ঋতির উপহার – পিনাকী মুখোপাধ্যায় (মুখার্জী)

ঋতির উপহার – পিনাকী মুখোপাধ্যায় (মুখার্জী)

ঋতি যখন মণি মুখার্জি রোডের সাত নম্বর বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল তখন শীতের সন্ধ্যা আরও ঘন হয়েছে। ভীষণ নার্ভাস লাগছে তার। সে কোনো ভুল করছে না তো? তার কি একবার মনোজিৎকে ফোন করা উচিত ছিল? কালো রঙের বিশাল লোহার গেটটার সামনে দাঁড়িয়ে ঋতি ভাবছিল সে ফিরে যাবে কি না। তখনই বেজে উঠল মোবাইলটা।

একটু চমকে উঠল ঋতি। দেবযানীর ফোনটা রিসিভ করতে গিয়ে একটু যেন কেঁপে গেল গলাটা, ‘হ্যালো।’

‘কতদূরে?’

‘আপনাদের বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।’ আড়ষ্ট গলায় বলল ঋতি।

‘কেন? দাঁড়িয়ে আছ কেন? গেট খুলে চলে এসো ভেতরে। নীচে কলিংবেল বাজালেই রঘুদা দরজা খুলে দেবে।’

‘ঠিক আছে।’—ফোনটা ব্যাগে রেখে ধীরে ধীরে গেট খুলে ঢুকে আসে ঋতি। মোরাম বিছানো চওড়া পথের দুপাশে গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা আর গ্যাঁদার মিছিল। বারান্দায় উঠে কলিংবেলে হাত ছোঁয়াল ঋতি।

একটু পরেই একজন বয়স্ক লোক দরজা খুলে দিলেন। ইনিই বোধহয় রঘুদা। ঋতি কিছু বলার আগেই বলে উঠলেন, ‘বউদিমণি ওপরে আছেন। এ ঘরের পরেই সিঁড়ি পাবেন। উঠেই প্রথম ঘরটা।’

‘বউদিমণি’ কথাটা কি একটু জোর দিয়ে বললেন ভদ্রলোক? না কি ঋতির কানেই একটু বেশি জোরে বাজল শব্দবন্ধটা? বুঝতে পারল না ঋতি।

ক’টা মাত্র সিঁড়ি। অথচ পা দুটো যেন চলতেই চাইছে না। কেন যে রাজি হল ঋতি এখানে আসতে? সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকেই বিগড়ে ছিল মেজাজটা। সারা সপ্তাহের লাগামছাড়া ব্যস্ততার মাঝখানে রবিবারের চিলতে অবসরটা একটু ঢিলেঢালাভাবে কাটাতে ইচ্ছে করে ঋতির। ভেবেছিল একটু বেলা করে উঠবে। কিন্তু সাতটা বাজতে না বাজতেই দরজায় টোকা।

ঘুমচোখে দরজা খুলতেই বিরক্ত গলায় মা বলে উঠেছিলেন, ‘আজও বাজারে না যাওয়ার মতলব নাকি তোর? অন্ধ্রের রুই খেতে খেতে তো চড়া পড়ে গেল জিভে।’

‘সাতটাও তো বাজেনি মা। আটটার আগে তো ভালোভাবে বাজারই বসে না।’ হাই তুলতে তুলতে বলেছিল ঋতি।

‘সেটা আমিও জানি। কিন্তু মেকাপ নিয়ে রেডি হতেই তো তোমার ঘণ্টাখানেক লাগবে। কুসুম তো আর সারাদিন ধরে বসে থাকবে না। আর যদি ভেবে থাকো আজও ডালসেদ্ধ, আলুসেদ্ধ দিয়ে চালিয়ে পয়সা বাঁচাবে, তবে যাও। আবার শুয়ে পড়ো গিয়ে। তোমার তো ইচ্ছে ঘুম। চিন্তাভাবনা তো নেই কিছু।’

সবসময় সুরমা এইরকম ঠুকে ঠুকে কথা বলেন। সাধারণত চুপ করেই থাকে ঋতি। কিন্তু আজ হঠাৎই গরম হয়ে গেল মাথাটা। বলবে না বলবে না করেও বলে উঠল, ‘কীসে পয়সা বাঁচাতে দেখলে? যা বলছ তাই তো করা হচ্ছে। পয়সার জন্য কী আটকেছে তোমার?’

‘পাড়ার ডাক্তার দেখিয়ে আমার চিকিৎসা করানো পয়সা বাঁচানো ছাড়া কী? সুগার, প্রেসার নর্মাল থাকলেই মানুষ সুস্থ থাকে? হাঁটুর ব্যথাটা কবে থেকে ভোগাচ্ছে, একজন ভালো হাড়ের ডাক্তারকে দেখানোর কথা একবারও মনে হয়েছে তোর?’

‘ডক্টর সাধুখাঁ এম.ডি./মা। যথেষ্ট নামকরা ডাক্তার। উনি যে ব্যায়ামগুলো করতে বলেছিলেন একদিনও করেছ? ব্যায়াম না করলে ব্যথা এমনি এমনি কমবে? যাকেই দেখাও, ব্যায়ামই প্রেসক্রাইব করবেন।’

‘তুই তো সব জেনে বসে আছিস। বেশি জেনেই তো এই দশা। আইবুড়ো থেকে হাড় মাস জ্বালিয়ে খাচ্ছিস আমার। তোর দিদিদের বাড়ি গিয়ে দু’দিন যে জুড়িয়ে আসব সে উপায় অবধি নেই। জীবনভর মেয়ের হেঁশেল সামলাতে হবে।’

চুপ করে যায় ঋতি। মিথ্যে কথার কী জবাব দেবে সে? বড়দি, মেজদি কখনও মাকে নিজেদের কাছে নিয়ে রাখতে চায় না। যেহেতু ঋতি ভালো চাকরি করে এবং তার বিয়ে হয়নি, তাই মাকে দেখার দায়িত্বটা শুধুই যেন তার। সে কারণেই ছত্রিশ পেরনো ঋতির বিয়ের প্রসঙ্গ সযত্নে এড়িয়ে চলে সকলে। ঋতির হেঁশেল সামলায় রাতদিনের লোক কুসুম। কুটোটা নাড়তে হয় না মাকে। কথা বাড়াতে আর রুচি হল না ঋতির। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘কুসুমকে চা বসাতে বলো। আমি আসছি। আর আসছে সপ্তাহেই একজন অর্থপেডিককে দেখিয়ে আনব তোমায়।’

সুরমা কিছুতেই খুশি হল না। ওঁর কপালে বিরক্তির গভীর আঁচড়গুলো কিছুটা নরম দেখাল শুধু।

বাজার থেকে ফিরে সোফায় বসে তখন দ্বিতীয় দফার চা খাচ্ছিল ঋতি। চোখ বোলাচ্ছিল খবরের কাগজের হেডিংগুলোয়। অচেনা নম্বর থেকে ফোনটা তখনই এসেছিল। ভুরুতে হালকা ভাঁজ ফেলে ফোনটা ধরেছিল, ‘হ্যালো।’

‘হ্যালো! চিনতে পারছ?’—সুরেলা মহিলা কণ্ঠ মোটেই চেনা নয়। ঋতি যখন স্মৃতি হাতড়াচ্ছে, দূরভাষিণী বলে উঠেছিল, ‘আমি দেবযানী দত্ত বলছি।’

হাতে ধরা চায়ের কাপটা থেকে কিছুটা চা চলকে পড়েছিল ঋতির কামিজে। হৃৎপিণ্ডের গতি মুহূর্তেই কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কথা জোগাচ্ছিল না মুখে।

‘জানি, তুমি খুব অবাক হচ্ছ। হয়তো ভাবছ এটা আমার নতুন কোনো চাল। কিন্তু বিশ্বাস করো এর মধ্যে কোনো চালাকি নেই। সবকিছুর জন্যই তো একটা প্রস্তুতি লাগে তাই না? আমার হয়তো সময়টা একটু বেশিই লেগেছে। আল্টিমেটলি আই হ্যাভ ডিসাইডেড ঋতি। কিন্তু তার আগে একবার আমি দেখতে চাই তোমাকে। আজ একটিবার তুমি আসবে?’ আন্তরিক শুনিয়েছিল দেবযানীর কথাগুলো।

বিশ্বাস—অবিশ্বাসের দোলাচলে কেঁপে উঠেছিল ঋতি। হঠাৎই যেন অনেকখানি অক্সিজেন ঢুকে গিয়েছিল বুকের ভেতর। ঋতি নয়, যেন অন্য কেউ বলে উঠেছিল, ‘যাব…।’

‘আমার আর একটা কথা রাখতে হবে তোমায়।’

থমকে গিয়েছিল ঋতি, ‘বলুন।’

এখানে আসার কথাটা এখন কাউকে বলতে পারবে না তুমি। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, হোয়াট আই মিন?’

বুঝতে পেরেছিল ঋতি। কাউকে কিছু বলেনি সে। বিকেলে দার্জিলিং থেকে যখন ফোন করেছিল মনোজিৎ, এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি তাকে। আসলে ঋতি ভয় পেয়েছিল। কথার খেলাপ করলে আবার যদি মত বদলায় দেবযানী।

পায়ে পায়ে কখন সিঁড়িগুলো পেরিয়ে এসেছে বুঝতেই পারেনি ঋতি। ভেলভেটের পর্দা সরাতেই ঘরের মাঝখানে চওড়া খাটে শুয়ে থাকা মধ্য বয়সিনী মাথাটা একটু তুলে বললেন, ‘এসো ঋতি। ভেতরে এসো।’

এই দেবযানী? একসময় যে নজরকাড়া রূপসী ছিলেন দেখলেই বোঝা যায়। এক বছর আগের সেরিব্রাল অ্যাটাক সেই রূপের অনেকখানি কেড়ে নিলেও সবটা পারেনি। ওঁর শরীরের বাঁ দিকটা অ্যাফেকটেড হয়েছিল। নিয়মিত ফিজিওথেরাপিতে কিছুটা উন্নতি হলেও একা একা এখনও চলাফেলা করতে পারেন না দেবযানী। তবে কথার মধ্যে কোনো জড়তা নেই।

বিছানার সামনে একটা গদিআঁটা চেয়ারে ঋতিকে বসতে বললেন দেবযানী। শুয়ে শুয়েই বেডসাইড টেবিলের পাশে একটা সুইচ টিপলেন। ঋতি তখনই লক্ষ করল টেবিলটায় প্রচুর ওষুধপত্র রাখা। কিছুক্ষণের মধ্যে বছর পঁচিশের একটি রোগা বউ দৌড়ে ঘরে এল, ‘ডাকছিলেন বউদিমণি?’

‘আমায় একটু বসিয়ে দে তো শম্পা।’

হেডবোর্ডে কয়েকটা বালিশের ঠেস দিয়ে সাবধানে দেবযানীকে বসিয়ে দিল শম্পা। দেবযানী বললেন, ‘ভালো করে দু’কাপ চা নিয়ে আয়।’

‘আমার কিন্তু চায়ের দরকার নেই।’ অপ্রতিভ গলায় বলল ঋতি।

‘তুমি আজ প্রথম এলে। একটু চা—ও না খাওয়ালে বাইরে গিয়ে নিন্দে করবে যে। সেটি হচ্ছে না।’

শম্পা চলে গেল। ঋতি অনুভব করছিল একটা অপরাধবোধ খুব ধীরে ধীরে মাথা তুলছে চেতনার গভীরে। যে দেবযানীর কথা শুনে এসেছে ঋতি, সামনের মহিলার সঙ্গে তাকে যেন মেলানো যাচ্ছে না। সব হিসাব কেমন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে।

পাশাপাশি টেবিলে কাজ করতে করতে কবে যে একটা সহজ বন্ধুতা গড়ে উঠেছিল দুজনের ঋতি বা মনোজিৎ কেউই বুঝতে পারেনি।

ঋতি লক্ষ করত হুল্লোড়ে, হাসিখুশি মনোজিৎ মাঝেমাঝেই কেমন বদলে যেত। গুম হয়ে থাকত ক’টাদিন। তারপরে অবশ্য আবার আগের মতো হয়ে যেত।

ক্যান্টিনে একসঙ্গে টিফিন খেতে খেতে একদিন ঋতি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মাঝে মাঝে আপনার কী হয় বলুন তো? হঠাৎ এত গম্ভীর হয়ে যান, কথা বলতেও ভয় করে। একটুও ভালো লাগে না তখন।’

কেমন একটা চোখে ঋতির দিকে তাকিয়েছিল মনোজিৎ। শিরশির করে উঠেছিল ঋতির শরীরটা। চোখ সরিয়ে নিতে নিতে মনোজিৎ বলেছিল, ‘আরেকদিন বলব।’

সেই দিনটা আসতে কেটে গিয়েছিল বেশ কয়েকটা সপ্তাহ। এক শনিবার ছুটির পর মেট্রো অবধি ঋতিকে এগিয়ে দিতে দিতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল মনোজিৎ। দেবযানীর কথা সেদিনই প্রথম শুনেছিল ঋতি। শুনেছিল ভালোবাসাহীন একটা সম্পর্কের জের টেনে চলার যন্ত্রণার কথা।

এক ছাদের তলায় থেকেও দেবযানীর জগৎ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তার ডিকসনারিতে ‘কম্প্রোমাইজ’ বলে কোনো শব্দ ছিল না। নিজের বুটিকের ব্যবসা, বন্ধুবান্ধব, ক্লাব, পার্টির বাইরে কারওর জন্য সময় ছিল না দেবযানীর। জন্মের পর থেকেই একমাত্র মেয়ে থাকত আয়ার কাছে। মনোজিৎ—এর আপত্তি সত্ত্বেও মাত্র ক্লাস থ্রি—তেই দেবযানী মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছিল কার্শিয়াং—এর কনভেন্ট স্কুলে। ছুটি ছাটাতে যখন আসত পৌলমি তখনও পেত না মাকে। দিনের পর দিন অফিস ছুটি নিয়ে মেয়েকে সঙ্গ দিত মনোজিৎ। আসলে প্রথম থেকেই বাচ্চচা চায়নি দেবযানী। মনোজিৎ—এর জেদাজিদিতে শর্তসাপেক্ষে মা হতে রাজি হয়েছিল। বলেছিল, বাচ্চচার সবরকম দায়িত্ব সামলাতে হবে মনোজিৎকেই। মনোজিৎ ভেবেছিল মা হলে বদলে যাবে দেবযানী, ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। ব্যবসাটাও মন দিয়ে করত না দেবযানী। কর্মচারীদের হাতে ছেড়ে দিলে ব্যবসার যা হাল হয় তাই হয়েছিল। কিন্তু ঠাটবাটের কমতি ছিল না। টাকার জোগানে টান পড়লেই তুমুল অশান্তি শুরু করত দেবযানী। মনোজিৎ—এর বড়দা আলাদা থাকলেও পারিবারিক জুয়েলারির ব্যবসাটা যৌথ মালিকানাতেই। বড়দাই মূলত দেখাশোনা করেন। সেখান থেকে যে শেয়ারটা পায় মনোজিৎ সেটাও কম নয়। কিন্তু তবুও যেন কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছিল না। একরকম বাধ্য হয়েই এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে দার্জিলিং—এর একটা হোটেল লিজ নিয়েছিল মনোজিৎ।

‘টাকা দিয়ে অনেক কিছু কেনা যায় হয়তো, কিন্তু শান্তি কেনা যায় না।’ বিষণ্ণ গলায় বলেছিল মনোজিৎ।

ভারী হয়ে উঠেছিল ঋতির মনটাও।

ছ’মাসের মাথায় ঋতি আর মনোজিৎ—এর সম্পর্কটা হঠাৎ করেই বাঁক নিয়েছিল একদিন। অফিসফেরত একটা রেস্তোরাঁর কেবিনে পাশাপাশি বসেছিল ওরা। স্যান্ডুইচের প্লেট নাড়াচাড়া করতে করতে মনোজিৎ বলেছিল, ‘আমি আর পারছি না ঋতি। একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছি।’

‘দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ সহানুভূতির গলায় বলেছিল ঋতি।

‘কিচ্ছু ঠিক হবে না। কিচ্ছু ঠিক হবার নয়। একদিন দেখো, নিজেকে শেষ করে দেব আমি।’ ভাঙাচোরা গলায় বলে উঠেছিল মনোজিৎ।

আমূল কেঁপে উঠেছিল ঋতি। নিজের অজান্তেই মনোজিৎ—এর একটা হাত টেনে নিয়েছিল দু’হাতের মুঠিতে, ‘এসব কী বলছ যা তা?’

পলকেই কী যে হয়ে গেল! ঋতিকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে বাচ্চচাদের মতো ফুঁপিয়ে উঠেছিল মনোজিৎ। পাড় ভাঙার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল ঋতি। শুরুটা হয়তো আগেই হয়েছিল। বুঝতে পারেনি ঋতি। সমর্পণ তাই বুঝি অমন অনায়াস ছিল। তার উন্মুখ ঠোঁটের গভীর থেকে যেন জীবনের আশ্বাস শুষে নিচ্ছিল মনোজিৎ।

এক ছুটির সকালে লংড্রাইভে যেতে যেতে ঋতি বলেছিল, ‘সমাজের কাছে আমার পরিচয়টা একবারও ভেবে দেখেছ? ঠারে ঠোরে অনেক কথা কানে আসে। কী বলব? চুপ করে থাকি।’

‘ব্যাপারটা নিয়ে আমিও ভেবেছি ঋতি। মিউচুয়াল সেপারেশনের জন্য আমি অলরেডি কথা বলেছি ল’ইয়ারের সঙ্গে।’

‘কিন্তু পৌলমী? সে মেনে নেবে? ও তো আর ছোটটি নেই এখন। ওরও তো একটা মতামত আছে।’

‘ছেলেবেলা থেকেই তো দেখেছে মা কে। মানসিক কোনো সম্পর্কই নেই দেবযানীর সঙ্গে। ছুটিতে যখন বাড়িতে আসে ওর সবকথা আমার সঙ্গে। আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মতো। তোমার কথা ও জানে। ওর কোনো আপত্তি নেই।’

অবাক চোখে চেয়ে থাকে ঋতি। মা—মেয়ের বোঝাপড়া কোন তলানিতে এসে ঠেকলে মেয়ের এমন মনোভাব হয়? ভাবছিল ঋতি। তারপর বলেছিল, ‘দেবযানীকে বলেছ?’

গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল মনোজিৎ। বলেছিল, ‘তার সঙ্গে যখন রাতে দেখা হয়, কোনোদিনই সুস্থ অবস্থায় থাকে না। আর সকালে আমি যখন বের হই তখন তার মাঝরাত।’ একটু থেমে যোগ করেছিল, ‘তবু বলতে তো হবেই। আজই বলব।’

পরদিন থেকে অফিসে আসছিল না মনোজিৎ। ফোনেও ধরা যাচ্ছিল না তাকে। অস্থির হয়ে উঠেছিল ঋতি।

দু’দিন বাদে ছুটির পর ডালহৌসী থেকে চাঁদনিচক মেট্রো স্টেশনে যাওয়ার পথে ফোন এসেছিল মনোজিৎ—এর। ঋতি কোথায় আছে জেনে নিয়ে সেখানেই অপেক্ষা করতে বলেছিল ঋতিকে। ট্রাম কোম্পানির অফিসের সামনে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বাইক নিয়ে হাজির হয়েছিল মনোজিৎ। তাকে দেখে আঁতকে উঠেছিল ঋতি। মাথায় ব্যান্ডেজ, উসকো—খুসকো চেহারা। মনোজিৎ—এর মুখে সবকিছু শুনে বোবা হয়ে গিয়েছিল ঋতি।

পরশুরাতেই ডিভোর্সের কথা বলেছিল মনোজিৎ। সঙ্গে সঙ্গেই ভায়োলেন্ট হয়ে উঠেছিল দেবযানী। নোংরা গালাগালি দিতে দিতে জিনিসপত্র ছুড়তে শুরু করেছিল। দেবযানীর ছোড়া ফুলদানিতেই কপাল ফেটে গিয়েছিল মনোজিৎ—এর। তিনটে স্টিচ পড়েছিল। সে রাতেই মণি মুখার্জি রোডের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল মনোজিৎ। ক’দিন বন্ধুর বাড়িতেই ছিল। তারপর গড়িয়াতে একটা টু বেডরুম ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে উঠে এসেছিল।

দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছিল তিনটে বছর। ডিভোর্স পেপারে সই করেনি দেবযানী।

এক বছর আগে যখন সেরিব্রাল হল দেবযানীর, ডাক্তার, নার্সিংহোম সবকিছু মনোজিৎকেই করতে হয়েছিল। মনের অগোচরে পাপ নেই। ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে গিয়েছিল ঋতি। ওদের ভাঙা সম্পর্কটা জোড়া লেগে যাবে না তো?

ঋতির আশঙ্কা সত্যি হয়নি অবশ্য। দেবযানী কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরেই সরে এসেছিল মনোজিৎ।

কিছুদিন আগে দেবযানী, মনোজিৎ—এর কমন ফ্রেন্ড তিলোত্তমা মনোজিৎকে জানিয়েছে, এবার নাকি সেপারেশনের ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবছে দেবযানী।

বিশ্বাস করতে ভয় করত ঋতির। তবু গোপন একটা অপেক্ষা তো ছিলই।

দীর্ঘ সেই প্রতীক্ষা শেষ হতে চলেছে। কিন্তু উচ্ছ্বাসটা কেন যে আসছে না সেভাবে? কাঁটার মতো কী যেন একট খচ খচ করছে। করেই চলেছে।

‘কী এত ভাবছ বলো তো?’ দেবযানীর প্রশ্নে চমকে ওঠে ঋতি।

‘এখন কেমন আছেন আপনি?’ সহজ হওয়ার চেষ্টা করে ঋতি।

‘ভালোই। দিন—রাত বিছানায় শুয়ে শুয়ে যতটা ভালো থাকা যায় আর কি। হুইলচেয়ারে বসিয়ে শম্পা মাঝে মাঝে ব্যালকনিতে নিয়ে যায়। বেশিক্ষণ বসতে পারি না। আবার এনে শুইয়ে দেয়। কী বিড়ম্বনা বলো তো। এরচেয়ে একেবারে চলে যাওয়াই ভালো ছিল। তাই না? তোমাদেরও সুবিধে হত।’

মুখটা কালো হয়ে যায় ঋতির। কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। তখনই হেসে ওঠেন দেবযানী, ‘ঘাবড়ে গেলে নাকি? মজা করছিলাম।’

দেবযানীর কথার মাঝখানেই চা আর স্ন্যাক্সের ট্রে হাতে ঘরে এল শম্পা। কোনার দিক থেকে একটা গোল টেবিল টেনে এনে ট্রে—টা রাখল। একটা কাপ তুলে ঋতিকে দিয়ে অন্য কাপটা নিয়ে দেবযানীর কাছে গিয়ে বসল।

‘চা টা আমার হাতে দিয়ে তুই এখন যা।’ বললেন দেবযানী।

‘তোমার অসুবিধে হবে তো। চা টা খাইয়ে দিয়ে যাই?’

‘কিচ্ছু অসুবিধে হবে না। ডান হাতটা তো ঠিক আছে রে বাবা। তাছাড়া ঋতিও তো আছে। তুই যা।’

একরকম বাধ্য হয়েই চলে যায় শম্পা। মাথা নিচু করে চা খাচ্ছিল ঋতি। বুঝতে পারছিল দেবযানী তাকেই দেখে যাচ্ছেন। অস্বস্তি হচ্ছিল তার। দেবযানী তখনই বললেন, ‘আমি খুব খারাপ। কত যে খারাপ ভাবতেও পারবে না তুমি। মা ছিল না তো। ছোটবেলা থেকেই স্পয়েল্ড হয়ে গিয়েছিলাম। সত্যিকারের সহমর্মিতা, ভালোবাসা কোনোদিন পাইনি। তাই বোধহয় এত ডেস্ট্রাকটিভ আমি, শুভ কিছু, সুন্দর কিছু সহ্য করতে পারি না।’

ঋতি বুঝতে পারছে না, ঠিক কী বলতে চাইছেন দেবযানী। ঋতির দিকে চেয়ে একটু বুঝি থমকে গেলেন দেবযানী। মৃদু হেসে বললেন, ‘তোমাকে খুব বোর করছি না? আর সময় নষ্ট করব না তোমার। তুমি একটু কষ্ট করে ডানদিকের ওই আলমারিটা খোলো তো।’

‘আমি!’ অবাক ঋতি।

‘তাছাড়া আর কে আছে এখানে? এদিকে বিছানার তলা থেকে চাবিটা নিয়ে আলমারিটা খোলো। একদম ওপরের তাকে একটা ফাইল আছে, সেটা নিয়ে, আর ওই ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা পেন নিয়ে আমার কাছে এসো।’

দেবযানী যা যা বললেন একে একে তাই করে গেল ঋতি। ফাইলটা খুলতেই পাওয়া গেল ডিভোর্স পেপার। গোটা গোটা অক্ষরে সই করে দিলেন দেবযানী। একটু যেন ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। হাঁপ নিয়ে বললেন, ‘ওই গ্লাসটা একটু দেবে ঋতি? বড্ড তেষ্টা পাচ্ছে।’

টেবিল থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে ঢাকনা খুলে এগিয়ে দিল ঋতি। জল খেতে গিয়েই ঘটল বিপত্তিটা। বিষম খেয়ে হিক্কার মতো উঠতে লাগল। দেবযানীর মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল ঋতি। হিক্কাটা কমলেও প্রবলভাবে কাশতে লাগলেন দেবযানী।

ভয় পেয়ে ঋতি বলে উঠল, ‘কষ্ট হচ্ছে আপনার? শম্পাকে ডাকব?’

হাতের ইশারায় ঋতিকে নিষেধ করলেন দেবযানী। থেমে থেমে বললেন, ‘এরকম প্রায়ই হয়। ওই টেবিলে দেখো একটা কালো মতো সিরাপের শিশি আছে। ওখান থেকে দু ঢাকনি দাও তো আমাকে।’

সিরাপের শিশি থেকে ঢাকনি মেপে গ্লাসে ওষুধ ঢালতে ঢালতে ঋতি শুনল কাশতে কাশতেই দেবযানী বলছেন, ‘অনেক কষ্ট দিলাম তোমাকে। কিন্তু তোমাদের নতুন জীবন শুরুর চাবিকাঠিটাও তো দিয়ে দিলাম বলো। অনেক শুভেচ্ছা রইল।’ একটু দম নিয়ে আবার বললেন, ‘ভেবোনা মৌখিক শুভেচ্ছা জানিয়েই দায় সারব আমি। উপহারটা ডিউ থাকল। সময়—মতো ঠিক পাঠিয়ে দেব।’ হাঁপাচ্ছিলেন দেবযানী।

এত কথা কেন যে বলছেন দেবযানী? কাশি তো আরও বেড়ে যাবে। খুব যত্ন করে দেবযানীকে ওষুধটা খাইয়ে দিল ঋতি।

কমে এসেছে কাশিটা। কাশির ধকলেই বোধহয় বেশ কাহিল দেখাচ্ছে দেবযানীকে। শ্রান্ত গলায় দেবযানী বললেন, ‘এবার এসো তুমি। সাবধানে যেও।’

সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে কেন যেন শির শির করছিল ঋতির চোখ দুটো। হিসেবটা মিলছে না কিছুতেই।

বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল ঋতির। পাহাড়ে রাত গভীর হয় আরও তাড়াতাড়ি। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে মনোজিৎ। সুখবরটা কালই দেবে। ভাবল ঋতি।

পরদিন সকালে বেজে চলা পরিচিত রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙল ঋতির। মোবাইল কানে চাপতেই ভেসে এল মনোজিৎ—এর উদ্বিগ্ন গলা, ‘কাল তুমি মণি মুখার্জি রোডের বাড়িতে গিয়েছিলে কেন?’

‘তুমি কী করে জানলে?’ অবাক ঋতি।

‘টিভিতে দেখাচ্ছে। প্রতিটা চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ এটা।’

‘মানে? ইয়ারকি হচ্ছে?’

‘ইয়ারকি নয়। টিভিটা খুললেই বুঝতে পারবে। কাল রাতে খুন হয়েছে দেবযানী। কাশির ওষুধের সঙ্গে বিষ খাইয়ে খুন করা হয়েছে। রঘুদাদার কাছ থেকেই পুলিশ জানতে পেরেছে তোমার কথা। আমাকেও ফোন করেছিল পুলিশ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরতে বলেছে। কিন্তু আমাকে কিছু না বলে তুমি হঠাৎ কেন যেতে গেলে ও বাড়িতে?’

থর থর করে কাঁপছে ঋতি। ঋতির কাছে কালকের সমস্ত ঘটনা শুনতে শুনতে পাথর হয়ে যাচ্ছে মনোজিৎ। সিরাপের শিশিতে, গ্লাসে, আরও কত জায়গায় কী নিপুণ চালাকিতে ঋতির ফিঙ্গার প্রিন্ট ধরে রেখেছে দেবযানী! ঋতির সঙ্গে তার ঘর বাঁধার ছাড়পত্রে সই করে কী দারুণ সারপ্রাইজটাই না দিয়ে গেল দেবযানী! কী যেন দলা পাকিয়ে যায় মনোজিৎ—এর গলায়।

‘কাল দেবযানীর অনেক কথা হেঁয়ালির মতো লাগছিল জানো। এখন সবকিছু জলের মতো পরিষ্কার আমার কাছে। আমি বোকা মনোজিৎ…’ কান্নায় বুজে আসে ঋতির গলা।

ঠিক তখনই কারা যেন জোরে জোরে নক করতে থাকে দরজায়। মা, কুসুমের চেঁচামেচি ছাপিয়ে ঋতি শুনতে পায় একটা ভারী গলা, ‘…মিস সেন…দরজাটা খুলুন….মিস সেন….দরজা ভাঙতে বাধ্য করবেন না আমাদের…শুনতে পাচ্ছেন….’

‘হ্যালো! ঋতি! কী হল! কথা বলছ না কেন?…’ মনোজিৎ—এর চিৎকার, দরজার আওয়াজ চাপা পড়ে যাচ্ছে একটা অশরীরী হাসিতে। ঋতি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে দেবযানীর গলাটা—’উপহার পছন্দ হয়েছে ঋতি? বলেছিলাম না সময়মতো পাঠিয়ে দেব…।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *