নায়কের প্রবেশ ও প্রস্থান

নায়কের প্রবেশ ও প্রস্থান – মতি নন্দী – উপন্যাস

এক

ঝকঝকে আকাশি-নীল স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডটা, আট হাত চওড়া জয়রাম মিত্র লেন আর কুড়ি হাত চওড়া তারক কবিরাজ স্ট্রিটের মোড়ে, তারক কবিরাজের বাড়ির সামনে অসীমকে লক্ষ করেই থেমে গেল। অসীম তখন ভাবছিল, এখুনি ত্রিশটা টাকা কোথা থেকে জোগাড় করা যায়। ড্রাইভার-আসন থেকে প্রশ্ন হল, ”এটাই কি জয়রাম মিত্র লেন?”

অসীম দাঁড়িয়েছিল বাঁ পায়ের উপর ভর দিয়ে, কোবরেজদের রকে বাঁ হাত রেখে শরীরটাকে হেলিয়ে, যাতে ডান পা ভারমুক্ত থাকে। ডান পায়ের হাঁটুতে গত বছর চোট পেয়েছিল নবদ্বীপে এক শীল্ডের ফাইনালে খেলতে গিয়ে। দিন পঁচিশ ভুগিয়েছিল হাঁটুটা। তারপর একটু ভয়ে ভয়েই খেলত। মাঝে মাঝেই খচখচ করে ওঠে ব্যথাটা। লাফিয়ে ট্রামে উঠতে গিয়ে কী স্লাইডিং ট্যাকল করতে গিয়ে অসীম বুঝেছে চিকিৎসা করানো দরকার। ডাক্তার দেখিয়েছিল। এক্সরে করানোর পরামর্শ নিয়ে ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরে। করাবো করাবো মনে রেখে প্রায় একটা বছর তারপর কেটে গেছে।

গতকাল তারকেশ্বরের মাইল ছয়েক দূরে এক গ্রামে ফোর্থ রাউন্ড খেলতে গিয়ে চোট পেয়েছে আবার ডান হাঁটুতে। রাইট-ইনটা প্রথম থেকেই পা চালিয়ে খেলছিল। হাফ-টাইমের আগেই অসীমের লেফট-হাফকে মাঠ থেকে বার করে দিল মুখ ফাটিয়ে। অসীম রাইট-ইনের কাছে গিয়ে বলেছিল-”এটা কী খেলা হচ্ছে, ফুটবল?” রাইট-ইন কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দেয়, ”তবে নয় তো কি।” দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে অসীম বলেছিল, ”বটে।”

”শুনছেন, এই গলিটাই কি জয়রাম মিত্র লেন?”

মোটর চালকের মুখ জানলা থেকে একটু বেরিয়ে এসেছে। তারক কবিরাজ স্ট্রিটের রাস্তার বালবগুলো খুলে ফ্লুরোসেন্ট টিউব লাগানো হয়েছে। কাউন্সিলর কুমার চৌধুরীর এইটিই আপাতত সর্বশেষ কৃতিত্ব জনগণকে তার সেবা সরবরাহে। এই আলোয় মোটর চালকের গৌরবর্ণ কপালের টিকোলো নাকের এবং চিবুক ও গালের কিছুটা অংশ অসীমের চোখে পড়ল। ওর মনে হল, মুখখানি যেন চেনা-চেনা।

অসীম কৌতূহলী হয়ে, চোখ দুটি তীক্ষ্ন করে তাকাল। কোথায়, কোথায়, কোথায় যেন দেখেছে।

হেরাল্ডের দরজা খুলে নেমে এল আরোহী। দোহারা গড়ন, লম্বায় প্রায় পাঁচ-দশ, ধুতি-পাঞ্জাবি, চুলগুলি অবিন্যস্ত। দরজায় চাবি দেবার জন্য পিছন ফিরতেই ঘাড়ে দুটি ভাঁজ দেখতে পেল অসীম। ওর কাছে হেঁটে এল হালকাভাবে, কিন্তু প্রতি পদক্ষেপে দেহের ওজন জমিতে রেখে, মাথাটা ঝুঁকিয়ে।

সামনে এসে দাঁড়াতেই অসীম চমকে উঠল। আশ্চর্য, এতক্ষণ চিনতে পারেনি কেন সে। এই গলির মোড়ে, সন্ধ্যাবেলা এমন অপ্রত্যাশিত উপস্থিতি, অসীমকে অভিভূত করে ফেলল।

”আলোটা বড্ড কম ঠিক বুঝতে পাচ্ছি না, আচ্ছা এটাই কি জয়রাম মিত্র লেন?”

সেই ভরাট গলা, নিরাসক্ত ভঙ্গি, শব্দগুলো শিথিল করে মুখ থেকে বার করে দেওয়া। বছর পাঁচেক আগের, নিউ থিয়ের্টাস দু’নম্বর স্টুডিয়োর ফ্লোরের একটি দৃশ্য ঝলসে উঠল অসীমের চোখে। ডিরেক্টর শেষবারের মতো সিচুয়েশন বুঝিয়ে দিচ্ছে। শুনতে শুনতে একবার চোখ তুলে ওদের কয়েকজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ”তাহলে, প্রথম ঘুষিটা খেয়েই পড়ে যাব। সেটা মারবে কে?” অসীমের মনে হয়েছিল স্বর কেমন যেন ক্লান্ত। ডিরেক্টর আঙুল দিয়ে দেখাল অসীমের পাশে দাঁড়ানো দাঁত উঁচু লোকটিকে। তখন হেসে বলল ”দেখবেন ভাই, খুব জোরে কষাবেন না। তেবড়ে-তুবড়ে গেলে রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে।” তাই শুনে লোকটার দাঁত আরও খানিকটা বেরিয়ে আসে এবং চাপা গলায় একমাত্র অসীমকে শুনিয়ে বলেছিল, ”গাল দুটো তো বাবা, লাখ টাকার ইন্সিয়োর করে রেখেছ, রোজগার বন্ধ হলেই বা কি!” শুনে সির সির করে উঠেছিল অসীমের দুই বগল। চাপা গলায় সে বলেছিল, ”এইরকম একস্ট্রার পার্ট করতে হয়েছিল ওকেও।” দাঁত-উঁচু তাই শুনে অসীমের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেছিল, ”নায়ক হবার সাধ হয়েছে? ভালো ভালো।” শুনে জ্বালা করে উঠেছিল অসীমের মাথার ভিতরটা।

”ক’ নম্বর খুঁজছেন?”

অসীম গলার স্বরে ব্যক্তিত্ববান হবার চেষ্টা করল। এ পাড়ায় তার ওজন আছে, এবাড়ি-ওবাড়ির মধ্যে ঝগড়া হলে মধ্যস্থতা করে, ছোটোদের বেচাল দেখলে কড়কে দেয়, অন্য পাড়ায় গিয়ে সোডার বোতলও ছুঁড়ে আসে, নানাবিধ রাজনৈতিক আন্দোলনে যখন পুলিশ রাইফেল তুলে তাড়া করে, সে ইঁট ছোঁড়ে। জয়রাম মিত্র লেন তার স্টুডিয়ো ফ্লোর।

”নীরবালা ভটচায, তিনের বি, বছরখানেক এসেছেন, স্কুলে পড়ান।”

”বিধবা, একলা থাকেন, চুলগুলো ধবধবে, কর্পোরেশন স্কুলে পড়ান?”

”হ্যাঁ হ্যাঁ, কতটা ভেতরে হবে বলুন তো ভাই?”

অসীম দু’ পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। উদাসীন বা ক্লান্ত, ভরাট কণ্ঠস্বরের ‘ভাই’ শব্দটি তার ভালো লেগেছে।

”চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি।”

”গাড়িটা কি ভেতরে নিয়ে যাব, না এখানেই রাখব?” অসীমের মুখের দিকে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে তাকিয়ে রইল নির্দেশের অপেক্ষায়। এটা অসীমকে অভিভূত করল আবার। তার ইচ্ছা হল, মোটরটা জয়রাম মিত্র লেনের মধ্যে ঝকঝকে একটুকরো আকাশের মতো ভেসে আসুক।

”গলির ভেতরেই রাখুন। চোরের উৎপাত বেড়েছে আজকাল এখানে। এই সেদিন একটা গাড়ির হেডলাইট খুলে নিয়ে গেছে। আসুন জায়গাটা দেখিয়ে দিচ্ছি।”

”তাই নাকি! কেরিয়ারের লকটা আবার ভেঙে গেছে, স্পেয়ার টায়ারটা ভেতরে। বলে ভালোই করলেন।”

অসীমকে অনুসরণ করে ঝকঝকে আকাশি-নীল মোটরটা গলির মধ্যে ঢুকল। তেইশ নম্বর বাড়ির লাগোয়া কর্পোরেশন টিউবওয়েলে স্নান করছিল সত্যচরণ। দু’বেলা স্নান করে এবং অফিস যাওয়ার আগে ও ফিরে এসে তার একমাত্র কাজ বালতি বালতি জল টিউওয়েল থেকে এনে সারা বাড়ি ধোওয়া এবং ভাতের কণা কী মাছের কাঁটা বাড়ির কোথাও পড়ে আছে কিনা খুঁটিয়ে লক্ষ করা।

সত্যচরণের আট বছরের ছেলেটি হাতলে বুক দিয়ে পাম্প করে বালতিটা ভরে চলেছে। জলটা ঠান্ডা। মগে করে জল তুলে অনেকক্ষণ ধরে চোখ বুজে মাথায় ঢেলে ঢেলে সত্যচরণ আনন্দ করছিল। মোটরের ইঞ্জিনের শব্দে চোখ খুলেই আঁতকে উঠল সে।

”দ্যাখো দ্যাখো, কাণ্ড দ্যাখো, চাপা দেবেন নাকি মশাই!”

গামছার কসি চেপে ধরে সত্যচরণ উঠে দাঁড়াল। অসীম দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ”চুপ করুন তো, কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, এখনও শিখলেন না।”

”কেন, ইনি কি চিফ সেক্রেটারি।” সত্যচরণ খিঁচিয়ে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গেই আঁতকে বলল, ”মাড়িয়ো না, মাড়িয়ো না, জুতো পরে মাড়িয়ো না, ধুয়ে রেখেছি যে জায়গাটা।”

অসীম টিউবওয়েলের চারপাশে ধুয়ে রাখা অঞ্চলের উপর পা রেখেই সত্যচরণের কানের কাছে মুখ এনে শুধুমাত্র দুটি শব্দ চাপা স্বরে বলেই পিছিয়ে গেল। সত্যচরণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, ”আ মোলো, যত রাজ্যের গু-মুত লাগানো চাকা একেবারে চান করার জায়গায়!”

”এই গলির মধ্যে তিনের-বি, চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি।”

অসীম হাত তুলে তাঁতিদের গলিটা দেখাল। চওড়ায় দু’হাত, দৈর্ঘ্যে প্রায় চল্লিশ হাত। এর মধ্যে আছে চারটি বাড়ির ঠিকানা। এরকম শাখা গলি জয়রাম মিত্র লেনে গুটি পনেরো আছে। কোনোটির নাম উকিলদের গলি, কোনোটি চক্রবর্তীদের গলি, কোনোটির নাম ময়রাদের গলি।

”আপনি না থাকলে ট্রাবলে পড়তাম।”

তাঁতি গলির মুখেই কর্পোরেশনের আলো। অসীম লক্ষ করল, দুজনের ছায়াই দৈর্ঘ্যে যেন সমান। কথা বলতে গিয়ে ঘড়ঘড় করে উঠল তার গলাটা।

”নতুন লোকের পক্ষে একটু ট্রাবল হবেই।”

তিনের বি-র দরজা বন্ধ। দরজার পাশেই জানলা। তার একটা পাল্লা খোলা। অসীম উঁকি দিয়ে দেখল পিছন ফিরে নীরবালা ভটচায ঠোঙা থেকে কৌটোয় কিছু একটা ঢালছেন। অসীম গলাখাঁকারি দিতেই জানলার দিকে তাকালেন।

”আপনাকে একজন খুঁজছেন।” অসীম নামটা উচ্চচারণ করতে গিয়ে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করল।

”আমাকে?”

অবাক হয়ে তিনি জানলার ধারে এলেন। আবছা গলিতে ঠাওর করার চেষ্টা করছেন মুখটিকে, তখন অসীমের পিছন থেকে ক্লান্ত অথচ ব্যক্তিত্বে ভরাট স্বর বলে উঠল, ”পিসিমা, আমি হাঁদু, দরজাটা খুলুন।”

অসীমের মনে হল, তার মতো খুবই সাধারণ একজন, এই লোকটা। বাড়ির এবং পাড়ার অনেকেই এখনও তাকে ফ্যালা নামে ডাকে। পিসিমা থাকলে তার বাড়ি গিয়ে হয়তো এইভাবেই সে বলত, ”আমি ফ্যালা, দরজাটা খুলুন।”

অসীম এই কথা ভেবে, সমান-সমান একরকমের বোধের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। ঝকঝকে আকাশি-নীল মোটরটির গায়ে সে যত্নে হাত রাখল। এটিকে এখন তার নিজের বলেই মনে হচ্ছে। এখন ইওসেবিয়ো-র পর্যায়ের ফুটবলার হিসেবে নিজেকে ভাবতে ইচ্ছে হল তার। ঝুঁকে ডান হাঁটুতে হাত ছোঁয়াল। মুখ থেকে আপনিই বেরিয়ে এল, ”শাললা।”

পা-টা সরিয়ে নিতে মুহূর্তের জন্য দেরি হয়ে গেছল। রাইট-ইন বুট তুলেছে দেখতে পেয়েও অসীম এগিয়ে দিয়েছিল ডান পা, বলটাকে টাচ লাইনের ওধারে ঠেলে দেবার জন্য। না দিলে বল যেত রাইট-আউটের কাছে। সে চিপ করলেই, ওৎ-পাতা সেন্টার ফরোয়ার্ড বল পায়। সেখান থেকে নেট করা এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়। রাইট-ইনের পা-টা ঠিক হাঁটুতেই লাগল। বাকি সময়টা অসীম লেফট-আউটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দেয়। খেলায় এক গোলে হেরেছিল। খেলা শেষে একদল লোক লাঠি নিয়ে তাড়া করে তাদের চারজনকে-যারা কলকাতা থেকে এসেছিল টাকা নিয়ে খেলতে। অন্ধকারে ধান খেতের মধ্যে দিয়ে ছোটবার সময় অসীম দু’বার পড়ে যায়। দু’মাইল ছুটে এসে বাসে ওঠে। বাসে উঠে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ওরা। অবশেষে একজন চাপা গলায় বলে, ”বাকি টাকাটা আর দিল নারে।” আর একজন বলেছিল, ”বড্ড খিদে পেয়ে গেছে, জিতলে মুরগি খাওয়াবে কথা ছিল।” অসীম হাঁটু চেপে ধরে মাথা নামিয়ে শুধু বসে ছিল। হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছবার পয়সা মাত্র তার পকেটে। তখনও সে জানত না বাড়িতে তার বাবা কী কাণ্ড বাধিয়ে বসেছে।

”হ্যাঁরে ফ্যালা, কাদের বাড়িতে এল রে?”

অসীম উপর দিকে তাকাল। সতেরো নম্বরটা একতলা। ছাদের পাঁচিল নেই। ও বাড়ির সেজোমেয়ে শেফালি, বয়স প্রায় চল্লিশ, সময় পেলেই ছাদের কিনারে এসে বসে থাকে। বিয়ের ছয় মাস পরই স্বামীর ঘর থেকে চলে এসে, শেফালি পনেরো বছর যাবত বাপের বাড়ি রয়েছে। কেন রয়েছে তাই নিয়ে পাড়ায় প্রভূত জল্পনা হয়ে গেছে এক সময়। নতুন ভাড়াটেরা কৌতূহল দেখালে শেফালি একই জবাব দেয়, ”সন্ন্যাস নিয়ে বেরিয়ে গেছেন।” তবে পাড়ার প্রত্যেকেরই ধারণা, শেফালির কর্কশ কণ্ঠস্বর, রোমশ, কঠিন পেশি সম্বলিত দেহে কোমল বক্রতার নিদারুণ অভাব, পুরুষোচিত চলাফেরা, সতেরো বছরের কিশোরের মতো গোঁফ, কুচুটে স্বভাব ইত্যাদির জন্যই স্বামী সংসার ত্যাগ করে বিবাগী হয়ে গেছে। কেউ বলে, মোটেই সন্ন্যাসী হয়নি, আবার বিয়ে করেছে, চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে, বউ নিয়ে দিব্যি সংসার করছে। বাগবাজারে স্টেশনারি দোকান আছে, বিশ্বাস না হয় যে-কেউ গিয়ে ভজিয়ে আসতে পারে। কিন্তু কেউ ভজিয়ে এসেছে বলে জানা যায়নি।

শেফালির বাবা মারা গেছে পাঁচ বছর আগে। দাদা এবং তিন ভাই বিবাহিত। সে থাকে রান্নাঘরের পাশের ঘরটিতে। বাড়ির আঠারো জনের রান্না করে যে সময়টুকু পায়, সেটা ব্যবহার করে ছাদের কিনারে বসে আর এবাড়ি-ওবাড়ি করে। শেফালির আনন্দ প্রতি বাড়ি থেকে সংবাদ সংগ্রহে ও বিতরণে। ছাদের কিনার তার পর্যবেক্ষণ-ঘাঁটি। পাড়ার বউ-ঝিরা দুপুরে সাজগোজ করে বেরোলেই ছাদ থেকে অবধারিত প্রশ্ন ঝরবে-”কোথায় গো, সিনেমা?” ছোটো ছেলেমেয়ের হাতে শালপাতার ঠোঙা কী ভাঁড় দেখলে প্রশ্ন হয়-”কে এসেছে রে?”

শেফালি যখন যে বাড়িতে হাজির হয়, সঙ্গে সঙ্গে চালু আলোচনা ধামাচাপা পড়ে। পাশের বাড়ির বউ ইলার শোবার ঘরের জানলাটি শেফালিদের ছাদের লাগোয়া। সন্ধ্যা থেকেই সে জানলা বন্ধ রাখে, যেহেতু গল্পচ্ছলে শেফালি তাকে জানিয়েছে, ”বুঝলে গো, এ পাড়ার সব ঘরেই কোনো-না-কোনো ব্যাপার আছে, শুধু তোমাদের ঘরেই যা নেই।”

শুনেই ইলা বুঝে গেছে, শেফালি নজর রাখছে তার ঘরে এবং একটা ‘ব্যাপার’ আবিষ্কার না করা পর্যন্ত ও স্বস্তি পাবে না। অশোক প্রায়ই রাতে মদ খেয়ে ফেরে। কিন্তু মাতলামো করে না। সে কথা কি আর জানেনা শেফালি, নিশ্চয় জানে। তবু বলেছিল, ”সব ঘরেই আছে, জোর দিয়ে অমন কথা বলবেন না, ঠাকুরঝি।”

”বেশ, তাহলে বলো কোন ঘরে নেই?”

”তা কী করে বলব।” ইলা অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করে ওঠে। কোন ঘরের নাম করলে সেটাকে মোচড় দিয়ে শেফালি কী অর্থ করে পাড়ায় চাউর করবে কে জানে!

”তাহলে! বলতে তো পারলে না।” শেফালি খুশি হয়ে বলল।

ইলা তখন বলে, ”প্রফেসারদের ঘরে কিন্তু আপনি খুঁজে পাবেন না। বেশ ছিমছাম পরিবার, বউ, ছেলে আর শালি। ভদ্রলোক মাঝে মাঝে রেডিয়োয় বলে, গলাটি বেশ। ওর বউ নাকি স্কুলে পড়ায়। উনি বলছিলেন, মাসে হাজার সাতেক টাকা রোজগার করে।”

শেফালি নিমীলিত চোখে, মুখে হাসি ফুটিয়ে কথাগুলি শুনে যায়। অবশেষে বলে, ”তা ঠিকই বলেছ, তবে বউকে ফেলে আইবুড়ো যুবতী শালির সঙ্গে সিনেমা যাওয়া, দিদি বাড়ি থেকে বেরোলেই বোনের অমনি ভগ্নিপতির গা ঘেঁষে বসা, শ্বশুর তো বোর্ডিংয়ে রেখেই মেয়েকে পড়াতে চেয়েছিল, অমনি জামাই হাঁই-হাঁই করে বলে উঠল, ‘আমি থাকতে আভা বোর্ডিংয়ে থাকবে কি!’ লক্ষ করেছ তোমার প্রফেসারের বউ কেমন দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে! আসলে রস মরে গেছে, বুঝলে গো, রস মরে গেছে। আর ওদিকে বোনের চেকনাই ফুটেছে। নদীর এ-কূল ভেঙে ও-কূল গড়ে উঠছে। তুমি বাপু, রোজ ও লোকটার বেরোবার সময় জানলায় অমনভাবে দাঁড়িয়ো না, খারাপ দেখায়।”

শেষ বাক্যটিতে বিবর্ণ হয়ে গেছল ইলার মুখ।

”এই ফ্যালা, কাদের বাড়ি বল না?”

অসীম ভেবেছিল না শোনার ভান করে চলে যাবে। কিন্তু হাঁটুটার হঠাৎ চিড়িক দিয়ে ওঠায় দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছে। আভাকে বঙ্গ-সংস্কৃতি সম্মেলনের কার্ড দিতে গেছল অসীম, আধুনিক গানের দিন। আভা নেয়নি। বলেছিল, ”একা কোথাও যাওয়া দিদি পছন্দ করে না। দিদির কাছে থাকি, সুতরাং তার পছন্দ-অপছন্দ মেনে চলতে হবে তো।” অপ্রতিভ হয়ে অসীম বলেছিল, ”আমি পৌঁছে দেব, নিয়েও আসব আপনাকে।”

”না, দিদি ভীষণ স্ট্রিক্ট, একা কিছুতেই যেতে দেবে না।”

কথাগুলো হয়েছিল চার মাস আগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। জয়রাম মিত্র লেন, তারক কবিরাজ স্ট্রিট ছাড়িয়ে যেখানে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিন্যুয়ে পড়েছে, সেই মোড়ে। আভা তখন কলেজ যাচ্ছিল। কিন্তু শ্যামলের কাছে থেকে অসীম তিনদিন পরই শোনে, ”কিরে, কার্ড নিল না তো।” এবং শ্যামল জানায়, খবরটা সে বাড়িতে আলোচিত হতে শুনেছে মেয়েমহলে এবং শেফালি তখন হাজির ছিল।

”আপনাকে আর বলব কী, ঠিকই জেনে যাবেন।” অসীম মুখ তুলে বিরক্ত স্বরে বলল। ”যে এসেছে, তার মতো লোক এ গলির বাপের জন্মে ঢোকেনি, ঢুকবেও না।”

”কে, কে, নামটা বল নারে।” শেফালি হামা দিয়ে ঝুঁকে পড়ল।

অসীমের কী খেয়াল হল, নামটা চেঁচিয়ে বলল। শোনা মাত্র শেফালি লাফিয়ে উঠে ইলার বন্ধ জানলায় কিল মারতে মারতে চাপা চিৎকার শুরু করল, ”শিগগিরি খোল গো ইলা, পাড়ায় কে এসেছে দেখে যাও।”

এরপর অসীমের ইচ্ছা হল, খবরটা আভাকে দেয়। তিরিশের একের বাড়ির একতলার ঘরগুলির জানলায় গাঢ় খয়েরি পর্দা। পিছনে এবং উপরে তাকিয়ে, দেয়াল ঘেঁষে আস্তে চলতে চলতে অসীম তৃতীয় জানলায় একবার থমকে, পর্দার কিনারের ফাঁক দিয়ে ভিতরে তাকাল। দেখল আভা টেবিলটার ধারে মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে। চেয়ারে বসা হিরণ্ময় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। ঘরে টেবিল ল্যাম্পের চাপা আলো।

দুই

”তোমার দিদি জানে?”

”না।”

”কোথায় গেছে?”

”বলে যায়নি, টিপুকে নিয়ে বেরিয়েছে। বোধহয় দর্জির দোকানে।”

হিরণ্ময় চুলের মধ্যে আঙুল ঢোকাল। মুঠোয় চেপে চুল টানল। অভ্যাসমতো আঙুলগুলো চোখের সামনে ধরে দেখল কটা চুল উঠেছে। কয়েকটা ফুঁ দিয়ে ফেলার চেষ্টা করল। অ্যাশ-ট্রের উপর রাখা সিগারেট থেকে ধোঁয়া উঠছে পেনসিলের মতো সরু হয়ে। হিরণ্ময় তাকাল আভার দিকে। ধোঁয়ার স্তম্ভটি পাতলা হয়ে ভেঙে যাওয়ার জায়গাটিতে স্থির চোখে তাকিয়ে ও। হিরণ্ময় সিগারেটটা তুলে ঠোঁটে রাখল।

”তাহলে?” হিরণ্ময় বলল।

আভা ওর মুখ থেকে চোখ সরিয়ে বুক-কেসের দিকে তাকাল। অর্থনীতির লেকচারারের পড়ার ঘর। বই আর পত্রিকা ইতস্তত ছড়ানো। বুক-কেসের উপর ব্রোঞ্জের বুদ্ধের মাথা। ধুলোয় কালো হয়ে রয়েছে। তার পাশে একটি মাটির ফুলদানি। ফুল নেই। সরকারি এক কারুশিল্প বিপণি থেকে শোভা বছরখানেক আগে ও দুটো কিনে এনেছিল। প্রথম মাস-দুয়েক মুছত, ফুল রাখত। লম্বা সোফার বিপরীতে একটি ছোটো তক্তপোশ। পাতলা তোশকের উপর ঝালর দেওয়া গাঢ় খয়েরি খদ্দরের চাদর। তাতে পাখি উড়ছে আর তাই দেখার ব্যস্ত ছেলে কাঁধে এক গ্রাম্য বধূর গুটি ত্রিশ ছাপে ভরা চাদরটি। লিখতে লিখতে বা পড়তে পড়তে ক্লান্ত হলে হিরণ্ময় তাকিয়া টেনে তক্তপোশে শোয়। কখনো বা সোফায় হেলান দিয়ে নিচু ছোট্ট টেবিলটায় পা তুলে দেয়। ছাত্ররা এলে সে চেয়ারে বসে। ওদের সোফায় বসতে বলে।

”এমন যে ঘটবে জানতুম।” হিরণ্ময় চশমাটা হাতে নিয়ে টেবিল ল্যাম্পের আলোর দিকে ধরল। জলের দাগ লেগে আছে। ধুতির খুঁট দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, ”তোমার কোনো দোষ নেই।” গলাটা সামান্য ধরা। কথা বলল চাপা গম্ভীর স্বরে। সাধারণত উত্তেজিত হলে ওর স্বর সরু হয়ে যায়।

”কেন, দোষ নেই কেন?” আভা যেন তর্ক করতে চায়। কিন্তু ভঙ্গিটা উৎকণ্ঠার।

”কীসের দোষ তোমার?” চশমাটা চোখে এঁটে স্পষ্ট করে হিরণ্ময় তাকাল।

আভা উত্তর দেবার জন্য কথা খুঁজছে। টেবিলের ধারে দাঁড়িয়েছে বলে হিরণ্ময় ওর নাভি থেকে ঊর্ধ্বাংশটুকু শুধু দেখতে পাচ্ছে। ভয়েলের ছাপা শাড়ির পাড় নেই। নাভির উপরটা সামান্য উঁচু হয়ে রয়েছে কাপড়ের কুচির জন্য। আঁচলের কিনারে কোমরের মসৃণ তেলতেলা চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। ভাঁটার সময় গঙ্গার পাড়ে যেমন ফেলে যাওয়া পলিতে ভাঁজ দেখা যায়। অমন ভাঁজ ওর গ্রীবাতেও দেখা যায়, যখন মুখটা ফিরিয়ে বা ঘাড় কাত করে থাকে। আভা বেশ লম্বা, বাঙালি মেয়েদের তুলনায়। কাঁধ দুটি পুরুষালি ঢঙে প্রশস্ত। ব্লাউজের গলার ঘের কাঁধের প্রান্তে এসে ঠেকেছে, পিঠে শিরদাঁড়ার চতুর্থ গ্রন্থিটিও দেখা যাবে যদি পিছন ফেরে। হাঁটলে, পুরুষমাত্রেই ওর নিতম্বে চোখ রাখতে বাধ্য হয়। ওর স্বাস্থ্যের দৃঢ়তা বিষয়ে যাবতীয় অনুমান দর্শকরা এইখান থেকে করতে শুরু করে এবং গলা পর্যন্ত পৌঁছে অভ্রান্তই প্রমাণিত হয়। কিন্তু ওর থুতনি চাপা, গালের হনু উঁচু, ঠোঁট দুটি পুরু, মুখ গোলাকৃতি। চোখ দুটি বড়ো হওয়ায় মাত্রা-হারানো ভাব সারা মুখে।

”দোষ আমার, যেহেতু আমি বিবাহিত। স্ত্রী ছাড়া অপর কোনো স্ত্রীলোকের প্রতি আকর্ষণ বোধ করার অধিকার আমার নেই। হৃদয়ের সম্পর্ক স্থাপন অপরাধ, দেহ স্পর্শ করা পাপ। অথচ তিনটি অন্যায়ই আমি করেছি। সুতরাং আমি দোষী নয়তো কী?”

হিরণ্ময় থেমে থেমে এমনভাবে বলল, যেন ক্লাশের ছেলেমেয়েদের নোট দিচ্ছে-লিখে নিতে অসুবিধা না হয়।

”ভালো কথা, তুমি কি সিওর যে-” হিরণ্ময় অসমাপ্ত রাখল।

”হবার তারিখ ছিল ফিফথ।” আভা ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে হিরণ্ময়ও। সমুদ্রতীরে জেলে-ডিঙি, ঝাউবন এবং আবছা কয়েকটা মূর্তি ক্যালেন্ডারে। দিন গুণতে গুণতে মুহূর্তের জন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেল হিরণ্ময়ের মুখ।

”আজ টোয়েন্টি ফিফথ, এতদিন বলোনি কেন?”

”ভেবেছিলাম-” আভা মাথা নামিয়ে রাখল।

”কী ভেবেছিলে?”

”এমন তো আগেও হয়েছে দু-একবার। ছ’দিন, সাতদিন পর্যন্তও দেরি হয়েছে।” আভা ফিস ফিস করে বলল। ডান হাতে টেবিলের প্রান্ত আঁকড়ে ঈষৎ নুয়ে পড়েছে। আঙুলগুলোয় উত্তেজনার প্রবাহ স্পষ্টই দেখতে পেল হিরণ্ময়। ”আচ্ছা, আপনার যে একজন ডাক্তার বন্ধু আছে, সে তো ব্যবস্থা করে দিতে পারে!”

আভা উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে। কথাটির প্রতিক্রিয়া কী হয়, সেটা আদ্যপ্রান্ত সে দেখতে চায়। আভাকে তার মনোভাব বুঝতে না দেবার জন্য হাত বাড়িয়ে হিরণ্ময় বুদ্ধ-মস্তকটি তুলে নিল। হিমাংশুকে বললে ব্যবস্থা করে দেবে। একটা করুণ, শোচনীয়, বিয়োগান্ত গল্প বানিয়ে বললেই হবে। হিমাংশু আর্ত-আতুরকে সেবার সুযোগ পেলে ছাড়ে না।

কিন্তু আমি তো জানতামই। আমি তো বহুদিন আগে, একমাস, ছ’মাস, এক বছর আগে থেকেই জানতাম কিছু একটা ঘটবে। হিরণ্ময় বুদ্ধের মাথার ধুলো তর্জনী দ্বারা মুছতে মুছতে ভাবল। তোমার কোনো দোষ নেই আভা। আমি অপেক্ষা করেছি বহুদিন কিছু একটা ঘটাবার জন্য। কারণ আমি হাঁফিয়ে পড়েছি। আমি বদল চাইছিলাম এই নিত্যদিনের একঘেঁয়েমির থেকে। যখনই কলকাতায় কোনো কারণে পুলিশ গুলি চালায়, আমি রাস্তায় বেরিয়ে যেতাম এই আশায় একটা গুলি যদি গায়ে লাগানো যায়। তাহলে বেঁচে যেতাম রোজ এই চেয়ারে বসে ছাত্র-পাঠ্য বই লেখার দায় থেকে। ও-ঘরের বিছানাটায় শোবার দায় থেকে। ক্লাশে দম দেওয়া পুতুল হওয়ার দায় থেকে। আভা, আমি তৈরিই ছিলাম কিছু একটা ঘটাবার জন্য।

”না, হিমাংশুর কাছ থেকে এরকম ব্যাপারে সাহায্য নেওয়া যায় না। ও আমাকে শ্রদ্ধা করে খুব।”

”তাহলে?” ভয় এবং যন্ত্রণা, একসঙ্গে আভার মুখের চামড়া টেনে ধরল। লাল ঢাকনা মোড়া টেবিল ল্যাম্পের আলো থুতনির নীচে গাঢ় অন্ধকার তৈরি করে মুখটাকে কঠিন করে দিয়েছে। হিরণ্ময়ের মনে হল, মেয়েটি মোটেই যেন আবেগপ্রবণ নয়।

”তাহলে আর কি।” বুদ্ধের মাথাটি বুক-সেলফের উপর যত্ন ভরে বসিয়ে দিয়ে হিরণ্ময় লক্ষ করতে লাগল।

”যখন সবাই জানবে, দিদি জানবে? তখন আপনার কি হবে?”

”কিছু একটা নিশ্চয় হবে, সেটা এখনও জানি না।”

”আমি তো হতে দেব না।”

”কীভাবে?”

”চলে যাব এখান থেকে।”

”কোথায়, বাবা-মার কাছে?”

”জানি না কোথায় যাব। তবে শেষ পর্যন্ত ট্রেনে কাটা পড়ার কী ছাদ থেকে ঝাঁপ দেবার পথ তো খোলাই আছে।”

”আমিও তাই করব।’

শোনামাত্র আভা নিজের মুখগহ্বর তালু দিয়ে বদ্ধ করে দিল। তবু একটা ক্ষীণ শব্দ হিরণ্ময় শুনতে পেল।

”না, লক্ষ্মীটি না। এমন চিন্তা কোরো না।” আভা টেবিলে অনেকখানি ঝুঁকে বলল।

হিরণ্ময় হেসে উঠল নিঃশব্দে।

”বিবাহিতদের এমন চিন্তা করারও অধিকার নেই। তাহলে স্ত্রী-পুত্রের কী দশা হবে, তাই না?”

এরপর আভা মুখ নিচু করে দু’ হাতে টেবিলে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করল। হিরণ্ময় উঠে দাঁড়াবার আগেই সে হাঁটু গেড়ে বসে টেবিলের পায়া জড়িয়ে ফুঁপিয়ে উঠল বিকৃত স্বরে।

”আমি শত্রুতা করেছি নিজের দিদির সঙ্গে। আমি জানি, দিদির সর্বনাশ করেছি, আমার জন্যই ছারখার হল এ সংসার। আমি মুখ দেখাতে পারব না আর।”

”ওঠো, ওঠো। এটা বাইরের ঘর। রাস্তা থেকে কেউ দেখে ফেলতে পারে, ওঠো।” বিরক্তি চাপার চেষ্টা করতে করতে হিরণ্ময় ধমক দিল।

আভা টেবিলের পায়ায় মাথা ঘষতে শুরু করেছে একগুঁয়ের মতো। হিরণ্ময় জানলার পাল্লাগুলো বন্ধ করে এসে বলল, ”ও ঘরে চলো।”

”আমার জন্য তোমারও মান-মর্যাদা রইল না।”

”আগে উঠে দাঁড়াও।” তীব্রস্বরে হিরণ্ময় বলল। এইবার সে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।

আভা গ্রাহ্যে আনল না সে তীব্রতা। ”কিন্তু আমি কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না তোমার সম্মান। আমি দুঃখ দেব না দিদিকে।”

হিরণ্ময় নিচু হয়ে আভাকে টেনে তোলার চেষ্টা করল। এবং পারল না। দেহে যে পরিমাণ শক্তি থাকলে এ কাজে সফল হওয়া সম্ভব, তা নেই বুঝতে পেরে একটা হিংস্র রাগে তাকে পেয়ে বসল। বগলের নিচ দিয়ে আভাকে দু’ হাতে জড়িয়ে সে আবার টানল ওকে দাঁড় করাবার জন্য। কুঁজো হয়ে টেবিলের পায়া আঁকড়ে আভা শরীরটাকে শক্ত করে রেখেছে।

”ওঠো, ওঠো বলছি।” আভার কানের কাছে মুখ রেখে হিরণ্ময় অক্ষম রাগে চাপা চিৎকার করল। আবার ওকে টেনে তোলার জন্য সে নিজেকে ধনুকের মতো বাঁকাল। দম বন্ধ করে, আভাকে দু’ হাতে বেড় দিয়ে সোজা হয়ে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা করে এবারও পারল না। আভাও হাঁফাচ্ছে। দশটা আঙুলকে বেঁকিয়ে থাবার মতো করে হিরণ্ময় ওর বুকের কোমল মাংসে বসিয়ে উপড়ে ফেলার জন্য টেনে ধরল। সারা শরীর অন্ধ জেদে টনটন করছে। নিশ্বাস ফেলে আবার বুক ভরে নিল। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু একটিই কথা-ভাঙব, ওর অবাধ্যতা আমি ভাঙবই। ধীরে ধীরে সে মোচড়াতে শুরু করল তার থাবা দুটো। একটু একটু করে আভার মুখ ঊর্ধ্বমুখী হল। যন্ত্রণায় ঠোঁট দুটি ফাঁক হয়ে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। তারপর জিভ দেখা গেল। গলার দুটো পেশি দড়ির মতো পাকিয়ে উঠল আর চোখের কোল বেয়ে জল কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে নামল। এবং আরও জোরে সে আঁকড়ে ধরল টেবিলের পায়াটা।

হিরণ্ময় ওকে ছেড়ে দিয়ে সিধে হয়ে দাঁড়াল। কপালে চিটচিটে ঘাম ফুটেছে। দপদপ করছে রগের শিরা দুটো। নিজেকে তার মনে হচ্ছে অক্ষম, দুর্বল, পরাভূত। শুধুমাত্র গায়ের জোরে আভা তাকে অগ্রাহ্য করতে পারল। আভা টেবিলের পায়ায় কপাল ঠেকিয়ে কাঁদছে। টেবিল ল্যাম্পের চাপা আলোয় ওকে দেখতে দেখতে হিরণ্ময়ের মনে হল একটা কুকুর টেবিলের পায়া ধরে দাঁড়িয়ে কুঁই কুঁই করছে।

নিজের উপর সে হঠাৎ রেগে উঠল। বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে শোবার ঘরে এসে, চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল খাটে। আলো থেকে চোখ আড়াল করতে ডানবাহু চোখের উপর রাখল। মনে মনে বিড়বিড় করে বলল, সম্মান, মর্যাদা, দুঃখ! আশ্চর্য নির্বোধ! আত্মত্যাগের পরাকাষ্ঠা দেখাতে ট্রেনে কাটা পড়বে! যদি বলি এই মুহূর্তে ছাদ থেকে ঝাঁপ দাও, নিশ্চয় দেবে। পাড়ার লোকগুলো অমনি পিলপিল করে পিঁপড়ের মতো এসে ওকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়াবে। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ঘাড়গুলো শুঁড়ের মতো নাড়াবে। আর আভার থেঁতলানো দেহ থেকে ছিটকানো রক্ত এত লাল কেন তাই নিয়ে বলাবলি করবে। আভা মরার আগে ওদের শুনিয়ে স্বীকারোক্তি দেবে-পাঁচিলে ঝুঁকতে গিয়ে ভার সামলাতে পারিনি। তারপর পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্স আসবে। হাসপাতালে পোস্ট-মর্টেম করা হবে এবং তখন জানা যাবে-”ওখানে দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে এসো।”

আভা পর্দা সরিয়ে ঘরের ভিতর এল। হিরণ্ময় আপাদমস্তক দেখল ওকে। শোভার থেকে আট বছরের ছোটো। একই উচ্চচতা, একই গড়ন, একই রঙ দুজনের। শুধু আলাদা হয়ে যায় চুম্বনের সময়, চাহনিতে, শ্বাস-প্রশ্বাস ক্ষেপণে, দেহের তাপে।

”আমাকে-” আভা দ্বিধায় থেমে রইল। কিছু চুল ওর গালে লেপটে রয়েছে। ব্লাউজটা কুঁকড়ে কোমর থেকে উঠে গেছে খানিকটা। চওড়া কাঁধ যেন ঝুলে পড়েছে। ওকে দেখাচ্ছে ভগ্নস্তূপের মতো।

”বলো”। ধীর মৃদু হবার চেষ্টা করল হিরণ্ময়।

”আমাকে আর তুমি ভালোবাসবে না নিশ্চয়।”

”কেন!”

”ক্ষতি করলাম।”

”আগের থেকেও এখন বেশি ভালোবাসব।”

আভার মুখের উপর বিস্ময়ের ছায়া পড়ল। বোধহয় বিশ্বাস করছে না। হিরণ্ময় মমতা বোধ করল ওর জন্য। পোস্ট-মর্টেম থেকে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই জানা যাবে। সবাই তখন বুঝবে এটা আত্মহত্যা। কিন্তু এজন্য কে দায়ী সেটা জানা যাবে না। তাকে ধরা যাবে না। হিরণ্ময় টের পেল, তার মনের কোথাও যেন একটুখানি স্বস্তি দানা বাঁধল। তাইতে সে এই বলে নিজেকে বোঝাল-আর পাঁচজনের মতো তাহলে আমিও নিরাপদে বাঁচতে চাই! সব মানুষের মধ্যেই জানোয়ার আছে, আমিও বাদ নই।

তাহলে গুলি খাবার জন্য রাস্তায় বেরোই কেন? হিরণ্ময় পরমুহূর্তেই এলোমেলো হতে শুরু করল। মরতে চাওয়া এবং বাঁচার ইচ্ছার মধ্যে কোনটি খাঁটি। শোভা একটা সরল অঙ্কের ছকের মধ্যে এসে গেছে। ধাপে ধাপে নেমে যাবে নির্ভুলভাবে। স্বাভাবিক একটা গেরস্ত উত্তরও পাওয়া যাবে। উত্তরমালা খুলে শুধু মিলিয়ে নেওয়া। আভা অন্য কিছু। ওর অঙ্কটাই প্রশ্নমালায় নেই। পাঁচজনের মতো নিরাপদে বা জানোয়ার-বোধ দিয়ে এ অঙ্কের উত্তর মেলানো যায় না। সারাজীবনই কষে যেতে হবে শুধু। হঠাৎ এমন এক উটকো অঙ্কে কেন হাত দিলাম।

সব মিলিয়ে হিরণ্ময় যখন একটা ফর্মূলা তৈরি করার চেষ্টা করছে তখন আভা বলল, ”দিদি আপনাকে খুব ভালোবাসে।”

”জানি।”

”যদি জানতে পারে?”

”জানবে। আমিই ওকে সব বলব।”

”সে কি!” আভা দ্রুত কাছে এল হিরণ্ময়ের। ”না, কিছুতেই না। তাহলে দিদিকে আমি জ্যান্ত মুখ দেখাতে পারব না।”

মাত্র এক হাত উপরে ঝুঁকে রয়েছে মুখটা। হাত বাড়িয়ে কপাল, গাল অথবা চিবুক স্পর্শ করা যায়। হিরণ্ময়ের মনে হল, আর বোধহয় নিজেকে সে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না। আভাকে বুকের উপর চেপে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠবে কিংবা টানতে টানতে ছাদের পাঁচিলের কিনারে নিয়ে যাবে ঠেলে ফেলে দেবার জন্য।

”বড্ড ছেলেমানুষ তুমি আভা। এভাবে ব্যাপারটার সমাধান হয় না। আত্মহত্যা আমিও তো করতে পারি। কিন্তু তাতে অপমানের হাত এড়াতে পারব মাত্র। কেউ হয়তো বড়োজোর বলবে, লোকটার প্রবল আত্মমর্যাদা বোধ ছিল। তুমিও বোধহয় আমার প্রতি আনুগত্য দেখাতে কিছু একটা করে বসবে। কিন্তু এসব করার জন্যেই কি আমরা ভালোবেসেছি?”

”আমি যদি মুখ ফুটে না জানাতাম, হিরণ্ময়, তোমায় আমি ভালোবাসি, তাহলে ব্যাপারটা এই পর্যন্ত গড়াত না।” কথাগুলো আভা কাঁপা গলায় বলল। হিরণ্ময়ের নাম উচ্চচারণের সময় ওর ভিতরটা প্রতিবারই নড়ে ওঠে।

”একটা কিছুতে গড়াত।” হিরণ্ময় আনমনা হয়ে গেল সামান্য। যেভাবে ক্লাসে চাহিদা ও জোগান তত্ত্ব বোঝায়, সেই ক্লান্ত স্বরে থেমে থেমে বলল, ”একটা কিছু ঘটাবার জন্য আমি অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু বুঝছি না, কেন আমি তা চাই। বাঁচার জন্য না মরার জন্য, সেটা বুঝছি না।”

রাস্তায় জানলার কাছে টিপুর গলা শোনা গেল। সদর দরজায় খিল দেওয়া। কড়া নাড়ার শব্দ হল। ঠাকুর রান্নাঘর থেকে গিয়ে খিল খুলে দিল। টিপু বাড়ি ঢুকতে চাইছে না। শোভার ধমক শোনা গেল সদরের দরজায়।

আভা ফ্যাকাশে মুখে হিরণ্ময়ের দিকে তাকাল। ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাবার আগে চাপা স্বরে শুধু বলল, ”আমি তোমাকে মরে যেতে দেব না।”

হালকা চটির শব্দ ঘরের দরজা পর্যন্ত এসে থেমে রইল। শোভা এসেছে। হিরণ্ময় প্রাণপণে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করতে করতে বলল, ”কী ব্যাপার দাঁড়িয়ে রইলে!”

”আসব?”

”তার মানে!”

হিরণ্ময় সত্যিই অবাক হল এবং সেই সঙ্গে বুঝতে পারল স্নায়ুগুলো, হঠাৎ প্রখর আলোয় ধাঁধানো চোখের মতো অনুভবরহিত হয়ে পড়েছে। শোভা কি জানতে পেরেছে? জানার পর লক্ষ করে যাচ্ছে? নিশ্চয় তুমুল একটা কিছু করবার জন্য তৈরি হচ্ছে। বিশ্রী কুৎসিত একটা নাটক। রাস্তার জানলায় দর্শক জমবে, মনে মনে তারা হাততালি দিতে দিতে এনকোর এনকোর বলবে। দৃশ্যটি চকিতে ভেসে উঠল হিরণ্ময়ের চোখে। নিজেকে সে বলল, তার আগে আমিই ওকে সব জানাব। ওকে চিৎকার করার সুযোগ দেব না। ওকে বলব, কেন আমি আভার সর্বনাশ করেছি।

চোয়াল কঠিন করে হিরণ্ময় বলল, ”ভেতরে এসো, তোমাকে একটা খবর দেব।”

”সে খবরটা আমিও জানি!” পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল শোভার মুখ। ”রাস্তায় বেশ ভিড় জমে গেছে। আশ্চর্য, ওই টিচারের বাড়িতে আসবে ভাবতেই পারিনি। আভা কোথায়, ওর তো ফেবারিট হিরো।”

তিন

জয়রাম মিত্র লেনের এক থেকে ত্রিশ নম্বর পর্যন্ত চুয়াত্তরটি বাড়ির রঙই পাণ্ডুর, কলিচটা। প্রায় দুশোটি উনুনে আঁচ পড়ে প্রতি ভোরে। অধিকাংশ বাড়ির পলেস্তারা খসে জিরজিরে ইঁট বেরিয়ে পড়েছে। এই গলিতে ভোটার সংখ্যা সাতশো, খবরের কাগজ রাখে বত্রিশটি, বছরে বিয়ে হয় গড়ে তিনটি, শ্রাদ্ধ তিনটি, অন্নপ্রাশনও তিনটি। সাতটি আস্তাকুঁড়ে, একটি টিউবওয়েল, রাস্তার আটটি ইলেকট্রিক বাতি, একটি খাটাল, একটি পাঠশালা, গুটি পঞ্চাশ রেডিয়োর শব্দ এবং কমপক্ষে পঞ্চাশটি শিশুর চিৎকার জয়রাম মিত্র লেন দিয়ে হেঁটে গেলে চোখে বা কানে আসবে।

তারক কবিরাজ স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে গলির দিকে তাকালেই চোখে পড়বে তিন নম্বর বাড়ির ছাদে ভাঙা-ট্যাঙ্কের পাশে অশ্বত্থ গাছটাকে। ওটা বাড়তে চাইলেই ও-বাড়ির ভাঁড়ু বা হাবু লাঠি-পেটা করে ডালগুলো ভেঙে দেয়। ফলে গাছটা বাড়তে না পেরে ঝাঁকড়া হয়ে উঠেছে। শিকড়ের ঝুড়ি নেমেছে দোতলা পর্যন্ত। বৃষ্টি জলের পাইপগুলো রাস্তা পর্যন্ত নামানো, কিন্তু ছেলেদের বলখেলার ধকল সইতে না পেরে সবকটিরই তলার অংশ ভাঙা। বহু বাড়ির জানলার পাল্লা লটপটে বুক পকেটের থেকেও অর্থহীন-ঝড়, বৃষ্টি, রোদে সামাল দিতে পারে না।

জয়রাম মিত্র লেনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে হলে মুখটাকে তুলতে হয় যতক্ষণ না ঘাড়ে টান পড়ে। সূর্যকিরণ একমাত্র গ্রীষ্মে ছাড়া রাস্তা স্পর্শ করতে পারে না। সারা বছর স্যাঁতস্যাঁতে, ভ্যাপসা গন্ধ গলিতে অনড় হয়ে থাকে। নতুন মানুষরা ঢুকলেই অনুভব করে, দেড়শো বছরের বন্ধ সিন্দুকের ডালা যেন খুলে গেল। তারা কৌতূহলে এপাশ-ওপাশ তাকাতে তাকাতে পথ চলে। পাড়ার বৃদ্ধদের সন্দিগ্ধ চোখ দেখে দ্রুত হয়ে যায়।

অনন্ত সিংহের মেয়ে পুতুল ষোলোয় পড়েছে! দুবছর আগে, ক্লাস সিক্সে ওঠামাত্র স্কুল ছাড়িয়ে ওকে সংসারের কাজে লাগানো হয় অনন্তের নির্দেশে। সেই সময় থেকে পাত্রের সন্ধান করে করে অবশেষে আহিরিটোলার শীলেদের পঞ্চম পুত্রটির খোঁজ পেয়ে অনন্ত দ্রুত কথা চালিয়ে ব্যাপারটা প্রায় পাকা করে এসেছে। ছেলেটি দু’বার স্কুল ফাইনালে ব্যর্থ হয়ে পৈতৃক হার্ডওয়ার দোকানে বসছে। ত্রিশ হাজার টাকা যৌতুক পেলে আলাদা দোকান করবে বরানগরে। অনন্ত ত্রিশ হাজারকে পনেরো হাজারে এবং দশ ভরি গহনাকে আট ভরিতে নামাতে পেরেছে ছয় মাসে। পাত্রের বাড়ির মেয়েরা পুতুলকে দেখে গেছে। আজ আসবে পাত্র তার দুই বন্ধুকে নিয়ে। মাসখানেক আগে অনন্ত কলি ফিরিয়েছে বাড়ির। দেখলে মনে হয় গলিটার কপালে শ্বেতি হয়েছে।

ঝকঝকে নীল স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডটা যে টিউবওয়েলের ধারে রাখা হয়েছে, সেটি অনন্তর সদর দরজারই লাগোয়া। টিউবওয়েলটি এখানে বসানোর ব্যাপারে ওর সঙ্গে বাসুদেব ধরের প্রচণ্ড একচোট হয়ে গেছল। কুমার চৌধুরী কাউন্সিলর হয়েছে তারই কৃপায়, এরকম একটা ধারণা অনন্ত বরাবরই পোষণ করে আসছে।

পাড়ার প্রাচীন এবং বনেদি বাড়ি হিসাবে সিঙ্গি বাড়ি জয়রাম মিত্র লেনে বিদিত। তিনতলায় গোপীনাথ জীউয়ের বিরাট ঘর। তার মেজে শ্বেতপাথরের। পালা পার্বণে অনন্ত খরচ করে। এখনও পাড়ায় যে তিন-চারটি বাড়িতে বৈঠকখানা আছে, তার মধ্যে বৃহত্তমটি অনন্তের। চারটি নিচু তক্তপোশের উপর শতরঞ্চি পাতা। দেয়ালে পাগড়ি মাথায় ওর ঠার্কুদা পূর্ণচন্দ্র এবং তার ভাই নারায়ণচন্দ্রের তেলরঙা প্রতিকৃতি। ধুলায় বিবর্ণ। এক বাণ্ডিল কোম্পানির কাগজ এবং চারটি বাড়ি দিয়ে যায় পুত্র গৌরচন্দ্রকে। বছর দশেকের মধ্যে তার অর্ধেক ফুঁকে দিয়ে যৌনব্যাধিতে ভুগে দুই পুত্র অনন্ত ও দুলালকে রেখে গৌরচন্দ্র মারা যায়। বাবা মারা যাবার আট মাসের মধ্যেই সম্পত্তি ভাগ করে অনন্ত ও দুলাল আলাদা হয়ে যায়।

তেইশ নম্বরের ভিতরের অংশে থাকে দুলাল। পিতার দোষগুলি সে পূর্ণ মাত্রায় আয়ত্ত করে দুখানি বাড়িই বিক্রি করে দিয়েছে। এখন সন্ধ্যা থেকেই দিশি মদের দোকানে বসে থাকে। অপরপক্ষে, অনন্ত পৈতৃক সম্পত্তি পূর্ণমাত্রায় রক্ষা করে, নিজে একটি বাড়ি কিনেছে, শেয়ার বাজারে দালালি থেকে অর্জিত অর্থ, তিনটি বাড়ির ও চারটি রিকশার ভাড়া এবং তেজারতি ও বন্ধকি কারবার থেকে মাসে তার যা আয়, তাতে জয়রাম মিত্র লেনের মধ্যে ধনী হিসাবেও সে খাতির পেয়ে থাকে।

কাজেই ইলেকশনের সময় কুমার চৌধুরী এ পাড়ায় প্রথম অনন্তর কাছেই এসেছিল। ওকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ার প্রতি বাড়িতে যায়। শুধু ছাব্বিশ নম্বর বাড়িটি ছাড়া। বাসুদেব ওর বাল্যবন্ধু কিন্তু বাক্যালাপ বন্ধ যৌবন থেকেই। কুমার সতেরো ভোটে জিতেছিল। বৈঠকখানায় তাকিয়া কোলে নিয়ে দুলতে দুলতে অনন্ত বলেছিল, ”আমি না বেরোলে ওই সতেরোটা ভোট পেত কি?”

তাই শুনে সত্যচরণের চোখ ঠেলে বেরিয়ে এল। বিস্ময় দমন করে এক সময় বলতে পারল সে, ”সিঙ্গিমশাই যার হয়ে নিজে ক্যানভাস করছেন, সে জিতবে না তো কে জিতবে! এগেনস্টে নেহরু দাঁড়ালেও যে হেরে যাবে। সামনের বার আপনিই বরং দাঁড়ান, কমপক্ষে দু’হাজার ভোটের মার্জিনে জিতবেন।”

অনন্ত অপ্রতিভ হয়ে বলে, ”না না, এসব ঝামেলায় আমি যেতে চাই না। পাবলিক ওয়ার্ক বড়ো কঠিন কাজ সত্য, বড়ো কঠিন কাজ। ভালো করলেও ব্যাটা চোর, খারাপ করলেও ব্যাটা চোর। এ হচ্ছে শাঁখের করাত।”

কিন্তু শাঁখের করাত, অনন্তর মনের মধ্যে তারপর থেকে প্রতিদিনই একটি কথা কেটে চলেছে-”কমপক্ষে দু’হাজার ভোটের মার্জিনে জিতবেন।” পাড়ায় পাড়ায় কুমারের খাতির, বৈঠকখানা ভর্তি অনুগ্রহপ্রার্থীদের দেখে মাঝে মাঝে লোভ হয় অনন্তের। নিজের পাড়ার বাইরে কেউ তাকে চেনে না, পাত্তাও দেয় না। ইদানীং সেটা বেশি করে সে বুঝেছে। গত বছর সার্বজনীন পুজোর জেনারেল মিটিংয়ে সত্যচরণ সহ-সভাপতি পদে অনন্তর নাম প্রস্তাব করেছিল। বাসুদেব বানচাল করে বেপাড়ার এক আগরওয়ালার নাম ভোটে পাশ করিয়ে নেয়।

তাছাড়া আর একটি কারণ অনন্তর অবচেতনে কাঁটার মতো বিঁধে আছে, যেটা সে কোনোক্রমেই তুলে ফেলতে পারেনি। কুমার চৌধুরীর বাবা ভুবনের ছিল সাইকেল সারাই ও ভাড়ার দোকান। স্কুল পালিয়ে অনন্ত এক আনা ঘণ্টা হিসাবে ভাড়া নিয়ে সাইকেল চালানো শিখত। সহায়ক ছিল বাসুদেব। অনন্ত সাইকেলে বসত, এক হাতে সিট আর অন্য হাতে হ্যান্ডেল ধরে বাসু নির্দেশ দিতে দিতে ছুটত-”চাকার দিকে তাকাচ্ছিস কেন? ম্যাড়া কোথাকার, সামনে তাকা…..ব্রেক কর গাধা, ব্রেক কর…আরে রাঙামূলো বেলটা আছে কী করতে, বাজা, বাজা।”

কয়েকদিন পর হ্যান্ডেল ছেড়ে দিয়েই বাসু ছুটত। তারপর চুপিসারে সিট ধরা হাতটাও ছেড়ে দিত মাঝে মাঝে। অনন্ত যখন ব্যাপারটা বুঝত অমনি হাত কেঁপে বেটাল হয়ে পড়ে যেত। বাসু সামনের উঁচু দাঁত দুটো বার করে হাসত, ”অমন টুকটুকে গতর নিয়ে কী আর সাইকেল শেখা হয়রে ব্যাটা। এবার আমায় দে দেখি।” বলেই তড়াক করে সাইকেলে উঠে পাঁই পাঁই চালিয়ে উধাও হয়ে যেত বাসুদেব। ওদের চুক্তিই ছিল, প্রথম আধঘণ্টা অনন্ত সাইকেল শিখবে, শেষ আধঘণ্টা বাসুদেবের। ভাড়ার পয়সা অবশ্য অনন্তের। বাসু আধঘণ্টায় ধর্মতলা কী শেয়ালদা কী কাশিপুর ঘুরে আসত। সেন্ট্রাল অ্যাভিনু তখন কয়েক বছর মাত্র তৈরি হয়েছে। এত মোটর, ট্রাক, মানুষজনের ভিড় তখন ছিল না।

একদিন বাসুদেব ফিরল পিছনের মাডগার্ডটা তুবড়ে। সাইকেলটা অনন্তের হাতে গছিয়ে দিয়েই বাসুদেব সটকে পড়ে। ভুবন দেখামাত্র আট আনা ফাইন চেয়ে বসে এবং না পেলে অনন্তর ঠাকুর্দার কাছ থেকে আদায় করে আনবে বলে হুমকি দেয়। পূর্ণচন্দ্রের বয়স তখন ঊনসত্তর। বদরাগী, রাশভারী। কয়েকদিন আগেই চার টাকার বদলে সাড়ে চার টাকার গামছা কেনার জন্য লাঠি হাতে দুই সন্তানের পিতা গৌরচন্দ্রের দিকে তেড়ে গিয়ে বলেছিল, ”রক্ত জল করা পয়সা আমার, আর বাবুয়ানি করে ফুঁকে দেওয়া হচ্ছে?” এমন লোকের কাছে আট আনা এবং পৌত্রের পিঠের চামড়া সমান বস্তু।

অনন্ত ভয়ে কেঁদে ফেলে। তাই দেখে হঠাৎ নরম হয়ে গেল ভুবনের মন। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে দিতে ওকে দোকানের ভিতরে নিয়ে গেল ভুবন। ন-দশ বছরের কুমার বসেছিল দোকানের মধ্যে। তাকে ধমক দিয়ে বার করে দরজাটা ভেজিয়ে দেয়। অনন্ত যখন বেরিয়ে এল তখন বাসুদেব দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে কুমারের সঙ্গে। অনন্তকে দেখে মিটমিট হেসে বলল, ”ফাইন শোধ হয়ে গেছে তো, ব্যস। এবার থেকে তোর ভাড়ার পয়সাও আর লাগবে না।” শুনে কুমারও হেসে ওঠে।

ওইদিন থেকেই অনন্ত চটতে শুরু করে বাসুদেবের উপর। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারে না। বাসু যদি ব্যাপারটা রটিয়ে দেয়, লজ্জায় মুখ দেখানো যাবে না। তারপর পঁয়ত্রিশ বছর কেটে গেছে। ভুবন মরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানও উঠে যায়। কুমার এখন দু’শো টাকা ফি-এর উকিল। ওকে দেখলেই অনন্তর মনে পড়ে, দোকান থেকে বেরোবার আগে কেমন অদ্ভুতভাবে ও তাকিয়েছিল তাদের দুজনের দিকে আর হেসেছিল। নিশ্চয় বুঝেছিল ব্যাপারটা। এখনও মাঝে মাঝে মনে পড়ে আর ভেতরে দুঃসহ জ্বালা বোধ করে অনন্ত। ইলেকশনে দাঁড়িয়ে কুমারকে হারিয়ে দিতে পারলে বোধহয় কিছুটা সান্ত্বনা পাওয়া যেতে পারে-এই চিন্তা তখন জেঁকে বসে।

কিন্তু কুমার তাকে যথোচিত সমীহ ও সম্ভ্রম দেখায়। কুমারের নির্দেশে, তার সদর দরজার মাথায়ই রাস্তার আলো লাগানো হয়েছে। তাই নিয়ে বাসুদেব গণ-দরখাস্ত সংগ্রহ করে প্রতিবাদ পাঠিয়েছিল কমিশনারের কাছে। টিউবওয়েলও বসেছে অনন্তর বাড়ির লাগোয়া।

”কর্পোরেশন কি কারুর বাপের সম্পত্তি।” টিউবওয়েল বসাবার সময় বাসুদেব চিৎকার করেছিল পাড়ায় দু-তিনজনকে দাঁড় করিয়ে। ”দেখুন, কোথায় বসানো হচ্ছে দেখুন। এখানে টিউবওয়েল বসলে পাড়ার একটা বাড়ি ছাড়া আর কার লাভ হবে, বলতে পারেন? সকলের বেনিফিটের কথাটা ভাবুন একবার। আমরা কি ট্যাকসো দিই না? ধরুন, হঠাৎ কারুর রান্নার জল ফুরিয়ে গেল, বাড়িতেও তখন কোনো পুরুষ কি ছোটো ছেলেপুলে নেই যে দৌড়ে এক বালতি জল এনে দেয়। এমন অবস্থা হতে তো পারে? বলুন, আপনারই বলুন, তখন কি বাড়ির মেয়েরা এত দূরে এসে কল থেকে পাম্প করে জল নিয়ে যাবে? যুবতী মেয়েও তো অনেক বাড়িতে রয়েছে, তারা কি এখানে আসবে জল নিতে?”

বাসুদেবের কথা শুনে একজন বললে, ”পাড়ার আরও ভেতর দিকে বসলেই ভালো হত, বেপাড়ার লোক এসে দিনরাত জল নিয়ে নিয়ে কলটা খারাপ করে দিতে পারবে না।”

আর একজন বলল, ”ভিতরের বসাবার স্থান কোথায়! কল বসলে রিকশাও আর যাইতে পারবো না। এখানে রাস্তাটা চওড়া, ঠিকই বসানো হচ্ছে। রাত্রদিন খ্যাচাং খ্যাচাং শব্দ আর জলকাদায় রাস্তা মাখামাখি হয়ে তো থাকব, বরং বাইরের দিকেই বসানো ভালো। পিপাসা পাইলি বাইরের লোক এসে খ্যায়া যেতে পারবো।”

”দেখুন মশাই, আপনাদের মাথায় মেয়েদের প্রেস্টিজ জিনিসটা একদমই আসে না। আপনাদের মেয়েরা যেটা অনায়াসে পারে, ওয়েস্ট বেঙ্গলের মেয়েদের সেটা করতে বাধে। টিউয়েলটা এখানে বসানো কেন উচিত নয়, সেটা অন্য পয়েন্ট থেকে দেখছি আমরা, আপনি আর কথা বলতে আসবেন না।” বাসুদেব এক বেঁটেখাটো নিরীহদর্শন লোকের নাকের কাছে ঘন ঘন হাত নাড়ল চপেটাঘাতের ভঙ্গিতে। এরপর দেখা গেল পাড়ার এক-চতুর্থাংশ বাসুদেবের বিরুদ্ধে চলে গেছে এবং টিউবওয়েলও অনন্তের সদরের পাশেই বসেছে।

প্রথম জল নেয় সত্যচরণ। টিউবওয়েলকে স্নান করিয়ে চারপাশের তিন হাত পর্যন্ত রাস্তা জল দিয়ে ধুয়ে বালতি পাতার আগে সে চেঁচিয়ে বলেছিল, ”যুবতী মেয়েদের জন্য ভেবে ভেবে তো আমাশা হয়ে গেল ব্যাটার। নিজের মেয়ের কী হল সেটা খোঁজ কর আগে।”

বাসুদেব কথাগুলো স্বকর্ণে শোনেনি। গল্পচ্ছলে শেফালি বলে আসে বাসুর বউকে এবং সত্যচরণ দোতলার পিছন দিকে লুকিয়ে একটা পায়খানা করেছে সে তথ্যও জানিয়ে দিল। বাসুদেব দ্রুত কর্পোরেশনে বেনামা চিঠি দিয়ে সত্যচরণের একশো টাকা খসিয়ে দেয়। রাগটা তাতে অনেকখানি কমে।

অনন্ত এই সন্ধ্যাবেলা বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে দেখল, সদরের অর্ধেক আড়াল করে একটা ঝকঝকে নীল মোটর দাঁড়িয়ে। সুতরাং চিৎকার করল, ”গাড়ি কার, অ্যাঁ রাখার কি আর জায়গা পেল না। এটা লোকের বাড়ির সদর সেটা খেয়াল হল না।”

”কী হয়েছে অত চেঁচাচ্ছেন কেন?”

পা টেনে টেনে অসীম এগিয়ে এল। ওর গম্ভীর গলা, যেটা-‘চুপ কর শালা’ বলার সময় প্রয়োগ করে-শুনে অনন্ত থতমত হল। আঠারোর-সি-র দ্বারিক চক্রবর্তী অর্থাৎ ভোম্বল দোতালার জানলা থেকে উঁকি দিল।

”আমিই বলেছি ওখানে রাখতে। পাড়ার মধ্যে মোটর রাখার আর জায়গা কোথায়? যা একখানা গলি। রিকশা ছাড়া আর কিছুতে চড়া মানুষ তো কোনো জন্মে ঢোকেনি। অসুবিধে হয় তো একটু ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছি বরং।”

”একটু পরেই পুতুলকে দেখতে আসবে তো। তাই বলছিলুম”, অনন্ত কণ্ঠস্বর মোলায়েম করে বলল, ”কে এল অসীম, কার বাড়িতে?” ফ্যালা নামে ডাকার ভরসা হল না তার।

উত্তর পেয়ে অনন্ত অবাক হয়ে মোটরটার দিকে তাকিয়ে রইল। অসীম চলে যাচ্ছে একটু খুঁড়িয়ে। অনন্ত ব্যস্ত হয়ে বলল, ”হল কী পায়ে?”

”চোট লেগেছে।” অসীম মুখটুকুও ফেরাল না।

”চিকিৎসা করাচ্ছ তো?” অনন্তকে চেঁচিয়ে বলতে হল, কেননা জবাব দিতে অসীম দাঁড়ায়নি।

কিন্তু শুনেছে। দাঁত চেপে অসীম নিজেকে শুনিয়ে বলল, ”দরদ দেখাচ্ছে।” এখুনি তার ত্রিশটা টাকা দরকার, কেননা ওর বাবা এক কাণ্ড বাধিয়ে বসে আছে। যেভাবে হোক এখুনি তাকে টাকা জোগাড় করতে হবে।

অনন্ত চিন্তায় পড়ে গেল। গাড়িটা এখানে থাকলে, ওরা এসে দেখে কিছু ভাববে না তো। এসব লোক লম্পট দুশ্চরিত্র হয় বলেই তার ধারণা। ত্রিশ বছরে গুটি চারেক সিনেমা সে দেখেছে, কিন্তু ফ্যালাটা যার নাম করে গেল তার ‘বই’ একটাও দেখেনি। পুতুলের ডিসকোয়ালিফাই হবার কারণ, এই গাড়িটা হতে পারে কি না, সেটা কার কাছ থেকে জানা যাবে, তাই ভাবতে শুরু করল অনন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে। ঝি ভিতর থেকে এসে বলল-

”বাবু, মা তাড়া দিচ্ছে। আর বলে দিল সন্দেশগুলো বড়ো বড়ো চারটাকাওলার আনতে। ওম্মা, গাড়ি কার গো, এসে গেছে নাকি!”

”অন্য লোকের গাড়ি।” অনন্ত গম্ভীর স্বরে বলল। এইসময় তার মনে হল, সদরে এমন ঝকঝকে একটা মোটর দাঁড়িয়ে থাকলে মন্দ দেখায় না। গৃহস্বামীর মানও বাড়ে। পুতুলের মামা কি মেসোর গাড়ি বলেও তো চালিয়ে দেওয়া যায়!

বাসুদেব ধর অফিস থেকে ফিরছে। দূরে ওকে দেখতে পেয়েই অনন্ত সিংহ মোটরটার বাম্পারে একটা পা তুলে দিল। পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরিয়ে, এটার মালিক তার খুবই নিকট আত্মীয় এতই নিকট যে পা পর্যন্ত তোলা চলে, এমন একটা ভঙ্গি ফুটিয়ে অনন্ত আকাশে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল।

যাবার সময় বাসুদেব আড়চোখে একবার মাত্র তাকাল।

চার

দ্বারিক ওরফে ভোম্বল জয়রাম মিত্র লেনে সবথেকে ভালো ছেলে হিসাবে ঘরে ঘরে সুখ্যাত। স্কুল ফাইনালে অঙ্কে লেটার পায়। বি.কম-এ উঁচু সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে। কিছুদিন জোড়াবাগানে এক আখড়ায় কুস্তি শিখেছিল। লাইব্রেরি থেকে বই আনে হপ্তায় চারবার। দ্বারিক স্কুলজীবনে মোহন সিরিজ, শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর শেষ করে ফেলেছে। কলেজে ইউনিয়নের সহ-সভাপতি হয়ে কিছুদিন বিবেকানন্দ এবং মাও-সে-তুং পড়ে। ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢুকে এখন রবীন্দ্রনাথ পড়ছে। তবে ছোকরা লাইব্রেরিয়ানটি যেদিন বসে, সেদিন ক্যাটালগে যৌন-বিজ্ঞানরূপে চিহ্নিত বইগুলি থেকেই একটি নেয়। নিজের ঘরে তোশকের নীচে সেই বই রাখে। দরজা বন্ধ করে গভীর রাতে পড়ে এবং শরীরে খুবই চঞ্চলতা অনুভব করে। লুকিয়ে হিন্দি ফিল্ম দেখছে প্রায়শই। সন্ধ্যার পর চৌরঙ্গী অঞ্চলে সে অলসভাবে হেঁটে ফেরে। সুগঠিতা মহিলারা এই অঞ্চলে মানসিক জড়তামুক্ত হয়ে চলাফেরা করে এবং তাদের দেখতে দেখতে দ্বারিক ঝিমঝিমে এক ধরনের অনুভবের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে কাউকে অনুসরণ করে, কখনো সিনেমায়, কখনো মনুমেন্টের নীচে রাজনৈতিক প্রতিবাদ সভায়, কখনো বাসে উঠে গড়িয়া বা হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তারপর বাড়ি ফেরার সময় নিজেকে প্রভূত ধিক্কার দিতে দিতে প্রতিজ্ঞা করে ”এই শেষ। আর এভাবে ইন্দ্রিয়ের দাস হবে না। কিছুতেই না।” পরদিন থেকেই সে শীর্ষাসন শুরু করে, এবং সপ্তাহকাল অফিস থেকে সোজা বাড়ি চলে আসে। ট্রামে বা বাসে লেডিজ সিটের দিকেও তাকায় না। কিন্তু পরশু দিনই গড়ের মাঠ থেকে কিছু নিয়ে একটি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের পার্ক সার্কাসের বাড়ির দরজায় পৌঁছেই বিবেকের এক প্যাঁচে নিজেকে মাটিতে ফেলে কষে লাথি মেরেছে আর বলেছে ”এই শেষ, এই শেষ।”

প্রকৃতপক্ষে দ্বারিক কিন্তু মুখচোরা, দায়িত্ববান যুবক। চাকরিতে ঢুকেই ব্যাঙ্কিং-এর প্রথম পরীক্ষা পাশ করে পঞ্চাশ টাকা ইনক্রিমেন্ট পেয়েছে, দ্বিতীয়টির জন্য তৈরি হচ্ছে। তাহলে আরও দুটি ইনক্রিমেন্ট পাবে। এখন তার বেতন প্রায় চার হাজার। এম.কম. পরীক্ষা সামনের বছর দেবেই। অফিসে পরিশ্রমী হিসাবে সুনাম অর্জন করেছে। দ্বারিকের বারো বছর বয়সে মা এবং ষোলো বছরে বাবা মারা যায়। দুই দাদার যৌথ সংসারে সে এখন মাসিক হাজার টাকার সদস্য। দোতলার রাস্তার দিকের ছোটো ঘরটি তার ফলে সম্পূর্ণই তার একার। পঞ্চাশ হাজার টাকার জীবনবিমা করেছে সে। ব্যাঙ্কে প্রতি মাসে দু’হাজার টাকা জমা দেয়। প্রতিদিন জমা খরচের হিসাব লেখে, রাত্রে শোবার আগে। প্রতি রবিবার কাগজে জমিবাড়ি-সম্পত্তির বিজ্ঞাপনগুলি খুঁটিয়ে পড়ে। কলকাতার আশেপাশে চার-পাঁচ কাঠা জমি কিনে রাখার ইচ্ছা সম্প্রতি তার হয়েছে, ভবিষ্যতের কথা ভেবে।

সাতটি নাবালকের বাবা অফিসের ভোলানাথ পাঁড়ুই এক বিকেলে ট্রামে উঠতে গিয়ে পিছলে বাসের চাকার নিচে চ্যাপটা হয়ে যায়। হাসপাতাল এবং শ্মশান হয়ে দ্বারিক ভোলানাথের বাড়িতে গেছল। সেখানে ছেলেমেয়েগুলির অসহায় মুখ এবং ভোলানাথের স্ত্রীর কান্না শুনে, দ্বারিকের বুকের মধ্যে কেমন করে ওঠে। নিজেকে ভোলানাথের জায়গায় কল্পনা করে, তারপর থেকে সে, মাঝে মাঝেই ভয় পাচ্ছে। সাবধানে রাস্তা পার হয়, নিশ্চল না হওয়া পর্যন্ত ট্রামে-বাসে ওঠে না, কর্পোরেশন অফিসে গিয়ে বসন্তের টিকা নিয়ে এসেছে। এমনকি বিয়ে না করার কথাও সে ভেবেছে। বড়োবউদি তার বিবাহযোগ্যা এক মাসতুতো বোনের অসাধারণ রূপ ও গুণাবলির কথা ইদানীং দ্বারিককে প্রায়ই শোনাচ্ছে। মেজোবউদি আড়ালে তাকে বলেছে, ”সব বাজে কথা, মানুর থেকেও দেখতে খারাপ।”

মানু অর্থাৎ মনীষা এইবার বি.এ. পরীক্ষা দেবে। বছর পাঁচেক আগে এ পাড়া থেকে উঠে গিয়ে শ্যামপুকুরে রয়েছে। মেজোবউদির থেকে বয়সে দশ-বারো বছরের ছোটো, কিন্তু সখীস্থানীয়া। এ পাড়ায় থাকার সময় ফ্রক পরে রোজই আসত। তখন ওকে দেখে দ্বারিকের সাধ হত হাস্য-পরিহাসের, সান্নিধ্যলাভের। কিন্তু ঘড়ঘড়ে গলায় ”এই যে” বলা ছাড়া আর কিছুই বলা হয়ে ওঠেনি।

তারপর হঠাৎ একদিন অফিস যাবার জন্য বাস স্টপে দাঁড়িয়ে দ্বারিক দেখল, মানু শাড়ি পরে কলেজে যাচ্ছে। আশ্চর্য হয়ে দ্বারিকের মনে হল মানুতো বেশ সুন্দর! সঙ্গে সঙ্গে কিছু বাসনার উদয় হল এবং তারই প্রকোপে সে মুগ্ধ হয়ে তাকাল। মানু ওর পাশ দিয়ে যাবার সময় লাজুক হয়ে মাথাটি নামিয়ে আঁচলটি বুকে টেনে দেয় এবং কিছুদূর গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। এরপর, প্রায়ই দ্বারিক বাস স্টপে দাঁড়িয়ে তিন-চারটি বাস ছেড়েও অপেক্ষা করে। মাঝে মাঝে দেখা হয় মানুষ সঙ্গে। কিন্তু প্রথম দিনের মতোই মানু মাথা নামিয়ে চলে যায় এবং দূরে গিয়ে তাকায়। দ্বারিকের খুব ইচ্ছা করলেও আজও কথা বলা হয়ে ওঠেনি।

মানু গড়নে রোগা এবং ঢ্যাঙা। মাথায় প্রচুর চুল, গায়ের রঙ মিশকালো। হাসে হো হো করে, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় শেষের দুটি ধাপ লাফিয়ে নামবেই, কণ্ঠস্বর অসম্ভব মিষ্টি এবং ভালোই গান গায়, তর্ক করতে ভালোবাসে, যুবকদের নাজেহাল করার সুযোগ পেলে ছাড়ে না, কলেজ স্পোর্টসে দৌড়ায় এবং কলেজ ইলেকশনে বক্তৃতা দেয়। মা-বাবা এবং পাঁচ ভাইবোনের সংসারে কোনো কাজ করতে তার ভালো লাগে না। দ্বারিকের মেজোবউদি প্রায়ই ভালোমন্দ শখের রান্না করে, ঘরে হিটার জ্বেলে। কীভাবে যেন মানু তখন ঠিক হাজির হয়ে যায়। ও অসম্ভব খেতে ভালোবাসে। অকপটেই বলে, ”ভাত-ডাল-চচ্চচড়ির বেশি তো আর জোটে না। তাই যেখানেই খাবার গন্ধ পাই ঠিক হাজির হই। কলেজে অ্যায়সা খিদে পায়, মাঝে মাঝে ভাবি বেশ পয়সাওলা ছেলে যদি পাই তো প্রেম করি!” তারপরই হো হো করে হেসে উঠে বলে, ”যা রক্ষেকালীর মতো চেহারা আমার। একটা ছেলেও কাছে আসে না।”

এই সময় হঠাৎ মানু এসে হাজির। দ্বারিক তখন সদর দরজায় দাঁড়িয়েছিল। অসীমের চেঁচিয়ে বলা কথায় উঁকি দিয়ে ঝকঝকে আকাশি-নীল একটা মোটর দেখে কৌতূহলী হয়ে নিচে নেমে আসে। সত্যচরণ বালতি হাতে যাচ্ছিল জল নিতে। দ্বারিককে দেখে বলল, ”হ্যাঁগো, গাড়িটা এখানে রাখা কি উচিত হল, বলো তো তুমি?”

”কার গাড়ি?”

”ওম্মা, এখনও শোননি। ওই যে বায়স্কোপের হিরো গো। যাকে দেখলে মেয়েরা পাগল হয়ে যায়।”

নামটা শুনে খুবই অবাক হল দ্বারিক। বিশ্বাসই করতে পারল না। অসীমকে আসতে দেখে সে ইতঃস্তত করল, জিজ্ঞাসা করবে কি না।

”ওগো, এটাকে তো পাড়ায় ঢোকালে”, সত্যচরণ অসীমকে লক্ষ করে বলল, ”চাকায় চাকায় যত রাজ্যের গু-মুত এবার থেকে ঢুকতে শুরু করবে তো।”

”তা করবে।” অসীম তার প্রায় ছ’ফুট দেহটিকে তেরিয়া করে দাঁড়াল। সত্যচরণ কথা না বাড়িয়ে ডিঙি মেরে কিছু একটা অতিক্রম করে টিউবওয়েল পৌঁছে গেল।

”চাকায় চাকায় আসে আর লোকের পায়ে পায়ে আসে না? রাস্তাটা কি আপনার শোবার ঘর?” অসীম আরও কিছু বলত, ওর ছোটোভাইকে ছুটে আসতে দেখে চুপ করল।

”দাদা, সেই লোকটা এসেছে।”

”কিছু বলেছে?” চাপা গলায় অসীম বলল।

”হ্যাঁ, রাগারাগি করছে, টাকা ফেরত চাইছে আর তোমাকেও খুঁজছে।”

কিছুক্ষণের জন্য পাংশু হয়ে রইল অসীমের মুখ। দ্বারিক তাকিয়ে আছে দেখে ছোটোভাইকে বলল, ”আমি ঠাকুরের চায়ের দোকানে আছি, চলে গেলেই খবর দিবি।”

অসীম চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মানু এল। দ্বারিক তখনও সদরে দাঁড়িয়ে। মানুকে দেখামাত্র বলল, ”কার গাড়ি বল তো?”

মানু অবাক হল। এমন উত্তেজিত ছেলেমানুষি গলায় দ্বারিককে কথা বলতে শোনেনি কখনো। তাছাড়া চারটি শব্দবিশিষ্ট বাক্য দ্বারা তাকিয়ে যেচে কথাও শুরু করেনি। মোটরের দিকে এক পলক তাকিয়ে সে বলল, ”কী জানি।”

”যদি বলতে পারো তাহলে মিত্র কাফের ফাউল দোপেঁয়াজি খাওয়াব, ফুল প্লেট।”

”ওরে ব্বাস, তবে বলতেই হয়।” মানু কোমরে হাত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে আকাশ-পাতাল ভাবার ভান করল। দ্বারিক সেন্টের মৃদু গন্ধ পেল। খোঁপায় লাল গোলাপ দেখল। শাড়িটি সিল্কের। ব্লাউজের হাতা নেই।

সত্যচরণ বালতি ভরে জল নিয়ে যেতে যেতে দুজনের দিকে তাকিয়ে গেল। দ্বারিক তাইতে অস্বস্তি বোধ করল। মেজোবউদি বিকেলে বাপের বাড়ি গেছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। মায়ের নাকি অসুখ করেছে, রাতে ফিরবে। বড়োবউদি ইনফ্লুয়েঞ্জায় শয্যাশায়ী। অফিস থেকে ফিরে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় দ্বারিকের কানে আসে বড়দা বাঁকা সুরে বলছে, ”রান্নাঘরে যেতে হবে কিনা, তাই বোধহয় মায়ের অসুখ হয়েছে।”

মেজোবউদি না থাকলে মানুর এ বাড়িতে ঢোকার কোনো কারণই থাকে না। বড়োবউদির সঙ্গে ওর আলাপটা নেহাতই সৌজন্যমূলক। দ্বারিক সাহস করে বলে ফেলল, ”এখানে দাঁড়িয়ে ভাবলে আর বলতে পারবে না। মেজোবউদি তো নেই বরং আমার ঘরে বসে ভাবতে পারো।”

”কোথায় গেছে মেজোবউদি!”

”বাপের বাড়ি, মায়ের অসুখ করেছে। কোথাও যাচ্ছ নাকি, এত সেজেছ যে?”

”ধ্যেৎ, একে আবার সাজা বলে নাকি। এই চেহারায় সাজবোটা কোথায়।”

হেসে উঠতে গিয়ে দ্বারিকের মুখের দিকে তাকিয়ে মানুর বুকের মধ্যেটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। দ্বারিকের চোখে ভর্ৎসনা এবং আহত হওয়ার মিশ্র একটা রূপ ফুটে রয়েছে। অস্ফুটে সে বলল, ”চলুন”।

দুজনেই পা টিপে চুপিসারে দোতলায় এসে দ্বারিকের ঘরে ঢুকল। কেন যে এমন করে লুকিয়ে এল, ওরা তার কৈফিয়ৎ খোঁজার জন্যই বোধহয় পরস্পরের মুখের দিকে, তাকাল। দ্বারিকের চোখ চাপা উত্তেজনায় ঝকঝক করছে। ঘড়ঘড়ে গলায় সে বলল, ”দাঁড়িয়ে কেন, বসো।”

”আপনার ঘরে এই প্রথম এলুম।”

”সে কি! এত বছর আসছ অথচ-”

”যা গম্ভীর আপনি। ভয় করে আপনাকে দেখলে।”

”এখন করছে না?” দ্বারিক খুশি হয়ে দরজার পর্দাটা ভালো করে টেনে দেবার জন্য পিছু ফিরল।

মানু ঘরের সর্বত্র চোখ বুলিয়ে, টেবিলের উপর পাতা খুলে উপুড় করে রাখা একটি বই দেখে বলল, ”পড়ছিলেন বুঝি?”

ফ্যাকাশে মুখে ঘুরে দাঁড়াল দ্বারিক। বইটা তোশকের নিচে রেখে একতলায় যাওয়া উচিত ছিল তার।

”হ্যাঁ, ব্যাঙ্কিংয়ের সেকেন্ড পার্টটা দেব ভাবছি।”

দ্বারিক পায়ে পায়ে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। তবু রক্ষে বইটা কালো মলাটে বাঁধানো। টেবিলে আরও কয়েকটা বই রয়েছে। মানুর দিকে পিঠ ফিরিয়ে বইটা চটপট গুঁজে দিল অন্যগুলোর মধ্যে।

”কি, বললে না তো, এখন তো ভয় করছে কিনা?” হাঁফ ছেড়ে দ্বারিক মুখোমুখি চেয়ারে বসল।

”বলুন না গাড়িটা কার?”

”উঁহু, আগে আমার কথাটার উত্তর দাও।”

”কী উত্তর দেব!”

”বারে, সেটা কি আমি বলে দেব।”

”দিন না বলে।” হেসে মুখ ফিরিয়ে মানু আলনায় ঝোলানো পোশাকগুলো দেখতে মন দিল। দ্বারিকের মনে হল, এত সুন্দর মুখ আর হয় না।

”বললে কী খাওয়াবে?”

”আমার পয়সা কোথায় যে খাওয়াব?”

”পয়সা লাগে বুঝি খাওয়াতে!”

মানু চট করে দ্বারিকের মুখটা দেখে নিল একবার। বেপরোয়া দুঃসাহসে পেয়ে বসল দ্বারিককে। জীবনে এই প্রথম একঘরে একটি বিংশোত্তীর্ণা অনাত্মীয়া কুমারীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ সে পেয়েছে, জীবনে আর কোনোদিন আসবে কিনা কে জানে। এলেও হয়তো তখন সে আর যুবক থাকবে না। কিংবা কালই ভোলানাথ পাঁড়ুইয়ের মতো বাস চাপা যেতে পারে।

”পয়সা লাগে না এমন জিনিসও তো মেয়েরা খাওয়াতে পারে!”

”সে আবার কি জিনিস?” মানু সন্ত্রস্ত হয়ে খোলা বাঁ-কাঁধটি আঁচলে ঢাকল। দ্বারিকের চোখে অদ্ভুত মিষ্টি এক চাহনি।

”বলব?”

হ্যাঁ, বলতে গিয়ে কিছু না বলে, মানু মাথা নুইয়ে চুপ করে রইল। দ্বারিক মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ভাবল, শেষ পর্যন্ত বোধহয় যুবক হতে পারব।

মনে মনে সে দ্রুত বলল, আসলে আমি খুব ভিতু। কোনোদিন মেয়েদের সঙ্গে মেশার সুযোগ তো হয়নি। আমার গাম্ভীর্যটা পুরোপুরিই নকল। আমায় তুমি ভয় পেয়োনা, কেমন।

দম বন্ধ করে উৎকণ্ঠিত চোখে দ্বারিক তাকিয়ে রইল। মানু মুখ তোলেনি।

”মনীষা, উত্তর দিচ্ছ না যে?”

মুখ তুলে মানু তাকাল। দুটি চোখ জ্বলজ্বল করছে। দ্বারিকের বুকের মধ্যে মোচড় দিল। কী বলবে ভেবে না পেয়ে, অসহায়ভাবে এধার-ওধার তাকাল। দারুণ একটা কিছু বলতে ইচ্ছে করছে তার এবং কোনোক্রমে আবেগ সংযত করে বলল, ”ওই নীল গাড়িটায় আমাদের পাড়ায় কে এসেছে জানো!”

নামটা শুনেও কোনো ভাবান্তর ঘটল না মানুর। তাইতে দ্বারিকের মনের গভীরে নিরুদ্বিগ্ন সুখের সঞ্চার ঘটল। হেসে বলল, ”বেরিয়ে যখন মোটরে উঠবে আমার এই জানলা দিয়ে দেখা যাবে। তুমি ততক্ষণ বসবে?”

মানু ঘাড় নেড়ে বলল, ”আমার একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না দেখার।”

পাঁচ

”অ বউ, কোথায় গেলি, সন্ধে দেখিয়েছিস? অ বউ, শুনতে পাচ্ছিস? খোকাকে বলিস কাল বাজার থেকে যেন কচুরমুখী আনে। মনে করে দিস ওকে। বড়ি দিয়ে ঝাল করিস।”

থুত্থুড়ে শাশুড়ি এক তলায় দালানের এক কোণায় সকাল-সন্ধে উবু হয়ে বসে থাকে। হামা দিয়ে নর্দমা পর্যন্তও যেতে পারে না। চোখে দেখে না, কানে কম শোনে।

”অ বউ, খোকা দোকান থেকে ফিরেছে?”

কোনো সাড়া না পেয়ে অবশেষে বিরক্ত হয়ে বলল, ”আঁটকুঁড়ির গেরায্যই নেই। মর তুই, খোকার আবার বিয়ে দোব, টুকটুকে বউ আনব, বছর বছর বিয়োবে, দেখি তোর দেমাক থাকে কোথায়।”

বুড়ি এখন ঘণ্টাখানেক এইভাবে বকবক করে যাবে। কিন্তু যাকে শোনাবার জন্য, সে তখন দোতলায় ইলার রান্নাঘরের দরজায়।

”বলিসকি লো, সত্যি!” পারুল ধাক্কাটা সামলে ওঠার জন্য দরজাটা চেপে ধরল।

”হ্যাঁরে গুঁপো-ঠাকুরঝি এই তো জানালা দিয়ে বলল। তিনের-বি-তে যে বিধবা মাস্টারনি থাকে, ওই যে রে, রাস্তায় কুকরদের বিস্কুট কিনে খাওয়ায়, ওরই কাছে এসেছে।” ইলা বেগুনের পিঠ ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল।

”যাঃ, বাজে কথা, অন্য কেউ হবে।” পারুল বিশ্বাস করতে পারছে না। ”এই গলিতে কী কত্তে আসবে, ওর মতো দেখতে কেউ হয়তো হবে।”

”তোর অমনি অবিশ্বাস।” ইলা চটে উঠল। বেগুনটাও পুড়ে গেছে। কড়াটা ঠকাস করে উনুন থেকে নামিয়ে রাখল। ”কেন, আসতে পারে না নাকি এ পাড়ায়? এক সময় কত বড়ো বড়ো লোক ছিল জানিস! ওই যে ছুঁচিবেয়ে সত্যচরণ, ওর ঠাকুর্দার নামে মেডিকেল কলেজে একটা বেড আছে। স্যাকরা বাড়ির পাশে বাসু ধর, ওদের বাড়িটা তো তিন মহলা ছিল, ওই পেছনের কালী ঘোষ স্ট্রিটে ছিল সদর দরজা, এখন তো ওরা থাকে আগের বাড়ির খিড়কির দিকে। সব বিক্রি হয়ে গেছে। ওর যে কাকা ব্রাহ্ম হয়ে গেছে, সে হাইকোর্টের জজ হয়েছিল, এই পাড়াতেই তো মানুষ! আর এখনও কি নেই ভেবেছিস? ওই প্রোফেসারের কাছে কত বড়ো বড়ো লোক আসে তা জানিস?”

ইলার রুদ্ধশ্বাস বাক্যস্রোতে পারুল ভেসে গেল। ধুপ করে উবু হয়ে বসে ইলার কানের কাছে মুখ এনে বলল, ”চল না, এখটুখানি দেখে আসি। সিনেমায় কত দেখেছি, রক্তমাংসের মানুষটাকে সামনা-সামনি একবারও দেখিনি। দ্যাখ না, রোজই তো বাপু এই সময় রাস্তার জানলার ধারে এটা করি ওটা করি, কেউ গেলে চোখে পড়েই। আর আজকেই এমন বরাত যে-আরে বলব কী, বিকেল থেকেই বুড়িটা খালি খাবো খাবো করে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। চুপ করে শুয়ে ছিলুম। মনে হল বটে মোটরগাড়ির মতো কী একটা যেন ঢুকল। বুড়ি যে কবে ঘাটে যাবে।”

অন্য সময় হলে পারুলের শাশুড়ির বিষয়ে শোনার সময় হত ইলার, এখন সেও ব্যস্ত হয়ে বলল, ”ওনারও মাথা ধরেছে, শুয়ে আছেন খোকাকে নিয়ে।”

”ভালোই তো হল, চট করে তাঁতি গলিতে ঢুকে জানালা দিয়ে দেখেই চলে আসব। মাইরি, একবার চল।” পারুল দু হাতে ইলাকে জড়িয়ে শব্দ করে গালে চুমু খেল এবং বগলের নিচে খামচে ধরল।

”অই অই, আবার যা-তা শুরু হল তো। ইলা সরিয়ে দিল পারুলের হাত। গলা নামিয়ে বলল, ‘উনি রয়েছেন ঘরে, পাগলামি করিসনি’।”

”ওরে বাবা, আজ যে বড়ো তাড়াতাড়ি! দশটা-এগারোটার কম তো ফেরে না।”

”মাথা ধরেছে ভীষণ।”

”শনিবার দিন তো সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে পড়ে গেছল, আমি না থাকলে আর উঠতে হত না-বাব্বাঃ মুখে কী ভুরভুরে গন্ধ।”

ইলা তীক্ষ্ন চোখে তাকাল পারুলের দিকে। আঁটকুঁড়িটার বড্ড নজর অশোকের দিকে। রোজ রাতে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য জেগে বসে থাকে। যখন তখন উপরে উঠে আসে অশোক থাকলে। গায়ে মাথায় কাপড় ঠিক থাকে না। এর জন্যই শেফালিদের ছাদের দিকের জানলাটা বন্ধ রাখতে হয়। শনিবার রাতে অশোককে ধরে তুলেও দিয়েছে। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ইলা, হঠাৎ মনে পড়ল দোকান থেকে আট গজ মারকিন আনিয়ে দিয়ে পারুল দাম নেয়নি।

”কী দেখছিস, যাবি তো তাড়াতাড়ি কর।”

পারুল এইভাবে ইলার তাকানোয় অস্বস্তি বোধ করল। তাও সে বলেনি, অশোক বারবার ঝুমি ঝুমি, তোমাকে ঝুমির মতো দেখতে, বলে ঘাড়ে চুমু খেয়েছিল। ঝুমিটা কে, কদিন ধরে পারুল তাই জানার চেষ্টা করেও জানতে পারেনি। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নামটা ইলার সামনে করেছে কিন্তু ইলা কখনো শুনেছে বলে মনে হয়নি তার।

পারুল উঠে দাঁড়াল। শোবার ঘরের আধখানা দেখা যাচ্ছে। খাটে আট মাসের বাচ্চচাটা ঘুমোচ্ছে। তার পাশে অশোকের পিঠ আর মাথা। ফুটফুটে, উলের বান্ডিলের মতো নরম ছেলেটা। সারা দুপুর ওকে নিয়ে পারুল চটকায়, কাঁদায় হাসায়। অমন একটা বাচ্চচা তার চাই। বাপের বাড়ি গিয়ে, লুকিয়ে যে ডাক্তার দিয়ে নিজেকে পরীক্ষা করিয়েছে। ডাক্তার বলেছে, বাঁজা নও। তোমার স্বামীকে পরীক্ষা করা দরকার, তাকে নিয়ে এসো। মৃত্যুঞ্জয়কে সে কথা আজও জানায়নি পারুল। মা হবার ক্ষমতা তার আছে, এইটুকু জেনে সে স্বস্তি পেয়েছে। আঁটকুড়ি আঁটকুড়ি শুনে এখন তার প্রচণ্ড রাগ হয় অপদার্থ হোঁৎকা স্বামীর উপর। ময়না কিনে দিয়েছে, টিয়া কিনে দিয়েছে অথচ সাজানো তকতকে ঘরটা তছনছ নোংরা করে দেবার মতো একটা দস্যি নিয়ে আসার ক্ষমতা নেই। দোকান থেকে রোজ রাতে বাড়ি ফিরে টাকার হিসেব নিয়ে বসবে। একটা সিকি এধার-ওধার হয়ে গেলে রাতে ঘুমোবে না। মাদুলি, জলপড়া, হত্যে দেওয়া, মানসিক করা-সবকিছুই মৃত্যুঞ্জয়ের নির্দেশে করে যায় পারুল। শুধু ডাক্তারের বলা কথাটা জানায়নি।

ইলা পিছন ফিরে রান্না ঢাকা দিয়ে রাখছে। পারুল শোবার ঘরে বাচ্চচার দিকে আবার তাকাল। হঠাৎ অশোককে পাশ ফিরতে দেখে সে চোখ সরিয়ে নিল। ইলা ন্যাতা দিয়ে রান্নাঘরের মেঝে নিকোচ্ছে। পারুলের মনে হল যেন, অশোক ওঘর থেকে তার দিকে তাকিয়ে। সন্তর্পণে সে চোখ ফেরাল। সোজা তার মুখের উপর একদৃষ্টে অশোক তাকিয়ে। ওর চোখে পারুল কী যেন দেখতে পেল আর সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে থরথর করে উঠল।

”আমার শরীরটা কেমন করছে রে ইলা।”

”সেকি রে!”

”হ্যাঁ, বুকের ব্যথাটা শুরু হবে মনে হচ্ছে। বোধহয় আমি আর যেতে পারব না।” পারুল দেয়ালে হাতের ভরে শরীর রেখে চোখ বুজল।

”সেকি! তোরই লাফানি বেশি আর তুই-ই এখন যেতে পারবি না বলছিস। কী যে ঢঙ বুঝিনা বাপু।” ইলা গরগর করে উঠল ক্ষোভে।

”আমার শরীরটা ভালো লাগছে না, মাথা ঘুরছে, তুই বরং শেফালি ঠাকুরঝিকে সঙ্গে নে, আমি আর যাব না। শুয়ে পড়ি।” বলতে বলতে পারুল সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল দ্রুত। শেষের তিনটে ধাপ আগে পায়ে পা জড়িয়ে পড়ে গেল সে। তাড়াতাড়ি উঠে ঘরে গিয়ে, আলো নিভিয়ে আছড়ে পড়ল খাটে। তার সারা শরীর এখন কেমন করছে।

দালানের কোণ থেকে শাশুড়ি বলে উঠল, ‘অ-বউ, কী পড়লে রে?’

অশোক একদৃষ্টে পারুলের দিকে তাকিয়ে থাকলেও আসলে সে পারুলকে দেখছিল না। ভাবছিল গত চার ঘণ্টার মধ্যে ঘটে যাওয়া কতকগুলো ঘটনা।

চার ঘণ্টা আগে সুকুমারের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হল চৌরঙ্গীর পুব ফুটপাথে, বাস স্টপে। জেনারেল ম্যানেজারের কাছে এগারো দফা দাবি পেশ করার জন্য ব্রাঞ্চগুলো থেকে যে মিছিল শ্লোগান দিতে দিতে হেড অফিস পর্যন্ত আসে তার মধ্যে অশোকও ছিল। গেটের সামনে জমায়েত হয়ে বক্তৃতা শুরু হতেই সে ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে। একঘেঁয়ে কথাগুলো শোনার উৎসাহ তার আর নেই। ধর্মতলা-চৌরঙ্গীর মোড়ে পৌঁছে ভাবল, এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে কী করব। এখন সিনেমার ম্যাটিনি শো মাঝামাঝি অবস্থায়, ফুটবল লিগের খেলা শুরু হতেও ঘণ্টা দেড়েক বাকি। হাসপাতালে কেউ পরিচিত রুগি হয়েও নেই যে দেখে আসা যায়, শুঁড়িখানায় বসার মতো পকেটে যথেষ্ট টাকাও নেই। তাহলে কি ইউসিস লাইব্রেরিতে বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাতে হবে?

বিরক্ত হয়েই অশোক বাস স্টপে দাঁড়িয়েছিল, এমন সময় সাহেবি পোশাক পরা পোর্টফোলিয়ো ব্যাগ হাতে বেঁটেখাটো একটা লোক ওর সামনে এসে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। অশোক দেখেই বুঝল মদ খেয়ে চুর হয়ে আছে। লোকটা চেনার চেষ্টা করছে কিন্তু অশোক চিনতে পারল সুকুমারকে। বেশ মোটা হয়ে গেছে।

”অশোক ভাটাচারিয়া আই প্রিজিউম।”

”হ্যাঁ, আর তুমি সুকুমার গুহ।”

”অনেকদিন পর, কত বলো তো?”

”প্রায় আট বছর।”

”করছ কী?”

এইবার অশোক মনে মনে রেগে উঠল, কেননা সুকুমার দিব্যি মদ সাঁটিয়ে মেজাজে কথা শুরু করেছে এবং বলছে ভারিক্কি চালে, যেন উত্তর দিতে বাধ্য এমন কারুর সঙ্গে। তখন অশোক স্থির করে ফেলে সুকুমার চাল মারতে পারে এমন একটা প্রশ্নও সে করবে না, অর্থাৎ কবে আমেরিকা থেকে ফিরলে, এখন কোথায় কাজ করছ, কত মাইনে পাচ্ছ, কলকাতার কোন মহল্লায় থাকো এবং কত ভাড়া দিচ্ছ, গাড়ি কিনেছ কি না, ছেলে বা মেয়ে কোন ফিরিঙ্গি স্কুলে পড়ে, পুজোয় কোথায় ঘুরে এলে-এইসব প্রশ্ন। আর স্থির করল চাল মেরে ব্যাটার সঙ্গে কথা বলতে হবে।

”আপাতত একটা সিনারিও নিয়ে ব্যস্ত।”

অশোক মোটামুটি নিজের পোশাকের দিকে তাকিয়ে হিসেব করে ফেলেছে কতটা দামি করা যায় নিজেকে। ধুতি-পাঞ্জাবি-চটি-ঘড়ি এবং চেহারাটা দিয়ে সিনারিও রাইটার, বড়োজোর এম.এল.এ-এর বেশি ওঠা যায় না।

”বাংলা না হিন্দি?”

অশোক লক্ষ করল কথাগুলো জড়িয়ে গেল, এবং স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। মদ খেত না, এখন খাচ্ছে। কেন? একটু সদুপদেশ দিয়ে দিলে কেমন হয়! ওর বউ অর্থাৎ ঝুমি তো খুবই মাতালদের ঘেন্না করে বা একদা করত!

”হিন্দি।”

”পয়সা আছে হিন্দিতে।”

যেন তারিফ করল। এটা ভালো লাগল না অশোকের। ঈর্ষা করাতে না পারলে চাল মেরে সুখ নেই।

”তেমন আর কই, মাত্র পঞ্চাশ হাজার দেবে।”

”ওতেই রাজি হয়ে যাও। নয়তো অন্য কেউ দেখবে বাগিয়ে নেবে। কোথা থেকে টুকলে? লিখতে-টিখতে পারতে বলে তো শুনিনি।”

”কলিন কাউড্রের একটা ছোটো গল্প থেকে।”

”হু ইজ কাউড্রে?”

”সে কি!”

আকাট মুখ্যু বানিয়ে দেওয়া যাক। এই ভেবে অশোক খুশি হল বিস্তর।

”ওহ তুমি কি খবর-টবর আর রাখো না নাকি?”

”না, মানে, আজকাল এত কাজের চাপ, কাউড্রে নামটা অবশ্য শোনা-শোনা লাগছে, ইজ হি এ ক্রিকেটার।”

”নো নো, এ কানাডিয়ান রাইটার।”

”ওহোঃ, হ্যাঁ হ্যাঁ পড়েছি। ব্রিলিয়ান্ট তবে কিছুটা সেন্টিমেন্টাল, বোধহয় আটলান্টিক মান্থলিতে ওকে নিয়ে”-

”না, না, তুমি ভুল করছ, এনকাউন্টারে একটা রিভিউ বেরিয়েছিল বিল লরির করা, বছরখানেক আগে।”

”আটলান্টিক মান্থলি নয়? আর ইউ সিওর? কী জানি পড়াশুনোর সময় একদমই পাইনা তো। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত শুধু…টাকা টাকা টাকার পিছনেই তাড়া করে চলেছি। ব্যাপারটা এত অশ্লীল আগে বুঝিনি, এই সংসার-ধম্মো করা। তুমি কি বিয়ে করেছ?”

”ন্নাঃ” অশোকের মুখ দিয়ে আপনা থেকেই শব্দটা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে এল। সুকুমারের ঘোলাটে এলোমেলো চাউনিতে যেন এখনই সে পরশ্রীকাতরতা ফুটে উঠতে দেখল।

”আজকাল বড্ড বেশি খাটতে হচ্ছে। একদিন এসো-না আমাদের বাসায়। একটা ট্যাক্সি ধরার চেষ্টা করছি তখন থেকে অথচ পাচ্ছি না। কী যে জঘন্য এই চৌরঙ্গীটা।”

”কোথায় আছ?”

সুকুমার বাঁ হাতে কোটের ভিতর পকেট থেকে পার্স বার করল। হাতে ঝোলানো ব্যাগটা ফুটপাথে রেখে, পার্স থেকে কার্ড বার করে দিল। ঠিকানাটা পড়ে অশোক বলল, ”টালায় আছ? আমি শুনেছিলাম যোধপুর পার্কে!”

”ঝুমির জন্য। দক্ষিণ কলকাতায় বাপের বাড়ি তাই ওদিকে যাবে না। জানোই তো ওরা আমাদের উপর কি ভীষণ খাপ্পা। বুঝিনা অশোক, আমি এমন কি অপাত্র! ঝুমির মতো মেয়ে কি আমার থেকেও ভালো স্বামী জোটাতে পারত! তুমি জানো, স্বভাবটাও ওর সত্যিই মিষ্টি কিন্তু কী ভীষণ ডাল।”

সুকুমারের কথা আরও জড়িয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে দুলে উঠছে। গলা চড়ছে। দু-একজন ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল।

”বড্ড একঘেঁয়ে, কোনো ভেরিয়েশান নেই। অথচ আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। জানো অশোক, আমার মাঝে মাঝে কী ইচ্ছে করে?”

এলোমেলো চোখ দুটো অশোকের মুখের কাছে এগিয়ে এনে সুকুমার বলল, ”ইচ্ছে হয় ওকে খুন করি। আমাকে ঠকিয়েছে। ওর সেক্স দিয়ে আমাকে চিট করেছে। তুমি খুব বেঁচে গেছ, ওযে তোমায় রিফিউজ করেছিল সেটা তোমার পক্ষে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। তবে শিগগিরিই একদিন সকালে কাগজ খুলে দেখতে পাবে হেডিং-স্বামী কর্তৃক স্ত্রী খুন। কিন্তু নিশ্চিত জেনো, আমি ফেরার হব না। আমি পুলিশের কাছে সারেন্ডার করব। ডিফেন্ড করব না। কোর্টে। শুধু বলব, জেল-টেল নয়, আমাকে ফাঁসি দেওয়া হোক। আই ওয়ান্ট টু ডাই!”

ঝুঁকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে সুকুমার কোনোরকম বিদায় না জানিয়ে হাঁটতে শুরু করল উত্তর দিকে। ভিড়ের মধ্যে একাকার হয়ে যাবার আগে পর্যন্ত অশোক ওকে লক্ষ করল। শরীরটা ডানদিকে একটু হেলে রয়েছে, পা ঠিকমতো পড়ছে না, মাথা ঝুঁকিয়ে গুলি খাওয়া শুওরের মতো রাগে দিশাহারা হয়ে যেন ও লন্ডভন্ড করতে চলেছে।

অশোক ঘড়ি দেখল। সাড়ে চারটে মাত্র। সুকুমারের দেওয়া কার্ডটা তখনও হাতে। আর একবার চোখ বুলিয়ে পকেটে রাখল। এখনও কয়েক ঘণ্টা সময় কাটাতে হবে। জয়রাম মিত্র লেনে রাত না বাড়লে কোলাহল থামে না। অশোক আনমনে রাস্তার ওপারে কিছুক্ষণ তাকিয়ে, আউটরাম ঘাটে বসে সূর্যাস্ত দেখবে ঠিক করে, রাস্তা পার হবার জন্য প্রস্তুত হতে গিয়ে বাঁদিকে তাকাল, তারপর ডানদিকে।

দূরে কী যেন হয়েছে। মানুষ ছুটে ছুটে জড়ো হচ্ছে রাস্তার মধ্যে। একটা ডবল-ডেকার বাস দাঁড়িয়ে। অশোক সময় কাটাবার রগরগে একটা উপলক্ষ্য পেয়ে আশ্বস্ত হল এবং জোরে হেঁটে ভিড়ের কাছে পৌঁছল। যা প্রথমে ভেবেছিল, তাই-ই ঘটেছে। একজনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, ”কী করে চাপা পড়ল?”

”যা করে পড়ে। চলন্ত বাসে উঠতে গিয়ে!”

”একদম শেষ হয়ে গেছে কি?”

”সঙ্গে সঙ্গে।”

অশোকের ইচ্ছা হল চটকানো মাংস আর রক্ত একটুখানি দেখে। ভিড় ঠেলে গোড়ালিতে ভর দিয়ে উঁকি দিল।

একি! থরথর করে কেঁপে উঠল সে। কোনো সন্দেহ নেই। ব্যাগটা পুলিশের জিম্মায় দেখেই চিনতে পারল। ভয় তাকে কোণঠাসা করে ফুটপাতের কিনারে হাজির করল। কাঁপুনি থামেনি। এখন কী করবে? ছুটে কোথাও পালাতে ইচ্ছে করল তার। যে চাপা পড়েছে আমি তার বন্ধুস্থানীয় বা পরিচিত বললে অনেক দায়িত্ব ঘাড়ে এসে যাবে। হাসপাতাল-পুলিশ-মর্গ-শ্মশান এত ঝঞ্ঝাটে জড়াতে হবে। অশোক বিরক্ত বোধ করল সুকুমারের উপর। এভাবে তার উপর পাষাণ ভার চাপিয়ে দেবে, আট বছর পর, অযথা অকারণে, বুঝলে সে গঙ্গার ধারে গিয়ে সূর্যাস্তই দেখত। রক্ত মাখা নাড়িভুঁড়ি দেখতে আসত না। তবু কিছু একটা করা দরকার।

একটি লোককে দেখে অশোকের মনে হল অনেকগুলি সন্তানের পিতা, স্বল্প আয় কিন্তু টাকা জমায়। ওর কাছেই বুদ্ধি নেওয়া যাক এই ভেবে সে জিজ্ঞাসা করল, ”সঙ্গে কেউ নেই লোকটার?”

”থাকলে তো দেখতেই পাওয়া যাবে।”

”তা বটে, তবে থেকেই বা কী করত, করার মতো কিছু তো আর নেই এখন।”

”তবু বাড়িতে খবরটা তাড়াতাড়ি পৌঁছত।”

”ঠিকানা কী?”

”কী জানি, পকেটে নিশ্চয় মানিব্যাগ-ট্যাগের মধ্যে আছে।” এই বলে লোকটা বুক পকেটের উপর হাত রেখে, সন্দেহের চোখে চারধারে তাকিয়ে ভিড়ের থেকে দূরে সরে গেল।

বাড়িতে খবর দেওয়া! ভারতী অর্থাৎ ঝুমিকে জানানো! তাড়াতাড়ি কার্ডটা বার করে অশোক পড়ল। পুলিশ নিশ্চয় খবর দেবে। সুকুমারের পার্সে অনেকগুলো এই কার্ড আছে। তার আগেই পৌঁছে খবরটা দিতে হবে। সময় কাটাবার একটা চমৎকার কাজ পাওয়া গেছে, অশোক উত্তেজিত হয়ে ধাবমান একটি ট্যাক্সির উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল। থামল না। আর একটি খালি ট্যাক্সি দেখে হাত তুলে ছুটে গেল। কিন্তু সেটিও ওকে গ্রাহ্য করল। এরপর উন্মত্তের মতো অশোক ছোটাছুটি শুরু করে দিল।

ওর পৌঁছবার আগেই ঝুমি পুলিশের কাছ থেকে খবর পেয়ে গেছল। সুকুমারের কার্ডে ফোন নম্বর লেখা ছিল অশোক সেটা লক্ষ করেনি। বাড়িওয়ালারা বলল, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল গেছে। তাই শুনে অশোক হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরে এসে শুয়ে পড়েছে। মাথা মোটেই ধরেনি। আসলে ইলার ভ্যাজভ্যাজানি বন্ধ রাখতে চায়। এখন চোখ বন্ধ করে বালিশটা বুকে আঁকড়ে ঝুমিকে ভাবতে ইচ্ছে করছে। আট-দশ বছর আগের ঝুমিকে। ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে পারুলের গলার শব্দ পেয়ে তাকাল সে।

পিঠ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত চড়াই-উৎরাইগুলো হুবহু ঝুমির মতো। গলার স্বরও। প্রথমদিন পারুলকে দেখে সে চমকে উঠেছিল। গত শনিবার নেশার ঘোরে কী করেছে অশোক কিছুতেই মনে করতে পারেনি সকালে। শুধু মনে হয়েছিল পারুল যেন বলছিল, ”বড্ড নেশা হয়েছে। না না এসব এখন থাক। শুয়ে পড়ুনগে।” ঝুমিও বলেছিল, ”বিয়ের কথাবার্তা এখন থাক। তুমি বরং বাড়ি চলে যাও।” আর সুকুমার বলল, ”ঈশ্বরের আশীর্বাদ।”

অশোকের সঙ্গে এই সময়ই চোখাচোখি হল পারুলের। মনে পড়ল ঠিক ঝুমির মতো গলায় এই দুর্দান্ত স্বাস্থ্যের বউটি বলেছিল, ”না না, এসব এখন থাক।” কী থাক? পারুলের শরীর বেয়ে অশোক চোখ নামিয়ে আনল। ঝুমিরই শরীর। ওই শরীরটাকে দখল করার প্রবল ইচ্ছা ন-দশ বছর আগে ভর করেছিল তার সর্বাঙ্গ জুড়ে। তখন দুজনেই ফিফথ ইয়ারে। ঝুমি প্রশ্রয় দিত। ওদের বাড়িতে যাতায়াতের সুযোগ করে দিয়েছিল। ইচ্ছে করলেই অশোক একতলার বৈঠকখানায় না বসে দোতলায় উঠে যেতে পারত। ওদের বাড়িতে তখন অনেকেই উপরে আসত।

সেদিন বারান্দায় ঝুমি দাঁড়িয়েছিল। অশোক ভেবেছিল তারই জন্য অপেক্ষা করছে। লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি টপকে উপরে উঠল।

ঝুমি পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে। ওর ঘাড়ে চুমু খাবার প্রবল বাসনা নিয়ে অশোক এগোচ্ছে আর তখুনি সুকুমারের কণ্ঠস্বর শোনা গেছল এক তলায়-”খবর দাও আমি এসেছি।” তখুনি নিচে নেমে গেল ঝুমি। শুধু যাবার আগে মাথা হেলিয়ে বলে, ”আর একদিন, কেমন?”

সেই আর একদিন আর আসেনি। অশোকের মাথার মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। ঠিক এইভাবে, এখন যেভাবে পারুল নেমে গেল, এইভাবেই ঝুমি তাকে ফেলে রেখে, নেমে গেছল। এখন সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বালিশটাকে কামড়ে মনে মনে হেসে বলল : আসবে, যেভাবেই হোক। তোমায় আমি দেখে নেব।

”খোকন রইল, ওকে একটু দেখো। আমি একবার ঘুরে আসছি শেফালি ঠাকুরজির কাছ থেকে। জানো পাড়ায় কে এসেছে?” ইলা কাছে এসে দাঁড়াল।

”মাথা ধরেছে এখন বকবক কোরোনা। যেখানে যাচ্ছিলে যাও।”

ছয়

মাস দুয়েক আগে শচীন দত্তগুপ্ত একদিন পারসোনেল ডিপার্টমেন্ট থেকে ফিরে চেয়ারে বসেই বাসুদেব ধরকে বলেছিল :

”এখানকার মায়া কাটাবার নোটিশ পেলুম বাসু। এক্সটেনশন দিল না। আমি নাকি ফিজিক্যালি আনফিট। পঁয়ত্রিশ বছর কাটালুম এই ঘরেই, সামনের মাস থেকে আর আসতে হবে না।” এই বলে ঘরের সকলের দিকে তাকিয়ে হাসবার চেষ্টা করেছিল ষাট বছরের শচীন দত্তগুপ্ত।

বাসুদেব অবাক হয়ে বলে, ”শচীনদা, আপনি ফিজিক্যালি আনফিট! তাহলে আমরা কী হব?”

শচীন মাথা নামিয়ে যোগ-বিয়োগের হিসেবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাসুও মনে মনে হিসেব কষে নেয়, তার রিটায়ার করতে আর ক’ বছর বাকি। এখনও এগারো বছর। ছোটোছেলেটার বয়স হবে তখন চোদ্দো, ছোটোমেয়ের এগারো। তারপর ওদের লেখাপড়া বা বিয়ে দেওয়ার কী হবে? প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্র্যাচুইটির টাকা ফুঁকে দিলে বুড়ো বয়সে স্বামী-স্ত্রী খাব কী?

মোট চার মেয়ে ও দুই ছেলের হিল্লে না হওয়া পর্যন্ত তার রেহাই নেই। তাছাড়া সংখ্যাটা আরও বাড়তে পারে। প্রদীপ নামে অ্যাকাউন্টসের ছোকরাটা কদিন আগে ক্যান্টিনে চেঁচিয়ে বলছিল, ভ্যাসেকটমি করিয়ে এসেছে, যে ভয় করেছিল তা হয়নি, বউ খুব হ্যাপি। কিছু অসুবিধে হচ্ছে না। ওর দুটিমাত্র ছেলে।

বাসুদেব এরপর ফিজিক্যাল ফিটনেস ও ভ্যাসেকটমি, এই দুই জাঁতাকলে পড়ে পিষ্ট হতে শুরু করে। কখনো সে রেগে ওঠে নিজের উপর এই ভেবে যে, সাতটি সন্তানের পিতা কেন হতে গেল। কেন রাধারানি নামে একটা অশিক্ষিত মাংসের বস্তা তার বউ হল। আবার ভয়ে সিঁটিয়ে যায় জেনারেল ম্যানেজারকে দেখলে। এই বুঝি ফিজিক্যালি আনফিটরূপে তার নামের পাশে ঢ্যাঁড়া দিয়ে রাখল। এগারো বছর পর সেই ঢ্যাঁড়া দেখে নিশ্চয় মাথা নেড়ে বলবে-সরি, নো এক্সটেনশন।

বাসুদেব রাতে ঘুমোতে পারে না। রাধারানি গায়ে হাত রাখলে, দাঁত কিড়মিড় করে খাট থেকে নেমে মেঝেয় মাদুর পেতে শোয়। ফিজিক্যাল ফিটনেসের প্রমাণ দিতে হাঁটার চলন বদলে ফেলল। একজোড়া ট্রাউজারস কিনেছে তিনশো টাকায়, জুতো দু’শো টাকায়। কলপ লাগাচ্ছে কানের উপরের চুলে। দাড়িও কামাচ্ছে রোজ।

ওকে দেখে অফিসের অনেকেই ঠাট্টা করল। অল্পবয়সিরা বলল, ”দাদার কি দ্বিতীয় পক্ষ নেবার ইচ্ছে হয়েছে?” তবে সমবয়সি দু-একজন ঈর্ষাতুর গলায় যখন বলল, ”ইয়ং-ইয়ং লাগছে হে বাসু, ব্যাপার কী?” খুশিতে খান খান হয়ে গেছল বাসুদেবের ভিতরটা। কিন্তু এরা বললেই তো আর নিরাপদ বোধ করা যায় না। আসল লোকটির বলা চাই।

অফিসের একতলাটা রাস্তা থেকে বেশ উঁচু। আটধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। জেনারেল ম্যানেজার আসে ঠিক দশটায়। মোটর থেকে নেমে সিঁড়ি ভেঙে উঠেই লিফটে ঢুকে পড়ে। কোনোদিকে তাকায় না। বাসুদেব পৌনে দশটা থেকে উলটো ফুটপাতে অপেক্ষা করে। জি.এম. মোটর থেকে নামছে দেখলেই রাস্তা পার হয়। তারপর ওর সামনে দুই লাফে আটধাপ সিঁড়ি টপকে উঠে যায়। পরপর তিনদিন করেছে। চতুর্থ দিন নতুন জুতোর জন্য পিছলে মুখ থুবড়ে পড়ল। জি.এম.-ই ওকে টেনে তুলে বেশ সহানুভূতির সঙ্গেই বলল, ”সাবধানে উঠুন, এই বয়সে হাত-পা ভাঙলে আর সারবে না।”

ভয়ে কুঁকড়ে গেল বাসুদেব। ‘এই বয়সে’ বলতে কী বোঝায়? শারীরিক অক্ষমতা? ফিজিক্যালি আনফিট? পরদিনই আঁশবটি দিয়ে জুতোর তলা ঘষে খরখরে করে নেয় এবং জি.এম. যাতে ব্যাপারটা ভুলে যেতে পারে সেজন্য ওর চলাফেরার পথের ত্রিসামানাও বাসু আর মাড়ায় না।

এর কিছুদিন পরই অফিসের স্পোর্টসের তারিখ নোটিশ বোর্ডে টাঙানো হয়। দড়ি টানাটানি, ক্রিকেট বল ছোঁড়া, ফুটবলে লাথি মারা-এইসব বিষয়গুলোর উপর চোখ বোলাতে-বোলাতে বাসুদেব পাশের লোককে জিজ্ঞাসা করেছিল, ”প্রাইজ দেবে কে?” উত্তর পেয়েই মাথায় বুদ্ধি খেলতে শুরু করে। একটা থার্ড প্রাইজও জি.এম.-এর হাত থেকে যদি নেওয়া যায়, তাহলে সেটা এগারো বছর পরও কি কাজে লাগবে না!

স্পোর্টস সেক্রেটারির কাছে নাম দিতে হবে। বাসুদেব সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝল, দড়ি টানাটানিতে ডিপার্টমেন্টের টিম তৈরি হয়ে গেছে। টিমের কারুর ওজনই দু মণের কম নয়। বল ছোঁড়ায় বা লাথি মারায় ছোকরাদের সঙ্গে সে পারবে না। শুধু আধমাইল হাঁটার রেসে বয়স বেঁধে দেওয়া আছে-৪৫ ঊর্ধ্বে। বাসুদেব ঠিক করে, হাঁটায় নামবে।

তারপর থেকে সে রোজ ভোরে উঠে পার্কে চক্কর দেয়, ঘড়ি ধরে আধঘণ্টা। শরীরের প্রত্যেকটি গাঁট জং-ধরা কবজার মতো ক্যাঁচক্যাঁচ করে। প্রথম প্রথম হাঁপিয়ে পড়ত বাসুদেব জোরে পনেরো মিনিট হাঁটলেই। তারপর সয়ে গেছে। ওয়াকিং রেসে যারা নাম দিয়েছে, গোপনে তাদের লক্ষ করে দেখেছে। একমাত্র রামরাজ সাইকেল পিয়োন ছাড়া আর কারুর সম্পর্কে তার দুশ্চিন্তা নেই। ডেসপ্যাচের শৈলেন রায় এখনও ক্রিকেট খেলে বলে শোনা গেছে। কিন্তু ওর একটা পা ছোটো, খুঁড়িয়ে হাঁটে। বাসুদেব তাইতে উদ্বিগ্ন হচ্ছে না। বেয়ারা ভক্তিপদ-র বয়সটা স্টাফ সেকশান থেকে জেনে এসেছে-চুয়াল্লিশ বছর আটমাস এগারো দিন। ওকে ডিসকোয়ালিফাই করার প্রমাণ বাসুদেব সংগ্রহ করে রেখেছে।

দিন দিন মেজাজটা খোশ হয়ে আসছিল বাসুদেবের। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে শুনল, বড়োমেয়ে সুমি অর্থাৎ শর্মিলা বাড়ি থেকে পালিয়েছে। বয়স হয়েছিল আঠারো। দেখতে ছোটোখাটো, গত বছর পর্যন্ত ফ্রক পরে কাটিয়েছে, ক্লাস নাইনে পড়ে। বাসু শুনেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। স্কুল যাবার পথে ছেলেটার সঙ্গে নাকি ভাব হয়। মেজোমেয়ে প্রমীলা তাকে একবার মাত্র দেখেছে পাড়া দিয়ে হেঁটে যেতে। আর কেউ তাকে দেখেনি বা জানে না কোথায় থাকে। ব্যাপারটা এমনই কারুর কাছে খোঁজ নিতে যাওয়া মানেই কেলেঙ্কারিটা ছড়িয়ে দেওয়া। সুমি দু’লাইনের চিঠি রেখে গেছে-”আর ফিরব না, সুতরাং খোঁজ কোরো না। মনে কোরো আমি মরে গেছি।”

”খোঁজ নেবে না?” রাধারানি ব্যাকুল স্বরে বলেছিল।

”কোথায়!” দিশাহারা বাসুদেব জানতে চেয়েছিল।

”সুমির স্কুলের বন্ধুরা হয়তো বলতে পারে।”

”খোঁজ নেব কেন, ফিরিয়ে আনবার জন্য?”

”তাহলে অনুষ্ঠান করে বিয়ে দেওয়া যায়। এখন লোকের কাছে বলব কী?”

”কী আবার বলবে, মেয়ে যা বলে গেছে তাই বলবে-মরে গেছে গঙ্গায়। চান করতে গিয়ে ডুবে মরেছে, ওলাওঠায় মরেছে। করো কি সারাদিন শুধু রান্নাঘরে বসে ঘুটুর ঘুটুর করা ছাড়া? নজর রাখতে পারোনি, মেয়ে বিগড়োচ্ছে বুঝতে পারোনি?”

বাসুদেব চাপা গলায় চিৎকার করেছিল। রাধারানির চোখ দিয়ে টপটপ জল পড়ছে। পাশের ঘরে ছেলেমেয়েরা না শোনার ভান করে কাঠ হয়ে বসে।

”বংশের মান গেল, কলঙ্ক লেপে দিয়ে গেল সকলের মুখে। ছি ছি, শেষে কিনা বেরিয়ে গেল! দুদিন পরে তো মেয়েটাকে ফেলে পালাবে। তারপর গিয়ে উঠতে হবে সোনাগাছিতে। যাক, ওই ওর কপালে আছে। ফল ওকে ভুগতেই হবে। শুধু এতবড়ো বনেদি বংশের মাথাটা হেঁট করে দিয়ে গেল। মুখ দেখাব কী করে পাড়ায়, আত্মীয়দের কাছে।”

”যদি ও ফিরে আসে-”

”তাহলে পিঠের চামড়া তুলে নেব। তুমি, তুমি, তোমার জন্যই ছেলেমেয়ে একটাও মানুষ হল না।” বাসুদেব দুহাতে মাথা চেপে ধরে ঘরে দ্রুত পায়চারি করে। ”শুধু দু’বেলা ভাত রাঁধা আর ছেলেপুলের জন্মো দেওয়া ছাড়া আর কী পারো তুমি? একা রাস্তায় বেরোতে পারো না, লোকের সঙ্গে দুটো কথা বলতে পারো না, পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকতে জানো না, একটা বই কোনোদিন পড়তে দেখলুম না। এমন মায়ের মেয়ে বেরোবে না তো কী? সব কটা বেরিয়ে যাবে, আমি লিখে দিচ্ছি, একটাও মানুষ হবে না।”

চোখের জল ফেলতে ফেলতে রাধারানি ঘর থেকে বেরিয়ে ঢোকে রান্নাঘরে। অফিস ফেরত স্বামীকে এখনও খাবার দেওয়া হয়নি। কিছুক্ষণ পায়চারি করে বাসুদেব পাশের ঘরে এসে ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলে-”সবই জেনেছ তোমরা। তোমাদের বোন যে কলঙ্ক দিয়ে গেল তা যেন বাইরে না বেরোয়। তোমাদের মেজোপিসিমা থাকে এলাহাবাদে, কেউ সুমির কথা জিগ্যেস করলে বলবে এলাহাবাদ গেছে, মেজোপিসির খুব অসুখ। দেখাশোনার জন্য নিয়ে গেছে, কবে ফিরবে ঠিক নেই। মনে থাকবে তো?”

সবাই হাঁপ ছেড়ে ঘাড় নেড়েছিল।

এই কদিনে বাসুদেব যতটা ফিজিক্যাল ফিটনেস অর্জন করেছিল, সুমি তা ধসিয়ে দিয়ে গেছে। রাত্রে ঘুমোতে পারে না, দাড়ি কামাতে ভুলে যায়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে, পরিচিতদের এড়িয়ে যাচ্ছে অফিসে এবং পাড়ায়, পিঠ নুয়ে পড়েছে, চোখে বিষাদ ফুটে উঠেছে। সুমির থেকেও তার ভাবনা, বংশের মান-মর্যাদা নিয়ে। জানাজানি হয়ে গেলে কী হবে? ছেলেমেয়েরা অবশ্য যথাযথভাবেই রটিয়ে দিয়েছে শেখানো কথাটা।

শেফালি একদিন এসে জেরা করে গেছে রাধারানিকে। ”কই, আগে তো কখনো মেজোপিসির বাড়ি থেকে খোঁজখবর করেছে বলে শুনিনি। যাক, তবু এলাহাবাদটা দেখা হয়ে যাবে এই তলে। ফিরবে কবে গা?”

রাধারানি নেহাতই ভালো মানুষ। বেশিক্ষণ মিথ্যা কথা বলে যেতে পারে না। তবু প্রাণপণে বুদ্ধি খরচ করে বলল, ”ফেরার কি কিছু ঠিক আছে। অসুখ না সারা পর্যন্ত থাকবে, আর কবে যে সারবে কে জানে।”

”তদ্দিন স্কুল কামাই হবে তো?”

”তা হবে।”

”ভালোই হয়েছে। স্কুল যাবার পথে বখাটে একটা ছেলে বড্ড ওর পিছু লাগত। চিঠিফিটিও দিত। আর দেখছই তো আজকাল ছেলেমেয়েরা কিনা কাণ্ড করছে। এইভাবেই রাস্তাঘাটে ভাব-সাব হয়, তারপর একদিন বাড়ি থেকে পালায়। আর বাপ-মা তার ঠ্যালা সামলাতে নাকানি-চোবানি খায়। তবে একটা উপকার বাপু করে দেয়, বিয়ে দিতে যে খরচটা হত সেটা বেঁচে যায়। বলো, ঠিক কিনা?”

রাধারানি কোনোমতে ঘাড় নাড়ে আর শুধুই তার মনে হয়, শেফালির কথাগুলো যেন কেমন বাঁকা ধরনের। রাত্রে চুপি-চুপি বাসুদেবকে বলা মাত্র, বাসু উঠে বসে বিছানায়।

”সর্বনাশ হবে, আমি জানি হবেই। ধুলোয় লুটোবে ধর-বাড়ির মান-মর্যাদা। তোমার জন্য, সব তোমার জন্য।” বলতে বলতে বাসুদেব কাটা তালগাছের মতো লুটিয়ে পড়ে।

রাধারানি স্তব্ধ হয়ে বসে ভাবে, তার কী দোষ। কেন সবকিছুর জন্য সেই দায়ী। গভীর রাতে তার মনে হয় সুমি চুপিসারে ফিরছে। রাস্তার ইলেকট্রিক আলোয় তাকে দেখা যাবে, এই ভয়ে সে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ময়রা গলিতে। রাধারানির ইচ্ছে হয়, বেরিয়ে গিয়ে সব রাস্তার আলো নিভিয়ে পাড়াটা অন্ধকার করে দেয়।

এক এক রাত্রে সে সদর দরজার খিল খুলে একটা পাল্লা সামান্য ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকে। সুমি আসছে দেখলেই ছুটে গিয়ে আঁচল দিয়ে ওকে ঢেকে ঘরে নিয়ে আসবে। মেয়েটা লজ্জায় আসতে পারছে না, নইলে সুমি তেমন মেয়ে নয় যে বাপ-মাকে কষ্ট দিয়ে বেশিদিন দূরে থাকতে পারবে। ওর দৃঢ় বিশ্বাস সুমি ফিরে আসবেই, শুধু এত আলোর মধ্যে দিয়ে আসতে হবে বলে লজ্জায় পারছে না।

এক রাতে বাসুদেব নিঃশব্দে উঠে এসে, সদরে দাঁড়ানো রাধারানির কাঁধে হাত রাখল। চমকে উঠে সিঁটিয়ে গেল সে। বোধহয় যাচ্ছেতাই করে এইবার কিছু বলবে।

”ওকি আর ফিরবে।” বাসুদেব ক্লান্ত স্বরে বলল। রাধারানি কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না।

”এমন কাজ করার কী যে দরকার ছিল ওর।” বিষণ্ণ সুর ছড়িয়ে পড়ল অন্ধকারে। ”কতই বা বয়স, জীবনের কী-ই-বা দেখল, জানলো। ও কি ভেবেছিল, বাবা বিয়ে দিতে পারবে না? গরিব হয়ে গেছি বটে, কিন্তু কোনোদিন কারুর কাছে তো হাত পাতিনি। যেভাবেই হোক, বাইশ বছর ধরে সংসার তো চালিয়ে আসছি। এত কষ্ট করি সকলের জন্য, কিন্তু আমার মুখ চাইল না।”

”এখনও ছেলেমানুষ। বুঝবে ঠিকই, ফিরেও আসবে।” রাধারানি আলতো করে হাত রাখল বাসুদেবের বুকে।

”চলো, দাঁড়িয়ে লাভ নেই।”

”ও এলে তুমি কিছু বলো না। যা বলার আমি বলব। ওকে আমি মারব, ভীষণ মারব, এমন মারব যে জীবনেও ভুলতে পারবে না।” বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠল রাধারানি। বাসুদেব ওকে টেনে নিয়ে গেল ঘরে।

অফিস স্পোর্টসে বাসুদেব চারজনের পর হাঁটা শেষ করল। প্রথম তিনজন প্রাইজ নিল জেনারেল ম্যানেজারের হাত থেকে। প্রাইজ দেবার সময় জি.এম. হেসে দু-চারটে রসিকতা করে। কেষ্ট দত্ত একটা ইলেকট্রিক ইস্ত্রি হাতে ডগমগ হয়ে বলল, ”কী বলল শোন, আমি নাকি তিরিশ বছর বয়স ভাঁড়িয়ে রেসে নেমেছি। কালই সার্ভিস রেকর্ড খুলে বয়স চেক করবে।”

টেবল ল্যাম্পটা ছেলের হাতে দিয়ে প্রমোদ বোস বলল, ”আর আমায় কী বলল জানিস, নিশ্চয় মিসেস বোস এখানে আছেন, নয়তো এমন ইনসপায়ারড ফিনিশিং সম্ভব হত না।” ফুলদানিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে রামরাজ বলল, ”এটা নিয়ে হামি কী কোরব। কৌন কামে লাগবে হামার।”

অদ্ভুত একটা শূন্যতা বোধ নিয়ে ফিরছিল বাসুদেব। পাড়ায় ঢুকেই দূর থেকে দেখল অনন্ত সিংহের বাড়ির দরজায় একটা নীল মোটর দাঁড়িয়ে। ওর মেয়েকে আজ দেখতে আসবে, বোধহয় গাড়িটা তাদেরই। পুতুলের থেকে সুমি দু-তিন বছরের বড়ো। সুমির বিয়ে দেবার কথা এক-আধবার মনে এসেছিল, কিন্তু অন্যান্য চিন্তায় তলিয়ে যায়। এখন আর মনে করার দরকার হবে না।

অনন্ত মোটরের বাম্পারে পা তুলে দিল। বাসুদেব বুঝল, সেটা তাকে দেখেই। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ার কায়দাটা যে অহঙ্কার বোঝাবার জন্য সেটাও বুঝল সে। মাথার মধ্যেটা গরম হয়ে উঠল বাসুদেবের। আজকাল বাড়িতে পা দিয়েই সে জিজ্ঞাসা করে,-”প্রমি কোথায়?” ষোলোয় পড়েছে। এখন থেকে আর চোখের আড়াল করা নয়।

”কোথায় গেছে?” বাসুদেব চিৎকার করে উঠল।

”আমায় বলেই গেছে?” রাধারানি রান্নাঘর থেকে ছুটে এল। ”কে এক সিনেমার হিরো এসেছে বুঝি তিনের-বি বাড়িতে, দেখতে গেছে।”

”কার সঙ্গে গেছে?”

”একাই গেছে।”

‘শিগগিরি ডেকে পাঠাও, সিনেমার হিরো দেখে আর কাজ নেই।’

এই বলে বাসুদেব দ্রুত ঘরে ঢুকল; অফিস থেকে ফিরেই আর একবার পায়খানা যাওয়া তার অভ্যাস। অভ্যাসটি পালন করতে গিয়ে টের পেল প্যানের মধ্যে কিছু একটা পড়ে রয়েছে, যার ফলে গর্তটা বোজা। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এসে চিৎকার করল, ”জেনেশুনেও কি তোমরা চুপ করে মজা দেখছিলে? যখন ঢুকলুম তখন বলতে পারতে তো, বল পড়েছে। বাঁ হাত দিয়ে তুলে নিতুম। এখন তুলি কী করে?”

এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুত্রদ্বয়কে বেধড়ক কয়েক ঘা দিল বাসুদেব। ”পড়াশুনো নেই, দিনরাত শুধু খেলা আর খেলা। এখন এই বল তুলবে কে?”

”একটা ধাঙড় ডেকে আনলেই তো হয়।” রাধারানি বুদ্ধি করে বলল। অবশ্যই ভয়ে ভয়ে।

”সন্ধের পর ধাঙড় বসে আছে বল তোলার জন্য।” বাসুদেব রাগে গজগজ করে কয়েক বালতি জল ঢেলে বাঁ হাতে বলটা তুলল।

বল আর বেড়ালে কোনো তফাত নেই। যেখানেই ছেড়ে এসো না ঠিক ফিরে আসবে। দূরে গিয়ে ফেলে আসতে হবে নয়তো ছেলে দুটো এই বল নিয়ে আবার খেলা শুরু করে দেবে। তারক কবিরাজ স্ট্রিটে যে ডাস্টবিনটা আছে তার মধ্যে ফেলার উদ্দেশ্যে বেরোতে গিয়ে বাসুদেব সদরেই থমকে গেল। নীল ঝকঝকে মোটরে পা তুলে দাঁড়ানো অনন্তের ধোঁয়া ছাড়ার অহঙ্কারি ভঙ্গিটি মনে পড়ল তার। আবার তাকে দেখলে আবার পা তুলবে, আবার ধোঁয়া ছেড়ে মিটমিট করে তাকিয়ে হাসবে।

হাসাচ্ছি তোকে! বাসুদেব তরতরিয়ে ছাদে উঠে এল। যেদিকে দু চোখ যায় ছুঁড়ে দেবে! এধার-ওধার তাকিয়ে কোনদিকে ছুঁড়বে ঠিক করে উঠতে পারল না সে। বলটা ছাদের মেঝেয় রাখল। নর্দমার ঢালু দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে দেখে পা দিয়ে আটকাল। পা তুলতেই বলটা আবার গড়িয়ে যাচ্ছে। পায়ের চেটো দিয়ে বাসুদেব বলটাকে টানল। বলটা পিছিয়ে পাঁচিলে ধাক্কা খেয়ে আবার গড়িয়ে এল।

বাসুদেবের মন্দ লাগল না ব্যাপারটা। আস্তে সট করল বলটায়। পাঁচিলে লেগে আবার তার কাছেই ফিরে এল। অন্ধকার ছাদে ভালো করে নজর করা যাচ্ছে না, তবু বাসুদেব আন্দাজে ব্যাপারটা চালিয়ে যাওয়ার একটা মজা পেয়ে গেল। এখন তার মনে হচ্ছে চল্লিশ বছর আগের বয়সে যেন ফিরে যাচ্ছে সে।

সাত

অসীম কাল রাতে বাড়ি ফিরেই শোনে, গুণোদা একজনকে পাঠিয়েছিল। বসিরহাটে সেমিফাইনাল খেলতে হবে। গুণোদার পেশা বিভিন্ন ক্লাবে খেলোয়াড় কম পড়লে জোগাড় করে দেওয়া। এজন্য কমিশন পায়। মফসসল ক্লাব-কর্মকর্তাদের ভিড় লেগেই আছে ওর বাড়িতে। ট্রফি পাইয়ে দেবার কনট্রাক্টও গুণোদা নেয়। ওর তালিকায় জনা তিরিশ খেলোয়াড়ের নাম আছে, যাদের অর্ধেকই কলকাতার ফার্স্ট ডিভিশনে খেলে। তাদের অনেকে ভারতের জার্সিও পরেছে। নাম অনুযায়ী গুণোদা ওদের দাম দেয়। গুণোদার অনুগ্রহে কেউ কেউ বছরে পাঁচ হাজার টাকাও সংগ্রহ করে। ওর তালিকায় অসীমও আছে। দূর গ্রামাঞ্চলে, অখ্যাত টুর্নামেন্টে খেলতে ‘নামীরা’ যেতে চায় না। তখন অসীমের ডাক পড়ে।

কাল গুণোদার লোকটি অসীমের জন্য বাড়িতে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছে। বারকয়েক রাস্তায় বেরিয়ে ঘোরাঘুরি করে অবশেষে প্রভাতের হাতে অগ্রিম বাবদ তিরিশ টাকা দিয়ে, পরদিন সন্ধ্যায় আসবে জানিয়ে চলে গেছে। টাকা পাওয়া মাত্র তাই থেকে কুড়ি টাকা তখনি খরচ হয়ে যায়। বহুদিন পর রাত্রে ওদের উনুনে রুটি সেঁকার বদলে ভাতের হাঁড়ি চড়ে।

অসীমের বাবা প্রভাত রায় ত্রিশ বছর আগে রোভারস কাপেও খেলেছে। আটাশ বছর আগে আই.এফ.এ শিল্ডের ফার্স্ট রাউন্ডের খেলায় গোড়ালিতে চোট পেয়ে জখম হয়। ফোর্থ রাউন্ডে ক্লাব-কর্তারা জোর করে নামায়, ইঞ্জেকসন দিয়ে ব্যথা অসাড় করে। সে খেলায় ওরা হেরে যায় এবং সমর্থকদের ধারণা প্রভাতের জন্যই। খেলা শেষে বাড়ি ফেরার সময় ময়দানের অন্ধকারে টেনে নিয়ে কারা ওকে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে যায়। সেদিন থেকে প্রভাত রায় আর ফুটবলে পা দেয়নি। সেদিন অজ্ঞান হবার আগে ওর কানে শুধু এই কথা কটি ঢুকেছিল-”ঘুষ নিয়ে বড়োলোক হবি শালা? হওয়াচ্ছি। ক্লাব কি টাকা দেয় না তোকে? তবুও অত লকলকে নোলা কেনরে বেইমান, নেমকহারাম। ঘুষ নিয়ে আমাদের ইজ্জত ডোবানো বার করছি।”

”ইজ্জত”! অসীম বুনো মোষের মতো ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ”টাকা নেবার সময় মনে ছিল না ইজ্জতের কথা। এই পা নিয়ে আমি হাঁটতে পর্যন্ত পারছি না, আর খেলে এসে তোমার ইজ্জত বাঁচাব? কে বলেছিল হাত পেতে টাকা নিতে? কে, কে, কে, বলেছিল? আমার পা কি পা নয়? আমার জীবনটা কি আমার নয়? সব দান করে যেতে হবে তোমাদের খাওয়াবার জন্য?”

চিৎকার করতে করতে অসীম পায়চারি করে। মা, বাবা, ভাই, বোন আর ঠাকুমা মাথা নামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে। ভাত খাওয়া এঁটো থালাগুলো বাইরে দালানে পড়ে, চেটেপুটে খেয়েছে ভাইগুলো।

”যেখান থেকে পারো, জোগাড় করে দিয়ে দাও। কাল এলেই দিয়ে দেবে। ইজ্জত আমারও আছে।”

”কোথায় পাব ত্রিশ টাকা, কালকের মধ্যেই।” প্রভাত করুণ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকায়।

”কোথায় পাবে তার আমি কি জানি? এ সংসার কি আমি তৈরি করেছি?”

”তুই বড়োছেলে, তোরও তো খানিকটা দায়িত্ব নেওয়া উচিত। বড়োতো হয়েছিস।” ঠাকুমা ভয়ে ভয়ে বলল।

”তুমি চুপ করো তো। আমি কি টাকা দিই না? আমার নিজের জন্য কি কিছুই খরচ করব না? এই পা দুটো আমার ভবিষ্যৎ, আমার জীবন। এর একটা শেষ হয়ে গেলে আমি কোথায় দাঁড়াব? কে তখন আমায় দেখবে? পয়সার জন্য চোটটা সারাতে পারছি না। চোট আছে জানলে কেউ আর পয়সা দিয়ে ডাকবে না। তাই জানাতেও পারি না।”

বলতে বলতে অসীম থেমে গেল! গলা আটকে গেছে অবরুদ্ধ বাষ্পে। প্রভাতের দিকে ঘরের সবাই তাকাল। পুরু কাচের চশমাটা খুলে প্রভাত গেঞ্জি তুলে মুছতে লাগল ঘাড় হেঁট করে।

”দেখি, অফিসে কারুর কাছে ধার পাই কি না। এই বাজারে একসঙ্গে তিরিশ টাকা পাওয়া-” প্রভাতের গলা ক্ষীণ হয়ে থেমে গেল।

ঘুম থেকে উঠেই অসীম আজ বেরিয়ে পড়ে। পাওয়া সম্ভব এমন লোকেদের কাছে চেষ্টা করে টাকা ধার পেল না। তারপর বেলা বারোটা পর্যন্ত ঠাকুরের চায়ের দোকানে কাটিয়ে বাড়ি ফেরে।

গুণোদার পাঠানো সেই লোকটা এসেছিল। ছোটোবোন নিলি অসীমকে আড়ালে ডেকে বলল, ”বাবাকে যাচ্ছেতাই করে বলে গেল লোকটা। বলল, কালকেই ম্যাচ খেলা আর এখন বলছে যেতে পারবে না, পায়ে চোট! সব বাজে কথা।”

”বাবা বলেছিল পায়ে চোট থাকার কথা!” অসীম অবিশ্বাস ভরে তাকিয়ে রইল।

”বারে, লোকটা যে বলল, প্যাঁচ কষে টাকা বাড়াবার জন্য মিথ্যে করে এখন বলা হচ্ছে চাকরির ইন্টারভিউ আছে। বাবা তো প্রথমে তাই বলেছিল। লোকটা চিঠি দেখতে চায়। বাবা বলে অসীমের কাছে আছে। তখন ওইসব বলতে শুরু করে-বাবা শেষকালে বলল, পায়ে লেগেছে, বিশ্বাস না হয় রাতে এসে দেখে যাবেন। হাঁটতে পর্যন্ত কষ্ট হয়। তাইতে লোকটা বলে সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে, ইঞ্জেকশানের খরচ আমরাই দোব। তাইতে বাবা কী ভীষণ রেগে উঠল। বেরিয়ে যান এখুনি, আপনার ট্রফির থেকেও আমার ছেলের জীবন দামি। লক্ষ টাকা দিলেও ও খেলতে যাবে না। ভারি তো আপনার তিরিশটা টাকা, নিয়ে যাবেন রাতে এসে, এইসব বলে খুব চেঁচাতে থাকে।”

”লোকটা কী বলল?”

”টাকা নিতে আসবে আজ রাতে। অন্য প্লেয়ার জোগাড় করতে টাকাটা আজই দরকার। না পেলে কেলেঙ্কারি করবে বলে শাসিয়ে গেল।”

”হ্যাঁ, কেলেঙ্কারি করবে! শালাকে তাহলে আর জান নিয়ে ফিরতে হবে না।”

অসীম গা-ঝাড়া দিয়ে প্রসঙ্গটা বন্ধ করে দিল। কিন্তু ওর ভালো লেগেছে প্রভাতের কথাগুলো। ছেলেকে কোনোদিন খেলায় উৎসাহ দেয়নি বা বারণও করেনি। ফুটবলের কথা উঠলে কখনো মুখ খোলেনি। মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছা করত অসীমের, বাবা কোনোদিন তার খেলা দেখেছে কিনা! জানতে পারেনি। প্রভাত তার সময়ে নাম-করা উঠতি প্লেয়ারদের একজন ছিল বলে, বুড়োরা যখন অসীমকে গল্প শোনায় তখন গর্ব হয় তার। প্রভাত রায়ের ছেলে বলে অনেক জায়গায় সে খাতিরও পেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হল। একটা ভালো চাকরিও জোগাড় করতে পারেনি প্রভাত। পা খুইয়ে বিদায় নিল মাঠ থেকে। ক্লাবও আর খবর নিল না। এইরকমই হয়।

অসীম দুপুরে ঘুমিয়ে একটা স্বপ্ন দেখল। পর্তুগালের বেনফিকা ক্লাব থেকে লোক এসেছে জয়রাম মিত্র লেনে। প্রভাতের সঙ্গে কথা বলছে লোকটা, হাতে চেক বই।

”আপনি টাকার ফিগারটা বসিয়ে নিন।”

প্রভাত দিশাহারা হয়ে আমতা-আমতা শুরু করেছে দেখে লোকটা ব্যস্ত হয়ে বলল, ”ইওসেবিওকে যত টাকা দিয়ে আমরা এনেছিলাম, তার থেকে বেশি দিতেও আমরা রাজি।”

”কিন্তু আমার ছেলেকে আপনারা নেবেন কেন?”

”তার মানে?”

সাহেবটা খুব অবাক হয়ে গেল। তারপর মুচকি হেসে বলল, ”আপনার ছেলের খবর আমরা পেয়েছি, আমাদের ক্লাবের কোচ মারফত। তিনি জাপান যাচ্ছিলেন। কলকাতায় প্লেন বিগড়ে যাওয়ায় একদিন থাকতে বাধ্য হন। সেদিন মোহনবাগান মাঠে একটা খেলা দেখেন। সেই রাতেই ট্রাঙ্ককল করেন লিসবনে। বলেন, ইওসেবিওর থেকেও দারুণ একটা ছেলের খোঁজ পেয়েছি, এখনি ধরতে হবে। পরের প্লেনেই আমি কলকাতায় পৌঁছে পর পর অসীমের তিনটে খেলা দেখে তারপর আপনার কাছে এসেছি। আমরা ইওসেবিওকে রিপ্লেস করতে চাই। ক্লাব প্রেসিডেন্ট রওনা হওয়ার আগে বলে দিয়েছেন, যদি বোঝ কোচের কথা সত্যি, তাহলে সই করা সাদা চেক এগিয়ে দেবে।”

প্রভাতের হাতে চেকবই আর কলম দিয়ে পর্তুগিজ সাহেব হাসল। অন্যমনস্ক হয়ে প্রভাত একটা তিন আর শূন্য বসাল চেকের উপর। তারপর কী ভেবে বলল, ”লক্ষ টাকা দিলেও ওকে আমি খেলতে দেব না। ওর জীবনের দাম অনেক অনেক বেশি। পায়ে যদি চোট পায় তাহলে ও শেষ হয়ে যাবে।”

চেক বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্রভাত উঠে দাঁড়াল, সাহেব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে।

”নো, নো, গেট আউট। আমি দেব না, লক্ষ লক্ষ টাকাতেও দেব না। গেট আউট, গেট আউট।”

ঘুম ভেঙে গেল অসীমের। এক্ষুনি উঠতে ইচ্ছে করল না তার। কাত হয়ে শুয়ে রইল। স্বপ্নটা দেখার জন্য তার লজ্জা করছে। অথচ চাপা এক ধরনের মমতায় ফেঁপে উঠছে তার বুকটা। চোখ বুজে সে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করল-”ওর জীবনের দাম অনেক অনেক বেশি।”

সারা শরীরের উপর কে যেন আদর বুলিয়ে যাচ্ছে। অসীম প্রবল সুখে আচ্ছন্ন হল। একবার সে হাসল আপনমনে। তিরিশের পাশে আরও চারটে শূন্য বাবা অনায়াসেই বসিয়ে দিতে পারত। তিন লক্ষ! গোটা জয়রাম মিত্র লেন কুড়িয়ে তিন লক্ষ টাকা বেরোবে না। শুনলে পাড়ার লোকগুলোর মুখ কেমন হয়ে উঠবে কিছুক্ষণ ধরে অসীম তাই ভাবল। ভাবতে ভাবতে আভার মুখটা ভেসে উঠল। তারপর পা থেকে মাথা পর্যন্ত! আর অসীমের দেহ থেকে আচ্ছন্ন সুখটা উবে যেতে শুরু করল।

আভার মুখে কোনো ভাবান্তর ঘটবে না। হাসবে ভদ্রতা করে। হয়তো বলবে, ”তিন লাখ টাকা ফুটবল খেলে পাওয়া যায়, জানতাম না তো! ভালোই হল।” খুবই নিরাসক্ত গলায় বলবে। বি.এ. এম.এ. পাশ করার থেকে ফুটবল খেলা সোজা নয়-এটা ওদের কেউ বুঝবে না। কত খাটুনি কষ্ট সয়ে যে খেলা শিখতে হয় তা জানে না। শুধু বোঝে আর জানে চেয়ারে বসে খুচ খুচ করে লেখা, নাকের কাছে বই ধরে বিছানায় চিত হয়ে পড়ে থাকা, আর চিবিয়ে চিবিয়ে বড়ো বড়ো বাত ঝাড়া। একটা বাইশ-চব্বিশ বছরের মেয়ে অমন গম্ভীর, উদাসীন হয়ে থাকে কী করে? ওর কী কোনো প্রেমিক আছে?

অসীম বিরক্ত মনে উঠে পড়ে। ত্রিশ টাকা জোগাড় করে প্রভাত ফেরে কিনা দেখার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। প্রভাত অফিস থেকে ফিরে সকলের দিকে তাকিয়ে যখন মাথা নামিয়ে জামার বোতাম খুলতে শুরু করল অসীম তখনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে তারক কবিরাজ স্ট্রিটের মোড়ে এসে দাঁড়ায়। তারপর আসে ঝকঝকে আকাশি-নীল স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডটা।

ঠাকুরের চায়ের দোকানে রাজনীতির তর্ক চলেছে। ওরা কেউ তিরিশ টাকা এক্ষুনি দিতে পারবে না। অসীম একধারে চুপ করে বসে। লোকটা চলে গেলেই ছোটোভাই এসে খবর দেবে। আধঘণ্টা কেটে গেল এখনও আসছে না। তাহলে কি কিছু ঘটছে বাড়িতে?

লোকটা কী চিৎকার করে লোক জমিয়েছে? নাকি গুম হয়ে বাইরের রকে বসে আছে অসীমের অপেক্ষায়। সত্যিই দেখে যাবে পায়ে চোট হয়েছে কিনা। কিন্তু হাড়ভাঙা নয়, কাটাকুটি নয় যে প্লাস্টার কী ব্যান্ডেজ করা থাকবে। অসীম ডান হাঁটুতে হাত বোলাল। উপর থেকে দেখে কিছুই বোঝা যাবে না। মাথাধরা পেট কামড়ানো কী দেখে বোঝা যায়? ব্যথা রয়েছে, ডান পায়ে ভর পড়লেই যন্ত্রণা হচ্ছে এটা কী করে বোঝাবে।

লোকটা কি অপমান করছে বাবাকে? সকালে জোর গলায় প্রভাত বলেছে, ভারি তো তিরিশ টাকা! লোকটা হয়তো এখন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কথা দিয়ে কাটছে আর নুন ছিটোচ্ছে প্রভাতের গায়ে। পাড়ার খচ্চচর লোকগুলো মুচকি হাসছে। এই দৃশ্য বারবার ভেসে উঠতে লাগল অসীমের চোখে। ছটফট করে সে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। ব্যাটাকে পুঁতে ফেলব যদি বাবাকে অপমান করে। যদি একটু বেইজ্জতি কথা বলে থাকে তাহলে জান নিয়ে ফিরতে দেব না।

অসীম দ্রুত বাড়ির দিকে চলল। পায়ের ব্যথাটা এখন লাগছে না। তারক কবিরাজ স্ট্রিট থেকে পাড়ার মধ্যে ঢুকতেই দেখল ছোটোভাইটা ছুটে আসছে। ওর আসা দেখে ঠান্ডা হয়ে গেল অসীমের সর্বাঙ্গ।

”লোকটা বসে আছে দাদা।”

”চেঁচায়নি?”

”না। একবার ভেউভেউ করে কাঁদল। বলছে, এখনও প্লেয়ার জোগাড় হল না, শিল্ডটা বোধহয় হাতছাড়া হয়ে গেল। একজনের কাছে গেছল, সে পঞ্চাশ টাকা চেয়েছে। বাবার পায়ে ধরে বলল, হয় অসীমকে দিন নয়তো টাকাটা এক্ষুনি দিন।”

”বাবা কী বলল?”

”চুপ করে বসে আছে। দিদি চুপিচুপি এইটে দিল তোমায় দেবার জন্য।”

পকেট থেকে একটা আংটি বার করে অসীমের দিকে এগিয়ে ধরল।

”অনন্ত সিংগীর কাছে এটা বাঁধা দিয়ে তিরিশটা টাকা নিয়ে আসতে বলল দিদি।”

আংটিটা হাতে নিয়ে অসীম ইতস্তত করে বলল, ”আচ্ছা যা।”

কোনোদিন নিলির আঙুলে এটা সে দেখেনি। অসীম অবাক হয়ে গেল। দেখতে ঝকঝকে, তার মানে ব্যবহার হয়নি, তোলা ছিল। ওর কাছে এটা এল কী করে? বাবা-মা দেয়নি, দেওয়ার ক্ষমতাই নেই। নিলির হাতে দু’গাছা ফিনফিনে সোনার চুড়ি ছিল, গত বছরই অনন্তের সিন্দুকে উঠেছে। তাহলে এটা পেল কার কাছ থেকে? প্রেম ট্রেম করছে নাকি!

অসীম রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়েই ভাবল, আংটিটা বাঁধা দেব কি দেব না। চোখে পড়ল সত্যচরণ বালতি হাতে বেরিয়ে টিউবওয়েলের দিকে যেতে যেতে মোটরটার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর উবু হয়ে গাড়ির নিচে তাকিয়ে হুশ হুশ শব্দ করছে হাত নেড়ে। কিছু একটা তাড়াচ্ছে।

অসীম এগিয়ে এসে বিরক্তস্বরে বলল, ”কী করছেন?”

”দ্যাখ তো ফ্যালা, একটা বেড়াল-বাচ্চচা কোত্থেকে এসে জুটল। আরে ঢুকবি তো একেবারে মোটরের নিচেই। গাড়িটা চললেই তো চটকে যাবে। রক্তে মাংসে রাস্তাটার কি না হবে! কাক এসে ঠুকরে নিয়ে এবাড়ি-ওবাড়িতে বসবে, ছড়াবে, ছয়লাপ হবে। ডেঞ্জারাস। এভাবে তলায় বসে থাকতে দেওয়া উচিত নয়।”

অসীম নিচু হয়ে দেখল। সত্যিই পিছনের চাকার সামনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে একটা বেড়াল-বাচ্চচা। মিউ মিউ করে যাচ্ছে অনবরত।

”আছে থাক। স্টার্টের আওয়াজ পেলেই সটকান দেবে।”

”বলছিস পালাবে?” বলেই সত্যচরণ অনমনস্ক হয়ে গেল। কালীর মা অর্থাৎ আঙুরবালা টিউবওয়েলে জল নিতে এসেছে। আগে বাসন মাজতো সত্যচরণের সংসারে। চারুশীলা বছর তিনেক আগে ওকে বরখাস্ত করে দিয়েছে। আঙুর তারক কবিরাজ স্ট্রিটের বস্তিতে থাকে। বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ।

এই সময় অনন্তের সদরে ওর ভাই দুলাল এসে দাঁড়াল। অসীমকে লক্ষ করে বলল, ”গাড়িটা কার রে ফ্যালা?”

প্রশ্নের সুরটা অসীমের পছন্দ হল না। তাচ্ছিল্য ভরে বলল, ”কে জানে।”

দুলালের মুখে দিশি মদের গন্ধ। অনন্তের সঙ্গে ওর মুখ দেখাদেখি নেই যদিও একই বাড়ির পিছনের অংশে থাকে। অনন্তের সঙ্গে দেখা করতে হলে, ডেকে দেবার জন্য কাকে বলা যায়। কাউকে দেখার আশায় অসীম উঁকি দিল রাস্তা থেকেই। চেঁচিয়ে ডাকাডাকি করতে তার বাধল।

”কাকে খুঁজছিস?” দুলাল বলল।

”অনন্ত জ্যাঠাকে।”

”ও ব্যাটাকে আবার কী কম্মে দরকার। আমায় বল।” দুলাল বিড়ি বার করল পকেট থেকে।

”পারসোনাল টক আছে।”

”ওরে বাব্বা, অনন্ত সিংগীর সঙ্গেও লোকে পারসোনাল টক করে। কতই দেখব বাওয়া, দিনে দিনে। দ্যাখ, দ্যাখ, সত্যটা কেমন করে মাগিটার দিকে তাকাচ্ছে।”

অসীম দেখল ঘাড় ফিরিয়ে। প্রশ্রয় পেলে দুলাল অশ্রাব্য ভাষায় কেচ্ছা শুরু করে দেবে। তাছাড়া ওর সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখলে অনন্ত একটা পয়সাও বার করবে না, দোরগোড়া থেকেই ভাগিয়ে দেবে। আংটিটা বাঁধা দিয়ে তিরিশ টাকা পাওয়া যাবে কি না অসীমের সন্দেহ আছে! এক আনা সোনাও বোধহয় নেই। দুলালের সঙ্গ এড়াবার জন্য সে এগিয়ে গেল সত্যচরণের দিকে। সত্য কী বলছিল কালীর মাকে, চুপ করে গেল।

”অনন্ত জ্যাঠাকে কী করে ডাকি বলুন তো?”

”ও মা, সে তো এই খানিক আগে বেরোল। মিষ্টির দোকানে গেছে, এখুনি ফিরবে। ওর মেয়েকে আজ যে পাত্র নিজে দেখতে আসছে। আইরিটোলার শীলেদের বাড়ির ছেলে।”

অসীম আর দাঁড়ানোর দরকার বোধ করল না। মোড়টা ঘোরার সময় মনে হল তিরিশের-একের বসবার ঘরের জানলার খয়েরি পর্দা সরিয়ে কেউ মাথা হেলিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। আভা কি না দেখার জন্য সে কৌতূহলী হয়ে উঠল। কাছাকাছি হতেই খুব অবাক হয়ে দেখল শোভা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

অসীম একটু দূরে সরে যেতেই সত্যচরণ থেমে যাওয়া কথাটার খেই ধরল।

”আমি কি আর তোমায় ছাড়িয়েছি গো। তোমার বউদিকে তো চেনই কেমন মানুষ।”

”আপনিও কেমন মানুষ তা আমার জানা আছে। একজোড়া বালা মেয়েকে গড়িয়ে দেবেন বলে তো আজ পাঁচ বচ্ছর ধরে ঘোরাচ্ছেন।”

”ওমা, এইতো গত বছর সবে বললুম, আর বলছ পাঁচ বছর।”

কথা না বলে কালীর মা পাম্প করতে থাকল। সত্যচরণ প্রবল আগ্রহে প্রতিটি ঝাঁকির সঙ্গে ওর সারা শরীরের দুলুনি লক্ষ করায় তৎপর হল। তার মনে হল, আঙুরবালা আর অতটা আঁটো-সাটো নেই। একজোড়া বালা, চোদ্দো ক্যারট হলেও কম করে গোটা হাজার টাকা খসবে। অত টাকা এখন আঙুরের উপর ইনভেস্ট করা উচিত হবে না বলেই তার মনে হচ্ছে। চারুশীলা যদি ওকে তাড়াবার উদ্দেশ্যে চুক্তি ভঙ্গ করে, বাসনের সঙ্গে দুটোর জায়গায় তিনটে পোড়া বার করে না দিত, তাহলে বালা গড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিটা হঠাৎ মুখ ফস্কে কি বেরিয়ে যেত? তবুও আঙুর কাজ ছেড়ে দিল। দেখে দেখে চিমড়েপোড়া এক বুড়িকে চারুশীলা কাজে লাগিয়েছে। এর আগে তিনজনকে তাড়িয়েছে, একই ছুতোয়। ঝিগুলো আসে হতকুচ্ছিত রোগাপটকা চেহারা নিয়ে, তারপর চারুশীলার নজরে, কেমন যেন পরিপাটি হয়ে যায়, ঢলানি-ঢলানি ভাব ধরা পড়ে, আর সত্যচরণও যেন উঠোনের জানলার ধারে বসে বড়ো বেশিক্ষণ সময় নেয় দাড়ি কামাতে। এই নিয়ে রাতে বহুবার তুলকালাম হয়ে গেছে ওদের। আঙুরের চতুর্থ মেয়েটির পাশে সত্যচরণের দুই মেয়ে ভুতি আর টুনুকে দাঁড় করিয়ে দিলে কার সাধ্য বলে ওরা তিন বোন নয়-এই কথাটি কে যেন একবার পাড়ায় চাউর করেছিল। সত্যচরণের দৃঢ় ধারণা কাজটা শেফালিরই। কেননা, একদিন শেফালিই বাড়ি বয়ে জানিয়ে গেছল, ”সত্যদার মতো লোকের চরিত্র নিয়ে কথা বলার সাহস পায়, বউদি, কী হয়েছে যে পাড়ার কী বলব।”

জলের বালতি হাতে ঝুলিয়ে কালীর মা মিষ্টি করে হেসে নিচু গলায় বলল, ”বড্ড ঠ্যাকায় পড়ে গেছি, পাঁচটা টাকা দিতে পারেন।”

”পাঁচ! এখুনি?” সত্যচরণ গামছার কসি আঁট করতে করতে হাসল। বাঁ হাতে ঘোমটাটা আর একটু টেনে দিতে দিতে কালীর মা ঘাড় নাড়ল।

”আচ্ছা! আজই তাহলে দিয়ে আসব।”

সত্যচরণ হঠাৎ প্রফুল্ল বোধ করল। গুন গুন সুর বেরোল মুখ দিয়ে। পিছু ফিরে, আঙুরের চলন দেখে এখন তার মনে হল, মেয়েটাকে বালা গড়িয়ে দিতে কতই বা আর খরচ।

আট

”আশ্চর্য”, শোভা উত্তেজিত হয়ে আবার ঘরে ঢুকল। ”আভাকে এত করে বললাম, অথচ কানেই নিল না। সিনেমায় দেখা আর এমনি সামনা-সামনি দেখায় কত তফাত। আচ্ছা, তুমি কখনো কাউকে সামনা-সামনি দেখেছ?”

হিরণ্ময় বই থেকে মুখ তুলে তাকাল।

”না।”

”খুব ছোটোবেলায়, এই টিপুর মতো বয়সে আমি একবার অশোককুমারকে দেখেছিলাম। তখন বাবা বোম্বাইয়ে বদলি হয়েছিলেন।”

খাটের উপর খালি সিগারেটের প্যাকেটগুলো সাজিয়ে টিপু খেলা করছে। নিজের নাম শুনে মায়ের দিকে তাকাল। হিরণ্ময় পা দিয়ে একটা প্যাকেট ফেলে দিল ওকে রাগাবার জন্য। প্রায়ই এমন করে সে।

টিপু একটা কিল মারল হিরণ্ময়ের পায়ে। ”উঃ” বলে হিরণ্ময় পায়ে হাত বুলোতে শুরু করল। কিছুক্ষণ টিপু লক্ষ করবে না ব্যাপারটা। ক্রমাগত উঃ, আঃ করে যেতে হবে। তখন ওর ডাক্তারি শুরু হবে। সেটা দেখার জন্য মা ও মাসির অবশ্যই হাজির থাকা চাই।

”আজ থাক।” শোভা একটু চাপা গলায় হিরণ্ময়কে বলল। ”আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে, কী করে দেখা যায় বলো তো?”

”জানলায় দাঁড়িয়ে থাকো। বেরিয়ে এসে যখন গাড়িতে উঠবে দেখে নেবে।”

”কী যে বলো! জানলায় হাঁ করে দাঁড়াই আর যত রাস্তার বাজে লোক তাকিয়ে তাকিয়ে যাক! তুমি কলেজ থেকে ফিরে খেয়েছ তো?”

”থাকগে। একদম খিদে নেই।”

”আভা দেয়নি? ঠাকুরকেও তো বলে গেছলাম। জানো, ব্লাউজের ছিটটা থেকে কুড়ি সি.এম. কাপড় বাঁচবে, ওটা দিয়ে কী করা যায় বলো তো?”

হিরণ্ময় লক্ষ করল টিপু ঘনঘন তাকাচ্ছে তার পায়ের দিকে। গেঞ্জি বা ব্লাউজ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে, বগলে পেনসিল দিয়ে জ্বর দেখে, কাগজে ঘসঘস করে প্রেসক্রিপসান লিখবে। নিজেই ওষুধ কিনতে যাবে পাশের ঘরে। জলভরা একটা শিশি হাতে ঢুকবে এবং ঢক করে সবটা খেতে হবে। তারপর গলা পর্যন্ত চাদর টেনে দিয়ে ঘুমোতে বলবে। না ঘুমোলেই বিপদ। ঘুমের জন্য বারবিটুরেড ট্যাবলেটগুলো আছে আলমারিতে। শোভার কাছে চাবি। বার করে দেওয়ার জন্য বায়না ধরবে। ঘুমের ট্যাবলেট মাঝে মাঝে হিরণ্ময় খায়। হিমাংশুর ডাক্তারখানা থেকে শিশি ভর্তি এনে রেখে দিয়েছে। টিপুর হাতে কোনোক্রমে এই বিষাক্ত বস্তুটি যাতে না পড়ে, সেজন্য আলমারির মধ্যে তোলা।

হিরণ্ময় বুঝতে পারছে, একবার পায়ে হাত দিয়ে যন্ত্রণায় মুখ বিকৃতি করলেই টিপুর চিকিৎসা শুরু হয়ে যাবে। মাস ছয়েক আগে পা মচকে যাওয়ায় হিমাংশু এসে যা যা করেছিল সেইগুলিই হুবহু অনুষ্ঠিত হবে।

”টিপু আজ নিয়ে পর পর তিনদিন তুমি পড়তে বসোনি। যাও মাসির ঘরে।”

”বাবার পায়ে যে ব্যথা হয়েছে।” টিপু মাসির ঘরে না যাওয়ার অজুহাত খাড়া করল।

”হোক ব্যথা, চলো।”

শোভা ওকে টানতে টানতে আভার ঘরের দিকে নিয়ে গেল। হিরণ্ময় হাতটা কপালের উপর রাখল। প্রায় প্রত্যেকদিনই এই ব্যাপার ঘটে। শুধু মজা লাগে টিপুর অজুহাতগুলো শুনতে। ওকে কিছুক্ষণ কাছে নিয়ে রাখার ইচ্ছা হল হিরণ্ময়ের। উঠে বসল সে।

ড্রেসিং টেবিলের উপর দুজনের ছবি মুখোমুখি। শোভা আর হিরণ্ময়। বিয়ের একমাস পর, দার্জিলিংয়ে তোলা। ফ্রেমের কিনারে হলুদ দাগ ধরেছে। সিগারেট ধরাতে ধরাতে হিরণ্ময় তাকাল। নিজেকে লক্ষ করল আয়নায়। বয়সের লক্ষণগুলো বেশ প্রকট মনে হচ্ছে। একমাস আগে চুল কাটার সময় নাপিত বলেছিল, ঘাড়ের উপরে দু-তিনটে চুল পেকেছে। শোভার চোখে আজও পড়েনি, নয়তো ও নিজেই কলপ কিনে আনত দু-তিনটে পাকা চুলকে ঘায়েল করতে। কোমরের বেড়ও বেড়েছে। চোখের চাউনিতে কীসের ছাপ ফুটেছে দেখার জন্য সে আয়নার কাছে এগিয়ে গেল।

”একদম পড়তে চায় না আজকাল, আর আভারও যে কী হয়েছে”-বলতে বলতে শোভা থেমে পড়ল ঘরে ঢুকেই। ”কী দেখছ অমন করে?”

”বয়স।”

”তার মানে।”

”কতটা বেড়েছে দেখছি।”

শোভা ভেবে পেল না এরপর কী বলবে। বালিশটা চাপড়ে সমান করতে করতে একবার শুধু তাকাল হিরণ্ময়ের দিকে।

”তোমার কী মনে হয়, খুব বুড়ো দেখাচ্ছে?” হিরণ্ময় ঘুরে দাঁড়াল।

”খুব আর কোথায়। তবে আগের মতো আর হাসিখুশি থাকো না, সবসময়ই মুখ গম্ভীর, একটুতেই খিটখিট শুরু করো।”

”কেন বলো তো?” হিরণ্ময় যেন ক্লাশে একচেটিয়া-তত্ত্ব বোঝাতে হঠাৎ একটা প্রশ্ন এমনিই করে ফেলল।

”আমি কী করে বলব।” শোভার স্বর একটু গম্ভীর।

ধীরে পায়চারি শুরু করল হিরণ্ময় ঘরের অবশিষ্ট ফাঁকা মেঝের উপর।

”আমার গায়ে আর জোর নেই। কোনোকালেই খুব বেশি অবশ্য ছিল না। কিন্তু এখন একদমই নেই। সেটা আজ বুঝেছি। কিন্তু আমি-”

হিরণ্ময় থমকে পড়ল। সিগারেটের ছাই ঝাড়ল মেঝের উপর, যা দেখেও শোভার ভ্রূ কুঞ্চিত হল না।

”আজই কীভাবে বুঝলে?”

দ্বিধায় পড়ল হিরণ্ময়। একটা মেয়েকে দুহাতে টেনে তুলতে পারিনি এবং মেয়েটি আভা, একথা বলার সময় হয়েছে কিনা বুঝতে পারছে না সে। যদিও এক সময় মনে হয়েছিল শোভাকে বলব-কেন আমি আভার সর্বনাশ করেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বলার কোনো অর্থ হয় না, যুক্তিও নেই। স্বীকারোক্তি দিয়ে কোনো লাভ হয় না। আসলে যা করার করে যেতে হয়।

”বুক-কেসের পিছনে এই বইটা পড়ে গেছল। কেসটা সরাতে পারলাম না একা। একটুও না। আভাকে ডাকলাম, ও এসে সরিয়ে বার করে দিল।”

”এইতেই বুঝলে!” শোভা স্পষ্টভাবে হেসে উঠল এবং উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে বলল, ”আমি একটু মোটা হয়ে গেছি না?”

হিরণ্ময় তাকাল এবং মনে মনে বলল, একটা সরল অঙ্ক ছাড়া আর কী? কিন্তু আমি জটিল অঙ্কে হাত দিলাম কেন? পুলিশ গুলি চালাচ্ছে খবর পেয়ে রাস্তায় বেরিয়েই বা গেছলাম কেন? আর আভা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়বে বলায় যৎসামান্যও আশ্বস্তবোধ করলাম কেন?

”দিদি দ্যাখো, টিপু পড়তে চাইছে না, ঘুম পাচ্ছে বলছে।”

আভা পর্দা সরিয়ে ঘরের দরজাতেই দাঁড়িয়ে থাকল। হিরণ্ময়ের দিকে একদমই তাকাচ্ছে না।

”ওই ওর বজ্জাতি। তিনটে শ্লেট ভাঙল, চারটে প্রথম ভাগ ছিঁড়ল, এখনও ক, খ-র বেশি এগোল না। ঘুম পাবে না তো কী? সারা দুপুর চোখের পাতা এক করে!”

”খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও। মন যখন নেই, তখন আর পড়া হবে না। মিছিমিছি যন্ত্রণা দিয়ে লাভ কী?”

হিরণ্ময় শোভাকে উদ্দেশ্য করে বলল। অবশ্য সরাসরি আভাকেই বলতে পারত, কেননা টিপুকে খাওয়ানো ও ঘুম পাড়ানোর কাজটা তার। আভা তাকাল তার দিদির মুখে নির্দেশের জন্য। অবশ্য হিরণ্ময়ের কথা শুনেই সে টিপুকে খাইয়ে দেবার জন্য চলে যেতে পারত, কেননা এর উপর আর কারুর কথা খাটবে না।

”তাই দে।”

আভা চলে যেতেই আয়নার দিকে আবার তাকিয়ে শোভা বলল, ”হাসিদি বলছিল, আমি আগের থেকে বেশ মোটা হয়ে গেছি। ট্যাবলেট খেতে বারণ করে দিল। যারা খাচ্ছে সবাই নাকি মোটা হয়ে পড়ছে।” কিছুক্ষণ ঘাড় হেলিয়ে চুপ থেকে অনিশ্চিত স্বরে বলল, ”ভাবছি মাস দুই-তিন খাওয়া বন্ধ রাখব, কী বল?”

”তোমার খুশি।”

”আহা একা যেন আমারই খুশি।” আদুরি গলায় শোভা বলল এবং লাজুক চোখে তাকাল। পাউডার পাফটা দিয়ে আলতো করে গালে সুড়সুড়ি দিতে দিতে হঠাৎ শিউরে উঠে বলল, ”না বাবা, একটাই থাকা ভালো। একজনকে সামলাতেই হিমসিম খাচ্ছি, আর হয়ে দরকার নেই। তোমায় কিন্তু মনে করিয়ে দিচ্ছি আর তিনটে ট্যাবলেট মাত্র রয়েছে।”

”তুমি নিজেই কিনতে পারো।”

”না বাপু, কেমন লজ্জা করে।”

শোভা ব্যস্ত হয়ে টেবিলে রাখা টাইমপিসটায় সময় দেখল। প্রতিদিন রাত আটটায় সে ট্যাবলেট খায়। কিছুতেই এর নড়চড় হয় না।

আসলে যা করার করে যেতে হয়, এই কথাটা ভাবতে ভাবতে হিরণ্ময় বাইরের ঘরে এল। ওর পিছনে শোভাও।

”কেউ বুঝতে পারবে না অথচ দেখাও হয়ে যায়, কীভাবে সেটা করা যায় বলো তো?”

হিরণ্ময় সোফায় গা এলিয়ে শোভার দিকে তাকিয়ে ভাবল : একটা উত্তর বার করতেই হবে আভাকে নিয়ে এখন কী করা যায়!

”আমার কী মনে হয় জানো”, শোভা বসল হিরণ্ময়ের গা ঘেঁষে। ”তোমার তো ব্লেড ফুরিয়ে গেছে, টুথপেস্টও কিনতে হবে। যদি এখন কিনতে বেরোই, যদি আস্তে আস্তে যাই আর ফিরি তার মধ্যে কি দেখে নেওয়া যাবে না?”

”কিন্তু তার মধ্যে যদি না বেরোয়!” হিরণ্ময় ভাবনার মধ্যেই কথাটা বলে দিয়ে আবার শুরু করল: গুলি খাওয়ার ইচ্ছাটাই কি ছদ্মবেশ ধরে ভালোবাসা হয়ে এল? একজনের মধ্যে এ দুটো জিনিস এল কী করে! মরা আর ভালোবাসা কি একই ব্যাপার!

”ওই সিংগী বাড়িতে গেলে অবশ্য দেখা যায়, কিন্তু আমার সঙ্গে তো চেনা নেই।”

”চেনা করে নাও।”

”নাঃ। ও বাড়িতে একটা মাতাল থাকে।” শোভার নাক কুঁচকে উঠল।

অতঃপর হিরণ্ময় শুরু করল : দুটোর একটা বেছে নেওয়া দরকার। হয় হিমাংশুর কাছে গিয়ে আভার ব্যবস্থা করা, নয়তো যেমন আছে তাই থাক। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা প্রকাশ হোক। শোভা জানুক, ওর বাবা-মা জানুক। ছ্যা ছ্যা করুক, আলাদা হয়ে যাক। তারপর পরিচিতরা জানুক, হাসাহাসি করুক, দুশ্চরিত্র লম্পট বলে নাক সিঁটকোক। আর তার মাঝে বেপরোয়ার মতো চলাফেরা, খাওয়া শোওয়া, কলেজ-পাবলিশার নিয়ে এক ধরনের বেঁচে থাকা। যা করার তাই করে যাওয়া ছাড়া পথ নেই। জিনিসটা আভাকে বলা দরকার, এখনি।

”তুমি বরং ওই ছেলেটার সাহায্য নিতে পারো। ওই যে কদিন আলাপ জমাতে এসেছিল। ফুটবল খেলে বেড়ায়।”

”অসীম!”

”মোটরের কাছাকাছি যে-কোনো একটা বাড়িতে জানলা কী বারান্দায় ও তোমাকে হাজির করে দিতে পারবে।”

শোভা নির্নিমেষে তাকিয়ে থেকে কিছু ভাবল। তারপর জানলায় গিয়ে পর্দা সরিয়ে খুঁজতে লাগল অসীমকে।

অতঃপর হিরণ্ময় শুরু করল : আভাকে বলতে হবে, আমার মানমর্যাদা, তোমার দিদির সংসার এসব নিয়ে চিন্তা না করে নিজের কথা ভাব। যতক্ষণ না নির্দিষ্ট একটা উত্তর পাওয়া যাচ্ছে, অঙ্কটা কষেই যেতে হবে। তোমাকে টেনে তুলতে পারিনি, যেহেতু তুমি গায়ের জোরে আমার বিরুদ্ধতা করেছ, অথচ আমি বললেই তুমি ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই ধরনের উলটোপালটা ব্যাপারগুলোর মধ্যে একটা সমতা আনা দরকার। বিবেক দংশনের যন্ত্রণায় এভাবে কাতর হয়ে পড়ার কোনো দরকারই নেই। বিবেক চেহারা বদলায় তোমার-আমার অস্তিত্বের টানাপোড়েনের উপর।

আভার গলা শোনা যাচ্ছে শোবার ঘর থেকে। গল্প না শোনালে টিপু ঘুমোতে চায় না। ওকে ঘুম পাড়ানো-র কাজও আভার। হিরণ্ময় কান পাতল আভার গলা শোনার জন্য।

”ওই তো অসীম!” শোভা হাতছানি দিয়ে ডাকল।

অসীম কাছে আসতেই শোভা ফিসফিস করে বলল, ”একটু দেখিয়ে দিতে পার?”

”দেখবেন।” অসীম ঠোঁট কামড়ে ভাবতে শুরু করল কীভাবে দেখাবার ব্যবস্থা করা যায়।

”চার নম্বর বাড়ির একতলায় যারা ভাড়া থাকে, তাদের ঘরের জানলা আর ওই মাস্টারনির জানলাটা একদম মুখোমুখি, যদি চার নম্বরে যান, তাহলে-”

”ওরা কিছু মনে করবে না তো? আমি অবশ্য বেশিক্ষণ থাকব না।”

”মনে আবার করবে কী, আমি নিয়ে যাচ্ছি না!” অসীম তার ক্ষমতার বহর গলার স্বর দিয়ে শোভাকে বোঝাবার চেষ্টা করল।

শেফালি আর ইলা সেই সময় তাঁতি গলিতে ঢুকছে। তাই দেখে অসীম শোভাকে বলল, ”দুজন ঢুকছে, বোধহয় ওইজন্যই। দাঁড়ান, জিগ্যেস করে দেখি, তাহলে ওদের সঙ্গেই ভিড়ে যেতে পারবেন।”

অসীম দ্রুত গেল এবং এল। ”হ্যাঁ, আপনি আসুন, ওরা নিয়ে যাবে।”

শোনামাত্র শোভা চটি গলিয়ে সদরের দিকে ছুটে গেল প্রায়। খিলে হাত দিয়ে আবার ছুটে এল শোবার ঘরে। ট্যাবলেট খাবার সময় হয়েছে তার। ওর দৃঢ় ধারণা প্রতিদিন ঘড়ি ধরে না খেলে কোনো ওষুধেই ফল ফলে না। চাবি দিয়ে আলমারি খুলে মোড়ক থেকে একটি ট্যাবলেট বার করে মুখে ছুঁড়ে দিয়ে ”খোলা রইল, চাবি বন্ধ করে দিস”, আভাকে এই বলেই সে ছুটে বেরিয়ে গেল।

হিরণ্ময় শুনতে পেল রাস্তায় অসীম হতাশস্বরে বলছে, ”আপনি একাই যাবেন?”

উঠে দাঁড়াল সে। টিপু ঘুমিয়ে পড়েছে কি? আভাকে বলতে হবে, হেস্তনেস্ত করে জীবনটাকে বেশ একটা নাড়া দেওয়া দরকার। সেইজন্যই তো ব্যাপারটা ঘটালাম, জেনেশুনে, ইচ্ছে করেই।

ইলা ভাবল সিল্কের শাড়িটা পরবে কিনা। মনস্থির করতে করতে, চিরুনি টানল চুলে। একটু ক্রিমও লাগাল গালে। অবশেষে অশোকের মতামত নেওয়াই উচিত মনে করল।

”হ্যাঁগা, এই শাড়িটা পরেই যাব?”

অশোক বিরক্ত হয়ে মুখ তুলল বালিশ থেকে, ”তবে কী পরে যাবে? যাচ্ছ তো পাশের বাড়ি!”

ইলারও মনে হল কথাটা ঠিকই বলেছে। তাছাড়া সিল্কের শাড়িটা সবে আড়াই টাকা দিয়ে কাচিয়ে আনা হয়েছে। এইরকম ব্যাপারে বার করলে একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যায়।

নিচে এসে দেখল পারুলের দরজা ভেজানো। খুলে দেখল, পারুল শুয়ে, কপালে হাত, চোখ বন্ধ।

”কীরে, মাথা-ধরা কমলো?”

”না ভাই, আরও যেন মাথাটা ছিঁড়ে পড়ছে। তুই বরং যা।” বলে পারুল মুখচোখে যন্ত্রণা ফুটিয়ে তুলল। তাই দেখে ইলা আর কথা বাড়াল না।

শেফালি ভাতের হাঁড়িটা নামিয়ে তর্জনী ঠোঁটে ঠেকিয়ে ইলাকে চুপ থাকতে ইশারা করল।

”বাড়ির কেউ জানে না। তাহলে বউয়েরা হাতে কাজ ধরিয়ে বেরোনো বন্ধ করে দেবে।” ফ্যান গালতে গালতে ফিসফিস করে শেফালি বলল। ”বউগুলোকে জানোই তো। বিনি-পয়সায় দুমুঠো খাওয়া আর থাকার বদলে এই দাসীবৃত্তি আজীবন আমার ভাগ্যে লেখা আছে।”

সমবেদনায় ইলার অন্তর ভরে উঠল। শেফালি হাঁড়িটা মেঝেয় উপুড় করে বলল, ‘আসছি ভাই।”

রেডিয়োয় নাটক হচ্ছে। দুই ঘরে দুটি রেডিয়ো। বাড়ির সবাই দুই ঘরে ভিড় করে শুনছে। শেফালির হঠাৎ ইচ্ছে হয়েছে সিঁথেয় একটু চওড়া করে সিঁদুর দেয়। ঘরে এতলোক দেখে সে ফিরে গিয়ে অন্ধকার বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়াল। কী যেন তার হচ্ছে বুকের মধ্যে। হঠাৎই এখন পঞ্চাননকে মনে পড়ছে বারবার। মাস দুয়েক আগে দেখা করেছিল ওর সঙ্গে। বাগবাজারের দোকানটা আগেই সে চিনে রেখেছিল। অনেকদিন সামনে দিয়ে হেঁটে গেছে, পঞ্চাননকে এক ঝলক দেখে নেবার আশায়। একদিন সে বেপরোয়ার মতো ঢুকেও পড়েছিল।

পনেরো বছর পর দেখে চিনতে পারেনি পঞ্চানন। খদ্দের ভেবে এগিয়ে এসে কাউন্টারে ঝুঁকে বলল, ”কী চাই বলুন।”

নিজের নাম বলতে শেফালির সঙ্কোচ হল। শুধু কোনোক্রমে বলে, ”কিছু কিনতে আসিনি।”

চশমার কাচের পিছনে পঞ্চাননের চোখ দুটিতে বিস্ময় ফুটতে ফুটতে হঠাৎ সম্বিৎ পেয়ে তীক্ষ্ন হয়ে গেল।

”তাহলে কী চাই?”

স্বরের গাম্ভীর্য পরিমাপ করে শেফালি বুঝল, চিনতে পেরেছে।

”কথা ছিল।”

পঞ্চানন একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ডান গালের আঁচিলটার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটেনি। গোঁফটা আগের থেকে ছোটো হয়েছে, জামার কলার ময়লা, নখগুলো বড়ো, চামড়া খসখসে, অন্তত দু’দিন দাড়ি কামায়নি, অনেকগুলো চুল পেকেছে।

”আমার সম্বন্ধে কী ঠিক করেছ?” শেফালি স্পষ্ট স্বরে জানতে চাইল। তেজ দেখাবার বয়স আর নেই। লজ্জা করলেও চলবে না। বিয়ে করা বউ তো বটে, এই ভেবে সে সরাসরি পঞ্চানন্দের চোখের দিকে চেয়ে রইল।

”আমার তো ঠিক করার কথা নয়।”

”স্ত্রীর সম্পর্কে স্বামী ঠিক করবে না তো কে করবে? সেটাই তো নিয়ম।”

”তুমি যে আমার স্ত্রী, কে বলল?”

”আইন বলবে।”

”ওঃ, আইন দেখাতে এসেছ।”

পঞ্চাননের শরীর শিকার দেখা হিংস্র প্রাণীর মতো কুঁজো হয়ে গেল।

”দরকার হলে তাই দেখাব।”

থতমত হল পঞ্চানন। ঝাড়ন দিয়ে কাউন্টারের ধুলো মুছতে শুরু করল। এই সময় এক খদ্দের এল পাঁউরুটি কিনতে। শেফালি একধারে সরে দাঁড়াল। যাবার সময় লোকটি অভিযোগ করল, ”কালকের রুটি কিন্তু বাসি ছিল।”

”কী করব বলুন, কোম্পানি যেমন দেয়।”

”কোম্পানিকে জানান।”

লোকটি চলে যেতেই শেফালি বলে, ”তাহলে? ভায়েদের সংসারে এইভাবেই পড়ে থাকব? শাড়ি গয়নার তো আমার দরকার নেই, খাই-খরচ পেলেই চলবে।”

”যদি না দিই।”

”তাহলে মামলা করে আদায় করব।” শেফালি কাউন্টারে চাপড় মারল।

”যদি বলি স্বেচ্ছায় চলে গেছ, আমি বরাবরই তোমায় আমার কাছে রাখতে রাজি ছিলুম, এখনও রাজি?”

”এখনও রাজি!” শেফালি এবার থতমত হল। অবিশ্বাসের সুরে বলল, ”আমি স্বেচ্ছায় আসিনি, তুমিই তাড়িয়ে ছিলে। মদ খেয়ে এসে আমায় লাথি মেরে কী বলেছিলে আজও আমার তা মনে আছে। আমি মেয়েমানুষ নই, আমাকে নিয়ে তোমার সুখ হয় না-”

কান্নায় গলা বুজে গেল শেফালির। দুচোখ দিয়ে টপটপ জল পড়ল। পঞ্চানন কাউন্টারের তলার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল। দোকানের দরজার পাল্লা আধ-ভেজিয়ে, ফিরে এসে বলল, ”দাঁড়িয়ে কেন, এই টুলটায় বোসো।”

শেফালি বসল।

”এই তো দোকান দেখছ। মাসে কতই বা রোজগার, বড়োজোর হাজার দুই। এর থেকে তিন-চারশো টাকা খোরপোশ দিতে হলে আমার সংসার অচল হয়ে যাবে। তাছাড়া তোমায় যদি বলি, এখন আমার কাছে এসে থাকো, পারবে?”

”ছেলেমেয়ে ক’টি?” ইতস্তত করে শেফালি বলল।

”বড়োটি মেয়ে, তেরোয় পড়ল। এখনও স্কুলে পড়ছে। তবে আর পারব না। পরের চারটি ছেলে। এই আয়ে এতগুলোকে নিয়ে আর চালাতে পারছি না। ভিখিরিরও অধম হয়ে থাকি। চাকরি খুঁজছি। এই বয়সে পাবই বা কোথায়!”

পঞ্চানন করুণ চোখে তাকাল। শেফালি চোখ সরিয়ে অস্পষ্টভাবে বলল, ”ওরা কি আমার কথা জানে?”

”জানে।”

”কিছু বলে।”

”তোমায় নিয়ে কোনো কথাই হয় না।”

”আর কেউ কিছু বলে না।”

”গীতা তোমায় শুধু একবার দেখতে চেয়েছিল।” পঞ্চানন ইতস্তত করে, কিছু ভেবে নিয়ে যোগ করল, ”আমি বলেছিলাম কিনা তুমি ওর থেকেও সুন্দরী।”

শোনামাত্র উঠে দাঁড়াল শেফালি।

”রোগে ভুগে ভুগে গীতার আর কিছু নেই। শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। হয়তো আর বাঁচবেই না। তুমি একদিন এসে দেখে যেতে পারো, সত্যি বলছি কিনা।”

শেফালি দরজার দিকে এগোল।

”আমার এই সামান্য আয়ে আর ভাগ বসিয়ো না। ছাপোষা মানুষ আমি। জোড় হাতে মিনতি করছি শেফালি। মনে করো তুমি বিধবা হয়ে গেছ।”

কথা না বলে দোকান থেকে বেরিয়ে আসে শেফালি।

দোতলা থেকে শেফালি নেমে আসতেই ইলা ব্যস্ত হয়ে বলল, ”দেরি হয়ে গেল বোধহয় ঠাকুরঝি। আপনার সঙ্গে চেনা আছে তো ওবাড়ির লোকেদের?”

”আমি এ পাড়ার মেয়ে, জম্মো থেকেই রয়েছি। চার নম্বর বাড়ির ভাড়াটেদের সঙ্গে নাইবা চেনা থাকল, জানলা দিয়ে একবার দেখব, তা কি আর দেখতে দেবে না? ওঘরে আগে থাকত লক্ষ্মীরা। তখন কত যাতায়াত ছিল।”

ওরা দুজন রাস্তায় নামল। অনন্ত সিংহ হাতে সন্দেশের বাক্স নিয়ে ফিরছে। শেফালি বলল, ”পুতুলকে সাজাচ্ছে কে গো, কাকিমা?”

”হ্যাঁ। আর আজকালকার যা সাজগোছের বহর, নিজেরাই সেজে নিতে পারে।”

অনন্ত এড়িয়ে গেল শেফালিকে। সত্যচরণ পাম্প করে যাচ্ছে টিউবওয়েল। শেফালি বলল, ”কীগো সত্যদা, জল নেওয়া যে আর শেষই হয় না। তখন থেকে তো হ্যান্ডেল চালাচ্ছ।”

‘দ্যাখ না, কালীর মা কিনা কীসের একটা বালতি এনে জল নিয়ে এল। সব ধুয়ে টুয়ে-”

”অ, কালীর মা জল নিচ্ছিল এতক্ষণ!” শেফালি মুখ টিপে ইলার দিকে তাকিয়ে হাসল। লক্ষ করে সত্যচরণের বুক ঢিপঢিপ করে উঠল। কাল দুপুরে নির্ঘাৎ হারামজাদিটা গল্প করতে আসবে চারুশীলার কাছে। আঙুরকে পাঁচটা টাকা দিয়ে আসতে হবে। টাকা থাকে চারুর কাছে। চেয়ে নিতে হবে। কিন্তু আঙুরের সঙ্গে এই দেখা হওয়ার কথা কানে গেলেই, পাঁচ টাকার সঙ্গে সেটি গেঁথে তুমুল কাণ্ড বাধিয়ে ফেলবে। দাঁত কিড়মিড় করে সত্যচরণ তাঁতি গলির দিকে তাকাল। সেখানে অসীমের সঙ্গে কথা বলছে শেফালি।

শোভা আসতেই শেফালি বলল, ”আপনি এতদিন রয়েছেন পাড়ায়, অথচ ভাবসাব হয়নি। যাক আজ হয়ে গেল।”

”আমার কেমন আড়ষ্টতা লাগে। একদমই মিশুক নই, তবে ইচ্ছে করে খুবই।” শোভা নম্রস্বরে বলল।

”বউদিকে সেজন্য পাড়ায় বলে ডাঁটিয়াল।” অসীম হাসল শোভার দিকে তাকিয়ে।

”ওসব পাড়ার লোকের কথায় কান দিতে হবে না আপনাকে। সবাইকে আমার চেনা আছে। চলুন।” শেফালি তাঁতিগলির মধ্যে ঢুকল।

ইলা এতক্ষণ শোভার আপাদমস্তক দেখছিল খুঁটিয়ে। তাঁতিগলিতে ঢুকে শোভার পিছনে যেতে যেতে বলল, ”আপনার বোন এল না?”

”ও পড়ছে। ফাইনালের তো আর বেশি দেরি নেই।”

”আমি আর যাব না।” অসীম চার নম্বর বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে পড়ল।

”কেন রে, তুইও আয় না।”

”আপনারা দেখুন; আমি অনেক দেখেছি, কথাও বলেছি।”

অসীম গলি থেকে বেরিয়ে অনন্ত সিংহের বাড়ির সদরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করল। তারপর কড়া নাড়ল।

 নয়

”আপনি সিগারেট খান!”

ভোম্বল অর্থাৎ দ্বারিক সিগারেটের বাক্সটা সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে রাখল টেবিলে।

”কেন, আমি কি খেতে পারি না?”

”কোনোদিন তো দেখিনি।” মানু অর্থাৎ মনীষা খাটের উপর বালিশে কনুই ভর দিয়ে হেলে পড়ল।

”দেখবে কী করে, কোনোদিন কী তাকিয়ে দেখেছ?”

”আহা, এতবার এসেছি এ বাড়িতে আপনাকেই তো দেখতে পাই না।”

”মিথ্যে কথা বলো না। বাসস্টপে একদিনও তো ফিরে তাকাওনি। বড্ড ডাঁট তোমার।”

”আহা-হা, ডাঁট আবার কোথায় দেখলেন। আমি রোজই দেখতে পাই, আপনিই তো গম্ভীর হয়ে থাকেন। কথা বললে উত্তর দেবেন কী দেবেন না-” মনীষা মুখ টিপে হাসল।

দ্বারিক জোরে সিগারেটের টান দিয়ে ধোঁয়ার রিং তৈরি করতে করতে ভাবল, এই নিয়ে দুবার ‘গম্ভীর’ শব্দটি ব্যবহার করল। গম্ভীর লোক তাহলে একদমই পছন্দ করে না ও। কিন্তু মুখ টিপে হাসলে মানুকে দারুণ দেখায়, আর কী বলা যায়, যাতে মানু এইভাবে হাসে।

”আমাকে তাহলে তুমি খুবই অভদ্র মনে করো।”

”করিই তো।” বলেই মনীষা ভাবল, ভোম্বলদা কি আবার গম্ভীর হয়ে যাবে এই শুনে! বড্ড হাসি পায় এইভাবে ওকে দেখলে।

”বেশ তাহলে আর কোনো কথা বলব না।”

ভোম্বল খুব খুশি হয়ে মুখখানাকে থমথমে করে তোলার চেষ্টায় ব্যস্ত হল। চপল লঘু সুরে কথা বললেই মানুকে মানায়।

”না বললে আমার বয়েই গেল। আমি এখন কোনো বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তাহলে গল্প করব।”

”মেয়ে না পুরুষ বন্ধু?” ভোম্বল কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে বলল।

”পুরুষ বন্ধু।” মনীষা মুখটিপে হাসল, ভোম্বলের মনে হল, খুনসুটি না করলে মানু এমন করে হাসবে না।

”তোমার তো অনেক পুরুষ বন্ধু।”

”আছেই তো।”

”আমার কোনো মেয়ে বন্ধু নেই।”

”হবে কী করে, আপনি নামেও ভোম্বল, কাজেও ভোম্বল।”

”মোটেই না। অনেকেই এসেছিল বন্ধুত্ব করতে, কাউকেই পাত্তা দিইনি। সব বাজে চিপ-টাইপের।” কথাগুলোকে যুক্তিবান করার জন্য ভোম্বল আর একটু যোগ করল, ”ব্যাঙ্কিং-এর সেকেন্ড পার্টটা পাশ করলে অফিসার গ্রেডে যাবার চান্স আরও সহজে পাব, জানে তো, তাই এসে জুটছে।”

শুনতে শুনতে কালো হয়ে উঠল মনীষার মুখ। অন্যমনস্কের মতো আলতো আঙুলে খোঁপার গোলাপটি স্পর্শ করার জন্য হাত তুলতেই কাঁধ থেকে সিল্কের শাড়ির আঁচলটি পড়ে গেল।

”তুমি আবার কবে থেকে হাত কাটা ব্লাউজ পরা শুরু করলে?”

আঁচলটা বাহুর উপর টেনে সিধে হয়ে বসল মনীষা। বিব্রত স্বরে বলল, ”অনেকেই পরছে, ভাবলুম, দেখি একবার পরে।”

ভোম্বল গম্ভীর হয়ে সিগারেট ধরাল। দরজার পর্দাটা মনে হল যেন একটু সরে রয়েছে। বড়দা দেখে ফেলতে পারে ভেবে, টেনে-টুনে ঠিক করে দিল।

”এইরকম ব্লাউজ চিপ মেয়েরা পরে। আর ওইভাবে কোমরের অত নিচে শাড়ি পরা।”

”আমি তো চিপই।”

ভোম্বল আহত চোখে তাকাল। মানু কী রাগ করল তার কথায়? হয়তো চলে যেতে চাইবে এখুনি।

”তবে অনেককে পরলে ভালো দেখায়। বিশেষত যাদের গায়ে চর্বি নেই, ছিপছিপে লম্বা। তোমাকে বেশ মানিয়েছে।” বলে ভোম্বল হাঁফ ছাড়ল। মনীষা তবু মেঝের দিকে তাকিয়ে। মুখটা থমথমে হয়ে আছে।

”তোমাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে আজ।”

মনীষা মুখ তুলে একবার তাকাল। একটু হাসি ঠোঁটে লাগিয়ে বলল, ”আপনি মিথ্যে কথা বলছেন।”

”মোটেই না, যা সত্যি তাই বলছি।” সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ভোম্বল জানলায় গেল।

”চিপ মেয়েরা আবার সুন্দর হয় নাকি।”

ভোম্বলের আর ছাই ঝাড়া হল না। পাংশু মুখে ফিরে তাকাল সে।

”তুমি রাগ করেছ?”

”না না, রাগ করব কেন, আপনি তো ঠিকই বলেছেন। সবাই তো আমায় তাই ভাবে।” মনীষা শান্ত গলায় বলল বটে, কিন্তু অভিমান চাপতে পারল না।

”সবাই কী ভাবে, তা দিয়ে কিছু এসে যায় না।” ভোম্বল খাটের উপর বসল। ”আসলে পাত্তা না দিলেই হল। সত্যিই তোমাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ফুলটা চেয়ে নিই।”

”সুন্দর বলে তো ঠাট্টা করলেন। তার উপর ফুল চেয়ে আর নুনের ছিটে দিতে হবে না।”

”সত্যি সত্যিই চাইছি।” ভোম্বল সিগারেট ধরা হাতই বাড়াল।

”নিয়ে কী করবেন?”

চট করে উত্তর দিতে পারল না ভোম্বল। দারুণ একটা কিছু বলার জন্য সে ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল। এমন একটা কিছু বলতে হবে যাতে এইসব ধানাই-পানাই শেষ হয়ে আসল ব্যাপারে আসা যায়। অর্থাৎ, ভোম্বল ভাবল, মানু যেন ঠাট্টা না করে এবার সিরিয়াস কথা বলতে শুরু করে।

গোলাপটা খোঁপা থেকে হাতে নিয়ে মনীষা গন্ধ শুঁকছে। মুখে চাপা হাসি। ঠোঁটে হালকা বেগুনি রঙ, আঁচলটি পিঠের দিকে সরে যাওয়ায় ডান বাহুটি অনাবৃত, বাঁ পায়ের উপর ডান পা-টি রেখে ধীরে ধীরে নাচাচ্ছে।

”আজ একজন ঠিক আপনার মতোই চাইল ফুলটা।”

ভোম্বলের মনে হল ভূমিকম্প ঘটছে, দাঙ্গা হচ্ছে, আগুন লেগেছে, বন্যা হচ্ছে। নিশ্বাস ত্যাগের প্রথম ফুরসত পেয়েই সে বলল, ”কে?”

”নাম বললে আপনি চিনবেন না।”

”কেন চাইল?”

”তা কী করে বলব!”

”কে হয় তোমার? কোনো বন্ধু?”

”কে আবার, কেউ না।”

”তাহলে চাইল কেন?”

”আপনিই বা চাইছেন কেন, আপনি কি কেউ হন? তাছাড়া কেউ না হলে বুঝি চাইতে পারে না!”

”নিশ্চয় পারে যদি চাইবার মতো ঘনিষ্ঠতা থাকে।”

মনীষা এবার থেমে উত্তর খোঁজার জন্য খুবই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। তাই গোলাপটি হাত থেকে পড়ে গেল খাটের উপর। আর সঙ্গে সঙ্গে ভোম্বল সেটি তুলে নিল। মনীষা চমকে বলল, ”একি!”

ঘরের আলো নিভে গেছে।

”বোধহয় মেন ফিউজ হয়ে গেছে।” ভোম্বল উঠে দরজার দিকে যেতে গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর এবং আবেগপূর্ণ স্বরে বলল, ”মনীষা, অন্ধকারে ভয় পেয়ো না।”

”না।”

ভোম্বলের বুক চিতিয়ে উঠল তাই শুনে। একটা চাপা কলরব শুনতে পেল সে। সারা পাড়া যেন হঠাৎ একবার হইহই করে উঠল। জানলায় এসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, ”সেরেছে। আজও আবার হল। শুধু আমাদের বাড়িতেই নয়, গোটা পাড়াটাই। দেখবে এসে, কী অদ্ভুত দেখাচ্ছে রাস্তাটা, বাড়িগুলো এই অন্ধকারে।”

মনীষা উঠে এসে ভোম্বলের পাশে দাঁড়াল। সেন্টের গন্ধ পেল ভোম্বল। মিষ্টি একটা আবেশ তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করল। ফিসফিস করে বলল, ‘আমি এই তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, সত্যিই খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায়।”

বৈঠকখানার তক্তপোশে চারটি ভব্যযুক্ত হয়ে বসে। অনন্ত ঝিয়ের হাত থেকে চায়ের ট্রে তুলে নিয়ে ওদের সামনে রাখল।

”প্রায়ই তা আসে। গাড়িটা বরাবর আমার বাড়ির সামনেই রাখে। একদিন পুতুল দোতলার ঘরে গাইছে, গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়েই শুনে পিসিকে গিয়ে বলে, একটি মেয়ের গলা শুনলুম, ভারি মিষ্টি তো! জিগ্যেস করো তো যদি সিনেমার গান গাইতে রাজি থাকে, তাহলে এখনি কনট্রাক্ট করব। পুতুলের মা’র কাছ থেকে শুনে আমি বললুম, দরকার নেই বাপু। আগে বিয়ে হোক, তারপর শ্বশুরবাড়ি যদি চায় তখন নয় সিনেমা-জলসায় গাইবে। আমি আবার একটু সেকেলে ধরনের মানুষ। অনেকে তো তাই বলে, অনন্ত সিংগী মরে গেলেও বনেদিপনা ছাড়বে না কিছুতেই।”

খাবারের প্লেট হাতে ঝি ঢুকতেই অনন্ত কথা বন্ধ করে প্লেটগুলি ওদের সামনে সাজিয়ে রাখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তখন যুবক চতুষ্টয় নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে-

”গলির মধ্যে তাই হেরাল্ডটা এনেছে। নয়তো ছ’টা হেডলাইট-ওয়ালা সেই ফোর্ডটাতেই চড়ে।”

”জিতু বলছিল, ওটার কারবুরেটারটা গোলমাল করছিল বলে ওদের গ্যারেজে একবার পাঠিয়েছিল।”

”জিতুর কথা তো! চেপে যা বাবা। কোনোদিন হয়তো শুনবি বোম্বাই থেকে রাজকাপুর গাড়ি এনেছিল অ্যাক্সেল বদলাতে।”

যে যুবকটি কথা বলেনি অর্থাৎ পুতুলের হবু স্বামীকে অনন্ত বলল, ”নাও বাবাজি, আগে একটু মিষ্টিমুখ হয়ে যাক।”

এই সময় সদরে কড়া নাড়ার শব্দ হল। অনন্ত বৈঠকখানা থেকেই হাঁক দিল,”কে?”

”আমি অসীম।”

শুনেই উদ্বিগ্ন হয়ে অনন্ত বেরিয়ে এল।

”কী ব্যাপার?”

আংটিটা বার করে অসীম বলল, ”পাঁচশো টাকা দিতে পারেন এক্ষুনি।”

”এখন তো পারব না, সিন্দুক আজকের মতো বন্ধ করে ফেলেছি। কাল সকালে বরং এসো।”

এরপর অনন্ত আংটিটা হাতে নিয়ে আলতোভাবে দুবার লুফে বলল, ”তিনশো টাকার বেশি তো হয় না।”

”আমার এখুনি পাঁচশো টাকা দরকার।”

”কাল সকালের আগে দিতে পারব না। এখন আমি খুবই ব্যস্ত রয়েছি, কাল বরং এসো চারশো পর্যন্ত দিতে পারব।”

অনন্তের পা দুটো জড়িয়ে ধরবে কিনা অসীম ভাবল। লোকটা হয়তো এতক্ষণে আবার চিৎকার শুরু করেছে। ঘরের কোণে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে প্রভাত মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসবার চেষ্টা করছে। এবাড়ি-ওবাড়ি উঁকিঝুকি দিচ্ছে।

অসীম হাত বাড়িয়ে নিচু হতে যাচ্ছে, অনন্ত এক পা পিছিয়ে গেল।

”একি, এসব কেন! বলছি তো কাল এসো। আজ কিছুতেই পারব না। লোক বসে রয়েছে, তুমি এখন এসো, আমি খুব ব্যস্ত।”

বলতে বলতে অনন্ত পিছিয়ে যেতে লাগল। এই সময় ছাদের ঠাকুরঘরে ঝনঝন শব্দ উঠল বাসন পড়ার। দোতলার বারান্দায় উবু হয়ে যারা বৈঠকখানার জানলা দিয়ে পুতুলের হবু-বরকে দেখার চেষ্টা করছিল, তাদের কেউ ছুটে গেল তিনতলায়।

অসীম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখল অনন্ত বৈঠকখানায় ঢুকে গেল। রাগে অন্ধকার হয়ে এল তার দৃষ্টি। বাবা, মা, ভাইবোন, ঠাকুমা প্রত্যেককে অকথ্য গালাগাল দিতে দিতে নিজের ডান হাঁটুকে কিল মারতে শুরু করল। ”এইটে, এইটেই যত নষ্টের গোড়া।”

”এই এক ঝামেলা” বৈঠকখানায় ঢুকেই অনন্ত চারজনের প্লেটের উপর চোখ বোলাল, ”একি হাত যে চলছে না। অ্যাঁ, ইয়ংম্যান সব, এখনও এতগুলো পড়ে রইল যে।”

”এত দিয়েছেন, দশজনেও যে শেষ করতে পারবে না।”

”তার উপর আসার আগে রেস্টুরেন্টে একটা করে কাটলেট সাঁটিয়ে এসেছি।”

”অবিশ্যি আমাদের পল্টুকে আনলে কোনো ভাবনা ছিল না। মনে আছে রে, গত বছর দমদমের সেই পিকনিকে?”

ওরা সবাই মুচকি হাসল।

”কাউন্সিলার কুমার চৌধুরী আবার লোক পাঠিয়েছিল। এই এক ঝামেলা।” অনন্ত গুছিয়ে বসল, ”আমিই ওকে দাঁড় করিয়েছি। ছোটো থেকেই বলতে গেলে আমাদের বাড়িতেই মানুষ। বাবা তো একটা সাইকেল মিস্তিরি ছিল, সাইকেল ভাড়া দিত। আমরা শিখেছি ভুবনের সাইকেল ভাড়া নিয়ে। সেই ভুবনের ছেলে কুমার। কিছুতেই রাজি ছিল না ইলেকশানে নামতে। জেতার কোনো চান্স অবিশ্যি ওর ছিল না। পাড়ার লোকেরা ধরল এসে, অনন্তদা তুমি বেরোও একবার, কুমারও এসে ধরল। একদিন বেরোলুম ওর জন্য। আমার যত মামলা-মোকদ্দমা সব তো ওই করে, এক পয়সাও ফি নেয় না। ওকি, সন্দেশটা পড়ে রইল কেন! না, না, কিচ্ছু ফেলা চলবে না। এইমাত্র কুমার একটা ছেলেকে পাঠিয়েছিল, যদি আমার কাছ থেকে চিঠি আনতে পারে, তবেই ওকে কর্পোরেশনে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেবে। আমি না বললে হবে না। ছেলেটা তো পা জড়িয়ে ধরল। এ যে কী জ্বালা কী বলব। দিনরাত কড়া নড়েই চলেছে। কী? না, কুমারবাবু পাঠিয়ে দিল। এমন শত্রুতা করবে জানলে কী আর ওটাকে জেতাতুম।”

অনায়াসে কথাগুলো বলার সুখে ঝকমক করতে লাগল অনন্তের চোখ। লক্ষ করল, যুবক চতুষ্টয়ের বসার ভঙ্গিতে সমীহের ছাপ লেগেছে। ঝি ব্যস্ত হয়ে এসে বলল, ‘বাবু একবার ভেতরে আসুন, কাণ্ড হয়েছে এক।”

অনন্ত বেরিয়ে দেখে ওর স্ত্রী দাঁড়িয়ে, হাতে একটা সবুজ রবারের বল।

”এই দ্যাখো, কে ছুঁড়ে মেরেছে ঠাকুরঘরে সোজা গুপীনাথের গায়ে। গুপীনাথ উলটে পড়ে গেছেন। কী যে অমঙ্গল ঘটবে। আমার কেমন বুক কাঁপছে ভয়ে। কে এমন শত্রুতা করল গো।” ডুকরে কেঁদে উঠল অনন্ত গৃহিণী।

ভয়ে অনন্তের মুখ শুকিয়ে গেল। হঠাৎ এই সময় কে বল ছুঁড়ল? তাও সোজা গোপীনাথের গায়ে। নিশ্চয় কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে। ক্ষতি করতে চায়, নয়তো অত ভারী বিগ্রহ পড়ে যাবেই বা কেন! কাছে থেকেই ছুঁড়েছে। ঠাকুরঘরের দরজার সামনেই তো বাসুদেবের ছাদটা।

”হ্যাঁগা, কী হবে!”

”গুপীনাথ কি পড়েই আছেন?”

”হ্যাঁ, মেঝেয় একেবারে মুখ থুবড়ে।”

”থাকুন ওইভাবে, কেউ যেন ওঁকে টাচ না করে। আমি থানায় ডায়রি করে আসছি। মন যেন কেমন কু-গাইছে। দেখি, বলটা দাওতো।”

বলটা ফুটো। টিপতেই হাওয়া বেরিয়ে চুপসে গেল। হঠাৎ অনন্তর মনে হল, এটা যেন চেনা। আজই সকালে তার বাড়ির সামনে বাসুদেবের ছেলেটা একটা সবুজ বল টিপে টিপে চোপসাচ্ছিল।

”হারামজাদা।” দাঁতে দাঁত ঘষে অনন্ত তিরবেগে সদর দরজার দিকে ছুটে গেল। লাফ দিয়ে রাস্তায় পড়ল। ভারী শরীরটা টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে সামনের বাড়ির দেয়ালে ধাক্কা খেল। ঘুরে সোজা হয়েই দেখল বাসুদেব তাঁতিগলির মুখে দাঁড়িয়ে ছোটোছেলেকে বলছে-”যা দিদিকে ডেকে নিয়ে আয়, আর বাড়ির বাইরে থাকতে হবে না। বল বাবা ডাকছে, এখুনি না এলে জুতিয়ে পিঠের চামড়া তুলে নেবে।”

”শালা তোরই চামড়া তুলব।” চিৎকার করে অনন্ত এগিয়ে গেল বাসুদেবের দিকে।

বাসুদেবের কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল অনন্তের কথাগুলো কার উদ্দেশ্যে, বুঝতে। বোঝার পর আর সময় পেল না।

”এটা কীরকম ছোটোলোকমি হল অ্যাঁঃ? আমি থানা-পুলিশ করব।” অনন্ত রবাবের বলটা তুলে ধরল। সেটা দেখে বাসু মিইয়ে গেল।

”কেন, থানা-পুলিশ কীজন্য?”

”ন্যাকা, জানো না? এ বল আমার ঠাকুরঘরে ছুঁড়ে গুপীনাথকে ইনজিওরড করা হয়েছে, আর এ বল তোরই ছেলের।”

”কে বলেছে ওটা আমার ছেলের বল?” বাসু তেরিয়া হবার চেষ্টা করল।

”বলটা তবে কার?”

”কার তা আমি কী করে বলব! উইদাউট এনি প্রুফ বললেই হল? ওরকম বল হাজার হাজার, থাউজেন্ড অ্যান্ড থাউজেন্ড ছেলের কাছে পাওয়া যাবে।”

”তোর ছেলের হাতে আজ সকালেই আমি দেখেছি। এই দ্যাখ, এইভাবে”-বলটা বাসুর মুখের সামনে ধরে অনন্ত টিপল। ”তোর ছেলে, এইতো এই ছেলেটাই, টিপছিল।”

বাসুর ছেলে তখন তার দিদি প্রমীলাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোচ্ছে তাঁতিগলি থেকে। ভ্যাবাচাকা খেয়ে কেঁদে উঠল ভয়ে।

”হোয়াট ইজ দিস!” বলের হাওয়া মুখে লাগতেই বাসু আঁতকে পিছিয়ে গেছল। ”অ্যাঁ নোংরা বলের হাওয়া মুখের উপর? আমার ছেলেকে থ্রেট করে কাঁদানো? আই উইল কল পুলিশ। আমিও থানায় যাব। তেল বার করে ছাড়ব।”

বাসুদেব চিৎকার শুরু করল লোক জড়ো করার জন্য। বারান্দা এবং জানলা ভরে গেল। বাড়ি থেকে অনেকে বেরিয়ে এল। পথচলতিরা কৌতূহলে দাঁড়াল।

”কী হয়েছে বাসুবাবু?” একজন জিজ্ঞাসা করল।

”এই দ্যাখো না ভাই”, বাসু খুশি হল প্রশ্নটা হওয়ায়। ”অনন্তর ঠাকুরঘরে কে ওই বলটা ছুঁড়েছে, আর এসে গালাগাল দিয়ে বলছে, বলটা আমার ছেলের অর্থাৎ ওই ছুঁড়েছে।” ”আমি জানতে চাই” বাসু বাঁ তালুতে ডান হাতের চাপড় মারল। ”আই ডিমান্ড, আমার ছেলেকে কেন, কীসের ভিত্তিতে দায়ী করা হল? প্রুফ নেই, উইটনেস নেই। আর তম্বি করা হচ্ছে থানা-পুলিশ করবে! করুক না, দেখি কত তেল হয়েছে।”

অনন্ত থিতিয়ে যাচ্ছিল। বাসুর শেষ কথাটায় ভেসে উঠল। ”হয়েছেই তো। একশো বার তেল হয়েছে। তুই তোর নিজের চরকায় তেল দে না। জানেন মশাই, ব্যাটা কী বলেছে মুদিকে! আমার ঠাকুর্দা নাকি নোট জাল করত, ডাক্তারবাবুকে বলেছে, আমার বাবার নাকি খারাপ রোগ ছিল।”

”কোন শালা আমার বাপ-ঠাকুর্দা তুলে কথা বলেছে।”

হঠাৎ ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল দুলাল। নাকে কাপড় দিয়ে কাছের লোকেরা একটু সরে গেল।

”আমি বলেছি”, বাসু সমান তেজে চিৎকার করল, ”গরম, পয়সার গরম দেখাবে অনন্ত সিংগী? গাড়িতে পা তুলে একদিন আমার বাপ-ঠাকুদা ও দাঁড়াত রে, তখন তোর বাপ-ঠাকুর্দা এসে আমাদের বৈঠকখানায় জুতো খুলে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকত, বসতে বললে তবেই বসতে পারত। পয়সা আজ আছে কাল নেই, কিন্তু বংশের শিক্ষা-দীক্ষা চিরকাল রক্তে থেকে যায় রে থেকেই যায়।”

”ব্যাটার মাসের মধ্যে দশ দিন তো উনুন ধরে না।” অনন্ত ভাইকে পেয়ে প্রচণ্ড বলশালী বোধ করছে। নিশ্চিন্তে এবার সে বলটা বাসুর নাকের কাছে আবার টিপল।

”আমার উনুন ধরে কি না ধরে তোর বাপের কী?”

”চপরাও শালা, বাপ তুলবি না।” দুলাল টলে পড়ে যাচ্ছিল, অনন্তই ধরে ফেলল। রক্তারক্তি করে দোব। অনন্ত সিংগীকে যা খুশি বল শালা, বাপ-ঠাকুর্দা নিয়ে টানাটানি করলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দোব।”

”ব্যাটা, ছেলেমেয়েদের খেতে দিতে পারিস না। বড়োমেয়েটা তো সেজন্যই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।” অনন্ত বলটা কচলাতে লাগল মুঠোয়।

”থাক গে অনন্তবাবু, ওসব পারিবারিক কেলেঙ্কারি আর রাস্তার মাঝে বলার দরকার কী।” একজন শ্রোতা অনুরোধ জানাল অনন্তকে উসকে দেবার জন্য।

”বাসুদা বাড়ি যাও, বাড়ি যাও। আর চেঁচাতে হবে না। তোমার আবার ব্লাডপ্রেশার আছে।” এক শুভানুধ্যায়ী বাসুর হাত ধরে টানল।

বিমূঢ় বাসুদেব ফ্যালফ্যাল করে সকলের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। অনন্ত গোলাকার ভিড় থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ির সদরের দিকে এগোল। গোলমাল শুনে তার বাড়ির সবাই এসে সদরে দাঁড়িয়েছে। ঝি এসে ফিসফিস করে অসমাপ্ত পারিবারিক কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। পাত্রী দেখতে আসা চার-যুবকও সদরে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে। অনন্তর মনে হল, তার প্রতাপের সম্যক পরিচয় পেয়ে নিশ্চয় ওরা পুতুলকে পছন্দ করার সময় খানিকটা কন্সিডার করবে।

হঠাৎ পাগলের মতো ছুটে গিয়ে বাসুদেব হাত ধরল অনন্তের।

”বলব? সেই কথাটা বলব? কেন তুই কুমার চৌধুরীকে দেখলে ভয় পাস, কেন তুই কুমারের কথায় ওঠ-বোস করিস-এবার বলে দিই পাড়ার লোককে? ভেবেছিস ভুলে গেছি, অ্যাঁ, পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা বলে, ভেবেছিল ভুলে গেছি, অ্যাঁ-আমার মেয়ে পালিয়েছে, অ্যাঁ।”

অনন্ত দেখল সারা জয়রাম মিত্র লেন আবার কৌতূহলে তাকিয়ে। এমনকি চার যুবকও। হঠাৎ তার চোখে সবকিছু অন্ধকার হয়ে এল। মাথার মধ্যে শুধু সোঁ সোঁ শব্দ। তার মনে হল বন্যা ছুটে আসছে-এবার সে ভেসে যাবে। আশ্রয়ের জন্য সে এধার-ওধার তাকাতেই দেখল টিউবওয়েলের পাশে একটা আধলা ইঁট পড়ে।

”এবার বলি ব্যাটা রাঙ্গামুলো? বলি, ভুবন চৌধুরী তোকে ওই কুমারের সামনেই দোকানের মধ্যে-”

এই সময়ই অনন্তের ছোঁড়া ইটটা ওর মুখে এসে পড়ল। আর তখনি দপ করে সারা জয়রাম মিত্র লেনের বাড়ির আলোগুলো নিভে গেল।

”আবার!” একজন বলল।

”দ্যাখো, আজ কতক্ষণ অন্ধকার থাকে।” আর একজন বলল।

”চল চল, দরজা খোলা রয়েছে, চুরি-টুরি না হয়।”

ভিড়টা খসে পড়তে লাগল অন্ধকারে।

.

”অ বউ, কোথায় চললি। খোকা ফিরল? অ বউ সাড়া না দিয়ে যাচ্ছিস কোথা?

”যমের বাড়ি।” দাঁতে দাঁত চেপে পারুল বলল।

”অ বউ, কাল খোকাকে বাজার যাবার সময় মনে করিয়ে দিস।”

পারুল ততক্ষণে বেড়ালের মতো হালকা পায়ে নিঃশব্দে উপরে উঠে গেছে। শোবার ঘরের দরজা খোলা, অশোক চোখ বুজে চিত হয়ে শোওয়া, বাচ্চচাটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

পারুল সামান্য ইতস্তত করে, ঘরে ঢুকে মৃদুস্বরে বলল, ”মাথাধরার ওষুধটা আছে।”

অশোক চমকে উঠল। এতক্ষণ ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে সুকুমার আর ঝুমিকে নিয়ে কতকগুলো দৃশ্য তার মনের মধ্যে আসা-যাওয়া করছিল। এইমাত্র তার দেখতে ইচ্ছে করছে ঝুমিকে। মেডিকেল কলেজে না গিয়ে বাড়ি ফিরে আসাটাকে সে অন্যায় বলে মনে করতে শুরু করেছে। এখনই ঝুমির দরকার একজন পুরুষ মানুষের। অথচ কেন যে সে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি চলে এল, পথে চিনেবাদামও কিনেছিল, তার কারণ বুঝে উঠতে পারছে না অশোক। হয়তো ঝুমিকে হাউ হাউ করে কাঁদতে দেখবে এবং সে দৃশ্য না দেখার ইচ্ছাতেই ফিরে এসেছে। কিংবা সুকুমারকে দেখলেই বরাবর যে এক ধরনের আড়ষ্টতা বোধ করত এবং তুলনায় নিজেকে নগণ্য বোধ করার সেই ভয়টা থেকেই হয়তো মেডিকেল কলেজে যায়নি। সুকুমারকে মাতাল অবস্থায় পেয়েছিল বলেই না ওর সঙ্গে তামাশা করতে পেরেছিল। নয়তো বিদ্যা-বুদ্ধি-রূপে-ব্যক্তিত্বে মদ-না-খাওয়া সুকুমার অন্য ব্যাপার।

অশোক নিজেকে অল্পবিস্তর কাপুরুষও মনে করল। একটা মাতালকে যে-কেউই পরিহাস করতে পারে। তার বোধশূন্যতার সুযোগ ভাঙিয়ে ব্যঙ্গ করার মধ্যে সাহস নেই। দুঃসংবাদ পাওয়া ঝুমির, যে একদিন একটা চুমু দেবে বলেও দেয়নি, সামনে যেতে পারেনি এই সাহসের অভাবের জন্যই। জীবনে কোনো উন্নতিই করতে পারেনি সে সাহসহীনতার জন্য।

ভাবতে ভাবতে অশোক তেতে উঠতে শুরু করে, সাহসী একটা কিছু করার জন্য। এমন একটা কিছু যাতে তার মনে হয়, ঝুমিকে সে অনায়াসেই পেতে পারত, নেহাতই সুকুমারের প্রতি অনুগ্রহবশত-

”ছিঁড়ে পড়ছে মাথাটা।”

পারুল দু’হাতে কপাল চেপে যন্ত্রণাসূচক একটা শব্দ করল অস্ফুটে। অশোক উঠে বসল।

”ওষুধ তো ফুরিয়ে গেছে।”

অশোকের মনে হল, একথা শুনে ঝুমির শরীরওলা বউটি মোটেই হতাশ হল না।

”তাহলে কী করি?”

”আসুন, বরং মাথাটা টিপে দি।”

”থাক থাক। বউ নেই কিনা তাই খুব সাহস দেখাচ্ছেন।”

‘সাহস’ কথাটা শুনেই অশোকের চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল, আপনা থেকেই দুই চোয়াল শক্ত হয়ে পড়ল। এই অশিক্ষিত বউটির ঠাট্টা তার ভালো লাগেনি। কেমন যেন চ্যালেঞ্জ রয়েছে ওর গলার স্বরে।

”বউয়ের সামনে অনেক সাহস না দেখানোই তো সাহসের কাজ।”

”খুব বীরপুরুষ আপনি।” পারুল মাথা হেলিয়ে চোখ দুটো আধবোজা করে হাসল। ”শনিবার যা ধাক্কা দিয়েছিলেন মাথায়।”

”আমি! মাথায় ধাক্কা!” অশোক খুব অবাক হবার চেষ্টা করল।

”শুধু ধাক্কা!” পারুল পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়াল। ”ঘাড়ে এই দাঁতের দাগ কীসের?”

”কই দেখি”। অশোক এগিয়ে গেল। পারুলের পিঠ-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওর মাথার নারকোল তেলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে আলতো করে কাঁধে আঙুল ছোঁয়াল। ”এইখানে?”

”শুধু ওখানে?” পারুল হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, ”ব্লাউজের একটা বোতামও তো আস্ত রাখেননি। ইলা যদি তখন এসে পড়ত!”

”এখন তো আর ইলা নেই।”

”এখন তো আপনি মদও খেয়ে নেই। সাহস হবে কী করে।”

অশোকের আঙুলগুলো কুঁকড়ে চেপে বসল পারুলের কাঁধে। হঠাৎ হ্যাঁচকা টানে সে পারুলকে গায়ের উপর এনে ফেলল।

”মদ না খেয়ে সাহস হয় কিনা দেখবে?”

পারুল ঘাড় ফিরিয়ে অশোকের চোখে চোখ রাখল। ধীরে ধীরে ঠোঁটের কোল মুচড়ে হাসল এবং দেহটিকে আলতো করে চেপে ধরল অশোকের সঙ্গে।

”ঝুমি হলে নিশ্চয় আপনার সাহস হত।”

শোনামাত্র অশোকের শরীরের ভিতরে এবং বাইরে শক্ত হয়ে উঠল। একটু পিছিয়ে গিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, ”ঝুমিকে জানলে কী করে।”

”জেনেছি।” পারুল ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে তেরছা চোখে তাকাল। ”ভয় নেই, ইলা জানে না।”

”জানুক, আমি কেয়ার করি না।”

”ঝুমিটা কে?” পারুল বলল।

”একটা মেয়ে। এখন দুটো ছেলের মা। কয়েক ঘণ্টা আগে বিধবা হয়েছে।”

”প্রেম ছিল?”

”হ্যাঁ।”

”বিয়ে হল না কেন?”

”আমি ভীতু, তাই সাহস নেই। নিজের উপর ভরসা নেই, তাই তোমাকে-”

হাত বাড়িয়ে অশোক বুকের উপর পারুলকে টেনে এনে চেপে ধরল। প্রচণ্ডভাবে চুমু খেল এবং ছেড়ে দিল। স্থির দৃষ্টিতে পারুল তাকিয়ে রয়েছে।

”দেখলে তো। ঘরে আলো জ্বলছে, দরজাও খোলা, সাহস আছে কি না দেখলে?” অশোক হাঁফাচ্ছে। চোখের জ্বালা বাড়ছে। ধীরে ধীরে দৃষ্টি থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে বউটির মুখ। সেখানে ঝুমির মুখ সে বসাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু বসছে না।

”আপনি মদ খেয়ে আসুন।”

”কেন।” অশোকের মনে হল তার গালে এই অশিক্ষিত বউটি ঠাস করে চড় মারল।

”আপনি সত্যিই ভীতু।”

শোনামাত্র অশোকের চোখ থেকে মুছে গেল ঘরের আলো এবং পারুল। ঠিক এই গলাতেই ঝুমি বলেছিল। আট-ন বছর আগে। একই কথা। সেদিন লজ্জা পেয়েছিল, আজ রাগে দিশেহারা হয়ে পড়ল। হাত বাড়িয়ে সে পারুলের গলাটা দু মুঠোর মধ্যে ধরল।

”আহ।” অস্ফুটে পারুল চাপা চিৎকার করল। আর তখনই দপ করে নিভে গেল ঘরের আলোটা।

”কী হল।” পারুল ছিটকে সরে গেল দরজার দিকে।

”হয়তো আবার সেদিনের মতো নিভল।”

পারুল জানালায় গিয়ে উঁকি দিল। সারা পাড়া অন্ধকার। রাস্তায় কোথায় চিৎকার করে কে চেঁচাচ্ছে। নিচে থেকে বুড়ির গলা ভেসে এল, ”অ বউ, কোথায় আছিস, খোকা ফিরল?”

তখন অশোক টেনে আনল পারুলকে খাটের উপর।

.টিপু ঘুমিয়ে পড়েছে। আভা ওর পাশে কাত হয়ে শুয়ে। টিপুর গায়ে ডান হাতটা আলতো করে রাখা। হিরণ্ময় কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গলায় শব্দ করল। আভা ব্যস্ত হয়ে গায়ের কাপড় ঠিক করতে করতে উঠে দাঁড়াল।

”কী ভাবছ?” দরজার কাছ থেকেই হিরণ্ময় প্রশ্ন করল।

”কিচ্ছু না।” মুখ নামিয়ে আভা উত্তর দিল।

”হ্যাঁ ভাবছিলে। বলব? তোমার দিদির কথা। জানাজানি হলে আমার মানমর্যাদা ধুলোয় লুটোবে, সেই কথা। আর নিজের কথাও ভাবছিলে।”

”আমার কথা?” আভা মুখ তুলল। ”ওসব আমি ভাবিনি।”

”মিথ্যে কথা, মানুষ মাত্রেই নিজের কথা ভাবে। আমিও ভাবি। ভাবাটা অন্যায় নয়, স্বার্থপরতাও নয়। আমি চাই তুমি নিজের কথা ভাব।”

”কী ভাবব?”

”তোমার ইচ্ছা, যা তোমার নিজস্ব, সেগুলো যাতে পূর্ণ হতে পারে। মায়া-মমতার মতো বাজে জিনিসগুলো যাতে তোমায় চেপে কুঁকড়ে ছোটো করে না দেয় সেজন্য পথ খুঁজে বার করার উপায় ভাববে। সে পথ ট্রেনে কাটা পড়া বা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়া নয়।”

”কিন্তু আর কী পথ আছে?” আভা অসহায় স্বরে বলল। ”আপনি যদি অবিবাহিত হতেন, যদি আমার ভগ্নিপতি না হতেন তাহলে-”

”তাহলে কী?” হিরণ্ময়ের চোখও তীক্ষ্ন হল, কথার মতো।

”তাহলে কোনো সমস্যাই উঠত না।”

”তার মানে বিয়ে?”

আভা মাথা নামিয়ে চুপ করে রইল। হিরণ্ময় বিরক্ত স্বরে বলল, ”এ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারো না? বিয়ে করলেই কি মোক্ষলাভ হবে, বিয়ে করলেই কি ভালোবাসা প্রেম সার্থক হয়ে উঠবে?”

”হ্যাঁ।” হঠাৎ উদ্ধত ভঙ্গিতে অধৈর্য স্বরে আভা বলে উঠল। এতক্ষণ ধরে হিরণ্ময়ের ক্রমান্বয় প্রশ্নে সে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়তে পড়তে ক্ষেপে উঠছিল। কথাগুলোর মধ্যে নিছকই কথা ছাড়া, আসল এবং আসন্ন বিপদ থেকে রেহাই পাবার কোনো উপায় সে খুঁজে পাচ্ছিল না।

”তাহলে আমায় ভালোবাসলে কেন?” হিরণ্ময়ের স্বরে এতক্ষণে রাগ ফুটে উঠল। ”তাহলে আমায় বাধা দিলে না কেন? তোমার এই অবস্থা করার সুযোগ দিলে কেন? তুমি কি জানতে না, বিয়ে করার উপায় আমার নেই? বলো, জবাব দাও আমার কথার?”

আভা কথা না বলে হিরণ্ময়ের পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে বেরোবার জন্য এগোতেই, হাত তুলে দরজা আটকে দাঁড়াল হিরণ্ময়। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, আভার গায়ের জোর তার থেকেও বেশি। ইচ্ছে করলে তাকে ঠেলে সরিয়ে, বেরিয়ে যেতে পারে।

কিন্তু আভা তা করল না। তাতে হিরণ্ময় মনে করল, এটা ওর বিনয়। উত্তেজিত স্বরে আবার প্রশ্ন করল, ”জানতে না, তুমি অন্যায় কাজ করছ। জানতে না, তুমি পাপ করছ?”

”না। আমি জানতাম না, সত্যি বলছি বুঝতে পারিনি তখন আমি কী করছি। কিন্তু আমি ভালোবাসি আপনাকে, এখনও ভালোবাসি। আপনি আমায় ছেড়ে দিন। আমি পারব না আপনার মতো নিষ্ঠুর হতে। আপনি যা চাইছেন তা হয় না।”

আভা কান্নার দমকে কাঁপতে শুরু করল। হিরণ্ময় দরজা থেকে হাতটা নামাল। আভা দুহাতে চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে বলে উঠল।

”সারাক্ষণ আমি ভেবেছি আর বারবার মনে হয়েছে, কী অপরাধ আমি করেছি! কার কাছে আমি অপরাধী?”

”তোমার দিদির কাছে।”

”হ্যাঁ, তাই। জানেন, একদিন স্বপ্ন দেখেছি দিদি মারা গেছে ট্রেনে কাটা পড়ে। আমার কতদূর যে অধঃপতন হয়েছে। আমি ওর মৃত্যু নিশ্চয় চুপিচুপি কখনো কামনা করেছিলাম। ভাবতে পারেন, আমি খুনি হতে চেয়েছিলাম!”

”আমিও চেয়েছি। স্বপ্নে নয়, জেগেই আমি চাই। তোমায় বিয়ে করতে পারব বলে নয়, শুধুই রেহাই চাই। কীসের রেহাই, কেন রেহাই, অত বোঝাতে পারব না এখন। তবে, হাত-পা ছড়িয়ে আমি একা ঘুমোতে চাই ওই বিছানাটায়। আর কিছু নয়, আর কিছু নয়।”

মুখ থেকে হাত নামিয়ে ফেলেছে আভা। ক্লান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। শুকনো স্বরে বলল, ”আপনি চাইতে পারেন কিন্তু আমি পারব না। আমি জানি, আমি পাপ করেছি, তার জন্য শাস্তিই আমার প্রাপ্য।”

”শাস্তি তাহলে আমারও প্রাপ্য। কিন্তু নিজেকে তিল তিল খুন করে অপরকে সুখী করতে হবে, এমন কোনো শর্ত পূরণ করার কথা আমাদের আছে কি?” হিরণ্ময়ের স্বর তীব্র। চোখ দুটি জ্বলজ্বলে। সে উত্তেজনায় কাঁপছে।

”অনেক কিছুই তো নেই আমাদের।” আভা কথাগুলোকে টেনে টেনে বলল। ”সবই কি আমরা চাইলেই পেতে পারি?”

”যা পাওয়া সম্ভব, তা কেন চাইব না?”

”আপনি দিদিকে খুন করতে পারেন?”

উত্তর দিতে গিয়ে থমকে গেল হিরণ্ময়। আভা লক্ষ করে হাসল। হিরণ্ময় ক্ষিপ্ত, মরিয়া স্বরে বলল, ”পারব। আভা, তোমার জন্য আমি পারব। তুমি যদি-”

আভার চিৎকারে চমকে উঠে চুপ করে গেল হিরণ্ময়। ”চুপ করুন। আমি আর সহ্য করতে পারছি না, আপনার এইসব কথা। জেনে রাখুন, আমি আর আপনাকে ভালোবাসি না। হ্যাঁ, তাই। আপনাকে কেউ ভালোবাসতে পারে না, পারে না, পারে না। আমি ভুল করেছি, ভীষণ ভুল করেছি। আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে।”

বলতে বলতে আভা ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে যখন, তখনই দপ করে নিভে গেল সব আলো। রান্নাঘর থেকে ঠাকুর চেঁচিয়ে উঠল, ”আবার আজও!”

হিরণ্ময় একইভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে হচ্ছে, অন্ধকার আবার তাকে ঘিরে ধরবে। আবার তার ইচ্ছা হবে রাস্তায় পুলিশ গুলি চালাচ্ছে খবর পেলে বেরিয়ে পড়তে। আবার সহজ অঙ্কটা কষে কষে যেতে হবে। আবার মরে যাওয়া!

মনে মনে বলল, আমি ব্যর্থ, ব্যর্থ, ব্যর্থ।

.

”ওই ঘরটা।” শেফালি বলল।

শোভা আর ইলা তাকাল। ঝুপসি অন্ধকার, ভাঙাচোরা দেয়াল, ভ্যাপসা গন্ধ, আর ছেঁড়া কাগজে ভরে আছে একতলাটা। তিনটির মধ্যে দুটি ঘর ভাড়া দেওয়া রাস্তায়-কুড়োনো ছেঁড়া নোংরা কাগজের এক কারবারিকে। শুধু সিঁড়ির পাশের ঘরটিতে বাস করে এক ফেরিওলা পরিবার। ওরা দেখতে পেল ঘরের মধ্যে একটি বছর তিনেকের শিশু মেঝেয় উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। একটি বছর পনেরো-ষোলোর মেয়ে কলাইয়ের থালায় কিছু একটা মাখছে আর তার সামনে দুটি ছেলে, আট থেকে বারোর মধ্যে বয়স, একদৃষ্টে থালার দিকে তাকিয়ে। ঘরের আলো অনুজ্জ্বল, পাণ্ডুর। কোনো আসবাব ওদের চোখে পড়ল না। দেয়ালের তাকে কয়েকটা মাটির হাঁড়ি আর পুরনো কৌটো।

শোভা ফিসফিস করে বলল, ”ওদের মা নেই?”

”কী জানি।” শেফালি বোধহয় এই প্রথম পাড়ার একটি পরিবার সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করল।

”জানলাটা কোথায়?” শোভা আবার বলল।

”ডানদিকে। ঘরে ওই একটাই জানলা।”

বোধহয় ওদের কথার শব্দ পেয়েই, ঘরের তিনজন তাকাল। মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। শীর্ণ দেহে ফ্রকটি ঢোলা দেখাচ্ছে। মেয়েটির চোখ দু’টি বড়ো, গায়ের রঙ ফ্যাকাশে।

ওরা তিনজন ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। এইবার পুরো ঘরটা দেখতে পাচ্ছে। ডানদিকে জানলাটা বন্ধ। তার নিচেই ছেঁড়া চিটচিটে তোশকের উপর একটি স্ত্রীলোক শুয়ে, চোখ আধবোজা, মণি দুটি কোণে সরে গিয়ে সাদা অংশটিকে বাড়িয়ে দিয়েছে, হাত দুটি পাশে এলানো। স্ত্রীলোকটির মুখ খোলা। হলদে দাঁত দেখা যাচ্ছে। দেহের কাঠামো দেখলে মনে হয় বহুকালের বিসর্জিত প্রতিমা জল থেকে তুলে এনে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বসন বিস্রস্ত। হাঁটু পর্যন্ত কাপড় উঠে-থাকা পা দুটি যেন প্লাস্টিকের দু-গাছা লাঠি পেতে রাখা। ব্লাউজের বোতাম উন্মুক্ত। জিরজিরে বুকের উপর দুটি চর্মসার স্তন। পায়ের আঙুলে হাজা। স্ত্রীলোকটির নিশ্বাস পড়ছে কিনা বোঝা গেল না।

শেফালির মনে হল, মরে গেছে। শোভারও তাই মনে হল, ইলারও। ওরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ঘরের ডানদিকের কোণে একটি সাত-আট মাসের বাচ্চচা মেঝে থেকে খুঁটে খুঁটে মুড়ি খাচ্ছে একমনে। তিনজনকে দেখে সে ভয় পেল। হামা দিয়ে স্ত্রীলোকটির কাছে সরে গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে থাকল।

”কী চাই আপনাদের?” বড়োমেয়েটি জানতে চাইল। ওর কণ্ঠ কর্কশ। বলার ভঙ্গি শীতল নিস্পৃহ।

”কী হয়েছে তোমার মায়ের?” শেফালি আন্দাজেই ধরে নিল স্ত্রীলোকটি এদের মা।

”অসুখ।”

”কী অসুখ, কতদিন ধরে?” শেফালিই বলে গেল।

”অনেকদিন হাসপাতালে ছিল, ছেড়ে দিয়েছে।”

”সেরে গেছে?”

”না। বাঁচবে না বলে ছেড়ে দিয়েছে।”

ওরা তিনজন আবার তাকাল স্ত্রীলোকটির দিকে। একসঙ্গে তিনজনের মনে হল মরে গেছে। একসঙ্গে তিনজন ভাবল, তাহলে জানলাটা খুলতে বলা উচিত হবে কি! বিছানাটা না সরালে জানলা দিয়ে দেখা যাবে না।

”জানলাটা বন্ধ কেন, খুলে দাও না।” শোভা বলল। কেন খুলতে হবে, তার কারণটা বলতে আটকাল তার।

”না। বাবা বারণ করেছে। এরা চিৎকার গোলমাল করে, পাশের বাড়ির লোকেরা খুব বিরক্ত হয়।”

”বাচ্চচা ছেলেপুলে থাকলে গোলমাল তো হবেই। তাই বলে অসুস্থ মানুষটার কথাও তো ভাবতে হবে। এই বন্ধ ঘরে থাকলে অসুখ তো বেড়ে যাবে। খুলে দাও, বলুক ওরা যা বলার।” শেফালির স্বর কোমল এবং অন্তরঙ্গ।

”না, বাবা বকবে।” মেয়েটি গোঁয়ার গলায় বলল।

”তাহলে?” ইলা ফিসফিস করে শেফালির কাছে জানতে চাইল। শেফালি তা গ্রাহ্য না করে মেয়েটিকে বলল, ”বাবা কখন আসবে?”

”এগারোটা-বারোটা হয়ে যায়।”

”তুমি করছিলে কী?”

”ছাতু মাখছিলুম।”

”ভাত কিংবা রুটি করোনি?”

”না। মাঝে মাঝে ভাত হয়।”

ওরা কথা বলছে সেই ফাঁকে ছেলে দুটি থালা থেকে খামচা দিয়ে মাখা ছাতু তুলে নিল। মেয়েটি দেখতে পেয়ে ধমকে উঠল।

”তুমি স্কুলে পড়ো না?” শোভা প্রশ্ন করল।

মেয়েটি উত্তর না দিয়ে, ছাতু মাখায় ব্যস্ত হল। ইলা আবার বলল, ”তাহলে?”

”তাহলে আবার কী!” শেফালি ঝাঁঝিয়ে উঠল বিরক্ত হয়ে। ”দেখছ একটা মানুষ মরছে, এতগুলো বাচ্চচা ভাই-বোন নিয়ে একা ওইটুকু মেয়ে হিমসিম খাচ্ছে, আর এখনও তোমার শখ গেল না।”

ইলা লজ্জায় এতটুকু হয়ে গেল। শোভা মনে মনে অপ্রতিভ হল। স্ত্রীলোকটি নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে, তার বুকের উপর উপুড় হয়ে বাচ্চচাটি স্তন চুষছে। মেয়েটি ছাতুর একটা গোল্লা পাকিয়ে ডাকল-”আয়, বাবু আয়।” বাচ্চচাটি সঙ্গে সঙ্গে মায়ের বুক থেকে নেমে হামা দিয়ে মেয়েটির কাছে গেল। ওকে কোলে বসিয়ে মেয়েটি একটু একটু করে খাওয়াতে লাগল।

শেফালি এগিয়ে গিয়ে স্ত্রীলোকটির হাঁটু থেকে কাপড়টা গোড়ালি পর্যন্ত নামিয়ে দিল। ঝুঁকে কপালে হাত রাখল। শোভার মনে হল, তারও কিছু একটা করা দরকার। করার মতো কিছুই সে দেখতে পেল না। ইলা তাকে বলল, ”ঘরটায় একদম হাওয়া নেই, কী ভ্যাপসা!”

শেফালি বলল, ”বোধহয় ডাক্তার ডাকতে হবে। তেমন সুবিধের মনে হচ্ছে না। জানলাটা খুলে দাও তো ইলা।”

মেয়েটি কী বলতে যাচ্ছিল, শেফালি হাত নেড়ে চাপা দাবড়ানি দিল, ”যা বলার আমিই বলব তোমার বাবাকে। যা করছ তাই করো। দাঁড়িয়ে কেন? খুলে দাও, হাওয়া আসুক।”

বিছানা ঘেঁষে ইলা দাঁড়াল। ছিটকিনিটা আঁট হয়ে রয়েছে। টানাটানি করতে ওর মনে হল কার ঠান্ডা হাত যেন তার পায়ে ঠেকল। শোভা তাকিয়েছিল জানলার দিকে। ওর মনে হল, আধবোজা নিথর চোখে কে যেন তার দিকে তাকিয়ে। দুজনেই হঠাৎ শিউরে উঠল। আর জানলাটা যে মুহূর্তে খুলল, তখনই দপ করে ঘরের আলোটা নিভে গেল। ইলা জড়িয়ে ধরল শোভাকে। বাচ্চচাটা ভয়ে ঢুকরে উঠল। শেফালি স্থির গলায় বলল, ”আঁচলে পয়সা বাঁধা আছে। খুলে দাও তো ইলা, মোমবাতি আনুক।”

 দশ

তখন ভোম্বল আর একটু কাছে সরে এল মানুর।

এতক্ষণে অন্ধকার সয়ে এসেছে চোখে। এখন মানুর অবয়ব জমাট বেঁধে গেছে। ভোম্বলের চোখ সেটি খোদাই করে অন্ধকার থেকে একটা মূর্তি বার করে নিয়েছে। দীর্ঘ, ছিপছিপে, মাথায় প্রচুর চুল, নাকের ডগাটি তীক্ষ্ন। ভোম্বল তার হাতের গোলাপটি মানুর গালে বুলিয়ে দিল।

”আমি কিন্তু সত্যি বলেছি।” মানু খুব সহজভাবে বলার চেষ্টা করল।

”তুমি তাকে দিলে না কেন?” ভোম্বল লঘু হতে গিয়েও পারল না।

”দিয়েছি নাকি! পড়ে গেল আর আপনি তুলে নিলেন।” মানু সহজভাবে বলার চেষ্টা করল।

”তাহলে দরকার নেই আমার, এই নাও।” ভোম্বল আর লঘু হবার চেষ্টা করল না। গোলাপটি এগিয়ে ধরে রইল। অন্ধকারে মানু দেখতে পায়নি। বুঝতে পারল হালকা মিষ্টি গন্ধটা নাকে যেতেই, আর তাইতে কেঁপে উঠল ওর অন্তর। ফোঁটা ফোঁটা শিশিরের মতো ঝরল চোখের জল। অন্ধকারে ভোম্বল দেখতে পায়নি। বুঝতে পারল হাতের উপর পড়তেই।

”মানু, কাঁদছ!” ভোম্বল ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, ”এই মানু কী হয়েছে, কাঁদবার কী হল?”

”আমি সত্যি বলছি, দ্বারিকদা। যে চেয়েছিল এই গোলাপটা, সে আমায় চাকরি করে দেবে তার অফিসে।”

”কে সে?” ভোম্বলের হৃদস্পন্দন দ্রুত হল, নিশ্বাস ফেলতে পারল না।

”চিনবেন না। আমার এক বন্ধুর বাবা। বড়ো অফিসার একটা এনজিনিয়ারিং ফার্মের। আজ যেতে বলেছিল অফিসে, গেছলাম। লোকটা ভালো নয়।”

”বন্ধুকে সে-কথা বলে দাও।”

”না। আমার চাকরি দরকার।”

”কীজন্য?”

”বাবা আর পারছে না। আমরা সাত মাসের ভাড়া দিতে পারিনি বলে বাড়িওলা রোজ এসে চিৎকার অপমান করে যাচ্ছে, উঠে যেতে বলছে, মামলা করবে শাসাচ্ছে। একটা কিছু আয়ের ব্যবস্থা আমাদের দরকার। বাবা যথাসাধ্য করছে, আমাকেও কিছু করতে হবে।”

”তাই বুঝি সেজেগুজে গেছলে। তাই বুঝি হাতকাটা ব্লাউজ, কোমরের নিচে শাড়ি!”

মানু চুপ করে রইল। ভোম্বল গোলাপটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। ফুল পড়ার শব্দটুকু মানু শুনতে পেল।

”এই বাজারে চাকরি পাওয়া শক্ত। আমার তো কোনো যোগ্যতা নেই।” মানুর ধীর স্বর অন্ধকারে সাদা হয়ে ফুটে উঠল। পিছিয়ে এসে ভোম্বল খাটের উপর বসল।

”তুমি আর যেয়ো না লোকটার কাছে।” ভাঙা ভাঙা স্বরে ভোম্বল বলল।

”কেন যাব না?”

গলা পরিষ্কার করার জন্য ভোম্বল ঢোঁক গিলল পরপর। প্রশ্নটার জবাবে সে বলতে চাইল-আমি চাইনা, কেউ তোমার দেহ স্পর্শ করুক। কিন্তু কথা বলতে বুঝল গলার মধ্যে কিছু একটা জমে আছে। তখন ও বলতে চাইল-এ খবরটা আমায় না বলে চেপে যেতে পারতে তো।

”আমার কোনো যোগ্যতাই নেই। না বিদ্যে-বুদ্ধি, না রূপ।”

”কে বলল তোমায়?”

”আমি জানি। এসব কাউকে বলে দিতে হয় না। তবে থাকলেই বা কী হত!” মানুর হতাশ স্বর ভোম্বলের কানে করুণ হয়ে বাজল।

”বিদ্যে-বুদ্ধি, রূপ-গুণ এ সবই তো একটিমাত্র পুরুষকে সুখী করার জন্য। সে যদি সুখী হবে মনে করে তাহলে তোমার আর কীসের পরোয়া।”

”পরোয়া করি আমার এই মনটাকে। যদি ছেলে হতুম, তাহলে এই নিয়ে চিন্তাই করতুম না। যে আমায় ভালোবাসে তাকে বিয়ে করে ফেলতুম। কিন্তু মেয়েদের বাপের বাড়ি ছাড়তে হয়। গরিব বাপ-মা, ভাই-বোনেদের সে আর সাহায্য করতে পারে না।”

”তুমি কি বিয়ে করবে না?” ভোম্বল অবাক হয়ে অন্ধকারের ভিতর একটা মূর্তিকে ভেঙে পড়তে দেখল।

তখন দরজার বাইরে বড়দার গলা শুনল সে। মোমবাতি হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করছে, ”তোর কি চাই একটা?”

ধড়ফড় করে উঠে গিয়ে ভোম্বল মোমবাতিটা নিয়ে এল। ঘরে ম্লান ছায়া পড়ল দুজনের। মানু সামলে নিয়েছে নিজেকে। দরজার দিকে সে এগোল।

”চললে? রাস্তায় অন্ধকার, দাঁড়াও আলো জ্বলুক। অন্ধকার বেশিক্ষণ থাকবে না,আগেরবার আধঘণ্টা মতো ছিল।”

”না আমি যাই। এভাবে দুজনের থাকাটা ঠিক নয়, পরে কথা হবে।”

”হোক। আমি তাতে ভয় পাই না।” মোমবাতির শিখা এবং ভোম্বলের কণ্ঠস্বর, দুটোই কেঁপে উঠল।

”এসব বীরত্ব দেখিয়ে কী লাভ দ্বারিকদা।” মানু স্পষ্টভাবে তাকিয়ে রইল ভোম্বলের চোখের দিকে। তাইতে ভোম্বলের বুকের মধ্যেকার দাপাদাপিটা বন্ধ হয়ে গেল। সে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল মোমবাতিটা।

”এ কি করলেন!” মানু দ্রুত দরজার দিকে এগোল। ভোম্বল ওর হাত চেপে ধরল।

”একটা কথা বলব?”

”মোমবাতিটা নিভিয়ে দিলেন কেন?”

”আলোয় বলতে পারব না, তাই। অন্ধকারে তো অনেক সময় ভরসাও পাওয়া যায় তাই। বলব?”

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে রইল অন্ধকার ঘর। রাস্তায় কিছু একটা ঘটছে। চিৎকার আসছে ঘরে। কার ট্রানজিস্টর রেডিয়োতে সেতার বাজছে। অন্ধকারে ভয়-পাওয়া শিশুরা মাঝে মাঝে ডুকরে উঠছে। ভোম্বল নিশ্বাস রোধ করে অপেক্ষা করছে।

”বলুন।”

ভোম্বলের মনে হল এইবার সে প্রচণ্ডরূপে যুবক হতে চলেছে। এইবার সে দারুণ একটা কথা বলে লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। সে মৃদুস্বরে বলল, ”মনীষা।” তারপর বলল, ”আমিও বিয়ে করব না তাহলে।” এই বলে ভোম্বল বুকের মধ্যে একরাশ গোলাপের গন্ধ পেল।

.

অনন্ত আর বাসুর ঝগড়া দেখতে চারুশীলা ছাদের পাঁচিলে ঝুঁকে রয়েছে। সত্যচরণ সেই ফাঁকে দোতলার ঘরে এসে আলমারির চাবি খুলে পাঁচটি টাকা বার করেছে মাত্র, তখনই আলোগুলো নিভে যায়। হকচকিয়ে গেছল প্রথমে। তারপর ব্যাপারটা বুঝে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় বেরোয়। ওর মনে হল, ঝগড়াটা শেষ পর্যন্ত যেন কিছু একটা গুরুতর ব্যাপারে গড়িয়েছে। কিন্তু ওখানে খোঁজ নিতে যাওয়া মানে মূল্যবান এই অন্ধকারের খানিকটা নষ্ট করা। মরুক ব্যাটারা ঝগড়া-মারামারি করে।

অন্ধকারে মোটরটা একটা কচ্ছপের মতো পড়ে রয়েছে। পাশ দিয়ে যাবার সময় সত্যচরণ থমকে দাঁড়াল। বেড়াল-বাচ্চচাটা তলায় মিউমিউ করে যাচ্ছে। ওটাকে বের করে দেবে কিনা ভাবল। অবশেষে সাব্যস্ত করল, মরুক ব্যাটা চাপা পড়ে।

তারক কবিরাজ স্ট্রিটের বস্তির পরিচিত সরু গলিটা অন্ধকারে চেনা যায়। সত্যচরণ খুশি হল, কেউ তাকে ঢুকতে দেখবে না। আঙুর চটপট ব্যাপারটা চুকিয়ে দিলে অন্ধকার থাকতে থাকতেই বেরিয়ে আসা যাবে। কেউ জানবে না। শুধু চারুশীলা পাঁচটা টাকা চুরি যাওয়ার জন্য কাল বড়োছেলে কী মেজোমেয়েটাকে ঠ্যাঙাবে।

সত্যচরণ গলিতে ঢুকতে গিয়েই একজনের সঙ্গে জোর ধাক্কা খেল। মাথায় একটা মোটরের চাকা নিয়ে সেও ঢুকছে বস্তির গলিতে। সত্য ঘাড়ে ব্যথা পেয়ে বিরক্ত হয়ে বলল, ”চোখের কী মাথা খেয়েছ গা।”

”এই অন্ধকারে কি চোখ থাকে কারুর?” অসীম পালটা খেঁকিয়ে উঠল। স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডের চাকার ভারে সে বিব্রত নয়, কিন্তু সত্যচরণকে গলার স্বরে চিনে সে তাই হয়ে পড়ল। একটু আগে ভয় পেয়েছিল বিড়াল-বাচ্চচাটার মিউমিউ শুনে। ভাঙা কেরিয়ারের ডালা তুলে চাকাটা বার করার সময় যখন তার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি কেউ চেঁচিয়ে উঠল চোর-চোর বলে, তখনই বেড়াল বাচ্চচাটা ডেকে ওঠে। অসীম ভয়ে কিছুক্ষণ জমাট বেঁধেছিল।

”এই অন্ধকারে বস্তিতে ঢুকছেন যে?” অসীম গলাটাকে ষড়যন্ত্রকারীদের মতো নামিয়ে বলল।

”এটা কার গাড়ির চাকা রে ফ্যালা?” সত্যচরণ শিশুর মতো কৌতূহল প্রকাশ করল।

দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝবার চেষ্টা করল অন্ধকারে। এরপর দুজনেই আর কথা বাড়াল না। একসঙ্গে ঢুকল বস্তিতে।

.হাউ হাউ করে বাসুদেব কেঁদে উঠল।

”তোমার জন্য, সব তোমার জন্য। এ সংসার ফেলে রেখে চলে যাব। যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাব। কেউ আমার মুখ চায় না। কেউ না, কেউ না!”

বাড়ির উঠোনে বাসুদেব উবু হয়ে বসে। ছেলেমেয়েরা একটু তফাতে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে। রকের উপর লম্ফ জ্বলছে। রাধারানি ন্যাকড়া বেঁধে দিচ্ছে মাথায়।

”বুঝবে তখন, কী করে আমি চালাচ্ছি। কত অপমান সয়ে আমায় চলতে হয়।” বলতে বলতে বাসুদেব উঠে দাঁড়াল। ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে, কুঁজো হয়ে অন্ধকার ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। লম্ফটা দপদপ করছিল, এই সময় সামান্য এক দমকা হাওয়াতেই নিভে গেল। উঠোনটা আবার অন্ধকার হয়ে পড়ল। আর তখন রাধারানির মনের মধ্যে হঠাৎ অন্ধ একটা আশা ছলাৎ করে উঠল।

কেউ দেখতে পাবে না। কেউ দেখতে পাবে না ওকে আসতে। সদর দরজা খুলে রাধারানি দাঁড়াল। গাঢ় অন্ধকার জয়রাম মিত্র লেনকে একাকার করে দিয়েছে। দরজায় হেলান দিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রাধারানি খুব ক্লান্ত বোধ করল। বিড়-বিড় করে সে বলল, ”আর একবার। মারব, ভীষণ মারব, এমন মারব যে জীবনও ভুলতে পারবি না।”

.”অ বউ, খোকা এসেছে? কাল কচুরমুখী আনতে বলবি তো? বড়ি দিয়ে কাল করে দিস। কতকাল যে খাইনি।”

অন্ধকারে বিড়ালের মতো পারুল নেমে এল। মাথাধরা সেরে গেছে তার। ঘরের মধ্যে এসে আলমারির আয়নার সামনে দাঁড়াল কিছুক্ষণ। কিছুই দেখা যায় না। আলতোভাবে সে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। অস্ফুটে একটা ক্লান্ত শব্দ বেরোল মুখ থেকে।

”কথা কস না কেন, অ-বউ। দ্যাখো আঁটাকুড়ির গেরায্যিই নেই। আবার আমি খোকার বিয়ে দোব। দেমাক ভাঙব তোর।”

”দে না তোর খোকার বিয়ে।” পারুল গলা না চড়িয়ে পাশের লোককে বলার মতো করে বলল। বলে খিলখিল করে হাসতে হাসতে নিজের তলপেটে হাত রাখল আর আলতো ভাবে সুখ নেমে এল ওর সর্বাঙ্গে।

”চাঁদপানা বউ আনব। দেখিস বছর বছর বিয়োবে। আহা, ঘর ভরে উঠবে গো। কচুরমুখী আনতে বলবি তো বউ?”

সেও আঁটকুড়ি থাকবে। পারুল মনে মনে বলল, সেও আমার মতো হবে। মানত, জলপড়া, মাদুলি, হত্যে দেওয়া, যত্তোসব বাজে। ইলার ছেলে হয়েছে-পারুল পাশ ফিরে ভাবল, আমারও হবে।

.অন্ধকারে হিরণ্ময় জানলার ধারে দাঁড়িয়ে। পর্দা সরানো। রাস্তায় যেন অন্ধকারটা আরও বেশি মনে হচ্ছে তার।

খসখস শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়াল। কে যেন ঢুকেছে ঘরে! আলমারির পাল্লা খোলার শব্দ হল। চোর? হিরণ্ময় সন্তর্পণে এগোল। একটা টিনের ঢাকনা পড়ার শব্দ হল। নিচু হল যেন কুড়োতে। চিনতে পারল সে।

”কী করছ তুমি?”

”আলমারিটা খোলা ছিল, বন্ধ করতে ভুলে গেছি।” আভার গলার স্বর বিচলিত হয়ে কথাগুলোকে কাঁপিয়ে দিল।

হিরণ্ময় এগিয়ে এসে ওর হাত ধরল।

”দেখি কী নিচ্ছ।”

”কিছু না।”

”মুঠো খোল।”

হিরণ্ময় চেষ্টা করল আভার মুঠো খুলতে। পারল না। আভা টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল। আর সঙ্গে সঙ্গে রাগে কেঁপে উঠল হিরণ্ময়। গায়ের জোর বেশি। শুধু এইটুকুর জোরে তাকে অগ্রাহ্য করল। হাতটা পিছনে অনেকখানি তুলে চড় মারার জন্য হিরণ্ময় তৈরি হতেই আভা ঝাঁপিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল।

”আমি রেহাই চাই। হিরণ্ময়, হিরণ্ময় আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমি যে তোমাকে ভালোবাসি। কী করব বলে দাও আমায়, দয়া করে বলে দাও।” টপ টপ করে আভার হাত থেকে ঘুমের ট্যাবলেটগুলো মেঝেয় পড়তে থাকল।

”আমি জানি না আভা। সত্যি বলছি, আমি কিছুই জানি না। বেঁচে থাকার কী মরে যাওয়ার কোনো যুক্তিসংগত কারণ এখনও খুঁজে পাইনি।”

আভাকে খাটের উপর বসাল হিরণ্ময়। রাস্তায় কীসের একটা গোলমাল চলছে। আভার থুতনি ধরে ওর মুখটি তুলে হিরণ্ময় নিজের মুখ নামিয়ে এনে বলল, ”এইসব ছোটোখাটো বাজে কারণে মরার কোনো অর্থ হয় না। ভয় নেই, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমি এখন হিমাংশুর কাছে যাব। তুমি এগুলো কুড়িয়ে তুলে রাখো। আর এবার থেকে আমরা সাবধান হব।”

এই বলে হিরণ্ময় পাঞ্জাবি পরতে শুরু করল।

.শেফালির মনে হল কিছু একটা বলতে চাইছে যেন। ঝুঁকে মুখটা নিয়ে গেল মুখের কাছে। শুধু একটা ঘড়ঘড় শব্দ শুনল।

বাচ্চচাটা শোভার কোলে চুপ করে বসে। দু’হাতে আঁকড়ে রয়েছে তার হাত। ইলা গা ঘেঁষে রয়েছে শোভার। ছেলে দুটি মোমবাতি কিনতে গেছে এখনও ফেরেনি।

”জানলাটা খোলা মাত্রই-” ইলা চুপ করে গেল হঠাৎ। শোভা কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরেছে।

”আমার কেমন ভয় করছে।” ইলা আবার বলল, ”দেখেছেন কী ঠান্ডা মেঝেটা। মরা মানুষের গায়ের মতো। যেন একটা মড়ার উপর বসে আছি।”

”চুপ করুন তো।” শোভা চাপা ধমক দিল। সিরসির করে উঠছে তার বগলের দুপাশ। মোমবাতি এলেই চলে যেতে হবে। তার মনে হচ্ছে, আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে অন্ধকার তার গায়ে ঠান্ডা হাত রাখবে।

শেফালি আবার ঝুঁকে পড়ল। ফিসফিস করে বলল, ”আমি আছি, ওদের আমি দেখব, অত ঘাবড়াচ্ছ কেন?” তারপর মাথা তুলে ঘরের সবাইকে শুনিয়ে বলল, ”বোধহয় মারা গেল।”

তাই শুনে কেউ একটা কথাও বলল না।

 এগারো

আলো জ্বলে উঠেছে জয়রাম মিত্র লেনে। আকাশি-নীল স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডটা কখন যে চলে গেছে অন্ধকারের মধ্যে কেউ খেয়াল করেনি, বাড়িতে বাড়িতে রেডিয়ো বাজছে, পাখা ঘুরছে। রাস্তা দিয়ে লোক চলছে। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার পর স্বাভাবিক হয়ে গেছে পাড়াটা।

সত্যচরণ বালতি হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল।-”দেখলে গা, যা বলেছিলুম তাই হল। এখন কাক-চিলে ওই মরা বিড়াল-বাচ্চচা নিয়ে টানাটানি করে পাড়াটা ছয়লাপ করুক!”

ব্যস্ত হয়ে চলেছে শেফালি। এই নিয়ে তিনবার সে তাঁতিগলিতে ঢুকল দু ঘণ্টায়। ওকে দেখে সত্যচরণ বলল, ”কী রে, তখন থেকে দেখছি যাচ্ছিস আর বেরোচ্ছিস।”

”সত্যদা, শ’দুই টাকা না হলে তো মড়া বার করা যাচ্ছে না। দিতে পারো?”

”আমি!” সত্যচরণ এতবড়ো বিস্ময়ের সম্মুখীন জীবনে এই প্রথম হল যেন। ”আমি পাব কোত্থেকে? পাঁচটা টাকাও হাতে নেই।”

”কী যে করি।” শেফালি উৎকণ্ঠা ভোগ করতে করতে বলল, ”অনন্তদার কাছে চাইলে পাব?”

”দ্যাখ চেষ্টা করে।” সত্যচরণ টিউবওয়েলে জোরে জোরে পাম্প শুরু করল। পাঁচশো টাকার মতো লাগবে মেয়েটাকে বালা গড়িয়ে দিতে। মড়া পোড়াবার খরচ জোগাতে গিয়ে আঙুরকে হারানোর মতো বোকামি করতে সে রাজি নয়। হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল সত্যচরণ। আঙুরের মেয়েটার মুখ ভুতি-টুনির মতোই। হুবহু ওদের বোন বলেই মনে হয়।

অনন্ত সিংহ বাড়ি নেই। আহিরিটোলায় শীলেদের বাড়ি গেছে, এখনও ফেরেনি। আলো নিভে যাওয়ায় মেয়ে দেখানো যায়নি। ওরা যাতে আর একবার দেখতে আসে তারই তদ্বির করতে গেছে। ফেরার পথে কুলগুরুর বাড়িতেও যাবে। গোপীনাথের গায়ে বল লাগার ফলে কোনোরকম সর্বনাশ ঘটতে পারে কি না, সে সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে আসবে।

শেফালি ফাঁফরে পড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল। অসীমকে আসতে দেখে বলল, ”ফ্যালা, ভাই একটা উবগার করবি? শুনেছিস তো বউটা মরে গেছে। লোকটার হাতে দশটা টাকাও নেই, তুই কোথাও থেকে শ দুয়েক টাকা অন্তত যদি জোগাড় করে দিস-”

”কত টাকা?” অসীম হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে গেল।

”দুশো। ঘাট খরচের টাকাটাও অন্তত যদি পাওয়া যায়।”

অসীম ঘাড় বেঁকিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে বলল, ”আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না। সব খরচ আমার।”

”স-অব!”

”দেখুন না, এমন সাজিয়ে নিয়ে যাব যে দেখলে আপনারই মরতে ইচ্ছে করবে।” বিরাট একটা বোঝা নামবার স্বস্তি অসীমের হাসিতে ফুটে উঠল। ডান পা টেনে টেনে সে দ্রুত বাড়ির দিকে রওনা হল টাকা আনার জন্য। আভাদের জানলার সামনে দিয়ে যাবার সময় তার ইচ্ছা হল একবার উঁকি দিতে। বসবার ঘরটা অন্ধকার। হিরণ্ময়ের শোবার ঘরের জানলার পর্দা পাখার হাওয়ায় ফুলে উঠেছে। অসীম দেখতে পেল হিরণ্ময় পাঞ্জাবি খুলছে। শোভা চুল আঁচড়াচ্ছে। আভাকে দেখতে না পেয়ে সে একটু ক্ষুণ্ণ হল মাত্র।

পাঞ্জাবি খুলতে খুলতে হিরণ্ময় বলল, ”খালি চিৎকার চেঁচামেচি আর ঝগড়া। তিষ্টোনো যায় নাকি। এর মধ্যে কারুর পড়াশোনা হতে পারে। আভাকে হস্টেলে রাখব ভাবছি।”

এই বলে হিরণ্ময় পকেট থেকে খামের মতো একটি ট্যাবলেটের প্যাকেট বার করল। তাই দেখে শোভা ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ”বাব্বা, কতগুলো ছেলেমেয়ে ওই বউটার। মরে রেহাই পেল।”

হিরণ্ময় অস্ফুটে ”রেহাই” শব্দটি উচ্চচারণ করে শোভার থেকে চোখ সরিয়ে হেসে বলল, ”তুমি কিন্তু মোটা হয়ে গেছ।”

”থাক আর নজর দিতে হবে না।” শোভা পিঠ ফিরিয়ে চুল আঁচড়ে চলল।

লঘুস্বরে হিরণ্ময় বলল, ”পাড়ার সেই গম্ভীর ছেলেটিকে একটু আগে দেখলাম, একটা কালো ঢ্যাঙা মেয়ের সঙ্গে বেড়াচ্ছে রাস্তায়।”

.

মনীষাকে বাড়ি পৌঁছে দেবার পর অনেকক্ষণ পার্কে শুয়ে ছিল দ্বারিক। বাড়িতে ঢোকার সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সে বলেছিল, ”তাহলে অফিস ছুটির পর আমরা মিট করব অ্যাসেম্বলির দক্ষিণ দিকের গেটে, কেমন?” মানু ঘাড়টা হেলিয়ে দিয়েছিল শুধু। সেই হেলানো মাথাটি বুকে নিয়ে ভোম্বল বহুক্ষণ ঘাসের উপর শুয়েছিল।

অবশেষে বাড়ি ফেরার জন্য পাড়ায় ঢুকে দেখল তাঁতিগলির মুখে একটি খাট রাস্তার উপর। অসীম আর আরও পাঁচ-ছটি ছেলে নারকেল দড়ি দিয়ে বাঁশ বাঁধছে খাটের সঙ্গে। খাটে একটি শীর্ণ নারীমুখ দেখা যাচ্ছে। দেহটি প্রচুর গোলাপে ঢাকা।

একরাশ গোলাপের গন্ধে দ্বারিকের বুকের মধ্যেটা মোচড় দিয়ে উঠল। টুকরো টুকরো কথায় সে বুঝল ওদের সাহায্যকারী দরকার। অসীমের কাছে গিয়ে সে বলল, ”যদি দরকার হয় তো আমি যেতে পারি তোমাদের সঙ্গে।”

”তাহলে বোঁ করে বাড়ি থেকে একটা গামছা কী তোয়ালে নিয়ে চলে আয়।”

অসীম তুই বলায় দ্বারিক খুব খুশি হল।

ওরা খাটটাকে কাঁধে তোলামাত্র ডুকরে কেঁদে উঠল বড়োমেয়েটি। তাই দেখে শেফালির কোলের বাচ্চচাটিও। ওকে ভোলাবার জন্য শেফালি নাচাতে নাচাতে বলল, ”না না কাঁদে না, ওইতো মা এক্ষুনি আসবে। আমি ধরে নিয়ে আসব মাকে। চুপ করো সোনামণি, কাঁদে না।”

খাট নিয়ে ওরা জয়রাম লেন থেকে তারক কবিরাজ স্ট্রিটে পড়ামাত্র, যে লোকটা টলতে টলতে সামনে দিয়ে আসছিল হঠাৎ কীসের ভয়ে যেন দেয়ালে সেঁটে গেল। ওর পাশ দিয়ে খাটটা অতিক্রম করার সময় উঁচিয়ে দেখল, কে খাটের উপর। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ”যাক, সুকুমার নয় তাহলে।”

দরজায় খিল দেওয়া। অশোক রোজকার মতো খুটখুট করে কড়া নাড়ল। রোজকার মতো প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খুলে গিয়ে দরজার পাল্লা ঘেঁষে কেউ একজন দাঁড়াল না। বারকয়েক কড়া নাড়ার পর ইলা এসে খুলে দিল। সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময় অশোক বিড়বিড় করল, ”সব সমান, সব সমান।”

এরপর জয়রাম মিত্র লেন নিশুতি হয়ে গেল। শুধু রাধারানি দরজার একটা পাল্লা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে। সে শুধু ভাবছে, আলোর মধ্যে দিয়ে আসতে ওর লজ্জা করবে। হে ভগবান, গলিটাকে অন্ধকার করে দাও, আর একবার অন্ধকার করে দাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *