স্বর্ণকুমারী

স্বর্ণকুমারী – উপন্যাস – মতি নন্দী

এক

উনিশশো বিরানব্বই এর ২৫ মে, শুক্রবার বোম্বাই—আহমেদাবাদ—লখনৌ—পাটনা— কলকাতা, উড়াল নম্বর ২৯৬—এর বোয়িং ৭৩৭ দমদম টারম্যাকে চাকা ছোঁয়াল ছটা পঞ্চান্নয়। ছোঁয়াবার কথা পাঁচটা পঁচিশে।

বিমান থেকে বেরিয়েই সিঁড়ির মাথায় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদের মুখের চামড়া সিরসির করে উঠছে গরমে। বিমান নামার আগেই এয়ার হোস্টেস জানিয়ে দিয়েছিল, বাইরের তাপমান ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বিমান থেকে যাত্রীরা হেঁটে অ্যারাইভাল লাউঞ্জে পৌঁছল। যাদের লাগেজ সংগ্রহ করা দরকার তারা কনভেয়রের কাছে অপেক্ষা করতে লাগল। যাদের সেই প্রয়োজন নেই তারা বেরিয়ে গেল। তাদের সঙ্গেই বেরিয়ে এল মাঝারি উচ্চচতার একটি লোক। তার কাঁধে সবুজ ক্যারি ব্যাগ, চোখে গাঢ়, সান গ্লাস, ধূসর রঙের জ্যাকেট, গোড়ালির ইঞ্চি চারেক উপরে ট্রাউজার্স, লাল মোজা এবং মেরুন স্পোর্টস শ্যু। রেশমের মতো হালকা পাতলা একমাথা অবিন্যস্ত কালো চুলের কিছুটা কপালের উপর ঝুঁকে পড়েছে। মুখের তামাটে চামড়ার নীচে পেশির শক্ত ভাঁজ। চলনে মাথা ও কাঁধ সামনে ঈষৎ ঝোঁকানো, পদক্ষেপে ব্যস্ততা এবং ব্যক্তিত্বের সমন্বয়।

লোকটি চারদিকে তাকিয়ে অবশেষে এনকোয়ারি কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে জ্যাকেটের পকেট থেকে ডানহিল সিগারেটের প্যাকেট বের করল।

কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে লোকটিকে লক্ষ্য করছিল এক তরুণী। দীর্ঘাঙ্গী সুঠাম তন্বী গড়ন। স্লিভলেস খয়েরি ব্লাউজের নীচের প্রান্ত ও শাড়ির কোমরের প্রান্তের মধ্যে অন্তত একফুট অনাবৃত রয়েছে মেদহীন কিন্তু পেলব মধ্যদেশ। চোয়াল দুটি ছড়ান, ওষ্ঠদুটি ছোটো এবং পুষ্ট, বক্ষ দুটি উন্নত এবং দৃঢ়। চুল পুরুষদের মতোই প্রায় ছোটো করে কাটা, একপাশে সিঁথি। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম, গোলাকার চোখের মণিতে পিঙ্গলের আভাস। তার কাঁধ থেকে চামড়ার পটিতে ঝোলান ব্যাগটি প্রায় নিতম্বের কাছে নেমে এসেছে। খয়েরি রেশমের শাড়ি দেহের সঙ্গে লেপটে থাকায় তার নিতম্বের বতুলতা ও দৃঢ় বদ্ধতা মনোরমভাবে প্রকট। ডানহাতে একটি সোনালি ঘড়ি এবং দুই কানের লতিতে বিন্দুর মতো দুটি মুক্তো ছাড়া দেহে কোনো আভরণ নেই।

তরুণীটি তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে লক্ষ করছিল লোকটিকে। এইবার এগিয়ে এল।

‘আপনি মি. অরোরা?’

লোকটি চমকাল না। শুধু শরীরটা মুচড়ে পাশ ফিরল। ‘ইয়েস… রাহুল অরোরা। আপনি বোধহয় অর্জুন হালদারের…।’

তরুণীর চাহনিতে সমর্থন ফুটে উঠল। হালকা গোলাপি লিপস্টিক মাখা ঠোঁট ছড়িয়ে, গালে টোল ফেলে বলল, ‘প্রাইভেট সেক্রেটারি, রাধিকা পাইন।’

‘অর্জুন বলেছিল রিসিভ করার জন্য একজন থাকবে, কিন্তু সে যে এমন মনোরম একজন হবে ভাবতে পারিনি।’ রাহুল সিগারেট ধরাতে ধরাতে কালো কাচের মধ্য দিয়ে রাধিকার দেহ জরিপ করে নিল। রাধিকার অবশ্য অনুমান করে নিতে মুহূর্তেরও দেরি হল না, তার বস—এর এই বন্ধুটি সিগারেট ধরাতে এত সময় নিচ্ছে কেন!

‘চলুন’। রাহুল প্রথম ধোঁয়াটি ছেড়ে বলল। ‘ফ্লাইট দেড় ঘণ্টা লেট, তার ওপর অসহ্য এই ভ্যাপসা গরম। এই সময় কেউ কলকাতায় আসে। পৌঁছেই গলা পর্যন্ত ডুবে থাকব বাথটাবে।’

‘মি. হালদারের ছাদে একটা মিনি পুল আছে।’ এয়ারপোর্ট বাড়িটার বাইরে এসে ওরা গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে। অর্জুন হালদারের সাদা মার্সিডিজ ওদের দেখতে পেয়ে পার্কিং লট থেকে এগিয়ে আসছে।

‘জল তো টগবগ করে ফুটছে এখন। ৩৯ ডিগ্রি! ভাবা যায়?’

‘পুলের উপর শেড আছে, জল ঠান্ডা রাখারও ব্যবস্থা আছে।’

‘সত্যি! আহহ, শুনেই পাঁচ ডিগ্রি গরম কমে গেল।’

রাহুল এই বলেই জিপার টেনে জ্যাকেটটার বুক খুলে ফেলল। ভিতরে সবুজ রঙের পোলোনেক স্পোর্টস শার্ট। বুকে সাদা ছাপে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা: আই অ্যাম মেকানিক্যালি ইনক্লাইনড, আই স্ক্রু এনিথিং।’

রাধিকা চোখ সরিয়ে নিয়ে মনে মনে হাসল। লোকটা প্লে বয় টাইপের। তার উপর নির্দেশ রয়েছে, একে খুশি রাখতে হবে। এই ঢিলেঢালা সুদর্শন, চল্লিশের কাছাকাছি বয়সি কোটিপতি লোকটি, রাহুল অরোরা অ্যাসোসিয়েটস নামে বিরাট বিপণন কোম্পানির মালিক। অফিস আছে ভারতের তিনটি শহরে। একটা স্পনসরশিপের ব্যাপার রাহুলকে দিয়ে হাশিল করাতে হবে। অর্জুন এর বেশি তাকে কিছু বলেনি। রাহুলের আর এ এ, সংক্ষেপে র‌্যা, এখন ভারতের একনম্বর মার্চেন্ডাইসিং সংস্থা। ৩৭ জন নামি লোককে ম্যানেজ করা, প্রোমোট করা, ইন্সিওর করার দায়িত্বে রয়েছে র‌্যা। এদের মধ্যে আছে টিভি, সিনেমা, ফ্যাশন, সঙ্গীত এমন কী খেলার সুপারস্টাররাও। এশিয়ার কয়েকটা দেশেও সম্প্রতি ব্যবসা পেয়েছে। অত্যন্ত ব্যস্ত লোক। অর্জুনের মতোই অবিবাহিত।

রাহুলের বোম্বাইয়ের ফ্ল্যাটে অর্জুন টেলিফোনে সাত দিন আগে বলেছিল, ‘একটা বিজনেসের খবর আছে। শুক্রবার কি শনিবার আসতে পারবে কলকাতা? তা হলে রবিবারটা কাটিয়ে সোমবার চলে যেতে পার। জানি জানি খুব ব্যস্ত তুমি, তবে এলে কিন্তু ঠকবে না। একটা অদ্ভুত ধরনের ডীল হতে পারে। এখন সেটা তোমায় বলব না, জানই তো আমি ফোনে এই ধরনের ব্যাপারে কথাবার্তা বলি না। শুক্রবারই তা হলে এসো, বিকেলের ফ্লাইটে, দু—তিন দিনের একটা লং উইকয়েন্ড কাটান যাবে।’

রাহুল রাজি হয়ে গেছিল। তার ধারণা হয়, অর্জুন বোধহয় পেশাদারি সার্কিটে নাম এবং টাকা করার ইচ্ছা হয়েছে এমন কোনো গজল গাইয়ে বা ভরতনাট্যম নাচিয়ের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিতে চায়। হয়তো শনিবার কোনো অনুষ্ঠানে গান গাইবে বা নাচবে, সেটা শুনতে বা দেখতে যেতে হবে। ঘাড় নাড়তে হবে, মুখে ‘আহা আহা’ বলতে হবে তারপর তার এজেন্ট হবার জন্য রাজি হতে হবে। খদ্দের ধরার জন্য অন্তত সাত আটটা এজেন্সির লোক এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্সি ফার্ম, কনস্ট্রাকসান ফার্ম ছাড়াও ডুয়ার্সে অর্জুনের চা—বাগান আছে, ঘাটশিলায় মাইকার খনি আছে, বোম্বাইয়ে দুটি হোটেলের এক—তৃতীয়াংশ শেয়ার তারই। কিন্তু ললিত কলা, ক্ল্যাসিকাল গান ও নাচ সম্পর্কেও সে সমঝদার। হয়তো নতুন কোনো প্রতিভার দেখা পেয়ে তাকে ডেকে পাঠিয়েছে।

মোটরে রাহুল জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আপনমনে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। একসময় বলল, ‘দশ বছর আগেও যা দেখেছিলাম আজও তাই। শুধু কিছু বাড়ি তৈরি হয়েছে আর প্রাইভেট বাসের সংখ্যা বেড়েছে।’

রাধিকা একবার বাইরে তাকিয়ে হেসে শুধু মাথা নাড়ল। শুধু চাকরির কারণেই তার মাথা নাড়া নয়, রাহুলের কথায় সত্যতাও আছে।

‘কলকাতার বয়স এখন তিনশো দুই, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমার বাপ—ঠাকুরদা এখানেই ব্যবসা করেছে, আমি কলেজ জীবন পর্যন্ত এখানে ছিলাম। নকশাল পিরিয়াডে কানাডা চলে যাই। তখন থেকে আজ পর্যন্ত একটুও উন্নতি হয়নি এই শহরটার শুধু মেট্রো রেল হওয়া ছাড়া।’

‘আপনি আর মি. হালদার তো একসঙ্গে কলেজে পড়েছেন?’

‘হ্যাঁ। অর্জুন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল। পৈতৃক চা—বাগান, বাবার ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্সি ফার্ম, ল্যান্ড স্পেকুলেশন বিজনেস, বড়োলোকই ছিল। এখন তো আরও রিচ। আমাকে খুব সাহায্য করেছে। শুধু পড়াশুনোতেই নয়, এখন যে ব্যাবসা করছি তাতেও। ও আমার সব থেকে পুরোনো বন্ধু, ও আমার স্বভাব ভালোই জানে।’

কথা বলতে বলতে রাহুল আড়চোখে রাধিকার দিকে তাকাচ্ছিল। এবং কেন তাকাচ্ছে সেটা বুঝতে পেরে রাধিকা শরীরটা সামান্য এলিয়ে দু—হাত দিয়ে চুল ঠিক করায় ব্যস্ত হল। আবার জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নিজের ভাবনায় ডুবে যাবার আগে রাহুলের ঠোঁট চাপা হাসিতে মুচড়ে গেল।

আলিপুরে অর্জুনের বাড়িতে তারা পৌঁছল প্রায় সাড়ে আটটায়। উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ির গেট দিয়ে সোজা গিয়েই পোর্টিকো, বাঁ দিকে সবুজ মখমলের মতো ঘাসের জমি। সেখানে বেতের চেয়ার ও টেবল পাতা। কিন্তু কোনো লোক নেই।

দোতলায় অর্জুন অপেক্ষা করছিল। রাহুল তার ক্যারি ব্যাগটা হাত বাড়ানো চাকরের হাতে না দিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে দোতলায় উঠে এল।

‘প্লেন ডিলেড?’ সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল অর্জুন। সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরা, পাট করে আঁচড়ানো চুল। স্নান এইমাত্র বোধহয় সারা হয়েছে।

‘ডিলেড তো বটেই! আগে স্নান তারপর কথা।’

‘ঘরে গিয়ে আগে পালটে নাও, লুঙ্গি রেখে দিয়েছি।’

‘আহহ এই হল অর্জুন!’ রাহুল মুখ ঘুরিয়ে পাশে দাঁড়ান রাধিকাকে খবরটা দিল। ‘আমার ফেভারিট জিনিসগুলোর কথা ঠিক জানে।’

‘ছাদের পুলের ধারে ককটেল লাউঞ্জ। চিলড বিয়ার নিয়ে জলে গলা ডুবিয়ে থাকো। আধঘণ্টা পর দেখা হবে।’

অর্জুন হাত তুলে বারান্দার শেষপ্রান্তের ঘরটা রাহুলকে দেখাল। রাধিকার দিকে একবার তাকিয়ে শিস দিতে হিতে রাহুল ঘরের উদ্দেশ্যে এগোল।

‘কোনো অসুবিধে হয়নি?’ অর্জুন বলল।

‘না।’ রাধিকা নম্র জবাব দিল।

‘মানুষ ভালো, নিজের চেষ্টায় পরিশ্রমে বড়ো হয়েছে।’

‘একটু ছেলেমানুষি আছে।’

‘অত্যন্ত শ্রুড বিজনেস ব্রেইন। গত বছর ওর প্রি—ট্যাক্স টার্নওভার হয়েছে সতেরো কোটি টাকা। ওকে দেখে তা বুঝতে পারবে না।’

‘আমি কি আরও কিছুক্ষণ থাকব?’

‘অসুবিধে না থাকলে…।’

‘না না অসুবিধে নেই, বাড়িতে বলেই রেখেছি আজ ফিরতে দেরী হতে পারে।’

‘প্রত্যেক ঘরেই অ্যাটাচড বাথ আছে। যেকোনো একটায় গিয়ে তুমি স্নান করে নিতে পার। সত্যিই আজ গরমটা বিশ্রী রকমের।’

‘থ্যাঙ্ক ইয়ু স্যার।’

আধঘণ্টা পর দোতলার বারান্দা—ছাদে রাহুল ও অর্জুন বসল বিয়ার নিয়ে। রাধিকার হাতে টোম্যাটো জুস।

‘রাহুল তোমাকে কেন ডেকে এনেছি সেটা এইবার বলব—দেখো তুমি আমার অনেক সাহায্য করেছ। মালেশিয়ায় ওয়াটার রিজার্ভার তৈরির কনট্রাক্ট পাওয়ার ব্যাপারটায় তুমি যা…।’

‘অর্জুন আই টুক মাই কমিশন। শুধু শুধু কারুর উপকার আমি করি না।’

‘কাল কাগজে দেখলাম চেতন বড়ুয়া স্টকহলম ওপেনে আগাসির কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরেছে। চেতন তো র‌্যা—রই ছেলে?’

‘হ্যাঁ, হি ইজ অন দ্য বুকস। চার বছর আগে ওকে আমি নিয়েছিলাম। দেখো অর্জুন একটা সময় ছিল, প্লেয়াররা নাম করলে, গ্রাঁপ্রী জিতলে, সিডেড হলে তবেই ডানলপ বা স্ল্যাজেঞ্জার বা স্পলডিং কিংবা নাইকে বা অ্যাডিডাসরা এনডোর্সমেন্ট কনট্রাক্ট নিয়ে এগিয়ে আসত। ওসব এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। এখন এত টুর্নামেন্ট যে কেউ আর হাত গুটিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করে থাকতে পারে না। থাকলে সে একটাও বড়ো প্লেয়ার শেষপর্যন্ত আর পাবে না। এখন হল, কোনো ইয়াং প্লেয়ারের মধ্যে সম্ভাবনা আছে বুঝলেই কনট্রাক্ট করে বেঁধে ফ্যালো। এখন কোটি কোটি টাকা টেনিসে। যেকোনো প্রমিসিং ইয়াং প্লেয়ারের পকেট ভরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট টাকা। চেতনকে আমি তুলে নিয়ে টাকা ঢেলেছি, প্রোমোটার, স্পনসরার জোগাড় করেছি। এখন মনে হচ্ছে খুব ভুল করিনি। ইউ এস ওপেন টাইটেল হোল্ডারের কাছে সিক্স—টু, সিক্স—সেভেন, টু—স্কিস, থ্রি—সিক্স হেরে যাওয়াটা খুব হতাশজনক নয়!”

‘চেতন বড়ুয়ার মতো আর কাউকে পেলে?’

‘ব্যাডমিন্টনে হরিয়ানা থেকে একটি মেয়ের আর গলফে পুনে থেকে একটি ছেলের খবর পেয়েছি। দেখেছি ওদের। কনট্রাক্ট করে নেব। দাবায় তোমার কলকাতার গ্র্যান্ড মাস্টার রজত চ্যাটার্জি আমার ক্লায়েন্ট। গত এক বছর তার পারফরম্যান্স ভালো নয়। চারটে জি এম টুর্নামেন্টে ফিফথের উপর প্লেস পায়নি।’

‘অন্য খেলার দিকে নজর দিচ্ছ না কেন?’

‘অন্য খেলা? সেখানে প্লেয়ার কোথায়? ফুটবলে, হকিতে, সাঁতারে—’ রাহুল তালিকা দিতে শুরু করল।

‘অ্যাথলেটিকসে যাচ্ছ না কেন?’

‘অ্যাথলেটিকস?’ অর্জুন যদি চোর—পুলিশ খেলার কথা বলত তাহলেও নয় রাহুল গুরুত্ব দিত। ‘কি বললে অ্যাথলেটিকস?’

‘হ্যাঁ, যাকে বলে দৌড়।’

‘ধুর। এতে এমনি কোনো টাকা নেই। এখনো অ্যামেচার স্পোর্টস। হ্যাঁ কার্ল লিউইস, এডুইন মোজেস, ড্যালি টমসন, গ্রেগ লুগানিস, বা ফ্লোরেন্স জয়নারের মতো অবিশ্বাস্য কিছু করতে পারলে, তাও যদি ওলিম্পিক গেমসের মতো স্টেজে, দুশো কোটি টিভি ভিউয়ারের সামনে করতে পারে তবেই টাকা। হ্যাঁ, কোটি টাকা আয় সম্ভব তো বটেই। কুড়ি বছর আগে মার্ক স্পিৎস সাতটা গোল্ড না জিতলে, কোনো সাঁতারুর পক্ষে কোটিপতি হওয়া সম্ভব, এটা এখনো কাউকে বোঝাত পারতে না। সোল ওলিম্পিকস থেকে এখন পর্যন্ত এই চার বছরে ফ্লোরেন্স জয়নার চার কোটির ওপর রোজগার করেছে শুধুই কি তার ফ্যান্টাস্টিক পারফরমেন্সের জন্য? তার গ্ল্যামার, তার সেক্স অ্যাপিল, তার ড্রেস ফ্যাশন, প্রেসের সঙ্গে তার কথাবার্তা, এইসবই তাকে বিরাট মার্চেন্ডাইসিং প্রোপোজিশন হিসাবে বানিয়ে তোলে। নয়তো অ্যাথলেটিকস আর সার্কাসে কোনো তফাত নেই।”

অর্জুন অবশ্য সহজে পিছু হঠার লোক নয়। রাহুলের খালি গ্লাসে বিয়ার ঢালতে ঢালতে বলল, ‘মেরি লু রেটন জিমন্যাস্ট ছিল। ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলিস গেমসে মেয়েদের ওভারঅল ইন্ডিভিজুয়াল গোল্ড পেয়েছিল—।’

‘জানি। হ্যাঁ কোটি টাকা রোজগার করেছে। কিন্তু কেন? প্রথম মেয়েটা দেখতে ভালো, সতেরো বছর বয়স, আমেরিকার মেয়ে আর মিডিয়া পাবলিসিটি যা পেয়েছিল কোনো সিনে অ্যাকট্রেস অস্কার জিতেও তা পায়নি। সব থেকে বড়ো কথা, জিমন্যাস্টিকসে কমিউনিস্টদের একচেটিয়া আধিপত্য ভেঙে ফ্রি ওয়ার্লডের একটা মেয়ে গোল্ড ছিনিয়ে আনল, ভাবতে পারো অর্জুন কী বিরাট ব্যাপার এটা আমেরিকানদের কাছে? এইরকম একটা কাজ যদি কোনো ভারতীয় মেয়ে করতে পারত তাহলে সেও কোটিপতি, নাকি কোটিপত্নী হতে পারত। তবে মেয়েটা চালাক কিংবা বলা যাক তার এজেন্ট আই এম জি চালাক। চটপট গরম গরম নিউজের মধ্যে থাকতে থাকতেই সে টাকা রোজগার করে সোল গেমসের আগেই রিটায়ার করে ফেলে। মেরি জানত সোলে কমিউনিস্ট দেশের মেয়েরা আসছে তার যশ খ্যাতি গুঁড়িয়ে দেবার জন্য। ১৯৭২—এ স্পিৎস, ১৯৮৪—তে মেরি গ্রেট নিউজ। কিন্তু এখন কে ওদের খবর জানতে চায়?’

.

অর্জুন মাথা নেড়ে স্বীকার করল। ‘কিন্তু তুমি এটা তো মানবে, অলিম্পিকের একটা অকল্পনীয় যোগ্যতা আছে জিনিস বিক্রি করিয়ে দেওয়ার। শুধুমাত্র টিভি কভারেজেই তা হয়।’

‘বার্সিলোনা থেকে টেলিকাস্টে একটু জায়গা পাবার জন্য এডভার্টাইজারসদের কাছ থেকে নেটওয়ার্ক কী ধরনের টাকা চেয়েছে তা কাগজে বেরিয়েছে, বোধহয় তুমি পড়েছ। অবিশ্বাস্য, তাই না? এক মিনিটের জন্য ৪০ লাখ টাকা। আমি জানি স্পোর্টসের ঘাড়ে চেপে প্রোডাক্ট বিকোয় কিন্তু এত টাকা যেখানে জড়িত সেখানে হাত দিয়ে হাত পোড়ানোর সম্ভাবনাও রয়েছে।’

‘তার মানে তুমি অলিম্পিকসের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে রাজি নও?’

রাহুল জবাব দিতে ইতস্তত করল। অর্জুন যেভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অ্যাথলেটিকসের ব্যাপরটা নিয়ে কথা চালাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে ও যেন এটার মধ্যে নাক গলিয়েছে। এখন যদি সে তর্ক চালিয়ে বলে যায় অ্যাথলেটিকসের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নেই আর একটু পরেই খাবার টেবলে যদি কোনো প্রতিশ্রুতিমান স্প্রিন্টার কি হাইজাম্পার এসে বসে তা হলে সে নিজে অপ্রতিভ হবে। বন্ধুকেও লজ্জায় ফেলে দেবে। সুতরাং যুক্তিটাও এবার একটু ঘোরানো দরকার।

‘অর্জুন ব্যাপারটাকে তুমি এইভাবে দেখো। চার বছরে একবার আমার পেশার লোকেদের তুমি পৃথিবীর নানান ট্র্যাক সিটের আশেপাশে ভনভন করতে দেখবে। অলিম্পিকস টিমে স্থান পেতে পারে এমন অ্যাথলিটদের তারা হাতে চাঁদ পাইয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দেবে। কিন্তু যতক্ষণ না সোনা জিতছে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কিছুই পাকা নয়, আর যে স্পীডে কনট্রাক্ট তৈরি হয়ে সই হয় তাতে ডোপ করা বেন জনসনও হেরে যাবে। সইয়ের পরের দিনই তোমার স্বর্ণবিজয়ীটি সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দেবে তার সাফল্যের জন্য সে ঋণী ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল, সফটড্রিঙ্কস, সান গ্লাস আর বাটন—ডাউন শার্টের কাছে। দু—সপ্তাহ পরেই লোকটাকে সবাই ভুলে যাবে। যাইহোক, হয়তো বাড়িয়েই বললাম, কিন্তু আমার বক্তব্যটা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ। আামার মতো ব্যবসায়ীরা এইসব থেকে একটু তফাতেই থাকতে চাই। কোয়ার্টার কি হাফ মাইলারদের সঙ্গে হাসফাঁস করে দৌড়োদৌড়ি করাটা ঠিক আমাদের পক্ষে মানায় না। তবে নজর আমরা ঠিকই রাখি।’

রাহুল এই পর্যন্ত বলে ব্যাপারটা ছেড়ে দিল। এখন অর্জুন যদি আলোচনা টানতে চায় তো টানুক।

‘আমারও তাই মনে হয়েছে।’ অর্জুন মুখ ফিরিয়ে রাধিকার দিকে তাকাল। মেয়েটি চুপ করে শুধু কথা শুনে যাচ্ছে আর রাহুলের মুখের ভাব লক্ষ করছে।

‘রাধিকা প্লেটগুলো যে খালি রয়ে গেছে। আর একটু চিকেন স্প্রিং রোল কি মাছের—’

‘না না না।’ রাহুল সোজা হয়ে বসে হাত তুলে থামিয়ে দিল চেয়ার থেকে উঠতে যাওয়া রাধিকাকে। ‘মিস পাইনের এক সেকেন্ডের অনুপস্থিতির ক্ষতি এক প্লেট চিকেন রোল দিয়ে পূরণ করা যাবে না।’

‘আমার মনে হয় সেটাই স্প্রিং রোল না খাওয়ার কারণ নয়।’ রাধিকার ঝকঝকে দাঁত ঝিলিক দিল। ‘মি. অরোরা আসলে আর ক্যালোরি নিতে চান না।’

‘কারেক্ট, জানলেন কী করে?’

‘আপনার ফিগারই জানিয়ে দিচ্ছে। কঠিনভাবে যত্ন না করলে, মিয়ম নেমে না চললে এমন বড়ি তৈরি করা যায় না।’

রাহুলের মুখ সুখে এবং চাপা গর্বে উদ্ভাসিত হল। অর্জুন তারিফ জানানো দৃষ্টি উপহার দিল রাধিকাকে। রাহুলের দুর্বল জায়গাটিতেই তির ছুড়েছে মেয়েটি। ওর কঠিন ব্যাবসায়িক বর্ম ভেদও করেছে। রাহুল এবার কিছুটা দুর্বল হবে। কমপ্রোমাইজ করবে। অর্জুন মাথা নেড়ে হেসে রাধিকাকে উৎসাহ দিল কথাবার্তা এই লাইনে চালিয়ে যাবার জন্য।

অবশ্য রাহুলের ভালোই লাগছে শরীরের ফিটনেস নিয়ে কথা বলতে। ভারতীয়দের খাদ্যাভ্যাস, শ্রম বিমুখতা, খেলা সম্পর্কে অপেশাদারি আবেগপ্রবণ মনোভাব, এইসব নিয়ে তার নিজস্ব কিছু ভাবনাচিন্তা আছে। সেগুলো শোনবার মতো শ্রোতা পেয়ে সে অনর্গল কথা বলে গেলেও একটা ব্যাপার সে ঠিকই মাথায় রেখেছে। খাবার টেবলে অর্জুন যদি কোনো অসুবিধার কথা তুলে ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেওয়া যেতে পারে।

নিজেকে ফিট রাখার জন্য, ওজন বাড়তে না দেবার জন্য কী খায়, কী ব্যায়াম করে তার বর্ণনা, খুঁটিয়ে দিতে দিতে রাহুল কথার মাঝে ইচ্ছে করেই নীরবতা ঢুকিয়ে দিচ্ছিল।

অর্জুন অবশ্য রাহুলের মতো ততটা সূক্ষ্মভাবে জিনিসটা নাড়াচাড়া করতে ইচ্ছুক হল না। ‘ফিটনেস নিয়ে তারাই বেশি মাথা ঘামায় যাদের হাতে টাকা আর সময় আছে। ইউরোপ, আমেরিকায় ওটা যাচ্ছে বলেই ওইসব দেশ থেকে টপক্লাস চ্যাম্পিয়ান অ্যাথলিটরা বেরিয়ে আসে, তবু দেখো, আমাদের এই গরীব দেশ থেকেও কিছু কিছু লোক তো বেরিয়েছে। মডার্ন ইকুইপমেন্টস নেই, ট্রেনিং মেথড জানা নেই, লেবরেটরি, মেডিসিন নেই তবু তিরিশ বছর আগে পর্যন্ত তো ধ্যানচাঁদ, রূপ সিং, মিলখা সিং, রামনাথ কৃষ্ণনদের মতো লোকেদের পাওয়া গেছিল। রাহুল ভাব তো এদের এজেন্ট হয়ে তুমি তখন কী টাকাটাই না লুটতে পারতে! তুমি পি টি উষার কথাই ভাব? ছ—বছর আগে সোল এশিয়াডে উষা যা করল তুমি তা থেকে কোনো ফায়দা তুললে না।’

‘ইচ্ছে করেই তুলিনি কেননা খুব বেশি তোলার সম্ভাবনা ছিলও না। উষা তো ফ্লোরেন্স জয়নার নয়। কোনো গ্ল্যামার নেই, ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলতে পারে না, ব্যক্তিত্ব নেই, ভেরি কনজারভেটিভ ইন অ্যপিয়ারেন্স, পোশাক—আসাকেও। কোনো কমমেটিকস, ফ্যাব্রিকস, গারমেন্টস, অটোমোবিল, এয়ারলাইনার, ইলেকট্রনিকস, কোনো কোম্পানিই ওকে দিয়ে তাদের প্রোডাক্ট এনডোর্স করাতে রাজি হত না শুধু বোধহয় ফার্টিলাইজার ছাড়া। আর তার পারফরম্যান্স? শুধুই এশিয়ান সার্কিটে তিন—চারটে মাত্র মিটে। সে সাকসেসফুল তাও বহু মাস পর পর। ইউরোপ, আমেরিকার সার্কিটে যদি ঘন ঘন দৌড়ত, নাম করত ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করে তা হলেও না বলা যেত মার্চেন্ডাইসিংয়ে ওর সম্ভাবনা আছে। আর সোল অলিম্পিকসে গিয়ে তো নিজের যাবতীয় ইমেজ নিজেই নষ্ট করল। এমন ট্র্যাজিক পরিণতি হবে আমি ভাবিনি! অথচ যদি ১৯৮৪—র পর সাহস করে উষা বাইরের দুনিয়ায় বেরোত, মস্তিষ্কবান আধুনিক চিন্তার কোচিং নিত তা হলে হয়তো সোল ওলিম্পিকস থেকে গোল্ড, সিলভার, ব্রোঞ্জের মধ্যে যে—কোনো একটা মেডাল আনতে পারত। একবার তুমি ভেবে দেখ, যে অস্ট্রেলিয়ান মেয়েটা ১৯৮৪—তে ৪০০ হার্ডলসে ফিফথ হল সে তাতেই গোল্ড জিতল চার বছর পর।’

‘যদি উষা একটা মেডাল আনত তাহলে কী হত?’ এতক্ষণে রাধিকা মূল আলোচনায় প্রথম তার কণ্ঠস্বর পেশ করল।

‘ফ্যান্সাস্টিক কাণ্ড হত। মেয়েদের ট্র্যাক ইভেন্টে ১৯৮৪ পর্যন্ত মাত্র দুটি মেডেল জিতেছে এশিয়ান মেয়েরা। ১৯২৮—এ এক জাপানি মেয়ে রুপো জিতেছিল ৮০০ মিটারে। লোকে ভুলেই গেছে তার নাম, আমিও। আর ১৯৬৮—তে ১০০ হার্ডলসে তাইওয়ানের চি চেং একটা ব্রোঞ্জ! উষা যদি কিছু একটাও আনত তাহলে ভারত কেন এশিয়ার দশ বারোটা দেশ থেকে এনডোর্সমেন্টের কনট্রাক্ট নিয়ে লাইন পরে যেত।’

কথাটা লুফে নিয়ে অর্জুন বলল, ‘ধরো উষার থেকেও জিনিয়াস কোনো মেয়ে এ বছর যদি ভারতে উঠে আসে আর অলিম্পিকসে সোনা জেতে? তুমি কি তার কমার্শিয়াল রাইটস সম্পর্কে আগ্রহী হবে না?’

‘কোনো এজেন্টই এমন বিরাট কমিশন হাতছাড়া করতে চাইবে না।’ কথাটা বলে রাহুল চোখ টিপল। ‘ব্যাপারটা কী, একটু খোলসা করেই বল না। মিস পাইন কি ইন্ডিয়ান অলিম্পিকস টিমের জন্য ক্যান্ডিডেট নাকি?’

‘হ্যাঁ।’ অর্জুন কিছু বলার আগেই রাধিকা ছদ্ম গাম্ভীর্যের মুখোশ মুখে টেনে বলল, ‘কোন অ্যাথলেটিকস ইভেন্টের বলুন তো? দেখি আপনার চোখ কেমন?’

‘চোখ আমার ভালোই। আপনার ফিগার বলছে জাম্পিং ইভেন্টের।’ রাহুল বলেছিল রসিকতা করে, রাধিকাও জবাব দিয়েছে সেই ভাবে। সুতরাং কথাবার্তা ওই স্তরেই চালাবার জন্য রাহুল যোগ করল, ‘লং লেগস, ফার্ম রাউন্ড বাটকস, সেন্ডার ফ্ল্যাট স্টম্যাক… আরও বলব?’

‘আপত্তি নেই, ফ্ল্যাটরড তো বহুক্ষণই বোধ করছি, নয় আরও করব;’ রাধিকা গম্ভীর হয়ে থেকেই পায়ের উপর পা তুলে দিল। তবে চোখে কৌতুক।

‘না। এরপর কিছু বলতে হলে কালিদাস থেকে ধার করতে হবে। কিন্তু দেনাদার হয়ে থাকতে আমার বিশ্রী লাগে।’

‘তাহলে নিজের কথাতেই বলুন।’

‘আমি কবি নই সুতরাং খারাপ ভাষা দিয়ে বর্ণনা করে আপনার দেহটিকে নষ্ট করতে পারব না।’

অর্জুন মিটমিট করে হেসে ওদের কথা শুনছিল। এইবার সে বলল, ‘ধরো আমি যে অ্যাথলিটের কথা বললাম তাকে এখন পর্যন্ত লোকে চেনেই না।’

‘তাতে তাকে সেল করা মোটেই সম্ভব হবে না।’ সিরিয়াস গলায় তার যুক্তিটা দেখাতে চাইল। ‘অজানা অখ্যাত ভারতীয় বার্সিলোনায় মেডেল জিতল, এইভাবে যদি ব্যাপারটা বিরাট করে তোলা যায়।’

‘হ্যাঁ, মন্দ নয়।’ রাহুল উদার গলায় বলল। ‘আমার মনে হচ্ছে অর্জুন, তুমি জার্নালিজমে একবার চেষ্টা করে দেখতে পার। তবে যা বললে তাতে একটা খিঁচ রয়ে গেছে। তোমার এই সম্পূর্ণ অজানা অ্যাথলিটটি ভারতীয় অলিম্পিক দলে ঢুকবে কী করে?’

‘হ্যাঁ, এটা একটা ভালো হয়েন্ট বটে। অলিম্পিক দলে জায়গা পেতে হলে একটা নির্দিষ্ট যোগ্যতামানে পৌঁছতে হবে। আর সেজন্য ট্রায়াল হয়। যদি আমাদের অজানা অ্যাথলিটটি সেই মানে পৌঁছয় তা হলেই জায়গা পাবে।’

রাহুল যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বেশ খুশি মনেই সে গ্লাসে বিয়ার ঢালল সতর্ক হাতে, একমনে। ফেনা থিতিয়ে যাবার জন্য সময় নিয়ে সে চেয়ারে হেলান দিয়ে ধীরে সুস্থে বলল, ‘তা হলে ট্রায়াল! ভালো কথা। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না অর্জুন, তোমার এই অনভিজ্ঞ অ্যাথলিট যে কখনো প্রকাশ্যে দৌড়য়নি সে কী করে ভালো কোচিং পাওয়া অ্যাথলিটদের হারিয়ে টিমে জায়গা করবে?’

‘ওহো।’ অর্জুন হাত তুলে স্বীকার করল যুক্তিটা। ‘আমি বলেছি আমাদের অথ্যালিটটি অজানা, কিন্তু অনভিজ্ঞ বলিনি। তুমি তফাতটা লক্ষ করোনি। এক্সপার্ট কোচিং পেয়েছে মেয়েটি।’

‘মেয়েটি? আমরা কোনো মেয়েকে নিয়ে কথা বলছি নাকি?’ রাহুলের বিস্ময় হালকা কথাবার্তার উপর ঝপ করে যেন ভিজে কাঁথা ফেলে দিল।

অর্জুন বলল, ‘হ্যাঁ মেয়েই। চমৎকার দেখতে। বিজ্ঞাপনের পক্ষে খুবই ভালো। তার থেকেও বড়ো কথা ফ্যান্টাস্টিক রানার। দ্যাখো রাহুল, ভারতের অ্যাথলেটিকসের অবস্থা তো তুমি জানো।’

‘আমি কেন, একটা রিকশাওলাও জানে—হাস্যকর, জঘন্য।’

‘বরাবর পুরুষরাই প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিল। সেটা ভেঙে উষাই প্রথম এগিয়ে আসে। পুরুষদের নিয়েই ভারতীয় দল তৈরি হত, দু—একটা মেয়েকে কৃপা করে রাখা হত। কিন্তু ছেলেরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ল, উষাই হল মধ্যমণি। তাকে ঘিরে উঠে এল আরও কিছু মেয়ে। ছ—বছর আগে সোল এশিয়ান গেমসে আমাদের যা কিছু অ্যাথলেটিকস মেডেল তা মেয়েরাই এনে দিল। কিন্তু অলিম্পিকসে চূড়ান্ত ফ্লপ। এসব পুরোনো কথা। এখন এমনই অবস্থা অলিম্পিকে পাঠাবার মতো একটা ছেলে বা মেয়ে ৯০ কোটি মানুষের দেশে নেই। দেশের লোক হতাশ, হাল ছেড়ে দিয়েছে। তারা বিশ্বাসই করে না, আগামী পঁচিশ বছরে ভারতের কেউ অলিম্পিকস থেকে মেডেল আনতে পারবে।’

‘তাদের মধ্যে আমিও একজন।’

‘কিন্তু এই মেয়েটি পারবে।’ অর্জুনকে উত্তেজিত দেখাল। রাহুল ভ্রূ তুলে রাধিকার মুখভাব লক্ষ করে বুঝল মেয়েটি সম্পর্কে বোধহয় খবর রাখে।

‘ব্যাপার কী?’ রাহুল দাবি জানাল বিস্তারিত তথ্যের জন্য।

‘দু—বছর আগে জগ করার সময় আমার হ্যামস্ট্রিং টেনে ধরে, বোধহয় জান সে কথা।’ অর্জুন নড়েচড়ে চেয়ারের হাতলে দুটো কনুই রাখল। ‘মাঝে মাঝেই এমন টান ধরত যে হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যেত। ডাক্তারের পর ডাক্তার দেখালাম, কিছুই হল না। শেষে বর্ধমানের এক ফিজিওলজিস্টকে দেখাতে বলল আমার এক আত্মীয়। সেখানকার মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপনা করেন। তার চিকিৎসায় একদম সেরে উঠলাম। ডা. সরকার, দারুণ লোক।’

‘মনে পড়ছে। তুমি খুব এর প্রশংসা করেছিলে।’

‘ওর সঙ্গে প্রায়ই নানান কথা হত ফিজিয়োথেরপি ট্রিটমেন্ট চলার সময়। একদিন কথায় কথায় অ্যাথলেটিকসের প্রসঙ্গ উঠল। আমাদের দেশে কত রকমের ঘাটতি, অসুবিধে, অজ্ঞতা, দলাদলি রয়েছে তাই বলতে বলতে তিনি এই মেয়েটির কথা বললেন। দৌড়ে অসম্ভব ট্যালেন্ট রয়েছে কিন্তু কিছু একটা ব্যবস্থা না করলে ধীরে ধীরে করেছেন ভালো কোচ দিয়ে ওকে ট্রেইনিংয়ের ব্যবস্থা করাবেন লোক চক্ষুর আড়ালে। তার ধারণা দু—বছরের মধ্যেই সে অলিম্পিকসে যাবার উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারবে। ওকে গড়ে তোলার জন্য টাকার দরকার। তিনি কয়েকজন ব্যবসায়ীকে ধরে মেয়েটিকে স্পনসর করার ব্যবস্থা করলেন। ব্যাপরটা এ দেশের অ্যাথলেটিকসের ক্ষেত্রে নতুন। এইভাবে ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটা সংঘ বা কনসর্টিয়াম গড়া কখনো হয়নি। তারা ত্রিশ—চল্লিশ হাজার টাকা এক একজন দিয়েছে। যদি মেয়েটি জেতে তা হলে তারা টাকা ফেরত পাবে, সুদসহ।’

‘টাকাটা ফেরত দেবে নিশ্চয় কমার্শিয়াল বিজ্ঞাপন থেকে টাকা পেয়ে। আর মনে হচ্ছে, তুমিও বোধ হয় এই ব্যবসায়ীদের সংঘে যোগ দিয়েছ।’

‘আমি প্রথমে একটা প্রাইভেট ট্রায়ালে মেয়েটির দৌড় দেখতে গেছিলাম বর্ধমানে, জিটি রোডে। দেখে মনে হয়েছে খাঁটি সোনা।’

‘জিটি রোড? সেকি! ট্র্যাকে না দৌড়ে রাস্তায়?’

‘মেয়েটি ম্যারাথনার। তবে পাঁচ আর দশ হাজার মিটারেও তৈরি হয়েছে।’

‘মাই গড! কত দিয়েছ?’

‘বুঝলাম না!’ অর্জুন ভ্রূ কোঁচকাল।

‘বাজির টাকা। ডা. সরকারকে কত দিয়েছ?’

‘এক লাখ।’

রাহুল চোখ বুজল।

‘আমাকে সারিয়ে তোলার জন্য অত টাকাই ওর পাওয়া উচিত।’

‘ভালো। কিন্তু গোপনীয়তা কেন? ডা. সরকার কি এটার সম্পর্কে কিছু বলেছেন?’

‘প্রধানতই নাটকীয় একটা চমক জাগাবার জন্য। যদি দু—বছর ধরে মেয়েটি নানান কম্পিটিশনে নামত তা হলে ইতিমধ্যেই সে অলিম্পিক ফেভারিট হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যেত। রাহুল বিশ্বাস করো, মেয়েটি সেইরকমই, অত ভালোই। সোনা জিতলে কেউ আর তখন অবাক হবে না। কিন্তু অজানা থেকে সেটা করলে জেতাটা চাঞ্চল্যকর গণ্য হবে। তোমার কি মনে হয় না কি বিরাট প্রচার পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে?’

‘ডা. সরকারের মতলবটা কী?’ রাহুল জানতে চাইল।

‘ভারত ইনডিভিজুয়াল ইভেন্টে একটি মাত্র ব্রোঞ্জ এনেছে অলিম্পিকস থেকে সেই কবে—৪০ বছর আগে, কুস্তিতে। আর ১৯০০ পারীতে নর্মান প্রিচার্ডের রুপোর মেডেল দুটো যদি ধরো তা হলে মোট তিনটে। দশকের পর দশক এত বড়ো একটা দেশ থেকে কেউ একজন এখনও একটা সোনা জিততে পারেনি! এই লজ্জা এই ক্ষোভ আর অপমান বোধ থেকেই বোধহয় তিনি এই অভিনব পন্থায় অ্যাথলিট গড়ার চিন্তা করেন। তুমি নিজেই বরং ওকে বুঝে নেবার চেষ্টা করো। উনি এখুনি এসে পড়বেন, ডিনারে ওকে বলেছি।’

‘তাই বুঝি!’ রাহুল সিধে হয়ে বসল। ‘মেয়েটিও আসছে নাকি?’

‘না। তার বদলে উনি একটা ফিল্ম আনবেন। সেটা আমি নিজেও এখনও দেখিনি। আরও একজন আসবে, যারা টাকা দিয়েছে তাদেরই একজন, নাম হীরাভাই পটেল, ডিটারজেন্ট সাবান আর টু হুইলার ম্যানুফ্যাকচারার, কলকাতারই লোক, আমেদাবাদে কারখানা।

‘হীরাভাই নামটা জানি। ওর যা প্রফিট মার্জিন তাতে লাখ দু—লাখ লোকসানে কিছু আসে যায় না।’

অর্জুনকে একটু ক্ষুণ্ণ দেখাল। বলল, ‘মনে হচ্ছে আমার কথা তোমাকে ইমপ্রেস করেনি।’

‘ঘাবড়িও না অর্জুন। তোমার অতিথিদের সামনে এভাবে কথা বলব না। তবে কী জানো পুরো ব্যাপারটা আমার যেন কেমন কেমন লাগছে।’

দুই

একটা কালো ফিয়াট গেট দিয়ে ঢুকে ড্রাইভ ওয়ে ধরে পোর্টিকোয় এসে থামল।

‘এসে গেছে।’ অর্জুন বলল, চেয়ার থেকে উঠে সে আর রাধিকা এগিয়ে গেল। রাহুল ঘাড় ফিরিয়ে প্রথম বারের মতো ডা. সরকারকে দেখতে লাগল। অতি সাধারণ দর্শন, ছোটোখাটো চেহারা মাথাভরা কাঁচা পাকা চুল। কালো প্যান্ট আর হলুদ নীল ডোরাকাটা বুশশার্ট। শীর্ণ গড়ন।

অর্জুন ওদের নিয়ে বাড়ির মধ্যে গেল। রাধিকা ফিরে এসে রাহুলকে বলল, ‘চলুন ডাইনিংয়ে যাওয়া যাক। ডিনারের পর ফিল্মটা দেখান হবে।’

ডাইনিং টেবলে রাহুলের ডানদিকে হীরাভাই বাঁদিকে রাধিকা বসল। এবং বসামাত্রই হীরাভাই বুঝিয়ে দিল সে কথা বলতে ভালোবাসে।

‘তা হলে আপনিই রাহুল অরোড়া, সুপার সেলসম্যান, কি যেন বলেন… মারচেনডাইসিং এজেন্ট না কি যেন?’

‘হ্যাঁ, ট্যাক্স ফর্মে তাই লিখি।’ রাহুল সাদামাটা স্বরে বলল। ‘তবে আমাদের পেশায় কেউ কেউ এজেন্ট শব্দটা পছন্দ করে না। তারা ম্যানেজার বা কনসালটান্ট বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসে। অবশ্য আমার যে কোনোটাতেই চলে যায়।’

‘যত্তো সব গালভরা তকমা,’ হীরাভাই বলল, ‘আমার তো সাবানের ব্যাবসা। আপনি আমাকে সাফাইওলা বলুন আমি কিছু মনে করব না যদি অবশ্য আপনি আমার মাল কেনেন।’

বহু লোকই যে হীরাভাইয়ের মাল কেনে সেটা তার দু—হাতের আঙুলে বড়ো বড়ো মূল্যবান পাথর বসান গোটাছয়েক আংটি থেকেই বোঝা যায়।

‘আমি প্রোডাকশন সাইডটা আর পারচেজটাই দেখি। সেলিংয়ের জন্য আপনাদের মতো লোকদের উপরই নির্ভর করি। ডাক্তারবাবু যখন এই ব্যাপারে টাকা লাগাতে বললেন, ওনাকে আমি সরাসরি বলে দিলাম, মশাই আমি কিন্তু স্লিপিং পার্টনার থাকব। আমি একদম নাক গলাব না—কয়েক হাজার টাকা ইনভেস্ট করব, ব্যস। আমি আমার কথা রেখেছি কিন্তু। ঠিক কিনা বলুন ডাক্তারবাবু। তারপর যখন শুনলাম ওনারা সব একজন মার্কেটিং করার লোক কী যেন আপনি নিজের টাইটেলটা বললেন?—একজনকে ঠিক করছেন, তখন ভাবলাম লোকটাকে একবার তো দেখা দরকার?’

হীরাভাইয়ের বকবকানি থামাবার জন্য অর্জুন বেয়ারাকে ইসারা করল খাবার পরিবেশনের জন্য।

‘তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে ফিল্মটা দেখতে বসা যাক, কি বলেন ডা. সরকার। আর কতটা কাজ এগিয়েছে সেটাও শোনা যাবে।’ অর্জুন বলল। ডা. সরকার মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। তিনি কথা বলেন কমই। মাঝে মাঝে শুধু তার পাশে বসা অর্জুনের সঙ্গে চাপা স্বরে কথা বিনিময় করলেন। রাহুলের মনে হল, এমন লোকের পক্ষে চালাকি করে টাকা রোজগার করা সম্ভব নয়। সে পাশে বসা রাধিকার দিকে ঝুঁকে বলল, ‘ফিল্মটা কী নিয়ে? বিষয়টা কী?’

রাধিকা ঝুঁকে রাহুলের কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে বলল, ‘বলা বারণ। প্রোজেক্ট নিয়ে ডিনার টেবলে কথা বলতে মি. হালদার বারণ করেছেন। উনি চান আগে আপনি ফিল্মটা দেখুন।’

টেবলে নানা ধরনের কথাবার্তা হল শুধু খেলার বিষয় ছাড়া। নিরামিষ খাওয়ার উপকারিতা থেকে ভারতের অর্থনীতি, ধর্ম, পাকিস্তানের পরমাণু বোমা, কলকাতার ভাঙাচোরা রাস্তা, বিদ্যুৎ ঘাটতি ইত্যাদি অনেক বিষয়েই প্রত্যেক কিছু না কিছু মন্তব্য করল। খাওয়া শেষ হলে সবাই উঠে গেল বসার ঘরে। সেখানেই ভিডিও ফিল্মটি দেখানো হবে।

ডা. সরকারের ফিল্ম দেখানোর জন্য দুটো সোফা পাশাপাশি জোড়া দেওয়া হয়েছে। তাতে অন্তত আটজন স্বচ্ছন্দে বসতে পারে। ঘরে ঢোকার সময় রাহুল একটু পিছিয়ে রইল। হীরাভাই বসার পর সে সোফার অন্য প্রান্তে বসল অর্জুন এবং রাধিকাকে মাঝখানে রেখে।

কফি এল। বেয়ারা ট্রে নিয়ে সবার সামনে ধরল। রাহুল মাথা নেড়ে সিগারেট ধরাল। অর্জুন ডা. সরকারকে জিজ্ঞাসা করল, ফিল্মের ভূমিকা হিসাবে কিছু বলবেন কি না।

‘না, ফিল্মই যা বলার বলবে।’

‘তা হলে শুরু করি।’ অর্জুন ক্যাসেট নিয়ে এগিয়ে গেল প্রোজেক্টারের কাছে।

ঘোলাটে ছাই রঙা স্ক্রিনটা কয়েক সেকেন্ড আলোর বুদবুদ কেটে, ফুলঝুরি ছড়িয়ে ধীরে ধীরে সোনালি হয়ে উঠল। হলুদেরই ফিকে থেকে গাঢ় নানান ধরনকে সোনা বলা হয় কিন্তু খাঁটি সোনার আলাদা একটা গুণ আছে যেজন্য এটাকে রং হিসাবে আলাদা করা হয়।

অন্তত দশ সেকেন্ড সোনার রঙে ক্রিনটা জ্বল জ্বল করার পর ক্রমশ গিরিমাটির রং ধরল। রাহুল এবার টের পেল, গরম মসৃণ গাত্র ত্বকের উপর বিশুদ্ধ রোদের আলো ক্লোজ আপে দেখানোর ফল যে কেমন হতে পারে সেটাই দেখান হচ্ছে। গুঁড়ি গুঁড়ি সোনালি লোমের জন্য সোনা রঙার ধরন রেশমের মতো।

একটি মেয়ের ঊরু। ধীরে ধীরে সেটা মিলিয়ে ভেসে উঠল কোমর। ক্যামেরা চক্রাকারে কোমরটাকে ঘুরে এল নাভির উপর। স্ক্রিনের উপর ফুটে উঠল শুধু একটি শব্দ: স্বর্ণকুমারী। নিথর সাদা অক্ষরগুলোর জন্য ত্বকের নড়াচড়াটা প্রকট হয়ে উঠল। কোন কলাকুশলীর নাম ফুটে উঠল না।

ক্যামেরা ধীরে ধীরে পিছিয়ে এল আর স্ক্রিন জুড়ে দেখা দিল একটি মেয়ের পূর্ণ শরীর। দীর্ঘকায়া, অনস্বীকার্যভাবে সুন্দর নীল পটভূমিতে গতিহীন, বাতাসে দীর্ঘ কালো চুল উড়ছে। ছবিটা তোলা হয়েছে কোনো উঁচু জায়গায় কেননা মেয়েটির হাঁটুর পিছনে দূরের একটা টিলা দেখা যাচ্ছে। ক্যামেরা কোণ বদলাচ্ছে। মেয়েটির ডানদিকে ক্যামেরা এল অর্থাৎ সূর্যের মুখোমুখি হল। মুখের কালোছায়ার কিনারে সোনালি রেখা নাটকীয় অনুভূতি জানাল।

রাহুল অস্বস্তি বোধ করছে। মেয়েটিকে সে চিনে উঠতে পারছে না। টিভি কমার্শিয়ালে যেসব মেয়েরা মডেলের কাজ করে তাদের প্রায় সকলেরই মুখ তার চেনা। সকলের নাম অবশ্য তার মনে নেই। কিন্তু নামটা তত জরুরি নয়। একই মেয়ে দশ রকমের বিজ্ঞাপনে নামছে প্রেশার কুকার থেকে টুথপেস্ট, ফাস্ট ফুড। বিজ্ঞাপন ব্যবসায় যারা জড়িত তারা চিহ্নিত করে রাখে এদের। যে মেয়ে জাতীয় কার্যক্রমে ছেলেকে প্রতি রাত্রে জেলিমাখন পাউরুটি খাওয়াচ্ছে, কোনো কোম্পানির বড়কর্তা ম্যাগাজিন খুলেই পুরো পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনে সেই মেয়েকে দেখে নিশ্চয় খুশি হবে না। বিপণনে সুদক্ষরা এমন কাজ কখনোই করে না এবং রাহুলের কাজ হল, এমন ব্যাপার যাতে না ঘটে সেটাই দেখা।

স্বর্ণকুমারী যে—কোনো এজেন্সি ক্যাটালগে নেই, সে বিষয়ে রাহুল নিশ্চিত। মুখটি এমনই যে একবার দেখলে ভুলে যাওয়া অসম্ভব। গোলাকার ঈষৎ চ্যাপটা মুখের গড়ন, কিছুটা মোঙ্গোলীয় আদল ধরা পড়ে। পাতলা গোলাপি ঠোঁট। চোখে সামান্য বিষাদের ছোঁয়া। ব্যক্তিত্বে গর্বে টলমল করছে, কপালের ঢাল বেয়ে নেমে আসা সরু টিকোল নাক, জোড়া ভুরু, গালের উঁচু হাড়। সম্রাজ্ঞীর মহিমা ছড়ানো মুখমণ্ডলে। তাকে ঘিরে ক্যামেরার আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাহুল অবাক হচ্ছিল এই ভেবে যে এমন দারুণ একটি মেয়েকে বিজ্ঞাপন দুনিয়া খুঁজে পায়নি এখনও। দেহে কোনো খুঁত—টিকার দাগ, পোড়া বা ক্ষত বা জরুল আছে কি না দেখার জন্য রাহুল তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে শটগুলিতে চোখ রাখল। নিখুঁত দেহ।

ক্যামেরা দেহ আবর্তন করে আবার শুরুর অবস্থানে এসে পেটের উপর ক্লোজ আপে রইল। স্ক্রিনের উপর দিয়ে নাভিটা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। যেখানে আগে টাইটেল পড়েছিল, নাভি সেইখানে পৌঁছেই থেমে গেল। সোনা রঙের পটভূমিতে সাদা অক্ষরে ভেসে উঠল সাজানো একটা পরিসংখ্যান।

স্বর্ণকুমারীর ২০ বছর বয়স পূর্ণ হবে

২৫ অগাস্ট, ১৯৯২

ওজন ৬৭ কেজি

উচ্চচতা ৫ ফঃ ৯ ইঃ

কাঁধ (ব্যাস) ১ ফুঃ ৩ ইঃ

নিতম্ব (ব্যাস) ১১ ইঃ

বাইসেপ ১০ ইঃ

ঊরু ১ ফুঃ ১০/১/৪ ইঃ

পায়ের কাফ ১ ফুঃ

লেখাগুলো মিলিয়ে গিয়ে ভেসে উঠল দ্বিতীয় পর্যায়ের ছবি। জিমন্যাসিয়াম। মেয়েটির পাশে তার কান সমান উচ্চচতায় সাদা ঢিলে সুতির কোট পরা একটি লোক, হাতে একটা জটার কলম ডা. সরকার।

সাউন্ডট্র্যাকে ডা. সরকারের গলা শোনা গেল।

‘এই তরুণীকে খুব মন দিয়ে লক্ষ করার জন্য আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি। মেয়েটি আকর্ষণীয় অবশ্যই শারীরিক দিক থেকেও কৌতূহল জাগানোর মতো। এটা আরও ভালো ভাবে বুঝতে পারবেন যদি ওর রেডিওগ্রাফি পরীক্ষা করে দেখেন।’

স্ক্রিনের উপর ডা. সরকারের পাশে প্রক্ষিপ্ত হল মেয়েটির পূর্ণ দৈর্ঘ্যের এক্স—রে।

‘ওর কাধ এবং থোরাক্সের ব্যবধানটা লক্ষ্য করুন। অ্যাভারেজের থেকেও বড়ো বুকের খাঁচার জন্য ওর ফুসফুসের ক্ষমতা অবশ্যই বেশি। মানুষের এরোবিক ক্ষমতা অর্থাৎ যাকে বলা হয়, সর্বাধিক যতটা পরিমাণ সম্ভব অক্সিজেন টেনে নিয়ে সেটা ক্রমান্বয়ে শারীরিক ক্রিয়ার মধ্যে থেকে প্রতি মিনিটে পাঠানো এবং সেটাকে ব্যবহার করা, এটা নির্ভর করে ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের আকার, রক্তে হেমোগ্লোবিনের পরিমাণের এবং পেশিতে তন্তুর পরিমাণের উপর। এখন যদি আমরা পেশির সংস্থান পরীক্ষা করি—’এক্স—রে কঙ্কাল মিলিয়ে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠল স্বর্ণকুমারীর মনোরম চেহারা,’—তা হলে আমরা দেখব চমৎকার পেশিখরা ঊরু আর পায়ের ডিম বা কাফ। এই ধরনের পা খাটো চেহারার মেয়েদেরই হয়। মেয়েদের সৌন্দর্য বিচারে চিরাচরিত যে পদ্ধতি নেওয়া হয়—বুক, কোমর এবং নিতম্বের আনুপাতিক হার—সেটা নিশ্চই বুঝতে পারছেন এখানে সুন্দরভাবে বজায় রয়েছে। বুক এবং নিতম্ব—’ ডা. সরকার তার হাতের কলম শূন্যে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে—’অতুলনীয় ক্ল্যাসিক গড়নের।’

রাহুল চট করে দর্শকদের দিকে একবার তাকিয়ে নিল। হীরাভাই তালুতে পানপরাগ ঢেলে সেটা সব মুখে চালান করতে সময় পায়নি। অর্জুন হাতের মুঠোয় চিবুক রেখে সামনে ঝুঁকে। রাধিকা সোফায় হেলান দিয়ে, দুই হাত তুলে মাথার পিছনে রাখা। রাহুলের চোখে চোখ পড়তেই বুকের সরে যাওয়া আঁচল টেনে দিল।

‘এটা এখন প্রমাণিত যে,’—ডা. সরকার বলে চললেন, ‘গত একশো বছরে, পূর্বপুরুষদের থেকে এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটু তাড়াতাড়িই পিউবার্টির বয়সে পৌঁছনোর লম্বা হওয়ার আর বলিষ্ঠ চেহারা পাওয়ার প্রবণতাটা বেড়ে গেছে। উপর দিকে বেড়ে ওঠার ঝোঁকটা আমেরিকায় আর পশ্চিম ইউরোপে প্রতি দশকে গড়ে এক সেন্টিমিটার। আমাদের দেশে এটা যে কত তা জানা সম্ভব নয়, কেননা এখনও এই সম্পর্কে ভারতে কোনো কাজ হয়নি। তবে এইরকম লম্বা বহু মেয়েই আমাদের দেশে দেখা যায় কিন্তু এই মেয়ের সঙ্গে তুলনীয় দৈহিক সক্ষমতা সম্পন্ন লম্বা মেয়ে বোধহয় পাওয়া যাবে না। এটা আমি আমার চল্লিশ বছরের আনথ্রোপমেট্রির অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। দৈহিক বৃদ্ধির যে ঝোঁকটার কথা বলেছি তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে একবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় মেয়েদের গড়ন এইরকমই দাঁড়াবে। তখন তাদের আরও বেশি ফুসফুসের ক্ষমতা গভীর বুকের খাঁচা, শক্তিশালী কার্টিওভাসকুলার সিস্টেম, পেশির উন্নতি ঘটতে পারে। এই মেয়েটি তার যুগের থেকে ইউজেনিক্যালি তিরিশ চল্লিশ বছর এগিয়ে রয়েছে। আর সেটা যে কীভাবে আপনারা এখনি তা দেখতে পাবেন।’

ফিল্ম এবার কাট করে দেখাল মেয়েটি লোহার ভারী চাকতি লাগানো রডের পাশে দাঁড়িয়ে।

‘এগুলো চল্লিশ কেজি ওজনের ট্রেনিং ওয়েট যা পুরুষ অ্যাথলিটরা ব্যবহার করে। এইবার ও দেখাবে শরীরে সাবলীলতা। এটা কিন্তু শক্তির পরীক্ষা নয়। লক্ষ্য করুন কত সহজে স্বচ্ছন্দে, চটপট কাজগুলো করছে।’ ডা. সরকার কথা বন্ধ করলেন।

নীচু হয়ে ঝুঁকে মেয়েটি বারবেল তুলে আনল বুকের সামনে মসৃণভাবে। দশবার করল। তারপর বুক থেকে কোমর এবং কোমর থেকে বুক পর্যন্ত তারপর কাঁধে বারবেল রেখে আধা—বৈঠক, তারপর বেঞ্চ প্রেস।

‘ওর নাড়ির গতি যদি নিই’, মেয়েটি যখন ব্যয়াম শেষ করে তার পাশে দাঁড়িয়ে গভীর সহজভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে তখন ডা. সরকার আবার বলতে শুরু করলেন, ‘তা হলে ব্যয়ামের সময় প্রতি মিনিটে স্পন্দন পাব ১৫০ আর দু—মিনিটেই সেটা নেমে আসবে স্বাভাবিক হার ৪৫—এ। আমেরিকা, রাশিয়া আর পশ্চিম জার্মানি থেকে পরিসংখ্যান ডাটা আনিয়ে মাসের পর মাস ওকে নিয়ে তার ভিত্তিতে ব্যাপক পরীক্ষা চালিয়ে মাপজোক করে এখন এইটুকু বলতে পারি, এইসব প্রতিটি পরীক্ষায় এই তরুণীর পারফরম্যান্স পৃথিবীর শীর্ষ পর্যায়ের তা সে যেকোনো বয়সিই হোক না, শতকরা দুই বা তিনজন মেয়ের মধ্যে পড়বে।’

ডা. সরকার হাত নেড়ে নিজের বক্তব্যকেই যেন বাতিল করে দিলেন, এমন একটা ভঙ্গিতে আবার বলতে থাকলেন, ‘কিন্তু এইসব ফিজিওলজিক্যাল ডাটা শুধু ফিজিওলজিস্টদের কাছেই প্রাসঙ্গিক। একটা ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাফ শুধু আমাকেই উত্তেজিত করতে পারে সাধারণ নরনারীর কল্পনা শক্তিকে নাড়া দেবে না। শারীরিক ক্ষমতা যাচাই করার জন্য আরও অনেক উপায় আছে যেটা লেবরেটরিতে মাপজোকের থেকে একটু কম সূক্ষ্ম তবে বহু বছর ধরে মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করার সেটা এখন স্বীকৃত হয়ে গেছে। আমি জনপ্রিয় খেলাগুলোর কথাই বলছি, যে খেলায় হিসেব নিকেশ করা যায়। বিশেষ করে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড অ্যাথলেটিকসে। পুরুষ এবং নারীর চূড়ান্ত সাফল্যের প্রমাণ এর একাধিক ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে। স্পোর্টসের পত্রিকাগুলো সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর ঘটে যাওয়া হাজার হাজার পারফরম্যান্সের বিবরণ ছেপে যাচ্ছে।

‘কিছু কিছু অ্যাথলেটিক কাজকর্ম আমরা বাদই দিচ্ছি কেননা আমাদের যা জানার দরকার তার সঙ্গে ওসবের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন, জাম্পিং বা থ্রোয়িং ইভেন্টগুলোর মান উঠছে টেকনিকের উন্নতির জন্য, এত দ্বারা শরীরগত মাপজোক বা পরীক্ষার জন্য সাদামাটা সরল যে সুযোগটা ছিল সেটা নষ্ট হয়েছে। তবে এখনও অনেক ইভেন্ট রয়ে গেছে যেগুলো কোচিং টেকনিকের জটিলতার হাত এড়াতে পেরেছে যেমন দূর পাল্লার দৌড়।’

এইবার ফিল্ম ফিরে গেল ঘন শাল জঙ্গলের মধ্যে লাল মাটির রাস্তায়। ডা. সরকার একটা সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে লাল শর্টস সাদা স্পোর্টস শার্ট আর স্পোর্টস শু। সূর্যের আলো একদিক থেকে গাছের ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে। তাই থেকে বোঝা যায় সময়টা মধ্যাহ্নের কয়েক ঘণ্টা আগে।

‘তা হলে এবার দেখা যাক আমাদের এই তরুণী রানার হিসাবে কেমন হতে পারে। একটা কথা বলে রাখা ভালো, মেয়েটি জীবনে কখনো কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়নি। প্রথমে দেখা যাক সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে সে কেমন দৌড়য়, শুধুমাত্র দৌড়ের আনন্দে দৌড়কে উপভোগ করার জন্য।’

এবার স্বর্ণকুমারীকে দেখা গেল। সোনালি সিল্কের শর্টস আর হাতকাটা সাদা জামা পরা কিন্তু খালি পায়ে। সেই লাল মাটির রাস্তা দিয়ে সে সাবলীল গতিতে ছুটে চলেছে। মাথার চুল কাঁধের উপর ঝাঁকাচ্ছে। তার সঞ্চরণের মধ্যেই জমানো শক্তি লুকিয়ে থাকার ধারণা দিচ্ছে। দুটি বাহু অনায়াসে দুলছে একই ছন্দে। ডা. সরকার কথা বলে যাই বোঝাবার চেষ্টা করুন না কেন, রাহুলের মনে হচ্ছে গতিময় এই মেয়েটি অনবদ্য, এর দৌড়ের মধ্যে শারীরিক উচ্ছ্বাস ও খুশিরই যেন প্রকাশ ঘটেছে। ওস্তাদ বীণকার তার যন্ত্রে প্রথম সুর লাগানো মাত্র হৃদয়ে যে কম্পন জাগে, এই মেয়েটির দৌড় প্রায় সেই রকমই অনুভূতি জাগাচ্ছে। রাহুল এরপর টের পেল নিজের অজান্তেই সে কার্পেটে ডান পা চেপে ধরে আছে, যেভাবে সে মোট গাড়ির অ্যাক্সিলেটর চেপে ধরে।

মেয়েটি তার দৌড়ের গতি বাড়িয়েছে। পিছনে সাইকেলে চেপে যাচ্ছিলেন ডা. সরকার। ধীরে ধীরে তিনি পিছিয়ে পড়ে ফিল্মের ফ্রেম থেকে বেরিয়ে গেলেন। মসৃণভাবে মেয়েটি গতি বাড়াচ্ছে, কালো চুলের রাশ তার পিছনে ওঠানামা করছে ঢেউয়ের মতো। দুটি মুঠো করা বাহু পিস্টন রডের মতো এগোচ্ছে পিছোচ্ছে, দুটি খালি পা সমান তালে রাস্তার মাটি কামড়ে চিবিয়ে পিছনে ফেলে দিচ্ছে। প্রায় তিরিশ সেকেন্ড প্রচণ্ড গতিতে দৌড়ে ধীরে ধীরে সে মন্থর হয়ে এল। তখন আবার ডা. সরকারকে ফ্রেমের মধ্যে সাইকেল চালিয়ে ঢুকতে দেখা গেল।

যে জিনিসটা রাহুলকে কৌতূহলী করল, সেটি হল, নিছক আনন্দের জন্য দৌড়চ্ছে বলা হলেও মেয়েটির মুখে কিন্তু উদ্দীপনা বা তৃপ্তির কোনো ভাব দেখা গেল না। সারা ফিল্মে যেমন তেমনই নিরাবেগ নৈর্ব্যক্তিক রয়ে গেল তার মুখ।

ডা. সরকার আবার কথা বলতে শুরু করলেন: ‘এতক্ষণে ওর গা গরম হয়েছে এবার তা হলে ওকে আরও দৌড়তে বলা যাক। আমার সাইকেলে মাইলোমিটার লাগান রয়েছে। মিটারে সংখ্যার ঘর শূন্যতে আনলাম।’ ক্যামেরার চোখ মিটারের উপর পড়ল। দেখা গেল চারটি ঘরেই শূন্য অঙ্ক। ‘আমি আগে আগে যাব। আমার গলায় ঝুলছে স্টপওয়াচ। ও দৌড়বে দশ কিলোমিটার। পুরো দৌড় দেখানো যাবে না, তাতে যত সময় লাগবে আধ ঘণ্টা তো বটেই ততক্ষণে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। আসলে মেয়েটি বন্ধুর অসমান পাহাড়ি পথে, চড়াই ভেঙে কীভাবে দৌড়চ্ছে সেটাই দেখাতে চাই।’

মেয়েটিকে এবার দেখা গেল এক পাহাড়ি নদীর কিনারে ক্ষয়ে যাওয়া ঢালু জমি ঘেঁষে দৌড়চ্ছে। নদীর অপর পারে পাহাড়। ডা. সরকারের গলা শোনা গেল: ‘সিংভূম জেলার সারাণ্ডা অরণ্যাঞ্চল এটা, নদীর নাম সঞ্জাই। ওপারে দূরের পাহাড়টার নাম চিরুবেরা। আমরা শুরু করেছি চক্রধরপুরের ঠিক বাইরে একটা জায়গা থেকে।’

মেয়েটি পাকা রাস্তা ছেড়ে মোরাম দেওয়া রাস্তায় মোড় নিল। একটা টিলায় উঠল। দু—ধারে ঢেউ খেলান জমি। আদিবাসী মেয়েরা বাচ্চচারা মহুয়া কুড়োতে কুড়োতে একবার মেয়েটির দিকে তাকাল। তাদের চোখে বিস্ময় বা ঔৎসুক্য নেই। যেন এই মেয়েটির দৌড় দেখায় তারা অভ্যস্ত। প্রচুর গাছ আর অজস্র লাল ফুলে স্ক্রিনে যেন আগুন ধরে গেছে।

রাস্তায় বড়ো বড়ো গর্ত, কোথাও ঢিবি। ডা. সরকারের সাইকেলের চাকা থেকে উড়ছে লাল ধুলো। দমকা হাওয়াতেও ধুলোর পর্দা উড়ে আবার সরে যাচ্ছে।

‘এবার যে পাহাড়টা দেখছেন ওটার নাম সাহেদবা। ওর ঠিক নীচেই টুইয়া গ্রাম। ওখানে আমরা শেষ করব।’

ডা. সরকার সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে। ক্যামেরা মাইলোমিটারে দেখাল ১০ সংখ্যাটা। স্টপওয়াচ হাতে তিনি অপেক্ষা করছেন। দৌড়ের শেষের দিকে এগিয়ে চলেছে মেয়েটি প্রচণ্ড গতিতে। ডা. সরকারকে সে অতিক্রম করা মাত্র স্টপওয়াচের বোতামে একটা তর্জনীর চাপ পড়ল। ক্লোজ আপে স্টপওয়াচটিকে দেখানো হল।

‘সময় হল ৩১ মিনিট ৩৩.৭ সেকেন্ড। এটা যদি কোনো প্রতিযোগিতায় করত তা হলে এই বছরের সেরা আধডজন মেয়েদের মধ্যে ও এসে যাবে। চার বছর আগে সোল অলিম্পিকসে এই সময় করলে ষষ্ঠ স্থান পেত। সপ্তম হয়েছিল চীনের ওয়াং। তার সময় হয়েছিল ৩১ মিনিট ৪০.২৩ সেকেন্ড। একটা কথা মনে রাখবেন দশ হাজার মিটার দৌড় হয় স্টেডিয়ামের মধ্যে সিন্থেটিক ট্র্যাকে। তাতে ওর সময় আরও কমত।’

‘কত কমত?’ রাহুল অস্ফুটে কথাটা বললেও ডা. সরকারের কানে তা পৌঁছল। তিনি মুখ ফিরিয়ে একবার তার দিকে শুধু তাকালেন।

ফিল্মে ডা. সরকারের সঙ্গে মেয়েটিকে দেখা গেল। হাঁটুতে দু—হাত রেখে কুঁজো হয়ে শ্বাস নিচ্ছে। অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণ করতে।

‘শেষ করার আগে একটা ছোট্ট অঙ্কের কথা বলি। পৃথিবীর সেরা পনেরোটি দূরপাল্লার মেয়ের উচ্চচতা যদি হিসেব করা যায়, তা হলে আমরা দেখব তাদের গড় উচ্চচতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। এখন যে মেয়েটির দৌড় দেখলেন তার থেকে পাঁচ ইঞ্চি কম। এটা প্রমাণিত পেশি থেকে সর্বাধিক যতটা শক্তি প্রয়োগ করা যায় সেটার সঙ্গে শরীরী উচ্চচতার সরাসরি আনুপাতিক হিসেব করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি বিশ্বের সেরাদের থেকে গড়পড়তায় ও শতকরা ৯ ভাগ লম্বা আর পেশির শক্তিতে ওর ক্ষমতা শতক ১৯ ভাগ বেশি।’

ফিল্ম শেষ হল ওই পাহাড়ি রাস্তা ধরেই ফিরে যাওয়ার দৃশ্য দিয়ে। তবে এবার সাইকেল চালাচ্ছে স্বর্ণকুমারী আর পিছনে বসে রয়েছেন ডা. সরকার। স্লো মোশানে দেখা গেল, প্যাডেলরত গোড়ালি থেকে ক্যামেরা আলতো ভাবে উঠে চলেছে উপরে। ঘাসে ভেজা ত্বকের নীচে হাঁটু ঊরুর পেশির তির তির কম্পন, হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরা হাতের পেশির কাঠিন্য, ধুলো মাখা মুখ ঝাঁকিয়ে ওঠা চুল এবং নিরাসক্ত দৃষ্টিতে সামনে তাকানো চোখ। ফিল্ম এরপর ফ্রিজ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কেউই কোনো কথা বলল না। রাহুল প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করতে করতে ভাবল অর্জুন যা বলেছে সেটাই তা হলে ঠিক। একটা অজানা মেয়ে তা হলে রয়েছে যাকে মনে হল যেন দৌড়তে পারে। তবে অলিম্পিক মান অনুযায়ী কি না সেটা বলা সম্ভব নয়। ডা. সরকার বললেন দশ হাজার মিটার দৌড়ল ওই সময়ে। হবেও বা! কিন্তু উনি বললেই যে সময়টা ওইরকম হবে তার ঠিক কী? ক্যামেরার কারসাজিতে কেঁচোকেও তো অজগর বানানো যায়।

রাহুল এরপর কথা শুনে বুঝল অর্জুন বিশ্বাস করেছে ডা. সরকার যা বলছেন তাতে অবিশ্বাস করার কিছু নেই। হীরাভাইও বিশ্বাস করেছে। স্বর্ণকুমারীর জন্য ওরা টাকা বিনিয়োগ করেছে সুতরাং যতটা টাকা আদায় করে নেওয়া সম্ভব। সেটা ওরা করতে চাইবেই। মেয়েটির যোগ্যতা সম্পর্কে কোনোরকম সন্দেহ প্রকাশের সময় এখন নয়। ফিল্মে যেমনটি দেখা গেল স্বর্ণকুমারী আসলে সত্যি সত্যিই ওই রকম চমকপ্রদ কিনা তাই নিয়ে কথা না বলে সে নিজেকে এর সঙ্গে জড়াবে না। না জড়াতে চাইলে সরে আসার জন্য দাখিল করার মতো যুক্তি তার জানা আছে।

রাহুলের খাতায় সুপারস্টার পর্যায়ে আছে চারজন খেলোয়াড়। পাকিস্তানের শাজাহান খাঁ যে এখন স্কোয়াশে বিশ্বের এক নম্বর, অল ইংল্যান্ড এবং এশিয়ান ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন মোহিত কাত্রে, রেসিং জকি জিমি দারুওয়ালা আর সিঙ্গাপুরের একজন গল্ফার। এখন ওরা এক একজন চলন্ত ব্যবসায়ী সংস্থা। টাকা খাটাবার জন্য নিজেদের ম্যানেজার, ট্যাক্স কনসালট্যান্ট রেখেছে। এদের সাফল্য দেখে লোকে ভাবে যেকোনো তাগড়াই বাচ্চচাকে খেলায় নামিয়ে দিলেই বুঝি ওইরকম হতে পারবে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা যে অন্য রকম সেটা তারা জানে না। বিপণনের সুযোগ খেলার লোকেদের সহজে মেলে না। ঘটনাগতিকে যতক্ষণ না এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়ে যায় যেটা সারা পৃথিবীকে ঘাড় ধরে টিভি—র সামনে বসাচ্ছে ততক্ষণ কেউ বিপণনযোগ্য হয়ে ওঠে না। সুতরাং ঘটনা চাই অবস্থাটা তৈরি করার জন্য। একজন অ্যাথলিট যদি লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করতে চায় এবং এই ১৯৯২ সালেই, তা হলে তাকে বার্সিলোনায় যেতে হবে। কিন্তু অলিম্পিক সোনার মেডেল পেলেই যে সাবানের বিজ্ঞাপনে মুখ দেখান যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। রূপকথার রাজকুমারের মতো দৈত্যদানোকে বধ করতে হবে। মুখ থুবড়ে পড়ে আবার উঠতে হবে এবং তার পরও জিততে হবে। স্বর্ণকুমারী প্রতিযোগিতায় নামার যার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই তাকে এই সব করতে হবে।

রাহুলকে এই কথাগুলোই এবার এই লোকগুলোর মগজে ঢোকাতে হবে। বহু টাকা ইতিমধ্যেই মেয়েটির জন্য এরা ঢেলেছে। এখন যদি বলা যায় তাদের জিনিসটা বিক্রি করার মতো নয় তা হলে ওরা হতাশ হবে। ব্যাপারটা তার পক্ষে খুব স্বস্তিকর হবে বলে মনে হচ্ছে না। ডা. সরকার উঠে দাঁড়িয়ে স্মিত হেসে রাহুলের দিকে তাকিয়ে যখন বললেন, ‘কিছু কথা বলব, আপনি কি একটু এই দিকের সোফাটায় এসে বসবেন?’ তখড় সে মনের মধ্যে চাপা দুঃখের ছোঁয়া পেল।

তিন

‘মাপ চেয়ে নিয়েই শুরু করি। অর্জুনবাবু যখন ফিল্ম শুরু হওয়ার আগে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলেন তখন আমি ভূমিকার মতো কিছু বলতে অস্বীকার করি। এই অসৌজন্যতার জন্য আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি।’ ফিল্মের গমগমে স্বরের পর এখন ডা. সরকারের স্বর পাতলা শোনাচ্ছে। ‘আজকের এই জমায়েতের কথা ভেবে আমি ঠিকই করেছিলাম, আমার আগাম কথা দিয়ে নয়, স্বর্ণকুমারী নিজেই নিজের সম্পর্কে ধারণা আপনাদের মনে তৈরি করে দিক। তাই এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাখ্যা দিইনি। আজকের এই জমায়েতের কারণ সম্পর্কেও আগাম কিছু বলিনি। আপনারা ব্যস্ত লোক, অনেক জরুরি কাজ ফেলে আজ এখানে এসেছেন, সেজন্য আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। কেন আপনাদের আগাম কিছু জানাইনি সেটাই একবার বলব।’

ডা. সরকার কথা বলার সাময়িক বিরতি দিলেন। মাথা নীচু করে বক্তব্য গুছিয়ে নিয়ে দুবার গলাখাঁকরি দিয়ে বসে চললেন ‘আমার সম্পর্কে এই পরিকল্পনার বা প্রোজেক্টের সঙ্গে আমার জড়িত থাকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আপনাদের জানানো উচিত বলে আমি মনে করি। আমার পুরো নাম সারদাচরণ সরকার। আমার জন্ম কলকাতায়, ১৯৩৫ সালে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম বি বি এস আর হামবুর্গ থেকে পিএইচ. ডি করেছি। স্পেশালাইজ করি ফিজিওলজিতে। ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্যাল এডুকেশনের ফেলো, চণ্ডীগড় ইন্সটিটিউট অফ হিউম্যান সায়েন্সে অধ্যাপক ছিলাম ১৯৮৫ পর্যন্ত। আমার কাজের ক্ষেত্রে সর্বশেষ যা কিছু ঘটেছে তার সঙ্গে পরিচিত থাকার চেষ্টা করি। আপাতত বর্ধমানে থাকি। আমার মনে হয় আপনারাও নিজেদের যৎসামান্য পরিচয় যদি অন্যদের জানিয়ে দেন তা হলে সুবিধা হয় কথাবার্তা বলায়। মি. প্যাটেল আপনার সাবান তো লোকের ঘরে ঘরে ব্যবহৃত হয়, বহু লোক আপনার তৈরি স্কুটারে চড়ছে কিন্তু আপনার সম্পর্কে জানার কৌতূহল—।’

হীরাভাই পান মশলার কৌটো হাতে নাড়াচাড়া করছিল। থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি আর বেশি কী বলব? পনেরো বছর আগে বাবা ছোটো একটা ঘরে গুঁড়ো সাবান তৈরির কারবার শুরু করেছিলেন, আমি সেটা একটু বড়ো করেছি কারখানা বানিয়ে। স্কুটার আমি একা তৈরি করি না, বাইশ পারসেন্ট শেয়ারের মালিক আমি। খেলায় ইন্টারেস্ট আছে। রোজ ভোরে ময়দানে ভলিবল খেলি। এখন বয়স ছেচল্লিশ। বউ আর দুটি মাত্র ছেলে আছে। এবার মি. অরোরা বলুন।’

হীরাভাই যতটা জানাল, তার থেকেও কম বলবে ঠিক করে রাহুল বলল, ‘এখন আমি দিল্লির তার আগে কলকাতারই ছিলাম। ব্যবসায়ে গোড়া থেকেই আমি শুধু মারচেনডাইজিং—য়ের দিকটাতেই আছি। নিজের এজেন্সি তৈরি করেছি। এন্টারটেইনমেন্ট আর স্পোর্টস জগতের নামি স্টারদের জন্য কনট্র্যাক্ট পাইয়ে দেওয়ার দিকেই আমার ঝোঁকটা বেশি। আমার অফিস আছে বোম্বাইয়ে, ব্যাঙ্গালোরে, দিল্লিতে তো বটেই। এশিয়ার পূবে সোল আর টোকিওয় পশ্চিমে তেহরান আর রিয়াধে, আফ্রিকায় কায়রোতেও আমার রিপ্রেজেন্টেটিভ আছে। আমার ক্লায়েন্টদের মধ্যে নাইট ক্লাব সিঙ্গার থেকে গলফার অনেক রকম পেশার লোকই আছে কিন্তু কোনো ট্র্যাক স্টার নেই।’

‘বলছেন কি মি. অরোরা? আপনি আমাদের এজেন্ট হবেন আর আপনি দৌড়ের বিষয় কিছু জানেন না?’ হীরাভাই তাজ্জব হবার ভান করল।

‘মি. পটেল এসব কথা বাদ দিন। রাহুল গজল জানে না, ভারতনাট্যম জানে না কিন্তু ওর ক্লায়েন্ট লিস্টে ভারতের সেরা সিঙ্গার আর ডান্সাররা আছে।’ অর্জুন একটু তীব্র স্বরে বলল, ‘রাহুল এখন ভারতের সেরা এজেন্ট আর সেজন্যই ওকে ডেকে এনেছি।’

হীরাভাই উত্তর দেবার আগে ডা. সরকার বললেন, ‘নিজের পেশায় মি. অরোরা খুবই নামি লোক। তিনি আজ এখানে এসেছেন কারণ আমার মনে হয়েছে এই আলোচনায় ওর উপস্থিতি থাকার এইটেই ঠিক সময়।’ কথা বলার ভঙ্গি থেকেই বোঝা যাচ্ছে সরকারই এই আলোচনার নেতৃত্ব দেবেন। ‘ফিল্মটা আগে আপনারা তো কখনো দেখেননি। কেমন লাগল বলুন?’

‘মেয়েটিকে ভালোই মনে হল।’ অর্জুন প্রথম মন্তব্য করল।

‘দৌড়য়ও খুব ভালো।’ হীরাভাই বলল, ‘মি. অরোরা আপনার কী রকম মনে হল? ওকে গজল গাওয়ালে ভালো হবে না কথক নাচালে?’

‘মি. পটেল ঠাট্টা মস্করা নয়।’ অর্জুন হুঁশিয়ারি দিল।

‘আমাদের এই কনসরটিয়ামকে যদি সফলভাবে চালাতে হয়, তাহলে পরস্পরের উপর শ্রদ্ধা থাকা দরকার।’ গম্ভীর স্বরে সারদাচরণ বললেন, ‘এই ধরনের কথাবার্তা হলে, চেয়ারম্যান হিসেবে আমি তাহলে এই আলোচনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হব।’

হীরাভাই পানমশালার কৌটো পকেটে রেখে সোফায় দেহ এলিয়ে বলল, ‘ডাক্তারবাবু কিছু মনে করবেন না, আমি এইভাবেই কথা বলে থাকি। বহুদিনের অভ্যাস। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। আপনি জিজ্ঞাসা করলেন ফিল্মটা কেমন লাগল। খুব ভালো লেগেছে। ২৪ ক্যারেটের মেয়ে, কোনো সন্দেহ নেই। অরোরা কী বলেন?’

‘হ্যাঁ, আমি ইমপ্রেসড হয়েছি। দৌড় বিষয়ে আমি পণ্ডিত নই তবে বড়ো বড়ো অ্যাথলিটের দৌড় টিভি—তে দেখেছি। আমার মনে হয় বড়ো রানার চিনে নেবার মতো বোধবুদ্ধি আমার কাছে। তবে অন্যান্য রানারের বিরুদ্ধে আপনার স্বর্ণকুমারী কী করবে সেটাই দেখতে চাই।’

রাহুলের শেষ বাক্যটিকে সমালোচনা হিসাবে ধরার বদলে, সারদাচরণ খুশিই হলেন। ‘আমিও তাই চাই মি. অরোরা। আর সেটাই দেখব। আপনাদের আমি একটা গল্প বলব যেটা আমি ছাড়া এখনো পর্যন্ত আর কেউ জানে না। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই অনুরোধ করব, আর কারুর কাছে সেটা বলবেন না।

‘আজ থেকে প্রায় ৪৯ বছর আজে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। বর্মা ফ্রন্টে জাপানীরা হু হু করে এগিয়ে আসছে ভারতের দিকে। আজাদ হিন্দ ফৌজের যোদ্ধারা আরাকান পর্যন্ত এসে গেছে, সেই সময় পিছু হটছে মিত্রপক্ষের বাহিনী। তাড়া খেয়ে পালাতে পালাতে এক ব্রিটিশ রেজিমেন্টের সারজেন্ট দলছুট হয়ে যায়। গভীর জঙ্গল আর পাহাড়েনর মধ্যে সে পঁচিশ দিন ধরে হেঁটে ছিল শুধু বুনো ফল, নদীর জল খেয়ে। ম্যালেরিয়ায় অর্ধমৃত অবস্থায় সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, মি. আও নামে এক জঙ্গল অঞ্চলে। তাকে কুড়িয়ে নিয়ে যায় আপাতনি উপজাতিদের একটি ভ্রাম্যমাণ দল। তারা এই ব্রিটিশ সারজেন্টকে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দেয়, বুনো ভেষজ ওষুধের সাহায্যে সুস্থ করে তোলে। সেই গভীর গহন অরণ্যে যুদ্ধের ভয়াবহতা পৌঁছতে পারেনি। দরকারও হয়নি। সেই সারজেন্ট দু—বছর লুকিয়ে ছিল জঙ্গলে আপাতানিদের সঙ্গে। এরই মধ্যে এক আপাতানি মেয়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয় এবং মেয়েটি তার ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। ব্যাপারটাকে মেয়েটির আত্মীয়রা এবং সমাজের লোকেরা ভালো চোখে দেখেনি। সাহেবকে তারা মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। সেটা জানতে পেরে সেই সার্জেন্ট পালায়, মেয়েটিও তার সঙ্গ নেয়। তখন সে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গভীর জঙ্গলের মধ্যে বুনো কুকুর, সাপখোপ, জোঁক, হাতি, ভালুক আর বাঘের হাত এড়িয়ে ওরা নামদাফা ফরেস্ট, যা এখন জাতীয় অরণ্য হিসেবে টাইগার প্রোজেক্টে স্থান পেয়েছে, অতিক্রম করে এসে পড়ে লেখাপনিতে। সেখান থেকে তিনসুকিয়ায় যখন পৌঁছোল তার কয়েক সপ্তাহ আগে হিরোশিমায় আণবিক বোমা ফেলা হয়ে গেছে।

‘তিনসুকিয়া থেকে ডিব্রুগড়, এখানেই সেই সাহেব মেয়েটিকে ফেলে রেখে, ঝাঁকের কৈ ঝাঁকে মিশে যাওয়ার মতোই ওখানকার ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। তারপর সে যে কোথায় গেল তার হদিশ আর পাওয়া যায়নি। সেই মেয়েটি, যার নাম আমি জানতে পারিনি, তারপর লেডোয় কয়লার খনিতে মজুরের কাজ পায় আর যথাসময়ে একটি মেয়ের জন্ম দেয়। নবজাতকের নাম রাখে মায়াকাং। মেয়েটির মার সঙ্গে সেখানে আলাপ হয় এক খাসি যুবকের। দুজনে স্বামী—স্ত্রীর মতো বাস করতে থাকে। তারপর তারা চলে আসে ডুয়ার্সের এক চা—বাগানে। মায়াকাং যখন সতেরো বছরের তখন ওর মা মারা যায় রোগে ভুগে, সম্ভবত, টাইফয়েডে। মায়াকাং সুন্দরী ছিল। তার মাতৃকুল আপাতানি। এই উপজাতিদের সৌন্দর্যের জন্য খ্যাতি আছে। ওর পিতৃকুল ইংরাজ মায়াকাং—এর চোখের রং ছিল কটা, পিঙ্গল।

‘এরপর মায়াকাং আয়ার কাজ নেয়ে নোবান চা—বাগানের ম্যানেজারের কোয়ার্টারে। সাহেব ম্যানেজার ডেনিস ম্যাকব্রাইট তার বউ আর দুটি বাচ্চচা। চা—বাগানটা বিক্রির কথাবার্তা চলছে, ভালোরিয়ারা সেটা কিনতে চায়। ব্রিটিশ চা কোম্পানিগুলো তাদের বাগান ভারতীয়দের কাছে বিক্রি করে চলে গেলেও, দু—চারটে বাগান অনেক দিন পর্যন্ত তারা রেখে দিয়েছিল, এই নোবান তাদের মধ্যে একটি। ডেনিস ম্যাকব্রাইটের বাংলোয় মায়াকাং আট—ন বছর কাটায়। এর মধ্যে তার বিয়ে হয় কিন্তু কয়েক মাস পরই বিধবা হয়ে তার পুরোনো কাজে ফিরে আসে। অবশ্য ডেনিসের ছেলেদুটি ততদিনে বড়ো হয়ে উত্তর ইংল্যান্ডে লীডসে তাদের ঠাকুমার কাছে চলে গেছে স্কুলে পড়ার জন্য।

‘বাংলাদেশ যুদ্ধ যখন শুরু হল তখন চা—বাগান অঞ্চল দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঢোকার জন্য বিদেশি সাংবাদিকদের আনাগোনা শুরু হল। ম্যাকব্রাইটের কলকাতার এক বন্ধুর চিঠি নিয়ে হাজির হল এক অস্ট্রিয়ান ফোটোগ্রাফার। ডেনিস তাকে খাতির করে বাংলোয় রাখল। লোকটির নাম হান্স গুন্টার ভিঙ্কলার, বছর বত্রিশ বয়স। ১৯৬৪ টোকিও অলিম্পিকসে জার্মান রোয়িং টিমে ছিল, একটা ব্রোঞ্জ মেডেলেও পায়। ডেনিসের বাংলোকে ঘাঁটি করে সে ছবি তুলতে যেত। দু—চার দিন পর ফিরে এসে ফিল্ম ডেভেলপ, প্রিন্ট করে ডেনিসের সাহায্যে কলকাতায় পাঠাত। দিন পনেরো থেকে ভিঙ্কলার চলে যায় আর তার দু—মাস পর ডেনিসকে তার বউ জানায় মায়াকাং গর্ভবতী।’

সারদাচরণ কথা বলা থামলেন। শ্রোতাদের মুখে কিছু প্রতিক্রিয়া দেখবেন আশা করে ভ্রূ তুলে রইলেন।

‘কাজটা ভিঙ্কলারের?’ হীরাভাই বলল।

‘তা না হলে আবার কার?’ অর্জুন মৃদু ধমক দিল।

‘কেন ডেনিসই কি কাজটা করতে পারে না?’ হীরাভাই তর্ক শুরুর পথ দেখতে পেরে পা বাড়াল।

‘কাজটা ভিঙ্কলারেরই।’ সারদাচরণ দুজনকেই থামিয়ে দিলেন। ‘মায়াকাংয়ের স্বীকারোক্তি থেকে এটা জানা যায়। এদিকে চা—বাগান বিক্রির কথা তখন পাকা হয়ে গেছে। ম্যাকব্রাইটরা ইংল্যান্ডে ফিরে যাবে। মায়াকাংকে নিয়ে তারা পড়লেন মুশকিলে। অবশেষে তাদের খুব পরিচিত এক রিটায়ার্ড ইংরেজ কর্নেল, বিপত্নীক, বৃদ্ধ গ্রেহাম পার্কসের কাছে তার থাকার ব্যবস্থা করলেন কার্শিয়াংয়ে। আর্মি থেকে রিটায়ার করে পার্কস সেখানে একটা বাংলো বানিয়ে রয়েছেন প্রায় বাইশ বছর। দেশে আর ফিরবেনই না ঠিক করেছেন। ওর স্ত্রী মারা গেছেন ১০৭০—এ। দেখাশোনা করার লোক দরকার ছিল।

‘কার্শিয়াংয়ে মায়াকাংয়ের একটি মেয়ে হল। আর মেয়েটিকে প্রসব করতে গিয়ে সে মারা গেল। বৃদ্ধ কর্নেল পড়লেন মুশকিলে। কে সেই বাচ্চচার লালনপালন করবে? ওখানকার এক নেপালি পরিবারে বাচ্চচাটিকে রাখলেন, সেজন্য টাকাও দিতেন। কিন্তু বছর দুই পর তারা বাচ্চচাটাকে ফিরিয়ে দেয়, কেননা তাদের সংসারে নানান বিপর্যয়ে, ঝগড়াঝাঁটিতে ভাঙন ধরায় হাঁড়ি আলাদা হয়ে গেছে। কেউই বাচ্চচাটাকে রাখতে রাজি নয়। পার্কস তখন চিঠি লিখতে শুরু করলেন নানান অনাথ আশ্রমে। অধিকাংশ চিঠিরই উত্তর এল না। শুধু দুটি অর্ফ্যানেজ অক্ষমতা জানিয়ে বলে তিন বছরের বাচ্চচাকে নিতে তারা অক্ষম।

‘সেই সময় আমি আর আমার বোন সুরুচি দার্জিলিং বেড়াতে যাই। সুরুচি বিয়ে করেনি, লা মার্টিনিয়ারের টিচার। দার্জিলিংয়ে আমরা এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলাম। তিনিও রিটায়ার্ড ব্রিগেডিয়ার। আমরা একদিন জিপে কার্শিয়াং বেড়াতে যাই। আমার আত্মীয় বললেন, চলো একবার কর্নেলের সঙ্গে দেখা করে যাই। কার্টসি কল! আমরা আর বাংলোয় ঢুকলাম না, জিপ থেকে নেমে পায়ের আড়ষ্ঠতা কাটাতে হাটাচলা করতে লাগলাম। সেই সময় সুরুচি হঠাৎ বলে উঠল, ‘দাদা কী বিউটিফুল দেখো!’ কর্নেলের বাংলোর বাগানে একটা বছর পাঁচেক বাচ্চচা মেয়ে, পরনে লাল গেঞ্জি আর জাঙ্গিয়া, দুটোই ময়লা, হাতে মুখে মাটি, অপরিচ্ছন্ন চুল, একটা গাঁদা গাছের আড়াল থেকে আমাদের লক্ষ করছে, দু—চোখে কৌতূহল। সুরুচি হাতছানি দিয়ে ডাকতেই একটু ইতস্তত করে পায়ে পায়ে এগিয়ে এল। ওর নাম জিজ্ঞাসা করায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বুঝলাম ভাষা বুঝতে পারছে না।

‘বাংলোর ভিতর থেকে তখন কর্নেল আর ব্রিগেডিয়ার বেরিয়ে আসছেন। সেই বাচ্চচাটিকে দেখিয়ে ব্রিগেডিয়ার বললেন, ‘এর কোনো ব্যবস্থা করতে পারলেন।’ কর্নেল বিষণ্ণমুখে মাথা নেড়ে বললেন, ‘না’। আমার এখন থেকে একে নিয়েই চিন্তা। কত জায়গায় লিখলাম, কত লোককে বললাম যদি অ্যাডপ্ট করে!’ ফিরে আসার সময় ব্রিগেডিয়ার, বাচ্চচাটি সম্পর্কে যতটুকু জানতেন আমাদের বললেন। শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম ওর বয়স কত? উনি বললেন তিন। চমকে উঠলাম, তিন! আমি তো ভেবেছিলাম পাঁচ। তখন আমি মানুষের শরীরের উপর হেরেডিটির অর্থাৎ বংশ পরম্পরাক্রমে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যের উপর একটা রিসার্চ প্রোজেক্টে নিযুক্ত ছিলাম। বাচ্চচাটির বয়সও শরীরের অনুপাতের মধ্যে, গড়পড়তা ভারতীয় বাচ্চচার যেরকম গঠন হয়, সেইরকম, গঠন ছিল না। বললাম ওকে আর একবার দেখব, ওর বাবা—মা সম্পর্কেও যতটা পারা যায় জানব।

‘রাতে আমার বোন সুরুচি হঠাৎ বলল, তার মায়া হচ্ছে বাচ্চচাটার জন্য, বাচ্চচাটাকে তার খুব ভালো লেগেছে, সে অ্যাডপ্ট করবে। পার্ক সার্কাসে সে একা ফ্ল্যাটভাড়া নিয়ে থাকে। ভালো বেতন পায়। ওর পক্ষে কোনো অসুবিধেই হবে না। নানাদিক থেকে ব্যাপারটা নিয়ে আমরা দুজনে অনেকক্ষণ আলোচনা করি। আমাদের প্রস্তাব শুনে ব্রিগেডিয়ার তো খুব খুশি। পরদিন সকালেই আমরা আবার কার্শিয়াং গেলাম। কর্নেল বুড়ো তো হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সিন্ধুবাদের নাবিকের মতো বাচ্চচাটা তার ঘাড়ে চেপে বসেছিল। আমি বাচ্চচাটার বাবা—মায়ের কথা জানতে চাইলাম। কর্নেল পার্কস তখন ডেনিস ম্যাকব্রাইটের কাছ থেকে যা যা শুনেছিলেন তাই জানালেন আর সেটাই একটু আগে আমি আপনাদের বলেছি।

‘মায়াকাং চা—বাগান থেকে কার্শিয়াং—এ আসে একটা সুটকেশ নিয়ে। সে মারা যাবার পর কর্নেল সেটা খুলে তার মধ্য থেকে পান দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এক ব্রিটিশ স্যাপার ইউনিটের নম্বর লেখা মেটাল রিস্টব্যান্ড, ছুটি মঞ্জুরের একটি চিঠি তাতে প্রাপকের নাম রয়েছে: সার্জেন্ট জে বি স্টিভেনসন। কয়েক ছড়া পাথরের মালা যা আপাতানি মেয়েরা ব্যবহার করে। এগুলো তার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। আর মায়াকং—এর নিজস্ব বলতে ছিল কয়েকটি সাদাকোলো ফোটো। বলাবাহুল্য সেগুলো ভিঙ্কলারের তোলা। একটি ছিল গ্রুপ ফোটো, তাতে ম্যাকব্রাইট দম্পতি ও মায়াকাং দাঁড়িয়ে বাংলোর সামনে। তিন—চারিটি ছিল শুধুই মায়াকাং—এর, নানাভাবে পোজ দিয়ে লাজুক মুখ থেকে বোঝা যায় ফোটোগুলি ঠিক প্রকাশ্যে নয়, কারোর অনুরোধে, নির্দেশে একটু আড়ালেই তোলা। কয়েক বছর খামের মধ্যে অযত্নে পড়ে থাকায় ছবিগুলো হলুদ হয়ে গেছে। তবু বোঝা যায় কি অপরূপ সুন্দরী ছিল। মুখটা গোল, নাক চোখা, জোড়া ভ্রূ, বেশ বোঝা যায় ইংরেজ রক্ত আর শারীরিক প্রভাব এর উপজাতীয় হেরেডিটিকে বদলে দিয়েছে। গ্রুপ ফোটোয় মায়াকাং—এর পাশে দাঁড়ানো মিসেস ম্যাকব্রাইটকে খাটো দেখালো। কর্নেল আমাকে বলেন, মায়াকাং অন্তত পাঁচ ফুট ছয় বা সাত ইঞ্চি লম্বা ছিল। কিন্তু সবথেকে আকর্ষণীয় এবং মূল্যবান, অন্তত আমার কাছে, হান্স গুন্টার ভিঙ্কলারের ছবিটা। ম্যাকব্রাইটের পাশে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে। কার তোলা বলতে পারব না, হয়তো মিসেস ম্যাকব্রাইটের।

‘অন্তত সাড়ে ছ—ফুট লম্বা, উঁচু প্রশস্ত কপাল। পাতলা ভ্রূ, মেয়েদের নজরে পড়ার মতো মুখশ্রী, আর পাথরে কোঁদা শরীর। টোকিও অলিম্পিকসের পর প্রতিযোগিতামূলক রোয়িং—এ আর অংশ নেয়নি কিন্তু অভ্যাসটা যে ছাড়েনি সাত বছর পর ওর শরীর দেখে সেটা বোঝা যায়। মায়াকাংকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। ভিঙ্কলারের দেহের কাঠিন্যের মধ্যে একধরনের আকর্ষণ ছবির মধ্য দিয়েও অনুভব করা যায়।’

‘তাহলে আমাদের এই মেয়েটির নাম স্বর্ণকুমারী ভিঙ্কলার আর মায়ের নাম মায়াকাং স্টিভেনসন!’ হীরাভাই উৎসাহ নিয়ে সোফার কিনারে টেনে আনল তার নিতম্ব। ‘ইংরেজ ও অস্ট্রিয়ান রক্তের সঙ্গে এখনকার অরুণাচলের উপজাতীয় রক্ত মিশে তৈরি হয়েছে এই মেয়ে।’

‘সোলজার আর অলিম্পিক বোয়ার, এমন দুটি লোকের শরীরের খাটবার আর সহ্য করার ক্ষমতার ভাগও পেয়েছে!’ অর্জুন বলল।

সারদাচরণ এইসব কথা যেন শুনতেই পাননি, এমন ভাব মুখে ফুটিয়ে বলে চললেন, ‘বাচ্চচাটির আর তার মায়ের জন্মবৃত্তান্ত, যে সব ঘটনার যোগাযোগের মধ্য দিয়ে এই বাচ্চচা মেয়ের জেনেটিক প্রোফাইল গড়ে উঠেছে তা জানার যদি না আমি ওর সম্পর্কে আগ্রহী হইল তাহলে আমি একজন বাজে ফিজিয়োলজিস্ট হিসাবে গণ্য হব। ওকে দেখেই জেনে যাই চমকপ্রদ দেহ উত্তরাধিকারসূত্রে মেয়েটি পেয়েছে। বাচ্চচাদের দৈহিক পরিণতি লাভের ইঙ্গিত পাওয়া যায় তার অস্থিকাঠামোর বয়স ধরে, তাতে আমার মনে হয়েছিল তারিখধরা বয়সের থেকে এই শিশু অন্তত চার—পাঁচ মাস এগিয়ে। এটা চার বছরের কমবয়সিদের পক্ষে খুব তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য। ওর পেশির গড়নও ছিল চমৎকার। চার দিন পর বাচ্চচাটিকে নিয়ে আমরা কলকাতায় ফিরে আসি।’

সারদাপ্রসাদ তীক্ষ্ন চোখে শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে তার এই বৃত্তান্তের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে লাগলেন। রাহুলের মনে হল, বাচ্চচাটিকে সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যটা যেন ওনার রিসার্চেরই একটা অঙ্গ। হয়তো সে লোকটি সম্পর্কে ভুল ধারণা করেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত উনি পালিত কন্যা সম্পর্কে যে ভাবে বললেন তাতে পিতৃসুলভ ভাবের থেকে বিজ্ঞানীর মনই যেন বেশি প্রকাশ পেয়েছে।

 ‘আপনারা নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, আমি কিন্তু এখনও শিশুটির নাম উল্লেখ করিনি।’ সারদাচরণ চোখ রাখলেন রাহুলের উপর। ‘একটা মেয়ের পক্ষে নামটা অস্বাভাবিকই: আলি। আমি বা আমার বোন নামটা পছন্দ করিনি। কর্নেল জানিয়েছিলেন এটা ওর মায়েরই দেওয়া। কেন যে এমন একটা মুসলমানি নাম রাখল তা বলতে পারব না। নামটা পালটাব ঠিক করলাম কিন্তু তখুনি নয়। আগে সে আমাদের সঙ্গে সড়গড় হোক তারপর বদলাব। এক বছর পর, অ আ ক খ শেখার আগে, নামটাকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে সোনালি বলে ডাকতে লাগলাম। দেখলাম এটা ওর মনে ধরেছে।’

‘আমারও খুব ভালো লাগছে।’ হীরাভাই দু—হাত তুলে জানাল। ‘কানে দারুণ লাগছে—কাগজে, ম্যাগাজিনে, টিভি—তে শুধু স্বর্ণকুমারী সোনালি। হিট, সিওর হিট!’

‘এসব ব্যাপারে তখন আমরা চিন্তা করিনি। আর পাঁচটা স্কুলে যাবার বয়সি মেয়েদের মতোই সে পার্কসার্কাসে নাসিরুদ্দীন রোডের বাড়িতে বড়ো হয়ে ওঠে।”

রাহুল ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘স্কুলেই কি ওর স্পোর্টসের ক্ষমতাটা জাহির হয়ে যায়নি। ফিল্মে তো আপনি বললেন ও জীবনে কখনো মেয়েদের সঙ্গে কমপিট করেনি।’

‘ঠিকই। যদি ভালোভাবে আমার কথা শুনে থাকেন, আমি বলেছি ওর স্কুলে যাবার বয়সের কথা, স্কুলে গেছে এমন কথা বলিনি। আমার বোন ওকে বাড়িতেই পড়াত, এ জন্য প্রাইভেট টিউটরও ছিল।’

‘কেন?’

‘এটা আমরাই ইচ্ছাতে হয়েছে। ওর মানসিক, শারীরিক বিকাশের জন্য সম্ভাব্য সবরকম সুযোগ যাতে পায়, সেজন্যই স্কুলে দিইনি। পুষ্টি সম্পর্কে, ব্যায়াম সম্পর্কে আমার নিজস্ব যে চিন্তা সেটা থেকে পুরোপুরি উপকার পাওয়া সোনালির পক্ষে সম্ভব হত না যদি ও স্কুলে ভরতি হত। বাড়িতে আমরা ওর সুষম খাদ্যের দিকে বা দেহের ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ আর খেলাধুলার দিকে নজর দিতে পারব। শরীরের দিক থেকে ও যা পেয়েছে সেটা তো প্রকৃতিরই দান। যাদের এমন খেলোয়াড়ি শরীর তাদের এমন এক ধরনের শিক্ষা দরকার বা চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করায়, দাবি জানায়। ওর বয়সি বাচ্চচাদের স্কুলে যে শরীর শিক্ষা দেওয়া হয় সেটা একদমই বাজে। ফলে একঘেঁয়ে বিরক্তি বোধ করত আর বাড়তি ওজন শরীরে জমত।’

সারদাচরণের যুক্তি শুনতে শুনতে রাহুলের মাথা গরম হয়ে উঠছিল। নিজেকে যথাসাধ্য সংযত রেখে সে বলল, ‘ওর সামাজিক উন্নতি ঘটাবার কথাটা কি ভেবেছিলেন?’

‘নিশ্চয়। ছ—বছর বয়সে ওকে নাচের স্কুলে ভরতি করানো হয়, রবীন্দ্র সরোবরে সাঁতারের ক্লাবে গিয়ে সাঁতারও কাটত। দু—জায়গাতেই ওর বন্ধু সংখ্যা কম ছিল না। ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত সোনালি এইভাবেই বড়ো হয়ে ওঠে। ছোটো থেকেই ওকে পার্কসার্কাস ময়দানে দৌড় করাতাম। ওর অগ্রগতির হিসাব রাখতাম। ষোলো বছরে ওকে রেস কোর্সে নিয়ে গিয়ে ট্রায়াল নিলাম আর তাই থেকে একটা জিনিস বুঝলাম, ঠিকমতো ট্রেনিং ব্যবস্থা করলে আর প্রথম শ্রেণির কোচের উপদেশ পেলে সোনালি অলিম্পিকসে যাবার মতো পর্যায় দু—তিন বছরের মধ্যেই পৌঁছবে। এমনকী সোনার মেডেলও জিততে পারে। যদি বলি এই প্রথমবার আমার মনে ওর অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হবার সম্ভাবনার কথাটা জাগল, তাহলে মিথ্যে বলা হবে। এই চিন্তাটা বহু বছর আগেই মাথার মধ্যে ডিম পেড়েছিল। কিন্তু সেটা ফুটিয়ে বাচ্চচা বার হতে দিইনি অর্থাৎ আমার আকাঙ্ক্ষার বোঝা বাচ্চচার কচি কাঁধের উপর চাপিয়ে দিতে চাইনি। তবে কোনো শিশু কৈশোরে পৌঁছে যদি বিরাট ট্যালেন্ট প্রকাশ করে বা বড়ো কিছু করার সম্ভাবনা দেখায় তাহলে আমার মনে হয়, অভিভাবকদের এটা নৈতিক কর্তব্য সেই ট্যালেন্টকে লালন করার, বাড়িয়ে তোলার জন্য তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করা। পৃথিবীতে খেলার ইতিহাসে এইরকম বাবা—মায়ের কথা প্রচুর পাওয়া যাবে। যথাযোগ্য উৎসাহ পেলে ট্যালেন্টেড ছেলেমেয়েরা পৃথিবীর সেরাদের হারাতে পারে।’

‘আর কমপক্ষে লাখ পঁচিশ টাকা তো ব্যাঙ্কে আসতে পারেই।’ হীরাভাই আন্দাজে একটা হিসাব দিয়ে ফেলল।

‘রানার হিসাবে সোনালির সম্ভাবনাকে পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা আমার করা উচিত আর সে জন্য যা যা প্রয়োজন বিশেষ করে কোচ, জিমন্যাসিয়াম, দূরপাল্লা দৌড়ের জন্য উপযুক্ত রাস্তা, এগুলো যাতে সে পায় তার ব্যবস্থাও করা দরকার। এসবের জন্য টাকা লাগে কিন্তু আমার অত টাকা নেই।’

‘আর সেই টাকার ব্যবস্থা করতে ওনার সঙ্গে আমাদের যোগ দেওয়া।’ অর্জুন জানিয়ে দিল রাহুলকে।

‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা সেইরকমই।’ সারদাচরণ হাসলেন। রাহুলকে লক্ষ্য করেই বললেন, ‘স্পনসর করার মতো লোকেদের কাছে টাকার জন্য যাব ভেবে প্রথমে অর্জুনবাবুর কাছেই ব্যাপারটা বলি। উনি তো শোনামাত্রই উৎসাহিত হলেন। আমার এই প্রোজেক্টকে একটা বাণিজ্যিক প্রস্তাবের রূপ দিয়ে কয়েকজন চেনালোকের কাছে কথা পাড়ি। কিছু টাকা যদি ফিরে পাবার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে লোককে টাকা ইনভেস্ট করার জন্য তো বলা যায় না। হীরাভাইবাবু তাদের মধ্যে একজন যিনি টাকা দিয়েছেন সোনালিকে সামনের ওলিম্পিকসে স্বর্ণকুমারী হয়ে ওঠার কাজে মদত দিতে। এ পর্যন্ত চার লাখ টাকা খরচ হয়েছে। মোট খরচ ধরা হয়েছে, পাঁচ লাখের কিছু বেশি।’

রাহুল মুখ তুলে সিলিংয়ের দিকে তাকাল।

‘আমরা পঁচিশ লাখ কমপক্ষে আশা করছি, তাহলে সুদসমেত ইনভেস্টমেন্টের টাকাটা ফিরিয়ে দেওয়া যাবে। আর সেই জন্যই আপনাকে আমাদের দরকার।’

চারজোড়া চোখের দৃষ্টি রাহুলের মুখে বিঁধে গেল। শুকনো হেসে সে বলল, ‘পঁচিশ লাখ!’

‘আপনি কার্ল লিউইস বা রেটন বা ফ্লোরেন্স জয়নার কত টাকা কামিয়েছে তা নিশ্চয় জানেন? মার্ক স্পিৎজের কথা ভাবুন!’ হীরাভাই নামগুলো উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিল সে এই ব্যাপারে খেলো নয়, খবর রাখে।

‘ওরা প্রত্যেকে আমেরিকান। সে দেশে টাকা ফেলে জিনিস কেনার লোকের সংখ্যা বিরাট আর তাদের কাছে ওরা কিছুদিনের জন্য দেবদেবী পর্যায়ে উঠে গেছিল, মিডিয়াই উঠিয়ে দিয়েছিল। আর ওদের সাফল্যের বহরটাও মনে রাখবেন। কেউ তিনটে, কেউ চারটে, কেউ সাতটা সোনা, তার সঙ্গে অবিশ্বাস্য বিশ্বরেকর্ড!’

‘আমাদের দেশেও লোকে এখন টাকা বার করছে মাল কেনার জন্য। অলিম্পিকসে সোনা তো বটেই কেউ একটা কাঁসার মেডেল পেলে এখন ভারতের লোক মন্দির বানিয়ে তার পুজো করবে। পঁচিশ লাখ আসবে না, কি বলছেন আপনি!’ হীরাভাইয়ের অবাক হওয়াটাকে রাহুলের মনে হল যেন তার পেশাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলা হল। কিন্তু তাতে সে উসকে উঠল না।

‘দেখুন, স্বর্ণকুমারীকে দারুণ দেখতে, চমৎকার দৌড়য়ও। কিন্তু পঁচিশ লাখ টাকা টেনে বার করতে পারার মতো জোর ওর নেই।’

‘যদি ম্যারাথন আর দশ হাজার মিটার, দুটো সোনা জেতে?’ সারদাচরণ নিরাবেগ মুখ নিয়ে প্রশ্নটা করলেন।

রাহুল হেসে উঠল। মাথা নেড়ে বলল, ‘অসম্ভব। এবার কিন্তু আমরা আজগুবি কথায় চলে গেছি। এরপর কী বলবেন ১০০ মিটারেও সোনা জিতবে?”

‘না, তা বলব না, তবে মি. অরোরা মেয়েদের ম্যারাথন মাত্র দুটো অলিম্পিকসে হয়েছে আর দশ হাজার হয়েছে মাত্র একবার। বলতে গেলে দুটোই নতুন। এখনও পর্যন্ত দূরপাল্লা দৌড়ে কোনো মেয়ে একই অলিম্পিকসে এই দুটোর সোনা জেতেনি।’

‘এবারে যে কেউ জিতবে না তার কোন নিশ্চয়তা আছে কি? ওলিম্পিকসে একটা ইভেন্টের জন্য পূর্ব জার্মানিতে একডজন মেয়ে ট্রেনিং পাচ্ছে দশ বছর বয়স থেকে। রাশিয়ানরা, চীনারাও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। অসম্ভব, যে দেশের অলিম্পিকস দৌড়ে মেডেল জেতার ঐতিহ্য বলে কোনো ব্যাপার নেই সে দেশে একটা মেয়ে আনবে দু—দুটো সোনা! রূপকথায় এসব হয়।’

ঠান্ডা চোখে রাহুলের দিকে তাকিয়ে সারদাচরণ কথাগুলো শুনে বললেন, ‘ঠিক আছে। এটাই যখন আপনার ধারণা তা হলে কিছুক্ষণ না হয় রূপকথার জগতেই আমরা বাস করি। মি. অরোরা আপনার সুবিজ্ঞ মতামত দিয়ে যদি একটু উপকার করেন তা হলে ধন্য মনে করব। ধরুন আজগুবিটাই সত্যি হয়ে গেল। স্বর্ণকুমারী অলিম্পিকসে গেল আর দুটো সোনাও জিতল। এক অজ্ঞাত অনামা ভারতীয় মেয়ে, আপনার কথায় যাকে দারুণ দেখতে, দুবার সে বার্সিলোনা স্টেডিয়ামে সোনা পেল, আর সেটা দেখল ইতিহাসের বৃহত্তম টিভি দর্শকরা। আপনি যদি আগাম জেনে থাকেন এইরকম একটা ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে আর আপনি যদি সেই মেয়েটির এজেন্ট হন আর বিজয় মঞ্চ থেকে তার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচার যন্ত্রকে চালু করার বোতামটি যদি টেপার অপেক্ষায় আপনার আঙুলের সামনে থাকে, তা হলে বাণিজ্যের দিন থেকে কত টাকা আপনি তুলতে পারবেন বলে আশা করেন?’

রাহুল কাঁধ ঝাঁকাল। ‘তা, মোটামুটি ভালোই হবে। তবে ডা. সরকার আমি দিবাস্বপ্ন নিয়ে বাণিজ্য করি না।’

‘পঁচিশ লাখ? পঞ্চাশ?’

‘হতে পারে। দেখুন, ম্যারাথন আর দশ হাজার মিটার দৌড়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান মাত্র সাত দিন। বিশ্ব পর্যায়ের মেয়েদের সঙ্গে ৪২ কিলোমিটার আর ১০ কিলোমিটার, দুটো এতবড়ো দৌড় টানার ধকল কোনো মেয়ের পক্ষে সওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া ড্রাগ টেস্টও আছে।’

‘ড্রাগের কথা তো আমরা বলিনি!’ সারদাচরণ আহত স্বরে বললেন, ‘আমরা যে প্রস্তাব দিচ্ছি তাতে কারচুপির কোনো ব্যাপারই নেই। আপনার কাছে এ সবই নতুন ব্যাপার কিন্তু আমরা এটা নিয়ে দু—বছর কী তার বেশিই হবে, দিন কাটাচ্ছি। এই প্রোজেক্টের কাজকর্ম, এর সাফল্যের সম্ভাবনা বুঝে উঠতে আপনার কিছুটা সময় লাগবে। তাই আমি বলছি আজকের মতো আলোচনাটা মুলতুবি রেখে রবিবার আবার বসা যাক।’

‘সেই ভালো। আলোচনায় আমি বসব কেননা অর্জুনের ডাক পেয়েই এসেছি। এত দিনের বন্ধুর মনে দুঃখ দেওয়া ঠিক হবে না ভেবেই বসব। তবে যত টাকা পাবেন বলে আশা করছেন সেই বিষয়ে আগাম একটা কথা বলে নিই। যে ভাবেই হোক ব্যাপারটা আপনারা হয়তো করে ফেললেন আর মেয়েটিও দুটো সোনা জিতে গেল, তাতেই যে পঁচিশ বা পঞ্চাশ লাখ আপনারা পাবেনই তার কোনো গ্যারান্টি নেই। মনে রাখবেন, আমরা কারবার করছি একজন মানুষ নিয়ে, বাজারে বেচার সাবান বা টুথপেস্ট নিয়ে নয়। কত আদায় হবে সেটা নির্ভর করছে, মেয়েটির নিজের উপর। তার পার্সোনালিটি, তার চেহারা, স্বভাব—চরিত্র, তার কথাবার্তার ধরন—ধারণ এই সবই তখন বিচার্য বিষয় হবে। আপনারা জানেন কি সোল অলিম্পিকসের পর ফ্লোরেন্স গ্রিফিথ জয়নার কত টাকার কনট্র্যাক্ট পেয়েছিল?’

রাহুল প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকাল। তার মনে হল এরা সবাই সেটা জানে কিন্তু তার মুখ থেকে শোনার জন্য চুপ করে আছে। বেশ, তা হলে আবার জানুক। ‘অলিম্পিকসে মিডিয়া ওর ডাক নাম দিয়েছিল ‘ফ্লো জো’ কিন্তু দু মাসের মধ্যে সেটা বদলিয়ে নাম রাখল ‘ক্যাশ ফ্লো’। বড়ো বড়ো কর্পোরেট বিজ্ঞাপনদাতারা সোল গেমসের পর অলিম্পিয়ানদের সম্পর্কে খুব বেশি উৎসাহ দেখায়নি। তার কারণ টিভি দর্শকদের রেটিং যা আশা করা হয়েছিল তার থেকেও অনেক কম হয়, দর্শকদের নিস্পৃহতাই এই রেটিং থেকে প্রকাশ পায়, তা ছাড়া ড্রাগের ঘটনায়ও গেমসে কলঙ্ক লেগেছিল। এই দুটি কারণে তারা আগ্রহ বোধ করেনি। কিন্তু ফ্লোরেন্স তিনটে সোনা, একটা রূপোর সঙ্গে এনডোর্সমেন্ট আয়ের মেডেলটা জিতে নেয়। সোল গেমসের আগে বক্তা হিসাবে ওর হাজির থাকার কী ছিল দশ হাজার ডলার, গেমসের পর হয় ২৫ হজার ডলার।’

‘এখন এক ডলারে কত টাকা?’ হীরাভাই ফিসফিস স্বরে বলল।

‘প্রায় ষোলো টাকা।’ রাধিকা বলল।

‘তা হলে দু—চারটে কথা বলার জন্য প্রায় চার লাখ টাকা!’ হীরাভাই নির্ভেজাল বিস্ময় নিয়ে রাহুলের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘ফ্লোরেন্সের এজেন্ট এক—একটা প্রোডাক্ট এক বছরের জন্য এনডোর্সমেন্ট বাবদ তিন লক্ষ ডলার চেয়েছিল, দরাদরি করে সেটা আড়াই লক্ষ ডলারে দাঁড়ায়। পুতুল তৈরি করে এম সি এ, তারা বারবি ডল বানিয়ে বিরাট সফল হয়েছিল, সেই আদলে ‘ফ্লো জো’ ডল বানাবার চুক্তি করে ফ্লোরেন্সের সঙ্গে। সে জন্য লাইসেন্সিং কনট্র্যাক্টে সে প্রথমে পায় আড়াই লাখ ডলার আর পাচ্ছে বিক্রির একটা পার্সেন্টেজ। এ ছাড়া সফট ড্রিঙ্কস, অ্যাপারেল, ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও চুক্তি হয়। কিন্তু কথাটা হল, কেউ এত পেল না অথচ ও পেল কেন? ১৯৮৪—তে মেরি লু রেটন জিমন্যাস্টিকস সোনা জিতে এনডোর্সমেন্ট থেকে প্রায় আধ কোটি ডলার আয় করেছিল। এত টাকাই ১৯৭২—এ পেয়েছিল মার্ক স্পিৎজ। ফ্লোরেন্সের আয় বছরে দশ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছিল। সেটা কি শুধু রেকর্ড করা পারফরমেনসের জন্যই? সে তো অনেকেই করেছিল।

‘আসল ব্যাপারটা হল ইমেজ। সোলে যাওয়ার আগে থেকেই সে নিজের একটা স্বতন্ত্র ইমেজ তৈরি করে যাচ্ছিল সযত্নে। সোলে সেটাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে অবিশ্বাস্য ১০০ মিটার রেকর্ড করে। নিউ ইয়র্ক ওয়াল্টার টমসনের ডিরেক্টর অফ ট্যালেন্ট তখন বলেছিল: ‘শী ইজ গ্রেট লুকিং, ওয়ারস কালারফুল কস্টিউমস অ্যান্ড ইজ আ পার্সোনালিটি।’ এক পা কাটা রানিং স্যুট, লম্বা লম্বা রঙিন নখ তার ইমেজকে ওরিজিনালিটি আর ফ্রেশনেস দিয়েছিল। নিউ ইয়র্কের আর একটা বিজ্ঞাপন এজেন্সি, ওগিলভি গ্রুপের কাস্টিং বিভাগের হেড বলেছিল, ফ্রোরেন্স এক ধরনের চরিত্র আর ওর আপিলটা সেখানেই। বিজ্ঞাপন কোম্পানির কর্তারা ওকে কর্পোরেট প্রতিনিধি হিসাবে সব থেকে আকর্ষণীয়া মনে করেছিল বলেই এখন সে প্রায় এক কোটি ডলারের মালিক।’

‘ষোলো কোটি টাকা।’ হীরাভাই বলল।

‘আমরা তো ২৫ লাখের বেশি ভাবতে সাহসই পাইনি! পাব কী করে, ভারতে অত বড়ো বড়ো কোম্পানিই যাদের প্রোডাক্ট পৃথিবী ছড়িয়ে বিক্রি হয়! বিজ্ঞাপনে খরচ করবে কাদের জন্য? খদ্দেররা তো গরিব।’ অর্জুন বলল।

সারদাচরণ চুপ করে এতক্ষণ শুনছিলেন। এবার কথাবার্তার মোড় ঘুরিয়ে দেবার জন্য বললেন, ‘মি. অরোরা, একটা কথা আপনাকে বলতে পারি, লাখ পাঁচেক টাকা যের আমরা এই প্রোজেক্টে ঢেলেছি সেটা একেবারেই কিছু না জেনে, না বুঝে অজ্ঞের মতো নয়। সত্যি কথাটা হল আমরা এখন টেলিভিশন যুগে। অন্যান্য স্পোর্টসের মতো দৌড়ও এখন এত ছক কেটে হচ্ছে যার ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও হাড্ডাহাড্ডি হচ্ছে। বিজয়ী আর বিজিতের মধ্যে পার্থক্যটা অতি সামান্য। অনিশ্চয়তা না থাকলে নাটকীয়ত্ব থাকে না, দর্শকদের জড়িয়ে পড়াটাও ঘটে না।’

‘যে মাঠে টিভি ক্যামেরা চলবে না, সেখানে স্পনসরসও থাকবে না, স্পোর্টসও আর হবে না।’ রাহুল কথাগুলো বলল সারদাচরণের সঙ্গে সুর মিলিয়ে। ‘এ পর্যন্ত আমি আপনার সঙ্গে একমত। কিন্তু নাটকীয়তা কি দূরপাল্লার দৌড়ে সম্ভব?’

‘সম্ভব, যদি অজানার, অপ্রত্যাশিতের পরশ তাতে থাকে। কিনিয়ার অ্যাথলিটরা কেমন চমক জাগিয়েছিল নিশ্চয় আপনার তা মনে আছে। ইথিওপিয়ার আবেবা বিকিলা? খালি পায়ে দৌড়ে রোমে ম্যারাথন জিতে আবার টোকিওতেও জিতেছিল। লোকে টগবগ করে উঠেছিল। মুখে মুখে তখন কিনো, টেমু, বিকিলার নাম। আফ্রিকার এই উত্থান কিন্তু আসলে এদের আরও দশ বছর আগে শুরু হয়েছিল। ১৯৫৪—য় ভ্যাঙ্কুভার কমনওয়েলথ গেমসে কিনিয়া দু’জন কিসি উপজাতির অ্যাথলিট পাঠায় দূরপাল্লা দৌড়ে অংশ নিতে। তখন পর্যন্ত বিশ্বাস করা হত দূরপাল্লা দৌড়ে শারীরগতভাবে সাদাদের সঙ্গে কালোরা প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্য নয়। ভ্যাঙ্কুভার যাবার পথে লন্ডনে ওরা ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপসে অংশ নেয়। তখন ব্রিটিশরা দূরপাল্লা দৌড়ে পৃথিবীর সেরা দেশগুলোর অন্যতম। সেই দুই কিনিয়ানদের একজন চেপকোনি ছয় মাইল দৌড়ে শুরু থেকেই প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে যায়। মাইল তিনেক পর অন্যরা তাকে পেরিয়ে যায় যেহেতু সে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। দাঁড়াবার কারণটা জানলে নিশ্চয় তাকে মাপ করে দেবেন। তার হাঁটুর হাড় সরে গেছল। অন্যজনের নাম মাইওরো। সে নামে তিন মাইল দৌড়ে। শুরু থেকে সেও দারুণ গতিতে দৌড়ায়, এমনই গতি যে পৃথিবীর সেরা কয়েকজন দূরপাল্লার রানার কিছুক্ষণের মধ্যেই ৫০ মিটার পিছিয়ে পড়ে। সবাই ভাবল কয়েক চক্করের পরই দম ফুরিয়ে ট্র্যাকে মুখ থুবড়ে পড়বে। কিন্তু পড়েনি। তাকে হারাতে সেদিন নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়তে হয়েছিল।

‘ভ্যাঙ্কুভারে মাইওরো চতুর্থ আর চেপকোনি সপ্তম হয়েছিল তাদের ইভেন্টে। ট্যাকটিকস বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞ থাকায় ওরা মার খায়। কিন্তু ব্যাপারটা হল ওরা সেরা পর্যায়ের দূরপাল্লা দৌড় সম্পর্কে কোনোরকম পূর্ব ধারণা ছাড়াই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় হাজির হয়েছিল। স্রেফ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়েছিল জেতার জন্য। কাদের সঙ্গে দৌড়েছিল? বিশ্বের অভিজাতদের সঙ্গে,যারা কি না বহু বছর ধরে এক্সপার্ট কোচিং নিয়ে ফিটনেসের চূড়োয় পৌঁছেছে, নিবিড় ট্রেনিং আর নিয়মিত কম্পিটিশনের সাহায্যে। যখন সবাই ট্রেনিংয়ের গোপন রহস্যটা জানার জন্য ওদের চেপে ধরল তখন অবাক করে দিয়ে তারা বলল, হপ্তায় মাত্র তিন দিন তারা দৌড়োয়, তাও মাত্র তিন থেকে পাঁচ মাইল। এর সঙ্গে তুলনা করুন, ইউরোপীয়ান আর আমেরিকান রানারদের বাধ্যতামূলক হপ্তায় একশো মাইল দৌড়ের!’

‘অলটিচিউডের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে।’ রাহুল বলল। কোথায় যেন একটা লেখায় সে পড়েছিল। ‘হয়তো কিনিয়া পর্বতের অঞ্চলে ওর বাস করে।’

‘এটা ঠিকই কথা, হালকা পাতলা বাতাসের মধ্যে ট্রেনিং করলে দম বাড়ে কেননা ফুসফুস আর হৃৎপিণ্ডকে বেশি খাটতে হয় পেশিতে অক্সিজেন পৌঁছে দেবার জন্য। কিন্তু সমুদ্রের লেভেলে হপ্তায় ১০০ মাইল দৌড়লে যে উন্নতি হয় ততটা সম্ভব নয় ছ—হাজার ফুট উপরে হপ্তায় পনেরো মাইল দৌড়লে। না, মি. অরোরা, অলটিচিউড—এর কারণ নয়। কিনিয়ান দু—জন অত ভালো দৌড়েছিল, যেহেতু ট্র্যাকের টেকনিক্যাল ব্যাপার—স্যাপার সম্পর্কে কিছুই না জানার জন্য বা যাদের বিরুদ্ধে দৌড়চ্ছে তাদের বিরাট খ্যাতির বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞ থাকার। অতি সহজ সরল ভাবে তারা দৌড়টাকে নিয়েছিল হার—জিতের চ্যালেঞ্জ হিসাবে। অ্যাথলিটরা মনে করে সেরা প্রতিযোগীদের বিরুদ্ধে নামলে নিজেদের মানের উন্নতি ঘটবে। কথাটা হয়তো সত্যি। কিন্তু উন্নতি হবে কোন পর্যন্ত? যাদের বিরুদ্ধে দৌড়োচ্ছে তাদের স্তর বা সামান্য আর একটু উপর পর্যন্ত উঠবে। একই পর্যায়ের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে অবিরত প্রতিযোগিতা করার ফলে তাদের একটা ছাঁচ এসে যায়। এক মাইল দৌড়োনো মানে ট্র্যাকটা একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে চক্কর দিতে হবে। তারা বিশ্বাস করে, ট্রেনিং তাদের শারীরিক সম্ভাবনার পূর্ণতায় পৌঁছে দিচ্ছে, আসলে কিন্তু তা দিচ্ছে না। তাই যদি হত তা হলে আমাদের ধারণায় যারা যথেষ্ট ট্রেনিং পাওয়া নয়, সেই দুই কিনিয়ান ওদের সঙ্গে লড়াইয়ে রয়ে গেল কী করে?’

‘আপনি বলতে চান নিয়মিত কম্পিটিশন একজন অ্যাথলিটের উন্নতিকে সীমিত করে দেয়।’

‘ঠিক তাই।’ সারদাচরণ একটু উত্তেজিতভাবেই বলে উঠলেন। ‘স্বর্ণকুমারী যদি কোনো অ্যাথলেটিক ট্রেনিং সেন্টারে যোগ দিত তা হলে সেখানকার অন্যান্য মেয়েদের থেকে খুব খারাপ বা খুব ভালো কিছু হত না। মাঝারিয়ানার ফাঁদে যাতে না পড়ে সে জন্য ইচ্ছে করেই আমরা ওকে কম্পিটিশনের থেকে সরিয়ে রেখেছি। এজন্য অভিজ্ঞতা থেকে ও হয়তো বঞ্চিত হয়েছে কিন্তু তার বদলে লাভও করেছে কিছু। কিনিয়ানদের মতোই দৌড়কে সে ভাবমুক্ত মনে নিতে পেরেছে, পাবলিসিটির ডামাডোল শান্তি নষ্ট করছে না আর যথাসময়ে নামী প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোক্ষম ঘা মারার ক্ষমতা ও রাখে। স্বর্ণকুমারী সম্পর্কে আর কিছু বলার থেকে বরং আপনার তাকে স্বচক্ষে দেখাই ভালো। পরশু রবিবার সকালে সে ম্যারাথনে নামবে। জীবনে তার প্রথম প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা। স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার উদ্যোগে পুরুষ আর মেয়েদের নিয়ে এটা হচ্ছে। পাঁচ লক্ষ টাকা টোট্যাল প্রাইজমানি। দু—বিভাগেই বিজয়ী পাবে এক লক্ষ টাকা। অশোকনগর থেকে শুরু হবে সকাল আটটায়, প্রথমে পুরুষরা, তার পনেরো মিনিট পর মেয়েরা স্টার্ট করবে। ন্যাশনাল হাইওয়ে ৩৫ ধরে এসে বারাসাত, সেখান থেকে দমদম, ভি আই পি রোড ধরে উল্টোডাঙার মোড়, ইস্টার্ন বাইপাস পাস দিয়ে সল্ট লেক স্টেডিয়ামে শেষ হবে। এই রেসটা কিন্তু ওলিম্পিক ট্রায়াল হিসেবেও গণ্য হচ্ছে। আর ঠিক দু—মাস পর ৩১ জুলাই বার্সিলোনায় অ্যাথলেটিকস ইভেন্টগুলো শুরু হবে, প্রথম দিনেই থাকছে মেয়েদের ম্যারাথন।’

‘পরশু আমি দেখতে যাব।’ রাহুল দু—হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভেঙে বুঝিয়ে দিল আর সে কথা বলতে চায় না।

চার

‘ভোরবেলাতেই সারদাচরণ আর কোচ বিজয় সিনহা মোটরে রওনা হয়ে গেছল সোনালিকে নিয়ে অশোকনগরের উদ্দেশ্যে।

রাহুল আর অর্জুন পৌঁছল ম্যারাথন শুরু হবার আধ ঘণ্টা আগে, সাড়ে সাতটায়। ফুটবল মাঠে একটা সামিয়ানা খাটানো হয়েছে তার নীচে কাঠের মঞ্চ। সেখানে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে এক যুবক অবিরাম ঘোষণা করে যাচ্ছে। তিন—চারটি ফেস্টুন রাস্তায় আড়াআড়ি দড়ি দিয়ে বাঁধা। পুলিশ আর ভলান্টিয়াররা ভিড় ঠেলে রাখার ব্যস্ত। রেস শুরু হবার আগে বক্তৃতা হবে। পশ্চিমবাংলার ক্রীড়ামন্ত্রী বন্দুক ফুটিয়ে দৌড় শুরুর সংকেত দেবেন।

আবহাওয়া আজ খুব ভালো। এখন পর্যন্ত রোদের তাত বাড়েনি। তাপমাত্রা ৩১ ডিগ্রির কাছাকাছি রয়েছে। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। পুরুষ আর মেয়ে রানারদের হাজিরা কলকাতাতেই নেওয়া হয়। সেখান থেকে বাসে তাদের আনা হয়েছে। জানিয়েই রাখা হয়েছিল, সোনালি আলাদাভাবে আসবে অশোকানগরে।

সাত—আটটা মোটর আর পনেরোটা মোটর সাইকেল সংগঠকরা রেখেছে রানারদের সঙ্গে থাকার জন্য। দুটো অ্যাম্বুলেন্সও। ঘোষণা থেকে জানা গেল পুরুষ বিভাগে প্রতিযোগী ৭০ জন। মেয়েদের সংখ্যা ২১। আড়াইশো পুরুষ নাম পাঠিয়েছিল, তার মধ্য থেকে বাছাই করে ৭০ জনকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে সাতজন পুরুষ এসেছে,—নেপালের তিনজন, কিনিয়া ও ফিলিপিনস থেকে একজন করে ব্রিটেন থেকে দুজন। বিদেশি মেয়ে আছে চারজন। সিঙ্গাপুর, তানজানিয়া, শ্রীলঙ্কা আর অস্ট্রেলিয়া থেকে তারা এসেছে।

ছোটো গাড়ি মারুতি নিয়ে ওরা এসেছে। স্টাটিং পয়েন্ট থেকে পঞ্চাশ মিটার দূরে গাড়িতে বসে খবরের কাগজ পড়ায় ব্যস্ত দু—জনেই। খেলার পাতায় আজকের ম্যারাথন প্রসঙ্গে যা সব বেরিয়েছে, সেগুলো খুঁটিয়ে ওরা দেখছিল। কে জিততে পারে তাই নিয়ে বিজ্ঞ আলোচনা রয়েছে। সম্ভাব্য বিজয়ী হিসাবে পুরুষদের মধ্যে একজন ব্রিটিশ আর কিনিয়ান রানারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। নামকরা নয় তবে ব্রিটিশটি গত দু—বছর লন্ডন ম্যারাথন দৌড়ে ৩১ ও ৪২ স্থান পেয়েছিল। গতবছর রটারডমে কিনিয়ানটি ৪৭ জনের পর শেষ করে। শুধু এই তথ্যের ভিত্তিতেই ওরা ফেভারিট।

মেয়েদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান ডেবি ট্যাটারসলকে বিজয়ী প্রায় বলেই দেওয়া হয়েছে। গত সোল ওলিম্পিকসে সে এগারো স্থান পেয়েছিল ২ ঘণ্টা ৩২ মিনিট ৬ সেকেন্ড সময় করে। এখন বয়স ৩১। দুই ছেলের মা। সোনা বিজয়িনী পোর্তুগালের রোজা মোতার থেকে তার সময় মাত্র ছয় মিনিটরে একটু বেশি ছিল। অন্যান্যদের যা সময় দেওয়া হয়েছে তাতে ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের কমে আর কেউ নেই। ভারতীয় মেয়েদের মধ্যে সেরা সময় অন্ধ্রপ্রদেশের শীলা নাইডুর ২ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট। তিনটি বাঙালি মেয়ে রয়েছে তাদের দু—জনের সময় সওয়া তিন ঘণ্টার কাছাকাছি। ‘তৃতীয় মেয়ে সোনালি সরকার, তার সেরা সময় কত, তা জানা যায়নি।’

মোটর থেকে নেমে রাহুল স্টার্টিং পয়েন্টের দিকে এগিয়ে গেল। প্রায় দুশো লোকের জটলা যার মধ্যে ৭০ জন দৌড়বে। সে খুঁজছিল সারদাচরণ আর সোনালিকে। সামিয়ানার পিছনের মাঠেও একটা ভিড়। মেয়ে প্রতিযোগীরা সেখানে জড়ো হয়েছে। বেশিরভাগ মেয়েই ট্র্যাকসুট পরা, ওয়ার্ম আপে ব্যস্ত।

রাহুল পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। মেয়েদের মধ্যে তাকাতে তাকাতে একজনকে দেখে তার চোখ আটকে গেল। নিশ্চয়ই স্বর্ণকুমারী। দৈর্ঘ্য, গায়ের রং আর মুখের গড়ন তার চেনা। পরশু রাতে ফিল্মে দেখা মেয়েটিকে সে এর মধ্যেই ভুলতে পারে না। সম্ভবত কুড়ি বছর পর দেখালেও চিনে ফেলবে।

দু পা ফাঁক করে ঝুঁকে ক্যারিসথেনিকসে রত সোনালি। পরনে উজ্জ্বল হলুদ ট্র্যাকসুট। হলুদ ফিতে দিয়ে চুল টেনে বেঁধে রাখা। পাশে দাঁড়িয়ে বিজয় সিনহা তার গা গরমের ব্যায়াম দেখছে আর কথা বলে যাচ্ছে। রাহুল কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সে এই প্রথম চাক্ষুষ করছে স্বর্ণকুমারীকে।

বিজ্ঞাপনের লোকেদের সামনে কোনো প্রোডাক্টকে যখন হাজির করা হয় বা কোনো দ্রব্যের বাজারে ছাড়ার জন্য ঢাক—ঢোল পেটানোর অনুষ্ঠান হয় তখন চোখ এবং মন ভোলানোর উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত নিতম্ব, স্তন ইত্যাদি অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র প্রোডাক্টের দিকেই নজর রেখে যাওয়ার কাজটা রাহুল শিখে ফেলেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ব্যাপারটা উলটো। এখানে কামনা করার মতো রমণীয় মূর্তি ধরে হাজির প্রোডাক্ট স্বয়ং। ক্যামেরা লেন্স মারফত সে স্বর্ণকুমারীর প্রতিটি রোমকূপের গোড়া পর্যন্ত দেখে নিয়েছে, তার পরিসংখ্যানও পড়ে ফেলেছে, তার জন্মমৃত্তান্ত জেনে গেছে, কিন্তু একটা জিনিস সে জানত না যেটা এখন জানল—মেয়েটির যৌন আবেদন। হৃৎস্পন্দন গতি দ্রুত হল, শরীরে আবেগ সঞ্চার করল, মনের মধ্যে ঝড় তুলল জাতীয় বস্তা—পচা কথা বাদ দিয়ে সোজা কথায় রাহুলের মনে হল লক্ষ মেয়ের মধ্যে একটি মেয়ে আলাদা হয়ে যায় পুরুষের মধ্যে যে পাশব কামনা জাগাবার ক্ষমতার জন্য, এই মেয়েটির মধ্যে তা রয়েছে।

স্বর্ণকুমারীর জন্য ট্র্যাকসুটের থেকেও আরও বেশি মোহময় পোশাকের কথা রাহুল ভাবতে পারে কিন্তু তার কোনো দরকার আছে বলে তার মনে হল না। ওর পুরো অস্তিত্ব থেকেই এটা ফুটে বেরোচ্ছে। স্বর্ণকুমারী তার থেকে ইঞ্চি দুয়েক লম্বা, তা হোক। আকর্ষণের কারণটা ওর শরীরের পরিসংখ্যানের ব্যাপার নয়, যদিও চমৎকার ওর গড়নের সামঞ্জস্য। ওর শরীরের আদলের জন্যও নয়। রাহুলের মনে হল মেয়েটি তাকে আকর্ষণ করছে সফলতার জন্য। রাহুলের মনে হল মেয়েটি তাকে আকর্ষণ করছে সফলতার জন্য। যেন ও ধরেই নিয়েই, পৃথিবীর সবাইকে হারিয়ে জিতে নিয়েছে। এই ধারণা বা বিশ্বাসটাই ওর চোখে—মুখে, দেহের গতিতে ধকধক করে যাচ্ছে।

অর্জুন কাছে এসে দাঁড়াল। কাঁধ থেকে ক্যামেরা ঝুলছে। সিগারেট প্যাকেট এগিয়ে দিতে রাহুল একটা বার করে নিয়ে ধরাল।

‘স্বর্ণকুমারীকে দেখছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী মনে হচ্ছে?’

‘খুবই আকর্ষণীয়।’

এই সময় সোনালি তার ওয়ার্ম আপ শেষ করে সামনে তাকিয়ে দু—জন লোককে দেখে হেসে মাথা ঝাঁকাল। মনে হল, যেকোনো অপরিচি লোক যদি বন্ধুর মতো চাহনিতে তার দিকে তাকায় তা হলেই সে হেসে মাথা নাড়বে।

‘ডা. সরকারকে দেখছি না যে?’

‘অর্গানাইজারদের সঙ্গে কথা বলছে। পুরুষদের রেস এবর শুরু হবে, দেখবে না?’

‘বক্তৃতার ব্যাপারগুলো চুকে যাক। ততক্ষণ স্বর্ণকুমারীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা যাক।’ রাহুলের কথা শেষ হতে—না—হতেই মাইকে গমগম করে ঘোষণা হল ক্রীড়ামন্ত্রীকে এবার মালা দেওয়া হচ্ছে। রাহুল স্বর্ণকুমারীর দিকে এগিয়ে গেল।

‘গুডমনিং, আপনিই কি সোনালি সরকার?’

‘হ্যাঁ।’ অবাক চোখে সে তাকাল।

‘আমি প্রেসের লোক, পিটিআই। কয়েকটা প্রশ্ন করব।’

‘রেসের সময় হয়ে এল, পরে প্রশ্ন—ট্রশ্ন করবেন।’ বিজয় সিনহা ভারিক্কি চালে বলল। ‘মেন্টাল প্রিপারেশন নিয়ে ফেলেছে, এখন আর ডিস্টার্ব করা উচিত নয়।’

‘না না, আমার মেন্টাল ব্যালান্স ঠিকই থাকবে। হ্যাঁ বলুন, কী প্রশ্ন?’

রাহুলের ভালো লাগল ওর স্বচ্ছন্দ ঝরঝরে ভঙ্গিতে কথা বলার ধরন। চোখে কৌতূহলের পরিমাণ দেখে তার মনে হল, জীবনে কখনো কোনো সাংবাদিকের সম্মুখীন হয়নি।

‘অনেকেরই টাইমিং কাগজে বেরিয়েছে, আপানারটা নেই। আপনি এর আগে কখনো ম্যারাথনে নামেননি। কিন্তু প্রাইভেট ট্রায়াল নিশ্চয় দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ দিয়েছি।’

‘তখন টাইমিং নেওয়া হয়েছিল নিশ্চয়।’

‘হয়েছিল।’

‘কত?’

সোনালি বললে যাচ্ছিল সময়টা কিন্তু তার আগেই বিজয় হাঁই হাঁই করে উঠল। ‘নো নো, ডোন্ট ডিজক্লোজ ইট বিফোর দি রেস।’

‘এত গোপনীয়তার কি আছে? ওয়ার্ল্ড বেস্ট টাইম কী?’ রাহুল ইচ্ছে করেই একটু ব্যঙ্গের রেশ মাখাল তার কথায়। সোনালির চোখ দপ করেই আবার হাসিতে ভরে গেল।

‘ওয়ার্ল্ড বেস্ট! হতে পারে।’ সামান্য কাঁধ ঝাঁকাল সোনালি। ক্রীড়ামন্ত্রীর বক্তৃতা অপ্রত্যাশিতভাবে এত সংক্ষিপ্ত হবে বোধহয় কেউ তা ভাবেনি। তাই রেহাই পাবার আনন্দে হাততালি খুব জোরেই পড়ল।

‘ভারত থেকে কোনো মেয়ে অলিম্পিকসে ম্যারাথনে যায়নি। আপনি কি মনে করেন যেতে পারেন? এটা তো অলিম্পিক ট্রায়ালই।’

‘ভারতের মেয়েরা নিশ্চয়ই যেতে পারে। সোল গেমসের সিকসথ পোজিশন টাইমিং টাচ করলেই কোয়ালিফাই করতে পারবে। আই ও এ সেইরকমই জানিয়েছে। অবশ্য গতবারের মতো যদি হয় তা হলে কোনো কোয়ালিফাইং টাইমিংয়ের প্রশ্নই থাকবে না।’

‘আপনি পি টি উষার সোল যাওয়ার ব্যাপারটা বলছেন?’

সোনালি উত্তর না দিয়ে শুধু হাসল।

‘সোল ওলিম্পিকসে সিকসথ পোজিশনের টাইমিংটা কত ছিল জানেন কি?’

‘দু—ঘণ্টা আটাশ মিনিট সাত সেকেন্ড।’

ব্যস্ত ভঙ্গিতে সারদাচরণকে আসতে দেখা গেল।

অর্জুন ফিসফিস করে রাহুলের কানে বলল, ‘পিটিআই এবার কেটে পড়ো।’

‘দাঁড়াও না।’

‘গুড মর্নিং মি. অরোরা, মি. হালদার। কতক্ষণ এসেছেন?’

‘মিনিট কুড়ি। কথা বলছিলাম আপনার মেয়ের সঙ্গে।’

‘নিশ্চয়। বুলন কথা।’ সারদাচরণ প্রত্যয় ভরে সোনালির দিকে তাকালেন।

‘তোমার সঙ্গে পরিচয়—’

‘হয়ে গেছে, হয়ে গেছে।’ রাহুল ওনাকে থামিয়ে দিয়ে সোনালির দিকে তাকাল। ‘আজ কি ওই টাইমিং টাচ করতে পারবেন?’

‘পারতেই হবে নয়তো বার্সিলোনা যাওয়ার জন্য। তাতেও কোয়ালিফাই করতে পারেন। কলকাতায় সল্ট লেকে তো অলিম্পিক ট্রয়ায়াল হবে সামনের মাসেই।’

‘হ্যাঁ মাস্টার্স মিট হবে।’

বন্দুকে ফায়ারিংয়ের শব্দ এবং জনতার উচ্ছ্বাস ধ্বনিতে বোঝা গেল পুরুষদের যাত্রা শুরু হল। ওরা সবাই মুখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগল রাস্তা ধরে প্রায় ধাক্কাধাক্কি করে সত্তরটি লোক মন্থর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য পাঁচ কিলোমিটার পর থেকেই ভিড়টা পাতলা হয়ে ওরা দ্রুত পা ফেলার মতো ফাঁকা জায়গা পেয়ে যাবে।

রাহুলের চোখে পড়ল কালো ট্র্যাকসুট পরা এক শ্বেতাঙ্গ বিদেশিনীকে। পুরুষদের স্টার্টিং দেখতে গেছল, ফিরে এসে কিট ব্যাগটা তুলে নিয়ে এক কৃষ্ণাঙ্গী বিদেশিনীর সঙ্গে কথা বলছে। ক্যামেরা হাতে। কাঁধে পেটমোটাব্যাগ ঝোলান দু—জন লোক তাদের দিকে এগিয়ে গেল। বোধহয় প্রেস ফোটোগ্রাফার।

‘ইনিই নিশ্চয় ডেবি ট্যাটারসল। আর অন্যজন কে?’

‘তানজানিয়ার ক্যাথি বোডো।’ সোনালি একঝলক তাকিয়ে নিয়ে বলল। ‘ডেবি ওয়ার্ল্ড ক্লাস রেসার, ক্যাথির বেস্ট টাইমিং জানি না।’

‘এই রেসে কোয়ালিফাই করার জন্য দৌড়বেন তার মানে দু—ঘণ্টা আটাশ মিনিটের মধ্যে—’ রাহুলের কথা ডুবে গেল মাইকে গাঁক গাঁক করে ওঠা ঘোষণায়। যেসব মেয়ে এখনো স্টার্টিং লাইনে আসেনি তাদের শেষবারের মতো অনুরোধ জানানো হচ্ছে।

সোনালিরা দ্রুত সেদিকে রওনা হল। যাবার সময় সে হাত নেড়ে রাহুলকে চেঁচিয়ে বলল, ‘দেখা যাক, বার্সিলোনা যেতে পারি কি না।’ কথাটা বলেই সে একটা চোখ টিপল।

‘চলো, স্টার্টিংটা দেখি।’ চোখ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে অর্জুন বলল।

‘তুমি যাও, আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি।’

‘বেশ। আমি তা হলে গোটাকয়েক স্ন্যাপ নিয়ে আসি।’

রাহুল গাড়িতে এসে পিছনের সিটে পা গুটিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। কাল মাঝরাতের পর ঘুমিয়ে আর ভোরে ঘুম থেকে ওঠার জন্য তার এখন ঘুম পাচ্ছে। ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে জেগে উঠলে মেয়েদর রেসের ১৫ কিলোমিটার পর থেকে দেখা যাবে। তার আগে দেখার মতো কিছু তো ঘটবে না। ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত মেয়েরা স্বচ্ছন্দে দৌড়ে যাবে।

ঘুমে আচ্ছন্ন চেতনায় রাহুল অস্পষ্টভাবে বন্দুকের শব্দ শুনল। সময় এখন কত দেখার জন্য বাঁ হাতের কব্জিটা চোখের সামনে আনার জন্য তার মস্তিষ্ক নির্দেশ পাঠাল কিন্তু বাঁ হাত তা মানতে চাইলনা। আবার নির্দেশ গেল। বাঁ হাত চেষ্টা শুরু করল। একটু একটু করে হাতটা বুকের কাছ থেকে উঠে ঝপ করে পড়ে গেল গাড়ির মেঝেয়। আধমিনিটের মধ্যে রাহুলের বুক ওঠা—নামা করতে লাগল গভীর শ্বাস—প্রশ্বাসের নিয়মিত তালে।

একটা স্পিড ব্রেকারে গাড়িটা লাফিয়ে উঠতেই তার ঘুম ভাঙল। ধড়মড়িয়ে উঠে বসেই সে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল, গ্রামের মতো একটা জায়গা কিন্তু যথেষ্ট পাকা বাড়িও দেখা যাচ্ছে। দোকানগুলোয় কিছু কিছু বিলাস দ্রব্যও রয়েছে। রাস্তার ধারে সারি দিয়ে লোক। বাচ্চচা কোলে বউ থেকে লাঠি হাতে বৃদ্ধ, নানান বয়সি মানুষ, চোখে—মুখে উত্তেজনা, হাসিমুখ। চিৎকার করে অল্পবয়সিরা হাত নাড়ছে।

মাথা ঝাঁকিয়ে রাহুল বলল, ‘কতক্ষণ হল শুরু হয়েছে? আমরা এখন কোথায়? সোনালির কী হল?’

‘ট্রেস করতে পারছি না। এইসব অর্গানাইজাররা এমন ব্যবস্থা করেছে! আমাকে এগোতে দিল না বাঞ্চের সঙ্গে। বলল নিয়ম নেই। পিছন পিছন গাড়ি গেলে অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে। বললুম পাশে পাশে যাব। তাও অ্যালাওড নয়। হোয়াট আ ব্লাডি অ্যারেঞ্জমেন্ট! তোমার অ্যাম্বুলেন্সের গাড়ি,প্রেসের গাড়ি, টিভি—র গাড়ি, নিজেদের গাড়ি যাচ্ছে আর আমার কম্পিটিটার রয়েছে কিন্তু আমার গাড়ি যেতে পারবে না!’ অর্জুন প্রবল বিরক্তিভাবে ক্লাচ আর ব্লেক একসঙ্গে চেপে ধরল।

তার গাড়ির সামনে চরটি মেয়ে দৌড়োচ্ছে। কোনোরকমে পা ফেলেছে বলাই উচিত। মনে হচ্ছে আর মিনিট দশেক পরেই তুলে নিতে হবে। মুমূর্ষু, মৃত্যুমুখীন জন্তুকে দেখে শকুনিরা যেমন পাক দিতে দিতে নেমে আসে, সেইরকমই সংগঠকদের একটা ছোটো ভ্যান এই চারজনের পিছন পিছন চলেছে।

‘এদের ক্রস করে এগিয়ে যাও। তারপর তো সামনের রাস্তা ফাঁকাই।’ রাহুল অধৈর্য হয়ে বলল। ‘সবাই এগিয়ে গেছে, একজনকেও তো দেখা যাচ্ছে না। চলো চলো, ওভারটেক করো।’

অর্জুন তাই করল। মারুতিটা হঠাৎই একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গতি নিল। মেয়ে চারটিকে বাঁ দিকে রেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। পথে আবার পাঁচজনকে এক বাঞ্চে দৌড়তে দেখল। তাদেরও পাশ কাটিয়ে মারুতি এগিয়ে গেল।

‘মনে হচ্ছে সোনালি প্রথম বাঞ্চে আছে।’ অর্জুন বলল।

‘কতক্ষণ হল স্টার্ট হয়েছে?’

‘ঠিক সওয়া আটটায়। এখন হল—, ‘অর্জুন কবজি তুলল। রাহুলওতার ঘড়িতে চোখ রাখল।’ ন—টা আটচল্লিশ, তার মানে এক ঘণ্টা তেত্রিশ মিনিট রেস চলছে। অযথা দেরি করিয়ে দিল। এই জায়গাটা বামনগাছি।’

পথের ধারে টেবল পাতা। সেখানে বরফজল গ্লাসে নিয়ে ভলান্টিয়াররা অপেক্ষা করছে। গ্লুকোজ, পাতিলেবুও রয়েছে। অর্জুন গাড়ি থামিয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভাই খবর কী? আমরা প্রেসের লোক। মেয়েদের মধ্যে প্রথম গেছে কারা বলতে পারেন?’

‘প্রথমে গেছে একজন মেমসাহেব, কী যেন নামটা?’

‘ডেবি ট্যাটারসল।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। তার প্রায় দুশো গজ পিছনে নিগ্রো মেয়েটা। আর তার কুড়ি গজ পিছনে একজন।’

‘কীরকম তাকে দেখতে, ইন্ডিয়ান কি?’

‘৫১ নম্বর। দাঁড়ান, লিস্ট দেখে বলছি।’ লোকটি টেবলে বসা একটি লোকের কাছ থেকে জেরক্স করা নামের তালিকাটা চেয়ে নিল।

‘৫১ নম্বর সোনালি সরকার। বাঙালি মেয়ে। কিন্তু দেখলে তো মনে হয় না!’

‘কতক্ষণ আগে ওই তিনজন গেছে?’

‘তবু, আন্দাজে বলুন।’

‘কী জানি ঘড়ি দেখেনি।’

রাহুল দাঁত চেপে মনে মনে অশ্রাব্য বিশেষণে তাকে ভূষিত করল। একটি বালক হঠাৎ বলল, ‘তখন সওয়া ন—টা হবে।’

‘তার মানে এক ঘণ্টায় ওরা এখানে পৌঁছেছে। ওদের পরের মেয়েরা কতক্ষণ বাদে এল?’

‘ওহহ, সে অনেক পর পর। ওদের পরের মেয়েটা তো দশ মিনিট বাদে, তার পর একসঙ্গে দুটো মেয়ে পনেরো মিনিট বাদে। ধুঁকছে, মনে হয় না শেষ করতে পারবে। বোধহয় প্রথম দিকে জোরে ছুটে ফেলে এখন আর সামলাতে পারছে না। তা স্যার আপনারা কোন কাগজের লোক?’

‘প্রাভদা।’ বলে অর্জুন মারুতি ছেড়ে দিল।

বারাসাতে ঢুকেই একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানল, প্রথমে গেছে ডেবি, তার পিছনে একইসঙ্গে ক্যাথি আর ৫১ নম্বর। আর তাদেরও পিছনে দশ—বারোজন পুরুষ।

‘বুঝলেন দাদা, ওই মেয়ে তিনটের যা দম আর স্ট্যামিনা দেখলাম, অনেক পুরুষকে হারিয়ে দেবে। পনেরো মিনিট আগে স্টার্ট নিয়ে কি না মেয়েমানুষের কাছে পিছিয়ে পড়ল! রামো, রামো। ভালো করে একটু লিখে দেবেন।’

‘দোব?’

‘কী পেপার আপনার?’

‘নিউ ইয়র্ক টাইমস।’ রাহুল জানলার কাচ তুলে দিল।

মধ্যমগ্রামের মোড়ে পৌঁছবার আগেই তারা মেয়ে রানারদের পেতে শুরু করল। ক্লাসপায়ে, দরদর ঘামতে ঘামতে প্রায় জগ করার মতোই তারা এগোচ্ছে। তাদের একে একে ছাড়িয়ে গিয়ে একটি ভারত মেয়েকে পেল আর মুখে ক্লান্তির ছাপ ফুটলেও, দীর্ঘ সরু পায়ের কদমে তা ধরা পড়ছে না। হাতকাটা ব্লাউজটা ভিজে জবজবে। মাথায় বরফজল ঢালার জন্য কিংবা ঘামের জন্যও হতে পারে। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। ওর পাশে পাশে মোটরবাইকে এসকর্ট চলছে।

‘শীলা নাসডু বোধ হয়।’

‘ওর বেস্ট টাইম তো দু—ঘণ্টা চুয়াল্লিশ মিনিট?’

‘ওই টাইটাই যদি শীলা রাখে মানে এখনো পর্যন্ত ওই গতিতেই ছুটে থাকে তা হলে সোনালিরা আরও কম টাইমে ফিনিশ করবে।’

‘কত কমে?’ রাহুল সামনে তাকিয়ে কয়েকজন পুরুষ প্রতিযোগীকে দেখতে পেল।

‘দু—ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ? দু—ঘণ্টা বত্রিশ। ওই দু—ঘণ্টা তিরিশ? পেসটা ডেবিই সেটা করেছে, ওকে চেঞ্জ করেছে দু—জন?’

‘এই টেম্পারেচারে, এমন হিউমিড কন্ডিশনে এই রকমটাইম রাখা, মনে হয় না সম্ভব।’

বাঁদিকে দমদম এয়ারপোর্টের পাঁচিল। একটা এয়ারবাস নামার জন্য এখন ইনবাউন্ড হয়ে পি—লুপ টার্ন নিচ্ছে। এবার রানওয়ের সঙ্গে একই লাইনে আসবে। রাহুল আকাশের দিকে তাকিয়ে প্লেনের অবতরণ লক্ষ করায় ব্যস্ত।

অর্জুন ব্রেক কষে মারুতিকে থামাল। রাস্তায় একটা ট্রাক উলটে রয়েছে। ভিড় জমে গেছে। ওলটানো ট্রাকের পাশ দিয়ে একটামাত্র গাড়ি যাবার জায়গা রয়েছে। হলুদ—কালো চৌখুপ্পি ঘর কাটা একটা হাইওয়ে পেট্রল জিপ দাঁড়িয়ে। গাড়ি চলাচল বন্ধ করে ম্যারাথন রানারদের আগে পথ করে দেওয়ার কাজে পুলিশ ব্যস্ত।

‘হয়ে গেল!’ হতাশ স্বরে অর্জুন দু—হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল। ‘এখান থেকে বেরোতে বেরোতে ওরা তো ভি আইপি রোড ধরে ফেলবে।’

পুরুষ রানার ক—জন বেরিয়ে গেল। দমদম থেকে আসা কিছু গাড়ি ছাড়া পেল। শীলা নাইডুর জন্য পথ করে দিতে আবার গাড়ি চলা বন্ধ। এর পর মধ্যমগ্রামের দিক থেকে আসা গাড়িগুলোকে যেতে দেওয়া হল।

যশোর রোড থেকে বাঁদিকে ঘুরে ভিআইপি রোডে পড়েই অর্জুন মারুতিকে সত্তর কিলোমিটার বেগে ধাওয়া করাল। কৈখালি ফেলে রেখে বাগুইআটির মোড় পার হয়ে দেখল ক্যাথি বোডো আর তার পঞ্চাশ মিটার আগে দু—জন পুরুষ ছুটছে। সামনে যত দূর চোখ যায় আর কোনো রানারের টিকিও দেখা যাচ্ছে না।

‘সোনালি আর ডেবি, তা হলে এই দু—জনই এখন লিড করছে।’ রাহুল নিশ্চিত স্বরে বলল।

কৃষ্ণপুর আসছে। দূর থেকে ওরা দু—জনকে দেখতে পেল। দু—পাশে মোটরবাইক, পিছনে একটা ছোটো ভ্যান তাতে সাদা একটা পতাকা বাঁধা। মোটর থেকে বেরিয়ে আছে একটি মাথা, ডা. সরকারের। মারুতি গিয়ে মোটরের পিছনে ফেউ নিল।

‘রাহুল তোমার তো রুমালটা সাদাই। চটপট ওই পতাকার মতো লাগাবার ব্যবস্থা করো, নইলে আটকে দেবে।’

‘কী দিয়ে লাগাব, একটা স্টিক চাই, একটা লাঠিফাটি অন্তত যদি—।’

অর্জুন মারুতিকে রাস্তার বাঁ দিক ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে প্রায় লাফিয়েই নামল। হাত দুই লম্বা একটা বাখারি কুড়িয়ে এনে গাড়িতে উঠল।

‘এটার সঙ্গে বেঁধে নাও, আর জানলার বাইরে উঁচিয়ে ধরে থাক। আমি ঠিক ভ্যানটার পিছু পিছু যাব।’

‘রুমালটা যে বাঁধব, একটা দড়িটড়ি—’রাহুল পিছনের সিটের দিকে তাকাল।

‘জুতোর ফিতে খুলে বাঁধো।’

পাশাপাশি দু—জন ছুটে যাচ্ছে। সোনালির পরনে গাঢ় হলুদ শর্টস ও বগলকাটা গেঞ্জি। চুলের রাশ গোছা করে টেনে বাঁধা। মাথা সোজা করে রাখা। পায়ে হলুদ জুতো। সোনালি আগাগোড়াই সোনালি। তার পাশে লাল ব্লাউজ আর কালো শর্টস পরা ডেবি ট্যাটারসল। সোনালির থেকে অন্তত এক বিঘৎ খাটো। কৃশ তনু। মাথাটি একটু ডান দিকে হেলানো।

পিছন থেকে দু—জনের মুখ দেখা যাচ্ছে না। রাহুলের মনে হল ডেবি যেন একবার মুখটা সোনালির দিকে ফেরাল আর হঠাৎ গতি বাড়িয়ে দিল। বাঙ্গুর অ্যাভিন্যু ছাড়িয়ে লেকটাউন এসে গেল। ডেবি এবার থার্ড গিয়ারে তুলল তার গতি। সোনালি তার সঙ্গে লেগে রয়েছে।

এইবার রেসটা ট্যাকটিকাল পর্যায়ে পৌঁছেছে। ওয়ার্ল্ড ক্লাস রানারের সঙ্গে দৌড়বার কোনো অভিজ্ঞতাই সোনালির নেই। ডেবির জমিয়ে রাখা দম আর শরীরের ক্ষমতা কতটা সোনালিকে সেটা এবার বুঝে নিয়ে নিজের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু বুঝতে পারবে কি? রাহুল উৎকণ্ঠা নিয়ে লক্ষ করতে লাগল।

কিনিয়ান দুই অ্যাথলিটের কথা ডা. সরকার বলেছিল। সহজ সরলভাবে দৌড়টাকে নিয়েছিল শুধুই হারজিতের একটা চ্যালেঞ্জের মতো। তার ভাবমুক্ত মনে দৌড়য় নিজেদের স্বাভাবিক ক্ষমতাকে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে গিয়ে। রাহুল ভাবল, সোনালিও কি তাই করছে? ডেবি যতই ট্যাকটিকাল দৌড় দৌড়ক না, সোনালি তার ফুসফুস আর পেশির উপর ভরসা রেখে দৌড়ে যাচ্ছে। তার মধ্যেও কতটা শক্তি জমানো আছে তা এখনও প্রকাশ পায়নি।

‘কটা বাজে?’ অর্জুন জানতে চাইল। রাহুল ঘড়ির দিকে চোখ রেখে সময়টা বলতে যাচ্ছে তখনই ‘আরে সোনালি—’ বলে স্টিয়ারিংয়ের উপর ঝুঁকে পড়ল।

সোনালি আচমকা গতি বাড়িয়েছে। সামনে উলটোডাঙ্গা ব্রিজ। ডেবিও সঙ্গে সঙ্গে গতি বাড়াল। রাস্তার দু—ধারে কাতারে কাতারে মানুষ। উলটোদিক থেকে আসা যানবাহন থেমে পড়েছে। প্রবল চিৎকার শুরু হয়েছে দু—জনের মধ্যে, কে এগিয়ে যাবে লড়াই শুরু হতে দেখে।

ব্রিজের শীর্ষ পর্যন্ত দু—জনে পাশাপাশি, তার পরই সোনালি একটু একটু করে ডেবিকে পিছনে ফেলে দিতে শুরু করল। ৪২,১৯৫ মিটার দৌড়ের শেষ দু—হাজার মিটারে যে এইরকম গতিতে দৌড়ানো যায় রাহুলের সেটা কল্পনার বাইরেই ছিল। তার মনে হল, ম্যারাথনের নয়, সে যেন দেড় হাজার মিটার দৌড়ের ফিনিশ দেখছে।

ভিআইপি রোড থেকে বাঁয়ে ইস্টার্ন মেট্রোপিলিটান বাইপাসে যখন সোনালি ঘুরল ডেবি তখন কুড়ি মিটার পিছিয়ে গেছে। গতিটা ধরে রেখে সোনালি, বাঁ দিকে বিধান নগর আর ডান দিকে মানিকতলা ও বেলেঘাটার মাঝ দিয়ে ছুটে যেতে লাগল। দূরে একটা বিরাট ফেস্টুন দেখা যাচ্ছে। তাতে ইংরাজিতে লেখা ‘ফিনিশ’।

সল্ট লেক স্টেডিয়ামের বাইরের ফটকের সামনে রাস্তার উপর সাদা রংয়ে দাগ টানা। সেখানে ইলেকট্রনিক ঘড়ি জ্বলজ্বল করে সময় নির্দেশ করছে। দাগের ওধারে কর্মকর্তাদের জটলা। ফিনিশের পঞ্চাশ মিটার আগে থেকে রাস্তার পাশে শাল খুঁটিতে বাঁশের বেড়া। পুলিশ দাঁড়িয়ে দশ গজ অন্তর।

আর যেতে দেওয়া হবে না গাড়িকে। পুলিশের নির্দেশে ফিনিশিংয়ের প্রায় আধ কিলোমিটার আগে অর্জুন রাস্তা ঘেঁষে মারুতিকে থামাল।

‘ফিনিশটা দেখা হল না।’ আক্ষেপ করল রাহুল।

‘যা দেখেছি তাই যথেষ্ট।’

সামনের ভ্যানটাকেও পুলিশ আটকে দিয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে সারদাচরণ ও বিজয় দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। তাদের বাম বাহুতে সবুজ কাপড়ের পটি জড়ানো। সেটাই তাদের ছাড়পত্র।

‘সবুজ রুমাল আছে?’

অর্জুন মাথা নেড়ে বোঝাল নেই। দু—জনে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়াল। সোনালির মাথার চুলের গোছাটা তার পিঠের উপর ঝাপটাচ্ছে, এইটুকু ছাড়া তারা ওর আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না রাস্তায় বহু লোক নেমে পড়ায়।

সোনালি দু—হাত আকাশের দিকে তুলে দিল। একটা উল্লাস সেখানকার জনতার কণ্ঠ থেকে হাউইয়ের মতো শূন্যে উঠে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অর্জুন ও রাহুল কবজি তুলে প্রায় একইসঙ্গে ঘড়ির দিকে তাকাল। পরস্পরের মুখের উপর অবাক চাহনি রেখে প্রায় একই সঙ্গে দু—জনে বলে উঠল, ‘দারুণ!’

‘দু—ঘণ্টা চব্বিশ মিনিট পঞ্চান্ন বা দু—চার সেকেন্ড এধার—ওধার! সোল অলিম্পিকসে তো সোনা জিতে যেতে পারত সোনালি, ইয়ে….স্বর্ণকুমারী!’ অর্জুনের উত্তেজিত স্বরে কয়েকটি ছেলে তার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এল।

‘হ্যাঁ, দাদা এটা কি ওয়ার্ল্ড রেকর্ড?’

‘ম্যারাথনে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বলা হয় না, বলা হয় ওয়ার্ল্ড বেস্ট। সোনালি সরকারের টাইম যা হল সেটা ওয়ার্ল্ড বেস্ট নয় বটে তবে চার বছর আগের ওলিম্পিকসে সোনা জিতে যেতে পারত।’ অর্জুনের কণ্ঠস্বর উচ্চচগ্রামে উঠে থরথর কাঁপতে লাগল।

‘আরিব্বাস, দাদা বলছেন কী। গোল্ড জিতে যেত, এই মে দিবসের পটকাগুলো সব ফাটিয়ে ফেলেছে কি না দ্যাখতো, তাড়াতাড়ি যা।’

রাহুল হাত ধরে অর্জুনকে টেনে নিয়ে গাড়িতে উঠল।

‘দাঁড়াও ডেবি ট্যাটারসলের টাইমটা জানতে হবে, প্রায় সত্তর—আশি মিটার পিছনে পড়েছিল।’

‘আমি আর কারুর টাইমে ইন্টারেস্টেড নই।’

‘তা হলে তুমি আমাদের কনসরটিয়ামে জয়েন করছ?’

‘আগে আমি স্বর্ণকুমারীর সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চাই। অর্জুন তুমি ব্যবস্থা করো।’

পাঁচ

পেভমেন্ট ঘেঁষে মারুতিকে রেখে, রাহুল গাড়ি থেকে নামল। বাড়িটার দিকে একনজর তাকিয়ে সে মারুতির দরজায় চাবি দিয়ে রংচটা লোহার গেট পেরিয়ে ভিতরে এল। চটা—ওঠা, ভাঙা সিমেন্টের পথটা সোজা গিয়ে শেষ হয়েছে একটা দেওয়ালে। পথের বাঁ দিকে দুটো দরজা। এই ফ্ল্যাটবাড়ির দুটো ভাগ তাই দুটো সিঁড়ি। দুটো দরজা দিয়ে ঢুকে দুটো সিঁড়ি পাওয়া যাবে।

রাহুল প্রথম দরজাটার সামনে দাঁড়াল। টেলিফোনে কাল রাতে ডা. সরকার বলে দিয়েছিলেন:’প্রথম দরজা দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি ধরে দোতলায় উঠে বাঁ দিকের ফ্ল্যাট। আমি সকালেই বর্ধমান চলে যাচ্ছি কোচ বিজয় সিনহাকে সঙ্গে নিয়ে। তাতে আপনার কোন অসুবিধে হবে না। আমার বোন তো থাকবেই। দরকার হলে তার সঙ্গেও কথা বলে নেবেন। হ্যাঁ, আমিও মনে করি স্বর্ণকুমারীর কথাবার্তা, হাবভাব, কালচারাল লেভেল বা এই ধরনের ব্যাপার সম্পর্কে না জানলে তাকে বা তার ব্যক্তিত্ব বিষয়ে কোনো ধারণা না পেলে তাকে মার্কেট করা সম্ভব নয়। আপনি ওর মা—দিদিমার কথাও তুলতে পারেন, কিছুই আমরা ওর কাছে লুকোইনি। তা হলে বিকেল পাঁচটায় আপনি আসছেন।’

রাহুল ঘড়ি দেখল। পাঁচটা বাজতে দুই এখন। দোতলায় ছোটো বারান্দাটার রেলিংয়ে একটা নীল তোয়ালে শুকোচ্ছে। তিনতলার বারান্দায় এক মহিলা নীচের দিকে তাকিয়ে। এই মুহূর্তে ভারতীয় অ্যাথলেটিকসের এক চাঞ্চল্যকর ঘটনার নায়িকা, গতকালই যে এক লক্ষ টাকার একটা চেকে পেয়েছে, আজ প্রতি কাগজে যার প্রথম পাতায় ছবি বেরিয়েছে, এমন একজন যে এই বাড়িতে রয়েছে মনে হয় না সেটা কেউ জানে। অবশ্য জানলেও, এটা এমনই এক পাড়া তাই নিয়ে হইচই কেউ করবে না।

দোতলায় উঠে এসে রাহুল কলিংবেলের বোতাম টিপল। টুং টাং আওয়াজ শোনা গেল। কয়েক সেকেন্ড পরই একটি বছর বারোর মেয়ে দরজা খুলে দাঁড়াল।

‘সুরুচি দেবী আছেন? কিংবা সোনালি?’

তার কথা শেষ হতে—না—হতেই ভিতর থেকে সোনালির কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘কে এসেছে রে ধনিয়া?’

বলতে বলতেই বেরিয়ে এল সোনালি।

‘ওহ আপনি, আসুন আসুন, একদম কাটায় কাটায় পাঁচটায়!…আপনার সঙ্গে কিন্তু আমার একটা ঝগড়া রয়ে গেছে। কাল মিথ্যে পরিচয় দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন।’

ছোটো ফ্ল্যাট। ঢুকেই ডান দিকে রান্নাঘর, কলঘর। সোজা গেলে শোবারঘর যেটার দরজায় পুরু হ্যান্ডলুমের গেরুয়া রঙের পর্দা ঝুলছে। বাঁ দিকে বসার ঘর। রাহুল বসার ঘরে ঢুকে গদিপাতা চৌকিতে, না দুটি সোফার একটিতে, কোথায় বসবে ঠিক করতে পারছে না।

‘এই সোফাটায় বসুন।’ সোনালি আঙুল দেখিয়ে নির্দেশ করল। রাহুল বসে পড়ল। সামনের সোফায় সে নিজে বসল।

‘আপনি পিটিআই…।’

রাহুল দু—হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘তখন কথা বলার জন্য একটু ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছিল। খেলার লোকেরা মিডিয়াকে খাতির করে তো।’

‘আমার কিন্তু একদমই বারণ। পাবলিসিটির কোনোরকম ধারকাছ দিয়ে যাওয়া চলবে না।’

‘কার বারণ, ডা. সরকারের।’

‘হ্যাঁ, বাবা এ জন্য ভীষণভাবে আমাকে আড়াল করে রাখেন। খবরের কাজ, রেডিয়ো, টিভি, কাল আমাকে ইন্টারভিউ করার জন্য তো হুড়োহুড়ি শুরু করেছিল। বিজয়দা আমাকে একটা ধুতি দিয়ে মুড়ে, শুধু চোখ আর নাক খোলা রেখে, সেই ভিড়ের মধ্য দিয়ে টানতে টানতে একটা গাড়িতে তুলে পাচার করে দেন। কাগজে দেখেছেন কী লিখেছে?’

‘হ্যাঁ ইংরিজি কাগজে দেখলাম। সেনসেশ্যনাল রানিং অফ এ মিস্ট্রি গার্ল হু মপড আপ দ্য ম্যারাথন টাইটল উইথ অলিম্পিক কোয়ালিফাইং পারফরম্যানস, আরও সব…টল, আট্রাকটিভ গার্ল হু গেভ হার নেম অ্যাজ সোনালি সরকার, ইজ আননোন টু অ্যাথলেটিকস সোশালিস্টস…শী পোস্টেড টাইম অফ টু আওয়ার্স টোয়েন্টি ফোর মিনিটস ফিফটি সিক্স সেকেন্ডস…আরও বলব?’

‘আপনি তো দেখছি মুখস্থ করে ফেলেছেন।’

সোনালির চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল। দু—পা জড়ো করে হাঁটু দুটো বুকের কাছে টেনে মাতৃগর্ভে ভ্রূণাবস্থায় থাকার মতো ভঙ্গিতে সে সোফায় কাত হয়ে গড়িয়ে পড়ল।

রাহুল চোখ সরিয়ে নিল অস্বস্তিভরে। সোনালি অত্যন্ত হ্রস্ব একটা সুতির কালো শর্টস পরে রয়েছে যেটা তার তলপেট ও ঊরুরু সঙ্গে চেপে বসান। ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা ঢিলেঢালা সুতির লাল হাফ শার্ট যায় ওপরের বোতাম খোলা এবং প্রথম দর্শনেই রাহুলের বুঝে নিতে অসুবিধে হয়নি, সোনালি ব্রা পরেনি। কিন্তু এইভাবে গড়িয়ে কাত হতেই তার শর্টসে টান পড়ার জন্য সেটা দুই উরুর ঊর্ধ্বপ্রান্ত পর্যন্ত উঠে গেছে। তাই নয় শার্টের খোলা বোতাম দিয়ে একটি স্তনের বৃন্ত পর্যন্ত উন্মোচিত অবস্থায়।

একজন লোক কথা বলতে আসবে, সোনালি তা জানে। জেনেও সে জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখেনি উপযুক্ত পোশাক পরে। রাহুলের মনে হল, তার আসার গুরুত্বটা এই মেয়েটি ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারেনি বা বাইরের লোকের সামনে এইরকম পোশাক পরাটাকেই হয়তো ও স্বাভাবিক মনে করে। কিংবা হয়তো ওর উপর হুকুম হয়েছে, লোকটাকে তালগোল পাকিয়ে দাও যাতে সে আমাদের সঙ্গে হাত মেলায়। সে জন্য যা করতে হয় করো। যাই হোক না কেন রাহুল ঠিক করে ফেলল খুব হুঁশিয়ার হয়ে পা ফেলবে। সেক্স বিষয়ে কোনো চিন্তাকে মনে স্থান দেবে না। সে এসেছে তথ্য সংগ্রহ করতে। সোনালি কীভাবে বড়ো হয়ে উঠেছে সেটা জানা দরকার। নিজের শরীর সম্পর্কে সচেতন হয়ে না ওঠা বা এইরকম খোলামেলা মনোভাব ওর মধ্যে গড়ে উঠল কী করে? দেহে যৌবন আসার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা যে স্বাভাবিক লজ্জার, আড়ষ্টতার অন্তর্গত হয় তার ছিটেফোঁটাও সোনালির মধ্যে নেই।

‘আমার কিন্তু কাগজ পড়া বারণ ছিল।’ সোনালি বাচ্চচা মেয়ের মতো ফিসফিস করে বলল গোপন খবর জানাবার ভঙ্গিতে।

‘তাহলে পড়লে কেন?’

‘বাহ, ইচ্ছে করে না!’

‘আর কী কী ইচ্ছে করে?’

‘আর কী কী—’, সে কয়েক সেকেন্ড চিন্তায় ডুবে থেকে আচমকা বলল, ‘আপনি অরোরা, তার মানে পাঞ্জাবি, তাহলে এত ভালো বাংলা বলেন কী করে? আপনার বাব মা কি বাঙালি?’

‘আমি কলকাতাতেই জন্মেছি, বড়ো হয়েছি, আমার মেলামেশা ছিল বাঙালিদের সঙ্গে।’

‘ঠিক ঠিক। আমার মা আর দিদিমা আপাতানি ট্রাইবের ছিল। এখন যেটা অরুণাচল বলা হয় সেখানে আছে এই ট্রাইব।’

‘তুমি কী মনে করো তুমি বাঙালি নও? তোমার বাবা…’

‘আমি তো পালিত মেয়ে।’

রাহুল লক্ষ করল কথাটা বলার সময় সোনালির মুখটা দুমড়ে গেল। সেটা রাগে, না হতাশায়, না আক্ষেপে বুঝতে পারল না। প্রসঙ্গ বদলাতে সে বলল, ‘আর কাউকে এখানে দেখছি না যে? ডা. সরকারের বোন, তিনি কোথায়?’

‘পিসি? টিভি মেকানিক খুঁজতে গেছে। কাল ছেকে সেটটা চলছে না। টিভি না দেখলে পিসির ঘুম আসে না।’

রাহুল ঘরের চারধারে চোখ বোলাল। কোথাও টিভি সেট দেখতে পেল না।

‘এ ঘরে নয়, পিসির বেডরুমে আছে ওটা।’ সোনালি আঙুল দিয়ে বাঁ দিকের দেওয়ালটা দেখাল ‘ছোটোবেলায় আমিও ওইঘরে থাকতাম। এই ঘরটা ছিল আমার খেলার ঘর। কী নিয়ে খেলতাম জানেন ক্লাইম্বিং ফ্রেম, দড়ি, গরাদ ধরে ব্যায়াম। রোজ আমাকে বাধ্য করা হত এই নিয়ে খেলতে, সকালে আর বিকেলে। আমার খারাপ লাগত না। তবে বাবার একটা থিওরি আছে অক্সিজেন বেশি টানা বিষয়ে, সে জন্য আমার বুকের খাঁচাটা বড়ো করার চেষ্টা হত। দিনে একবার আমার বুকের পাঁজরে বেল্ট লাগানো মোটা কাপড় বেঁধে তারপর সেটা টানা হত। খুব লাগত, ব্যথা হত। রোজ একবার করে এটা করা হত। আমার যে কী রাগ হত, ঘেন্না করতাম। ইঞ্জেকশনকেও ঘেন্না করতাম।’

‘ইঞ্জেকশন? কীসের?’

‘বোধহয় আয়রন ঢোকানো হত শক্তি বারবার জন্য। সপ্তাহে একটা, ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত নিয়েছি। খাবারদাবার সম্পর্কেও খুব কড়াকড়ি ছিল, চিনির তৈরি কিছু একদম নয়।’

‘তোমার শরীরের জোর কতটা বাড়ছে বা কমছে, সেটা কি ডা. সরকার মাপতেন?’

‘প্রতি শনিবার, পুরো ব্যায়াম করিয়ে সব লিখে রাখেন। এখানেও তাই হয়।’

রাহুল কথাবার্তা এবার অন্যদিকে ঘোরাতে চাইল। একই বিষয়ে বেশিক্ষণ কথা না বলে নানান মুড, আবেগ, বোধ, বুদ্ধি যাতে ধরা পড়ে তাই করা উচিত।

‘কই বললে না তো, কী কী ইচ্ছে তোমার করে?’ রাহুল সিগারেট প্যাকেট পকেট থেকে বার করে কী ভেবে আবার পকেটে রাখতে যাচ্ছিল, সোনালি বারণ করল।

‘খান না। সিগারেটের গন্ধ আমার ভালো লাগে।’

‘সিগারেটের ধোঁয়া অ্যাথলিটের ফুসফুসের পক্ষে ক্ষতিকর।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু বাবা তো এখানে নেই। বিজয়দা আমাকে জিমে ওয়ার্ক করাবার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে খায়। বাবা তা জানে না।’

‘ডা. সরকারকে তোমরা ভয় করো?’

সোনালি চুপ করে রইল।

‘আচ্ছা তোমার ওয়ার্ক আউটের কথা বলো। শুনেছি খুব মর্ডান ইকুইপমেন্টস আছে তোমাদের বর্ধমানের জিমনোসিয়ামে। নানারকম ফিজিওলজিক্যাল টেস্ট করার ব্যবস্থাও আছে। সত্যি?’

‘নিজে দা দেখলে, শুধু মুখের কথা শুনে বুঝতে পারবেন না।’

‘পারব। তুমি বলো।’

‘ওখানে আমার মনের আর শরীরের কন্ডিশনিং করা হয়। বাবা আর বিজয়দা করান। যেমন ধরুন ট্রিডমিল।’ সোনালি সোজা হয়ে বসল। তার দুটি গাল ও চোখ দিয়ে উদ্দীপনার আভা ফুটে বেরোল। নিজের সাম্রাজ্যে যেন নির্বাসিতা রানি ফিরে যাচ্ছে, এমন একটা উত্তেজনা তার অবয়বে ছড়িয়ে পড়েছে।

‘ট্রিডমিল হল, রোলারের ওপর রবারের শিট পাতা থাকে। তার একদিকে থাকে ইলেকট্রিক মোটর। সেটা চালালে রোলার ঘুরতে থাকে আর সেইসঙ্গে বেল্টের মতো রাবারের শিটটাও। সেই চলন্ত রাবার শিটে দাঁড়িয়ে, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, ছুটতে হয়। যত জোরে শিটটা চলবে তার সঙ্গে তাল রেখে তত জোরে ছুটতে হবে, ছোটার স্পিড কমলেই দড়াম করে চিৎপটাং। আমাকে দেড়ঘণ্টা ট্রিডমিল করতে হয় সপ্তাহে দুদিন। করার সময় আমাকে মন্ত্রের মতো বলতে হয় ‘আমি সোনা জেতার জন্য দৌড়চ্ছিল।’ এটা বলতে বলতে কী রকম একটা ঘোরের মতো ব্যাপার মাথায় তৈরি হয়, তখন দৌড়তে খুব কষ্ট হয় না। কাল যখন ফিনিশিং থেকে একমাইল দূরে ডেবি ট্যাটারসলকে ফেলে রেখে স্পিড তুললাম তখন এটাই মনে মনে বলছিলাম। এছাড়া করি ওয়েট ট্রেনিং। রোড রানিং, ফিল্ম দেখা, মালিশ, মোটিভেশন, আলট্রা ভায়োলেট…।’

‘প্রতিদিন, মাসের পর মাস সকাল থেকে রাত এইরকম একটা জীবন, ভালো লাগে? বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে করে না?’

‘তার মানে?’

‘এটাই ওদেরকে বলা, যথেষ্ট হয়েছে আর নয়, এবার আমাকে কলকাতায় বেড়াতে নিয়ে চলো। সেখানে সিনেমা দেখব, নিউ মার্কেটে ঘুরব, পার্ক স্ট্রিটে রেস্তোরাঁয় খাব, মেট্রোয় চড়ব।’

‘না, বলব না এসব।’ অপ্রত্যাশিত বদলে গেল সোনালি। ‘আমি ওলিম্পিক সোনা জিততে চাই। সিনেমা দেখা, ঘোরাঘুরি খাওয়াদাওয়ার জন্য বাকি জীবন তো রয়েছে।’

‘তুমি এর থেকে কী পাবে আশা করো?’

‘জেতাটাই আমার কাজ, এই জন্যই তো জন্মেছি। কারুর যদি ট্যালেন্ট থাকে তাহলে সেটা নষ্ট করা কি উচিত? আপনার ট্যালেন্ট আপনি কীভাবে কাজে লাগান?’

‘ট্যালেন্টেড লোকেদের জন্য টাকা কামানোয়। সেই জন্যই তারা আমায় ডাকে।’

‘কারা ডেকেছে?’

‘যেমন ধরো, ইমদাদ আলি, গজল গায়। নাম শুনেছ?’

‘আহহ, ওর গানের টেপ আছে আমার কাছে। ওকে চেনেন?’

‘আমি ওর এজেন্ট। কোথায় টেপ করলে?’

‘রেডিয়ো থেকে। আচ্ছা ওর মতো লোকেদের সঙ্গে কি কথা বলার সুযোগ আমার হবে? আপনার কী মনে হয়?’

‘বার্সিলোনার পর, কে বলতে পারে হয়তো ইমদাদই তোমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য ব্যস্ত হবে।’

‘আমি ভালো আলাপী নই।’

‘কে বললে নও, দিব্যিই তো আমার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছ।’

‘কথা বলা শেখার জন্য সপ্তাহে দু—ঘণ্টা আমাকে ইন্টারভিউ দেওয়ার ক্লাস করতে হয়।’

‘তার মানে?’ রাহুল অবাক হয়ে গেল।

‘বাবা চলে গেছেন ট্রেনিং সম্পর্কে আপনি যা জানতে চান, জানাতে শুধু, খুব ব্যক্তিগত কথা নয়। তাই আপনাকে বলছি, বার্সিলোনায় দুটো সোনা জেতার পর প্রেস ইন্টারভিউ রুমে আমাকে যেতে হবে। তখন সেসব প্রশ্ন হবে বা হতে পারে এটাকে তারই উত্তর দেওয়ার রিহার্সাল বলতে পারেন।’

‘আশ্চর্য তো! কী ধরনের প্রশ্ন করা হয়?’

‘ঘরের চারদিকে চারটে টেপরেকর্ডার থাকে। তাতে প্রশ্নগুলো নানান লোকের গলায় ইংরিজিতে টেপ করা থাকে। একের পর এক রেকর্ডারের সুইচ টিপে চালান হয়। আমি উত্তর দিতে যাই। উত্তরগুলো আগেই আমাকে লিখে দেওয়া হত, এখন আর তার দরকার হয় না আমি নিজেই উত্তর দিতে পারি।’

‘কয়েকটা প্রশ্ন বল তো।’

‘যেমন ধরুন, গেমসের আগে কি বিশ্বাস করতে তোমার পক্ষে দুটো সোনার মেডেল জেতা সম্ভব?’

‘বাহ, তুমি কী জবাব দেবে?’

‘নিজের ওপর কনফিডেন্স থাকা দরকার। একদিক থেকে বলতে গেলে আমি এখনও বিশ্বাসই করতে পারছি না দুটো সোনা জিতেছি। কিন্তু বার্সিলোনায় এসেছি জিততে, হ্যাঁ জিততে, কথাটা অবশ্য অহংকারীর মতো শোনাচ্ছে কিন্তু আমি নিজের চিন্তাকে গোপন করায় অভ্যস্ত নেই। জবাবটা কেমন হল?’

রাহুল মন্তব্য না করে বলল, ‘আর একটা প্রশ্ন।’

‘আর একটা? আচ্ছা।’ সোনালি মুহূর্তের জন্য চিন্তা না করে বলল, ‘অলিম্পিকসে এখনো পর্যন্ত ম্যারাথন যে জিতেছে সে আর অন্য কোনো ইভেন্ট সেই গেমসে আর জিততে পারেনি শুধু একজন ছাড়া চেকোশ্লোভাকিয়ার এমিল জেটোপেক, ঠিক চল্লিশ বছর আগে। এখন তুমি এটা করলে। নিজেকে এখন তোমার কেমন লাগছে? আমার উত্তর, শুনে খুবই ভালো লাগছে। তবে বেশি প্রশংসা করবেন না, হেল্টাথলনে যে মেয়েটি সোনা জিতল তারই বেশি প্রশংসা প্রাপ্য। সে দৌড়, ছোঁড়া, লাফানো কতরকমের বিষয়ে অংশ নিয়েছে, আর আমি? শুধু দৌড়েছি মাত্র। …কেমন লাগছে? আমার শৈশবে মারা যাওয়া মায়ের ছবির দিকে তাকালে যেমন লাগে সেইরকম এখন লাগছে।’

দারুণ! রাহুল মনে মনে তারিফ জানাল। মিডিয়া এই দিকটা লুফে নেবে।

‘আর একটা?—মিস সরকার আপনি যে এত কঠোর ট্রেনিং করে গেছেন, এটা কী আত্মত্যাগ নয়? উত্তর : আত্মত্যাগ? ছেলেদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি না করাটাই কী আত্মত্যাগ? সে জন্য তো দিনের শেষে কয়েক ঘণ্টা সময় তো হাতে থাকেই, সন্ধের পর তো আর মাঠে বা রাস্তায় দৌড়ানো যায় না কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে অন্যান্য কাজ তো করা যায়।…এই শুনে নিশ্চয় সবাই হেসে উঠবে।’

‘আমারই হাসি পাচ্ছে এখন।’ রাহুল মুচকি হেসে সোনালির মুখভাব লক্ষ করল। কি যেন একটা কামনার ছায়া ওর মুখে বিষণ্ণতা ছড়িয়ে ভেসে চেলে গেল।

‘কিন্তু আপনারা যা ভাবছেন তাতে আমার আপাতত কোনো আগ্রহ নেই। সন্ধ্যার পর আমার সময় কাটে বই পড়ে, গান শুনে।’ আর একটা প্রশ্ন : মিস সরকার একটা কি সত্যি যে ভিলেজে অন্যান্য ভারতীয় মেয়েদের থেকে আপনি একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলেন? উত্তর : ‘সোনালি বলুন আমি কিছু মনে করব না। হ্যাঁ, কথাটা অনেকটা সত্যি। দেখুন ওরা তো বহুদিন ধরে নানান জায়গায় ট্র্যাক মিটগুলোয় নামছে, পরস্পরকে খুব ভালোই চেনে। আমি একেবারেই নতুন, মাত্র দু—মাস আগে প্রথমবার একটা রেসে নামি। সুতরাং মেয়েদের কাছে আমি অপরিচিতই। আর আমাদের স্বভাব নয় গায়ে পড়ে বন্ধুত্ব করা।’ আর একটা প্রশ্ন : ‘সোনালি তোমার কি কোনো সংস্কার আছে বা দৈবে বিশ্বাস করো? যেমন বিশেষ কোনো জুতো জামা বা ম্যাসকট?’

আহ? মাল বিক্রির কী দারুণ সুযোগ! রাহল মনে মনে উত্তরটাও বানাল: হ্যাঁ আছে। আমার কাস্টম—মেড অ্যাডিডাস জুতো আর নাইকে মোজা।

‘আমার উত্তর: না কোনো সংস্কার নেই। তবে এখন থেকে এই মেডেল দুটোই আমার তাবিজ।’

খুব বেশি ভেবেচিন্তে সোনালিকে উত্তর দিতে হচ্ছে না, আগে থেকেই এগুলো তাকে মুখস্থ করানোর জন্য। কিন্তু যেভাবে কথা বলছে তাতে একধরনের স্বতঃস্ফূর্ততা ফুটে বেরিয়েছে। চমৎকার অভিনেত্রী! রাহুলের মনে হল, প্রেস কনফারেন্স মাতিয়ে দেবার মতো ক্ষমতা ওর আছে। হয়তো মাসের পর মাস রগড়ানিরই ফল এটা। এবার আমি যদি একটা দুটো প্রশ্ন করি যেটা সম্পর্কে ওকে তৈরি করে রাখা হয়নি।

সোনালি তাকিয়ে রয়েছে রাহুলের মুখের দিকে। মুখভাব থেকেই আঁচ করে নিয়ে বলল, ‘আপনি বোধহয় কিছু প্রশ্ন করবেন। করুন। বাবা বলে দিয়েছেন উত্তর দেবার জন্য।’

‘আচ্ছা সোনালি তুমি তো এখন নামী, সফল। তুমি কি দৌড়ে আর নামবে না যেসব কমার্শিয়াল সুযোগ এখন তোমার সামনে খুলে গেছে সেগুলোর ফায়দা তুলবে?’ রাহুল নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করল জবাব শোনার জন্য।

‘ওই জিনিসগুলো কী শুধুই বিশেষ কয়েকজনের জন্য? দৌড়ব তো বটেই। কমার্স সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুবই কম। জ্ঞান বলতে যদি ব্যবসাবাণিজ্য সংক্রান্ত কাগজ, ম্যাগাজিন পড়াকে বোঝায় তাহলে আমি একটা গবেট। ওহহ মি. অরোরা, আপনি কোন কমার্স কাগজের লোক?’

রাহুল হেসে ফেলল। জনসংযোগের ব্যাপারে সোনালির সোনার মেডেল পাওয়ার যোগ্যতা আছে।

‘আচ্ছা সোনালি আপনি কি কখনো পুরুষদের সঙ্গে রেসে নেমেছেন?’

‘এই সাতটা দিনই, ক্যামেরা হাতে ধরা পুরুষদের সঙ্গে তো নামতেই হল। কী তাড়া যে আমি খেয়েছি, একমাসের ট্রেনিংয়ের সমান প্রায়। তবে আপনার প্রশ্নে জবাবে বলছি, এখনও পর্যন্ত পুরুষদের বিরুদ্ধে দৌড়ইনি।

‘আপনি কি সম্পূর্ণ রমণী বলে নিজেকে মনে করেন?’ রাহুল ভালোমানুষের মতো মুখ করে জানতে চাইল।

সোনালির ভ্রূ কোঁচকাল। চোখটা নামিয়ে চট করে নিজের শরীরের উপর দিয়ে চাহনি বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘এখানে আপনাদের সামনে এসে এতক্ষণ ধরে এত কথা বললাম, তার মধ্যে কিন্তু আমার মনে হয়নি এ সম্পর্কে কারুর মনে কোনোরকম সন্দেহ জাগতে পারে।’

কথাটা বলে সোনালি দু—হাত তুলে চুলের গোড়া বেঁধে রাখা ফিতের গেরোটা খোলার জন্য টানাটানি শুরু করল। বোতাম খোলা জামা সরে গিয়ে তার স্তনের ওপরের অংশ ও তাদের মধ্যের উপত্যকা রাহুলের দৃষ্টির সামনে বেরিয়ে এল। গেরো খোলার চেষ্টায় যে আন্দোলন তার দুই বাহু বেয়ে বুকে নেমে এল তাতে সামনে বসা পুরুষটি পুলক বোধ করল। রাহুলের মনে হল এটা বোধহয় শিখিয়ে পড়িয়ে রাখা জিনিসগুলোর মধ্যে নেই, সোনালির নিজেরই ব্যাপার, নিজস্ব সংযোজন।

‘সোনালি আজকের সন্ধ্যাটা কীভাবে কাটাবেন ভেবেছেন কি?’

একটু সন্ত্রস্ত ভাব সোনালির মধ্যে দেখা গেল। সে ঠোঁট কামড়ে কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল। ধীরে ধীরে চোখে ফুটে উঠল অসহায়তা। তারপই হেসে ফেলল।

‘এটা কি প্রেস কনফারেন্সের প্রশ্ন?’

‘না। আমার প্রশ্ন।’

‘জানি না। সন্ধ্যা আমি একাই কাটাই।’

কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। এক মহিলা কণ্ঠের কথা ভেসে এল, ‘কী মুশকিলে পড়লাম। মিস্ত্রি আসতে পারবে না। সেটা দোকানে দিয়ে আসতে হবে। এখন আমি দিয়ে আসি কী করে?’

‘পিসি।’ সোনালি বলল।

সুরুচি ঘরে ঢুকে রাহুলকে দেখে জিজ্ঞাসু চোখে সোনালির দিকে তাকালেন।

‘আজ আসবেন বলে বাবা যার কথা বলে গেছলেন।’

‘ওহ।’ সুরুচি নমস্কার করলেন। ‘দাদা তো সকালে বর্ধমান চলে গেলেন।’

‘আমায় উনি বলেছিলেন সে কথা। …আপনার টিভি সেট কি দোকানে দিয়ে আসতে হবে।’

‘ওদের দু—জন মেকানিকের মধ্যে একজন অ্যাবসেন্ট, আর একজন সার্ভিসে বেরিয়েছে। আউটডোরে যাবার মতো কেউ নেই। বলল, নিয়ে আসুন। অতবড়ো একটা ভারী জিনিস আমি নিয়ে যাই কী করে?’

‘আমার গাড়ি রয়েছে, যদি আপত্তি না করেন তো আমি পৌঁছে দিচ্ছি।’

‘আপনি!’

‘বাঃ প্রবলেম সলভড!’ সোনালি লাফ দিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। ‘তাহলে আমিও যাব।’

‘তুমি যাবে?’ সুরুচি ইতস্তত করলেন। ‘দাদা বলেছিলেন বাড়ি থেকে না বেরোতে।’

‘আমি গাড়িতেই বসে থাকব। কেউ আমাকে চিনতেও পারবে না। আরে আমি এখানে গোল্ড জিতিনি, এটা তো একটা অল ইন্ডিয়া রেস মাত্র! আমার অটোগ্রাফের জন্য একজনও এখন এগিয়ে আসবে না।’

‘আচ্ছা চলো, কিন্তু এই ড্রেসে নয়!’

‘পিসি, শাড়ি পরব।’

‘না, দাদার বারণ।’

‘জানতে তো পারবে না। জানেন মি. অরোরা, বাবা আমাকে কখনো শাড়ি পরতে দেননি। শাড়িতে নাকি স্ট্রাইড খারাপ হয়ে যায়। ইন্ডিয়ান মেয়েরা লম্বা করে পা ফেলতে পারে না নাকি শাড়ির জন্য। কিন্তু আমার যা ইচ্ছে করে। আমার একটাও শাড়ি নেই।’

‘সোনা যা বলছি শোন।’ সুরুচির গলা কঠিন হল। ‘যাও ট্রাউজার্স পরে এসো।’

শোবার ঘর যেত এত অনাড়ম্বর হতে পারে রাহুলের তা ধারণায় ছিল না। একটি ডাবল ইংলিশ খাট আর একটি স্টিল আলমারি। দুটি দেওয়াল তাক তাতে দুটি পর্দা ঝুলছে। বড়ো ঘরের একদিকে টিভি স্ট্যান্ডে একটি ছ—সাত বছর আগের মডেলের সেট। প্রায় একটা সুটকেসের মতো আকারে।

রাহুল দু—হাতে সেটটা তুলেই নামিয়ে রাখল। বেশ ভারী। তবে নীচে একতলা পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যেতে তার অসুবিধে হবে না।

‘সরুন।’ সোনালি কাঁধ দিয়ে রাহুলকে মৃদু ঠেলে দিয়ে সরিয়ে দু—হাতে তুলে নিল সেটটা। ‘চলুন।’

যেন হালকা একটা মুড়ির ধামা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এমন সহজভাবে সোনালি একতলায় নেমে রাস্তা পর্যন্ত এল। রাহুল দরজা খুলে সেটটা ভিতরে তোলায় সাহায্য করল।

টিভি সার্ভিসিংয়ের দোকানে পৌঁছতে মিনিট চার—পাঁচ লাগল। তোলার মতো নামানোর কাজটাও করল সোনালি। দোকানের মালিক সেটটা পিছনের ঘরে নিয়ে গেল। একটিমাত্র স্টিলের চেয়ার দেয়াল ঘেঁষে। সুরুচিকে বসার জন্য রাহুল অনুরোধ করল।

‘ঘণ্টাখানেক তো লাগবে। আপনি বসুন, আমরা গাড়িতে গিয়ে বসছি। কিছু কথাবার্তা আছে সেটা সেরে নিই।’

সুরুচি চেয়ারে বসলেন। তার আগে জেনে নিলেন, ‘সেটটা বাড়িতে আবার পৌঁছে দেবেন কি?’

‘নিশ্চয় দেব।’ রাহুল একঘণ্টা সোনালির সঙ্গে কাটাবার সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নয়। তারা দু—জনে গাড়িতে এসে বসল। গাড়ি থেকে সুরুচিকে দেখা যাচ্ছে না।

‘ছ—টা প্রায় বাজে, এই সময়টায় তুমি করো কী?’

‘এখনও তো সূর্যের আলো রয়েছে, দৌড়ই।’

‘এই সময় মেয়েরা বেড়ায়, ওই দ্যাখো তিনটে মেয়েকে।’ রাহুল আঙুল দিয়ে দেখাল। সোনালি একবার মুখ ফিরিয়ে দেখল মাত্র।

‘ওরা কেউ অলিম্পিকস সোনা জিতবে বলে ট্রেনিং করে না।’

রাহুল চুপ করে রইল কিছুক্ষণ।

‘তোমার বাবা, মানে পালিত বাবা, চান অলিম্পিকসের পর আমি তোমার এজেন্ট হই। যখন ওকে প্রথম দেখি তখন ধরে নিই লোকটার মাথায় ছিট আছে, মনে মনে ঠিক করে ফেলি এই প্রোজেক্টের ছায়া মাড়াব না। কিন্তু যতই তুচ্ছভাবে ব্যাপারটা নিই না কেন মনের কোণে একটা লোভ তো আছে! আমি একজন ব্যবসায়ী, কিছুটা প্রতিষ্ঠিতও। ভাবতে আমার ভালোই লাগে যে আমি এগোচ্ছি। এই ভাবটা যেদিন ভাবতে পারব না সেদিনও আমার রিটায়ার করার সময় হয়েছে ধরে নেব। মনের কোণে স্বার্থসিদ্ধির ইচ্ছাটা আমায় বলল, তুমি দাঁও মারতে পার, স্বর্ণকুমারী প্রোজেক্টের কমিশন তোমার নেওয়া উচিত। এখন যদি ওরা আমাকে বলে, মশাই কি ঠিক করলেন? আমি বলব, হ্যাঁ। আমি একটা চান্স নেব। তবে এটা এখনো কিন্তু চান্সই। তুমি যে মেডেলটা জিতবে বলে আশা করছ সেটা অন্য কেউ জিতে নিতে পারে। সে জন্যও কিন্তু আমি চান্স বলছি না। আমার কাজটা খুব একটা সুন্দর ব্যাপার নয়। আমার কারাবার মানুষ নিয়ে। সফল, নামি, চ্যাম্পিয়ান এইসব হল আমার খদ্দের। বড়ো বড়ো মালটিন্যাশনালস আর কর্পোরেশনকে অফার দিই এদের পাবার জন্য দর দিন। আমার খদ্দেররা সিন্দুক ভরায় টাকায় আর আমি তার একট অংশ নিই। ব্যবস্থাটা ভালোই, অনেকের কাছে তো খুবই ভালো।’

‘ইমদাদ আলি?’

‘হ্যাঁ। চমৎকার লোক। মেয়েরা ওকে ভীষণ পছন্দ করে আর ও সেটা মনপ্রাণ দিয়ে চায়। ওর সবকিছু গেঁথে আছে একটা জিনিসেই—প্রশংসায়, তারিফে। টাকা, মেয়েমানুষ, দেশে দেশে ঘোরা এসব ওর ভালো লাগে কিন্তু তখনই চনমন করে ওঠে যখন আসরে বসে। কিন্তু অ আরও পাঁচটা বছর যাক, যখন ওর চেহারার জলুস কমবে, গলা নষ্ট হবে তখন লোকটার মধ্যে প্রাণ বলে আর কিছু থাকবে না। তখন প্রকৃত অর্থেই, অল্পবয়সি উঠতি গাইয়েদের সঙ্গে দাপট দেখাতে গিয়ে ও নিজেকে মেরে ফেলবে, অনেকেই মরেছে। আর যদি বেঁচে থাকে তাহলে জীর্ণ, শূন্য জীবন নিয়ে, হালকা চটুল গানে সফল হবার চেষ্টা করতে করতে বেঁচে থাকবে। এটা ইমদাদ জানে, এই নিয়ে আমি ওর সঙ্গে কথাও বলেছি। অন্য ধরনের কিছু করাটা ওর প্রকৃতিতেই নেই। আমার ধারণা ও আর বছর দশেক বাঁচবে। কিন্তু তাই নিয়ে আমার বিবেক মোটেই বিচলিত হচ্ছে না। শুনে আমার সম্পর্কে কী মনে হচ্ছে সোনালি? লোকটা নিষ্ঠুর, শয়তান?’

সোনালি মুখ নামিয়ে একটু ভাবল। ‘আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি।’ থম হয়ে যাওয়া চাহনি তুলে তারপর বলল, ‘আপনি কী বলতে চান আমরাও ওইরকম হবে?’

‘বলতে চাই আমি একটা অর্থলোলুপ পিশাচ। যাতে ভাঙিয়ে টাকা রোজগার করতে পারব মনে করব, তাকে ঠেলতে ঠেলতে ধ্বংসের কিনারা পর্যন্ত নিয়ে যাব।’

‘কিন্তু তাদের কতদূর কী সম্ভাবনা সেটা আপনি প্রথমে তাদের জানিয়ে দেন নিশ্চয়।’

‘আমার মনের শান্তির জন্য সেটা করি বটে, বিবেককে চোখ ঠারা আর কী!’

সোনালি রাস্তায় লোক চলাচল দেখতে লাগল। চোখে আনমনা চাহনি। অন্যমনস্ক ভাবেই কপালে নামা চুলগুলো তুলে দিতে দিতে বলল, ‘থামলেন কেন। আমার ভাগ্যে তাহলে কী আছে সেটা বলুন।’

‘ওটাতেই গোলমাল।’

‘আহহ বলুন।’

‘ইমদাদ আলিকে আমি বুঝি, কিন্তু সোনালি সরকারকে নয়।’

‘কেন বোঝেন না? আমি সাধারণ একটা বাঙালি মেয়ে যে দুটো সোনার মেডেল জিততে চায়।’

‘কেন?’

‘কী বলতে চান?’

‘খুব মামুলি একটা কথা দিয়েই জিজ্ঞাসা করছি, সোনালি কীসের তাড়নায় তুমি জিততে চাইছ?’

ভ্রূ কোঁচকাল সোনালি। যেন হদিশ করতে পারছে না প্রশ্নের উদ্দেশ্যটাকে। ‘এটা কি খুবই দরকারি জানার জন্য?’

‘এই বিকেলে আমার কাছে দরকারি।’

‘তাহলে আর একটা মামুলি কথা দিয়েই উত্তর দিই। এটাই আমার জীবনের ধরন।’

রাহুল লক্ষ্য করল সোনালি অন্যমনস্ক হয়ে তার শার্টের গলার কাছে একটা আলগা সুতো ছেঁড়ার চেষ্টা করছে। রাহুলের মনে হল, সে আবার আটকে গেল। সোনালি মন খুলে কথা বলতে তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু ওর ভিতরে যে পাঁচিল গাঁথা হয়ে গেছে সেটা এত উঁচু, এত শক্ত যে ওর পক্ষে সেটা ডিঙোন বা ভাঙা সম্ভব হল না। ‘চল কোথায় গিয়ে চা খাই, পিসি কি আপত্তি করবেন?’

‘জানি না, তবে আমি চা খাই না।’

‘সত্যিই খাও না নাকি আমার সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বলছ?’

‘আপনি খুব খোলাখুলি, রাখঢাক না করে আমার সঙ্গে কথা বলছেন বলে আপনাকে আমার ভালোই লাগছে। আগে কেউ কখনো আমায় বলেনি যে টাকার জন্যেই তারা এর মধ্যে জড়িয়েছে, এর মধ্যে মানে আমাকে সোনা জেতাবার প্রেজেক্টের মধ্যে। সবসময়ই শুনে আসছি, আমার ট্যালেন্টকে চিনিয়ে দিতে বা আমার সম্ভাবনাকে পূর্ণতা দিতে বা ভারতের জন্য সোনা এনে দিতে ওরা এটা করছে। আপনি হাসছেন! বিজয়দা কিন্তু এটাই আমাকে অবিরত বলে যাচ্ছেন।’

‘দেশের জন্য কিছু করছি ভাবাটা খুবই জোরালো প্রেরণা। নিজের জন্য যত জোরে দৌড়বে তার থেকেও বেশি জোরে দৌড়বে ভারতের জন্য। স্পোর্টসে এটা খুবই পুরনো একটা আপ্ত বাক্য: তুমি আরও ভালো করবে যদি কোনোকিছুর প্রতিনিধিত্ব কর—কলেজ, ক্লাব বা পাড়ার। বার্সিলোনার জন্য তুমি নিঃসঙ্গ হয়ে তৈরি হয়েছ। এখন অলিম্পিকস এসে পড়েছে এখন বিজয়দা তোমাকে তেরঙ্গা ঝান্ডা দেখাবে।’

সোনালি মন দিয়ে কথা শুনছে। ওর চোখ—মুখই বলে দিচ্ছে এই ধরনের কথাবার্তার সঙ্গে ওর পরিচয় নেই।

‘আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানার আছে। এখন যে কথাগুলো বললেন, এইসব কথা আমার বোঝা দরকার।’

রাহুল গাড়িতে স্টার্ট দিল। সোনালি অবাক হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছে, তার আগেই রাহুল বলল, ‘এভাবে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। একটু ঘুরি। টিভি সেটটা ভালো হয়ে ওঠার আগেই ফিরে আসব।’

ধীরে চালিয়ে সে জগদীশ বোস রোড ধরে দক্ষিণে গিয়ে বেকবাগান মোড়ের থেকে পশ্চিমে বেঁকে তারপর আবার দক্ষিণে শরৎ বসু রোড ধরল।

‘কেন বার্সিলোনায় জিততে চাই, আপনার এই প্রশ্নটার উত্তর আমি দেব। পরিষ্কার জানাচ্ছি, আমি জিততে চাই। এটা ডা. সরকার বা বিজয় সিনহা বলছে না, আমি বলছি।’

‘স্বর্ণকুমারীও বলছে না?’ রাহুল প্রশ্ন তুলল।

‘ঠিকই, স্বর্ণকুমারীও নয়। আলি, আমি আলি মায়াকাং দুটো সোনার মেডেল জিততে চাই। কেন চাই বলতে গেলে আমাকে কীভাবে মানুষ করা হয় সেটাও বলা দরকার। এ সম্পর্কে ডা. সরকার কিছু কি আপনাকে বলেছেন?’

‘খুব কিছু নয়। তোমাকে বাড়িতে পড়ান হয়েছে।’

‘টিউটর ছিল। কলেজে পড়ার মতো না হলেও মোটামুটি জ্ঞান আছে। শরীরের দিকে কী ধরনের নজর দেওয়া হয়েছিল সেটা তো তখন বাড়িতেই বললাম। ওরা যদি আমার শরীরের দিকে নজর না দিতেন তা হলে আমি চ্যাম্পিয়ন হতেই পারতাম না। আমার কার্ডিয়োভাসকুলার সিস্টেম অত্যড়ত ভালো।’

‘পিসির সঙ্গে তুমি দু—তিন বছর আগেও থাকতে।’

‘হ্যাঁ। ভালো মন, নরম ধরনের। স্কুল মিসট্রেস, শাসন, ডিসিপ্লিন এইসব ব্যাপার ভালোবাসেন। আমাকে অ্যাথলিট হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে কখনো মাথা ঘামননি। বাবা আমাকে বর্ধমানে নিয়ে গেলেন ওখানে নতুন হসপিটালে চাকরি পেয়ে। তখনই পুরোপুরি আমার দিকে নজর দিলেন। আর উনি অত্যন্ত জেদি প্রকৃতির মানুষ। কয়েকজনের কাছ থেকে প্রোজেক্টের জন্য টাকা পেয়ে ট্রেনিং ক্যাম্প করলেন, সারান্ডার নির্জন জঙ্গলের পথে দৌড়োবার জন্য চক্রধরপুরের কাছে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়। মেডিক্যাল টেস্টের, ফিজিওথেরাপির যন্ত্রপাতি সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি আর বিজয়দা বছরের কয়েকটা মাস ওখানে কাটাই, তখন বাবাও সপ্তাহে একদিন যেতেন আমার শরীরের, ট্রেনিংয়ের প্রগ্রেস পরীক্ষা করতে। নিঃসঙ্গ, নির্জনে কী অবস্থায় যে দিন আর রাত কাটিয়েছি। ঘাম ঝরান, রক্ত ঝরান আমার ক্ষেত্রে খুব হাস্যকর ছেঁদোকথা। ট্রেনিং শেষে এক একদিন বিজয়দা কোলে করে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছেন। হেঁটে আসার ক্ষমতা থাকত না। তিনি যা ট্রেনিং শিডিউল করে দিতেন তার এক মিলিমিটার কম কাজ হলে বেত দিয়ে মেরেছেন। ওলিম্পিকে জেতার জন্য এসবও আমি মানতে রাজি। মি. অরোরা আমি জানি আমি বার্সিলোনায় জিততে পারি। সেটা নিশ্চিত করার জন্য যদি কঠিন ট্রেনিং না করি তাহলে সেটা বিশ্বাসঘাতকতাই হবে, নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। বুঝতে পারছেন, আমার কাছে এখন পর্যন্ত জীবনের অর্থ, বেঁচে থাকার মানে সবকিছুই নির্ভর করছে জেতার উপর। এখন যদি সব ছেড়েছুড়ে বিয়ে করে সংসারে বসে যাই—একবার তা ভেবেও ছিলাম—তাহলে এতগুলো বছর শুধুই নষ্ট করেছি বলা ছাড়া আর কিছু কি বলা যাবে? কিন্তু আমি তা চাই না। আমি আমার সোনা দুটো চাই, আমার জীবনকে কিছু একটা দিতে চাই যাতে মনে হবে এখনো আমি বেঁচে আছি। তারপর একদিন ফুলস্টপ দিয়ে দেব।’ গাড়ির উইন্ডশীল্ডের কাচে তর্জনীর ডগ্য চেপে ধরল এবং ঘষতে ঘষতে বলল, ‘তারপর খুঁজে দেখতে থাকব আসলে আমি কে?’

‘একটা পর্যায় পর্যন্ত এটা ঠিকই আছে।’ রাহুল সামনের রাস্তা থেকে পাশের দোকানগুলোর দিকে নজর ফেরাল।

‘আমি জানি আপনি কী বলবেন। বলবেন ফুলস্টপ দেওয়া সম্ভব হবে না, তাই তো? বার্সিলোনার পর আমি স্বর্ণকুমারী হয়ে যাব। তখন আর আমি কে, এই খোঁজের সময় আর থাকবে না।’

‘তুমি কি স্বর্ণকুমারী হতে চাও?’

সোনালি মুখ ঘুরিয়ে জানলার বাইরে তাকাল। ভাবছে।

‘এটা হওয়া কি খুবই দরকারি?’ রাহুল মৃদু স্বরে চাপ দিল উত্তর পাবার জন্য।

হঠাৎ তারদিকে ঘুরে বসে সোনালি ব্যাকুল চোখে তাকল। ‘আমি চাই, স্বীকার করছি আমার দরকার।’

‘সব মেয়েই চাইবে।’

‘কিন্তু তারা সবাই এটা জানে তারা কে, কোথা থেকে তারা আসছে। এটা গোড়ার ব্যাপার, এখান থেকে তাদের শুরু হয়। আমার মনেই হয় না এটা আমার আছে।’

‘ডা. সরকারকে বলেছ?’

‘ওর কথা হল, তুমি হচ্ছ স্বর্ণকুমারী। এটা যখন মেনে নেবে তখন আর তোমার কোনো উদবেগ থাকবে না।’

রাহুল গাড়ি থামাল। নেমে গিয়ে সামনের স্টেশনারি দোকান থেকে চারটে চকোলেট বার কিনে এনে সোনালির কোলের উপর ছুড়ে দিল।

‘এসব কিন্তু খাওয়া—’ প্রতিবাদ করে উঠল সোনালি। রাহুল তাকে থামিয়ে দিল দুহাত তুলে।

‘এবার ফিরব। তার মধ্যেই ওগুলো কপাকপ শেষ করে ফেলা চাই। মাঝে মাঝে না ভাঙলে বিধিনিষেধগুলো ঠিকমতো মানছ কিনা বুঝবে কী করে!’

সোনালির মুখে হাসি ফুটল। মোড়ক ছিঁড়ে চকোলেট বার করে ভেঙে আধখানা এগিয়ে ধরল। ‘বিধিভাঙা শেখাবার জন্য এটা আপনার প্রাপ্য কমিশন।’

‘কমিশন আমি কখনো ছাড়ি না।’ চকোলেট হাতে নিয়ে রাহুল বলল, ‘তুমি কথা বলা শিখলে কার কাছে?

‘টেপ করা কয়েকশো প্রশ্ন আর তার উত্তর আমাকে সপ্তাহে দু—দিন শুনতে হয়েছে। জেতার পর বার্সিলোনায় আমাকে প্রেসের লোকেদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না। তাও আমাকে তৈরি করান হয়েছে।’

‘তোমার শাড়ি পরতে ইচ্ছে করে?’

‘ভীষণ। কিন্তু পরা বারণ। পা ফেলায় একটা বদ অভ্যাস নাকি হয়ে যাবে।’

‘কাল ম্যারাথন দৌড়েছ এখন তো তোমার বিছানায় শুয়ে থাকার কথা। পায়ে ব্যথা হয়নি?’

‘হয়েছে। এখনও কিরকম ভারী হয়ে রয়েছে। এই রকম আড়ষ্টতা হয় লং ডিস্ট্যান্স ট্রেনিংয়ের পর।’

রাহুল মুখ ফিরিয়ে সোনালির মুখটা দেখে নিয়ে এবার গাড়ির গতি বাড়াল। অন্ধকার নেমে গেছে। রাস্তায় দোকানে আলো জ্বলে গেছে। সুরুচি তাদের দেখতে না পেলে কিছু ভাবতে পারে। রাহুলের বরয়সও সুদর্শনত্বকে অভিভাবকরা দুশ্চিন্তার কারণ মনে করলে, খুব ভুল তারা করেন না।

ঠিক সময়েই মারুতি পৌঁছল। সুইচটা বদলানো ছাড়া আর কিছু করতে হয়নি। সুরুচি কিছু বলার আগেই রাহুল বলল, ‘আমার এক বোন এখানেই থাকে, বেকবাগানে, সোনালিকে দেখতে নিয়ে গেছলাম। বোন তো দেখে বিশ্বাসই করতে পারছিল না এমন একজন নামী লোক তাঁর বাড়িতে এসেছে।’

‘কিন্তু দাদার বারণ ছিল কারুর সামনে…’

‘না না সেরকম হইচই ওখানে হয়নি।’ রাহুল লক্ষ করল সোনালির মুঠোয় তখনও ধরা দুটো চকোলেট বার, সন্তর্পণে জিনসের পকেটে সে ঢুকিয়ে দিল।

টিভি সেট নিয়ে ওরা ফিরে এল। রাহুলই দুহাতে ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে তুলল দোতলায়। ঘরে বসিয়ে দিয়ে সে বলল, ‘এবার চলি, খুব ভালোই কথা হল। ডা. সরকারের সঙ্গে এবার কথা বলব।’

ছয়

‘তোমার একটা কল এসেছিল বর্ধমান থেকে।’

রাহুল ফেরামাত্র অর্জুন তাকে জানাল।

‘কল? দিল্লির? কিন্তু আমি তো বলেছিলাম কোনো কাজের কথা—’

‘কাজেই কথাই তবে তোমার অফিস থেকে নয়। বর্ধমান থেকে ডা. সরকারের। কাল সকালে আমার এখানে কনসরটিয়ামের মিটিং, নটায়, তুমি অবশ্যই থাকবে।’

‘কীজন্য, কিছু বলেছেন?’

‘হ্যাঁ। স্বর্ণকুমারীর কমার্শিয়াল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আলোচনা। সব মেম্বারের সামনেই সেটা হবে।’

‘ভালো। আমি এখন একটু ঘুমোব।’

‘এই সন্ধেবেলায়?’

‘হ্যাঁ। কেন জানি হঠাৎই টায়ার্ড লাগছে।’

রাহুল তার ঘরের দিকে চলে গেল। এখন সে ভাবতে চায়। এই প্রোজেক্টেরই কথা নয়, সোনালির ভবিষ্যতের কথাও। তার দুঃখ হচ্ছে মেয়েটির জন্য।

রাহুল কাঁটায় কাঁটায় ন—টায় অর্জুনের বাড়ির একতলায় মিটিং রুমে ঢুকল। ছোটো ঘর। একটা লম্বা টেবল। দুধারে আটজন বসার জন্য আটটা গদি আটা চেয়ার। টেবলের মাথায় একটি। সেখানে এখন বসে আছেন ডা. সরকার। হীরাভাইকে সে চিনল কিন্তু অন্য দুজন তারা অপরিচিত।

ডা. সরকার হাত বাড়িয়ে একটা চেয়ার দেখিয়ে তাকে বসতে বললেন। সবাই তার দিকে তাকিয়ে। অর্জুনের পাশের চেয়ারে সে বসল।

‘মি. অরোরার সঙ্গে আমাদের দু—জন মেম্বারের পরিচয় এখনও হয়নি। আমার ডানদিকে রয়েছেন সুরজ সিং, ধানবাদে থাকেন, কয়লা আর ট্রাকের ব্যাবসা’ রাহুল মাথা ঝোঁকাল। সুরজ সিং বিশাল গোলাকার মুখ থেকে একটা শব্দ বার করল। বোধহয় নমস্কার বলল। ‘আর আমার বাঁ দিকে রয়েছেন প্রণব দত্ত। কলকাতাতেই থাকেন। জমির স্পেকুলেশন, ডেভেলপমেন্ট, অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং তৈরি এইসবের ব্যাবসা।’ রাহুল এবারও মাথা ঝোঁকাল। প্রণব দত্ত ডান হাতের দুটো আঙুল নাকের কাছে তুলল। ‘আর মি. অরোরার পরিচয় এখানে যারা রয়েছেন সবাই জানেন।’

সারদাচরণ সবার মুখের উপর চোখ বুলিয়ে আবার শুরু করলেন, ‘আজ সময় খুব কম। প্রণববাবু এগারোটার ফ্লাইটে বাঙ্গালোর যাবেন, সুরজবাবুও পাটনা যাবেন তার একটু পরেই, তাই যা সিদ্ধান্ত নেবার দ্রুতই নিতে হবে। আপনারা জানেন, মি. অরোরাকে এখানে আসতে বলেছি আমাদের প্ল্যান সম্পর্কে তাকে ওয়াকিবহাল করার জন্য। উদ্দেশ্যটা হল বার্সিলোনায় স্বর্ণকুমারীর জেতার পর তার হয়ে কমার্শিয়াল যা করণীয় তাই করার জন্য। মি. অরোরা, আপনি মোটামুটিভাবে এই প্রোজেক্ট সম্পর্কে একটা ধারণা ইতিমধ্যে পেয়ে গেছেন। ধরে নিতে পারি আপনার এজেন্সি এর সঙ্গে যোগ দেবে কি না সে সম্পর্কে আপনি একটা সিদ্ধান্তে এসেছেন।’

‘আপনি কি থাকবেন?’ হীরাভাই বলল।

‘প্রথমে কয়েকটা ব্যাপারে একটু পরিষ্কার হতে চাই।’ রাহুল টেবলে দুই কনুই রাখল। ‘সোনালি সরকারের এজেন্ট হিসেবে আপনারা রাহুল অরোরা অ্যাসোসিয়েকটসকে অর্থাৎ র‌্যা—কে একমাত্র স্বত্ব দিতে চেয়েছেন, যে সব কমার্শিয়াল গ্রুপ তার নাম, ছবি, পার্সোনাল এনডোর্সমেন্টে আগ্রহী তাদের সঙ্গে চুক্তি করার জন্য। রেডিয়ো, টিভি, ফিল্ম, থিয়েটার, বই, ম্যাগাজিন, খবরের কাগজ—সবেরই একমাত্র স্বত্ব। কিন্তু আমার এজেন্সির সুনাম রক্ষা করার কথাও আমাকে ভাবতে হবে। বড়ো বড়ো ব্যাবসা র‌্যা—কে বেশি গণ্য করে অন্যান্য এজেন্সির থেকে তার কারণ আমাদের লিস্টে শতকরা একশোভাগ নির্ভরযোগ্য লোককে আমরা রেখেছি। কোনো ব্যবসাদারের ব্রান্ড ইমেজ রাতারাতি ধ্বংস করে এমন একজন কাউকেও আমরা নিই না। বুঝতেই পারছেন খারাপ ধরনের কিছু যদি লোকে জানতে পারে—আমি এটা হবেই যে তা বলছি না—তাহলে আমার এজেন্সি স্বর্ণকুমারীর ব্যাপারে একেবারেই হাত ধুয়ে ফেলবে।’

‘আপনি কী বলতে চান?’ সুরজ সিং বলল।

‘রক্ষাকবচ বলতে যা বোঝায়, তাই। ধরুন আপনাদের মধ্যে কেউ সতীপ্রথার পক্ষে আন্দোলনে যোগ দিলেন, আর ঠিক করলেন আপনার যুক্তির পক্ষে তার মুখ দিয়ে দু—চার কথা বলবেন। যে মুহূর্তে সে এই ব্যাপারে মুখ থেকে কথা খসাবে সেই মুহূর্তেই কমার্শিয়াল দিক থেকে সে খতম হবে।’

‘না, না, আমরা সতীপ্রথার বিরুদ্ধেই।’ হীরাভাই কথাটা বলে সুরজ সিংয়ের দিকে পানমশালার কৌটো এগিয়ে দিল।

‘স্বর্ণকুমারীর চরিত্র হতে হবে দৃষ্টান্তযোগ্য এবং বিতর্কের বাইরে, এটাই আমরা ধরে নিচ্ছি।’ সারদাচরণ বললেন। ‘তাহলে আপনাদের কারুরই এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই বলেই মনে হচ্ছে। মি. অরোরা এ ক্ষেত্রে কী আমরা—’

‘এখনও বাকি আছে। প্রোমোশনাল ক্যাম্পেনের সময়টা ঠিক করার কথাটা এখনও বাকি। অলিম্পিকের ঠিক পরেই, সব থেকে সুবিধাজনক সময়ে, যখন পাবলিক ইন্টারেস্ট একেবারে তুঙ্গে আপনারা চান ঠিক সেই সময়ে ধাক্কা দেবার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা তৈরি করে রাখতে। তা করতে হলে খুঁটিনাটি যাবতীয় কথাবার্তা অলিম্পিকসের আগেই চালাতে হবে। স্বর্ণকুমারীর সাফল্যের উপরই শর্ত সাপেক্ষে চুক্তিগুলো হবে কিন্তু গেমসের আগেই ব্যবসার কর্তাদের সঙ্গে অবশ্যই কথা বলা শুরু করতে হবে। কিন্তু তারপর ওর দুটো লং ডিস্টান্স সোনা জেতার স্বপ্ন কিন্তু আর গোপনে রাখা সম্ভব হবে না।’

‘এটাও আমরা মেনে নিচ্ছি ম্যারাথনে তো ধরেই নেওয়া যায় ও নির্বাচিত হয়ে গেছে। দশ হাজার মিটারেও হলে, তখনই তো ব্যাপারটা লোকে বুঝে নেবে।’ সারদাচরণ বললেন।

‘ট্রায়ালের পর একমাস মাত্র সময় পাচ্ছেন, তাতে হবে?’ প্রণব দত্ত এই প্রথম মুখ খুললেন। ঋজু, ব্যক্তিত্ব ভরা কণ্ঠস্বর।

‘হতেই হবে।’ রাহুল বলল।

‘মি. অরোরা আপনি কত পারসেন্ট নেবেন?’ হীরাভাই ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে পানমশলার কৌটোটা টেনে আনল সুরজ সিংয়ের সামনে থেকে।

‘এই কাজটার জন্য পনেরো পারসেন্ট।’

‘হায় নারায়ণজি, তাহলে আমাদের জন্য কত থাকবে?’ হীরাভাই শুকনো মুখে তাকাল।

‘পঁচাশি,’ রাহুল ঝুঁকে বলল, ‘হিসেব করতে সুবিধে হবে মনে হলে আপনি আমাকে কুড়িই দেবেন।’

‘আমরা কত তুলতে পারব বলে আপনি মনে করেন?’ প্রণব দত্ত দ্রুত কাজের কথায় এল। তাকে প্লেন ধরতে হবে।

‘যদি দুটোই জেতে আর তারপরও শ্বাস টেনে যায়, তাহলে আমার অনুমান ষাট লাখের মতো।’ রাহুল শান্ত গলায় বলল।

কিছুক্ষণ ঘরটা নীরব থাক। সবাই মানসাঙ্কে ব্যস্ত।

‘আমি রাজি।’ হীরাভাই বলল।

‘আমিও।’ অর্জুন নিজের মতো জুড়ে দিল।

‘মি. অরোরাকে কমিশন দিয়ে আমাদের যা থাকবে তাকে পাঁচ ভাগ করলে প্রত্যেকের নয় লক্ষের কিছু বেশি হবে।’ সুরজ সিং বলল।

‘আমার কোনো আপত্তি নেই।’ প্রণব দত্ত মাথা হেলাল।

‘এক সেকেন্ড, স্বর্ণকুমারী এর থেকে কত পাবে?’ রাহুল জানতে চাইল।

সারদাচরণ তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়, আমি ওর ব্যবস্থা করব। আমরা স্বর্ণকুমারীর নামে একটা কর্পোরেশন গঠন কর। আমরাই বোর্ডের সদস্য হব। লাভের আমার অংশ থেকে যা পাওয়া যাবে তাতে ওর বাকি জীবন চলে যাবে।’

‘কিন্তু বোর্ডে তো স্বর্ণকুমারী নেই।’ রাহুল বলল।

‘বয়সটা খুবই কম।’ সারদাচরণ মাথা নাড়লেন। বরং ওর তরফে একটা ট্রাস্ট ফান্ড করা হোক। আমার ভাগ্যের একটা বড়ো অংশ ওকে দেওয়া হবে।’

‘কত বড়ো অংশ?’

‘এখনও তা ঠিক হয়নি, তবে আমার ইচ্ছে অন্তত এক তৃতীয়াংশ। আপনার অনুমান ঠিক হলে, তাহলে তিনলাখ।’

রাহুল দ্রুত চিন্তা করল। বোর্ডে যোগ দিলে সোনালির বিশেষ কিছু লাভ হবে না। বরং ট্রাস্ট পড়াই ভালো। এইসব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে টাকাপয়সার ব্যাপারে দর কষাকষির সুযোগ কম, তবে যতটা নিংড়ে বার করা যায় করে দেখবে।

‘স্বর্ণকুমারী কর্পোরেশন প্রস্তাবটাই মনে হয় ভালো। কিন্তু যেটা আমাকে চিন্তায় ফেলেছে সেটা হল, আয়ের টাকার কতটা স্বর্ণকুমারী পাবে। খবরের কাগজ যদি জানতে পারে স্বর্ণকুমারীর প্রত্যক্ষ কোনো রকম অধিকার এই কর্পোরেশনে নেই তাহলে লেখালেখি শুরু হবে। এর থেকে ট্রাস্টই ভালো। কিন্তু লক্ষ লক্ষ টাকার কতটা অংশ ট্রাস্টে যাচ্ছে, এই নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। হিসেবে দাঁড়াচ্ছে পাঁচ পার্সেন্ট। খবরের কাগজ বলবে মাত্র পাঁচ! এটা তো একটা মেয়েকে শোষণ, বঞ্চনা। আমি আপনাদের সমালোচনার জন্য বলছি না, শুধু পাবলিক রিলেশনের কথা ভেবেই বলছি।’

‘আপনি বলছেন মেয়েটির অংশ বাড়িয়ে দিতে?’ প্রণব দত্ত ভ্রূ বাঁকিয়ে বলল।

‘পঞ্চাশ পার্সেন্ট করলে ভালো হয়।’

ঘরে আবার নীরবতা বিরাজ করল। সেটা প্রথম ভাঙল হীরাভাই।

‘যদি ফিফটি পার্সেন্ট করা হয় তাতে আপনার সুবিধেটা কী?’

‘আমার স্বার্থ হল লোককে কী বলা হচ্ছে। কাগজ ক্ষেপে উঠলে প্রোজেক্টের প্রচুর ক্ষতি হবে।’

‘কীভাবে স্বর্ণকুমারীর অংশ বাড়াতে বলছেন?’ সারদাচরণ হুঁশিয়ার গলায় বললেন।

‘দেখুন সত্যিকথা বলতে, আপনারা ষাট লাখ টাকা উঠবে এটা কখনো ভাবতে পারেননি। অঙ্কটা হয়তো ভুলও হতে পারে। তবে সম্প্রতি কয়েকজন সে পর্যায়ে রাস্টারের কনট্রাক্ট নিয়ে কথাবার্তা চালিয়ে আর মেয়েটির মার্কেটে বিকোবার মতো প্রবল পার্সোনালিটি দেখে মনে হয়েছে ষাট লাখের মতো উঠতে পারে। শুনে আপনারা যে অবাক হয়েছিলেন সেটা আমি দেখেছি।’ রাহুল থেমে তার পরের কথাটার জন্য ওদের প্রস্তুত করাল। ‘মি. পটেল, মি. দত্ত, মি. সিং, মি. হালদার প্রত্যেকের জন্য ছয় লাখ টাকা গ্যারান্টি দেওয়া, পাবেনই। যদি ষাট লাখ ওঠে তাহলে আমার এজেন্সিও নেবে ছয় লাখ। সোনালি পাবে মোট টাকার পঞ্চাশ ভাগ। লোকে তাই জানবে। সে নিজের ভাগ থেকে তার বাবাকে কত দেবে সেটা বাপ—বেটির নিজেদের ব্যাপার।’

‘প্রস্তাবটা ভালো।’ প্রণব দত্ত বলল, ‘কিন্তু ষাট লাখের কম উঠলে কী হবে?’

‘আপনাদের ছ লাখ টাকা আপনারা পাবেনই, ট্রাস্টে তিরিশ লাখ টাকা তাহলে হবে না। মনে রাখবেন ষাট লাখের বেশি উঠে গেলে বাড়তি টাকাটা ট্রাস্টেই যাবে।’

‘আমার সায় আছে, ছ—লাখ তো গ্যারান্টেড।’ সুরজ সিং

‘যদি দুটো সোনা জেতে।’ রাহুল মনে করিয়ে দিল।

‘তাহলে চুক্তিপত্র তৈরি করার জন্য আমার উকিলকে বলছি।’ সারদাচরণ কথার সুরে জানিয়ে দিলেন এটাই পাকা সিদ্ধান্ত।

.

সেইদিনই বিকেলের ফ্লাইটে রাহুল দিল্লি ফিরল। দমদমে সিকিউরিটি চেকিংয়ের পর সে একটা চেয়ারে বসে যখন অপেক্ষা করছে তখন তার পরিচিত এক ডাক্তারকে হাতে ব্রিফকেস নিয়ে ঢুকতে দেখে সে দাঁড়িয়ে উঠে হাত নেড়ে ডাকল। ঘণ্টা দুয়েকের জন্য একজন সঙ্গী পেলে সময়টা তাহলে আর ব্যাজার হয়ে কাটাতে হবে না। ডাক্তার সুদের বোন কানাডায় টরন্টোয় থাকে। ডা. সুদ বোস্টনের টাফটস ইউনিভার্সিটিতে বায়োকেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট করতে গেছলেন। সেখান থেকে সাতদিনের জন্য বোনের সঙ্গে দেখা করতে আসেন তখন রাহুলের সঙ্গে ওঁর আলাপ হয়েছিল।

বেঁটেখাটো, গৌরবর্ণ, টাই সুট পরা ডা. সুদ রাহুলকে দেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন।

‘কেমন আছেন ডা. সুদ? অনেকদিন পর, চিনতে পারছেন?’

‘অবশ্য অবশ্য। আপনি আমার খোঁজ না রাখলেও আমি কিন্তু রাখি। এখন তো আপনি বিরাট ব্যবসা বানিয়েছেন। আপনার এক ক্লায়েন্ট আমার পেশেন্ট, তার কাছ থেকে খবর পেয়েছি।’

‘কে আমার ক্লায়েন্ট?’

‘ডান্সার কৃষ্ণমোহিনী। তার পায়ের একটা ব্যাপার। নাচতে শুরু করার পরই পা ভারী হয়ে যাচ্ছে। স্টিফ হয়ে যাচ্ছে মাসল। ব্যথা শুরু হচ্ছে।’

‘কৃষ্ণমোহিনীর এরকম অবস্থা তাতো জানতাম না, কিছু তো আমায় বলেনি। এখন ও আর কোথায়?’

‘গত সপ্তাহে আমার কাছে চণ্ডীগড়ে এসেছিল।’

‘সিরিয়াস?’

‘হ্যাঁ সিরিয়াসই। নাচ একদম বন্ধ করতে বলেছি, অন্তত যতদিন না ব্লাড সুগার নর্ম্যাল হয়।’

রাহুল মনে মনে উদবিগ্ন হলেও মুখে তার চিহ্নও রাখল না। যেন কিছুই নয় এমন ভাব করে প্রসঙ্গ ঘোরাল। ‘আপনি চণ্ডীগড়ে কোথায় এখন, হসপিটালে?’

‘আমি আছি ইনস্টিট্যুট অব হিউম্যান সায়েন্সে। একদিন আসুন না।’

রাহুলের মাথার মধ্যে নামটা ধাক্কা দিল। ডা. সরকার এইখানেই তার গবেষণা নিয়েছিলেন। কীসের যেন গবেষণা?

‘আচ্ছা আপনাদের ইনস্টিট্যুটে ডা. সরকার বলে কেউ কি ছিলেন?’

‘ডা. সরকার? হ্যাঁ ছিলেন তো। চেনেন নাকি?’

‘না। তবে ওর এক আত্মীয়কে চিনতাম। তার কাছে শুনেছিলাম উনি কী একটা বিষয়ে ওখানে…।’ কথাটা অসম্পর্ণ রেখে সে ডা. সুদের মুখভাব লক্ষ করল। কিরকম যেন, তাচ্ছিল্য, শ্রদ্ধা, ভয় সব মিলিয়ে একটা ভাব ওর মুখে।

এয়ারক্র্যাফটে চড়ার জন্য ঘোষণা হচ্ছে। দরজার দিকে হুড়মুড়িয়ে সবাই ছুটেছে বাসে ওঠার জন্য।

‘প্লেনে উঠে আপনাকে বলব ওর কথা, ‘ড. সুদ যেচেই বললেন রাহুলকে।

রানওয়ে দিয়ে ছুটে জমি ছাড়ায় এবং সিট বেল্ট বাঁধার নির্দেশ জ্বলা অক্ষরগুলো নিভে যাবার পর ডা. সুদ পাশে বসা রাহুলকে একগাল হেসে বললেন, ‘এই সময়টায় আমি একটু ভগবানের নাম করি। এত কাজ যে ফুরসত পাই না।’

‘তবু তো টেকঅফের সময় করেন, ল্যান্ডিংয়ের সময় ভগবানকে ভুলে যান না তো? তখনও করবেন কিন্তু।’

‘নিশ্চয় করি। একটু বেশিই করি।’

‘ডা. সরকার সম্পর্কে বলবেন বলেছিলেন। আচ্ছা, একটা কথা বলে রাখি, কোনো একটা ব্যাপারে আমি ওর সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক। দ্য ইনফ্লুয়েন্স অব হিরেডিটি অন হিউম্যান গ্রোথ নামে উনি একটা প্রোজেক্ট শুরু করেন যখন হামবুর্গে ছিলেন, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘একটা প্রোজেক্টে, যার সম্পর্কে আপনকে বলতে পারব না, কেননা কথা দিয়েছি কাউকে এখন জানান যাবে না, উনি এবং অনেকে ইনভেস্ট করেছেন। কেন, কী উদ্দেশ্য করেছেন সেটা বুঝতে পারছি না বলেই কেমন যেন ধাঁধার মতো লাগছে। কোন ব্যাপারটা ওকে মোটিভেট করছে? আচ্ছা ওকে আপনি চেনেন কতটা?’

‘চণ্ডীগড়ে ওর বিভাগেই আমি এক বছর ছিলাম। বছর তিনেক আগে উনি স্বেচ্ছায় রিটায়ার করে চলে যান। কাজের বাইরে ওর সম্পর্কে কিছু জানি না। শরীর সম্পর্কে ওর কিছু থিওরি আছে।’

‘কী সেগুলো?’

মানুষের শরীরের বৃদ্ধি সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়াতেই বহু বছর কাটিয়েছেন। তাই থেকে সিদ্ধান্তে এসেছেন প্রতি দশকে এক সেন্টিমিটার করে গড় মানুষের বৃদ্ধি ঘটছে। সরকারের স্টাডিটা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণেই এটা সম্পর্কে আগেও স্টাডি হয়েছে। তাদের গবেষণা হয়েছিল কমবয়সিদের নিয়ে যখন শরীরের পুরো বৃদ্ধি ঘটেনি, অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। সরকার কাজ করেন পরিণত শরীরের মানুষ নিয়ে। মুশকিলটা হল, সরকারের কথা মতো, মানুষ প্রতি দশকে এক সেন্টিমিটার করে বাড়তে থাকলে একদিন তো কিংকংয়ের আকার নেবে? দুশো বছর পরে সবাই তো কুড়ি সেন্টিমিটার বা আট ইঞ্চি লম্বা হয়ে যাব! প্রশ্নটা হল, মানুষের হাড়ের গঠন যেভাবে সাজানো তাতে কি এই বৃদ্ধির সঙ্গে তা তাল রাখতে পারবে? উনি এ সব কথা মানতে চাইলেন না।’

‘কেন তাল রাখতে পারবে না?’

‘এখন মানুষের গড় উচ্চচতা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। এটাই চূড়ান্ত আর মানুষের দেহ কাঠামো প্রস্তর যুগের মানুষের থেকে এখন পর্যন্ত খুব একটা বদলায়নি। কঙ্কাল মেপে দেখা গেছে প্রস্তর যুগে মানুষের গড় উচ্চচতা ছিল পাঁচ ফুট নয়, তাম্র যুগে পাঁচ—আট, লৌহ যুগে পাঁচ—ছয়। আবার মধ্য যুগে পাঁচ—সাত।

‘মানুষ কোঁকড়াতে শুরু করল কখন?’

‘শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে। শহরের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বসবাসের মান খারাপ হতে লাগল। জীবন যাপনের ক্ষেত্রে একটা থমকানি এল। একশো বছরেরও উপর লাগল এর থেকে বেরিয়ে আসতে। তবে এখন আবার তাম্র যুগের উচ্চচতায় মানুষ ফিরে গেছে।’

‘ডা. সরকার এ সম্পর্কে কী বলেন?’

‘প্রাগৈতিহাসিক মানুষের মাপের সত্যতা উনি মানতে চান না। শুধু শক্তিমান আর লম্বা প্রাণীরাই পূর্ণ বয়সে পৌঁছতে পারবে বেঁচে থেকে। তাই ওনার মতে, সভ্য যুগে যখন দুর্বলদের পক্ষেও বেঁচে থাকা সম্ভব, তখন সভ্য যুগের সঙ্গে প্রাগৈতিহাসিক যুগের তুলনা করাটা বোকামি, অর্থহীন। ওর মতে এখনকার গড়পড়তা লোকই পৃথিবীর ইতিহাসে সব থেকে লম্বা, আর উনি মানতে চান না যে আমরা বৃদ্ধির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। যতদূর মনে পড়ছে একদিন উনি আমায় বলেছিলেন, মানুষের আগামীকালে যতটা বৃদ্ধি ঘটবে অন্তত পরের ছয় দশকের বৃদ্ধি ধারণ করার মতো ক্ষমতা তার দেহ কাঠামোর গঠনের মধ্যে আছে।’

রাহুলের মনে পড়ল, অর্জুনের বাড়িতে সারদাচরণ ফিল্মের মধ্য দিয়ে প্রথম স্বর্ণকুমারীকে তাদের দেখান একবিংশ শতাব্দীর স্ত্রী জাতির অবিকল নমুনারূপে।

‘এটা কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ?’ রাহুল বলল।

‘সরকারের কাছে অন্তত তাই। ওর হামবুর্গের রিসার্চ ওর কাছে জীবনের প্রধান আর একমাত্র জিনিস। ওনার যাবতীয় থিওরির মূল ভিতই এটা। ওর ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির থিওরিটা নিয়ে উনি একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে যান। কিন্তু আর কোনো বিশেষ সারবস্তু ওতে যোগ করতে পারেননি। বহু লোক, এমনকি আমরাও অবাক হয়ে ভাবি, আপনিও ভেবেছেন, সত্যিই কী এটা গুরুত্বপূর্ণ?’

প্লেনের লাউডস্পিকারে ঘোষণা হল জলপান দেওয়া হবে। প্লাস্টিকের ট্রে হাতে এয়ারহোস্টেসদের আনাগোনা শুরু হল। সামনের সিটের পিছন থেকে টেবল নামানো হতে লাগল। রাহুলও ডা. সুদ আলোচনা বন্ধ রেখে চিজ স্যান্ডুইচ ও একটি রসগোল্লা দিয়ে জলপান সারল। দুধ আর কফি—পট দু’হাতে নিয়ে একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কফি?’ রাহুল মাথা নাড়ল। তার পিছনেই এল আর একটি মেয়ে। ‘টি?’ রাহুল ‘ইয়েস’ বলতেই সে ঝুঁকে চায়ের লিকার এবং তারপর দুধ টেবলে রাখা কাপে ঢালতে লাগল। এই সময়টুকুর জন্য তার রাধিকা পাইনকে মনে পড়ল। বুক থেকে কোমরের ধরটা ঠিক একইরকম।

‘মি. অরোরা একটা কথা জানবেন, ‘ডা. সুদ আবার বলতে শুরু করলেন, ‘এইসব লোকেরা এমন কিছু একটা করে ফেলতে পারেন যা আমাদের চিন্তাধারাকেই বদলে দিতে পারে। কিন্তু প্রতি একজনের সাফল্যের জন্য কয়েক ডজন লোককে ব্যর্থতা বরণ করতে হয়। পূর্ণতার বদলে তারা পায় শূন্যতা। ডা. সরকার এই শেষের দলে পড়েন। চণ্ডীগড় ছেড়ে তিক্ত মন নিয়ে তিনি চলে যান।’

‘ডা. সরকারের থিওরি সম্পর্কে এবার একটা বোকার মতো প্রশ্নই করব। তিনি প্রমাণ করতে চান, মানুষের কঙ্কাল গঠনগতভাবে দেহের বৃদ্ধিটা নেওয়ায় সক্ষম, তাই তো?’

‘তার আগে মানুষের বৃদ্ধি সম্পর্কে তাঁর যুক্তিটা কতটা নির্ভরযোগ্য সেটা দেখতে হবে। অনুপাত আর উপাদান বদল না করে কোনো প্রাণীরই নিজস্ব চেহারার বিশেষ একটা আকার ছাড়ানো, বদল ঘটানো প্রকৃতির পক্ষে অসম্ভব, এটা গত তিনশো বছর ধরে বহু বৈজ্ঞানিকই বলে এসেছেন।’

‘আচ্ছা কৃত্রিমভাবে কি শরীরের বৃদ্ধি সম্ভব?’

‘অ্যানাবলিক স্টিরয়েড? না, ওতে লম্বা হওয়া যায় না।’

‘তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি ঘটানো যায় না?’

‘বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটা এখনও বায়োলজিক্যাল ধাঁধা হয়ে রয়েছে।’

‘হরমোন টরমোন দিয়ে? বৃদ্ধিটা নিয়ন্ত্রণ করে তো এই দিয়েই?’

‘পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে সোমাটোট্রপিক—মানুষের বৃদ্ধির হরমোন বেরোয়—’

‘এই হরমোন কৃত্রিমভাবে যদি শরীরে দেওয়া হয় তাহলে কী হবে?’ রাহুলের ঘুরে বসার চেষ্টা থেমে গেল কোমরে বাঁধা সিটবেল্টে বাধা পেয়ে। সে অনেকখানি এগিয়েছে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে। এখন একটা ক্ষীণ আলো যেন দেখতে পাচ্ছে।

‘বিশেষ এক ধরনের বামনদের উপর এটা প্রয়োগ—’

‘বামনটামন নয়, স্বাভাবিক শিশুদের উপর যদি প্রয়োগ করা হয় তাহলে কী হবে?’

ডা. সুদ কয়েক সেকেন্ড ভাবলেন। ‘জানি না, আমার কোনো ধারণা নেই। তা ছাড়া আমি তো কারণ দেখতে পাচ্ছি না এটা করার?’

‘কারণ হয়তো বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লম্বা হবে।’

ডা. সুদ চুপ করে রইলেন।

‘স্বাভাবিক শিশুর দেহে বৃদ্ধির হরমোন ঢুকিয়ে দেওয়া নিশ্চয় বীভৎস চিন্তা, কেউই তা করবে না। যদি কোনো ঘাটতি থাকে তাহলে ঠিক আছে কিন্তু স্বাভাবিক শরীরে উচিত নয়। ব্যায়াম করে তো লম্বা হওয়া যায়?’ রাহুল বলল।

‘খুব সামান্য। বৃদ্ধিটা একটু তাড়াতাড়ি ঘটানো যায় মাত্র, তবে আপনি তো জানতে চাইছেন স্বাভাবিক উপায়ে লম্বা হওয়া ছাড়াও আর কোনোভাবে মানুষকে লম্বা করা যায় কিনা?’

‘একেবারে ঠিক কথাটাই বললেন।’

‘মধ্যযুগে লোককে ধরে এনে অত্যাচার করার জন্য, হাত আর পা বেঁধে দু—দিকে টানা হত। এতে লম্বা বোধহয় করা যায়। অত্যাচারের সপক্ষে যুক্তি দেওয়া হত, সত্য আবিষ্কারের জন্য নাকি এটা করা হচ্ছে।’

রাহুল মাথা নেড়ে বলল, ‘এটা ভেবে দেখব।’

সাত

স্বর্ণকুমারীকে কমার্শিয়াল হাউসগুলোর কাছে বিক্রি করার কৌশল ভাঁজতে ব্যস্ত রইল রাহুল। কীভাবে প্রচার শুরু হবে, ধাপেধাপে কোনটের পর কোনটে আসবে সেটার খসড়া তৈরির কাজে সে নিজেকে এমন নিবদ্ধ রেখেছিল যে কলকাতার বা বর্ধমানের কোনো খবর রাখেনি।

একদিন বিকেলে সে অর্জুনের টেলিফোন পেল বাঙ্গালোর থেকে।

‘কী ব্যাপার অর্জুন?’

‘এসেছি স্বর্ণকুমারীর টিমের সঙ্গে।’

‘কেন? হঠাৎ বাঙ্গালোরে?’

‘তুমি কোনো খবর রাখ না দেখছি। এখানে মেয়েদের একটা মিট হচ্ছে। এটাকে অলিম্পিক ট্রায়ালের ট্রায়াল বলতে পার। ইন্দো—সোভিয়েত কালচারাল এক্সচেঞ্জ বলে একটা ব্যাপার আছে জানো তো? একটা সোভিয়েত অ্যাথলেটিক্স টিম শ্রীলঙ্কায় গেছল। ইন্ডিয়া গভমেন্ট সেটাকে ভারতে আনিয়েছে। উদ্দেশ্যে, ওদের সঙ্গে কম্পিট করিয়ে আমাদের অ্যাথলিটরা কতটা আন্তর্জাতিক মানের সেটা পরখ করা। ‘সাই’ থেকে বিশেষ করে বলা হয়েছে সোনালি দশ হাজার মিটারে যেন অবশ্যই নামে। লং ডিসট্যান্সে দুটো রুশি মেয়ে এসেছে আর আমাদের তরফে নামবে চারটে মেয়ে। তাদের একজন সোনালি। ওর ম্যারাথন টাইমিং দেখে চমকে গেছে তো! বিশ্বাসই করতে চায় না পাতিয়ালার এনআইএস কর্তারা। ওরা একবার দেখে নিতে চায় স্বচক্ষে।’

‘কিন্তু ক—দিন হল সোনালি ম্যারাথন দৌড়েছে? দু—সপ্তাহ?’ রাহুল দেওয়াল ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল। তারিখটা দেখে নিয়ে চট করে হিসেব করে ফেলল, ‘ঠিক সতেরো দিন। এর মধ্যেই আবার।’

‘ডা. সরকারও তো তাই বলছেন। তিনি তো রাজিই হননি। কিন্তু গভমেন্ট প্রেশার। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেই দিয়েছে এই মিটটায় না নামলে অলিম্পিকের জন্য সিলেকশন পাওয়া শক্ত হবে। ডা. সরকারের শর্ত, সোনালি সিলেক্টেড হলে পাতিয়ালা বা অন্য কোথাও গিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে থাকা বা কোনো এনআইএস কোচের আন্ডারে ট্রেনিং নেওয়ায় তিনি রাজি নন। গভমেন্ট তাতে রাজি প্রোভাইডেড এই মীটে যদি তেমন কিছু ফল দেখাতে পারে।’

‘ডা. সরকার রাজি হয়েছেন তো?’

‘তা না হলে এখানে সবাই এসেছি কেন? উনি বুদ্ধিমান লোক। ব্যাপারটা কোনো জায়গায় শেষ মুহূর্তে আটকে যাক এটা চাইবেন না। তবে গজগজানি আজ বিকেলেও দেখেছি। বিজয় সিনহা সোনালিকে ওয়ার্ম—আপ করাতে নিয়ে যাবার পর আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হল। তোমার কাছ থেকে আর কোনো খবর না পেয়ে উনি খুব উদবিগ্ন।’

‘আমি পেপার ওয়ার্কে ব্যস্ত। কাদের কাছে অ্যাপ্রোচ করব, কখন করব, কী বলে করব সেই সব ঠিক করায় একটু সময় লাগে। ভালো কথা, মিট করে?’

‘কাল, দুপুরে। তোমার পক্ষে আসা কি সম্ভব?’

‘এত শর্ট টাইমে! দিল্লি—বাঙ্গালোর ফ্লাইট সকালে একটা আছে। আচ্ছা আমি ট্র্যাভেল এজেন্টকে ফোন করছি, যদি পাই চলে যাব। কোথায় হবে? সোনালির ইভেন্ট তো…”

‘কান্তিরবা স্টেডিয়ামে। আমি ওয়েস্ট এন্ড হোটেলে আছি, ওরা তিনজনও রয়েছে। দ্যাখো যদি পার। গুড নাইট।’

টেলিফোন রিসিভার না রেকেই রাহুল ডায়াল করল তার ট্র্যাভেল এজেন্টের অফিসে। কথা বলে সে আশ্বস্ত হল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তারা টিকিট পাঠিয়ে দিচ্ছে। সকাল দশটায় ফ্লাইট। দুপুর বারোটা নাগাদও যদি সে বাঙ্গালোরে নামে তাহলে পৌনে একটার মধ্যে স্টেডিয়ামে পৌছতে পারবে। অবশ্য এই হিসেবটা আন্দাজের করল কেননা স্টেডিয়াম যে বাঙ্গালোরে নামে তাহলে পৌঁনে একটার মধ্যে স্টেডিয়ামে পৌঁছতে পারবে। অবশ্য এই হিসেবটা আন্দাজেই করল কেননা স্টেডিয়াম যে বাঙ্গালোর শহরে কোথায় তা সে জানে না।

পরদিন সকাল ন—টায় পালাম এয়ারপোর্টে এসে রাহুল জানল, ফ্লাইটের বিলম্ব হবে অন্তত এক ঘণ্টা। বোম্বাই থেকে প্লেনটির আসার কথা কিন্তু যথাসময়ে আসছে না। রাহুল একবার ভাবল ফিরেই যাই। নিশ্চয় ভিভি কভারেজ দেবে। লাইভ না হলেও ভিডিও করে রাতের দিকে দেখাতে পারে। তারপরই সোনালির চেহারাটা তার চোখে ভেসে উঠল। লালমাটির রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে। কাঁদের উপর চুল লাফিয়ে উঠছে। পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে গোছ থেকে শার্টস পর্যন্ত পায়ের পেশি ফুলে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে। বুকে আলগোছে একটা কাঁপন লাগল। সে ঠিক করে ফেলল প্লেনের জন্য অপেক্ষাই করবে।

রাহুল বাঙ্গালোরে নেমে কান্তিরবা স্টেডিয়ামে পৌঁছে যখন গ্যালারিতে বসল, তখন মেয়েদের দশ হাজার কিলোমিটার দৌড় প্রায় শেষ হবার মুখে। স্টেডিয়ামে দর্শক হাজার দুই। অ্যাথলেটিক্স দেখতে ভারতে এখনও কোথাও ভিড় হয় না। ডা. সরকার বা অর্জুনকে খোঁজার সময় নেই। সে পাশের লোককে জিজ্ঞাসা করল, ‘কত পাক এখন চলছে?’

‘কুড়ি শেষ হল।’

রাহুল দেখে অবাক হল, দুটি রুশি আর চারটি ভারতীয় মেয়ে একসঙ্গে ছুটছে। কুড়ি পাক অর্থাৎ আট হাজার মিটার পর্যন্ত ভারতের মেয়েরা এইভাবে রুশিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে, এটাই তাকে অবাক করেছে।

তার চোখ আটকে রইল সোনালির উপর। রুশি মেয়েদের নাম সে জানে না। সকালে দিল্লির কাগজে এই মিটের কথা ছোটো করে এক কোণায় ছাপা হয়েছে বলে কিন্তু কারোর নাম দেওয়া হয়নি। তবে এটুকু সে জানে শ্রীলঙ্কায় রাশিয়ানরা তাদের নামি কোনো অ্যাথলিটকে পাঠবে না। দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির ছেলেমেয়েদেরই ওরা দুর্বল দেশগুরলোয় পাঠায়। গোহারান হারিয়ে দিয়ে বন্ধু দেশকে বিষণ্ণ করে দেওয়াটা ভালো কূটনীতি নয়।

রাহুল ধরে নিল এই মেয়ে দুটি উঁচুমানের নয়। সোনালিকে নয় সে বাদই দিল, অন্য তিনটি মেয়েও যখন পাল্লা দিচ্ছে তখন ওরা আন্তর্জাতিক মানের হতেই পারে না।

প্রথমে রুশি মেয়ে দুটি, তাদের গোড়ালিতেই সোনালি, সমান পদক্ষেপে। তার দশ মিটার পিছনে তিনটি ভারতীয় মেয়ে। কিন্তু এই দশ মিটার ব্যবধানটা একটুএকটু করে বেড়ে যাচ্ছে। রাহুল পাশের লোকটিকে অযাচিতই বলল, ‘এবার এই তিনজনের দম ফুরিয়ে আসছে। ওদের সঙ্গে পাল্লা না দিলেই পারত।’

লোকটি অবাক হয়ে তাকাল রাহুলের দিকে।

‘কতক্ষণ এসেছেন’

‘এই তো, এইমাত্র।’

‘অ। ওই তিনটে মেয়ে পাল্লা দেবে কী, ওরা তো সবে এ উনিশ পাক শেষ করল।’

রাহুল অপ্রতিভ হয়েও হেসে ফেলল। সে মন দিল সোনালির উপর। জোঁকের মতো লেগে আছে রুশিদের সঙ্গে পেশিতে ঠাসা দুটি পা, পাঁচ ফুটের কাছাকাছি, কোঁকড়া চুল, সাদা ব্লাউজ পরা মেয়েটি হঠাৎ গতি বাড়াল, লাল হাতকাটা গেঞ্জি পরা রুগণ চেহারার, ছেলেদের মতো ছাঁটা চুল অন্য মেয়েটিও তার পিছু নিল, সঙ্গে সঙ্গে সোনালিও। দুশো মিটার এইভাবে দৌড়ে সাদা ব্লাউজ মন্থর হতেই লাল গেঞ্জি গতি বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল। সোনালি সাদা ব্লাউজকে ধরে রইল। এই রকম আচমকা গতির হেরফের তিনবার হল।

যখন ওরা তার সামনে দিয়ে যাচ্ছে, রাহুলের মনে হল সোনালির মুখে সহজাত স্বাচ্ছন্দ্যটা যেন নেই। তার পা ফেলার মধ্যে ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠছে। রুশিরা ওর ফুসফুসকে নিংড়ে নিংড়ে দম বার করে দেওয়ার কৌশল শুরু করেছে।

পিছিয়ে পড়ছে সোনালি। দু—জনের অন্তত পনেরো মিটার পিছনে। স্টেডিয়ামের এধার—ওধার থেকে তাকে চাঙ্গা করার জন্য কিছু উৎসাহ বাক্য চেঁচিয়ে বলা হল।

আবার ওরা রাহুলের সামনে আসছে। ভালো করে দেখার জন্য সে গ্যালারি থেকে উঠে ফেন্সিংয়ের ধারে গিয়ে দাঁড়াল। চোখের নজর বাড়িয়ে সে সোনালির মুখের দিকে তাকাল। মুখটা লাল হয়ে উঠেছে, মাখানো তেলের মতো সারা শরীর ঘামে চকচক করছে। ঠোঁট ফাঁক হয়ে দাঁত দেখা যাচ্ছে। এর আগে যখন রাহুল লক্ষ করেছিল তখন ঠোঁট বন্ধ ছিল। এখন চিবুক ঝুলে পড়েছে। পা দুটো জমি থেকে আগের মতো উঠছে না।

রাহুলের মনে হল সোনালি যে একবার একটুখানি মুখটা ফেরাল। কিন্তু তাকে দেখতে পায়নি। মনে হল, ওর গতি যেন বাড়ল।

শেষ পাকের ঘণ্টা বেজে উঠল। শেষ হবে রাহুলের ডান দিকে প্রায় একশো মিটার দূরে। পাঁচ—দশ হাজার মিটারে এখন তো শেষ দু—তিনশো মিটার স্প্রিন্ট করে ফিনিশ করে। স্পোর্টস টেকনোলজি অ্যাথলিটদের শরীরের ক্ষমতা কত দূর বাড়িয়ে দিয়েছে দু—চারটে প্রবন্ধ থেকে রাহুল তা জেনে রেখেছে।

রুশিরা ফিনিশিংয়ের ধাক্কাটা দিয়েছে। ওরা দু—জন এখন নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করেছে। ওদের কুড়ি মিটার পিছনে সোনালি, সেও গতি বাড়াল।

ওরা এবার তার সামনে আসছে। প্রথমে রয়েছে রুগণ চেহারার লাল গেঞ্জির মেয়েটি। তার এক মিটার পিছনে সাদা ব্লাউজ। কোথায় সোনালি? সেই কুড়ি মিটার পিছনেই। এই ব্যবধানটা বজায় রাখার চেষ্টা করে কোনোক্রমে সে দৌড়চ্ছে।

‘স্বর্ণকুমারী… হেরে যাচ্ছ।’

রাহুল চিৎকার করল। সোনালি তাকাবার কোনো চেষ্টাই করল না। তার চোখ বেয়ে জলের ধারা নামল। রুমাল বার করে সে মুছে নিল।

ফিনিশিং লাইনে চারমিটার আগে সোনালি মুখ থুবড়ে পড়ল নিজের পায়ে পা জড়িয়ে। রাহুল দেখল, বিজয় সিনহা ছুটে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়ে চলে গেল। তার পিছনে ডা. সরকার আর অর্জুন।

স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে এল রাহুল। তার মনের মধ্যে এখন প্রচণ্ড সাইক্লোনের পরের অবস্থা। সে ঠিক করতে পারছে না এখন সে কোনখান থেকে তার চিন্তাটা শুরু করবে।

কিছু একটা গোলমাল ঘটেছে। সেটা কোথায়? মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে? দুই বিদেশির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে গিয়ে কি নার্ভাস হয়েছে? জীবনে এটা ওর দ্বিতীয় প্রকাশ্য রেস। কিন্তু প্রথমবারও তো প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি ছিল এক অস্ট্রেলিয়ান, নামি ম্যারাথনার। অলিম্পিকসে এগারো স্থান পাওয়া। তাকে হারিয়ে সোনালি পৃথিবীর সেরা সময়গুলোর কাছাকাছি এসেছে। ওয়ার্ল্ড বেস্ট থেকে তিন—চার মিনিট দূরে। প্রচণ্ড গরমে, হিউমিড কন্ডিশনের মধ্যে দৌড়ে শেষ করেছে। শেষ হাজার মিটারে অস্ট্রেলিয়ান মেয়ের সঙ্গে ব্যবধান বাড়ানোর দৃশ্যটা রাহুলের চোখে ঝলসে উঠল। কী সবল দুটো পা! ঋজু নমনীয় দেহ। মুখে পাতলা হাসি। ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই। এখুনি আবার আর একটা রেসে নামার মতো ক্ষমতা ওর পদক্ষেপে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল।

আর সেই মেয়ে, কী বিশ্রীভাবে শুধু দৌড়লই না, শেষ করল কী অমর্যদাকরভাবে! যদি স্বাভাবিকভাবে দৌড়ে একঘণ্টা সময় নিয়েও শেষ করত তাহলে এত কষ্ট হত না। ম্যারাথনে সোনালির সময় ভারতের সব কাগজেই বেরিয়েছে, দিল্লিতে এসে রাহুল তার অফিসে রাখা আঠারোটা প্রধান ও মাতৃভাষার কাগজের ফাইল থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবর বিশ্লেষণ করে তার প্রচারের ধরন কী হবে, সেটা ঠিক করেছে।

আর এখন? কাল কী বেরোবে কাগজগুলোয়? বলবে ম্যারাথনের টাইম ধরায় গোলমাল ছিল। বলবে, ডোপ করে ম্যারাথন দৌড়েছিল। বলবে ম্যারাথন রুটের ডিসট্যান্সের মাপে গোলমাল আছে, নিশ্চয় ২৬ মাইলের কম।

কিন্তু ৬০ লক্ষ টাকার ব্যাপারটা কী হবে? এরপর সোনালির দুটো সোনা জেতার কী হবে?

রাহুল কালা—বোবা—অন্ধ হয়ে হাঁটছে, শুধুই হাঁটছে। এই টাকার একটা অংশ মাত্র সে পাবে। না পেলেও তার কিছু আসে যায় না। তার সুনাম, তার ব্যাবসা, তার বুদ্ধি ভবিষ্যতে তাকে কোটি টাকার এনে দেবে। বহু মেয়েকে, পুরুষকে সে ক্লায়েন্ট করেছে, কিন্তু তার অর্ধেকও প্রতিশ্রুতিমতো পূর্ণতা পায়নি। তাতে সে ভেঙে পড়েনি, মাথাও চাপড়ায়নি। কিন্তু এই মেয়েটি তার শরীরে—মনে অদ্ভুত এক অনুভূতি জাগিয়েছে। কোথায় যে আকর্ষণ করেছে, সেটাই সে ধরতে পারছে না। ওর সঙ্গে কথা বলার পর রাহুল হঠাৎই এক বিচিত্র শূন্যতা বোধের মধ্যে কয়েকটা দিন কাটিয়েছে। সোনালির সৌন্দর্য স্বাস্থ্য, অকপটতা, সোনা জেতার স্থির বিশ্বাস, জড়তাহীন আচরণ আর যৌন বাসনা জাগানোর ক্ষমতা, সব মিলিয়ে তার কাছে একটা আবেগ হয়ে উঠেছে মেয়েটি। ওর কাঠিন্যের মধ্যে কোথায় যেন একটা অরক্ষিত জায়গা আছে যেখানে থেকে সোনালির দুর্বলতা বেরিয়ে এসে তাকে ধ্বংস করবে বলে তার মনে হয়েছে। মেয়েটিকে রক্ষা করা দরকার।

সোনালির অলিম্পিক টিমে সিলেকশন পাওয়ার এবার ঝঞ্ঝাট দেখা দেবে। ওর এইভাবে দম হারিয়ে থুবড়ে পড়াটা অ্যাথলেটিক ফেডারেশন, আই ও এ—সাই—য়ের লোকেরা সন্দেহের চোখে দেখবেই। নিজেদের ডাক্তার দিয়ে মেডিক্যাল চেক—আপ করাবেই। যদি তখন কিছু গোলমাল ওর শরীরে ধরা পড়ে? কিন্তু গোলমাল কী হতে পারে অমন টগবগে, মাসল ফেটে পড়া শরীরে?

হাঁটতে হাঁটতে রাহুল দেখল সে মাহাত্ম গান্ধী রোডে এসে পড়েছে। সারি সারি দোকান রাস্তার একদিকে। চওড়া পেভমেন্ট। রাস্তার ওপারে উঁচু জমি। দেখেই বোঝা যায় অঞ্চলটা মালভূমির মতো পাহাড়ে জমি সমান করে তৈরি করা হয়েছে, রাস্তা ঢালু হয়ে আবার উঠেছে অনেক জায়গায়। কর্ণাটক ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের স্টেডিয়াম দেখে রাহুল সেটা লক্ষ্য করে এগোল। ওর পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়া যায় ওয়েস্ট এন্ড হোটেলের দিকে।

কিন্তু সে এখন যাবে কি? রাহুল দাঁড়িয়ে পড়ল। ওখানে গিয়ে কি লাভ? কনসরটিয়ামের প্রোজেক্টকে একযু আগেই সে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখেছে। সোনালিকে ঘিরেই তো ষাট লক্ষ টাকার স্বপ্ন।

ফেরার জন্য প্লেনের ওপের টিকিট তার সঙ্গে রয়েছে। যদি সিট পায় তাহলে কাল সকালের ফ্লাইটেও যেতে পারে। তারপর রাহুলের ইচ্ছে করল সোনালিকে দেখতে। ঠিক কী ব্যাপার সেটা জানার ইচ্ছাটা ক্রমশ প্রবল হয়ে ওঠার সে একটা অটোরিকশা ডেকে তাতে চড়ে বসল।

ওয়েস্ট এন্ড হোটেলের রিসেপশন কাউন্টারে সুরেশ, সুন্দর চেহারার দুটি পুরুষ ও মহিলা। রাহুল চাইল, অর্জুন হালদারের সঙ্গে দেখা করবে, কত নম্বরে সে আছে?

‘কবে এসেছেন?’

‘বোধ হয় দু—দিন আগে, কলকাতা থেকে।’

মোটা, বিরাটাকার রেজিস্টারটার পাতা ওলটাতে ওলটাতে মহিলা দুবার ফোন তুলে প্রশ্নের জবাব দিলেন।

‘আসার তারিখটা ঠিক করে বলতে পারেন?’

‘আপনি পরশু, এগারো তারিখের—’ রাহুলের নজর ছিল রেজিস্টারের খোলা পাতর উপর, হঠাৎ সে অর্জুনের নামটা দেখতে পেয়ে গিয়ে বলল, ‘এই যে।’

‘রুম নাম্বার টু টু নাইন।’ মহিলা পিছনে তাকিয়ে দেয়ালে আটা নম্বরলেখা কাঠের খোপগুলোর দিকে তাকালেন। খোপের নীচে সেই নম্বরের ঘরের চাবি ঝুলছে। তিনি দেখে নিয়ে বললেন ‘হ্যাঁ ঘরে আছেন।’ রাহুলও দেখল চাবি ঝুলছে না।

চমৎকার লন, তাতে বেতের চেয়ার আর টেবল পাতা। লনের ধার দিয়ে ফুলের গাছ। অনেক মেয়ে—পুরুষ চেয়ারে বসে গল্প করছে। চা, কফি বা মদ খাচ্ছে। রাহুল ২২৯ নম্বর ঘরের উদ্দেশ্যে যেতে যেতে তাকিয়ে দেখছিল। একটি লোককে একা একটা টেবল বসে সিগারেট খেতে দেখে থেমে গিয়ে লোকটির দিকে এগিয়ে গেল।

‘বিজয়বাবু একা বসে যে!’

বিজয় সিনহা সিগারেট ধরা হাতটা দ্রুত টেবলের তলায় চালান করে, তারপর রাহুলকে দেখে হাতটা আবার টেবলের উপর আনল।

‘আমায় চিনতে পারছেন? মনে আছে আছে ম্যারাথনের স্টার্টিংয়ের আগে আমি সোনালির সঙ্গে কথা বলছিলাম। তখন আপনি আপত্তি—’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে।’

‘বসব?’

‘নিশ্চয় নিশ্চয়।’ বিজয় পরে জেনেছে লোকটি কে এবং কী উদ্দেশ্যে সেদিন ম্যারাথন দেখতে গেছল। ডা. সরকার ওকে বলেছিলেন, রাহুল অরোরা নামের এই লোকটা গানবাজনা, স্পোর্টস, ফিল্ম এইসব লাইনের নামি লোকেদের এজেন্ট। তাদের জন টাকা রোজগারের ব্যবস্থা করে দেয় আর সেই টাকার একটা নির্দিষ্ট পারসেন্ট কমিশন নেয়। বিরাট ব্যাবসা, এশিয়ার নামি লোক ওর ক্লায়েন্ট। সোনালি বার্সিলোনায় দুটো সোনা জিতলে রাহুলকে ওর এজেন্ট করা হবে।

এটা শোনার পর বিজয় সিনহার মনে হয়েছিল, অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের কোচও তো হেঁজিপেজি লোক নয়। ছাত্রী নাম করলে গুরুরও নাম হবে। তখন অনেক জায়গা থেকে তাঁর ডাক আসবে। সেগুলো ম্যানেজ করার জন্য এইরকম একজন এজেন্ট থাকলে তো ভালোই হবে।

রাহুল চেয়ারে বসে তার ডানহিলের প্যাকেটটা টেবলে রেখে বিজয়ের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘দিশি সিগারেট খেয়ে কী হবে, এটা খান।’

বিজয় তার হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে, ডানহিল ধরাল, প্রথম টানটা দিয়ে আমেজ মৃদু মৃদু ধোঁয়া মুখ দিয়ে বার করল।

‘আপনি এখন এখানে?’ বিজয় জানতে চাইল।

‘বিজনেসের কাজে এসেছি। কাগজে দেখলাম আজ এখানে সোনালির—’।

রাহুলকে শেষ করতে না দিয়ে বিজয় হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘আমি সেই কবে ডা. সরকারকে বলেছিলাম, একবার ওকে ভালো করে পরীক্ষা করা দরকার। ট্রেনিংয়ের পর মাঝে মাঝে বলত পা দুটো কেমন ভার হয়ে যাচ্ছে। সোনালিকে দেখাশোনা করে যে মেয়েছেলেটা তার নাম শৈলবালা। শৈলকে মাসাজ করতেও শেখানো হয়েছে। ও যখন বলত, পা আড়ষ্ট লাগছে তখন শৈলকে দিয়ে মালিশ করাতাম। ডা. সরকার বললেন, এটা সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার থেকে হচ্ছে, এটার কারণ উদবেগ। অলিম্পিকসের কথা ভেবে উত্তেজিত হচ্ছে, চিন্তা বাড়ছে। ভালো ঘুম দরকার। উনি ওকে রাতে খাবার জন্য ট্যাবলেট দিলেন।’

‘ব্যাপার কী? আজ রেসে সোনালি জিতেছে?’

‘আরে জিতবে কি। আপনি জানেন মেয়েটা এখন ঘরে বিছানায় শুয়ে। দৌড় শেষই করতে পারেনি। আমি জানতাম এ রকম একটা কিছু হবে। আজও গাড়ি থেকে নেমে স্টেডিয়ামে ঢোকার সময় চুপিচুপি বলল, ‘বিজয়দা কি যেন একটা হচ্ছে, শরীরটা কেমন ভার ভার লাগছে। আমি কিছু আর বলিনি। কিই বা বলব রেসের পরেরো মিনিট আগে?’

‘বোধহয় নার্ভাস হয়ে এটা হয়েছে।’

‘প্রত্যেক অ্যাথলিটেরই এটা হয়। না আমার মনে হয়নি নার্ভাসনেস থেকে এ সব হয়েছে।’

‘বেশ বলুন তাহলে আপনার কী মনে হচ্ছে?’

অযথাই বিজয় সিনহা চট করে চারপাশ দেখে নিয়ে বলল, ‘শরীরে কিছু হয়েছে। মনে হয় কোনো ভাইরাসঘটিত ব্যাপার। অবশ্য আমি ডাক্তার নই, হয়তো আমার ভুল হতে পারে।’

‘তাহলে ডা. সরকারের ওকে পরীক্ষা করা উচিত ছিল, করেছেন কি?’

‘করবেন বলেছিলেন কিন্তু করেননি। এটাই আমার কাছে অবাক লাগছে মি. অরোরা এত পরিশ্রম, এত খুঁটিনাটি যত্ন, এত চিন্তাভাবনা উনি করেছেন, আমিও করেছি, এত টাকা খরচ হয়েছে অথচ এই ব্যাপারটায় ওনার কীরকম যেন একটা এড়ানো এড়ানো ভাব। এই নিয়ে সেদিনও বর্ধমানে কথা কাটাকাটি হয়েছে ওর সঙ্গে। দুবছর ধরে আমি মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করেছি মেয়েটার জন্য। আহা, কী দারুণ যে রানার মি. অরোরা, কী খাটিয়ে আর কী যে ট্যালেন্টেড আপনাকে কী বলব। দুনিয়াকে দেখবার মতো একটা জিনিস ভারত পেয়েছে। আর তার কোচ, বলুন আমার কী জানার অধিকার নেই ওর শরীরে কী হয়েছে? মেয়ে কি শুধু একলা ওনারই, আমারও কি নয়?’

বিজয় সিগারেট ছুড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে আবার চেয়ারে বসল। ‘একটু আগে ওনার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেছে। উনি রাজি হয়েছেন সোনালিকে চেক—আপ করতে। কলকাতায় ফিরে গিয়েই করাবেন।’

‘আপনি কিছু বূঝতে পারছে না, ভাইরাস ছাড়া অন্য কিছু?’

‘সত্যিই আমি বুঝছি না।’ অসহায় মুখে বিজয় তাকাল। রাহুল উঠল। ‘আমি একবার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে আসি।’

রাহুল যাবার সময় সিগারেটের প্যাকেট টেবলেই রেখে গেল।

ডা. সরকার আর তার সঙ্গে দুটি লোক এগিয়ে আসছে। একটি তরুণী বছর দুয়েকের বাচ্চচার হাত ধরে রাহুলের বাঁ—পাশে গিফট স্টোর থেকে বেরোচ্ছে। বাচ্চচটি বার বার দোকানের ভিতরে তাকাচ্ছে। বোধ হয় কিছু একটা চেয়েছিল, মা কিনে দেয়নি। রাহুল চট করে বাচ্চচাটিকে কোলে তুলে নিয়ে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ওর মাকে বলল, ‘আমি বাচ্চচাদের ভালোবাসি, ওর জন্য কিছু কি কিনে দিতে পারি?’

মহিলা থতমত হয়ে আমতা আমতা করছেন। সেই সময় ডা. সরকার এবং দু—জন তার পাশ দিয়ে চলে গেল। রাহুল হাঁফ ছাড়ল। তাকে চিনতে পারেননি। মুখ নামিয়ে কী যেন ভাবতে ভাবতে ডা. সরকার হাঁটছেন। এভাবে হাঁটলে একটু দূরের লোককে দেখা যায় না।

‘না বলবেবেন না প্লিজ। আমি আসছি।’

রাহুল হতভম্ব মহিলাকে দাঁড় করিয়ে গিফট স্টোরে ঢুকল বাচ্চচাটিকে কোলে নিয় এবং মিনিট চারেক পরই বেরিয়ে এল। একটা একফুট লম্বা ভাল্লুক বাচ্চচার হাতে আর তার নিজের পকেটে দুটো চকোলেট বার।

‘এত সুন্দর আপনার বাচ্চচা যে আমি কিছু প্রেজেন্ট করার লোভ সামলাতে পারলাম না। না না, ধন্যবাদ দেবার দরকার নেই। আচ্ছ—’ বাচ্চচার গাল টিপে দিয়ে রাহুল এবার দ্রুত ২২৯ নম্বর ঘরের দিকে ছুটল। শ—খানেক টাকা বেরিয়ে গেল যাক। ডা. সরকারকে এখন সে এড়িয়ে যেতে চায়।

দরজার টোকা দিয়ে ‘কাম ইন প্লিজ’ শুনে রাহুল ভিতরে ঢুকল। অর্জুন টিভি—র দিকে তাকিয়ে বিছানায় পা ছড়িয়ে আধশোয়া। রাহুলকে দেখে অবাক হয়ে উঠে বসে বলল, ‘কখন এলে?’

‘ঠিক সময়ে। আমি দেখেছি স্টেডিয়ামে কী ঘটল। সোনালি কোথায়?’

‘পাশেই ২৩১ নম্বর ঘরে।’

‘ব্যাপারটা কী জানতে হবে। ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই। বিজয় সিনহার সঙ্গে কথা বলেছি। ডা. সরকারের সঙ্গেও বলব কেননা পুরো প্রোজেক্ট এখন বিপদের মুখে এসে গেছে। সোনালির সিলেকশনই আটকে যেতে পারে আজকের এই ঘটনার পর। তাহলে কী হবে ভেবে দেখেছ?’

‘ঠিক এই কথাটা আমারও মনে হয়েছে।’ অর্জুন উঠে বসল। ‘কখন খেয়েছ? আনাব কিছু?’

‘কয়েকটা চিজ স্যান্ডুইচ আনাও আর কফি। আমি এখনো হোটেলে চেন—ইন করিনি। সঙ্গে একটা ব্রিফকেস পর্যন্ত নেই। রাতটা কাটিয়েই চলে যাব। নীচে ট্রাভেল এজেন্টের অফিস রয়েছে। তুমি আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করো কাল সকালেই। এই নাও টিকিট, ওর সিট পাইতে দিতে পারে। জরুরি কাজ ফেলে শুধু এই রেসটা দেখব বলেই এসেছি। আমাকে ফোন করে জানানোর জন্য তোমাকে অজস্র ধন্যবাদ অর্জুন। এখানে উড়ে না এলে, ঘটনাটা দেখলে আমি অন্ধকারেই থেকে যেতাম।’

বলতে বলতে রাহুল শার্ট খুলতে শুরু করল।

‘আমার সুটকেশটা দেখো। ফ্রেশ শার্ট—প্যান্ট পাবে। আর অন্য ব্যবস্থাগুলো রিসেপশনে কথা বলে করে দিচ্ছি।’ অর্জুন টেলিফোন তুলে রুম সার্ভিস চাইবার আগে বলল।

প্যান্ট খুলে, নগ্নদেহে তোয়ালে জনিয়ে রাহুল স্নান করার জন্য বাথরুমে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফিরে এসে টেলিফোন তুলল। অর্জুন জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

‘৩৩১ নম্বর ঘর আমাকে দিন, প্লিজ।’

অর্জুন চাপা গলায় বলল, ‘সোনালিকে সিডেটিভ দিয়েছেন ডা. সরকার, ওর এখন রেস্ট দরকার।’

ফোন বেজে যাচ্ছে। সাত—আটবার রিং হবার পর রিসিভার তোলার শব্দ হল।’

‘হ্যালো, কে বলছেন?’

সোনালির গলা।

‘আমি রাহুল অরোরা। তুমি কি ঘুমোচ্ছিলে?’

‘না। টিভি দেখছিলাম। বাবা ট্যাবলেট দিয়েছিলেন। খাইনি। আমার এখন ঘুমোতে ইচ্ছে করছে না। আপনি কোথা থেকে বলছেন? আজ স্টেডিয়ামে ছিলেন? আমি কী বিশ্রীভাবে দৌড়লাম, পড়ে গেলাম। কেন যে—’

রাহুলের মনে হল সে যেন কান্না চাপার মতো আওয়াজ পেল।

‘আমি বাইরে থেকে ফোন করছি। তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। জানতে চাই কেন এমন হল। কুড়ি মিনিটের মধ্যেই যাচ্ছি। ডা. সরকার তো বেরিয়েছেন তাই না!’

‘হ্যাঁ। ফেডারেশন থেকে দু—জন লোক এসেছিলেন। ওরা আজকের ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চায়। বাবা এন আই এস অফিসে গেছেন।’

‘আমি আসছি।’

ফোন রেখে রাহুল বাথরুমে ঢুকল। বেরিয়ে এসে দেখল স্যান্ডুইচ, কফি টেবলে রাখা। অর্জুন আর তার গড়ন একই সুতরাং টি—শার্ট ও প্যান্ট ঠিকই শরীরে লেগে গেল। সে দ্রুত খেতে শুরু করে দিল।

‘রাহুল খুব সাবধানে কথা বোলো ওর সঙ্গে। কাল যখন ওকে তুলে আনা হল ট্র্যাক থেকে তখন হিস্টিরিয়ার মতো ওর হাবভাব দেখেছি। মনে হচ্ছিল মেন্টাল ব্যালন্স হারিয়ে ফেলেছে।’

রাহুল জবাব না দিয়ে খেয়ে চলল। সে তখন সোনালির ঝুলেপড়া চোয়াল, বিস্ফারিত চোখ আর শ্রান্ত পদক্ষেপ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে।

২৩১ নম্বর ঘরের দরজা পিছনে বন্ধ করে রাহুল তাকাল সোনালির দিকে । তারপর ঘরের চারধার। ঘরটা একা ওর জন্যই। পাশের ঘরে ডা. সরকার ও বিজয়। টিভি বন্ধ করে সোনালি উঠে দাঁড়াল। ওর পরনে ঢলঢলে ম্যাক্সি গাউন।

‘আমি কিন্তু এখন ভালোই আছি। শুধু গলায় একটু ব্যথা আর জলতেষ্টা পাওয়া ছাড়া আর কোনো অসুবিধে নেই। প্রায় এক কলসি জল খেয়ে ফেলেছি।’ সোনালি হেসে উঠল। ‘এখনও তেষ্টা পাচ্ছে। গলার জন্য বাবা ট্যাবলেট দিয়েছেন, সেটা খেয়েছি।’

‘তোমার শরীরে ভারভার লাগা, আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া এসব তো আগে থেকেই হত। বিজয়বাবু তাই বললেন। কলকাতায় ম্যারাথনের পরও হয়েছে।’

‘কিন্তু ম্যারাথন আমি জিতেছি, আমার টাইমও ওয়ার্ল্ড বেস্ট থেকে বেশি পিছনে নয়। বার্সিলোনায় আমি ইনগ্রিড ক্রিস্টিয়েনসেনের সাত বছরের পুরোনো বেস্ট টাইমটা ভাঙবই। সেদিন অত গরমের জন্য পথে একটু বেশি জল খেয়ে ফেলেছিলাম। ৩১ জুলাই বার্সিলোনায়, ভূমধ্যসাগরের ধারে, ওয়েদার খুব ভালো থাকবে। তা ছাড়া রাস্তাও খুব ভালো পাব।’

রাহুলের মনে হল, নিজেকে চাঙ্গা করার জন্যই এইসব কথা বলছে। কিন্তু ওর কটা চোখের পিছনে ভয়ের একটা ছাড়া থেকে থেকেই ভেসে উঠছে।

‘আপনি কি খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন? তাই তো, ষাট লাখ টাকা কামাবার প্ল্যানটা বোধ হয় ভেস্তে গেল?’

‘না। টাকার কথা ভাবছি না।’

‘তা না আর কী ভাববেন, আপনি ব্যবসায়ী।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি মানুষও তো বটে।’

‘মানুষ তো সবাই, কিন্তু কীরকম মানুষ আপনি?’

‘সোনালি আমি তোমার ভালোমন্দর কথা ভাবি। তুমি কী ভাবো না, সোনা জেতার বাইরেও একটা জীবন আছে।’

ওর মুখের উপর দিয়ে দিশেহার একটা মেঘ ভেসে গিয়েই আবার রোদ ফুটে উঠল।

‘আগের কথা আগে। আগে বার্সিলোনার ভাবনা তারপর অন্য জীবনের ভাবনা।’

‘তুমি কি জান, কত্ত লোকের আশা—আকাঙ্ক্ষা তোমার উপর নির্ভর করছে? তোমার ওই দুটো পায়ের উপর?’

‘জানতাম না সেটা। কিন্তু সেদিন ম্যারাথনে আমি খানিকটা বুঝেছি। জানেন, ডেবির সঙ্গে ছোটার সময় বুঝতে পারছিলাম আমি ওকে হারাতে পারব। তাই ইচ্ছে করেই ওকে একটু এগিয়ে যেতে দিয়েছিলাম। ইঁদুর—বেড়াল খেলার মতো। কিন্তু জানতাম আমি জিতব, আমি জানতাম শেষ কিলোমিটারে ওকে আমি গড়াগড়ি খাওয়াব। তখন এটা মনে হতেই আমারমধ্যে অদ্ভুত একটা ভাব জেগে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল আমি কে, সেটা যেন কিছুটা টের পাচ্ছি। নিজেকে যেন খুঁজে পাচ্ছি। পুরো খুঁজে পাব যখন বার্সিলোনায় গিয়ে পৃথিবীকে হারাব।’

‘তুমি কি ঠিক জান, নিজেকে তুমি খুঁজে পাচ্ছ?’

‘তার মানে?’

রাহুল একটু সাবধানে বলল, ‘তোমার ম্যারাথনের অভিজ্ঞতা থেকে তুমি নিজের আসল প্রকৃতিটা টের পেয়েছ। তাই তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘না। জীবনে ওটা তোমার প্রথম সুযোগ ছিল ভিতরের উদবেগ উত্তেজনা বার করে দেবার। তুমি ইঁদুর—বেড়াল খেলার মেয়ে নও?’

‘তাহলে আমি কী?’

‘আমি জানি না। তবে এখন তুমি আমার কাছে একটি মেয়েই। দুটো সোনা জেতার জন্য কঠোর ট্রেনিংয়ের চাপে যন্ত্র হয়ে যাওয়া, স্বাধীন তেতনা হারানো রোবোট নও, যে শুধু নিজেকে জাগিয়ে তোলার জন্য তোতাপাখির মতো শেখানো বুলি আওড়ায়।’

কথা বলতে বলতে রাহুল এগিয়ে এসে সোনালির সামনে দাঁড়িয়েছিল। এইবার সে অদ্ভুত একটা কাজ করল। দু—হাত দিয়ে জড়িয়ে ওকে বুকে টেনে এনে আচমকা ঠোঁটে চুমু খেল। সেইসঙ্গে অনুভব করল মৃদু একটা কম্পন সোনালির বুক থেকে ঝলকে নেমে গেল। ওর দেহ ক্রমশ আলগা, ভারী হয়ে যাচ্ছে বাহুর বন্ধনে। যেন তারিয়ে উপভোগ করছে নতুন একটা ব্যাপার। আর নয়, রাহুল হাত খুলে দিয়ে দু—পা পিছিয়ে এল।

হতভম্ব চোখে সোনালি তাকিয়ে। মুখ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। পিছিয়ে গিয়ে সে খাটে বসে পড়ল।

‘নিজেকে আর খোঁজার চেষ্টা নাই বা করলে সোনালি। এ খোঁজার শেষ কোথাও নেই।’ রাহুলের গলায় মিনতি। ‘তোমার বেঁচে থাকাটা এখন বড় কথা। লক্ষ লক্ষ লোকের উচ্ছ্বাস, আরাধনা, বন্দনা, কাগজে কাগজে ছবি আর প্রশস্তি। এ সবই এক বছর বড়োজোর দু—বছরের জন্য। তারপর দেখবে বিরাট শূন্যতা তোমায় গিলে খাচ্ছে। বহু সুপারস্টারের জীবনে এটা ঘটতে দেখেছি। সে বড়ো ভয়ংকর অবস্থা। তোমার ফেভারিট গায়ক ইমদাদ ক্রমশ ওই অবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তুমিও যাবে। ভেবে দ্যাখো।’

কথাগুলো বলে রাহুল আচমকাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সোনালি অনেকক্ষণ বন্ধ দরজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর বালিশের তলা থেকে ঘুমের ট্যাবলেটটা বার করে মুখে পুরল। তারপর বিছানায় শুয়ে মাথার বালিশটা বুকে জড়িয়ে হাত হয়ে চোখ বন্ধ করল।

আট

রাহুল দিল্লি ফিরে এসে আবার কাজের মধ্যে ডুবে গেল। এনডোর্সমেন্টে আগ্রহী হতে পারে এমন কয়েকটা কোম্পানিতে খোঁজ নিতে লাগল। শ্যাম্পু, মল্ট, ড্রিঙ্কস, সফট ড্রিঙ্কস, সাইকেল টুথপেস্ট, স্পের্টসওয়্যার, রিস্ট ওয়াচ, গায়েমাখা সাবান তৈরির ব্যাবসা সংস্থার কর্তাদের সঙ্গে দেখা করার কাজ সেরে ফেলার জন্য বোম্বাই যাবে ঠিক করল যেদিন তার পরদিনই সে কলকাতার একটা ইংরাজি সান্ধ্য পত্রিকার প্রথম পাতায় দেখল সোনালির ছবি আর পাশে বিরাট মোটা অক্ষরে হেডিং ‘সোনালিকে খঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনুমান অপহরণ করা হয়েছে।’

রাহুলের হাত থেকে কাগজটা পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। সে গোগ্রাসে খবরটা গিলতে শুরু করল: স্টাফ রিপোর্টার, কালকাতা—আসন্ন বার্সিনোলা অলিম্পিকসে পদক জেতার প্রতিশ্রুতি জাগানো মেয়ে লং ডিস্ট্যান্স অ্যাথলিট সোনালি সরকারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বল তার বাবা ডা. সারদাচরণ সরকার আজ পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে জানিয়েছেন। গতকাল সোনালি তাদের ধর্মমানস্থ বাসভবন ও ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য পার্ক সার্কাসে তার পিসির বাড়ি থেকে সকালে একটি ট্যাক্সিতে রওনা হয়েছিল একাই। উদ্দেশ্য, হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে বর্ধমান যাওয়া। সেখানে তার বাবা এবং কোচ বিজয় সিনহা রয়েছেন। সোনালি না পৌঁছানোয় সারাদিন তার অপেক্ষা করেন। অবশেষে পরদিন ডা. সরকার ছুটে আসেন তার বাবা এবং কোচ বিজয় সিনহা রয়েছে। সোনালি না পৌঁছানোয় সারাদিন তারা অপেক্ষা করেন। সবশেষে পরদিন ডা. সরকার ছুটে আসেন আলিপুরে ভাবানী ভবনে। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের এক মুখপাত্র বলেছেন, সোনালিকে সম্ভবত কিডন্যাপ করা হয়েছে বলেই তাদের অনুমান।

তিন সপ্তাহ আগে সোনালি সাই—এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া ইনভিটেশ্যনাল ম্যারাথনে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছিল অকল্পনীয় সময় রেখে এবং জিতেছিল এক লক্ষ টাকা। তার সময় বিশ্বের সেনা সময়ের কাছাকাছি হয়। ধূমকেতুর মতো আবির্ভূতা কুড়ি বছর বয়সি এই মেয়েটির চোখধাঁধানো পারফরমেন্স তাকে অলিম্পিক পদক জয়ের জন্য চিহ্নিত করে দেয়। ১৯৫২—এ কুস্তিগীর যাদবের ব্রোঞ্জ লাভের পর এখন পর্যন্ত কোনো ভারতীয় অ্যাথলিট যা অর্জন করতে পারেনি। সবথেকে বিস্ময়কর, সোনালি সরকার সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত কেউ কিছুই জানে না, এমনকী বাংলার অ্যাথলেটিক্স সংস্থার লোকেরাও তার বিষয়ে অন্ধকারে রয়েছেন। ম্যারাথনে সে কোনো ক্লাব, জেলা বা রাজ্যের তরফ থেকে নয় ‘অসংশ্লিষ্ট’ হিসাবে সরাসরি সাই—এর কাছে নাম পাঠিয়েছেন। ঠিকানা ছিল পার্কসার্কাসে নাসিরুদ্দীন রোডে তার পিসির বাড়ির। সোনালি আগামী মাসে সল্টলেক স্টেডিয়ামে অলিম্পিক ট্রায়ালে দশ হাজার মিটার দৌড়েও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে ঠিক করেছে। বাঙ্গালোরে সদ্য অনুষ্ঠিত ইন্দো—সোভিয়েত মিটে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করার সময় ফিনিশিং লাইনের কাছে পড়ে যাওয়ার দশ হাজার মিটার রেসটি শেষ করতে পারেনি। পতনের আগে পর্যন্ত তার যা সময় হয়েছিল তাতেও অলিম্পিক পদক জয়ের মতো আশা রাখা যায়। আগামী সপ্তাহে সল্টলেক এনআইএস—এ সোনালির পতনের কারণ সম্পর্কে তার মেডিক্যাল পরীক্ষার কথা।

পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সিআইডি, আই জি, গোপাল সিং বলেছেন, ‘এখনই নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তবে সোনালিকে কিডন্যাপ করার কথাটাই আমরা প্রথমে ভাবছি। মেয়েটির পদক জয়ের সম্ভাবনা যথেষ্টই, অলিম্পিকসও এসে পড়েছে। সুতরাং তার অপহরণকারীরা ভেবে থাকতে পারে বহু টাকার মুক্তিমূল্য তারা এখন আদায় করতে পারবে। বহু অর্থবান দেশপ্রেমী যারা ভারতের অলিম্পিক সাফল্য দেখতে চান, তারা হয়তো সোনালির মুক্তির জন্য টাকা নিয়ে এগিয়ে আসবেন যাতে সে বার্সিলোনায় যেতে পারে।’

এরপর যা লেখা আছে রাহুলের তা পড়ার আর দরকার নেই। সোনালির মেডিক্যাল পরীক্ষা কয়েকদিনের মধ্যেই। তা ছাড়া গেমসের জন্য ওর প্রস্তুতিও বাধা পেল। আর কিনা এখন—’

হঠাৎ তার মনে হল, সোনালি নিজেই কোথাও পালিয়ে যায়নি তো? কোনো বন্ধুর বাড়ি, আত্মীয়ের বাড়ি? কিন্তু যেভাবে ও মানুষ হয়েছে তাতে ওর কোনো বন্ধু থাকার কথা নয়। আত্মীয়দের বাড়িতে গেলে ধরা পড়ে যাবে। তা ছাড়া পিসি ছাড়া আর কোনো আত্মীয়কে কি চেনে?

পুলিশ বলছে, কিডন্যাপিং সত্যিই যদি তাই হয় তাহলে ভাবনার কথা। মাত্র একলাখ টাকা সোনালি জিতেছে। তা ছাড়া ডা. সরকারের নিজের কোনো অর্থ নেই। তবে কনসরটিয়ামের টাকা তার কাছে এবং তিনিই তা নাড়াচাড়া করেন। কিন্তু তার ফান্ডেই বা এখন কত টাকা আছে? কিডন্যাপাররা কী এটা ভেবে দেখবে না, টাকা তারা পাবে কোথা থেকে? দেশপ্রেমী ভারতীয়? কিংবা এমনও হতে পারে, স্বর্ণকুমারী প্রোজেক্টের সঙ্গে জড়িত ৬০ লক্ষ টাকার কথাটা, কোনোভাবে হয়তো বাইরের কেউ জেনে গেছে। তারা জানে সোনালিকে ফিরে পাবার জন্য কনসরটিয়াম মুক্তিমূল্য দেবেই দশ লক্ষ টাকা চাইলেও দেবে।

রাহুল যখন ভেবে কিছুই ঠিক করতে পারল না তখন সে সেক্রেটারিকে বলল কলকাতায় অর্জুনের অফিসে ফোন করতে। সে কথা বলবে।

দু—মিনিট পরই ‘হ্যালো, অর্জুন? গতকালের একটা কলকাতার কাগজে খবর দেখলাম একটা, সত্যি?’

‘সোনালি এখন ঠাকুরপুকুরের কাছে একটা প্রাইভেট নার্সিং হোমে রয়েছে।’

‘হিডন্যাপ হয়নি?’

‘না।’

‘তাহলে পুলিশে খবর দিয়ে এসব কী কথা হচ্ছে?’ বিস্ময় থেকে রাহুল এবার রাগে চলে গেল।

‘কী করা হচ্ছে বলতে পারব না তবে ওকে অবজারভেশনে রাখা হয়েছে।’

‘কার ব্যবস্থা এটা, ডা. সরকারের?’

‘তা না হলে আবার কার। সোনালির পা ভারী হওয়া আড়ষ্ট হওয়ার কথা তো জান।’

‘হ্যাঁ, ভাইরাস থেকে। গলাও শুকিয়ে যাচ্ছে। তা সেটা এখনও সারেনি?’

‘না। বাঙ্গালোর থেকে ফেরার সময় প্লেনে বারবার জল চাইছিল। কলকাতায় নেমে দেখা গেল ও বেশ অসুস্থ। ভীষণ ঘামছে আর বলল দুর্বল লাগছে। দমদম থেকে ওদের সবাইকে নিয়ে আমি সোজা আমার বাড়িতে আনি। পরদিন ডা. সরকার ওকে পরীক্ষা করে সিনহাকে বললেন অনন্ত সাতদিন ট্রেনিং বন্ধ রাখতে হবে। শুনে তো সিনহা ক্ষেপে উঠল, চেঁচিয়ে বলল, আপনিই দায়ী সোনালির এই অসুস্থতার জন্য। একেই বেশি সময় হাতে নেই, তার উপর কিনা এক সপ্তাহ বাদ। ডা. সরকার বললেন, তার থেকেও জরুরি ব্যাপার, আর আটদিন পরই সোনালির মেডিক্যাল টেস্ট। তারমধ্যে ওকে তৈরি করে ফেলতে হবে। টেস্টে উতরোতে না পারলে গোটা প্রোজেক্টই চুরমার হয়ে যাবে।’

‘অর্জুন আমি বুঝতে পারছি না, অসুস্থ যদি হয়ে থাকে তাহলে সেরে ওঠার যথেষ্ট সময় এখনও হাতে রয়েছে। ওর তো এইডস বা ওইরকম কিছু তো হয়নি।’

‘কেউ জানে না ওর কী হয়েছে একমাত্র ডা. সরকার ছাড়া। একটা ব্যাপারে উনি প্রচণ্ড জেদি—ফিট না হওয়া পর্যন্ত সোনালির মেডিক্যাল টেস্টে কিছুতেই অ্যাপিয়ার হওয়া চলবে না। আমার মনে হল রাহুল, হার্টের কোনো ব্যাপার। যেভাবে ওরা ওকে গরুমোষ তাড়ানোর মতো করে অমানুষিক ট্রেনিং করিয়েছে, তাতে হার্ট জখম হওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। উনি ভয় পাচ্ছেন, কার্ডিওগ্রামে এটা ধরা পড়ে যাবে।’

‘অবস্থা এখন এমনই যে প্রাইভেট নার্সিং হোমে রাখার মতো?’

‘সরকার তো বললেন আরও রেস্ট, আরও অবজারভেশনে রেখে আবার টেস্ট না করে উনি মেডিক্যালে পাঠাবেন না। তারপর সিনহার সঙ্গে আলাদা কী সব কথাটথা বলে আমাকে জানালেন, সোনালিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এই কথাটা তিনি রটাতে চান। এটা তিনি চান, ওর সেরে ওঠার জন্য খানিকটা সময় যাতে পাওয়া যায়। সোনালি সেরে উঠলে ওকে পাঠাবেন এন আই এস ডাক্তারদের কাছে।’

‘পাগলামি স্রেফ পাগলামি।’

‘তা বলতে পার, কিন্তু আমার কাছে এটাই এই মুহূর্তে যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। তাই আমিই আমার এক বন্ধুর নার্সিং হোমে ওকে রাখার ব্যবস্থা করেছি। কলকাতার একটু বাইরে নির্জন বাড়ি কেউ টের পাবে না। ওখানে কর্মচারী, নার্সরা সোনালিকে কেউ চিনলেও চেপে থাকবে খবরটা, চাকরি যাবার ভয় আছে তো।’

‘পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে, এটা মনে রেখো।’

‘পুলিশ এ ক্ষেত্রে কী করবে? তারা বাবার কথাই তো সত্যি বলে ধরবে। মিসিং পার্সন বলে গণ্য করে এবার মুক্তিমূল্যের জন্য টেলিফোন বা চিঠির অপেক্ষা করা ছাড়া আর কী করতে পারে?’

‘খোঁজখবর তো করবে।’

‘ডা. সরকারের দেওয়া খবর থেকে যতটা পারে রুটিনসাফিক খোঁজ করবে।’

‘এরপর সোনালি ফিরে এসে কী বলবে?’

‘বলবে একদল লোক তাকে ট্যাক্সি থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছল। ডা. সরকার বললেন, তার কয়েকজন ব্যবসায়ী বন্ধু মুক্তিমূল্যের টাকাটা দিয়েছেন। কিডন্যাপররা সরাসরি তার সঙ্গে কথা বলে আর জানিয়েও দেয় পুলিশকে কিছু বললে সোনালির লাশ গঙ্গায় ভাসবে। তাই ভয়ে তিনি পুলিশকে জানাননি। রাহুল, গেমসের পর কমার্শিয়াল কনট্রাক্টে ওর সই করার কারণ হিসাবেও এটা ভালো কাজ দেবে। সোনালি বলবে, যারা তার মুক্তিমূল্যের টাকা দিয়েছিল তাদের ঋণ সে শোধ করতে চায়?’

অর্জুনের কথা শুনে রাহুল বিন্দুমাত্র উল্লসিত হল না। ‘সরকারের সঙ্গে আমি সোজাসুজি কয়েকটা কথা বলতে চাই অর্জুন। সোনালির ট্রেনিং যদি এইসব কারণে বন্ধ থাকে তাহলে কিন্তু আমি গভীর জলে পড়ে যাব। আমি স্পষ্ট জানতে চাই নার্সিং হোমে হচ্ছেটা কি? সরকার এখন কোথায়?’

‘বর্ধমানে কিংবা পার্কসার্কাসে বোনের বাড়িতে, ঠিক জানি না।’

বিরক্ত মুখে রাহুল রিসিভার রেখে দিল। পরদিন সকালেই সে নেহরু স্টেডিয়ামে সাই—এর নতুন মেডিক্যাল ডিরেক্টর ড. যোশির সঙ্গে দেখা করল, তার অফিসের একটি ছেলের ভগ্নিপতি ড. যোশি। গোলগাল ছোটোখাটো, বছর তিরিশের যুবক। পরিচয় দিয়ে রাহুল সরাসরি প্রশ্ন করল, ‘একজন অ্যাথলিটের উপর খুব বেশি ট্রেনিংয়ের চাপ পড়লে কী কী লক্ষণ ফুটে উঠবে?’

‘আপনি আর একটু নির্দিষ্ট করে বলুন। রানার কি?’

‘হ্যাঁ। লং ডিস্টানস।’

‘মাসকুলার ইনজুরির কথা বলছেন কি?’

‘না। মনে হয় হার্টের ব্যাপার।’

‘দেখুন আধুনিক যেসব জ্ঞানের ভিত্তিতে এখন ট্রেনিং পদ্ধতি গড়ে উঠছে তাতে হার্টের জখম আর হয় না। অজ্ঞদেরই এটা হতে পারে।’

‘কিন্তু লক্ষণগুলো কী?’

‘শরীরের উপর প্রচণ্ড ধকল হলে নানাভাবেই তার প্রকাশ হতে পারে। ধরুন সাধারণভাবে বমি, মাথাঘোরা, রক্তচাপ নেমে যাওয়া, হার্টেও—দেখুন অরোরাসাব আমাদের সময়টা অনেক বেঁচে যাবে যদি বলেন আপনার অ্যাথলিটের মধ্যে কি ধরনের লক্ষণ দেখা গেছে।’

‘ধরুন, অনেকটা দৌড়বার পর বা খুব হেভি ট্রেনিংয়ের পর হাত পায়ে ভার ভার লাগে।’

‘এতে চিন্তা করার কী আছে?’

‘গলা শুকিয়ে যায়’ রাহুল বলে চলল, ‘ক্লান্তি আসে, খুব তেষ্টা পায়, ওজনও কমে গেছে।’

‘খাচ্ছে কেমন, স্বাভাবিক।’

‘হ্যাঁ, তাই।’

‘খুব জল খাচ্ছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘পেচ্ছাপও বারবার করছে?’

‘বলতে পারছি না।’

‘এটা হার্টের ব্যাপার নয়। ডাক্তার দেখিয়ে ব্লাড শ্যুগার টেস্ট করান। শুনে মনে হচ্ছে ডায়াবিটিস।’

‘ডায়াবিটিস।’ রাহুলের স্বরে অবিশ্বাস স্পষ্ট। ‘ট্রেনিংয়ের বাড়াবাড়ির কারণে এটা হতে পারে নাকি?’

ড. যোশি মাথা নাড়লেন। ‘কারণে নয়। প্রত্যক্ষ ভাবে নয়। যদি কোনো অ্যাথলিটের রোগটা থেকে থাকে, তাহলে চাপের মধ্যের অবস্থায় এটার প্রকাশ ঘটতে পারে, ট্রেনিংয়ের মধ্যেও হতে পারে। যেকোনো ধরনের শারীরিক গলদ ট্রেইনড অ্যাথলিটদের মধ্যে তাড়াতাড়ি ধরা পড়ার একটা ঝোঁক থাকে। তার মানে এই নয় অ্যাথলেটিকসই এর কারণ। প্রচুর লোকের মৃদু ধরনের ডায়াবিটিস আছে কিন্তু তারা তা জানে না। এরা যদি খেলাধুলোর নামে তাহলে এদের রোগটা খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশিই হবে।’

‘ডায়াবিটিস মানে, শরীর যখন আর চিনি শুষে নিতে পারে না?’

‘হ্যাঁ, চিনি, স্টার্চ।’ ড. যোশি মাথা নাড়লেন। ‘পাকস্থলীর নীচের অংশের তলায়, পেটের পিছন দিকে প্যানক্রিয়াস নামে যে গ্ল্যান্ড, সেখান থেকে যখন যথেষ্ট হরমোন ইনসুলিন আর তৈরি হয় না, তার ফলে তখন অত্যাধিক পরিমাণ চিনি রক্তে আর পেচ্ছাপে জমা হয়। চিকিৎসা না করালে রক্তে জমা বিষ ব্রেইনকে আক্রমণ করবে, তার ফলে কোমার অবস্থায় নিয়ে যাবে, তারপর মৃত্যু। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম জি রামচন্দ্রনের মৃত্যু এভাবেই হয়েছিল। শুরু হয়েছিল ডায়াবিটিস থেকে। খাওয়ার নিয়ন্ত্রণ আর ওষুধের সাহায্যে, বিশেষ করে ইনসুলিনের সাহায্যে, একে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কিন্তু চিরতরে সারিয়ে তোলা যায় না। বছর সত্তর আগে ইনসুলিন চিকিৎসার পূর্ববর্তী সময়ে ডায়াবিটিস ছিল মৃত্যু পরোয়ানা।’

‘আচ্ছা প্যানক্রিয়াসের কাজ বন্ধ হওয়ার কারণটা কি আমরা জানি?’

‘জেনেছি বললে ভুল বলা হবে। যতদূর মনে হয় কিছু স্ট্রেস বা চাপের অবস্থার মধ্যে এটা হওয়া সম্ভব। যদি ওখানে কিছু দুর্বলতা থেকে থাকে তাহলে বা মোটা লোকেদের ক্ষেত্রেও মনে হয় বাড়িয়ে তোলে। গর্ভাবস্থা স্টেরসের একটা কারণ, তেমনি শারীরিক বৃদ্ধি বা গ্রোথ।’

‘গ্রোথ?’ রাহুল চেয়ার থেকে অর্ধেক উঠে শূন্যেই থমকে রইল। ‘শারীরিক বৃদ্ধি?’

‘নিশ্চয়। কৈশোরে ধকধক করে বেড়ে ওঠার সময় প্রায়ই তো ডায়াবিটিস ধরা পড়ে। যে সব অল্পবয়সিদের এটা হয়েছে গবেষণা থেকে দেখা গেছে, শরীরের বাড়ের সময়টায় তারা গড়পড়তা সমবয়সিদের থেকে কমপক্ষে অন্তত একবছর এগিয়ে। অরোরা সাব একটা কথা কিন্তু বলে রাখি, ঠিকমতো ডায়াগনোসিস না করে আগেভাগেই কিছু ধরে নিলে কিন্তু ভুল করা হবে। আপনি যেসব লক্ষণের কথা বললেন তার ভিত্তিতে আমার ব্যাখ্যা ভুলও হতে পারে। সেজন্য দরকার ব্লাড শ্যুগার টেস্ট।’

‘ধন্যবাদ ডক্টর। ওটাই যাতে হয় সেটা আমি দেখছি। আপনার পরামর্শের জন্য সত্যিই কৃতজ্ঞ রইলাম।’

নেহরু স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের অফিসে এসেই রাহুল তার ব্রিফ কেস ঘেঁটে ড. সুদের দেওয়া কার্ডটা বার করল। এককোণে চণ্ডীগড়ের ফোন নাম্বারটা রয়েছে। এস টি ডি ডায়াল করে সে পেয়ে গেল।

‘ড. সুদ। হু ইজ দিস?’

‘রাহুল অরোরা। ডক্টর সেদিন প্লেনে আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় আপনি গ্রোথ হরমোন নিয়ে একটু বলেছিলেন। ওটার নাম কী যেন—’

‘এইচ জি এইচ, হিউম্যান গ্রোথ হরমোন—সোমাটোট্রোপিন। পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে হয়।’

‘আপনার মনে আছে কি, আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম, স্বাভাবিক শিশুদের ওপর এই জি এইচের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? তাইতে আপনি বলেছিলেন এমন কাজ লোকে কেন করবে সেটা আপনি বুঝে উঠতে পারছেন না।’

‘মনে পড়ছে।’

‘ব্যাপারটা আবার একটু জেনে নেওয়ার জন্য ফোন করছি। খুব জরুরি না হলে আপনাকে বিরক্ত করতাম না। শুধু একটা প্রশ্ন। এর উত্তরের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।’

‘বলুন।’ ড. সুদের শান্ত গলা।

‘এইচ জি এইচ প্রয়োগ সম্পর্কে আপনার আপত্তির কারণ কি এটাই যে এর সঙ্গে ডায়াবিটিসের সম্পর্ক আছে?’

‘আপনি যদি বেশ কিছু কাল ধরে বেশি পরিমাণে এইচ জি এইচ দিয়ে যান তাহলে যে অবস্থাটা তৈরি হবে তাকে হাইপারগ্লিসেমিয়া বলে। তার ফলে কতকগুলো ব্যাপার প্যানক্রিয়াসে ঘটে শেষ পর্যন্ত ক্রনিক ডায়াবিটিস দাঁড়াবে। মি. অরোরা, যারা এটা ব্যবহার করে তারা এটা জানে।’

নয়

‘বলছ কী তুমি?’

অর্জুনকে যদি কেউ বলত এইবার তোমার টেবিলে পরমাণু বিস্ফোরণের পরীক্ষাটা করে দেখানো হবে তাহলেও সে বোধ হয় এত অবাক এত সন্ত্রস্ত হত না।

‘আমি ঠিক কী ভুল সেটা জানতেই দিল্লি থেকে উড়ে এসেছি। বড়ো বড়ো কোম্পানির সঙ্গে এনডোর্সমেন্ট চুক্তি করে তারপর বোকা বনে আমার নাম খোয়াতে আমি রাজি নই। তা ছাড়া এটা যদি সত্যি হয় তাহলে একটা জীবনও নষ্ট হয়ে যাবে। আমি এখনি সোনালিকে দেখতে যাব, তারপর ডা. সরকারের সঙ্গে কথা বলব। অর্জুন এখন তুমি আমায় সেই নার্সিং হোমে নিয়ে চলো। তুমি এটাও বুঝতে চেষ্টা করো, এই প্রোজেক্টের সঙ্গে তোমারও স্বার্থ জড়িয়ে আছে। তুমি অলরেডি লাখ টাকা ঢেলেছ।’

‘নিশ্চয় আমার স্বার্থ রয়েছে।’ অর্জুন উঠে দাঁড়াল। ‘তুমি চান করে নাও। সোজা দমদম থেকে আসছ তো?’

‘চান না করলেও চলবে। চলো বেরিয়ে পড়ি।’

ডায়মন্ডহারবার রোড থেকে রাস্তাটা পশ্চিমদিকে গেছে একটা সাজানো কলোনির দিকে। চমৎকার সব একতলা বাড়ি। অনেক বাড়ি তৈরি হওয়ার পথে। পার্ক, পুকুর, খেলার মাঠ, পেরিয়ে মারুতি থামল একটা দোতলা বাড়ির সামনে।

গেট থেকে সিমেন্টের পথ ঘুরে গেছে গাড়ি বারান্দার নীচে। মারুতিকে দরজার কাছে থামিয়ে দু—জনে নামল। দারোয়ানের মতো একজন টুলে বসেছিল। উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল কাকে চাই।

‘মেট্রনকে।’

‘অফিসে যান ওই ডানদিকে।’ হলঘরে দোতলায় যাবার সিঁড়ির পাশের ঘরটা সে দেখিয়ে দিল।

রাহুল দাঁড়িয়েই রইল। ‘তুমি গিয়ে কথা বল, আমি অপেক্ষা করছি এখানে।’

মাঝবয়সি, সুশ্রী মেট্রন হাসিমুখে তাকাল অর্জুনের দিকে। তিনি অর্জুনকে আগেও দেখেছেন, জানেনও এই লোকটি নার্সিং হোমের মালিক, ডা. দাশগুপ্তর বন্ধু।

‘আমি একবার সোনালি সরকারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।’

‘কিন্তু স্ট্রিক্ট, নির্দেশ আছে কারুর সঙ্গে দেখা করতে না দেবার।’

‘কার নির্দেশ?’

‘ডা. দাশগুপ্তর। খবরের কাগজের লোকজন আসতে পারে বলেই এই বারণ।’

‘কিন্তু আমি তো রিপোর্টার নই। আচ্ছা আপনি ওকে একটা ফোন করে বরং বলুন অর্জুন হালদার সোনালির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।’

‘আমাদের ফোনটা দু—দিন হল ডেড। তবে আমি পাশের বাড়ি থেকে করছি। আপনি কাইন্ডলি একটু বসুন।’

মেট্রন ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বেরোলেন। অর্জুন না বসে বেরিয়ে এসে রাহুলকে দেখতে পেল না। চারধারে তাকাল। হলঘরেই তো ছিল, গেল কোথায়? নির্জন, শান্ত বাড়িটা। তকতকে পরিষ্কার। আমেরিকায় এগারো বছর প্র্যাকটিস করে ফিরে এসে দাশগুপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি আর নিয়মশৃঙ্খলা দিয়ে এই নার্সিং হোমটা তৈরি করেছে। অর্জুন দরজার কাছে সিগারেট ধরাল।

অর্জুন যখন মেট্রনের সঙ্গে কথা বলতে গেছে তখনই রাহুল চারদিক দেখে নিয়েছিল কেউ তাকে দেখছে কি না। লোকটা টুল বসে এবং সেখান থেকে সিঁড়িটা দেখা যায় না।

রাহুল তিনলাফে সিঁড়ির মাঝের ল্যান্ডিংয়ে পৌঁছে ঘুরে গিয়েই আবার তিনলাফে দোতলার করিডোরে পৌঁছল। সার সার কেবিন একদিকে, অন্যদিকে বারান্দার রেলিং, নীচে সবুজ ঘাসের উঠোন। করিডরটা সোজা গিয়ে ডাইনে বেঁকেছে ‘এল’ অক্ষরের মতো। অন্তত পনেরোটা কেবিন, সবগুলোর দরজায় পর্দা। দরজার পাশে দেয়ালে নম্বর।

কোন কেবিনে সোনালি? নম্বরটা অর্জুন জানে। যদি সে একবার জিজ্ঞাসা করেও রাখত। এখন নীচে গিয়ে জেনে আসতে গেলে ধরা পড়ে যাবে।

ডানদিকে দরজা খোলার শব্দ হতেই রাহুল একপা পিছিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। হালকা সবুজ রঙের গোড়ালিপর্যন্ত ঢোলা রোগীর গাউন পরা মাঝবয়সি এক মহিলা একটা বই হাতে বেরোচ্ছেন। রাহুল দরজা দিয়ে ভিতরে তাকিয়ে কয়েকটা বই ভরা আলমারি দেখতে পেল। নিশ্চয় লাইব্রেরি।

‘শুনছেন।’ মৃদু গলায় রাহুল বলল। ‘খুব লম্বা, ফর্সা, গোলমুখ একটি মেয়ে এখানে পেশেন্ট। তার কেবিন কোনটে দয়া করে বলবেন?’ রাহুল তার সর্বোত্তম বিগলিত হাসিটা মুখে ফোটাল।

‘আপনি কে হন।’

‘দাদা। দিল্লি থেকে আসছি খবর পেয়ে। সোজা এয়ারপোর্ট থেকে এখানে।’

‘কী হয়েছে ওর?’

‘ডায়াবিটিস।’

‘ওহঃ, এই বয়সেই! সোজা যান সবশেষে বাঁ দিকেরটা।’

‘ধন্যবাদ।’

রাহুল পারলে দৌড়ত। কিন্তু সেটা সন্দেহজনক হবে বলে স্বাভাবিক ভাবেই হেঁটে গেল। পর্দা সরিয়ে দেখল দরজা বন্ধ। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ঠেলতেই খুলে গেল।

সোনালি ঢিলে গাউন পরে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে, সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে। পাশে একটা বই খোলা অবস্থায়। তাকে দেখে ধড়মড়িয়ে সোনালি উঠে বসল। মুখটা বসে গেছে। বাঙ্গালোরে যেমন দেখেছিল তার থেকেও চোপসান মুখ।

‘তোমার কী অসুখ হয়েছে? এরা বলেছে কিছু।’

সোনালির চোখ হঠাৎ ছলছল করে উঠল। হাসবার চেষ্টা করে বলল, ‘কিছুই হয়নি আমার। খাওয়ার গোলমালে এটা হয়েছে। যা খেলে অ্যালার্জি হয় তাই খেয়েই শরীর খারাপ।’

‘চিনি বোধ হয়।’

‘হয়তো। আমাকে চায়ের সঙ্গে চিনি দেওয়া হয় না। বাবা বলেছেন ভবিষ্যতে খাওয়ার ব্যাপারে সাবধান হতে হবে।’

‘তুমি কি কাগজ পড়েছ?’

‘না। এখানে কাগজ দেওয়া হয় না, কেন, কিছু কি বেরিয়েছে? আচ্ছা ফেডারেশন কি আমার মেডিক্যাল টেস্টে না যেতে পাবার জন্য খুব রেগে যাবে? সিলেকশন আটকে দেবে? আমার অসুখের কথাটা তো বাবা ওদের জানিয়েই দিয়েছেন।’

‘তুমি কি এখনো বার্সিলোনা যাওয়ার কথা ভাবছ?’

সোনালির মুখে উদবেগ ফুটল। ‘কেন ভাবন না? ম্যারাথনে তো সিলেক্ট হয়েই গেছি। আর দশ হাজারে—ওহ বাঙ্গালোরে তো প্রায় শেষ করেই এনেছিলাম যদি না—।’

‘কীভাবে শেষ করেছিলে? হুমড়ি খেয়ে। কেন?’

‘ওটা অ্যাকসিডেন্ট।’

‘না সোনালি। আমি দেখেছি তুমি অসুস্থ ছিলে।’

‘না আমি ফিট ছিলাম।’

‘ছিলে না। আমি ট্রাকের পাশে ফেন্সিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে তোমার মুখ দেখেছি, তোমার পা ফেলার ধরন দেখেছি। টেকনিকের আমি কিছুই বুঝি না কিন্তু কোনো জিনিস স্বাভাবিক না হলে সেটা বুঝতে পারি।’

‘কে যেন স্বর্ণকুমারী বলে ডেকেছিল। সেটা তাহলে—’

সোনালি একদৃষ্টে রাহুলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অদ্ভুত ধরনের একটা কোমলতা রাহুল ওর চোখে দেখতে পেল। যেটা কৃতজ্ঞতার কিনার ঘেঁষে যায়।

‘তারপর আর দেখা করলেন না কেন?’ আবার কোমলতা। এবার কণ্ঠস্বরে এবং অভিমানের ছোঁয়া লাগা।

‘করিনি কারণ,’ রাহুল ইতস্তত করল। বাঙ্গালোরের হোটেলের ঘরে হঠাৎ সোনালিকে চুম্বনের প্রতিক্রিয়া সে এবার ওর চোখে, গলার স্বরে দেখতে পাচ্ছে। ‘আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম কিছু খোঁজ খবর নেওয়ার কাজে।’

এই সময় দরজাটা খুলে গেল।

‘সেই কাজেই আপনি কি এখন এখানে?’ প্রশ্ন করলেন ডা. সরকার। তার পিছনে অর্জুনের বিপন্ন মুখটা দেখা গেল।

রাহুল চমকাল না। ডা. যোশির সঙ্গে কথা বলে সে সোনালির অসুখের পিছনে সম্ভাব্য একটা কার্যকারণ সম্পর্কের ধারণা পেয়েছিল। ডা. সুদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হবার পরসেই যম্ভাব্যতা কঠিন হয়ে সন্দেহের আকার পায়। ব্যাপারটা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যতই সে ভেবেছে সে রেগে উঠেছে। তার স্থির ধারণা হয়েছে ডা. সরকার তাচ্ছিল্যভাবেই সোনালির স্বাস্থ্য ধ্বংস করেছেন।

এখন তিনি ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে দরজায় দাঁড়িয়ে। এখন দরকার ধীর শান্ত ভঙ্গিতে, যুক্তিযুক্ত কথার মধ্য দিয়ে সত্যকে বার করে আনা।

সারদাচরণ বললেন, ‘আমাদের দু—জনের মধ্যে কথা হওয়া দরকার তবে এখানে নয়।’

তার মানে সোনালির সামনে নয়। রাহুল মাথা নেড়ে বলল, বিষয়টায় সোনালিরও স্বার্থ আছে সুতরাং শোনার অধিকারও আছে।’

‘ও কিছুই জানে না।’

‘ঠিকই। আর সেটা এবার আপনি জানিয়ে দিন।’

সোনালি কিছুই বুঝতে পারছে না জুজনের কথা। সে বিভ্রান্ত চোখে একবার সারদাচরণ, আর একবার রাহুলের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। শুধু আঁচ করতে পারল তাকে নিয়েই দুজনের মধ্যে কাঠিন্য গড়ে উঠেছে।

‘ওর শরীরের কথা আমাকে ভাবতে হবে।’ সারদাচরণ বললেন, ‘এখন ওর মনে আঘাত লাগার মতো কোনো কথা, ডাক্তার হিসাবেই আমি—’

‘ওসব কথা থাক। ওর বয়স এখন কুড়ি। গোলমালটা কোথায় এবং কেন এটা জানার অধিকার ওর হয়েছে।’ রাহুল এবার গলাটাকে কঠিন করল।

কথাগুলো যে সারদাচরণকে নাড়া দিয়েছে সেটা ওর মুখে ফুটে উঠল। গলাটা শক্ত দেখাচ্ছে। হাতের মুঠো খুলছেন আর বন্ধ করছেন।

‘আপনি বোধ হয় আন্দাজ করার চেষ্টা করছেন আমি কতটা জানি।’ রাহুল বলল, ‘ভাবছেন আমি বোধ হয় ধাপ্পা দিচ্ছি। না, ডা. সরকার, আমি কিছু অনুসন্ধান করেছি। গ্রোথহরমোন, কী যেন নামটা—এইচ জি এইজ বা সোমাটোট্রোপিন দিয়েই কি শুরু করব?’

‘দোহাই, সোনালির সামনে এসব কিছু বলবেন না।’ সারদাচরণ করুণ স্বরে প্রায় মিনতি করলেন।

‘বাবা আমাকে নিয়ে যদি কথা হয় তাহলে আমি শুনতে চাই।’ সোনালি এগিয়ে এসে সারদাচরণের হাত চেপে ধরল। সারদাচরণ ধীরে এগিয়ে এসে খাটের রেলিং চেপে ধরলেন। অর্জুন ধরের মধ্যে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। সোনালি খাটে বসল। রাহুল দেওয়ালে ঠেশ দিয়ে রইল।

‘আপনার হামবুর্গ রিসার্চ নিয়ে বেশি কথা বলার কোনো দরকার এখন নেই।’ রাহুল শুরু করল।

পরের প্রজন্ম যদি আগেরটির থেকে লম্বা হয় তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেন অনির্দিষ্টভাবে আরও লম্বা হবে না? আপনার সমালোচকরা বল মানুষের কঙ্কাল গঠনগতভাবেই তার বেশি বৃদ্ধি সইতে পারবে না। ঠিক বলছি কি?’

সারদাচরণের চোয়াল শক্ত হয়ে বসে গেছে। শুধু একটু কাঁধ নাড়ালেন।

‘কিন্তু মুশকিলটা হল আপনার থিয়োরির সমর্থনে আপনি কোনো প্রমাণ দাখিল করতে পারেননি। যেজন্য কেউ আপনাকে গ্রাহ্য করেনি। কোথাও আপনি পাত্তা পাননি।’

 প্রতিবাদ করার জন্য সারদাচরণ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই রাহুল বলল, ‘পঁচাত্তর সালে আপনি কার্শিয়াংয়ে সোনালিকে পান এক বুড়ো ইংরেজ কর্নেলের বাড়িতে। সোনালির বোধহয় সেসব মনে নেই।’

‘আছে। আমাকে একটা জিপে করে দার্জিলিংয়ে আনা হয়। সেখানে আমার হাত—পা এত জোরে টিপেটিপে দেখেছিলেন যে ব্যথায় আমি কেঁদে উঠেছিলাম।’

সারদাচরণ মাথা ঝুঁকিয়ে সমর্থন করলেন তবে সোনালির মুখের দিকে তাকালেন না।

‘বাচ্চচাটিকে যখন দেখন তখনই আপনি বুঝতে পারেন আপনার থিয়োরিকে প্রমাণ করার, একটা সম্ভাবনা এর মধ্যে রয়েছে। যদি আপনি নির্ভুল হন তাহলে সোনালি তার মা আর দিদিমার থেকেও লম্বা হতে বাধ্য। কী দারুণ সুযোগ আপনার থিয়োরি প্রমাণের জন্য। একটা অনাথ শিশু, তাকে পালন করে তার পরিণত বয়সে পৌঁছানো পর্যন্ত সপ্তাহে সপ্তাহে তার বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করার, খুঁটিনাটি সব লিখে রাখার এমন সুযোগ আর কোথায় পাবেন। আর সেই সব থেকে সিদ্ধান্তে এসে ছাপিয়ে, আপনি আপনার থিসিসকে সমর্থনও করতে পারবেন।

‘তাহলে আমি একটা গিনিপিগ ছিলাম?’ সোনালি তীব্রস্বরে, ভর্ৎসনা মাখিয়ে বলল।

‘বাজে কথা।’ সারদাচরণ রেগে উঠলেন। ‘তোমাকে আমরা আর পাঁচটা বাচ্চচার মতোই মানুষ করেছি।’

‘তাহলে সব বাচ্চচার মতো আমাকে স্কুলে পাঠাওনি কেন?’

প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া গেল না।

‘সোনালিকে নানাভাবে পরীক্ষা করে আপনি দেখতে পান, বয়সের পক্ষে ওর দেহের ক্ষমতা অস্বাভাবিক রকমের বেশি। আর তখনই বোধ হয় অলিম্পিকসের চিন্তাটা মাথায় আসে। আপনার রিসার্চ পেপারকে চড়চড় করে বিখ্যাত করে দেবে যদি সোনালি সোনার মেডেল জেতে। মাত্র একজনকে দিয়ে অবশ্য থিয়োরির যথার্থতা প্রমাণ করা যায় না কিন্তু আপনার ধারণাটাকে তো প্রচণ্ড পাবলিসিটি দেওয়াতে পারবে। যেটা তখন আপনার খুব দরকার ছিল, কেন—না আপনার পেপার আর তখন ছাপা হয় না, আপনি কোনো নতুন কথাও বলতে পারছেন না। খুব হতাশার মধ্যেই ছিলেন।’

‘এসব কথা কে আপনাকে বলেছে?’ সারদাচরণ খরখরে স্বরে বললেন।

‘যেই বলে থাকুক, তাতে কী আসে যায়। আপনি তো ধরেই রেখেছিলেন আপনিই যথার্থ। কিন্তু প্রমাণ দিতে হবে। কীভাবে দেবেন? একবিংশ শতাব্দীর গড়পড়তা উচ্চচতর মানুষকে হাজির করে।’

সোনালি ভীত চোখে রাহূলের দিকে তাকাল। চোখে বিস্ময় এবং ভয়ও। আরও কী যে এরপর সে বলবে এবং সে সব কথায় কী ভয়ংকরতা যে লুকিয়ে আছে তা সে জানে না। আর সেজন্যই ভয়। ওর করুণ মুখ দেখে রাহূল একটু বিচলিত হল। এইভাবে এইসব কথা সবার সামনে সে বলতে চায়নি। সে চেয়েছিল একান্তে ধীরে ধীরে সোনালিকে জানাতে। কিন্তু সে বিশ্বাস করত না। সারদাচরণের সামনে এসব বলা দরকার। সে চাহনি বিশ্বাস করত না। সারদাচরণের সামনে এসব বলা দরকার। সে চাহনি দিয়ে চেষ্টা করল সোনালিকে ভরসা জানাতে। তারপর আবার শুরু করল।

‘বছর তিরিশ আগে এইচ জি এইচ এবং তাই দিয়ে মানুষের শরীরের বৃদ্ধি সংক্রান্ত গবেষণার কথা আপনি শোনেন। তখনি আপনি দেখেতে পেলেন এটাকে আপনার রিসার্চে কাজে লাগতে পারবেন। আপনি সপ্তাহে সপ্তাহে সোনালির বাড় মাপছেন, আপনি জানেন যখন ও সাবালিকা হবে তখন কতটা লম্বা হবে। কিন্তু এইচ জি এইচ দিয়ে বাড়টা অনেক আগেই করিয়ে ফেলা যাবে। তিন প্রজন্ম পরে, আপনার বিশ্বাসমতো, মানুষ যতটা লম্বা হবে সেটা সোনালিকে দিয়ে আপনি এখনই করে দেখাতে পারেন।’

সোনালি দাঁড়িয়ে উঠল। ‘আমাকে যে ইঞ্জেকশনগুলো দিতে? সেগুলো কী ছিল?’ ঠকঠক করে কেঁপে উঠে সে ছুটে গিয়ে সারদাচরণের কাছ ধরে ঝাঁকানি দিল। ‘তুমি আমাকে হরমোন ইঞ্জেকশন দিতে। বলো, বলো!’

সারদাচরণ ধীরে ধীরে সোনালির মাথায় হাত রাখলেন। ‘বিশ্বাস করো এত হালকাভাবে আমি কিছু করিনি। শরীরের বাড় সম্পর্কে যা কিছু পড়াশুনো, যা কিছু জানার সব আমি করেছি। এইচ জি এইচ আর তার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে গভীর স্টাডি করেছি।’

‘তাই বুঝি আমি এত লম্বা। তুমি হিসেব করে আমার এই হাইট করিয়েছ।’ সোনালির মুখে আতঙ্কের আঁচড়ানি পড়ল।

‘হ্যাঁ, হিসেব করেই এটা আমি করিয়েছি। পরের শতাব্দীতে মেয়েরা যতটা লম্বা হবে ততটাই।’

‘তোমার থিয়োরি প্রমাণের জন্য তাই আমাকে একসারসাইজ করাতে, ফিজিওথেরাপি করতে, নিখুঁত শারীরিক নমুনা লোককে দেখাবার জন্য?’

‘সোনালি তুমি স্বর্ণকুমারী। আমি বলছি তুমি কী কী অর্জন করবে। খ্যাতি, গরিমা, খরচ করে উঠতে পারবে না, এতটাকা।’

‘কে পাবে ওইসব?’ দু—হাত ঝাঁকিয়ে সোনালি চিৎকার করে উঠল। ‘কে পাবে? কার্শিয়াং থেকে যে বাচ্চচাটাকে এনেছিলে? আমিই কি সেই? খ্যাতি গরিমা কি আলি মায়াকং পাবে না মড়ার শরীর থেকে বার করা হরমোনগুলো পাবে? জবাব দাও।’

‘তুমি জন্ম অ্যাথলিট।’ সারদাচরণ কেন সোনালির কথাগুলো শুনতে পাননি এমনভাবে বলতে লাগলেন। ‘তোমার বাবা ব্রোঞ্জ পাওয়া জার্মান অলিম্পিক রোয়িং টিমে ছিল। তোমার দিদিমা কঠিন পার্বত্য জঙ্গলের মেয়ে। ক্ষমতাটা তুমি জন্মসূত্রেই পেয়েছ। চ্যাম্পিয়ান রানার করার জন্য তোমার ইঞ্জেকশন দিইনি, তা দিয়ে করা যায় না। তোমাকে লম্বা করার, বিরাট করার জন্য দিয়েছি। দৌড়ের মধ্য দিয়ে তুমি প্রমাণ করছ যে তোমার কাঠামো বাড়তি বৃদ্ধিটাকে মানিয়ে নিতে পেরেছ। এর কোনো দুর্বলতা নেই। ওটাই আমার সারাজীবনের কাজের চূড়ান্ত জয়।’

‘ডা. সরকার, এই জয় কিন্তু একদমই নিরর্থক, ফাঁপা। কারণ এটা আপনি প্রকাশ করতে পারবেন না।’

রাহুলের মুখের দিকে সবাই তাকাল বিস্ময়ভরে।

‘সোনালিকে কি এবার আপনি বলবেন, কেন ওকে ওখানে রেখেছেন?’

ভীত চোখে সোনালি তাকাল রাহুলের দিকে। ‘তার মানে? কেন আমি এখানে?’

‘সেটা উনিই বলবেন।’

সারদাচরণ ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে লাগলেন মুখ নীচু করে। ‘বলতেই হবে?’

‘হ্যাঁ।’ সোনালি দাবি জানাল।

‘যখন তোমায় হরমোন দিচ্ছিলাম তখন জানতাম এর একটা ঝুঁকি আছে। তোমার শরীরের ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু জানতাম না ঝুঁকিটা কতটা। এটা জানতাম দীর্ঘদিন ইঞ্জেকশন চালিয়ে গেলে চিরকালের জন্য প্যানক্রিয়াস গ্ল্যান্ডটার ক্ষতি হতে পারে। আর সেটাই হয়ে গেছে। কেন তুমি বাঙ্গালোরে পড়ে গেছলে, ছুটতে পারছিলে না, পা ভার হয়ে যাচ্ছিল জান? তোমার ডায়াবিটিস হয়েছে। ইঞ্জেকশনই এর জন্য দায়ী।’

‘না, দায়ী নয়।’ সোনালি হিংস্র চোখে তাকাল, কথা বলল শান্ত গলায়, ‘দায়ী তুমি।’

ওকে স্পর্শ করার জন্য সারদাচরণ হাতটা বাড়ালেন কিন্তু স্পর্শ না করে সেটা ঝুলে পড়তে দিলেন, সোনালির চোখে ঘৃণা দেখে। ‘আমি ফাটকা খেলেছিলাম। এত তাড়াতাড়ি যে ঘটে যাবে ভাবিনি। চেয়েছিলাম প্রথমে তোমার সোনার মেডেল জেতাটা হয়ে যাক। তারপর তোমাকে বলতাম কেন এসব করেছি। ওলিম্পিকসের সাফল্য তোমার সব ক্ষতি পুষিয়ে দিত তাহলে। যশ, খ্যাতি, অর্থ, জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্য তোমাকে সান্ত্বনা দিত। এজন্যই আমি তোমাকে স্বর্ণকুমারী করে তোলার সবরকম চেষ্টা করেছি। টাকার আমার দরকার নেই। আমিও চাইও না। তোমার স্বাস্থ্যের বিনিময়ে আমি টাকা চাইনি, সোনালি, আমি শুধু একযা বৈজ্ঞানিক সত্যকে দেখাতে চেয়েছি।’

হঠাৎ পাগলের মতো সোনালি হাসতে শুরু করল। তীক্ষ্ন গলায় কান্নার মতো একটা শব্দ। কুঁজো হয়ে সে হেসে যাচ্ছে আর পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে। মাথাটা তুলে সে একবার বিছানায় চিৎ হয়ে গড়িয়ে পড়ল। আর সেই সঙ্গে হাসিটাও বেড়ে গেল। ঘরের সবাই চোখ সরিয়ে অস্বস্তিভরে অন্যত্র তাকাতে লাগল।

সোনালির হাসি একসময় বন্ধ হল। চুপ করে সে মেঝের দিকে তাকিয়ে গভীর কোনো ভাবনায় যেন ডুবে গেল। তারপর শান্ত গলায় একসময় বলল, ‘সবাই এবার ঘর থেকে বেরিয়ে যান। আমায় একা থাকতে দিন।’

.

সাতদিন পর রাত্রে রাহুলের শোবার ঘরের টেলিফোন বেজে উঠল। তখন সে ভিডিয়োর সেল অলিম্পিকসে পুরুষদের ফাইনাল ১০০ মিটার দৌড় দেখেছিল। উঠে গিয়ে রিসিভার তুলল।

‘হ্যালো, হ্যাঁ আমি, কে অর্জুন?’

‘রাহুল, ডা. সরকার মিথ্যে করে পুলিশকে বলেছিলেন সোনালিকে পাওয়া যাচ্ছে না। আর আজ সকালে আমি সত্যি করেই নার্সিং হোম থেকে জানলাম, সোনালি ওখান থেকে কাল রাতে কোথায় চলে গেছে। কেউ জানে না। সরকার, তার বোন, বিজয় সিনহা তারাও কেউ জানে না। ওকে তো আমাদের খুঁজে বার করতে হবে।’

‘খুঁজে লাভ নেই। কোনোদিনই ওকে আর পাওয়া যাবে না।’ রাহুল রিসিভার রেখে ভিডিয়োর সামনে এসে বসল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *