বারান্দা

বারান্দা – মতি নন্দী – উপন্যাস

এক

কলকাতার বহু পঞ্চাশ বছর বয়েসি বাড়িতে এইরকম বারান্দা পাওয়া যাবে। রাস্তার দিকে হাত চারেক বেরিয়ে, কোমর উঁচু জাফরি কাটা ঢালাই লোহার রেলিং, বারান্দাগুলো প্রতি তলায় থাক দিয়ে উঠে গেছে, মাথায় আচ্ছাদন নেই। উপরের বারান্দা থেকে নীচেরটি সম্পূর্ণ দেখা যায়। রেলিংয়ে বছর কুড়ি রং পড়েনি। তার উপরের কাঠগুলি হাত, কনুই, কাপড়, তোশক, রোদ ও বৃষ্টির ঘষায় মসৃণ। পিছনে সাধারণত দুটি ঘর থাকে, বারান্দা তাদের অন্যতম সংযুক্তকারী পথ। দরজা ছাড়াও ঘরের আয়তন অনুযায়ী একটি বা দুটি জানলা থাকে বারান্দার দিকে। এই সব দরজা-জানালায় পর্দা থাকা না থাকা প্রধানত নির্ভর করে ঘরের বিপরীত গৃহের অধিবাসীদের রুচির ওপর। গ্রীষ্মে, যখন সন্ধ্যায় দক্ষিণ থেকে বাতাস বয়, তখন অনেকেই লোভ সামলাতে না পেরে পর্দাগুলি গুটিয়ে স্প্রিংয়ের দড়িতে বা দরজার মাথায় তুলে দেয়।

তিনতলার বারান্দায়, ভারী সেগুন কাঠের চেয়ারে বসে গিরি, অর্থাৎ গিরিজাপতি জাফরিকাটা রেলিংয়ের ফাঁকা দিয়ে অঘোর ঘোষ স্ট্রিট ধরে পুব দিকে তাকিয়ে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর প্রায় কুড়ি মিটারের একটা চাকলা, একটা মোটর গ্যারেজের টিনের দরজা, চায়ের দোকানের বেঞ্চ, ফুটপাতে শিবমন্দিরের একদিকের দেয়াল এবং বাস স্টপে প্রতীক্ষমাণদের সে চেয়ারেবসা অবস্থায় দেখতে পায়।

ভোরের রেশ এখনও কাটেনি। ফিকের ছাই থেকে আকাশটার কিছু অংশ ফিকে হলুদ হয়েছে মাত্র। দ্রুত-সাইকেলে খবরের কাগজওলা, কিছু লরি, দুধের বোতল হাতে জনাতিনেক গেরস্থ, চায়ের দোকানের ধোঁয়া, ভোরের ট্রেন ধরার জন্য সুটকেস নিয়ে বাস স্টপে অপেক্ষমাণ একজনকে ছাড়া গিরি আর কিছু লক্ষ করেনি। কারণ তার মন ও কান রয়েছে পিছনের ঘরে।

মাঝে মাঝে কথার টুকরো ভেসে আসছে। শব্দগুলো অস্ফুট হয়ে যাচ্ছে পর্দা ভেদ করে আসতে আসতে। ঘাড় ফিরিয়ে গিরি তাকাল। পর্দাটা একটুখানি সরিয়ে দেবার জন্য হাত বাড়িয়ে ঝুঁকেও হাতটা ফিরিয়ে আনল।

”…মোজা জোড়া বড্ড ছেঁড়া… ক’টা লাগে বছরে!”

”এখন চাইলে পাব না, লিগ শুরু হলে…”

”তোমাদের অফিসের ক্যান্টিনে ক’টা থেকে ভাত পাওয়া যায়?… ওখানেই রাখো আমি কেচে দেবখন। রুমাল আর আছে তো?”

”না। তোমারটা…’

গিরি আর কিছু শুনতে পেল না। সম্ভবত ওরা খাবার টেবিলটার দিকে সরে গেছে।

স্থির হয়ে সে বসে রইল; অদ্ভুত ধরনের অস্বস্তি, অস্বাচ্ছন্দ্য সে বোধ করছে, কিন্তু কেন, বুঝতে পারছে না। মনে মনে সে এখন ওদের দু’জনকে অনুসরণ করে যাচ্ছে।

দালানের মতো জায়গাটা প্রায় চৌকো, আয়তনে অনেকখানি। একদিকে জুতোর র‌্যাক, তার পাশ দিয়ে দেড় গজ চওড়া গলি। লম্বায় পাঁচ গজ। গলিতে আছে পর পর কলঘর ও পায়খানা। জুতোর র‌্যাকের পিছনে জানলা। পাল্লা খুলেই সিঁড়ির তিনতলার চাতালটা দেখা যায়। মাস দশেক আগে জানলাটার শিক খুলে চোর ঢুকেছিল। গিরি বা রুনু কিছুই টের পায়নি। তার ঘুম গভীর কিন্তু রুনু তো বেড়াল হেঁটে গেলেও জেগে ওঠে। ঘুমের মধ্যে গায়ে হাত লাগামাত্র হাতটা সরিয়ে দেয়। কিন্তু রুনুও শুনতে পায়নি শিক ভাঙার, চোরের বা চোরেদের চলাফেরা, জিনিস নাড়ানাড়ির শব্দ। রুনু নিজেই বহুবার অবাক হয়ে বলেছে, ”আমার এত গভীর ঘুম! অফিসে তো সেদিন খুব বেশি কাজ ছিল না।”

চোর বা চোরেরা বিশেষ কিছুই পায়নি। অ্যালুমিনিয়ামের একটা সসপ্যান, একটা ডেকচি, স্টিলের হাতা আর দড়িতে শুকোতে দেওয়া একটা ভয়েলের শাড়ি। মাস দুয়েক আগে রিডাকশানে শাড়িটা কিনেছিল রুনু ছত্রিশ টাকায়। আসল দাম নাকি আটচল্লিশ। সাদা শাড়ি, এক বিঘৎ নীল নকশার পাড়। ওটা সে লন্ড্রিতে দিত না পাছে জখম হয়। নিজে কেচে ইস্ত্রি করত। ওটার জন্য সে মুষড়ে পড়ে। গিরি কিন্তু অন্য কারণে খুশি হয়ে বলেছিল, ”দেখলে তো, চিনেমাটির প্লেট কত পয়সা বাঁচল। স্টিলের থালা পেলে ঠিক নিয়ে যেত।”

দুটি লোকের জন্য বাসন কয়েকটি মাত্রই যথেষ্ট ছিল। ঝি-চাকর নেই, প্রয়োজনও হয় না। দুটো ঘরের একটি এতকাল অব্যবহৃত বন্ধ ছিল। রান্না, কাপড়কাচা, বাসনধোয়া, ঘরের মেঝে পরিষ্কার গিরিই করত, দুপুরে। রুনু আপত্তি জানিয়েছিল।

”কেউ তো আর দেখতে পাচ্ছে না, ঘরে কী কচ্ছি, না কচ্ছি।”

”তা হোক। পুরুষমানুষের এ-সব কাজ করা মানায় না। লোকে জানলে আমায় কী বলবে? তা ছাড়া উবু হয়ে বসে এ-সব কাজ করায় তোমার যে কষ্ট হয়, আমি তা বুঝতে পারি।”

প্রায় জল এসে গেছল রুনুর চোখে। গিরি আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বাঁ হাত তুলে বলেছিল, ”না না, কষ্ট হয় না। তোমার সামনে একদিন নয় কাপড় কেচে দেখাব।”

”কিচ্ছু দেখাতে হবে না।”

”আচ্ছা আর করব না।”

”বাসন যেমন এঁটো থাকে থাকবে, আমি অফিস থেকে ফিরে মাজব।”

জানলার শিকটা চোর নিয়ে গেছে। ওখান দিয়ে একটা মানুষ গলে আসতে বা বেরোতে পারে। গিরির স্থির বিশ্বাস, আর চোর আসবে না। বাসন বা কাপড় যা আছে সেগুলোর জন্য খাটুনির মজুরি তুলতে পারবে না, এটা নিশ্চয় ওরা জেনে গেছে। গহনা কিছুই নেই একটা সোনার বালা ছাড়া। সেটা রুনুর হাতেই থাকে। ওর হাতঘড়িটা টেবিলের উপর থাকে। সেটা নিতে হলে খাটটাকে ঘুরে মাথার কাছে আসতে হবে। চোরের পক্ষে তা হলে খুবই ঝুঁকি নেওয়া হবে। কাঠের আলমারিতে রুনুর মাইনের টাকা থাকে শাড়ির ভাঁজে। অল্প কিছু থাকে হাত ব্যাগটায়, একটা সিগারেটের তামাকের কৌটোয় রেজগি। সাড়ে চারশো টাকা মাইনের যতটুকু অবশিষ্ট থাকে চোরকে আগ্রহী করার পক্ষে সেটা যথেষ্ট নয়।

রুনুর ধারণা আবার চোর আসবে। তারই পীড়াপীড়িতে গিরি মাপমতো একটা শিক কিনে এনে জানালায় লাগিয়েছে। কোনওরকমে ওপর-নীচে কাঠের গর্তে শিকটাকে ঢুকিয়ে রাখা মাত্র। যে-কেউই খুলে নিতে পারে। তলার গর্তটা বড়ো করে দিয়ে গেছে চোরেরা। গিরি বলেছিল, ”কাঠটা না বদলালে শিক লাগাবার মানে হয় না। কীরকম ঘুণ ধরে ক্ষয়ে গেছে দেখেছ?”

”তা হোক। চট করে কেউ বুঝতে পারবে না। তলাটা নড়নড় করছে, খানিকটা পুডিং দিয়ে এঁটে দিলেই হবে।”

”তা হবে।” শিকটায় ঝাঁকুনি দিয়ে সে কতটা আলগা পরীক্ষা করে।

”এ বাড়ির কেউ কি দেখেছে?”

”দেখেছে মানে!”

”শিকটা যখন লাগাচ্ছিলে, কেউ কি তখন সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেছে?”

”লক্ষ করিনি, মনে তো হয় না।… ওহ, ওপরের পাগলিটা তখন একবার নেমেছিল বটে। আমাদের তলা পর্যন্ত নামেনি, সিঁড়িতে কী একটা কুড়িয়ে আবার উঠে চলে গেল।”

”আর কেউ?”

”কেন, দেখলেই বা!”

”শিকটা আলগা, এটা বাইরের লোকের না জানাই ভালো।”

গিরির হেসে উঠতে ইচ্ছে করেছিল। কিন্তু তা না করে সে গম্ভীর হয়ে বলে, ”জানালাটা বন্ধই থাকুক। ওর পেছনে এমন একটা কিছু রাখা যাক, পাল্লা খুললেই যাতে সেটা পড়ে গিয়ে শব্দ হবে।”

রুনু ভেবেচন্তে কয়লা ভাঙার লোহাটাকে জানলার চৌকাঠের লাগোয়া ইঞ্চি চারেক জায়গাটায় লম্বালম্বি পাল্লার গায়ে হেলান দিয়ে রেখে দেয়। লোহাটা মোটরগাড়ির অ্যাকসেলের হাতখানেক লম্বা একটা টুকরো। ইউনিভার্সাল মোটর সার্ভিসিং-এর থেকে বছর পনেরো আগে এনেছিল গিরি। ওটাকে দেখলে কখনও কখনও তার অস্বস্তি হয়। চুরি করে আনা জিনিস। ইউনিভার্সালের ফোরম্যান গিরিজাপতি বিশ্বাসকে গেটের দরোয়ানরা তল্লাস করবে না, এই সুযোগ নিয়ে সে কয়লা ভাঙার জন্য লোহাটাকে আনে। শীতকাল ছিল। কোটের মধ্যে ঢুকিয়ে বগলে চেপে সে যখন দরোয়ানটার সামনে পৌঁছয় তখন হঠাৎ একটা চাপা আতঙ্ক তার হৃৎপিণ্ডটাকে আঁকড়ে ধরে। হাতটা কেঁপে ওঠে মনে হয়েছিল ওটা বোধ হয় পড়ে যাবে। লোহাটা প্রাণপণে মুঠোয় ধরে ঘাতকের মতো সন্তর্পণে সে দরোয়ানকে অতিক্রম করে। বহু দূরে এসে অকারণেই পিছনে ফিরে তাকায়।

সেই মুহূর্তের আতঙ্কটা গিরির মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। তখন বুকের মধ্যে ড্রাম বাজানো মতো, ক্ষীণ গুড়গুড় শব্দ ওঠে। কিছুক্ষণের জন্য তার মনে হয়, কারা বোধ হয় সদলবলে আসছে। তারা হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে ইউনিভার্সালের ম্যানেজার প্রকাশ মেহরার সামনে তাকে দাঁড় করাবে। মেহরা তোবড়ানো গাল দুটো আরও চুবড়িয়ে বলবে, ”আপনাকে তো অনেস্টম্যান বলেই জানতাম।” ইদানীং এইরকমই তার মনে হয় এবং অদ্ভুত একটা অস্বস্তিতে সে গুম হয়ে ওঠে। বাচ্চচাদের মতো অসহায় বোধ করে। লোহাটাকে চোখের আড়াল করার জন্য মাসখানেক রান্নাঘরের তাকে তুলে রেখেছিল। তাতে কোনও কাজ হয়নি।

.”চা অত বেশি খাও কেন, উঁউ? খুব খারাপ।”

রুনুর বলার ধরনটায় গিরি আবার অস্বস্তি বোধ করল। চা তৈরি হয়ে গেছে। ওরা তা হলে এখন টেবিলে। রুনু দাঁড়িয়ে থাকবে ওর অভ্যাস মতো। নাভিটা টেবিলের কিনারে চেপে দাঁড়ায়। গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে কি? কীভাবে তাকাচ্ছে? কাপটা এগিয়ে দেবার জন্য ঝুঁকবে, দরকার না থাকলেও ঝুঁকবে; ব্লাউজের গলাটা ঢিলে হয়ে তখন রাক্ষুসে হাঁ করবে আলজিভ দেখিয়ে। অম্বরের চোখ কোথায় থাকবে? তখন কি হাতটা বাড়িয়ে রুনুর হাত বা আর কোথাও-।

রুনুর হাসি শুনতে পেল গিরি। হাত বাড়িয়ে পর্দাটা তুলে সে মাথা হেলাল। কোনও কথা, বা ধ্বনি পেল না। হতাশ হল। সে আশা করেছিল কিছু একটা বুঝতে পারবে। ওরা দু’জন কতটা সম্পর্কিত এটা তার জানা দরকার। না জানা পর্যন্ত সে নিজেকে কোথাও স্থিরভাবে রাখতে পারছে না। ভালোবাসা, ঘৃণা বা দীনতা-এর মধ্যে একটা কোথাও সে বাস করতে চায়।

”তোমার চা।”

গিরি মুখ তুলল। রুনু তার দিকেই তাকিয়ে। গিরির মনে হল চাপা একটা আভা ওর মসৃণ পাতলা কফি রঙের চামড়ার নীচে সারা মুখে ছড়ানো। তাজা ঝরঝরে দেখাচ্ছে, যেন এইমাত্র স্নান করে উঠেছে। নিতম্বচুম্বী দীর্ঘ ভারী চুল হাত-খোঁপা করে ঘাড়ে ঝুলিয়ে রাখছিল আধঘণ্টা আগেও। কিন্তু এখন পিঠে কেন ছড়িয়ে?

গিরি হাত বাড়িয়ে কাপটা ধরল। রুনুর নখে চটা ওঠা লাল রং। টসটসে আঙুলগুলো পুরন্ত কাঁচালঙ্কার মতো। পনেরো-ষোলো বছর আগে এমন ছিল না। তখন গাঁটগুলো উঁচু দেখাত।

”চুলগুলো জটের মতো দেখাচ্ছে।”

রুনু বাঁ হাতে এক গোছা চুল সামনে ধরে বলল, ”আজ শ্যাম্পু করব।”

শ্যাম্পু! গিরি বিস্ময় চাপতে চায়ে চুমুক দিল ঘাড় নিচু করে। সে ভালোভাবেই জানে তাদের সংসারে ও বস্তুটি নেই। তা হলে রুনু বলল কেন? অম্বরের ঘরে কি শ্যাম্পু আছে!

”অনেকদিন পর পরশু তোমাকে বেণি ঝোলাতে দেখলাম।”

রুনু হাসল। ”কেমন দেখাচ্ছিল?”

গিরির মনে হল কণ্ঠস্বরে আগ্রহ নেই। ”কলেজে তুমি এইরকম বেণি ঝুলিয়ে যেতে।”

”কেন, তারপরও তো বেণি কেরছি।”

গিরি মনে করার চেষ্টা করল। সম্ভবত এই ফ্ল্যাটে উঠে আসার পর নয়। হাসপাতালে যখন তাকে দেখতে যেত, তখন বোধ হয় দু’-চারদিন রুনুর বেণি দেখেছে।

”অফিসে কেউ কিছু বলেনি?”

”কী বলবে!”

”ঠাট্টা করেনি, বুড়ো বয়সে বেণি ঝুলিয়েছ বলে?”

রুনু উত্তর দিল না। পাশের ঘরে অম্বর সুর ভাঁজছে। ফিল্মের গান। গিরি কান পেতেই বুঝল এখন সে চুল আঁচড়াচ্ছে।

”দত্তগুপ্তর ব্যাপারটা এখনও চলছে, না মিটে গেছে?”

রুনুর অফিসে অশোক দত্তগুপ্ত নামে একটি ছেলে বিয়ের পরই মরে গেছে। তার বিধবাকে চাকরি দেওয়ার দাবিতে ইউনিয়ন লড়াই করে যাচ্ছে এক মাস ধরে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।

”মিটে যাবে। গ্র্যাজুয়েট নয় মেয়েটা, নইলে অ্যাতো ঝামেলা হত না।”

”বউদি দরজাটা বন্ধ করে দিয়ো।”

রুনু ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকিয়ে বলল, ”ভেজিয়ে দিয়ে যাও।”

রাস্তাটা তিরিশ ফুট চওড়া। সামনের বাড়ির জানলা খুলে একটি লোক ওদের দিকে তাকিয়েই একটা পাল্লা বন্ধ করে পিছিয়ে গেল। লোকটি এখন যোগব্যায়াম করবে। তারপর জানলা খুলে দিয়ে দুটি ছেলেকে পড়াতে বসবে এবং মিনিট পাঁচেক পরই জানলা আবার বন্ধ করবে। তখন বন্ধ জানলার ওপার থেকে ছেলে দুটির আর্তনাদ ভেসে আসবে।

অম্বর দ্রুত পায়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর দিকে চলেছে। টকটকে লাল নাইলনের গোলগলার গেঞ্জি, চামড়াসাঁটা ঘিয়ে প্যান্ট, প্রায় ছ’ফুট লম্বা শরীরটা চাবুকের মতো দেখাচ্ছে চলনের দোলায়। সরু কোমর, দেহটা বিরাট নয়, কিন্তু সর্বত্র মাংস মানানসই হয়ে ছড়ানো। ঘাড় ঢেকে রয়েছে লম্বা রুক্ষ চুলে। অতিরিক্ত চুলের জন্যই ওর শরীরে একমাত্র মাথাটাকে বেঢপ দেখায়। কপালটার আধখানা ঢেকে চুল।

গিরি তীক্ষ্ন চোখে ওর হাঁটা দেখতে লাগল। সপ্তাহ তিনেক ধরে রোজই দেখছে। দেখার জন্য সে ভোর থেকে অপেক্ষা করে। সামনে ঝুঁকে হাঁটছে ছোটো ছোটো দ্রুত পদক্ষেপে। ঊরুর ও পাছার মোড়ের পেশি টেরিলিন প্যান্টে ভাঁজ ফেলছে। পায়ের ডিমের কাঠিন্য আঁটো কাপড়ে ফুটে উঠছে। কোমর সামান্য দোলে কিন্তু হাত দুটি দোলে না হাঁটার সময়।

রুনু অলস চোখে তাকিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে। গিরি শূন্য কাপ ওর হাতে দেবার সময় দেখল মৃদু চাপা একটা হাসি ওর ঠোঁটে। কিছু মজার ব্যাপার মনে পড়লে এরকমভাবে ঠোঁটে সেটা ফুটে ওঠে।

চোখাচোখি হতেই ঠোঁট দুটো চমকে কুঁকড়ে গেল। গিরি ভ্রূ কুঞ্চিত করল।

অম্বর বাস স্টপ থেকে ফিরে আসছে লম্বা পা ফেলে। বারান্দায় রুনুকে দেখে দূর থেকেই হাত তুলে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করল।

”কী ব্যাপার ফিরে আসছে যে! কিছু ভুলে গেছে বোধ হয়। যা ভুলো মন।”

গিরি শেষ বাক্যটির সুরে যেন খানিকটা স্নেহের আভাস পেল।

”রোববারও ওদের প্র্যাকটিস থাকে নাকি?”

”সোমবারে বন্ধ থাকে।”

গিরি তা জানে। অম্বরের প্রতিদিনের গতিবিধি, অবশ্য ফ্ল্যাটে বসে যতটুকু জানা সম্ভব, গিরির তা মুখস্থ। তবু সে জিজ্ঞাসা করেছিল অম্বরকে কথার মধ্যে ধরে রেখে রুনুর অভিব্যক্তি বা কণ্ঠস্বর পরীক্ষা করে দেখতে।

”বউদি থলিটা।”

রাস্তা থেকে অম্বর চেঁচাল। চেয়ারে বসে গিরি রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে ওকে দেখতে পাচ্ছে না। রুনু ঝুঁকে নীচে তাকিয়ে হাত তুলে অপেক্ষা করতে বলল।

”থলি কী জন্য?”

কথার উত্তর না দিয়ে রুনু ভিতরে ছুটে গেল। লঘু পদক্ষেপ, কোনও শব্দ হল না। অল্পবয়সি মেয়েদের মতো। গিরি সামনের বাড়ির দিকে তাকাল। জানলাটার পাল্লা এখনও বন্ধ। রবিবারে লোকটি ছেলেদের পড়ায় না।

বাজারের থলিটা পাকিয়ে ধরে বারান্দা থেকে রুনু ঝুঁকেছে।

”পারবে?”

হাত থেকে ছেড়ে দিল। তিন-চার সেকেন্ড পর উজ্জ্বল হয়ে উঠল চোখ। অম্বর তা হলে থলিটা লুফেছে।

”কী হবে থলি?”

”আজ আর তোমায় বাজার যেতে হবে না। ফেরার পথে অম্বর মুরগি আনবে নিউ মার্কেট থেকে।”

”কেন?”

”বলল আনব। হোটেল-ফোটেলে তো প্রায়ই খায়। খেয়াল হয়েছে আমার রান্না মুরগি খাবে আজ।”

”তুমি নিশ্চয় রাঁধার কথাটা তুলেছ। নিশ্চয় বলেছ, হোটেলের থেকে ভালো রান্না করি।”

”আমি!” রুনু অবাক হল। ”আমি তো মুরগি একদমই ভালোবাসি না, খাওয়ার কথা ভাবলেই কেমন যেন লাগে।”

”তা হলে বারণ করলে না কেন। কে খাবে?”

”তোমরা দু’জন খেয়ো।”

”ওর খরচ করার কথা নয়। এ-সব বাড়তি বাজার কেন করবে? যা টাকা দেয়, আমরা যা দিতে পারি, তার বেশি আমরা চাইও না, দিতেও পারব না।”

”এগুলো শখের ব্যাপার, এর সঙ্গে হিসেব নিকেশের সম্পর্ক কী?”

রুনুর কণ্ঠে ক্ষোভ এবং কিছুটা বিরক্তির আভাস পেয়ে গিরি আপসকারীর সুরে কথা বলার ভঙ্গি বদলাল।

”আমি তো বারণ করছি না। আসলে কেমন যেন লাগে ও খরচ করলে। ও সংসারের কেউ নয়, নিছকই পেয়িং গেস্ট। মাসে মাসে দেড়শো টাকা যেমন দেয় তেমনিভাবেই খাবে থাকবে। তার বেশি আমাদের কিছু নেওয়া উচিত নয়।”

”কিন্তু কিছু আনলে তখন তো মুখের উপর না বলা যায় না। ও তো তোমার দূর সম্পর্কের ভাই।”

গিরির বাবার খুড়তুতো ভাইয়ের ছেলে অম্বর। ওকে সে কখনও দেখেনি, চিনতও না। মাস ছয়েক আগে গত পুজোর ঠিক পর, মানিকতলায় পিসিমার বাড়িতে বিজয়া করতে গিয়ে গিরির সঙ্গে পরিচয় হয় অম্বরের। মেসে থাকে কিন্তু থাকতে ভালো লাগছে না। তার গোটা একটা ঘর চাই। গ্রামের বাড়ি হাসনাবাদের থেকে চার মাইল ভিতরে। সেখান থেকে কলকাতায় এসে খেলা এবং চাকরি সম্ভব নয়।

”গিরি তোর তো ঘর আছে একটা। অম্বরকে রাখ না। তোর সংসারেই খাবে, মাসে মাসে টাকা দেবে। অসুবিধে কী, তোরা তো মোটে দুটো লোক।”

.

পিসিমার প্রস্তাবটা গিরির কাছে ভালোই লাগে। টাকার বিশেষ দরকার। রুনুর মাইনেতে চলে না, চালিয়ে নিতে হয়। জিনিসের দাম অসম্ভব গতিতে চড়ছে। আয় বাড়াবার এই সুযোগ অপ্রত্যাশিত মনে হল তার কাছে।

সতর্কভাবে সে বলে, ”ঘরটা দেওয়া যায় বটে কিন্তু খাওয়াদাওয়ার তো অসুবিধে হবে। রুনু ন’টায় অফিসে বেরোয়, রান্না কিছুই হয় না। অফিস ক্যান্টিনেই ভাত খেয়ে নেয়। আমি নিজে যা-হোক রান্না করে খাই। রাত্রেও আমাদের-”

”ও আপনি কিছু ভাববেন না দাদা।” অম্বর হাত তুলে গিরিকে থামিয়ে দেয়। ”আমারও বাইরে বাইরেই বেশির ভাগ দিন খাওয়াটা হয়।”

গিরির মনে হয়েছিল চৌকো মুখ কৃষ্ণবর্ণ, স্কুল ফাইনাল পাশ তার এই জ্ঞাতি ভাইটি কিঞ্চিৎ চপল, ছটফটে অমার্জিত। দু’-তিন মিনিটের বেশি এক জায়গায় বসে থাকতে পারে না। সামনের দুটি উঁচু দাঁত, কালো পুরু ঠোঁট, ব্রনের দাগে ভরা গাল, কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত ফুলে থাকা শিরার শাখা প্রশাখা এই সবের মধ্য দিয়ে বৃষ্টিভেজা বুনো ঝোপের গন্ধের মতো একটা তাজা অনুভব গিরি পাচ্ছিল।

কলকাতায় ফুটবলে অম্বরের এখন নাম হয়েছে। এটা গিরির কাছে কোনও ব্যাপার না। বছর কুড়ি ফুটবল খেলা দেখেনি। খেলা তার কাছে প্রাগৈতিহাসিক জিনিসে পরিণত হয়েছে।

”রুনুকে একবার জিজ্ঞাসা না করে আমি কিছু বলতে পারছি না।”

”আমি গিয়ে বউদিকে বলব, রাজি না হলে পায়ের ওপর পড়ব। দাদা, আর মেসে বাস করা সম্ভব হচ্ছে না। নানা ঝামেলা, টিকিট-ফিকিট তো আছেই তা ছাড়া রাতে ঘুমোতে পারি না, বড্ড চেঁচামেচি হয়।”

”গিরি উপভোগ করল নাটুকে ভঙ্গিতে হাতজোড় করা অম্বরের কৃত্রিম কাতরতা। মনে মনে সে তখন কিন্তু ভাবছিল, কত টাকা চাওয়া যায়। কত রোজগার করে? এখন ফুটবল খেলে হাজার-হাজার টাকা নাকি পাওয়া যায়। ক্লাব থেকে। তা ছাড়া শ’-চারেক টাকার চাকরি নিশ্চয় করে। ব্যাঙ্কে তো এখন ভালোই মাইনে দেয়, বিয়ে করেনি। বাড়িতে দাদারা ছাড়া কেউ নেই, সেখানে টাকা দিতে হয় না। ঠাকুর্দার আমলে সম্পত্তি ভাগাভাগির সময় ধান জমি আর বিলগুলো ওরাই নিয়েছিল।

রুনুর সঙ্গেই বরং কথা বলুক। সম্পর্কিত ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা চাওয়ার ব্যাপারে গিরি সংকোচ বোধ করেছিল। শ’খানেক টাকা হয়তো দিতে পারবে, তাই বা মন্দ কী। রুনুকে তাই বলে দেব।

”নেতাজি সুভাষ রোডে রুনুর অফিস লামসডেন অ্যান্ড মেহরোত্রা। দোতলায়, সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ডান দিকে হলঘর, পূর্বে ঠিক জানলা ঘেঁষে। ওর টেবিলে আরও দু’জন মেয়ে একজন পুরুষ বসে। রুনু বিশ্বাস বললেই যে-কেউ দেখিয়ে দেবে। ওখানে দেখা করাটাই সুবিধে। তোমার অফিসের কাছেই হবে।”

”খুব কাছে। অফিসটা আমি চিনিও। বউদিকে খুঁজে নিতে কিছু অসুবিধে হবে না। অম্বর বিশ্বাস হাজির হলে চার-পাঁচজন তো এগিয়ে আসবেই।”

অম্বরের বড় দাঁত দুটো হাসিতে বেরিয়ে এল। গিরির তখন মনে হয়েছিল তাদের বংশে এত বড় দাঁতওলা আর কেউ নেই। রুনু দেড়শো টাকা চেয়েছিল, অম্বর এককথাতেই রাজি হয়ে যায়।

”হলেই বা জ্ঞাতি ভাই, অম্বর বাইরেরই লোক। ওদের সঙ্গে আমাদের কোনওকালে সদ্ভাব ছিল না। ওর বাবা অত্যন্ত মামলাবাজ ছিল। তার জন্যই আমাদের সব গেছে, মানে, আমরা সম্পত্তি বিক্রি করে পাট চুকিয়ে পরানহাটি থেকে চলে আসি। তারপর থেকে বছর তিরিশ কোনও সম্পর্ক নেই। শুধু ওই পিসিমা ছাড়া আমার যে আর কেউ আছে-”

গিরি থেমে গেল। তার রুনু আছে। বস্তুত পৃথিবীতে একমাত্র রুনুই আছে। গত পনেরো বছর ধরে একমাত্র তার কাছেই সে নিরাপদ বোধ করে। জীবনের সঙ্গে তার যোগাযোগের নিকটতম সূত্র।

রুনু অপেক্ষা করছে বাকি কথাটা সম্পূর্ণ হবার জন্য। গিরি সেটা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে হেসে বলল।

”পরশু গরমের কথা বলছিল?”

”ওর ঘরটায় হাওয়া তেমন ঢোকে না।”

দুটো ঘরে পাখা নেই। তিনতলায় পুব খোলা ঘরে গ্রীষ্মে যতটুকু হাওয়া আসে তাতে ওরা প্রয়োজন বোধ করেনি পাখার। কখনও কখনও গুমোট পড়ে। দরদর ঘাম ঝরে। ঘরের আলো নিভিয়ে অন্ধকার বারান্দায় গিরি খালি গায়ে বসে। রুনু মাদুর পেতে শোয় ব্রেশিয়ারের উপর আঁচল মেলে। কিন্তু গুমোট যখন দিনে হয় এবং প্রায়ই হয়, তোয়ালে ভিজিয়ে গায় জড়িয়ে থেকে ফ্যাকাশে হয়ে যায় চামড়া। দিনের অনেকটাই অন্তত আট ঘণ্টা রুনু বাইরে থাকে, যে-সময় দিনের তাপ সর্বাধিক। ওদের অফিস এয়ারকন্ডিশনড।

”তা হলে একটা পাখা কিনুক, কিংবা ভাড়া নিক। আমার মনে হয় ভাড়া নেওয়াই উচিত।”

”আমিও তাই বলেছি।”

বলা তা হলে হয়ে গেছে। গিরি মুখ ফিরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। ছুটির দিন সকালে বাস স্টপে ভিড়টা বেশি হয়। এখনও তেমন হয়নি। সপরিবার যাত্রীই বেশি দেখা যায়। সামনের রাস্তাটায় আজ বয়স্ক ছেলেরা রবারের বল খেলতে শুরু করবে দশটা-সাড়ে দশটা থেকে। ওদের মধ্যে দু’-চারজন চাকুরে, বিবাহিতও থাকে। প্যান্ট গুটিয়ে একদিন অম্বরকে ওদের সঙ্গে খেলতে দেখেছে গিরি। তাতে ওরা যেন সম্মানিত বোধ করছিল। পাশের ফ্ল্যাটে তাসের আড্ডা বসবে, চলবে সারা দুপুর।

রুনু বারান্দায় নেই। ঘরে বালিশ চাপড়ানোর শব্দ হচ্ছে। বিছানা ঠিক করছে। এরপর ঘর ঝাঁট দেবে। তারপর পাশের ঘরে যাবে। গিরি অন্যদিনের মতো আজও ফুলঝাড়ুর মসৃণ খসখসানি শোনার জন্য কান পেতে রইল।

”কাগে এ এ জ।”

রাস্তা থেকে কাগজওলার চিৎকার শুনেই গিরির মাথার উপরের বারান্দায় পায়ের শব্দ হল।

দড়ি বাঁধা পাকানো কাগজটা তার চোখের সামনে দিয়ে উড়ে চারতলায় বারান্দায় পড়বে। নিখুঁত টিপ লোকটার। কবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে, কাগজটা আবার নীচে পড়ে যাবে, গিরি প্রত্যেকবার সেই প্রত্যাশায় অপেক্ষা করে। একদিনও পড়েনি।

কাগজটা ফুড়ুত করে লম্বাভাবে উড়ে গেল। গিরি উপর দিকে তাকাল। এইবার একটা কাড়াকাড়ির শব্দ হবে। তারপর গম্ভীর গলায় ধমক। সব শান্ত। রুনু খবরের কাগজ পড়ে না। অম্বর শুধু খেলার পাতাটুকু দেখে এবং সে-জন্য তার কাগজ কেনার দরকার হয় না। ডিটেকটিভ আর সিনেমা মাসিক পত্রিকা প্রায়ই আনে। রুনুর হাতে একবার সে ডিকেটটিভ পত্রিকা দেখেছে। গিরি কোনওরকম আগ্রহ বোধ করে না খবর জানার জন্য। তার কাছে কাগজ পড়ার অর্থ অযথা ঝামেলা বাড়ানো।

পাশের ঘরে শব্দ বন্ধ হল। কয়েক মাস আগেও শব্দের প্রতি গিরির আকর্ষণ এত বেশি ছিল না। আগের থেকে অনেক বেশি জোরে সে এখন শুনতে পায়। সামনের বাড়ির ছেলে দুটো মার খেয়ে যখন চেঁচায় তখন তার কানে যন্ত্রণা শুরু হয়। রুনু এখন কী করছে? ফুটবলারের ঘরে হয়তো এক ধরনের কঠিন ঘেমো আঁশটে গন্ধ থাকে। অনেকক্ষণ ধরেই ও-ঘরে রয়েছে। রুনুর কি ভালো লাগে এই গন্ধ? ইউনিভার্সাল থেকে ফেরার পর এক-একদিন রুনু বলত, ”ঘরে ঢুকলেই কেমন একটা গন্ধও তোমার সঙ্গে ঘরে আসে।”

”কেন খারাপ গন্ধ?” গিরি উদ্বিগ্ন স্বরে খোঁজ করেছিল। ”ভালো করে সাবান ঘষে চান করে, তবেই বেরিয়েছি।”

”গন্ধটা বেশ লাগে আমার।”

ফুটবলারের গায়ে, জামা-প্যান্টে নিশ্চয় পেট্রল, ডিজেল, মোবিল অয়েল বা গ্রিজের গন্ধ নেই। একদিন অম্বরের গেঞ্জি সে শুঁকে দেখেছে। পাউডারের গন্ধের সঙ্গে শুকনো বাসি ঘামের গন্ধ ছাড়া আর কিছু গিরি পায়নি।

কিংবা সিনেমা পত্রিকার ছবি দেখছে। স্টিলের ছোটো টেবিলটায় অনেকগুলো পত্রিকা আছে। সকালে রুনু যখন ঘরটা পরিষ্কার করে তখন খোলা দরজার সামনে দিয়ে গিরি যাতায়াত করে এক পলক দেখেছিল ট্রানজিস্টর রেডিয়োটা বিছানায়, দেয়ালে কাগজ আঁটা তার উপরে হ্যাঙ্গারে দুটো প্যান্ট ঝুলছে, টেবিলে অনেক রকমের শিশি, পেস্টের টিউব, আয়না এবং রঙিন ছবির মলাট দেওয়া পত্রিকা। খাটের নীচে পুরনো একজোড়া বুট। দরজার পাশের দেয়ালের দিকে কী আছে সে জানে না। ওদিকে একটা দেয়াল-তাকও আছে।

ঘরের চাবি থাকে রুনুর কাছে। অথচ এক-একদিন অম্বর দুপুরেই ফিরে এসে তালা খুলে ঘুমোয়। চাবি কি আর একটা আছে নাকি, রুনুর অফিসে গিয়ে চাবিটা আনে? হয়তো একটাই চাবি। রুনুর সঙ্গে গল্প করতে, সান্নিধ্য পেতে চাবি আনার ছুতো করে যায়। কিন্তু অফিসে কাজ করার মধ্যে গল্প করতে কি দেবে? রুনু বলেছিল, ওদের বসার জায়গা নতুন করে সাজানো হয়েছে। ওর টেবিলের মুখোমুখি নতুন ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্টের টেবিল। গম্ভীর ছোকরা। মেয়েদের প্রতি একটু বেশি কড়া।

হয়তো ক্যান্টিনে বসে ওরা কথা বলে। কিন্তু কতক্ষণ বসতে পারে? এখন নাকি ঘড়ি ধরে টিফিনে যাওয়া-আসার সময় রাখছে ডেপুটি ছোকরা। এমনকী ইউনিয়নের ছোটোখাটো ডিলাররাও হুট হুট সিট ছেড়ে ঘোরাঘুরি বন্ধ করেছে।

কিংবা এ-সব কিছুই হয়নি। আগের মতোই লামসডেন অ্যান্ড মেহরোত্রা অফিস চিৎকার, ঝগড়া, খিস্তিতে ভরা আছে। অম্বর গেলেই রুনু উঠে পড়ে। পাশের চেয়ারে ওর বন্ধু সবিতাকে হয়তো বলে যায়- ”কেউ খুঁজলে বলিস, ওষুধ কিনতে বেরিয়েছি।” রুনু একদিন অফিসের গল্প করতে করতে বলেছিল, ”সবিতার বয়-ফ্রেন্ড এলেই ওরা অফিস থেকে বেরিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে। আর আমাকে তখন সামলাতে হয় ওর কাজের ঝামেলাগুলো।”

রুনু যে ওইভাবে অফিস থেকে বেরোয় না বা বেরোবার কোনও উপায় নেই এটা বোঝাবার জন্যই হয়তো নতুন করে সাজানো বসার ব্যবস্থার, নতুন এক কড়া ছোকরা উপরওলার গল্প বানিয়ে বলেছে।

সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে উঁচু ফ্ল্যাট বাড়িটার গা ঘেঁষে সূর্য এবার উঠে এসেছে। রোদ্দুরটা মুখে এসে লাগছে গিরির। কাল রাতে মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙেছে, যা কখনও আগে হত না। হাতটা সন্তর্পণে এগিয়ে দিয়ে দেখেছে রুনু বিছানায় আছে কি না। বারান্দায় পায়ের শব্দ শোনার জন্য কান খাড়া করে থেকেছে।

চোখ জ্বালা করছে গিরির। খানিকটা ঘুমোলে চোখ দুটো ঠিক হয়ে যাবে। ওঠার জন্য সে হাত বাড়াল দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা ক্রাচ দুটোর দিকে। সেই সময় তার নজরে পড়ল মোহন স্কুটারে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে অঘোর ঘোষ স্ট্রিটে ঢুকছে।

ক্রাচ দুটো বগলে লাগিয়ে গিরি উঠে দাঁড়াল। মোহন মুখ তুলে তাকে দেখে হাসল। ফুটপাথ ঘেঁষে স্কুটারটা থামাল।

গিরি ঝুঁকে চিৎকার করে বলল, ”রাস্তায় রাখিসনি, ফুটে তুলে দেয়াল ঘেঁষে রাখ। ছেলেরা এখুনি বল খেলা শুরু করবে।”

 দুই

অম্বর বেরিয়ে যাবার পর দরজা বন্ধ করেনি রুনু। পাল্লা দুটো খুলে গিরি অপেক্ষা করতে লাগল।

পাশের ফ্ল্যাট থেকে ঝগড়ার শব্দ আসছে। প্রায়দিন সকালেই বউটির সঙ্গে স্বামীর কথা কাটাকাটি মিনিট দুয়ের মধ্যেই চিৎকারে পৌঁছয়। সাত বছরের দম্পতি ওরা। লোকটি দু’চারবার জোরে কথা বলেই নীরব হয়ে যায়। বউ একদা তার ছাত্রী ছিল। বয়সের পার্থক্য কুড়ি বছরের। লোকটি অঙ্কের অধ্যাপক, প্রচণ্ড নেশা কনট্রাক্ট ব্রিজ খেলার।

চারতলা থেকে, টাক মাথা গম্ভীর দত্তবাবু বাজারের থলি হাতে নামতে নামতে শুকনো হাসল গিরিকে দেখে। পালটা হাসল গিরি। লোকটির বিধবা বোনের মাথার গোলমাল আছে।

মোহন উঠতে দেরি করছে।

”দাঁড়িয়ে যে, কেউ আসছে নাকি?”

রুনু উনুনে কয়লা সাজাচ্ছে কলঘরের গলিতে। গিরি অস্পষ্ট স্বরে বলল, ”মোহন আসছে।”

”অনেকদিন পর।”

সে তাকাল না রুনুর দিকে। সিঁড়িতে পায়ের শব্দটা উঠে আসছে। খুবই ধীরে, অসুস্থ মানুষের পদক্ষেপের মতো শব্দগুলো সময় নিচ্ছে। মোহন আসছে প্রায় তিন মাস পর।

মাথার সামনের চুল উঠে গিয়ে অর্ধেক খুলি মসৃণ বাদামি। বাকি চুল ঘন কালো। কপালটা উঁচু এবং গড়ানে। রগ থেকে কেঁচোর মতো একটা শিরা কানের উপরে পড়ে। সিঁড়ির বাঁকটায় মোহন দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। গিরি শুধু দেখতে পাচ্ছে মাথাটুকু।

নীল বুশ শার্টের দু’ধারে শীর্ণ ফ্যাকাশে দুটি হাত ঝুলছে। চোয়ালের নীচে প্রবাল রঙের আঁচিল। গিরি ইউনিভার্সালে প্রথম যখন মোহনকে দেখে সর্বাগ্রে আঁচিলটাতেই চোখ পড়ে। এত ঝকঝকে, নিটোল এবং এমন লাল আঁচিল কখনও সে দেখেনি। ষোলো-সতেরো বছরে ওটা এখন প্রায় বৈঁচির আকার পেয়েছে। ওর হাতে সিগারেট তামাকের কৌটো। গিরি দরজা থেকে সরে দাঁড়াল পথ ছেড়ে দিয়ে।

”কী রে, এত সকালেই এদিকে?”

মোহন বেলেঘাটায় থাকে। বউ এবং দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে। ইউনিভার্সালে সে সিনিয়ার ফোরম্যান ছিল। মোহনই বলেছিল অ্যাকসেলের টুকরোটা কোটের মধ্যে লুকিয়ে নিতে। প্রতিদিনই টুকটাক যন্ত্রপাতি মোহন এইভাবে নিয়ে বেরিয়ে যেত। বছর বারো আগে সে ইউনিভার্সাল ছেড়ে একটা রিপেয়ারিং গ্যারেজ খোলে। ধীরে ধীরে সেটা বড়ো করে তুলেছে। এখন এন্টালিতেও ছোটোখাটো একটা কারখানা খুলেছে দুটো লেদ মেশিন নিয়ে। সল্ট লেকে পাঁচ কাঠার প্লট কিনেছে।

মোহন প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে রুনুকে লক্ষ করে বলল, ”এক গ্লাস জল দাও রুনু, তারপর চা।”

ঘরে এসে মোহন লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল চটি পরা পা দুটো খাটের বাইরে রেখে। চটির তলায় ধুলোর চিহ্ন দেখতে পেল না গিরি। নানা সময়ে ব্যবহারের জন্য মোহনের নানারকম জুতো আর চটি। এইটাই ওর বাবুয়ানি।

গিরি মোড়াটায় বসে ক্রাচ দুটো খাটের উপর শুইয়ে রাখল। বাঁ পা টান করে সামনে ছড়িয়ে আবার গুটিয়ে নিল।

”বউদি কেমন আছে?”

”ভালো। ভালোই আছে।”

রুনু জলের গ্লাস নিয়ে দাঁড়াতেই মোহন উঠে বসল। জল খাওয়ার সময় ওর চোখ রুনুর মুখে নিবদ্ধ। রুনু মুখ ফিরিয়ে একবার গিরির দিকে তাকাল। রুনু গ্লাস নিয়ে চলে যাচ্ছে, মোহন কোনওরকম সংকোচের বালাই না রেখে ওর নিতম্বের দিকে যে-ভাবে তাকিয়ে থাকল তাতে গিরি অস্বস্তি বোধ করল।

মোহনকে সে চেনে, অসৎ এবং ইতর চরিত্রের। মোহন মারফতই রুনুর বা রুনুদের বাড়ির সঙ্গে সে পরিচিত হয়। তখন রুনু উনিশ-কুড়ি বছরের রোগা একটি মেয়ে, সবেমাত্র আই এ ক্লাসে ভরতি হয়েছে।

”তোর বউ তো দিনদিন বেশ সুন্দরী হয়ে উঠছে। আগেরবার এসে যা দেখেছিলুম, তার থেকেও বেশ-”

মোহন দু’হাতে গোলাকার একটা কিছু সন্তর্পণে শূন্যে তৈরি করে সেটিকে আলতো ধরে রইল।

গিরি অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। রুনুর যত বয়স বাড়ছে, ততই যেন লাবণ্য বাড়ছে। ভরাট হয়েছে, নিটোলত্ব পেয়েছে, ভাঁজ পড়েছে দেহের বহু জায়গায়। রাস্তায় পুরুষরা ফিরে ফিরে তাকায়। যখন তারা দু’জন একসঙ্গে বেরোয়, লক্ষ করেছে, পা-কাটা খোঁড়া লোকটার পাশের মেয়েটির দুর্ভাগ্যের জন্য পথচারীদের চোখে সমবেদনা ফুটে উঠত।

কিন্তু মোহন যে রুনুর জন্য সমবেদনায় কাতর হবে না, এটা গিরি জানে। বরং তার মনে হয় গিরিকে সে ঈর্ষা করে রুনুর জন্যই। হাসপাতালে থাকার সময়ই নিঃসঙ্গ দিনগুলো কাটাতে কাটাতে প্রায়ই তার মনে হত এবার রুনু বোধহয় তাকে ছেড়ে চলে যাবে। তারা বিবাহিত নয়। কিন্তু তারপরও পনেরো বছর তারা একসঙ্গে রয়েছে। রুনুকে কষ্ট কম করতে হচ্ছে না। কিন্তু কখনও সে অভিযোগ অবহেলা বা বিরক্তি জানায়নি। এ-জন্য গিরির কৃতজ্ঞতার অবধি নেই।

একবার মাত্র গিরি বিয়ের কথা তুলেছিল। হাঁটছিল ওরা সন্ধ্যায় গঙ্গার ধারে। কাশী মিত্র শ্মশানটা দেখিয়ে গিরি বলে, ”এখানে বাবাকে পোড়ানো হয়েছিল। আমি তখন বারো বছরের। রেঙ্গুন দখল করে জাপান তখন এগিয়ে আসছে ভারতের দিকে। কলকাতার লোক ভয়ে পালাচ্ছে। ব্ল্যাক আউটের মধ্য দিয়ে আমি আর-”

তারপরই মনে পড়ে এ-সব কথা রুনুকে সে আগেও বলেছে। কিন্তু রুনু অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে যখন শোনা-কথাই আবার শোনে, গিরি বুঝতে পারে ও ভান করে আছে। তার বাল্য ও কৈশোরের দুঃখ দুর্দশার গল্প বহুবার বলেছে এবং দেখেছে প্রত্যেকবারই রুনুর চোখ ছলছল করে ওঠে।

একটা মৃতদেহকে পোড়ানোর ব্যবস্থা হচ্ছিল। ওরা রাস্তা থেকেই দেখছিল। অল্পই বয়স বউটির। সিঁথিতে কেউ উপুড় করে দিয়েছিল সিঁদুর কৌটো। লাল বেনারসিতে ঢাকা। পা দুটি আলতায় লাল। রুনু বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে বলেছিল, ”বউটা যেন দোল খেলেছে। এমন লাল আমি দেখিনি।”

”মোহনের আঁচিলটা দ্যাখোনি?”

কেন হঠাৎ মোহনের কথা তার মনে এসেছিল! রুনু হাসবার চেষ্টা করে বলেছিল, ”আমিও যেন এইরকম সিঁথেয় সিঁদুর নিয়ে যেতে পারি।”

”কোথায় যেতে পারো?”

”স্বর্গে।”

”সেখানে তো পাপীরা যেতে পারে না।”

রুনু আহত চোখে তাকিয়েছিল। গিরি দ্রুত বলে, ”মানুষ মাত্রেই পাপ করেছে। নিশ্চয় কখনও নিজের অজান্তে করেছে।”

”আমি কখনও করিনি। আর অজান্তে পাপ করলে কোনও দোষ হয় না।”

রুনু গম্ভীর হয়ে গিরির পাশে পাশে হাঁটতে থাকে। ক্রাচের খটখট শব্দটা যখন দু’জনের নৈঃশব্দ্যের মাঝে অসহ্য হয়ে উঠল তখন গিরি বলেছিল, ”সিঁদুর পরো বটে কিন্তু আমাদের বিয়ে এখনও হয়নি।”

রেললাইনের ধারে, কুমোরটুলির দিকে মোড় ফেরার রাস্তাটায় যে মৃদু মলিন আলো, তার দ্বারা গিরি দেখেছিল, রুনুর চোখ বিস্ময়ে ভরে গেল যেন তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।

”কেন?”

”কী কেন!”

”বিয়ের কথা তুললে কেন। বিয়ে করা বউ কি স্বামীকে ত্যাগ করে না?”

”ও-কথা তো আমি বলিনি।”

”আমার মনে হল, তুমি বোধহয় এইরকম কিছু একটা ভাবছ।”

”রুনু, আমি তোমায় ভালোবাসি।”

”আমিও।”

রুনু আলতো করে তার বাহুতে হাত রাখল। গিরি মুখ নামিয়ে বলল, ‘পাপের কথাটা এমনিই বলেছি। কিছু মনে কোরো না।”

”না, মনে করিনি। এ-ভাবে আমি কিছু ভাবি না। তবে মনে হচ্ছে তুমি যেন অসুখী।”

সেই মুহূর্তে দারোয়ানের সামনে দিয়ে লোহাটা নিয়ে বেরিয়ে আসার মতো বহুকাল আগের আতঙ্কটা তাকে পেয়ে বসেছিল কেন? ছোটোখাটো সাংসারিক কাজ আর সারাদিন বারান্দায় নয়তো খাটে বসে অপেক্ষা করা রুনুর ফেরার জন্য। অজস্র রকমের চিন্তা তখন তাকে ছেঁকে ধরে। চিন্তা করার জন্য তার সময়ও অজস্র। হয়তো তার স্নায়ুগুলো অত্যধিক চিন্তায় দুমড়ে গেছে বলেই আতঙ্কটা হয়েছিল।

”তুমি কাছে থাকলে আমি অসুখী বোধ করি না।”

”আর যখন কাছে থাকি না?”

”তখন অপেক্ষা করতে করতে ভাবি, কখন তুমি ফিরবে।”

”অজান্তে তোমাকে কি কখনও ব্যথা দিয়েছি?”

”না।”

মোহনকে ধীরে ধীরে দু’হাত দিয়ে নিজের গাল চেপে ধরতে দেখে এই মুহূর্তে গিরির মনে হল, এই লোকটা জীবনে কখনও সুখী হবে না। যেমন কোনও কোনও লোককে দেখে বলে দেওয়া যায়, তার মনের মধ্যে কোনও কুটুরি আছে কি না, প্রবল অশান্তি ঘটলেই যেখানে সে পালিয়ে যেতে পারে। মোহনকে দেখে মনে হচ্ছে, পালাবার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে।

”আংটিতে ওটা কী? নতুন মনে হচ্ছে।”

”গোমেদ।”

”এইসবে তার বিশ্বাস এখনও গেল না।”

”অবিশ্বাসেরই বা কারণ কী! রত্ন ধারণ করে অনেকেরই তো অনেক কিছু হয়েছে।”

”আমি তো কুষ্ঠি-ঠিকুজি গ্রহ নক্ষত্র বিশ্বাস করি না তা হলে আমার কেন এ-রকম হল?”

গিরি মিটিমিটি করে হাসতে লাগল। ইউনিভার্সালের অনেকের মতো তারও ধারণা মোহনের গাফিলতিতেই দুর্ঘটনা হয়েছে। হয়তো মোহনও মনে মনে সেটা স্বীকার করে।

ইউনিভার্সালের সেই দেড় টনের হাইড্রালিক লিফটটার বসানোতেই গোলমাল থাকায় ব্যালান্সের হেরফের ছিল। একদিকে সামান্য হেলে থাকত। তাতে গ্যাসকেটে জখম হয়ে নিয়মিত তেল বেরিয়ে যেত। হেলে থাকার জন্য লিফটের মোটা লোহার থামটা, হাওয়া বার করে দেবার পরও নামত না, সিলিন্ডারের গায়ে আটতে থাকত। ধাক্কা দিলে ঝপ করে নেমে আসত গাড়ি সমেত। ঘষাঘষিতে মসৃণ ঝকঝকে থামটার গায়ে আঁচড় পড়ে গেছিল। এ ছাড়া হাওয়া বার করে দেবার ভালভেও লিক দেখা দিয়েছিল। ক্ষয়ে যাওয়া পুরনো ভালভ সিট ও ভালভ ককের ফাঁক দিয়ে প্রচণ্ড চাপের হাওয়া নিঃসাড়ে বেরিয়ে যায়, একথাটাও মোহনকে জানিয়েছিল একজন মেট। সে বলেছিল, ”আচ্ছা দেখছি।”

যদি দেখত! গিরি ডান পায়ের কাটা ঊরুর দিকে চোখ নামাল। মোহন চোখ সরিয়ে নিল কেন?

ইউনিভার্সালে যারা মাল সরবরাহ করে তাদের সঙ্গে ওর কমিশনের বন্দোবস্ত আছে, এ-রকম একটা কথা সে ফিটার-মেকানিকদের মহলে শুনেছিল। প্রকাশ মেহরাও নাকি তার ভাগ পায়। মোহন কী বলবে- ”নীচস্থ বুধ তৃতীয়ে ছিল” বা ”রাহু সাড়ে বাইশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে থেকে সোজা তাকিয়ে আছে!”

কৌটো থেকে তামাক বার করে ও তালুতে চটকাচ্ছে। ভিতরে ভিতরে অধৈর্য, বিরক্ত এটা বোঝা যায়। গিরির মনে হল ওগুলো বার করে দেবার জন্যই সে এসেছে।

”ছেলেটার কার্ডিয়াক রিউম্যাটিসম। ডাক্তারের কাছ থেকেই এখানে আসছি। কার্ডিয়োগ্রাম করে ধরা পড়েছে। মেয়েটার অ্যামিবিক কোলাইটিসে চিকিৎসা চলছিল, তারপর বলল অ্যাপেন্ডিসাইটিস, ইউরিন টেস্ট করে এখন বিকোলাইয়ের জার্ম পাওয়া গেছে। রমুকে পনেরো দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে, ভাত খাওয়া বন্ধ, চান করা বন্ধ, মাটিতে শোয়া কোনওদিনই চলবে না, বৃষ্টিতে ভিজতে পারবে না।”

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে মোহন এত নির্লিপ্তভাবে সিগারেট পাকাচ্ছে, তার মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ, অবশ্যই নিজের ভাগ্যের প্রতি, ধিকিধিকি জ্বলছে। গিরি দুঃখ বোধ করল রমুর জন্য। ছটফটে তেরো বছরের ছেলেটা পনেরো দিন বিছানায় থাকবে কী করে! সে নিজে সাড়ে চার মাস বিছানায় ছিল। গোছ থেকে গ্যাংগ্রিন ধরা পা কাটাতে ঊরু পর্যন্ত বাদ দিতে হয়েছে। তখন বয়স ছিল তিরিশ আর রমুর তেরো। অঙ্গ না হারিয়ে চৌকো একটা প্রায় ৩০ বর্গফুট এলাকায় বন্দি থাকার অসহনীয়তা কিছুটা সে আন্দাজ করতে পারে।

”ভাবলে কষ্ট হয়।”

”রমুর জন্য?”

মোহন ফিকে হাসল। সে যেন প্রত্যাশাই করছিল রমুর দুঃখেই গিরি এ-কথা বলবে। একটা অস্পষ্ট অভিমান ওর ঠোঁটে চিবুকে নড়াচড়া করে পালাবার মুহূর্তে গিরির নজরে ধরা পড়ে গেল।

”তোর জন্যই।”

”কেন?”

”বউদির সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে?”

”অসম্ভব।”

গিরি মোহনের বউকে শেষবার দেখেছে হাসপাতালে। রক্তাল্পতায় ভোগা, হাড় আর চামড়া সর্বস্ব, খিটখিটে, অশিক্ষিত স্ত্রীলোক। গিরি প্রথম যখন মোহনের বাড়িতে যায়, তখন রমু জন্মায়নি, বড়মেয়ে ডলি তিন-চার মাসের। আলমারির মাথার উপর থেকে দিশি মদের বোতলটা নামিয়ে মোহন অপ্রতিভ চোখে তাকিয়েই সেটা দেয়ালে ছুড়ে মারল। কাচ ছড়িয়ে পড়ল। ওতে এক ফোঁটা মদও নেই। তিন-চার পা এগিয়েই বউয়ের গালে প্রচণ্ড চড় কষাল।

বাধা দেবার সময় পাওয়া গেল না। গালে হাত দিয়ে, চোখ দুটোকে ঠেলে বার করে এনে মোহনের বউ চিৎকার করেছিল, ”মারলে, মারলে, বাইরের লোকের সামনে বউয়ের গায়ে হাত তুললে?… বে-এ-এশ করব, আবার আনো নর্দমায় ফেলে দোব।”

কাছের এক বস্তিতে খাটিয়ার উপর বসে চোলাই খেতে খেতে মোহন বলেছিল, ”জীবনটা নষ্ট করে দিল এই মাগি, তুই আর যাই করিস, বিয়েতে যাসনি। পুরুষমানুষের মন মেজাজ বোঝার ক্ষমতা খুব কম মেয়েরই আছে। ওদের ধারণা পুরুষরা বুঝি শুধু শরীরের ওই একটা জায়গাই চায়।”

মোহন এ-রকম ভাবে সেদিনও খেদভরে মাথাটা নাড়ছিল।

”অসম্ভব কেন? বছর কুড়ি তো কাটিয়েছিস। বাকিটাও কেটে যাবে।”

মোহন দ্রুত টান দিচ্ছে সিগারেটে।

”বাকিটাকে আমি আর নষ্ট করব না। আমি ঠিক করে ফেলেছি নষ্ট করার কোনও মানে হয় না, যুক্তি নেই। এবার আমি নিজের কিছু করছি।… আচ্ছা, এক কাপ চা করতে রুনু এত সময় নিচ্ছে কেন! জনতা জ্বেলে করলেই তো হয়।”

মোহন খাট থেকে নেমে ঘরের বাইরে যাচ্ছে, রুনু দু’কাপ চা হাতে ঢুকল।

”আজ মুরগি রাঁধছে রুনু, খেয়ে যা।”

”বটে, কোথা থেকে কিনলি?”

”আমি নয়, অম্বর কিনে আনবে মাঠ থেকে ফেরার পথে।”

প্রথম চুমুক দেওয়ার পর কাপ নামিয়ে মোহন বলল, ”বড্ড চিনি দিয়েছ, একটু লিকার এনে দাও।”

মোহন এবার তাকাল না রুনুর পিছনে। গিরি ভেবে রেখেছিল মোহন তাকাবে এবং ভ্রূকুটি করে সে বিরক্তি প্রকাশ করবে।

”অম্বর খেলে কেমন? অনেকদিন আর মাঠের খোঁজ খবর রাখি না।”

”আমি দেখিনি কখনও, শুনেছি নাম হয়েছে।”

মোহন যেন কিছু একটা বলতে চায়, ছেলেমেয়ের অসুখের কথাই শুধু জানাতে এসেছে মনে হয় না। গিরি আন্দাজ করার চেষ্টায় বলল, ”হাসপাতালে আমাকে দেখতে বউদি একদিন একা এসেছিল, তুই তো তা জানিস?”

”জানি, অনেক পরে আমায় বলেছিল।”

”আমার খুব ভালো লেগেছিল। দুটো কমলালেবুও হাতে করে এনেছিল।”

রুনু ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে গিরি বলল, ”বউদির হাসপাতালে গিয়ে আমাকে দেখার কথাটা বলছিলুম। তুমিও তো তখন ছিলে।”

”সেই আমি প্রথম দেখলাম। তোমার কপালে বুকে অনেকক্ষণ হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন।”

মোহন যেন অস্থির হচ্ছে। সিগারেটের মতো চা-টাও দ্রুত শেষ করে, কাপটা এগিয়ে দিল রুনুর দিকে। ”কী রাঁধবে, রোস্ট?’

”ওরে বাবা, ঘি পাব কোথায়?”

”ঠিক আছে, রোস্টই হোক। ঘি-ফি সব এসে যাবে। ফ্রায়েড রাইসও তা হলে। কী কী আনতে হবে লিস্টি করে দাও।”

রুনু বিব্রত চোখে গিরির দিকে তাকাল। গিরি মাথা হেলাল।

”তা হলে তো চালও আনতে হবে।”

”নিশ্চয়ই। চটপট লিখে দাও। আজ এখানেই চারটি খেয়ে যাব।”

রুনু বেরিয়ে যেতে মোহন আবার তামাক বার করল। মাথা নিচু করে মন দিয়ে চটকাচ্ছে। গিরি অপেক্ষা করতে লাগল।

”একটা মেয়ের সঙ্গে আমার ভাব হয়েছে।”

মৃদু ফিসফিস স্বরে মোহন বলল, ‘ভাব’ শব্দটা ওর মুখে বেমানান। ‘পটিয়েছি’ বললে গিরি এতটা অস্বস্তি বোধ করত না। মেয়েটি কে, কীভাবে, কবে, কত বয়স, কী করে নানাবিধ কৌতূহলের মধ্যে গিরি বাছাবাছি করে চলল।

”ঠিক করেছি আমরা দু’জন একসঙ্গে থাকব। একসঙ্গে মানে, ওকে একটা এই রকম ফ্ল্যাটে রাখব, আমি মাঝে মাঝে এসে থাকব। ফ্ল্যাটের অ্যাডভান্স করেই তোর কাছে আসছি।”

”ডাক্তারের কাছ থেকে নয়?”

”প্রথমে ডাক্তারের কাছে তারপর বাড়িওলা হয়ে আসছি। ফ্ল্যাটটা এই পাড়াতেই, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর ঠিক ওপারে বনমালী সরকার লেনের একটু ভিতরে। তোর বারান্দা থেকে দেখা যাবে না।”

গিরি হঠাৎ কৌতূহল ও উত্তেজনার প্রকোপ অনুভব করতে শুরু করল। মোহনকে এত আন্তরিক কখনও সে দেখেনি।

”কী করে ভাব হল?”

”আমার ফিটারের মেয়ে। প্রাইভেটে গত বছর স্কুল ফাইনাল পাশ করেছে। আমিই খরচ করেছি। বয়স হয়েছে কিন্তু বোঝা যায় না, ম্যালনিউট্রিশন। সতেরো বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। বিদ্যাসাগর মর্নিং-এ প্রি-ইউতে ভরতি করালাম, পড়ুক।”

মর্নিং-এ কেন, ডে-তে দিতে পারত। নাকি ছোকরাদের সঙ্গে পড়াবার ভরসা পাচ্ছে না। মোহনের বয়স এখন কত হবে, আটচল্লিশ-সাতচল্লিশ। দেখায় প্রায় ষাটের মতো। বছর দুয়েকের মধ্যে শরীরটা হঠাৎ ভেঙে পড়েছে। গিরি ওর থেকে বছর তিনেকের ছোটো।

”লোকটার চার মেয়ে। শুধু বড়টারই বিয়ে দিতে পেরেছে। আর তিনটের পারবে না। হাঁপানিতে শেষ হয়ে এসেছে। মিস্ত্রি হিসেবে খুবই ভালো। ওকে বলেছি বুলিকে হস্টেলে রেখে পড়াব।”

ফর্দ হাতে রুনু ঘরে ঢুকতেই মোহন উঠে দাঁড়াল।

”পনেরো থেকে বিশ মিনিটের মধ্যে আসছি।”

মোহন চাহনিতে সাবধান করে দিল গিরিকে। আধ ইঞ্চি মাথা হেলাল গিরি। মিনিট দুয়েক পরে রাস্তায় স্কুটার স্টার্ট নেওয়ার শব্দ শুনে সে উঠে বারান্দায় এল। মোহনকে বাঁ দিকে বেঁকে যেতে দেখল। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর ওপারে বনমালী সরকার লেনের বাড়িগুলোর দিকে সে তাকাল। রাস্তাটা তিরিশ গজ পরেই বাঁক নিয়েছে। তারপর কোনও একটা বাড়িতে সেই ফ্ল্যাটটা!

গিরি সন্তর্পণে চেয়ারে বসল। একদৃষ্টে সামনের দিকে তাকিয়ে সে আপন মনে বলল, ”মোহনের এতটা বাড়াবাড়ি করার কী দরকার।”

মোহন একদিন ছুটির পর হাতে তরল সাবান মাখতে মাখতে বলেছিল, ”বাড়ি ফিরে কী করবি?”

”কী আবার করব। গল্পের সেই বই পড়ব নয়তো সিনেমায় যাব।”

”তা হলে চল, এক জায়গায় নিয়ে যাব তোকে আজ।”

”আগে বল কোথায়।”

”চলই না। ভালো লাগবে তোর।”

কলে হাত ধুয়ে, হাতটা ঝাড়তে ঝাড়তে মোহন বলেছিল, ”আমার গার্লফ্রেন্ডের কাছে। প্রাইভেট নার্স।”

মোহনের হাসিটা বিরাট নিঃশব্দ এবং অর্থবহ ছিল।

”মাঝে মাঝে যাই।”

একতলা টালির চালের বাড়ি। বাইরের দরজায় সাদা অক্ষরে লেখা, ”মিসেস এস মজুমদার। প্রাইভেট নার্স।” দরজার পাশে সরু রক। জায়গাটা আধো অন্ধকার। গেঞ্জি গায়ে একটা লোক দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। মোহন আঙুলের গাঁটে ঠুকে টোকা দেবার মিনিট খানেক পর দরজা খুলে দাঁড়াল একটি স্ত্রীলোক। ঘরের আলো ওর পিছনে, মুখটা দেখা যাচ্ছিল না। পরনে কালো পাড় সাদা বুটিদার তাঁতের শাড়ি।

”আরে, মোহনবাবু, কী ভাগ্যি, আসুন ভেতরে।”

পাশ ফিরে সরে দাঁড়াতে গিরি ওকে সম্পূর্ণ দেখতে পেল। চল্লিশ ছুঁয়েছে বা সদ্য অতিক্রম করেছে। শ্যামলা রং, টিকোলো নাক, চোখে হালকা সুরমা, পাউডারের গুঁড়ো থুতনির কাছে। স্থূল কোমর এবং তলপেট চর্বিতে ঝুলে পড়েছে, বুকের উপর মাংসের স্তূপকে জমাট করে রেখেছে ব্রেসিয়ার। কঠিন চাপের ফলে ব্লাউজের গলা উপচে ফুলে রয়েছে মাংস। গিরি অনাস্বাদিত উত্তেজনা বোধ করে ওকে দেখে।

”আমার এক বন্ধুকে নিয়ে এলাম, আলাপ করিয়ে দিতে। মাঝে মাঝে ও আসবে।”

মিসেস মজুমদারের চাহনি গাঢ় হল, মাথা হেলিয়ে বললেন, ”নিশ্চয়, এলে খুশি হব।”

”একা একদমই একা ছেলেটা। অত্যন্ত কুনো, জোর করেই ধরে আনলাম।”

”ভালোই করেছেন। চা খাবেন?”

মিসেস মজুমদার ঘাড় ফিরিয়ে ঘরের কোণের দিকে তাকালেন। একটা নীল পর্দা ঝুলিয়ে ঘরটার কিছুটা আলাদা করা। একটা টেবিল, তাতে সারি দিয়ে সাজানো বই। দেয়ালের দিকে মুখ করে একটি রোগা মেয়ে খোলা বইয়ের উপর ঝুঁকে। ওর পিঠ এবং ডান বাহুর অংশ মাত্র দেখতে পেল গিরি।

”রুনু, দু’কাপ চা করে দিতে পারবে?”

অনুরোধের স্বর, কিন্তু বিনা বাক্যব্যয়ে দ্রুত রুনুর উঠে যাওয়া থেকে বোঝা যায় ওটা আদেশ।

মোহন এবং মিসেস মজুমদারের হালকা এবং অবান্তর কথাবার্তার মধ্যে গিরি চুপ করে থাকে। ঘরটায় ভ্যাপসা গন্ধ। প্রতিটি আসবাব জীর্ণ এবং মলিন। হাস্যকর লাগছিল দেয়ালে ঝোলানো পশমে বোনা একটি কাকাতুয়াকে। কাচটায় এত ধুলো যে কাকাতুয়াটাকে চিল মনে হচ্ছে। একটি বছর পাঁচ-ছ’য়ের ফ্রক পরা মেয়ে, চশমা পরা একটি লোকের কোলে সম্ভবত ছবি তোলবার লজ্জাতেই বা কোলে ওঠার জন্যই বুকে মুখ লুকোতে চাইছে। গিরির মনে হয়েছিল এটি ওই রুনু নামের মেয়েটি এবং লোকটি ওর বাবা।

রুনু চা আনল। নিস্পৃহ মুখে সে হাতে তুলে দিল। এবং চা খাওয়ার পর মিসেস মজুমদার হাতঘড়ি দেখে বললেন, ”আমার একটা কল আছে, ন’টায় বেরোতে হবে কিন্তু।”

”ওহ, তাই নাকি। একটা কথা বলার ছিল।” মোহন ইতস্তত করল।

”প্রাইভেট কথা?”

”একটু প্রাইভেট।”

”তা হলে ও ঘরে চলুন।”

একা বসে থাকতে থাকতে গিরির চোখ বারবার সেই নিথর পিঠটির ওপর গিয়ে পড়ছিল। মেরুদণ্ডে সূক্ষ্মভাবে বিদ্রোহের রেশ। দুটি কাঁধ করুণা প্রত্যাশায় ঝুঁকে রয়েছে ভ্যাপসা জীর্ণ নীরব ঘরটার মধ্যে। মেয়েটির পিঠ তাকে অসাড় করে রেখেছিল।

প্রায় আধঘণ্টা পর মোহন ফিরে এল একাই। রাস্তায় বেরোবার সময় গিরি মুখ ফিরিয়ে দেখেছিল পিঠটা একই রকম রয়েছে। রকের লোকটাও একই ভঙ্গিতে বসে। ফেরার পথে গিরি জিজ্ঞাসা করেছিল, ”রুনুও কি-”

”হতে পারে।”

 তিন

”কী হতে পারে?”

গিরি চমকে পাশে তাকাল।

”বিড়বিড় করে কী বকছ?”

মুখ তুলে গিরি বিভ্রান্তের মতো রুনুর দিকে তাকিয়ে বলল, ”রাতে ঘুম হয়নি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বিশ্রি একটা স্বপ্ন… যাক গে। ক’টা বাজল অম্বর এসেছে?”

”না, তুমি কি পেঁয়াজ আদা ছাড়িয়ে দেবে? আমি চানটা করে নিতে পারি তা হলে।”

”এখানেই ছুরিটা আর ওগুলো দিয়ে যাও।”

তারপর মোহনকে আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি। সংকোচে নয়। যদি বলে হ্যাঁ মায়ের মতো রুনুও-। অনেক সময়ে সে বড়াই করে, বিশেষত মেয়েদের সম্পর্কে, মিথ্যাও বলে। গিরি ভয়ে জিজ্ঞাসা করেনি, পাছে বিষিয়ে ওঠে তার মন। ওই রকম একতলা বাড়িতে, প্রাচীন আসবাবের মধ্যে, নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে পিঠ ফিরিয়ে বসে থাকা একটি রোগা মেয়ে তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল।

অভ্যস্ত দক্ষহাতে আদার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে গিরি রেলিংয়ের মধ্য দিয়ে সামনের বাড়ির দোতলার ঘরে তাকাল। ঠিক এই সময়ই ফ্রক-পরা মেয়েটি রাইফেল বগলে ধরে সামনে তাক করে। মিনিট পনেরো মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ড্রাই প্র্যাকটিস করে যায়। অসাধারণ ধৈর্য। বহুদিন গিরি ওর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, চেয়ারে বসেই একটা ক্রাচ তুলে রাইফেলের মতো ধরে থেকেছে। কিছু পরেই হাত ভার হয়ে আসে কেঁপে ওঠে। আড়চোখে দেখত মেয়েটি তখনও ধরে আছে কি না। তারপর লজ্জা পেত। ক্রাচের তলাটা ভারী লোহায় মোড়া। চলার সময় শব্দ হত। নীচের ফ্ল্যাটের জাঁদরেল গিন্নি একদিন রুনুকে ডেকে রবার লাগিয়ে নিতে পরামর্শ দেয়। রুনুই অফিসের স্টিলের চেয়ারের পায়া থেকে দুটো রবার খুলে নিয়ে আসে।

”এ-ভাবে নিয়ে আসাটা কিন্তু চুরিই।”

”ভারী তো চার আনা দামের জিনিস।”

খুব হালকা চালে বললেও রুনুর মুখ অপ্রতিভ হয়ে গেছল। গিরি বেদনা বোধ করেছিল উদ্দীপ্ত মুখটি হঠাৎ নিভিয়ে দেওয়ার জন্য। রবারের টুপি দুটো ক্রাচে লাগিয়ে ঘরে বার কয়েক চলাফেরা করল। রুনু কান পেতে শুনছে শব্দ হচ্ছে নাকি। একপায়ের উপর শরীরের ভর রেখে হালকাভাবে ক্রাচ ফেলে গিরি ঘোরাফেরা করতে করতে দেখল রুনুর মুখে স্বস্তি ফুটে উঠেছে।

”বড্ড ঝগড়ুটে। নিজেদের সুবিধেটুকু ছাড়া আর কিছু বোঝে না। খটখট শব্দে নাকি বালি খসে পড়ে।”

”বাড়িটা অবশ্য পুরনো।”

”যত পুরনোই হোক, তাই বলে বালি খসে পড়ার মতো অবস্থা হয়নি। ওপরের ছেলেগুলো কম শব্দ করে? কই, আমরা তো বলতে যাই না।”

”চলো একবার বেরিয়ে ট্রায়াল দিয়ে আসি।”

”খেয়েদেয়ে বেরোব।”

”না, না, আজ বাইরেই খাব। অনেকদিন কচুরি খাইনি, খাওয়াবে?”

রুনু অত্যন্ত খুশি হল। গিরি তার কোনও ইচ্ছা বা সুখের কথা সহজে বলে না। তা হলে রুনুকে আর্থিক চাপের মধ্যে পড়তে হবে তো বটেই, তা ছাড়া ওর কাছ থেকে কিছু চাওয়ার কথা ভাবলেই রুনুর বাবাকে তার মনে পড়ে।

বহুদিন আগে, তখনও ওরা একসঙ্গে বসবাস শুরু করেনি, তখন একদিন কথাপ্রসঙ্গে গিরি বলেছিল, ”তোমাদের বাড়িতে যতবার গেছি, রকে একটা লোককে বসে থাকতে দেখেছি। বরাবর একই ভঙ্গিতে, দেয়ালে ঠেস দিয়ে, উপরের দিকে তাকিয়ে।”

রুনু ইতস্তত করে বলে, ”আমার বাবা। ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। তারপর একটা ব্যাপারে কিছুদিন জেলে ছিলেন।”

গিরি এরপর বহুদিন ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছে, কৌতূহলবশে রুনুকে তার বাবার কথা যদি কোনওভাবে জিজ্ঞাসা করে ফেলে। রুনুও সাবধানে এড়িয়ে চলে সেই সব বিষয়, যা তার বাবাকে টেনে আনতে পারে।

রুনু কখনও তার সামনে শাড়ি বদলায় না। কিন্তু সেদিন সায়া পরেই সে আলমারি থেকে ঘন বেগুনি রঙের সিল্কের শাড়িটা বার করল। ওই কাপড়ের ব্লাউজটাও বার করে, কী ভেবে আবার রেখে দিল।

”রাখলে কেন!”

”পরব?”

গিরি মাথা হেলাল। রুনু নিশ্চয় এখন ব্রেসিয়ার খুলবে না। স্নান এবং শয়ন ছাড়া ওটা সে ত্যাগ করে না। সেই মুহূর্তে গিরি, স্তনদ্বয় দেখার তীব্র ইচ্ছায় বশীভূত হয়ে পড়েছিল। দূর থেকে সে কখনও দেখেনি, কেন না খাটের চৌহদ্দির বাইরে রুনু কখনও উন্মুক্ত থাকেনি।

হয়তো রুনু বুঝতে পেরেছিল। ব্লাউজ খোলার পর কনুই তুলে কাঁধের ওপর দিয়ে হাত দুটি পিঠের দিকে এনে হুকটা খোলার চেষ্টা করতে করতে বলল, ”ঘামে ভেজা পরতে বিশ্রী লাগে।”

”আমি খুলে দি।”

তিন গজ দূরে রুনু। কোনও রকম খুকিপনা না করেই পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়াল। এক পায়ে হালকা তিনটে লাফ দিয়ে গিরি ওর কাছে পৌঁছল। হুকটা খুলে স্ট্র্যাপ দুটো কাঁধ থেকে সরিয়ে দিল। মসৃণভাবে ব্রেসিয়ারটা ঝরে পড়ল মেঝেয়। কাঁধে হাত রেখে ঝুঁকে সে তাকিয়ে রইল। এখনও দৃঢ়, বৃত্তটা পনেরো বছর আগের থেকেও ভরে উঠেছে। গিরি চুমু খেতে শুরু করল, গলায়, ঘাড়ে বাহুতে, বুকে। রুনু চোখ বন্ধ করে অস্ফুট শব্দ করল। দু’হাতে বেড় দিয়ে গিরি ওকে নিজের দেহে চেপে ধরল।

”ফিরে এসে।”

”না এখুনি।”

”আলো নেভাও।”

”না।”

হঠাৎ গিরি ওকে পাঁজাকোলা তুলে নিলে আগের মতো। সেই মুহূর্তে সে ভুলে গেছল তার আর একটা পা নেই। খাটের দিকে হেঁটে যেতে গিয়ে সে টলে পড়ল। প্রচণ্ড শব্দে দু’জনে মেঝেয় আছড়ে পড়তেই কাতরে উঠল রুনু।

অপ্রতিভ গিরি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে খাটের গায়ে হেলানো ক্রাচের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে, ”আশ্চর্য আমি ভুলেই গেছলুম।”

রুনুর কনুইটা ফুলে উঠেছিল। গিরিকে একাই বেরোতে হয়েছিল বরফ কেনার জন্য।

স্কুটারের শব্দ শুনে গিরি রেলিংয়ের মধ্য দিয়ে রাস্তায় তাকাল। দেখতে পেল না। খোসা ছাড়ানোর কাজ শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। আঙুল শুঁকল। সাবান দিয়ে পেঁয়াজের গন্ধটা তোলা দরকার। উঠে দাঁড়াল সে।

মোহন থলি থেকে জিনিসগুলো টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, ”রুনু কোথায়? মাংস এসেছে?”

”রুনু চান করছে। অম্বর এখনও ফেরেনি।”

গিরি দেখল কাগজে মোড়া একটা বোতল আর তেলেভাজার ঠোঙা মোহন বার করছে।

”এটার জন্যই একটু দেরি হয়ে গেল। তোদের পাড়ায় একটা ভালো দোকান নেই। জল আর দুটো গ্লাস নিয়ায়, রাম এনেছি।”

পনেরো বছর গিরি কোনওরকম মদই খায়নি। স্বাদ কেমন, তা প্রায় ভুলেই গেছে। খাওয়ার ইচ্ছা বা দরকারও বোধ করেনি। মাথা নাড়ল সে।

”খাবি না! কেন?”

”দরকার কী, বেশ তো চলে যাচ্ছে।”

মোহন আর কিছু না বলে, প্যাঁচ কাটার জন্য ছিপিটা মোচড়াতে লাগল।

অম্বরকে দরজায় দেখা গেল। হাতের থলিটা ভারী। ভিতরে এসে মোহনের হাতে বোতলটার দিকে বার কয়েক তাকাল। গিরি অস্বস্তি বোধ করে বলল, ”আমার বন্ধু মোহন। অনেক দিনের বন্ধু। ও আজ এখানে খাবে।”

ইচ্ছে করেই বলার ভঙ্গি এবং স্বর গম্ভীর করল যাতে অম্বর বোঝে, এখানে মোহনের গুরুত্ব তার থেকেও বেশি।

”বউদি কোথায়?”

”কলঘরে।”

কুঁজোটা ঘরের টেবিলের উপর। মেঝেয় রাখলে গিরির অসুবিধা হয় নিচু হয়ে জল গড়াতে। মোহন বোতল থেকে গ্লাসে ঢালছে। বহু বছর পর গন্ধটা গিরির নাকে এল।

”দু’জনে খাব বলে বড়ো বোতল কিনলুম।”

জল ঢেলে গ্লাসটাকে প্রায় ভরিয়ে, মোহন সেটা তুলে ধরল।

ঠোঙা থেকে একটা আলুর চপ তুলে গিরি সেটা উঁচু করে ধরে বলল, ”তোর নতুন জীবনের সুখ কামনা করে।”

চপটা মুখে পুরল গিরি। গ্লাসটা ধরে থেকে মোহন অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে।

”রুনুর স্বাস্থ্য কামনা করে।”

এক চুমুকে মোহন গ্লাসের কফি রংটা অর্ধেক নামিয়ে আনল। গিরির মনে হল তরল উত্তাপ তার নিজেরই কণ্ঠনালি থেকে পাকস্থলীর দিকে চুইয়ে নামছে। বাসি গুড়ের স্বাদে মুখ ভরে গেছে। গুলিয়ে উঠল তার পেট।

”রুনু খুব ভালো মেয়ে, বুলিও। তোর সঙ্গে একদিন আলাপ করিয়ে দেব, দেখবি লাখে একটা মেলে কি না সন্দেহ। ছ’মাস হয়ে গেল, এখনও আমি ওকে টাচ করিনি। চুমু পর্যন্ত খাইনি।”

মিথ্যে বলছে। নিজের চারিত্রিক সততা আবিষ্কার করার কৃতিত্ব দেখাতে নয়, দুষ্প্রাপ্য প্রণয় সংগ্রহের সৌভাগ্য জাহির করতেই বানিয়ে বলছে। গিরি আর একটা আলুর চপ ঠোঙা থেকে বেছে নিয়ে বলল, ”টাচ না করে কি সুখ পেয়েছিস?”

মোহনের মুখে রহস্যময়তা ছড়িয়ে পড়ল মুচকি হাসি মারফত। মাথা দুলিয়ে বলল, ”আমাকে ভীষণ বিশ্বাস করে।”

আমিও করেছিলাম। গিরি ওর মাথা দোলানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে করল, লিফটে রাখা লরিটার কথা। তার তলায় দাঁড়িয়ে সে পরীক্ষা করছিল কিং পিন ও টাই রডের মধ্যবর্তী ক্ষয়ে আলগা হয়ে যাওয়া কবজির জোড়গুলো। ড্রাইভারের সিটে বসে তার নির্দেশে স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছিল একজন মেট। সেই সময়ই লরি সমেত লিফটটা নেমে আসে আমচকা। ইঞ্জিনের তলায় লুব্রিকেটিং অয়েলের গামলাটা প্রথমে মাথায় আঘাত করে। গিরি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। তখন লিফটটা ধীরে ধীরে নেমে আসছে। কে একজন চিৎকার করে উঠেছিল, ”বিশ্বাসবাবু বিশ্বাসবাবু, শুয়ে পড়ুন।”

গিরি তা না করে বেরিয়ে আসতে গেছল তলা থেকে। ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু চিন্তা করার ভগ্নাংশ সেকেন্ড সময়ও তখন ছিল না। হয়তো মানুষে-জানোয়ারে কোনও পার্থক্য থাকে না, প্রাণ বাঁচানোর ব্যাপারে। সে পালাতে গেল। কিন্তু দেরি হয়ে গেছল।

এই লোকটা পঞ্চাশের কাছাকাছি, অর্ধেক টাকপড়া, চুলে কলপ দেওয়া, রোগা লোকটা পালাচ্ছে, জীবনের অর্ধেক অংশ ফেলে রেখে। গিরির হঠাৎ মনে হল, ওকে কি ঈর্ষা করছি?

মোহন গ্লাস খালি করে আবার বোতল থেকে ঢালছে। তখন তাজা, ঝকঝকে রুনু সাবানের গন্ধ নিয়ে ঘরে ঢুকল। ভ্রূ কুঞ্চিত করল। গিরির হাতে গ্লাস নেই দেখে আশ্বস্ত হল। চুল থেকেও মিষ্টি গন্ধ বেরোচ্ছে, শ্যাম্পুর। চিরুনি নিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় সে ঠোঙাটা ফাঁক করে দেখল।

”নিয়ে যাও, নিয়ে যাও। আমি খাব না, গিরি তুই?”

মাথা নাড়ল গিরি। শ্যাম্পু নিয়ে যখন কলঘরে যায়, তখন অম্বর বাড়ির বাইরে। ওকে না বলেই শ্যাম্পু ব্যবহার করেছে। হয়তো তোয়ালেও ব্যবহার করে। গত পনেরো বছর রুনুকে চুল নিয়ে শৌখিন হতে দেখা যায়নি।

রুনু ঠোঙাটা তুলে নিল।

”রান্নাঘরে যা গরম। আজ সকাল থেকে গুমোট শুরু হয়েছে।… বিরিয়ানিটা তুমি করবে?”

”না, তুমিই করো। অম্বর তো আছে হেল্প করার জন্য।”

গিরি তাকাল রুনুর মুখের দিকে। ছোটো রান্নাঘর। ঘেঁষাঘেষি করে ওরা বসবে। রুনু নিচু টুলটায়, অম্বর হাতকাটা সাদা গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট পরে চৌকাঠের কাছে উবু হয়ে।

”ভালো কথা, ঠাকুরপো তিনটে থিয়েটারের টিকিট এনেছে, আজকেরই। ওদের ক্লাবের একটা ছেলে অভিনয় করে, মুক্তাঙ্গনে আজ তাদের প্লে।”

অম্বর নয় ঠাকুরপো! গিরির কানে ধরা পড়ল। আগে কখনও ঠাকুরপো বলেনি। সন্দেহ এড়াবার জন্যই এটা বলা।

”আমি যাব না। থিয়েটার আমার ভালো লাগে না।”

”বাঃ টিকিট তা হলে নষ্ট হবে?”

”তোমরা দু’জনে যাও।”

”তা কী করে হয়।”

গিরির মনে হল রুনুর মুখে চাপা উত্তেজনা, সারা সন্ধ্যা পাশাপাশি দু’জন কাটাতে, অন্ধকার অডিটোরিয়ামে দু’জনে মুঠো জড়াজড়ি করতে পারবে।

”না হবার কী আছে? একটা টিকিট বিক্রি করে দিলেই হবে।”

”টিকিট নয়, পাস।”

”কাউকে দিয়ে দেবে। নেবার অনেক লোক পাবে।”

গিরি এক দৃষ্টে রুনুর মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখে হতাশা ছায়া ফেলেছে। মুখ নামিয়ে রুনু অন্যমনস্কের মতো চিরুনি দিয়ে চুলে আঁচড় টানল। গিরির বুকের মধ্যে একদলা বাতাস চাপ দিয়ে তাকে বিষণ্ণ করছে।

”ক’দিন ধরে ভালো ঘুম হচ্ছে না, শরীরটা কেমন লাগছে। ভাবছি সন্ধেবেলায় ঘুমোব।”

মোহন চুপ করে শুনে যাচ্ছে-আর গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে।

”মুক্তাঙ্গনটা সাউথে না? রাসবিহারির মোড়ে তো?”

গিরি মাথা নাড়ল।

কথা না বলে রুনু বেরিয়ে গেল। দুঃখ পেয়েছে। কিন্তু নতুন কোনও জায়গায় রুনুর সঙ্গে যেতে তার অস্বস্তি হয়, বিশেষ করে কয়েক ঘণ্টা বসে থাকতে হলে। একবার মাত্র সে রুনুর অফিসে গিয়েছিল। সকলের নজর প্রথমেই ক্রাচের উপর, তারপর রুনুর মুখে পড়ে। প্রত্যেকের চোখে সে একটি কথাই ফুটে উঠতে দেখেছিল; এমন সুশ্রী মেয়ের কিনা এমন খোঁড়া স্বামী, বেচারা। হয় তার জন্য, নয়তো রুনুর জন্য লোকে করুণা বোধ করে। বাড়ির এক মাইল বৃত্তের মধ্যে কেউ এখন আর তাদের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় না। সকলে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

”বুলি ভীষণ থিয়েটার দেখতে ভালোবাসে। একসঙ্গে বার চারেক আমরা দেখেছি।”

”ওর বয়স কত?”

”বেশি নয়, ডলির থেকে বছর চারেকের বড়ো।”

”তোর তো প্রায় মেয়ের বয়সি।”

মোহন যেন সুখবোধ করল কথাটা শুনে। খালি গ্লাসটা দু’হাতের তেলোয় ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ”বয়সটা কাঁচাই তবে মেনটালি যথেষ্ট ম্যাচিওরড। আমাকে খুব খরচ করতে দেয় না। বাড়ির খোঁজখবর, তোর বউদির কথা, এ-সব জিজ্ঞাসা করে।”

”তুই ওর বাবাকে কত টাকা দিস?”

ওর ত্রস্ত সতর্ক হয়ে ওঠা দেখে গিরি মনে মনে হাসল।

”তার মানে? বুলি সে টাইপের মেয়েই নয়। টাকা কামাবার ধান্দা একদমই নেই। ওর বাবাও খুব সরল, সিম্পল মানুষ।”

”তা হলে তোদের সম্পর্কটা কী দাঁড়াচ্ছে? বুলি চিরকাল এইভাবে বসবাস মেনে নেবে?”

মোহন কুঁজো হয়ে ঝুঁকে গলাটা লম্বা করে বলল, ”তোরাও তো সেইভাবে বসবাস কচ্ছিস আজ প্রায় ষোলো বছর। অবশ্য অ্যাডভানটেজ তোর রয়েছে, পেছনে বউ ছেলেমেয়ে এ-সব নেই।”

গিরি চুপ করে শুধু একদৃষ্টে লাল আঁচিলটার দিকে তাকিয়ে রইল।

”রুনু আর তুই, তাই বলে কি সুখী নোস? খোঁড়া লোককে নিয়ে রুনু পনেরো বছর কাটাল, তুই কি ভাবিস অসুখী হলে ও থাকত? কবে লোক জুটিয়ে নিয়ে ভেগে পড়ত!

হাতটা তুলে প্রচণ্ড একটা চড় কষাল গিরি মনে মনে। পনেরো বছর ধরে অপেক্ষা করে আসছে, পনেরো বছর যথেষ্ট সময়। সব কিছুই ঘটতে পারে এমন অনুমানের, যে-কোনও ধরনের সর্বনাশ সম্ভাবনার কথা ভাবতে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে যাবার পক্ষে প্রচুর সময় সে পেয়েছে। আর সেই ভাবনাটাই মোহন…

সে হাসল।

”কী কষ্ট করে রুনু যে তোকে…”

পুষছে। মোহন উচ্চচারণ করতে পারল না শব্দটা কিন্তু ওটা হওয়া উচিত ”সহ্য করছে।”

”…শ্রদ্ধা হয়। মেয়েমানুষ যে কীসে সুখী হয়, বোঝা বড় শক্ত। বুলিকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলুম।”

ডান দিকে ঝুঁকে, টেবিল থেকে বোতলটা তুলে নিল মোহন। ”বড্ড তাড়াতাড়ি খাচ্ছি, মাসখানেক পর তো। বুলির জন্যই কমিয়ে দিয়েছি। ও পছন্দ করে না।”

গিরি ক্রমশ বিরক্ত বোধ করছে। একটি কুদর্শন অতীত আড়মোড়া ভেঙে পিট পিট করছে তার মাথার মধ্যে। রান্নাঘর, খাওয়ার টেবিল থেকে কথাবার্তার টুকরো ভেসে আসছে। নিচু স্বরে ট্রানজিস্টারে হিন্দি গান হচ্ছে। মাঝে মাঝে পাশের ঘরে পায়ের শব্দ।

”তুই কি একদমই খাবি না?”

”না।”

মোহন গ্লাসটা মুখের কাছে ধরে যেন চিন্তায় ডুবে গেল। বোধহয় চাইছে, কৌতূহলে ছটফট করিয়ে অবশেষে ঘোষণা করবে ওর বুলির বক্তব্যটি। গিরি বাঁ পা ছড়িয়ে মালাইচাকিটা নাড়াতে লাগল হাত দিয়ে।

”রমু পনেরো দিন বিছানায় কী করে থাকবে। ভাবতে পারিস? দুরন্ত ছটফটে ছেলে নয়তো সিরিয়াস দিকে টার্ন নিতে পারে অসুখটা। এ-সব রোগে মারাও যায়।”

”তোর খরচ অনেক বাড়ল।”

”ডাক্তার যা বলল, তাতে মনে হল খুব একটা খরচের ব্যাপার নয়।”

”চিকিৎসার খরচের কথা বলছি না। তোর নিজের সংসার, বুলিকে নিয়ে আর একটা সংসার। রোজগার কত তোর?”

”এ-কথাটা ও তুলেছিল। কারখানা আর গ্যারেজ থেকে যা পাই তাতে আরও দুটো সংসার মোটামুটি চালিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমার পয়েন্টটা হচ্ছে টাকা খেটেখুটে আয় করা কী জন্য, সুখের জন্য নিশ্চয়?”

মোহনের গলা ক্রমশ চড়ে উঠছে। গিরির মনে হল, উত্তেজনাটা শুধু মদের কারণেই নয়। বহু বছর ধরে যে-সব জট ওকে ঘিরে রয়েছে তাই থেকে বেরোবার জন্য নিজেকে শানাচ্ছে আর ভাবছে এবার লণ্ডভণ্ড করে মুক্ত হবে। কিন্তু হওয়া যায় কি!

”টাকা আমি উড়িয়ে যাব, কিছু রাখব না। ওদের জন্য একটা বাড়ি করে দিয়ে যাব আর ব্যবসাটা, ব্যস।”

”বুলির কী হবে? তুই তো বুলির অনেক আগে মরবি, ও তখন করবে কী?”

মোহন বোধহয় এতটা দূর পর্যন্ত ভেবে দেখেনি। থতিয়ে গেল।

”তার এখন অনেক দেরি।”

”কত আর দেরি। বছর পনেরো-কুড়ি তুই বাঁচবি। তখন ওর বয়স কত হবে! দেখতে কেমন?”

মোহনকে আশ্বস্ত দেখাল। গ্লাসে নিশ্চিন্ত মনে চুমুক দিয়ে বলল, ”বুলির একটা চোখ কানা। কেউ ওর দিকে ফিরেও তাকাবে না। ছোটোবেলায় পক্স হয়েছিল। মুখে এখনও দাগ আছে, ও আর মিলোবে না।”

দালানে দু’জনের হালকা হাসি শোনা যাচ্ছে। মোহন দরজার দিকে তাকাল। কিছু দেখতে পাবে না। খাট থেকে রান্নাঘরের দিকটা দেখা যায় না। গিরি কান পেতে শোনার চেষ্টা করল।

”থাক থাক। আর অত সেবা করতে হবে না।.. বারণ করছি না।”

”বড্ড ঘেমে গেছ।”

ঘেমে গেছে রুনু। সেবা করছে অম্বর। কীভাবে? ও কি তোয়ালে দিয়ে মুখ, গলা ঘাড় মুছিয়ে দিচ্ছে! গিরির ইচ্ছে করছে কোনও একটা ছুতোয় উঠে গিয়ে দেখে আসে। অম্বর যতক্ষণ ফ্ল্যাটে থাকে সে নিশ্চিন্ত বোধ করে না। রুনু যতক্ষণ বাইরে থাকে সে নানা নোংরা সন্দেহে ছটফট করে। তখন রুনুর আগের এবং এখনকার কথা, আচরণগুলো অন্য আর এক অর্থ পায়। একমাত্র সে আর রুনু যখন একা থাকে, তখনই এ-সব ভাবনা তার হয় না। কিন্তু কতক্ষণই বা। সব থেকে কষ্ট পায় যখন তার মনে হয় এই সব চিন্তার কোনওটাই অসম্ভব নয়, বেশির ভাগ লোকই রুনু সম্পর্কে এই রকমই ভাবতে পারে হয়তো, ভেবেও থাকে। সে নিজেও তাদের মতো ভাবছে।

”গিরি, এ-সব কথা কিন্তু রুনুকে বলিস না।”

”কেন, বললেই বা।”

”দরকার কী বলার। মেয়েরা এ-সব ব্যাপার খুব অপছন্দ করে। ওরা সব সময় স্ত্রীর পক্ষ নিয়েই বিচার করে তো।”

”রুনু তা করবে না। ও তোকে জানে।”

”জানুক, সে জানা দিয়ে মানুষকে বোঝা যায় না। ও জানে আমি মাতাল লম্পট। ওদের বাড়িতে যেতুম শুধু-ভালো কথা, ওকি তোর সেইটে জানে?”

গিরি সচকিত হল।

”কোনটে?”

”সেই যে একদিন দুপুরে তুই-”

মোহনের ধূর্ত চোখে বেশিক্ষণ চোখ রাখতে পারল না গিরি। অবধারিত দৃষ্টি আঁচিলে সরে গেল। ওখানে একটা গভীর গর্ত নিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসে শুকিয়ে ডেলা হয়ে রয়েছে যেন। ভাবল বলে- হ্যাঁ, রুনু জানে।

”আমি জানি, তুই ওকে সেটা বলতে পারবি না।”

গিরির মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। মোহনের এই নিশ্চিত স্বরটা তার পছন্দ হচ্ছে না। অন্যে কি পারবে বা পারবে না, সেটা ওর ইচ্ছানুসারেই যেন ঠিক হয়ে যাবে। তার সঙ্গে রুনুর বোঝাপড়া কতদূর পর্যন্ত হতে পারে, এটা যেন ও মেপেই রেখেছে।

কিন্তু মোহনের মাপে ভুল নেই। ও ঠিকই অনুমান করেছে গিরি সে-কথাটা বলতে পারেনি। বাকি জীবনটাকে চেটেপুটে নিয়ে মোটামুটি সেটাকে সম্পূর্ণ করতে ব্যগ্র এই লোকটা তাকে একটা পর্যায়ে ফেলে রেখেছে, অক্ষম কাপুরুষদের পর্যায়ে।

”আমি সে-কথা রুনুকে বলেছি।”

”বলতে পারলি!”

”কেন পারব না। লুকিয়ে কী লাভ।”

”সত্যি! আমি কিন্তু রুনুকে জিজ্ঞাসা করব।”

”করিস।”

করবে না। জিজ্ঞাসা করতে সাহস দরকার। ক্রাচে ভর দিয়ে গিরি উঠে দাঁড়াল।

”আমি চানটা করে আসি, তুই একটু বোস।”

শব্দ না করে গিরি ঘর থেকে বেরোল। ওদের অপ্রস্তুত অবস্থায় সে দেখতে চায়।

রুনু রান্নাঘরে টুলে বসে। চুল পিঠে ছড়ানো। এত গরমেও মুখটি তাজা, শ্রান্তির ছাপ নেই। ঠোঁট চেপে রয়েছে। এইমাত্র যেন একটা হাসি সম্পূর্ণ করল। খাওয়ার টেবিলে কনুইয়ে হেলান দিয়ে অম্বর চেয়ারে। টেবিলে একটা রঙিন হাতপাখা। নিশ্চয়ই ওটা তারই। গায়ে গেঞ্জি।

টেবিলের তলায় ওর নগ্ন বাম হাঁটুর উপর ডান পায়ের গোছ দেখতে পেল গিরি। খেলার খাটো প্যান্টটাই পরে আছে। তাকে দেখেই অম্বর ডান পা নামিয়ে নিল।

গিরি সেটা লক্ষের মধ্যে না এনে, রুনুকে শুধু বলল, ”চান করতে যাচ্ছি।”

ছোট্ট কলঘর। চৌবাচ্চচাটা ফুট তিনেক উঁচু। তার গায়ে দেয়ালে ফুট চারেক উঁচুতে জলের কলটা বেরিয়ে। বাঁশের ডোঙা লাগিয়ে কল থেকে চৌবাচ্চচায় জল আসে। প্লাস্টিকের বালতিতে সাবান-জলে ডোবানো কিছু কাপড়। গিরি আঙুল দিয়ে তুলে দেখল রুনুর ব্লাউজ সায়ার নীচে অম্বরের মোজা রুমাল গেঞ্জি।

গিরি আবার মুখের মধ্যে বাসি গুড়ের স্বাদ অনুভব করল। চৌবাচ্চচার পাড়ে বসে, দুটো ক্রাচে বগলের ভার রেখে সে বালতিটার দিকে তাকিয়ে থাকল। কাপড় কাচার গুঁড়ো সাবান অম্বরের। রুনু যেন ক্রমশ অম্বরকেও তার অন্ধকারের গণ্ডির মধ্যে টেনে নিচ্ছে।

রাগ হচ্ছে না তার। কোনও ব্যাপারে কখনও সে রুনুর সঙ্গে রাগারাগি করেনি। বরং সে অবাক হয়েছে, দিনে দিনে অভিভূত হয়েছে ওর আন্তরিকতায়, একটা অকেজো মানুষকে মুখ বুজে সহ্য করায়। এক সময় সে নিজেই ভেবেছিল, রুনু যদি কিছু করে, ও যদি চায় কারুর সঙ্গে…

সাত-আটজনের কথা সে ভেবেছিল। অফিসের সহকর্মী, বিশেষ করে দত্তগুপ্ত। রুনু ওর নামটা প্রায়ই করত। দত্তগুপ্ত মারা গেছে। পাশের ফ্ল্যাটের অঙ্কের অধ্যাপক, সামনের বাড়ির যোগব্যায়ামকারী, বাড়ির নীচে লন্ড্রির মালিক কাপ্তান ছোকরা, এদের মুখ একবার করে ভেসে উঠেছিল।

কিন্তু সব থেকে জ্বালা বোধ করেছিল মোহনের মুখ মনে পড়ায়। কেন মনে হয়েছিল! সব কথাই ও বলে, কিন্তু রুনু সম্পর্কে একবারও কিছু বলেনি গিরিকে। রুনুও কিছু বলে না মোহন সম্পর্কে। নিশ্চয় চেষ্টা করেছিল। হয়তো সফলও হয়েছে। রুনুর মা চেয়েছিল মেয়েকে তার পথেই আনতে। মোহনকে হয়তো সুযোগ দিয়েছিল রুনুকে বাধ্য করাতে।

এ-প্রসঙ্গ তোলা যায় না রুনুর কাছে, মোহনের কাছে। এখন তুললে তো হাস্যকর হয়ে পড়বে। কিন্তু এ-সব কথা এখন কেন মনে হচ্ছে?

”…আমি জানি তুই ওকে সেটা বলতে পারবি না।” ঠিকই, রুনুকে সে বলতে পারেনি। এখন সে-কথা বলার অর্থ হয় না।

একদিন দুপুরে গিরি একা হাজির হয়েছিল রুনুদের বাড়ি। সেই লোকটি বাইরের রকে বসে ছিল দেয়ালে ঠেক দিয়ে। পুরনো ঢিলে ফুলশার্ট বোতাম ছিল না। একদৃষ্টে ফাঁকা আকাশে তাকিয়ে। তখনও সে জানত না লোকটি রুনুরই বাবা।

মোহনের মতোই সে আঙুলের গাঁট দিয়ে দরজায় টোকা দেয়। এই সময় রুনু কলেজে থাকে। কিন্তু কোনও কারণে যদি বাড়ি ফিরে এসে থাকে স্ট্রাইক বা প্রোফেসার আসেনি কিংবা শরীর খারাপের জন্য! ভয় হয়েছিল টোকা দেবার সময়। একটা অজুহাত অবশ্য তৈরি ছিল। যদি রুনুই দরজা খোলে, তা হলে বলবে, ”কাল মোহন একটা চাবি ফেলে গেছে।”

কাল ওরা দু’জন এসেছিল। যথারীতি ‘প্রাইভেট কথা’ বলতে মোহন উঠে গেছল ভিতরের ঘরে। গিরি একা বসে তাকিয়েছিল পর্দার ওধারে ফাঁকা চেয়ারটায়। রুনু ঘরে ছিল না। কথা প্রসঙ্গে ওর মা জানিয়ে দিয়েছিল, রুনু একটা টিউশনি পেয়েছে।

পুরনো ভ্যাপসা, ম্লান ঘরটা হঠাৎ গিরিকে কোণঠাসা করে ফেলে। অন্যান্য দিন আর একটি মানুষের উপস্থিতি তাকে সজাগ রাখত। বিষণ্ণতার মতোই একটা অনুভব, নিঃসঙ্গ ঘরে সে বোধ করতে শুরু করে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছল ভিতরের ঘরটার দিকে।

দরজা বন্ধ ছিল। সে আশা করেছিল, অশ্লীল বইয়ে পড়া, নানাবিধ শব্দের মতো কিছু কিছু শব্দ শুনতে পাবে। হতাশ হয়ে সে বাইরের ঘরটায় ফিরে আসে। নৈঃশব্দ্যে ধীরে ধীরে তাকে পুরুষোচিত উত্তেজনায় আক্রান্ত করে।

ফেরার সময় সে মোহনকে বলে, ”বড্ড দেরি করিস, অতক্ষণ লাগে কেন?”

”কোথায় দেরি করেছি? বরং আজ তো তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। তোর কি বিরক্তি লাগে?”

”লাগবে না!”

”তোর কথা আজ বলছিল, এসে শুধু শুধু বসে থাকে ছেলেটা। আমি বললুম, এখনও এ-সব করে-টরেনি, লজ্জা পাচ্ছে। বলল, একা আসতে বলুন না। যাস তো চলে যা একদিন। টাকা দশেকের তো ব্যাপার, দুপুর-টুপুরেই যাস।”

গিরি পরদিন দুপুরেই যায়।

ভিতরের ঘরে সে দেয়ালে একটা যুবতী স্ত্রীলোকের কোলে একটি শিশুর ছবি দেখেছিল। প্যান্ট খুলতে খুলতে সে ছবি থেকে চোখটা সরিয়ে নেয়। স্ত্রীলোকটি তার সামনেই নিজেকে শিথিল করে দিয়ে খাটে শুয়ে রয়েছে। কিন্তু শিশুটি কি রুনু?

কোনওদিনই সে রুনুকে জিজ্ঞাসা করে কৌতূহলের নিরসন ঘটাতে পারেনি। ভিতরের ঘরের কোনও কিছুর উল্লেখ করলে তার থেকে একটি কথাই স্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে আসবে, যেটা সে রুনুকে জানাতে চায় না। একবার মনে হয়েছিল রুনুর মাকে বলে, তার এই আসার কথা কাউকে যেন না জানায়। লজ্জায় বলতে পারেনি। রুনুর মা তখন বিছানা ঠিক করায় ব্যস্ত। এই বিছানাতেই রাত্রে রুনুও মার সঙ্গে হয়তো শোয়।

”কী হল, এত দেরি হচ্ছে কেন?”

বন্ধ কলঘরের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে রুনু। উৎকণ্ঠিত, শঙ্কিত স্বর।

গিরি চৌবাচ্চচার পাড়ে বসেই চেঁচিয়ে বলল, ”ঠিক আছি। ভয়ের কিছু নেই।”

গিরি একবার কলঘরের শ্যাওলায় ক্রাচ সমেত পিছলে পড়ে কোমরে চোট পেয়েছিল। রুনু ওকে তুলেছিল। সেই থেকে প্রতিদিন কলঘরের মেঝে, রুনু ঝাঁটা দিয়ে একবার ঘষবেই।

”এতক্ষণ ধরে কী করছ?… মোহনবাবু চলে গেলেন এইমাত্র।”

”কেন?”

”বললেন, ছেলেটা হয়তো হুটোপাটি করছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে ওকে শোয়াতে হবে। কিছুতেই আর বসলেন না।”

স্নান সেরে ঘরে এসে গিরি দেখল মোহন আধ ভরতি অবস্থায় বোতলটা ফেলে রেখে গেছে।

 চার

রুনু যখনই বাইরে যায় গিরি তখন বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। দ্রুত পায়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ অভিমুখে যেতে যেতে রাস্তা পার হবার আগে অন্তত একবার ও ফিরে তাকাবেই বারান্দায় দাঁড়ানো গিরির দিকে। সেই মুহূর্তে প্রতিবারই বুকটা ধক করে ওঠে। হয়তো বিদায় নিচ্ছে। এই বোধহয় শেষ বারের জন্য তাকে দেখে নিচ্ছে। আর ফিরবে না।

রাস্তা পেরিয়ে বাস স্টপ বোর্ড আঁটা পোস্টের সামনে দাঁড়াবে না। একটু সরে দাঁড়ায় যেখানে গিরি তাকে দেখতে পাবে না। ও চলে যাবার পর গিরি কিছুক্ষণ অসহায় বোধ করে। মুহ্যমান হয়ে বসে থাকে। আবার বিকেলে বারান্দায় দাঁড়ায় রুনুর ফেরার সময়।

সেই সময় তার দোতলার ফ্ল্যাটের বারান্দায়ও দাঁড়ান নতুন বউটি। তার স্বামীরও অফিস থেকে ফেরার সময় হয়েছে। গিরি ওকে বারান্দায় দেখলেই পিছিয়ে আসে। স্ত্রী অফিস থেকে ফিরবে তাই স্বামী অপেক্ষা করছে এটা ভাবলেই সে কুঁকড়ে যায়। ব্যাপারটা ঠিক উলটো হওয়াই রীতি। রুনু প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় বেরোয়, বাসে অফিসে রাস্তায় দিনের অনেকটা সময় অপরিচিত একটা জগতে কাটিয়ে ফিরে আসে। কত লোকের সঙ্গে কথাবার্তা, কাজ, গল্প করে যাদের গিরি চেনে না, দেখেনি বা শুধু নামটুকু মাত্র জানে। রুনুর সেই জগতে তার কোনও ভূমিকা নেই, অংশ নেই।

এ-জন্য তার কোনও ঈর্ষা হয় না। শুধু তার ভয়ংকর অসহ্য মনে হয় রুনুর অপসৃয়মাণ দেহটিকে। ওর অস্তিত্ব, প্রয়োজনীয়তা তখন সে তীব্রভাবে অনুভব করে।

এই মুহূর্তে রুনু আর অম্বর সিঁড়ি দিয়ে নামছে। দু’জোড়া পায়ের শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসছে। দরজাটা বন্ধ করতে করতে গিরির মনে হল পনেরো বছর আগে রুনুই এইভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকত। কান পেতে তার পায়ের শব্দ শুনত, তারপর ছুটে আসত বারান্দায়। বুকটা রেলিংয়ের বাইরে রেখে ঝুঁকে দাঁড়াত।

ওরা থিয়েটার দেখতে যাচ্ছে। গিরি ধীরে বারান্দায় দরজার কাছে এসে পর্দাটা একটুখানি সরিয়ে রাস্তায় চোখ রাখল। রুনু তাকে আবার অনুরোধ করেছিল। অম্বরও তাকে একবার বলেছিল।

গিরি একই উত্তর দিয়েছে, ”থিয়েটার আমার ভালো লাগে না। কিন্তু আমার ভালো লাগে না বলে তোমরা কেন যাবে না?”

”না আমি যাব না।”

রুনু দুই মুঠো কোলে রেখে খাটে বসে থাকে অবাধ্য মেয়ের মতো।

পাশের ঘরে অম্বরের শিস শোনা যাচ্ছে। গিরি লক্ষ করেছে, গায়ে পাউডার দেবার বা জুতোর ফিতে বাঁধার সময় ও শিস দেয়। বেরোবার জন্য ও তৈরি হচ্ছে। গিরি কঠিন, বিরক্তি মাখানো স্বরে বলল :

”বসে রইলে কেন?”

দরজার বাইরে অম্বরের জুতোর শব্দ শোনা গেল, ”বউদি আমি কিন্তু রেডি।”

রুনু ফিসফিস করে বলল, ”আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।”

”তোমার জন্য পাস আনল…”

”আমি আনতে বলিনি।”

”না বললেই বা। তোমার কথা ভেবেই তো এনেছে।”

রুনু একদৃষ্টে গিরির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ”আমি যাই, এটা তুমি চাও না।”

”কে বলল চাই না?”

”আমি বুঝতে পারি।”

গিরি সচকিত এবং সাবধানী স্বরে বলল, ”কী বুঝতে পারো?”

রুনু কথা না বলে খাট থেকে উঠে পড়ল। দেরাজ খুলে শাড়ি বার করল। বেলেরপানা রঙের তাঁতের শাড়ি, যেটা একদিন সারা দুপুর ধরে গিরি রিপু করেছিল।

গিরি বারান্দায় বেরিয়ে এল। অম্বর বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। গিরিকে দেখেই সে ব্যস্ততার ভঙ্গিতে বলল, ”দাদা, আপনার চেনা ইলেকট্রিকের কোনও দোকান আছে? একটা পাখা ভাড়া না করলে আর চলছে না।”

”সিলিং ফ্যান?”

”হ্যাঁ। টেবিল ফ্যানে ঠিক করে সব জায়গায় হাওয়া পাওয়া যায় না। আপনি একটু দেখবেন?”

গিরি ঘাড় নাড়ল।

”আপনি থিয়েটারে যাবেন না?”

না প্রশ্ন না অনুযোগ। বারবার একই কথার জবাব একইভাবে দিতে হবে ভেবে গিরি বিরক্তি বোধ করে বলল, ”ফ্ল্যাটগুলোয় আজকাল চুরি হচ্ছে। একদম খালি ফেলে রেখে যাওয়া ঠিক হবে না।”

”শুনেছি বটে। শিক ভেঙে ঢুকেছিল আমাদের ফ্ল্যাটে।”

নিশ্চয়ই রুনুই বলেছে। গিরি মুখ ফিরিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে গাড়ি চলাচল লক্ষ করতে লাগল।

”কই ঠাকুরপো, চলো।”

গিরি মুখ ফিরিয়ে তাকালও না। শুধু চোখের কিনার দিয়ে হলুদ রঙের একটা ঝলক দেখতে পেল বারান্দার দরজার কাছে।

বেরিয়ে যাবার সময় রুনুই চেঁচিয়ে বলল, দরজাটা বন্ধ করে দিতে।

বন্ধ করতে আসার সময় দরজার পাশেই জানলাটায় বসানো শিকটার দিকে তাকাল। কয়লা ভাঙা লোহাটা জানলায় হেলান দিয়ে রাখা থাকে, সেটা নেই। রুনু তা হলে রান্নাঘরে নিয়ে রেখেছে।

এরপর সে ধীরে ঘরে ঢুকে বারান্দার দরজার কাছে এসে পর্দাটা একটুখানি সরিয়ে রাস্তায় চোখ রাখল। ওরা দু’জন পাশাপাশি চলেছে। রুনু একবারও পিছন ফিরে বারান্দার দিকে তাকাচ্ছে না। অম্বর দু’হাত নাড়ল কিছু একটা বুঝিয়ে বলতে। রুনু মাথাটা হেলাল। দু’জন খুব কাছাকাছি হয়ে হাঁটছে। অম্বরের কনুই বোধহয় রুনুর বাহুতে লাগছে।

রাস্তা পার হবার জন্য ওরা দাঁড়িয়ে। অম্বর কী একটা বলতেই রুনু ওর মুখের দিকে তাকাল। অম্বর হাত তুলে ট্যাক্সি থামাল। রুনু ইতস্তত করছে। অম্বর দরজা খুলে কী যেন বলল। তারপর কনুই ধরে আলতো আকর্ষণ করতেই রুনু ট্যাক্সিতে উঠল।

গিরি অবসাদ বোধ করল। রুনুকে নিয়ে প্রথম ট্যাক্সিতে ওঠা মনে পড়ছে। তখন ওদের আলাপ সদ্য আপনি থেকে তুমি হয়েছে। ইউনিভার্সালের কাছে বাস স্টপে প্রতি শনিবার রুনু এসে দাঁড়িয়ে থাকত। মোহনকে এড়িয়ে সে আগেই বেরিয়ে পড়ত। ওরা হাঁটত, কোনওদিন কার্জন পার্কে, কখনও আউট্রাম ঘাটে, কখনও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানে। সন্ধ্যা হবার আগেই রুনুকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হত। গিরি বাদাম কিনত, রুনু খোসা ভেঙে দানাগুলো ওর হাতে তুলে দিত। মাঝে মাঝে গিরি আঙুলগুলো চেপে ধরত। কখনও কখনও পারত না। রুনু আগে বুঝে নিয়ে দানাগুলো তালুর উপর ফেলেই হাতটা সরিয়ে নিত।

এক শনিবার গিরি হঠাৎ একটা খালি ট্যাক্সি থামিয়ে বলল, ”চলো লেকে যাই।”

”বাসে করেই তো যাওয়া যায়।”

”তা যায়, কিন্তু আজ যাব না?”

”কেন পয়সা কি কামড়াচ্ছে?”

ট্যাক্সিওয়ালা ভ্রূ কুঁচকে ওদের লক্ষ করছে দেখে গিরি দরজা খুলে ওর কনুই ধরে ফিসফিস করে বলল, ”চটপট মোহন আসছে।”

ব্যস্ত হয়ে ট্যাক্সিতে ঢোকার সময় রুনুর মাথাটা ঠুকে গেছল। রুনুর একমাত্র ভয় ছিল মোহনকে। যদি মাকে বলে দেয়।

এইমাত্র অম্বর ট্যাক্সির দরজা খুলে কী বলল? গিরি অধৈর্য হয়ে কথাটা তৈরি করার চেষ্টা করতে লাগল।

”ওঠো ওঠো, বারান্দা থেকে দেখতে পাবে না।”

কিংবা, ”বারান্দায় কেউ নেই চটপট উঠে পড়ো।”

কিংবা ”দেখছে তো দেখুক, ওঠো।”

অম্বর রুক্ষ অমার্জিত। হয়তো ‘ল্যাংড়া’ শব্দটাও ব্যবহার করে থাকতে পারে। পাশের ফ্ল্যাটের তাসের আড্ডায় তর্কাতর্কি চলছে। রাস্তায় বাচ্চচারা চিৎকার করে খেলা করছে। সামনের বাড়ির যোগব্যায়ামবীরের স্থূলাঙ্গী স্ত্রী গিরির নীচের ফ্ল্যাটের গিন্নির সঙ্গে চেঁচিয়ে গল্প করে যাচ্ছে।

শব্দ আর শব্দ। মাথার মধ্যে শব্দের আঘাতে দুমড়ে যাচ্ছে অতীত। অবাস্তব চেহারা নিচ্ছে। গিরি ভেবে উঠতে পারছে না, কী করে সে তার দুটি পা নিয়ে অসম্ভব-প্রায় সেই অদ্ভুত জীবনটার মধ্যে বাস করে এসেছে। দুঃখ পাচ্ছে না, তিক্ততা বোধ করছে না, শুধু বিস্ময় লাগছে এখন। পনেরোটা বছর এক পায়ে কাটাল। তারা দু’জন তবু একসঙ্গে, এক ঘরে রয়ে গেছে। এই পনেরোটা বছর সে অপেক্ষা করেছে প্রতিদিন একটি কোনও অমোঘের জন্য।

এবং সেই অবশ্যম্ভাবী এইবার আসছে। অত্যন্ত ধৈর্যবান সে। সারাজীবনই ধৈর্য ধরে রয়েছে। সে জানে কীভাবে অপেক্ষা করতে হয়, প্রতিদিনই সে করে। রুনু কি সত্যিই সুখী এই পনেরো বছর? চিন্তাটা তাকে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চিবিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার মিনিট পঙ্গুর সঙ্গে কাটিয়ে কেউ কি হাঁফিয়ে পড়বে না? নিশ্চয় পড়বে।

মোহন কি পড়েছে?

গিরির চিন্তা মোহনকে কেন্দ্র করে পাক দিয়ে উঠতেই তার মনে পড়ল কয়লা ভাঙা লোহাটা কোথায়?

রান্নাঘরে এল গিরি। ডেকচির ঢাকা খুলে দেখল বিরিয়ানির প্রায় অর্ধেক রয়েছে। নোংরা, অগোছালো করে রান্নাঘর রুনু কখনও রাখে না। সে সপ্রশংস চোখে সার দিয়ে রাখা কৌটো এবং শিশিগুলোকে দেখল। বাসনগুলো ঝকঝকে। খেয়ে উঠে দুপুরেই মেজে রেখেছে রুনু।

লোহাটা রান্নাঘরে নেই। দালানের কোথাও নেই। কলঘরের গলিটা পরিষ্কার। জুতোর র‌্যাকে থাকা সম্ভব নয়। কলঘরের মধ্যেও উঁকি দিল সে। প্লাস্টিকের বালতিটা বোধহয় ফাটা। সাবান জল চুঁইয়ে মেঝে দিয়ে নর্দমায় গেছে।

গিরি বিব্রত হয়ে পড়ল। যখন তার দুটি পা ছিল, তখনকার একমাত্র অবশিষ্ট জিনিস এই লোহাটি। ওটার জন্য তার অস্বস্তি এবং দুর্বলতা, উভয়ই আছে। রুনুকে সে বলেছিল,পুরনো লোহার দোকান থেকে দু’টাকায় কিনে এনেছে। মিথ্যা কথা সে অনেক বলেছে, কিন্তু চুরি এই প্রথম।

মোহনই তাকে চুরি করতে বলে। কীভাবে গেটের দারোয়ানের সামনে দিয়ে বেরোতে হবে দেখিয়েও দেয়। মোহনই জানে একটা দুপুরে সে রুনুদের বাড়িতে গেছল। এই দুটি কথা রুনুকে কখনও গিরি জানায়নি। রুনুকেও সে জিজ্ঞাসা করতে পারেনি মোহনের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক ছিল কি না; রুনুর মা নিখোঁজ হবার পর মাস দুয়েক রুনু আর তার বাবার সংসারটি কীভাবে চলেছিল গিরি আজও তা জানে না। এটি ওর জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি সময় যেখানে ও কখনও ঢোকে না। সযত্নে পাহারা দিয়ে গেছে, যাচ্ছে কৌতূহলীদের কাছ থেকে। রুনু তাকে এ সম্পর্কে একটি কথাও বলেনি, এমনকী মার নিখোঁজ হওয়ার কথাও চেপে গেছল। সেই দুপুরের পর থেকে গিরি আর ওদের বাড়ি যায়নি। যাতায়াত থাকলে নিশ্চয়ই জানতে পারত।

জানত মোহন। সে-ও চেপে গেছল। কেন? শুধু চাপাচাপি আর গোপনীয়তা রক্ষা। আজও তার জের টেনে চলতে হচ্ছে। রুনুর মার রোজগারেই তাদের চলত। তার অবর্তমানে দুটি মাস কীভাবে চলেছিল, কে চালিয়েছিল? মোহন!

বারান্দায় চেয়ারে বসে গিরি রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে ব্যথা অনুভব করল। দিনের আলো পড়ে আসছে। দুর্বিষহ চিন্তাগুলোকে নিয়ে নাড়াচাড়া ছাড়া আর কোনও কাজ তার নেই।

অম্বরের পাখা ভাড়ার ব্যাপারটা আছে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতেই পাশাপাশি দুটো দোকান। বৃহস্পতি না রবিবারে বন্ধ থাকে? সিলিংয়ে হুকের দুটো ঘরেই লোহার ‘এস’ ঝুলছে। এই ফ্ল্যাটে আগে যারা থাকত তাদের পাখা ছিল।

গিরি দরজায় তালা লাগিয়ে অভ্যাসমতো টানল। সিঁড়ি দিয়ে সন্তর্পণে প্রতিবারই নামে। প্রথম কয়েকদিন রুনু পাশে পাশে নামত। বাহুটা শক্ত করে ধরে থাকত। টাল হারিয়ে তার একশো চৌদ্দ পাউন্ড ওজনের শরীরটা উলটে পড়লে যেন ও সোজা করে রাখতে পারবে!

হাসি পেল গিরির এবং একতলার সদর দরজায় দাঁড়িয়ে হাসিটা মুখে রেখেই সামনে তাকাল।

রুনু আসছে। গিরিকে দেখতে পেয়েই দূর থেকেই লাজুক হাসল। মুখ নামিয়ে চলার বেগ দ্রুত করল।

”ভীষণ মাথা ধরেছে, তাই ফিরে এলাম।”

গিরি পিট পিট করে তাকিয়ে হাসছে।

বিব্রত হয়ে রুনু বলল, ”হাসছ যে?”

”চলো একটু হাঁটি।”

ওরা একবারও থিয়েটারের কথা তুলল না। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর মোড়ে পৌঁছে বাঁ দিকে ঘুরল।

”ইলেকট্রিকের দোকানে যাব ভেবেছিলুম।”

”এখনই যাবে না ফেরার সময়?”

”বন্ধ হয়ে যেতে পারে।”

দুটি দোকানের একটি খোলা। কাউন্টারের ওধারে মালিকের চেয়ারটি শূন্য। এধারে দুটি মিস্ত্রিগোছের লোক গল্পে ব্যস্ত। তাদেরই একজন জিজ্ঞাসু চোখে গিরির দিকে তাকাল।

”পাখা ভাড়া পাওয়া যাবে? সিলিং ফ্যান।”

”একটু অপেক্ষা করুন, মালিক একশো টাকার নোট ভাঙাতে গেছে।”

লোক দুটি গল্প করছে। গিরি দাঁড়িয়ে রইল।

”বাচ্চচাটাই ছিল পাখার তলায়, অথচ একদম আঁচড় লাগেনি। মায়ের মাথাটাই থেঁতলে গেছে।”

”আজেবাজে নতুন ছেলে দিয়ে এইসব পাখা লাগানোর কাজ করলে এইরকমই হয়। সহজ কাজ, কিন্তু দ্যাখো একটা লোকের জীবন চলে গেল সামান্য ভুলে। একটা পেরেকও যদি বুদ্ধি করে গর্তে ঢুকিয়ে রাখত তা হলে লোহাটা সরত না, পাখাটাও পড়ত না। পুরনো আমলের পাখায় এই এক ফ্যাচাং। এখনকার পাখা ধরো আর ঝুলিয়ে দাও।” গিরি কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল শুনতে শুনতে। জিজ্ঞাসা করল, ”পাখা খুলে পড়ে গেছে?”

”লাগিয়ে দিয়েছে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পড়েছে। তলায় বাচ্চচা নিয়ে মা শুয়েছিল, সেকেলে ক্লাইড ফ্যানের অন্তত দশ কিলো ওজনের হাঁড়িটা একেবারে মায়ের মাথায়।”

লোকটি দু’হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরল।

”কী করে হল?”

”বরাতে ছিল তাই হল। পাখাটা ঝোলে যে লোহাটার ভরে সেটা সরে গেলেই পাখা পড়বে। যাতে না সরে সে-জন্য পিন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আর নড়াচড়া করতে পারে না। পিন ঢোকাতে ভুলে গেছল, কি হয়তো ছিল না। এইভাবেই তো আজেবাজে দোকানের মিস্ত্রিরা কাজ করে।”

মালিকও এসে গেছে।

”পাখা ভাড়া পাওয়া যাবে, সিলিং ফ্যান?”

”কবে চাই?”

”আজ বা কাল।”

”কাল দুপুরে লোক যাবে। মাসে দশ টাকা ভাড়া।”

”ঠিক আছে, বাড়ির ঠিকানাটা লিখে নিন।”

লোকটি হাত তুলে বলল, ”জানি। আপনাদের দোতলার ফ্ল্যাটে দিন দশ আগেই তো পাখা দিলুম। আপনি তো তিনতলায় থাকেন।”

ইতস্তত করে রুনু বলল, ”একজন ভালো লোক পাঠাবেন।”

”না না, কোনও ভয় নেই। এইসব ঘটনা লাখে একটা হয়।”

হাসি মুখেই লোকটি কঠিন চোখে লোক দুটির দিকে তাকাল। দুটো কাজ একসঙ্গে সম্পন্ন করতে হাসতে ও ধমকাতে।

”কী হচ্ছে, মুখটা অমন কচ্ছ কেন?

গিরি দু’ধারে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ”তুমি লক্ষ করোনি লোকটা কেমন করল?”

”শুনতে বিচ্ছিরি লাগছিল।”

রাস্তা পার হয়ে ওরা উত্তর দিকে এগোতে থাকল। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর মাঝখানে কালী মন্দির। তার পুবের রাস্তাটাকে দেখিয়ে গিরি বলল, ”এটাকে ছোটোবেলায় আমরা রাজা রাস্তা বলতাম। রাস্তার দু’ধারেই শোভাবাজার রাজবাড়ি। পুজোয় এখানে মেলা বসত।”

”এখন আর বসে না বোধ হয়।”

”একটা দুটো নাগরদোলা হয়তো বসে। ছবি তোলার দোকানগুলো আর কোথাও বোধহয় বসে না। এখন বড্ড বেশি ছবির দোকান হয়ে গেছে, ক্যামেরাও লোকের হাতে হাতে।”

”আমাদের একটাও ছবি নেই।”

”তোমার ছোটোবেলার ছবি?”

রুনু মাথা নাড়ল। ছিল, ভিতরের ঘরে মায়ের কোলেচড়া ছবি। গিরি সেটার উল্লেখ করতে পারল না। রাজা রাস্তার দিকে মুখ ফিরিয়ে সে চলতে লাগল।

একবার পুজোর সময় সে ম্যাজিকওলার তাঁবুতে ঢুকেছিল দু’পয়সার টিকিট কেটে। স্টেজের সামনে শতরঞ্চিতে বসেছিল। ম্যাজিক চলার মধ্যেই সে দেখল এক মাঝবয়সি স্ত্রীলোক তাঁবুতে ঢুকে দর্শকদের পাশ দিয়ে স্টেজের কাছে এসে জুতো খুলছে। স্টেজ থেকেই ম্যাজিসিয়ান খেলা দেখাতে দেখাতে বলল, ”দেরি হল যে?”

স্ত্রীলোকটির মুখে রং মাখা। চুলটা ফাঁপিয়ে কান ঢেকে রাখা, কানে মস্ত কানপাশা। জুতো খুলতে খুলতে লাজুক হাসল মাত্র। স্টেজের পাশের পর্দাটা তুলে ভিতরে ঢুকল আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্টেজে ঢুকে নাচতে শুরু করল। মিনিট তিন-চার নেচেই সে আবার স্টেজের পাশে চলে গেল। গিরি ছেঁড়া পর্দাটার মধ্য দিয়ে তখন দেখল স্ত্রীলোকটি সিগারেট খাচ্ছে।

একটা মাঠ ছিল তার পিছনে পুকুর। বিরাট বাড়িটা দেখে তার মনে পড়ল, ছোটোবেলায় কর্পোরেশনের অবৈতনিক স্কুলে পড়ার সময়, সে এই মাঠে আসত। পুকুরে রাজহাঁস চরত। ফুটবল খেলা হত মাঠে। গোলের পিছনে দাঁড়াতে তার ভালো লাগত। একবার প্রচণ্ড শট তার মাথায় লেগে মাঠে বল ফিরে যায়। লোকেরা হো হো করে হেসে উঠেছিল। গিরির মাথা ঝনঝন করছিল অনেকক্ষণ।

বিশেষ কিছু কথা ওরা বলল না। মন্থর গতিতে হাঁটতে হাঁটতে ওরা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর সঙ্গেই বাঁক নিল পুবে শ্যামবাজারের দিকে। কাঠগোলায় একটা আলনা তৈরি হচ্ছে। রুনু দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ”একটা মিটসেফ আমাদের দরকার।”

এরপর তারা শ্যামস্কোয়্যার পার হয়ে গেল। রুনুর কলেজের সামনে আসতেই গিরি বলল, ”তোমার জন্য প্রথম দিন দাঁড়িয়েছিলাম এই বাস স্টপে, তখন একটা মেয়ে এসে আমার নাম জিজ্ঞাসা করেছিল।”

”বাণীকে পাঠিয়েছিলাম, তোমাকে বলতে মিনিট পনেরো আমার দেরি হবে। এস এন বি-যে কখন ক্লাস থেকে বেরোবে কেউ জানে না। হঠাৎ বাণীকে যে মনে পড়ল?”

”এমনিই। এক একটা জায়গায় এলে অদ্ভুত সব ঘটনা, দৃশ্য, মানুষের কথা মনে পড়ে। তোমার মনে পড়ে না?”

রুনু মাথাটা হেলাল।

গিরি অপেক্ষা করল রুনু কিছু বলবে মনে-পড়া সম্পর্কে। কিন্তু রুনু নীরবে চলেছে মনে পড়ার মতো ঘটনা বা মানুষের কথা হয়তো বলতে চায় না। কিংবা এখন যা দেখেছে তা তাকে কিছু মনে পড়াচ্ছে না।

”শনিঠাকুরের মন্দির দেখলে আমার কেমন গা ছমছম করে। মা প্রত্যেক শনিবার, আমাদের পাড়ার শনি মন্দিরে সন্ধ্যাবেলায় গিয়ে বসে থাকত। বাবা মারা যাচ্ছেন, তখনও বসে। আমি ছুটে গিয়ে খবর দিলাম মাকে, কিছুতেই বিশ্বাস করেনি। না, মরতে পারেন না। বাজে কথা বলছিস। কী অসম্ভব যে ঠাকুরের ওপর বিশ্বাস, দেখে আমার ভয় করেছিল।”

”তোমার বোধ হয় ক্লান্তি লাগছে, ফিরবে?”

”না না, কিচ্ছু লাগছে না।”

”বগলে আর ব্যথা হয় না?”

গিরি মাথা নাড়ল। রাস্তায়, দোকানে আলো জ্বলে উঠেছে। রাস্তায় এখন প্রচণ্ড ভিড়। ফুটপাথে ক্রমশই ভাঙা, গর্ত, ঢিপি বাড়ছে। চলতে অসুবিধা হচ্ছে গিরির। ওরা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পার হল।

”এবার গলি দিয়ে ফেরা যাক।”

”এদিকের গলি আমি ভালো চিনি না। এদিকটা কি শ্যামপুকুরের মধ্যে?”

”হ্যাঁ।”

”বাণীরা এদিকেই থাকত। খুব গরিব ছিল। আমরা দু’জনেই ভীষণ বন্ধু ছিলাম। কিন্তু কখনও বাড়ি নিয়ে যেত না। তোমার কথা ওকে সব বলতুম।”

”কী বলতে?”

”সে-সব কি মনে আছে?”

”বলো না কী বলতে?”

”কী আবার বলতুম, মেয়েরা যা বলে থাকে ওই সময় তাই।”

গিরি চুপ করে রইল। এখন রাস্তায় আলো কম, লোকের চলাচলও; এখানে একটা মাঠ ছিল, প্রতি বছর লক্ষ্মীপুজোয় জলসা হত। মাঠ খুঁজে পাচ্ছে না সে।

”বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে তোমার সঙ্গে প্রথম কথা বলার গল্পটা বাণীকে করেছিলাম।”

”সম্মেলনে নয়, বাইরে রাস্তায়। আমিই প্রথম কথা বলি।”

”তাই বলেছিলাম। বাসের জন্য অপেক্ষা করছি বাস আসছে, কিন্তু ভিড়ে উঠতে পারছি না। তুমিও উঠতে পারছিলে না…”

”এটা ঠিক বলোনি। আমি উঠে যেতে পারতাম। তোমার সঙ্গে উঠব বলেই বাস ছেড়ে দিচ্ছিলাম।”

”সেটা ও বুঝে নিয়েছিল। যে লোক রোজ খুঁজে খুঁজে আমার পাশে কি পিছনে এসে বসে, সে যে ভান করছিল, এটা যে শুনবে সেই বুঝে নেবে।”

”হেঁটে বাড়ি ফেরার কথা বলামাত্র তুমি রাজি হয়ে গেলে, এটা শুনে ও কিছু বলেনি?”

”বলামাত্র মানে!”

”তা নয় তো কী? দু’মিনিটের বেশি আমাকে বলতে হয়নি।”

”আমি ওকে বলেছিলাম, বলার সঙ্গে সঙ্গেই।”

”মেয়েরা একটা বয়সে বাহাদুরি নেবার জন্য মিথ্যে কথা বলে।”

রুনু হাসল। একটা বয়সে না সব বয়সে! ও আজও কি মিথ্যা বলে যাচ্ছে না? চোখের কোণ থেকে গিরি দেখল ওর মুখে হাসির রেশ লেগে আছে। একটু মন্থর হল সে রুনুর গোটা শরীরটা দেখার জন্য। কলেজে পড়ার সময় রুনুকে এত সুশ্রী মনে হত না। হয়তো তখনও তা ছিলও না। গিরি তাই নিয়ে মাথা ঘামায়নি। রুনু একটি মেয়ে এটাই যথেষ্ট ছিল। স্তন বা নিতম্ব আছে কি না বোঝাই যেত না। ও যে এত বদলে গেছে, এটা টের পেতে গিরির অনেক বছর সময় লেগেছে। প্রকৃতপক্ষে কয়েক মাস আগে সে আবিষ্কার করেছে। এখন আর ওকে লাজুক, অভিমানী দেখায় না। বরং ধীর সংযত, কোমল প্রকৃতির ভদ্রমহিলা রূপে ওকে ভাবা যায়।

রাস্তার আধখানা রঙিন কাপড়ে ঘিরে নিমন্ত্রিতদের জন্য চেয়ার পাতা হয়েছে। বিয়ে অথবা বউভাত। ওরা তার পাশ দিয়ে যাবার সময় বাড়িটার ভিতর দিকে তাকাল। বিয়ে। মখমলের তাকিয়া ঠেস দিয়ে একটি যুবক বসে। কপালে চন্দন, গরদের পাঞ্জাবি পরা। সামনে ফুলদানিতে তোড়া। একটি ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে। বরটি অত্যন্ত গম্ভীর হতে চাইছে ব্যক্তিত্ব ফোটাবার জন্য।”

”দেখেছ?”

”হ্যাঁ।”

আর কিছু বলার দরকার নেই। দৃশ্যটা দু’জনেই মনের মধ্যে ধরে রেখেছে। ওরা স্মৃতির অজস্র খোপের একটার মধ্যে দৃশ্যটাকে ভরে রাখল। পরে যদি দরকার হয়, আজকের সন্ধ্যার কথা যদি মনে করতে হয় তা হলে খোপ থেকে এটা বার করলেই সব মনে পড়ে যাবে। প্রতিদিনের এ-রকম অজস্র টুকরো অপ্রয়োজনীয় কথা, ইঙ্গিত, ভঙ্গি, গিরির স্মৃতিতে ভরা আছে।

রুনুর বাবার রকে বসে থাকা ভঙ্গির থেকে বেশি মনে আছে আকাশে তাকিয়ে থাকা চোখ দুটো। পৃথিবীটার কোনও অস্তিত্ব চোখে ছিল না। মৃত মানুষের চোখ, গিরি একমাত্র নিজের বাবার ছাড়া আর দেখেনি। রুনুর মার শুয়ে থাকার ভঙ্গি। পিছনের ছবিটা। দুটো এক সঙ্গে তার মনে তিক্ত একটা গাছের বীজ বপন করে দিয়ে গেছে।

অস্বস্তি ভরে গিরি মনের মধ্যে খোপটা বন্ধ করতে চাইল।

”বড্ড জোরে হাঁটছ।”

”কই!”

”তুমি কী ভাবছ এখন?”

”বিশেষ কোনও একটা কিছু নয়। আচ্ছা, আমরা একবারই বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন খেয়েছি, মনে আছে? তোমাদের গ্যারেজের এক মেকানিকের মেয়ের বিয়ে ছিল। আমার ভীষণ দাঁতের যন্ত্রণা হচ্ছিল। যাব না বলেছিলুম, তুমি জোর করে নিয়ে গেছলে।”

”তুমি তখন অত্যন্ত একগুঁয়ে ছিলে। জোর ফলাতে।”

”এখন জোর ফলাই না? আজও তো একগুঁয়েমি করলাম থিয়েটারে না গিয়ে।”

”গেলে না কেন? অম্বর পাস এনেছে বলে?”

”এ-কথা কেন বললে?”

”মনে হল। আজকাল প্রায়ই অনেক কিছু মনে হয়। তুমি কিন্তু ঘামছ, চলো এবার ফিরি।”

কথা না বলে ওরা এগোতে লাগল। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে অঘোর ঘোষ স্ট্রিটে ঢুকতে গিয়ে গিরি থমকে দাঁড়াল। রাস্তার ওপারে বনমালী সরকার লেনের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে চলতে লাগল।

”দাঁড়িয়ে পড়েছিলে কেন?”

”এমনিই।”

”তুমি সুখী হবার চেষ্টা করো।”

”চেষ্টা করে হওয়া যায় না।”

”আমাকে বিশ্বাস করতে তো পারো।”

গিরি মুখ তুলে তাকাল। রুনুর মুখে কোনও হালকা ব্যাপার নেই। চোখে বিষণ্ণ, অনুনয়ের চাহনি। কিন্তু গিরি নিজেকে হঠাৎ হালকা ঝরঝরে বোধ করল। এই কথাটা শোনার ইচ্ছা অনেকদিন ধরেই মনে জমে উঠেছিল।

”অম্বরকে চলে যেতে বলেছি। আমাদের অসুবিধে হচ্ছে, বিশেষ করে তোমার।”

বাড়ির দরজায় ওরা এসে গেছে। গিরি নীরবে সিঁড়ি দিয়ে উঠল। অত্যন্ত কৌতূহলী দোতলার লোকেরা। একটি দুটি কথা থেকেই ওরা পুরো ব্যাপারের অর্থ নিংড়ে বার করে নিতে পারে। তিনতলায় পাশের ফ্ল্যাটে তাসুড়েদের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। রুনু তালা খুলে সরে দাঁড়াল। এটা ওর অভ্যাস। অন্ধকার ফ্ল্যাটে ঢুকতে ওর ভয় করে।

গিরি দালানের আলো জ্বেলে দিয়ে শোবার ঘরে এল। অতি ক্ষীণ রামের গন্ধ ঘরে ভাসছে। বারান্দায় এসে চেয়ারে বসল। রুনু শাড়ি বদলাচ্ছে ঘরে, তারপর আলো জ্বালবে। দুপুর থেকে বোতলটা টেবিলের উপরই পড়ে আছে।

মোহন সত্যিই বদলে গেছে নয়তো অতখানি রাম ফেলে রেখে যেত না। অসৎ, মিথ্যাবাদী, লোভী লোকটা স্থিরভাবে বাকি জীবনটাকে নাড়াচাড়া করতে চায়। ওকে প্রশংসা করা উচিত। মোহন অত্যন্ত উদ্যমী। চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় নেমে হাজার হাজার টাকা রোজগার করেছে। ওর এক ধরনের ধৈর্য আছে। গিরি অনুভব করল, সেটা তার ধৈর্যের থেকে সম্পূর্ণই আলাদা। হয়তো মোহনের দুটো পা আছে বলেই।

ঘরে আলো জ্বলল।

”তুমি কি এখন চা খাবে?”

”না।… কিন্তু কী অসুবিধের কথা ওকে বলেছ?”

”বলেছি, ওই ঘরটা আমাদের দরকার। মাথার যন্ত্রণায় রাত্রে তোমার ঘুমের অসুবিধা হয়। ডাক্তার বলেছে সম্পূর্ণ নির্জন ঘরে না ঘুমোলে, যন্ত্রণা সারবে না।”

”এ-সব মিথ্যে কথা।”

”আমি নিরুপায়। অম্বর অবশ্য বিশ্বাস করেনি।”

”কী বলল?”

”ও বুঝতে পেরেছে কেন আমি চলে যেতে বলেছি।”

”কী বুঝতে পেরেছে?”

কতটা চেঁচিয়ে উঠেছে, সেটা গিরি অনুমান করতে পারল রুনুর এক-পা পিছিয়ে যাওয়া থেকে। লজ্জা পেল সে।

”আমি ওর চলে যাওয়া চাই না। আমি অপেক্ষা করতে চাই সুখী হওয়ার জন্য। তুমি ওকে থাকতে বলো।”

শেষের কথাগুলো এত মৃদু হয়ে গেল, গিরি নিজেই শুনতে পেল না। ঘাড়ে রুনুর হাতের আলতো চাপ অনুভব করল।

”আমি তো যথাসাধ্য করি।”

জানি জানি, সে-জন্য তোমার কাছে কৃতজ্ঞও। কিন্তু গিরি কথাগুলো বলতে পারল না। গলায় বাতাস জমে উঠছে।

”অম্বর চলে গেলে দেড়শো টাকা কমে যাবে।”

”তবুও। আমি পারব চালিয়ে নিতে। ও আসার আগে কি চলেনি?”

রুনু চলে গেল বারান্দা ছেড়ে। গিরি একদৃষ্টে রেলিংয়ের জাফরির মধ্য দিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অবসন্ন বোধ করল। আবার তার মনে পড়ল টেবিলের উপর আধ ভর্তি বোতলটা রয়েছে।

হাত বাড়িয়ে পর্দা সরাল। রুনু ঘরে নেই। দরজার কাছেই টেবিলটা। গিরি ক্রাচের সাহায্য ছাড়াই দেয়াল ধরে হালকা লাফে ঘরে এল। দ্রুত বোতলটা তুলে নিয়ে আবার বারান্দায় ফিরে চেয়ারে বসল। দালান থেকে রুনু বলল-

”তুমি কি এখন খাবে? তা হলে গরম করি।”

”না, একদম খিদে নেই। ঢাকা দিয়ে টেবিলে রেখে দাও।”

”আমারও খিদে নেই। আমি শুয়ে পড়ছি, ক্লান্তি লাগছে।”

গিরি ছিপির প্যাঁচ খুলে, বোতল থেকেই মুখে ঢালল। গন্ধে, ঝাঁঝে গুলিয়ে উঠল পেট। বহু বছর পর আবার। স্বাদটা, ভুলেই গেছে প্রায়। ঠোঁট চেপে, বেরিয়ে আসতে চাওয়া রামকে আবার পাকস্থলীতে ফিরিয়ে আনার জন্য সে চোখ বুজে নিশ্বাস বন্ধ করল। মিনিট দুয়েক পর সে অনুভব করল তার শরীরের মধ্যে সেই বিস্মৃতপ্রায় উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে। আর এক ঢোঁক খেয়ে বোতলটা চেয়ারের নীচে রাখল।

কলঘরে কাপড় থোবানোর শব্দ হচ্ছে। নিজের ব্লাউজই নয়, অম্বরের রুমাল, গেঞ্জিও কাচছে। গিরি হাতটা নাকে ধরে পিয়াজের সামান্য গন্ধ পেল। উপরের বারান্দায় গুনগুন সুর। পাগলি গান গাইছে। একতলায় লন্ড্রির রোলার শাটার বন্ধ করার কর্কশ শব্দ উঠেই অঘোর ঘোষ স্ট্রিটকে আবার নৈঃশব্দ্যে ডুবিয়ে দিল।

গিরি বোতলটা তুলে নিয়ে কোলে দুই ঊরুর মধ্যে রাখল। মাথার মধ্যে ঝোড়ো হাওয়ার শব্দ, চোখে ঝাপসা লাগছে। বনমালী সরকার লেনের মুখ, বাস স্টপে দাঁড়ানো কয়েকটি লোক মাঝে মাঝে দৃষ্টি থেকে ছিটকে যাচ্ছে। গুম হয়ে সে বসে থেকে, বিরক্ত বেপরোয়ার মতো বোতলটা মুখে তুলে ধরে বাকিটুকু ঢেলে নিল।

প্রায় আধঘণ্টা পর তার মনে হল অম্বর হেঁটে আসছে। দেখার জন্য একপায়ে দাঁড়িয়েই আবার বসে পড়ল। রুনু আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। দরজাটায় হয়তো খিল দেওয়া। উঠে এসে কড়া নাড়লে পর দেখা যাবে। চেয়ারে হেলান দিয়ে সে অন্ধকার বারান্দায় চোখ বুজল। নিশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠছে, বুকে টান লাগছে। এত বছর পর এ-ভাবে ঢকঢক করে গেলা ঠিক হয়নি। গিরি মাথা নাড়তে লাগল।

পাশের ঘরে আলো জ্বলল। বারান্দার দরজা খুলে অম্বর বেরিয়ে এসে রেলিং ধরে একবার দাঁড়িয়েই আবার ঘুরে ঢুকে গেল। খোলা দরজা দিয়ে আলো পড়েছে বারান্দায়, জংধরা ময়লা রেলিংয়ে। জাফরিতে।

গিরি চোখ খুলে একবার মেঝেয় আলোটার দিকে তাকিয়েই আবার মাথা ঝুঁকিয়ে দিল বুকের ওপর। মাথার মধ্যে প্রচণ্ড ঘূর্ণি। পাকস্থলী থেকে একটা চাপ ঠেলে উঠছে গলা পর্যন্ত।

দরজাটা কি খোলাই ছিল? কিন্তু চুরি হবার পর থেকে সন্ধ্যা হলেই রুনু খিল দিয়ে রাখে। দরজার কড়া কি নেড়েছিল? গিরি মাথাটাকে ঠেলে ঠেলে তুলে সিধে করল। শুনতে পাইনি তো। রুনু কি দরজার কাচে অপেক্ষা করছিল? সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেয়েই খুলে দিয়েছে। তারপর?

ঝুঁকে দু’হাত বাড়িয়ে গিরি রেলিংয়ের জাফরি মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে, মাথাটা ঝুলিয়ে দিল। কেন নয়? সবই সম্ভব। হাঁফাচ্ছে সে। হাঁ করে আছে। গোঙানির মতো আওয়াজ বেরিয়ে এল। কীসের অসম্ভব? মাকে দেখেছে রুনু। টাকার জন্য সেই আধবুড়ি, পেটমোটা মেয়েমানুষটা লোক নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করেছে। দরকার রুনুরও আছে। ওর মজবুত নরম শরীর উচ্ছল প্রাচুর্যে ভরিয়ে নেবার দরকার কি বোধ করে না? করে নিশ্চয় করে।

রেলিংটা ধরে গিরি ঝাঁকাবার চেষ্টা করল। চোখ খুলতে পারছে না। মাথার মধ্যে নাগরদোলার ওঠা-নামা চলছে। হাতড়ে হাতড়ে ক্রাচ দুটো ধরে উঠে দাঁড়াল। এখুনি কলঘরে গিয়ে তাকে বমি করতে হবে।

অন্ধকার ঘরে রুনু খাটে শুয়ে আছে কি না দেখার জন্য গিরি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছু দেখতে পাচ্ছে না, বুঝতে পারছে না। না থাকলে কোথায় যাবে। কলঘরে? দালানটা অন্ধকার। ওর মুখস্থ কোথায় কী আছে। বাঁ দিকে দরজা তার পাশে জুতোর র‌্যাক, তার পিছনে জানলা, তাতে কয়লা ভাঙার লোহাটা… ওটাকে সে আজ দেখতে পায়নি স্নান করে বেরিয়ে। চোরাই মাল। গেছে ভালোই হয়েছে।

কলঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গিরি নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করল। ভারী চোখের পাতা তুলতে গিয়েও পারল না। কেউ কি কলঘরে রয়েছে নাকি?

”কে?”

গিরি অপেক্ষা করল সাড়া পাবার জন্য। ”ধ্যাৎ!” কলঘরের দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকেই অস্পষ্টভাবে মনে হল, সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। কেউ যেন তার ক্রাচজোড়া টানছে তলা থেকে। রুনু কি? সামনে হুমড়ি খেয়ে ঝুঁকে পড়ল গিরি এবং মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারাবার আগে মুহূর্তের জন্য তার মনে হল কয়লা ভাঙা লোহাটা তার মাথায় কে যেন মারল।

 পাঁচ

হাসপাতালে জ্ঞান ফিরে আসার পর যে-লোকটি তাকে প্রশ্ন করেছিল, ”আপনার কি মনে হয় কেউ আপনাকে আঘাত করেছিল?” তার মুখটি গিরি মনে করার চেষ্টা করল।

নীল বুশ শার্ট। অতি সাধারণ মুখ। দাঁতগুলোয় পানের ছাপ। দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিল।

”কেন?”

”থানা থেকে আসছি। এ-রকম কেসে আমরা স্টেটমেন্ট নিয়ে থাকি। আপনার একটা পা নেই, তার ওপর মদ খেয়েছিলেন, তবু ফর্মালিটিজ শেক…”

”না আমার কিছু বলার নেই।”

বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল গিরি। লোকটার স্বর, বসার ভঙ্গি, দাঁত খোঁচানো তার অসহ্য লাগছিল।

বিকেলে রুনু এসেছিল। একা। মুখটা শুকনো। গিরি নার্সের কাছে শুনেছিল প্রায় আটাশ ঘণ্টা পর তার জ্ঞান আসে। সকালে পুলিশের লোকটা যে-টুলে বসেছিল সেটাই টেনে নিয়ে রুনু বসে। চোখে উদ্বেগ ও স্বস্তি একের পর এক ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। রুনু আলতো করে হাত রাখল তার বুকে। ওর বসার ভঙ্গিতে করুণা, চাহনিতে মমতা।

তখন হঠাৎই গিরির মনে হয়েছিল, গত পনেরো বছরে তারা পরস্পরের এত কাছাকাছি কখনও আসেনি। এত কাছে, যার থেকে দুটি প্রাণের পক্ষে আরও বেশি সম্ভব নয়। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার হাসপাতালে রুনু তার পাশে বসল। মাঝে পনেরোটা বছর। হয়তো ও বদলায়নি।

গিরি তখন প্রতিটি সেকেন্ডে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। তার শরীর ও মন আরও তীক্ষ্ন অনুভূতি লাভ করছে, হৃৎপিণ্ড থেকে আবেগ ছিটকে পড়ছে সারা দেহে। মাথার মধ্যে যন্ত্রণাটা অসহ্য লাগছে না। মনের মধ্যে বুদবুদের মতো ফেটে পড়ছে অজস্র দ্রুত চিহ্নসমূহ-হঠাৎ ধরাপড়া কোনও কথার সুর, তীব্র গন্ধ, পলকে দেখা কোনও চাহনি, শয়নের ভঙ্গি, এমনকী রাস্তা থেকে ভেসে আসা চিৎকারও। অন্য আর এক পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগসূত্র এইসব ছবি, গন্ধ, ধ্বনি খোদিত হয়েছে পনেরো বছর ধরে।

রুনু বুকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।

”পুলিশের একটা লোক এসেছিল। জিজ্ঞাসা করছিল কেউ আমাকে মেরেছে কি না।” সঙ্গে সঙ্গে রুনুর হাতটা একবার আড়ষ্ট হয়ে গেছল।

”তুমি কী বললে?”

গিরি একদৃষ্টে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিল। আতঙ্ক ছাড়া আর কিছু চোখ দুটোয় ছিল না। কৌতূহল নয় কেন? ওটাই স্বাভাবিক হত! সে অপেক্ষা করে ছিল কতক্ষণে আতঙ্কটা অপহৃত হয়। রুনুর চোখে অস্বস্তি ফুটে উঠেছিল।

”আমি কিছু বলিনি।”

অস্বস্তিটা যেন আরও বাড়ল।

”কিছু বলোনি?”

”না। বলার কিছু নেই। একটা পা নেই, তার ওপর মদ খেয়েছিলাম, পড়ে গিয়ে চোট পাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।”

”কলঘরটা সাবান জলে হড়কানো ছিল। যখন আমি আর অম্বর তোমায় তুলছিলাম তখন ও একবার হড়কে গেছল।”

”জানলে কী করে?”

”অম্বরই শব্দ পেয়েছিল। আমাকে ডেকে তোলে।”

”তুমি ঘুমোচ্ছিলে?”

”হ্যাঁ।”

”ও কি ঘরে ঢুকে ডেকে তুলল?”

”হ্যাঁ।”

মাথার মধ্যে যন্ত্রণাটা আবার ফিরে আসছে। গিরির মনে হল সে আবার তার নিজের জগতে, অন্ধকার দমচাপা কুটুরিতে ঢুকছে। চোখ বন্ধ করে বুকে হাত রাখল। রুনু তার হাতটা আগেই তুলে নিয়েছে।

”ডাক্তার বলেছে দিন চার-পাঁচ তোমাকে এখানে থাকতে হবে। এক্স-রে করে খুলিতে ক্র্যাক পাওয়া গেছে। তবে ভয়ের কিছু নেই।”

”তুমি কি অফিস থেকে আসছ?”

”না। টেলিফোন করে জানিয়ে দিয়েছি এক সপ্তাহ যাব না।”

”একা আছ?”

গিরি চোখ খুলল না মুখের দিকে তাকাবার জন্য।

”অম্বর আছে। কয়েক দিনের মধ্যেই ও চলে যাবে। আপাতত এক বন্ধুর বাড়িতে উঠবে।”

গিরি চুপ রইল।

”ওকে ক’টাদিন থাকতে বলেছি তোমার জন্যই, আমাকে সাহায্য করতে।”

”পাখা দিয়ে গেছে?”

”আজ দুপুরে দিয়েছে।”

”কেমন পাখাটা, ঠিক মতো লাগিয়েছে তো?”

”রেগুলেটর ছিল না, এনে লাগাল। পাখাটা বেশ পুরনো, হাঁড়িটায় অনেকগুলো ঘুলঘুলি। তবে ভালো হাওয়া দেয়।”

”রাতে কাপড় কেচে তুমি কলঘরের মেঝেয় জল ঢেলে দাওনি!”

”বোধহয় না।”

”কিন্তু তুমি তো এ-সব ব্যাপারে খুঁতখুঁতে।”

রুনুর মুখের অভিব্যক্তি দেখার জন্য গিরি চোখ খুলল। মুখটা নামিয়ে রাখা। অপরাধীর মতো।

”পুলিশের লোকটা জানতে চাইল, কেউ আমাকে মেরেছে কি না।”

”কে মারবে? মারার মতো কে আছে?”

গিরি উত্তর না দিয়ে জানলার দিকে মুখ ফেরাল। একটা দোতে বামনা ঘুড়ি আকাশে তোলপাড় করছে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে। দ্বিতীয় কোনও ঘুড়ি দেখা যাচ্ছে না।

”আমারই দোষে হল। যদি জল ঢেলে ধুয়ে দিতুম…”

”কয়লাভাঙা লোহাটাকে সেদিন সকাল থেকে দেখিনি।”

গিরি আড়চোখে দেখল। মনে হল রুনুর মুখ থেকে যেন রক্ত শুষে নেওয়া হয়েছে।

”আমি তো খেয়াল করিনি। কয়লা তো ভেঙেই দোকান থেকে পাঠিয়ে দেয়, তাই ওটার কোনও দরকারই হয় না।”

”আমি আগের দিনও ওটা দেখেছিলাম।”

গিরি ডান হাতের দুটো আঙুল মাথার ব্যান্ডেজে ছোঁয়াল। রুনুর চোখে বিভ্রান্তি।

”লোহাটা খুঁজেছিলাম যখন তুমি বেরিয়েছিলে অম্বরের সঙ্গে, পাইনি কোথাও। অম্বরের ঘরটা অবশ্য তালা দেওয়া ছিল।”

ওরা অনেকক্ষণ কথা বলেনি।

”তুমি একটা ভয়ংকর রকমের বাজে চিন্তা করছ।”

রুনু উঠে চলে যাওয়ার পর গিরির মনে হয়েছিল, বোধহয় ঠিক কথাই বলেছে। কিন্তু ওরাও কি ভয়ংকর চিন্তার প্রভাবে এই কাজটা করেনি?

.

বালিশে থুতনি রেখে গিরি উপুড় হয়ে শুয়ে। খোলা বারান্দার দরজা দিয়ে তার দৃষ্টি, জাফরির ওপারে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পর্যন্ত। আট দিন হল সে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে।

যে ক’দিন সে হাসপাতালে ছিল রুনু প্রতিদিন গেছে। চুপ করে বসে থাকত। গিরিও কথা বলত না। কখনও তাদের চোখাচোখি হত। দু’জনেই চোখ সরিয়ে একই সঙ্গে জানলার বাইরে তাকাত। সাধারণ কথা মাঝে মাঝে বলেছে যখন নীরবতাটা তিক্ত হয়ে পড়ত। যেমন, ”বাসে কি খুব ভিড় ছিল আজ? নার্স বলেছিল আজ ট্রাম ধর্মঘট হয়েছে।”

”না তেমন কিছু ভিড় নয়।”

কিছু পরে গিরি আবার জিজ্ঞাসা করে : ”ট্যাক্সিতে শেয়ারে যেতে পারো।”

”কী দরকার।”

কিছু নয়। কী দরকার। গিরির কাছে এ-সব কিছু নয়, এ-সবের দরকার নেই কারণ গিরি ওই জগতের কেউ নয়। ও-সব নিয়ে বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে বলেই দায়সারা উত্তর। ”তেমন কিছু নয়।” প্রতিদিনই যখন বাড়ি ফেরে তখন দেখে মনে হয় না কষ্টকর একটা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এল। জীবনের স্রোত থেকে যেন সরে এল। বিশেষ একটা জীবনের, যেটা অনেক উত্তেজক ঘটনাবহুল ঘরে যাপন করা তার জীবন থেকে।

রুনুকে সে জীবনে কী দিতে পেরেছে?

একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে গিরির চোখ জ্বালা করছে। বালিশে মুখ চেপে ধরল। তারা স্বামী-স্ত্রী নয় বটে, কিন্তু পুরুষ এবং নারী। বহু বছর একসঙ্গে বাস করছে, একই বিছানায় শুচ্ছে। ও ভোরে উঠে উনুন ধরায় বাসন মাজে, ঘর মোছে, চা করে অফিস যায়। ফিরে এসে ঘরের মধ্যে কাটায়। আত্মীয় নেই, প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্প করে না, বন্ধুদের বাড়ি যায় না। কখনও হয়তো তারা দু’জনে পথে বেরোয়, একই পথ ধরে একই বাড়ি, একই দোকান, একই দৃশ্য দেখে ফিরে আসা। ভরা যৌবনা মেয়েমানুষের পক্ষে এটা কি কোনও জীবন? তার কি কোনও অধিকার আছে রুনুকে এই সংকুচিত জীবনের গণ্ডির মধ্যে দণ্ডভোগ করতে বাধ্য করানোয়?

কিন্তু এরজন্য একটা দীর্ঘদিনের পরিচিত লোককে মেরে ফেলতে চাওয়া কেন? রুনু তো অনায়াসেই তাকে ত্যাগ করে চলে যেতে পারে। যে-কোনও লোকের সঙ্গে এমনকী অম্বরের সঙ্গেই যেতে পারে। অম্বর নিশ্চয় ওর থেকে সাত-আট বছরের ছোটো। তাতে কিছু এসে যায় না। স্থূল ধরনের রুচি, সরল এবং ভোঁতা বুদ্ধি। শুধুই শরীরের ভরে জীবনটাকে দাঁড় করিয়েছে, রুনুর মাংস ছাড়া আর কিছু ওর প্রয়োজন হবে না। রুনু পাবে দু’পাওয়ালা একটা লোক, যে ওকে খুশি রাখার জন্য ব্যস্ত হবে, আমোদ দেবে। ওকে দু’হাতে তুলে নিয়ে অন্তত এক হাত হাঁটার ক্ষমতা তো অম্বরের আছে।

দূরত্বটা কম করেই সে ধরেছে। হাসপাতাল বেড থেকে চাকা লাগানো চেয়ারে বসে লিফটে এবং একতলায় ট্যাক্সির কাছে সিঁড়ি পর্যন্ত তাকে আনা হয়েছিল। ক্রাচ দুটো নিয়ে আসার কথা রুনুর মনে ছিল না। কিন্তু অম্বরকে সঙ্গে এনেছিল। চেয়ার থেকে উঠে কারুর কাঁধে ভর করে এক পায়ে সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামলে মাথায় ধাক্কায় লাগবে।

দু’জন ওয়ার্ড বয়কে ডেকে গিরিকে তুলে ট্যাক্সিতে বসাবার কথা যখন হচ্ছে, তখন অম্বর ওকে হাত ধরে তুলে দাঁড় করায় এবং পরমুহূর্তে পাঁজাকোলা তুলে সিঁড়ির চারটে ধাপ নেমে ট্যাক্সির দরজার কাছে এসে নামিয়ে দেয়।

বড়জোর পনেরো সেকেন্ড। গিরি নিজেকে অত্যন্ত অসহায়, পরনির্ভরশীল বোধ করেছিল। বিশেষত রুনুর সামনে এটা ঘটায়।

রুক্ষ স্বরে সে বলেছিল, ”ক্রাচ আনোনি কেন?”

পাঁচ দিন সে হাসপাতালে ছিল, পাঁচ দিন পাঁচ রাত ওরা দু’জন এই ফ্ল্যাটে ছিল। ওই পাঁচটি দিনের যে-সময়টুকু অজ্ঞান হয়ে বা ইনজেকশন দ্বারা ঘুমিয়েছে তার বাইরে জাগ্রত অবস্থাটুকু অসহনীয় হয়ে উঠেছিল শুধু এই চিন্তায়। ডাক্তার বলেছিল আরও চব্বিশ ঘণ্টা কাটিয়ে যেতে। সে রাজি হয়নি।

সম্ভবত এই বিছানায় দু’জনে শুয়েছে। গিরি বালিশ শুঁকল। রুনুর চুলের গন্ধ। উপুড় হয়ে শুঁকতে শুঁকতে বিছানাটার প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করল। অম্বরের অস্তিত্ব না পেয়ে হতাশ হল। ওর গায়ের গন্ধটা তার জানা। হয়তো অম্বরের বিছানায় রুনুর গন্ধ পাওয়া যাবে।

ওরা স্বাধীন ছিল পাঁচটা দিন-রাত।

বিছানায় বসে আছে গিরি। রেলিংয়ের উপর দিয়ে রাস্তা দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ মোহনকে দেখল স্কুটারে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে। অপেক্ষা করছে গাড়ি দেখার জন্য পিছনে ঘাড় ফিরিয়ে। ডান দিকে বনমালী সরকার লেনে ঢুকবে। ও জানে না গিরি মাথায় চোট পেয়ে হাসপাতালে ছিল। জানলে নিশ্চয় দেখতে যেত। গিরির ইচ্ছা করল ওকে চিৎকার করে ডাকতে।

ক্রাচটা বগলে দিয়ে সে দ্রুত বারান্দায় এল। মোহনের স্কুটার তখন বনমালী সরকার লেনে ঢুকে পড়েছে। তা হলে এখন বুলি এখানেই থাকে!

গিরি অদ্ভুত রকমের একটা অনুভবের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। কুৎসিত ভয়ংকর চিন্তা থেকে রেহাই পাওয়া যায় কী করে। চাবি ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেডিয়ো বন্ধ করার মতো চিন্তা বন্ধ করার কোনও উপায়ের কথা বার বার ভেবেছে। কিন্তু একটা চাবিও পাওয়া সম্ভব হয়নি।

বহুবার চোখে ভেসে উঠেছে রুনুর বাবার বসার ভঙ্গি, আকাশে তাকানো চোখজোড়া। তখন লোকটির স্ত্রী হয়তো ভিতরের ঘরে প্রাইভেট কথা বলায় ব্যস্ত। রুনুর কি এমন কোনও ভিতরের ঘর আছে? চোখ বন্ধ করেও গিরি ছবি দেখা বন্ধ করতে পারেনি। বরং এই ছবির পরই ভেসে উঠেছে আর একটা-সে নিজে বসে আছে শূন্য দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে।

তা হলে বুলি এখন মোহনের ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে রয়েছে। নয়তো মোহন এই দুপুরে কী জন্য আসবে। একটা চোখ নষ্ট হওয়া, মুখে বসন্তের আঁচড়, বয়সে মোহনের মেয়ের থেকে দু’-চার বছরের বড়, সবে কলেজে ঢুকেছে। গিরি আঁচ করার চেষ্টা করল বুলিকে কেমন দেখতে।

রোদটা বারান্দা থেকে সামনের বাড়ির দেয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বারান্দার মেঝে এখনও তেতে। গিরি ঘরের মধ্যে ফিরে এল। ঘামছে সে। পাশের ঘরে সারারাত খটখট শব্দ হচ্ছিল পাখাটা থেকে। পুরনো পাখার বুশ বেয়ারিং ক্ষয়ে গেছে নিশ্চয়। এই ঘরের জন্য একটা পাখা ভাড়া করলে মন্দ হয় না। ইচ্ছাটা সে মুহূর্তেই পরিত্যাগ করল, কেননা পাখা ভাড়ার টাকা রুনুকেই দিতে হবে। উপরন্তু দেড়শো টাকা কমে যাচ্ছে সামনে মাস থেকে। অম্বর কয়েক দিন পরই সম্ভবত চলে যাবে।

ঘাড়ের পিছনে দুটি বালিশ দিয়ে মাথাটাকে উঁচু রেখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে অনুমান করতে শুরু করল, বুলিকে কেমন দেখতে। ছিপছিপে, লম্বায় পাঁচ-চার কি পাঁচ-তিন, শ্যাম বর্ণ। একটা চোখ না থাকায় অন্যটি কোমল এবং বিষণ্ণ। নাকটি উঁচু যার ফলে পাশ থেকে অন্যদিকের চোখটি দেখা যায় না। ওর কোন চোখটা নষ্ট? বাঁ দিকের হলে ডান দিক থেকে লোকে যাতে দেখে সেইভাবে মুখ ফিরিয়ে থাকে নিশ্চয়ই। হাতের আঙুল লম্বা কিন্তু তালুটা তুলনায় ছোটো, নরম এবং রেখাগুলো গভীর। হয়তো কনুইয়ের নীচে লোমগুলো বড়ো।

গিরি হেসে উঠল শব্দ করে। প্রায় ষোলো-সতেরো বছর আগের রুনুকেই সে মনে করার চেষ্টা করছে। বুলি এখন সেই বয়সিই। নিশ্চয়ই তখনকার রুনুর মতোই হাসে ঠোঁট দুটি দু’পাশে ছড়িয়ে নাকের পাশে ভাঁজ তৈরি করে, দাঁত না দেখিয়ে। ওই বয়সি মেয়েরাই, যখন ব্যক্তিত্ব সংগ্রহ করতে শুরু করেছে, তখন তাদের মধ্যে অনেক মিল ধরা পড়ে। চলায়, চাহনিতে, বসায় এমনকি বিস্ময় বা বিরক্তি প্রকাশেও। বুলিকে মনে মনে গড়ে তুলতে গিয়ে বারবার গিরি দেখতে পেল রুনুকে। গিরিই বলেছিল, ”তোমার মা-র কাছে যাব এবার।”

”কেন?”

অসম্ভব চমকে উঠেছিল রুনু।

”কোনও দরকার নেই যাবার।”

”তা হলে কাকে বলব বিয়ের কথা? তোমার বাবা তো…”

”কাউকে বলতে হবে না। আমি নিজেই আমার গার্জেন।”

এই ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তারা কথা বলছিল। আগের ভাড়াটেদের ফেলে যাওয়া ছেঁড়া কাগজ, ঝুড়ি, ভাঙাচোরা জিনিসগুলো তখন ছড়ানো। বিনা সেলামিতে মোহনই ফ্ল্যাটটা পাইয়ে দিয়েছিল। তিন মাসের ভাড়া অগ্রিম দিয়ে রুনুকে দেখাতে এনেছিল সে।

দিন চারেক পরই সন্ধ্যাবেলা কড়ানাড়া শুনে গিরি দরজা খুলে দেখে রুনু। কাঁধে ঝোলা ভরতি বই, হাতে ছোটো সুটকেস।

”চলে এলাম।”

”মানে!”

”এখানেই থাকব আজ থেকে।”

সেইদিন থেকে ওরা একসঙ্গে বাস করছে। নিজের গার্জেন যে ও নিজেই সেটা আজও গিরি ভুলতে পারে না। বিয়ের কথা ওরা তোলেনি, তার দরকারও বোধ করেনি। এতই ওরা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল।

কিন্তু বুলির পক্ষে এটা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই রুনুর মতো শুধুই ভালোবেসে মোহনের সঙ্গে সে পরিবার ছেড়ে বাস করতে আসেনি। গিরি তখন যুবক, অবিবাহিত, মোহনের এই সুবিধা নেই। হয়তো টাকা দিয়ে ঘাটতিটা ঢেকে নিয়েছে। বুলির বাবার মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছে হয়তো।

অত্যন্ত চতুর। মোহন ঝোঁকের মাথায় কখনও কখনও কিছু কাজ করেছে সেটা ব্যবসা সংক্রান্ত, কিন্তু জীবন সংক্রান্ত ব্যাপারে অতি কৃপণ, সাবধানী।

”মিসেস মজুমদারের কাছেও আমি ও-সব পকেটে নিয়ে যাই।”

বুলি যদি কুদর্শনা না হত, মোহন ওকে নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি কিছুতেই করত না। কেউ ওর দিকে তাকাবে না, কারুর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কও গড়ার প্রশ্নই উঠবে না। মোহন নিশ্চিন্ত। এই রকম একটা ভাবনা রুনু সম্পর্কেও গিরির মাথায় মাসখানেক আগে এসেছিল। কুদর্শনা বা বিকলাঙ্গ হয়ে যাক কিংবা হঠাৎ বৃদ্ধা হয়ে যাক রুনু। তা হলে সব লোক গিরির দিকেই তাকাবে সমবেদনার দৃষ্টিতে, পুরুষদের ক্ষুধার্ত চাহনি চাইবে না রুনুর শরীর।

মোহনকে বয়সের তুলনায় অন্তত পনেরো বছর বেশি দেখায়। এটা ও জানে বলেই খুঁতওলা মেয়ে বেছে নিয়েছে। গিরির মনে হল, সে নিজেও কি তা হলে বুড়ো হয়ে গেছে? নয়তো রুনু সম্পর্কে সে এত ভীত সন্দিগ্ধ হয় কেন!

এইসব চিন্তা আর নয়। গিরি চোখ বুজে দ্রুত মনে করে যেতে লাগল প্রতিবেশীদের, ইউনিভার্সাল গ্যারেজের লোকদের, হাসপাতালের রুগি, ডাক্তার, নার্সদের, নিজের বাপ-মা, স্কুল এবং কিছুক্ষণে মধ্যেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে ঢুলতে শুরু করল।

মিনিট পনেরো পর গিরি চোখ মেলে মাথা তুলল। টিপটিপ যন্ত্রণা। আলনায় রুনুর ব্লাউজ এমনভাবে ঝুলছে, সামান্য বাতাসেই পড়ে যাবে। গুমোট গরম, বাতাসের চিহ্নমাত্র নেই। ঘরের সব কিছুই অনড় নিষ্পন্দ। ব্লাউজটার রাখা দেখে বোঝা যায় রুনু তাড়াহুড়ো করে অফিসে বেরিয়েছে। হাতাবিহীন চেলিধরনের ব্লাউজটার আর একটা জোড়া আছে, সেটা পরেই বেরিয়েছে। অন্তত ছয় ইঞ্চি পিঠ ও পেট দেখা যায়।

গিরি পছন্দ করে না খাটো ঝুলের হাতাবিহীন ব্লাউজ। দু’জনে রাস্তার বেড়াবার সময়, গিরি বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেছে এই রকম জামা পরা মেয়েদের দেখে। তবু পুজোর সময় রুনু ওই ব্লাউজ করিয়েছে।

”আমি যা-তা বলেছি দর্জিকে। করতে দেবার সময় বার বার করে বলে দিয়েছিলাম ঝুল বেশি হবে, হাতা হবে। এত দামি রুবিয়া ভয়েলের কাপড়টাই নষ্ট হল।”

গিরি বিরক্তি প্রকাশ করেছিল দর্জির অন্যমনস্কতা সম্পর্কে। কিন্তু এখন সে বিশ্বাস করে রুনুর নির্দেশেই এটা তৈরি হয়েছে। গিরি যা পছন্দ করে না সেটা পরা ওর উচিত কি অনুচিত সে প্রশ্ন উঠছে না। নিজে থেকেই ব্লাউজ দুটো তুলে রাখতে কিংবা অফিসের কাউকে দিয়ে দিতে পারত উপহার হিসাবেই। টাকা তিরিশেক খরচ হয়েছে। গিরির জন্য এটা অনায়াসেই করতে পারত।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রুনু সুন্দর হয়ে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু শরীরের অংশ দেখিয়ে সেটা জাহির করা কিংবা পুরুষদের দৃষ্টি টেনে আনার কী এমন দরকার হল? ওকি শুধুমাত্র গিরির চাহনি বা স্পর্শে খুশি নয়? ভালোবাসা, পোশাক বা প্রসাধনের তোয়াক্কা করে না, ভালোবাসাই লাবণ্য এনে দেয়। গিরির ভালোবাসা এতই অভ্যাস মতো হয়ে গেছে যে এটাকে নিশ্চয় স্থায়ী একটা কিছু হিসাবে ও ভাবে। এটা জিইয়ে রাখার আর দরকার মনে করে না। কেন?

গিরি বিছানা থেকে নামল। একটু চা হলে ভালো লাগবে বা গুমোট কিছুটা সহনীয় হবে। তারপর মনে হল মোহনের সঙ্গে দেখা করে এলে কেমন হয়! খুঁজে বাড়িটা বার করা এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। স্কুটারটা নিশ্চয় বাইরেই থাকবে। ওটা দেখেই বাড়িটার খোঁজ পাওয়া যাবে। বুলি নিশ্চয় রান্না করে খায়। চা ওখানেই পাওয়া যাবে।

গিরি কাচানো পাজামা-পাঞ্জাবি পরল। এটা বুলির কথা ভেবেই। পরিচ্ছন্ন হয়ে সে ওর সামনে প্রথমবার হাজির হতে চায়। আয়নায় দাড়ি দেখল। চার দিনের দাড়ি, অর্ধেকই পাকা। সাবান মাখিয়ে কামাতে গেলে দেরি হবে। জলে ভিজিয়ে ক্ষুর দিয়ে চাঁছতে শুরু করল।

তখনও মুখের চামড়ায় জ্বালা করছে যখন সে রাস্তায় নামল। রোদের ঝাঁঝে চোখ মেলে দূরে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। বাড়ির ছায়ায় বসে এক বুড়ি ভিখিরি বাটি থেকে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। একবার মুখ তুলে তাকাল। তারপাশেই একটা ষাঁড় উদাসীন চোখে জাবর কেটে চলেছে। বাড়ির রকে মাথার নীচে ব্যাগ রেখে জুতো সারাইওয়ালা গামছায় মুখ ঢেকে ঘুমোচ্ছে। নরম পিচে টায়ারের চড়চড় শব্দ ছাড়া গিরির কানে আর কিছু ধাক্কা দিল না।

সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পার হয়ে সে বনমালী লেনে ঢুকল। তিন-চার বারের বেশি সে এই রাস্তায় ঢোকেনি। পুরনো বাড়িগুলোর মধ্যে নতুন তৈরি একটা বাড়ির দরজা ঘেঁষে মোহনের স্কুটারটা দেখতে পেল।

দরজাটা খোলা। তিনতলা বাড়ির প্রতি তলায় দুটি করে ছোটো বারান্দা। অর্থাৎ ছটি ফ্ল্যাট। এর কোনটিতে মোহনকে পাওয়া যাবে?

দরজা পেরিয়েই মিটার বক্সগুলো। তার পাশে দেওয়ালে সারি দিয়ে চারটি লেটার বক্স। একটিতেও মোহনের নাম নেই। প্রত্যেক নামের আগেই মিস্টার শব্দটি আছে। নামের নীচে ফ্ল্যাট নম্বরগুলো থেকে গিরি বুঝে গেল একতলার দুটি ফ্ল্যাটের একটিতেই মোহন থাকতে পারে।

গ্রীষ্মের দুপুরে ভুল দরজার কড়া নেড়ে ঘুমভাঙানো ঝুঁকির কাজ। দুটি দরজা একই রকমের। একটি পাল্লায় খড়িতে লেখা, ”মধুমিতা”। বিবর্ণ হয়ে গেছে নামটা, এটা হতে পারে!

পিছনে দরজা খোলার শব্দে গিরি মুখ ফেরাল। এক প্রৌঢ়া মহিলা। চশমা, সাদা শাড়ি এবং ছাতা দেখে মনে হয় পড়ানোই পেশা। তার পিছনে একটি বছর সাত-আটের মেয়ে দরজা বন্ধ করার জন্য দাঁড়িয়ে। অবাক হয়ে সে ক্রাচ দেখছে।

এই ফ্ল্যাট কিছুতেই নয়। তবু নিশ্চিন্ত হবার জন্য গিরি বিপরীতের বন্ধ দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ”নতুন ভাড়াটে?”

মেয়েটি মাথা হেলাল।

”নাম জানো?”

”না।”

”কে কে আছে?”

”একজন মেয়ে একা থাকে।”

”একটা চোখ কানা, মুখে বসন্তর দাগ?”

গুটিয়ে সেফটিপিন দিয়ে আটকানো পাজামার পায়ের দিকে কৌতূহলে তাকিয়ে থেকে মেয়েটি আবার মাথা হেলাল এবং গিরির মাথার ব্যান্ডেজে চোখ রাখল।

কড়া থাকলেও গিরি টোকা দিল। মোহন এইভাবে টোকা দিত রুনুদের বাড়ির দরজায়। সেটা মনে পড়তেই, তখুনি সে কড়া নাড়ল মৃদুভাবে। পিছন ফিরে তাকাল। মেয়েটি লক্ষ করছে তাকে।

মোহন দরজা খুলল। অত্যন্ত অবাক হয়েছে।

”তুই, এখন!”

গিরি হাসল। মোহন খালি গায়ে লুঙ্গি পরে। জিরজিরে বুক। পায়ে হাওয়াই চটি।

”পড়ে গেছলাম কলঘরে, ক’দিন হাসপাতালে ছিলাম। দেখ, খুঁজে ঠিকই বার করেছি। তোকে দেখলাম স্কুটারে ঢুকলি, তাই-”

”ভেতরে আয়,” এই কথাটা শোনার জন্য গিরি অপেক্ষা করতে লাগল। দরজার একটা পাল্লা বন্ধ রেখে মোহন দাঁড়িয়ে।

”এই দুপুরে, মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, কেউ বেরোয়!”

মোহন শুধু ভর্ৎসনাই করল না, বিরক্তিও ফোটাল গলার স্বরে।

”একা দুপুর কাটানো যে কী কষ্টকর।”

”এত বছর তা হলে কাটল কী করে? রুনু তো অনেক বছর চাকরি করছে।”

”তুই এত কাছে আস্তানা করেছিস, দেখে আর থাকতে পারলাম না।”

”আসার সময় রুনুকে যেন দেখলুম, এসপ্ল্যানেডে কে সি দাসের সামনে। রাস্তা পার হবার জন্য দাঁড়িয়ে।”

”ওখানে! এখন?”

”তাই তো দেখলুম। হাতে ব্যাগ, ডিপ খয়েরি রংয়ের শাড়ি।”

গিরির নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। মোহন ঠিকই দেখেছে। কিন্তু রুনু অফিস থেকে বেরিয়ে এখন কোথায় যাচ্ছে? সিনেমায়?”

”রুনু তো সাদা শাড়ি পরে বেরিয়েছে।”

”তা হলে অন্য কেউ।”

”চা খাওয়াতে পারবি। আসলে চা খাব বলেই তোর এখানে এলুম। নিজে হাতে তৈরি করে খেতে ইচ্ছে করল না।”

মোহন কয়েক সেকেন্ড কী ভেবে দরজার বন্ধ পাল্লাটা খুলে সরে দাঁড়াল। লম্বা এক ফালি গলি। তার একদিকেই ঘর। কলঘর, রান্নাঘর তারপর বড়ো শোবার ঘর। সেটাকে ক্যানভাসের পার্টিশনে দু’-ভাগ করা। একটি বেতের সোফা, স্টিলের ফোল্ডিং টেবিল প্লাস্টিকের রঙিন চাদরে ঢাকা। তাতে পরিপাটি রাখা বই ও খাতা, পেনসিল, কলম। দুটি স্টিলের চেয়ার। দরজা জানালায় নতুন পর্দা। পার্টিশনেও পর্দা। সেদিকে গিরি তাকাল না।

মোহন সোফায় বসে গিরিকে একদৃষ্টে দেখছে। ঘরে আর কোনও জিনিস নেই তাকাবার মতো। গিরি টেবিলে কনুই রেখে চেয়ারে বসে। মনের মধ্যে ঝাপসাভাবে রুনুকে সে দেখতে পাচ্ছে রাস্তা পার হতে। মোহন অত্যন্ত ধূর্ত, ওর চোখ ভুল দেখে না। সাদা শাড়ির কথাটা নিশ্চয় বিশ্বাস করেনি।

”বুলি।”

মোহনের মৃদু গলার ডাক ঘরের অর্ধেকও অতিক্রম করেনি, গিরি তার পিছনে পর্দা সরাবার শব্দ পেল। সে মুখ ফেরাল।

ফ্রক পরিয়ে তেরো-চোদ্দো বছরের মেয়ে বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। রুগণ, অপুষ্ট দেহ। মুখে বসন্তের ক্ষতের দাগ যে এতটা গভীর হবে সে ভাবেনি। বাঁ চোখটিতে মণি নেই তাই বন্ধ পাতা ভিতরে ঢুকে আছে। বুলিকে কখনও কোনও যুবক কামনা করবে না। এটা মোহন জানে, বুলিও হয়তো জানে। গিরি জানল।

”গিরি।”

বুলি পলকে গিরির দিকে তাকিয়ে হেসে মাথা ঝোঁকাল। গিরি তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে টলে গেল এবং টেবিলটাকে ধরে সামলাল।

বুলি দু’হাত এগিয়ে ঝুঁকেছিল তাকে সাহায্য করতে এটা সে লক্ষ করল। ঠিক রুনুরই মতো। প্রথম সাক্ষাতেই গিরি কৃতজ্ঞতাবোধ দ্বারা বিব্রত হয়ে নমস্কার করবে কি করবে না দ্বিধায় পড়ে, ঠিক করল এতটুকু মেয়ের কাছে এটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।

”আমার কথা বুঝি ওকে বলেছিস?”

”গিরি চা খেতে এসেছে, হবে?”

”হ্যাঁ করে দিচ্ছি।”

”আমাকেও দিয়ো।”

বুলি ঘর থেকে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল। ভ্রূ কুঁচকে মোহন ওর বেরিয়ে যাওয়া দেখল।

”এখন এসে তোর অসুবিধা করলাম।”

”না, কী আর অসুবিধে। বুলি এই সময়টায় পড়ে।”

মিথ্যে কথা, পড়ার কোনও চিহ্ন টেবিলে নেই। নিশ্চয় দু’জনেই শুয়েছিল পার্টিশনের ওপারে। চা খেয়েই চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিল গিরি।

”একা পড়ে?”

”আমার কি পড়াবার মতো বিদ্যে আছে! অনেক এম এ বি এ পাশ মেয়ে তো টিউশনি করে দুপুরে, তাদেরই কাউকে রাখার কথা বলেছি।”

”ছেলে মাস্টারই ভালো পড়ায় শুনেছি।”

মোহন আঙুলের নখ চোখের সামনে ধরে মনোযোগে দেখতে দেখতে বলল, ”হুঁ।”

বিনা পয়সায় পেলেও পুরুষ মাস্টার রাখবে না। মোহন চায় না, বুলির মনে বয়সোচিত এমন কোনও আকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্ন ঝলক দিক, যা পয়সা বা স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে মেটানো যাবে না। এই ভাবে ব্যাপারটা দেখতে গিয়ে গিরি অস্বস্তিতে পড়ল। রুনু সম্পর্কেও তো সে এই রকমই ভাবে। রুনু কি এখন সিনেমা হলে অম্বরের পাশে বসে ইংরেজি ফিল্ম দেখছে। ইংরেজি ছবিতে চুমু, জড়িয়ে ধরা, কাপড় খুলে বিছানায় যাওয়া এ-সব তো সামান্য ব্যাপার। ইংরেজি কথা দু’জনেই বোঝে না, ওরা যাবে শুধু দেখতে।

মাথাটা টিপ টিপ করছে। গিরি ব্যান্ডেজে আঙুল ছোঁয়াল। রুনুর আকাঙ্ক্ষা যে কত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, এটাই তার প্রমাণ।

”কী করে পড়লি? হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে হল!”

”তোর জন্য এটা হয়েছে। বোতলটা রেখে এলি, লোভ সামলাতে পারলাম না। ঢক ঢক শেষ করে রাত্রে কলঘরে গিয়ে পড়লুম কলটার উপরে। মাথায় এমন গর্ত হয়েছে যে ডাক্তারেরা মনে করেছিল যেন কেউ ডান্ডা দিয়ে মেরেছে।”

”ও-ভাবে খাওয়াটা উচিত হয়নি। অনেক দিন পরে তো।”

”রুমু কেমন আছে?”

”ভালোই। এখনও স্কুলে যাওয়া বারণ, তবে বাড়ির মধ্যে হাঁটা-চলা করে। হপ্তাখানেক পর আর একটা কার্ডিওগ্রাম করতে হবে। …তুই বুলির কথা কাউকে বলেছিস নাকি?”

”রুনুকে? নাঃ।”

”বলাবলি না হওয়াই ভালো।”

”রাতে থাকিস?”

”না।”

”এই বাড়ির কি পাড়ার লোকেরা কৌতূহল দেখাবে কিন্তু।”

মোহন হাসল। ও-সব ওর জানা আছে। রুনুদের বাড়ি সম্পর্কে পাড়ার লোক হাসাহাসি করত। কেউ কথা বলত না। প্রতিবেশীদের সম্পর্কে রুনুর আড়ষ্টতা আজও কাটেনি। ওর মা যে হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল! মোহনই একদিন ইউনিভার্সালে রুনুর বাবার খবর দেয়।

”রুনুকে বলিস ওর বাবা গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে।”

”সে কী, কবে?”

”দিন পাঁচেক আগে। পচা গন্ধ পেয়ে পাশের বাড়ির লোক পুলিশে খবর দেয়। আজই আমি শুনলুম, ও-পাড়ারই কাছাকাছি থাকে এক ফিটারের কাছে। ঘরের জিনিসপত্তর বেচেই খাচ্ছিল। শেষে বেচার মতোও কিছু ছিল না। দিন দশেক উপোস দিয়ে আর সহ্য করতে পারেনি।”

গিরির প্রথমেই মনে হয়েছিল, রুনুর ছবি দুটোও কি বেচে দিয়েছে? যে-ছবিতে ও বাবার কোলে।

ভেবেছিল শোনামাত্র রুনু কান্নায় ভেঙে পড়বে। কিন্তু এত ঘৃণা ওর মধ্যে আছে গিরি জানত না।

”ভালোই করেছে, বেঁচে গেল।”

গিরি থ’ হয়ে তাকিয়েছিল। রুনু তখনও মর্নিং কলেজের ছাত্রী, দু’বেলা রান্না করে। সারা দুপুর বাড়িতে থাকে।

”তোমাকে তো হবিষ্যি টবিষ্যি করতে হবে।”

”কিছু করব না।”

রাত্রে বুকে মুখ গুঁজে কেঁদেছিল রুনু।

”আমার মা অমন হত না। শুধু বাবার জন্যই… শুধু বাবার অক্ষমতার জন্যই।”

গিরি তখন জানত না সে নিজে কিছুদিন পর অক্ষম হয়ে পড়বে। রুনু কি কারুর কানের কাছে মুখ রেখে এখন বলছে, ”আমি এমন ছিলাম না, আমি ভালোবাসতাম ওকে!”

গিরি আবার ব্যান্ডেজে আঙুল ঠেকাল।

”যন্ত্রণা হচ্ছে? দাঁড়া ট্যাবলেট দিচ্ছি।”

মোহন ক্যানভাস পার্টিশনের পর্দা সরিয়ে ভিতরে গেল। সেই সময় গিরি ঘরের ভিতরটা দেখার জন্য মুখ ফেরাল এবং চমকে পাংশু হল তার মুখ।

ভাঙা অ্যাকসেলের টুকরোটা খাটের পিছনে দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা। খাট থেকে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে। আরও দেখল, সিঙ্গল বেড খাটে নতুন পালিশ, রঙিন বেডকভার, পাশাপাশি দুটো মাথার বালিশ।

গিরি ঝপ করে যেন একটা গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে। এখানে কেন লোহাটা? কী করে এল?

তা হলে মাথায় ওটা দিয়ে কেউ মারেনি। এতদিন অযথা বাজে সন্দেহ করে এসেছে। রুনুকে তো প্রকারান্তরে জানিয়েওছে এই সন্দেহের কথা। বেচারা রুনু।

”দুটো ট্যাবলেট একসঙ্গে খা। দাঁড়া জল আনি।”

মোহন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গিরি ঝুঁকে পর্দাটা তুলল।

সেইটেই। একদিকের মাথার ইঞ্চি খানেক ত্যারচা কাটা, লম্বায় সেই মাপেরই, কালচে। ওটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গিরির মনে হল, সে গর্তের আরও নীচে নেমে যাচ্ছে। শুধু নিজেই সে এতদিন একটা কদর্য ভয়ংকর চিন্তার চাপে নুয়ে থাকেনি, সেটা রুনুর মধ্যেও ঢুকিয়ে দিয়েছে। রুনু হয়তো অম্বরকেও বলেছে। ওরা কী ভাবছে গিরির সম্পর্কে!

এখন সে কী বলবে রুনুকে? লোহাটা পাওয়া গেছে মোহনের এই গোপন ডেরায়, তোমরা নিরপরাধ! মনের কুৎসিত চেহারাটা ওরা দেখে ফেলেছে। সেটা ঢাকতে, গোপন রাখতে দেরি হয়ে গেছে।

মোহন চুরি করে এনেছে। রুনু বা অম্বর লক্ষ করেনি। দরজার পাশেই জানলা, টুক করে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। চুরির পুরনো অভ্যাসটা মোহন ছাড়তে পারেনি। ওদের লক্ষ করা উচিত ছিল। নিশ্চয় নিজেদের রান্নার ছলে দু’জনে ব্যস্ত ছিল। কেন ব্যস্ত থাকে? শাস্তি ভোগ করুক তা হলে অপরাধী সন্দেহের পাষণভার বুকে নিয়ে।

গর্ত থেকে খানিকটা উঠে গিরি যখন নিরাপত্তার কথা ভাবছে তখনই চোখে পড়ল ঘরের দরজায় বুলি, হাতে চায়ের কাপ। ওর একমাত্র চোখটি বিস্ময়ে ভরা। গিরি অপ্রতিভ হয়ে ধরে থাকা পর্দাটা ছেড়ে ছিল। বুলির পিছনে মোহনকে দেখা গেল জলের গ্লাস হাতে।

”আগে এ-দুটো খেয়ে নে, তারপর চা।”

ট্যাবলেট দুটো জল দিয়ে পাকস্থলীতে নামিয়ে গিরি চায়ের কাপ তুলে নিল বুলির হাত থেকে। আঁচলটা বুকে পিঠে জড়িয়ে বাঁ হাতে ধরা। দেখার মতো কিছুই নেই। যথাসাধ্য সপ্রতিভ থাকার চেষ্টা ও নম্রতা ছাড়া।

”সেদিন থিয়েটার দেখতে গেছলি?”

”না। আমি আর রুনু বিকেলে বেরিয়েছিলাম।”

”রুনুও যায়নি!”

অবাক হবার কী আছে! ওর কি ধারণা রুনু খুব ফুর্তিবাজ চপল?

”দাঁড়িয়ে কেন?”

গিরি এখন ঠিক করতে পারছে না বুলিকে আপনি না তুমি বলবে। বয়সে অত্যন্ত ছোটো, কিন্তু অপরিচিত তো বটে। যদি রাস্তায়, দোকানে বা ট্রামে এই বয়সি কোনও মেয়েকে কিছু বলার দরকার হয় তা হলে কি সে ”আপনি” সম্বোধন করবে না?

আর একটা চেয়ার দেয়ালে ঠেস দেওয়া। সেটা পেতে বুলি আলতোভাবে বসল।

”গিরির কথা তো তোমায় বলেছি, খুব কাছেই থাকে।”

”এখান থেকে বেরিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে পড়লেই ওপারে তিনতলার বারান্দাটা।”

”এত কাছে!”

গলার স্বরটি গিরির ভালো লাগল। সরল কৌতূহল ঝিকমিক করছে একটা চোখে।

”আমার সম্পর্কে কী বলেছে ও?”

বুলি একবার তাকাল মোহনের দিকে।

”বলেছিলেন গিরি নামে এক বন্ধু আছে, তার একটা পা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল অনেকদিন আগে। তখন আপনারা দু’জনে একজায়গায় কাজ করতেন।”

”আর?”

”আপনার স্ত্রী চাকরি করেন, খুব সুন্দর দেখতে।”

গিরি দেখতে পাচ্ছে মোহনের মুখ। রুনু সম্পর্কে কী গল্প করেছে বুলির কাছে? নিশ্চয় বলেনি অবিবাহিত দম্পতি, পাতানো বউয়ের রোজগারে বসে বসে খায়। বন্ধুকে ছোটো করে দেখালে মোহন নিজেই গুরুত্ব হারাবে বুলির কাছে।

”আমি কিন্তু তুমি বলব।”

”নিশ্চয়, কত ছোটো আমি আপনার থেকে।”

”বাজার করে কে?”

”বুলি মাছ খায় না। বাজারের যা-কিছু আমিই এনে দিয়েছি। তিন-চার দিনের মতো। একজনের জন্য আর রেশনকার্ড করাবার দরকার কী, চাল-টাল বাজার থেকে কিনলেই হবে। গ্যাসেই রান্না হয়, বাসন মাজামাজির পাট নেই। ক’টা বাজে দেখো তো।”

বুলি উঠে পার্টিশনের ভিতরে গেল এবং মোহনের হাতঘড়িটা আনল।

”পৌনে চার! সাড়ে চারটের মধ্যে আমায় কয়লাঘাটায় পৌঁছতেই হবে।”

মোহন খাড়া হয়ে বসে ঘড়িটা পরছে। গিরিকে তা হলে এবার উঠতে হবে। ইচ্ছে করছে কিছুক্ষণ থাকতে।

এতক্ষণ সে রুনুকে, দুপুরে তার অফিস পালিয়ে কোথাও যাওয়ার কথাটা ভুলেছিল। আবার একা ফ্ল্যাটে চিন্তাগুলো পিঁপড়ের মতো ছেঁকে ধরবে।

ক্রাচ বগলে দিয়ে গিরি দরজার দিকে এগোল।

”চলি রে।”

”আচ্ছা।”

বলল না আবার আসতে। চায় না তার এই ডেরাটায় ভিড় হোক। কিংবা দ্বিতীয় কোনও পুরুষ বুলির সামনে আসুক। গিরিকে পুরুষ হিসেবে মোহন ভাবে কি?

পিছনে বুলি দরজা বন্ধ করতে আসছে। দরজার উপরে ছিটকিনিটা লাগানো রয়েছে। খুলতে গিরির অসুবিধা হবে ভেবে সে পিছন থেকে হাত বাড়াল। ব্যান্ডেজ ঘেঁষে বুলির হাতটা উঠতেই, লাগার ভয়ে আপনা থেকেই গিরি অস্ফুটে ”আঃ” বলে মাথাটা সরিয়ে নিল।

”লাগল?”

বুলির ডান হাতের আঙুলগুলো গিরির বাম বাহুটা আঁকড়ে ধরল অপ্রস্তুত হয়ে। গিরি ওর একমাত্র চোখটিতে, ভয় লজ্জা বেদনা একসঙ্গে দেখতে পেল।

বুলি ধরে আছে হাতটা। গিরির মনে হল তার সারা শরীর থেকে স্নেহলোভী একটা উত্তাপ হাতের ওই জায়গাটার দিকে হামা দিয়ে এগোচ্ছে। আলতো করে সে বুলির আঙুলগুলোর ওপর ডান আঙুল রাখল।

”সামান্য। এখনও ভালো শুকোয়নি।”

মিথ্যাকথা। কিন্তু মিথ্যা বলার এত ভালো সময় কমই জীবনে আসে।

”ব্যথা দিলাম তো। আমারই দোষ।”

রুনুর মতো স্বর কিন্তু আরও অস্ফুট, কোমল, করুণায় ঘন। গিরির অনেক ভালো লাগল বুলির একটা চোখের দুঃখ, সমবেদনা। ও আমাকে অনেক বেশি বুঝবে রুনুর থেকে।

”দেখবি শরীর কেমন ঝরঝরে ফিট হয়ে যায়। ব্যথাট্যাথা একদম মিলিয়ে যাবে।”

ঘরের মধ্যে থেকে চেঁচিয়ে মোহন বলল। গিরি হাতটা তুলে ছিটকিনি খুলল।

”ব্যথা লাগেনি আমার।”

”ঠিক বলছেন!”

”হ্যাঁ।”

বুলি দরজা বন্ধ করছে। একটা পাল্লা ভেজিয়েছে। একটা চোখ আর ক্ষতভরা একদিকের গাল গিরি দেখতে পাচ্ছে।

”আবার আসব।”

অনুমতি নয়, প্রশ্ন নয়, ঘোষণাও নয়। একটা সিদ্ধান্ত জ্ঞাপনের মতো গিরি বলল।

বুলি মাথা হেলিয়ে দরজা বন্ধ করল।

 ছয়

রুনু ফিরল সন্ধ্যা নামার পর।

বারান্দায় অন্যদিনের মতো গিরি আজও অপেক্ষা করছিল চেয়ারে বসে। জাফরির ফাঁক দিয়ে সে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর দিকে তাকিয়ে একটার পর একটা বাসকে উত্তরে যেতে দেখলেই ভেবেছে, এইটায় রুনু আছে। অফিস থেকে ফেরার বাস অঘোর ঘোষ স্ট্রিট থেকে পঞ্চাশ গজ উত্তরে থামে।

এত দেরি আর কখনও হয়নি। গিরির হিসাব কষাই আছে। লামসডেন অ্যান্ড মেহরোত্রা থেকে বেরোবে পাঁচটা দশ বা পনেরোয়, লালদিঘিতে আসতে মিনিট পাঁচেক। বাস পাওয়া এবং উঠতে পারার সময়ের হিসাব করাটাই হয় মুশকিলের। তবে পৌনে ছ’টা নাগাদ প্রায় প্রতিদিনই রুনু ফেরে।

বাস বা ট্রাম বন্ধ থাকলে হেঁটে ফেরে। তাতে আরও পঁয়তাল্লিশ মিনিট বেশি লাগে। ছ’টার পর রুনু বাইরে থেকেছে, গিরির মনে পড়ে না।

মোহন ঠিকই দেখেছে। আজ রুনুর দেরি হওয়ারই কথা। যদি সিনেমায় গিয়ে থাকে,তা হলে ওরা পাঁচটা কুড়ি বা সাড়ে পাঁচটায় হল থেকে বেরুবে। তবু ছ’টার মধ্যেই ফেরা সম্ভব। ছ’টা বেজে গেছে। তা হলে ওরা কোনও রেস্টুরেন্টে ঢুকেছে। সেখানে কম করেও আধ ঘণ্টা। সাড়ে ছ’টায় ফিরতে পারে।

রুনু ফিরল প্রায় সাতটায়।

তার আগে গিরি একবার চা তৈরি করে খেয়েছে। তখন সে মোহন এবং বুলির কথা ভেবেছিল। তার ভালো লাগছিল বুলিকে। অতটুকু মেয়ের পক্ষে বিপজ্জনক কাজই, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসা। মোহন নিশ্চয় এমন কোনও চাপ তৈরি করেছে যে-জন্য বুলি ওর সঙ্গে বসবাসে বাধ্য হয়েছে। মোহনকে ভালোবাসার প্রশ্ন ওঠেই না।

মোহনই খাটের পাশে লোহাটা রেখেছে। ওখানে রাখার কী দরকার? কেউ আক্রমণ করলেই হাত বাড়িয়ে যাতে পায়। কে আক্রমণ করবে কাকে ওর ভয়? ওর বউ, বুলির বাবা নাকি বুলিকেই ভয়!

কলেজে বা মোহনের সঙ্গে থাকার সময় ছাড়া বুলি কীভাবে সময় কাটাত? বই পড়ে? সম্ভব কি পড়ার বই নিয়ে বসে থাকা! গিরির নিজের কথা মনে পড়ল। পনেরো বছর এই ফ্ল্যাটে সে কাটাচ্ছে। দিনে একবার হয়তো বেরোয়। দু’-তিন দিন রাস্তায় পা পড়েনি এমনও হয়েছে।

দ্বিতীয়বার সে চা তৈরির জন্য কেটলিতে জল ভরছে তখন দরজায় কড়া নাড়ল।

রুনু এসেছে। প্রতিদিনের মতো একই ভঙ্গিতে শব্দটা হয়েছে।

”যাই।”

প্রতিদিনের মতো গিরি সাড়া দিল। রুনুর হাতে প্যাকেট। দরজায় খিল দেবে রুনু। তাই দিল।

”চায়ের জল বসাচ্ছিলাম।”

”আমারও দিয়ো।”

রুনু ঘরে গেল কাপড় বদলাতে। অন্যান্য দিনের থেকে আজ চঞ্চল দেখাচ্ছে। লাবণ্য যেন অনেক বেড়ে গেছে। জ্বলজ্বল করছে চোখ মুখ।

চায়ের কেটলি বসিয়ে গিরি অপেক্ষা করতে লাগল টেবিলে। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে রুনু এল।

”কী আছে?”

রুনু শুধু হাসল দড়ির গিঁট খুলতে খুলতে।

”তোমার পাঞ্জাবি একজোড়া, খদ্দরের।”

গিরি উৎসাহভরে ঝুঁকে পড়ল।

”কোথায় কিনলে?”

”খাদি গ্রামোদ্যোগের রিডাকশনে। কত দাম নিয়েছে বলো তো?”

পাঞ্জাবি দুটো হাতে নিয়ে কাপড় পরীক্ষা করার ছলে গিরি দামের টিকিট দেখে নিল। এত দেরি করে ফেরার কারণ পাঞ্জাবি কিনতে যাওয়া নয়। এই দিয়ে অজুহাত তৈরি নেহাতই ছেলেমানুষি হবে। ও নিজে থেকেই বলুক কেন দেরি হল, দুপুরে বেরিয়েছিল কেন।

”পঁচিশ টাকা।”

”হল না।”

”আরও বেশি?”

”মোটেই না… আঠারো টাকা জোড়া। দারুণ সস্তা নয়?”

”সত্যি!”

”ছেঁড়া আছে পকেটের কাছে। বোঝাই যায় না এত সামান্য। সেলাই করে দেব।”

”আর কী আনলে।”

”টাকা কোথায় যে আনব। অফিসে তরুণবাবু বলল কাল দুটো কিনেছে আর গোটা তিন-চার আছে। এখুনি গেলে হয়তো পাওয়া যেতে পারে।”

”তখুনি চলে গেলে?”

”অফিসের সময়ের মধ্যে বেরোই কী করে। ছুটির পর হাঁটতে হাঁটতে গেলাম, কম দূর!”

”সঙ্গে কেউ ছিল?”

”সবিতা ছিল। ও কিছু কেনেনি।”

”আর কেউ?”

”না।”

কেটলির জল ফোটার শব্দ হচ্ছে। রুনু চা করতে উঠল। গিরি পাঞ্জাবি ভাঁজ করে রাখল।

”অম্বরকে আর দেখতেই পাই না। কখন আসে কখন যে যায়। রাত্রে পাখার শব্দটায় বুঝি ও আছে।”

”একটু রাত করে ফেরে। যখন আসে কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পাও না?”

”বুঝতে পারি না। খুব আস্তে আস্তে নাড়ে বোধহয়। ও কি রাত্রে খায়?”

”মাঝে মাঝে খেয়ে আসে।”

”বাইরে মাঝে মধ্যে খাওয়া মন্দ নয়।”

গিরি অপেক্ষা করল রুনুর জবাবের জন্য। কাপে চিনি ঢালছে একমনে হয়তো ও বলবে : ”চলো-না তা হলে আজ বাইরেই খেয়ে আসি। একদিন কচুরি খেতে বেরোব বলেও তো বেরোনো হল না।”

কিন্তু রুনু একমনে চামচ নাড়ছে। গিরি অপেক্ষায়।

হয়তো বলবে ; ”আজ আর রাঁধতে ইচ্ছে করছে না।”

”তা হলে চলো বাইরে কিছু খেয়ে আসি।”

”কোথায়?”

”যেখানে কম খরচে খাওয়া যায়।”

”কচুরি! মনে পড়লেই একটা দিনের কথাও মনে পড়ে।”

চায়ের কাপ কাছে টেনে নিয়ে গিরি চুমুক দিল। রুনু টেবিলের ওধারে মুখোমুখি বসল। ওরা কথা বলছে না কিছুক্ষণ।

বোধহয় সিনেমা থেকে বেরিয়ে কোথাও বসে ওরা খেয়েছে, তাই আর বাইরে বেরিয়ে খাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ নেই। রাতে কি রুনু খাবে? লক্ষ করতে হবে।

”অনেকদিন পর ব্লাউজটা পরলে আজ।”

তাড়াতাড়ি রুনু আঁচল টেনে কাঁধ ঢাকল।

”পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে, তাই ভাবলুম…”

”তোমাকে কিন্তু ভালোই দেখায়, অনেক কমবয়সি লাগছে।”

”কত কম?”

”বছর পনেরো।”

”তার মানে কুড়ি-একুশের মেয়ের মতো?”

”হ্যাঁ, যখন এই ফ্ল্যাটে প্রথম তুমি এলে।”

”তখন আমায় কেমন দেখতে ছিল মনে আছে তোমার?”

”আছে।”

”আমি কিন্তু জানি না কিছুই। যদি ছবি থাকত তা হলে সেটা দেখে মনে করার চেষ্টা করতে পারতুম। খুব শক্ত নিজের চেহারা মনে রাখা।”

”তোমার তো তবু ছোটোবেলার ছবি ছিল, আমার তা-ও ছিল না।”

”সে-ছবি আমায় খুব কষ্ট দিত। ভাবলে আজও দেয়।”

”কেন?”

খালি চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রুনু হাতটাও কাপের পাশে রেখে দিয়েছে। গিরি তার ওপর নিজের হাত রাখল। রুনু চোখ নামিয়ে নিরুত্তর রইল।

”আমি তোমার দুটো ছবিই দেখেছি।”

গিরি ভেবেছিল রুনুর চোখ সন্দিগ্ধ হবে। দুটো ছবি তাদের পক্ষেই দেখা সম্ভব যারা ভিতরের ঘরে গেছে। সে-ঘরে একটি উদ্দেশ্যেই বাইরের লোক যায়।

হঠাৎ ম্লান, ক্লান্ত দেখাল রুনুকে। ওর দিকে তাকিয়ে থেকে গিরি নিজেও ক্লান্তিবোধ করল। হয়তো রুনু জানে, গিরি এক দুপুরে গিয়েছিল ভিতরের ঘরে।

একটা ভোঁতা যন্ত্রণা গিরির মাথার মধ্যে ফেঁপে উঠছে। তার ইচ্ছে করছে সেটার মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে দিতে। আর ইচ্ছে করছে রুনুর সঙ্গে কথা বলতে। মনের মধ্যে যত ধোঁয়াটে সন্দেহ, কুৎসিত ধারণা দমবন্ধ করছে, যখন তখন কুরে খাচ্ছে, সেগুলো গলগলিয়ে বার করে দিয়ে হালকা হতে।

একটা সুযোগের অপেক্ষা সে অনেকদিন ধরে করছে। কথা বলে মনটাকে হালকা করার সুযোগ। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হত বোঝা নামানো মানেই রুনুর মনের ওপর বোঝা চাপিয়ে দেওয়া। ব্যাপারটা নিছকই স্বার্থপরতা হবে।

”চলো বারান্দায় গিয়ে বসি।”

একটি মাত্র চেয়ার। দু’জনে মেঝেয় বসল। পর্দার তলা দিয়ে ঘরের আলো বারান্দায় পড়েছে। রুনু তার গোড়ালিতে আঙুল ঘষছে চেয়ারে ঠেস দিয়ে। রেলিংয়ে পিঠ দিয়ে গিরি।

”তোমার আর ব্যথা করে রাত্রে?”

ঘুমের মধ্যে নড়াচড়ায় গিরির মাথায় লেগে যেতে পারে, তাই রুনু এখন মেঝেয় শোয়।

”দিনেরবেলায় করে।”

”দুপুরে ঘুমোও?”

”না।”

”তা হলে কী করো, বসে বসে শুধু ভাবো?”

”হ্যাঁ।”

”কী ভাবো? আমার কথা?”

”হ্যাঁ, তোমার কথা। তোমাকে সুখী করতে না পারার কথা।”

”আমি সুখী নই, এটা বুঝলে কী করে?”

”নিজের দিকে তাকিয়ে। কিছু কিছু ব্যাপার আছে যা ভাবতে ভালো লাগে। নিজেকে শক্তিমান বিচক্ষণ স্বাবলম্বী এইসব, আমাকে ছাড়া পৃথিবীতে তোমার কোনও ভরসা নেই, কোনও প্রয়োজন নেই, অবলম্বন নেই।”

রুনু কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। হাত বাড়িয়ে গিরির বাম ঊরুর ‘পরে রাখল। মাথা নাড়ল গিরি।

”আমি কিন্তু সুখী।”

”আমি সম্পূর্ণ তোমার উপর নির্ভর করে বেঁচে আছি।”

”দিনরাত কি তুমি এই চিন্তাই করো?”

গিরি ইতস্তত করল।

”একা থাকলে মানুষ চিন্তা করবেই। যখন তুমি বেরিয়ে যাও কেমন অদ্ভুত একটা অস্বস্তি, ভয় আমাকে পেয়ে বসে।”

”আমি তা হলে চাকরি ছেড়ে দেব?”

”না না না, এটা পাগলের মতো কথা হল। খাওয়া পরার কথা বাদ দিলেও তুমি তো আর আমার মতো অঙ্গহীন নও। তোমার শরীরের, মনের জন্যই এই ছোট্ট জায়গায় বন্দি হয়ে থেকে কী লাভ?”

”তা হলে…”

”দাঁড়াও শেষ করতে দাও আমাকে।”

নিজেকে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করে গিরি বুঝল সম্ভব নয়। আবেগ তাকে মথিত করছে।

”আমি বেঁচে আছি তোমারই হাতে… তুমি বাইরে যাও, সেটা অন্য জগৎ… যখন ফিরে আস সেই জগতের রূপ রস গন্ধ মনে মাখিয়ে নিয়ে। আমরা দু’জনে দু’রকম মন নিয়ে বাঁচছি। আমি আমার এই খুদে জগতে বসে নানা দুঃস্বপ্ন গড়ছি আর তার মাঝেই চাইছি, আন্তরিকভাবেই, তোমাকে ভালোবাসতে। কী যে কঠিন ব্যাপার একা এ-ভাবে সময় কাটানো। মাঝে মাঝে তোমার বাবাকে মনে পড়ে। একা চুপচাপ বসে আকাশে তাকিয়ে দিন কাটাতে সত্যিই ক্ষমতার দরকার।”

”আমরা অন্য কোথাও বাসা বদল করি…”

রুনু জবাব দিল না। রুনু হাত বুলোচ্ছে তার ঊরুতে। স্থান বদল করলে মন বদলাবে যে-সব ব্যাপারে, এটা তা নয়। সে জানে, অম্বর চলে গেলেও সন্দেহের জ্বালা থেকে রেহাই পাবে না।

”কিংবা তুমি একটা কিছু কাজ নিয়ে যদি ব্যস্ত থাকতে পারো।”

”ঠোঙা বানানো?”

”ঠাট্টা নয়। সিরিয়াসলিই বলছি। মোটরের কাজটাজ কি একদম ভুলে গেছ?”

”হ্যাঁ।”

”ভাবছিলুম, মোহনবাবুর তো কারখানা আছে, সেখানে গিয়েও যদি রোজ বসো। আবার সব মনে পড়ে যাবে।”

”অনেক কিছুই মনে পড়ে যাবে।”

ছড়ানো বাঁ পায়ের পাশে ডান হাঁটুর নীচে অদৃশ্য পায়ের ওপর গিরি চড় মারল। মেঝেয় শব্দ হতেই সে হেসে উঠল।

”শব্দটা হত না যদি মোহন কথাটা কানে নিত। ওকে তিন দিন আগে একজন মেট জানিয়েছিল লিফটে লিক করছে, ভালভ কক থেকে হাওয়া বেরিয়ে যাচ্ছে। লিফট বিপজ্জনক জেনেও আমাকে লরিটা চেক করতে পাঠিয়েছিল তলায় ঢুকে। হয়তো আশা করেছিল অ্যাকসিডেন্ট ঘটবে-আমি মরেও যেতে পারি।”

”কেন, তোমার মনে হল কেন?”

ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। শুধু অন্যের চোখের সাদা অংশটুকু ছাড়া ওরা আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তার দ্বারা বুঝতেও পারছে না, কী ভাবছে অপরে। নীরবতা অসহ্য হয়ে উঠতে গিরি অবশেষে বলল,

”তোমার প্রতি দুর্বলতা ছিল।”

গিরি সাবধানে ‘আছে’ শব্দটি এড়িয়ে গেল।

”বহুকাল আগের কথা।”

”তোমার মা চলে যাওয়ার পর দু’মাস কীভাবে তোমার চলেছিল?”

রুনু চমকাল না। স্বাভাবিক স্বরে বলল, ”ভিক্ষে করে চলেছিল।”

”এড়িয়ে যাচ্ছ প্রশ্নটা।”

”তোমার কী মনে হয়?”

”মোহনের কথাই মনে হয়।”

”তুমি তা হলে জানো।”

”কী জানি? তুমি আমায় কিছু তো বলোনি।”

”বলার মতো নয় বলেই জানায়নি। দু’মাস হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকা যায় না। তোমার কাছে হাত পাততে পারতুম, কিন্তু ওকেই বেশি পাকা লোক মনে হয়েছিল। এমন ক্ষেত্রে, বেঁচে থাকার প্রশ্নটাই বড় হয়ে ওঠে। শরীরকে শরীর দিয়েই বাঁচানো ছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না। এত বছর পর ছেঁদো কথা বলে, তর্ক করে লাভ নেই। পছন্দ-অপছন্দ বা ভালোবাসাবাসি এ-সব আমাদের মধ্যে ছিল না। মোহন টাকা দিয়েছে আমি শোধ করেছি। জানতাম যতটুকু পাওয়া যায় তার বেশি কিছু ও চাইবে না। আত্মমর্যাদার প্রশ্ন নয়, বাঁচার ব্যাপারটাই বড় ছিল।”

গিরি চমকাল না, আহত বোধ করল না। তার বহুদিনের অনুমান মিথ্যায় পর্যবসিত হয়নি। রুনুকে দু’মাস টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে মোহন। সে দুঃখবোধ করল রুনুর জন্য। কুৎসিত, রুচিহীন, স্বার্থপর একটা লোককে দু’মাস সহ্য করতে হয়েছে, এর থেকে অত্যাচার আর কী হতে পারে!

”ও রোজ আসত?”

”প্রায়ই।”

”থাকত?”

”রাতে? … মাঝে মাঝে থেকেছে।”

এত অসংকোচ স্বীকারোক্তি গিরি আশা করেনি।

”আমার সম্পর্কে কিছু বলত?”

”চাইত না তোমার সঙ্গে মেলামেশা করি।”

”কেন!”

রুনু হাসল, ”ও জানত তোমার আমার মধ্যে গভীর কিছু একটা আছে। সেইটাই ও নিজে চাইত।” রুনু আবার হাসল।

”আশ্চর্য, এ-সব কিছুই জানতাম না। তখন রোজই আমাদের দেখা হত কিন্তু তোমায় দেখে কিছুই বুঝতে পারতাম না। মোহনের সঙ্গেই তো তুমি থেকে যেতে পারতে।”

”সম্ভব নয়। ও লোকটা অন্যের জীবন দখল করে, জীবন পেতে চায়। কিছুদিন ধার দেওয়া যায়, চিরকাল কি সম্ভব?”

”আমিও তো তোমার কাছে জীবন ধার করে এখন বাঁচছি।”

”ও-কথা বোলো না। দুটো একরকম নয়। এখনই আমি বুঝতে পারছি কিছু একটা করছি। একটা উদ্দেশ্য কিংবা একটা দায়িত্ব যাই বলি না কেন, পালন করছি। তৃপ্তি পাই, খাটুনিকে বিরক্তিকর মনে হয় না। আমার জীবনের সব থেকে সুখের সময় এখনই বোধ হয়।”

”যা-সব বললে, তাতে তোমার ভয় করছে না? মনে হয়নি কি, আমি রেগে যাব, ঘেন্না করব তোমাকে?”

”বলার সুযোগ পেলে আগেই ওই ব্যাপারটা বলতাম। আমি তো জানি তুমি আমায় কত ভালোবাস।”

রুনু ঘুরে বসে গিরির বুকে হাতের পাঁচ আঙুলই স্পর্শ করল। অনুভবটা আজ দ্বিতীয়বার সে পেল। বুলি যখন ছুঁয়েছিল, সেটা প্রথমবার এত অসংকোচে তারা কখনও কথা বলেনি।

”আমারও একটা কথা বলার আছে। একদিন দুপুরে তোমার মার কাছে…”

”জানি।”

গিরি প্রশ্ন করল না কার কাছে ও শুনেছে। মোহন ছাড়া আর কেউ বলার নেই। হঠাৎ একটা ক্রোধ তাকে ঝাঁকুনি দিয়েই রগের কাছে কেন্দ্রীভূত হল। সেখান থেকে তার সারা দেহে একটা তরঙ্গ কেঁপে কেঁপে বয়ে গেল বার কয়েক। প্রাণপণে সে নিজেকে সংযত করে রাগ থেকে নিজেকে মুক্ত করল। বহুকাল ঘরের কোণে রাখা সিন্দুক সরিয়ে নিলে মেঝেয় তার পায়ের দাগ রয়ে যায়। বুকের মধ্যে গিরি দাগ দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু বুকটা বড় লাগছে, ফাঁকা বোধ করছে।

হঠাৎ সেই ফাঁকা জায়গাটায় একটা লোহাকে সে দেখতে পেল। দেয়ালে হেলান দেওয়া, খাট থেকে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। রুনুকে এটার কথা জানানো যায়। ওর বুক থেকে পাষাণভার তুলে নিয়ে ওকে সে মুক্তি দিতে পারে।

”লোহাটা অম্বরের ঘরে আছে কি না দেখেছ?”

”লোহা! কোন লোহা?”

রুনুর বিস্মিত ত্রস্ত স্বরে গিরি মায়া বোধ করল। বুক থেকে হাতটা আস্তে তুলে নিল।

”তোমার কি ধারণা…”

গিরি মনে মনে হাসল। বলুক কী বলবে।

”অম্বর তোমার মাথায় মেরেছে? কেন মারবে?”

”আমি কি তাই বলেছি? তুমি অযথা সন্দেহ করছ। আমাকে মেরে ফেলবে কেউ এটা চিন্তাই করতে পারি না।”

”সেই রকম ইঙ্গিতই দিয়েছ এর আগে।”

”তোমাদের মধ্যে কোনও ব্যাপার ঘটেনি?”

রুনু দু’হাতের ভরে সামনে ঝুঁকে গিরির মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ”তুমি এইসব চিন্তা শুরু করেছ, তার মানে বুড়ো হয়ে গেছ। তোমার এই ব্যাপারটা, সন্দেহ করাটা আমার বিশ্রী লাগে। আমি ঠিকই বুঝতে পারি, কিন্তু কেন, কেন? আমার মধ্যে কী দেখলে যাতে মনে হতে পারে আমি… অন্যে আসক্ত? তোমার মন নোংরা হয়ে গেছে, আমি বলছি।”

কাঁচা পিঁয়াজ আর রাই-এর গন্ধ গিরি পাচ্ছে রুনুর মুখ থেকে।

দুপুরে সিনেমা দেখে তা হলে ওরা রেস্টুরেন্টেই গেছল। কাটলেট, চপ, মোগলাই পরটা, ফিশ ফ্রাই এ-গুলোর সঙ্গেই কাঁচা পিঁয়াজ, রাই দেয়। পনেরো বছর লুকিয়ে রেখেছিল অনেক কথা। লুকিয়ে রাখতে ও পারে।

”বোধ হয় বুড়োই হয়ে গেছি।”

গিরি স্থির করল লোহাটার কথা রুনুকে বলবে না।

 সাত

অন্যদিনের মতো গিরি ভোরবেলায় বারান্দায় এসে চেয়ারে বসল।

শেষ রাতে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। বাতাস স্থির। অঘোর ঘোষ স্ট্রিট ভোরে আবছা আলোয় স্যাঁতস্যাঁত করছে। চেয়ারটা ভিজেছে। নিলাম থেকে কেনা কোনও এক বনেদি বাড়ির জিনিস। অত্যন্ত ভারী। গত বছর এক দুপুরে বৃষ্টির সময় গিরি এটাকে টেনে ঘরে ঢোকাবার চেষ্টা করেছিল, পারেনি।

অফিস থেকে ফিরে রুনু চেয়ারটাকে ঘরের মধ্যে আনে। চৌকাঠ পার করার জন্য তুলতে হয়েছিল। কুঁজো হয়ে ঝুঁকে যখন তুলছিল, গিরি তখন লক্ষ করে ওর ফুলে ওঠা কাঁধের পেশি, সংকুচিত কোমর, কঠিন নিতম্ব।

রুনুর দেহে তারুণ্য লুকিয়ে আছে, গিরি কাল থেকে এটা আবার আবিষ্কার করেছে। খেলোয়াড়ের মতো মেদবিহীন মসৃণ গড়ন। গত রাত্রে রুনুকে খাটে এসে শোবার জন্য বলতে ইচ্ছে করছিল। কাল সন্ধ্যা থেকে ওকে অপরিচিত একটা মেয়ের মতো মনে হচ্ছে। ওর গতিবিধি, কণ্ঠস্বর, চাহনি অশ্লীল অভিপ্রায়গুলোকে খুঁচিয়ে উত্তেজিত করছিল।

স্বচ্ছ এবং স্থির ভোরের বাতাস দীর্ঘ গভীর শ্বাস-দ্বারা ফুসফুসে টেনে গিরি তাজা বোধ করছে। রেলিংয়ের জাফরির ফাঁক দিয়ে সে রাস্তায় তাকিয়ে। প্রতিদিনের ভোরের মতোই একটি ভোর। শান্তভাবে একটি দিন শুরু হচ্ছে।

রুনু চা করছে। অম্বর এইমাত্র কলঘর থেকে বেরোল। ওরা আর গল্প করে না। দুটি সিদ্ধ ডিম খোসা ছাড়িয়ে টেবলে রাখবে রুনু। একজোড়া কলা থাকবে তার পাশে। অম্বর যখন খাবে, রুনু তখন কাজে ব্যস্ত হয়ে শোবার ঘর থেকে রান্নাঘর যাতায়াত করবে। নিশ্চয় অম্বরের চোখ অনুসরণ করবে ওকে।

”তোমার চা।”

গিরি হাত বাড়িয়ে কাপ নিল। রুনু ব্লাউজটা বদলেছে। বাসিচুল কানের পাশে ঝুলে রয়েছে। এখনও স্নান করেনি।

”আজ বাজারে যেতে হবে।”

”তোমার মাথা এখন কেমন?”

”ভালোই। বেলায় বাজারে ভিড় থাকে না, ধাক্কা লাগার ভয় নেই।”

”টাকা রেখে যাব।”

চা খেয়ে গিরি কাপটা মেঝেয় নামিয়ে রাখল। অম্বর মাঠে যাবে এখন। সামনের হপ্তা থেকেই লিগ শুরু হচ্ছে। তখন প্র্যাকটিস বন্ধ হবে। সকালে মাঠে যাবে না, ভাত এখানেই খাবে। ভিতর থেকে কথাবার্তার শব্দ আসছে না। ওরা বোধ হয় চুক্তি করে ফেলেছে গিরির সন্দেহ উদ্রেকের মতো কিছুই করবে না।

সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পর্যন্ত রাস্তাটা জাফরির একটা ফাঁক দিয়ে গিরি দেখতে পাচ্ছে। ওপারে বাস স্টপে একটি মেয়ে এসে দাঁড়াল। ছাপা সবুজ শাড়ির তলার অংশ দেখা যাচ্ছে। সে কুঁজো হল মেয়েটিকে দেখার জন্য।

বুলি!

হাতে খাতা বা বই ছাড়া আর কিছু নেই। এত দূর থেকে ওর কানা চোখটি দেখা যায় না। কলেজে যাচ্ছে। স্টপে আর কোনও লোক নেই। উত্তরে মুখ করে বাসের জন্য তাকিয়ে। ও হয়তো ভুলে গেছে রাস্তার ওপারে তিনতলার বারান্দায় গিরি থাকে। নয়তো কৌতূহলভরে দু’-একবার অন্তত তাকাত।

গিরি উঠে দাঁড়াল।

অম্বর এগোচ্ছে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর দিকে। লাল গেঞ্জিটার বদলে আজ হলুদ নকশার বুশ-শার্ট। দ্রুত পা ফেলা।

বুলি একবার মুখ ফিরিয়ে বাস স্টপে এসে দাঁড়ানো নতুন লোকটিকে দেখল। অম্বর ওর হাত দশেক তফাতে দাঁড়াল। দেখল বুলিকে। পকেট থেকে খুচরো পয়সা বার করে গুনল এবং দ্বিতীয়বার বুলির দিকে তাকাল, গিরি জানে এই দ্বিতীয়বার তাকানোটা কোনও মেয়ের দিকে নয়, বুলির কুরূপতার দিকে। এটার জন্য অন্তত দু’বার বুলির দিকে তাকাতে হয়।

সাধারণত যতক্ষণ তাকানো উচিত অম্বর তার থেকে বেশিক্ষণই তাকিয়েছে। বুলি আস্তে আস্তে দক্ষিণ দিকে মুখটা ফিরিয়ে নিল। হাত ঘড়িতে সময় দেখার জন্য মুখটি নামিয়ে রাখল। গিরির কষ্ট হচ্ছে বুলির এই করুণ অবস্থার জন্য। সে নিজে জানে কত অসহায় লাগে এই সময়টায়।

হয়তো বুলি অভ্যস্ত হয়ে গেছে এই রকম চাহনির সঙ্গে। তবু একটি যুবকের চোখ থেকে মুখ সরিয়ে নিতে হচ্ছে এই বয়সি মেয়েকে, গিরি নিজেই আহত বোধ করল। বুলি জানে তার মুখে ওরা কী দেখে।

ক্রাচ দুটো রেলিংয়ে হেলান দিয়ে রেখে এক পায়ে দাঁড়িয়ে গিরি দু’হাত ওপরে তুলল। আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিতে। বুলির চোখ যদি এদিকে ফেরে। কিন্তু ও আবার উত্তরে তাকিয়ে রয়েছে। অম্বর আর ওর দিকে তাকায়নি। বুলি নিশ্চয়ই জানে, কেন তাকাচ্ছে না।

আর একটি লোক এসেছে। মাঝবয়সি, হাতে রেশনব্যাগ, খুবই অস্থির। বুলির কাছে সময় জানতে চাইল। জানার পর বিরক্তমুখে কিছু বলল। বুলি জবাব দিল। তারপরই একসঙ্গে তিনজন উত্তরে তাকিয়ে দু-তিন পা এগোল।

বাসটা চলে যাবার পর গিরি আবার চেয়ারে বসল। প্রতিদিনের দেখাশোনা জানা রুটিন-মাফিক ব্যাপারগুলো চারদিকে হয়ে চলেছে। সে ঘরে এল। রুনু এইমাত্র ঘর মুছে গেছে, মেঝেটা ভিজে। খাটে শুয়ে তার মনে হল আর একটু ঘুমিয়ে দিনটাকে ছোটো করে আনা যায়। সে চোখ বন্ধ করল।

ঘুমোতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হল গিরি। রুনুর অফিসে বেরোবার তোড়জোড় চোখ বুজেই সে দেখতে পেল।

”টাকা টেবিলে রেখে যাচ্ছি।”

”হুঁ।”

”দরজা বন্ধ করো।”

”যাচ্ছি।”

প্রতিদিন এই সময়ে সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। আজ আর গেল না। বাইরের দরজা ভেজিয়ে রুনু নেমে যাচ্ছে। গিরি শব্দ পেল না। আগে পেত।

ওপরতলার ছেলে দুটি স্কুলে যাচ্ছে। গিরি উঠে বসল। চার-পাঁচটা সিঁড়ির উপর থেকে ওরা গিরির ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাওয়াটায় লাফিয়ে পড়ে। প্রত্যেক তলায় ওরা এ-ভাবে লাফিয়ে পড়বে।

বারান্দায় এসে দাঁড়াল সে। রাস্তায় এখন ভিড় ব্যস্ততা শব্দ। বনমালী সরকার লেনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বাজারে যাবার কথা ভাবল। দু’-তিন দিন ঘরে রাখা যায় এমন আনাজ সে কেনে। এ-ছাড়া অম্বরের জন্য ডিম ও কলা। রুনু পনেরো টাকা রেখে গেছে। অর্থাৎ মাছ কেনা যাবে না।

বাজারে মিনিট কুড়ির বেশি গিরি থাকে না। একসময় তার অভ্যাস ছিল বার দুয়েক বাজারটার দুই প্রান্ত ঘুরে দরদাম করে জিনিস কেনা। এখন আর তা করে না। ছক কেটে রেখেছে, সেই অনুযায়ী পরপর কিনে বেরিয়ে আসে। থলি ভরে উঠলে মুশকিল হয় একসঙ্গে ক্রাচ ও থলি ধরে চলতে।

বাজার থেকে বেরিয়েই বুলিকে তার মনে পড়ল। কৌতূহল বোধ করল, কী করছে এখন? কলেজ থেকে এতক্ষণ ফিরেছে নিশ্চয়। রান্না করে খাবে। হয়তো তারই ব্যবস্থা করছে। একবার দেখে এলে হয়!

দরজার পাল্লা দুটো ভেজানো। ইঞ্চি খানেক ফাঁক রয়েছে। গিরি দরজায় টোকা দিল।

বুলি অবাক হয়ে গেল ওকে দেখে।

”আমি ভাবলাম এইসময় কে আবার!”

”মোহন বুঝি এ-সময় আসে না?”

”না। সকালে তো কারখানায় যেতেই হয়।”

”চা খেতে এলাম। কালকের চা খুব ভালো লেগেছিল। তা-চাড়া, আসব বলেছিলাম মনে আছে।”

”ভেতরে আসুন।”

বুলি বেশ কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে। স্নান হয়ে গেছে। ভিজে চুল দু’ভাগে পাট করে আঁচড়ানো। মাথায় চুল কম। কপালের চামড়া খসখসে এবং ফ্যাকাশে। সারা শরীর হাহাকার করছে ভিটামিন ও স্নেহ পদার্থের জন্য। শাড়িটায় কোরা গন্ধ। বোধহয় মোহন কিনে দিয়েছে এখানে আসার পর।

”কী করছিলে, রান্না?”

”না। সামনের ঘরের একটা বাচ্চচা ছেলে আছে, লজেন্স দিয়ে ভাব করে ফেলেছি। কলেজ থেকে ফেরার সময় দাঁড়িয়ে থাকে আমার জন্য। ও ছিল এতক্ষণ। বারবার আসে-যায় তাই দরজা খোলাই রেখেছি। একা কি চব্বিশ ঘণ্টা কাটানো যায়।”

বুলি হাসছে। গিরিও হাসল। মোহন কি পছন্দ করবে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাব জমানো?

”আমারও একই অবস্থা। তবে রুনু চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত পনেরো ঘণ্টা থাকে।”

”তা হলে একই অবস্থা হল কী করে?”

”কেন, মোহন এখানে বেশ কয়েক ঘণ্টা তো থাকে।”

বুলির অক্ষত চোখটা স্থির হয়ে গিরির মুখ থেকে কিছু একটা পেতে চাইছে। অশ্লীলতা? গিরি অপ্রতিভ হতে থাকল।

”বাজার করে এলেন?”

চেয়ারটা বুলি এগিয়ে দিল।

”দু’-তিন দিন অন্তর বাজারে যাই। আজ সকালে তোমায় দেখলুম বাস স্টপে।”

”কী করে? ওহ, আপনার বারান্দা থেকে তো দেখা যায়। দাঁড়ান চায়ের জল বসাই।”

বুলি বেরিয়ে যেতেই হাত বাড়িয়ে গিরি পার্টিশনের পর্দাটা তুলল। লোহাটা একই ভাবে রয়েছে। চোরের ওপর বাটপাড়ি করেছে মোহন। গিরি পর্দা আর একটু তুলল। দেয়ালের কোণে ঘেঁষা খাটের দু’পাশে এক গজের মতো জায়গা। দেয়ালের ধারে বোধ হয় আলনা আছে। শাড়ির অংশ দেখা যাচ্ছে।

চটির শব্দ হল। গিরি পর্দা নামিয়ে দিল। বুলি চটি পরে ঘরের মধ্যে। রুনু এটা পছন্দ করে না।

”বাস বড্ড দেরিতে আসে।”

”ন’ নম্বর রুটে এই রকমই। দেখলুম একটা লোক তোমার কাছে সময় জানতে চাইল, তারপর কী বলল ও যেন!”

”বলল, সাতটার মধ্যে মেটেবুরুজ পৌঁছতেই হবে, সেখান থেকে কাজ সেরে কালীঘাট। আমাকে জিজ্ঞাসা করল সময়ে পৌঁছতে পারবে কি না। আচ্ছা আমি কী করে বলি সাতটার মধ্যে পৌঁছতে পারবে কি পারবে না। খুব হাসি পাচ্ছিল। আর একজন দাঁড়িয়েছিল, সে বলল, পৌঁছতে পারবেন।”

”আর একজন ছিল নাকি, দেখিনি তো!”

”হ্যাঁ ছিল।”

বুলি উপেক্ষা করে গেল অম্বরকে। অর্থাৎ গিরির কৌতূহলকে। গিরির তা ভালো লাগল।

”তুমি রাঁধবে না?”

”আমি তো আলুভাতে-ভাত ঘি দিয়ে খাব। মিনিট পনেরোতেই হয়ে যাবে।”

”মাছ তো খাও, না, ডিম?”

”মাঝে মাঝে।”

গিরি মেঝে থেকে বাজারের থলিটা তুলে নিয়ে দুটো মুরগির ডিম বার করল।

”আমি জানি তুমি আপত্তি করবে, ঠিক কি না?”

”করবই তো।”

গিরি ডিম দুটো থলির মধ্যে রেখে দিল।

”তা হলে আর আমার খাওয়া হল না।”

”কেন?”

”অনেক দিন খাই না তাই ভেবেছিলুম ওমলেট করিয়ে খাব।”

বুলি হেসে উঠল।

”দিন তা হলে?”

”না থাক। আমি একা খাব আর তুমি দেখবে তাই কখনও হয়! চক্ষুলজ্জা আছে না?”

”আচ্ছা আচ্ছা, আমি নয় একটু খেয়ে আপনাকে লজ্জা থেকে রেহাই দেব।”

গিরি চারটে ডিম বার করল। বুলি ভ্রূকুটি করেছে।

”এইটুকুটুকু দুটো ডিমের থেকে ভাগ দিলে আমার তো কিছুই থাকবে না। চারটের কমে হয় কখনও?”

”তা তো বটেই। আমার একটা চোখ, আপনার দুটো। লজ্জা তো আমার থেকে আপনার ডবল হওয়ারই কথা।”

বুলি কয়েক সেকেন্ড গাম্ভীর্য বজায় রেখে গিরির সঙ্গে হাসতে শুরু করল।

ওরা রান্নাঘরে এল। ঘরটা প্রায় ফাঁকাই। প্লাস্টিকের জালি থলিতে কয়েকটা আলু, ঢোঙায় চাল, ডাল, নুন। ঘিয়ের বোতল, আর একটা বোতলে চিনি। কনডেনসড মিল্কের কৌটো। দেখলেই বোঝা যায় এখনও গুছিয়ে বসেনি। বুলি অ্যালুমিনিয়ম বাটিতে চায়ের জল গরম করতে বসাল।

”সারাদিনই ঘরে থাকি, তাই সংসারের অনেক কাজ সময় কাটাতেই করি। অবশ্য রুনু সেটা একদমই পছন্দ করে না। কিন্তু কী করব, কিছু একটা না করে মানুষ কি শুধুই বসে বসে দিন কাটাতে পারে?”

”কিছু একটা হাতের কাজ, পুতুল তৈরি কি কাঠের শৌখিন জিনিস বানানো, তা হলে কিন্তু সময় কাটানো শক্ত হয় না।”

”আর পয়সাও আসে।” গিরির চোখ হাসিতে ঝকঝক করতে লাগল, ”আসলে আমি ভীষণ কুঁড়ে। নয়তো ইচ্ছে ছিল বাটিকের কাজ শেখার।”

”আমি জানি। শিখবেন।”

”কোথায়? এখানে?”

দু’জনের তিনটি চোখ কয়েক মুহূর্ত স্থির নিবদ্ধ থেকে আলোচনাটাকে এখানে ছেড়ে দিল।

গিরি ক্রাচে ভর দিয়ে সামনে ঈষৎ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে, বুলি ডিম ফাটাচ্ছে একটা কাচের গ্লাসে। ঠং ঠং শব্দ হচ্ছে।

”কতদিন হয়েছে আপনার অ্যাকসিডেন্ট?”

”পনেরো বছর।”

বুলি ঘুরে তাকাল গিরির মুখের দিকে। পায়ের দিকে তাকাবে না এটা সে জানে।

”তোমার?”

”তেরো বছর। বাড়ির সকলেরই হয়েছিল। একটা ছোট ভাই ছিল, মারা গেল।”

”অসুবিধা হয় না?”

”হত, এখন হয় না। আপনার কি হয়?”

গিরি জবাব দিল না। বুলি বার্নার থেকে বাটি নামিয়ে তার মধ্যেই চায়ের পাতা দিল।

”হয়।”

বুলি আবার মুখ ফিরিয়ে তাকাল। চোখে প্রশ্ন।

”আমার এখন প্রায়ই ছুটতে ইচ্ছে করে, লাফাতে ইচ্ছে করে। পারি না বলেই অসুবিধা হয়।”

গিরি হাসতে লাগল। একটা চোখ আর একটা পা, দুটোর মধ্যে উপযোগিতার গুরুত্ব অনুযায়ী সে চোখের বিনিময়ে পা চাইবে বুলি নিশ্চয় চাইবে চোখ।

”আমি না থেমে সাতশো আটাশ পর্যন্ত একবার স্কিপ করেছি।”

”ছোটোবেলায়?”

”পাঁচ বছর আগেও। বাচ্চচাটা স্কিপিং রোপ এনেছিল। আপনি আসার একটু আগে, একশো দশের পর হাঁফ ধরল, ছেড়ে দিলুম।”

”আহ, আর একটু আগে এলেই তো ভালো হত।”

”আপনার সামনে কি তাই বলে স্কিপ করতুম নাকি!”

”আমাদের বাড়ির সামনে একটা মেয়ে আছে, শু্যটার। রাইফেল তুলে তাক প্র্যাকটিস করে একটা চোখ বন্ধ করে থাকে, চোখটা তখন ওর কোনও কাজেই আসে না, একেবারে অদরকারি হয়ে পড়ে। ভাবতে পারো?”

”ওগুলো সাময়িক। খাটে শুয়ে কি মনে হয় পায়ের তখন কোনও কাজ আছে? কিন্তু আমরা তো সারাক্ষণ শুয়েই থাকি না।”

বুলি কড়াই চাপিয়ে ঘি দিল। গলে যেতেই সাঁড়াশিতে ধরে কড়াইটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঘি-টা মাখিয়ে দিতে লাগল।

”বেগুনের বোঁটা থাকলে চট করে মাখিয়ে দেওয়া যেত।”

”আমিও ঠিক তাই ভাবছিলাম।”

”তোমরা বাঙাল, না?”

”হুঁ, তবে দেশের কিছুই মনে নেই। আপনি মনে করতে পারেন বাচ্চচা বয়সের কথা?”

গিরি পারে। কিন্তু সেগুলো কষ্টের যন্ত্রণার স্মৃতি, দারিদ্র্য এবং গঞ্জনার। মাথা নেড়ে বলল, ”না, মনে পড়ে না।”

”আমার দু’-একটা মনে পড়ে। তবে দেশের নয়। রিফিউজি হয়ে আসি যখন বছর ছয়েক বয়স। মা ঠিক ঝিয়ের কাজ করত। আমি সঙ্গে থাকতাম, হেল্পার।”

”সাঁড়াশিটা দাও, চা অনেকক্ষণ ভিজছে। কড়া চা আর বিষ একই জিনিস।”

গিরি একটু বেশি ব্যস্ত হয়েই কথাগুলো বলল। বুলির বাল্যস্মৃতি সে শুনতে চায় না। এ-সব কথাবার্তা এখন অর্থহীন। বুলি নীরবে সাঁড়াশিটা এগিয়ে দিল।

ডান ক্রাচটা দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে বাম ক্রাচে ভর দিয়ে গিরি বাটিটা সাঁড়াশিতে ধরে কাপে লিকার ঢালতে শুরু করল। বুলি একবার দেখল মাত্র।

”তুমি তো পাথরের চোখ লাগিয়ে নিতে পারো!”

”উনিও সে কথা বলেছেন।”

উনি! গিরির অদ্ভুত লাগল শব্দটা। বুলি অন্যের সামনে কী বলে মোহনকে সম্বোধন করে? মোহনদা! মোহনকাকা! মোহনমামা!

”ওতে কোনও লাভ হবে না আমার। মুখের অবস্থাটা দেখেছেন। মানুষ সব থেকে ভালোবাসে নিজের মুখটাকেই তো? প্রত্যেকেই সুন্দর বা সুন্দরী মনে করে নিজেকে আয়নার সামনে। নিজেকে আমায় ভয় করে, বীভৎস মনে হয়।”

স্বরে কোনও রকম আবেগ নেই, কাঠিন্যও নেই। মুহূর্তের জন্য গিরি রুনুর বাবার বসার ভঙ্গিটা দেখতে পেল। সে অনুভব করল তার হাতটা আড়ষ্ট হয়ে গেছে।

”নিজেকে তুমি ভালোবাস না?” গিরি যথেষ্ট সংকোচ এবং ভয় নিয়ে প্রশ্নটা করল। বুলি তার একমাত্র দৃষ্টি পূর্ণভাবে নিক্ষেপ করল গিরির মুখে।

”না। কোনও কারণ আছে কি? একটা আস্ত সুন্দর জিনিসকেই মানুষ চায়, খুব স্বাভাবিক। আমি আস্ত নই, সুতরাং আমাকে কেউ চাইবে বা ভালোবাসবে, তাই কি মনে করব?” বুলির হাসিটা স্বতঃস্ফূর্ত ঠোঁটের উপর দিয়ে ভেসে গেল। ”ভালোবাসা কোনওদিনই পাব না, দেবও না।”

হঠাৎ সন্ত্রস্তের মতো বুলি থেমে গিয়ে তার চাহনিকে গুটিয়ে আনল। ভয় পেয়েছে? গিরির মনে হল, ‘দেবও না’ কথাটা যদি মোহনের কানে যায় সেইজন্যেই। মেয়েটা নিজেকে ভালোবাসে না। ও অন্যকে ভালোবাসবে কী করে! অথচ মোহনের ধারণা, তাকে নাকি ভালোবাসে। গিরি মনে মনে হেসে উঠল।

”তা হলে তুমি এখানে এলে কেন?”

বুলির পিঠটা শক্ত হয়ে গেল। বাড়াবাড়ি করা হল বোধহয় কথাটা জিজ্ঞাসা করে। জবাব না দেওয়ায় গিরি কুঁকড়ে গেল। বুলি গভীর মনোযোগে ওমলেট ভাঁজ করছে। রুনু কি আজও দেরি করে ফিরবে?

”মোহন আসবে কখন?”

”ঠিক নেই, না-ও আসতে পারে।”

যদি এখন এসে পড়ে তা হলে গিরিকে দেখে কী ভাববে, কী বলবে? কাল ভাবভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে, সে বিরক্ত হয়েছে। ট্যাবলেট খাইয়েছে বটে কিন্তু সেটা আত্মতৃপ্তি পাবার জন্য।

”চলুন ও-ঘরে যাই।”

প্লেট এবং কাপ হাতে বুলি শোবার ঘরে এল, পিছনে গিরি। বেতের সোফাটায় বসল। বুলি স্টিলের চেয়ারে।

”কলেজ ছাড়া আর কোথাও বেরোও না।”

নিজের লোকেদের কাছে যায় কি না জানার জন্য প্রশ্ন করা। এগিয়ে ধরা ওমলেটের প্লেটটা গিরি হাতে নিল, চামচ দিয়ে খণ্ড করতে লাগল।

”ইচ্ছে করে না বেরোতে। এদিককার কিছুই তো চিনি না। তা ছাড়া যা ভিড় আর নোংরা হাঁটতে ইচ্ছে করে না।”

”কলেজের বন্ধুদের বাড়িতে যেতে পারো।”

”আমার বন্ধু নেই।”

”আমারই মতো।”

বুলির সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হল। গিরির মনে হল একই চিন্তাতরঙ্গে তারা পাশাপাশি উপস্থিত। তারা দু’জনেই একটি করে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হারিয়ে পরস্পরকে বুঝে নিতে অসুবিধা বোধ করছে না। পনেরো আর তেরো বছর ধরে একটা বিশেষ ভঙ্গি তারা অর্জন করেছে যার দ্বারা বাস্তবের কঠিন জায়গায় সেঁধিয়ে যেতে পারে। ভঙ্গিটা হচ্ছে, সন্দেহ।

”উনি কি আপনার বন্ধু নন?”

”নিশ্চয়। ওর সব কথাই আমাকে বলে। ওই একজনই আমার বন্ধু। মোহনেরও আমি ছাড়া বোধ হয় আর বন্ধু নেই।”

গিরি একটু বেশি ব্যস্ত হয়েই বলল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল, মোহনই তাকে বলে দিয়েছিল, অ্যাকসেল টুকরোটা কীভাবে লুকিয়ে দারোয়ানের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। দুটো মাস রুনুর রক্ষাকারীর ভূমিকা নিয়েছিল, অথচ একইসঙ্গে কাজ করলেও সে-কথা জানায়নি। অবশ্য রুনুও তা গোপন করেছে, গত সন্ধ্যা পর্যন্ত।

”আমার কথাও নিশ্চয় তা হলে বলেছেন।”

”অল্পক্ষণের জন্য এসেছিল। বেশি কথা বলার সময় ছিল না। শুধু বলল, এখানে ফ্ল্যাট নিয়েছে জীবনের বাকিটুকু ভোগ করতে।”

গিরি স্পষ্টই দেখছে বুলির মুখে অপ্রতিভতা ফুটে উঠল। ‘ভোগ’ শব্দটার মধ্যে অশ্লীলতা আছে। হয়তো অপমানিত বোধ করেছে। কিন্তু ওর বদলে আর কী শব্দ ব্যবহার করা যায়! মোহন তো ভোগই করতে চায়।

খালি প্লেট ও কাপগুলো নিয়ে বুলি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আড়ালে গিয়ে নিজেকে ‘ভোগ’ শব্দটা থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। ওর সঙ্গে মোহনের সম্পর্কটা গিরি জানে, মুখোমুখি আলোচনার বিষয় নয়।

বুলি ঘরে ঢুকল, চোখে স্বচ্ছ প্রফুল্লতা।

”ক’টা বাজে?”

”সময় দিয়ে কী হবে, বসুন না। আপনার সমস্যা তো সময় কাটানো, গিয়ে রান্না করবেন?”

”রুনুই সকালে রেঁধে রেখে যায়, তবে কোনও কোনও দিন ও অফিস ক্যান্টিনে খায়, আমি নিজে রেঁধে খাই।”

”আপনি রাঁধতে পারেন! কী কী রান্না জানেন?”

”পোলাও, কোপ্তা, কাবাব, বিরিয়ানি।”

পিছনে হেলান দিয়ে গিরি হাসছে। বুলিও।

”তা হলে তো আপনার রান্না একদিন খেতে হয়।”

গিরি সামনে ঝুঁকে পড়ল।

”কবে? কালকেই?”

অপ্রত্যাশিত আমন্ত্রণে বুলি থতমত হয়েছে, তবে হেসে যাচ্ছে।

”তুমি এলে আমার খানিকটা সময় কাটবে, পনেরো বছর আমাদের ফ্ল্যাটে কোনও মেয়ের পা পড়েনি রুনু ছাড়া।”

বুলির হাসিটা ভেঙে গেল দুই ঠোঁটের চাপে। চাহনি কোমল। নিজের কণ্ঠস্বর আর্তনাদের মতো গিরির কানেই ধরা পড়েছে।

”আপনার খুব…”

বুলি ইতস্তত করল।

”কষ্ট?”

ও মাথা নাড়ল।

”কষ্ট ঠিক নয়, কী রকম যেন একটা একা, নিঃসঙ্গ ভাব… বোঝানো শক্ত। আমার মাঝে মাঝে লাগে।… তখন আনন্দ কি কষ্ট কিছুই বোঝা যায় না।… নিজেকে খুব ফালতু অ-দরকারি মনে হয়। হয় না তোমার?”

রুনুর বাবার মতো! গিরি ম্লান হাসল।

”ফাঁসির হুকুম পাওয়া লোকের মতো?”

”অনেকটা। আমিও তো আস্ত মানুষ নই।”

গিরি নিজের গোটানো পাজামার দিকে তাকাল।

”আমি নিজের সম্পর্কেই কথাটা বলেছিলাম। আপনার কথা তখন মনে ছিল না যে আপনি আমার মতো কুৎসিত নন। ভালোবাসা আপনি পান… হয়তো পান, তাই ভালোবাসেনও, হয়তো। আসলে ‘আস্ত’ শব্দটা আমার ব্যবহার করা উচিতই হয়নি। আপনি নিশ্চয় আঘাত পেয়েছেন।”

”একটুও না। এটা আমার নিজেরই মনে হয়। বহু সময় ভাবি রুনু কি ভালোবাসে, মানে তা কি সম্ভব? চিন্তাটা র্যাঁদার মতো ঘষে ঘষে ক্ষইয়ে দিয়ে একটা গর্ত তৈরি করে ফেলেছে। ভয়ংকর গর্ত, যার মধ্যে আমি অনবরত পড়ছি আর থ্যাঁতলাচ্ছি। আসলে আমাদের যত কিছু আঘাত তা নিজেদেরই তৈরি, তাই না?”

”ব্যাপারটা, অর্থাৎ থ্যাঁতলানিটা একদমই ঘটবে না যদি ভালোবাসা জিনিসটাই না থাকে।”

”তা হলে মানুষে মানুষে সম্পর্কটা কী দিয়ে তৈরি হবে? ভান, অভিনয় দিয়ে? নিছক শরীরের ব্যাপারগুলো দিয়ে? কতদিন তা টিকবে?”

গিরি বুঝতে পারল তার গলা দরকারের চেয়েও বেশি চড়ে গেছে। বুলি পাংশু মুখে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে।

ওরা কথা বন্ধ রেখে দিল।

থলিটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে গিরি উঠল।

”কাল, এই সময় যাব। আমি কিন্তু নিরামিষ খাই।”

দরজার কাছে এসে গিরি ঘুরে দাঁড়াল আচম্বিতে। বুলি ছিল পিছনেই, প্রায় বুকের কাছে এসে পড়ল।

”কিন্তু দুটো ভাঙা জুড়ে একটা আস্ত হয়, হতে পারে!”

বুলি পিছিয়ে যাবার কোনও ইচ্ছা প্রকাশ করল না। মুখ তুলে শুধু গিরির মুখে তাকিয়ে রইল। ভাবখানা, যা বলার বলে যাও। গিরি বাঁ হাতটা ওর কাঁধে রাখতেই ক্রাচটা টলে পড়ছিল, ডান হাতে বুলি সেটা ধরে ফেলল।

”নিজেকে তুমি কুৎসিত ভাবো কেন? তুমি সুন্দর, খুব সুন্দর।”

”স্তোক?”

”কী লাভ দিয়ে। যা মনে হচ্ছে তাই বললাম। আমরা আস্ত হতে পারি, পারি না?”

”কীভাবে? ভালোবেসে!”

সরাসরি এবং সহজ স্বরে বুলির মুখ থেকে ‘ভালোবাসা’ শব্দটা গিরিকে অপ্রতিভ করল।

”আর একজন মাঝে আছে ভুলে যাচ্ছেন কেন?”

”কে মোহন?”

”আপনার স্ত্রী।”

”থাকুক। আমাকে সম্পূর্ণ করার সাধ্য তার নেই।” গিরি কাঁধ থেকে হাতটা বুলির ঘাড় বেয়ে গালে তুলল। চোখ বুজল বুলি।

”আমি এখন আসি, তা হলে কাল?”

”হ্যাঁ। আপনার কথা আমি ভাবব?”

বনমালী সরকার লেন ধরে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে পৌঁছে গিরি রাস্তা পার হবার জন্য অপেক্ষা করছে। মোহনের স্কুটার তখন বাঁক নিল। স্কুটার থামল না। একবার গিরির দিকে তাকিয়ে সে ভ্রূ কোঁচকাল মাত্র। চোখে কালো চশমা থাকায় বোঝা গেল না ওর মনের অবস্থা। রাস্তা পার হয়ে গিরির মনে হল, বুলিও তো কালো চশমা পরতে পারে।

চারটে ডিম কমে গেল। কেন, তা বলা যাবে না রুনুকে। কিন্তু কিছু একটা বলা দরকার। পকেটমার হয়েছে… দোকানেই ভুলে ফেলে এসেছি… হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে… হঠাৎ ইচ্ছে করল তাই খেয়ে ফেললাম!… একটার পর একটা ভেবে গেল সে, আর অস্বস্তি বাড়তেই লাগল। রুনুকে সে বুলির কথা জানাতে চায় না।

রুনুকে কৈফিয়ত দিতে হবে যেহেতু টাকা তার। চারটে ডিমের দাম পূরণ করার ক্ষমতা গিরির নেই। সে যতটা না অসহায় বোধ করল তার থেকেও বেশি রেগে উঠল। ছোটোবেলায় পায়ের ধাক্কায় সরষের তেলের বাটি উলটে যাওয়াতে বাবা চড় মেরে বলেছিল, ”পারবি কিনে পূরণ করে দিতে?” আধ ছটাক তেল বোধহয় বাটিটায় ছিল।

গিরির মনে হল, রুনু কৈফিয়ত শুনে কিছুই বলবে না, তাকাবে মাত্র। সেটাই চড়। সাবধান হও না কেন, পয়সা যখন নিজের নয়! বিশ্বাস একটা কৈফিয়ত এখন তাকে খুঁজতে হবে। ডিমুগলো খরচ না করলেও কিছু এসে যেত না, তবে এ-জন্য তার অনুশোচনাও হচ্ছে না। বহু বছর পর একজনকে সে আসতে বলেছে।

গিরি বাজারের থলি থেকে জিনিসগুলো রান্নাঘরে গুছিয়ে রাখল। বাঁশের ধামায় আনাজ, কলা, কৌটোয় ডাল, মশলা। দশটি ডিমের ছ’টা রয়েছে। এনামেল-চটা ফুটো বাটিটায় কালকের জন্য দুটো ডিম রেখে দিয়ে ঢোঙাটা উঁচু তাকে তুলে রাখল। দরকারের আগে রুনুর চোখে যেন না পড়ে।

বুলিকে কী খেতে দেবে? বেগুনভাজা ডাল ছাড়া রান্নার মতো আর কিছু নেই। রুনু অফিসে বেরিয়ে যাবার পর চটপট এর বেশি আর কী করতে পারে সে। দই? কেনার পয়সা কোথায়? গিরি হতাশ বিরক্ত হয়ে পড়ল।

রুনুর ফিরতে দেরি হয়নি। গিরি সন্ধ্যাটা বারান্দায় কাটিয়ে ঘরে এসে শুয়ে পড়ল।

”মাথায় কি যন্ত্রণা হচ্ছে?”

”টিপটিপ করছে।”

”আলো নিভিয়ে দোব?”

”দাও। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে, রাতে খাব না।”

আর তাদের কথা হয়নি।

 আট

ভোরে বারান্দায় এসে গিরি তাকিয়ে রইল বনমালী সরকার লেনের দিকে! বুলি তাকে দেখার আগে সে হাত তুলল। ওর পরনে গতদিনের শাড়ি। হাতে একটি খাতা। থমকে পড়ে তাকাল এবং খাতাটা কানের পাশে তুলল। গিরি মাথাটা কাত করে মুখে গ্রাস তোলার ভঙ্গি করল। বুলি মাথা হেলিয়ে দিল।

বাস স্টপে দাঁড়িয়ে বুলি মাঝে মাঝে বারান্দার দিকে তাকাচ্ছে।

গিরির সারা শরীরে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে চাপা উত্তেজনা। রুনু এখুনি চা এনে দেবে। এতদূর থেকে চোখ দেখা যাচ্ছে না, মুখের গর্তগুলোও নয়। সবুজ শাড়িতে একটি অবয়ব যার সঙ্গে কুশ্রীতার কোনও সম্পর্ক গিরি দেখতে পাচ্ছে না। বুলি ওখানে একা দাঁড়িয়ে। ওর উদাসীন নির্মোহ অবস্থানের সঙ্গে অচঞ্চল থমথমে ভোরবেলা পরিপূরক হয়ে উঠেছে। তার কথা বুলি ভেবেছে হয়তো। বুকভরে বাতাস নিতে নিতে গিরির মনে হল সে বুলিকে শুষে নিচ্ছে। মৃদু একটা গন্ধে সে ভরে যাচ্ছে।

তখনই একটা দোতলা বাস এল।

”তোমার চা।”

হাতটা এগিয়ে দিল গিরি পাশে। রুনুর দিকে সে তাকাল না। দাঁড়িয়েই চা খেল। অম্বরকে যেতে দেখল বাস স্টপের দিকে। আজ ওর দেরি হয়েছে বেরোতে। লিগ শুরু হলে একদিন ময়দানে গিয়ে ওর খেলা দেখে আসবে। অবশ্যই টিকিট কেটে খেলাটা দেখবে, কাউকে না জানিয়ে।

ঘরে এসে গিরির চোখে পড়ল আলমারিতে চাবিটা লাগানো। কান পেতে বুঝল রুনু পাশের ঘরে। বালিশ থাবড়ানোর শব্দ হচ্ছে। অম্বরের বিছানা গুছিয়ে ঘর ঝাঁট দেবে।

গিরি দ্রুত আলমারির কাছে এসে চাবি ঘোরাল। পাল্লা খুলেই ঘন বেগুনি সিল্কের শাড়ির ভাঁজ তুলল। পাঁচ-ছ’টি দশ টাকার নোট আর একটি এক টাকার বান্ডিল। পিন থেকে কতকগুলো এক টাকার নোট নিয়ে আলমারি বন্ধ করে যখন খাটে এসে বসল তখনও আঙুলগুলো কাঁপছে। রুনু জানতে পারবেই, তবে দিন দশেকের আগে নয়।

অস্থিরতা কাটাবার জন্যই গিরি দাড়ি কামাতে বসল। অন্যদিনের থেকে দ্রুত শেষ করল। ক’টা টাকা নিয়েছে জানে না। পকেট থেকে বার করে গুনে দেখতেও ভয় করেছে, যদি রুনু এসে পড়ে। বারান্দায় এসে গুনল, ছ’টাকা। চারটে ডিমের দাম বাদ দিয়ে সে বাকিটায় দই-সন্দেশের কথা ভাবল।

”তুমি শুধু নিজের জন্যই ভাত কোরো। আমি এবেলাও কিছু খাব না।”

রুনু উদ্বিগ্ন চোখে তাকাল।

”শরীর এখনও খারাপ? জ্বর হয়েছে নাকি?”

”জ্বর নয়। ম্যাজম্যাজানি, গায়েও ব্যথা। ফ্লু কি না কে জানে। উপোস দেব এ-বেলাটা।”

”তা হলে আর রেঁধে কী হবে। অফিসেই খেয়ে নোব।”

রুনু যখন অফিসে বেরোল গিরি তখন স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছে। রাস্তায় যেতে যেতে রুনু পিছু ফিরে বারান্দায় তাকিয়েছিল অভ্যাসমতো। বারান্দা থেকে গিরিও হেসেছিল। সে তখন ভাবছিল অন্য কথা।

পর্দাটা সরিয়ে গিরি দাঁড়িয়ে। প্রায় আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছে সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। বাড়িগুলোর ছায়ার, গাড়ি চলাচলের, পথিক সংখ্যার, শব্দের তীব্রতার পরিবর্তন লক্ষ করার মেজাজ তার নেই। বুলির জন্য সে অপেক্ষা করছে।

বুলি আসছে।

হৃৎস্পন্দনের আঘাত যে অনুভব করছে। বাঁ পায়ের হাঁটুটা দুর্বল লাগছে। সাদা শাড়ি, কালো ব্লাউজ, পিঠে ছড়ানো চুল। বারান্দায় বেরিয়ে এসে গিরি রেলিংয়ে ঝুঁকে বাড়ির দরজা দেখাল আঙুল দিয়ে। বুলি মাথা নেড়ে বোঝাল সে জানে।

বুলি ঢুকে যেতেই গিরি লাফিয়ে লাফিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খোলার জন্য এগোল। পাল্লা দুটো মেলে দিয়ে সে কান পেতে রইল। বহুদিন এইভাবে সে অফিস-ফেরত রুনুর জন্য দাঁড়িয়েছে।

চটির শব্দ উঠে আসছে। গিরি দরজার বাইরে গেল। বুলি সিঁড়ির বাঁক ঘুরে দেখতে পেল ওকে।

”তিনতলার বাইরের দিকের বারান্দা তো, আমি ঠিকই বার করে নিতুম।”

”তা নয়, তা নয়। ফ্ল্যাট খুঁজে বার করা কী এমন শক্ত ব্যাপার। তোমাদেরটা বার করলাম কী করে।”

রুনু বেরিয়ে যাবার পরই পেনসিল দিয়ে সাদা কাগজে বড়ো অক্ষরে ‘গিরিজাপতি বিশ্বাস’ লিখে সে আটাগোলা মাখিয়ে দরজায় সেঁটে দিয়েছিল। দই কিনে ফেরার সময়ও দেখেছে, ছিল। এখন নেই। ওপরের ছেলে দুটো স্কুলে যাবার সময় হয়তো খুলে নিয়েছে।

কৌতূহলী চোখে বুলি ঘর দেখছে। যতটা পারা যায় গিরি গুছিয়েছে। বিছানার চাদর বা বালিশের ওয়াড় ধবধবেই আছে। আসবাব কিছুই প্রায় নেই। দেয়ালটাই শুধু ময়লা, বহু জায়গায় বালি খসা। ভাড়া নেওয়ার পর আর কলি-ফেরানো হয়নি। গিরি খদ্দরের পাঞ্জাবি পরেছে। পকেটের ছেঁড়া জায়গাটা সেলাই করে দিয়েছে রুনু। দই ও সন্দেশ কিনে একটা আধুলি ফিরেছে, সেটা এখন পকেটে।

”তোমার দেরি হয়েছে।”

”মোটেই না। এখন সাড়ে বারোটাও বাজেনি।”

”তোমার বোধহয় দেরি করে খাওয়া অভ্যাস।”

”মর্নিং স্কুলে পড়লে এই বদ অভ্যাসটা হয়।”

বুলি পর্দা সরিয়ে বারান্দায় এল। গিরি ওর পিছনে।

”লাভলি বারান্দা তো! অনেকখানি দেখা যায় তিন দিকেই।”

”বেশির ভাগ সময় আমার এখানেই কাটে।”

বুলি রৌদ্রের তাতে দাঁড়াতে পারল না। ঘরে এসে খাটে পা ঝুলিয়ে বসল! গিরি মোড়ায়।

”কাল যখন আসছি তখন মোহন যাচ্ছে। আমাকে দেখল।”

”জিজ্ঞাসা করেছিল আপনি এসেছিলেন কি না।”

গিরি উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল। বুলি কী বলেছে!

”বললুম আসেননি।”

কেন বলল মিথ্যে কথা! সত্যিই কি ও তাই বলেছে? গিরি বিভ্রান্তির মধ্যেও আলগা একটা সুখের আমেজ পেল। বুলি তাকে গোপন করেছে, সে-ও করেছে রুনুর কাছে। কেন? অযথাই কি? একদৃষ্টে সে বুলির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল এবং তার মনে হল, সত্যিই সুন্দর। দুই কাঁধের উঁচু হাড়, কবজির উপর জড়ানো শিরা, শীর্ণ বাহু, অনুন্নত বুক প্রভৃতি সত্ত্বেও, সুন্দর।

গিরির চাহনি লক্ষ করে বুলি বিব্রত হল।

”আপনারা দু’জনেই এইঘরে থাকেন?”

”হ্যাঁ, আবার কোথা থাকব! ওহ, তুমি বলছ আলাদা শুই কি না?”

”না না, ধ্যাৎ। পাশে একটা ঘর রয়েছে তাই বললুম।”

”ওটায় আমার এক দূর সম্পর্কের ভাই থাকে। ফুটবলার। দু’চারদিনের মধ্যেই চলে যাবে। ওর অসুবিধে হচ্ছে।”

”কী রকম গুমোট পড়েছে। বাইরে একদম হাওয়া নেই।”

বুলি মুখ তুলে সিলিংয়ে তাকাল।

”পাশের ঘরে পাখা আছে, ভাড়া করা। ও চলে গেলে পাখাটা রেখে দেব। তবে পর্দা তুলে রাখলে হাওয়া আসে।”

গিরি দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়াতেই ব্যস্ত হয়ে বুলি পর্দাটা দরজার পাল্লার ওপর গুটিয়ে রেখে আবার খাটে এসে বসল।

”এখন খাবে?”

”আপনার কি খিদে পেয়েছে?”

গিরি মাথা নাড়ল।

”গল্প করার লোক পেলে আমি এক বছর না খেয়ে থাকতে পারি।”

”গল্প করার কেউ নেই আপনার?”

বুলিকে বিষণ্ণ দেখাল কয়েক সেকেন্ডের জন্য।

”কারুর সঙ্গে মিশতে আমারও ভালো লাগে না, আপনার লাগে?”

গিরি মাথা নাড়ল।

”যদি পারি তা হলে দুপুরে আমি আসব। অসুবিধে হবে না তো?”

”কিন্তু দু’-চারদিনেই তুমি ক্লান্ত হয়ে যাবে।”

বুলি গম্ভীরভাবে কিছু চিন্তায় মগ্ন। ঠোঁটে একটা হাসি ফুটিফুটি করছে। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ”না, বোধ হয় হব না।”

”কেন হবে না?”

”মনে হচ্ছে। আমার এ-রকম বহু ব্যাপারই মনে হয়। পরে দেখেছি ঠিক মিলে গেছে। আচ্ছা, কাল যে গর্তের কথা বললেন না, আমি সেটা নিয়ে ভেবেছি।”

”কেন ভাবলে? তোমার তো গর্ত হবার কোনও কারণ নেই। তুমি তো ভালোবাসার প্রত্যাশা করো না।”

”আমি কিছুরই প্রত্যাশা করি না। একসময় আমি আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলুম।”

”প্রেমিক ছিল?”

”আমার এই চেহারা হবার পর সে আর দেখা দেয়নি। ওকে আর দোষ দিই না। পরে ভেবে দেখলাম, আত্মহত্যা যদি করতেই হয় তা হলে এমনভাবে করা উচিত যাতে অন্যরা উপকৃত হয়।” বুলি স্বচ্ছকণ্ঠে হেসে উঠল। ”আমার বাবা এখন নামকাওয়াস্তে কারখানায় যায় আর মাসে আড়াইশো টাকা পায়।”

শুনতে শুনতে গিরি মেঝেয় চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। তুলে দেখে বুলির চোখ রাস্তায় আটকে রয়েছে। আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে বসার ভঙ্গি। অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এল ওর মুখ দিয়ে।

গিরি যথাসম্ভব ঝুঁকে দরজা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। এতদূর থেকে জাফরির মধ্য দিয়ে রাস্তাটা দেখা যায় না।

”আমি যাচ্ছি। আর একদিন এসে…”

বুলি ছুটল দরজার দিকে। হতভম্ব গিরি উঠে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। স্কুটারে মোহনের পিঠ দেখতে পেল সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে বনমালী সরকার লেনে ঢুকছে। গিরি একইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে দেখল বুলি প্রায় ছুটেই চলেছে অঘোর ঘোষ স্ট্রিট ধরে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পার হবার জন্য একটু থামল। গিরি আশা করল, একবার অন্তত পিছনে মুখ ফেরাবে। ওর পিঠ ঘেঁষে একটা ট্যাক্সি বেরিয়ে গেল। মুখ বাড়িয়ে ড্রাইভার কিছু বলল। বুলি বনমালী লেনে ঢুকে অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত গিরি দাঁড়িয়ে দেখল।

”কেন।”

রাগে সে থরথর করে একা ঘরে কেঁপে উঠল।

রুনু যখন অফিস থেকে ফিরল তখনও সে শুয়েছিল। বুলির জন্য টেবিলে সাজিয়ে রেখেছিল ভাত-ডাল, ভাজা, দই-সন্দেশ। দুপুরেই সেগুলো হাঁড়িতে ভরে, রাস্তায় বেরিয়েছিল ভিখিরির খোঁজে। বুড়ি ভিখিরিটা অবাক চোখে প্রথমে তাকায়, তারপর বিড়বিড় করে : ”ভগবান তোমার মঙ্গল করুক বাবা, রাজা হও, ছেলে-বউ নিয়ে সুখে থাকো বাবা।”

”শুয়ে ছিলে?”

রুনু কপালে হাত দিয়ে তাপ দেখল।

”মনে হচ্ছে জ্বর-জ্বর। কিছু খাবে? হরলিকস?”

তাদের হরলিকস নেই, অম্বরের আছে।

”না।”

আর কথা না বলে গিরি শুয়ে পড়ে। ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভেঙে গেল একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখে। বারান্দায় ঝুঁকেছে দোতলার ঘরে নতুন বউটির কাপড় ছাড়া দেখার জন্য। তখন সে বোতল হয়ে বারান্দা থেকে রাস্তায় পড়ে গেল।

নিশ্চল হয়ে সে বিছানায় শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। জলতেষ্টা পেয়েছে ডান পাশ ফিরল খাট থেকে নামার জন্য। মেঝেয় শতরঞ্চি পেতে রুনু শুয়ে আছে। সাবধানে পা ফেলার জন্য তাকিয়ে থেকে অন্ধকারের সঙ্গে চোখ সইয়ে নিল। রুনু শুয়ে নেই।

কোথায় তা হলে! একমাত্র পা-টি বেয়ে কার যেন ঠান্ডা হাত উঠছে। গিরি ভয় পেল। কোথাও কোনও শব্দ নেই, তা হলে কি সে কালা হয়ে গেছে! দরজার পর্দাগুলো তোলা। রাস্তার আলোয় সামনে বাড়ির দেয়াল অবাস্তব জগতের মনে হচ্ছে। হঠাৎ গিরির মনে হল সে গ্যারাজে একা। রুনু এখন কোথায়? পাশের ঘরে? লিফট, তার উপর আড়াই টন ট্রাক, নীচে সে দাঁড়িয়ে। গিরি ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল।

ক্রাচের জন্য হাত বাড়িয়েও হাতটা ফিরিয়ে নিল। শব্দ হবে। হামা দিয়ে সে বারান্দায় এল। চেয়ারটা ছাড়া আর কিছু নেই। মাটি শুঁকে এগোনো কুকুরের মতো ঝুঁকে গিরি এগোল অম্বরের ঘরের দরজার দিকে। প্রাণ বাঁচানোর ব্যাপারে মানুষে-জানোয়ারে কোনও পার্থক্য নাকি থাকে না। রুনুই প্রাণ, প্রাণই রুনু। এখন রুনু ছাড়া তার চেতনায় কোনও কিছুই অস্তিত্ব নেই।

দরজাটা বন্ধ। মুখটা এগিয়ে দিয়ে সে দরজায় কান পাতল। ঠিক এইভাবেই সে রুনুদের বাড়ির ভিতরের ঘরে দরজায় একদিন কান পেতেছিল। তখন দু’পায়ে ভর দিয়ে সে দাঁড়াত।

ভিতরে কি কথা বলল কেউ? একটা অস্পষ্ট ধ্বনি যেন ভেসে আসছে অম্বরের ঘরের মধ্য থেকে। ধীরে ধীরে তার মাথাটা ঝুঁকে পড়ল। কঙালটা মেঝেয় রেখে দু’হাতের ভর থেকে দেহটা নামিয়ে দিল। এইভাবে সামনের বাড়ির লোকটাকে একদিন সে যোগব্যায়াম করতে দেখেছে। দরজার তলার ফাঁক দিয়ে ধ্বনিটা দীর্ঘ হয়ে তীব্র হয়ে বেরিয়ে এসে একটা চিৎকারের আকৃতি নিল।

”বিশ্বাসবাবু, বিশ্বাসবাবু, শুয়ে পড়ুন।”

গিরি সেই নির্দেশ শুনেই উপুড় হয়ে বারান্দায় শুয়ে পড়ল।

”এইবার কি আমি বেঁচে যাব!”

উপুড় হয়ে হাঁফাতে লাগল গিরি। এখন বুঝতে পারছে, গভীর গর্তের তলদেশে সে পড়ে রয়েছে। এখান থেকে তার আর উদ্ধার নেই। বাঁচার কোনও উপায় নেই। সে দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত।

ভোরে সে চেয়ারে বসে জাফরির মধ্য দিয়ে তাকিয়ে। বুলি বাস স্টপে দাঁড়িয়ে। বারান্দার দিকে বারবার তাকাচ্ছে।

”তোমার চা।”

নেবার সময় একবার রুনুর মুখের দিকে তাকাল। কোনও তফাত নেই অন্যান্য দিনের থেকে।

”তুমি কি কাল রাতে বাথরুমে গেছলে?”

”হ্যাঁ।”

চা খেতে খেতে সে দেখল বুলিকে। উঠে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ার ইচ্ছে তার হচ্ছে না। বাস এল এবং বুলিকে নিয়ে চলে গেল। অম্বরের দ্রুত চলাও সে দেখল।

 নয়

দরজাটা আজও খোলা।

টোকা না দিয়ে গিরি ভিতরে ঢুকল। বুলি কথা বলছে। কচি গলায় পালটা প্রশ্ন হচ্ছে।

গিরিকে দেখে বুলি দাঁড়িয়ে উঠল সোফা থেকে। লাজুক হাসল। খালি গায়ে জাঙিয়া পরা বছর তিন বয়সি হৃষ্টপুষ্ট ছেলেটি অবাক হয়ে তাকিয়ে।

”তোমার নতুন বন্ধু?”

”হ্যাঁ। কাল বলেছিল চকোলেট আনতে, এনেছি লজেন্স। তাই এতক্ষণ ক্ষমাপ্রার্থনা করছিলুম। কিন্তু মন গলাতে পারছি না। মোড়ের দোকান থেকে এখুনি কেন এনে দিচ্ছি না, এটাই ওর অভিযোগ।”

”বেশ সুন্দর দেখতে।”

বুলি আদরভরা চোখে বাচ্চচাটার দিকে তাকাল।

বাইরে থেকে নারীকণ্ঠের ”বাপী” ডাক শুনেই ছেলেটি তড়াক করে সোফা থেকে নেমে ছুটে বেরিয়ে গেল।

”মাকে ভীষণ ভয় পায়।”

”সব বাচ্চচাই পায়। আমিও পেতাম।”

”এই ঝাঁ ঝাঁ রোদে বেরিয়েছেন। কী রকম ঘেমেছেন যে! ভিতরে খাটে বসুন, টেবিল-ফ্যান আছে।”

”অসুবিধে হচ্ছে না আমার।”

”আমার হচ্ছে। এমন দরদরে ঘাম দেখলে অস্বস্তি হয়।”

বুলি পার্টিশনের ওপারে গেল এবং ভোমরা ওড়ার শব্দের সঙ্গে পর্দাটা কাঁপতে শুরু করল। ”আসুন এখানে।”

ভিতর থেকেই বুলি ডাকল। ইতস্তত করে গিরি ভিতরে এল। ঘরের প্রত্যেকটা জিনিসই নতুন। পাখা, খাট, আয়না, এমনকী আলনার কাপড়গুলোও। খাটে বসেই আরাম বোধ করল। গদিটা ফোম রাবারের। মোহন অনেক খরচ করেছে। জীবন ভোগ করতে তা হলে সত্যিই বদ্ধপরিকর।

”পাখার তারটা এত ছোটো যে বাইরে নিয়ে যাওয়া যায় না।”

”একটা সিলিং-ফ্যানেই ভিতরে-বাইরে হাওয়া পাওয়া যাবে।”

দু’জনেই গতকালের ঘটনা এড়িয়ে কথা বলে গেল। গিরি জানে, বুলির কাছে এ সম্পর্কে হতাশা বা অনুযোগ প্রকাশ করলে ওকে বিব্রত করা হবে। তারা দু’জনেই এটা জানে।

”পাখা কি সারারাত চালাও। সর্দি হবে কিন্তু।”

”কিছুক্ষণ পরেই বন্ধ করে দিই। হাত বাড়ালেই রেগুলেটারটা পাওয়া যায়।… আপনি বালিশটা ঘাড়ে রেখে ঠেস দিয়ে বসুন না।”

”তুমিই বা দাঁড়িয়ে কেন?”

”মাথার চোট কেমন?”

”প্রায় সেরে এসেছে।”

গিরি অসুবিধা বোধ করতে লাগল কথা চালিয়ে যেতে। বুলিও জানে একসময় প্রশ্নটা উঠবেই। হয়তো জবাব নিয়ে তৈরি হয়ে আছে।

”চুলটা এইভাবে দু’পাট করে রাখলে তোমাকে ভালো দেখায়।”

”আমাকে ভালো…!”

বুলির চোখটি অবিশ্বাস্যতায় বিস্ফারিত হল না। নিঃশব্দে হেসে উঠল মাত্র।

”সত্যি?”

”আমার তো লাগে।”

বুলির হাসি মিলিয়ে গেল।

”তুমি কালো চশমা পরতে পারো।”

”ক্লাসের একটা মেয়েও আমায় বলেছিল। তাতে কী হবে? আমাকে ভালো দেখাবে কি?”

গিরি চট করে উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। বুলি তাকিয়ে আছে।

”ওটায় চোখটা তা হলে ঢাকা পড়বে।”

”কার কাছ থেকে? চশমা পরে থাকলেও আপনি সব সময়ই মনে রাখবেন আমার একটা চোখ নেই। আর রাস্তায়, বাসে, কলেজে কে কী ভাবল তা আমি গ্রাহ্য করি না।”

”কেন করবে না।”

”তাদের কোনও দরকার নেই আমাকে। আমিই বা তাদের দরকারি ভাবব কেন?”

”আমার দরকার আছে।”

”আপনার!”

অস্ফুটে বুলি আর একটা শব্দ করল।

”কী দরকার? হাড় চামড়া ছাড়া আমার আর কিছু নেই।”

”কাছে এসো।”

বুলি ঘাড় বেঁকিয়ে বসে আছে। গিরি হাত বাড়াল। পৌঁছল না। বালিশ থেকে মাথাটা তুলে কনুইয়ে ভর রেখে কাত হয়ে সে তাকিয়ে থাকল।

”আমার কাউকে কিছু দেবার নেই, আমাকে কারুর দরকার হতে পারে না।”

”আমারও সম্বল কিছু নেই। সব আমি হারিয়েছি। আমি গর্তের মধ্যে পড়ে গেছি। আমি নিজেকে পর্যন্ত আর বিশ্বাস করতে পারছি না। তোমার কাছ থেকে কিছু নিয়ে এবার বাঁচতে হবে।”

”দুটো ভাঙা জোড়া দিয়ে একটা আস্ত? হয় কখনও? দাগ একটা রয়েই যাবে।”

বুলি সরে এল গিরির পাশে। বালিশে হেলান দিয়ে গিরি হাসল। বিছানায় বুলির হাত। তার ওপরে সে আলতো হাত রাখল।

”কী হারিয়েছেন বলছিলেন?”

গিরি নিজের বুকের ওপর হাত রাখল।

”আপনি তো বেঁচে আছেন।”

”না।”

বুলি এগিয়ে এসে ঝুঁকে গিরির বুকে কান পাতল।

”দপদপ করছে।”

আলতো ওর মাথায় হাত রাখল গিরি।

”করছিল না, এইমাত্র করে উঠল।”

বুকের উপর গলিত অন্ধ চোখ আর ক্ষতে খোদলানো মুখটা বুলি চেপে ধরল। গিরি চোখ বুজল। দু’হাতে বুলির মুখটা তুলে ওর কপালে চুমু দিল। ঠোঁট দুটি সরু করে এগিয়ে দিয়ে বুলি হাসতে লাগল চোখ বন্ধ রেখে। গিরি মুখের মধ্যে বুলির ঠোঁট ভরে নিল।

খসখসানি শব্দ হল। চোখ খুলল গিরি। পর্দা সরিয়ে মোহন তাকিয়ে রয়েছে। দু’চোখ ভরে অবিশ্বাস। গিরির চোখ আটকে রইল লাল আঁচিলটায়। মুহূর্তে সেটা টকটকে হয়ে উঠল, তারপর সারা মুখ হিংস্র রাগে কুঁচকে গেল।

মোহন হাত বাড়িয়ে বুলির চুলের গোছা ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। অপ্রত্যাশিত এই আক্রমণে আর্তনাদ করে বুলি দাঁড়িয়ে উঠতেই মোহন ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। কাত হয়ে মেঝেয় পড়ে থাকা বুলির মুখের উপর মোহন ডান পা রেখে চেপে ধরল। গোঙিয়ে উঠল বুলি।

ছয়-সাত সেকেন্ডের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটল। কিছু চিন্তা করার সময় নিল না গিরি। নিছক প্রবৃত্তিবশে সে খাট থেকে হাত বাড়াল। অ্যাকসেলের ভাঙা খণ্ডটা ওর জন্যই যে অপেক্ষা করছে। দ্রুত উঠে দাঁড়াল এক পায়ে। টলে পড়ার আগেই সে বুলির মুখ পা দিয়ে মেঝেয় ঘষায় ব্যস্ত, কুঁজো হওয়া মোহনের মাথার পিছনে সজোরে লোহার ঘা মারল।

মোহন স্থির হয়ে রয়েছে। পার্টিশনে হাত রেখে গিরি মাথাটার দিকে তাকিয়ে। পাতলা চুলের মধ্যে দিয়ে নারকেল শাঁসের মতো সাদা একটা দাগ। সেটায় ক্রমশ গোলাপি রং ফুটে উঠছে। মোহন পাশে হাত বাড়াচ্ছে কিছু একটা ধরার জন্য।

একটা শ্রান্ত লোকের মতো, পর্দাটা মুঠোয় আঁকড়ে, মোহন একটু একটু করে দুমড়ে মুচড়ে মেঝেয় বসে পড়ল। পার্টিশনটাকে কাঁপিয়ে একবার ওঠার চেষ্টা করল এবং নিজের সঙ্গে কয়েক মুহূর্ত ধস্তাধস্তির পর যুক্তিগ্রাহ্যভাবে নিজের প্রাণহীন দেহটাকে শুইয়ে দিল কাত করে। বুলি উঠে বসেছে। গিরি লোহাটা তুলে দেখাল।

”আসলে এটা ইউনিভার্সাল গ্যারাজের।”

অ্যাকসেল টুকরোটা আস্তে মেঝেয় নামিয়ে রাখল। কর্কশ শব্দে গড়িয়ে সেটা মোহনের পিঠে লেগে থেমে গেল। মোহনের মুখটা পার্টিশনের দিকে ফেরানো। মাথা থেকে রক্ত কাঁধ বেয়ে মেঝেতে গড়িয়ে যাচ্ছে।

”কী হয়েছে ওর, মারা গেছে?”

বুলি থরথর কাঁপছে। গিরি উবু হয়ে বসে মোহনের ডান হাত তুলে নাড়ি দেখল এবং মাথা হেলিয়ে বলল, ”হ্যাঁ।”

”আঃ।”

বুলি নিজের মুখে হাত চাপা দিল চিৎকারটা চাপা দিতে। টাল সামলাতে অন্য হাত রাখল খাটের ওপর।

”দরজাটা খোলা ছিল। বাপি যাওয়ার পর আর বন্ধ করা হয়নি।”

গিরি জবাব দিল না।

”বন্ধ করে দিয়ে আসব?”

গিরি মাথা নাড়ল।

”তা হলে?”

”বুলি, আর আমাদের কিছু করার নেই। তুমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলে না একসময়ে?”

”হ্যাঁ।”

গিরি মুখ ফিরিয়ে মোহনের দিকে তাকাল। ঝুঁকে ওর বাহুতে একবার হাত বোলাল। ”বেঁচে গেল। আর কোনও বোকামি করার সুযোগ পাবে না।”

”আমরাও কি?”

গিরিকে সচেতন করে দিল বুলির স্বর। শান্ত, আবেগবর্জিত কিন্তু উদ্দেশ্যহীন। বুলির গালে ধুলো। হাত বাড়িয়ে মুছে দিতে দিতে সে বলল, ”লেগেছে খুব? চলো বাইরে বসি।”

সোফায় ওরা পাশাপাশি বসে রইল। পার্টিশনের পর্দার তলা থেকে কাবুলি জুতো পরা মোহনের মসৃণ পায়ের গোড়ালি দেখা যাচ্ছে।

”স্কুটারের শব্দও আমরা পাইনি।”

গিরি ফিকে হাসল।

”এবার কী করব আমরা? হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”

”মরে গেছে, দরকার কী।”

”পুলিশে খবর দিতে হবে?”

”দরকার কী, ওরাই খুঁজে নেবে।”

বুলি যেন কেঁপে উঠল। গিরি ওকে কাছে টানল কাঁধ ধরে। বুলি সরে এল। রাস্তায় বাসনউলির ক্লান্ত গলা জানলার কাছে ডেকে উঠল দু’বার। বুলি ফিসফিস করে বলল, ”ওর কাছে একটা স্টিলের হাতা কিনেছিলুম।”

দু’জনে গোড়ালিটার দিকে তাকিয়ে বসে রইল। জানলার পর্দা নড়তে দু’জনেই তাকাল।

”বাতাসে।”

”আজ এই প্রথম দিল।”

গিরি হাসল। বুলির হাতটা তুলে নিল হাতে।

”ভয় করছে?”

বুলি ফিকে হেসে গিরির হাত কোলের উপর টেনে আনল।

”আমরা ভাগাভাগি করে নোব।”

”না। ঠিক যা দেখেছ তাই বলবে পুলিশকে। ডান্ডাটা আমিই মেরেছি।”

”পুলিশ আসবে!”

”আসবে, আজ না হোক, কাল কিংবা পরশু।”

”আমার মনে হচ্ছিল কিছু একটা ঘটবে। আমাদের দু’জনের জীবনেই।”

”এই রকমই কিছু, না অন্য রকম?”

”অন্য রকম। কিন্তু এখন ও-সব কথা বলে কী লাভ।”

”কথা বলতে আমারও ভালো লাগছে না।”

কিছুক্ষণ পর গিরি বলল, ”তোমার ওপরই ভরসা করে তোমাদের সংসার। তোমার থাকাটা দরকার। আমি না থাকলে রুনু অসুবিধায় পড়বে না। কাজেই ভাগাভাগির প্রশ্ন ওঠে না।

”যা কিছু করেছি, নিজের জন্য একটিও নয়। আপনিই প্রথম… আমার নিজের জন্য প্রথম।” দু’হাতে মুখ ঢাকল বুলি। তার কানা চোখটা দিয়েও জল গড়াচ্ছে।

বিকেল এল এবং ক্রমশ চলে যাচ্ছে। ওরা একই ভাবে বসে। মোহনের গোড়ালিটা ম্লান হয়ে গেছে। বেলা অবসানে নীচের তলায় ঘরের আলো দ্রুত কমে যায়।

”ওর জন্য এক একসময় মায়া হত।” বুলি ফিসফিস করে বলল। ”হয়তো আমাকে ভালোবেসেছিল।”

”অনুতাপ?”

”কী জানি! বোধহয়।”

”তালাচাবিটা নাও।”

গিরি উঠে দাঁড়াল।

”আমরা চলে যাব?”

”হ্যাঁ। এখন তুমি বাড়িতেই যাও। যা হোক একটা কিছু ওদের বোলো। তোমার কি নেবার আছে নিয়ে নাও।”

”কী লাভ।”

”তবু তিন-চারটে দিন পাবে।”

বুলি মাথা নাড়ল।

গিরি জানলা দুটো বন্ধ করে ছিটকিনি দিল।

তালা লাগিয়ে চাবিটা হাতে নিয়ে বুলি ইতস্তত করছে।

”কোথাও ফেলে দিয়ো, যাবার পথে।”

বাড়ির দরজার পাশে স্কুটারটা রাখা। ওরা তাকাল না। রাস্তায় বেরিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর দিকে এগোতেই ঝিয়ের কোলে বাপিকে আসতে দেখল। সে কৌতূহলে গিরির ক্রাচ এবং চলা লক্ষ করছে। বুলির দিকে তাকালই না। তাকে অতিক্রম করে যাবার পর বুলি পিছনে মুখ ফিরিয়ে একবার তাকাল।

”চকোলেটের কথা বলতে ভুলে গেল।”

”আমাকে দেখতে গিয়েই।”

সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর বাস স্টপে ওরা দাঁড়াল। বুলি দক্ষিণ দিকে যাবে।

”কাল আমার জন্য বেচারা অপেক্ষা করবে, ভাবতে খারাপ লাগছে।”

”আমি এসে ওকে চকোলেট দিয়ে যাব।”

”ঠিক।”

গিরি মাথা কাত করল। আধুলিটা এখনও আছে।

ওদের মধ্যে আর একটিও কথা এর পর হয়নি। অপেক্ষমাণদের থেকে একটু তফাতে রাস্তার যতদূর দেখা যায়, সেই পর্যন্ত দৃষ্টি মেলে দু’জনে দাঁড়িয়ে থাকে বাসের জন্য। দূরে বাস দেখে বুলি কয়েক পা এগিয়ে যায়। গিরি দাঁড়িয়েই থাকে। ভিড় রয়েছে বাসে। ওঠার লোকও অনেক। ঠেলাঠেলির মধ্যে বুলির হাতটা সে দেখতে পেল হাতল ধরেছে। পাদানিতে উঠল। গিরির দিকে তাকাতে চেষ্টা করছে। পিছন থেকে অধৈর্য ঠেলায় তাকে ভিতরে পাঠিয়ে একটা লোক পাদানিতে উঠে দাঁড়াল।

বাসটা গিরির সামনে দিয়ে চলে গেল। বুলিকে দেখতে পেল না। উত্তর থেকে একটা বাস এসে বিপরীতে দাঁড়াল। দরজায় মানুষ ঝুলছে, বাসটা হেলে রয়েছে। অফিস ফেরত ভিড়। রুনু কি এই বাস থেকে নামবে, নাকি এসে গেছে! কিংবা সেদিনের মতো দেরি করে ফিরবে।

সাবধানে দু’ধারে তাকিয়ে সে রাস্তা পার হল। অঘোর ঘোষ স্ট্রিটে ঢুকতে গিয়ে সে তার বারান্দার দিকে তাকিয়ে একবার দাঁড়াল। এখনও দিন চার বা পাঁচ ওখানে বসার সুযোগ পাবে। মোহন পচে গন্ধ ছড়ালে পাশের ফ্ল্যাটের লোকেরাই পুলিশ ডাকবে। অবশ্য তালা বন্ধ দরজার সঙ্গে স্কুটারটা যুক্ত করে আগেই সন্দেহ করবে। ওরাই পুলিশকে বলে দেবে, একটা খোঁড়া লোকের সঙ্গে তারা মেয়েটাকে চলে যেতে দেখেছে। খোঁড়া লোকটাকে এ অঞ্চলে অনেকেই দেখেছে ওপারে তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে।

গিরি এগোতে শুরু করল। পুলিশ তালা ভেঙে মোহনকে বার করবে। তার এক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবে মোহনের বাড়িতে। সেখানে থেকে গ্যারাজে, কারখানায়। বসন্তের দাগ কানা মেয়ের খোঁজ পেতে পাঁচ মিনিটও সময় লাগবে না।

তালা খুলে গিরি ফ্ল্যাটে ঢুকল। রুনু এখনও আসেনি। আলো জ্বালল না। বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এখন সে ক্লান্তি বোধ করছে। একটু গরম চা পেলে ভালো হয়। আগামীকাল চকোলেট কিনতে হবে, এটা মনে পড়তেই সে রেলিংয়ের জাফরিতে হাত বুলোল।

রুনু আসছে অফিস থেকে। অভ্যাস মতো হাত তুলতে গিয়ে সে বুঝতে পারল অন্ধকারে রুনু তাকে দেখতে পাবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *