পুবের জানালা

পুবের জানালা – উপন্যাস – মতি নন্দী

এক

দ্বিতীয়বার সে বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। হাঁটার মধ্যে এমন একটা ভাব বজায় রাখল যেন সে খুবই প্রত্যয়ী, তার মধ্যে কোনো উদবেগ বা ব্যস্ততা নেই। কারও দৃষ্টি আকর্ষিত হতে পারে এমন পদক্ষেপ একবারও করেনি। শুধু তার চোখ দুটি অস্বাভাবিক তীক্ষ্ন এবং কৌতূহলী। কিন্তু রাস্তার আলোয় তার চোখ খুব স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল না। তার কাঁধে ঝুলছে একটা নীল আর কালো নকশাকাটা কাপড়ের ঝুলি। পরনে হালকা সবুজ পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা। পায়ে কোলাপুরি। এসব আজই কেনা। কিন্তু তার গালের দাড়ি তিন মাসের। আজকের দিনটির কথা ভেবেই সে দাড়ি রাখতে শুরু করেছিল। বাড়িতে ঢোকার আগে পাড়ার লোক অন্তত যাতে চিনতে না পারে।

দু—পাল্লার লোহার ফটকটা হাট করে খোলা। সাধারণত একটা পাল্লা বন্ধ থাকে। মোটর ঢোকার বা বেরোবার সময় দুটো পাল্লাই খোলা হয়। কোনো মোটর কি এখন ঢুকেছে বা বেরিয়েছে? মোটর তো আছে শুধু তার দাদা গোপেন্দ্রর। কোনো ট্যাক্সি তো ভিতরে ঢুকবে না। এই নিয়ম বাবার আমল থেকে চলে আসছে, কিন্তু গত ষোলো বছরে সেটা কী টিকে আছে?

রাস্তার আলোটা ফটকের পাশ দিয়ে বেরিয়ে—যাওয়া শিবু বর্ধন লেনের মুখেই সনৎদার বাড়ির দেওয়ালে আঁটা। ওই আলোতেই গলির মুখ আর ছাব্বিশ নম্বর সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিটের ফটক ছাড়িয়ে আরও তিরিশ মিটার রাস্তা আলোকিত। রাস্তার এক প্রান্ত গিয়ে পড়েছে গৌরচরণ ঘোষ লেনে। এই দুই রাস্তার মোড়ে একটি পার্ক। এই পার্কে বাল্যে সে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলেছে। পরে খেলেছে ভলিবল। পার্কের দক্ষিণে একটা ব্যায়ামের আখড়া, সেখানে আছে হনুমানজির মূর্তি, পাথরে তৈরি দু—হাত লম্বা। সবাই তাই বলে হনুমানজি পার্ক। পার্কের রেলিংয়ের ধার ঘেঁষে বেঞ্চ পাতা। কিছুক্ষণ আগে সে পার্কের মাঝামাঝি অন্ধকার জায়গায় একটা খালি বেঞ্চে বসেছিল।

অত্যন্ত ক্লান্ত সে। সকাল দশটায় জেলের ফটকের বাইরে পা দিয়েই তার মনে হয়েছিল, আজ সে লম্বা একটা হাঁটা হাঁটবে। হাঁটতে সে ভালোবাসে। যদিও তার মোটরবাইক ছিল, কিন্তু খুব তাড়া না থাকলে বাড়ি থেকে এক বা দেড় মাইল হেঁটেই চলে যেত। আজ সে হেঁটেছে। আলিপুর থেকে উত্তরে সোজা রেসকোর্স হয়ে পশ্চিমে গেছে। গঙ্গার ধার দিয়ে আবার উত্তরে ইডেন গার্ডেনস। গাছের ছায়ায় ঘাসের উপর চিত হয়ে সে ভেবেছে। তার গত ষোলো বছরকে নয়, ভেবেছে কয়েক ঘণ্টা পর কী ঘটতে পারে সেই কথা। তাকে নিয়ে যাবার জন্য কেউ আসেনি জেল—ফটকে। সে দু—সপ্তাহ আগে বিবিকে চিঠি দিয়েছিল তার খালাসের তারিখ জানিয়ে। ‘বিবি’ তার বউ জাহ্নবীর ডাকনাম।

বিবি গত চার বছর একবারও দেখা করতে আসেনি। সেজন্য তার কোনো দুঃখ, ক্ষোভ বা মর্মবেদনা হয়নি। তার ধারণা সে অনেক বদলে গেছে মানসিকভাবে। এখন সে বুঝতে পারে অন্য মানুষের অনুভবকে, এখন সে ধৈর্য ধরতে, সহ্য করতে এবং আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। কিন্তু এর কোনোটাই পরীক্ষিত হয়নি। এবার হবে।

কীভাবে তাকে ওরা গ্রহণ করবে? তার মেয়ে গুলু, তখন ছিল চার বছরের। এখন সে কুড়ি। তার ছেলে গোরা, তখন ছিল দু—বছরের, এখন সে আঠারো, দুজনকে সে ষোলো বছর চোখে দেখেনি। পুরোপুরি আসা বন্ধ করার আগে বিবি যখন এক—দেড় মাস অন্তর দেখা করতে আসত, তখন সে একবার বলেছিল, ‘গুলু আর গোরার ভালো নাম কিছু রেখেছ?’ বিবি বলেছিল, ‘এখনও কিছু রাখিনি।’ ‘আমি কী রাখব?’ খুব সন্তর্পণে সে বিবির কাছে অনুমতি চেয়েছিল। পরে বুঝেছিল সে ভয় পাচ্ছে, যদি প্রত্যাখ্যাত হয়! নামকরণের অধিকারটা এখনও তার দখলে আছে কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি। এক ধরনের কাঠিন্য আর জেদ বিবির মৃদু স্বভাবের আড়ালে প্রচ্ছন্ন থাকে। নিমেষে সেটা কখন যে প্রকাশ্যে আসবে তা কেউ জানে না। বিবি বলেছিল, ‘ছেলেমেয়ের নাম রাখবে, তুমি!’ বিবির চোখ থেকে সে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল। অদ্ভুত একটা ঝাঁঝ ছিল বিবির বিস্ময়ের মধ্যে। ‘ওদের একবার আনবে? দেখব।’ কর্কশস্বরে উত্তর পেয়েছিল, ‘না’।

এবার বিবির সামনে গিয়ে তাকে দাঁড়াতে হবে। ইডেন গার্ডেনস থেকে হনুমানজি পার্ক, তার মধ্যে সে নতুন পাঞ্জাবি, গেঞ্জি, পাজামা, চটি এবং ঝুলিটা কিনেছে। একটা চিনা খাবারের দোকানে পেট ভরে চাওমিয়েন আর চিংড়ি মাছ ভাজা খেয়েছে। দোকানের টয়লেটে হাত ধোবার সময় আয়নায় চুল আঁচড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। তার মনে হয়েছিল, দাড়িটা রেখে ঠিক কাজই করেছে, তাকে চেনা যাচ্ছে না। তাকে রাশভারি দেখাচ্ছে। তামাটে চামড়ার সঙ্গে কটা চোখ, ঘন ভুরু। কানের উপর, জুলফিতে আর চওড়া চোয়ালের নীচে পাকা চুলের সাদা ছোপ—ধরা কালো দাড়ি তার মুখটাকে বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিকের মতো গম্ভীর করে দিয়েছে। কিন্তু সে নিজেকে হাসিখুশি, উৎফুল্ল একটা সহজ মানুষ হিসাবে সমাজে, বাড়িতে, ছেলেমেয়েদের এবং বিবির কাছে ফিরে আসতে চায়।

চোখ দুটিকে উজ্জ্বল দেখতে চেয়ে সে মণিদুটিকে স্ফীত করেছিল। কপালে তখন তিনটে ভাঁজ পড়ে, আয়নার কাছে মুখ এগিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকায়। তার মনে হয়েছিল আগের সেই ঝকঝকে ব্যাপারটা যেন আর নেই। দুশ্চিন্তায় স্তিমিত দুটো চোখ যা তার কাছে নতুন, এরপর সে বুকটা সামনে ঠেলে টানটান হয়ে দাঁড়ায়। ছ—ফুট দু—ইঞ্চি, বিরাশি কেজি ছিল ষোলো বছর আগে। এখনও তাই আছে বলেই তার মনে হয়। ওজনটা হয়তো একটু বেড়েছে, পেটটা একটু উঁচু হয়ে উঠেছে। তা হোক, সে ঝুঁকে পড়েনি বয়সের ভারে। গৌরবর্ণ টকটকে গায়ের রঙ আর নেই। সেজন্য তার মনে কষ্ট নেই। পঞ্চাশের কাছাকাছি হতে যাচ্ছে বয়স। জীবনের একটা এলাকা ছেড়ে দিয়ে আর একটা জমিতে পা রাখতে চলেছে, সেখানে গায়ের রঙ দিয়ে সে কিছু লাভ করবে না।

হনুমানজি পার্কে বেঞ্চে বসে থাকার সময় তার মনে হয়েছিল, এখানকার কিছুই বদলায়নি। বাড়িগুলো একই চেহারায় রয়ে গেছে। অবশ্য ষোলো বছরে বদলাবেই বা কীভাবে। চল্লিশ বছর আগেও সে বাড়িগুলোকে এই রকমটিই দেখেছিল। হয়তো কোনোটার গায়ে কলি পড়েনি, দেওয়ালে অশ্বত্থ বা বটের চারা, জানালার পাল্লা কবজা থেকে ঝুলে গেছে, বারান্দায় পার্টিশান হয়েছে, সদর দরজার চৌকাঠটা আর একটু ক্ষয়ে গেছে, কিন্তু এগুলোকে বদল বলা যায় কী? ঘেঁষাঘেঁষি বাড়িগুলোর কাঠামো তো একই রয়ে গেছে। ছাব্বিশ নম্বর সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিট—এর বাড়িটাকে সে একটু আগেই বাইরে থেকে দেখে এল, একই রয়েছে। তবে লোহার ফটকে মরচে, পাঁচিলের খসে পড়া পলেস্তারা, ফটক থেকে ভিতরে ঢোকার ইট বাঁধানো পথটায় ঢেলা ইট, গর্ত আর ছেঁড়া কাগজ দেখে মনে হয়েছিল বাড়ির মানুষগুলো আগের শৃঙ্খলার মধ্যে আর নেই।

পার্কের বেঞ্চে সে একাই বসেছিল। এক প্রৌঢ় এসে তার পাশে বসে। সে কিনারের দিকে সরে যায়। আড়চোখে তাকিয়ে সে চেষ্টা করে লোকটিকে চেনার । দেখা মুখ কিন্তু সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিটের নয়। কিন্তু লোকটি তাকে চিনে ফেলতে পারে কি? পাজামা, পাঞ্জাবি আর বিশেষ করে দাড়িটা কি যথেষ্ট ছদ্মবেশ নয়? দাড়িটা সে রেখেই দেবে তবে বিবি বোধহয় পছন্দ করবে না। ছোটোবেলায় চন্দননগরে মামার বাড়িতে যাত্রায় দেখেছিল, এক অত্যাচারী নবাবকে গ্রাম থেকে এক সুন্দরী গৃহবধূকে হরণ করে নিয়ে যেতে। নবাবের ছিল দাড়ি। সেই থেকে বিবির কাছে দাড়ি আর লাম্পট্য এক হয়ে গেছে।

নিজের অজান্তেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল। দাড়িটা তাকে কাটতেই হবে। সে তখন পাশে মুখ ফিরিয়ে দেখতে পায় লোকটি তার দিকে তাকিয়ে। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। তার মনে হয় লোকটি তাকে চেনার চেষ্টা করলে হয়তো চিনতে পারবে। এই পার্কেই ফুটবল খেলার সময় সে ঘুসি মেরে দাঁত ভেঙে দিয়েছিল পাশের পাড়ার বস্তির একটি ছেলের। রক্তাক্ত মুখে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটি তার বাবাকে ডেকে আনে। এই লোকটিই সেই বাবা। হন্তদন্ত হয়ে লোকটি প্রায় ছুটে এসে তাকে চড় মারার জন্য হাত তুলেও মারেনি। না মারার কারণ সে পরে বুঝতে পেরেছিল। তার মুখ চোখ আর গায়ের রঙ লোকটাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, ছেলেটা বড়ো ঘরের। ‘কোথায় তোর বাড়ি?’ শুধু এইটুকু জানতে চেয়েছিল। সে বলেছিল, ‘দত্তবাড়ি। আমার বাবা অমিয় দত্ত। এর জন্য ডাক্তার ওষুধের খরচ আমার বাবা দিয়ে দেবে।’ লোকটা চিৎকার করে বড়োলোকদের গাল দিতে দিতে তখন ছেলেকে নিয়ে চলে যায়। পরের দিন রাত্রে বাবা তাকে ডেকে বলেছিল, ‘রঘু, তোর একটা ঘুসির দাম চুকোতে চল্লিশ টাকা খসে গেল। আর ঘুঁসোঘুসি করিসনি বাবা।’ বাবা প্রশ্রয়ের হাসি হেসেছিল।

এই সেই লোক। কিন্তু ঘটনাটা কম করে পঁয়ত্রিশ বছর আগের, তার মধ্যে সে লোকটিকে একবারও দেখেনি। হয়তো লোকটি তাকে দেখেছে, বহুবারই। ছ—ফুট দু—ইঞ্চি, টকটকে রঙ, কটা চোখ, চওড়া কাঁধ, এসব কি সহজে ভুলে যাওয়া যায়! লোকটি একটি বিড়ি ধরিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসল। চিনতে পারেনি, জায়গাটা অন্ধকারও। এবারে উঠে পড়া যাক।

রঘু, যার পোশাকি নাম রাঘবেন্দ্র, তখন হনুমানজি পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে। সে পার্কের ফটক দিয়ে না বেরিয়ে রেলিংয়ে যেখানে একটা শিক উপড়ে মানুষ গলে যাওয়ার জন্য ফোকর করা, সেখান থেকে বেরোল। পার্কের ফটকে ফুচকা আর উনুনের উপর পিতলের থালায় রাখা ঘুগনি বিক্রি হচ্ছে। চল্লিশ বছর আগেও সে এদের দেখেছে তবে তখন অন্য লোক বিক্রি করত। যদুপতি একটা টিনের বাক্স নিয়ে ফটকের পাশে বিকেলে বসত। তার মধ্যে গোল দুটো ডিব্বায় থাকত শুকনো ঘুগনি আর ঘন ঝোলের আলুর দম। চাপড়া চিংড়ির চপ আর কাগজের মতো পাতলা মামলেটও তার কাছে পাওয়া যেত। যদুপতির কালো চুল সে আধ—পাকা হয়ে যেতে দেখেছে। অন্তত পঁচিশ বছর ধরে সে এই পাড়ার ঘুগনিওয়ালা ছিল। সন্ধ্যার পর টহল শুরু করত। ছাব্বিশ নম্বরের ফটকের কাছ থেকে মুখটা বেঁকিয়ে যদুপতি ‘ঘউগ….নিইই’ বলে হাঁক দিলেই সে তার প্রাইভেট টিউটর উমাপদবাবুর মুখের দিকে তাকাত। তিনি তখন মাথা হেলিয়ে বলতেন, ‘দেরি কোরো না।’ সে তখন ছুটে বেরিয়ে আসত ফটকে আর ফিরে যেত চার পাতা ঘুগনি হাতে নিয়ে। দুটো পাতা উমাপদবাবুর জন্য। একদিন দেশের বাড়ি থেকে খবর এল, একমাত্র ছেলে সাপের কামড়ে মারা গেছে। তিনি সেই যে দেশে গেলেন আর ফিরে আসেননি।

ধরদের রকে একটা স্টেশনারি দোকান হয়েছে। প্রথমবার সামনে দিয়ে যাবার সময় এটা সে লক্ষ করেনি। বড়োজোর আড়াই হাত চওড়া, দু—হাত লম্বা। দোকানি একটি সুশ্রী যুবক। সামনে একটা কাচের শো—কেস, তার উপর সার দিয়ে কাচের জার। নানান রঙের প্যাকেট দেওয়ালে আর দোকানের সামনে ঝোলানো। নড়াচড়ার জন্য দু—হাত জায়গাও নেই। একটা টুলের উপর বসে বা দাঁড়িয়ে এই পঁচিশ—ছাব্বিশ বছরের ছেলেটি দিনে কত ঘণ্টা কাটায়! আট? দশ? সে জেলে গেছিল বত্রিশ বছরে। সেখানে হাঁটা চলা দৌড়বার জায়গার অভাব ছিল না। ছেলেটি এই দু—হাত জায়গায় নির্বাসিত থাকবে কত বছর? দোকানের উলটো দিকের বাড়ির দরজায় সালোয়ার—কামিজ পরা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। হয়তো অকারণেই।

রাস্তায় লোক চলাচল কম। যারা সামনে দিয়ে আসছে,তাদের কাছ থেকে না—চেনা আলতো একটা চাহনি ছাড়া আর কিছু সে পেল না। হাতঘড়িতে সে সময় দেখল সাড়ে আটটা। এখন বিবি গোরা গুলুরা কী করতে পারে? হারমোনিয়ামের মতো দেখতে একটা টিভি সেট সে কিনেছিল। তখন টিভি রঙিন হয়নি। জেলে সে রঙিন দেখেছে। বিবি এতদিনে নিশ্চয়ই পুরনো সাদা—কালোটা বাতিল করে রঙিন কিনেছে। ওরা এখন কি টিভি দেখছে? কিন্তু বিবি কি দেখতে দেবে? এখন তো পড়াশুনোর সময়। পড়ার ব্যাপারে বিবি খুব সিরিয়াস। ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে বি এসসি। পরীক্ষার মধ্যেই ওর বাবার স্ট্রোক না হলে ফার্স্ট ক্লাস হয়তো পেত। বাবা সামলে উঠেই মা—মরা মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এক মাসের মধ্যে বিয়ে দিলেন। দেওয়াটা উচিত কী অনুচিত হয়েছে, তাই নিয়ে সে বিবিকে একবার জিজ্ঞাসাও করেছিল, ‘আমার মতো এক অর্ডিনারি বিএ—র সঙ্গে তোমার বিয়ে হওয়াটা উচিত হয়নি।’ বিবি নিরাসক্ত গলায় বলেছিল, ‘তাহলে কার সঙ্গে বিয়ে হলে উচিত হত?’ সে চট করে বিবিকে জবাব দিতে পারেনি। শুধু বলেছিল,’তুমি আমার থেকে অনেক বেশি রিফাইনড, শিক্ষিত।’ বিবির ভ্রূ কুঁচকে উঠেছিল শুনে। ওই কোঁচকানোর অর্থটা সে কোনোদিনই ধরতে পারেনি, এখনও নয়।

ছাব্বিশ নম্বরের ফটকের সামনে দ্বিতীয় বার পৌঁছে সে আগের মতো ফিরল না। বেঁকে যাওয়া সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিট ধরে আরও এগিয়ে গেল। একশো মিটার গেলে একটা ভাঙা শিব মন্দির, তারপর আশুর তেলেভাজার দোকান। আর একটু এগোলে কচুবাগান বস্তি, নারান পণ্ডিতের পাঠশালা, তারক স্যাকরার দোকান, রেশন দোকান, চুল কাটার দোকান।

নতুন কিছুই চোখে পড়ল না, শুধু পুরোনোগুলো আরও পুরোনো হয়েছে। শিবুর দোকান বন্ধ রয়েছে, অথচ বিকেল থেকেই ভিড় লেগে যেত মোচার চপের জন্য। শিবু কি মরে গেছে! নারান পণ্ডিতের পাঠশালা ঘরে কারা ড্রাম আর অ্যাকর্ডিয়ান বাজিয়ে হিন্দি ফিল্মের গান চর্চা করছে, তার মধ্যে মেয়ের গলাও সে পেল। সন্ধের পর হয়তো ভাড়া নেয় ঘরটা। গান শোনার জন্য দরজায় ভিড়। স্যাকরার দোকানের মাঝামাঝি লোহার গরাদ দিয়ে ঘরটা দু—ভাগ করা। আগে এটা ছিল না। গরাদের ওপারে মাথা নীচু করে হাতুড়িতে ঠুকঠাক করে যাচ্ছে একজন। তারক স্যাকরার ছেলে বলাই, তার সঙ্গে স্কুলে পড়েছে। আশ্চর্য, এত বড়ো টাক—এর মধ্যে ওর হল কী করে! বলাই তাকে নিশ্চয়ই চিনতে পারবে।

সে দ্রুত পা চালাল। শুভ্রা সেলুনে গেঞ্জি গায়ে, লুঙ্গি পরা একজনকে দাড়ি কামিয়ে দিচ্ছে অল্পবয়সি ছেলে। প্রৌঢ় মালিক বাইরের রকে চেয়ারে পা তুলে বসে। এখানে কখনো সে চুল কাটেনি দাড়ি কামায়নি। লোকটা তাকে চেনে না। সেলুনের উলটোদিকের বাড়ির জানালার নীচে কালী মহাদেব আর কৃষ্ণ—নানা রঙ দিয়ে দেওয়ালে আঁকা। লোকের পেচ্ছাপ করা বন্ধের অব্যর্থ দাওয়াই! হলুদ রঙের মোটর গাড়ির সাইজের একটা আবর্জনা ভরা লোহার বাক্স রাস্তায় বসানো। তার পাশের ঢাকনা খোলা। সেখান থেকে উপচে রাস্তায় পড়ে আছে আবর্জনা। আঁশটে বাসি গন্ধ ঠেলে তার আর এগোবার ইচ্ছে হল না।

সবই তো একই রকম রয়ে গেছে। এক ধরনের ভরসা সে এবার অনুভব করল। চোখে, নাকে, কানে তো অভ্যস্ত জিনিসগুলোই পৌঁছল। তাহলে কি সে তার আগের জায়গাতেই ফিরে এসেছে? ছাব্বিশ নম্বর বাড়িও একই রকম হয়েছে? হয়তো রয়েছে। তার ষোলো বছর না থাকায় কতটকু বদলাতে পারে? গুলু গোরা বড়ো হয়ে উঠেছে, তাদের দেখলে সে চিনতে পারবে না। বিবি একদিনও আলিপুরে ওদের নিয়ে যায়নি। ওদের কাছে বাবা অপরিচিত মানুষ।

পাঁচ বছরের দাম্পত্য জীবনে বিবির সঙ্গেও কি তার পরিচয় হয়েছে! দিদির শ্বশুরবাড়ি চন্দননগরে, বিবির মামার বাড়ির পাড়ায়। সাহেবদের মতো গায়ের রঙওয়ালা, লম্বা—চওড়া ভাইয়ের জন্য মানানসই মেয়ে খোঁজার দায় দিদিই নিয়েছিল। জাহ্নবী তারই আবিষ্কার। সুন্দরী হওয়ার জন্যই ডাকনাম ‘বিবি’। টকটকে না হলেও গৌরাঙ্গী। টানা চোখ, কালো মণি। পাশাপাশি দাঁড়ালে বিবির মাথা তার কানের নীচে পৌঁছয়, সাড়ে পাঁচ ফুটের মতো লম্বা আর যে দেহ—গড়ন পাওয়ার জন্য মেয়েরা ব্যায়াম করে, খাওয়ার বাধ্যবাধকতা মেনে চলে, বিবি তার কিছু না করেই তেমন একটি দেহ পেয়েছে। দিদি বলেছিল, ‘মেয়ের গড়ন—পেটন যেমন, তেমনই মেঘের মতো চুল!’ কোমর ছাড়ানো ঘন চুল। মাথাটা হেলিয়ে বিবি যখন চিরুনি দিয়ে আঁচড়াতো তখন সে তাকিয়ে থাকত। একদিন সে বলেছিল, ‘এ তো দেখছি চুলের ঝরনা! মেয়েরা কেন যে চুল কেটে ছোটো করে!’ চিরুনি থামিয়ে ও বলেছিল, ‘আমার তো কেটে ফেলতে ইচ্ছে করে।’ সে জবাব দিয়েছিল, ‘আমাদের বাড়িতে মেয়েরা চুল কাটে না।’ বিবির ভ্রূ কুঁচকে উঠেছিল কথাটা শুনে।

তাদের দুজনের জীবন যেন দুটি স্তরে বসানো। কেউ কারও মনের গতিবিধির খবর জানে না। জানার জন্য বিবির তরফ থেকে কখনো আগ্রহ প্রকাশ পায়নি। ওর সঙ্গে কোনোদিনই তার পরিচয় হয়নি। ওকে কখনো সে নগ্ন দেখেনি, বিছানাতেও নয়। রুটিনমাফিক সম্পর্কের বাইরে বিবি কখনো যায়নি।

ছাব্বিশ নম্বরের ফটক থেকে সে ভিতরে ঢুকতে গিয়ে থমকে পড়ল। ধুতি আর শার্ট পরা একটি লোক বেরিয়ে আসছে। কে হতে পারে? ধুতির বহর দেখে মনে হচ্ছে কোনো চাকর। দুলাল নয়। এত দিনে তার বয়স সত্তরের কাছাকাছি হওয়ার কথা। কিন্তু এর চলন অল্পবয়সিদের মতো। লোকটি তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একবার তাকাল মাত্র। সে একে আগে দেখনি।

পথের ডান দিকে বাড়ি, বাঁ দিকে পাঁচিল। পথটা সোজা গেছে বাগানে। কিন্তু তার আগেই ডান দিকে ঘুরে পথটা পৌঁছেছে বিরাট সদর দরজায়। বাগান অর্থে চারটে টেনিস কোর্ট হওয়ার মতো ঘাসের জমি। তার পুব দিকের পাঁচিল ঘেঁষে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। কামিনী, টগর আর শিউলির গাছ ছিল, কিন্তু সেগুলো কেটে ফেলতে হয়েছে তার স্টিল ফার্নিচারের কারখানা বসাবার জন্য।

সদর দরজার মাথায় আলোটা জ্বলছে। তাতে বাগানের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। প্রায় এক কাঠা জমিতে অ্যাসবেসটসের চালার কারখানাটি তিনটি ঘর নিয়ে। কাজ এখন হচ্ছে না কিন্তু একটি ঘরের দরজা খোলা, আলো জ্বলছে। ভিতরে থেকে কথার শব্দ আসছে। মিস্ত্রিরা এখনও বাড়ি যায়নি।

সদর খোলা। একতলায় সব সময় চাকর থাকে কিন্তু এখন নেই। দরজা দিয়ে ঢুকেই একটা বড়ো ঘর। সেখানে কাঠের গোলাকার একটা বড়ো টেবিল, বেঞ্চ আর তিনটে চেয়ার। এটা বৈঠকখানা নয়, সম্মান দেবার মতো নয় এমন লোকেদের সঙ্গে দেখা করার ঘর। এই ঘরের ডানদিকে ভিতরের উঠোনে যাবার দরজা, তার পাশেই দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। ঘরের বাঁ দিকে বৈঠকখানা। ভিতরে উঠোন ঘিরে নীচু দালান, তার পাশে পাশে দুটো রান্না ঘর, কল—পায়খানা, কাজের লোকেদের থাকার ঘর।

অদ্ভুতভাবে নিঃশব্দ বাড়িটা। সে ভাবল এটা কি তার জন্যই? আজ সে খালাস পেয়ে বাড়ি ফিরবে এটা নিশ্চয় দাদা, বউদি, ছেলেমেয়েরা, বিবিকে লেখা তার চিঠি মারফত জেনে গেছে। কিংবা বিবি কাউকেই জানায়নি। দেখা করতে যাওয়া বন্ধ করার পর সে আটটা চিঠি দিয়েছিল। প্রথম দুটোর দায়সারা উত্তর পাওয়ার পর আর জবাব পায়নি। বিবি বাড়ির লোকেদের সম্পর্কে একটি কথাও লেখেনি। শুধু, ‘আমরা সবাই ভালো আছি। আশা করি তুমিও ভালো আছ।’

একতলার ভিতর থেকে কাপড় কাচার অস্পষ্ট শব্দ আসছে। কান পেতে দোতলার পিছন মহলে তার দাদা গোপেন্দ্রর ঘর থেকে হিন্দি সংলাপ ক্ষীণভাবে শুনতে পেল। বোধহয় টিভি—তে সিরিয়াল হচ্ছে। সদর ঘরের উপরেই বড়ো, মাঝারি আর একটা ছোটো—তিনটি ঘর আর চওড়া একটা দালান নিয়ে তার মহল। দুটো ঘরের সঙ্গে জুড়ে বাইরের বাগানের দিকে জাফরি—কাটা রেলিংয়ের টানা বারান্দা। সদর দিয়ে ঢোকার সময় বারান্দায় সে আলো দেখেনি।

সিঁড়ি দিয়ে সে দোতলায় উঠে এল। শেষ ধাপের পর একটা চৌকো জায়গা। সামনের দরজাটা তাদের, ডান দিকেরটা দাদার। সিঁড়ির দেওয়ালে কয়েক ধাপ অন্তর চারটে নিগর্স—চিত্র, সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো। ফ্রেমের রঙ কালো হয়ে গেছে, কাচে ময়লা জমে ছবিগুলো অস্পষ্ট। এগুলো পরিষ্কার রাখার দায়টা যৌথ, কেননা সিঁড়িটা সবাই ব্যবহার করে। পরিষ্কার করার কাজটা সে দুলালকে দিয়ে করাত। ছবিগুলো নোংরা হয়ে রয়েছে, সে ধরে নিল দুলাল আর এই বাড়িতে নেই।

সামনের দরজাটা বন্ধ। সন্তর্পণে দরজার কড়া ধরে সে ঠুকঠুক শব্দ করল। ভিতরের প্রথম ঘরটাই ছিল বাবা—মার। তারপর তার আর বিবির, এখন সম্ভবত শুধুই বিবির। ওর কান খুব সজাগ। যদি ঘরে থাকে তাহলে এই ঠুকঠাক শব্দটুকুই শুনতে পাবে। জানে আজ সে ছাড়া পাচ্ছে সুতরাং বিবি প্রতীক্ষা করছে। তবে গত চারবছর যে তার সঙ্গে দেখা করেনি, চিঠিরও উত্তর দেয়নি, তার প্রতীক্ষাটা স্বামীর সঙ্গে ষোলোবছর পর মিলনের আশায় উচাটন মন, অধীরা বিরহিণীর মতো যে হবে না, এটা সে জানে। মনের গভীরে ভয় মেশানো একটা অস্বস্তি সে বোধ করল।

বিবি প্রতীক্ষা করছে একটা বোঝাপড়ার জন্য এবং সে জানে রাঘবেন্দ্র দত্তর বৈধ স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ের মা বোঝাপড়ার জন্য প্রতীক্ষা করতেই পারে।

দুই

ভিতর থেকে পায়ের শব্দ দরজা পর্যন্ত এল। তার মনে হল দরজার আই—হোল দিয়ে কেউ তাকে দেখছে। বিবি না অন্য কেউ? সে মুখ নামিয়ে অপেক্ষায় রইল।

দরজার দুটো পাল্লা ফাঁক করে যে দাঁড়িয়ে, তাকে সে কখনো দেখেনি। মাঝবয়সি এক স্ত্রীলোক। সিঁদুর নেই, থানকাপড়ে ঘোমটা দেওয়া উজ্জ্বল শ্যাম মুখ। চোখে সন্দিগ্ধ কৌতূহল।

‘কাকে চাই?’ নীচু গলায় প্রশ্ন করল।

‘বাড়িতে কেউ নেই?’ সে পালটা প্রশ্ন করল।

‘সবাই কাল চন্দননগর গেছে, আপনি?’

‘আমার নাম রাঘবেন্দ্র দত্ত।’ তার নাম শুনে প্রতিক্রিয়া কী হয় দেখার জন্য সে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

প্রত্যাশিত চেনা নাম শুনলে যা হয় মুখে সেটাই ফুটে উঠল। সেইসঙ্গে একটা স্বস্তিও। বোধহয় তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। দরজার পাল্লা দুটো পুরো খুলে দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল। সে ভিতরের চওড়া শ্বেত পাথরের দালানে পা রাখল।

ষোলো বছর পর নিজের আবাসে। বুকের মধ্যে একটা মোচড় দিল। এখন সে সত্যি সত্যিই তাহলে মুক্ত। এই মুহূর্তটার জন্য সে কতবছর যে অপেক্ষা করেছে। তার সারা শরীরের লোমকূপ থেকে উৎকণ্ঠা, প্রত্যাশা, উদবেগ আর হতাশা যে অবসাদ তৈরি করেছিল, তা যেন বাষ্প হয়ে বেরিয়ে তার চোখদুটোকে সজল করে দিচ্ছে। এবার সে নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে। কিন্তু বিবির চন্দননগরে যাওয়াটা কি খুবই জরুরি ছিল?

‘আপনি দুপুরে আসবেন তাই ভাত করে রেখেছিলুম।’

এ কে? দিনরাতের কাজের লোক? নিশ্চয় নিঃসন্তান, অনাথা বিধবা এবং ভদ্র গেরস্ত বাড়িরই, না হলে বিবি রাখত না। এর হাতে সংসার ছেড়ে দিয়ে চলেও যেত না। বিবির খুব কাছের লোক!

‘দুপুরে আসব কে বলল?’

‘বউদি বলেছিলেন।’

‘কোথা থেকে আসব বলেছে?’

মুখে থতমত ভাব। নিশ্চয়ই জানে সে জেল খেটে আসছে, নিশ্চয়ই জানে কেন সে জেলে গেছিল। সে মুখ থেকে চোখ সরিয়ে বাঁয়ে প্রথম ঘরের দিকে তাকল। এই ঘরটার নাম কত্তার ঘর। বাড়ির কর্তারা, তার ঠাকুরদা দ্বারিক দত্ত, বাবা অমিয় দত্ত এই ঘরে বাস করেছে, মারাও গেছে। ঠাকুরদাকে সে দেখেনি। দরজায় ফিকে হলুদ জমিতে হালকা খয়েরি চাকার মতো ছাপ দেওয়া পরদা। পুকুরের জলে ঢিল ফেললে চক্রাকার তরঙ্গ যেমন বাড়তে বাড়তে পাড়ের দিকে যায়, সেই রকম। দরজার দু—পাশে দুটো জানালারও একই কাপড়ের পরদা। দালানের দুটো টিউব আলোই জ্বলছে। এই উজ্জ্বলতার মধ্যে চক্রাকার তরঙ্গগুলো যেন জীবন্ত হয়ে তার বুকের মধ্যে আর একটা তরঙ্গ তুলল। তার মনে হল সব কিছুই ঠিক আছে, চিন্তার কিছু নেই। তার নিজের জায়গা তাকে আগের মতোই গ্রহণ করবে।

দালানের ডান দিকে কাঠের ফ্রেমে তিন রঙের ঘষা কাচ বসানো টানা লম্বা জানালা। আটটা ছোটো ছোটা পাল্লা। খুললেই নীচে উঠোন, উলটোদিকে একইরকম কাচ বসানো দাদার দালান। রোদ যখন পশ্চিম থেকে আসে, এই দালানটা তখন রঙিন হয়ে যায়। সে আবার বিকেলের দালানকে ফিরে পাবে।

‘চন্দননগর কেন গেল?’

‘বউদির ভাইঝির মুখে ভাত।….আপনার ভাত তোলা আছে, গরম করে দোব?’

‘পরে। জানলাগুলো বন্ধ কেন?’

‘বউদি বলে গেছেন।’

‘তোমার নাম কী?’

‘অরুণা।’

‘কতদিন এখানে আছে?’

‘দু—বছর।’

‘আগে কোথায় ছিলে?’ কথাটা বলে সে এগিয়ে গেল। পরদাটা সরিয়ে ঘরের ভিতরে তাকাল। আলো নেবানো, সে ডান হাত দিয়ে দরজার পাশের দেওয়ালে তৃতীয় সুইচটা খুঁজে নিয়ে টিপল। হুবহু সেই ষোলো বছর আগের ঘর। পুবের দেওয়ালে বাবা—মার ছবি একই জায়গায়। মেহগনির খাটটা নড়াতে কম করে চারজন জোয়ানের দরকার। ওটাও একই জায়গায়। তবে একটু—আধটু অন্যরকম এতদিনে যে হবে, এটা সে ধরেই রেখেছে। বেডকভারেও হলুদ—খয়েরি। তার নীচে দুটো মাথার বালিশ। নিশ্চয় বিবি আর গুলুর। আয়না লাগানো আলমারিটা বাঁ দিকে উত্তরের দেওয়ালে সরানো হয়েছে আর সেই জায়গায় একটা কাঠের টেবিল। তার উপর কয়েকটা বই, টেবল ল্যাম্প, প্রচুর খাতা, কাঠের গ্লাসে রঙিন পেনসিল ও কলম আর একটা হাতল—ছাড়া চেয়ার। এগুলো নতুন। টিভি সেটটা এই ঘরেই ছিল, সেটাই শুধু নেই।

‘আগে কোথায় ছিলে?’ সে অরুণার মুখের দিকে তাকাল।

ঘোমটা বাড়িয়ে দিয়ে অরুণা বলল, ‘বাপের বাড়ি। আগে কোথাও কাজ করিনি।’

সে কাঁধ থেকে থলিটা নামিয়ে সেটা বিছানার উপর ছুড়ে দিয়ে পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে শুরু করল।

‘আপনি ভাত খাবেন তো?’

 ‘আগে চান করব।’

সে বিছানায় বসল। শিমুল তুলোর চার ইঞ্চি পুরু গদির উপর দুটো তোশক। তার সারা দেহ কয়েক সেকেন্ড থরথর করেই স্তিমিত হয়ে এল। দু—হাতের চেটো বিছানায় আলতো বোলাতে বোলাতে সে হাসল। তার পরিচিত আরাম এবার সে পেল, এবার থেকে পাবে। চেটো দুটো সে দুই গালে চেপে ধরে দেখল, দরজা থেকে অরুণার কৌতূহলী নজর।

‘খুব অবাক লাগছে?’

অপ্রতিভ হয়ে অরুণা মুখটা পাশে ফেরাল। সে দেখল, যাই যাই করেও তারুণ্য ওর ঠোঁটে চিবুকে আর চোখে এখনও হালকাভাবে লেগে আছে। রাতে এই বাড়িতে আমরা দুজনেই শুধু থাকব, এমন একটা পরিস্থিতি রেখে দিয়ে বিবি ছেলেমেয়ে নিয়ে চন্দননগর চলে গেল কেন? এটা কি ইচ্ছে করে? সে অরুণার দিকে সোজা তাকাল।

‘বাড়িতে তুমি একা, আর কোনো লোক নেই?’

‘বাইরের কাজের জন্য হেমন্ত আছে, নীচে থাকে। ওকে ডেকে দোব?’

‘থাক।’

বাইরের বারান্দার দরজাটা খোলা। সে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এখনও কারখানা ঘরে আলো জ্বলছে। জরুরি বড়ো অর্ডার থাকলে সারারাত সে কাজ করিয়েছে। নিজেও মিস্ত্রিদের সঙ্গে রাত জেগেছে। কিন্তু এখন কারখানাটা কে চালাচ্ছে, কে দেখাশোনা করে? বিবি? চালাবার মতো যোগ্যতা ওর আছে। বিবি খুব শক্ত আর হিসেবি, অলস নয়। ব্যবসাটা বড়ো নয়, তাহলেও চালাতে গেলে বিশ্বাসী লোক দরকার, অর্ডার ধরার জন্য নানান জায়গায় যেতে হয়। পার্টির কাছে থেকে টাকা আদায় একটা বড়ো সমস্যা।

এবার থেকে সে আগের মতো নিজেই কাজকারবার দেখবে। সে উত্তর থেকে দক্ষিণে বাগানের উপর দিয়ে চোখ বোলাল। পিছনের বাড়িগুলোর জানালায় আলো জ্বলছে। বাঁ দিকে শিবু বর্ধন লেনের সেই বাড়িটার জানালায় পরদা সরানো। বারান্দা থেকে সে চিঠি তুলে ইশারা করত সনতের বোন মিতাকে। পরে জেনেছিল ওর ভালো নাম সুমিতা। মিতা তখন ক্লাস সেভেনে, সে টুয়েলভে। একদিন মিতা বেদম মার খেল তার মায়ের হাতে। ওকে এলাহবাদে মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হল। কিছুদিন সে খুব মনমরা হয়েছিল, তারপর মিতাকে ভুলে গেল। কম বয়সে এই রকমই হয়, ক্ষীণ হাসি ফুটল তার চোখে।

ভালোই হয়েছে। দুজনের পক্ষেই ভালো। মিতা কোনোভাবেই বিবির ধারে—কাছে আসে না। সে বারান্দা থেকে ফিরে এসে টেবিলটার পাশে দাঁড়াল। একনজরেই সে বুঝল, পড়াশুনোর জন্য এটা ব্যবহৃত হয়। বইগুলো ফিজিক্সের। বিবি কেন যে এমএসসি পড়তে রাজি হল না, সেটা আজও তার কাছে রহস্য। বাবাও অনুরোধ করে বলেছিল, ‘আমাদের বাড়িতে এমএ তো দূরের কথা, গ্র্যাজুয়েট বউ—ঝিও নেই। ছোটো বউমা তুমি পড়তে চাইলে পড়ো।’ বিবি মুখ নামিয়ে বলেছিল, ‘দেখি।’

বিবি দেখেনি। বাবা মারা গেলেন। বিবিকে সে বলেছিল, ‘বাবার ইচ্ছেটা পূরণ করো।’ একই জবাব তাকেও দিয়েছিল। একটা খাতা তুলে মলাট দেখেই বুঝল, উচ্চচ মাধ্যমিক পরীক্ষার উত্তরপত্র। প্রায় ষাট—সত্তরটা খাতা। এগুলো এখানে কেন? বিবি স্কুলে বা কলেজে পড়াচ্ছে নাকি! সে দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা অরুণার দিকে তাকাল।

‘বউদি স্কুলে পড়ায়?’

‘কলেজে পড়ান।’

‘কতদিন পড়াচ্ছে?’

‘বলতে পারব না, আমি তো এসে তক দেখছি পড়াচ্ছেন।’

বিবি তাহলে এর মধ্যেই এম এসসি পাশ করেছে! আশ্চর্য, খবরটা তাকে জানায়নি! আরও কত কী সংসারে ঘটে গেছে কে জানে! বাড়িতে ঢুকে এই প্রথম সে একটা নাড়া খেল। তার মনে হল, বিবি ইচ্ছে করেই যেন স্বামী আর শ্বশুরকে অগ্রাহ্য করেছিল, আর সেটা বুঝিয়ে দিতেই ওদের অনুপস্থিতিটাকে কাজে লাগিয়েছে।

কিন্তু ব্যাপারটাকে সে এভাবেই বা দেখছে কেন? সংসারের প্রধান, একমাত্র পুরুষটি না থাকায় অবশ্যই স্ত্রী একা হয়ে পড়েছিল আর মানুষের সঙ্গ পাওয়ার জন্য তাকে তো বাড়ির বাইরে যেতে হবেই। এ বাড়িতে বড়ো জায়ের সঙ্গে বিবির ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তার বউদি বাড়ির বাইরে যাওয়ার সময় ছাড়া ব্রেসিয়ার পরে না।

কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য বিবি আবার পড়াশুনো শুরু করল তাতে অস্বাভাবিক কিছু খোঁজার মানে হয় না। কিন্তু চাকরি নিল কেন, টাকাপয়সার অভাবে? জেলে থাকার সময়, মামলা চালাবার খরচের জন্য সে তার যাবতীয় স্থাবর—অস্থাবর সম্পত্তি দেখাশোনার আর বিক্রি করার, পোস্ট অফিসের সার্টিফিকেট ভাঙানোর আর ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার অধিকার সই করে বিবিকে দিয়েছিল উকিলের দেওয়া স্ট্যাম্প পেপারে। ব্যাঙ্কের নগদ টাকা, ব্যবসা আর গোকুলানন্দের চাষের যে জমিজায়গা, তার থেকে কত খরচ হয়েছে তিন বছর ধরে মামলা চালাতে? স্বামীর জন্য বিবি কি এমনই নিঃস্ব হয়ে গেল যে, তাকে চাকরি করতে হচ্ছে!

‘বউদির কলেজ কোথায়?’

‘বালিগঞ্জে।’

‘আমি এখন চান করব।’

সে ঝুলি থেকে খয়েরি ট্রাউজার্স আর সবুজ—সাদা ডোরাকাটা হাওয়াই শার্টটা বার করল। দরজিকে দিয়ে মাস ছয়েক আগে তৈরি করানো। তার অন্যান্য পোশাক, তোয়ালে, সাবান, আয়না, যা কিছু ছিল বিলিয়ে দিয়ে এসেছে। বিবি একটা পুরো—হাতা সোয়েটার বছর দশেক আগে কিনে দিয়েছিল। সেটার দশা দেখে কেউ নিতে চাইল না। জেলে রোজগার থেকে যা জমেছিল তার থেকে এত বছর ধরে খরচ—খরচা বাদ দিয়ে জেলার তাকে দিয়েছে সাতাশশো তেরো টাকা। আজ প্রায় চারশো খরচ হল। কত বছর পর সে এতটাকা অন্য লোকের হাতে দিল।

কাগজে মোড়া নোটগুলো বিছানার উপর রেখে সে বলল, ‘তোয়ালে আছে?’

‘কলঘরে নতুন তোয়ালে দেওয়া আছে।’

প্রত্যেকের জন্য আলাদা তোয়ালে, আলাদা চিরুনি এই বাড়ির নিয়ম। কলঘরের দরজার সামনে তোয়ালেগুলো দড়িতে ঝোলানো থাকে। চান করতে যাবার সময় যে যার নিজেরটা নিয়ে যায়, বেরিয়ে এসে আবার ঝুলিয়ে দেয়। প্রত্যেকটার আলাদা রঙ আর নকশা, ভুল হবার উপায় নেই।

‘তোয়ালে দিতে কে বলল, বউদি?’ কথাটা বলেই সে উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকাল।

‘হ্যাঁ’। একটা হালকা বাতাস খেলে গেল তার বুকের মধ্যে। তার দরকারের দিকে বিবি সজাগ থাকবে, এটা তো স্বাভাবিকই। তাকে পাঞ্জাবি খুলতে দেখে অরুণা দরজা থেকে সরে দালানে গিয়ে দাঁড়াল।

দালানটা চওড়া। কত্তার ঘর, তারপর মেজো ঘর। এই দুটো ঘরের মাঝে দেওয়াল ঘেঁষে খাওয়ার টেবল। জন্মে থেকেই সে শ্বেত পাথর বসানো টেবলটা আর কাঠের ছ—টা চেয়ারকে দেখে এসেছে। টেবলে রাখা জিনিসগুলো আগে সে দেখেনি, শুধু টেলিফোনটা ছাড়া। আগের ভারী কালো রঙের বদলে এটা জলপাই রঙের হালকা। টেবলের পাশেই ফ্রিজ। সাদার বদলে এটা টোমাটো রং—এর। তার অনুপস্থিতিতে কেনা। টুলের উপর রাখা জলের ফিলটারটাও নতুন। পিতলের ফুলদানিটা মোরাদাবাদি। তাতে আধ শুকনো রজনীগন্ধার কয়েকটা ছড়। প্লাস্টিকের ছোটো ধামায় চারটে সিঙ্গাপুরি কলা, খোসা কালো হয়ে উঠেছে। কাচের দুটো নুনের কৌটো, উপুড় করা চারটে স্টিলের গ্লাস আর নিকেলের ফোল্ডিং ফ্রেমের মধ্যে পোস্টকার্ড মাপের দুটি শিশুর রঙিন ছবি।

কলঘরে যাওয়ার সময় সে টেবলের পাশে থমকে ছবি দুটোর দিকে তাকাল। বছর দশেকের একটি মেয়ে, মাথায় কুঁচি করে ঘোমটার মতো বাঁধা ওড়না, ফুলের মুকুট, কপালে চন্দনের ফোঁটা, চোখে পুরু কাজল। সামনে থেকে তোলা ছবি, নাকটা হুবহু বিবির মতোই সরু, লম্বা। বোধহয় নাচের কোনো অনুষ্ঠানের পর সাজঘরে তোলা ছবি। মেয়েটি গুলু নিশ্চয়। এত ভারী মেক আপে বোঝা যাচ্ছে না মুখটা কেমন। হাসির জন্য ঠোঁট দুটি খোলা, নীচের একটা দাঁত নেই। অন্য ছবিটি অবশ্যই গোরার। ট্রাই সাইকেলে বসে, প্যাডেলে চটি—পরা পা, হাফ প্যান্ট, গোল—গলার গেঞ্জিতে ছাপছোপ দেওয়া, বাগানে তোলা ছবি। মুখটা সে ছবির কাছে নিয়ে গেল। তার মনে হল, শিশুটির চোখের মণির রঙ তার মতোই কটা, কান দুটি দীর্ঘ, চোয়াল সামান্য চওড়া। ভ্রূকুটি করে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে। দুজনে এখন কত বড়ো হয়েছে? গুলুর বয়স এখন কুড়ি, গোরার আঠারো। সে মুখ ঘুরিয়ে পাশে তাকাল। অরুণা তাকে লক্ষ করছে। ‘দাদামণি আর দিদিমণির ছবি।’ অরুণা পরিচয় দিল ছবি দুটোর।

‘জানি’।

সে দ্রুত পায়ে কলঘরের দিকে এগোল। দালানের শেষ প্রান্তের ঘরটাকে বলা হয় ছোটো ঘর। তার ডান পাশের সরু পথ দিয়ে যেতে হয় কলঘরে আর পায়খানায়। দড়িতে ঝুলছে তিনটি শুকনো রঙিন তোয়ালে। সে তিনটিতেই নাক ঠেকিয়ে গন্ধ নিল। বিবির গায়ের গন্ধ কোনটিতে সে বুঝে উঠতে পারল না। ও চান করে বেরিয়ে আসার পর কলঘরটা ভরে থাকত যুঁইয়ের গন্ধে। এই গন্ধের সাবান ছাড়া মাখে না। তোয়ালেতেও গন্ধটা লেগে থাকত। কাল চন্দননগর গেছে চান করে, আজ গন্ধ থাকার কথা নয়।

কলঘরে নিকেলের রডে ঝুলছে একটা সাদা তোয়ালে, তাতে আনকোরা গন্ধ। সাবানদানিতে সাদা নতুন সাবানের নীচে আধ খাওয়া একটা গোলাপি সাবান। সে শাওয়ারের কলটা ঘুরিয়েই বন্ধ করে দিল। পাজামাটা শুকনো রাখা দরকার, এটা পরেই কলঘর থেকে তাকে বেরোতে হবে। চান করে পরার মতো কিছু অরুণা রাখেনি। বিবি কি ভুলে গেছিল একটা পাজামা রেখে দেবার কথা বলতে! কিন্তু তার পুরনো জামা প্যান্ট, জুতো কি এখনও পরার মতো অবস্থায় আছে?

মাথার উপর থেকে বৃষ্টির মতো জল ঝরে পড়ছে। সে চোখ বন্ধ করল। কানের পাশ দিয়ে জলধারা গড়িয়ে নামছে। কাঁধ, বাহু, বুক যেন শুষে নিচ্ছে খরা জমির মতো। মুখ তুলে সে জলের আঘাত চোখে, কপালে, গালে নিতে লাগল। রাত্রে নিয়মিত সে চান করত চুল না ভিজিয়ে। সারারাত পাখার তলায় ভেজা চুলে শুলে তার সর্দি হয়। হয়তো কাল তার সর্দি হবে।

কলটা বন্ধ করে সে নতুন সাদা সাবানটা তুলে দিয়ে শুঁকল। ল্যাভেন্ডারের গন্ধ। সেটা রেখে দিয়ে গোলাপিটা শুঁকল। জুঁই, এটা বিবি মাখে। একটু ইতস্তত করে সে গোলাপি সাবানটা গলায় ঘষল। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে অনুভব করার চেষ্টা করল, কিছু একটা তার মধ্যে ঘটে কি না। কিন্তু কিছুই ঘটতে শুরু করল না।

সাবানটা বুকে পেটে ঘষতে ঘষতে তার মনে পড়ল, সেদিনও তার দেহের কোষগুলো প্রবল সুখে ফেটে পড়েনি, আবেশে ঝিমিয়েও যায়নি। মনের মধ্যে শুধু একটা জ্বালা বোধ করেছিল। ষোলো বছর আগে এগারোই জুন শুক্রবার রাতে সে মেজোঘর থেকে এসেছিল কত্তার ঘরে। খাটে চতুর্থ জনের জন্য জায়গা হত না, তাই ছেলেমেয়ে নিয়ে বিবি এই ঘরে শোয়।

‘আজ থাক।’

‘বিবি প্লিজ।’ পাজামাটা খুলতে খুলতে সে বলেছিল।

‘কালকে বরং—’

‘কাল সকালে গোকুলানন্দে যাচ্ছি, রোববার বিকেলে ফিরব।’

‘ফিরে এসে বরং—’

‘না।’

অধৈর্য রুক্ষ স্বরটা বিবিকে বুঝিয়ে দিয়েছিল প্রত্যাখ্যান করলে আরও রূঢ়তা আসবে।

‘ওদের ঘুম যেন না ভাঙে।’

এ বাড়িতে তার জন্য বিবির ওটাই শেষ কথা। দু—হাতে অনিচ্ছুক ঊরুদুটো সরিয়ে তাকে নিজের জন্য জায়গা করতে হয়েছিল। আজও মনে আছে, তখন ঘুষি মেরে বিবির মুখটা থেঁতলে দিতে পলকের জন্য একবার ইচ্ছে করেছিল। প্রচণ্ড রাগ চেপে সে হিংস্রভাবে নিজের বিরাশি কেজি ওজন আছড়ে ছিল ওর নরম শরীরে। ওর ঠোঁট চাপা মুখ থেকে সে একটা শব্দ বার করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়, বিবি টুঁ শব্দটি করেনি। অন্ধকারের মধ্যেই সে ওর চোখের মণিদুটোকে পাথরের মতো কঠিন নিষ্পন্দ হয়ে থাকতে দেখেছিল। নিজের উপর অহেতুক একটা রাগ আর জ্বালা নিয়ে সে মেজোঘরে ফিরে আসে। ব্যাপারটা ধর্ষণ ছাড়া আর কিছু নয়, শেষ রাত পর্যন্ত জেগে থেকে এই চিন্তাটা যতই তার মাথায় ধুঁইয়েছে, ততই সে গ্লানিতে আচ্ছন্ন হয়েছে। বিবি তাকে কখনোই বোঝার চেষ্টা করেনি, তাকে দয়া দেয়নি।

কিন্তু তার অপরাধটা কী? একজন স্বাভাবিক, সক্ষম স্বামী যা করে থাকে, সেইটুকুই সে করতে চেয়েছে। তা হলে এই বিরোধিতা কেন? ওর ইচ্ছা—অনিচ্ছার সামনে কী হাত জোড় করে দাঁড়াতে হবে? সে স্ত্রীকে ভালোবাসে, সুন্দরী, শিক্ষিত বিবির জন্য তার অহংকারও আছে। তবু কেন তাকে অপছন্দ করে, যেটা এক—এক সময় ঘৃণার মতো মনে হয়। বিবি এখনও কী ষোলো বছর আগের মতোই রয়ে গেছে?

চটকানো সাবানটা মুঠোর আঙুলের ফাঁক দিয়ে কাদার মতো বেরিয়ে আসতেই তার হুঁশ ফিরল। শুকিয়ে যাওয়া ফেনায় সারা গা চিটচিট করছে। শাওয়ারের কল খুলে দিয়ে সে চোখ বন্ধ করে হাসল, কাল তার সর্দি হবেই।

অরুণা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে। দালানের পাখাটা ঘুরছে। গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে তাকে আসতে দেখে সে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘তোয়ালেটা দিন।’

‘দড়িতে তো জায়গা নেই আর।’

‘আর একটা দড়ি আছে।’

আর একটা দড়ি সে দেখেছে। তাতে একটা গামছা ঝুলছে, নিশ্চয় সেটা অরুণার। কাজের লোকের গামছা আর তোয়ালে একই দড়িতে থাকবে না, এটাই এ বাড়ির রীতি। তাহলে শুকনো তোয়ালেগুলো সরিয়ে তার তোয়ালের জন্য জায়গা বার করে দিতে পারে। অরুণা সেটা করার কথা ভাবল না কেন? আমাকে কি নীচু চোখে দেখছে? বিবির কাছ থেকে ও কতটা শুনেছে আমার সম্পর্কে?

তোয়ালেটা রেখে এসে অরুণা বলল, ‘চিরুনি দোব?’

‘এখন না, চুলটা আগে শুকোক। তুমি পাখাটা আর একটু বাড়িয়ে দাও আর খাওয়ার জল দাও।’

রেগুলেটারটা এক ঘর বাড়িয়ে অরুণা তার দিকে তাকাল।

‘আরও এক ঘর দাও।’

মুখ তুলে ঘূর্ণির বৃদ্ধিটা দেখতে দেখতে তার খেয়াল হল পাখাটা নতুন। ছোটো ছোটো অনেক বদলই ঘটে গেছে।

‘আপনাকে একটা গেঞ্জি দোব?’

অবাক হয়ে সে তাকাল। ‘গেঞ্জি আছে নাকি?’

‘দাদামণির আছে।’

‘গোরার!’ আরও অবাক সে। গোরা কত বড়ো হয়েছে? ‘আনো তো।’

অরুণা মেজোঘরের বন্ধ দরজায় পেতলের হুড়কোটা খুলে ভিতরে গেল, গোরা তাহলে এই ঘরেই থাকে। অরুণা গেঞ্জি এনে হাতে দিতেই সে চোখের সামনে ঝুলিয়ে অবিশ্বাসভরে তাকিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘এটা গোরার তো? ….. এত বড়ো হয়ে গেছে!’

গেঞ্জিটা পরে সে গভীর তৃপ্তির হাসি হাসল। আমার চেহারাটাই পেয়েছে, আঠারো বছরে আমি এত বড়োই ছিলাম। সে ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াল।

‘আপনার ভাত গরম করে আনি?’

‘কী রান্না হয়েছে?’

‘মসুর ডাল, আলু—পটলের ডালনা আর মাংস।’

মসুর ডাল তার প্রিয়, এটা অরুণার জানার কথা নয়। নিশ্চয় বিবি বলে দিয়েছে। ডালের সঙ্গে ভাজা না থাকলে সে খেতে পারে না। মসুর ডালের সঙ্গে তার পছন্দ করলা ভাজা।

‘ভাজা করোনি?’

‘করলা ভেজেছি।’

‘বউদি বলে দিয়েছে?’

‘হ্যাঁ।’

তার চোখ ক্ষণেকের জন্য উজ্জ্বল হল। আসল জায়গায় বদল ঘটেনি। বিবি ভোলেনি তার পছন্দের ব্যাপারটা। একটা আবেগ তার বুক থেকে উঠে আসছে। সে ঢোঁক গিলে সেটাকে নামিয়ে দেবার চেষ্টা করল।

অরুণা একতলায় নেমে গেছে। জামা, ট্রাউজার্স আর নোটগুলো আবার ঝুলিতে ভরে সে একপাশে সরিয়ে রাখল। কাপড়চোপড়গুলো সে আর পরবে না ঠিক করেই রেখেছে। কাউকে দিয়ে দেবে, কিন্তু কাকে? তার মাপের লোক কে আর আছে? গোরা! পাগল নাকি, জেলের গন্ধ লাগা জিনিস নিজের ছেলেকে! বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে সে চোখ বন্ধ করল। বহু বহু বছর পর এমন একটা আরামের উপর সে শরীর রাখল। তার চেতনা থেকে অতীত ধীরে ধীরে এবার মুছে যাবে। একটা নতুন মানুষ হয়ে তার জীবন শুরু হবে আজ থেকেই।

অরুণার রান্নার হাত ভালো। সে প্রায় জাবর কাটার মতো অনেক সময় নিয়ে চিবিয়ে যাচ্ছে এক—একটা গ্রাস। টেবিলের অপর ধারে অরুণা দাঁড়িয়ে, সারা বাড়িতে কোনো সাড়াশব্দ নেই। দাদার টিভি বন্ধ। ও বাড়িতে দুই মেয়ে, নিশ্চয়ই এত দিনে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে, তাহলে এখন লোক মাত্র দু জন। ওরা দশটায় শুয়ে পড়ে। এখন কটা বাজে?

সে মুখ তুলে দেওয়ালঘড়িটা দেখার জন্য তাকাল। এতক্ষণ সে লক্ষ করেনি, পেন্ডুলাম ঝোলানো সাদা ডায়ালের ঘড়ির জায়গায় একটা সোনালি ফ্রেমের গোলাকার ঘড়ি রয়েছে। ডায়ালটা ফিকে গোলাপি, তিনটে কাঁটা সোনালি। রাত্রে ঘুম না এলে সে দালানের ঘড়ির টকটক শব্দ শুনতে পেত। প্রতি ঘণ্টায় আর আধ—ঘণ্টায় ঘড়িটা বাজত। হপ্তার দম সে নিজের হাতে দিত।

‘আগের ঘড়িটার কী হল?’

‘জানি না। আমি এসে তো এই ঘড়িটাই দেখছি।’

‘তুমি রাতে শোও কোথায়?’

‘বউদির ঘরে, মেঝেয়।’

‘বউদির ঘর’ শব্দটা তার কানে বাজল। এটা তার কাছে নতুন। ‘কত্তার ঘর’ কথাটা হয়তো কেউই আর বলে না। গুলু আর গোরার জন্য এই বাড়ির কতটা অতীত বাকি রইল।

‘আমি আজ আসব, এটা আর কে জানে?’

‘হেমন্ত জানে।’

‘ও বাড়ির কেউ?’

‘বউদি বলতে বারণ করেছে।’

‘দালানের জানালা তুমি বন্ধ করে রেখেছ?’

‘বউদি আজ বন্ধ করে রাখতে বলেছে।’

‘আমি কেন জেলে গেছিলাম, জানো?’

সে অরুণার মুখের দিকে তাকাল। বিবি ওকে কী বলেছে, সেটা জেনে রাখা দরকার। বাড়ির আর পাড়ার লোকেরা, আত্মীয়স্বজনেরা কী শুনেছে বা জেনেছে তা সে জানে না। না জানলেও সে অনুমান করতে পারে। শুধু তো খুন নয়, তার সঙ্গে ছিল—।

‘আপনাকে কতকগুলো লোক খুন করতে এসেছিল। আপানি আটকাতে গিয়ে তাদের একজনকে মেরে ফেলেন।’

বিবি যতটা সম্ভব করেছে। ব্যাপারটাকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য এর থেকে ভালো গল্প আর কী হতে পারে! সে মেরে ফেলেছে, খুন করেনি, সে অপরাধ করতে বাধ্য হয়েছে—এই কথা কি বিবি ছেলেমেয়েদেরও বলেছে?

‘আপনাকে কী আরও মাংস দোব?’

‘না। রান্না ভালো হয়েছে।’

‘ঝাল ঠিক হয়েছে? বউদি বলেছিল আপনি বেশি ঝাল খান।’

সে মাথা হেলিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে।’

‘টক দই এনে রেখেছি।’

নিশ্চয় বিবি ওকে বলে গেছে। ওই বাড়িতে একমাত্র সে—ই মিষ্টি পছন্দ করে না। বাবার ডায়াবিটিস ছিল, তবু প্রতি রাতে চারটে সন্দেশ না খেলে তার ভালো ঘুম হত না। নিজের খাওয়ার ব্যাপারে বিবি কড়াভাবে নিয়ম মেনে চলে। এখনও হয়তো রাতে শোয়ার আগে এক গ্লাস দুধ খায়। এটা ওর ছোটোবেলার অভ্যাস।

ফ্রিজ থেকে অরুণা দইয়ের ভাঁড় বার করে চামচ দিয়ে দই কেটে পিরিচে রাখছে। সে আড়চোখে অরুণার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথার মধ্যে হঠাৎ একটা কম্পন অনুভব করল। হুবহু সেই আঙুল। মোটা, বেঁটে আর ভোঁতামাথার আঙুল। সেইরকম ভাবেই চৌকো সাদা নখগুলো ছাড়িয়ে আঙুলের মাথা বেরিয়ে রয়েছে। দুটো মানুষের আঙুল হুবহু এক হয় কী করে!

আমি কী এখনও তাহলে ভুলে যেতে পারিনি।

‘থাক।’ সে চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। ‘আজ আর দই খাব না। শরীরটা ভালো লাগছে না।’

অরুণাকে অনুরোধের সুযোগ না দিয়ে সে দ্রুত বেসিনের দিকে এগিয়ে গেল। সাবানে হাত ধুতে ধুতে বলল, ‘তুমি শোবে কোথায়?’

‘বউদির ঘরে।’

‘কোথায়?’

অরুণা মৃদুস্বরে বলায় সে স্পষ্ট শুনতে পায়নি। মুখ তুলে সামনের ছোটো আয়নাটায় সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। দালানের অর্ধেক আর টেবিলটা দেখা যাচ্ছে। অরুণা বাসন তুলছে। সে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘ কোথায় শোবে বললে?’

অরুণা তার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকাল। ‘কেন বউদির ঘরে, রোজ যেমন শুই।’

‘সেকি, এক ঘরে দুজন?’

‘তা কেন, আপনি আপনার ঘরে শোবেন, বিছানা তো করাই আছে।’

অরুণা ডানহাতের তর্জনি তুলে ছোটোঘরের বন্ধ দরজাটা দেখাল।

একটা চিৎকার তার গলা পর্যন্ত উঠে এসে থমকে গেল। সে বলতে চাইল, ‘বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। কোথায় আমি শোব, সেটা আমিই ঠিক করব। তুমি একটা ঝি, কাজের লোক। আর এই পরিবারের কর্তা আমি!’

‘ছোটোঘরে শোব, সেটা কে তোমায় বলল?’

‘বউদি।’

একহাতে বেসিনটা সে ধরে না নিলে টলে যেত। এই মেয়েমানুষটা তার মনিবের নির্দেশমাত্র পালন করছে। এর সামনে রাগ, ক্ষোভ চিৎকার মানে নিজেকেই সাধারণ স্তরে নামিয়ে আনা।

‘তুমি এখন নীচে খেতে যাবে?’

‘হ্যাঁ। ছোটোঘর খোলাই আছে।’

অরুণা নীচে চলে গেল। বিবি তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে, এটা সে একবারও ভাবেনি। ভাবা উচিত ছিল। চার বছর তার সঙ্গে দেখা করতে যায়নি, একটা চিঠিরও উত্তর দেয়নি, জেলের ফটকেও তাকে নিয়ে যাবার জন্য কেউ ছিল না। এগুলোই তো জানিয়ে দিয়েছে তাকে উপড়ে ফেলেছে এরা মন থেকে। এই বাড়িতে একটা মাছি আর সে কি একই ধরনের মনোযোগ পাবে? বুকের কাছে মাথা নামিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে রূঢ় ধাক্কাটা সামলে চেয়ারে এসে বসল।

তার মনে হচ্ছে সে যেন আবার অধিকার হারাল। মায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়েরাও তাকে বোধহয় পরিত্যাগ করবে। এখন আর সে বাবা নয়, স্বামী নয়, কিছুই নয় এই বাড়িতে। সে এই বারান্দায় হাঁটবে, সবার সঙ্গে কথা বলবে, টেবিলে বসে খাবে, টিভি দেখবে, বাড়ির বাইরে যাবে, প্রতিটি কাজ স্বাভাবিক মানুষের মতো করবে অথচ সে কিছুই নয়।

কী ভয়ংকরভাবে বিবি তাকে শাস্তি দিল। ও বোধহয় আজকের দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। ইচ্ছে করেই সবাইকে নিয়ে চন্দননগরে গেছে, যাতে তার নির্দয়তার আঘাতে ভেঙে পড়া একটা মানুষকে না দেখতে হয়। তার প্রতিভূ হয়ে অরুণা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই বাড়িতে তার জায়গা কোথায়।

আপাতত অ—দরকারি কিন্তু ভবিষ্যতে দরকার হতে পারে, এমন সব জিনিস রাখার জায়গা এই ছোটোঘর। একটা উঁচু কাঠের র‌্যাকে ছেঁড়া বই, খবরের কাগজ; ইলেকট্রিকের, কর্পোরেশন ট্যাক্সের, টেলিফোনের বিল, পুরনো জুতো, গ্রামোফোন রেকর্ড; ভাঙা আয়না, চেয়ার, শ্বেত পাথরের টুকরো এমনকী বাটনা বাটার শিল পর্যন্ত এই ঘরে ছিল। একটা ছোটো তক্তপোশে গোটানো থাকত শতরঞ্চি মোড়া তোশক। পুবে আর দক্ষিণে দুটো ছোটো জানালা, অন্য দুটো ঘরের মতো এর লাগোয়া কোনো বারান্দা নেই। আগে ছোটো একটা ছাদ ছিল, তার ঠাকুরদার সময়ে ছোটোঘরটা তৈরি হয়। বাড়ির সর্বত্র কাঠের কড়িবরগা, এই ঘরের লোহার।

সে ছোটোঘরের ভেজানো দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ভেজানো দরজাটা খুলে ঢুকলেই সে আর একটা জগতে পৌঁছে যাবে। জেল সে জানে। যাবজ্জীবন কারাবাসের দণ্ডাজ্ঞা নিয়ে জেলে ঢুকলেও সেখানে একটা প্রতিশ্রুতি ছিল, একদিন সে মুক্তি পাবে। কিন্তু এই ছোটোঘরটাকে সে জানে না। সে জানে না কীসের সম্ভাবনা এখানে রয়েছে। তার সারা শরীর কেঁপে উঠল। খুনের মামালায় আসামি, ধর্ষণের মামলায় আসামি, আমি রাঘবেন্দ্র নারায়ণ দত্ত, আমার আর কিছুই করার নেই। এবার আমি নিজেকে বিলোপ করার দণ্ড মাথা পেতে নিচ্ছি।

আমি এখনও বুঝতে পারছি না আমি কে! সে চোখ বন্ধ করে ছোটোঘরের দরজায় হাত রাখল।

তিন

সে ঘুমের মধ্যে অস্বস্তিভাবে নড়াচড়া করল। পাখা ঘুরছে তবু সে ঘেমে উঠল। একবার ঘুম ভেঙে উঠেও বসে। নতুন বিছানার চাদরের গন্ধ শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকে পাকাপাকিভাবে যদি রয়ে যায়, এমন একটা ধারণা তাকে কিছুক্ষণ বিব্রত করে রেখেছিল। মুখে ঘাড়ে জল দেবার জন্য বেসিনে যাওয়ার ইচ্ছাটা দমন করে সে আবার শুয়ে পড়ে। এই ঘরে কোনোদিনই সে রাত কাটায়নি। নতুন কলি করা হয়েছে, চুনের গন্ধ এখনও মিলিয়ে যায়নি।

চোখ বন্ধ করে বুকের উপর দু—হাত রেখে সে ঘুমোবার চেষ্টা করে। তখন আবছাভাবে মনে পড়ে শ্রীগোপালের কথাটা : ‘যদি ঘুম না আসে, তাহলে মদ খেলে আসবে।’ ‘তোকে কে বলল?’ ‘বাবাকে দেখেছি ঘুম না এলে খায়।’ ‘নন্দকাকা মদ খায়।’ ‘ঘরের তাকে কাগজে মোড়া বোতল লুকিয়ে রাখা আছে। আলো জ্বেলে প্রথমে দেখে নেয় আমি ঘুমিয়েছি কি না। আমি তখন মটকা মেরে থাকি।’ ‘তুই খেয়েছিস কখনো?’ ‘খেয়েছি। তুই খাবি?’ ‘খেলে মাতাল হয়, বাবা পিঠের চামড়া তুলে দেবে।’ ‘একটু খেলে কিচ্ছু হয় না। এলাচ দিয়ে পান খাবি, কেউ মুখে গন্ধও পাবে না। খাবি তো আমাদের ঘরে আয়।’ দুপুরে একতলায় নন্দকাকার ঘরে, কালমেঘ রস খাওয়ার মতো সে ঢক করে জীবনে প্রথমবার নির্জলা মদ খেয়েছিল। চোখ বুজে সে উগরে আসতে চাওয়া তরল জিনিসটাকে নীচের দিকে নামাতে ধস্তাধস্তি করেছিল নিজের সঙ্গে। চোখ খুলে সে শ্রীগোপালের লম্বা মুখ আর বেরিয়ে থাকা লম্বা দুটো উপরের দাঁতের দিকে তাকিয়ে ছলছল স্বরে বলেছিল, ‘ঘোড়ামুখো, তুই আমাকে নষ্ট করলি!’ সে ছুটে দোতলায় এসে ছোটোঘরের দরজা বন্ধ করে তক্তপোশে শুয়ে ছিল।

তখন সে ক্লাস এইটে, শ্রীগোপাল ক্লাস সিক্সে। তারা সমবয়সি ছিল। তাদের কাচ আর আয়নার ব্যবসা, গোকুলানন্দর জমি—জায়গা নন্দকাকাই দেখাশোনা করত। মা—মরা শ্রীগোপালকে মেদিনীপুরের গ্রাম থেকে নিয়ে যখন এল তখন তার বয়স দশ। ফেল করে করে শ্রীগোপাল কুড়ি বছর বয়সে মাধ্যমিক পাস করল, তার দু—মাস পর পঁয়তাল্লিশ বছর দত্তদের সেবা করে নন্দকাকা মারা গেল আলসারে ভুগে। মারা যাবার এক হপ্তা আগে নন্দকাকা দোতলায় উঠে এসেছিল বাবার সঙ্গে দেখা করতে। ‘বড়োবাবু, শ্রীগোপালকে একটু দেখবেন। আমি মরে গেলে ও অনাথ হয়ে যাবে। ‘ ‘একথা বলছ কেন নন্দ? রঘু আর শ্রীগোপালকে আমি আলাদা করে দেখি না তো। তুমি নিশ্চিন্ত থাক, ওর দায়দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।’ শ্রীগোপাল চেয়েছিল কলেজে ভরতি হতে। বাবাকে সেকথা সাহস করে বলতে পারেনি। তাকে ধরেছিল, ‘রোঘো, তুই বল। তুই বললে জ্যাঠামশাই শুনবেন।’ বাবা শোনেননি। ‘শ্রীগোপালের পড়াশুনোর মাথা নেই, মিছিমিছি বছরগুলো নষ্ট হবে। তার থেকে বরং রোজগারের চেষ্টা এখন থেকেই করুক। ওকে গোকুলানন্দে রাখব। ওর যা বিদ্যে তাতে চাকরিবাকরি হবে না, বরং চাষবাসের লাইনে যাক, এতে পয়সা আছে।’ সে শ্রীগোপালকে সেই কথাই জানিয়েছিল। তখন কীরকম থমথমে হয়ে গেছিল ওর মুখ। বড়ো বড়ো দুটো দাঁতে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে হতাশা আর ক্ষোভ দমন করে বলেছিল, ‘তোকে আর আমাকে নাকি আলাদা করে দেখেন না? তুই কলেজে পড়বি আর আমি ধানচাষ করব। এই হচ্ছে বড়োলোকদের চরিত্র। ঠিক আছে তাই করব।’ তখন সে শ্রীগোপালকে কী বলেছিল? তিরিশ বছর আগে…না আরও কম, আঠাশ বছর। কী বলেছিলাম? মনে পড়ছে না….মনে পড়ছে না….আমার স্মৃতিশক্তি কমে গেছে….কিন্তু আমার সব কথা মনে পড়ার আর কি কোনো দরকার আছে?

ধীরে ধীরে তার অবসাদভরা চেতনা ক্ষীণ হয়ে ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি জায়গায় তাকে রেখে নিল। একসময় তার মনে হল, বাইরের দালানে কারা হাঁটচলা করছে, কথা বলছে। তার ইচ্ছে হল উঠে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ায়। দাঁড়াবার জন্য অস্থির হয়ে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে সে আবার ঘুমের মধ্যে ঢুকে গেল। পুবের খোলা জানলা দিয়ে বিছানায় রোদ এসে তার ঘুম ভাঙাতে সে চোখ খুলে প্রথমেই দেখল সিলিংয়ে ঝোলানো রঙচটা পাখাটাকে। অবাক হয়ে সে বুঝতে চেষ্টা করল, এখন সে কোথায়? পাখাটা রাতে ঘুরছিল, এখন থেমে রয়েছে।

সে ঘরের চারিদিকে চোখ বোলাল। যে ছোটোঘরটাকে সে চিনত, সেটা ছিল অন্যরকম। কাঠের র‌্যাকটা রঙিন বিবর্ণ একটা পরদা ঝুলিয়ে আড়াল করা। যে সিঙ্গল খাটে সে শুয়ে রয়েছে সেটাও নতুন। প্লাস্টিকের চাদরে ঢাকা কাঠের একটা ছোটো টেবল, তার ওপর হাতঘড়িটা, প্লাস্টিকের জাগ, কাচের গ্লাস আর একটা কাঠের চেয়ার। এর বেশি আর কিছু তার চোখে পড়ল না। সে উঠে বসে হাতঘড়িটা তুলে নিয়ে সময় দেখল। আটটা—পঞ্চাশ। ঘরটা আগের মতো হতশ্রী নয় কিন্তু কীরকম যেন খেলো, দায়সারা আর যত্ন—বঞ্চিত। খাটের কাঠ খুবই সস্তার। সে চাদরটা তুলে দেখল তোশকটা নতুন এবং পাতলা।

দালানে কারা কথা বলছে? কান পেতে সে শোনার চেষ্টা করল। মেয়ে গলায় কে বলল, ‘চায়ে চিনি নিতে বারণ করেছি অরুণাদি, তবু দিয়েছে।’ অরুণার উত্তরটা সে শুনতে পেল না। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। গোরার গেঞ্জিটা তার গায়ে। চুল আঁচড়ানো দরকার কিন্তু চিরুনি নেই, দাঁত মাজার ব্রাশও নেই। ব্রাশটা রেখে দেওয়া উচিত ছিল। দু—হাতের আঙুল চুলে ঢুকিয়ে পিছনে চিরুনির মতো চালাল। দরজার কাছে এসে একটু ইতস্তত করে পাল্লাদুটো সে ভিতরদিকে টানল।

ওরা একসঙ্গে মুখ ফিরিয়ে তাকাল তার দিকে। ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই ওরা জেনে গেছে, সে কালরাতে এসেছে, তাই চমকাল না। টেবলের তিনদিকে তিনটি চেয়ারে বসে ওরা তার দিকে সোজা তাকিয়ে রয়েছে। বড়ো চেহারার যে ছেলেটি, যার চোখ একবার কুঁচকে উঠল, সে নিশ্চয় গোরা। যে মেয়েটি মুখ পিছনে ঘুরিয়ে দেখছে, চোখদুটো বড়ো হয়ে উঠেছে, সে নিশ্চয় গুলু। দুজনের মাঝে বসে রয়েছে বিবি। সে ডানদিকে মুখ ফিরিয়ে দেখছে। তিনজনের চাহনিতে একটাই মিল। চোখগুলো যেন, প্রচণ্ড ক্ষমতাসম্পন্ন লেনসের দূরবিন দিয়ে তার মুখের ভাব ধরার জন্য গভীর অনুসন্ধানী। তার চোখের, ঠোঁটের প্রতিটি কোষ, তন্তু, শিরা, শ্বাসপ্রশ্বাস পর্যবেক্ষণ করছে প্রবল কৌতূহলে । তার কাছে এটা খুবই স্বাভাবিক মনে হল। ষোলো বছর এরা তাকে দেখেনি, সেও দেখেনি এদের।

কৌতূহলটা পনেরো—কুড়ি সেকেন্ড পর্যন্ত প্রখর থেকে ধীরে ধীরে নিবে এল। গুলু মুখ ফেরাল তার মায়ের দিকে। গোরা মুখ নামাল চায়ের কাপে। বিবিই শুধু তাকিয়ে রইল তার দিকে। ওর চোখেই অপরিচয়ের ছাপটা নেই। মুখ নামিয়ে চাপাস্বরে সে কিছু বলতেই গুলু তার মায়ের বাঁদিকে খালি চেয়ারটায় উঠে এল চায়ের কাপ হাতে নিয়ে। এটা বিবির না—বলা নির্দেশ—ওই চেয়ারটায়ই তাকে এখন বসতে হবে।

সে হাসার চেষ্টা করল। আর শুধু বিবিই সেই হাসিটা দেখল। সে আশা করল, পালটা এক চিলতে হাসি বিবির চোখে ফুটে উঠবে। তার বদলে বিবি মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে গুলুর পরিত্যক্ত চেয়ারটা দেখাল। বসার আগে সে তিনজনের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে বলল, ‘গুড মর্নিং।’ শুধু গুলু অস্ফুটে বলল, ‘মর্নিং।’

‘চন্দননগর থেকে কখন তোমরা ফিরলে?’ জিজ্ঞাসাটা বিবিকে।

‘আধঘণ্টা আগে। তোমাকে চা দেবে?’

‘হ্যাঁ।’

ঘুম ভাঙার পর বিছানাতেই সে এক কাপ চা খায়। বিবির সেটা নিশ্চয় মনে আছে। এতে আপত্তি ছিল ওর: ‘দাঁত না মেজে কিছু খাওয়া আনহাইজিনিক।’ সে বলেছিল, ‘গোলি মারো তোমার হাইজিনকে, বেড—টি দাঁত মেজে খেলে সেটা আর বেড—টি হয় না।’ বিবি আর একদিনও দাঁত মাজার কথা তোলেনি।

আজও তুলল না। তাহলে কি ও বদলায়নি কিংবা ভীষণভাবে বদলেছে বলেই ব্যাপারটা গ্রাহ্যে আনল না?

‘দাঁত মাজার ব্রাশ, পেস্ট কিছুই আমার নেই। কাউকে দিয়ে আনানো যাবে কি?’

‘কেন যাবে না!’ ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ডাক তো হেমন্তকে।’

গোরা দ্রুত উঠে গিয়ে দালানের জানালা দিয়ে চেঁচিয়ে হেমন্তকে ডাকল। ওর ডাকার স্বরটা কেমন যেন, উৎকণ্ঠিত, জরুরি, তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করতে চাওয়ার মতো। কী নিষ্পত্তি করতে চায়? বাবাকে প্রথম দেখার টাল যে সামলাতে পারছে না সেটা বোঝাই যাচ্ছে ওর ভাবভঙ্গিতে। নিজেকে খাড়া রাখতে চাইছে। বাবাকে গ্রাহ্য করবে কী করবে না এখনও তা ঠিক করে উঠতে পারেনি। গোরার পুরো চেহারাটা এই প্রথম সে দেখল। আঠারো বছরের, কিন্তু একটা ব্যাটাছেলের মতোই বটে! সে স্নেহভরা তারিফ নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকল।

‘এক্সকিউজ মি।’ অস্ফুটে সবার উদ্দেশে কথাটা বলে গোরা মেজোঘরে ঢুকে গেল। বাবার দিকে সে একবারও তাকাল না।

স্বাভাবিকই। সে মনে মনে বলল, বলতে গেলে এই প্রথম বাবাকে দেখছে, জড়তা তো থাকবেই। ধীরে ধীরে আলাপ হবে। নতুন করে বিবির সঙ্গেও সম্পর্ক তৈরি করতে হবে, এখনও তো তার সঙ্গে বাইরের লোকের মতোই ব্যবহার করা হচ্ছে।

অরুণা চা দিয়ে বলল, ‘কিছু খাবেন, মাখন—পাউরুটি?’

‘না।’ সে বিবির দিকে তাকাল, খাওয়ার কথাটা ওরই তো তোলা উচিত ছিল।

‘চন্দননগর থেকে কখন বেরিয়েছ? কার মেয়ের ভাত, সুবোধের?’ সুবোধ ওর ছোটোভাই, তার বিয়ের সময় ক্লাস ফোর—এ পড়ত।

‘সাতটার ব্যান্ডেল লোকাল ধরে এলাম। হ্যাঁ, সুবোধের মেয়ের ভাত।’ সহজ স্বচ্ছন্দ বলার ধরন। বিজ্ঞানের ছাত্রী, কলেজে পড়ায়, যতটুকু প্রশ্ন ততটুকুই উত্তর। সে বিবির মুখের দিকে এখন ভালো করে তাকাল। মুখটা সামান্য ভারী হওয়া ছাড়া আর কিছুই বদলায়নি। থুতনির নীচেটা একটু ফুলে রয়েছে, চর্বি। গলাটা আর লম্বা দেখাচ্ছে না। বাহুদুটো অন্তত দু—তিন ইঞ্চি মোটা হয়েছে। গায়ের রঙও আর আগের মতো ফরসা নেই। কানে সেই পুরোনো হিরের—তার চোখ নিথর হয়ে গেল। বিবি চুল কেটে ফেলেছে।

সে মুখ নামিয়ে টেবিলে চোখ রাখল। সে টের পাচ্ছে গুলু একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে। বিবির চুল, ঘাড় আর কাঁধের উপর ছড়ানো, পিঠে ব্রেসিয়ারের দু—পাশে চর্বি উপচে উঠেছে। কাজটা বোধহয় ইচ্ছে করেই করেছে। ওর দীর্ঘ চুল তার ভালো লাগত বিবি সেটা জানে। তাকে আঘাত দেবার জন্য যদি চুল কেটে থাকে, তাহলে বিবি খুব সফল নয়। গত রাতে ছোটোঘরের দিকে তোলা অরুণার আঙুলই তাকে চুরমার করে দিয়েছে। তারপর আর কোনোকিছুই তাকে যন্ত্রণা দিতে পারবে বলে তার মনে হচ্ছে না।

‘তোমার ভালো নাম আমি জানি না।’

‘জনা।’

‘বেশ নাম। কে রেখেছে, মা?’

‘হ্যাঁ।’

‘গোরার ভালো নাম কী?’

‘গোরা!’ গুলু অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। ‘গোরা কে?’

‘উনি রণোর কথা বলছেন। ওর ভালো নাম রণব্রত।’ বিবি তার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেবার সময় ভ্রূ কোঁচকাল। তার মনে হল, বিবির চাহনিতে ঔদ্ধত্য আর বিরাগ। যেন বলতে চায়, এরা আমারই ছেলেমেয়ে, এদের আমিই মানুষ করেছি, আমার দেওয়া নামেই এরা পরিচিত হবে। রাঘবেন্দ্র নারায়ণ দত্তর দেওয়া নাম এরা বহন করবে না।

‘জনাকে আমরা জনা বলেই ডাকি, ওর ডাকনাম এটাই।’

সে আবার মুখ নামিয়ে ফ্যাকাশে হাসি হাসল। বিবি নামটা ওর বাপের বাড়ির দেওয়া। যদি তার দেওয়া হত, তাহলে বিবি নিশ্চয় বদলে নিত ।

দালানের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে সেই লোকটি, কাল রাতে যে ফটকের কাছে তার পাশ দিয়ে চলে গেছিল। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স, গোল মুখটা বোকামিতে ভরা, তেল চকচকে ব্যাকব্রাশ চুল, হাফশার্টের হাতার তলায় একটা বড়ো মাদুলি।

‘বউদি, ডেকেছেন?’

‘এত দেরি হল কেন আসতে? ডেকেছি তো অনেকক্ষণ।’ বিবি চেয়ার থেকে উঠল। ‘দোকানে যেতে হবে, তাড়াতাড়ি কয়েকটা জিনিস এনে দাও।’ ব্যস্তভাবে সে ঘরে ঢুকে তার ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এল।

‘কী আনতে হবে?’

‘টুথব্রাশ, পেস্ট তো বাড়িতেই রয়েছে, একটা চিরুনি চাই। আর তো এখন কিছুর দরকার হচ্ছে না।’

বিবি তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল। এই প্রথম আজ বিবির গম্ভীর মুখ থেকে সে টেনশন আর ব্যক্তিত্ব সরে যেতে দেখল। স্বাভাবিক, সহজ হাসিভরা বিবি একটা দুর্লভ প্রাপ্তি।

‘একটা সেফটি রেজারও দরকার।’

ডান হাতটা নিজের থেকেই তার গালে উঠে এল। বিবি দাড়ি পছন্দ করে না। ‘দাড়িটা আমি রাখব।’

সে যা দেখবে আশা করেছে তাই হল। বিবির ভ্রূ কুঁচকে রইল তিন—চার সেকেন্ড, চাহনিটা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠল। বিবি বুদ্ধিমতী, নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে তার বিরুদ্ধে এটা প্রতিরোধের জন্যই বলা। আবার সেই পুরোনো রাঘবেন্দ্র নারায়ণ। কিন্তু কতদিন সে বিবিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে? এক সময় তো নুয়ে পড়তে হবেই। বিষয় সম্পত্তি অর্থ সবই তো সে লিখে দিয়েছে। এই বাড়িতে দাদা—বউদিরা ছাড়া বোধহয় সবই নতুন হয়ে গেছে। পুরোনোর সঙ্গে বিবির সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টাটা কেন, এতে ওর কী লাভ হবে?’

‘দাড়ি থাকলে চট করে মানুষকে চেনা যায় না। আমার বোধহয় আপাতত সেটাই দরকার।’

‘হ্যাঁ, সেটাই দরকার।’

বিবি মুখ নামিয়ে মৃদুস্বরে কথাটা বলে ব্যাগ থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বার করে হেমন্তর হাতে দিল। ‘একটা দাঁতমাজার ব্রাশ আর একটা ছেলেদের চিরুনি আনবে।’

বিবি ব্যাগটা ঘরে রেখে ফিরে আসতেই সে বলল, ‘আমার জামাকাপড়গুলোর কিছু এখনও আছে কি?’

‘থাকা কি সম্ভব?’

‘তা বটে! এই দ্যাখো, গোরার গেঞ্জি পরে আছি। কিছু কাপড়—চোপড় তো কিনতেই হবে।’ সে সচেতন থেকেই ‘গোরা’ নামটা উচ্চচারণ করল, এই নাম তারই দেওয়া। ‘রণো’ সে স্বীকার করবে না। বিবির নিশ্চয় কান এড়ায়নি ‘গোরা’ শব্দটা। বুদ্ধিমতী, তাই মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া ফোটাল না।

‘আমি কিনে এনে দেব।’

‘তুমি কি আমার মাপ জানো?’

‘রণোকে সঙ্গে নিয়ে যাব।’

বিবি আবার হাসল। এই হাসিতে তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য নষ্ট হল না। সে হৃদয়ের গভীরে তৃপ্তি বোধ করল, গোরা আর সে সমান—সমান। গোরার বয়সে তার বাপও অমন চেহারার ছিল। সে চেয়ার থেকে উঠে বলল, ‘আমার ঘরে একটা আয়না নেই।’ সে মেনে নিল ছোটোঘর তারই ঘর। ‘একটা আলনাও দরকার। পাখাটা বন্ধ হয়ে গেছে।’

‘লোডশেডিং।’ বিবি বলল।

‘পাওয়ার কাট।’ গুলু বলল।

‘একই ব্যাপার জন্য।’ প্রায় ধমকের মতোই শোনাল বিবির স্বর।

গুলু ঢোঁক গিলল। মেয়েটার মুখ মায়ের মতো হলেও স্বভাবে বোধহয় ততটা মিল নেই। দালানের দুই প্রান্তের জানলাগুলো খোলা, শুধু টেবিলের সামনে মাঝেরটা বন্ধ। দাদার দিক থেকে দেখা যাবে না টেবিলে বসা লোকেদের। এটা নিশ্চয় বিবির তাকে আড়ালে রাখার চেষ্টা।

‘তুমি কী পড়ছ এখন?’

‘ফার্স্ট ইয়ার, সায়ান্স।’

‘কোথায়?’

‘যাদবপুরে।’

‘আজ কলেজে যাবে না?’

‘যাব, সাড়ে এগারোটায় ক্লাস।’ গুলু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে পড়ল।

‘জনা, বাথরুমে যাবে তো এখুনি যাও।’

‘তুমি কলেজে পড়াচ্ছ শুনলাম, এমএসসি—টা কবে পাশ করলে? আজ তোমার কলেজ নেই?’

নিছকই কৌতূহল মেটাতে প্রশ্ন করা। কিন্তু বিবি সহজভাবে সেটা নিল না। গুলু ঘরে ঢুকে যাবার পর সে বিরস স্বরে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ পড়াচ্ছি, বসে খাবার মতো অত টাকা কোথায়? সবই তো শেষ হয়ে গেছে।’

কেন শেষ হয়ে গেছে বিবি তা আর বলল না। আন্দাজে ওর অনুক্ত কথাটা ধরে নিয়ে সে অনুতপ্ত গলায় বলল, ‘আমার জন্যই।’

বিবি নীরব রইল। সে আড়চোখে ওর মুখের দিকে তাকাল। মুখটা কঠিন। হয়তো মনে মনে বলছে, সংসারটাকে মানে মর্যাদায় ডুবিয়ে, টাকাপয়সায় নিঃস্ব করে দিয়ে এখন অনুশোচনা করার কোনো মানে হয় না।

‘আমি কিন্তু তোমাকে খরচ করতে বারণ করেছিলাম। সুপ্রিম কোর্টে যেতে মানা করেছিলাম। জলের মতো টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, এটা আমি বুঝতাম।’

‘এই বোঝার কোনো মূল্য নাই। তুমি এটা কি বোঝনি, স্বামীর জন্য স্ত্রী শেষচেষ্টা করবেই। এমন একটা অবস্থা এসেছিল যে, গোকুলানন্দর জমিজায়গা সম্পত্তি বিক্রি করার কথাও ভাবতে হয়েছিল। আমার কাকা বাধা না দিলে হয়তো বিক্রিই করে ফেলতাম। তার বদলে স্টিল ফার্নিচারের কারখানাটা লিজ দিলাম একজন গুজরাটিকে।’

‘লিজ!’ সে চমকে সোজা হয়ে বসল। ‘আর. ডি. এন্টারপ্রাইজ লিজ দিয়েছ?’

‘একত্রিশ বছরের জন্য।’ বিবি চকিতে তার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘ওটা চালাবার মতো কেউ তো আমার নেই। মিছিমিছি পড়েই থাকত।’

‘কারখানাটা তাহলে এখন আর আমাদের নয়?’

‘না।’

‘আমার দাদার কাছ থেকে তো টাকা চাইতে পারতে।’

‘তোমার দাদাকে তুমি ভালোই চেনো। একবারও খোঁজ নেননি, পাশে এসে দাঁড়াননি। এমন লোকের কাছে টাকার জন্য হাত পাতার প্রবৃত্তি হয়নি।’

সে মুখ ফিরিয়ে বন্ধ জানলার দিকে তাকাল। হাত পঁচিশেক দূরে দাদা থাকে, কিন্তু মানসিকভাবে তাদের মধ্যে ব্যবধান পঁচিশ হাজার মাইলের। বিবি টাকা না চেয়ে হয়তো ঠিক কাজই করেছে। গুলু ঘর থেকে বেরিয়ে তার মায়ের পিছন দিয়ে কলঘরে যাবার সময় বাবার দিকে তাকাল। তার মনে হল ক্ষীণ একটা হাসি যেন গুলুর চোখে নড়ে উঠল।

‘জনা চুল ভিজিও না, কাল রাতে অনেক বার কেশেছ।’ বিবি মৃদু স্বরে বলল। ওর কড়া নির্দেশগুলো মুখ থেকে বেরিয়ে আসে চাপা স্বরে।

‘তুমি কলেজ যাবে না?’

‘না।’

কেন যাবে না, সে কথা জিজ্ঞাসা করার সাহস তার হল না। গোরা সেই যে মেজোঘরে ঢুকেছে, আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। হেমন্ত ফিরে এসেছে। টুথব্রাশের লম্বা বাক্সটা আর চিরুনির সঙ্গে কিছু খুচরো আর কয়েকটা নোট বিবির সামনে টেবিলে রাখল।

‘ঠিক আছে তুমি যাও আর অরুণাকে ডেকে দিয়ো।’

হেমন্ত চলে যাবার আগে কৌতূহলী চোখে তার দিকে তাকাল। বিবি তা লক্ষ করল। ‘শোনো, তোমাকে ও বাড়ির কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেছে?’

‘না তো!’

‘কাল রাতে দই এনেছ, সকালে গন্ধ হয়ে গেছে। জিনিস দেখে কিনবে।’

হেমন্ত মাথা নেড়ে চলে যেতেই সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কত দিন কাজ করছে?’

‘দু মাস।’

‘দুলালের খবর কী?’

‘ছাড়িয়ে দিয়েছি। বড়ো বেশি গল্প করে, তা ছাড়া বয়সও হয়ে গেছিল।’

সে এবার আর চমকে সোজা হল না, ‘গল্প’ মানে তার সম্পর্কে গল্প। ও বাড়ির লোক, পাড়ার লোক, তাদের সামনে দিয়ে বিবিকে হাঁটতে হয়। তাদের চাহনি, ফিসফাস কথাবার্তা ওর মতো আত্মমর্যাদা সচেতনের পক্ষে সহ্য করা কঠিন তো বটেই।

ফোন বেজে উঠল। সে হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুলতে গিয়ে হাত টেনে নিল। বিবি তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে, ডান হাতটা বাড়িয়ে। সে রিসিভার তুলে দিল বিবির বাড়ানো হাতে।

‘মিসেস দত্ত বলছি….ওহহ বলো…আচ্ছা ডেকে দিচ্ছি।’ রিসিভারটা টেবিলে রেখে বিবি ডাকল, ‘রণো, তোর ফোন।’

গোরার পরনে জিনস, খালি গা। রিসিভারটা তোলার সময় সে বাবার দিকে একবার তাকাল। ‘হ্যালো, কে? ….কখন যেতে হবে? …ফিরতে রাত হয়ে যাবে?…. আচ্ছা ঠিক আছে।’

বিবি জিজ্ঞাসু চোখে গোরার দিকে তাকাল।

‘সুজিতের ঠাকুমা পড়ে গিয়ে কোমরের হাড় ভেঙেছেন। কৃষ্ণনগর থেকে ওঁকে আনতে হবে। ঠিক এগারোটায় ও গাড়ি নিয়ে আসবে।’

‘তুই কেন?’

‘গাড়িতে তোলা—নামানো, …সুজিতকে তো দেখেছ, ওদের বাড়ির লোকেদের চেহারাও ওর মতো।’

‘কী রোগা ছেলেটা! এক—এক ফ্যামিলির এক—এক রকম গড়ন হয়। …তুই ফিরবি কখন?’

‘বলল তো আটটার মধ্যেই কলকাতায় ফিরতে পারব। ওর কাকার বন্ধুর নার্সিংহোম মৌলালিতে। সেখানে ভরতি করাবে।’

অরুণা দালানে এসেছে। বিবি ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘রণো বেরোবে, রান্না হয়েছে?’

‘ভাত হয়ে গেছে, ডাল এবার নামাবো।’

‘নামিয়ে মাছের ঝাল চটপট করে দাও। তারপর দাদাবাবুর রুটি সেঁকে দিয়ে দাও।’ বিবি টেবিলে পড়ে—থাকা টুথব্রাশের বাক্সটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘দাঁতটা মেজে নাও।’

এতক্ষণ সে যেন বাইরের লোক হয়ে বসে ছিল। বিবি ‘দাঁতটা মেজে নাও’ বলে ওকে যেন সুযোগ দিল পরিবারের ভিতরে আসতে। যে কৃতজ্ঞ হাতে বাক্সটা থেকে সবুজ রঙের ব্রাশ বার করল।

‘বেসিনের ওপর ব্র্যাকেটে পেস্ট রয়েছে।’

কাল রাতেই সে দেখেছে ব্র্যাকেটে তিনটে টুথব্রাশ রয়েছে একটা গ্লাসে, পেস্টের আধ—গোটানো একটা টিউব, হাত ধোওয়ার সাবান, রিংয়ে ঝোলানো হাত মোছার ছোটো তোয়ালে আর সেফটি রেজারের বাক্স। তখন দেখে খেয়াল করেনি বাক্সটা কার জন্য হতে পারে। গোরা যখন ফোনে কথা বলছিল সে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। গোরা দাড়ি কামায়। আঠারো বছরের ছেলে দাড়ি কামাতেই পারে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, তবুও সে অবাক হয়ে গেছিল। কুড়ি—একুশ বয়স পর্যন্ত সে দাড়ি কামিয়েছে লুকিয়ে। যৌবন দেখা দেওয়ার, ব্যাটাচ্ছেলে হয়ে ওঠার চিহ্নগুলো ফোটার জন্য লজ্জা পেত। গোরার বুকে লোম, তবে তার মতো এত ঘন হয়ে ওঠেনি। বাইসেপস, ডেল্টয়েড, ট্রাইসেপস যেন ছেনি দিয়ে কেটে তৈরি করা। নিশ্চয় ব্যায়াম করে। জিনসটা এঁটে বসেছে, ভারী গোল সুগঠিত পাছার উপর। চোখ রাখলেই মনে হবে ওর গায়ে ভীষণ জোর।

নতুন ব্রাশের খোঁচায় মাড়িতে জ্বালা করে। সে সন্তর্পণে ব্রাশ ঘষতে ঘষতে দেখল দালানটা নির্জন হয়ে গেল। গুলু কলঘরে, বিবি আর গোরা তাদের ঘরে। কেউ তার সঙ্গে কথা বলার জন্য নেই। হঠাৎই সে অসহায় বোধ করল। তাকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে না উঠলেও অন্তত কাছাকাছি থাকবে, কথা বলবে। দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর বউ, ছেলেমেয়ের কাছে ফিরে আসা একটা লোক, যে অপরাধই করে থাকুন না, এমন পরিত্যক্ত বোধ করবে কেন? বিবি তার সম্পর্কে ষোলো বছর ধরে ছেলেমেয়েদের কী বুঝিয়েছে? খারাপ চরিত্রের, সে ঘৃণার যোগ্য, পরিবারটাকে নষ্ট করেছে, একে বর্জন করো! মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার জন্য এবার কি ওরা শাস্তি দেবে?

ব্রাশটা কলের জলে ধুয়ে সে গ্লাসে রাখতে গিয়ে থমকে গেল। তিনটে ব্রাশের সঙ্গে বিবি কি চতুর্থ ব্রাশটা মেনে নেবে? ওর চোখে সে বিরাগ, বিরক্তি মাঝে মাঝে ঝিকিয়ে উঠতে দেখেছে। আয়না আর আলনার দরকার শুনে বিবি কোনো কথা বলেনি। বালবটায় একটা শেড দরকার, না থাকলে চোখে লাগে। কিন্তু চাইলে কি বিবি কিনে দেবে? তার কাছে টাকা আছে, সে আয়না, আলনা বা শেড নিজে কিনে আনতে পারে। কিন্তু বিবি কি এখন তার বাইরে যাওয়া পছন্দ করবে! কিন্তু কতদিন সকলের দৃষ্টি থেকে বিবি তাকে সরিয়ে রাখতে পারবে? একটা জেলখানা থেকে বেরিয়ে কি আর একটা জেলখানায় সে ঢুকল? এই বাড়িতে কর্তৃত্ব, দাপট আর ইচ্ছাকে ব্যবহার করার যে স্বাভাবিক অধিকার তার ছিল—সংসারের উপর, মানুষের উপর, বিবির উপর—সবই তার হাত থেকে এইভাবে যে চলে যাবে, কখনো সে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারত না।

‘দাদাবাবু আপনার খাবার।’

সে চমকে ঘুরে দাঁড়ল। টুথব্রাশটা হাতে নিয়ে কখন সে নিজের অজান্তেই ছোটোঘরে ফিরে এসেছে! ফ্যাল ফ্যাল করে অরুণার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী খাবার?’

‘গোলমরিচ দিয়ে পাউরুটি মাখন আর চা। বউদি বললেন, আপনি যদি ঘরে বসে খেতে চান তো খেতে পারেন।’

বিবি তাকে আরও বিচ্ছিন্ন করে দিতে চায়। সবার মতো, সবার সঙ্গে দালানে বসে সে খাক এটা বিবি চাইছে না। ছেলেমেয়েরা তাকে দেখুক সেটাও তার ইচ্ছে নয়। ওর ইচ্ছেতেই তাকে চলতে হবে! হঠাৎই তার মাথা গরম হয়ে উঠল।

‘ডিম নেই?’ তার তীব্র স্বর অরুণার শান্ত চোখকে ব্যস্ত করে দিল।

‘আছে, সেদ্ধ করে দোবো?’

‘দাও, কলা আছে?’

‘নেই, শেষ হয়ে গেছে।’

‘ফ্রিজে জেলির শিশি দেখলাম, জলের বোতলও রয়েছে। শিশিটা আর একটা বোতল দিয়ে যাও, এই প্লাস্টিকের জাগটা নিয়ে যাও।’ সে আঙুল তুলে জাগটা দেখাল। কাল রাতে অনেকটা এইভাবেই অরুণার আঙুল উঠেছিল। ওর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, ভাবতে পারেনি লোকটা আচমকা এমন রুক্ষভাবে কথা বলবে। নিশ্চয় বিবির কাছে এখনই লাগাবে।

খাবারের প্লেটটা রেখে জলের জাগটা তুলে নিয়ে অরুণা যখন বেরিয়ে যাচ্ছে সে বলল, ‘বরাবরাই আমি দুটো ডিম সকালে খাই, বউদি সেটা জানে। আর আমার সব খাবারদাবার এই ঘরে দিয়ে যাবে।’

মাথা হেলিয়ে অরুণা চলে গেল। সে চায়ের কাপটা তুলে চুমুক দিয়েই বুঝল, অনেক কিছু পরিবর্তন ঘটে গেলেও বিবির দামি গন্ধওয়ালা দার্জিলিং চা খাওয়ার অভ্যাসটা বদলায়নি। বাইরে বাগানে মোটর ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যেতেই সে দ্রুত পুবের জানালায় এসে দাঁড়াল। একটা মাতাদোর ভ্যানে স্টিলের শিট এসেছে। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল চায়ের কাপ হাতে নিয়ে। ভ্যানের পিছনের ডালা খুলে দুটো লোক শিটগুলোকে টেনে টেনে মাটিতে ফেলেছে। কর্কশ ঝনঝন শব্দ তার কানে ধাক্কা দিতেই সে জানালা বন্ধ করে দিল। অন্যের কারখানার দিকে তাকিয়ে থাকার কোনো যুক্তি নেই।

‘ডিম সেদ্ধ আর জেলি, জলের বোতল দিয়ে যাচ্ছি।’ অরুণা তার মুখের দিকে একবারও না তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বাইরে ফোন বাজছে। গোরার গলা শোনা গেল, ‘মা, তোমার ফোন।’

বিবি ফোনে গলা চড়িয়ে কথা বলে না। ঘর থেকে শোনা যাবে না ওর কথা। অরুণা ঠান্ডা জলের বোতল নিয়ে এল।

‘কলঘর কি খালি রয়েছে?’

‘বউদি বোধহয় যাবেন, জিজ্ঞেস করে আসি।’

‘কে খাচ্ছে এখন, গোরা?’

অরুণা বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কে খাচ্ছে?’

ওকে ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা না করে সে বলল, ‘দাদামণি খাচ্ছে কি?’

‘হ্যাঁ, সঙ্গে দিদিমণিও বসেছে।’

সে পাউরুটির স্লাইস তুলে নিয়ে চেয়ারে বসল। ঠান্ডা রুটি চিবোতে তার ভালো লাগে না। আধখাওয়া টুকরোটা হাতে ধরে সে চোখ বন্ধ করল।

‘বউদি বললেন ঠিক সাড়ে এগারোটায় বাথরুমে যাবেন।’

সে মাথা নাড়ল। কাজের লোকও এ বাড়িতে কলঘরকে বাথরুম বলছে। বদলের ছাপ মুখের কথাতেও!

দুপুরে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। শরীরটা ঝরঝরে হালকা রাখতে পেট ভরে ভাত খায়নি। কাল রাতে বেশি খেয়ে ফেলায় ঘুম ভালো হয়নি। গোরা আর গুলুর বেরিয়ে যাওয়ার পর বিবিও বেরিয়ে গেল। বলেছিল কলেজে যাবে না। আগে বিবির বেরোনোর দরকার হত না, হলেও একা বেরোতো না। চন্দননগরে যতবার গেছে সঙ্গে সে—ও গেছে। শেষবার গেছে ওর বাবার বাৎসরিকে। ফিরে আসার পর বিবি ক্ষুব্ধ স্বরে বলেছিল, ‘তুমি কি ভাব আমি একা যেতে পারি না? তিন বছর আমি চন্দননগর থেকে যাদবপুর যাতায়াত করেছি, একা। এভাবে পাহারা দিয়ে কেউ সঙ্গে গেলে বিশ্রী লাগে।’ ‘আমাদের বাড়ির বউয়েরা একা ট্রেনে যাচ্ছে, লোকে শুনলে বলবে কী? তা ছাড়া স্বামী সঙ্গে থাকলে বিশ্রী লাগবে কেন?’ ‘সব ব্যাপারেই স্বামীকে সঙ্গে থাকতে হবে কেন? আমাকে কি তোমাদের বাড়ির অশিক্ষিত জবুথবু মেয়েদের মতো মনে করো নাকি?’ তার রেগে ওঠা উচিত ছিল। বাড়ি বা বংশ নিয়ে কোনো হেয় কথা সে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু বিবির কথাটা সত্যের থেকে বেশি দূরে নয়। সে কথা কাটাকাটিতে না গিয়ে বলেছিল, ‘বাবা গাড়িটা বিক্রি করে না দিলে এসব প্রবলেম দেখা দিত না, তুমি একাই ড্রাইভারকে নিয়ে চলে যেতে পারতে। তোমাকে তো বলেছিলাম মোটরবাইকে নিয়ে যাব, রাজি হলে না।’ ‘কোমর জড়িয়ে ধরে যাওয়া!’ বিবি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছিল।

সেই অবাক চোখ এখন আর বিবির নেই। এখন আর কারুর অনুমতির জন্য ওকে অপেক্ষা করতে হয় না। হয়তো এবার থেকে তাকেই অনুমতি নিয়ে চলাফেরা করতে হবে, হাতও পাততে হবে। হাজার দুয়েক টাকার আয়ু কতদিন আর? টাকা রোজগারের কথা তাকে ভাবতে হবে, চেষ্টা করতে হবে, লোকের সামনে যেতে হবে।

সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল টেলিফোনের শব্দে। দশ—বারো বার বাজতেই সে খাট থেকে উঠে পড়ল। কেউ নেই যখন, অরুণারই ফোন ধরার কথা। নিশ্চয় অরুণা নেই। সে দরজার কাছে পৌঁছবার আগেই বাজা থেমে গেল।

দালানে কেউ নেই, মাত্র দুটো জানালা খোলা। সূর্য এখন পশ্চিমে, তাই রঙিন কাচগুলো উজ্জ্বল হয়ে দালানকে বাহারি করে তুলেছে। সে অবাক হয়ে প্রায়ান্ধকারের মাঝে চেয়ারে বসে পড়ল। কত্তার ঘরের, মেজোঘরের দরজার হুড়কো টানা। বাইরে থেকে তালা দেওয়া। সে একা, তার সঙ্গী শুধু বাল্যকালের বিকেলের দালান। সে স্কুল থেকে ফিরেছে, মা নীচের রান্নাঘরে, বাবা ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় চেয়ারে বসেছে। স্কুলের ব্যাগ পিঠে, দরজা ঠেলে সে দালানে পা দিয়েই থমকে দাঁড়াত। বড়োজোর আধ মিনিট …তিরিশ সেকেন্ড বিশাল সময়, ওইটুকুর মধ্যেই একটা মানুষকে মেরে ফেলা যায়, …ওইটুকু সময়েই একটা মেয়েমানুষকে শুইয়ে তার শাড়ি টেনে খুলে ফেলা যায়,… ওইটুকু সময়ের মধ্যেই একটা মানুষের ধ্বংস ঘটে যায়…।

সে নির্জন দালানে স্তিমিত হয়ে বসে রইল। বর্তমান থেকে সরে যাওয়ার কোনো উপায় আর তার নেই। স্মৃতি, সে ভেবেছিল কমে গেছে। এই একটা জিনিস চেষ্টা করলেও তার হ্রাস—বৃদ্ধি ঘটানো যায় না। যত পিছিয়ে যাবে ততই খুঁটিনাটিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মিতাকে তাদের অন্ধকার বাইরের ঘরে দেয়ালে চেপে ধরে সারা শরীর দিয়ে পিষে চুমু খাওয়ার সময় ওর মুখে পেঁয়াজের গন্ধ পায়। মিতাকে সে ঝালমুড়ি খেতে দেখেছিল হনুমান পার্কে। বহুদিন ঝালমুড়ি খাইনি, ঘুগনি খাইনি…টেলিফোন বেজে উঠল। দ্বিধা না করে সে রিসিভার তুলে নিল।

‘হ্যালো।’

‘কে বলছেন আপনি?’ নারীকণ্ঠ, একটু ভারী স্বর, বয়স্ক, মার্জিত উচ্চচারণ।

ফোন ধরেই কথার আগে নিজের পরিচয় দাখিল করতে হবে, এতে মনে হয় যেন তাকে দাবিয়ে দেওয়া হল। কর্কশ স্বরে সে বলল, ‘রাঘবেন্দ্র দত্ত। আপনার কাকে চাই?’

‘জাহ্নবীকে চাই, আছে কি?’

‘বেরিয়েছে। কিছু জানাবার থাকলে বলতে পারেন, আমি ওর স্বামী।’

‘স্বামী!’ মহিলা যেন ছ্যাঁকা খেলেন, ‘আপনি ওর স্বামী?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, বিবাহিত বৈধ স্বামী!’

‘জাহ্নবী আবার কবে বিয়ে করল? ওকে তো ডিভোর্সি বলেই জানি, সেই কথাই তো আমাদের বলেছে।’

‘আপনি কে বলছেন?’

‘আমি ওর কলিগ, রমা ঘোষ।’

ফোন সে রেখে দিল। এই কথোপকথন নিশ্চয় বিবি জানবে। সে কোনো মিথ্যা কথা বলেনি। কিন্তু বিবি নিজেকে কেন ডিভোর্সি বলে বাইরে জাহির করল! এতে ওর কোনো সুবিধা হয়েছে কি? ‘আবার কবে বিয়ে করল?’ বিয়ে করার বয়স ওর এখনও রয়েছে, পুরুষদের উত্তেজিত করার মতো উপাদানভরা ওর শরীর। বিবি তাকে ডিভোর্স করতে পারত, হয়তো ছেলেমেয়ের কথা ভেবেই করেনি।

‘অমিয়ার মা, অমিয়ার মা, ওপরে এসো তো একবার।’

বউদির গলা বোধহয়, ঝিকে ডাকছে। সে উঠে জানালার পাশে গিয়ে একটা চোখ দিয়ে তাকাল। বউদি তাদের খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে সরে গেল।

মেজোঘরের দরজার সামনে সে দাঁড়াল। গোরা জন্মাবার পর, বিছানার জায়গা কমে যাওয়ায় সে এই ঘরে একা শুতো। ঘরটা এখন কীরকম রয়েছে, সেটা দেখার প্রবল ইচ্ছায় দরজার হুড়কোটা টেনে সে একটা পাল্লা খুলল। বারান্দার দিকের দরজা আর জানালাটা খোলা রয়েছে, ঘরে যথেষ্ট আলো। তার মনে হল, সে যেন অন্য একটা জগতের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘরের চারদিকে সে চোখ বোলাল।

দেয়ালে সাঁটা রঙিন পোস্টারে ফুটবলার, ক্রিকেটার, আর গিটার হাতে মাইকের সামনে যেসব বিদেশি মুখ, তাদের একজনকেও সে চেনে না। কয়েকটি পোস্টারে বুক, কোমর, পাছা দেখাবার জন্য উৎকট ভঙ্গিতে মেয়েরা। এইসব ছবি বিবি নিশ্চয়ই দেখেছে, তবুও রাখতে দিয়েছে! এই ঘরেই রয়েছে টিভি সেট। এটা বাইরের দালানে থাকা উচিত ছিল, সবাই তাহলে দেখতে পেত। বিছানার উপর টেপরেকর্ডার আর একটা ইংরেজি ম্যাগাজিন। তার মলাটে একজোড়া মেয়ে—পুরুষ, বোধহয় ফিল্মের। পুরনো কাঠের র‌্যাকটায় গোটা চল্লিশ অডিও ক্যাসেট আর কিছু বই। ওয়ার্ডরোবটা যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে। পাল্লাটা টানতেই খুলে গেল। হ্যাঙারে ঝুলছে ট্রাউজার্স আর নানা রঙের টি—শার্ট। তলার তাকে বাতিল পুরনো ট্রাউজার্স, জামা। তার নীচে ড্রয়ার। সেটা টেনে আধখানা বার করেই সে চমকে উঠল। একটা হুইস্কির পাঁইট, তার অর্ধেক খালি।

পিছন থেকে হঠাৎ কেউ যেন তার মাথায় ডান্ডা বসিয়ে দিল। থরথর করছে শরীরের ভিতরটা, চোখে কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্ধকার নেমে এল। বোতলটা কেঁপে উঠল তার হাতে। সেটা রেখে দিয়ে ড্রয়ারটা ঠেলে বন্ধ করে কিছুক্ষণ সে দাঁড়িয়ে থাকল। অসাড় হয়ে গেছে তার স্নায়ু।

গোরা তাহলে গোল্লায় গেছে! কী করে এটা সম্ভব হল? বিবির মতো মানুষের হাতে লালিত হয়ে তার নিজেরই ছেলের এমন দশা হল কী করে? ও কি অন্ধ হয়ে গেছে? ও কি একবারও এই ঘরে আসেনি, উঁকি দিয়েও দেখেনি? তার মদ খাওয়ায় বিবির প্রবল আপত্তি ছিল আর আজ নিজের ছেলের ঘরেই মদের বোতল, দেয়ালে নোংরা ছবি। নিশ্চয়ই জানে। বিবি জেনেশুনে ছেলেকে নষ্ট হতে দিচ্ছে!’

ঘরে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে সে দুটো হাত আড়াআড়ি কপালের উপর রাখল। ঘুম থেকে উঠে যে তাজা ভাবটা বোধ করেছিল সেটা উবে গেছে। আবার তার ক্লান্তি লাগছে। তার একমাত্র বংশধর নষ্ট হয়ে গেছে এটা মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। গোরা কাদের সঙ্গে মেশে, কারা ওর বন্ধু, টাকা পায় কোত্থেকে? বিবি কি কোনো খবর রাখেনি? ষোলোটা বছর সে বাড়িতে থাকলে এটা ঘটতে পারত না। মাথার উপর বাবা আছে, এই অনুভূতিটাই তো ছেলেমেয়েদের রক্ষাকবচ। শ্রীগোপাল তাকে একঢোঁক মদ খাইয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার পরের সাত বছর সে একফোঁটাও জিভে ছোঁয়ায়নি। বাবা দালানে বসে রেডিয়ো শুনত, তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে গন্ধ পেতই। মাস্টারমশায়ের কাছে পড়তে হত দাদার সঙ্গে, সুতরাং মদ খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না!

গোকুলানন্দেই সে টাকা দিয়ে মদ আনিয়ে শ্রীগোপালের ঘরে বসে প্রথমবার খায়, রাতে ওর বিছানাতেই ঘুমোয়, সোমবার সকালে মোটরবাইকে কলকাতায় ফিরে আসে। বাড়িতে ঢোকার আগে সে এলাচ লবঙ্গ দিয়ে মিঠে পাতার পান খেয়েছিল। তখন তাদের দুজনেরই বিয়ে হয়নি। রাত্রে শ্রীগোপাল বলেছিল, ‘রোঘো, মেয়েমানুষ আনব? খালপাড়ে পাওয়া যায়!’ ‘না’। ‘না কেনরে, বড়োলোকের ছেলে না তুই?’ শ্রীগোপাল তার দাঁত দুটো বার করে নাক দিয়ে হাসির মতো শব্দ করেছিল। ‘বাবার কাছে শুনেছি তোর ঠাকুরদার গরাণহাটায় কেপ্ট ছিল, তুইও একটা রাখ না। তোর বংশের সামন্ততান্ত্রিক ধারাটা তাহলে বজায় থাকবে।’ অ্যালকোহল তার মাথার কোষগুলোতে সবেমাত্র চেপে ধরেছে, দৃষ্টি তখনও ঝাপসা হতে আরম্ভ করেনি, সে অবাক হয়েছিল ‘সামন্ততান্ত্রিক’ শব্দটায় নয়, শ্রীগোপালের উচ্চচারণে। এমন একটা খটমট বানানের শব্দ মদ খেয়ে স্পষ্ট উচ্চচারণ করতে পারবে সে ভাবেনি।’ বলার অভ্যাস আছে বলেই পেরেছে। একদিন ও বলেছিল ‘আমি সোশালিস্ট’ নির্ভুল উচ্চচারণে। ‘ঘোড়ামুখো, রাখতে হলে তোর বউকে কেপ্ট রাখব, আগে তুই বিয়েটা কর তো।’ শ্রীগোপাল তাই শুনে বলেছিল, ‘পনেরোটা টাকা দে, খালপাড়টা ঘুরে আসি।’ সে টাকা দিয়েছিল। শ্রীগোপাল তার জীবনের প্রথম বন্ধু।

গোরাও কি কোনো ‘শ্রীগোপাল’ পেয়েছে? ওর সঙ্গে কী সে একবার কথা বলবে? কিন্তু কী কথা বলবে? ছেলেটাকে মনে হল না নম্র, বিনীত ধরনের। যদি মুখের উপর বলে ‘আপনি কে?’

বাইরে দালানের দরজা খোলার শব্দ হল। অরুণা এসেছে। দরজায় বাইরে থেকে তালা দিয়ে গেছিল। টেবিলে পড়ে থাকা এঁটো থালা—বাটি তুলে নেবার জন্য এলে বলতে হবে ‘এ বাড়িতে দরজায় তালা দিয়ে কেউ বেরোয় না, কাজের লোকেরা তো নয়ই।’ অরুণার জন্য সে অপেক্ষায় রইল।

‘বাবা, আপনি কি চা খাবেন?’

মাথার মধ্যে কথাগুলো তৎক্ষণাৎ বসল না। তবে সে মুখটা ফেরাল। দরজায় গুলু দাঁড়িয়ে। ধীরে ধীরে সে উঠে বসল। নিজের অজান্তেই সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো একটা হাত বাড়িয়ে দিল, ‘গুলু’!

গুলু পায়ে পায়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল। ওর বাঁ হাতটা নিজের হাত তুলে মেয়ের মুখের দিকে সে নির্নিমেষে তাকিয়ে রইল। অপ্রতিভ গুলু মুখ নামিয়ে নিয়েছে। এখন তার হাতের মধ্যে একটা টলটলে দিঘি। তার সারা শরীরের কম্পনের আঘাতে ছোটো ছোটো তরঙ্গ উঠছে। তিরতির করে সেই তরঙ্গ তার করপুটে ভেঙে পড়ছে। ওর নরম আঙুলগুলো নিজের মুঠোয় চেপে থেকে সে নাকের পাশে সুড়সুড়ি অনুভব করল। চোখ দিয়ে জল নামছে তো নামুক। সেই চার বছরের গুলু, মাঝরাত্রে বিছানায় উঠে বসে কান্না জুড়ত। কেন কে জানে, বোধহয় কৃমির জন্য। কিছুতেই কান্না থামত না। বিরক্ত বিবি চড় কষালে আরও জোরে কেঁদে উঠত। তখন সে মেয়েকে নিয়ে দালানে পায়চারি করত। পিঠে চাপড় দিতে দিতে কত রকমের কথা বলত গুলুর কান্না থামাতে।

এখন ঝাপসা চোখে সে কুড়ি বছরের গুলুর মুখের দিকে তাকিয়ে ঘড়ঘড়ে স্বরে একটা শব্দ বার করল, ‘মা।’

এবার গুলু কি অনেক কথা বলবে না তার বাবার কান্না থামাতে!’

‘চা খাবেন?’

কী স্নিগ্ধ, মিষ্টি স্বর। বিবির গলার সঙ্গে কোনো মিল নেই। ওর ঠাকুমার এমন স্বর ছিল। ‘তুই এখন আমার সামনে বোস।’

গুলু খাটের উপর তার পাশে বসামাত্র সে ওর দু—কাঁধ ধরে বুকের উপর টেনে নিল: ‘আমার গুলু….আমার মেয়ে…আমার মেয়ে, তোর বাবাকে মাপ করে দে….আমি সবার সঙ্গে অন্যায় করেছি…গুলু আমি তোদের ক্ষতি করেছি…।’

‘আপনি অমন করছেন কেন, শান্ত হয়ে বসুন।’

‘আমাকে ‘আপনি’ বলছিস কেন, আমাদের বাড়িতে বাবাকে ‘তুমি’ বলে। তুই কি এই বাড়ির মেয়ে নোস?’

‘আমি চা করে আনি। অরুণাদি তার ভাইয়ের বাড়ি গেছে, সন্ধের মধ্যেই আসবে। আমি ডুপ্লিকেট চাবিটা নিয়ে বেরিয়েছিলাম।’

ঘর থেকে গুলু চলে যাওয়ার পরই সে বিছানায় ভেঙে পড়ল। বালিশটা মুখের উপর চেপে সে হিক্কা তোলার মতো শব্দ করল। মিনিট দুয়েকের মধ্যে শান্ত হয়ে সে উঠে বসল। পুবের জানলা দিয়ে কয়েকটা বাড়ি দেখা দেয়। বিকেল শেষের স্তিমিত আলো পুরোনো দেওয়ালগুলোয় সন্ধ্যার ছায়া ফুটিয়েছে। তারে ভিজে কাপড় নাচিয়ে নাচিয়ে ঝোলাচ্ছে একটি স্ত্রীলোক। সিঁড়ি দিয়ে একটি বালক দুড়মুড়িয়ে নেমে গেল। চড়াই পাখিদের কিচিরমিচির কৃষ্ণচূড়া গাছে। দূরে কোথাও পটকা ফাটার আওয়াজ হল।

চা আর চারখানা বিস্কিট নিয়ে এল গুলু।

‘মা কোথায় গেছে?’

‘বলতে পারব না। মনে হয় সল্টলেকে অপূর্ব মামার ফ্ল্যাটে গেছে। ওঁর ম্যালেরিয়া হয়েছে শুনেছি।’

‘কে অপূর্ব মামা?’

গুলু একটু অবাক হল যেন। ‘অপূর্ব মামাকে জান না! মা—র ছোটোবেলার বন্ধু, চন্দননগরে একই পাড়ায় বাড়ি ছিল, ওরা একই সঙ্গে যাদবপুরে পড়েছে, তবে মা—র থেকে দু—বছরের সিনিয়ার।’

‘না, আমি এর কথা বিবির কাছে কখনো শুনিনি। বেশি কথা তো বলত না। পড়াশুনোর কথা তো একদমই নয়।’

‘অপূর্বমামা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলেন। ফুলব্রাইট ফেলোশিপে রচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন, সাত—আট বছর আমেরিকায় ছিলেন। এখন আছেন সায়ান্স কলেজে।’

গুলুর চোখেমুখে কেমন যেন উজ্জ্বল আভা ফুটে উঠল কথাগুলো বলার সময়, কথার সুরে শ্রদ্ধা আর সমীহ। এই উজ্জ্বলতা বাবার কথা বলার সময় কখনোই ফুটবে না। তার ভিতরটা ধসে পড়ছে। ক্ষীণভাবে হঠাৎই তার মনে হল, এই অপূর্বর সঙ্গে বিবির কোন ধরনের একটা সম্পর্ক বোধ হয় আছে।

‘উনি এ বাড়িতে আসেন না?’

‘কেন আসবেন না? অপূর্ব মামার কাছে পড়েই তো মা এমএসসি পাশ করল, মাকে কলেজে ঢুকিয়ে দিলেন তো উনিই।’

‘অপূর্বমামা বিয়ে করেছেন?’

গুলু থতমত হল। প্রশ্নটা এই মুহূর্তে অপ্রত্যাশিত।

‘হ্যাঁ।’

‘তাঁকে দেখেছিস? তোর মায়ের মতো সুন্দরী?’

‘মোটামুটি, তবে মায়ের মতো নয়। অপূর্বমামার বউ ডাক্তার, গায়নোকোলজিস্ট। ….একি, বিস্কুটগুলো পড়ে রইল কেন?’

‘বিস্কুট খেতে আমার ভালো লাগে না। তুই বরং খা।’

‘আমারও ভালো লাগে না।’

‘আচ্ছা গুলু, আমি এতকাল না থাকার জন্য তোর মনে কি কষ্ট হত? এখন তুই কি খুশি হয়েছিস?’

গুলুর মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। ‘কষ্ট তো হতই। তোমার চেহারাটা আমি মনে করে রেখে দিয়েছিলাম। কী সুন্দর দেখতে ছিলে। চার বছর বয়সে দেখেছি, ভুলে যাবার কথা নয়। রণোর অবশ্য একদমই মনে নেই। একবার তুমি মোটরবাইকে সামনে বসিয়ে আমাকে পরেশনাথ মন্দির দেখাতে নিয়ে গেছিলে, তাও মনে আছে।’

‘সেদিন পেছনে একজন বসে ছিল, কে বল তো?’

‘মনে নেই।’

‘শিবু বর্ধন লেনে থাকে সন্তু, আমার স্কুলের বন্ধু। ও মানিকতলা যাবে বলে চড়েছিল। সনতের সঙ্গে একবার দেখা করব।’

‘কেন? মা কিন্তু কারুর সঙ্গে দেখা করাটা পছন্দ করবে না।’

সে স্থির চোখে গুলুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর মার পছন্দ—অপছন্দ সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, এই ধারণা মেয়েটার হল কী করে! স্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ী স্বামী চলবে, সেটা এ বাড়ির ধারা নয়।

‘তুই মাকে ভয় পাস?’

‘ভয় পাব কেন!’

‘মা অপছন্দ করবে, এটা জানলি কী করে?’

গুলুর মুখ ম্লান হয়ে গেল। চোখ নামিয়ে ইতস্তত করে শুকনো হাসল। ‘আমি জানি। অ্যালবাম থেকে তোমার সব ছবি খুলে নিয়ে টুকরো টুকরো করে পুড়িয়ে দিয়েছে আমাদের সামনে। পরশুদিন বলল, তোমাদের বাবা আসছে, কেউ কিন্তু যেচে একটি কথাও বলবে না, বাইরের কাউকেও কথা বলতে দেবে না।’

‘আর কিছু বলেছে?’

‘আর কী বলবে।’ গুলু এমনভাবে তাকাল যেন এরপরও আর কিছু বলার থাকে কি?

বাইরের আলো আরও কমে এসেছে। ঘরের আলো জ্বলতে যাচ্ছিল গুলু, সে বারণ করল। ‘থাক, আলোটা চোখে লাগে।…হ্যাঁ রে, গোরা লেখাপড়া করে?’

‘এবার হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছে।’

‘বোধ হয় পাশ করবে না।’

গুল চুপ করে রইল।

‘তোর মা ওকে খুব ভালোবাসে।’

গুলু অস্ফুটে কী যেন বলল।

‘গোরার বন্ধুবান্ধব কারা, জানিস? কেমন ধরনের তারা?’

‘ওর নানা রকমের বন্ধু, তবে অ্যাকাডেমিক দিক থেকে কেউ তেমন ভালো নয়। বাড়িতে যারা আসে তাদের কথাবার্তা ব্যবহার তো ভালোই। খুব হইচই করে, ক্যাসেটে পপ গান শোনে…বাইরে কে কেমন তা জানি না।’

‘তোর মা গোরাকে পড়তে বসায় না, শাসন—টাসন করে না?’

‘ও মাকে খুব একটা গ্রাহ্য করে না। ছোটো থেকেই কেমন যেন একগুঁয়ে, জেদি, রাফ। মা বলে তোমার জন্যই নাকি গোরা এমন হয়ে গেছে।’

‘আমার জন্য!’ সে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। ‘কেন, কীভাবে? আমি কী করলাম!’

‘জানি না। …মা আমাদের বলত, ডাকাতদের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে একজনকে মেরে ফেলেছিলে, তাই জেলে গেছ। একদিন গোরা মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, রেপ মানে কী? তখন ও ক্লাস ফোর—এ পড়ে। বিকেলে হনুমান পার্কে খেলতে গিয়ে কী নিয়ে যেন ঝগড়া হয়, তখন কেউ ওকে বলে, তোর বাবাতো…।’

ঘরে এখন আঁধার। গুলু কথাটা সম্পূর্ণ করল না। বড়ো হয়েছে, বাবাকে লজ্জায় ফেলতে চাইল না, নিজেরও লজ্জা করবে। ওর মুখটা এখন কেমন দেখাচ্ছে, সেটা দেখার ইচ্ছে তার হল, কিন্তু আলো জ্বেলে নয়।

কোর্ট বলেছে, তোদের বাবা শুধু মার্ডারারই নয় রেপিস্টও। কিন্তু রেপ আমি করিনি। অনেকবার কোর্টে এই কথা বলেছি, আজও কথাটা তোকে বলছি। গুলু তুই বড়ো হয়েছিস, লেখাপড়া করছিস, তোর বিচারবুদ্ধি তৈরি হচ্ছে, পাঁচটা অশিক্ষিত লোকের মতো তোর বিবেচনা—বোধ নয়। গোকুলানন্দর দারোগা আর শ্রীগোপালের বউ সড় করে…।’ কথাগুলো সে বলল মনে মনে।

গুলু ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। ওর মুখটা আর দেখা হল না। গুলুও কি তাহলে বিশ্বাস করে, কোর্ট ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিল!

চার

শুধু বাড়িটা নয়, সারা উত্তর কলকাতা, পশ্চিমবাংলা, ভারতবর্ষ এখন ঘুমের মধ্যে। পৃথিবীর নানান জায়গা এখন কর্মব্যস্ত, কোথাও বা স্টেডিয়ামে খেলা, ডিস্কো থেকে হই—হুল্লোড়, কোথাও বা শীর্ষ সম্মেলন কী গুলিগোলা চলছে। ছাব্বিশ নম্বর সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বাড়িটা এখন অন্ধকার, ঘুমন্ত। কিন্তু একটা ঘরে আলো জ্বলছে। সে জেগে রয়েছে, টেবিলে তার খাবার থালা দিয়ে ঢাকা।

সে তার ঘর থেকেই জেনেছে কখন অরুণা, কখন বিবি, কখন গোরা ফিরল। খাওয়ার টেবিলে বিবির সঙ্গে গুলুর কথাবার্তার টুকরো তার কানে এসেছে।

‘কেমন আছেন দেখলে?’

‘জ্বর নেমে এসেছে। ওর বউই দেখেছে। তবে বড়ো ধরনের কিছু নয়, একটা গাইনির পক্ষে যতটা সামাল দেওয়া…..কলকাতাটা যে কী হয়ে উঠেছে, হেন কুচ্ছিত রোগ নেই যে হচ্ছে না। আমরা ছোটোবেলায় শুনেছি ম্যালেরিয়া নাকি শুধু গ্রামেই হয়!’

গোরা ফিরল। দরজা খুলে দিল বিবি।

‘এত রাত হল যে!’

‘কত আর, এগারোটা।…খাবার রেখেছ নাকি? আমি সুজিতদের বাড়িতে খেয়ে এসেছি। রোজ সেই একঘেঁয়ে রান্না আর খাবার, ধ্যাৎ…..তুমি তো অনেক কিছু রাঁধতে জান, তাহলে পরীক্ষার চোতা অ্যানসার পেপারগুলো না দেখে রান্নাঘরে যাও না কেন?’

এরপর দড়াম করে মেজোঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ।

এই শব্দটাই তাকে বলে দিল গোরা যথেষ্টভাবে প্রকৃতিস্থ নেই। এখন তার বিবির মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে। বলতে ইচ্ছে করছে, তোমারই হাতে মানুষ হয়েছে গোরা। তুমি ভালো করেই জানো, এখন ও কোথায় পৌঁছেছে। বাবা রেপ করে জেলে গেছে বলেই ওর মানসিক সর্বনাশ ঘটে গেছে, এই মিথ্যা ধারণাটা ছড়িয়ে কোনো লাভ নেই, ছেলেমেয়েরা তৈরি হয় মায়ের হাতে, বাবার হাতে নয়। আর এই ছেলে তুমিই তৈরি করেছ!

সে উত্তেজিতভাবে ঘরে পায়চারি করতে করতে একসময় থামল। এভাবে একা ঝগড়া চালিয়ে কোনো লাভ নেই। বরং মুখোমুখি সে বিবির সঙ্গে কথা বলবে। এখন ঘুম আসবে না। মাথাটা ঠান্ডা হোক আগে। পরদার কাপড়ে ঢাকা র‌্যাকটার সামনে দাঁড়িয়ে কাপড়টা সে তুলতেই দেখল, তার চোখের সামনে গাদা হয়ে রয়েছে বাল্যকালের গ্রামোফোন রেকর্ড, পাঁজি, বাড়ির ট্যাক্সের, ইলেকট্রিকের, সর্বজনীন দুর্গোপুজোর বিল, বাজারের হিসেবের খাতা, স্কুলের ছেঁড়া বই, গীতা। উপরের তাকে একটা ছাতার বাঁট দেখা যাচ্ছে, তার পাশে একটা সাপের চামড়ার হাতব্যাগ। ব্যাগটাকে সে চিনল, বিবিকে কিনে দিয়েছিল চর্মশিল্পের মেলায়। হাত তুলে ব্যাগটা টেনে নামাতেই ধুলো পড়ল তার মুখে। ফুঁ দিয়ে ধুলো ঝেড়ে ব্যাগটা পরদার কাপড়ে মুছল।

চামড়াটা সাপের বলেই বিবি আপত্তি করেছিল। ‘এটাকে দেখেই তো গা শিরশির করছে, বরং অন্য একটা, ওই সাদাটা নাও।’ আঙুল দিয়ে বিবি একটা ব্যাগ দেখিয়েছিল। ‘আরে বাবা, এটা সাড়ে চারশো টাকার ব্যাগ, কোনটে তা হলে নেওয়া উচিত?’ বিবি বলেছিল, ‘শুধু দাম দিয়েই কি জিনিসের ভালোমন্দ বিচার হয়! রুচি বলেও তো একটা ব্যাপার আছে।’ বলার সময় ওর চোখের কোণ কুঁচকে গেছল। সে বুঝতে পেরেছিল বিবি কী বলতে চেয়েছে। সে তখন বলেছিল, ‘চেহারা দিয়ে বিচার করলে আমিও তো ওই সাদা ব্যাগ, কম দামি কিন্তু বগলে নিয়ে ঘোরা যায়।’ বিবির মুখ রাগে থমথম করে ওঠায় তার হাসি পেয়েছিল। সে দুটো ব্যাগই কিনেছিল।

ব্যাগের টেপা বোতামটা খোলার সময় ‘কট’ শব্দ হল। ভিতরে কয়েকটা পুরনো কাগজের টুকরো, খবরের কাগজ থেকে কাঁচি দিয়ে কাটা। একটা টুকরো তুলে তাকিয়ে সে যেন সাপের ছোবল খেল। এক কলাম তিন লাইন হেডিংয়ে: বাল্যবন্ধুকে খুন, বন্ধুর স্ত্রীকে ধর্ষণ। শব্দগুলো বুলেটের মতো তার মাথায় আঘাত করল। তার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল গুঁড়িয়ে যাওয়া খুলিটার টুকরোগুলো জড়ো করতে।

‘নিজস্ব সংবাদদাতা : খালেদনগর, ১৫ জুন—গত শনিবার রাতে খালেদনগর থানার গোকুলানন্দ গ্রামে বাল্যবন্ধু শ্রীগোপাল বিশ্বাসকে দা দিয়ে কুপিয়ে খুন করে তার স্ত্রী পারুলবালাকে ধর্ষণ করার দায়ে পুলিশ রাঘবেন্দ্রনারায়ণ দত্তকে গ্রেপ্তার করেছে। আসামীর জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য করে মহকুমা আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ১৪ দিন পুলিশ হাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। পারুলবালাকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়।’

তার নামের নীচে কালির দাগ, নিশ্চয় বিবির করা। খবরের কাগজ থেকে কেটে রেখেছে বিবিই, সে না হলে এ কাজ এ বাড়িতে কে করবে! কেন কেটে রেখেছিল, ছেলেমেয়েদের দেখাবে বলে? কিন্তু ওরা তো একদিন জানবেই, জেনে গেছেও। কিন্তু সবটা জানে কী?

খবরের দ্বিতীয় প্যারায় সে চোখ রাখল—’রসপুর মৌজার অন্তর্গত কলকাতাবাসী সম্পন্ন রায়ত রাঘবেন্দ্রর জমিজমা ও সম্পত্তির দেখাশোনার কাজ করতেন শ্রীগোপাল। তিনি স্থানীয় কৃষক আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এক সময় রাঘবেন্দ্রর বহু বিঘা জমি আন্দোলনকারী কৃষকরা দখল করে নেবার চেষ্টা করেছিল। তাঁর সন্দেহ হয়, আন্দোলনকারীদের পিছনে শ্রীগোপালের মদত আছে। শনিবার সন্ধ্যায় এই নিয়ে তার সঙ্গে শ্রীগোপালের কথা কাটাকাটি ও বচসা হয়। এরপরই রাঘবেন্দ্র দা নিয়ে শ্রীগোপালকে আঘাত করে। পারুলবালা স্বামীকে রক্ষার জন্য ছুটে এলে রাঘবেন্দ্র তাকে ঘরের মধ্যে টেনে এনে ধর্ষণ করে। গোকুলানন্দ গ্রামে সেদিন রাত্রে যাত্রাপালা হবে বলে আসরের তোড়জোড় চলছিল। পারুলবালার চিৎকার শুনে যাত্রার উদ্যোক্তা গ্রামের লোকরা ছুটে এসে রাঘবেন্দ্রনারায়ণকে ধরে ফেলে, তখন তিনি মদের নেশায় আচ্ছন্ন ছিলেন।’

হ্যাঁ, তখন তার নেশা হয়েছিল, কিন্তু আচ্ছন্ন সে ছিল না। সেদিন শনিবার সকাল দশটায় সে গোকুলানন্দে পৌঁছেছিল। রথতলার মোড়ে বাসরাস্তার দু—ধারে বাজার তখন জমজমাট। আনাজ বিক্রির একটা মাঝারি পাইকারি হাট প্রতি শনিবার এখানে বসে। স্তূপাকার কুমড়ো, ঝুড়িভরা বেগুন, পটল, কাঁচালংকা, ঢ্যাঁড়স তার সঙ্গে রবারের জুতো, চুটি, তেলেভাজা, রেডিমেড পোশাক, লুঙ্গির পশরা আর ক্রেতাদের ভিড় রাস্তাটাকে সরু করে দিয়েছে। এরই মধ্যে দিয়ে মোটরবাইক চালিয়ে যাওয়ার সময় সামনে থেকে একটা ট্রাক এসে পড়ে। সে বাইকটা দ্রুত সরাতে গিয়ে কাঁধে একটা গোরুর গাড়ির জোয়ালের খোঁচা খায়। জায়গাটা চিনচিন করে ওঠে।

রথতলা থেকে আধমাইল এগিয়ে বাঁ দিকে নেমে গেলে গোকুলানন্দে যাবার মাটির রাস্তা। হাঁটাপথে দশ মিনিট। রাস্তাটা খালপাড় ধরে গ্রামের পাশ দিয়ে চলে গেছে ভাতারিয়া, রাইহাটা হয়ে সখিবাড়ি। খালপাড় দিয়ে যাবার সময় বরাবরই সে বাইকটা মন্থর করে। সাত—আটটা টালির চালের দরমার ঘরে বেশ্যারা থাকে। শনিবার হাটের দিনেই এদের বড়ো রোজগার। সস্তার রঙিন সিল্কের শাড়ি, ছোটোখাটো চেহারা হলে ফ্রক পড়ে, মুখে রঙ মেখে এরা সকাল দশটা থেকেই নিজেদের বিজ্ঞাপন শুরু করে। খদ্দের আসবে দুপুর থেকে। এদের দেখতে তার মজাই লাগে। মোটরবাইকে চড়া লোক মানেই পয়সাওয়ালা, যদি খদ্দের হয়। এই আশায় ওরা যেভাবে চোখ বড়ো করে তাকায়, সেটা দেখার জন্যই সে মন্থর হয়। এরা বিবির নখের যুগ্যি নয় বটে। কিন্তু এরা তার বাসনার জানালাগুলো খুলে দেয়, যেটা তার বউ পারে না।

সেদিনও সে মন্থর হয়ে তাকিয়েছিল। একজনকে দেখে তার কেন যেন মনে হল, অনেকটা শ্রীগোপালের বউয়ের মতো!

খামারবাড়িতে পৌঁছবার আগেই পিছন থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে পারুলকে দেখতে পায়, রাস্তা দিয়ে জারিকেন হাতে ঝুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পারুলের বয়স যখন তেরো—চোদ্দো সেই সময়ই ওকে সে প্রথম দেখেছে। তাদের বাসনমাজা ঠিকে ঝি কার্তিকের মা—র ছোটোমেয়ে, থাকত কচুবাগান বস্তিতে। বহু পরে বউদির কাছে সে শুনেছে নন্দকাকা নাকি ওর ঘরে প্রায়ই যেত। শ্রীগোপাল তা জানত নিশ্চয়। ঘরে বসেই নির্ভুল খবর সংগ্রহে বউদির দক্ষতার কথা বাড়ির সবাই জানে। পারুল মা—র সঙ্গে আসত কাজে সাহায্য করার জন্য। মাঝেমধ্যে তখন তার চোখে পড়েছে হাইজাম্পারদের মতো লম্বা দুটো পা, শীর্ণ দেহ, দুটো বিনুনি, মাজা গায়ের রঙ আর বড়ো চোখ। তাকে দেখলেই চোখ নামিয়ে নিত। তখন সে ক্লাস টেন—এ পড়ত, মিতার সঙ্গে প্রণয় চলছে। একতলার ঘরে শ্রীগোপাল থাকত দুলালের সঙ্গে। ঘরের সামনেই উঠোন, যেখানে বসে কার্তিকের মা বাসন মাজত মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। শ্রীগোপালের বয়স তখন উনিশ, তার প্রথমবার মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে। ঘরে বসে দুপুরে লেখাপড়া চর্চা করে। সেই সময়ই একদিন দোতলার জানালা থেকে তার চোখে পড়েছিল ঘর থেকে শ্রীগোপাল চোখের ইশারায় কার্তিকের বোনের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান চালাচ্ছে। সেই দিনই সে শ্রীগোপালকে বলেছিল, ‘কদ্দূর এগোলি’? ‘দারুণ মেয়ে মাইরি।’ ‘নাম কী রে?’ ‘পারুল’। ‘দেখিস ধরা পড়ে যাসনি।’ সামনের লম্বা দাঁত দুটো বার করে শ্রীগোপাল হেসেছিল, ‘ধরা অতই সোজা যেন!’

পোষাচ্ছে না বলে বছরখানেক পর কার্তিকের মা কাজ ছেড়ে দেয়। এরপর শ্রীগোপাল পাড়ার বাইরে সন্ধ্যাবেলার পারুলের সঙ্গে দেখা করত, এইটুকু মাত্র সে জানে। এই প্রসঙ্গে নিয়ে শ্রীগোপালের সঙ্গে কথা বলাকে মর্যাদার পক্ষে যথেষ্ট নয় বলে সে মনে করত। তার সঙ্গে পারুলের মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখা হয়েছে। পাড়ার বস্তিবাসী ঝিয়ের মেয়ে, সুতরাং কথা বলার প্রশ্নই নেই। হয়তো সে পরিচিতের ফিকে হাসি হেসে থাকবে, তখন পারুলের বড়ো বড়ো চোখ মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখে সে মজাই হয়তো পেয়েছে। একদিন সে হনুমান পার্কের ফটকে যদুপতির কাছে ঘুগনি কেনার সময় একটি মেয়ের সঙ্গে পারুলকে শাড়ি পরে যেতে দেখেছিল। শালপাতার টুকরো দিয়ে খানিকটা ঘুগনি তুলে মুখে দিতে দিতে সে আড়চোখে দেখেছিল, পারুলকে আরও লম্বা, আরও রোগা লাগছে শাড়ি পরার জন্য। আর দেখেছিল পারুলের মুখ সোজা সামনের দিকে, কিন্তু চোখদুটো ডানদিকে ঘুরিয়ে নজর তার মুখে রেখে কথা বলতে বলতে পাশ দিয়ে চলে গেল। খানিকটা গিয়েই ওরা দুজন ফিরে এল যদুপতির কাছে। ‘এক আনা—এক আনা করে দু—জায়গায় ঘুগনি দাও তো।’ সে সেখান থেকে তখন সরে গেছিল।

এখন খালপাড় দিয়ে সেই পারুলই হাতে একটা প্লাস্টিকের জারিকেন নিয়ে চলেছে। অদ্ভুতভাবে বদলে গেছে ওর চেহারাটা। তিন বছর আগে যখন সে এসেছিল, তখন দেখা সেই রোগা মেয়ের চিহ্নমাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না ওর শরীরে। তিল তিল করে কবে যে ও ভরাট হয়ে উঠল তা সে জানে না। তিন বছর আগে শ্রীগোপাল এসে যখন বলল, ‘রোঘো, বিয়ে করে ফেললুম মেয়েটাকে, একদিন গোকুলানন্দে আয় বউভাত খাওয়াব।’ তখন সে অবাক হয়ে বলেছিল, ‘কাকে, পারুলকে?’ ‘তবে না তো কাকে? বউদি, আপনি তো এখনও একবারও যাননি গোকুলানন্দে, এবার একদিন রঘুর সঙ্গে আসুন।’ বিবি হেসে ‘যাব’ বলেছিল। পরে বিবি জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘পারুল কে? মনে হল তুমি যেন চেনো।’ ‘চিনি বলতে মেয়েটার মা আমাদের ঠিকে ঝি ছিল, মায়ের সঙ্গে ও আসত, এই পর্যন্ত। শ্রীগোপাল তখন থেকেই প্রেম চালিয়েছে। সিড়িঙ্গে একটা মেয়ে, ড্যাবাড্যাবা চোখ, এইটুকু শুধু মনে আছে।’ কার্তিকের মা—র সঙ্গে নন্দকাকার সম্পর্কের কথাটা সে আর বলেনি।

গোকুলানন্দর বাড়িটা ষাট সত্তর বছরের, চুন—সুরকির গাঁথনিতে তৈরি। জমিজমার সঙ্গে বাড়িটাও তার ঠাকুরদা কিনেছিল গায়েনদের কাছ থেকে। পলেস্তরা খসে পড়েছে, জানলার কাঠের গরাদ ভাঙা, পাল্লার কাঠ ক্ষয়ে যাওয়ায় দরজা বন্ধ করলেও বৃষ্টির ছাট কি কনকনে বাতাস ঘরে ঢোকে। ঘরের মেঝের সান চটে যাওয়ায় ঝাঁট দিলেই ধুলোর মতো সুরকি উঠে আসে।

বছরে দু—তিনবারের বেশি কেউ না আসায়, বাড়িটাকে সংস্কার করার গরজ কেউ দেখায়নি। তার আগে দত্তবাড়ির কেউ এখানে রাত কাটায়নি। শ্রীগোপাল দু—তিনবার বলেছিল বাড়িটা সারাইয়ের জন্য। ‘হাজার দশেক ঢাললেই নতুন হয়ে যাবে।’ কিন্তু হচ্ছে—হবে করে সেও মাসের পর মাস পার করে দিয়েছে।

বিবি একবার বলেছিল, ‘বাড়িটা সারিয়ে নিলেই তো হয়।’ সে বলেছিল, ‘সারাতে গেলে তো রোজ আমাকে কলকাতা থেকে গিয়ে কাজ দেখতে হবে। শ্রীগোপালকে ভার দিলে ও বেটা তো অর্ধেক টাকা আগে নিজের পকেটে পুরবে। দেখ না, প্রত্যেকবারই একটা—না—একটা অজুহাত দিয়ে টাকা কম দিচ্ছে, হয় বর্ষা হয়নি বলে বীজতলার চারা নষ্ট হয়েছে; নয়তো কালবোশেখিতে ধানের মোহর ঝরে গেছে কী পোকা লেগে ধান নষ্ট হয়েছে। বাঁশ, নারকোল বেচে দিয়ে কত টাকা যে মেরেছে, তার হিসেব করা যাবে না। ওকে ছোটোবেলা থেকেই জানি তো!’

গ্রাম থেকে খানিকটা বাইরে একটা পুকুর, দুটো ফলের বাগান আর একটা বিঘে চারেকের সবজি খেত পেরিয়ে তাদের বাড়িটা। নিকটতম প্রতিবেশী কম করে চারশো মিটার দূরের শরৎ বসাক। টাকাওয়ালা লোক। পাটের ব্যবসায়ী, একটা ট্রাক আছে, তেজারত করে। একান্নবর্তী পরিবার ছেড়ে, জমি কিনে একতলা নতুন বাড়ি করে বছরখানেক হল বাস করছে। শরৎ বসাক ছাড়া গোকুলানন্দর আর কারুর সঙ্গে তার আলাপ নেই।

বাড়ির একতলায় একটি বড়ো ঘর আর সেপটিক ট্যাঙ্কের পায়খানা, তার উপরে দোতলায়ও একটি ছোটো ঘর আর সেই মাপেরই ছাদ। পায়খানাটা শ্রীগোপাল ব্যবহার করে। বাড়ির লাগোয়া একটা ইঁদারা। নীচের ঘরে ধানের বস্তা, খড়, সার, চাষের জন্য দরকারি সরঞ্জাম রাখা হয়। এরই পাশ দিয়ে দোতলায় ওঠার সরু দু—হাত চওড়া সিঁড়ি। সিঁড়ির মাথায় বাঁদিকে ঘর, ডানদিকে ছাদ। ঘরটা তালা দেওয়া থাকে, চাবি থাকে শ্রীগোপালের কাছে।

তার ঠাকুরদা দ্বারিক দত্ত বেলজিয়াম থেকে নানা ধরনের কাচ, ঝাড়বাতি আর আয়না আমদানি করে পূর্ব ভারতে একচেটিয়া ব্যবসা শুরু করে বিশ শতকের প্রথম দিকে। গোকুলানন্দে চাষের জমি, ফলের বাগান, পুকুর সব মিলিয়ে নব্বই বিঘের সম্পত্তি আর বাড়িটা তার আমলেই হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তার কাচ আমদানির ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধ থামার পর হাঁপানির রোগী আটাত্তর বছরের বৃদ্ধের পক্ষে আবার নতুন করে ব্যবসা পাতার মানসিক ও দৈহিক সার্মথ্য আর ছিল না।

দ্বারিকের একমাত্র ছেলে অমিয় বাবার বিষয়সম্পত্তি ও ব্যাঙ্কের পাসবই দেখে স্থির করে, যে বিশ্রামটা বাবার নেওয়া উচিত ছিল, সেটাই সে নেবে বাবার তরফে। চারটে ওষুধ কোম্পানির হোলসেল ডিলার হয়ে অমিয় বাগরি মার্কেটে ঘর নিয়ে বড়োছেলে গোপেন্দ্রনারায়ণকে বসিয়ে দিল ব্যবসায়। আর নিজে ব্যস্ত রইল তার ক্লাব মোহনবাগানকে নিয়ে। ধবধবে ধুতি—পাঞ্জাবিতে শোভিত হয়ে, হুডখোলা অস্টিনে চড়ে অমিয় নিয়মিত বিকেলে ময়দানে যেত, ক্লাব লনের বেঞ্চে বসে বনেদি লোকেদের সঙ্গে গল্প করত। হাজার হাজার টাকা চাওয়া মাত্র ক্লাবকে দিয়েছে এবং কখনো ফেরত চায়নি, কার্যনির্বাহী সমিতিতেও সদস্য হয়েছে।

তার বিষয়—আশয় দেখার ভার ছিল নন্দলাল বিশ্বাসের ওপর। এই ব্যাপারে তার দুই ছেলের থেকেও সে বেশি ভরসা করত তার পুরোনো বিশ্বস্ত লোকটিকে। বেঁচে থাকতেই অমিয় তার বিষয়সম্পত্তি গোপেন্দ্র ও রাঘবেন্দ্রকে ভাগ করে দিয়ে যায়। ওষুধের ডিলারশিপ, বসতবাড়ির সামনের অংশ, ভবানীপুর ও দর্জিপাড়ার বাড়ি পায় বড়োছেলে। বসতবাড়ির পিছনের অংশ ও বাগানের জমি আর গোকুলানন্দর জমিজমা পায় ছোটোছেলে। একমাত্র মেয়ে সরযূর বিয়েতে অমিয় দেড় লাখ টাকা খরচ করেছে, যৌতুকের মধ্যে ছিল গ্রে স্ট্রিটের বাড়িটা আর ডাক্তার জামাইয়ের চেম্বার সাজিয়ে দেওয়া। অমিয় উইল করে যায়, ক্যাশ সার্টিফিকেটে আর নগদে প্রায় চার লক্ষ টাকা তার দুই ছেলের মধ্যে ভাগ হবে আর স্ত্রী রাধারানীকে দেয় পঞ্চাশ হাজার টাকা। স্ত্রীর মৃত্যুর পর পঞ্চাশ হাজার থেকে যে টাকা রয়ে যাবে, তা সমানভাবে পাবে দুই পুত্রবধূ। এই টাকা রাধারানীর খরচের দরকার হয়নি, ফলে সুদে—আসলে যা দাঁড়িয়েছিল, তার অর্ধেক প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা বিবি পায়।

অমিয় তার ছোটোছেলেকে বলেছিল, ‘রঘু, তোকে গ্রামের জমিজমা দিলাম বলে মনে দুঃখ পাসনি তো? পুরনো ভাড়াটের বাড়ি থেকে কোনো লাভ হয় না। ডিলারশিপের কারবারটা গোপুই গড়ে তুলেছে, ন্যায্যত এটা ওরই পাওয়া উচিত।…. তোর স্বাস্থ্য আছে, খাটবার ক্ষমতা আছে, তুই কেন বসা কাজ করবি? চাষবাস ভালোভাবে করতে পারলে তাতে অনেক পয়সা, মাটি হল সোনা! কেমিক্যালস দিয়ে, ট্রাক্টর দিয়ে, সয়েল টেস্ট করে, উন্নত বীজ দিয়ে যেভাবে ইউরোপ আমেরিকায় হয়, সেইভাবে এগ্রিকালচারাল ফার্ম কর, এর ভবিষ্যৎ আছে। ফিশারিজ কর, পোলট্রি কর, ডেয়ারি কর… যদি তোর উদ্যোগ থাকে, বড়ো হবার স্বপ্ন থাকে…আমি তোকে জমি আর কিছু টাকা শুধু দিয়ে গেলাম—এবার তুই যা করার কর।’

বাবার কথা সে মন দিয়ে শুনে বলেছিল, ‘আমি দুঃখ পেয়েছি এমন ধারণা তোমার হল কী করে? তুমি তো আমায় সেরা জিনিসই দিয়েছ! গ্রাম তো আমার ভালোই লাগে।’ কিন্তু সে চাষ করতে গ্রামে যায়নি, তখন তার সদ্য বিয়ে হয়েছে। বউকে কলকাতায় রেখে গোকুলানন্দে গিয়ে বাস না করে বাড়ির বাগানের জমিতে স্টিলের অফিস—সরঞ্জাম তৈরির কারখানা খোলে। তবে বছরে দু—তিনবার সে গোকুলানন্দে যেত, যদি বিশেষ দরকার পড়ত। যুক্তফ্রন্ট আমলে চাষিরা যখন জমি দখলের লড়াই শুরু করে, বড়ো বড়ো রায়তদের সঙ্গে তখন শ্রীগোপাল ছুটে এসেছিল কলকাতায়।

‘রোঘো, তোর জমি আর বোধহয় বাঁচানো যাবে না। রাইহাটায় চাটুজ্যেদের জমিতে চারটে লাশ পড়েছে, আটকাতে পারেনি, জমিতে লালঝান্ডা পুঁতে দিয়েছে। কালোসোনায় দু—বার ধান কাটতে এসেছিল, মল্লিকরা কলকাতা থেকে গুন্ডা আর বন্দুক এনে হটিয়েছে, দুটো লাশ পড়েছে, জানি না শেষ পর্যন্ত কী হবে। শয়ে শয়ে মানুষ, বড়োজোর দু—তিন দিন আটকাতে পারব, তারপর?’

‘আমার তো আর দুশো কিংবা তিনশো বিঘে নয়, তাহলে আমার জমি নেবে কেন?

‘বারো বছর আগে কংগ্রেস সরকার ভূমিসংস্কার করে পঁচাত্তর বিঘের যে সিলিং বেঁধে দিয়েছিল, তার থেকে তো তোর চোদ্দ—পনেরো বিঘে বেশি রয়েছে। বাড়তি সেই জমিতো আজও চাষিরা পায়নি। এখন যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমল, এবার তো আর ছাড়ানছুড়িন নেই।’

‘তুই তো একটা কৃষক নেতা, কিছু একটা ব্যবস্থা কর।’

‘আমি! …তুই বলিস কী?’ শ্রীগোপালের দাঁতদুটো আরও বেরিয়ে আসে। ‘আমার লাশ পড়ুক, তুই কি চাস?’ ওর অবাক চাহনি ঘিরে রেখেছিল ভয়। উপরের ঠোঁট ধীরে ধীরে নেমে এসেছিল বেরিয়ে থাকা দাঁতদুটোর উপর। ‘জমির মালিক অথচ জমিতে কখনো যাস না। আমি শালা ওখানে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মুখে রক্ত তুলে চাষ করাবো আর ধান বেচার, পুকর—আমবাগান জমা দেওয়ার টাকা বাড়ি বয়ে তোকে দিয়ে যাব, কি না দুটো টাকা আর থাকার একটা ঘর তোরা আমাকে দিচ্ছিস বলে?…যা, এবার গোকুলানন্দে গিয়ে জমি সামলা। …এই যে ছুটে এসে খবর দিলুম, এটা করাও আমার উচিত হয়নি।’

তাদের কথা হচ্ছিল বৈঠকখানার সামনে সদর ঘরে। শ্রীগোপাল চেয়ারে হেলান দিয়ে মুখ উপরে তুলে চোখ বন্ধ করে গভীর চিন্তায় ডুবে গেছিল আর সে চুলের মধ্যে আঙুল চালাচ্ছিল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে।

‘আমি কি তাহলে গোকুলানন্দে যাব?’

‘একদম নয়…তোর সেফটির দায়িত্ব আমি নিতে পারব না।’

‘তাহলে?…জমি কি হাতছাড়া হয়ে যাবে?’

‘বাবা সারাজীবনটাই তোদের জন্য দিয়ে গেল…কী পেল?

আমাকে দয়া করে তোরা রাখলি, খেতে পরতে দিলি, স্কুলেও পড়ালি, কিন্তু কলেজে পড়তে দিলি না।’ আপনমনে শ্রীগোপাল বিড়বিড় করেছিল।

‘পড়াশুনো তোর লাইন নয় বলেই বাবা পড়ায়নি।’

‘তোর লাইনও কি ছিল? পড়ে কী হয়েছিস তুই? চেহারা দেখিয়ে, বাইক ফটফটিয়ে চলা ছাড়া আর কী পেয়েছিস?’

সে মাথা নীচু করে শ্রীগোপালের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে রাখে। দুজনের কেউ অনেকক্ষণ কথা বলেনি।

‘একটা যাহোক ব্যবস্থা কর…তুই—ই পারবি।’ টেবিলে ঝুঁকে একটা হাত বাড়িয়ে সে শ্রীগোপালের হাত ছোঁয়ার চেষ্টা করে। হাতটার দিকে অদ্ভুতভাবে তার লম্বা মুখটা কুঁচকিয়ে সে তাকিয়ে ছিল।

‘তুই—ই আমাকে করাপ্ট করবি।’ কথাটা বলেই শ্রীগোপাল চেয়ার থেকে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে পড়ে। আর একটি কথাও না বলে দ্রুত পায়ে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। সে ওর পিছনে নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ফটক পর্যন্ত ছুটে গেছিল। শ্রীগোপাল পিছু ফিরে তাকায়নি, হনহনিয়ে কচুবাগান বস্তির দিকে সে চলে গেল। তখন একবার মনে পড়েছিল, কয়েক বছর আগে বলা কথাটা : ‘ঘোড়ামুখো তুই আমাকে নষ্ট করলি!’

তার জমির এক শতক পরিমাণও বেদখল হয়নি। কেন যে হয়নি সেটা জানার চেষ্টা সে করেনি। যদি ও বলে ‘রোঘো তোর জন্যই করাপ্ট হলাম।’ তাহলে কোনোদিন সে আর আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারবে না। তবে সে লক্ষ করেছে শ্রীগোপাল কেমন যেন বদলে গেছে। তাকে হেয় করে অপমান করে কথা বলার প্রবণতাটার সঙ্গে বেড়েছে মদ খাওয়াও। একবার শ্রীগোপাল বলেছিল, ‘টাকা রোজগারের অনেক রাস্তা আছে রে রোঘো, ফিকিরটা শুধু জানতে হয়।’ ‘কীরকম ফিকির?’ ‘পলিটিক্স’, শ্রীগোপাল তেরছা চোখে তাকিয়ে বলেছিল ‘ভাবছি এবার ওটাই করব। …টাকা না থাকলে জীবনে কিছুই থাকে না, সুখ শান্তি, মানমর্যাদা, দাপট কিছুই জোটে না। বাপ—ঠাকুরদা পলিটিক্স বলতে যা বুঝত, ইংরেজ তাড়ানো, সে জিনিস নয়। এখন গরিবি তাড়ানোর পলিটিক্সে ঢুকতে হবে।’ আর একবার বলেছিল, ‘সততার কোনো দাম নেই রে রোঘো।’ ‘হঠাৎ এ কথা?’ ‘এমনিই বললুম। দুখিরাম গায়েনের পুকুরে কে ফলিডল ঢেলে মাছ মেরে দিয়েছে। ওর ধারণা আমিই এটা করেছি। …ওর দেড় বিঘের পুকুর জমা নিতে চেয়েছিলুম, দেয়নি, তাই রাগ মেটাতে আমি নাকি ওর মাছ মেরেছি। এখন বলছে পুকুরটা দেবে, ব্যাটা ভয় পেয়ে গেছে।’ শ্রীগোপালের বলার ধরন আর মুখ দেখে তখন তার মনে হয় কাজটা সম্ভবত ওরই করা, কিন্তু এ নিয়ে সে প্রশ্ন তোলেনি। কী জানি, কথায় কথায় যদি বলে বসে, ‘বেশ করেছি ফলিডল ঢেলেছি।’ তাহলে ওর অধঃপতনের জন্য নিজেকে ছাড়া আর কাকে সে দায়ী করবে?

.

ব্যাগটার মধ্যে আরও কয়েকটা কাগজের কাটিং রয়েছে। আর একটা তুলতে গিয়ে সে হাত টেনে নিল। সাপের গর্তে হাত ঢোকাতে যাচ্ছিল! বুকের ভিতরটা অবশ হয়ে যাচ্ছে, দ্রুত হয়েছে হৃদস্পন্দন। বিবি এগুলো কেটে রেখে দিয়েছে তাকে পড়াবার জন্য? ব্যাগটা এই ঘরে রেখেছি কি সেই উদ্দেশ্যেই, যাতে কৌতূহলবশে তুলে নিয়ে সে খোলে। তাকে আবার মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য?

তখন প্রত্যেকটা খবরের কাগজেই নিশ্চয় এইরকম রিপোর্টই বেরিয়েছে। তার চেনাশোনা, আধচেনা, একদমই অচেনা লক্ষ লক্ষ লোক পড়েছে। ‘পারুলবালা স্বামীকে রক্ষার জন্য ছুটে এলে রাঘবেন্দ্র তাকে ঘরের মধ্যে টেনে এনে ধর্ষণ করে।’ কী মারাত্মক একটা বাক্য। লক্ষ লক্ষ চোখের সামনে তাকে কুৎসিত নোংরা মানুষ করে দিয়েছে। ভাগ্যিস বাবা—মা তখন বেঁচে ছিল না।

কিন্তু এখন কি সবাই ঘটনাটা ভুলে গেছে? স্মৃতি নাকি ধূসর হয়ে যায়! ষোলো বছরে কি ধূসর হতে পারে? কালের প্রলেপে নাকি স্মৃতি ঢাকা পড়ে, মুছে যায়? কতটা সময়কে ‘কাল’ ধরা হয়? ষোলো বছর কী একটা ‘কাল’ হতে পারে? হয়তো তাকে সবাই ভুলে গেছে। কিন্তু ঘটনাটাকে তারা মনে রাখবেই। এখনও কাগজে এইরকম খবর বেরোয়, সেগুলো চোখে পড়লেই হয়তো তারা বলেছে, ‘দত্তদের রঘুও এইরকম ব্যাপার করে জেলে রয়েছে। যাবজ্জীবন …ফাঁসিও হতে পারত, তাই হওয়া উচিত এইসব বজ্জাতদের।’

ব্যাপারটা কীভাবে যে ঘুরে গেল! গোকুলানন্দ থানার দারোগা বিজয় ঘোষ তাকে সেই রাতেই থানায় বসে বলেছিল, ‘পঞ্চাশ হাজার টাকার কমে বাঁচাতে পারব না। সাক্ষী প্রমাণ সব ম্যানেজ হয়ে যাবে, ‘বেকসুর খালাস করিয়ে দোব।’ আরে মশাই বড়োলোক আপনি, এই ক—টা টাকা তো হাতের ময়লা। উঁচুঘরের লোক, মানসম্মানের কথা ভাববেন তো?’

সদর থানায় হাজতে বিবি তার সঙ্গে দেখা করে। চিন্তায় আর অনিদ্রায় বসে যাওয়া চোখ দুটো তার দিকে পৃথিবীর যাবতীয় ধিক্কার আর ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে থেকেছিল। সে কোনো কথা বলতে পারেনি। তার মনে হয়েছিল, মানমর্যাদা তার নয়, বিবিরই, ধুলোয় গড়াগড়ি দিচ্ছে। চাপা হিসহিসে স্বরে বিবি বলেছিল, ‘কোনো অজুহাত আমাকে দিয়ো না। কোনো কথা শোনার ইচ্ছে আমার নেই…তবে মামলা চালিয়ে যাব, তোমার যা বলার উকিলকেই বলো, আমাকে বলে কোনো লাভ নেই।’

বিবিকে সে বলতে পারেনি, দারোগাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে আমায় বাঁচাও। বললে বিবি হয়তো টাকা দেবার ব্যবস্থা করত। তার স্বামী নির্দোষ, ষড়যন্ত্র করে একটা বউ রাঘবেন্দ্রনারায়ণকে ফাঁসাবার জন্য মিথ্যা রেপ চার্জ এনেছিল, এটা সবাইকে জানানোর সুযোগ বিবি ছাড়ত না। ওর সব যন্ত্রণার উৎস ছিল এই একটি শব্দে—রেপ। কিন্তু খুনের অভিযোগটা? বিজয় ঘোষ বলেছিল, ‘বেকসুর খালাস করিয়ে দোব।’

এখন শুধু লজ্জা। গুলু, গোরা এদের সামনে রোজ তাকে মুখ দেখাতে হবে। মেয়েটা কথা বলবে মায়ের আড়ালে। মুখভাব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করবে। কিন্তু সে জানে, গুলুর মনের গভীরে কখনোই স্থির স্বচ্ছ উজ্জ্বল হয়ে তার বাবার ছবি থাকবে না। গোরা তাকে উপেক্ষা করে যাবে। বিবিও। কে এই অপূর্বমামা? গুলু বলল মা—র ছোটোবেলার বন্ধু, একই পাড়ায় বাড়ি, একই সঙ্গে পড়েছে। নিশ্চয়ই একসঙ্গে ওর ট্রেনে রোজ কলকাতায় যেত। একটি তরুণ একটি তরুণী…ওদের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি? …বিবি ডিভোর্সি বলে নিজেকে চালাচ্ছে, কেন? এই অপূর্ব বিবিকে লেখাপড়া শুরু করিয়েছে অথচ বাবার অনুরোধ ও রাখেনি।

তার মাথার মধ্যে দপদপ করে উঠল। গত তিন—চার বছর হল তার মাথায় মাঝে মাঝে একটা যন্ত্রণা হয়। কপালের দু—ধারে হাতুড়ির মতো ঘা পড়ে। তখন সে ধাক্কাগুলোকে সহনীয় করার জন্য মাথায় ঘের দিয়ে শক্ত করে কাপড় কি দড়ি বেঁধে রাখে। সে বুঝতে পারছে মাথায় এবার যন্ত্রণাটা আসছে। সে একটা কাপড়ের টুকরো খুঁজল, ঘরের কোথাও দেখতে না পেয়ে গায়ের গেঞ্জিটা খুলে কপালে জড়িয়ে একটা গিঁট দিল। গোরার গেঞ্জি! ও যদি জানতে পারে তাহলে কী বলবে, ‘আমাদের সবার মাথায় একটা করে গেঞ্জি বেঁধে দাও।’

র‌্যাকে যথাস্থানে ব্যাগটা রেখে, আলো নিবিয়ে সে শুয়ে পড়ল। এবার যন্ত্রণা আসবে তার মাথার মধ্যে, বুকের মধ্যেও।

পাঁচ

ছাদের উত্তর—পূর্ব কোণ থেকে সনৎদের দোতলার দুটো ঘর দেখা যায়। একটার দুটো জানালাই খোলা কিন্তু ঘর অন্ধকার, অন্যটার দুটো জানলায় পরদা ঝোলানো, ঘরে আলো জ্বলছে। পরদার উপরের দিকে ইঞ্চি দুয়েক ফাঁক, সেখান দিয়ে ঘরের একটা চিলতে অংশ সে দেখতে পাচ্ছে। একটা স্টিলের আলমারির অর্ধেক, তার পাশে একটা খাটের পায়ের দিক। লুঙ্গিপরা কেউ একজন শুয়ে রয়েছে। পা দুটো নাড়াচ্ছে। খাটে পা ঝুলিয়ে বসে রোগা এক স্ত্রীলোক, বাঁদিকে তাকিয়ে। একে সে কখনো দেখেনি। এই ঘরটা যদি সনতের হয়, পা দুটোর মালিক যদি সনৎ হয়, ওর যদি বিয়ে হয়ে থাকে, তাহলে এই স্ত্রীলোকটি নিশ্চয়ই ওর বউ। ওরা দুজন টিভি সেটের দিকে তাকিয়ে।

সনৎ ক্লাস নাইনে পড়ার সময় একদিন তাকে স্কুলের টিফিনের সময় বলেছিল, ‘বিবেকানন্দের মতো সন্ন্যাসী হব।’ ‘কেন হবি?’ ‘স্বামীজির মতো সারা ভারত ঘুরব, বক্তৃতা দোব, লিখব, দেশের অন্ধকার দূর করব, অস্পৃশ্যতা ঘোচাব।’ ‘তুই একা একা পারবি?’ ‘কেন পারব না!’ ‘স্বামীজি ধর্মের বই, ফিলজফির বই পড়েছিলেন, সংস্কৃত জানতেন।’ ‘সংস্কৃত না জানলেও চলবে, বেদ গীতা বাংলাতেও পাওয়া যায়।’ ‘স্বামীজি বিয়ে করেননি।’ ‘আমিও করব না।’ সনৎকে তারা বলত খ্যাপাটে।

দুলাল বাড়ি থেকে তাদের দুই ভাইয়ের জন্য টিফিন নিয়ে যেত। স্কুলের উঠোনের একধারে দাঁড়িয়ে তারা খেত। ডিমসেদ্ধ, কলা বা অন্য কোনো ফল, মাখন লাগানো পাঁউরুটি, দুটো সন্দেশ, এক গ্লাস দুধ। কোনো কোনো দিন ডিমের বদলে থাকত ঘুগনি বা আলুমরিচ। একদিন তার চোখে পড়ে দূর থেকে সনৎ তাদের খাওয়া লক্ষ করছে। ওকে কখনো টিফিনের সময় কিছু খেতে সে দেখেনি। তার মনে হল সনৎ ক্ষুধার্ত। সে টিফিন কেরিয়ারের বাটি হাতে ওর দিকে এগিয়ে যায়। ‘আমার খেতে ইচ্ছে করছে না, একদম খিদে নেই, তুই ডিম আর রুটি দুটো তুলে নে।’ সনৎ তুলে নিয়েছিল। ফিরে আসতেই দাদা বলেছিল, ‘দেবার কি দরকার ছিল, এবার থেকে রোজ দাঁড়িয়ে থাকবে। তুই দিবি?’ দাদা ভুল বলেনি,সনৎ টিফিনের সময় তার সামনে ঘোরাঘুরি করত। রোজ না হলেও প্রায়দিনই সে বাটি হাতে এগিয়ে গেছে। মিতার দাদা সনৎ, এটাই ছিল খাদ্য সরবরাহের প্রধান প্রেরণা। তা ছাড়া গোগ্রাসে খাওয়াটা দেখতেও তার ভালো লাগত।

সনৎকে সে একবার কুড়িটা টাকা ধার দিয়েছিল পোস্টাল অর্ডার কেনার জন্য। কোথায় যেন চাকরির দরখাস্তের সঙ্গে পাঠাবে। টাকাটা শোধ করেনি, সেও ফেরত চায়নি, সনৎ জানত মিতার সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। জেনেও না জানার ভান করে থাকত। কিন্তু মিতার মা ছিল অন্য ধরনের, অতি বাস্তববাদী, ঠোঁটকাটা। একদিন, যখন সে ক্লাস টুয়েলভে, মিতার মা তাকে ধরল সিঁড়িতে। লাফিয়ে লাফিয়ে সে উঠছিল দোতলায়। তখন একতলার রান্নাঘরের দরজা থেকে গম্ভীর চাপা গলায় ডাক শুনল, ‘রঘু শোনো।’ শুনেই তার বুক ধড়াস করে উঠেছিল। ‘আর তুমি এ বাড়িতে এসো না।’ সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছিল। ‘মিতার সঙ্গে মেলামেশা আজ থেকে তোমাকে বন্ধ করতে হবে, নইলে তোমার কোনো ক্ষতি না হলেও ওর হবে। একদিন ওর বিয়ে হবে তো।’ তখন সে বলে ফেলেছিল, ‘আমি যদি বিয়ে করি।’ ‘না। তুমি বাচ্চচাছেলে, কী বলছ তুমি জান না। তোমাদের বাড়ি কেমন, তা আমি জানি। তোমরা ধনী, তোমাদের বড়োলোক আত্মীয়স্বজন, জাতেও আলাদা, আমাদের সঙ্গে কোনো তুলনাই হয় না। মিতাকে আজ থেকেই ভুলে যাও। এখন তোমাদের কম বয়স, ভুলে যেতে অসুবিধে হবে না।’

সত্যি কথাই বলেছিল মিতার মা। ভুলে যেতে তাদের অসুবিধা হয়নি। স্কুল যাবার পথে চিঠির আদান—প্রদান শুরু হয়। দুজনে ছাদ থেকে কখনো বা বারান্দা থেকে ইশারায় কথা বলত। সেটা ওর মা—র চোখে পড়ে। তারপরই মারধোর করে ওকে এলাহবাদ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মিতা ফিরেছিল গ্র্যাজুয়েট হয়ে। সে ওর ফেরাটা একদমই লক্ষ করেনি। একদিন ওদের ছাদে বাঁশ—ত্রিপল বাঁধতে দেখে সে দুলালকে কারণ জিজ্ঞাসা করে শুনেছিল, ‘ও বাড়ির মিতার বিয়ে। নেমন্তন্ন করে গেছে কত্তামশাইকে, যাবে তো?’ সে উত্তর দেয়নি। শুধু একঝলক মনে পড়েছিল মিতার মুখের পেঁয়াজের গন্ধটা। বিয়েতে বাবাকেই যেতে হয়েছিল কেননা নতুন বউকে নিয়ে সেই সন্ধ্যায় সে নান্দীকারের ‘তিন পয়সার পালা’ দেখতে যায়।

লুঙ্গিপরা লোকটা উঠে বসল। স্ত্রীলোকটি খাট থেকে উঠে গেল বোধ হয় ঘরের বাইরে। লোকটার খালি গা, মাথার চাঁদিতে চুল ফাঁকা, মুখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকাল। এ কি, এই লোকটাই তো সন্তু, সনৎ! কাঁধটা সরু, বুকটা চাপা, পেটে বড়ো একটা ভুঁড়ি, মাথায় টাক পড়েছে, তার হাসি পেল। এ কি চেহারা করেছে! সে কলেজে ঢোকার পর থেকেই বা মিতার এলাহাবাদ চলে যাবার পর থেকেই সনতের সঙ্গে দেখা—সাক্ষাৎ কমতে শুরু করে। কদাচিৎ পথে দেখা হলে দুজনেই ফিকে হেসে মাথা হেলিয়েছে। বলেছিল, স্বামী বিবেকানন্দ হবে, দেশের অন্ধকার দূর করবে, বিয়ে করবে না। কথাগুলো মনে করিয়ে দেবার জন্য একবার ওর সঙ্গে দেখা করলে কেমন হয়। নিশ্চয় আঁতকে উঠবে তাকে দেখেই। রেপ কেসে জেলখাটা খুনির থেকেও, এরা বেশি বিপজ্জনক। কিন্তু সনতের বাড়িতে গিয়ে সে রেপ করবেটা কাকে? ওর রুগণ, পাটকাঠির মতো হাতওয়ালা বউকে?

এবারের হাসিটা তার মুখে ছড়িয়ে গেল। দেখা করতে যেতে হবে একদিন। পিছনে একটা শব্দ হল। চমকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল ছাদের দরজায় গুলু দাঁড়িয়ে।

‘কী ব্যাপার?’

‘কিছু না, দেখতে এলাম।’

‘কী দেখতে, পালিয়ে গেছি কিনা?’

‘কাউকে বলে বেরোওনি তো, মা তাই বলল খুঁজে দেখতে।’

‘তুই এখন কী করছিস? গল্প করার ইচ্ছে হচ্ছে রে, আমার অনেক কিছু মনে পড়ছে।’

‘আমি পড়ছি এখন…যাই।’ খাপছাড়াভাবে গুলু চলে গেল।

গুলু ভালোই জানে মা পছন্দ করবে না বাবার সঙ্গে কথা বলা। বিবি চায় না সে ঘরের বা বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলে, বা বাড়ির বাইরে যায়। তাহলে সারা দিনরাত, হপ্তার, মাসের, বছরের পর বছর সে করবে কী, কীভাবে সময় কাটাবে? রাত্রে ছাদে এলেও তার খোঁজ করা হবে! এটা কি জেলখানা?

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখল দাদার দরজা দিয়ে ওদের ঝি বেরোচ্ছে, দরজা বন্ধ করতে গিয়েও বউদি শিবানী পাল্লাটা আবার খুলল।

‘বউদি কেমন আছ?’ হঠাৎই কথাগুলো তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল। সামনাসামনি হয়ে এত বছরের চেনা মানুষের সঙ্গে কথা না বলা মানে নিজেকে আসামি করে রেখে দেওয়া।

‘ভালো আছি, তুমি কেমন আছে? ফিরেছ যে সেটা আমি পরের দিনই জেনেছি। দাড়ি দেখে ভাবলুম এই কাবুলিওয়ালাটা ছাদ থেকে নামছে কেন? বুকটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল…ভেতরে এসো।’

শিবানীর সঙ্গে সে বসার ঘরে এল। ঘরটাকে নতুন করে তার মনে পড়ল। দাদার অংশে শেষ এসেছিল সে বাবার শ্রাদ্ধের সময়। এই উপলক্ষে দুটো অংশ একাকার হয়ে গেছিল আত্মীয়স্বজনের ভিড়ে। এই ঘরে বসেই সে দাদার সঙ্গে শ্রাদ্ধের জন্য খরচ—খরচার খসড়া করেছিল। কুড়ি বছর হল কি? …বোধহয় উনিশ। সোফাটা একই জায়গায়, শুধু ঢাকনার কাপড়টার রঙ বদলেছে। দেয়ালে বাবা—মার ছবি একই জায়গায়। ছবিতে শুকনো মালা ঝুলছে, সাদা চন্দনের ফোঁটা। বিবির ঘরের দুটো ছবিতে এসব নেই।

‘দাদা কোথায়, দোকানে? ভালো আছে?’

‘তেমন আর ভালো আছে কোথায়! ওনার ব্লাডপ্রেশার তো ছিলই, এখন আবার ঘাড়ের কাছে একটা ব্যথা শুরু হয়েছে। ডাক্তার বলছে স্পন্ডালিসিস না কি যেন হয়েছে। …তুমি চা খাবে?’

‘না।’

‘ছাদে গেছিলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘বাইরে বেরোওনি?’

সে সজাগ হয়ে উঠল। প্রশ্নটার উত্তর বউদিকে আরও অস্বস্তিকর প্রশ্নের সুযোগ এনে দিতে পারে।

‘বেরিয়েছিলাম। এদিক—ওদিক হাঁটলাম। সবই তো দেখছি একইরকম রয়েছে, তোমাদের এই ঘরটার মতো।’

‘একই রকম। কী বলছ ঠাকুরপো? এই আমাকেই দ্যাখো না, আরও মুটিয়ে যাইনি? তোমার দাদা অ্যাম্বাসাডার বিক্রি করে মারুতি কিনেছে, এটাও বদল। অপু—নুপুর বিয়ে হয়ে গেছে, ওরা না থাকায় আমার আর তো হাতে কিছু কাজই নেই…এসব কি বদল নয়? …একটু বোসো, আজ ক্ষীরের পুলি বানিয়েছি।’ শিবানী উঠে দাঁড়াল, ‘দুটো চেখে যাও।’

সে চুপ থেকে সম্মতি জানাল। শিবানীর ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে তার মনে হল সত্যিই বদল ঘটেছে, নইলে তাকে ডেকে ঘরে বসিয়ে বউদি ক্ষীরের পুলি খাওয়াচ্ছে, স্বপ্নেও কি ভাবা যেত! আর একটা ব্যাপারও লক্ষ করার মতো, তার গত ষোলো বছর নিয়ে কোনো কৌতূহল দেখায়নি। এটাই তাকে সহজ করে দিচ্ছে।

চারটে পুলি আর একটা চামচ আকাশি নীল লতাপাতার ছাপ তোলা বোন—চায়নার প্লেটে, অন্য হাতে কাচের গ্লাসে জল নিয়ে শিবানী ফিরে এল। এইরকম প্লেট কুড়ি বাইশ বছর আগে তাদের বাড়িতে সে দেখেছে। বাবা কিনে দিয়েছিল বড়ো বউকে। আজও রয়ে গেছে। বউদি খুব যত্নে রাখে জিনিসপত্র। পুলিগুলোর আকার সরু ঢ্যাঁড়শের মতো। সে চামচ দিয়ে কেটে একটুকরো মুখে দিয়ে চোখ বুঁজল।

‘কেমন হয়েছে?’

চোখ খুলে দেখল বউদির উদবিগ্ন দৃষ্টি। ‘কাজ খুঁজছ? একটা মিষ্টির দোকান করো। কলকাতার কোন দোকান এত ভালো করতে পারবে না।’

‘মেয়েরাও বলে, মা—র হাতের মিষ্টি খেলে দোকানের মিষ্টি আর খেতে ইচ্ছে করে না।’

‘দোকান যদি না করো তো বই লেখো, মিষ্টান্ন রন্ধন প্রণালী।’

‘ওরে বাবা, বইফই লিখব কী, মেয়েকে চিঠি লিখতেই কলম ভেঙে যায়।’ শিবানী খিলখিল করে হেসে উঠল। বহু বছর পর সে হাসির শব্দ শুনল। অবাক হয়ে সে বউদির মুখের দিকে তাকাল।

‘বই লিখতে পারবে তোমার বউ, তবে রান্নার বই পারবে না।’

‘বিবি তো ভালোই রাঁধে।’

‘কোনোদিন তো রান্নাঘরে ঢুকতে দেখলুম না। খালি তো হটর হটর করে বাইরে বেরোনো।’

‘একা মেয়েমানুষ, দুটো বাচ্চচা, না বেরোলে চলবে কেন?’

‘একবারও বিবি আমাদের কাছে এসে দাঁড়ায়নি। তোমার দাদা দুঃখু বলে বলেছিলেন, বউমা যদি একবার এসে বলত তাহলে যত টাকা লাগে আমি খরচ করতুম, বাড়ির বউকে ছোটাছুটি করতে হত না। হাজার হোক রঘু আমার মায়ের পেটের ভাই।’

‘ওর কথা ছেড়ে দাও বউদি। জানই তো আমাদের বাড়ির অনেক ব্যাপার বিবি ঠিক বোঝে না। ও অন্য কালচারে মানুষ হয়েছে।’

‘তা হবে। তবে ওর বাপের বাড়ির লোকেরা দুঃসময়ে কিন্তু খুব করেছে। মামলা তো ওরাই চালাল, টাকা অবশ্যই তোমারই, তা হোক গতর খাটানোর ব্যাপার তো আছে! তারপর বিবিকে আবার পড়াশুনো করানো।’

তার মুখে হয়তো খানিকটা বিস্ময়, খানিকটা জিজ্ঞাসা ভেসে উঠে থাকবে। বউদির চোখে সেটা ধরা পড়ল। ‘বাপের বাড়ির পাড়ার কে বন্ধু, সেই তো রোজ এসে পড়াত। কেন, তুমি জান না?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, জানব না কেন…অপূর্ব, আমার বিয়ের দিনই ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। খুব ভালো ছেলে, পড়াশুনোয় দারুণ, আমেরিকা থেকে ডক্টরেট করে এসেছে, ওর বউ তো ডাক্তার গাইনি।’ একটানা সে বলে গেল। উসকে ওঠার আগেই বউদিকে নিবিয়ে দেবার জন্য না বলে তার উপায় ছিল না।

‘আলাপ ছিল নাকি!’ বউদি চোখদুটো ছোটো করে তাকাল। ‘তুমি থাকতে ওকে এ বাড়িতে তো কখনো আসতে দেখিনি।’

‘দেখবে কী করে। তখন তো অপূর্ব আমেরিকায়।’

‘অ।’

‘আর কী খবরটবর…বলো।’ অন্য প্রসঙ্গে আসার জন্য সে বউদির কথার ধাঁচ বদলাতে চায়। বিবিকে দু—চক্ষে দেখতে পারে না। কিন্তু সেটা কখনো কখনো গোপনও করে না।

‘খবর আর কী…ভালো কথা, মিতাকে মনে আছে তোমার? শিবু বর্ধন লেনের সেই মেয়েটি, এখন বাপের বাড়িতেই রয়েছে। স্বামী ওকে নেয় না, আর একটা বিয়ে করেছে, খুব বাজে লোক…মিতা আলাদা থাকে মাকে নিয়ে।’

‘মিতা করে কী?’

‘চাকরি করে কোথায় যেন। সনৎ তো মাকে দেখে না, মা—ছেলের ঝগড়া তো লেগেই আছে।’

খালি প্লেটটা টেবলে রেখে সে জলের গ্লাস তুলে নিল। মিতাকে স্বামী নেয় না কেন? হালকা একটা দুঃখ তাকে ছুঁয়ে গেল। এই মিতা তার জন্যই মায়ের হাতে বেদম মার খেয়েছিল! ওকে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে, তাকে কীভাবে মনে রেখেছে সেটা জানার বাসনা তাকে গ্রাস করেছে। পেঁয়াজের ক্ষীণ একটা গন্ধ তার মনে ভেসে এল। বিবেকানন্দ হবার স্বপ্ন দেখা সনৎ এখন মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে!

‘বউদি, এখন উঠি, দাদার আসতে তো দেরি হবে, পরে দেখা করব। আবার পুলি করলে খবর দিয়ো।’

‘ওরে বাবা, তোমার ঘরে খবর দিতে যাবে কে, তার থেকে তুমিই বরং খবর নিয়ে যেয়ো। আমার ঘরে মিষ্টি খেয়েছ এই খবর বিবির কানে গেলে দ্যাখো ও তোমায় কী বলে।’

‘কী বলবে?’ হঠাৎই এক ঝলক রক্ত তার মস্তিষ্কের কোষগুলোয় ঢুকে পড়ল। ‘আমার বাড়ির কর্তা আমি। যেখানে খুশি আমি যেতে পারি, পারি না কি?’

‘দুলাল মাঝে মাঝে আমার কাছে এসে গল্প করত। পুরোনো লোক, বয়সও হয়েছিল, তাই বলে সেজন্য বিবি ওকে তাড়িয়ে দেবে? অত বছরের পুরনো চাকর কলকাতা শহরে ক—টা লোকের বাড়িতে আছে?’

‘তোমার কি মনে হচ্ছে বিবি আমাকে তাড়িয়ে দেবে?’ বলে সে হাসল। তার সঙ্গে যোগ দিল শিবানীও। আর তখনই বুঝতে পারল, কথাটা বলে নিজের অসহায় অনিশ্চিত অবস্থানটাকে সে প্রকট করে দিল।

‘বিষয়—সম্পত্তি সব ওর নামে লিখে দিয়ে ঠাকুরপো তুমি যে কী ভুল করেছ! অবশ্য মামলার খরচ চালাবার জন্য তা না করে তোমার উপায়ও ছিল না। এখন তো একটা টাকার জন্যও বউয়ের কাছে তোমার হাত পাততে হবে।”

অদ্ভুত দৃষ্টিতে সে বউদির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মুখে কোনো জটিলতা নেই। বউদি জানে এখন সে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে।

‘আমি আসি।’

দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। খাওয়ার টেবলে কয়েকটা খাতা, বিবি কলম হাতে ঝুঁকে রয়েছে। তার মনে হল দরজা বন্ধের শব্দে বিবির পিঠ আড়ষ্ট হয়ে গেল। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল না। বোধহয় তার জন্যই অপেক্ষা করছে, নয়তো ঘরে বসেই খাতা দেখতে পারত। শোবার ঘরে টেবল ল্যাম্প জ্বালিয়ে গুলু পড়ছে। গোরার ঘর থেকে টিভি চলার আওয়াজটা কানে এসে ধাক্কা দিল। বিবির পাশ দিয়ে সে গোরার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। খাটের উপর গোরা পা ছড়িয়ে শুয়ে, দেয়ালে ঠেস দেওয়া দুটো বালিশে মাথা রেখে, সামনে টিভি সেট। হিন্দি সিনেমার গানের সঙ্গে একদল মেয়ে নাচছে। দরজায় তাকে দেখে গোরা চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকাল।

‘সাউন্ডটা একটু কমাও। মা কাজ করছে, দিদি পড়ছে, ওদের ডিসটার্ব হচ্ছে।’

গোরা সেটের উপর চোখ ফিরিয়ে নিল। তার মধ্যে নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে সে বলল, ‘কী হল?’

‘কারুর ডিসটার্ব হচ্ছে না।’ গোরার চোখ সেট থেকে সরল না।

‘জানলে কী করে হচ্ছে না? এত জোরে চালালে পড়াশুনো করা যায় না।’

‘জোরে চলছে না। ওরা কেউ বলেনি ডিসটার্বড হচ্ছে।’ গোরা এবারও তার দিকে তাকাল না।

তার মাথার মধ্যে ঝনঝন করে উঠল। এতটা ঔদ্ধত্য গোরা দেখাবে সে আশা করেনি। তার ইচ্ছে করল সেটটা বন্ধ করে দিয়ে ওর গালে একটা চড় বসাতে। সে আড়চোখে বিবির দিকে তাকাল। বিবি মুখ তুলে তাকে দেখছে, চোখ বিব্রত।’

‘ওরা বলেনি তো কী হয়েছে, আমি বলছি। গম্ভীর এবং ঝাঁঝালো গলায় সে বলল। গোরা ভ্রূকুটি করে তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় বলল, ‘যাবার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যাবেন। আমায় আর ডিসটার্ব করবেন না।’

সরাসরি এই প্রথম গোরা তাকে প্রত্যাখান করল। মাথা নীচু করে সে চোখদুটো বন্ধ করল।

‘তুমি ঘরে যাও।’ বিবি খাতার উপর আবার ঝুঁকে পড়ল।

সে বিবির পাশে এসে ওর কলমধরা হাতটা মুঠোয় চেপে ধরে মুখ নামিয়ে চাপা স্বরে বলল, ‘এসব কী হচ্ছে…বাড়িতে এসব কী হচ্ছে? …তুমি নিজের কানে শুনলে, দেখলে, তবু একটা কথাও ওকে বললে না! বাপকে অপমান করছে ছেলে, এ বাড়িতে এই প্রথম।’

বিবি হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল না। চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘এ বাড়িতে আর কারুর কি আগে যাবজ্জীবন হয়েছিল?’

হাত ধরা মুঠোটা ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে এল। নিজের হাত থেকে বিবি মুঠোটা নামিয়ে দিল সন্তর্পণে। ‘ঘরে যাও।’

পায়ে পায়ে সে ছোটো ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। আলো জ্বালল না। ‘ঘরে যাও’! সেটা কি এই ঘর! অন্ধকারে দাঁড়িয়ে নিজেকে ধসে পড়তে না দেওয়ার জন্য সে দেয়ালে একটা ঘুঁষি বসাল, তারপর চেয়ারে বসল, দুই হাতের মধ্যে মাথাটা ধরে ঝুঁকে পড়ল।

‘তুমি কি ওর বাড়িতে এখন গেছলে?’ দরজার কাছে থেকে মৃদু গলায় বিবি বলল। সে উত্তর দিল না। বিবি ঘরে ঢুকল।

‘আমাকে একটু একা থাকতে দাও।’

‘আগে কথাটার জবাব দাও।’

‘কী জবাব দেব! তুমি তো জেনে শুনেই প্রশ্নটা করেছ। …হ্যাঁ গেছলাম তাতে হয়েছেটা কী?’ সে রুক্ষভাবে চেয়ারে ঘুরে বসল।

‘কী বলল তোমার বউদি আমার সম্পর্কে?’ অন্ধকারের মাঝে বিবি দাঁড়িয়ে। স্বরে উত্তাপ নেই।

‘অনেক কথা বলল, অনেক অনেক…. হয়েছে!’

‘হয়নি। আমি জানতে চাই কী বলল?’ বিবির স্বরে এবার ক্ষীণভাবে অধৈর্যতা প্রকাশ পেল।

‘তুমি দুলালকে তাড়িয়েছ, কেন!’

‘শুধু এই কথা বলল? …বলেনি আমি তোমার টাকা, বিষয়—সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছি?’

‘হাতিয়ে নিয়েছ বলেনি, সব লিখে দেওয়াটা ভুল হয়েছে বলেছে।’

‘এই বাড়িটা এখনও তোমার নামেই আছে। …কারখানা অবশ্য লিজ দিয়েছি, গোকুলানন্দর কিছু জমি বিক্রিও করেছি, কিন্তু বাকি জমি তোমারই আছে। সেখান থেকে চাষ করিয়ে যা পাই তাই দিয়ে সারা বছরের সংসার খরচ চালাতে হয়, ও টাকা সংসারের।’

‘ব্যাংকের টাকা? সার্টিফিকেটগুলো?’

‘কিছু আছে, তবে ওতে কাউকে হাত দিতে দেব না। জনা আর রণোর ভবিষ্যতের কথা আমাকেই ভাবতে হত।’

‘তাহলে একটা টাকার জন্যেও তো এখন তোমার কাছে হাত পাততে হবে।’

সে উত্তর পেল না।

‘বাড়ি আমার! কথাটার কোন মানে হয়? খিদে পেলে বাড়ির ইট চিবিয়ে খাব? বাড়ির জানালা দরজা কি আমার পরনের কাপড় দিতে পারবে?’

‘বিক্রি করে দাও।’

‘তার মানে!’ সে অবাক হয়ে তীক্ষ্ন চোখে বিবির মুখ দেখার চেষ্টা করল। ‘বিক্রি? বাপ—ঠাকুরদার বাড়ি বিক্রি করব? তুমি বাইরের থেকে এ বাড়িতে এসেছ তাই এমন কথা উচ্চচারণ করতে পারলে।’

‘তাহলে রোজগার করো।’

সে চুপ করে রইল। অতি সাধারণ গ্র্যাজুয়েট, বয়সও হয়ে গেছে, তার উপর জেলখাটা, কোথায় সে চাকরি পাবে? বিবি এতসব জেনেও রোজগারের কথাটা ইচ্ছে করেই বলল তাকে, তার দুর্দশাটা বুঝিয়ে দিতে। বড়ো মর্মান্তিকভাবে সে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।

দালানে ফোন বেজে উঠল। কেউ রিসিভার তুলল। ‘মা তোমার ফোন…অপূর্ব মামা।’ দরজার কাছে এসে গুলু জানিয়ে দিল।

সে কান পাতল, দালান থেকে বিবির গলা শোনা যাচ্ছে। ‘…তিনটে টিকিট? রণো বোধহয় যাবে না, ও ক্ল্যাসিকাল গান একদমই পছন্দ করে না…গায়ত্রী সময় করে উঠতে পারবে তো, চেম্বারে তো ভিড় লেগেই আছে…না না, যতই সারুক…এয়ার কন্ডিশনড হল—এ তোমায় এখন বসতে হবে না, ভীমসেন আরও বহুবার কলকাতায় আসবেন, তখন শুনে নিয়ো…আমি না থাকলেও অরুণা কি জনা তো থাকবে, ওরাই রেখে দেবে। তুমি বরং দুটোই পাঠিয়ো, মিছিমিছি কেন একটা টিকিট নষ্ট হবে। …বাড়ি ফেরার ট্যাক্সি পাওয়াটাই তখন মুশকিলে ফেলে, তুমি থাকলে লিফট পাওয়া যেত…তোমার বউয়ের গাড়িতে চাপা মানেই ‘পেট্রলের দাম কী ভীষণ বেড়েছে’ সেই গপ্পো সারা পথ শুনতে হবে, রক্ষে করো…বুধ কী শুক্রবার ব্রিটিশ কাউন্সিলে যাব, তার আগে তোমাকে জানিয়ে দেব। …হ্যাঁ, হ্যাঁ, আচ্ছা…।’ বিবির স্বর হঠাৎ অস্পষ্ট হয়ে হেসে উঠল। সে আর ওর কথা শুনতে পাচ্ছে না।

বিবির কথা বলা শেষ হয়ে গেছে কি? সে চেয়ার থেকে উঠে দরজার কাছে এল। বিবির বাঁ কানে রিসিভার, মুখটা সামান্য নামিয়ে চোখে হাসি। ডান হাতে ধরা কলমটা অন্যমনস্কের মতো টেবলে আলতো করে ঠুকছে। একটু আগেই স্বামীর সঙ্গে যেরকম কঠিনভাবে কথা বলেছিল, তার ছিটেফোঁটাও ওর বসার শিথিল ভঙ্গিতে নেই। বিবি যেন এখন অন্য জগতে। কথা বলতে বলতে বিবি একবার ছোটো ঘরের দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ভ্রূ কুঁচকে চাপা গলায় দ্রুত কয়েকটা কথা বলে নিয়ে রিসিভারটা রেখে দিল।

‘কিছু বলবে?’

‘কার সঙ্গে কথা বলছিলে?’ সে এগিয়ে গেল বিবির যতটা সম্ভব কাছাকাছি। দুটো ঘরে দুই ছেলেমেয়ে রয়েছে। গুলু যতই পড়ুক, গোরা যত জোরেই টিভি চালাক, দালানে বাবা—মায়ের মধ্যে কথাবার্তায় ওরা উৎসুক কান পাতবেই।

‘তা জানার কি খুব দরকার আছে তোমার?’

‘হ্যাঁ আছে।….এই অপূর্ব লোকটা কে?’

বিবির মুখের উপর রাগ ভেসে উঠেই বিরক্তির চাপে ডুবে গেল। ‘আমার বন্ধু…ছোটোবেলার বন্ধু।’

খাতাগুলো গুছিয়ে নিতে লাগল বিবি। তার ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে, ‘যথেষ্ট উত্তর দিয়েছি’—র মতো ভাব।

‘কখনো তো শুনিনি এর কথা!’

‘কার, অপূর্বর? …না শুনে থাকলে এখন শুনে নাও।’

‘তুমি কিন্তু এখনও বিবাহিতা।’

‘কী বলতে চাও?’ বিবির চোখ কঠিন হয়ে উঠল, চোয়ালের পেশী চেপে বসল। ‘যা বলার স্পষ্ট করে বলো, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলা আমি সহ্য করতে পারি না।’

‘তুমি আমাকেও সহ্য করতে পারছ না…বোধহয় প্রথম থেকেই পারনি…কারণটা কী অপূর্ব?’ সে অতি ধীরে ধীরে প্রায় অস্পষ্ট স্বরে কথাগুলো বলল। খুব মন দিয়ে শুনলে তাতে বেদনার আভাস পাওয়া যাবে।

‘তোমার এইসব কথার আমি কোনো জবাব দেব না…দিতে বাধ্যও নই। একটা কথা মনে রেখ, জীবনের সেরা সময়ে ষোলোটা বছর লজ্জা, ঘেন্না আর যন্ত্রণা সঙ্গে নিয়ে কাটাতে বাধ্য হয়েছি, আমাকে বাধ্য করেছ তুমি। তোমার কোনো নৈতিক অধিকার নেই…।’ বিবি চুপ করে গেল। তার মনে হল, কথাগুলো দীর্ঘ সময় ধরে তিল তিল করে বিবির মনের মধ্যে জমেছে, নয়তো এত দ্রুত মুখ থেকে বেরোতে পারত না।

সে বিবির কথাগুলোকে ন্যায্য মনে করল। সাতাশ বছর বয়স থেকে ও একা। সে জবাব দিতে পারল না। সে জানে তার অপরাধটা নিছকই ব্যক্তিগত। সে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুসেনা খতম করার মতো বা অত্যাচারী শাসককে হত্যা করার মতো বা স্ত্রী—পুত্র—কন্যাকে বাঁচাতে ডাকাত মারার মতো কাজ করেনি। তার কাজের সঙ্গে কারুরই স্বার্থ বা হিত জড়িয়ে নেই। তার কৃতকর্মের জন্য যে প্রতিক্রিয়াগুলো ঘটবে তার ফল তাকেই ভোগ করতে হবে। সে জানে, এটা তাকে মেনে নিতেই হবে। কিন্তু যুক্তির কথা আর একটা পুরুষমানুষের অন্তর, আবেগ, অনুভূতি, ব্যক্তিত্ব নাও মিলতে পারে। প্রত্যেকেরই মনের নিজস্ব চলন আছে। এভাবে বউকে হারাতে হবে সে কখনো ভাবেনি। কিন্তু বিবি হারিয়ে গেছে। ওর মনে তার জন্য এক মিলিমিটারও জায়গা নেই। দয়া ছাড়া আর কিছু ওর দেবার নেই।

‘বিবি, ন্যায়—অন্যায়ের প্রশ্ন তুললে, আমার কিছুই বলার নেই। কিন্তু আমি এসে দেখছি এই সংসারের সবাই অস্বাভাবিক, আমি আপন করে পেতে চেয়ে কাউকেই পাচ্ছি না। আমি খারাপ লোক, তাই বলে ছেলে কেন অপমান করবে? তুমি সেটা চুপ করে দেখে গেলে। বাবাকে শ্রদ্ধা করতে বলছি না কিন্তু একটা বয়স্ক লোকের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয় সেটা সে শিখল না কেন?…আমি কি এর উত্তর তোমার কাছে দাবি করতে পারি? আমাকে ঘেন্না করতে শিখিয়ে তুমি ওদের ক্ষতি করেছ।’

এমন একটা প্রশ্নের জন্য বিবি তৈরি নেই বলে তার মনে হল। নয়তো মুখ নামিয়ে হাতের খাতাগুলো জড়ো করে টেবলে ঠুকে ঠুকে গোছানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ত না।

‘তুমি ওদের মন বিষিয়ে দিয়েছ আমার বিরুদ্ধে।’

‘আমাকে কিছুই করতে হয়নি। ওরা বড়ো হয়েছে, ওদের বাইরে বেরোতে হয়।’ বিবির মুখ তুলে তার চোখের দিকে তাকাল। ওর দৃষ্টিতে একই সঙ্গে অসহায়তা আর মর্মবেদনা সে দেখতে পেল।

‘ওদের বিচারবোধ গড়ে উঠেছে, ওরা অনেক কিছু শুনেছে, ওরা অস্বাভাবিক হয়ে উঠলে তার জন্য কে দায়ী?’

উত্তর দাবি করার ভঙ্গি নয়, বিবি যেন বিবৃতি দিল। বিবৃতিটা তার কাছে অপ্রত্যাশিত নয়। ‘মা বলে তোমার জন্যই রণো এমন হয়ে গেছে।’ গুলুকে সে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিল, ‘তোর বাবাকে মাপ করে দে…তোদের ক্ষতি করেছি।’ সে গোরাকে যদি বুকে টেনে নিয়ে মাপ চায় তা হলে কী গোরা বলবে, ‘তুমি এতকাল না থাকার জন্য কষ্ট তো হতোই।’

খাতাগুলো নিয়ে বিবি ঘরে চলে গেল। অরুণা ট্রেতে রাতের খাবার নিয়ে এসেছে একতলা থেকে। টেবলে ঢাকা দেওয়া বড়ো বড়ো বাটিগুলো রেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার খাবার এখন আনব?’

‘আর একটু পরে।’

ঘরে যাবার সময় সে রণোর ঘরের খোলা দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে পেল বাগানের দিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রণো সিগারেট খাচ্ছে। নিজের ঘরে ফিরে সে বিছানায় শুয়ে পড়ল এবং এতক্ষণে অনুভব করল দেয়ালে ঘুঁষি মারাটা উচিত হয়নি..আঙুলের গাঁটে যন্ত্রণা হচ্ছে।

ছয়

স্কুল থেকে ফেরার সময় প্রায় প্রতিদিনই সে অন্নদা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে হয় আট আনার দই নয়তো একটা রাতাবি সন্দেশ কিনত। অন্নদার এই দুটি তল্লাটের নামকরা জিনিস। যারা মিষ্টির সমঝদার, দূর থেকে এসেও মাঝে মাঝে তারা বাক্সভরা রাতাবি কিনে নিয়ে যায়।

দোকানটার গড়ন একই রয়ে গেছে। ঘোষদা যেখানে বাবু হয়ে বসত, এখন সেখানে সেইভাবেই বসে আছে এক ছোকরা। সামনে দইয়ের দুটো আধখালি সরা। তার বাঁ দিকে কাচের আলমারিতে কয়েকটা সন্দেশের থালা। সাদামাটা একই দই—সন্দেশের দোকান। আলমারির পিছনেই মেঝেয় বসে দুটো বিশাল বারকোশে দুজন লোক সন্দেশের দুটো তাল মাখছে, লেচি কাটছে, হাতে পাকাচ্ছে, ছাঁচে চেপে আতা কী শাঁখ কী তালশাঁস বানিয়ে থালায় সাজিয়ে রাখছে। থালাটা চলে যাচ্ছে আলমারিতে, সেখান থেকে ফিরে আসছে খালি থালা। লোক দুটোর পিছনে ছোটো একটা তক্তপোশে বসে থাকত ঘোষদার বাবা। দিনে কতবার যে থালা চালাচালি হয় তার হিসেব একমাত্র জানে তক্তপোশে বসা লোকটি, যার কনুইয়ের নীচে একটা ময়লা কাঠের ক্যাশবাক্স। তার পিছনে একটা ছোট্ট ঘরে ভিয়েন। তক্তপোশে বসেই তৈরি হওয়া থেকে বিক্রি পর্যন্ত সবটাই লক্ষ রাখা যায়।

অন্নদার সামনে সে মিনিট তিনেক দাঁড়িয়ে শুধু দোকানটাকে দেখল। আলমারিতে নরম আর কড়া দু—রকম পাকের সন্দেশই থালায় রয়েছে। সে সেখল কড়াপাকের রাতাবি রয়েছে মাত্র কয়েকটা। তার দরকার দু—বাক্সে অন্তত চল্লিশটা। একটা বাক্স সনতের, অন্যটার মিতার জন্য।

‘রাতাবি কত করে?’

‘এক টাকা আর দেড় টাকা।’ দই কেটে ভাঁড়ে তুলে দিতে দিতে ছোকরা বলল। চোখ তুলে তাকাবারও ফুরসত তার নেই।

‘কখনকার তৈরি?’

‘বিকেলের।’

‘থালায় তো কয়েকটা মাত্র।’

‘আপনার কত চাই?’

‘দেড় টাকার চল্লিশটা, দুটো বাক্সে।’

ছোকরা দুটো কার্ডবোর্ডে ভাঁজ করে বাক্স বানিয়ে আলমারির পিছনে ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘দেড় টাকার চল্লিশটা, দু—বাক্সে।’

সে একটু পাশে সরে অন্য খদ্দেরদের জন্য জায়গা করে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তক্তপোশে আধ ময়লা ধুতি আর গেঞ্জি পরা একজন বসে। মুখে বসন্তের দাগ, চোখে পুরু লেন্সের চশমা। ক্যাশবাক্সের উপর একটা কাঁসার থালা, একটা ছুরি দিয়ে পেস্তা কুচোচ্ছে। সে ঘোষদাকে চিনতে পারল।

‘ঘোষদা ভালো আছেন?’

লোকটি মুখ তুলে ভুরু আর নাক কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, ‘অনেকদিন পর দেখছি, তুমি ভালো আছ? দাড়ি কবে রাখলে?’

‘ভালো আছি। দাড়িটা এই তিন—চারমাস।’

ঘোষদা আবার মাথা নামিয়ে কাজে মন দিল। একটা হালকা ভাব তাকে এখন জড়িয়ে ধরল। ঘোষদা তাকে চিনতে পেরেছে দাড়ি থাকা সত্ত্বেও। এই লোকটার কাছে এখনও সে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা ছেলেটা হয়েই রয়েছে। দই নেবার পর প্রতিবারই বায়না করত, ‘আর একটু ঘোষদা।’ তরুণ বয়সি দোকানি চামচটা দিয়ে অতি সামান্য একটা চাকলা তুলে ভাঁড়ে ঝাঁকিয়ে ফেলে দিয়ে বলত, ‘পালা এ বার।’

বাক্স দুটো ঝুলিতে ভরে সে গৌরচরণ ঘোষ লেন ধরে ফিরে এল সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিটে। হনুমান পার্কের ফটকে ঘুগনি আর ফুচকার সামনে ভিড়। এতটা পথ সে এল, কেউ তার দিকে ভালো করে তাকালও না। প্রেসের সিসে চুরি করেছিল বলে তাদের পাড়ার একটা লোক তিনমাস জেল খেটেছিল। একদিন একটা লোক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তাকে দেখিয়ে সনৎ বলেছিল, ‘ওই দ্যাখ নাড়ু চাটুজ্জে যাচ্ছে, সিসে চুরি করেছিল।’ ‘কবে?’ ‘অনেকদিন আগে, একবছর হবে!’ ‘তুই, জানলি কী করে?’ ‘কেন! সবাই তো জানে!’ সে যাবজ্জীবন খেটে বেরিয়ে এসেছে, কেউ তাকে চেনেই না! পাড়ায় এখন এত ভিড়, এত অচেনা লোক!

ধরেদের রকের স্টেশনারি দোকানের ছেলেটি এক বুড়িকে দু—তিনটে চিরুনি দেখাচ্ছে, একটি বউ বুড়ির পাশে, হাতে প্লাস্টিকের দুটো টিফিন বাক্সের কোনটে নেবে ঠিক করতে পারছে না। সামনের বাড়ির সালোয়ার—কামিজ পরা মেয়েটি স্টিলের গ্লাসে জল নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে দোকানের ছেলেটির সামনে এল। ছেলেটি ব্যস্ত দুজন খদ্দের পেয়ে, মেয়েটি গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে রইল। হেমন্ত বোধহয় এই দোকান থেকেই তার জন্য চিরুনি আর টুথ ব্রাশ কিনেছে।

সে ছাব্বিশ নম্বরের ফটকের সামনে এসে দু—ধারে তাকাল। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। বিকেলে মেঘ দেখেছিল। তখন ঠান্ডা বাতাসও কয়েক মিনিট বয়ে ছিল। রাতে জোরে যদি নামে তা হলে সে ছাদে গিয়ে ভিজবে। দূর থেকে থলি হাতে হেমন্তকে সে আসতে দেখল।

‘তুমি রঘু না?’

সে চমকে ঘুরে দাঁড়াল। সেই বুড়ি, যে চিরুনি কিনছিল। কিন্তু একে তো সে চিনতে পারছে না!

‘তুমি তো জেলে গেছলে, কদ্দিন ছিলে?’

‘ষোলো বছর।’

‘ষো—লো—ব—ছ—র!…আমার নাতিটাকে পুলিশ তুলে নিয়ে সাতদিন রেখেছিল, এমন মার মেরেছিল যে চারমাস শয্যাশায়ী ছিল, ডান পা—টা খোঁড়াই হয়ে গেল, আজও ভালো করে হাঁটতে পারে না।’

‘কী করেছিল আপনার নাতি?’

‘নকশাল করত। তবু ভালো গুলিটুলি করে মেরে দেয়নি।…মাধ্যমিকটাও যদি পাশ করত। বাপের তো কোনো নজর ছিল না সংসারের দিকে, তখন তো বাড়িতেও থাকত না ওই নকশালদের ভয়ে।’

‘আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না।’

‘এই শবু বর্ধন লেনের ভেতর দিকে থাকি, তোমাকে তো ছোটোবেলা থেকে আমি দেখেছি। আমার ছেলে দিলীপকে তো তুমি চেনো!’

‘ও হো, আপনি দিলীপদার মা।..দিলীপদা কী করছে এখন?’

‘সে তো ছ—বছর হল মারা গেছে, ক্যানসারে।’

সে অপ্রতিভ হয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে কেউ যে মারা যেতে পারে, সেটা তার মনে কখনো আসেনি। এ বার থেকে খেয়ালে রাখতে হবে। হেমন্ত দাঁড়িয়ে তাদের দুজনকে দেখে বাড়ির মধ্যে চলে গেল। বৃষ্টির ফোঁটা আর পড়ছে না।

দিলীপের সঙ্গে তার কখনো আলাপ হয়নি। দিলীপদা কম্যুনিস্ট পার্টি করত। এক সন্ধ্যায় দেখেছিল, ছোটো একটা মিছিল নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। সে তখন মোটর বাইকে ফিরছিল, মিছিল দেখে দাঁড়িয়ে যায়। অযথাই দিলীপদা তার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে স্লোগান দেয় : ‘ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ব্যর্থ করো…ব্যর্থ করো…ব্যর্থ করো।’ হঠাৎ যে কেন তার সামনেই ওর স্লোগান দেবার ইচ্ছে হল, সেটা কোনোদিনই সে বুঝে উঠতে পারেনি।

‘বাবুল তো ওরই ছেলে, যে খোঁড়া হয়ে গেছে।’

‘বাবুল করছে কী?’

‘কী আর করবে, ইস্কুলের পাশ তো হল না, একটা রোলের দোকান দিয়েছিল, চলল না। একজনকে ধরে জুতোর দোকানে একটা কাজ জুটিয়ে দিলুম। বলব কী বাবা, সেখানে এমন ধর্মঘট লাগল যে, দোকান সেই যে বন্ধ হল, আজও খুলল না। ওর মা বাগনানে একটা ইস্কুলে পড়ায়, তাতেই সংসার চলে। হ্যাঁ বাবা, তোমার তো অনেক চেনাজানা আছে। দ্যাখো না আমার নাতিটার জন্য…কত লোককে তো বললুম!’

সে প্রায় হতভম্ব হয়ে গেল বুড়ির কথা শুনে, ছুঁচ ফোটার মতো কষ্ট বোধ করল। এইমাত্রই শুনল ষোলো বছর সে জেলে ছিল, আর তার কাছেই নাতির জন্য কাজ যোগাড় করে দিতে বলছে! সে কোনোক্রমে বলল, ‘আমি কী করে কাজ দেব!’

‘কেন তোমার বাড়িতে যে ইস্টিলের আলমারি টেবিল তৈরি হয়, ওখানে বলে ঢুকিয়ে দাও না।’

‘ওটা আমার ব্যবসা নয়, আমি ওর মালিক নই।’

‘তোমার বাড়ির মধ্যেই তো, তুমি বললে ফেলতে পারবে না।’

বুড়ি তার হাত চেপে ধরল। অদ্ভুত একটা সিরসিরানি তার হাত বেয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। বুড়ি তার সম্পর্কে কতটুকু শুনেছে কে জানে, কিন্তু একটা মানুষ অন্তত ধরে নিয়েছে সে কিছু উপকার করতে পারে। বুকের মধ্যে কী যেন একটা কেঁপে উঠছে, দয়া, মমতা কিছু একটা হবে। কিংবা নিজের উপর আস্থা।

‘আচ্ছা আমি দেখব, কোথাও যদি কিছু করা যায়।’

‘দেখবে বাবা?…বড়ো কষ্টে আছে ছেলেটা, বয়স হয়ে গেছে, রোজগার নেই…।’ বুড়ির মুখের চামড়া গুটিয়ে ভাঁজ পড়েছে, চোখের রঙ ঘোলাটে, কষের দাঁত পড়ে গিয়ে গাল দুটো বসা। ‘তাহলে কবে তোমার কাছে বাবলুকে পাঠাব?’

‘না না পাঠাতে হবে না, আমিই দরকার হলে খবর দেব। আপনার বাড়ি তো আমি চিনি।’

‘চেনো? এই শিবু বর্ধন লেনে যাকে জিজ্ঞেস করবে বাবুলদের বাড়ি কোথায়, দেখিয়ে দেবে।’

‘আচ্ছা মাসিমা, আমার কাজ রয়েছে, আমি এবার যাব।’ সে হাতটা ছাড়িয়ে নিল বুড়ির মুঠো থেকে।

‘বাবা দেখবে তো? ছেলেটা দিন দিন কীরকম মনমরা হয়ে যাচ্ছে…।’

আর শোনার জন্য সে দাঁড়াল না। হন হন করে সে ফটক দিয়ে ঢুকে পড়ল। বাগান পর্যন্ত গিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখল বুড়ি চলে যাচ্ছে। তাকেও ওই গলিতেই সনতের বাড়ি যেতে হবে, বুড়িকে এগিয়ে যাবার সময় দিতে সে দাঁড়িয়ে রইল। …দিলীপদা বাড়িতে থাকত না, ছেলেটাকে চোখের সামনে রাখেনি…বউ বাগনানে…। সেজন্যই কি বাবুলের লেখাপড়া হল না? …বিবির চোখের সামনেই তো গোরা থাকত, তা হলে এমন হল কেন? কিশোর বাবুল রাজনীতির কিছু বুঝত কী?

শিবু বর্ধন লেনে বস্তিতে কিছু নকশাল ছেলে ঘাঁটি করেছে এটা সে শুনেছিল। পিস্তল হাতে সাদা পোশাকের পুলিশকে দুপুরে গলিতে ঢুকতেও দেখেছে। ঘরের বারান্দা থেকে দেখেছে বাড়ি বাড়ি জানালায়, ছাদে উঁকি দিচ্ছে বাড়ির মেয়েরা। তখন দু—তিনটে বোমা ফাটার শব্দও পেয়েছে। এইরকম পুলিশি হানায় হয়তো বাবুলকে তুলে নিয়ে গেছে। …দিলীপদা ছেলের দিকে নজর দিলে বাবুল আজ কী হতে পারত? আর যাই হোক, গোরা হত না।

বুড়ি আরও একটু এগিয়ে যাক। সে ফটকের কাছে এসে দাঁড়াল। বুড়ি কিন্তু একবারও জানতে চাইল না কেন কীজন্য সে জেল খেটে এল। নিশ্চয়ই জানে, তবুও কৌতূহল নেই। সাঁইত্রিশ কি আটত্রিশ বছরের নাতি মনমরা, প্রায় পঙ্গু…ঠাকুমার প্রাণ! এইরকম একটা প্রাণ কি বিবি পেতে পারত না?

সে ফটক ছেড়ে এগিয়ে শিবু বর্ধন লেনে উঁকি দিল। বুড়িকে দেখা গেল না। সনৎদের একতলায় বৃষ্টির অনুমানেই জানলাগুলো বন্ধ। সে দ্রুত গিয়ে জানালার পাশ দিয়ে একগজ চওড়া সিমেন্ট বাঁধানো গলিটায় ঢুকল। প্রথম দরজাটা সনৎদের, পরেরটা বঙ্কু পাইনদের।

দরজাটা খোলা রয়েছে। ঢুকেই সামনে রান্নাঘরটা। এরই দরজা থেকে মিতার মা ডেকেছিল, ‘রঘু শোনো।’ কী গম্ভীর গলায়। এখন রান্নাঘরের দরজায় শিকল তোলা। ডানদিকের ঘরের দরজাটা বন্ধ। বাঁদিকে সিঁড়ি সে দোতলার বারান্দায় উঠে এল।

‘সন্তু আছিস নাকি?’ কত বছর পর সে এইভাবে ডাকল? সন্তু তখন ঘর থেকে বলত, ‘আছি রে, আয়।’

আদুড়—গা বছর দশেকের একটা রোগা ছেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পাজামা—পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝুলি, দাড়ি, কটা চোখ আর ছ—ফুটের উপর লম্বা ভারী চেহারা, সব মিলিয়ে ছেলেটা হতভম্ব।

‘সনৎ আছে?’

কথা না বলে ছেলেটা ঘরে ঢুকে গেল। বারান্দাটা আগের মতো ছিমছাম নেই। একধারে নোংরা লাগা পুরোনো চটি আর জুতো, তার পাশে রেলিংয়ে গোঁজা রয়েছে ঘর মোছার ন্যাতা, তারে ঝোলানো প্যান্ট, জাঙ্গিয়া, গেঞ্জিগুলো ময়লা, ছেঁড়া। গামছাটারও সেই দশা। বারান্দার শেষ প্রান্তে বোধহয় রান্নাঘর। ওখানে একটা গ্যাসের সিলিন্ডার রাখা।

‘কে?’ খালি গায়, লুঙ্গির কষি আঁটতে আঁটতে বেরিয়ে এল সনৎ। তার পিছনে ছেলেটা আর ফ্রক পরা এক কিশোরী। ‘কাকে চাই?’ বলেই সে চিনতে পেরে কপালে ভাঁজ ফেলল। ‘রঘু!’

সে যা ভেবেছিল, সেটা ঘটল না, আঁতকে ওঠেনি তাকে দেখে।

‘অবাক হয়ে যাচ্ছিস তো?’

‘তা একটু হচ্ছি…ব্যাপার কী?’

‘এসে ডিস্টার্ব করলাম না তো?’

‘যোগব্যায়াম কচ্ছিলুম…শিরদাঁড়াটায় একটা রেগুলার যন্ত্রণা হয়… তোর ফেরার খবর পেয়েছিলুম ঠিকই…বসবি?’

‘একটু বসি।’

সনৎও তার ফেরার কথা জানে। পাড়ায় তা হলে তো সবাই জেনে গেছে। বলল, ‘একটু অবাক হচ্ছি’, আসলে যথেষ্টই হয়েছে। তারা দুজনে আলাদা কলেজে পড়েছে, আর তখন থেকেই তো তাদের বন্ধুত্বের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছল। আবার এত বছর পর একেবারে দোতলায় আচমকা তাকে দেখতে পেয়ে বোধহয় অস্বস্তিতে পড়ল।

সনৎ তাকে নিয়ে বসাল, শোবার ঘরে নয়, ছোটো একটা ঘরে। আলনায় রাখা পোশাক, ছোট্ট টেবলটায় রাখা বইপত্র থেকে বোঝা যায়, এ ঘরে ছেলে আর মেয়ে থাকে। দরজার ঠিক পিঠ করে রাখা ঘরের একমাত্র স্টিলের ফোল্ডিং চেয়ারটা দেখিয়ে সনৎ ‘বোস’ বলে নিজে বসল খাটে।

বসার পর ঝুলি থেকে সে রাতাবির একটা প্যাকেট বার করে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে বাড়াতেই সে নিয়ে নিল।

‘আরে আরে, এসব কী…না না, দিতে হবে না…বাবু ওটা নিয়ো না।’ সনৎ যেভাবে আঁতকে উঠল তাতে সে একটা ধাক্কা খেল। ছেলের হাত থেকে বাক্সটা ছিনিয়ে নিয়ে সনৎ এগিয়ে ধরল তার দিকে। তার আসাটা পছন্দ করেনি বোধহয়।

‘আরে অন্নদার রাতাবি, আজ বিকেলের তৈরি!’

‘হোক, তুই এটা রেখে দে।’

টিফিন খাওয়ার সময় দূর থেকে সনতের চাহনিটাকে সে এখন ওর চোখে খুঁজল। আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখল সেই চাহনিটা রয়েছে ওর ছেলের চোখে। এখন সনতের চোখে গৃহস্থের সামাজিক বিপন্নতা। একটা খারাপ অপরাধী তার ঘরে এসে বসেছে। সে রেগে উঠবে নাকি মজা পাবে, ঠিক করে উঠতে না পেরে বাক্সটা হাত থেকে নিয়ে টেবলে রাখল।

বোধহয় সনৎ বুঝতে পেরেছে, দৃষ্টিকটু রকমের ভদ্রতার অভাব সে ঘটিয়েছে তাই ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘চা খাবি?’

‘খাব।’ ইচ্ছে নেই তবু বলল। সনৎ নিশ্চয় আশা করেছিল সে ‘না’ বলবে, তা হলে তাড়াতাড়ি তাকে বিদেয় করার সুযোগ পেত। কিন্তু তার ক্ষীণ একটা ইচ্ছে জেগেছে একটা পরিবারের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটাতে।

‘বাবু, মাকে বল তো চা করতে।’

‘এক কাপ?’

‘না, দু—কাপ।’ ছেলে বেরিয়ে যেতেই সনৎ বলল, ‘তুই তো বেশ মোটা হয়েছিস, হলি কী করে? জেলে পাথর টাথর ভাঙতে হত না?’

‘না।’

‘আচ্ছা, তুই তো চোদ্দো বছরের বেশিই রইলি, কিন্তু আমি তো জানি যাবজ্জীবন মানে চোদ্দো বছর।’

‘যাবজ্জীবন মানে যাবজ্জীবনই। একটা লোক কতদিন বাঁচবে, সেটা তো আগাম বলা যায় না। তাই যাবজ্জীবন কথাটা ব্যবহার করা হয়। তবে কমপক্ষে চোদ্দো বছর কেটে যাবার পর অথরিটি রিভিউ করে দেখে লাইফারের আচার—আচরণ কেমন ছিল, ডিসিপ্লিন নিয়মকানুন ভেঙেছে কি না। সব কিছু ওদের মনোমতো হলে চোদ্দো বছর পরই ছেড়ে দেয়। তা ছাড়াও নানারকম ব্যাপারেও রেমিশন পাওয়া যায়।’

‘তাহলে তোর ষোলো বছর হল কেন?’

‘ওদের মনোমতো আমি হতে পারিনি।’ সে হাসল সনতের চোখে কৌতূহল জ্বলে উঠতে দেখে। সে বুঝল আরও বহু প্রশ্ন তাকে করবে।

‘কেন মনোমতো হতে পারিসনি?’

‘নানান রকম করাপশন, টাকা চুরি, ঘুষ, খাওয়াদাওয়া যা দেবার কথা দিত না, দাবি করলে নানা ছুতোয় মারধোর চালাত…এইসব নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলাম, ক—জনকে সঙ্গে নিয়ে হাঙ্গার স্ট্রাইকও, তার ফলও পেলাম।’

এসব কথা বলতে তার ভালো লাগছে না। সে ভুলে যেতে চায় তার কারাবাসের জীবনটাকে, জীবনের কালো অধ্যায়টাকে। তবুও মাঝে মাঝে এক—একটা দেখে যাওয়া ঘটনা ফুলকির মতো ছিটকে ওঠে, জ্বালা ধরায়।

‘হ্যাঁরে রঘু,’ সনৎ দরজার দিকে চট করে তাকিয়ে নিয়ে ঝুঁকে চাপা গলায় বলল, ‘পারুল তো তোদের বাড়িতে বাসন মাজত!…ওর মা—র কাছে তো শ্রীগোপালের বাবা রেগুলার যেত!’

সে উত্তর না দিয়ে সনতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কী বলতে চায় ও! চোখ দুটো ছোটো করে, ঠোঁট টিপে সনৎ একটা রহস্যকে গোপন রাখতে চাওয়ার চেষ্টা দেখাচ্ছে। সে জানে সনৎ কী ইঙ্গিত করতে চায়।

‘শুনেছিলাম নন্দ কাকা যেত।’

সনৎ আবার চট করে দরজার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘পারুল হচ্ছে ওরই মেয়ে, সেটা জানিস?’

‘রোঘো আমি যা পাপ করেছি তার কোনো প্রায়শ্চিত্ত নেই…নিজের গলা নিজেই টিপে মরে যেতে ইচ্ছে করে।’

‘না, জানি না, তোকে কে বলল?’ ঠান্ডা গলায় সে জানতে চাইল।

‘হেঃ, এ তো সবাই জানে। দুজনের মুখের গড়নটা মনে করে দ্যাখ!’

‘তুই মনে করে দেখেছিস?’

‘ধ্যাৎ ধ্যাৎ, একটা প্রসের মেয়ের মুখ…’

‘কী আজেবাজে চিন্তা করছিস শ্রীগোপাল, তোকে নেশায় ধরেছে….আর খাসনি।’ ‘নেশা হনি আমার রণো, আমি এখন আরও খাব।’

‘ওর মুখটা কিন্তু ভালোই দেখতে ছিল।’

‘সেইজন্যই তুই…’ সনৎ বাক্যটা শেষ না করে চোখদুটোকে হাসাতে শুরু করল।

চা নিয়ে এল মেয়েটি, সুঙ্গে দুটো বিস্কিট। ‘তোমার নাম কী মা?’

‘পৌলমী।’

‘বাঃ বেশ নাম। সন্তু, মেয়ের মুখ তোর মতোই হয়েছে।’

সনৎ চুপ করে রইল। বিস্বাদ চা, দুটো চুমুক দিয়ে কাপটা টেবলে রেখে একটা বিস্কিট তুলে নিল। ‘মাসিমাকে দেখছি না যে, কেমন আছেন?’

‘মা নীচে আছে, ভালোই আছে।’ একটু থেমে সনৎ বলল, ‘নীচে মিতাও থাকে।’

‘তাই নাকি!’

‘স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে…আর বলিস না, মাকে নিয়ে হয়েছে যত ঝামেলা। পোস্টাপিসের কেরানি, কত আর মাইনে পাই, নিজের সংসার দেখব না বোনকে দেখব? তবু ভালো, একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ পেয়ে গিয়ে আমার ঘাড় থেকে নেমেছে।’ অনিচ্ছাভরে সনৎ খবরগুলো দিল।

‘তোর শিরদাঁড়ার ব্যথাটা যোগব্যায়াম করে কমেছে?’

‘অনেকটা।’ সনৎ কনুই ভেঙে ডান হাত ঘুরিয়ে পিঠে ঠেকাল।

‘তাহলে তোর ব্যায়ামে আর ব্যাঘাত ঘটাব না।’ সে উঠে দাঁড়াল। ‘তোর বউয়ের সঙ্গে পরিচয় হল না। …পরে একদিন আসব।’

সে ঘর থেকে বেরিয়েই দেখল, ছাদ থেকে সেদিন রাতে যাকে দেখেছিল, সেই স্ত্রীলোকটি দরজার পাশ থেকে ছিটকে শোবার ঘরে ঢুকে গেল। নিশ্চয়ই দরজা দিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করছিল। ধর্ষণকারীর মতো উত্তেজক জিনিস দেখার লোভ বেচারা সামলাতে পারেনি।

‘তুই মা—র সঙ্গে দেখা করবি নাকি?’

‘এলাম যখন দেখেই যাই।’

‘যা। আমার নামে এককাঁড়ি নিন্দে শুনবি।’ সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সনৎ বলল, ‘ওরা নিজেরাই আলাদা হয়ে গেছে, আর লোকের কাছে বলে বেড়ায় আমি নাকি মা—বোনকে ভিন্ন করে দিয়েছি। তুই তো আমার মাকে হাড়ে হাড়ে জানিস।’

সনতের গলায় উৎকণ্ঠা। তার কৈফিয়তটা বিশ্বাস করল কি না সেটা জানার জন্য উদবেগ নিয়ে তাকিয়ে। ‘হাড়ে হাড়ে জানিস’ বলে পুরোনো কথা মনে পড়িয়ে দিতে চাইল? এতে কি তার মনটা তিক্ত, বিরোধী হয়ে উঠবে বলে ও আশা করে? জেলখাটা লোকের কাছে নিজেকে সুসন্তান বোঝাবার জন্য এই চেষ্টা কেন! সনতের মনের মধ্যে অপরাধ—বোধের গ্লানি যেন রয়ে গেছে, যাবজ্জীবন এটা থাকবে। বিবেকানন্দ হবার বাসনার কথাটা এখন আর নিশ্চয় ওর মনে নেই।

একতলায় নেমে এসে মিতাদের বন্ধ দরজার সামনে সে প্রায় এক মিনিট দাঁড়িয়ে রইল। টেবলে সন্দেশের বাক্সটা রেখে এসেছে, সেটা ফেরত দেবার জন্য যদি সনৎ ডাকে! তারপর সে দরজায় খুট খুট টোকা দিল গাঁট দিয়ে। চারবার টোকার পর ভিতর থেকে সাড়া এল, ‘কে?’

মনে হল মাসিমার গলা। ‘দরজা খুলে একবার দেখুন না।’

দরজার দুটো পাল্লা আধ হাত ফাঁক হল। মাসিমাই দাঁড়িয়ে। চশমা নিয়েছে, শরীর একটু ঝরেছে, সে হাসল। ‘চিনতে পারছেন মাসিমা? বলুন তো কে?’

‘রঘুদা!’

সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে শুধু বলল, ‘মিতা!’

‘দাড়িটাড়ি রাখলেও চিনতে ঠিকই পেরেছি।’

‘আমি পারিনি।’ কথাটা কুণ্ঠিত স্বরে বললেও মিতার ঝকঝকে চোখ তাকে স্বস্তি দিল।

‘ভেতরে এসো…মা দ্যাখো, কে এসেছে।’

‘কে রে?’ ঘর থেকে বেরিয়ে এল এক প্রৌঢ়া; স্থূল বপু, থান কাপড় ছাড়া আর সবই একরকম রয়ে গেছে। চাহনি বলে দিল চিনতে পারেনি।

‘চিনতে পারছ না?’

‘না তো…ওমমা, এ তো রঘু!’

সে প্রণাম করল। কত বছর পর? শেষবার বাবাকে খাটে তোলার আগে? …দাদাকে বিজয়ার দিনে? মাসিমাকে শেষ কবে দেখেছে মনে পড়ছে না। আজকের মিতার মতোই দেখতে ছিল। ঝুলি থেকে সন্দেশের বাক্সটা বার করে মিতার দিকে এগিয়ে ধরল।

‘অন্নদার!…অনেক দিন ওদের গুজিয়া খাইনি…এনেছ নাকি?’ বাক্সটা হাতে নিল মিতা।

‘রাতাবি।…গুজিয়ার কথাটা মনে ছিল না।’

‘তুমি আমাকে গুজিয়া খাওয়াতে।’ মিতার ঠোঁট ছড়িয়ে পড়ল। ছড়ানো ঠোঁটের ধাক্কায় পঁচিশ—তিরিশ বছর যে কীভাবে ধসে পড়ে সে অবাক হয়ে দেখল।

‘ঘরে নিয়ে বসা, দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?’

‘রঘু শোনো…আর তুমি এ বাড়িতে এসো না…’ বছর, বয়স, ঘটনা, মানুষকে কীভাবে পালটে দেয়! ‘তোমাদের কম বয়স, ভুলে যেতে অসুবিধে হবে না।’ ভুলে কে গেছে? জীবনের প্রথম ঘটনাগুলো ভোলা যায় না। এ বাড়িতেই তার প্রথম চুমু, প্রথম অপমান।

দুটো সিঙ্গল খাট ঘরের দু—ধারে। পরিষ্কার দুটো সাদা—সবুজ মোটা ডোরাকাটা বেডকভার, তার উপর একটা খবরের কাগজ, বোধহয় মিতা পড়ছিল। দেয়াল—তাকগুলো পরদা দিয়ে ঢাকা। জানলাগুলো খুলে পরদা নামিয়ে দেওয়া, পাখা ঘুরছে। ঘরে আসবাব বলতে একটা ছোটো টেবল আর চেয়ার, ট্রানজিস্টর রেডিয়ো, কিছু বইয়ের একটাকে মনে হল অভিধান, ছোটো একটা ঘড়ি, দু—তিনটে ফাইল, টেবল ল্যাম্প। অনেকটা বিবির ঘরের মতোই, তবে কমদামি। আলনাটা দাঁড়িয়ে আছে শাড়ি ব্লাউজ, ছাতা, হাতব্যাগ ঘাড়ে ঝুলিয়ে।

‘এই খাটটায় বোসো, ওটা মায়ের।’ মিতা বাক্সের রাবারব্যান্ড খুলতে খুলতে বলল, ‘মা—র একটু ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপার আছে।’

সে মিতার মুখ থেকে পা পর্যন্ত চোখ নামাল। কালো পাড়ে জরির পটি, বেলের পানা রঙের জমি। শাড়িটা ওর শ্যামলা গায়ের রঙকে খুলে দিয়েছে। বাহু, ঘাড়, কবজি, গলা ডৌল বজায় রেখেছে। বিবিরই বয়সি, তবে তার মতো কোমরের নীচে চর্বি জমেনি। মিতা বদলেছে কী বদলায়নি তা সে জানে না। বস্তুত সম্পূর্ণ একটা নতুন মানুষকেই সে দেখছে। বহুকাল আগে কিছুদিনের জন্য তারা প্রেমিক—প্রেমিকা ছিল, এই পর্যন্তই। কিন্তু সেই সম্পর্কটাকে এখন টেনে আনা যায় না। সেও তো এদের কাছে নতুনই। মিতার মুখটা খোলামেলা, চোখদুটোয় অস্পষ্টতা নেই, শক্ত চোয়ালে স্বনির্ভরতা, কথা ঝরঝরে। একটু আগেই বোধহয় অফিস থেকে ফিরেছে, ক্লান্তি মুখে লেগে।

বাক্সটা খুলে চোখদুটো বড়ো করে মিতা একটা সন্দেশ তুলে মুখে দিল। ‘ভীষণ খিদে পেয়েছে…নাও ধরো।’ বাক্সটা তার মুখের কাছে ধরল।

‘আমি ছুঁলে মাসিমাকে দেবে কী করে?’

মিতা চট করে ঘরের বাইরে তাকাল। ‘মা এখন চায়ের জল বসাতে গেছে…তুলে নাও। মা—র এই ব্যাপারটা আমি সহ্য করতে পারি না, খিটিমিটি লাগে।’

সে একটা সন্দেশ তুলে নিল। বাক্সটা হাতে নিয়ে মিতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সে এখানে এল কোন সুবাদে? ছেলের বন্ধু? মেয়ের বন্ধু? প্রতিবেশী? এরা নিশ্চয় জানে গত ষোলো বছর সে কোথায় ছিল, কিন্তু কৌতূহলের কোনো ছিটেফোঁটা আভাসও দেয়নি। দুজনেই যেন খুশি হয়েছে সে আসায়। এরা নিঃসঙ্গ বোধহয়।

‘ওমলেট খাবে?’ জলের গ্লাস এগিয়ে মিতা বলল।

‘না। ডিমে অ্যালার্জি।’ মিথ্যে বলল, ডিম তার প্রিয় খাদ্য।

‘তা হলে?’ বিপন্ন দেখাল মিতাকে। ‘কী দিই বলো তো?’

‘গরম রুটি আর বেগুন ভাজা হবে, সঙ্গে কাঁচালংকা?’

‘হবে। বেগুন আছে, কাঁচালংকা আছে কি না দেখি।’ মিতা দ্রুত বেরিয়ে গেল।

ফরমাস করে রান্না করিয়ে খাওয়া, শেষ কবে? মাকে সে প্রায়ই বলত ‘নারকোল ছোলা দিয়ে মোচার সেই ঘণ্টাটা!’ ‘কাল বাজার থেকে মোচা আনতে বলব।’ ইলিশের মাথা দিয়ে তেঁতুলের টক করলে না কেন?’ ‘এবার ইলিশ এলে করে দেব।’ আর কাউকে কী তারপর খাওয়ার ইচ্ছের কথা সে বলেছে?

মিতা ফিরে এল। ‘কাঁচালংকা আছে।’

‘থাকুক, তুমি বসো তো! মনে হচ্ছে, একটু আগেই অফিস থেকে ফিরেছ?’

‘কোথায় অফিস জানো, তারাতলা! কম দূর, দু—বার বাসে চড়তে হয়!’

দু—হাত ছড়িয়ে সে পিছনে হেলে বসল, মিতা বসেছে চেয়ারটা টেনে তার থেকে চার হাত দূরে। কীসের অফিস, সেখানে কী কাজ করতে হয়, এমন সব প্রশ্ন করার ইচ্ছে হলেও সে করল না। যদি পালটা জিজ্ঞাসা শুরু করে! মিতা দেখেছে শ্রীগোপালকে, এলাহাবাদ যাবার আগে ফ্রক পরা পারুলকেও। ষোলো বছর আগে মিতা শ্বশুরবাড়িতে, হয়তো খবরের কাগজে পড়ে থাকবে।

‘অফিস আর বাড়ি, আর কিছু নয়?’ কথা শুরু করার জন্য নতুন করে দুই সদ্য পরিচিত আর কী বলতে পারে?

‘আবার কী? যাতায়াতেই প্রাণ বেরিয়ে যায়। বাড়ি ফিরে ধপাস করে বিছানায় পড়া, তারপর স্নান। রেডিয়োটা খুলি, গল্পের বই হাতে পেলে পড়ি…ভারী কিছু মাথায় ঢোকাতে ইচ্ছে করে না। এক একসময় ইচ্ছে করে ছবি আঁকি। এলাহাবাদে গান শিখেছিলাম কিন্তু একা একা কি গান গাওয়া যায়?’

‘সিনেমা দেখতে পার। একটা টিভি সেট কিনে ফেল।’

‘ভাবছি। একটা সাদাকালো ছোটো সেট দু—হাজার দুই—আড়াই পড়বে। মা—র তাহলে চেঁচামেচি করাটা বন্ধ হবে।’

‘চেঁচামেচি! কার সঙ্গে?’

‘ওপরে দাদার সঙ্গে। আর বোলো না, তুচ্ছ জলকল, ছাদ নিয়ে প্রায়ই দুজনের লেগে যায়। আমি আসার পর থেকেই এই ঝঞ্ঝাটের শুরু। দাদা পছন্দ করেনি এখানে এসে থাকি। আসলে বাড়ির শেয়ার দিতে হবে, এটাতেই আপত্তি। দাদার ধারণা, তার অনুগ্রহে আমি এ বাড়িতে রয়েছি। বলেই দিয়েছে, অংশ দাবি করলে কোর্টে যাও। …যাক গে এসব কথা।’

এসব কথা শুনতে তারও ভালো লাগছে না। সে এসেছে মিতাকে দেখতে, কৌতূহল মেটাতে। দু—কাপ চা হাতে মাসিমা এল। ‘একেবারে খালি পেটে খাবে, মিতা চানাচুরের শিশিটা বার কর।’

তাকের পরদা সরিয়ে একটা পেটমোটা শিশি মিতা নিয়ে এল। খবরের কাগজটার উপর কিছুটা ঢেলে নিজে একমুঠো তুলে নিয়ে বলল, ‘এই একটা শখ আমার, কিনে এনে রেখে দিই আর মাঝে মাঝে খাই।’

‘তোমার শখের খাওয়া ছিল তো এন্তার পেঁয়াজ দিয়ে ঝালমুড়ি।’ সে মনে করিয়ে দিল ইচ্ছে করেই। মিতার স্মৃতিতে তার ছবি কতটা ঝাপসা হয়েছে সেটা সে জানতে চায়।

‘তোমার মনে আছে!’

মিতার চোখ ঝকঝক করে উঠল বাচ্চচা মেয়ের মতো। সে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে খুঁজল সেখানে আরও কিছু দেখতে পাওয়া যায় কি না। অনাবিল সারল্য, মজা পাওয়া…লাজুক একটা ছায়া ভেসে গেল না। ও যদি ভুলে গিয়ে থাকে তা হলে সে হাঁফ ছাড়বে। এখন দুজনেরই বয়স হয়েছে।

‘টেবিলে ফাইল দেখছি, অফিসের নাকি?’

মিতা টেবলের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘মাঝে মাঝে গল্প লেখার চেষ্টা করি। সময় কাটাতে হবে তো।’

‘ছাপা হয়েছে? আমি তো পড়াটড়ার ব্যাপারে…’ কথাটা শেষ না করে শুধু হাসল।

‘তিন—চারটে ম্যাগাজিনে পাঠিয়ে ছিলাম, একটাও ছাপা হয়নি।’

মিতাও হাসল। হাসিতে তিক্ততা নেই। ‘কাঁচা লেখা, বুঝতে পারি। তবুও পাঠিয়েছিলাম।’

‘একটা পড়াবে?’

‘ওরে বাবা! পড়বে আর হাসবে, আর মনে মনে বলবে কী অপরিণত, ছেলেমানুষি লেখা। দরকার নেই পড়িয়ে। কোথাও আর এখন পাঠাইও না।’

‘আচ্ছা আমাকে দেখে তুমি অবাক হওনি?’

‘হইনি মানে? এখনও হচ্ছি। গলগল করে কথা বলতে, আর এখন টিপে টিপে একটা দুটো করে মুখ থেকে বেরোচ্ছে।’

‘আমি ঠিক এইরকম অবাক হওয়ার কথা বলছি না। হঠাৎ এতদিন পর এলাম কেন, এটা তোমার জানতে ইচ্ছে করছে না।’

‘করছে, বলো কেন এসেছ?’

‘ভীষণভাবে তোমাকে দেখার ইচ্ছে হল বলে।’ বলে ফেলেই তার মনে হল, বলাটা ঠিক হয়নি। কথাটার অনেক রকম অর্থ করা যায়। ‘আসলে আমার পুরোনো দিনের আর এখনকার দিনের মধ্যে একটা বিরাট গর্ত রয়ে গেছে, সেটা ভরাট করার চেষ্টা করছি। কে কীরকম হয়ে গেছে সেটা দেখতে চাই।’

‘দেখে বুঝতে পারবে? আমাকে তো দেখছ, বলো তো আমি কী রকম হয়েছি? বাইরের চেহারা অনেক বদলে গেছে, সেটা নিশ্চয় ভরাট করার কাজে লাগবে না।’

সে মুখ নামিয়ে মিতার পায়ের কাছে মেঝেয় চোখ রাখল। কী বলবে? এলাহাবাদে গিয়ে কতদিন পর্যন্ত আমাকে মনে রেখেছিলে? …বিবি চার বছর আমার সঙ্গে দেখা করতে যায়নি, শেষ ছ—টা চিঠির উত্তর দেয়নি, বিবি আমার বউ!…শ্রীগোপাল বেঁচে থাকলে কী বলতো ‘রোঘো তোর জন্য করাপ্ট হয়ে গেলুম।’ …আমি কেন গুলুকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলাম? …সন্দেশের বাক্সটা নিতে চাইল না, টিফিনের সময় আমার খাবারের ভাগ নিয়েছে…দিলীপদা যদি ছেলের কথা ভেবে…

‘কই বলো?’

‘কী বলব ভেবে পাচ্ছি না, এই তো কিছুক্ষণ মাত্র তোমায় দেখছি। তুমি কী ছিলে সেটাই জানি না, তোমার বদল হওয়াটা আমি ধরতে পারছি না, পারবও না।’

‘আমি কী ছিলাম সেটা তুমি জান না?’ প্রশ্ন করলেও সেটা অবাক হয়ে।

সে মাথা নাড়ল যেন গভীর ভাবনার মধ্যে ডুবে থেকে। যা মনে পড়ছে সেটা শুধু পেঁয়াজের গন্ধ।

দুটো ছোটো থালায় রুটি, বেগুনভাজা নিয়ে মাসিমা এল। একটা থালা দিল মিতাকে, তাতে কাঁচালংকা নেই।

‘আসার পর থেকেই দেখছি আপনি রান্নাঘরে, বসুন।’

মিতা গম্ভীর হয়ে গরম বেগুনভাজা আঙুল দিয়ে খোঁচানোয় ব্যস্ত। এতে তাড়াতাড়ি জুড়োয়। সে, গরমই খেতে চায়।

‘বসার আর ফুরসত কোথায় বাবা, একা হাতেই তো সব করতে হয়। ঘরমোছা, বাসনমাজার ঝি একটা আছে, দোকানবাজার তো আমাকেই করতে হয়, রান্নাবান্নাও। ….তোমার ছেলেমেয়েরা তো সব বড়ো হয়ে গেছে, করছে কী? পড়ছে?’

‘হ্যাঁ।’ রুটির ছেঁড়া টুকরোয় বেগুনভাজা তুলে মুখে দিল।

‘শিক্ষিত বউ, ছেলেমেয়েদের পড়াশুনো তো হবেই। ওপরে যাবে নাকি?’

‘গিয়েছিলাম।’

‘আমাদের কথা কিছু বলল?’

‘না।’ কাঁচালংকা দাঁতে কাটল।

‘সন্তুর বন্ধু ছিলে, তখন তুমি খুব আসতে।’

সে চট করে মিতার মুখের দিকে তাকাল। মুখটা নামিয়েই রয়েছে। তার মনে হল, কিছু একটা ভাবছে।

‘মিতার বিয়েতে তুমি আসনি।’

সে চুপ করে রইল। লংকাটায় ঝাল আছে। মিতা মুখ তুলে তাকে দেখে বলল, ‘খুব ঝাল?’

‘ঠিক আছে।’

‘মেয়েটার কী যে ভাগ্য… তাড়াহুড়ো করে বাপ এমন জায়গায় বিয়ে দিল, খোঁজখবরও ভালো করে নেওয়া হয়নি। …সবাই বলে খোরপোষের মামলা করতে। সন্তুই করতে দেয়নি। কাগজে খবর বেরোবে, চতুর্দিকে ঢিঢিক্কার পড়ে যাবে…তোমার কী মনে হয়?’

‘যদি কেস তেমন থাকে, তা হলে করা উচিত।’

‘আমিও তাই বলি। ছেলেটা আবার বিয়ে করেছে, আগে থেকেই নাকি মেয়েটার সঙ্গে ভাবসাব ছিল।’

‘বিয়েটা করা উচিত হয়নি।’ দুজনেই অবাক চোখে তার দিকে তাকাল। মাসিমা কিছু বলে ওঠার আগেই সে যোগ করল, ‘দুজনেরই।’

পাওয়ার কাট। অন্ধকার ঘরে মাসিমা বিরক্ত স্বরে বলল, ‘এই এক জ্বালা, কবে যে শেষ হবে কে জানে।’

মিতা উঠে গিয়ে তাক থেকে মোমবাতি—দেশলাই এনে জ্বালল। পাখাটা মন্থর হতে হতে শেষ চক্কর দিচ্ছে। সিলিংয়ে শকুন ওড়ার ছায়া ঘুরছে। গোকুলানন্দে সে শকুনকে মরা গোরুর পেটের উপর বসে মাংস ছিঁড়তে দেখেছে। কাগজে তো তারও খবর বেরিয়েছিল, খোরপোষ চাওয়ার থেকেও বড়ো খবর। কিন্তু সবই তো এখন স্বাভাবিক।

‘হাত ধোব।’

‘এসো।’ মোমবাতি হাতে মিতার পিছনে সে কলঘরে এল। এটা তার চেনা জায়গা। সিঁড়ির পাশে টিনের পাল্লা দেওয়া ঘেরা জায়গাটা চৌবাচ্চচা। মেঝেয় সম্প্রতি সিমেন্ট করা হয়েছে। দড়িতে গামছা ঝুলছে।

‘হাতে তেল লেগে, সাবান দাও।’

কাঠের র‌্যাক থেকে সাবানদানিটা মিতা তার হাতে দিল। ক্ষয়ে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া গোলাপি সাবানে জুঁইয়ের গন্ধ।

‘কী শুঁকছ?’ মিতার এক হাতে জলভরা মগ। জল ঢালার জন্য তার কাছ ঘেঁষে নীচু হল। ওর গায়ে বাসি ঘামের টক গন্ধ, বিবির গায়ে কখনো সে ঘামের গন্ধ পায়নি।

‘গন্ধটা বেশ লাগে।’

‘ও কথা বললে কেন, বিয়ে করা উচিত হয়নি?’

‘তোমাকে বলিনি, তোমার স্বামীর জন্য বলা।’ হাত ধুয়ে হাত দুটো ঝাড়ছিল, মিতা আঁচল এগিয়ে ধরল। হাত মুছে আঁচলটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘একটা পুরুষ না হয়ে এ ক্ষেত্রে যদি মেয়ে হত, তা হলে কী করত?’

‘মানে?’

‘মানে কিছুই নয়, এমনিই মনে হল। তোমার স্বামীর মতো—মেয়েটা তার স্বামীকে ত্যাগ করে তার লাভারকে বিয়ে করতে পারত কি?’

‘মেয়েদের অনেক অসুবিধে।’

‘কেমন?’ সে তীক্ষ্ন নজর রাখল মিতার মুখে। কিছু বলার জন্য ঠোঁট দুটো নড়ে উঠলেও কথা বেরোল না। কোনো আবেগকে যেন দমিয়ে রাখার চেষ্টায় ওর চোখ ছলছল করে উঠল। কৈশোরের ছেলেমানুষি আবার ফিরিয়ে আনার জন্য সে ইঙ্গিত দিচ্ছে, মিতার এমন ধারণা হলেও হতে পারে! কষ্টকর, নিঃসঙ্গ, একঘেঁয়ে বর্তমান অনেক সময় বুদ্ধিকে ঘোলাটে করে দেয়।

চড়বড় শব্দ করে বৃষ্টি নামল। এবার তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। সে নিজেকে কথা দিয়েছে, বৃষ্টিতে ভিজবে ছাদে দাঁড়িয়ে। মিতা তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ভালোই করেছে, তা হলেই কথা বেড়ে গিয়ে সময় খরচ হবে।

‘তাড়া আছে আমার, বৃষ্টিটা যদি জাঁকিয়ে নামে, তাহলে ফিরতে পারব না।’

‘কতদূরে বাড়ি যে ফিরতে পারবে না? ছাতা আছে।’

সে ব্যস্ত হয়ে ঘরে এসে শূন্য ঝুলিটা কাঁধে তুলে নিল। ‘মাসিমা আমার তাড়া আছে, একজনের আসার কথা…আর একদিন আসব, মিতা চলি।’

মিতার মুখ দেখে বুঝল, ‘একজনের আসার কথাটা বিশ্বাস করেনি। তার এই হঠাৎ ফেরার তাড়া ওকে অপ্রতিভ করে দিয়েছে। নিশ্চয় তার এই আচমকা আসা আর বেমানান বিদায় নেওয়ার কারণ খুঁজতে অনেক রাত পর্যন্ত হাতড়াবে…বিবিও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে তার অসুবিধেগুলোকে হয়তো নাড়াচাড়া করেছে।

মোমবাতি আর ছাতা হাতে মিতা সদর দরজা পর্যন্ত এল। ‘আজ আমার ভিজতে ইচ্ছে করছে, ছাতার দরকার নেই।’

‘সত্যি দরকার নেই?’

‘সত্যিই নেই।’ হয়তো মিতা চায়, ছাতা ফেরত দিতে সে আবার আসুক। তার বলতে ইচ্ছে করল, ‘একটু এগিয়ে দেবে?’

জমাট অন্ধকার আর বৃষ্টিধারায় তৈরি চাদরে ধাক্কা দিয়ে মিতার হাতে ধরা মোমবাতির আলো ফিরে এল। তাদের বাগানের পাঁচিলটা দেখা যাচ্ছে না। কেউ একজন ছুটে গেল ছপছপ শব্দ তুলে। আগে জল জমত শিবু বর্ধন লেনে, এখনও হয়তো জমে। চটি জোড়া খুলে সে থলিতে ভরল।

‘বহু বছর পর তুমি এলে রঘুদা।’ মিতার স্বর গভীর, অস্পষ্ট।

সে বৃষ্টির মধ্যে অন্ধকারে নেমে পড়ল। সিমেন্ট বাঁধানো গলি, গর্ত বা ঢিবি নেই তবে পেরেক বা মাছের কাটা পড়ে থাকতে পারে। আলতো করে পা ফেলে সে এগোল। শিবু বর্ধন লেনে পা দেবার আগে সে পিছন ফিরে তাকাল। হাতের তালুতে মোমবাতির শিখা আড়াল করে মিতা মাথা হেলিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করছে। অযথা চেষ্টা, তাকে দেখা যাবে না।

খালি পায়ে সে ছুটে ছাব্বিশ নম্বরের ফটকে পৌঁছল। চোখটা সইয়ে নিয়ে আবার এক ছুটে পৌঁছল সদর দরজায়। এইটুকু ছুটেই সে হাঁফিয়ে পড়েছে। থলি দিয়ে মুখের জল মুছে সে দরজা ঠেলতেই সেটা খুলে গেল। ভিতরে ঘন অন্ধকার। শুধু উঠোনে যাবার দরজাটা আধখোলা, সেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে রান্নাঘরের হারিকেনের আলো। একটা অস্ফুট চমকে ওঠার শব্দ। দ্রুত পায়ে কেউ সিঁড়ির দিকে চলে গেল। উঠোনের দরজা দিয়ে একজন নিঃসাড়ে প্রায় পিছলে ঢুকে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। পাল্লা দুটো পুরো বন্ধ হয়নি। ফাঁক দিয়ে সে দেখতে পেল রান্নাঘরে ঢুকল অরুণা।

অন্ধকারে কী করছিল অরুণা! কে উঠে গেল দোতলায়! থলি থেকে চটি বার করে মেঝেয় ফেলল। পা গলিয়ে বুঝতে পারল, ভেজেনি। চেনা সিঁড়ি। দোতলায় উঠে দরজা ঠেলতেই খুলে গেল। এমার্জেন্সি লাইট জ্বালিয়ে বিবি খাতা দেখছে। এই সময় দালানে বসে ওর কাজ করা মানেই তার জন্য অপেক্ষা করা। ঘরে চিমনি লাগানো পিতলের কেরোসিন ল্যাম্প জ্বালিয়ে গুলু পড়ছে।

‘আমার আগে কেউ কি নীচের থেকে এল?’ গলা নামিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ, রণো…কেন?’

‘কিছু না।’ সে একবার গোরার ঘরের দিকে তাকাল। দরজা আধ—ভেজানো, ঘর অন্ধকার।

‘কোথায় গেছলে তুমি?’ শান্ত গলা, কৌতূহল নেই।

‘সনতের কাছে।’

‘এত লোক থাকতে ওর কাছে! কী দরকার পাড়ার লোকের বাড়িতে যাওয়ার।’ কথার ভঙ্গিটা পরামর্শ দেওয়ার মতো।

‘তাতে কী হয়েছে?’

‘মুখরোচক কথাবার্তা আবার শুরু হবে, এই যা!’

‘হয় হবে।’ সে ছোটো ঘরের দিকে এগোল।

‘শোনো।’ এবার গলায় কর্তৃত্বের দাপট, নীচু স্বরে। সে ফিরে তাকাল। ‘তুমি কোনো দিন কি আমার ফোন ধরেছিলে?’

‘একদিন, হ্যাঁ…বেজে যাচ্ছিল, ধরার কেউ ছিল না, তাতে হয়েছে কী?’

সে বিবির মুখ কঠিন হতে দেখল। আন্দাজ করতে পারল কেন দপ করে উঠল চোয়ালের পেশি। ‘তোমায় কী জিজ্ঞাসা করেছিল?’

‘আমি কে…কে কথা বলছি।’

‘কী বললে তুমি?’ বিবি সোজা হয়ে বসল।

‘বললাম জাহ্নবীর স্বামী বলছি।’ বলেই সে কাঠ হয়ে গেল বিবির মুখটা দেখে।

থম হয়ে গেছে। তিক্ত চাহনির মধ্য দিয়ে ও কী বলে চলেছে! কলমটাকে মুঠোয় গুঁড়িয়ে ফেলার চেষ্টাটা কেন? ডিভোর্সি পরিচয় দিয়ে বিবি কী সুবিধে পায়?…কোনো পুরুষের সঙ্গে যদি ওকে দেখা যায়, তা হলে কেউই সেটা দোষের মনে করবে না! ডিভোর্সির স্বাধীনতা আছে প্রেমিক সংগ্রহের। এই সুবিধাটাই কি সে বানচাল করে দিয়েছে! বিবিকে কি কলিগদের ফিসফাস শুনতে হয়েছে।… নিশ্চয় সেই রমা ঘোষ বলেছে, ‘রাঘবেন্দ্র দত্ত লোকটা কে বলো তো?’ ‘কে রাঘবেন্দ্র?’ ‘ওই যে ফোনে বলল তোমার বৈধ স্বামী।’ আমার আগের স্বামী, এখনও তোমায় ভুলতে পারছে না, এখনও মনে করে আমি ওর স্ত্রী…।’ ‘তোমার বাড়িতে ফোন ধরল যে, তোমার কাছেই থাকে নাকি?’ ‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তাই কিছুদিন হল বাড়িতে রেখেছি। কী করব, বেচারার কেউ নেই।’

‘তোমার সঙ্গে দু—একটা কথা আছে।’ বিবি তার মুখের দিকে নিথর চোখ রেখে স্থির স্বরে বলল।

‘আমারও একটা বলার কথা আছে, ঘরে আসবে?’ সে ইঙ্গিত করল ছোটো ঘরের দিকে। বিবি উঠে দাঁড়াল।

দালান থেকে আলোটা দরজা দিয়ে যতটকু এসেছে, তাতে ঘরটাকে প্রায়ান্ধকার বলা যায়। খাটের দিকটা অন্ধকার, সে খাটে বসল। টেবল আর চেয়ারে ক্ষীণ আলো পড়েছে, বিবিকে চেয়ারে বসতে হল। সে বিবির মুখটা দেখতে চায়।

‘অরুণা মানুষটা কেমন?’

‘হঠাৎ এ কথা কেন?’ ভ্রূ কুঁচকে উঠল বিবির।

‘দরকার আছে। কোথা থেকে ওকে পেয়েছ, ওর অতীত সম্পর্কে কী জান?’

‘বুঝতে পারছি না হঠাৎ এই সব প্রশ্ন কেন! আমাদের কলেজের এক ক্লার্ক ওকে দিয়েছে। সোনারপুরে ওদেরই পাড়ার মেয়ে। বিধবা, গরিব, দাদার সংসারে থাকত। আমার কাছে দু—বছর রয়েছে, হাতটান নেই, পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন, যতটা সম্ভব মার্জিত কথাবার্তা, চালচলন…কারুর কোনো কমপ্লেন নেই ওর সম্পর্কে।’

সে চুপ করে রইল। একটা বিশ্রী কথা, নিজের সন্তান সম্পর্কে, বলতে তার সংকোচ হচ্ছে। বিবির প্রতিক্রিয়াটা কেমন হবে অনুমান করতে পারছে না। অরুণার উপর যে ওর প্রচুর আস্থা, সেটা একটু আগেই কথার মধ্যে ধরা পড়ল। গোরা সম্পর্কে কোনো কথাই কানে নেবে না, তার কথা বিশ্বাসই করবে না।

‘অরুণা কিছু করেছে কি?’ এবার বিবির স্বরে উৎকণ্ঠা ধরা পড়ল।

‘সদর দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই অন্ধকারে মনে হল কারা যেন রয়েছে। পায়ের শব্দে বুঝলাম একজন ছুটে উপরে উঠে গেল, আর একজন তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে চলে গেল।…উপরে যে উঠে এসেছে সে গোরা।’

চাপা মন্থর স্বরে বলা কথাগুলো শুনতে শুনতে ম্লান আলোতেই সে দেখতে পেল বিবির মুখ থেকে রক্ত সরে গেল, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে লাগল সারা মুখ। চামড়ার সঙ্গে ভিজে গেঞ্জিটা সেঁটে রয়েছে, পাঞ্জাবিটা সপসপে। পাজামার তলা জলে ভারী। এগুলো খোলার দরকারটা এখন তার কাছে বড়ো কথা নয়।…গোরা এখন বিপদে।

‘কী বলছ তুমি! ঠিক দেখেছ তো?…অরুণা আর রণো!…ওর ছেলে থাকলে সে তো রণোর বয়সিই হত!’

‘অরুণার যৌবন এখন ফুরিয়ে যায়নি।’

‘না ফুরোক, …তুমি যে ঠিক দেখেছ সেটা বিশ্বাস করব কীভাবে?…যেকোনো কারণেই হোক ওরা দুজন ওই সময় ওখানে অ্যাকসিডেন্টালি এসে গেছিল, এটাও তো হতে পারে?’

‘তা হতে পারে, কিন্তু তা হলে দুজনের ছুটে পালাবার তো কোনো দরকার ছিল না!’

বিবি মুখ নামিয়ে চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে, দুশ্চিন্তায়। ডুবন্ত লোক বাঁচার চেষ্টায় হাঁসফাঁস করে উঠবেই, এক্ষেত্রে সেটা ছেলের চরিত্রকে পরিচ্ছন্ন মনে করার চেষ্টা। বিবি তা করবে, করতেই হবে। বিবি জানে না গোরার বয়সে তার বাবা কেমন ছিল। অকালে পূর্ণবয়স্কের শরীর, অথচ সেটাকে বাগ মানাবার মতো মনের গড়ন না থাকলে এইরকমই হয়। এটা হবেই। বাবার আকারটাই শুধু নই প্রবৃত্তিটাও গোরা পেয়েছে। মিতাকে তার মা সরিয়ে না দিলে ব্যাপারটা কতদূর গড়াত?…কে জানে!

‘তুমি ওকে কিছু বোলো না, তবে অরুণাকে এখুনি ছাড়িয়ে দাও। সামনে থেকে সরে গেলে গোরা দু—দিনেই ভুলে যাবে।…এখন কম বয়স, ভুলে যেতে অসুবিধে হবে না।’

মিতার মা ‘অসুবিধে হবে না’—ই বলেছিল। সে নিশ্চিত গোরা মনে রাখবে না কিন্তু মনে করে রাখবে বাবাকে, তার ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়া একটা মুহূর্তের সাক্ষীকে। গোরা ডিস্টার্বড থাকবে। একই বাড়িতে পাশাপাশি ঘরে তারা দুজন,রোজই একবার অন্তত মুখোমুখি হবে, কেউ কথা বলবে না। চোখে চোখ পড়লেই একজন চোখ সরিয়ে নেবে।

‘এখুনি ছাড়ালে কাজের এমন একটা লোক পাব কোথায়?…অনেক চেষ্টায় পাওয়া।’

‘তাই বলে তুমি…!’ সে অবাক হয়ে বিবির বিরক্ত মুখের দিকে তাকাল।

‘তুমি অন্ধকারে যে কি দেখেছ…শুধু ওরা ছুটে পালাল, এটার উপর ভরসা করে কি কাউকে অ্যাকিউজ করা যায়?’

‘আপনি দেখলেন আসামি কাটারিটা আপনার স্বামীর ঘাড়ে বসাল…তারপর কী করল, ছুটে পালিয়ে গেল?’

‘না।’

‘তা হলে তখন কী করল আসামি?’

‘আমার দিকে এগিয়ে এল।’

‘গোরা একটা লোককে অন্ধকারের মধ্যে সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে অন্তত ‘কে’ বলে এগিয়ে যাবে তো?

‘হয়তো ভয় পেয়ে গিয়ে থাকবে।’

বিবি মানতে চাইছে না, চাইবেও না। উলটে তার সম্পর্কেই বিরক্ত হয়ে উঠছে। হয়তো বলবে উদ্দেশ্য নিয়ে গোরার চরিত্রে কালি ছিটোচ্ছি। কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে আমার? একটাই তো, ছেলেকে বাপের মতো হতে না দেওয়া।

‘তুমি আসার পর থেকেই সবাইকে জ্বালিয়ে যাচ্ছ।’ চেয়ার থেকে ঝাঁকি দিয়ে বিবি উঠে দাঁড়াল। ‘এখানে তোমার আর থাকা উচিত নয়।’

ঘর থেকে বিবি প্রায় ছিটকেই বেরিয়ে গেল। দালানের দরজা খোলার শব্দে সে বুঝল নীচে যাচ্ছে। সম্ভবত রান্নাঘরে, অরুণার সঙ্গে কথা বলতে। সে ভিজে পাঞ্জাবিটা খুলতে খুলতে বেরিয়ে এল তোয়ালের জন্য। গোরার ঘরের দরজা ভেজানো। তার মনে হল, এখানে থাকলে সে নিজেই নিজেকে কুরে কুরে ফোঁপরা করে দেবে।

বিদ্যুৎ ফিরে এসেছে । খাওয়া শেষ করে খালি থালা আর বাটির সামনে সে বসে আছে অনেকক্ষণ। খেতে খেতেই সে লক্ষ করেছিল অরুণা দরজার কাছে দু—বার এসে ফিরে গেছে। দাদার টিভি—তে শেষ অনুষ্ঠান হচ্ছে বোধহয়, নয়তো সারা বাড়ি নীরব। এগারোটার মধ্যে বিবি শুয়ে পড়ে, ছেলেমেয়েদেরও অভ্যাসটা করিয়েছে। এঁটো বাসন নীচে নামিয়ে দিয়ে তবেই অরুণা শোয়। আজ সে দেরি করে খেয়েছে।

হাত ধোয়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল দালানে অরুণা দাঁড়িয়ে। কপালের কিনার পর্যন্ত ঘোমটা, সর্বাঙ্গ কাপড়ে ঢাকা, শুধু টেবিলে রাখা ডান হাতের আঙুলগুলো দেখা যাচ্ছে। তাকে দেখেই চোখ নামিয়ে নিল, কিছু একটা বলতে চায়। কী বলবে, আমি নির্দোষ, তাড়িয়ে দিলে আমার আর কোথাও জায়গা হবে না!

ঘরে ফিরে জলের গ্লাস তুলে নিয়েছে, পিছন থেকে অরুণা বলল, ‘দাদাবাবু আপনি বউদিকে বলেছেন আমাকে ছাড়িয়ে দিতে?’

‘হ্যাঁ।’ গ্লাস মুখে তুলল। অরুণার স্বরটা অপরাধীর মতো নয়।

‘বউদি আমাকে ছাড়াতে পারবে না!’

‘কেন?’

জবাব দিল না। সে তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে। থালার উপর বাটি রাখা, এবার থালাটা তুলে নিলে ওর চলে যাবার কথা। কিন্তু যাচ্ছে না। আরও কিছু বলতে চায়। ‘কেন পারবে না?’

‘সে আমি বলব না, তবে বলছি পারবে না।’

‘তুমি গোরাকে নষ্ট করছ, এটা তার বাপ—মা সহ্য করবে না।’

‘আপনারা নিজের ছেলেকে খুব ভালো মনে করেন, না?’ বলার সঙ্গে সঙ্গে অরুণা ঘোমটা ফেলে কাঁধ থেকে আঁচল সরাল। ‘দেখুন।’

অরুণা যেখানে আঙুল রেখেছে সে সেখানে তাকাল। বাঁ কানের নীচে সরু গর্ত তাতে রক্ত জমে। বোধহয় দাঁত বসানোর দাগ। বাঁ গালে, গলায় কালো ছোপ। ‘ব্লাউজ খুলে দেখাব?’

‘নাহ।…এসব কী?’ সে স্পষ্টতই আর্তনাদ করল।

‘আপনার ছেলের কাজ। লোডশেডিং হতেই ঘাপটি দিয়ে ছিল সিঁড়ির কাছে অন্ধকারে। আমি ওপরে যাচ্ছিলুম, তখন ধরল…।’ অরুণা ফুঁপিয়ে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল। ‘আগেও দু—তিনবার চেষ্টা করেছে, বউদিকে বলতে লজ্জা করেছিল…এইটুকু ছেলে…।’

‘কাঁধের এই ইনজুরিটা কী করে হল?’ সদর হাসপাতালে এমার্জেন্সির মেডিক্যাল অফিসার জিজ্ঞাসা করেছিল। তখন সে পুরো উলঙ্গ হয়ে আউটডোরের পাশের ঘরে কাপড়ে ঘেরা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে। সিলিং থেকে ঝুলছে একটা বালব, একটা খাট, টেবিলে কিছু শিশি, দেওয়ালে মহাদেবের ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডার। তার সামনে মেডিক্যাল পরীক্ষার সাক্ষী হিসাবে ছিল হাসপাতালের অল্পবয়সি এক জমাদার, গোকুলানন্দ থানার কনস্টেবল, আর ফরসা, রুগণ, লম্বা এক সিস্টার, যার বয়স পনেরো থেকে পঁয়তাল্লিশ হতে পারে। সিস্টারের চোখ তার উলঙ্গ শরীরটা আর সবার সঙ্গেই দেখছিল। লজ্জায় সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। নিজেকে তখন একটা গুয়েপোকা ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি।

‘শনিবার সকালে রথতলায় একটা গোরুর গাড়ির জোয়ালের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল।’

ডাক্তার টর্চ জ্বেলে কাঁধ পরীক্ষা করতে মুখটা কাছে আনে। তখন সে মনে মনে বলেছিল, ‘যেন ভুল না করে…ইনজুরিটা ধরতে পারে যেন।’ ডাক্তারের ভাবলেশ মুখের দিকে সে আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে থেকেছিল। ‘এটা জোয়ালের ধাক্কাতেই’, কথাটা সে আর একবার বলেছিল।

‘আপনার ছেলেই এই সব করেছে।’ অরুণা আবার বলল, ঘোমটা মাথায় তুলে দিয়ে। ‘আমাকে ছাড়িয়ে দেবেন?…তা হলে আমিও অনেক কিছু দেখেছি, যাবার আগে সবাইকে বলে যাব।’ অরুণার চোখ দপ করে উঠল, উদ্ধত ভঙ্গিতে চিবুক তুলল। ঠান্ডা নম্র মানুষটার এ কী পরিবর্তন!

‘কী বলে যাবে?’

‘বউদিকে জিজ্ঞেস করবেন।’ থালা তুলে নিয়ে অরুণা বেরিয়ে যাবার সময় শেষ কথা বলল, ‘জোঁকের মুখে দেবার নুন আমার কাছে আছে, বউদি সেটা জানে।’

জরাগ্রস্তের মতো সে দাঁড়িয়ে। বিবি কী জানে? অরুণা তাকে প্রায় ধমকেই গেল। একটা ঝি তাকে চোখ রাঙিয়ে বলে গেল, তাকে ছাড়ানো যাবে না। বিবি কী জানে এই বাড়িতে এটাই প্রথম…ব্ল্যাক—মেইলিং!… ‘অনেক কিছু দেখেছি’, কী দেখেছে?…’এখানে আর তোমার থাকা উচিত নয়।’ বোধহয় উচিত নয়। কোথায় যাব…গোকুলানন্দে?

পরদিন সকালে দালানে ওরা তিনজন খাচ্ছে। অরুণা পট থেকে চা ছেঁকে কাপে ঢালছে। সে গিয়ে বিবির পাশে বসল। এখানে এই সময় তার বসার কথা নয়। সবাই অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে। অরুণা ইঞ্চিখানেক ঘোমটা বাড়িয়ে দিয়ে মৃদু গলায় বলল, ‘আপনার খাবার এখানে দোব?’

‘দাও।’

ওরা মুখ নামিয়ে খাওয়ায় ব্যস্ত হল। সে প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে খবরের কাগজটা তুলে নিল। অরুণা তার সামনে চায়ের কাপ রাখল। কাগজের প্রথম পাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে আড়চোখে সে ছেলের দিকে তাকাল। কড়া করে সেঁকা পাঁউরুটির টুকরোর অর্ধেকটা মুখে ঢুকিয়ে দাঁতে কামড়ে চোখ বুজে চিবোচ্ছে! বাঁ হাতে ধরা ছাড়ানো কলায় কামড় দিয়ে আবার চোখ বুজল, চোখ খুলে সামনে তাকাল, মুখটা ফুলে উঠেছে। সামনে, টেবিলের অপর প্রান্তে অরুণা। গোরার চোখে তৃপ্তি, পা দুটো নাড়াচ্ছে। গালের পেশি দপদপাচ্ছে ডাঙায় তোলা মাছের কানকোর মতো।

একটা আঁশটে গন্ধে ঘিনঘিন করে উঠল তার ভিতরটা। সে কাগজের ওপাশ দিয়ে গুলুর দিকে তাকাল। একদৃষ্টে টেবিলে চোখ রেখে কাপে ছোটো চুমুক দিল। মেয়েটা কম খায়, হয়তো ছিপছিপে থাকার জন্য। ওকে বলা দরকার এতে শরীরের জোর কমে যায়, কিন্তু কে বলবে? বিবি উসখুস করছে।

‘ভেবে দেখলাম আমি গোকুলানন্দে গিয়েই থাকব।’ ঘোষণার মতো কথাটা সে বলল হাতের কাগজ নামিয়ে।

চকিতে সবাই তাকাল তার দিকে। সবার চোখে অবাক ধরবে এটা সে জানে। সে ঘাড় কাত করে বিবিকে বলল, ‘ডিসিশানটায় কোনো ভুল আছে?’

‘না। আমিও তাই ভাবছিলাম।’

‘ভাবছিলে!’

‘হ্যাঁ, এখানে তুমি অ্যাডজাস্ট করতে পারছ না আমাদের সঙ্গে।’

‘হ্যাঁ ঠিক, …তুমিই তো এ বাড়ির সব, আমি একটা ফালতু…তাই ঠিক করলাম।’ সে আবার চোখ বোলাল টেবিলের তিন পাশে। ‘এ বাড়িতে কোনো কিছুতেই স্টেপ নেবার অধিকার আমার নেই…মার্ডারার, রেপিস্ট…কে গ্রাহ্য করবে, কোনো সম্মান নেই। কাজে লোককে বরখাস্ত করার মতো জোরও আমার নেই।’

সে অরুণার মুখের দিকে তাকল। ‘ঘাড় ধরে একবস্ত্রে বার করে দিতাম, কিন্তু আমি তা পারব না।…তুমি অনেক কথা নাকি সবাইকে বলে যাবে, তাতে আমার বংশের সম্মান থাকবে না। সুতরাং…’

‘থাক আর বলতে হবে না।’ বিবি তাকে থামিয়ে দিল। ‘তুমি গোকুলানন্দে গিয়েই থাকো। হেমন্তকে পাঠাচ্ছি, তোমার থাকার বন্দোবস্ত করে আসতে। তোমার কোনো অসুবিধা, মনে হয় না হবে…পারুল আছে, সে তোমায় দেখবে।’

নামটা মাথায় থিতু হবার পরই সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উঠল, ‘কে দেখবে?’

‘যাকে তুমি বিধবা করেছ।…যাকে দেখার দায়িত্ব আমিই নিয়েছি। পারুলই এখন গোকুলানন্দর সব কিছু দেখছে। …হেমন্তকে কালই পাঠাব।’

সাত

রথতলার মোড়ে সে বাস থেকে যখন নামল, বিকেল তখন শুরু হয়েছে। ষোলো বছর পর। বোধহয় গত রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। পিচ রাস্তার বাইরের মাটি ভিজে, বহু জায়গায় কাদা। বিকেলে বাজার বসত, আজও বসেছে। তবে কেনাবেচা এখনও জমেনি। সেই একই আনাজপাতি, রাস্তায় বসা দোকানগুলোয় একই জিনিস।

কিন্তু রথতলার অনেক বদলও ঘটে গেছে। রাস্তার দু—ধারে ব্যারাকের মতো টানা লম্বা পাকা দোতলা বাড়ি উঠেছে। একটা বাড়িতে ব্যাঙ্কের সাইনবোর্ড, তলায় টিভি সেট, টেপরেকর্ডার বিক্রির দোকান, তার পাশে গানের ক্যাসেটের। …বড়ো একটা ওষুধের দোকান, স্টেশনারি দোকানটা রঙবেরঙের জিনিসে ভরা। এর উলটোদিকে পাশাপাশি দুটো দোকানে শাড়ি আর রেডিমেড পোশাকের লম্বা কাউন্টারে লোক দাঁড়িয়ে। হিন্দি পপ গানের ক্যাসেট বাজছে…শস্য আর আনাজ বীজের…মিষ্টির দোকান ‘মুখোরুচি’, …কাঠের খাট, লক্ষ্মীর আসন, ড্রেসিং টেবিল…ফিনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, পান—সিগারেটের দোকানে সফট ড্রিঙ্কসের বাক্স…নতুন সাইকেল, জুতো…সরকারি মৎস্য, কৃষি বিভাগ, তার পাশে নতুন ডাকঘর, উপরে টেলিফোনের তার, একটা বাড়ির দোতলায় ঢালাইয়ের কাজ চলছে…সে দেখতে দেখতে হেঁটে চলল।

রথতলা আর প্রায় চেনাই যায় না। দোকানগুলোর ভিতরে ফ্লুরোসেন্ট আলো দিনের বেলাতেও জ্বলছে। কাচে আলো লেগে দোকানগুলো ঝকঝকে। বিবি বলেছিল, ‘চিনে যেতে পারবে? সঙ্গে হেমন্ত যাক। সে হেসেছিল, ‘এতবার গেছি।’ রথতলা বদলেছে ঠিকই, কিন্তু না চেনার মতো নয়। রাস্তা ধরে আধ মাইল এগোলে বাঁ দিকে গোকুলানন্দের খালপাড়। রাস্তা নেমে গেছে। রাস্তার ধারেই সেই টালির চালের বাড়িগুলো, বাইকে যাবার সময় সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত বেশ্যাদের।

বাস, ট্রাক, অটো রিকশা তার সঙ্গে গোরুর গাড়ির, সাইকেল আর ভ্যান রিকশা, নিশ্চিন্তে রাস্তা দিয়ে হাঁটা যায় না। সে রাস্তা থেকে নেমে মাটির উপর দিয়ে হেঁটে চলল। এত লোক, দোকান, যানবাহন, কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না। এতে সে অবাক হল না। পাজামা, পাঞ্জাবি, দাড়ি কাঁধে ঝুলি থাকলেই যে দ্রষ্টব্য হয়ে যাবে কিংবা কটা চোখ, ছ—ফুটের উপর লম্বা, তামাটে হয়ে যাওয়া গায়ের রঙ হলেই যে সবাই তাকাবে, এমনটা সে আশা করছে না। রথতলা প্রতিদিনই নানান রকমের মানুষ দেখায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

থানাটা রথতলার মোড় থেকে উত্তরে খালেদনগরের দিকে চলে যাওয়া রাস্তার উপরে। ওইদিকেই হাইস্কুল আর থানা। একবার তার মনে হল, পিছিয়ে গিয়ে থানাটা দেখে আসবে কী না! চারটে সিঁড়ি ভেঙে টালির চালের খোলা দালান, তার পিছনে একটা বড়ো ঘর। সেখানে বসে দারোগা। ওই ঘরের পিছনেই হাজতঘর। সেখানে তাকে দুটো রাত কাটাতে হয়েছিল ষোলো বছর আগে। পরদিন ছিল রবিবার। সোমবার কোর্টে হাজির করে তাকে খালেদনগর সদর থানায় নিয়ে রাখা হয়। দারোগা বিজয় ঘোষ রবিবারই বলেছিল ‘পঞ্চাশ হাজার টাকার কমে বাঁচাতে পারব না।’

বিজয় ঘোষ নিশ্চয় এখন আর এই থানায় নেই। সজল নামের সেই কনস্টেবলটাও নিশ্চয় নেই, যে তার কোমরে মোটা দড়ি বেঁধে, ভ্যান রিকশায় বসিয়ে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছিল। এতদিনে নিশ্চয় বদলি হয়ে গেছে, প্রোমোশন পেয়েছে। বিজয় ঘোষ বলেছিল, ‘বউটা আপনার এগেনস্টে রেপিংয়ের চার্জ এনেছে…পরীক্ষার জন্য আপনাদের দুজনকে হাসপাতালে পাঠাব।’ এই রাস্তা দিয়েই ভ্যান রিকশাটা গেছিল সদর হাসপাতালে। তার পিছনেই বাবু হয়ে অন্যদিকে মুখ করে বসেছিল পারুল! পথচারীরা অবাক চোখে দেখছিল।

খালপাড়ের টালির চালের ঘরগুলো একইভাবে রয়েছে। তার মনে হল দু—তিনটে ঘর বোধহয় বেড়েছে, জানালায় আগে পরদা দেখেছে বলে মনে পড়ল না। দুটো অ্যান্টেনা তাকে অবাক করল। এদের রোজগার তা হলে টিভি সেট কেনার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। শ্রীগোপাল খালপাড়ের ঘরে আসত পনেরো টাকা নিয়ে!

চাষখেতের জমিতেই তিনটে একতলা ছোটো পাকা বাড়ি। বারান্দায়, জানালায় গ্রিল। রাস্তা থেকে বিদ্যুতের তার গেছে। স্থানীয় লোকই করেছে, হয়তো রিটায়ার্ড। তার মনে পড়ল শরৎ বসাকের বাড়িটা। এই একমাত্র লোক যার সঙ্গে এখানে তার পরিচয় হয়েছিল। এখন তাকে দেখে লোকটা দরজা বন্ধ করে দেবে, নাকি আগের মতোই চা খাওয়াবে? দেখা করে পরীক্ষা করতে হবে। বোকাসোকা দেখতে হলেও চালাক লোক, নয়তো ব্যবসা করে পয়সা করল কী করে?

খালপাড় থেকে গ্রামের দিকে যাওয়া রাস্তাটায় মাটি পড়েছে, চওড়া হয়েছে। একটা মোটরগাড়ি চলে যেতে পারে। এইখানেই সে ষোলো বছর আগে, পিছন থেকে পারুলকে দেখেছিল খালি পায়ে, জারিকেন হাতে নিয়ে হেঁটে যেতে। সে কলকাতা থেকে আসছিল মোটর বাইকে। শব্দ শুনে পারুল রাস্তার ধারে সরে গিয়ে পিছনে তাকায়। সে বাইকটাকে ওর পাশে এনে বলেছিল, ‘যাচ্ছ কোথায়?’ পারুল দাঁড়িয়ে যায়। ‘কেরোসিন আনতে একজনের বাড়ি থেকে।’ ‘কত দূরে? …উঠে পড়ো, পৌঁছে দিচ্ছ।’ পারুল গম্ভীর হয়ে বলেছিল, ‘না’। ‘না কেন? বাইকে তো মেয়েরাও চড়ে!’ বাবুর সঙ্গে ঝিয়ের মেয়ে চড়ে না।’ পারুল হনহন করে হাঁটতে শুরু করে দেয়। সে বাইকটাকে ওর পাশে পাশে চালিয়ে বলেছিল, ‘এখন তুমি ঝিয়ের মেয়ে নও, শ্রীগোপালের বউ, শ্রীগোপাল আমার ছেলেবেলার বন্ধু, বন্ধুর বউ…উঠে পড়ো।’

পারুল থমকে দাঁড়ায়, চোখ কুঁচকে কিছু একটা ভেবে নিয়ে সে বাইকের পিছনে উঠে বসে। ‘ঠিক করে উঠে বসো। শাড়িটা হাঁটুর মধ্যে গুঁজে দাও…বাঁ হাতে জারিকেনটা নাও আর ডান হাতে আমার কোমর ধরো।’ পারুল কোমর ধরেনি। সে ইচ্ছে করেই বাইকটা এমন গতিতে ছেড়ে দিল যে পারুলের পড়ে যাবার মতো অবস্থা হয়, সামলাতে গিয়ে সে তার কাঁধটা আঁকড়ে ধরে। ‘কাঁধে একটা খোঁচা খেয়েছি একটু আগে, জ্বালা করছে।’ পারুল তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নেয়। ‘রাস্তাটা খারাপ, ঝাঁকুনিতে পড়ে যেতে পারো…ডান হাত দিয়ে ধরতে বললাম।’ ‘আমাকে নামিয়ে দিন। আর একটুখানি, হেঁটে চলে যাব।’ সে বাইক থামায়নি, পারুলেরও নামা হয়নি। ওর কাঁধ তার পিঠে চাপ দিচ্ছে, রাস্তার বড়ো বড়ো গর্ত পাশ কাটিয়ে যেতে বাইককে এঁকেবেঁকে চালাতে হচ্ছিল। ‘এভাবে চালালে আমি কিন্তু পড়ে যাব।’ সে বাইক থামিয়ে মুখ পিছনে ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘অনেক দূর এসেছি, আর কতটা?’ তাকে অবাক করে দিয়ে পারুল বলেছিল, ‘অনেকক্ষণ ছাড়িয়ে এসেছি।’ ‘বলোনি তো!’ ছোটোবেলায় আমার খুব ইচ্ছে করত চড়তে, আজ শখটা মিটিয়ে নিলুম।’ বলেই হেসে উঠল। ‘এবার ফেরান, দেরি হয়ে গেছে। ঘরে বাচ্চচা রয়েছে।’ ‘শ্রীগোপাল কোথায়? তুমি কেন কেরোসিন আনতে এতটা হেঁটে যাবে, ও কি করছে?’ ‘সকালেই বেরিয়েছে…কাল থেকে ঘরে তেল নেই, চলুন।’

বাইক ঘুরিয়ে নিয়ে আবার সে ফিরে এসেছিল মাটির রাস্তারই কাছাকাছি। একটা বাবলা গাছের পাশ দিয়ে নেমে গেছে পায়ে চলা পথ। কতকগুলো খড়ের বাড়ি। বাইক থামিয়ে সে বলেছিল, ‘কেরোসিন নিতে এখানে?’ পারুল বলেছিল, ‘এটা দোকানদারের বাড়ি, দোকানের তেল সব বাড়িতেই, ব্ল্যাকে বিক্রি করে। আপনাকে আর আসতে হবে না।’ জারিকেন হাতে পারুল সেই সরু পথটা দিয়ে হেঁটে চলে গেল। পিছন থেকে সে ওর দিকে তাকিয়েছিল। …এই সেই রোগা, লম্বা, হাইজাম্পারদের মতো দুটো পা—ওয়ালা পারুল, কার্তিকের মা—র মেয়ে! তাকে দেখলেই তখন চোখ নামিয়ে নিত। এখন ওকে দেখে কে বিশ্বাস করবে! শ্রীগোপাল বলল, ‘রোঘো, বিয়ে করে ফেললুম মেয়েটাকে।’ তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল ‘কাকে, পারুলকে?’ বিবিকে সে বলেছিল, ‘সিঁড়িঙ্গে একটা মেয়ে, ড্যাবড্যাবে চোখ।’

কেন যে পারুলের হেঁটে চলে যাওয়ার দিকে সে তাকিয়ে থেকেছিল, আজ ষোলো বছর পরেও তা বুঝতে পারছে না। …কোনো অশ্লীল ইচ্ছে জেগেছিল? …তার কোনো অভাব, অপূর্ণতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল?…একটা রুগণ, অপুষ্ট গাছকে হঠাৎ একদিন ফুলে ভরে যেতে দেখার চমক কি সেই তাকানোটাকে তৈরি করেছিল?

উনিশ বছর আগে শ্রীগোপাল বলেছিল ‘রোঘো বিয়ে করে ফেললুম…গোকুলানন্দে আয়, বউভাত খাওয়াব।’ সে আগাম না জানিয়ে খেতে গেছিল পরের রবিবারে। মোটর সাইকেলের পাশের ব্যাগে ছিল উপহার, শ্রীগোপালের জন্য টেরিলিনের প্যান্ট পরা শার্টের কাপড়, বড়ো এক বোতল হুইস্কি। পারুলের জন্য মুর্শিদাবাদী সিল্কের শাড়ি, ব্লাউজ পিস, আর নকল চুনীকে ঘিরে নকল মুক্তো বসানো একটা সোনার আংটি। বিবিকে সে বলেছিল, ‘শ্রী গোপাল যেভাবে আমাদের জমিজমা বাঁচিয়েছে, তাতে পাঁচ হাজার টাকার উপহার দেওয়া উচিত।’

‘ঘোড়ামুখো তোর বউভাত খেতে এলুম রে।’ উঠোনে মোটরবাইকে বসেই সে চেঁচিয়েছিল। খড়ের চালার ঘর থেকে শ্রীগোপাল খালি গায়ে প্রায় ছুটে বেরিয়ে আসে। ‘আরে রোঘো!’ আনন্দে শ্রীগোপালের সামনের চারটে দাঁত বেরিয়ে পড়েছিল। ‘বউকে রান্না চড়াতে বল।’ খামার বাড়িটা প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে। বাইকটা একতলার খামারঘরে রেখে ব্যাগ থেকে জিনিসগুলো বার করে হাতে নিয়ে হেঁটে আসতে আসতে দেখল পারুল দাওয়ায় মাদুর পাতছে। ওকে সেই হনুমান পার্কে ঘুগনি কিনতে দেখার পর এই প্রথম দেখা, একইরকম রোগা, লম্বা রয়ে গেছে। তার দিকে পারুল তাকাল, সেই ড্যাবড্যাবে চোখ।

বোতলটা দেখেই শ্রীগোপাল হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলেছিল, ‘কী জিনিস এনেছিস রে! অনেকদিন বিলিতি খাইনি। আজ মুরগি খাওয়াব তোকে।’ পারুল দাওয়ায় দাঁড়িয়ে দেখছিল, তার কাছে গিয়ে সে শাড়ির বাক্সটা হাতে দিয়ে আংটির কৌটোটা খুলে সামনে ধরল, ‘পছন্দ হয়?’ পারুল মাথায় ঘোমটা তুলে ছোট্ট করে মাথা হেলায়। ‘হাতটা দাও, পরিয়ে দিই।’ সে নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়, পারুল আঁচলের নীচে হাত লুকিয়ে ফেলে শ্রীগোপালের দিকে তাকায়। বোতলের ছিপির প্যাঁচ মুচড়ে খোলায় ব্যস্ত শ্রীগোপাল বলেছিল, ‘পরিয়ে দিচ্ছি পরে নাও, রোঘোর ছোঁয়া লাগলে কী গায়ে ফোস্কা পড়বে?…উপহার এটা।’

পারুল বাঁ হাত বাড়িয়ে দিল। ওর তালুটা মুঠোয় ধরতেই তার মনে হল, হাতটা যেন কেঁপে উঠল। মুখের দিকে তাকাতেই পারুল চোখ নামিয়ে নিল। আংটিটা অনামিকায় খাপ খেয়েছে। পারুল হাতটা টেনে নিচ্ছিল সে চে পে ধরে বলল, ‘দেখি একটু কেমন লাগছে…বাহ, চমৎকার দেখাচ্ছে…শ্রীগোপাল দ্যাখ তো।’ পারুলের হাতটা সে তুলে ধরল। ‘বিউটিফুল…সোনার জিনিস…দুটো গ্লাস দাও তো, চট করে একটু খেয়ে নিশিদার বাড়ি যাই, ওর মুরগির টেস্ট ভালো।’ ‘তুই এই সকালে এখন মদ খাবি?’ ‘সকাল বলছিস কিরে রোঘো, দশটা তো কখন বেজে গেছে।’ পারুল দুটো কাচের ক্লাস আনে, শ্রীগোপাল একটায় প্রায় সিকি গ্লাস ঢেলে, অন্যটায় ঢালতে যাচ্ছে তখন সে গ্লাসটা তুলে নিয়ে বলল, ‘থাক, এখনও আমার সকাল চলছে।’ ‘তা হলে চলুক তোর সকাল। বড়োলোকের ছেলে, শরীরের দিকে নজর তো থাকবেই।’

শ্রীগোপাল এক ঢোঁকে প্রায় অর্ধেকটা নামিয়ে দিয়ে চোখ বুজল। মুখটা দু—তিনবার দুমড়ে গিয়ে ক্রমশ থমথমে হয়ে গেল, কপাল ভিজে ভিজে দেখাচ্ছে। চোখ খুলে হাঁফাল দু—তিনবার। সে দেখল পারুল উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে। ‘ভালো জিনিস জল দিয়ে নষ্ট করতে নেই, খেলে নিট খাওয়া উচিত, বাবা তাই খেত। জানো পারুল, রোঘোকে আমিই প্রথম মদ চাখিয়েছি। তখন ও ক্লাস এইটে, আমি সিক্সে। ও খেয়ে বলেছিল আমি ওকে নষ্ট করলুম।’ শ্রীগোপাল হাসতে শুরু করে। ‘আমরা কীরকম বন্ধু জান?’ দ্বিতীয় ঢোঁকে বাকি মদটুকু শেষ করে শ্রীগোপাল পারুলের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করে বলে ‘আমাদের বিয়ের আগে, এই ঘরে বসে একদিন বললুম তোর ঠাকুরদার কেপ্ট ছিল, তুইও একটা রাখ। তাতে ও কী বলল জান, তুই বিয়ে কর তোর বউকে কেপ্ট রাখব। …এবার যাই।’ শ্রীগোপাল সোজাভাবে হেঁটে মুরগি আনতে চলে গেল।

তখন নোংরা একটা লজ্জায় তার মাথা ঝুঁকে পড়েছিল। সেই সময় পারুলের মুখ দেখার মতো সাহস তার ছিল না। শ্রীগোপাল যে এতটা মাথামোটা এর আগে কখনো তার মনে হয়নি। চতুর, ধূর্ত, যেকোনো খারাপ কাজ অবলীলায় করতে পারে, এটাই তার জানা ছিল। হয়তো রসিকতা ভেবেই কথাটা বলেছে, কিন্তু বুঝল না কী বিশ্রী চেহারায় পারুলের সামনে তাকে দাঁড় করাল। কোনোদিনই সে আর ওর কাছে পরিচ্ছন্ন একটা মানুষ বলে গণ্য হবে না।

‘মামলেট করে দোব, খাবেন?’ আচমকা পারুলের স্বাভাবিক গলা শুনে সে তাড়াতাড়ি বলে ফেলে ‘খাব’। ‘চান করবেন?’ ‘হ্যাঁ করব, আমার ঘরের চাবিটা দাও। …কোথায় চাবি আছে জান তো?’ পারুল জবাব না দিয়ে ঘর থেকে চাবি এনে দেয়। সে ছুটেই প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরের খামারবাড়িতে পৌঁছয়। দোতলার বন্ধ ঘরের তালা খুলে ভ্যাপসা বাসি গন্ধটা কাটাতে সে পুবের জানালাটা খোলে। জানালা থেকে দেখতে পেল দাওয়ার একধারে রান্নার জায়গায় বসে পারুল তখন উনুনে কাঠ দিচ্ছে। তার মনে হল পারুলের চোখ উনুনের দিকে নয়, জানালার দিকে।

পারুল একটা মোটা ওমলেট কাঁসার থালায় তাকে দোতলার ঘরে দিয়ে গেছিল। ‘আমাদের ভাত কিন্তু মোটা চালের।’ ‘জানি, আগেও খেয়ে গেছি।’ ‘খেতে কিন্তু দেরি হবে, মুরগি নিয়ে কখন ফিরবে তার ঠিক নেই। …পেটে পড়েছে তো।’ ‘দেরি করবে না, বোতলটা তো এখানে। …শেষ করতে হবে তো? শুধু মুরগির ঝোল আর ভাত আর কিছু রেঁধো না।’ কথা বলতে বলতে সে অনেকটা সহজ হয়ে যায়। তবে একবার ভেবেছিল, একটা কোনো কৈফিয়ত দিলে ভালো হয়, যেমন শ্রীগোপাল যে তোমাকেই বিয়ে করবে সেটা জানলে অমন কথা বলতাম না বা এই ধরনের কিছু। কিন্তু পারুলের স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ তার অস্বস্তি কাটিয়ে দেয়।

সন্ধ্যায় কলকাতা রওনা হবার জন্য সে মোটরবাইকটা যখন খামারঘর থেকে ঠেলে বার করছে তখন শ্রীগোপাল এসে দাঁড়ায়। ‘নেশাটা হঠাৎ এমনভাবে ধরে নিল যে তোর সঙ্গে বসে খাওয়াটাও হল না। পারুল তোকে ঠিকমত খাইয়েছে তো?’ ‘খুব ভালো মুরগিটা রেঁধেছে।’ ‘যাক…তুই যে সত্যি সত্যিই আসবি ভাবিনি, বউদিকে একদিন আনিস কিন্তু। ঝিয়ের মেয়ে বলে পারুলের একটা কমপ্লেক্স আছে, সেটা তা হলে কেটে যাবে।’ ‘আনব…তুই এখন শুয়ে থাক, বড্ড খেয়েছিস খালি পেটে।’ ‘হুইস্কি অনেকদিন খাইনিরে, দিশিই জোটে এখানে…রাস্তাটা খারাপ, দেখে চালাস।’ সে বাইকে স্টার্ট দিল। ‘রোঘো একটা সত্যি কথা বলবি?’ শ্রীগোপাল তার কাঁধে হাত রাখল। গলার স্বর জটিল সমস্যায় ভরা। ঝুঁকে মুখটা কাছে এনে বলল, ‘ঠিক করে বল তো, আমার আর পারুলের মুখের মিল আছে কি না? ঠিক বলবি।’ শুনেই ধড়াস করে উঠেছিল তার বুক। শ্রীগোপাল কি কিছু শুনেছে? ‘কই, কোনো মিল তো আমার চোখে পড়েনি!’ তার মনে হল, শ্রীগোপাল ভয়ংকর একটা গর্ত ডিঙোবার চেষ্টা করছে। ‘চোখ, নাক, ঠোঁট, কপাল? ওর দাঁত আমার মতো নয় কিন্তু চোখ কুঁচকোলে, হাসলে?…কোনো মিলই নেই? তুই তো আমাদের দুজনকে কবে থেকে দেখছিস, কখনো মনে হয়নি?’ ‘একবারও নয়…ছাড় এবার যাব। নেশা এখনও তোকে ধরে আছে, আবোলতাবোল বকছিস।’ মোটরবাইকের হেডলাইটটা সে জ্বালল। উঠোনে দাঁড়িয়ে পারুল। আলোর তীব্রতায় চোখ বন্ধ করে কয়েক পা সরে গেল। ‘আর একটা কথা, জাস্ট ওয়ান ওয়ার্ড…বাবাকে তো জন্ম থেকেই দেখেছিস, পারুলের মুখের সঙ্গে…’ সে ধাক্কা দিয়ে শ্রীগোপালকে ঠেলে সরিয়ে বাইক চালিয়ে দিয়েছিল। ‘পারুল চললাম…ওকে শুইয়ে দাও, বাজে বকছে।’ ‘আবার আসবেন।’ উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় পড়ার সময় সে শুনতে পায় শ্রীগোপালের চিৎকার ‘রোঘো, দেখে চালাস।’

এর তিন বছর পর সে এসেছিল সেই জুন মাসের শনিবারে। রথতলার কাঁধে জোয়ালের ধাক্কা লেগেছিল, পারুলকে পিছন থেকে দেখেছিল রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে, ওকে বাইকের পিছনে তুলে নিয়েছিল। পারুল বলেছিল, ‘ছোটোবেলায় খুব ইচ্ছে করত চড়তে, আজ শখটা মিটিয়ে নিলুম।’ কলেজে ভরতি হতেই বাবা মোটরবাইক কিনে দেয়, পারুলের শখ কি তখনই জন্ম নেয়? না হলে কচুবাগানে বস্তির মেয়ে ছোটোবেলায় আর কাকে বাইক চালাতে দেখেছে? পাড়ায় আর তো কারুর ছিল না!

ওই তিন বছরে সে অনেকবারই গোকুলানন্দে এসেছে, কয়েক ঘণ্টা থেকে ফিরে গেছে। তখন পারুলকেও দেখেছে, কিন্তু ও যে ‘সিড়িঙ্গে’ থেকে ধীরে ধীরে অন্য একটা কমনীয় শরীর পেতে শুরু করেছে, এটা তার নজরে আসেনি, হয়তো চারপাশের ফাঁকা জমি, খেত, আকাশ, গাছপালার পটভূমিতে দূর থেকে দেখলে মানুষের অন্য চেহারাটা ধরে পড়ে। কিংবা হয়তো গত রাতে বিবির কাছ থেকে পাওয়া উদাসীন অবহেলায় ভরা সম্পর্ক রক্ষা, যেটা ধর্ষণ ছাড়া আর কিছু নয়, যেটা তাকে গ্লানি আর রাগ ছাড়া আর কিছু দেয়নি।’ …সেটাই কি তাকে প্ররোচিত করেছিল পারুলকে একটু বেশি আকর্ষণীয় করে ভাবতে?…বিবির চোখের স্থির হয়ে থাকা দুটো মণি তার মনের মধ্যে হয়তো তখনও তাকিয়ে রয়েছিল। সেই নিষ্পন্দ চাহনিটাকে ঢেকে দেবার জন্যই কি সে এমন কারও খোঁজ করছিল, যার বড়ো বড়ো চোখ কথায় ভরে থাকবে?

পারুল কেরোসিন তেল নিয়ে ফিরে না আসা পর্যন্ত সে বাবলা গাছটার পাশে অপেক্ষা করেছে। ‘একি আপনি এখনও রয়েছেন!’ পারুল অবাক হওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু চেষ্টাটা দেখাবার জন্য হেসেও ছিল। ‘তেল পেলে?’ ‘হ্যাঁ।’ পারুল হাঁটতে শুরু করল। সে বাইকে স্টার্ট দিল। ওর পাশে বাইকটাকে এনে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘ওটা দাও…দাও বলছি।’ প্রায় কেড়ে নিয়েই জারিকেনটাকে সে পেট্রল ট্যাঙ্কের ওপর রেখে হুকুমের সুরে বলে ‘উঠে পড়ো।’ পারুল তখন একবার মাত্র তার বড়ো বড়ো চোখের পূর্ণ চাহনি তার চোখে রেখেছিল। কী কথা ছিল ওই চাহনিতে? তার মনের মধ্যে একঝলক ঠান্ডা হাওয়া খেলে গেছিল। রাতের গ্লানি যতটুকু ছিল সেটা বেরিয়ে গিয়ে সে মুহূর্তে হালকা হয়ে উঠেছিল।

পারুল বাইকের পিছনে উঠে বসে। ‘এটা এবার কোলে নিয়ে একহাতে ধরে থাকো।’ অন্য হাতটা কীভাবে রাখবে সেটা আর সে বলেনি। পারুলের ডান হাত আলতো ভাবে তার কোমরে বেড় দিল। ডান দিকে তাদের বাড়ি যাবার রাস্তা, সে বাঁ দিকে বাইক ঘোরাল। পারুল অস্ফুটে কিছু একটা বলল। সেই গর্ভভরা ভাঙা রাস্তায় গতি বাড়াতেই পারুলের হাতের বেড় শক্ত হয়ে কোমর আঁকড়ে ধরল। রাস্তা দিয়ে অল্পস্বল্প লোক চলেছে, তারা কৌতূহলে তাকাচ্ছে। গ্রামের রাস্তায় এমন দৃশ্য সাইকেলে দেখলেও, মোটরবাইকের পিছনে মেয়েমানুষ তারা দেখেনি।

‘এবার ফিরুন, ঘরে ছেলেটা একা রয়েছে।’ সাত—আট মাস আগে পারুলের একটা ছেলে হয়েছে। ‘একা রয়েছে?’ ‘একটা বুড়িকে রেখেছি, বাসন মাজে, ছেলে দ্যাখে। …আর নয় ফিরুন।’ ‘শখ মিটে গেল?’ পারুল উত্তর দেয়নি। সে বাইক ঘোরাল। বাঁ দিকে একটা পুকুর আর বিশাল একটা অশ্বত্থ গাছ। ডান দিকে আমন ফসলের জন্য জমিতে লাঙল দিচ্ছিল এক চাষি। ‘এই জায়গাটার নাম কী?’ ‘বোধহয় রাইহাটা…আমি কখনো এতদূর আসিনি।’

রাস্তা থেকে একটা পুকুর, আমবাগান আর বাঁশবাগান, আর একটা বড়ো সবজি খেত পেরিয়ে শ্রীগোপালের খড়ের চালের ঘর, উঠোন, খামারবাড়িটা। দোতলায় পুবের জানালা দিয়ে উঠোন, খড়ের ঘরটা, সরু রাস্তার খানিকটা দেখা যায়, আমগাছ আর বাঁশ, তারপর আর কিছু দেখতে দেয় না। তার ভালো লাগে জানালাটায় দাঁড়াতে। কলকাতায় চোখ আটকে যায় একশো—দেড়শো মিটার পর্যন্ত দৃষ্টি গিয়েই। ফিকে হয়ে যাওয়া রঙ, নোংরা কালো রাস্তা, দুর্গন্ধ, পলেস্তারা ভাঙা দেওয়াল, রঙচটা দরজা জানালা, অবিরাম শব্দ, আঁস্তাকুড়,…কেমন যেন অবসন্ন করে দেয় চেতনা। এই জানালা থেকে সবুজ গাছের পাতা আর আকাশ দেখতে তার ক্লান্তি আসে না। বিশাল বিশাল আমগাছগুলোর অর্ধেকই তার বাবার আমলে নন্দকাকা বসিয়ে ছিল, ল্যাংড়া, হিমসাগর, ফজলি, বোম্বাই। বাকিগুলো আগেই ছিল। অন্তত দশ মিটার দূরত্বে এক—একটা গাছ, গাছতলা পরিষ্কার, পুকুরের দিকে একটু ফাঁকা জমি, ছোটোবেলায় স্কুলের সহপাঠীদের এনে পিকনিক করে গেছে ওখানে।

উঠোনে নেমে পড়ে পারুল। ষাট—বাষট্টি বছরের, মাথায় চুল ছেলেদের মতো করে কাটা, শীর্ণ ছোটোখাটো চেহারার এক বুড়ি পারুলের ছেলেকে কোলে নিয়ে দাওয়ায় বসে ছিল। ‘এত দেরি করলে বউ।’ পারুল জারিকেনটা দাওয়ায় রেখে ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। একটা বছর ছয়—সাতেকের মেয়ে, খালি গা, নোংরা চুল, নাকের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে বাইকটাকে ম্যাজিক দেখার মতো অবাক হয়ে দেখছে। ‘মামি, তুমি এটায় চড়ে এলে?’

‘মলম—টলম কিছু আছে, কাঁধটা জ্বালা করছে।’ পারুল ঘর থেকে একটা দোমড়ানো টিউব এনে বলল, ‘অনেক দিনের, টিপেটুপে বেরোয় কিনা দেখুন!’ প্রায় নিঃশেষিত টিউবটা দেখে সে বলেছিল, ‘কাজ চালাবার মতো বোধহয় পাওয়া যাবে… তুমি লাগিয়ে দেবে?’ বুড়ির হাতে ছেলেকে দিয়ে পারুল বলল, ‘খুলুন।’ সে পাঞ্জাবি, গেঞ্জি খুলে পিছন ফিরে দাঁড়ায়। টিউব থেকে পারুল আঙুলের ডগায় সামান্যই মলম পেল। ‘ইসস গত্তো হয়ে গেছে… গরম জলে ধুয়ে দোব? রক্ত জমে গেছে।’ ‘দরকার নেই, এমনিই লাগিয়ে দাও।’ পারুলের আঙুল কাঁধ থেকে কানের নীচে আলতোভাবে অনেকটা জায়গা নিয়ে ঘেরাফেরা করেছিল। ‘আপনার তিলটা আর বাড়েনি তো!’ ‘কোথায় তিল!’ ‘এই তো’ পারুল তার ডান বগলের পিছনে আঙুল ঠেকাল, ‘মানুষ বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে তিলও তো বড়ো হয়!’ ‘তুমি আগে এটা দেখছ?’ পারুল উত্তর দেয়নি।’ আংটিটা তোমায় পরতে দেখি না তো।’ ‘এখানে পরে কাকে দেখাব?’ দেখাবার মতো কে আছে?’ ‘কেন শ্রীগোপাল তো আছে।’ পারুল উত্তর দেয়নি। …আপনি কিছু খাবেন?’ ‘একেবারে ভাত খেয়ে ঘুম দেব… শুধু ঝোল—ভাল, রাতেও কিন্তু খাব।’

সে বাইকের সাইড ব্যাগ থেকে সন্দেশের বাক্স আর খবরের কাগজ মোড়া হুইস্কির বোতল বার করল। ‘এটা তোমার আর এটা শ্রীগোপালের, তবে এটা এখন আমার কাছে থাকবে।’ বাক্সের গায়ে ছাপা নামটা পড়ে পারুল খুশি হয়ে বলেছিল, ‘অন্নদার মিষ্টি!’ বাক্স খুলে একটা গুজিয়া মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল, ‘এ হল বুলি, বুড়ির নাতনি। মা নেই, বাপ আবার বিয়ে করেছে, দিদিমার সঙ্গে আমার এখানেই থাকে। একেবারে হাবাগবা, কোনো বোধবুদ্ধি নেই।’ ‘বয়স বাড়লেই বুদ্ধি বাড়বে, ও তো পিঠের তিল নয়। …আমি ওপরে যাচ্ছি। শ্রীগোপাল গেছে কোথায়?’ ‘ব্যবসার কাজে। ভোরেই খবর পেল দশ হাজার টাকার মাল পুলিশে ধরেছে, তাই ছুটেছে।’ সে অবাক হয়েই বলল, ‘দ—শ—হা—জা—র! তাহলে শ্রীগোপাল তো এখন বড়োলোক। ‘হ্যাঁ, রাতে ঘুমোতে পারে না।’

শ্রীগোপালের কাছ থেকেই সে মাসছয়েক আগে শুনেছিল, চোরাচালানের কারবারে নেমেছে। বিদেশ থেকে বাংলাদেশে যেসব রেডিমেড পোশাক সাহায্য বাবদ পাঠানো হয়েছে, সেগুলোই সীমান্ত পেরিয়ে চলে আসছে ভারতে। কলকাতায় চৌরঙ্গির ফুটপাথে সে দেখেছে স্তূপ হয়ে রয়েছে ফুলপ্যান্ট, গুদামে পচা অবিক্রিত সিন্থেটিক কাপড়ের আনকোরা জিনিস। পঁয়ত্রিশ—চল্লিশ টাকায় এত ভালো ভালো প্যান্ট বিক্রি হতে দেখে সে তাজ্জব হয়ে গেছিল।

‘চান করব। পরার মতো কিছু দিতে পার, শ্রীগোপালের লুঙ্গিটুঙ্গি যদি থাকে—’। ‘মলমটা মিছিমিছিই লাগালেন জলে তো ধুয়ে যাবে।’ পারুলের গলায় নরম বকুনি ছিল। ‘আর একবার নয় লাগিয়ে দিয়ো।’ পারুল ঘর থেকে একটা পাট করা সবুজ তাঁতের শাড়ি এনে বলল, ‘লুঙ্গি পরতে হবে না, বাসি নোংরা হয়ে আছে।’ শাড়িটায় বাক্সে তুলে রাখার গন্ধ। ‘তোমার শাড়ি পরতে হবে?’ ‘অন্যের বউয়ের শাড়ি পরতে হবে বলে কি লজ্জা করছে?’ ‘তা একটু করছে।’

ইঁদারা থেকে বালতিতে জল তুলে মাথায় ঢালার সময় তার মনে হয়েছিল, এমন হালকা কথাবার্তা বিবির সঙ্গে কখনো বলার সুযোগ তার হয়নি, তার সঙ্গে কেউ বলেওনি। পারুল তাকে সূক্ষ্মভাবে আশকারা না দিলে সে বোধহয় এমন ঠাট্টা—তামাশার স্তরে নিজেকে নিয়ে আসতে পারত না। এজন্য বিবি কি কৃতিত্ব দাবি করতে পারে না? কাল রাতে ওর মুখে ঘুষি মারতে ইচ্ছে করেছিল… ‘ওদের ঘুম যেন না ভাঙে’ শ্রীনাথই বলেছিল, ‘তোর বউয়ের খুব পার্সোনালিটি আছে, গ্র্যাভিটি নিয়ে চলে।’ কে যেন পিছনে দাঁড়িয়ে। মাথায় জল ঢালা বন্ধ রেখে সে পিছনে তাকায়। বুলি দাঁড়িয়ে। ‘কি চাই এখানে?’ ‘মামি বলল, তোমার পাজামাটা এখানেই রেখে যেয়ো, কেচে দেবে।’ ‘আচ্ছা, এখন পালা।’

ঘরে আয়না নেই, তাহলে সে দেখত শাড়ি কোমরে জড়িয়ে তাকে কেমন দেখাচ্ছে, জীবনে এই প্রথম। তাও এমন একজনের, যাকে দেখে বছর পনেরো আগেও সে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে! বাড়ি থেকে চিরুনি আনার কথাটা মনে ছিল না। সে জানালায় এসে শ্রীগোপালের ঘরের দাওয়ার দিকে তাকাল। পারুল থালা থেকে কাটা আনাজ তেলের কড়াইয়ে ঢালছে মুখটা পাশে ঘুরিয়ে রেখে। তার মনে হল পারুলের চোখ যেন জানালার দিকে। পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে নীচে নেমে এসে সে চিরুনি চাইল। পারুল চিরুনি দেওয়ার সময় বলে, ‘এখন কিন্তু আমি রান্নার হাতে মলম লাগাতে পারব না।’ সে জানে পারুলকে বললেই মলম লাগিয়ে দেবে তবে দু—বার অনুরোধ করার পর। উঠোনের একদিকে মাচায় দুটো কুমড়ো ঝুলছে। ‘কুমড়ো গাছ তুমি করেছ নাকি?’ ‘তা নয়তো কে করবে?’ এটা কী গাছ লাগিয়েছ, কাঁঠাল?’ ‘হ্যাঁ, দিন দশেক আগে। আমার খুব ভালো লাগে খাজা কাঁঠাল, মুড়ি দিয়ে খেয়েছেন?’ ‘খেয়েছি দারুণ…, হোক, এসে খেয়ে যাব।’

দাওয়ার পা ঝুলিয়ে বসে সে বলল, ‘শ্রীগোপাল চাষবাস ঠিকমতো দেখে তো? নাকি নিজের ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত?’ চাষ তো বলতে গেলে অনেকটা আমিই দেখি।’ ‘তুমি!’ সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছিল পারুলের মুখের চাপা গর্ব আর চোখের অস্ফুট হাসির দিকে। ‘না পারার কী আছে, আমাকে তো আর জমিতে নেমে কাজ করতে হয় না। ফুরোনে কাজ, ঠিকমতো কাজটা হচ্ছে কি না তদারকি করা। সার—টার কিনে আনা, সেচের জলের ব্যবস্থা, টেসকো দেওয়া সেসব ও করে। বাগান, পুকুর জমা দেওয়ার কথাবার্তাও আমি শুনে শুনে শিখে গেছি। তবে ছেলেটা হবার পর জমির দিকে আর তেমন যেতে পারি না। …সাহস করে এগোলে সবই করা যায়।’ তার কানে ‘সাহস করে এগোলে’ ফাঁকা কথা মনে হল না।

শ্রীগোপাল দুপুরেও ফেরেনি। সে একাই ভাত খেয়ে ঘরে ফিরল। জানালা দিয়ে চোখে পড়ল তার পাজামাটা, পারুল দড়িতে মেলে দিচ্ছে। তক্তপোশে পাতলা তোশকের উপর হ্যান্ডলুমের বেডকভার, শক্ত একটা বালিশ। সে শোওয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছিল।

একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। পশ্চিম থেকে বিকেল শেষের রোদ—বৃষ্টি ধোওয়া গাছের পাতাগুলোকে ঝলসানো সবুজ করে তুলেছিল। ভিজে মাটি আর ঝোপঝাড় থেকে একটা গন্ধ তার ঘুম ভাঙা মস্তিষ্কের কোষগুলো সতেজতায় ভরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেছে। দু—হাত তুলে হাতের আঙুলের ডগা ধীরে ধীরে সে পায়ের পাতায় ঠেকাবার চেষ্টা করল হাঁটু না ভেঙে। সফল হতেই সে আমেজ বোধ করল। পিঠ, কোমর, বাহু, ঊরুর ভারী পেশিগুলোতে টান পড়ার ব্যায়াম কয়েক মিনিট করার পর ধীরে ধীরে একটা চমৎকার হালকা প্রফুল্লতা তার শরীর আর মন ছেয়ে এল। একেই বলে স্বাস্থ্য। এই সময় তার চোখে পড়ল কাঠের ছোটো টেবিলে রাখা কাগজে মোড়া বোতলটা। শ্রীগোপাল এতক্ষণে এসে গেছে কি? সে জানালায় দাঁড়াল। বৃষ্টি নামতেই কাপড়চোপড়গুলো দড়ি থেকে বোধ হয় তুলে রেখেছিল পারুল, এখন সেগুলো মেলছে। দুপুরে নিশ্চয় ঘুমোয়নি। উঠোনে হালকা হলুদ রোদের আভার মাধ্যে সে অন্য এক পারুলকে দেখল, যে বৃষ্টিভেজা এই বিকেল, মাটির গন্ধ, গাছের সবুজ, মেঘলা আকাশের আর প্রবল নৈঃশব্দ্যের সঙ্গে সূর্যকিরণের মতো একাকার। তার শরীরে রোমাঞ্চ লাগল।

বুলি রঙিন ফ্রক পরেছে, তাকে ডেকে পারুল কিছু বলল। মেয়েটা ছুটে আসছে, সিঁড়িতে পায়ের ধুপধুপ শব্দ হল, ‘মামি বলল তুমি চা খাবে?’ ‘খাব।’ …চট করে বড়ো একটা জায়গায় খাবার জল আর একটা গ্লাস আগে নিয়ে আয়।’ ‘বড়ো জায়গা… কলসীতে?’ সে হেসে ফেলে বলেছিল, ‘হ্যাঁ।’ সে বোতলে জড়ানো কাগজ মুঠোয় দুমড়ে ঘরের একধারে ফেলে দিয়ে ছিপির প্যাঁচ এক মোচড়ে খুলে মদের গন্ধ শুঁকতে নাকের কাছে ধরল। তার ভালো লাগল। টুলটা ছাদে নিয়ে গিয়ে ওখানে বসে খেলে কেমন হয়? সে ছাদে এসে দেখল বহু বছরের আবর্জনা, গাছের শুকনো পাতা, কাগজ, গাছের ডালের টুকরো আর ধুলো, বৃষ্টির জলে লেপটে রয়েছে। এতবার এসেছে অথচ ছাদটাকে কখনো সে নজরই করেনি। ছাদটা পরিষ্কার রাখার দায় শ্রীগোপালের, কিছুই দেখে না।

মাথায় কাচের গ্লাস বসানো একটা স্টিলের জাগ দু—হাতে আঁকড়ে বুলি এল। জাগটা ঝকঝকে, এখনও গায়ে টিকিট সাঁটা, আজই বোধহয় প্রথম ব্যবহার হচ্ছে। মেয়েটা দাঁড়িয়ে তার জল খাওয়া দেখল। ‘মামা এসেছে?’ ‘না।’ ‘মামি কী করছে?’ ‘কাপড় পরছে।’ ‘চা আনতে পারবি?’ একটু ভেবে বলল, ‘না।’ ‘তুই এবার যা।’ অনেকদিন আগে এই জানালা থেকে চেঁচিয়ে শ্রীগোপাল বলেছিল, ‘গ্লাস দিয়ে যাও।’ পারুল দুটো স্টিলের গ্লাস নিয়ে আসে। হতাশ স্বরে শ্রীগোপাল বলে ‘কি বুদ্ধি! এই গ্লাসে কেউ মদ খায় না, জল খায়। কাচের গ্লাস আনো।’ পারুল কাচের গ্লাস পাঠিয়েছে, ও তাহলে জানে সে এখন কী খাবে। নাকি তাকে খুঁচিয়ে দিল খাবার জন্য!

বোতল থেকে সে গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে অল্প জল মিশিয়ে চুমুক দিল। কড়া হয়ে গেছে। আর একটু জল দেবে কি না ভাবল, ইতস্তত করে জল দিল না। সে তাড়াতাড়ি গ্লাস শেষ করে আবার ঢালল, অল্প জল দিল, এবারও তাড়াতাড়ি শেষ করে খাটে বসল। সে টের পাচ্ছিল তার ভিতরে কিছু একটা ঘটে চলেছে। একটা অস্থিরতা বুক থেকে নীচে নেমে যাচ্ছে, চোখ ঝাঁ ঝাঁ করছে। তাড়াতাড়ি নেশা হবে বলে শ্রীগোপাল এইভাবে খায়। সে কী তাহলে শ্রীগোপাল হয়ে গেল…ঘোড়ামুখো…করাপ্ট। সে জাগটা মুখে তুলে ঢকঢক করে জল খেয়ে খাটে বসল। মুখ ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে তাকাল। ঘোলাটে আকাশ ছাড়া আর কিছু দেখার নেই। শান্তভাবে আকাশটা অপেক্ষা করছে দিনের মৃত্যুর। রাতে হয়তো বৃষ্টি নামবে। সে চমকে দরজার দিকে তাকাল, পারুল!

ওর মুখের দিকে তাকিয়েই তার চোখ স্থির হয়ে গেছিল। প্রকৃতির মধ্য থেকে যেন বেরিয়ে এসেছে এই পারুল। দু—পাট করে টানটান আঁচড়ানো চুলের মাঝখানে সরু সিঁথিতে সিঁদুর, আলতো একটা খোঁপা ঘাড়ের উপর, কপালের ঠিক মাঝে বড়ো একটা লাল রঙের টিপ, পরনে সেই মুর্শিদাবাদী সিল্কের চওড়া পাড় সোনালি বুটি দেওয়া লাল শাড়ি, ওই কাপড়েরই ব্লাউজ, মুখটা তেলতেলে, খুব সূক্ষ্ম কাজল। পারুল সেজেছে। এক হাতে পিরিচে ঢাকা চায়ের কাপ, অন্য হাতে তার পাজামাটা। ‘শুরু করে দিয়েছেন….চা খাবেন না?’ সে শুধু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছিল। উত্তরে ছাদের দরজা দিয়ে দুর্বলভাবে আলো আসছে, পুবের জানালার চৌকো এক খণ্ড ঘোলাটে আলো, পারুল সামনের টেবিলে চায়ের কাপ রাখতে এগিয়ে এল। হালকা একটা মিষ্টি গন্ধ ওর শরীর থেকে সে পেল। কাপটা বাঁ হাতে তুলে তার দিকে এগিয়ে ধরে পারুল বলেছিল, ‘কষ্ট করে করলুম আর….।’

সে তাকিয়েছিল পারুলের আঙুলে আংটিটার দিকে। ‘সত্যিই চমৎকার দেখাচ্ছে।’ ‘কী চমৎকার?’ সে কাপটা হাতে নিয়ে টেবিলে রেখে পারুলের বাঁ হাত তুলে নিল। মাথা ঝুঁকিয়ে আংটির উপর আলতো চুম্বন করল। পারুল হাতটা টেনে নিয়ে দু—পা পিছিয়ে যেতেই সে উঠে দাঁড়াল। ঘরে এখনও যা আলো রয়েছে তাতে সে দেখতে পাচ্ছে পারুলের চোখ। বড়ো বড়ো চোখ দুটোয় ভয় নেই, বকুনি নেই। ‘তোমার সব শখ কি মিটেছে…পারুল?’ সে উত্তর পেল না। তখনই সে দু—হাতে কাঁধ ধরে পারুলকে বুকে টেনে নিয়ে ছিল। একটা কোমল ‘নাহহ’ ছাড়া আর কোনো প্রতিরোধ সে পেল না। উন্মাদের মতো সে চুম্বন করেছিল, পিষে দিচ্ছিল ওষ্ঠপুট। পাতলা সিল্কের উপর দিয়ে ছোটাছুটি করা তার করতল অনুভব করছিল পারুলের শরীর ধকধক করছে তার মোটরবাইকের ইঞ্জিনের মতো গরম, ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরোবার জন্য প্রস্তুত। তার কাঁধে বসে যাচ্ছে পারুলের আঙুল, জ্বালা করছে জায়গাটা, এই সুখের অনুভূতিটা সে চেয়েছে বিবির কাছে…

শিক্ষা, রুচি, পার্সোনালিটি….ঝিয়ের মেয়ে, শ্রীগোপালের বউ…চুলোয় যাক…পারুলকে টেনে তক্তপোশের উপর ফেলে দিয়ে সে ওর বুকের উপর নিজেকে নামিয়ে দিয়েছিল। ‘ছাড়ুন’, ‘না’, ‘ছাড়ুন বলছি’, ‘না’। সে টের পাচ্ছিল তার দেহের নীচে শক্ত শরীরটা আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে যাচ্ছে, দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ঊরুর পেশি। ‘আমায় দেখে মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতেন’, ফিসফিস করে পারুল বলেছিল ‘…মনে আছে?’ ‘আছে…সে ছিল অন্য মেয়ে।’ এরপরই সে টান দিয়ে শাড়িটা পারুলের ঊরুর উপরে তুলে দেয়।

‘মামি…’ ছিটকে দুজনে উঠে দাঁড়ায়। আঁধার ঢুকে পড়েছে ঘরে। দরজায় একটা ছায়া, বাইরে পাখিদের অবিশ্রান্ত কিচিরমিচির। ‘কি চাই তোর?’ পারুল ভাঙা গলায় ধমক দিয়েছিল দরজায় দাঁড়ানো বাচ্চচা মেয়েটাকে। ‘মামা এয়েচে, তোমার ডাকচে।’

তার মুখ তখন পুবের জানালাটার দিকে ঘুরে যায়। উঠোন থেকে চিৎকার করছে শ্রীগোপাল, ‘পারুল…পারুল।’

আট

‘তারপর আসামি আপনার দিকে এগিয়ে এসে কী করল?’

‘আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে ঘরের খাটে নিয়ে ফেলল।’

‘আপনি বাধা দেননি?…চেঁচাননি?’

‘ডান হাতটা আটকা ছিল বগলের নীচে, বাঁ হাতে কোনোরকমে ওর ডান কাঁধটা খামচে ধরি। …গলা দিয়ে তখন স্বর বেরোচ্ছিল না।’

‘খামচে ধরা ছাড়া আর কী করেছিলেন বাধা দেবার জন্য?’

‘ও তখন আমার বাঁ হাতটা মুচড়ে ধরে।’

‘হাসপাতালে মেডিক্যাল পরীক্ষার সময় ডাক্তারকে সে কথা বলেছিলেন?’

‘হ্যাঁ।’

ডাক্তারকে সে বলেছিল ‘এটা জোয়ালের ধাক্কাতেই।’ ডাক্তার টর্চ জ্বেলে মন দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন…ডাক্তারবাবু আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, রিপোর্টে লিখেছিলেন ইনজুরিটা ভারী কিছুর ধাক্কা লাগার জন্য। উকিল আর পুলিশের শেখানো কথা পারুল কোর্টে দাঁড়িয়ে অম্লানবদনে বলেছিল। সে তখন স্তম্ভিত হয়ে দেখছিল শুধু আর—একটা পারুলকে, যাকে সে কোনোদিনই দেখেনি।

এইখানেই সে মোটরবাইকে বসে বলেছিল ‘উঠে পড়ো।’ খালপাড় থেকে খামারবাড়ির লালমাটি ফেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে দেখল বাঁশ আর আমবাগানটা একইরকম রয়েছে। পুকুরে কতকগুলো হাঁস, ঘাটলায় বসে ছিপ হাতে একটি লোক, তার পিছনে দাঁড়িয়ে হাফপ্যান্ট পরা শার্ট গায়ে রুগণ একটি ছেলে। তাকে দেখতে পেয়েছে ছেলেটা, পুকুরের ধার দিয়ে এগিয়ে আসছে। ছেলেটা ল্যাংচাচ্ছে বোধহয় পোলিয়ো।

‘কাকে খুঁজছেন?’

‘পারুল বিশ্বাসকে।’

‘কলকাতা থেকে আসচেন…মালিকের লোক?’

‘হ্যাঁ।’

‘এখানে থাকবেন বলে?’

‘হ্যাঁ। তুমি চেনো পারুল বিশ্বাসকে?’

‘আমার মা হয়…এই রাস্তা ধরে সোজা গেলেই আমাদের ঘর। …মা বলেছিল একজন কলকাতা থেকে আসবে, এখানে থাকবে।’

ছেলেটার মুখ দেখেই তার আন্দাজ করা উচিত ছিল। শ্রীগোপালের মতোই লম্বাটে, সামনের দুটো দাঁতও হয়েছে বাবার মতো। চোখদুটোয় সারল্য, কম বুদ্ধির ছাপ, কথা বলতে চায় লোকের সঙ্গে। বাঁ পা শুকিয়ে লাঠির মতো সরু। সে খুব ধীরে হাঁটতে শুরু করল, ছেলেটা তার সঙ্গ নিয়েছে।

‘লোকটা কীরকম দেখতে সে কথা মা বলেনি?’

‘বলেচে খুব লম্বা চওড়া, সাহেবদের মতো রঙ আর কটা চোখ।’

‘নাম বলেছে?’

‘না। …আপনার নাম কী?’

প্রশ্নটাকে গ্রাহ্যে না এনে বলল, ‘আমায় দেখে চিনতে পেরেছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোমার নাম কী?’

‘শ্রীমন্ত…মন্তা।’ ছেলেটা মুখ তুলে তাকাল। দাঁত দুটো বেরিয়ে এসেছে। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে সামনে তাকাল। এখন বিকেলের মাঝামাঝি, আকাশের আলোয় এখনও টান পড়েনি। খামারবাড়ির দোতলার জানালাটা দেখা যাচ্ছে। একটা কাঁঠাল গাছ, তার পিছনে খড়ে—ছাওয়া একটা ঘর। ঘরের পিছনে ঢালু একটা নীচু খড়ের চালা, ঢুকতে গেলে কুঁজো হতে হবে। নিশ্চয়ই গোয়াল।

‘পুকুরে হাঁস দেখলাম, কার?’

‘আমাদের, এগারোটা ছিল, এখন ন—টা। শ্যালে দুটো নিয়েছে।’

‘তুমি স্কুলে পড়ো?’

‘পড়ি…অঘোরনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়, কেলাস ফোর। বড়ো ইস্কুল সেই রথতলায় থানার পিছনে, আমার এই পা নিয়ে অতদূর যাব কী করে…এখানে ইস্কুল খুলতেই ভরতি হয়েছি।’ ছেলেটা হাসল। সরল বোকামিভরা হাসি। ওর বয়স এখন প্রায় সতেরো।

মন্তার উচ্চচারণে কলকাতার ছাপ, বোধহয় মায়ের সঙ্গেই সময়টা বেশি কাটে। পায়ের জন্য খেলাধুলা সম্ভব নয়, বন্ধুবান্ধব নিশ্চয় বেশি নেই। আমবাগানের পাশেই সবজির জমি, সেই জমির অর্ধেকটায় ধান লাগানো হয়েছে। ধানের মাথাগুলো সতেজ স্থির। চোখ জুড়ানো সবুজ। অথচ এখানে ছিল সরষে খেত, কলার বাগান, বেগুন, মুলো, টোমাটোর চাষও হত। পারুল চাষ বদলে দিয়েছে।

কাঁঠাল গাছটার বয়স সে জানে। ষোলো বছর দু মাস দশ দিন। একটা কালো গোরু গাছতলায়। দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে বসে দুটি লোক পরনে রঙিন বুশশার্ট, ধুতি। পিছন ফিরে দাওয়ায় ওঠার সিঁড়ির ধাপে বসে এক স্ত্রীলোক, তিনজনে কথা বলছে।

‘মা।’ মন্তা চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই দ্যাখো।’

স্ত্রীলোকটি মুখ ফিরিয়েই পিঠের উপর কাপড় টেনে দিয়ে উঠে দাঁড়াল, মাথায় তুলে দিল ঘোমটা। সে থমকে পড়ল অবাক চোখে। এই কি পারুল…এ কী চেহারা হয়েছে! একেই বোধহয় বলে দশাসই। গলায় ঘাড়ে চর্বি, মুখটা বড়ো দেখাচ্ছে, আঁচলে ঢাকা থাকলেও বোঝা যায় স্তনদুটো ঝুলে রয়েছে, কোমরের পরিধি দ্বিগুণ, দুটো হাত মসৃণ গোল, তলপেটে একটা ঢিবি। পরনে লাল ব্লাউজ, তুঁতে রঙের শাড়ি।

তার দিকে একপালক তাকিয়েই পারুল ঘরের মধ্যে চলে গেল। যাওয়াটা ওর দেহের ওজনের সঙ্গে একদমই খাপ খেল না, গতি আগের মতোই দ্রুত রয়ে গেছে। লোক দুটি তার দিকে তাকিয়ে। দেখে মনে হল চাষবাস করে, বয়স কম। পারুল ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ‘মস্তা এই নে চাবি, দোতলার ঘরটা খুলে দিয়ায়। …রাতে ভাত দিয়ে আসবে। টেবিলে হারিকেন দেশলাই আছে, কলসিতে জল ভরা আছে।’ শেষের কথাগুলো তাকে উদ্দেশ করে বলা। গলাটা একটু খরখরে এবং ভারী।

পারুল তার অবাক চাহনিটা নিশ্চয় লক্ষ করেছে, তাই মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। শরীরটা যে আগের মতো নেই, সেটা নিশ্চয় জানে। এজন্যই কি মুখ লুকোতে চাইছে, নাকি কোর্টে দাঁড়িয়ে মিথ্যা কথা বলার জন্য কিংবা স্বামীর খুনির প্রতি ঘৃণায়? সে মন্তার পিছনে খামারবাড়ির দিকে এগোল। একতলার বড়ো ঘরের কাঠের দরজাটা নেই, সেই জায়গায় বাঁশ আর চ্যাটাইয়ের একটা ঝাঁপ হেলান দিয়ে রাখা। মোটরবাইকটা এই ঘরে রাখা ছিল। এখনও রয়েছে কি? সে ঝাপের ফাঁক দিয়ে ভিতরে তাকাল। উত্তর দিকের দেওয়াল ভাঙা, জানালাটাও নেই। ঘরের অর্ধেকটা খড়ে বোঝাই, ধানের কয়েকটা বস্তা, ধান ঝাড়াইয়ের কাঠের পাটা…বাইকটা সে দেখতে পেল না।

‘এখানে একটা মোটরবাইক ছিল না?’

মন্তার চোখ বড়ো হয়ে উঠল, ‘ভটভটিয়াটা?…সে তো চোরেরা ওই জানালা ভেঙে খুলে নিয়ে গেছে…দুটো চাকা, আলোটা, বসার সিটটা। …ওটা কার ছিল জানেন?’

‘না।’

তারা দোতলায় পৌঁছে গেছে। মন্তা তালা খুলছে, সে ডান দিকে ছাদের দিকে তাকাল। ছাদটা পরিষ্কার করা হয়েছে। মন্তা ঘরে ঢুকে বলল, ‘আজ সকালে মা পরিষ্কার করিয়েছে বুলিদিকে দিয়ে।’

বুলিদি! নামটা তার কানে ঘটাং করে উঠল। এই দরজাটায় দাঁড়িয়ে মেয়েটা ‘মামি’ বলে ডেকে উঠেছিল। ছ—সাত বছরের রোগা কালো মেয়ে। না ডাকলে কী ঘটে যেত! সেই তক্তপোশ, টেবিল, ছোটো টুল সবই রয়েছে। টেবিলের উপর রাখা একটা ছোটো সুটকেশ, হেমন্তর হাত দিয়ে পাঠানো। সে এগিয়ে গিয়ে পুবের জানালাটার ছিটকিনি তুলে পাল্লা দুটোয় ধাক্কা দিল।

দাওয়ায় লোকদুটো বসে, সিঁড়ির ধাপে পারুল। জানালায় সে দাঁড়াতেই পারুল কথা বলতে বলতেই শাড়িটা কাঁধের উপর টেনে বিছিয়ে দিল। সে সরে এল জানালা থেকে।

‘বুলিদি কে?’

‘আমাদের কাজ করে। গোরু—হাঁস দেখে, মা—র সঙ্গে বাজারে যায়, কাপড় কেচে দেয়…খুব গরিব, আরও একটা বাড়িতে কাজ করে।’

‘বিয়ে হয়ে গেছে?’

‘কব্বে। দুটো ছেলে আছে, ওর বর ওকে ফেলে চলে গেছে কোথায়।’

বুলির বয়স এখন তেইশ—চব্বিশ হবে। নতুন কলসির ওপরে মাটির সরা, তার উপরে কাচের গ্লাস। তোশক, চাদর, বালিশ নতুন, হ্যরিকেনটাও।

‘এসব কিনল কে?’

‘কলকাতা থেকে হেমন্ত বলে একটা লোক পরশু এসেছিল। রথতলা থেকে ভ্যানরিকশায় করে কিনে এনেচে। …আপনি এখানে কতদিন থাকবেন?’ মন্তা টুলের উপর বসল। ওর মুখের দিকে সে চোখ কুঁচকে তাকাল। প্রশ্নটা সে নিজেকেও করেছে এই ঘরে পা রেখেই।

‘বলতে পারছি না…হয়তো সারাজীবন।’

‘সারাজীবন!’ মন্তা অবিশ্বাস করতেই পারে। কলকাতা থেকে একটা লোক এখানে কেন সারাজীবন কাটাতে আসবে? ‘কী করবেন?’

প্রশ্নটা বাসে আসার সময় তার মনেও উঠেছিল। তখন মনে পড়েছিল বাবার কথাগুলো, ‘তোর স্বাস্থ্য আছে, খাটবার ক্ষমতা আছে, তুই কেন বসা কাজ করবি? চাষবাস ভালোভাবে করতে পারলে তাতে অনেক পয়সা, মাটি হল সোনা। ….আমি তোকে জমি আর কিছু টাকা দিয়ে গেলাম এবার তুই যা করার কর।’ বাবা তখন জানত না তার ষোলোটা বছর কীভাবে নষ্ট হবে, সে সর্বস্বান্ত হবে।

‘ভাবতে হবে কী করা যায়। …তুমিই বল তো কী করা যায়?’

মন্তার মুখে অপ্রতিভ লজ্জা ফুটে উঠল। ‘আমি কী জানি।’

‘আচ্ছা, চাষ করলে কেমন হয়?’

‘চাষ! আপনি কী করে চাষ করবেন, আপনি কি চাষি?’

‘লোক দিয়ে করাব, যেমন তোমার মা করায়।’

‘মা—র তো জমি আছে, আপনার জমি কোথায়?’

তার কথা বলতে আর ভালো লাগছে না। ক্লান্তি এবার তার শরীর থেকে মনের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। পারুল কীভাবে তার এখানে থাকাটাকে গ্রহণ করবে সেটাই তাকে আন্দাজের গর্তে ফেলে দিয়েছে। এখনও পর্যন্ত আগেকার পরিচয়ের কোনো ঝলক ওর কথায় আচরণে ফুটে ওঠেনি, তাকে বন্ধুভাবে নেয়নি। শত্রুভাবে কতটা নিয়েছে সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। পাঞ্জাবিটা খুলে সে সুটকেসের উপর রাখল। এখন চা পেলে ভালো লাগত। মন্তাকে কি বলবে? সে বিছানায় আলতো করে নিজেকে শুইয়ে নিয়ে চোখ বুজল।

‘মন্তা, তুমি আমার নাম জান না। আমাদের তো রোজ দেখা হবে, কী বলে তা হলে আমায় ডাকবে?’

মন্তা সমস্যায় পড়ে গেল। সম্ভবত ওর জীবনের প্রথম জটিল সমস্যা। সে নিঃশব্দে হাসতে শুরু করল। বহু বছর পর এটা তার প্রথম মজা পাওয়ার হাসি। ‘আমাকে একটু চা খাওয়াবে।’

ঘর থেকে মন্তা বেরিয়ে যাবার পর সে চোখ খুলল। জানালা দিয়ে দেখল সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সে ঝুলি থেকে চার ব্যাটারির নতুন টর্চটা বার করে টেবিলে রেখে, বিছানায় ফিরে এসে আবার চোখ বন্ধ করল। বিবি বলেছিল, ‘পারুল আছে, সে তোমায় দেখবে…যাকে তুমি বিধবা করেছ….পারুলই এখন গোকুলানন্দর সব কিছু দেখছে।’

বিবি ভেবেচিন্তে ইচ্ছে করেই তাকে শাস্তিটা দিল। পারুলের মুঠোর মধ্যে তাকে তুলে দেওয়ার মতো নিষ্ঠুর সূক্ষ্ম কাজ ওর দ্বারাই সম্ভব। ‘খাওয়াপরার জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না। আমাদের জমিজমার টাকা পারুলই আদায় করে, হিসেব রাখে। খরচখরচা বাদ দিয়ে যা থাকে আমাকে দিয়ে যায়। খুব সৎ মেয়ে। এবার থেকে অন্য খরচের মধ্যে তোমার খরচটাও ধরবে। তোমার যা দরকার ওর কাছ থেকে চেয়ে নেবে। তোমার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা পারুলই করবে…আমি ওকে চিঠি লিখে দিচ্ছি।’

অনেকদূর পর্যন্ত ভেবে রেখে দিয়েছে বিবি, হয়তো জেল থেকে তার বাড়িতে পৌঁছনোর আগেই ছকে রেখেছিল। ছাব্বিশ নম্বর থেকে তাকে যুক্তিগ্রাহ্য উপায়ে তাড়ানোর বা কেউ প্রশ্ন করলে একটা স্বাভাবিক কারণ দেখানোর রাস্তাও খুলে রেখেছে… ‘গ্রামে এগ্রিকালচারাল ফার্ম করবেন বলে গেছেন।’ কেন যে সে নিজে থেকেই কথাটা বলল ‘ভেবে দেখলাম, আমি গোকুলানন্দে গিয়েই থাকব’, তা হলে বিবির ইচ্ছেটা এত তাড়াতাড়ি পূরণ হত না। পারুল গোকুলানন্দে বসবাস করছে এটা যদি সে ঘুণাক্ষরেও জানত! কী বোকামি, না জেনে কী ভুল সে করে বসল কথাটা বলে। এখন তাকে পারুলের হাত—তোলা হয়ে থাকতে হবে!

‘অসম্ভব। গোকুলানন্দে থাকতে পারি কিন্তু পারুলের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক থাকবে না…আর জমিজমা এবার থেকে আমি নিজে দেখব।’ বিবি শান্ত গলায় ধীরে ধীরে বলেছিল, ‘তা কী করে হয়? এত বছর ধরে পারুল দেখাশোনা করছে, নিয়মিত টাকা দিয়ে যাচ্ছে, পুরো কর্তৃত্ব আমিই ওকে দিয়েছি। এখন কী যুক্তিতে আমি তা কেড়ে নেব?…বাচ্চচা নিয়ে অসহায় একটা মেয়ে বিধবা হল…,’ বিবি তার মুখের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে ছিল, ‘তাকে তো আমায় দেখতে হবে।’ ‘কীজন্য তোমায় দেখতে হবে?’ ‘বিবেক…তার জন্য।’ বিবি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই গুলু, গোরা, অরুণার দৃষ্টি তার উপর এসে পড়ে। ‘যেতে হয় যেয়ো, ইচ্ছে না হলে যেয়ো না। …তবে জমিজমার উপর অধিকার পেতে হলে তোমাকে কোর্টে যেতে হবে।’ বিবি ঠান্ডা গলায় কথাটা বলে নিজের ঘরে চলে গেছিল।

তার অবস্থাটা যে কোথায় পৌঁছেছে সে তা ভাবতে পারেনি। নিজের সম্পত্তি ফিরে পাবার জন্য কোর্টের দরজায় যেতে বলল তার নিজের স্ত্রী! এর থেকে কতটা বেশি অপমান পারুল করতে পারবে? কে বলতে পারে, গোকুলানন্দে তার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে? হয়তো পারুলের বিবেক ষোলো বছর ধরে আর বেঁচে নেই। চব্বিশ ঘণ্টা পরই সে বলেছিল, ‘গোকুলানন্দেই যাব।’

‘জেঠু, আপনার চা। হারিকেনটা জ্বালেননি?’

বিছানা থেকে উঠে টর্চটা তুলে নিয়ে জ্বালতেই দু—হাতে একটা কাচের গ্লাস ধরে মন্তা সাবধানে পঙ্গু পা ফেলে ঘরে ঢুকল। তাড়াতাড়ি গ্লাসটা ওর হাত থেকে নিয়ে বলল, ‘তুমি কেন এই গরম গ্লাস হাতে সিঁড়ি ভাঙতে গেলে?’

‘মা এই পর্যন্ত দিয়ে গেল।’ মন্তা দরজার দিকে মুখ ফেরাল। সে অনুমান করল গ্লাস নিয়ে দরজা পর্যন্ত ছেলেকে পৌঁছে দিয়েই পারুল নীচে নেমে গেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে বিশ্রী একটা স্বাদ সে পেল। খুব কমদামি, নয়তো খুব বাসি চা দিয়ে তৈরি, না হলে পারুল ভালোই তো চা বানাত। সে গ্লাসটা রেখে হারিকেন জ্বালাল।

‘জেঠু’ বলতে কে বলে দিল?’

‘মা।’

শ্রীগোপাল তার থেকে বয়সে কিছু বড়ো ছিল, এটা তো পারুল জানে, তা হলে জেঠু কেন! ‘আমার চা কিংবা খাবার তুমি এভাবে আনবে না। হয় আমি নীচে গিয়ে নিয়ে আসব, নয়তো তোমার মা যেন ঘরে এসে দিয়ে যায়।’

কয়েক সেকেন্ড থেমে বলল, ‘…আমি যখন ঘরে থাকব না। বলতে পারবে?’

‘হ্যাঁ। আমি এখন যাই। মা বলে দিল যখন কিছুর দরকার হবে জানালা দিয়ে চেঁচিয়ে ‘মন্তা’ বলে ডাকতে।’

এখন থেকে এই ঘরটাই তার সংসার, বাসস্থান। যেভাবে ঘরটা রয়েছে এখন সেইভাবেই থাক, কাল সকালে বরং সুটকেস খুলে কাপড়চোপড় বার করবে, টাঙাবার জন্য একটা দড়ি দরকার। প্রায় দু—হাজার টাকা হাতে রয়েছে, কিছু কেনার দরকার আছে কিনা সেটা দু—তিনদিন না কাটলে বোঝা যাবে না। তবে রথতলায় চা—পাতার খোঁজে তাকে যেতে হবেই।

‘জেঠু…জেঠু।’ মন্তা চেঁচাচ্ছে নীচের থেকে। সে জানালায় গিয়ে দাঁড়াল। ‘মুড়ি খাবেন, তেলমাখা মুড়ি…লংকা পেঁয়াজ দিয়ে?’

‘খাব।’

ঝুলি থেকে কাগজে মোড়া হাওয়াই চটিটা বার করে সে পায়ে গলাল। পারুল উপরে মুড়ি দিতে এলে, এই নিরালা ঘরে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও, একটা দমবন্ধ করা অস্বস্তি তৈরি হবে। নির্জনে সে পারুলের চোখের দিকে তাকাতে চায় না।

দাওয়ায় বসে পারুল মুড়ি মাখছে তেল দিয়ে। মন্তা পেঁয়াজ ছাড়াচ্ছে। উনুনে হাঁড়ি বসানো, ভাতের গন্ধ ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে ছড়িয়ে পড়েছে উঠোনে। গোয়ালের পাশে হাঁসের ঘর থেকে একবার ‘প্যাঁক প্যাঁক’ ডাক উঠল। সে উঠোনে অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে। আকাশ পাতলা মেঘের একটা জায়গা সামান্য উজ্জ্বল। ওখানে চাঁদ। আমবাগান, বাঁশঝাড়, ধানখেত একাকার একটা ছায়ার মতো । জোলো বাতাসে বৃষ্টির গুঁড়ো। সে দূরে হারিকেনের দোলা দেখতে পেল, কেউ একজন চলেছে। কতকগুলো ধাপ পেরিয়ে জীবন তাকে এই উঠোনের মাঝে দাঁড় করিয়েছে? সব কিছুর জন্য কি সে একাই দায়ী? ওই যে স্ত্রীলোকটি দাওয়ায় বসে, ছাব্বিশ সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিটে যে স্ত্রীলোকটি পরীক্ষার খাতা দেখছে বা টেলিফোনে কথা বলছে, এই যে ছেলেটি, তার বাবা…।

‘কে, কে ওখানে?’ পারুল হারিকেন তুলে ধরেছে। সে এগিয়ে গেল। পারুলের চোখে ভয়।

‘আমি। মুড়ি খেতে এলাম।’

‘এভাবে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকারে?’ পারুলের স্বরে অনুযোগের ধমক। মন্তা হাসছে। বাবার মতো দাঁত বেরিয়ে এসেছে।

‘মা—র ভূতে ভয় করে…অপঘাতে মরলে মানুষ ভূত হয়, এখানে বাবার ভূত আছে।’

‘চুপ কর!’ তীক্ষ্ন গলায় পারুল ধমকে উঠল। যে অস্বস্তিতে পড়তে না চেয়ে সে দোতলা থেকে নেমে এসেছে, সেটাই এখন তার আর পারুলের মাঝে তৈরি হয়ে গেল। বিবি কি এটাই চেয়েছে?

একটা অ্যালুমিনিয়ামের ছোটো গামলায় পেঁয়াজ, লংকা আর তেলমাখা মুড়ি তুলে ছেলের দিকে এগিয়ে দিয়ে পারুল চাপা স্বরে বলল, ‘দিয়ায়।’

মন্তা উঠে দাঁড়াবার আগেই সে গামলাটা তুলে নিল। ছোটো ছোটো লালচে মুড়ি। সঙ্গে আস্ত পেঁয়াজ, কাঁচালংকা। সে নাকের কাছে গামলাটা তুলে গন্ধ শুঁকল। আপনা থেকেই সে ‘আহহ’ বলে উঠল। একগাল মুড়ি মুখে দিয়ে পেঁয়াজ কামড়াল, দাঁতে লংকা কাটল। মা আর ছেলে তার দিকে তাকিয়ে।

‘লংকাটায় বেশ ঝাল, বাড়ির গাছের নাকি?’ জিজ্ঞাসাটা মন্তাকে উদ্দেশ করে, জবাব দিল পারুল, ‘হ্যাঁ,…মন্তা পড়া আছে না? বই নিয়ে বসবি কখন?’ কথাটা বলে পারুল ভাতের হাঁড়িতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সে পায়ে পায়ে সরে গেল অপ্রতিভ হয়ে। মুড়ি দোতলায় ঘরে বসে খাওয়া যায় কিংবা উঠোনে পায়চারি করতে করতে। সে অন্ধকার রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। একটু দূরে শরৎ বসাকের বাড়ি। ঠিক কোন বরাবর তাকালে বাড়ির আলো চোখে পড়বে বুঝতে পারছে না। সে আর একটু এগোল।

‘জেঠু, অন্ধকারে যাবেন না।’ মন্তার চিৎকার তার কানে এল। ‘মা বলছে সাপখোপ আছে।’

সে এগোল না। সাপের কামড়ে মরা মানে অপঘাতে মরা। শ্রীগোপালের সঙ্গে তা হলে সেও ভূত হয়ে এখানে রয়ে যাবে। ভূত ভূতকে দায়ের কোপ বসায় না, একসঙ্গে তাকায় তাদের কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়। …সেদিনও কথা ছিল না যে সে পারুলকে জড়িয়ে ধরবে, চুমু খাবে, তাকে বিছানায় শুইয়ে দেবে…কথা ছিল না শ্রীগোপালের দশ হাজার টাকার মাল পুলিশে ধরবে, সেই মাল দু—হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে তার মাথায় রক্ত চড়ে যাবে, সারা দিন অভুক্ত থাকবে। তবু ঘটে গেল!

মন্তা আসছে। ওকে চলতে দেখলে কষ্ট হয়। ওর জন্য পারুলের নিশ্চয় দুর্ভাবনা রয়েছে। বিবিরও কি নেই গোরাকে নিয়ে!

‘আপনি ফিরে আসুন জেঠু, অন্ধকারে যাবেন না আর।’

‘না, যাব না। আচ্ছা মন্তা, শরৎ বসাকের বাড়িটা ঠিক কোন জায়গায় বলো তো? অন্ধকারে ঠাওর হচ্ছে না।’

‘ওই তো, ওই দিকটায়’ মন্তা হাত তুলে দেখাল। ‘বসাকদের বাড়ির সবাই তো মরে গেছে!’

‘সবাই মরে গেছে, মানে!’

‘একদিন রাত্তিরে ছেলেমেয়ে বউয়ের গায়ে তোশক জড়িয়ে কেরোসিন ঢেলে লোকটা আগুন ধরিয়ে দিয়ে, নিজেও গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেশলাই জ্বেলে দেয়…কেউ বাঁচেনি।’

‘কেন? সবাইকে মেরে নিজে মরল! কারণ কী?’ খবরটা তাকে অসাড় করে দিচ্ছে। এই একজনের সঙ্গেই এখানে তার পরিচয় হয়েছিল। দুটো না তিনটে ছোটো ছেলেমেয়েকে তখন সে দেখেছে। বাবা জ্যান্ত তাদের পুড়িয়ে মেরে দিল, এ কি বিশ্বাস করা যায়!

‘আমি জানি না। পুলিশ এল, কত লোককে জিজ্ঞাসা করল।’

‘বাড়িতে কে আছে এখন?’

‘তালা দেওয়া, ওদিকে কেউ যায় না। …এবার চলুন। কথা না শুনলে মা রেগে যায়।’

‘তোমার মা খুব রাগী?’

‘ভীষণ।’

শরৎ বসাকের খবর শুনে তার মনে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। আত্মহত্যা তাকে বিমর্ষ করে দেয়, আর এটা তো নিরীহ কয়েকজনকে হত্যা করে! সে এখন কোনো কিছুতেই আর আগ্রহ বোধ করছে না। প্রায় অর্ধেক মুড়ি শেষ হয়েছে, বাকিটুকু খেতে তার ইচ্ছা করল না। ফিরে আসার সময় সে অন্ধকারে মুড়িগুলো রাস্তার পাশে ফেলে দিল মন্তার নজর এড়িয়ে।

খালি গামলাটা দাওয়ার উপর রাখার সময় সে জিজ্ঞাসা করল মন্তাকে, ‘ভাত নিতে কখন আসব?’

‘রান্না আমার প্রায় হয়ে গেছে…আমরা তাড়াতাড়ি শুই।’ পারুল উত্তর দেয়।

.

স্টেশনারি দোকানে বড়ো বড়ো কোম্পানির প্যাকেটের চা পাওয়া যাবে, কিন্তু এইসব চা তার ভালো লাগে না। খুচরো লুজ চা বিক্রি হয় এমন দোকান সে খুঁজতে শুরু করল। গন্ধ আর লিকার এই দুটোর জন্য দু—রকম চা এক—একজন দোকানদার এত ভালো মেশাতে পারে! বাবা নিজে গিয়ে মজুমদারমশায়ের দোকান থেকে মেশানো চা কিনে আনত দু পাউন্ড করে, মাসে দু—বার। বাবা মোটরেই বসে থাকত, গলায় কণ্ঠি, ফতুয়া পরা মজুমদারমশাই চায়ের ঠোঙাটা গাড়িতে দিয়ে যেত নিজে, নমস্কার করত। বাবা বলত, ‘লোকটা অদ্ভুত ব্লেন্ড করে, একসময় চা—বাগানে কাজ করত।’

কাঠের ফার্নিচারের দোকানের বাইরে টুলে বসা লোকটাকে দেখে তার মালিক বলেই মনে হল। সে এগিয়ে গেল। ‘এখানে চা—পাতার দোকান আছে?’

‘চা—পাতার?…ওই সামনে যে সারের দোকানটা দেখছেন, ওর পিছনেই পাবেন।’

‘ধন্যবাদ।’

রাস্তা পার হয়ে হার্ডওয়্যার দোকান, তার পাশে সারের দোকান, একটা সরু গলি, ঢুকে প্রথম দোকানটাই ‘চা ঘর’। পাঁচ—ছ’টা লালরঙের টিন তাতে সাদা বড়ো অক্ষরে প্রত্যেকটায় ‘চা’ লেখা। দোকানি একজন খদ্দেরের জন্য চা ওজন করছে। সে দাঁড়িয়ে থাকল। পাশের ‘বিভূতি ফার্টিলাইজারস’ সাইনবোর্ডের দোকানের সামনে সাইকেল হাতে ধুতি আর হাতা গোটানো সাদা শার্ট পরা এক বছর—চল্লিশের লোক রাস্তা থেকে চেঁচিয়ে কথা বলছে। তার কান ওই দিকেই গেল।

‘কি বলছেন আপনি! বোরো আই আর ছত্রিশ এখন অবসোলিট হয়ে যাচ্ছে। এখন সুপারফাস্ট ধান পি এন আর এসে গেছে। আমি তো এবার পাঁচ বিঘেতে পি এন আর তিনশো একাশি লাগিয়েছি।’ দোকানের ভিতর থেকে একজন কী যেন বলল। হাতে সাইকেল ধরা লোকটি প্যাডেলে একটা পা রেখে হেসে বলল, ‘তিন মাসে বিঘেতে তেইশ মণ ফলনও পেয়েছে, আমি কুড়ি মণ পাব আশা করছি। …দেখাই যাক না।’

‘আপনাকে কী দোব?’ চশমাপরা, গোলগাল, নম্রভাষী চা—দোকানি জিজ্ঞাসা করছে।

‘দার্জিলিং বড়ো পাতা, হবে?’

‘বড়ো পাতা নেই, ফ্যানিংস আছে, নব্বুই টাকা কেজি।’

‘হাফ কেজি দিন।’ সে একটু অবাক হল, রথতলায় এখন নব্বুই টাকার চা পাওয়া যায় শুনে।

‘না দাদা, ঢ্যাঁড়শ, বেগুন নয়, এবার খালধারের জমিতে কপি লাগাব, …ইস্কুল করব, চাষও দেখব অত সময় কোথা! চলি বটুকদা।’ সাইকেল হাতে ধরে লোকটি হেঁটে চলে গেল।

‘এই যে আপনার চা।’

চায়ের ঠোঙায় প্যাকেটটা ঝুলিতে ফেলে সে সাইকেলওয়ালার খোঁজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এধার ওধার তাকাল। লোকটাকে তার দরকার। বোধহয় স্কুলমাস্টার, নিজে চাষ করায়, খোঁজখবর রাখে, এক্সপেরিমেন্ট করার সাহস আছে। লোকটিকে না পেয়ে সে স্টেশনারি দোকানে ঢুকল। দু প্যাকেট বিস্কিট, এক শিশি জ্যাম, একটা লুডোর পর একঠোঙা টফি কিনল। দরমার চালায় সারসার হাফপ্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি, ব্লাউজ, সায়ার দোকান। একটা ছাপছোপ মারা গোল—গলা গেঞ্জি ঝুলছে দেখে তার মন্তার কথা মনে পড়ল। ওর থেকে বছর দেড়েকের বড়ো গোরা। এই গেঞ্জিটা পরতে গেলে গোরার মাথাটাও গলবে না, মন্তার গায়ে ফিট করে যাবে। ছেলেটার শরীর বাড়েনি, বোধহয় অপুষ্টির জন্য। কিন্তু পারুল এমন দশাসই হয়ে গেল কী করে! সে গেঞ্জিটার সঙ্গে একটা হাফপ্যান্টও কিনল।

লোকটাকে সে দেখতে পেল সাইকেল নিয়ে ফলওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে। অনেকগুলো মুসম্বি লেবু থলিতে ভরে সেটা সাইকেলের হাতলে ঝোলাচ্ছে।

‘যদি কিছু না মনে করেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?’

দাড়িওয়ালা, কটা চোখের, দীর্ঘদেহী, অপরিচিত একজনের এহেন হঠাৎ প্রশ্নে লোকটি অবাক। ‘বলুন!’

‘একটু আগে বিভূতি ফাটিলাইজারসে আপনার কথা কানে আসছিল।’

‘আপনি তো চা কিনছিলেন।’

‘আমার নিজের খুব চাষের ইচ্ছে, অল্প কিছু জমি আছে কিন্তু চাষবাস সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। আপনার কথা শুনে মনে হল, আপনি অনেক জানেন, নিজে চাষ করান।’

‘হ্যাঁ, বিঘে পনেরো আছে।’

‘আপনি আমায় সাহায্য করবেন পরামর্শ দিয়ে?’

সে নিজেই বুঝতে পারল তার চোখে, গলার স্বরে আবেদনের মতো কিছু একটা ফুটে উঠেছে। লোকটির মুখ ভারিক্কি হয়ে উঠল। ‘আপনি থাকেন কোথায়?’

‘গোকুলানন্দে।’ বলেই সে সিঁটিয়ে উঠল। এবার অনিবার্য প্রশ্নটা হবে, ‘আপনার নাম?’

‘আপনার নাম, কোন বাড়ি?’

‘দত্তদের বাড়ি, কলকাতায় থাকি।’

লোকটির ভ্রূ কুঁচকে উঠল, ‘পারুল নামে একজন মেয়েছেলে যে বাড়িতে থাকে?…খুন হয়েছিল যে বাড়িতে?’

‘হ্যাঁ। …আমার নাম রাঘবেন্দ্র দত্ত।’

লোকটি মনে করার চেষ্টা করছে। ওর মুখ দেখেই বোঝা যায়, নামটা স্মৃতিকে ঘিরে ওর মাথার মধ্যে ঘুরছে, ভিতরে ঢোকার জন্য একটা ছিদ্র খুঁজছে। নিশ্চয় তাকে আগে কখনো দেখেনি, নামটা হয়তো শুনে থাকবে। রাঘবেন্দ্র লোকটা কে নিশ্চয় পরে জানতে পারবে।

‘আমিই সেই খুনিটা…গোকুলানন্দে থাকব বলে এসেছি।’

লোকটির ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল। তবে দু চোখে ভূত দেখার মতো কিছু না ঘটলেও যথেষ্ট অবাক হয়েছে। এভাবে, ‘আমিই সেই খুনিটা’, পৃথিবীতে ক—টা লোকের শোনার ভাগ্য হয়েছে? ‘আপনিই!’

লোকটি নিজেকে সামলে নিয়েছে। এখন কৌতূহলী হবে। ‘এবার আপনি আমার সম্পর্কে খুব একটা হীন ধারণা করবেন তো?’

‘না, তা করব না। আপনি রিহ্যাবিলেটেড হতে চান, আপনি ক্রিমিন্যাল নন। নিশ্চয় আপনাকে সাহায্য করব।’ লোকটি হাসল। সেই হাসিতে তার বুকের মধ্যে সোঁসোঁ বাতাস বইতে শুরু করল, মেঘ জমে উঠল, বুকের মধ্যে টপটপ বৃষ্টি ঝরে পড়ল, বুকের পাষাণ ভারটা গলে যেতে লাগল।

‘আমি থাকি রাইহাটায়, এই রথতলা মাধ্যমিক স্কুলে ইতিহাস পড়াই… আমার নাম শক্তিপদ হালদার। …আপনার তো এখন বিঘে তিরিশেক ধানজমি রয়েছে।’

‘জানলেন কী করে!’

‘আপনার স্ত্রী যখন জমি বিক্রি করলেন তখন আমি পাঁচ বিঘে কিনেছিলুম। …আপনি যদি লোক দিয়ে নিজে চাষ করান আর হাইব্রিড বীজ, পেস্টিসাইড, রাসায়নিক সারে টাকা খরচ করেন, তাহলে অনেক বেশি রিটার্ন পাবেন। …বাড়ির দিকে যাবেন তো? আমিও যাব। …আপনার ওই পারুল তো চাষিকে লিজ দিয়ে চাষ করায়। অশিক্ষিত চাষি, জমিতে তেমন টাকাও ঢালতে পারে না, ফলনও বেশি হয় না।’ শক্তিপদ কথা বলতে বলতে হাঁটছে, সাইকেলের এধারে সে।

হঠাৎই নিজের মধ্যে এখন একটা প্রবল জোর সে অনুভব করতে শুরু করেছে। কী একটা দপদপ করছে তার শিরা—উপশিরায়। মাথাটা হালকা লাগছে, হাত—পায়ের খিল খুলে যাচ্ছে। অনেক কিছু করা যায়, সে করতে পারে। …’তুই কেন বসা কাজ করবি… স্বাস্থ্য আছে, খাটবার ক্ষমতা আছে’, নিশ্চয়ই আছে। …’সাহস করে এগোলে সবই করা যায়।’ যায়। কিন্তু ভুল জায়গায় সাহস করে এগিয়ে ছিলাম পারুল!

‘আপনি যেকোনো ছুটির দিন আমার বাড়িতে আসুন, কথা হবে। আজ একটু তাড়া আছে। শক্তি মাস্টারের বাড়ি বললে রাইহাটায় যে—কেউই দেখিয়ে দেবে। …আমি চলি।’

শক্তি মাস্টার সাইকেলে উঠে পড়ল। খানিকটা এগিয়ে গেছে তখন সে অস্ফুটে বলল, ‘আসুন, আমি যাব।’

বাড়ি ফিরে দেখল উঠোনে রোগা এক তরুণী। গায়ের রঙ কালো, ময়লা নীল ছেঁড়া শাড়ির ফাঁক দিয়ে সায়া দেখা যাচ্ছে, চোয়ালের হাড় প্রকট। মুখটি মিষ্টি। হাঁসগুলোকে তাড়িয়ে ওদের ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কাঁঠাল গাছের নীচে গোরুটা খোঁটায় বাঁধা।

‘তুমিই বুলি, তাই না?’

মেয়েটি লাজুক হাসল। হাসিটা ঝকঝকে দেখাল সাজানো সাদা দাঁতের জন্য। বুলির দুটো বাচ্চচা, স্বামী পরিত্যক্তা, দুটো বাড়িতে কাজ করে, বয়স তেইশ—চব্বিশ…. ওর ভবিষ্যৎ কী? যদি ও দোতলার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ‘মামি’ না বলত তাহলে? তাহলে পারুল আর একটা ‘শখ’ না মেটার অতৃপ্তিতে সেদিন তিক্ত কটু আচরণ করত না সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত, নেশায় চুরচুর শ্রীগোপালের সঙ্গে।

ঘর থেকে মন্তা বেরিয়ে এসেছে দাওয়ায়। সে ঝুলি থেকে লুডো, গেঞ্জি ও প্যান্টের প্যাকেট আর টফির ঠোঙাটা বার করল। ‘এগুলো তোমার।’ জিনিসগুলো সে বাড়িয়ে ধরল। মন্তা প্রথমেই নিল লুডোর বোর্ডটা। ছকের ঘরগুলো তাকে এত খুশি করেছে যে কথা বলতে পারছে না। সে লক্ষ করল বুলি তাকিয়ে রয়েছে। ঝুলি থেকে বিস্কুটের একটা প্যাকেট বার করে সে এগিয়ে গেল। ‘তোমার।’ বুলি দ্বিধা না দেখিয়ে হাত বাড়িয়ে নিল।

‘মন্তা, তোমার গেঞ্জি আর প্যান্টটা পরে দ্যাখোতো ফিট করে কিনা, না হলে দোকানি বলেছে বদলে দেবে। …তোমার মা কোথায়?’ চায়ের প্যাকেট হাতে নিয়ে সে ঘরের দিকে তাকাল। রথতলায় যাবার সময় সে দেখে গেছে পারুল ঘরে ছিল।

‘মা ঝোড়ো মণ্ডলের বাড়ি গেছে, খড় নিয়েছিল এখনও টাকা দেয়নি। এখুনি আসবে।’

‘চায়ের প্যাকেটটা রেখে দাও, মাকে দিয়ো। যাও এগুলো পরে এসো।’

মন্তা ঘরের মধ্যে চলে গেল। সে দাওয়ায় বসল। বুলি হাঁসগুলোকে বাঁশের বেড়ার দু—হাত উঁচু খুপরিতে ঢুকিয়ে একহাত চওড়া খোপের মুখটা পাটা দিয়ে বন্ধ করে ভারী একটা গাছের ডালের টুকরো টেনে আনল।

‘এখন ক—টা ডিম দিচ্ছে?’ প্রশ্ন করল বুলিকে।

ঘরের ভিতর থেকে মন্তা চেঁচিয়ে বলল, ‘আজ দিয়েছে তিনটে। কাল দুটো দিয়েছিল।’ মন্তা ঘর থেকে বেরিয়ে এল, কোমরে মুঠো করে প্যান্টটা ধরা। গেঞ্জিটা বুক—কাঁধ ঠিকই হয়েছে, শুধু ঝুলটা একটু বেশি।

‘বাহ, চমৎকার দেখাচ্ছে… কাল পরে স্কুলে যেয়ো। প্যান্টের কোমরটা বড়ো হয়েছে, না?’

‘দড়ি দিয়ে বেঁধে নিলে ঠিক হয়ে যাবে।’ পঙ্গু পায়ের দিকে মন্তা হেলে রয়েছে। মুখ নীচু করে কাঁধ—বুক বারবার দেখছে।

‘টফিগুলো একবারেই যেন শেষ কোর না। ঠোঙাটা আনো, বুলিকে একটা দিই।’

মন্তা ঠোঙা আনল। সে একটা টফি হাতে নিতেই মন্তা বলল, ‘জেঠু, এগুলোকে টফি বলে?’

‘হ্যাঁ… বুলি এদিকে এসো।’ দুটো টফি তুলে নিয়ে ঠোঙাটা সে মন্তাকে ফিরিয়ে দিল।

‘আপনি খাবেন না?’

‘না, বড়োরা খায় না…বুলি এ দুটো তোমার ছেলেদের।’

সে উঠে দাঁড়াল। বুলিকে দেখে তার মনে হল কিছু যেন বলতে চায়। ‘আর একটা টফি চাই?’

বুলি লজ্জা পেল। ‘না, …একটা কথা বলব?’

‘বলো।’

‘কলকাতায় তো আপনার অনেক চেনাজানা আছে, কারও বাড়িতে একটা কাজ ঠিক করে দিতে পারেন?

তার মনে পড়ল দিলীপদার মা—র কথাটা, ‘বাবা দেখবে তো? ছেলেটা দিনদিন কীরকম মনমরা হয়ে যাচ্ছে।’ বুড়ির নাতির জন্য কাজ কোনোদিনই সে খুঁজে দেখার সুযোগ আর পাবে না, বুলির জন্যও নয়। কিন্তু সেকথা বললে এই আধপেটা থাকা দুই বাচ্চচার মা বিশ্বাস করবে কি? বুলি তাকে হৃদয়বান মনে করেছে বিস্কিট আর টফি পেয়ে। তার মুখের দিকে বুলির তাকিয়ে থাকাটায় সে অস্বস্তি পেতে শুরু করল।

‘কলকাতায় তো ছেলে সমেত কাউকে কাজে রাখবে না।’

‘ওদের এখানে দাদার বাড়িতে রেখে যাব, মাসে মাসে টাকা পাঠাব।’

‘আচ্ছা, খোঁজ পেলে বলব। …মন্তা, মা এলে নতুন পাতা দিয়ে এক গেলাস চা করে দিতে বোলো।’ এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। এবার থেকে বুলিকে এড়িয়ে চলতে হবে। সে বাড়ির দিকে পা বাড়াল।

‘জেঠু, আপনি আমার সঙ্গে খেলবেন?’

‘মা—র সঙ্গে খেলো।’ সে পিছনে না তাকিয়েই বলল। দোতলায় এসে জানালাটা খুলে দেখতে পেল, লুডো পেতে মন্তা একাই খেলছে। সে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।

আধঘণ্টা পরে সে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেয়ে উঠে বসল। কে হতে পারে? কিছুক্ষণ আগে সে পারুলের গলা শুনেছে। চা করে কাউকে দিয়ে পাঠিয়েছে!

‘কে?’

‘আমি মন্তা।’ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, ঘরে ঢোকেনি।

‘কি ব্যাপার, ঘরে এসো।’

মন্তার খালি গা, পরনে পুরোনো প্যান্টটা। হাতে লুডো, গেঞ্জির প্যাকেট আর টফির ঠোঙা। সে শুধু তাকিয়ে রইল।

‘মা বলল এগুলো ফিরিয়ে দিতে।’ মৃদু স্বরে মন্তা বলল। চোখ দুটো নামানো।

‘কেন?’

‘জানি না। …নিয়েছি বলে মা মারল।’

একটা আগুন দপ করে জ্বলে উঠল তার মাথার মধ্যে। প্রায় লাফিয়েই বিছানা থেকে নামল, চমকে ওঠা মন্তা তাড়াতাড়ি সরে যেতে গিয়ে টলে পড়ল। সে ভ্রুক্ষেপ না করে সিঁড়ি দিয়ে দুড়দাড় করে নেমে গেল। তার মাথার মধ্যে এখন উত্তপ্ত ধোঁয়া, তার যাবতীয় বোধ পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। …অপমান! একটা বাচ্চচা ছেলেকে দেওয়া তার স্নেহ পারুল পায়ে চটকে দিল… কেন, কেন?

উনুনে একটা বাটিতে গরম জল ফুটছে। পারুল উবু হয়ে বসে। কাচের গ্লাসে দুধ—চিনি, ঠোঙাটা থেকে একটা টিনের কৌটোয় চা ঢেলে রাখছে। বুলিকে সে দেখতে পেল না।

‘আমি মন্তাকে দিয়েছি। তোমার এত সাহস যে ওগুলো ফেরত পাঠিয়েছ?

পারুল অচঞ্চল, মুখে বিরক্তি। ‘কোনো কিছু আমার ছেলেকে দেবেন না।’

‘দিলে কী হয়েছে?’ সে চিৎকার করল।

‘অত কৈফিয়ত আমি দিতে পারব না। আমার ছেলেকে আমি নিতে দোব না।’ পারুলের স্বরে পালটা উত্তেজনা নেই। সাঁড়াশি দিয়ে বাটিটা নামিয়ে এক চামচ চা গরম জলে দিয়ে একটা রেকাবি ঢাকা দিল। ধীরে ধীরে কাজগুলো করল।

এগুলো ওর স্পর্ধা দেখানো! উপেক্ষা করা!

‘তুমি জান আমি কে?’

পারুল মুখ তুলে তাকাল, চোখে বিস্ময়।

‘এই সব কিছুর মালিক আমি…সব কিছুর, জমিজায়গা, বাড়ি সব কিছুর।’

‘আমারও?’

‘হ্যাঁ তোমারও। যতদিন আমার জায়গায় থাকবে ততদিন। …তুমি আমার আশ্রিত, তোমাকে দয়া করে, এখানে থাকতে দেওয়া হয়েছে। আমাকে অপমান করার কোনো অধিকার তোমার নেই।’

‘যান যান।’ পারুল উঠে দাঁড়াল তার দশাসই দেহ নিয়ে। কচুবাগান বস্তির স্বর তার গলায়। ‘অধিকার দেখাচ্ছেন, অধিকার! কে আমার অধিকারীমশাই এলো রে অধিকার ফলাতে! এখানে আমায় রেখেছে বউদিমণি। আজ বিশ বছর এখানে বাস কচ্ছি। বউদিমণির দয়ায় তো আপনি এখানে থাকতে এসেছেন। বাড়িতে তো জায়গা জোটেনি, সব খবর আমি রাখি, আমাকে আবার দয়া দেখাচ্ছে! ফুটুনি অন্য জায়গায় মারবেন। সারা রসপুর মৌজার লোক পারুল বিশ্বাসকে চেনে খুন—হওয়ার বউ বলে। উনি এয়েচেন কিনা আমার মালিক হতে!’

একটানা কর্কশ স্বরে পারুল কথাগুলো বলে ঝপ করে বসে পড়ল। তার বড়ো বড়ো চোখ থেকে আগুন ঝরছে, বুক ওঠানামা করছে। বাটি থেকে গ্লাসে চায়ের লিকার ঢালতে লাগল। সে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে পারুলের মুখের দিকে। হাত—পা কাঁপছে, ক্রোধে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে সে। চোখের সামনে যা কিছু ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে শুরু হয়েছে। দুটো রগ দপদপ করছে। …শ্রীগোপালেরও এমন হয়েছিল।

.

‘রোঘো, আজ থানার লোকগুলো এত অপমান করল যে মাথা খারাপ হয়ে গেছে, অথচ মাসে মাসে ওরা আমার কাছ থেকে টাকা খায়। …বরুণ এই তল্লাটের উঠতি নেতা, পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা চেয়েছিল, দিইনি। এখন পুলিশ দিয়ে শোধ নিচ্ছে, আমার ব্যাবসা লাটে তোলাতে চায়। আমি যখন রাজনীতি করি বরুণ তখন হাফপ্যান্ট পরে, থানা এখন ওর কথায় ওঠে বসে।’ কথাগুলো বলে শ্রীগোপাল দেয়ালে ঠেস দিয়ে গুম হয়ে বসে ছিল। দোতলার ঘরের বিছানায়। কোলে দু—হাতে ধরা প্রায় পূর্ণ মদের বোতলটা।

পারুল নেমে গেছে নীচে, তার সঙ্গে বুলি। ঘর ছিল অন্ধকার। তারা সারা শরীরে লেগে ছিল পারুলের স্পর্শ। একতলা থেকে ‘পারুল, পারুল’ চিৎকার করতে করতে শ্রীগোপাল যখন উঠে আসছিল, তখন একটা ভয় তার কলজেটা চেপে ধরে। শ্রীগোপাল কি কোনো সন্দেহ করবে?সে কাঁটা হয়ে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল।

‘হারিকেনটা জ্বালিসনি কেন?’

‘এই জ্বালছি।’

সে টর্চ জ্বালল, তারপর হরিকেন। শ্রীগোপালের চোখ পড়ল বোতলে। ‘খুলেছিস?’ ‘সবে একটু খেয়েছি।’ শ্রীগোপাল ছিনিয়ে নেবার মতো করে বোতলটা তুলে নিয়ে খাটে বসল। গ্লাসটা সে এগিয়ে দেয়। ‘রাখ, লাগবে না।’ সারাদিন খাসনি, একটু কিছু পেটে দে।’ কথাটা বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিল, ঠিকমত বললে পালিয়ে গেছিল। শ্রীগোপালকে তার করুণার পাত্র মনে হচ্ছিল। বোকাটা জানে না, একটু আগেই এই ঘরে বউ ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সে চাপা গলায় ডেকেছিল ‘পারুল, পারুল।’ দাওয়ায় ছেলে কোলে বসেছিল বুড়ি, তার পাশে বুলি। ঘর থেকে বেরিয়ে এল পারুল। সিল্কের শাড়িটা বদলে আটপৌরে শাড়ি পরে নিয়েছে। কপালে টিপটা নেই। হাতের আঙুল খালি। চোখে চাপা উৎকণ্ঠা। পারুলও ভয় পেয়ে গেছে।

‘কিছু খেতে দাও ওকে, আছে কিছু?’ আপনা থেকেই তার স্বর ফিসফিসে হয়ে যায়।

‘ডালবাটা আছে, বড়া করে দোব লংকা দিয়ে?’ পারুলও গলা নামিয়ে বলেছিল।

তারা পরস্পরের চোখের দিকে চোখ রেখে নিথর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। দুজনেই কী কথা তখন বলতে চেয়েছিল? তখনই কি বিদ্বেষ আর ঘৃণা জন্ম নিচ্ছিল? দুজনে প্রায় একই সঙ্গে দোতলায় পুবের জানালার দিকে হঠাৎই তাকায়। তার মনে হয়েছিল, একটা মানুষের ছায়া যেন জানালায় দাঁড়িয়ে। পারুলেরও কি তাই মনে হয়েছিল?

‘ধরুন’।

চায়ের গরম গ্লাস রেকাবির উপর রেখে পারুল তার সামনে দাঁড়িয়ে। মাথায় ঘোমটা, মুখ স্বাভাবিক। একটু আগে যে বিশ্রী ভঙ্গিতে কর্কশস্বরে চিৎকার করেছিল, তার কোনো চিহ্ন ওর স্থূল দেহে লেগে নেই।

তার মাথার মধ্যে যে আগুন জ্বলে উঠেছিল সেটা নিবে এসেছে। শুধু ধিকিধিকি করছে একটা কথা, ‘বউদিমণির দয়ায় তো আপনি এখানে থাকতে এসেছেন।’ কথাটা সত্যি। রেকাবিটা হাতে নিয়ে সে যাওয়ার জন্য ঘুরতেই চোখ চলে গেল দোতলার জানালায়। মন্তার ভীত মুখ ভাঙা গরাদের ফাঁকে। সে পিছনে তাকিয়ে দেখল, পারুলের চোখও জানালার দিকে।

‘দোতলায় উঠে এসে সে মন্তাকে বলল, ‘ওগুলো রেখে যাও।’

‘আপনি রাগ করেচেন?’

‘না।’

নয়

সেই রাতে একটা ভয়ঙ্কর কিন্তু সত্যি স্বপ্ন সে ঘুমের মধ্যে দেখল।

দোতলার ঘরে তারা তিনজন। একটা থালায় কয়েকটা ডালের বড়া। শ্রীগোপাল চোখের পাতা খুলে রাখার চেষ্টা করছে। সে আর পারুল একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে শ্রীগোপালের মুখের দিকে।

‘বড়ো অন্ধকার লাগছে রে রোঘো, হারিকেনটা জ্বালা।’

সে হাত বাডিয়ে পলতেটা উসকে দিল।

‘রোঘো, আমি তোকে অনেক ঠকিয়েছি। …তুই কি জানিস আমবাগান জাম দিয়ে,পুকুর জমা দিয়ে যে টাকা পেয়েছি তার সবটা তোকে দিইনি। বাঁশ বিক্রির সব টাকা দিইনি… তুই কি তা জানিস?’

‘জানি।’ সে পারুলের দিকে তাকাল। পাথরের মতো ওর চোখ। চোখের পিছনে কী ঘটে চলেছে তা বোঝা যাচ্ছে না। হারিকেনের শিখা লালচে হয়ে এসেছে, বোধহয় তেল কমে গেছে। শ্রীগোপাল ঝুঁকে পড়ছে ক্রমশ।

‘জানিস? তা হলে চোর বলে এতদিন আমাকে ধরিসনি কেন? … আমি জানি কেন ধরিসনি। তুই জানিস আমি করাপ্ট হয়েছি তোর জন্য, তোর জমি রক্ষার জন্য ওদের ভুল বুঝিয়েছি, বিট্রে করেছি। আমার সঙ্গে তুইও নষ্ট হয়ে গেলি। তোর নষ্ট বিবেকের সুযোগটা আমি নিয়েছি। … আমি আজ তোর এখানে শোব, শুতে দিবি?’

‘হ্যাঁ।’

‘পারুল সম্পর্কে আমার কে হয় জানিস? ওর সঙ্গে শুয়ে আমি পাপ করেছি। সেই পাপের ফল আজ আমি পেয়েছি। আমার দশ হাজার টাকার মাল সিজ করে নিল।’

পারুলের ভ্রূ কুঁচকে রয়েছে। শ্রীগোপাল কী বলবে সেটা যেন ও জানে। মুখ নীচু করে দুটো আঙুলে চেখের পাতা টিপে ধরল।

‘বাবার ফোটো আমার কাছে আছে। পারুল আর আমার ফোটোও আছে। পাশাপাশি তিনটে ছবি রেখে আমি দেখেছি… এক মুখ…তুই হাসছিস, পাগল ভাবছিস? … পারুলের মা জানত পারুলের বাপ কে, কিন্তু কিছু বলেনি, আমার সঙ্গে পারুলের বিয়েতে আপত্তি করল না। … বিয়ের খবর শুনে দুলালদা আমাকে বলেছিল, ‘পারুলের বাপ তোর বাবা,বোনকে বিয়ে করলি?’ রেঘো, তখন ছেলেটা ওর পেটে এসে গেছে, আমার আর কিছু করার ছিল না।’

‘কী করে যে মাথায় এই সব ঢুকল।’ ফিসফিস করল পারুল।

‘কে আবার ঢোকাবে…ভগবান ঢুকিয়ে দিয়েছে। … জীবনের বড়ো ভুল কী করেছি জানিস?’ শ্রীগোপাল সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করতে করতে তাকাল তার দিকে। ‘ছেলের জম্মো দিয়ে। … ওর ঠাকুদ্দা আর দাদামশাই একই লোক, একথা একদিন তো জানবে, তখন কী বলবে আমায়? … রেঘো আমার ভয় করে।’

‘কি আজেবাজে বকছিস। শুয়ে পড় তুই।’ সে ছোট্ট ধমক দিল। ‘পারুল তুমি ঘরে চলে যাও।’

‘না না, থাকুক আমার সামনে। … পারুল আজ তোর মোটরবাইকে চেপেছে, তোর কোমর জড়িয়ে পিঠে বুক ঠেকিয়েছে, পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়েছে … সবই কানে এসেছে। কিরে রোঘো, কেমন লাগছিল বল তো?’

ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল তার মুখ। শ্রীগোপাল মুখ তুলে ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে। মুখে হালকা হাসি। পারুলের চোখে কোনো ভাব নেই। কথাগুলোর প্রতিবাদ করা যায় না। সে বাইকে ওঠার জন্য কয়েকবার পারুলকে বলার পর উঠেছিল। না উঠলেই পারত। শখ ছিল মিটিয়ে নিল, এটা কি একটা কারণ? শখেরও বেশি আরও কিছু ছিল।

‘বাইকে চেপেছি তো কী হয়েছে?’ পারুল মৃদু একটা রোখা স্বরে বলল।

‘কী হয়েছে!’ শ্রীগোপাল সটান সোজা হয়ে বসল। তার চোখের চাউনি বদলে গেল। নেশাগ্রস্তের চিহ্নমাত্র নেই, তার বদলে ধূর্তামি ঝিলিক দিল।

‘হয়েছে কী তাতে? আমার পিছনে বসলে কি কোমর জড়িয়ে ধরলেই পারুল খারাপ হয়ে গেল? … তোর মাথার এখন ঠিক নেই, শুবি তো শুয়ে পড়।’ সে একটা বড়া তুলে মুখে দিল তার নার্ভাস হওয়া গোপন করতে। কত স্বাভাবিক রয়েছে সেটা প্রকাশ করার জন্য সে অলস নিশ্চিন্তভরে চিবোতে লাগল।

‘কিছু হয়নি? … তোর মনের মধ্যে নোংরা ঢোকেনি? ও তোর মনে খারাপ চিন্তা এনে দেয়নি? … এই মেয়েছেলেটা জানত ওর বাপ কে, জেনেশুনেই আমাকে ট্র্যাপে ফেলেছিল। বিয়ের আগে এই ঘরেই ও আমার সঙ্গে রাত কাটিয়ে গেছে, তুই কি তা জানিস? ওর মা পাঠিয়ে দিয়েছিল, নইলে ওই খ্যাংরাকাঠির মতো মেয়েকে কে বিয়ে করত … আমাকে বলল, পেটে বাচ্চচা এসেছে, এখুনি বিয়ে করো… ‘

বড়ার থালাটা উড়ে এসে শ্রীগোপালের মুখে পড়ল। পারুল উঠে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে স্ফুলিঙ্গ, প্রচণ্ড রাগ দেহটাকে ফুলিয়ে দিয়েছে। থরথর কাঁপছে যেন কিছুর ভর হয়েছে। অস্ফুটে ‘তবে রে’ বলেই টেবিল থেকে চার ব্যাটারির টর্চটা তুলে শ্রীগোপালের দিকে ঝুঁকল। থালাটা মুখে জোরে আঘাত করেনি। শ্রীগোপাল আচমকা আক্রমণে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে ছিল কয়েকটা সেকেন্ড। টর্চটা তার মাথায় নেমে আসার আগেই সে হাতটা তোলে। হাতের উপর পড়ল টর্চের ভারী দিকটা। সে খপ করে পারুলের চুল মুঠিতে ধরে টান দিয়ে মাথাটা বিছানায় চেপে ধরল।

এত দ্রুত ব্যাপারটা ঘটে যায় যে সে কিছু করে উঠতে পারেনি। সম্বিৎ ফিরতেই চুল থেকে মুঠোটা ছাড়িয়ে নিতে সে শ্রীগোপালের হাত ধরে টানল। শক্ত করে ধরা মুঠো ছাড়াতে পারল না। পারুলের মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত, চোখ বন্ধ,ঠোঁট ফাঁক হয়ে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। শ্রীগোপালের চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে, ফুলে উঠেছে গলার শিরা, সারা মুখ ভয়ঙ্কর কোন ইচ্ছায় দুমড়ে যাচ্ছে, চোখের কোণে লাল ছোপ। সে দেখল শ্রীগোপালের চেহারা নেওয়া একটা হিংস্র পশুকে।

‘ওকে আমি খুন করব…আমাকে মারতে হাত তুলেছে, এত সাহস! … মেরে ফেলব আজ।’

সে ঘুষি মারল শ্রীগোপালোর বাহুতে একবার, দু—বার। মুঠো আলগা হতেই পারুল ঝাঁকুনি দিয়ে মাথা ছাড়িয়ে নিল। কিছু চুল শ্রীগোপালের আঙুলে লেগে। পারুল উঠে দাঁড়াল। ‘আজ আমিই তোকে খুন করব।’ পারুল ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে, দুড়দুড় করে নীচে নেমে গেল।

‘আমাকে মারলি রোঘো!’ শ্রীগোপাল অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে গিয়ে খাটের কোনায় ধাক্কা লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। হাঁটু চেপে ধরে ‘শাললা’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে শ্রীগোপাল খাটে একটা কিল মেরে বেরিয়ে গেল। সে তখন পুবের জানালায় এসে দাঁড়ায়। অন্ধকার উঠোন। দাওয়ার এক ধারে পলতে নামানো হারিকেন জ্বলছে। কয়েক মিটার পর্যন্ত দেখা যায়, তারপরই আবছা থেকে ঘন অন্ধকার।

ঘরের ভিতর থেকে পারুল ছুটে বেরিয়ে এল, হাতে একটা লম্বা কাটারি। পিঠের ওপর ছড়ানো চুল, শাড়ির আঁচল লুটোচ্ছে, হারিকেন পিছনে থাকায় মুখ অন্ধকার। দাওয়া থেকে নেমে পারুল ছুটে এল খামার বাড়ির দিকে। ও তাহলে সত্যি সত্যিই ‘খুন করব’ বলেছে, সে দেখল অন্ধকারের মধ্য থেকে শ্রীগোপাল এগিয়ে গেল, হাতে একটা লম্বা লাঠির মতন কিছু। সে জলদি টর্চটা বিছানা থেকে তুলে জানালা দিয়ে উঠোনে আলো ফেলল। মুখের উপর তীব্র রশ্মি পড়তেই পারুল চোখ বুজল আর তখনই শ্রীগোপলের হাতে ধরা বাঁশের খোঁটাটা পড়ল কাটারির উপর। টর্চ নিবিয়ে সে ছুটেছিল সিঁড়ির দিকে। যখন উঠোনে পৌঁছল তখন পারুল মাটিতে চিৎ হয়ে শ্রীগোপাল। তার ডান হাত হাঁটুতে চেপে বুকের ওপর ঘোড়সওয়ারের মতো বসে, এক হাতে পারুলের বাঁ হাতটা মুচড়ে ধরে রয়েছে, অন্য হাতে গলা টিপে। ঘড়ঘড়ে দমবন্ধ আওয়াজ পারুলের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে। পা দুটো মাটিতে দাপাচ্ছে। কুঁজো হয়ে শ্রীগোপাল মুখটা পারুলের মুখের কাছে রেখে ‘ইঁ ইঁ ইঁ’ শব্দ করে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। তখন তার মনে হয়েছিল, পারুল মরে যাচ্ছে।

কাটারিটা তার পায়ে ঠেকল, সে তুলে নিল।

.

‘না, না, না!’

সে উঠে বসল বিছানায়। মাথা নীচু করে বিছানায় কিছুক্ষণ বসে থেকে চোখ খুলল। জানালায় তাকিয়ে ময়লা কাপড়ের পরদার মতো আকাশ দেখতে পেল। আর একটু পরেই ভোর হবে। যে ভয় করে এসেছে সেটাই ঘটল, সে এই স্বপ্নটা দেখল।

যদি না বিকেলে পারুল আর সে মুখোমুখি হত, প্রচণ্ড রাগে চোখের সামনের সব কিছু তার দৃষ্টি থেকে যদি মুছে যেত তাহলে সে বোধহয় স্বপ্ন দেখত না। সব কিছু মোছেনি… ষোলো বছর আগে দোতলার ঘরে শ্রীগোপালের সামনে ক্রোধে ফুলে ওঠা পারুলকে সে দাওয়ায় দেখতে পেয়েছিল। …’অধিকার দেখাচ্ছেন, অধিকার!’ কদাচিৎ দেখা যায় স্ত্রীলোকের এই রূপ, সৌন্দর্য! পলকের জন্য তার মনে ভেসে উঠেছিল মহিষাসুরের দিকে তাকানো দুর্গার চোখ।

দু—হাতে সে মাথা চেপে ধরল। সেই যন্ত্রণাটা আবার শুরু হয়েছে। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সে দড়ির আলনার কাছে পৌঁছে পাঞ্জাবিটা নিল। সেটা পাকিয়ে শক্ত করে মাথায় বেঁধে সে শুয়ে পড়ল। পারুল তাকে কি ঘেন্না করে, কেন? সেদিন শ্রীগোপাল ওকে মেরেই ফেলত, সে বাঁচিয়েছে। অথচ কোর্টে পারুল একদম উলটো কথা বলল। যা শেখানো হয়েছিল তাই বলেছে। কেন রাজি হল বলতে? ও কি আমাকে সাজা দিতে চেয়েছিল! যাবজ্জীবন সাজা তো জেলে ঢোকার আগেই সে পেয়েছে।

ওর জন্যই হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে তাকে চারটে লোকের সামনে উলঙ্গ হতে হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিল মেয়ে। শরীরের যে জিনিসটা সে নিজে আর বাচ্চচা বয়সে মা ছাড়া আর কেউ স্পর্শ করেনি, বিবি তো নয়ই, ডাক্তার সেটাকে যখন আঙুলে তুলে দেখছিল তখন সে চোখ বন্ধ করে মৃত্যু কামনা করেছিল। তার শরীরে খোঁজা হয়েছিল বাধা দেওয়ার ধস্তাধস্তির চিহ্ন, তার পাজামা থেকে পাছার কাপড়ের টুকরো ডাক্তার কেটে নিয়েছিল ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য। সেই জায়গাটা তখন পাঞ্জাবি দিয়ে ঢেকে না নিলে তাকে পাগল বলে ভাবা যেত। … জীবনে সেই হেনস্থা, অপমান, লজ্জা কী করে ভুলবে! এই সবই পারুল দিয়েছে। সেদিন যদি ওকে বাঁচাবার জন্য সে শ্রীগোপালের মাথায়…।

কিছুক্ষণ পরেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।

.

শক্তি মাস্টার বলেছিল যেকোনো ছুটির দিন তার বাড়িতে যেতে, রাইহাটায় যে—কেউই তার বাড়ি দেখিয়ে দেবে। রাইহাটা প্রায় আড়াই মাইল। পতে ভ্যান রিকশায় উঠে পড়া যায়, যদি বসার জায়গা থাকে। সে রবিবার সকাল ন—টা নাগাদ বেরোল। হেঁটেই যাবে। বেরোবার সময় পারুলকে সে দেখতে পেল না।

খালপাড়ের রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই গ্রাম শেষ। তারপর একরের পর একর জুড়ে বিশাল ধানখেত। হাই টেনশান বিদ্যুতের মোটা মোটা তার লোহার থামে ভর করে খেতের উপর দিয়ে বহুদূর চলে গেছে। বৃষ্টির জলে কোমর ডুবিয়ে রয়েছে সবুজ ধান গাছ। আর মাস তিনেক পরই সোনালি রঙে ভরে যাবে মাঠ। খেত একজনের নয়। কারুর আট বিঘে, কারুর দু বিঘে করে জমি এর মধ্যে রয়েছে। বহুদিন আগে সে শ্রীগোপালকে বলেছিল, ‘এর মধ্যে থেকে নিজের জমিটা চিনে নেয় কি করে বল তো?’ শ্রীগোপাল বলেছিল, ‘একশোটা বাচ্চচার মধ্যে নিজের বাচ্চচাটাকে মা ঠিক চিনে নেয় যেভাবে।’ তার তিরিশ বিঘে ধানজমি এক লপ্তে নয়, তিন জায়গায় ছড়িয়ে আছে। কোথায় কত বিঘে রয়েছে সে জানে, কিন্তু দেখিয়ে দিতে বললে দেখাতে পারবে না,পারবে পারুল।

জনমজুর দিয়ে, ছড়ানো তিরিশ বিঘে জমিতে নিজে দাঁড়িয়ে চাষ করানো একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই লিজে চাষ করায় পারুল। এই কয়েক সপ্তাহে যে যতটুকু দেখেছে তাতে মনে হয়েছে পারুলের প্রতিপত্তি আছে চাষিদের কাছে। অল্পবয়সি তিনটে ভাই মিলে চাষ করে, ‘পারুল বউদির জমি’। এরা করে কুড়ি বিঘে, আর একটি লোক করে দশ বিঘে। বাড়ির কাছে পুকুরের ধারে পাঁচ বিঘেটায় সবজির বদলে ধান চাষ শুরু করেছে পারুল। বাড়ির লাগোয়া বলে এটা নিজেই লোক দিয়ে চাষ করাচ্ছে। ‘সাহস করে এগোলে সবই পারা যায়।’

পারুলের সাহস আছে আর আছে অদ্ভুত একটা মন। কোর্টে দাঁড়িয়ে পারুল তার দিকে আঙুল তুলে বলেছিল, ‘এই লোকটাই।’ সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছিল। সে ভেবেছিল, এতবড়ো মিথ্যা কথাটা বলতে ওর গলা কাঁপবে, চোখের দিকে তাকাতে পারবে না। কিছুই হল না। ওর শরীরে শ্রীগোপালের দেওয়া আঘাতগুলোই ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছিল বলে কোর্টে বিশ্বাস করে।…একদিন পরে পারুল রেপিংয়ের চার্জ এনেছিল। ওই একদিন তাকে সময় দিয়েছিল দারোগা বিজয় ঘোষ, পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়ার জন্য। পারুল কি ওই টাকার ভাগ পেত?… বিশ্বাস হয় না, টাকার জন্য পারুলের লোভ নেই।

রাইহাটা গ্রামটা বড়ো নয়। দুটি লোক রাস্তায় কথা বলছিল। তাদেরই একজন বলে দিল, ‘ওই তেঁতুল গাছটার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা, সেটা দিয়ে তিরিশ গজ গেলেই ডানদিকে শক্তি মাস্টারের বাড়ি।’ একমানুষ উঁচু পাঁচিলের একধারে দরজাটা খোলাই রয়েছে। ভিতরে ঢুকতেই মাটির একটা বড়ো উঠোন। একধারে উঁচু রকের সঙ্গে পরপর টিনের চালের তিনটে ঘর। দুটোয় তালা ঝুলছে। আর একধারে টালির চালের নীচে গাদাকরা খড়। তার পাশে গোয়াল। ভিতর বাড়িতে ঢোকার দরজাটাও খোলা। সে দরজায় উঁকি দিয়ে দুটো মরাই, একটা জবা গাছ আর তুলসী মঞ্চ ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না।

‘শক্তিবাবু আছেন নাকি?’ বেশ জোরেই সে ডাকল। বছর দশেকের একটি ছেলে ভিতর থেকে এল। ‘শক্তিবাবু আছেন?’

‘আছেন। আপনার নাম?’

‘বলো রাঘবেন্দ্র দত্ত।’

ছেলেটি চলে যাবার দু মিনিটের মধ্যেই পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে শক্তি মাস্টার বেরিয়ে এল। ‘চলুন, বারঘরে গিয়ে বসি।’

তালা খোলা ঘরটায় তক্তপোশ, তার উপর মাদুর, দুটো হাতলওয়ালা জীর্ণ কাঠের চেয়ার, দেয়ালে ইলেকট্রিক বালব আর গণেশের ছবি দেওয়া বাংলা ক্যালেন্ডার ছাড়া ঘরে আর কিছু নেই।

‘এই দশ মিনিট আগে কিছু লোকজন এসেছিল পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে। …এবার তো মেয়েরা পঞ্চায়েতে দাঁড়াবে।’ শক্তি মাস্টার একটা চেয়ারে বসল। তার সামনে তক্তপোশে সে। পঞ্চায়েত শব্দটা তার কানে প্রায় নতুন ঠেকল। ষোলো বছর আগে শুনেছে কিনা তার মনে পড়ছে না। গ্রামের চালচালন অনেক বদলে গেছে। ‘গোকুলানন্দ গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে পারুল বিশ্বাসকে ভোটে দাঁড়াতে বলুন না।… শক্ত মেয়েছেলে, ও পারবে।’

সে অবাক হল, অস্বস্তিও বোধ করল। নির্বাচন, ভোট মানেই তো রাজনীতি। পারুল রাজনীতির ধার ধারে বলো তো মনে হয় না, রাজনীতি করত শ্রীগোপাল।

‘পারুলকে বরং আপনারা কেউ বলুন, আমি বললে কানে তুলবে না… তার কারণ।’ সে থেমে গেল। শক্তি মাস্টার তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল কারণটা বুঝে নিয়ে।

‘বলুন, কী সাহায্য করতে পারি?’

সে ফাঁপরে পড়ল। পারুলের সঙ্গে তার ঝগড়ার পরই সে বুঝে গেছে, চাষ করব বললেই তার পক্ষে জমিতে কিছু করা সম্ভব নয়। বিবি আর পারুল, কেউই তাকে জমি ফিরিয়ে দেবে না। ফিরে পেতে গেলে যে জনবল আর অর্থবল থাকা দরকার তা তার নেই। কিন্তু এসব কথা তো শক্তিমাস্টারকে এখন বলা যায় না। তবু সে এসেছে সেদিনের ওই কথাটার টানে… ‘আপনি রিহ্যাবিলেটেড হতে চান, আপনি ক্রিমিন্যাল নন’, শোনার পরই তার বুক হালকা হয়ে গেছিল।

‘পারুল মেয়েছেলে, লিজ দিয়ে চাষ করানো ছাড়া ওর উপায় ছিল না। কিন্তু আমি যদি গোকুলানন্দে থেকে নিজেই লোক দিয়ে চাষ করি?’

‘পারবেন না। হঠাৎ চাষ করব বলে বাইরে থেকে এসে চাষ করা যায় না, একদম ডুবে যাবেন। অভিজ্ঞতা বলে একটা জিনিস আছে, আমার জন্ম কর্ম সবই এই গ্রামে। আমি মানুষদের জানি, জমি চিনি, প্রাকৃতিক ব্যাপার—স্যাপার বুঝি। বহু বছর গ্রামে বাস করে পারুল অভিজ্ঞ হয়েছে। আপনি আরও কিছুদিন বাস করুন, ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন।’ শক্তিমাস্টার ক্লাসের ছাত্রদের বুঝিয়ে বলার মতো থেমে থেমে ভারী গলায় বলল।

‘আমি যদি অল্প জমিতে, ধরুন আমার বাড়ির লাগোয়াই প্রায়, যে পাঁচ বিঘেটা রয়েছে, তাতে যদি সবজি বা ফলের চাষ করি?’

‘করুন না! জলে না নামলে সাঁতার শেখা যায় না, আপনি ছোটো জমিতে সবজি দিয়েই শুরু করুন। লোকসান হলে অল্পের উপর দিয়েই যাবে কিন্তু অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগবে।… আপনি কিছুটা জমিতে কলাগাছ লাগিয়ে দেখুন। কাঁটালি কলা কাঁদিতে পাবেন দেড়শোর মতন, ধরুন বারো ডজনই। যদি পাঁচ টাকা করে ডজন বেচেন, তাহলে একটা কাঁটালির কাঁদি থেকে পাবেন ষাট টাকা। আপনি যদি দুশো গাছ লাগান, তাহলে সব গাছ না বাঁচলেও, দশ হাজার টাকা আশা করতে পারেন। …. না না ওটা আপনি লাভ করছেন না। গাছ লাগানো আর বিক্রির মধ্যে একটা বড়ো খরচ আছে, অর্ধেক বাদ দিতে হবে। …যদি দুশো না পারেন একশো গাছ লাগান, হিসেব করে দেখুন কত পেতে পারেন।

সে একটা বিদঘুটে সমস্যায় পড়ল। মনে মনে একটা বিয়োগ, গুণ, ভাগের চেষ্টা করে, হাল ছেড়ে, সে শুধু হাসল।

‘আপনি টমেটো লাগান। … ফরাসি হাইব্রিড রেড স্টার বীজ এসেছে। খুব ভালো ফলন, চট করে রোগে ধরে না। … পেঁপেও লাগাতে পারেন। বিদেশি হাইব্রিড অনেক রকমের বীজ আসছে, লংকা, ঢ্যাঁড়স, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধা কপি। চাষের পদ্ধতি যতটুকু জানি আপনাকে বলে দোব, জমির ধান উঠলেই নভেম্বর কি ডিসেম্বর থেকে যাতে নামতে পারেন সেজন্য আপনি আগে তৈরি হয়ে নিন। আপনার জমির মাটি পরীক্ষা করাতে হবে, কোন মাটিতে কী সার লাগবে, তাতে কোন ফসল ভালো হবে। এটা সবার আগে জানা দরকার। এইসব না জেনেই তো ফসল বুনে মার খায়।’

শুনতে শুনতে তার মনে হল, চাষবাস অন্য একটা জগৎ নয়। এই জগতের মতোই এতে সাধনার দরকার হয়, অধ্যবসায় লাগে। একটা গাছ একটা প্রার। তাকে লালন করে বড়ো করতে হয়। এতে থ্রিল আছে। কেউ যেন গোরার মতো না হয়, মন্তার মতো না হয় সেজন্য সারাক্ষণ নজরে রাখতে হয়। ষোলো বছর তার যা করে ওঠা হয়নি, এবার সে তা পুরিয়ে নিতে পারে সবজি মানুষ করে। গোকুলানন্দকে বরাবরই অবহেলা করে, অন্যলোকের হাতে তুলে রেখে, আজ তাকে এক অপরিচিত লোকের সামনে বসে কিনা জিজ্ঞাসা করতে হচ্ছে ‘যদি সবজি চাষ করি?’

উঠোন থেকে একটি লোক ডাকল, ‘সেজদা আছেন?’ শক্তিমাস্টার ঝুঁকে দরজা দিয়ে দেখল। ‘নেপু নাকি, ভেতরে আয়।’ সে ঘড়ি দেখল। ‘আমি উঠি এবার।’ তার সঙ্গে শক্তিমাস্টারও উঠল। ‘অতদূর থেকে আজ প্রথম আমার এখানে এলেন, একটু মিষ্টিমুখ না করিয়ে কিন্তু ছাড়ব না… এক মিনিট।’ তাকে হতভম্ব করে শক্তিমাস্টার ভিতর—বাড়ির দিকে হনহন করে চলে গেল। নেপু নামের লোকটি ঘরে এসে বসল। বোধহয় প্রতিবেশী আত্মীয়।

অপরিচিত লোক, বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে, সে অস্বস্তি বোধ করে ঘরের বাইরে এল। আকাশ পরিষ্কার, মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। রোদের তাপে মাটির উপরের স্তর শুকোচ্ছে। মেটে গন্ধটা তার ভালোই লাগছে, পাঁচিলের ধারে দুটো টগর গাছের নীচে অজস্র সাদা ফুল ছড়িয়ে রয়েছে। তার মনে পড়ে গেল সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বাগানেও টগর গাছ ছিল। কারখানার জন্য ঘর তুলতে গিয়ে সেটা কেটে ফেলতে হয়। …সেই কারখানা আজ অন্য লোকের। মামলার খরচ তুলতে বিবি লিজ দিয়ে দিয়েছে। এখানে পারুলও তাই করেছে, তবে জমি যেকোনো সময় ফিরিয়ে নিতে পারবে। … পাঁচ বিঘের জমিটা যদি তাকে ছেড়ে দেয় পারুল!

শক্তি মাস্টার ভালো কথাই বলল, অভিজ্ঞতা চাই। ‘আরও কিছুদিন বাস করুন’, …সে করবে। ঝড়বৃষ্টি, পোকামাকড়ের সর্বনাশ থেকে দু—হাতে আগলে ধান, সবজি মানুষ করবে। বাচ্চচা থেকে বড়ো করে তুলবে। যে সন্তানদের দেখে বাবার মনে গভীর শান্তি ছড়িয়ে যায় তেমন সন্তান সে খেতে তৈরি করবে… পাগলের মতোই এবার থেকে সে ভাববে। পাগলরা মান—সম্মান অধিকার নিয়ে মাথা ঘামায় না। সে পারুলকে বোঝাবে, দরকার হলে বিবির কাছে যাবে…হাতজোড় করতে হয় যদি করবে। বাকি জীবনটা দোতলার ঘরে দিনরাত বন্দির মতো কাটিয়ে যেতে হবে ভাবলেই বুকের ভিতরটা হিম হয়ে যায়।… যাবজ্জীবন থেকে আর একটা যাবজ্জীবনে, পারুলকে চোখের সামনে রেখে বেঁচে থাকা!

‘একি উঠোনে ঘুরছেন যে, ঘরে চলুন।’ শক্তিমাস্টারের এক হাতে চিনেমাটির প্লেট অন্য হাতে জলের গ্লাস। প্লেটে চারটি নারকেল নাড়ু, দুটো ক্ষীরের সন্দেশ। ‘সব বাড়ির তৈরি।’

‘আমি কিন্তু…’ বলে সে সন্দেশ দুটো একসঙ্গে মুখে ঢোকাল, নাড়ু চারটে পকেটে পুরল। শক্তি মাস্টার হাসল। জল খেয়ে সে ‘এখন আসি, আবার আসব’ বলে সদর দরজার দিকে পা বাড়াল।

‘রঘুবাবু আপনি কিন্তু পারবেন।’

সে থমকে ফিরে দাঁড়াল। ‘কী করে বুঝলেন?’

‘যে লোক আমিই সেই খুনিটা’ পরিষ্কার গলায়, চোখে চোখ রেখে বলতে পারে, তার মনের জোর আছে, সাহসও আছে। সে পারবে।’

হায়রে সাহস! পারুল আর তার বউদিমণি, একজন রণমূর্তি ধরে, অন্যজন মার্জিতভাবে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে এই পৃথিবীতে তার জায়গা কোথায়। ছাব্বিশ নম্বর বাড়ির ছোট ঘরে প্রথম দিন ঢোকার সময় দরজায় হাত রেখে নিজেকে সে বলেছিল ‘এখনও বুঝতে পারছি না আমি কে!’

.

দাওয়ায় একা মন্তা। দেয়ালে ঠেশ দিয়ে পা ছড়িয়ে, হতে কাঁচি, একটা রঙিন ম্যাগাজিন থেকে ছবি কাটছে। পাশে গঁদের শিশি। ওর মা কোথায়? বেরোবার সময় সে পারুলকে দেখতে পায়নি। উনুনের দিকে সে তাকাল। একটা থালায় তার দুপুরের ভাত, দুটো বাটি, তার উপর উপুড় করা একটা থালা, নিবানো উনুনের উপর রাখা।

‘করছ কী?’

মন্তা ম্যাগাজিনটা তুলে দেখাল। সিনেমার। একটি মেয়ে যথাসম্ভব বুক খুলে চটুল চোখে এমনভাবে বসে যাতে উরুদুটো থেকে খাটো স্কার্ট উঠে যায়। সে অবাক হতে গিয়েও হল না। মন্তার সতেরো বছর বয়স, মেয়েদের শরীর দেখার ইচ্ছা ওকে তাড়া করতেই পারে।

‘পেলে কোথায়? মা দেখলে কী বলবে?’

প্রশ্ন দুটো এড়িয়ে গিয়ে মন্তা শুধু হাসল। সামনের দাঁত দুটো বেরিয়ে এল, হাসিটা ঠিক বোকার মতো নয়। পারুল তা হলে ঘরে নেই। সে পকেট থেকে নাড়ু চারটে বার করে বাড়িয়ে ধরতেই মন্তা ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে নিয়ে বলল ‘কে দিল?’

‘এখানে আমার এক বন্ধু আছে, সে দিল। …মা কোথায়?’

‘কলকাতা গেছে।’ মন্তা একটা নাড়ু মুখে দিয়ে চিবোতে শুরু করল।

শুনেই তার মনে হল, বিবির কাছে গেছে। নিশ্চয় নালিশ জানিয়ে বউদিমণির নির্দেশ চাইবে। নিশ্চয় বলবে, ‘আমি মালিক সব কিছুর, জমি জায়গা বাড়ির ‘সব কিছুর মালিক’ বলে চে�চিয়েছি। শুনে বিবির মুখে তৃপ্তির হাসি খেলে যাবে। হয়তো জিজ্ঞাসা করবে, ‘কি বলেছে? …তুমি আমার আশ্রিত? …দয়া করে থাকতে দেওয়া হয়েছে? বলতে দাও, যত পারে চেঁচাক।’

‘কলকাতায় কোথায় গেছে?’

‘জেঠিমার কাছে।’

‘তুমি জেঠিমাকে দেখেছ?’

‘খুব ছোটোবেলায়… এখানে একবার এসেছিল। খুব সুন্দর দেখতে।’

‘মা ফিরবে কখন?’

‘বলেছে বিকেলে ফিরবে, সকালে রান্না করে রেখে গেছে …লুডোটা রেখে দিয়েছেন এখনও?’

‘হ্যাঁ। তুমি কি ঘর পাহারা দিচ্ছ?’

‘মা বলে গেছে ঘর ফেলে রেখে কোথাও যেন না যাই। বুলিদি কাজ করতে আসবে, ও যা চোর একটা! গাছ থেকে কাঁটাল চুরি করেছিল! লোকের বাড়ি থেকে চাল চুরি করে, বাসন চুরি করে…খুব খারাপ হয়ে গেছে।’

‘তাই নাকি, খুব খারাপ?’ চোখ বড়ো করে সে হালকা সুরে বলল, ‘কতটা খারাপ?’

মন্তার মুখ বয়স্কদের মতো গম্ভীর হয়ে গেল। গলাটা নামিয়ে বলল, ‘খালপারের মেয়েগুলো যা করে বুলিদিও তাই করে… একদম খারাপ হয়ে গেছে। মা তো সেজন্য ওকে ওপরে যেতে দেয় না।’

তার গালে কেউ যেন ঠাস করে একটা চড় মারল। মুখটা জ্বালা করে উঠল। পারুল তার সম্পর্কে এতটা নীচু ধারণা করে! উনুনের উপর থেকে ভাতের থালাটা তুলে নিয়ে সে খামার বাড়ির দিকে এগোল।

‘জেঠু, গেঞ্জিটা এখনও আছে?’

সে জবাব দিল না। মন্তাকে তার বিশ্রী লাগছে।

বিকেলে সে পারুলের গলা শুনতে পেল। বুলিকে ধমকাচ্ছে।

‘কাজ ছেড়ে দে, তোকে আর করতে হবে না… অনেক লোক পাওয়া যাবে। …এখনও ঝাঁট দেওয়া, হাঁসগুলোকে তোলা কিছুই হল না।’

সে জানালায় উঁকি দিয়ে দেখল পারুল গরম জলের বাটি উনুন থেকে নামাচ্ছে, বুলি উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। জানালা থেকে সে সরে গেল।

‘বল চা হয়ে গেছে।’

রোজকার মতোই বুলি জানালার নীচে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে চেঁচাল ‘মামাবাবু চা হয়ে গেছে।’ বুলিকে দিয়ে উপরে চা পাঠানো যায় কিন্তু কেন পাঠায় না তার কারণটা সে মন্তার কাছে জেনেছে, বুলি ‘একদম খারাপ হয়ে গেছে।’

নেমে এসে চায়ের গ্লাসটা নেবার সময় পারুল তাকে বলল, ‘বউদিমণি একটা চিঠি দিয়েছে আপনাকে।’

সাদা খাম আঠা দিয়ে বন্ধ। খামে লেখা ‘শ্রীরাঘবেন্দ্রনারায়ণ দত্ত।’ চিঠিটা পারুলের সামনে খুলে পড়া ঠিক হবে না ভেবে সে দোতলায় উঠে এল। সে নিশ্চিত, পারুল তার বিরুদ্ধে কিছু বলেছে আর চিঠিটা সেই সম্পর্কেই।

তার অনুমানটা ঠিকই। লেটার হেড—এ সবুজ কালিতে বিবির নাম উপরে ছাপা, ‘শ্রীমতী জাহ্নবী দত্ত,’ নীচে বাড়ির ঠিকানা। মোটা ভারী ঝকমকে কাগজ।

বিবি চিঠিতে বরাবরই তাকে সম্বোধন করত ‘রঘু’, এই চিঠিতেও তাই। তাদের বাড়ির মেয়ে—বউদের মধ্যে বিবিই প্রথম ‘শ্রীচরণেষুর’ রীতিটা ভেঙেছে। বিবির হাতের লেখা মুক্তোর মতো, কোনো কাটাকুটি নেই।

‘পারুল যা বলল তার সবটা বিশ্বাস করছি না, কিছু নিশ্চয়ই বাড়িয়েছে। একটা কথা তোমার বোঝা দরকার, গোকুলানন্দে থাকতে হলে ওকে চটিয়ো না। পারুল শুধুই আশ্রিত নয়, তারও কিছু বেশি। সেটা তুমি জান। ওর সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা কোরো। ওখানকার জমিজমা ওর হাতেই থাকবে। ওখানকার সব কিছুর মালিক তুমি, এই ধরনের কথা, ওকে না বলাই ভালো। এতে নিজের সম্মান বাড়ে না। বিবি।’ শুধুই ‘বিবি’। তার আগে ‘ইতি’ নেই, তারিখ নেই। এটা চিঠি না অধস্তনকে নির্দেশ দেওয়া একটা সরকারি ফাইলের নোট!

চিঠিটা দু—বার পড়ে সে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। পরিষ্কার নীল। কিন্তু তার মনে মেঘের আনাগোনা। একটা কথা সে বুঝেছে, বিবি তাকে সন্ধি করে থাকতে বলছে। …পারুলই সর্বময়ী হয়ে থাকবে… তার ইচ্ছা—অনিচ্ছা পূরণে বিবির কোনো মাথাব্যথা নেই, বরং যে ইঙ্গিত শেষ বাক্যটিতে দিয়েছে সেটাই মারাত্মক। পারুল তাকে সম্মান না—ও দেখাতে পারে!… অপমান করবে?

খালি গ্লাস হাতে সে নীচে নেমে এল। গ্লাসটা দাওয়ার উপর রেখে সে ডাকল, ‘পারুল।’

ঘর থেকে পারুল বেরিয়ে এল বিস্ময় চোখে নিয়ে। সে বিবির চিঠিটা এগিয়ে ধরে বলল, ‘পড়ো’।

ভ্রূ কোঁচকাল পারুল, ‘আপনার চিঠি, আমি পড়ব কেন?’

‘এ চিঠি পড়া যায়, তোমারও পড়া দরকার।’

চিঠিটা হাতে নিয়ে পারুল ঘরে ঢুকে গেল, সে দাওয়ার সিঁড়িতে বসল। পারুল ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে। বিবির চিঠিতে শক্ত বানান নেই হাতের লেখাও পরিষ্কার, সুতরাং ছোট্ট চিঠিটা পড়ে ফেলতে ওর বেশি সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু লাগছে। সে মুখ ফিরিয়ে ঘরের ভিতর তাকাল। পারুল খাটের উপর বসে, হাতের চিঠির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে।

‘মুড়ি লাগবে নাকি গো?’ মাথায় ছোটো একটা বস্তা নিয়ে এক প্রৌঢ়া ঘরের সামনে এসে বলল। ‘না’। পারুল ঘর থেকে জানিয়ে দিল।

‘মামি, আমি চললুম।’ বুলি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেই উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে চলে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে এল পারুল।

‘আমি কিন্তু একটা কথাও বাড়িয়ে বলিনি, তবু বউদিমণি লিখল কেন, ‘বাড়িয়ে বলেছি’।

‘কেউ যদি কাউকে দোষী প্রমাণ করতে চায় তখন তার বিরুদ্ধে বাড়িয়েই বলে থাকে। বিবি সেটাই হয়তো ধরে নিয়েছে।’

‘আমি তো আপনাকে দোষী করার মতো কিছু বলিনি।’ পারুলের গলায় ক্ষীণ একটা গ্লানির ভাব তার কানে ধরা পড়ল।

সে পারুলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখে বয়সের ছাপ পড়েছে, শরীরে এখনও যৌবনের শেষ রশ্মিটুকু থাকার কথা, কিন্তু রাত্রি নেমে আসছে। পঙ্গু একটা ছেলেকে নিয়ে গ্রামের নির্জন কিনারে একা ষোলো বছর ধরে বাস করা তরুণী বিধবার পক্ষে সহজ কথা নয়। উদবেগ ওকে কঠোর করে দিয়েছে, ঢেকে দিয়েছে রুক্ষ আবরণে। তবু ওর মধ্যে কোথাও একটা নরম জায়গা আছে, যেখানে ঘা দিলে ব্যথা পায়। ‘আমি তো আপনাকে দোষী করার মতো কিছু বলিনি, একটা কথাও বাড়িয়ে বলিনি।’ হয়তো বলেনি। কিন্তু কোর্টে আঙুল তুলে বলেছিল ‘এই লোকটাই।’ পারুল কি ভুলে গেছে?

‘তুমি কী বলেছ জানি না। কিন্তু আমি তো জানি, কী আমি বলেছি। … আমার তখন মাথার ঠিক ছিল না। ভালমনেই আমি মন্তার জন্য ওগুলো কিনেছিলাম, খুবই সামান্য জিনিস। কিন্তু তুমি যে ফিরিয়ে দেবে আমি তা ভাবতে পারিনি।’ সে উঠে দাঁড়াল। পারুল মুখ নীচু করে রয়েছে। ‘একটা লোকের সঙ্গে রথতলায় সেদিন আলাপ হয়েছিল। আজ তার বাড়িতে গেছিলাম, শক্তিপদ হালদার।’

‘শক্তি মাস্টার! কী জন্য?’

‘লোকটা স্কুলে পড়ায়, চাষবাসও করে, গ্রামে যে এমন বিচক্ষণ মানুষ পাব ভাবতে পারিনি। ওর কাছ থেকে কিছু জেনেটেনে নিয়ে নিজেই এই পাঁচ বিঘে জমিটায় সবজির চাষ করব ঠিক করেছি।’

‘আপনি করবেন!’ পারুলের মুখে ক্ষীণ হাসি ফুটল।’ আপনি চাষের কিছু জানেন?’

‘তুমিও কি কিছু জানতে? জলে না নামলে কি কেউ সাঁতার শিখতে পারে?’

‘কী সবজি করবেন?’

‘টমেটো নয়তো কলা কিংবা কপি … ফুলকপি, মুলো, বেগুন।’

‘আমি ওই জমিতে ধান দিয়েছি, অন্য কিছু করতে দোব না।’ পারুলের হালকা হয়ে আসা কথার ভঙ্গি হঠাৎই কঠিন হয়ে গেল।’ মটর আর সরষে বুনে আমি লোকসান খেয়েছি। … সাঁতার শিখতে গিয়ে ডুবেও যায় মানুষ, তখন তো নিমিত্তের ভাগি হব আমিই! বউদিমণিকে কী বলব লোকসান হলে?’

পারুল সন্ধি করতে রাজি নয়। এখন আর কথা বলে লাভ হবে না। সে কয়েক পা এগিয়ে ফিরে দাঁড়াল। ‘শক্তি মাস্টার বলল, পঞ্চায়েত নির্বাচন আসছে, এবার মেয়েদের পঞ্চায়েত মেম্বার করা হবে, তুমি যদি ভোটে দাঁড়াও…।’

পারুল উঠে ঘরের ভিতর চলে গেল। ‘ভোট—ফোটে আমি দাঁড়াতে পারব না।’

দশ

আচমকাই বিকেলে হাজির হল হেমন্ত। একটা বাজারের বড়ো থলি ভরা জিনিস পারুলের দাওয়ায় নামিয়ে ডাকল, ‘পারুলদি।’

ওর গলার আওয়াজে প্রায় একই সঙ্গে গোয়ালের পাশে মানকচুর গোড়া শাবল দিয়ে খোঁড়ায় ব্যস্ত পারুল উঠে দাঁড়াল আর সে গিয়ে দাঁড়াল জানালায়। হেমন্তকে দেখে সে অবাক হল। হঠাৎ এখানে কেন এল? দুজনের কথা সে শুনতে পাচ্ছে না। মন্তার ছিপ আর একটা খালুই নিয়ে পুকুরে সারা দুপুর কাটিয়ে একটু আগেই সে ফিরেছে।

ইদানীং, সে দুপুরে মাছ ধরার ছুতোর সময় কাটায়। পুঁটি, খলসে, ট্যাংরার থেকে বড়ো মাছ এই ছিপে ওঠে না। চড়া রোদে আচ্ছাদনহীন জায়গায় বেশিক্ষণ বসা যায় না তাই তার বসার জায়গা ঘাটলার গায়ে নিম গাছটার নীচে। বুলি এখানে এঁটো বাসন মাজে, পাতের ভাত খাবার জন্য মাছগুলো ঘাটলায় আসে। স্বচ্ছ জলের নীচে ওদের ঘোরাঘুরি উপর থেকেও দেখা যায়। আর দেখা যায় আমবাগানটা। বড়ো বড়ো গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে দূরে শরৎ বসাকের বাড়িটা, আরও দূরে খালপারের রাস্তার একটুখানি। দু—চারটে মানুষ, ভ্যান রিকশা, সাইকেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখা যায়। শালিক, কাক আর ঘুঘু ছাড়া আর কোনো পাখির ডাক সে চেনে না। মাঝে মাঝে হঠাৎই বুলবুলি এসে যায়। পাখি চিনতে, পাখির ডাক চিনতে তার ইচ্ছে করে। তুলসীপাতার মতো গন্ধওয়ালা কমলা—সাদা ফুলের ঝোপ পুকুরের পাড়ে, বাড়িতে ইঁদারার ধারে, খামার ঘরটার পাশে। সে এই ফুলের নাম জানে না। কাউকে জিজ্ঞাসা করতেও লজ্জা করে। ধীরে ধীরে জেনে নেবে পাখিদের, ফুলেদের, মাছেদের, শাকপাতার নাম। ধান, মাটি, সার, বীজ, পোকামাকড় সম্পর্কে কিছুই সে জানে না। থিয়োরেম প্রব্লেমের মতো, সন—তারিখের কি পদ্যের অনেক নাম, অনেক ধরন, এদের মধ্যে অনেক রকমের সম্পর্ক, আলাদা চালচলন, এগুলো স্কুলে বইয়ের মতো মুখস্থ করা যায় না। এগুলো শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো শরীরের নিয়মের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হয়। এজন্য সময় লাগবে… ‘আপনি আগে তৈরি হয়ে নিন।’

তৈরি হবার জন্য সব কিছু থেকে মনকে গুটিয়ে এনে একটা জায়গায় জমা করতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফাৎনাটার দিকে তাকিয়ে থেকে তার মনে হয়েছে এটা একটা ভালো পদ্ধতি। সকালে ইস্টদেবতার নাম চোখ বুজে জপ করত মা কাঠের মালা বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। তখন মা—র মুখ দেখে তার মনে হত জগৎ—সংসার থেকে আলাদা হয়ে শুধু কোনো একটা জায়গায় যেন নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছে। … গুরুদেবের কাছে মন্ত্র নেওয়ার কথা জীবনে সে ভাবেনি, এখনও ভাবে না। সে এখন গভীরভাবে ফাৎনাটার দিকে তাকিয়ে থাকে, কখন ওটা ঠকঠক কেঁপে ওঠে, কখন সাদা কাঠিটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই ডুব দেয়।

আজ একটা চিংড়ির বাচ্চচা আর চারটে পুঁটি পেয়েছে। দেখে হয়তো মন্তা তার সামনেই হাসতে শুরু করবে। পারুল হাসে না। ও এমন একটা ভাব দেখায় যে, একটা কিছু নিয়ে তো লোকটাকে থাকতে হবে, এই নিয়েই থাকুক। সে যে ক—টা মাছ পায়, রাত্রে ঝাল বা ঝোলের বাটিতে ঠিক সেগুলোই তার কাছে ফিরে আসে। এই নিয়ে সে কোনো কথা বলে না। হয়তো পারুল বলে বসবে, ‘আপনার ধরা মাছ আমরা খাব কেন?’

পারুল মাটি খুঁড়ে মান কচুর গোড়া তুলছিল। তার পাশে উবু হয়ে বুলি পাতাগুলো ছিঁড়ে ডাঁটা জমাচ্ছে। সে ছিপ আর খালুইটা দাওয়ায় রেখে শুধু চেঁচিয়ে বলল, ‘ছিপটা রইল।’ এর মিনিট দশেক পরই হেমন্ত এল। কথা বলতে বলতে হেমন্ত থলিটা থেকে দুটো সাদা বাক্স বার করল। দেখেই সে বুঝল ওতে মিষ্টি রয়েছে। ব্যাপার কী? হেমন্ত একটা বাক্স পারুলের হাতে দিতেই ওর মুখে হাসি আর বিগলিত ভাব ফুটে উঠল। হেমন্ত অন্য বাক্সটা নিয়ে এবার খামার বাড়ির দিকে আসছে। সে অপেক্ষা শুরু করল একগ্লাস জল হাতে নিয়ে।

‘দাদাবাবু।’ দরজায় দাঁড়িয়ে হেমন্ত। সে তাকাল। ‘বউদিমণি পাঠিয়ে দিলেন … দাদামণি পাশ করেছে।’

হেমন্তর গালভরা হাসিটা চুপসে গেল দাড়িওয়ালা লোকটার চাহনি দেখে। ‘এতে কী আছে?’

‘সন্দেশ … অন্নদার।’

‘সেতো বাক্সর গায়ে লেখা থেকেই বুঝেছি। ছোটোবেলায় মিষ্টি খেতাম তারপর ছেড়ে দিয়েছি,তোমার বউদিমণি তো সেটা জানে।… ওটা নিয়ে যাও, বরং তুমিই খেয়ে নাও, বউদিমণি জানতে পারবে না।’

‘আপনার জন্য আনা … নিয়ে যাব!’ হেমন্ত মুশকিলে পড়ে গেছে। কলকাতায় ফিরে বলবে কী, সেটাই বোধহয় এখন ও ভাবছে।’

‘তোমার কাজ তুমি করেছ, কেউ যদি না নেয়—তুমি কী করতে পার।’

‘সন্দেশটা খুব ভালো ছিল, বউদিমণি আনন্দ করে পাঠিয়ে দিলেন, একটা অন্তত মুখে দেবেন তো!’

‘একটাও না। … এই নিয়ে আর কথা বোল না। তুমি কি সন্দেশ দিতেই কলকাতা থেকে এসেছ?’

হেমন্তর বলার ভঙ্গি চাকরবাকরের মতো নয়, আত্মীয়তার ছোঁয়া ওর কথায় লেগে আছে। ছেলের পাশের খবরে বাবা কিছুমাত্র উচ্ছ্বসিত না হওয়ায় ও যেন মর্মাহত। রূঢ় হওয়ার জন্য নিজেকে এবার তার দোষী মনে হচ্ছে। ‘ঘরে এসো, বাক্সটা টেবিলে রাখ।’

দমে যাওয়া হেমন্তর মুখ সতেজ হয়ে উঠল। ‘দাদামণি বন্ধুদের নিয়ে কাল পিকনিক করতে আসবে, তাই আমি এলুম সব ব্যবস্থা করে রাখতে।’ হেমন্ত বাক্সটা টেবিলে রাখল।

‘এখানে পিকনিক করবে? … ক—জন আসবে?’ স্কুলে পড়ার সময় সে—ও পিকনিক করে গেছে ক্লাসের ছেলেদের নিয়ে।

‘আমবাগানে রান্নাবান্না হবে। ওখানে তো আগেও হয়েছে। … আমিও অবশ্য দেখিনি। অরুণাদি বলল, বউদিমণি বন্ধুদের নিয়ে এসে পিকনিক করেছেন।’

বন্ধু! বিবির বন্ধু তো অপূর্ব! সঙ্গে আর কারা ছিল? গুলু, গোরা থাকবে, কিন্তু অপূর্বর বউ কি ছিল? অরুণা? … ‘আমিও অনেক কিছু দেখেছি, যাবার আগে সবাইকে বলে যাব।’ অরুণা এখানে কি কিছু দেখেছিল?

‘হাঁড়ি—কড়া বাসনপত্তর সবইতো পারুলদির ঘরে তোলা আছে। কয়লার উনুনটা আছে এই নীচের ঘরে। পারুলদি মুরগির জোগাড় করে দেবে, আমি রথতলা থেকে বিকালে কয়লা কিনে বাজার করে আনব। কলকাতা থেকে বাসমতি চাল, ব্যাসন, মুগের ডাল, গুঁড়ো দুধ, চা, কাগজের গেলাসও এনেছি, মাত্র ছ—সাতজন তো আসবে।’

হাত তুলে সে হেমন্তকে থামাল। ‘তাহলে তোমার তো এখন অনেক কাজ।’

‘কাজ তো সকালে। উনুন ধরিয়ে রান্নার তোড়জোড়… আমিই রাঁধব।’

বুলির ডাক নীচের থেকে শোনা গেল, ‘মামাবাবু, চা হয়ে গেছে।’

‘চলো, নীচে যাই। … রাতে থাকবে কোথায়?’

‘দাওয়াতেই রাতটা কাটিয়ে দেব।’

তারা দাওয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। স্টিলের গ্লাসে পারুল চামচ নাড়ছে। নাড়া শেষ হতেই সে হাত বাড়াল নেবার জন্য।

‘আপনার নয় … হেমন্ত চা নাও।’

‘দাদাবাবুকে আগ দাও।’ হেমন্ত দাঁড়িয়ে রইল।

এইবার সে লক্ষ করল চিনেমাটির কাপে পারুল লিকার ঢালছে। হঠাৎ তাকে খাতির! চাকরের সামনে মনিবকে গ্লাসে চা দেওয়া যায় না বলে? ডিস সমেত কাপটা নেবার সময় সে পারুলের মুখে চোখ রাখল। নির্বিকারমুখ পারুল শুধু বাঁ হাতে ঘোমটাটা বাড়িয়ে দিল।

সকালে নীচে সে দেখল খাবার ঘরের দরজার ঝাঁপটা সরানো। এখানে আসার পর একদিনও সে ঘরটার ভিতরে ঢোকেনি। ঝাঁপের ফাঁক দিয়ে প্রথম দিন যতটুকু দেখেছিল তাই—ই রয়েছে। তবে তখন সে দেখেনি, মেঝেয় ঝাঁটা আর এক কোণে ধানের বস্তার পাশে পড়ে থাকা তার মোটর বাইকের কঙ্কালটাকে। ভাঙা দেওয়াল, জানালার ফোকর,আঁটি বাঁধা খড় ছাড়া আর কিছু দেখার নেই। বাইকটা কলকাতার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বিবি বিক্রি করে দিতে পারত! মাডগার্ড, হ্যান্ডল, আর এঞ্জিনটা চোরেরা কেন যে রেখে গেল! বাইকে শেষবারের মতো চেপেছিল পারুলকে পিছনে বসিয়ে, ভাবলে এখন অবাক লাগে।

পারুল আজ একটু ব্যস্ত। একটা পুরনো বেডকভার আর লম্বা কাপড়ের পাড়ের ফালি বুলির হাতে দিয়ে বলল, ‘ছুট্টে হেমন্তকে দিয়ে আয় আর বেলার মা—র কাছ থেকে আমার নাম করে কয়লা ভাঙার হাতুড়িটা এনে কয়লাগুলো ভেঙে দে। তারপর বাটনা বাটা আছে… আজ তুই এখানে খাবি।’

সে দাঁড়িয়ে আছে চায়ের জন্য। চায়ের জল এখনও বসানো হয়নি। পারুল কৈফিয়তের সুরে বলল, ‘সকালে মুরগির জন্য গেছলুম নিশি মণ্ডলের বাড়ি … কেটে,ছাড়িয়ে আনতে দেরি হল; আমি আর হেমন্ত দুজনে মিলে উনুনটা বাগানে নিয়ে গেলুম,… গাছে কাক—শালিক রয়েছে, মাথার ওপর একটা কিছু ঢাকা না দিয়ে কি রান্না করা যায়? চাদরটা বার করে দিলুম … এখুনি চা হয়ে যাবে, একটু বসুন।’

পায়ে পায়ে সে উঠোন থেকে রাস্তার দিকে এগোল। আমবাগানের মাঝামাঝি সব থেকে বড়ো গাছটার নীচে রান্নার বাসনগুলো, তার সঙ্গে বড়ো একটা তোলা উনুন, কয়লার চাঙড়, কয়েকটা ঠোঙ্গা, কৌটো আর তেলের বোতল। চাদরটা হেমন্তর হাতে দিয়ে বুলি চলে যাচ্ছে বোধহয় হাতুড়ির খোঁজে। মন্তা জট পাকানো পাড়ের ফালি টেনে টেনে খুলছে। আজকের সকালটা খুব চমৎকার। ভাদ্রমাস পড়ে গেছে। ঝকঝকে রোদ, মেঘ নেই আকাশে, পুকুরের জলে ছায়া পড়েছে বাঁশঝাড়ের, খালপারের রাস্তা থেকে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং, আকাশে চিল, গা জুড়োনো বাতাস। আধবোজা হয়ে এল তার চোখ।

‘চা হয়ে গেছে।’

সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল পারুল এগিয়ে আসছে তার দিকে, হাতে একটা জারিকেন। ধ্বক করে উঠল তার বুক। মুহূর্তের জন্য একটা অশুভ ছায়া তার মনে ভেসে উঠল। পারুলের হাতে ওই জিনিসটা কেন?

‘স্যাঁতানো ঘুঁটে কি ওমনি ওমনি ধরবে কেরোসিন না দিলে!… আপনার চা ঢাকা দিয়ে রেখে এসেছি।’ পারুল তার পাশ দিয়ে আমবাগানের দিকে এগিয়ে গেল। ওকে পিছন থেকে দেখতে দেখতে আর একবার তার বুক কেঁপে উঠল। উঠোনে দাঁড়িয়েই চা খেয়ে সে উপরে উঠে এল। হঠাৎই কেমন যেন অস্থিরতা বোধ করছে। ব্লাড প্রেশার শুরু হল কিনা কে জানে! তাজা বোধ করছে অথচ একটা পুরোনো স্মৃতি তাকে অবসাদে ভরিয়ে দিল কয়েক মিনিটেই। সে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

একসময় সে মোটর এঞ্জিনের শব্দ পেল। কিছু উত্তেজিত পুরুষ কণ্ঠস্বর ক্ষীণভাবে তার কানে পৌঁছল। ওরা এসে গেছে। ওরা আজকের দিনটা উপভোগ করবে, ওদের মধ্যে গোরাও আছে। তার ইচ্ছে করল ছেলেকে পলকের জন্য হলেও একবার দেখতে। সে বিছানা ছেড়ে জানালায় এসে দাঁড়াল।

আমবাগানের খানিকটা জানালা থেকে দেখা যায়, বাকিটা বাঁশঝাড়ের আড়ালে। সেই আড়ালে—পড়া অংশেই রান্না হচ্ছে। সে অনেকক্ষণ চোখ পেতে রইল যদি একজনকেও দেখা যায়, কিন্তু কাউকেই দেখতে না পেয়ে নীচে নেমে এল। উঠোন পেরিয়ে যাবার সময় দেখল পারুল রান্না করছে। কোমরে জলভরা কলসি আর এক হাতে জলের বালতি নিয়ে বুলি চলেছে আমবাগানের দিকে। সে আর না এগিয়ে একটা খেজুর গাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল।

টেপরেকর্ডারে রক সংগীতের সুর বাজছে। মন্তা উবু হয়ে রেকর্ডারটার পাশে বসে। ঘাসের উপর পাতা বেডকভারে একটি ছেলে চিৎ হয়ে শুয়ে, আর একজন পা ছড়িয়ে বসে। জিনস আর কালো গেঞ্জি পরা লম্বা চওড়া গৌরবর্ণের একটি ছেলে, চোখে সানগ্লাস, একাই শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে দুমড়ে মুচড়ে নেচে চলেছে। দেখামাত্রই সে গোরাকে চিনতে পারল। অতবড়ো শরীর আর কার হবে! এই নাচকে কী বলে … টুইস্ট? শ্যেক? নাকি অন্য কিছু।

গোরা একটু একটু করে সরে গিয়ে আচমকা বুলির পথ জুড়ে নাচতে লাগল। কলসি আর বালতির ভারে বেঁকে যাওয়া বুলি তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওকে পাক দিয়ে গোরা ঘুরছে। বেডকভার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে ছেলে দুটি এবার তালি বাজাতে শুরু করল।

দু—তিনবার পাক দিয়ে হঠাৎ নাচ থামিয়ে গোরা সিঁটিয়ে থাকা বুলির হাত থেকে বালতিটা টেনে নিল, কলসিটা নেবার জন্য অন্য হাত বাড়াতেই এবার বুলি পিছিয়ে গেল। বাবুদের ছেলে জল বইছে এটা দেখা বোধহয় ওর কাছে লজ্জার ব্যাপার। কলসির বদলে বুলির কাঁধ ধরে প্রায় ঠেলে নিয়েই গোরা রান্নার কাছে এগিয়ে গেল। জলের বালতিটা রেখে হেমন্তর সঙ্গে দুটো কথা বলে গোরা ফিরে গেল বেডকভারের দিকে। মন্তা হাসছে বুলির দিকে তাকিয়ে। ওরা তিনজনও হাসছে। ওরা আমোদ করতে এসেছে।

মোটরের হর্ন সে শুনতে পেল। আর একটা গাড়ি। গাড়িটা বাঁশঝড়ের আড়ালে থেমেছে বলে সে দেখতে পাচ্ছে না। ওরা তিনজন হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল। সে নবাগতদের দেখার আশায় উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইল। আরও চারজন, তাদের দুজন খুব খাটো হাফ প্যান্ট, আর ছাপমারা গেঞ্জি পরা, কার্ডবোর্ডের দুটো পেটি বয়ে এনে বেডকভারের উপর রাখল। এতদূর থেকেও সে চিনতে পারল পেটিদুটো বিয়ারের। ওরা আমোদ করতে এসেছে।

সে ফিরে এল। উঠোন দিয়ে যাওয়ার সময় পারুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শরীরটা ভালো নেই। আজ আর কিছু খাব না।’ নিজের ঘরে এসে প্রথমেই সে জানালাটা বন্ধ করে দিল। ওদের কারুরই এদিকে আসার দরকার পড়বে না। গোরা এসে তার বাবার সঙ্গে দেখা করবে এমন সম্ভাবনাকে আমল দেবার প্রশ্নই ওঠে না।

সত্যিই তার শরীর অবসন্নতায় ভরে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে তার ভিতরে কীরকম একটা ভয় নিঃসাড়ে ঢুকে এসেছে, সম্ভবত জারিকেন হাতে পারুলকে দেখেই কিংবা গোরার নাচের সঙ্গে। আজ সে একটা সুন্দর সম্পর্ক বোধ করেছিল প্রকৃতির সঙ্গে, এখন আর তা করছে না। যোগাযোগ করার পথগুলো এক—এক সময় মনে হয়েছে এত বেশি দীর্ঘ যে, সারাজীবন শুধু হেঁটেই যেতে হবে। হাঁটতে তার ভালো লাগে, যদি জানে শেষ পর্যন্ত একটা বিশ্রামের জায়গা পাওয়া যাবে। গোকুলানন্দে এসে পর্যন্ত সে হেঁটেই চলেছে। কিন্তু শ্রীগোপালের মতো কখনোই সে মাঝপথে বলবে না পাপ করেছি, করাপ্ট হয়েছি। সে কিছুই বলতে চায় না। গাছ, জল, আকাশ, বাতাস, মাছ, পোকামাকড়ের মতো কথা না বলে থাকতে পারলে সে কখনোই বলত না ‘উঠে পড়ো, পৌঁছে দিচ্ছি।’ … পৌঁছলাম। কিন্তু কোথায়?

পাতলা একটা ঘুমের আস্তরণের আড়লে জগতের সঙ্গে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে সে ব্যর্থ হচ্ছিল। নানান ধরনের শব্দ বাইরে থেকে জীর্ণ জানালা দরজা দেয়াল ভেদ করে তার চেতনায় ঢুকে পড়েছে আর সে সেগুলোকে আলাদা আলাদা করে কথায় রূপান্তরিত করে গেছে। একটা কথারও অর্থ সে ধরতে পারেনি। অস্বস্তিতে এপাশ ওপাশ করে একসময় তার মনে হল, সিঁড়িতে কার যেন উঠে আসার পায়ের শব্দ সে শুনল। কার শব্দ হতে পারে? এখানে কারুরই তো আসার সম্ভাবনা নেই! তবু মনে হল ঠিকই শুনেছে। বিছানায় সে উঠে বসল। খোলা দরজা দিয়ে আসা আলোয় ঘড়িটা টেবিল থেকে তুলে সময় দেখল… আড়াইটে!

বিছানা থেকে নেমে কলসি থেকে কাচের গ্লাসে জল গড়াল। চোখে জল দেবার জন্য গ্লাসটা নিয়ে ছাদের দিকে যেতে গিয়েই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে সে থমকে পড়ল। পাঁচিলবিহীন ছাদের উত্তরদিকের কিনারে মন্তা উপুড় হয়ে, তার বুক পর্যন্ত প্রায় কার্নিসের বাইরে। ও নীচের দিকে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে। সর্বনাশ, ও তো পড়ে যাবে! তার মনে হল, চেঁচিয়ে উঠলেই মন্তা চমকে যাবে তাইতে বিপদ ঘটে যেতে পারে।

সে পা টিপে ঘটে যেতে পারে।

সে পা টিপে মন্তার কাছে পৌঁছেই খপ করে ওর জামার কলারটা ধরে পিছন দিকে টান দিল। মন্তার রোগা দেহটা ছাদের ভিতরে হিঁচড়ে চলে এল। ভীত চোখে ও চিৎ হয়ে শুয়ে, মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে।

‘কী করছিস? এখুনি তো পড়ে যেতিস… কী দেখছিলি ওভাবে?’

মন্তা ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল, ‘কিছু না।’

‘কিছু না?’ সে ধমকে উঠল। ‘কিছু নয়তো, ওভাবে প্রাণ হাতে নিয়ে কেউ ঝুঁকে পড়ে?… বল কী দেখছিলি?’ সে কান ধরল মন্তার।

‘বল শিগগিরই… তোর মা কোথায়?’

‘ঘরে, শুয়ে আছে।

‘চল তোর মা—র কাছে।’

‘না।’ মন্তা ধাতস্থ হয়েছে। ওর চোখে বোকামিটা ফিরে এসেছে কিন্তু তা ছাড়াও আরও কী যেন ঝিলিক দিচ্ছে। কান থেকে সে হাত নামাল। দ্রুত ছাদের কিনারে গিয়ে নীচে তাকাল। ঝোপ, ঝাড়, ভাঙা ইট ছাড়া আর কিছু নেই। মুখ ফিরিয়ে মন্তার দিকে তাকাতেই দেখল, ওর সামনের দাঁতদুটো বেরিয়ে রয়েছে… হাসছে।

‘নীচের ঘরে বুলিদি।’

‘কী হয়েছে তাতে?’

‘ওর সঙ্গে দুটো ছেলেও।’

‘কী বললি?’ তার গলা দিয়ে অস্পষ্টভাবে কথাটা বেরোল। ‘দুটো ছেলে!’

‘হ্যাঁ জেঠু। দেয়ালের ভাঙা জায়গাটা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটুখানি… বুলদি শুয়ে আছে।’

‘কী বললি… কোন দুটো ছেলে?’ সে চাপা গলায় বলল, ‘কোন দুটো?’

‘বেঁটে মতন রোগাপানা হাফপ্যান্ট পরা আর সেই বড়ো ছেলেটা…’ মন্তা ভয়ে থেমে গেল একটা বিশাল হাঁ—করা মুখ দেখে।

‘ওহ গোরাআআ।’ আকাশের দিকে মুখ তুলে সে কাতরে উঠল।

জলের গ্লাস হাতে নিয়েই সে ঘূর্ণিঝড়ের মতো সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। খামার ঘরের ঝাঁপটা দরজার ফাঁকা জায়গায় দাঁড় করানো। সে একটানে ঝাঁপটা সরিয়ে নিয়ে ভিতরে তাকাল।

বুলি চিৎ হয়ে খড়ের উপর। তার দুই হাঁটু উঁচু হয়ে, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ দুটি শীর্ণ ঊরু দু—পাশে ছড়ানো। ঢেকে রয়েছে চওড়া একটা কালো গেঞ্জি পরা পিঠ, জিনসটা হাঁটু পর্যন্ত নামানো, ধবধবে দুটি বিশাল পাছা। একধারে দাঁড়িয়ে হাফ প্যান্ট পরা বেঁটে একটি ছেলে।

দুই কি তিন সেকেন্ড, সে ছুটে গিয়ে গোরার চুল মুঠোয় ধরে হ্যাঁচকা টান দিল, যেভাবে একটু আগে মন্তাকে টেনেছিল। গোরার মুখ উঠে গেল উপর দিকে। কয়েকটা মুহূর্তের জন্য দু—জোড়া চোখ পরস্পর জড়িয়ে রইল, তারপরই গোরা লাফিয়ে উঠে জিনসটা কোমরে টেনে তুলেই একটা ঘুষি চালাল। খট করে শব্দ হল চোয়ালে। সে দেয়ালে ছিটকে পড়ল। দরজার কাছ থেকে মন্তা ছুটে পালাল চিৎকার করতে করতে, ”মা, মা, জেঠুকে মারছে… মা জেঠুকে ছেলেটা মারছে… শিগগির এসো।’

রাগে অন্ধ হয়ে যাওয়া গোরা আবার ঘুঁষি চালাল। সে উঠতে যাচ্ছিল, মাথায় আঘাতটা লাগতেই আবার পড়ে গেল।

‘ব্লাডি রেপিস্ট!’

মেঝেয় মাথা চেপে বসে পড়া দেহটার পিঠে গোরা জুতো পরা পায়ের লাথি মারল। সে দেয়ালে ঢলে পড়ল। মনে মনে বলল, ‘এটাই পাওনা ছিল।’ দু—হাতে তার চুল ধরে গোরা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ‘মেয়েটাকে টাকা দিয়েছি, তোমার মতো ফ্রি পাবার চেষ্টা করিনি, আন্ডারস্ট্যান্ড?… ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?’ কথাটার সঙ্গেই সে থুথু দিল তার মুখে।

সে স্থির দৃষ্টিতে গোরার মুখের দিকে তাকিয়ে। তার মনে হচ্ছে এখন যেন তার নিজের চোখেই শ্রীগোপালের চোখ বসানো রয়েছে, ‘তুই আমাকে মারলি রোঘো!’ মুখের মধ্যে সে নোনতা স্বাদ পাচ্ছে।’

‘আমি রেপ করিনি রে।’ ফিসফিস করে সে বলল।

‘করিনি রে।’ গোরা ভেঙচিয়ে উঠল। ‘সারা বংশের নাম ডুবিয়েছ…. কেন, কেন,কেন আমরা সবাই সাফার করব, কেন?’ উন্মাদের মতো চাহনি গোরার। ‘মেরেই ফেলব আজ।’

‘রনো, থাক এবার …লেটস পুশ অফ।’ হাফপ্যান্ট—পরা এতক্ষণে কথা বলল।

‘যেতে হয় শালা তুই যা, আমি এই লোকটাকে শেষ করে যাব।’

‘আর একবার হাত তুলেছিস কি তোর লাশ এখানে পড়বে হারামজাদা!’

চমকে উঠে সারা ঘর ঘুরে তাকাল। শাড়ি গাছ—কোমর করা পারুল দরজায় দাঁড়িয়ে। উত্তেজনায় ওঠানামা করছে বিশাল বুক, ধকধক করছে চোখ, দু—হাতে তুলে রয়েছে শাবলটা। আপনা থেকেই গোরা এক পা পিছিয়ে গেল।

‘গেট আউট, গেট আউট।’ গোরা চিৎকার করে উঠল।

‘গেট আউট?… কার গায়ে তুই হাত তুলেছিস জানিস?’

‘আমি জানি। যে তোমাকে রেপ করে—’ গোরা কথাটা শেষ করার আগেই শাবলটা তার গলার পাশ দিয়ে বিদ্যুতগতিতে গিয়ে দেয়ালে আঘাত করল। রক্ত সরে গেল গোরার মুখ থেকে। পারুল শাবলটা আবার দু—হাতে তুলে ধরেছে। গলা লক্ষ করেই যে শাবলটা চালানো হয়েছিল সেটা গোরা বুঝে গেছে। আর বুঝে গেছে দ্বিতীয়বার এই মেয়েছেলেটা ফসকাবে না।

‘পারুল বিশ্বেস কী জিনিস আজ তোকে বুঝিয়ে ছাড়ব। আর একটা খুন হবে এ বাড়িতে।’

‘না, পারুল, না।’ সে উঠে দাঁড়িয়ে দু হাত মেলে পারুলের সামনে দাঁড়াল। ‘গোরা বেরিয়ে যা, নইলে ও খুন করে দেবে।’

পারুলের মুখের দিকে জ্বলন্ত চোখে একবার তাকিয়ে গোরা দ্রুত বেরিয়ে গেল, তার পিছনে হাফপ্যান্ট—পরা। ঘরে শুধু তারা দুজন, দরজার কাছে মন্তা। বুলি নিঃসাড়ে কখন যে বেরিয়ে গেছে, কেউ লক্ষ করেনি। শাবলটা সে পারুলের হাত থেকে তুলে নিল।

কাঁধ ঝুলে পড়েছে পারুলের, অবসন্নের মতো ধুঁকছে। একবার চোখ তুলে তাকাল তার মুখের দিকে। করুণ চাহনিতে পারুল কী বলতে চাইছে, সে যেন বুঝতে পারছে। তার মুখে ক্ষীণ একটা হাসি ফুটে উঠতে দেখে পারুলের চোখে পলকের জন্য আলো ফুটে উঠল।

‘ঘরে গিয়ে এখন শুয়ে থাক।’ পারুলের পিঠে হাত রেখে সে থাবড়াল। ষোলো বছর ধরে পারুল পরিশ্রম করেছে। ওর এখন বিশ্রাম চাই।

.

অন্ধকার ঘরে সে জানালায় দাঁড়িয়ে।

বাইরের চরাচর গাঢ় অন্ধকরে একাকার। বাতাস বইছে কি বইছে না, সে বুঝতে পারছে না। ঘুমের মধ্যেও পাখিরা ডেকে ওঠে, সে এখনও কোনো ডাক শুনতে পায়নি। গোরুটা আজ গভীর ঘুমে নিশ্চয়, যেমন হাঁসগুলোও। প্রকাণ্ড নৈঃশব্দ্য জানালায় ঝুঁকে রয়েছে। সে দু—হাতে শক্ত মুঠিতে জানালার গরাদ ধরে দাঁড়াল। বুকের মধ্যে শব্দহীন একটা প্রতিরোধ ঘনিয়ে উঠছে। মাছগুলো পুকুরের তলায় জলের চাপ সহ্য করে যেমন, এখন নিথর তেমনই সে এই নীরবতার চাপ গ্রহণ করছে। সে তার বাল্য, কৈশোর, যৌবনের স্মৃতির চাপ আত্মস্থ করবে। ধপে ধাপে সে শৈশবে ফিরে যেতে পারে, খুবই সুখের সফর হবে সেটা, কিন্তু ভবিষ্যতের দিকে হাঁটাটা? স্মৃতিতে ভরা একটা বিরাট বোঁচকা মাথায় নিয়ে হাঁটা!

সে তীক্ষ্ন নজরে দূরের দাওয়ার দিকে তাকাল। কেউ কি ওখানে বসে রয়েছে! থাকার কথা, আজ পারুলও জেগে থাকবে। বিছানা ছেড়ে উঠে এসে নিশ্চয়ই ওখানে বসবে। টর্চটা জ্বেলে একবার দেখবে কি?… মুখের উপর টর্চের আলো পড়েছিল বলেই পারুল চোখ বন্ধ করে ফেলে আর শ্রীগোপাল তখনই ওর হাতের কাটারিতে…

দাওয়ায় কেউ কি বসে? এত অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। সে একটা হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বন্ধ করে দিয়েছিল। স্পন্দন বন্ধ মানেই কি নৈঃশব্দ্য! বড়ো মূল্যবান শব্দ এই ধকধকানিটা, সে একটা মূল্যবান শব্দ বন্ধ করার জন্য দায়ী। একমাত্র পারুলই জানে, কেন সে দায়ী। আজ কি পারুল ঋণ শোধ করল? ওর চোখে বোধহয় সেই কথাই ছিল। ও কি ঋণমুক্ত হল?… হওয়া যায় কি, যাবজ্জীবন থেকে কখনো বেরিয়ে আসা যায় কি?

জানালার বাইরে অন্ধকার আর নৈঃশব্দ্য। দাওয়ায় এসে একজন বসবে। পারুলের চোখে পলকের জন্য তখন একটা আলো ফুটে উঠেছিল। সেই আলোটাই কি বিরাট হয়ে গিয়ে বলবে, ‘আপনিই সব কিছুর মালিক’!

সে জানালায় দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ন নজরে তাকিয়ে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *