৫. হিন্দুস্থানের হিন্দুদের কথা

হিন্দুস্থানের হিন্দুদের কথা

[ফ্রান্সের একজন দরিদ্র কবি *জ্যঁ শাপলাকে একখানি পত্রে ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের ভারতবর্ষের হিন্দুদের ধর্ম, ধ্যান—ধারণা, আচার অনুষ্ঠান, সামাজিক প্রথা, সংস্কার ইত্যাদি সম্বন্ধে অনেক কথা লিখেছিলেন। নিজের চোখে যা তিনি দেখেছিলেন এবং নিজের কানে যা শুনেছিলেন, তাই তিনি লিখেছিলেন বলে তার মূল্য আছে, বিশেষ করে সামাজিক ইতিহাসের উপাদান হিসেবে।—অনুবাদক]

ফরাসি ও ভারতীয় সূর্যগ্রহণ

জীবনে আমি দুটি সূর্যগ্রহণ দেখেছি, যা কোনোদিন ভুলতে পারব বলে মনে হয় না। তার মধ্যে একটি সূর্যগ্রহণ দেখেছি ফ্রান্সে ১৬৫৪ সালে, আর একটি দেখেছি দিল্লিতে ১৬৬৬ সালে। প্রথম গ্রহণের সময় ফরাসি জনসাধারণের এমন সব যুক্তিহীন ও অর্থহীন আচরণ স্বচক্ষে দেখেছি, যা আমার মনে গেঁথে রয়েছে চিরদিনের মতো। এমন ভয়াবহভাবে আত্মজ্ঞান বিস্মৃত হয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠল তারা যে অনেকে গ্রহণ লাগার আগে ওষুধপত্র কিনে খেতে লাগল আত্মরক্ষার জন্য। অনেকে ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে চুপ করে বসে রইল সারাদিন বন্দি হয়ে। এমনভাবে তারা চারিদিক বন্ধ করে বসে ছিল যাতে আলোর রশ্মি পর্যন্ত ঘরে না প্রবেশ করতে পারে। অন্ধকার কুঠরি খুঁজে তার মধ্যে ঢুকে বসে রইল অনেকে। দলে দলে হাজার হাজার লোক চলল গির্জার দিকে দেবতার কাছে প্রার্থনা করার জন্য। কেউ কেউ উদভ্রান্ত হয়ে গেল আসন্ন বিপদের আশঙ্কায়—কি জানি কি দুর্ঘটনা ঘটে এই ভেবে। অনেকে ভাবল পৃথিবীর ও মানুষের অন্তিমকাল ঘনিয়ে এসেছে, গ্রহণ লাগলে পৃথিবীর ভিত পর্যন্ত কেঁপে উঠে হয়ত সব ধ্বংস হয়ে যাবে। এই ধরনের আজগুবি সব ধারণা ও বিশ্বাস ছিল আমাদের দেশবাসীর। গ্যাসেন্ডী, রোবারভাল ও অন্যান্য বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদদের ব্যাখ্যা সত্ত্বেও গ্রহণ সম্পর্কে লোকের আতঙ্ক ও ভুল ধারণার সীমা ছিল না। বিজ্ঞানীরা বলে দিয়েছেন, গ্রহণ লাগলে কোনো ভয়ের কারণ নেই, কারও কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষের ভয় গেল না। কিছু মতলববাজ গণৎকার ও জ্যোতিষীর অপপ্রচার ও মিথ্যা কল্পনার ফলে সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে ভুল ধারণা তাদের বদ্ধমূল রইল।

১৬৬৬ সালে হিন্দুস্থানে দিল্লি শহর থেকে যে সূর্যগ্রহণ আমি দেখেছি তার কথাও আমার বিশেষভাবে মনে আছে। গ্রহণ সম্পর্কে ওই একই হাস্যকর ধারণা ও কুসংস্কার ভারতীয়দেরও আছে দেখলাম। যে সময় গ্রহণ লাগবার কথা, সেই সময় আমি আমার বাড়ির উপরের একটি খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। যমুনার তীরেই আমার বাড়ি ছিল, সুতরাং সমস্ত দৃশ্যটি দেখবারও আমার সুযোগ হয়েছিল। দেখলাম যমুনার তীরে অসংখ্য লোকের ভিড় জমেছে। এককোমর জলে নেমে দাঁড়িয়ে আছে তারা ঊর্ধ্বে আকাশের দিকে চেয়ে, করজোড়ে, সেই মুহূর্তটির অপেক্ষায় যখন গ্রহণ লাগবে। গ্রহণ লাগলেই তারা জলে ডুব দিয়ে স্নান করবে। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা সকলেই প্রায় উলঙ্গ; পুরুষদের অধিকাংশের পরনে গামছা; বিবাহিতা ও ছয়—সাত বছরের মেয়েদের পরনে শাড়ি। বড়ো বড়ো রাজা মহারাজা ও ধনী লোকেরা, ব্যবসায়ী, ব্যাঙ্কার ও জুয়েলাররা সপরিবারে যমুনার তীরে এসে তাঁবু খাঁটিয়ে থাকার ব্যবস্থা করেছেন। যমুনার জলে চারিদিকে পর্দা টাঙিয়ে জনতার চক্ষুর অন্তরালে তাঁদের পরিবারবর্গের স্নানের ব্যবস্থা হয়েছে। যে মুহূর্তে গ্রহণ লাগার সংবাদ রটল, অমনি যমুনার বক্ষ থেকে হাজার হাজার কণ্ঠের একটা সম্মিলিত ধ্বনি উঠল এবং সকলে জলে ডুব দিতে লাগল বার বার। ডুব দিয়ে তারা জলে দাঁড়িয়ে, হাতজোড় করে সূর্যের দিকে চেয়ে বিড়—বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করতে আরম্ভ করল এবং মধ্যে মধ্যে জলে হাত ডুবিয়ে সূর্যের দিকে জল ছিটাতে লাগল। কখনও মাথা হেঁট করে, কখনও হাত নেড়ে তারা কতরকম যে ভঙ্গি করতে আরম্ভ করল, তার ঠিক নেই। গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা এইভাবে অনবরত ডুব দিতে আর মন্ত্র পড়তে রইল। স্নান করে উঠে এসে যমুনার জলে টাকাপয়সা ছুঁড়তে লাগল এবং দান করতে লাগল ব্রাহ্মণদের। ব্রাহ্মণরাও বেশ বুদ্ধিমান, দিনক্ষণ বুঝে দানের লোভে অনেকে এসে হাজির হয়েছিল সেখানে। স্নানান্তে সকলেই নতুন কাপড় পরে পুরনো কাপড় ছেড়ে ফেলে দিল।

এইভাবে আমার ঘরের বারান্দা থেকে চোখের সামনে আমি যমুনার ওপর গ্রহণের অনুষ্ঠান দেখেছিলাম। শুধু যমুনায় নয়, সিন্ধু থেকে গঙ্গা পর্যন্ত এবং অন্যান্য নদনদীতে এইভাবে সমারোহে গ্রহণপর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। থানেশ্বরের নদীতে প্রায় দেড়লক্ষ লোক জমা হয়েছিল গ্রহণের স্নান করার জন্য। তাদের ধারণা, গ্রহণের দিন নদীর জল অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি পবিত্র হয় এবং তাতে স্নান করলে পুণ্যসঞ্চয়ও হয় বেশি।

মোগল বাদশাহ, মুসলমান হলেও, হিন্দুদের এইসব ধর্মকর্মে, আচার—অনুষ্ঠানে হস্তক্ষেপ করতেন না কখনও। কেবল এই জাতীয় কোনো সামাজিক পার্বণের সময় বা উৎসব—অনুষ্ঠানের সময়, ব্রাহ্মণরা দেখেছি প্রায় লাখখানেক টাকা নজরানা দেন বাদশাহকে, এবং বাদশাহ তার পরিবর্তে তাঁদের একটা হাতি আর কয়েকটা ভেস্ট খেলাৎ দেন।

সূর্যগ্রহণ সম্বন্ধে কেন হিন্দুস্থানের এই ধারণা এবং কেন এই অনুষ্ঠানের আয়োজন, সেই কথা এইবার বলব :

হিন্দুরা বলেন, তাঁদের চারটি ‘বেদ’ আছে—পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। ব্রাহ্মণের মাধ্যমে ভগবান এই বেদ প্রচার করেছেন জগতে। বেদে কথিত আছে নাকি যে, কোনো এক ভয়ঙ্কর কৃষ্ণবর্ণ দানবীয় দেবতা সূর্যের উপর ভর করে তার জ্যোতি ম্লান করে দেয় এবং তার জন্যই সূর্যগ্রহণ হয়। দানব গ্রাস করে ফেলে সূর্য দেবতাকে। সূর্য মঙ্গলময়, করুণাময় দেবতা। তিনি জীবন দান করেন। সুতরাং গ্রাসাচ্ছাদিত অবস্থায় যখন সূর্যদেব যন্ত্রণা ভোগ করেন তখন প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য তাঁকে সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়া। প্রার্থনা করে, পূজার্চনা করে, দানধ্যান করেই একমাত্র তা করা সম্ভবপর। সূর্যগ্রহণের সময় এইজন্য এইসব কাজের গুরুত্ব বেশি এবং কাজ করলে পুণ্যার্জনও করা যায় বেশি। গ্রহণের সময় দান করলে যা পুণ্য হয়, অন্য সময় তার একশভাগের একভাগও হয় না। এত যখন লাভ হয়, তখন কে তার সুযোগ গ্রহণ করতে ছাড়বে বলুন?*

মোটামুটি এই হল হিন্দুস্থানের সূর্যগ্রহণ। এই গ্রহণ কি কখনও ভুলতে পারা যায়? লোকের এই কল্পনা, ধারণা ও বিচিত্র বিশ্বাস সম্বন্ধে আমি আর কিছু মন্তব্য করতে অক্ষম। বাকিটা ভেবে নেবেন।

পুরীর জগন্নাথ

বঙ্গোপসাগরের কূলে জগন্নাথ দেবতার নামে একটি শহর আছে। জগন্নাথের মন্দিরও আছে সেখানে, বিখ্যাত মন্দির। প্রত্যেক বছর জগন্নাথের যে বিরাট উৎসব হয়, তা প্রায় আট—নয় দিন ধরে চলতে থাকে। উৎসবের সময় হিন্দুস্থানের সমস্ত অঞ্চল থেকে অসংখ্য লোকের সমাগম হয়, আগে যেমন হনুমানের মন্দিরে হত এবং এখন যেমন হয় মক্কায়। শুনেছি, সমাগত লোকসংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। বিশাল একটি কাঠের রথ (বার্নিয়ের ‘কাষ্ঠযন্ত্র’ বলেছেন) তৈরি করা হয় এবং তাতে নানারকমের সব কিম্ভূতকিমাকার জীব ও মূর্তি বসানো থাকে—যেমন ভয়ংকর তেমনি কদর্য। চোদ্দটি বা ষোলটি চাকার উপর রথটিকে বসানো হয়, যেমন কামানগাড়ির উপর কামান বসানো হয় তেমনি। বসিয়ে প্রায় পঞ্চাশ—ষাটজন লোক সেটা টানতে থাকে। জগন্নাথের মূর্তিটি মধ্যিখানে বসানো হয়, রীতিমতো সাজিয়ে—গুছিয়ে এবং তাকে টানতে টানতে এক মন্দির থেকে অন্য মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়।

উৎসবের প্রথমদিনে যেদিন মন্দিরে জগন্নাথের দর্শনের জন্য দরজা খোলা হয়, সেদিন যাত্রীদের এমন প্রচণ্ড ভিড় হয় যে ভিড়ের চাপে যাত্রীদের প্রাণ কণ্ঠাগত হয়ে ওঠে এবং অনেকের মৃত্যু হয়। বহু দূর থেকে যাত্রীরা জগন্নাথ দর্শনের জন্য পায়ে হেঁটে আসে এবং পথের ক্লান্তিতে প্রায় মরণাপন্ন হয়ে থাকে। সুতরাং ভিড়ের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা থাকে না তাদের। যাদের মৃত্যু হয়, হাজার হাজার যাত্রীর কাছে তারা সবচেয়ে বেশি পুণ্যাত্মা হয়ে ওঠে এবং সকলেই তাদের সশরীরে স্বর্গযাত্রার জন্য ‘ধন্য ধন্য’ করে। অতঃপর যখন সেই জগন্নাথের রথ ঘর্ঘর করে চলতে থাকে তখন সমবেত দর্শক—যাত্রীদের মধ্যে এমন এক বিকট বন্য উদ্দামতার সঞ্চার হয় যে তার তাড়নায় অনেকে সেই চলন্ত রথের চাকার তলায় পথের উপর শুয়ে পড়ে এবং নিষ্পেষিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। দর্শকদের মধ্যে একটা ত্রাসের সঞ্চার হয় বটে, কিন্তু সকলেই উচ্চকণ্ঠে বাহবা—ধ্বনি দিতে থাকে। এর চেয়ে মহত্তর আত্মত্যাগ ও বীরত্বের নিদর্শন আর কিছু নেই, তাদের মতো আত্মত্যাগী বীরদের দৃঢ় বিশ্বাস যে এইভাবে মৃত্যুকে বরণ করতে পারলে তারা তৎক্ষণাৎ স্বর্গে চলে যাবে এবং সেখানে দেবতা তাদের পুত্রবৎ স্নেহ করবেন ও পালন করবেন। সংসারের দুঃখ বা জ্বালা—যন্ত্রণা বলে কিছু থাকবে না। মহাসুখে তারা স্বর্গে দেবতাদের সঙ্গে বসবাস করতে পারবে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে এইসব ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করার জন্য প্রধানত হিন্দুস্থানের ব্রাহ্মণরাই দায়ী। নিজেদের পার্থিব স্বার্থের জন্যই ব্রাহ্মণরা এই জাতীয় ধর্মকর্ম ও কুসংস্কারের প্রেরণা দিয়ে থাকেন। রথের সময় দেখেছি একটি সুন্দরী মেয়েকে সাজিয়ে—গুছিয়ে জগন্নাথের ‘কনে’ বলে পরিচয় দেওয়া হয় এবং জগন্নাথের পাশে বসিয়ে মহাসমারোহে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য মন্দিরে। সেখানে মেয়েটি জগন্নাথের সঙ্গে রাত্রি যাপন করে। সাধারণ লোকের বিশ্বাস, জগন্নাথ ঠাকুর মেয়েটিকে ভার্যার মতো মনে করবেন এবং সেইভাবে তার সঙ্গে ব্যবহারও করবেন। মেয়েটিকে নানাবিধ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়, যেমন এ—বছর কেমন যাবে, মঙ্গল হবে কি না ইত্যাদি। প্রশ্নের উত্তরের জন্য মুক্তহস্তে দানধ্যান করা হয়, মানত করা হয়। তার পরদিন রথ যখন ফিরে যায়, তখন পুরোহিত তাকে রাত্রে কানে—কানে যা বলে দেয়, সেই সব কথা সে সাক্ষাৎ জগন্নাথের উক্তি মনে করে দর্শকদের চেঁচিয়ে বলতে থাকে। দর্শকরাও মেয়েটির প্রত্যেকটি মুখের কথা বিশ্বাস করে।

জগন্নাথের রথের সামনে ও মন্দির—প্রাঙ্গণে বারাঙ্গনারা নানারকম দৃষ্টিকটু ভঙ্গি করে নৃত্য করতে থাকে (বার্নিয়ের ‘দেবদাসী’ নৃত্যের কথা বলেছেন)। কেউ কোনো আপত্তি করে না। এরকম অনেক সুন্দরী মেয়ে আমি স্বচক্ষে দেখেছি জগন্নাথধামে। ‘বারাঙ্গনা’ বলতে যা বোঝায়, তারা ঠিক তা নয়। হিন্দুই হোক, মুসলমানই হোক বা খ্রিস্টানই হোক, কাউকেই তারা সংস্পর্শে আসতে দেয় না, এবং কারও কাছ থেকে তারা কোনো টাকাপয়সা বা উপহার ইত্যাদি গ্রহণ করে না। তারা মনে করে দেবতার উদ্দেশ্যে তাদের জীবন উৎসর্গ করা হয়েছে এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিত বা পূণ্যাত্মা সাধু ছাড়া তাদের ছায়া মাড়াবার পর্যন্ত অধিকার নেই কারও। ভাল কথা, সাধুসন্ন্যাসীদের কথা তো বলাই হল না। মন্দিরের সীমানার মধ্যে চারিদিকে অনেক সাধু—সন্ন্যাসীদের দেখা যায়। সকলেই নগ্ন অবস্থায় বসে থাকে, মাথায় বড়ো বড়ো জটা, মুখে দাড়ি, গায়ে ভস্ম মাখা।

সতীদাহ ও সহমরণ

সতীদাহ ও সহমরণ—প্রথা সম্বন্ধে অনেক পর্যটক অনেক কথা বলেছেন। নতুন কথা কিছু বলবার নেই। অনেকে অবশ্য সতীদাহের যথেষ্ট অতিরঞ্জিত বিবরণও দিয়েছেন। ক্রমেই সতীদাহের সংখ্যা কমে আসছে মনে হয়। এবং আগের তুলনায় এখন অনেক কমে গেছে। মুসলমান রাজত্বকালে মুসলমান বাদশাহরা নানাভাবে হিন্দুদের সহমরণপ্রথা নিবারণ করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কখনও কোনোদিন তাঁরা হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করেননি এবং প্রত্যক্ষভাবে বিধিনিষেধ জারি করে সতীদাহ বন্ধ করার চেষ্টা করেননি। নানারকম কৌশলে তাঁরা এই অমানুষিক দাহ বন্ধ করার চেষ্টা করেছেন। প্রাদেশিক গভর্নর বা সুবাদারের অনুমতি ছাড়া কেউ সহমরণ বরণ করতে পারবেন না বলে তাঁরা এক আদেশ জারি করে দিয়েছিলেন। সহমরণের জন্য সুবাদারের অনুমতি নিতে হবে এবং তাঁর কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদন করলে সুবাদার সহজে অনুমতি দিতেন না, নানাভাবে চেষ্টা করতেন আবেদনকারীকে বুঝিয়ে—সুঝিয়ে বাঁচাবার জন্য। নানারকম যুক্তি দিয়ে আশার কথা বলে সুবাদার নিজে যখন ব্যর্থ হতেন, তখন তিনি সহমরণ প্রার্থিনীকে অন্দরমহলে মহিলাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। সুবাদারের পরিবারের মহিলারা তাঁকে নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করতেন। সমস্ত ব্যর্থ হলে এবং বাইরে থেকে কোনো প্ররোচনা দেওয়া হচ্ছে না বলে সুবাদারের বিশ্বাস হলে, তবে তিনি সহমরণের অনুমতি দিতেন। এত চেষ্টা সত্ত্বেও সহমৃতার সংখ্যা হিন্দুস্থানে খুব বেশি বলা চলে। বিশেষ করে, প্রায় স্বাধীন হিন্দু দেশীয় রাজ্যের মধ্যে সতীদাহের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। মুসলমান শাসকরা এইসব রাজ্যের মধ্যে কোনো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। হিন্দুরাজারা সতীদাহ শাস্ত্রসম্মত বলে মনে করেন, সুতরাং তাঁদের রাজ্যে অবাধে সতীদাহ চলতে থাকে। যতগুলি সতীদাহ আমি স্বচক্ষে দেখেছি তার বিস্তৃত বিবরণ আমি এখানে দেব না। কেবল দু—তিনটে ঘটনার কথা উল্লেখ করব। প্রত্যেকটি সহমরণের সময় আমি নিজে নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত থেকে দেখেছি। প্রথম এমন একটি সতীদাহের বিবরণ দিয়ে আরম্ভ করব। যার সঙ্গে আমি নিজে জড়িত ছিলাম। অর্থাৎ সহমরণ প্রার্থিনীকে বুঝিয়ে—সুঝিয়ে নিরস্ত করার জন্য আমাকে নিয়োগ করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমি কৃতকার্য হয়েছিলাম।

আগা দানেশমন্দ খাঁর একজন অন্যতম কেরানি ছিলেন, নাম বেণীদাস। বেণীদাস আমারও বিশেষ বন্ধু ছিলেন। প্রায় দু’বছর ধরে কঠিন অসুখে ভুগে তিনি মারা গেলেন। আমি তাঁর চিকিৎসা করেছিলাম। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী স্থির করলেন স্বামী সহমৃতা হবেন। আগার কাছে বেণীদাসের আরও অনেক বন্ধুবান্ধব চাকরি করতেন। আগা খাঁ তাঁদের বললেন যে, কোনোরকমে বেণীদাসের বিধবা পত্নীকে বুঝিয়ে সহমরণের সঙ্কল্প যাতে তিনি ত্যাগ করেন সেই চেষ্টা করতে। বেণীদাসের বন্ধুবান্ধবরা আগার কথায় উৎসাহিত হয়ে চেষ্টা করলেন যথেষ্ট বেণীদাস পত্নীকে বোঝাতে। তাঁরা বললেন যে, সহমরণের সঙ্কল্প যে তিনি গ্রহণ করেছেন সেটা খুবই সাধু সঙ্কল্প। পুণ্যাত্মা আদর্শ স্ত্রী ছাড়া এরকম সঙ্কল্প অন্য কেউ গ্রহণ করতে পারেন না। এতে তাঁর কুলগৌরব যে বাড়বে এবং তিনি নিজে দেবীর মতো পূজিত হবেন, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। তবু তাঁরা তাঁকে অনুরোধ করলেন কয়েকটা কথা ভেবে দেখতে। তিনি কয়েকটি সন্তানের জননী এবং তারা প্রায় সকলেই বয়সে শিশু, তাদের দেখবে কে? কে তাদের প্রতিপালন করবে? মায়ের চেয়ে বেশি কে তাদের স্নেহ করবে, পিতার অবর্তমানে? তাদের এরকম অনাথ ও অসহায় অবস্থায় ফেলে যাওয়া উচিত কি? তারা তো কোনো অপরাধ করেনি। কিছুই জানে না তারা, ধর্ম কি, পুণ্য কি? অন্তত তাদের মুখের দিকে চেয়ে তাঁর উচিত, সহমরণের সাধু সঙ্কল্প ত্যাগ করা। পতিপ্রেমের চেয়ে অসহায় সন্তানদের কল্যাণ চিন্তা তাঁর কাছে এখন বড়ো হওয়া উচিত।

এত অনুনয়—বিনয়, কাকুতি—মিনতি, যুক্তি—তর্ক সত্ত্বেও কিছু ফল হল না। বেণীদাসপত্নী সহমরণের সঙ্কল্পে অবিচলিত রইলেন। অবশেষে শেষ চেষ্টা করার জন্য খাঁ সাহেব আমার শরণাপন্ন হলেন এবং আমাকে ডেকে বললেন : ‘বার্নিয়ের সাহেব! আপনি তো বেণীদাস কেরানিবাবুর একজন পুরাতন বন্ধু। চিকিৎসার জন্য দীর্ঘদিন তাঁর পরিবারের সকলের সঙ্গে আপনি পরিচিত। আপনি একবার শেষ চেষ্টা করে দেখুন কেরানিবাবুর স্ত্রীকে বাঁচানো যায় কি না।’ আমি রাজি হলাম এবং কেরানিবাবুর গৃহাভিমুখে যাত্রা করলাম। বাড়ি গিয়ে যা দেখলাম তা বর্ণনা করা যায় না। মৃত বেণীদাসকে ঘিরে সাত আটজন বৃদ্ধ—বৃদ্ধা ও চার—পাঁচ জন্য ব্রাহ্মণ দাঁড়িয়ে আছেন। সকলে মধ্যে মধ্যে প্রাণপণ চিৎকার করে উঠছেন, একটা বীভৎস আর্তনাদের মতো, এবং সজোরে হাত চাপড়াচ্ছেন। মনে হল যেন নরকে ভূত—প্রেতের রাজ্যে ঢুকেছি। মৃত স্বামীর পায়ের কাছে বিধবা পত্নী বসে আছেন, চুল আলুথালু, মুখ শুকনো। চোখের জল শুকিয়ে গেছে, আগুনের মতো দপ দপ করে জ্বলছে যেন। ব্রাহ্মণরা যখন আর্তনাদ করে উঠছেন বিকটভাবে, তখন তিনিও তাঁদের সঙ্গে চিৎকার করছেন এবং তাঁদের সঙ্গে তাল দিয়ে হাত চাপড়াচ্ছেন। হল্লা, চিৎকার ও চাপড়ানি যখন খানিকটা শান্ত হল, তখন আমি হতভম্বের মতো তাঁদের দিকে এগিয়ে গিয়ে কেরানিবাবুর স্ত্রীকে ডেকে বললাম : ‘আগা খাঁ নিজে আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন এবং বলেছেন আপনাকে জানাতে যে তিনি আপনার দুই পুত্রের জন্য দুই ক্রাউন করে মাসিক ভাতা দেবার বন্দোবস্ত করবেন, যদি আপনি সহমরণের সঙ্কল্প ত্যাগ করেন। আপনি জানেন, আপনার ছেলেদের মানুষ করার জন্য, তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য, আপনার বেঁচে থাকা কত প্রয়োজন। আমরা ইচ্ছা করলে জোর করে যে আপনার সহমরণ বন্ধ করতে পারি না তা নয়, স্বচ্ছন্দেই পারি। শুধু তাই নয়, যেসব পাষণ্ড মতলববাজ আপনাকে এইভাবে সহমরণের জন্য প্ররোচিত করছে, তাদেরও কিভাবে শাস্তি দিতে হয়, তাও আমরা জানি। তা আমরা করতে চাই না। আপনার সুবুদ্ধির কাছেই আমরা আবেদন করতে চাই। আপনার আত্মীয়স্বজন সকলেই চান যে অন্তত সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে আপনি বেঁচে থাকুন। আপনি সন্তানের জননী, সুতরাং নিঃসন্তান তরুণী বিধবাদের বেঁচে থেকে যেরকম লাঞ্ছনা—গঞ্জনা, অপবাদ সহ্য করতে হয়, আপনাকে তা করতে হবে না।’ এই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমি বহুবার বললাম, কিন্তু ভদ্রমহিলার মুখ থেকে কোনো উত্তর শুনলাম না। মুখ বুজে তিনি সব শুনলেন। অবশেষে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন : ‘আমাকে যদি সহমরণে বাধা দেওয়া হয়, তাহলে আমি দেওয়ালে মাথা ঠুকে মরব।’ আমি আর সহ্য করতে না পেরে বললাম : ‘মনে হয়, আপনার স্কন্ধে কোনো প্রেতাত্মা বা অপদেবতা ভর করেছে, তা না হলে এরকম কথা মা হয়ে আপনি কি করে বলতে পারেন, কল্পনা করা যায় না। বেশ, তাই হোক তাহলে। কিন্তু তার আগে আপনার ছেলেদের কাছে ডাকুন এবং নিজের হাতে তাদের গলা কেটে আপনার স্বামীর চিতায় সমর্পণ করে দিন। এ কাজ আপনাকে করতেই হবে। যদি না করেন, তা হলে তারা অনাহারে তিলে তিলে মরবে এবং এখনই আমি খাঁ সাহেবের কাছে গিয়ে তাদের ভাতা নামঞ্জুর করার ব্যবস্থা করব।’ অত্যন্ত সংযত ও সুদৃঢ় কণ্ঠে কথাগুলো আমি বলে ফেললাম। বেণীপত্নীর মুখের দিকে চেয়ে মনে হল, কিছুটা কাজ হয়েছে কথায়। একটি কথাও আর তাঁর মুখ দিয়ে বেরুল না। দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে রইলেন। দেখলাম, ঘরে বৃদ্ধারা ও ব্রাহ্মণরা একে—একে চম্পট দিলেন ঘর থেকে। মুখের উপর তাঁদের ক্রোধ ও বিরক্তির ভাব খুব স্পষ্ট। যাই হোক, আমি তারপর তাঁকে তাঁর আত্মীয়স্বজন ও বান্ধুবান্ধবদের কাছে রেখে, অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে, ঘোড়ায় চড়ে ঘরমুখো রওয়ানা হলাম। সন্ধ্যার সময় যখন খাঁ সাহেবের কাছে আমর প্রচেষ্টার ফলাফল জানাবার জন্য যাচ্ছি তখন পথে বেণীদাসের একজন আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা হতে তিনি বললেন যে বেণীপত্নী সহমরণের সঙ্কল্প ত্যাগ করেছেন। নিশ্চিন্ত হলাম শুনে।

মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপ দিয়ে পুড়ে মরতে এত স্ত্রীলোককে দেখেছি যে সহমরণ সম্বন্ধে আমার মনে রীতিমতো আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। সতীদাহের বীভৎস দৃশ্য স্বচক্ষে দেখার মতো শক্তিও আর নেই আমার, এমন কি তার বিবরণ দেবারও ইচ্ছা নেই। তবু চেষ্টা করব যতদূর সম্ভব সঠিক বিবরণ দিতে। যা স্বচক্ষে দেখেছি তাই বলব। এই ধরনের ভয়াবহ মর্মান্তিক দৃশ্যের নিখুঁত বিবরণ দেওয়া যে কত কষ্টকর, তা বুঝিয়ে বলতে পারব না। লিখিত বিবরণ পাঠ করে, সহমরণ বা সতীদাহ সম্বন্ধে মনে মনে কোনো ধারণা করা সম্ভব নয়। স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

আমেদাবাদ থেকে আগ্রা যাবার সময় অনেক দেশীয় নৃপতির রাজ্য অতিক্রম করে যেতে হয়। পথে একটি বাগানের মধ্যে আমাদের ক্যারাভান যখন বিশ্রামের জন্য থামল, তখন আমরা খবর পেলাম, কাছেই একটি সতীদাহের আয়োজন সম্পূর্ণ হয়েছে এবং মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপ দেবার জন্য স্ত্রী প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে। শুনেই তৎক্ষণাৎ আমি সেখানে দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখলাম, শুকনো একটি ডোবার তলায় বেশ বড়ো করে গর্ত কেটে চিতা তৈরি করা হয়েছে। চিতার উপর কাঠ সাজানো। তার উপর মৃত ব্যক্তিকে সটান শুইয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর জীবন্ত স্ত্রীও বসে রয়েছেন সেই চিতার উপর। চার—পাঁচজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত চিতার চারিদিকে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন। পরিপাটি করে, পোশাক—পরিচ্ছদ পরে জন—পাঁচেক মধ্যবয়স্কা মহিলা পরস্পর হাত ধরাধরি করে সেই চিতার চারিদিকে ঘুরে—ফিরে নাচছেন গাইছেন। দর্শকদের ভিড় হয়েছে এবং তাদের মধ্যে পুরুষ ও মহিলা দর্শক দুইই বেশ যথেষ্ট সংখ্যায় আছেন।

প্রচুর পরিমাণে তেল—ঘি ঢালা হয়েছিল চিতার উপর। সুতরাং অগ্নিসংযোগ করতে না করতেই দাউ—দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। স্ত্রীলোকটির পরনের কাপড়ে আগুন ধরে গেল। সুগন্ধ তেল ও চন্দন পূর্বেই তাঁর গায়ে লেপে দেওয়া হয়েছিল। সারা গায়ে আগুন ধরে গেল। আশ্চর্য ব্যাপার! এতটুকু বিচলিত হতে দেখলাম না তাঁকে। কোনো বেদনা যন্ত্রণা, এমন কি সামান্য অস্বস্তির ভাব পর্যন্ত তিনি প্রকাশ করলেন না। স্থির হয়ে অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে মুখে বেশ স্পষ্টভাবে ‘পাঁচ’, ‘দুই’ ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণ করতে লাগলেন। ‘পাঁচে’র অর্থ হল, পূর্বজন্মে এরকম পাঁচবার তিনি তাঁর এই স্বামীর সঙ্গে সহমরণ করেছেন। আর দুই জন্মে দু’বার হলেই সাতবার সম্পূর্ণ হয় এবং তাহলেই এই মানবজন্ম থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি স্বর্গলোকবাসিনী হতে পারেন। সে এক বিচিত্র দৃশ্য! দেখলে মনে হয়, কোনো অদৃশ্য শক্তি সেই স্ত্রীলোকটির মনপ্রাণ যেন একেবারে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।

কিন্তু এ তো সবে শুরু। করুণ কাহিনির আরও অনেক বাকি আছে আমি ভেবেছিলাম, যে পাঁচজন মহিলা চিতার চারিদিকে ঘুরে—ফিরে নাচছে—গাইছে, তারা কোনো শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান বা আচার পালন করছে মাত্র। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। চিতার লকলকে আগুন তাদের মধ্যে একজনের কাপড়ে লেগে গেল। আগুন জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, সেই মহিলাটিও চিতার অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। দ্বিতীয়জনও দেখতে দেখতে তার অনুগমন করল। বাকি তিনজন তখনও সেইরকম হাত ধরাধরি করে নাচছে—গাইছে, কোনো চাঞ্চল্য লক্ষ্য করলাম না তাদের মধ্যে। কিছুক্ষণ পরে তারাও একে—একে চিতার আগুনের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল।

অতঃপর বুঝলাম, এই একাধিক সহমরণের কারণ কি? ওই পাঁচজন মহিলা ক্রীতদাসি। গৃহস্বামী যখন অসুস্থ হয়েছিলেন তখন গৃহকর্ত্রী তাঁর সেবা—শুশ্রূষা করতেন এবং বলতেন যে তাঁর মৃত্যু হলে তিনিও স্বামীসহমৃতা হবেন। দাসিরা তাই শুনে স্থির করেছিল যে গৃহস্বামীর মৃত্যুতে যদি গৃহকর্ত্রীও সহমৃতা হন, তাহলে তারাও তাদের জীবন উৎসর্গ করবে।

হিন্দুস্থানের অনেক লোকের সঙ্গে এ বিষয়ে আমি আলাপ—আলোচনা করেছি। তাঁরা সকলেই আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন যে ভালোবাসার আধিক্যই সহমরণের অন্যতম কারণ। হিন্দুস্থানের মেয়েরা কোমল—প্রকৃতি ও স্নেহপ্রবণ। সেইজন্য স্বামীর মৃত্যু তাঁরা সহ্য করতে পারেন না এবং নিজেরাও স্বামীর সহমৃতা হন। একথা আমি বিশ্বাস করি না। অনুসন্ধান করে আমি যেটুকু জানতে পেরেছি তাতে আমার অন্যরকম ধারণা হয়েছে। বাল্যকাল থেকে হিন্দুস্থানের মেয়েদের মনে নানারকম কুসংস্কারের বীজ বপন করা হয়। প্রত্যেক মেয়েকে মা শিক্ষা দেন যে স্বামীই হলেন একমাত্র দেবতা এবং মৃত স্বামীর ভস্মাবশেষের সঙ্গে নিজের দেহ মিশিয়ে দেওয়ার চেয়ে জীবনের মহত্তর কর্তব্য আর কিছু হতে পারে না। এইটাই হল সনাতন প্রথা। কোনো নারী এ—প্রথার বিরোধিতা করতে পারে না, করা উচিত নয়, মহাপাপ। আমার ধারণা, পুরুষরাই হল এই সব প্রথা ও সংস্কারের স্রষ্টা। মেয়েদের দাসির মতো পদানত করে রাখার জন্য, তাদের সেবা—শুশ্রুষা আদায় করার জন্য, যাতে তারা কোনোদিন কোনো কারণে স্বামীর বিরুদ্ধাচরণ করতে না পারে সেইজন্য পুরুষরাই মাথা ঘামিয়ে এইসব প্রথা আবিষ্কার করেছে।

যাই হোক, এরকম আরও দু—একটা মর্মান্তিক ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। একটি বিখ্যাত ঘটনার কথা বলছি যা আমি স্বচক্ষে দেখিনি অবশ্য, কিন্তু যার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি এবং যা উল্লেখ না করলে সহমরণ—প্রসঙ্গ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আমি নিজে স্বচক্ষে যা দেখেছি তাও যদি অন্যদের কাছে বলি তাহলে কেউ তা বিশ্বাস করতে চাইবেন না। এরকম ঘটনা এতই অবিশ্বাস্য যে নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তা আমি মর্মে মর্মে বুঝতে পারি। তাই শোনা ঘটনা হলেও আমি সেটা অবিশ্বাস্য মনে করি না এবং উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি। হিন্দুস্থানে সকলের মুখে মুখে কাহিনিটি চালু হয়েছিল একসময়। প্রত্যেকে কাহিনিটি সত্য বলে বিশ্বাস করেন। হয়ত হিন্দুস্থানের বাইরে ইউরোপেও এই কাহিনির প্রচার হয়েছে এতদিনে।

কাহিনিটি এই। কোনো একজন হিন্দু স্ত্রীলোক তার প্রতিবেশী একজন তরুণ মুসলমান দর্জির প্রেমে পড়েছিল। মুসলমান ছেলেটি খুব ভাল সেতার বাজাতে পারত। মেয়েটি নিরুপায় হয়ে তার স্বামীকে বিষ খাইয়ে হত্যা করল। তার বিশ্বাস ছিল যে মুসলমান ছেলেটি তাকে বিবাহ করতে রাজি হবে। সে তার প্রেমিকের কাছে গিয়ে পতিহত্যার কাহিনি বলল এবং তাকে বিবাহ করার জন্য অনুরোধ করল। মেয়েটি বলল : এখনই এই স্থান ছেড়ে তাদের চলে যাওয়া দরকার। যেতে দেরি হলে তার মৃত্যু ভিন্ন কোনো উপায় থাকবে না। স্বামীর শবদাহের সঙ্গে তাকেও সহমরণ করতে হবে। মুসলমান ছেলেটি আসন্ন বিপদের আশঙ্কা দেখে মেয়েটিকে বিবাহ করতে রাজি হল না। মেয়েটি তখন সোজা তার আত্মীয়স্বজনের কাছে চলে গিয়ে বলল যে তার স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে সে অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছে এবং স্বামীর সহমৃতা হবার সঙ্কল্প করেছে। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সকলেই তার সঙ্কল্পে খুশি হয়ে বলল যে তার মতো মহীয়সী নারী আর হয় না, পরিবারের গৌরব সে। অবশষে শবদাহের জন্য চিতা তৈরি হল এবং তাতে অগ্নিসংযোগ করা হল। মেয়েটি চিতার চারিদিকে ঘুরে ঘুরে আত্মীয়স্বজনকে আলিঙ্গন ও চুম্বন করে তাদের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিতে লাগল। বাদ্যকাররাও উপস্থিত ছিল চিতার পাশে এবং তাদের মধ্যে সেই মুসলমান ছেলেটিও ছিল। মেয়েটি একে একে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ধীরে ধীরে সেই মুসলমান ছেলেটির কাছে এগিয়ে গিয়ে, হঠাৎ তার গলা ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে চিতার ধারে নিয়ে এসে, জোরে ধাক্কা দিয়ে আগুনের মধ্যে ফেলে দিল এবং নিজেও সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপ দিল।

সুরাট থেকে পারস্য যাত্রার সময় আমি আর একজন বিধবা মহিলার পতিভক্তি ও সহমরণ স্বচক্ষে দেখেছি। এইসময় শুধু আমি একা নই, একাধিক ইংরেজ ও ডাচ ভদ্রলোক এবং প্যারিসের মঁশিয়ে শাঁর্দা (Chardin) উপস্থিত ছিলেন। এই সতীদাহের বিবরণ নিখুঁতভাবে ভাষায় বর্ণনা করার মতো আমার ক্ষমতা নেই। মহিলার মুখে যে পৈশাচিক সাহস ও স্বচ্ছন্দতা আমি লক্ষ্য করেছি সহ—মরণের সময়, তা ভাষায় প্রকাশ করা কি সম্ভবপর? কি নির্ভীক নির্বিকার ভঙ্গি তাঁর! স্থিরভাবে তিনি সকলের সঙ্গে কথা বলছেন আলাপ করছেন, কোনো দুর্ভাবনার ছাপ নেই কোথাও। কি অবিচলিত আত্মবিশ্বাস তাঁর। কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই কোনো কিছুতে। সঙ্কোচ নেই, জড়তা নেই, অস্বস্তি নেই। বসে বসে নিবিষ্ট মনে চিতার কাঠখড় ইত্যাদি নেড়েচেড়ে দেখছেন। দেখবার পর শান্তভাবে চিতার উপর উঠে তিনি মৃত স্বামীর মাথাটি কোলের উপর তুলে নিয়ে বসলেন গম্ভীরভাবে। তারপর একটি জ্বলন্ত মশাল নিয়ে নিজের হাতে চিতায় অগ্নিসংযোগ করলেন, বাইরে থেকে ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা আগুন জ্বেলে দিলেন। বর্ণনা করা যায় না সে দৃশ্য! ভাষার জোর নেই আমার। ছবি এঁকেও সেই ভয়াবহ দৃশ্য চোখের সামনে জীবন্ত করে ফুটিয়ে তোলা যায় না। আগাগোড়া সতীদাহের এই দৃশ্যটি এমনভাবে আমার মনে ছাপ রেখে গেছে যে আজও আমার মনে হয় যেন মাত্র কয়েকদিন আগে আমি ঘটনাটি ঘটতে দেখেছি চোখের সামনে। সমস্ত দৃশ্যটি একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়।

অবশ্য আমি সতীদাহের এমন অনেক ঘটনাও দেখেছি, যেখানে মৃত স্বামীর চিতার সামনে দাঁড়িয়ে বিধবা স্ত্রী ভয়ে শিউরে উঠেছেন এবং আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। তখন আমার মনে হয়েছে যে সতীদাহ থেকে আত্মরক্ষা করার যদি কোনো শাস্ত্রীয় বিধান থাকত, তাহলে এই হতভাগ্য মহিলাদের মধ্যে অনেকে হয়ত সহমরণ না করে বেঁচে থাকতেন। কিন্তু পুরোহিতরা সেরকম কোনো বিধানের কথা কোনোদিন বলেননি এবং সহমরণে অনিচ্ছুক ভীত ও সন্ত্রস্ত বিধবাদের তাঁরা বাধ্য করেছেন মৃত্যু বরণ করতে। অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি, ভীত আতঙ্কিত মহিলাদের জোর করে ঠেলে চিতার মধ্যে ফেলে দিতে। চিতার কাছ থেকে পাঁচ—ছয় পা পিছিয়ে এসেছে ভয়ে, এরকম মহিলাদের জোর করে চিতার মধ্যে মেরে ফেলে দিতে দেখেছি। চিতার ভিতর থেকে প্রাণপণে ছুটে পালিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করছে এবং বাইরে থেকে বাঁশের গোঁজা দিয়ে জোর করে তাকে চিতার মধ্যে চেপে ধরে রাখা হয়েছে, এরকম নিষ্ঠুর দৃশ্যও একাধিক দেখেছি।

কোনো—কোনো সময় বিধবাদের পালাতেও দেখেছি। শবদাহের সময় চিতার কাছে ডোম—মুর্দাফরাসদের ভিড় হয়। সতী বয়সে যদি তরুণী হয়, দেখতে সুন্দর হয়, তাহলে অনেক সময় মুর্দাফরাসরা মতলব করে তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করে। পলাতকা সতীকে তারা লুকিয়ে রাখে। যাদের আত্মীয়স্বজন তেমন নেই, সঙ্গতিহীন ও দরিদ্র, তাদেরই সাধারণত এইভাবে বাঁচানো সম্ভব হয়। কিন্তু এইভাবে যারা পালিয়ে কোনোরকমে আত্মরক্ষা করতে পারে, এবং নিম্নশ্রেণির কাছে আশ্রয় পায়, তাদের জীবন শেষ পর্যন্ত দুর্বিষহ হয়ে ওঠে এবং অভিশপ্ত হতভাগিনীর মতো তারা দিন কাটায়। কেউ তাদের শ্রদ্ধা করে না, স্নেহ করে না, ভালোবাসে না, সমাজের মধ্যে ভদ্রভাবে তারা আর জীবন কাটাতে পারে না। পতিতা ও কলঙ্কিনীর অপবাদ চিরজীবন তাকে সহ্য করতে হয় মুখ বুজে। সুতরাং তার আশ্রয়দাতা যারা তারাও তার অসহায় অবস্থার জন্য তার প্রতি দুর্ব্যবহার করে। পলাতকা কোনো সতীকে সসম্মানে আশ্রয় দিতে কোনো মোগল বা মুসলমানও চায় না, ভয় পায়। সতীর ধর্মদ্রোহিতা তাদের ভয়ের কারণ। তবে অনেক হিন্দু বিধবাকে পর্তুগিজরা সতীদাহের কবল থেকে উদ্ধার করেছে। প্রধানত বন্দরের কাছাকাছি জায়গাতেই তারা উদ্ধার করেছে বেশি, কারণ পর্তুগিজদের বাস ছিল বেশি বন্দরের কাছেই। আমার নিজের যা মনে হয়েছে সতীদাহের দৃশ্য দেখতে দেখতে তা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না। মনে হয়েছে যে পুরোহিত—শ্রেণি সমাজে এই শাস্ত্রীয় বিধানের প্রবর্তন করেছেন তাঁদের সকলের আগে সমূলে উচ্ছেদ করা উচিত।

লাহোরে একবার একটি সুন্দরী বালিকার সহমরণের দৃশ্য দেখেছিলাম, ভুলতে পারব না কোনোদিন। বছর বারোর বেশি বয়স নয় মেয়েটির। চিতার সামনে মেয়েটিকে যখন নিয়ে আসা হল তখন দেখলাম ভয়ে সে আধমরা হয়ে গেছে। সেই মর্মান্তিক দৃশ্য চোখে না দেখলে বর্ণনা করে বোঝানো যায় না। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাউ—মাউ করে কাঁদতে লাগল মেয়েটি। কিন্তু সমবেত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবাদি দর্শকদের মধ্যে কোনো চাঞ্চল্য দেখা গেল না। একজন বৃদ্ধা মহিলা মেয়েটির হাত ধরল এবং চার—পাঁচজন পুরোহিত মিলে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তার মৃত স্বামীর চিতার উপর বসিয়ে দিলে। তার হাত পা সব বেঁধে দেওয়া হল, পাছে সে উঠে দৌড়ে পালায়। তারপর চিতায় অগ্নিসংযোগ করা হল এবং জীবন্ত দ্বাদশী বালিকাটিকে পুড়িয়ে হত্যা করা হল। এরকম কোনো ঘটনার সামনে আমার পক্ষে আত্মসংবরণ করা যে কঠিন হতে পারে তা বুঝতেই পারছেন। মনে হল, চিৎকার করে প্রতিবাদ করি। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিলাম। কারণ প্রতিবাদ করে লাভ নেই। আগামেমনন (Agamemnon) নিজের কন্যা ফিজিনিয়াকে (Iphigenia) যখন ডায়ানার কাছে উৎসর্গ করেছিলেন, তখন কবি লুক্রেসিয়াস এই ধর্মের নামে অধর্মাচরণ সম্বন্ধে দুঃখ করে যা বলেছিলেন, সেই কথা আমার মনে পড়ল।

এখনও তো এই বর্বর কুসংস্কার সম্বন্ধে, এই নিষ্ঠুরতা সম্বন্ধে সব কথা বলা হয়নি। হিন্দুস্থানের সর্বত্র যে এই সতীদাহ প্রচলিত প্রথা, তা নয়। কোনো কোনো অঞ্চলে বিধবা স্ত্রীকে স্বামীর চিতায় দাহ না করে তাকে টুটি টিপে হত্যা করা হয়। দু—তিনজন মিলে হঠাৎ হতভাগিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার টুটি চেপে ধরে এবং তাকে হত্যা করে। তারপর তার মৃতদেহ মাটি—চাপা দিয়ে পদদলিত করা হয়।

অধিকাংশ হিন্দুরা অবশ্য শবদাহ করে। কেউ কেউ দেখেছি, নদীর ধারে মৃতদেহ নিয়ে গিয়ে কোনো উঁচু জায়গা থেকে জলের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। গঙ্গানদীর ধারে এরকম মৃতের সৎকার আমি একাধিক দেখেছি। কাক চিল শকুন, কুমীর হাঙরের খাদ্য হয় মৃতদেহ।

কেউ কেউ রুগ্ন ব্যক্তিকে মৃত্যুর পূর্বে নদীর ধারে বহন করে নিয়ে যায় এবং পা থেকে গলা পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে রাখে। ঠিক মৃত্যুর মুহূর্তে তাকে জলে চুবিয়ে দেওয়া হয় এবং সেইভাবে জলের মধ্যে রেখে, খুব জোরে জোরে হাততালি দিয়ে, চিৎকার করে উঠে, সকলে ফিরে চলে যায়। এইভাবে সৎকার করার উদ্দেশ্য কি, একথা আমি জিজ্ঞাসা করেছি। তার উত্তরে শবযাত্রীরা বলেছেন : মৃত্যুর সময় আত্মা যখন দেহ ছেড়ে চলে যায় ঠিক সেই মুহূর্তে যদি গঙ্গাজলে তাকে স্নান করানো হয় তাহলে কলুষিত আত্মার সমস্ত পাপ ধুয়ে মুছে যায় এবং নিষ্কলঙ্ক আত্মার স্বর্গযাত্রা ত্বরান্বিত হয়। জানি না হয় কি না হয়। তবে এ বিশ্বাস শুধু যে অশিক্ষিত সাধারণ লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা নয়। রীতিমতো শিক্ষিত ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরও আমি এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তর্ক করতে দেখেছি।

সাধুসন্ন্যাসী ফকিরদের কথা

হিন্দুস্থানে সাধু—সন্ন্যাসী, ফকির দরবেশ ইত্যাদির সংখ্যা ও বৈচিত্র্য এত বেশি যে তা বর্ণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়। অনেক সাধু—সন্ন্যাসী আশ্রমে বাস করেন এবং সেখানে গুরুর আদেশ পালন করে চলেন। আশ্রমে তাঁদের সহজ সরল জীবনযাত্রা, ব্রহ্মচর্য, গুরুভক্তি ইত্যাদি আদর্শ মেনে চলতে হয়। এতরকমের বিচিত্র জীবন এইসব ফকির ও সাধু—সন্ন্যাসী যাপন করেন যে, তার সঠিক বর্ণনা দেওয়া সত্যিই কঠিন। একশ্রেণির সাধু আছেন, তাঁদের ‘যোগী’ বলে। ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের পন্থা যাঁরা জানেন, অথবা যোগসূত্র যাঁদের আছে, তাঁরাই হলেন যোগী। কত যোগী যে হিন্দুস্থানে আছেন তা বলা যায় না। নগ্নদেহে ভস্ম মেখে তাঁরা ধ্যানস্থ হয়ে বসে থাকেন। কখনও কোনো গাছতলায়, কোনো নদনদীর ধারে, আবার কখনও বা কোনো দেবালয়ের আশেপাশে তাঁদের যোগাসনে বসে থাকতে দেখা যায়। মাথায় আজানুলম্বিত কেশ, জট—পাকানো, মুখে দাড়ি। কেউ একটি কেউ বা দুটি হাত ঊর্ধ্বে তুলে বসে থাকেন! লম্বা লম্বা হাতের নখ—মেপে দেখেছি, প্রায় অর্ধেক আঙুলের সমান লম্বা। হাতগুলি শীর্ণ ও ক্ষুদ্র, অনাহারক্লিষ্ট রোগীর মতো। সাধুরা প্রায় অনাহারেই থাকেন বলে তাঁদের দেহ শীর্ণ দেখায়। পেশিগুলি যেন শক্ত হয়ে গেছে মনে হয়, শিরাগুলি যেন পাকিয়ে গেছে। সাধারণ লোক এই শীর্ণকায় সাধুদের দেবতার মতো ভক্তি করে এবং তাঁদের অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মহাপুরুষ বলে মনে করে। দলে দলে তারা সাধুদের কাছে এসে ভিড় করে। যোগাসনে উপবিষ্ট দীর্ঘ জটাজূট শ্মশ্রূ সম্বলিত, লম্বা নখবিশিষ্ট নগ্নদেহ এই যোগীদের দেখলে বাস্তবিক ভয় করে।

দেশীয় রাজ্যের মধ্যে দেখেছি, নগ্ন সন্ন্যাসীরা দলবদ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন (নাগা সন্ন্যাসীদের কথা বলছেন বার্নিয়ের)। ভয়াবহ দৃশ্য! কারও হাত ঊর্ধ্বে প্রসারিত; মাথার জট বৃত্তাকারে চূড়া করে বাঁধা; হাতে লাঠি, লোহার ডাণ্ডা ও ত্রিশূল; কারও পরনে, কারও কাঁধে বাঘের ছাল। ঠিক এইভাবে আমি তাদের দল বেঁধে সারা শহরময় ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। কোনো ভয় নেই, সঙ্কোচ নেই। স্ত্রী পুরুষ দর্শক সকলে মিলে তাদের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে দেখে, ভয়ে বিহ্বল হয়ে, ভক্তিতে গদগদ হয়ে। মহিলারা তাদের দানধ্যান করেন মহাপুরুষ মনে করে। মহাপুরুষ, সাধু—সন্ন্যাসীদের দানধ্যান করলে পুণ্য হয়, স্বর্গবাস হয়—এ—বিশ্বাস সাধারণের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে আছে।

দিল্লি শহরের মধ্যে এরকম একজন উদ্ধত উলঙ্গ সাধুর আচরণে আমি রীতিমতো বিরক্তি বোধ করতাম। সারা শহরের মধ্যে, পথেঘাটে সাধুটি উলঙ্গ হয়ে নির্বিকার চিত্তে ঘুরে বেড়াত, কচি খোকার মতো। কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, ভয় ডর নেই। সম্রাট ঔরঙ্গজীবের অনুরোধ ও হুমকি দুইই সে উপেক্ষা করে চলত, গ্রাহ্য করত না। বহুবার তাকে কাপড় পরে ভদ্রবেশে থাকার জন্য অনুরোধও সম্রাট করেছেন, শেষে শাস্তি দেবেন বলে ভয়ও দেখিয়েছেন। কিন্তু কিছুই সে গ্রাহ্য করেনি। অবশেষে সম্রাটের আদেশে দিল্লি শহর থেকে স্থানান্তরিত করে, এই ঔদ্ধত্যের জন্য সাধুটির শিরশ্ছেদন করা হয়।

মধ্যে মধ্যে এই ফকির ও সাধু—সন্ন্যাসীরা দল বেঁধে দূরদেশে তীর্থযাত্রা করে। কেবল নগ্নদেহে নয়, বড়ো বড়ো লোহার শিকলাদি নিয়ে। হাতির পা—বাঁধা শিকলের মতো মোটা মোটা লোহার শিকল। অনেক সাধুকে দেখেছি, সাত—আটদিন ধরে সমানে রাতদিন সোজা হয়ে একস্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে, আহার—নিদ্রা ত্যাগ করে। সাত—আটদিন ধরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য পা ফুলে যায়। কাউকে কাউকে দেখেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাতের উপর ভর দিয়ে, মাথা নিচু করে, পা দু’খানা উপরে তুলে অবস্থান করতে। এরকম আরও নানারকমের দৈহিক কসরতের দৃশ্য দেখেছি, যা এত কষ্টকর যে সাধারণ লোকের পক্ষে অনুকরণ করা সম্ভব নয়। এসব করা হয় একটা অলৌকিক শক্তির নিদর্শনরূপে।

প্রথমে যখন হিন্দুস্থানে আমি যাই, তখন এইসব কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের নিদর্শন দেখে আমার মনে রীতিমতো অবজ্ঞার ভাব এসেছিল—একথা নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করতে আমার আপত্তি নেই। তাছাড়া আর কি ভাবা যেতে পারে এসব সম্বন্ধে, আমি জানতাম না। মধ্যে মধ্যে আমার মনে হত এই সাধুরা একদল নৈরাশ্যবাদী ছাড়া আর কিছু নয়। কোনো শিক্ষাদীক্ষা নেই, যুক্তি বা বুদ্ধিসম্মত বিচারের ক্ষমতা নেই তাদের। মধ্যে মধ্যে মনে হত, হয়তো তারা সত্যিই সাধু—প্রকৃতির লোক, সরল বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে এরকম আচরণ অভ্যাস করছে। কিন্তু সাধুতার বিশেষ কোনো চিহ্ন তাদের মধ্যে খুঁজে পাইনি কোনোদিন। অনেক সময় মনে হয়েছে হয়তো এরকম একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন, অলস, অকর্মণ্য, ভ্রাম্যমান জীবনের প্রতি তাদের একটা বিশেষ আকর্ষণ আছে বলেই তারা সাধু হয়েছে। আবার একথাও মনে হয়েছে যে সাধু হিসেবে তাদের একটা অহমিকাবোধ আছে এবং সেই বোধ থেকেই তারা এইসব আচরণ করে থাকে। সাধুদের সম্পর্কে এই রকম অনেক কথা আমার মনে হয়েছে।

সাধুরা যে এত কষ্ট সহ্য করেন এবং আত্মনিপীড়ন করেন তার কারণ তাঁরা মনে করেন, পরবর্তী জীবনে তাঁরা রাজা হবেন। অর্থাৎ এমন এক জীবন লাভ করবেন তাঁরা যার সুখ—স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তি রাজকীয় জীবনের চেয়ে অনেক বেশি। পরবর্তী জীবনে ইহজীবনের রাজাদের চেয়েও তাঁরা বেশি সুখী হবেন—প্রধানত এই ধরনের বিশ্বাস থেকেই তাঁরা আত্মনিগ্রহ অভ্যাস করেন। অনেক সময় আমি তাঁদের বলেছি, পরজীবনে কি হবে না—হবে তার জন্য ইহজীবনের সমস্ত সুখ—স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে এত দুঃখ—কষ্ট ভোগ করা, কি কারণে তাঁরা যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা করেন? আমি বুঝতে চেয়েছি, বোঝাতে চেয়েছি, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি, কারণ আমাকে বোঝানো খুব সহজ নয়। আমি বলেছি, অতি সহজ যুক্তিতে আমি ওই সব পরলোকের স্বর্গসুখ বা রাজকীয় সুখের কথা বুঝতে রাজি নই। নির্বুদ্ধি না হলে কেউ পরলোকের সুখের ভরসায় ইহলোকে স্বেচ্ছায় এরকম দুঃখকষ্ট ভোগ করে না।

সাধু সন্ন্যাসীদের মধ্যে কেউ কেউ উচ্চস্তরের সাধু বলে জনসমাজে পরিচিত। একেবারে সিদ্ধ যোগীপুরুষ তাঁরা, ভগবানের সঙ্গে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ। সকলের ধারণা, পার্থিব জীবন থেকে তাঁরা একেবারে বিচ্ছিন্ন, সংসারত্যাগী ও গৃহত্যাগী। দূরে কোনো অরণ্যমধ্যে নির্জন নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন তাঁরা, সাধারণত জনপদের দিকে যান না। কেউ যদি খাবার—দাবার ভক্তিভরে তাঁদের এনে দেন, তাঁরা তা গ্রহণ করেন, আর যদি কেউ না আনেন, তাহলে তাঁরা অনাহারেই দিনের পর দিন কাটিয়ে দেন। ভগবান তাঁদের বাঁচিয়ে রাখেন। দীর্ঘকাল অনশন উপবাসে অভ্যস্ত বলে তাঁদের বিশেষ কোনো কষ্ট হয় না। প্রায়ই দেখা যায়, এই ধর্মাত্মা যোগীপুরুষরা ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকেন। তাঁরা বলেন যে এইভাবে তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অক্লেশে থাকতে পারেন, কারণ তাঁদের আত্মা এই সময়ে একটা অতীন্দ্রিয় আনন্দে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে থাকে; বাহ্যজ্ঞান তাঁদের লোপ পায়, ইন্দ্রিয়ের বোধশক্তি বলে তখন আর কিছু থাকে না। যোগীরা ভগবানের সাক্ষাৎ দর্শনলাভ করেন। আলোকের মতন জ্যোতির্ময় মূর্তিতে ঈশ্বর তাঁদের দৃষ্টিপথে আবির্ভূত হন। তখন তাঁরা এক অলৌকিক আনন্দের শিহরণ অনুভব করেন এবং ইহলোক, সংসার পৃথিবী সব তাঁদের কাছে তখন অতি তুচ্ছ ও নগণ্য মনে হয়। আমার একজন বিখ্যাত যোগীপুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল। তিনি বলতেন যে এরকম ধ্যানস্থ হয়ে যতক্ষণ ইচ্ছা তিনি থাকতে পারেন। সাধারণ মানুষ যারা যোগীপুরুষদের সান্নিধ্য কামনা করে তারা এই যোগসাধনা ও দেবতাদর্শন ইত্যাদি গভীরভাবে বিশ্বাস করে। আমার মনে হয়, এই ধরনের যোগসাধন ও যোগবলে ঈশ্বরদর্শনাদির অলৌকিক ব্যাপারের মধ্যে কিছুটা সত্য হয়ত নিহিত আছে। নিঃসঙ্গ নির্জন জীবনযাত্রা, দীর্ঘ উপবাস ও আত্মনিগ্রহের ফলে মানুষের কল্পনাশক্তি অনেক উগ্ররূপ ধারণ করে এবং তখন মানুষের পক্ষে নানারকমের অধ্যাসাদি বাস্তব সত্য বলে মনে হয়। অবশ ও ক্লান্ত দেহের মধ্যে ঘুমন্ত, মূর্ছিত মন বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখে। সাধুসন্ন্যাসীরা যেভাবে আত্মনিগ্রহ অভ্যাস করেন, তাতে এরকম কাণ্ডজ্ঞান অসম্ভব বলে মনে হয় না। ইন্দ্রিয়গুলিকে তাঁরা ক্রমে নিজেদের আয়ত্তে আনেন এবং তখন ইচ্ছা মতো ধ্যানস্থ হয়ে অলৌকিক স্বপ্ন দর্শন করলে তাঁদের কোনো কষ্ট হয় না। সাধুরা বলেন—কোনো নির্জন স্থানে গিয়ে একাকী ধ্যানস্থ হতে হবে, প্রথমে ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করতে হবে; পূর্ণ উপবাস করতে হবে; জল পর্যন্ত স্পর্শ করা চলবে না; ঊর্ধ্বনেত্রে যোগাসনে বসে, চোখ দুটি ধীরে ধীরে আনত করে নাসিকাগ্রে নিবদ্ধ করতে হবে; নাসিকাগ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কিছুকাল অবস্থান করার পর দেবতা জ্যোতির্ময় আলোকরূপে অবতীর্ণ হবেন যোগীর সামনে।

এই ভাবোন্মত্ততাই হল যোগীদের অলৌকিক রহস্যবাদের মূল কথা। যোগীদের মতো চালচলন সূফীদের মধ্যেও দেখা যায়। আমি এটা রহস্যবাদ বলছি, কারণ সমস্ত ব্যাপারই তাঁদের কাছে গুহ্য ব্যাপার। কিছুই তাঁরা বাইরে প্রকাশ করেন না, করতে চান না। তাঁদের যোগসাধনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এই গোপনতা। হয়ত বলবেন, তাহলে আমি এত সব কথা কোথা থেকে জানতে পারলাম? একজন পণ্ডিতের সাহায্যেই আমি এই সব কথা জানতে পেরেছি। আমার মনিব আগা দানেশমন্দ খাঁ একজন হিন্দু পণ্ডিতকে বেতন দিয়ে নিযুক্ত করেছিলেন, শাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য। পণ্ডিত মশাই আমাদের কাছে কিছুই গোপন করতেন না। সূফীদের সম্বন্ধে দানেশমন্দ খাঁর যথেষ্ট জ্ঞান ছিল।

আমার নিজের বিশ্বাস—দারিদ্র্য, অনশন ও আত্মনিপীড়ন—এই তিনের প্রভাবে মানুষের পক্ষে এই ধরনের আত্মজ্ঞানহীন অবস্থায় পৌঁছানো সম্ভব হয়। আমাদের দেশের (ইউরোপের) ধর্মযাজক ও সাধুপুরুষরা এইদিক দিয়ে যে এশিয়া বা হিন্দুস্থানের যোগীপুরুষদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ তা নয়। বরং এদিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য হল আর্মেনিয়ান, কেল্ট, গ্রিক, নেস্টোরিয়ান, জেকোবিন ও মেরোনাইটরা। তাদের সঙ্গে তুলনা করলে ইয়োরোপীয় সাধুদের শিক্ষানবীশ বলে মনে হয়। অবশ্য একথাও ঠিক যে, অনশন ও উপবাসের কষ্ট শীতপ্রধান ইয়োরোপে হিন্দুস্থানের তুলনায় অনেক বেশি।

এইবার অন্য আর এক শ্রেণির ফকিরের কথা বলব, যাঁরা ঠিক যোগীদের মতন নন, অথচ যাঁদের প্রতিপত্তি যোগীদের তুলনায় কোনো অংশেই কম নয়। প্রায় সর্বদাই তাঁরা ভ্রাম্যমাণ জীবন যাপন করেন, চারিদিকে ঘুরে ঘুরে বেড়ান, উদাসীন ভাব দেখান এবং অনেক কিছু গুহ্য ব্যাপার জানেন বলে প্রচার করেন। সাধারণ লোক মনে করে যে এই ফকিরবেশী সাধুরা জানেন না এমন কোনো জিনিস নেই এবং তাঁদের এমন ঐশ্বরিক শক্তি আছে যে, তাঁরা যে কোনো পদার্থকে সোনা তৈরি করতে পারেন। অভ্রজাতীয় এমন এক পদার্থ তাঁরা তৈরি করেন—যা সামান্য দু—একটা দানা প্রতিদিন সকালে গলাধঃকরণ করলে যে কোনো অসুস্থ লোক সুস্থ হয়ে যায়, দুর্বল শরীরে শক্তিসঞ্চার হয়, যা খাওয়া যায় তাই তৎক্ষণাৎ হজম হয়ে যায়। শুধু তাই নয়। যদি এই শ্রেণির দুজন সাধুপুরুষ দৈবক্রমে হঠাৎ কোথাও মিলিত হন, তাহলে উভয়ের মধ্যে অলৌকিক শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতে থাকে। তখন দুজনেই এমন সব জাদুবিদ্যার খেল দেখাতে থাকেন যে সাধারণ মানুষের বিস্ময়ের আর অবধি থাকে না। কে কি মনে মনে চিন্তা করেছে তা তাঁরা অনর্গল গড়গড় করে বলে দেন, পত্রপুষ্পহীন শুকনো গাছের ডালে বিড়বিড় করে ফুল ফুটিয়ে দেন, ফল ফলিয়ে দেন। এক ঘণ্টার মধ্যে, পনের মিনিটের মধ্যে বুকের ভিতর ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটান, এবং শুধু বাচ্চা নয়, যে কোনো পাখির বাচ্চা ফোটান, তাকে ঘরের মধ্যে উড়িয়ে দিয়ে তবে ছাড়েন। এরকম আরও অনেক তাজ্জব কাণ্ডকারখানা তাঁরা করেন, জানুবলে ও মন্ত্রবলে যার রহস্য কারও পক্ষেই ভেদ করা সম্ভব হয় না।

এই শ্রেণির ফকিরের সম্বন্ধে লোকমুখে যা শুনেছি তা সত্য কি মিথ্যা, যাচাই করে দেখার সময় হয়নি। আমার আগা (দানেশমন্দ খাঁ) একবার এরকম একজন সবজান্তা ফকিরকে ডেকে পাঠিয়েছেন এবং তাঁকে বলেছিলেন যে তিনি যদি তাঁর মনের কথা সব ঠিক—ঠিক বলে দিতে পারেন, তাহলে আগা তাঁকে তিনশো টাকা পুরস্কার দেবেন। আগা বলেছিলেন যে আগে থেকে তিনি একটি কাগজে তাঁর মনের কথা লিখে রেখে দেবেন, যাতে ফকিরের মনে সত্য—মিথ্যা সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ না উপস্থিত হয়। এই সময় আমিও ফকিরকে বলেছিলাম যে আমিও তাঁকে পাঁচশ টাকা পুরস্কার দেব যদি আমার মনের কথা তিনি বলে দিতে পারেন। আশ্চর্য! সাধুবাবা তারপর আর আমাদের বাড়িমুখো হলেন না। আর একবার আমার ইচ্ছা হল, এই সাধুবাবারা কি করে ডিমে তা’ দিয়ে বাচ্চা ফোটান দেখতে হবে। তাও স্বচক্ষে দেখা কোনোদিন সম্ভব হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে আমার এত আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও কোনোদিন সাধুবাবার তাজ্জব কাণ্ড দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়নি। দু—এক জায়গায় যখনই আমি উপস্থিত হয়েছি এবং দেখেছি যে জনতার মধ্যে রীতিমতো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে, তখন আমি নানারকম প্রশ্ন করে দেখেছি যে আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটাই হল চালাকি ও ধাপ্পাবাজি, কোনো অলৌকিক শক্তির কোনো চিহ্ন নেই কোথাও। একবার আমার আগা সাহেবের টাকা চুরি গিয়েছিল এবং সাধুবাবা বাটি চেলে চোর ধরার কৌশল দেখাচ্ছিলেন। আমি সেই চালাচালির চালাকিটা ফাঁস করে দিয়েছিলাম।

আর একশ্রেণির ফকির আছেন তাঁদের চালচলন অন্যরকম। তাঁরা বাইরে বিশেষ কোনো ভড়ং দেখান না, পোশাক—পরিচ্ছদের মধ্যেও তেমন কোনো জাঁকজমক নেই এবং ভক্তির আতিশয্যও তাঁদের কম। সাধারণত খালি পায়ে তাঁরা চলাফেরা করেন, মাথাতেও কোনো পাগড়ি—টাগড়ি পরেন না। একটা লম্বা আজানুলম্বিত আলখাল্লা পরে, তার উপর ওড়নার মতো একটা সাদা চাদর হাতের তলা দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে, তাঁরা ঘুরে ঘুরে বেড়ান। এমনিতে তাঁরা খুব পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন থাকেন, অন্যদের মতো অপরিচ্ছন্ন নন। দুজন দুজন করে চলাফেরা করেন, একা নন। চলাফেরার ভঙ্গিও খুব নম্রসম্র। একহাতে কমণ্ডলুর মতো একটি ভিক্ষার পাত্র থাকে। সাধারণত তাঁরা দোকানে দোকানে ঘুরে ভিক্ষা করেন না অন্যান্য সাধু—ফকিরদের মতো। ভদ্রলোকের বাড়িতে যান এবং যাওয়া মাত্রই আপ্যায়িত হন। ভদ্রলোকেরা ও গৃহস্থরা তাঁদের আগমনে কৃতার্থ বোধ করেন, প্রাণ খুলে অতিথিসৎকার করতেও কুণ্ঠিত হন না। হিন্দু গৃহস্থরা মনে করেন, এই সাধুদের আবির্ভাব সাক্ষাৎ দেবতার আবির্ভাবের মতো। যে পরিবারে যখন তাঁরা যান, সেই পরিবারের লোক তখন তাদের ভাগ্যবান বলে মনে করেন। বাইরে এঁদের আচার—ব্যবহার চরিত্র ইত্যাদি সম্বন্ধে নানারকম কানাঘুঁষো শোনা যায়। পরিবারের সঙ্গে, এমনকি স্ত্রীলোকদের সঙ্গেও তাঁরা এমন অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশা করেন যে সকলেই তাঁদের সন্দেহের চোখে না দেখে পারে না। মোগল রাজ্যের মধ্যে এই গুরুসেবা ও সাধুসেবার এই জাতীয় বিচিত্র প্রথা সর্বত্র প্রায় প্রচলিত আছে দেখা যায়। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে যখন দেখি এই সাধুরা নিজেদের কতকটা খ্রিস্টান পাদরি সমগোত্র বলে মনে করেন। এঁদের দেখলে আমার মনে নানারকম কৌতূহলের সঞ্চার হত এবং চারিত্রিক দুর্বলতা ও দম্ভ দুই—ই আমার কাছে বেশ উপভোগ্য হত। মধ্যে মধ্যে তাঁদের ডেকে আমি আলাপ করতাম। দেখতাম তাঁরা বলাবলি করছেন আমার সম্বন্ধে : এই ‘ফিরিঙ্গি সাহেব আমাদের দেশের অনেক ব্যাপার জানে, কারণ অনেকদিন এখানে আছে। সাহেব জানে যে আমরা হলাম ওদের দেশের পাদরিদের মতো।

যাই হোক, এই সব সাধু ফকির সম্বন্ধে অনেক কথা বললাম। এখন হিন্দুদের শাস্ত্র সম্বন্ধে দু—চার কথা বলব।

হিন্দুশাস্ত্রের কথা

আমি সংস্কৃত ভাষা জানি না। হিন্দুস্থানে সংস্কৃত ভাষা দেবভাষা বা ব্রাহ্মণ—পণ্ডিতদের ভাষা। সেই ভাষা সম্বন্ধে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছি বলে যেন বিস্মিত হবেন না। আমার আগা সাহেব, দানেশমন্দ খাঁ, কতকটা আমার অনুরোধে এবং কতকটা তাঁর নিজের কৌতূহল চরিতার্থের জন্য, একজন বিখ্যাত হিন্দু পণ্ডিত নিয়োগ করেছিলেন শাস্ত্র অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে। এরকম সর্বশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত তখন হিন্দুস্থানে খুব কমই ছিলেন। আগে সম্রাট সাজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশিকোর অধীনে এই পণ্ডিত কাজ করতেন। এই পণ্ডিতমশায়ের সাহচর্যে প্রায় তিন বছর কাটিয়েছি এবং তিনিই আমাকে অন্যান্য আরও অনেক পণ্ডিতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আগা সাহেবের সঙ্গে হার্ভে (William Harvey) ও পেকেতের (Jean Pecquet)  বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্বন্ধে, অথবা গ্যাসেন্ডি (Gassendi) ও দেকর্তের (Descartes) দর্শন সম্বন্ধে, মধ্যে মধ্যে আমার আলোচনা হত। আমি তাঁদের রচনা পারসি ভাষায় অনুবাদ করতাম আগার জন্য। প্রায় পাঁচ ছয় বছর খাঁ সাহেবের কাছে থেকে এই অনুবাদের কাজই করতে হয়েছে আমাকে। খাঁ সাহেবের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শন নিয়ে আমার রীতিমতো তর্ক—বিতর্ক হত। তারই ফাঁকে—ফাঁকে আমরা পণ্ডিত মশাইকে ডাকতাম এবং হিন্দুস্থানের কথা ব্যাখ্যা করতে বলতাম। পণ্ডিতমশাই এমন গম্ভীর হয়ে শাস্ত্রকথা আলোচনা করতেন যে, আমাদের হাসি পেত অনেক সময়। অথচ শাস্ত্রালোচনার সময় তিনি একটুও হাসতেন না। আমাদের কাছে তাঁর ব্যাখ্যান ও বক্তৃতা প্রায়ই নীরস মনে হত।

হিন্দুদের বিশ্বাস যে স্বয়ং ভগবান তাদের জন্য চারখানা শাস্ত্রগ্রন্থ আদিতে সৃষ্টি করেছিলেন—তার নাম ‘বেদ’। বেদ বা জ্ঞান; বেদ অধ্যয়ন করলে সর্ববিদ্যাবিশারদ হওয়া যায়। যা বেদে নেই, তা অন্য কোথাও নেই। প্রথম বেদের নাম ‘অথর্ববেদ’; দ্বিতীয় বেদের নাম ‘যজুর্বেদ’; তৃতীয় বেদের নাম ‘ঋকবেদ’; এবং চতুর্থ বেদের নাম ‘সামবেদ’। বেদে আছে যে মানুষ নানা জাতিতে বিভক্ত হয়ে যাবে, তার মধ্যে প্রধান জাতি হবে চারটি।* প্রথম ও শ্রেষ্ঠ জাতি হল ‘ব্রাহ্মণ’, যাঁরা শাস্ত্র ব্যাখ্যা করেন; দ্বিতীয় জাতি হল ‘ক্ষত্রিয়’ যাঁরা যুদ্ধবিগ্রহ করেন; তৃতীয় জাতি হল ‘বৈশ্য’ যাঁরা ব্যবসাবাণিজ্য করেন, এবং সাধারণত ‘বেনিয়া’ বলে পরিচিত; চতুর্থ জাতি হল ‘শূদ্র’, যাঁরা কারিগর, মজুর ও দাস। এইসব জাতির মধ্যে কোনো সামাজিক লেনদেনের সম্পর্ক নেই, এক জাতির লোক অন্য জাতিতে বিবাহাদি করতে পারবে না। কোনো ব্রাহ্মণ কোনো ক্ষত্রিয়কে বিবাহ করতে পারবে না। এই বিধিনিষেধ অন্যান্য প্রত্যেক জাতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

হিন্দুরা কতকটা পাইথাগোরিয়ানদের মতো আত্মার অবিনশ্বরতা, দেহাতীত সত্তায় বিশ্বাস করে। তার জন্য সাধারণত তারা জীবজন্তু হত্যা করা বা ভক্ষণ করা পছন্দ করে না। এটা অবশ্য মোটামুটি ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা অন্যান্য জাতির লোকেরা জীবজন্তু হত্যা করতে বা ভক্ষণ করতে পারে। তবে তাদের ক্ষেত্রেও গোহত্যা করা পাপ। সর্বশ্রেণির হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আছে গরুর প্রতি। প্রায় দেবতার মতো তারা গরুকে ভক্তি করে, তার কারণ তাদের ধারণা, ইহলোক থেকে পরলোক যাত্রার সময় গরুর লেজ ধরে বৈতরণী পার হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। যে গরুর লেজ ধরে বৈতরণী পার হতে হবে, সেই গরুকে পারের কাণ্ডারী ভগবানের মতো ভক্তি না—করা অন্যায়। বোধহয়, প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রকাররা রাখাল বালকদের এইভাবে মিশরের নীলনদ পার হতে দেখেছিলেন, এক হাতে গরুর লেজ, আর এক হাতে লাঠি নিয়ে। সেই সুদূর অতীতের স্মৃতি তাঁরা এইভাবে শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন। অথবা এমনও হতে পারে যে, গরুর উপকারিতার জন্য হিন্দুরা তাকে এই চোখে দেখে। গরুর দুধ—ঘি—মাখন জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করে; গরু দিয়ে হালচাষ করে ফসল ফলাতে হয়, অর্থাৎ গরু জীবন দান করে। সুতরাং জীবনীশক্তির উৎস গরু হল ভগবান। এছাড়া আরও একটা বিষয় বিবেচনা করা দরকার। উত্তম চারণভূমির খুব অভাব হিন্দুস্থানে তার জন্য গো—মহিষের সংখ্যা বৃদ্ধি করা খুব বেশি সম্ভব নয়। সেইজন্য হয়তো গোহত্যা নিষিদ্ধ হয়েছে, এমনও হতে পারে। ফ্রান্স, ইংলন্ড বা অন্যান্য দেশের মতো যদি হিন্দুস্থানে গোহত্যা করা হত, তাহলে দেশের চাষবাসে রীতিমতো সঙ্কট দেখা দিত। গ্রীষ্মকালে হিন্দুস্থানের উত্তাপ এত বেশি হয় যে, মাঠের গাছপালা সব শুকিয়ে পুড়ে যায় এবং গরুবাছুরের খাদ্য বলে কোথাও কিছু থাকে না। প্রায় আট মাসকাল গ্রীষ্ম থাকে এবং এইসময় গরুবাছুর খাদ্যাভাবে মাঠে—জঙ্গলে যা কিছু আবর্জনা খেয়ে শূয়োরের মতো বেঁচে থাকে। গবাদি পশুর অভাবের জন্যই সম্রাট জাহাঙ্গীর একসময় কিছুদিনের জন্য ফরমান জারি করে গোহত্যা নিষিদ্ধ করেছিলেন। সম্রাট ঔরঙ্গজীবের সময় হিন্দুরা এই মর্মে আবেদন করেছিল। আবেদনপত্রে তারা জানিয়েছিল যে গত পঞ্চাশ—ষাট বছরের মধ্যে দেশের বনজঙ্গলের এত দ্রুত অবনতি হয়েছে যে গরুবাছুর অত্যন্ত দুর্লভ হয়ে গেছে।

হিন্দু শাস্ত্রকাররা গোহত্যা বা মাংসাদি ভক্ষণ নিষিদ্ধ করার সময় হয়তো ভেবেছিলেন যে, এই নিষেধাজ্ঞার ফলে মানুষের উপকার হবে এবং লোকচরিত্রের উন্নতি হবে। জীবজন্তুর প্রতি যদি তাদের করুণার উদ্রেক করা যায়, তাহলে মানুষের প্রতি মানবতাবোধও জাগ্রত থাকবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক গভীর হবে, মানবিক হবে। তাছাড়া আত্মার অবিনশ্বরতায় বিশ্বাসের ফলে কোনো জীবজন্তুকে হত্যা করাকে তারা পিতৃপুরুষ হত্যার সামিল মনে করে। তার চেয়ে ঘোরতর অপরাধ আর কী হতে পারে? এমনও হতে পারে যে, ব্রাহ্মণ শাস্ত্রকাররা বুঝেছিলেন যে, হিন্দুস্থানের মতো গ্রীষ্মপ্রধান গোমাংস ভক্ষণ স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক অনিষ্টকর। সেইজন্যও হয়তো তাঁরা গোমাংসভক্ষণ নিষিদ্ধ বলে জারি করেছিলেন।

বেদের বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক হিন্দুর কর্তব্য হল প্রতিদিন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তিনবার পুবদিকে মুখ করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা। সকালে একবার, দুপুরে একবার, রাত্রে একবার। তিনবার স্নান করাও তার কর্তব্য; অন্তত মধ্যাহ্নভোজনের আগে একবার তো নিশ্চয়ই। স্নান করতে হলে বদ্ধ জলে স্নান না করে, স্রোতের জলে অবগাহন করাই শ্রেয়। এখানেও দেখা যায়, দেশের ভৌগোলিক পরিবেশের প্রতি শাস্ত্রকারদের সতর্ক দৃষ্টি ছিল। শীতপ্রধান দেশের লোকরা সহজেই বুঝতে পারবেন, এই ধরনের শাস্ত্রীয় বিধান যদি তাঁদের উপর প্রয়োগ করা হত, তাহলে কি ভয়ানক শোচনীয় অবস্থা হত! অথচ আমি দেখেছি, হিন্দুস্থানের লোক এই শাস্ত্রীয় বিধান বর্ণে—বর্ণে পালন করেন, নদ—নদীর স্রোতের জলে স্নান করেন এবং যেখানে কাছাকাছি কোনো নদী নেই, সেখানে কলসি বা অন্য জলপাত্রে জল নিয়ে মাথায় ঢালেন। মধ্যে—মধ্যে আমি তাদের এই শাস্ত্রীয় বিধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতাম এবং বলতাম যে, শীতপ্রধান দেশে এ—বিধান মেনে চলা সম্ভব নয়। সুতরাং বেশ পরিষ্কার বোঝা যায় যে, এর মধ্যে ধর্মের ব্যাপার কিছু নেই; এ হল একেবারে নিছক স্বাস্থ্যের বিধান। আমার এই অভিযোগের উত্তরে তারা বলেছে : ‘আমরা কি কোনোদিন বলেছি সাহেব যে, আমাদের শাস্ত্রের বিধান অন্যান্য সকল দেশের সকল জাতের লোকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? তা তো আমরা বলিনি কোনোদিন। ভগবান কেবল আমাদের দেশের লোকের জন্যই এইসব শাস্ত্রীয় বিধান রচনা করেছেন, বিধর্মী বিদেশিদের জন্য নয়। আমরা কোনোদিন এমন কথাও বলিনি যে, তোমাদের ধর্ম মিথ্যা। তোমাদের ধর্ম তোমাদের সাহেব, আমাদের ধর্ম আমাদের। তোমাদের যা প্রয়োজন ঠিক সেইভাবে তোমাদের ধর্মশাস্ত্র তৈরি করা হয়েছে। ভগবান ধর্মাচরণের বিভিন্ন পন্থা দেখিয়ে দিয়েছেন। যে—কোনো পথ ধরে স্বর্গে যাওয়া যায় সাহেব!’ এরপর আমার পক্ষে উত্তর দেওয়া মুশকিল হল। আমি কিছুতেই তাদের বোঝাতে পারালাম না যে, আমাদের খ্রিস্টধর্ম পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য এবং হিন্দুদের ধর্ম কেবল হিন্দুস্থানের জন্য। একথা কিছুতেই তাদের যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝাতে পারলাম না।

বেদের শিক্ষা হল—ভগবান এই পৃথিবী সৃষ্টি করবেন সঙ্কল্প করলেন, কিন্তু প্রথমে তিনজন অবতার সৃষ্টি করলেন তার জন্য। একজন ব্রহ্মা, যিনি সর্বভূতে বিরাজমান; একজন বিষ্ণু এবং একজন মহাদেব। ব্রহ্মাকে দিলেন তিনি সৃষ্টির দায়িত্ব, বিষ্ণুকে দিলেন পালনের দায়িত্ব এবং মহাদেবকে দিলেন সংহারের দায়িত্ব। ব্রহ্মা হলেন সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু পালনকর্তা, এবং মহাদেব ধ্বংসের দেবতা। ভগবানের আদেশে এই ব্রহ্মাই চতুর্বেদ সৃষ্টি করলেন এবং নিজেও সেইজন্য চতুর্মুখ হলেন।

ইয়োরোপীয় পাদরি সাহেবদের সঙ্গে আমি এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। তাঁরা বলেন যে, এই ত্রয়ীর কল্পনা হিন্দুধর্মের একটি অন্যতম বিশেষত্ব। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় রহস্যাবৃত, কিন্তু তা নয়। তিনজন যদিও স্বতন্ত্র সত্তাবিশিষ্ট, তাহলেও তাঁরা আসলে এক ও অভিন্ন। এই বিষয়ে হিন্দু পণ্ডিতদের সঙ্গেও আলোচনা করে দেখেছি, তাঁরা এমন ভাষায় ব্যাখ্যা করেন যে তা থেকে তাঁদের পরিষ্কার মতামত কি তা জানা যায় না। তারা বলেন যে তিনজন একই ভগবানের অংশবিশেষ এবং তাঁরা দেবতা। কিন্তু ‘দেবতা’ বলতে তাঁরা ঠিক কি বোঝেন তা বলা যায় না। অন্যান্য পণ্ডিত যাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেছি তাঁরাও ওই একই কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন যে তিনজনই একই দেবতা, কেবল তিন রূপে কল্পনা করা হয়েছে মাত্র। একজন সৃষ্টিকর্তা, একজন ত্রাণকর্তা, একজন সংহারকর্তা।

আমার সঙ্গে রেভারেন্ড রোয়া বা রথের (Father Heinrich Roth) পরিচয় ছিল। জার্মান জেসুইট ফাদার রথ তখন আগ্রায় ছিলেন। সংস্কৃতভাষায় তাঁর মতো পণ্ডিত বিদেশিদের মধ্যে তখন কেউ ছিলেন কি না সন্দেহ। তিনি বলেন যে, এক দেবতার তিন রূপের কল্পনা নয় শুধু, দ্বিতীয়জনের অর্থাৎ বিষ্ণুর আবার দশাবতার রূপ আছে। এই দশাবতার রূপ সম্বন্ধে যেটুকু তিনি হিন্দু পণ্ডিতদের কাছ থেকে এবং অন্যান্য পাদরিদের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন, তা আমাকে বললেন। পৃথিবীতে এক—এক বার সঙ্কট দেখা দিয়েছে, ধ্বংসের মুখে এগিয়ে গেছে পৃথিবী। যতবার এরকম যুগসঙ্কট দেখা দিয়েছে, ততবার দেবতা বিষ্ণু বিভিন্ন অবতারের রূপ ধরে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং মানুষকে সঙ্কট থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এরকম ন’বার সঙ্কট দেখা দিয়েছে, এবং ন’বার বিষ্ণু নয় অবতারের রূপে আবির্ভূত হয়েছেন মানুষের মুক্তির জন্য। বিষ্ণুর অষ্টম অবতাররূপে আবির্ভাবের কাহিনিটি সবচেয়ে রোমাঞ্চকর (কৃষ্ণাবতার)। পৃথিবীতে দৈত্যদানবের প্রতিপত্তি যখন খুব বেড়ে গেল, তখন এক কুমারীর গর্ভে মধ্যরাত্রে বিষ্ণু অবতাররূপে জন্ম নিলেন। দেবদূতরা তাঁর আবির্ভাবে উৎফুল্ল হয়ে নৃত্যোৎসব করল। সারারাত ধরে আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হল অনর্গল। কাহিনির সঙ্গে খ্রিস্টানদের পৌরাণিক কাহিনির যেন বেশ সাদৃশ্য আছে মনে হয়। যাই হোক, কাহিনিটা বলি। অবতাররূপে ভূমিষ্ঠ হয়ে, দানবের সঙ্গে যুদ্ধে রত হলেন বিষ্ণু। দানবের বিশাল মূর্তি আকাশের সূর্যকে আচ্ছাদন করে ফেলল। অন্ধকার হয়ে গেল পৃথিবী। বিষ্ণুর অবতার তাকে বধ করলেন। ভূপৃষ্ঠে আছাড় খেয়ে পড়ল দানব, তখন কেঁপে উঠল সারা পৃথিবী। মাটি ফুঁড়ে রসাতলে নরকে প্রবেশ করল দৈত্য। অবতার আবার ঊর্ধ্বে স্বর্গে চলে গেলেন। হিন্দুরা বলেন, বিষ্ণুর দশম অবতার মুসলমান যবনদের হাত থেকে তাদের মুক্ত করার জন্য পৃথিবীতে অবতীর্ণ হবেন। একথা শাস্ত্রে লেখা নেই অবশ্য, এমনি প্রচলিত কিংবদন্তী।

হিন্দুরা বলেন যে, তৃতীয় দেবতা মহাদেবেরও পৃথিবীতে আবির্ভাবের কাহিনি আছে। কাহিনিটি এই : এক হাজার এক কন্যা ছিল। কন্যা যখন বিবাহযোগ্যা হল, তখন রাজা একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, কি রকম পতি সে বরণ করতে চায়। কন্যা উত্তর দিল যে, দেবতা ছাড়া অন্য কাউকে সে পতিরূপে বরণ করবে না। কন্যার এই উত্তর শুনে মহাদেব অগ্নিরূপে আবির্ভূত হলেন এবং রাজকন্যার পাণিপ্রার্থী হলেন। রাজা তাঁর কন্যাকে মহাদেবের প্রস্তাবের কথা বললেন এবং কন্যাও সম্মতি জানাল বিনা দ্বিধায়। মহাদেব অগ্নিরূপেই রাজসভায় উপস্থিত হলেন এবং যখন দেখলেন যে, সভাসদরা বিবাহের বিরোধিতা করেছেন তখন তিনি তাঁদের দাড়িতে প্রথম আগুন ধরিয়ে দিলেন। তারপর তাঁদের দগ্ধ করে ভস্ম করলেন। রাজকন্যার সঙ্গে মহাদেবের বিবাহ হল। বিষ্ণুর অবতার সম্বন্ধে হিন্দুরা বলেন যে, প্রথমে বিষ্ণু সিংহরূপ ধারণ করেছিলেন। দ্বিতীয় রূপ বরাহের, তৃতীয় কূর্মের, চতুর্থ নাগের, পঞ্চম হ্রস্বকায় বামনের, ষষ্ঠ নরসিংহের, সপ্তম ড্রাগনের, অষ্টম কৃষ্ণের, নবম হনুমানের, এবং দশম বীর অশ্বারোহীর।১০

রেভারেন্ড রথ যে বেদজ্ঞ পণ্ডিত এবং হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে তিনি যা বলেছেন তা যে সত্য, সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তাঁরই কাছ থেকে শোনা পুরাণকাহিনি আমি এখানে বর্ণনা করেছি। এ বিষয়ে অনেক বেশি লিখে ফেলেছি আমি, এবং হিন্দুদের দেবদেবী বা দেবমূর্তি যা তাদের দেবালয়ে দেখেছি, তা স্কেচ করে নিয়েছি। শুধু তাই নয়, তাদের দেবভাষা যে সংস্কৃতভাষা তাও আমি নকশা করে নিয়েছি। ফাদার *কার্কারের (Father Kirker) China Illustrate-গ্রন্থে এ—সব লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।১১এখানে তার পুনরাবৃত্তি আর করব না। ফাদার রথ যখন রোমে ছিলেন তখন কার্কার তাঁর কাছ থেকে অনেক মূল্যবান উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন। আমার মনে হয়, ওই বইখানি যদি একবার আপনি পড়েন তাহলে অনেক কথা জানতে পারেন। ‘অবতার’ সম্বন্ধে একটি কথা এখানে বলে শেষ করি। ফাদার রথ যেভাবে ‘অবতার’ কথার প্রয়োগ ও ব্যাখ্যা করেছিলেন, তা আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। একদল পণ্ডিত ‘অবতার’ কথার এইভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন : দেবতারা বিভিন্ন অবতারের রূপ ধরে মর্ত্যধামে অবতীর্ণ হন এবং নানারকম দৈবশক্তি ও কার্যকলাপের পরিচয় দিয়ে বিদায় নেন। অন্যান্য পণ্ডিতেরা বলেন : পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব ও বীর যাঁরা তাঁদের মৃত্যুর পর আত্মা অন্য কোনো দেহের ভিতরে আশ্রয় নেয়। তখন সেই দেহ এক ঐশ্বরিক রূপ ধারণ করে সেই আত্মার সংস্পর্শে। মহামানবদের আত্মা এইভাবে যখন ভিন্ন দেহান্তর্গত হয়, তখনই সে দেবতার রূপ ধারণ করে। আত্মার সঙ্গে দেবতার যে একটা সম্পর্ক আছে, একথা হিন্দুরা যে ভাবেই হোক, স্বীকার করেন। মানবাত্মা দেবতারই অংশবিশেষ, এই হল হিন্দুদের ধারণা।

কোনো কোনো পণ্ডিত অবতারবাদের আরও সূক্ষ্ম জটিল ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা বলেন যে, দেবতার বিভিন্ন অবতারের কল্পনা তাঁর বিভিন্ন গুণাগুণ প্রকাশের কৌশল মাত্র। অবতার কথার এছাড়া কোনো শব্দগত আভিধানিক অর্থ নেই। আধ্যাত্মিক অর্থে অবতার কথার তাৎপর্য বুঝতে হবে। খুব বিচক্ষণ পণ্ডিতের মধ্যে কেউ কেউ বলেন যে, অবতারের কল্পনার মতো আজগুবি কল্পনা আর হয় না। শাস্ত্রকাররা এই সব আজগুবি কৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন, সাধারণ লোককে ধর্মের আওতার মধ্যে রাখবার জন্য। তাঁরা বলেন যে, মানুষের আত্মা যদি দেবতার অংশবিশেষ হয়, তাহলে অবতারের সমস্ত কল্পনা অর্থহীন হয়ে যায় এবং ব্যাপারটা এই দাঁড়ায় যেন আমরাই আমাদের পূজার্চনার জন্য নানারকম ধর্মশাস্ত্র রচনা করেছি, দেবদেবীর কল্পনা করেছি। তা হয় না। অবাস্তব কথা ও অর্থহীন যুক্তি।

পাদরি কার্কার ও রথের কাছে হিন্দুধর্মের এই বিবরণের জন্য যেমন আমি বিশেষভাবে ঋণী, তেমনি মঁশিয়ে লর্ড ও আব্রাহাম রোদারের কাছেও আমার ঋণ কম নয়।১২ এই পাদরি পণ্ডিতদের মূল্যবান গ্রন্থাদি থেকে হিন্দুস্থানের সম্পর্কে অনেক মূল্যবান উপকরণ আমি সংগ্রহ করেছি, কিন্তু তাঁরা যতটা পরিশ্রম করে ও ধৈর্য ধরে সেগুলির সুবিন্যস্ত বিবরণ দিয়েছেন, আমার পক্ষে তা দেওয়া সম্ভব হবে না। এখানে তাঁদের সেই বিবরণ থেকে আমি যতটা সম্ভব হিন্দুদের বিদ্যা ও বিজ্ঞানচর্চা সম্বন্ধে সংক্ষেপে কয়েকটা কথা বলব।

সংস্কৃতচর্চা ও কাশীধামের কথা

গঙ্গানদীর তীরে কাশী। যেমন তার প্রাকৃতিক অবস্থান, তেমনি মনোরম পরিবেশ। এই কাশী বা বারাণসীই হল হিন্দুদের সংস্কৃতবিদ্যা ও শাস্ত্রচর্চার প্রধান কেন্দ্র। ‘It is the Athens of India, whither resort the Brahmans and other devotees, who are the only persons who apply their minds to study.’ এই বারাণসীই হল ভারতবর্ষের এথেন্স। এই বারাণসীতে ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য ভক্তদের সমাগম হয়। ব্রাহ্মণ—পণ্ডিতদের সমাগমতীর্থ। ব্রাহ্মণরাই মনপ্রাণ দিয়ে শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। শহরের মধ্যে আমরা কলেজ বা স্কুল বলতে যা বুঝি আজকাল তা নেই। যেমন বিশ্ববিদ্যালয় থাকে, তার অধীন স্কুল—কলেজ থাকে, তেমন কিছু বারাণসীতে নেই। বিদ্যালয় যা আছে তা প্রাচীন যুগের বিদ্যালয়ের মতো। গুরুমশাই ও শিক্ষকরা শহরের বিভিন্ন স্থানে বা শহরের বাইরে থাকেন, এবং প্রধানত বণিকরাই থাকেন শহরের মধ্যে। গুরুমশায়ের কাছে থেকে ছাত্ররা বিদ্যাভ্যাস করে। সব—গুরুমশায়ের ছাত্র—সংখ্যা সমান নয়। কারও ছাত্রসংখ্যা মাত্র চারজন, কারও পাঁচ—ছয়জন, আবার কারও বারো কি পনেরোজন। তার বেশি ছাত্র কারও নেই। ছাত্ররা সাধারণত দশ বছর থেকে বারো বছর পর্যন্ত গুরুর কাছে থাকে এবং সেই সময় গুরুমশাই তাদের ধীরে ধীরে নানা শাস্ত্রে শিক্ষাদান করেন। ধীরে—সুস্থে শিক্ষা দেন, তার কারণ সাধারণত দেখা যায় গুরুমশাইরা খুব যে পরিশ্রমী ও কর্মতৎপর, তা নন। ধীরে—সুস্থে, মন্থর গতিতে তাঁরা সব কাজকর্ম করেন। এর কারণ বোধহয় তাঁদের বিশেষ খাদ্য এবং গ্রীষ্মের প্রাবল্য। প্রচণ্ড গ্রীষ্মের উত্তাপের মধ্যে, ওই ধরনের খাদ্য খেয়ে, খুব বেশি কাজকর্ম করা যায় বলে মনে হয় না। ছাত্রদের মধ্যে কোনো পরীক্ষালব্ধ সম্মান বা কৃতিত্বের জন্য কোনো প্রতিযোগিতা রেষারেষি বলে কিছু নেই, যেমন আমাদের দেশের ছাত্রদের মধ্যে আছে। শিক্ষার্থীরা সেইজন্য গুরুমশায়ের কাছ থেকে শান্ত সংযতভাবে বিদ্যাভ্যাস করতে পারে এবং অধ্যয়ন ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ের প্রতি তাদের মন আকৃষ্ট হয় না। স্থানীয় ধনিক ও বণিকরাই সাধারণত তাদের ভোজ্য—দ্রব্যাদি পাঠিয়ে দেন এবং তারা খিচুড়ির মতো খুব সাদাসিধে খাদ্য পেলেই খুশি হয়।

প্রথমে শিক্ষা দেওয়া হয় সংস্কৃত ভাষা। এই সংস্কৃতভাষা নাকি এই ব্রাহ্মণ—পণ্ডিতরা ছাড়া অন্য কেউ ভাল জানেন না এবং হিন্দুস্থানের লোক যে ভাষায় বাক্যালাপ করে তার সঙ্গে এই ভাষার কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। এই সংস্কৃতভাষার অক্ষরই প্রথম পাদরি কার্কার মুদ্রিতরূপে প্রকাশ করেন, পাদরি রথের সাহায্যে। ‘সংস্কৃত’ কথার অর্থ হল যা অমার্জিত বা রূঢ় নয়, অর্থাৎ যা পরিমার্জিত ও পরিশুদ্ধ, এরকম একটি ভাষা। হিন্দুদের বিশ্বাস, ভগবান ব্রহ্মা প্রথমে চতুর্বেদ সৃষ্টি করেন যে—ভাষায়, সেই ভাষা হল সংস্কৃতভাষা। সেইজন্য সংস্কৃতভাষা হিন্দুরা দেবভাষা ও বিশুদ্ধ পবিত্র ভাষা বলে মনে করেন। তাঁদের ধারণা, ব্রহ্মার মতোই এই সংস্কৃত ভাষা অনাদি ও অনন্ত। ভাষার উৎপত্তি সম্বন্ধে এরকম আজগুবি কথায় অবশ্য বিশ্বাস করা যায় না। সংস্কৃত ভাষা যে প্রাচীন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, সংস্কৃত ভাষায় রচিত হিন্দুদের শাস্ত্রগ্রন্থাদির মধ্যে রীতিমতো প্রাচীন গ্রন্থও অনেক আছে। দর্শনশাস্ত্র, আয়ুর্বেদশাস্ত্র এবং অন্যান্য আরও অনেক শাস্ত্রগ্রন্থ সংস্কৃতভাষায় রচিত হয়েছে। কাশীতে এইসব সংস্কৃত শাস্ত্রগ্রন্থের বিশাল একটি পাঠাগার দেখেছি।

শিক্ষার্থীরা সংস্কৃত ভাষায় কিছুটা পারদর্শী হবার পর তারা ‘পুরাণ’ পাঠ করে। সংস্কৃত ব্যাকরণে বেশ খানিকটা দখল না থাকলে ‘পুরাণ’ পাঠ করা বা অর্থ বোঝা সম্ভব নয়। বেদের সারকথা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করে পুরাণের মধ্যে বলা হয়েছে।* বেদ বিরাট গ্রন্থ, অন্তত। আমি যে বেদ কাশীতে দেখেছি তা সত্যিই যদি বেদ হয়, তাহলে তার বিরাটত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ নেই। ‘বেদ’ এত দুষ্প্রাপ্য ও দুর্লভ গ্রন্থ যে আমার আগা দানেশমন্দ খাঁ অনেক চেষ্টা করেও এক কপিও সংগ্রহ করতে পারেননি। হিন্দুরা অত্যন্ত সাবধানে বেদ বা অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ লুকিয়ে রেখে দেয়, কারণ তাদের ধারণা মুসলমানরা জানতে পারলে সব পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলবে।

পুরাণপাঠ শেষ হবার পর শিক্ষার্থীরা দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন আরম্ভ করে। দর্শনশাস্ত্র খুব তাড়াতাড়ি আয়ত্তে আনা রীতিমতো কঠিন। তার ওপর স্বভাব—শৈথিল্যও শিক্ষার অগ্রগতির পথে অন্যতম অন্তরায়। ইয়োরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বা শিক্ষক অধ্যাপকরা যে—রকম তৎপর, হিন্দুস্থানের টোলের গুরুমশাই বা ছাত্ররা তা নন। তার কারণ আগেই বলেছি। সর্বক্ষেত্রে এখানকার গতিটাই মন্থর।

হিন্দুস্থানে যেসব খ্যাতনামা দার্শনিকের আবির্ভাব হয়েছে তাঁদের মধ্যে ছয়জনের নাম উল্লেখযোগ্য। এই ছয়জন দার্শনিকের অনুগামীদের নিয়ে ছয়টি বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে হিন্দুদের মধ্যে। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের পণ্ডিতরা মনে করেন, তাঁদের অনুসৃত দর্শনই অভ্রান্ত এবং একমাত্র সত্য দর্শন, বেদই তার উৎস।১৩ এছাড়া আরও একটি সপ্তম ধর্মসম্প্রদায় আছে, তাঁদের ‘বৌদ্ধ’ (বার্নিয়েরর ভাষায়—‘Baute’) বলা হয়। বৌদ্ধরা নাকি আবার দ্বাদশটি শাখা—উপশাখায় বিভক্ত। যাই হোক, এখন আর বৌদ্ধদের তেমন প্রভাব প্রতিপত্তি নেই, হিন্দুস্থানে সংখ্যাও তেমন বেশি নয়। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকরা ভয়ানক ঘৃণা ও উপেক্ষা করে এবং তাদের নাস্তিক ও ধর্মজ্ঞানহীন বলে ঠাট্টাবিদ্রূপ করে। বৌদ্ধরা এখন সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক বিচিত্র জীবন যাপন করে।১৪

প্রত্যেক দর্শনশাস্ত্রেরই মূল বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে এবং এক—একজন শাস্ত্রকার এক—এক ভাবে করেছেন। কারও পদ্ধতি ও রীতির সঙ্গে অন্য কারও কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ বলেন, প্রত্যেক বস্তু সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পদার্থ দিয়ে গঠিত। এইসব সূক্ষ্ম পদার্থ অবিভাজ্য, নিরেট বলে নয়, কণার মতো ক্ষুদ্রতম বলে। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেক তত্ত্বকথার অবতারণা করেছেন শাস্ত্রকার, যা শুনলে ডেমক্রিটাস (Democritus) ও এপিকিউরাসের (Epicurus) কথা মনে হয়। কিন্তু মতামতগুলি এমন শিথিল অসংলগ্ন ভঙ্গিতে ব্যক্ত করা হয়েছে যে সব কথা, সব যুক্তিতর্কই নিতান্তই ভাসা—ভাসা মনে হয়, কোনো অর্থ কিছু বোধগম্য হয় না বিশেষ। আর পণ্ডিতরা এমন সংস্কারগ্রস্ত ও অজ্ঞ এসব বিষয়ে যে এই দুর্বোধ্যতার জন্য কারা দায়ী, শাস্ত্রকাররা, না তাঁদের ভাষ্যকার এই পণ্ডিতেরা—তা সঠিক বলা যায় না।

কোনো দার্শনিক বলেন—উপাদান ও রূপ, এই নিয়েই জগৎ। এর বেশি কিছু তাঁদের বক্তব্য বোঝা যায় না এবং কোনো পণ্ডিতই ব্যাখ্যা করে বুঝতে চান না। উপাদানটা কি বস্তু এবং রূপই বা কি, তা তাঁরা কখনও বুঝিয়ে বলবেন না। আমার মনে হয়, ভাষ্যকার পণ্ডিতরা এ সব কথার তাৎপর্য নিজেরা কিছু জানেন না বা বোঝেন না। যদি জানতেন বা বুঝতেন, তাহলে আমাদের দেশের দার্শনিকদের মতো সেটা ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করতেন। উপাদান থেকেই রূপের জন্ম—এ—কথা বোঝাবার জন্য তাঁরা কুম্ভকারের মৃৎপাত্রের দৃষ্টান্ত দেন। অর্থাৎ কুম্ভকার যেমন কাদামাটি থেকে মাটির পাত্রকে নানাভাবে রূপ দেয়, তেমনি বিশ্বের বাস্তব উপাদান থেকে নানা রূপ সৃষ্টি করেন ভগবান।

কেউ বলেন যে শূন্য থেকে সবকিছুর উৎপত্তি এবং চারটি মৌলিক উপাদান দিয়ে সবকিছু গঠিত। কিন্তু শূন্যবাদ বা উপাদানের রূপান্তর সম্বন্ধে কোনো সন্তাোষজনক ব্যাখ্যা তাঁরা করতে পারেন না। যে—ব্যাখ্যা তাঁরা করেন, তা কারও বোধগম্য হয় বলে মনে হয় না।

কেউ বলেন, আলোক ও অন্ধকারই আসল, কিন্তু আসল তত্ত্বের ব্যাখ্যা তাঁরা যেভাবে করেন তা সত্যিই হাস্যকর। এমন যুক্তিতর্কের সাহায্যে তাঁরা তাঁদের প্রতিপাদ্য বোঝাতে চেষ্টা করবেন এবং এমন লম্বা বক্তৃতা দেবেন যে তার ভিতর থেকে কোনো সারবস্তু কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না।

অনেকে আবার সাধনা, তপস্যা, আত্মনিগ্রহ, উপবাস ইত্যাদির উপর এমন গুরুত্ব আরোপ করেন যে মনে হয় যেন ওইগুলিই চরম সত্য। একটা দীর্ঘ তালিকা তাঁরা আওড়ে যাবেন। এই তালিকা থেকে বোঝা যায় যে কোনো বিচক্ষণ শাস্ত্রকার এসব কথা শাস্ত্রগ্রন্থে বলে যাননি। এত তুচ্ছ সব ব্যাপার নিয়ে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতরা কোনোকালে মাথা ঘামাতেন বলে মনে হয় না।

অনেকে আবার এমন কথাও বলেন যে সবই দৈব বা অদৃষ্টচক্র মাত্র। এছাড়া আর কোনো জীবনদর্শনে তাঁরা বিশ্বাসী নন। তাঁরাও এমন সব কথা বলবেন যা শুনলেই বোঝা যায় যে কোনো শাস্ত্রকার কোনোকালে তা বলেননি।

এইসব দার্শনিক মতামত সম্বন্ধে পণ্ডিতরা বিশ্বাস করেন যে এগুলি সনাতন। এ বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই। শূন্য থেকে সবকিছু সৃষ্টি বা উৎপত্তি হয়েছে, একথা প্রাচীন দার্শনিকদের মনে জাগেনি, হিন্দু দার্শনিকদের মনেও না। একজন হিন্দু দার্শনিক নাকি এ—সম্বন্ধে চিন্তা করেছিলেন।১৫

হিন্দুদের চিকিৎসাবিদ্যা

শারীরবিদ্যা সম্বন্ধে হিন্দুদের কয়েকখানি গ্রন্থ আছে; কিন্তু তার অধিকাংশই ওষুধ ও পথ্যের তালিকা ছাড়া কিছু নয়। শারীরবিদ্যার বা তত্ত্বের কোনো আলোচনা তার মধ্যে করা হয়নি। এ—সম্বন্ধে সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থখানি পদ্যে লেখা। হিন্দুদের চিকিৎসা—প্রথার সঙ্গে আমাদের প্রথার পার্থক্য অনেক। কয়েকটি মূলনীতির উপর তাদের চিকিৎসাশাস্ত্রের ভিত্তি গঠিত। নীতিগুলি হল :

(ক) রোগীর অসুখ হলে তার পুষ্টির কোনো প্রয়োজন নেই;

(খ) অসুখের প্রধান চিকিৎসা হল উপবাস;

(গ) মাংসের ক্কথ ইত্যাদি রোগীর পথ্য নয়। অসুস্থ রোগীর এই জাতীয় পথ্য বিষবৎ বর্জনীয়;

(ঘ) বিশেষ প্রয়োজন না হলে রোগীর দেহ থেকে রক্ত নেওয়া উচিত নয়।

এই চিকিৎসাপদ্ধতি সঙ্গত কি না, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি না, তা বিচক্ষণ চিকিৎসকরা বিবেচনা করে দেখবেন। আমার বক্তব্য হল, এই চিকিৎসাপদ্ধতি হিন্দুস্থানে বেশ ফলপ্রদ হয়েছে দেখা যায়। শুধু হিন্দুরা নয়, মোগল ও অন্যান্য মুসলমান চিকিৎসকরা এই একই পদ্ধতিতে রোগীর চিকিৎসা করেন। উপবাস করতে হবে অসুখ হলে, একথা সকল শ্রেণির চিকিৎসকরাই স্বীকার করেন। মোগল চিকিৎসকরা হিন্দুদের চেয়ে রোগীর দেহ থেকে রক্ত—নিষ্কাশনের পক্ষপাতী বেশি বলে মনে হয়। মাথার অসুখ, লিভার বা কিডনির কোনো অসুখের সম্ভাবনা থাকলে তাঁরা রোগীর দেহ থেকে রক্ত বার করে নেন। গোয়া বা প্যারিসের ডাক্তাররা যেভাবে অল্পস্বল্প করে নেন, মোগল চিকিৎসকরা তা করেন না।১৬  তাঁরা প্রাচীন চিকিৎসকদের মতো এক—একজন রোগীর দেহ থেকে আঠার থেকে বিশ আউন্স পর্যন্ত রক্ত নিষ্কাশন করেন এবং তার ফলে অনেক সময় রোগী অচৈতন্য হয়ে পড়ে। এইভাবে তাঁরা বলেন যে রোগীর দেহ থেকে বদরক্ত বার করে দিলে, যে—কোনো বিষাক্ত রোগই হোক না কেন গোড়াতেই তার মূলে আঘাত করা হয় এবং রোগের দ্রুত উপশম হয়।

হিন্দুরা শারীরবিদ্যা সম্বন্ধে যে একেবারে অজ্ঞ তাতে অবাক হবার কিছু নেই। মানুষের শরীরের ভিতরের গড়ন স্বচক্ষে না দেখলে, শারীরবিদ্যা সম্বন্ধে কোনো ধারণা বা জ্ঞান হওয়াও সম্ভব নয়। হিন্দুরা কোনোদিন কোনো রোগীর দেহের মধ্যে অস্ত্রোপচার করেন না। তাঁরা দেখেননি কোনোদিন দেহের মধ্যে কি আছে, না আছে। মানুষ তো দূরের কথা, কোনো জন্তু—জানোয়ারের দেহও এইজন্য তাঁরা কোনোদিন কেটেকুটে দেখেননি। মধ্যে মধ্যে আমি যখন কোনো ছাগল বা ভেড়ার দেহ চিরে ফেলে আমার মনিব আগাকে দেহের মধ্যে রক্তচলাচলের পদ্ধতির ব্যাখ্যা করতাম, তখন হিন্দুরা ভয়ে বিস্ময়ে সেখান থেকে পালিয়ে যেতেন। যাঁরা শরীরের ভিতর একটি শিরার দিকেও কোনোদিন চেয়ে দেখেনি, তাঁরা মানুষের দেহে কতগুলি শিরা—উপশিরা আছে, তা মুখস্থ বলে দিতে পারেন। হিন্দুরা বলেন, মানুষের শরীরে পাঁচ হাজার শিরা—উপশিরা আছে, একটিও বেশি বা কম নেই। যেন প্রত্যেকটি শিরা দেখে—দেখে তাঁরা গুণে রেখেছেন মনে হয়।

হিন্দুদের জ্যোতির্বিদ্যা

জ্যোতির্বিদ্যা সম্বন্ধেও হিন্দুদের নিজস্ব গণনা—পদ্ধতি আছে এবং সেই গণনানুসারে তাঁরা গ্রহণাদির ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। ইয়োরোপীয় জ্যোতিষীদের মতো তাঁদের গণনা একেবারে নির্ভুল না হলেও অনেকটা যে নির্ভুল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গ্রহণাদি সম্পর্কে তাঁদের যা যুক্তি তার সঙ্গে অবশ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁরা বলেন, সূর্যগ্রহণ একই কারণে হয় এবং কোনো দানব বা রাক্ষস সূর্য ও চন্দ্রকে গ্রাস করে ফেলে। এই সময় কতকগুলি নিয়ম না পালন করলে মানুষের অমঙ্গল হতে পারে, এই তাঁদের বিশ্বাস। এখানকার জ্যোতিষীদের ধারণা, সূর্য থেকে চন্দ্রের দূরত্ব প্রায় চল্লিশ লক্ষ ক্রোশ। চন্দ্র জ্যোতির্ময় পদার্থ—বিশেষ। চন্দ্র থেকে মানুষের দেহে যে তরল পদার্থ নিসৃত হয়ে আসে তাই প্রথম মগজে এসে জমা হয় এবং সেখান থেকে দেহের অন্যান্য অংশে সঞ্চারিত হয়ে সমস্ত শরীরটাকে সক্রিয় ও তেজদ্দীপ্ত করে রাখে। হিন্দু জ্যোতিষীদের ধারণা হল—সূর্য, চন্দ্র ও অসংখ্য গ্রহনক্ষত্র দেবতা—বিশেষ। তাদের দৈবশক্তি আছে। সুমেরুর অন্তরালে সূর্যদেব যখন বিশ্রাম গ্রহণ করেন তখন বাইরের জগতে অন্ধকার নামে এবং রাত্রি হয়। এই সুমেরু পর্বত, তাঁরা বলেন, পৃথিবীর ঠিক মাঝখানে অবস্থিত, দেখতে কতকটা উল্টানো পাঁউরুটির মতো এবং তার চূড়া যে কত লক্ষ ক্রোশ দূরে তার হিসেব নেই! সুতরাং তার অন্তরালে সূর্যদেব যখন লুকিয়ে থাকেন, তখন বাইরের পৃথিবীতে আলো প্রবেশ করে না।

হিন্দুদের ভৌগোলিক ধারণা

জ্যোতিষের মতন ভূগোল সম্বন্ধেও হিন্দুদের নানারকমের বিচিত্র ভ্রান্ত ধারণা আছে। তাঁদের মতে পৃথিবীটা গোলাকার নয়, চ্যাপটা ত্রিকোণাকার। পৃথিবীতে সাতটি ‘লোক’ আছে এবং প্রত্যেকটি লোক সাগরবেষ্টিত। সাগরও একরকমের নয়, নানারকমের। কোনো সাগর দুধের সাগর, কোনোটা চিনির, কোনোটা নদীর, কোনোটা বা সুরার ইত্যাদি। দুগ্ধসাগর, শর্করাসাগর, সুরাসাগর ইত্যাদি বিভিন্ন সাগরবেষ্টিত লোকে এক এক শ্রেণির অতিমানুষ ও মানুষের বসবাস আছে। এইভাবে সাগর ও মৃত্তিকার সাতটি স্তর বা বেষ্টনী নিয়ে পৃথিবী গঠিত এবং তার মধ্যস্থলে সুমেরু পর্বত। পর্বত স্তরে, সুমেরুর শিখরের কাছে বড়ো—বড়ো দেবতাদের বাসস্থান; দ্বিতীয় স্তরে ছোটো—ছোটো অসংখ্য দেবতারা বাস করেন। তাঁরা মানুষের চেয়ে অনেক বড়ো, কিন্তু বড়ো—বড়ো দেবতাদের মতো শক্তিশালী নন। এইভাবে পর—পর ছয়টি স্তরে অনেক রকম দেবতা, উপদেবতা ও অপদেবতাদের বাস আছে। সপ্তম স্তরে মানুষের বাস। এই সপ্তম স্তরই হল মর্তলোক বা মাটির পৃথিবী। তাছাড়া, হিন্দুদের ধারণা, এই পৃথিবীটা অসংখ্য হাতির পিঠের উপর প্রতিষ্ঠিত। হাতিগুলো যখন দোলে তখন পৃথিবীটাও দোলে, ভূমিকম্প হয়।

হিন্দুস্থানের ব্রাহ্মণদের প্রাচীন শাস্ত্রবিদ্যার যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে, এতদিন আমরা তাদের জ্ঞানবিদ্যা সম্বন্ধে ভুল ধারণা পোষণ করেছি। সত্যই এটা ঠিক কিনা, অর্থাৎ প্রাচীন হিন্দুদের জ্ঞানবিদ্যা সম্বন্ধে এরকম ধারণা করা সঙ্গত কি—না, আমি এখনও বলতে পারব না। সুপ্রাচীন কাল থেকে হিন্দুশাস্ত্রকাররা এইসব শাস্ত্রবিদ্যার চর্চা করে আসছেন এবং তাঁদের শাস্ত্রও সংস্কৃতের মতো প্রাচীন ভাষায় রচিত। এতকালের প্রাচীন ঐতিহ্যকে হঠাৎ অপাংক্তেয় বলে বর্জন করাও কঠিন। খুব মুশকিলে পড়তে হয় এই জন্য। যাইহোক, এখন আমি হিন্দুদের দেবদেবীর সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলব।

হিন্দু দেবদেবীর কথা

গঙ্গা নদী ধরে যেতে—যেতে আমি বারাণসীতে পৌঁছলাম। বারাণসীতে পৌঁছে সেখানকার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত যিনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। বারাণসী প্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্র বলেও হিন্দুদের কাছে প্রসিদ্ধ। যে পণ্ডিতের কথা আমি বলছি তিনি তখনকার আমলে শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত বলে খ্যাত ছিলেন। ফকির বা সাধকের মতো তিনি থাকতেন। তাঁর পাণ্ডিত্যের এমন খ্যাতি ছিল যে, তিনি সেইজন্য সম্রাট সাজাহানের কাছ থেকে বাৎসরিক দু’হাজার টাকার মতো বৃত্তি পেতেন। বেশ বলিষ্ঠ সুপুরুষ চেহারা তাঁর। সাদা সিল্কের কাপড় আর গায়ে লাল সিল্কের চাদর জড়িয়ে তিনি থাকতেন। দিল্লিতে মধ্যে—মধ্যে এই পণ্ডিতমশাইকে আমি এই পোশাক পরে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। রাজদরবারে বাদশাহের সামনেই হোক বা ওমরাহদের কাছেই হোক, সব সময় তিনি এই পোশাক পরে হাজির হতেন। পায়ে হেঁটেও যাতায়াত করতেন, মধ্যে মধ্যে পালকিতেও চড়তেন। প্রায় এক বছর ধরে এই পণ্ডিতমশাই আমার মনিব দানেশমন্দ খাঁর কাছে যাতায়াত করেছিলেন। যাতায়াতের উদ্দেশ্য ছিল, তাঁকে ধরে সম্রাট ঔরঙ্গজীবের কাছ থেকে বৃত্তি আদায় করা। ঔরঙ্গজীব তাঁর বৃত্তি বন্ধ করে দিয়েছিলেন বলে তিনি আগাকে ধরে বৃত্তি আদায় করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময়, যখন তিনি আমার মনিবের কাছে যাতায়াত করতেন, তখন তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। তখন মধ্যে মধ্যে তাঁর সঙ্গে আমি নানাবিষয়ে আলোচনাও করতাম। অনেক বিষয় নিয়ে তর্কও হত তাঁর সঙ্গে। সুতরাং তাঁর সঙ্গে যখন বারাণসীতে আমার দেখা হল, তখন তিনি আমাকে সাদর সম্ভাষণ জানালেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারে আরও ছয়জন কাশীর পণ্ডিতকে নিমন্ত্রণ করে আমার সঙ্গে সাক্ষাতের ও আলোচনার ব্যবস্থা করে দিলেন।১৭ পণ্ডিতদের সঙ্গে আলোচনার এরকম অপ্রত্যাশিত সুযোগ পেয়ে আমিও প্রস্তুত হলাম। ঠিক করলাম হিন্দুদের দেবতাসম্বন্ধে আলোচনা করব। সভা যখন আরম্ভ হল তখন আমি তাঁদের বললাম : ‘হিন্দুস্থান থেকে আমি এই মূর্তিপূজা সম্বন্ধে ও বহুদেবতার পূজা সম্বন্ধে একটা অত্যন্ত অপ্রীতিকর ধারণা নিয়ে চলে যাচ্ছি। যে—দেশে আপনাদের মতো এরকম বিচক্ষণ শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতরা আছেন, সে—দেশে এরকম বহুদেবতা ও মূর্তিপূজার প্রবল প্রচলন হয় কেমন করে, আমি ভাবতে পারি না। আমাকে আপনারা বুঝিয়ে দিন, এই পূজার অর্থ কি?’ এই কথার উত্তরে পণ্ডিতেরা বলেন :

‘আমাদের দেবালয়ে বহু দেবদেবীর মূর্তি আছে, যেমন ব্রহ্মা, মহাদেব, গণেশ, ভবানী ইত্যাদি (নামগুলি যথাক্রমে বার্নিয়ের এইভাবে লিখেছেন—Brahma, Mehadeu, Genich, Gavani)। এঁরাই প্রধান দেবদেবী। এঁরা ছাড়াও আরও অনেক দেবদেবী আছেন যাঁদের হিন্দুরা পূজা করে নানা কারণে। এইসব দেবদেবীর মূর্তি আমরা পূজা করি ঠিক। সাষ্টাঙ্গে আমরা মূর্তির সামনে প্রণাম করি, ফুল, লতাপাতা, নানারকমের চাল, ঘি, তেল খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদির নৈবেদ্য সাজিয়ে পূজা দিই, জাঁকজমক—সহকারে অনুষ্ঠান করি। সবই ঠিক। কিন্তু একথাও ঠিক যে যখন দেবতার মূর্তিকে আমরা এইভাবে পূজা করি, তখন সত্যই তাঁরা যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু (Bechen) প্রমুখ দেবতা না মনে করি না। তাঁদেরই প্রতিমূর্তি যে তা সব সময় মনে রাখি। সাক্ষাৎ দেবতা ভাবি না। কেবল সেইসব মূর্তি কোনো বিশেষ দেবতার রূপ বলে তার সামনে আমরা পূজা করি। মূর্তিকে করি না, দেবতাকেই করি। তবু কেন মূর্তি গড়ে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করি, এ প্রশ্ন করা বাইরের লোকের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। মন্দিরে আমরা মূর্তি গড়ে এইজন্য প্রতিষ্ঠা করি যাতে সাধারণ লোক সামনে কিছু চোখে দেখে, সেই দেবতার ধ্যান করে তাঁর আরাধনায় মনোনিবেশ করতে পারে। এছাড়া মূর্তিপূজার আর কোনো কারণ নেই। সামনে একটা প্রত্যক্ষ মূর্তি থাকলে তার উপর মনপ্রাণ নিবদ্ধ করে প্রার্থনা করা অনেক সহজ হয়। তার জন্যই মূর্তির কল্পনা। আসলে মনে—মনে সব সময় আমরা দেবতার পূজা করি এবং তিনি একই দেবতা ও ঈশ্বর যে—রূপেই বা যে—মূর্তিতেই তাঁকে কল্পনা করি না কেন।’

কাশীর বিখ্যাত পণ্ডিতরা আমাকে যা বলেছিলেন তার হুবহু বিবরণ আমি দিলাম। একটি কথাও এর মধ্যে যোগ করিনি বা বাদ দিইনি। তবে আমার সন্দেহ হয় যে, আমাকে তাঁরা এইভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছিলেন, আমি খ্রিস্টান বলে। তাঁরা যেভাবে বহুদেবতার পূজা ও মূর্তিপূজার ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে তা এক দেবতার পূজা বলে মনে হয় এবং খ্রিস্টিয় ধর্মের সঙ্গে তার যে পার্থক্য আছে তা বোঝা যায় না। অন্যান্য পণ্ডিতদের কাছে এই একই বিষয়ে যে রকম ব্যাখ্যা শুনেছি, তাতে অন্যরকম ধারণা হয় মনে, অর্থাৎ পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা করার পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য আছে দেখা যায়।

হিন্দুদের কালগণনা

দেবদেবী সম্বন্ধে আলোচনার পর আমি কালগণনা সম্বন্ধে আলোচনা আরম্ভ করলাম। পণ্ডিতেরা এই ব্যাপারে আমাকে সবচেয়ে বেশি তাক লাগিয়ে দিলেন। কালগণনার এমন এক বিচিত্র হিসেব দাখিল করলেন তাঁরা যা আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। হিন্দু পণ্ডিতেরা এমন কথা বলেন না যে সৃষ্টি অনাদি। সৃষ্টির আদি আছে একথা তাঁরা স্বীকার করেন। কিন্তু তার এমন একটা হিসেব দেন যা আমাদের কাছে অসীম অনন্তকালের মতো মনে হয়। তাঁরা বলেন, সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকে কালগণনা করা হয়, এবং তাকে চারটি যুগে ভাগ করে। যুগ বলতে আমরা যা বুঝি, তাঁরা তা বোঝেন না (বার্নিয়েরের ‘Dgugues’– যুগ)। যুগের হিসেব শতক বার সহস্রকের হিসেবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মোটামুটি এক কোটি বছর করে তাঁরা প্রত্যেকটি যুগের হিসেব করেন। সঠিক কত বছর তা বলতে পারব না। প্রথম যুগের নাম সত্যযুগ ((State-Dgugue)। সত্যযুগ প্রায় পঁচিশ লক্ষ বছর ছিল শোনা যায়। দ্বিতীয় যুগের নাম ত্রেতাযুগ (Trita-Dgugue)। ত্রেতাযুগের অস্তিত্ব ছিল বারো লক্ষ বছর। তৃতীয় যুগের নাম দ্বাপর যুগ (Duapar-Dgugue)। দ্বাপর যুগ প্রায় আট লক্ষ চৌষট্টি হাজার বছর ছিল। চতুর্থ যুগের নাম কলিযুগ (Kale-Dgugue)। কলিযুগ যে কত লক্ষ বছর ধরে চলবে তা বলা যায় না। পণ্ডিতেরা বলেন যে প্রথম তিনটি যুগ—সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর—শেষ হয়ে গেছে এবং চতুর্থ, অর্থাৎ কলিযুগেরও অনেকটা কেটে গেছে। কলিযুগের পরে আর কোনো যুগের অভ্যুদয় হবে না। এই চতুর্থ যুগই বর্তমান পৃথিবীর জীবনের শেষ পর্ব। কলিযুগেই সৃষ্টির ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। কলিযুগের শেষে পৃথিবী আবার তার প্রাথমিক স্তরে ফিরে যাবে, সৃষ্টির আদিকালের অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। যতবার পণ্ডিতদের (Pendets) জিজ্ঞাসা করেছি যে পৃথিবীর বয়স কত, ততবার তাঁরা নানাভাবে অঙ্ক কষে, হিসেব করে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ একজনের সঙ্গে অন্যজনের হিসেব কিছুতেই মেলে না। মেলে না যখন তখন তাঁরা যা বলেছেন তা থেকে এইটুকু শুধু বুঝেছি, যে, পৃথিবীটা এত প্রাচীন যে তার বয়সের কোনো হিসেব নেই। তাতেই আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। যখন তাঁদের জিজ্ঞাসা করেছি যে কোথা থেকে তাঁরা এইসব হিসেব পেলেন, তখন তাঁরা কেবল বেদের নাম করে চুপ করে থেকেছেন। ‘সব বেদে আছে’—এই তাঁদের বক্তব্য। স্বয়ং ব্রহ্মা তাঁদের জন্য বেদ রচনা করে তার মধ্যে এইসব সারগর্ভ কথা বলে গেছেন।

দেবদেবীর প্রস্তুতি সম্বন্ধে তাঁদের কাছে জানার যথেষ্ট চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। কেউ কেউ বলেন, দেবতা তিন রকমের আছেন—ভাল, মন্দ ও উদাসীন। কেউ বলেন, দেবতাদের উপাদান অগ্নি, কেউ বলেন আলোক। আবার কেউ বলেন, দেবতা হলেন ব্যাপক (বার্নিয়েরের ‘Biapek’– ব্যাপক)। ব্যাপক কথার অর্থ আমি সঠিক উলব্ধি করতে পারিনি। যা ‘ব্যাপক’, তা নাকি স্থান ও কালের ঊর্ধ্বে এবং তার ধ্বংস হয় না। আবার এমন অনেক পণ্ডিত আছেন যাঁরা বলেন যে, দেবতারা হলেন পরমেশ্বরের অংশ মাত্র। কেউ বলেন, দেবতারা হলেন একজাতীয় ‘দৈব’ জীব যাঁরা পৃথিবীতে বিচরণ করেন।

সুফিদের ধর্ম ও দর্শন

এইবার সুফিদের সম্বন্ধে কিছু বলে আমার বক্তব্য শেষ করব। হিন্দুস্থানে সম্প্রতি এই সুফিদের মতবাদ ও দর্শন নিয়ে খুব একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে বলেন যে, হিন্দু পণ্ডিতেরা নাকি সম্রাট সাজাহানের পুত্র দারাশিকো ও সুলতান সুজার উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। প্রাচীনকালের দার্শনিকেরা, আপনি জানেন, সৃষ্টির মধ্যে এক সনাতন প্রাণশক্তির সন্ধান করতেন এবং মনে করতেন যে জীব মাত্রই সেই অনাদি অনন্ত প্রাণশক্তি কণা—বিশেষ ছাড়া কিছুই নয়। দার্শনিক প্লেটো ও আরিস্ততেল থেকে সকলেই প্রায় নানাভাবে এই অভিমত প্রকাশ করে গেছেন। হিন্দু পণ্ডিতেরাও প্রায় এই একই কথা বলেন এবং একই ধরনের মত পোষণ করেন। এই মতবাদই হল সুফিদের মতবাদ এবং পারস্যের পণ্ডিত ও দার্শনিকেরাও নাকি এই মতবাদ সমর্থন করেন। পারস্যের কাব্যে—গুলশান রাজে ১৮ এই মতবাদই চমৎকার ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে।

হিন্দুস্থানের হিন্দুদের এই সব বিচিত্র আচার—অনুষ্ঠান, ধ্যানধারণা, ধর্মকর্ম, দেবদেবী, দর্শন—বিজ্ঞান ইত্যাদি দেখে—শুনে এবং এত কষ্ট স্বীকার করে আমার মনে হয়েছে যে, পৃথিবীতে এমন কোনো আজগুবি বা অবিশ্বাস্য মতবাদ নেই যা মানুষের কাছে বিশ্বাসের যোগ্য নয়।*

……………….

* জঁ শ্যপলেঁ (১৫৯৯—১৬৭৪) Jean chapelain ফরাসি কবিও সমালোচক। আকদেমি ফ্রান্সেজ—এর অন্যতম সংগঠক। তাঁর বিখ্যাত কাব্য ‘লা পুসেল’ জোয়ান অব আর্ককে (১৪১২—১৪৩১) অবলম্বন করে লেখা।

* বলা বাহুল্য, বার্নিয়েরের মতো বিদেশি পর্যটকদের পক্ষে হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যা এর চেয়ে সঠিকভাবে করা সম্ভব নয়। হিন্দুধর্ম, দেবতা, ব্রাহ্মণ ইত্যাদি সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য ভুল হলেও, প্রণিধানযোগ্য—অনুবাদক।

১। বিখ্যাত বিদেশি পর্যটক জন শাঁর্দা (John Chardin) ১৬৪৩ সালে প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৭১৩ সালে লন্ডনে মারা যান। ১৬৬৫ সালে প্রথমে তিনি বিদেশ যাত্রা করেন—পারস্যে ও ভারতবর্ষে। তিনি ছিলেন জুয়েলার বা জহরত ব্যবসায়ী। ১৬৭০ সালে তিনি প্যারিস ফিরে যান এবং পুনরায় ১৬৭১ সালে তিনি পারস্যে ও হিন্দুস্থানে আসেন। ১৬৭৭ সালে উত্তমাশা অন্তরীপের পথে তিনি ইয়োরোপে ফিরে যান। ১৬৬৭ এবং ১৬৭৫ সালে শাঁর্দা সুরাটে ছিলেন। ১৬৬৭ সালে বার্নিয়েরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সতীদাহের দৃশ্য বার্নিয়েরের সঙ্গে শাঁর্দা এই সময় একসঙ্গে দেখেছিলেন।

১। পর্তুগিজ শব্দ ‘পাদরি’ প্রথমে রোমান পুরোহিতদের সম্বন্ধে প্রয়োগ করা হত। পরে হিন্দুস্থানের খ্রিস্টান পুরোহিতদের সকলকে ‘পাদরি’ বলে অভিহিত করা হয়।

২। দারাশিকো যখন বারাণসীতে ছিলেন তখন সেখানকার বিখ্যাত সব হিন্দু পণ্ডিতদের সাহায্যে তিনি সংস্কৃত ‘উপনিষদ’ পারসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। সেই পারসি অনুবাদ থেকে পরে আবার লাতিন ভাষায় উপনিষদ অনুবাদ করা হয়।

৩। উইলিয়াম হার্ভে (১৫৭৮—১৬৫৭) ১৬১৬ সালে লন্ডনের চিকিৎসকমণ্ডলীর কাছে তাঁর রক্তচলাচলের (Blood circulation) যুগান্তকারী তত্ত্বকথা প্রচার করেন। জাঁ পেকেতও হার্ভের সমসাময়িক একজন বিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী ছিলেন। এই সময় ফ্রান্সের বিখ্যাত বস্তুবাদী দার্শনিক দেকর্তের আবির্ভাব হয়।

৪। বার্নিয়েরের বেদের ক্রমভাগ ভুল। ‘ঋকবেদ’ সবচেয়ে প্রাচীন, তারপর যজুর্বেদ, সামবেদ এবং সর্বশেষে অথর্ববেদ রচিত হয়েছে বলে এখন পণ্ডিতেরা মনে করেন।

* বার্নিয়ের ‘tribus’ বা ‘tribe’ কথা ব্যবহার করেছেন ‘জাতি’—অর্থে, ‘caste’ কথা ব্যবহার করেননি। পর্তুগিজ ‘casta’ থেকে ‘caste’ কথা এসেছে এবং জাতিধর্মে ব্যবহৃত হয়েছে।—অনুবাদক

৫। বার্নিয়ের এই জাতি পরিচয় তাঁর অসাধারণ বোধশক্তির আর—একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পণ্ডিতের সংস্কৃত ব্যাখ্যার পার্সি অনুবাদ থেকে মুখে শুনে, ভারতীয় সমাজের পরিচয় এইভাবে লিপিবদ্ধ করে যাওয়া যে কত কঠিন, তা আজ আমরা ঠিক বুঝতে পারব না। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র ইত্যাদি কথা যেভাবে বার্নিয়ের ভাষান্তরিত করছেন তা যথাক্রমে এই : —Brahmens, Quetterys, Bescue, Seydra.

৬। গোহত্যা, গোমাংসভক্ষণ বা শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ সম্বন্ধে বার্নিয়েরের এই চমৎকার ব্যাখ্যা তাঁর অনুসন্ধানী মনের পরিচায়ক। সাধারণ বিদেশিদের মতো তাঁর রচনার মধ্যে কোনো তাচ্ছিল্যের ভাব কোথাও প্রকাশ পায়নি। আন্তরিক নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি হিন্দু ও মুসলমানদের প্রতিটি আচার ব্যবহার বুঝতে চেষ্টা করেছেন।

৭। মুইর তাঁর ‘Original Sanskrit Texts’–এর মধ্যে এ—সম্বন্ধে যা উদ্ধৃত করেছেন তা এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য মনে হয় :

 ‘I shall declare to thee that form composed of Hari and Hara (Vishnu and Mahadeva) combined, which is without beginning, middle or end, imperishable, undecaving. He who is Vishnu is Rudra; He who is Rudra is Pritamahya (Brahma); the substance is one, the gods are three : Rudra, Vishnu and Pitamaha’– Muir’s Original Sanskrit Texts, Vol. IV, p.237

৮। বার্নিয়েরের ‘অবতার’ সম্বন্ধে আলোচনা পড়ে পাঠকরা হয়ত কৌতূকবোধ করবেন। কিন্তু একজন বিদেশি বিভাষি পর্যটকের পক্ষে এত গভীরভাবে হিন্দুধর্মের মর্মকথা উপলব্ধি করার চেষ্টার মধ্যে যে আন্তরিকতার পরিচয় আছে, তা সত্যই অতুলনীয়। অনেক বিষয়ে বার্নিয়েরের অস্পষ্ট ধারণা হলেও, তিনি যে হাস্যকর বিপরীত ধারণা করেছিলেন, তা নয়। তাঁর ধারণার অনেকটাই সত্য। ঠিক যে তিনি বুঝতে পারছেন না, এ—সম্বন্ধে সচেতন হয়েই তিনি লিখেছেন। ‘অবতার’ রূপ সম্বন্ধে বার্নিয়ের যা বলতে চেয়েছেন, তার চমৎকার ব্যাখ্যা ‘গীতা’য় করা হয়েছে। যেমন —

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যাহম্।।

পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।

ধর্ম—সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।

৯। গিরিরাজ হিমালয়দুহিতা উমার সঙ্গে মহাদেবের শুভমিলনের উপভোগ্য বর্ণনা করেছেন বার্নিয়ের।

১০। বার্নিয়ের অনেক চেষ্টা করে বিষ্ণুর দশাবতার রূপ সম্বন্ধে যা নিজে বুঝেছেন, তাই বর্ণনা করেছেন এখানে। বর্ণনাটি উপভোগ্য হলেও, যথার্থ নয়। কিন্তু তাহলেও তিনি যে অনেকটা নির্ভুল বর্ণনা দিয়েছেন তাই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট। বিষ্ণুর ‘দশাবতার’ রূপের এই সংস্কৃত শ্লোকটির সঙ্গে অনেকেই পরিচিত :

মৎস্যঃ কূর্মো বরাহশ্চ নরসিংহোহ্থ বামনঃ।

রামো রামশ্ব বুদ্ধঃ কল্কীতি তে দশ।

—অর্থাৎ মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নরসিংহ, বামন, রাম (পরশুরাম), রাম (দাশরথি রাম), রাম (বলরাম), বুদ্ধ ও কল্কি—এই হল বিষ্ণুর দশাবতার।

১১। ফাদার কার্কারের China Illustrate-গ্রন্থ আমস্টার্ডামে ১৬৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থের মধ্যে সংস্কৃত অক্ষরের পুরো পাঁচ পৃষ্ঠা তাম্রখোদাই প্রতিলিপি ছাপা হয়। ইউরোপে সংস্কৃত অক্ষর প্রথম মুদ্রিত হরফে এই গ্রন্থেই ছাপা হয়। তার আগে আর—কোনো গ্রন্থে মুদ্রিত হরফে সংস্কৃত ভাষা রূপায়িত হয়নি। হবার কথাও নয়, কারণ ১৬৬৭ সালে মুদ্রণের সামান্য প্রচলন হয়েছিল মাত্র। আমাদের দেশে তখনও মুদ্রণ ও মুদ্রিত হরফে বই ছাপা অরম্ভ হয়নি। সুতরাং China Illustrate-গ্রন্থের এই পাঁচ পৃষ্ঠা সংস্কৃত মুদ্রিত হরফের তাম্রখোদাই প্রতিলিপি হল, সারা পৃথিবীর মধ্যে প্রথম প্রকাশিত সংস্কৃত মুদ্রিত হরফের নমুনা। পাদরি কার্কার উর্ব্জবুগ ‘Wurtzburg’ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যভাষার (Oriental Language) অধ্যাপক পদে নিযুক্ত ছিলেন। বিদেশি সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের মধ্যে ফাদার কার্কার আদিযুগের একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত।

* প্রকৃতনাম Athanasius kircher (1602-1680) জার্মান জেসুইট পন্ডিত China illustrata ১৬৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। ১৬৫৮ সালে রোগ প্রতিরোধের জন্য ‘মাস্ক’ পরার প্রয়োজনীয়তার কথা প্রথম বলেন।

১২। সুরাটের চ্যাপলেন ছিলেন হেনরি লোর্ড (Henni Loard)। তিনি এ—সব বিষয়ে কয়েকখানি বইও লিখেছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল , (ক) A Display of two Forraigne Sects in the East Indies; (খ) A Discoveries of the Sect of the Banians; (গ) The Religion of the Persees; (Inprinted at London for Francis Constable, and are to be sold at his Shoppe in Paul’s Churchyard, at the signe of the Crane, 1630) আব্রাহাম রোজার (Abraham Rozer) পুলিকাটের প্রথম ডাচ চ্যাপলেন ছিলেন (১৬৩১—১৬৪১ খ্রিঃ অঃ)। ভারতের আদি ডাচ উপনিবেশের গির্জার প্রথম চ্যাপলেন রোজারও ধর্মবিষয়ে বই লিখেছিলেন। ১৬৪৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বই প্রকাশিত হয়।

* পুরাণের সঙ্গে বেদের এই সম্পর্কের ব্যাখ্যা ঠিক নয়।—অনুবাদক।

১৩। বার্নিয়ের এখানে হিন্দুদের ‘ষড়দর্শনের কথা বলেছেন। এই ষড়দর্শন হল : সাংখ্য ও যোগদর্শন, বৈদেশিক ও ন্যায়দর্শন, এবং বেদান্ত ও মীমাংসাদর্শন। কপিল সাংখ্যের, পতঞ্জলি যোগদর্শনের, কণাদ বৈশেষিকের, গৌতম ন্যায়দর্শনের এবং বাদরায়ণ বেদান্ত বা উত্তর—মীমাংসার, জৈমিনি মীমাংসা বা পূর্ব—মীমাংসার প্রতিষ্ঠাতা বলে কথিত।

১৪। ভারতের বৌদ্ধদের সম্বন্ধে বার্নিয়েরের এই মন্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতীয় সমাজে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা কি অবস্থায় পৌঁছেছিলেন, বার্নিয়েরের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

১৫। বার্নিয়ের এখানে পূর্বোক্ত ষড়দর্শনের ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছেন সংক্ষেপে। কিন্তু সাংখ্য, যোগ, বৈদেশিক, ন্যায়, বেদান্ত ও মীমাংসাদর্শন যে এত সহজে ও সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা যায় না, তা বলাই বাহুল্য। তবু সপ্তদশ শতাব্দীতে একজন বিদেশি পর্যটকের পক্ষে হিন্দুদর্শনের নানাদিক সম্বন্ধে এতখানি কৌতূহলী হয়ে তার মূল তত্ত্বকথা জানার চেষ্টা কম প্রশংসনীয় নয়। এর মধ্যে বার্নিয়েরের অদম্য ও জাগ্রত অনুসন্ধানী মনের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা শ্রদ্ধার যোগ্য। ষড়দর্শনের ব্যাখ্যা তাঁর অনেকটাই হাস্যকর বলে গণ্য হলেও তিনি তাঁর নিজস্ব বুদ্ধি ও দৃষ্টি দিয়ে তার প্রত্যেকটি প্রতিপাদ্য বুঝতে চেষ্টা করেছেন।

১৬। এইসময় গোয়ার চিকিৎসকরা বিশেষ মর্যাদা পেতেন এবং তার জন্য মাথায় ছাতি ধরে তাঁরা চলতে পারতেন। মাথায় ছাতি দিয়ে চলার অধিকার এককালে সকলের ছিল না। বিশেষ সম্মানিত ব্যক্তিরা সেই অধিকার অর্জন করতেন। গোয়ার ডাক্তারদের সম্বন্ধে জনৈক পর্যটক বলেছেন : ‘There are in Goa many Heathen physitions which observe their gravities with hats carried over them for the sunne, like the Protingales, whjich no other heathens doe, but (only) Ambassadors, or some rich Marchants.’ (Voyaga to the East Indies– Hakluyt Soc,ad,, 1885, Vol 1, P.230.

১৭। ১৬৬৫ সালে আগ্রা থেকে বাংলাদেশে ভ্রমণের সময় বিখ্যাত পর্যটক তাভার্নিয়েরের সঙ্গী ছিলেন ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের। ওই বছরের ১১ থেকে ১৩ ডিসেম্বর তাভার্নিয়ের বারাণসীতে ছিলেন এবং তিনি তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে (Travels, Vol II, pp. 234-235) লিখে গেছেন : প্রকাণ্ড একটি মন্দিরের কাছে একটি বিরাট গৃহ আছে কাশীতে। এই গৃহটিতেই রাজা জয়সিংহের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত। এই বিদ্যালয়ে সদ্বংশের সন্তানদের শিক্ষা দেওয়া হয়। রাজকুমারদেরও আমি এই বিদ্যালয়ে পড়তে দেখেছি। তাঁরা ব্রাহ্মণপণ্ডিতদের কাছে লেখাপড়া শেখেন এবং পুরোহিতদের ভাষা বা দেবভাষা সংস্কৃতও অধ্যয়ন করেন।’

১৮। ‘গুলশান রাজ’ কাব্য (Mystic Rose Garden) ১৩১৭ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়, সুফিদের সম্বন্ধে পনেরটি প্রশ্নের উত্তর হিসাবে।

* এরপর বার্নিয়ের ঔরঙ্গজীবের কাশ্মীর অভিযানের কথা বলেছেন। তার অনুবাদ করার কোনো প্রয়োজন এখন আছে বলে আমার মনে হয় না। তারপর কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরপ্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশের সৌন্দর্য ও সম্পদ সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *