১. রাজপুত্রকন্যাদের কথা

রাজপুত্রকন্যাদের কথা

পৃথিবী ভ্রমণের দুর্নিবার বাসনা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি দেশ ছেড়ে। ফিলিস্তিন ও মিশর ঘুরে ইচ্ছা হল লোহিতসাগরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত কি আছে দেখতে হবে। তাই প্রায় একবছর কায়রোয় থাকার পর আবার বেরিয়ে পড়লাম এবং বত্রিশ ঘণ্টা পথ চলার পর সুয়েজে পৌঁছলাম। সুয়েজ থেকে নৌকা করে সাগরতীরের কোল ঘেঁষে—ঘেঁষে এলাম জিদ্দা বন্দরে। মক্কা থেকে বেশি দূর নয়, মাত্র আধবেলার পথ। ‘বে’ আমাকে ভরসা দিয়েছিলেন এবং আমি ভেবেছিলাম যে নিশ্চিন্তে এখানে চলাফেরা করতে পারব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মহম্মদের এই পূণ্যতীর্থে পা বাড়াতে আমার ভয় হল। শুনলাম, খ্রিস্টানদের সেখানে যাবার অধিকার নেই। অবশ্য এ অধিকার শুধু স্বাধীন খ্রিস্টানদের নেই, ক্রীতদাসদের আছে। সুতরাং প্রায় পাঁচ সপ্তাহ আটকে থেকে আবার সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। দেশভ্রমণের নেশা পেয়ে বসেছে আমাকে, মুসাফির আমি, আমার বিশ্রাম নেই। ছোটো একখানি বজরায় উঠে যাত্রা করলাম, এবারে বাসনা হল হাবসিদের রাজ্য দেখার। কিন্তু শুনলাম, সেখানেও কোনো ক্যাথলিক খ্রিস্টানের যাওয়া নিরাপদ নয়। কয়েকজন পর্তুগীজ পর্যটককে তারা নাকি একেবারে কেটে ফেলেছে। গ্রিক বা আর্মেনিয়ানের ছদ্মবেশে অবশ্য যাওয়া যেত, কিন্তু তাও ভরসা হল না। ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম হিন্দুস্থানেই যাব। একখানি ভারতীয় বজরায় উঠে পড়লাম এবং বাইশদিন পর সুরাটে পৌঁছলাম। মোগল বাদশাহ তখন হিন্দুস্থানের সম্রাট!

হিন্দুস্থানে এসে দেখলাম, ভারতসম্রাট সাজাহান তখন রাজত্ব করছেন। সাজাহান হলেন জাহাঙ্গীরের পুত্র এবং আকবর বাদশাহের পৌত্র। তিনি হুমায়ুনের প্রপৌত্র এবং তৈমুরের বংশধর, সেই বিখ্যাত আমির তৈমুর, যাঁকে আমরা ‘তৈমুর লং’ বা খোঁড়া তৈমুর বলে জানি। তৈমুর ও চেঙ্গিস খাঁর সংমিশ্রিত বংশধরদেরই ‘মোগল’ বলা হয়। এই মোগলরাই এখন হিন্দুদের হিন্দুস্থানে রাজত্ব করেন। কিন্তু মোগলবংশীয়রাই যে সমস্ত রাজকীয় সম্মান ও রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদার একচেটে অধিকারী, তা নয়। রাষ্ট্রিক বা সামরিক কোনো বিভাগেই মোগলদের একচেটিয়া আধিপত্য নেই। অন্যান্য জাতির লোকেরাও অনেকে এইসব পদে বহাল আছেন, যেমন পারসি আরবি ও তুরকিরা। ‘মোগল’ বলতে কেবল তৈমুরবংশীয়দেরই বোঝায় না। যে—কোনো ইসলামধর্মী বিদেশি শ্বেতাঙ্গকে ‘মোগল’ বলা হয়ে থাকে। কেবল ইয়োরোপীয় খ্রিস্টানদের বলা হয় ‘ফিরিঙ্গি’ (Franguis) এবং হিন্দুদের বলা হয় ‘জেন্টিল’ (Gentil)। হিন্দুদের গায়ের রং একটু কালো।

হিন্দুস্থানে পৌঁছে শুনলাম, সম্রাট সাজাহান রীতিমতো বৃদ্ধ হয়েছেন, তাঁর বয়স তখন প্রায় সত্তর বছর এবং তিনি চার পুত্র ও দুই কন্যার পিতা। তিনি তাঁর পুত্রদের বিভিন্ন প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছেন এবং নিজে প্রায় বৎসরাধিক কাল কঠিন পীড়ায় ভুগছেন। তাঁর মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে বলে সকলে মনে করেন। পিতার আসন্ন মৃত্যুর কথা চিন্তা করে পুত্রদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। দুঃখে নয়, সিংহাসনলোভে। দিল্লির রাজসিংহাসনে কে বসবেন, বিশাল মোগল—সাম্রাজ্যের অধীশ্বরকে হবেন, তাই নিয়ে লোভ, হিংসা ও বিদ্বেষের আগুন জ্বলে উঠেছে গৃহযুদ্ধের মধ্যে। শুনলাম, প্রায় পাঁচবছর ধরে নাকি গৃহযুদ্ধ চলছে, সিংহাসনলোভে ভাইয়ে—ভাইয়ে যুদ্ধ।

এই গৃহযুদ্ধের কিছু—কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালাভের আমার সুযোগ হয়েছিল। এখানে তা বর্ণনা করবার ইচ্ছা আছে। প্রায় আটবছর আমি মোগল দরবারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলাম। চাকরি নিতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম, কারণ আমার আর্থিক অবস্থা তখন শোচনীয়। রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় চোরডাকাতের উপদ্রবে আমার যা সম্বল ছিল সব প্রায় তখন শেষ হয়ে গেছে। তা ছাড়া সুরাট থেকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম নগরী আগ্রা ও দিল্লিতে পৌঁছতে আমার প্রায় সাত সপ্তাহকাল সময় লেগেছে এবং তাতে আমার বাকি যেটুকু সম্বল ছিল, চুরিচামারি লুটপাটের পর, তাও নিঃশেষ হয়ে গেছে। দিল্লিশ্বরের কাছে দিল্লিতে যখন পৌঁছলাম তখন আমি প্রায় পথের ফকির। বাধ্য হয়ে চাকরি নিতে হল, রাজপরিবারের চিকিৎসকের চাকরি, বাঁধা মাইনেতে। পরে আর একজন বিখ্যাত ওমরাহ ও বিশেষ ব্যক্তির অধীনে চাকরি করেছি।

মোগল বাদশাহ সাজাহানের জ্যেষ্ঠপুত্রের নাম দারা বা ‘ডেরিয়াস’; দ্বিতীয় পুত্রের নাম সুলতান সুজা বা ‘বীর রাজকুমার’; তৃতীয় পুত্র ঔরঙ্গজীব বা ‘সিংহাসনের শোভা’; কনিষ্ঠ পুত্র মুরাদ বা ‘সার্থক কামনা’। কন্যা বেগম সাহেবা হলেন জ্যেষ্ঠা রাজকুমারী আর কনিষ্ঠা রৌশনআরা বেগম বা আলোককুমারী। এই ধরনের নামকরণ করা হল এদেশের রাজবংশের ধারা। যেমন সাজাহানের স্ত্রীর নাম ‘তাজমহল’ (মমতাজ), অর্থাৎ বিবিমহলের তাজস্বরূপ শ্রেষ্ঠা মহিষী। মমতাজের রূপ ছিল অতুলনীয় এবং তাজমহল নামে তাঁর যে স্মৃতিসৌধ আছে তা সারা দুনিয়ার এক বিস্ময়কর কীর্তি। মিশরের পিরামিড আমি দেখেছি কিন্তু আমার মনে হয় হিন্দুস্থানের তাজমহলের তুলনায় মিশরের পিরামিড পাথরের অবিন্যস্ত স্তূপ ছাড়া কিছু নয়। যা বলছিলাম। রাজবংশের কুমার—কুমারী বা অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের এরকম নামকরণের কারণ কি? ইউরোপের মতন তাঁদের ‘অমুক স্থানের লর্ড’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় না কেন? আমার মনে হয়, তার প্রধান কারণ হল, ইউরোপের লর্ডরা যেমন ভূমির স্বত্বাধিকারি হতে পারেন হিন্দুস্থানের রাজকুমার বা ওমরাহরা তা হতে পারেন না। সম্রাটই হলেন হিন্দুস্থানের সমস্ত ভূমি বা ভূসম্পত্তির মালিক, সুতরাং আর্লমাকুই ডিউক লর্ড এই জাতীয় উপাধি হিন্দুস্থানে দেখা যায় না। সম্রাট নিজে ভূমির একমাত্র স্বত্বাধিকারি বলে, তিনি তাঁর অধিকার বা স্বত্ব অন্যদের দান করেন, উপহার দেন, অথবা ভাতা বা বেতন হিসাবে দেন।

দারাশিকোর চরিত্র

জ্যেষ্ঠ পুত্র দারার যথেষ্ট সদগুণ ছিল। কথাবার্তায়, আলাপ—আলোচনায় আচার—ব্যবহারে তাঁর মতন ভদ্র ও শিষ্ট আর কোনো রাজকুমার ছিলেন কি না সন্দেহ। কিন্তু নিজের সম্বন্ধে তাঁর অত্যন্ত বেশি উচ্চধারণা ছিল। তিনি ভাবতেন, তাঁর মতন বুদ্ধিমান ব্যক্তি আশেপাশে আর কেউ নেই এবং কোনো ব্যাপারে কারও সঙ্গে যে সলাপরামর্শ করা যেতে পারে, তা তিনি মনে করতেন না। এই হামবড়াই ভাবের জন্য তাঁকে কোনো উপদেশ বা পরামর্শ দিতে কেউ সাহস করতেন না। এইভাবে তিনি তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধুদের কাছে পর্যন্ত অপ্রীতিভাজন হয়ে উঠেছিলেন। সিংহাসনলোভে তাঁর ভাইদের গোপন চক্রান্তের কথা তাঁর বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অনেকে জানলেও তাঁর এই উদ্ধত স্বভাবের জন্য কেউ তাঁকে কিছু জানাতে সাহস করেনি। আত্মম্ভরিতাই শুধু তাঁর চরিত্রের প্রধান দোষ নয়, তিনি অত্যন্ত বদমেজাজী। হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি যাকে যা খুশি বলতে এতটুকু ইতস্তত করেন না, হোমরাচোমরা ওমরাহদেরও না। কথায় কথায় তিনি সকলকে অপমান করেন, গালাগাল করেন, যদিও ক্রোধ তাঁর স্ফুলিঙ্গের মতন দপ করে জলে উঠে খপ করে নিবেও যায়। মুসলমান হিসেবে তিনি নিজ ধর্মের ক্রিয়াকর্ম সবই করতেন, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর কোনো ধর্ম গোঁড়ামি ছিল না। তিনি হিন্দুদের সঙ্গে হিন্দুর মতন মিশতেন, খ্রিস্টানদের সঙ্গে খ্রিস্টানের মতন। তাঁর আশেপাশে সবসময় হিন্দু পণ্ডিত শাস্ত্রকাররা থাকতেন (Gentile Doctors or Pendets) এবং তাঁদের বৃত্তিদানেও তিনি কার্পণ্য করতেন না। এই কারণে অনেকে তাঁকে কাফের মনে করত। কিন্তু সে—কথা পরে বলব, হিন্দুস্থানের ধর্মানুষ্ঠান নিয়ে যখন আলোচনা করব তখন। ‘জেসুইট ফাদারদের’ সঙ্গে তাঁর বিশেষ খাতির ছিল। শোনা যায়, রেভারেণ্ড ফাদার বুজির ওপর তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল এবং তাঁর মতামত তিনি নাকি শ্রদ্ধাভরে শুনতেন। একদল লোক বলতেন যে দারা কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করেন না, সব ধর্মের প্রতিই তিনি কেবল কৌতূহলবশে আগ্রহ দেখান এবং মজা করার জন্য সকলের সঙ্গে মেশেন। কেউ কেউ বলেন যে সবটাই হল তাঁর রাজনৈতিক মতলববাজি, কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তিনি সুবিধামতো হিন্দুপ্রীতি ও খ্রিস্টানপ্রীতি দেখান। গোলন্দাজবাহিনীতে খ্রিস্টানদের সংখ্যা তখন বেশি ছিল বলে তখন তিনি তাঁদের সঙ্গে সৌহার্দ্য বজায় রাখতেন, কারণ তাতে সামরিক ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকা যেত। হিন্দুপ্রীতি দেখাতেন দেশীয় নৃপতিদের ক্ষেত্রে, যাঁরা অধিকাংশই হিন্দু এবং রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রে বা বিদ্রোহে যাঁদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য অবশ্য প্রয়োজন। কিন্তু তাহলেও দারার এই ধর্ম উদারতার কৌশল খুব বেশি কাজে লাগেনি এবং তাতে তাঁর কোনো উদ্দেশ্যই চরিতার্থ হয়নি। পরন্তু তাঁর ছোটোভাই ঔরঙ্গজীব তাঁর এই ভণ্ডামির সুযোগ নিয়ে তাঁকে ‘কাফের’ ও ধর্মদ্রোহী পাষণ্ড প্রতিপন্ন করে, তাঁর শিরচ্ছেদ করতে পেরেছেন স্বচ্ছন্দে। সে—কাহিনি পরে বলব।

সুলতান সুজার চরিত্র

সুলতান সুজার চরিত্রের সঙ্গে দারার অনেক দিক থেকে সাদৃশ্য থাকলেও, তিনি আরও বেশি হিসেবী, বুদ্ধিমান, দূরদর্শী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং ব্যক্তিগত ব্যবহারেও অনেক বেশি মার্জিত ছিলেন। ষড়যন্ত্র করতে সুজার মতন ওস্তাদ আর কেউ ছিলেন না। নানারকম উপহার, পুরস্কার ইত্যাদি দিয়ে তিনি গোপনে ওমরাহদের হাত করতেন এবং যে—কোনো ষড়যন্ত্রে তাঁদের খেলার পুতুল করে তুলতেন। এইভাবে তিনি যশোবন্ত সিংহের (Jessomseingue) মতন বড়ো বড়ো হিন্দু রাজাদের পর্যন্ত নিজের দলে এনেছিলেন। কিন্তু তাঁরও চরিত্রের একটি মারাত্মক দোষ ছিল। ইন্দ্রিয়াসক্তি তাঁর এত প্রবল ছিল যে তিনি তার ক্রীতদাস ছিলেন বললেও ভুল হয় না। স্ত্রীলোক পরিবেষ্টিত হয়ে থাকলে তাঁর কোনো চেতনাই থাকত না। সারারাত, সারাদিন তিনি নাচগান—পান—হল্লার মধ্যে বিভোর হয়ে কাটিয়ে দিতে পারতেন, অন্য কোনো বিষয়ে কোনো কাণ্ডজ্ঞানই থাকত না। তাঁর মোসাহেবদের তিনি দামি—দামি খিলাৎ দিতেন এবং তাঁদের তনখা খুশি মতন, নিজের মর্জি মতন, বাড়াতেন কমাতেন। সুতরাং কোনো ওমরাহের পক্ষেই তাঁর জীবনের দৈনন্দিন ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার উপায় ছিল না। অন্তত স্বার্থের খাতিরেও তাঁদের সুলতান সুজার সঙ্গে প্রমোদ—সমুদ্রে গা ভাসিয়ে দিতে হত। তার ফলে তাঁর রাজ্যের অবস্থাও তেমনি শোচনীয় হল। প্রজাদের দুঃখদুর্দশা ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগল এবং অভিযোগ জানাবার, বা আবেদন—নিবেদন করবার কোনো উপায় রইল না। কার কাছে কি জানাবে তারা? সুজা ও তাঁর ওমরাহরা দিনরাত মদ ও স্ত্রীলোক নিয়ে মশগুল থাকতেন।

সুলতান সুজা পারসিদের ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন, তুরকিদের নন। ইসলামধর্ম বহুসম্প্রদায়ে বিভক্ত, গুলিস্তানের কবি শেখ সাদির মতে বাহাত্তর সম্প্রদায়ে। তার মধ্যে দুটি সম্প্রদায়ই প্রধান—তুরকিপন্থী ও পারসিপন্থী। তুরকিরা মনে করেন, তাঁরাই মহম্মদের প্রকৃত বংশধর এবং পারসিরা বিধর্মী কাফের। আবার পারসিরা মনে করেন, তাঁদের আচরিত ধর্মই আসল ইসলামধর্ম, তুরকিদের ধর্ম নয়। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষভাব ও শত্রুতা অত্যন্ত তীব্র। সুলতান সুজার তুরকিপন্থী বা ‘সিয়া’ সম্প্রদায়ভুক্ত হবার কারণ হল রাজনৈতিক। যেহেতু মোগলসাম্রাজ্যের অধিকাংশ আমির—ওমরাহ ‘সিয়া’ সম্প্রদায়ের মুসলমান এবং মোগল দরবারে তাঁদের প্রভাব—প্রতিপত্তিও বেশি, সেইজন্য সুজাও সিয়াপন্থী, কারণ তাতে ওমরাহদের দিয়ে তাঁর কার্যোদ্ধারের সম্ভাবনা অনেক বেশি।

ঔরঙ্গজীবের চরিত্র

ঔরঙ্গজীব ভিন্ন প্রকৃতি। জ্যেষ্ঠ দারাশিকোর মতন তাঁর বাইরের চরিত্রে কোনো মাজাঘষা চাকচিক্য ছিল না, কিন্তু তার বিচারবুদ্ধি ছিল অসাধারণ। বন্ধুবান্ধব আমলা—অমাত্য নির্বাচনে তিনি অত্যন্ত হুঁশিয়ার ছিলেন এবং এমন কাউকে কোনোদিন আমল দিতেন না, যার দ্বারা তাঁর নিজের কার্যসিদ্ধি হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। সেইভাবেই তিনি পদমর্যাদা পুরস্কারাদি বিতরণ করতেন। কতবার যে তিনি রাজদরবারে এবং ভাইদের কাছে ধনদৌলত, রাজৈশ্বর্যাদির প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত বীতরাগ ও বৈরাগ্যের ভান করেছেন এবং গোপনে সিংহাসন অধিকারের ষড়যন্ত্র করেছেন, তার ঠিক নেই। ছলাকলা ও কুটবুদ্ধিতে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ ছিলেন না। যখন তিনি দক্ষিণাপথের সুবাদার হলেন, তখনও তিন সকলের কাছে বলতেন যে, প্রাদেশিক সুবাদারিতে তিনি খুশি নন, তাঁর দিল চায় ফকির হতে, দরবেশ হতে। সুবাদারির ঝকমারি তাঁর পোষায় না, তাঁর বিরাগী মেজাজের সঙ্গে খাপ খায় না। দানধ্যান, দায়দাক্ষিণ্য করে, খোদাতাল্লার কাছে প্রার্থনা করে, তিনি তাঁর জীবনের দিনগুলো শান্তিতে কাটাতে চান। অথচ তাঁর জীবন ঠিক এর উলটো পথ ও নীতি ধরে চলেছে আগাগোড়া। একটার পর একটা চক্রান্ত না করে তিনি যেন স্বস্তিতে থাকতে পারতেন না। কিন্তু তাঁর সেই চক্রান্তের ওপরে এমন একটা বৈরাগ্যের মুখোস লাগানো থাকত যে একমাত্র দারা ছাড়া বোধহয় আর কেউ তাঁর ভয়ংকর দুরভিসন্ধির কথা জানতেন না। বাইরের বেশটা ফকির দরবেশের আলখাল্লা, ভিতরের মনটা কুচক্রী মতলববাজের। এই হলেন ঔরঙ্গজীব, সম্রাট সাজাহানের তৃতীয় পুত্র। ঔরঙ্গজীবের প্রকৃতি সম্বন্ধে সাজাহানেরও উচ্চধারণা ছিল না। দারা সেইজন্য তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধুদের কাছে প্রায় বলতেন যে তাঁর সব ভাইদের মধ্যে ওই ‘নামাজী’ (যিনি অত্যধিক নামাজ পড়েন) ভাইটিকে নিয়েই তাঁর দুশ্চিন্তা সবচেয়ে বেশি।*

মুরাদের চরিত্র

অন্যান্য ভাইদের তুলনায় কনিষ্ঠ মুরাদ ছিলেন সবচেয়ে বুদ্ধিহীন। তাঁর একমাত্র চিন্তা ছিল আমোদপ্রমোদ বিলাসব্যসন। তাতেই তিনি চব্বিশঘণ্টা মশগুল হয়ে থাকতেন। এমনিতে অবশ্য তিনি উদার প্রকৃতির ও ভদ্র ছিলেন। তিনি প্রায় গর্ব করে বলতেন যে, কোনো রাজনৈতিক চক্রান্তের তিনি ধার ধারেন না এবং গোপন চক্রান্ত তিনি ঘৃণা করেন, কারণ ওটা কাপুরুষের ধর্ম, বীরের ধর্ম নয়। তাঁর ধর্ম বীরের ধর্ম, তাঁর নীতি বীরের নীতি, তলোয়ার ও বলপরীক্ষার প্রকাশ্য নীতি। মুরাদ অবশ্য সাহসী ছিলেন খুব। কিন্তু সাহস তাঁর যথেষ্ট থাকলেও বুদ্ধি বিশেষ ছিল না। মুরাদের যতটা সাহস ছিল, তার এতটুকু যদি বুদ্ধি থাকত, তাহলে বলা যায় না, হয়ত তিনিই বাকি তিন ভাইকে সরিয়ে দিয়ে স্বচ্ছন্দে হিন্দুস্থানের সম্রাট হয়ে বসতে পারতেন।

বেগমসাহেবার প্রকৃতি

সাজাহানের জ্যেষ্ঠা কন্যা বেগমসাহেবা অসাধারণ সুন্দরী ও গুণবতী ছিলেন। সম্রাট তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। তাঁদের এই প্রীতির সম্পর্ক নিয়ে রাজদরবারে ওমরাহমহলে নানারকমের কানাঘুষা গুজব পর্যন্ত রটেছিল। শেষ পর্যন্ত সম্রাট নিজে মোল্লাদের ডেকে ব্যাপারটার বিচার করে একটা ফয়সালা করতে বলেছিলেন। মোল্লারা নাকি বলেছিলেন যে, কন্যার সঙ্গে সম্রাটের এই সম্পর্ক রাখার অধিকার ন্যায়সঙ্গত, কারণ যে—বৃক্ষ তিনি নিজে রোপণ করেছেন, তার ফল আস্বাদনের অধিকারও তাঁর আছে। মোল্লাদের এই কথার অর্থই বাইরে বিকৃত হয়ে রটেছিল। এই কন্যার ওপর সাজাহানের অগাধ বিশ্বাস ছিল এবং তিনি পিতার সমস্ত দায়িত্ব বহন করতেন। সাজাহান যা আহার করতেন তা তাঁর তত্ত্বাবধানেই তৈরি করা হত, অন্যের তৈরি খাদ্য তিনি কখনো খেতেন না। এইজন্য মোগল দরবারে সম্রাটের এই কন্যার প্রভাব প্রতিপত্তিও ছিল অসাধারণ। সম্রাটের সঙ্গে তিনি ছায়ার মতন থাকতেন, তাঁর আমোদ—প্রমোদ, হাসিঠাট্টায় যোগ দিতেন, এবং কোনো গুরুতর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করবার সময় কন্যার মতামতের যথেষ্ট মূল্য দিতেন। বেগমসাহেবার ব্যক্তিগত ধনদৌলতও প্রচুর ছিল। কারণ তিনি সম্রাটের কাছ থেকে মোটা ভাতা ও উপহার তো পেতেনই, ওমরাহ আমলা—অমাত্যরাও যাতে তাঁর নেকনজরে থাকেন তার জন্য সর্বদাই তাঁকে নানারকম উপঢৌকন দিয়ে খুশি করার চেষ্টা করতেন। জ্যেষ্ঠপুত্র দারা সে সম্রাটের প্রীতিলাভে সমর্থ হয়েছিলেন তার প্রধান কারণ তাঁর ভগিনীর সহানুভূতি। দারা সবসময় এই ভগিনীর মন যুগিয়ে চলতেন এবং এমন কথাও নাকি বলতেন যে, তিনি যদি সম্রাট হতে পারেন তাহলে বেগমসাহেবাকে বিবাহের অনুমতি দেবেন। অনেকে হয়ত এই কথা শুনে ভাববেন যে বিবাহের প্রতিশ্রুতি আবার এমন কি ব্যাপার। কিন্তু হিন্দুস্থানের রাজবংশের কাহিনি যাঁরা জানেন, তাঁদের কাছে রাজকন্যার বিবাহের এই প্রতিশ্রুতি দানের তাৎপর্য সহজেই ধরা পড়বে। রাজকুমারীদের সহজে বিবাহ দেওয়া হত না, পাছে জামাইরাও রাজ্যলোভী হয়ে ওঠেন সেইজন্য। রাজকন্যার বিবাহ রাজপুত্রের সঙ্গেই দিতে হত এবং রাজপুত্রের পক্ষে রাজ্যলোভী হওয়াই স্বাভাবিক। সুতরাং রাজকুমারীদের বিবাহ দেওয়া হিন্দুস্থানে একটা কঠিন সমস্যা।

দেশভেদে প্রেমের কৌশল বর্ণনা

রাজকুমারী বেগমসাহেবার প্রণয়কাহিনি যা শোনা যায় তার মধ্যে দুটি কাহিনি আমি এখানে উল্লেখ করব। কেউ যেন ভাববেন না যে অকারণে আমি রোমান্স বা রূপকথা রচনা করতে বসেছি। যা আমি লিখছি তা সব ইতিহাসের ঘটনা এবং আমার একমাত্র উদ্দেশ্য হল, হিন্দুস্থানবাসীর আচার—অনুষ্ঠান, রীতিনীতি সম্বন্ধে যা আমি স্বচক্ষে দেখেছি ও স্বকর্ণে শুনেছি, তাই কোনোরকম অতিরঞ্জিত না করে বর্ণনা করা। প্রথমেই বলি, ইয়োরোপে প্রেম করা যত সহজ, এশিয়ায় তত সহজ নয়। ইয়োরোপের প্রেমিক—প্রেমিকারা অনেকটা নির্ভয়ে প্রণয়ের দুঃসাহসিক পথে অভিযান করতে পারেন, কিন্তু এশিয়ায় পদে—পদে বিপদের সম্ভাবনা। ফ্রান্সে প্রেম করা হল মজার ব্যাপার। ফরাসিরা হেসে, হৈ—হল্লা করে, হাততালি দিয়ে প্রেম উড়িয়ে দিতে পারে, এবং হাসির মতনই প্রেম সেখানে ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু এদেশে (এশিয়ায় ও হিন্দুস্থানে) প্রেম একটা ভয়াবহ ব্যাপার, প্রেম একবার করলে আর রেহাই নেই, তার শোচনীয় মর্মান্তিক ফলাফল ভোগ করতেই হবে। এইজন্য এশিয়াটিক প্রেমের পরিণতি সাধারণত ট্র্যাজিক।

বেগমসাহেবা সর্বদাই প্রায় অন্দরমহলে বন্দি হয়ে থাকতেন এবং পরিচারিকরা তাঁকে ঘিরে থাকত। বাইরের কোনো ব্যক্তি সেখানে প্রবেশের অনুমতি পেতেন না। একজন ভাগ্যক্রমে পেয়েছিলেন এবং তিনি যে খুব উচ্চবংশজাত কেউ তা নন, সাধারণ একজন অমায়িক ভদ্রলোক। পরিচারিকারা সবসময়ে বেগমসাহেবাকে চোখে—চোখে রাখতেন, তাদের চোখ এড়িয়ে কিছু করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। সুতরাং কন্যার প্রণয়কাহিনির খবর সম্রাটের কাছে ঠিক পৌঁছল। হঠাৎ একদিন সম্রাট অতর্কিতে এসে তাঁর কন্যার গোপন কক্ষে এমন এক অপ্রত্যাশিত সময়ে ঢুকে পড়লেন যে, বেগমসাহেবার প্রণয়ী কোনো দিশা না পেয়ে পাশের স্নানঘরের গরম জলের টবের মধ্যে আত্মগোপন করলেন। সম্রাট এমন একটা ভাব দেখালেন যেন তিনি কিছুই জানেন না, কিছুই বুঝতে পারেননি। কন্যার সঙ্গে বসে—বসে নানাবিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললেন। শেষকালে, একথা সেকথার পর, কথার মোড় ঘুড়িয়ে হঠাৎ তিনি বললেন যে বেগমসাহেবার গায়ের রং আগের চেয়ে ময়লা হয়ে গেছে এবং বেশ বোঝা যাচ্ছে যে তিনি শরীরের তেমন তোয়াজ করেন না, প্রসাধন করেন না। এই কথা বলেই সম্রাট হুকুম দিলেন খোজাদের গোসলখানা খুলে দিতে এবং টবের জল গরম করার জন্য আগুন ধরিয়ে দিতে। আগুন ধরানো হল, গোসলখানায় টবের জল টগ বগ করে ফুটতে লাগল এবং তার মধ্যে বেগমসাহেবার হতভাগ্য প্রেমিকও সিদ্ধ হতে লাগলেন। সম্রাট সাজাহান চুপ করে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। খোজারা যখন বললে যে তাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে তখন তিনি গম্ভীরভাবে কন্যার কক্ষ ত্যাগ করে উঠে গেলেন। এইভাবে বেগমসাহেবার প্রেমের পরিণতি হল, ফুটন্ত গরম জলে সিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হল প্রেমিকের।

বেগমসাহেবার দ্বিতীয় প্রেমকাহিনির পরিণতিও করুণ। এইবার বেগমসাহেবা একজন উচ্চবংশজাত সুদর্শন পারসি যুবককে পছন্দ করে তাঁকে তাঁর ব্যক্তিগত খানসামা নিযুক্ত করলেন, নাম নজর খাঁ। ঔরঙ্গজীবের পিতৃব্য সায়েস্তা খাঁ এই যুবকটিকে নাকি বিশেষ স্নেহ করতেন এবং সম্রাটের কাছে বেগমসাহেবার সঙ্গে তার বিবাহের প্রস্তাবও নাকি তিনি করেছিলেন। সম্রাট প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর কন্যার সঙ্গে এই পার্সী যুবকের যে গোপন প্রণয়সম্পর্ক আছে তা সম্রাট বুঝতে পেরেছিলেন। একদিন সম্রাট তাকে আমন্ত্রণ জানালেন দরবারে। যুবকটি আসতেই তিনি আমির—ওমরাহদের সামনেই তাকে হাসিমুখে একটি পান দিয়ে অভ্যর্থনা করলেন। অ্যাপায়নে নিজের ভাগ্য সম্বন্ধে আশান্বিত হয়ে যুবক নজর খাঁর বুক তখন ফুলে উঠল। তিনি মহানন্দে সাজাহানের হাতে—করে—দেওয়া সুগন্ধি পান চিবোতে লাগলেন। উপস্থিত কেউ ভাবতে পারেননি যে পানের মধ্যে বিষ আছে এবং সম্রাট তা নিজের হাতে নজর খাঁকে খেতে দিয়েছেন। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে নজর খাঁ মনের আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে, বেগমসাহেবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে, নিজের পালকিতে গিয়ে উঠলেন। পানের ক্রিয়া পালকির মধ্যেই হল, আর তাঁকে নামতে হল না। প্রেমের পান খেয়ে বেগমসাহেবার দ্বিতীয় প্রেমিকের প্রেমলীলা ও ভবলীলা দুই—ই সাঙ্গ হল।

কনিষ্ঠা রৌশনআরার প্রকৃতি

রৌশনআরা বেগম জ্যেষ্ঠা ভগিনীর মতন সুন্দরী বা বুদ্ধিমতী ছিলেন না। তা না হলেও, ভোগবিলাসী তিনি কম ছিলেন না। রৌশনআরা ছিলেন ঔরঙ্গজীবের অনুরাগী এবং প্রকাশ্যেই তিনি দারা ও বেগমসাহেবার শত্রুতা ও বিরোধিতা করতেন। সেইজন্য তিনি খুব বেশি ব্যক্তিগত ধনদৌলত সঞ্চয় করতে পারেননি এবং রাজকার্যেও তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও অন্তঃপুরে থেকে তিনি অনেক গোপন পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের খবর পেতেন এবং তার প্রত্যেকটি পূর্বাহ্নে ঔরঙ্গজীবকে জানিয়ে হুঁশিয়ার করে দিতেন।*

………….

১. বার্নিয়ের ১৬৫৮ সালের শেষে কিংবা ১৬৫৯ সালের গোড়ার দিকে সুরাটে পৌঁছন। ভারতের সম্রাট তখন সাজাহান।

২। ‘ফিরিঙ্গি’ কথা ফার্সি ‘ফরঙ্গি’ থেকে এসেছে। মুসলমান আমলে যে—কোনো ইয়োরোপবাসী শ্বেতাঙ্গকে ‘ফিরিঙ্গি’ বলা হত। ‘জেণ্টিল’ কথা পর্তুগিজ ‘Gentio’ (জেন্টিয়ো) থেকে এসেছে এবং তার থেকেই ইঙ্গ—ভারতীয় স্ল্যাং Gentoo’ (জেন্টু) কথার উৎপত্তি। ইংরেজযুগের প্রথমদিকে সাহেবরা সাধারণত হিন্দুদেরই ‘জেন্টু’ বলতেন এবং মুসলমানদের বলতেন ‘মুর’। (মুর—’Moros’ থেকে ‘Moors’)। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ও ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রকাশিত ইংরেজদের লেখা ভারতীয় ইতিহাসের গ্রন্থাদিতে এই ‘Gentoo’ ও ‘Moor’ শব্দের ছড়াছড়ি দেখা যায়—অর্থ হল ‘হিন্দু’ ও ‘মুসলমান’।

৩। সাজাহান ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। বার্নিয়ের যখন ভারতে এসে পৌঁছান তখন তাঁর বয়স ৬৫ কি ৬৬ বছর হবে। সাজাহানের কন্যা চারটি, বার্নিয়ের শুধু জ্যেষ্ঠা কন্যার কথা উল্লেখ করেছেন।

৪। কিন্তু তা সম্পূর্ণ আক্ষরিক অনুবাদ করার দরকার বা ইচ্ছা নেই। কারণ গৃহযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিবরণ অনুবাদ করলে আসল ‘ইতিহাস’ জানার কৌতুহল মিটবে বলে আমার মনে হয় না। এই সময়কার বহু ঘটনাপ্রধান ইতিহাসের মধ্যে এই বিবরণ লিপিবদ্ধ করা আছে, যাঁরা এ—বিষয়ে বিশেষ কৌতূহলী তাঁরা তা পড়তে পারেন। তার জন্য বার্নিয়েরের বিবরণ পড়ার, অনুবাদকারে, কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ মোগল—যুগের সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কোনো পরিচয় তার মধ্যে তেমন পাওয়া যাবে না।

৫। এই বিখ্যাত ব্যক্তি একজন পারসি ব্যবসায়ী, নাম মহম্মদ সফী বা মুল্লা সফী। ১৬৪৬ সালে তিনি সুরাট আসেন এবং সেখান থেকে সম্রাট সাজাহান তাঁকে সাক্ষাতের জন্য তলব করেন। তাঁর ওপর প্রীত হয়ে সম্রাট তাঁকে তিনহাজারি মনসবদারিতে সম্মানিত করেন, ‘বকশীর’ পদে নিয়োগ করেন এবং ‘দানেশমন্দ খাঁ’ (পণ্ডিত বীর) উপাধি দেন। ঔরঙ্গজীবের রাজত্বকালে তাঁর আরও পদোন্নতি হয় এবং তিনি সাজাহানাবাদের (দিল্লির) সুবাদার নিযুক্ত হন। ১৬৭০ সালে দিল্লিতেই তাঁর মৃত্যু হয়।

৬। ইয়োরোপ ও ভারতের ‘ভূমিস্বত্বের’ (Propriestorship of Sell) পার্থক্য সম্বন্ধে বার্নিয়ের এই মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষ্য করা উচিত। এই প্রসঙ্গে কার্ল মার্ক্স ও ফ্রিডরীশ এঙ্গেলসের পত্র দু—খানির কথা পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। ‘ভূমিকায়’ পত্র দু—খানি অনুবাদ করে দিয়েছি।

৭। ফ্রাসোঁয়া কাত্রু (১৬৫৯—১৭৩৭) ফরাসি ঐতিহাসিক। নিকোলাও মানুচ্চি (১৬৩৮—১৭১৭)র স্টোরিও দ্য মোগর এর ১৭১৫ সালে হিস্টোয়ার জেনারেল দ্য লাএমপায়ার দু মুঘল নামে অপর ভাষ্য উপস্থিত করেন। ১৯১৫ সালে বর্লিন থেকে আরো তিনটি ভাষায় প্রকাশিত হয়। কাত্রু (Catrou) তাঁর ‘History of the Mogul Dynasty in India’ (প্যারিস, ১৭১৫) নামক গ্রন্থে দারশিকোর এই পাদরি—প্রীতির আরও বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। ভেনিসিয় পর্যটক মনুচ্চিত্র (Signor Manucci) সংগৃহীত তথ্যের ওপর নির্ভর করেই কাত্রু এই বই লিখেছেন। মনুচ্চি দীর্ঘদিন দিল্লি ও আগ্রার রাজদরবারে চিকিৎসক ছিলেন এবং দারার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। কাত্রু লিখেছেন : ‘দারা যখন থেকে কর্তৃত্ব শুরু করলেন, তখন থেকেই তাঁর অহংকার ও অপরের প্রতি তাচ্ছিল্যের মনোভাব দেখা দিল। মুষ্টিমেয় কয়েকজন সাহেবমাত্র তাঁর একান্ত বিশ্বাসভাজন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে জেসুইট ফাদারদের ওপর দারার অগাধ বিশ্বাস ও ভক্তি ছিল। বিশেষ করে একজনের ওপর, তাঁর নাম ফাদার বুজি। এই ফাদারটির প্রচণ্ড প্রভাব ছিল দারার ওপর। এত বেশি প্রভাব যে দারা সিংহাসন লাভ করলে হয়ত সেই সঙ্গে খ্রিস্টানরাও হিন্দুস্থানের রাজা হয়ে বসতেন।

* সম্রাট ঔরঙ্গজীবের চরিত্রের অন্যান্য মহৎগুণ সম্পর্কে এমন অনেক কথা বার্নিয়ের পরে বলেছেন, যা তাঁর মতন একজন অন্তরঙ্গ প্রত্যক্ষদর্শীর পক্ষেই বলা সম্ভব। ঔরঙ্গজীবের চরিত্র—বিশ্লেষণে বার্নিয়ের যে অন্তদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন, তা আর কেউ দিতে পারেননি। এই গ্রন্থের ‘দ্বিতীয় অধ্যায়’ দ্রষ্টব্য।—অনুবাদক।

৮। ভ্যালেন্টিন ও কাত্রু এই গুজবের কথা উল্লেখ করেছেন। কাত্রু লিখেছেন : ‘বেগমসাহেবা শুধু যে সুন্দরী ছিলেন তা নয়, ছলাকলায় ও বুদ্ধিতে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। পিতা সাজাহানের প্রতি তাঁর এত দুর্বলতা ছিল এবং সম্রাট সাজাহানও এত বেশিমাত্রায় তাঁর কন্যার প্রতি প্রীতির উচ্ছ্বাস দেখাতেন যে, বাইরে তাই নিয়ে রীতিমতো জল্পনা—কল্পনা চলত। মনে হয়, সমস্ত ব্যাপারটাই ভিত্তিহীন গুজব মাত্র এবং ওমরাহদের ব্যক্তিগত বিদ্বেষপ্রসূত অপপ্রচার।’

৯। বাংলা ‘পাল্কি’ কথা সংস্কৃত ‘পলাঙ্ক’ থেকে এসেছে। পর্তুগিজরা বলতেন ‘Palanchino’  ইংরেজরা ‘Palanquin’

* সম্রাট সাজাহানের পুত্রকন্যার স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে আলোচনা করে বার্নিয়ের বলেছেন যে চারপুত্রের বদমেজাজের জন্য শেষজীবনে সাজাহান রীতিমতো ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে কাটিয়েছেন। পুত্ররা সকলেই বিবাহিত ও বয়স্ক, কিন্তু তবু সমস্ত আত্মীয়তার বন্ধন ও রক্তসম্পর্ক ছিন্ন করে ভাইয়ে—ভাইয়ে প্রচণ্ড বিরোধ দেখা দিল সিংহাসন নিয়ে। রাজদরবারের পরিবেশও বিষাক্ত হয়ে উঠল। সম্রাট তাদের শাস্তি দিতে পারতেন, বন্দিও করে রাখতে পারতেন, কিন্তু সাহস করেননি। চারপুত্রকে চারটি প্রদেশের সুবাদারি দিয়ে তিনি শান্ত করতে চাইলেন, কিন্তু তাতে উলটো ফল হল। সুবাদারি পাবার পর পুত্রদের স্বেচ্ছাচারিতা আরও বাড়তে লাগল। স্বাধীন রাজার মতন তাঁরা বেপরোয়া ব্যবহার করা শুরু করলেন এবং রাজস্ব পর্যন্ত দেওয়া বন্ধ করে দিলেন সম্রাটকে। গৃহবিবাদ শেষে যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত গড়িয়ে গেল। এই গৃহযুদ্ধের বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন বার্নিয়ের। অনেক ইতিহাসের বইয়ে এই বিবরণ পাওয়া যাবে। এখানে তার পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তাই বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্তের এই অংশটুকু অনুবাদ করলাম না। এই অধ্যায়ে যুদ্ধের বর্ণনার শেষে বার্নিয়ের লিখেছেন : ”এইভাবে চার ভাইয়ের সাম্রাজ্যলাভের জন্য যে গৃহযুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠেছিল, তার অবসান ঘটল। প্রায় পাঁচ ছ—বছর ধরে যুদ্ধ চলেছিল অর্থাৎ প্রায় ১৬৫৫ সাল থেকে ১৬৬০ কি ১৬৬১ সাল পর্যন্ত। যুদ্ধের শেষে ঔরঙ্গজীব বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হলেন।” এই কথা বলে বার্নিয়ের গৃহযুদ্ধের অধ্যায়টি শেষ করেছেন।

 পরবর্তী অধ্যায়—‘Remarkable Occurrences’—যুদ্ধান্তের পর রাজদরবারের প্রায় পাঁচ বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি। এর মধ্যে মোগলযুগের রাষ্ট্রীয় আদরকায়দার অনেক উপকরণ ছড়িয়ে আছে, যদিও অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান বিশেষ নেই। রাষ্ট্রীয় আচারেরও ঐতিহাসিক মূল্য আছে বলে এই অধ্যায়ের ‘সারানুবাদ’ করেছি। এই দুই অধ্যায় মূলগ্রন্থের অর্ধেকের কিছু কম, তার মধ্যে যুদ্ধের বিবরণের অধ্যায়টি চারভাগের একভাগ। বাকি অধের্ক হল ফ্রান্সের তাৎকালিক অর্থসচিব (চতুর্দশ লুইর রাজত্বকালে) মঁশিয়ে কলবার্টের কাছে ভারতবর্ষ সম্পর্কে লিখিত বার্নিয়ের বিখ্যাত চিঠি, ফরাসি পণ্ডিত মঁশিয়ে ভেয়ারের কাছে আগ্রা এবং দিল্লির সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবরণ সম্পর্কিত চিঠি, ফরাসি কবি শাপালাঁর কাছে লিখিত হিন্দুস্থানের সমাজসংস্কার ও বিভিন্ন শ্রেণির লোক সম্বন্ধে চিঠি, ঔরঙ্গজীবের কাশ্মীর অভিযান ও কাশ্মীর সম্পর্কে কয়েকখানি চিঠি এবং বাংলাদেশের সম্পদ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিবরণ। এর মধ্যে কলবার্ট ভেয়ার ও শাপলাঁর কাছে লিখিত চিঠি তিনখানি এবং বাংলাদেশের বিবরণটি, আমার মনে হয়, বার্নিয়ের ভ্রমণবৃত্তান্তের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান। এই চিঠি তিনখানি ও বাংলাদেশের বিবরণ সম্পূর্ণ অনুবাদ করেছি, কাশ্মীরের কথা বাদ দিয়েছি।—অনুবাদক)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *