প্রস্তর ঘাতক – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

প্রস্তর ঘাতক – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

দিবাকরদা যে ঘরে বসে আছেন ঈশান সে ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ৷ একদম সাজিয়ে গুছিয়ে বসেছেন দিবাকরদা ৷ ডান হাতে স্কচের গ্লাস, বাঁ হাতের মুঠোর মধ্যে বেশ কায়দা করে ধরা জ্বলন্ত সিগারেট ৷ চারপাশে আট-দশ-জন আয়োজক ৷ তাদের মুখ থেকে নিজের স্তুতি শুনছেন দিবাকরদা ৷ এক ভদ্রলোক তাঁর উদ্দেশে বললেন, আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে কলকাতা থেকে আপনি যে এতদূর ছুটে আসবেন তা এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না ৷ অনুষ্ঠানটা আমরা ভোপালে বা সাতনায় করতেই পারতাম কিন্তু এখানে করলাম কারণ, আপনার মতো গুণী মানুষ যাঁরা আসছেন তাঁরা অনুষ্ঠানের সাথে সাথে এই খাজুরাহোটাও ঘুরে দেখতে পারবেন ৷

 লোকটার কথা শুনে দিবাকরদা মৃদু হেসে বললেন, ‘তাহলে লোভ দেখিয়ে টেনে আনলেন বলছেন? এ জায়গা কিন্তু আমার দেখা ৷ বছর কুড়ি আগে আমরা কয়েকজন লেখক বন্ধু মিলে এখানে বেড়াতে এসেছিলাম ৷ সে অর্থে এ জায়গা আমার কাছে, এখানে সেই একটা সুর সুন্দরীর মূর্তি আছে না, যে নৃত্যের ভঙ্গিমায় এক পায়ে দাঁড়িয়ে আর এক পা থেকে কাঁটা তুলছে? মনে আছে আমার ৷ এখানে তো অনেক মন্দির আছে! হিন্দু মন্দির, জৈন মন্দির ৷’

 তাঁর কথা শুনে একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, হ্যাঁ, পার্শ্বনাথের মন্দিরের গায়েই অমন মূর্তি আছে ৷ আমি আসলে ঠিক আপনার কথা বলতে চাইনি ৷ আপনি এত বড় সাহিত্যিক ৷ আপনি যে দেশবিদেশের সর্ব্রত্র ঘুরেছেন ৷ এই খাজুরাহো আপনার নিশ্চয়ই দেখা থাকবে ৷ আসলে অন্য এমন অনেকে আসবেন যাদের এ জায়গা দেখা নেই ৷’

 দিবাকরদা লোকটার কথার প্রতুত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ঈশানকে দেখতে পেয়ে হুইস্কির গ্লাসটা উচিয়ে ধরে প্রথমে বললেন, এসো, এসো, বসে পড়ো ৷ লজ্জা কোরো না ৷ আরও একটা গ্লাস আছে ৷’ তারপর অন্যদের উদ্দেশে বললেন, ঈশান কিন্তু খুব ভালো লিখছে ৷ আমরা আর কতদিন লিখব, ওরাই এখন বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ ৷ তাই আপনারা যখন কোনো তরুণ লেখককে সঙ্গে আনার কথা বললেন, তখন ওর কথা আমার মাথায় এল ৷ আপনারা কেউ পড়েছেন ওর লেখা?

 সুতরাং একটা নিস্তব্ধতাই ঈশানকে বুঝিয়ে দিল তারা পড়েনি ৷ অবশ্য পড়ার কথাও নয়, আসলে প্রথমত কলকাতার সব বাংলা কাগজ আসে না ৷ তাছাড়া মাত্র বছর চারেক লিখতে শুরু করেছে ঈশান ৷ মাত্র তিনটে বই তার ৷ কলকাতায় তার লেখা কিছুটা পরিচিতি পেলেও এত তাড়াতাড়ি এত দূরে তার নাম ছড়াবে তা ঈশান আশা করে না ৷ সেটাই স্বাভাবিক ৷ কিন্তু ঘরের লোকগুলো ঈশান যাতে ব্যাপারটাতে অপ্রস্তুত না হয় সে জন্য তার লেখা পড়েছে কিনা সে জবাব না দিয়ে একসাথে বলে উঠল, ‘ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে আসুন, ভিতরে আসুন?’

 এখানে আসার পর ভোপালের বঙ্গভাষী সমিতির আয়োজকরা ঈশানের প্রতি আতিথেয়তার ত্রুটি না রাখলেও ঈশানের নিজের মনের ভিতর কেমন যেন লজ্জা বোধ হচ্ছে ৷ তার খালি মনে হচ্ছে নিজের যোগ্যতায় নয়, দিবাকরদার সঙ্গী বলেই সবাই খাতির করছে তাকে ৷ আরও অনেক অতিথি অভ্যাগত এসেছেন এই সাংস্কৃতিক বঙ্গ সম্মেলনে ৷ তাদের কেউ চিত্রকর, কেউ নাট্যকর্মী, কেউ অধ্যাপক, কেউ বা নৃত্যশিল্পী ৷ এই রিসর্টেরই নানা ঘরে তাঁরা আছেন ৷ কিন্তু নাম আর খ্যাতির বিচারে উদ্যোক্তাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু দিবাকরদাই ৷ আর দিবাকরের আলোকছটা ঈশানের গায়েও লাগছে ৷ তাই উদ্যোক্তারা তাকেও খাতির করছে ৷’

 দিবাকরদা ও অন্যদের কথা শুনে ঈশান বলল, ‘না, না, আপনারা বরং গল্প করুন ৷ জানলা দিয়ে দেখলাম কিছুটা দূরে একটা মন্দির দেখা যাচ্ছে ৷ ওদিকটায় একবার দেখে এলে অসুবিধা হবে?’

 একজন লোক, সম্ভবত স্থানীয় কেউ হবেন, তিনি হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আটটা বাজে ৷ রাত হলেও এখানে তেমন কোনো অসুবিধা নেই ৷ চোর-ডাকাতের ভয় নেই ৷ ওটাই কান্তরিয় শিব মন্দির ৷ যেতে পারেন ৷ তবে কাল তো দুপুরে আমাদের অনুষ্ঠান শুরু, সকালবেলায় আপনাদের এখানকার প্রধান মন্দিরগুলো ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে ৷ গাইডও থাকবে সঙ্গে ৷ সব বুঝিয়ে দেবে ৷

 ঈশান বলল, ‘তখন তো দেখবেই ভালো করে ৷ আসলে দেখলাম বাইরে জ্যোৎস্না ফুটেছে ৷ মন্দিরটাও দেখা যাচ্ছে, তাই ভাবলাম… তার কথা শেষ হতে না হতেই দিবাকরদা হেসে বললেন, ‘যাও তবে ঘুরে এসো, বুঝতে পারছি তোমার আর ওসব দেখার তর সইছে না ৷ তোমার বয়সে আমি যখন এসেছিলাম তখন আমারও এমন আগ্রহ ছিল ঐ মূর্তিগুলো নিয়ে ৷ বহুদিন ধরে শুনতাম ওদের কথা ৷ দেখে এসো, তারপর স্বপ্নে আহ্বান করো ওদের ৷’ এই বলে চোখ মটকালেন তিনি ৷’

 তাঁর কথা শুনে একটা চাপা হাসির রেখা খেলে গেল উপস্থিত সকলের ঠোঁটের কোণে ৷ দিবাকরদার ইঙ্গিতটা স্পষ্ট ৷ এই খাজুরাহোর মন্দিরগুলোর গায়ে অসংখ্য মিথুনমূর্তি আছে ৷ অনেকে সেই মূর্তিগুলোর টানেই এখানে ছুটে আসেন ৷ বসনহীন নারী-পুরুষের মুর্তি সব ৷ এ ব্যাপারটা না দেখলেও শোনা আছে ঈশানের ৷ এখানে আসার পর এক ফাঁকে একটা পোস্টকার্ড পিকচার বুক কিনেছে ঈশান ৷ তাতেও ছবি আছে তেমন কিছু ভাস্কর্যের ৷ দিবাকরদার মুখে এতগুলো লোকের সামনে এ কথা শুনে বেশ লজ্জা পেল ঈশান ৷ সে আর কথা না বলে এগোল রিসর্ট ছেড়ে বাইরে বেরোবার জন্য ৷ রিসর্টের গেটে দাঁড়িয়ে ছিল সিকিউরিটির একজন লোক ৷ বাইরে বেরোবার আগে ঈশান তবু তাকে একবার বলল, ‘ঐ যে মন্দিরটা দেখা যাচ্ছে ওখানে একবার যাচ্ছি, কোনো অসুবিধা হবে না তো?’

 লোকটা হিন্দিতে জানাল, ‘না, কোনো অসুবিধা নেই, রাতে মাঝে মাঝে পুলিশ পেট্রল হয় ৷ তারা জিজ্ঞেস করলে বলবেন আপনি এখানে উঠেছেন ৷ আপনার গলায় আইডেন্টিটি কার্ড তো ঝুলছেই ৷ কোনো সমস্যা হবে না ৷ ওই কান্তারিয় মন্দিরেই একমাত্র পূজা হয় ৷ তবে মন্দিরের পুরোহিত সন্ধ্যারতি শেষ করে এতক্ষণে মনে হয় চলে গেছেন ৷ যান দেখে আসুন ৷ লোকটার কথায় আশ্বস্ত হয়ে রিসর্ট ছেড়ে বাইরে বেরোল ঈশান ৷

 শীতের রাত ৷ ফাঁকা রাস্তা ৷ ট্যুরিস্টপার্টি যারা খাজুরাহো দেখতে এসেছিল তারা হয় ফিরে গেছে অথবা হোটেল রিসর্টে কম্বলের তলায় রাত্রিবাস করছে ৷ কুয়াশা নামতে শুরু করলেও চাঁদের আলোতে মোটামুটি সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ৷ দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন সব মন্দিরের চুড়ো ৷ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ওভাবেই চাঁদের দিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে আছে তারা ৷ কান্তারিয় মন্দির রির্সর্ট থেকে যত কাছে মনে হয়েছিল ঠিক তত কাছে নয় ৷ নির্জন পথে হাঁটতে মন্দ লাগছিল না ঈশানের ৷ এক সময় পিছনের হোটেল রিসর্ট থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ শব্দটুকুও মিলিয়ে গেল ৷ মিনিট পনেরো চলার পর মন্দিরের কাছাকাছি পৌঁছতেই ঈশানের সামনের সব কিছু হঠাৎ যেন ঝাপসা হয়ে গেল ৷ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ঈশান ৷ ব্যাপারটা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল ৷ আসলে একটা কুয়াশার চাদর হঠাৎই যেন নেমে এসেছে মন্দিরের চারপাশে, তাই কুয়াশার আড়ালে প্রায় অদৃশ্য মন্দিরটা ৷ গায়ে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে কুয়াশা ভেদ করে সামনে এগোতে লাগল ঈশান ৷ আর তারপর সামনের কুয়াশার পর্দা যেন কেটে গেল ৷ ঈশান দেখতে পেল সুবিশাল প্রাচীন এক মন্দিরের বেদিমূলে এসে দাঁড়িয়ে সে ৷ প্রাচীন পাথরের তৈরি সোপানশ্রেণি তার সামনে থেকে উঠে গেছে বেদির ওপর ৷ আর সেখান থেকে মন্দিরগাত্র পর্বতমালার মতো ধাপে ধাপে পিরামিডের মতো উঠে গেছে চন্দ্রালোকিত আকাশের দিকে ৷ মন্দিরের গায়ে চাঁদের আলোতে জেগে আছে অসংখ্য ভাস্কর্য, অলংকরণ, মূর্তি ৷ অদ্ভুত সুন্দর হাজার বছরের প্রাচীন এক মন্দির! খাজুরাহোর কান্তরিয় মন্দির ৷ চান্দেলা রাজবংশের অতুলনীয় কীর্তি ৷

 অনেকটা মন্ত্রমুগ্ধর মতোই সোপানশ্রেণি বেয়ে ওপরে উঠে এল ঈশান ৷ মন্দিরের ভিতর থেকে কোনো আলো ভেসে আসছে না, কোথাও কোনো লোকজন নেই ৷ শুধু ঘি আর ধূপমিশ্রিত মৃদু সুবাস ছড়িয়ে আছে বাতাসে ৷ রিসর্টের সেই লোকটা সম্ভবত ঠিকই বলেছিল ৷ সন্ধ্যারতি শেষ করে পূজারি মন্দির ছেড়ে চলে গেছেন অনেকক্ষণ আগে ৷ উঁচু বেদি থেকে একবার দূরে চারদিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল ঈশান ৷ কিন্তু কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না ৷ চারপাশে কুয়াশাবৃত্তর আড়ালে যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন মন্দিরটা ৷ মাথার ওপর পূর্ণচন্দ্র যেন শুধু ওপর থেকে মায়াবী আলো ফেলছে মন্দিরের ওপরেই ৷ গর্ভগৃহ অন্ধকার হলেও মন্দিরের শীর্ষবিন্দু থেকে বেদি পর্যন্ত বহিঃগাত্রর সব কিছু স্পষ্ট দৃশ্যমান ৷ ঈশানের কিছুটা তফাতেই বেদিমণ্ডপে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক শার্দূল মূর্তি ৷ বিভিন্ন পশুপাখির শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মিলিয়ে প্রাচীন ভাস্করের দল রচনা করেছিল সেই কল্পিত শার্দূল ৷ ঈশান তার কাছে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখল মূর্তিটাকে ৷ সত্যিই কী অসম্ভব সুন্দর কল্পনা ছিল সে সময়ের শিল্পীদের! তারপর সে ধীর পায়ে প্রদক্ষিণ শুরু করল মণ্ডপ ৷ বয়সের ভারে কিছু কিছু মূর্তি ভেঙে গেলেও মহাকাল তার থাবা সম্পূর্ণ বসাতে পারেনি এই মন্দিরের ওপর ৷ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কত ঝড় জলকে উপেক্ষা করে, মহাকালকে অগ্রাহ্য করে আজও মন্দির গাত্রে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন ভাস্কর্যগুলো ৷ চাঁদের দিকে তাকিয়ে তারা যেন হাসছে ৷ ঈশান ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করল মন্দির গাত্রের ভাস্কর্যগুলো ৷ অসংখ্য দেবদেবী, সুরসুন্দরী, অপ্সরা, যক্ষ, জীবজন্তুর মূর্তি ছড়িয়ে আছে চারদিকে ৷ আর আছে বিভিন্ন ভঙ্গিমার অগুনতি মিথুনমূর্তি ৷ চাঁদের আলোতে তারা সব যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে ৷ তারা যেন কেউ পাথরের তৈরি নয়, রক্তমাংসের মানুষ সব! ঈশান অবাক হয়ে ধীরে ধীরে দেখতে লাগল সেসব ৷

 প্রাচীন শিল্পীরা সেসময়ের মানুষদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের চিত্রও খোদিত করে গেছেন মন্দির গাত্রে ৷ বিশেষত নারীদের অঙ্গ সজ্জার দৃশ্য ৷ ঘুরতে ঘুরতে তেমনই এক দৃশ্যর সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল ঈশান ৷ দেওয়াল-গাত্রে খোদিত সেই ছবিতে এক অপরূপা সুরসুন্দরী বসে আছে ৷ তার এক পা বুকের কাছে, অন্য পা সামনে প্রশস্ত ৷ সে-পায়ে মল পড়িয়ে দিচ্ছে একজন পরিচারিকা ৷ অন্য দুজন পরিচারিকার একজন তাঁর কবরীবন্ধনে ব্যস্ত, আর একজন তার সামনে দর্পণ ধরে আছে ৷ সেই সুরসুন্দরীর দেহসৌষ্ঠব যেন ম্লান করে দিচ্ছে আকাশের চন্দ্রিমাকে ৷ কবরীবন্ধন আর মল পড়ানো শেষ হলেই উঠে দাঁড়াবে উন্নত বক্ষদেশ ম্লান কটির সেই অপরূপা ৷ মূর্তিটার দিকে স্থির দৃষ্টে তাকিয়ে ঈশান ভাবছিল, কীভাবে ভাস্কররা কল্পিত করত এই সব নারীদের! এরা কি সত্যিই ছিল? এই যে দেওয়ালগাত্রে খোদিত এত নারী ৷ মূর্তি, মিথুনরত নারীমূর্তি এ সবই কি নিছক প্রাচীন শিল্পী ভাস্করদের কল্পনা, নাকি সত্যিই একদিন রক্তমাংসর ছিল এই নারীরা? নইলে কীভাবে এত জীবন্তভাবে তাদের রচনা করলেন সে সময়ের শিল্পীরা?

 ‘মগধ, মালব, কামরূপ, বঙ্গ-সমতট থেকে বিশেষ শারীরিক লক্ষণযুক্ত নারীদের সংগ্রহ করে আনা হত এখানে ৷ তারপর তাদের মধ্যে থেকে আবার পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত করা হত কাদের সুরসুন্দরী বা দেবদাসী বানানো হবে ৷ যাদের দেখে মূর্তি নির্মাণ করতেন ভাস্করের দল ৷’ — কথাটা কানে যেতেই চমকে উঠে ফিরে তাকাল ঈশান ৷ যেন মনে মনে নয়, ঈশান প্রশ্নটা কাউকে করে ছিল, আর সে তার জবাব দিল! ঈশানের কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন মহিলা ৷ শাড়ির ওপর শাল জড়ানো ৷ শালের অবগুণ্ঠনের আড়ালে চন্দ্রালোকে তার মুখমণ্ডল যতটুকু দৃশ্যমান, তাতে তাকে যুবতী বলেই মনে হয় ৷ এই নির্জন মন্দিরপ্রাঙ্গণে এত রাতে একাকী তাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল ঈশান ৷ কোথা থেকে এলেন এই মহিলা? তারপর তার মনে হল তিনিও হয়তো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছেন ৷ যখন তিনি বাংলায় কথা বলছেন ৷ আর তাকে দেখে অবাক হবার কিছু নেই ৷ আর মেয়েরা এখন অনেক সাহসী ৷ ঈশান নিজে যদি এত রাত্রে একলা এখানে মন্দির দেখতে আসতে পারে তবে সে-ও আসতে পারবে না কেন?

 ঈশান প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে একটু ইতস্তত করে তাকে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কোথা থেকে এখানে এসেছেন?’

 ‘তিনি মৃদু হেসে জবাব দিলেন ‘ঐ যে বঙ্গ সমতট ৷’

 ঈশান বলল, ‘আমার নাম ঈশান ৷ একটু আধটু লেখালেখি করি ৷ আপনি?’

 মহিলা জবাব দিলেন, ‘আমার নাম সোমদত্তা ৷ এ মন্দির যে সময় তৈরি হয়েছিল সে সময় হলে আমাকে ‘‘নটী’’ বলত, এখন বলা হয় ‘‘নর্তকী’’ ৷’ বেশ জবাব দিচ্ছেন ভদ্রমহিলা ৷ ঈশান এবার হেসে ফেলে বলল, ‘হ্যাঁ, শুনেছি, কলকাতা থেকে একটা ডান্সট্রুপ এসেছে ৷ যদিও তাদের কারো সাথে পরিচযের সুযোগ হয়নি ৷ আপনার সাথেই প্রথম আলাপ হল ৷ এত রাতে একলা এখানে আপনার ভয় করছে না?’

 মুহূর্তর জন্য যেন প্রশ্নটা শুনে চুপ হয়ে গেল সোমদত্তা ৷ তারপর কুয়াশার পর্দা ভেদ করে দূরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে বলল, ‘সত্যি কথা বলতে কি ভয় যে করছে না তা নয়, তবে আপনাকে পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম ৷ চলুন মন্দিরটা এবার ঘুরে দেখা যাক ৷’

 ঈশান বলল, ‘হ্যাঁ, চলুন ৷’

 ধীর পায়ে মন্দির প্রদক্ষিণ করা শুরু করল তারা দুজন ৷ চারপাশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য সব মূর্তি ৷ তার মধ্যে অধিকাংশই সব মিথুনমূর্তি, অথবা স্বল্পবসনা বা বিবসনা নারীমূর্তি ৷ সুন্দর মুখশ্রী, কোমলবাহু, ঘন সন্নদ্ধ স্তনদ্বয়, মাংসল উদরে গভীর নাভিকূপ, ক্ষীণ কটিদেশের নারীমূর্তিগুলো যেন তাকিয়ে দেখছে তাদের দুজনকে ৷ সঙ্গে মহিলা থাকায় প্রাথমিক অবস্থায় ঈশানের যে একটা মৃদু অস্বস্তি হচ্ছিল না তা নয়, তবে চুপচাপ মূর্তিগুলো দুজন মিলে ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে সে অস্বস্তি এক সময় কেটে গেল ৷ ক্রমশ মন্দিরের গোলকধাঁধায় প্রবেশ করল তারা দুজন ৷ মন্দিরের গর্ভগৃহকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ছোট ছোট মন্দির ৷ তার ভিতর আছে অসংখ্য দেবদেবী লক্ষ্মি গণেশ-নারায়ণ ইত্যাদির মূর্তি, স্তম্ভগাত্রে খোদিত আছে শৃঙ্গার দৃশ্য ৷ ঈশান খেয়াল করল সম্ভবত ভদ্রমহিলার পায়ে মল বা নূপুর পরা আছে ৷ মাঝে মাঝে মৃদু ঠুং টাং শব্দ হচ্ছে ৷ এতবড় মন্দির চত্বরে শব্দ বলতে শুধু ওইটুকুই ৷ বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াবার পর মৌনতাভঙ্গ করার জন্য ঈশান বলল, ‘অদ্ভুত সুন্দর মন্দির ৷ এসব ভাস্কর্য কোনারক মন্দিরে কিছুটা দেখা যায়, কিন্তু শুনেছি আর অন্য কোথাও দেখা যায় না ৷ কারা কেন দেবালয়ে তৈরি করল এসব মূর্তি?’ শেষ বাক্যটা স্বগতোক্তির স্বরেই বলল ঈশান ৷

 সোমদত্তা বেশ স্পষ্টভাবে বলল, আপনি ওই মিথুনমূর্তিগুলোর কথা বলছেন তো ৷ দেবালয়ে মিথুনমূর্তি নির্মাণের পিছনে বেশ কয়েকটা কারণ ছিল ৷ সেসময় মানুষের বিশ্বাস ছিল মন্দিরে মিথুন মূর্তি থাকলে বজ্রপাত হয় না ৷ বজ্র স্পর্শ করে না মিথুনরত নারী পুরুষকে ৷ আবার কেউ কেউ বলেন ওই যুগল মূর্তিগুলোর মিলনের মধ্যে দিয়ে দেহের সাথে আত্মার মিলনকে বোঝানো হয়েছে ৷ তাছাড়া সেসময়ের ভাস্কর-শিল্পীরা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সত্যকে গোপন রাখতে চাননি ৷ তা খোদিত করে গেছেন মন্দিরগাত্রে ৷ এক সময় চান্দেল রাজাদের রাজধানী ছিল এই মন্দির নগরী খাজুরাহো ৷ আর এই কান্তরিয় মহাদেব মন্দির-নির্মাণ করিয়েছিলেন মহারাজ বিদ্যাধর ৷ কী আমি ঠিক বলছি তো?’

 ঈশানের খাজুরাহো নিয়ে তেমন কোনো পড়াশোনা নেই ৷ তবে সঙ্গিনীর কথা শুনে কেন জানি তার মনে হল এ কথাগুলো তার জানা, যে গাইডবুকটা সে কিনেছিল তাতে একবার ইশান চোখ বুলিয়েছিল ৷ হয়তো-বা সেখানেই লেখাছিল এই কথাগুলো ৷ তবে মেয়েটা যে এই জায়গা সম্বন্ধে বেশ কিছু জানে তা অনুমান করে ঈশান তাকে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি ইতিহাসের ছাত্রী ছিলেন? আগে এসেছেন এখানে?’ সোমদত্তা জবাব দিল, ‘এ মন্দিরের আমি সব কিছু চিনি-জানি ৷’

 ‘ঈশান হেসে বলল, ‘বুঝলাম, তার মানে আপনি আগে এসেছেন এখানে ৷ বিনা পয়সায় তাহলে একজন গাইড পেলাম আমি ৷’

 ঈশানের কথায় সোমদত্তা যেন মৃদু হাসল মনে হয় ৷ তারপর বলল, ‘আচ্ছা, এ জায়গা আপনার চেনা মনে হয় না? মনে হয় না আপনিও কোনো দিন এখানে এসেছেন?’

 ঈশান জবাব দিল, ‘আমি এখানে প্রথম এসেছি ৷ তবে এক জায়গাতে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালে মনে হয় সে জায়গা আমার চেনা ৷ যেন আগে কোনোদিন এসেছি সেখানে ৷ সে অনুভূতি কিছুটা আমার হচ্ছে ৷’

 সোমদত্তা বলল, ‘আসুন আপনাকে একটা জিনিস দেখাই ৷’ এই বলে সে এগোল গর্ভ মন্দিরের দিকটাতে ৷ ঈশান তাকে অনুসরণ করল ৷ গর্ভমন্দিরের প্রবেশ মুখের কাছাকাছি পৌঁছে ঈশান থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘ভিতরে যাওয়া কি ঠিক হবে? যা অন্ধকার!’

 মন্দিরের ভিতরে ঢোকার মুখটাতে ঈশানের কথা শুনে মুহূর্তর জন্য পিছনে ফিরে তাকিয়ে সোমদত্তা বলল, ‘ভয় পাচ্ছেন?’

 ঈশানের এবার বেশ লজ্জাবোধ হল তার কথা শুনে ৷ সে যখন ভিতরে ঢোকার সাহস পাচ্ছে তখন ঈশান পারবে না কেন? ‘আচ্ছা, চলুন’ বলে ঈশান প্রবেশ করল গর্ভমন্দিরে ৷

 বিশাল গর্ভমন্দির ৷ তার ভিতরেও নানা অলিগলি ৷ সেখানে আলো-আঁধারিতে দাঁড়িয়ে আছে নানা দেবদেবী বা সুরসুন্দরীদের মূর্তি ৷ ছাদের ফাটল গলে বা অন্য কোনোভাবে কিছুটা চাঁদের আলো ঢুকছে ভিতরে ৷ আলো-আঁধারিতে দাঁড়িয়ে থাকা নারী-পুরুষের মূর্তিগুলোকে কেমন যেন রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে ৷ ঈশানের কয়েক পা আগে চলেছে সোমদত্তা ৷ তার শান্ত ধীর পদচারণা দেখে ঈশানের মনে হল, সত্যি যেন সে মন্দিরটা চেনে ৷ ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে সে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ৷

 ঈশানকে সঙ্গে নিয়ে এক সময় এক জায়গাতে এসে থামল সোমদত্তা ৷ কোথা থেকে যেন চাঁদের আলো এসে পড়েছে সামনের দেওয়ালটার ওপর ৷ আর সেই আলোতে তাদের সামনে জেগে আছে একসার ক্রীড়ারত নারীমূর্তি ৷ ছোট ছোট বল বা গোলক নিয়ে তারা খেলা করছে ৷ কারো হাতের তালুতে গোলক রাখা, কেউ আবার গোলক স্থাপন করেছে তাদের উন্মুক্ত বক্ষ বিভাজিকার খাঁজে ৷

 অদ্ভুত সুন্দর নারীমূর্তি সব ৷ প্রত্যেকেই যেন জীবন্ত ৷ ছোট গোলক নিয়ে নারীদের খেলার ব্যাপারটা খুব প্রাচীন প্রথা ৷ মূর্তিগুলোকে দেখে একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল ঈশানের ৷ সাহিত্যের কথা ৷ একটু ইতস্তত করে ঈশান বলল, ‘জানেন মহাকবি কালিদাসের রচনায় এই বলের উল্লেখ আছে — ‘‘ছোট্ট গোলক তুমি আমার প্রিয়ার করকমলের ছোঁয়ায় লাফাও ৷ উঁচুতে আরও উঁচুতে লাফাও ৷ ছুঁতে চাও তার ওষ্ঠ ৷ অথচ প্রতিবারই ভুল করে নেমে আসো মাটিতে ৷ আমি সাক্ষী থাকি সেই মর্মবেদনার ৷’’

 সোমদত্তা সেকথা শুনে প্রথমে যেন মৃদু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, মর্মবেদনা ৷’ তারপর যেন একটু উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘আর কিছু, আর কিছু মনে পড়ছে আপনার এই নারী-মূর্তিগুলো দেখে? বিশেষত ওই গোলকগুলোর ব্যাপারে?’

 ভালো করে মূর্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে ঈশান বলল, ‘না, তেমন কিছু নয়, তবে এই মূর্তিগুলো দেখে কেন জানি মনে হচ্ছে এদের আগে আমি দেখেছি ৷ এমনও হতে পারে কবির বিবরণ পড়ে মনের কল্পনায় ৷ তাই হয়তো একটু চেনা মনে হচ্ছে এই রমনীদের ৷’

 ঈশানের কথা শুনে মৃদু চুপ করে থাকার পর সোমদত্তা বলল, ‘ওই ছোট গোলকগুলো কিন্তু অন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজেও ব্যবহার করা হত ৷ বক্ষ সৌন্দর্য এই নারীমূর্তিগুলোর অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল ৷ যেসব নারীদের মগধ, কামরূপ, বঙ্গ সমতট থেকে সংগ্রহ করে আনা হত তাদের সুরসুন্দরী রূপে নির্বাচন করা হবে কিনা তার জন্য এক অন্তিম পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল ৷ ওইসব নারীদের বক্ষ উন্মুক্ত করে দাঁড় করিয়ে কিছুটা তফাত থেকে আকাশের দিকে এমনভাবে ওই ছোট গোলক ছুড়ে দেওয়া হত যা ওপর থেকে এসে নারীর দুই বক্ষের মাঝে পড়ে ৷ গোলক যদি ফাঁক গলে গড়িয়ে নীচে পড়ে তবে সে নারীকে সুরসুন্দরী হবার অনুপযুক্ত ধরা যেত ৷ তারা দাসী হত সুরসুন্দরীদের ৷ আর যে নারী ওই গোলক তার দুই বক্ষের মাঝখানে ধারণ করতে পারত, সে হত সুরসুন্দরী ৷ তাকে দেখে মূর্তি নির্মাণ করত ভাস্করের দল ৷ এই মন্দিরে যত সুরসুন্দরীদের মূর্তি আছে তাদের সবাইকেই এই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে ৷

 সম্পূর্ণ অজানা এক কথা শুনলেও ঈশানের কেন জানি মনে হল এ কথাটাও তার জানা ৷ সে শুধু বলল, ‘যদি মন্দিরের আরও ওপরে ওঠা যেত তবে মন্দিরের শীর্ষগাত্রে যেসব মূর্তিগুলো আছে তাদেরকেও কাছ থেকে ভালোভাবে দেখা যেত ৷’

 সোমদত্তা বলল, ‘চলুন তবে ৷ আমি ওপরে ওঠার পথ চিনি ৷ ওই পথ বাইরে থেকে বোঝা যায় না ৷ মন্দির যখন নির্মিত হয়েছিল তখন ভাস্করের দল ওই পথে ওপরে উঠে কাজ করত ৷’

 তার কথা শুনে ঈশান বলল, ‘আপনি এ মন্দিরের এত কিছু চেনেন কী করে? কতবার এসেছেন এখানে?

 সোমদত্তা তার কথা শুনে হাসল ৷ তারপর এগোল সামনের দিকে ৷ অগত্যা ঈশান অনুসরণ করল তাকে ৷

 গর্ভগৃহ সংলগ্ন একটা কক্ষ থেকে সংকীর্ণ একটা সোপানশ্রেণি ওপরে উঠে গেছে ৷ সোমদত্তা উঠতে শুরু করল সেই সিঁড়ি বেয়ে ৷ আর তার পিছন পিছন ঈশান ৷ দেওয়ালের ফাটল দিয়ে মাঝে মাঝে আলো এসে পড়ছে সিঁড়িতে ৷ বাকি জায়গাগুলো অন্ধকার ৷ ছমছম নূপুর বাজছে সোমদত্তার পায়ে ৷ সিঁড়ির অন্ধকার বাঁকগুলোতে যেখানে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে সোমদত্তা, সেখানে ওই নূপুরধ্বনিকেই অনুসরণ করছে ঈশান ৷ বেশ কিছুক্ষণ ধরে ওপরে ওঠার পর এক সময় সামনেটা বেশ আলোকিত হয়ে উঠল ৷ সোমদত্তার পিছন পিছন ঈশান এসে প্রবেশ করল ঘরের মতো একটা জায়গাতে ৷ মাথায় ছাদ থাকলেও তার চারপাশ খোলা ৷ চারদিক থেকে মন্দিরগাত্রের পাথুরে থাক এসে মিশেছে সে-জায়গার সাথে ৷ চন্দ্রালোকে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুরসুন্দরীরা ৷ ঈশান বুঝতে পারল সে সম্ভবত মন্দিরের শীর্ষদেশের কোনো জায়গায় উঠে এসেছে ৷ নীচের মন্দির চত্বরটা পুরো দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে ৷ আর মন্দিরকে ঘিরে থাকা কুয়াশাবলয়ের মাথার ওপর দিয়েও এদিক-ওদিকে দেখা যাচ্ছে মন্দির-নগরীর সার সার চূড়া ৷

 ঘরের মতো জায়গাটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সোমদত্তা প্রশ্ন করাল ‘এই জায়গাটা চেনা মনে হচ্ছে আপনার?’

 ঈশান ভালো করে তাকাল চারপাশে ৷ ঘরের মতো জায়গাটার এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে নানা প্রকারের প্রস্তরখণ্ড, কিছু অর্ধসমাপ্ত মূর্তি ৷ জায়গাটার এক কোণে কিছু লৌহ কীলক, হাতুড়ি ইত্যাদি প্রাচীন যন্ত্রপাতিও পড়ে আছে ৷

 ঈশান কোনো দিন এ জায়গাতে আসেনি ৷ কিন্তু এবার হঠাৎ তার মনে হতে লাগল জায়গাটা তার পরিচিত ৷ সে বলল, ‘আচ্ছা এখানে সিক মূর্তি বানানো হত?’

 সেমদত্তা বলল ? হ্যাঁ, তারপর সে মূর্তিগুলো স্থাপন করা হত এ জায়গা সংলগ্ন মন্দির-শীর্ষের তাকগুলোতে ৷ এ জায়গা দেখে আর কিছু মনে পড়ছে আপনার?’

 চারদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে কেমন যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি শুরু হল ঈশানের মনে ৷ ঈশান স্পষ্টভাবে জবাব দিল, ‘কেমন যেন চেনা মনে হচ্ছে এ জায়গা…’

 সোমদত্তা আবার জানতে চাইল, ‘আর কিছু আর কিছু?’

 জায়গাটা দেখে ঈশানের মনের ভিতর অস্পষ্ট কিছু ফুটে উঠে আবার যেন মিলিয়ে যাচ্ছে ৷ ঈশানের মনে হচ্ছে সে যেন কিছু একটা এবার বুঝেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না!

 ঈশানকে চুপ করে থাকতে দেখে সোমদত্তা যেন একটু বিষণ্ণভাবে বলে উঠল, ‘এই মন্দির, গোলক নিয়ে ক্রীড়ারত সুরসুন্দরীদের মূর্তি, ভাস্করদের এই জায়গা দেখে এখনও তোমার কিছু মনে পড়ছে না ঈশান?’

 কথাগুলো বলা শেষ করে সোমদত্তা ঘরের কোণ থেকে তুলে নিল একটা লৌহ কীলক আর হাতুড়ি ৷ তারপর বলল, ‘এসো আমার সঙ্গে’ ৷ ঈশান খেয়াল করল সোমদত্তার সম্বোধন এবার পাল্টে গেছে ৷ ঈশানের কপালের দু-পাশের রগগুলো কেমন যেন দপদপ করতে শুরু করেছে ৷ কীলক আর হাতুড়িটা নিয়ে সে জায়গা ছেড়ে একটা তাকের দিকে এগোতে শুরু করল সোমদত্তা ৷ তাকে অনুসরণ করল ঈশান ৷

 মন্দিরের শীর্ষদেশের সংকীর্ণ তাক! কোনো প্রাকার নেই তার ৷ অনেক নীচে মন্দির প্রাঙ্গণ ৷ উন্মুক্ত তাকগুলোর মাঝেমাঝে শুধু বিভিন্ন ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে সুরসুন্দরীদের দল ৷ চাঁদের আলোতে তাদের ঠোঁটের কোণে যেন আবছা হাসি লেগে আছে ৷ যেন কিছুর জন্য প্রতীক্ষা করছে তারা ৷ তাক ধরে এগিয়ে চলছে সোমদত্তা ৷ তার পিছনে ঈশান যত এগোচ্ছে তত যেন ঈশানের মনে হচ্ছে এ জায়গা তার খুব চেনা, খুব চেনা! কিন্তু তা কী করে সম্ভব? তাকের শেষ প্রান্তে এক সময় এসে পৌছল সোমদত্তা ৷ সেখানে অন্য মূর্তিগুলোর তফাতে একাকী দাঁড়িয়ে আছে এক সুরকন্যার মূর্তি ৷ সেখানে এসে থামল তারা দুজন ৷

 সোমদত্তা ঈশানকে বলল, ‘এবার ভালো করে তাকাও মূর্তিটার দিকে ৷’

 ঈশান তাকাল ৷ চাঁদের আলোতে দাঁড়িয়ে আছে সেই সুরকন্যা, গ্রীবাটা ঈষৎ আনত ৷ চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকা ঘন সন্নিবেষ্ট বক্ষদেশ, ক্ষীণ কটির সেই সুরসুন্দরীর গা বেয়ে যেন জ্যোৎস্না চুইয়ে পড়ছে ৷ মৃণাল লতার মতো তার বাহুযুগলের করপল্লব দুটো বুকের ঠিক মাঝখানে চেপে ধরা ৷ হাত দুটো কি লজ্জা নিবারণের জন্য বুকের মাঝখানে ওভাবে চেপে ধরেছে, নাকি সেখানে লুকিয়ে রেখেছে অন্য কিছু?

 ঈশান বলল এ মূর্তি যে আমার চেনা মনে হচ্ছে?

 সোমদত্তা সেই লৌহ-শলাকা আর হাতুড়িটা ঈশানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এ মূর্তি তো তুমিই বানিয়ে ছিলে একদিন ৷ বঙ্গসমতট থেকে এসেছিল এক নারী ৷ ভাস্করশ্রেষ্ঠ তুমিও বঙ্গ সমতটেরই লোক ছিলে ৷ এই মন্দিরের প্রধান ভাস্কর ৷ তোমার কাছেই থাকত সেই দুর্মূল্য স্ফটিক গোলক ৷ যা বক্ষের মাঝখানে ধারণ করেছিল এই নারী, আর তার সাথে সাথে তোমার হৃদয়ও …’

 কী বলছে সোমদত্তা! মাথার ভিতরটা যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে ঈশানের ৷ যেন বাস্তব আর পরাবাস্তবতার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঈশান ৷ সোমদত্তা বলে চলল, ‘তারপর তোমাকে আর এই নারীকে নিয়ে রচিত হল কত ভাস্কর্য ৷ তুমিও ভালোবেসেছিলে তাকে ৷ কিন্তু একদিন তোমার কার্যে্যাপলক্ষে কিছু দিনের জন্য দেশে ফেরার প্রয়োজন হল ৷ নারীর সৌন্দর্য নির্বাচনের জন্য ওই স্ফটিক গোলক ছিল হীরকখণ্ডর চেয়েও দামি ৷ যাবার আগে তুমি সেই গোলক গচ্ছিত রেখে গেলে এই নারীর কাছে, তোমার সৃষ্ট এই মূর্তির মধ্যে ৷ বলে গেলে তুমি যত দিন ফিরে না আসো ততদিন সে যেন বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখে সেই গোলক ৷ কিন্তু তুমি আর ফিরলে না ৷ রাজ নির্দেশে একদিন তল্লাশি শুরু হল সেই গোলকের ৷ তারা অনুমান করল তোমার প্রেয়সী নিশ্চয়ই সন্ধান জানে সেই গোলকের আর তারপর … ৷’

 সোমদত্তার কথাগুলো যেন তছনছ করে দিচ্ছে ঈশানের মাথার ভিতরটা ৷ ঈশানের ভিতর থেকে যেন জেগে উঠেছে অন্য এক ঈশান ৷ তবু সে শেষ একবার বলার চেষ্টা করতে যাচ্ছিল, ‘এ সব আবোলতাবোল কী বলছেন আপনি!’

 সে কথা বলার জন্য ঈশান তাকাল সোমদত্তার দিকে ৷ কখন যেন শালের আবরণ খসিয়ে ফেলেছে সোমদত্তা ৷ ঈশান দেখতে পেল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা সুরসুন্দরী আর সোমদত্তার মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই ৷ তারা দুজন যেন একই নারী!

 সে দৃশ্য দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ঈশানের মনের ভিতর থেকে যেন খসে পড়ল হাজার বছরের খোলস ৷ ঈশান চিৎকার করে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি ৷ সব মনে পড়ে গেছে আমার ৷ সংসারবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বঙ্গ সমতট থেকে এ দেশে আর ফেরা হয়নি আমার ৷’

 তার মূর্তিটার মতোই তার ঠোঁটের কোণে একটা বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল সোমদত্তার ৷ সে বলে উঠল, ‘কিন্তু আমি যে হাজার বছর ধরে তোমার প্রতীক্ষায় এখানে দাঁড়িয়ে আছি ভাস্করশ্রেষ্ঠ ৷ তোমারই সেই স্ফটিক গোলক বুকে নিয়ে, তোমার ভালোবাসাকে বুকের মধ্যে আগলে ধরে ৷ আমি কাউকে জানতে দিইনি তার কথা ৷ কারো হাতে তুলে দিতে পারিনি তোমার-আমার ভালোবাসাকে ৷

 ঈশান আর্তনাদ করে বলে উঠল, ‘আমাকে তুমি ক্ষমা করো ৷ আমি ভুলে গেছিলাম তোমাকে ৷’

 বিষণ্ণ হেসে সোমদত্তা বলল, ‘ক্ষমা নয়, আমি যে তোমায় ভালোবাসি ৷ সেজন্যই তো আমি সে-গোলক তুলে দিতে পারিনি রাজরক্ষীদের হাতে ৷ সে গোলক যে ভাস্করের হাতে যেত সেই হত তোমার জায়গায় প্রধান ভাস্কর ৷ সে কেমন করে সইতাম আমি ৷ কিন্তু হাজার বছর ধরে বুকের মাঝখানে লুকিয়ে রাখা এ গোলকের ভার আমি আর সহ্য করতে পারছি না ৷ সামান্য সুরসুন্দরী আমি ৷ হাজার বছর আগে তুমি যদি আমাকে ভালোবেসে থাকো তবে মুক্তি দাও আমাকে ৷’

 বিস্মিত ঈশান বলে উঠল, ‘মুক্তি? কী ভাবে?’

 সোমদত্তা বলে উঠল ওই মূর্তি আর আমি অভিন্ন নই ৷ তোমার হাতের ওই লৌহশলাকা হাতুড়ি দিয়ে বিদ্ধ করে আমার বুকে ৷ খুন করে আমাকে ৷ আমার বুকের ভিতর থেকে উৎপাটিত করো তোমার স্ফটিক গোলক ৷ এই বলে নীচের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখার চেষ্টা করল সে ৷ এক মুহূর্তর জন্য একখণ্ড কালো মেঘ এসে ঢেকে দিল চাঁদকে ৷ ঈশান দেখতে পেল মূর্তিটা অদৃশ্য হয়েছে তার জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে সোমদত্তা!

 ঈশান বলল, ‘এ কী বলছ তুমি ৷ চলো আমরা এখান থেকে পালিয়ে যাই ৷’

 সোমদত্তা বলে উঠল, ‘পালানো হবে না আমার ৷ আমাকে নিয়ে পালাতে গেলে তোমারও বিপদ হবে ৷ রক্ষীরা ঠিক ধরে ফেলবে দুজনকে ৷ আমাকে তুমি খুন করে মুক্তি দাও এই সুরসুন্দরীর জন্ম থেকে ৷ কীলক বসিয়ে দাও আমার বুকে, কথাগুলো বলতে বলতে এবার কেমন যেন সে চঞ্চল হয়ে উঠল ৷

 ঈশান বলল, ‘কোথায় রক্ষী কেউ তো কোথাও নেই!’

 সোমদত্তা বলল, ‘খুন করো, খুন করো আমাকে ৷ কীলক বসিয়ে দাও ৷ দ্বিধা কোরো না ৷ যেমনভাবে কঠিন পাথরের গায়ে এই কীলক আর হাতুড়ির ঘায়ে তুমি আমার প্রাণ সঞ্চার করেছিলে তেমনই ভাবো কোনো প্রস্তরমূর্তির বুকে আঘাত হানছ তুমি ৷ নারী নয়, তুমি প্রস্তর ঘাতক ৷’

 আর এরপরই সোমদত্তা চিৎকার করে উঠল, ওই দেখো তারা এসে পড়েছে! আর সময় নেই ৷’

 তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন মশালের আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল মন্দির চত্বর ৷ এখানে-ওখানে মন্দিরগাত্রের নানা জায়গাতেও জ্বলে উঠল মশালের আলো ৷ নীচে তাকিয়ে ঈশান দেখতে পেল ৷ মন্দির চত্বর থেকে পাথুরে দেওয়ালের পথ বেয়ে সার বেঁধে ওপর দিকে উঠে আসছে হাজার বছরের প্রাচীন এক রক্ষীবাহিনী ৷ মশালের আলোতে ঝিলিক দিচ্ছে তাদের হাতে ধরা তলোয়ার, বর্শার ফলা ৷ তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে আদিম জিঘাংসা, নারী লালসা ৷ অতি দ্রুত ওপরে উঠে আসছে তারা!

 সোমদত্তা আবারও চিৎকার করে উঠল, ‘আর দেরি কোরো না ৷ খুন করো আমাকে, নইলে তুমিও বাঁচবে না ৷ ওই গোলকের জন্য হাজার বছর ধরে এমন চাঁদনি রাতে ওরা আসে ৷ সবাই মিলে গোলক না পেয়ে চরিতার্থ করে তাদের লালসা ৷ তুমি কি সহ্য করতে পারবে সেই দৃশ্য? গোলক ওদের হাতে তুলে দেব না বলে যুগ যুগ ধরে সহ্য করেছি এই অত্যাচার ৷ দোহাই তোমার ৷ এবার আমাকে মুক্তি দাও ৷ খুন করে মুক্তি দাও আমার প্রাচীন আত্মাকে ৷ তারপর আবার আমার তোমার মতো নবজন্ম হবে ৷ দোহাই তোমার দেরি কোরো না ৷’

 ভাস্কর ঈশান চিৎকার করে অসহায়ভাবে বলে উঠল— ‘না, এ দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারব না ৷’

 ক্রমশ উঠে আসছে পিশাচের দল ৷ কানে আসছে তাদের অস্পষ্ট উল্লাসধ্বনি ৷

 না, আর দেরি নয় ৷ মন শক্ত করল ভাস্কর ৷ তার দু-হাতের মাংসপেশী শক্ত হয়ে উঠল ৷ স্তনের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে সোমদত্তা ৷ মনের সব শক্তিকে একত্রিত করে সোমদত্তার বুকের ঠিক মাঝখানে লৌহ কীলক প্রতিস্থাপিত করল ঈশান ৷ মুহূর্তর জন্য এবার যেন হাসি ফুটে উঠল সেই সুরসুন্দরীর ঠোঁটের কোণে ৷ মুক্তির হাসি ৷ কোলাহল আরও কাছে উঠে এসেছে ৷ আর দেরি না করে ঈশান হাতুড়ির ঘা দিল কীলকে ৷ ঠং করে একটা শব্দ হল ৷ তার আঘাতে কী যেন একটা ছোট্ট উজ্জ্বল গোলকের মতো জিনিস তার স্তনের ভিতর থেকে নিক্ষিপ্ত হল আকাশের দিকে ৷ লৌহ শলাকাটা আমূল প্রেথিত হল সুরসুন্দরীর স্তনে ৷ থরথর করে কেঁপে উঠল সুরসুন্দরী ৷ তারপর টাল খেয়ে উন্মুক্ত তাক থেকে ছিটকে পড়ল নীচের দিকে ৷ তার দেহ নীচে আছড়ে পড়ার সাথে মিশে গেল ঈশানের আর্তনাদ ৷ আর সঙ্গে সঙ্গেই সব কোলাহল থেমে গেল, সব আলো নিভে গেল ৷ নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশ ৷ একদম নিস্তব্ধ যে বৃত্তাকার কুয়াশার স্তর কান্তরিয় মন্দিরকে ঘিরে ছিল তা যেন মন্দিরকে গ্রাস করতে শুরু করেছে ৷ ওপরে উঠে আসছে কুয়াশা ৷ ঈশান এরপর যে-পথ বেয়ে সেখানে পৌঁছেছিল পাগলের মতো ছুটতে শুরু করল সেদিকে ৷

 পরদিন বেলা আটটা নাগাদ দিবাকরদার ডাকে ঘুম ভাঙল ঈশানের ৷ ঘুম ভেঙে উঠে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মনে পড়ে গেল, গতরাতের ঘটনার কথা ৷ সেটা কি সত্যি ছিল, নাকি স্বপ্ন? সে দিবাকরদাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কাল কখন ঘরে ফিরেছি আমি?’

 দিবাকরদা বললেন, ‘তা তো বলতে পারব না ৷ কাল পানটা একটু বেশি হয়ে গেছিল ৷ ওরাই আমাকে ধরাধরি করে এঘরে পৌছে দেয় ৷ কোনো হুঁশ ছিল না আমার ৷ এখন চটপট তৈরি হয়ে নাও ৷ গাইড এসে গেছে, মন্দির দেখতে বেরোতে হবে ৷’

 কিছু সময়ের মধ্যেই মন্দির দেখার জন্য গাইডের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল ঈশানরা ৷ সঙ্গে আয়োজকরাতো আছেই ৷ বেশ বড় দল ৷ তারা প্রথমে এসে উপস্থিত হল কান্তরিয় মন্দিরে ৷ বিশাল মন্দির ৷ অপূর্ব তার শিল্প সুষমা ৷ সকালের সূর্যালোকে তার গায়ে জেগে আছে অসংখ্য সুরসুন্দরী, মিথুন ভাস্কর্য ৷ হাজার বছরের প্রাচীন মন্দিরের গায়ে সেসব ভাস্কর্য দেখলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয় ৷ গাইড তাদের বলল, ‘এই মন্দিরে যেসব সুরসুন্দরীদের আপনারা দেখতে পাবেন তারা কিন্তু কেউ কল্পিত ছিলেন না ৷ মগধ, উজ্জয়িনী, কামরূপ এমনকী আপনাদের বঙ্গসমতট থেকেও তাদের সংগ্রহ করে এনে তাদের মডেল বানিয়ে মূর্তি নির্মাণ করত শিল্পী ভাস্করের দল ৷’

 গাইডের সাথে তার কথা শুনতে শুনতে বিমোহিতভাবে মূর্তিগুলো দেখতে দেখতে মন্দির দেখতে শুরু করল সবাই৷ হঠাৎ এক জায়গাতে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল গাইড ৷ তার সাথে সাথে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল পুরো দলটা ৷ সামনেই পাথুরে চাতালের ওপর পড়ে আছে খণ্ডবিখণ্ড এক সুরসুন্দরীর মূর্তি ৷ গাইড একবার মন্দির শীর্ষের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সম্ভবত মাথার ওপরের কোনো তাক থেকে রাতে খসে পড়েছে মূর্তিটা ৷ গতকালও এখানে এটা দেখিনি ৷ মাঝে মাঝে এমন হয় ৷ হাজার বছরের প্রাচীন স্থাপত্য তো ৷ মাঝে মাঝে এটা-ওটা খসে পড়ে ৷ সবাই গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়াল মূর্তির খণ্ডিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে ৷ তার বুকটা অক্ষত আছে ৷ আর তার মধ্যে প্রোথিত আছে একটা প্রাচীন লৌহ শলাকা ৷ একজন বলল, ‘এ শলাকাটা দিয়েই মনে হয় দেওয়ালের গায়ে আটকে রাখা হয়েছিল মূর্তিটাকে ৷ কিন্তু এখন দেখে মনে হচ্ছে ঠিক যেন কেউ বুকের মধ্যে শলাকা বিঁধে খুন করেছে সুরসুন্দরীকে ৷’ তার কথা শুনে মৃদু চমকে উঠল ঈশান ৷ আর তারপরই তার পায়ের কাছে একটা জিনিস পড়ে থাকতে দেখে সেটা কুড়িয়ে নিল ঈশান ৷ পাথরের তৈরি নিটোল একটা গোলক ৷ অনেকটা পায়রার ডিমের আকৃতির ৷ হয়তো হাজার বছর ধরে পাথরের মধ্যে থাকার কারণে: স্ফটিক গোলক রূপান্তরিত হয়েছে লালচে পাথরের গোলকে ৷ গাইড গোলকটা দেখে বলল, ‘এ ধরনের বল মাঝে মাঝে এখানে কুড়িয়ে পাওয়া যায় ৷ চলুন এগোনা যাক ৷ এ মন্দির দেখা শেষ করে অন্য মন্দিরে যেতে হবে ৷ আরও অন্য মন্দির আছে এখানে৷’

শলাকাবিদ্ধ সেই সুরসুন্দরীকে পাশ কাটিয়ে অন্যদের সাথে ঈশান এগোল সামনের দিকে ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *