বিজলিবালার মুক্তি

বিজলিবালার মুক্তি – উপন্যাস – মতি নন্দী

এক

দুদিন ধরে কখনো টিপটিপ কখনো ঝমঝম বৃষ্টি পড়ে চলেছে। উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে চৌধুরিদের রাধাবল্লভ ঠাকুরবাড়িতে রথযাত্রার উৎসব। মাহেশের রথের মতো নয় চূড়া বিশিষ্ট দু—মানুষ উঁচু কাঠের রথ। ফুলে পাতায় ব্যাটারিতে জ্বলা টুনির আলোয় নানারঙের রাংতায় মুড়ে সাজিয়ে রাস্তা দিয়ে টেনে এলাকায় ঘোরানো হয়। রথের সামনে ইউনিফর্ম পরা বালক সংঘের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা কুচকাওয়াজ করে ড্রাম বাঁশি করতাল বাজাতে বাজাতে যায়। তার পিছনে সাইকেলের চাকা লাগানো ছোট্ট টেবিলের একটা ঠেলাগাড়ি তার উপর রাখা হারমোনিয়াম। বাদকের পাশে নানা বয়সি সাত—আটজন গায়ক। ব্যান্ড বাদকরা বাজনা বন্ধ করে দাঁড়ায় যখন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গায়করা জগন্নাথদেবকে নিয়ে রচিত গান সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে। রথের দু—পাশে চামর হাতে শাড়িপরা দুটি কিশোরী হাঁটতে হাঁটতে যায়। কাঠের তৈরি প্রায় দেড় ফুট লম্বা জগন্নাথ সুভদ্রা বলরাম ত্রিতল রথের দ্বিতলে থাকেন ও চামরের বাতাস খান। প্রায় কুড়ি মিটার লম্বা শোভাযাত্রার সঙ্গে থাকে কার্বাইড গ্যাসের বাতি মাথায় চারটি মুটে।

উত্তর কলকাতায় চৌধুরিদের ঠাকুরবাড়ির রথযাত্রা চল্লিশ—পঞ্চাশ বছর আগে আরও জমকালো ছিল। বিজলিবালা হুগলি জেলার ভেনিয়াপুর গ্রাম থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে যখন প্রথম জয় দত্ত স্ট্রিটের শ্বশুরবাড়িতে আসেন তখন থেকেই শাশুড়ির সঙ্গে দেখতে যেতেন চৌধুরিদের রথযাত্রা উৎসব। সবার সঙ্গে রথের রশি ধরে প্রথম টান দিতেন। বছরের পর বছর এটা করে তাঁর অভ্যাস বা নিয়মে পরিণত হয়ে যায়। শাশুড়ি মারা যাবার পর স্বামী কৃষ্ণকিশোর তাকে সঙ্গে নিয়ে রশি টানতে যেতেন; স্বামী মারা যাবার পর তিনি একাই যেতেন। গত সাত বছর হল সঙ্গে থাকছে পদ্মমণি।

বিকেলে হঠাৎ টিপটিপানি বৃষ্টিটা ঝমঝমিয়ে উঠতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিজলি বললেন, ‘পদ্ম এবার আর বোধহয় রথ টানতে যাওয়া হল না।’

‘কেন হবে না মাসিমা। এখুনি বৃষ্টি ধরে যাবে, কাল থেকে এই রকমই তো চলছে।’ পদ্ম কথা বলতে বলতে বারান্দায় দড়িতে ঝোলানো কাপড় হাত দিয়ে টিপে বলল, ‘কাল থেকে মেলা এখনও ভিজে রয়েছে। মাসিমা রথের দিনে পাঁপড় তেলেভাজা এবার খাবে না? সব বছরই তো খাও।’

‘ওই যাঃ, একদম ভুলে গেছি। ঘরে তো পাঁপড় নেই, তুই ছাতাটা নিয়ে সাধুখাঁর দোকান থেকে সন্ধেবেলাতেই কিনে আনবি। রথের দিনে পাঁপড় খাওয়ার ইচ্ছেটা ছোটোবেলায় বাবার সঙ্গে মাহেশের রথ দেখতে গিয়ে মনের মধ্যে সেই যে ঢুকে গেল তারপর এই পঞ্চাশ বছরে দু—তিনবার ছাড়া সব বছরই মেনেছি।’

পদ্ম অবাক হয়ে বলল, ‘পঞ্চাশ বছর ধরে!’

‘বললুম তো দু—তিন বছর বাদ দিয়ে। শ্বশুর মারা গেলেন রথযাত্রার আগের দিন। অশৌচ, তখন কি পাঁপড় ভেজে খাওয়া যায়? আর একবার শাশুড়ির অম্বলশূলের ব্যথা উঠল। ছটফটাচ্ছেন, উনি ডাক্তার আনলেন। তিনি দেখেটেখে ওষুধ দিয়ে বললেন, ‘অপারেশন না করালে আবার হবে। বেলগেছের কারমাইকেল কলেজে ভরতি করাল ওর ছেলে। ডাক্তার পঞ্চানন বাঁড়ুজ্জে, মস্ত বড়ো ডাক্তার, অপারেশন করলেন। আর সেইদিনই রথযাত্রা, তখন তো আমি হাসপাতালে শাশুড়ির বেডের পাশে। আর একবার কেন যে পাঁপড় খাওয়া হল না এখন আর মনে পড়ছে না।’

‘মাসিমা তুমি মাহেশের রথ দেখেছ? আমাকে একবার তোমার জামাই বলেছিল নিয়ে গিয়ে দেখাবে। বলেছিল লক্ষ লক্ষ লোক হয় আর রাস্তার দু—ধারে দোকান বসে। রথটাও পেল্লায় উঁচু। ইয়া মোটা লম্বা রশি। সবাই হুড়োহুড়ি করে রশি একবার ধরে টানার জন্য। টানলে নাকি মরার পর স্বগ্গে যায়, সত্যি?’

বিজলি ঘাড় কাত করে বললেন, ‘সত্যি। এখনকার ছেলেমেয়েরা তো এসব বিশ্বাসই করে না। আমি যেবার যাই সেবার একটা বুড়ি রথের চাকার নীচে পড়ে যায় ঠেলাঠেলির চোটে। ইয়া চারতলা বাড়ির মতো লোহার রথ তেমনি ভারী একশো বছরেরও আগে সাহেব কোম্পানির তৈরি; বড়ো বড়ো বারোটা লোহার চাকা; দুটো তামার তৈরি ঘোড়া একটার রং নীল অন্যটার সাদা; দুটো কাঠের রাজহাঁস, রথের সারথি মানুষের মাপের কাঠের তৈরি। আর রশিটা এখান থেকে শেতলের মিষ্টির দোকান পর্যন্ত, দু—হাতের মুঠোর মধ্যে আমি ধরতে পারিনি এত মোটা!’

পদ্ম বলল, ‘বুড়িটার কী হল মাসিমা?’

‘যা হবার তাই হল, তক্ষুনি মরে গেল। সবাই বলল, ‘ভাগ্যবতী, জগন্নাথদেব ওকে নিজের কাছে টেনে নিলেন’, শুনে আমার মনের ভেতরে তখন কীরকম যেন একটা হল।’

উৎসুক স্বরে পদ্ম বলল, ‘রথের চাকার নীচে পড়ে তোমার মরার ইচ্ছে হল? আচ্ছা মাসিমা চৌধুরিদের রথের চাকার নীচে পড়ে গিয়ে মরলে মানুষ স্বগ্গে যাবে?’

শুনেই ভ্রু কুঁচকে উঠল বিজলির। চোখ সরু করে বললেন, ‘কেন তোর কি মরার ইচ্ছে হয়েছে? জামাইয়ের খবরটবর রাখিস?’

‘শুনেছি আর একটা মেয়ে হয়েছে।’

‘তা হলে তো ভালোই আছে। তোকে কে বলল মেয়ে হয়েছে?’

‘আরতির বর শ্যামল শালকেতে তুলোর দোকানে কাজ করে, মাঝেমধ্যে ওর সঙ্গে দেখা হয়। ওই বলেছে এবারও মেয়ে হল! শ্যামলের কাছ থেকে শুনে আরতি আমায় বলেছে। থাকগে মাসিমা ওসব কথা বাদ দিন, যার যা কপালে লেখা আছে তাই হবে।’ পদ্ম বারান্দার বাইরে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘বৃষ্টি ধরেছে, চলো বেরিয়ে পড়ি। ফেরার সময় পাঁপড় কিনে নোবখন।’

দোতলার ঘরে আর সিঁড়ির দরজায় তালা দিয়ে, দু—জনে একতলায় নামল। সিঁড়ির ডান দিকে টানা রক, সামনে ছোটো উঠোন। উঠোন পেরিয়ে সদর দরজা। রকের পাশে দুটো ঘর, শয়নের এবং রান্নার। ঘর ভাড়া নিয়ে আছে স্বামী স্ত্রী ও একবছরের একটি ছেলে। জ্যোতির্ময় হাবড়ায় একটি স্কুলের শিক্ষক, একহারা চেহারা, সুদর্শন যুবক, ঠান্ডা স্বভাব, কথাবার্তায় নম্র। হাসি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, স্বামীর বিপরীত স্বভাবের, দ্রুত কথা বলে, সর্বদাই হাসিখুশি, দেহের গড়ন কিঞ্চিৎ ভারী, দৈর্ঘ্যে সাধারণ বাঙালি মেয়ের থেকে খাটো। ভুটুর মুখখানি ও গায়ের রং মায়ের মতোই। স্বাস্থ্যবান শিশু। তার রান্না কালেভদ্রে শোনা যায়। হাসি চাকরি করে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে এক ট্রান্সপোর্ট এজেন্টের অফিসে।

একতলায় নেমে বিজলি বললেন, ‘দেখো তো পদ্ম হাসি ঘরের দরজায় ঠিকমতো তালাটা দিয়েছে কিনা, যা তড়বড়ে মেয়ে!’

পদ্ম দুটো ঘরের তালা ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, ‘দিয়েছে। কোথায় গেছে হাসিদি? তোমায় বলে গেছে?’

‘বলেছিল তো ডাক্তারের কাছে যাবে। বুকের এইখানে কী একটা অনেকদিন ধরে খচখচ করছে।’ বিজলি ডান দিকের স্তনে হাত দিলেন। ‘ভুটুকে সঙ্গে নিয়েই গেছে অপিস থেকে ফিরে।’

‘ছেলেটা বেশ নাদুসনুদুস, কল্পনা বলছিল বেশিক্ষণ কোলে রাখতে কষ্ট হয়।’

‘ষাট ষাট, বচ্ছরকার এমন দিনে তুই ওর শরীরে নজর দিলি, বালাই ষাট। নে চল।’ বিজলির বিরক্ত স্বরে পদ্ম কুঁচকে গেল।

‘আমি আবার নজর দিলুম কোথায়! ভালো কথা বললে যে নজর দেওয়া হয় আমি জানতুম না বাপু।’

সদর দরজার ভিতরের কড়ায় তালা ঝুলছে। সেটা চাবি দিয়ে খুলে দু—জনে বাইরে বেরিয়ে এল। দরজার বাইরের কড়ায় তালা লাগাতে লাগাতে পদ্ম বলল, ‘চাবি হাসিদির না দাদার কাছে রয়েছে?’

‘হাসির কাছেই তো থাকে, অপিস থেকে তো আগে ফেরে। জ্যোতির তো ফিরতে ফিরতে রাত সাতটা—আটটা হয়ে যায়। হাবড়া কি কম দূর? তার ওপর বনগাঁ লাইন, ট্রেনের গন্ডগোল তো লেগেই আছে। ছাতাটা খোল।’

জয় দত্ত স্ট্রিট খুব সরু গলি নয়। মুখোমুখি হলে দুটি রিকশা পাশ কাটিয়ে যেতে পারে। ওরা দু—জন একটা বাঁক ঘুরে চওড়া রাস্তা হরি মিত্র লেনে পৌঁছেই থমকে দাঁড়াল। কর্পোরেশনের মিস্ত্রিরা রাস্তা খুঁড়ে জলের পাইপ সারিয়ে ইট আর মাটি দিয়ে গর্ত বুজিয়েছে। জায়গাটা হয়ে আছে কচ্ছপের পিঠের মতো। বৃষ্টির ফলে মাটি পিচ্ছিল, একটা—দুটো ইটের মাথা মাটির উপরে উঠে রয়েছে। ঢিপিটার পাশের দেওয়ালে রাস্তার টিউব লাইটের, টিউবটা আছে আলো নেই। দূর থেকে রাস্তার আলো আবছা হয়ে পড়ে ঢিপিটা চকচক করছে।

‘পদ্ম সাবধান। ওই ধার দিয়ে ঘুরে চল। ঢিপির ওপর উঠেছিস কি হড়কেছিস।’

ছাতা হাতে নিয়ে বিজলি পা টিপে টিপে ঢিপির পাশ দিয়ে এগোলেন, পিছনে পদ্ম। এবার হরি মিত্র লেন ধরে দু—জনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ছাতার নীচে থেকে চলল চৌধুরিদের রাধাবল্লভ ঠাকুরবাড়ির উদ্দেশে। জোরে বৃষ্টি নামল সঙ্গে দমকা হাওয়া, জলের ঝাপটা থেকে বাঁচতে পদ্ম ছাতাটা বিজলির হাত থেকে নিয়ে সামনে ঝুঁকিয়ে বলল, ‘মাসিমা এই বৃষ্টিতে রথ চালাবে কী করে? সব তো ভিজে ঢোল হয়ে যাবে।’

‘রথের দিনে বৃষ্টি না হলে রথযাত্রা আবার কীসের! ঠিক বেরোবে রথ।’

ট্রাম রাস্তায় পৌঁছে ফুটপাথ দিয়ে মিনিট পাঁচেক হেঁটে ওরা ঠাকুরবাড়ির লোহার ফটকে পৌঁছোল। ভিতরের ছোটো উঠোনে রথ অপেক্ষা করছে। বিজলি প্রথমে হাত জোড় করে রথকে প্রণাম জানিয়ে খুচরো রেজগি ও নোট রাখার চামড়ার ছোটো মানিব্যাগটা পদ্মর হাতে দিয়ে চটি খুলে মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে উঠলেন। রাধা কৃষ্ণ যুগ্ম বিগ্রহের সামনে দাঁড়িয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলেন। মিনিট দুই পর প্রণাম করলেন গড় হয়ে।

ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যেই, রথের রশিতে টান পড়ল। ছাতা বন্ধ করে পদ্ম দাঁড়াল বিজলির পাশে রশি ধরার জন্য। বৃষ্টির জন্যই এবার লোকজন কম। অন্যান্য বার ঠেলাঠেলি হয় রথ টানার জন্য। উঠোন থেকে ফুটপাত সমতল। বিজলি রশি ধরলেন পদ্মও ধরল।

‘তুই চাকার দিকে কেন, আমার বাঁদিকে আয়।’ বিজলির স্বরে সন্দিগ্ধ ধমক। চৌধুরিদের রথের নীচে পড়ে পদ্মর স্বগ্গে যাওয়া যায় কিনা প্রশ্নটা এখন মনে পড়ায় তাঁর এই ধমক। তিনি রথের চাকার দিকে তাকালেন। মাহেশের মতো অত বড়ো নয়। এ চাকার নীচে পড়লে পদ্মর মতো বছর তিরিশের মেয়ে মরবে না, বড়োজোর হাত—পা ভাঙবে। তাঁর মতো বুড়িটুড়ি হলে আলাদা কথা। বিজলি মোটামুটি আশ্বস্ত হলেও পদ্মর বুদ্ধিশুদ্ধিতে বিশেষ আস্থা নেই। বিয়ের ছ—মাস কাটতে—না—কাটতেই স্বামীর ঘর ছেড়ে তাকে উড়েপাড়ার বস্তিতে তার মা মকরবালার কাছে ফিরে আসতে হয়। ‘রোজ মদ খেয়ে এসে গোরু পেটানোর মতো কী পেটান যে পেটায় না!’ বলেছিল পদ্ম।

ওর শীর্ণ শরীরে মারের দাগ দেখে বিজলি মনে মনে আহত হয়েছিলেন। তখুনি বলেছিলেন, ‘মাকে বল আমার কাজ ছেড়ে দিতে, বুড়ি হয়েছে এবার ঘরে বসে থাকুক। তুই থাকবি আমার কাছে, আর তোকে স্বামীর ঘর করতে হবে না। মকর এত কষ্ট করে হাড়মাস কালি করে টাকা জমিয়ে শেষে এমন একটা পশুর সঙ্গে কিনা মেয়ের বিয়ে দিল! ছি ছি ছি, ভালো করে আগে একটু খোঁজখবরও নিল না! ব্লাউজটা পরে নে।’ মারের দাগ দেখাবার জন্য পদ্ম ব্লাউজ খুলে ছিল। টেপা বোতাম লাগাতে লাগাতে পদ্ম হঠাৎ হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে, ‘মাসিমা আমি কালো কুচ্ছিত রোগা, ওকে আমি খুশি করতে পারি না, আমার পাছা নেই বুক নেই। আমার কী দোষ মাসিমা?’ পদ্ম জানতে চেয়েছিল।

বিজলি ওর মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়েছিলেন। পদ্মর নাকের মাঝখানটা কেউ যেন নোড়া দিয়ে থেঁতলে বসিয়ে দিয়েছে। সেজন্য ওর ডাকনাম বুঁচি। বিজলি ওকে নাকের কথা মনে না করানোর জন্য প্রথম থেকেই ডাকেন ভালো নামে। কপাল নেই, ভুরুর একটু ওপর থেকে শুরু হয়েছে ঘন কোঁকড়া চুল। বড়ো গোল চোখের মণি কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে। বিজলি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন পদ্ম কুরূপা।

‘মেয়েমানুষের বিচার হয় কি শুধু বাইরের রূপ যৌবন দিয়ে রে পদ্ম। গুণ বলে একটা জিনিস আছে। দয়া মায়া মমতা স্নেহ যার নেই রূপসি হয়েও সে সুন্দরী নয়। অন্তর সুন্দর না হলে সৌন্দর্য ফোটে না। তুই কষ্ট পাচ্ছিস কেন রে, অন্তরের মধ্যে তোর গুণের পদ্ম ফুটিয়ে তোল, দেখবি সবাই তোকে ভালোবাসবে। তাতেই তুই রূপসি হবি।’ পদ্মর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে স্নেহ মাখিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন বিজলি সাত বছর আগে। পরের মাস থেকেই পদ্ম দিনরাতের সঙ্গিনী হয়ে আছে বিজলির।

নামেই রথের রশি টানা। ওরা দু—জন ধরে একটু টান দিল মাত্র। আসলে টানল জনা পনেরো ছেলেবুড়ো। গড়গড়িয়ে রথ উঠোন থেকে ফুটপাতে। কাঠের পাটা পাতা ছিল তার উপর দিয়ে ফুটপাত থেকে ট্রাম রাস্তায় রথ নেমে গেল। বৃষ্টির মধ্যেই বালক সংঘের ব্যান্ড পার্টি বাজাতে শুরু করল। প্রতি বছরের মতোই হারমোনিয়াম, গ্যাসবাতি, টুনিবালব, চামর হাতে দুটি মেয়ে সঙ্গে নিয়ে শুরু হল জগন্নাথদেবের যাত্রা। বিজলি হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলেন। মিনিট তিনেক পর রথটি ডানদিকের রাস্তায় ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

‘পদ্ম একটা রিকশা ডাক আর হেঁটে যেতে পারব না, যা কাদা আর গর্ত!’

মন্দিরের ধারেই হুড আর পরদা ফেলে একটি রিকশায় উবু হয়ে বসে রিকশাওয়ালা। পদ্ম গিয়ে তার সঙ্গে হাত নেড়ে নেড়ে গন্তব্যস্থল বুঝিয়ে ফিরে এল বিজলির কাছে। ‘মাসিমা, বলল পনেরো টাকা নেবে।’

‘য়্যা, দু—মিনিটের রাস্তা পনেরো টাকা! বলিস কী?’

‘বিষ্টি পড়লে এই রেট, কী মেজাজ!’

‘চল তাই দোব, তবে বাড়ির দোরগোড়া পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে কিন্তু।’

রিকশায় উঠে বিজলি ফিসফিস করে বললেন, ‘পদ্ম এতো হাড় জিরজিরে বুড়ো, টানতে পারবে তো?’

‘খুব পারবে, দ্যাখো না।’

মাথায় গামছা জড়ানো রবারের পাম্পশু পরা শীর্ণদেহী রিকশাওয়ালা প্রথমে লম্বা পায়ে তারপর জগিং করার মতো ছুটতে শুরু করল। বিজলি বললেন, ‘আগে রিকশাওয়ালা খালি পায়ে থাকত। গরমে পিচের রাস্তায় পা রাখা যায় না তখনও দেখেছি খালি পায়ে ওরা রিকশা টানত। ভালোই হয়েছে জুতো পরছে, কী বল?’

‘জুতো, হাওয়াই চটি পরছে বলেই তো ভাড়া বাড়িয়েছে।’ পদ্ম বিজ্ঞের মতো বলল।

‘যা বলেছিস। বিয়ের পর প্রথম সিনেমা গেলুম হাতিবাগানে, উত্তম—সুচিত্রার তখনও এত নাম হয়নি, মনে আছে বইটার নাম সাড়ে চুয়াত্তর, তোর মেসোমশাইয়ের সঙ্গে নাইট শো—এ গেছলুম। ফেরার সময় উনি বললেন চলো রিকশা করে যাই। কত ভাড়া নিল জানিস? বারো আনা!’

বিজলি অবাক চোখে পদ্মর দিকে তাকালেন, ‘ভাবতে পারিস?’

‘কী জানি আমি তো তখন জন্মাইনি।’

রিকশা হরি মিত্র লেন ধরে জয় দত্ত স্ট্রিটের কাছাকাছি হতেই পদ্ম ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘বাঁয়ে গলিমে ঢুকেগা।’ তারপর স্বগতোক্তি করল, ‘রাস্তার আলোটা এত কম, গলিটা চেনা যায় না।’

‘বৃষ্টি পড়লে রাস্তার আলো কম কম লাগে।’ বিজলির কথা শেষ হওয়ামাত্রই ঘটে গেল ব্যাপারটা।

রিকশার চাকা ঢিপিতে ঘটাং শব্দ করে ধাক্কা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিকশাওয়ালার পা কর্দমাক্ত মাটিতে হড়কে গেল। সে মুখ থুবড়ে পড়ার সময় তার মুঠো থেকে টানার হাতল দুটি ছিটকে বেরিয়ে যাওয়ামাত্র রিকশাটা দুই সওয়ারির ভারে পিছন দিকে উলটে গিয়ে উলটানো ‘৯’কার বা ‘ৎ’—এর মতো হয়ে গেল। বিজলি ও পদ্ম বলাবাহুল্য উলটানো রিকশার তলায় চাপা পড়ে গেল।

‘বাবারে।’ বলে পদ্ম প্রথমেই আর্তনাদ করে উঠে চিৎকার করল ‘বাঁচাও বাঁচাও, মরে গেলুম।’

তালগোল পাকিয়ে পড়েছেন বিজলি, তার উপরে পদ্ম। তার চিৎকার শুনে পাশের দুটি বাড়ি থেকে কয়েকজন বেরিয়ে এল। পাড়ার নেতাজি তরুণদলের ঘরে কয়েকটি তরুণ ক্যারাম খেলছিল, তারা ছুটে এল চিৎকার শুনে। শীর্ণকায় রিকশাওয়ালা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে দুটি হাতল ধরে রিকশাটাকে সোজা করে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে। কাজটা করে দিল দুটি তরুণ হাতল দুটি ধরে টেনে নামিয়ে।

মাটির উপর জড়াজড়ি করে পড়েছিল ওরা দু—জন। পদ্ম নিজেই উঠে দাঁড়াল, তার ডান ভ্রুর উপরে কপাল থেকে রক্ত ঝরছে। বিজলি ওঠার চেষ্টা করে পারলেন না। তাঁর কাপড় হাঁটুর উপরে উঠে রয়েছে। পদ্ম দ্রুত নামিয়ে দিল কাপড়।

‘মাসিমা হাত ধরুন।’ বিজলির বাড়ানো হাত ধরে পদ্ম টেনে তোলার চেষ্টা করে পারল না। সে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের দিকে তাকাল।

‘সরো সরো, ঘণ্টু আয় তো দিদিমাকে তোল।’ পদ্মকে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে এল একটি যুবক, মাঝারি উচ্চচতা, বলিষ্ঠ গড়ন, তরুণদলের সচিব।

‘কে রে পলাশ! এই ডান পাটা বোধহয়—।’ বিজলি কথা শেষ করার আগেই দু—জন তাঁর বগল ধরে দাঁড় করাল। দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। পলাশ তাঁকে পাঁজাকোলা করে তুলে পাশের রোয়াকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল। ইতিমধ্যে জমে গেছে ভিড়।

রিকশাওয়ালা তখন দুটো থাপ্পড় খেয়ে হাত জোড় করে বোঝাচ্ছে, ‘আমার কী কসুর আছে বাবু। এই দেখুন জমিনের হাল আউর আলো ভি কমতি আছে। আমি তো দেখতেই পাইনি, দেখলে কি রিকশা এর উপর চড়হাতাম?’

‘ঠিকই তো বলেছে।’ লুঙ্গির কষি আঁটতে আঁটতে চেঁচিয়ে বললেন এক মধ্যবয়সি ‘আলো তো মাসখানেক ধরে নেই। এই ঢিপিটা তো এক হপ্তা ধরে এমন হয়ে রয়েছে! রাস্তা খুঁড়ে সমান করে পিচ দেওয়ার দায়িত্ব তো কর্পোরেশনের। এসব দেখাশোনার দায় তো কাউন্সিলরের। তিনি যদি দায়িত্ব পালন না করেন তা হলে তো অ্যাকসিডেন্ট হবেই। পাড়ায় ঘুরে ঘুরে হাত জোড় করে ভোট চাইবেন, এই করে দোব তাই করে দোব বলবেন, যেই জিতলেন আর তার টিকিটি দেখা গেল না।’

‘চল পলাশ, শক্তি মুখুজ্জেকে ধরে এনে দেখাই। এইখানে দাঁড়িয়ে ওকে কথা দিতে হবে তিন দিনের মধ্যে রাস্তা আলো ঠিকঠাক করে দেবে—না দিলে রাস্তা অবরোধ হবে।’ বলল ট্রাউজার্স—হাওয়াই শার্ট পরা সিদ্ধার্থ ওরফে ঘণ্টু।

‘আমাদের বস্তির টিউবকলটাও ওইসঙ্গে ঠিক করে দিতে বোলো।’ ভিড়ের মধ্যে এক স্ত্রীকণ্ঠে শোনা গেল।

‘অবরোধ টবরোধ পরে হবে ঘণ্টু’ পলাশের গলা ভারী কর্তৃত্বব্যঞ্জক। ‘আগে দিদিমাকে ডাক্তারখানায় নিয়ে চল, মনে হচ্ছে সিরিয়াস কিছু হয়েছে।’

রিকশাওয়ালা বুঝে গেছে এই দুর্ঘটনার পর ভাড়া চাওয়া উচিত হবে না। পনেরোটা টাকা মারা যাওয়ার দুঃখ চেপে সে রিকশা নিয়ে চলে যাচ্ছিল।

‘অ্যাই রিকশা যাতা কাঁহা? মাইজিকো তুলো। ডাক্তারখানামে লে চলো।’ পলাশ ধমকে উঠল। ‘অ্যাকসিডেন্ট তুম কিয়া অব ভাগ রাহে হ্যায়?’

রিকশাওয়ালা তটস্থ হয়ে ফিরে এল। বিজলি উঠে দাঁড়াতে পারল না। পদ্ম রিকশায় উঠে বসল। পলাশ আর ঘণ্টু ধরাধরি করে বিজলিকে রিকশায় তুলে বসিয়ে দিতে পদ্ম তাঁকে ধরে রাখল।

‘পদ্ম তোর মুখ তো রক্তে ভেসে যাচ্ছে রে, অ ঘণ্টু তোমার রুমাল টুমাল থাকে তো দাও না।’ রিকশার পাশে পাশে হাঁটছে চারটি ছেলে। বিজলির কথা শুনে একটি ছেলে খয়েরি রঙের একটা রুমাল দিল পদ্মর হাতে।

হরি মিত্র লেন যেখানে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে পড়েছে তার বাঁদিকের বাড়িতে সাধুখাঁর মুদির দোকান, শীতলার মিষ্টির দোকান আর সূর্য মেডিক্যাল হল, বড়ো ওষুধের দোকান। এখানে দু—বেলা চার জন ডাক্তার বসে পালা করে। ডানদিকে কাউন্টার ও কাচের শোকেস, বাঁদিকে প্লাইউডের দেওয়ালে ভাগ করা দুটো চেম্বার পরদা, ঝোলানো দরজা। চেম্বারের সামনে বেঞ্চে বসে জনা সাতেক চিকিৎসাপ্রার্থী নারী ও শিশু। তাদের সঙ্গের লোকেরা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে।

প্রায় চ্যাংদোলা করে বিজলিকে নিয়ে এল তিনটি ছেলে।

‘উঠুন উঠুন দিদিমাকে বসতে দিন।’ পলাশ বলামাত্র দু—জন স্ত্রীলোক তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। ওরা বেঞ্চে বসিয়ে দিল বিজলিকে। পরদা সরিয়ে ডানদিকের চেম্বারে ঢুকল পলাশ।

‘ডাক্তারবাবু রিকশা উলটে পড়ে গেছে দিদিমা। বোধহয় পা ভেঙেছে, বাইরে বসিয়েছি, আপনি এসে একটু দেখুন।’

অল্পবয়সি সুদর্শন ডাক্তারের সামনে বসে দু—জন স্ত্রীলোক, কোলে বাচ্চচা। পলাশকে দেখে ডাক্তার যেভাবে তাকাল তাতে বোঝা যায় সে পলাশকে চেনে।

‘আপনার দিদিমা?’

‘হ্যাঁ।’

রুগি ফেলে ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উবু হয়ে বসে বিজলির ডান পা আলতো করে হাতে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল। পলাশ তখন পদ্মকে দেখিয়ে দোকানের এক কর্মচারীকে বলল, ‘কপালটা পরিষ্কার করে ওষুধ টষুধ যা লাগে লাগিয়ে দিন।’

ডাক্তার জানালেন, ‘হাড় ভেঙেছে, অপারেশন করে জোড়া দিতে হবে, হাসপাতালে নিয়ে যান বা পাশের নার্সিংহোমেও যেতে পারেন। তবে পয়সা খরচের কথা যদি না ভাবেন তা হলে বলব হাসপাতালে না যাওয়াই ভালো।’

‘কী দিদিমা কোথায় যাবেন?’ পলাশ জিজ্ঞাসা করল হালকা সুরে। সন্ত্রস্ত হয়ে বিজলি বললেন, ‘না বাবা হাসপাতালে যাব না, যা সব শুনি! ওই নার্সিংহোমেই আমাকে নিয়ে চলো। বেশ যন্ত্রণা হচ্ছে।’

ডাক্তার যন্ত্রণার জন্য ট্যাবলেট লিখে দিল। দোকান থেকেই কিনে নিলেন বিজলি। পায়ে ব্যান্ডেজ করে ডাক্তার ঘড়ি দেখে বলল, ‘তাড়াতাড়ি নিয়ে যান, ওদের এক্সরে ইউনিট সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে।’

টাকার ব্যাগটা তখনও পদ্মর কাছে। ষাট টাকা নিয়ে বেরিয়ে ছিলেন বিজলি। ওষুধ আর ব্যান্ডেজের দাম মিটিয়ে দিয়ে পলাশের কাছে পদ্ম জানতে চাইল, ‘কত টাকা লাগবে দাদা নার্সিংহোমে?’

নিরস্ত করার ভঙ্গিতে হাত তুলে পলাশ বলল, ‘এখন ওসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না, পরে দিলেও চলবে।’ তারপর সে সঙ্গের ছেলেদের বলল, ‘দিদিমাকে নিয়ে তোরা লোটাস নার্সিংহোমের দোতলায় চলে যা। আমি গিয়ে কথাবার্তা বলে রাখছি।’

বিজলি হাতছানি দিয়ে পদ্মকে ডেকে ফিসফিস করে বললেন, ‘ঘরের চাবি তো তোর কাছে। আলমারির চাবি আছে শ্রীধরের সিংহাসনের তলায় বারকোশ ঢাকা খুঞ্চিপোশটার নীচে। সেটা নিয়ে আলমারি খুলে ওপরের তাকে গরম কাপড়ের পেছনে নীল কাপড়ের একটা থলি দেখবি। দু—হাজার টাকা আছে। নার্সিংহোম যেমন যেমন টাকা চাইবে দিয়ে দিবি।’

ওষুধের দোকান থেকে নার্সিংহোম তিরিশ মিটার দূরে। তিনটি ছেলে বিজলিকে বহন করে লোটাসের দোতলায় নিয়ে গেল, সঙ্গে পদ্ম। রিসেপশন কাউন্টারের মেয়েটির সঙ্গে তখন পলাশ কথা বলছিল। বিজলিকে চেয়ারে বসিয়ে রাখল, ‘দিদিমা আপনার ভাগ্যটা সত্যিই খারাপ। দশ মিনিট আগে এলে এক্সরে—টা করা যেত। যে করবে সে চলে গেছে।’

‘তা হলে বাড়ি ফিরে যেতে হবে, আবার কাল আসতে হবে!’ বিজলি হতাশ বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে রইলেন।

‘আমিও তাই ভাবলুম, ফিরে যাওয়া আবার আসা? তার থেকে বরং রাতটা এখানেই থেকে যান, ভাঙা পায়ের ধকলটা আর তা হলে নিতে হবে না। সেটাই বললুম দিদিমণিকে। বেড একটা খালি আছে। একটা রাত তো, কোনোরকমে কাটিয়ে দিন, পারবেন না?’

বিজলি একমুহূর্ত ভেবে নিয়ে বললেন, ‘পারব। তোমরা আমার জন্য যা করলে বাবা চিরকাল মনে রাখব। আর তোমাদের কষ্ট দোব না। আর বসে থাকতে পারছি না, একটু শুইয়ে দেবে?’

পলাশ ব্যস্ত হয়ে রিসেপশনিস্টকে বলল, ‘বেডটা কোথায় দেখিয়ে দিন, ওঁকে শুইয়ে দিই।’

ভিতরে একটি বড়ো ঘর। আটটি বেড। ঘরের পাশে দুটি ছোটো ঘর। কেবিন। বেশি টাকা দিয়ে যারা আলাদা থাকতে চায় তাদের জন্য। একটি কেবিন আজ বিকেলেই খালি হয়েছে। বিজলিকে সেখানে খাটে শুইয়ে দিল ছেলেরা।

‘যন্ত্রণা হচ্ছে খুব?’ পলাশ জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ বাবা।’

নার্সকে ডেকে পলাশ বলল, ‘ঘুমের ওষুধ কিছু থাকলে দিন, ঘুমিয়ে থেকে অন্তত রাতটায় রেহাই পান।’ তারপর বিজলিকে বলল, ‘দিদিমা রাতে কিছু খাবেনটাবেন তো নাকি উপোস দেবেন?’

‘উপোসই ভালো, এরকম জায়গায় কিছু মুখে তুলতে পারব না।’

পদ্ম বলল, ‘দুধটা গরম করে এনে দোব মাসিমা, খই আর চিনি দিয়ে?’

‘দরকার নেই, রাতে উপোস দেওয়া আমার অভ্যেস আছে। পদ্ম, যাবার সময় পাঁপড় কিনে নিয়ে যাবি। এদের খাওয়াবি তুইও খাবি। পলাশ তোমরা ক্লাবের ঘরে এখন থাকবে তো, পদ্ম পাঁপড় ভেজে দিয়ে আসবে, রথের দিনে একটু মুখে দিয়ো। পাঁপড় হাসিকেও দিতে ভুলিসনি।’

ওরা কেবিন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, বিজলি ডাকলেন পদ্মকে। ‘অনেকগুলো ছেলে, বেশি করে পাঁপড় কিনিস। পয়সা না কুলোলে আলমারি থেকে টাকা বার করে নিস। আর শোন সত্যর চায়ের দোকানে বলে দিস ছেলেদের যেন চা দিয়ে আসে। হাসিকে বলিস ভুটুর মুখে যেন একটু পাঁপড় দেয়, জগন্নাথের প্রসাদ বলে। চটিজোড়া ভিজে আমসত্ত্ব হয়ে গেছে, বারান্দার একধারে রাখবি। সকালে জলখাবার খেয়ে তবে আসবি, এখন যা।’

দুই

পরের দিন দুপুর গড়াতেই বিজলি বাড়ি ফিরলেন, ডান পায়ের পাতার অর্ধেকটা থেকে গোড়ালি মুড়ে উপর দিকে পায়ের ডিম পর্যন্ত সাদা প্লাস্টারে মোড়া। চারটি ছেলে ধরাধরি করে রিকশায় তুলে পদ্মর পাশে বসিয়ে দেয়। রিকশা জয় দত্ত স্ট্রিটের মুখে আসতেই পদ্ম চেঁচিয়ে হুঁশিয়ারি দেয়, ‘দেখে চালাও বাপু, সব্বোনেশে জায়গা ওই ঢিবিটা।’

কাল রাত থেকেই বৃষ্টি ধরে গেছে। ঘোলাটে মেঘের ফাঁক দিয়ে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে, রোদও এসে পড়েছে রাস্তায়, বাড়ির দেওয়ালে। বাড়ির দরজায় বিজলিকে রিকশা থেকে নামাল ছেলেরা। কড়া নাড়তে দরজা খুলল কল্পনা, কোলে ভুটু। ছেলেরাই দোতলায় তুলে নিয়ে গিয়ে বিজলিকে খাটে শুইয়ে দিল।

‘হ্যাঁ বাবা, কাল পাঁপড় খেয়েছিলে তো?’

ওরা একসঙ্গে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ দিদিমা। এক ঝুড়ি পাঁপড় দিয়ে গেছিল পদ্ম, তারপর সত্যদা চা পাঠিয়ে দেয়, আমরা এবার চললুম। পলাশদা বলেছে দরকার হলে ক্লাবে খবর দেবেন।’

‘দোব।’ বিজলির মুখে নিশ্চিন্তি। তৃপ্তির সঙ্গে স্নেহের হাসি ফুটে উঠল। তারপরই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ‘পদ্ম রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দেওয়া হয়নি, দৌড়ে যা।’

দুটো বালিশে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে বিজলি। মাথার পিছনে পশ্চিমের জানলা, তার পাশে আশি বছরের পুরোনো বার্মা সেগুনের বড়ো আলমারি আর দাঁড়—করানো কাঠের আলনা, তার পাশে আবার জানলা। উত্তরের দেওয়াল ঘেঁষে দু—হাত উঁচু চার হাত লম্বা একটা কাঠের বাক্স। তার উপর পাশাপাশি দুটি স্টিলের তোরঙ্গ। তার পাশের জানলা আকারে অন্য তিনটির থেকে ছোটো। এই জানলার পরেই শ্রীধরের সিংহাসন। পুজোর সরঞ্জাম ও বাসনপত্র একটা জলচৌকিতে এবং তার পাশে পুবের দেওয়াল। এই দেওয়ালের পিছনের ঘরটি রান্নার, যার দরজা বারান্দায়। খাটে বসে বিজলি সোজা তাকিয়ে পুবদিকের দরজা দিয়ে বারান্দার ও—মাথা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেন। দেখলেন ভুটুকে কোলে নিয়ে কল্পনা নীচের থেকে উঠে এল, তার পিছনে পদ্মর সঙ্গে পাশের বাড়ির একতলার ভাড়াটে বউ অলকা।

‘ছেলেগুলো ছিল তাই, দশ টাকার কম নেবে না বলছিল। ওরা ধমকে বলল পাঁচ টাকা নিবি তো নয়তো রিকশার চাকা ভেঙে দোব। এইটুকু রাস্তা বলে কিনা দশ টাকা! পা ভাঙা লোক বেকায়দায় পড়েছে দেখেছে তো অমনি ভাড়া বাড়িয়ে দিল!’ পদ্মর গজগজানি থামিয়ে দিলেন বিজলি।

‘আমি হলে দশ টাকাই দিতুম। কাল রিকশায় চড়ে বৃষ্টির মধ্যে অতটা এলুম, তাকে কি ভাড়া দিয়েছিস? রিকশা উলটে গেছিল কি ওর দোষে? বেচারা শুধু শুধু মার খেল।’

‘জেঠিমা কালকেই শুনেছি রিকশা উলটে আপনার পা ভেঙেছে, লোটাস নার্সিংহোমে গেছেন। ভাবলাম গিয়ে দেখে আসি। রাত হয়ে গেছে বৃষ্টিও তখন আবার নামল। আর যাওয়া হল না।’ অলকার গলায় যেন কৈফিয়তের সুর। ‘সকালে জানেনই তো আমার স্কুল।’ অলকা দুই সন্তানের মা, হাওড়ার কদমতলায় এক প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। ভোরবেলায় তাকে বাড়ি থেকে বেরোতে হয়।

‘ও পদ্মদি, পদ্মদি ঠাকুমা ফিরে এসেছে?’

পাশের বাড়ি থেকে মেয়ে গলার ডাক শুনে পদ্ম জানলার কাছে গেল। সালোয়ার কামিজ পরা এক কিশোরী বারান্দায় ঝুঁকে রয়েছে। পদ্মকে দেখে বলল, ‘ঠাকুমা ফিরেছে বলল সিধুর মা, পা নাকি দু—টুকরো হয়ে গেছিল, অপারেশন করে জুড়ে দিয়েছে। এখন কেমন আছে?’

‘এখন লাফাচ্ছে।’

‘যাহহ, ঠাট্টা করছ।’

‘ঠাট্টা! রিকশা থেকে নেমে গট গট করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল। তুমি সিধুর মাকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখো, ও নিজের চোখে দেখেছে। বিশ্বাস না হয় তো নিজে এসে দেখে যাও।’

বিজলি শুনে হাসছিলেন। দু—হাত বাড়িয়ে দিলেন ভুটুর দিকে, ‘ওকে দে আমার কাছে।’ ভুটুকে কোলে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাল পাঁপড় খেয়েছ তো সোনা?’

‘মাসিমা কেউ খায়নি।’ কল্পনা বলল, ‘ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে এসে বউদি তো শুয়ে পড়ল। দাদা ফিরতে দু—জনে কথা বলতে বলতে কীরকম যেন গম্ভীর হয়ে গেল। বউদি বলল কিছুই খাব না দাদাও বলল খিদে নেই পাঁপড়গুলো তুমি খেয়ে নাও। অত পাঁপড় আমি খাব কী করে! বাড়িতে নিয়ে গেলুম।’

বিজলি অবাক হয়ে বললেন, ‘কী এমন হল যে পাঁপড় খেল না?’

‘রাতেও কেউ খায়নি, খাবার যেমন ঢাকা দেওয়া ছিল তেমনই পড়ে ছিল সকালে। গরম করে দিলুম দাদা তাই খেয়ে বেরিয়েছে। বউদি অপিস যায়নি, খায়ওনি।’

‘হাসি কোথায়?’ বিজলি উদবিগ্ন স্বরে বললেন।

‘বিছানায়।’

‘যা ওকে বল আমি ডাকছি।’

কল্পনা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর অলকা ইতস্তত করে বলল, ‘জেঠিমা কী ব্যাপার বলুন তো! ডাক্তার দেখিয়ে এসেই হাসি অমন শুয়ে পড়ল, খেলোদেলোও না! অমন চনমনে উচ্ছল মেয়ে, যার মুখে সর্বদা হাসি লেগেই থাকে সে এমন করল কেন, সিরিয়াস কিছু হয়েছে বোধহয়।’

বিজলির গলার সরু সোনার চেনটা ধরে ভুটু টানাটানি করছে। চেনটা ওর মুঠো থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বিজলি বললেন, ‘আসুক, দেখি কী বলল ডাক্তার।’

হাসির বদলে এল অনুলেখা, পাশের বাড়ির কিশোরী। অলকার বাড়িওয়ালার মেয়ে।

‘ঠাকুমা তুমি নাকি লাফাচ্ছ?’ অনুলেখা আলতো করে আঙুল ছোঁয়াল বিজলির প্লাস্টারে, ‘ব্যথা লাগে?’

‘লাফিয়ে দেখাব তোকে?’

‘না না ওসব করতে যেয়ো না। যখন শুনলুম রিকশা উলটে ডিগবাজি খেয়ে পড়েছ তখন মনে হল ইসস এমন একটা সিন দেখা হল না। আমি বাবা আর জীবনে রিকশায় চড়ব না।’ বলেই অনুলেখা হেসে উঠল।

অলকা গম্ভীর স্বরে বলল, ‘অনু এটা হাসির ব্যাপার নয়। মনে রেখো একজন বুড়োমানুষ দুর্ঘটনায় পড়ে পা ভেঙেছেন আর তুমি বিশ্বাস করতে পারলে কী করে জেঠিমা লাফাচ্ছেন? হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছ কলেজে ভরতি হয়েছ, এখন একটু বুঝে শুনে কথা বলো।’

‘পদ্মদি ঠাট্টা করল তাই আমিও পালটা দিলুম। আর আহা উহু করে চোখের জল ফেললে কি ঠাকুমার পা ভালো হয়ে যাবে না ব্যথা দূর হবে? যদি হয় তা হলে এখুনি এক বালতি চোখের জল বার করে দেব।’ অনুলেখার গলায় ঝাঁঝ ফুটল।

‘হয়েছে হয়েছে, একবার উঠে দাঁড়াই তারপর দেখাব হনুমানের লাফ। আমার ছাদ থেকে অনুদের ছাদে লাফিয়ে পড়ব। তারপর ওকে নিয়ে রিকশায় চড়ে গঙ্গায় চান করতে যাব। যাবি তো?’

‘জেঠিমা কবে প্লাস্টার কাটবে?’ অলকা বলল পরিবেশটা বদলাবার জন্য।

‘বলেছে তো একমাস নড়াচড়া নয়। পায়ে কোনোরকম চাপ পড়ে এমন কিছু করা নয় তার মানে ডান পায়ে ভর দিয়ে কিছু করা চলবে না।’

‘তার মানে ঠাকুমার হাঁটা চলা বন্ধ। শুয়ে শুয়ে এবার কড়িকাঠ গোনো। আচ্ছা তুমি তো বারান্দায় চেয়ারে বসে রাস্তার লোকজন দেখতে পারো। বেস্ট হয় এবার যদি একটা টিভি কিনে ফ্যালো। এইভাবে পা ছড়িয়ে বসে হাতে রিমোট কন্ট্রোলটা নিয়ে পর পর শুধু হিন্দি বাংলা সিরিয়াল দেখে যাবে।’

‘রক্ষে কর, সিরিয়ালে আমার দরকার নেই, টিভি দেখতে হয় তোরা দ্যাখ। রাধুকে দেখতে গিয়ে একদিন ওর ঘরে বসে টিভি দেখলুম। হিন্দি একটা সিনেমা হচ্ছিল। সে কী বেলেল্লা নাচ একঝাঁক ছেলেমেয়ের। রাধুকে বললুম তুমি এই সব বসে বসে দ্যাখো? বলেই কিন্তু মনে হল, বেচারা আর করবেই বা কী? ও এমনভাবে তাকিয়ে রইল যে আমার বুকে মোচড় দিল।’

রাধু অর্থাৎ রাধাকিঙ্করী সামনের বাড়ির বউ, বিজলির থেকে বছর পনেরোর ছোটো। আট বছর আগে এক পাওয়ার কাট হওয়ার রাত্রে রাধাকিঙ্করী দোতলার সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে একতলায়। আশপাশের বাড়ির অনেকের ধারণা বা দৃঢ় বিশ্বাস শঙ্কর চাটুজ্যে বউকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। উদ্দেশ্য আবার বিয়ে করা। রাধাকিঙ্করী মরেনি তবে মরলেই ভালো হত। ওর শিরদাঁড়ার মাঝখানটা ভেঙে যায় এবং স্নায়ুকেন্দ্রে যে আঘাত লাগে তাতে তার নিম্নাঙ্গ সাড় হারায়, জিহ্বারও কথা বলার ক্ষমতা নষ্ট হয় প্রায় পঞ্চাশ ভাগ। তার জড়ানো অস্পষ্ট কথা শুধু বুঝতে পারে বাড়ির দু—তিনজন আর বিজলিবালা।

শঙ্কর চাটুজ্যে পঙ্গু বউয়ের পরিচর্যার জন্য দিনরাতের এক দাসী রেখেছে। মধ্য ত্রিশের বিধবা দুই সন্তানের মা অন্নপূর্ণা বা অন্ন দুর্ভাগ্যক্রমে প্রখর যৌবনা, বুদ্ধিমতী এবং সুশ্রী। অতএব আশপাশের বাড়ি দ্রুত এই সিদ্ধান্তে আসে অন্নপূর্ণা দিনে গৃহিণীর সেবায় নিয়োজিত থাকে রাত্রে গৃহস্বামীর। শঙ্কর চাটুজ্যে সফল ব্যবসায়ী, চার পুরুষ এই পাড়ায় বসবাস করছে। একটি মোটরগাড়ি এবং দুটি ঘরে এয়ারকুলার ও টিভি আছে। ব্যবসার কাজে ভারতের নানান শহরে যেতে হয়। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন নিউ জার্সিতে কর্মরত সফটওয়্যার পারদর্শী বর্ধমানের ছেলের সঙ্গে। বিয়েতে তিনি জয় দত্ত স্ট্রিটের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে নিমন্ত্রণ করেন। মেয়ের বিয়ের পরের বছরই রাধাকিঙ্করী পঙ্গু হয়। গত আট বছর শুধু বিজলিবালাই তাঁর এই পঙ্গু বান্ধবীকে নিয়মিত দেখতে যান, যথাসাধ্য কথা বলার ও শোনার চেষ্টা করেন। রাধাকিঙ্করী হুইলচেয়ারে বসে থাকে, অন্নপূর্ণা টিভি চালিয়ে দেয়। সে বসে দেখে এবং শুধু চোখ মারফত বুঝিয়ে দেয় তার ভালো লাগা মন্দ লাগা।

‘ক—টা দিন তো পা ছড়িয়ে বসে থাকব তারপর আগের মতো যে কে সেই। রাধুর মতো পঙ্গু হলে নয় টিভি কেনার কথা ভাবব। এই দ্যাখো, কল্পনা সেই যে হাসিকে বলতে গেল তো গেলই। পদ্ম ভুটুকে দুটো এলাচদানা দে।’

শ্রীধরের কাঠের সিংহাসনের পাশে একটা দু—হাত উঁচু আলমারি তার মধ্যে শিশি বোতল ঠাকুরের বাসন বিছানা রাখা। পদ্ম হরলিকসের বোতল থেকে এলাচদানা বার করল। বিজলি কোল থেকে ভুটুকে মেঝেয় নামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যা, মাসির কাছে যা।’

ভুটু টলতে টলতে দু—পা এগিয়েই সামনে ঝুঁকে পড়ল। দু—হাত মেঝেয় রেখে দ্রুত হামা দিয়ে এগোল।

‘ধর ধর পদ্ম, নারায়ণ শিলায় হাত দেবে। সেদিন ওকে কোলে নিয়ে শিবের মাথায় ফুল বেলপাতা দিচ্ছি নজরটা একটু সরিয়েছি, ওম্মা খপ করে নারায়ণকে তুলেই মুখে, শিলাটা ভাগ্যিস বড়ো নইলে মুখে ঢুকে গেলে কী কাণ্ডটাই যে হত!’ বিজলি শিউরে উঠলেন। ‘ব্যাটা বড়ো হয়ে পুরুত হবে, চক্রবর্তীর ব্যাটা তো!’

‘ঠাকুমা তোমার নারায়ণ শিলা ভুটু এঁটো করে দিল?’ অনুলেখা তির্যক স্বরে বলল। ‘আর আমি যদি হাত দিই অমনি হাঁ হাঁ করে উঠে বলবে, ছুঁয়ে দিলি নারায়ণকে?’

‘কে বলেছে তোকে আমি বলব?’ বিজলি বললেন তীক্ষ্ন স্বরে। ‘তুই তো কায়েতের মেয়ে, চামার মেথর নোস। আমাকে ভাবিস কী তুই?’

অনুর নাম ধরে পাশের বাড়ি থেকে চিৎকার ভেসে এল। ব্যস্ত হয়ে অনু বলল, যাই ঠাকুমা। মা—র চেল্লানি থামিয়ে আসি।’

অনুলেখা বেরিয়ে যাবার পর অলকা বলল, ‘মাস্টারমশাই পড়াতে এসেছেন। উঠতে বসতে গঞ্জনা দেয় ওকে, কেন সাতশোর ওপর নম্বর উঠল না! চার চার জন প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়েও কেন তিনটের বেশি লেটার পেলি না বলে বাবা—মা শুধু মারতে বাকি রাখে। জেঠিমা, অনু দিনে ছ—সাত ঘণ্টা পড়ত, খাটিয়ে মেয়ে, কিন্তু শুধু খাটুনিতে কি দশ—কুড়ি জনের মধ্যে আসা যায়, মাথাটাও তো থাকা দরকার। ওর পড়ায় ব্যাঘাত হবে বলে টিভি পর্যন্ত কেনেনি। এই দেখুন না এখনও কলেজের ক্লাস শুরুই হয়নি, বাড়িতে মাস্টারের কাছে পড়া শুরু হয়ে গেছে।’

‘অনু কিন্তু বুদ্ধিমতী মেয়ে। ছোটো থেকে ঠিকমতো মানুষ করলে ও অনেক ভালো নম্বর করত।’ বিজলির স্বরে স্নেহ ও খেদ। মেয়েটার কথাবার্তা তাঁর ভালো লাগে, ওর চাপল্যে মজা পান।

‘ঠিকই বলেছেন জেঠিমা। বাবামা—ই যদি অশিক্ষিত হয়, উঠতে বসতে যদি বিধিনিষেধের বেড়ি পরিয়ে রাখে আর দিনরাত কানের কাছে যদি মন্ত্র জপে ‘রেজাল্ট চাই রেজাল্ট চাই, পড় পড়’ তা হলে যা হবার তাই হয়েছে অনুর। প্রায় সাতশো নম্বরেও ওরা খুশি নয়।’

‘বউমা অনুর বাবা মাকে অশিক্ষিত বলছ কী, ওরা দু—জনেই গ্র্যাজুয়েট!’

‘জানি জেঠিমা। কেন মেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে সেটাই তো ওরা জানে না। একদিন কথায় কথায় ওর মা বলেছিল মেয়েকে কম্প্যুটার সায়ান্স পড়াবে, কুড়ি—পঁচিশ হাজার টাকার চাকরি বাঁধা। এটাই হল ওদের লেখাপড়া শেখাবার লক্ষ্য, একটা সম্পূর্ণ মানুষ গড়ে তোলার কথা ওরা ভাবে না, ওদের অশিক্ষিত বলব না তো কাকে বলব?’

বিজলি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন তখনই হাসি এল। তার পোশাক দেখেই বোঝা যায় বাইরে কোথাও যাবে।

‘মাসিমা এসেছেন অথচ একতলা থেকে উঠে এসে একবার দেখা পর্যন্ত করতে এলুম না, নিজেকে কী যে অপরাধী লাগছে। আসলে কাল ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর থেকে মনটা এত খারাপ হয়ে গেছিল যে বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা ছিল না।’ হাসি ক্ষীণ ভাবে হাসল। ‘বলুন এখন কেমন আছেন?’

হাসির প্রশ্নটা অগ্রাহ্য করে বিজলি শঙ্কিত গলায় বললেন, ‘ডাক্তার খারাপ কিছু বলেছেন নাকি?’

‘না না খারাপ কিছু নয়। বললেন এক্স রে করাতে, এখন সেটাই করাতে যাব।’ হাসির উত্তরটা প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার মতো। বিজলি বুঝলেন কিছু একটা চেপে যাচ্ছে হাসি। তিনি আর কিছু জিজ্ঞাসা না করে বললেন, ‘কাল বেস্পতিবার আমি তো নড়াচড়া করতে পারব না। তুমি সন্ধেবেলায়লক্ষ্মীপুজোটা করে দিতে পারবে? পুজো মানে পাঁচালিটা পড়া; আমার গরদের কাপড় রয়েছে পরে নেবে, শাঁখটা পদ্মই বাজাবে। আমি সব বলে বলে দেব। তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।’

‘মাসিমা আমি কিন্তু কখনো পাঁচালি পড়িনি, আর কাউকে বলুন না।’ হাসি সংকুচিত হয়ে বলল।

‘এ বাড়িতে আর কে আছে বল যাকে দিয়ে পুজো করাতে পারি? তুমি বামুন, উঁচু জাত, পদ্মকে দিয়ে তো করাতে পারব না আর পাঁচালিও পড়তে পারবে না। দেখি আর কে সময় দিতে পারবে, কাউকে না পেলে পুজো বন্ধ রাখতে হবে।’ বিজলির চোখে হতাশা, কণ্ঠস্বরে বেদনা।

‘আমি কাল সন্ধেবেলায় আসব মাসিমা। এখন যাই।’ হাতঘড়ি দেখে হাসি উঠে দাঁড়াল, ভুটু দু—হাত বাড়াল মায়ের দিকে। ছেলেকে কোলে নিয়ে হাসি বলল, ‘এখন কিছুক্ষণ ঠাম্মার কাছে থাকো, আমি ফিরে এসে নিয়ে যাব। কল্পনা লক্ষ রাখিস কিছুতে হাতটাত যেন না দেয়।’ অলকার দিকে তাকিয়ে মাথা হেলিয়ে হেসে বেরিয়ে গেল হাসি।

ভুটু কান্না জুড়ল মা চলে যেতেই। বিজলি বললেন, ‘কল্পনা ওকে নিয়ে ছাদে যা। একটু ঘোরাঘুরি করে ভুলিয়ে রাখ।’

কল্পনা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর অলকা বলল, ‘জেঠিমা বিছানায় একা একা এ ভাবে থাকতে হলে তো আপনিও বোর ফিল করবেন।’

‘তা একটু করব, ওই পদ্মর সঙ্গে কথা বলে যতটা পারি সময় কাটাব, ভুটু আছে, ওর মা হাসি আছে। ওর বাবা জ্যোতিকে অবশ্য চোখে দেখি না ছুটির দিন ছাড়া। স্কুলে বেরোয় আটটায়, উলটোডাঙা থেকে ট্রেন ধরে হাবড়ায় পৌঁছোয় পৌনে দশটায়, ছুটির পর ওখানেই একটা বাড়িতে গিয়ে পড়ায় হপ্তায় একদিন করে ছ—টা ছেলেমেয়েকে, সায়েন্সের মাস্টার, খুব যত্ন করে পড়ায় তাই টানাটানি ওকে নিয়ে। হাসির কিন্তু প্রচণ্ড আপত্তি। একেই জ্যোতির দুবলা শরীর, খাওয়াদাওয়া একদমই হয় না, সারা দিনে একফোঁটা বিশ্রাম নেই। সেই সকালে বাজার করে এসে নাকে মুখে দুটো গুঁজেই বেরিয়ে গিয়ে রাত ন—টা—সাড়ে ন—টায় বাড়ি ফেরা—এতে কি শরীর থাকে? হাসি একদিন বলছিল, একটা লোক ঘুম থেকে উঠে টানা চোদ্দো ঘণ্টা যদি বসে আর দাঁড়িয়ে কাটায় আধপেটা থাকে তা হলে সে তো যে—কোনো দিন কঠিন অসুখে পড়ে যাবে। হাসি বলে বলে ওর টিউশনি করা বন্ধ করেছিল, ভুটু হবার পর আবার ধরেছে। ছেলের খাওয়া পরা, ছেলেকে ধরার জন্য লোক রাখার খরচ মেটাতে নাকি টাকার দরকার!’

অলকা বলল, ‘হাসিও তো চাকরি করছে, তা হলে?’

‘মাইনে খুব কম, আড়াই হাজার টাকা মাত্র। ওইটুকু ছেলেকে ফেলে রেখে তোমার দরকার কী বাপু চাকরি করার, একথা বলতেই বলল, লেখাপড়া শিখে ঘরে বসে থাকব আর স্বামী মুখের রক্ত তুলে উদয়াস্ত খেটে সংসার চালাবার জন্য টাকা রোজগার করবে তাই কখনো হয়?’

অলকা বলল, ‘আমার পড়াতে যাওয়া নিয়ে শ্বশুর—শাশুড়ি দু—জনেরই আপত্তি ছিল তবে অন্য কারণে। ঘরের বউ চাকরি করবে এটা নাকি লজ্জার ব্যাপার, পরিবারের মাথা হেঁট হয়। উনি কিন্তু বাবামা—র আপত্তি গ্রাহ্য করেননি, আমাকে বলেন করো চাকরি। ক—টা মাস মন কষাকষি চললে তারপর ঠিক হয়ে যায়। জেঠিমা আমি কিন্তু ইচ্ছে করলেই টিউশানি করতে পারতাম, করিনি। ওই সময়টা, আমার মনে হল ক—টা টাকা পাওয়ার বদলে বাচ্চচু আর মিঠুকে দিলে অনেক বেশি লাভ করব।’

‘খুব ভালো করেছ বউমা, বাপমায়ের কাছে ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের থেকে বড়ো ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। হাসির কথা শুনেও মনে হয় হাসি চাকরি করে ঠিকই করেছে, স্বামীর ভালোমন্দও তো বউয়ের দেখা উচিত। এখন ভাবি আমার অল্পবয়সে তোমাদের মতন এমন করে চিন্তা করার কোনো সুযোগই ছিল না। থাকলে সেকেন্ড ক্লাস পর্যন্ত না পড়ে আরও পড়তুম।’

অলকা বলল, ‘আপনি তো সময় কাটাবার জন্য বইটই পড়তে পারেন।’

‘পারিই তো। একসময় খুব পড়তুম। উনি কিনে দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্রের বই। বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী। শরৎবাবুর লেখা কী ভালো যে লাগত। ‘দত্তা’ চার বার—পাঁচ বার পড়েছি। আবার পেলে আবার পড়ব। বছর দশেক আগে ঘরে উই লাগল। একশো বছরের পুরোনো বাড়ি তো, দেওয়ালে ড্যাম্প। সব বই উইয়ে খেয়ে ফেলল,’ বিজলি ফিকে হাসলেন। চোখ তুলে মোটা মোটা কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওই দ্যাখো এখনও দাগ রয়েছে উইয়ের বাসার।’

অলকা মুখ তুলে কড়িকাঠ দেখে নিয়ে বলল, ‘আমার কাছে বিভূতিভূষণের বই আছে। আপনাকে দিয়ে যাব, পড়ে দেখুন ভালো লাগবে। জেঠিমা এখন চলি, যখন যা দরকার হবে বলবেন।’

‘আর দরকার।’ বিজলি দীর্ঘশ্বাসের মতো করে বললেন। ‘আমার আবার দরকার কী, বিছানায় এইভাবে যাকে কাটাতে হবে তার কিছুর কি আর দরকার হয়? পদ্মই এখন আমার চোখকান, হাত পা। ওর দয়া নিয়ে এখন আমায় বাঁচতে হবে।’ বলে মিটিমিটি হেসে পদ্মর দিকে বিজলি তাকালেন।

‘কী যে বলেন মাসিমা।’ লজ্জা ও পুলকে জর্জরিত পদ্ম আদুরে স্বরে ধমক দিল।

অলকা চলে যাবার পর পদ্ম বলল, ‘মাসিমা তখন বললেন পুজো করে দেবার জন্য হাসিদি ছাড়া আর বলার মতো কেউ নেই। কেন অলকা বউদিই তো রয়েছে, ওকে বললেই তো পারতেন। বউদি খুব ভালো লোক, আপনি বললে না করবেন না।’

বিজলি মাথা নেড়ে বললেন, ‘নারে পদ্ম ওকে পুজো করতে বলা যায় না, অলকারা ব্রাম্মো।’

পদ্ম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, ‘বামুন তো! তবে?’

‘বামুন বামুন ব্রাহ্মণ নয়রে ব্রাম—হো। ওরা ঠাকুর দেবতা মানে না, পুজোআচ্চচা করে না, ওদের ধর্ম আমাদের মতো নয়। ওদের বিয়েতে হোম যজ্ঞটজ্ঞ হয় না, পিণ্ডি দেয় না শ্রাদ্ধে। এবার বুঝলি কেন ওকে বলিনি।’

‘বউদির কথাবার্তা চলনবলন তো আমাদের মতো!’ পদ্মর বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি। ‘পুজোর সময় তো নতুন শাড়ি পরে ঠাকুর দেখতে বেরোয়, তা হলে?’

‘ঠাকুর দেখতে বেরোয় কিন্তু প্রতিমা নমস্কার করে কি? অলকা সিঁদুর দেয় না শাঁখা পরে না সেটা লক্ষ করেছিস?’

‘শাখা নোয়া তো কত এয়োই পরে না, সিঁদুরও দেয় না।’ পদ্ম ক্ষীণ একটা তর্ক জোড়ার উদ্যোগ নিল। ‘বাসন মাজতে গিয়ে আরতির দু—দুটো শাঁখা ভাঙতে ও আর শাঁখা পরে না, বলে অত শাঁখা কেনার পয়সা কোথায়। সবাই বলল না পরলে স্বামীর অমঙ্গল হবে। কই কিছুই তো হয়নি শ্যামলের, আগেও যেমন ছিল এখনও তেমনই আছে।’

‘এসব হল হিন্দুদের আচার প্রথা নিয়ম।’ বিজলি গলা নামিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন, ‘হাজার হাজার বছর আগে মুনিঋষিরা এসব বিধান দিয়ে গেছেন। ওনারাই ঠিক করে দিয়েছেন সমাজে কারা উঁচু কারা নীচু, সেইভাবেই মানুষ ভাগ করা।’ কথাগুলো বলে বিজলি দেখলেন পদ্মর চোখে আরও বিস্ময়। ‘দেবতার পুজো তাই যাকে তাকে দিয়ে করা যায় না। এসব তুই বুঝবি না। দ্যাখ তো ছাদে ভুটু কান্নাকাটি করছে কিনা। ভিজে ছাদ, কোল থেকে নামালে ঠান্ডা লেগে যাবে। কল্পনা তো ওকে বেশিক্ষণ কোলে রাখতে পারে না।’

পদ্ম ঘর থেকে বেরোচ্ছে বিজলি ডাকলেন, ‘রাধাকে গিয়ে বলে আয় দিদির ঠ্যাং ভেঙেছে এখন তোমার মতোই অবস্থা, যতদিন না জোড়ে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে। অনেক দিন ওকে দেখতে যেতে পারব না। বেচারা, একজনও কেউ গিয়ে ওর সঙ্গে দুটো কথা বলে আসে না। কথা বলবেই বা কী, লোকে তো বিরক্ত হয়ে যায়।’ বিজলি রাধার কথা ভেবে বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। ‘আর শোন কাল তো সন্ধে দেখাসনি। আজ একটু ভালো করে গঙ্গাজলের ছড়া দিস। ভুটুর দুধ খাওয়ার টাইম হয়েছে, কল্পনা ওকে খাওয়াতে পারে না, ওকে বল আমার কাছে দুধটা দিয়ে যেতে, আমি খাইয়ে দোব।’

বালিশে পিঠ রেখে পা ছড়িয়ে বিজলি তাঁর স্বভাবমতো নিজেকে ব্যস্ত করে তোলার জন্য কাজের খোঁজ শুরু করলেন। তাঁর জন্য নানারকমের কাজ ছড়িয়ে থাকেও। শুধু সেগুলো সংগ্রহ করা আর পদ্মকে নির্দেশ দেওয়া। একটা কাজ শেষ হতেই মনে পড়ে যায় আর একটার কথা। যেমন পদ্ম ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মনে পড়ল মোমবাতি আনিয়ে রাখতে হবে। লোডশেডিং আবার শুরু হয়েছে। তারপর মনে পড়ল ঘড়ায় গঙ্গাজল কতটা আছে দেখা দরকার। ইলেকট্রিক বিল আসার তারিখ তো হয়ে গেছে, পদ্মকে রোজ বলতে হয় লেটার বক্সটা দেখতে, বিলের টাকা দেবার তারিখ পেরিয়ে গেলে রিবেট পাওয়া যাবে না এটা ওর মাথায় কিছুতেই ঢোকানো গেল না।

বই পড়ে বা টিভি দেখে অলকা কথিত ‘বোরড ফিল’ করা থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো দরকার বোধ করছেন না বিজলি। নানান ভাবনায় তাঁর মন সারাদিনই ভরে থাকে। এগারো বছর আগে বিধবা হবার পর নিঃসন্তান বিজলি বাড়িতে খুবই একা বোধ করেছিলেন। তখনই তিনি পাড়ায় এবাড়ি ওবাড়ি গিয়ে সুখদুঃখের গল্প করা শুরু করেন। বিজলি কোনো বাড়িতে গিয়ে পরচর্চা করেন না এবং সুরসিকা, কথা বলতে পারেন মজা করে তাই সব বাড়িতেই তিনি স্বাগত। জয় দত্ত স্ট্রিটে সব থেকে পরিচিত মানুষ, সাতচল্লিশের বি নম্বরের বাড়ির বিজলিবালা ভট্টাচার্য। তিনি একাধারে দিদিমা ঠাকুমা মাসিমা জেঠিমা এবং বউদিও। তাঁর আপশোস তাঁকে কাকিমা বলার লোক এখনও খুঁজে পাননি।

বিজলির স্বামী কৃষ্ণকিশোর ছিলেন পিতামাতার একমাত্র সন্তান। বিলাতি সওদাগরি অফিসে একটি বিভাগের বড়োবাবু ছিলেন। হিসেবি ও গোছানে লোক। তাঁর অফিসের নানান ধরনের ব্যবসার একটি ছিল খয়ের উৎপাদনের ও সারা ভারতে বিক্রির। বড়ো সাহেবের প্রিয় পাত্র কৃষ্ণকিশোর স্ত্রীর নামে বিহার ও ওড়িশায় খয়ের বিক্রির এজেন্সি নেন। জৌনপুর থেকে চটের মোড়কে খয়ের আসত, বাড়ির একতলার ঘরে বস্তাগুলি রাখা হত আবার তা চলে যেত পুরী কটক পাটনা গয়া প্রভৃতি স্থানে মহাজনদের কাছে। এই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় সাহেবরা যখন ভারতীয়দের কাছে তাদের প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দেশে ফিরে গেল। তত দিনে কৃষ্ণকিশোর হাজার পঞ্চাশ টাকা উপার্জন করে ফেলেছেন। রক্তে শর্করাধিক্যের রোগে তিনি মারা যান চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার তিন মাস পরেই।

কৃষ্ণকিশোর মিতব্যয়ী ছিলেন কিন্তু কঞ্জুস নন। ব্যবসা থেকে সঞ্চিত টাকা ও অবসর গ্রহণকালে অফিস থেকে প্রাপ্য টাকা ভবিষ্যতের কথা ভেবে স্ত্রীর নামে গচ্ছিত করেন ডাকঘরের টাকা দ্বিগুণ করা জাতীয় সঞ্চয় সার্টিফিকেটে এবং ব্যাঙ্কে। সেই টাকার পরিমাণ এখন দুই লক্ষাধিক। বিজলিবালাকে কদাচিৎ হাত দিতে হয়েছে ডাকঘরের টাকায়। কেন না হুগলি জেলার ভেনিয়াপুকুরে তাঁর বাবা মহিমারঞ্জন হালদারের স্থাবর সম্পত্তির অর্ধেকের উত্তরাধিকারী হন তিনি বাবার মৃত্যুর পর। বিজলির অসীম সৌভাগ্য স্নেহময় বিবেকবান সৎ সীতেশরঞ্জনকে দাদা পাওয়ায়। প্রতি বছর জমির ফসল বিক্রির, পুকুর ও আমবাগান জমা দেওয়ার টাকার ভাগ তিনি একমাত্র বোনের কাছে নিয়মিত নিজে পৌঁছে দিয়ে যান। সেই টাকার পরিমাণ বছরে পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা হয়।

বিজলির একতলা দীর্ঘ দিন খালি পড়ে থাকে তাঁর পছন্দের ভাড়াটিয়া না পাওয়ার জন্য। কয়েকজন দালালকে প্রত্যাখান করেছেন, দু—হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়ার প্রস্তাবও নাকচ করেছেন। তিনি চান ভদ্র শিক্ষিত মার্জিত এবং কম লোকের এমন পরিবারকে যারা ঝগড়া করবে না নোংরা করবে না এবং ভাড়া ফেলে রাখবে না। প্রতিবেশীরা বলল, আজকের দিনে এমন শর্ত পূরণ করার মতো ভাড়াটিয়া পাওয়া কঠিন। অবশেষে ভাড়াটিয়া এনে দিল পলাশ।

‘দিদিমা দিদিমা শুনুন।’ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন বিজলি। পলাশের ডাক শুনে দাঁড়ালেন। সত্যর চায়ের দোকান থেকে ছুটে এল পলাশ।

‘আপনার একতলার জন্য ভাড়াটে পেয়েছেন?’

‘না।’

‘আমার পিসতুতো দাদার বন্ধু, যাদবপুরে ওর সঙ্গে এম এসসি পড়েছে। এখন স্কুলমাস্টার, হাজার চোদ্দো—পনেরো মাইনে, বউও চাকরি করে। একটা শুধু বাচ্চচা মাস ছয়েক বয়স। দু—জনেই ভদ্রলোক, দু—জনেই রোজগেরে, ভাড়া ঠিক সময়ে পেয়ে যাবেন। আপনি যে ভয় পাচ্ছেন ছ্যাঁচড়া হবে কিনা, দাদা বলল অত্যন্ত ঠান্ডা নিরীহ ছেলে। বউও খুব পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন। গড়িয়ায় থাকে এদিকে বাসা পেলে দু—জনেরই সুবিধা হয়। আমি বলেছি আমাদের পাড়ায় দুটো বড়ো বড়ো ঘর আছে একতলায়, ওরা রাজি, দেবেন ভাড়া?’

বিজলি কথাগুলো শুনে বলেন, ‘জাত কী?’

‘বামুন বামুন, এই দ্যাখো আসল কথাটাই বলা হয়নি, চক্রবর্তী, জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী।’

ভুটুকে নিয়ে জ্যোতির্ময় আর হাসি এসে দেখা করে বিজলির সঙ্গে। একপলক দেখেই দু—জনকে তাঁর ভালো লেগে যায়। ভুটুকে কোলে নেওয়ার এক মিনিটের মধ্যে সে হিসি করে দেয় বিজলির কাপড়ে। সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বসিত হয়ে বিজলি বলে ওঠেন, ‘ব্যাটা ঠিক চিনেছে আমাকে। কোলে উঠেই জানিয়ে দিল তোমাকে জ্বালাতন করব। এ তো আমার গোপাল ঠাকুর গো। সামনের পয়লা তারিখেই তোমরা চলে এসো, কত ভাড়া দেবে বল?’

জ্যোতির্ময় ভয়ে ভয়ে বলেছিল, ‘আটশো টাকা পর্যন্ত দিতে পারি।’

‘ঠিক আছে চলে এসো, তবে বাপু ভাড়া ঠিক পয়লা তারিখে দিতে হবে আর লোক এলে সদর দরজা খুলে দেবে, রোজ সকালে জমাদার এলে উঠোন ধোয়ার জল দেবে, আর স্বামী—স্ত্রীর ঝগড়া যেন আমার কানে না পৌঁছায়। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ, শান্তি ভঙ্গ করলে কিন্তু আমি অন্য মানুষ, ঝেঁটিয়ে তোমাদের তাড়াব এটা মনে রেখো।’

সন্ধ্যা নামার মুখে এল পলাশ। ভুটুকে তখন খাটে বসিয়ে একহাতে জড়িয়ে ধরে বিজলি বোতলে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন।

‘এসো পলাশ, কই টাকাপয়সার কথা তো কিছু বলল না ওরা?’ বিজলি অস্বস্তিভরে বলে ভুটুকে কল্পনার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এবার তুই খাওয়া।’

‘বলেনি আমি বারণ করেছিলুম বলে। বলেছিলুম বিল আগে আমাকে দেবেন। দিদিমা, এরা অনেক কিছু বাড়িয়ে দেয়। যে—ওষুধ কেনা হয়নি তার দাম ধরে দেয়, যে—অক্সিজেন ব্যবহার করা হয়নি সেটাও বিলে ঢুকিয়ে দেয়, আয়া না রাখলেও বলবে রাখা হয়েছে। এসব তো আপনি ধরতে পারবেন না। তাই বলে রেখেছিলুম আগে আমি বিল চেক করব।’

‘চেক করে দেখলে?’

‘না কোনো কারচুপি করেনি। করবে না অবশ্য জানতুম।’ পলাশ পকেট থেকে বার করল লোটাস নার্সিংহোমের খাম। তার থেকে বার করল চারটে বিল। তার তিনটি সূর্য মেডিক্যাল হলের।

‘দিদিমা সব মিলিয়ে মোট আঠারোশো টাকা। আজকেই দেব বলেছি।’ পলাশ খাটের তলা থেকে টুল টেনে বার করে বসল। ‘যন্ত্রণাটন্ত্রণা হচ্চেচ? হলে যে ক্যাপসুল খেতে বলে দিয়েছে খাবেন। ডাক্তার বলেছে খুব শক্ত ধাতের মহিলা, এই বয়সেও শরীর খুব মজবুত।’

‘তা তো বুঝলুম কিন্তু বিলটাও তো বেশ জম্পেশ।’ বিজলি চোখ পিটপিট করে বিল তুলে ধরে বললেন। ‘জগন্নাথদেবের আশীর্বাদ এটা।’

পদ্ম বলল, ‘আর কখনো রিকশায় চেপো না এটাই বলে দিলেন জগন্নাথ।’

‘পা—টা তো ভাঙলি তুই। হুড়মুড়িয়ে পড়লি আমার পায়ের ওপর অমনি মট করে শব্দ হল। এখন দে আঠারোশো টাকা।’ বিজলি ছদ্মকোপ দেখিয়ে বললেন।

‘আহাহা আমি কি ইচ্ছে করে তোমার পায়ের ওপর পড়েছি নাকি? টাকা তোমার বালিশের নীচে রাখা আছে।’

বিজলি বালিশের তলা হাতড়ে টাকার ছোট পুঁটুলিটা বার করলেন। দাদার দিয়ে যাওয়া নগদ টাকা তিনি ঘরেই রাখেন, কখন কীজন্য হঠাৎ টাকার দরকার পড়ে কে বলতে পারে। পুঁটলির গেরো খুলে গুনে গুনে আঠারোশো টাকা বার করে দিলেন পলাশকে।

টাকা হাতে উঠে দাঁড়িয়ে পলাশ ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘দিদিমা এবার সত্যি কথাটা বলি, লোটাসের মালিককে বলেছি দিদিমা এত টাকা দিতে পারবেন না, তিনশো কমিয়ে দেড় হাজার করুন। তাই করে দিল। বিলটা আপনি ভালো করে তো দেখলেনই না। লেস থ্রি হান্ড্রেড তা হলে চোখে পড়ত।’

‘তাই তো!’ বিজলি অবাক হয়ে বিলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ‘এক কথায় তিনশো টাকা কমিয়ে দিল?’

‘দেবে না মানে? কত হাজার টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছি। যখন লোটাসের দুটো কর্মচারীকে গাফিলতির জন্য বরখাস্ত করে তখন কর্মচারীরা গেট বন্ধ করে দিয়ে ধর্মঘট শুরু করেছিল, মেরে সরিয়ে দিয়েছিল তো আমাদের ছেলেরাই, মালিক তো সেটা মনে রেখেছে। তবে দিদিমা এবার নাতির একটা আবদার রাখতে হবে।’ জিজ্ঞাসু চোখে বিজলি তাকাতে সে বলল, ‘ছেলেরা অনেকদিন পেট ভরে মাংস খায়নি।’

‘ঠিক আছে ঠিক আছে, ও টাকা আর আমাকে ফেরত দিতে হবে না। অনেকগুলো ছেলে, মাংসের দাম যা হয়েছে, তিনশো টাকায় কি হবে?’

‘হবে না। আরও অন্তত দুশো চাই।’ পলাশ পরিষ্কার দাবি জানাল।

বিজলি আবার পুঁটলি খুলে দুশো টাকা দিতেই পলাশ নাটকীয়ভাবে কপালটা বিজলির পায়ের প্লাস্টারে ঠেকিয়ে ‘লং লিভ দিদিমা।’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বিজলি মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘কাণ্ড দ্যাখো আমাকে জক দিয়ে গ্যালো।’

পদ্ম বলল, ‘কিন্তু বাপু তোমার জন্য করেছেও অনেক। ওরা না থাকলে কী আতান্তরে যে পড়তুম ভগবানই জানেন।’

‘ওদের জন্যই তো নিশ্চিন্তে আছি, মরলে শ্মশানে ঠিক পৌঁছে যাব। তুই আমার শ্রাদ্ধে ওদের ভালো করে খাওয়াস।’

‘আমার টাকা কোথায় যে ওদের খাওয়াব,’ ঠোঁট ফুলিয়ে পদ্ম বলল।

বিজলি অবাক হয়ে বললেন, ‘টাকা কোথায় মানে? আলমারিতে এখনও বারো হাজার রয়েছে, সব তো তোর জিম্মায়।’

‘বারো হাজার টাকায় তোমার ছেরাদ্দ? মাথা খারাপ হয়েছে তোমার। গোটা পাড়ার লোককে না খাওয়ালে তোমার মান থাকবে, তোমাকে মনে রাখবে? লোকে বলবে মাসিমা কেমন ছিল, দায়সারা করে কাজ সেরেছে আর সবাই দুষবে আমাকে। না বাপু আমাকে এর মধ্যে জড়িয়ো না।’

‘তার মানে তুই বলছিস আমার শ্রাদ্ধ হবে না! আমার আত্মার গতি হবে না? আমি প্রেত হয়ে ঘুরে বেড়াব?’ বিজলি উত্তেজিত হয়ে গলা চড়িয়ে বললেন।

সন্ত্রস্ত হয়ে পদ্ম বলল, ‘এই দ্যাখো তোমার ছেরাদ্দ হবে না কখন বললুম! বারো হাজারে ক—টা লোক খাওয়াব বলো? আমাদের বস্তিতে কনকের বিয়েতে শুধু ভাত ডাল মাছ আর রসগোল্লা খাওয়াতেই পাঁচ হাজার টাকা গলে গেল। আর এপাড়ায় তিরিশ—চল্লিশ ঘর লোক, তার মানে দেড়শো—দুশো মুখ। নিয়মভঙ্গে তুমি তো চাইবে শুধু মাছ নয় সঙ্গে মাংসও। তারপর মিষ্টি, এখন হিসেব করো কত খরচ হবে। এরপর আছে প্যান্ডেল, কেত্তন, ফুল, বামুনকেও কত কী দান করতে হবে। না মাসিমা বারো হাজারের মধ্যে আমি নেই। আমাকে মাপ করো তুমি অন্য লোক দ্যাখো।’

বিজলি গম্ভীর হয়ে গেলেন। ‘লোকে বলবে মাসিমা কেপ্পন ছিল’ পদ্মর এই কথাটা তাঁর মনের গভীরে নাড়া দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত লোকে কি তাঁকে এইভাবেই মনে রাখবে? ভাবতেই তাঁর চেতনায় ছড়িয়ে পড়ল ভয়, বিস্মরণে চলে যাবার ভয়।

‘পদ্ম, পোস্টাপিসে আর ব্যাঙ্কে যত টাকা আছে সব আমি তুলে তোর কাছে রাখব। তুই আমার শ্রাদ্ধটা ভালো করে করিস, কোনো কার্পণ্য করবি না কথা দে আমায়।’

হতভম্ব পদ্ম। বিজলির পায়ের প্লাস্টারে হাত রেখে বলল, ‘মাসিমা তুমি বলছ কী? আমি টাকা গুনতে পারি না। অত টাকা হাতে পেলে তো আমার মাথা ঘুরে যাবে। তুমি বরং নীচের দাদাকে ডেকে কথা বল।’

‘পদ্ম একটা কথা দে, গয়ায় গিয়ে আমার পিণ্ডি দিবি। নয়তো আমার মুক্তি ঘটবে না রে, আবার তা হলে আমাকে জন্মাতে হবে!’

‘আবার জন্মালে কী এমন ক্ষতি হবে?’

‘ওরে কী হয়ে জন্মাব তা তো আমি জানি না, কুকুর হয়ে জন্মাতে পারি ছারপোকা হয়ে জন্মাতে পারি রাজার ঘরেও জন্মাতে পারি, আবার দুঃখ কষ্ট লাঞ্ছনা ভোগ করা, তার থেকে একেবারে মুক্তি পেয়ে যাওয়া অনেক ভালো, তুই আমার মুক্তির ব্যবস্থা করবি, কথা দে।’

বিজলির দু—চোখ দিয়ে নামা জলের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনতে শুনতে পদ্মর বুকের মধ্যে কেমন যেন হতে থাকল। সে দু—হাত বাড়িয়ে প্রায় ছুটে এসে বিজলিকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। ‘মাসিমা তুমি অমন করে বোলো না, আমি কথা দিচ্ছি যে—করেই হোক গয়ায় গিয়ে তোমার পিণ্ডি দেব, মুক্তির ব্যবস্থা করব। কুকুর ছারপোকা হয়ে তোমাকে জন্মাতে না হয় সেই পাত্থনা শ্রীধরের কাছে আমি রোজ করব।’

তিন

‘এই গরদের থানটা নাও। নীচে তোমার ঘরে গিয়ে পরে এসো। ভেতরে বাসি—পরা কাপড় কিছু রেখো না। আমি পুজো শুরু করি শাশুড়ির লালপাড় গরদের শাড়ি পরে সেটার তো তখন কুটিকুটি অবস্থা, গা ঢাকব কী! এদিক ছেঁড়া ওদিক পেঁজা। তাই পরেই ক—টা বছর চালালুম, বিধবা হবার পর এই থানটা কিনলুম। যাও পরে এসো।’

বিজলি তাঁর এগারো বছরের পুরোনো বস্ত্রটি এগিয়ে ধরলেন। হাসি সেটা হাতে নিয়ে ইতস্তত করে বলল, ‘বাসি—পরা কাপড় রাখব না মানে!’

পদ্ম হেসে ফেলল। ‘মানে সায়া বেলাউজ আর বেচিয়ার গায়ে রাখবে না, আমরা তো দুটো মেয়েমানুষ। বাড়িতে এখন ব্যাটাছেলে বলতে তো ভুটু। লজ্জা করার কিছু নেই। যাও সব ছেড়ে থানটা পরে এসো।’

কাপড়টা নিয়ে হাসি বেরিয়ে যাবার পর পদ্ম বলল, ‘দেখলে মাসিমা বাসি কাপড় গায়ে রেখো না বলায় ওর মুখখানা কেমন হয়ে গেল।’

‘অল্পবয়সি মেয়ে, লেখাপড়া করা, বাইরে যায়, এরা কি চট করে গা—গতর আঢাকা করতে পারে? আমি যা পারি হাসির পক্ষে তা কি করা সম্ভব? মেয়েটা খুব সভ্য। বাড়ির শিক্ষা থেকেই এসব পায়, বুঝলি রে! ধুনুচিতে আর দুটো কাঠকয়লা দে, পিদিমটা এবার জ্বালা। আসনটা গুটিয়ে আছে কেন ঠিক করে পাত। রেকাবিতে শুধু বাতাসা! এলাচদানাও রাখ, ভুটু আছে না! পাঁচালি বইটা বার করে আমায় দে, হাসিকে দেখিয়ে দিতে হবে কোথা থেকে কোথা পর্যন্ত পড়বে।’

বালিশে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে বিজলি ঘরের কোণে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে একে একে নির্দেশ দিয়ে গেলেন। ঠাকুরের ছোটো আলমারি থেকে পাঁচালির বইটা বার করে পদ্ম বিজলির হাতে দিল।

‘মাসিমা বইটা এবার গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে নতুন একটা কেনো, পাতাগুলো ঝুরঝুর করছে। এই দ্যাখো দ্যাখো পাতাটা খসে গ্যালো।’ পদ্মর হাতে পাতলা বইটা থেকে একটা পাতা ঝরে পড়ল মেঝেয়। সে সেটা তুলে বিজলির হাতে দিল।

‘থাক না রে। গোটা আলমারি তো দখল করে নেই, বিসর্জন দেব কেন।’

খসে—পড়া পাতাটা সযত্নে পাঁচালি বইয়ের মধ্যে তিনি ঢুকিয়ে রাখলেন। ‘আট বছর আগে কেনা বইটা বুড়ো হয়ে গেছে, দেখেছিস কেমন পাকা চুলের মতো কাগজের রং, দাঁত পড়ার মতো খসে পড়ছে পাতা, চোখের নজরের মতো আবছা হয়েছে অক্ষর। বুড়ো হলেই কি গঙ্গায় পাঠিয়ে দিতে হয়, এই সময়ই তো যত্ন করতে হয়, সেবা করতে হয়।’ বিজলির স্বর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে অদৃশ্য হল।

হাসি ঘরে ঢুকল, তার পিছনে ভুটুকে কোলে নিয়ে কল্পনা। হাসি আষ্টেপৃষ্ঠে গরদের থানটা শরীরে জড়িয়েছে। বিজলি মুচকি হাসলেন।

‘অত লজ্জা কীসের? ঘোমটা দিয়ে আঁচলটা গলায় জড়িয়ে নাও। এবার ধরো পাঁচালি বইটা, আমি পাতাটা খুলেই রেখেছি দশ—বারো পাতা। বেশি নয় আধঘণ্টার মধ্যেই পড়া হয়ে যাবে।’

বইটা হাতে নিয়ে হাসি ছেঁড়া মলাটের দিকে তাকিয়ে রইল। শিরোনামে রয়েছে ‘প্রতি বৃহস্পতিবারের শ্রীশ্রী লক্ষ্মীদেবীর ব্রতকথা ও পাঁচালি’। লেখার নীচে লক্ষ্মীদেবীর রঙিন ছবি, সিংহাসনে বসে কোলে ঝাঁপি, মাথায় মুকুট, দুই পা পদ্মফুলের উপর রাখা। তাঁর দুই পাশে নতজানু হয়ে প্রণাম জানাচ্ছে এক সধবা ও এক পুরুষ। বোধহয় স্ত্রী ও স্বামী। হাসি কৌতূহলভরে কিছুক্ষণ ছবিটা দেখে বলল, ‘মাসিমা ব্রতকথার শুরুতে যে বাংলায় চারলাইন সংস্কৃত কথা রয়েছে ও আমি পড়তে পারব না। ভুলভাল উচ্চচারণ করে শেষে অমঙ্গল ডেকে আনব!’

বিজলি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘না না ওসব না পড়লেও চলবে। আমিও তো উচ্চচারণ করতে পারি না বলে বাদ দিয়ে পড়ি। তুমি ওইখান থেকে পড়বে। এই বলে তিনি সুর করে মুখস্থ বলে গেলেন—’দোল পূর্ণিমানিশি নির্মল আকাশ। মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস।। লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ। করিতেছে নানা কথা সুখে আলাপন।।’ যাও ওই আসনে বসে কোষাকুষি থেকে গঙ্গাজল হাতের চেটোয় নিয়ে মুখে দাও, হাতটা মুছে নাও মাথায় তারপর প্রণাম করে শুরু করো।’

হাসি কম্বলের আসনে বসে হাতজোড় করে লক্ষ্মীর বাঁধানো ছবিকে প্রণাম করে যেভাবে বিজলি সুর করে চার লাইন মুখস্থ বলেছিলেন সেই ভাবে পড়তে শুরু করল। তার পাশে বসে পদ্ম। ধুনুচিতে ধুনোর গন্ধে ম ম করছে সারা ঘর। একগোছা ধূপও জ্বলছে পটের সামনে। ভুটুকে কোলে নিয়ে কল্পনা খাটের ধারে মেঝেয় বসল। দুই দেওয়ালে দুটি নিয়ন আলোয় ঘর উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। বিজলি বুকের উপর দুই কর রেখে আধবোজা চোখে হাসির দিকে তাকিয়ে। পাকা সোনার মতো প্রদীপ শিখার কাঁপা আলো হাসির শ্যামবর্ণ গালে কপালে নাকের ডগায় কানের লতিতে যেন চামর বুলিয়ে চলেছে। বিজলির মনে হল, মন্দ মন্দ মলয় বাতাস যেন হাসির মুখের উপর দিয়ে বহিতেছে।

সারা পাঁচালিটা গত পঁয়তাল্লিশ বছরে অন্তত দু—হাজার বার বিজলি পড়েছেন। এখন তাঁকে আর বই দেখে পড়তে হয় না, মুখস্থ বলে যান। হাসির পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে তিনিও পড়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ হাসি পড়া থামিয়ে বইয়ের উপর ঝুঁকে পড়ল।

‘কী হল?’ ব্যস্ত হয়ে বিজলি জানতে চাইলেন।

‘মাসিমা এ জায়গাটায় পড়া যাচ্ছে না, অক্ষরগুলো মুছে গেছে।’

‘আগের লাইন দুটো বলো।’

হাসি পড়ল,

 ‘সহিতে না পারি আর সংসার যাতনা।

 ত্যজিব জীবন আমি করেছি বাসনা।।’

হাসি শেষ করা মাত্র বিজলি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘নারায়ণী বলে শুনো আমার বচন। আত্মহত্যা মহাপাপ নরকে গমন।। অবন্তী নগরের লক্ষপতি ধনেশ্বর রায়ের বিধবা ছেলে বউদের অত্যাচারে ঘরে তিষ্টোতে না পেরে বনে চলে গেল মরবে বলে। এমন সময় নারায়ণী সেখানে ছদ্মবেশে হাজির হয়ে ওকে কথাগুলো বললেন। নাও পড়ো এবার, যাও সতী গৃহে গিয়ে কর লক্ষ্মীব্রত—।’

হাসি আবার পড়া শুরু করল। পাঁচালির সুর অন্যের মুখে বিজলি বহু বছর পর শুনছেন। শুনতে শুনতে একটা ঘোর তাঁকে আচ্ছন্ন করতে লাগল। শাঁখের আওয়াজ তাঁর ঘোর কাটিয়ে জানিয়ে দিল পাঁচালি পড়া শেষ হয়েছে।

‘এই তো কী সুন্দর পড়লে! এবার প্রসাদ মুখে দাও।’ বিজলি স্মিত মুখে বললেন।

হাসি বলল, ‘যা ভয় ভয় করছিল, মাসিমা আমি ঠিকমতো পড়েছি তো?’

‘বললুম তো সুন্দর পড়েছ, তোমার গলার স্বরটা তো খুব মিষ্টি, গানের মতো লাগছিল। পদ্ম, ভুটুকে এলাচদানা দে, কীরকম চুপ করে ব্যাটা মায়ের পড়া শুনছিল! ক—টা বছর যাক, বই পড়তে শিখুক, তখন ওকে দিয়ে পাঁচালি পড়াব। জানো হাসি তোমার মেসোমশাই তখন দশ বছরের, আমার শাশুড়ি ওকে দিয়ে বেস্পতিবারে পাঁচালি পড়াতেন।’

হাসি একটা বাতাসা মুখের মধ্যে দিয়ে চিবোতে থাকল। পদ্ম নীচু গলায় বলল, ‘আগে কপালে ঠেকিয়ে তবে মুখে দেবে।’

আর একটা বাতাসা রেকাবি থেকে তুলে কপালে ঠেকিয়ে মুখে পুরে হাসি বলল, ‘এবার হয়েছে? কত যে নিয়মকানুন। মাসিমা আপনার এখানে কত দেবদেবী আছেন বলুন তো? এ তো প্রায় একটা মিউজিয়াম। পাথরের মূর্তি পেতলের মূর্তি, ছবি। এত জনকে আপনি সামলান কী করে?’ সিংহাসনের সামনে লাল কাপড় মোড়া লম্বা কাঠের পাটাতনটা সে দেখাল।

পদ্ম বলল, ‘রোজ সকালে এক ঘণ্টা ধরে তো মাসিমা ওদের নিয়েই থাকে। আমাকে তো ছুঁতে দেয় না।’

‘সব না হলেও বেশিরভাগই আমার কেনা।’ বিজলি উৎসাহভরে নড়ে উঠেই সতর্ক হলেন পায়ের কথা ভেবে।

‘পদ্ম পিঠের বালিশটা ঠিক করে দে।’ হাসির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওই যে নারায়ণ শিলা দেখছ ওটা দিয়েছেন আমার শাশুড়ি। তিনিও পেয়েছিলেন তাঁর শাশুড়ির কাছ থেকে। ওই যে কৌটোটা ওটা হল গাছকৌটো, কিনেছিলুম কালীঘাট থেকে। দ্বিতীয় বার পুরী গিয়ে কিনেছিলুম পাথরের জগন্নাথ সুভদ্রা বলরামের ওই মূর্তি। তারকেশ্বরের থেকে কিনেছি পাথরের তারকনাথ।’

বিজলি তিন ইঞ্চি উঁচু একটি শিবলিঙ্গ তর্জনী বাঁকিয়ে দেখালেন। ‘একটু সরে বোসো, এবার দ্যাখো ওই যে পঞ্চমুখী একরত্তি মূর্তিটা উনি হলেন গায়ত্রী দেবী। ওঁর পাশে গণেশবাবাজি। তোমার ছেলের ভীষণ পছন্দ ওঁকে। বালগোপাল দেখেছ? ওই যে ওখানে তারা মায়ের ছবির নীচে হামা দিচ্ছেন। ওই ছবিটা তো নিশ্চয় চেনো, তিরুপতি নাথ।’ বিজলি থামলেন। কল্পনার কোল থেকে নেমে ভুটু দাঁড়িয়ে উঠে খাটটা ধরে বিজলির সাদা প্লাস্টারে চাপড় বসিয়েছে।

‘ধর কল্পনা ধর।’ হাসি ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। ‘লেগেটেগে যাবে, একটু হুঁশ রাখবি তো?’

বিজলি বললেন, ‘হাসি, এটা পাথরের মতো শক্ত, দ্যাখো ওর হাতে ব্যথা লেগেছে কিনা।’

দুরন্ত ছেলেকে এই ঘরে আর রাখতে না চেয়ে হাসি ভুটুকে নিয়ে নীচে চলে গেল। যাবার আগে বলে গেল, ‘কাপড়টা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

‘একদম কিছু জানে না হাসিদি।’ পদ্ম বলল, ‘শুধু লেখাপড়াই করেছে। তবে হ্যাঁ গলাটা খুব মিষ্টি, পড়েছেও বেশ পষ্ট করে।’

‘তা তো বুঝলুম। তোকে যে বললুম রাধাকে গিয়ে বলে আসতে আমার পা ভেঙেছে বলেছিস?’ বিজলি চড়া গলায় বললেন।

‘ওই দ্যাখো! একদম ভুলে গেছি। এখুনি যাচ্ছি।’ পদ্ম জিভ কেটে ছুটে বেরিয়ে গেল।

বিজলি এখন একা এবং একা হলেই নানান কথার বিষয় তাঁর মাথায় ভিড় করে। প্রথমেই মনে হল হাসি কাল এক্সরে করাতে গেছিল, ওকে তো জিজ্ঞাসা করা হল না কী পাওয়া গেল ছবিতে? শ্রীধর, খারাপ কিছু যেন ছবিতে না বেরিয়ে আসে। বিজলি মুখ ফিরিয়ে পিতলের রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহের দিকে তাকিয়ে চোখ বুজলেন। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে বিড়বিড় করলেন, ‘আচ্ছা মেয়ে তো, বলবে তো আমায় ছবিতে কী পাওয়া গেল। যেচে যেচে আমাকেই জিজ্ঞেস করতে হবে। কেন?’ এই কেনর সন্ধান করতে গিয়ে বিজলি ক্রমশ নিজের উপর বিরক্ত হতে থাকলেন। ‘যত উটকো ঝামেলা নিয়ে মাথা ঘামানো।’

এই সময় ‘দিদিমা আসব?’ দরজার কাছ থেকে ডাক শুনে বিজলি তাকালেন এবং বললেন, ‘আয়, তপতী। আমার ইলেকট্রিক বিল কিন্তু এখনও আসেনি।’

তপতী, আঠারো—উনিশ বয়সি বউ। তার পরনের সস্তা শাড়ি, রুক্ষ গাত্রত্বক এবং আভরণহীনতা বুঝিয়ে দেয় দারিদ্র্যের কিনার ঘেঁষে সে জীবনযাপন করে। লাজুক কোমল স্বভাবের মেয়েটিকে এক দুপুরে পলাশই পরিচয় করাতে বিজলির কাছে এনেছিল।

‘দিদিমা এই হচ্ছে তপতী, আমার বন্ধু দুলাল, তাকে চেনেন তো, না চিনলেও নামটা তো শুনেছেন, এ হচ্ছে দুলালের বউ। দুলাল ওয়াটার পোলো খেলত হেদোয় সেন্ট্রাল ক্লাবে, খুব ভালো প্লেয়ার ছিল, বেঙ্গলে খেলেছে, ইস্টার্ন রেলে চাকরি প্রায় হয়েই গেছিল। কিন্তু—।’

‘কিন্তু কী? আমি শুনেছি বোমা বাঁধতে গিয়ে ডান হাতটা কবজি থেকে উড়ে গেছে।’ বিজলি কঠিন কর্কশ স্বরে পলাশকে শুনিয়ে দিয়েছিলেন। ‘যারা বোমাটোমা নিয়ে কারবার করবে তারা বিয়ে করে কেন বল তো? দ্যাখ তো এই একরত্তি মেয়েটা বিয়ে করে কী বিপদে পড়ল। স্বামীর হাত নেই। রোজগার করার জন্য একমাত্র তো সম্বল ছিল ওই হাত, এবার খাবে কী? বিয়ে দেবার আগে বাপ—মা কি একটু খোঁজখবরও নেয় না, কেমন ছেলের হাতে মেয়েকে দিচ্ছে।’

‘দিদিমা, বাপমা বিয়ে দেয়নি, তপু নিজেই বিয়ে করেছে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে। দুলাল কিন্তু বাজে ছেলে নয়। বাড়ির বড়ো ছেলে, গরিব, মাধ্যমিক পাশ। বাবা খবরের কাগজ বিক্রি করে। তাই দিয়ে বাড়িভাড়া মিটিয়ে সাতটা লোকের সংসার চালানো যায় না। দুলাল কার জন্য কাদের জন্য বোমা বাঁধত সে প্রশ্ন করবেন না। দিদিমা এই মেয়েটা দাঁড়াতে চায় একে একটু সাহায্য করুন।’

বিজলি একদৃষ্টে পলাশের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনেছিলেন। তারপর তাকান তপতীর দিকে। মাথা নামিয়ে ছিল মেয়েটা, মাথা—ভরতি ঘন চুলের মধ্যিখানে সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর, হাতে শাঁখা লোহা পলা। মেয়েটা একবার মাথা তুলে তাকায় বিজলির দিকে, ভীত ত্রস্ত চাহনি। বিজলি জিজ্ঞাসা করেন, ‘ভাত খেয়েছিস?’

তপতী চুপ করে থাকে।

‘পদ্ম ভাত চড়া।’ বিজলি চেঁচিয়ে ওঠেন। তারপর পলাশের দিকে তাকান। ‘বল এবার আমাকে কী করতে হবে?’

‘পাড়ার সব বাড়িতেই আপনি যান, সব বাড়িকেই ইলেকট্রিক অফিসে বিল জমা দিতে হয়, টেলিফোন আছে তেরোটা বাড়িতে তাদেরও বিল জমা দিতে হয়। পোস্টাপিসে টাকা তোলা জমা দেওয়া অনেককেই করতে হয়। কর্পোরেশন ট্যাক্সও সবাইকে দিতে হয়। যা সব বললুম সবগুলোতেই লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। তপুকে যদি চারটে করে টাকা দেয় তা হলে আর লাইনে দাঁড়াতে হবে না, লাইন দিয়ে কাজটা ওই করে আসবে। আপনি যদি ওকে নিয়ে বাড়িগুলোয় একটু ঘোরেন। আমিও এটা করতে পারতুম তবে আমাকে তো বিশ্বাস করবে না, আপনাকে কিন্তু করবে।’

সেই দিনই বিকেল থেকে বিজলি জয় দত্ত স্ট্রিটের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আবেদন জানিয়েছিলেন পদ্ম আর তপতীকে সঙ্গে নিয়ে। ‘গরিব মেয়ে, স্বামীর রোজগার নেই, খেটেখুটে ক—টা টাকা আয় করতে চায়। ওকে আপনারা একটু দেখুন না। আমি ওকে চিনি, এই অ্যাতোটুকু বয়স থেকে দেখে আসছি। আপনারা নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে ওর হাতে টাকা দিতে পারেন আমি জামিন থাকব।’

দু—দিনেই পাড়ার পঁচাত্তর শতাংশ পরিবার তপতীর খদ্দের হয়ে যায়। পদ্ম একবার বলেছিল, ‘মাসিমা তুমি বললে কী করে মিথ্যে কথাটা, তপুকে অ্যাতোটুকু বয়স থেকে দেখে আসছি, ওকে তো সেদিনই প্রথম দেখলে।’

‘মিথ্যে কথা বলেছি তো কী হয়েছে?’

‘মিথ্যে বললে পাপ হয় না?’

‘হয় তো হোক। শ্রীধর জানেন আমি কেন কীজন্য বলেছি, আমি মানুষ চিনি। তোর মতো রাস্তার চাপাকল থেকে জল এনে বলি না গঙ্গা থেকে নিয়ে এলুম।’ বলেই পদ্মর সামনে থেকে দ্রুত পা চালিয়ে নীচে নেমে এসে অলকাদের বাড়ি চলে যান।

‘পদ্মকে খেপিয়ে দিয়েছি এখন আধঘণ্টা বাড়ি ঢুকতে পারব না।’ বলে সময় কাটাতে বকরাক্ষসের গল্প শোনাতে শুরু করেন বাচ্চচু আর মিঠুকে।

বিজলি একা শুয়ে হাসির এক্সরে করা এবং তার ফলাফল তাকে না জানানোয় মাথা গরম করে যখন নিজের উপর বিরক্ত সেই সময় ‘দিদিমা’ বলে তপতী হাজির হল।

‘এত রাত্রে কী ব্যাপার, হাতে ওটা কী?’

‘নিমপাতা, আপনি নিমের ঝোল খেতে ভালোবাসেন বলেছিলেন। আমাদের সামনের বাড়িতে নিমগাছ আছে। মাঝেমাঝে ডাল ছাঁটে আজ ছাঁটছিল আমি সেখান থেকে দুটো কঞ্চি নিয়ে রেখেছি আপনার জন্য।’

‘ভালো রেখে যা। কাজকম্মো কেমন চলছে, খদ্দের বাড়ল?’

‘বাড়ছে আর কই, সবাই বলে আমাদের বিল দেবার লোক আছে। ওই তো আপনার সামনের বাড়ির শঙ্করবাবু, আজ গেছিলুম, অন্নপূর্ণাদি বলল, টেলিফোনের বিল আর তোমাকে দিতে হবে না। ব্যাঙ্কের সঙ্গে ব্যবস্থা হয়েছে, তারাই টেলিফোন অফিসে টাকা পাঠিয়ে দেবে।’ তপতী হতাশ চোখে তাকাল। ‘এরপর তো অন্যরাও একই পথ ধরবে।’

‘তোর বর করছে কী?’

‘বাঁ হাত দিয়ে যতটা পারে চেষ্টা করছে। একজন বলেছে নকল হাত করালে কাজ করতে সুবিধে হবে। সেও তো কত টাকার ব্যাপার!’

‘কত টাকার খোঁজখবর নিয়েছিস?’

তপতী কিন্তু কিন্তু করে বলল, ‘হাজার পাঁচ—ছয় পড়বে বলেছে।’

‘পাঁচ—ছ—হাজার বলে হাত আটকে থাকবে?’ ধমক দিয়ে বিজলি কড়া চোখে তাকালেন, ‘একটা হাতের গুরুত্ব মানুষের জীবনে কত তা কি তুই বুঝিস? এখনও কত বছর বাঁচবে, তোর বর, সে কি ওই নুলো হয়ে? এরপর ছেলেপুলে হবে, রোজগারপাতি বাড়াতে হবে, দুটো হাত, তা যেমন তেমনই হোক না, থাকলে তো সুবিধেই হবে। আমার তো তিনকাল গিয়ে এককাল ঠেকেছে, এই খোঁড়া হয়ে শুয়ে রয়েছি, জানি না জীবনে আর ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারব কিনা, তবু তো আমার ইচ্ছে করে তোদের মতো হাঁটতে ফিরতে চলতে।’ দ্রুত কথাগুলো বলে বিজলি তাকিয়ে রইলেন। মাথা নীচু করে বসে তপতী, মুখটি শুকিয়ে করুণ।

‘কবজি থেকে চেটো নেই জেনেই বিয়ে করেছিস?’

‘হ্যাঁ।’ ক্ষীণস্বরে তপতী বলল।

‘কেন?’

‘আমার ভালো লেগেছিল ওকে।’ আরও ক্ষীণ গলায় বলল।

‘কেন ভালো লাগল?’

‘জানি না দিদিমা।’ তপতী মাথা নাড়ল, ‘আমি জানার চেষ্টাও করিনি। ও বারণ করেছিল, বলেছিল, তোমাকে কষ্ট করে থাকতে হবে। আমি বলেছিলুম সীতা যদি স্বামীর সঙ্গে বনে গিয়ে কষ্ট করে থাকতে পারে তা হলে আমিও পারব।’

বিজলি চুপ করে রইলেন। তপতী লক্ষ করল দিদিমার চোখ বোজা মুখখানি ফেরানো রয়েছে ঠাকুরের সিংহাসনের দিকে। মুখটি মমতায় মায়ায় কোমল।

‘টাকার ব্যাপারটা খোঁজ নে। হাজার পাঁচেকের মধ্যে হলে আমাকে বলিস। আর শোন সেলাই জানিস?’

‘না।’

‘বরকে বল খোঁজ নিতে কাছাকাছি কোথায় সেলাই শেখবার ইস্কুল আছে, ভরতি হয়ে যা। বাড়িতে বসেই জাঙিয়া, ফ্রক, সায়া, ব্লাউজ তৈরি করতে পারবি। পাঁচ নম্বর বাড়ির দুর্গাচরণ হাওড়ার মঙ্গলাহাটে এইসব বিক্রি করে। ওকে আমি বলব তোকে যেন অর্ডার টর্ডার দেয়। লোকটা ভালো।’

‘দিদিমা আমার তো সেলাই মেসিন নেই। কী করে জাঙিয়া, ফ্রক করব?’

‘আহহ এই হল তোদের দোষ।’ বিরক্তিতে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন বিজলি। ‘ধৈর্য বলে কোনো পদার্থ আজকাল ছোঁড়াছুঁড়িদের নেই। ভালো লেগেছে তো পট করে বিয়ে করে ফেলল। আগে গাছে তো ওঠ তারপর তো এককাঁদি পাবি। সেলাই কাটা কাঁচি ধরা এসব আগে শেখ তারপর তো মেসিন লাগবে। চোদ্দো নম্বর বাড়ির দোতলার ভাড়াটেবউ একটা নতুন মেসিন কিনেছে তাতে এমবয়ডারি করা যায়। কথায় কথায় আমাকে বলেছিল পুরোনোটা বিক্রি করে দেবে দু—হাজার টাকা পেলে। এক্ষুনি গিয়ে দ্যাখ ওটা আছে না বিক্রি হয়ে গেছে। থাকলে বলবি আমি কিনব, মানে তুই কিনবি। চিনিস তো বাড়িটা? রাস্তার আলো যে—বাড়িটার গায়ে লাগানো, দোরগোড়ায় একটা টিউয়েল ছিল।’

‘চিনি। কালো রোগা লম্বা চশমা পরা বউ তো? ওদের টেলিফোন ইলেকট্রিক বিল তো আমিই দিই, মাসে মাসে পোস্টাপিস থেকে তো সাড়ে তিনশো টাকা আমি তুলে আনি।’

‘দৌড়ে যা এক্ষুনি।’

আক্ষরিক অর্থেই তপতী পায়ে হাওয়াই চটি গলিয়ে বারান্দা দিয়ে ছুটে গেল। সিঁড়িতে ওর চটির দ্রুত ফটফট শব্দ থেকে বিজলি বুঝলেন, মেয়েটার দাঁড়ানোর আগ্রহ কতটা। খড়কুটো যা পাবে এখন আঁকড়ে ধরবে। এবং এটাও বুঝলেন নরম মনের শান্ত স্বভাবের একরত্তি তপতী লড়বে, দাঁড়াবে।

সারা দিনে এই সময়টাই বিপন্নবোধ করেন বিজলি। সব বাড়িই এখন সংসারের কাজে ব্যস্ত, যাওয়া যায় না। ঘরে কতক্ষণ আর পদ্মর সঙ্গে কথা বলা যায়। ওই টিভি বা টেলিফোন থাকলে সময় কাটানো যায় কিন্তু এর কোনোটাই তাঁর নেই বা রাখতে চাননি। কথা বলার মতো কেউ এলে তিনি খুশি হন। সমবয়সি বুড়িদের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর একদমই ভালো লাগে না। ওরা এত নীরস নিষ্প্রাণ, যে দুটো কথা বলার পরই তিনি ক্লান্ত বোধ করেন।

তপতী চলে যাবার পর একা ঘরে তাঁর মনে হল টিভি থাকলে তবু সময় কাটানো যায়। টেলিফোন থাকলে কারোর সঙ্গে কথা বলা যায়। কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলবেন? কথা বলার মতো লোকজন তো সব পাড়াতেই রয়েছে তাদের সঙ্গে কি ফোনে কথা বলতে হবে! ভেনিয়াপুরে দাদার বাড়িতে অবশ্য টেলিফোন আছে। কিন্তু শুধু একজনের সঙ্গে কথা বলার জন্য টাকা খরচ করে ওটা রাখার মানে হয় না। বিজলি বাংলা খবরের কাগজ রাখতেন। বছর চারেক আগে হাসপাতালে কুকুরে আধখাওয়া এক শিশুর ছবি কাগজে দেখার পর তিনি কাগজ নেওয়া বন্ধ করে দেন। গ্রামোফোন ছিল। তাঁর বিয়ের আগে শ্বশুর কিনেছিলেন। এখন সেটা কাঠের সিন্দুকটার মধ্যে ভাঙা স্প্রিং নিয়ে পড়ে আছে। প্রায় সত্তরটা রেকর্ড বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। নেবার লোক পাননি। টেপরেকর্ডার আর ক্যাসেটের যুগ এখন। একই গান কতবার আর শোনা যায়? সাত—আটবার শোনার পর একঘেঁয়ে লাগতে শুরু করে। রেকর্ডগুলো কিলো দরে বিক্রি করে দিয়েছেন।

বিজলির এখন মনে হল তাঁর একটা ছেলে থাকলে বউমা নাতি নাতনিতে সংসার ভরে থাকত। তিনিও এমন একা নিঃসঙ্গ হয়ে থাকতেন না। শ্রীধরের কাছে নিত্য প্রার্থনা করেছেন সন্তানের জন্য, কত নামকরা দেবদেবীর স্থানে মানত করে হত্যে দিয়েছেন, গাছে ঢিল বেঁধেছেন, এঁদো পুকুরে স্নান করে পুজো দিয়েছেন, বুক চিরে রক্ত বার করেছেন কিন্তু কিছুতেই গর্ভে সন্তান আসেনি। একসময় দত্তক নেবার কথাও ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু কৃষ্ণকিশোর রাজি হননি। তাঁর বংশধারায় অন্য ধারার রক্ত নিয়ে আসায় প্রবল আপত্তি ছিল। বিজলি ডাক্তারের কাছে তাঁকে নিয়ে যাবার কথা বলেছিলেন, স্বামী রাজি হননি। কেন রাজি হননি সেটা এখনও তাঁর কাছে হেঁয়ালি হয়ে রয়েছে।

বারান্দায় পায়ের শব্দে চোখ খুলে বিজলি তাকালেন। পদ্ম চটি খুলে ঘরে ঢুকল।

‘বলেছিস রাধাকে?’

‘বলেছি।’

‘শুনে কী বলল?’

বিজলির পাশে এসে কানের কাছে মুখ রেখে পদ্ম ফিসফিসিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ বলল, আমাকে বিষ এনে দিবি?’

অবাক চোখে বিজলি তাকিয়ে বললেন, ‘কেন?’

‘কেন, তা বলার মতো ক্ষমতা থাকলে তো বলবে, তুমি আন্দাজ করে নাও, একটা মানুষ বিষ খেয়ে মরতে চায় কেন!’ পদ্ম জিজ্ঞাসু চোখে বিজলির বিমূঢ় দৃষ্টির মোকাবিলা করে নিজেই উত্তরটা দিল, ‘আট বছর ধরে চাকা লাগানো চেয়ারে বসা আর খাটে শোয়া; দাঁড়ানো নয় চলা নয়, পরিষ্কার করে কথাও বলতে পারে না; এমনভাবে জীবন কাটাতে কার ভালো লাগে বলো?’

বিজলি চট করে উত্তর দিতে পারলেন না। নিজেকে নিয়ে একটু ভাবলেন। একটা পা ভেঙে দুটো দিন মাত্র বিছানায় শুয়ে আছেন, বাইরের লোক আসছে, কথা দিব্যি বলছেন, এবং এটাও জানেন পা আবার ভালো হয়ে যাবে। আগের মতো হাঁটাচলা করবেন, এবাড়ি ওবাড়ি যাবেন। জীবন যেমন ভাবে চলে এসেছে সেই ভাবেই চলবে। এটা জানা সত্ত্বেও তো দুটো দিন কি একঘেয়ে বিরক্তকর লাগেনি? চলাফেরা কিংবা গতি না থাকলে জীবন যেন অর্থহীন হয়ে যায়—বিজলির এটাই মনে হচ্ছে এখন।

রাধা তো আট আটটা বছর বেঁচে মরা হয়ে রয়েছে। ওষুধ খেয়ে সেবাযত্ন পেয়ে হয়তো আরও দশ—পনেরো বছর বেঁচে থাকবে। কিন্তু সে বাঁচা তো মরার বাড়া। চতুর্দিকে লোক হাঁটছে ছুটছে ইচ্ছেমতো কাজকম্মো করছে, নানান ব্যাপার দেখছে তাইতে হেসে উঠছে, দুঃখ পাচ্ছে, ছুটে বারান্দায় এসে ঝুঁকে রাস্তা এধার—ওধার দেখছে, ফেরিওয়ালাকে ডাকছে, এসবের তো কিছুই রাধা পাচ্ছে না! ওর মনে ওঠানামাও তো মরেই গেছে!

‘রাধার কথা শুনে তুই কী বললি পদ্ম?’

‘বললুম এমন কথা মুখে এনো না। জানো না আত্মহত্যা মহা পাপ, নরকে গমন? তাই শুনে মাথাটা শুধু কাত করল। মনে হল জানে আত্মহত্যা করলে নরকে যেতে হবে!’ পদ্মকে অবাক দেখাল।

‘তবু বিষ খেতে চায়! পাঁচালির কথাগুলো এখন মনে হচ্ছে কেমন জানি অচল হয়ে যাচ্ছে রে পদ্ম, কেউ আর তেমন গ্রাহ্যি করে না। করবেই বা কেন, শরীর পঙ্গু হয়ে গেলে তার আর নরকের ভয় থাকে না। রাধুর চলে যাওয়াই ভালো।’ মন্থর ভগ্ন স্বরে বিষণ্ণ গলায় বিজলি বললেন। তারপরই মনে পড়ল হাসি তো গরদের থানটা ফেরত দিয়ে যায়নি এখনও।

‘ওরে পদ্ম নীচে গিয়ে দেখ তো হাসি কাপড়টার কী করল। অনেকদিনের পুরোনো, ছিঁড়েটিড়ে না ফেলে।’

নীচের থেকে ঘুরে এল পদ্ম। হাতে ভাঁজ—করা গরদের কাপড়টা। ‘হাসিদি বেরিয়েছে বুকের ছবিটা আনতে, ডাক্তারের কাছে হয়ে বাড়ি ফিরবে। কল্পনাকে বলে গেছিল কাপড়টা ফেরত দিয়ে আসতে। ভুটুকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে ও নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি ডেকে তুললুম।’

‘হাসি কখন ফেরে একটু নজর রাখিস। ফিরলেই নীচে গিয়ে জেনে আসবি এক্সরে রিপোর্টে কী বলেছে। কেন জানি আমার ভালো লাগছে না। তুই বরং নীচে গিয়ে সদরে দাঁড়িয়ে থাক।’

কিছুক্ষণ পরেই হাঁফাতে হাঁফাতে এল তপতী।

‘দিদিমা আছে এখনও, বিক্রি হয়নি।’ উত্তেজনায় উদ্দীপনায় টসটস করছে তপতীর মুখ। ‘প্রথমে বলল তিন হাজার, এখন নতুনের দামই পাঁচ হাজার, আমি বললুম দিদিমাকে তো বলেছেন দু—হাজার পেলেই বেচে দেবেন। তাইতে বলল তখন বলেছিলুম তখনকার দাম, এখন বেড়ে গেছে। আমি তারপর বললুম মেশিন দিদিমা কিনবে। অমনি বলল ঠিক আছে দু—হাজারেই দোব তবে তিন দিনের মধ্যে পুরো দাম চুকিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’

‘আমার নাম করলি? বারণ করেছিলুম না?’ বিজলির গলায় ভর্ৎসনা।

অপ্রতিভ হয়ে কুঁকড়ে গেল তপতী। ‘কী করব। মেশিনটা দেখলুম চোখের সামনে ঢাকনা দেওয়া রয়েছে। মনের মধ্যে কীরকম যেন একটা করে উঠল, আমি বলে ফেললুম আপনার নাম।’ মুখ নামিয়ে সে ভাঙা গলায় বলল, ‘আমার দোষ হয়েছে, মাপ চাইছি।’ বিলির প্লাস্টারে হাত রাখল তপতী।

‘কাল এসে টাকাটা নিয়ে যাস। আর সেলাই মেশিনটা আমাকে দিয়ে যাবি। যত দিন না সেলাই শিখবি তত দিন ওটা আমার এই ঘরে থাকবে। আমি দেখব তুই আমার চোখের সামনে বসে ভুটুর জাঙিয়া, পদ্মর ছায়া আর আমার ব্লাউজ সেলাই করেছিস তবেই ওটা পাবি নইলে পাবি না। যা বলেছি এখুনি সেলাই ইস্কুলে ভরতি হয়ে যা। তোর কাজ দেখার পর দুর্গাচরণকে বলব।’

‘কাল কখন আসব দিদিমা?’ তপতী উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইল।

‘দশটা এগারোটার সময় আসিস আর দুটো ছেলে জোগাড় করে আনবি—ওটা তো বয়ে আনতে হবে।’

তপতী চলে যাবার পর বিজলি টাকার পুঁটলিটা খুললেন। গুনে গুনে দু—হাজার টাকার একশো—পাঁচশোর নোট বার করে আলাদা রেখে বাকি টাকা গুনে পুঁটলিতে বেঁধে রাখলেন। বিড়বিড় করলেন, ‘আর খরচ করা নয়, এখনও দুটো মাস চালাতে হবে। দাদাকে খবর দিতে হবে পা ভেঙে বিছানায় পড়ে আছি।’

আবার একা। মনে পড়ল মুখ থেকে বেরিয়ে আসা পদ্মকে বলা কথাটা : ‘পঙ্গু হয়ে গেলে তার নরকের ভয় থাকে না।’ কথাটা কি মন থেকে বেরিয়ে এসেছিল? তাঁর কি নরকের ভয় নেই। বিজলি সাত পাঁচ ভেবে বললেন। দেখতে পেলেন বারান্দা দিয়ে গুটি গুটি ছাই রঙের হুলো বেড়ালটা আসছে। প্রায়ই আসে, রান্নাঘরে ঢোকে, এটাওটা শুঁকে বেরিয়ে যায়। নিরিমিষ হেঁসেল। ওঁর খাবার মতো কিছু থাকলে তো! বিজলি ‘হেই হেই’ বলে চিৎকার করলেন, ‘কিছু নেই যা ভাগ ভাগ।’ এধার ওধার তাকিয়ে তিনি খুঁজলেন লাঠির মতো কিছু পাওয়া যায় কিনা। না পেয়ে তালু দিয়ে বিছানায় চাপড় দিয়ে আবার চিৎকার করলেন। হুলো মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে আবার গদাইলশকরি চালে ফিরে গেল। বোঝা গেল, এই বাড়িতে কখনো প্রহার জোটেনি। তাই কাউকে তোয়াক্কা করে না।

বিজলির চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি সদর থেকে পদ্ম উঠে এসেছে।

‘সেই হুলোটা এসেছিল। বোধহয় আজ খাওয়াটাওয়া জোটেনি। চেঁচিয়ে তাড়ালুম। দুধ আছে তো তোলা, তাই থেকে খানিকটা ওকে দে। দ্যাখ ধারেকাছেই কোথাও আছে। মা ষষ্ঠীর বাহন উপোস দিয়ে থাকবে?’

নীচের থেকে কল্পনার গলার আওয়াজ আর ঝাঁটা মারার শব্দ ভেসে এল। বিজলি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ‘ওরে পদ্ম নীচে রয়েছে। এখুনি দুধটা দিয়ে আয়, মারতে বারণ কর।’

পদ্ম ছুটে বারান্দায় গিয়ে ঝুঁকে পড়ল। ‘কল্পনা ওকে মারিসনি। আমি ওর দুধ নিয়ে যাচ্ছি, খাওয়াব।’

পদ্ম প্লাস্টিকের বাটিতে দুধ নিয়ে নেমে গেল। মিনিট দশেক পর ফিরে এল, সঙ্গে হাসি। হাসির হাতে হলুদ রংয়ের একটা বড়ো খাম।

‘তোমার ব্যাপার কী বলো তো?’ বিজলি অনুরোগ অভিমান রাগ একসঙ্গে মিশিয়ে দিলেন তারস্বরে। ‘ডাক্তার দেখাচ্ছ এক্স—রে করছ অথচ আমায় কিছু বলছ না। অবিশ্যি আমি কে যে আমায় বলবে।’

‘ভালো কিছু খবর থাকলে নিশ্চয় বলব।’ স্বাভাবিক অনুত্তেজিত স্বর হাসির, ‘ডাক্তার সন্দেহ করছেন ক্যানসার, নিশ্চিত হবার জন্য বায়োপসি করাতে বললেন।’

বিজলি স্তম্ভিত চোখে হাসির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, মুখ দিয়ে কথা সরছে না।

‘এই হচ্ছে ব্যাপার। আমি যাই মাসিমা।’ হাসি কথাটা বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বিজলির বিমূঢ় ভাব তখনও কাটেনি। পদ্ম বলল, ‘হাসিদি কী অসুখ হয়েছে বলল?’

‘ক্যানসার, তুই বুঝবি না। একে বলে কর্কট রোগ। কর্কট মানে কাঁকড়া। এই রোগে কাঁকড়ার কামড়ের মতো অসহ্য যন্ত্রণা হয়, তাই এই নাম। এ রোগে বাঁচে খুব কম।’ বিজলি ক্ষীণ স্বরে বললেন, বুকের মধ্যেটা যা তাঁর খালি লাগছে। বিশ্বাস হচ্ছে না তাঁর থেকে এত অল্পবয়সির এমন একটা রোগ হতে পারে।

পদ্মর চোখ বিস্ফারিত হল বিজলির কথা শুনে। ‘বলে কী মাসিমা, হাসিদি বাঁচবে না? কাঁকড়ার কামড় খেতে খেতে মরে যাবে! এ কী রকমের অসুখ, আমি তো কাউকে এমনভাবে মরতে দেখিনি, শুনিনি।’

‘জীবনে তুই কতটুকু আর দেখেছিস শুনেছিস? আমার নন্দাই এই রোগে মারা গেছিল। বুকের কলজেদুটো খেয়ে ফেলেছিল, সারা শরীরে রোগ ছড়িয়ে গেছিল, গা ফেটে রক্ত বেরোত। খুব সিগারেট খেত দিনে তিরিশ—চল্লিশটা।’

‘হাসিদি তো সিগারেট খায় না!’

‘না খেলেও নয় । কখন যে কার হবে কেউ বলতে পারে না। এই পাশের বাড়িতে অলকাদের আগ যারা ভাড়া থাকত তাদের গিন্নির হয়েছিল পেটে। অপারেশন করার পর ক—টা দিন ভালো ছিল, ওর কিন্তু যন্ত্রণা হত না। তারপর আবার রোগ ছড়িয়ে শ্বাসনালিটায় ধরে, শ্বাস নিতে পারত না, সাত দিন বেঁচেছিল।’ বিজলির এখন পর পর মনে পড়ছে ক্যানসারে মারা যাওয়ার ঘটনাগুলো, পদ্মর ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি চুপ করে রইলেন।

‘মাসিমা কখন কার হবে কেউ জানবে না! বলছো কী তুমি, আমার হলে তা হলে আমিও জানব না?’ ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে পদ্মর কণ্ঠস্বর।

বিজলি কান দিলেন না পদ্মর কথায়। মনের মধ্যে হাসির মুখটা বড়ো হয়ে ফুটে উঠছে। শান্ত অচঞ্চল চোখদুটো। ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা যেন আগেই চুকিয়ে ফেলেছে। মৃত্যু নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আর কোনো লাভ নেই, তিরিশ—চল্লিশ বছর পরে তো মরতুমই নয় তিরিশ—চল্লিশ বছর আগেই মরব এমন একটা ভাব যেন ওর বলার ভঙ্গিতে ছিল। কিন্তু হাসি তোয়াক্কা না করলেও তিনি তো করেন। তাঁর বুকের মধ্যেটা যে খালি লাগছে। বিশাল বিশাল গাছের একটা বন ছিল, গাছগুলো আচমকা প্রচণ্ড ঝড়ে মড়মড় করে ভেঙে পড়ে তৈরি করে দিল ফাঁকা জমি। এই ফাঁকা জমিতে চারদিক থেকে বাতাস ছুটে আসছে। ধুলো বালিতে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে চোখ।

বিজলি বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে বাহু চোখের উপর রেখে বললেন, ‘রাতে আর খাব নারে, তুই খেয়ে নে। আলোটা নিভিয়ে দে, চোখে লাগছে।’

চার

প্রতিদিন ভোরে যখন বিজলির ঘুম ভাঙে তখনও ঘরটা আবছা থাকে। জয় দত্ত স্ট্রিটের ঘরে ঘরে সূর্যের আলোর আভা উজ্জ্বল হয়ে উঠতে সাতটা বেজে যায়। মধ্যরাত পর্যন্ত তিনি ঘুমোতে পারছেন না দু—দিন ধরে। অজস্র রকমের ভয়ংকর চিন্তা তাঁকে গ্রাস করে থাকে। শেষ রাতে তাঁর মাথাটা ঝিমিয়ে আসে। চিন্তা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়, তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।

‘মাসিমা, ও মাসিমা কী কাণ্ড হয়ে গ্যাছে ওদিকে, ওঠো ওঠো।’

পদ্মর ঠেলা খেয়ে বিজলি চোখ খুলেই বললেন, ‘হাসির কী হল?’

‘হাসি নয় হাসি নয়, ও বাড়ির রাধু মাসিমা। ধরাধরি করে ওঁকে শঙ্করবাবু আর নাথু গাড়িতে তুলল, সঙ্গে অন্ন। হাসপাতালে নিয়ে গেল। বাড়ির সামনে লেকে জমে গেছে, বলাবলি করছে রাতে বিষ খেয়েছে নাকি! রাধু মাসিমা বিষ পেল কী করে?’

বিজলি যেসব চিন্তা রাতে করেছেন তাতে রাধুকে তিনি চিন্তার গণ্ডির মধ্যে আনেননি। কেন আনেননি ভেবে অবাক হলেন। রাধুই তো এতকাল ছিল তাঁর দুশ্চিন্তা!

‘ওদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নে। জবার মা তো ভোরে কাজ করতে আসে। নিশ্চয় কথাবার্তা যা হচ্ছিল শুনেছে? ওকে জিজ্ঞেস কর। আর নীচের দাদাকে দেখতে পেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বল। হাসিকে কী যেন একটা পরীক্ষা করতে বলেছিল ডাক্তার, তার কী হল সেটা জানতে হবে।’

এরপর শুরু হল বিজলির ছটফটানি। ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে যেতে সামনের বাড়িতে। রাধুকে কোথায় নিয়ে গেল, কেমন রয়েছে, কী করে বিষ খেল, বাঁচবে না মরবে এমন অজস্র প্রশ্ন তাঁর মাথায় কেঁচোর মতো নড়েচড়ে উঠছে। উত্তরগুলো সংগ্রহ করে ফেলতে পারতেন যদি চলাফেরা করতে পারতেন। না পারার জন্য রেগে উঠলেন নিজের ভাঙা পায়ের উপর। ‘হতচ্ছাড়া পা, ভাঙার আর সময় পেলি না, পদ্মটাও তেমনি একটা রোগাপটকা বুড়ো রিকশাওয়ালাকে ধরে আনল, শক্ত জোয়ান হলে রিকশাটা ঠিক ধরে রাখত, উলটোত না।’

রাধাকিঙ্করীর জন্য বিজলির অস্থির বোধ করার যুক্তি আছে। তিরিশ বছর আগে রাধু যখন বিয়ের পর প্রথম শ্বশুরবাড়িতে আসে তখন তাকে বরণ করে যাঁরা তোলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন সামনের ভটচায বাড়ির বউ বিজলি। এক ঘড়া জল তিনি মোটরের দরজার সামনে রাস্তায় ঢালেন। গাড়ির দরজা খুলে নতুন বউ জল ধোওয়া রাস্তায় প্রথম পা ফেলেছিল। তারপর থেকে তিনি তিরিশ বছর রাধুর ‘দিদি’। ওদের ছাদটা বড়ো। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বাঁশের লম্বা ঝুলঝাড়াটা নিয়ে রাধু ছোটাছুটি করে কাটাঘুড়ি ধরছিল। এ—বাড়ির ছাদ থেকে বিজলি হাততালি দিয়ে বলেছিল, ‘রাধু ওড়া তো দেখি।’ ঘুড়িটার সঙ্গে ছিল অনেকখানি সুতো। রাধু টুঙ্কি দিয়ে দিয়ে ঘুড়িটা আকাশে অনেকখানি তুলেছিল। সুতো শেষ প্রান্তে পৌঁছোতে হাত থেকে ছেড়ে দেয়। ‘এই যাহহ’ বলে সে হেসে উঠেছিল। বিজলি আপশোস করে বলেছিলেন, ‘ছেড়ে দিলি কেন বেশ তো উড়ছিল!’ রাধু বলেছিল, ‘ছাড়ব কেন, সুতো ফুরিয়ে গেছে, খেয়াল করিনি।’

ঘুড়িটা বাচ্চচার হাঁটার মতো টলতে টলতে আকাশে ভাসতে থাকে। বিজলি খাটে আধবসা হয়ে সেদিনের ঘুড়িটাকে দেখে যাচ্ছেন। মনে পড়ছে চেঁচিয়ে বলা রাধুর কথাগুলো। খেয়াল করিনি, এটা বাজে কথা। পরিষ্কার দেখেছি সুতোটা ইচ্ছে করে ছেড়ে দিল। এবারও ইচ্ছে করেই নিজের জীবনটা ছেড়ে দিল। ভালো করল না মন্দ করল কে বলবে?

‘মাসিমা আমাকে ডেকেছেন?’ দরজার কাছে জ্যোতি দাঁড়িয়ে।

‘এসো বাবা,’ জ্যোতিকে ধুতি পাঞ্জাবি পরা দেখে বললেন, ‘ইস্কুলে যাচ্ছ?’

‘হ্যাঁ।’ ঘরে ঢুকে জ্যোতি বিজলির পায়ের দিকে তাকিয়ে হালকা সুরে বলল, ‘খুব অসুবিধে হচ্ছে তো? হাঁটাচলা একদম বন্ধ।’

‘আমি বিছানায় পড়ে আর কত কী ঘটে যাচ্ছে। সামনের বাড়িতে আমার ছোটো বোনের মতো রাধু সে একটা কী কিত্তি করে বসেছে। এদিকে হাসি সেও একটা খারাপ অসুখের কথা বলে দিব্যি হাসি হাসি মুখ করে সেই যে নীচে নেমে গেল এখনও পর্যন্ত একটু জানাল না, কী যেন পরীক্ষাটা?’

‘বায়োপসি, আরও তিন দিন পরে রিপোর্ট পাওয়া যাবে।’

বিজলি লক্ষ করলেন জ্যোতির মুখে কোনো উদবেগ নেই। ভাবখানা যেন ক্যানসার কালান্তক রোগই নয়, সর্দিকাশির মতো একটা ব্যাপার। বিরক্ত হয়ে বিজলি বললেন, ‘রোগটকে তোমরা দু—জনেই গুরুত্ব দিচ্ছ না, এটা কেমন কথা?’

‘দিচ্ছি না কে বলল মাসিমা। ডাক্তার যখনই বলল তার সন্দেহ হচ্ছে হাসির বুকের লাম্পটা ক্যানসারাস, এক্স—রে করুন, সেই রাতে আমরা ঘুমোইনি। দু—জনে দু—জনের দিকে তাকিয়ে জেগেছি, কথা বলে গেছি ভুটুকে মাঝে রেখে। সেই রাতেই আমরা তৈরি হয়ে যাই, যা হবেই যাকে আটকানো যাবে না তা একদিন হবেই। তত দিন জীবনটাকে বিস্বাদ বিশ্রী করে রাখার কোনো মানে হয় না। মাসিমা মরার আগেই হাসি মরতে চায় না।’

জ্যোতি বিজ্ঞানের শিক্ষক, ক্লাসে ছাত্রদের পড়া বোঝাবার জন্য ব্যাখ্যা করে, স্পষ্ট উচ্চচারণ অনর্গল বলে যায়। বিজলি স্তম্ভিত হয়ে শুনে যাচ্ছিলেন। কত সহজে এই অল্পবয়সি দম্পতি মৃত্যুকে গ্রহণ করছে। এই পৃথিবী, এই সংসার, আদরের ছেলেকে ফেলে চলে যেতে হাসির কষ্ট হবেই তবু সে তাঁর অনুরোধ লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়ে গেল। একটুও টের পেতে দিল না কালব্যাধি তার শরীরে বাসা বেঁধেছে! কত বড়ো মন, কী সাহস মেয়েটার! বিজলির চোখের সামনে থেকে থিয়েটারের যবনিকা যেন ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে। মঞ্চে কুশীলবরা—জ্যোতি, হাসি, রাধু, তপতী, পলাশ, অলকা, পদ্ম, পাড়ার ছেলেরা। সবাই ভালো সবাই ভালো।

বিজলি চোখ বন্ধ করলেন। মনে মনে বললেন, ‘শ্রীধর এরা নিজের—নিজের মতো করে বেঁচে থাকুক, তুমি ওদের দেখো।’

কিছুক্ষণ পর চোখ খুলতে দেখলেন জ্যোতি চলে গেছে। সিঁড়িতে পটপট হাওয়াই চটির শব্দ, তপতী এল।

চটি খুলে ঘরে ঢুকে তপতী বোকার মতো হেসে বলল, ‘দিদিমা আমি এসেছি।’

‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি। বলেছিলুম সঙ্গে করে লোক আনতে, এনেছিস?’

‘হ্যাঁ, তিন জনকে পেলুম।’

বিজলি বালিশের তলা থেকে টাকা বার করলেন। ‘গুনতে পারবি তো, যোগ করা শিখেছিস?’ নোটগুলো হাতে দেবার সময় বললেন, ‘গুনে দ্যাখ।’

‘আমি এইট ক্লাস পর্যন্ত পড়েছি দিদিমা।’

‘পড়েছিস তো, শিখেছিস কিছু?’

তপতী গোনার সঙ্গে সঙ্গে বিড়বিড় করে যোগ করছিল। ‘দু—হাজার দিদিমা, আমি যাই ওরা নীচে দাঁড়িয়ে আছে।’

তপতী চলে যাচ্ছে। বিজলি একটা পঞ্চাশ টাকার নোট হাতে নিয়ে ডাকলেন, ‘ওরে অঙ্কের পণ্ডিত এটা নিয়ে যা। তোকে পঞ্চাশ টাকা কম দিয়েছি। আনন্দে নাচতে নাচতে তো টাকা গুনে বললি দু—হাজার। কেলাস এইট পর্যন্ত পড়েছি।’ ভেংচে উঠলেন বিজলি। ‘এই বিদ্যে নিয়ে রোজগার? আমার টাকাটাই দেখছি জলে গেল।’ তারপর দাবড়ানি, ‘ভাগ আমার সামনে থেকে।’

আবার বোকার মতো হেসে তপতী চলে গেল। এক ঘণ্টা পর পদ্ম এসে জানাল, ‘রাধু মামিমাকে লোটাসে নিয়ে গেছে। নাথু ফিরে বলল বোধহয় বাঁচবে না। আর কী বলল জানো? বলল, বিষ খায়নি ঘুমের বড়ি খেয়েছে। বড়ি পেল কী করে বলো তো?’ পদ্ম অবাক চোখে প্রশ্ন করল।

‘কী করে পেল তা আমি জানব কী করে? তুই এক কাজ কর অলকাদের বল ভেনিয়াপুরে দাদাকে ফোন করে জানিয়ে দিতে, আমি পা ভেঙে শয্যাশায়ী। ওইটুকু বললেই হবে। ফোন নম্বরটা লিখে দিচ্ছি নিয়ে যা।’

সন্ধ্যাবেলাতেই বিজলি জেনে গেলেন রাধাকিঙ্করীকে রাত্রে খাটে শোয়াবার জন্য হুইলচেয়ারে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল অন্নপূর্ণা। রাধু তখন জল খেতে চায়। হুইলচেয়ার থামিয়ে অন্নপূর্ণা জল আনতে ঘরের বাইরে যায়। চেয়ারটা ছিল টেবল ঘেঁষে, টেবলে ছিল ওষুধ রাখার প্লাস্টিকের বাক্সটা। রাধু তখন হাত বাড়িয়ে বাক্স থেকে তুলে নেয় আধ—ভরতি ঘুমের বড়ির ছোট্ট সরু শিশিটা। বড়িগুলো বাঁ হাতে ঢেলে মুঠোবন্ধ করে রাখে। ডান হাতে গেলাস ধরে জল খায়। মুখের মধ্যে জল ধরে রেখে গেলাস ফিরিয়ে দেয়, অন্নপূর্ণা গেলাসটা টেবলে রাখতে যেই মুখটা ঘুরিয়েছে তখুনি রাধু মুঠো—ভরতি বড়ি মুখে পুরে জল সমেত গিলে ফেলে। অন্নপূর্ণার সন্দেহ হয়, কী যেন একটা মুখে পুরল রাধুবউদি। ‘কী মুখে দিলে, দেখি দেখি হাঁ করো।’ সে বলেছিল। রাধাকিঙ্করী মুখ খোলেনি।

বাঁচেনি রাধাকিঙ্করী। এটা পরিকল্পিতভাবে খুন না আত্মহত্যা তার তদন্তে পুলিশ আসে। বাড়ির লোকেদের জেরা করে থানার তরুণ এক অফিসার। তারপর রাধাকিঙ্করীর সঙ্গে যাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল তাদের খোঁজ করে অফিসারটি। পাড়ার লোকেরা তাকে জানায় বিজলির নাম। বিজলিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে অফিসার দোতলায় আসে। হাতে ফাইল, সাদা ইউনিফর্ম, মাথায় কালো ক্যাপ, কাঁধে রঙিন ফিতে, অফিসারটি ঘরে জুতো সমেত ঢুকতে যাচ্ছিল। পদ্ম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘ঘরে ঠাকুর আছে, জুতো খুলে ঢুকুন। মাসিমা কাউকে জুতো পরে ঘরে ঢুকতে দেন না।’

পারিবারিক, সামাজিক আচার আচরণ পালনের নিয়ম মান্য করার রীতিটা এই অল্পবয়সি অফিসার এখনও ভুলে যায়নি। অপ্রতিভ হয়ে সে জুতো খুলে ঘরে ঢুকল, সন্তর্পণে তাকাল ঠাকুরের সিংহাসনের দিকে। বিজলি বললেন, ‘পদ্ম ওকে বসার টুলটা এনে দে।’ তরুণটি টুলে বসার পর বিজলি বললেন, ‘রাধুকে আমি তিরিশ বছর ধরে জানি। খুব সুখেরই সংসার ছিল ওর। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যথেষ্ট মনের মিল ছিল, ভালোবাসাও ছিল। আপনি হয়তো পাড়ার লোকের কাছে শঙ্কর ঠাকুরপো সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছেন বা শুনবেন। সব মিছে কথা।’

‘কীসের ভিত্তিতে আপনি বলছেন মিছে কথা?’ অফিসার জানতে চাইল।

‘আট বছর আগে রাধুর যখন দুর্ঘটনা ঘটল, এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে ফিসফাস হল, বউকে সিঁড়ি দিয়ে ইচ্ছে করে ঠেলে দিয়েছে শঙ্কর চাটুজ্যে। রাধু নিজে আমাকে পরে বলেছে একদম বাজে কথা, হ্যাঁ, রাধু নিজে আমাকে বলেছে সে অন্ধকারে সিঁড়ির ধাপ ফসকে গড়িয়ে পড়েছিল। আর এই যে মারা গেল, যেজন্য আপনি খোঁজ নিতে এসেছেন, নিশ্চয় আপনাকে কেউ—না—কেউ বলেছে, চুপি চুপি বলেছে, ওকে ঘুমের বড়ি ইচ্ছে করে খাইয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। ঠিক কিনা?’ উত্তরের জন্য বিজলি স্থির দৃষ্টিতে তরুণটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ‘অতগুলো বড়ি কি ইচ্ছেমতো গিলিয়ে দেওয়া যায়।’

ইতস্তত করে অফিসারটি বলল, ‘একজন অভিযোগ করেছে ফোনে।’

‘নাম বলেছে?’

‘নাম ঠিকানা তো বলতেই হবে। নয়তো অভিযোগ আমরা অ্যাকসেপ্ট করব কেন। উড়ো ফোন তো অনেক আসে। কত লোকের কত রকম উদ্দেশ্য থাকে।’

‘রাধুদের পেছনের বাড়ি বিনোদ ঘোষের। ছাদে বেআইনি বাথরুম তুলেছিল। শঙ্কর ঠাকুরপো কর্পোরেশনে খবর দিয়ে বাথরুমটা ভেঙে দেয়। সেই থেকে বিনোদ ঘোষ ছুতোনাতায় ওদের পেছনে লেগে আসছে। শঙ্কর ঠাকুরপো আর অন্নপূর্ণাকে জড়িয়ে নোংরা কথাবার্তা ওই লোকটাই চাউর করেছে পাড়ায়। রসালো কেচ্ছা, সবাই গপগপিয়ে গিলেছে। আর এবার তো আরও ভয়ংকর খুনের গপ্প রটানোর সুযোগ পেয়ে গেছে। তবে আপনাকে আমি পষ্ট করে বলছি এটা মেরে ফেলা নয়, আত্মহত্যাই। রাধু অনেক বার আমাকে বলেছে, ‘দিদি এভাবে আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।’ বলত আর দু—চোখ দিয়ে দরদরিয়ে জল নামত। খুব ছলবলে ছিল, দিনের মধ্যে কতবার যে ছুটে ছুটে একতলা দোতলা করত তার ইয়ত্তা নেই।’

বিজলির চোখের কোলে জল টলটল করছে, গলা ধরে এসেছে। তরুণ অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে বলল, ‘রাধাকিঙ্করী চ্যাটার্জি মনে হচ্ছে খুব প্রাণবন্ত ছিলেন, এমন মানুষ তো আরও বেশি করে বাঁচতে চাইবেন, তাই না?’

‘এর উলটোটাও তো হতে পারে। রাধুকে দেখেছি ঘুড়ি ওড়াতে, বৃষ্টি হলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছাঁট মুখে লাগাতে, মশলাধোসাওলাকে ডেকে কিনতে। একদিন রাতে কোকিলের ডাক শুনে ও আমাকে বলেছিল রাতে ঘুমোতে পারেনি। এমন মেয়ে যদি অথর্ব পঙ্গু হয়ে যায় তা হলে কি তার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে? তার কষ্ট তো হাজারগুণ বেড়ে যাবে। দগ্ধে দগ্ধে মরার থেকে একেবারে মরা খারাপ কী! এই আমি পা ভেঙে বিছানায় পড়ে আছি, আমার অবশ্য মরে যেতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু যদি জানি চিরকাল এভাবেই থাকতে হবে তা হলে অন্যরকম তো ভাবতেই পারি, রাধুও অন্যরকম ভেবেছিল। এই তো দু—দিন আগে ও পদ্মকে বলল বিষ এনে দিতে।’

তরুণ অফিসার তাকাল পদ্মর দিকে। ‘ইনি কে?’

‘আমার দিনরাতের সঙ্গী। ধৃতরাষ্ট্রের যেমন ছিল সঞ্জয় আমার তেমনি পদ্ম। বাইরের সব খবর আমি পাই ওর কাছ থেকে।’

‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে এই মৃত্যুতে আপনি দুঃখ পাননি, এতে যেন আপনার সায় আছে।’ তরুণটি তার তদন্তের বিষয়ের বাইরে গিয়ে কৌতূহল দেখাল।

‘রাধু মনের কষ্ট, শরীরের যন্ত্রণা নিয়ে তিলতিল করে মরণের দিকে এগোচ্ছে সেটা দেখতে কি খুব ভালো লাগে? বাঁচব কি মরব সেটা তো নিজের বিষয়, রাধুকেই তা ঠিক করতে দেওয়া উচিত, নয় কি?’ বিজলি উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলেন।

প্রশ্নটায় তরুণ অফিসার বিব্রত হয়ে পড়ল। গলাখাঁকারি দিয়ে এধার—ওধার তাকাল। এই বৃদ্ধার কাছে এমন একটা বেমক্কা অবস্থায় পড়তে হবে জানলে সে কথাবার্তা অনেক আগেই চুকিয়ে দিয়ে চলে যেতে পারত। দেশের আইন বলছে আত্মহত্যার চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, পুলিশ আইনের রক্ষক। পুলিশের উর্দি পরে সে কী করে আত্মহত্যাকে সমর্থন করবে? আবার এই বৃদ্ধার যুক্তিটাও সে ফেলে দিতে পারছে না। এখনও ভোঁতা হয়ে যায়নি তার অনুভূতি।

অফিসারের দোনামনা ভাব দেখে বিজলি বললেন, ‘আপনি যদি ব্যাপারটা এইভাবে দেখেন তা হলে বোধহয় আমার পক্ষে বোঝাতে সুবিধা হয়। প্রত্যেক ট্রেনেরই একটা নির্দিষ্ট সময় আছে স্টেশন থেকে ছাড়ার। যদি কেউ ট্রেনে উঠে কোথাও যেতে চায় তা হলে সেই লোকটিই ঠিক করবে কবে, ক—টার ট্রেন সে ধরবে। রাধু নির্দিষ্ট সময়ে তার ট্রেনে উঠেছে নিজের ইচ্ছায়, আপনি আমি বাধা দেবার কে?’

অফিসার হাতের ঘড়ি দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। ‘আমাকে আর এক জায়গায় যেতে হবে।’

.

তিন দিন পর বেলা এগারোটায় হাজির হলেন সীতেশরঞ্জন। সাদা ফুলশার্ট, ধুতি ও পাম্পশ্যু পরা, ছিপছিপে দীর্ঘদেহী সত্তর বছর বয়সি লোকটি ব্যস্ত থাকেন সবসময় হাঁটাহাঁটি করেন প্রচুর। চাষবাস তদারক করেন নিজে। দুই ছেলে দুই মেয়ে। ডাক্তার ছেলে থাকে বর্ধমানে, কাঠের ব্যবসায়ী ছেলে থাকে শিলিগুড়িতে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে দুর্গাপুরে ও চন্দননগরে। তারা সচ্ছল ও সুখী। সীতেশরঞ্জনের ঝাড়া হাত—পা। স্বামী—স্ত্রী, গোরু বাছুর, ফলমূলের গাছ, ধানের গোলা, পুকুরের মাছ ইত্যাদি নিয়ে এখন তাঁর সংসার। দেড়শো বছর আগের গ্রামবাংলার মানুষ ও মানসিকতা নিয়ে যদি কেউ গবেষণা করতে চান তা হলে হুগলি জেলার এই মানুষটিকে অনুধাবন করেই প্রার্থিত যশোলাভ করতে পারবেন।

‘কীরে বুড়ি, পা ভাঙলি কী করে?’

দরজার বাইরে জুতো খুলতে খুলতে সীতেশ হালকা চালে বললেন। বিজলি বালিশে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে দু—হাতে চোখের সামনে গরদের থানটা তুলে ধরে খুঁজছিলেন কোথায় কোথায় ছিঁড়েছে কোথায় পিঁজে গেছে। ‘বুড়ি’ শুনেই ঝুপ করে হাত নামিয়ে বাচ্চচা মেয়ের মতো ‘দাদা’ বলে চিৎকার করে উঠলেন।

সীতেশের কাঁধে একটা ঝোলা। সেটা নামিয়ে হাঁক দিলেন, ‘পদ্ম কোথায় গেলি রে। কী ভিড় রে বাবা ট্রেনে, তার আগে ট্রেকারে তো লোকের কোলে বসে ইস্টিশনে এলুম।’ বলেই তিনি মুখ তুলে পাখার দিকে তাকালেন। ‘একটু জোর করে দে তো, যা ভ্যাপসা গরম। ক—দিন ধরে আমাদের ওদিকে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, তোদের এখানে কেমন?’

বিজলি বিহ্বল চোখে দাদার দিকে তাকিয়ে, পদ্ম রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে প্রণাম করে বলল, ‘মামাবাবু কতদিন পর, ভাত চড়াই?’

‘দাঁড়া দাঁড়া এটা ধর।’ সীতেশ তার কাঁধের ঝোলাটা তুলে দিলেন পদ্মর হাতে। পদ্ম ঝোলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বার করল গাওয়া ঘিয়ের শিশি, একটা বড়ো পেঁপে, দুটো নারকেল, একটা বড়ো ওলের আধখানা আর মিষ্টির বাক্স।

‘পদ্ম পেঁপেটা দু—দিন রেখে খাবি, এখনও পাকেনি। ঝুলিতে রয়ে গেছে কাঁচালঙ্কা। বুঝলি বুড়ি তুই যেমন ঝাল ভালোবাসিস ঠিক তেমনি কষকষে ঝাল! ওলভাতে ঘি আর কাঁচালঙ্কা মেখে খেয়ে দেখিস। মা মেখে গোল্লা করে তোর মুখে দিত আর ভয়ে ভয়ে বলতিস কুটকুট করবে না তো, মনে আছে তোর?’

‘খুব মনে আছে। আর তুমি অমনি মুখ বাড়িয়ে দিয়ে বলতে, বুড়ি খাসনি ভীষণ কুটকুটে, মা আমাকে দাও। মা তোমাকে ধমকে বলত এখনও তোর পাতে মাখা রয়েছে আগে শেষ কর, এটা বুড়ি খাবে।’

ঝকঝক করছে বিজলির চোখ, দাদাকে পেয়ে প্রায় ষাট বছর আগে পিছিয়ে গেছেন। সীতেশ বললেন, ‘আধখানা ওল আমি আর তোর বউদি খেয়েছি, বাকিটা তোর জন্য আনলুম। পদ্ম ভাত চড়াই বলে দাঁড়িয়ে রইলি কেন! আমি খেয়েই কিন্তু বেরোব, অনেক কাজ আছে। বুড়ি তোকে দেখে মনে হচ্ছে পা ভেঙে ভালোই হয়েছে, বিশ্রাম পেয়েছিস। হাড় সেট হতে ক—দিন লাগবে বলেছে ডাক্তার?’

‘দু—মাস পর ভালো করে হাঁটতে পারব। তুমি চান করবে তো? পদ্ম আমার একটা কাপড় আলমারি থেকে বার করে দে।’

সীতেশ স্নান করতে যাওয়ার পর বিজলি পদ্মকে বললেন, ‘শুধু ডাল ভাজা আর ঝিঙে কুমড়ো মামাবাবুকে খাওয়াবি? চট করে শীতলার থেকে দই আর রসগোল্লা নিয়ে আয়। দাদা দই খুব ভালোবাসে।’ বালিশের তলা থেকে বিজলি টাকা বার করে দিলেন।

সীতেশ ঘরের মেঝেয় বসে ভাত খেলেন। খেতে খেতে বিজলির ভাইপো ভাইঝিদের খবর জানার কৌতূহল মিটিয়ে রান্নার গ্যাস নেওয়ার কথাও জানিয়ে দিলেন।

‘দু—মাইল দূরের থেকে সাইকেল রিকশায় সিলিন্ডার আনা এক ঝামেলা, তা হলেও কয়লার হাত থেকে তো বেঁচেছি। তোর বউদি তো এবেলার রান্না ওবেলা খায় না, নইলে ফ্রিজটাও নিয়ে ফেলতুম। ঘণ্টুর তো দুটো ফ্রিজ বর্ধমানের বাড়িতে, একটা পাঠিয়ে দেবে বলেছিল। তোর তো ফ্রিজ নেই, বলব ঘণ্টুকে?’

‘থাক দাদা, টিভি ফ্রিজ টেলিফোন ছাড়াই বড়ো হয়েছি, ওসব ছাড়াই বাকি জীবনটা কেটে যাবে। যন্তরপাতি ঢোকানো মানেই ঝঞ্ঝাট ঢোকানো, দেখি তো সব এবাড়ি ওবাড়িতে। আজ এই ওটা খারাপ হচ্ছে কাল সেটা খারাপ হচ্ছে ডাক মিস্তিরিকে খবর দে অফিসে। তা ছাড়া অমনি অমনি তো আর টিভি টেলিফোন চলে না, টাকা দিতে হয় মাসে মাসে। আমার অত টাকা কোথায়? এই বেশ সুখে আছি সেধে ভূতের কিল খেতে যাব?’

‘তা বটে। আমাদের ওখানে দিনে ছ—ঘণ্টা কারেন্ট থাকে না। কখন যাবে কখন আসবে কেউ জানে না। সবথেকে অসুবিধে হয় ছেলেমেয়েদের, সেই হ্যারিকেনের আলোতেই লেখাপড়া করতে হচ্ছে যেমন আমরা করেছিলুম।’

‘দাদা জামরুল গাছটার জায়গায় তো পেয়ারা গাছ লাগিয়েছ, হয়েছে পেয়ারা?’

‘হবে না কেন! এখনও পাকেনি, তুই ডাঁশা খেতে পারবি কি পারবি না ভেবে আর আনুলম না।’

‘পারবি কি পারবি না মানে?’ বিজলির ভঙ্গিতে ও স্বরে ঝগড়া ঘনিয়ে উঠল। ‘এই দ্যাখো আমার দাঁত। এখনও আখ দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে চিবিয়ে খাই।’ বিজলি ঠোঁট টেনে ফাঁক করে দাঁত দেখালেন।

সীতেশ বোনের মুখের দিকে না তাকিয়ে বললেন, ‘ডান দিকে ওপরের পাটির কষের দাঁতটা তো এখনও গজাল না, আখ চিবোস কী করে?’ দইমাখা হাত চাটতে চাটতে সীতেশ আড়চোখে তাকিয়ে বললেন।

বারো বছর বয়সে বিজলির দাঁতটা ভেঙে ছিল জামরুল গাছ থেকে তাড়াহুড়ো করে নামার সময় পড়ে গিয়ে, সীতেশ দোতলার ছাদে দাঁড়িয়ে গাছ থেকে বোনের জামরুল পাড়া দেখছিলেন। তখনই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি ভর করে। চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, ‘বুড়ি হাবিদা আসছে রে, নেমে পড় নেমে পড়।’

হালদারবাড়ির বাগানে এই জামরুল গাছটির মালিক গ্রামেরই ছেলে হাবিবুল্লা চৌধুরী। তার মালিকানা পাওয়ার ব্যাপারটাও একটা গল্প। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের ছেলে হবিবুল্লা, ম্যাট্রিক পরীক্ষায় জেলার মধ্যে প্রথম এবং সারা বাংলায় সপ্তম হয়। ভেনিয়াপুর গ্রামের মানুষ আনন্দে আত্মহারা হয়ে দলে দলে মণিরুল চৌধুরির টিনের চালের বাড়িতে যায়। কারোর হাতে নতুন পাজামা কারোর হাতে কাতলা মাছ, কেউ দিল এক হাঁড়ি রাজভোগ কেউ দিল টর্চ, পাউডারের কৌটো। রাজু ঘোষাল পইতেটা হাবিবুল্লার মাথায় ছুঁইয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের মুখোজ্জ্বল করেছ বাবা, দীর্ঘজীবী হও, আরও বড়ো হও।’ হাবিবুল্লা রাজু ঘোষালকে প্রণাম করে স্মিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।

পরের দিন সে যায় হালদারি বাড়িতে। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট মহিমারঞ্জন স্নান করে তখন পুজোয় বসেছিলেন, হাবি এসে অপেক্ষা করছে জানতে পেরে পুজো ফেলে উঠে আসেন। সদর ঘরে দাঁড়িয়ে ছিল হাবিবুল্লা, তাঁকে প্রণাম করতেই মহিমারঞ্জন জড়িয়ে ধরেন।

‘ওগো কোথায় তুমি, নাড়ু নিয়ে এসো, পুজোর থালায় সন্দেশ রয়েছে শিগগিরি আনো। কতবড়ো মানুষ আমার বাড়িতে এসেছে, সারা হুগলি জেলায় প্রথম হওয়া কি চাট্টিখানি কথা! হাবি তো আমাদের গর্ব।’ বাবার চিৎকার শুনে হাফপ্যান্ট পরা সীতেশ ও ফ্রক পরা বিজলি ছুটে আসেন।

মহিমারঞ্জন আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘বাবা খালি হাতে তো আশীর্বাদ হয় না। তোকে তো এখন একটা কিছু দিতে হয়, কিন্তু কী দিই বল তো!’ তিনি চারপাশে তাকিয়ে দেবার জিনিস খুঁজলেন। দেবার মতো কিছুই হাতের কাছে নেই। জানলা দিয়ে চোখে পড়ল জামরুল গাছটা, তাতে ফলও ধরে রয়েছে।

‘হাবি ওই জামরুল গাছটা তোকে দিলুম। আজ থেকে ওটা তোর। ওতে যা ফলবে সব তোর।’

ঘরের সবাই হতভম্ব মহিমারঞ্জনের এই দান দেখে। বিব্রত হাবিবুল্লা বলল, ‘কাকা এই গাছ নিয়ে আমি কী করব। আমি থাকি গ্রামের শেষ প্রান্তে আর এই গাছ এখানে আপনার বাগানে, আমি তো গাছটা তুলে নিয়ে যেতে পারব না। এটা আপনারই থাক।’

‘ব্রাহ্মণের মুখ থেকে একবার যে—কথা বেরিয়েছে তা তো আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।’ মহিমারঞ্জন দৃঢ় ও গাঢ় স্বরে বলেছিলেন, ‘ও গাছ তোমার। ফিরিয়ে নিলে আমি ধর্মচ্যুত হব। তাই কি তুমি চাও?’

নির্বাক হবিবুল্লা মাথা নীচু করে মেনে নিয়েছিল এই দান। সীতেশ আর বিজলি মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছিল। বিজলি পরে দাদাকে বলে, ‘বাবা যেন কী! দিয়ে দিল অমন জামরুল গাছটা?’

সীতেশ বলেছিলেন, ‘দিয়েছে তো কী হয়েছে? হাবিদা কি এতদূর আসবে জামরুল খেতে? ও গাছ আমাদেরই থাকবে।’

তাই—ই ছিল। মহিমারঞ্জনই বরং মরশুমে ফল ধরলে ধামায় করে জামরুল হাবির জন্য খেতে পাঠিয়ে দিয়েছেন, যত দিন সে ভারতে ছিল। হাবিবুল্লা শিবপুর এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করে জলপানি পেয়ে মেটালার্জিতে গবেষণা করতে আমেরিকা চলে যায়। সেখানই বড়ো এক ইস্পাত প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে বিয়ে করে বসবাস শুরু করে, আর গ্রামে ফিরে আসেনি। তবে আমৃত্যু সে মাসে মাসে মাকে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে গেছে।

জামরুল গাছটা হালদারদেরই অধীনে ছিল। শিবপুর থেকে ছুটিছাটায় হবিবুল্লা গ্রামে এলে গাছটা দেখতে আসত। সীতেশ বলেছিলেন বিজলিকে, ‘মনে রাখিস এটা পরের গাছ। পরের দ্রব্য না বলিয়া লইলে চুরি করা হয়। তুই তো হাবিদাকে বলে গাছে উঠে জামরুল পাড়িস না। এটা চুরিই, ধরা পড়লে হাবিদা তোকে পুলিশে দেবে। পুলিশ কোমরে দড়ি বেঁধে সারা গ্রামে ঘোরাবে।’

শুনে বিজলির বুক ঢিপঢিপ করলেও মুখে তেজ দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘ঘোরাক কোমরে দড়ি বেঁধে। জামরুল আমি পাড়বই, হাবিদা জানতে পারলে তো!’

বিজলি যেদিন গাছ থেকে পড়ে দাঁত ভাঙেন তার আগের দিন হাবিবুল্লা বাড়ি এসেছে এটা তিনি জানতেন। ‘হাবিদা আসছে রে, নেমে পড়’, শোনামাত্র তিনি আঁকুপাকু করে নামতে গিয়ে জমিতে পড়ে যান। একটা ইটে ঠোক্কর লেগে দাঁতটা ভাঙে। এখনও বড়ো করে হাসলে বিজলির দাঁতের পাটিতে একটা খালি জায়গা দেখা যায়।

পঞ্চাশ বছরেরও বেশি হয়ে গেল দাঁতের এই শূন্যতার বয়স। মনে থাকে না, দাদা মনে পড়িয়ে দিল। জামরুল গাছটা বুড়ো হয়ে আর ফল দিতে পারত না, কেটে ফেলে সেখানে লাগানো হয়েছে পেয়ারা গাছ। গাছটার সঙ্গে জড়ানো আছে বাবার স্মৃতি ‘ব্রাহ্মণের মুখ থেকে একবার যে—কথা বেরিয়েছে তা আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না, নিলে ধর্মচ্যুত হব।’ হাবিদার কথা : ‘কাকা এই গাছ নিয়ে আমি কী করব এটা আপনারই থাক।’

কিন্তু রইল আর কোথায়? হাবিদা গ্রামে রইল না, গাছটাও কেটে ফেলা হল। আর আমি? বিজলি ভারী নিশ্বাস ফেললেন। ভিজে গামছায় হাত মুছছেন সীতেশ।

‘বুঝলি বুড়ি এবার যেদিন আসব আগে ফোন করে দোব। অলকাদের নম্বরটা তো আমার কাছে আছে। পদ্ম তা হলে অনেক রকম রান্না করে রাখার সময় পাবে। ওর হাতের রান্না বড়ো ভালো।’

আনন্দে পদ্ম বিগলিতপ্রায়। ‘আমি আর রান্নার কী জানতুম। সব তো মাসিমার কাছে শেখা। মামাবাবু আপনাদের যজ্ঞিডুমুর গাছ আছে শুনেছি। এবার যখন আসবেন নিয়ে আসবেন তো খানিকটা। মাসিমা বলেছে শিখিয়ে দেবে ডুমুরের ডালনা।’

‘বুড়ি তোর অর্ডার কী?’

‘কিছু না। বাপের বাড়ির থেকে যা আসবে তাই আমার কাছে সোনার তুল্য।’

ধুতির কষি আঁটতে আটতে সীতেশ বললেন, ‘তোর বউদিও বলে বাপের বাড়ির জিনিসের দাম হয় না, অমূল্য! গত বছর জামাইষষ্ঠীতে ছোটো শালা বাড়ির গাছের আম পাঠিয়েছিল, দবির খাস। আজকাল এই আম তো বাজারে মেলে না। তোর বউদি দিনে একটার বেশি দিত না পাছে ফুরিয়ে যায়। দশদিন ধরে দশটা খেয়েছি। ভালো কথা, মিষ্টির বাক্সটা খুলে দেখলি না, গুণোময়রার বোঁদে! মনে আছে, মা—র কাছে থেকে পয়সা নিয়ে কিনতে গেলে গুণো বলত, ‘এ পয়সা অচল, তামার পয়সা আনো।’ তখন ফুটো পয়সা গরমেন্ট চালু করেছিল। গুণো তো এখন হরে ভূত। ওর নাতি নাদু এখন দোকান চালাচ্ছে, অনেক রকম মিষ্টি বাড়িয়েছে, কাচের শো কেস করেছে, তবে বোঁদেটা ঠাকুরদার আমলের মতোই রেখেছে, খেয়ে দেখিস।’

‘ভাত খেয়েই ছুটছ, কী এমন কাজ তোমার? এতকাল পরে এলে দুটো কথা যে বলবে তাও তোমার সময় হয় না।’ বিজলি প্রায় ঠোঁট ফুলিয়ে আদুরে গলায় বললেন।

শার্টটা মাথায় গলিয়ে সীতেশ বললেন, ‘কাজ কি একটারে, হ্যারিসান রোডে গিয়ে অমিয় বিশ্বাসের জন্য হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ কিনতে হবে, হাঁপানিতে খুব কষ্ট পাচ্ছে। বড়োবাজারে একটা মশারি কিনব আর ভালো হিং পাওয়া যায় কিনা দেখব। পাঁচটা বত্রিশের ট্রেনটা না ধরলে সন্ধে সন্ধে বাড়ি পৌঁছোতে পারব না। তুই হাঁটাচলা শুরু কর তখন এসে দুটো কেন দুশো কথা বলব। তুই বরং আয় না আমাদের ওখানে। তোর বউদি তো প্রায়ই বলে কত বছর ঠাকুরঝিকে দেখি না, আসবি।’

বিজলি হতাশ চোখে তাকালেন শ্রীধরের সিংহাসন আর দেবদেবীদের দিকে। ‘এদের ফেলে রেখে যাব কী করে দাদা। আমি যে নিজের হাত পা নিজেই বেঁধে ফেলেছি। কবে যে মুক্তি পাব!’

সীতেশের সঙ্গে পদ্মও একতলায় নেমে তাঁকে সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। ওপরে ওঠার সময় দেখল ভুটুকে কোলে নিয়ে কল্পনা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে।

‘কী কচ্ছিস?’

‘কী আবার করব, ছেলে আগলাচ্ছি। মা কখন ফিরবে কে জানে।’ বিরক্ত স্বরে বলল কল্পনা।

‘কোলে নিয়ে আছিস কেন, ছেড়ে দে হাঁটুক। চাদে নিয়ে যা।’

পদ্মকে দেখে ভুটু হেলে পড়ল দু—হাত বাড়িয়ে, পদ্ম তাকে তুলে নিল কল্পনার কোল থেকে।

‘আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। হাসিদি এলে ওকে নিয়ে আসিস।’

‘হাসিদি তো কাল সকালে নার্সিংহোমে ভরতি হবে। বুকে কী হয়েছে অপারেশন করবে।’

‘কই আমাদের তো বলেনি!’ পদ্ম রীতিমতো অবাক।

‘ওরা অমনই, কাউকে কিছু বলে না, নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় বলাবলি করে।’

‘হাসিদি নার্সিংহোমে গেলে ভুটু কার কছে থাকবে?’ পদ্ম আরও অবাক হয়ে বলল।

‘আমার কাছে। তা ছাড়া আর কার কাছে থাকবে?’

‘আর রাতে?’ পদ্মর বিস্ময়ের ঘোর এখনও চলছে।

‘বাবার কাছে থাকবে।’ কল্পনা বলল সহজ কথায়।

‘অ।’ ছোট্ট একটা শব্দে পদ্ম তার ক্ষোভ বিরগ আপত্তি প্রকাশ প্রকাশ করে ভুটুকে কোলে নিয়ে উপরে উঠে গেল।

বিজলির ঘরে ঢুকেই পদ্ম গজগজ করে উঠল। ‘আমাদের পর ভাবে নইলে একবার বলতে তো পারত, মাসিমা ভুটুকে আপনারা রাখুন যত দিন না নার্সিংহোম থেকে ফিরে আসছি। কল্পনা সারাদিন ওকে দেখবে ভেবেছো? কুঁড়ের বেহদ্দ, কুম্ভকন্যের মাসতুতো বোন, পড়ে পড়ে তো শুধু ঘুমোবে।’

‘হয়েছে কী? অত রাগ কেন?’

‘রাগব না? হাসিদি একবার বলল না অপারেশন করাতে যাবে আর কালকেই যাবে! আমরা জানলে কি ওকে যেতে দোব না? বুঝলে মাসিমা যতই তুমি ওদের আপন ভাবো, পাঁচালি পড়াও ওরা কিন্তু তোমাকে আপন ভাবে না, এই আমি বলে দিলুম।’

ভুটুকে সে বসিয়ে দিল বিজলির পাশে। সঙ্গে সঙ্গে ভুটু পা ছড়িয়ে বসা বিজলির দুই ঊরুর উপর উঠে দু—ধারে দুটো পা দিয়ে ঘোড়ায় চড়ার মতো বসে শরীর দোলাতে শুরু করল।

‘হয়েছে হয়েছে, বাবা আমার লাগছে, তুমি এখন আমার পাশে লক্ষ্মী ছেলের মতো বসো তো।’ বিজলি দু—হাত দিয়ে ধরে ভুটুকে বিছানার উপর রাখলেন। এবার উঠে দাঁড়িয়ে ভুটু দু—হাত দিয়ে বিজলির গলা জড়িয়ে ধরে নাকটা মুখের মধ্যে পুরে নিল।

‘পদ্ম পদ্ম ধর ধর। আমার নাক গেল।’ বিজলি আর্তনাদ করে উঠলেন। পদ্ম দ্রুত ভুটুকে ধরে মেঝেয় নামিয়ে দিল।

‘ব্যাটার চারটে দাঁত উঠেছে, দ্যাখ তো রক্তটক্ত বেরিয়েছে কিনা?’

‘না কিছু হয়নি।’ বিজলির আঁচল দিয়ে নাক থেকে লালা মুছে দিল পদ্ম।

‘হাসি কাল নার্সিংহোমে যাবে কে বলল তোকে, কল্পনা? বলবে নিশ্চয়। এক বাড়িতে থাকি যখন, এতবড়ো একটা ব্যাপার হতে যাচ্ছে, না বলে পারবে? তুই রাগারাগি করছিস কেন!’ বিজলি প্রত্যয় ভরে শান্ত স্বরে বললেন।

‘দ্যাখো বলে কিনা।’ পদ্ম ঠোঁট উলটিয়ে কথাটা বলেই লাফিয়ে গিয়ে ধরল ভুটুকে। ‘তোমার এই ঠাকুরদেবতার সব্বোনাশ কিন্তু এই ছেলের হাতেই হবে বলে রাখছি।’

বিজলি হাসতে শুরু করলেন। স্নেহ মমতায় তাঁর দু—চোখ ভরা। ‘সব্বোনাশ হলে তো ভালোই, মুক্তি পাব এঁদের হাত থেকে। বাক্সটা খুলে ওকে দুটো বোঁদে দে, মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসে।’

‘কল্পনা বলল রাতে ভুটুকে রাখবে ওর বাবা। এই বাচ্চচাকে রাখবে পুরুষমানুষ!’ পদ্মর ভ্রু কপালে উঠল।

বিজলি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘এটা ওকে বাড়াবাড়ি। আমি নয় শয্যাশায়ী কিন্তু তুই তো আছিস। হাসি তো বলতে পারত ভুটুকে রাতে তোর কাছে রাখতে। রাতে কত রকমের কাজ থাকে বাচ্চচার, সেসব কি ব্যাটাছেলে করতে পারবে? হাসি এলে তুই গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলবি, জানিয়ে দিবি মাসিমা খুব দুখ্যু পেয়েছে তোমাদের ব্যবহারে।’

পাঁচ

হাসি ঘরে পা দেওয়ামাত্র ঝাঁঝিয়ে উঠলেন বিজলি। ‘তোমাদের কত্তাগিন্নির ব্যাপার কী বলো তো? আমাদের কাছে ভুটুকে রেখে গেলে কি ও জলে পড়ে যাবে? জ্যোতি পারবে রাত্তিরে ওকে রাখতে?’

বিব্রত হয়ে হাসি বলল, ‘ভাঙা পা, আপনার তো অসুবিধে হবে। তাই—’

হাসির কথা শেষ হবার আগেই বিজলি প্রায় ধমকে উঠলেন। ‘তাই ভদ্রতা দেখিয়ে আমাকে আর বলোনি। ক—দিন থাকবে নার্সিংহোমে?’

‘ছ—সাত দিন।’

‘আমার পা ভাঙা কিন্তু পদ্মর তো পা ভাঙেনি! ভুটু ওর ন্যাওটা, পদ্মর কাছে ও সবথেকে ভালো থাকবে। ওর বিছানা, কাঁথা, দুধের বোতল, জামা সব কল্পনাকে দিয়ে কাল ওপরে পাঠিয়ে দেবে আর খেলনা যা আছে তাও যেন দিয়ে যায়।’

হাসি মাথা হেলাল, মুখে স্পষ্ট স্বস্তি।

‘নার্সিংহোমটা কোথায়, আমাদের লোটাস?’

‘বউবাজারে রোজমেরি নার্সিংহোম। জ্যোতির এক ছাত্রের বাবার। উনি চারটে ইনস্টলমেন্টে টাকা নেবেন তবে ডাক্তারদের ফি একসঙ্গে একেবারে দিতে হবে।’

‘ডাক্তাররা কত নেবে?’

‘সেটা আমি ঠিক জানি না মাসিমা।’

‘তোমার এখন কোনো কষ্ট হচ্ছে?’

‘না।’

‘তোমরা ওল খাও?’

হাসি অবাক হয়ে বলল, ‘খাই। হঠাৎ ওল খাই কিনা জিজ্ঞাসা করছেন?’

‘আমার দাদা দিয়ে গেছেন। রাতে তোমরা তো ভাত খাও, পদ্ম ডালনা করে দিয়ে আসবে। ওল খেলে রক্ত পরিষ্কার হয়। আপিস থেকে ছুটি নিয়েছ কত দিনের?’

‘একমাসের।’

‘এরপর আপিস যাতায়াত করবে খুব সাবধানে, যা ভিড় হয়, লেগেটেগে যেন না যায়।’

‘মাসিমা আপনার একটা নতুন পাঁচালির বই জ্যোতিকে আনতে বলেছি।’

‘বই দিয়ে আর কী হবে। বেস্পতিবারের পাট এখন তো বন্ধ। তুমি ফিরে এসো, তত দিনে মনে হয় পা ফেলতে পারব। ঠাকুরদের ফুল মালা চন্দন দেওয়া, শোয়ানো, নারায়ণকে স্নান করানো কিছুই হচ্ছে না। জ্যোতিকে বোলো আমাকে যেন রোজ তোমার খবরটা দেয়। পোড়া পায়ের এই অবস্থা না হলে আমি নিজে গিয়ে খোঁজখবর নিতুম। জ্যোতি ছুটি নিয়েছে?’

‘কালকের দিনটা নিয়েছে। অন্যদিনগুলোয় স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে চলে আসবে। এর আগেও দু—দিন তাড়াতাড়ি স্কুল থেকে বেরিয়ে আমাকে দেখিয়ে এনেছে ওখানে। স্ক্যান করাতে বায়পসি করাতেও নিয়ে গেছিল। ওকে হেডমাস্টার বলেছিলেন ছুটি নিন, ও নেয়নি। অপারেশন কালকেই যে হবে এমন কোনো কথা নেই পরশুও হতে পারে। যদি পরশু হয় তা হলে পরশুও স্কুলে যাবে না।’

‘ভালোয় ভালোয় ফিরে এসো ভগবানের কাছে এই প্রার্থনাই করি।’

পরদিন সকাল আটটা নাগাদ স্বামীর সঙ্গে হাসি ট্যাক্সিতে উঠল। ভুটুকে কোলে নিয়ে কল্পনা দাঁড়াল সদর দরজায়। ভুটু ঝুঁকে পড়ে দু—হাত বাড়িয়ে দিল গাড়িতে বসা মায়ের দিকে। কল্পনা তাকে আঁকড়ে ধরে সামলাতে লাগল। শুরু হল ভুটুর কান্না। হাসি গাড়ি থেকে নেমে এসে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে দু—গালে চুমু দিয়ে কল্পনার হাতে ফিরিয়ে দিল। দ্রুত গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করেই সামনে তাকিয়ে বলল ‘চলো।’

বিজলি পরের দিন সন্ধ্যায় খবর পেলেন হাসি ভালো আছে। ডান স্তনটা কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। জ্ঞান ফিরেছে কথা বলেছে। প্রথম দিন ভুটু দিনের বেলায় একতলায় কল্পনার কাছে ছিল। সন্ধ্যায় তাকে বিজলির খাটের উপর পদ্ম তুলে দেয়। কাপড়ের একহাত লম্বা একটা পাণ্ডা ভালুক, হাওয়া ভরা প্লাস্টিকের ডলফিন, প্যাঁচ দেওয়া লাঠির মতো বেলুন, দুটো প্লাস্টিকের চাকাভাঙা মোটরগাড়ি, এইসব সামগ্রী নিয়ে বিজলির সঙ্গে কিছুক্ষণ খেলার পর ভুটু উৎসাহ হারিয়ে খাট থেকে নামার জন্য বায়না জোড়ে। পদ্ম এলাচদানা দিয়ে শান্ত করে। এলাচদানা ফুরিয়ে গেলে আবার কান্না শুরু হয়।

‘সন্ধের সময় বাচ্চচাদের মাকে মনে পড়ে।’ বিজলি বললেন পদ্মকে, ‘হাসি আপিস থেকে ফিরে ওকে নিয়েই তো থাকত। পদ্ম ওকে এবার একটু রাস্তায় ঘুরিয়ে আন, গাড়িঘোড়া লোকজন দেখে ভুলে থাকবে।’

পদ্ম ভুটুকে নিয়ে জয় দত্ত স্ট্রিট থেকে বড়ো রাস্তার মোড় পর্যন্ত যায়। ভুটু যানবাহন আলো শব্দ মানুষজন মুগ্ধ কৌতূহলে দ্যাখে। দেখতে দেখতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পদ্মর কাঁধে মাথা রেখে ঝিমিয়ে পড়ে। পদ্ম ফিরে আসে ঘুমন্ত ভুটু আর একটা পকেট ট্রানজিস্টর হাতে নিয়ে।

‘কোথায় পেলি এটা?’ বিজলি অবাক।

ভুটুকে খাটে শুইয়ে দিয়ে পদ্ম বলল ‘নীচের দাদা দিল, এটা হাসিদির। বলল মাসিমাকে দাও উনি শুনবেন। আমি বললুম আপনি শুনবেন না? তাইতে বলল আমার শোনার জন্য একটা আছে। এই বলে একটা ক্যাসেট টেপ রেকর্ডারে ঢুকিয়ে চাবি টিপল আর অমনি গান বাজতে লাগল।’

রেডিয়োটা হাতে নিয়ে বিজলি বললেন, ‘হাসি গান শুনতে ভালোবাসে। মাঝে মাঝে অনেক রাত্তিরে নীচের থেকে গান ভেসে আসত।’ একটা কথিকা হচ্ছে, তিনি ডায়ালের কাঁটা ঘোরাতেই গান বেজে উঠল। লোকসংগীত পুরুষের গলায়, তিনি শুনতে লাগলেন।

‘মাসিমা মেঝের কোন দিকটায় ভুটুকে শোয়াব? এই দিকে তোমার খাটের পাশে বিছানা পাতি? তুমি তো আর নামছ না।’

অনেক বছর পর বিজলি মন দিয়ে গান শুনছেন। শুনতে ভালো লাগছে। পদ্মর কথায় আলগাভাবে বললেন ‘যা ভালো বুঝিস কর। ঘুম থেকে তুলে ওকে দুধটা খাইয়ে দে। কলঘরে গিয়ে মুতিয়ে আনবি।’

ছোট্ট তোষকের উপর রাবার ক্লথ ও কাঁথা পেতে মাথার বালিশটা রাখতেই বিজলি হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘পদ্ম করলি কী? উত্তর দিকে মাথার বালিশ? তোকে সেদিনই বললুম না গণেশের মাথাটা কেন হাতির হল? বালিশ এদিকে রাখ।’

অপ্রতিভ পদ্ম তাড়াতাড়ি বালিশটা বিছানার অন্য দিকে রেখে বলল, ‘ও দিকটা যে উত্তর জানতুম না, ভাগ্যিস বললে। ভুটুর মাথাটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দোব মাসিমা?’

‘তুই ভেবেছিস তা হলে শনির দৃষ্টি আটকানো যাবে? মুখ্যু কোথাকার, ঠাকুর দেবতার দৃষ্টি কাপড় দিয়ে আড়াল করা যায় না। পুণ্যি অর্জন করলেই দেবতার শুভ দৃষ্টি পাওয়া যায়।’

পরের দিন দুপুরে এক কাণ্ড ঘটল। ঘরের দরজা খুলে কল্পনা দুপুরে ঘুমোচ্ছিল পাশে ভুটুকে শুইয়ে। একসময় ঘুম ভেঙে ভুটু উঠে বসে খাটের তলায় ঝুড়িতে জমিয়ে রাখা পুরোনো কাপড়গুলো টেনে বার করে সময় কাটাচ্ছিল। সেই সময় হুলো বেড়ালটা ঘরে ঢুকে একটা বাচ্চচা ছেলেকে দেখেই অত্যাচারিত হওয়ার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে শুরু করে। ভুটু হামা দিয়ে হুলোর পিছু নেয়। ভুটু দোতলার শেষ ধাপে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং টলমল করতে করতে পিছন দিকে উলটে যায়।

বিজলির ঘুম পাতলা। ‘ঢপ’ একটা শব্দ এবং ভুটুর চিৎকার ও কান্না শুনেই বিছানায় উঠে বসে তারস্বরে বলতে থাকেন, ‘কী হল, অ কল্পনা ভুটু বোধহয় পড়ে গেছে, দ্যাখ দ্যাখ ভুটু বোধহয় সিঁড়িতে পড়ে গেছে।’

ভুটু তখনও চিৎকার করে যাচ্ছে শুনে বিজলি বুঝে গেলেন কল্পনা নীচে নেই বা এখনও ঘুমোচ্ছে। পদ্মও বাড়িতে নেই, মাইনে বাবদ বিজলির দেওয়া মাসের বরাদ্দ তিনশো টাকাটা মাকে দিতে গেছে। বিজলি বিছানায় বসে আবার চিৎকার করলেন, ‘ওরে কল্পনা, ভুটু সিঁড়িতে পড়ে গেছে গিয়ে দ্যাখ।’

কান্নাটা এখন ফুঁপিয়ে হচ্ছে। বিজলি খাট থেকে দুটো পা ঝোলালেন। ধীরে ধীরে ভালো পা—টা মেঝেয় রেখে প্লাস্টার করা পা—টা এক বিঘৎ মেঝে থেকে তুলে রেখে খাটে দু—হাতের ভর রেখে লাফিয়ে লাফিয়ে খাটের শেষ প্রান্তপর্যন্ত গিয়ে বারান্দার দিকে মুখ করে চিৎকার করলেন, ‘ওরে হারামজাদি কল্পনা। মুখপুড়ি তুই কোথায়?’ কল্পনার সাড়াশব্দ না পেয়ে এবার তিনি ধীরে ধীরে একপায়ে ভর রেখে উবু হয়ে বসে দু—হাত মেঝেয় রাখলেন। তারপর হামা দিয়ে বারান্দায় এসে দুই রেলিঙের মাঝে মুখটা চেপে কর্কশ স্বরে চিৎকার করলেন। ‘ভুটু যে মরে গেল! হারামজাদির কালঘুম এখনও ভাঙল না? ওরে আবাগির বেটি উঠে দ্যাখ ছেলেটার কী হল, বাঁচল না মরল সেটা দ্যাখ।’

পাশের বাড়ির জানলা থেকে এক গৃহিণী বললেন, ‘কী হল দিদি অমন চ্যাঁচাচ্ছেন কেন?’

‘আর বোলো না। এই এক ঘুমকাতুরে মেয়ের হাতে বাচ্চচা রাখার দায়িত্ব দিয়ে গেছে বাবা, মা গেছে নার্সিংহোমে অপারেশন করাতে। টাকা নিয়ে কাজ করছিস, কাজটা অন্তত কর তা নয় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে! ছেল এদিকে সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে চিক্কুর দিয়ে উঠেছে। মাথাটাথা ফেটেছে কিনা কে জানে। ওই শোনো ভুটু এখনও কাঁদছে।’

তাই শুনে পাশের বাড়ির গৃহিণী বিজলির সাহায্যে নেমে বাজখাঁই কণ্ঠে চেঁচালেন, ‘ওরে কল্পনা উঠে দ্যাখ কী কাণ্ড হয়েছে।’

ভুটুর কান্না বন্ধ। বিজলি বুঝে গেলেন কল্পনা ঘুম থেকে উঠেছে।

‘দিদি আপনার পা এখন কেমন? ওই পা নিয়ে আপনি বারান্দায় বেরিয়ে এসেছেন!’ পাশের বাড়ির গৃহিণী যুগপৎ তারিফ ও বিস্ময় তাঁর কণ্ঠে ধরে দিলেন।

‘কী করব ভাই ছেলেটাকে তো দেখতে হবে। একটা অসহায় বাচ্চচা, ভিখিরির ছেলে তো নয় ভদ্র বামুনের ঘরের ছেলে।’

‘শুনলাম ওর মায়ের ক্যানসার, সত্যি?’

‘হ্যাঁ সত্যি।’

‘ইসস কী যন্ত্রণা পাচ্ছে বলুন তো! এখন বাঁচলেই ভালো।’

ভুটুকে কোলে নিয়ে কল্পনা দোতলায় উঠে এল। বিজলি তখনও বারান্দায় হাঁটু গেড়ে। ভুটুর রক্তপাত হয়নি, রগের কাছটা ফুলে লাল হয়ে রয়েছে। বিজলিকে দেখে সে ফুঁপিয়ে উঠল। তিনি দু—হাত বাড়িয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলে। নানান সান্ত্বনা বাক্যে ভুটুকে তুষ্ট করতে করতে তিনি বুঝলেন এখন তিনি বিপন্ন। উঠে দাঁড়াতে হলে দু—পায়ের উপর চাপ দিয়ে দাঁড়াতে হবে।

‘ধর ওকে।’ ভুটুকে তুলে দিলেন কল্পনার হাতে। তারপর হামা দিয়ে ঘরে ফিরে এসে খাটের পায়া ধরে দাঁড়ালেন এক পা মেঝে থেকে তুলে।

‘মাসিমা তোমাকে ধরব?’ ভয়ে ভয়ে কল্পনা বলল।

‘ধরে ধরে নিয়ে চল।’ অসহায়ভাবে বললেন বিজলি। ভেবেছিলেন প্রচণ্ড বকুনি দেবেন, কিন্তু ওর সাহায্যটাও এখন দরকার। যা বলার পরে বলবেন।

‘কী করব আমার খালি ঘুম পায়। মা বলে এটা নাকি আমার ব্যামো।’ ভুটুকে খাটে বসিয়ে কল্পনা বিজলির একটা হাত গলায় জড়িয়ে তাঁকে খাটের ধারে নিয়ে যেতে যেতে বলল।

‘ঘরের দরজাটা বন্ধ করে যদি ঘুমোতিস ভুটু তা হলে বেরোতে পারত না।’ বিজলি শান্ত গলায় বললেন, কল্পনার অকপটতা তাঁকে স্পর্শ করেছে।

‘এবার থেকে তাই করব। নাও বোসো, আমি দুটো পা খাটে তুলে দিচ্ছি তুমি গড়িয়ে চিত হয়ে যাও।’

কল্পনার কথামতো বিজলি তাই করলেন। টের পেলেন পায়ের ভাঙা জায়গাটায় ছুঁচ ফোটার মতো একটা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।

পরের দিন দুপুরে কথায় কথায় পদ্ম বলল, ‘রাধুমাসিমার শ্রাদ্ধ হবে না?’

‘কেন, তোর তাতে কী?’

‘আমার আবার কী হবে। মা—র কাছে শুনলুম আত্মঘাতী হলে নাকি ওরা ভূত হয়ে বেঁচে থাকে, ওদের মুক্তি হয় না, সত্যি?’

বিজলি মুশকিলে পড়লেন, আত্মঘাতী হলে শ্রাদ্ধ করা যায় কি না সেটা ঠিক জানেন না। তাঁর জীবনে আত্মীয়স্বজন বা পরিচিতদের মধ্যে কেউ আত্মহত্যা করেনি, তবে অপঘাতে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তাদের শ্রাদ্ধও হয়েছে। যতদূর শুনেছেন আত্মহত্যা করলে শ্রাদ্ধ নয় প্রায়শ্চিত্ত করাতে হয়। অবশ্য তাতে আত্মার মুক্তি ঘটে কিনা সে সম্পর্কে তাঁর সন্দেহ আছে।

‘রাধুমাসি ভূত হবে বলছিস?’ বিজলি গম্ভীর স্বরে বললেন।

‘আমি নয় মা বলল।’

‘মেয়েমানুষ ভূত হয় না পেত্নি হয়, এটা তোর মা জানে না?’

‘ভূতেরা তো ঘাড় মটকায়।’

‘পেত্নিরাও মটকায়। বেঁচে থাকতে যারা শত্রুতা করেছে, কষ্ট দিয়েছে মারা গিয়ে তাদের ঘাড় মট করে ভেঙে দেয়। খুব সাবধান পদ্ম। তোর কাছে বিষ চেয়েছিল তুই দিসনি, মনে আছে?’

‘ওকে বাঁচাতেই চেয়েছি, এটা কি শত্রুতা?

বিজলির চোখ দিয়ে বিস্ময় ঠিকরে বেরোল। ‘তোর কাছে চাইল আর তুই দিলি না এটা কি রাধু ভুলে যাবে ভেবেছিস?’ পদ্মর মুখ কাঁদোকাঁদো হয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি আশ্বাস দিলেন, ‘ভয় পাচ্ছিস কেন? সেই মন্তরটা বলবি ‘ভূত আমার পুত পেত্নি আমার ঝি। রামলক্ষ্মণ বুকে আছে করবি আমার কী।’ ব্যস তিন বার বলবি রাত্তিরে ঘুমোবার আগে, তোর ধারেকাছে ভূত পেত্নি আসবে না। জানলা দিয়ে হাত বাড়াবে কিন্তু তোকে ছোঁয়ার সাহস হবে না।’

বিকেলেই পদ্ম শোভাবাজারে গিয়ে রাম সীতা ও লক্ষ্মণের রঙিন একটা কাচে বাঁধানো এক ফুট লম্বা ছবি কিনে আনল।

‘তুই আবার রামভক্ত কবে থেকে হলি রে পদ্ম?’ বিজলি মুচকি হেসে বললেন।

হাসিটা দেখে পদ্ম চটে গেল। শুকনো স্বরে বলল, ‘তুমি এতগুলো দেবদেবীর ভক্ত হতে পারো আর আমি রামের ভক্ত হলেই দোষ! সবারই নিজের নিজের ভক্তি করার দেবতা আছে।’

‘তা তো আছে কিন্তু রাম লক্ষ্মণকে রাখবি কোথায়? আমার ওখানে তো জায়গা নেই।’

‘মাথার কাছে রাখব।’

‘সে তো রাতে আর দিনেরবেলায়?’

‘খাটের নীচে।’

বিজলি ধমকে উঠলেন, ‘খবরদার, দেবতাদের মাথার উপরে শুয়ে আমি পাপ কুড়োতে পারব না, তুই অন্য জায়গা দ্যাখ। খাটের নীচে রাখলে তো ভুটুর হাতে পড়বে তখন তো তিনটুকরো হয়ে যাবে তোর দেবতা।’

বিব্রত মুখে পদ্ম ঘরের এধার—ওধার তাকিয়ে বলল, ‘ওই সেলাইকলটার ওপর দিনের বেলায় রাখব,’ ঘরের কোণে তপতীর জন্য কিনে রাখা সেলাইকলটা সে দেখাল।

আলো নিভিয়ে রাতে ভুটুকে নিয়ে শুয়ে পদ্ম ছবিটা তার বালিশের নীচে রাখল। বিজলি শুনতে পেলেন পদ্ম বিড়বিড় করছে। একটু পরে পদ্ম উঠে তার পায়ের দিকের জানলাটা বন্ধ করল।

‘কী রে জানলা বন্ধ করলি যে?’

ভারী গলায় পদ্ম বলল, ‘মেঘ করেছে বৃষ্টির ছাট এসে সব ভিজিয়ে দেবে।’

পাঁচ দিন পর যখন ফিরে এল হাসি, তখন বিজলি আবার লোটাস নার্সিং হোমে গেছেন পায়ের যন্ত্রণা অব্যাহত থাকায় এক্সরে করাতে। পাড়ার ক্লাবের সেই ছেলেরাই তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে গেল এবং ফিরিয়ে দিয়ে গেল, সঙ্গে ছিল পদ্ম এবং অলকা। তার পায়ের অবস্থার কথা শুনে অলকাই লোটাসে গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে নিয়ে যায়। লোটাস থেকে ফিরেই তিনি শুনলেন হাসি ফিরে এসেছে এবং ভালো আছে। তিনি নিজেই পদ্মকে বললেন, ‘ভুটু রাতে মায়ের কাছে থাকবে, এটা বলে আয় ওদের। অনেকদিন ছেলে ছাড়া হয়ে আছে এবার ছেলেকে কাছে নিক। আর বলিস সঙ্গে করে এক বিছানায় যেন না শোয়, বুকে অতবড়ো অপারেশন হয়েছে, ভুটু যা হাত—পা ছোড়ে লেগেটেগে যেতে পারে।’

রাতে অন্ধকার ঘরে মেঝেয় শোয়া পদ্ম একসময় বলল, ‘মাসিমা কীরকম খালি খালি লাগছে, তোমার?’

‘আমারও।’

একমাস পর হাসি অফিসে গেল। এক্সরে দেখার পর ডাক্তারের নির্দেশ ‘একমাস একদম নড়াচড়া নয়। অমন করে খাট থেকে নেমে বারান্দায় না গেলে জোড়াটা ঠিকমতো লেগে যেত। খুব বেশি ক্ষতি হয়নি, একটু বেঁকে থাকবে। বলেন তো আর একবার অপারেশন করে ঠিক করে দিতে পারি।’

বিজলি আঁতকে উঠে বলেছিলেন, ‘রক্ষে করো। অজ্ঞান হতে পারব না।’

বিজলি এরপর থেকে কঠিনভাবে ডাক্তারের নির্দেশ পালন করে যাচ্ছেন। ভুটুকে আর খাটে তোলেন না। পদ্ম বা কল্পনার কাছ থেকে হাসির এবং পাড়ার খবর নেন। অলকা প্রায়ই আসে। জ্যোতি ঘরভাড়া দিতে এলে তিনি জানিয়ে দেন, ‘আমার এখন টাকার জন্য ব্যস্ততা নেই। তোমাদের অনেক টাকা খরচ হয়েছে, আরও হবে। ও টাকা তুমি রেখে দাও পরে সুবিধেমতো ভাড়া দিয়ো।’

হাসি মাসখানেক অফিস করার পর আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবার সে ডাক্তার দেখায়, এক্সরে করে। চার দিন পর বিজলি শুনলেন, ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে ফুসফুসে, গলায়। প্রথম বার অপারেশন করাতে বা ডাক্তার দেখাতে গড়িমসি করায় ক্যানসার বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে যায়। যদি কোনো ক্যানসার বিশেষজ্ঞ দিয়ে প্রথমেই দেখাত তা হলে এখনকার এই অবস্থা হত না। বিজলি বললেন, ‘কপাল! যার যা কপালে লেখা আছে, কে তা খণ্ডাতে পারে।’

রাত্রে ভুটুকে দোতলায় দিতে এসেছিল জ্যোতি। বিজলি তাকে চেপে ধরলেন, ‘সত্যি করে বলো তো হাসির অবস্থাটা কেমন, সেরে উঠবে কিনা?’

ইতস্তত করে জ্যোতি বলে, ‘ডাক্তার তো বললেন ছড়িয়ে গেছে। ছড়ানোটা বন্ধ করতে রেডিয়ো থেরাপি করাতে বললেন। আমার এক ছাত্রের দাদা এন আর এসে হাউসস্টাফ। তাকে বলেছি ওখানে রে দেবার ব্যবস্থা করে দিতে। পরশু থেকে শুরু হবে, দশ বার নেবে।’

‘তা হলেই হাসি ভালো হয়ে যাবে?’

‘না।’ দ্রুত উত্তর দিল জ্যোতি। বিজলির মনে হল উত্তরটা তৈরি হয়েই ছিল। শুধু অপেক্ষা করছিল মুখ থেকে বার করে দেবার সময়ের জন্য।

‘হাসি জানে?’

‘এখন বোধহয় জেনে গেছে। মাসিমা ভুটু রইল।’

জ্যোতি চলে যাবার পর বিজলি চিত হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। রাতে ঘুম এল না।

হাসি রেডিয়ো থেরাপি করাতে যায় ট্যাক্সিতে, দুপুরে সঙ্গে যায় কল্পনা। বাড়িতে পদ্ম আগলে রাখে ভুটুকে। জ্যোতি যথারীতি সকালেই স্কুল বেরিয়ে যায়। দশটা রে নেবার পর ডাক্তার শেষ চেষ্টা হিসাবে কেমোথেরাপি করতে বলে। বিজলি বিছানায় বসে উদবিগ্ন হয়ে পদ্মকে বলেন, ‘হ্যাঁরে কেমোথেরাপিটা কী জিনিস? একবার জ্যোতিকে জিজ্ঞাসা করে আয় না। রেডিয়ো থেরাপির মতো কি?’

পদ্ম রাতে জ্যোতির কাছ থেকে শুনে এসে বলে, ‘এটা অন্য ভাবে করে। হাতে ছুঁচ ফুটিয়ে উঁচু থেকে নল দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে শরীরে ওষুধ ঢোকায়। চার—পাঁচ ঘণ্টা কি তার বেশি সময় লাগে। দশ দিন অন্তর নিতে হবে হাসিদিকে।’

‘তখন কি খুব কষ্ট হয়?’

‘তা তো জিজ্ঞেস করিনি! দাঁড়াও জিজ্ঞেস করে আসি।’

‘থাক আর জিজ্ঞেস করতে হবে না। বার বার অসুখের কথা তুললে ওর খারাপ লাগবে।’ কেমো নেবার এক মাসের মধ্যে হাসির মাথার চুল ঝরে পড়ল। তিন বার কেমো নেবার পর ডাক্তার জ্যোতিকে বলেছেন, আর খরচ করার দরকার নেই। ওনার যা খেতে ইচ্ছে হয় খেতে দিন।

শেষের কথাটা বিজলির কানে আসতেই পদ্মকে তিনি বললেন, ‘জেনে আয় তো হাসির কাছে থেকে কী খেতে ভালোবাসে তবে নিরিমিষ্যি কিন্তু।’

‘ওম্মা চিবিয়ে খাবে কী, গলা দিয়ে কিছু কি নামে? নালিটালি সব তো ক্যানসারে খেয়ে ফেলেছে। এখন তো শুধু জলের মতো জিনিস চামচে করে খায়!’

বিজলি স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এতবড়ো একটা ব্যাপার কয়েক দিনের মধ্যে তাঁর ঘরের নীচে ঘটে গেল আর তিনি রয়েছেন অন্ধকারে। গুম হয়ে বসে তিনি নিজের ভাগ্যকে দুষলেন। কেন যে মরতে রথ টানতে গেলুম, কেন যে ওই রোগাপটকা রিকশাওয়ালাটার রিকশায় উঠলুম, কেন যে রাস্তা খুঁড়ে সারায় না। ভাবতে ভাবতে তাঁর মাথা গরম হয়ে উঠল। হাসির গলা দিয়ে কিছু নামে না তার মানে ও মরছে। বাচ্চচাটা এবার কী করবে, কোথায় কার কাছে থাকবে? ভেবে কূলকিনারা পেলেন না।

থালায় ভাত, চচ্চচড়ি, করলাভাতে, বাটিতে ডাল নিয়ে পদ্ম টুলটা টেনে এনে খাটের ধার ঘেঁষে রাখল। থালাটা তার উপর রেখে বলল ‘জানো মাসিমা বাজারে আজ ফুলকপি দেখলুম, অসময়ের কপি, ভাবলুম কিনে ফেলি তুমি তো ফুলকপি ভালোবাস। এইটুকু একটা বলল কিনা কুড়ি টাকা। কী দাম—’

তার কথা শেষ হবার আগেই ঝনঝন শব্দে কাঁসার থালা মেঝেয় ছিটকে পড়ে ছড়িয়ে গেল ভাত, ছিটকে পড়ল ডাল। বিজলি তারপর টুলটাও উলটে ফেলে দিলেন।

‘মেয়েটা খেতে পারছে না কষ্ট পাচ্ছে, আর আর আমি চিবিয়ে চিবিয়ে কপি গিলব? দূর কর সব আমার সামনে থেকে।’

বিজলির মুখের ভাব দেখে ফ্যাকাশে হয়ে গেল পদ্ম। ছিটকে যাওয়া ভাতের কয়েকটা ঠাকুরের সিংহসন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। সিংহাসন ছোঁয়া তার বারণ, তা মনে না রেখে রাধাকৃষ্ণর পায়ের উপর থেকে পদ্ম কুড়িয়ে নিল ভাতগুলো। ঝাঁটা এনে জড়ো করল মেঝেয় ছড়ানো ভাত, ন্যাতা দিয়ে মুছল মেঝে, একটি কথাও এতক্ষণ সে বলেনি।

‘তুই খেয়ে নে।’ বিজলি গম্ভীর গলায় হুকুম করলেন। কোনো কথা না বলে পদ্ম ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মাথার নীচে দু—হাতের তালু রেখে শুয়ে রইলেন বিজলি। পদ্ম ঘরে ঢুকল বিকেলে।

‘ভাত খেয়েছিস?’

পদ্ম চুপ।

‘কীরে জবাব নেই কেন?’

‘না।’ বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ছয়

ভুটুকে বুকের কাছে আঁকড়ে বিজলি বিছানায় শুয়েই শুনলেন হরিবোল ধ্বনি। বিজলির টাকায় পাড়ার ছেলেরা খাট আনে ফুল আনে। পদ্ম চন্দন বেটে হাসির কপালে লবঙ্গ দিয়ে ছাপ দেয়। চওড়া করে সিঁথিতে সিঁদুর দেয়। বেনারসি নেই, রেশমের শাড়ি পরিয়ে দু—পায়ে আলতা দেয়। ফুল দিয়ে ঢেকে দেয় কেশবিহীন মাথাটা। কে একজন একটা গীতা হাসির বুকের উপর রেখে দিল।

জয় দত্ত স্ট্রিটের দু—ধারের বাড়ির দরজায় মানুষ, বারান্দা জানলা ছাদেও মানুষ। এত অল্পবয়সি এয়োতি স্মরণকালের মধ্যে এ পাড়ায় মারা যায়নি। অল্পবয়সি বউয়েরা হাসির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম জানিয়ে কামনা করল তার মতো সিঁথির সিঁদুর বজায় রেখে যেন চিতায় উঠতে পারে।

ছটফট করছে ভুটু। তাকে দু—হাতে আঁকড়ে রয়েছেন বিজলি। অবশেষে বিজলির বাহু বন্ধন থেকে মুক্তি না পেয়ে সে কান্না জুড়ে দিল। পদ্ম, কল্পনা, সবাই নীচে। অসহায়ভাবে তিনি শিশুর কান্না শুনে যেতে লাগলেন। এই বাড়িতে চিৎকার করে কাঁদছে শুধু একজনই আর একজনেরই চোখ দিয়ে নীরবে দরদর করে জল নামছে। অলকা দরজায় এসে দাঁড়াল। বিজলি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চলে গেছে?’

‘হ্যাঁ। ওকে আমার কাছে দিন।’ অলকা তুলে নিল ভুটুকে। ‘এর কী হবে এখন?’

‘শ্রীধরই জানেন, তিনিই দেখবেন।’

‘জ্যোতিবাবুর মা—বাবা আছেন তো?’

‘জানি না, ওদের সম্পর্কে কিছুই জানি না, জিজ্ঞেস করতে হবে।’

‘সেখানে ওকে পাঠিয়ে দিলেই তো হয়।’

‘তা তো হয়, জ্যোতিকে বলব। দুটো দিন থাক শোকটা কমুক তখন বলব।’

‘হাসির বাপের বাড়ির কেউ এসেছিল কি?’

‘জানি না। আমি তো ওপরে এই অবস্থায়। কে এল না এল জানার তো উপায় নেই আমার।’ ক্লান্ত স্বরে টেনে টেনে কথা বলে যাচ্ছেন বিজলি। ‘পদ্মকে দেখলে?’

‘পদ্ম তো এদের সঙ্গে শ্মশানে গেল।’

‘ও আবার গেল কেন, বাড়িতে এখন কত কাজ। শ্মশান থেকে ফিরলে ওদের জন্য নিমপাতা, মটরডাল, লোহা, ঘুঁটের আগুন সদর দরজায় রাখতে হবে, এসব তো হিন্দুদের সংস্কার, মানা উচিত। শ্মশানযাত্রীদের অন্তত দুটো মিষ্টি খাওয়াতে হবে, তুমি বউমা এগুলো একটু দ্যাখো।’ বিজলি বিব্রত স্বরে বললেন।

‘ঘুঁটে এখন কোথায় পাব, দেখি আমাদের কাজের মেয়েটাকে বলে।’ অলকা ভুটুকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

রাত দশটা নাগাদ পদ্ম ফিরল শ্মশান থেকে। তার একটু পরেই ঘুমন্ত ভুটুকে নিয়ে এসে অলকা বলল, ‘জেঠিমা ভুটু যদি রাত্রে আমার কাছে থাকে তা হলে আমার কোনো অসু!বেধ হবে না।’

‘তা জানি, তবে পদ্মর সঙ্গেই এর ভাব বেশি। রাতে পদ্মর সঙ্গেই শোয়। ও বরং এখানেই থাকুক।’

অলকার কাজের মেয়েটিকে দিয়ে বিজলি একশো টাকার রসগোল্লা আনিয়ে ছিলেন। পদ্ম সেগুলো বিলি করে উপরে এল, একটা কোরা কাপড়ের সরু ফালিতে বাঁধা চাবি হাতে নিয়ে।

‘এটা কী হবে?’ বিজলি বিস্মিত।

‘ভুটু গলায় পরবে। বাপ—মা মরলে ছেলেরা পরে।’ পদ্মর স্বরে বিশ্বাস ও ভক্তি।

‘রাখ ওসব।’ বিজলি ধমক দিলেন, ‘ওইটুকু ছেলের গলায় ওসব পরাতে হবে না।’

‘মাসিমা এটাই তো নিয়ম। বাবা মারা যেতে দেখেছি দাদারা সবাই পরেছিল।’

‘ওসব নিয়মটিয়ম রাখ তো। ভুটুর গলায় চাবি ঝোলালে লোকে দেখে হাসবে। ও তো এক মিনিটেই গলা থেকে খুলে ফেলবে নয়তো মুখে পুরে দেবে। কাণ্ডজ্ঞান মেনে তো নিয়ম মানবি! তা ছাড়া ওর বাবা আছে তাকে জিজ্ঞাসা না করে এসব পরানো উচিত নয়, জ্যোতির তো আপত্তি থাকতে পারে। যদি বলে কোনো শাস্ত্রে লেখা আছে যে গলায় চাবি ঝোলাতে হবে? তুই দেখাতে পারবি?’

বিজলির কথার ঝাঁঝে পদ্ম মিইয়ে গেল। চাবিটা সে বালিশের তলায় রেখে দিয়ে বলল, ‘দাদা কাঠের চুল্লিতে পোড়ালো না, ইলেকট্রিকে দিল। একটা বামুন এল, হাতের সরায় শিশিতে ঘি ফুল আর কী কীসব ছিল, মুখে আগুন দেবার প্যাকাটিও এনেছিল। দাদা বামুনকে বলল, ওসব কিছু দরকার নেই। বামুন তো ঝগড়া শুরু করল, বলল এসব না করলে শ্মশানের অকল্যাণ হবে, অপদেবতা ভর করবে। আমাদের বাবলা তখন দাদাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কী সব বলল তারপর তিরিশটা টাকা এনে বামুনকে দিয়ে ঝামেলা থামাল।’

বিজলি উদবিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন, ‘মুখে আগুনটা দিয়েছে?’

‘না দেয়নি। দাদা কী রকম যেন।’ পদ্মর স্বরে অনুযোগ : ‘বড্ড একগুঁয়ে। কত করে বললুম কিছুতেই রাজি হল না, ছেলেরা চারশো টাকা চাইল অমনি দিয়ে দিল, ওখানেই কোথায় গিয়ে তখুনি ওরা মদ গিলে এল।’

‘তুই নীচের ঘরে আমার এই পিলসুজ আর পিদিমটা নিয়ে গিয়ে জ্বালিয়ে রেখে আয়। জ্যোতি আপত্তি টাপত্তি করলে বলবি এটা মাসিমার বাড়ি, এ বাড়িতে মাসিমার নিয়ম মেনে চলতে হবে, বাড়ির একটা ধর্ম আছে, সেটা রক্ষা করতে হবে। নাস্তিকপনা যদি দেখাতে হয় সেটা বাড়ির বাইরে গিয়ে দেখাও গে। পারবি বলতে?’

অনিশ্চিত স্বরে পদ্ম বলল, ‘হুঁ।’

প্রদীপে তেল ঢেলে তাতে সলতে দিয়ে পদ্ম পিলসুজটা হাতে নিয়ে নীচে নেমে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল, ‘কিছু বলতে হয়নি। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রেকর্ডারে খুব আস্তে গান শুনছিল। আমি আলো জ্বাললুম, দেখি চোখ মুছল। বলল, জানলার ওই ধারটায় জ্বালিয়ে রাখো। তোমার হাসিদি ওইখানে মোড়া পেতে বসে গল্প করত, ওটা ওর খুব পছন্দের জায়গা ছিল। জানো মাসিমা আমার মনে হল বউকে খুব ভালোবাসত তবে বাইরে সেটা দেখাত না, খুব দুঃখু পেয়েছে।’

বিজলি চুপ করে রইলেন।

অলকার কথাটা বিজলির মাথায় ঘুরছিল, মা—বাবার কাছে ছেলেকে পাঠিয়ে দিতে পারে জ্যোতি! পদ্মকে দিয়ে চার দিন পর তিনি রাত্রে জ্যোতিকে ডাকিয়ে আনলেন।

‘ভুটু কি এইভাবে থাকবে? একটা কিছু তো ব্যবস্থা করতে হয়।’ পায়ের দিকে দাঁড়ানো জ্যোতিকে লক্ষ করে বললেন। ভুটু তখন খাটে বিজলির পাশে ঘুমোচ্ছে। পদ্ম তাঁর মাথার দিকে খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে।

অসহায় দেখাল জ্যোতিকে। ‘হ্যাঁ ব্যবস্থা কিছু তো করতে হবে। কিন্তু কী করব ভেবে উঠতে পারছি না। আমার এক কলিগ বললেন, অশোকনগরে তার চেনা এক নিঃসন্তান ফ্যামিলি আছে। তাদের কাছে যদি রাখতে রাজি হই তা হলে তিনি কথা বলতে পারেন। ফ্যামিলিটির মুদির দোকান আছে লেখাপড়া তেমন করেনি। মাসে মাসে কয়েকশো টাকা দিলেই হবে।’

‘ওইরকম ফ্যামিলিতে তোমার ছেলে মানুষ হবে ভেবেছ?’ বিজলির স্বরে বিরক্তি ও আপত্তি গোপন রইল না। জ্যোতিকে দেখে তাঁর মনে হল এটা যেন জ্যোতিরও মনের কথা।

‘আমি তো আর বিশেষ কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছি না। ওকে তো আপনারাই যেমন রাখছেন তেমনি রাখতে পারেন।’

‘আমার বয়স হয়েছে আজ আছি কাল নেই। এখন কাজ চালাবার মতো নয় রাখছি। পরে কী হবে?’

এইসময় পদ্ম হঠাৎ বলে বসল, ‘দাদা তো আবার বিয়ে করতে পারেন।’

‘তুই থাম’ বিজলি দাবড়ানি দিলেন। ‘সব ব্যাপারে তোর নাক গলানো চাই। আর একটাও কথা বলবি না।’

পদ্মর কথায় হেসে ফেলেছে জ্যোতি। ‘মাসিমা ওকে বকবেন না। এরকম ক্ষেত্রে সবাই যা ভাবে সেটাই পদ্ম বলে ফেলেছে। আমি আর আমার বোন যখন স্কুলে পড়ি তখন আমার মা মারা যান জলে ডুবে। ছ—মাসের মধ্যে জ্যাঠামশাই কৃষ্ণপদ চক্রবর্তী তার ভাই বিপ্রদাসের বিয়ে দেন তাঁর দূর সম্পর্কের শালির সঙ্গে। যুক্তিটা ছিল এই একই, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা। তারপর আমার চার ভাইবোন হয় কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতাটা খুব ভালো হয়নি। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেই আমি বাড়ি ছাড়া হই, বোনের বিয়ে হয় জমিজমা আছে পাশের গ্রামের এক অশিক্ষিত পূজারি ব্রাহ্মণের সঙ্গে। এখন তার দুটি ছেলেমেয়ে।’

‘তোমার বাড়ি কোথায়?’

‘বর্ধমান থেকে কাটোয়া যাবার রাস্তায় কৈচরের আগে মল্লিকপুর নামে একটা গ্রাম। আপনি কখনো কি ওদিকে গেছেন?’

‘না যাইনি। বিষয় সম্পত্তি আছে?’

‘আছে। ধানজমি, পুকুর, বর্ধমান শহরে একটা বাড়ি, চালের আড়ৎ আরও ছোটোখাটো কী সব ব্যবসা।’

‘অবস্থা তো বেশ ভালোই।’ মন্তব্যটি করে বিজলি বললেন, ‘সব মেয়েই যে ডাইনি হবে, সতীনের ছেলেকে আদর—যত্ন করবে না, তা তো নয়, লেখাপড়া জানা শিক্ষিত শহরের মেয়েরা অন্যরকম হয়, তুমি পদ্মর কথাটা ভেবে দেখতে পারো।’

জ্যোতি চলে যাবার পর পদ্ম বিজলির গলা নকল করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘তুই থাম, আর একটা কথাও বলবি না। এখন সেই তো পদ্মর কথাটাই মুখ দিয়ে বেরোল। মুখ্যু হতে পারি কিন্তু যা বলি কড়ায়—গণ্ডায় ঠিক বলি।’

বিজলি আড় চোখে পদ্মর মুখটা দেখে নিয়ে বললেন, ‘বিছানা কর। ভুটুকে শুইয়ে দে আর জানলাটা কাল ভালো করে বন্ধ করিসনি কেন? মড়মড় মড়মড় করে রাতে শব্দ হচ্ছিল।’

পদ্ম আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। চুপ করে জানলার দিকে তাকিয়ে রইল।

.

দু—মাস পর বিজলির পায়ের প্লাস্টার খোলা হল। পদ্ম নিয়মিত রোজ মালিশ করে দেয় পায়ে, তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে বারান্দায় হাঁটেন, সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারেন না এখনও। দেবতাদের নিত্য দিনের পরিচর্যা শুরু করেছেন। ভুটু এখন একতলা—দোতলা করে ইচ্ছেমতো। তিনতলার ছাদেও উঠে যায়। বিজলি যখন সকালে পুজোয় বসেন তখন ভুটুর উপদ্রবের ভয়েই ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দেন। কল্পনা ঘরের এবং রান্নার কাজ করে, যথারীতি দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ে, সন্ধ্যায় বাড়ি চলে যায়। ভুটুকে দেখাশোনার দায়িত্ব পদ্ম নিজের হাতে তুলে নেওয়ায় কল্পনার এখন কাজ কমে গেছে। জ্যোতি এখন রাত করে ফিরছে, শিক্ষক রাজনীতিতে নিজেকে জড়িয়ে নেওয়ায়।

বিজলি মাঝে মাঝে দুপুরে বারান্দায় এসে টুলে বসেন। রাস্তা দিয়ে লোক চলাচল দেখেন, সামনের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। রাধাকিঙ্করীকে মনে পড়ে, অল্পবয়সি পুলিশ অফিসারকে বলা কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করেন। মাথা নীচু করে অফিসারটি তাঁর কথাগুলো লিখতে লিখতে ভ্রু তুলে তাকানো অবশেষে লেখা বন্ধ করে শুধু শুনে যাওয়া। সেদিন তিনি কী বলেছিলেন? রাধু ঠিক করেছে, এখনও কি তিনি তাই মনে করেন? মনে করেন কি রাধু নরকে যাবে। ভাবতে ভাবতে মাথা ভার হয়ে এলে ঘরে ফিরে শুয়ে পড়েন।

এক হাত দেওয়ালে অন্য হাতে পদ্মর কাঁধে রেখে সিঁড়ি দিয়ে একদিন নীচে নামলেন। শোয়ার ঘরের দরজা খোলা দেখে ঢুকলেন। হাসিরা ভাড়া নেবার পর এ ঘরে এক বার কি দু—বার ঢুকেছেন তারপর আজ। কল্পনা মেঝেয় ঘুমোচ্ছে। চারপাশ চোখ বোলালেন। দেওয়ালে ছবি বা ক্যালেন্ডার নেই। খাট, টেবল। তার উপর রুপোলি ফ্রেমে বাঁধানো হাসির মুখের ছবি, স্টিলের বইয়ের র‌্যাক। টেবিলের পাশে দুটো মোড়া, নীচু টুলের উপর স্তূপ হয়ে খবরের কাগজ। দরজা জানলায় গেরুয়া পরদা ধুলোয় মলিন। কাগজ ফেলার ঝুড়িতে জমে আছে পাঁউরুটি ও বিস্কুটের মোড়ক। আলনায় জ্যোতির ব্যবহৃত ময়লা ধুতি ও পাঞ্জাবি। স্টিলের আলমারির মাথায় দুটো সুটকেস।

একঝলক দেখে নিয়ে বিজলি বুঝলেন খাওয়া ও শোয়া ছাড়া জ্যোতির কাছে এই ঘরের আর কোনো প্রয়োজন নেই। টেবিলের কাগজপত্র উলটেপালটে দেখে বইয়ের র‌্যাকে চোখ দিলেন। সবই প্রায় ইংরিজি বই, দু—তিনটি বাংলা বই তাঁর চোখে পড়ল। বইগুলো আঙুল দিয়ে টেনে একে একে বার করে দেখলেন পাতা খুলে। তার মধ্যে থেকে একটা বই পদ্মর হাতে দিয়ে বললেন, ‘ধর এটা। পড়তে হবে।’

‘কী বই গো মাসিমা?’

‘রামকৃষ্ণদেবের নাম শুনেছিস তো, দক্ষিণেশ্বরে আমার সঙ্গে গেছিলিস মনে নেই? তিনি যেখানে যা বলেছেন তাঁর এক ভক্ত সব টুকে রেখেছেন, সেইসব কথা নিয়ে বই। এর নাম কথামৃত, তোকে পড়ে শোনাব। কিন্তু বইটা এখানে কে পড়ে, তোর কাকে মনে হয়?’

চোখ কুঁচকে দু—লহমা ভেবে নিয়ে পদ্ম বলল, ‘হাসিদি।’

‘কেন তোর হাসির কথাই মনে হল?’

‘দ্যাখো বাপু ধম্মোকম্মো মতি মেয়েদেরই হয়। দাদা কেমন যেন কাঠখোট্টা ধম্মো মানে না, শ্মশানেই তো দেখলাম। ছেরাদ্দটা তুমি না করালে তো হাসিদির মুক্তিই হত না। পাঁচালি পড়ে হাসিদি যেভাবে পেন্নাম করল দাদা কি সেভাবে পারবে? ওই দিয়েই তো বুঝলুম।’

‘এই ঘরের ছিরি দেখে এবার কী বুঝছিস।’

‘কল্পনাকে আমিই এখানে কাজে লাগিয়েছি আমিই ঝেঁটিয়ে বিদেয় করব। এত টাকা মাইনের এমন সুখের কাজ কোথাও পাবে নাকি? দ্যাখো মাসিমা কেমন ভোঁসভোঁস করে মড়ার মতো ঘুমোচ্ছে, দুটো লোক যে ঘরে ঢুকেছে সেদিকে খেয়াল নেই, যদি আমরা চোর হতুম?’

ঘর থেকে বেরিয়ে বিজলি বললেন, ‘তোরও খেয়াল নেই, কী বললি। মড়া কখনো ভোঁসভোঁস করে ঘুমোয়? চোর আসবে সদর দরজা খোলা থাকলে। দেখে সে দরজা দিয়েছে কিনা।’

বিজলি সিঁড়ি দিয়ে ওঠা শুরু করলেন, সাত—আটটা ধাপ উঠেছেন পদ্মর উত্তেজিত স্বর শুনলেন, ‘মাসিমা চিঠির বাসকে একটা খাম। চাবিটা দাও।’

বিজলি অবাক হলেন। চিঠি কার! কে লিখল? দাদর চিঠি আসে বিজয়ার পর। তা ছাড়া চিঠি দেওয়র আর তো কেউ নেই। জ্যোতি বা হাসির কোনো চিঠিপত্র আজ পর্যন্ত আসেনি। এলে জানতে পারতেন, লেটার বক্সের তালার চাবি তাঁর কাছে। আঁচল থেকে চাবির তোড়াটা খুলে পদ্মর হাতে দিয়ে কৌতূহল ভরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

একটা ধূসর রঙের ঘাম হাতে নিয়ে এসে পদ্ম বিজলির হাতে দিল। অভ্যাস না থাকলেও ইংরেজি পড়তে এবং কিছুটা বুঝতে পারেন বিজলি। খামের উপর প্রাপকের ইংরেজিতে টাইপ করা নামটা দেখেই তাঁর চোখ গাঢ় হয়ে উঠল। পদ্মকে বললেন, ‘পিয়োন ভুল করে দিয়ে গেছে রে। এ নামে এখানে কেউ থাকে না।’

‘কী নাম মাসিমা?’ স্বাভাবিক কৌতূহল পদ্মর গলায়।

‘হাসিনা বানো। তবে ঠিকানাটা এই বাড়িরই।’ বলেই তিনি তাকিয়ে থাকলেন পদ্মর চোখের দিকে।

‘ভুল নাম অথচ বাড়ির নম্বর ঠিক, মাসিমা খুলে দ্যাখো তো?’

বিজলি খামটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে বাকি সিঁড়ি ভেঙে ঘরে এসে খাটে বসলেন। খামের একটা দিক ছিঁড়ে বার করলেন টাপে করা একটা ইংরেজি চিঠি। ইংরেজি পড়ার চেষ্টা করে তিনি কিছু বুঝতে পারলেন না। কিন্তু চিঠিটা এই বাড়ির ঠিকানায় কেন? হাসিনা বানোই বা কে? এ তো মুসলমানি নাম! তার মাথার মধ্যে নাগরদোলার মতো হাসিনা শব্দটা ওঠানামা করতে করতে হঠাৎই মনে হল হাসিনাটা হাসি নয়তো! নাগরদোলা থেকে গিয়ে তাঁর মাথা ঘুরতে লাগল। অসম্ভব, এ হতে পারে না। হাসি কিছুতেই মুসলমান নয়।

বিজলি বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে হাসির চলনবলন হাবভাব কথার উচ্চচারণ পরতে পরতে বিছিয়ে গেলেন মাথার মধ্যে। কোথাও এমন কিছু দেখতে পেলেন না যা দিয়ে তাকে অলকা বা রাধুর থেকে আলাদা করা যায়। তিনি ভাবতে চেষ্টা করলেন পিয়োন ভুল করেছে। হাসিনা বানো যে হাসিই হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু মাঝে ৪৭বি জয় দত্ত স্ট্রিট দেখেই তো পিয়োন লেটার বক্সে ফেলে গেছে, ভুল তো করেনি! বাড়ির নম্বর আর রাস্তার নামটা এমনই যে অন্যমনস্ক হয়ে বা ভুল করে টাইপ করে ফেলেছে বলা যাবে না।

মুখ ঘুরিয়ে বিজলি শ্রীধরের সিংহাসন, তার দু—পাশের দেবদেবীর ছবি ও মূর্তির দিকে তাকালেন। দেখতে পেলেন প্রদীপ জ্বলছে, গরদের থান—পরা হাসি পাঁচালি পড়ছে, প্রদীপের আলো হাসির শ্যামবর্ণ মুখের উপর কাঁপছে, হাসির স্পষ্ট উচ্চচারণ তিনি শুনতে পেলেন, ‘গুরুবারে সন্ধ্যাকালে মিলি নারীগণে। করিবে লক্ষ্মীর ব্রত হরষিত মনে।’ হিন্দুর মেয়ে ছাড়া পাঁচালির সুর অন্য ধর্মের মেয়ে এভাবে গলা থেকে বার করে আনতে পারবে না। বিজলি নিজেকে আশ্বস্ত করতে স্থির সিদ্ধান্তে এলেন হাসিনা বানো আর হাসি চক্রবর্তী কিছুতেই একই লোক নয়। তবু জ্যোতিকে একবার জিজ্ঞাসা করা দরকার।

‘পদ্ম, জ্যোতি এলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবি আর তখন তুই ভুটুকে নিয়ে নীচে থাকবি।’

রাত প্রায় দশটা, তখন জ্যোতি ফিরল। পদ্ম সদর দরজা খুলেই বলল, ‘মাসিমা আপনাকে দেখা করতে বলেছেন।’

জ্যোতি নিজের ঘরে না গিয়ে সোজা দোতলায় উঠে এল। তাকে দেখেই বিজলি চিঠি ভরা খামটি বাড়িয়ে ধরলেন। বিস্মিত জ্যোতি খামটার উপরের লেখা ঠিকানাটা পড়ে কয়েক লাইনের চিঠিটা এক ঝলকে দেখে নিয়ে বিজলির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলুন?’

‘এই হাসিনা বানো কে?’

‘আমার বউ।’

‘হাসি?’

‘হ্যাঁ।’

গম্ভীর হয়ে চুপ করে রইলেন বিজলি। একটা যন্ত্রণা তাঁর চোয়ালের পেশি মুচড়ে চলেছে। জ্যোতি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। প্রায় এক মিনিট ধরে দু—জনের মধ্যে নীরবতা দেওয়া—নেওয়া চলার পর বিজলি বললেন, ‘আমাকে ঠকালে কেন?’

‘নিরুপায় হয়ে। মাসিমা, ঘর ভাড়া নিতে গেছি, বউ মুসলমানের মেয়ে শুনে ভাড়া দেয়নি। ভাড়া নিয়ে একমাস থেকেছি, বাড়িওয়ালা পাড়ার লোক দিয়ে তুলে দিয়েছে। শেষে হাসিনাকে হাসি করে ঘর পাই। কিন্তু সেই গড়িয়া থেকে কাজের জায়গায় যেতে আমাদের দু—জনেরই খুব অসুবিধে হচ্ছিল। ভুটু তখন সবে জন্মেছে। আমরা এদিকেই ঘর খুঁজছিলুম, আপনার এখানে পেয়ে চলে এলুম। আমি কিন্তু আপনাকে ঠকাইনি। আপনি আমার বা হাসির ধর্ম নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেননি। আমরাও সেধে তা বলার দরকার মনে করিনি, এতে ঠকানো হল কোথায়?’

বিজলি চুপ করে রইলেন। জ্যোতি বলে চলল, ‘কোনো হিন্দু মেয়ের সঙ্গে কি হাসির তফাত করতে পারবেন শুধু তার নামটা ছাড়া? এই খামের উপরের লেখাটা পড়ার আগে পর্যন্তও আপনি ওকে হিন্দু বলে বিশ্বাস করে এসেছেন। তাকে দিয়ে পাঁচালিও পড়িয়েছেন, সে আপনার ঠাকুর দেবতাও ছুঁয়েছে। চক্রবর্তীর বউ বলেই ওকে দিয়ে এসব করিয়েছেন, ধরেই নিয়েছিলেন হাসি ব্রাহ্মণ। এখন সেই ধারণাটাই ধরে থাকুন না যে হাসি মুসলমান নয় সে হিন্দু চক্রবর্তী।’

‘জানার পর তা সম্ভব নয়। তোমরা অদ্ভুত লোক তো।’

বিজলির স্বর তীব্র ও কর্কশ হয়ে উঠল, জ্যোতির কথাগুলো তাঁর এত বছরের লালিত ধর্মবোধকে কোণঠাসা করে দিচ্ছে এটা তিনি সহ্য করতে পারছেন না। নিজেকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য মরিয়া হলেন। ‘কী চমৎকার ভাবে তোমরা নিজেদের লুকিয়ে রেখেছিলে। আমি তো জীবনেও জানতে পারতুম না হাসি মুসলমান, জানলে কি ওকে ঠাকুর ছুঁতে দিতুম? আর হাসিই বা কোন আক্কেলে পাঁচালি পড়ল? ওর ধম্মেও তো এসব করা বারণ। এটা পাপ। তুমিও ধম্মো মানোনা, মানলে মুসলমান মেয়ে বিয়ে করতে না।’

বিজলির গলা থেকে ঝরে পড়ছে তিক্ততা। তিনি আবার শুরু করলন, ‘এবার হয়তো কোনদিন শুনব তুমি তোলাবাজদের পাণ্ডা কি নোট জাল করো সেটা জানতে পারব বাড়িতে পুলিশ এলে। একটা কথা বলো, তুমি হাসিকে ফুসলিয়ে বার করে আনোনি তো? ঠিকমতো বিয়েটা করেছ তো?’

‘করেছি। স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হয়েছে। আর ফুসলিয়ে আনার প্রশ্নই ওঠে না, ও সাবালিকা।’

‘হাসির এতবড়ো অসুখ হল ওর বাপের বাড়ির কাউকে তো আসতে দেখলুম না। এমনকী মারা যাবার পরও কেউ এল না, কী ব্যাপার?’

‘হাসির বাপের বাড়ি আপনার থেকেও বেশি গোঁড়া। সেই বাড়ির মেয়ে হিন্দুকে বিয়ে করলে কী ঘটতে পারে অনুমান করুন। হাত—পা বেঁধে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল সাতদিন, জলটুকুও খেতে দেয়নি।’

বিজলির মনে পড়ল তাঁদের গ্রামের দত্তবাড়ির মেয়ে কলকাতার পি জি হাসপাতালে নার্সের চাকরি করত। বিয়ে করেছিল খ্রিস্টান হয়ে এক খ্রিস্টান ডাক্তারকে। মেয়েটি আর গ্রামে ফিরতে পারেনি, দত্তদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল। বাহান্ন বছর আগের ঘটনা। তাঁকেও তো প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। পাড়ার লোকেরা যখন শুনবে হাসি মুসলমানের মেয়ে ঠাকুরের সিংহাসনে শুধু হাতই দেয়নি বিজলির অনুরোধে লক্ষ্মীর পাঁচালিও পড়েছে তখন কোথায় মুখ লুকোবেন! ঠাকুরদেবতা ফেলে দেবেন? ভুটু নারায়ণ শিলা মুখে পুরেছিল সেটাও কি গঙ্গায় বিসর্জন দেবেন? শিলাটা শাশুড়ির কাছ থেকে পাওয়া। তিনি পেয়েছিলেন তাঁর শাশুড়ির কাছ থেকে। বংশের অতীতের সঙ্গে যোগসূত্র বলতে এখন ওই শিলাটি। একশো বছরের পুরোনো নারায়ণ শিলার গল্প তিনি পাড়ার বহু বউ—ঝিয়ের কাছে করেছেন।

তাঁর মনে হল ব্যাপারটা জানাজানি না হওয়াই ভালো। কেউ না জানলে পুরুতমশাইকে দিয়ে শোধন করিয়ে নিলেই হবে, তার আগে জ্যোতিকে এই বাড়ি থেকে বিদায় করতে হবে, তার সঙ্গে ভুটুকেও।

‘এই চিঠিটা কীসের? হাসিনা বানো কেন?’

‘এই নামেই হাসি বি এসসি পাশ করেছে, এই নামেই ও চাকরি পেয়েছে বিয়ের আগেই, এই নামেই ওর প্রভিডেন্ট ফান্ড হয়েছে। এই চিঠিটা প্রভিডেন্ট ফান্ড অফিসের।’

‘পদবিটা যদি বদলে নিত অফিসে ঢোকার সময় তা হলে ঠিকানায় লেখা এই নামটা আমি জানতেই পারতুম না।’ বিজলির কণ্ঠে আপশোস। ‘তাহলে আমাকে এই নরকযন্ত্রণার মধ্যে পড়ে দগ্ধাতে হত না। এখন আমাকে দেখে সবাই আঙুল দেখিয়ে হাসবে আর বলবে, ‘ওই যে ভটচায বাড়ির বিজলিবালা অন্য জাতের মেয়েকে দিয়ে পুজো করিয়ে ধম্মের বড়াই কর।’ আমি জানতুম না বললেও কেউ কি বিশ্বাস করবে?’

জ্যোতি মুখ নীচু করে শুনছিল ও ভাবছিল। এখন বলল, ‘এক্ষেত্রে আমার চলে যাওয়াই উচিত। আপনি দেখুন ঘটনাটা যেন জানাজানি না হয়, আপনি—আমি ছাড়া আর কেউ তো ব্যাপারটা জানে না। কালই আমি স্কুলে খোঁজ নেব ওখানে কোনো পরিবারে পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকা যায় কিনা। মনে হয় পেয়ে যাব। ভুটুরও একটা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। যত দিন না সেটা হচ্ছে তত দিন পর্যন্ত ওকে আপনি যদি রাখেন তা হলে আমি খুব কৃতজ্ঞ থাকব।’

‘তুমি তো ‘জানাজানি না হয় যেন’ বলে চলে যাবে কিন্তু যে আঁচড় আমার বুকে পড়ল তার ঘা তো আর শুকোবে না।’ বিজলি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার এত দিনের ঠাকুর তাকে কত যত্নে আগলে রেখেছি, আমার এত দিনের পুজো এত দিনের ভক্তি সব সব তোমরা মিথ্যে করে দিলে নস্যাৎ করে দিলে।’ বিজলি ফুঁপিয়ে উঠলেন।

জ্যোতি ম্লান চোখে তাকাল। ‘আমাকে ক্ষমা করবেন।’

নিঃশব্দে জ্যোতি সরে গেল বিজলির সামনে থেকে। দু—চোখের কোণে জমা জল মুছে তিনি খাটে পড়ে থাকা ভাল্লুকটা মেঝেয় ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে থমকে আস্ত নামিয়ে রাখলেন, মনে মনে বললেন, ‘ওর আর দোষ কী।’

সাত

যেন জানাজানি না হয়, জ্যোতির এই কথাটা বিজলির মাথার মধ্যে গেঁথে গেল। তিনি তাঁর সব রকমের ভাবনার সঙ্গী, যার সঙ্গে মতামত বিনিময় করেন অহরহ, সেই পদ্মের কাছেও ব্যাপারটা গোপন রাখলেন। তিনি বেশ ভালো মতোই জানেন ওর পেটে কথা থাকে না। কখন যে কোন বাড়ির কাজের মেয়েকে গল্প করতে করতে বেফাঁস বলে ফেলবে তা সে নিজেও জানে না।

জ্যোতি কয়েক দিন আগে এসে জানায়, সে হাবড়াতেই থাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। স্কুলের কাছে তার এক প্রাইভেট ছাত্রের বাড়িতে আলাদা ঘরে থাকা ও খাওয়া বাবদ দু—হাজার টাকা দেবে, ছাত্রটিকে পড়াবার জন্য সে টাকা নেবে না। সে আরও জানাল, এই বাড়ির ঘর আপাতত ছাড়বে না, মাসে মাসে যেমন ভাড়া দিয়ে যাচ্ছে তেমনই দিয়ে যাবে। ভুটুকে বিজলি আপাতত রাখতে রাজি হয়েছেন, সেজন্য জ্যোতি প্রভূত কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলে, ‘মাসিমা বিয়ে করতে বলবেন না, হাসিকে সারা জীবনে ভুলতে পারব না, ভোলা উচিত নয়, সম্ভবও নয়। ওর স্মৃতি মুছে দেবার মতো যোগ্যতা এই পৃথিবীতে কোনো মেয়ের আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। আপনিও বোধহয় কখনো হাসিকে ভুলতে পারবেন না।’

নীচের ঘর সারা দিনই প্রায় তালা দেওয়া থাকে, চাবি থাকে পদ্মর কাছে। কল্পনাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এক বাড়িতে তাকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে পদ্ম। প্রতিদিন নীচের ঘর সে পরিষ্কার করে মাঝে মাঝে দুপুরে ভুটুকে নিয়ে শোয়। রাতে তারা শোয় বিজলির ঘরে মেঝেয়। একদিন বিজলিই বললেন, ‘আমার খাটটা তো অনেক বড়ো, ওকে আমার পাশে শুইয়ে দে।’

‘না মাসিমা বড্ড নড়াচনা করে, পড়েটড়ে যাবে। থাক না নীচে।’

বিজলি বুঝলেন পেত্নির লম্বা হাতের ভয়ে সে একা শুতে চায় না। তা ছাড়া স্নেহ—মমতা দেবার ও আদর করার জন্য ওর বাৎসল্যের খিদেটা দেখেছেন ক্রমশ বাড়ছে। সন্তান নেই, হবার কোনো সম্ভাবনাও নেই এই স্বামী পরিত্যক্তার। একটা শিশুকে অবলম্বন করে মা হবার সাধটা যদি মেটাতে চায় তো মেটাক না। বিজলি তাই ভুটুকে পালন করার দায়িত্ব পদ্মর হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন। জ্যোতি রবিবার এসেছিল, বলেছে, তার ইচ্ছা নয় মুদির বাড়িতে রেখে ছেলেকে মানুষ করার। ‘শিক্ষিত কালচার্ড নিঃসন্তান এমন পরিবার নিশ্চয়ই আছে, শুধু খুঁজে বার করে নিতে হবে।’

বিজলি বলেছিলেন, ‘রক্তের সম্পর্ক থাকলে তবেই ও ঠিক ঠিক যত্ন পাবে। তোমার কি হাসির আত্মীয়দের মধ্যে খোঁজ নাও, কেউ যদি ওকে রাখে।’

জ্যোতি মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘কেউ ওকে রাখবে না।’

বিজলির মনে হয়েছিল রাখবে কি রাখবে না সেটা যাচাই না করেই জ্যোতি বলে দিল কত সহজে! যদি হাসির বাপের বাড়ির ঠিকানাটা তিনি পেতেন তা হলে নিজে গিয়ে ওর বাপ—মাকে ধরে পড়তেন মরা মেয়ের ছেলেটাকে আশ্রয় দিতে। বলতেন, হলই বা হিন্দু বাপ, ওর মা তো আপনার মেয়ে, মুসলমান রক্ত তো ওর শরীরে আছে। ওকে আপনাদের ধর্মের বিধানমতো মুসলমান করে নিন, তা হলে ও একটা নিজের পরিবার পাবে, যত্ন পাবে শাসন পাবে, তা না পেলে ছেলেমেয়েরা মানুষ হয় না। কেন আপনাদের নাতিকে একটা হিন্দু বিধবার হাতে ছেড়ে দেবেন?

দুপুরে খাটে শুয়ে বিজলি রেডিয়ো চালিয়ে সেতার শুনছিলেন। রাগ—রাগিণীর কিছুই বোঝেন না, তবে বাজনাটার আওয়াজ তাঁর ভালো লাগে, একধরনের আমেজ তৈরি করে দেয়। সেতার শুনতে শুনতে তিনি দেখতে পেলেন বারান্দায় ভুটু দু—হাতে হুলো বেড়ালটাকে চটকাচ্ছে, হুলোটা চিত হয়ে শরীরটা ওলটাচ্ছে পালটাচ্ছে আর থাবা দিয়ে ভুটুকে মারছে। দু—জনে খেলছে। বিজলি শুনেছেন বেড়াল থেকেই ডিপথেরিয়া হয়। মারাত্মক রোগ, তাতে মারাও যায়।

ধড়মড়িয়ে তিনি খাট থেকে নেমে বারান্দার দিকে ‘হেই ভাগ ভাগ’ বলতে বলতে এগোলেন। তাঁকে দেখেই হুলো পালাল। বিজলি ভুটুকে নিয়ে কলঘরে গিয়ে দুটো হাত সাবান দিয়ে ধুইয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন পদ্মর জন্য। উড়ে পাড়া বস্তিতে কার গায়ে হলুদ, রান্নাবান্না শেষ করেই পদ্ম সেখানে গেছে। ভুটুকে বিছানায় চেপে ধরে চাপড়াতে লাগলেন ঘুম পাড়াবার জন্য, তখন সেলাই মেশিনের উপর থাকা কথামৃতর উপর তাঁর চোখ পড়ল। বইটা কবে যেন নীচের ঘর থেকে এনেছিলেন আজও খুলে দেখা হয়নি। পদ্ম বলেছিল ‘ধম্মের বই পড়ে মেয়েরাই’, তাই ওর ধারণায় কথামৃত হাসিই পড়ার জন্য এনেছে বা কিনেছে।

ভুটু ঘুমিয়ে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই। কথামৃত হাতে নিয়ে বিজলি পাতা উলটে যেতে লাগলেন। তখন একটা সাদা কাগজ বই থেকে পড়ে গেল। সেটা তুলে তিনি এপিঠ—ওপিঠ দেখলেন। দোকানের সাদা বিল, তাতে লেখা কয়েক লাইনের চিঠি। হাতের লেখা বাংলায়, পরিচ্ছন্ন স্পষ্ট। চিঠির নীচে লেখা ‘আব্বা’। শব্দটা দেখেই তিনি সচকিত হয়ে উঠলেন। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে পড়ে ফেললেন। হাসিকে লেখা তার বাবার চিঠি। পড়ে বুঝলেন হাসি মাকে চিঠি দিয়ে তার ছেলে হওয়ার খবর দেয়। সেই চিঠির জবাব দিচ্ছে তার বাবা।

‘হাসি, তোর সাহস দেখে তাজ্জব হয়েছি। আম্মিকে তুই যে লুকিয়ে চিঠি লিখিস তা আমি জানতুম না। আমাদের গ্রামে সবাই জানে তুই মরে গেছিস। তুই মরেই থাক। তোর মরার খবর দিয়ে চিঠি পেলে আমি খুশি হব। যে—মেয়ে পরিবারের মুখ পুড়িয়ে হিন্দুর ছেলে পেটে ধরে তার হাতের লেখার উপর চোখ রাখলে খোদাতালা আমায় অন্ধ করে দেবেন। আর কখনো চিঠি লিখবি না। ইতি আব্বা।’

খুব দ্রুত লেখা শিক্ষিত হাতের এই চিঠি পড়ে বিজলির মাথার মধ্যে ধিকিধিকি জ্বলতে শুরু করল ক্রোধ। ‘হিন্দুর ছেলে পেটে ধরে কথাগুলো এমন ঘৃণার সঙ্গে লেখা যে তাঁর কাছে অসহ্য মনে হচ্ছে। জ্যোতির মতো ছেলেকে জামাই পেয়ে লোকটার বর্তে যাওয়ার কথা। জাত ধর্মটাই বড়ো হল, ছেলে কেমন সেটা বিবেচনা করবে না? বাপ হয়ে কী করে লিখতে পারল ‘তোর মরার খবর দিয়ে চিঠি পেলে খুশি হব’! মেয়ের ইচ্ছে অনিচ্ছেটা দেখবে না?

চিঠিটা পুরোনো, হয়তো জানে না মেয়ে সত্যি সত্যিই মারা গেছে। লোকটাকে জানানো দরকার, আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে, আপনাকে আর অন্ধ হতে হবে না। চিঠির মাথায় মোটা অক্ষরে ইংরেজিতে ছাপা ‘আলম ফার্নিচারস’ শব্দ দুটির শেষেরটি বিজলি পড়তে পারলেন না, তার নীচে ‘হায়ার অ্যান্ড পারচেজ’ বানান করে পড়লেন অবশ্য অর্থটা বোধগম্য হল না। অলকাকে দিয়ে মানেটা জেনে নিতে পারেন বটে কিন্তু তা হলে তো চিঠিটা ওর হাতে দিতে হয়! হাতে পেয়ে অলকা চিঠিতে চোখ বুলোবেই আর হাসির পরিচয় জানতে কিছুই বাকি থাকবে না।

দরকার নেই অলকার। ছাপা ঠিকানা রয়েছে বিলে এবং ফোন নম্বরও। রাস্তার নামটা বড়ো বড়ো। পড়ে উঠতে পারলেন না। বিজলির মনে হল ফোনে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন হাসির বাবার হদিশ করা যায় কিনা। কিন্তু ফোন করবেন কোথা থেকে! পাড়ার কোনো বাড়ি থেকে করা যাবে না। টেলিফোনের কাছে কেউ—ন—কেউ দাঁড়িয়ে থাকবেই কথা শোনার জন্য।

এবার তাঁর মনে পড়ল বড়ো রাস্তার দোকানগুলোতে টেলিফোন আছে। দেখেছেন পয়সা দিয়ে বাইরের লোককে ফোন করতে। তিনি ঠিক করলেন দোকান থেকেই ফোন করবেন, তবে কাছেপিঠের কোনো দোকান থেকে নয়।

ভুটু ঘুমোচ্ছে, পদ্ম এখনও ফেরেনি। সে না ফিরলে ভুটুকে একা রেখে কী করে বেরোবেন! পরের বাড়ির গায়েহলুদ, তোর সেখানে থাকার কী দরকার? বিজলি বিরক্ত হতে হতে ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। মাথার মধ্যে পিঁপড়ের মতো নড়ে বেড়াচ্ছে চিঠির অক্ষরগুলো। এক্ষুনি লোকটার খোঁজ নিতে হবে, দু—কথা শুনিয়ে দিতে হবে। বারান্দা থেকে ঘরে এসে চিঠিটা পড়লেন। পাট পাট ভাঁজ করলেন বিলটা, এমনভাবে চিঠির অংশটা যাতে পড়া না যায়, শুধু দোকানের নাম ঠিকানা ফোন নম্বরটা দেখা যাচ্ছে। সেটা ভাঁজ করে তাঁর টাকার ব্যাগে রাখলেন। এবার ভুটুকে নাড়া দিয়ে জাগিয়ে তুললেন। গাঢ় ঘুম হঠাৎ ভাঙায় ভুটু অবাক চোখে প্রথমে তাকিয়ে থেকে ঠোঁট উলটে ফুঁপিয়ে উঠল।

ভুটুকে কোলে তুলে বিজলি একতলায় নেমে এসে রাস্তায় বেরোলেন। সদর দরজায় তালা দিয়ে গেলেন পাশের বাড়িতে অলকার কাছে।

‘ভুটুকে একটু রাখো তো, খুব দরকারে আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে ননদের বাড়ি, খবর দিয়ে গেল এখন—তখন অবস্থা, দু—বছর ধরে আলসারে ভুগছে।’

অলকা বলল, ‘পদ্ম বাড়িতে নেই?’

‘সে থাকলে তো ঝক্কি চুকেই যেত। চার ঘণ্টা আগে বেরিয়েছে উড়ে পাড়ায় কার গায়েহলুদ দিতে, এখনও ফেরার নাম নেই। সদরের চাবি আমার কাছেই রইল, পদ্ম এলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে।’

অলকার জিম্মায় ভুটুকে রেখে বিজলি ধীরে ধীরে হেঁটে বড়ো রাস্তায় এলেন। কয়েক মাস পর এতটা পথ হাঁটলেন। পায়ে খচখচ লাগছে, ব্যথা শুরু হয়েছে। তাঁর মনে হল আরো কিছু কিছুদিন পর রাস্তায় বেরোলে ভালো করতেন। ডাইনে—বাঁয়ে তাকিয়ে বাঁ দিকে এগোলেন। ফুটপাথে একটা রেলিং—ঘেরা শান বাঁধানো চাতাল, তার মাঝে সিঁদুর মাখা বাসি মালা দেওয়া পাথর। বিজলি দু—হাত মাথায় কপালে ঠেকিয়ে এগিয়ে চললেন, শিবরাত্রিতে মাইক লাগিয়ে ধুমধাম হয় এখানে। পর পর দোকান। তীক্ষ্ন চোখে টেলিফোন খুঁজতে লাগলেন। সামনের কাউন্টারের উপরই থাকে অথবা পিছনে মালিকের টেবিলে। এক ছিট—কাপড়ের দোকানে দেখতে পেলেন টেলিফোন। কিন্তু চার—পাঁচ জন খদ্দের রয়েছে। তারপরে ইলেকট্রিক মিস্ত্রির দোকানে ফোন নেই তারপরে রঙের দোকানে, আছে।

কাউন্টারে ফোন, একটিও খদ্দের নেই শুধু এক তরুণ মাথা নীচু করে একটা ইংরেজি সিনেমা ম্যাগাজিন পড়ছে বা ছবি দেখছে।

‘হ্যাঁ বাবা ফোন করা যাবে এখান থেকে?’

তরুণটি মুখ তুলে এক বৃদ্ধাকে দেখে বলল, ‘যাবে।’

‘কত লাগবে?’

‘দু—টাকা।’

‘একটা কাজ করে দেবে বাবা, এটা একটু পড়ে দেবে।’ বিজলি ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা বিলটা বার করে তরুণটির হাতে দিল। বিলটিতে চোখ বুলিয়ে সে বলল, ‘পুরোনো ফার্নিচার কেনা—বেচা আর ভাড়া দেওয়ার দোকান। প্রোপাইটার অর্থাৎ মালিকের নাম মেহমুদ আলম, দোকানটা রফি আহমেদ কিদোয়াই স্ট্রিটে। আর রয়েছে ফোন নম্বর।’ বৃদ্ধাকে সাহায্য করতে পেরে তরুণটিকে উৎসাহী লাগছে। ‘আপনি কি এই নম্বরে ফোন করবেন?’

‘হ্যাঁ বাবা, তুমি নম্বর টিপে ফোন লাগিয়ে দেবে? আমার এসব ঠিক আসে না।’

তরুণ বোতাম টিপে টিপে অপেক্ষা করল। ওধার থেকে সাড়া পেতেই বলল, ‘এটা কি আলম ফার্নিচারস?… একটু ধরুন একজন আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।’

তরুণ রিসিভারটি এগিয়ে দিল বিজলির দিকে। বিজলির কানে লাগিয়ে ভূমিকা না করে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘হাসি আপনার কেউ হয়?’

ওধারে কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর পালটা প্রশ্ন হল, ‘আপনি কে বলছেন?’

‘আগে আমার কথার উত্তর দিন তারপর আপনাকে বলব আমি কে।’

‘হাসি আমার মেয়ে।’ একটা অনিচ্ছুক উত্তর এল দোখনো টানে।

‘আমি বিজলিবালা ভটচায। হাসি আর তার স্বামী আমার ভাড়াটে। ওদের একটি চোদ্দো মাসের ছেলে আছে, ভুটু। হাসি একটা চিঠি দিয়ে বোধহয় ওর মাকে তার ছেলে হওয়ার খবর জানিয়েছিল। হয়তো সেই চিঠি আপনি দেখেছেন। তার একটা জবাব আপনি দিয়েছিলেন একটা বিলের ওপর লিখে। সেই চিঠিটা আজ আমার হাতে পড়তেই এই ফোন করছি।’ বিজলি দ্রুত বলে গেলেন। কণ্ঠ ঈষৎ উত্তেজিত। এবার স্বর তীব্র করে ধমকে উঠলেন, ‘হিন্দু ছেলে বিয়ে করেছে বলে আপনি ওকে মরতে বলেছেন, এ কীরকম বাবা আপনি, ছি ছি ছি। আপনি ছেলেটিকে জানেন? আর অন্য ধর্মের হলেই সে অচ্ছুৎ হয়ে যাবে?’ বিজলির হাতের রিসিভার থরথর করছে।

‘এ ভাবে আপনি কথা বলছন কেন? আমার মেয়েকে যাই লিখি না কেন আপনি তাই নিয়ে বলার কে?’ ও পক্ষেও স্বর চড়ে উঠছে। তরুণটি অবাক হয়ে বিজলির দিকে তাকিয়ে।

‘আমি কে সেটা তো গোড়াতেই বলেছি। আমি আপনার কাছে বিধর্মী, আপনি থাকুন আপনার ধর্ম নিয়ে, আমি তা নিয়ে মাথা ঘামাতে যাব না। কিন্তু একটা মেয়ে যখন একটা ছেলেকে ভালোবাসে তখন সেটা অন্য ব্যাপার হয়ে যায় আলমবাবু, ধর্মকে তখন পিছু হটতে হয়। ওদের পরিচয় তখন হয় শুধুই মানুষ। আর সেটা স্বীকার করাকে বলে মনুষ্যত্ব। আপনি মারধর করেও তো হাসিকে থামাতে পারেননি কারণ ও তখন মানুষ হয়ে গেছে।’

‘আপনি সত্যিই বাড়াবাড়ি করছেন। কোথায় থাকেন আপনি?’ ধমকের সুর ওপ্রান্ত থেকে শোনা গেল।

‘ঠিকানা নিয়ে কী কববেন, এসে মারবেন? লিখুন ঠিকানা সাতচল্লিশের বি বিজয় দত্ত স্ট্রিট, কলকাতা পাঁচ। নর্থ ক্যালকাটার একটা গলি।’

‘আপনাকে মারতে যাব এমন ছোটোলোক ভাবলেন আমায়!’ আহত স্বরে বলল মেহমুদ আলম।

‘মেয়ের চিঠি পড়লে অন্ধ হয়ে যাবে যে বাবা লেখে, তার মতো নিষ্ঠুর লোক সম্পর্কে আর কী ভাবব! তবে আপনি জেনে আশ্বস্ত হবেন আপনাকে আর অন্ধ হতে হবে না?’

‘তার মানে?’ আলমের সন্ধিগ্ধ স্বর।

‘মানে হাসি মারা গেছে, শুনে সুখী হলেন তো?’

‘কী বললেন, কী বললেন, কী বললেন? হাসির কী হয়েছে।’ আলমের গলায় আর্তনাদ, অবিশ্বাস, আতঙ্ক।

‘চার মাস হল ক্যানসারে মারা গেছে। তার ছেলেটি একা, দেখার কেউ নেই।’ কথাটা বলার পর বিজলির মনে হল ওপ্রান্তে ডুকরে ওঠার মতো শব্দে আলম, ‘হাসি হাসিরে’ বলে উঠল। বিজলি রিসিভার রেখে দিয়ে ব্যাগ থেকে টাকা বার করে দিলেন।

‘খুব আচ্ছাসে দিলেন তো লোকটাকে।’ তরুণটি তারিফ ভরা সুরে বলল, ‘ঠিক বলেছেন ভালোবাসলে ধর্মটর্ম হটে যায়।’

বিজলি শুনে শুকনো হাসলেন। তাঁর দেহের যাবতীয় আবেগ নিঃশেষিত হয়ে তাঁকে অবসন্ন করে দিয়েছে। ধীর মেদুর পায়ে তিনি বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বার বার শুনে যেতে লাগলেন, ‘হাসি, হাসিরে।’ এইবার অনুশোচনার আগুনে পুড়বে লোকটা, নরকযন্ত্রণা ভোগ করবে। বিজলি কষ্ট বোধ করলেন হাসির বাবার জন্য। নিশ্চয় বাড়ি গিয়ে খবরটা দেবে, হাসির মা কী করবে? আর ভাবতে চাইলেন না বিজলি।

সদর দরজায় তালা দেওয়াই রয়েছে। পদ্ম কি এখনও ফেরেনি? তিনি অলকার কাছে খোঁজ নিতে গেলেন।

অলকা বলল, ‘আপনি যাবার একটু পরেই পদ্ম এসে হাজির, দেখেই ভুটু বায়না জুড়ল। পদ্ম ওকে নিয়ে ঘুরে আসতে গেছে। কেমন দেখলেন ননদকে?’

‘ভালো নয়। ডাক্তার জবাব দিয়ে গেছে।’ ক্লান্ত স্বর বিজলির। অবসাদে মুখ বসে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় পায়ের ব্যথাটা আবার অনুভব করলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাধুর বারান্দা শূন্য। এই সময় অন্নপূর্ণা ওকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে বারান্দায় রেখে যেত। অন্নপূর্ণা কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। রাধুর মৃত্যু নিয়ে পুলিশ টানাহ্যাঁচড়া করেনি। পাড়ার দু—চার জন বলেছিল শঙ্কর চাটুজ্যে টাকা খাইয়ে পুলিশের মুখ বন্ধ করেছে।

বিকেলের এই সময়টায় সূর্যের দাপট যখন ক্ষমতা হারাতে শুরু করে, তখন জয় দত্ত স্ট্রিটের বাড়িগুলোর শরীরে জরা ফুটে ওঠে। বিজলি লক্ষ করেছেন, এই সময়ই পাড়াটা নিজের মনের মধ্যে সেঁধিয়ে যায়, হইচই হট্টগোল ঝিমিয়ে পড়ে কিছুক্ষণের জন্য। তার পরই বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয় টিভি—র চিৎকার, শোনা যায় শাঁখের আওয়াজ। কয়েক বছর আগে শোনা যেত কিশোরী কণ্ঠে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান সাধা। এখন গান না জানলেও মেয়েদের বিয়েতে অসুবিধে হয় না।

পশ্চিমের বাড়ির জন্য বিকেল থেকে বিজলির ঘরে আলো কম হয়ে যায়। বারান্দা থেকে তিনি ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আবার শুনতে পেলেন আর্তনাদটা ‘হাসি, হাসিরে।’ লোকটিকে অমন কঠোরভাবে বলা ঠিক হয়নি। মুখ দিয়ে তখন অনেক কথা রাগের মাথায় বেরিয়েছে। সেগুলো তো আগে থাকতে তৈরি করে রাখা ছিল না। মানুষ কাকে বলে—সেটা তো তখনই মনের মধ্যে কীভাবে যেন এসে গেল। ভালোবাসলে ধর্ম থাকে না, এই বোধটা যে তাঁর মধ্যে ছিল, এটাই তিনি জানতেন না। জ্যোতির কাছ থেকে হাসির উপর অত্যাচার আর তা সহ্য করে যাওয়ার কথা শোনার পর তাঁর মনে হয়েছিল হাসি নিছকই মুসলমান মেয়ে নয়, হিন্দুর বউও নয়, ও একটা মানুষ।

বিজলির মনে হল, পুজোআচ্চচা তো মানুষ হয়ে ওঠার জন্যই করা। পুজো না করেও তো হাসি আর জ্যোতি যথেষ্ট মানুষ হতে পেরেছে। মৃত্যুর পরোয়ানা পাবার পরও মেয়েটা পাঁচালি পড়ে গেল। কী বুকের পাটা!

বিজলি মুখ ফিরিয়ে, মলিন আলোয় শ্রীধরের সিংহাসন, নারায়ণ শিলা, গাছকৌটো, গায়ত্রীদেবী, লক্ষ্মীর ছবি, জগন্নাথদেব, গণেশমূর্তির উপর দিয়ে চোখ বোলালেন। স্পষ্টভাবে কিছুই দেখতে পেলেন না, সবই কেমন আবছা, ধ্বক করে উঠল বুকের মধ্যে। প্রদীপের আলোয় কাঁপা একটা শ্যামলা মুখ পাঁচালি পড়ছে—উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠল তাঁর চোখে। চোখ বন্ধ করে তিনি মাথাটা ঝাঁকিয়ে দৃশ্যটা বন্ধ করে দিলেন। ও মুসলমানের মেয়ে।

বকবক করতে করতে পদ্ম উঠছে সিঁড়ি দিয়ে। বিজলি তৈরি হলেন ওকে বকুনি দেওয়ার জন্য।

‘দ্যাখো তো কী কাণ্ড, পার্কে নিয়ে গেছিলুম। একটা মেয়ে আলুকাবলি খাচ্ছিল, আদিখ্যেতা করে এতোটা ভুটুর মুখের সামনে ধরল আর ছেলে অমনি গপ করে মুখে ঢুকিয়ে নিল। তারপরই ঝাল লেগে চিল চিৎকার। শেষে আইসক্রিম কিনে মুখে দিতে ঠান্ডা হল।’

বিজলি শান্ত গলায় বললেন, ‘পদ্ম এরকম ঝামেলা অনেক হবে। আমাদের দু—জনের পক্ষে সব সামলানো সম্ভব হবে না। ঘরে পুরুষমানুষ নেই, কখন কী বিপদ—আপদ ঘটিয়ে ফেলে তার ঠিক নেই। ওকে বরং ওর বাবার দেশের বাড়িতে ঠাকুরদা ঠাকুমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়াই ভালো।’

শুনেই মুখভার হয়ে গেল পদ্মর। বলল, ‘কী আর এমন ঝামেলা করে ভুটু, ও আমি সামলে নোব।’

‘নারে সেরকম সামলাবার কথা হচ্ছে না।’ বিজলি আরও শান্ত স্বরে বললেন, ‘বড়সড় নানারকম বিপদ হতে পারে। ওর মা—র মতো যদি কিছু হয়, আমরা তো দু—জন মুখ্যু মেয়েমানুষ, তখন কী করব? তা ছাড়া পরের ছেলে এটা মনে রাখিস। চল ওকে নিয়ে জ্যোতিদের বাড়িতে গিয়ে রেখে আসি।’

‘তুমি বাড়ি চেনো?’

‘জ্যোতি তো বলল গ্রামের নাম মল্লিকপুর। বর্ধমান থেকে কাটোয়া যাবার রাস্তায় পড়বে। তোর মেসোমশায়ের সঙ্গে মোটরে একবার গেছিলুম কাটোয়া, ওনার বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে। বর্ধমান থেকে বাস যায়। বাসে উঠে কনডাকটরকে বললে মল্লিকপুরে ঠিক নামিয়ে দেবে। তারপর জ্যোতির জ্যাঠার নাম করব। কেউ—না—কেউ ঠিক বাড়ি দেখিয়ে দেবে। অত ঘাবড়াছিস কেন, বেরিয়ে তো পড়ি। বর্ধমান আর কতটুকু পথ—রোজ কত লোক কলকাতায় এসে চাকরি করে বর্ধমান ফিরে যায়। যদি খুঁজে না পাই তা হলে ফিরে আসব।’

‘তার থেকে বরং দাদাকে জিজ্ঞেস করে সব জেনে নিয়ে যাওয়াই ভালো, রোববার তো আসবে।’

‘জ্যোতি আমাদের যেতে বলবে না। বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক নেই ওর। তাতে আমাদের কী। ছেলেকে কোথাও রাখার ব্যবস্থা যদি না করে তা হলে সেটা আমাদেরই করতে হবে।’

দু—দিন পর ওরা সকাল ন—টা নাগাদ বেরিয়ে পড়ল হাওড়া স্টেশনের উদ্দেশে। পদ্মর কোলে ভুটু, বিজলির কাঁধে একটা কাপড়ের ঝোলা। তাতে ভুটুর জন্য দুধ বিস্কুট কমলালেবু সোয়েটার প্যান্ট। বাসে ওরা স্টেশনে পৌঁছে একজনকে জিজ্ঞাসা করে টিকিটঘরে পৌঁছোল। অন্তত কুড়িজনের লাইন জানলার সামনে। বিজলি লাইনে দাঁড়ালেন। মিনিট দশেকের মধ্যেই টিকিট পেয়ে আবার একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই লোকটি দু—নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘বর্ধমান লোকাল, এখুনি ছাড়বে দৌড়ে যান।’

তারা দু—জনে আধা দৌড়—আধা—হাঁটা অবস্থায় গার্ডের কামরা পার হয়েই প্রথম যে দরজাটি পেল তাতে উঠে পড়ল। বসার জন্য জায়গা নেই, ভিড় আছে কিন্তু কষ্টকর নয়। পদ্ম হাঁ করে শ্বাস নিতে নিতে বলল, ‘মাসিমা হার্ট ফেল হয়ে যাবে আমার।’

‘ফেল হয় হোক ট্রেনটা তো ধরা গেল।’ বিজলির কথা শেষ হওয়া মাত্র ট্রেন ছেড়ে দিল। ‘দেখলি তো, না দৌড়োলে পরের ট্রেনের জন্য এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হত। এক কাজ কর, দেখছিস বসার সিটগুলোর মাঝখানে লোক দাঁড়িয়ে। তুই ভুটুকে নিয়ে ঢুকে যা, সিট খালি হলেই বসে পড়বি।’

পদ্ম তাই করল। সিটে বসা একটি অল্পবয়সি বউ ভুটুর দিকে দু—হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমার কাছে দিন।’ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল পদ্ম। কিছুক্ষণ পর সে বউটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘কত দূর যাবেন?’

‘শ্যাওড়াফুলি।’

নামটা পদ্মর শোনা কিন্তু কতদূরে জায়গাটা, কতক্ষণ যেতে লাগবে জানে না। আধঘণ্টা পরে পাশে বসা পুরুষটি উঠে দাঁড়াতেই বউটি বলল, ‘এবার নামব আপনি বসুন।’

ভুটুকে কোলে বসিয়ে পদ্ম তাকাল বিজলির দিকে। বিজলি তাকে হাত নেড়ে বসে থাকতে বললেন। ঘণ্টাখানেক পর বিজলিও বসার জায়গা পেয়ে গেলেন। বর্ধমান স্টেশনে নেমে কাটোয়ার বাসের জন্য আবার একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন বিজলি।

‘তিনকোনিয়া যান সেখানে থেকে ছাড়ে কাটায়োর বাস।’

‘কত দূরে তিনকোনিয়া?’

লোকটি তাঁদের দু—জনকে আপাদমস্তক দেখে বলল, ‘রিকশা করুন।’

রিকশায় মিনিট পাঁচেক গিয়ে বাস টার্মিনাস। বাসের রুট বোর্ডে নাম দেখে, কনডাকটরকে জিজ্ঞাসা করলেন বিজলিবালা, ‘হ্যাঁ বাবা, এই বাস মল্লিকপুর যাবে?’

‘যাবে।’

‘কতক্ষণ লাগবে যেতে?’

‘পঞ্চাশ মিনিট।’

পদ্ম বলল, ‘ভাড়া কত?’

‘তেরো টাকা’ বলেই কনডাকটর যোগ করল, ‘এটা সুপার বাস।’

তারা বাসে উঠল এবং বসার জায়গা পেল। টিকিট কেনার সময় বিজলি বললেন, ‘বাবা মল্লিকপুরে নামিয়ে দিয়ো, আমরা নতুন যাচ্ছি, কিচ্ছু চিনি না।’

দশ মিনিট যাবার পরই বিজলি উদবিগ্ন স্বরে বলে উঠলেন, ‘মল্লিকপুরে নামব, মনে আছে?’

অল্পবয়সি কনডাকটর চিৎকারে ভাঙা গলা যথাসাধ্য কোমল করে বলল, ‘ঠিক নামিয়ে দোব দিদিমা, ব্যস্ত হবেন না।’

মিনিট চল্লিশ পর সে বলল, ‘দিদিমা মল্লিকপুর। গেটের কাছে আসুন।’

বাস থেকে নেমে তারা এধার—ওধার তাকাচ্ছে। এক ভ্যান রিকশাওয়ালা তাকে লক্ষ করছিল। বলল, ‘যাবেন কোথায়?’

‘মল্লিকপুর।’

‘কাদের বাড়ি।’

‘চক্রবর্তীদের।’

‘কোন চক্রবর্তী, নাম কী?’

মুশকিলে পড়লেন বিজলি। জ্যোতির বাবার নাম একবার মাত্র শুনেছেন,এখন মনে পড়ছে না, জ্যাঠার নামও জ্যোতি বলেছিল সেটাও ভুলে গেছেন।

তাঁর বিপন্ন ক্ষুব্ধ মুখ দেখে রিকশাওয়ালা সাহায্য করল।

‘ওই বইয়ের দোকানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে আসুন।’

খাতা কাগজ কলমের রিফিল আর স্কুলপাঠ্য বইয়ের সঙ্গে পাঁজি এবং উপন্যাস নিয়ে বইয়ের দোকান। দুপরে ক্রেতা নেই। এক প্রৌঢ় কাউন্টারের পিছনে টুলে বসে।

বিজলি শুরু করলেন, ‘জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী নামে একটি ছেলে থাকত মল্লিকপুরে। বাড়ির অবস্থা ভালো। বর্ধমান শহরে বাড়ি আছে, চালের আড়তও আছে। বোনের বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামে পুজুরি ব্রাহ্মণের সঙ্গে। জ্যোতির্ময়ের বাবার নাম জানি না, আপনি কি বলতে পারবেন ওনার বাড়িটা কোথায়?’

প্রৌঢ় একমনে শুনে বললেন, ‘বিপ্রদাস চক্রবর্তী। দ্বিতীয় পক্ষের বউ।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। জ্যোতির্ময় প্রথম পক্ষের।’ বিজলি স্রোতে ভাসতে ভাসতে ধরার মতো একটা কাঠ যেন পেলেন।

‘তা বিপ্রদাসকে কী দরকার। তার তো হাঁপানি, বাতেও পঙ্গু। শয্যাশায়ী।’

‘ওর সঙ্গে দুটো কথা বলতে এসেছি।’

‘বিপ্রদাসের বাড়ি এখান থেকে একমাইল—তেঁতুলতলায়। রিকশা করে যান, রাস্তা খুব খারাপ, হাঁটতে পারবেন না।’

ভ্যান রিকশায় দুটি লোক উঠে পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে। পদ্ম উঠে রিকশার পাটাতনে ভুটুকে কোলে নিয়ে বসল। বিজলিবালা চাকার পাশে বসলেন পা ঝুলিয়ে, পদ্ম জিজ্ঞাসা করল, ‘মল্লিকপুর যেতে পড়বে কত?’

‘পাঁচটাকা করে।’

বিজলিবালার কানের কাছে মুখ এনে পদ্ম বলল, ‘কলকাতার থেকে সস্তা, তাই না মাসিমা।’

প্রৌঢ় ঠিকই বলেছিলেন। রাস্তা যে এত ভাঙা হতে পারে, এত গর্ত থাকতে পারে সে ধারণা ওদের ছিল না। পদ্ম একবার শুধু বলে, ‘মাসিমা বাড়ি ফিরে দু—দিন শুয়ে থাকব,গায়ের ব্যথা মারতে।’

একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে রিকশাওয়ালা বলল ‘এই বিপ্রদাস চক্রবর্তীর বাড়ি।’

বাড়িটা চৌকো গড়নের। উপরে নীচে সার দিয়ে সাত—আটটা জানালা। বাড়ির মাঝামাঝি সদর দরজা। ভুটু বাসে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়েছে, এখন সে চনমনে। ওকে হাঁটিয়ে নিয়ে বিজলি সদর দরজার দিকে এগোলেন। দোতলায় জানলা থেকে সরে গেল এক স্ত্রীলোকের মুখ।

সদর দরজা খোলা রয়েছে। ইতস্তত করে বিজলি ভিতরে ঢুকলেন। একটা উঠোন থেকে ঘিরে রক। দোতলায় বারান্দা। সেখানে দাঁড়িয়ে এক বছর পঞ্চাশ বয়সি মহিলা।

‘কাকে চাই।’ গলার স্বর ভারী ব্যক্তিত্বপূর্ণ।

‘আমরা কলকাতা থেকে আসছি। বিপ্রদাসবাবুর সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই।’ বিজলি যথাসম্ভব বিনীত স্বরে বললেন।

‘ওপরে আসুন, ডান দিকে সিঁড়ি। উনি অসুস্থ, ঘুমোচ্ছেন। কিছু বলার থাকলে আমায় বলতে পারেন।’

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় পদ্ম চাপা স্বরে বলল, ‘মাসিমা গলায় স্বর শুনলেন! সোজা লোক নয়।’

‘একদম কথা বলবি না।’

সিঁড়ি শেষ হয়েছে লম্বা দরদালানে। তার একদিকে পর পর ঘর। সারা বাড়িতে সাড় নেই। কোনো লোকজনও দেখলেন না। দালানটা চকচকে লাল সিমেন্টের। পুরোনো বাড়ি। মোটা দেওয়াল, খড়খড়ির জানলা। দালানের এক প্রান্তে ঝাঁঝরি বসানো নর্দমার ধারে প্লাস্টিকের বড়ো একটা জলের ড্রাম। তার ঢাকনার উপর একটা প্লাস্টিকের লাল হাতল ভাঙা মগ। হাত—পা ধোয়ার জল রাখা হয়। বিজলিবালার চোখ পড়ল জলচৌকিতে রাখা একটা তামার টাটে তার উপর রাখা কোষাকুষি আর পুজোর ঘণ্টা। বুঝলেন এ বাড়িতে দেবতার নিত্যপুজো হয়। মহিলা একটি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কৌতূহল ও বিস্ময় নিয়ে। পরনে সাদা শাড়ি নকশাদার সবুজ পাড়, সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর। গলায় সরু হার, হাতে দু—গাছা করে সোনার চুড়ি। মাথায় আধ ঘোমটা। গায়ের রং ফরসা। তিনি কিছু বলার আগেই বিজলি বললেন, ‘আমার নাম বিজলিবালা ভটচায। কলকাতায় আমার বাড়ি। জ্যোতির্ময় নামে এই বাড়ির কোনো ছেলে আছে?’

‘ছিল। বাড়ির সঙ্গে এখন তার সম্পর্ক নেই। হঠাৎ ওর খোঁজ নিতে এলেন কেন?’

‘বলছি। আপনি ওর কে হন?’

‘সৎমা।’

বিজলি হুঁশিয়ার হয়ে গেলেন। ভুটুকে বিস্কুট দিল পদ্ম, সে ফেলে দিল। থার্মোফ্লাসকে দুধ এনেছে, দু—চুমুক দিয়ে খেল না। মহিলা ভুটুকে দেখতে দেখতে বললেন, ‘আপনার নাতি?’

হেসে বিজলি বললেন, ‘আপনার নাতি’।

মহিলা অবাক হয়ে ভ্রু তুলে তাকালেন, ‘আমার!’

‘এ জ্যোতির ছেলে। এর জন্যই আমি এসেছি। জ্যোতি আমার ভাড়াটে। চার মাস আগে জ্যেতির বউ মারা গেছে। এই বাচ্চচাকে দেখার কেউ নেই। আমি ওকে রাখছি। কিন্তু আমার মনে হয় ওর নিজের রক্তের সম্পর্কের লোকেদের হাতেই বড়ো হওয়া উচিত। তাই নিয়ে এসেছি।’

‘আপনি এনেছেন না জ্যোতি পাঠিয়ে দিয়েছি, সম্পত্তির ভাগ নেবার জন্য এই দাবিদারটি তৈরি করে। দেখুন আমরা যথেষ্ট খোঁজ নিয়েছি, খবরও রাখি। জ্যোতি একটা মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করেছিল। এই ছেলেটি সেই মুসলমান মায়ের সন্তান।’

‘মাসিমা হাসিদি—!’ পদ্মর বিস্ফারিত চোখ স্তিমিত হয়ে গেল বিজলির একটি চাহনিতেই।

‘দেখুন এই দোতলায় আমাদের কুলদেবতা রয়েছেন। কথা বলতে চান যদি তাহলে নীচে চলুন।’ মহিলা কঠিন গলায় বললেন। বিজলির দু—কান গরম হয়ে উঠল। হঠাৎ নীচে যেতে বলার পিছনের কারণটা স্পষ্ট। দোতলায় কুলদেবতা এবং মুসলমান মায়ের সন্তান দু—জনের থাকা চলবে না। কিন্তু তিনি এসেছেন প্রার্থী হয়ে, যা বলে বলুক হজম করতে হবে।

ধানের বস্তায় অর্ধেক ভরা নীচে মহিলা তিনজনকে নিয়ে এসে একটা ঘরে তক্তপোশে বসালেন। বিজলি বললেন, ‘জ্যোতির সঙ্গে কথা বলে যা বুঝেছি সে সম্পত্তির অংশ দাবি করবে না। আর এই শিশুটিকে আমিই এনেছি। জ্যোতি পাঠায়নি। এমনকী সে জানেও না। ওর নিজের বংশের লোকেদের সঙ্গে থেকে মানুষ হওয়া উচিত বলেই মনে করে ওকে এনেছি, ও আপনার নাতি এটা ভেবেই ওকে আপনার কাছে রাখুন।’

‘নাতি!’ মহিলা প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। ‘এই বাড়িতে মুসলমান মায়ের ছেলে থাকবে? দেখুন আপনি ধর্ম মানেন কিনা জানি না কিন্তু আমরা মানি।’

এই সময় পদ্ম বলে উঠল, ‘একটু জল দেবেন, ভুটু সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এখনও পর্যন্ত জল খায়নি।’

মহিলা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেলেন। পদ্ম অবসন্ন ভুটুকে পাশে বসিয়ে জনিয়ে ধরে রইল। মহিলা ফিরে এলেন প্লাস্টিকের হাতলভাঙা লাল মগে জল নিয়ে। দেখেই মগটাকে তিনি চিনতে পারলেন। তার মাথার মধ্যে অগ্ন্যুৎপাত ঘটে গেল।

‘পদ্ম ও জল ছুঁবি না।’

ঘরে যেন বাজ পড়ল। বিপ্রদাস চক্রবর্তীর বউয়ের হাতের মগ কেঁপে উঠল। পদ্মরও তটস্থ অবস্থা।

‘আমাকে ধম্মো শেখাবেন উনি? পায়খানার মগে করে জল এনেছেন ভুটুকে খাওয়াবার জন্য! পদ্ম ওঠ, এ বাড়িতে আর এক মুহূর্তও নয়!’

বিজলিবালা কথাটা বলেই দ্রুতপায়ে এগোলেন সদর দরজার দিকে। ভুটুকে কোলে তুলে পড়িমরি তাকে অনুসরণ করল পদ্ম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে তারা হাঁটতে লাগল। এখানে রিকশা পাওয়া যায় না। রাস্তার গর্তে পা পড়ে ভুটুকে নিয়ে পদ্ম হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। কোনোরকমে সামলে নিয়ে বলল, ‘মাসিমা আর একটু ভালো করে বললে না কেন, ধম্মো কি গায়ে লেখা থাকে? না ভড়ং দেখিয়ে পুজো করলেই ধাম্মিক হওয়া যায়। ধম্মো তো অন্তরে থাকে তাই না মাসিমা?’

বিজলি শুধু বললেন, ‘হুঁ।’

‘মাসিমা ওই টিনের চালের বাড়ির সামনে একটা বুড়ি, একটু জল চাও না।’

বিজলি এগিয়ে গেলেন বুড়ির দিকে। ‘মা এই শিশুটা অনেকক্ষণ জল খায়নি, একটু জল দেবে?’

কথাটা শুনে বুড়ি ‘দাঁড়াও বাছা’ বলে হনহনিয়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল। একটা ছোট্ট রেকাবিতে চিনি আর ঝকঝকে স্টিলের গ্লাসে জল নিয়ে এল। ভুটু আধ গ্লাস জল শেষ করল বাকিটা আলগোছে খেল পদ্ম।

‘আর জল খাবে?’ বুড়ি জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ।’ বলেই পদ্ম খানিকটা চিনি মুখে দিয়ে রেকাবিটা বিজলির সামনে ধরল।

‘তুমি।’

‘আমিও।’ বিজলি বললেন রেকাবিটা হাতে নিয়ে।

জল খেয়ে ওরা রওনা হল বাস ধরতে। কিছুটা হেঁটে বিজলি বললেন, ‘ওরে আমি আর পারছি না, পায়ের যন্ত্রণাটা আবার চাগাড় দিয়েছে।’

‘তা হলে একটু দাঁড়াও, কমুক যন্তাোন্নাটা।’ ভুটুকে কোল থেকে সে নামাল।

বিজলি দাঁড়িয়ে পড়লেন। পদ্ম কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞাসা করল, ‘হাসিদি মুসলমান, একথাটা তো আমায় বলোনি।’ গলার স্বরে অভিমান স্পষ্ট।

‘তোর মনে আছে হাসি লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়েছে, নারায়ণ শিলা ছুঁয়েছে!’

‘তোমার মতো করে পেন্নামও করছে।’

‘লোকে জানলে কী বলবে কী ভাববে সেই ভয়ে আমি তোকে বলিনি। তোর পেটে তো কথা থাকে না! চল হাঁটি। দাঁড়িয়ে থেকে যন্ত্রণা কমবে না। ভুটুকে এবার মুতিয়ে নে।’

ওরা একটা মিনিবাস পেয়ে গেল। বর্ধমানে নেমে পদ্ম বলল, ‘মাসিমা এখানকার মিহিদানার খুব নাম, তুমি খেয়েছ?’

বিজলি কথার জবাব না দিয়ে ব্যাগ থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে পদ্মর হাতে দিয়ে বললেন, ‘লোককে জিজ্ঞেস কর এখানে নাম করা দোকান কোনটে, এতে যতটা হয় কিনে আন। আমি ভুটুকে নিয়ে দাঁড়াচ্ছি।’

এবার ট্রেনে উঠে ওরা বসার জায়গা পেল। কামরার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মাথা ঠেকিয়ে বিজলি চোখ বুজলেন। জানলার ধারে বসে পদ্ম কমলালেবু খাওয়াতে লাগল ভুটুকে। এক একটা স্টেশন আসছে, যাত্রীরা ওঠানামা করছে, হকার চেঁচাচ্ছে, বিজলির চোখ একবারও খুলল না।

‘মাসিমা ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’

‘কেন?’ চোখ না খুলে বললেন বিজলি। পায়ের যন্ত্রণাটা এখন তাঁর মুখে ছাপ ফেলেছে।

‘ভুটু থাকবে আমাদের বাড়িতে?’ মুখে উৎকণ্ঠা নিয়ে পদ্ম জানতে চাইল।

জবাব দিলেন না বিজলি। হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে অনেকটা পথ প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে গেটে টিকিট দিয়ে বেরিয়ে এসে বিজলি বললেন, ‘শরীর আর বইছে নারে পদ্ম, ট্যাক্সি করে বাড়ি যাব।’

ট্যাক্সিতেই তারা বাড়ি ফিরল। বিজলি দেওয়াল ধরে ধরে দোতলায় উঠে খাটে শরীর এলিয়ে দিয়ে পদ্মকে বললেন ‘আলো নিভিয়ে পাখাটা খুলে দে। আমাকে এখন জ্বালাতন করবি না।’

‘আয় ভুটু আমরা নীচে গিয়ে মিহিদানা খাই।’ পদ্ম ভুটুর হাত ধরে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে। মিহিদানার বাক্সটা থলির মধ্যে ঘরেই রয়ে গেছে। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। পদ্ম চেঁচিয়ে উঠল ‘কে?’

‘আমায় চিনবেন না। একবার দরজাটা খুলুন।’

‘দাঁড়া ভুটু কে এল দেখে আসি।’

ভুটুর হাত ছেড়ে দিয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল। গুটি গুটি পায়ে ভুটু বিজলির ঘরে ফিরে এল। সদর দরজা খুলে পদ্ম অবাক। হাঁটু পর্যন্ত সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরা কৃষ্ণকায় এক দীর্ঘদেহী পুরুষ, গালে চাপ দাড়ি। সন্ধ্যার মুখের এমন একটি অচেনা লোককে সদরে দেখে তার বুক ঢিপঢিপ করে উঠল। ঢোক গিলে বলল ‘কাকে চাই?’

‘এই বাড়িতে হাসিনা থাকে?’ গলার স্বর মৃদু, চাপা। পদ্ম ভরসা পেল।

‘হাসিনা আবার কে? হাসিদি থাকত, সে তো মারা গেছে।’

‘আমি হাসির বাবা। আমাকে যিনি ফোন করেছিলেন তিনি কি আছেন?’

পদ্মর গলার স্বর মৃদু ও ব্যথিত হয়ে গেল। বলল, ‘কে ফোন করেছিল তা তো আমি জানি না। আচ্ছা দাঁড়ান মাসিমাকে জিজ্ঞাসা করে আসি।’

পদ্ম ছুটে দোতলায় উঠে ঘরের দিকে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। কীরকম একটা শব্দ হচ্ছে, মেঝেয় পাথর গড়ানোর মতো। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। এমন সময়েই তো রাধুমাসিরা বেরোয়! কান খাড়া করে শুনল, কেমন যেন একটা গলার আওয়াজ, তারপরই কিছু একটা পড়ার শব্দ আর ভুটুর কেঁদে ওঠা, পদ্ম দ্রুত ঘরে ঢুকে আলোর সুইচ টিপল। যা দেখল তাতে চোখ কপালে ওঠার উপক্রম হল। খাটের দিকে তাকিয়ে দেখল বিজলি ওপাশ ফিরে বালিশ জড়িয়ে শুয়ে।

তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল পদ্ম, ‘ও মাসিমা গো দ্যাখো গো, কী সব্বোনেশে কাণ্ড করেছে ভুটু। দ্যাখো উঠে একবার দ্যাখো।’

নারায়ণ শিলা খাটের তলায়। সিংহাসন সমেত রাধাকৃষ্ণ মেঝেয় উপুড় হয়ে, জগন্নাথ আলাদা হয়ে রয়েছে সুভদ্রা বলরামের সঙ্গে। গায়ত্রী দেবীর মাথা নিখোঁজ। ভয়ে জড়সড় ভুটু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে।

মুখ না ফিরিয়ে বিজলি বললেন, ‘তুই দ্যাখ,ভাঙাভাঙির আওয়াজ আগেই পেয়েছি।’ বিজলি এবার পাশ ফিরে পদ্মর দিকে তাকালেন, ‘তোকে আর গয়ায় গিয়ে পিণ্ডি দিতে হবে না, মুক্তি দেবার লোক আমি পেয়ে গেছি। কে এসেছে নীচে?’

‘হাসিদির বাবা।’

‘যা ওনাকে এখানে নিয়ে আয়। আমার পায়ের যন্ত্রণা এখনও কমেনি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *