দ্বিতীয় আততায়ী

দ্বিতীয় আততায়ী – উপন্যাস – মতি নন্দী

খুটখুট শব্দ।

রীণার ঘুম খুব সজাগ। কান পেতে রইল আবার শোনার জন্য। ঘরের দুটো জানালাই খোলা। বাইরের দালানে রতন ঘুমোচ্ছে। সম্ভবত রান্নাঘরে বেড়াল ঢুকেছে।

শব্দটা আবার হল।

রীণার মনে হল বোধহয় উপরের গৌতমবাবু। ফেরেন অনেক রাতে। খবরের কাগজের রিপোর্টার। কিছুক্ষণ আগে অফিসের গাড়ি ওকে নামিয়ে দিয়ে গেছে গলির মুখে। তন্দ্রার ঘোরেও রীণা তা টের পেয়েছিল। লোকটির নানান বাতিক, হয়তো জুতোর তলা চেঁছে গোড়ালি ঠুকছে।

আবার শব্দ—এবার একটু জোরেই।

রীণা ধড়মড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। খুটখুটুনিটা উপরে নয়, রান্নাঘরেও নয়, পাশের ছোট্ট ঘরটাতেই যেন। ও ঘরটায় আছে ভাঙা তোরঙ্গ, বেতের ঝুড়ি, ছেঁড়া লেপ, শিশি—বোতল, মাদুর, পুরোনো জুতো আর যত রাজ্যের পুরোনো পত্রপত্রিকা। দরজায় শিকল দেওয়া থাকে। দরজাটা এই ঘরের মধ্যেই।

রীণা ভয় পেল। ফ্ল্যাটে সে আর রতন। হয়তো চোর ঢুকেছে কিংবা ঢোকার চেষ্টা করছে। গৃহস্থ সজাগ এই ইঙ্গিতটুকু দিলে চোর নিশ্চয় পালাবে। রীণা গলা খাঁকাল।

খুটখুট শব্দটা হতে থাকায় ভাবল চোর নয়। রীণা ঘরের আলো জ্বালাল। চোখ পড়ল টেবলে। টেবলটা ছোটোঘরের দরজার লাগোয়া। ফুলদানিটা কিনারে সরে রয়েছে। দরজাটা খুলবে কি খুলবে না ভাবতে ভাবতে সে টেবলের মাঝখানে ফুলদানিটা সরিয়ে রাখল। রতনকে তুলে এনে একসঙ্গে ঢোকা উচিত। দিনকাল যা পড়েছে। রতন বুড়ো মানুষ তবুও যদি দাঁড়িয়ে থাকে অনেক ভরসা পাওয়া যাবে। গত পাঁচদিন হল রাহুল বাড়ি নেই। বাড়ির কেউই জানে না এখনও তার স্বামী পাঁচদিন নিরুদ্দেশ।

অকাতরে ঘুমোচ্ছে রতন। দাড়ি কামায় সাতদিন অন্তর। মুখটা হাঁ হয়ে রয়েছে। সামনের দুটো দাঁত নেই। হাতদুটো অসহায়ের মতো পাশে ছড়ানো। মায়া হল রীণার। হয়তো দেখা যাবে ইঁদুর লাফালাফি করছিল। দরকার নেই বুড়ো মানুষটার ঘুম ভাঙিয়ে। রীণা ফিরে এল।

আলো নিবিয়ে খাটে শুতে যাচ্ছে, তখন আবার শব্দ। কেউ যেন ডাকছে, শব্দটা চাপা হলেও, বাড়ির সদরে এইভাবেই আগন্তুকরা টোকা দেয়। কিন্তু ও ঘরের জানালায় তো মানুষ আসার কোনো উপায় নেই। এক, যদি পাইপ বেয়ে গলি দিয়ে কেউ উঠে আসে। কেন আসবে? চোর! তা হলে ডাকবার মতো সুর তুলে টোকা দেবে কেন? তা হলে?

ভাবতে গিয়ে রীণার হাত—পা জমে যাবার মতো অবস্থা হল এই গরমেও।

সাবধানে দরজাটার কাছে এসে শিকল খুলল। পাল্লাদুটো এঁটে রয়েছে। যাতে শব্দ না হয় তাই যথেষ্ট সময় নিয়ে চাপ দিয়ে দিয়ে খুলে ফেলল। সুইচ টিপে খেয়াল হল বালব নেই।

মেঝেয় জায়গা খুব অল্প। ধুলোয় কিচকিচ করছে। ভ্যাপসা বাসি গন্ধ। শোবার ঘরের আলো খোলা দরজা দিয়ে যতটুকু এসেছে, তাতে একমাত্র জানালাটা ঠাওর করে রীণা এগিয়ে গেল ভয়ে ভয়ে। ঘষা কাচের পাল্লা। চেষ্টা করেও রীণা ওধারে অন্ধকার থাকার জন্য কিছুই দেখতে পেল না। চাপা সুরে সে বলল, ‘কে?’

উত্তর নেই।

ওধার থেকে নখ দিয়ে যেন কেউ কাচে আঁচড় কাটল। জানালার কড়া ধরে রীণা সজোরে টানল। দীর্ঘদিন খোলা হয় না। একটুখানি কেঁপে পাল্লাদুটো আগের মতোই রয়ে গেল। বাঁ হাতে একটা পাল্লা চেপে আবার টানল, মনে হল ওধার থেকেও কেউ যেন তাকে সাহায্য করছে। একটা ক্যাঁচ শব্দ করে জানালা খুলে গেল। ছোট্ট জানালাটা জুড়ে কোমর পর্যন্ত একটা মানুষের ছায়া।

থরথর করে কেঁপে উঠল রীণা। অস্ফুটে বলল, ‘কে?’

‘আমি। আমি রাহুল।’ ফিসফিসে গলাটা ভরাট, উত্তেজিত। ‘রতন কি ঘুমোচ্ছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আলো নিবিয়ে বারান্দার দরজাটা খুলে রাখ, রতন যেন না জাগে, তাড়াতাড়ি।’ দমচাপা দ্রুত নির্দেশ দিল ছায়ামূর্তি।

রীণা শোবার ঘরে এল। আলো জ্বলছে, জানালা খোলা, পর্দা গুটিয়ে তুলে রাখা। পর্দা ফেলে সে জানালা বন্ধ করে আলো নিবিয়ে দিল। রতনের পাশ দিয়ে পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে সাবধানে খিলটা খুলে দাঁড়িয়ে থাকল।

ছায়ার মতো মানুষটার ছায়া ঝুল বারান্দার পাঁচিল টপকে ঢুকে এল। নিজেই খিল দিল। নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিচ্ছিল। রীণা ফিসফিস করে বলল, ‘রতন দেওয়াল ঘেঁষে শুয়ে।’

‘তা হলে তুমি আগে যাও।’

রীণাকে অনুসরণ করে শোবার ঘরে এসে, দরজা বন্ধ করে আলো জ্বালল।

যেন আগে থেকেই তৈরি ছিল রীণা। খাটে হেলান দিয়ে দু—হাতে চোখ ঢাকল। পিছন ফিরল এবং উপুড় হয়ে বালিশে মুখ চেপে ধরল।

রাহুল বিব্রত হয়ে এপাশ—ওপাশ চাইল। দরজা—জানালা সবই বন্ধ। ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এগিয়ে এল। ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, ‘খুব খিদে পেয়েছে, আছে কিছু?’

‘না বোধহয়। দেখি রান্নাঘরে কিছু আছে নাকি।’

উঠে দাঁড়াল রীণা। কোনোদিকে না তাকিয়ে দরজার দিকে এগোচ্ছিল, রাহুল হাত টেনে ধরল।

‘কোথায় যাচ্ছ?’

‘রান্নাঘরে।’

‘তাই বলে এত শব্দ করে। আগে আলো নেবাও, সাবধানে দরজা খুলে পা টিপে যাও।’

রীণা অবাক হয়ে রাহুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। ধীরে ধীরে তার বোধশক্তি ফিরে এল। আস্তে দরজা খুলল। অন্ধকারে রতন ঘুমোচ্ছে। আন্দাজে পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। রান্নাঘরে বালতিটা দরজার ধারেই ছিল, ঢোকামাত্র পায়ে লাগল।

‘কে?’

রতনের ঘুম ভেঙে গেছে। কাঠের মতো রীণা দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘আমি।’

‘বউদি।’

‘হ্যাঁ।’

‘কী কচ্ছো?’

রতন উঠে রান্নাঘরের দরজায় এল। রীণা আলো জ্বালল।

‘লেবু খুঁজতে এসেছি। কীরকম চোঁয়া ঢেকুর উঠছে। জল দিয়ে খাব।’

‘দাঁড়াও আমি কেটে দি।’

বুড়ো মানুষটি গত পাঁচ বছরে একবারও নিজেকে রাঁধুনি বা চাকর ভাবতে পারেনি। রীণা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল তার লেবু কাটা। রস নিংড়ে, মিশিয়ে গেলাসটা এগিয়ে দিল। রীণা এক চুমুকে শেষ করল। মনে হল সত্যিই তার তেষ্টা পেয়েছিল।

‘আর লাগবে?’

‘না থাক, তুমি ঘুমোও।’

শোবার ঘরে এসেই রীণা অবাক। রাহুল নেই। খাটের তলা দেখল, আলমারির পাশটাও। নজরে পড়ল ছোটোঘরের দরজাটা বন্ধ। ওটা তো খোলাই ছিল এতক্ষণ। ঠেলতেই খুলে গেল। দেওয়ালে পিঠ দিয়ে রাহুল দাঁড়িয়ে। রীণাকে দেখে সে এগিয়ে এল। ইশারায় জানায় এই ঘরেই সে থাকবে।

‘বালিশ আর বেডকভার দাও।’

রীণা জিনিসগুলো দিয়ে দিল রাহুলকে।

‘বাইরে যেমন শেকল দেওয়া ছিল দিয়ে দাও।’

ঘর থেকে বেরিয়ে রীণা দরজা বন্ধ করল। আলো নিবনো। বিছানায় বসে ভাবল এবার সে কী করবে?

.

জায়গা নেই পাশ ফেরার মতো। রাহুল কোনোরকমে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। ঘরের মধ্যে যত রাজ্যের জঞ্জাল আর বাজে জিনিস। গুমোট ভ্যাপসা গন্ধ। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জানালাটা খোলা। বন্ধ করা উচিত। উঠতে গিয়েও সে উঠল না। স্নায়ুগুলো টানটান, যেন প্রত্যেকটিতে পাথর বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। জানালাটা বন্ধ করে দিলে হাওয়া যেটুকু আসছে, তাও আসবে না, খোলাই থাক, রাত্রে বাইরে থেকে কেউ তাকে দেখতে পাবে না।

উত্তেজিত ক্লান্ত শরীরে ঘুম আসে না। তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো ছুটে বেড়াতে হয়েছে এই ক—টা দিন। ক—দিন? এক সপ্তাহ…এক মাস…এক বছর? আজীবন?

ঘরটা এত গরম! রীণার দেওয়া বেডকভারটায় সে শুয়ে। সেটা এত মোটা বলেই বোধহয় গরমটা বেশি লাগছে। মেঝের ধুলোয় কিচকিচ করছে। ভ্যাপসা বাসি গন্ধ। ভাঙা কাঠের চেয়ারে জড়ো করে রাখা ছেঁড়া তোশকটা থেকে আরশোলার চলাফেরার মতো শব্দ হচ্ছে। এইসব জঞ্জাল, আরশোলা, ইঁদুর, পোকামাকড় নিয়েই তাকে থাকতে হবে। রাহুল ভাবল, বেঁচে আছি। এখনও ধরা পড়িনি। হয়তো বেঁচে যাব…বেঁচে থাকব।

রীণাকে ব্যাপারটা বোঝাতে হবে। আবেগসর্বস্ব অল্পবুদ্ধির মেয়েমানুষ। একটু নাটক করতে হবে, এই যা। রাহুলের ঠোঁট মুচড়ে গেল। রতন সর্বক্ষণই বাড়িতে, দিনের বেলায় হয়তো সুযোগ হবে না। রাত্রে এই ঘরে রীণাকে ডেকে একসময় সে ওকে বুঝিয়ে দেবে।

কী বুঝিয়ে দেবে? কেন সে এমন একটা কাজ করে বসল? কিন্তু সেটা কি খুব সহজে কয়েকটা কথার জাল বুনে স্ত্রীকে বোঝানো যাবে?

সে মনে করার চেষ্টা করল সেই রাতের ঘটনাটাকে। একটা উপন্যাসে বর্ণিত কয়েকটা পাতার মতন সে ব্যাপারটা পড়তে শুরু করল চোখ বুজে—

.

সকাল থেকে মেঘ, দুপুরে বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে। সন্ধ্যার পরই রাস্তা নির্জন। রাত তখন প্রায় আটটা। বাসস্টপ থেকে হেঁটে শর্টকাট করতে প্লাইউড কারখানার টিনের পাঁচিলের পাশ দিয়ে সে দ্রুত চলেছিল ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে। সরু রাস্তাটায় আলো নেই। কারখানার ভিতরে একটা বালব জ্বলছিল কিন্তু তার যৎসামান্যই পাঁচিল ডিঙিয়ে বাইরে আসতে পেরেছে। তার ডানদিকে মাঠ, যেটা প্লট করে বিক্রি হয়ে গেছে কিন্তু এখনও বাড়ি ওঠেনি। মাঠের মধ্যে আগাছার ঝোপগুলো চাপড়া চাপড়া অন্ধকার হয়ে রয়েছে। মাঠের ওপাশে অ্যাপার্টমেন্ট বাড়িতে আলো জ্বলছে।

একটা কাতর আর্তনাদ, আর ঝোপের আন্দোলনের শব্দ। সে থমকে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল, ‘কে?’ কাতরানি আর শব্দ থেমে গেল। সেই সময় তার মনে হল দুটো লোক অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে চারধারে তাকিয়ে পাঁচিলের গা ঘেঁষে মাটিতে পোঁতা একটা দু—হাত লম্বা খোঁটা দেখতে পেল।

মাঠ থেকে একজন ছুটে আসছিল। তার চিৎকার শুনে সে বুঝতে পেরেছিল মেয়ে।

‘বাঁচাও বাঁচাও—।’ তারপরই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মেয়েটির পিছনে ছিল একজন, সেও ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর।

শুধু এইটুকু ঘটনা। কিন্তু তার মাথায় কেন যে রক্ত উঠে এল, রাহুল গত চারদিনে বার কয়েক তার কারণ খুঁজেছে, পায়নি। বাঁশের খোঁটাটা ধরে ষোলো ইঞ্চি বাইসেপসের বাহু টান দিতেই, বৃষ্টিভেজা নরম জমি থেকে সেটা উঠে আসে। যে লোকদুটো এগিয়ে আসছিল তারা হঠাৎই ঘুরে গিয়ে ছুটে পালায়।

সে মাঠের মধ্যে ছুটে গেছিল। লোকটা তখন সবেমাত্র উঠে দাঁড়িয়েছে। চাপা গলায় বলেছিল, ‘এক পা এগিয়েছিস কী চাকু চালিয়ে দোব।’ এই শুনেই সে বাঁশের খোঁটাটা বসিয়েছিল লোকটার মাথায়। এরপরও লোকটা দৌড়েছিল অন্তত তিরিশ গজ। তারপর চিৎকার করে পড়ে গেল। আর কী এক অন্ধ আবেগে সে লোকটার মাথায় পর পর ক্ষ্যাপার মতো আঘাত করে গেছিল। তারপরই সংবিৎ ফিরে পেয়ে সে নিথর দেহটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আবছা আলো, ঝিরঝিরে বৃষ্টি, স্তব্ধ নির্জন চরাচর আর একটা মানুষের উপুড় হয়ে থাকা। দেখে সে ভয় পেয়ে যায়। সে বুঝতে পেরেছিল, ওটা একটা মৃতদেহ।

তখনই মাথার মধ্যে কে যেন ফিসফিস করে বলে উঠল: রাহুল তুমি খুনি! এখন তুমি পালাও। তারপরই সে দৌড়ল।

জানালা দিয়ে একফালি রোদ এসে পড়েছে। রাহুল হাত বাড়িয়ে তরল সোনার মতো রোদ তালুতে সংগ্রহ করল। হাতটা ঘুরিয়ে ধরতেই সোনায় মাখামাখি হয়ে গেল। হাতটা মেলে রেখে সে উপুড় হয়ে শুয়ে রইল।

‘এত দেরি করলে বাপু আমরা কিন্তু অন্য লোক দেখব।’

চমকে হাত সরিয়ে নিল রাহুল। জানালার উলটোদিকে সামনের বাড়ির বারান্দা। সেখানে দাঁড়িয়ে ঠিকে ঝি আর বাড়ির গিন্নি। বুকে ভর দিয়ে সরীসৃপের মতো পিছলে রাহুল পেছনে সরতেই দেওয়ালে পা ঠেকে গেল। সে ওদের দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু ওখান থেকে ওরা কি তাকে দেখতে পাচ্ছে?

বোধহয় না। ঘরটা বেশ অন্ধকার। তবু জানালাটা একসময় বন্ধ করে দিতে হবে। রাহুল অপেক্ষা করতে লাগল। কিছু পরেই বারান্দাটা ফাঁকা হয়ে গেল। কাকে যেন দাঁত মাজার জন্য তাড়া দিচ্ছে। ওদের বড়ো মেয়েটির সঙ্গে রীণার ভালোই আলাপ আছে। নাম মায়া, বছর ষোলো—সতেরো বয়স। আসা—যাওয়া করে।

রাহুল উপুড় হয়ে পড়ে রইল মেঝেয় থুতনি ঠেকিয়ে। এই ছোটোঘরের দেওয়ালের পরেই পাশের ফ্ল্যাট। চিনেমাটির বাসন ভাঙার শব্দ হল। ওপরের ঘরে কেউ চলাফেরা করছে। রাস্তায় একদল কচি গলা চিৎকার করল। সবথেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে একটা কাকের কণ্ঠস্বর। প্রচুর শব্দ একসঙ্গে নানান কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আলাদা করে এক—একটা শব্দ বেছে নিতে গেলে বহুক্ষণ মন দিতে হয়। সে সময় কার আছে?

পা দিয়ে ভাঙা তোরঙ্গে রাহুল ধাক্কা দিল। ফাঁপা শব্দ হল। সে জানে এ শব্দটা কেউ শুনতে পাবে না। শোনার জন্য কেউ কান পেতে নেই। তার জন্য কেউ কি ওত পেতে বসে আছে? কলকাতার লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে আলাদা করে তাকে খুঁজে বার করবে পুলিশ! গোয়েন্দারা কি ওত পেতে আছে? এখানে প্রতিদিন কি তারা খোঁজ করতে আসবে, নিশ্চয় না। নজর রাখবে, কিন্তু কাল রাতে কি তারা দেখেছে এ বাড়িতে তাকে ঢুকতে? নিশ্চয় না, তা হলে এতক্ষণে ওরা নিশ্চয় এসে পড়ত।

রাহুল তোরঙ্গে আবার ধাক্কা দিল। এই শব্দটা তাকে ভরসা দিচ্ছে। অনেক কিছুর অধিকার তা হলে এখনও অটুট রয়েছে! অধিকারগুলো কী, তা অবশ্য নির্ধারণ করতে হবে। আপাতত বোঝা যাচ্ছে দিনের বেলাটা নিরাপদ।

জানালার কার্নিশ ধরে একটা বিড়াল হেঁটে গেল। একবার ঘাড় ফিরিয়েছিল, সম্ভবত বন্ধ থাকা জানালাটা হঠাৎ খোলা দেখে। তবে ভ্রূক্ষেপ না করেই চলে গেল। তার মজা লাগল। অপেক্ষায় রইল কখন আবার ও ফিরে আসে। এইভাবেই সে অপেক্ষা করত যখন সুধাংশুকে চিফ অ্যাকাউন্টেন্টের ঘরে যাবার জন্য বেয়ারা ডাকতে আসত। বলির পাঁঠার মতো সুধাংশু যেত। আর ডিপার্টমেন্টের তারা কয়েকজন মুখ লুকিয়ে হেসে অপেক্ষায় থাকত ওর ফিরে আসাটা দেখার জন্য। মত্ত ষাঁড়ের মতো সুধাংশু ছুটে আসত, ‘অসম্ভব, সন অফ এ বিচ, চাকরি ছেড়ে দোব।’

রাহুল ডান পা—টা পাশের দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছিল। পায়ে শক্ত কিছু একটা ঠেকতেই উঠে বসল। একটা হাতুড়ি। এই ফ্ল্যাটে প্রথম আসার দিন ঠেলাগাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে টেবলের পায়াটা খুলে যায়। গৌতমের চাকর সিঁড়িতে দাঁড়িয়েছিল। ওর কাছ থেকে সে হাতুড়িটা চেয়ে নিয়েছিল। ফেরত দিতে ভুলে গেছে, ওরাও চেয়ে নিতে ভুলে গেছে। এত তুচ্ছ জিনিসটা!

হাতুড়িটা রাখতে গিয়ে রাহুলের কী খেয়াল হল নিজের মাথায় সেটা বার কতক ঠুকল। ব্যথা লাগে, অথচ আরামও বোধ হল। রেখে দিল। বেড়ালটা আর ফিরছে না। আর তখনই তার মনে হল পাশের ঘরে কেউ যেন চলাফেরা করছে। কেউ যেন হঠাৎ গলা টিপে ধরল তার। অসহায়ের মতো আত্মরক্ষার জন্যই যেন সে হাতুড়িটা শক্ত করে চেপে, কাঠ হয়ে বসে রইল। উৎকর্ণ হয়ে থাকল, কোনো শব্দ নেই। বোধহয় ভুল হয়েছে। হামাগুড়ি দিয়ে দরজার পাল্লার জোড়ে চোখ রাখল।

জোড়ের মাঝে পোস্টকার্ড গলে যায় এমন ফাঁক। সেখানে ভ্রূ লাগিয়ে তাকালে শোবার ঘরের এক—চতুর্থাংশ দেখা যায়। এই অংশটির মধ্যে পড়ে টেবলের বাঁ ধার, খাটের উপরের দিক অর্থাৎ যেখানে বালিশগুলো রয়েছে, দেওয়ালের সাদা অংশ যেটুকুতে ছবি, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি নেই, ইজিচেয়ারের দুই হাঁটু, আর মাঝে মাঝে দরজার পর্দা, যখন হাওয়ায় নৌকোর পালের মতো ফুলে ওঠে।

ঘরে কেউ রয়েছে। রাহুল কতকগুলো ব্যাপার এখন বুঝতে পারে। কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে কি না, কেউ কাছেপিঠে রয়েছে কি না, নড়াচড়া কতটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, চলাফেরার শব্দে কীসের ইঙ্গিত ইত্যাদি।

ওর মনে হল ঘরে কেউ রয়েছে। কে থাকতে পারে? নিশ্বাস বন্ধ করে শব্দ শোনার চেষ্টা করল। তারপরই মনে হল, এত মনোযোগ দিয়ে মানুষটাকে আবিষ্কারের কী দরকার, এ তো রতন! এইভাবেই তো শব্দ হয় তার ঝাঁট দেবার। হাঁটুর কাছে কাপড় গুটিয়ে উবু হয়ে বসে। মসৃণ মেঝেয় সাবধানে ফুলঝাঁটা টানে। কারণ রাহুল বিছানায়, সরকারিভাবে তখনও তার ঘুম ভাঙেনি। ঝাঁট দেবার ছপছপ শব্দটা সে পছন্দ করে না মোটেই।

রাহুলকে ভয় করে রতন, ভালোও বাসে। বরং রীণাকে যেন সে কিছুটা অপছন্দ করে। হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তোলায় রীণা একদিন আপত্তি করেছিল। রীণাও বিশেষ পছন্দ করে না ওকে। রোজই রাহুলের কাছে ওর সম্পর্কে কিছু—না—কিছু বলত। বুড়ো মানুষ, নিড়বিড়ে, এক মিনিটের কাজ দশ মিনিট লাগায় ইত্যাদি শুনে শুনেও রাহুল দ্বিতীয় কোনো লোক নিয়োগের জন্য ব্যস্ত হয়নি।

না হওয়ার কারণ রতনের বয়স, আনুগত্যবোধ এবং পিতৃসুলভ চালচলন। ওর বয়স ষাট—পঁয়ষট্টির মধ্যে। বরখাস্ত করলে কোথাও কাজ পাবে না, ফলে সে তটস্থ হয়ে থাকে এবং প্রাণপণে হুকুম তামিলের চেষ্টা করে অথচ বয়সোচিত কারণেই সে এই সংসারের কর্তা—গিন্নির সাংসারিক বুদ্ধিশুদ্ধির অভাবগুলি বিরক্তি প্রকাশ করে শুধরে দেয়।

শেষোক্ত ব্যাপারটি রাহুলের ভালোই লাগে। বারো বছর বয়সে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে যেত টালা পার্কে। ফিরত ট্রামের দ্বিতীয় শ্রেণিতে, ভাড়া ফাঁকি দিয়ে। একদিন মুখোমুখি হয়ে গেল কন্ডাক্টরের। ট্রাম তখন জোরে চলেছে। এক বৃদ্ধ হাত চেপে তাকে আগলে ধরলেন,—’অ্যাঁ পালানো হচ্ছে, নামতে গেলে যে পড়ে মরবে সে খেয়ালও কি নেই? চুপটি করে দাঁড়াও।’

গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, যাতে রাহুলের মনে হল কন্ডাক্টর ভাড়া চাইলে এই বুড়ো তার ভাড়া দিয়ে দেবে। কন্ডাক্টর চেয়েছিল। বৃদ্ধ ভাড়া দেয়নি, হেসে বলেছিল, ‘এই বয়সেই ফাঁকি দিতে শিখছে। বড়ো হলে যে পকেট মারবে!’ ট্রাম দাঁড়াতেই রাহুল লাফিয়ে নেমে পড়ে। রাগে, অপমানে কানের ডগা জ্বালা করছিল।

তাদের সঙ্গে খেলতে যেত জ্যোতি নামে একটি ছেলে। চলন্ত ট্রাম থেকে নামায় ওস্তাদ ছিল। কন্ডাক্টরের তাড়া খেয়ে একদিন সে ডান পা—টা ভাড়া হিসাবে চাকার তলায় দিয়ে দেয়। রাহুলের মনে হয়েছিল সেই বুড়োটা থাকলে জ্যোতি খোঁড়া হত না।

তার মাঝে মাঝে মনে হত রতনই সেই বুড়োটা।

মসৃণ মেঝের ওপর চেয়ার সরাবার শব্দ হল। রাহুলের মনে পড়ল, এইভাবেই রীণা তাকে বিছানা ত্যাগের শেষ সংকেত জানাত। একদিনের কথা তার মনে পড়ল—

.

‘আটটা বাজতে চলল বিছানা তুলবে কখন?’ বলতে বলতে রীণা আয়নার কাছে মুখটা এগিয়ে এনে, সাবধানে টিপ পরল। বুক, কোমর, পাছা এবং মুখটাকে ঘুরিয়ে— ফিরিয়ে নানান ভঙ্গিতে দেখল।

‘অত করে যে দেখছ, দেখবে তো সেই বুড়োটা! সেজন্য সাজাগোজার কী দরকার? বুকের কাপড়টা একটু সরিয়ে দিয়ো আর পাছাটা সুইং করিয়ে হেঁটো, তা হলেই কাজ হবে।’ এই ধরনের কথা রীণার গা—সওয়া হয়ে গেছে। শুধু চট করে একবার দেখল রতন ঘরে আছে কি না।

‘নাও, ওঠো খুব হয়েছে। ওই বুড়োটার জন্যেই অ্যাসিসটেন্ট হেডমিস্ট্রেস হয়েছি, মনে থাকে যেন।’

‘এবং হেডমিস্ট্রেসও হবে।’

রীণা গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেল। বুড়োটা অর্থাৎ সনৎপ্রসাদ কুমার যার বড়োবাজারে ঝাড়ামশলার দোকান, দেশে জমিজমা, পুকুর, দু—খানা ফ্ল্যাট বাড়ি, একটি স্ত্রী, আটটি ছেলেমেয়ে, মা—র নামে একটি স্কুল, বৃন্দাবনে বাবার নামে ধর্মশালা। কোষ্ঠকাঠিন্যের অস্বস্তি, সন্তানাদি মানুষ না হওয়ার দুঃখ এবং যুবক থাকার ইচ্ছা প্রভৃতি আছে—তিনি রীণাকে স্নেহের চোখে দেখেন।

রাহুলের ধারণা, বুড়োটাকে যৌন ক্ষমতা হারাবার ভয় পেয়ে বসেছে, তাই রীণার সান্নিধ্যে চাঙ্গা হতে চায় এবং নিশ্চয় রীণা এজন্য তাকে সচেতনভাবে সাহায্য করে। একবার এসে ঘণ্টা দুয়েক ছিল, তার মধ্যে চারবার অন্তত উল্লেখ করেছিল, ‘আপনাদের ছেলেপুলে হয়নি কেন? অ্যাঁ?’ রাহুল মুচকি হেসে প্রসঙ্গটার পাশ কাটাতে চেয়েছিল কিন্তু বুড়োটা জোঁকের মতো লেগেছিল।

‘আমার বে—র প্রথম তিন বছরেই তিন ছেলে। আমার বড়ো ছেলের দু—বছরে দুটি। বড়ো মেয়ের চার বছরে তিনটি। প্রথমদিকেই তো ছেলেপুলে হওয়া ভালো। তবে আপনারা শিক্ষিত, আজকাল আবার কত ওষুধবিসুদ বেরিয়েছে। কিন্তু বেশি বয়সে বাপ হলে ছেলেকে মানুষ করে তুলতে তুলতেই দেখবেন বুড়ো হয়ে গেছেন। আর অল্পবয়সে হলে, বয়স যখন পঞ্চাশ তখনই ছেলে রোজগার শুরু করে দেবে। ব্যস, বসে বসে তখন বুড়ো—বুড়িতে শুধু খাও আর ঘুমোও। এই দেখুন না উনসত্তর চলছে, দেখে বুঝতে পারবেন? কোনো টেনশান নেই, ছেলেরাই সব দেখাশোনা করছে।’

সনৎকুমারের মতে এই হল সংসার—ধর্মের সার কথা। আর দু—ঘণ্টা ধরে এই আলোচনাটা রীণার সঙ্গেই হয়েছিল। রাহুল খাটের এককোণে কাত হয়ে শুয়ে বাসি খবরের কাগজটা তখন পড়ার ভান করছিল। পাঁচ বছর চাকরি করে রীণা কীভাবে অ্যাসিসটেন্ট হেডমিস্ট্রেস হল, রাহুল সেটা জানার দরকার বোধ করেনি বা জানতে ইচ্ছা হয়নি। শুধু এক—আধবার মনে হয়েছিল যাদের ন্যায্য দাবি ডিঙিয়ে ও ওপরে উঠল, তারা মনে মনে ওর সম্পর্কে কী ভাবে!

কিন্তু রীণার ভাবনা, সনৎকুমার কীসে সন্তুষ্ট হয়। ফাউন্ডার—প্রেসিডেন্টের প্রত্যেকটা কথাতেই সে সায় দিল। ‘কত সামান্য থেকে আজ এইখানে উঠেছি,’ সেই কাহিনি শুনতে শুনতে নানাভাবে বিস্মিত হয়ে বুড়োকে খুশি করল। সেই রাতেই রীণা পিল খেতে প্রথম অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিল। রাগে আপাদমস্তক জ্বালা করে উঠলেও রাহুল ওর ইচ্ছায় আপত্তি করেনি, তর্কও নয়। কিন্তু তিন মাস পরও কোনো ফল না ফলায়, সে ডাক্তারের কাছে হাজির হয়েছিল।

.

‘কতক্ষণ লাগে একটা ঘর ঝাঁট দিতে? ভাত নামিয়ে নাও তাড়াতাড়ি।’

রাহুল দরজার জোড়ে চোখ রাখল। রীণা স্নান করে এসেছে, ভিজে কাপড়গুলো হাতে। বারান্দায় নিজেই মেলবে। রতন তা হলে বাজার থেকে ফিরে ঝাঁট দিচ্ছিল। এবার রান্নাঘরে যাবে। রীণা জোড়ের ফাঁক থেকে সরে গেছে। বালিশগুলো থাবড়ে ফুলিয়ে রাখতে রাখতে রতন বিছানা গোছগাছ করছে। রীণা ঘরে ঢোকামাত্র চুপ করল। এখন রীণা স্কুলে যাবার সাজ করবে। সাধারণত এই সময় আমি থাকি বাথরুমে, রাহুল জোড়ে চোখ রেখে ভাবল, তখন শায়া আর ব্রেসিয়ারটা বদলে নেয়। এটা কোনোদিন দেখা হয়নি।

রতন বেরিয়ে যেতেই রীণা খাটে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল ঠিক মুখোমুখি। জোড়ের ফাঁক দিয়ে রাহুল সম্পূর্ণভাবে দেখতে পাচ্ছে তাকে। আট—ন ফুট দূরে মাত্র। স্থির দৃষ্টিতে এইদিকেই তাকিয়ে। রাহুল বুঝতে পারছে না এখন ও কী ভাবছে।

উদবেগ, রাহুলের তাই মনে হচ্ছে, আবার মনে হচ্ছে ভয় কিংবা উত্তেজনা। দুই ভ্রূর মাঝে ফুলে উঠেছে চামড়া। নিশ্বাসটা গাঢ় হচ্ছে, দ্রুত হচ্ছে। কণ্ঠনালি ওঠানামা করল ঢোঁক গেলায় আর ঠোঁট দুটি যেভাবে ফাঁক হয়ে রয়েছে তাতে মনে হয় ভিতরে প্রবল আলোড়ন ঘটছে। জানালা বন্ধ করতে সরে গেল রীণা। আবার এল। ঘরের দরজা বন্ধ করে খিল এঁটে এগিয়ে আসতেই জোড়ের ফাঁক ঢেকে গেল।

শিকল খোলার সময় লোহায় লোহায় ঘষার একটা শব্দ শুনল রাহুল। দরজার কাছ থেকে সে এক পা পিছিয়ে গেল। সন্তর্পণে পাল্লাদুটো খুলে রীণা দাঁড়িয়ে। কড়িকাঠের কাছে ঘুলঘুলি দিয়ে আলো আসছে। ফলে ওর টিকালো নাক, কানের ডগা, বাম বাহু, চুলের কিয়দংশ বেশ স্পষ্টই দেখা যায়।

‘তুমি বাথরুমে যাবে না?’

রীণা এমনভাবে বলল যেন রাহুল অন্য জগতের লোক। প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন ওর দরকার হয় কিনা, সে—সম্পর্কে যথেষ্টভাবে নিশ্চিত নয়।

‘কেন যাব না?’

‘কীভাবে যাবে?’

রাহুল চিন্তিত হল। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা। ও পাশের বাড়ির তিনটে জানালা থেকে দেখা যায়। তবে বারান্দার পাঁচিলটা কোমর সমান উঁচু। হামা দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু রতন?

‘ঠিক চলে যাব তুমি বরং রতনকে দোকানে পাঠাও।’

রীণা দরজা বন্ধ করে দিতেই রাহুলের প্রথমে মনে হল, তার স্বাধীনতার একটা বিরাট ভাগ থেকে এখন সে বঞ্চিত। নিজের দেহ বা তার প্রাকৃতিক যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে চিন্তামুক্ত থাকার স্বাধীনতা আর তার নেই।

এখন থেকে বাথরুমে যাবার দরকার হলে তাকে রীণার মুখাপেক্ষী হতে হবে। ঘরের জানালা বন্ধ করে, রতনকে বাইরে পাঠিয়ে, ওপাশের বাড়ির জানালায় কেউ আছে কি না দেখে রীণা তাকে সংকেত জানালে তবে সে বাথরুমে যেতে পারবে। যদি রীণা না থাকে এবং তখন যদি বেরোবার দরকার হয়? রাহুল তা ভাবতে গিয়ে ধীরে ধীরে রেগে উঠতে শুরু করল। তার মনে হল, আত্মরক্ষার জন্য এ কোন দশায় পৌঁছালাম!

দরজা খুলে রীণা চাপা স্বরে ডাকল। উঁকি দিয়ে রাহুল দেখল, বারান্দার তারে ভিজে কাপড়টা মেলে দিয়ে অনেকখানি ঢেকে দিয়েছে কিন্তু সবটা ঢাকেনি। ঘর থেকেই হামাগুড়ি দিয়ে সে বারান্দায় বেরোল। সেই সময় একবার মুখটা ঘুরিয়ে রীণা তার দিকে তাকিয়েছিল। চতুষ্পদ প্রাণীর দিকে প্রবল কৌতূহলে শিশুরা হয়তো এভাবে তাকায়। রাহুল সেই মুহূর্তে নিজেকে কুকুর ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারল না। তাড়া খাওয়া, দু—পায়ের ফাঁকে লেজ ঢোকানো এবং করুণাপ্রার্থী! নিজেকে ধিক্কার দিয়েই সে বাথরুমে ঢুকে গেল। দরজা বন্ধ করার আগে শুনল রীণা বলছে, ‘রতন কিন্তু দশ মিনিটের মধ্যেই এসে যাবে।’

রাহুলের মনে হল, এই আটত্রিশ বছরের জীবনে কখনো কোনো ইতর প্রাণীর সঙ্গে নিজেকে তুলনা করিনি। মেধা, বুদ্ধি, মহত্ত্ব, করুণা, ভালোবাসা, এমনকী ক্রোধ, আমার অধিগত বা জন্মগত কোনো গুণাবলি দেখবার কোনো সুযোগই এই চার দেওয়ালের মধ্যে নেই। আমি এখন ইচ্ছা করলেই কথা বলতে পারি না একমাত্র নিজের সঙ্গে ছাড়া। না গান, না হাসি। খাওয়া, মল—মূত্রত্যাগ এবং ঘুম ছাড়া আর কিছু করার নেই। অবশ্য বইপড়া, লেখা বা ঠোঙা তৈরির মতো কোনো কাজ করতে পারি। কিন্তু এগুলি আমার দেহকে বাঁচিয়ে রাখতে কোনো সাহায্যই করবে না। আমি পালিয়েছি শুধুই বাঁচার তাগিদে, আমার বিদ্যাবুদ্ধির নির্দেশ ছাড়াই ইতর প্রাণীর মতো। যেভাবে একটা সৈনিক পরিখা থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে মেশিনগানের প্রতিরোধের মধ্য দিয়েই শত্রুর দিকে ধেয়ে যায় বীরত্ব দেখাতে নয়, এ ছাড়া তার বাঁচার আর অন্য উপায় নেই বলেই। সেইভাবেই পালিয়েছিলাম। জৈব অস্তিত্ব রক্ষার সহজাত প্রেরণায় এবং অসাড় মস্তিষ্কে। একে এখনও অস্বীকার করতে পারি না, এজন্য আমি নিজেকে কাপুরুষও ভাবতে পারছি না।

কিন্তু কুকুরের কথা ভাবছি। এই প্রাণীটি হয়তো—বা সাহসী, কর্তব্যনিষ্ঠ কিন্তু নিকৃষ্ট চরিত্র বোঝাবার জন্য একটা বিশেষণ। কুকুরের কয়েকটি বিশেষত্ব এখন আমাতে যে বর্তেছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অপরিচিত কেউ এলে আমি চিৎকার করতে পারব না, আগে দরজা খুলে যেমন বলেছি, ‘আরে পরিমল! অনেকদিন পর…ভেতরে আয়’—এখন আর বলা সম্ভব নয়।

কিংবা অপর একটা কুকুর দেখে তাকে কামড়াবার জন্য ছুটে যেতে পারব না যেমন গৌতমবাবুর ফ্ল্যাটে গিয়ে গরবাচভের গ্লাসনস্ত বা মারাদোনাই গ্রেটেস্ট, তাই নিয়ে তর্ক করতাম।…কুকুরদের বিবাহিত স্ত্রী থাকে না, কিন্তু আমার আছে। ফলে সুবিধাটা এই যে, কোনো কুকুরীর সহচর হওয়ার জন্য আর পাঁচটা কুকুরের সঙ্গে কামড়াকামড়ি করতে হয় না।

রাহুলের মনে হল, শুধু এই ব্যাপারেই আমি কুকুর নই। রীণাকে শুইয়ে তার বুকের উপর উঠতে পারি (কখনো বাধা দেয়নি)। এই স্বাধীনতাটুকু এখনও দখলে আছে। শ্রম, বিশ্রাম, আনন্দ, সুখ এইসবের জন্য এই চার দেওয়ালের মধ্যে এবার থেকে রীণার দেহখানা সম্বল করা ছাড়া আর তার কিছু নেই।

ভাবতে ভাবতে রাহুলের মনে পড়ল গত পাঁচদিনে সে স্ত্রীলোক বিষয়ে বিন্দুমাত্রও চিন্তা করেনি। কী করে বাঁচব, কী করলে ধরা পড়ব না, শুধু এই ভাবনাতেই সে আচ্ছন্ন ছিল। আর যেইমাত্র এই ঘরের নিরাপত্তাটা পেল আর অমনি তার মন ব্যালান্স হারাতে শুরু করেছে। এটা হওয়া উচিত নয়। এখন সে বিপদের মধ্যগগনে। সামান্য অসাবধান হলে ধরা পড়ে যেতে পারে।

নিজেকে সংহত করতে, অনুভূতিগুলোকে প্রখর করতে গভীর কোনো বিষয়ের ভাবনার মধ্যে ঢুকতে পারলে ভালো হয়। রাহুলের মনে হল, আদিম মানব আর আমার মধ্যে নৈকট্য কতটা সে বিষয়ে তো ভেবে দেখা যেতে পারে!

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকনমিকস অনার্স পাওয়া ইউনাইটেড কেমিক্যালসের অ্যাসিসট্যান্ট পাবলিক রিলেশনস ম্যানেজার এবং পাঁচ হাজার বছর আগের মানুষ কিংবা কুকুর এই শিরোনামে সন্দর্ভ রচনার কথা যদি ভাবা যায়, তা হলে কেমন হয়!

.

একটা চিনেমাটির প্লেটে চারখণ্ড টোস্ট আর এক গ্লাস চা, রীণা দরজার একটা পাল্লা খুলে মেঝেয় রেখেই আবার দরজা বন্ধ করে দিল। রাহুল শিকল তুলে দেওয়ার শব্দ শুনতে পেল। গোগ্রাসে টোস্টগুলো শেষ করে তারিয়ে তারিয়ে চা—টুকু খেল। দেখে নিয়েছিল আজকের খবরের কাগজটা খাটের উপর। দেখে একবার ইচ্ছে হয়েছিল জানতে কলকাতায় কোথাও নারী ধর্ষণ হয়েছে কি না আর ভিভ রিচার্ডস ছিয়াশি নট—আউট ছিল, শেষ পর্যন্ত কত করল! জন্মাষ্টমী আজ। রীণার স্কুল নিশ্চয় বন্ধ। সারাক্ষণ বাড়িতে থাকলে ভালোই। কোনো কিছুর দরকার হলেই ডেকে বলা যাবে। কিন্তু কীভাবে ডাকব? রাহুল বিভ্রান্ত বোধ করল। এত তুচ্ছ অথচ বিপজ্জনক একটা সমস্যার আবির্ভাব ঘটতে পারে তা ধারণা করতে পারেনি। গলা থেকে কোনো স্বর বার করা যাবে না। কুকুর অন্তত কুঁইকুঁইও করতে পারে। দরজায় টোকা দেওয়া যায়। কিন্তু রতন যদি ঘরে থাকে আর শুনতে পায়!

রাহুল ভেবে দেখল, প্রথমেই এই সমস্যাটা মেটানো দরকার। তার কাছে এখন সবথেকে জরুরি বিষয়, রীণাকে ডেকে প্রয়োজন জানাবার উপায় আবিষ্কার করা। কিন্তু শূন্য চিনেমাটির প্লেট আর গ্লাসটা চোখের পক্ষে পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে। প্রোডাকশান ম্যানেজার কৃষ্ণমূর্তির বাড়ির বারান্দায় এইরকম প্লেট, অবশ্য কলাইয়ের, সে দেখেছে। আলসেশিয়ানটা সেখানেই বাঁধা। প্লেটটা তার পাশে থাকে আর একটা বাটিতে জল। রাহুলের মনে হল, জল তেষ্টা পেলে সে কী করবে! ঘরের কুঁজোটা এনে রাখা ছাড়া উপায় নেই। রোজ তাতে জল ভরার কাজটা রীণাকেই করতে হবে।

ঘরের বাইরে রীণার ক্রুদ্ধ স্বর শোনা যাচ্ছে। জোড়ের ফাঁকে চোখ রেখে সে দেখতে পেল না। নখ দিয়ে দরজা আঁচড়াতে লাগল যদি শুনতে পায়। রীণা ঘরে ঢুকল, পিছনে রতন। রাহুল আঁচড়কাটা বন্ধ করল।

‘পই পই করে বলেছিলুম গোলমাল হতে পারে, কাপড়গুলো এনে রাখ, এনে রাখ। এখন আমি এই ময়লা শাড়ি পরে থাকব? একটা বুড়ো ভূত কোথাকার। কথা বললে শোন না কেন? অন্য কোনো বাড়িতে এমন কর্তামি করলে দূর করে দিত।’

রতনের জবাব শোনা গেল না। এখন ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না, সেটা ভালোই। যন্ত্রণাকাতর বৃদ্ধমুখ অত্যন্ত কষ্টদায়ক।

‘দাঁড়িয়ে থেকে আর কাজ বাড়িয়ো না, ওদিকে ভাতের তলা ধরে গেল হয়তো! তবে এই বলে রাখছি এবার যদি কথামতো কাজ না কর, তা হলে অন্য জায়গায় কাজ খুঁজে নিতে হবে।’

রাহুল চিন্তায় পড়ল। রতন কোথাও যাবে না বা ওর কোথাও যাবার জায়গা নেই। কিন্তু বলা যায় না, যেসব ভাইপোর কথা প্রায়ই বলত, হাতে করে মানুষ করেছি, এখন ভালো রোজগার করে, যারা প্রায়ই নাকি বলে, ‘কাকা আমাদের কাছে এসে থাক, দরকার কী বুড়ো বয়সে কষ্ট করে’—তাদের কেউ এসে যদি রতনকে এখন নিয়ে যায় তা হলে নতুন একটা লোক রাখতেই হবে। নিশ্চয় কোনো মেয়েমানুষ এবং রীণার অনুপস্থিতিতে কৌতূহলবশতই হয়তো একদিন, এ ঘরটা বন্ধ থাকে কেন জানতে শিকল খুলে উঁকি দিতে পারে।

ব্যাপারটা রীণাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। রতনের সঙ্গে কোনোরকম খারাপ ব্যবহার করা তার চলবে না। ওর অনাবশ্যক কোনো কৌতূহল নেই, অন্তত এ ঘরটা সম্পর্কে নেই। নিজের মতো করে কাজগুলো করতে দিলেই ও খুশি থাকে। তাই দেওয়া হোক, রীণা যেন কর্তৃত্ব ফলাবার চেষ্টা না করে। এখন এই সংসারে বা এই ফ্ল্যাটে কোনো রকমের পরিবর্তন ঘটানো চলবে না, পুলিশ নিশ্চয় এখনও ওয়াচ রাখছে।

রতন ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। রীণা ঘরেই আছে তবে দেখা যাচ্ছে না। রাহুল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে বসল। এখন তার কিছু করার নেই। জানালার খোলা পাল্লাটা দিয়ে আলো আসছে বটে, কিন্তু হাওয়া নেই। ওটা বন্ধ করলে আলো এবং হাওয়াহীন এই ঘরে কয়েক ঘণ্টার বেশি বাঁচা যাবে না। সুতরাং ঝুঁকি নিয়ে পাল্লাটা খুলে রাখতেই হবে। উপায় নেই। যারা মুক্ত সংসারে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদেরও তো ঝুঁকি নিতে হয়। যেমন রীণা। একটা খুনিকে ঘরে লুকিয়ে রাখার রিসক, হোক না স্বামী,…নিয়েছে তো! পুলিশ ঠিক কী কী প্রশ্ন করেছিল সেটা জেনে নিতে হবে। এখন পর্যন্ত নার্ভ শান্ত রেখেছে, হাউমাউ করে কান্না জোড়েনি বা প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুরু করেনি। আচরণে, কথায় অচঞ্চল শান্ত ভাবটা বজায় রাখা সহজ ব্যাপার নয়! তার শ্রদ্ধা জাগল রীণার প্রতি।

কিন্তু ভ্যাপসা গরমটা ক্রমশই অসহনীয় লাগছে। ওঘরে পাখা ঘুরছে। পুরোনো কিছু খবরের কাগজ একধারে ছড়ানো। তারই একটা ভাঁজ করে নিজেকে সে হাওয়া দিতে শুরু করল। কিন্তু কয়েক মিনিট পরই বিরক্ত লাগায় কাগজটা ছুড়ে ফেলল। এতে গরমবোধ যেন আরও বাড়ল। বাইরে হাওয়া আছে কি না লক্ষ করার জন্য জানালা দিয়ে তাকাল। ছাতের পাঁচিলে মেলে দেওয়া একটা শাড়ির প্রান্ত ঝুলছে ঠিক জানালা বরাবর। হাওয়া নেই তাই দুলছে না।

সে ভাবতে চেষ্টা করল শাড়িটা কার? অনুর না তার দিদি তনুর? এই শাড়িটা পরেই, যতদূর মনে পড়ে, অনু কয়েকবার তাদের ফ্ল্যাটে এসেছে আবার তনুকেও এটা পরে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। তনু কয়েকবার এসেছে, অতি লাজুক, রান্নাঘর আর ছাদের বাইরে গেলে দিশাহারা হয়। ঠিক বিপরীত প্রকৃতির অনু। দিনে বারদুয়েক তো এই ফ্ল্যাটে সকালে বা সন্ধ্যায় আসবেই।

রাহুলরা প্রথম যখন এখানে এল অনু তখনই ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছে। এক ছুটির দুপুরে ও রীণাকে শুনিয়েছিল সীতাংশুকে তার কতখানি ভালো লাগে আর সীতাংশুও প্রতি চিঠিতে সেই কথাই জানিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা চিঠি সে রীণাকে পড়িয়েও ছিল।

‘এইটুকু মেয়ের সঙ্গে এইসব নিয়ে কথা বলো কেন?’ রাহুল ভর্ৎসনা করেছিল।

‘ওইটুকু মেয়ে!…সীতাংশু ওকে কত পর্নো লিটারেচার পড়িয়েছে জানো?’

‘জেনে দরকার নেই…সীতাংশুটা কে?’

‘মোড়ের ব্যানার্জি মেডিকোর ছেলে। দাদার স্কুটারে চেপে মাঝে মাঝে এখান দিয়ে যায়। পয়সা আছে। অনুর দুখ্যু, সোনার বেনে না হয়ে যদি সে বামুনের ঘরে জন্মাত! একদিন জিজ্ঞেস করল, ‘বউদি আপনাদের বিয়েতে জাত নিয়ে আপত্তি ওঠেনি?’ আর একবার জানতে চেয়েছিল, ‘যদি আপত্তি উঠত তা হলে কী করতেন?’

রাহুলের মনে পড়ল একটা দৃশ্য। মাস তিনেক আগে দেখা। লুকিয়ে সীতাংশুর সঙ্গে ছবি তোলাতে যাবে বলে অনু রবিবার বিকেলে এসেছিল রীণার একটা ছাপা পলিয়েস্টার শাড়ি পরতে আর চুল বাঁধতে। সেই সময় রাহুল অফিসের এক ক্লায়েন্টকে লাঞ্চ খাইয়ে, আড্ডা দিয়ে ফেরে। ওর আসাটা অনু টের পায়নি। ঘরে ঢুকতে গিয়ে রাহুলকে থমকে পড়তে হয়। অনু দু—হাত তুলে স্লিভলেস ব্লাউজের পিঠের হুক লাগাচ্ছে। পরনে শায়া। তাকে দেখেই কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে, পিছন ফিরে অনু ড্রেসিং টেবলের উপর কুঁকড়ে ঝুঁকে পড়ল, রাহুল দ্রুত সরে যায়। রীণা তখন রান্নাঘরে পুডিং তৈরিতে ব্যস্ত।

দৃশ্যটা—কুঁজো হওয়া একটা সতেরো—আঠারো বছরের ডাঁটো দেহ, ব্লাউজ ও শায়ার মাঝে কোমর বেড় দিয়ে বাদামি রেশমের মতো মসৃণ কোমল ত্বক, নিতম্বের উপর আধময়লা সাদা শায়ার মাঝ দিয়ে একটা ভাঁজ—সে বহুদিনই মনে মনে চোখের সামনে পুঙ্খানুপুঙ্খ ফুটিয়ে তুলেছে। যতই দিন গেছে বরং সে যেন এর সঙ্গে আরও কিছু যুক্ত করেছে নিজের অজান্তেই।

প্রায়শই সে দেখে, অনু পিছন ফিরে ঝুঁকে পড়ছে না, শুধু চোখের পাতা নামিয়ে থরথর কাঁপছে বা যখন সে হঠাৎ দরজায় এসে দাঁড়াল তখনও ব্লাউজটা অনুর গায়ে দেওয়াই হয়নি। সে আরও আবিষ্কার করেছিল, এইরকম ভাবনায় রীণা তখন আর রান্নাঘরে নয়, স্কুলের কাজে আটকে পড়ে বাড়ি ফিরতে দেরি করছে। পরে রাহুল এই ধরনের দৃশ্য রচনার জন্য একটা কারণ খুঁজে পায়। সে ভেবেছিল, অনু নিশ্চয় রীণাকে তার অপ্রতিভ হওয়ার খবরটা জানাবে আর রীণা তাকে সেটা বলবে একটু সন্দিগ্ধ গলায়। কিন্তু রীণা কিছুই তাকে বলেনি অর্থাৎ অনু এটা চেপে গেছে।

এসব কল্পনা রুচিবিগর্হিত, অন্তত আমার পক্ষে শোভা পায় না, এইভাবে রাহুল বহুবার নিজেকে ধমকেছে, ভয়ও দেখিয়েছে, বিকৃত চিন্তা করতে করতে কখন কী করে ফেলবে আর মানইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। তবুও সে লক্ষ করেছে, অবৈধ অশ্লীল ছবি ফোটাবার মানসিক যন্ত্রটি তার আয়ত্তাধীন নয়। এই অক্ষমতা তাকে বার বার নিজের উপর রাগিয়ে তুলেছে।

কে যেন শাড়িটা তুলে নিল। কে তুলল দেখার জন্য রাহুল বুক চেপে জানালার দিকে এগোতে গিয়ে থমকে পড়ল। পুরুষের গলা শোনা যাচ্ছে ভিতর থেকে। দরজায় চোখ রাখল। ঘরে কেউ নেই। রীণা দালানে কথা বলছে কার সঙ্গে? পুলিশ? রাহুল মুহূর্তে বিদ্যুৎপৃষ্ট মৃতদেহের মতো কঠিন হয়ে গেল। মাত্র শ্রবণ ক্ষমতার দ্বারা এখন সে জীবিত। পুরুষ কণ্ঠটি নির্দিষ্ট মাত্রায় ধীর লয়ে কর্তব্য সম্পাদনের পেশাদারি ভঙ্গিতে নয়, লঘু কখনো বা দ্রুত, কণ্ঠে পূর্ণমাত্রায় বন্ধুত্বের প্রকাশ।

রাহুল ধীরে ধীরে শিথিল হতে শুরু করল। এখন সে দেখছে ঘরের মধ্যে ধূম্রবর্ণ আলো, অনুভব করছে দেহের ধাবমান রক্ত, স্বেদবিন্দুতে পিছল গাত্রত্বক এবং মুখের মধ্যে অম্ল স্বাদ। কার কণ্ঠস্বর, এ তথ্য জানার কৌতূহল তার হচ্ছে না। একবার শুধু সে ভাবল, মিথ্যেই ভয় পেয়েছিলাম।

পাশের ঘরেই এবার কথা হচ্ছে। রাহুল দেখতে পেল না রীণাকে। তার বদলে একটি যুবককে দেখল যাকে সে আগে এই পাড়াতেই দেখেছে বলে মনে হল। থুতনি কর্কশ, গালে দু—একটি মরা ব্রণের গর্ত, ছিপছিপে, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, লঘু ছেলেমানুষি ওর দাঁড়াবার ভঙ্গিতে। ভালো দরজির হাতে তৈরি ট্রাউজার্স। এই কি তবে অনুর সীতাংশু? তা ছাড়া আর কে হতে পারে! কিংবা রীণার বাপের বাড়ির কেউ?

‘আমি তো দাঁড়িয়েছিলুম দোকানের সামনে’, ছেলেটি উত্তেজিত স্বরে বলল। ‘দূর থেকে পুলিশের গাড়িটা আসছে, সার্চ লাইটের আলো। আমাদের গলি থেকেই তো বোমাটা ছুড়ল।’

‘ওভাবে তখন দাঁড়িয়ে থাকে?’ রীণার আদুরে ধমক রাহুল শুনল।

‘দাঁড়াব না তো কী করব, সব বাড়ির ছাদে, বারান্দায় লোক, তা ছাড়া রাস্তার সব আলো নেভানো, সব বাড়িরও। সে যে কী অন্ধকার কী বলব, একটা হাতিও যদি তখন হেঁটে যায় তো কেউ দেখতে পেত না। আর পুলিশের গাড়িগুলো বুনো শুয়োরের মতো ঘোঁত ঘোঁত করে ছুটে যাচ্ছে আর আসছে। বোমাটা পড়তেই দাদা শব্দ শুনে আমার হাত ধরে এমন টানল যে বেটাল হয়ে পড়ে গেলুম আর সেই মুহূর্তে গুলিটা এসে দেওয়ালে লাগল। যেখানে দাঁড়িয়েছিলুম তার এক ইঞ্চি কী দু—ইঞ্চি দূরে।’

‘ইসস’ রীণা শিউরে উঠল শব্দ করে, ‘কী ছেলে বল তো! যদি দাঁড়িয়ে থাকতে তা হলে কী হত?’

ছেলেটি তাচ্ছিল্য দেখাতে ট্রাউজার্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে পা—দুটো ফাঁক করে দাঁড়াল।

রাহুল আন্দাজ করল রীণা এখন ড্রেসিং টেবলটার সামনে দাঁড়িয়ে। কী করছে ওখানে? চিরুনি? টিপ? পাউডার? এই সবের কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত? ছেলেটি খাটে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। অর্থাৎ কিছুক্ষণ থাকবে।

‘তোমায় যে চা করে দেব তারও উপায় নেই। চিনি একদম ফুরিয়েছে।’

‘রেশন আনাননি? দোকান তো খোলা দেখলুম।’

‘তাই নাকি!’

রীণাকে দেখা গেল। সবটা নয়, ডান হাঁটু, ডান বাহু ইত্যাদি। ছেলেটির থেকে দু—হাত ব্যবধান। রতনকে ডেকে রেশন কার্ড আর টাকা দিয়ে দোকানে পাঠাল।

ঘামে সপসপ করছে জাঙিয়া। আজ ছ—দিন ধরে সে এটা পরে রয়েছে। জামাটা ছাড়া আর কিছুই শরীর থেকে খোলা হয়নি। এখনি চান করে পরিষ্কার পাজামা পরতে হবে।

ট্রাউজার্সটা খুলে সে সারা শরীরের ঘাম মুছল। দেওয়ালে পিঠ দিতেই ঘামটা শুষে নিল চুনবালি। দু—হাত তুলে মুখোমুখি হয়ে সারা শরীর দিয়ে দেওয়ালটাকে আঁকড়ে ধরল। ও ঘরে কী কথা হচ্ছে শোনার আগ্রহ তার নেই। বাতাসহীন, প্রায়ান্ধকার ভ্যাপসা গন্ধওয়ালা এই ছোট্ট ঘরটা তাকে উদব্যস্ত করে তুলছে। কানের পিছন, ঘাড় এবং কণ্ঠা দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। উলঙ্গ হয়ে রাহুল মেঝেয় গড়াগড়ি দিতে থাকল।

আর কথা হচ্ছে না। রাহুল উঠে দরজার জোড়ে চোখ রাখল। ঘরে কেউ নেই। ছেলেটা বোধ হয় চলে গেছে। রতনের ফিরতে অন্তত একঘণ্টা, নখ দিয়ে সে দরজা আঁচড়াতে শুরু করল।

রীণা আসছে না। টোকা দিল। তবুও আসছে না, জোরে ধাক্কা দিল কয়েকবার। হঠাৎ একটা সবুজ রং এগিয়ে এসে কালো হয়ে চোখের সামনে দাঁড়াল। রাহুল পিছিয়ে এল।

দরজাটা খুলেই রীণা অস্ফুট শব্দ করে মুখ ঘুরিয়ে নিল। রাহুল দ্রুত ট্রাউজার্সটা পরতে পরতে বলল, ‘চান করব। ভীষণ গরম, আমি আর পারছি না…আমি চান করব।’

‘রতন এসে পড়ে যদি!’

রাহুল শুনতে পেল না কথাটা, হামা দিয়ে ততক্ষণে বাথরুমের দিকে যেতে শুরু করেছে। রীণা তার পিছনে পিছনে এল। বাথরুমে ঢুকেই রাহুল বলল, ‘আমার পাজামাটা দাও, শিগগিরি।’

রীণা দ্রুত ঘরে এল। সময় এখন সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। রতনই নয় অন্য কেউও এখন এসে পড়তে পারে। লন্ড্রিতে কাচা পাজামাটা রীণার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে রাহুল বাথরুমের দরজা বন্ধ করল। ছোটো মগে বার বার জল ঢালার ধৈর্য এখন তার নেই। ট্রাউজার্স সমেত সে চৌবাচ্চচায় নেমে পড়ল।

মিনিট পাঁচেক পর দরজায় টোকা পড়তে রাহুল চৌবাচ্চচা থেকে উঠল।

‘কে?’

‘আমি, তাড়াতাড়ি নাও।’

‘হ্যাঁ, নিচ্ছি।’

‘প্যান্টটা কী করবে?’

রাহুল প্রথমে বুঝতে পারল না। জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে খেয়াল হল, ভিজে ট্রাউজার্সটা প্রকাশ্যে শুকোতে দিলে রতনের কৌতূহলী প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। অবশ্য ছোটো ঘরটায় নিয়ে গিয়ে তোরঙ্গটার উপর মেলে দিলে কোনো সমস্যা দেখা দেবে না। রাহুল এই প্রথম একটা জটিল অসুবিধার পাশ কাটাতে পেরে হালকা বোধ করল।

বাথরুমের ব্র্যাকেটে সাবান, মাজন এবং দাড়ি কামাবার সরঞ্জামগুলোয় তার চোখ পড়তেই সে অবাক হয়ে ভাবল, এগুলো ছাড়াই সে কয়েকটা দিন কাটিয়ে ফেলল কী করে? নিশ্চয় তার মুখে দুর্গন্ধ, শরীরে দুর্গন্ধ। গালে তালু ঘষল। কিন্তু এখন নিজেকে পরিষ্কার করার মতো সময় তার হাতে নেই।

রীণা আবার দরজায় টোকা দিল। রাহুল চৌবাচ্চচার খোলা জলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হয়ে গেছে। যাচ্ছি।’

ফিরে আসার সময় তার মনে হল, চার হাত—পায়ে চলাটা তো বেশ সহজই। যেন দু—পায়েই হাঁটছি। এটায় যেন শৈশবে ফিরে যাওয়ার মজা রয়েছে। আর একটু বাড়িয়ে ভাবলে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ হওয়ার অভিজ্ঞতা পাওয়া যাচ্ছে। দাঁত মাজা নেই, দাড়ি কামানো নেই, চুল আঁচড়ানো নেই…আছে অতর্কিত ভয়ের আক্রমণ।

বিষণ্ণ, করুণ চোখে রীণা তাকিয়ে দেখছে। ভিজে ট্রাউজার্সটা কাঁধে রেখে হামা দিয়ে যেতে যেতে রাহুল ঘাড় তুলে তাকাল, হাসল। জীবনটাকে নিছকই মুক্ত রাখার জন্য চার—পেয়ে হওয়া, এতে দুঃখ পাবার কী আছে! শোবার ঘরে পাখা ঘুরছে। রাহুল হাওয়ার নীচে বসল।

‘রতন ফেরার আগেই আমাকে চাট্টি ভাত দিয়ো।’

‘এখনও তো কিছু রান্নাই হয়নি।’

‘এই ছেলেটাই কি অনুর সীতাংশু?’

‘হ্যাঁ।’

‘এসেছিল কেন?’

‘যদি অনুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! অনুও তো সকালে একবার ঘুরে গেছে। শোবার ঘরে ঢোকেনি বলে তুমি জানতে পারোনি।’

‘তুমি কি বেরোবে এখন?’

‘হ্যাঁ, স্কুলে যাব।’

‘আজ জন্মাষ্টমী…।’

‘বন্ধ থাকলেও, গার্জিয়ান কমিটির সঙ্গে বসতে হবে। ওদের কিছু কমপ্লেন আর সাজেশানস—।’

‘কিন্তু আমার সঙ্গে যে তোমার একবার বসা দরকার। কেন, কীজন্য, কীভাবে…তোমার কি জানতে ইচ্ছে করছে না? পুলিশের কাছ থেকে, খবরের কাগজ থেকে, লোকজনের মুখ থেকে নিশ্চয় অনেক কিছু শুনেছ। কিন্তু আসল লোকটির কাছ থেকে কি—’

‘যা শুনেছি সেটাই যথেষ্ট।…আমি ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছি। আর কিছু শোনার নেই।’

রাহুল লক্ষ করল রীণার চোখমুখ কঠিন হয়ে উঠল। বেশ বোঝা যাচ্ছে, ও এখন তার কথা বিশ্বাস করবে না। ধরেই যেন রেখেছে, রাহুল বানিয়ে বানিয়ে একটা গল্প ফাঁদবে।

‘ঘরটা পরিষ্কার করা দরকার আর কুঁজোটা।’

‘রতন রোজ জল ভরে। কুঁজোটা দেখতে না পেলে জিজ্ঞাসা করবে।’

‘বলবে ভেঙে গেল, ফেলে দিয়েছি।…আমার খাওয়া—দাওয়ার ব্যবস্থাটা ভাবতে হবে। বাথরুমে যাওয়ার দরকার হলে…’ রাহুল তাকিয়ে রইল রীণার মুখের দিকে।

‘আজ স্কুলে না গেলেই নয়?’

‘হ্যাঁ, যেতেই হবে।’

রাহুলের এখন বলতে ইচ্ছে করছে, তার থেকেও জরুরি আমার জন্য তোমার আজ এখানে থাকা। বদলে তার মুখ থেকে আবেদনের মতো বেরিয়ে এল, ‘নাইবা গেলে। কী আর এমন গুরুতর কথা—।’

রীণার মুখে বিরক্তি জমে উঠেছে দেখে সে থেমে গেল।

‘তোমার ঘরটা পরিষ্কার করে দি।’ রীণা ঝাঁটা আনতে ঘরের বাইরে গেল।

তোমার ঘর! রাহুল ভাবল, তা হলে তার একটা আলাদা অস্তিত্ব তৈরি হল। দু—জনের মধ্যে ব্যবধান মনে মনে হয়তো এসে গেছে। সে ডাবল বেড খাটের দিকে তাকাল। মাথার বালিশদুটো আর পাশাপাশি নেই, এখন একটার উপর আর একটা। রীণা আলমারি থেকে বেডকভার বার করে তাকে দিয়েছে। বিছানায় পাতা প্লেইন সবুজটা দেয়নি, বালিশটাও দেয়নি। দেখতে না পেয়ে যদি রতন প্রশ্ন করে, বালিশ—বেডকভার গেল কোথায়?

এখন প্রতি পদে তাদের ভাবতে হচ্ছে রতন যেন কিছু সন্দেহ না করে। রতনের চোখে যেন না পড়ে।

রীণার ঝাঁট দেওয়া এক মিনিটেই শেষ। মেঝেয় জায়গা কোথায় যে ঝাঁটা বুলোবে। সে বালতিতে জল আর ন্যাতা নিয়ে এল। দু—তিনবার মুছল।

‘ঘরের প্রায় সব জিনিসগুলো ফেলে দেওয়া দরকার। কোনোটাই কাজে লাগে না অথচ রেখে দেওয়া হয়েছে।’ রাহুল বিরক্ত স্বরে বলল।

‘এসব তুমিই রেখেছ। তোরঙ্গটা কী দরকার ছিল রাখার। তুমিই বললে পুরোনো বই, ম্যাগাজিন ওর মধ্যে রেখে দাও। কিন্তু ওই বই—ম্যাগাজিনগুলোই বা রাখার কী দরকার? কেউ তো একবারও উলটেও দেখল না এতদিনে।… এসবই উঞ্ছ মানসিকতা।’ রীণার গলার স্বর উচ্চচগ্রামে উঠেছে। সভয়ে রাহুল হাতটা বাতাসে থাবড়ে থাবড়ে তাকে গলা নামাতে ইশারা করল।

জানালায় পর্দা ঝুলছে। অন্য বাড়ি থেকে দেখা যাবে না ঘরের মধ্যেটা। ট্রানজিস্টারটা কোথায়? টিভি কেনার পর রেডিয়ো আর শোনাই হয় না। ব্যাটারিও নিশ্চয় নিঃশেষ। তারা দু—জন কথা বলার সময় ট্রানজিস্টারটা চালিয়ে দিলে একটা ভয় থেকে রেহাই মিলবে।

‘আজই ট্রানজিস্টারের ব্যাটারি আনিয়ো, আর ধূপ।’

‘ধূপ কীজন্য?’

‘ঘরে বিশ্রী ভ্যাপসা একটা গন্ধ। ধূপ জ্বালালে তবু কিছুটা কমবে।’

‘ধূপের গন্ধ আর ধোঁয়া দরজার ফাঁক দিয়ে যখন এঘরে আসবে আর রতন ধরে নেবে নিশ্চয় আগুন—টাগুন ধরে গেছে আর তাই ভেবে তাড়াতাড়ি দরজা ঠেলে যখন ঢুকবে তখন তো ভূত দেখার মতো চিৎকার শুরু করবে।’

রাহুল অপ্রতিভ হয়ে প্রসঙ্গটা ঘোরাবার জন্য বলল, ‘ন্যাপথলিন কিনে এনো, গন্ধ হবে পোকামাকড়ও পালাবে।’

‘তুমি কি ওই ঘরে পাকাপোক্তভাবে বাস করার কথা ভাবছ নাকি!’ রীণা জিজ্ঞাসা করল না, শুধু সারাজীবনে যত বিস্ময় সে সঞ্চয় করেছে, সেগুলো একসঙ্গে প্রকাশ করল তার গলা দিয়ে।

রাহুল জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইল। কারণ সে নিজেও এখন পর্যন্ত জানে না, সে কী করবে। শুধু জানে, তাকে বাঁচতে হবে।

‘এভাবে কতদিন লুকিয়ে থাকবে?’

‘যতদিন সম্ভব…যতদিন—’

সদর দরজার কলিং বেল বেজে উঠল। কথা অসমাপ্ত রেখে, রাহুল ছিটকে তার কুঠুরিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করল, ভিতর থেকে খিল বা ছিটকিনি নেই। সে দরজায় পিঠ দিয়ে পা ছড়িয়ে বসল।

খবরের কাগজে যা কিছু বেরিয়েছে রাহুল তা পড়েছে। মেয়েটার বাড়ি রানাঘাটে। রোজই কলকাতায় আসত ‘দেহ বিক্রয় করে’ রোজগারের জন্য। বয়স পঁচিশ। নাম ছবি। তাকে নিয়ে রাত আটটা নাগাদ জনা চারেক লোককে অন্ধকার মাঠের দিকে হেঁটে যেতে দেখা গেছিল বলে এক স্থানীয় চা—ওয়ালা জানায়। ওই মাঠে লোকগুলি ছবিকে পরপর ধর্ষণ করার পর তাকে গলা টিপে মারে। ছবির দেহে অলংকার বা তার হাতব্যাগে টাকা পাওয়া যায়নি। মনে হয় গহনা বা টাকার জন্যই তাকে খুন করা হয়েছে। ধর্ষণকারীদের মধ্যে একজনকে মৃত অবস্থায় কাছেই পাওয়া যায়।

তাকে বাঁশ দিয়ে মাথায় মেরে খুন করা হয়। পুলিশের অনুমান এই খুন গহনা বা টাকার ভাগ নিয়ে বিবাদেরই ফল। নিহত ব্যক্তির নাম শ্যামল, সে ঘটনাস্থলের আধমাইল দূরের শীতলাতলার বাসিন্দা। তার নামে কয়েকটি ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মামলা আছে। আততায়ীরা কেউ ধরা পড়েনি, তবে পুলিশ জোর তল্লাশ চালাচ্ছে। তাদের ধরার মতো সূত্র পুলিশ পেয়েছে।

রাহুলকে ভাবিয়েছে ওই ‘ধরার মতো সূত্র’ কথাটা। সে কিছু কি ফেলে এসেছে মাঠে? কলম, রুমাল, ঘড়ি, জুতো, মানিব্যাগ, কাপড়ের টুকরো, মাথার চুল?…হাতের ছাপ, পায়ের ছাপ? হ্যাঁ বাঁশের খোঁটাটায় হাতের ছাপ থাকতে পারে, কিন্তু তারপরই তো জোরে বৃষ্টি নেমেছিল। হাতের বা পায়ের ছাপটাপ কি আর তাতে ধুয়ে যায়নি? তা ছাড়া কিছুই তো সে ফেলে আসেনি?

চা—ওয়ালাটা কি শুনছে, কি দেখেছে? ওই লোকটাই ‘সূত্র’ হতে পারে। রাহুল বুঝতে পারছে না, লোকটা তাকে চেনে কি না। অনেক লোকই শর্টকাট করার জন্য মাঠের পথটা ধরে। চা—ওয়ালা সবাইকে কি চিনে রেখেছে? সেও তো ভালো করে মুখটা কখনো দেখেনি, কখনো ওর দোকান থেকে চাও খায়নি। ওর কাছ থেকে পুলিশ কি জানতে পারবে?

আরও দুটো লোক ছিল যারা ছুটে পালায়। তাদের কেউ ধরা পড়েনি। শ্যামলের মতো লোকের সঙ্গী যখন নিশ্চয় ওরাও ডাকাতি—ছিনতাই করে। ওরা দু—জন ছবিকে খুন করেনি, কেননা ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে ছবির চিৎকার করার সময় ওরা দূরে ছিল। ছবির কাছে ছিল শ্যামল, সেই গলা টিপেছে। অন্য দু—জন তখন ছুটে পালাবার সময় জানতও না শ্যামল ছবিকে খুন করছে এবং সে নিজেও দ্বিতীয় এক আততায়ীর হাতে খুন হতে চলেছে। লোকদুটো তাকে দেখেছে। হয়তো শ্যামলের মতো ওরাও আধ মাইলের মধ্যেই বাস করে। ওরা তাকে দেখলে চিনতে পারবে কি না সে বিষয়ে রাহুলের সন্দেহ আছে। আলো যথেষ্টই কম ছিল। কিন্তু শ্যামলের খুনি যে তারা দু—জন নয়, এই কথাটা বলার জন্য ওরা কি পুলিশের কাছে যাবে?

মোটেই নয়। এরা হার্ডকোর ক্রিমিনাল। একটা সেক্সবেচুনি মফস্সলের গরিব মেয়েকে ঠকাবে এবং লুঠও করবে স্থির করেই তাকে ওরা এনেছিল। মেয়েটা চেঁচাতে এবং তার এসে পড়াতেই গলাটা টিপে দিয়েছে। সে এসে পড়েছিল বলেই রাহুলের বিশ্বাস, ছবি মরল। না হলে… তা হলেও বোধ হয় মরত। এদেরই হাতে কিংবা এইডসে কিংবা… এত রকমে মরা যায় যে রাহুল এই নিয়ে আর ভাবতে চায় না।

তবে ছবির টাকা—গহনার ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে… এটা মনে পড়লেই রাহুলের হো হো করে হেসে ওঠার ইচ্ছে হয়। সোনাদানা গায়ে দিয়ে রানাঘাট থেকে কেউ কি এই ব্যবসা করতে আসে? আর ‘বিবাদ’ যে হয়েছে এটাই বা পুলিশ বুঝল কী করে! সোজা ব্যাপারটাকে জটিল করে না তুলতে পারলে বোধ হয়, বুদ্ধির পরিচয় দেওয়া যায় না।

কিন্তু সূত্র ধরে পুলিশ এই ফ্ল্যাটে এসেছিল, রীণার সঙ্গে কথা বলে গেছে। ওরা জানল কী করে? কী কথাবার্তা হয়েছে, রীণা তা বলতে চায়নি। স্কুল থেকে ফিরলে ওকে চেপে ধরতে হবে। কথা বলার সুযোগ রতন জেগে থাকা পর্যন্ত পাওয়া যাবে না। রতন না থাকলে এই কুঠুরিতে অন্ধকারে বসে তাকে ভেপসে মরতে হত না। এখন তা হলে সে শোবার ঘরে পাখার হাওয়ার নীচে হাত—পা ছড়িয়ে খাটে শুয়ে থাকতে পারত।

রতনটাকে কি বিদায় করা যায় না?

চিন্তাটা আসা মাত্র সে কুঁকড়ে গেল। এতকাল ধরে যে করুণা, মায়া সে এই বৃদ্ধটি সম্পর্কে পোষণ করে এসেছে সেটা কখন যেন নিজের স্বার্থের, দৈহিক নিরাপত্তার প্রশ্নে উবে গেছে। রাহুল অপ্রতিভ বোধ করল নিজের কাছেই। মহৎ, সৎ অনুভবগুলো দেখছি এই একটা জিনিসের কাছে জব্দ—নিজের প্রাণ নিয়ে যখন প্রশ্নটা ওঠে। অস্বাভাবিক কিছু নয়, পৃথিবীর সব মানুষের কাছে এটাই রক্ষা করার তালিকায় এক নম্বরে।

রীণা স্কুল থেকে ফিরল ক—টার সময় রাহুল সেটা তার হাতঘড়ি থেকে বুঝতে পারল না। দম না দেওয়ায় ঘড়িটা বন্ধ। তবে সামনের বাড়ির ঝিয়ের গলা থেকে আন্দাজ করল চারটে বেজে গেছে। স্কুলের মিটিং ছিল এগারোটায়। এতক্ষণ ধরে কি গার্জেনরা বসে থেকেছে!

রাহুল কুঁজো থেকে গ্লাসে জল গড়িয়ে খেল। বসবাসের জন্য ঘরের এটাই নতুন উপকরণ। একটা চিনেমাটির প্লেট অবশ্য রয়েছে কিন্তু ওটা বার করে দিতে হবে। রীণা ভাত খেতে বসে রতনকে বাথরুমে পাঠিয়েছিল, সাবানজলে ভিজিয়ে রাখা বালিশের ওয়াড়গুলো কাচতে। ডাইনিং স্পেশ অর্থাৎ দালান থেকে শোবার ঘরের দরজায় ভাতের প্লেট, তাতে ডাল—তরকারি—মাছ ঢেলে একটা অদ্ভুত খাদ্য বানিয়ে, রীণার পৌঁছতে দশ সেকেন্ডও লাগেনি।

শিকল খুলে দরজার পাল্লা ফাঁক করে, প্লেটটা মেঝেয় রেখে ঠেলে দিয়েছিল। কোনো কথা না বলে দ্রুত দরজা বন্ধ করে শিকলটা আবার তুলে দেয়। রাহুল খুব তৃপ্তিভরে প্লেটটা শেষ করেছিল। ঘোঁট পাকানো খাদ্য খেতে তার কোনো অসুবিধা হয়নি।

রীণা খাটে বালিশে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে। স্কুলের শাড়িটা বদলায়নি। একদৃষ্টে সে ছোটো ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে কী ভাবছে। রতন বাইরে থেকে কী জিজ্ঞাসা করল, রীণা মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘টেবিলেই থাক, দরকারি জিনিস। তুমি হাত দিয়ো না।’ তারপর কী ভেবে উঠে ঘরের বাইরে গেল আর ফিরে এল খবরের কাগজে মোড়া দড়িবাঁধা একটা প্যাকেট হাতে। সেটা ছোটো টেবিলের উপর রেখে লেখার প্যাড আর কলম নিয়ে খাটে উপুড় হয়ে লিখতে শুরু করল।

জোড়ের ফাঁক দিয়ে রাহুলের মনে হল সে যেন থিয়েটার দেখছে। রীণা জানে সে এই ঘরে যা কিছু করুক বা বলুক, সবসময়ই তার একজন দর্শক আছে। হোক না স্বামী, আড়াল থেকে কেউ সদাসর্বদা লক্ষ করতে থাকলে সেও আড়ষ্ট হয়ে যাবে। এক ধরনের নজরবন্দি দশার মধ্যে থাকতে থাকতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। রাহুল এটা অনুভব করতে পারলেও, নিরুপায়।

যদি রতন না থাকত, তা হলে কত স্বচ্ছন্দে রীণা এই দরজাটা খুলে রেখে তার কাজকর্ম করতে পারত! রতনকে বিদায় করা দরকার।

একটা চিঠি লিখল রীণা। কাগজটা ভাঁজ করে সে ঘরের বাইরে গেল। রতনের সঙ্গে কথা বলছে। কী চিঠি? কাকে চিঠি?

‘চা আমি করে নিচ্ছি। তুমি আগে এটা দিয়ে এসো।’

মিনিট পাঁচেক পর সদর দরজা খোলার ও বন্ধের শব্দ হল। গ্লাসে চা নিয়ে রীণা ঘরে ঢুকল। শিকল খুলল।

‘জানালার পর্দা।’

‘টেনে দিয়েছি।’

রাহুল বেরিয়ে এসে চায়ের গ্লাস নিল। খাটে বসল। রীণা নিজের চায়ের কাপ নিয়ে এসে প্যাকেটটা খুলছে।

পাউরুটি, বিস্কুটের প্যাকেট, জেলির শিশি! রাহুল জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল।

‘সবসময় তো খাবারদাবার দিতে পারব না… এগুলোই তখন খেয়ো।’

‘ভালোই করেছ।’

‘হাতে করে আসার সময় ভয় করছিল।’ শাড়ি খুলতে খুলতে রীণা পিছন ফিরে দাঁড়াল।

‘ভয়! কীজন্য?’ রাহুল বিস্কুটের প্যাকেট ছিঁড়ে একটা বার করল।

‘পুলিশের ওয়াচ তো নিশ্চয় আছে। হাতে এত খাবার নিয়ে যেতে দেখে সন্দেহ করতে পারে।’

‘এসব জিনিস তো সব পরিবারেই প্রায় দরকার হয়, এতে সন্দেহ করার কী আছে!’

‘কিছুই নেই, কিন্তু এখন আমাকে সর্ব ব্যাপারে ভয়ে ভয়ে থাকতে হচ্ছে। চলাফেরা, কথা বলা, কেনাকাটাতেও পর্যন্ত। নতুন কুঁজো কিনতে দিতে পারিনি, যদি কেউ মনে করে হঠাৎ এখনই কিনা পুরোনোটা ভাঙল! তোমার দুটো প্যান্ট লন্ড্রিতে রয়েছে, আনতে পারছি না।… অদ্ভুত একটা কমপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে, কিছুই আর স্বাভাবিকভাবে করতে পারছি না। বাইরে বেরোতেই মনে হয়, কেউ যেন লক্ষ করছে, ফলো করছে।’

শাড়ি পরা হয়ে গেছে। রাহুল দ্বিতীয় বিস্কুট দাঁতে ভাঙল। প্যাকেটটা রীণার দিকে বাড়িয়ে ধরল। একটা তুলে নিয়ে সে কাপে চুমুক দিয়ে রাহুলের পাশে বসল। দু—জনে কিছুক্ষণ নিজেদের চিন্তায় ডুবে গেল।

‘রতনকে কোথায় পাঠালে!’

‘নন্দিতার কাছে। আজ এগারো দিন স্কুলে আসছে না, পা ভেঙে পড়ে আছে। কিন্তু সেজন্য নয়… পরশুর আগের দিন খবর পাঠিয়েছিল, ওর হাতে কাজের লোক আছে, অল্পবয়সি, বিবাহিতা, দেশ থেকে সবে এসেছে। পাঠিয়ে দেবে কিনা জানতে চেয়েছে।’

‘কী লিখলে!’ রাহুল উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইল। ‘রতনটা খুব অসুবিধে করছে।’

রীণা একটু অবাক হয়েই বলল, ‘রতনকে ছাড়াতে বললে তুমিই তো আপত্তি করতে… ‘যাক বুড়ো মানুষ, এই বয়সে যাবে কোথায়, কে ওকে কাজ দেবে’ এইসব বলে তো আমাকে বোঝাতে! এখন বলছ অসুবিধা করছে?’

‘হ্যাঁ বোঝাতাম। তখন অবস্থাটা অন্যরকম ছিল।’

‘কার অবস্থা? আমার, এই সংসারের…না রতনের?’

‘আমার অসুবিধেটা কি একটা গুরুত্ব পাবার মতো ব্যাপার নয়?’

‘কিন্তু এখন রতনকে নিয়ে আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না, আর এটাও আমার কাছে এখন খুব দরকারি ব্যাপার, কেননা আমাকেই এখন সবকিছু টানতে হবে। পাড়া—প্রতিবেশী, স্কুলের কলিগরা ছাড়া পুলিশও আছে। সবাই এখন আমায় এড়িয়ে চলছে। অনু… যে দিনে দু—বার অন্তত আসত, সে পর্যন্ত গত চারদিনে একবার এসেছে, তাও লুকিয়ে, তাও সীতাংশুর সঙ্গে দেখা করতে। এই যখন অবস্থা, হঠাৎ কাজের লোককে ছাড়িয়ে দিলে—’

‘কেউ সেটা অত তলিয়ে দেখতে যাবে না।’

‘যাবে কি যাবে না তা আমি জানি না, তুমিও জান না। ঘরে বসে থাকা এক জিনিস আর বাইরে সবকিছু ফেস করা আর এক জিনিস।’

‘বাইরেটা যে কী জিনিস তা আমি তোমার থেকে ভালোই জানি।’

‘হ্যাঁ জান। বাইরে গিয়ে কী ফেস করেছ, তা তো আর লোকের কাছে বলার মতো নয়।’

‘কী করেছি বাইরে?’

‘রেপ… মার্ডার। এর থেকে নোংরা, জঘন্য আর কিছু মানুষে করতে পারে?’

রীণা উঠে দাঁড়িয়েছে। চাহনিতে আগুন। দু—চোখের মণি ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নাকের পাটা ফোলা। ঠোঁটদুটো ঘৃণায় অবজ্ঞায় দোমড়ানো। দেহটা শান্ত হয়ে ঈষৎ ঝোঁকানো।

রাহুল থম হয়ে শুধু স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘আমি রেপ করিনি…মেয়েটাকে স্পর্শ পর্যন্ত করিনি।’ ধীরে ধীরে দাঁত চেপে সে বলল। খুন করার কথাটা বলতে গিয়েও বলল না।

‘সাফাই গেয়ো না।’ রীণা চাপা গলায় ধমকে উঠল। ‘তুমি আমাকেও জড়িয়েছ তোমার পাপের সঙ্গে।’

‘তোমাকে জড়িয়েছি!’

‘একটা মার্ডারারকে সেল্টার দিলে আইন কি বউ বলে আমাকে ছেড়ে দেবে?’

রাহুল অবুঝ অবোধ শিশুর মতো রীণার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। যাকে দেখছে সে অন্য এক রীণা। একে সে চিনতে পারছে না।

‘নন্দিতাকে জানিয়ে দিলাম কাজের লোকের এখন দরকার নেই।’

রাহুল উঠে দাঁড়াল। শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে ধীর পায়ে সে নিজের কুঠুরিতে ঢুকে গেল। দরজা বন্ধ করল।

একটু পরেই দরজার একটা পাল্লা ফাঁক হল। কাগজের প্যাকেট মেঝেয় নামিয়ে রেখে রীণা দরজা বন্ধ করল।

অনেকক্ষণ পর রাহুল পাল্লার জোড়ে চোখ রেখে দেখল বিছানায় উপুড় হয়ে রীণা, বোধ হয় কাঁদছে। সে বুঝতে পারছে, ওর মানসিক যন্ত্রণা। যে অবস্থার মধ্যে পড়েছে সেটা তারই তৈরি। রীণার সহ্যশক্তি যে এতখানি, রাহুল এখন তা অনুভব করছে। ভয় শুধু তো তার একারই নয়, রীণাকেও ভাগ নিতে হয়েছে। চাপের মধ্যে পড়েও বুদ্ধি হারায়নি। খুঁটিনাটি সাবধানতার দিকে হুঁশ রেখেছে। সবথেকে বড়ো কথা, তাকে সহ্য করছে। রেপ, মার্ডার… এইসব সত্ত্বেও তার প্রতি মমত্ববোধটা হারায়নি। ওর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

মাঝরাতে রাহুল কুঠুরি থেকে বেরোল। বাথরুমে যাবে। অন্ধকার শোবার ঘরের মধ্য দিয়ে দরজার দিকে এগোচ্ছে তখন রীণা চাপা স্বরে বলে উঠল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’

‘বাথরুমে।…তুমি ঘুমোওনি?’

‘দাঁড়াও।’ রাহুলের প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে রীণা খাট থেকে নেমে এল। টর্চের আলো পড়ল মেঝেয়।

‘আমি আগে দেখি রতনকে। তারপর যেয়ো।’

সন্তর্পণে, সময় নিয়ে রীণা খিল নামাল। টর্চ জ্বেলে ডাইনিং—দালানটা দেখে এসে বলল, ‘যাও…বাঁদিক দিয়ে।’

বুড়ো মানুষটা কাত হয়ে হাঁটুমুড়ে অঘোরে। মুখ হাঁ হয়ে রয়েছে। কণ্ঠার আর পাঁজরের হাড়গুলো প্রকট। রাহুল তার পাশ দিয়ে পা টিপে বাথরুমের দরজায় পৌঁছাতেই রীণা টর্চ নিভিয়ে ফেলল।

রাহুল যখন বেরিয়ে এল রীণা তখনও দালানে দাঁড়িয়ে। টর্চ জ্বেলে পথ দেখাল। আসার সময় থমকে, রাহুল বারান্দার পাঁচিল থেকে ঝুঁকে দু—ধারে তাকিয়েছিল। রীণা মুখে শব্দ করে উঠতেই তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে আসে। দরজা বন্ধ করে রীণা খিল এঁটে দিল।

‘রাত্তিরে অনেকেরই ঘুম হয় না, জানালা কি বারান্দায় দাঁড়ায়।’ রীণা চাপা গলায় বলল।

‘তুমিও ঘুমোওনি।’ রাহুল মৃদু শান্তস্বরে, অন্ধকার মূর্তির মতো রীণাকে লক্ষ করে বলল। ‘আমার জন্য তোমায় ভাবতে হবে না, শুয়ে পড়ো…মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, ঘুম এসে যাবে।’

‘না।’ রীণা খাটে উঠল। বালিশটা সামান্য সরিয়ে শোবার উদ্যোগ করে বলল, ‘যাও, শুয়ে পড়ো তুমি।’

‘যাচ্ছি।’ কিন্তু রাহুল বসেই রইল। রীণা বিছানায় ছড়িয়ে দিল দেহভার। কিছুক্ষণ তারা কথা বলল না।

রাহুল ঝুঁকে বাঁ কনুইয়ে ভর দেখে রীণার মুখের কাছে মুখ আনল। ‘তুমি খুব ক্লান্ত।’

রীণা চুপ। রাহুল ডান হাতের তালু ওর কপালে রাখল।

‘ঘুমোবার চেষ্টা কর।’ রাহুলের তালু অত্যন্ত কোমলভাবে রীণার কপাল থেকে গালে, চিবুকে, নাকে, ঠোঁটে মন্থর গতিতে সঞ্চরণ করতে লাগল। রীণা প্রত্যাখ্যান করছে না, তালুটা গলা বেয়ে কাঁধের প্রান্তে পৌঁছল। রীণা ব্লাউজ খুলে রাত্রে শোয়।

‘থাক।’ একসময় রাহুলের হাতটা চেপে ধরল রীণা। ‘এবার শুতে যাও।’

‘আর একটু।…তোমার ভালো লাগবে। তুমি অত্যন্ত টেনসড হয়ে রয়েছ, এবার আলগা হও। নার্ভগুলো এলিয়ে পড়ুক।’

রীণা প্রতিবাদ জানাল না। শুধু মুখ থেকে একটা ক্ষীণ শব্দ বেরিয়ে এল। রাহুলের মনে হল, তার কথাগুলোকে সমর্থন করেই যেন রীণার দেহটা শিথিল হয়ে আসছে। বহুদিন, বহু মাস হয়ে গেল এমন যত্নে সে রীণার শরীরে হাত দেয়নি। এত মায়া, মমতা নিয়ে ওর বুকে হাত বুলোয়নি।

রাহুল ঝুঁকে রীণার কপালে ঠোঁট রাখল। তারপর চোখের উপর এবং ওষ্ঠে। ধীরে ধীরে সে বিছানায় রীণার পাশে নিজেকে বিছিয়ে দিল। চুম্বনকে ক্রমশ গাঢ় এবং তীব্র করে তুলল।

‘এবার যাও।’ রীণার স্বরে দুশ্চিন্তার আভাস। ‘বহুদিন এত ভালো লাগেনি তোমাকে চুমু খেয়ে।…তোমার কষ্ট, তোমার দুঃখ,…বেদনা অনুভব না করলে বোধ হয় এই ভালো লাগাটা পেতাম না।’ রাহুল কথাগুলো বলল রীণার অনাবৃত বুকের মাঝে মুখ চেপে রেখে। তার মনে হল রীণার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠল।

‘রীণা আমি এভাবে বন্দি হতাম না, চার দেওয়ালের ওই কুঠুরিটায় আমি ঢুকতাম না, যদি মেয়েটার চিৎকার শুনে থমকে না দাঁড়াতাম। আমি তো অগ্রাহ্য করে নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে যা হচ্ছে হোক গে আমার কী, এমন একটা ভাব করে নাও তো দাঁড়াতে পারতাম। কিন্তু দাঁড়ালাম কেন?’

রীণার শ্বাসপ্রশ্বাস ধীর হয়ে আসছে। যেন দম বন্ধ রেখে অপেক্ষায় থাকবে উত্তর শোনার জন্য। রাহুল মুখ তুলে বলল, ‘আমি শুধু এইটাই ভেবেছি এই ক—দিন ধরে। উত্তর পাইনি।…মানুষ বিপদে এগিয়ে যায় কেন? তুমি কি এর উত্তর জান?’

‘না।’ ক্ষীণস্বরে জবাব এল। রাহুল জানে এই শব্দটি ছাড়া রীণার পক্ষে আর কিছু বলা সম্ভব হবে না।

‘বহু লোক অন্যকে বিপদের মধ্যে দেখে পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে চলে যায়, কেন যায় জান?’

‘না।’

‘আমাদের সম্পর্কটা আগের মতো রাখা সম্ভব হবে কি?’

রীণা নিরুত্তর রইল। রাহুল হঠাৎই তীব্র একটা আবেগে আচ্ছন্ন হতে শুরু করল। সে রীণার দুই ঠোঁট মুখের মধ্যে ভরে দাঁত দিয়ে চাপ দিল। তারপর নিজেকে টেনে রীণার দেহের উপর তুলল।

‘না, না…অসম্ভব।’

‘কেন অসম্ভব?’ রাহুল প্রশ্নের মতো স্বরে দাবি জানাল। বহুদিন পর সে কামনার প্রবল সাড়া দেহে পেয়েছে। এটা সে নষ্ট হতে দেবে না। এখন খুবই অনিশ্চিত তার ভবিষ্যৎ। কে জানে এটাই হয়তো তার শেষবার!

‘রাহুল না, সম্ভব নয়…আমি পিল খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। কিছু হয়ে গেলে আর মুখ দেখাতে পারব না।’

এরপরই রাহুল এমন একটা কথা বলে ফেলল যেটা বলার জন্য সে পর মুহূর্তেই অনুতাপ করেছে।

‘কিছু হবে না তোমার। অনেক আগেই ডাক্তার দিয়ে নিজেকে পরীক্ষা করিয়েছি, আমার কখনো সন্তান হবে না।’

রীণার চাপা আর্তনাদটা রাহুলের মুখের উপর এমন জোরে আঘাত করল যে তার মুখ অসাড় হয়ে গেল।

‘লুকিয়ে রেখেছিলে! কিন্তু আমি যে চাই… একটা অন্তত।’ রীণার বুকভাঙা স্বরে রাহুল যেন ছবির শেষবারের চিৎকারটার রেশ শুনতে পেল। ধীরে ধীরে সে বুকের উপর থেকে নেমে এল।

দু—হাতে রীণা মুখ ঢেকেছে। অন্ধকার ঘর। রাহুলের মুখ দেখবে না বলে কিংবা তার নিজের মুখ না দেখানোর জন্য বা শোকের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি এটাই। রাহুল ভাবল, খবরটা কেন ওকে জানাতে গেলাম? এটা কী এমন জরুরি, অবশ্য দরকারি ব্যাপার যে আজ রাতেই…ধৈর্য, সংযম, অপেক্ষা কি করা যেত না? শরীরের তাড়নায় যুক্তি, বুদ্ধি হারানো এমন অন্ধত্ব তাকে পেয়ে বসল কেন? তা হলে ওই লোকগুলোর সঙ্গে তার তফাত কোথায়?

খাট থেকে নেমে রাহুল নিজের কুঠুরিতে ফিরে এল। নিজহাতে দরজা বন্ধ করল। পা ছড়িয়ে বসে প্রথমেই তার মনে হল, বাঁশের খোঁটা হাতে নিয়ে কেউ একজন এবার তার দিকে এগিয়ে আসবে। কবে আসবে তা সে জানে না।

বেডকভারটা টেনে আনার জন্য সে হাত বাড়াতেই হাতুড়িটা হাতে ঠেকল।

রতনের দাঁতে যন্ত্রণা হয়। দাঁতটা তুলে ফেলে দিতেই হবে। রীণা বলেছিল, টাকা দিচ্ছি ডাক্তারের কাছে গিয়ে তুলিয়ে ফেল। রতনের আপত্তি টাকা খরচ করায়। সে জানতে পেরেছে, ঠিকে ঝি কমলের মা একই যন্ত্রণায় ভুগছে এবং ডেন্টাল হসপিটালে গিয়ে দাঁত তুলিয়ে আসবে। রতন অতঃপর কমলের মা—র সঙ্গে ব্যবস্থা করে ফেলে, সেও ওর সঙ্গে যাবে দাঁত তোলাতে।

এসব কথা রাহুল জানল যখন রীণা রাত্রে তাকে বলল, ‘রতন কাল সকালেই দাঁত তোলাতে যাবে। ফিরবে কখন ঠিক নেই, হয়তো দুপুরে আসবে।’

‘তা হলে কে ওকে দরজা খুলে দেবে? তুমি তো সাড়ে ন—টায় বেরোবে!’

‘বাইরে তালা দিয়ে চাবিটা অনুর কাছে রেখে যাব, রতন এসে চেয়ে নেবে।’

সকালে ঘুম ভাঙতেই রাহুলের প্রথমেই মনে হল, রতন আছে না বেরিয়ে গেছে? অন্যান্য দিনেও রতন বেরোয় দুধ আনতে। তারপর বাজারে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে। আজ রতন টানা অনেকক্ষণ বাইরে থাকবে। হাসপাতালটা কাছে নয় আর বিনি পয়সায় চিকিৎসা করাতে হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। রাহুল ধরে নিল, দুপুর পর্যন্ত সে এই ফ্ল্যাটে স্বাধীনভাবে থাকছে।

দরজা খুলে রীণা বলল, ‘রতন দাঁত তোলাতে চলে গেছে। বাথরুমে যেতে পার।’

রাহুল শোবার ঘরের দরজা থেকে হামা দিয়ে বাথরুমে গেল। এইভাবে যাওয়াটা এখন তার স্বাভাবিক হয়ে গেছে। রীণাও আর তাকে লক্ষ করে না তবে ওই সময়টায় সে পাশের বাড়ির দিকে চোখ রাখে, তারপর হাত নেড়ে তাকে এগোবার জন্য ইশারা করে। ততক্ষণ রাহুল মুখ তুলে তাকিয়ে থাকে রীণার দিকে। শুধু এই সময়টুকু সে নিজেকে একটু অন্যরকম ভাবে। করুণাপ্রার্থী একটা অসহায় জন্তু, রীণা তার মনিব।

স্বামী—স্ত্রী সম্পর্কটা এই সময়টুকুতে আর থাকে না। তার লেখাপড়া, ব্যায়াম করা, শিক্ষা, রুচি, কান্তি, বিত্ত সব নিশ্চিহ্ন হয়ে সে একটা চতুষ্পদ ছাড়া নিজেকে আর কিছু মনে করতে পারে না।

রীণা সেদিন রাত্রের পর থেকে নিস্পৃহ, আচরণে আবেগবর্জিত কর্তব্যে যথাযথ। রাহুল খবরের কাগজ চোখের সামনে রেখে কান রাখল দালানে। রীণা রান্নাঘরে আর দালানে কাজের জন্য চলাফেরা করছে, মাঝে একবার ঘরেও এল। কলকাতার সকাল তার নিজস্ব শব্দ তৈরি করে যাচ্ছে। সূর্যের আলো পর্দার ফাঁক দিয়ে প্রতিদিনের মতো অভ্যস্ত জায়গায় পড়েছে।

রাহুলের চোখ ঘরের চারদিকটা ঘুরে এল। ঘরটা একই রকম রয়েছে এখনও। অধিকাংশ আসবাব তার পছন্দেই কেনা। রীণা চেয়েছিল রাবার—ফোম গদির খাট। শিরদাঁড়ার নানান ব্যাধির ভয় দেখিয়ে সে তুলোর গদি আর তোশকের খাট কেনে। প্রত্যেকটা আসবাবই তার জীবনের পটভূমির এক—একটা অংশ। একদিন আর তা থাকবে না। রীণা একার রোজগারে হয়তো চালাতে পারবে না। তখন কি টিভি, রেডিয়ো, খাট, ফ্রিজ বিক্রি করে দেবে?

রীণা স্নান করে ভাত খেল, স্কুলে যাবার জন্য শাড়ি পরল। থালা হাতে ঘরে ঢুকে বলল, ‘তোমার ভাত এই টেবলে রেখে যাচ্ছি, রতন আসার আগেই তোমার ঘরে তুলে নিয়ে যেয়ো।…চাবিটা অনুর কাছে দিয়ে যাচ্ছি।’

রাহুল কাগজে চোখ রেখে মাথা নাড়িয়ে একটা শব্দ করল। সে জানে রীণা কথাটা বলেই ঘুরে দরজার দিকে এগিয়ে গেছে। তার মাথা নাড়া দেখার জন্য সময় দিতে ইচ্ছুক নয়।

রীণা চলে যাবার পর আধঘণ্টা কি তারও বেশি সময় কেটে গেছে, হিসেবটা রাহুল আর করার দরকারবোধ করেনি। এখন তার কাছে সময়ের কোনো দাম বা দরকার নেই। সে পাখার গতি বাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে। তন্দ্রা মাঝে মাঝে চেতনাকে ঢেকে দিচ্ছে। তবু জেগে থাকার চেষ্টা করছে। রতন এসে যেন তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় না দেখে ফেলে।

হঠাৎ তার মনে হল সদর দরজায় তালা খোলার শব্দ হল। স্প্রিংয়ের মতো বিছানায় উঠে বসল। শোবার ঘরের দরজাটা খোলাই। দরজায় খিল আঁটার শব্দ শুনতে তার ভুল হল না। সে দু—লাফে কুঠুরিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। জোড়ের ফাঁকে চোখ রেখে সে অপেক্ষা করতে লাগল। এত তাড়াতাড়ি রতন ফিরে এল!

ঘরে ঢুকল অনু। প্রথমেই তাকাল ঘুরন্ত পাখার দিকে। হাসল। রাহুল খুবই অবাক হয়ে যায় ওকে দেখে। কেউ চাবি গচ্ছিত রেখে গেলেই কি তালা খুলে তার ঘরে এভাবে আসা উচিত! কিন্তু পাখার দিকে হাসাটা দেখেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। নিশ্চয় মনে মনে প্রশ্ন তুলবে, কেন ঘুরছিল, কে হাওয়া খাচ্ছিল, সে তা হলে গেল কোথায়? ওই দরজা বন্ধ ঘরটায় কী?

অনু পাখার সুইচ বন্ধ করে, পা টিপে জানালার কাছে গেল। পর্দা সরিয়ে বাইরে দু—ধারে, উপরে সন্তর্পণে নজর বোলাল। তারপর শাড়ির আঁচল বার করে কয়েকবার নাড়ল। দু—পা পিছিয়ে এসে অনু দাঁতে আঙুল চেপে জানালার দিকে তাকিয়ে কী ভাবতে লাগল। রাহুল দেখল মেয়েটির গৌরবর্ণ মুখ লাল হয়ে উঠেছে, কপালে ঘাম ফুটেছে, আর দু—চোখে জ্বলজ্বলে অস্বাভাবিক চাহনি।

অনু ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কী ব্যাপার? আঁচল নেড়ে কী করল! কাউকে ইশারা? সংকেত জানাল?…উদ্দেশ্য? অনু কি চলে গেল, নাকি ফিরে আসবে! পাখাটা বন্ধ করার সময় ও কী ভেবেছিল?

আবার খিল তোলার শব্দ। অনু বেরিয়ে যাচ্ছে তা হলে। রাহুল দরজাটা ফাঁক করল আর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিল। চাপা গলায় কে কথা বলল।

সীতাংশু ঢুকল, পিছনে অনু। উত্তেজনায় টসটসে দু—জনের মুখ। কথা না বলে ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে। কিছুক্ষণ পর ওরা হাসল।

‘তুমি এমনভাবে দোকানে ঢুকলে, মুখ দেখে মনে হচ্ছিল কী যেন ঘটেছে!’

‘চাকরটা দুপুরের মধ্যেই ফিরবে, তাই ছুটতে ছুটতে গেছি।’

‘দাদা কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দোকানে আসবে…কর্মচারীদের হাতে দোকান ফেলে বেরিয়েছি শুনলে ভীষণ রেগে যাবে।’

‘যাবে তো যাবে। আমার জন্য বকুনি খেতে পারবে না?’

সীতাংশু একগাল হাসল। অনুকে বুকে টেনে নিয়ে চুমু খেতে গিয়ে জানালার দিকে তাকাল।

‘বাইরে থেকে দেখা যায়।’

‘পর্দা টানা আছে তো।’

‘তা হলেও…বন্ধ করে দি।’ সীতাংশু আর অনু জোড়ের ফাঁক থেকে সরে গেল। দুই ধাপে ঘর অন্ধকার হল। দরজা দিয়ে যতটা আলো আসা উচিত, আসছে না, রীণার টাঙানো শাড়িতে বাধা পেয়ে। ওদের আর রাহুল দেখতে পাচ্ছে না।

‘কেউ এসে পড়বে না তো?’

‘দরজায় খিল দেওয়া।’

‘তবু যদি কেউ এসে পড়ে!’ সীতাংশুর গলা।

‘তুমি বড্ড ভিতু।’ অনুর মিষ্টি ধমক।

কিছুক্ষণ পর সীতাংশুর গলা, ‘ভাত না খেয়েই স্কুলে গেছে।’

‘পাখাটাও নেভাতে ভুলে গেছিল।’

‘মাথার ঠিক নেই… এই বয়সে একা থাকা! বউদির কোমর—বুক—পেট দেখেছ কী দারুণ না?’

‘তোমার ছাড়া আমি আর কারোর দেখি না।’

কথা আর হচ্ছে না। রাহুলের চোখের পাতা দরজার কাঠে ঠেকে গেল। উপরে—নীচে জোড়ের নানান জায়গা থেকে সে দেখার চেষ্টা করল। দেখতে পাচ্ছে না দু—জনকে।

‘আমি অত বড়ো করে লিখি আর তুমি অতটুকু করে উত্তর দাও কেন?’ সীতাংশুর অনুযোগ।

‘আমাদের কি তোমাদের মতো অত বড়ো বাড়ি যে নিরিবিলিতে লেখার জায়গা পাব?’

আবার কথা বন্ধ হল। রাহুল আর দেখার চেষ্টা করল না। এখন তার শিরার মধ্য দিয়ে তরল আগুন শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। থরথরিয়ে হাঁটু কেঁপে উঠতেই সে উবু হয়ে বসে পড়ল। দু—হাতে ঊরু জড়িয়ে হাঁটু চেপে তার যন্ত্রণাটাকে দমিয়ে নিল।

‘না, খাটে নয়…বউদি এসে ঠিক বুঝতে পারবে।’

‘কী করে পারবে?’

‘বিছানায় পুরুষ মানুষ শুলে গন্ধ লেগে যায়।’

‘সব বাজে কথা।’

‘হ্যাঁ গো, পুরুষের গায়ের আলাদা গন্ধ আছে?’

‘তা হলে মেঝেয়…’

‘কিছু হবে না তো?…তা হলে কিন্তু গলায় দড়ি দিতে হবে।’

রাহুল বুঝতে পারল না ঘড়ঘড়ে চাপা স্বরে সীতাংশু কী বলল। সে শুনল শুধু অনুর গলা, ‘মহা শয়তান তুমি, আগে থাকতে ভেবে পকেটে করেই নিয়ে এসেছ…আগে বলো আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসবে না।’

‘না, বাসব না।’

‘গা ছুঁয়ে দিব্যি কর।’

‘কাউকে ভালোবাসব না, কোনোদিন নয়।’

‘যদি আমাদের বিয়ে না হয়?’

‘কেন হবে না! জাতটাত নিয়ে এখন আর কেউ অত আপত্তি করে না। আর যদি করে…বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বিয়ে করব। তোমার জন্য কষ্ট স্বীকার করতে—।’

সীতাংশুর কথা শেষ হল না কেন? রাহুল জোড়ের ফাঁকে চোখ রেখে ওদের খুঁজতে লাগল। খাটের ওধারে মেঝেয় দু—জোড়া পা সে দেখতে পেল। পায়ের অবস্থান, নড়াচড়া দেখে সে জানতে পারছে দু—জনে কী করছে।

রাহুল হাঁটু গেড়ে মেঝেয় কপাল ঠেকিয়ে। সে সহ্য করতে পারছে না শোবার ঘরের ঘটনাটা। তার মনে হল, অনু যা করছে, সীতাংশু যা করছে, কিছুই এমন অন্যায় নয় যে তাকে দরজা খুলে বেরিয়ে ওদের ভয় পাওয়াতে হবে। তার অসহ্য লাগছে, এটা চোখের উপর ঘটছে কেন? এটা কি তার জন্য শাস্তি? বেচারারা জানে না, একজন তাদের দেখতে পাচ্ছে! এটা যদি ওরা জানতে পারে তা হলে কী মানসিক অবস্থার মধ্যে পড়বে? ভয়ে সিঁটিয়ে থাকবে ছেলেমেয়েদুটো!

ওদের কি ভয় দেখাব?

রাহুল এটা ভেবেই মেঝেয় মাথা ঠুকল। তার মন নোংরা হয়ে গেছে। ভয় দেখানোর মতো নীচ কাজ করার কথা সে ভাবতে পারল কী করে! বেশ তো আছে ওরা নিজেদের মতো ভালোবেসে। ওষুধের দোকানের মালিকের ছেলে, পাড়ার অর্ধশিক্ষিত মেয়ে। বিয়ে হতে পারে, নাও পারে! কিন্তু ওদের জীবনে এই মুহূর্তগুলো…রাহুলের মনে পড়ছে, তার জীবনেও এমন ধরনের মুহূর্ত বিয়ের আগে এসেছিল। কিন্তু তাই নিয়ে সে আর ভাবতে চায় না।

আবার সে দরজার ফাঁকে চোখ রাখল। সীতাংশুর গলা দু—হাতে জড়িয়ে ওর বুকে মাথা রেখে অনু কাঁদছে। সুখের কান্না?

‘আমি এবার যাই, দোকান ফেলে রেখে এসেছি।’

বুকে মুখ ঘষে অনু চোখের জল মুছল।

‘তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই।’

রাহুলের মনে হল, পৃথিবীটা একই রয়ে গেছে শকুন্তলা, সীতার আমল থেকে।

‘আমারও কেউ নেই তুমি ছাড়া।’

‘বিয়ের কথাটা বাড়িতে তাড়াতাড়ি তুলো।’

‘তুলব।’

‘রাজি না হলে, আলাদা হয়ে যাবে তো?’

‘যাব।…এইবার যাই, দাদা আসার আগেই—’।

সীতাংশু বুক থেকে অনুকে সরিয়ে দিল। রাহুল হাসতে শুরু করল। ছেলেটা পারবে না, মেয়েটাও ছাড়বে না।

এবার ওরা বিদায় হোক এই ফ্ল্যাট থেকে।

‘আমি কিন্তু বিষ খাব যদি তোমাকে না পাই।’

‘না অনু তোমাকে মরতে দেব না, তাহলে আমিও—’

সীতাংশুর মুখ চেপে ধরল অনু। তারপর কামনাভরা তীব্র চুম্বন করতে করতে দু—জনে খাটের উপর পড়ল।

রাহুল চোখ সরিয়ে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তার ছোটো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

একসময় ওরা দু—জন চলে গেল। একসময় রাহুল ঘর থেকে বেরিয়ে ভাত খেয়ে নিল। রতন ফিরে এল। রীণা ফিরল জ্বর নিয়ে। খাটে শুয়ে সে রতনের কাছ থেকে জেনে নিল হাসপাতালের ডাক্তার কী কী বলেছে। রতন প্রেসক্রিপসান দেখাল। ওষুধগুলো খেয়ে সাতদিন পর যেতে বলেছে, সবগুলো দাঁতই তুলে ফেলতে হবে।

রীণাকে ‘অনু—সীতাংশু’ ব্যাপারটা রাহুল বলল না। রীণা আলো নিভিয়ে শুয়ে রইল সারা সন্ধ্যাটা। রতন জানতে চাইল খাবে কি না।

‘তুমি এখানে ঢাকা দিয়ে রেখে যাও। রাতে খিদে পেলে খাব।’

রীণা খায়নি। রাতে শোবার ঘরের দরজায় সে খিল দিয়ে এখন শোয়। আজ কোনোক্রমে উঠে খিল দিল। রাহুল তখন কুঠুরি থেকে বেরোল।

‘কী হয়েছে?’ উদবিগ্ন হয়ে রাহুল জিজ্ঞাসা করল।

‘দুপুর থেকেই গা গরম লাগছিল। শরীরটা জ্বরজ্বর লাগছে…ক্রমশই যেন বাড়ছে। খুব ক্লান্ত—।’

‘থার্মোমিটার তো আর কেনা হয়নি?’

‘না।’

রীণার কপালে তালু রেখে রাহুল উদবেগবোধ করল। জ্বর অন্তত একশো দুই—তিন। ভাইরাস ইনফেকশনই বোধ হয়।

‘গায়ে ব্যথা?’

‘হ্যাঁ…ভীষণ।’

‘খাবে কিছু?’

‘না…খাবারটা তোমার জন্য, খেয়ে নাও।’

দুধ, সেঁকা পাউরুটি আর একটা বাটিতে পাতলা ডাল। রাহুল গোগ্রাসে খেয়ে নিল। এখন তার একটা কথাই মনে হচ্ছে, জ্বর বাড়লে রীণার খাওয়া—দাওয়া বন্ধ হবে। রতন নিশ্চয় তখন ওকে ডাল—ভাত—মাছ রেঁধে দেবে না। তখন কে তাকে লুকিয়ে ভাত বা রুটি খাওয়াবে!

‘কাল রতনকে দিয়ে ক্রোসিন বা নোভালজিন আনিয়ে খেয়ে নিয়ো।…আর দু—প্যাকেট বিস্কিট। একটা থার্মোমিটারও কিনতে দিয়ো।’

রাহুল তার কথার কোনো সাড়া না পেয়ে রীণার কপালে আবার তালু রাখল। বেহুঁশের মতো চিত হয়ে। শ্বাস—প্রশ্বাস খুবই ধীর। তার মনে হল, এখন মাথায় আইসব্যাগ দিলে জ্বর নামবে। কিন্তু ফ্রিজ থেকে বরফ বার করে, ব্যাগে ভরে কে মাথায় ধরবে? কাল সকালের আগে কিছু করা যাবে না। কিন্তু সকালেই বা করবে কে? রতনের নিশ্চয়ই ধারণা নেই এক্ষেত্রে কী করা দরকার। বড়োজোর হয়তো কপালে জলপটি দেবার কথা ভাবতে পারে। রীণা ওকে দিয়ে আইসব্যাগটি আলমারি থেকে বার করিয়ে, কী করতে হবে যদি বলে দেয়!

সে আলমারি খুলল। কাজ এগিয়ে রাখার জন্য টর্চ জ্বেলে কাপড়ের স্তূপ সরিয়ে আইসব্যাগটা বার করে টেবলে, চোখে পড়ার মতো জায়গায় রাখল। খাটে শোবে কি না, তাই নিয়ে সে দ্বিধায় পড়ল। যদিও ঘুমের মধ্যে সে নড়াচড়া করে না, তবু অসুস্থ মানুষের পাশে শুলে বীজাণু সংক্রমিত হতে পারে। দু—জনেই শুয়ে পড়লে ব্যাপারটা তখন বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে যাবে।

রাহুল মেঝেয় শুয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। তার ঘুম ভাঙল দরজা ধাক্কানোর শব্দে। প্রথমে সে বিরক্ত হয়ে দরজার দিকে তাকাল। তারপরই উঠে দাঁড়াল বুকের মধ্যে বরফ নিয়ে।

‘বউদি দরজা খুলুন… অ বউদি।’ রতনের উৎকণ্ঠিত চিৎকারের সঙ্গে দরজায় অধৈর্য করাঘাতও চলেছে।

রাহুল খাটে শোওয়া রীণার দিকে তাকাল। চোখ মেলে দিশাহারার মতো তাকাচ্ছে। ওঠার ক্ষমতা নেই। রাহুল বাইরে রতনকে আশ্বস্ত করার জন্য মেঝেয় রাখা থালা—বাটিতে পা দিয়ে ধাক্কা দিল। এতে কাজ হল। করাঘাত বন্ধ করে গলা নামিয়ে রতন বলল, ‘বউদি দেখে পা ফেলুন।’

রীণাকে দু—হাতে প্রায় হিঁচড়ে রাহুল খাট থেকে নামাল। শাড়ি খুলে কোমর থেকে ঝুলছে। চুল আলুথালু। তাকে টেনে নিয়ে সে দরজার কাছে দাঁড় করাল। খিলটা ধীরে ধীরে তুলে, টলে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় থাকা রীণার একটা হাত খিলের উপর রেখেই রাহুল ছুটে কুঠুরিতে এসে দরজা বন্ধ করল।

সে একই সঙ্গে রীণার এবং খিলটা খুলে পড়ে যাওয়ার শব্দ পেল।

‘দেখছ কাণ্ড! এমন বেহুঁশ জ্বর নিয়ে উঠে আসা…আর খিল দিয়ো না দরজায়।…উঠতে পারবে?’

জোড়ের ফাঁকে চোখ দিয়ে রাহুল বাকিটা দেখল। বুড়ো রতন দু—হাতে রীণাকে বগলের নীচ থেকে জড়িয়ে টেনে দাঁড় করাল। শাড়িটা খুলে পড়ে গেল। ব্লাউজের দুটো হুক খুলে গেছে। হাত বাড়িয়ে কোনোক্রমে রীণা খাট পর্যন্ত পৌঁছে খাটে উপুড় হয়ে পড়ল। মুখ দিয়ে গোঙানির মতো শব্দ বেরোচ্ছে। দুটো পা ধরে রতন রীণাকে খাটে তুলে শুইয়ে দিল। মাথার নীচে বালিশ রাখল। ব্লাউজের হুক লাগাবার জন্য ঝুঁকে পড়ল এবং চেষ্টা করতে করতে সফল হল। শাড়িটা যথাসম্ভব বিছিয়ে দিল গলা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত। এত কিছু করার সময়, রাহুল লক্ষ করল, রতনের মুখে মমতা আর স্নেহ টলটল করছিল।

এইবার সমস্যায় পড়ল রতন। এখন সে কী করবে? রাহুল ভাবল, আমি হলে কী করব? প্রথম কাজ দৌড়ে ডাক্তার ডেকে আনা। রতনের হাতে টাকা নেই। রীণার হাতব্যাগে পঞ্চাশ—ষাট টাকা থাকেই। রতন নিশ্চয় তা জানে।… আর নয়তো কাউকে ডেকে আনা।

চিন্তিত মুখে ঘর থেকে রতন বেরিয়ে গেল। সদর দরজা খোলার শব্দ হল। রতন যাচ্ছে কোথায়? উপরের গৌতমবাবুর কাছে? রাহুল অপেক্ষা করতে লাগল। শোবার ঘরে দীর্ঘশ্বাসের মতো কাতর শব্দে রীণা বুঝিয়ে দিচ্ছে সে এখন যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছে।

রতন ফিরল, সঙ্গে অনু। কপালে, গলায় তালু ছুঁইয়ে অনু বলল, ‘এ যে অনেক জ্বর!…ডাক্তার ডাকতে হবে।’

‘আমি তো কিছু জানি না। কোথায় ডাক্তার পাব…তুমি একটু ডেকে আনবে?’

‘দাঁড়াও, সীতাংশুকে বলছি। ওদের দোকানে ডাক্তার বসে।’

অনু বেরিয়ে গেল। রতন দাঁড়িয়ে রইল রীণার মাথার কাছে। বেচারার এখন কিছু করার নেই। শুধু উৎকণ্ঠাভরে বার বার জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছে, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে বউদি?…কোথায়, মাথায়? টিপে দেব?…জল খাবে?’

রতন গ্লাসে জল এনে, রীণার ঘাড়ের নীচে বাহু দিয়ে তুলে খাওয়াবার চেষ্টা করল। খেল কিনা, রাহুল তা বুঝতে পারল না। রীণার মাথায় কপালে রতন হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

মিনিট কুড়ির মধ্যেই ডাক্তার আর সীতাংশুকে নিয়ে অনু ফিরে এল। চারজন লোকের ভিড়ে রাহুল দেখতে পারছে না ডাক্তার কী পরীক্ষা করছে। স্টেথিস্কোপটার দুটো নল কানে লাগাল এই পর্যন্ত সে দেখেছে। আর দেখেছে সবাই উৎকণ্ঠিত চোখে ডাক্তারের মুখ লক্ষ করছে।

‘ব্লাড টেস্ট করতে হবে…তুমি দুর্গাবাবুকে বলো এখুনি এসে ব্লাড নিয়ে যাক। দোকানে চলো, প্রেসক্রিপশন লিখে দোব। রেগুলার টেম্পারেচার নিতে হবে… আইসব্যাগ তো রয়েছে দেখছি, মাথায় বরফ দেবার ব্যবস্থা কর।’

‘কী মনে হল?’ সীতাংশু জিজ্ঞাসা করল।

‘ব্লাড রিপোর্ট না পেলে বলা শক্ত।…এনার আছেন কে?’ পেশাদারি গলায় ডাক্তার প্রশ্ন করল।

‘আপাতত কেউ নেই, শুধু এই কাজের লোকটি ছাড়া।’

ডাক্তার ভ্রূ কুঁচকে রতনের দিকে তাকাল। ‘আত্মীয়স্বজন কেউ নেই?’

সীতাংশু তাকাল অনুর দিকে। অনু রতনের দিকে।

‘আমি তো কিছু জানি না, কাউকে কখনো আসতে দেখিনি। তবে ইস্কুল থেকে মাঝে মাঝে দু—একজন আসতেন।’ রতন বিব্রত অসহায় মুখে তাকিয়ে রইল।

‘ইনি তো বিবাহিত, হাজব্যান্ড কোথায়?’

‘বাইরে আছেন…সে অনেক কথা, পরে আপনাকে বলব। চলুন।’ সীতাংশু প্রসঙ্গটা চাপা দিতে দরজার দিকে এগোল।

‘নিকটজন কারোর এখন কাছে থাকা দরকার।’

তিনজন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রতন চুপ করে দাঁড়িয়ে, কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। অনু ফিরে এল।

‘আইসব্যাগে বরফ ভরে দিচ্ছি তুমি ততক্ষণ মাথায় ধরো, আমি ওষুধের দোকান থেকে ঘুরে আসছি। আর বউদি একবার আমায় বলেছিল ওর ছোটোবেলার এক বন্ধু ওরই সঙ্গে স্কুলে পড়ায় সে হয়তো বউদির বাপের বাড়ির ঠিকানা জানে। তুমি কি ওর নামটা জান?’

‘না।’

‘আচ্ছা আমি গিয়ে খুঁজে বার করে নেব।’

নন্দিতা পা ভেঙে বাড়িতে রয়েছে, রাহুল মনে মনে বলল, অনু ওকে স্কুলে পাবে না, আর পেয়েও কি কোনো লাভ হবে? রীণার বাপের বাড়ির কেই বা এখন আসবে? বাবা মৃত, মাকে নিয়ে ছোটোভাই চণ্ডীগড়ে, ছোটোবোন বিয়ে করে আছে সল্ট লেকে। নন্দিতা কারোর ঠিকানাই দিতে পারবে না, শুধু বিডন স্ট্রিটে বাপের বাড়িরটির ছাড়া।

নিকটজন বলতে একমাত্র আমি, রাহুল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে ভেবে চলল, সীতাংশুর কথামতো ‘বাইরে’ আছি। অথচ রীণার থেকে এখন হাত দশেকও দূরে নই। থেকেও নেই। কোথাও এখন আমি নেই অথচ আমি বেঁচে আছি! এইরকম অবস্থায় কোনো লোক কখনো কি পড়েছে? চোখের সামনে বউ অসুখে মরবে আর স্বামী খুব কাছের থেকে হাত গুটিয়ে বসে সেটা দেখবে!

ভয়ে। প্রাণের ভয়ে। কী অসম্ভব মূল্যবান এই প্রাণভয় ব্যাপারটি। রাহুল চোখ বুজল বুকের বাঁদিকে হাত রেখে। হৃৎস্পন্দনটা অনুভব করতে পারল না। কবজির কাছে দুটো আঙুল টিপে ধরল।…পাওয়া গেছে। এটা যদি বন্ধ হয়!…এই যদিটাই হল ভয়।

তাকে বাথরুমে যেতে হবে। তলপেটটা ফুলে ভারী হয়ে উঠেছে। কাল রাতের পর এখনও সে পেচ্ছাপ করেনি। অন্তত বারো ঘণ্টা তো বটেই। পায়খানায়ও যাওয়া দরকার। কাল রাতে দুধ—পাউরুটির পর পেটে কিছু পড়েনি। রাহুল আকুল হয়ে শোবার ঘরের মধ্যে চোখ রাখল।

রতন আইসব্যাগ ধরে আছে রীণার মাথায়। মাঝে মাঝে তোয়ালে দিয়ে মুখ থেকে জল মুছিয়ে দিচ্ছে। এই বুড়োটা কি এখন কিছুক্ষণের জন্য ফ্ল্যাটের বাইরে যাবে না? রাহুলের মনে হল এই কুঠুরিটায় নিশ্চয় কোনো নর্দমা আছে। থাকা উচিত।

বন্ধ জানলার দিকের দেওয়ালে সে মেঝের কাছে হাতড়াতে শুরু করল। একটা গর্ত যদি হাতে ঠেকে। তিনবার, চারবার সে দেওয়ালের নীচের দিকটা আঙুল দিয়ে খুঁজল। নেই। ক্রমশ সে রেগে উঠতে লাগল। অদ্ভুত বাড়ি বানিয়েছে। ঘর তৈরি করেছ অথচ নর্দমা রাখনি? গবেট, গাধা, উল্লুক। তার মনে হল, এই দিকের নয়। হয়তো অন্যদিকের দেওয়ালে নর্দমাটা আছে। কিন্তু জিনিসপত্রের স্তূপে দু—দিকের দেওয়াল চাপা। সে শব্দ না করে জিনিসগুলো সরিয়ে জানলার দিকে আনতে লাগল। ভ্যাপসা গন্ধটা বদ্ধ ঘরে আরও ঝাঁঝালো হয়ে উঠল। কয়েকটা পোকা তার হাত বেয়ে সরসর করে উঠে আসতেই সে হাত ঝাড়ল। তোরঙ্গে হাত লেগে শব্দ হওয়া মাত্র সে চট করে জোড়ের ফাঁক দিয়ে তাকাল। রতন একইভাবে রীণার মাথায় আইসব্যাগ ধরে মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। শব্দটা শুনতে পায়নি।

রাহুল আঙুল দিয়ে দেওয়ালের সঙ্গে মেঝের সংযোগের জায়গাগুলো আঁচড়ে যেতে লাগল। গর্ত এদিকেও নেই। ঘরের কোথাও নেই।

তা হলে? প্রশ্নটা নিজেকে করেই রাহুল ট্রাউজার্সের চেন টানল।

ধীরে ধীরে তলপেট থেকে টনটনানিটা নেমে যাচ্ছে। রাহুল চোখ বুজে চমৎকার একটা আরাম উপভোগ করে যেতে লাগল। ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে লাগছে। কোণের দিকে মেঝেয় জমে থাকবে। ওর ওপর ছেঁড়া তোশকটার তুলো ফেলে দিলে তো ব্লটিংয়ের মতো শুষে নেবে। মনে হওয়া মাত্র রাহুল দাঁত দিয়ে তোশকের কাপড় ছিঁড়ে তুলো বার করে মেঝেয় ছুড়ে ছুড়ে ফেলল। অন্ধকারে সে বুঝতে পারছে না তুলোগুলো ঠিক জায়গায় পড়ল কি না।

শোবার ঘরে লোক এসেছে। রাহুল চোখ রাখল। অনুর সঙ্গে একটি লোক। পিছন ফিরে খাটে বসে লোকটি রীণার হাত টেনে নিল। রক্ত নিতে এসেছে। পরীক্ষা করে কীসের বীজাণু পাবে? রাহুল ভাবতে লাগল, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, ডায়বিটিস, যক্ষ্মা, ক্যানসার…আর কী হতে পারে? এনসেফেলাইটিস, এইডস? না এইডস নয়, কোথা থেকে এই রোগ পাবে? তার তো নেই। অন্য কারোর কাছ থেকে রীণা কি পেতে পারে? কিন্তু ও স্বামীর প্রতি খুবই বিশ্বস্ত। এ ব্যাপারে সন্দেহের উপরে।

ছোট্ট হাতব্যাগে লোকটা তার সরঞ্জামগুলো ভরে উঠে পড়ল, তাকে এগিয়ে দিয়ে অনু ফিরে এল।

‘তোমার কাছে টাকাপয়সা আছে তো? না, না, এসব খরচের জন্য বলছি না সীতাংশুদের দোকানে প্যাথোলজিরও কাজ হয়, ওষুধেরও পয়সা লাগবে না। ডাক্তারবাবুর ফি—ও দিয়ে দেবে। বলছি দোকানবাজারের খরচের কথা।’

‘বাজার যা আছে আজ চলে যাবে। দোকানের আর কী কেনার আছে।’ রতন কিন্তু কিন্তু স্বরে বলল।

‘দরকার হলে বলো…আর শোন, আমাদের ঘরের কাউকে বলতে যেয়ো না যে বউদির অসুখ করেছে, আমি ডাক্তার ডেকে এনেছি।’

‘না না, সে আমি বলব না। আর বউদির ব্যাগ তো ওই পড়ে রয়েছে, ওতেই টাকা থাকে।…দিদিমণি ডাক্তার কী অসুখ বললেন?’

‘এখনও বলেননি। রক্ত পরীক্ষার পর বলবেন। আমি আজ বউদির স্কুলে একবার যাব। ওর কে বন্ধু আছে তাকে জিজ্ঞেস করব ওর বাপের বাড়ির কারোর ঠিকানা জানে কি না। আর এই ক্যাপসুলগুলো রইল। তুমি পারবে না, আমি এসে খাইয়ে যাব। থার্মোমিটারটা…দাঁড়াও জ্বরটা দেখি।’

রাহুল উৎকর্ণ হয়ে উঠল। জ্বর কত? আজ নয়তো কাল সকালের মধ্যে রীণা উঠে চলার ক্ষমতা পাবে কি? তা না হলে বিরাট বিপদের মধ্যে সে পড়ে যাবে। পায়খানা দু—দিন চেপে রাখা যাবে কিন্তু তারপর?…না খেয়ে আরও বেশিদিন থাকা যায়। যতীন দাস কতদিন অনশনের পর মারা গেলেন। দু—মাস? তারও বেশি? আমি দু—সপ্তাহ তো থাকতে পারবই।…জল তেষ্টা পেলে সে কী করবে? কুঁজোয় অবশ্য ধরা আছে কিন্তু তাতে কতবার আর খাওয়া যাবে! তারপর?

মাথাটা ঘুলিয়ে যাচ্ছে রাহুলের। দেহটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একসঙ্গে এতরকম সমস্যার সামনে যে তাকে পড়তে হবে, কখনো সে ভাবতেও পারেনি। তার বিদ্যাবুদ্ধি, শিক্ষা, রুচি সবকিছু নস্যাৎ করে দিয়েছে কতকগুলো জৈব দাবি, যেগুলোকে সে চিন্তার যোগ্য বলেই কোনোদিন মনে করেনি।

‘একশো পাঁচ!…বাবা! কাগজ কলম দাও, ডাক্তারবাবু লিখে রাখতে বলেছেন।’

রাহুলের কাছে তাপের পরিমাণটা চিন্তিত হবার মতো ঠেকল, কিন্তু তার পেটের অস্বস্তিটাই তাকে অন্য ধরনের চিন্তায় ঠেলে দিল। দু—দিন চেপে রাখা নয়, আর দু—ঘণ্টাও সে পায়খানা চেপে থাকতে পারবে না।

.

তিনদিন, না পাঁচদিন, না পাঁচ বছর রাহুল মিনিটের, ঘণ্টার, দিনের হিসাব হারিয়ে ফেলেছে, কুঠুরিটা মল আর মূত্রের দুর্গন্ধে ভরা। ক্ষুধা জিনিসটা যে কী, সেই বোধ এখন আর তার নেই। জল ফুরিয়ে গেছে গত রাত্রে।

ওরা রীণাকে নিয়ে গেছে নার্সিং হোমে। যতটুকু সে বুঝেছে, কাছাকাছিই সীতাংশুর চেনা একটা নার্সিং হোমে ওকে ভরতি করানো হয়েছে।

‘রতন তোমার কোনো চিন্তা নেই। নার্সিং হোমের মালিক আমাদের খুব চেনা, টাকার কথা উনি সেরে উঠুন, পরে হবে। খুব কঠিন অসুখ, মাথায় রক্ত উঠে জমে গেছে। দিনরাত বউদিকে নজরে রাখতে হবে।’ সীতাংশু বলেছিল।

‘কেন আমি কি পারতুম না।’ ক্ষুব্ধ স্বরে রতন বলে।

‘পারতে না কেন, তবে ওদের ওখানে যেভাবে হবে তা তো এখানে হবে না। তুমি যখন খুশি যেয়ো, কেমন?’

প্রায় অজ্ঞান রীণাকে ধরাধরি করে সবাই যখন নীচে নিয়ে গেল তখন রাহুল ভেবেছিল—এইবার, এইবার ছুটে গিয়ে চৌবাচ্চচায় মুখ দিয়ে চোঁ চোঁ করে জল খেয়ে আসবে। কিন্তু ভয়ে কুঠুরি থেকে বেরোতে পারেনি। যদি হুট করে কেউ এসে পড়ে? ভয়, ধরা পড়ার ভয়। শুধু এই একটা ব্যাপারই তাকে স্বাভাবিক মানুষের জীবন থেকে সরিয়ে পশুর জীবনে নামিয়ে দিয়েছে।

কয়েকবার বমি করেছিল রাহুল। তারপর আর তাও হয় না। পেটে কিছু থাকলে তো হবে। হিক্কার মতো হয়েছিল, টকটকে লালা থু থু করে ফেলে। সে আশা করেছিল রীণাকে নার্সিং হোমে পাঠালেও শোবার ঘরটা খোলাই থাকবে। কিন্তু রতন তা রাখেনি। দিনের বেলাতেও এই পাড়ায় চুরি হয়েছে, এটা রীণাই ওকে বার বার হুঁশিয়ার করে বলেছে। তারই ফল হল, যতক্ষণ সে ফ্ল্যাটে থাকে শোবার ঘরের দরজা খোলা রাখলেও নার্সিং হোমে যাবার জন্য যখনই বেরোয় ঘরের দরজাটা বন্ধ করে শিকল তুলে তালা দিয়ে যায়। রাত্রেও শিকল তুলে দিয়ে দালানে ঘুমোয়। তখন রাহুল শোবার ঘরে বেরিয়ে আসে।

প্রথমবার সে উন্মাদের মতো সারা ঘরে খাদ্য খুঁজেছিল, পায়নি। নতুন কুঁজোটায় সামান্য তলানি জল ছিল, সেইটুকুই পায়। অদ্ভুত চোখে সে ঘরের আসবাবগুলোর দিকে তাকিয়ে ভেবেছিল খাট, বিছানা, আলমারি, টেবল, টিভি, আয়না, রেডিয়ো, বই, জামাকাপড় এগুলো যদি ভাত, রুটি, ডাল, তরকারি আর খাবার জল হয়ে যেত! সে হিসাব করার চেষ্টা করেছিল, মাথার বালিশটা পাউরুটি হয়ে গেলে সে কতদিন চালাতে পারবে। মনে মনে পাউরুটির মতো স্লাইস করে তার মনে হয়েছে দিনে আট স্লাইস করে সতেরো দিন চালাতে পারবে। সেই সঙ্গে আর একটা ব্যাপারও মনে হয়েছে—তার মাথা খারাপ হয়ে আসছে।

অন্ধকার কুঠুরিতে মাড়িয়ে ফেলেছিল নিজেরই মল। তুলো দিয়ে ঘষে ঘষে পায়ের আঙুলের ফাঁক থেকে সেগুলো পরিষ্কার করলেও দুর্গন্ধ যায়নি। বার বার সে হাত শুঁকেছে, পায়ের কাছে মুখ নিয়ে গেছে। বাসি মলের গন্ধ সারাক্ষণ যেন তার নাকের চারপাশ ঘিরে ভনভন করছে। সে অতিষ্ঠ হয়ে বন্ধ দরজাটা বালিশ দিয়ে পিটিয়েছে।

অবশেষে সুযোগ এল। শোবার ঘরে রতন কী যেন খুঁজতে শুরু করল। রাহুল তখন জানলাটা সামান্য ফাঁক করে সকালের রোদের অপেক্ষা করছিল। নটা—সাড়ে নটার আগে সেই তরল সোনা এই ঘরে গড়ায় না। সে ফাঁক দিয়ে দেখেছে রতন খাটের নীচে, আলমারির পিছনে কী যেন খুঁজছে।

হঠাৎই কুঠুরির দরজাটা খুলে গেল। রতনের প্রথমে ঠাওর হয়নি, চোখের মাত্র দু—হাত দূরে, এত কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের অবয়বটিকে। তার চেতনায় দৃশ্যটা ছবি পাঠাতে দেরি করল। রাহুলই প্রথম অসাড় ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে, কিছু একটা অবলম্বন চেয়ে হাতটা পাশে বাড়াতেই হাতুড়ির বাঁটটা মুঠোয় পেল। চিন্তার ঢেউ ওঠার আগেই সে তুলে নিল সেটা।

খাটে পা ঝুলিয়ে রাহুল নির্নিমেষে রতনের মুখের দিকে তাকিয়ে। মুখটায় কোনো হেরফের নেই। যন্ত্রণার ছাপ বা বিকৃতি কিছুই নেই। রোজ সকালে ঘুম ভাঙিয়ে চা দেবার সময় যেমন থাকত, মুখটা প্রায় সেইরকমই। একটু ব্যস্ততা যেন। উনুনে দুধ চাপিয়ে এসেছে এমন একটা ভাব। এ ছাড়া রতন খুব স্বাভাবিকভাবেই মেঝেয় শুয়ে আছে।

হাতুড়িটা খাটের উপর পড়ে। রাহুল সেটা তুলে চোখের সামনে ধরে কৌতূহলী চোখে দেখতে লাগল। সে আশ্চর্যবোধ করল একটা কথা ভেবে, বাঁশের খোঁটার থেকে এটা কত ছোটো অথচ এটারই ক্ষমতা কত বেশি! মাত্র একটা ঘা দিতেই…।

রাহুল হুঁশিয়ার হয়ে রতনকে পাশ কাটিয়ে শোবার ঘরের দরজার দিকে এগোল। দালানে এসে পায়ের দিকে তাকাল। না, রক্ত মাড়ায়নি। এইবার তাকে পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন হতে হবে। সবার আগে জল খেতে হবে।

ফ্রিজ থেকে বোতল বার করে মুখে দিতে গিয়ে রাহুল থমকে গেল। তার অভ্যাস গ্লাসে ঢেলে খাওয়ার। সে গ্লাসে জল ঢেলে ধীরে পান করল। ঝুড়িতে শুকনো টোম্যাটো, শশা। ডেকচিতে দুধে সর পড়েছে। সে হাসল। এখন নয়, আগে বাথরুমে যাওয়া। অনেকক্ষণ ধরে সাবান ঘষবে, দাড়ি কামাবে, শ্যাম্পু করবে, আফটার শ্যেভ গালে লাগাবে। লন্ড্রি থেকে আনা ট্রাউজার্স, শার্ট পরবে। এখন তার অনেক কাজ।

প্রায় দেড়ঘণ্টা পর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে দরজায় তালা দেবার পর চাবিটা পকেটে রেখে রাহুল থরথর করে কেঁপে উঠল। পৃথিবীটা যে এত বড়ো, এই বোধটা সে এখন পাচ্ছে। রতনই তাকে বাঁচিয়ে দিল।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে মাথাটা তুলে, সামনে চোখ রেখে হাঁটতে শুরু করল। এখন সে যাবে রীণাকে দেখতে। নার্সিং হোমটার নাম সে জানে না, তবে সে জানে বাসস্টপ থেকে মিনিট তিনেক বড়ো রাস্তা ধরে হেঁটে বাঁদিকে একটা রাস্তায়।

কেউ কি তার দিকে তাকিয়ে দেখছে? অবাক হয়ে যাচ্ছে? দেখুক। কানাকানি, ফিসফিস হবেই তাকে দেখে। হোক। কেউ তার কাছে এগিয়ে এসে কথা বলবে না। পাড়ায় কারোর সঙ্গে তার আলাপ নেই। এখন নার্সিং হোমের ভিজিটিং আওয়ার্স নয়। সে ওদের কাছে অপরিচিত। নিশ্চয় দারোয়ান কিংবা নার্স জানতে চাইবে, ‘আপনি কে?’ বলব, ‘আমি আপনাদের পেশেন্ট রীণা মিত্রর স্বামী।’ সন্দেহের চোখে তাকাবে কি? ওরা কি জানে সে এখানকারই একটা মাঠে, এক বর্ষার রাতে…’দেখুন, আমি বেটাইমে এসেছি জানি, কিন্তু নিরুপায়…আমাকে এখনই থানায় যেতে হবে, আমার চাকর খুন হয়েছে। আততায়ীকে আমি চিনি, সেটাই থানায় গিয়ে বলব।…আমি একবার স্ত্রীকে দেখতে চাই, প্লিইজ…।’

একা কথা বলতে বলতে, স্বচ্ছন্দে স্বাভাবিকভাবে রাহুল হেঁটে যেতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *