আততায়ী – যশোধরা রায়চৌধুরী

আততায়ী – যশোধরা রায়চৌধুরী

একটা স্ট্রবেরি রঙের আকাশ, এক কোনায় মেঘ জমে আছে ডিপ চকলেট রঙের। যেন তুলতুলে স্ট্রবেরিটার উপরে জমাট, লোভনীয় ক্রাস্টের মতো ঠান্ডা, শক্ত চকলেট, ভেঙে ফেললেই গড়িয়ে পড়বে রসের মতো আলোমাখামাখি ভোর।

দিবাস্বপ্ন দেখছিল সঞ্চিতা, বারান্দায় বসে। ভোর ফুটে গেছে অনেকক্ষণ। জগিং সেরে এসে ওটস খেয়ে এখন ফেসিয়ালে বসেছে। ওর ছোট্ট নুক, দড়ির দোলনায়।

.

দুলতে দুলতে সমস্ত অ্যাটমসফিয়ার দুলছিল যেন। আকাশের ফ্রেমটাও।

মামপি, শোন।

চটকা ভাঙল।

নিলুপিসি, তুমি ডাকছিলে?

বারান্দা থেকে ঘরের দিকে মুখ বাড়াল সঞ্চিতা। ওর নিটোল ডিমের মতো মুখ। টাটকা ক্রিমিশ ত্বক আপাতত সাদা ধবধবে আস্তরণের তলায়।

—সারা মুখে কী মেখেছিস এসব? অফিসে বেরোনোর আগে, বাবা, পারিসও বটে।

—ধ্যাত, ছাড়ো তো। বলো না কী বলছিলে। সঞ্চিতা হাসল। ফেসিয়াল মাখা মুখ, যেন মুখোশের আড়ালে ঢাকা। কিছুটা ক্লাউন যেন।

—আরে কতবার করে তোর ফোনটা বাজছিল। রিংটোনে এমন একটা ঝাঁঝালো গান লাগিয়েছিস, শুনলেই পিত্তি জ্বলে যায়। এটা তোর কত নম্বর ফোন?

—আমার তো দুটোই ফোন, জানোই তো। ওটা পুরোনোটা। বাজুক। আমি এখন ধরছি না।

—কেন, ওটা কি হ্যালাফেলার ফোন?

—ফোনটা না, ফোনের কনট্যাক্টগুলো। কলেজের সব বন্ধুরা ওই নাম্বারটা জানে। ভীষণ বোর।

—হুম। বুঝেছি। এখন তোমার নতুন চাকরি, নতুন অফিসের নতুন বন্ধুরা সব। তাদের চিনে নিতে যত মজা, পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে কি আর তত মজা পাবে?

উফ, ছাড়ো না। ফরগেট ইট ইয়ার। তোমার যত্তসব পুরোনো পুরোনো কথা…

ওরে, কথায় বলে পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে।

এবার পুরোটা ঘরের মধ্যে ঢুকে আসে সঞ্চিতা। হেলায় একবার খাটের উপর থেকে তুলে দেখে পুরনো মডেলের, পুরনো সিম ভরা সেই ফোনটা। যেটায় আটটা মিসড কল রেখেছে ঋদ্ধিমান। ওর পুরোনো বয়ফ্রেন্ড। শিট। কী ভীষণ টায়ারসাম। হতাশ লাগে সঞ্চিতার। কেন যে লোকজন বোঝে না!

.

নিলুপিসিটাও তেমনি। এসব কথা খুঁচিয়ে ওর পেট থেকে বার করবেই। অর্চির ব্যাপারেও খুব কৌতূহল। অর্চিই যেন সবটা জুড়ে আছে সঞ্চিতার। এমন একটা ভাব। না হয় কয়েকদিন ডেট করেইছে। তাই বলে…অর্চি কী খায়, অর্চি কী পরে, অর্চির ফ্যাভ মিউজিক কী। অত জানার কী দরকার?

নিলুপিসি, ইউ জাস্ট গিভ মি এ ব্রেক, ওকে? আমার সব ব্যাপারে মাথা গলাতে হবে না তোমাকে। মা কি গলায়? বাবা? তাহলে তুমি কেন?

নীলুপিসি নিজে তো বেশ ডিভোর্স টিভোর্স করে ছাড়া গরু। এটা মা বলে, ফিসফিসিয়ে। নিজের কোনও ইস্যু নেই বলে আমার মেয়েটাকে নিয়ে পড়েছে। যেন একদম অ্যাডপ্টই করে ফেলেছে সঞ্চিতাকে, নিলুটা।

.

আজকাল এই নিলুপিসির জন্যেই বাবা—মার সঙ্গে আগের মতো ভুলভাল, অ্যাজিটো কেওটিক বিহেভ করতে পারে না সঞ্চিতা। আগে তো হুটহাট করে হোম ডেলিভারিতে বিরিয়ানি আনিয়ে খেত, পিৎজা আনিয়ে নিত নিজের জন্য। ডালভাত হরিবোল, পটলের ডালনাকে রিজেক্ট করতে ইউজ করত নিজের খ্যাপামি, জোর ফলাত মাথা গরম করে। রাগ করে দুম করে দরজা বন্ধ করা, সারা রাত না ঘুমিয়ে চ্যাটিং, তারপর সকাল দুপুর গড়িয়ে বেলা বারোটা অবধি ভোঁসভোঁস ঘুমোনো…সবটাই চলত। এখন আর মা—বাবা ওকে ভয়ই পায় না। এসব দেখাতে গেলেই সবাই হাসতে শুরু করে।

পিসি এসে কী যেন উল্টো ফ্যাচাং করেছে। সঞ্চিতার আর আগের সম্মান নেই। লোকে আর ওকে ভয় পায় না। হিটলারি যে ব্যাপারগুলো করে দিব্যি চালাচ্ছিল নিজে, মাকে ভয় খাইয়ে, বাবাকে চুপ করিয়ে রেখেছিল নানা কলকাঠি নেড়ে। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং করলেই বাবা সুড়সুড় করে টাকা বের করে দিত আগে…স্টুডেন্ট লাইফে, এখন নিজের টাকা নিজের সব…তাহলেও যেন সেরকম মজা নেই বাবা—মায়ের উপর কর্তৃত্ব ফলিয়ে…

সব ভেস্তে দিয়েছে পিসিই।

যাও না বাবা তুমি তোমার দামড়া কাকুবন্ধুগুলোর সঙ্গে কফি হাউজে আঁতলামো করতে, তা না, সঞ্চিতার সঙ্গেই যত কথা!

অর্চি এখনও মেয়ে দেখলে ঘাবড়ে যায়। কিন্তু সেদিন সঞ্চিতাকে দেখে কী যেন হয়ে গেল। ফানি আছে একটু, কিন্তু ভীষণ কিউট। রোগা, মিষ্টি, ছোট্টখাট্টো একদম, টাইটস কুর্তিতে কেমন যেন পাখি পাখি। খুব উজ্জ্বল দুটো চোখ। দেখলেই মনে হয় মিচমিচে শয়তান। কিন্তু কেন যেন অর্চির ওকে দেখে একটুও ভয় করল না। বেশ পাশে বসে ভাটাল অনেকক্ষণ। তারপর উঠে যাওয়ার সময় ক্যাজুয়ালি বলল, সি ইউ। আর অমনি মেয়েটাও সি ইউ বলে মোবাইল নাম্বার নিয়ে নিল। সেই থেকে টুকটাক ফোন হচ্ছে। দু’দিন বসল কাফে কফি ডে—তে। অর্চির পয়সা খসল কিছু, একদিন সঞ্চিতাও খাওয়াল। ওদের দুজনের অফিস একটাই বিল্ডিং—এ, সেক্টর ফাইভ—এ। দুটো আলাদা ব্লক অবশ্য। কিন্তু বাসস্টপে, নিচের লবির কফি শপে, এখানে—ওখানে দেখা হয়ে যাওয়ার স্কোপ প্রচুর।

অর্চি একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, অবশ্যই ক্লিয়ারলি না, সঞ্চিতার কোনও স্টেডি বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা। সঞ্চিতাও ওকে তো সরাসরি কিছু বলেনি, তবে একটা মেসেজ দিয়েছে। না, ফোনের টেক্সট মেসেজ না। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বলে দিয়েছে, এখন কেউ নেই। আগে হয়তো ছিল। সেটা আপাতত ম্যাটার করে না।

সেই থেকে মোটামুটি লটকে আছে সম্পর্কটা একই জায়গায়। এগোচ্ছে বলা যায় না। কারণ ফিজিকাল হওয়া হয়নি এখনও। হয়তো নেক্সট টাইম আর একটু প্রাইভেসি আছে এমন জায়গায় দেখা হয়ে যাবে।

তবে একটাই আশার কথা, সেদিন ইমেল করেছে অর্চি ওকে, একটা পাতলা পর্দার আড়ালে একটা সেক্সি টপ পরা দীপিকা পাডুকোনের ছবি, পর্দাটায় ক্লিক করলেই ছবিটা একটা মোটকা মহিলায় কনভার্টেড হয়ে যায়। আর একটা গলা বলে ওঠে, দ্যাটস মাই মাম্মি!

সেটা দেখে হি হি হাসির চারটে ইমোটিকন পাঠিয়েছে ওকে সঞ্চিতা।

তার মানে কেস টা এগোচ্ছে। আপাতত অর্চি বসে আছে ওর কিউবিকলে, পাশের কিউবিকল থেকে চুমকি ঘোষটা গলাটা জিরাফের মতো বাগিয়ে বলে উঠল, অর্চি, আমাকে লবিতে বেরোলে একটা কফি এনে দেবে, প্লিইইজ?

কেন কেন, তোমার কফি বওয়া আমার কাজ নাকি? মনে মনে ঝাঁজালেও, অর্চি মেয়েটাকে পুরো কাটাল না। মেয়েটার চোখে একটা থ্রেট দেখতে পেল যেন। আসলে চুমকি ঘোষ দেখেছে, কাজের ফাঁকে চ্যাট করতে অর্চিকে। ওকে ঘাঁটালে ম্যানেজমেন্টকে যদি আবার লাগায়? তার উপর ও শুনেছে, মেয়েটার বাবা দীপেন ঘোষ পুলিশে কাজ করে। কে ঘাঁটাবে ওকে, বাবা!

চুমকি ঘোষের মোটা, ফুলো মুখটা ফর্সা আর মেক আপ লাগানো, কিন্তু ভীষণ চওড়া, ওকে দেখলে ভারতের ম্যাপ না, সাইবেরিয়া, তুন্দ্রা, তাইগাসহ একটা চ্যাপটা রাশিয়ার ম্যাপ মনে পড়ে যায়। এক কান থেকে আর এক কান পর্যন্ত পৌঁছতে দু—দুটো সাদা ধবধবে মরুভূমির মতো গাল আর একটা প্রকাণ্ড নাক পেরোতে হবে…দূর, অতটা পাড়ি দেওয়ার ধক কার আছে?

উল্টোদিকে সঞ্চিতাকে দেখ, ছোট্ট একটা মুখ, ছোট্ট একটা দেশের মতো…না ভারতও নয়, ধানি লংকার শেপের শ্রীলংকা যেন, কুচুত করে দাঁতে কেটে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।

অর্চি কিছুটা রিপালসানের বশেই চুমকিকে না চটিয়ে দু কাপ কফি এনে নীরবে এক কাপ ওর ডেস্কে রাখে। চুমকি ওর স্থূল শরীরটা যথাসম্ভব পিছিয়ে নেয়, বেন্ডিং ব্যাকওয়ার্ডস যাকে বলে, ঘোরানো চেয়ারের পিঠের উপর ভর দিয়ে, নেকু নেকু গলায় বলে, থ্যাংক্যু সুইটি। নাউ টেল মি, ওয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?

মেনশন নট, লাজুক মুখে বলে, অর্চি কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে কাজে বসে যায়। ইয়ারফোনটা একটা ব্যারিয়ারের কাজ করবে এবার।

সংগোপনে স্কাইপে মেসেজ পাঠায় সঞ্চিতাকে, R u online?’

উত্তর আসে ইমোটিকনে। উত্থিত হাতের ছবি। মানে হ্যাঁ, আই অ্যাম অ্যাট মাই ডেস্ক।

অর্চি এবার লেখে, gr8!

নিলুপিসি উল্টোদিকের রেস্তোরাঁয় বসে থেকে থেকে নজর রাখছে। সঞ্চিতা ঢুকে গেল ওই কাফেটায়। নিলুপিসি বসেছে। সস্তার রেস্তোরাঁয়। অর্চি আসবে। জেনেছে ওদের কনভার্সেশন থেকে, চ্যাটে। গতকাল সাইন আউট না করে কম্পিউটার থেকে উঠে গেছিল মেয়ে।

নীলুপিসি পুলিশগিরি করছে কোনও কৌতূহল থেকে নয়। স্রেফ সিকুউরিটি কনসার্ন থেকে। পরে, ঋদ্ধিমানের মামা, পুলিশ মামা, নিলুপিসিকে ইনপুট দিয়েছেন কিছু। আপাতত, নিলুপিসির ব্রিফ খুব পরিষ্কার। ঋদ্ধিমানের রিসেন্ট ডিপ্রেশনটা নিলুপিসিকে ভাবিয়েছে, প্লাস, একটা ফায়ার আর্ম মিসিং রিপোর্ট। এখন হাতে নাতে ধরতে হবে। যে কোনওদিন অবশ্য অ্যাটাক হতেই পারে, তবে আজকের চান্স খুব বেশি।

বেশ কিছুদিন ধরেই আসলে সঞ্চিতার আগের ফোন—এর কললিস্টের ভেতর থেকে দু—তিনটে কনট্যাক্ট নিলুকে খুব ভাবাচ্ছিল। ফোনটা এখন সঞ্চিতা ইউজই করে না। ওর সময় নেই এতগুলো ফোনের এতগুলো কনট্যাক্টের সঙ্গে সম্পর্ক মেনটেন করার। খাটের উপর ফেলে রাখতে রাখতে একদিন সঞ্চিতা ফোনটার কথা ভুলেই গেল। বাড়িতে পড়ে থাকা ফোনটা কিন্তু নিলুপিসিকে ভাবিয়ে চলেছিল। আর এভাবেই একদিন ঋদ্ধিমানের কলটা রিসিভ করে ফেলে নিলু।

পর পর সাত—আটদিন, ওই ফোনে ঋদ্ধিমানের প্রচুর মিসড কল ছিল।

দেখার পর নিলুপিসি গোপনে সিদ্ধান্তটা নেয়। ফোনটা রিসিভ করে। দায়িত্ব নিয়ে সঞ্চিতার মতো গলা করে কথা বলে। অবশ্য গলা চেঞ্জ না করলেও চলত, কারণ ঋদ্ধিমান সঞ্চিতাই ফোনটা ধরেছে ভেবে এতটাই এক্সাইটেড ছিল, প্রায় আনন্দে উন্মাদ, ও নোটিসই করত না নিলুপিসির গলাটার ডিফারেন্সটা। মুখের কাছে হাত চেপে কথা বলেছে নিলুপিসি। একদম হুঁ হাঁ দিয়ে চালিয়েছে, ঋদ্ধিমান বুঝতেই পারেনি, তাছাড়া ওর বোঝার মতো অবস্থাও ছিল না… হাউ হাউ করে চিৎকার করেছে শুধু।

তারপর থেকে বেশ কয়েকবার ওকে ফোন করে শোনার কাজটা করে গেছে নিলুপিসি।

ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক হয়ে গিয়েছে ঋদ্ধিমানের কমিউনিকেশন। ও এখন একতরফা কথা বলে যায়। কথা শুনতে শুনতে কান জ্বলে যায়, তবু শোনে নিলু। সঞ্চিতাকে ভালো রাখতে চায়, বোধ হয় ঋদ্ধিমানেরও ভালো চায়।

তুমি আমাকে কেন কিছু বলছ না, সঞ্চিতা। কেন বলে গেলে না, সেদিন ওফেলিয়া বার থেকে ওইভাবে উঠে চলে এসেছিলে, কেন? পরদিন কাফেতে তিনঘণ্টা বসেছিলাম… তোমাকে ফলো করে করে তোমার অফিস অবধি গেছিলাম, তুমি আমাকে দেখতেও পেলে না…

এরপর কিন্তু তোমার বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে পড়ব। ইউ নো, আই ক্যান কিল মাইসেলফ…কিন্তু আগে তোমাকে বলতে হবে তুমি কী চাও? বলো, বলো সঞ্চিতা…

উফফফ কেন এরকম করছ সঞ্চিতা…আমি ছ’দিন পর পর বাড়ি থেকে বেরোইনি, কিন্তু যেদিন বেরোব, দেখবে কী করি…আমি পাগল হয়ে যাব, আই হ্যাভ নোবডি টু টক টু…

তুমি সেদিন আবার গোলাপি জামাটা পরেছিলে আমি দেখেছিলাম…বাট হাউ ক্যান ইউ বি সো ইনডিফারেন্ট টু মি?

ঋদ্ধিমানের বাড়িটা খুঁজে বার করে ফেলেছে নিলু। ওর কথা ফলো করে করে, নিজে স্বল্প কথা গুনগুন করে বলে, ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করে, ক্লু ইউজ করে বার করে নিয়েছে ওর ঠিকানা। এখন ঋদ্ধির বাড়ির কাছে অনেকটা সময় কাটায় নিলুপিসি। সামনের লেডিস টেলারটাতে তিন—তিনবার ব্লাউজ বানাতে দিয়েছে, একবার সালোয়ার কামিজ। তাতেই কার্যসিদ্ধি। এখন ঋদ্ধির ছোটমামা, পুলিশের মাঝারি লেভেলের অফিসার, নিলুপিসির পকেটে, ওরই সঙ্গে দু—তিনবার ঋদ্ধিকে দেখেছিল এর আগে, উর্দি দেখে বুঝেছে লোকটা পুলিশ। সুতরাং এবার ভদ্রলোকের সঙ্গে মিট করা, মিসিং রিভলভারের খোঁজ, অনেক বেশি সাবধানতা, সাইকিয়াট্রিক হেল্প এর ব্যবস্থা রাখা, এবং আজ, এই এখন, কাফের সামনে বসে থাকা।

তুমি কি আমাকে ভালোবাসো, সঞ্চিতা?

সঞ্চিতার ব্লু জামা পরা ছোট্ট চেহারাটা কাফের দরজা থেকে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কী ভীষণ সেক্সি, কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই ধরা দেবে না ওর কাছে, ঠিকই করে নিয়েছে যেন। দু—চারটে ফোনের পর একদিন সারাদিন ফোন আর রিসিভই করল না হয়তো। উইমসিকাল মেয়ে, না ইচ্ছে করে নাচাচ্ছে?

নাচাচ্ছে, নাচাচ্ছে, আমাকে নাচাচ্ছে। উফফ ভাবতেই কান গলা বেয়ে গরম ঢেউ, একটা রাগ আছড়ে পড়ে শিরায় শিরায়। মনে পড়ে যায় পুরনো অপমানগুলো। সেই যে সেবার, অস্মি বলে মেয়েটা। জাস্ট কিছুদিন ডেটিং করে কেটে গেল। জাস্ট নো সাড়া নো শব্দ। বুকের মধ্যে হাঁকপাঁক করে অপমান, রাতের ঘুমে হানা দেয় মেয়েটার তাগড়া শরীর আর ফিল্মসি জামাকাপড়। এভাবেই কষ্ট জমছে বুকের ভেতর। আর রাগ জমছে মাথার মধ্যে। শু্যট করে দেব…জাস্ট শু্যট হার। যেরকম স্বপ্নে দেখেছিল সেদিন…কাছে যাচ্ছে যত, দূরে দূরে সরে যাচ্ছে মেয়েটা…কে ছিল সেটা? অস্মি না সঞ্চিতা? সঞ্চিতাই বোধ হয়।

আর, বন্দুকটা, ওর দিকে তাক করতে করতেই, শু্যট! মাথার মধ্যে বলে ফেলল ওর পৌরুষ। অমনি স্বতোৎসার উঠে এল ফোয়ারায়, রাগের উৎসমুখ খুলে গেল, অনুরাগেরও। সবকিছুর মূলে, একেবারে গোড়ায়, সেই দপদপানি, সেই কষ্টটা আছে, যা ওকে করায় সবকিছু। ফলো করায় সঞ্চিতার মতো তিতলিদের…

ও আজ পকেটে মালটা নিয়েই বেরিয়েছে। শক্ত ধাতব ফিল। ওকে উত্তেজিত করে ফিলটা। অনুভূতি ভোঁতা হওয়ার আগেই কাজটা করে ফেলতে হবে। কার্গো প্যান্টটা, অনেকগুলো পকেটসুদ্ধু, খুব হালকা লাগে আজ। শরীরটাই হালকা লাগে যেন। উড়তে উড়তে কাফেতে ঢুকে যায়। হাসিমুখেই, কিচ্ছুটি না বুঝে, সরল চোখে সঞ্চিতা ওর দিকে মুখ ফেরাবে। যদিও ছেনাল মেয়েমানুষ, তবু সরল। না—বোঝা হরিণ চোখ। বোকা চোখ। সেই ওর সাদা চোখে আস্তে আস্তে বিস্ময়, তারপর বিস্ফারিত দুটি চোখে ধীরে ধীরে ভয়, ধীরে ধীরে বিভীষিকা…আহ, কী মজা!

মা যখন বাবাকে ছেড়ে চলে যায় বাবা বলেছিল, মেয়েমানুষ ছোঁবে না কখনও। তখন বোঝেনি ও। মানেটা কী। তারপর সুচিত্রাকাকিমা যখন এল, বাবাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল তুমি যে বলেছিলে, মহিলা ব্যাপারটাই একটা যাচ্ছেতাই জিনিস, মাউসট্র্যাপ, জীবনকে ভেতর থেকে ফোঁপরা করে দেয়? তখন ওর চোদ্দো। বাবার দিকে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে শেখেনি, অথচ ভেতরে ঘৃণা থরথর করত, বাবা যখন সুচিত্রাকাকিমাকে নিয়ে ফিরত বাড়ি, মাল খেত।

অনেক পরে ও অর্জি কথাটা শেখে। অথচ মেয়েরা ওকে চায় না। ও তাদের এমএমএস পাঠায়, অশ্লীল জোকস পাঠায়। তারা কিছুদিন ওর সঙ্গে মেশে, ওকে দেখে নেয়, মেপে নেয়, তারপর সরে যায়। তারা শুধু ওকে শুকনো শুকনো ইমোটিকন পাঠায়। তারপর একদিন চুপ মেরে যায়। একদিন শুধু ওর ইমেল গিয়ে গিয়ে তাদের মেলবক্সে জমে যায়, জমাট বেঁধে যায়। হয়তো সেই ইমেলগুলোকে না দেখেই সোজা ডিলিট করে বা স্প্যাম ফোল্ডারে পাঠিয়ে দেয়। একদিন হয়তো তারা ওকেই পুরো ব্লক করে দেয়। উফফফ।

মেনে নেওয়া যায় না এটা। একদম মেনে নেওয়া যায় না। একটা কিছু করতেই হবে।

দীঘল, কনফিডেন্ট পায়ে কাফের ভেতরটায় ঢোকে ও, তারপর একদম ক্লোজ রেঞ্জে এসে রিভলভারটা সটান তুলে ধরে প্রিয়, নীলরং জামা পরা, পাখি পাখি ছোট্ট চেহারার মেয়েটার দিকে। ব্যাং।

ব্যাং ব্যাং ব্যাং।

সঞ্চিতা লুটিয়ে পড়ে। চেয়ার উল্টে যায়।

নিলুপিসি, এক কাপ চা আর দুটো লেড়ো বিস্কুট নিয়ে বসে আছে। সঙ্গে তপন। ওর বন্ধু। দুজনেই অ্যালার্ট, কিন্তু অফ গড়িয়াহাট রোড, একটু ভেতরের এক কাফে কফি ডে আর তার উল্টোদিকের চায়ের দোকানের মুখটা এখনও ফাঁকা…ফাঁকা মানে, নাঃ, এখনও কোনও চিহ্ন দেখা যায়নি ঋদ্ধিমানের। ওর পুলিশ মামা দীপেন ঘোষ মোবাইলে বলেছেন, ঋদ্ধি বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। সবকিছু মিলে যাচ্ছে কিন্তু। উনিও উদ্বিগ্ন। রিভলভারটা মিসিং হওয়ার খবর উনিই বলেছিলেন, উইথ লট অফ ওয়ারি।…যেখান থেকে গেছে, সেটাও ঋদ্ধির নাগালে…কিন্তু যতটা পেরেছেন, ঋদ্ধির ঘর সার্চ করে পাওয়া যায়নি জিনিসটা। খোলাখুলি কিছু করতে বা বলতে সাহস পাননি উনি, কেননা ঋদ্ধি যথেষ্ট ডিস্টেবিলাইজড, ওকে সন্দেহ করা হচ্ছে জানলে বলা যায় না, সুইসাইডাল টেনডেন্সি হতে পারে।

বাড়িতেও নজর রাখছেন উনি। কিন্তু ঋদ্ধি বেরিয়ে পড়ার পরই, ওকে ফলো করছে একটা গাড়ি। আর, সঞ্চিতা যে কাফেতে বসেছে, অর্চির সঙ্গে মিট করবে বলে, সেখানে নজর রাখছে সঞ্চিতার পিসি।

ব্যাং ব্যাং ব্যাং। আচমকা পাড়াটাকে চিরে দিয়ে আওয়াজটা, চিৎকার তারপর, হইচই। তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল নিলুপিসি, প্রায় চায়ের কাপ উল্টে ফেলে তপনও। কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে হতবাক, কেননা ঋদ্ধি, ঋদ্ধি তো এখনও বালিগঞ্জ ফাঁড়ি ক্রস করেনি, এখনই জানা গিয়েছে। জাস্ট দু সেকেন্ড আগেই।

কাফে থেকে লাফ দিয়ে বেরোচ্ছে এখন, সঞ্চিতাকে শু্যট করে, তার আততায়ী। গুলিটা মারার পরপর ও কী করবে, ভেবে পায়নি দু—চার মোমেন্ট। বিস্রস্ত কাফেটা, চারিদিকে ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে লোকজন। মাতালের মতো ঘুরে গিয়েই হঠাৎ তিরবেগে দৌড়তে শুরু করে দিল অর্চি।

ততক্ষণে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দেওয়া সার্ভিস রিভলভারটা ধোঁওয়া ওঠার পর ঠান্ডা। একরাশ মানুষের স্থির দৃষ্টির সামনে। একমাত্র পাশের কিউবিকলের ওই চুমকি ঘোষ মেয়েটাই অর্চিকে ততটা টানত না…বেশ নিরাপদ রাশিয়ার মতো চেহারার মেয়েটা বাবার ড্রয়ার থেকে সার্ভিস রিভলভার এনে দিয়েছিল অর্চিকে।

রোজ এক কাপ কফির ফেভারের পরিবর্তে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *