মালবিকা

মালবিকা – উপন্যাস – মতি নন্দী

ঘটনাটার শুরু এই বাড়ি থেকেই, তাই গৃহস্বামী ও গৃহকর্ত্রীকে আগে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক।

সুধাংশুকুমার গাঙ্গুলি বাংলা খবরের কাগজে চিফ সাব—এডিটরের চাকরি করেন। পঁয়ত্রিশ বছরের সাংবাদিক জীবনে তিনটি কাগজে কাজ করেছেন। খুব ছোটোই তাঁর সংসার। স্ত্রী উমা, তিনমাস—বিয়ে—হওয়া একমাত্র ছেলে প্রভাংশু আর ছেলের বউ সুচিত্রা। অবশ্যই একটি চাকর আছে, কল্যাণ। ইতিহাসের এম এ সুধাংশু সাবধানী এবং হিসেবি কিন্তু কৃপণ নন। একটু রক্ষণশীল কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল রেখে উদারও। ঔদার্যের চরম সীমা এখন পর্যন্ত ছুঁয়েছেন ছেলের বিয়েতে। প্রভাংশু সুবর্ণবণিকের মেয়ে বিয়ে করতে চাইলে তিনি আপত্তি করেননি। সুচিত্রা রূপবতী, ধনী কন্যা এবং বাংলা অর্নাসসহ গ্র্যাজুয়েট। প্রায় পনেরো ভরি সোনার গহনা সে বাপের বাড়ি থেকে এনেছে। সুধাংশু এটা রোধ করতে না পারলেও রঙিন টিভি সেট ও রেফ্রিজারেটর কিছুতেই নিতে রাজি হননি। ওগুলো তাঁর আছে। কিন্তু থাকলেও অনেক ছেলের বাপ তো লোভ সামলাতে পারেন না কিন্তু তিনি পেরেছেন। নিজের সম্পর্কে সুসভ্য ও শিক্ষিত বলে তাঁর চাপা একটা গর্ব আছে।

চাকরি—জীবন শুরু করে বড়দার কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়ে সুধাংশু কলকাতার উপকণ্ঠে পাতিপুকুরে তিন কাঠা জমি কিনে ফেলেন। কলকাতা অদূর ভবিষ্যতে বাড়বে এবং পাতিপুকুর কলকাতার মধ্যে ঢুকে যাবে এটা তিনি পঁয়ত্রিশ বছর আগেই বাস্তব হালচাল থেকে বুঝে গেছলেন। দাদার ঋণ তিন বছরেই শোধ করে, তিনতলার ভিত গেঁথে প্রথমে একতলা একটি বাড়ি তৈরি করেন। এ—জন্য দু—বছর ধরে নানান জায়গা থেকে সস্তায় গৃহনির্মাণ সামগ্রী তাঁকে সংগ্রহ করতে হয়েছিল।

যতটা পরিশ্রম ও অধ্যবসায় নিয়ে সুধাংশু একতলা বাড়িটাকে দোতলায় পরিণত করেন ঠিক ততটা যত্ন ও নিষ্ঠা নিয়েই তিনি প্রতিদিন প্রভাংশুকে পড়াতে বসতেন। ছেলের শিক্ষার ভিতটা উচ্চচ মাধ্যমিক পর্যন্ত গেঁথে দেওয়ায় সে শিবপুর থেকে উচ্চচ প্রথম শ্রেণি পাওয়া ধাতুবিদ্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিশাখাপত্তনমে ইস্পাত কারখানায় এখন মোটা বেতনের চাকুরে।

ছেলের সম্পর্কে সুধাংশু যতটা নিশ্চিন্ত, উমা সম্পর্কে ঠিক ততটা নন। গ্রামের স্কুল থেকে কোনোক্রমে মাধ্যমিক পাশ করা, সাদাসিধা সরল উমা, একজন চিফ সাব—এর বউয়ের পক্ষে যতটা চৌকশ হওয়া উচিত, সুধাংশুর ধারণায় ততটা নয়। উমা বাইরে একা চলাফেরা করেন, দোকানে বাজারে যান, দর করে দামও কমাতে পারেন, কম তেল মশলায় সুস্বাদু করে রাঁধতে পারেন, সর্বোপরি একত্রিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে একবারও গলা চড়িয়ে স্বামীর সঙ্গে কথা বলেননি। ঠান্ডা, নরম, ভালোমানুষ বিশেষণগুলো যেন গহনার মতো উমার অঙ্গে শোভা পায়।

কিন্তু সুধাংশুর চাপা একটা খেদ রয়ে গেছে। বাইরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে গেলে, সাংসারিক বিষয়ের বাইরে কথাবার্তা হড়কে গেলেই উমা হাবুডুবু খায়। পৃথিবীতে কত কী ঘটছে, ভারতেও কত কী ওলটপালট হচ্ছে তার কোনো খবরই উমা রাখে না। মণ্ডল কমিশন, রামজন্মভূমি, বোফর্স, গ্লাসনস্ত, পেরোস্ত্রৈকা, খোলা বাজার, রুশদি, তেন্ডুলকর, ম্যান্ডেলা এইসব বেশি তলিয়ে বোঝার হয়তো দরকার নেই কিন্তু ব্যাপারটা কী বা লোকগুলো কেন বিখ্যাত সেই সম্পর্কে তো ওপর ওপর কিছু জেনে রাখা দরকার। ইংরেজি বাংলা দুটো খবরের কাগজ বাড়িতে আসে। বাংলা কাগজের হেডিংগুলো পড়লেও তো কিছু জানা যায়। কিন্তু উমার প্রবল আলস্য কোনো কিছু পড়ায়। গল্প—উপন্যাসও পড়ে না।

তাই সুধাংশু প্রায়শই সকালের বাজার এনে রান্নাঘরের দরজার কাছে চেয়ারে বসে, উমার জানা দরকার এমন সব হেডিং কাগজ থেকে পড়ে শোনান। ইংরেজি কাগজ হলে ইংরেজির সঙ্গে বাংলা তর্জমাও করে দেন। কুটনো কোটা আর দুনিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার কাজ উমা একসঙ্গেই চালান।

আজ রবিবার। সকাল প্রায় দশটা। একটু আগে বউকে নিয়ে প্রভাংশু চন্দননগরে শ্বশুরবাড়ি গেল। সেখানে রাত্রিবাস করে কাল বিকেলে ফিরবে, পরশু সে বউকে নিয়ে বিশাখাপত্তনমে চলে যাবে। উমা আজ দুপুরে বকুল আর তার মেয়ে মালবিকাকে নিমন্ত্রণ করেছেন। মালবিকার বিয়ে আর আট দিন পরেই, উমা তাকে আইবুড়ো ভাত খাওয়াবেন। ঠিক করেছেন, কাঁচালঙ্কা সর্ষেবাটা দিয়ে চিংড়ি মাছের ভাপা রাঁধবেন, এটা তাঁর খুবই পছন্দের। ইঞ্চিচারেক সাইজের চিংড়ি রোজ পাওয়া যায় না, আজ ভোরে বাজারে গিয়ে সুধাংশু পেয়ে গেলেন। দিনটা তা হলে ভালো যাবে, এমন এক আনন্দের বশবর্তী হয়ে চল্লিশ টাকা দিয়ে আধ কেজি চিংড়ি কিনে ফেললেন।

সুধাংশু তিন সপ্তাহ আগে ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা ভেঙেছিলেন বাস থেকে নামার সময় পড়ে গিয়ে। আঙুলের প্লাস্টার কাটা হয়েছে বটে কিন্তু কলম ধরে লিখতে পারছেন না। আশা করছেন এক মাসের ছুটিটা ফুরোবার আগেই বোধহয় পারবেন। আঙুলের জোর পরখ করার জন্যই চিংড়ি ও রুই মাছ ভরা আটশো গ্রামের থলিটি তিনি ডান হাতে ধরে বাড়ি ফিরলেন, পিছনে আর একটি থলি হাতে কল্যাণ।

ঘটনাটির কেন্দ্রে রয়েছে মালবিকা, অতএব তার এবং তার মা বকুলের কথা এবার বলা যাক।

পিতৃমাতৃহীন বকুল লালিত হয়েছে মামার বাড়িতে। মামারা ছাপোষা গেরস্ত। ভাগ্নিকে তাঁরা গলগ্রহ মনে করতেন। কোনোক্রমে ক্লাস নাইন পর্যন্ত বকুলকে পড়িয়ে আর তাঁরা পড়াননি। লাস্যে ভরা, চপল প্রকৃতির বকুল এজন্য মোটেই দুঃখ পায়নি। ভাঙাচোরা, স্যাঁতসেঁতে, অপরিচ্ছন্ন বাড়িতে স্থানাভাব তাই সুযোগ পেলেই সে পাড়ার এবাড়ি—সেবাড়ি করে বেড়াত। তাই করতে করতে সে একসময় পাড়ার বাইরেও পা বাড়াল। সিনেমায়, রেস্টুরেন্টে, ট্যাক্সিতে তাকে দেখা গেল পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে। অচিরেই বকুলের গতিবিধি সম্পর্কে নানান মুখরোচক খবর মামিদের মারফত মামাদের কানে পৌঁছল। তাঁরা বকুলের বিয়ের ব্যবস্থায় উদ্যোগী হলেন।

মামাদের নিষ্কৃতি দিয়ে হঠাৎই এক সন্ধ্যায় সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুর দেওয়া বকুল বাড়ি ফিরল। বাড়ির লোকেরা প্রথমে ঠিক করতে পারেননি, কী ধরনের প্রতিক্রিয়া তাঁরা প্রকাশ করবেন। একটা বড়ো খরচ বেঁচে গেল, এই স্বস্তিটা চেপে গিয়ে কেউ রাগ দেখালেন, কেউ বললেন বেশ করেছে। বকুল মিনিট দশেকের বেশি বাড়িতে থাকেনি।

দেড়শো বছরের পুরোনো বিশাল এক বাড়ির, বহু শরিকের অন্যতম দিলীপরঞ্জন দত্তকে বকুল রেজেস্ট্রি বিয়ে করে। সুশ্রী, গৌরবর্ণ, দীর্ঘদেহী এবং বাকচতুর দিলীপরঞ্জন বাড়ির একটিমাত্র ঘরের অধিকারী, ইস্টার্ন রেলওয়ের কেরানি এবং পেশাদার মঞ্চে অনিয়মিত ক্ষুদ্র এক অভিনেতা। তার সঙ্গে দিলীপরঞ্জনের বয়সের তফাত পনেরো বছরের হলেও বকুল মনে করেছিল সে লটারির প্রথম পুরস্কার জিতেছে। পরে সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারে লটারির টিকিটটি ছিল জাল। আভিজাত্যপূর্ণ চালচলন, কথাবার্তা ও চেহারাটাই শুধু সে দেখেছিল কিন্তু এইসবের আড়ালে দিলীপরঞ্জনের বৈষয়িক অবস্থা বা তার চরিত্রের দৈন্যদশা সে লক্ষ করেনি। বিয়ের চার মাস পরই তার স্বামী সাসপেন্ড হয় ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে। যেভাবেই হোক দিলীপরঞ্জন সেটা সামাল দেয়। মেয়ে মালবিকা জন্মায় বিয়ের পর অষ্টম মাসে। তাই নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ও মামার বাড়িতে যেসব অশ্লীল মন্তব্য ও হাসাহাসি হয় তার অধিকাংশই বকুলের কানে আসে এবং সে নীরবে তা হজম করে, কেননা ঘটনাটা সত্য। দিলীপরঞ্জনকে বিবাহে বাধ্য করার জন্য তাকে দিয়ে কৌমার্য ভঙ্গের কাজটি সে করিয়ে নিয়েছিল, এই তথ্যটি মালবিকা বারো বছর বয়সে একদিন বাবা—মায়ের তিক্ত ঝগড়ার মধ্য দিয়ে জেনে গিয়েছিল।

মালবিকা বড়ো হয়ে ওঠে এমনই পরিবেশে যেখানে বাবা মাঝেমধ্যে রাতে বাড়ি ফেরে না, মাঝেমধ্যে মাতাল হয়ে ফেরে, বাবার হাতে মা মার খায়। বাড়ির অন্যান্য অংশে বসবাসকারী জ্যাঠা, কাকা, তাদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা তাকে এবং তার মাকে ঠারেঠোরে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, হেয়জ্ঞান করে এটা সে বাল্য থেকেই দেখে এসেছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে ভর করে জীবন সম্পর্কে একটা অনিশ্চিত বোধ, আশ্রয়চ্যুত হবার ভয়, নিরাপদ স্থিতি পাওয়ার ব্যাকুলতা এবং নিছকই জৈব অস্তিত্ব রক্ষার জন্য দরদভরা অবলম্বন খোঁজার চেষ্টা আর এইগুলো থেকেই তার মধ্যে গড়ে উঠেছে ফলাফলের পরোয়া না করা, বাস্তববোধ বর্জিত, অন্ধ আবেগে ভরা এমন এক মানসিকতা যার সঙ্গে তার মা বকুলের বহু জায়গায় মিল রয়েছে। যেমন মিল আছে দু—জনের প্রায় একই ধরনের পারিবারিক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে বড়ো হয়ে ওঠার। মায়ের থেকে স্কুলে দুই ক্লাস বেশি পড়ে মেয়ে পড়া ছেড়েছে।

মালবিকা তার মাকে পছন্দ করে না এবং অবহেলাও করে না, একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া নিয়ে সে ভালোবাসে বকুলকে। তবে বাবাকে সে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকী বাবার মতো গৌরবর্ণ, লম্বা চেহারার পুরুষদের দেখলে তার ভিতরটা কুঁকড়ে শক্ত হয়ে যায়। সে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে থাকে যতক্ষণ না লোকটি চোখের সামনে থেকে সরে যায়।

হয়তো এই প্রতিক্রিয়া থেকেই সে আকৃষ্ট হয় সমীরণ মিত্রের প্রতি।

বকুল বুঝে গেছল লেখাপড়া মালবিকার দ্বারা হবে না। কিন্তু সে লক্ষ করেছে মালবিকার গানের গলাটি খুব সুন্দর। সুরেলা এবং মধুর। লতা মঙ্গেশকর বা আশা ভোঁসলের গাওয়া ফিল্মের গানগুলো হুবহু অবলীলায় গেয়ে দেয়। সে স্থির করে মেয়ে যেন তার মতো একটা অকেজো, রান্না—খাওয়া—ঘুমসর্বস্ব গৃহপালিত জন্তু না হয়ে ওঠে। জীবনে তার যা—সব আকাঙ্ক্ষা ছিল—একটা মোটরগাড়ি, খরচ করার জন্য হাতে প্রচুর টাকা, নিজস্ব একটা বাড়ি, তাতে সাজানো ঘর, রোমান্টিক অনুগত স্বামী এবং স্বাধীনতা, এসব তার কাছে স্বপ্নই রয়ে গেল। কিন্তু মেয়ের ভাগ্যে যেন স্বপ্নটা সম্ভব হয়, যেন বিরাট গায়িকা হয়ে প্রচুর বিত্ত অর্জন করতে পারে এই আশা সে মনে লালন করতে থাকে। সে জানে, শুয়ে বসে শুধুই আকাশকুসুম দেখলে, যেটা সে নিজে করেছে, কোনোদিনই সেই কুসুম পৃথিবীর মাটিতে ফুটিয়ে তোলা যাবে না।

মেয়েকে গান শেখাবার জন্য উদ্যোগী হল বকুল। সেজোজায়ের মেয়েকে গান শেখাতে আসত এক মহিলা, বকুল তাকেই মালবিকার শিক্ষিকা রাখল। মাস দুয়েক পর সে বুঝল এই মহিলা বারো বছরের মেয়েকে গান শেখাতে পারবেন, উনিশ বছরের মেয়েকে নয়। এই সময়ই একদিন বকুলের আলাপ হল উমা ও সুধাংশুর সঙ্গে।

কাগজের সিনেমা—নাটক বিভাগের সম্পাদকের সঙ্গে সুধাংশুর হৃদ্যতা আছে। ম্যাজিক, নাচ, যাত্রা, অফিসের নাটক, জলসা ইত্যাদির কার্ড প্রায়শই সে চেয়ে নেয়, অনুষ্ঠান দেখে দু—চার প্যারাগ্রাফ লিখে দেবার বিনিময়ে। মহাজাতি সদনে একটা ব্যাঙ্ক রিক্রিয়েশন ক্লাবের নাচ—গান ও নাটক অনুষ্ঠানের দু—খানা কার্ড সুধাংশু চেয়ে নিয়েছিলেন একটি কারণেই, সমীরণ মিত্র গান গাইবে।

বৈঠকি চালে টপ্পা, খেয়াল ঢঙের পুরাতনী আর থিয়েটারের গান গেয়ে সমীরণ আসরের পর আসর মাত করে এখন জনপ্রিয়তম গায়কদের একজন। ইতিমধ্যেই তার বারোখানা গানের ক্যাসেট বাজারে বিকোচ্ছে। শুধু কলকাতায়ই নয় গৌহাটি, পাটনা, কটক তো বটেই দিল্লি বোম্বাই বাঙ্গালোর থেকে বাঙালি সমাজের ডাক তার কাছে আসে। আমেরিকার নিউ জার্সির বাঙালিদের আমন্ত্রণও এসেছিল কিন্তু সেই সময় জন্ডিস হওয়ায় যেতে পারেনি। কিন্তু সমীরণ মিত্রর সংগীত—ভক্ত হিসাবে সুধাংশু বা উমা এই অনুষ্ঠানে আসেননি। সমীরণ তাঁদের পাড়ার ছেলে।

তাঁদের তিনখানা বাড়ির পরই থাকত সমীরণরা। ভাড়া দু—খানা ঘরে আটজন লোক। ওর বাবা ছিল আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে কম্পাউন্ডার। সমীরণকে তার কৈশোর থেকেই তাঁরা চিনতেন। একটু বাউন্ডুলে স্বভাবের, লেখাপড়ায় কলেজ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল বাবার জুতোপেটার জোরে, ছোটো বয়সেই ভালো তবলা বাজাত আর জোড়াসাঁকোয় তখনই কোনো এক ওস্তাদের কাছে তালিম নিতে শুরু করেছিল। তাঁদের বাড়িতেও সে আসত, উমাকে ডাকত মাসিমা বলে। ক্রমশ নামডাকের সঙ্গে এল প্রচুর অর্থ এবং ব্যস্ততা। সমীরণ বিয়ে করল তারই ছাত্রী শিঞ্জিনীকে এবং মানিকতলার কাছে বাড়িভাড়া নিয়ে পাতিপুকুর ছেড়ে চলে যাবার পর যোগাযোগটা এখন ক্ষীণ হয়ে গেছে।

সমীরণ সেদিন গাইল আটখানা গান, প্রতি গান পাঁচ মিনিটের। তৃতীয় গানটি যখন গাইছে উমা তখন চাপা গলায় স্বামীকে বলেন, ‘যে ক্যাসেটটা আমাদের দিয়েছিল তাতে এই গানটা আছে।’ সুধাংশু তখন বলেন, ‘ওর আগমনী গানের একটা ক্যাসেট আছে, সুন্দর নাকি গেয়েছে, ভাবছি টেলিফোন করে একটা চাইব।’

ওঁদের এই কথোপকথন উমার পাশের আসনে বসা বকুল শুনেছিল। তার পাশে ছিল মালবিকা। সমীরণের তৃতীয় গানটি শেষ হতেই সে উমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বিনীত স্বরে বলে, ‘ওঁকে কী আপনি চেনেন?’

‘কাকে, সমীরণকে? ওকে তো ছোটোবেলা থেকেই চিনি। আমাদের প্রতিবেশী ছিল।’ উমা চাপা গর্বে কিঞ্চিৎ ফেঁপে উঠে অতঃপর বলেন, ‘আমাকে মাসিমা বলে।’

দ্রুত চিন্তা করে নিয়ে বকুল বলে, ‘খুব নাম ওনার, খুব ভালো গান। আমার মেয়ের খুব ইচ্ছে ওঁর কাছে গান শেখার।’

‘শিখুক না।’ যেন একটা ছাড়পত্র দিলেন উমা এমন ভঙ্গিতে বলেন।

‘শুনেছি খুব খুঁতখুঁতে, যাকে মনে করবেন কিছু হবে শুধু তাকে ছাড়া আর নাকি কাউকে শেখাতে চান না।’

‘ওর স্কুলে অত ছেলেমেয়ে সবাই কি সন্ধ্যা মুখুজ্জে না লতা মঙ্গেশকর হবে?’

‘না না স্কুলে নয়, পার্সোনালি আলাদা করেও উনি শেখান।’

‘তাই নাকি!’

‘আপনি একটু ওঁকে বলবেন দিদি?’ ঝুঁকে উমার হাত চেপে ধরে বকুল।

‘আপনার মেয়ে কেমন গায় তা না জেনে কী করে বলব?’ উমা হঠাৎ সাবধানী হয়ে যান।

‘সে তো নিশ্চয়। তবে একবার পরীক্ষা করে যদি দেখেন…দিদি আপনি একটু ওঁকে বলুন না।’ বকুল মিনতি করে হাতটা উমার হাঁটুতে ছোঁয়ায়।

‘আচ্ছা বলব, তবে কথা রাখবে কি না জানি না। খুব বড়ো হয়ে গেছে তো!’

সমীরণের অষ্টম গানটি শেষ হতেই সুধাংশু ওদের নিয়ে আসেন গ্রিনরুমে। কিছু লোক ঘিরে রয়েছে তাকে। সমীরণ কাকে যেন বলছিল তার নিজস্ব সঙ্গতকারদের গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবার জন্য। একজন জুঁই ফুলের গোড়ে তার হাতে তুলে দিয়ে প্রণাম করল। চার রকমের বৃহদাকার মিষ্টির প্লেট নিয়ে দাঁড়ানো লোকটি অনুনয় করল, ‘অন্তত একটা’, সমীরণ তাকে হাত দিয়ে সরিয়ে, ‘একটাও নয় ভাই। চল্লিশে পা দিয়েছি, মিষ্টি খাওয়া বনধ।’ এই বলেই সে উমা ও সুধাংশুকে দেখতে পেল।

‘আরে মাসিমা!…মেসোমশাই।’ সমীরণ এগিয়ে এসে প্রণাম করল। উমা গর্বে আপ্লুত হয়ে পিছনে দাঁড়ানো বকুলের দিকে মুখ ফেরালেন, মুখের ভাবখানা, দেখলে তো! বকুল বিশ্বাস করল, এই মহিলার অনুরোধ সমীরণ ফেলতে পারবে না।

‘তোমার গান শুনতে এসেছি।’ উমা বললেন।

‘তা হলে এই মিষ্টিগুলো আপনার। এতক্ষণ কান তেতো করেছেন এবার মুখটা মিষ্টি করে নিয়ে বলুন কেমন লাগল।’ সমীরণ লঘুস্বরে কথাগুলো বলে প্লেটটা লোকটির হাত থেকে নিয়ে উমার সামনে ধরল।

‘তোমার গানের সুখ্যাতির জন্য আমার জিভ মিষ্টি করার দরকার হয় না।’ উমা প্লেটটা নিয়ে বকুলের দিকে এগিয়ে ধরে বললেন, ‘নাও, তুলে নাও।’ নিজেও একটা তুলে নিলেন।

বকুল একটা সন্দেশ তুলে নিল বিনা বাক্যব্যয়ে। উমার খুশির সঙ্গে তাল রাখতে সে এখন বদ্ধপরিকর। উমা প্লেটটা ধরলেন মালবিকার সামনে। সে একটা রসে ভেজা চিত্রকূট তুলে নিল। সুধাংশুও বাদ পড়লেন না।

মালবিকা একদৃষ্টে সমীরণের মুখের দিকে তাকিয়ে। লোকটার মধ্যে কীরকম যেন এক সম্মোহন ক্ষমতা রয়েছে যে—জন্য তার উনিশ বছরের হৃৎপিণ্ডটার স্পন্দন হঠাৎই বেড়ে গেল! মাঝারি উচ্চচতা, মাঝারি গড়ন। ফুলহাতা গরদের পাঞ্জাবির আড়ালে একটা বলিষ্ঠ শরীরের আভাস। সমীরণের গায়ের রং মালবিকাকে তাদের বাড়ির পুরনো মেহগনি কাঠের টেবলটাকে মনে পড়াল। টেবলটার পালিশ উঠে গেছে কিন্তু এই লোকটার মুখের চামড়ায় যেন ঘাম তেল মাখানো।

এত কালোর উপর এত সুন্দর মুখ সে কখনো দেখেনি। কপালটা সামান্য চওড়া, মাথাটা ছোটো কিন্তু অবিন্যস্ত চুল দিয়ে সেটা মানানসই করে নেওয়া, তাতে জুলফি নেই। লম্বাটে ডিমের মতো মুখের আকৃতি, লম্বা কান, পাতলা ঈষৎ গোলাপি ঠোঁট, ঠোঁটের উপরে ডান নাকের নীচে একটা তিল, বাঁকা ভুরু দুটি যেন পেনসিল দিয়ে আঁকা। আর চোখ!

সমীরণের চোখ দুটোই মালবিকাকে সম্মোহিত করেছে।

মণি দুটো ঈষৎ পিঙ্গল এবং সাদা অংশের থেকে বেশি জায়গা নিয়েছে। বুলবুলির মতো মণি দুটো ছটফট করে যাচ্ছে সারাক্ষণ। কথা বলতে বলতেই ঘরের এদিক—ওদিক তাকাচ্ছে, চাহনিতে মজা পাওয়া বাচ্চচাদের মতো চঞ্চলতা। উমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সমীরণ দু—তিনবার মালবিকার দিকে তাকাল। চাহনিটা হালকা বাতাসের মতো কপাল থেকে নেমে বুকের উপর কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়েই ঝরে পড়ল। শিরশির করে উঠল মালবিকার সারা দেহ।

প্রতিবারই কেঁপে উঠল তার বুক। চুন্নিটা বুকের উপর থেকে সামান্য সরে রয়েছে সেটা বিছিয়ে দেবার জন্য সে কোনো চেষ্টা করল না।

‘এ কী তুমি খাচ্ছ না যে! আমার মতো মিষ্টি খাওয়া ছেড়েছ নাকি?’ সমীরণ কথাটা বলে হাসল। সরলভাবে মাড়িতে বসানো ঝকঝকে দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল আর গালের পেশি কুঞ্চিত হয়ে ভাঁজ ফেলল। চোখের মতো মুখটাও নড়াচড়া করে।

বকুল চাপা কঠিন স্বরে বলল, ‘খেয়ে নে।’

‘না।’ মায়ের নির্দেশ অমান্য করে মালবিকা জেদি গলায় বেপরোয়ার মতো বলল, ‘আমিও মিষ্টি ছেড়ে দিয়েছি।’

‘এত কম বয়সেই! কবে ছেড়েছ?’

‘এই মাত্র।’

সমীরণ কিছু একটা বলতে গিয়ে থমকে অবাক চোখে তাকাল। চিত্রকূটটা প্লেটে রেখে দিল মালবিকা।

‘তা হলে অভিনন্দন। এই নাও।’ জুঁই ফুলের গোড়েটা সে এগিয়ে দিল। গোড়েটা নেবার সময় সমীরণের আঙুল সে মুহূর্তের জন্য ইচ্ছে করেই স্পর্শ করল। ভ্রূ তুলে সমীরণ তাকাতেই মালবিকার গৌরবর্ণ মুখটা গরম হয়ে উঠল, চোখ আনত হয়ে এল। মালাটা আলতো করে বুকে চেপে ধরল।

বকুলের চোখে কিছুই এড়ায়নি। তার শুধু মনে হল, কথাটা পাড়ার জন্য এখনই মোক্ষম সময়।

‘দিদি, বলুন না কেন এসেছি।’

উমা এতক্ষণ মুখে হাসি ফুটিয়ে মালবিকা আর সমীরণের কথা শুনে যাচ্ছিলেন। প্লেটটা নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা সুধাংশুর হাতে তিনি ধরিয়ে দিলেন, ‘এটা শেষ করো।’

সমীরণ হাতঘড়ি দেখল। একটি লোককে, বোধহয় ড্রাইভারকে বলল, ‘গাড়িটা এনে গেটের কাছে রাখুন।’

‘তোমার কি তাড়া আছে, কোথাও যাবে?’ উমা বললেন।

‘হাওড়ায় যাব।’

‘সমীরণ তো এখন দিনে দু—তিনটে ফাংশান করে।’

সুধাংশু এতক্ষণ কথা বলার একটা উপলক্ষ খুঁজে বার করলেন।

‘না মেসোমশাই, বন্ধুর ছেলের অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্নে যেতে হবে। আর দিনে দু—তিনটে ফাংশান কোনোকালেই আমি করিনি।’

‘কিন্তু আমি যেন শুনেছিলাম—’ অপ্রতিভ সুধাংশু থেমে গেলেন।

‘তোমার ছেলে কত বড়োটি হল? বউমা কেমন আছে, গানটান করে?’

‘ছেলে এখন ক্লাস সিক্সে পড়ছে, ক্যালকাটা বয়েজে। আর শিঞ্জিনী মাঝে মধ্যে তানপুরা নিয়ে বসে বটে তবে সে কিছু নয়। এখন গানের স্কুলটা দেখাশোনাতেই ব্যস্ত থাকে।’

‘দিদি—’

‘বলছি, বলছি। যাব যাব করেও আর যাওয়া হয়ে ওঠে না, সমীরণ এবার তোমার বাড়িতে একদিন যাব।’

‘গেলে তাড়াতাড়ি আসুন। পার্ক সার্কাসে একটা ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা হচ্ছে। পেলে স্কুলটা মানিকতলায় রেখে পার্ক সার্কাসে আমরা গিয়ে থাকব। কালোয়ারপটিতে থাকতে আর ভালো লাগছে না।’

‘স্কুল না হয় রয়ে গেল কিন্তু তুমি যে স্পেশাল করে শেখাও তার কী হবে?’

সমীরণ একটু অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি জানেন দেখছি! তেমন বুঝলে স্পেশাল ক্লাস পার্ক সার্কাসেই তখন করব।’

‘তোমাকে এই মেয়েটিকে স্পেশালে শেখাতে হবে। খুব ভালো গায়। তোমার কাছে ছাড়া কারুর কাছে শিখবে না, মেয়ের একেবারে ধনুক ভাঙা পণ! তুমি কিন্তু না বলতে পারবে না। তোমাকে বলার জন্য ওর মা, এই যে ইনি আমার বোনের মতো, আমাকে খুব ধরেছে।’

উমা এইরকমই। কিছুক্ষণ আগে মাত্র আলাপ, একদমই জানেন না মেয়েটির গলায় গান না মেশিনগান কোনটা রয়েছে অথচ তদবির শুরু করলেন এমনভাবে যেন নিজের মেয়ের জন্য বলছেন।

সমীরণ মিটমিট চোখে মালবিকার দিকে তাকাল। কী যেন সে মুখটায় দেখল। ধীরে ধীরে মৃদু স্বরে বলল, ‘কিন্তু মাসিমা, আলাদা করে যাদের শেখাই আগে তাদের গান শুনি, নিষ্ঠা আছে কি না দেখি। আমি যে পরিশ্রম করব সেটা যে বেনাবনে মুক্তো ছড়ানো হবে না সেটা তো আগে আমায় বুঝে নিতে হবে। এরকম ঘটেছে, ভস্মে ঘি ঢেলেছি।… তোমার নাম কী?’

মালবিকার গলা দিয়ে স্বর বেরোতে চাইল না। ঢোঁক গিলে কোনোরকমে বলল, ‘মালবিকা দত্ত।’

‘বাহ, বেশ নাম। থাকো কোথায়?’

‘রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে, গৌরীবাড়ির কাছে।’

‘তা হলে তো খুব কাছেই। কারুর কাছে গান শেখো?’

‘একজনের কাছে বাড়িতে কিছুদিন শিখেছিলুম। কয়েকটা ভজন আর রবীন্দ্রসংগীত।’ কুণ্ঠিত স্বরে মালবিকা বলল।

উমা মনের জোর পেয়ে গেছেন। এত জিজ্ঞেস করছে যখন তা হলে স্পেশালে মেয়েটাকে নেবেই। ‘কবে যাবে গান শোনাতে?’

সমীরণ যাকে গেটের কাছে গাড়ি আনতে বলেছিল, সেই ধুতিপরা প্রৌঢ় লোকটি এসে বলল, ‘গাড়ি এনেছি, গেটের সামনেই আছে।’

‘গাড়িতে থাকুন, আমি যাচ্ছি।’ সমীরণ এবার উমার দিকে ফিরে বলল, ‘আপনারা কি নাটকটা দেখবেন না বাড়ি যাবেন? যান তো তা হলে—’ সমীরণ একটু তফাতে দাঁড়িয়ে থাকা একটি যুবকের দিকে তাকাল। ‘তা হলে গাড়ির ব্যবস্থা হতে পারে।’

‘মালি কবে কখন যাবে?’ বকুল তার উৎকণ্ঠা চেপে রাখতে পারল না। ব্যাপারটা সে আধপাকা করে রাখার পক্ষে নয়।

‘ডাকনাম বুঝি মালি?… আসুন তিন—চারটে দিন বাদ দিয়ে। কাল জামশেদপুর যাব। সকাল দশটা—এগারোটা নাগাদ আসুন, আমার ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়।… মাসিমা?’

‘আর নাটক দেখে কী হবে বলো?’ উমা প্রশ্নটাকে সিদ্ধান্তের আদলে বকুলের দিকে পাঠাল।

‘ও আর দেখার কী আছে।’ বকুল সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন জানিয়ে দিল।

‘মিহির।’ সমীরণ দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটিকে ডাকল। দ্রুতপায়ে প্রায় কৃতার্থের মতো সে সমীরণের কাছে এল।

‘আমার ছাত্র মিহির, মিহিরচাঁদ শীল। ওর গাড়ি আছে, ও আপনাদের পৌঁছে দেবে। মিহির, ইনি আমার মাসিমা। এঁদের সবাইকে বাড়ি পৌঁছে দাও।’ প্রায় হুকুমের সুরেই সমীরণ নির্দেশ দিল। মিহির অনুগৃহীতের মতো মাথা নেড়ে গেল।

‘তোমার কোনো অসুবিধে হবে না তো?’ নিছকই ভদ্রতাসূচক একটা অপ্রয়োজনীয় কথা বলল সমীরণ।

‘না না, একদমই না।’ মিহির শশব্যস্তে উত্তর দিল।

সমীরণ দরজার দিকে এগোল। ‘আপনারা একটু দাঁড়ান আমি আসছি।’ বলে মিহির পিছু নিল সমীরণের। ঘরে এখন নাটকের লোকদের ভিড়। পোশাক, মেকআপ ইত্যাদির ব্যস্ততার মধ্যে ওরা চারজন দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে।

‘তোমার নামটি তো এখনও জানলুম না।’ উমা জিজ্ঞাসা করলেন বকুলকে।

‘বকুল দত্ত।’

‘ছেলেমেয়ে ক—টি?’

‘এই মালিই, আর হয়নি।’

‘হয়নি না হওয়াওনি।’ উমা মুখ টিপে হেসে বললেন, ‘আমারও এক ছেলে, ইঞ্জিনিয়ার। এই তিন মাস হল বিয়ে হয়েছে। আগে থেকে ওদের ভাবসাব ছিল। উনি খবরের কাগজে চিফ সাব—এডিটার’—মিহিরকে দেখে তিনি থেমে গেলেন।

‘সমীরণদাকে তুলে দিয়ে এলুম। আসুন আপনারা।’

মাখন রঙের অ্যাম্বাসাডর গাড়ি। মিহিরের সঙ্গে তার এক বন্ধু রয়েছে। পিছনের সিটে মেয়েরা তিনজন, সামনের সিটে চালক মিহির ছাড়া তার বন্ধুটি ও সুধাংশু।

‘আমার বন্ধু বেলেঘাটা যাবে, ওকে যদি আগে নামিয়ে দি তা হলে কি আপনাদের অসুবিধে হবে?’ মার্জিত, নম্র বাকভঙ্গি, গলার স্বর সরু। ঘাড় ফিরিয়ে মিহির তাকাল পিছনে, আসলে তাকাল উমার দিকে।

মালবিকার ভালো লাগল না এটা অর্থাৎ তাদের দু—জনকে অগ্রাহ্য করে উমার দিকে অনুমতি চাওয়ার মতো করে তাকানোটা। এর আগেও সমীরণ যখন বলল, ‘মিহির, ইনি আমার মাসিমা?’ তখনও তারা দুজন উপেক্ষিত হয়। তখন সে রাগেনি, দুঃখও পায়নি। শুধু একটা অকারণ অভিমান বুকের মধ্যে ফেঁপে উঠেছিল। বাড়িতেও বাইরের কেউ এলে বলা হয়, ‘আমার সেজোজায়ের মেয়ে’। ব্যস, নামটুকু পর্যন্ত নয়।

মালবিকা আন্দাজ করতে পারে কেন তারা যথেষ্ট মনোযোগ লোকেদের কাছ থেকে পায় না। সব জায়গাতেই তাদের ভূমিকাটা থাকে অনুগ্রহপ্রার্থীর। মায়ের বাপের বাড়ির তরফে বংশগৌরব নেই, পরিচয় দেবার মতো মান্যগণ্য, ধনী কোনো আত্মীয় নেই। মা বা সে নিজে লেখাপড়া করেনি।

তার বাবা দিলীপরঞ্জন রেলের কেরানি এবং সবাই তাকে দুশ্চরিত্র বলেই জানে।

একটা মিষ্টি সুশ্রী মুখ আর ধারালো দেহ ছাড়া সে জানে তার আর কোনো সম্পদ নেই। সে আরও জানে, এই সম্পদ ভাঙিয়েই তাকে জীবন গুছিয়ে নিতে হবে। তার গলায় সুর আছে কী নেই, বড়ো গাইয়ে হবে কী হবে না, সে—সব পরের কথা, এখন তাকে সমীরণ মিত্রর গানের স্পেশাল ক্লাসে জায়গা করে নিতেই হবে। গান এবং সমীরণের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া তার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই বন্ধ গলি থেকে রাজপথে যাওয়ার।

মিহির তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে উমা ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘কোনো অসুবিধে হবে না বাবা, আমাদের এখন কোনো তাড়া নেই। কী গো বকুল, তোমার কী তাড়া আছে?’

‘না দিদি। যখন হোক পৌঁছলেই হল।’ বকুল শুধু খুশিই নয় তৃপ্তও।

কতদিন পর যে সে মোটরগাড়িতে চড়ল। বাড়িতে বড়োভাসুরের মোটর আছে, মেজোভাসুরের ছেলের স্কুটার আছে। আজ কুড়ি বছর প্রায় বিয়ে হয়েছে কিন্তু বড়োভাসুরের গাড়িতে দু—তিনবার ছাড়া তার চড়া হয়নি। মোটরে চড়ার দুর্নিবার আকর্ষণটা বকুলের ছোটোবেলা থেকেই। দিলীপরঞ্জনের একটা মরিস মাইনর ছিল। চার হাত ফেরতা ছোট্ট গাড়ি। রংচটা, জানলার কাচ ওঠে না, সিটের স্প্রিং বসে যাওয়া গাড়িটাতেই বকুল বিয়ের আগে দিলীপরঞ্জনের সঙ্গে ঘুরেছে। যতই পুরোনো ঝরঝরে হোক মোটরগাড়ি তো বটে! চড়লেই নিজেকে রাস্তার লোকেদের থেকে যথেষ্ট আলাদা বোধ হয়। কিন্তু বিয়ের মাস কয়েক পরই গাড়িটা আর রইল না। ঘুষ নিতে গিয়ে দিলীপরঞ্জন ধরা পড়ল, গাড়িটা সে তখনই বিক্রি করে দেয়।

‘শ্বশুরবাড়িতে কে কে আছেন?’ উমা তাঁর কৌতূহল মেটাবার কাজ শুরু করলেন।

‘শ্বশুর—শাশুড়ি নেই, তা ছাড়া সবাই আছেন। খুবই বনেদি, বড়ো পরিবার।’ বকুলের উত্তরের মধ্যে ঝোঁকটা পড়ল ‘বড়ো পরিবার’ শব্দ দুটোয়।

‘আলাদা হাঁড়ি?’

‘হ্যাঁ। শাশুড়িই আলাদা করে দিয়ে গেছেন।’

‘ভায়ে ভায়ে সদভাব নেই বুঝি?’

‘না না, ঠিক তা নয়। খুব বুদ্ধিমতী ছিলেন তো! বলতেন, যতদিন আমি আছি ততদিন সদ্ভাব থাকবে, এক হেঁসেলে চলবে কিন্তু আমার মরার পর কে কীরকম হয়ে যাবে তা তো জানি না, দিনকাল তো আর একরকম থাকে না।’

‘ভালোই বলেছেন। দিনকাল যে কীভাবে বদলেছে, কত রকমের কাণ্ড যে চারদিকে ঘটছে। চোর ডাকাত খুনিতে দেশটা ভরে যাচ্ছে। হুট হুট করে কত বড়োলোক এখন গজাচ্ছে আর গরিবরা আরও গরিব হচ্ছে।’

উমার কথাটা শুনে সামনের সিটে সুধাংশু হর্ষ এবং আশ্বস্ত বোধ করলেন। একটু—আধটু রাজনীতির হালচাল মেয়েদের জানা থাকা ভালো। খবরের কাগজের হেডলাইন পড়ে শোনানোটা যে বৃথা যায়নি সেটা বুঝতে পারছেন।

মেট্রো রেলের জন্য মহাজাতি সদনের সামনের চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের মাঝখানটা খোঁড়া রয়েছে প্রায় দশ বছর। দু—পাশের সরু পথ ধরে বাস ট্রাক মোটর চলাচল করে। সেই পথের দুর্দশা বর্ণনার অযোগ্য। এর উপর রয়েছে ট্র্যাফিক জ্যাম। মিহিরের মোটর এখন জ্যামে পড়েছে। একহাত—দু—হাত করে গাড়ি এগোচ্ছে মহাত্মা গান্ধী রোড মোড়ের দিকে।

‘এই যে দু—পাশের বাড়ি দেখছ,’ সুধাংশু তাঁর স্ত্রীর কথারই জের টেনে বললেন, ‘এগুলো সব মারোয়াড়িরা কিনে নিয়েছে। একটাও আর বাঙালির নেই, বিক্রি করে দিয়ে কলকাতার আশেপাশে চলে গেছে।’

‘একটাও নেই বোলো না, তোমার জটুদারা তো থাকে বিডন স্ট্রিটের মোড়ে।’

‘ওই দু—তিনটে বাড়ি পাবে। ব্ল্যাকমানির জোরে এমন লোভ দেখায় যে পড়তি অবস্থার বাঙালিরা আর লোভ সামলাতে পারে না। আসলে বাপ—ঠাকুর্দার জমানো টাকা পায়ের উপর পা তুলে খেয়ে খেয়ে এমন একটা কুঁড়েমির অভ্যাসে—’

‘এটা কিন্তু ঠিক কথা নয় মেসোমশাই।’

বকুল ঝাঁকুনি খেয়ে সোজা হয়ে মেয়ের ঊরুতে একটি রামচিমটি কাটল। সেটা অগ্রাহ্য করে মালবিকা বলল, ‘সব বাঙালিই কুঁড়ে নয়। ব্যবসা করে সবাই বড়োলোক হতে চাইলে গানটা তা হলে গাইবে কে? সমীরণ মিত্র নিশ্চয়ই কুঁড়ে নন। খেটেছেন বলেই আজ এমন উঁচু জায়গায় পৌঁছেছেন। কলকাতার ক—টা মারোয়াড়ির অটোগ্রাফ নিতে মানুষ ভিড় করে?’

মিহির সন্তর্পণে মুখ ফিরিয়ে মালবিকার মুখটা একবার দেখার চেষ্টা করল আর উমা দ্বিগুণ উৎসাহে বলে উঠলেন, ‘বাঙালি যদি কুঁড়েই হত, তোমার কথাই ধরো না, অত খেটে কি বাড়িটা করতে পারতে? ছেলেকে নিয়ে যে রোজ পড়াতে বসতে, কুঁড়ে হলে কি বসতে? মালবিকা ঠিকই বলেছে।’

সুধাংশু নীরব রইলেন এবং এই নীরবতা অনুধাবন করে বকুল বুঝে নিল ভদ্রলোককে নয় তার স্ত্রীকেই পাত্তা দিতে হবে। সমীরণ মিত্র একে প্রণাম করে, মাসিমা বলে!

‘ঠিকই বলেছেন দিদি, দাদা যদি কুঁড়ে হতেন তা হলে ছেলে কি ইঞ্জিনিয়ার হতে পারত?’

সুধাংশু এবং উমা উভয়েই প্রীত হলেন। এবং বকুলকে পালটা প্রীত করার জন্য উমা বললেন, ‘তুমিও বাপু কুঁড়ে নও। মেয়েকে গান শিখিয়ে বড়ো করার জন্য ঠিক ঠিক লোককে ধরার কাজে তো তুমি গাফিলতি করোনি। …এটা কিন্তু ভালোই। যাকে দিয়ে করিয়ে নিলে কাজ হবে, তুমি তাকে দিয়ে নিশ্চয় করিয়ে নেবে, চক্ষুলজ্জা করলে চলবে না।’

বকুল ঠিক করতে পারল না সে হাসবে না গম্ভীর হবে। তাকে কতটা ঠেস দেওয়া বা প্রশংসা করা হল এটা সে বুঝতে পারছে না। মাঝামাঝি পথ ধরে সে বলল, ‘আপনি ঠিক আমার শাশুড়ির মতোই কথা বলেন।’

‘বলবই তো! কত বয়সে উনি মারা যান?’

‘ছিয়াত্তর বছরে।’

‘আমার এখন পঞ্চান্ন। কত আর পার্থক্য, আমরা একই রকমের কথা তো বলবই!’

অবশেষে গাড়ি চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ থেকে বাঁ দিকে মহাত্মা গান্ধী রোডে মোড় নিল। খানিকটা স্বচ্ছন্দে গিয়ে আটকা পড়ল কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে।

‘উমা দ্যাখো, এই ডান দিকে ইউনিভার্সিটি, স্যানসক্রিট কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কফি হাউস, হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুল, সব এই জায়গাটায়।’ সুধাংশু স্ত্রীকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহের দায়িত্বটা পালন করলেন। তাঁর ধারণা, কলকাতার কোথায় কী রয়েছে সেটা মেয়েদের জেনে রাখা দরকার। উমা ঝুঁকে জানলা দিয়ে তাকালেন ডান দিকে, আর পাঁচটা অপরিচ্ছন্ন, ভাঙাচোরা বড়ো রাস্তার মতো কলকাতার একটা ট্রাম রাস্তা দেখলেন মাত্র।

মিহির এখনও পর্যন্ত চুপচাপ, তার বন্ধুটিও। উমার মনে হল, যার গাড়িতে চেপে যাচ্ছি, ভদ্রতা বা কৃতজ্ঞতাবশতও তার সঙ্গে কিছু কথা বলা উচিত।

‘হ্যাঁ বাবা, তুমি কতদিন সমীরণের কাছে গান শিখছ?’

‘বছর চারেক।’ মিহির বলল।

আমহার্স্ট স্ট্রিটের মোড়ে পুলিশ হাত তুলে রয়েছে। শেয়ালদার দিকে যাবার রাস্তাটা খোলা। মোড়টা তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যাওয়া দরকার, তাই সে উমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, ‘কতটা শিখেছ’—র উত্তর সঙ্গে সঙ্গে দিতে পারল না। রাস্তার দু—ধারের ফুটপাথে কাঁচা সবজি আনাজের বাজার বসেছে। উমার চোখ ইতিমধ্যে সেই দিকে নিবদ্ধ হল।

‘অল্প দিন শিখছি।’ সামনে দাঁড়ানো বাস—এর পিছনে গাড়ি থামিয়ে মিহির বলল। গোটা পনেরো ওল—এর একটা টিলার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকা উমার কানে বোধহয় কথাটা ঢোকেনি। বকুলেরও কিছু জানার কাছে তাই সে শুরু করল কথাবার্তা।

‘রোজ শিখতে যাও?’

‘হপ্তায় একদিন, রবিবার।’

‘কতক্ষণ শেখান?’

‘ঘণ্টাখানেক।’

‘কত করে দাও?’

‘মাসে দু—শো।’

বকুল চুপ করে রইল। মনে মনে দ্রুত একটা হিসাব করে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস চেপে সিটে হেলান দিল। মেয়েটার বোধহয় আর সমীরণ মিত্রর কাছে শেখা হল না। হঠাৎ তার মনে হল, উমা নামের তার পাশের এই প্রৌঢ়া যদি অনুরোধ করে তা হলে সমীরণ কি তা ফেলতে পারবে? অনেক ছাত্র—ছাত্রীর মধ্যে কেউ যদি অর্ধেক মাইনেতে শেখে তাতে সমীরণের মতো পয়সাওলার কিছু যাবে আসবে না।

কিন্তু সে পুরোপুরি হতাশও হচ্ছে না। সমীরণের চোখ দুটো যখন মালির মুখের দিকে তখন কি মুখটাই শুধু দেখছিল? আর ওর নজরের মধ্যে বার কয়েক যে—জিনিসটা ফুটে উঠছিল, মালির এই বয়সের বকুল বহু পুরুষের চোখে একদা তা দেখেছিল। বকুল সে—সব অগ্রাহ্য করেও শেষ পর্যন্ত দিলীপরঞ্জনের পুরোনো মরিস মাইনরের, বাকপটুতার আর গৌরকান্তির কাছে হার মেনেছিল।

গাড়ি শিয়ালদহ ফ্লাইওভারের দক্ষিণ দিকে এসে বাঁ দিকে ঘুরল। রেলব্রিজ পেরিয়ে এখন ঢুকেছে বেলেঘাটার ঘিঞ্জি রাস্তায়। গাড়িতে কথাবার্তা আর হচ্ছে না। বকুল বুঝতে পারছে না গাড়ির অন্যান্যরা মনে মনে এখন কী চিন্তা করছে? জুঁইয়ের মালা হাতে মেয়েটা ঠায় সামনের দিকে তাকিয়ে। কী ভাবছে সে জানে! সমীরণের চাহনির জবাবে ওর চোখ যে সংকেত পাঠাচ্ছিল বকুলের কাছে তার অর্থ খুবই স্বচ্ছ। আর সেইজন্যই সে অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। তবে মালি বোকা মেয়ে নয়, শুধু এইটাই তার ভরসা।

মিহিরের বন্ধু নেমে গেল রাসমণির মোড়ে। সুধাংশু হাত—পা শিথিল করে বসার সুযোগ পেয়ে মিহিরের সঙ্গে আলাপ শুরু করলেন।

‘গাড়ি কতদিন চালাচ্ছেন?’

‘আপনি নয় তুমি বলুন।’

‘বেশ। কতদিন শিখেছ?’

‘বারো—তেরো বছর।’

‘খুবই অল্প বয়সেই। গাড়িটা তোমাদেরই।’

‘হ্যাঁ। বাবার।’

‘তোমার বাবা কী করেন?’ পিছন থেকে উমা বললেন।

‘আমাদের একটা প্রেস আছে। এন্টালিতে, বাড়ির কাছে। পঞ্চান্ন বছর আগে বাবাই শুরু করেন, খবু অল্প বয়সে, ছোট্ট একটা ঘরে। অসম্ভব পরিশ্রম করে প্রেসটাকে বড়ো করেন। সাতটা ভাষায় কম্পোজ আর ছাপার কাজ হত।’

‘এখন হয় না?’ আবার উমার প্রশ্ন।

‘হয় না কারণ সময় বদলেছে। একটু আগে আপনি বললেন, দিনকাল যেভাবে বদলেছে, টেকনোলজির ব্যাপারেও তাই। এত অবিশ্বাস্য উন্নতি ঘটে গেছে যে তার সঙ্গে তাল দিয়ে না চললে আপনি পিছিয়ে যাবেন। আমরাও পুরোনো মেশিনপত্র বিক্রি করে পিটিএস কিনেছি, চার কালারের অফসেট মেশিন কিনেছি।’

‘আমাদের অফিসেও পিটিএস—এ কম্পোজ হয়।’ সুধাংশু এই বলে পিছনে মাথা ঘুরিয়ে উমাকে তারপর জানালেন, ‘টাইপরাইটারের মতো ছোটো ছোটো মেশিন। আগে যেমন ময়লা কাপড়—চোপড় পরে লাইনো অপারেটররা কম্পোজ করত, পিটিএস—এ তা করতে হয় না। অনেক মেয়েও কাজ করে। একেবারে অফিসের টাইপিস্টের মতো কাজ। তবে ঘরটাকে ভীষণ ঠান্ডা রাখতে হয়, কম্পিউটার আছে তো।’

সুধাংশুর মনে হল, এখন এর বেশি স্ত্রীকে আর কিছু তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়। টেকনোলজির গূঢ় কাজকর্মের ব্যাপারগুলো মোটরগাড়ির থেকে বাড়িতে বসে জানিয়ে দেওয়াই ভালো। অবশ্য তার আগে পিটিএস সুপারভাইজারের কাছ থেকে অনেক কিছু জেনে নিতে হবে।

‘আপনাদের প্রেসে কী কী ছাপা হয়?’ প্রশ্নটা এল মালবিকার কাছ থেকে। এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর হঠাৎ তার এই কৌতূহলে একমাত্র অবাক হল বকুল।

গাড়ি তখন ফুলবাগান, কাঁকুড়গাছি ছাড়িয়ে উল্টোডাঙা মোড়ের কাছাকাছি। গাড়ি মন্থর করে, ট্র্যাফিক সামলাতে ব্যস্ত মিহির থেমে থেমে বলল, ‘অনেক কিছুই হয়। টেক্সট বই, গল্প, উপন্যাস, তার মলাট, ম্যাগাজিন, অফিসের ফর্ম, চালান, বিল, স্যুভেনির। আমাদের একটা বাইন্ডিং সেকশানও আছে।’

‘কে দেখাশুনো করেন?’ বকুলের প্রশ্ন।

‘আমিই মেইনলি তবে বাবাই সব দেখেন। পঁচাত্তর বয়স কিন্তু রোজ দু—ঘণ্টা এসে বসেন।’

‘ভাইবোন ক—টি?’ উমা জানতে চাইলেন।

‘দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। ভাই নেই। ছোটোবোন আমেরিকায় পেনসিলভানিয়ায় ডক্টরেট করছে।’

‘আমেরিকা’ শব্দটা শুনেই গাড়িটা সমীহতায় তটস্থ হয়ে গেল। গাড়ি লেকটাউনে ঢুকল। মিহির বলল, ‘এখানকার রাস্তা কিন্তু আমি একদম চিনি না, পাতিপুকুর পর্যন্ত গাইড করতে হবে।’

‘নিশ্চয় নিশ্চয়, এই আর একটু এগিয়েই বাঁ দিকের রাস্তাটা।’ সুধাংশু নড়েচড়ে সোজা হলেন।

দু—তিনটি বাঁক ঘুরে সুধাংশুর নির্দেশমতো মিহির গাড়ি থামাল। গাড়ি থেকে নেমে সে পিছনের দরজা খুলে ধরে রইল। উমা নামলেন এবং তার পিছনে বকুলও।

‘এই আমাদের বাড়ি। ভেতরে এসো, এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যাও।’ মিহিরকে বলে উমা বকুলের দিকেও তাকালেন।

‘না মাসিমা আজ থাক।’ মিহির নম্রভাবে জানাল। ‘বাড়িতে দিদি জামাইবাবুর আসার কথা, আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আর একদিন এসে বরং চা খেয়ে যাব, বাড়ি তো চিনে গেলুম।’

‘মিহির ওই যে বাড়িটা দেখছ,’ সুধাংশু তার বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া প্রায়ান্ধকার সরু গলিটা লক্ষ করে আঙুল তুললেন। ‘ওই যে পর্দা দেওয়া জানলাটা, ওটাই সমীরণদের। ওখানেই ও থাকত, এখন থাকে ওর ভাইয়েরা, বাবা—মা তো অনেকদিনই গত হয়েছেন।’

সবাই গলিটার ভিতরে কিছুক্ষণ চোখ রাখল। এরপর উমা বললেন, ‘মিহিরের দেরি হয়ে যাবে, নয়তো বকুল আর মালবিকাকে বলতুম চা খেয়ে যেতে।’

বকুল সংকটে পড়ল। দ্রুত ভেবে নিল উমার সঙ্গে আলাপটাকে ঘনিষ্ঠ করে তোলা দরকার এবং চা খেতে খেতে সেই কাজটা মসৃণভাবে করা যায়। মালিকে সামনের দিকে ঠেলে নাম করিয়ে দেওয়ার জন্য উমা যদি অনুরোধ বা আবদার জানায় তা হলে সমীরণ কতটা তা রক্ষা করবে, সেটা সম্পর্কে কোনো দৃঢ় ধারণায় আপাতত সে আসতে পারেনি। তবে সমীরণের মাসিমার স্নেহের বোন হওয়ার জন্য অবশ্যই তাকে চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সেই চেষ্টা এখন করতে গেলে গাড়িতে চড়ে বাড়ি ফেরার এই সুযোগটা তাকে তা হলে হারাতে হবে।

সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সে নিমেষেই সিদ্ধান্ত দিল, মেয়ের ভবিষ্যৎ অনেক গুরুত্বপূর্ণ গাড়ি চড়ার থেকে।

‘দিদির বাড়িতে প্রথমবার এসে বোন চা খাবে না তাই কি হয়?’ বকুল চেষ্টা করল গদগদ স্বর গলায় আনার।

‘মা।’ মোটরের ভিতর থেকে মালবিকার তীব্র স্বর বেরিয়ে এল। ‘বাবা ন—টায় ফিরবে। এখন সাড়ে আটটা।’

‘ওহহ দেখছ, একদমই ভুলে গিয়েছি। মালির বাবাকে ঘড়ি ধরে ন—টার সময় খেতে দিতে হয়। ডাক্তারের কড়া হুকুম, তারপর খাওয়াতে হয় ক্যাপসুল। না দিদি আজ থাক, আর একদিন এসে চা খেয়ে যাব।’

‘অসুখবিসুখ?’ উমা উদবেগ জানালেন, হঠাৎ পাওয়া বোনটিকে তাঁর মন্দ লাগেনি। মুখটি ভারি মিষ্টি, কথাবার্তাও তেমনি। কেমন যেন সরল আর ঘরোয়া ভাব পাচ্ছেন বুকলের মধ্যে।

‘মাথায় বহুদিন ধরেই একটা যন্ত্রণা হয়। মাঝে মাঝে সেটা বাড়ে। ডাক্তার অনেক দেখানো হয়েছে কিন্তু কেউই ঠিক করতে পারছে না।’ করুণ স্বরে বকুল বলল।

‘এক্স রে করানো হয়েছে?’ সুধাংশু জানতে চাইলেন।

‘হয়েছে, কিছু পাওয়া যায়নি।’

‘মা।’ এবার মালবিকার স্বরে চাপা বিরক্তি।

মিহির চুপ করে শুধু দেখে ও শুনে যাচ্ছিল। এবার কুণ্ঠিত স্বরে সে বলল, ‘আমার কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

‘ওহহ তাই তো! দেখেছ ভুলেই গেছি।’ বকুল ব্যস্ত হয়ে গাড়িতে উঠল। মিহির দরজা বন্ধ করে গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে এল। আর তারই মধ্যে মালবিকা চাপাস্বরে তার মাকে বলল, ‘কী আজেবাজে কথা বলে গেলে? দরকার কী এসব বলার?’

মিহির গাড়িতে উঠেছে। বকুল মেয়েকে উত্তর না দিয়ে জানলা দিয়ে হাত বার করে নাড়ল।

‘এই রাস্তা দিয়ে গিয়ে বাঁ দিকের প্রথম রাস্তাটা ধরবে, তারপর সোজা গিয়ে যশোর রোড।’ সুধাংশু জানিয়ে দিলেন মিহিরকে। সে মাথা কাত করে গাড়িকে প্রথম গিয়ারে দিল।

পঞ্চাশ—ষাট মিটার যাবার পরই মিহির শুনতে পেল মা ক্ষুব্ধ স্বরে মেয়েকে বলছে, ‘দরকার আছে কি না তা তুই বুঝবি না।’

‘না বোঝার কী আছে?’

‘আছে, আগে তুই মা হ তারপর বুঝবি মায়ের কী জ্বালা আর অশান্তি।’

‘ডায়ালগ এখন থামাও তো। আমাকে নিয়ে তোমার কীসের অশান্তি হল শুনি? এখন চুপ করে থাকো।’

‘তোর বাবার মতো যদি—’, বকুলের কথা অর্ধ সমাপ্ত হয়ে গেল।

‘আচ্ছা মিহিরবাবু, আপনি কি ফাংশানে গান করেন?’

মালবিকার প্রশ্নটা এল তার মায়ের কথা শেষ না হতেই।

‘না।’

‘চার বছর ধরে তা হলে কী শিখলেন?’

‘বলতে পারেন কিছুই শিখিনি।’

‘অ্যা!’ এবার স্তম্ভিত বকুলের কণ্ঠস্বর, ‘চার বছরেও কিছু শিখতে পারলে না। তা হলে নাম করবে কবে?’

‘নামটাম করার ইচ্ছা নিয়ে শিখছি না। প্রাচীন বাংলা গানের কথা আমার ভালো লাগে, বিশেষ করে নিধুবাবুর গান। সমীরণদার কাছে গানের প্রচুর স্টক রয়েছে আমি তার থেকে কিছু কিছু তুলে নিচ্ছি।’

‘তুলে নিয়ে কী করবেন?’ মালবিকার জিজ্ঞাসা।

‘গাইব, তবে পাঁচজনের সামনে নয়। নিজের মনেই গাইব।’

‘অদ্ভুত তো!’

‘অদ্ভুত কেন হবে?’ বকুল মেয়ের কথার মৃদু প্রতিবাদ করল। ‘অনেকেই তো আপন মনে গায়। যার টাকার দরকার সে ফাংশান করে, ক্যাসেট করে—’

‘থামো তো। সবাই শুধু টাকার জন্যই গায় না।’ ছোট্ট ধমকটা দিয়ে মালবিকা জুঁইয়ের গোড়েটা মায়ের নাকের কাছে ধরে বলল, ‘শুঁকে দ্যাখো, গন্ধটা কিন্তু ভারি মিষ্টি।’

‘সমীরণ মিত্তিরের টাকার অভাব নেই। গাড়ি করেছেন, পার্ক সার্কাসে ফ্ল্যাট কিনছেন, গানের স্কুল থেকেও যথেষ্ট আয়। উনি এখন কি শুধু টাকার জন্যই গান?’ মিহির আরজিকর হাসপাতাল পেরিয়ে খালের ব্রিজের উপর দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, ‘একটা জায়গায় উঠে গেলে আর তখন নামা যায় না। বলতে পারেন নেশার মতো তখন গান গাওয়াটা পেয়ে বসে।’

‘ঠিক বলেছেন।’ মালবিকা তারিফ না জানিয়ে পারল না।

বকুলের মনে হল, তাই যদি হয় তা হলে মালিকে তো ফ্রি—তেই স্পেশ্যালে ভরতি করে নিতে পারে!

‘সমীরণের ওখানে মাইনেটা বড়ো বেশি।’ কথাটা বলামাত্রই পাঁজরে একটা কনুইয়ের ধাক্কা পেল বেশ জোরেই।

‘সমীরণবাবু বলো।’ ফিসফিসিয়ে মালবিকা বলল।

‘হ্যাঁ একটু বেশি, এটা ভিড় এড়াবার জন্য। আলাদা করে না শিখলে পঞ্চাশ টাকা।’ গাড়িটাকে বাঁ দিকে রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে ঢুকিয়ে মিহির চট করে একবার পিছনের সিটের দিকে তাকিয়ে নিয়ে যোগ করল, ‘আপনাদের কাছে দুশো চাইবেন না।’

‘কেন’, মালবিকা উত্তর দাবি করল। মিহির উত্তর দিল না, শুধু তার মুখে এক চিলতে হাসি খেলে গেল।

‘এ—কথা বললেন কেন?’ মালবিকার স্বর এবার কৌতূহলে নরম।

‘সমীরণদা ভালো গলা পেলে আর যদি সুন্দরী হয় তা হলে কমেতেও শেখান।’

‘এখানে এখানে, এই বাঁ দিকের রাস্তাটায়।’

বকুলের ব্যস্ত গলা মিহিরকে ব্রেক কষাল। দেশবন্ধু পার্কটা তারা ছাড়িয়ে এসেছে। পাশাপাশি দুটো মোটর যাবার মতো একটা রাস্তা বাঁ দিকে।

‘আপনি ভালোই কথা বলতে পারেন।’

মিহির পুরো মুখ ফিরিয়ে মালবিকার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ব্যবসা করে খাই তো।’

‘আপনার বাড়িতে সত্যিসত্যিই কি দিদি জামাইবাবুর আসার কথা?’

‘দিদি কাল এসেছে। জামাইবাবুর আসার কথা নেই।’

‘তা হলে মিথ্যে কথা?’

‘বলেইছি তো ব্যবসা করে খাই। আমার তখন চা খাবার ইচ্ছে ছিল না। সে—কথা না বলে এই কথাটা বললুম, একই ব্যাপার।’

‘এই যে, এই যে।’

বকুলের কথায় মিহির গাড়ি দাঁড় করাল একটা লোহার ফটকের সামনে। ফটকের ধারেই রাস্তার ইলেকট্রিক ল্যাম্প পোস্ট। জায়গাটায় যথেষ্ট আলো। ফটক থেকে সোজা একটা পথ ভিতরে গেছে। তার শেষে একটা কাঠের পাল্লা দেওয়া মোটর গ্যারেজ। বাড়িটা পথের ডান দিকে। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল মিহির। ওরা দুজনও নেমেছে।

‘কী দেখছেন? খুব পুরনো বাড়ি, দেড়শো বছর বয়স। একতলার দেয়ালগুলো আমার হাতের দু—হাত চওড়া।’ মালবিকা তার দু—হাতের আঙুলের ডগা বেঁকিয়ে হাতটা সমান্তরাল করে দেখাল।

‘আমাদের বাড়ির দেয়াল আড়াই হাত চওড়া। দিদিদের শ্বশুরবাড়ির দেয়ালও তাই।’

বকুল বাড়ির দোতলার বারান্দা আর খড়খড়ি দেওয়া জানলাগুলোর দিকে দু—তিনবার তাকাল। ট্যাক্সিতে নয় একটা প্রাইভেট গাড়িতে চড়ে এসেছে অথচ বাড়ির কেউ সেটা দেখল না তা তো হতে পারে না।

‘আচ্ছা, সমীরণবাবু মালিকে কী টেস্ট করবে বলতে পারো?’ বকুল রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা করল, গাড়িটাকে কিছুক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য। খড়খড়ি তুলে কেউ—না—কেউ নিশ্চয়ই দেখবে আর সারা বাড়িতে চাউর করবে, এটাই সে এখন চায়।

‘একটা দুটো গান গাওয়াবেন, তাল টাল নিয়ে দু—চারটে প্রশ্ন করবেন—’

‘তাল! মালি তুই জানিস তো?’ বকুল উদবিগ্ন হয়ে পড়ল। ‘তবলার সঙ্গে তো ও গান শেখেনি।’

‘আমাদের বাড়িতে তবলা নেই। তবলার আওয়াজ আমার জ্যাঠারা পছন্দ করেন না।’ মালবিকার স্বরে কিঞ্চিৎ শ্লেষ।

‘অনেকটা আমার বাবার মতোই। উনি গানবাজনাটাই পছন্দ করেন না, অথচ মা করেন।’

‘তা হলে আপনি যে শিখছেন?’

‘বাবা জানে না। বাড়ির সামনেই আমাদের পুরনো প্রেসবাড়িটা। ওর তিনতলায় পিছন দিকে একটা ঘরে সময় পেলে বসি। আচ্ছা মাসিমা এবার আমি যাব।’

হেলমেট পরা একজন স্কুটারে বসে ফটক দিয়ে ঢোকার সময় তাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে গেল। বকুল হাঁফ ছাড়ল। তার মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। ভটু নিশ্চয়ই কাউকে— না—কাউকে বলবে, দেখলুম ছোটোকাকিমা আর মালি মোটরে কোথা থেকে যেন ফিরল।

‘তুমি তো বাবা চা খাও না, নইলে বলতুম একটু বসে গিয়ে এককাপ চা খাওয়ার জন্য।’

‘আর একদিন এসে খেয়ে যাব মাসিমা।’

‘এটা কি ব্যবসাদারের কথা?’ মালবিকা ঠোঁট ছড়িয়ে দিল। তার মনে হয়েছে, অতি সাধারণ দর্শন এই যুবকটি রসিকতা যখন করতে পারে তখন নিতেও পারে।

‘এতে একটুও ব্যবসা নেই। আবার তো দেখা হচ্ছে সমীরণদার ওখানে, তখন নয় চা খাওয়ার দিন ঠিক করে নোব।’

‘তুমি কী বাবা টেস্টের সময় থাকবে?’ বকুল আর একবার উদবিগ্ন হল।

‘বলেন যদি থাকব, তবে সমীরণদা ওকে নিয়ে নেবেন।’

‘তুমি থেকো বাবা। আর মাইনের ব্যাপারটা, কমসম করবে কি?’

‘বলে দেখুন না। আপনারা শনিবার দশটা—সাড়ে দশটা নাগাদ যাবেন।’

মিহির গাড়িতে উঠল। বকুল মালবিকা ফটকের দিকে এগোল। গাড়িতে স্টার্ট সবে দিয়ে মিহির দেখল, মালবিকা দ্রুত তার দিকে আসছে।

‘কী ব্যাপার!’

জানলায় মাথা ঝুঁকিয়ে চাপা স্বরে মালবিকা বলল, ‘আচ্ছা তখন একটা কথা বললেন, সমীরণদা ভালো গলা আর সুন্দরী হলে কমেতে শেখান, এ—কথা কেন বললেন?’

‘কেন মিথ্যে বলেছি নাকি? আপনি সুন্দরী নন?’

মালবিকাকে এই প্রথম, প্রায় অপরিচিত একজন, আচমকা সুন্দরী বলল। রমণীয়ভাবে সে অপ্রতিভ বোধ করল।

‘বেশ তাই নয় হলুম কিন্তু আমার গলা ভালো এটা জানলেন কী করে? আমি তো কখনো আপনার সামনে গাইনি।’

‘এটা নিছকই অনুমান করে বললুম। গলা আপনার হেঁড়ে নয় আর আপনি গান শেখায় আগ্রহী, ব্যস। ভালো গাইয়ে হওয়ার জন্য এটাই তো যথেষ্ট।’

রিভার্স গিয়ার দিয়ে মিহির ক্লাচ ছেড়ে দিল। গাড়ি পিছু হটে গলি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। মালবিকা তাকিয়ে রইল।

‘ছেলেটার পয়সাকড়ি আছে, বড়োলোক, মনটাও ভালো।’

মালবিকা প্রায় চমকে উঠে পিছনে তাকাল। বকুল কখন যেন তার পিঠের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

‘তাতে কী হল, অত্যন্ত বেঁটে।’

‘তাতেই বা কী হল! টাকার উপর দাঁড়ালেই লম্বা হয়ে যায়।’

‘কিছুই হয় না, চলো ভেতরে যাই। ওর ঘাড়ে, গেঞ্জির গলার কাছে বোতামের সাইজের একটা সাদা স্পট দেখলুম, বোধহয় শ্বেতি।’

.

যে ঘটনাটার কথা বলা হবে তাতে মিহিরেরও একটা বড়ো অংশ আছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবকটি লোকেরই যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় দেবার চেষ্টা এতক্ষণ করলাম। ঘটনাটি ঘটবে কিন্তু বিরানব্বই সালের ছয় ডিসেম্বর। দিনটা ছিল রবিবার। সুধাংশু গাঙ্গুলি সেদিনই বাজারে গিয়ে চার ইঞ্চি সাইজের হাফ কেজি চিংড়ি কিনে ফেলবেন।

কিন্তু এখন মা ও মেয়ে প্রসন্ন ও কিঞ্চিৎ উত্তেজিত মনে বাড়িতে ঢুকল। দোতলায় উঠেই সিঁড়ির মুখে দেখা হল বকুলের বড়োজা পার্বতীর সঙ্গে। বয়স ষাটের কাছাকাছি। স্থূলকায়া, রাশভারী চালচলন, কথাবার্তায় বুঝিয়ে দেন হাঁড়ি আলাদা হলেও এই পরিবারের তিনিই প্রধানা।

‘কীসের মালা রে?’

‘দিদি, ওকে সমীরণ মিত্র নিজের হাতে দিয়েছে।’ বকুলের চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

‘কে সমীরণ মিত্র?’ পার্বতী স্থির ঠান্ডা চোখে ও গলায় বুঝিয়ে দিলেন নামটা এই প্রথম শুনলেন। বকুল বাকরহিত হয়ে রইল।

‘গান করেন। খুব নাম এখন।’ মালবিকা জানিয়ে দিল।

‘অ। তোকে মালা দিল কেন, চেনে?’

‘আজই প্রথম আলাপ হল। মহাজাতি সদনে একটা ফাংশান ছিল, আমি আর মালি শুনতে গেছলুম। সেখানে আমার এক দিদি গান হয়ে যাবার পর আমাদের গ্রিনরুমে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিতেই কী ভেবে জানি না মালিকে উনি মালাটা উপহার দিলেন!’ এক নিশ্বাসে বকুল কথাগুলো বলল। ‘আমি তো অবাক। পরিচয় হতে—না—হতেই…আর বললেন, আমার গানের স্কুলে এসো, স্পেশাল ক্লাসে গান শেখাব।’

‘ভালো।’ পার্বতী পাশ কাটিয়ে নেমে গেলেন।

বকুলের শেষের কথাটা সেজোজা অর্চনা শুনতে পায় ঘর থেকে। বেরিয়ে এসে সে ডাকল বকুলকে।

‘মালি গান শিখবে বুঝি সমীরণ মিত্তিরের কাছে?’

‘হ্যাঁ। স্পেশালে শেখাবে…শেখাবেন।’

‘কত করে নেবে?’

‘ওইটেই তো সেজদি মুশকিলে ফেলেছে…দুউউশো! তোমার দেওরকে তো জানোই, মাসে মাসে এতগুলো টাকা বাড়তি খরচ!’

‘নামি লোকের কাছে গান শেখাতে গেলে খরচ তো করতেই হবে। অবুকে ভাবছি ভালো কারুর কাছে শিখতে দেব, তুমি একটু দ্যাখো না?’

অর্চনার অনুরোধটা অনুনয়ের ধার ঘেঁষে গেল। ঘর থেকে অবু অর্থাৎ অবন্তি এইসময় বেরিয়ে এসে মায়ের পাশে দাঁড়াল। বিয়ের এগারো বছর পর বহু ডাক্তার—বদ্যি দেখিয়ে ঠাকুর দেবতার দোর ধরে মানত করে অর্চনার অবশেষে কন্যালাভ হয়। অবু মায়ের মতোই কৃশ, লম্বা, বছর বারো বয়স। মুখটি খুবই মিষ্টি। এরই গানের শিক্ষিকার কাছে মালবিকা কিছুকাল গান শিখেছে।

বকুল দ্রুত চিন্তা করে নিল, সেজদির ঘরে ফোন আছে। যদিও আজ পর্যন্ত তাকে ফোন করতে বা ধরতে ওই ঘরে যেতে হয়নি কিন্তু এবার যদি কেউ তাকে করে? উমা বা মিহির কিংবা কোনো কারণে সমীরণ মিত্র যদি তাকে বা মালিকে ফোনে ডাকে? কাউকে ডেকে ফোন দেওয়ার ব্যাপারে তার এই সেজোজা—টি খুবই বিরক্ত হয়। বহু সময় বলে দেয় ‘বাড়ি নেই’। এজন্য তো বটেই তা ছাড়া এই বাড়িতে পুরুষ—মেয়ে মিলিয়ে সবার মধ্যে অর্চনাই একমাত্র এম.এ, দর্শন শাস্ত্রে। তাকে সবার অপছন্দের অন্যতম কারণ, এই তথ্যটি সুযোগ পেলেই সে জানিয়ে দেয়। বড়োজা পার্বতীও তাকে এড়িয়ে চলেন। সেজোভাসুর কেমিক্যালসের ব্যবসায়ী, রোজগার ভালো।

সেজোজা—কে হাতে রাখা দরকার, বকুলের দ্রুত চিন্তার সেটাই শেষ কথা। ‘নিশ্চয় বলব সেজদি। এখনও তো অবুর গলা তেমন তৈরি হয়নি, ওকে স্পেশালে দেবার দরকার কী? পঞ্চাশ টাকার ক্লাসে ভরতি করিয়ে দাও না। ওখানেও খুব মন দিয়ে শেখায়। তবে এত ভিড় যে নতুন ভরতি করছে কি না জানতে হবে।’

‘তবু দ্যাখো না একবার। গুণী লোকের কাছে প্রথম থেকেই শেখা ভালো।’

বকুল তিনতলায় যাবার সিঁড়িতে যখন পা রেখেছে পিছন থেকে তখন অর্চনা বলল, ‘আচ্ছা তুমি কার গাড়িতে এলে গো?’

‘তোমায় কে বলল?’ বকুল প্রশ্নটা পেয়ে খুশি হল।

‘শুনলুম ভটু বড়দিকে বলছিল ছোটোকাকি মোটরে করে বাড়ি এল।’

‘এই দ্যাখো, সামান্য একটা ব্যাপার সেটাও বাড়িতে খবর হয়ে গেল। আচ্ছা সব লোক বাবা! সমীরণ তো, ইয়ে সমীরণবাবু তো তাঁর নিজের খাবারের প্লেটটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘সবই আপনার। শেষ করতেই হবে।’ এই অ্যাত্তো বড়ো বড়ো তিন টাকা চার টাকা দামের গোটা ছয়েক মিষ্টি।’ হাত দিয়ে মিষ্টির আকার দেখাবার সময় সে আড়চোখে একবার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিল। মালবিকার মুখের বিরক্তি সে গ্রাহ্য করল না।

‘তা দু—জনে মিলে তো শেষ করলুম। লোকটা কী ভদ্র আর বিনয়ী দ্যাখো সেজদি। এই তো সবে প্রথম আলাপ, তারপর বলল…বললেন, ‘আপনাদের বাড়ি পৌঁছে দেবে আমার এক ছাত্র।’ ছেলেটির নাম মিহির, দুশো টাকা দিয়ে গান শেখে। বিরাট প্রেসের মালিক। কলকাতায় সাত—আটটা বাড়ি, গাড়িই দু—খানা, এক বোন আমেরিকায় ডাক্তারি করছে। খুবই শিক্ষিত, গান শিখছে শখ করে। দিদিকে পাতিপুকুরে পৌঁছে দিয়ে সে আমাদের নামিয়ে দিল।’

‘তোমার দিদি আছে জানতাম না তো!’

‘বলিনি, পিসতুতো দিদি। আমার কে কোথায় আছে সে খবর তো এ বাড়ির কেউ জানতে চায় না, তাই আর বলিও না।’ বকুলের চোখেমুখে সামান্য অভিমান ফুটে উঠল। ‘দিদি একবার ফোন নম্বর চেয়েছিল আমি বলেছিলুম আমাদের বাড়িতে ফোনটোন নেই।’

‘সে কী, নেই বললে কেন?’ অর্চনা বিব্রত হল, বাড়িতে টেলিফোন নেই, এমন এক লজ্জাজনক মিথ্যা খবর ছোটোজারের পিসতুতো দিদির কাছে পৌঁছে গেছে, এতে সে ক্ষুব্ধ হল। ‘এক্ষুনি ওনাকে ফোন করে আমার নম্বরটা বলে দাও।’

ফাঁপরে পড়ল বকুল। উমার বাড়িতে ফোন আছে কি না সেটা তার জেনে নেওয়া হয়নি। মায়ের মুখ দেখেই মালবিকা বুঝে নিল বাড়াবাড়িটা রাশছাড়া হয়ে গেছে।

‘মাসির বাড়িতে ফোন করবে কী, আজ এগারো দিন হল ডেড হয়ে রয়েছে না? তুমি তা হলে তখন শুনলে কী?’ মালবিকা মাকে ছোট্ট ধমক দিল। ‘এখন চলো, বাবা এসে পড়বে।’

‘হ্যাঁ চল। সেজদি, আমি অবুর কথা বলব।’

তালা খুলে ঘরে পা দিয়েই বকুল সিল্কের শাড়ি খুলতে খুলতে বলল, ‘মালি, চট করে রুটিগুলো বেলে দে। দেরি হয়ে গেছে বড্ড।’

শাড়িটা খাটের উপর ছুড়ে দিয়েই সে আলনা থেকে আধময়লা তাঁতের শাড়ি তুলে নিল। ঘরের উত্তরের দেয়ালে মালবিকার ছোট্ট ঘরটার দরজা। দরজায় এসে উঁকি দিল বকুল। মালবিকা জুঁইয়ের গোড়েটা তার বালিশের উপর বিছিয়ে রাখছে। ভ্রূ কুঁচকে বিরক্ত স্বরে বকুল বলল, ‘আদিখ্যেতা এখন রাখ। আটা মাখাই আছে, বেলে দে, আমি তাড়াতাড়ি রুটি করে ফেলছি। ইসস বড্ড দেরি হয়ে গেল।’

দু—বেলার রান্না সকালেই সেরে রাখে। রাতে শুধু রুটি করা, আর রান্নাগুলো গরম করে নেওয়া। ঘরের বাইরের বারান্দা দিয়ে যেতে হয় রান্নাঘরে ও কলঘরে। মা ও মেয়ে দুজনেই যখন রান্নাঘরে তখন শোবার ঘর থেকে দিলীপরঞ্জনের ডাক শোনা গেল।

‘শুনে আয় তো কেন ডাকছে।’

‘তুমি যাও, আমি এগুলো করে ফেলছি। আর মাইনের কথাটা বোলো। দুশো টাকা শুনেই যেন না লাফিয়ে ওঠে।’

বকুল শোবার ঘরে ঢোকামাত্র খাটে পা ঝুলিয়ে পাজামা পরা, খালি গায়ে দিলীপরঞ্জনের চোখ কুঁচকে গেল। চাপা গলায় সে বলল, ‘গাড়িটা কার?’

‘কার মানে!’ বকুল বুঝে উঠতে পারল না প্রশ্নের আড়ালে কী জমা রয়েছে।

‘কার মানে কার। এর থেকে সোজা বাংলা আর কী হতে পারে। কার গাড়িতে চেপে এলে?’

‘তোমাকে তো বলেই ছিলুম, মায়া আর তার বর অফিসের ফাংশান দেখতে যাবে না বলে কার্ড দুটো আমাদের—’

বকুলকে থামিয়ে দিয়ে দিলীপরঞ্জন বলল, ‘কার্ডের কথা নয় গাড়ির কথা জানতে চেয়েছি।’ কিছুক্ষণ বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সে আবার বলল, ‘ছোকরা কে, যার গাড়ি চড়ে এলে?’

‘তুমি দেখেছ?’

‘দেখেছি। মোড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলুম। দেখলুম গাড়িটা ঢুকল গলিতে। দূর থেকে দেখলুম খুব গল্প হচ্ছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। ব্যাপারটা কী?’

বকুলের মনে হল তার স্বামী অল্পই খেয়ে এসেছে। এখন আর টাকা খরচ করার সামর্থ্য নেই, দেশি চোলাই দিয়েই নেশাকে সন্তুষ্ট রাখে। খুব বেশি খেয়ে দিলীপরঞ্জন তিনতলা পর্যন্ত টলমল অবস্থায় পৌঁছে গেলে বকুলের উদবেগ ও শারীরিক যাতনাটা কিছু কমে। নিয়ন্ত্রণ হারানো দেহটাকে টেনে হিঁচড়ে, ঠেলেঠুলে খাটের উপর ফেলে দিতে পারলেই কাজ চুকে যায়। এতে মালিও তাকে সাহায্য করে।

কিন্তু অল্প খেয়ে সামান্য নেশা নিয়ে বদমেজাজ তৈরি করে ফিরলে বকুল প্রমাদ গোনে। আজও সে প্রমাদ গুনল।

‘নিজে মোটরে চড়ছ চড়ো, আমার এখন তো আর মোটর নেই, অন্যের মোটরে তো চড়বেই। তাই বলে মেয়েটাকে চড়তে শেখাচ্ছ কেন?’ দিলীপরঞ্জনের ধীরে ধীরে শান্ত কঠিন গলায় বলা কথাগুলো বকুলের রক্ত হিম করে দিল। নিশ্চয় পুরোনো কথা তুলে চিৎকার করবে ‘ফাংশানে সমীরণ মিত্রের সঙ্গে একজন আলাপ করিয়ে দিল, তিনিই তাঁর এক ছাত্রকে গাড়ি করে আমাদের পৌঁছে দিতে বললেন, এঁদের কাউকেই কখনো আগে দেখিনি, আলাপও ছিল না। বিশ্বাস করো।’ বকুল ক্ষমাপ্রার্থীর মতো স্বরে বলল।

‘চোখে দ্যাখোনি, আলাপও ছিল না আর অমনি অমনি সমীরণ মিত্তির গাড়ির ব্যবস্থা করে দিল? কেন? তার কীসের অত আঠা যে মা আর মেয়েকে দেখেই রসে চপচপে হয়ে পড়ল।

বকুল এসব কথার কী জবাব দেবে। সে চুপ করে রইল। রান্নাঘরে মালি রুটি সেঁকছে না বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছে, সেটাই তাকে ভাবনায় ফেলল। স্বামী বহুদিন, বহুভাবে মেয়ের সামনে তাকে হেনস্থা করেছে, মারধোরও। কিন্তু মালি এখন উনিশ বছরের। এসব এখন বন্ধ করা উচিত। বয়স্ক বাবা—মার কুৎসিত কথাবার্তা আচরণের প্রভাব যতটুকু মালির উপর পড়েছে তাতেই ওর যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। কিন্তু আর এটাকে বাড়তে দেওয়া যায় না।

কিন্তু কী করে সে বন্ধ করবে। তার অত ক্ষমতা কোথায়? সে তো স্বামীর হাততোলা! পালটা সেও যদি চিৎকার করে? তাতে তার স্বামী লজ্জা পাবে না, মুখও বন্ধ করবে না। বরং সারা বাড়ি তার বিরুদ্ধে যাবে। এই বাড়িতে সে বাইরের লোক। মারধোর করলে পালটা মার দেবে? তার অত গায়ের জোর কোথায়? বরং বাধা না দিয়ে মার খেলে অল্পক্ষণেই তার স্বামীর প্রহারের উৎসাহটা কমে যায়।

কোনো কোনো গভীর রাতে চেতনায় অপমান আর শরীরে যন্ত্রণা নিয়ে বেঘোরে ঘুমোনো স্বামীর পাশে শুয়ে বকুল তার ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছে, ‘আমাকে বিধবা করে দাও। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আর কোনো উপায় আমার সামনে নেই।’ মনে মনে সে বহুবার তার স্বামীর মৃতদেহ দেখেছে। বাসের তলায়, জলে ডুবে, সাপের কামড়ে, চারতলার ছাদ থেকে পড়ে, ভেজাল চোলাই খেয়ে দিলীপরঞ্জন মারা যাচ্ছে, এমন ছবি তার চোখে ভেসে উঠেছে। দেখতে দেখতে উত্তেজিত মাথা একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লে সে ভয়ে কাঁটা হয়ে তারপর ভেবেছে, আমার আর মালির তখন কী হবে? আমাদের খাওয়াবে পরাবে কে? দিন চলবে কী করে? ভাসুরদের দয়ায়? সংসারে ঝি হয়ে?

বেঁচে যাওয়ার একমাত্র উপায় হিসাবে অতঃপর সে দেখতে পায় নিজের মেয়েকে। যদি তার মেয়ে রোজগার করতে পারে সে ঠিক করে রাখল, তা হলে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে এই বাড়ি ছেড়ে। কখনো—না—কখনো তার দিন আসবেই, এই চিন্তাটাই তাকে আশা দিয়ে সব অত্যাচার সহ্য করিয়ে গেছে। কিন্তু কীভাবে যে লক্ষ্যপূরণ হবে সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। মালবিকার লেখাপড়ায় মাথা নেই কিন্তু সুন্দর একটা গানের গলা আছে। এই সংক্ষিপ্ত জানাটুকুর সঙ্গে তার বাস্তববোধ যুক্ত করে সে বুঝেছে, গান ছাড়া তার মেয়ের বড়ো হয়ে ওঠার মতো আর কোনো সংগতি নেই। অপ্রত্যাশিতভাবে সমীরণ মিত্রর সঙ্গে আলাপ হয়ে যাওয়াটাকে সে ভগবানের দান হিসাবে গণ্য করেছে। এই দান সে দু—হাতে আঁকড়ে ধরবে, সেজন্য যত অত্যাচার সহ্য করতে হয় সে করবে।

বকুল ও দিলীপরঞ্জনের মধ্যে কথাবার্তার মাঝে, কাহিনির প্রবাহ বন্ধ করে এত যে কথা ঢুকিয়ে দেওয়া হল, তার কারণটি খুবই প্রাঞ্জল। বকুল তার অসহায় অস্তিত্বের মধ্যে ডুবে রয়েছে এবং মেয়েকে কোথাও একটা শক্ত জমিতে দাঁড় করিয়ে নিজে ভেসে থাকতে চাইছে। এই দুই বিপরীত অবস্থার সংঘাত তার মধ্যে আলোড়ন তুলছে এবং তার ফলে তার আচরণে ও কথায় মরিয়া ভাব এসে যাওয়া যে স্বাভাবিকই, সেই কথাটাই বলে দেওয়া হল।

দিলীপরঞ্জন যখন তাকে বলল, ‘তার কীসের অত আঠা যে মা আর মেয়েকে দেখেই রসে চপচপে হয়ে পড়ল!’ তখন বকুলের দীন করুণ ভাবটা নিমেষে বদলে কঠিন হয়ে উঠল।

‘কেউ যদি আমাদের দেখে চপচপে হয়, তা হলে আমরা কী করতে পারি।’

‘কী করতে পারি মানে?’ ধমক দিয়ে উঠল দিলীপরঞ্জন। ‘তুমি কী জানো লোকটা কেমন? জানো না বোলো না, বহু লোক একসময় চরিয়েছ লোক চেনো না বোলো না। সমীরণ মিত্তির একের নম্বরের ক্যারেক্টারলেস, শুয়োরের বাচ্চচা, অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছে। ওর সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। বউ তো দু—বার ওকে ছেড়ে চলে গেছল। ওর এক ছাত্রী রেপিং চার্জ এনেছিল ওর নামে, পুলিশকে খাইয়ে শেষ পর্যন্ত কেস ভন্ডুল করে দেয়। লম্পট মাতাল কোথাকার।’ খাট থেকে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে উঠল দিলীপরঞ্জন। ঘৃণায় তার মুখের পেশি বিকৃত।

‘তুমি অন্য লোককে মাতাল বলো কী করে? তোমার নামেও তো ঘুষ নেওয়ার চার্জ তোমার অফিস এনেছিল। তুমিও তো গাড়িটা বিক্রি করে টাকা খাইয়ে চাকরি বাঁচিয়েছ।’ বকুল জানে তার কথার প্রতিক্রিয়াটা মারাত্মকভাবে হবে। তাই হোক, তবু সে আজ কথা বলবে।

দিলীপরঞ্জন অদ্ভুত চোখে তার বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। দরজায় দাঁড়িয়ে মালবিকা বলল, ‘খাবার গরম করেছি, দিয়ে যাব?’

‘নিয়ায়।’ বকুল উঠে গেল একধারের দেয়াল ঘেঁষে রাখা টেবলটায়। শোবার ঘরের মধ্যেই তাদের খাওয়া সারতে হয়। একসময় যে ঘরে তারা খেত সেটা এখন মালবিকার ঘর।

‘সমীরণের হয়ে ওকালতি করছ যে, ব্যাপার কী?’

‘কোথায় আবার ওকালতি করলুম!’

‘আমি মদ খাই ঠিকই কিন্তু পরের বউ—মেয়ের দিকে হাত বাড়াই না। ও আর আমি এক জিনিস নই।’

দুটো বড়ো বাটিতে ডাল আর ডিমের ঝোল হাতে নিয়ে মালবিকা ঘরে ঢুকে টেবলে রেখে বেরিয়ে গেল। বেরোবার সময় একবার বাবার মুখের দিকে তাকাল।

‘হ্যাঁ, তুমি শুধু নিজের বউয়ের দিকেই হাত বাড়াও, তফাতটা শুধু এই।’

‘চুপ কর হারামজাদি, যত বড়ো মুখ নয় তত বড়ো কথা! জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব।’

দিলীপরঞ্জন দু—পা এগিয়ে গেল। বকুল একপা পিছিয়ে চেয়ারের পিঠ আঁকড়ে ধরল। সে খুন দেখতে পাচ্ছে স্বামীর চোখে। বোকার মতো কথাটা সে বলে ফেলেছে তো বটেই। মালির গান শেখার জন্য টাকা এই লোকটার কাছ থেকেই পেতে হবে।

‘আমাকে গালাগাল দিয়ে, মারধোর করে তুমি যেন কী একটা জ্বালা জুড়োও, কীসের জ্বালা?’

একটা ডেকচিতে রুটি নিয়ে মালবিকা আবার ঘরে এল। টেবলের উপর সেটা রেখে বলল, ‘আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমোতে যাচ্ছি।’

‘এই হচ্ছে আমার আর—একটা জ্বালা।’ দিলীপরঞ্জন দাঁত চেপে আঙুল তুলে মালবিকার ঘরের দরজাটা দেখাল। ‘মায়ের থেকেও এককাঠি ওপরে যাবে।’

‘যাক না। মায়ের মতো ভুল যদি না করে—’

‘কীসের ভুল? ভুল তো আমি করেছি।’ দিলীপরঞ্জন দু—হাতে বকুলের কাঁধ আঁকড়ে ধরে ঝাঁকানি দিয়ে শাড়ির আঁচলটাকে টেনে মেঝের উপর ফেলে দিল।

বকুল স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। স্বামীকে বাধা দেবার কোনো চেষ্টা তার মধ্যে নেই। আঁচলটাও কাঁধের উপর তুলল না। দিলীপরঞ্জন কর্কশ দৃষ্টিতে বকুলের বুকের উপর চোখ রেখে বলল, ‘সমীরণকে পটাবার জন্য দেখছি খুব তুলে দিয়েছ, বুঝি না কিছু ভেবেছ?’

এইসব কথা বকুলের কাছে নতুন নয়। দিলীপরঞ্জন একদিন একটু মত্ত হয়ে দু—হাতে ব্লাউজের গলা ধরে হ্যাঁচকা টানে হুকগুলো ছিঁড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর হেসে উঠে হাঁ করে একটা স্তন মুখে পুরে জোরে কামড়ে ধরে। বকুল চিৎকার করে উঠতে গিয়েও করেনি, পাশের ঘর থেকে মেয়ে তা হলে বেরিয়ে আসবে। এখন তার মনে হচ্ছে দিলীপরঞ্জন ওইরকম কিছু একটা করতে চাইলে এতক্ষণে তা করে ফেলত। করেনি যখন তার মানে নেশার ঘোরটা কেটে গেছে।

‘আমি তো বলেইছি, সমীরণের সঙ্গে আলাপ হবে তা আমি জানতুমই না। হঠাৎ—ই হয়ে গেল।’

‘আর অমনি মুখখানি দেখেই গাড়িতে তুলে বাড়ি পাঠিয়ে দিল!’

‘ওঁর এক ছাত্রর এদিকেই বাড়ি। তাকে বললেন আমাদের বাড়ি পৌঁছে দিতে। আমি ঠিক করেছি মালিকে ওঁর কাছে গান শেখাব।’ কথা বলতে বলতে বকুল আঁচলটা তুলে নিল। টেবলে গিয়ে থালা পেতে ডেকচি থেকে ঢাকনা তুলে বলল, ‘ক—টা রুটি দোব?’

‘ওই দুশ্চরিত্রের কাছে মেয়েকে গান শিখতে পাঠাবে?’

‘আমার তো মনে হল উনি ভদ্রলোক।’

‘ভদ্দরলোকের তুমি কী জানো? ক—টা ভদ্দরলোক তুমি আজ পর্যন্ত দেখেছ?’

‘একজনকেও নয়।’ বকুল চারখানা রুটি থালায় রাখল। দিলীপরঞ্জন এক ঝটকায় থালাটা মেঝেয় ফেলে দিল।

‘আমাকে অপমান করার সাহস কোথায় পেলে?’

মেঝে থেকে থালা আর রুটি টেবলে রেখে বকুল বলল, ‘খাওয়ার ইচ্ছে আছে না নেই?’

‘আগে আমার কথার জবাব দাও।’

‘মালিকে আমি সমীরণ মিত্রের কাছে গান শেখাব। ওকে বড়ো করব, পাঁচজনের একজন হবে, ভালো বিয়ে দেব। আমার মতো দুর্ভাগ্য যাতে ওর না হয় সেজন্য আমি সব করব, সবকরব,’ দাঁত চেপে, দু—হাতের মুঠো ঝাঁকিয়ে বকুল জানিয়ে দিল সে বদ্ধপরিকর।

দিলীপরঞ্জন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল তার বউয়ের দিকে। বকুলের এমন মূর্তি কখনো সে দেখেনি। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নীচু গলায় বলল, ‘খেতে দাও।’

টেবলে দু—হাত রেখে দিলীপরঞ্জন গোঁজ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে বলল, ‘টাকা আমি দোব না।’

‘লোকের বাড়ি বাসন মেজে আমি টাকা তুলব।’

‘তাই কোরো।’

পরদিন সকালে মালবিকা তার মাকে জানাল, ‘বাবার টাকার দরকার নেই, তোমাকেও বাসন মাজতে হবে না। গান আমি শিখব না।’

.

কিন্তু বকুল ও মালবিকা শনিবার সকাল দশটায় সমীরণ মিত্রর বাড়িতে পৌঁছল। একতলায় স্কুল, দোতলায় সে স্ত্রী ও ছেলে নিয়ে থাকে। সকালে স্কুল বসে না। একতলার দুটো ঘরে তালা দেওয়া। ওরা দোতলায় উঠে এল।

সিঁড়ি থেকেই সামনে একটা ঘর। বড়ো বড়ো গোলাপ ফুলের প্রিন্ট করা ভারী পর্দা দরজায়। ডান দিকে দালান চলে গেছে। সেখানেও পরপর দুটো খোলা দরজায় একই প্রিন্টের হলুদ আর আসমানি রঙের পর্দা ঝুলছে। বকুল সামনের ঘরের পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল। ঘরে একমাত্র লম্বা সোফাটায় জড়োসড়ো হয়ে দুটি লোক বসে। বকুলকে দেখেই তারা দাঁড়িয়ে উঠে নমস্কার করল। বকুল হতভম্ব।

চট করে ঘরের চারপাশটা সে দেখে নিল। আর কেউ নেই। বেশ বড়োই ঘর। তিনটে ফোম রাবার আসনের বেতের চেয়ার, বেতের সেন্টার টেবল। দেয়ালে সোনালি পাড় দেওয়া গোল একটি ঘড়ি, যার কাঁটা দুটি রুপালি। ঘরের আধখানা জুড়ে শতরঞ্জির উপর সাদা চাদর, তাতে দুটি গেরুয়া ওয়াড় দেওয়া মোটা তাকিয়া। হারমোনিয়াম, বাঁয়া—তবলা, তানপুরা, অ্যাশট্রে। নিরাভরণ, অগোছালো, অযত্নে রাখা। দেয়ালে দু—তিন জায়গায় পলেস্তারা ফাটা। মেঝে থেকে এক মানুষ সমান লম্বা জানলা, যার তলার অর্ধেকটার খড়খড়ি দেওয়ালে আঁটা, খোলা যায় না। উপরের ভাগের পাল্লা হেলে পড়েছে কবজা থেকে, বহুকাল জানলায় রং করা হয়নি। এমন এক বিমর্ষকর ঘরে খুবই বেমানান লাগে এক ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ীর বিরাট ক্যালেন্ডারটা। উজ্জ্বল হাসিভরা দুটি শিশু লোমশ একটা কুকুরছানা নিয়ে বাগানে খেলছে, অবশ্যই একটা ট্রানজিস্টর ঘাসের উপর রাখা। নতুন সিলিং ফ্যানটাও কড়িকাঠের সঙ্গে খাপ খায় না।

লোক দুটিকে কী বলবে বকুল ভেবে পেল না। মালবিকাই এই অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে তাকে উদ্ধার করল।

‘আমরাও কিন্তু সমীরণবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’ মালবিকা ঠেলে বকুলকে ঘরের ভিতরে পাঠাল।

লোক দুটি লজ্জায় পড়ল। ওদের মধ্যে কমবয়সিটি আবার সোফায় বসে পড়ে বলল, ‘আমরা গোবরডাঙা থেকে আসছি। আমরা ভেবেছিলুম আপনি বোধহয় সমীরণ মিত্রের স্ত্রী। লোকটা আমাদের বসিয়ে বলল, ‘মাকে ডেকে দিচ্ছি’, তারপরই আপনি উঁকি দিলেন। তাই আমরা ভাবলুম—।’

‘না, না, আমি ওনার স্ত্রী নই, আমরাও একটা দরকারে ওঁর কাছে এসেছি।’

বকুল একটা বেতের চেয়ারে বসল, তার পাশেরটায় মালবিকা। পর্দা সরিয়ে একটি লোক তাদের দেখে নিয়ে চলে গেল। এতবড়ো একজন নামী গাইয়ে পুরোনো বাড়িতে আর এমন একটা বসার ঘর নিয়ে বাস করে, এটা দেখে বকুল একটু দমে গেল। সিনেমায় বা টিভি—তে বড়ো বড়ো লোকেদের বসার ঘরের সঙ্গে একফোঁটা মিলও সে খুঁজে পাচ্ছে না।

মালবিকা মুখটা বকুলের কানের পাশে এনে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘মা কে?’

‘বোধহয় ওর বউ।’

বয়স্কজনটি কথাটা শুনতে পেয়ে বলল, ‘কমার্শিয়াল ব্যাপারটা ওঁর স্ত্রী শিঞ্জিনী দেবীই তো দেখেন। যা কিছু কথাবার্তা উনিই বলেন, উনিই টাকাপয়সা ঠিক করে দেন।’

লোকটির কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পর্দা সরিয়ে একজন ঘরে ঢুকল, যাকে দেখামাত্র ওরা বুঝে নিল, এই হচ্ছে শিঞ্জিনী। মাথা ঘুরিয়ে চারজনের দিকে ওর তাকানোর ভঙ্গিতে কর্তৃত্ব প্রয়োগের একটা ঔদ্ধত্য রয়েছে। শিঞ্জিনী ভ্রূ কুঁচকে বকুল—মালবিকাকে দেখে নিয়ে গোবরডাঙার দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কে বিকাশ মুখোপাধ্যায়?’

‘আ—আমি।’ কমবয়সি উঠে দাঁড়াল।

‘আপনি মল্লিকার চিঠি নিয়ে এসেছেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার বউ।’

‘কিন্তু ভাই টাকা তো আমি কমাতে পারব না ওঁর যা রেট—’

‘না, না, না, টাকা কমাবার কোনো প্রশ্নই নেই। উনি যা নেন তাই নেবেন। আমার অনুরোধ প্রোগ্রামটা শনিবারের বদলে রবিবার হচ্ছে, উনি যদি রবিবারে আসেন তা হলে আমরা ধন্য হব।’ বিকাশ করজোড়ে তাকিয়ে রইল শিঞ্জিনীর দিকে।

দুই ভুরুর মাঝখানটা চুলকিয়ে একটু বিব্রত গলায় শিঞ্জিনী বলল, ‘রবিবার তো একটা ঘরোয়া আসরে ওঁর গাইবার কথা। সাহিত্যিক, ফিল্ম ডিরেক্টর, আইএএস, আইপিএস—দের বউয়েরা, দু—একজন জার্নালিস্টও আসরে থাকবেন। সমীরণের তো এখানে কথাও দেওয়া হয়ে গেছে।’

‘কথা কি পাকাপাকি দেওয়া হয়ে গেছে? ডেটটা চেঞ্জ করা যায় না?’

‘প্রায় একরকম পাকাপাকিই বলা যায়।’

‘একটু ওঁদের বলে দেখুন না যদি অন্য দিনে হয়। আমরা তা হলে দশ হাজার দেব যদি উনি রবিবারে আসেন।’

‘দেখুন ওঁর শরীরটা খুব খারাপ। কাল রাতে জামসেদপুর থেকে ফিরলেন কী যে শরীর নিয়ে! এতটা লং জার্নি মোটরে করাই উচিত হয়নি।’

‘আমরা ওঁকে ট্রেনে গোবরডাঙা নিয়ে যাব। বিটি রোড, যশোর রোডে ওঁর গাড়ির চাকাই পড়বে না। ম্যাডাম, আপনি কিছু ভাববেন না, ট্রেনে কলকাতার রাস্তার মতো গর্তটর্ত, ঝাঁকুনি নেই।’

শিঞ্জিনী তৃতীয় বেতের চেয়ারটায় বসে ভ্রূ কুঁচকে কপালে আঙুলের কয়েকটা টোকা দিল। লোক দুটি জলে পড়েছে, কী করে তাদের উদ্ধার করা যায়, এমন একটা সমস্যা তার মুখে ফুটে উঠল। ‘দশ নয় ওটা বারো করুন। তা হলে রবিবারের ওই আসরটা থেকে সমীরণকে তুলে আনা যেতে পারে। টাকাটা কিন্তু আগাম পুরোই চাই, ক্যাশে।’

‘তা হলে আপনি দায়িত্ব নিন ওঁকে নিয়ে যাবার। বারোতেই আমরা রাজি। কাল কী পরশু এসে কনট্রাক্ট করিয়ে টাকা দিয়ে যাব।’

‘আমি আর ওঁকে নিয়ে যাব না, উনি নিজেই যাবেন । দুটো গাড়ি ঠিক সময়ে পাঠাবেন আর এগারোটার মধ্যে পৌঁছে দেবেন। কিন্তু খেতেটেতে চাইলে দেবেন না। ঠিক দু—ঘণ্টা গাইবেন।’ শিঞ্জিনী ফর্দ পড়ার মতো বলে গেল।

ওরা দুজন উঠে দাঁড়াল। মুখে বিগলিত হাসি। নমস্কার করে তারা চলে যাবার পর শিঞ্জিনী বকুল ও মালবিকার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

‘আমাদের সমীরণবাবু আসতে বলেছেন। এই আমার মেয়ে মালবিকা, ওর গান শেখার ব্যাপারেই আসা।’

মালবিকা প্রণাম করল শিঞ্জিনীকে। বকুল একবার ভাবল সে—ও করবে কি না, কিন্তু প্রায় সমবয়সি বা ছোটোই হবে বিবেচনায় শুধু স্মিত মুখে সে তাকিয়ে রইল।

‘তা হলে তিনটের পর আসুন তখন স্কুল খুলবে।’ শিঞ্জিনী তীক্ষ্নচোখে মালবিকার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

‘ওকে স্পেশালে শেখাবেন বলেছেন, তার আগে গান শুনবেন। সেজন্য আসা।’ বকুল নম্রস্বরে বলল।

‘কার কাছে গান শেখে?’

‘কারুর কাছে নয়। বহু আগে একজনের কাছে শিখেছে, সে না—শেখারই মতো।’

‘হারমোনিয়াম বাজাতে পারে তো?’

‘তা পারে।’

দু—জনের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে, কোনো কথা না বলে শিঞ্জিনী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার ভঙ্গিতে প্রকট ছিল অবহেলা, মালবিকার সেটা ভালো লাগল না।

‘বেশ সুন্দরীই।’ বকুল মাথা হেলিয়ে চাপা গলায় বলল।

‘এককালে ছিল।’ মালবিকা কথাটা বলেই যোগ করল, ‘মেক—আপ করেছে বলে অমন দেখাচ্ছে।’

‘তা কেন, মুখখানি বেশ সুন্দরই তো। শরীরের গড়নও ভালো। রং ফরসা, কোমর—টোমর সরু রেখেছে। শুধু চোখদুটোই যা ছোটো ছোটো।’

‘তুমি একে ভালো ফিগার বলো কী করে? কেমন একটা কাঠ—কাঠ ভাব, গায়ের চামড়াটাও খসখসে। গালে ব্রণর দাগগুলো লক্ষ করেছ?’

‘আস্তে বল।’

কিছুক্ষণ ওরা চুপচাপ বসে থাকার পর উসখুস শুরু করল। সেন্টারটেবলের নীচের তাকে কয়েকটা ম্যাগাজিন দেখে মালবিকা একটা তুলে নিল। বাচ্চচাদের ম্যাগাজিন, বোধহয় সমীরণের ছেলের। কয়েক পাতা উলটে সে রেখে দিল।

‘আমরা যে এসেছি সেটা বোধহয় ওকে জানানো হয়নি।’ মালবিকা বলল।

‘নিশ্চয় জানিয়েছে। দেরিতে ওঠেন তো বলেই দিয়েছিলেন। মিহির আসবে বলেছিল, কই এখনও তো এল না।’

‘রেখে দাও ওসব আসা—টাসার কথা। বলার জন্যই বলা।’

‘ছেলেটি কিন্তু বেশ।’

‘তোমার সব কিছুতেই ‘বেশ’। এটা বলা থামাও তো।’

দুজনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ক্রমশ ব্যাজার হতে হতে বকুল কথা শুরু করল।

‘বারো হাজার টাকা নেন মাত্র দু—ঘণ্টা গাইতেই।’

‘বারো হাজার না আরও কিছু। ওরা তো ডেট বদলাতে চেয়ে দশ হাজার অফার করল। তার মানে আগে আরও কমে কথা হয়েছিল। এখন ইনি গরজ বুঝে মোচড় দিয়ে ওটাকে বারোয় তুলল। রবিবারে কোথায় যেন গাইবার কথা আছে বলল না? সব ফলস। খুব জাঁহাবাজ মেয়েমানুষ।’

‘তোর দেখছি ওকে একদমই ভালো লাগেনি।’

‘না। ভাবভঙ্গিটা দেখলে না? প্রণাম করলুম, একটা কিছু তো লোকে বলে। অথচ যেন দেখতেই পায়নি এমন একটা ভাব করল। নিজে অত সেজেছে আর ঘরটা কী করে রেখেছে?’

‘গাইয়ে বাজিয়েদের ঘর এইরকমই হয়।’

‘মোটেই তা নয়। আসলে দরকার ইচ্ছে, সেটা থাকলে ঘরটা পরিচ্ছন্ন করে রাখা যায়। পর্দাগুলো এত দামি আর দেয়ালটা দ্যাখো!’

বকুল চারদিকের দেয়ালে চোখ বোলাল। সেই সময় রাস্তা থেকে কয়েকবার মোটরের হর্ন বাজল। পাশের ঘরের জানলা থেকে শিঞ্জিনীর গলা শোনা গেল, ‘যাচ্ছি, এক মিনিট।’

মালবিকা উঠে গিয়ে জানলা থেকে দেখল বাড়ির সামনে একটা সবুজ রঙের মারুতি দাঁড়িয়ে। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি নিশ্চয় ড্রাইভার।

ঘরের সামনে ব্যস্ত চটির শব্দ হল। পর্দা সরিয়ে শিঞ্জিনী বলল, ‘আপনারা বসুন, আসছেন।’ পর্দা পড়ল। চটির শব্দ একতলায় নেমে গেল। মালবিকা জানলা থেকে শিঞ্জিনীর গাড়িতে ওঠা দেখল।

‘মারুতি গাড়ি।’ মালবিকা চেয়ারে ফিরে এসে বসল। ‘বউই চড়ে বেড়ায়।’

‘কত দাম?’

‘লাখ দুয়েক—দেড়েক হবে।’

‘অ্যাতো! তুই পারবি অমন একটা গাড়ি কিনতে?’ গলায় ক্ষীণভাবে আবদারের মতো সুর ফুটে উঠল।

মালবিকা মুখ ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। হালকা একটা বিষণ্ণ হাসি তার চোখে ভেসে এল। ‘মাইনের টাকাটা কত বলে সেটা আগে জেনে নাও। আকাশকুসুম দেখতে শুরু কোরো না।’

দরজার পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল সমীরণ মিত্র। আদ্দির পাঞ্জাবি আর ঢোলা পাজামা, সাদা রাবারের চটি। চুলে চিরুনি পড়েনি। ফুলো ফুলো দুই চোখ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু খুব দেরি করিনি, আপনারাই আগে এসে পড়েছেন। আসলে হয়েছে কী, কথা ছিল ট্রেনে ফেরার। সঙ্গে ছিল তিনজন, তবলা আর খোল বাজাবার দুজন আর তানপুরো ছাড়ার মেয়েটি, আমারই ছাত্রী প্রতিভা। টাটার এক অফিসার কলকাতায় আসছিলেন গাড়ি করে। আমি দেখলুম ভোররাতে উঠে স্টিল এক্সপ্রেস ধরা আমার দ্বারা হবে না। তার থেকে বরং—’, সমীরণ সোফায় বসে গা এলিয়ে দিল।

তখনই মালবিকা তাকে প্রণাম করতে এগিয়ে গেল। হাঁটু গেড়ে বসে সমীরণের দুই পায়ের পাতা দু—হাতে ধরে সে নুয়ে পড়ল। কপাল ঠেকল পাতায়।

‘আরে আরে।’ সমীরণ সোজা হয়ে বসে মালবিকার দুই কাঁধ ধরে ‘থাক থাক’ বলে তাকে তোলার চেষ্টা করল। মালবিকা তখন অনুভব করল, আঙুলগুলো তার ঘাড়টাকে বার দুই যেন হালকাভাবে কচলাল। সহজাত বোধ তাকে জানিয়ে দিল, এই কচলানিটা কিছু একটা ইঙ্গিত দেবার জন্য। সে চোখ তুলে সমীরণের চোখে বিহ্বল দৃষ্টি রেখে ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিল।

‘বোসো বোসো।’ সমীরণ হাত ধরে মালবিকাকে তার পাশে বসাবার সময় সামান্য একটা টান নিল। মালবিকা তার গা ঘেঁষে বসল। বকুল এত নামি গায়কের এমন সারল্য দেখে পুলক বোধ করল। তার মনে আশা জাগল, বোধহয় মেয়েটার একটা হিল্লে হবে। এখন মাইনের ব্যাপারটায় যদি একটু বিবেচনা করেন!

‘মালির গান শুনে বলুন, ওর কিছু হবে কি না।’ বকুল নড়েচড়ে বসল।

সমীরণ তার ঝকঝকে চটুল চাহনি মালবিকার চোখের উপর রেখে বলল, ‘হবে না কেন? যদি পরিশ্রম করে, খাটে, আমার কথামতো যদি রেগুলার সাধনা করে তা হলে নিশ্চয় হবে। কী বলো, হবে না?’ কথাটা বলে সমীরণ মালবিকার ডান হাতের মুঠি বাঁ হাতে চেপে ধরল।

মালবিকা মাথা নামিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আপনি যদি আমাকে গাইড করেন।’

সমীরণ কয়েক সেকেন্ড কী যেন ভেবে নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা তোমার গলাটা একটু শুনি। যে—কোনো একটা গান গাও, খালি গলায় কিন্তু।’

গান গাইবার জন্যই আসা সুতরাং কয়েকটা গান সে স্থির করেই এসেছে। মালবিকা কয়েক সেকেন্ড চোখ বুজে থেকে গান শুরু করল। ‘সখী, বহে গেল বেলা, শুধু হাসি খেলা এ কি আর ভালো লাগে।’

রেকর্ড থেকে হুবহু তোলা, শুধু গলাটাই যা মিহি এবং তীক্ষ্ন। কয়েকবার স্বর কেঁপে গেল, শ্বাস নেওয়া ও ছাড়ায় ভুল করল, সুরচ্যুতি ঘটল এবং অবাক চোখে সমীরণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। গান শেষ হবার পর ঘর নীরব রইল কিছুক্ষণ। মালবিকা উৎকণ্ঠিত চোখে তাকিয়ে রইল সমীরণের বন্ধ চোখের দিকে।

‘তুমি যে এইরকম একটা গান শোনাবার জন্য বেছে নেবে, সেটা আমি ভাবতে পারিনি। গলায় এখনও সুর বসেনি তবে মোটামুটি তুমি উতরে গেছ তোমার ভগবান—দত্ত মিষ্টি গলাটার জন্য। আমি রবীন্দ্রসংগীত জানি না, গাইও না, কিন্তু তোমারও এটা লাইন নয়। তুমি অন্য ধরনের গান শেখো।’

‘বেশ তো আপনিই ঠিক করে দিন কোন লাইনে ও যাবে।’ বকুল ব্যগ্র স্বরে বলল।

‘সা রে গা মা থেকে ওকে শিখতে হবে। এখন যা শুনলেন সেটা অশিক্ষিত পটুত্ব, বেশিদূর যাওয়া যাবে না। রোজ তিন—চার ঘণ্টা চর্চা করতে হবে।… কী গো মালি ভয় পাচ্ছ নাকি?’

মুখ নামিয়ে মালবিকা শুনছিল। মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করছে। গান শেখাবে কী শেখাবে না, সেটা স্পষ্ট করে ওর কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে না। কিছু উপদেশ দিয়ে হয়তো বলবে, যাও বাড়িতে বসে গলা সাধো। ‘ভয় পাচ্ছ নাকি’, বলে সমীরণ তার পিঠে ছোটো একটা চড় বসিয়ে হাতটা আর তোলেনি। তার এই একটিই ব্লাউজ এবং এটি এমনই, পরিধান করলে পিঠটা অর্ধেক প্রায় খোলা থাকে আর কাঁধ থেকে স্তনের উপরিভাগ পর্যন্ত অনাবৃত রয়ে যায়। বাড়িতে ব্লাউজটা সে কখনোই পরে না। বাইরে বেরোবার সময় পাড়ার মোড় পর্যন্ত আঁচল দিয়ে ঊর্ধ্বাঙ্গ জড়িয়ে রাখে। আজ সে ইচ্ছে করেই পরে এসেছে।

সমীরণের আঙুলের ডগা পিঠের ছয় ইঞ্চি জায়গা জুড়ে আলতো ঘোরাফেরা করছে। শিরশির করছে পিঠ এবং সারা শরীরে সেটা ছড়িয়ে যাচ্ছে। মালবিকা চট করে একবার বকুলের দিকে তাকাল। বকুলের দ্রুত চোখ সরিয়ে নেওয়া দেখে তার মনে হল, সম্ভবত মা ব্যাপারটা লক্ষ করেছে। কিছু কি ভেবে নিচ্ছে?

‘প্রতিভা আমার স্কুলে গান শেখায়। গান শেখেও আমার কাছে। ওর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এই সামনের মাসেই। বলেছে গান ছাড়বে না তবে আমার সঙ্গে এখানে ওখানে যাওয়াটাও আর সম্ভব হবে না, স্কুলেও শেখাতে পারবে না। কনজারভেটিভ শ্বশুরবাড়ি, আপত্তি করবে বলেছে। গান নিয়ে যদি কেউ সারাক্ষণ পড়ে না থাকে তার কিছু হবে না। আমার ছাত্রীদের মধ্যে ওই ছিল সেরা।’ সমীরণের স্বর আফশোস আর দুঃখেই বোধহয় ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ল। মালবিকার পিঠে আলতো বোলানো আঙুল এখন আঁচড় কাটছে নখ দিয়ে।

‘তানপুরো ছাড়ার জন্য আমার একজন কাউকে এখন চাই।’ সমীরণ তাকাল মালবিকার দিকে, মালবিকা মায়ের দিকে। বকুল মনে মনে বলল ভগবান, উনি যেন মালির হাতেই তানপুরাটা তুলে দেন।

‘আমার তো মনে হয়, শিখিয়ে নিলে মালির কাছে এটা শক্ত ব্যাপার হবে না। আসরে আমার পাশে বসেই অনেক কিছু শিখতে পারবে। অবশ্য মা—বাবার যদি আপত্তি না থাকে—।’ সমীরণ জিজ্ঞাসু চোখে বকুলের দিকে তাকাল। ‘এখানে ওখানে যেতে হবে, রাতেও হয়তো থেকে যেতে হতে পারে।’

ভগবান তা হলে শুনেছেন! চেয়ার থেকে হুমড়ি খেয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল বকুল। ‘প্রণাম কর, প্রণাম কর। এত ভাগ্যি তোর! আপত্তি করব কী!’

মালবিকা কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল। তার পিঠের উপর সমীরণের পাঁচ আঙুল মাংস খাবলাবার চেষ্টা করছে। চর্বি না থাকায় জুত করতে পারছে না। সোফা থেকে নেমে মালবিকা আবার পায়ের দুটো পাতা দুই মুঠোয় ধরল এবং কী একটা ভেবে নিয়ে পাতাদুটোর ওপর আলতো চিমটি কাটল।

‘বারবার প্রণাম কেন, বসো বসো।’ সমীরণ দুই বাহু ধরে মালবিকাকে পাশে বসাল। মুখ টিপে হেসে বোঝাবার চেষ্টা করল, চিমটি কাটা সে উপভোগ করেছে।

এই সময়ই ঘরে ঢুকল মিহির। তাকে দেখে সমীরণ মালবিকার বাহুধরা হাতটা সরিয়ে নিল।

‘আয় আয় মিহির, বোস। প্রতিভার তো বিয়ে, তাই ঠিক করলুম মালিই এবার থেকে তানপুরো নিয়ে আমার সঙ্গে বসবে। পারবে না?’

‘পারতে চাইলেই পারবে।’ মিহির একটা চেয়ারে বসল। পাশে বসা বকুলকে নীচু গলায় বলল, ‘বলেছিলুম আসব, এসেছি।’

‘জানো বাবা, মালির গান শুনে উনি বললেন, খাটলে হবে, গলাটা খুব মিষ্টি।’

‘সমীরণের মুখে প্রশংসা! সহজে তো উনি এটা করেন না। কোকিল ডাকলে উনি বলেন কাক ডাকছে। তাও আবার ‘খুউব’ মিষ্টি বলেছেন? আমি কিন্তু মাসিমা, গান না শুনে আগেই বলেছি।’

মিহির মুখ টিপে মালবিকার দিকে তাকাল।

‘ঠাট্টা নয় মিহির, গলাটা সত্যিই মিষ্টি।’

কয়েক মিনিটের মধ্যে দুটি পুরুষমানুষ মুখ টিপে তার দিকে তাকিয়ে হেসেছে। মালবিকার মাথার মধ্যে কেমন যেন একটা ঘোর লাগছে। তার মনে হচ্ছে, এরা তার কাছে কিছু যেন চায়। কিন্তু তার আছে কী দেবার মতো? সে নিজেই তো সকলের অনুগ্রহ চায়!

‘সমীরণদা বউদি কোথায়?’

‘পার্ক সার্কাস গেছে, ইলেকট্রিক ফিটিংসের কাজ দেখতে।’

.

মিহিরের গাড়িতে সেদিন ওরা দুজন বাড়ি ফিরেছিল। ফেরার পথে মিহির বলে, ‘তানপুরা নিয়ে গান গাওয়ার অভ্যাসটা আপনার দরকার, হারমোনিয়াম দিয়ে ওটা হবে না।’ মুখ ফিরিয়ে সে পিছনে বসা মালবিকার মুখটা দেখে নিল।

‘মালিকে আবার ‘আপনি’ বলছ কেন বাবা, ও তোমার থেকে অনেক ছোটো।’

‘আপনি আমার বয়স জানেন?’ মিহির মজা করেই বলল। ফাঁপরে পড়ল বকুল, সে মেয়ের দিকে তাকাল। মালবিকা মিহিরকে শুনিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘বলো একশো।’

‘উঁহু, হল না। বয়স ষোলো।’ মিহির স্বাভাবিক গলায় বলল।

‘অ্যাতো বয়স?’ মালবিকা গলা অবাক করে ভ্রূ তুলল। ‘আমার থেকে তো অনেক বড়ো, আমি তো সবে আটে পড়েছি।’ সে মিহিরের মুখ দেখার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল গাড়ির সামনের কাচের উপর দিকে চালে আঁটা পিছন দেখার আয়নাটা দিয়ে মিহির তাকে দেখছে। ঠোঁট মুচড়ে হেসে মালবিকা একটু সরে বসল। মিহির বাঁ হাত তুলে আয়নাটা সামান্য ঘোরাল। আবার ওর মুখ মালবিকা দেখতে পাচ্ছে। সে এবার সরে এল বকুলকে ঘেঁষে। মিহির আয়নাটা আবার ঠিক করে নিল।

অসমান রাস্তার জন্যই গাড়িটা অস্থির, আয়নাটা কাঁপছে, মিহিরের মুখটাও। উঁচু কলারের হাওয়াই শার্ট। মালবিকার মনে হল, ঘাড়ের সাদাটা ঢাকার জন্যই এমন একটা জামা পরেছে। তাদের পাড়ার স্টেশনারি দোকানের রাজেনদার দুই চোখের কোণে প্রথমে ফুটকির মতো সাদা দাগ হয়। ক্রমশ সেটা বড়ো হতে হতে সারামুখে ছড়াতে থাকে। তিন—চার বছরের মধ্যে রাজেনদা পুরো সাদা হয়ে যায়। ছোটোরা ওকে সাহেবদা বলে ডাকতে শুরু করে। ওকে দেখলেই মালবিকা কীরকম যেন একটা অস্বস্তি বোধ করত। সে শুনেছে এটা কোনো রোগ হয়, ছোঁয়াচেও নয়। তবু সে রাজেনদার দোকান থেকে জিনিস কেনা বন্ধ করে।

মিহিরের ঘাড়ের দাগটা চামড়া পুড়ে যাওয়ার জন্যও হতে পারে। মালবিকা মনে মনে বলল, তাই যেন হয়। নয়তো তিন—চার বছর পর ধবধবে মিহিরের চেহারা যে কেমন দেখতে হবে, সে কল্পনাও করতে পারল না। জানলা দিয়ে সে বাইরে তাকিয়ে রইল। যে উত্তেজনা নিয়ে সে সমীরণের বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, আপ্লুত আশায় যে গড়াগড়ি তার মনের মধ্যে চলেছে সেটা ক্ষণেকের জন্য স্তিমিত মৃদু হয়ে পড়ল। বেচারা! তারপরই সে ভাবল, ও তো মেয়ে নয়। প্রচুর টাকা আছে কোনো অসুবিধে হবে না।

পথটা একেবারে চিনে গেছে মিহির। বাড়ি পর্যন্ত ঠিকই চলে এল। গাড়ি থেকে নামবার আগে মালবিকা বলল, ‘আর একদিন এসে চা খেয়ে যাবেন বলেছিলেন। নিশ্চয়ই সেই আর একদিনটা আজ নয়?’

‘এই দুপুরবেলায় চা খেতে বলছেন?’

‘না, বলছি না।’ মালবিকা গাড়ি থেকে নেমে আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে নিল। চোখ তুলে তিনতলায় নিজেদের ঘরের জানলাটাও দেখে নিল। পর্দাটা গুটিয়ে তুলে রাখা। জানলায় তার বাবার মুখটা নেই।

‘দুপুরে লোকে ভাত খায়, কই ভাত খাওয়ার কথা তো বললেন না?’

‘খাবে বাবা?’ বকুল ঝুঁকে জানলাটা ধরে মিহিরকে অনুরোধ জানাল।

‘না মাসিমা, আর একদিন…এই দেখুন আবার বলে ফেললুম আর একদিন। আমার মা বসে থাকবেন ভাত নিয়ে, এক ছেলে হওয়ার এই এক প্রবলেম। আর শুনুন।’ একটু জোরেই মিহির ডাকল বাড়ির ফটকে পৌঁছে যাওয়া মালবিকাকে।

‘তানপুরা নিয়ে গলা সাধতে হলে আগে একটা তানপুরা চাই, সেটা আছে কি?’

‘নেই।’ মালবিকার হঠাৎই খেয়াল হল সমীরণের মতো মিহির তানপুরাকে ‘তানপুরো’ বলে না।

‘আমার একটা আছে, সেটা দিয়ে যাব।’

‘আর একদিন এসে, তাই তো?’

‘আজই, সন্ধেবেলায়। চা—ও খাব।’

‘তানপুরাটা দিয়ে দিলে আপনি কী নিয়ে গাইবেন?’

‘আমার দুটো আছে।’

মিহির গাড়ি ছেড়ে দিল।

.

একটি দিনেই প্রধান চরিত্রগুলোকে নিয়ে কাহিনিটি পৌঁছল আর এক পর্যায়ে। আরও দু—তিনটি পর্যায় পেরিয়ে পৌঁছবে মালবিকার আইবুড়ো ভাত খাওয়াবার সেই রবিবারে। তার মধ্যে দ্রুত সম্পর্কের হেরফের ঘটে যাবে, তার কিছু কিছু অংশ এবার বলা যাক।

যেমন শনিবার সন্ধ্যায় মিহির তানপুরাটা দিতে এল। হঠাৎ একজন অপরিচিত একা লোকের পক্ষে বাড়ির মধ্য দিয়ে তিনতলায় উঠে আসা, এ—বাড়িতে সম্ভব নয়। অসুস্থ মেজোভাসুরের অফিসের লোক একবার উঠে এসেছিল না বলে। পার্বতী ডেকে মেজোজাকে বলে দেন, ‘এটা ফ্ল্যাট বাড়ি নয়।’

মালবিকা আর বকুল পালা করে সন্ধে থেকে তিনতলার জানলা দিয়ে রাস্তায় চোখ রাখে। দিলীপরঞ্জনকে বলে রেখেছিল বকুল, ‘সেই ছেলেটি আসবে যে গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছে।’

কী যেন ভেবে দিলীপরঞ্জন বলেছিল, ‘আমাদের স্বজাতি?’

‘হ্যাঁ, শীল। বিকেলে যদি বেরোও তা হলে রাত করে ফিরো।’

রেগে খেঁকিয়ে ওঠার বদলে স্বাভাবিক গলায় দিলীপরঞ্জন বলেছিল, ‘শরীরটা ভালো লাগছে না, আজ বেরোব না।’

বকুল অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। শনি—রবি পরপর দু—দিন অফিসের ছুটি, অথচ মদ খেতে বেরোবে না! তখন সে বলেছিল, ‘বিকেলে তা হলে একটু বাজারে যেয়ো।’

গাড়িটা ফটকের সামনে থামতে দেখেছিল মালবিকাই। ‘এসেছে।’ বলেই সে ছুটে নেমে যায় মিহিরকে উপরে আনতে। দিলীপরঞ্জন তখন পাঞ্জাবিটা ট্রাউজার্সের উপর ঝুলিয়ে আয়নায় দাঁড়ায় চুল আঁচড়ে নিতে। বকুল কলঘর থেকে ভিজে শরীরে কোনোরকমে শাড়ি জড়িয়ে ছুটে এসে মালির ঘরে ঢুকল, ঢোকার আগে লন্ড্রি থেকে আনা শাড়িটা আলনা থেকে তুলে নেয়।

মিহির প্রায় তিন ঘণ্টা ছিল। তার মধ্যে সে বুঝে নিল এদের তিনজনের পারস্পরিক সম্পর্কটা কেমন। দিলীপরঞ্জন জেনে নিল মিহিরের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর খবর ও পারিবারিক অবস্থা। বকুল খোঁজ করল, মালবিকার বড়ো গাইয়ে হবার জন্য কতদিন সময় লাগবে আর মালবিকার মনে হল মিহিরের তাকে ভালো লেগেছে এবং সেটা কিছু জটিলতা তৈরি করবে।

তানপুরা কীভাবে বাঁধতে হয়, কীভাবে সুর ছাড়তে হয় মিহির খাটের উপর বসে পদ্ধতিগুলো শিখিয়ে দিল। শেখাবার সময় অবশ্যই কয়েকবার সে মালবিকার করস্পর্শ করল! তার আঙুল ধরে, যার কোনো দরকারই ছিল না, মিহির যখন দেখিয়ে দিচ্ছিল কীভাবে তারের উপর দিয়ে পরপর টেনে নিয়ে যাবে তখন সে ওর ঘাড়ের সাদা দাগটা দেখার চেষ্টা করেছিল। উঁচু কলারের পাঞ্জাবি এবং বোতামগুলো তৃতীয় ঘর পর্যন্ত আঁটা থাকায় দেখতে পায়নি। সে স্বস্তি পেয়েছিল।

‘বাবা, একটু বলে দাও তো তানপুরা দিয়ে ও কীভাবে গলা সাধবে?’ বকুল জানতে চায়।

‘আহহ মা! যার কাছে শিখব তিনিই বলে দেবেন। তুমি অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন বলো তো।’ মালবিকা বিরক্ত হল। বকুল অপ্রতিভ।

‘ঠিকই বলেছেন।’ মিহির সায় দিল।

‘আমাকে ‘বলেছেন’ ‘করেছেন’ বলবেন না, শুনলে বয়স বেড়ে যায়।’ মালবিকা এবার মিষ্টি ধমক দিল। খুশি হল মিহির।

‘আচ্ছা আচ্ছা আর বলেছেন নয়। মাসিমা, মালি যা বলল সেটাই উচিত। সমীরণদার কাছে শিখবে, অথচ আমি বলে দেব, তা হয় না। জানতে পারলে সমীরণদা ওকে আর ও বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। তা ছাড়া আমি তো সবে শিখছি, মাস্টারি করার বিদ্যে এখনও হয়নি।’

‘ওরে বাবা, না না তোমাকে আর বলেটলে দিতে হবে না। সমীরণবাবু যা শিখিয়ে দেবেন তাই করবে। আমি চা নিয়ে আসি।’ বকুল ত্রস্ত হয়ে উঠে গেল।

খাটের আর একদিকে বসে দিলীপরঞ্জন শুনছিল ওদের কথা। গলাখাঁকারি দিয়ে সে বলল, ‘সমীরণ মিত্তির লোকটা কেমন বলো তো? শুনেছি খুব মদ খায়, মেয়েঘটিত কেলেঙ্কারিও আছে।’

মিহিরকে হুঁশিয়ার দেখাল। কুণ্ঠিত স্বরে বলল, ‘আমি গান শিখতে যাই, ঘণ্টা দেড়—দুই থেকে চলে আসি। আমরা তিন—চারজন শিখি। এর মধ্যে কিছু আমি দেখিনি।’

‘আহা তা কী করে দেখবে, এসব কী দেখিয়ে কেউ করে। শুনেছ কিছু?

মিহির ইতস্তত করে চুপ রইল। সমীরণদা সম্পর্কে যা শুনেছে সেগুলো বলতে তার বাধছে। অশোভনও হয়ে যাবে। বললে হয়তো মেয়েকে গান শেখাতেই পাঠাবে না। তাতে ক্ষতি হবে মালবিকারই।

মাথা নেড়ে সে বলল, ‘আমি তো কিছু শুনিনি।’

দিলীপরঞ্জন তীক্ষ্ন নজরে তাকিয়ে ছিল। বুঝে নিল ছেলেটি চেপে যাচ্ছে।

‘তুমি শোনোনি এক ছাত্রীকে সমীরণ রেপ করেছিল। কেস হয়। প্রমাণ না হওয়ায় খালাস হয়ে গেছল। অবশ্য বছর দশেক আগের কথা। আমাদের অফিসের একজনের পাড়ার মেয়ে। মেয়েটার আজও বিয়ে হয়নি।’

‘হ্যাঁ, এরকম একটা কথা শুনেছিলুম বটে। মেয়েটি নাকি রেগুলার ওর কাছ থেকে টাকা নিত। টাকা দেওয়া বন্ধ করতেই নাকি কেস করে।’

‘অ। বউয়ের সঙ্গে সমীরণ মিত্তিরের সম্পর্ক কেমন?’

‘কেন, ভালোই তো!’ মিহির আবার হুঁশিয়ার হল।

‘স্বামীকে ছেড়ে ক—বার চলে গেছল? জানো কি সেটা?’

‘না তো। আপনি জানলেন কী করে?’

‘হুঁ হুঁ, বহু জায়গায় আমার আড্ডা, কানে খবর ঠিকই আসে। ওই কেসটা হওয়ার পর থেকে ওদের রিলেশনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। টাকাপয়সা সব তো এখন বউয়েরই কন্ট্রোলে। বউ তো একসময় ওরই ছাত্রী ছিল। বাপের বাড়ির অমতে অনেক লটঘট করে বিয়েটা করেছিল। এখন পস্তাচ্ছে।’ দিলীপরঞ্জন বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে মেয়ের দিকে তাকাল।

মাথা নামিয়ে মালবিকা আদরের মতো করে আঙুল বোলাচ্ছিল তানপুরায়। এই সময় চকিতে তার মনে পড়ল, অনেকটা এই ভাবেই তার পিঠে একটা আঙুল নড়ে বেড়িয়েছিল। শিরশির করেছিল পিঠ। তানপুরা থেকে আঙুলটা তুলেই বাবাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, ‘বউয়ের সঙ্গে সমীরণ মিত্রের সম্পর্ক দিয়ে আমার কী আসে যায়। আমি তো যাব গান শিখতে।’

কিছু একটা ভেবেই মালবিকা আর বলল না, ‘এখানে ওখানে যেতে হবে, রাতেও হয়তো থেকে যেতে হতে পারে।’ এতসব কথার পর এই কথা আর বলা যায় না। বাবাকে সে ভালোই জানে।

‘হ্যাঁ, শুধু শিখতে, শেখা হলেই বাড়ি চলে আসবে।’

‘ওঁর সঙ্গে ফাংশানেও যেতে হবে, বলে দিয়েছেন।’

দিলীপরঞ্জনের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। ‘কেন?’

মিহির তাড়াতাড়ি বলল, ‘ছাত্রছাত্রীরা গুরুর গান শুনতে তো যায়ই, আমিও তো যাই। এই যে গোবরডাঙায় সমীরণদা গাইতে যাবেন, আমিও তো যাব।’

‘সত্যি! আমাকে নিয়ে যাবেন?’ মালবিকা প্রায় লাফিয়ে ওঠার মতো ভঙ্গি করল।

মিহির তাকাল দিলীপরঞ্জনের দিকে। তার মনে হল লোকটা কী যেন ভেবে নিল।

‘আর কে সঙ্গে যাবে?’

‘দু—তিনজন মিউজিক হ্যান্ডস, আর প্রতিভা তো যাবেই।’ একটি মেয়ে যাবে শুনে হয়তো মেয়েকে যেতে দিতে পারে ভেবেই মিহির প্রতিভার নাম জুড়ে দিল।

‘ওর না বিয়ে?’ মালবিকা বলল।

‘এখনও দিন পনেরো তো বাকি। হয়তো এইটেই ওর শেষবারের মতো তানপুরা নিয়ে বসা হবে।’

মালবিকা মনে মনে বলল, ‘তারপর আমি।’

‘যাবে—আসবে কীসে, মোটরে?’ দিলীপরঞ্জন আরও জানতে চাইল।

‘দুটো মোটর যাবে, তাই না মিহিরদা?’ মালবিকার মুখ থেকে আপনা থেকেই ‘মিহিরদা’ বেরিয়ে এল। মিহির হাসল।

‘সমীরণদা তো মোটরে একাই যান, বরাবরই। অন্য মোটরে হারমোনিয়াম, তবলা, তানপুরা আর হ্যান্ডসরা।

‘আমি কিন্তু আপনার মোটরে যাব, যাব বাবা?’ মালবিকা আদুরে গলায় বলল। মনে মনে কিন্তু সে জানে, বাবা রাজি না হলেও সে যাবে। তাকে সমীরণ মিত্রর কাছাকাছি হতেই হবে।

প্লেটে গরম লুচি আর বাটিতে রান্না মাংস নিয়ে বকুল ঘরে ঢুকল। টেবলে ওগুলো রেখে বলল, ‘এসো বাবা, আজ প্রথম দিন এলে, কিছু রাঁধার তো সময়ই পেলুম না। একটু মুখে দাও। চা পরে দোব। মালি, রান্নাঘর থেকে সন্দেশের প্লেটটা এনে দে।’

মিহির কোনো ওজর—আপত্তি না তুলে উঠে টেবলে এল। সে বুঝে গেছে নাছোড়বান্দা এই মহিলা সত্যি দুঃখ পাবে যদি সে কিছু না খায়। শুধু বলল, ‘যা দিয়েছেন এটা আমার দু—দিনের খাদ্য। অর্ধেক তুলে নিন।’

বকুল তুলল না এবং মিহির সবটাই খেয়ে নিল যেহেতু মাংসের রান্নাটা উপাদেয় লাগায়। বিদায় নেবার সময় বকুল বলল, ‘একদিন তোমাদের বাড়িতে গিয়ে তোমার মা—র সঙ্গে আলাপ করে আসব।’

‘যাবেন। আমি এসে নিয়ে যাব।’ মিহির কথাটা বলে মালবিকার দিকে তাকাল।

‘আমিও মা—র সঙ্গে যাব।’ মিহিরের চোখে অনুরোধ দেখে সে নিরাশ করল না।

দিলীপরঞ্জন বলল, ‘তোমাদের প্রেসটা একদিন দেখে আসব। নতুন ধরনের যন্ত্রপাতি, কালিঝুলি, ঘটংঘটং শব্দের কোনো ব্যাপারই নেই! একবার তো দেখতেই হয়।’

তিনতলা থেকে মিহিরের সঙ্গে মালবিকাও নামল। দু—তিনটি ঘর থেকে কৌতূহলী মুখ উঁকি দিয়ে মিহিরকে দেখল। জানলা থেকে দিলীপরঞ্জন দেখল গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ওরা দুজন কথা বলছে।

‘ছেলেটাকে ভালোই মনে হল। ব্যবসা—ট্যাবসা কেমন চলছে সেটা বোঝা দরকার। গাড়ি থাকলেই তো আর বড়োলোক হয় না। প্রেসটা দেখে আসতে হবে।’ খাটে পা ঝুলিয়ে বসে বকুলকে ইশারা করে বলল, ‘ওটা এবার আনো।’

রান্নাঘর থেকে বকুল দিশি মদের বোতলটা এনে টেবলে রাখল, সঙ্গে কাচের গ্লাস। বিকেলে বাজার থেকে ফেরার সময় পান সিগারেটের দোকান থেকে দিলীপরঞ্জন এটা কিনে এনে বকুলকে রান্নাঘরে রাখতে দিয়েছিল।

‘মালি তো গানের টিউশনিও করতে পারবে।’

বকুল চেয়ারে বসল স্বামীর মুখোমুখি হয়ে। গ্লাসে ছোটো একটা চুমুক দিয়ে মুখবিকৃতি করে দিলীপরঞ্জন বলল, ‘নামি গাইয়ের ছাত্রী হলে দরটা বাড়বে।’

বকুল আশ্বস্ত হল। মিহির সম্পর্কে তো নয়ই এমনকী সমীরণ সম্পর্কেও দুশ্চরিত্র, মাতাল বলে তার স্বামীর এখন আর কোনো আপত্তি নেই। হঠাৎ তার বুকের মধ্যে ক্ষীণ একটা কষ্ট এই লোকটির জন্য তৈরি হল।

সেই সময় গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে মালবিকা বলল, ‘তা হলে সত্যি সত্যিই আর একদিন আর হল না।’

‘হত, কিন্তু দেখলুম বেশিদিন দেরি হয়ে গেলে আমাকে তোমরা আর মনে রাখবে না। মনে রাখার মতো তো আমার চেহারা নয়, গুণও কিছু নেই।’

‘কে বলল নেই?’ মালবিকার স্বর মৃদ গাঢ় হয়ে এল।

‘তানপুরাটা দিলেন, আমার উপকারই করলেন। কিনতে হলে বাবাকে খুবই অসুবিধেয় পড়তে হত। আপনার হৃদয় আছে আর পুরুষমানুষের রূপ তো তার হৃদয়, এটা ক—জনের থাকে?’

‘পুরুষদের থাকে কি না জানি না তবে সুন্দরী মেয়েদের বোধহয় থাকে না।’

‘আপনি জানেন?’ মালবিকা মুখ টিপল। এখন সে বেশ সহজ ঝরঝরে বোধ করছে। মিহিরকে তার ভালো লাগছে ওর কথাবার্তা আর আচরণের জন্য। তবে এটাই তার কাছে ভালো লাগার শেষ কথা নয়। সে পুরুষদের কাছ থেকে আরও কিছু চায়।

‘জানার চেষ্টা করছি।’

‘করে কী বুঝছেন?’

‘আরও চেষ্টা করতে হবে।’ মিহিরের চোখে ঝিলিক দিল প্রত্যাশা।

‘কী চেষ্টা করবেন সুন্দরীদের হৃদয় বুঝতে?’

‘নিজেকে তুমি তা হলে সুন্দরী স্বীকার করলে।’

‘কে বলল? আমি তো একজন সুন্দরীর কথা বলিনি, বলেছি সুন্দরীদের কথা।’ মালবিকা গাড়ির জানলায় হাত রেখে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। উপরে তাকিয়ে দেখল তিনতলার জানলায় কেউ নেই। রাস্তা দিয়ে অল্প লোক চলাচল করছে। দু—বার কেউ তাকাল না তাদের দিকে।

‘আমি তো একজনকেই সুন্দর জানি।’ মিহিরও গাড়ির জানলায় হাত রাখল।

‘খুব হয়েছে, উঠুন এবার।’

‘সুন্দরী মেয়েদের যে হৃদয় থাকে না নিজেই কিন্তু তা প্রমাণ করে দিলে। ‘উঠুন এবার’, এমন একটা কুচ্ছিত কথা কার পক্ষে বলা সম্ভব?’

‘আমি তা হলে কুচ্ছিত?’

‘অবশ্যই।’

‘দূর হও আমার সামনে থেকে।’ মালবিকা মিহিরের হাতের উপর চড় মেরে ঠোঁট ওলটাল।

মিহির অবিশ্বাস ভরে মালবিকার দিকে তাকাল। ‘হও’ বলল। দূর ‘হোন’ নয়। মালবিকার আঙুলগুলো মুঠোয় রেখে সাহস পেয়ে ধরা গলায় মিহির বলল, ‘তোমাকে আমার ভালো লাগে মালি।’

‘হাত ছাড়ো, বাড়ি থেকে দেখছে।’ মালবিকা ফিসফিসিয়ে বলার ধরনে মিহির দ্রুত হাত সরিয়ে নিল। তিনতলার জানলায় অবশ্য কেউ ছিল না।

‘কাল যেয়ো সমীরণদার ওখানে, আমিও যাব।’ দরজা খুলে মিহির গাড়িতে উঠল।

‘যাচ্ছ তো? গোবরডাঙায়?’

‘হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে গেলে সমীরণদা কিছু মনে করবে না তো!’

গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নিল। ‘মনে করার কী আছে। বরং খুশিই হবেন। তখন তোমার বাবাকে বললুম সমীরণদা গাড়িতে একাই যান। মোটেই যান না, ওঁর সঙ্গে আর একজন যায়। প্রতিভা।’ প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য মিহির অপেক্ষা করল না।

গাড়ি চলতে শুরু করার পর মালবিকার মনে হল সে যেন মিহিরের ঘাড়ে সাদা একটা দাগ দেখল।

সমীরণ খুশি হয়েছিল। কেন হয়েছিল সে—কথা এবার বলা দরকার কেননা গোবরডাঙা থেকে ফেরার সময় মালবিকা বুঝে যায় তার জীবন এবার অন্য একটা খাত ধরে বইবে এবং সেই খাতটা শুধুই কাদায় ভরা।

আসরটা মূলত গানের নয়, যাত্রার। টিন দিয়ে ঘিরে হাজার আষ্টেক লোক বসার ব্যবস্থা হয়েছে। যাত্রা হচ্ছে তিন দিন ধরে। সমীরণ মিত্রের গানের পর রাত ন—টায় ‘তোমার মতো বউ হয় না’ পালা শুরু হবে। মিহিররা পৌঁছে দেখল টিকিট ঘরের সামনে প্রায় যুদ্ধ চলছে। চাউমিন, ঘুগনি, রোল, ওমলেট ইত্যাদির দোকান বসে গেছে। যাত্রাকে ঘিরে একটা মেলা—মেলা ভাব। মিহির একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানল, দলবল নিয়ে সমীরণ একটু আগে পৌঁছেছে, বিশ্রাম নিচ্ছে ক্লাবের সেক্রেটারির বাড়িতে। সেই লোকটিকেই গাড়িতে তুলে নিয়ে মিহির সেক্রেটারির বাড়িতে পৌঁছল এক মিনিটেই।

ঘরে সোফায় বসেছিল সমীরণ, তার পাশে প্রতিভা। অন্য সোফায় বসে বিজনবাবু, সোমনাথবাবু। তবলা আর সারেঙ্গি নিয়ে সংগত করছেন দুজনে। তাদের দেখেই সমীরণ বলে উঠল, ‘আয় আয় মিহির, বোস এখানে।’ মালবিকাকে বলল, ‘ভাবতেই পারিনি তুমি আসবে, বসো।’

মালবিকা সবাইকেই গানের স্কুলে দেখেছে। প্রতিভা অল্পবয়সিদের গান শেখায়। সমীরণ ওর কাছেই মালবিকাকে গান শিখতে বলেছে। ‘যতদিন প্রতিভা রয়েছে, ওর কাছেই প্রাথমিক শেখাটা শিখে নাও। ক্ল্যাসিকাল জানে, শেখাবার কায়দাটা খুব ভালো। যেরকম বলবে, দেখিয়ে দেবে সেইভাবে বাড়িতে করবে।’ মঙ্গল আর বুধবার প্রতিভা ক্লাস করে। মালবিকা দু—দিন ক্লাস করেছে। দিলীপরঞ্জন অফিসে যাবার পর গত চারদিন সে নিজের ছোটো ঘরটায় প্রবল উৎসাহে তানপুরা নিয়ে বসেছে।

প্রথম দিন ক্লাসের শেষে প্রতিভা তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমার বাড়ি কোথায়?’

‘কাছেই, এই গৌরীবাড়িতে। আপনার?’

‘আমারও কাছেই বাড়ি তবে তোমার উলটোদিকে, রাজাবাজারে।’

‘ওটা তো মুসলমান পাড়া?’

‘হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে?’

‘ভয় করে না?’

প্রতিভা হেসে উঠে মাথা নাড়ে। ‘আজ চব্বিশ বছর ওখানে আছি। রাজাবাজারের মোড়ে বড়ো মসজিদটা দেখেছ? তার পাশেই আমরা ভাড়া থাকি। হিন্দু—মুসলমানের মধ্যে কোনো দাঙ্গা বা গোলমাল হতে দেখিনি। শুনেছি চৌষট্টি সালে দাঙ্গা বাধাবার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু ওখানে বাধেনি। বেশ, তুমি চলো আমার সঙ্গে, নিজের চোখে দেখে আসবে। বাড়ি ফেরার তাড়া নেই তো?’

‘চলুন, আমার কোনো তাড়া নেই।’

মালবিকার খুব ভালো লেগে গেছে প্রতিভাকে। গড়পড়তা বাঙালি মেয়েদের থেকে লম্বা এবং আনুপাতিক হারে চওড়া। মোটা কবজি, চওড়া কাঁধ। ঘাড়ে পিঠে মেদ জমেছে, তলপেটের পেশি আর টানটান নেই। শান্ত চোখ, কথাও বলে শান্ত ভাবে। প্রথম দিনেই ধৈর্য ধরে সে মালবিকার অপটুত্বকে যত্ন নিয়ে শোধরাবার চেষ্টা করেছে।

মালবিকার শুধু একটাই ভয় ছিল, তাচ্ছিল্য বা বাঁকা মন্তব্য যেন না তাকে সইতে হয়। হয়নি। প্রতিভাকে সত্যিই তার দিদি বলে মনে হয়েছে।

আমহার্স্ট স্ট্রিট অর্থাৎ রামমোহন রায় সরণি ধরে দক্ষিণ দিকে ওরা হাঁটছিল। মালবিকা কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘প্রতিভাদি, সামনের মাসেই আপনার বিয়ে?’

‘কে বলল?’

‘সমীরণদার কাছে শুনেছি। উনি দুঃখ করে বলেন আপনার বোধহয় আর কিছু হবে না। সারাক্ষণ গান নিয়ে পড়ে না থাকলে তার কিছু হয় না। আপনাকে ওঁর সেরা ছাত্রী বললেন।’

‘শুধু ছাত্রী, আর কিছু নয়?’

প্রতিভার স্বরে কেমন যেন একটা বিদ্রূপের মতো স্পর্শ ছিল যেটা মালবিকাকে আরও কৌতূহলী করে দেয়।

‘আর কিছু মানে?’

প্রতিভা জবাব দেয়নি। মালবিকা হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে দেখল নরম মুখটা হঠাৎ যেন কঠিন হয়ে গেল।

‘যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে তিনিও কি গান করেন?’

‘একদমই না। ভদ্রলোক বর্ধমান জেলার কোনো এক থানার ছোটোবাবু। বউ গায়ে আগুন দিয়ে মরেছে। সম্বন্ধটা এনেছে আমার দূর সম্পর্কের এক বউদি। ভদ্রলোকের ছেলেপুলে নেই, বর্ধমান শহরের ধারে দোতলা বাড়ি করেছেন, বয়স বিয়াল্লিশ, মাসে উপরি হাজার পাঁচেক টাকা। এমন পাত্র ভারতবর্ষে ক—টা পাবে? বাবা, মা দিনরাত শোনাচ্ছে, এখনই আমার বিয়ে করে ফেলা উচিত। আমার ছোটো দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মালবিকা, আমার বয়স এখন বত্রিশ, ওদের মতে এই বয়সে চার সন্তানের মা হয় মেয়েরা, আমি কেন এখনও হইনি? এ তো এক বড়ো বিদঘুটে সমস্যা।’

প্রতিভার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। মালবিকাও হাসল। ‘আপনি তো লেখাপড়া শিখেছেন?’

‘বিএ, ইতিহাসে অনার্স ছিল।’

‘এত ভালো গান জানেন!’

‘তাতে কী হল? এত গুণ আছে যখন চাকরিও তখন পেতে পারি, তাই তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘একটি চাকরি জোগাড় করে দিতে পারো?’

মালবিকা চুপ করে পাশাপাশি হেঁটে বলল, বাঁ দিকে একটা পার্ক। সেটা ছাড়িয়ে আমহার্স্ট স্ট্রিট থানা তার উলটোদিকে সিটি কলেজ।

‘লোকের মুখে সবসময় শুনবে, লেখাপড়া জানে তা হলে চাকরি করে না কেন? আরে বাবা চাকরি করতেই তো চাই, পাচ্ছি কোথায়? এখানে গান শিখিয়ে, দুটো গানের আর একটা মাধ্যমিক ছাত্রীর টিউশানি করে, সমীরণদার সঙ্গে তানপুরায় বসে গড়ে মাসে আট—ন—শো টাকা হয়। এতে কি চলে?’

‘ছোটোখাটো ফাংশান তো কতই হয়, গাইতে পারেন তো?’

‘আমাকে নেবে না। পাবলিসিটি, ব্যাকিং, গ্ল্যামারাস সাজ, এখন এসব খুবই বড়ো ফ্যাক্টর। ভেবেছিলাম সমীরণদা আমায় দেখবেন।’

প্রতিভা চুপ করে মাথা নামিয়ে মন্থরভাবে হাঁটতে লাগল। মালবিকার মনে হল প্রতিভাদির আরও কিছু বলার কথা আছে, কিন্তু সদ্য পরিচিতের কাছে সেগুলো বলতে চান না।

‘জয় মা মনসা’ ফিল্মটা দেখেছ?’

‘না।’

‘সমীরণদা মিউজিক দিয়েছেন। আমাকে একটা গান দিয়েছিলেন। ওই পর্যন্তই। ছবিটা মফসসলে খুব চলেছে। গানটা ভালোই গেয়েছিলুম। দু—তিনটে জলসায় আমাকে গাওয়ার চান্স করে দিয়েছিলেন। রেডিয়োর অডিশনের ব্যবস্থা করেছেন, বছরে পেয়েছি তিনবার প্রোগ্রাম। একটা ক্যাসেট বার করে দেবেন বলেছিলেন, চেষ্টা করলে পারতেন কিন্তু করেননি। এইভাবে কি দিন চলে? সবটাই ভাগ্যের ব্যাপার মালবিকা, নাম করা, টাকা রোজগার করা এসব ভাগ্য না থাকলে হয় না।’

‘আপনাকে কেন সংসারের কথা ভাবতে হবে?’

‘একটা ভালো কথাই বলেছ। আমিও নিজেকে এই প্রশ্নই করি। আমি অনেক কিছু করেছি, এখনও করছি।’

প্রতিভা এত জোরে ‘এখনও করছি’ বলে উঠল যে মালবিকা ওর হাত চেপে ধরল। রাস্তার দু—তিন জন তাকিয়ে দেখে গেল।

‘আস্তে প্রতিভাদি।’

গলা নামিয়ে প্রতিভা বলল, ‘বলির পাঁঠা কিন্তু আমি হব না। আমি এখনও ঠিক করিনি বিয়েটা করব কি না। ভাবতে পারো, ছেলের বাড়ি থেকে কিছু চাই না বলেও নগদ মাত্র আট হাজার শুধু চেয়েছে বউভাতের খরচের জন্য। এই টাকা আমাকেই জোগাড় করতে হবে। কোন দেশে কোন সময়ে আমরা রয়েছি? লেখাপড়া শিখে এসব আমি মেনে নেব?’

‘আস্তে প্রতিভাদি।’

‘কেন আস্তে হব? সবাই জানুক, পণপ্রথা তুলে দাও, জাতপাত তুলে দাও, বিচ্ছিন্নতাবাদ ঠেকাও, অপসংস্কৃতি ধ্বংস করো বলে মিছিল, মিটিং সেমিনার প্রবন্ধ লেখা হয়। সব বাজে সব বাজে। মালবিকা, তুমি বাচ্চচা মেয়ে, জানো না কী ভণ্ডামিতে দেশটা ছেয়ে গেছে। আর এরই ধাক্কায় আমি—আমিও নিজেকে নীচে নামিয়েছি।’

প্রতিভা আর কথা না বলে জোরে হাঁটতে শুরু করল। ওর সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে মালবিকাকে আধা—দৌড় দিতে হচ্ছে।

‘আস্তে প্রতিভাদি।’

প্রতিভা মন্থর হয়ে হেসে ফেলল, ‘খুব জোরে হেঁটে ফেলেছি, না? মোটা হয়ে গেলেও আমি কিন্তু হাঁটায় তোমায় হারিয়ে দিতে পারি। এইবার বাঁ দিকে কেশব সেন স্ট্রিটে।’

ওরা বাঁ দিকের রাস্তা ধরে রাজাবাজারের মোড়ের কাছাকাছি এসে বড়ো মসজিদের আগের গলিটায় পৌঁছল।

‘কি, ভয় করছে?’ প্রতিভা দাঁড়িয়ে পড়ল।

মালবিকা দু—ধারে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’

কলকাতার যে—কোনো একটা বড়ো রাস্তার মোড় যেমন হয় এই মোড়টা তার কাছে তেমনই লাগল, শুধু দারিদ্র্যের ছাপটাই প্রকট। দোকানগুলোয় ঔজ্জ্বল্য নেই, ভিড়ে রাস্তায় চলা বিরক্তিকর, ফুটপাথ আছে কী নেই বোঝা যায় না। পোশাক বা দোকানের সামগ্রী থেকে বোঝা যায় এখানে অভাবী মানুষই বেশি। অনেকগুলো খাওয়ার হোটেল। কাঠের টেবল আর বেঞ্চ ছাড়া হোটেলে আসবাব নেই। হিন্দু নামের সাইনবোর্ড লাগানো কয়েকটা মিষ্টির দোকান দেখে মালবিকা বলল, ‘প্রতিভাদি এইসব হোটেলে, মিষ্টির দোকানের মিষ্টি কখনো খেয়েছেন?’

প্রতিভা গলির মধ্যে ঢুকল। সরু গলি। পাকা বাড়িগুলোর সঙ্গে টালি ও টিনের ছাদওলা কাঠের দোতলা বাড়িও রয়েছে। একটা ঠেলাগাড়ির জন্য দেয়ালে প্রায় লেপটে গিয়ে প্রতিভা বলল, ‘না, একদম বাজে খাবার। তবে বাড়ির থেকে হোটেলে খাওয়াটা সস্তায় হয়, রুটি আর গোরুর মাংস। একটু পরে দেখবে হোটেলগুলোয় কী ভিড়!’

রাস্তা থেকে একহাত উঁচুতে সদর দরজা। দরজার কাঠের অবস্থা শোচনীয়। একফালি পথ, দু—ধারে ঘর, ঘরগুলোয় একটিমাত্র ছোটো জানলা, তারপর দোতলার সিঁড়ি যেটা চওড়ায় দু—হাত।

‘দেখে উঠো, সিঁড়িতে নানান জিনিস পড়ে থাকে অনেক সময়।’

দোতলায় সরু শিক লাগানো বারান্দা। পর পর দুটি ঘর প্রতিভাদের। দ্বিতীয় ঘরটায় থাকে সে। দরজায় নীল রঙের পর্দা। ঘরের একধারে তক্তপোশ। অন্যধারে একটা তানপুরা আর হারমোনিয়াম। প্রতিভার বাবার বৈঠকখানায় একটা লন্ড্রি আছে, এখন তিনি দোকানে। ওর মা—র সঙ্গে আলাপ করে মালবিকার ভালো লাগল।

প্রতিভার মা দুর্গা ঘর দুটো পরিষ্কার ফিটফাট রেখেছেন। চারদিকের নোংরা অপরিচ্ছন্নতার মধ্যে এদের সংসারটা যেন একটা বাগান।

‘আমি চা করে আনছি।’ দুর্গা রান্নাঘরে যাবার জন্য খাট থেকে উঠলেন। চারটে কাঠ দিয়ে উঁচু করা খাটটা বোধহয় ওনার বিয়েতে পাওয়া। খাটের নীচে সংসারের নানান জিনিস রাখা।

‘শুধু চা কিন্তু মাসিমা।’ মালবিকা তাড়াতাড়ি জানিয়ে দিল।

‘কেন! একটু মিষ্টিমুখ করবে না? প্রথম দিন এলে।’

‘মিষ্টি আমি একদম খাই না।’

‘একটু আগেই আমি ওকে বলেছি এখানকার খাবারগুলো বাজে।’ বলেই প্রতিভা জোরে হেসে উঠল।

‘না না, সে জন্য নয়। সত্যিই আমি মিষ্টি খাই না।’ কথাটা বলে মালবিকার হাসি পেল। মহাজাতি সদনে সমীরণের দেওয়া মিষ্টি সে খায়নি, বলেছিল, ‘খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।’ বলেছিল, ‘এইমাত্র ছেড়েছি।’ কীরকম অবাক চোখে সমীরণ তার দিকে তাকিয়ে জুঁই ফুলের মালাটা তাকে উপহার দিয়েছিল। মালবিকার মনে হয়েছে ওইটেই সেই মুহূর্ত যখন সে সমীরণের চোখ টেনেছিল। পরে সংশোধন করে নিজেকে সে বলে, সমীরণের মন টেনেছিল, তা যদি না হত, তা হলে সমীরণ কেন তার পিঠে আঙুল দিয়ে—।

‘কী ভাবছ অত? বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাচ্ছে?’ প্রতিভা জিজ্ঞাসা করল।

‘আমার বাবা একটু ভিতু ধরনের। মেয়ের বাড়ি ফিরতে দেরি হলে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে।’ মালবিকা কথাটা বলে মজা পেল। বাবা তার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে, ভাবা যায়!

চা—এর সঙ্গে দুটো বিস্কুট খেয়ে সেদিন মালবিকা বেরিয়ে আসে। প্রতিভা তাকে বাস স্টপ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে চেয়েছিল। সে বারণ করে।

.

সমীরণ ঠিক দু—ঘণ্টাই গাইল। দেড় হাত উঁচু আসর ঘিরে জমি ও গ্যালারিতে কয়েক হাজার শ্রোতা। যাত্রার জন্য সাত—আটটা মাইক্রোফোন আসরের উপর ঝুলছে। মালবিকা আর মিহির জমিতে ফরাসের উপর বসে। তাদের মুখোমুখিই আসরের মাঝখানে বসেছিল সমীরণ আর তার সামান্য পিছনে, বাঁ দিকে ছিল প্রতিভা।

সমীরণের আসরে এসে বসা, গান গাইবার সময় শ্রোতাদের দিকে তাকানো, তবলচির দিকে মুচকি মুচকি হাসি, মাথা নাড়া, চোখ বন্ধ করা ইত্যাদি ওর প্রত্যেকটি সঞ্চালনই যেন মেপে করা এবং দেখতে ভালো লাগে। ওর জনপ্রিয়তার পিছনে এইগুলিরও অবদান রয়েছে।

মালবিকা প্রথম গান থেকেই লক্ষ করল সমীরণ গাইছে তার দিকেই তাকিয়ে। মাথার দোলানি, ভ্রূ তোলা, মুখ টিপে হাসা সবই যেন তার জন্য। নিধুবাবুর একটা গানের শেষ দুটো পঙক্তি ছিল—’ছলে বলে কৌশলে, মালিনীরে ফাঁকি দিলে। উভয়ের মন অন্তঃশীলে, বহে ফল্গু নদী যেমন।’ সমীরণ মালিনী শব্দটাকে দু—ভাগ করে শুধুই ‘মালি’ শব্দটাকে গলায় খেলাতে থাকে অনেকক্ষণ পরে। ঊর্ধ্বাঙ্গ দুলিয়ে, কখনো চোখ টিপে, সাজানো দাঁতগুলোর ঝলসানি দিয়ে বারবার সে ‘মালি’ শব্দটাকে সুরের বাহারে সাজিয়ে তুলতে লাগল এবং মালবিকার দিকে তাকিয়ে।

ব্যাপারটা যে সে বুঝেছে সমীরণকে তা জানাবার জন্য মালবিকা ভ্রূকুটি করে নাক কুঁচকে কয়েকবার হাসল। তারপর পাশে বসা মিহিরকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখল মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে আর গম্ভীর। ব্যাপার কী? সমীরণ তার নামটা নিয়ে এমন করে গাইছে বলে মিহিরের কি পছন্দ হচ্ছে না? এত লোক শুনছে অথচ মিহির ছাড়া কেউ জানে না সমীরণের এই ‘মালি’টি কে! এটা ভেবে মালবিকা মজা পেল।

‘সমীরণদার কাণ্ডটা দেখেছ?’ মালবিকা ফিসফিসিয়ে বলল। মিহির কথা বলল না। কিছুক্ষণ পর অস্ফুটে মিহির বলল, ‘ড্রিঙ্ক করেছে।’

মিহিরের সঙ্গে দু—তিনবার কথা বলার চেষ্টা করল মালবিকা। হুঁ, হ্যাঁ ছাড়া জবাব পেল না। এবার মালবিকা বিরক্ত হয়ে ভাবল, তানপুরা দিয়ে আর মোটরে চড়িয়ে কি ভাবছে আমি ওর কেনা বাঁদি হয়ে গেছি? হঠাৎ—ই মিহিরের প্রতি বিতৃষ্ণা বোধ করল, আর মনে পড়ল ওর কাঁধে একটা সাদা দাগ আছে।

মালবিকা গোনেনি সমীরণ ক—টা গান গাইল। নিধুবাবু, নজরুল, নিজের দেওয়া সুরে রাগপ্রধান, দ্বিজেন্দ্রলাল, নানান জনের লেখা বোধহয় পনেরোটি গান।

‘ক—টা গাইল গুনেছ?’ সে মিহিরকে জিজ্ঞাসা করল।

‘না। গোনার জন্য আসিনি, শোনার জন্য এসেছি।’

মিহিরের বলার ভঙ্গিতে মালবিকা অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে রইল।

‘এগারোটার মধ্যে পৌঁছে দেব বলে এসেছি। আমি গাড়িতে আছি তুমি তাড়াতাড়ি এসো।’ মিহির তার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

আসর থেকে বেরিয়েই সমীরণদের গাড়িতে ওঠার কথা। একটু হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠতে হবে। বাইরে আসামাত্র অটোগ্রাফ নেবার জন্য একটা ভিড় সমীরণকে ঘিরে ফেলল। কখনো দাঁড়িয়ে কখনো চলতে চলতেই সে সই করে যাচ্ছিল।

কাঁধে একটা টোকা পড়তেই মালবিকা পিছনে তাকাল।

‘প্রতিভাদি।’

‘তুমি আমাদের গাড়িতে এসো।’

‘সে কী! আমি তো মিহিরদার গাড়িতে এসেছি।’

‘ফেরাটা নয় আমাদের গাড়িতেই হোক। এসো না।’

কীরকম একটা কাতর আবেদনের মতো শোনাল ‘এসো না’। মালবিকা ইতস্তত করে বলল, ‘মিহিরদা কী মনে করবেন।’

‘কিছু মনে করবে না। বলবে প্রতিভাদি অনেক করে বলছেন।’

‘সমীরণদাকে বলা দরকার।’

‘বলো। তবে আমার নাম কোরো না।’

মালবিকা প্রায় ছুটেই সমীরণের কাছে গেল। কয়েকজন কর্মকর্তা তখন ওর সঙ্গে চলেছে তাকে গাড়িতে তুলে দিতে।

‘সমীরণদা একটা কথা।’

মোটরের কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল সমীরণ। মালবিকা তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নীচু গলায় বলল, ‘আমি আপনার সঙ্গে যাব।’

‘আমার গাড়িতে? কিন্তু মিহির কিছু মনে করবে না?’

‘করুক। আমি আপনার সঙ্গে যাব।’ গলায় আবদার ছাড়াও মালবিকা অনুরোধকে আন্তরিক করতে সমীরণের কনুই আঁকড়ে ধরল। মদের গন্ধ সে চেনে, সমীরণের মুখ থেকে ক্ষীণভাবে সে গন্ধ পেল। বোধহয় আসরে আসার আগে সেক্রেটারির বাড়িতে অপেক্ষার সময় খেয়েছে। প্রতিভা গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে রয়েছে তাদের দিকে।

‘বেশ, চলো।’ সমীরণ গাড়ির দরজায় হাতলে হাত রাখল। ‘মিহিরকে বলে এসো।’

একটু দূরে মিহির তার গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে। মালবিকাকে হনহনিয়ে আসতে দেখে সে ইঞ্জিন চালু করল।

‘আমি সমীরণদার গাড়িতে যাব।’

‘সে কী!’

‘সমীরণদা বললেন একপিঠ তো মিহিরের গাড়িতে এলে এবার ফেরাটা আমার গাড়িতে। এমনভাবে বললেন যে না করতে পারলুম না।’

‘সে কী!’ মিহিরের স্বরে এবার বিস্ময়ের বদলে ফুটে উঠল অধৈর্যতা। ‘যার সঙ্গে এলে তার সঙ্গেই তো ফেরার কথা! আর তুমি হ্যাঁ বলে দিলে?’

‘কী করব। বললুম তো, এমনভাবে উনি বললেন যে—’, মালবিকা থমথমে মুখটা দেখে কথা অসমাপ্ত রাখল।

‘এমনভাবে বললেন। কীভাবে বললেন? ওর মুখে গন্ধ পাওনি?’

‘পেয়েছি। মদ খেয়েছেন। তা কী হয়েছে? উনি কী গাড়িতে আমার রেপ করবেন? ড্রাইভার রয়েছে, প্রতিভাদি রয়েছে। এত নীচ কেন তোমার মন?’ কথাটা বলেই তার মনে হল, না বললেই ভালো হত। মিহিরকে তার আরও অনেকবার দরকার হবে। কিন্তু সমীরণকে দরকার আরও বেশি। তার ভবিষ্যৎ তৈরি করে দেবার লোক তো ওই একজনই। বকুলও তাই বলে।

‘এটা ভদ্রতারও ব্যাপার। যার সঙ্গে আসা, উচিত তার সঙ্গেই যাওয়া। ঠিক আছে যাও তুমি’। মুখটা কালো হয়ে বসে গেছে। মিহির দাঁত চেপে নিজেকে সামলে রাখল।

‘রাগ করলে?’ জানলা গলিয়ে মিহিরের কাঁধে হাতটা রেখেই সে তুলে নিল। মিহির গাড়ি ছেড়ে দিল।

গাড়িতে বসে সমীরণ আর প্রতিভা অপেক্ষা করছে। অন্য গাড়িটা বিজনবাবু, সোমনাথবাবু আর বাজনাগুলো নিয়ে রওনা হয়ে গেছে। প্রাইভেট ট্যাক্সি, অবাঙালি হিন্দিভাষী ড্রাইভার, গ্যারেজ কলকাতায়। ওধারের জানলায় প্রতিভা, মাঝখানে সমীরণ। মালবিকা গাড়িতে উঠে সমীরণের ডানদিকে বসল।

গাড়ি গোবরডাঙা থেকে বেরোবার পরই সমীরণ ক্লান্ত শরীরটা পিছনে হেলিয়ে, নাগরা জোড়া খুলে পা দুটো ছড়িয়ে বলল, ‘এতগুলো গান গাওয়া সত্যিই কষ্টের।’

একটা পা মালবিকার বাঁ পায়ের পাতার ওপর রাখা। টেনে নিতে গিয়েও সে নিল না। বলল, ‘তা হলে কম গাইলেই তো পারেন।’

‘পারি না। প্রতিভা জানে কেন পারি না।’

‘আমি? আমি কী করে জানব।’ প্রতিভা এতক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। মুখ ফিরিয়ে সে কথাটা বলার সঙ্গেই, মালবিকার মনে হল, ডান পা টেনে নিয়ে বাঁ দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল।

‘তুমি জানো না? ন্যাকামো কোরো না। আমার বউ কী জিনিস তুমি জানো না?’ সমীরণ মাথাটা পিছনের গদিতে চেপে মুখ তুলে বড়ো একটা শ্বাস ফেলল। আড়মোড়া ভাঙার মতো করে দু—হাত তুলল। ডান হাত নামাল, বাঁ হাত প্রতিভার কাঁধের পিছনে সিটের উপরে রাখল।

প্রতিভা জবাব দেয়নি। সমীরণ আবার বলল, ‘আমার অসুবিধেটা তুমি জানো প্রতিভা।’

মালবিকা ডান দিকে মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকিয়ে। অন্ধকার রাস্তা। বাড়ির আর দোকানের ছাড়া কোনো আলো নেই। একঘেয়ে অন্ধকার। কিন্তু তার বাঁ দিকে একটা ব্যাপার হচ্ছে যেটা একঘেয়ে নয়।’

‘হ্যাঁ জানি। আর জানি বলেই—’

‘তোমাকে কী বিয়েটা করতেই হবে? না করলেই নয়?

‘করতে হবে। না করলেই নয়।’

‘কিন্তু কেন? তুমি কী আমাকে বিশ্বাস করো না?’

এবার নীরবতা। কিছুক্ষণ পর প্রতিভার গলা মালবিকা শুনল, ‘আর করি না।’ স্বরটা খুব নরম।

‘ওহহ।’

কিছুক্ষণ পর সমীরণ ডান দিক ফিরে মালবিকাকে বলল, ‘অর্ধেকটা খেয়েছি, বাকিটা যদি এখন খাই তোমার অসুবিধে হবে?’

‘না। আমার বাবাও তো খায়।’

ডান দিকের পকেট থেকে সমীরণ হুইস্কির পাঁইটটা বার করল। বোতলটা ডান হাতে মালবিকার সামনে ধরে বলল, ‘ছিপিটা খুলে দাও।’

ছিপির প্যাঁচ ঘোরাবার সময় মালবিকার হাত কেঁপে গেল। সমীরণ কাঁচা মদ ঢক ঢক গিলে নিয়ে গুম হয়ে রইল চোখ বন্ধ করে।

‘কেন যে খাই লোকে তা বোঝে না, তুমি কখনো খেয়েছ?’

‘না।’ মালবিকার গলা থেকে কোনোক্রমে শব্দটা বেরোল। এমন প্রশ্ন কখনো সে শোনেনি। এখন যদি খেতে বলে?

বোতলটা প্রতিভার মুখের সামনে ধরে সমীরণ বলল, ‘নাও।’

‘কী হচ্ছে কী?’ তিক্তস্বর প্রতিভার। ‘একটি অল্পবয়সি মেয়ে, একেবারে নতুন, তার সামনে এইসব বলে তুমি নিজেরই মান খোয়াচ্ছ।’

‘তুমি’? মালবিকা অবাক হল। তা হলে তলায় তলায় এদের সম্পর্কটা তুমির। সম্পর্ক যে একটা আছে সেটা সে আন্দাজ করেছিল, এখন নিশ্চিত হল এবং উত্তেজিতও।

‘নতুন তো একদিন পুরনো হবে, জানবে আমি লোকটা কেমন। কিন্তু পুরনো মদের কী তুলনা আছে। আর লজ্জা করতে হবে না। নাও, নাও।’ অমার্জিত কর্কশ স্বরটা আদেশের মতো। কথাটা বলেই বাঁ দিকে কাত হয়ে সমীরণ বাঁ হাতে প্রতিভার গলা ছড়িয়ে ঠোঁটের উপর হামলা চালাল।

কাঁটা হয়ে রইল মালবিকা। বাঁ দিকে তাকাবার সাহসও সে হারিয়ে ফেলেছে। ডান হাতে ধরা বোতলটা কাত হয়ে যাওয়ায় সমীরণের পাঞ্জাবির উপর অনেকটা মদ পড়ে গেল। মালবিকা বোতলটা আস্তে তুলে নিল নিজের হাতে। একবার আড়চোখে সে তাকাল। ধস্তাধস্তির মতো একটা ব্যাপার চলেছে। সমীরণ দু—হাতে প্রতিভাকে জড়িয়ে ওর বুকে মুখ ঘষছে। প্রতিভা একহাতে ঠেলে মুখটা সরাবার চেষ্টা করছে। কারুর মুখে কথা নেই, শুধু শ্বাস—প্রশ্বাসের ভারী শব্দ। মালবিকার বুঝতে অসুবিধে হল না ব্যাপারটা প্রতিভার মোটেই পছন্দের হচ্ছে না। অবশেষে চওড়া কবজিওয়ালা হাতের মুঠোয় সমীরণের চুল ধরে প্রতিভা মাথাটা সোজা করে দিল হ্যাঁচকা টানে। সমীরণ চাপা স্বরে ‘উহহ’ করে উঠল।

মুঠি থেকে চুলের গোছা ছেড়ে দিয়ে প্রতিভা গুম হয়ে জানলার দিকে বাইরে তাকিয়ে রইল। সমীরণ মালবিকার হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বোতলটা মুখ ধরে উঁচু করল। আর কিছু অবশিষ্ট আছে কি না মালবিকা বুঝতে পারল না তবে বিশ্রী একটা গালাগাল দিয়ে সমীরণ বোতলটা বাইরে ছুড়ে ফেলে দিল।

প্রতিভা নিশ্চয়ই অনুমান করেছিল এইরকম কিছু ঘটতে পারে আর সেজন্যই বোধহয় তাকে সঙ্গে যেতে বলেছে। নতুন ছাত্রীর সামনে সমীরণ অসভ্যতা করবে না, এটাই সে ভেবে নিয়েছিল। মালবিকা বুঝে উঠতে পারছে না এখন সে কী করবে। কিন্তু তার করারই বা আছে কী? ব্যাপারটা সম্পূর্ণতই ওদের দুজনের মধ্যে, এ—ক্ষেত্রে তার নিরপেক্ষ থাকাই উচিত। বাড়ি থেকে অনেক দূরে, অন্ধকারের মধ্যে ছুটন্ত মোটরগাড়িতে, অল্প পরিচিত দুটো মানুষ আর একদমই অপরিচিত ড্রাইভার, পরিস্থিতিটা থমথমে এবং বিস্ফোরক। এমন অবস্থার মধ্যে পড়ে তার বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। দেহ শক্ত করে কাঠের মতো বসে থাকা আর প্রতিভার জন্য সহানুভূতি জড়ো করা ছাড়া তার আর কী করার আছে? এখন তার মনে হচ্ছে মিহিরের গাড়িতে উঠলেই ভালো হত।

বুকের কাছে মুখ ঝুলিয়ে দিয়ে সমীরণ বসে। বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। মালবিকা শোনার করল চেষ্টা।

‘এত করেছি, তবু আরও চাই…বিয়ে করতে হবে, কেন?…ফুঃ, বিয়ে করলে মুটকিটাকে কেন করব! উঃ, এই ধুমসিকে?’

মালবিকার বাম ঊরুর উপর সমীরণের হাত এসে পড়ল। চমকে উঠে সে প্রথমেই ভাবল, হাতটা সরিয়ে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল মদ খেয়ে বাড়ি ফেরা দিলীপরঞ্জনকে। যখন চড়চাপড় মারে, মা না চেঁচিয়ে ঝগড়া না করে বাবাকে ধরে শোয়াবার চেষ্টা করে। উত্তেজনা উসকে দেবার মতো কোনো বাধা না পেয়ে বাবা ঝিমিয়ে আসে। সমীরণের হাতটা সে সরাল না। চড়চাপড় হয়তো মারবে না তবে গাড়ি থামিয়ে এখন যদি বলে ‘নেমে যাও!’ তা হলে সে কী করবে!

সমীরণের মাথাটা আর একটু ঝুলে পড়েছে। চাকা গর্তে পড়ে গাড়ি যখন লাফিয়ে উঠছে সমীরণের তখন হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হচ্ছে। একবার সামনের সিটে মাথা ঠুকে গেল।

‘মালবিকা ওকে সিধে করে বসিয়ে দাও তো।’

প্রতিভা মুখ বাইরের দিকে রেখেই বলল। স্বরের মধ্যে নিস্পৃহতা ছাড়া আর কিছু নেই। মালবিকা দুটো কাঁধ ধরে সমীরণকে টেনে তুলে সিটের পিছনে হেলান দেওয়াল। সবল, পুষ্ট কাঁধ আর বাহুর পেশি। সে দু—হাতের আঙুল ছড়িয়েও আঁকড়ে ধরতে পারছে না।

‘আমি ঠিক আছি।’ বলে সমীরণ সিধে হয়ে বসতে চেষ্টা করল। ‘ওইটুকু খেয়ে সমীরণ মিত্তিরের কিছু হয় না।’

মালবিকা জোর করে চেপে ধরে রইল। সমীরণ তার দিকে মুখ ফিরিয়ে অনেকক্ষণ কী যেন দেখার চেষ্টা করল। গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে আসা হালকা কুয়াশার মতো অস্বচ্ছ আলোয় মালবিকা দেখল পাতলা ঠোঁট, একটা তিল, বাঁকা দুটি সরু ভুরু আর স্থির দৃষ্টিতে থাকা দুটি হালকা ধূসর চোখের মণি। মহাজাতি সদনে এই চোখের চাহনিতে তার বুক কেঁপে উঠেছিল।

‘তুমি ভালো। দেখামাত্র তোমাকে ভালো লেগেছে।’ ফিসফিস করে সমীরণ বলল। ‘প্রতিভাও ভালো।’

‘হ্যাঁ প্রতিভাদি ভালো।’

‘কিন্তু যেমনটি চাই ও তা নয়।’

মালবিকা দেখল মাথা নীচু করে কপালে হাত দিয়ে রয়েছে প্রতিভা। মুখ দেখা গেল না। সমীরণের ডান হাত এখনও তার ঊরুর উপর। একবার জোরে আঁকড়ে ধরেই শিথিল করল আঙুলগুলো। কাঁধ ধরা হাত দুটো এবার সরিয়ে নেবে কি না মালবিকা বুঝতে পারছে না। যদি আবার সামনে ঝুঁকে পড়ে!

সেই সময় ঊরু থেকে হাতটা উঠে এল মালবিকার মাথার পিছনে। মাথাটাকে সামনের দিকে আলতো করে হাতটা ঠেলল। তার মুখটাও নিয়ে গেল সমীরণের মুখের দিকে। মদের কটু গন্ধ তার মুখে ছড়িয়ে যাচ্ছে। মাত্র তিন—চার ইঞ্চির ব্যবধান। দূরত্বটা ঘুচিয়ে দেবে কী দেবে না? তার শরীর, মন আর যেন নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারছে না। আড়চোখে সে দেখল, প্রতিভা একইভাবে কপালে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে স্থির রয়েছে। মিহিরকে তার মনে পড়ল। ‘ঠিক আছে, যাও তুমি।’ ওর ঘাড়ের কাছে একটা সাদা—।

মালবিকা সদ্য যুবতী, বোধ অপরিণত। বয়সকালের আবেগ সে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। সে বড়ো হয়ে উঠেছে শিক্ষা ও রুচিবর্জিত, জীবন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণাবিহীন। তরল মানসিকতাসম্পন্ন অভিভাবকদের আওতায়। সময় এখন একটা ছুটন্ত নেকড়ের মতো, তার থাবার আঁচড় সে দেগে দিচ্ছে মানুষের চেতনায়। মালবিকা উচ্চচাকাঙ্ক্ষী হয়েছে সময়ের দাগানো নির্দেশ মেনে নিয়ে। তার অনেক কিছুই চাই এবং খুবই তাড়াতাড়ি। তার কোমল একটি হৃদয় আছে এবং সময়বিশেষে সেটি কঠিন, স্বার্থপর হয়ে যায়। তার শিক্ষা নেই, ধৈর্য নেই। গুণাবলীও কিছু নেই। অথচ প্রচারমাধ্যমগুলি নিয়ত যে রাশি রাশি স্বপ্ন তৈরি করে চলেছে সেগুলি থেকে নিস্তার পাবার মতো মানসিক জোরও তার নেই। তার বয়সিদের মধ্যে ক—জনেরই বা তা আছে? মালবিকা স্বভাবজাত বাস্তববোধ থেকে এইটুকু বুঝে গেছে, তার তারুণ্য, তার চাপল্যই তার সহায়, পুরুষদের হাতেই যাবতীয় ক্ষমতা এবং পুরুষদের প্রতিরোধশক্তি খুবই ক্ষীণ, তাতে বহু রন্ধ্র আছে। তার একজন পুরুষ দরকার ছিল নিজের ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য। সে পেয়েছিল সমীরণ মিত্রকে। সে দেখতে পেয়েছিল সমীরণের রন্ধ্রগুলোকে, তার দুর্বলতাকে। চার ইঞ্চির ব্যবধানটা সেদিন ঘোচানোমাত্রই সে চূর্ণ করে দিয়েছিল বিখ্যাত ও জনপ্রিয় গায়কটিকে আর সেই সঙ্গে পা বাড়িয়ে দেয় বেপরোয়াভাবে কর্দমাক্ত পথে চলার সাহস। নিজের ভাগ্য নিজেই গড়ে নেবার জেদ তাকে পেয়ে বসে। সে জানে তাকে শক্ত হতে হবে, দ্বিধা—সংকোচ মানেই পতন।

উদ্ভট ও অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখা গেছল গোবরডাঙা থেকে ফেরা মোটরগাড়িটার মধ্যে। দু—পাশে দুই নারী মধ্যে এক পুরুষ। পুরুষটির জীবন থেকে এক নারী অস্তাচলে। অন্য নারী উদীয়মানা। পাশাপাশি বসে তারা বিচিত্র একটা পরিস্থিতি তৈরি করল। এর মধ্যে কে যে নির্মম, কে যে করুণ, কে যে সজীব সেটা বিচার করার দায় আমার নয়।

গোবরডাঙা থেকে একা মোটরে ফেরার সময় মিহিরও অসহ্য এক জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে ভেবেছিল, তার ঘাড়ে একটা দায় চাপল। এই আচরণ এই প্রত্যাখান আর অপমানের শোধ নেওয়ার দায়। সে শিক্ষিত, মার্জিত ও আর্থিক দিক থেকে সম্পন্ন এবং সে জানে মেয়েদের আকর্ষণ করার মতো চেহারা অথবা বিশেষ কোনো গুণ তার নেই। কিন্তু সে চেয়েছিল কারুর কাছ থেকে সাড়া পেতে। হৃদয়ের সাড়া। সে জানে চেহারাটাকে বদলানো, কান্তিমান করে তোলা, আরও দীর্ঘদেহী হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু একটা কোনো গুণ অর্জন, চেষ্টা করলে হয়তো সম্ভব। সে খেলাধুলা করেনি, অভিনেতা হওয়ার যোগ্যতা নেই, গল্প—কবিতা লিখতে পারে না, ছবি আঁকতে জানে না। জনপ্রিয় হবার কোনো পথই তার সামনে নেই। শুধু গানের পথটাই সে দেখতে পায় এবং ক্রমশ সে বুঝে যায় এ—পথেও তার সাফল্য আসবে না। অতি সাধারণ এক গায়ক হওয়া ছাড়া সে আর কিছু হতে পারবে না। সে কোনো মেয়েরই হৃদয় জয় করতে পারবে না। হীনন্মন্যতায় সে আক্রান্ত হয়।

মালবিকাই তাকে প্রথম আশার আলো দেখিয়েছিল। মহাজাতি সদন থেকে গাড়িতে বকুল ও মালবিকাকে রাত্রে বাড়ির সামনে নামিয়ে দেবার পর মালবিকা তার সঙ্গে আলাদা দু—চারটে কথা বলেছিল। মিহিরের সেটা ভালো লাগে। দ্বিতীয় দিন ওদের নিয়ে সমীরণের বাড়ি থেকে ফেরার সময় তার মনে হয়েছিল মালবিকা তার সম্পর্কে কৌতূহলী। সেদিনই সন্ধ্যার তানপুরাটা সে দিয়ে আসে। ফেরার সময় মালবিকা তার সঙ্গে তিনতলা থেকে নেমে এসে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাকে চটুল আলাপের মধ্যে টেনে নেয়। ‘দূর হও’ বলে মালবিকা তাকে আকাশে ওড়ার জন্য পাখা লাগিয়ে দিয়েছিল। গোবরডাঙায় আসার সময় মিহিরকে সে কয়েকবার হাত ধরতে দেয়।

আমাকে নিয়ে খেলা করার জবাব ওকে আমি দেব, এই চিন্তাটাই মিহিরকে পেয়ে বসে। এক একসময় সে নিজের উপরও রেগে ওঠে। কেন সে চিনতে পারেনি মালবিকাকে। কেন শুধু ওর প্রখর যৌবন, সুন্দর মুখ আর রঙ্গভরা আলাপে নিজের বোধবুদ্ধি হারাল? যতই সে ভেবেছে ততই বুকের মধ্যে ধিকি ধিকি জ্বলেছে অপমানের আগুন। আর একজন হল ওই সমীরণ মিত্তির। তার সামনে থেকেই ছিনিয়ে নিয়ে গেল তার মধুর ভবিষ্যৎ, তাকে উপহাসের স্তরে নামিয়ে দিয়ে।

কিন্তু কীভাবে সে শোধ নেবে? ভেবেচিন্তে সে ঠিক করল মালবিকাকে আগে মুঠোয় আনতে হবে। সে ওকে বিয়ে করবে। তারপর ওর উচ্চচাকাঙ্ক্ষা ঘোচাবে। বাড়ি থেকে এক পা—ও যদি বেরোয় তা হলে হাত—পা বেঁধে চাবকাবে। যতই সে এইভাবে ভেবেছে ততই একটা তপ্ত শলাকা তার হৃৎপিণ্ডের গভীরে ধীরে ধীরে ঢুকে গেছে। রক্তাক্ত করেছে তার প্রতিশোধ বাসনাকে।

মিহিরের মতো স্থিরবুদ্ধির যুবক যে ভুল চিন্তা করেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কখনো কখনো মানুষ ষড়রিপুর তাড়নায় দিগবিদিক বোধ হারায়, মনের ভারসাম্যতা নষ্ট করে। মিহিরেরও তাই ঘটল। সে মালবিকাদের বাড়িতে যাতায়াত বন্ধ করল না। আগের মতোই রসিকতা করে সে কথা বলে, মোটরে বকুল আর মালবিকাকে সে কয়েকবার নিয়ে গেল পাতিপুকুরে। উমার নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করল। সুধাংশুর পরামর্শ : ডেস্কটপ পাবলিশিং অর্থাৎ ডিটিপি তার প্রেসে চালু করার যৌক্তিকতা মেনে নিল। দক্ষিণেশ্বরে উমা ও বকুলকে নিয়ে পুজো দিয়ে এল। আর একটা কাজ সে করেছে, সমীরণ মিত্রর কাছে আর সে গান শিখতে যায় না। আরও একটা কাজ করেছে, বকুল, দিলীপরঞ্জন ও মালবিকাকে বাড়িতে এনে তার বাবা ও মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে।

পুত্রবধূ করায় মায়ের আপত্তি নেই, মালবিকাকে তাঁর পছন্দ হয়েছে। ছেলের পছন্দ যখন, বাবা তা মেনে নিতে আপত্তি তুললেন না। এরপর মিহির প্রস্তাবটা দেয় বকুলের কাছে।

ইতিমধ্যে আমরা মালবিকা ও সমীরণের সম্পর্কের খোঁজ নিতে পারি।

গোবরডাঙা থেকে ফেরার সময়কার ঘটনার পর প্রতিভা আর গানের স্কুলে আসেনি। মালবিকা একবার ভেবেছিল খোঁজ নিতে রাজাবাজারে যাবে। কিন্তু কী এক কুণ্ঠা তাকে বাধা দেয়। কপালে হাত দিয়ে সেদিন মুখ ঢেকে থাকলেও কান তো খোলা ছিল। প্রতিভা এখন তাকে কী চোখে দেখবে, কী ধরনের কথা বলবে তা বুঝে উঠতে না পারায় সে আর যায়নি। সমীরণ এখন নিজে তার সংগীত শিক্ষার তত্ত্বাবধায়ক।

মালবিকা সমীরণের সঙ্গে নানান ধরনের আসরে এখন বসছে তানপুরা নিয়ে। দূরদর্শনেও সমীরণের পিছনে তাকে দেখা গেছে। ফলে দত্তবাড়িতে তাকে এখন যে—নজরে দেখা হয়, সেটাই সে চেয়ে এসেছে—গুরুত্ব! সমীরণ প্রতিভাকে টাকা দিত, মালবিকাকে দিল তার থেকে বেশি, তিনশো টাকা।

দোতলায় ছাত্রছাত্রীরা চলে যাবার পর মালবিকাও যখন যাওয়ার উদ্যোগ করছে, তখন সমীরণ তাকে অপেক্ষা করতে বলে পাশের শোবার ঘরে যায়। ফিরে এল তিনটি একশো টাকার নোট নিয়ে।

‘এই নাও, তোমার পরিশ্রমের জন্য।’

জীবনে তার প্রথম রোজগার। মালবিকার ঠোঁট কেঁপে ওঠে কথা বলতে গিয়ে। কথার বদলে চোখ ভরে ওঠে জলে। সে তা হলে একটা কিছু হয়েছে, একটা জায়গায় দাঁড়িয়েছে। সমীরণের পায়ের উপর সে ভেঙে পড়ে। আঁকড়ে ধরে পাতা দুটো।

সমীরণ দুই বাহু ধরে তুলে শুধু একদৃষ্টে মালবিকার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী সে দেখছিল, খুঁজছিল মালবিকা তা বুঝতে পারল না।

‘কী দেখছেন?’

‘হালকা লাইট গান গাও, ভারী গান তোমার হবে না। সুরেলা গলা দিয়েছেন ভগবান, তাড়াতাড়ি উঠে আসবে তুমি।’

‘শুধু এইটুকুই দেখলেন, আর কিছু দেখতে পাচ্ছেন না?’ মালবিকা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে ধরল।

সমীরণের দু—হাত মালবিকার কাঁধে। কাছে টানল সমীরণ। সে পিছিয়ে গেল।

‘বললেন না তো কী দেখতে পেলেন?’

‘বলব সন্ধেবেলায় এসো।’

‘বউদি?’

‘থাকবে না।’

তিনশো টাকা হাতে নিয়ে বকুল আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল। এই তিনশো হবে তিন হাজার, তিন হাজার হবে তিন লাখ। সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল একটা বাড়ি, যেখানে থাকে শুধু মা আর মেয়ে। সদর দরজার বাইরে কৃপা—ভিক্ষুকের মতো বসে আছে দিলীপরঞ্জন। অনেক কষ্ট অনেক অপমান বকুল সহ্য করেছে।

সন্ধ্যাবেলায় আসে মিহির। মালবিকা নেই, বেরিয়ে গেছে। কোথায় গেছে বলে যায়নি। এখন বলে যাওয়ার দরকার আর হয় না। বকুল প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘মালির প্রথম রোজগারের টাকায় কেনা, সব তোমায় খেতে হবে বাবা।’

‘নিশ্চয় খাব।’ মিহিরের হাসিতে উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ল। তার চোয়াল শক্ত হওয়াটা বকুল লক্ষ করল না।

‘মাসিমা, একটা কথা।’

‘কী?’

‘মালিকে আমি বিয়ে করতে চাই। বাবা—মার এতে অমত নেই। আপনারা মত দিলেই—।’ মিহির শুধু ‘হ্যাঁ’ শোনার জন্য তাকিয়ে রইল। সে এদের মানসিক ও আর্থিক দৈন্যের আদ্যোপান্ত জেনে গেছে।

‘আমাদের মত! বলছ কী বাবা, এ তো আমাদের পরম ভাগ্যি, মালিরও ভাগ্যি।’

কথাটা বলার পর বকুলের চোখ দিয়ে টসটস জল পড়ল। ‘এত বড়ো ঘর! এত ভালো ছেলে! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। বাবা তুমি সত্যি বলছ তো?’

ঠিক সেই সময় সমীরণের শোবার ঘরে খাটের উপর শিথিলভাবে মালবিকা শুয়ে। সমীরণ বসে তার পাশে।

‘সত্যি বলছ?’ মালবিকার চোখে গাঢ় আবেগ।

‘সত্যি বলছি।’ সমীরণ ঝুঁকে মুখ নামিয়ে আনল। কপালে, গালে, চোখে তারপর আলতো চুমু দিল ঠোঁটে। চোখ বন্ধ হয়ে এল মালবিকার। দু—হাতে সমীরণের মুখটা ধরে ফিসফিস করল, ‘আমিও ভালোবাসি, সত্যি বলছি। তোমাকে ছুঁয়ে।’

মালবিকার বুকে মুখ চেপে ধরল সমীরণ। ওর চুলের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে মালবিকা বলল, ‘সারাজীবন ভালোবাসবে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমিও বাসব। সারাজীবন তোমার থাকব।’

‘আমিও থাকব।’

‘আমাকে ছুঁয়ে বলো।’

সমীরণ মুখ তুলল। মালবিকা আকুল দৃষ্টিতে উত্তরের অপেক্ষায়। তার মনে হল, মেয়েটা সত্যিই ছেলেমানুষ। ছুঁয়ে বললেই ও বিশ্বাস করে নেবে, নাকি এই সময় এই ধরনের কথাই বলতে ভালো লাগে!

‘কোথায় ছুঁয়ে বলব? এখানে ছুঁয়ে?’ সমীরণ ওর বুকের উপর হাত রাখল।

‘হ্যাঁ, ওখানে ছুঁয়ে।’

‘ব্লাউজটা না খুললে ছোঁব কী করে?’

‘পাজি কোথাকার! যত বদ বুদ্ধি!’

‘তা হলে ব্লাউজ ছুঁয়েই বলি?’

‘না।’ মালবিকার স্বর খসখসে হয়ে এল। চোখ আধ খোলা। সামান্য ফাঁক হয়ে রয়েছে ঠোঁট। কপাল ঘেমে উঠেছে। ‘ওরা এসে পড়বে না তো?’

‘থিয়েটার ভাঙতে এখনও অনেক দেরি। রবীন্দ্রসদন থেকে আসতেও সময় লাগবে।’

ব্লাউজের হুকে হাত দিয়ে মালবিকা বলল, ‘আলোটা নিভিয়ে দাও।’

প্রায় এক ঘণ্টা পর শিঞ্জিনীর ড্রেসিং টেবলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুঁচির পাট ঠিক করতে করতে মালবিকা বলল, ‘দেরি হয়ে গেল। বলে এসেছি আটটার মধ্যে ফিরব। এখনই আটটা বাজে।’

‘কেন, কেউ কী অপেক্ষা করবে?’ সমীরণ বিছানায় আধ শোওয়া হয়ে দেখছে কত দ্রুত মালবিকা নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। ‘চুলটা আঁচড়ে নাও।’

শিঞ্জিনীর চিরুনিটা তুলে নিয়ে মালবিকা বলল, ‘কে আবার অপেক্ষা করবে? আমার জন্য তো ভাবে আমার মা।’ আড়চোখে সে সমীরণের দিকে তাকাল। ‘আর কেউ না।’

সমীরণ চোখ মিটমিট করে হাসল। ‘তবু তোমার মা আছে ভাববার জন্য, আমার তো কেউ নেই।’

‘কেন তোমার বউ?’

‘ভাবে না। আলাদা থাকতে চায়।’

‘ডিভোর্স করবে?’ মালবিকার অজান্তেই তার গলায় প্রত্যাশার ছোঁয়া লাগল। সমীরণের কানে সেটা ধরা পড়ল। মনে মনে সে হাসল।

‘এখনও তো ওর শরীর ভালোই রয়েছে বিয়ে করতে পারবে।’ মালবিকা আয়নায় নিজেকে শেষবারের মতো দেখে নিল। সমীরণ উঠে বসল।

‘তা পারবে, আমিও পারব।’ ইঙ্গিতে ভরা হাসি সমীরণের মুখে খেলে গেল। মালবিকার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হল। ‘আমিও পারব’ বলে সমীরণ কী বোঝাতে চাইল?

নীচের থেকে ‘সমীরণদা আছেন নাকি?’ বলে কার ডাক শোনা গেল। সমীরণ তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘কে ভব নাকি? আয় আয়, ঘরে গিয়ে বোস, আমি আসছি।’

ঘরে ফিরে এসে সে মালবিকাকে বলল, ‘আমি ও—ঘরে যাচ্ছি, তুমি চুপচাপ বেরিয়ে যেয়ো।’ পাশের ঘরে যাবার জন্য পা বাড়িয়েও সে ঘুরে এল। মালবিকাকে দু—হাতে বুকে টেনে নিয়ে পিষে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ গভীর চুমু দিল। সমীরণ ছেড়ে দিয়ে মুখ তোলামাত্র মালবিকা বলল, ‘আমি কিন্তু সবসময় তোমার জন্য ভাবব।’

সমীরণ মনে মনে আর একবার হাসল।

.

মালবিকা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী আবার যথেষ্ট বোকাও। তার মায়ের মতোই আবেগ, অনুভব, হর্ষ, বেদনা সে চাপা দিয়ে রাখতে পারে না। পার্থিব সুখগুলি পাওয়ার জন্য তার ব্যাকুলতা যে—কোনো চতুর লোকের কাছেই ধরা পড়ে যায়। সে মিহিরকে অপছন্দ করে যেহেতু তার রূপ নেই, গুণ নেই, পরিচিতি নেই। আছে শুধু বিত্ত, যেটা মালবিকার বয়সের চোখে পছন্দের তৃতীয় সারিতে। এর উপরে কাঁধের চামড়ায় রয়েছে একটা সাদা দাগ। আবার মিহিরের মোটরে বেড়াতে, চিনা বা মোগলাই রেস্টুরেন্টে মিহিরের অর্থে খেতে, বাড়ির এবং পাড়ার লোকেদের দেখিয়ে মিহিরের মোটরে চড়তেও তার ভালো লাগে। তার চরিত্রের দুটো বিপরীত দিক রয়েছে এবং তাদের মধ্যে এতকাল কোনো সংঘাত ছিল না। কিন্তু এবার সেটা শুরু হল সমীরণের শোবার ঘর থেকে।

মালবিকা বাড়ি ফিরে দেখে ঘরে কেউ নেই। এই সময় বাবার থাকার কথা নয়, কিন্তু মা? বকুল তখন দোতলায় বড়োজয়ের ঘরে। মেয়ে ফিরেছে খবর পেয়ে তিনতলায় ছুটেই উঠে এল।

‘খবরটা বড়দিকে দিতে গেছলুম।’

‘কী খবর?’

‘দারুণ খবর।’ বকুল খাটে বসেই আবার উঠে দাঁড়াল। ‘তোর বিয়ে! মিহির এই সন্ধেবেলায় বলে গেল তোকে বিয়ে করতে চায়।’

‘ধ্যাত, কী আজেবাজে কথা বলছ!’ মালবিকা শাড়ি বদলাবার জন্য নিজের ঘরে ঢুকল। বকুল তার পিছু নিল।

‘আজেবাজে বলছিস কেন, তোর মত নেই নাকি?’

‘মত—অমতের কথা নয়। এখন বিয়েটিয়ে করা সম্ভব নয়, একদমই নয়। তা হলে গান শেখার বারোটা বেজে যাবে।’

‘সে কী কথা! বিয়ে করে কেউ গাইয়ে হয়নি নাকি! ওসব বাজে কথা ছাড়। আমি রাজি, তোর বাবার ইচ্ছেটাও জানি। দোতলার ওরা তো বলল, মালি ভাগ্য করে এসেছে বটে। উঁচু ঘর, বাপের এক ছেলে, এত ভালো ব্যবসা!’

‘ব্যস, তা হলেই খুব সুপাত্র।’ মালি রেগে উঠল। ‘আমার ওকে পছন্দ নয়।’

বকুল স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে রইল মেয়ের কথা শুনে। বলছে কী? মিহির সুপাত্র নয়!

‘মিহিরকে তোর পছন্দ নয় কেন? বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসা, বয়সও কম, দেখতে কুচ্ছিত নয়, লেখাপড়া করেছে, বংশ ভালো। বোন আমেরিকায় পড়ছে—।’

‘থাক থাক। তোমায় আর ওকালতি করতে হবে না। কেন পছন্দ নয় তা অত বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমার মোট কথা ওকে ভালো লাগে না।’

‘এটা কি একটা কথা হল? আমাদের সবাইয়ের পছন্দ, তার কি কোনো দাম নেই?’

‘না নেই। বিয়ে করব আমি, আমার পছন্দেরও কি কোনো দাম নেই?’

‘তুই এখনও ছোটো, অভিজ্ঞতা নেই। দামাদামির কী বুঝিস।’

‘ছোটো বলেই তো এখন বিয়ে করতে চাই না। অভিজ্ঞতা আর একটু হোক। ততদিন বিয়ের কথা তুলো না।’

‘এসব কী বোকার মতো বলছিস! অভিজ্ঞতা হতে হতে তো বুড়ি হয়ে যাবি। আমি কোনো কথা শুনতে চাই না, মিহিরকে বিয়ে করতে হবে তোকে। আহ্লাদিপনা দেখলে গা জ্বালা করে। পেটে ধরলুম, মানুষ করলুম, আর আমার ইচ্ছে—অনিচ্ছের কোনো দাম নেই।’ বকুলের গলা চড়ে উঠল। চোখের কোণে চিকচিক করছে জল। মালবিকার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে খাওয়ার টেবলে একটা চেয়ারে গুম হয়ে বসে রইল।

সমীরণের কাছ থেকে জীবনে প্রথম পাওয়া মাদকীয় সুখ দেহে বহন করে, একটা রমণীয় ভবিষ্যতের স্বপ্ন চোখে ধরিয়ে, উছলে ওঠা রোমাঞ্চের ধকল সামলাতে সামলাতে বাড়ি ফিরেই এ কী অবস্থার মধ্যে পড়তে হল! মালবিকা নিজের ঘরে খাটে বসল। মাথার মধ্যে এলোমেলো বাতাস আর শনশন শব্দ। বিছানায় গড়িয়ে পড়ে সে কপালের উপর দুই বাহু রেখে চোখ বন্ধ করল। এখন তার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।

আধো ঘুম, আধো জাগরণের মধ্যে সে টের পেল বাবা ফিরল। মদ খেয়ে আসেনি। দুজনের কথা হচ্ছে তাকে নিয়েই। বিয়েরই কথা। একবার বাবা চেঁচিয়ে উঠল, ‘চাবকে পিঠের চামড়া তুলে দোব।’

‘আস্তে আস্তে।’

‘বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দাও। গান শিখতে যাওয়া?…অত বাইরে বেরোলে বিগড়োবে না?…অপছন্দ! বাবা—মা যাকে পছন্দ করে দেবে তাকেই বিয়ে করতে হবে।…এসব হয়েছে তোমার জন্য।’

‘আমার জন্য?’

‘তবে না তো কী। যেমন বিদ্যেধরী মা তেমনি তার মেয়ে।’

‘মেয়ে তো তোমারও।’

‘হ্যাঁ আমারও। আর সেই জন্যই বলছি বাইরে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। নিজের কথা মনে নেই? কত ছেলে চরিয়ে বেড়াতে? আমাকে ফাঁসিয়ে তো বিয়েটা করলে, দ্যাখো গে মেয়ে এবার কাকে ফাঁসাচ্ছে।’

শুনতে শুনতে মালবিকার মনে হচ্ছিল, বাবা যদি মদ খেয়ে এসে মাকে দু—ঘা দিত তাহলেও ভালো ছিল। রাগটা বেরিয়ে গেলেই ঘুমিয়ে পড়ত। এভাবে নোংরা নোংরা কথা তা হলে আর শুনতে হত না।

কিছুক্ষণ পর তার মনে হল, সমীরণকে সে কি ফাঁসাচ্ছে? সে—ও কি প্রেগনান্ট হবে! শিউরে উঠে মনে মনে বলল, না, না, না, এভাবে নয়। তা হলে মায়ের মতো দশা হবে তার। বরং সমীরণের সঙ্গে কথা বলবে, ওর পরামর্শ চাইবে…পরামর্শ নয়, একটা আশ্বাস।

‘মিহিরের বাড়িতে গিয়ে ওর বাবা—মার সঙ্গে কথা বলে দিন পাকা করব। তুমিও যাবে। দেনা—পাওনার কথা কিছু বলেছে?’

‘শুধু শাঁখা—সিঁদুর। ওরাই গয়না দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে যাবে, বরযাত্রী খাওয়ানোর খরচও দেবে।’

‘খরচ তো আমাদেরও আছে। টাকার জোগাড় করতে হবে। খেতে দাও।’

পরদিন দুপুরে মালবিকা সেজোজেঠি অর্চনার ঘর থেকে সমীরণকে ফোন করল। অবুকে মালবিকাই সঙ্গে নিয়ে গিয়ে গানের ক্লাসে ভরতি করিয়ে দিয়েছে। চাকরের সঙ্গে সে বাসে যায় ও ফেরে। মালবিকার প্রতি অর্চনা প্রসন্ন।

ফোন ধরল সমীরণের চাকর অবনী।

‘কে বলছেন?’

‘আমি মালবিকা, সমীরণদাকে একবার ডেকে দেবে?’

‘দাদা বাইরের ঘরে কথা বলছে, লোক এয়েছে।’

‘বলো এক মিনিটের জন্য আসতে।’ মালবিকা আড়চোখে অর্চনার দিকে তাকাল। পিছন ফিরে বালিশে ওয়াড় পরাচ্ছে। সমীরণের ফোন শোবার ঘরে। নিশ্চয় শিঞ্জিনী এখন ঘরে নেই, থাকলে ফোনটা সেই ধরত।

‘হ্যালো, আমি মালি। একটু কথা বলার ছিল।’ আড়চোখে সে অর্চনাকে দেখে নিল। ওয়াড় পরানো আর শেষই হচ্ছে না।

‘খুব জরুরি কি?’

‘হ্যাঁ।’

‘বাড়িতে কিছু কি বলেছে দেরি হওয়ার জন্য?’ সমীরণের স্বরে উৎকণ্ঠা।

‘না, অন্য ব্যাপারে কথা বলব।’

‘কাল বললে হবে?’

‘হবে।’ গলা নামিয়ে মালবিকা বলল, ‘বাড়িতে নয়।’

ওদিকে কিছুক্ষণ চুপ। ‘সিরিয়াস কিছু?’

‘হ্যাঁ।’

‘কাল একটায় কলামন্দিরের সামনে থেকো, তুলে নিয়ে ক্লাবে যাব। ওখানেই লাঞ্চ। ঠিকমতো চিনে যেতে পারবে তো?’

‘পারব। ঠিক আছে।’

ফোন রাখতেই অর্চনা বলল, ‘তোর মা—র কাছে কাল শুনলুম। মিহিরের বাড়িতে কবে কথা বলতে যাবে?’

‘আজ—কালের মধ্যে যাবে।’

‘মিহিরও তো গান শেখে, এবার দুজনে একসঙ্গে শিখবি। স্বামী—স্ত্রীর একই রকমের হবি থাকলে মন কষাকষি হয় না।’

‘দেখি হয় কি না হয়।’ মালবিকা পা বাড়াল লাজুক সুরে কথাটা বলে।

‘দেখিস তোদের মনের মিল হবে, ছেলেটা ভালো।’

‘আর মেয়েটা ভালো নয় বুঝি?’

মালবিকা উত্তর পাওয়ার জন্য আর অপেক্ষা করেনি।

পরদিন একটার আগেই মালবিকা থিয়েটার রোডের মোড়ে মিনিবাস থেকে নামল।

সার্কুলার রোড পার হয়ে কলামন্দিরের ফটকের সামনে এসে দাঁড়াল। হাতঘড়ি দেখে মনে মনে সময়ের একটা হিসেব করল। সমীরণের সঙ্গে কথা বলা, খাওয়া, বাড়ি ফিরে যাওয়া চারটের মধ্যে সম্পূর্ণ করতে হবে। সকালে দিলীপরঞ্জন চাঁচাছোলা ভাষায় তাকে জানিয়ে দিয়েছে, বাড়ি থেকে বেরোলে ঠ্যাং ভেঙে দেবে। মালবিকা বিশ্বাস করে তার বাবা এই কাজটা করতে পারে। বকুল বারণ করেছিল। চারটের মধ্যে ফিরে আসবে কথা দিয়ে সে বেরিয়েছে। শুধু বলেছিল, ‘সমীরণদাকে বলে আসব, এবার থেকে আর গান শিখতে যাব না।’

ট্যাক্সিটা তাকে ছাড়িয়ে গিয়ে দাঁড়াল। রোদ—চশমা পরা সমীরণের মুখ জানলা দিয়ে একটু বার হয়ে তার দিকে তাকিয়ে। মালবিকা বুঝতে পারেনি। হাতছানিটা দেখে সে দ্রুত গিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল।

‘চিনতেই পারিনি।’

‘চলিয়ে ভাই।’ ট্যাক্সি চলতে শুরু করার পর সমীরণ বলল, ‘সেই জন্যই পরা। মানুষের চোখ ডেকে দিলে তাকে চেনা শক্ত।’

ট্যাক্সিওয়ালাকে সমীরণ বলেই রেখেছিল কোথায় যেতে হবে। ফটক দিয়ে ঢুকে ক্লাবের দরজায় ট্যাক্সি থামল। বাড়িটার জীর্ণ অবস্থা। কয়েক ধাপ উঠে সামনেই কাউন্টার। বাঁ দিকে কাঠের সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। ধাপগুলো ক্ষয়া। ইংরেজ আমলের ক্লাব। কাউন্টারে টাই পরা মাঝবয়সি একটি লোক বসে। দেখে মনে হয় পুরোনো কর্মচারী। সমীরণকে দেখে হাসল। খাতায় সই করে সমীরণ বলল, ‘সুইমিং পুলের ধারেই বসা যাক।’

মালবিকা কখনো এমন জায়গায় আসেনি। একটা হলঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সে অন্য পাশে একটা ঘরে চড়া মেকআপ করা কয়েকজন বয়স্ক মহিলাকে তাস খেলতে দেখল। পুলের ধারে সার সার সাদা রং—করা টেবল ও কাঠের চেয়ার। প্রায় টেবলেই লোক বসে খাচ্ছে। বাচ্চচা ছেলেমেয়েরাও রয়েছে । ওরা যে টেবলে বসল তার পাশেরটিতে এক মাঝবয়সি মহিলা। মুখটা ভালো, শরীর ভারী। দুজন পুরুষের সঙ্গে বসে। ওরা সবাই বিয়ার খাচ্ছে। মহিলাটি সমীরণের দিকে তাকিয়ে হাসল।

‘তোমায় চেনে।’

‘আগে থিয়েটার করত এখন যাত্রায় গেছে। অনেকদিন পরে দেখছি।’ কথাটা বলে টেবলে এসে দাঁড়ানো ওয়েটারের সেলাম নিয়ে সমীরণ বলল, ‘একটা বিয়ার, একটা অরেঞ্জ স্কোয়াশ, এই দিয়েই শুরু করা যাক। খাবারটা পরে হবে না কি এখনই বলব?’

মালবিকার কাল থেকেই খিদে পাচ্ছে না। উত্তেজনা, উদবেগ, ভয় সব মিলিয়ে খাওয়ার ইচ্ছেটা লোপ পেয়ে গেছে।

‘আমার খিদে নেই।’

সমীরণ অপেক্ষমাণ ওয়েটারকে বলল, ‘ঠিক আছে আগে এটাই আনো।’ তারপর মালবিকার দিকে তাকিয়ে রইল কোনো কথা না বলে।

মালবিকার বুকটা কেঁপে গেল একবার। কালো কাচের চশমা পরা একটা নিথর মুখ কথা না বলে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় যেন একটা মুখোশ। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না। আর তা না করতে পারলে সে আশ্বাস পাবে কী করে? তার মনে হচ্ছে সমীরণ তাকে কাছে আসতে দিতে চায় না।

‘আমার…আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’ মালবিকা চোখ নামিয়ে আবার তুলল। সমীরণের মুখে কোনো ভাবান্তর হতে সে দেখল না। শুনে চমকে উঠল না কেন সমীরণ!

‘কী করব?’ আকুল স্বরে জানতে চাইল মালবিকা।

জবাব পেল না।

‘শুনতে পাচ্ছ?’

‘আজ সকালে টেলিফোন করে মিহির আমাকে বলেছে।’ সমীরণের কণ্ঠ শীতল, তাতে বিচলন নেই।

‘কী বলেছে?’ মালবিকা টেবলে হাত রেখে ঝুঁকে পড়ল।

‘অনেক কথাই বলেছে। সবই আমার সম্পর্কে, তোমার তা শুনে কাজ নেই। শুয়োরের বাচ্চচাকে আমি শিক্ষা দেব।’

মুখোশে কোনো ভাঁজ পড়তে দেখল না মালবিকা। ক্রোধ চাপার চেষ্টায় যে বিকৃতি ঘটে তার লেশমাত্র নেই। স্বরেও কোনো বৈকল্য নেই।

‘বিয়ে তুমি করবে না। করলে তোমার সর্বনাশ হবে। ওর কথা শুনে মনে হল, কোনো মতলব এঁটে বিয়েটা করতে চাইছে। একবার গোবরডাঙার কথাটা বলল। ওর গাড়ি থেকে আমার গাড়িতে, আমি নাকি জোর করে তোমাকে তুলিয়েছি।’

‘সে কী! প্রতিভাদির অনুরোধেই তো আমি তোমার গাড়িতে গেছি।’ মালবিকার সাহস হল না, মিহিরকে সে আসলে তখন কী বলেছিল, এখন সে—কথা বলতে।

‘তাই বলেছিলে না আমার অনুরোধে বলেছিলে?’

মালবিকার বুক ধড়াস করে উঠল ভয়ে। মিথ্যা একবার যখন বলেইছে তখন সেটাই আঁকড়ে থাকা ভালো।

‘মিহিরকে আমি প্রতিভাদির কথাই বলেছি। হয়তো ও ধরে নিয়েছে—’, সমীরণের হাত তোলা দেখে সে কথা থামাল। বেয়ারা এসে গেছে টেবলে। কমলারঙের পানীয় মালবিকার সামনে রাখল। গ্লাসে বিয়ার ঢেলে বোতলটা রেখে বিলে সই করাল। সমীরণ তাকে বলল, ‘দু—প্লেট ফিশ ফিঙ্গার দিয়ো।’

‘আমি তোমার নামই করিনি। কিন্তু এসব কথা ফোনে তুলল কেন?’ বেয়ারা চলে যেতেই মালবিকা বলল।

‘জানি না। পুরনো একটা ঘটনা তুলে বলল রেপ করার জন্য আমি মেয়েদের গাড়িতে তুলি। ও নাকি আমাকে এক্সপোজ করবে। আমার খপ্পর থেকে তোমাকে উদ্ধার করবে…শুয়োরের বাচ্চচা, গাধার মতো একটা গলা, গান গেয়ে কিনা নাম করবে! সমীরণ মিত্তিরের রাইভাল হবে!’ সমীরণ একচুমুকে গ্লাসের তিনভাগ শেষ করে আবার বোতল থেকে ঢেলে পূর্ণ করল।

মালবিকা মুখোশটায় এবার ফাটল দেখছে। গলার স্বরে উত্তাপ। ‘বিয়ে তুমি করবে না। করলেও মিহিরকে নয়।’

‘মাকে আমি তাই বলেছি। ওকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাবা বলেছে বিয়ে করতেই হবে, মা—ও তাই চায়। আমি এখন কী করব?’ মালবিকার অভ্যন্তরে ধস নামছে। কিছু একটা আঁকড়ে ধরার জন্য সে হাতড়াচ্ছে।

‘আমার বিরুদ্ধে বাড়ির সবাই। আমার কোনো সহায় নেই। আমাকে তো বাবার আশ্রয়েই থাকতে হয়!’ মালবিকার হঠাৎ—ই প্রতিভার একটা কথা এখন মনে পড়ল: ‘লেখাপড়া শিখে এসব আমি মেনে নেব না’, ‘বলির পাঁঠা আমি হব না।’ মনে মনে সে বলল, কিন্তু প্রতিভাদি আপনি তবু লেখাপড়া আর গান শিখেছেন, আমি যে কিছুই শিখিনি। আমাকে তো মেনে নিতেই হবে। মালবিকা মাথা নীচু করে রইল।

বিয়ার শেষ করে সমীরণ মুখ ঘুরিয়ে একটা আঙুল তুলে বেয়ারাকে ইশারা করল আর একটা বোতল আনার জন্য।

‘আমাকে কিছু বলো।’

‘বলেইছি তো। এ—বিয়ে তুমি করবে না।’

‘বাবা লাথি মেরে বার করে দেবে বাড়ি থেকে।’

‘দিলে বেরিয়ে আসবে।’

‘যাব কোথায়, থাকব কোথায়?’

‘চট করে এখনই বলা সম্ভব নয়। ভেবে বলতে হবে। রিসক আছে।’

পাশের টেবলে হাসির শব্দ উঠল। মালবিকা মুখ ঘুরিয়ে দেখল মহিলার আঙুলে সিগারেট। বুকের আঁচল সরে গেছে। টেবলের পাশে মেঝেয় পাঁচ—ছটা খালি বিয়ারের বোতল।

ফিশ ফিঙ্গার আর বিয়ার এল। বিলে সই হল। সমীরণ গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, ‘খাচ্ছ না যে?’

‘খেতে ইচ্ছে করছে না, আচ্ছা খাচ্ছি।’ মালবিকা এক চুমুকে স্কোয়াশ শেষ করল। একটা ফিশ ফিঙ্গার তুলে কামড় দিল। চিবিয়ে গলা দিয়ে নামাবার জোর পাচ্ছে না। টুকরোটা মুখের মধ্যে রেখে দিল।

গ্লাস শেষ করে সমীরণ একদৃষ্টে পুলের জলের দিকে তাকিয়ে। মালবিকা চিবোতে শুরু করল। তারপর আর একটা তুলে সেটা হাতে ধরে বসে থাকল। মিনিট পাঁচেক পর দ্বিতীয় বোতলটা শেষ করে সমীরণ মুখ ফেরাল। মুখ লালচে দেখাচ্ছে।

‘বিয়ের তোড়জোড় কতদূর?’

‘কালই তো সবে কথা হল। এখনও তো বিয়ের দিনই ঠিক হয়নি, তারপর পাকাদেখা, কেনাকাটা, নেমন্তন্ন করা।’

‘অ। তা হলে এখনও অনেক দেরি আছে।’

‘অনেক আর কোথায়? দিন ঠিক হলে সাত দিনেও বিয়ে হয়।’

মালবিকার মনে হল কালো কাচের আড়াল থেকে একজোড়া তীব্র দৃষ্টি তাকে লক্ষ করছে। তার অন্তঃস্থল পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে।

‘মন শক্ত করতে পারবে?’

‘পারব।’ মালবিকা অচঞ্চল স্বরে জানাল।

‘বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে?’

‘পারব।’ মালবিকার গলা এবারও কাঁপল না।

‘আর কিন্তু ফিরতে পারবে না।’

‘জানি।’ মালবিকার গলা কঠিন হল।

সমীরণ কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বলল, ‘ঠিক দু—হপ্তা পর তোমাকে ফোন করব। আজ কুড়ি তারিখ, চোদ্দো দিন পর চার তারিখ। দুপুর একটা থেকে সওয়া একটার মধ্যে ফোনের কাছে থাকবে। নম্বরটা আমার কাছে আছে।’

‘ফোনের কাছে সেজজেঠি থাকে।’

‘আমি সেইভাবেই কথা বলব।’

‘কী বলবে তুমি ফোনে?’

সমীরণের মুখে হাসি ফুটল। পাতলা ঠোঁট দুটো ছড়িয়ে গেল। সাদা দাঁতগুলো ঝলসানি দিল। তিলটা সরে গিয়ে ফিরে এল। ভ্রূ দুটো বেঁকে রয়েছে। মালবিকা বিমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল। তার ইচ্ছে করছে ঝাঁপিয়ে ওর পাঞ্জাবিটা ছিঁড়ে ফালাফালা করে বুকে মুখটা ঘষতে। আর তার ভয় করছে না। কিছু একটা সমীরণ করবে তার জন্য। তাকে বাঁচাবে। মিহিরকে আর বিয়ে করতে হবে না। ওর ঘাড়ের সেই সাদাটা ওত পেতে রয়েছে। আমাকে সমীরণ বাঁচাবে।

মালবিকার মুখের উপর যা কিছু ফুটে উঠল সমীরণ তা লক্ষ করে যাচ্ছিল। ঝুঁকে মালবিকার মুখের দিকে মুখ এগিয়ে এনে গোপন কথা বলার মতো করে বলল, ‘বলব, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

সমীরণের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মালবিকার দুই চোখের কোণ বেয়ে জল নামল। সে মোছার চেষ্টা করল না।

‘তোমাকে কখন বাড়ি ফিরতে হবে?’

‘চারটের ভেতরে যেতেই হবে, মাকে কথা দিয়ে এসেছি। যদি বাবা এসে পড়ে? এখন তো আমায় চোখে চোখে রাখবে।’

‘আমার মনে হয় মিহির তোমার মুভমেন্টের ওপর নজর রাখবে।’

‘মতলব এঁটে বিয়ে করতে চাইছে বললে, কী মতলব?’

‘সেটা কী ও খুলে আমায় বলবে? ওর কথা বলার ঢং থেকে মনে হল। হয়তো প্রতিভা ওকে কিছু বলে থাকতে পারে।’

প্রতিভা আর গান শেখাতে আসে না, মিহিরও আসে না গান শিখতে তা হলে ওদের দুজনের দেখা হবে কী করে? মালবিকা দ্রুত ভেবে নিল। যদি ওদের দেখা হয়ে থাকেও তা হলে প্রতিভা যা বলবে তা শুনলে মিহিরের তো তাকে বিয়ে করতে চাওয়া উচিত নয়। মালবিকা নিশ্চিন্ত বোধ করল, প্রতিভার সঙ্গে মিহিরের দেখা না হওয়া সম্পর্কে। কিন্তু মিহিরের উপর সমীরণ এত রেগে গেল কেন? কী বলেছে সে যেজন্য সমীরণ ‘শুয়োরের বাচ্চচা’ বলল!

‘এখন থেকে তুমি বাধ্য মেয়ের মতো বাড়িতে থাকবে। যে যা বলবে করবে। বিয়ে করতে রাজি নও, এসব কথা একদম বলবে না, কেমন? দেখি কী করা যায়।’

‘করবে তো?’

সমীরণ জবাব দিল না। শুধু তাকিয়ে রইল মালবিকার মুখের দিকে। ছমছম করে উঠল মালবিকার বুক। জীবনে এই প্রথম সে এমন একটা সংকটের মধ্যে পড়েছে, যেখানে সে পুরোপুরি অন্য একজনের নিয়ন্ত্রণের আওতায় চলে গেছে। এমন একটা কাজ তাকে করতে হবে যার ফলাফল সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। নিজের ভাগ্য নিজে গড়ার মধ্যে অদ্ভুত এক ধরনের উত্তেজনা, ছমছমে ভয়, রহস্যে ভরা ভবিষ্যৎ, সব মিলিয়ে ব্যাপারটা তার কাছে জুয়া খেলার মতো লাগছে। যদি হার হয়? তাহলে কী যে তার অবস্থা হবে সে জানে না। মনে মনে সে বলল, ভগবান তুমি আমাকে দেখো।

সেইদিন সন্ধ্যাবেলায় মিহির এল। তার গাড়িতেই বকুল ও দিলীপরঞ্জনকে নিয়ে গেল তাদের বাড়িতে। ঘণ্টা দুই পরে তাদের সে ফিরিয়ে দিয়ে গেল। তিনতলায় আর উঠল না। উচ্ছ্বসিত বকুল মালবিকাকে বলল, ‘ওরা তো এইমাসেই বিয়ে দিতে চায়। মিহিরের মা বলল, পৌষ মাস পড়ে গেলে আরও প্রায় দু—মাস দেরি হয়ে যাবে। অঘ্রানের আজ চার তারিখ। আঠাশ তারিখই ঠিক হল। মাঝে চব্বিশটা দিন। কীভাবে যে কী হবে!’

মালবিকা চুপ করে রইল। তার কথা বলার কিছু নেই। বকুল তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকাল। মুখে প্রতিবাদ না দেখে সে আশ্বস্ত হল। ‘আর না বলিসনি মালি। বিয়ের দিন পর্যন্ত পাকা হয়ে গেছে, এরপরও যদি এ—বিয়ে না তা হলে আমাদের মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না। না ওদের কাছে, না এই বাড়িতে। তোর বাবার তো টাকাকড়ি বলতে কিছুই নেই। প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে হাজার পঁয়ত্রিশ হয়তো তুলতে পারবে, এ ছাড়া আর কিছুই নেই। আমি তো সোনাদানা নিয়ে এ—বাড়িতে আসিনি, শাশুড়ি দিয়েছিল সাড়ে তিন ভরির একটা গলার হার। তোর জেঠিরা যদি হাতে কানে গলায় একটা করে দেয়। উনি তাই কথা বলতে গেলেন দাদাদের সঙ্গে কিছু যদি পাওয়া যায়।’ মেয়ের হাত ধরল বকুল তারপর হাতটা কাঁধে রাখল।

‘তোমরা দিন যখন ঠিক করে ফেলেছ তারপর আর না বলি কী করে।’ মালবিকা নম্র করে চোখে মুখে বিষণ্ণতা ছড়িয়ে বলল। বাবার জন্য তার কষ্ট হচ্ছে জীবনে এই প্রথম।

বকুলের বুক থেকে যেন পাষাণ ভার নেমে গেল। খুশি চাপতে চাপতে বলল, ‘দেখিস এ বিয়েতে তোর ভালোই হবে। বাপ—মা কি হাত—পা বেঁধে মেয়েকে জলে ফেলে দিতে চায়? টাকা না থাকলে সুখ—শান্তি আসে না। মিহির ছেলে ভালো, টাকাকড়িও আছে। দেখতে—শুনতেও তো খারাপ নয়।’

মালবিকার এক্ষেত্রেও কথা বলার কিছু নেই। তবু বলার জন্য বলল, ‘আমার বিয়ের জন্য বাবা ধারদেনায় জড়িয়ে পড়বে সেটা ভাবতে আমার খারাপ লাগছে। বড়োজেঠিকে তো চিনি, তারপর চিমটি কেটে ঠেস দিয়ে কথা শোনাবে।’

‘শোনাক। ওর নাতনিদের বিয়ে তোর থেকে ভালো ঘরে হয় কি না দেখব। এই চব্বিশটা দিন তুই আর বাড়ি থেকে বেরোসনি। কথা দে।’

‘দিলুম।’

‘বাঁচালি আমায়।’

চারশোর মতো লোককে নেমতন্ন করা হবে। মালবিকা জানিয়ে দিয়েছে পাড়ার বা স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই, সুতরাং বলার মতো কেউই তার নেই। সমীরণ মিত্র আর শিঞ্জিনী বউদিকেও বলবে না। আত্মীয়স্বজন বলতে জেঠিদের বাপের বাড়ি, বড়োজেঠির বেয়াই বাড়ি, তিন পিসি আর বাবার দুই মামা। বাবার অফিসে, পাড়ার কয়েকটা বাড়িতে আর বরযাত্রীরা সব মিলিয়ে ধরা হয়েছে চারশো লোক।

বকুলের অ্যাডভোকেট বড়োভাসুর লিস্টিটা কাটছাঁট করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কথায়: ‘অ্যাতো লোককে বলার দরকার কী, খরচের দিকটাও তো দেখতে হবে? দিলুর যা সঙ্গতি তাতে এই বাজারে চারশো লোককে খাওয়ানো, ওর পক্ষে বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।’

বকুলের আপত্তিতে লিস্টি ছাঁটাই হয়নি।

দিলীপরঞ্জনকে সে বলে দিয়েছে, ‘দশটা নয়, দুটো নয় আমার একটাই মেয়ে। হোক খরচ। ওনার মেয়ের বিয়েতে বারোশো লোক খাইয়েছেন আর তোমার মেয়ের বিয়েতে চারশোও তুমি খাওয়াতে পারবে না? খরচ তো উনি দিচ্ছেন না।’

‘তুমি চটছ কেন। আমার মুখের দিকে চেয়েই বড়দা কথাটা বলেছে। উনি বললেই আমি রাজি হব নাকি? আত্মীয় বাড়ি, বেয়াই বাড়ি না বললে হয়? এদের বাদ দিয়ে আমাদের বংশে কখনো কোনো বিয়ে হয়েছে? আমার বিয়ের কথাটা বাদ দাও, ওটা একসেপশন।’ দিলীপরঞ্জনের শেষ বাক্যটি কোনো জ্বালা বা তিক্ততা নিয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে এল না। বরং বংশের ঐতিহ্য ভাঙা এই দুঃসাহসিক কাজটার জন্য প্রচ্ছন্ন একটা গর্ব যেন রয়েছে।

‘আজকাল কত মেয়ে যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিয়ে করছে।’ কথাটা বকুল বলল নিশ্চিন্ত স্বরে। মেয়ের বিয়েকে কেন্দ্র করে এখন স্বামীর সঙ্গে তার সখ্য গড়ে উঠছে। জীবনে এই প্রথম।

বকুলের লিস্টিতে শুধু তার মামারা আর দাদা—দিদি অর্থাৎ সুধাংশু এবং উমা। নিমন্ত্রণের কার্ড ছেপে আসার পর সে সন্ধ্যাবেলায় অর্চনার ঘর থেকে উমাকে ফোন করল।

‘দিদি আপনার কাছে এই রোববারেই যাচ্ছি একটা ভালো খবর নিয়ে।’

‘কী ভালো খবর?’

‘বলুন তো কী হতে পারে।’

‘ছেলেপুলে হবে নাকি?’

‘ধ্যেত, কী যে বলেন না। এই বয়সে আবার ওসব—’, হর্ষে, পুলকে বকুলের বাকরোধ হল।

‘এই বয়সে মানে? তোমার আর বয়স কত? তোমাকে দেখলে তো বিয়ে হয়েছে বলে মনেই হয় না। ভালো খবরটা কী? দিলীপবাবুকে তালাক দিয়ে আবার বিয়েটিয়ে করছ নাকি?’

সুখের সায়রে বকুল আবার অবগাহন করল। ‘আমি নয়, বিয়ে করছে আমার মেয়ে আর পাত্রটি হল মিহির।’

বলো কী! সত্যিই ভালো খবর। রোববার আসছ? মালিকেও নিয়ে এসো, ওকে আইবুড়ো ভাত খাওয়াব। এদের যে বিয়ে হতে পারে সেটা কিন্তু বকুল, আমি আঁচ করতুম। মিহির যেভাবে মালির দিকে তাকাত টাকাত, মুখচোখের ভাব যেরকম হয়ে যেত তাতেই বুঝে গেছলুম একটা কিছু হতে পারে।’

‘বিয়ের কথা মিহিরই পাড়ে।’

‘পাড়বেই তো, মালি তো মায়ের মতোই সুন্দরী।’

‘দিদি আপনি বড্ড আমার পেছনে লাগেন।’

‘আহা আমি যেন বাজে কথা বলছি মালির গড়নপেটন, মুখশ্রী তোমার মতো কি নয়?’

‘নিজের মেয়ে বলে বলছি না দিদি, মালি আমার থেকেও দেখতে ভালো, আমার থেকেও লম্বা, আর,’ ফোনে ঠোঁট প্রায় লাগিয়ে বকুল বলল, ‘আর ভীষণ সেক্সি। সেজন্যই তো ওকে নিয়ে আমার ভয় ছিল। বিয়েটা হয়ে গেলে আমি বেঁচে যাই।’

‘রোববার তা হলে ওকে নিয়ে আসছ তো?’

‘হ্যাঁ, এগারো—বারোটা নাগাদ যাব।’

মালির চারিদিকে ব্যস্ততা, সে কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত নয়। কোনো ব্যাপারেই আগ্রহ দেখায় না আবার উদাসীনতাও নেই।

তিনতলা থেকে সে প্রায় নামেই না। সেজজেঠির কাছ থেকে কয়েকটা সিনেমা ম্যাগাজিন নিয়ে এসেছে, তারই পাতা ওলটায়। টেপরেকর্ডারে ফিল্মের গান শোনে। মিহিরের দেওয়া তানপুরাটা তার ছোটো ঘরের এককোণে ফেলে রেখে দিয়েছে। নিজের অজান্তেই সে দিনে দু—তিনবার ক্যালেন্ডারের দিকে তাকায়।

সত্যি কী সমীরণের ফোন আসবে? নিশ্চয় আসবে। না আসবে না। আশায় এবং নিরাশায় দোলাদুলি করতে করতে মন ঠিক এইরকম অবস্থাটাই বেছে নেয়। ঝোঁকটা তখন বেশি পড়ে নৈরাশ্যের দিকেই। যতই তার মনে হতে থাকে সমীরণের ফোন আসবে না ততই তার ইন্দ্রিয়গুলো প্রখর হয়ে উঠতে শুরু করে, নিজেকে বিশ্লেষণ করার প্রবণতা বাড়ে। বহুবার সে নিজেকে প্রশ্ন করেছে, ‘ভুল করছি না তো?’ উত্তর খুঁজতে গিয়ে সে অনেক রকমের উত্তর পায়। তাইতে সে ধাঁধায় পড়ে যায়।

বাড়িতে এখন উৎসবের মতো পরিবেশ। সবাই কোনো—না—কোনো ভাবে খুশির উত্তেজনা নিয়ে চলাফেরা করছে, কথা বলছে। সবথেকে বড়ো কথা, দিলীপরঞ্জন তার ভবিষ্যৎ পুঁজির অর্ধেকেরও বেশি ভাঙিয়ে এই উৎসবটা তৈরি করছে। বকুল তার অপমানিত জীবনকে সম্ভ্রম দেবার চেষ্টা করছে। এগুলোকে ধ্বংস করতে হবে ভাবতে মালবিকা বেদনা বোধ করে।

আবার সে এটাও ভাবে, যাকে ঘিরে ওরা আনন্দের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে তার ইচ্ছা—অনিচ্ছাকে কোনো দামই ওরা দিল না। উৎসবে বলি হবার জন্য তাকে রেওয়াজ করে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু কেন আমি পাঁঠা হব। প্রতিভাদি বলেছে, সে মেনে নেবে না। ভালো কথা। কিন্তু মেনে না নিয়ে সে কী পাচ্ছে এই ত্রিশ বছর বয়সে? সমীরণ মিত্তিরের কাছ থেকে অনেক পাবে ভেবে প্রতিভাদি, নিশ্চয় ওর সঙ্গে শুয়েছে। কিন্তু ভালোবেসে শুয়েছে কী? সমীরণের মধ্যে ভালোবাসা পাবার জন্য একটা কাঙাল রয়েছে। প্রতিভাদি কি সেই কাঙালটাকে, ভূরিভোজ করতে পেরেছে? সমীরণ ভীষণভাবে শরীর চায়। প্রতিভাদি কি ভীষণভাবে শরীর দিতে পেরেছে? আমি সেটা পারব।

মালবিকার এক একসময় চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে—নেমন্তন্নর কার্ডগুলো ছিঁড়ে ফেলে দাও। ডেকরেটারকে অ্যাডভান্সের টাকা দিয়ো না। ভিয়েনের বামুনের সঙ্গে কথা বোলো না। বেনারসি শাড়ি, পাঞ্জাবির তসরের কাপড়, জুতো, সোনার বোতাম, আংটি, নমস্কারির শাড়ি এসবের জন্য টাকা খরচ কোরো না। তোমরা কেউ জানো না আমি কী এক ভয়ংকর কাজ করতে চলেছি। আমার ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য আমি জীবনকে বাজি ধরেছি।

মালবিকা এ—সময় স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছল। কাজটা সে করবেই। মায়ের মতো আমি হব না। একটা বাজে লোককে বিয়ে করার জন্য মা আমাকে পেটে ধরেছিল। আমি এই ভুল করব না। সমীরণকে বিয়েতে বাধ্য করাতে চাই না। যেমন স্বামী হয়ে রয়েছে তেমনই শিঞ্জিনীরই থাকুক। ও শুধু আমাকে ভালোবাসুক, ওর মন আমার দখলে থাকুক। সমীরণ খুব সুন্দর, আমি পছন্দ করি সুন্দর পুরুষকে। আমি চাই নিজের মতো করে জীবনকে ভোগ করতে। কেন ভোগ করব না? জীবনটা তো আমারই। তোমরা কেন তাকে ঘাড় ধরে খাঁচায় পুরতে চাও? আমার স্বাধীনতা আমারই হাতে থাকবে।

‘প্রায়ই দেখি তুই আপনমনে বিড় বিড় করছিস, ব্যাপার কী?’ বকুল একসময় বলল। মালবিকা তখন তার ঘরে শুয়ে।

‘কই, কিছু তো নয়! বিড় বিড় করেছি নাকি?’ উঠে বসল মালবিকা।

‘তোর মনে এখনও বোধহয় এ—বিয়েতে আপত্তি রয়ে গেছে।’

‘না না, আমি তো রাজি বলেইছি।’

বকুল তীক্ষ্ন চোখে মেয়ের মুখ লক্ষ করল। অবশেষে কঠিন হয়ে গেল তার দৃষ্টি।

‘মনকে ঠিক করে নে মালি। এ—বিয়েতে সবার ইচ্ছে রয়েছে এটা ভুলে যাসনি।’

‘আমি মনকে ঠিক করেই নিয়েছি।’

‘তোর মুখে হাসি নেই, কেন?’

‘হাসতেই হবে এমন কোনো কথা আছে?’

‘লোকে দেখলে বলবে কী? আজ বাদে কাল বিয়ে হতে যাচ্ছে যার, তার মুখে হাসি নেই, দৃষ্টিকটু লাগে।’

‘আচ্ছা হাসব।’ মালবিকা শুয়ে পড়ল।

‘রোববার পাতিপুকুরে মুখে যেন হাসি থাকে।’

সমীরণের বলে দেওয়া চোদ্দো দিন এল শুক্রবারে। মালবিকা একটার মিনিট পাঁচেক আগেই অর্চনার ঘরে একটা ম্যাগাজিন হাতে হাজির হল।

‘কী রে এই সময়ে?’ অর্চনা আলমারির পাল্লায় আঁটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে মুখে ময়েশ্চারাইজার লোশন ঘষা বন্ধ রেখে বলল। স্নান সেরে এইমাত্র সে ঘরে এসেছে।

‘এটা ফেরত দিতে এলুম।’ একটু থেমে মালবিকা বলল, ‘গানের স্কুলের প্রতিভাদিকে বলেছিলুম একটা নাগাদ ফোন করতে, এখানে।’ সে ফোনের এমন কাছাকাছি দাঁড়াল যাতে বেজে ওঠামাত্র হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুলে নিতে পারে।

‘উনি তো গানের স্কুল ছেড়ে দিয়েছেন, অবু কবে যেন বলল।’

‘হ্যাঁ, কী নিয়ে যেন শিঞ্জিনী বউদির সঙ্গে খটাখটি হতেই ছেড়ে দিয়েছেন। প্রতিভাদি মানুষটি খুব ভালো, যত্ন নিয়ে শেখান, আমাকে তো উনিই শেখাতেন। ওঁকে বলে রেখেছি আমার বিয়েতে আসতেই হবে।’

‘এলে আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিস তো। বাড়িতে এসে যদি অবুকে শেখাতে রাজি হন, তা হলে রাখব।’

‘বলব। তবে বিয়ের দিন আসতে পারবেন কি না সেটাই ফোনে জানিয়ে দেবেন। প্রতিভাদির শিরদাঁড়ায় কী যেন একটা হয়েছে, এই মাসেই অপারেশন হবার কথা।’

‘শিরদাঁড়ায়? তাহলে তো মেজর অপারেশন। তোর বিয়ের আগে হলে আর আসতে পারবেন না।’

এই সময়ের ফোন বেজে উঠল এবং ঝটকা দিয়ে মালবিকার হাত তুলে নিল রিসিভারটা।

‘হ্যালো কে, প্রতিভাদি? আমি মালবিকা।’

‘তোমার সেজজেঠি কি পাশেই?’

‘হ্যাঁ, তোমার অপারেশন কবে?’

‘পরশু রোববার, গানের স্কুল সাতটায় বন্ধ হবে। তারপরই তুমি চলে এসো। শিঞ্জিনী পার্ক সার্কাসের ফ্ল্যাটে যাবে, অবনীও ওর সঙ্গে যাবে। আমাদের খাট—বিছানা, আলমারি এমনকী টিভি, ফ্রিজও ওখানে পরশু চলে গেছে। সোমবার সকালে তোমায় কল্যাণীতে একজনের বাড়িতে নিয়ে ঘিরে রেখে আসব। কোনো ভয় নেই। ও কে? তুমি আসছ?’

‘হ্যাঁ। আটাশে অঘ্রান মানে চোদ্দোই ডিসেম্বর বিয়ের দিন তুমি তা হলে আসতে পারবে না।?’

‘দিন পাক্কা হয়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ। কী করে আর আসতে বলব, ডাক্তার যখন দিন ঠিকই করে ফেলেছে।’

‘তা হলে পরশু। ভয় করছে?’

‘না, একদমই না।’

ওধারে সমীরণ ফোন রেখে দিল। অর্চনা খাটের উপর পড়ে থাকা সেদিনের খবরের কাগজের দিকে তাকিয়ে। মালবিকা বলল, ‘প্রতিভাদির অপারেশনের ডেট পরশু।’

‘কী যে হচ্ছে এই রাম জন্মভূমি আর বাবরি মসজিদ নিয়ে, পরশু আবার করসেবা করবে।…হ্যাঁ, কী বললি, প্রতিভাদির অপারেশন হবে পরশু? তা হলে তোর বিয়েতে আসছেন না।’ বলেই অর্চনা খবরের কাগজটা তুলে নিল।

‘রাম জন্মভূমি নিয়ে পরশু কী হবে?’ মালবিকা কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল। সমীরণ বলেছে পরশু সন্ধ্যা সাতটায়।

‘অযোধ্যায় রাম জন্মভূমি ঘিরে একর তিনেকের একটা জমি নিয়ে মামলা হচ্ছে এলাহাবাদ হাইকোর্টে। রায় বেরোবে এগারো তারিখে। সেই জমিটায় মন্দির করতে চায় হিন্দুরা। পরশু লাখ লাখ লোক গিয়ে সেখানে ঝাঁট দিয়ে, গর্ত টর্ত বুজিয়ে, জল ঢেলে পরিষ্কার করবে। লিখেছে, প্রায় দেড়লাখ করসেবক দেশের নানা জায়গা থেকে অযোধ্যায় হাজির হয়ে গেছে। তার মানেই ঝামেলা, একটা বড়ো রকমের গন্ডগোল হবে। অবশ্য দুজন নেতা প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছে সংঘাত হবে না। কিন্তু নেতাদের কথা আজকাল কি কেউ আর মানে?’ অর্চনা খবরের কাগজ থেকে খুঁটে খুঁটে খবর তুলে তার সঙ্গে জুড়ে দিল নিজের মন্তব্যটা।

‘অযোধ্যায় সেদিন গণ্ডগোল হলে কলকাতায়ও কি হবে?’ মালবিকার অস্বস্তি লাগছে। রবিবারে এই গণ্ডগোল সম্ভাবনার কথাটা শুনে। রবিবারেই সমীরণ তাকে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বলেছে।

‘কলকাতায় কখন যে কী হয় কেউ কি বলতে পারে? এই তো আড়াইমাস আগে ফুলবাগান থানায় কী হল? তার আগে বানতলা? কিছু বলা যায় না। ইন্দিরা গান্ধী যখন মারা গেলেন তুই তখন অবুর বয়সি। তোর মনে আছে কি না জানি না, দুপুর থেকে কলকাতায় সে কী হাঙ্গামা, গন্ডগোল। ট্রাম বাসে আগুন, লুটপাট, বাচ্চচাদের স্কুল বাসকেও রেহাই দেয়নি ট্রেন বন্ধ।’

‘ওসব তো গুণ্ডাদের কাজ।’

‘তবে না তো কী! চারিদিকে গুণ্ডারা ওত পেতে রয়েছে, একটা ছুতো পেলেই হল। শুধু তো রাম নয় তার সঙ্গে বাবরিও রয়েছে। অযোধ্যায় কিছু একটা ঘটে গেলে সারা দেশে আগুন লেগে যাবে। অবু বড়ো হচ্ছে, এইবার আমার দুর্ভাবনা শুরু হল।’

মালবিকা হেসে বলল, ‘আমাকে নিয়ে দুর্ভাবনা হয় না?’

‘হয় না আবার!’

কাহিনি যেখান থেকে শুরু হয়েছিল এবার আমরা ফের সেখানে চলে যাব। সুধাংশু এবং উমার বাড়িতে। রবিবার মালবিকা তার মায়ের সঙ্গে সেখানে আসছে আইবুড়ো ভাত খেতে। সুধাংশু বাজার থেকে চিংড়ি এনেছেন। রান্নাঘরের ভিতরে কল্যাণ চিংড়ির খোসা ছাড়াতে বসেছে। ঘণ্ট করবেন বলে উমা গতকাল একটা মোচা কিনে রেখেছেন আর কিনেছেন দেড়শো টাকা দিয়ে মালবিকার জন্য একটা ছাপা শাড়ি।

রান্নাঘরের দরজা থেকে একটু দূরে চেয়ারে বসে সুধাংশু খবরের কাগজ থেকে দেশের হালচাল সম্পর্কে স্ত্রীকে ওয়াকিবহাল করার জন্য একটু গলা চড়িয়ে খবর শোনাচ্ছেন। উমা তখন চা তৈরি করায় ব্যস্ত।

‘শুনছ, আজ অযোধ্যায় করসেবা। সরযূ নদী থেকে হাতে করে, চাদরে করে বালি এনে জন্মভূমি পরিসরে তৈরি কংক্রিট প্ল্যাটফর্মের আশপাশের গর্ত ভরাট করবে। এক হাজার এক হাজার করে এক—একটা ব্যাচে আসবে বালি দিয়ে গর্তটর্ত ভরিয়ে চলে যাবে। এর পাশাপাশি চলবে প্ল্যাটফর্মটা সাফাইয়ের কাজ। তোমায় তো কাল বলেই ছিলুম হাইকোর্টের নির্দেশ রয়েছে যতক্ষণ না তারা রায় দিচ্ছে ততক্ষণ কোনো নির্মাণ করা যাবে না। বিজেপি—আরএসএস বলেছে, প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছে আদালতের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে তারা পালন করবে। গন্ডগোল সৃষ্টি হয়ে পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সেদিকে নজর রাখবে।’

‘তা হলে বলছ ভালোয় ভালোয় করসেবা হয়ে যাবে?’ রান্নাঘর থেকে উমা জানতে চাইলেন।

‘হয়ে যাওয়া তো উচিত। নেতারা তো ছেলেমানুষ নয় যে প্রধানমন্ত্রীকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবে।’

‘প্রধানমন্ত্রী তো সাধুদের সঙ্গেও কথা বলেছেন।’

‘তাইতেই তো জ্যোতিবাবু রেগে গেছেন। কাল তোমায় শোনালুম না, ময়দানের একটা মিটিংয়ে উনি বলেছেন—প্রধানমন্ত্রী সাধুসন্তদের সঙ্গে কথা বলছেন কেন? স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছর পরও সাধুরা দেশের ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেবেন নাকি?’

‘ঠিকই তো বলেছেন…হ্যাঁ গো, জ্যোতিবাবু ঠিক বলেছেন তো?’ উমা কিঞ্চিৎ উদবিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন, জ্যোতিবাবুকে সমর্থন করাটা তার ঠিক হয়েছে কি না।

সুধাংশু স্ত্রীর উদবেগ প্রশমনের চেষ্টা না করে অন্য খবরে চলে গেলেন। ‘জ্যোতিবাবুর নির্বাচনী কেন্দ্র সাতগাছিয়ায় কাল মমতা ব্যানার্জি মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে এসেছে।’

‘সত্যি!’ উমা রান্নাঘরের দরজায় প্রায় ছুটে এলেন। ‘যাই বলো বাপু, মেয়েটা করে দেখাল বটে। জ্যোতিবাবুর ঘণ্টাও বাজিয়ে দিয়ে এল? এবার কোথাও ঘণ্টা বাজলে আমাকে বোলো তো, শুনে আসব।’

‘আচ্ছা বলব তোমায়।’ সুধাংশু মৃত্যুঘণ্টার পাশের খবরটায় চলে গেলেন এবং কাগজের উপর ঝুঁকে পড়লেন। চায়ের কাপ টেবলে রেখে উমা ফিরে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর মনে হল সুধাংশু যেন বললেন, ‘সর্বনাশ!’

‘কীসের সর্বনাশ? কার সর্বনাশ?’

‘লরি, টেম্পো, ট্রাক, ম্যাটাডোরে মড়া নিয়ে যেতে দেবে না কর্পোরেশন। কারণ ওই সমস্ত গাড়িতে করেই ফলমূল, শাকসবজি, মাছ নিয়ে যাওয়া হয়। বলছে, সংক্রামক রোগের জীবাণু মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে মানুষের শরীরে, যেমন যক্ষ্মার জীবাণু। তার মানে লরি টেম্পোর রোগের জীবাণু রয়ে যায় আর সেগুলো সংক্রামিত হয় কলমি—পালং, আলুপটল, চিংড়ি, ট্যাংরা, তেলাপিয়ায়। সাংঘাতিক। এগুলোই তো খাই।’

উমা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল স্বামীর দিকে। সুধাংশুর দিশাহারা দৃষ্টি স্ত্রীর মুখে।

‘এখান থেকে নিমতলা ঘাট কতদূর জানো?’

‘টেম্পো ম্যাটাডোর বন্ধ করে দিলে আমাদের জন্য খোকার কত কষ্ট হবে ভাবো তো,’ উমা বিপন্ন স্বরে বলল।

‘চিংড়িমাছ, মুলো, পালং এই যে বাজার থেকে আনলুম এগুলো লরি কি ম্যাটাডোরেই তো বাজারে এসেছে।’ সুধাংশু চিন্তায় পড়ে গেলেন। খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে বসার ঘরে গিয়ে টিভি সেট খুলে সোফায় বসলেন। জাতীয় ঐক্য গড়ার জন্য তখন দূরদর্শনে কনসার্ট বাজছে। উমা রান্নাঘরে গিয়ে বঁটি পেতে বসলেন মোচাটা নিয়ে।

ওরা বারোটা নাগাদ এসে পৌঁছল। সন্দেশের বাক্সটা উমার হাতে দিয়ে বকুল ইশারা করল মালবিকাকে প্রণাম করার জন্য। ‘আর বলবেন না দিদি, বেলগাছিয়ার মোড়ে যা ট্র্যাফিক জ্যাম।’

প্রণাম নিয়ে মালবিকার চিবুক নেড়ে উমা বললেন, ‘সুখী হও মা। স্বামীর ভালোবাসা পাও, শতপুত্রের জননী হও—’

‘গান্ধারী হতে বলছেন মাসিমা?’

উমা থতমত হয়ে হেসে ফেলেন। ‘হ্যাঁ তাই হতে বলেছি।’

‘আপনাদের দুজনেরই কিন্তু একটি করে। বাকি নিরানব্বইটি এখনও ডিউ রয়েছে।’

উমার হাসির শব্দে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সুধাংশু।

‘মেয়ের কথা শোনো। বলে কিনা বাকি নিরানব্বইটা কই?’ উমা হাসি থামিয়ে হাসির কারণটা বলতেই সুধাংশুও হেসে উঠলেন।

‘তোমার তো আর বয়স নেই, নইলে চেষ্টা করে দেখতে পারতে, তবে বকুল কিন্তু ইচ্ছে করলেই নিরানব্বইকে নব্বুই করতে পারে।’

‘ধ্যাত, কী যে বলেন, আপনার জিভের কোনো আড় নেই।’

বকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের জন্য মালবিকার মনে হল তার মা শুধু সুন্দরীই নয়, তারই সমবয়সি। তারপরই বিষাদ তাকে স্পর্শ করল। তার হাতব্যাগে কয়েক লাইনের একটা চিঠি রয়েছে। মাকে লেখা। সেই চিঠি পড়ে মায়ের এই সুখের উচ্ছলতা আর কয়েক ঘণ্টা পর কীসে যে রূপান্তরিত হবে মালবিকা আন্দাজ করতে ভয় পেল।

এখন তাকে সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে। সবার চোখ এড়িয়ে বেরিয়ে তো যেতেই হবে, তাই নয়, তার বাসে ওঠার আগে পর্যন্ত কেউ যেন না বুঝতে পারে সে বেরিয়ে গেছে। এজন্য কম করে দশটা মিনিট তার চাই। খোঁজ করতে নিশ্চয় বাস—স্টপ পর্যন্ত ওরা ছুটে আসবে, তার আগেই তাকে বাসে উঠে পড়তে হবে। প্রচুর বাস শ্যামবাজারের দিকে যায়। যেকোনো একটায় উঠে পড়া। শ্যামবাজার থেকে মানিকতলা মোড়। সেখান থেকে হেঁটে আমহার্স্ট স্ট্রিট।

সমীরণ বলেছে স্কুল বন্ধের পর সাতটায় যেতে। কিন্তু তাকে তো অনেক আগেই এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। বেরিয়ে সে সাতটা পর্যন্ত সময় কাটাবে কী করে? রাস্তায় ঘোরাঘুরি তো কোনোমতেই নয়, চেনা লোকেরা তাকে দেখে ফেলতে পারে।

বসার ঘরে মালবিকা আর সুধাংশু টিভি—তে একটা তামিল ফিল্ম দেখছিল। ইংরেজি সাব—টাইটেলের সব কথা বুঝতে না পারলেও ছবিটা মালবিকার মজারই লাগছিল। তখন উমা আর বকুল ঘরে ঢুকল।

‘মালি এই নে, তোর আইবুড়ো ভাতের কাপড়।’

উমা সেলোফোনের মোড়ক থেকে ছাপা শাড়িটা বার করে মালবিকার হাতে দিলেন। সে জানত একটা কাপড় পাবেই তাই অবাক হল না বা হবার ভান করল না। শাড়ির প্রিন্ট দেখেই তার ভালো লাগল। বড়ো বড়ো লাল ফুল তার খুব পছন্দের।

‘পছন্দ হয়েছে?’

মালবিকা হাসল। তিনজনকে প্রণাম করল, আর তখনই একবার মিহিরকে তার মনে পড়ল। বেচারা। শুধু বাড়ি, গাড়ি, টাকাপয়সা আর শিক্ষাই একটা মেয়ের কাছে সব নয়। আরও কিছু তার দরকার। দরকার শরীর আর মনকে মাতিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা। তুমিও হাত ধরেছ, সমীরণও হাত ধরেছে কিন্তু শরীর ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল একজনের ধরাতেই। এটা একটা মেয়ের কাছে কম কথা নয়।

‘হবে না কেন, আমারই তো পরতে ইচ্ছে করছে।’ বকুল বলল। শুনে উমার মুখে খুশি ফুটল। বকুল এটাই চেয়েছিল।

‘দুটো প্রায় বাজতে চলল। আর দশ মিনিটের মধ্যেই খেতে দিচ্ছি। এসো বকুল আমাকে একটু সাহায্য করো’, বকুলকে নিয়ে উমা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সুধাংশু ও মালবিকা কিছুক্ষণ টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকার পর একটা গানের দৃশ্যে ঘাসে চিতপাত নায়কের বুকের উপর নায়িকার শরীরঘর্ষণ সুধাংশুকে অস্বস্তিতে ফেলল। তিনি উশখুশ করে আড়চোখে দেখলেন মালবিকা মন দিয়ে দৃশ্যটা দেখছে, চোখদুটি উজ্জ্বল।

‘সমীরণের কাছে গান শিখছ?’ সুধাংশু চাইলেন দৃশ্যটাকে কথা দিয়ে আড়ালে পাঠিয়ে দিতে।’

‘না।’ মালবিকা চোখ ফিরিয়ে আনল স্ক্রিন থেকে।

‘সমীরণ শেখাচ্ছে না?’

‘আমিই আর শিখতে যাই না।’ সুধাংশু পরের প্রশ্নের আগেই মালবিকা বলল, ‘শিখে আর কী হবে, বিয়ে তো হয়েই যাচ্ছে।’

‘হোক না বিয়ে, তাই বলে শেখা বন্ধ হবে কেন!’

‘মিহির পছন্দ করে না সমীরণ মিত্রকে। ওনার সম্পর্কে মিহিরের ধারণা খুব খারাপ, স্বভাবচরিত্র নাকি ভালো নয়।’

সুধাংশু অপ্রতিভ বোধ করলেন। সমীরণকে তিনি ওর বালক বয়স থেকে চেনেন। পাড়ার ছেলে। বাড়িতেও আসা যাওয়া ছিল। তাকে শ্রদ্ধা করে। তার সম্পর্কে মন্দ কথা শুনতে ভালো লাগল না। ‘মিহির তো ওর ছাত্র, সে এমন কথা বলল! তোমার কী মনে হয় সমীরণ সম্পর্কে?’

‘মিহির ওর কাছে শেখা ছেড়ে দিয়েছে। আমার নিজের মনে হয় সমীরণদার চরিত্র খুব ভালো। কেন জানি মিহির ওকে হঠাৎ—ই অপছন্দ করতে শুরু করেছে। বিয়ের পর মিহির নিশ্চয়ই ওর কাছে আমায় গান শিখতে দেবে না।’ মালবিকা সহজ সুরে বলে গেল। মুখে যে বিমর্ষতা থাকার কথা তা নেই।

‘এবার এসো তোমরা, ভাত দিয়েছি।’ ভিতর থেকে উমার গলা ভেসে গেল। ওরা দুজন টেবলে গিয়ে বসল।

‘বেশি কিছু করিনি। সুক্তো, ডাল, বেগুনভাজা, দু—রকম মাছ আর দই মিষ্টি। বকুল বসে পড়ো।’

‘দিদি আপনি?’

‘আমি পরে বসছি।’

খাওয়ার সময় হাসিঠাট্টা হল। সবার সঙ্গে মালবিকাও হাসল। সর্ষে—চিংড়ি চেয়ে নিয়ে খেল। মিহিররা শুধু শাঁখা সিঁদুর ছাড়া আর কিছু নেবে না শুনে উমা জানিয়ে দিলেন, প্রভাংশুকে টিভি সেট, ফ্রিজ দিতে চেয়েছিল শ্বশুর, কিন্তু তাঁরা নেননি। এরপর সুধাংশু কথাটা তুললেন, ‘মিহির নাকি সমীরণকে পছন্দ করে না, মালিই বলল। ওর নাকি স্বভাব— চরিত্র ভালো নয়।’

‘কেন, ও তো ভালো ছেলে!’ উমা অবাক হলেন। ‘মিহির এটা ঠিক বলেনি। কবে থেকে ওকে চিনি।’

‘তুমি যখন চিনতে তখন ভালো ছিল, এখন হয়তো বদলে গেছে। মানুষ কী চিরকাল একরকম থাকে?’ কথার সুরে বুঝিয়ে দিলেন সুধাংশু আলোচনাটা বন্ধ থাক।

খেয়ে উঠে বেসিনের কলে হাত ধোবার সময় বকুল চাপাস্বরে মেয়ের কাছে জানতে চাইল, ‘মিহির তোকে সমীরণ মিত্র সম্পর্কে কী বলেছে?’

‘মিহির তো বলেনি। সমীরণদাই আমাকে বলেছেন।’

‘কবে তোকে বলেছেন?’

‘তা দিয়ে তোমার কী দরকার?’ বিরক্তি জানাল মালবিকা। ভালো মেয়ে হয়ে সে ক—টা দিন কাটিয়েছে, সব কথায় সায় দিয়ে গেছে। এখন আর কীসের পরোয়া?

‘এসব কথা এখানে বলার কী দরকার।’

‘বেশ করেছি বলেছি, চুপ করো তো।’

শোবার ঘরের খাটটা বেশ বড়ো। উমা আর বকুল পাশাপাশি শুয়ে কথা বলছে। সুধাংশু ছেলের ঘরে খাটে শুয়ে খবরের কাগজ চোখের সামনে ধরে রবিবারের গল্পটা পড়ছেন। মালবিকা বসার ঘরে সোফায় কাত হয়ে, টিভি—তে চোখ রেখে শুয়ে আছে। ইংরেজি খবর হয়ে গিয়ে ফিল্মের শেষ অংশটা এবার শুরু হয়েছে।

চোখ টিভি—র স্ক্রিনে থাকলেও মালবিকা ফিল্ম দেখছিল না। এই সময় তার মাথায় ঘুরছে একটা ফিল্ম প্রোজেক্টার যন্ত্র। তার মনের পর্দায়, সারি দিয়ে চলছে টুকরো টুকরো ঘটনা, কথা। সে কখনো ঝাপসা, কখনো স্পষ্টভাবে দেখতে পেল তার শৈশব, বাল্য, কৈশোর থেকে আজ পর্যন্ত। এইগুলোর মধ্য থেকে সে সহানুভূতি দরদ আর ভালোবাসা শুধু সমীরণ ছাড়া আর কারুর মধ্যেই দেখতে পেল না। সে বারবার বকুলকে খোঁজার চেষ্টা করল তার বিশ্বাস, আস্থা সমর্পণ করার মতো একটা মানুষ হিসেবে। সে পারল না।

একসময় সে ঘড়িতে সময় দেখল। উঠে বসল। সাতটা বাজতে এখনও তিন ঘণ্টা বাকি। টিভি বন্ধ করে নিঃসাড়ে সে শোবার ঘরে এল। বকুল পাশ ফিরে আর উমা চিত হয়ে ঘুমোচ্ছে। শ্বাস প্রশ্বাস দেখে সে বুঝল ওরা ঘুমের গাঢ় অবস্থায়। পাশের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল সুধাংশু গভীর ঘুমে, খবরের কাগজটা মেঝেয় পড়ে রয়েছে। কল্যাণকে সে দেখতে পেল না।

এইটেই সময়। আর দেরি করলে ওরা উঠে পড়বে। মালবিকা সেলোফেন মোড়কে ভরা আইবুড়ো ভাতের শাড়িটা সাবধানে তুলে নিল। বকুলের কাশ্মীরি শালের নীচে তার হাত—ব্যাগটা চাপা রয়েছে। ব্যাগটা বার করে চেইন টেনে খুলল। ছোটো একটা চিঠি বার করে চারধারে তাকাল। কোথায় রেখে যাবে?

ডাইনিং টেবলের উপর? এই শালটার নীচে। আয়নার সামনে চিরুনি চাপা দিয়ে? ঘুম থেকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে যেন না চিঠিটা পায় এই ভেবে সে ঘরের বাইরে এল। পাম্প শ্যু পরল। বসার ঘরে টিভি সেটটা চোখে পড়তেই তার মনে হল ওর উপর রাখলে টিভি চালাতে গিয়ে একসময় চোখে পড়বে। চিঠিটা সেটের উপর রেখে মালবিকা অ্যাশট্রে চাপাল তার উপর।

আর কী তার করার আছে? আছে, ঊর্ধ্বশ্বাসে এবার বাস স্টপের দিকে যাওয়া। সন্তর্পণে সদর দরজার ছিটকিনি খুলে মালবিকা বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। রাস্তায় লোক চলছে, তবে কম। এখন তাকে কেউ দেখল কি না দেখল তাতে তার কিছু আসে যায় না। সে দ্রুত পা চালাল বাস রাস্তার দিকে।

বাসনমাজার ঝি সদরের বেল বাজাতে ওদের ঘুম ভাঙে। দরজাটা যে খোলাই রয়েছে সে বুঝতে পারেনি। উমা প্রথম খাট থেকে নেমে রান্নাঘরে যান। এই সময় তাঁকে চা করতে হয়। বকুল ঘুমোচ্ছে কিন্তু মালি কোথায়? মিনিট তিন—চার পর বকুল যখন ডাইনিং টেবলে বসে মাথায় হাত দিল, মালবিকা তখন শ্যামবাজারে নেমে আর একটা বাসে উঠছে। যখন সে মানিকতলায় নামবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে তখন সুধাংশু চিঠিটা দিচ্ছেন বকুলের হাতে।

‘দিদি, মালি চলে গেছে।…এবার কী হবে।’ বকুল চিঠিটি উমার দিকে বাড়িয়ে ধরে শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল।

চিঠিটা হাতে নিয়ে উমা পড়তে এবং শোনাতে লাগলেন সুধাংশুকে। ‘মা, আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো দাম তোমাদের কাছে নেই। এই বিয়েটা নিজেদের তৃপ্তির জন্য দিচ্ছ। তোমাদের ইচ্ছার কাছে আমি বলির পাঁঠা হব না। আমি চলে যাচ্ছি কলকাতার বাইরে। খোঁজ করার চেষ্টা কোরো না। তুমি কষ্ট পাবে জানি কিন্তু আমি নিরুপায়। প্রণাম নিয়ো, ইতি হতভাগিনী মালি।’

চিঠিতে অনেকগুলো বানান ভুল। উমা হাত রাখলেন টেবলে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদা বকুলের মাথায়। তার চোখে অসহায় বেদনা। সুধাংশু বসার ঘরে গিয়ে সোফায় আশ্রয় নিলেন।

‘দিদি ওদের সবাইকে আমি এবার কী বলব? মালির বাবার সামনে আমি দাঁড়াব কী করে? আমায় বলেছিল মেয়ে যেন বাড়ির বাইরে না যায়, এখন আমি কী জবাব দোব, বলে দিন আমায়।’ বকুল মুখ তুলে তাকাল উমার দিকে। উমার মুখ পাংশু হয়ে গেল। তাদের বাড়িতেই ঘটনাটা ঘটল! এর দায় তাদের ঘাড়েও এসে পড়ছে।

‘বলুন, বলুন দিদি, এবার গঙ্গায় ডুবে মরা ছাড়া আমার আর কী করার আছে?’

‘শান্ত হও বকুল। এখন ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। শক্ত করো নিজেকে। বাড়ি গিয়ে সবাই মিলে বসে একটা উপায় বার করতে হবে।’

‘না না দিদি, বাড়ি গিয়ে এ মুখ আমি দেখাতে পারব না।’ বকুল ছুটে শোবার ঘরে গিয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। বালিশে মুখ চেপে ধরে দু—হাতে ঘুসি মারতে লাগল বিছানায়। একটা গোঙানি শুধু তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে।

‘ওকে এইভাবে থাকতে দাও।’ দরজায় দাঁড়িয়ে সুধাংশু বললেন উমাকে। ‘শান্ত হোক, তারপর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব।’

বাস থেকে নেমে মালবিকা ঘড়ি দেখল। এখনও ঘণ্টা দুয়েক সময় কাটাতে হবে। গানের স্কুল বন্ধ হবে সাতটায়। তিনটে ঘরে তালা দিয়ে অবনী চাবির তোড়াটা দোতলার দালানে পেরেকটায় ঝুলিয়ে দেবে, নয়তো শিঞ্জিনীর হাতে দেবে। তারপর ওরা চলে যাবে পার্ক সার্কাসের ফ্ল্যাটে। সদর দরজা খোলা রেখেই কি যাবে নাকি তালা দেবে। সমীরণ বাড়িতে রয়েছে কি না বোঝা যাবে তালা দেখে।

মালবিকা এখন বাড়িটার সামনে যাবে না, সামনে দিয়ে হেঁটেও নয়। দূর থেকে সে দেখতে পেল সমীরণের মারুতি গাড়িটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। ওটা যতক্ষণ থাকবে বুঝতে হবে শিঞ্জিনী বাড়িতেই রয়েছে। সে আবার মানিকতলার মোড়ে এল। এখন সময় কাটানোই তার কাছে একটা জরুরি সমস্যা। এভাবে বড়ো রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয়। বাড়ির না হোক পাড়ার কত লোক তো বাসে ট্রামে এখান দিয়ে যায়। তাদেরই কেউ বলে দেবে, ‘বিকেলে তো ওকে মানিকতলার মোড়ে দেখলুম।’

সময় কাটাবার একটা জায়গা আছে, খুবই ভালো জায়গা, প্রতিভাদির কাছে যাওয়া। ওর সঙ্গে স্বচ্ছন্দে সময় কাটিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু ওর যে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, সেটা কি হয়ে গেছে? হয়ে গিয়ে থাকলে ফিরে আসতে হবে। তাই বা কেন, ওর মা—র সঙ্গে এটা—ওটা বলে তো সাতটা বাজিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

মালবিকা দ্রুত পা চালাল দক্ষিণে রাজাবাজারের উদ্দেশে। সায়ান্স কলেজ ছাড়িয়েই তার মনে হল কিছু একটা যেন সে অনুভব করছে। ফুটপাথে তিন—চারজনের জটলা দেখল অনেকগুলো। লোকগুলোর মুখ গম্ভীর, কথা বলছে গলা নামিয়ে। কিন্তু রাজাবাজারের মোড়ে পৌঁছে তার মনে হল আর পাঁচটা দিনের মতোই রয়েছে জায়গাটা। ওপারে রাস্তার ধার ঘেঁষে থাকা ফলের, প্লাস্টিক আর রবারের জুতোর সারি দেওয়া দোকানগুলো যথারীতি খোলা। ট্রাম, বাস, অন্যান্য গাড়ি বিকট শব্দে চলাচল করছে। এমনকী রবারের বলে ক্রিকেটও খেলা হচ্ছে। অস্বাভাবিক লাগল, রাস্তার ওপারে একটা বেঞ্চে সাদা উর্দি পরা সাত—আটজন পুলিশ দেখে। সবার হাতে রাইফেল। একটা ভ্যানও দাঁড়িয়ে।

মালবিকার বুক কেঁপে উঠল অজানা ভয়ে। এত পুলিশ কেন? অমঙ্গল কি ওর দিকে এগিয়ে আসছে? বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সে কি ভুল করল? ভাবতে ভাবতে সে মসজিদ ছাড়িয়ে গলির মধ্যে ঢুকল। তখন একবার তার মনে হল, ফিরে যাই। তারপর মনে হল এত দূর এগিয়ে আর ফেরা যায় না। সমীরণ তাকে ভালোবাসে কিন্তু সমীরণ যদি বাড়িতে না থাকে? যদি দরজায় সে তালা ঝুলতে দেখে? তা হলে কী করবে? রাস্তায় শুয়ে থাকবে? সমীরণ তাকে ডোবাবে না। ও খুব ভালো, ও নিশ্চয় ভেবেচিন্তেই তাকে সাতটায় আসতে বলেছে। কাল কল্যাণীতে নিয়ে যাবে। কোথায় রেখে আসবে, কার কাছে? কলকাতায় কি তাকে রেখে দিতে পারে না?

দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। মালবিকা ধাক্কা দিল। অন্যান্য বাড়ির দরজার সামনে বাসিন্দারা, বেরিয়ে এসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে উর্দুতে যার কিছুই সে বুঝছে না। ডিসেম্বরের সন্ধে নেমে আসছে। হাতের ব্যাগ আর শাড়িটা আঁকড়ে ধরে দরজায় আবার ধাক্কা দিল। প্রতিভাদিদের বারান্দায় কেউ নেই। সে ভাবল চেঁচিয়ে ডাকবে কি না।

দরজাটা সামান্য ফাঁক করে একটি মাঝবয়সি লোক তাকে দেখছে। গায়ে হাওয়াই শার্ট আর লুঙ্গি।

‘আমি উপরে যাব।’

লোকটি কথা না বলে পাল্লা খুলে সরে দাঁড়াল। একটি স্ত্রীলোক আর কয়েকটি শিশু ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ভীত চোখে তাকে দেখছে। মালবিকা অন্ধকার সরু সিঁড়িটা ধরে দোতলায় উঠে এসে দেখল বারান্দায় কেউ নেই।

‘প্রতিভাদি।’ মৃদু স্বরে সে ডাকল।

‘কে?’ প্রতিভার ঘর থেকে তার মা বেরিয়ে এলেন। বারান্দায় আলো জ্বেলে মালবিকাকে দেখে বললেন, ‘তুমি! এই সময়ে। ঘরে এসো, প্রতিভার তো খুব জ্বর। আজ সকালেও ছিল একশো তিন এখন একশোয় নেমেছে।’

মালবিকা নিশ্চিন্ত বোধ করল। বিয়ে তা হলে হয়নি। প্রতিভার বুক পর্যন্ত একটা ধূসর আলোয়ান, চোখ মুখ টসটসে, তক্তপোশের নীচে একটা বাটিতে জল আর তাতে ডোবানো এক ফালি কাপড়। বালিশের পাশে দুটো ক্যাপসুল। ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘এসো মালবিকা।’

মালবিকা বসল, প্রতিভার পাশে। ‘এদিকেই এসেছিলুম, ভাবলুম যাই তোমাকে দেখে আসি।’

‘ভালো, তবে আজ না এলেই পারতে।’

‘কেন?’ মালবিকার বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল।

‘শুনছি তো অযোধ্যায় বাবরি মসজিদটা ভেঙে দিয়েছে করসেবকরা। বাবা বললেন, বিবিসি নিউজে নাকি বলেছে। মুসলমানরা ভয় পেয়ে গেছে।’

‘ভয় কেন?’

প্রতিভার মা উত্তর দিলেন, ‘চারদিকেই তো হিন্দু। অবাঙালি হিন্দুরা তো মসজিদের ফুটপাথে গাছতলায় একটা মন্দির তৈরির চেষ্টা বহুদিন ধরেই করে যাচ্ছে। বন্দুক নিয়ে পুলিশ সব সময়ই বসে থাকে। এবার ওরা চেষ্টা করবে মন্দির তৈরির জন্য হাঙ্গামা বাধাতে। ওর বাবা তো তাই বললেন, রায়ট যদি বাধে তো রামের নামে ওরাই বাধাবে। চা খাবে?’

‘হ্যাঁ।’

প্রতিভার মা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মালবিকা ঝুঁকে প্রতিভার মুখের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞাসা করল, ‘মিহিরদা তোমার কাছে এসেছিল?’

প্রতিভা বিস্মিত হল। ভুরু কুঁচকে উঠল। ‘এ—প্রশ্ন কেন?’

‘এমনিই, বলুন না, এসেছিল কি না?’

‘এসেছিল।’

‘কিছু জিজ্ঞাসা করেছিল আমার আর সমীরণদা সম্পর্কে?’

‘করেছিল। অনেক কিছুই জানতে চেয়েছিল।’

‘কী জানতে চেয়েছিল, সেই একসঙ্গে গাড়িতে আসা?’

‘হ্যাঁ। আমি যা দেখেছি শুনেছি তাই বলেছি ওকে, রং চড়াইনি। আমার মনে হয়েছে তুমি সমীরণদার খপ্পরে চলে যেতে পারো।’

‘আমাকে বাঁচাবার জন্য তাই মিহিরদাকে সব বলে দিলেন?’

‘আমি পাশে বসে আর তোমরা যা শুরু করে দিলে, মালবিকা, আমার অস্তিত্বটাকেই অস্বীকার করে তোমরা যা করেছিলে তাতে একটু মর্যাদাবোধ যার আছে সে অপমানিত বোধ করবে। মদ খেলে সমীরণের বোধবুদ্ধি লোপ পায়, যা খুশি বলে, যা খুশি করে। কিন্তু তুমি তো মদ খাওনি। তা হলে তুমি কেন অসভ্যতা করবে, তাও আমার পাশে বসে। মনে করে দ্যাখো, সেদিন তুমি ওর কোলে বসে—’, প্রতিভা থেমে গেল। উত্তেজনায় চোখ জ্বলজ্বল করছে। স্বরে যতটা না ঘৃণা তার থেকেও বেশি আহত মর্যাদার যন্ত্রণা। শুকনো ঠোঁট চেটে নিল। হাঁফাচ্ছে। বালিশ থেকে মাথাটা তুলে ফেলেছে।

‘আপনি এসব বলেছেন?’ প্রতিভার কাঁধে চাপ দিয়ে মালবিকা মাথাটা বালিশে ফিরিয়ে দিল।

‘না। নোংরা বিষয় নিয়ে কথা বলতে গা ঘিন ঘিন করে। সমীরণ মিত্তিরের নাম তুমি আমার কাছে কোরো না। আমার যে সর্বনাশ করেছে, তা তোমায় বলতে পারব না। তবে মিহির বোকা নয়, সে সমীরণদার স্বভাবচরিত্রটা জানে, অনুমান করে নেবার মতো বুদ্ধি আছে। ও ছ্যাবলা নয়। প্রখর ওর মান—অপমান বোধ। তিন বছর ওকে দেখেছি তো।’

মিহিরের সঙ্গে তার যে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে মালবিকা বলতে গিয়েও তা বলতে পারল না। চায়ের কাপ হাতে প্রতিভার মা ঘরে ঢুকলেন।

‘চা—টা খেয়ে মা তুমি আর থেকো না। রাস্তায় নাকি লোকজন কমে যাচ্ছে। নীচের রুকিয়ার মা বলল গোলমাল হতে পারে।’

মালবিকার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একটা চুমুক দিয়ে সে কাপ রেখে দিল মেঝেয়। ‘প্রতিভাদি, মাসিমা, আমি এখন চলি, পরে একদিন আসব।’

মালবিকা যখন হনহনিয়ে কেশব সেন স্ট্রিট থেকে আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকে চলেছে তখন তার উকিল বড়োজ্যাঠার একতলার সেরেস্তায় চলেছে এক বৈঠক। ওদের তিন ভাই আর সুধাংশু টেবল ঘিরে বসে। মেজোভাই জামসেদপুরে টেলকোয় অ্যাকাউন্টেন্ট। বউ নিয়ে সেখানেই কোয়ার্টারে থাকে। তাদের এখানকার ঘর তালা দেওয়া। এই বাড়ির সাতেপাঁচে তারা থাকে না। দু—তিন বছর অন্তর তারা আসে, তারা নিঃসন্তান।

জ্যাঠার ছেলে ভটু দরজায় দাঁড়িয়ে। এই বৈঠকে মেয়েদের থাকতে দেওয়া হয়নি। দোতলায় অর্চনার ঘরে দেওয়ালে ঠেস ও কপালে হাত দিয়ে বসে থাকা বকুলকে ঘিরে তার দুই জা তখন মালবিকার সমালোচনায় ব্যস্ত।

‘আগেই পুলিশ কেন? পুলিশ লাগানো মানেই লোক জানাজানি করা। আগে চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করে দ্যাখো ফিরে আসে কি না।’ কথাটা বলল বড়োজ্যাঠা।

‘পুলিশের এখন এইসব মেয়ে—পালানোর মতো সিলি ব্যাপারে মাথা ঘামানোর সময় হবে না।’ ভটু গম্ভীর বিজ্ঞ স্বরে জানিয়ে দিল। বিকেলে সে স্কুটার নিয়ে বেরিয়েছিল। ‘ইউ এন আই—এ আমার এক বন্ধু আছে, সে বলল পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে বাবরি মসজিদ একেবারে গুঁড়িয়ে ধুলো করে দিয়েছে।’

‘পাঁচ ঘণ্টায় কী করে ধুলো করে? কামান নিয়ে গেছল?’ ব্যবসায়ী সেজোভাই সন্দেহ প্রকাশ করল। ‘তিন—তিনটে গম্বুজ আছে মসজিদটার, অমনি পাঁচ ঘণ্টায় ভেঙে দিল?’

‘আমি যা শুনেছি তাই বললুম। পাঁচশো বছরের কাদামাটির স্ট্রাকচার, হাজার হাজার লোক যদি শাবল, গাঁইতি, হাতুড়ি, লোহার পাইপ দিয়ে ভাঙতে শুরু করে তা হলে পাঁচ ঘণ্টায় ধুলো হবে না?’ ভটু তার কাকার অবিশ্বাসকে ভাঙার চেষ্টা করল।’

‘আচ্ছা, এসব আলোচনা পরে হবে।’ বড়োজ্যাঠা তার ছেলের দিকে হাত তুললেন। ‘পুলিশ—টুলিশ পরের কথা। তা ছাড়া ভটু যা বলল, তাতে এখানে কেন সারা দেশের পুলিশই তো এখন ল অ্যান্ড অর্ডার নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাবে না।’

‘আমি এটাই বলতে চেয়েছি।’ ভটু বলল।

‘দিলু, তুই কিছু আন্দাজ করতে পারিস ও কোথায় যেতে পারে বা মালির সঙ্গে কারোর—’, বড়োভাই শোভন হওয়ার জন্য থেমে গেল।

এতক্ষণ পাথরের মতো বসে থাকা দিলীপরঞ্জন মাথা নাড়ল।

‘বউমাকে জিজ্ঞেস করেছিলি?’

‘হ্যাঁ, ও কোনো হদিশ দিতে পারল না।’

‘ইদানীং ওর চালচলনে কোনোরকম সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েছে?’

‘সন্দেহজনক মানে?’ দিলীপরঞ্জন তেরিয়া ভাবটা কোনোক্রমে চেপে রাখল। মেয়ের চরিত্রের প্রতি কটাক্ষ তার ভালো লাগল না।

‘এতে আর মানেটানের কী আছে?’ ব্যবসায়ী দাদা সোজাসুজি কারবার ভালোবাসে। ‘কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেমটেম করছিল কী?’

‘সে কি বলেকয়ে প্রেম করবে?’ দিলীপরঞ্জন রাগ চেপে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘না, আমার চোখে কিছু পড়েনি।’

‘ওর চিঠিটা দেখি।’ উকিল দাদা হাত বাড়াল। ‘কোথায় চিঠিটা?’

দিলীপরঞ্জন বুকপকেট থেকে বার করে দিল। বড়োভাই চশমা পরে নিল। খুঁটিয়ে চিঠিটা দু—বার পড়ে নিয়ে চশমা খুলল। মুখে হতাশা।

‘সেরকম কিছু তো পাচ্ছি না।’

‘চেপে গেছে, বুদ্ধিমতী মেয়ে তো।’ সেজোভাই মন্তব্য করল। দিলীপরঞ্জনের ভ্রূকুটি তার নজর এড়াল না।

চুপচাপ বসে আছে সুধাংশু। তিনি বাইরের লোক। এই ধরনের কথাবার্তায় তাঁর নাক গলানো উচিত হবে কি না বুঝতে পারছেন না। ঘটনাটা যদি না তাঁর বাড়ি থেকে শুরু হত তা হলে তিনি এখানে বসে থাকতেন না। এখন তাঁর নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। কিন্তু এরা যেভাবে কথাবার্তা চালাচ্ছে সেটা তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। তাঁর মনে হচ্ছে এই মুহূর্তের জরুরি বিষয়টাই কেউ তুলছে না কেন?

‘বিয়ের আর আট দিন বাকি। কম করে অন্তত ষাট—সত্তরটা কার্ড বিলি হয়ে গেছে। তারা তো বিয়ের দিন হাজির হবে।’ সুধাংশু নিজেও শিউরে উঠলেন দৃশ্যটা কল্পনা করে।

‘আপনি কী বলতে চান মালি আর ফিরে আসবে না?’ উকিলের প্রশ্ন।

‘না না সে—কথা বলছি না।’ সুধাংশু প্রায় আঁতকে উঠলেন। ‘নিশ্চয়ই চাই ফিরে আসুক। কিন্তু অন্য সম্ভাবনাটাও মাথায় রাখা দরকার।’

‘উনি ঠিকই বলেছেন।’ দরজা থেকে ভটুর সমর্থন এল। ‘এটা খুবই ইম্পর্ট্যাণ্ট ইস্যু। আগে এটার ফয়সালা হওয়া উচিত। সবাইকে এখনই বারণ করে না দিলে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’

‘কী বলে বারণ করবি? আর সেটা করা হবেই বা কী করে?’ সেজোভাই জানতে চাইল এবং তার প্রশ্ন দুটির সারবত্তা ঘরটাকে চুপ করিয়ে রাখল।

সত্যিই তো এত লোককে কী কারণ দেখিয়ে বারণ করা যায়? মেয়ে পালিয়ে গেছে বললে শুধু দিলীপরঞ্জনেরই তো নয়, সারা পরিবারের মাথা কাটা যাবে। তাদের বংশে এমন কেলেঙ্কারি এই প্রথম। আত্মীয়স্বজন, কুটুম, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীদের কাছে মুখ দেখানো যাবে না। কী আতান্তরে যে মেয়েটা সবাইকে ফেলে দিল!

এরপরও সমস্যা, এত লোককে এই অল্পদিনের মধ্যে বারণ করা। সেটা কি সহজ কথা!

‘অলরেডি যাদের কার্ড দেওয়া হয়ে গেছে তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে বলে আসা। যার টেলিফোন আছে তাকে টেলিফোন করা নয়তো পোস্টকার্ড ছাড়া।’ ভটু সাবলীলভাবে সমাধানের পথ দেখিয়ে দিল।

‘পোস্টকার্ড নয়। পোস্টাল সার্ভিসের যা বহর, এখান থেকে বাগবাজারের চিঠি ড্রপ করলে দেখবি দশ দিনেও পৌঁছবে না। আর টেলিফোন? কালই সল্টলেকে মামাশ্বশুরকে টেলিফোন করে পেলুম না। ডেড হয়ে গেছে। তার থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলার কথাটাই ভাবো।’ ভটুকে তার সেজোকাকা পুরোপুরি নস্যাৎ করল না। একটা পথ খোলা রাখল।

‘বাড়ি বাড়ি যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা! বেলঘরিয়া থেকে পুটিয়ারি। ওদিকে উত্তরপাড়া। অফিসের লোকদের নয় বলে দেওয়া যাবে। পাড়ায় সবাই বিয়ের কথা জানে। তবে এখনও কাউকে বলা হয়নি। কিন্তু আত্মীয়—কুটুমদের তো বলা হয়ে গেছে।’ দিলীপরঞ্জনের দেহকাঠামো যতটা নয় তার থেকেও বেশি ভেঙে পড়েছে তার কণ্ঠস্বর। অস্ফুটে একবার বলল, ‘আমি যে এখন কী করি!’

‘কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে দিলেই হয়, বিয়ে স্থগিত রইল অনিবার্য কারণে।’ সেজোভাই শেষ করামাত্র বড়োভাই খিঁচিয়ে উঠল, ‘কী বুদ্ধি তোর! যারা কিছু জানত না তারাও এবার জেনে যাবে।’

‘সেজোকাকা, এখানেও একটা ব্যাপার আছে। কী কারণ দেখিয়ে তুমি স্থগিত রইলে বলবে? অনিবার্য কথাটার কোনো মানে হয় না। এতে লোকে নানা রকমের সন্দেহ করবে। একটা কংক্রিট কোনো কারণ দেখানো দরকার।’ ভটু চ্যালেঞ্জের সুরে সেজোকাকার মগজের পরীক্ষায় নামল।

‘এ তো খুব ইজি ব্যাপার, বলে দে মেয়ে মরে গেছে।’

দিলীপরঞ্জন একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মাথা তুলল। সুধাংশু বিস্ফারিত চোখে সেজোভাইয়ের দিকে তাকাল। বড়োভাই ভ্রূকুটি করল। ভটু চাপা গলায় ‘হুঁ’ বলল।

‘মরে গেছে মানে, একটা কঠিন কোনো রোগ হয়েছে মরার সম্ভাবনা আছে আমি তাই মিন করেছি। ধরো টিবি হয়েছে যদি বলি?’

‘টিবি?’ বড়োভাই চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে কী ভেবে বসে পড়ল। ‘এ রোগ তো গরিবদের হয়। আমাদের বাড়িতে টিবি ঢুকবে কী করে?’

‘তা হলে ক্যানসার। এটা বড়ো বড়ো লোকদেরও হয়। এইডসও হয়।’

‘সেজোকাকা! ভটু ধমকে উঠল। ‘এইডস কেন হয় তা জানো। মেডিক্যাল কলেজের গায়ে একটা বড়ো বোর্ডে তা লেখা আছে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে যেতে গেলে চোখে পড়ে। মালির এইডস হয়েছে বললে কেলেঙ্কারির উপর ডবল কেলেঙ্কারি হবে।’

‘তা হলে ছেলের এইডস হয়েছে বলো।’

‘তুই চুপ কর।’ সেজোভাইকে মৃদু দাবড়ানি দিয়ে উকিল দাদা বলল। ‘ভটু তুই বললি বাবরি মসজিদ গুঁড়ো হয়ে গেছে। এতে তা হলে মুসলমানরা খেপে যাবে, কেমন? খেপে গেলে রায়ট হতে পারে, কেমন? মিহিররা এন্টালির যে দিকটায় থাকে সেদিকে মুসলমানই বেশি তাই তো? ধর ও যদি রায়টে মারা যায়, তা হলে তো বিয়ে অটোমেটিক্যালি বন্ধ হয়ে যাবে।’

‘কিন্তু রায়ট হলে তো মরবে।’

‘যদি হয়। সেজন্যই তো গোড়াতেই বলেছি চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করো। তার মধ্যে মালি ফিরে আসতে পারে, তার মধ্যে রায়টও লেগে যেতে পারে। এর যেকোনো একটা হলে আমাদের মুখ রক্ষা হতে পারে।’

সুধাংশু আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। স্বার্থপর এবং মূর্খের মতো কথাবার্তায় তিনি বিরক্ত হচ্ছিলেন। এইবার বললেন, ‘আপনারা যেমন নিজেদের অসুবিধার কথা ভাবছেন ঠিক তেমনি ছেলের বাড়িও তো এই অসুবিধার সামনে পড়বে। ওঁরাও নিশ্চয় অনেককে নেমন্তন্ন করে ফেলেছেন। ওঁদের কথাটাও ভাবুন। ওঁদেরও মানসম্মান বোধ আছে। ঘটনাটা ওঁদের জানিয়ে দিন।’

সারা ঘর চুপ। শুধু দিলীপরঞ্জন বলল, ‘হ্যাঁ, এটা আমাদের কর্তব্য। আমি যেমন অনেক টাকা খরচ করে বসে আছি, তেমনই ওরাও যাতে খরচ আর না করে সেটা দেখা দরকার।’

‘তা হলে তুই জানিয়ে দে, এক্ষুনি।’ বড়োভাই টেলিফোনটার দিকে তাকাল। এ—বাড়িতে এটা দ্বিতীয় টেলিফোন কিন্তু ডায়ালে তালা দেওয়া। সকাল ও সন্ধ্যায় যখন ও সেরেস্তায় কাজে বসে তখনই শুধু টেলিফোনকে মুক্তি দেয়। অন্য সময় হাতকড়া লাগিয়ে রাখে।

দিলীপরঞ্জন মাথা নাড়ল। ‘না, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মেয়ের এই অপকর্ম নিজের মুখে আমি বলতে পারব না।’

‘তা হলে—’। সেজোভাইয়ের দিকে তাকাল।

‘আমার দ্বারা হবে না।’

‘তা হলে—’ সুধাংশুর উপর চোখ রাখল মালবিকার বড়োজ্যাঠা। ‘আপনি বাইরের লোক, আপনার তো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া মিহিরের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে।’

‘ওর নম্বরটা আমি জানি না।’

‘মালির মায়ের কাছে আছে, এনে দিচ্ছি।’

দিলীপরঞ্জন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেজোভাই তখন সুধাংশুকে বলল, ‘আপনি কি কিছু আন্দাজ করতে পারেন, মালি কোথায় যেতে পারে?’

‘একদমই নয়।’

‘অচেনা কোনো লোককে বাড়ির সামনে দেখেছেন?’

ভটু বলল, যেভাবে গল্পের গোয়েন্দারা বলে।

‘না। তবে আমার মনে হয়, পুলিশের সাহায্য ছাড়া আর কোনোভাবে ওকে খুঁজে বার করা যাবে না। বোঝাই যাচ্ছে একটা প্ল্যান করে রেখেছিল। দুঃখের বিষয় শুরুটা করল কিনা আমারই বাড়ি থেকে। বকুল তো আত্মহত্যা করবে বলেছিল।’

‘দেখা যাক।’ বড়োভাই বলল, ‘মেয়েটা হুট করে এমন একটা কাজ যে করে বসবে কে জানত! দুষ্টু লোকের হাতে পড়ল কি না কে জানে! দেখতে শুনতে তো ভালো, চটকও আছে।’

আলোচনাটা কেউ বাড়াল না। গম্ভীর মুখে সবাই নিজের ভাবনার মধ্যে ডুবে গেল। একটু পরেই একটুকরো কাগজ নিয়ে ফিরল দিলীপরঞ্জন। সেটা সে সুধাংশুর হাতে দিল।

‘বউমা কী করছে? ওকে চোখে চোখে যেন রাখা হয়।’ বড়োভাই চাবি ঘুরিয়ে তালা খুলে দিল।

‘এই সময় সিডেটিভ খাইয়ে কাকিমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা দরকার।’

ডায়াল করে নম্বরটা পেল সুধাংশু। বয়স্ক ঘড়ঘড়ে গলায় একজন ‘হ্যালো’ বলল। তাকে সে অনুরোধ করল মিহিরকে ডেকে দেবার জন্য। ‘বলুন পাতিপুকুরের সুধাংশু গাঙ্গুলি কথা বলতে চায়।’

এরপর অপেক্ষা। সবাই টানটান হয়ে উঠেছে। সুধাংশুর গলা শুকিয়ে আসছে। ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় ঘাম ফুটল তাঁর কপালে। এ কী বিদঘুটে পরিস্থিতির মধ্যে তিনি পড়লেন! ফটকের সামনে বকুলকে ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে দিয়ে তিনি তো তখনই ফিরে যেতে পারতেন। তাই করলেই ভালো হত। কেন যে তাঁর মনে করুণার সঞ্চার ঘটল। উমা যদি এইরকম অবস্থার মধ্যে পড়ত তা হলে কী হত? ভাগ্যিস তাঁদের মেয়ে নেই। এখন কী বলবেন, কীভাবে বলবেন মিহিরকে? মেয়ের বাবা জ্যাঠারা কেউ অপ্রিয় কাজটা করতে চাইল না অথচ ওদেরই তো করার কথা।

‘হ্যালো কে মিহির।’ সুধাংশুর হাত কাঁপল, গলা কাঁপল। কীভাবে শুরু করবেন ঠিক করতে না পেরে বললেন, ‘শুনেছ কী ঘটেছে?’

‘সত্যিই খুব দুঃখের। এটা পরিষ্কার বিশ্বাসঘাতকতা হল। এমন কাজ যে হতে পারে ভাবাও সম্ভব নয়।’

.

মিহিরের গলায় যে ক্ষোভ, রাগ, তিক্ততা এবং স্বরগ্রাম সুধাংশু আশা করেছিলেন, সেটা না পেয়ে কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত হলেন।

‘হ্যালো মেসোমশাই, আপনাদের ওদিকে অবস্থা কেমন? আমাদের এখানে সব নর্ম্যাল।’

‘মিহির তুমি কী নিয়ে বলছ?’

‘কেন বাবরি মসজিদের আজ যা সর্বনাশ হল! আপনি তা হলে কী ভেবেছেন?’

‘বাবরির থেকেও বেশি সর্বনাশ হয়েছে মালিদের বাড়িতে, মালি নেই।’

‘য়্যা, মারা গেছে?’

‘না, না, মারা যাওয়া নয়। আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না বাবা, মালি আর তার মা আজ দুপুরে আমার বাড়িতে আইবুড়ো ভাত খেতে গেছল, ওর মায়ের নয়, মালির আইবুড়ো ভাত। দুপুরে আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। সেই ফাঁকে দরজা খুলে ও বেরিয়ে গেছে এক কাপড়েই। না না, আইবুড়ো ভাতের শাড়িটা সঙ্গে নিয়ে গেছে। একটা চিঠি মাকে লিখে রেখে গেছে। পড়ব?’ সুধাংশু হাত বাড়ালেন দিলীপরঞ্জনের দিকে। চিঠিটা নিয়ে তিনি পড়ে শোনালেন মিহিরকে। পড়ার মধ্যে শুনতে পেলেন মিহির অস্ফুটে বলছে, ‘আবার আমায় অপমান করল।’

‘হ্যাঁ বাবা, এবার কী করা যায়?’

‘কী আর করা যাবে, মালির বাবা—মাকে বলুন নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোতে।’

‘তুমি রেগে যাচ্ছ। কিন্তু এটা কি রাগের সময়?’

‘এতে রাগব না তো কীসে রাগব? কত লোক জানে বিয়ে ওর সঙ্গে হচ্ছে। বাবার খুব একটা মত ছিল না কিন্তু আমার মুখ চেয়ে না বলতে পারেননি। এখন তার সামনে দাঁড়িয়ে কী করে বলব, তোমার ভাবী পুত্রবধূটি সটকান দিয়েছে। ছি ছি ছি কী নোংরামি করল। বিয়ে যদি নাই করতে চায় তা হলে ভদ্র পরিচ্ছন্নভাবে আমাকেও তো বলতে পারত। সবার মুখে কালি মাখিয়ে দেওয়ার কোনো দরকারই ছিল না। বুঝলেন মেসোমশাই অশিক্ষিত বাবা—মায়ের ছেলেমেয়েরা এইরকমই হয়। বাবাটা মোদো মাতাল, তাও আবার দিশি খায়। মেয়েও লেখাপড়ায় অষ্টরম্ভা, হিন্দি ফিল্মের সেক্স আর ভায়োলেন্স দেখে দেখে মাথার মধ্যে শুধু ওইসবই ঘুরছে, তার উপর জুটেছে আপনার আদরের শ্রদ্ধার কেষ্টঠাকুরটি। শুনুন মেসোমশাই, এ কাজ মালি করেছে সমীরণ মিত্তিরের কথায়। আই অ্যাম ডেড শিওর।’

‘তুমি বলছ কী মিহির?’ সুধাংশু রিসিভারটা জোরে আঁকড়ে ধরলেন যাতে হাত থেকে পড়ে না যায়। বড়োভাই, শরীরটা হেলিয়ে দিয়ে ওধারের কথা শোনার চেষ্টা করছেন। কিছু কিছু শুনতেও পাচ্ছেন কেননা মিহির বেশ চেঁচিয়েই কথা বলছে। দাদার মতো একই উদ্দেশ্যে সেজোভাই টেবলের উপর উপুড় হয়ে এগিয়ে এসেছে। ভটু দাঁড়িয়ে সুধাংশুর পিঠের কাছে। শুধু দিলীপরঞ্জন কপালে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে সোজা হয়ে বসে। তার আর কোনো কিছুতে উৎসাহ নেই।

‘ওদের মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। তার সাক্ষীও আছে। সব কিছুর মূলে কিন্তু আপনি আর মাসিমা। মহাজাতি সদনে আপনারাই ওদের গ্রিনরুমে নিয়ে গিয়ে সমীরণ মিত্তিরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। মনে পড়ে কি? যদি তা না করাতেন তা হলে আজকের এই ঘটনা ঘটত না।’

‘মিহির তোমার সঙ্গেও তা হলে মালির পরিচয় হত না। ঠিক বলেছ, এ ঘটনা ঘটত না। এই বিয়ের প্রশ্নই উঠত না। কিন্তু এখন তর্কাতর্কির সময় তো নয়। কিছু একটা তো করা দরকার।’

‘করতে হয় আপনি করুন, মালির বাবা করুন। আমি কী করতে পারি বলুন? রাস্তায় ওকে খুঁজে বেড়াব? পারলে একবার সমীরণ মিত্তিরের খবর নিন। ওর বাড়িতে যান। এখন বাবা—মার সামনে কী বলে যে দাঁড়াব—,’ রিসিভার রাখার শব্দ হল।

‘কী বলল? সমীরণ মিত্রের নাম করল বলে মনে হল?’ সেজোভাই টেবল থেকে নিজেকে টেনে তুলে বলল।

‘বলল, মালির সঙ্গে ওর একটা রিলেশন গ্রো করেছে। সমীরণ মিত্তিরের বাড়িতে যেতে বলল।’ ভটু দরজার দিকে যেতে যেতে বলল।

‘কিন্তু সব থেকে ভাইটাল পয়েন্ট হল, সুধাংশুবাবুই সব কিছুর মূলে।’ উকিল বড়োভাই ত্যারচা চোখে তাকাল সুধাংশুর দিকে। ‘তাই তো মিহির বলল।’

বুক শুকিয়ে গেল সুধাংশুর। কথাটা তো সত্যিই। সমীরণের সঙ্গে আলাপ তো তারাই করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারপর ওদের মধ্যে যদি কিছু হয়ে থাকে তা হলে কি তিনি বা উমা দায়ী হবেন?

‘এটা আপনার করানো উচিত হয়নি। একটা বদমাশ লোকের সঙ্গে, ভাইঝি বলে বলছি না, সুন্দরী একটা মেয়ের আলাপ করিয়ে দেওয়ার আগে আপনার দু—বার ভেবে দেখা উচিত ছিল।’ বড়োভাইয়ের গলা ভরাট এবং খুবই সূক্ষ্ম একটা হুমকিও যেন রয়েছে।

‘তা হলে আমার এখন কী করার আছে?’ কাতর স্বরে সুধাংশু বললেন। এখন তিনি সত্যিই ভীত।

‘আপনি বরং সমীরণ মিত্তিরকে একটা ফোন করুন।’ ভটু সুপারিশ করল। ‘আগে জেনে নিন লোকটা বাড়িতে আছে কি না।’

‘কিন্তু ওর ফোন নম্বর তো আমার কাছে নেই, বাড়িতে রয়েছে।’

‘দাঁড়ান দাঁড়ান, অবুর গানের স্কুলের বিলে ফোন নম্বর আছে। ওটা নিশ্চয় ওর বাড়িরই ফোন।’ সেজোভাই প্রায় ছুটেই দোতলার উদ্দেশে রওনা দিল।

.

কেশব সেন স্ট্রিট দিয়ে লাল পতাকা হাতে একটা মিছিল স্লোগান দিতে দিতে রাজাবাজারের দিকে আসছে। হিন্দু—মুসলমান সম্প্রীতি রক্ষার জন্য আবেদন জানানো হচ্ছে। মালবিকা মিছিলটার পাশ দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল। এবার আমহার্স্ট স্ট্রিটে একটা পথসভা। ফুটপাথে মাইকের সামনে একটি লোক। তিনরঙা দুটো পতাকা ল্যাম্পপোস্টে বাঁধা। ভিড় করে লোকজন শুনছে। ‘সারা দেশের পরিস্থিতি এখন উদবেগজনক। যে ধর্মীয় উন্মাদনা দেশকে আজ অগ্নিগর্ভ করে তুলেছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আঘাত হেনেছে, তার বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে…’ সভার পাশ কাটিয়ে মালবিকা দ্রুত এগিয়ে গেল। স্লোগান বক্তৃতা কিছুতেই তার দরকার নেই, কানে ঢোকাতেও চাইল না। তাই নিজের পরিস্থিতিই উদবেগজনক হয়ে রয়েছে। বাবরি মসজিদ রইল কি ভেঙে পড়ল তাই নিয়ে এই মুহূর্তে তার মাথাব্যথা নেই। সমীরণের বাড়িতে ঢুকে পড়া ছাড়া আর কিছু সে ভাবতে চায় না।

দূর থেকেই সে দেখতে পেল বাড়ির সামনে গাড়িটা নেই। তার মানে শিঞ্জিনীও নেই। সায়ন্তনও নেই, অবনীও তা হলে নেই। রাস্তার দিকে সরে এসে মুখ তুলে দেখল বসার ঘরে আলো জ্বলছে। মালবিকার বুকের মধ্য থেকে চাপটা সরে গেল। সে কলিংবেলের বোতাম টিপল।

জানলার পর্দা সরিয়ে অপরিচিত একটা মুখ উঁকি দিয়ে বলল, ‘কে?’

‘সমীরণদা আছেন?’

মুখটা ঘুরিয়ে লোকটি কার সঙ্গে কথা বলে নীচে তাকিয়ে বলল, ‘দাঁড়ান।’

মালবিকা রাস্তার দু—দিকে তাকাল। একটা পুলিশের জিপ যাওয়াকে যদি ‘উদবেগজনক’ ভাবা না যায় তা হলে রাস্তাটা অন্য যেকোনো দিনের মতোই। সে গভীর স্বস্তি বোধ করল।

‘আসুন, উনি আছেন।’

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় লোকটি বলল ‘সমীরণদার শরীরটা ভালো নেই, টেম্পারেচার উঠেছে একশোয়।’

মালবিকার স্বস্তি বোধটা নষ্ট হয়ে গেল সমীরণের জ্বর হয়েছে শুনে। হঠাৎ—ই তার মনে হল, এটা যেন অশুভ লক্ষণ। কেন যে মনে হল তা সে জানে না।

‘কাল আবার কাঁচরাপাড়ায় ওনার একটা আসর আছে, কী যে হবে।’

লোকটির কথা বলার ধরন দেখে মালবিকার মনে হল কাঁচরাপাড়ার আসরের একজন উদ্যোক্তা এবং সমীরণের বশংবদদের একজন। একে সে কখনো দেখেনি। দোতলায় বসার ঘরের পর্দা সরানো। সমীরণ সোফায় পা তুলে বসে, গায়ে জড়ানো সাদা শাল। আরও লোক রয়েছে। স্বামী, স্ত্রী ও একটা বাচ্চচা মেয়ে।

মালবিকাকে দেখে সমীরণের কোনো ভাবান্তর ঘটল না। বরং চোখটা দু—সেকেন্ডের জন্য কুঁচকে উঠল। মালবিকার চোখে সেটা এড়াল না। মলিন হয়ে গেল তার অভ্যন্তর।

‘তুমি পাশের ঘরে বোসো, আমি এদের সঙ্গে কথা বলে নি।’

সমীরণের গলা শুকানো। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে জ্বর হয়েছে, শরীর দুর্বল। মালবিকা পাশের শোবার ঘরে এল। ঘরে আসবাব প্রায় কিছুই নেই। ড্রেসিং টেবল, আলমারি, কাঠের ওয়ার্ডরোব, দুটো ছোটো টুল, টেবল, কাচের পাল্লার দেয়াল আলমারিতে রাখা সামগ্রী, টিভি সেট, টেপ রেকর্ডার, অজস্র ক্যাসেট, ভি সি আর সবই অদৃশ্য হয়েছে। কাঠের খাটটার জায়গায় রয়েছে লোহার খাট। হাসপাতালে যেমন দেখা যায়, মাথার ও পায়ের দিকে সারি দেওয়া সরু লোহার রেলিং। পুরোনো রবার ফোমের তোশকটা খাটে পাতা, তার উপর নতুন রঙিন চাদর। খাটটায় নতুন রং। সিলিং পাখা, আর পর্দাগুলো শিঞ্জিনী নিয়ে যায়নি। আর নিয়ে যায়নি টেলিফোনটা।

মালবিকা খাটে বসল। ঘরটাকে এখন বড়ো মনে হচ্ছে, ফাঁকা লাগছে। কাপড়ের মোড়ক আর হাতব্যাগটা পাশে রাখল। ঘরে চোখ বুলিয়ে তার মনে হল সমীরণ পাকাপাকি এখানে থাকবে না। হঠাৎ প্রয়োজনে এক রাত বা এক দিন থেকে যেতে হলে, থাকার কাজ চালানোর মতো ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। বসার ঘরের কোনো জিনিস বোধহয় সরানো হয়নি।

সমীরণ ঘরে ঢুকল। ব্যগ্র চোখে মালবিকা প্রথমেই বলল, ‘আমি চলে এসেছি, একেবারে।’

বিব্রত ভাবটা চট করে লুকিয়ে ফেলল সমীরণ। চিন্তিত স্বরে বলল, ‘না এলেই ভালো করতে। হাঙ্গামা বাধার ভয় আছে। শুনছি কাল বাংলা বনধ, কংগ্রেস বামফ্রন্ট দু—দলই ডেকেছে। ওরা আজই কিনা পার্ক সার্কাস গেল। …মুসলমান পাড়া, পাশেই বস্তি।’

অবশ হয়ে আসছে মালবিকার হাত—পা। ঠোঁট দুটো টেনে যে একটু হাসির ভাব ফোটাবে সে ক্ষমতাও যেন নেই। ‘তা হলে…তা হলে কি—’

‘তুমি এসেছ যখন থাকো। আমার সকাল থেকেই কেমন জ্বর জ্বর ভাব।’ সমীরণ এগিয়ে এসে মালবিকার দুই কাঁধ ধরে ঝুঁকে পড়ল চুমু খাবার জন্য। মুখে মদের গন্ধ। মালবিকা আকুলভাবে দু—হাতে গলা জড়িয়ে সমীরণের ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ঘষতে ঘষতে বলল, ‘আমাকে তুমি ছেড়ে যেয়ো না।…সমীরণ আমার সমীরণ। মরে যাব সমীরণ—’, সে কামড়ে ধরল সমীরণের দুই ঠোঁট। মুখের মধ্যে নিয়ে চুষতে লাগল।

‘উহহ।’ মালবিকাকে ধাক্কা দিয়ে সমীরণ পিছিয়ে গিয়ে বিরক্ত চোখে তাকাল। কর্কশ স্বরে বলল, ‘থাক এখন। পাশের ঘরে লোক রয়েছে।’ ঘর থেকে সে বেরিয়ে গেল।

সিঁড়ি দিয়ে একটি লোক দুড়দুড়িয়ে উঠে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘সমীরণদা, কাল বাংলা বনধ, বাজার—টাজার করে রাখুন। দিন আমায় টাকা দিন।’

‘বাজার তো আনবি, রাঁধবে কে?’

‘সে হয়ে যাবে, আমি এসে রেঁধে দোব।’

‘তোকে আর আসতে হবে না, লোক আছে আমার। চাল, ডাল, মাছ, আনাজ সবই ফ্রিজে আছে। একটা দিন হয়ে যাবে তুই বরং—’

শোবার ঘরে এল সমীরণ। পিছনে এক যুবক। মালবিকা খাটে হেলান দিয়ে একদৃষ্টে সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। সমীরণ ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ফিস ফিস করে বলল, ‘মাল প্রায় শেষ, আজ রাতের মতো শুধু আছে। তুই চট করে বড়ো দুটো বোতল এনে দে। দেরি করিসনি, দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। কী খাই জানিস তো?’

সে পকেট থেকে পার্স বার করে তিনটে একশো টাকার নোট যুবকটির হাতে দিয়ে আবার বসার ঘরে ফিরে গেল।

‘গৌরী, তোমরা আর দেরি কোরো না। বাচ্চচা মেয়ে সঙ্গে রয়েছে, শুনলে তো কাল বাংলা বনধ…সুবোধের কাছেই শেখো। কীর্তনটা ও ভালো জানে, যত্ন করে শেখায়ও।’

মালবিকা বসার ঘর থেকে সমীরণের কথা শুনতে পাচ্ছে। একটু আগের কর্কশ গলাটা বদলে গেছে। স্নেহে ভরা ঘর। কাঁধে জোরেই ধাক্কাটা দিয়েছে সমীরণ। ধাক্কাটার মধ্য দিয়ে বিরক্তি অনিচ্ছুক ভাব বেরিয়ে এসেছে। অভিমানে ছেয়ে যাচ্ছে মালবিকা।

সমীরণ শোবার ঘরে এল।

‘সবাইকে বিদেয় করা গেছে।’ দেয়াল আলমারি থেকে একটা বড়োমাপের বোতল বার করে সে চোখের সামনে ধরে দেখল কতটা আর বাকি আছে। একটা গ্লাসও বার করল। মালবিকা দেখতে পায়নি এগুলো আলমারিতেই ছিল। গ্লাসই রাখার মতো শক্ত জায়গা ঘরে নেই।

‘ধরো এটা।’ গ্লাসটা বাড়িয়ে দিতেই মালবিকা ধরল। ঢাকনা খুলে বোতলটা উপুড় করে ধরল গ্লাসে। আধ গ্লাস ভরল। ঢাকনাটা লাগিয়ে সমীরণ গ্লাসটা হাতে নিল।

‘জল এনে দোব।’

‘ধেত জল।’ বড়ো বড়ো দুটো ঢোঁকে সমীরণ অর্ধেকটা পেটে চালান করে চোখ বন্ধ করল। মুখটা বিকৃত হয়ে রয়েছে। মুখে রক্ত ছুটে আসায় চামড়ার রং বদলে যাচ্ছে।

‘জ্বরটা বোধহয় আবার বাড়বে।’

‘তা হলে খেয়ো না।’ মালবিকা গ্লাসটা নেবার জন্য হাত বাড়াল। সমীরণ হাত সরিয়ে নিয়ে আবার দুটি ঢোঁকে গ্লাস খালি করে দিল। খালি বোতল আর গ্লাস আলমারিতে রেখে সে খাটে বসল। পাশ বালিশটা টেনে কোলে তুলে নিয়ে, ঝুঁকে মালবিকার মুখের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। একটু একটু করে ঝিমিয়ে আসছে তার চাহনি।

মালবিকা যা আশা করেছিল তা ঘটল না। সে ভেবেছিল সমীরণ খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠবে। দু—হাতে বুকে জড়িয়ে ধরবে, তাকে নিয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়বে। আদরে আদরে বিধ্বস্ত করে দেবে। কিন্তু কোথায় কী? তার বাবার মতোই একটা মাতাল। ছাপোষা গেরস্ত। এর মধ্যে তার প্রেমিক সমীরণ কোথায়?

ফোন বেজে উঠল। মালবিকা উঠে ফোন ধরতে যেতেই হাত তুলল সমীরণ। ‘আমি ধরছি। ফোন তুমি ধরবে না।’

খাট থেকে নেমেই টলে গেল। সামলে নিয়ে সমীরণ রিসিভার তুলল।

‘হ্যালো, কে শিঞ্জিনী? কোথা থেকে ফোন করছ…অ। ওখানে অবস্থা কেমন? য়্যা গোলমাল হবার ভয় রয়েছে? শান্ত কোথায়? শিগগিরি ওকে ডেকে আনো। না না একতলার ফ্ল্যাটেও যাবে না, কোথাও যাবে না, ঘরে বসে থাকবে, বারান্দায় বেরোবে না।… হ্যাঁ হ্যাঁ, কিন্তু একতলার লোকেরা চলে যাবে কী করে, কাল তো বাংলা বনধ, গাড়ি চলবে না।…তুমিই বা এখানে আসবে কী করে?…ফ্ল্যাট কেনার সময় আমি কি জানতুম বাবরি মসজিদটাকে ভেঙে দেওয়া হবে? এখন আমাকে ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছ কেন, ইডিয়ট। তুমিই তো জেদ ধরেছিলে…গালাগাল আবার কী, এখনও তো মুখ খুলিনি। কিছু যদি ঘটে যায়, শান্তর যদি কিছু হয় তা হলে তোমাকে লাথি মেরে তাড়াব। সবই তো হাতিয়ে নিয়েছ। ছেলেকে আমি ছাড়ব না…আচ্ছা আচ্ছা দেখা যাবে। আমি মাগিবাজি করি কী ঠাকুরপুজো করি তাতে তোমার বাপের কী? যা বললুম, এখনই ওকে ঘরে নিয়ে এসো। ছটফটে ছেলে কখন রাস্তায় বেরিয়ে যাবে বলা যায় না। চোখে চোখে রাখবে। পরশু দিন ভোরেই ওকে নিয়ে চলে আসবে।’

রিসিভার রেখে সমীরণ ঘাড় নামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ দুটো রাগে জ্বলছে। অল্প টলছে। দু—পা এগিয়ে মালবিকার থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে দিল।

‘কাল তো কল্যাণী যাওয়া হবে না।’

‘জানি।’

‘এখনও রাত হয়নি। তুমি বাড়ি চলে যাও।’ স্বর বিকৃত জড়িয়ে যাওয়ার জন্য।

‘কী বলছ তুমি!’ মালবিকা উঠে দাঁড়াল।

‘ঠিকই বলছি। কাল বনধ। পরশু ভোরেই বউ ছেলে এসে যাবে। তখন কী হবে? য়্যা কী হবে? বড়ো খচ্চচর মাগি, আমাকে ছাড়বেও না আবার ছাড়ারও ভয় দেখায়।’

‘আমরা খুব ভোরে কল্যাণী চলে যাব।’ মরিয়া হয়ে মালবিকা বলল, ‘ওরা আসার আগেই চলে যাব।’

সমীরণ মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘হয় না। ভোরে আমার ঘুম ভাঙে না।’

‘আমি ভাঙিয়ে দোব।’

‘ধ্যাততেরি। জ্বরটা আবার বাড়ছে। …তুমিও তো দেখছি আর একটা শিঞ্জিনী।’

ফোন বেজে উঠল। সমীরণ চমকে উঠে মাথা ঝাঁকাল। ‘আবার কেন?’ বলে রিসিভার তুলল।

‘হ্যালো,…হ্যাঁ সমীরণ মিত্তির বলছি, আপনি কে …কী বললেন? জোরে বলুন…সুধাংশু গাঙ্গুলি? আরে মেসোমশাই! ….য়্যাঁ মালবিকাকে পাওয়া যাচ্ছে না? হারিয়ে গেছে?…অ, আপনার বাড়ি থেকে। তা আমাকে ফোন করছেন কেন, আমি কী ওকে হরণ করে নিয়ে এসেছি?’ সমীরণ আর দাঁড়াতে পারছে না, খাটে বসল। ‘মিহির বলল? শুয়োরের বাচ্চচার তো গাধার মতো গলা। ও বলল আর অমনি আপনি আমাকে ফোন করলেন! মেসোমশাই, আপনিও একটা শুয়োরের বাচ্চচা। মালবিকা কচিখুকি নয় যে বলামাত্র সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবে। আপনি বিনা প্রমাণেই আমাকে ক্রিমিনাল বানিয়ে দিলেন? এটা কী কোনো ভদ্দরলোকের, শিক্ষিত লোকের পক্ষে সম্ভব না শুয়োরের বাচ্চচার পক্ষে সম্ভব? বলুন, আপনিই? বিচার করুন। …আরে বাবা না না, মালবিকা অবলা বালিকা নয়, খুব বুদ্ধি ধরে। …আমি ওকে পটাব কী ওই আমায় পটিয়ে দেবে। আপনি যে সন্দেহটা করছেন তার কোনো কি যুক্তি আছে? ওকে ভাগিয়ে এনে আমি করবটা কী? শুধু যৌবন দিয়ে তো চিরকাল চলে না! দেখুন পাড়ার কোনো ছোকরার সঙ্গে সটকান দিয়েছে…আরে দূর, গানফান ওর দ্বারা হবে না। ফুটপাথে যেসব জলসা হয়, হিন্দি ফিল্মি গানার সঙ্গে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে মাইক হাতে নিয়ে, ওইসব গানেই ও নাম করতে পারবে। আপনি বরং পুলিশেই খবর দিন। …কী বললেন পুলিশ এখন এসব কেস নেবে না? …বাবরি মসজিদ? আরে মেসোমশাই ওই বাবরিই তো আপসেট করে দিল। কালকের বাংলা বনধটাও তা হলে হত না। কাল কাঁচরাপাড়ায় গান ছিল, কল্যাণী যাবার কথা ছিল। …না না বিশ্বাস করুন, লেখাপড়া করেনি। গানের ‘গ’ জানে না, আমি ওকে নিয়ে কী করব…খারাপ কথা আপনাকে বলেছি, আমাকে ক্ষমা করবেন, আপনার পায়ে ধরে মাপ চেয়ে নোব। মাসিমা ভালো—’

হাত বাড়িয়ে রিসিভার রেখে দিয়ে আপন মনে বলল, ‘শালা কেটে দিল।’ ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে টলে পড়ছিল। মালবিকার কাঁধ ধরে সামলে ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে গেল। যদি সে মালবিকার দিকে তাকাত তা হলে দেখতে পেত, অপমানে লজ্জায় আর নিজের নির্বুদ্ধিতা বুঝতে পারা কালো একটা নিথর মুখ। চোখের পলক পড়ছে না শুধু দু—চোখ বেয়ে জল ঝরছে।

যুবকটি দু—বোতল মদ নিয়ে আসতেই সমীরণ বলল, ‘খোল। দুটো গ্লাস আন।’

‘না না সমীরণদা আমি খাব না।’

‘যা বলছি কর। গ্লাস আন, রান্নাঘরে দেখ গিয়ে।’

আধঘণ্টা পর সমীরণ শোবার ঘরে এল। পাথর হয়ে গেছে তার শরীর। খাড়া অবস্থায় দাঁড়াল মালবিকার সামনে। তার চাহনিতে মৃত অভিব্যক্তি।

‘রান্না হয়েছে?’

মালবিকা শুধু তাকিয়ে রইল।

‘এটা কী? হাটাও, আমি শোব।’ সমীরণ শাড়িটা মেঝেয় ফেলে দিল।

‘নীচের দরজায় খিল দিয়ে এসো। করসেবকরা ঢুকে পড়ে যদি?…কথা কানে গেল না। লাথি খাবি?’

হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল মালবিকা। দাঁড়িয়ে উঠে দু—হাতে জড়িয়ে ধরল সমীরণকে।

‘আমি সত্যিই তোমায় ভালোবাসি, আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার কোরো না, আমার কষ্ট লাগছে। আমি তোমায় সত্যিই ভালোবাসি, ভালোবাসি। সমীরণ তুমি আমার, আমার।’

‘কে তোর? সমীরণ মিত্তির? আমি শালা কারুর নই, শুধু আমার ছেলের, শান্তর। ওকে চিনিস? সায়ন্তন মিত্তির, আমার দেওয়া নাম। তুই শালি কে? কী বললুম যেন, হ্যাঁ, সদর দরজায় খিল দিয়ায়। কাল বাড়ি চলে যাবি, বনধ তো কী হয়েছে, হেঁটে চলে যাবি।’

‘সমীরণ তুমি আমায় এইভাবে বললে? তোমার জন্য আমি কী কাজ করেছি তা কি তুমি জানো?’ মালবিকা হিংস্র চাপা গলায় বলল। ‘নিজেকে আজ সর্বনাশের মধ্যে টেনে এনেছি তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য।’

কথাগুলো বোধহয় সমীরণের কানে ঢুকল না। বিছানায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠে কোনোক্রমে বালিশটা মাথায় লাগিয়ে চিত হয়ে শুল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল।

মালবিকা একতলার দরজায় খিল দিয়ে এল। বসার ঘরের আলো নেভাল। বারান্দার আলো জ্বেলে রেখে শোবার ঘরের আলো নেভাল। জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে রাস্তার আলো ঘরে আসছে একটা লম্বা সাদা লাঠির মতো। সিঁড়ির আলো পড়ছে ঘরের দরজার কাছে। একটা আবছা অন্ধকার ঘরটায়। মালবিকা খাটের কোণে পা ঝুলিয়ে বসে। একদৃষ্টে সে তাকিয়ে আছে সমীরণের মুখের দিকে। মুখটা দেখা যাচ্ছে না। ভারী নিশ্বাসে বুকটা ওঠানামা করছে।

ভোর রাতে মালবিকা খাট থেকে নামল। আইবুড়ো ভাতের শাড়িটা নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে বাঁটিতে দু—টুকরো করল। আবার ঘরে ফিরে এল। কিছুক্ষণ সমীরণের নিথর শরীরটার দিকে তাকিয়ে রইল। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক। ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেছে।

আবার দু—চোখ বেয়ে জল নামল মালবিকার। গাল থেকে চিবুক পর্যন্ত জলের ধারা। শুধু একবার ফুঁপিয়ে উঠেই মুখটা কঠিন হয়ে গেল। সন্তর্পণে সে সমীরণের দুটি হাত মাথার দিকে তুলে নিয়ে শাড়ির একটা টুকরো দিয়ে খাটের রেলিংয়ে বাঁধল। পা দুটি জড়ো করে শাড়ির অন্য টুকরোটা দিয়ে বেঁধে সেটা রেলিংয়ে বাঁধল।

সমীরণ একটা ন্যাকড়ার পুতুলের মতো চিত হয়ে গভীর ঘুমে অচেতন। সে জানতেও পারল না কী ভয়ংকর অবস্থার দিকে সে চলেছে। মালবিকা পাশ—বালিশটা ওর মুখের ওপর রেখে বুকের উপর বসল সমীরণের দুই পাঁজরের পাশে দুই ঊরু রেখে এবং বালিশটা মুখে চেপে ধরল।

ছটফটিয়ে উঠল সমীরণ। হাত—পা বাঁধা। টানাটানি করার সঙ্গে তলপেটটা তোলানামা করতে লাগল। বালিশটার তলায় গোঁ গোঁ একটা শব্দ হচ্ছে। মুখটা ডাইনে বাঁয়ে নাড়াবার চেষ্টা চলছে।

একটা লোক মারা যাচ্ছে। মালবিকা অবাক হয়ে দেখছে। একটা লোককে সে নিজের হাতে মেরে ফেলছে। কিন্তু কেন?

মালবিকার হাতের চাপ আলগা হয়ে গেল।

কিন্তু কেন সে মারছে!

মালবিকা বালিশটা তুলে নিল। সে তো ঠিক করেছিল এই শাড়িটা গলায় বেঁধে পাখা থেকে ঝুলে পড়বে। তা হলে সে সিদ্ধান্তটা বদলাল কেন?

সে তো নিজেকেই শাস্তি দেবে বলে মরতে চেয়েছিল।

‘আমায় খুন করছ মালবিকা?’ ধীর শান্ত স্বরে সমীরণ বলল, যেটা প্রশ্ন নয়, অনেকটা বিবৃতি দেবার ধরন তার স্বরে।

বুকের উপর থেকে মালবিকা নামল। জানলায় গিয়ে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল। আবছা প্রভাতী আলোয়, ঠান্ডা মনোরম বাতাসে খুব সুন্দর একটা ভোর ফুটে উঠছে।

.

দু—মিনিট পর সদর দরজার খিল খুলে মালবিকা বেরিয়ে এল। দু—পাশে একবার তাকিয়ে দ্রুত পায়ে সে নিজেকে শাস্তি দেবার জন্য বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।

.

নির্দিষ্ট দিনেই মিহির ও মালবিকার বিয়ে হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *