চিত্রনাট্য – সুজন ভট্টাচার্য

চিত্রনাট্য – সুজন ভট্টাচার্য

বন্ধ জানলার ওপার থেকে বৃষ্টির শব্দটা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। বাড়িটার সামনে টিনের শেডটার উপরে হুড়মুড় করে জল আছড়ে পড়ছে বলে শব্দটা বেশ জোরেই বাজছে। বাইরের অন্ধকার আর কিছু টের পাবার উপায় নেই। এমনিতেই বাড়িটা একটেরেয়া। দিনের বেলাতেই লোকজনের খুব একটা দেখা মেলে না। সন্ধে নামলে আস্তে আস্তে চারপাশের অন্ধকারে বাড়িটাকে গিলে ফেলতে শুরু করে। নিজস্ব আলোটুকু দূর থেকে যেন আকাশের তারার মতোই লাগে। সুমন্ত্র এখানে পা দিয়েই তাই বোধহয় বলেছিল—বাড়ি করার আর জায়গা পেলে না শঙ্কর! রাতবিরেতে একটা কিছু হয়ে গেলে কেউ তো টেরও পাবে না।

শঙ্কর হাহা করে হেসে উঠেছিল—টের না পাওয়াই তো ভালো গো সুমন্ত্র। সবকিছু ঠিকঠাক নেমে যাবে প্ল্যানমাফিক; অথচ কেউ টেরটিও পাবে না, এমনটাই তো চাই।

তোমার কথা বোঝা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কম্মো না,—সুমন্ত্রও হেসে ওঠে।

জানলার পর্দাটা সামান্য সরিয়ে শঙ্কর বাইরে চোখ রাখে। নাঃ, বৃষ্টির ফোঁটাগুলোও নজরে আসছে না। এমন একটা জায়গা খুঁজে বের করতেই তো কতটা সময় চলে গেল ওর। চাইবাসা স্টেশন থেকে সরাসরি যাবার মতো গাড়ি নেই। জঙ্গলের ট্রাক আর পায়ে হাঁটাই সম্বল। পশ্চিম সিংভূম জেলার গভীর অরণ্যের মাঝখানে তামসাইয়ের এই বাড়িটার সংবাদ ও পেয়েছিল জামসেদপুরেই। যাদবপুরের ফ্ল্যাটে একা একা থাকা তখন ওর পক্ষে প্রায় অসহ্য হয়ে উঠেছে। ভিতর থেকে একটা শূন্যতা যখন হঠাৎই লাফ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে, তখন তাকে হজম করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। কলকাতার পাট প্রায় চুকিয়ে শঙ্কর তাই তখন ঘুরে বেড়ায় এখানে—ওখানে।

জামসেদপুরে দিমনা লেকের ধারে লোকটার সাথে আচমকা আলাপ হয়েছিল। শঙ্কর তখন একটা চেয়ারে বসে একমনে দেখে যাচ্ছিল একটা কাপলকে; বউটার খিলখিল হাসি বুঝিয়ে দিচ্ছে তার পরিবর্তনের বয়েসটা খুব বেশি নয়। মিলিও এমনি করেই ঝিলিমিলিয়ে হাসত। ওরা হানিমুনে গিয়েছিল পেলিং। কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলসে শরীর ভেজানোর জন্য মিলি যেন পাগল হয়ে উঠেছিল।

তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি!—শঙ্কর একটা সময় বিরক্তই হয়ে উঠেছিল।

জেনেশুনেই তো একটা পাগলিকে ঘরে নিয়ে এসেছিলে মশাই—মিলি চোখ ঘুরিয়ে বলেছিল,—এখন রেগে গেলে চলবে! —মিলির এই উচ্ছ্বাসটাই শঙ্করকে সবথেকে বেশি টানত। রাশভারী বাবা আর ডিপ্রেশনের পার্মানেন্ট পেশেন্ট মার সাথে থাকতে থাকতে শঙ্কর যেন শিখে নিয়েছিল আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করাটাই হল ভদ্রতা। বিয়ের পরে মিলি যেন জীবনের খাতার একেকটা পাতা উলটে ওর সামনে নতুন করে পড়াতে শুরু করেছিল।

ডোন্ট মাইন্ড,—পাশ থেকে গলাটা শুনেই চমকে উঠেছিল শঙ্কর। বেশ লম্বাচওড়া একটা লোক, স্কুটারটা স্ট্যান্ড করে দাঁড়িয়েছে। স্কুটার মানে লোকাল লোক। বাঙালি!

আজ দিনতিনেক ধরেই দেখছি আপনাকে। সারাটা দিন লেকের পাশে চুপ করে বসে থাকেন। দিমনা আর জঙ্গল আপনাকে বেশ পাকড়ে ধরেছে বুঝতে পারছি। জঙ্গলে একটা আস্তানা বানাবেন নাকি? আমার সন্ধানে আছে। একদম ভার্জিন ফরেস্ট। দারুণ একটা ছোট্ট বাড়ি আছে; মালিক মারা গেছে বলে ছেলেরা বিক্রি করে দেবে।

পরের দিনই শঙ্কর আর শ্যামল মল্লিক মানে সেই ভদ্রলোক রওয়ানা হল তামসাই। ছোট্ট বাড়িটাকে দেখে শঙ্করের একবারেই পছন্দ হয়ে গেল।

উত্তরে মাইল—তিনেক গেলেই সারান্ডা—সিংভূম রেঞ্জ; আর যদি পশ্চিমে মাইলখানেক যান, পেয়ে যাবেন রুরু নদী। ব্যস, আর কী চাই আপনার।

নিতান্ত জলের দরেই বাড়িটা কেনা হয়েছিল। শ্যামল মল্লিক তেমন কোনো কমিশনও নিতে চায়নি।—আরে দাদা, হঠাৎ করে হাজির হয়ে গেলে একটু জল—নাস্তার বন্দোবস্ত করে দেবেন।

গুছিয়েগাছিয়ে বসতে আরো প্রায় মাসচারেক। হ্যাঁ, কলকাতার সাথে সম্পর্ক একেবারে কেটে ফেলা সম্ভব না; তাই দু—তিনমাস অন্তর যেতেই হয়। সে—ও বড়জোর সপ্তাখানেক।

আমরা কি বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকব?—এতক্ষণে মিলি কথা বলে উঠল।

এই দেখেছ! এত করে নেমন্তন্ন করে নিয়ে এলাম; আজ কিনা দরজার তালাই খুলতে ভুলে যাচ্ছি। চলো, চলো। —বাড়তি উৎসাহে শঙ্কর ওদের ব্যাগদুটোও হাতে তুলে নিয়েছিল। মিলি বাধা দিতে গেলে কোনো কথা না বলে ওর হাতটা শঙ্কর হালকা একটা ছোঁয়া দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই শঙ্কর অনুভব করল বুকের মধ্যে কেমন একটা ধাক্কা যেন আচম্বিতে লাফ দিয়ে উঠল। আশ্চর্য! এতদিন পরেও!!

মাসখানেক আগে শঙ্কর যেদিন সুমন্ত্রর ফ্ল্যাটে হাজির হয়েছিল, মিলি সেদিন ছিল না। সুমন্ত্র প্রথমে অবাক হলেও তারপরে যেন মাঝখানে কোনো ইতিহাস নেই এমন ভঙ্গিতেই কথাবার্তা শুরু করে। শঙ্করও পুরোনো কাহিনির প্রসঙ্গ আর তোলেনি।

একটা ছোট্ট বাসা বানিয়েছি, বুঝলে,—চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শঙ্কর বলেছিল।—জঙ্গল তো তোমাদের খুব প্রিয়। বর্ষার জঙ্গল দেখেছ কোনোদিন? আমার ওখানে চলো। পাগল হয়ে যাবে। তিনদিনে একটা নতুন কবিতার বই হয়ে যাবে।

সব ঠিক হয়ে গেল। শঙ্কর চাইবাসা স্টেশনে চলে আসবে। সুমন্ত্র ওখানে বসেই মোবাইলে ট্রেনের টিকিট রিজার্ভ করে ফেলল।

চাইবাসা স্টেশনে ট্রেনটা ঢোকার পর দেখা দিতে শঙ্কর করেই একটু দেরি করেছিল। দরজা দিয়ে প্রথম বেরিয়েছিল সুমন্ত্র, হাতে লাগেজ। আবছা অন্ধকার কামরার ভিতর থেকে মিলির মুখটা প্রকাশ্য আলোতে বেরিয়ে আসতেই ওর যেন দমবন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ও তো ভেবেছিল এই মেয়েটার সবকিছু ওর জানা হয়ে গেছে; অথচ কতকিছুই যে জানার বাকি থেকে গেল! একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার পরে কি আর নতুন করে ভাবার কোনো সুযোগ আসে মানুষের জীবনে! ভাবতে ভাবতেই শঙ্কর সামনে এগিয়ে আসে।

এখানে আসতে মিলির ইচ্ছে ছিল না; সুমন্ত্রর চাপেই ও রাজি হয়েছিল। আবার শঙ্করের সামনে দাঁড়াতে হবে ভাবলেই ওর যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। না, অনুশোচনা নয়, কেমন একটা অজ্ঞাত ভার ওর উপর চেপে বসেছিল। এমন অনেক ঘটনাই থাকে মানুষ আগাপাশতলা না ভেবেই শুরুতে যার সঙ্গ নেয়; তারপর একদিন সেই ঘটনায় সে নিজেই হয়ে ওঠে মূল পরিচালক। মিলিও তো আসলে তাই। কোনো অপরাধ ও করেনি ঠিকই, কিন্তু অন্য একটা মানুষের অসহায় মুখটার কথা মনে পড়লে ওর নিজেরই খারাপ লাগে।

ট্রেনে ওর ঘুম হয়নি। শঙ্করের মুখোমুখি হলে ঠিক কী যে করবে ভেবে ভেবেই সারাটা রাত চোখ বড় বড় করে হালকা নীল আলো—ফ্যানের ঘুরে চলা ব্লেড—ঠিক উলটোদিকের স্লিপারে বাচ্চচা নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা অবাঙালি বউটাকে দেখে যাচ্ছিল। ট্রেনটা যখন স্টেশনে ঢুকছে তখন ওর যেন আর মাথা কাজ করছিল না।

শঙ্কর, এদিকে—সুমন্ত্রর কথায় ও চমকে উঠে তাকিয়েছিল সামনের দিকে। লম্বা শরীরটা কি সামান্য রোগা লাগছে? গোঁফটা আরেকটু পুরু হয়েছে, চোখদুটোও যেন খানিকটা বদলে গেছে, ভাষাটা যেন ঠিক পড়ে ওঠা যাচ্ছে না। সেই মানুষটাই, অথচ যেন সেই মানুষটা নয়। মিলির বুকের ঠিক মাঝখানে একটা হালকা ব্যথা উঁকি দিয়েই আবার মিলিয়ে গেল। গ্যাসের পেন! নাকি…

ওয়েলকাম, ওয়েলকাম বলে শঙ্কর হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সুমন্ত্রর দিকে। তারপর মিলির দিকে ঘুরে বলল—ট্রেনে কোনো অসুবিধে হয়নি তো মিলি?

শঙ্করের মুখে নিজের নামটা শুনে মিলি যেন কেঁপে উঠেছিল। শঙ্কর এত স্বাভাবিক গলায় কথা বলছে কী করে! হাবভাবে তো টের পাওয়াই যাচ্ছে না জীবনে এতগুলো নাটকীয় পরিবর্তন হয়ে গেছে। ওর কাছে কি মিলির জন্য আর একটুও স্পেস নেই! তাহলে মিলিই বা এত ভেবে মরছে কেন! মিলি নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে বলে—নাথিং।

বাড়ির ভিতরে ঢুকে ওরা যেন চমকে উঠেছিল। একটা মস্তবড় জার্মান শেফার্ড। লম্বা জিভটা মুখের বাইরে বের করে ওদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দেখলেই ভয় লাগে, এই বুঝি লাগাল এক কামড়। শরীরে নড়াচড়ার কোনো ইঙ্গিত নেই। চোখের লালচে আভায় যেন পড়ে নিচ্ছে আগন্তুকদের পরিচিতি।

কিলার ডগ, বুঝলে,—শঙ্কর বলে—অনেক কসরত করে শিখিয়েছি।

তোমার আবার কুকুর পোষার শখ জাগল কবে থেকে?—সুমন্ত্র যেন হঠাৎ চমকে ওঠার ভাবটা আড়াল করার জন্যই বলেছিল।

শখের কি কোনো নিয়মকানুন থাকে সুমন্ত্র! একটা শখ যায়, আরেকটা শখ আসে।—ব্যাগদুটো নিয়ে পাশের ঘরের দিকে যেতে যেতে শঙ্কর বলে। হঠাৎই খেয়াল হয় দরজার মুখে মিলি জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হ্যাঁ, কুকুরে যে ওর খুব ভয়, শঙ্কর জানে।

কী হল, মিলি! ভয় লাগছে?—শঙ্করের কথাতেও মিলি উত্তর না দিয়ে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে।—কী মুশকিল হল বল দেখি রেক্স! যা, তুই ওঘরে চলে যা। তোকে বেশিক্ষণ দেখলে ম্যাডাম আবার উলটোপথে হাঁটা না লাগায়।

শঙ্করের ইঙ্গিতে কুকুরটা খুব ধীরে ধীরে ওপাশের ঘরে চলে যায়। দরজাটা ডিঙোনোর সময় একবার মুখ ফিরিয়ে অতিথিদের দিকে একঝলক তাকিয়ে দেখে। শঙ্কর শুধু দেখে মিলির মুখটা যেন রক্তশূন্য হয়ে গেছে। মিলি এমনিতেই খুব ফর্সা। কিন্তু এক বাড়িতে একটা বাঁধনছাড়া কুকুরের সঙ্গে রাত্রিবাস করতে হবে ভেবে মুখটা যেন কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে।

কী হল, এবারে তো এসো। ভয় নেই, আমি না ডাকলে ও আর আসবে না।

ওটাকে বাঁধলে কি খুব অসুবিধে হবে?—মিলির গলায় ভয়ের ছোপটা খুব স্পষ্ট।

তা একটু হবে বইকি—শঙ্কর হেসে ফেলে। —বেঁধে ফেললে আশপাশে কী হচ্ছে টের পেলেও যে আর ঝাঁপাতে পারবে না। চোর তো ঘুরঘুর করছেই।

বলো কী শঙ্কর, এখানেও চোর!—সুমন্ত্র যেন খুব অবাক হয়েছে।—সবাই যে বলে পাহাড় আর জঙ্গলের মানুষরা খুব সৎ হয়।

তা তো হয়ই। কিন্তু মুশকিল কী জানো, সেখানেও যে শহরের বাবুবিবিরা হানা দেয়। এই যেমন তোমরা এসেছ।

মানে!—সুমন্ত্র যেন রুখে উঠতে চাইছে,—আমরা কি চোর!

শঙ্কর হাহা করে হেসে উঠেছিল। তারপর বলল—শোনো, এতটা জার্নি করে যে এসেছ। আগে ফ্রেশ হয়ে নাও। স্নান করে খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দাও। বিকেলে জঙ্গল দেখাতে নিয়ে যাব। এইসব জটিল কথা আলোচনার জন্য রাতটা তো পড়েই রইল। ওই ঘরটা তোমাদের জন্য। যাও, আর দেরি কোরো না।

শঙ্কর রান্নাঘর থেকেই টের পেয়েছিল স্নান সেরে মিলি সামনের ঘরে এসেছে। আগে এই সময়টায় মিলি গুনগুন করে গানের সুর ভাজার চেষ্টা করত। আজ কিন্তু তেমন কিছু টের পাওয়া যাচ্ছে না। মিলি কি আরো অনেক কিছুর মতোই এই অভ্যাসটাও ছুড়ে ফেলে দিয়েছে! রান্নাঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শঙ্কর একবার দেখল মিলি খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘরটা দেখছে। না, যাদবপুরের ফ্ল্যাটটার সাথে মেলাতে গেলে ভুল তো হবেই। কোনোকিছুই কি আর আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে!

হাতে ভাতের হাঁড়িটা নিয়ে এই ঘরে ঢোকার আগে শঙ্কর একটা গলাখাঁকারি দেয়। মিলি পিছনে ফিরে শঙ্করকে দেখে চুপ করে থাকে। টেবিলে হাঁড়িটা নামিয়ে শঙ্কর খুব মৃদু স্বরে বলে—কেমন লাগছে এখানে মিলি?

মিলির মুখে একঝলক রক্ত লাফিয়ে উঠে আবার যেন নেমে গেল শিরা আর ধমনীর অন্ধকারে। কেমন একটা ধরা গলায় মিলি বলল—আমি কি তোমায় হেল্প করব?

আরে না, না,—শঙ্কর হেসেই উত্তর দিল—এটুকু নিজেই পারব। পরে হেল্প কোরো।

মিলি টেবিলটার দিকে তাকিয়ে বলল—তুমি কি এখানে একাই থাকো শঙ্কর?

একা থাকব কেন? রেক্স আছে তো।—না, কথাটার মধ্যে খুব ভুল কিছু ছিল না। একাকীত্বের নিজস্ব দুর্গের মধ্যেই বাস করবে বলে বেশ উৎসাহ নিয়ে শঙ্কর এখানে ডেরা পেতেছিল; কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই টের পেল ও হাঁপিয়ে উঠছে। তাই একটা জার্মান শেফার্ডের পুঁচকে বাচ্চচা কিনে এনেছিল জামসেদপুর থেকেই। রেক্স তখনো দুধ খায়; কোলের মধ্যেই গুটিসুটি মেরে ঘুমোয়। সময়টা ভালোই কাটছিল যতক্ষণ না বাতাসি ওকে টেনে বাইরে এনে দাঁড় করিয়েছিল। শঙ্করও অবাক হয়ে গিয়েছিল ছোট্ট রেক্সের কারবার দেখে।

কোত্থেকে একটা খরগোশ অভিযাত্রীর মতো হাজির হয়েছিল বাগানে। শঙ্করের চোখে আগে কোনোদিন পড়েনি। রেক্স ছিল বারান্দায়। সেখান থেকেই ঝাঁপ দিয়ে বাগানে নেমে খরগোশটাকে তাড়া করে গেটের ঠিক মুখে দাঁতগুলো বসিয়ে দিয়েছে গলার নলিটায়। ওর মুখের হাঁ তখনো বড় হয়নি; সেখানে তাজা রক্তের ছোপ লেগে কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছিল রেক্সকে।

কিলার ডগ সাব—কেনার সময় লোকটা বলেছিল বটে। আর সেইদিন শঙ্কর বুঝে গিয়েছিল, যতই কোলে ঘুমোক আর চুকচুক করে দুধ খাক, কিলার ইনস্টিংক্ট রক্তের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে। সময় এলেই বাইরের আবরণটা খসিয়ে আসল চেহারাটা উঠে দাঁড়ায়। তারপর থেকে শঙ্করও রেক্সকে সাধ্যমতো ট্রেনিং দেবার চেষ্টা করে গেছে। জামসেদপুরের সেই লোকটার কাছে বারবার গিয়ে শিখেছে ট্রেনিংয়ের কায়দাকানুন। নাঃ, বিশেষ কিছু ভেবে শঙ্কর রেক্সের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেনি। রক্তের মধ্যে আছে যখন, দেখাই যাক না, এমনটাই ও ভেবেছিল।

শঙ্করের উত্তর শুনে মিলি কী বুঝল কে জানে! আর কোনো কথা না বলে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

জঙ্গল দেখছ? ওদিকে মাইলখানেক গেলেই একটা নদী আছে, রুরু। নদী মানে ঝোরা আর কি।

আজ দেখাবে তো—বলতে বলতে সুমন্ত্র ঘরে ঢোকে।

আরে এত জলদিবাজি করলে হবে?—শঙ্কর হেসে ওঠে।—আগে খেয়ে উঠে একটা ঘুম দিয়ে নাও। সময়ে সব হবে।

মুরগির মাংসটা খেয়ে সুমন্ত্র খুব তারিফ করেছিল। খেতে বসে মিলি আর মুখ খোলেনি। শঙ্করও কথা বলানোর চেষ্টা করেনি। সুমন্ত্রই শুধু বকবক করে যাচ্ছিল। নাটকের মূল প্ল্যানিংয়ে এইসব ছোটখাটো বিষয় ডিরেক্টাররা বাকিদের উপরই ছেড়ে দেয়। লাঞ্চ হয়ে গেলে ওরা পাশের ঘরে ঢুকে যায়। আজ ওরা বেশ লম্বা ঘুমই দেবে। ট্রেনে সাত ঘণ্টার পরে লড়ঝড়ে একটা মারুতি ভ্যানে আরো ঘণ্টা দুয়েক। তার মধ্যে অনেকটাই আবার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া এবড়োখেবড়ো কাঁচা রাস্তা। কোমরকে জানান দিয়ে ছাড়ে। তা—ও নেহাত শঙ্কর গাড়িটা ম্যানেজ করতে পেরেছিল। নাহলে আরো দেরি হত।

সুমন্ত্র আর মিলি ঘরে ঢুকে যাবার পর শঙ্কর বারান্দায় এসে বসেছিল। তখনো বাইরে সূর্যের দাপট মাটিকে যেন ভয় দেখানোর জন্য লড়ে যাচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবার মুখেই হাওয়া ছাড়তে আরম্ভ করে দিল। জঙ্গলে এমনটাই হয়। সারাদিন সূর্য যে তাণ্ডবটা নাচে, তাতে হাওয়াও যেন প্রাণ বাঁচাতে লুকিয়ে পড়ে গাছগাছালির আড়ালে। আলোটা একটু কমতেই সারাদিনের দাপাদাপির খামতিটা পুষিয়ে নিতেই যেন দুদ্দাড় করে ছুটতে থাকে। কিন্তু আজকের হাওয়াটার মধ্যে একটা অন্যরকম ইঙ্গিত ছিল। পাহাড়ের ঝরনার জল উপর থেকে নিচে ঠিকড়ে পড়ার সময় দুয়েক ফোঁটা গায়ে এসে লাগলে যেমন শিরশিরানি জাগে, অনেকটাই তেমন।

বৃষ্টি আসবে। বাঃ। ডিরেকটোরিয়াল পয়েন্টে এই বিষয়টা ছিল না। জঙ্গলের বৃষ্টির একটা অদ্ভুত রহস্য আছে। অনেকটা বিয়ের পরে পরে নতুন স্বামী—স্ত্রীর রুটিন—ভালোবাসাবাসির মতোই। অন্তত, ওরা বোর হবে না। পরিণতি জেনে ফেলার পরে মানুষ যে কেমন জড়পাথরের মতো হয়ে যায় সেটা তো ও নিজেই ভালো জানে। তার মধ্যে একটু রোমাঞ্চ আনতে পারলে ক্ষতি কী!

সবকিছু মানুষ ভেবেচিন্তে করতে পারে না। শঙ্করও পারেনি। এমনই এক বিকেলের মুখে দুটো বেজির লড়াই দেখে ও কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। ভালো করে দেখবে বলে বায়নোকুলারটা লাগাল চোখে। বোঝাই যাচ্ছে খাবারের দখল নিয়ে মারামারি। হঠাৎই চোখে পড়ল একটা পাথরের আড়ালে বসে আরেকটা বেজি মাথা উঁচু করে একবার যোদ্ধাদের দেখছে, আবার চোখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। হাঃ, আদিম খিদে, বুঝে নিতে শঙ্করের অসুবিধে হয় না। মিনিট—পাঁচেকের মধ্যেই মোটাসোটা বেজিটার কাছে হার মেনে অন্যটা পালিয়ে গেল। শঙ্করের উৎসাহ যেন আরো বেড়ে গেল। বারান্দার ধারে এসে ফোকাসটাকে আরো নিখুঁত করার চেষ্টা করল।

ততক্ষণে সেই পাথরটার ছায়ায় অপেক্ষায় থাকা মাদি—বেজিটার শরীরে মদ্দা—বেজিটা নিজের জায়গা খুঁজে পেয়েছে। শঙ্কর দেখতে থাকে। হঠাৎই ওকে একদম হতভম্ব করে দিয়ে সেই পালিয়ে যাওয়া বেজিটা কোত্থেকে একলাফে ঝাঁপিয়ে পড়ল মদ্দা—বেজিটার উপর; গলায় কামড়টা ঠিকঠাক বসেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। মোটা বেজিটা যেন বুঝতে পারছে না ঠিক কী করা যায়। আততায়ীকে সামাল দেবে; নাকি যে কাজটার জন্য এতকিছু, সেখানেই নিবিষ্ট থাকবে। খানিকটা ঝাপটাঝাপটির পর দুটোই চলে গেল পাথরের আড়ালে। খানিকবাদে মাদি—বেজিটার মুখটা দেখা গেল পাথরের বাইরে একটুখানি বেরিয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খাবি খাচ্ছে। বাকি দুটোকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েও আর দেখা গেল না। সন্ধে হয়ে যাওয়ায় শঙ্কর একসময় বায়নোকুলারটা নামিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। পরের দিন সকালে একটাকেও পাওয়া গেল না। পাবার কথাও না। জঙ্গলে কতরকমের জানোয়ার ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাতেই হাপিস করে দিয়েছে।

সেদিন রাতেই শঙ্কর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। চারপাশের পরিবেশ যেন ওকে এদিকেই ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। ও শুধু এক মনোযোগী, বাধ্য ছাত্রের মতো সেই নির্দেশগুলো পালন করে যাচ্ছে। কী হওয়া উচিত, সময়ই যখন সব ঠিক করে দিচ্ছে, তখন আরেকটু উদ্যোগী হওয়াটাই ভালো। কিন্তু কীভাবে! প্ল্যানটা ঠিকঠাক তৈরি করতে লেগে গেল আরো দিনসাতেক। তারপর শঙ্কর চলে গেল চাইবাসা। কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে।

ক্যায়া করে ভাইয়া; একেলা আদমি। কব ক্যায়া হো জাতা হ্যায়। —দোকানদারের প্রশ্নের উত্তরে সেফটি ক্যাচটা টেস্ট করতে করতেই শঙ্কর বলেছিল। দোকানদারের আর কী। রুটিন প্রশ্নের রুটিন জবাব শুনে শুনে ও—ও বোধহয় অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

সন্ধে নামার আগেই আকাশ পুরো কালো করে ফেলেছে। হাওয়ার জোরটাও বেড়েছে। বাইরের টিনছাওয়া বারান্দায় বসে শঙ্কর একমনে দেখছিল খানিকটা দূরে গাছের ডালগুলো কেমন যেন তালে তালে গা দুলিয়ে যাচ্ছে। যেন নাচের আসরের দর্শক। মাটি থেকে লাল—লাল ধুলো উড়ছে। শঙ্করের বেশ মজা লাগে। একটা নাটকের প্ল্যান বানানো কি মুখের কথা; কত কী ঘটে যেতে পারত মাঝখানের এই সময়টার মধ্যে। হয়তো শঙ্করই মুছে যেতে পারত পৃথিবী থেকে। হ্যাঁ, মাসদশেক আগে সাপের কামড়টা যদি হাই—নেক জুতোর উপরে না পড়ে আর ইঞ্চিতিনেক উপরে উঠত, সমস্ত অ্যারেঞ্জমেন্ট তো মাঠেই মারা যেত। কিংবা সুমন্ত্র আর মিলি ওর নেমন্তন্ন স্বীকার নাও করতে পারত। হয়তো ওরাও হারিয়ে যেতে পারত এমন কোনো জঙ্গলে যেখানে কোনোদিন শঙ্কর মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে হাজির হতে পারত না। শঙ্করের হঠাৎই নিজেকে কেমন যেন ঈশ্বর বলে মনে হতে থাকে। অন্তত দুটো মানুষের ভাগ্যের লেখা ও নিজেই স্থির করাতে পেরেছে।

বৃষ্টি নামবে নাকি! —পিছন থেকে সুমন্ত্রর গলাটা পেয়ে শঙ্কর মাথাটা ঘোরায়। তারপর বলে—উঠে পড়লে? চা খাবে তো? মিলি উঠেছে?

আরে দূর, এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? —সুমন্ত্র সিগারেটের প্যাকেট বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে দেয়।

নাঃ, ছেড়ে দিয়েছি অনেকদিন। তুমি খাও।

অ্যাই শঙ্কর, তোমাদের এখানে মহুয়া পাওয়া যায় না? পেলে একবার ট্রাই করতাম। —সিগারেটের প্রথম ধোঁয়াটা ছাড়তে ছাড়তে সুমন্ত্র বলে।

যাঃ, একদম মাথায় আসেনি। কিন্তু আজ তো আর ব্যবস্থা করা যাবে না।

ঠিক হ্যায়, কাল হবে। —সুমন্ত্রর গলায় যেন কেমন একটা ফুর্তির আভাস।

কাল! শব্দটা শুনতে যত ছোট, পিছনের ক্যানভাসটা ততটাই বড়। সারাটা জীবন মানুষ তো এই কাল শব্দটাকে নিয়েই বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। সেখানেই তো বেঁচে থাকার আসল মজা। শুধু অতীত আর বর্তমান নিয়েই থাকতে হলে শঙ্করই কি আর বেঁচে থাকত? ও—ও তো বেঁচে আছে স্রেফ সেই কাল শব্দটার ভরসায়। আর সেই কাল শব্দটা যখন আজ হয়ে উঠছে একটু একটু করে, আর কয়েক ঘণ্টা পরই স্রেফ গতকাল হয়ে যাবে, তখন কী করবে ও? বেঁচে থাকবে? কী নিয়ে থাকবে? আর তো কোনো কালের গল্প থাকবে না ওর জন্য। তাহলে?

শঙ্কর উঠে পড়ে। —চা বসিয়ে দিই।

দুপুরের রান্নাটা কি তুমিই করেছিলে? —সুমন্ত্রর সিগারেট প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

নাঃ, একটা মেয়ে আসে সকালে। ওই দুবেলার রান্নাটা করে দিয়ে যায়। বাকিটা আমিই সামলে নিই। বোসো, আমি আসছি,—বলে শঙ্কর ভিতরে ঢুকে যায়।

চা নিয়ে বারান্দায় এসে দেখে ততক্ষণে মিলিও চলে এসেছে। বাইরের অন্ধকারটা বেশ জাঁকিয়ে নেমে এসেছে। বারান্দার লাইটটা এখনো জ্বালানো হয়নি বলে একটা ভূতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। টেবিলের উপর চায়ের কাপগুলো রেখে শঙ্কর লাইটটা জ্বালিয়ে দেয়। একটা হাল্কা সাদা আলোয় হাতদশেক পর্যন্ত নজর করা যায়।

এখানে কি এরকমই লো—ভোল্টেজ থাকে নাকি? চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সুমন্ত্র বলে।

ওই আর কী। শঙ্কর দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ডাক দেয়—রেক্স…সঙ্গে সঙ্গে মিলি যে আবার জড়সড় হয়ে পড়ল, সেটা ওর চোখ এড়াল না। —ভয় নেই, এ এখন বাইরের মাঠে নিজের কাজ সেরে আসবে; তোমাদের ডিস্টার্ব করবে না।

লেজ নাচাতে নাচাতে রেক্স বাইরে বেরিয়ে গেল। মিলির হাতে চায়ের কাপটা সামান্য—সামান্য কাঁপছে। শঙ্করের হাসি পায়। এত ভয় কোথায় রাখবে ম্যাডাম যখন সবকিছু জেনে যাবে!

চা খাওয়া শেষ হতে না হতেই ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি এসে গেল। রেক্স এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেল। হাওয়ার দাপটে বৃষ্টির জল উড়ে এসে গায়ে লাগছে। বেশ রোম্যান্টিক। কিন্তু অতিথিদের কেমন লাগছে সেটাও জানা দরকার।

তোমরা কি এখানেই বসবে? নাকি ভিতরে যাবে?

দারুণ লাগছে কিন্তু যাই বলো মিলি। —সুমন্ত্র আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে। —শঙ্কর, ইউ আর রিয়েলি লাকি যে এমন একটা জায়গায় আস্তানা বানাতে পেরেছ। বাই দা বাই, তুমি এখন করো কী?

কী করি! —শঙ্কর মুচকি হাসে।—চিত্রনাট্য লিখি।

গ্রেট। তোমার এই গুণটা তো জানা ছিল না। বুঝেছি। সেই জন্যই এমন একটা জায়গায় বাড়ি বানিয়েছ। ক’টা ফিল্ম হল তোমার চিত্রনাট্যের উপর?

এখনো একটাও না। তবে প্রথমটার কাজ শুরু হয়ে গেছে। জানতে পারবে।

হঠাৎই রাস্তাটার ওপাশের গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে যে ঠাসবুনোট অন্ধকার, তার মধ্যে থেকে একটা তীক্ষ্ন ক্যারক্যারে আওয়াজ জলপড়ার শব্দকে ছাপিয়ে নিজেকে জানান দিল। টিমটিমে আলোতেও শঙ্কর টেল পেল মিলি কেঁপে উঠল সেই আওয়াজে।

কীসের শব্দ?—বহুক্ষণ পরে আবার মিলির মুখের কথা শোনা গেল।

মনে হচ্ছে খটাস; সাপ ধরেছে বোধহয়।

এখানে সাপও আছে,—মিলি ঝটতি চেয়ারের উপর পা তুলে বসে।

হাঃ হাঃ ম্যাডাম, এমন সব পোকাও আছে যারা কামড় দিলে মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মানুষ দু ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। বর্ষা হলে তারা আবার দালানকোঠায় শেল্টার খুঁজতে আসে।

আমি ভিতরে যাব,—বলেই মিলি উঠে পড়ে। সেই মুহূর্তেই রেক্স আবার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে দেখেই মিলি আতঙ্কে প্রায় গায়ের উপরেই উঠে পড়ে আর কি। চারটে বছর পরে মিলির গায়ের গন্ধটা আবার যেন শঙ্করকে ঘিরে ফেলতে চলে এল। ও তো ভুলেই গিয়েছিল বলা চলে। স্ক্রিপ্টে কি এগুলোও লেখা ছিল?

নাঃ সুমন্ত্র, ভিতরেই চলো,—শঙ্কর চায়ের কাপগুলো তুলে ফেলে। —এমনিতেই মিলি ভয় পাচ্ছে। তাছাড়া ঢোকার সময় ডানহাতে কেয়াগাছের ঝোপটা দেখেছ তো; বৃষ্টি নামলে তেনাদের আবার ফুর্তি চাগাড় দিয়ে ওঠে। নাও চলো।

ভিতরে ঢুকতে গিয়েই ও টের পায় রেক্সকে না সরালে মিলি ভিতরে যাবে না। —রেক্স! —শঙ্কর বলতেই রেক্স আবার ওপাশের ঘরে চলে যায়। দরজাটা বন্ধ করে দেবার পর মিলিকে এবার যেন একটু আশ্বস্ত দেখায়।

ও হ্যাঁ, মিলি, সুমন্ত্র, আজ রাতের খাওয়ার কিন্তু বন্দোবস্ত করতে পারিনি। —শঙ্কর বেশ কেটেকেটে বলে।

ছাড়ো তো, একটা রাত না খেলে মানুষ কি মরে যায় নাকি! কী বলো মিলি?

আমি কিন্তু কাল সকালেই চলে যাব, মিলি খুব জোর দিয়ে বলে ওঠে।

সে ঠিক আছে মিলি,—শঙ্কর সামান্য হেসে বলে। —তোমরা একটু বোসো; আমি এক মিনিটের মধ্যে আসছি।

বৃষ্টিটা যে ভালোই চলবে বুঝতে শঙ্করের অসুবিধে হল না। ছাতা মাথায় বাড়িটার পিছন দিয়ে ঘুরে আসতেও বেশ ভালোই ভিজে গেছে।

কোথায় গেছিলে? সুমন্ত্র অবাক হয়ে গেছে যেন। —পুরো ভিজে গেছ তো।

বাইরের গেটে তালা মারতে।

ওই বাগানের গেটে? ওখানে তালা মেরে কি তুমি চোর ঠ্যাকাতে পারবে?

হাসালে সুমন্ত্র,—শঙ্কর মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলে,—চোরকে তো আমি ইনভাইট করে আনি। তালা মারলাম বারান্দায় যাবার এই দরজাটায়।

মানে! বাইরে থেকে বন্ধ করে বাড়তি সুবিধে কী হবে?—সুমন্ত্র যেন বুঝতে চাইছে বিষয়টা। —তাছাড়া কাল সকালে তোমার ওই রান্নার মেয়েটা যখন আসবে, তখন ও বুঝবে কী করে যে আমরা ভিতরে আছি?

ও আর আসবে না সুমন্ত্র, শঙ্কর যেন মজা করছে এমন ভঙ্গিতে বলল।

ছাড়িয়ে দিলে নাকি?

নাঃ, এখানে সব্বাই জানে কাল ফার্স্ট ট্রেনেই আমি কলকাতায় চলে যাচ্ছি। আর কেউ আসবে না।

তাহলে আমাদের ডেকে এনেছ কেন? —মিলি উঠে দাঁড়িয়েছে। —নেমন্তন্ন করে এনে তুমি নিজেই চলে যাবে মানে?

এত টেন্সড হোয়ো না মিলি, শঙ্কর খুব মৃদু স্বরে বলে।

এটা কি ফাজলামি হচ্ছে? —এতক্ষণে মিলিকে শঙ্করের খুব চেনা চেনা মনে হয়। এই ঝাঁজটাই মিলিকে আর সবার থেকে আলাদা করে দিত।

একদম না মিলি। যে নাটকটা চার বছর ধরে লিখে যাচ্ছি, আজ তার এক ও একমাত্র শো চলছে। আমি একদম সিরিয়াস।

শঙ্কর, পুরনো কথা টেনে নিজেকে আর কষ্ট দিচ্ছ কেন—সুমন্ত্র সোজা হয়ে বসেছে।—তোমার খারাপ লেগেছে; আমাদেরও যে খুব ভালো লেগেছিল, এমনটাও তো নয়। কিন্তু মানুষ তো পরিস্থিতির শিকার।

দারুণ বললে কিন্তু সুমন্ত্র। শঙ্কর হাততালি দিয়ে বলে উঠল। —বন্ধু হিসাবে বাড়িতে ঢুকেছিলে; বেরোলে চোর সেজে।

বাজে কথা বন্ধ করো, সোফার হাতলে বাড়ি মেরে মিলি বলে উঠল।—যা হয়েছে তার জন্য তুমিও দায়ী। আমাকে বোঝার আদৌ কোনো চেষ্টা করেছিলে কোনোদিন?

শঙ্কর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর বলে—যেদিন বুঝলাম আমি তোমার কাছে একটা বোঝা, সেদিনই তোমাকে বোঝার চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছিলাম।

শঙ্কর, যাই হোক, তোমাকে আমি বন্ধু বলেই মনে করি,—সুমন্ত্র সোজা ওর দিকে তাকিয়ে বলছে। —তুমি না থাকলে আমি তো কোথায় হারিয়ে যেতাম। তোমার উপকার মনে আছে বলেই তো এতবছর বাদে তোমার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলাম না। মিলি আসতে চায়নি। আমিই জোর করে রাজি করালাম।

উপকার! হাঃ হাঃ হাঃ। বিনিময়ে বড় সুন্দর একটা উপহার দিয়েছিলে বন্ধু, উপকারীর বউকে চুরি করে নিয়ে।

বাজে কথা বলবে না,—মিলি আবার ফুঁসে উঠেছে। —আমরা দুজনে স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছিলাম। এটাকে চুরি বলে না।

আর আমার সন্তান!—শঙ্কর যেন সাপের মতোই হিসহিস করে ওঠে। —সেটা চুরি নয়!

শঙ্কর, অ্যাবর্শনটা খুব জরুরি ছিল,—সুমন্ত্র লাফ দিয়ে ওঠে, —নাহলে মিলিই বাঁচত না।

রাইট। সেই সিদ্ধান্তটা যার নেবার কথা, সে কিন্তু জানতে পারল সবকিছু মিটে যাবার পরে। এমনকী সে যে বাবা হতে পারে, সেই সংবাদটাও।

সুমন্ত্র আর মিলি মাথা নিচু করে বসে আছে। শঙ্কর উঠে পড়ে। ভিতরের ঘরের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ ঘুরে বলে—একটু চা খাবে নাকি? আরে, চা খেলে এই গুমোটটা কেটে যাবে।

করো, —সুমন্ত্রর গলাটা কেমন নির্জীব শোনাল। রান্নাঘরে চা বানাতে বানাতেই সুমন্ত্র আর মিলির দুয়েকটা কথার টুকরো টুকরো অংশ কানে পৌঁছে যাচ্ছিল শঙ্করের। যতই তেজ দেখাক, মিলি খুব ভয় পেয়েছে। সুমন্ত্রই ওকে বোঝাচ্ছে। মিলি বুঝতে চাইছে না। মেয়েদের এই ক্ষমতাটা জন্মগত। হয়তো চারিদিকের হাঙর—কুমির সামলাতে সামলাতে ওরা এটা খুব দ্রুত অর্জন করে ফেলে।

তোমার এই বন্ধুটাকে কিন্তু আমার মোটে সুবিধার মনে হয় না। রাতে শঙ্করের বুকে মাথা রেখে মিলিই একদিন বলেছিল। —চোখ দেখলেই অস্বস্তি লাগে; কেমন যেন খিদে—খিদে ভাব।

আরে, রোজগারপাতি নেই; কবিমানুষ। খিদে তো থাকবেই।

এ খিদে সে খিদে নয় মশাই; এ হল অন্য খিদে।

একটা জোয়ান মানুষ, তায় কবি। একটু ছোকছোকানি তো থাকতেই পারে।

আর যদি তোমার বউকেই খেয়ে ফেলে? —মিলি এবার শঙ্করের উপরে উঠে মাথাটা সামান্য উঁচু করে ওর চোখের দিকে সোজা তাকিয়েছিল।

শঙ্কর মুখটা উঁচু করে মিলির ঠোঁটটাকে আলতো স্পর্শ করে বলেছিল— তালে বুঝব, ব্যাটাচ্ছেলের ক্ষমতা আছে।

চা নিয়ে ঘরে ঢুকে শঙ্কর দেখে ওরা দুজনেই মোবাইল নিয়ে টেপাটেপি করে যাচ্ছে।

ওখানে নেটওয়ার্ক থাকে না সুমন্ত্র। নাও চা খাও।

চা খাওয়া শেষ হতেই শঙ্কর নিজের চেয়ারটা ঘুরিয়ে ওদের মুখোমুখি বসে। —হ্যাঁ, তাহলে এবারে নাটকটা শেষ করা যাক।

প্লিজ, শঙ্কর, এবার এটা বন্ধ করো। আর ভালো লাগছে না। —সুমন্ত্র আবার সিগারেট ধরিয়েছে।

না না, আর বেশি দেরি হবে না। সুমন্ত্র, মিলি, তোমাদের কেন নেমন্তন্ন করে এনেছিলাম জানো? —শঙ্কর বেশ হাসি হাসি গলায় বলে।

কেন?

তোমাদের পাপের শাস্তি দেব বলে। দুটো জীবনকে খুন করার পাপ।

তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে শঙ্কর, —সুমন্ত্র সোফা থেকে উঠতে যায়।

ওখান থেকে উঠবার চেষ্টা কোরো না সুমন্ত্র। একটা ইঙ্গিত করলেই রেক্স কিন্তু গলার নলিটা ফাঁক করে দেবে। কিলার ডগ মানেটা বোঝো তো? —নিজের নামটা শুনেই বোধহয় রেক্সও ঘরের মধ্যে ঢোকে।—দরজার পাশে বোস। —শঙ্কর কথাটা বলতে রেক্সও থাবা পেতে বসে পড়ল।

সুমন্ত্র তুমি কী বলছিলে? মাথা খারাপ—শঙ্কর আবার হাহা করে এসে ওঠে। —মাথা খারাপ না হলে কেউ কি আর খুনের প্ল্যান কষতে পারে?

তুমি আমাদের খুন করবে শঙ্কর? —মিলি এবারে কেঁদে ফেলেছে।

স্যরি মিলি, দাঁড়িপাল্লাটা একদিকে বড্ড ঝুঁকে রয়েছে; ওটাকে একটু ব্যালেন্স করে দেব।

শঙ্কর,—সুমন্ত্রর গলা কাঁপছে, —তুমি কী চাও বলো! আ—আ—আমরা সবকিছু দিতে রেডি। আমাদের ছেড়ে দাও, প্লিজ।

শঙ্কর উঠে পড়ে। ঘুরে ওদের সোফার পিছনে গিয়ে বলে—যদি বলি মিলিকে ফেরত চাই?

মানে!—সুমন্ত্র যেন বিস্ময়ের শেষ সীমায় এসে দাঁড়িয়েছে। —মিলিকে ফেরত চাও মানে? তোমার মাথাটা সত্যিই গেছে।

হতেই পারে সুমন্ত্র। —শঙ্কর যেন মজা পেয়েছে।—একটা লোকের বউ পালিয়ে গেল; বাচ্চচাটাকে খুন করা হল। তার পাগল হবার মতো যথেষ্ট অ্যালিবাই কি থাকতে পারে না? কী বলো?

আমি কোথাও পালাইনি—মিলি এবারে রুখে উঠতে চাইছে—তোমাকে সব জানিয়েই সুমন্ত্রর সাথে চলে গিয়েছিলাম।

আমিও তো তোমাদের সব জানিয়ে দিচ্ছি; আরো জানিয়ে দেব।—শঙ্কর মিটিমিটি হাসছে, যেন বাচ্চচাদের দুষ্টুমি এনজয় করছে।

শঙ্কর, একটা ঘটনা ঘটে গেছে, —সুমন্ত্র বোঝানোর জন্য চেষ্টা করে—সেটা যে খুব ভেবেচিন্তে হয়েছে, এমনটাও তো নয়। হয়ে গেছে, এই পর্যন্তই। তার জন্য খুন করতে হবে!

ধরে নাও, সেটাও এমনি এমনিই হয়ে যাবে। —শঙ্কর হাতের তালুদুটো ঘষতে ঘষতে বলে—তাহলে তো আর বলার কিছু থাকল না; কী বলো সুমন্ত্র?

সুমন্ত্র আর মিলির মুখে আর কোনো কথা নেই। শঙ্কর ওদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। এতক্ষণের নীরবতা বোধহয় রেক্সের পছন্দ হল না। তাই একবার মৃদু স্বরে একটা ঘেউ করে উঠল।

মিলিকে পেলে আমাদের ছেড়ে দেবে? —সুমন্ত্র যেন একটা সূত্র খোঁজার চেষ্টা করছে, এমনভাবে বলল।

মিলিয়ে ছাড়ব কী করে সুমন্ত্র! তোমাকে ছাড়তে পারি। —আরেকটু ঘুরে গিয়ে শঙ্কর মিলির মুখের দিকে তাকায়। চোখের কোলে জলের দাগটা এখনো শুকোয়নি। নাঃ, মেয়েটা সত্যি বড় মিষ্টি দেখতে। —তুমি কি কিছু বলবে মিলি? শঙ্কর খুব আদুরে গলায় বলে। শুনেই মিলি আবার কেঁদে ওঠে।

আর ইউ সিরিয়াস? সুমন্ত্র জিজ্ঞেস করে।

দেয়ারস নো ডাউট ফ্রেন্ড। মিলিকে চাইলেই যদি দিয়ে দিতে পারো, ইউ আর ফ্রি।

দেন, ইটস ডান। সুমন্ত্র সোফায় হেলান দিয়ে বসে পড়ে।

মিলি, তুমি কিছু বলবে না? শঙ্কর মিলির সামনে একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে। তোমার ফেলে যাওয়া হাজব্যান্ডকে যদি আবার জড়িয়ে ধরতে পারো, তোমার নেক্সট হাজব্যান্ড বেঁচে যেতে পারে। কি পারবে তো?

মিলি কোনো সাড়া দেয় না। শঙ্কর হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসে। তারপর ওর হাতদুটো ধরে বলে—আর যদি তোমাকে ছেড়ে দিয়ে সুমন্ত্রকে রেক্সের সামনে ছেড়ে দিই? তুমি চলে যাবে তো?

মিলি থরথর করে কেঁপে ওঠে। —আ—হা—আমি একা কোথায় যাব? —মনে হল এতক্ষণ যেন বলবার মতো একটা যুক্তি খুঁজে পেয়েছে।

শঙ্কর, তুমি কি খেলা পেয়েছ? —সুমন্ত্র চিৎকার করে ওঠে। কথা ঘোরাচ্ছ কেন?

একা কোথায় যাবে মানে কী, মিলি? —সুমন্ত্রকে পাত্তা না দিয়েই শঙ্কর বলে—সুমন্ত্রকে সঙ্গে নিয়েই যাবে? সেটা তো হবে না। হয় তুমি, না হয় ও, এনি ওয়ান।

আমি একা কোথায় গিয়ে উঠব? আমার তো থাকার জায়গা নেই। মিলির গলাটা কেমন যেন ঝিমিয়ে গেছে।

ওহো, এটা তো মাথায় আসেনি। ওকে; তুমি আমার এখানেই থাকতে পারো। টিভি নেই, ফোন নেই; এটুকুই প্রবলেম।

মিলি মাথা নিচু করে ফোঁপাতে থাকে।

কি, থাকবে? —শঙ্কর খুব আলতো করে বলে।

আমাকে মেরো না শঙ্কর; যা করতে বলো করব। মিলি সোফার ব্যাকরেস্টে হেলান দিয়ে চোখদুটো বুজে কোনোরকমে বলে।

মিলি! —সুমন্ত্র আবার চিৎকার করে ওঠে—ট্রেচারাস হোর।

গালাগালি নয় সুমন্ত্র, —শঙ্কর উঠে পড়ে। —বিশেষ করে মিলির মতো মিষ্টি গালিগালাজ করাটা আমি মেনে নেব না। রেক্সেরও বোধহয় পছন্দ হচ্ছে না। কী রে রেক্স? ঠিক তো?

নিজের নামটা শুনেই রেক্সের জিভটা যেন একটু বেশিই বাইরে বেরিয়ে আসে। —দেখলে তো সুমন্ত্র! —শঙ্কর আবার নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে। তারপর মাথাটা দোলাতে দোলাতে বলে—প্রবলেম, প্রবলেম। চারটে বছর একসাথে থাকার পর আজ দুজনেই প্রাণে বাঁচার জন্য অন্যকে খুন হতে দিতে রাজি। তাহলে স্কোপটা কার পাওয়া উচিত? এবারে সত্যি সত্যিই নিজেকে পাগল—পাগল লাগছে।

সুমন্ত্র আর মিলি কেউই কোনো কথা বলে না। শঙ্কর যেন খুব ভাবছে এমন ভঙ্গিতে পায়চারি করতে শুরু করে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলে—আইডিয়া। টস করেই ডিসিশান নেওয়া যাবে। রাইট। সুমন্ত্র, তোমার কাছে কয়েন আছে? —সুমন্ত্র পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা কয়েন তুলে সামনে বাড়ায়।

হুম, তাহলে হেড কে নেবে? আর টেল? লেডিস ফার্স্ট। তাহলে মিলিই বলো।

এটা আনফেয়ার, —সুমন্ত্রর গলাটা কেমন যেন ধরে এসেছে। —আমার নাম উঠলে আমি খুন হব, মিলি তোমার কাছেই থেকে যাবে। আর মিলির নাম উঠলে তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়ে মিলিকে তোমার কাছে রেখে দেবে। ইন এনি কেস মিলির কোনো রিস্ক নেই। তাহলে মিলিকেই রেখে দাও; আমি ভোর হলেই চলে যাব।

শঙ্কর খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর এগিয়ে আসে সুমন্ত্রর সামনে। তারপর বলে —আর আমার সেই মেরে ফেলা সন্তানটাকে যদি ফেরত চাই? সুমন্ত্র! মিলি! দেবে? দেবে আমার হাতে তুলে? তাহলে কিন্তু তোমাদের দুজনকেই ছেড়ে দিতে পারি।

শঙ্কর, প্লিজ, পাগলামো কোরো না, সুমন্ত্রর গলাটা কেমন যেন অসহায়ের মতো শোনায়।

সিদ্ধান্তটা নেবার সময় নিশ্চিত পাগলামি ছিল সুমন্ত্র; কিন্তু এখন আমি একদম সুস্থ। নাটকের শেষ কার্টেন ফেলা পর্যন্ত আমাকে সুস্থই থাকতে হবে। শোনো তোমাদের দুজনকেই আমি আজ খুন করব।

শঙ্কর, তুমিও কি বাঁচবে ভেবেছ? সবাই জানে আমরা তোমার কাছে আসছি। এখানেও লোকজন আমাদের দেখেছে। দুদিন। তিনদিন। তারপরেই খোঁজখবর শুরু হয়ে যাবে। তখন?

সেটা আমার ডিসিশন, শঙ্কর খুব ঠান্ডা গলায় বলে। —খুন তোমরা দুজনেই হচ্ছ। এই রিভলভারটা দেখেছ? —পকেট থেকে বের করার পর রিভলভারটা আলোতে ঝকঝক করছে। দেখেই মিলি আবার কাঁদতে শুরু করেছে। সুমন্ত্র গুম মেরে গেছে।

নাঃ, এতটা বাড়াবাড়ি করা ঠিক হচ্ছে না, —শঙ্কর আবার চেয়ারে বসে পড়ে। —আফটার অল, তোমরা আমার গেস্ট। ওকে, তোমরাই ঠিক করে নাও কীভাবে খুন হবে।

শঙ্কর, প্লিজ, মেরেই যদি ফেলতে চাও, একেবারে মেরে ফেলো। এই টার্চার আর সহ্য হচ্ছে না। —সুমন্ত্রর গলা ভেঙে গেছে। এতটাই ঠান্ডা পড়ে গেল নাকি!

তুমি মহুয়ার কথা বলছিলে না? —শঙ্কর রিভলভারটা আবার পকেটে ভরতে ভরতে বলে—খানিকটা ব্যবস্থা করা যাবে। আমার কাছে কুঁচিলার বিষ আছে; সাঁওতালরা খুব ব্যবহার করে। মহুয়ার সাথে মিশিয়ে দেব। নেশায়া যন্ত্রণাটা টের পাবে না। মুখ দিয়ে যে গ্যাঁজলাটা উঠবে সেটা যে কীসের জন্য ভাবতে ভাবতেই তোমরা চলে যাবে।

চুপ করো প্লিজ, মিলি বলে উঠল।

ওকে, এটা বাদ। এই সুমন্ত্র, তোমরা কি যাবার আগে একবার দুটো শরীর মিলিয়ে দেখবে নাকি? মরে গেলে আর তো চান্স নেই। তাহলে ওঘরে চলে যাও। বাথরুমে একটা বাথটব তো দেখেইছ। ওটাতে দুজনেই ঢুকে পড়ো। তোমাদের খেলা যখন জমে উঠবে ঠিক তখন আমি ইমারশন হিটারটা ভেঙে টবের জলে ছুড়ে দেব। কারেন্টের ঝটকায় তোমাদের উত্তেজনাটাও বেড়ে যাবে। যতক্ষণ টানতে পারবে চলবে।

তুমি উন্মাদ হয়ে গেছ। সুমন্ত্রর চোখদুটো যেন বাইরে বেরিয়ে আসছে।

যাঃ, এমন একটা রোমান্টিক মৃত্যুও তোমাদের পছন্দ না! তুমি তো আবার নাকি কবি। যাকগে, আরেকটা অপশন দিছি। এভাবেই। তবে বাথটবের বদলে বিছানায়। শেষ হলেই আমিও একটা গুলিতেই তোমাদের শেষ করে দেব।

বন্ধ করো, তীব্র চিৎকারে মিলি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

কী আশ্চর্য! একটা পছন্দসই মৃত্যুও তোমরা বেছে নিতে পারো না। আমি কিন্তু পারি, জানো। ঠিক আছে। দা লাস্ট ওয়ান। আমি তোমাদের দুজনকেই এক্ষুনি বাইরে বের করে দিচ্ছি। রাত ধরো এখন আটটা হবে। বৃষ্টি হচ্ছে ঠিকই। তবে কপালে থাকলে কোনো গ্রামে গিয়েও উঠতে পারো। মানে যদি সাপ—হায়না বা অন্য কিছুর পাল্লায় না পড়ো।

ওকে, আমরা এটাতে রাজি। —সুমন্ত্র উঠে দাঁড়িয়েছে।

আগে শোনো হে, এত জলদিবাজি করলে তো ভুল হয়ে যাবে। তোমাদের হাত আমি পিছন করে বেঁধে দেব। আর চোখও থাকবে বাঁধা।

এত অত্যাচার আমি আর সহ্য করতে পারছি না। —মিলি উঠে ওর দিকে এগোতে যায়। —আমাকে গুলি করে দাও।

উহু, এগিয়ো না। রেক্সের আবার এসব হজম হয় না।

রেক্স এতক্ষণ জুলজুল করে সবাইকে দেখছিল। নামটা কানে যেতেই সামান্য গড়গড় করে ওঠে। মিলি আবার সোফায় বসে পড়ে।

ওকে, তাহলে গুলিটাই ফাইনাল। ও, হ্যাঁ সুমন্ত্র, টেবিলে একটা কাগজ আছে, দেখতে পাচ্ছ তো? একটু জোরে জোরে পড়বে? যেন আমরা সবাই শুনতে পারি। আর শোনো, মনে করবে তুমি স্রেফ একজন নিউজরিডার; কোনো আবেগটাবেগ দেখাতে যেও না। নাও।

সুমন্ত্র কাঁপাকাঁপা হাতে কাগজটা তুলে নেয়। চোখ বোলাতে শুরু করে।

স্টার্ট প্লিজ।

তোমরা দুজন চারটে বছর ধরে আমাকে যে নরকযন্ত্রণা দিয়েছ, একটা গুলিতে তার শোধ হবে না। তাই তোমাদের আমি এক মৃত্যু দেব যার অভিজ্ঞতা তোমাদের আগে আর কারো হয়নি। রেক্স পাহারায় থাকবে। তোমরা সোফা থেকে ওঠবার চেষ্টা করলেই ও ঠিক আটকে দেবে। অবশ্য উঠেও লাভ নেই। পাগলাবাবুর কুঠির দিকে এমনিতেও কেউ আসে না। তারপর বাইরের দরজায় তালা। কেউ উঁকিও মারবে না। তোমরা ওই সোফাতেই এইভাবে বসে থাকবে দিনের পর দিন। স্যরি, খাবার বা জলের ব্যবস্থা থাকছে না। রেক্সের জন্য খানিকটা থাকছে। কিলার ডগ তো! দিনতিনেক পর থেকেই ঘরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে; পোকারা বাসা বেঁধেছে পচাগলা একটা লাশের উপর। তোমাদের মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে; কিন্তু মরতে পারছ না। বসে বসে সেই যন্ত্রণা তোমরা ভোগ করবে।

সুমন্ত্রর হাত থরথর করে কাঁপছে। মিলিও সোজা হয়ে উঠেছে। চোখদুটো যেন ঠিকরে আসছে। সুমন্ত্র অদ্ভুত এক ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠল—আর তুমি! তোমার কী হবে?

শঙ্কর রিভলভারটা পকেট থেকে বের করতে করতে বলল—রেক্স, এদিকে আয় বাপ। রেক্স উঠে ওর সামনে গেল। শঙ্কর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উল্টোদিকে আঙুল তুলে দেখাল। রেক্স সোফার দিকে মুখ করে একটু এগিয়ে গেল। তারপর আবার আগের মতোই সুমন্ত্র আর মিলির দিকে তাকিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল।

আমি! —শঙ্কর একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর কেমন একটা গাঢ় গলায় বলে উঠল—ওই যে…লাশটার ব্যবস্থা করে যাব। —বলতে না বলতেই কানফাটানো একটা আওয়াজ আর আলোর ঝলকানি।

সুমন্ত্র আর মিলি চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। চোখ খুলতেই দেখল, চেয়ারে মাথাটা হেলিয়ে শঙ্কর পড়ে আছে। ডানদিকের রগ থেকে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। চোখদুটো খোলা। বিস্ফারিত ঠোঁটে যেন একটা বিদ্রূপের হাসি ঝুলছে। রেক্স একবার মুখ ঘুরিয়ে শঙ্করের দেহটা দেখেই ওদের দিকে ফিরে তাকিয়ে মৃদু একটা গড়গড় আওয়াজ করতে থাকে।

সুমন্ত্র আর মিলি সোফায় বসে শঙ্করের লেখা চিত্রনাট্য অনুযায়ী অপেক্ষা করতে শুরু করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *