটে এসে শুতে পারো।”

সুনীত বেরিয়ে এল। শোবার ঘরের দরজা ভিতর থেকে খিল দেওয়া। উমা বিছানার ধার ঘেঁষে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে। ঘরের একটি জানলা খোলা। পর্দার উপরের ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়েছে বিছানায় উমার পিঠ থেকে একহাত দূরে। সুনীত শীতের আমেজ শরীরে পাচ্ছে। ডান তালু বাম বাহুতে বুলোতেই কাঁটা উঠল চামড়ায়। বই আকারের ছোট্ট রোদটুকু উপভোগের জন্য সে প্রলুব্ধ হচ্ছে কিন্তু উমার এত কাছে, পিঠ ঘেঁষে শুতে কুণ্ঠা হল। সন্তর্পণে সে উমার থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব রেখে শুল।

উমার চাহনিটাই তার কুণ্ঠার কারণ। সুনীত ড্রেসিং-টেবিল, বইয়ের র‌্যাক, আলনা, আলমারির উপর দিয়ে চোখ বোলাল। এ ঘরে যা কিছু কাঠের আসবাব তারই পছন্দে কেনা। এই খাটটাও। প্রায় আট বছর বয়স হল এটার। উমা চেয়েছিল রবার-ফোম বিছানার খাট। তীব্র আপত্তি এবং শিরদাঁড়ার নানাবিধ ব্যাধির ভয় দেখিয়ে সুনীত তুলোর গদির খাট কেনে।

প্রত্যেকটা আসবাবই তার জীবনের পটভূমির এক একটা অংশ। একদিন আর তা থাকবে না। উমা একার রোজগারে সংসার চালাতে হয়তো পারবে না। এগুলো একে একে বিক্রি করে দেবে। এই খাট, আলমারি, র‌্যাক অন্য কারুর ঘরে গিয়ে সেখানকার জগতের সঙ্গে মিশে যাবে। এগুলো সাক্ষীও বটে কিন্তু সুনীত যে ভিতরে ভিতরে বদলে গেছে, সেই বদলের সাক্ষী এরা নয়। দীর্ঘকাল ধরে গৃহসজ্জার অংশ হিসাবে ওরা অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে তাই বদল সম্পর্কে এদের কোনো সাড়া আর নেই। অনেকটা উমারই মতো।

সুনীত মুখ ফিরিয়ে তাকাল উমার দিকে। শ্বাসপ্রশ্বাসের ছন্দ থেকে বুঝল ঘুমোয়নি। সহজে ঘুম আসার কথাও নয়। অদ্ভুত এক পরিস্থিতি ওর জীবনে হঠাৎ আজ এসে পড়েছে।

”তোমার নিশ্চয় কৌতূহল হচ্ছে জানার জন্য?”

উমার তরফ থেকে সাড়া এল না।

”পরে সব বলব, তুমি জামসেদপুর থেকে ঘুরে এসে…ক’দিন থাকবে?”

সুনীত জবাব পেল না। উমার কাছ থেকে জবাব পাবার জন্য হাত বাড়িয়েও ঠেলা দিল না। হাতটা ফিরিয়ে এনে সে কাত হয়ে চোখ বুজল এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ঘুমিয়ে পড়ল।

গভীর রাতে উমাকে বুকের নীচে চেপে ধরে সুনীত চুমু খেতে খেতে অনুভব করল ভিজে কাগজের একটা তাল যেন সে জড়িয়ে ধরেছে। ধীরে ধীরে সে নিজেকে নামিয়ে নিল।

”কী হল তোমার?”

”কাল সকালে বাজারে যাব। তোমার জন্য যা পারি কিনে আনব…সুবলকেও ছাড়িয়ে দেব, কয়েকটা দিন যাক।”

অপ্রত্যাশিত উক্তি! শক্ত হয়ে গেল সুনীতের যাবতীয় পেশি। অপ্রতিভ হবার জ্বালাটা সইয়ে নেবার জন্য সে উঠে বসল। তখনই পরপর দুটি বিস্ফোরণ হল গোলাপবাগান রোডের উত্তর দিক থেকে।

সুনীত জানলায় গিয়ে দাঁড়াল। চশমাটা ভিতরের ঘরে রেখে এসেছে। পর্দা সরিয়ে দেখতে পেল, ফুটবল মাঠ, রাস্তা, রাস্তার আলো এবং বাড়িগুলোকে, যে ভঙ্গিতে সে দেখতে অভ্যস্ত তেমনই রয়েছে তবে ঝাপসাভাবে। দূর থেকে মোটর ইঞ্জিনের দ্রুত গমনের শব্দ ভেসে এল।

খুব কাছেই, খাটালগুলোর দিকে আবার একটা বিস্ফোরণ। সুনীতের আপাদমস্তক পেশিগুলো আবার শক্ত হয়ে আসছে। পুলুর গলাকাটার দৃশ্যটা মনে পড়ল, তখন সে এই জানলায়ই দাঁড়িয়ে হাবার বউকে লুকিয়ে দেখছিল। পুলু যখন ছটফট করতে করতে ঘাসে মুখ রগড়াচ্ছিল তখন সে জানলাটা বন্ধ করে পিছিয়ে আসে। একটা জানোয়ার…

একটা বিক্ষোভ সুনীতকে গ্রাস করছে। তার মায়া মমতা করুণা মড়মড় করে ভেঙে হিংস্র আবেগ তার মধ্যে দমকলের ঘণ্টা বাজাচ্ছে। জানলার গরাদ আঁকড়ে সে ঝুঁকে পড়ল।

দুটো ছায়া জানালার নীচ দিয়ে ছুটে গেল পাশের অর্ধসমাপ্ত বাড়ির পাঁচিলটার দিকে। সুনীত ঠিক যেখানটায় টপকে এসেছে, সেখানেই ওরা থামল। গোলাপবাগান রোডে একটা পুলিশের ভ্যান দেখতে পেল সুনীত।

”চটপট…ওরা এসে গেছে।”

সুনীত ফিসফিস করল। গরাদ ধরে সে কাঁপছে।

”টপকাও। শাবাশ। এবার দৌড়োও, দৌড়োও, মিলিয়ে যাও অন্ধকারে।”

সুনীত কাঁপতে কাঁপতে জানলার নীচে বসে পড়ল। দৃষ্টি আবছা হয়ে এসেছে, মাথার মধ্যে ঘূর্ণিঝড়। মাঠের উপর দিয়ে টর্চের রশ্মি ঘুরে বেড়াচ্ছে আনাচে-কানাচে তল্লাশ চালিয়ে। রশ্মিটা গুণেন ভবনের উপর দিয়েও ঝলসে গেল। তখন সুনীত ঘরের ভিতরে দেয়ালটা দেখতে পায়। একদমই সাদা।

সাত

প্যাকেটের ছেঁড়া কাগজগুলো পায়ের কাছে ছড়ানো। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে জোড়া হাঁটুতে থুতনি রেখে সুনীত বসে। বিস্কুটের তিনটি প্যাকেট রেখে গেছল উমা। দু’দিনেই তা শেষ হয়ে গেছে। আজ নিয়ে চারদিন কাটল ওর জামসেদপুর যাওয়ার। খিদে এখন হাঙরের মতো তাকে খোবলাচ্ছে।

পাল্লার জোর দিয়ে সুতোর মতো আলোর রেখা। সুবল শোবার ঘরের আলোটা জ্বেলে রেখে গেছে। দেয়ালে কান পেতে সে রান্নাঘর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পায়নি অনেকক্ষণ। সুবল ফ্ল্যাটের মধ্যে আছে কি না সে বুঝতে পারছে না।

তলপেটে যন্ত্রণা হচ্ছে। পাকস্থলীটা মুচড়ে উঠছে। সুনীত গত ছত্রিশ ঘণ্টা কিছু খায়নি। প্লাস্টিকের বালতিটা শূন্য আজ সকাল থেকে। জিভটা বারবার গলার ভিতরে নেমে যাচ্ছিল। ঢোঁক গিলতে এখন গলা ব্যথা করছে। মুখে আর থুথু উঠছে না। উমা নেই তাই চা হয় না। সুবলও ভোরে দুধ আনতে যায় না। সুনীত এই নরক থেকে বেরিয়ে শোবার ঘরের দরজার ওপাশে যেতে পারেনি চারদিন। রাতে সুবল দালানে ঘুমোয়।

দুর্গন্ধ জমাট হয়ে রয়েছে। ছোট্ট জানলাটা সে খুলতে পারেনি। বছরের পর বছর বন্ধ থাকায় পাল্লা দুটো এঁটে আছে। ছিটকিনির মুণ্ডিটা এতই ছোটো যে শক্ত করে ধরা যায় না। টানাটানি করে খোলার মতো জোর তার আঙুলে নেই। চারদিন সে কলঘরে বা পায়খানায় যেতে পারেনি। প্রাণপণে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাখতে গতকাল দুপুরে আর পারেনি। এই ঘরের মধ্যেই…সুবল যখন শোবার ঘরে আসবে তখন গন্ধ পাবে কি! জোড়ের ফাঁকটা ছাড়া আর কোনো রন্ধ্র নেই যেখান দিয়ে বাইরের সঙ্গে এই ঘরের সম্পর্ক রয়েছে। এই ক’দিন রাত্রে সে শোবার ঘরে বসে থেকেছে জানলার ধারে। দরজার কাছে গিয়ে দালানে উঁকি দিয়েছে। অন্ধকারে ঠিক কোন জায়গাটায় সুবল শুয়ে আছে ঠাওর করার চেষ্টা করেছে।

সাহস হয়নি ঝুঁকি নেবার। অন্ধকারে সুবলকে মাড়িয়ে ফেললে বা ও যদি জেগে থাকে আর খসখস শব্দ পায় তাহলে কী হবে?…কী হবে, কী হবে?

সুনীত ঝাঁকুনি দিয়ে হাঁটু থেকে মুখটা তুলল। দুর্গন্ধ, খিদে, তৃষ্ণা, অন্ধকার, বায়ুহীনতা। এর মাঝে আরও কতদিন তাকে যাপন করতে হবে সে জানে না। যাপন…অসমালোচিত জীবন নাকি যাপনযোগ্য হয়। কিন্তু কী সমালোচনা করব! একটা কাতর শব্দ তলপেট থেকে উঠে গলায় এসে আটকে রইল। আলোর সুতোটা ছিঁড়ে গেছে, সুবল এখন ঘরে রয়েছে।

যাবার আগে উমা বিস্কুটের প্যাকেটগুলো, এক কেজি টম্যাটো, শাঁকআলু দিয়ে বলেছিল ”হাতে টাকা নেই…দু’দিনের বেশি থাকব না, এতেই চালিয়ে নাও। সুবলকে বলেছি শোবার ঘরের দরজা সব সময় খুলে রাখতে।”

অতি সহজ সাদামাঠাভাবে যেন মুক্ত স্বাধীন কোনো মানুষকে জানাচ্ছে এমন ভঙ্গিতে উমা বলেছিল। আর কোনো কথা সে বলেনি। সুবলকে সে বাজার করার জন্য কিছু টাকা দিয়ে গেছে। দেয়ালে কান রেখে সুনীত শুনেছিল সুবলের কথা, ”অত কেন, পাঁচটা টাকা দিয়ে যাও।”

ঝিমুনি এসেছে সুনীতের। সন্ধ্যা থেকেই সে অবসন্ন বোধ করছে। বারকয়েক খিদের কথাটা মনে করার চেষ্টা করেছে, যদি তাতে শরীরটা চনমনে হয়ে ওঠে। কিন্তু হয়নি। তার মনে হচ্ছিল মস্তিষ্কও অবশ হয়ে আসছে। একবার কবজিতে আঙুল রেখে নাড়ির স্পন্দন দেখেছিল। অতি ধীর একটা দপদপানি তখন আঙুল বেয়ে তার চিন্তায় উঠে আসে মৃত্যু।

তখন থেকেই মাঝে মাঝে সে স্পন্দন পরীক্ষা করে গেছে। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে দপদপানিটা যেন আর হচ্ছে না। ভয় পেয়ে সে বুকে হাত রাখল, জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বুকের ওঠানামা অনুভব করল। পৃথিবীর অসাধারণ যন্ত্রটা রক্ত পাম্প করছে কি করছে না, এখন সেটাই তার বাঁচা বা মরার একমাত্র নির্দেশক। পড়া, দেখা, শোনা এবং নিজস্ব বোধ ও বুদ্ধি দিয়ে যা-কিছু আহরণ করে সে মাথার মধ্যে জমিয়ে রেখেছে তার কিছুই এখন কাজ করছে না, একমাত্র খিদের বোধটুকু ছাড়া।

সুনীত নখ দিয়ে পায়ের পাতা আঁকড়ে ধরল। নখগুলো চেপে বসাল। জ্বালা করছে কি না বুঝতে পারল না। মাথাটা পেছনের দেয়ালে ঠুকল বারকয়েক। ব্যথা করল না। এবার সে ভয় পেল। শরীরে সাড় নেই কেন?

সে হাবার বউয়ের শরীরের এক-একটি অংশ মনে করার চেষ্টা করল। স্মৃতি যেন পিছলে যাচ্ছে। কিছুতেই সে ধরে রাখতে পারছে না নরম মাংসগুলোকে, চুম্বনের স্বাদ বা গন্ধ মনে পড়ছে না, তার শরীরে কোনো সাড়া লাগছে না।

হায় পিতা, তোমাকে অনুসরণ করা আর সম্ভব হল না। সুনীত বন্ধ দরজাটা হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল। সে নিশ্চিন্ত জেনে গেছে এইভাবেই তাকে মরতে হবে। দেহটা এইভাবেই দেওয়ালে ঠেস দিয়ে পড়ে থাকবে। তারপর পচতে শুরু করবে।

দুর্গন্ধ…সুনীত নাক কুঁচকে শুঁকল। হয়তো এটা তারই পচনের গন্ধ।

মোটর ইঞ্জিনের শব্দ গোলাপবাগান রোড দিয়ে ছুটে গেল। সুনীত উঠে দাঁড়িয়েই টলে গেল। হাঁটুতে জোর নেই, শরীর ভেঙে পড়ছে অবসন্নতায়। নিশ্চয় পুলিশের গাড়ি। এবার গাড়িটা যখন যাবে জানলায় দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে ওদের ডাকবে। চেঁচিয়ে বলবে:

”সারেন্ডার, সারেন্ডার করতে চাই।”

দরজা খুলে দেয়াল ধরে সে জানলায় এল। চশমাটা আজও চোখে নেই। কিন্তু সেই একই রকম রয়ে গেছে মাঠটা। জীবনে অজস্র ভুল আর দুর্বলতা তাকে ঠেলতে ঠেলতে এই মাঠে এনে ফেলেছিল। ঠিক কোথায় ঘটেছিল? মাঠের একটা জায়গা সে চিহ্নিত করার জন্য খুঁজতে শুরু করল। ঠিক কোথায় সে হাবাকে…

দুটো বিস্ফোরণ ঘটল সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা রিভলবারের শব্দ। সুনীত থরথর কেঁপে উঠল। কিছু একটা ঘটছে, কাছাকাছিই। আরও দু’বার রিভলভারের শব্দ হল। এগুলো মৃত্যুর শব্দ। কেউ বা কারা এখন মৃত্যুকে উপেক্ষা করছে বা আত্মসমর্পণ করছে। যেই হোক, সুনীত ভাবল, আমার মতো পচে গলে যাওয়ার জন্য তারা অপেক্ষা করছে না।

জানলার গরাদ ধরে সে নিজেকে ঝাঁকাল। আমি বেরোব, যাই অপেক্ষা করুক, পচে মরা সম্ভব নয়। বাইরে গিয়ে বাঁচার জন্য একটা সুযোগ নেব। দৌড়তে দৌড়তে মিলিয়ে যাব। ওরা কাছাকাছিই রয়েছে, এদিকে হয়তো আসবে। আসার আগেই বেরিয়ে পড়তে হবে।

”পিণ্টু জোরে ছোট…আমি এগোচ্ছি।”

”হাঁটুর নীচে চালিয়েছে…।”

সুনীত নীচের দিকে তাকাল।

একটা ছায়ামূর্তি নিজেকে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। এগোতে গিয়ে চাপা আর্তনাদ করে দাঁড়িয়ে পড়ল।

সুনীত দেখতে পেল সাদা পাঁচিলের উপর উঠছে আর একটা ছায়া।

”পিণ্টু যেভাবেই হোক…আমি টেনে তুলে…”

একটা বিস্ফোরণ সুনীতের মাথার মধ্যে এবার ঘটে গেল। টুকরো টুকরো খসে পড়ছে তার স্নায়ু, হৃৎপিণ্ড, শিরা-উপশিরা।

”অপেক্ষা করো…আমি যাচ্ছি।”

সুনীত ঘর থেকে দালানে এল। সুইচটা কোথায় কে জানে। বুড়ো মানুষটাকে মাড়িয়ে জখম করতে সে চায় না। আলো জ্বলে উঠতেই সুবল ”আহ” বলে চোখ খুলল।

ওর পাশ দিয়ে সুনীত দ্রুত এগিয়ে দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল। পিছনে সুবলের ভীত কণ্ঠস্বর সে শুনতে পাচ্ছে : ”কে, কে, কে গেল?”

আর সে নিজেকে নিয়ে বিব্রত হবে না। এইবার তার শেষ। যা-কিছু দেখাশোনা বোঝার সব নিয়েই এবার সে শেষ করবে। কিছু কি বাকি রয়ে গেল? এখন আর ভেবে লাভ নেই।

যদি রুবি…

কিন্তু কোন রুবি? অন্য কেউ হলেও একই ব্যাপার ঘটত। হাবার বউ…বেচারা। ওকে দোষ দিয়ে কী লাভ।… এক এক জায়গায় এক এক রকম মিথ্যা, বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করে যাওয়া।

যেহেতু সে ভীরু…বাবাও ভীরু, শ্বেত ভাল্লুকও।

কোলাপসিবল গেটে তালা। সুনীত পকেট থেকে চাবি বার করে খুলল।

কোথায় সে? পিণ্টু!

অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে সুনীত খুঁজল। দেয়ালের কাছাকাছি কী যেন নড়াচড়া করছে।

কোনোদিনই তার নিজের উপর আস্থা ছিল না।

কিন্তু এখন নয়। এখন…বিশুদ্ধ হওয়ার বোধ আর কি ফিরে আসবে না?…আর একবার, উমা।

টর্চের তীব্র আলো সুনীতের পিঠে এসে পড়ল। পিছনে পায়ের শব্দ, চিৎকার।

”হ্যান্ডস আপ।”

আরও কীসব গোলমাল হচ্ছে কিন্তু সে শুনতে পাচ্ছে না। দু’হাত ধীরে ধীরে তুলে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। টর্চের আলোয় তার ছায়াটা সাদা পাঁচিলে পড়েছে। সে দেখতে পেল বিরাট একটা গাছের কাণ্ডের মতো তার দেহ তার উপর যেন দুটি শাখা আকাশের দিকে বাড়ানো।

তার বিস্ময়ের আর অবধি রইল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *